১. রত্না দরজায় টোকা দেওয়ার আগে

হটলাইন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ – অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯

জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে।

–জীবনানন্দ দাশ

.

ভূমিকা

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সুইসাইড হটলাইন রয়েছে। বিষণ্ণ, হতাশাগ্রস্থ বা আত্মহত্যা করতে উদ্যত মানুষেরা সেখানে ফোন করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতে পারে। আমাদের দেশেও এরকম হটলাইন আছে এবং সেখানে যেসব কমবয়সী ভলান্টিয়ারেরা কাজ করে তাদের অনেকের সাথে আমার পরিচয়ও আছে। এই ভলান্টিয়ারদের অভিজ্ঞতাগুলো অসাধারণ কিন্তু তারা যেহেতু গোপনীয়তার অঙ্গীকার করে কাজ করে সেজন্য তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলো কখনোই আমি তাদের মুখ থেকে জানতে পারিনি। তাই সুইসাইড হটলাইনের এই ছোট উপন্যাসটি আমাকে কল্পনা করে লিখতে হয়েছে।

আমার কল্পনার সাথে সম্ভবত বাস্তবতার খুব মিল নেই, সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ারেরা এই কারনে একটু বিচলিত হলেও আশা করছি পাঠকেরা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৫ জানুয়ারি ২০১৯

.

এক

রত্না দরজায় টোকা দেওয়ার আগে হাতে ঘড়ির দিকে তাকালো, নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকী। ঠিক নয়টা থেকে তার শিফট শুরু হবে, সে দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে। প্রথমদিন দেরী হলে খুব লজ্জার ব্যাপার হতো। ঢাকা শহরে অবশ্যি বিশ পঁচিশ মিনিট দেরী হলে কেউ কিছু মনে করে না, শুধু মুখে বিরক্তির ভাব করে বলতে হয়, যা ট্রাফিক জাম! শব্দটা ইংরেজী-জ্যাম, কিন্তু সবাই বলে জাম। সে জন্যে রত্নাও বলে জাম। ট্রাফিক জাম।

রত্না দরজায় টোকা দিল, সাথে সাথে খুট করে দরজা খুলে গেল। মনে হল কেউ বুঝি দরজা খোলার জন্যেই ছিটকিনিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রত্না দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, দরজার অন্য পাশে সুমী আপু দাঁড়িয়ে আছে। সুমী আপু রত্নার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালো, এসে গেছো?”

“জ্বী আপু।”

“কেমন করে এসেছ?”

“আব্দু নামিয়ে দিয়েছে।”

“সত্যি?”

রত্না মাথা নাড়ল। সুমী আপু বলল, “তোমার আব্লু তো ভালো আছেন। নিজে নামিয়ে দিয়েছেন। বাহ!” রত্না আবার মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, আমার আব্ব খুব সুইট।”

সুমী আপু দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে বলল, “বেশীর ভাগ মেয়েদের যা-তা অবস্থা। রাতের শিফট মানে নো ননা! রীতিমত

ঝগড়াঝাটি মারামারি করে আসতে হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। অনেক সময় আব্দুরা রাজী হয়ে যান কিন্তু আম্মুরা আরো দুই ডিগ্রী উপরে। কিছুতেই রাজী হতে চান না। এ রকম অবস্থা হলে সুইসাইড হটলাইনটা চলবে কেমন করে?”

রত্না কী বলবে বুঝতে না পেরে বড় মানুষদের মত মুখ গম্ভীর করে বলল, “চলবে আপু। একশবার চলবে।” কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে অবশ্যি কোনো ব্যাখ্যা দিল না।

সুমী আপু মুখ শক্ত করে বলল, “চালাতে তো হবেই, শুরু করে তো আর হঠাৎ করে বন্ধ করে দিতে পারব না।”

রত্না সুমী আপুর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। করিডোরের শেষ মাথায় সুইসাইড হটলাইনের কল সেন্টার। বন্ধ দরজা। দরজার উপর একটা কাগজ স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো। কাগজটাতে মার্কার দিয়ে লেখা, নো এন্ট্রে-প্রবেশ নিষেধ। সুমী যখন এখানে ট্রেনিং নিয়েছে তখন সে অনেকবার এই নোটিসটার দিকে তাকিয়েছে। একটা কাগজে মার্কার দিয়ে

লিখে যদি আসল একটা সাইনবোর্ড থাকতো তাহলে মনে হয় এর গুরুত্বটা কমে যেতো, কেমন জানি খেলে মনে হতো। কাগজে লেখার কারণে এর মাঝে কেমন জানি একটা ভয় ভয় ভাব এসেছে। মনে হচ্ছে দরজার অন্য পাশে রহস্যময় কিছু আছে। আজকে প্রথমবার সে এই দরজার অন্য পাশে যাবে, একটা ডেস্কে বসবে। সামনে একটা মোবাইল ফোন থাকবে। মোবাইল ফোনটা যে কোনো মুহূর্তে বেজে উঠবে। অন্য পাশে কে থাকবে সে জানবে না, শান্ত গলায় তাকে বলতে হবে, ‘সুইসাইড হটলাইন! আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

“শিফটে বসার জন্য রেডি?” সুমী আপুর কথাটা খুবই সাধারণ একটা কথা, শুধু বলার জন্য বলা কিন্তু রত্নার কেন জানি মনে হলো এটার একটা সঠিক উত্তর দিতে হবে। কিন্তু সে সঠিক উত্তর না দিয়ে বোকার মত বলে বসল, “না।”

“না?” সুমী আপু শব্দ করে হাসল, বলল, “এতো ট্রেনিং দিয়ে তোমাকে রেডি করলাম আর তুমি এখন বলছ, না? রেডি না?”

“ভয় করছে আপু।”

“ভয়? ভয় করবে কেন? বলতে পারো নার্ভাস লাগছে।”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু। নার্ভাস লাগছে।”

“নার্ভাস লাগার কিছু নাই। তোমার ডেস্কের উপর পুরো প্রটোকল লেখা আছে। কী বলতে হবে মনে না থাকলে চোখ বন্ধ করে একটার পর একটা পড়ে যাবে।”

“মনে আছে। বাসায় প্র্যাকটিস করেছি।”

“গুড।”

“কিন্তু-”

“কিন্তু কী?”

রত্না একটু ইতস্তত করে বলল, “যদি প্রথমেই একটা সুইসাইড কেস চলে আসে?”

সুমী আপু হাসল, বলল, “আসবে না। সত্যিকারের সুইসাইড কেস কম আসে। আর যদি চলেই আসে আসবে, সমস্যা কী? ফেস করবে। অন্যেরা করছে না?”

“অন্যদের তো কতো এক্সপেরিয়েন্স! আমি আজকে প্রথম।”

“সবারই একসময় প্রথম ছিল। এটা কোনো ব্যাপার না।”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু।”

সুমী আপু কল সেন্টারের হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল। রত্না ফিসফিস করে বলল, “এখনো নয়টা বাজে নাই। আমি ঢুকব?”

সুমী আপু নিচু গলায় বলল, “ঢুকবে না কেন? তুমি আমাদের সার্টিফাইড ভলান্টিয়ার যখন খুশী ঢুকতে পারবে। আস। তোমাকে বসিয়ে দেই।”

রত্না সুমীর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো। পাশাপাশি ছয়টা চৌকোনা ডেস্ক। একটা ডেস্কে একজন মেয়ে টেলিফোনে কথা বলছে। তার পাশের একজন ছেলে ডেস্কের উপর পা তুলে দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা রংচংয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। ঘরের মাঝামাঝি দুটি ছেলে এবং মেয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করছে। মেয়েটার চুল ছেলেদের মত ছোট করে কাটা। সুমী আপুকে ঢুকতে দেখে ডেস্কের উপর পা তুলে রাখা ছেলেটি তার পা নামিয়ে হাসার ভঙ্গি করল। ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন ছেলে মেয়ে কথা থামিয়ে সুমী আপুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

সুমী একটু এগিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা? কী রকম টেলিফোন আসছে?”

“কম। খুবই কম।”

“গুড। কল কম আসা মানে গুড নিউজ। মানুষের মনে দুঃখ কষ্ট নাই, ডিপ্রেশান নাই। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি নাই।”

দাঁড়িয়ে থাকা চুল ছোট করে কাটা মেয়েটা বলল, “কিংবা মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”

সবাই চাপা স্বরে হাসল। সুমী আপু বলল, “ঠিকই বলেছিস। মনে কষ্ট আছে কিন্তু মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”

রত্না একটু পিছনে খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমী আপু তার হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোদের রত্নার সাথে পরিচয় হয়েছে? আমাদের লাস্ট ব্যাচের ভলান্টিয়ার।”।

দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “ইয়া মাবুদ। এ কি আমাদের ভলান্টিয়ার? আমি ভেবেছিলাম সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ার হতে হলে এডাল্ট হতে হয়। এ-তত দশ বছরের মেয়ে!”

রত্না হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার বয়স আঠারো।”

মেয়েটি বলল, “খোদার কসম! দেখে মনে হয় তোমার বয়স দশ। ম্যাক্সিমাম বারো। ক্লাস সেভেনে পড়।”

“আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।”

সুমী আপু চুল ছোট মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম রুনু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।” তার সাথের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে ইমরান। সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরী করে।” রংচংয়ের ম্যাগাজিন হাতের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে রাজু। আর্কিটেক্ট। আর ঐ যে টেলিফোনে কথা বলছে সে হচ্ছে তিষা।” তারপর রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “রত্না আমাদের নতুন ভলান্টিয়ার, কিন্তু রত্না আজকে নাইট শিফট করবে!”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে বসে থাকা ছেলেটা তার চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এলো, বলল, “ওয়েলকাম রত্না। ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্লাব।”

রত্না দুর্বল ভাবে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “খুব নার্ভাস লাগছে!”

ম্যাগাজিন হাতে ছেলেটা বলল, “নার্ভাস লাগার কিছু নাই। নাইন্টি পার্সেন্ট কল রুটিন। মা বকা দিয়েছে, বাবা বকা দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ হয় নাই। ব্রেক আপ হয়ে গেছে। বয় ফ্রেন্ড পালিয়ে গেছে এইসব। খালি ধৈর্য্য ধরে ওদের কথা শুনবে।”

“বাকী টেন পার্সেন্ট?”

“বাকী টেন পার্সেন্ট একটু সিরিয়াস। কেস টু কেস ডিল করতে হবে।”

রত্না বলল, “ঐ টাই তো ভয়! যদি সিরিয়াস কেস চলে আসে?”

“ভয় নাই। আসবে না। সিরিয়াস কেস কম আসে।”

“ঐ যে আমাদের ট্রেনিংয়ের সময় আপু বলেছিল একটা কেস, বত্রিশটা ঘুমের টেবলেট হাতে নিয়ে ফোন করেছে–যদি সেইরকম কেস আসে?”

“আসবে না। ঐ রকম কেস খুব কম আসে। আমি দুই বছর থেকে কাজ করছি। এখনও পাই নাই।”

সুমী আপু বলল, “যাই হোক আজকে রত্নার প্রথম দিন। তাকে একটা ভালো ডেস্কে বসিয়ে দে।”

রুনু নামের মেয়েটা মাঝামাঝি ডেস্কটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “এইখানে বসে যাও। মোবাইলটা ভালো। কথা পরিষ্কার শোনা যায়।”

রত্না এগিয়ে গেল। ব্যাগটা টেবিলের নিচে রেখে চেয়ারটা টেনে বসল। সস্তা চেয়ার কিন্তু বসে আরাম আছে। টেবিলে একটা ক্লীপ বোর্ড, একটা বল পয়েন্ট কলম। সামনের দেওয়ালে একটা কাগজে তাদের প্রটোকল লেখা। কেউ যদি ভুলে যায় তাহলে কোন প্রশ্নের পর কোন প্রশ্ন

করতে হবে সেগুলো

গুছিয়ে বলে দেয়া আছে।

সুমী বলল, “রত্না তাহলে তুমি শুরু করে দাও। যদি খিদে লাগে ফ্রীজে টুকটাক খাবার আছে। ড্রিংকস। চীপস। রাত তিনটার সময় শিফট বদল হবে। যতক্ষণ পরের শিফট না আসে ম্যানেজ করো!”

“করব।”

সুমী সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা রত্নাকে দেখে শুনে রাখিস।”

সবাই প্রায় এক সাথে বলল, “রাখব।”

রত্না চারিদিকে তাকালো। তিষা নামের যে মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলছিল তার কথা আবছা আবছা ভাবে শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলছে। রত্না শোনার চেষ্টা করল, শুনল তিষা বলছে”মাহরীন আপু, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। থ্যাংক ইউ আপু যে তুমি আমাদের ফোন করেছ। তুমি ঠিকই বলেছ, জিশানের কাজটা ঠিক হয় নাই। কিন্তু তুমি যেভাবে পুরো ব্যাপারটা ফেস করেছ সেটা অসাধারণ।

সিমপ্লি গ্রেট। আজকে তাহলে আমরা এইখানে শেষ করে দিই?” মেয়েটা কিছুক্ষণ অন্য পাশের মাহরীন আপুর কথা শুনল, তারপর বলল, “হা হা মাহরীন আপু। তোমার যখন ইচ্ছা ফোন করতে পার। আমাদের ভলান্টিয়াররা কেউ না কেউ আছে। তারপর বেশ সুরেলা গলায় বিদায় জানাল, “বাই।”

টেলিফোনটা রেখে তিষা নামের মেয়েটা অন্য সবার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “আমাদের দেশের মেয়েগুলো হচ্ছে বোকা আর ছেলেগুলো হচ্ছে বদমাইস।”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “তিষা, তুই মনে হয় এখনো জানিস না যে আমি একজন ছেলে!”

“তুই ছেলে হয়েছিস তো কী হয়েছে? আমি সত্যি কথা বলতে পারব না?” মেয়েটা মোটামুটি হিংস্র মুখে বলল, “শুরু হবে ফেসবুক দিয়ে, তারপর টেলিফোন, তারপর দুই চার দিন ফাস্টফুডের দোকান-তারপর স্ট্রেট সেক্স! সেক্স হবার পর ছেলেটা ডাম্প করে চলে যাবে।”

দাঁড়িয়ে থাকা অন্য ছেলেটা রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “তিষা, এইখানে বাচ্চা একটা মেয়ে আছে।”

তিষা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “খবরদার বাচ্চা বাচ্চা করবি না। এইখানে ভলান্টিয়ার হতে হলে অনেক কিছু পার হতে হয়, এখানে কেউ বাচ্চা না টেলিফোন রিসিভ করবে আর দুনিয়ার ফ্যাক্টস জানবে না এইটা তো হতে পারে না।”

তিষা নামের মেয়েটা এবারে রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু, আমার নাম তিষা। তুমি-”

“রত্না।”

“রত্না। গুড, তুমি এতো ছোট থাকতেই ভলান্টিয়ার হতে পেরেছ হাউ নাইস। কগ্রাচুলেশন্স!”

রত্না বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু পারব কি না সেইটা তো বুঝতে পারছি না।”পারবে না কেন? খুব ভালো পারবে।”

“আমি শুনছিলাম তিষা আপু, তুমি কী সুন্দর করে কথা বলছিলে।”

“তুমিও বলবে। তুমি আমার থেকে সুন্দর করে কথা বলবে।”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে রাজু নামের ছেলেটা বলল, “তিষা শুধু টেলিফোনে সুন্দর করে কথা বলে। সামনা সামনি তার কথাবার্তা খুবই খারাপ।”

তিষা রাজুর কথাটার কোনো গুরুত্ব দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “পরের শিফটের সবাই এসেছে? আমার যেতে হবে।”

“তুই যা। অন্যরা না আসা পর্যন্ত আমরা আছি।”

তিষা রত্নার দিকে তাকিলে বলল, “ওকে রত্না। তোমার সাথে দেখা হবে। প্রথম শিফটটাই নাইট শিফট দিয়ে শুরু করেছ দ্যাট ইজ গুড। রাত যতো গম্ভীর হয় তত বেশী ইন্টারেস্টিং ফোন আসে। দেখবে কতো এক্সাইটিং।”

তিষা ডেস্কের নিচ থেকে তার ব্যাগটা বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কল সেন্টার থেকে বের হয়ে গেল।

ঠিক তখন রত্নার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

রত্না একটু চমকে উঠল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো। সবাই হাসি হাসি মুখে রত্নার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট করে কাটা চুলের রুনু নামের মেয়েটা বলল, “ধরো রত্না।”

রত্না টেলিফোনটা ধরে কল রিসিভ করার বাটনে চাপ দিয়ে কানে লাগালো তারপর শান্ত গলায় বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

অন্য পাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। রত্না আবার বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

এবারেও কোনো উত্তর নেই। রত্না টেলিফোনটা কানে ধরে রেখে একটু অবাক হয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই জানে মাঝে মাঝেই টেলিফোন আসে যখন অন্যপাশে যে থাকে সে কোনো কথা বলে না। মিনিট খানেক চেষ্টা করেও যদি কোনো কথা বলানো না যায় তাহলে টেলিফোনটা কেটে দিতে হয়।

রত্না তা-ই করবে। সে আরো একটু চেষ্টা করবে তারপর লাইন কেটে দেবে। রত্না আবার বলল, “হ্যালো! আমি সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” কোনো জবাব নেই, রত্না বলল, “আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

রত্না এবারে স্পষ্ট একটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। গভীর একটি নিঃশ্বাস। অন্য পাশে যে আছে সে তার কথা শুনছে কিন্তু তার কথার

উত্তর দিচ্ছে না। যদি উত্তর না দেয় তার আর কিছু করার নেই। রত্নাকে যেভাবে শেখানো হয়েছে সে সেভাবে চেষ্টা করল, বলল, “আপনি আমাদের ফোন করেছেন সেজন্যে আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনি যদি একটুখানি বলতেন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি তাহলে আরো খুশী হতাম। বলবেন?”

কোনো উত্তর নেই।

“আপনি কি কথা বলবেন?”

কথা বলল না।

কথা বলার এক পর্যায়ে তাদের জানতে হয় সে মানুষটি কি আত্মহত্যা প্রবণ কিনা। সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলতে হয়। যে মানুষটি কথাই বলছে

তাকে কি এটা জিজ্ঞেস করা যায়? রত্না কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আপনি কি আপনি কি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন?” অন্য পাশ থেকে কেউ কিছু বলবে রত্না আশা করেনি, কিন্তু সে প্রথমবার একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, কেউ একজন ভারী গলায় ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয়তলা থেকে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *