১. রবিবার ছাড়া প্রতিটি সকাল

ফিরে আসা – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রবিবার ছাড়া প্রতিটি সকাল একেবারে ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। বাড়িতে ঘড়ির সংখ্যা একুশটি, জ্ঞানব্রতর খুব ঘড়ির শখ। দেশে-বিদেশে যখনই বেড়াতে যান, বিভিন্ন আকৃতির একটি করে ঘড়ি সংগ্রহ করে আনেন। এগুলোতে চাবিও দেন তিনি নিজের হাতে।

এ ছাড়া ডাইনিং হলে আছে একটি বড়ো দেওয়াল ঘড়ি। এটা জ্ঞানব্রতর বাবার আমলের। এখনও বেশ চলে, দু-এক বছর অন্তর অন্তর অয়েলিং করতে হয় শুধু। টক টক টক টক করে সেটিতে প্রতি মুহূর্তের শব্দ হয়। জানিয়ে দেয় যে সময় চলে যাচ্ছে। ঘণ্টা বাজবার একটা খর-র-র খ-র-র আওয়াজ ওঠে, সেই আওয়াজ শুনলেই রান্নাঘরে কান খাড়া করে রতন। ডেকচিতে গরম জল চাপানোই থাকে, ন-টা বাজবার সঙ্গেসঙ্গে সে এসে বলবে, বাথরুমে স্নানের জল দেব?

বারোমাসই গরম জলে স্নান করা অভ্যেস জ্ঞানব্রতর।

ন-টা পর্যন্ত বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজ পড়েন, রতন এসে গরম জলের কথা বললেই স্নানের ঘরে চলে যান।

সাড়ে নটায় খাওয়ার টেবিলে। দশটায় ড্রাইভার গাড়ি বারান্দার নীচে গাড়ি বার করে তৈরি থাকে।

স্মরণকালের মধ্যে কোনোদিন এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।

সুজাতা নিজের হাতে কিছু রান্না করে না বটে, কিন্তু খাবার পরিবেশন করে নিজের হাতে। রতন সব কিছু সাজিয়ে রেখে যায় টেবিলের ওপরে!

খাবার টেবিলে এই আধঘণ্টা সময়ই যা সুজাতার জ্ঞানব্রতর সঙ্গে কথাবার্তা হয় সকালে।

জ্ঞানব্রত ওঠেন খুব ভোরে। সুজাতার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে প্রায় ন-টা বেজে যায়। জেগে উঠেই কোনোরকমে হুটোপাটি করে মুখ-চোখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে ছুটে আসে খাবার টেবিলে। সুজাতা না-আসা পর্যন্ত খালি প্লেট সামনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন জ্ঞানব্রত। সুজাতা এসেই বিভিন্ন পাত্রের ঢাকনা খুলে বলে, আজ, কী কী করেছে দেখি? এঁচড়ের তরকারি, চিংড়ি মাছের মালাইকারি..পনির দিয়ে পালং শাক করেনি? রতন, রতন!

ছেলে পড়ে দার্জিলিং-এর কনভেন্ট স্কুলে, মেয়ে উজ্জয়িনীর স্বভাবটাও অনেকটা মায়ের মতন। কলেজে যাবার ঠিক আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠেই হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। এজন্য মেয়েকে কোনোদিন শাসন করেননি জ্ঞানব্রত, কারণ স্কুলে প্রতিটি পরীক্ষায় সে ফার্স্ট হয়েছে, পঞ্চম স্থান পেয়েছে স্কুল ফাইনালে। ও রাত জেগে পড়ে। উজ্জয়িনীর জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সে, তাই বোধ হয় ফরাসিদের মতন ওর রাত জাগার অভ্যেস।

জ্ঞানব্রতকে খাবার দিয়ে সুজাতা সেই সঙ্গে নিজে চা খায়। সুজাতার বয়েস এখন ঠিক চল্লিশ, কিন্তু শুধু সাজপোশাকের গুণেই নয়, তার শরীরটা এখনও এমন তাজা যে তার বয়েস তিরিশ বললে কেউ চট করে অবিশ্বাস করবে না। সপ্তদশী উজ্জয়িনী যে সুজাতার মেয়ে তা অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না, ভাবে বুঝি দুই বোন।

সুজাতার চেয়ে ঠিক দশ বছরের বড়ো জ্ঞানব্রত, পুরুষ মানুষের পক্ষে এ বয়েস কিছুই নয়। শরীরটা তাঁর ভাঙতে শুরু করেছে। মাথায় কাঁচার চেয়ে পাকা চুলই বেশি, চামড়ায় নেই মসৃণতা, চোখের দু-পাশে কালের পায়ের ছাপ। সার্থকতা তাঁর শরীর থেকে মূল্য আদায় করে নিয়েছে।

চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল সুজাতা। জ্ঞানব্রত তিন মাস আগে সিগারেট-চুরুট পাইপ একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন, সুজাতা ওসব কিছু চিন্তাই করে না।

সকালের প্রথম সিগারেটটিতে পরিতৃপ্তির সঙ্গে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সুজাতা জিজ্ঞেস করল :

তুমি আজ কখন গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে পারবে?

জ্ঞানব্রত বলল, তোমার কখন চাই বলো?

সাড়ে এগারোটায়।

তার মানে সাড়ে বারোটা তো?

সুজাতা হাসল।

 জ্ঞানব্রতর যেমন প্রতি মুহূর্তে ঘড়ির হিসেব, সুজাতা তার ঠিক উলটো। বাড়ি থেকে যদি সাড়ে এগারোটায় বেরোবে ভাবে তো, কিছুতেই সে বারোটার আগে তৈরি হতে পারে না। জীবনে একটা সিনেমাও বোধ হয় সে শুরু থেকে দেখতে পারেনি।

কোথায় যাবে?

 আমাদের মহিলা সমিতির একটা মিটিং আছে।

ঠিক আছে, সাড়ে এগারোটাতেই গাড়ি আসবে।

চুমকি এই রবিবার ওর বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে যেতে চায়। তোমাকে কিছু বলেছে?

তোমাকে বলাই তো যথেষ্ট। কোথায় যাবে?

ব্যাণ্ডেল।

জায়গাটার নাম শুনতে পেলেন না জ্ঞানব্রত, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন।

 ঠিক এই সময়েই তিনি শুনতে পেলেন গানটা।

যোধপুর পার্কে একেবারে আনোয়ার শা রোডের ওপরে মাত্র দু-বছর আগে তৈরি করেছেন এই নতুন বাড়ি। সামনে বড়ো রাস্তা, তার উলটো দিকেই একটা পার্ক, সুতরাং সামনের দিকটা কোনোদিন ব্লকড হবে না। সাত কাঠা জমি, সামনে খানিকটা বাগান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। দোতলায় চারখানা ঘর, নীচে চারখানা। নীচতলাটা পুরোই ভাড়া দেওয়া হয়েছে চেক কনসুলেটের ফার্স্ট সেক্রেটারিকে দু-টি গ্যারাজসহ।

যখন এই বাড়ি বানান জ্ঞানব্রত তখন ডান পাশের তিন কাঠার জমিটাও কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মালিকানা নিয়ে কী যেন গন্ডগোল ছিল। হঠাৎ এই ছ-মাস আগে সেখানে একটা তিনতলা বাড়ি উঠে গেছে। অনেক লোকজন, বেশ গোলমাল হয় ওবাড়িতে। বিভিন্ন তলায় একই সঙ্গে রেডিয়ো রেকর্ডপ্লেয়ার চলে। এইসব আওয়াজে জ্ঞানব্রত একটু বিরক্ত হন, কিন্তু কিছু করবার উপায় নেই।

সেইরকমই, ওবাড়ির রেডিয়োতে একটা গান বাজছে। সে-দিকে হঠাৎ মন আটকে গেল জ্ঞানব্রতর।

…শহরে ষোলো জন বোম্বেটে;
করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে।
রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি,
চোরেরও সে শিরোমণি
নালিশ করিব আমি, কোনখানে কার নিকটে।
পাঁচ জন ধনী ছিল,
তারা সব ফতুর…হল।

গানটা শুনতে শুনতে জ্ঞানব্রতর মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়ল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ওকী, তুমি পুডিংটা খেলে না?
যতই সাহেব মানুষ হন জ্ঞানব্রত, অফিস থেকে দুপুরে তিনি কোথাও লাঞ্চ খেতে যান না। দোকানের খাবার তাঁর একেবারে পছন্দ নয়। ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার তিনি। সেখানে মাঝে মাঝে যান সাঁতার কাটতে। তারপর দু-এক পেগ মদ্যপান করেন। কিন্তু কোনো খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করেন না।

সকাল বেলা বাড়ির রান্না তিনি খেয়ে যান তৃপ্তির সঙ্গে। আজ বিমর্ষভাবে বললেন, পুডিং? না, থাক, খেতে ইচ্ছে করছে না।

হঠাৎ তুমি কেমন গম্ভীর হয়ে গেলে?

 তাই নাকি?

হ্যাঁ। কোনো কথা বলছ না। শরীর ঠিক আছে তো?

শরীর? হ্যাঁ, শরীর ভালো আছে।

উঠে বাথরুমে চলে গেলেন তিনি। আয়নার দিকে চেয়ে তার মনে হল, চুল কাটা দরকার। প্রত্যেক মাসের শেষ রবিবার তার চুল কাটার দিন। আজ মাসের মোটে অর্ধেক। এর মধ্যে চুল বেশি বড়ো মনে হচ্ছে কেন।

জ্ঞানব্রতর বাবার ছিল মাথা ভরতি টাক। সবাই বলত জ্ঞানব্রতরও চুল থাকবে না। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল, এখনও চুল একটুও পাতলা হয়নি।

বাবাকে অবশ্য খুব ভালো মনে নেই জ্ঞানব্রতর। তিনি যখন মারা যান তখন জ্ঞানব্রতর বয়স এগারো।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাতের ঘড়িটা দেখলেন। দশটা বাজতে তিন মিনিট বাকি। এখন তিনি খয়ের ছাড়া একটি পান খাবেন। তারপর গলায় টাই বাঁধবেন। সিগারেট চুরুট ছেড়ে দেবার পর এই পান খাবার অভ্যেসটা হয়েছে।

নিজের ঘরে যেতে বাঁ-পাশে মেয়ের ঘর পড়ে। দরজাটা খোলা, সারাবিছানা তছনছ করে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে উজ্জয়িনী। মায়ের চেয়েও বেশি রূপসী হয়েছে, ঠিক যেন এক ঘুমন্ত রাজকন্যা। একটুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন জ্ঞানব্রত। দেখতে দেখতে এত বড়ো হয়ে গেল? আর কিছুদিন পরেই কোনো পরপুরুষের হাতে ওকে সঁপে দিতে হবে!

ছেলে শুভব্রতর বয়েস চোদ্দো, বছরে মাত্র তিন মাস দেখা হয় তার সঙ্গে।

সুজাতার গালে একটা অন্যমনস্ক চুমু দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ধীরভাবে নামতে লাগলেন তিনি।

 গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে দরজা খুলে তটস্থভাবে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার।

গাড়ি একেবারে চকমকে তকতকে না থাকলেই বিরক্ত হন জ্ঞানব্রত। আজ সেদিকে নজর দিলেন না, উঠে বসলেন।

প্রথমে যেতে হবে বেহালার কারখানায়। কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগে। এই সময়টুকু তিনি ঘুমিয়ে নেন। গাড়িতে ওঠা মাত্র চোখ বুজে আসে। আজ ঘুম এল না।

নিজেই তিনি একটু বাদে অবাক হয়ে ভাবলেন, আমার মন খারাপ লাগছে কেন? কোনো কারণ নেই তো! শরীরও খারাপ নয়। তাহলে?

এর পরেই মনে এল সেই গানের কথাগুলো

শহরে ষোলোজন বোম্বেটে
করিয়ে পাগলপারা নিল…

তারপর?

বাকি কথা আর মনে পড়ছে না। সুরটা অবশ্য ঘুরছে মাথার মধ্যে।

এ গানের মানে কী?

জ্ঞানব্রত খুব-যে-একটা গান-বাজনার ভক্ত তা নয়। তার বাড়িতে বিলিতি রেকর্ডই বাজে বেশি। বড়োজোর দু-চারটে রবীন্দ্রসংগীত। এ গান তো মনে হচ্ছে দেহতত্ত্ব বা ওই ধরনের, এসব গান কে শুনবে? রেডিয়ো আছে, কিন্তু কক্ষনো খোলা হয় না। জ্ঞানব্রত শেষ রেডিয়ো শুনেছেন ইলেকশনের খবর শোনার জন্য। নিয়মিত রেডিয়ো শোনে মধ্যবিত্তরা।

কারখানার গেটের কাছে যখন গাড়ি এসেছে, তখন জ্ঞানব্রতর মনে পড়ল, নিল তারা সব লুটে! শহরে ষোলো জন বোম্বেটে–করিয়ে পাগল পারা নিল তারা সব লুটে…।

জ্ঞানব্রত এই গানটা যেন আগে কখনো শুনেছেন।

 কবে, কোথায়?

কারখানার দেখাশুনোর ভার তাঁর ভাগনে শেখরের ওপর। জ্ঞানব্রত এ কারখানা নিয়ে মাথা ঘামান না, শিগগিরই মাদ্রাজে আর একটি কারখানা খুলবেন, সেই চিন্তাতেই নিমগ্ন। তবু রোজ একবার করে এখানে আসেন। শেখর কিছু কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, জ্ঞানব্রত সেই সব রিপোর্টের ওপর এক নজরে চোখ বুলিয়ে হ্যাঁ কিংবা না বলে দেন।

একুশ বছর আট মাস বয়েস পর্যন্ত জ্ঞানব্রত ছিলেন এক অতিসাধারণ রিফিউজি ছোকরা। পড়াশুনোয় ভালোই ছিলেন, কিন্তু শৈশবে পিতৃহীন বলে মামারবাড়িতে মানুষ, টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতে হত।

মামাদের অবস্থা ভালো ছিল না। জ্ঞানব্রতর মা ছিলেন তার ভাইদের বাড়িতে বিনি মাইনের রাঁধুনি।

টুথপেস্টের ছিপির মধ্যে যে একটা ছোট্ট গোল শোলার চাক্তি থাকে, সেই দিয়ে ব্যবসা শুরু। ওই ছোট্ট জিনিসটাও খুব জরুরি, ওটা থাকে বলেই টিউব থেকে টুথপেস্ট বেরিয়ে আসে না। অত ছোটো জিনিস কোনো টুথপেস্ট কোম্পানি নিজে বানায় না, বাইরে থেকে কেনে।

মূলধন ছিল মাত্র দেড়শো টাকা। একটা পাঞ্চিং মেশিন আর কিছু কাঁচামাল। কারুকে না জানিয়ে জ্ঞানব্রত শুরু করেছিলেন এই কারবার, পুরোটা লোকসান গেলেও তো তার নিজের দেড়-শো টাকাই যাবে।

এখন তিনি একটি প্রখ্যাত মার্কিন টুথপেস্ট কোম্পানির সঙ্গে কোলাবোরেশনে এদেশে তৃতীয় টুথপেষ্ট কারখানা খুলেছেন। মামাদের উপকারের ঋণ শোধ করে দিয়েছেন তিনি, প্রত্যেক মামাকে নিয়েছেন কোম্পানির ডিরেক্টার বোর্ডে, দু-জন মামাতো ভাইকে বিলেতে পড়িয়ে এনেছেন। শুধু তার মা-ই কোনো সুখভোগ করে যেতে পারলেন না। সবেমাত্র এই বেহালার কারখানাটা লিজ নেওয়া হয়েছে, সেই সময় মারা গেলেন মা।

অফিস ঘরে বসে কাগজপত্র দেখছেন জ্ঞানব্রত, হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন শেখর, তুই এই গানটা জানিস? শহরে ষোলো জন বোম্বেটে। করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে।…

শেখর একেবারে অবাক।

তার মামা অত্যন্ত রাশভারি মানুষ। কাজের মধ্যে কোনোরকম ছ্যাবলামি করবেন তিনি, এ তো কল্পনাই করা যায় না। এ কী একটা বিদঘুঁটে গানের কথা জিজ্ঞেস করছেন!

গান? এটা কী গান?

জ্ঞানব্রত হাসলেন।

পুরোনো অভ্যেস মতোই বাঁ-হাতের দু-টি আঙুল কাঁচি করে ধরলেন মুখের সামনে, যেন সেখানে রয়েছে অদৃশ্য সিগারেট।

হঠাৎ এই গানটা শুনলাম রেডিয়োতে। তারপর অনবরত এটা মাথার মধ্যে ঘুরছে।

রেডিয়োতে শুনলেন? কখন?

 আজই খেতে বসে…

 নতুন নামকরা শিল্পপতি এবং সদাব্যস্ত জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি সকাল বেলা খাবার টেবিলে বসে রেডিয়োতে পল্লিগীতি শুনছেন–এ দৃশ্যও শেখরের পক্ষে কল্পনা করা দুষ্কর। পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা রেডিয়োর গান নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়?

মনে হচ্ছে যেন এই গানটা আমি আগে কোথাও শুনেছি। কোথায় শুনলাম বল তো?

আমি তো এ-রকম গান কক্ষনো শুনিনি!

তোর বাড়িতে ফোন কর তো?

বাড়িতে?

হ্যাঁ, তোর মাকে একবার ডাক।

দুই দিদি জ্ঞানব্রতর। বড়ো দিদি থাকেন ভোপালে। শেখরের মা ছোড়দি। ছেলেবেলায় খুব সুন্দর গান করতেন। তারপর যা হয় অধিকাংশ বাঙালি মেয়েদের। বিয়ের পর গান-বাজনার সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে যায়।

ছোটদি, আমি গেনু বলছি।

বয়েসে বড়ো দিদি হলেও প্রতিমা তার এই ছোটোভাইকে একটু সমীহ করেন। জীবনে এতখানি উন্নতি করেছে সে, তার ছেলেকে বিরাট চাকরি দিয়েছে। একসময় গেনু বলে ডাকলেও এখন বলেন জ্ঞান।

কী রে কী হয়েছে?

ছোড়দি, তুমি তো একসময় অনেক গান করতে। তুমি এই গানটা জান? শহরে ষোলো জন বোম্বেটে…

না তো!

ভালো করে ভেবে দেখো, কখনো শোননি?

না। হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস যে?

এই গানটা আমার মাথায় গেঁথে গেছে, কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। আগে শুনেছি মনে। হচ্ছে, খুব সম্ভবত ছেলেবেলায়।

সুজাতা কেমন আছে?

ভালো আছে। তোমাকে সুরটা শোনাব? তাহলে হয়তো তোমার মনে পড়তে পারে।

অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য! আরও একজন কর্মচারী এই সময় ঘরে ঢুকেছে। ইংরেজিতে যাকে বলে স্ক্যাণ্ডালাইজড, শেখরের সেই অবস্থা। গোল্ডেন স্টার টুথপেস্ট কোম্পানির একান্নভাগ শেয়ারের মালিক জ্ঞানব্রত অফিসঘরে বসে অত্যন্ত ব্যস্ত সময়ে টেলিফোনে পল্লিগীতির সুর শোনাচ্ছেন দিদিকে। মাথাটা খারাপ হয়ে যায়নি তো? ঘড়ির কাঁটা ধরে এই লোকের জীবন চলে।

প্রতিমা টেলিফোনের ওপ্রান্ত থেকে ঠিক বুঝতে পারছেন না, এই সময় তাঁর কি বলা উচিত। তাঁর ঝোঁক ছিল নজরুল ও অতুলপ্রসাদের গানে; সেও কতকাল আগের কথা। এ গান তো তিনি শোনেননি কখনো। তবু গুরুত্বপূর্ণ ছোটোভাইকে খুশি করবার জন্য তিনি আমতা আমতা করে বললেন :

হ্যাঁ, কেমন যেন শোনা শোনা মনে হচ্ছে।

এর পরের কথাগুলো জান?

না। খুশিকে অনেকদিন দেখিনি। একদিন আসতে বলিস না আমাদের এখানে।

 উজ্জয়িনীর ডাকনাম খুশি! সে তার মাসিদের ভক্ত, পিসির বাড়িতে যেতে চায় না।

আচ্ছা বলব। তাহলে গানটা তুমি জান না। তোমার কাছ থেকে শুনিনি।

রাস্তার ভিখিরিরা অনেক সময় এইরকম গান গায়।

টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়েই অভ্যেস মতন ঘড়ি দেখলেন জ্ঞানব্রত। ঠিক সাড়ে এগারোটা বাজে। সুজাতাকে গাড়িটা পাঠাবার কথা ছিল।

এ-রকম ভুল তার কখনো হয় না।

সুজাতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বিলেতে, সেই প্রথমবার জ্ঞানব্রত ওদেশে গিয়েছিলেন। এখন বছরে দু-বার-তিনবার তাঁকে বিলেত-আমেরিকায় যেতে হয়। সুজাতা তখন ওখানে পড়াশুনো করছে। আলাপের তৃতীয় দিনেই জ্ঞানব্রত বুঝেছিলেন, এই মেয়েটিকে না পেলে তাঁর চলবে না। প্রথম যৌবনেই ব্যবসা শুরু করে তার মধ্যে একবারে ডুবে গিয়েছিলেন জ্ঞানব্রত, কোনো মেয়ের দিকে তাকাবার সময় পাননি, সুজাতাকে দেখেই তাঁর মনে হয়েছিল যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে একেই, নইলে আর কারুকে নয়,

সেবার বিলেতে থাকার কথা ছিল তিন সপ্তাহ, থেকে গেলেন দু-মাস।

 কেনসিংটনের একটা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে জ্ঞানব্রত দুম করে সুজাতাকে বলেছিলেন, আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি থাকেন, তাহলে কাল আমি আসব, নইলে আজই আমাদের শেষ দেখা।

সুজাতা বলেছিল, কিন্তু আর পাঁচ মাস বাদে যে আমার পরীক্ষা!

আমি এখানেই বিয়েটা সেরে দেশে ফিরে যাব। আপনি পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে তারপর ফিরবেন।

কেন, আমি দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না?

না।

এত অধৈর্য কেন আপনি?

আমি চলে গেলেই আমার চেয়ে যোগ্য কেউ আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলতে পারে।

সুজাতা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার ধারণা ছিল, যারা প্রেমে পড়ে বিয়ে করে, তারা পরস্পরকে তুমি বলে। এ-রকম গুরুগম্ভীর ভাষায় কেউ যে কখনো বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তা আমি জন্মে ভাবিনি।

আসলে জ্ঞানব্রত লাজুক। ব্যবসায়ীদের জগতে তিনি গম্ভীর মানুষ বলে পরিচিত, সেটা লাজুকতারই একটা দিক। সুজাতাকে বিয়ের দিন পর্যন্ত আপনি-র বদলে তুমি বলতে বাধো বাধো ঠেকেছে।

তক্ষুনি নিজের গাড়িটা সুজাতাকে পাঠিয়ে দিয়ে কারখানার একটা গাড়ি নিয়ে তিনি চলে এলেন স্টিফেন কোর্টে তাঁর অফিসে।

বিকেল পর্যন্ত সেই গানটা তার সঙ্গ ছাড়ল না। যতই কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেই গানটা তাঁর মাথায় ঘুরে-ফিরে আসে। এখন তার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে যে এই গানটা তিনি পুরো শুনেছেন তো নিশ্চয়ই, শুধু তাই নয়, পুরো গানটাই তিনি জানতেন। কিন্তু কার কাছে যে শুনেছেন তা কিছুতেই মনে পড়ছে না।

অফিসঘরসংলগ্ন তাঁর নিজস্ব বাথরুম। বিকেলে সেখানে ঢুকে তিনি দিব্যি গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলেন গানটা

শহরে ষোলোজন বোম্বেটে
করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে

তারপর? তারপর?

জ্ঞানব্রত অনুভব করলেন এই গানটার বাকি কথাগুলো না জানতে পারলে তাঁর জীবনে আর সুখ আসবে না। রাত্তিরে ঘুমোতেও পারবেন না তিনি।

কিন্তু এ গান কী করে উদ্ধার করা যাবে? সকাল বেলা কোনো এক অখ্যাত গায়ক রেডিয়োতে গেয়েছে এই গান। কে তা শুনেছে বা মনে রেখেছে? অন্তত জ্ঞানব্রত যে-জগতে ঘোরাফেরা করেন সেখানে কেউ শুনবে না এই গান।

ফোন তুলে জ্ঞানব্রত চাইলেন আর. সি. চৌধুরি অ্যাণ্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের নাম্বার।

রশিদ সাহেব? আমি জ্ঞানব্রত চৌধুরি বলছি। টোকিও থেকে কবে ফিরলেন?

এই তো পরশু। আপনার জন্য একটা ঘড়ি এনেছি। আমার গরিবখানায় কবে আসবেন বলুন? নেক্সট সানডে?

না, ওই রবিবার আমি থাকব না, পরে হবে একদিন। আপনাকে অন্য একটা দরকারে ফোন করছি। আপনার বাড়ির পার্টিতে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, কলকাতা রেডিয়ো স্টেশনের নতুন স্টেশন ডিরেক্টর, কী যেন নাম ভদ্রলোকের?

এই রে, নাম তো জানি না আমিও। কেন, খুব দরকার?

 আপনার বাড়িতে নেমন্তন্ন করলেন, আপনি তার নাম জানেন না?

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে আমার ওয়াইফ ওনার ওয়াইফের খুব বন্ধু। এক সঙ্গে পড়তেন কলেজে! সেইজন্য আপনার ভাবিই নেমন্তন্ন করেছিলেন ওদের দুজনকে। নামটা বলেছিলেন বটে, এখন ভুলে গেছি।

আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে নামটা জানা যায় না?

কেন যাবে না? হঠাৎ রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টরকে আপনার কী দরকার পড়ল? পাবলিসিটি দেবেন?

না, না, সেসব কিছু নয়, অন্য একটা দরকার!

দশ মিনিট বাদে রশিদ সাহেব জানিয়ে দিলেন যে রেডিয়ো স্টেশনের ওই পরিচালকটির নাম পি সি বড়ুয়া।

এবার জ্ঞানব্রত চাইলেন রেডিয়ো স্টেশন।

আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রশিদ সাহেবের বাড়ির পার্টিতে, মনে করতে পারছেন তো?

নিশ্চয়ই। গোল্ডেন স্টার টুথপেস্ট তো? আমেরিকাতে আমি যখন পড়াশুনো করতুম, তখন থেকেই ওই টুথপেস্ট ব্যবহার করি।

আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ দরকার ছিল।

 বলুন।

ঠিক মুহূর্তে সামলে গেলেন জ্ঞানব্রত। আর একটু হলেই হয়েছিল আর কি! তার পক্ষে রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টরকে টেলিফোন করে হঠাৎ একটা পল্লিগীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা একেবারেই চলে না। মাস্ট নট ডান।

আপনি আজ সন্ধ্যে বেলা কি ব্যস্ত আছেন? ক্যালকাটা ক্লাবে একবার আসতে পারবেন?

 ক-টার সময়?

এই ধরুন সাড়ে-আটটা?

আচ্ছা আসব। এই ধরুন এইটস! আপনি কোথায়…

 আমি ওপরের বার রুমে থাকব।

ঠিক আছে দেখা হবে। আমার স্ত্রী সেদিন বলছিলেন, আপনার স্ত্রীর হাসিটি একেবারে গোল্ডেন স্টার স্মাইল। হাঃ হাঃ হাঃ।

জ্ঞানব্রত চিন্তা করে দেখলেন আজ সারাদিনে তিনি প্রায় কিছুই কাজ করেননি। কী একটা সামান্য গান তাঁকে একেবারে পাগলা করে তুলেছে। আজই এর একটা হেস্তনেস্ত করে পুরো ব্যাপারটা মন থেকে একেবারে চুকিয়ে ফেলা দরকার।

ওই বোম্বেটে শব্দটা! জ্ঞানব্রতর যেন মনে হচ্ছে এই গানেই তিনি বোম্বেটে শব্দটা প্রথম শোনেন। শহরে ষোলোজন বোম্বেটে …এ লাইনটার নিশ্চয়ই অন্য কোনো মানে আছে। পুরো গানটা শুনলেই তা বোঝা যাবে।

সুজাতাকে টেলিফোন করে জানিয়ে দিলেন, আজ তাঁর ফিরতে দেরি হবে।

রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টর ক্যালকাটা ক্লাবে আসবেন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। মাঝখানে অনেকটা সময়। জ্ঞানব্রত সাধারণত দুটোর পর অফিসে থাকেন না। এক একজন লোক দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ই অফিসে কাটাতে ভালোবাসে। খুব বেশি কাজের চাপ থাকলে জ্ঞানব্রত ফাইলপত্র বাড়িতে নিয়ে যান কিংবা ম্যানেজারদের বাড়িতে ডাকেন। তার বাড়িতে এজন্য দু-খানা আলাদা ঘর আছে।

সন্ধ্যের সময় অফিসের বদলে বাড়িতে বসে কাজ করার একটাই কারণ, খুব বেশিক্ষণ সুট-টাই-মোজা-জুতো পায়ে থাকা পছন্দ করেন না তিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে এই সব ধড়াচুড়ো ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটি পরলেই স্বস্তি।

আজ আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হবে না। এখন বাড়ি ফিরে আবার ক্যালকাটা ক্লাবে আসা একটা ঝক্কির ব্যাপার। জ্ঞানব্রত এখন বেশ লজ্জা পাচ্ছেন। কেন পি. সি. বড়ুয়াকে ডাকতে গেলেন। কী বলবেন তিনি ওঁকে? হঠাৎ এ-রকম ছেলেমানুষি কেন-বা চাপল কে জানে।

চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন জ্ঞানব্রত। সাত-তলায় ওপরের এই ঘর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওইতো কাছেই রেডিয়ো স্টেশন। তিনি ইচ্ছে করলেই ওখানে গিয়ে দেখা করতে পারতেন বড়ুয়া সাহেবের সঙ্গে। কিংবা ওঁকে বলতে পারতেন, অফিস থেকে ফেরার পথে টুক করে দু-মিনিট থেমে যাবেন এখানে। কিন্তু সেটা রীতি নয়। অল্প পরিচিত হোমরা-চোমরা ব্যক্তিদের ক্লাবে ডাকাই নিয়ম।

ডালহাউসি স্কোয়ারের চারপাশ এখন লোকে লোকারণ্য। ওপর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে, বুঝি কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা বেঁধে গেছে। সেসব কিছুই নয়, অফিস ছুটির সময় এ-রকম ভিড়ই হয়।

অন্য দিনের মতো ঠিক ছ-টার সময় বেরোলেন জ্ঞানব্রত।

সুজাতা বিকেলের দিকে আবার গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। না দিলেও অসুবিধে ছিল না। অফিসের অন্য যেকোনো একটা গাড়ি নিতে পারতেন। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়াল। ভেতরে উঠে বসে তিনি বললেন, ইডেন গার্ডেনের দিকে চলো।

শিক্ষিত ড্রাইভার কখনো বিস্ময় প্রকাশ করে না।

সন্ধ্যের সময় বড়োবাবু ইডেন গার্ডেনে হাওয়া খেতে যাবেন, এটা প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তবু সে কোনো কথা না বলে সে-দিকেই গাড়ি ঘোরাল।

এক্ষুনি ক্যালকাটা ক্লাবে যেতে চান-না জ্ঞানব্রত। সেখানে চেনাশুনো অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। এইসময়ে যারা যায়, তারা মদ খেতেই যায়। তাদের পাল্লায় পড়লে তাঁকেও মদের গ্লাস নিয়ে বসতে হবে। কিন্তু তাঁর মদ খাওয়ার প্রতি বিশেষ ঝোঁক নেই, মাঝে মাঝে দু-তিন পেগ খান বটে। খুব-একটা উপভোগ করেন না।

পি. সি. বড়ুয়াকে তিনি বার রুমে আসতে বললেন কেন? খেতে বসলে তো ড্রিংক না নেওয়ার কোনো মানে হয় না। কিছু না ভেবেই তখন বলেছেন। এখন বুঝলেন একটা কারণও আছে। রশিদ সাহেবের বাড়ির পার্টিতে তিনি পি সি বড়ুয়াকে ঘন ঘন স্কচ নিতে দেখেছিলেন।

ইডেন গার্ডেনের পশ্চিম গেটটার সামনে গাড়িটা থেমে গেল। জ্ঞানব্রতকে অন্যমনস্ক দেখে ড্রাইভার শুধু বলল, স্যার।

সময় কাটাবার জন্য ইডেন গার্ডেনে তিনি ঘুরে বেড়াবেন? সেটা হাস্যকর। ওখানে অল্প বয়েসি ছেলে-মেয়েরা যায়। অন্তত পঁচিশ বছরের মধ্যে জ্ঞানব্রত ইডেন গার্ডেনের এই দিকটায় সন্ধ্যে বেলা একবারও আসেননি। ক্রিকেটের সময় দুপুরে আসতেন বটে, তাও সারাদিনের পুরো খেলা কোনোবারই দেখা হয়নি।

তার চেয়ে গঙ্গার ধারে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়ালে হয়। শীতের বেলা, এরই মধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে। জ্ঞানব্রতর মনে পড়ল অনেকদিন তিনি কোনো নদী দেখেননি।

ড্রাইভারকে বললেন, তুমি এখানে থাকো। আমি আসছি।

স্ট্যাণ্ডের কাছটায় যে এমন সুন্দর সব ফুলের গন্ধ আর এ-রকম বাঁধানো রাস্তা হয়েছে জ্ঞানব্রত জানতেনই না। অনেকেই এখানে বেড়াতে আসে। এমনকী তার বয়সি লোকও রয়েছে।

আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে জ্ঞানব্রত আপন মনে গুনগুন করে সেই গানটা গাইতে লাগলেন

শহরে ষোলো জন বোম্বেটে
করিয়ে পাগলপারা নিল তারা
সব লুটে

এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবলেন, আমার কি মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল? এ কী গান আমি গাইছি? এ-গানটা সারাদিন আমার মাথায় গেঁথে আছে কেন? এর মধ্যে কী জাদু আছে। ট্রেনের ভিখিরি কিংবা বাউল-টাউলরা এ-রকম গান গায়, এর সঙ্গে গোল্ডেন স্টার টুথ পেস্ট কোম্পানির মালিকের কী সম্পর্ক!

একটু বিরক্ত মুখে তিনি গঙ্গার দিকে মুখ করে একটা গাছতলায় দাঁড়ালেন।

বড়ো বড়ো কয়েকটা জাহাজ আলোকমালায় সাজানো। ছোটো ছোটো অনেকগুলো নৌকা মোচার খোলার মতন দুলছে, এই মাত্র স্টিমার জলে ঢেউ তুলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে ডেকে চলে গেল। এই গানটার সঙ্গে জ্ঞানব্রতর ছেলেবেলার কোনো যোগ আছে নিশ্চয়ই। জ্ঞানব্রতর খুব ভালো মনে পড়ে না ছেলেবেলার কথা। এগারো বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। তারপর থেকে সব স্মৃতিই খুব স্পষ্ট, কিন্তু বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন তার আগের দিনগুলো যেন হারিয়ে গেছে একেবারে। অথচ সেইসবই ছিল সুখের দিন। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে তাদের সংসারটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল একেবারে।

ঠিক সাড়ে সাতটার সময় জ্ঞানব্রতর গাড়ি থামল ক্যালকাটা ক্লাবের সামনে।

এখনও তাঁর অন্যমনস্ক ভাবটা যায়নি। কোনো দিকে না তাকিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে, হঠাৎ প্রায় মুখোমুখি একজন দাঁড়িয়ে সোল্লাসে বলল, হ্যাল্লো জি বি! সিয়িং ইউ আফটার আ লং টাইম! একা যে?

জ্ঞানব্রত মুখ তুলে একটি বেশ দীর্ঘকায় মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিকে দেখলেন। তার পাশে এক ছিপছিপে চেহারার তরুণী মেয়ে।

পুরুষটিকে চেনেন জ্ঞানব্রত, কনসালটেন্সি ফার্ম আছে। জ্ঞানব্রত ব্যবসা শুরু করার পর গোড়ার দিকে কিছুদিন এর সাহায্য নিয়েছিলেন, এখন বিশেষ যোগাযোগ নেই, তবে তিনি শুনতে পান বাজারে এর অনেক টাকা ধার।

জ্ঞানব্রত ফিকে হাসির সঙ্গে বললেন, কী খবর, পি সি?

খবর তো অনেক। আমরা চলে যাচ্ছিলুম…চলুন তাহলে আপনার সঙ্গে আর একটু বসি। জি বি আপনি খানিকটা রিডিউস করছেন মনে হচ্ছে। ইউ লুক ইয়াং।

উঁচু মহলে কেউ কারুর নাম ধরে ডাকে না। নামের ইংরেজি দু-টি আদ্যক্ষর বলাই রেওয়াজ। জি পি, পি সি, আর এন, পি কে যেন মানুষ নয়, কোনো গুপ্ত সাংকেতিক চিহ্ন।

জ্ঞানব্রত বুঝতে পারলেন, পি সি নামের লোকটি এরই মধ্যে বেশ খানিকটা নেশা করেছে। ওর সঙ্গে টেবিলে বসে কথা বলার একটুও ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু লোকটি নিজেই নিজেকে নেমন্তন্ন করছে।

জ্ঞানব্রত বললেন, আমার সঙ্গে একজনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। অকারণেই হা-হা করে হেসে উঠে পি সি বলল কোনো গোপন ব্যাপার? কোনো পরস্ত্রী? আমরা সেখানে থাকলে অপরাধ হবে?

তারপর হঠাৎ মনে-পড়া ভঙ্গিতে পি সি তার পাশের মেয়েটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আলাপ করিয়ে দিই, মিট মাই কাজিন এলা। এই মেয়েটির নাম এলা..ইয়ে–মানে -কী যেন পদবি তোমার, কিছুতেই মনে থাকে না।

মেয়েটি বলল, মুখার্জি। এলা মুখার্জি।

পি সি নামের লোকটি তার এমনই কাজিনকে সঙ্গে এনেছে, যার পদবিও সে জানে না। আজকাল এ-রকম কাজে মিথ্যে কথা বলার দরকার হয় না। ওই পি সি যেকোনো মেয়ের সঙ্গেই ক্যালকাটা ক্লাবে এসে থাক না কেন তাতে জ্ঞানব্রতর কী আসে-যায়?

তলা থেকে আরও লোক আসছে, এই সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। জ্ঞানব্রত ওপরে উঠতে শুরু করতেই পি সি আর এলা মুখার্জি এল সঙ্গে সঙ্গে।

কোণের একটা টেবিলে বসবার পর পি সি জ্ঞানব্রতকে বলল, আই উইল হ্যাভ ওয়ান স্কচ অন ইউ। এলা কী খাবে আপনি জিজ্ঞেস করুন। ইউ ক্যান অফার হার হোয়াটএভার ইউ লাইক।

এলা বলল, সে আগে জিন আর লাইম খেয়েছে, এখনও তা-ই খাবে।

বয়কে ডেকে মৃদুকণ্ঠে হুইস্কি, জিন এবং নিজের জন্য মিনারাল ওয়াটার অর্ডার দিলেন জ্ঞানব্রত।

এলার কাঁধে আলগা হাত রেখে পি সি বলল জান তো এলা; এই জি বি নাও আ ভেরি বিগ ম্যান–কিন্তু একসময় ছিল, আমার কাছে আসতে হত, আমি ব্যাঙ্ক লোন পাইয়ে দিয়েছি। জি বি, দিইনি? ঠিক বলছি?

পি সি-র উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। একসময় সে জ্ঞানব্রতর উপকার করেছে। এখন তার প্রতিদান চায়। দু-চার পেগ স্কচ খাওয়াবে এ আর এমন কী! কিন্তু এ-রকম প্রতিদান যে সে অনেকবার নিয়েছে তা এলা জানে না।

জ্ঞানব্রত কৃপণ নন, পি সি-কে খাওয়াতে তার আপত্তি নেই। তা ছাড়া এইসব খরচই যাবে তাঁর এক্সপেন্স অ্যাকাউন্ট থেকে। কিন্তু তিনি জানেন, একবার নেশা হয়ে গেলে, পি সি আর থামতেই চাইবে না।

এলা মেয়েটি খুবই সুশ্রী। মুখে বুদ্ধির আভা আছে। পি সি-র সঙ্গে তার বয়েসের অনেক তফাত, অন্তত তিরিশ বছর তো হবেই। এইসব মেয়েকে মদ্যপানের সঙ্গিনী হিসেবে পি সি জোগাড় করে কীভাবে? আর এইসব মেয়েরাই-বা আসে কেন?

এলা নিজের হাতব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বার করল। দু-টিই বেশ দামি। তারপর জ্ঞানব্রতর দিকে তাকিয়ে একটু লাজুকভাবে জিজ্ঞেস করল, আমি আপনার সামনে সিগারেট খেতে পারি?

জ্ঞানব্রত অবাক না হয়ে পারলেন না। তাঁর সামনে মদ খেতে পারে, অথচ সিগারেট ধরাতে লজ্জা, এ আবার কী ধরনের মেয়ে?

জ্ঞানব্রত কিছু বলবার আগেই পি সি বলে উঠল, আরে খাও, খাও! জি বি কিছু মনে করবে না। বছরে দু-তিনবার লণ্ডন-আমেরিকা যায়। এলা বলল, না আমি ওকে আগে থেকেই চিনি কিনা!

আপনি আমাকে চেনেন?

আমাকে আপনি বলছেন কেন? পি সি আবার মাঝখানে বলে উঠল ওকে আপনি বলার কী আছে? জি বি ইউ আর সো ফরমাল…

জ্ঞানব্রতর মনে হল, এখানে এখন পি সি না থাকলেই ভালো হত। এলা নামের এই মেয়েটির সঙ্গে তাঁর কথা বলতে ভালো লাগত। এক-একটি মেয়ে থাকে, যাদের মুখের দিকে তাকালেই ভালো লাগে, এলা সেইরকম।

তুমি আমায় আগে থেকে চেনো?

হ্যাঁ, একবার দেখেছি। আপনি তো উজ্জয়িনীর বাবা! উজ্জয়িনীর সঙ্গে আমি ব্রেবোর্নে পড়েছি এক বছর। তখন একবার আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।

জ্ঞানব্রত স্পষ্ট টের পেলেন, তাঁর শরীরটায় ঝনঝন শব্দ হল। এই মেয়েটি তাঁর মেয়ে উজ্জয়িনীর সহপাঠিনী? পি সি-র মতন একজন সন্দেহজনক চরিত্রের লোকের সঙ্গে ঘোরে। তাঁর সামনে বসে মদ খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে তাঁর মেয়ের বান্ধবী, উজ্জয়িনীর কত বয়েস? কয়েক মাস আগেই ওর কুড়ি বছরের জন্মদিন গেল না? এই মেয়েটির বয়েসও তা হলে কুড়ি-একুশ। তবে কি উজ্জয়িনীও অন্য কোথাও অন্য কারুর সঙ্গে এইভাবে…না না, তা হতেই পারে না?

দু-এক মুহূর্ত আগে জ্ঞানব্রত ছিলেন পুরুষ মানুষ, এখন হয়ে গেলেন বাবা। তাঁর মেয়ের সম্পর্কে দুশ্চিন্তা হতে লাগল, উজ্জয়িনী অনেক স্বাধীন হয়ে গেছে, যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়… জ্ঞানব্রত তেমন খবর রাখতে পারেন না।

এলা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, উজ্জয়িনী এখন এম. এ. পড়বে না? আমি আর এম. এ. টা পড়লুম না!

তৎক্ষণাৎ সস্তা রসিকতার সুরে পি সি বলল, তার বদলে প্রেমে পড়ে গেলে! হাঃ-হাঃ হাঃ!

জ্ঞানব্রত আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন। এলার দিকে তিনি আর তাকাতেও পারছেন না।

এলা বলল, কলেজে আমরা একবার তাসের দেশ করেছিলুম, উজ্জীয়িনী হরতনি সেজেছিল, আপনি দেখতে গিয়েছিলেন?

জ্ঞানব্রত দু-দিকে মাথা নাড়লেন।

আমি হরতনির গান গেয়েছিলুম পেছন থেকে।

পি সি বলল, খুব ভালো গান গায়। জি বি-র অবশ্য গান-টান শোনার সময় নেই, সেকিং মানি অল দা টাইম

গান কথাটা শোনামাত্র জ্ঞানব্রতর আবার মনে পড়ল সেই লাইনগুলো–শহরে ষোলো জন বোম্বেটে–করিয়ে পাগলপারানিল তারা সব লুটে।

পি সি বলল, বাংলা সিনেমায়, রেডিয়োতে আজকাল যা বাজে বাজে গান হয়, সেই তুলনায় এলা…শি ইজ আ ওয়াণ্ডার…এমন চমৎকার গলা!

চুপ করো! তুমি বড়ো বাড়িয়ে বলছ।

জ্ঞানব্রত মুখ তুলে তাকালেন। এলা তুমি বলে কথা বলে পি সি-র সঙ্গে। এই মেয়েটির পশ্চাৎপটটা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাসও তাঁর নেই।

পি সি-র গেলাস খালি হয়ে গেছে। বেয়ারা এসে দাঁড়াতেই সে বলল, হ্যাঁ দাও, আর একটা!

এলা আর নিতে চাইল না। সে বলল, আমি এবার উঠব। তা ছাড়া উনি কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন, আমরা শুধু শুধু ডিসটার্ব করছি ওঁকে–

এক্ষেত্রে ভদ্রতা করে জ্ঞানব্রতর বলা উচিত, না, না, সেরকম কোনো ব্যাপার নয় ইত্যাদি। কিন্তু সে-সুযোগও তিনি পেলেন না, তার আগেই পি সি বলে উঠল, আরে যাঃ। জি বি-কে কি আমি আজ থেকে চিনি? কতকালের সম্পর্ক! সার্টেইনলি হি ওন্ট মাইণ্ড…তোমার মতো একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখেও বিরক্ত হবে, কী, জি বি?

জ্ঞানব্রত বললেন, মাই প্লেজার!

পরের গেলাসে দু-চুমুক দিয়েই পি সি বলল, আমি একটু আসছি। তারপর সে বেরিয়ে গেল।

এবার জ্ঞানব্রত আর এলা মুখোমুখি। জ্ঞানব্রত অশ্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।

আপনাকে দেখলে কিন্তু বোঝা যায় না।

জ্ঞানব্রত একটু চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কী?

আপনার মাথায় এত চুল, একটাও পাকেনি।

ও, বয়েস।

এখনও খুব ইয়াং আছেন!

এলার হাসিটা দেখে আরও চমকে উঠলেন জ্ঞানব্রত। কম বয়সি মেয়েদের সঙ্গে তেমন মেলামেশার অভ্যেস না থাকলেও এ হাসি দেখলে চিনতে ভুল হয় না। প্রশ্রয়ের হাসি। পি সি-র অনুপস্থিতিতে এলা তাকে আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করছে। তার মেয়ের সমবয়সি একটি মেয়ে…

জি ই সি কোম্পানির চৌধুরি এই সময় বাথরুমে ঢুকে জ্ঞানব্রতকে দেখে কথা বলার জন্য এগিয়ে এসে থমকে গেলেন হঠাৎ। তারপর দ্রুত চলে গেলেন উনি। এ-রকম ভরসন্ধ্যে বেলা ক্যালকাটা ক্লাবে কোনো যুবতী মেয়েকে নিয়ে মদের টেবিলে বসে থাকবেন জ্ঞানব্রত চ্যাটার্জি, এ-রকম যেন কেউ কল্পনাই করতে পারে না।

জ্ঞানব্রত মনে মনে একটু হাসলেন। চৌধুরি, বোধ হয় ভাবলেন হঠাৎ রাতারাতি তার চরিত্র পালটে গেছে।

কী মুশকিল, পি সি আসছে না কেন? বাথরুম করতে এত দেরি হয়? নিশ্চয়ই আর কারুর সঙ্গে গল্পে মেতে গেছে।

কতক্ষণ আর চুপচাপ বসে থাকা যায়, তাই জ্ঞানব্রত কথার কথা হিসেবে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় থাক?

গোল পার্কে। ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে।

হোস্টেলে? তুমি চাকরি করো?

করতাম। এখন করি না।

পর মুহূর্তেই এলা ঝরঝর করে হেসে বলল, ভয় নেই, আপনার কাছে চাকরি চাইব না। আমার গান-বাজনা নিয়ে থাকার ইচ্ছে। আপনি গান ভালোবাসেন না?

খুব যে ভালোবাসি কিংবা বুঝি, তা বলতে পারি না। তবে মাঝে মাঝে শুনি।

সামনের সপ্তাহ থেকে যে হাফেজ আলির নামে কনফারেন্স হচ্ছে তাতে যাবেন? আমি যেতে পারি আপনার সঙ্গে।

একটু গম্ভীর হয়ে জ্ঞানব্রত বললেন, সামনের সপ্তাহে আমার কলকাতায় থাকা হবে না। মুম্বাই যেতেই হবে।

বাবা! আপনারা সবসময় এত ব্যস্ত।

তুমি কী গান করো? পল্লিগীতি কিংবা পুরোনো বাংলা গান জানো?

ফোক সঙ? না ওসব আমি করি না..আমি নজরুল অতুলপ্রসাদের গান…রবীন্দ্রসংগীতও শিখেছি। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের আর্টিস্ট এত, যে চান্স পাওয়া যায় না।

এবার রেডিয়ো স্টেশনের বড়ুয়া দরজা দিয়ে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। জ্ঞানব্রত হাত তুললেন।

বড়ুয়া এলার দিকেই তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলেন। বড়ুয়া ও জ্ঞানব্রত প্রায় সমবয়সিই মনে হয়, মাথার চুলে কিছু পাক ধরেছে। কিন্তু জ্ঞানব্রতর তুলনায় বড়ুয়া অনেকটা ছটফটে ধরনের মানুষ। এদের আদিবাড়ি চট্টগ্রামে, তবে এখন নিজেকে অসমিয়া বলে পরিচয় দেন।

পাক্কা সাহেবের মতন সুট-টাই পরা বড়ুয়ায়। বসেই কোটের দু-পকেট থাবড়াতে থাবড়াতে বললেন, আই অ্যাম স্লাইটলি লেট–আটটা দশ–এই যাঃ! সিগারেট আনতে ভুলে গেলাম!

টেবিলের ওপর এলার সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার পড়ে আছে। বড়ুয়া ধরেই নিলেন সেগুলো জ্ঞানব্রতর। তিনি সে-দিকে অন্যমনস্কভাবে হাত বাড়াতেই জ্ঞানব্রত বললেন, আমি সিগারেট আনিয়ে দিচ্ছি, আপনার কী ব্র্যাণ্ড?

এলা বলল, নিন না!

এবার আলাপ করিয়ে দিতে হয়। জ্ঞানব্রত বললেন ইনি মিস এলা মুখার্জি, গান করেন, আর ইনি এন সি বড়ুয়া কলকাতা রেডিয়োর…

বড়ুয়ার চোখে বেশ খানিকটা কৌতূহল ফুটে উঠল। তিনি একবার এলার মুখের দিকে, একবার জ্ঞানব্রতর দিকে তাকাতে লাগলেন। ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না।

এ-রকম অদ্ভুত অবস্থায় জ্ঞানব্রত কখনো পড়েননি। ঝোঁকের মাথায় বড়ুয়াকে তিনি এখানে ডেকেছিলেন। বড়ুয়া নিশ্চয়ই একটা-কিছু কারণ জানতে চাইবেন। অন্তত মনে মনে। কিন্তু কী কারণ দেখাবেন জ্ঞানব্রত? যা বলতে চান তাও এখন বলা যাবে না। এলাকে নিয়ে তিনি বসে আছেন। এলা গান গায়। বড়ুয়া হয়তো ভাববেন এই মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্যই তাঁকে এখানে ডাকা হয়েছে। এই মেয়েটিকে যে জ্ঞানব্রত পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেও চিনতেন না। তা কি বিশ্বাস করবেন?

এরপরই এসে পড়ল পি সি।

 জ্ঞানব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলা হবে না, কোনো কথাই বলা হবে না আজ। অনাবশ্যক অন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ছেন।

তার ইচ্ছে হল, কারুকে কিছু না বলে হঠাৎ এখান থেকে উঠে চলে যেতে।

সে-রাতে জ্ঞানব্রত বাড়ি ফিরলেন এগারোটার পর এবং বেশ মাতাল অবস্থায়। এটা একটা অভিনব ঘটনা।

সুজাতা অবাক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিলিতি শিক্ষা অনুযায়ী মুখে সে-ভাব ফোটাল না। কোনো এক ইংরেজ মহিলা ঔপন্যাসিকের লেখায় সুজাতা পড়েছিল যে, যারা প্রকৃত লেডি, তারা কোনো কিছুতেই চট করে অবাক হয় না।

কেন দেরি হল, কাদের সঙ্গে ছিল এসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না সুজাতা। শুধু জানতে চাইল, তুমি কি রাত্রে আর কিছু খাবে?

জ্ঞানব্রতর চক্ষু দু-টি লাল, চুল এলোমেলো, টাইয়ের গিট আলগা। সারামুখে একটা জ্বলজ্বলে ভাব। মাথা নেড়ে বললেন না।

স্বামী-স্ত্রীর একই শয়নকক্ষ বটে কিন্তু আলাদা দু-টি খাট। ঘরটি বেশ বড়ো। খাট দু-টি দু দিকের দেয়ালে পাতা। এই ব্যবস্থা এইজন্য যে সুজাতা অনেক রাত জেগে উপন্যাস পড়তে ভালোবাসে। জ্ঞানব্রত ঘুমিয়ে পড়েন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটায় এবং চোখে আলো তাঁর সহ্য হয় না। সুজাতার খাটের সঙ্গে একটা ছোট্ট আলো লাগানো আছে বই পড়বার জন্য।

সুজাতা বলল, তুমি অ্যাসপিরিন বা অ্যান্টাসিড-জাতীয় কিছু ওষুধ খাবে?

জ্ঞানব্রত প্রথমে দু-দিকে ঘাড় নাড়লেন। তারপর এক মুখ হেসে শিশুর মতন আবদারের গলায় বললেন, একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। দেবে?

এতেও বিস্মিত ভাব দেখালেন না সুজাতা।

আজ এ-রকম পরপর নিয়মের ব্যাতিক্রম করছেন জ্ঞানব্রত।

একসময় তাঁর মুখে সিগারেট কিংবা চুরুট সবসময় লেগে থাকত। সাত মাস আগে একদিন বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার অবশ্য অনেক পরীক্ষা করেও হার্টের কোনো রোগ ধরতে পারেননি। তবে সাবধান হওয়া ভালো। সিগারেট চুরুট এসব ছাড়া দরকার।

সিগারেটের অভ্যেস ছাড়া পৃথিবীর বহু লোকের পক্ষে খুব শক্ত হলেও জ্ঞানব্রতর কাছে কিছুই না। সেই যে চুরুটের বাক্স ছুঁড়ে ফেলে দিলেন রাস্তায় তারপর থেকে এই সাত মাসের মধ্যে একবার ভুলেও ধূমপানের ইচ্ছে প্রকাশ করেননি। তাঁর যেমন কথা, তেমন কাজ।

একসময় মুখে দুটো সিগারেট একসঙ্গে নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে জ্ঞানব্রত তার একটা দিতেন সুজাতাকে। বিয়ের পর কিছুদিন রাত জেগে গল্প করার সময় দু-জনে পাশাপাশি বসে এক প্যাকেট সিগারেট উড়িয়ে দিতেন।

সুজাতা সিগারেটের অভ্যেস ছাড়তে পারেনি।

স্বামীর দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আই থিংক, ইউ বেটার নট।

 খাই-না একটা!

আগেকার মতন আর এক সঙ্গে দুটো সিগারেট জ্বালালেন না জ্ঞানব্রত। শুধু নিজেরটা ধরিয়ে বললেন, আজ একটা বড় মজার ব্যাপার হয়েছে। একটা গানের ক-টা লাইন এমন মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে যে কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। এমনকী এতখানি মদ গিলে ফেললুম, তাও যাচ্ছে না!

কী গান?

একটা হেঁচকি উঠতেই প্রথমে মুখে হাতচাপা দিয়ে জ্ঞানব্রত বললেন, সরি। তারপর উ উ করে সুর ভেঁজে গেয়ে উঠলেন–

শহরে ষোলো জন বোম্বেটে
 করিয়ে পাগলপারা নিল তারা সব লুটে
রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি,
চোরেরও সে শিরোমণি…

এমনিতেই জ্ঞানব্রতর গলায় খুব একটা সুর নেই, মাতাল অবস্থায় তার গলাটা আরও মজার শোনাচ্ছে।

সুজাতা হেসে ফেলে বলল, বাঃ বেশ গানটা তো!

পরের লাইনগুলো মনে পড়ছে না।

এটা কার গান?

কী জানি! আমি কি গান-বাজনার কোনো খবর রাখি? তবু এই একটা অদ্ভুত গান যে কেন মাথায় ঢুকে গেল…

এবার শুয়ে পড়ো, ঘুমোলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

জ্ঞানব্রত ধড়াচুড়ো ছেড়ে রাত্রের শোবার পোশাক পরতে লাগলেন। যথেষ্টই নেশা হয়েছে। মাঝে মাঝে তাঁর পা কেঁপে যাচ্ছে।

আচ্ছা সুজাতা তুমি এই গানটা আগে কখনো শুনেছ।

না!

 অথচ আমার মন বলে আমি আগে এটা অনেকবার শুনেছি। তা কী করে সম্ভব?

সুজাতার খাটের ওপর একটা বই অর্ধেক উলটানো। বেলজিয়ান লেখক জজ নিমেনোর সে নিদারুণ ভক্ত। গোয়েন্দা উপন্যাসের অর্ধেকটা যার পড়া হয়েছে, তার কেন সেই সময় একটা আজেবাজে গান সম্পর্কে আলোচনা শুনতে ভালো লাগবে?

–তুমি শুয়ে পড়ো, আমি আসছি। সুজাতা চলে গেল বাথরুমে। টুথপেস্ট কোম্পানি মালিকের স্ত্রী বলেই নয়, রাত্রে শোবার আগে দাঁত ব্রাশ করা সুজাতার ছেলেবেলা থেকেই অভ্যেস। টুথপেস্ট কোম্পানির মালিক স্বয়ং অবশ্য রাত্রে দাঁত মাজেন না শুধু তাই নয়, দাঁত মাজার পর টুথপেস্টের গন্ধমাখা মুখে চুমু খেতেও তাঁর ভালো লাগে না। সুজাতা তার স্বামীর ভাবভঙ্গি দেখে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, আজ আর তাঁর চুমু খাওয়ার কোনো বাসনা নেই।

সুজাতা ফিরে এসে দেখল জ্ঞানব্রত চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন জানলার কাছে।

প্রায় বারোটা বাজল, তুমি ঘুমোবে না?

হ্যাঁ, এবার শুচ্ছি। অনেক দিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। চলো এবার কোনো গ্রামে বেড়াতে যাই। যাবে?

তুমি যে বলেছিলে সামনের দু-তিন মাসে তোমার খুব বেশি কাজ? হায়দরাবাদে একটা ফ্যাক্টরি খোলা হবে…

হ্যাঁ, কাজ আছে তো বটেই…কিন্তু মন টানছে এমন কোথাও যাই, যেখানে সবুজ গাছপালা, একটা বেশ নির্জন নদী।

সুজাতার কাছে গ্রাম মানে ট্রেনের দু-ধারের দৃশ্য। শান্তিনিকেতনের চেয়ে কোনো ছোটো জায়গায় সে জীবনে থাকেনি। সাদা টালি বসানো বাথরুম যেখানে নেই সেসব জায়গা সুজাতার পক্ষে বাসযোগ্যই নয়। সুজাতার রূপ এবং সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যেই এই ভাবটা রয়েছে যে, এই পৃথিবীতে সে অবিমিশ্র সুখভোগের জন্যই এসেছে।

কেনই-বা সুখভোগ করবে না। একটাই তো জীবন?

তুমি যদি সময় করতে পার, চলো তা হলে একবার শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে আসি। চুমকিও বলছিল..

আগের বার শান্তিনিকেতন গিয়ে তোমার ভালো লাগেনি।

যা গরম ছিল সেবার। টুরিস্ট লজের যে ঘরটা আমাদের দিয়েছিল, এয়ারকুলারটা কোনো কাজ করছিল না।

হা-হা-হা-হা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *