যৌনতা, ক্ষমতা, নৈতিকতা : দুই ভিন্ন প্রেক্ষিত
‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ এবং ‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’র প্রথম খণ্ড পর্যন্ত ফুকোর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু ছিল ‘আধুনিক’ ইউরোপীয় সমাজে কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিস এবং ক্ষমতাসম্পর্কের মধ্য দিয়ে ‘বিষয়ী’কে নির্মাণ করা হয়েছে (যেমন, কীভাবে ‘উন্মাদ’, ‘অপরাধী’, ‘যৌনবিকারগ্রস্ত’—প্রভৃতি নির্দিষ্ট ব্যক্তিপরিচয়গুলি গড়ে ওঠে) ৷ অন্যান্য ‘আকরণবাদী’ তাত্বিকের মতোই ফুকোও মনে করতেন ‘স্বাধীন, সার্বভৌম ও স্বয়ংক্রিয় বিষয়ী’র অস্তিত্ব আদপেই সম্ভব নয় (অনেকেরই মনে পড়বে আলথুসারের সেই বিখ্যাত উক্তি—…’there are no ‘subjects’, that the ‘subject’ can be ‘deleted’ from Philosophical thinking’) ৷১ এমনকী The Order of Things-এর অন্তিম অংশে পৌঁছে যখন ফুকো তাঁর চরম বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেন—‘মানুষ’ হল একধরনের ‘আবিষ্কার’, ‘আধুনিকতা’র সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই এর ‘মৃত্যু’ও অবশ্যম্ভাবী, তখনও ‘বিষয়ী’র স্বাধীন সত্তাকে যেন খানিকটা অস্বীকারই করেন তিনি ৷ ‘যৌনতার ইতিহাস’-এর প্রথম খণ্ডে তিনি অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেন—কীভাবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকাঠামোর হাতে এই বিষয়ী-উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি রূপ পায়, কীভাবে ‘আধুনিক’ পাশ্চাত্য সমাজে ‘ব্যক্তি’-র যাবতীয় কার্যকলাপ, অবচেতন, ‘ব্যক্তি’-সম্পর্কিত ‘সত্য’ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি ঘুরপাক খেয়েছে ‘ব্যক্তি’-র যৌনতার ডিসকোর্সের সাপেক্ষে, যাকে পল র্যাবিনো তাঁর একটি লেখায় বলেছিলেন : “genealogy of the modern individual as ‘object’ ৷২ কিন্তু ফুকো তাঁর গবেষণার প্রথম দিক থেকেই সচেতন ছিলেন এই ব্যাপারে, যে, ‘ব্যক্তি’-কে সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোর নিছক ক্রীড়নক হিসেবে ধরে নেওয়াটা হবে নেহাতই আংশিক সত্য ৷ বরং এর উল্টোটাও বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব ৷ বিষয়ী তাঁর নিজের সম্পর্কে কী ভাবছে, কী বলতে চাইছে এবং তার এই আপেক্ষিক স্বাধীনতার অবস্থান থেকে কোনো ‘পাল্টা বাচন’ গড়ে ওঠা সম্ভব কিনা—এ সম্পর্কেও ফুকো ছিলে সচেতন ৷ ‘ব্যক্তি’-র প্রাতিস্বিক সত্তারও যে একটি স্বতন্ত্র নিজস্ব অবস্থান ও বাস্তবতা সম্ভব, সে সম্পর্কে বলতে গিয়েই ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’-এ বলেছিলেন : ‘it exists, if has a reality’, it is produced permanently around, on within the body by the functioning of a power’ ৷৩ অর্থাৎ ‘ক্ষমতাকাঠামো’র আগ্রাসী কৃৎকৌশলের ভিতরেই ব্যক্তি তার নিজস্ব উচ্চারণ বজায় রাখে ৷ পিয়ের রিভিয়ের এবং হারকিউলিন বারবিন-এর দুটি কেস স্টাডির মধ্য দিয়ে ফুকো-র এই স্বতন্ত্র বিষয়ী-সংক্রান্ত গবেষণা নতুন দিকে মোড় নিচ্ছিল ৷ প্রথমোক্তজন উনিশ শতকের একজন কুখ্যাত অপরাধী, যে তার মা-বোন-ভাইকে হত্যা করেছিল, দ্বিতীয়োক্ত জন উনিশ শতকের এক ফরাসি ‘হারমাফ্রোডাইট’ ৷ প্রথম জনকে অপরাধবিজ্ঞানের কোন ক্যাটেগরিতে ফেলা হবে সে সম্পর্কে সামাজিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দ্বিধা এবং দ্বিতীয়জনের উভলিঙ্গ যৌনপরিচয় ও তজ্জনিত চিকিৎসাবিজ্ঞানের সংকট-কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফুকো দেখাচ্ছেন কীভাবে আত্মকথনের মধ্য দিয়ে ওই দুজন সামাজিক ‘অপর’ ব্যক্ত করেছেন তাদের আত্মসত্তার নিজস্বতাকে ৷৪ অর্থাৎ ফুকো-র উত্তরজীবনের চিন্তাভাবনায় ক্রমশই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল বিষয়ী-র নিজস্ব চৈতন্যের স্বাতন্ত্র্য-সংক্রান্ত ভাবনা ৷
এই ভাবনা ক্রমশ পরিণত রূপ পেল ‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’র দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডে, (যথাক্রমে “The Use of Pleasure’ এবং ‘The Care of the Self’) ৷ এই দুটি খণ্ডের আধার প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান সভ্যতায় যৌনতার ইতিহাস ৷ আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে প্রাচীন পেগান সমাজে যৌনতার এক ভিন্ন নৈতিকতার অনুসন্ধানই ছিল ফুকোর উদ্দেশ্য ৷ ফুকো দেখাতে চাইলেন :
ক. ‘আধুনিক’ জ্ঞান-যুক্তি আলোকায়নের ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রক্রিয়ার দ্বারা ‘বিষয়ী’র যৌনসত্তা নির্মাণের কৃৎকৌশল থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একধরনের যৌননৈতিকতার হদিশ কীভাবে পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে ৷
খ. ‘আধুনিক যুগে বাহ্যিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক এক প্রক্রিয়ায় কীভাবে ‘বিষয়ী’-র যৌনতা নিয়ন্ত্রিত হত প্রাচীন গ্রিক সমাজে, কীভাবে ‘বিষয়ী’ নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করত সামাজিক ক্ষমতার অপেক্ষা না করে, ভিন্ন এক নৈতিকতার আধারে ৷ বস্তুত, এক্ষেত্রে ‘আধুনিক’ পাশ্চাত্য সমাজের মতো কোনো বাহ্যিক সামাজিক কর্তৃত্বের অস্তিত্বই ছিল না প্রাচীন গ্রিক সমাজে ৷
‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’-র এই দুটি খণ্ডে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক সভ্যতা থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের প্রাক খ্রিস্টীয় গ্রিস ও রোমের সমাজে যৌনতার ইতিহাস বিবৃত ৷ ফুকোর মতে খ্রিস্টপূর্ব পেগান সমাজে যৌননৈতিকতার ধারণাটি বিকশিত হয়েছিল চারটি পৃথক বিষয়কে কেন্দ্র করে ৷ প্রথমত, শারীরিক ‘সুস্থতা’ ও ‘স্বাস্থ্য’ ৷ নীরোগ শরীরের সঙ্গে যৌন পারঙ্গমতার ধারণাটি এক্ষেত্রে যুক্ত ৷ ‘পারিবারিকতা’ (ব্যক্তির যৌনতার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্য যথা, স্ত্রী, সন্তান, ভৃত্য বা দাস—এদের ভূমিকা বা সম্পর্ক,) ‘প্রণয়সম্পর্ক’ (মূলত, বালক ও কিশোরদের সঙ্গে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির সমকামী সম্পর্ক), এবং ‘সত্য’ (দার্শনিক জ্ঞানকাঠামোর উৎস হিসেবে যৌনতার গুরুত্ব) ৷ কয়েকটি প্রাচীন গ্রিক গ্রন্থে ‘স্বাস্থ্য’ ও যৌনতার সম্পর্ককে সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে মূলত প্রজননশক্তির হীনতা বা অপচয়ের সাপেক্ষে ৷ প্রজননে অক্ষমতাকে ব্যক্তি এবং সমাজ—উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে করা হত ৷ পারিবারিক জীবন এবং দাম্পত্যের ক্ষেত্রে বিবাহিত দুই সঙ্গীর ভিতর পারস্পরিক বিশ্বাসের আদর্শকে দেওয়া হত সর্বোচ্চ মর্যাদা ৷ স্ত্রী-র প্রতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি সমাজে ‘সম্মাননীয়’ বলে গণ্য হতেন ৷ কিন্তু এই পারস্পরিক বিশ্বাসের ধারণাটি কোনো আইনি বিধিবদ্ধতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত না, এবং ‘ব্যক্তি’র আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তিই এক্ষেত্রে ছিল মূল বিবেচ্য ৷ প্রাচীন গ্রিসে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ এবং বালকদের ভিতর সমকামী সম্পর্ক চালু ছিল, তবে কঠোরভাবে নজর রাখা হত এর দ্বারা পুরুষসঙ্গীটি যেন নপুংসক, নির্বীর্য-য় পরিণত না হয় ৷ আর যৌনতার মধ্য দিয়ে ‘সত্যে’র সন্ধান প্রসঙ্গে বলা যায়, গ্রিক সমাজ যৌনসংযম ও কৌমার্যরক্ষাকে দার্শনিক মাত্রায় ভূষিত করত ৷ আধুনিক ইউরোপীয় সমাজে, বিশেষত খ্রিস্ট্রীয় যৌননৈতিকতায় যেভাবে স্বাস্থ্যহানির প্রতিষেধক হিসেবে হস্তমৈথুনের উপর নিষেধাজ্ঞা, দাম্পত্যসম্পর্কের উপর ধর্মীয় প্রাধান্য আরোপ, পায়ুকাম ও নপুংসকত্ব-র ভিতর সম্পর্কস্থাপন, যৌনসংযম ও কৌমার্যরক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে কঠোর ডিসিপ্লিনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলেছে, গ্রিক পেগান যৌননৈতিকতার ধারণার সঙ্গে তার আপাতদৃষ্টিতে মিল থাকলেও এক্ষেত্রে কোনো সরাসরি যোগাযোগ ও ধারাবাহিকতা অনুসন্ধান করা ভুল ৷ ফুকো দেখাচ্ছেন, পেগান এবং প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগেই বেশ কিছু যৌননিয়ন্ত্রণের ধারণা গড়ে উঠলেও, সেগুলো ছিল ‘আধুনিক’ যুগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক জটিল নৈতিকতার বর্গে বিন্যস্ত ৷
একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যবন্ধে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক যৌননৈতিকতার চরিত্র ব্যাখ্যা করেছেন ফুকো—’the individual… to recognize himself as an ethical subject of sexual conduct’৫ ৷ আত্মন’-এর সঙ্গে ব্যক্তির নিজের সম্পর্ক বা ethos-এর রয়েছে মোট চারটি ভাগ :
ক. নৈতিকতার সামগ্রিক ধারণা বা নির্যাস
খ. ‘বিষয়ী’র আচরণসমূহ, যার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার ধারণাগুলি বাস্তব রূপ পায়
গ. অনুশীলনের নির্দিষ্ট পদ্ধতি/প্রকরণ
ঘ. পূর্ণাঙ্গ পরিণতি
গ্রিক যৌনতার সাপেক্ষে উপরোক্ত চারটি উপাদান নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এক্ষেত্রে যৌনতার সামগ্রিক ধারণাটি আবর্তিত হত ‘সুখানুভূতি’-কে কেন্দ্র করে, গ্রিক ভাষায় যাকে বলা হতো ‘আফ্রোডিসিয়া’ ৷ যে আচরণগত অভ্যাসের মধ্য দিয়ে এই সুখানুভূতির ধারণা বাস্তবায়িত হত তাকে বলা হত ‘chresis’ বা ‘use’ ৷ ব্যক্তি যে মনোভঙ্গির সহায়তায় এই যৌননৈতিকতা আয়ত্ত করতে চায় তার নাম দেওয়া যেতে পারে ‘কর্তৃত্ব’, এবং এই নৈতিকতার চরম লক্ষ্য হল নিয়ন্ত্রণ বা পরিমিতি যা গ্রিক ভাষায় ‘sophrosyne’ ৷ খ্রিস্টীয় বিধিনিষেধের মতো এক্ষেত্রে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হচ্ছে না, বরং নৈতিকতা এখানে একধরনের শৈল্পিক মাত্রা লাভ করছে, হয়ে উঠছে ‘শিক্ষিত’ অভিব্যক্তি ৷ গ্রিক সমাজে যৌননৈতিকতা যেন একধরনের কলাবিদ্যার রূপ পেয়েছিল ৷
‘আফ্রোডিসিয়া’-র ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে ৷ ফুকো দেখাচ্ছেন ‘আধুনিক’ পাশ্চাত্য সমাজের ‘সেক্সুয়ালিটি’র ধারণার সঙ্গে গ্রিক যৌন সুখানুভূতির পার্থক্য প্রকট ৷ আধুনিক সেক্সুয়ালিটির তুলনায় ‘আফ্রোডিসিয়া’ অনেক বেশি বহুত্ববাদী, খোলামেলা ও উদার ৷ এখানে ‘ব্যক্তি’র নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ কোনো সামাজিক কর্তৃত্বের নির্ধারণবাদী প্রকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত না ৷ এমনকী, ব্যক্তির যৌনসংযমও সেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অন্যতম অংশ হিসেবে পরিগণিত হত ৷ এক্ষেত্রে ব্যক্তি যৌনসংযম রক্ষায় বাধ্য হত না, বরং যৌনসংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ছিল, সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যক্তির সম্মানিত নাগরিক হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত ৷ যৌনতা যদি হয় ‘ক্রিয়া’, ‘বাসনা’/‘আকাঙ্ক্ষা’ এবং ‘সুখোপভোগে’র সমাহার, তবে বলতে হবে গ্রিক যৌনতায় খ্রিস্টীয় যৌনতার নির্দেশনামার মতন, একমাত্রিকভাবে ‘ক্রিয়া’কেই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ভাবা হয়নি ৷ সেখানে উপরোক্ত তিনটি উপাদানই একত্রীভূত হয়ে এক সামগ্রিক নৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল যা, খ্রিস্টীয় ‘রক্তমাংসের স্থুল জৈবিক, উপভোগে’র চেয়ে একেবারেই আলাদা ৷ মূলত দুটি দিক থেকে এই পার্থক্যকে বোঝা যেতে পারে ৷ ‘আফ্রোডিসিয়া’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছিল, তা হল যৌনতা উপভোগের পরিমাণগত দিক ৷ এমনকী প্লেটো যখন সমকামিতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তখনও কিন্তু সমকামিতাকে ‘অ-স্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন না, তিনি বলছেন সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, কারণ তা যৌনতাকে এক সুতীব্র প্রাচুর্য বা বাধাবন্ধনহীনতার দিকে নিয়ে যায়, ফলত, তা প্রকৃতির বিরোধিতা করে ৷ অতিরেক ও মাত্রাধিক্যকেই এখানে বিবেচ্য বলে ভাবা হয়েছে ৷ দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হত, সেটি হল যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ৷ নারী-পুরুষ অথবা বালক ও পূর্ণবয়স্ক পুরুষ—শারীরিক মিলন যেকোনো ধরনেরই হোক না কেন, সর্বদাই পুরুষের আত্মনির্ভর, সক্রিয় ভূমিকাটিকেই কাম্য বলে মনে করা হতো ৷ কারণ, পুরুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার অভিব্যক্তি নির্ভর করত তাঁর যৌনক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের উপর ৷ যৌন নিষ্ক্রিয়তাকে ‘অ-পুরুষোজনোচিত’ হিসেবে নীচু নজরে দেখানো হত ৷ কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিওকোনো বিধিবদ্ধ নিয়ম হিসেবে আরোপিত হতো না ৷ খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে যৌনতাকে যেভাবে ‘পাপ’ বা ‘অশুভ’ হিসেবে ভাবা হয়েছে তা থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা ৷ তাহলে ওই অপেক্ষাকৃত শিথিল নিয়ন্ত্রণটুকুই বা আরোপের হেতু কী? ফুকোর মতে, গ্রিকরা মনে করতেন, যৌনতা হল একধরণের বিমূর্ত শক্তি বা energia, যা মূলত পশুশক্তির চেয়ে পৃথক কিছু নয় ৷ খাদ্য ও পানীয়ের প্রতি মানুষের যেমন স্বাভাবিক আসক্তি দেখা যায়, তেমনই যৌনতার প্রতিও মানুষের তীব্র আসক্তি মানবচরিত্রের পশুত্বের দিকটিকেই প্রকট করে ৷ ফলত, যৌনতার স্বাভাবিক প্রবণতাই হল তীব্র অতিরেক-কে প্রশ্রয় দেওয়া—a tendency to exaggeration, to excess.৬ সেকারণেই যৌন সুখানুভূতির যথাযথ ‘ব্যবহার’ (use) শিক্ষা প্রয়োজন ৷
উপরোক্ত দ্বিতীয় উপাদানটি নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক ৷ গ্রিক সমাজে যৌনতা উপভোগের পদ্ধতি বা উপায়সমূহ নিহিত রয়েছে ‘use’ কথাটির ভিতরে ৷ ‘The use of pleasure’ শিরোনামটি সরাসরি নেওয়া হয়েছে গ্রিক ‘chresis aphrodision’ শব্দবন্ধ থেকে ৷ এই use শব্দটি গ্রিক যৌনতার নৈতিক শৈলিকে চিহ্নিত করে, যার সাহায্যে ব্যক্তি একইসঙ্গে নিজের শারীরিক আকাঙ্ক্ষার ডাকে সাড়া দিতে পারে, তেমনই পারে নিজের বেসামাল প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ৷ তিনটি পৃথক কৌশলের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হত ৷ প্রথম কৌশলটি নির্ধারিত হত শারীরিক চাহিদার প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে ৷ দার্শনিক দিওজিনিস প্রকাশ্য জনসমক্ষে হস্তমৈথুন করতেন ৷ তাঁর যুক্তি ছিল একমাত্র এভাবেই মানুষ তার বন্য কামনা থেকে মুক্তি পেতে পারে ৷ কিন্তু দিওজিনিসের এই আচরণকে ‘অ-স্বাভাবিক’ মনে করা হত না, বরং শারীরিক প্রয়োজনীয়তা মেটাবার উপায় হিসেবে নূ্যনতম ‘প্রান্তিক’ আচরণ হিসেবেই দেখা হত একে ৷ দ্বিতীয় কৌশলটি হল ‘সমায়ানুবর্তিতা’ ৷ প্লেটো মন্তব্য করেছিলেন: ‘‘সেই ব্যক্তিই সৌভাগ্যবান হবার যোগ্যতা অর্জন করে, যে সঠিক সময়ে ও সঠিক পরিমানে যৌনতা উপভোগ করে ৷’’ বস্তুত, গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানে এই সঠিক সময় নির্বাচনের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে ৷ আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও আত্মশাসনের সূচক হিসেবেই বিষয়টি ভাবা হয়েছিল ৷ তৃতীয় কৌশলটিকে বলা যেতে পারে সামাজিক ‘পদমর্যাদা’ রক্ষার উপায় ৷ যৌন আচরণের অনুপুঙ্ক্ষ নিয়মানুবর্তিতাই ব্যক্তিকে সামাজিক সম্মানের শিখরে ভূষিত করে, পক্ষান্তরে, অসম্মানজনক যৌন আচরণ সমাজের নীচুতলার মানুষের পক্ষেই স্বাভাবিক বলে মনে করা হত ৷ পুরো সমাজকে শাসন যিনি করবেন, তাঁকে যৌননৈতিকতার উচ্চ মান রক্ষা করে চলতে হবে—এটাই ছিল নিয়ম ৷ কিন্তু খ্রিস্টীয় অবদমন এবং বাধ্যবাধকতার সঙ্গে বিষয়টিকে এক করে দেখলে ভুল হবে, এটিকে গ্রিক নৈতিক শৈলীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই ভাবতে হবে ৷
এই নৈতিকতার উচ্চ মানকে স্পর্শ করার পিছনে ব্যক্তির যে মনোভঙ্গি কাজ করত, তা হল ‘আধিপত্যে’র আকাঙ্ক্ষা ৷ গ্রিক পরিভাষায় যাকে বলা যেতে পারে ‘enkrateia’ ৷ এই আধিপত্যের ধারণাটি গড়ে উঠেছিল তিনটি অক্ষের সাপেক্ষে: ব্যক্তির নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, প্রতিরোধ ও লড়াই ৷ ব্যক্তি-কে তুলনা করা হত নগররাষ্ট্রের সঙ্গে, শত্রুর মোকাবিলায় রাষ্ট্র যেমন সর্বদা সচেতন থাকে, তেমনই ব্যক্তি-র আত্মকর্তৃত্বও নির্ভর করত প্রতি মুহূর্তে নিজের অসতর্ক বাসনার বিরুদ্ধে তার লড়াই চালানোর দক্ষতা অর্জনের উপর ৷ ব্যক্তি জানে না, কখন প্রাকৃতিক তাড়নায় কামনার দাস হয়ে পড়বে সে, তাই নিরন্তর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সে চেষ্টা করত বাসনাকে জয় করার ৷ ব্যক্তিসত্তা যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, যেখানে শক্তিশালী অংশটি দুর্বল ব্যক্তিসত্তার অপর অংশকে পরাস্ত করবে ৷ ব্যক্তির উদ্দেশ্য ওই শক্তিশালী অংশের উপর আধিপত্য কায়েম করা ৷ খ্রিস্টীয় ভাবনায় ব্যক্তির সত্তার সবল অংশটি অন্তঃকরণ এবং দুর্বলতার অংশটি বহিরাগত শক্তি হিসেবে পরিগণিত হয় ৷ গ্রিক নৈতিকতায় এই অন্তঃকরণ/বহিঃকরণ সংক্রান্ত ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে ৷ এখানে ‘আত্মন’ অখণ্ড ও অবিভাজ্য, যা কিছু লড়াই—সবই সেই অখণ্ড ব্যক্তিসত্তার অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল ৷
এই আত্মনিয়ন্ত্রণের চরম লক্ষ্য হল নিজের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ৷ এই কর্তৃত্বে বাসনার নিশ্চিহ্নকরণ নয়, বরং এক চিরস্থায়ী সংযমের সাম্যাবস্থা গড়ে তুলতে চায় ৷ সক্রেটিস ‘আত্মপরীক্ষা-র মধ্য দিয়ে এই কর্তৃত্বের যাচাই করতেন ৷ তিনি তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের সঙ্গে রাত্রিবাস করা সত্বেও শারীরিক মিলনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্রয় দিতেন না ৷ তাঁর অন্তঃস্থ বাসনা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হত না, বরং বাসনার অবস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হত মানসিক শক্তির দ্বারা ৷ এই মানসিক শক্তি অর্জনই পরম গুণ হিসেবে বিবেচিত হত ৷ গৃহের অভ্যন্তরে এবং নাগরিক জীবনে দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকার সঙ্গে এই আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণাকে মিলিয়ে নেওয়া যায় ৷ পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ও ভৃত্যরা এবং রাষ্ট্রিক পরিসরে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা গ্রিক অভিজাতরা লাভ করত নিজের ‘আত্মন’-এর নিয়ন্ত্রিত অভিব্যক্তি শিক্ষার মধ্য দিয়েই ৷ এই কঠোর অনুশীলনের (গ্রিক পরিভাষায় ‘askesis’) প্রক্রিয়াটির শিক্ষা দিতেন গ্রিক দার্শনিকেরা ৷ কেবল তাত্বিকভাবেই নয়, রীতিমতো হাতে কলমে সেগুলি শিখত অভিজাত পরিবারের তরুণ শিক্ষার্থীরা ৷ শরীর এবং মনকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হত, যাতে নূ্যনতম প্রাচুর্য থেকে শুরু করে চরম প্রাচুর্যের মুহূর্তেও বিচলন না ঘটে ৷ ব্যক্তিসত্তার এই দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটিকেই গ্রিকরা বলত : ‘care of the self’ (epimeleia heautour)—যা ফুকোর যৌনতার ইতিহাসের তৃতীয় খণ্ডের শিরোনাম ৷
যেকোনো নৈতিক অবস্থানের ভিতরেই রয়ে যায় একধরনের ‘পরমকারণবাদ’ ৷ গ্রিক যৌননৈতিকতায় এই ‘পরমকারণ’টিকেই বলা হয়েছে moderation (গ্রিক sophrosyne), এটি এমন এক ধরনের অনুশীলন, যা ‘ব্যক্তি’কে শেষ অব্দি ‘স্বাধীনতা’ এনে দেয় ৷ ‘আধুনিক’ যুগে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে—কীভাবে আত্মসংযম ‘ব্যক্তি’কে ‘স্বাধীনতা’ দিচ্ছে ৷ কিন্তু গ্রিক প্রেক্ষিতটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷ যেমন নগররাষ্ট্রকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, তেমনি রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে তাদের অন্তরের শত্রুদের থেকেও আত্মরক্ষার উপায় শিখতে হবে ৷ এভাবেই নাগরিক এবং নৈতিক পরিসর দুটি একজায়গায় এসে মিশে গেছে একধরনের স্বাধীন, স্বয়ংক্রিয় ‘ক্ষমতা’/‘অধিকার’-এর ধারণায় পৌঁছে—’a power that one brought to bear on oneself in the power that one exercised over others’৭ ৷ শ্রেষ্ঠ শাসক তিনিই যিনি অন্যকে শাসন করার আগে নিজেকে শাসন করা শেখেন ৷ এই নৈতিকতার অপর একটি উদ্দেশ্য ‘পৌরুষ’-এর ধারণাকে পুষ্ট করা ৷ ‘আত্মন’-এর যে অংশটি শাসনকর্তা, সেই অংশটি যেন বাকি অংশগুলির তুলনায় অধিক পৌরুষসম্পন্ন হয় ৷ এক্ষেত্রেও যৌনতার নিরিখটি তুলনীয় ‘সামাজিক পৌরুষ’-এর সাপেক্ষে ৷ এমনকী একজন নারীও এই ‘পৌরুষ’-এর শক্তি অর্জন করতে পারে, নিজেকে এবং অন্যকে শাসন করার ক্ষমতা অর্জনের সূত্রে ৷ উল্টোদিকে একজন পুরুষও ‘মেয়েলি’ বলে পরিগণিত হতে পারে ওই ‘পৌরুষ’-বাচক গুণগুলি আয়ত্ত না-করার ফলে ৷ যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে কেবল নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করলেই প্রাচীন গ্রিসে কাউকে মেয়েলি ভাবা হত না ৷ বরং যে পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না নিজের যৌন বাসনাকে, যে যখন-তখন অসংখ্যবার মৈথুনে লিপ্ত হয় তাকেই ‘মেয়েলি’ আখ্যা দেওয়া হত ৷ অর্থাৎ ‘আত্মপ্রশাসন’-এর ধারণাটিই এক্ষেত্রে মুখ্য ৷ ‘স্বাধীনতা’ যদি হয় আত্মশাসনের একটি দিক, এর অপর দিকটি হল ‘সত্য’-এ উপনীত হওয়া ৷ এক পরম সত্য-ই (গ্রিক শব্দ logos) ব্যক্তিকে প্ররোচিত করে যৌননৈতিকতা-সংক্রান্ত ‘প্রাকৃতিক’/স্বতঃসিদ্ধ কিছু যুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে ৷ এই পরম ‘সত্য’-এর আবার তিনটি চেহারা—ক.গঠনগত খ.কলাকৌশলগত এবং গ.তত্ববিদ্যাগত ৷ প্রথম ক্ষেত্রে ব্যক্তি ‘সত্যে’র সর্বাত্মক মান্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাস্তবজীবনের প্রত্যক্ষ হাতে কলমে অভিজ্ঞতা থেকে পরম সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয় সে, আর তৃতীয় ক্ষেত্রে ‘আত্মন’-সংক্রান্ত জ্ঞান গড়ে ওঠে তত্ব ও প্রয়োগের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে ৷ ফুকোর মতে ‘স্বাধীনতা, সত্য ও আত্মশাসন’—এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন গ্রিক ‘আত্মন’-এর ধারণা ‘আধুনিক’ যুগের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ আধুনিক যুগে কনফেশন এবং মনস্তত্ববিদ্যা ‘ব্যক্তি’র ‘আত্মন’-কে উন্মোচিত করার দায়িত্ব নিয়েছে, যা তাঁর ভাষায় ‘the decipherment of the self’ বা ‘hermeneutics of desire’ ৷৮ পক্ষান্তরে গ্রিক যৌননৈতিকতার মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে উঠত ‘অস্তিত্বের নন্দনতত্ব’ যা আদতে হয়ে উঠেছিল এক ধরনের প্রায়োগিক জীবনপ্রণালী ৷
দুই
ফুকো-র ‘যৌনতার ইতিহাস’-এর তৃতীয় খণ্ড ‘The care of the self’ ৷ দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু ছিল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক পেগান সমাজের যৌনতার চর্চা, আর এই খণ্ডে আরও বিস্তারিত ভাবে আলোচ্য হয়ে উঠল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের যৌননৈতিকতা ৷ একে কখনো কখনো ‘প্রাক-খ্রিস্টীয়’ যৌনতার ইতিহাসও বলা হয়েছে ৷ এই দুই পর্যায়ের ভিতর যে প্রধান প্রতিসরণটি ফুকো চিহ্নিত করলেন, তা হল পেগান যুগে নৈতিক অনুশীলন একইসঙ্গে নগররাষ্ট্র/প্রশাসন (training for the government of others) এবং ‘আত্মন’ (training for the government of the self)—এই দুটি আধারকে একত্রে মেলাতে চেয়েছিল ৷ কিন্তু ‘প্রাক-খ্রিস্টীয়’ যুগে পৌঁছে এই দুটি ‘ক্ষেত্র’ একে অপরের চেয়ে পৃথগীকৃত হল ৷ Care of the self-এর ধারণাটি হয়ে দাঁড়াল একটি বিচ্ছিন্ন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ধারণা ৷ মোটের উপর এই সময় থেকেই ব্যক্তির যৌনতা একটু একটু করে সামাজিক ক্ষমতাতন্ত্র/আধিপত্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করল ৷ পূর্ববর্তী যুগের দার্শনিক যদি হন প্লেটো, তবে পরবর্তী যুগের প্রধান দার্শনিক হলেন, প্লুটার্ক ৷ এই দুই যুগের যৌননৈতিকতার পার্থক্যগুলিকে এভাবে সূত্রবদ্ধ করা যায়:
ক. নতুন যুগে প্রধান ঝোঁক পরিবর্তিত হল ‘আচরণ/‘উপায়’ (use, গ্রিক chresis) থেকে ‘আত্মকেন্দ্রিকতায়’ (The concern for oneself, গ্রিক epimeleia) ৷ ‘ব্যক্তি’র নিজস্ব ভালোমন্দ এবার অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করল ৷ epimeleia ‘দেহ’ এবং ‘মন’/‘আত্মা’র মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করল না ৷
খ. পূর্ববর্তী যৌননৈতিকতার তুলনায় epimeleia অনেক বেশি সুসামাজিক ৷ প্লেটো এবং জেনোফোনের (Xenophone) দর্শনের তুলনায় এই নৈতিকতায় ব্যক্তি নিজেকে অনেক বেশি সাজিয়ে নেয় তার পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে এবং আদলে (যেমন, পরিবার অথবা সামাজিক পরিসর) ৷
গ. আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণাটি একইভাবে বলবৎ থাকলেও আগের যুগের সঙ্গে এর প্রধান পার্থক্য তৈরি হল ‘ব্যক্তি’র সক্ষমতার প্রশ্নে ৷ এবার ধরে নেওয়া হল ‘ব্যক্তি’ স্বভাবতই দুর্বল ৷ তাই পরিবার এবং গার্হস্থ্যই তার স্বাভাবিক আশ্রয়স্থল ৷
ঘ. এই নতুন ‘আত্মন’-এর নৈতিকতা সমাজের সকল মানুষের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য—এটাই ধরে নেওয়া হল ৷ আগের যুগে নৈতিকতার চর্চা মুলত নির্দেশিত হত সমাজের শাসকশ্রেণির শ্রেষ্ঠ পুরুষদের উপর ৷ এবার নৈতিক অনুশাসনগুলি হয়ে দাঁড়াল অনেকাংশে—’universal principles of nature and reason’ ৷৯ যদিও এই অনুশাসনও সর্বদাই খ্রিস্টীয় পাপ-পুণ্য জাতীয় কঠোর নৈতিক বাঁধনের চেয়ে ছিল অনেক বেশি উদার ৷ ‘ব্যক্তি’ ‘আত্মজ্ঞান’ অর্জনের মাধ্যমে বেছে নিতে পারত তার যৌনক্রিয়ার সঙ্গী, মুহূর্ত ও স্থান ৷
ঙ. সর্বোপরি, এই যুগে পৌঁছেই আত্মনিয়ন্ত্রণ হয়ে দাঁড়াল পরম উপভোগের বিষয়বস্তু, এমন একটি স্তর যা বাসনামুক্তি এবং বাধাবিঘ্ন অতিক্রমকারী, ব্যক্তির চরম অন্বিষ্ট ৷
মোটের উপর বলা যায় পূর্ববর্তী যুগ থেকে এই যুগের যৌননৈতিকতা মূলগতভাবে খুব একটা পৃথক না হলেও, পূর্ববর্তী উপাদানগুলির সংকোচন-প্রসারণ ঘটেছে এখানে ৷ এই যুগে যৌনতা মূলত বিবেচিত হয়েছে তিনটি উপাদানের সাপেক্ষে :
অ. শরীর এবং চিকিৎসাশাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ
আ. গার্হস্থ্যজীবন ও পারিবারিকতা
ই. প্রেম, শৃঙ্গার ও সমকাম
প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগের শরীর-সম্বন্ধীয় চিকিৎসাভাবনা আধুনিক যুগের তুলনায় ছিল গুণগতভাবে পৃথক ৷ আধুনিক প্যাথলজির রোগনির্ণয়, সংশোধন ও আরোগ্য—এই ত্রিমুখী কৌশল থেকে এই চিকিৎসাবিদ্যা একেবারেই আলাদা ৷ যৌনতার ক্ষেত্রে, এই পদ্ধতি ছিল :
Problematization of sexual behaviour was accomplished less out of a concern for eliminating pathological forms than out of a desire to integrate it as fully as possible into the management of health and the life of the body.১০
এইযুগে ‘চিকিৎসক’ কোনো পৃথক পেশাদার ব্যক্তি ছিলেন না ৷ বরং চিকিৎসাশাস্ত্র অভ্যাস করতেন সমাজের প্রত্যেকটি নাগরিক ৷ মূলত পথ্যতালিকার উপর নির্ভর করা হত ৷ স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ককে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত ৷ যেমন, সঠিক যৌনতা/শরীররক্ষার জন্য বাড়ির নির্দিষ্ট ঘর, নির্দিষ্ট সময়সারণী নির্ধারণ করা হত ৷ এই যুগ থেকেই শরীর-যৌনতা বিষয়ক চিকিৎসাশাস্ত্রীয় নিদানগুলি কঠোর বিধিবদ্ধতার চেহারা নিতে শুরু করে ৷ ব্যক্তির মৃত্যু এবং তার পরবর্তী প্রজন্মের ভিতর সেতু নির্মাণের কাজ করে যৌনতা ৷ এই সময় থেকেই কেবল প্রজননের উদ্দেশ্যে যৌনতার ধারণার বীজ পোঁতা হয় ৷ যা পরবর্তী খ্রিস্টীয় নৈতিকতায় প্রজনন-অতিরিক্ত অন্যবিধ যে-কোন শৃঙ্গারক্রিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার ধারণায় পরিণত হবে ৷ এবং এই সময় থেকেই যৌনক্রিয়ায় পুরুষবীর্যের স্খলনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব লাভ করে, যাকে একধরনের ‘বীর্যকেন্দ্রিকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ৷ বীর্যই যে ‘ব্যক্তি’র জীবনীশক্তির প্রধানতম আধার এবং বীর্যের মধ্য দিয়েই মানবশরীর ও মনের যাবতীয় সারসত্তা প্রবাহিত হয়—এই যুগের দার্শনিক গ্যালেন এবং হিপ্পোক্রেটস-এর রচনায় তা স্পষ্ট ৷ তাঁরা এই জীবনীশক্তির আধারের নাম দেন—’pneuma’; ৷ যৌনতা শরীরের সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং যৌনতাই সকল শারীরিক অসুস্থতার উৎস—এহেন ধারণাও বিকাশ লাভ করে এই যুগেই ৷ যৌনমিলনের আনন্দ উপভোগ করা আদৌ ‘উচিত’ না ‘অনুচিত’—সে সম্পর্কে প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগের চিন্তাভাবনা পূর্ববর্তী যুগ থেকে অনেকাংশেই সরে এসেছিল ৷ সুনির্দিষ্টভাবে যৌনকাজটিই আদৌ ‘ভালো’ অথবা ‘মন্দ’—এই প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যৌনতার সঠিক সময় নির্ধারণ, যৌনতার সঙ্গে ব্যক্তির পদমর্যাদার প্রশ্ন পিছনে সরে যায় ৷ বীর্যের উৎপাদন শরীরের পক্ষে মঙ্গলজনক, কিন্তু বীর্যের ‘অপব্যয়’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ট্যাবু’ হয়ে দাঁড়ায় ৷ যৌনক্রিয়া কোনো কোনো শারীরিক অসুখের ক্ষেত্রে ফলপ্রদ হতে পারে (হিপ্পোক্রেটস যেমন বলেছিলেন যৌনমিলন শ্লেষ্মার নিরাময় ঘটাতে সক্ষম), এটা যেমন সত্য, যেমনই এই যুগেই এমন ধারণা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দানা বাঁধে যে যৌনতাই নানাবিধ অসুস্থতার কারণ—বিশেষত, তা দুর্বল মানুষকে প্রথমে শারীরিকভাবে উষ্ণ করে তোলে, অন্তঃপর শীতল করে দেয় ৷ এই সময় থেকেই যৌনতার আধারে ‘ব্যক্তি’র রোগনির্ণয় প্রক্রিয়ায় সূচনা ৷ পুরুষ এবং নারীর পূর্ণাঙ্গ শারীরিক পরিণতি না ঘটা পর্যন্ত তাদের যৌনমিলনে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করা হত ৷ মনে করা হত বীর্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যয়ের যথাযথ ভারসাম্য গড়ে ওঠা পর্যন্ত পুরুষের যৌনমিলনে অংশগ্রহণ না করা উচিত ৷ মেয়েদের ক্ষেত্রে ঋতু নিয়মিত হওয়া অব্দি অপেক্ষার নির্দেশ দেওয়া হত ৷ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হত ‘মন’ বা ‘আত্মা’কে, ‘মন’ যেন শরীরকে চালনা না করে, যেন যৌনবিষয়ক অবাস্তব কল্পনার পরিসর ‘ব্যক্তি’র শরীরকে চালনা না করে ৷ সে কারণেই যৌনতার উপযুক্ত সময হিসেবে রাত্রির অন্ধকার মুহূর্তই সঠিক হিসেবে বিবেচিত হত, কারণ সেক্ষেত্রে ‘শরীর’ অবাস্তব কল্পনার উৎস হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবে না ৷ পাশাপাশি, খুব আশ্চর্যভাবে হস্তমৈথুন সম্পর্কে আশ্চর্য সহনশীলতা বজায় ছিল ৷ একে দেখা হত ‘as an act of natural elimination, which has the value both of a philosophical lesson and a neccessary remedy ৷১১ যাই হোক, এই সময় থেকেই ‘ব্যক্তি’র শরীরযৌনতার উপর সামাজিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের সূচনা ৷
এই পর্বে দাম্পত্য এবং পারিবারিক জীবনের প্রেক্ষিতে ব্যক্তির যৌনতা পুনর্গঠিত হয় ৷ দার্শনিক প্লুটার্কের লেখা Dialogue on Love এবং মিউজোনিয়াসের Marriage Precepts এই নব্য দাম্পত্যকেন্দ্রিক যৌনভাবনার আকর গ্রন্থ ৷ পূর্ববর্তী যুগের ‘আত্মন’, ‘পরিবার’ এবং ‘নগর’-রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্কের জায়গায় এবার যাবতীয় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হল নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গ দাম্পত্য সম্পর্কের ভিতর ৷ নারী কেবল পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে নয়, সবচেয়ে গভীর, পরিপূরক ‘অপর’ হিসেবে নির্ধারিত হল ৷ বিবাহ এবং দাম্পত্যসম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের অবস্থানগত সম্পর্কের ভরকেন্দ্র ৷ স্বামী-স্ত্রী পরিণত হল এক‘প্রাকৃতিক বিপরীত যুগ্মক’-এ ৷ পূর্ববর্তী যুগে প্রশ্নটা ছিল বিবাহের ‘প্রয়োজনীয়তা’/‘অপ্রয়োজনীয়তা-কেন্দ্রিক’, এবার বিবাহ হয়ে দাঁড়াল ‘ব্যক্তি’র প্রধানতম নৈতিক কর্তব্য ৷ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে চিহ্নিত করা হতে লাগল একই শরীরে দুই পৃথক শরীরের একত্রীভূত রূপ হিসেবে ৷ ফলত, নারী-পুরুষের ভিতর এক নতুন ভাববিনিময়ের সূচনা হল—এক নতুন ধরনের পারস্পরিক আকর্ষণ, তারা হয়ে দাঁড়াল সবচেয়ে কাছের বন্ধু ৷ এর আগে মনে করা হত নারী-পুরুষ পৃথক মূল্যবোধের অধিকারী, কিন্তু প্লুটার্ক বললেন তাদের মধ্যে রয়েছে ‘an equal capability of virtue’ ৷১২ এই পারস্পরিকতার গুণকে তিনি সংজ্ঞায়িত করলেন ‘homonoia’ হিসেবে ৷ বিবাহিত দম্পতির যৌনতাই একমাত্র বৈধ যৌনতা হিসেবে স্বীকৃত হল ৷ অবৈধ প্রেম/যৌনতা পূর্বোক্ত ‘homonoia’ র চরম বিচ্যুতি হিসেবে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হল ৷ মিউজোনিয়াসের রচনায়, এমনকী গর্ভনিরোধক ব্যবহার করাকেও একধরনের নৈতিক সীমালঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়েছে, কারণ তা নর-নারীর প্রাকৃতিক শক্তির একধরনের অপচয় ৷ বিবাহসম্পর্কের ভিতর যৌন সুখানুভূতির প্রশ্নটি এবার অনেক বেশি আলোচিত হতে শুরু করলেও বৈধ দাম্পত্যের ভিতর সুখানুভূতির প্রয়োজনীয়তা প্রায় খোলাখুলি অস্বীকৃত হলো এবার ৷ কারণ, স্ত্রীকে প্রেমিকা হিসেবে দেখার ফলে স্ত্রী ‘অসম্মানিত’ হবেন—এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হল ৷ ‘সংযমের বাধ্যবাধকতা’ এবং ‘আকাঙ্ক্ষিত সুখভোগের তীব্রতা’-র ভিতর এক আপাত-অসম্ভব মীমাংসার চেষ্টার সূচনা ঘটল ইউরোপে এই সময়েই ৷ যদিও পরবর্তী খ্রিস্টীয় যুগের নৈতিক নির্দেশনামার কড়াকড়ি থেকে তা একেবারেই আলাদা ধরনের নৈতিক ধারণা, যেখানে গোটা বিষয়টিকে শুভ/অশুভ, পাপ/পূন্য-র দ্বৈততা দ্বারা বিচার করা হচ্ছে না ৷ প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগের যৌনতা এভাবেই গড়ে উঠেছিল, ফুকোর ভাষায়, ‘art of conjugal relationship’, ‘doctrine of sexual monopoly’ এবং ‘an aesthetics of shared pleasure’—এই তিনের সমন্বয়ে১৩
তবে যৌননৈতিকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে পুং-সমকামী সম্পর্কের ক্ষেত্রে ৷ রোমান সমাজে এমনিতেই বালক-কিশোরেরা বড়ো হত পিতা এবং শিক্ষকের কঠোর নজরদারিতে, এবার বিবাহই যৌনমিলনের একমাত্র পরিসর হিসেবে বিবিচেত হবার পর পুংমৈথুনের গুরুত্ব ক্রমশই কমতে শুরু করল ৷ প্লেটোর রচনায় বালকদের সঙ্গে সমকামী সম্পর্ককে দুটি পৃথক মানদণ্ডে বিচার করা হত—বিশুদ্ধ প্রেম (eros) এবং শারীরিক প্রেম (aphrodite) ৷ এবার প্রেম-যৌনতাকে বিচার করা হতে লাগল দুটি অন্য মানদন্ডে—পুং-মৈথুন এবং নারী-পুরুষ মৈথুন ৷ বিশুদ্ধ প্রেমের ধারণাটি এবার সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল দাম্পত্যসম্পর্কের মধ্যে এবং বিবাহিত স্ত্রী-ই যে সেই বিশুদ্ধ প্রেমের লক্ষণগুলি ধারণ করেন—প্লুটার্কের লেখায় এমন স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া গেল ৷ নারী-পুরুষ মৈথুনের তুলনায় পুং-সমকাম নিম্নস্তরের আনন্দ বহন করে—এমন ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হল ৷ অতীতে অনেক দার্শনিক সমকামকে শ্রেষ্ঠতর বলে ভাবতেন, কারণ নারী-পুরুষ মৈথুন এক নিতান্তই ‘জৈবিক’ এবং ‘প্রাকৃতিক’ বিষয়, পশুত্বের সমান ৷ এর ঊর্ধ্বে অবস্থান করে সমকাম ৷ কিন্তু প্লুর্টাক এই দার্শনিকদের সরাসরি খারিজ করে দেন ‘হিপোক্রিট’ বলে, কারণ, তাঁর মতে এঁরা মুখে বিশুদ্ধ উচ্চতর প্রেমের কথা বললেও, প্রকৃতপক্ষে সমকামের মধ্য দিয়ে জান্তব সুখ খুঁজে বেড়ান ৷ প্লুটার্কের এই অবস্থান সরাসরি ‘বিপরীতকামিতা’-র পক্ষে ৷ তাঁর মতে পুংমৈথুন বস্তুত বলশালী পুরুষের ধর্ষকাম ও দুর্বল বালকের পুরুষত্বহীন মর্ষকাম চরিতার্থ করে ৷ যদিও পুংমৈথুনের অভ্যাস আরও দীর্ঘদিন বলবৎ ছিল তার দার্শনিক ভিত্তি সমেত ৷ দার্শনিক লুসিয়ানের লেখা Affairs of the Heart বইটিও পুংমৈথুনের সপক্ষে লেখা দার্শনিক গ্রন্থ ৷ তবে সমকাম ও বিপরীতকামিতার এই দ্বিকোটিক বিভাজন তখনও খিস্টীয় আইনি নৈতিক কোড-এ পরিণত হয়নি ৷ এ যেন ছিল দুই বিপরীত জীবনপ্রণালীর দীর্ঘ দার্শনিক ও অভ্যাসগত সহাবস্থান ৷
শেষজীবনে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ফুকো বলেছিলেন পূর্বোক্ত দুই যুগের পার্থক্য হল ‘ব্যক্তিগত নৈতিকতা’ থেকে ‘আইনি বাধ্যবাধকতা’য় প্রতিসরণের উদাহরণ : ‘From Antiquity to christianity, we pass from a morality that was essentially the search for a personal ethics to a morality of obidience to a system of rules. ৷১৪ তাঁর পরিকল্পিত অথচ অসমাপ্ত ‘যৌনতার ইতিহাস’-এর চতুর্থ খণ্ড ‘মাংসের স্বীকারোক্তি’তে (Confessions of the Flesh) তিনি ধরতে চেয়েছিলেন খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের যৌননৈতিকতাকে; এবং খুঁজতে চেয়েছিলেন আধুনিক জ্ঞান-যুক্তি-আলোকপর্বের যৌনভাবনার সঙ্গে এই নৈতিকতার সংযোগসূত্রটি ৷ একইসঙ্গে তিনি সচেতন ছিলেন এই ব্যাপারেও যে, বর্তমান যুগের চেয়ে পূর্বোক্ত ওই দুই যুগের নৈতিকতার ধারণা এবং বোধ এতোটাই আলাদা যে ইতিহাসের পর্যায়ক্রমিক ন্যারেটিভ দিয়ে সেই যুগের অনুপুঙ্ক্ষব বাস্তবতাকে পুরোটা কখনোই ধরা যাবে না ৷ এখানেই ফুকোর ইতিহাসভাবনা একই সঙ্গে ‘ধারাবাহিকতা’ ও ‘ছেদ’-কে একত্রে ধারণ করতে চেয়েছে ৷ বর্তমান ‘আধুনিক’ সমাজের যৌনতার আলোচনায় যদিও সতেরো-আঠারো শতকের ইউরোপে বিকশিত ‘যৌনতার বিজ্ঞান’ (Scientia Sexualis) অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি প্রাচীন ইউরোপের যৌননৈতিকতা সম্পর্কিত এই প্রাথমিক ধারণা আমাদের ‘আধুনিক’ সময়ে শরীর/যৌনতা-র সঙ্গে ‘ক্ষমতা’-র সম্পর্ককে আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে কিছুটা হলেও সাহায্য করে ৷
তিন
পাশ্চাত্য সমাজে যৌনতার ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়েই প্রাচ্য সভ্যতায় যৌনতার ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে একটি মন্তব্য করেছিলেন ফুকো ৷ তিনি বলেছিলেন : ‘On the one hand, the societies—and there ane numerous : China, Japan, India, Rome, The Arbo-Moslem societies—whic h endowed themselves with an ars erotica. In the erotic art, truth is drawn from pleasure itself, understood as a practice and accumulated as experience; pleasure was not considered in relation to an absolute law of the permitted and the forbidden, nor by reference to a criterion of utility, but first and formost in relation to itself” ৷ এর বিপরীতে, পাশ্চাত্য সভ্যতার তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ‘scientia sexualis’, যেখানে ‘the truth of sex which are to a form of knowledge-power strictly opposed to the art of initiations and the masterful secret; ৷১৫ কিন্তু ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষিতে, বিগত কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে শরীর-ক্ষমতা-নৈতিকতা ও যৌনতা সংক্রান্ত যে বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে সমান্যতম পরিচয় থাকলেও, ফুকোর এই মন্তব্যকে একইসঙ্গে অতিসরলীকৃত, ইউরোকেন্দ্রিক এবং প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিকোণ হিসেবে বাতিল করতে হবে ৷ কারণ ইউরোপীয় ‘বিজ্ঞান’ এবং প্রাচ্য ‘কলাবিদ্যা’র এই সরল দ্বিকোটিক বিভাজন আরও একধরনের পরিশীলিত ‘প্রাচ্যবাদ’-রই নামান্তর ৷ ভারতীয় সাহিত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্মৃতিগ্রন্থসমূহেও আমরা পাই জ্ঞান-ক্ষমতার যৌগপত্য দ্বারা শরীর/যৌনতার বিধিবদ্ধকরণ এবং আমাদের নিজস্ব ‘আত্মনের যত্ন’-সংক্রান্ত এক বিপুল ধারণা ৷ হুবহু ইউরোপীয় ধাঁচে না হলেও আমাদের দর্শন/চিকিৎসা/যোগশাস্ত্রেও বিকশিত হয়েছিল একধরনের নিজস্ব অধিবিদ্যা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি ৷ যদিও পরবর্তীকালের একটি সাক্ষাৎকারে ফুকো তাঁর এই অতিসরলীকৃত মতামত প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ৷১৬
পাশ্চাত্য যৌনতার দর্শনের চেয়ে আমাদের সভ্যতায় যৌননৈতিকতার প্রধানতম পার্থক্যই হল ভারতীয় সভ্যতায় ‘ব্যক্তি’র সামগ্রিক জীবনপ্রক্রিয়ারই অন্তর্গত একটি উপাদান হল যৌনতা ৷ এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উপাদান নয় ৷ এই সামগ্রিক জীবনসাধনার নাম ‘পুরুষার্থ’ ৷ ভারতীয় কল্পনায় এই পুরুষার্থ ‘চতুর্বর্গ’ ৷ এর চারটি উপাদান : ধর্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ ৷ ব্যক্তির জীবনসাধনায় এই চতুর্বর্গের পৃথক পৃথক অর্থ ও তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব ঐতিহাসিকভাবে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকেনি ৷ আবার জীবনসাধনার উপাদানগুলি তাত্বিকভাবে প্রদর্শিত হলেও বাস্তবজীবনে সেগুলির প্রয়োগ নিয়ে সমস্যার উদ্ভব ঘটলে, ভারতীয় ধর্ম/দার্শনিক প্রস্থানগুলি ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তার মীমাংসা করেছে ৷ ফলত ওই চারটি উপাদান নিয়ে আলোচনার সময় মূলত দুটি বিষয় আমাদের নজরে রাখতে হবে :
ক. ইতিহাসনিরপেক্ষ আদর্শ হিসেবে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ সংক্রান্ত তাত্বিক ধারণা ৷
খ. বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে অনুসৃত বাস্তব প্রত্যক্ষ আদর্শ কীভাবে ওই ধারণাগুলির প্রয়োগ ঘটাত ৷১৭
‘পুরুষার্থ’ সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বাগ্রে বিবেচ্য ‘পুরুষ’ বলতে কী বোঝায় ৷ বৈদিক ঐতিহ্যে, যাকে ‘আমনায়’ (ammaya)১৮ বলা হয়েছে, সেখানে ‘পুরুষ’ বলতে তাঁকেই বোঝায়, যিনি ‘ক্রমাগত সামনের দিকে’ অগ্রসর হন (‘পুরতি অগ্রে গচ্ছতি’ : শব্দ-কল্পদ্রুম) ৷ সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পুরুষ’ শব্দটি দুই অর্থে প্রযুক্ত ৷ ঋগ্বেদের ‘পুরুষসূক্তে’, ‘পুরুষ’ হলেন সমগ্র সৃষ্টির মূল বস্তুগত কারণ (উপাদান কারণ), যেহেতু সৃষ্টি চলমান, তাই পুরুষও ক্রমাগ্রসর সত্তা ৷ ব্যক্তিমানুষের দেহেই ‘পুরুষ’-এর অবস্থান, তিনিই জীবাত্মা ৷ ‘মোক্ষ’ হল এই অবস্থা, যেখানে ‘জীবাত্মা’ ব্রহ্মে লীন হয়ে যায় ৷ ‘পুরুষ’ এবং ‘নর’ বা ‘মনুষ্য’-র ধারণা এক নয় ৷ ‘নর’ বলতে বোঝায় যিনি নিজের পাপ-পূন্যের ভার বহন করেন ৷ ‘গীতা’য় ‘নর’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে ৮ বার (২/২২, ৫/২৩, ১২/১৯, ১২/২২, ১৭/১৭, ১৮/১৫, ১৮/৪৫ এবং ১৮/৭১: ‘অধ্যায়’ এবং ‘শ্লোক সংখ্যা’র ভিত্তিতে) ৷ সর্বত্রই ‘নর’ হলেন সেই ব্যক্তি ৷ তিনি ‘মোক্ষ’-অভিমুখী নন ৷ ‘নর’ গড়ে ওঠেন—আত্মা, বুদ্ধি, মন, অহংকার এবং শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে ৷ গীতার মূল উদ্দেশ্য পার্থিব শারীরিক সুখ/বাসনা থেকে ‘মন’কে মুক্ত করা এবং তাকে ‘ব্রহ্ম’-এর আস্বাদন করানো ৷ ‘পুরুষ’ এবং ‘নর’-র এই পার্থক্যকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি আদর্শ তাত্বিক ধারণা এবং অভিজ্ঞতানির্ভর প্রত্যক্ষ ধারণা হিসেবে ৷ ‘পুরুষার্থে’র দ্বিতীয় বর্গ ‘অর্থ’ ৷ জীবনধারণের উপযোগী অবশ্যপ্রয়োজনীয় উপাদানই ‘অর্থ’ ৷ এই ‘অর্থ’ একটি ‘ইচ্ছাবিষয়’ ৷ অর্থাৎ ‘নর’ জীবনযাপন করতে গিয়ে যে কোনো একটি বর্গকে অস্বীকার করতে পারে ৷ ‘গীতা’র ভাষ্য অনুযায়ী ‘নর’ পূর্বজন্মলব্ধ ‘স্ব-ভাব’-এর বশে জাগতিক ‘কর্মে’ নিয়োজিত হয় ৷ তাই ‘মোক্ষ’-তে পৌঁছতে হলে তাকে ‘অভ্যাস’-এর সাধনা করতে হবে ৷ তাই ভারতীয় সাধনায় ‘মোক্ষ’ লাভের পথে মূল দ্বন্দ্ব ‘আত্মা’ এবং ‘শরীর-এর ভিতর ৷ এই দ্বন্দ্ব ‘দেহী’ এবং ‘দেহ’-র ৷ ‘জীবাত্মা’-র প্রধান লক্ষ্য যদি হয় ‘ব্রহ্মে’র সঙ্গে মিলিত হওয়া, তবে, ‘দেহ’-র আপতিক বাসনা জাগতিক সুখ ও প্রবৃত্তির চরিতার্থকরণ ৷ কিন্তু ‘দেহ’-বাসনা মানুষকে বেঁধে রাখে জন্ম/মৃত্যু-র বন্ধনে ৷ তাই ‘ধর্ম’—যে প্রথম বর্গটি ‘ব্যক্তি’কে ‘মোক্ষ’-র সন্ধান দেয়, তার সঙ্গে বিরোধ রয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্গ—‘অর্থ’ এবং ‘কাম’-এর ৷ আবার সামগ্রিকভাবে প্রথম তিনটি বর্গই ‘মোক্ষ’র বিপরীত ৷ ‘ধর্ম’ এবং ‘জীবাত্মা’-র সম্পর্ককে বলা হয়েছে ‘সমবায়’ বা ‘নিত্য’ (‘অবয়ব’ এবং ‘অবয়বী’-র সম্পর্ক) ৷ ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’-এর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক সাময়িক এবং অনিত্য ৷ ‘ধর্ম’-এর ভূমিকা ‘অর্থ’-এবং ‘কাম’-এর ‘অনিত্যতা’ উপলব্ধি করানোয়! ‘নর’ যদি এই দুই বর্গের ‘অনিত্যতা’ টের পায়, তবেই সে ‘ধর্ম’-এর অনুশীলনে রত হবে এবং ‘মোক্ষ’-য় পৌঁছতে পারবে ৷ প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘শরীর’ এবং ‘অর্থ’ ও ‘কাম’-এর সম্পর্ককে যদি ‘অনিত্য’-ই ধরা হয়, তবে ‘পুরুষার্থ’ সাধনায় এই দুই ‘বর্গ’কে অন্তর্ভুক্ত করা হল কেন? আসলে, হিন্দু তাত্বিক ভাবনায় ‘দেহ’কে ভেবে নেওয়া হয়েছে ‘আত্মা’-র আবরণ, ‘দেহ’ আসলে ‘মোক্ষ’-য় পৌঁছবার বাহ্যিক মাধ্যম মাত্র ৷ ‘দেহ’-কে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী রাখাই তাই ‘নর’-এর কাছে আবশ্যক ৷ কালিদাসের ‘কীরাতার্জুনীয়ম’-এ তাই দেহকেই ‘ধর্ম’ সাধনার প্রাথমিক আধার হিসেবে ধরা হয়েছে (শরীরমাধ্যম খলু ধর্মসাধনম) ‘অষ্টাঙ্গহৃদয়’ নামক গ্রন্থেও বলা হয়েছে সুস্বাস্থ্যই পুরুষার্থের মূল (ধর্মার্থ কামমোক্ষনম আরোগ্যম মূলমূত্তমম) ৷ তাই ভারতীয় ধর্মসাধনায় ‘শরীর’-এর গুরুত্ব কখনোই খর্ব হয়নি ৷ শরীরের নিজস্ব চাহিদাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’—এই দুই অভীষ্ট বস্তু লাভ করা সম্ভব ‘শরীর’-এর মধ্য দিয়েই ৷ প্রায় সব শাস্ত্রগ্রন্থেই ‘ধর্ম’, ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’-এর সাধনা করতে বলা হয়েছে অবিচ্ছেদ্যভাবে, পৃথক পৃথক ভাবে নয় (‘ধর্মার্থ কাম সমমেব সেব্য’) ৷ ‘অভ্যুদয়’ এবং ‘নিঃশ্রেয়স’ (যত অভ্যুদয় নিঃশ্রেয়স সিদ্ধিঃ স ধর্মঃ) ৷ ‘অভ্যুদয়’ বলতে বোঝায় বস্তুগত প্রাপ্তি, আর ‘নিঃশ্রেয়স’ হলো ‘মোক্ষ’ ৷ বৈশেষিক সূত্রের টীকাকার শঙ্কর মিশ্রের মতে ‘অভ্যুদয়’-এর অর্থ তত্বজ্ঞান (অভ্যুদয়ম তত্বজ্ঞানম) ‘অর্থ’—এই দুই অভ্যুদয় সাধনার ক্ষেত্রে‘ধর্ম’-র ভূমিকা হল এদের দ্বারা জাত ‘সুখ’-এর অনিত্যতা প্রতিপাদন ৷ কারণ ‘সুখে’র পরেই আসে ‘দুঃখ’ ৷ এভাবেই ‘ধর্ম’-এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’-এর সাধনা নেতিবাচকভাবে ‘মোক্ষ’-র সাধনাকেই পরিপুষ্ট করে ৷ কারণ ‘মোক্ষ’-ই মানুষকে দুঃখের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয় ৷ ‘নর’-এর কাছে ‘সুখ’ই প্রধান আকাঙ্ক্ষিত বিষয়, আর ‘সুখ’-এর আধার হল ‘দেহ’ ৷ কিন্তু এই ‘সুখ’ সাময়িক ৷ তাই চিরকালীন ‘আনন্দ’ লাভের জন্য ‘মোক্ষ’ লাভের কথাই বলা হয়েছে প্রায় সব হিন্দু দর্শনে ৷ ‘মোক্ষ’-র উপলব্ধি ঘটতে পারে দৈহিক বাসনাকে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ৷ ‘সাংখ্যসার’—অনুযায়ী ‘মোক্ষ’ রয়েছে মানুষেরই মনে, অন্য কোথাও নয় (২,৭/২৫) ৷ বাসনানিরুদ্ধির প্রধানতম উপায় ‘জ্ঞান’ ৷ ‘পরমার্থসার’-এ বলা হয়েছে ‘অজ্ঞানতা’র বন্ধন ছিন্ন করেই ‘জ্ঞান’ লাভ সম্ভব ৷ ‘ধর্ম’ ‘অর্থ’, ‘কাম’—এই ত্রিবর্গই ‘জ্ঞান’ লাভের উপায় ৷ আর ‘মোক্ষ’ হল, ‘জ্ঞান’-এর পরিণতি ৷ ফলত, ‘ত্রিবর্গ’ সাধনা এবং ‘মোক্ষ’ লাভ একে অপরের বিপরীতধর্মী নয় ৷ ‘ধর্ম’ সাধনার মধ্য দিয়েই ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’ লাভ করা সম্ভব ৷ আবার ‘ধর্ম’ সাধনাই ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’কে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে না ভাবতে শেখায় ৷
কিন্তু জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে পার্থিব মানুষ ‘পুরুষার্থ’-র তাত্বিক আদর্শকে নয়, বস্তুগত অর্থেই গ্রহণ করতে চায় ‘অর্থ’ ও ‘কাম’-কে ৷ আদর্শ এবং এই বাস্তবতার দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে চেয়েছে সাংখ্য দর্শন ৷ এখানে বলা হয়েছে ‘পুরুষে’র দুই অভীষ্ট : প্রথমটি পার্থিব দেশ-কালে আবদ্ধ সুখ—‘সর্গ’, দ্বিতীয়টি দেশ-কাল নিরপেক্ষ পরম সুখ বা মোক্ষ-‘অপবর্গ’ ৷ ‘সর্গ-এর উৎপত্তি ঘটে ‘প্রকৃতি’-র প্রভাবে ৷ ‘পুরুষ’ এবং ‘প্রকৃতি’-র প্রভাবেই ‘নর’-এর উৎপত্তি ৷ ‘সাংখ্যদর্শন’-এর ‘অপবর্গ’ লাভের উপায় উল্লিখিত ৷ বিপরীতে পুরাণ ও মহাকাব্যসমূহ পার্থিব ‘সর্গ’-এর মাধ্যমে ওই অর্জনের পন্থা নির্দেশ করে ৷১৯ যেমন, রামায়ণ-এ দেখানো হয়েছে ‘ধর্ম’-এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘কাম’-এবং ‘ধর্ম’-বহির্ভূত ‘কাম’-এর পার্থক্য ৷ প্রথম প্রকারভেদটি ‘মোক্ষ’-এর পথনির্দেশ করে, দ্বিতীয়টি যাবতীয় দুর্ভোগের কারণ হয় ৷ রাবণ ওই দ্বিতীয় প্রকার ‘কামে’র নিদর্শন ৷২০ এর পাশাপাশি আমরা রাখতে পারি ‘সত্যনারায়ণ ব্রতকথা’-র কাহিনি, যা বাংলার পাশাপাশি সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন রূপে প্রচলিত ছিল ৷ এই কাহিনিতে এক ব্রাহ্মণ, এক শূদ্র কাঠুরে, এক ক্ষত্রিয় এবং এক বৈশ্য সাধুব্যক্তি সত্যনারায়ণ ব্রত পালন করে ইহজীবনে ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’ লাভ করেন, যার বলে পরজন্মে তাঁরা ‘মোক্ষ’ প্রাপ্ত হন ৷ কাহিনির শেষে আশ্বাস দেওয়া হয় এই ব্রত পালন এবং সত্যনারায়ণের আখ্যান শ্রবণ করলেই ‘অর্থ’ ও ‘কাম’-এর মধ্য দিয়ে অবশেষে ‘মোক্ষ’ লাভ করা যায় ৷ এই গল্পের নীতিবাক্যটি হল : কোনো ব্যক্তি-র অভীষ্ট ‘মোক্ষ’ না-ও হতে পারে, কিন্তু সে যদি ‘ধর্ম’ সাধনা হিসেবে ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’-এর চর্চা করে তবে অবশেষে তারও, ‘মোক্ষলাভ’ ঘটবে ৷ ‘গীতা’য় বলা হয়েছে ‘ধর্ম’-সাধনাই ‘পুরুষে’র ‘স্ব-ভাব’কে স্থিতি দেয় এবং ‘যোগ’ সাধনার মধ্য দিয়ে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো ব্যক্তি ‘মোক্ষ’ লাভে সক্ষম (দ্র: ষষ্ঠ অধ্যায়, অভ্যাসযোগ বা ধ্যানযোগ, শ্লোক সংখ্যা ৪০, ৪১, ৪২ এবং ৪৩) ৷ তবে মনে রাখতে হবে ভারতীয় দর্শনে ‘অর্থ’ শব্দটি যেমন কেবল ‘ধনসম্পদ’ বা টাকাকড়ি বোঝায় না, ‘কাম’ শব্দটিও কেবল রতিক্রিয়া বোঝায় না ৷ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ ‘অর্থ’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘অস্যার্থ’—জীবনধারণের উপায় ৷ অর্থের মূলে আছে উত্থান—‘অর্থস্য মূলম উত্থানম’ ৷ মহাভারতে অর্জুন ‘অর্থমাহাত্ম্য’ ঘোষণা করেছেন : ‘অর্থাদ ধর্মশ্চ স্বর্গশ্চৈব নরাধিপঃ’ (১২, ৮, ১৭) ৷ কৌটিল্য নির্দেশ দিয়েছেন রাজা ইন্দ্রিয় জয় করে ধর্ম ও অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কামের সেবা করবেন ৷ এদের কোনো একটির প্রতি অত্যধিক আসক্তি জন্মালে অন্য দুটি পীড়িত হবে ৷২১ একইভাবে বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-এও ‘কাম’ এক বিস্তৃত নন্দনতাত্বিক অভিব্যক্তি ৷ ‘কামসূত্রে’র ‘সাধারণাধিকরণস্য’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে : ‘ধর্ম, অর্থ ও কাম এই তিনটি ত্রিবর্গ নামে অভিহিত হয় ৷ তাহার মধ্যে আবার ধর্ম ও অর্থ, এই দুইটির ফল বলিয়া কামই প্রধান পুরুষার্থ, কামবাদীরা, এই কথাই বলিয়া থাকেন ৷’’২২ ‘ধর্ম’ বলতেও বোঝায় এক সামগ্রিক জীবনপ্রণালী ৷ হিন্দু দর্শনশাস্ত্রে জীবনচক্রকে ‘আশ্রমধর্ম’-এর আধারে ভাবা হয়েছে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি জীবনের নির্দিষ্ট স্তরপরম্পরায় (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস) কর্তব্য পালন করা শেখে ৷ ‘ব্রহ্মচর্যে’ ‘কাম’ গ্রহণীয় নয়, কিন্তু ‘গার্হস্থ্যে’ তা অবশ্যপালনীয় ৷ কিন্তু স্তরপরম্পরায় এই কর্তব্য পালনও কেবল নিষেধাজ্ঞামূলক নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী তার রকমফেরও ঘটতে পারে ৷ সেকারণেই সুধীর কাকর ‘আশ্রমধর্ম’কে ‘ethical relativism’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৷ তাঁর ভাষায় :
Dharma is both the principle and the vision of an organic society in which all the perticipating members are interdependent, their roles complementary. The duties, privileges and restrictions of each role are prescribed by an immutable law, the ‘sanatan’ or ‘eternal’ dharma, and apply equally to the king as to the meanest of subjects.২৩
‘কাম’ এবং ‘প্রজনন’ দুই-ই এই আশ্রমধর্মের অঙ্গ ৷ পুরুষের ‘শুক্র-কে বলা হয় ‘বীজ’ এবং নারীর ‘গর্ভরস-কে বলা হয় ‘আর্তব’ ৷ পুরুষ ‘বীজ’ বপন করে নারীর গর্ভে বা ‘ক্ষেত্র’-এ ৷ ‘শুক্র’ এবং ‘আর্তব’—উভয়ই দেহের ‘রক্ত’ ঘনীভূত হয়ে গড়ে ওঠে ৷ তাই দেহের সারাৎসার ‘বীজ’-এর যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের নির্দেশ বারবার দেওয়া হয়েছে হিন্দু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রে ৷ ‘ব্যক্তি’র শরীরের গঠন, লিঙ্গনির্ণয়—সবই নির্ধারিত হয় ‘শুক্র’ এবং ‘আর্তব’-এর আনুপাতিক মিশ্রণ এবং প্রাধান্য অনুযায়ী ৷ কল্পনা করা হয়, দেহের কঠিন, কাঠামোগত অংশগুলি গড়ে ওঠে পুরুষবীর্য থেকে এবং অপেক্ষাকৃত কোমল অংশসমূহ চামড়া, মাংস—প্রভৃতি গড়ে ওঠে ‘আর্তব’ থেকে ৷ গর্ভাধানকালে বীর্যের প্রাধান্য পুত্রসন্তান, অর্তেব-এর প্রাধান্য কন্যাসন্তান, উভয়ের সমান আনুপাতিক মিশ্রণ থেকে ‘উভলিঙ্গ’ প্রজাতির (hermaphrodite) জন্ম হয় ৷২৪
‘পুরুষার্থে’র উচ্চ দার্শনিক ধারণাকে সাধারণ জনসমাজে ছড়িয়ে দেবার প্রক্রিয়াটি মধ্যযুগীয় সমাজে পৌঁছে ভিন্ন তাৎপর্য লাভ করে ‘ভক্তিধর্ম’ আন্দোলন বিকশিত হবার মধ্য দিয়ে ৷ সুদীর্ঘকালব্যাপী বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম ও একেবারে পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঠেকানো এবং অন্যদিকে বেদ-উপনিষদের জটিল অধিবিদ্যক বিষয়গুলিকে জনসমাজে সহজবোধ্য করে তোলার তাগিদ ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র উপলব্ধি করেছে বরাবর ৷ সাধারণ জনসমাজকে নতুনভাবে নিয়মানুবর্তী করে তোলা, তাদের কাছে পুরুষার্থের ধারণাটিকে সহজতম ভাষায় ব্যাখ্যা করার বিষয়টি এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে ৷ বৈষ্ণব তাত্বিকগণ সেকারণেই ভক্তিকে পঞ্চম ‘পুরুষার্থ’ হিসেবে উপস্থাপিত করেছিলেন ৷ ‘আমনায়’-এর ধারণাটি ‘ভক্তি’-ধর্ম, তীর্থযাত্রা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তরলীকৃত হয়েছিল ৷ ‘আমনায়’-এর প্রধান আয়ুধ ছিল ‘জ্ঞান’ ৷ ‘ভাগবতপুরাণ’-এ ‘জ্ঞান’ এবং ‘বৈরাগ্য’কে ভক্তির সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল (জ্ঞান বৈরাগ্য নামানৌ কালযোগেন জরজরৌ) ৷২৫ ‘ব্যক্তিধর্মে ঈশ্বরের ‘সামীপ্য’ লাভ ‘মোক্ষ’-র ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করে ৷ তুলসীদাস তাঁর ‘রামচরিতমানস’-এ জ্ঞান’-এর চেয়ে ‘ভক্তি’কেই কলিযুগের অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য পন্থা মনে করেছেন ৷ তবে ‘আমনায়’ বা পুরুষার্থপন্থীদের সঙ্গে ‘ভক্তি’বাদীদের ভাবগত সংঘাত বজায় থেকেছে ৷ তাঁরা ‘ভক্তি’কে ‘ধর্ম’সাধনে’র অংশমাত্রই ভেবেছেন ৷ তাঁদের কাছে ‘ধর্মসাধনে’র তিনটি ভাগ : ‘নিত্য’ (যা প্রত্যহ পালনীয়), ‘নৈমিত্তিক’ (যা বিশেষ অনুষ্ঠান হিসেবে পালনীয়) এবং ‘কাম্য’ (জাগতিক বাসনা অর্থাৎ ‘অর্থ’ এবং ‘কাম’ লাভের জন্য যা পালন করতে হয়) ৷
প্রশ্ন উঠতে পারে ‘চতুর্বর্গ পুরুষার্থ ‘সাধনার সঙ্গে ‘ক্ষমতা’-র সম্পর্ক কোথায়? এক্ষেত্রে ‘ক্ষমতা’ যতটা বাইরে থেকে প্রযুক্ত তার চেয়েও বেশি ‘অন্তরায়িত’ ৷ দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে ফ্রিডরিখ নিৎশে-র—internalization সংক্রান্ত ভাবনাকে ব্যবহার করে দেখিয়েছেন কীভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে দার্শনিক ‘শরীর’ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্রশাসিত ‘শরীর’-এর দ্বারা ৷ নিৎশে-র উক্তিটি ছিল এরকম : ‘all instincts that do not discharge themselves outworldly turn inward—that is what…internalization of man first developed what was Iater called his soul’২৬ দেবপ্রসাদের মতে ভারতীয় সংস্কৃতিতেও ‘আত্মন’ গড়ে ওঠার পদ্ধতিটি হল ‘internalization of threat and violence, which constructs the authenticated soul’২৭ ৷ হিন্দু পারিবারিক কাঠামোয় ‘ব্যক্তি’-র ‘স্বধর্ম’ পালনও যে বিধিবদ্ধ ‘দেশ’ (সংস্কৃতিতে ব্যক্তি যে পরিসরে বেঁচে রয়েছে), ‘শ্রম’ (আশ্রমধর্মের প্রত্যেক স্তরে যে উদ্যোগ তাকে গ্রহণ করতে হয়) এবং ‘গুণ-এর (যা তার বংশ, ঐতিহ্য ও পূর্বজন্মকৃত কাজের ফলাফলের সাপেক্ষে গঠিত) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ৷ তা দেখিয়েছেন সুধীর কাকর, পূর্বোক্ত প্রবন্ধে তাঁর মতে ‘to size up a situation for oneself and proceed to act upon ones momentary judgement is to take an enormous cultural as well as a personal risk. For most Hindus such independent voluntary action is unthinkable’.২৮
একথা নিশ্চিত, প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বের দীর্ঘ সময়পরিসরে ‘পুরুষার্থ’ সাধনার ধারাবাহিকতা কোনো একমাত্রিক, সমসত্ব প্রক্রিয়ায় এগোয়নি ৷ ঔপনিবেশিক পর্বে পৌঁছে বাংলার জনসংস্কৃতিও আর সেই তাত্বিক/ বিধিবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকেনি ৷ আলোকায়ন-নির্ভর জ্ঞান/যুক্তি, ‘যৌনতার বিজ্ঞান’ ক্রমশ প্রভাবিত করেছে ভারতীয় চতুর্বর্গের অন্যতম বর্গ ‘কাম’-কে ৷ কিন্তু এটি কোনো সর্বাত্মক ‘ছেদ’ ছিল—একথা পুরোপুরি ঠিক নয় ৷ ইংরেজিশিক্ষিত মুষ্টিমেয় এলিটসমেত এ দেশের বৃহত্তর জনসমাজে ‘পুরুষার্থ’-নির্ভর জীবনসাধনার বোধ, প্রয়োগক্ষেত্রে না হলেও, অন্তত তাত্বিক ভাবনায় গরহাজির ছিল না ৷ উনিশ শতকের একেবারে শেষদিকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী পরিসরের ভিতরেই ‘পুরুষার্থ’ ধারণাটিকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালায় ৷ কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে ধর্ম-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দেশীয় অভিব্যক্তি কীভাবে উপস্থাপিত/প্রকাশিত করেছিল ‘কাম’-কে? অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা তার একটি রূপরেখা আঁকব ৷ এই বিপুল সাংস্কৃতিক উপাদানকে প্রথমেই কয়েকটি বর্গে বিন্যস্ত করব আমরা :
অ. কামসূত্র, কোকশাস্ত্র, অনঙ্গরঙ্গ প্রভৃতি বই-এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ‘কাম’-এর নন্দনতত্ব ৷
আ. কয়েকটি প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃত/বাংলা টেক্সট, যেখানে শরীর-যৌনতা-যৌন আচরণে উন্মুক্ত প্রকাশ ঘটেছে ৷
ই. বিবিধ ‘দেহবাদী’ ধর্মীয় ‘প্রধান’/‘অ-প্রধান’ সাধনার ধারা ৷
ঈ. প্রতিষ্ঠিত / মান্য যৌনপরিচয়ের বাইরে শরীর / যৌনসত্তার ‘অপর’-এর পরিচয় (যেমন: তৃতীয় লিঙ্গ-এর ধারণা, সমকামী সম্পর্ক ইত্যাদি)
অ.
প্রাক-খিস্টীয় যুগ থেকে ১৫-১৬ শতক পর্যন্ত লেখা হয়েছে এরকম বেশ কিছু ভারতীয় টেক্সট, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে ‘কাম’-এর নন্দনতত্ব ৷ ‘কাম’-ই এগুলির প্রধান বিষয়বস্তু ৷ খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে লেখা বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-ই এধরনের পরবর্তীকালীন টেক্সটগুলির মান্য আদিরূপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ৷ ‘কামসূত্র’ ভারতীয় ‘পুরুষার্থ’ সাধনাকাঠামোর অঙ্গীভূত হিসেবেই ‘কাম’-কে উপস্থাপিত করা হয়েছে ৷ সাধারণ গৃহস্থের পক্ষে ধর্ম-অর্থ-কাম—এই ত্রিবর্গের সাধনাই মুখ্য ৷ বাৎসায়ন ‘কাম’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন : ‘আত্মসংযুক্ত মনঃ দ্বারা অধিষ্ঠিত শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষুঃ, জিহ্বা ও ঘ্রাণের স্ব স্ব বিষয়ে অনুকূলভাবে প্রবৃত্তি—কাম’ ৷২৯ ত্রিবর্গের ভিতর ‘কাম’-এর গুরুত্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে এইভাবে: প্রথম, ‘ধর্ম ও অর্থ, এই দুইটির ফল বলিয়া কামই প্রধান পুরুষার্থ ৷ কামবাদীরা এই কথাই বলিয়া থাকেন’, পক্ষান্তরে, ‘এ শাস্ত্রে প্রধান পুরুষার্থ বলিয়া কামই অধিকৃত, তথাপি কাম দ্বারা ধর্মার্থও অধিকৃত হইয়াছে ৷ এই শাস্ত্রের উপদেশানুসারে যথাযথ উপায় অবলম্বন করিয়া যে পুরুষ প্রবর্ত্তিত হইবে, তাহার পক্ষে ধর্ম, অর্থ ও কাম, এই ত্রিবর্গই সুসিদ্ধ হইবে ৷’ ত্রিবর্গের ভিতর ‘কাম’-এর গুরুত্ব প্রতিপাদনের জন্য উর্ব্বশী-পুরুরবার কাহিনি বিবৃত হয়েছে এখানে ৷ পুরুরবা ইন্দ্রকে দেখবার জন্য ইহলোক থেকে স্বর্গে গিয়ে মূর্তিমান ‘ধর্ম’কে দেখে ইতর দুই বর্গ-কে (‘অর্থ’ও ‘কাম’) উপেক্ষা করেছিলেন ৷ তাই ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ পুরুবাকে অভিশাপ দেন ৷ সেই অভিশাপের ফল বিপর্যয় ৷ ‘উর্ব্বশীর সহিত পুরুরবার বিরহ সেই কামের অভিসম্পাতের ফলেই হইয়াছিল ৷’ বাৎসায়ন বিভিন্নভাবে দেখিয়েছেন, এই ত্রিবর্গসাধনা ‘অন্যোন্যনুবন্ধ’ ৷ অর্থাৎ একটি অপরটির সঙ্গে এমন সম্পর্কে যুক্ত যে উভয়কেই একত্রে সম্পাদন করা যায় ৷ তবে, চতুরাশ্রমশাসিত জীবনে, বাৎসায়নের নির্দেশ : ‘বাল্যে অর্থ এবং ধর্মের, যৌবনে কাম এবং ধর্মার্থের; স্থবিরে—ধর্ম্ম এবং অনুষ্ঠান সামর্থ্য থাকিলে অর্থ কামেরও সেবা করিবে ৷’ তবে, ‘যতদিন পর্যন্ত বিদ্যারূপ অর্থ লাভ হইবে না, ততদিন পর্যন্ত কামের সেবা করিবে না ৷’ অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় সাধনায় জীবনযাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ই ‘কাম’ ৷ বাৎসায়নের মতে, যেকোনো শাস্ত্রের মতই ‘কামসূত্র’ও দুভাগে বিভক্ত:: ‘তন্ত্র’ ও ‘আবাপ’ ৷ যার দ্বারা ‘রতি’-কে তন্ত্রিত করা যায়, অর্থাৎ উদ্বোধিত করা যায়, তাকে ‘তন্ত্র’ বলে ৷ যেমন—‘আলিঙ্গনাদি’ ৷ ‘কামসূত্র’-এর ‘সাম্প্রয়োগিক’ অধিকরণ এই ‘তন্ত্র’ গ্রন্থের উদাহরণ ৷ আর যার দ্বারা সম্যকরূপে ‘রতি’র জন্য স্ত্রী ও পুরুষকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাকে বলে ‘আবাপ’ ৷ ‘আবাপ’ শব্দে সঙ্গমের উপায় বোঝায় ৷ যেমন, ‘কন্যাসম্প্রযুক্তকাদি’ অধিকরণ ৷
‘কাম’ শব্দের সাধারণ সংজ্ঞা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে ‘কামসূত্র’-এ ৷ ‘কাম’ দ্বিবিধ : ‘সামান্য’ ও ‘বিশেষ’ ৷ ‘সামান্য’ কাম ‘আত্ম-সমবায়ি-কারণ’ ৷ এক্ষেত্রে সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ আদি গুণ মনের সঙ্গে যুক্ত হয়, মন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে স্ব স্ব বিষয়ে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধে অধিষ্ঠিত হয় ৷ ‘আত্মাই তদ্বারা বিষয় ভোগ করিয়া যে সুখের অনুভব করেন, সেই প্রধান সুখই কাম ৷’ বিশেষ কাম দ্বিবিধ—প্রধান ও অপ্রধান ৷ মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভিতর ‘স্ত্রী’ ও পুরুষের যে অধোভাগ প্রকাশক সন্বাধ (যোনিমার্গ) আদি ত্বগিন্দ্রিয় তন্মাত্র-স্বভাবকেই, অর্থাৎ আনন্দোৎপাদনই তাহার স্বভাব ৷ …স্ত্রী ও পুরুষের অধোভাগস্থ স্ত্রীত্বব্যঞ্জক ও পুংস্তত্ববব্যঞ্জক চিহ্ন বিশেষের অন্তর্গত—মধ্যবর্তী যে স্পর্শবিশেষ সেই স্পর্শ-বিষয়ক প্রতীতিই অর্থপ্রতীতি’ ৷ যে ‘কাম’ অর্থপ্রতীতি’ জন্মায় তাকেই বলে ‘প্রধান কাম’ ৷ আর বিপরীত (পশ্বাদির) যোনিতে, অযোনিতে (হস্তমৈথুনাদি) বা অনভিপ্রেত-যোনিতে (বলাৎকারকালে) যে অর্থ প্রতীতি তাকে ‘অপ্রধান’ কাম বলে ৷ কারণ এই কাম স্ত্রী-পুরুষের অনুরাগব্যঞ্জক আভিমানিক সুখে অনুবিদ্ধ নয় ৷ অর্থাৎ যৌনতার বিভিন্নমুখী সম্ভাবনার কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন বাৎসায়ন ৷ ‘সাধারণমধিকরণম’ অধ্যায়েই বাৎসায়ন ‘কাম’ বিষয়ে বিরুদ্ধবাদীদের মত খণ্ডন করেছেন ৷ বিরুদ্ধবাদীদের মতটি এরকম:
‘কামের সেবা করিবে না; যেহেতু ধর্ম্ম ও অর্থ হইতে কামের উৎপত্তি বলিয়া ধর্ম্মার্থই প্রধান ৷ কামের সেবা করিলে কাম সেই প্রধানের শত্রু হইয়া দাঁড়ায় এবং অন্য মতেরও বিরোধী হয় ৷ ইহারা অনর্থজনের সহিত সম্পর্ক, অসদ্ব্যবসায়, অশৌচ এবং অপ্রভাবকে জন্মায় ৷’৩০
এই মত খণ্ডন করছেন বাৎসায়ন::
শরীরের স্থিতিহেতু বলিয়া কাম আহারাদির সমানধর্ম্মা এবং ধর্ম ও অর্থের ফল কাম ৷…যেমন আহার অজীর্ণাদি দোষ জন্মাইলেও প্রতি দিনই শরীর রক্ষার জন্য সেবিত হয়, সেইরূপ কাম্য ৷ অন্যথা রাগের উদ্রেকবশত উন্মাদ-আদি শরীর নষ্ট হইতে পারে ৷ ফলভূত কাম সুখের জন্যই ধর্ম ও অর্থের সেবা ৷ যদি সুখভোগই না করিলে, তবে ত ধর্ম ও অর্থ বন্ধ্যভূত হইয়া গেল, আর কেবল আয়াস-ফলই হইল ৷৩১
‘কামসূত্র’ প্রাচীন ভারতীয় ‘নাগরিক’ অভিজাত সমাজে প্রচলিত যৌননৈতিকতার এক অনুপম বিবরণ ৷ গার্হস্থ্যজীবনে এক বা একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে পুরুষের যৌনক্রিয়া এবং অবৈধ পরনারীগমনের দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন বাৎসায়ন ৷ ‘কন্যাসম্প্রযুক্তকাধিকরণম’, ‘ভার্যাদি-কারিকাধিকরণম’ এবং ‘পারদারিকাধিকরণম’—অধ্যায়ে এগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷ ‘বৈশিকাধিকরণম’ অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে সেযুগের বেশ্যাসংস্কৃতির ছবি আঁকা হয়েছে ৷ বেশ্যাদের প্রকারভেদ, লক্ষণভেদ, গুণাবলির অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ পাওয়া যায় এখানে ৷ আর শেষ দুই অধ্যায় ‘সাম্প্রয়োগিকাধিকরণম’ এবং ‘ঔপনিষদিকাধিকরণম’-এ যৌনক্রীড়া ও যৌনকুশলতা সম্পর্কে এক বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার উন্মোচিত হয়েছে ৷ প্রথমোক্ত অধ্যায়ে নায়কনায়িকার বয়স, যৌনাঙ্গ, আলিঙ্গন ও মিথুন আসনের প্রকারভেদ বর্ণিত, দ্বিতীয়োক্তটিতে যৌবন ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির উপায়, বশীকরণ কৌশল, যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির উপায়, কৃত্রিম উপায়ে রেতঃস্খলন ও ধর্ম-মর্ষকামী বিভিন্ন প্রকার যৌনমিলনের বর্ণনা রয়েছে ৷ ‘সাম্প্রয়োগিকাধিকরণম’-এর প্রথম অধ্যায়ে পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীযোনির প্রকারভেদ (নায়কগণের তিনপ্রকার ভেদ : শশ, বৃষ, অশ্ব; নায়িকাদেরও তিনপ্রকার ভেদ : মৃগী, বড়বা, হস্তিনী), দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলিঙ্গনের পদ্ধতি ও প্রকারভেদ (স্পৃষ্টক, বিন্ধক, উদঘৃষ্টক, পীড়িতক), তৃতীয় অধ্যায়ে চুম্বনের প্রকৃতি ও প্রকারভেদ (মিমিতক, স্ফুরিতক, ঘটিতক এবং সম, বক্র, উদভ্রান্ত এবং অবপীড়িতক), চতুর্থ অধ্যায়ে নখরাঘাত সংক্রান্ত আলোচনা, পঞ্চম অধ্যায়ে দন্তক্ষতের প্রকারভেদ, ষষ্ঠ অধ্যায়ে সুবিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে মিথনমুদ্রাসমূহ ৷ এর ভিতর রয়েছে সমগুণসম্পন্ন নারীপুরুষের ‘সমতর’ মৈথুনভঙ্গি (উৎফুল্লক, বিজৃম্ভিতক, ইন্দ্রাণিক) ছাড়াও আরও কয়েকপ্রকার মৈথুনভঙ্গি (সম্পুটক, পীড়িতক, বেষ্টিতক, বাড়বক—যেগুলি আবার দুপ্রকার হতে পারে : পার্শ্ব ও উত্থান) ৷ এছাড়াও কয়েকটি কম প্রচলিত মিথুনমুদ্রার বর্ণনাও দিয়েছেন বাৎসায়ন ৷ যেমন, ‘স্থিতরত’ (যেখানে নারী পাথরের খিলান বা স্তম্ভে শরীরের ভর রেখে মিলিত হয়), ‘অবলম্বিতক’ (যেখানে নায়িকা দণ্ডায়মান নায়কের দেহে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ভার অর্পণ করে শূন্যে মিলিত হয়), ‘ধেনুক’ (যেখানে নায়িকার দেহের পশ্চাৎভাগে নায়ক অবস্থিত) এমনকি একাধিক পুরুষের সঙ্গে এক নারীর মিলনমুদ্রাও বর্ণিত এখানে (সঙ্ঘটক’, যেখানে দুই পুরুষ এক নারীর দেহে প্রবেশরত, ‘গোযুথিকা’, যেখানে একজন নারীকে যৌনতৃপ্তিদানে রত পাঁচজন পুরুষ), সপ্তম অধ্যায়ে ‘প্রহণন’ বা মিলনপ্রহার ও তার অভিব্যক্তি (শিৎকার) আলোচিত হয়েছে ৷ যে প্রকরণগুলি এখানে আলোচিত তার ভিতর কয়েকটি ধর্ষকামী আচরণের নিদর্শন ৷ পরবর্তী দেড়হাজার বছরব্যাপী ভারতীয় চিত্রকলা, মন্দিরস্থাপত্যে বাৎসায়ন-প্রদর্শিত মিথুনমুদ্রা অনুসৃত হয়েছে ৷ যদিও কোনো কোনো সাম্প্রতিক গবেষক বাৎসায়ণের শৃঙ্গারপ্রকরণকে নিছক পাণ্ডিত্যঅভিলাষী, অবাস্তব কল্পনার ফসল হিসেবে খারিজ করে দিতে চান, তবুও পরবর্তী শৃঙ্গারতত্বের রচয়িতাদের গ্রন্থে আগাগোড়া বাৎসায়নের অনুসৃতি, এমনকী কাব্যে-সাহিত্যেও এর অনুকরণ দেখে মনে হয় সুদীর্ঘকালব্যাপী ভারতীয় জনসমাজের চেতনায় দেশীয় শৃঙ্গারভাবনার নন্দনতাত্বিক অভিব্যক্তি কতকটা বাৎসায়ন-অনুসারী পথেই পরিচালিত হয়েছিল ৷৩২ উনিশ শতকের বাংলায় ছাপাখানার দৌলতে যে সকল তথাকথিত ‘অশ্লীল’ বইপত্র ছাপা হত, তার ভিতরেও বেশ কয়েকটি কামসূত্র-অনুসারী ৷ যেমন : কামশাস্ত্র, প্রেম অষ্টক, রমণীরঞ্জন, শৃঙ্গাররস, রতিবিলাস প্রভৃতি ৷
দ্বিতীয় যে বইটির কথা আমরা উল্লেখ করব সেটি দ্বাদশ শতকে লেখা কোক্কোকের ‘রতিরহস্য’, যা সাধারণভাবে ‘কোকশাস্ত্র’ নামেই প্রচলিত ৷ যদিও কোকশাস্ত্রের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখতে গিয়ে ডব্লিউ জি. আর্চার মন্তব্য করেছিলেন, মধ্যযুগীয় ভারতের সমাজ বাৎসায়ন-সমকালীন প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো অতখানি উদার ছিল না এবং কোক্কোক ‘looks back to Vatsyayana much as the renaissance looked back to ancient Greece’, তবুও রতিশাস্ত্রের সামগ্রিক কাঠামো রচনা করতে গিয়ে এই লেখকও কিন্তু মূলত বাৎসায়নকেই শিরোধার্য করেছেন ৷৩৩ এই ধারার পরবর্তী মধ্যযুগীয় লেখকেরা আবার সরাসরি অনুসরণ করেছেন ‘কোকশাস্ত্র’কেই ৷ ‘রতিরহস্য’ মোট ১৫ অধ্যায়ে বিভক্ত ৷ অধ্যায়গুলি যথাক্রমে নায়িকাপ্রকরণ বা নায়িকার চার প্রকারভেদ, নায়িকাদের যৌনউদ্দীপনার উপযোগী ঋতুপ্রকরণ, নায়িকাবশীকরণের পদ্ধতি, ‘কামস্থান’ এবং ‘রতিতিথি’ সমূহ অর্থাৎ শরীরের নির্দিষ্ট যৌনউদ্দীপক ‘অঙ্গস্থান’ সমূহ ও যৌনমিলনের উপযুক্ত বারতিথি, নায়ক-নায়িকার যৌনাঙ্গের আকৃতি, গঠন, গভীরতা অনুসারে শ্রেণিবিভাগ, যৌনমিলন ও আনন্দের স্থায়িত্ব অনুসারে মৈথুনমুদ্রার প্রকারভেদ, বয়স-প্রকৃতি-যৌনপারঙ্গমতা অনুসারে নায়িকার শ্রেণিভেদ, বিভিন্ন অঞ্চলের রমণীদের পৃথক যৌনবৈশিষ্ট্য, আলিঙ্গন-চুম্বন, নখরাঘাত-দন্তক্ষত-যৌনপ্রহার-শিৎকারের প্রকারভেদ, বিভিন্ন মৈথুনমুদ্রা, রমণীবশীকরণের কৌশল, স্ত্রী-কর্তব্য, পরকীয়া সম্পর্ক, যৌনশক্তি এবং যৌবন বৃদ্ধি ও ধরে রাখার বিচিত্র উপায় নিয়ে রচিত ৷ মূলত বাৎসায়নকে অনুসরণ করলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কোক্কোক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং সেই স্বাতন্ত্র্যসমূহ অনুসৃত হয়েছে এই জাতীয় পরবর্তী রতিশাস্ত্রগুলিতে ৷ এরকম একটি ক্ষেত্র হল নারীর ‘কামস্থান’ ৷ বলা হয়েছে নারীশরীরের নির্দিষ্ট কয়েকটি অঙ্গসংস্থানে যৌনবোধ সর্বাপ্রেক্ষা অধিক অনুভূত হয় (আনন্দস্থিতি) ৷ চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধি অনুসারে, অর্থাৎ পূর্ণিমা তিথি থেকে আরম্ভ করে অমাবস্যা পর্যন্ত পনেরোটি রতিতিথিতে নারীশরীরের ষোলোটি অনঙ্গস্থানে ‘কামে’র প্রতিসরণ ঘটে ৷ এই পর্যবেক্ষণ বাৎসায়ন থেকে পৃথক ৷ শারীরিক গঠন, যৌনস্থায়িত্ব, যৌনপ্রকৃতি/পারঙ্গমতার বিচারে নারীকে পদ্মিনী, শঙ্খিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী—এই চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে ‘কোকশাস্ত্রে’ ৷ এখানে আর একটি নতুন বিষয় ‘নারীক্ষোভন’ বা রমণীর কামস্থানে পুংঅঙ্গুলি প্রয়োগ ৷ নারীর যোনিপথকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে : ‘করিকর’, ‘ফণীভোগ’, ‘অর্ধেন্দু’ ও ‘কামাঙ্কুশ’ ৷ এছাড়া নাম আলাদা হলেও কোক্কোক মূলত বাৎসায়ন-নির্দেশিত মৈথুনমুদ্রা, প্রহনন, শিৎকার (কোকশাস্ত্রে ‘হিংকার’), নায়ক-নায়িকাপ্রকরণ ব্যবহার করেছেন ৷ পরবর্তী যুগে সাহিত্য-শিল্পকলায় অবশ্য কোক্কোকের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় ৷ ১৪ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত উত্তর ভারতের মিনিয়েচার পেন্টিং-এ আঁকা নরনারীর রমণমুদ্রায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে কোকশাস্ত্র ৷ বিশেষত ১৭-১৮ শতকের মূঘল চিত্রকলায় এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি ৷ ১৫ শতকে লেখা ভানুদত্তের ‘রসমঞ্জরী’ বা ১৬ শতকে কেশবদাস-বিরচিত ‘রসিকপ্রিয়া’-য় কোকশাস্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট ৷ কোনো কোনো আলোচক জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এ রাধাকৃষ্ণের সুরতলীলায় কোকশাস্ত্রের প্রভাব আবিষ্কার করেছেন ৷৩৪ উনিশ শতকের বাংলা কামসাহিত্যেও এর প্রভাব দুর্লক্ষ্য ছিল না ৷ কোক্কোক যেভাবে স্তরপরম্পরায় রমণীর মদনপথের বর্ণনা দিয়েছেন, প্রায় তেমনই বর্ণনা পাওয়া যায় ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘নববিবিবিলাস’-এর ‘অথ নবযুবতীর পরিচয়’ অংশে ৷
এই ধরনের আরও পরবর্তীকালীন রতিশাস্ত্র ১৬ শতকে কল্যাণমল্লের লেখা ‘অনঙ্গরঙ্গ’ ৷ এই বইটি অনেকাংশেই পূর্বোক্ত ‘রতিরহস্য’-এর অনুসারী ৷ ‘অনঙ্গরঙ্গ’-এও বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে নারী শরীরের কামস্থান, রমণীকে তৃপ্তিদানের বিস্তৃত কৌশল, বিভিন্ন ধরনের মৈথুনমদ্রা (উচ্চ, সম, নীচভেদে নয় প্রকার আসন), দশ প্রকার স্বাভাবিক মুদ্রা, দুই প্রকার পার্শ্বমুদ্রা, সাত প্রকার আসীন মুদ্রা এবং দুই প্রকার বিপরীত রতির কৌশল ব্যক্ত করেছেন তিনি ৷৩৫ পূর্বোক্ত রতিশাস্ত্রকারদের তুলনায় কল্যাণমল্লের পার্থক্য, তিনি ‘লিঙ্গক্ষোভন’-এর কথা উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ আঙুল বা হাতের সাহায্যে নয়, পুরুষলিঙ্গের দ্বারা নারীর যৌন উদ্দীপনের কৌশল, যার দ্বারা বিভিন্ন প্রদেশের রমণীকে বশ করা যায় ৷ ‘অনঙ্গরঙ্গ’-এ কৃত্রিম যন্ত্রপাতি দ্বারা যৌনসুখ উপভোগের কথাও বর্ণিত হয়েছে ৷ কল্যাণমল্লের এই বই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে উনিশ শতক অবধি প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল ৷ মধ্যযুগে এটির ফার্সি অনুবাদ হয়েছিল ‘লিজ্জৎ-অল-নিসা’ বা ‘রমণীগণের আনন্দ’ এই নামে ৷ ১৮৫১ সালে কলকাতায় মদনমোহন দে এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন—‘সম্ভোগরত্নাকর’ ৷ মোটের উপর প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে ত্রিবর্গ সাধনার অন্যতম—‘কাম’ বিষয়ক রতিশাস্ত্রের একটি শক্তিশালী ধারা জনসমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল ৷ ১৬/১৭ শতকে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে শ্রীপতির লেখাপড়ার বিবরণে রয়েছে কামশাস্ত্র অধ্যয়নের কথা : ‘হিতউপদেশ কথা / পড়িল বাসবদত্তা / কামশাস্ত্র দীপিকা ভাস্বতী ৷’ বস্তুত এই রতিশাস্ত্রসমূহকে আলাদাভাবে নৈতিক নির্দেশনামার দ্বারা চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় উনিশ শতকে, তার আগে নয় ৷
আ.
ইংরেজি শিক্ষা, পাশ্চাত্য সেক্সুয়ালিটির ডিসকোর্স, নব্য ভিক্টোরীয় রুচিবাগীশতার দ্বারা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশীয় কাব্যসাহিত্যের ভিতর ‘অশ্লীলতা’ আবিষ্কারের আগে প্রাক-ঔপনিবেশিক সাহিত্যে শরীর-যৌনতার উন্মুক্ত প্রকাশভঙ্গি আধ্যাত্মিকতার আবরণে হলেও অদৃশ্য ছিল না ৷ রাধাকৃষ্ণ প্রণয়কথা থেকে শুরু করে, রোসাঙ্গ-আরাকানের রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য, আরবি-ফার্সি কিসসাসাহিত্য হয়ে ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ পর্যন্ত নায়কনায়িকার দেহবিহার আমাদের নিজস্ব কাব্যধারায় একটি সুপ্রচলিত বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে এসেছে ৷ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাসাহিত্যেই এধরনের টেক্সট লেখা হয়েছে অসংখ্য, যেখানে আধ্যাত্মিকতা এবং প্রেম/রতিলীলা মিলেমিশে গিয়েছে ৷ যদিও বহুক্ষেত্রেই এই ‘প্রেম’/‘কাম’-এর বিবরণ রূপকাশ্রয়ী, তবু উপাদান হিসেবে শরীর-যৌনতার অনাবিল উপস্থাপন লক্ষ করা যায় এই কাব্যগুলিতে ৷ এ প্রসঙ্গে একথাও উল্লেখ্য যে, এই আধ্যাত্মিক প্রতীকাশ্রিত যৌনতার বিবরণে, বিশেষত, কয়েকটি নির্দিষ্ট মৈথুনমুদ্রার উপস্থাপনায় কামসূত্র-কোকশাস্ত্রজাতীয় সংস্কৃত রতিশাস্ত্রের প্রতিফলন স্পষ্ট ৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে যৌনতা উপস্থাপনার একটি সর্বভারতীয় ধারাবাহিকতার মান্য উত্তরাধিকার বহন করছে এই বইগুলি ৷ আমাদের আলোচনার পরিসর সংক্ষিপ্ত ৷ রাধাকৃষ্ণ প্রণয়লীলার অন্তর্গত দুটি টেক্সট—জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ এবং বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এবং সর্বোপরি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’, যা ‘চৌরপঞ্চাশৎ’ জাতীয় কাব্যধারা নেওয়া—আমাদের আলোচনায় এদের প্রাসঙ্গিক অংশটুকুই মাত্র ব্যবহৃত হবে এবং এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে চাইব, উনিশ শতকের বাংলায়, একদিকে উপনিবেশিক ‘বৈজ্ঞানিক’ ডিসকোর্স, ‘সাহিত্য সমালোচনা’র ‘আধুনিক’ পদ্ধতি, ওই শতকের শেষদিকে আধুনিক ‘জাতীয়তাবাদী’ অভীপ্সা প্রেম/যৌনতা/পৌরুষসংক্রান্ত যে নতুন, ‘আধুনিক’, ‘মিশ্র বাচনে’র জন্ম দিল, প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রেম/শরীর/নারী-পুরুষের লিঙ্গ পরিচয়—সবকিছুই নির্ধারিত হত তার চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক রসোপভোগের নিরিখে ৷ বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থের ‘উপক্রমণিকা’য় জানান : ‘কৃষ্ণসম্বন্ধীয় যে সকল পাপোপাখ্যান জনসমাজে প্রচলিত আছে, তাহা সকলই অমূলক বলিয়া জানিতে পারিয়াছি’, অথবা যখন তিনি বলেন ‘যাহা ভাগবতে নিগূঢ় ভক্তিতত্ব, জয়দেব গোস্বামীর হাতে, তাহা মদনধর্ম্মোৎসব ৷ এতকাল, আমাদের জন্মভূমি সেই মদনধর্ম্মোৎসব-ভারাক্রান্ত’৩৬, তখন বঙ্কিমের কল্পনায় আদর্শ ‘জাতিরাষ্ট্র’ গড়ে তোলার তাগিদই স্পষ্ট, যে ‘আধুনিক’ বাঙালি জাতিকল্পনা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ-প্রসূত ‘মেয়েলি হিন্দুত্ব’-এর পরাভব ও লজ্জাকে অপসারিত করে এবং বলবীর্যশালী / পৌরুষসম্পন্ন পুরুষ/ নারীর নতুন ‘থাকবন্দ’ গড়ে তুলতে চায় ৷ কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিতে রাধাকৃষ্ণের প্রেম/শরীরী-মিলন এক সম্পূর্ণ পৃথক বাসনালোকের উপাদান, যা ঔপনিবেশিক বাংলার তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ দৃষ্টিকোণের সঙ্গে মিলবে না ৷ সুধীর কাকর তাঁর একটি বিখ্যাত গবেষণায় রাধাকৃষ্ণ প্রেমকথার এই দেশকালনিরপেক্ষ চরিত্রটি ধরতে চেয়েছেন ৷ তাঁর মতে পৃথিবীর প্রত্যেকটি সংস্কৃতিতেই প্রেম/রতি-সংক্রান্ত মিথগুলি ব্যবহৃত হয় জনমানসের ভিতর যুগ যুগব্যাপী প্রচলিত গোপন প্রতিস্পর্ধী আবেগের উপাদান হিসেবে : ‘Cultures, we found, use their myths of love in smuch the same way as do individuals their central sexual fantasy : to express their deeper wishes which are utterly at odds with the accepted ideologies of the man-woman relationship.’৩৭
জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’ রাধাকৃষ্ণের আবেগময় রতিকাহিনীর এক ধ্রুপদী নিদর্শন ৷ এর দ্বিতীয় সর্গে রাধার জবানিতে অতীত দিনে রাধাকৃষ্ণের শৃঙ্গারবর্ণনা, তৃতীয় সর্গে কৃষ্ণের অলংকৃত বিরহবিলাপের মধ্য দিয়ে রাধার শরীরী সৌন্দর্য বর্ণনা, অষ্টম সর্গে খণ্ডিতা রাধার মুখে কৃষ্ণের সম্ভোগচিহ্নিত শরীরের অলংকৃত বর্ণনা আর অন্তিম দ্বাদশ সর্গে রাধার কাছে কৃষ্ণের সম্ভোগ প্রার্থনা, প্রথমে বিপরীত রতি ও পরে সাধারণ রতির পর সুরতাক্লান্তা রাধার নির্দেশ মেনে কৃষ্ণকর্তৃক রাধার বেশবাস পূনর্বিন্যাসকরণ, প্রাক-ঔপনিবেশিক রাধাকৃষ্ণকথায় পরিবেশিত শরীর/যৌনতার আঙ্গিকটিকে তুলে ধরে ৷ বিপরীত রতি প্রসঙ্গ এসেছে কাব্যের অন্তিম সর্গে :
রতিকেলিরূপ সংকুল যুদ্ধে কান্তকে জয় করিবার অভিপ্রায়ে শ্রীরাধা তাঁহার বক্ষে আরোহণপূর্বক সাহসভরে যে উদ্যোগ করিয়াছিলেন তাহাতেই তাঁহার জঘনস্থলী নিস্পন্দ, বাহুলতা শিথিল, বক্ষ কম্পিত এবং নেত্র নির্মীলিত হইয়াছিল, রমণী কি কখনো পুরুষোচিত কার্য্য সাধন করিতে পারেন?৩৮
পুরুষের ভূমিকাগ্রহণকারী বিপরীতরতি সম্পাদনে রাধা কৃতকার্য না হলেও তাঁর বিপরীত রতি প্রয়াস, বিলাসকলায় তাঁর কর্তৃত্বের সূচক, কারণ এক্ষত্রে নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সমাজনির্দিষ্ট অবস্থানে পরিবর্তন ঘটছে আপতিকভাবে ৷ আর, বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ কৃষ্ণ রাধাকে প্রণয়নিবেদন করলে রাধা প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ৷ অবশেষে কৌশলে, ‘নৌকাখণ্ড’-এ কৃষ্ণের সক্রিয় কামক্রীড়ায় নিষ্ক্রিয় রাধা জানতে পারেন সুরত সুখের তাৎপর্য :
দৃঢ় ভুজযুগে ধরি কৈল আলিঙ্গনে ৷
রাধার বদনে কাহ্নাঞ্চিঁ কইল চুম্বনে ৷ ৷
কুচ কনককমলকোরক আকার ৷
ঘন ঘন মরদিল কাহ্নাএিঁ রাধার ৷ ৷…
রাধার মনত তবেঁ জাগিল মদন ৷
উরস্থলে কৈল রাধা দৃঢ় আলিঙ্গন ৷ ৷
ধীরে ধীরে পরসিয়া রাধার জঘন.
সরূপেঁ সফল কাহ্নাঞি মানিল জীবনে ৷ ৷
রাধার নিতম্বে কাহ্নাঞ্চিঁ দিল ঘন নখে ৷
চমকি করিল রাধা আতি রতি সুখে ৷ ৷৩৯
লক্ষণীয়, এই বর্ণনা পুরোপুরি ভারতীয় রতিশাস্ত্রসমূহে বর্ণিত শৃঙ্গারপ্রকরণের পদ্ধতি-পরম্পরায় রচিত হয়েছে ৷ জয়দেবের কাব্যে রাধা শেষ অব্দি পুরুষসাধ্য কাজ করতে না পারলেও বড়ুর রাধা শেষ অব্দি ‘বাণখণ্ডে’ কৃষ্ণের চেয়েও দ্বিগুণ সক্রিয়তায় পুরুষসাধ্য রতিক্রিয়া করেছে ৷ এবং রাধার এই সক্রিয়তা কৃষ্ণের কাছেও কম উপভোগ্য থাকেনি :
কপট কোপ করী রাধা নাগরী গোহালী ৷
বলে উঠিআঁ উপরে তলে কৈল হরী ৷ ৷
উপরে নাগরী রাধা তলে নন্দোবালা ৷
মেঘত উপরে যেহ্ন শোভে শশিকলা ৷ ৷
যেন রতি পরকার করিল কাহ্নে ৷
রাধাঞঁ করিল এবেঁ তেহেন দুগুণে ৷ ৷…
সুরতসুখে কাহ্ন মুকুলিত নয়নে ৷
তখনে তোষিল রাধা মাধবের মনে ৷ ৷৪০
১৭ শতকে লেখা দৌলত কাজির ‘লোরচন্দ্রাণী’ (১৬৫৯) আদতে সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে প্রচলিত লোরকথার বঙ্গীয় ভাষ্য ৷ এখানেও উপরোক্ত কাব্যদ্বয়ের মতোই নারীপুরুষের রতিমিলনের উন্মুক্ত বর্ণনা লভ্য ৷ যৌনতা এখানে উনিশ শতকীয় উপযোগবাদী, চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ডিসকোর্স থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ৷ চন্দ্রাণীর স্বামী বীর বামন নপুংসক, তাই অচরিতার্থ যৌনবাসনায় বিলাপ করে সন্তপ্ত চন্দ্রাণী ৷ বিবাহের প্রথম নিশিযাপনে : ‘পশু মতো নিদ্রা যায় স্বামী নরাধম ৷ ৷/থাউক কেলি কলারস রভস সুরতি ৷/ভার্যাভাবে উত্তর না দিল দূর্মতি ৷ ৷’৪১ অবশেষে বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পুরুষশ্রেষ্ঠ লোরের সঙ্গে মিলন হয় চন্দ্রাণীর :
দোহো উনমত্ত দোহো রসিক সুজান ৷
কামরসে রতিশাস্ত্রে দোহান বিদ্বান ৷ ৷…
প্রথমে মদন কেলি ঘন আলিঙ্গন ৷
কামতাপে ভয় লজ্জা ধৈর্য পলায়ন ৷ ৷…
পয়োধর গ্রীবা ধরি ঘন বাহু তাড়ি ৷
রতিরঙ্গে দুইজন মল্ল জড়াজড়ি ৷ ৷৪২
আরো পরে, ১৮ শতকে লেখা ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ পুরুষ সুন্দরই নায়িকা বিদ্যার কাছে বিপরীত রতি প্রার্থনা করেছে: ‘রায় বলে আমি করী/তুমি কমলিনীশ্বরী/ বান্ধহ মৃণালভুজ পাশে ৷/ আমি চাঁদ পড়ি ভূমি/ফুল্ল কুমুদিনী তুমি/ উঠ মোর হৃদয় আকাশে ৷ ৷/.. দিয়াছি যে আলিঙ্গন/ করিয়াছি যে চুম্বন/ যে সব ফিরিয়া মোরে দেহ ৷’ এবং এই প্রস্তাবে প্রাথমিক অসম্মতি জানিয়েও অবশেষে ‘মাতিল বিদ্যা বিপরীতরঙ্গে’৪৩ উপরোক্ত সবকটি উদাহরণই এভাবেই এক সুদীর্ঘ ধারাবাহিক ভারতবর্ষীয় কামসংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছে ৷
জয়দেব ও বড়ুর কাব্যে রাধাকৃষ্ণের মিলন কেবল নারীপুরুষের শরীরী অবস্থান বদলেই আটকে থাকছে না ৷ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের ‘রাধাবিরহ’ অংশে এক চুম্বনের মুহূর্তে : ‘যুড়ী রসনে রসনে ৷ / কৈল মুখমধু পানে ৷ / রাধা না জানিল আপন পর তখনে’ ৷ ৷৪৪ এক উত্তীর্ণ প্রণয়মুহূর্তে নারীপুরুষের শরীরী লিঙ্গপরিচয় ও লিঙ্গচেতনার নির্দিষ্ট সীমা এখানে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে ৷ এই আত্ম/অপর-এর চিহ্ন অতিক্রমকারী ‘বাসনা’ই চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব দর্শনে প্রকাশিত ৷ কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ পুরুষকৃষ্ণের তিনটি ‘বাসনা’র কথা বলা হয়েছে ৷ এই শ্লোকটিতে (শ্রীরাধায়াঃ দ্রণয়মহিমা কীদৃশো বানয়ৈবা…) বলা হয়েছে পুরুষকৃষ্ণ রাধারূপ ধারণ করতে চান ৷ কারণ শ্রীরাধার প্রণয়মহিমা কেমন, রাধা কৃষ্ণের যে মাধুর্য আস্বাদন করেন সেই মাধুর্যের স্বরূপ কী এবং সেই রূপ আস্বাদনের সুখ কেমন তা জানতে হলে পুরুষ শরীরের সীমা অতিক্রম করতে হবে ৷ এই রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত কৃষ্ণের লিঙ্গ-পরিচয় ধূসর ৷ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ অনুযায়ী চৈতন্যই রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত কৃষ্ণ ৷ চৈতন্য যে পুরুষ/নারীর যুগ্মসত্তা তা বোঝা যায় ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ রায় রামানন্দের সঙ্গে চৈতন্যের কথোপকথনে ‘দোহার বিলাস মহত্ব’ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ৷ এই ‘প্রেমবিলাসবিবর্তদশা’ ‘বুদ্ধিগতি’-র দ্বারা বোধগম্য নয়—‘না সো রমণ না হাম রমণী/দুহুঁ মন মনোভাব পেশল জানি ৷’৪৫ কবিকর্ণপুর রচিত ‘গৌরগণোদ্দেশদীপিকা’য় কৃষ্ণাবতারে বৃন্দাবনের চরিত্র এবং চৈতন্যাবতারে কলিযুগের চরিত্র হিসেবে তাঁদের জন্মগ্রহণের এক বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যায় ৷৪৬ সেখানে দেখা যায়, বৃন্দাবনের শ্রীরাধা ও তাঁর শ্রেষ্ঠ সখীবৃন্দ বিশাখা, বীরাদূতী, মধুমতী, রূপমঞ্জরী ও রতিমঞ্জরী হলেন যথাক্রমে : গদাধর পণ্ডিত, স্বরূপ গোস্বামী, শিবানন্দ সেন, নরহরি সরকার, রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী ৷ এপ্রসঙ্গেই জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর নদীয়াখণ্ডে চৈতন্যের ঘোষণা অনুধাবনযোগ্য :
সমুদ্রমথনে জেন লক্ষ্মীর উদয় ৷
গৌরাঙ্গের কেবল গদাধর প্রেমময় ৷ ৷
শ্রীরামের সীমা জেন কৃষ্ণের রুক্মিণী ৷
গৌরাঙ্গের গদাধর জানিহ আপনি ৷ ৷
আমার অঙ্গসেবায় গদাধরের অভিলাষ ৷
গদাধরের অঙ্গে মোর সতত বিলাস ৷ ৷…
গদাধর দেহে মোর সতত বেহার ৷৪৭
অর্থাৎ প্রাক ঔপনিবেশিক বৈষ্ণব সাধনায় তাত্বিকভাবে এবং হয়ত প্রায়োগিকভাবেও নারী/পুরুষ শরীরী সীমা অতিক্রমকারী পরিসর বর্তমান ছিল আমাদের সমাজে ৷ কিন্তু ঔপনিবেশিক বাংলায় একদিকে ইউরোপীয় জ্ঞান-যুক্তি-আলোকায়নের প্রভাবে ও আরও পরে, অন্ত্য-উনিশ শতকে ‘জাতীয়তাবাদী আধিপত্যমূলক বাচন’ ‘পৌরুষ’/‘নারীত্ব’- সংক্রান্ত এক স্পষ্ট বিভাজনমূলক সীমারেখাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এক নতুন ক্ষমতা/আধিপত্যের চাপে আমাদের জনসমাজে প্রচলিত এই নিজস্ব প্রয়োগিক অভ্যাসগুলি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয় অথবা চোখের আড়ালে সরে যায় ৷ ১৯ শতকীয় শিক্ষিত এলিটের চোখে এই সবকটি ধর্মীয়/সামাজিক ‘সাধনা’ই ছিল ‘আধুনিকতা’র পরিপন্থী, ‘অপর’-এর সমতুল্য ৷
ই.
প্রাক-ঔপনিবেশিক দেহবাদী সাধনার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছিল শরীর-সম্পর্কিত জ্ঞানতত্ব ৷ বিভিন্ন প্রধান-অপ্রধান ধর্মীয় ভাবধারায় দেহকাঠামোকেই সাধনার ‘আধার’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং ‘সত্য’কে খোঁজা হয়েছে দেহের ভিতরেই ৷ মান্য প্রতিষ্ঠিত ধর্মাচরণ ব্যতীত অপ্রধান ধর্মীয় সাধনাগুলির ভিতরেও বাহ্যিক ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলিকে ভিতরের দিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে বারবার ৷ এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে ‘উল্টাসাধন’ বা ‘উজানসাধন’ ৷ ‘কঠোপনিষদ’-এ এর নাম ‘প্রত্যগাত্মন’, ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদ-এ ‘উদযান’ ৷ সাধারণ জৈবিক প্রবাহ থেকে প্রত্যাবর্তনই ‘উল্টোসাধনে’র প্রধান কথা ৷৪৮ ‘কঠোপনিষদে’ এই ইন্দ্রিয়সমূহকে ‘উল্টোপথে চালনা’র মাধ্যমে সত্যোপলব্ধির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে সমগ্র সংসারই আসলে একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের মতো উল্টো হয়ে নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হচ্ছে (ঊর্ধ্বমুলোহবাকশাখ এষোহশ্বথঃ সনাতনঃ, কঠ ২/৩/১) গায়ত্রীমন্ত্রের ভিতরেও ‘ব্যাহৃতি’ শব্দটির মধ্য দিয়ে সমগ্র দেহমনকে অন্তর্মুখে আহরণ করে একটু একটু করে পরম সত্যস্বরূপের সঙ্গে মিলিত হবার ভাবনা প্রকাশিত ৷ ‘শ্রীমদভাগবদগীতা’য় বলা হয়েছে জোর করে ইন্দ্রিয়সমূহকে নির্যাতিত করে নিজেকে নিরাহার করে রাখলেই সত্যলাভ হয় না, বরং বহির্মুখ ইন্দ্রিয়গুলিকে অন্তর্মুখ করে তোলার সময়, জলরাশি যেমন পরিপূর্ণ অতল-গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করে, সেভাবেই সকল কামনাসমূহ যার ভিতরে প্রবেশপূর্বক একেবারে বিলীন হয়ে যায়, তিনিই শান্তি লাভ করেন, কামকামী ব্যক্তি কখনও শান্তি লাভ করেন না ৷৪৯ অন্তরের ভিতর অফুরন্ত রসের স্রোত আবিষ্কার করতে পারলেই যোগীপুরুষ ব্রহ্মস্বরূপত্ব লাভ করেন ৷ তমোগুণসম্পন্ন অবিবেকী ব্যক্তি উলুকের মতো দিবসান্ধ, উল্টোদিকে জ্ঞানী ব্যক্তি দিনের আলোকেই অবিদ্যারাত্রির গভীর অন্ধকার হিসেবে চিনতে পারেন ৷৫০
এই দার্শনিক তত্বই দেহসাধনার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে ভারতীয় তন্ত্রে ৷ তন্ত্র হলো ‘সত্য’কে উপলব্ধি করার উপযোগী কার্যকর পন্থা ৷ মানবদেহই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিমূর্তি, তাই সাধককে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে ফিরে আসতে হবে দেহভাণ্ডে ৷ তান্ত্রিকমতে দেহের ভিতরকার মেরুদণ্ডটিই মেরুপর্বতের মতো দেহব্রহ্মাণ্ডের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ এর সর্বনিম্নে অবস্থিত মূলাধারচক্রই দক্ষিণমেরু এবং সর্বোর্ধ্ব ‘সহস্রার’-ই উত্তরমেরু হিসেবে কল্পিত ৷ দেহের ভিতর শক্তির অবস্থান এই মূলাধারে, সার্ধত্রিবলিত কুণ্ডলীর ভিতরে তিনি কুল-কুণ্ডলিনী শক্তিরূপে নিদ্রিতা ৷ সহস্রারের নীচেই রয়েছে প্রসিদ্ধ ‘ষটচক্র’ (স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা প্রভৃতি) মূলাধার থেকে নাভিদেশে অবস্থিত ‘মণিপুর’ পর্যন্তই শক্তির রাজ্য—প্রবৃত্তির রাজ্য—এর উপরেই নিবৃত্তির পথ ৷ জাগ্রত শক্তিকে যৌগিক সাধনবলে মূলাধার থেকে ক্রমে ক্রমে ঊর্ধ্বে তুলতে হয় ৷ শক্তির ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর চক্রে গমনের ফলে সাধকের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর তত্বসমূহের উপলব্ধি হতে থাকে ৷ এভাবেই নিম্নস্থ শক্তিকে উল্টোমুখে ঊর্ধ্বগামিনী করে ঊর্ধ্বস্থ শিবের সঙ্গে মিলিত করাই তান্ত্রিক উল্টোসাধনের মূলতত্ব ৷ তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে এই উল্টো সাধনার পারিভাষিক নাম ‘পরাবৃত্তি’ ৷ ‘পরাবৃত্তি’ শব্দের অর্থ হল : মনের বৃত্তিসমূহকে উল্টোদিকে ফিরিয়ে দেওয়া ৷ ‘বৃত্তি’ শব্দের অর্থ চক্রাকারে অগ্রগমন, ‘আবৃত্তি’ শব্দের অর্থ সামগ্রিক পরিবর্তন বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ৷ ‘পরা’—এই উপসর্গের অর্থ এখানে উল্টো অভিমুখ ৷ যৌন-যৌগিক তন্ত্রসাধনায় এই শব্দটির গুরুত্ব অপরিসীম ৷৫১
তান্ত্রিক সাধনায় সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এর প্রয়োগিক দিকটি ৷ তন্ত্রমতে প্রত্যেক নর-নারীর ভিতরেই শিবতত্ব এবং শক্তিতত্ব নিহিত থাকলেও পুরুষের ভিতর শিবতত্বের প্রকাশাধিক্যে এবং নারীর ভিতর শক্তিতত্বের প্রকাশাধিক্যে পুরুষ শিববিগ্রহ এবং নারী শক্তিবিগ্রহ ৷ অদ্বয় সত্যের দুইরূপ এইভাবে ব্যবহারিক জগতে পুরুষ ও নারীর ভিতর প্রকাশ লাভ করেছে ৷ তান্ত্রিক সাধক তাই সাধিকা হিসেবে নারীসঙ্গিনী ব্যবহার করেন ৷ হঠযোগের সাহায্যে ক্ষরণমুখী জৈবিক ধারাকে উল্টো অভিমুখে প্রবাহিত করার ফলে এখানে শারীরিক সুখভোগই মোক্ষের দরজা খুলে দেয় ৷ তন্ত্রে বলা হয়েছে যেসকল পদার্থ সাধারণত মানুষের অধঃপতন নিশ্চিত করে, তন্ত্রে তারাই স্থানবিশেষ মুক্তি প্রদান করে (যৈরেব পতনং দ্রব্যৈরর্মুক্তিস্তৈরেব সাধনৈঃ) এবং তন্ত্রের এই পথের রহস্য যোগীদেরও অগম্য (কৌলোমার্গঃ পরমগহনো যোগিনামপ্যগম্যঃ) ৷ ভাগবতপুরাণেও বলা হয়েছে পঞ্চ ‘ম’কার ব্যবহারের প্রবৃত্তি মানুষের ভিতর স্বতই বিদ্যমান, তাই ধর্মলাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিতভাবে এই দ্রব্যাদি ব্যবহারের বিধান মানুষের উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে নিয়মিত করার জন্যই (ভাগবতপুরাণ—১১/৫/১১)৫২ ৷
তন্ত্রের মূল সাধনকাঠামোই অনুসৃত হয়েছে বৌদ্ধসহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথ ধর্ম ও বাউলসাধনার ভিতর ৷ সহজযানী বৌদ্ধ ধর্মেও সিদ্ধাচার্যরা দেহকেই সাধনার মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৷ জন্মমরণশীল স্থল দেহটিকে তাঁরা বলেছেন ‘নির্মাণকায়’ ৷ উল্টোসাধনের মধ্য দিয়ে আরও তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয়—সম্ভোগকায়, ধর্মকায় ও সহজকায় ৷ ‘সহজ’ বলতে বোঝায় ‘স’ এবং ‘হ’-এর মিলনজাত ফল ৷ ‘স’ অর্থে স্ত্রীতত্ব ‘প্রজ্ঞা’/‘শূন্যতা’ এবং ‘হ’ অর্থে পুংতত্ব ‘উপায়’/‘করুণা’ ৷ ‘সহজ’ মহাসুখ এই স্ত্রী-পুরুষ তত্বের যোগফল ৷ উল্টোসাধনার ক্রম অনুসারে সাধককে শূন্যতা’র চারটি স্তর অতিক্রম করতে হয়—শূন্য, অতিশূন্য, মহাশূন্য, সর্বশূন্য ৷ প্রথম স্তরে তেত্রিশটি, দ্বিতীয় স্তরে চল্লিশটি, তৃতীয় স্তরে সাতটি প্রকৃতিদোষ থাকে ৷ সর্বশূন্যে কোনো প্রকৃতিদোষ থাকে না—এটিই প্রভাস্বরশূন্যতা ৷ সহজযানী বৌদ্ধদের কায়সাধনার বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায় চর্যাপদের গানগুলিতে ৷৫৩ কাহ্নপাদ একটি গানে বলেছেন যোগী অদ্বয়ভাবে দেহনগরীর ভিতরেই বিহার করছেন (চর্যা নং ১১) ৷ দেহের ভিতর বোধিচিত্তবহা নাড়ীগুলির ভিতর তিনটি প্রধান—মেরুদণ্ডের বামে, দক্ষিণে, মধ্যভাগে যথাক্রমে ললনা, রসনা এবং অবধূতী ৷ এই ললনা/রসনা অর্থাৎ তন্ত্রের ইড়া/পিঙ্গলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রাণ/অপান বায়ুকে সুষুম্না বা অবধূতিকার পথে পরিচালিত করতে পারলেই সহজসুখলাভ করা যায় ৷ প্রজ্ঞোপায়যোগের মূল সূত্র ও সাধনক্রমের সংকেত এই মহাকাব্য—‘এবং ময়া শ্রুতম’ ৷ এর বাহ্য অর্থ ‘আমার দ্বারা এইরূপ শ্রুত হয়েছে ৷’ কিন্তু এর গূঢ়ার্থ ভিন্ন : ‘এ’= ভগ বা পদ্ম, প্রজ্ঞা বা শূন্যতা, ‘বং’ = কুলিশ বা বক্র, করুণা বা উপায়, ‘ময়া’= চালন বা এতদুভয়ের যোগ ৷ আর ‘শ্রুতম’ শব্দের অর্থ দ্বিবিধ উৎপত্তিক্রম এবং উৎপন্নক্রম অর্থাৎ সংসারগতি ও সহজগতি ৷ ‘উৎপত্তিক্রমে’ বোধিচিত্ত উষ্ণীষ কমল থেকে ক্ষরিত হয়ে নির্মাণকায়ে নেমে এসে পার্থিব ‘অহং’-এ পরিণত হয় ও প্রকৃতিদোষের অধীন হয় ৷ সাধকের কাজ উল্টোসাধনের মাধ্যমে এই সংবৃত্তি চিত্তকে পুনরায় পরাবৃত্ত গতিতে বোধিচিত্তে পরিণত করা ৷ ‘নাথপন্থী’দের দেহসাধনাও প্রায় একইরকম, যোগবলে দেহকে ‘পক্ব’ দেহে পরিণত করা, অর্থাৎ মরণশীল ‘দেহ’কে ‘শিবতনু’ বা ‘বৈন্দবতনু’-তে পরিণত করা ৷ দেহের ভিতরে ঊর্ধ্বে তালুমুলে অবস্থিত ‘চন্দ্র’ থেকে একটি ‘বঙ্ক নালে’ অমৃতধারা নীচে ক্ষরিত হচ্ছে আর নাভিদেশে অবস্থিত দহনাত্মক ‘সূর্য’ সেই অমৃত গ্রাস করছে ৷ এই ‘বঙ্ক নালী’র মুখই ‘দশমী দ্বার’ ৷ সেই ‘দশমী দ্বার’ রুদ্ধ করে চন্দ্রের অমৃতধারাকে রক্ষা করা ও অমৃত পান করাই যোগীর উদ্দেশ্য ৷ এই ‘অমৃত’ই নাথসিদ্ধদের বহুকথিত ‘মহারস’ ৷৫৪
বৈষ্ণব সহজিয়া তত্বে নর-নারীর শরীর এবং দেহমিলনের মধ্য দিয়ে পরমার্থ লাভের ধারণাটি অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট ৷ অন্যান্য তান্ত্রিক সাধনার মতোই বৈষ্ণব সহজিয়া তত্বেও বলা হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সকল তত্ব নিহিত রয়েছে দেহভাণ্ডের ভিতর—‘বস্তু আছে দেহ বর্তমানে’ ৷ এই ‘বস্তু’ হলো ‘রসবস্তু’, যার স্থ²ল রূপ ‘কাম’ এবং সূক্ষ্ম রূপ ‘প্রেম’, যা ‘সহজ স্বরূপ’ ৷ এঁদের মতে ‘কাম’ এবং ‘প্রেম’, স্বরূপ-বিলক্ষণ নয় ৷ ‘কাম’ প্রেমেরই প্রাকৃত রূপ মাত্র ৷ এই প্রাকৃতকে অবলম্বন করেই অপ্রাকৃত সহজ প্রেমের দেশ ‘নিত্য বৃন্দাবন’-এ পৌঁছতে হবে ৷ আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে এই দুই জগৎ পৃথক হলেও দুই-এর ভিতর সাধন সেতু আবিষ্কার করা সম্ভব ৷ ‘রত্নসার’-এ বলা হয়েছে : ‘সেই ত উজ্জ্বল রহে রসে ঢাকা অঙ্গ ৷/কাম হৈতে জর্ম প্রেম নহে কাম সঙ্গ ৷ ৷/লৌহকে করয়ে সোনা লৌহ পরসিয়া/তৈছে কাম হৈতে প্রেম দেখ বিচারিয়া’ ৷ ‘লৌকিক পীরিতি’ই অপ্রাকৃত প্রেম বা ‘সহজ’ রূপ ধারণ করে ৷ অদ্বয়-স্বরূপ ‘সহজ’ নিজেকে দ্বিধা-বিভক্ত করে ‘আস্বাদ্য’ ও ‘আস্বাদক’ রূপে ৷ এই ‘আস্বাদ্য’ ও ‘আস্বাদক’ই সহজিয়াদের ‘রতি’ ও ‘রস’ ৷ রাধাই ‘রতি’—‘সহজ’-এর নিত্য আস্বাদ্য রূপ, ‘কৃষ্ণ’ই রস—নিত্য আস্বাদক ৷ এই অপ্রাকৃত যুগলরূপ তার প্রাকৃতলীলা প্রকাশ করছেন বিশ্বের সকল নর-নারীর ভিতর দিয়ে ৷ প্রত্যেক নারীই ‘রাধিকা’, প্রত্যেক পুরুষই ‘কৃষ্ণ’ ৷ এভাবে ‘রূপে’র ভিতর দিয়ে ‘স্বরূপ সাধন’-কেই সহজিয়ারা বলেন ‘আরোপ সাধন’ :
প্রকৃত অপ্রাকৃত আর মহা অপ্রাকৃত ৷
বিহার করিছ তুমি নিজ স্বেচ্ছামত ৷ ৷
স্বয়ং কাম নিত্য বস্তু রস-রতিময় ৷
প্রাকৃত-অপ্রাকৃত আদি তুমি মহাত্রয় ৷ ৷
এক বস্তু পুরুষ প্রকৃতি রূপ হইয়া ৷
বিলাসহ বহুরূপ ধরি দুই কায়া ৷ ৷৫৫
বৈষ্ণব সহজিয়া সাধক শক্তিসাধনার উদ্দেশ্যে সাধনার সহজিয়ারূপ সাধিকা গ্রহণ করেন ৷ কারণ, নারীর মধ্যে শৃঙ্গার ভাবোদ্দীপক অগ্নিকুণ্ড রয়েছে ৷ সাধিকার সংস্পর্শে এসে তন্ত্রসাধক অন্তরঙ্গ ভাবশৃঙ্গারের দ্বারা অটল বীর্যকে তরলায়িত করে পিঙ্গলা পথে নীচে প্রবাহিত করেন এবং সাধন প্রক্রিয়ার দ্বারা তার অধোগতি রুদ্ধ করে ঈড়া পথে ঊর্ধ্বগতি সাধন করেন ৷ পিঙ্গলা ও ঈড়াপথে এভাবে বারবার বিন্দুর আবর্তন ঘটার ফলে পিঙ্গলা ও ঈড়ার মুখদ্বয় যুক্ত হয়ে যায় ৷ তখন আর বিন্দুপতনের সম্ভাবনা থাকে না ৷ এভাবেই ক্রমান্বয়ে সুষুম্নাপথে ঊর্ধ্বগামী শক্তি ষটচক্র ভেদে সমর্থ হয় ৷৫৬
কিন্তু সহজিয়া বৈষ্ণবরা কেন ‘কাম’ থেকে ‘প্রেম’-এ উত্তীর্ণ হতে চেয়েছেন? সহজিয়া বৈষ্ণব তত্বে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ৷ সহজিয়াদের মতে, কলিযুগে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষই কামরিপুর বশ—‘প্রকৃতি পুরুষ কলিকালে হবে কামী ৷ ৷/কাম লোভ দুই রিপু হইবে প্রবল ৷/এই দুই রিপু ধর্ম নাশিবে সকল ৷ ৷’ [রসসার] শরীরের ভিতর যে ‘কাম’রূপী কালসর্প রয়েছে, তা চরিত্রগতভাবেই দেহসর্বস্ব, আত্মসুখপ্রবণ :
শরীর ভিতরে জান আছে কালসর্প ৷ ৷
সেই সর্পে দিবানিশি করিছে দংশন ৷…
কাম নিবারিতে নারে জীব নরাধম ৷ ৷ [অমৃতরত্নাবলী]
তাই সাধককে প্রথমেই সচেতন হতে হয় ‘কাম’ এবং ‘প্রেম’-এর পার্থক্য বিষয়ে ৷ এদের পার্থক্য কেবল রূপগত, স্বরূপগত নয়—‘প্রেম-অমৃত কাম রহে এক ঠাঁই ৷/মিলন একত্রে সে স্বরূপ ভিন্ন নাই ৷ ৷’ (বিবর্তবিলাস) ৷ জ্ঞানমার্গীয় শাস্ত্রে ‘কাম’-কে বশীভূত করার জন্য জ্ঞান এবং কৃচ্ছ্রসাধনের উপর জোর দেওয়া হলেও, সহজিয়া বৈষ্ণবেরা ‘কাম’কে ধ্বংস করার কথা বলেননি, তাঁরা রক্তমাংসের সাধনসঙ্গিনী গ্রহণ করে কামসাধনার মধ্য দিয়েই, ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’ ‘কাম’ থেকে ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’ ‘প্রেম’-এ উপনীত হতে চেয়েছেন ৷ কারণ ‘কাম’-এর পরিতৃপ্তি না এলে ‘প্রেম’ জন্মায় না :
যখন সাধিয়া কাম পূর্ণ হয় মনে ৷
তবে ত স্বরূপ কামবস্তুতত্ব জানে ৷ ৷ [রসকদম্বকলিকা]
কঠোর নিয়মমাফিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নরনারী সম্ভোগের দ্বারাই ‘প্রেম’-এ উত্তীর্ণ হওয়া যায় ৷ সহজিয়া তত্বে তাই বলা হয়েছে :
প্রথম সাধন রতি সম্ভোগ শৃঙ্গার ৷
সাধিবে সম্বোগ রতি পালাবে বিকার ৷ ৷
জীবরতি দূরে যাবে করিলে সাধন ৷
তারপর প্রেমরতি করি নিবেদন ৷ ৷ [অমৃতরত্নাবলী]
তাই সহজিয়া বৈষ্ণবের মতে রমণীসান্নিধ্য না করলে, বাস্তব সম্ভোগের অভিজ্ঞতা বিনা প্রকৃত ‘রসিক’ হওয়া যায় না ৷ এবং এই বস্তুগত দেহতত্বের মধ্য দিয়েই সহজিয়া বৈষ্ণবরা প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজ থেকে শুরু করে উনিশ শতকীয় সমাজেও যৌনস্খলনের কারণে সমাজচ্যুত, প্রান্তবাসী মানুষজনের কাছে এক উদার তাত্বিক আশ্রয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল ৷ সহজিয়া বৈষ্ণবেরা ‘স্বকীয়া’ রতির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন ‘পরকীয়া’ রতির সাধনাকে ৷ একজন সাম্প্রতিক গবেষকের ভাষায় : ‘The utility of the Parakiya… is thus interpreted as having happened at least for the welfare of those who are fallen in the eye of religion. This is a very sympathetic treatment of human weakness. Indian thought has not considered this attitude morally reprehensible if it is for the good of the weak and the fallen who cannot be reclaimed by urging them to follow too high an ideal much above their capacity.’৫৭ তবে, সামগ্রিকভাবেই, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মতত্বে এমন একটি সুস্পষ্ট মাত্রা আছে যাতে যৌনতা সুপরিস্ফুট ৷ বৃন্দাবনের গোস্বামীরা যে ধর্মতত্ব প্রচার করেন তাতে রাধা এবং গোপীদের পরকীয়া প্রেমকেই আদর্শায়িত করা হয়েছে ৷ কিন্তু এই দার্শনিক পরকীয়া ভাবনা বৈষ্ণবসাধনার ভিতরেও প্রভাব ফেলেছে ৷ শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার যে ‘গৌরনাগরবাদ’ প্রচার করেন, তাতে বলা হয়েছে গৌরাঙ্গের প্রেমে নবদ্বীপের মহিলারা উন্মাদিনী হয়েছিলেন ৷ গৌরাঙ্গ কখনো অনাত্মীয় মহিলাদের দিকে তাকাতেন না, কিন্তু তাঁরা তাঁকে দেখলেই পাগলের মতো হয়ে যেতেন ৷ নরহরির শিষ্য লোচনদাস তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার মিলন বর্ণনা করেছেন: ইহা বলি গৌরহরি/আশ্লেষ চুম্বন করি/নানা রস কৌতুক বিহারে ৷/অনন্ত বিনোদ প্রেমা / লীলা লাবণ্যের সীমা / বিষ্ণুপ্রিয়া তুষিল প্রকারে ৷ ৷’৫৮ এভাবেই প্রাক-ঔপনিবেশিক বৈষ্ণব সাধনায় শরীর/যৌনতার নিরিখে সাধ্যবস্তু লাভের তত্ব প্রচারিত হয়েছিল ৷
ঈ.
প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত/মান্য যৌনপরিচয়ের বাইরে শরীর/যৌনসত্তার‘অপর’ হিসেবে পরিগণিত ব্যক্তিকে কীভাবে গ্রহণ করা হত, সে সম্পর্কে আলোচনার আগে যৌনপরিচয় এবং লিঙ্গপরিচয়-জনিত তাত্বিক পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন ৷ সাম্প্রতিক গবেষণায় এই যৌনতা/লিঙ্গপার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ৷ এই পার্থক্য গড়ে উঠেছে শারীরিক/সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সাপেক্ষে, যেখানে ‘শারীরিক’ পরিচয়টি ‘প্রাকৃতিক’ এবং ‘সাংস্কৃতিক’ পরিচয়টি ‘সামাজিক’ ক্ষমতাকাঠামোর দ্বারা নির্মিত ৷ একজন ব্যক্তির যৌনপরিচয় (‘স্ত্রী’ বা ‘পুরুষ’) জন্মগত, কিন্তু তার ভিতর ‘পৌরুষ’/‘নারীত্ব’-সংক্রান্ত ভাবধারা গড়ে ওঠে সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৷ একারণেই ‘নারীত্বে’র গুণসম্পন্ন পুরুষ এবং ‘পুরুষে’র গুণসম্পন্ন নারীর অস্তিত্ব সম্ভব হলেও এধরনের তথাকথিত বিপরীত গুণের সহাবস্থানকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত এবং ‘অপরায়িত’ করা হয় ৷ অর্থাৎ যৌনপরিচয় জনিত পরিকাঠামোর উপর লিঙ্গপরিচয়জনিত উপরিকাঠামোটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ৷ কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে এই যৌনতা/লিঙ্গ-এর দ্বিত্ব ধারণাটিও আজ সমস্যায়িত হয়েছে ৷ ফুকো যখন বলেন ‘sex is the anchorage point that supports the manifestations of sexuality’ (History of sexuality, vol-1, p. 152, তখন একথাই প্রমাণিত হয় যে, বিভিন্ন ‘আধুনিক’ বৈজ্ঞানিক / অ-বৈজ্ঞানিক ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের আওতামুক্ত কোনো ‘প্রাথমিক’ (prior) ‘যৌনতা’র ধারণাও থাকতে পারে না ৷ অর্থাৎ যৌনপরিচয়ও ব্যক্তির লিঙ্গপরিচয়-এর মতোই একটি সামাজিক নির্মাণ, কারণ ‘ব্যক্তি’র শারীরিক লক্ষণ ও বহিঃপ্রকাশসমূহও সামাজিক অস্তিত্বের লক্ষণসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় ৷ ‘আধুনিকতা’র নিজস্ব প্রক্রিয়াসমূহের মধ্য দিয়ে আজ ব্যক্তির যৌনলক্ষণ-সংক্রান্ত পার্থক্যের একমাত্রিক ধারণাই প্রাধান্যমূলক হয়ে উঠেছে সর্বত্র, কিন্তু সেটিই ব্যক্তির একমাত্র যৌনলক্ষণ হতে পারে না ৷ সম্প্রতি জুডিথ বাটলার দেখিয়েছেন, যৌনপরিচয়/লিঙ্গপরিচয়ের পার্থক্যের ধারণাটি তার যৌক্তিক সম্ভাব্যতার সীমানা অবধি প্রসারিত করলে পাওয়া যাবে : ‘a radical discontinuity between sexed bodies and culturally constructed genders. ৷ (দ্রঃ Gender Trouble : Faminism and the Subversion of Identity, 1990, p.6) ৷ বাটলারের মতে যৌনপরিচিত নির্মাণে ধারণাটিও রীতিমত ‘লিঙ্গাত্মক’ ৷ যেভাবে দীর্ঘকালব্যাপী সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিসমূহের ধারণাবলী ‘লিঙ্গপরিচয়’ নির্মাণ করে, তেমনভাবেই ‘যৌনপরিচিতি’ও নির্মিত হয় সুদীর্ঘ সামাজিক অভ্যাসের ‘স্বাভাবিকীকরণে’র মধ্য দিয়ে ৷ বাটলার তাই ‘বোধগম্য লিঙ্গপরিচয়ে’র ধারণাটি ব্যবহার করেছেন, যে ধারণা ‘culturally instituted relations of coherence and continuity between sex, gender, desire and sexual practice’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত ৷ আমাদের প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজেও মান্য/প্রতিষ্ঠিত, যৌন/লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে অন্য ধরনের পরিচিত নির্মাণের নিজস্ব প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল ছিল ৷
নারী/পুরুষ—এই প্রতিষ্ঠিত যৌন/লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে কীভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ সংক্রান্ত ধারণাটিকে বোঝা যায়, সে সম্পর্কে গবেষকরা একমত নন ৷ প্রথমত, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলতে সেই ব্যক্তিকেই বোঝায়, যে প্রতিষ্ঠিত নারী/পুরুষ যুগ্ম বৈপরীত্যের কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি ৷ দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে ‘লিঙ্গ নির্মাণে’র সামাজিক প্রক্রিয়াটিকেই এক সার্বিক প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন করা যেতে পারে ৷ এই দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের প্রক্রিয়া কীভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’কে নির্ধারণ করে, উল্টোদিকে, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিগণ কীভাবে সমাজের চোখে নিজেদের উপস্থাপিত করে ৷ ভারতবর্ষে, প্রাচীনকাল থেকেই তিনটি পৃথক লিঙ্গপরিচিতির মান্য কাঠামো প্রচলিত ছিল ৷ আধুনিক যুগে পৌঁছেও ‘হিজড়ে’ সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়ে আমরা সেই ত্রিমাত্রিক কাঠামোকেই বাঁচিয়ে রেখেছি ৷ মূলত তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি এই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-সংক্রান্ত ভাবনা গড়ে ওঠার পিছনে কাজ করেছিল :
ক. কোনো এক উভলিঙ্গ পূর্বপুরুষের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া তৃতীয় লিঙ্গ-বিশিষ্ট শরীরের ‘মিথ’ ৷
খ. উত্তর-বৈদিক যুগে পৌঁছে পৌরুষের শক্তি/যৌনক্ষমতা লোপ-সংক্রান্ত ভীতির সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের সম্পর্ক ৷
গ. ‘নপুংসক’ বা ‘ক্লীবলিঙ্গ’-সংক্রান্ত ব্যাকরণভিত্তিক নির্মাণ ৷৫৯
‘ঋগ্বেদ’ অনুসারে সৃষ্টির আগে, এই ব্রহ্মান্ডের চরিত্র ছিল উভলিঙ্গ ৷ তাই বারবার গর্ভাশয়বিশিষ্ট পুরুষ, একই শরীরের ভিতর গাভী এবং ষাঁড়-এর অবস্থান,—প্রভৃতি রূপকল্প ব্যবহৃত হয়েছে ৷ পরবর্তী ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘সংহিতা’ সমূহে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে পুরুষ মাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার গর্ভধারণের শক্তি রয়েছে (পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ-১০/৩/১, শতপথ ব্রাহ্মণ-২/৫/১/৩) ৷ ‘নপুংসক’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় ‘মৈত্রায়নী সংহিতা’য় (২/৫/৫) ৷ এখানে ‘নপুংসক’ শব্দের অর্থ সেই উৎসর্গীকৃত প্রাণী, পৌরুষ/যৌনক্ষমতা/প্রজননশক্তি বৃদ্ধির জন্য যাকে উৎসর্গ করা হয় ৷ এখানে ‘নপুংসক’-কে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে : নারীরূপী পুরুষ এবং পুরুষরূপী নারী ৷ অর্থাৎ ‘নপুংসক’ : না-স্ত্রী/না-পুরুষ—‘নাস্ত্রীপুমান’ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/১২/৬/১) এবং ‘অস্ত্রিপুমান’ (ঐতরেয় আরণ্যক ২/৩/৮/৬) ৷ এ হলো ব্যক্তির দ্বৈত যৌনসত্তা ৷ তবে অথর্ববেদে শব্দটির অর্থ : প্রজননশক্তিহীন পুরুষ, ‘ক্লীব’/‘পাণ্ডক’ নামেও তাদের অভিহিত করা হয়েছে (৬/১৩৮/১) ৷ ‘লিঙ্গকর্তন’ অর্থেও শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে ৷ অথর্ববেদেই ‘ক্লীব’ ব্যক্তিদের লম্বাচুলবিশিষ্ট (কেশবান, কেশিন) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যারা বিবাহ অনুষ্ঠান নৃত্যরত, অশুভ শক্তির অধিকারী ৷ অর্থাৎ ‘ক্লীব’ এখানে কেবল পৌরুষ/প্রজনননশক্তির দীনতাকেই বোঝাচ্ছে না, সামাজিক ভাবেও পুরুষের ভূমিকা থেকে বিচ্যুতিকেই চিহ্নিত করছে, যে কারণে নারীসূলভ লম্বা চুল রাখা, অলংকার পরিধান করা এবং নাচগানে পারদর্শিতাই নপুংসকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে ৷ খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকেই ‘নপুংসক’ কেবল পুংলিঙ্গ/স্ত্রীলিঙ্গের সীমা অতিক্রমকারী ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নয়, বরং একটি পৃথক সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত; যাদের আবার দুটি ভাগ : প্রজননশক্তিহীন (সন্দ) এবং যুগ্ম যৌনসত্তার অধিকারী (পাষণ্ড) ৷
প্রাচীন চিকিৎসশাস্ত্রেও ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নিয়ে আলোচনা পাওয়া যায় ৷ ‘সুশ্রুত সংহিতা’ (৩/৩/৫) অনুযায়ী, পিতামাতার জননরসের (বীর্য ও রক্ত) আনুপাতিক সাম্যই নির্ধারণ করে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর ভ্রুণের জন্ম ৷ এদের মধ্যে পুং-জননরসের আধিক্য পুত্রসন্তান এবং স্ত্রীজননরসের আধিক্য কন্যাসন্তানের জন্ম নিশ্চিত করে ৷ ‘চরকসংহিতায়’ বলা হয়েছে মাতৃগর্ভের বাঁদিকে কন্যাভ্রূণের অবস্থিতি, ডানদিকে পুং-ভ্রূণ, আর ঠিক মধ্যস্থলে অবস্থিত ভ্রূণ থেকে তৃতীয় লিঙ্গ-বিশিষ্ট সন্তানের জন্ম হয় (৪/২/২২/২৭) ৷ জৈন গ্রন্থগুলিতেও এই মধ্যাবস্থিত ভ্রূণ থেকে ‘নপুংসক’ জন্ম নেবার প্রক্রিয়াটি স্বীকৃত (দ্র: ‘তণ্ডুলবিচারিকাসূত্র’ নামক জৈনগ্রন্থ) ৷ তবে ‘নপুংসক’ বা তৃতীয়লিঙ্গের সঙ্গে বিকৃতির ধারণাটিও উল্লিখিত হয়েছে ৷ ‘চরকসংহিতা’য় ‘স্ত্রীপুরুষ-লিঙ্গন’ একধরনের যৌনবিকৃতির দ্যোতক (৪/২/১৭/২১) ৷ ‘সুশ্রুতসংহিতা’য় যে পাঁচ প্রকার যৌন অস্বাভাবিকতার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নিষ্ক্রিয় সমকামী যৌনতার অভ্যাস (কুম্ভক) এবং স্ত্রীলক্ষণযুক্ত পুরুষের যৌন আচরণ (স্ত্রীচেষ্টিকাকারঃ সন্দঃ)—এই দুই আচরণই নপুংসকত্বের অনুসারী (৩/২/৪১/৪৪) ৷ তবে, ভারতীয় সমাজে, সামগ্রিকভাবে, নপুংসকত্ব কোনো অ-স্বাভাবিকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি, প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, কোনো চিকিৎসাশাস্ত্রেই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানের জন্ম রোধ করার উপায় ব্যাখ্যা করা হয়নি ৷ এবং, পূর্বোক্ত ‘চরকসংহিতা’য় যে ‘তৃতীয়াপ্রকৃতি’-র কথা বলা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে জানা যায় পরবর্তী ‘কামসূত্র’ (তৃতীয় শতক) বা ভরতের ‘নাট্যসূত্র’-এ ৷ ৪র্থ-৫ম শতকে লেখা ‘অমরকোষ’ বা ১২ শতকে লেখা বররুচির ‘উভয়াভিসারিকা’ নাটকেও ‘তৃতীয়াপ্রকৃতি’র কথা পাওয়া যায় ৷ ‘কামসূত্রে’ ‘তৃতীয়া প্রকৃতি’র যৌনাচরণের কথা বলা হয়েছে ৷ এরা মূলত ‘মুখমেহন’ অভ্যাস করত ৷ স্ত্রীলক্ষণবিশিষ্টা তৃতীয়াপ্রকৃতি এই যৌনাচারণকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করত, পাশাপাশি পুং তৃতীয়াপ্রকৃতি পুরুষদের ‘ম্যাসাজ’ করত এবং যৌন উদ্দীপনে সাহায্য করত ৷ তবে মুখমেহন এবং পায়ুকাম কেবল ‘তৃতীয়াপ্রকৃতি’-র লক্ষণ ছিল না, পরিশীলিত ‘নাগরিক’গণও এগুলির অনুশীলন করতেন ৷ বৌদ্ধ ধর্মাচরণ ও দর্শনে বিপরীতকামিতার তুলনায় সমকামিতাকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ জৈন সম্প্রদায়ের ভিতরেও ‘নপুংসকে’রা সম্মানের আসন অধিকার করতেন, কারণ তাঁরা ছিলেন যৌন সংযম এবং যৌনক্ষমতা সংরক্ষণের প্রতীক, অন্যান্য সাধুদের মতো তাঁরা যৌনকেচ্ছায় জড়িয়ে পড়তেন না ৷ অর্খাৎ প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে ‘তৃতীয় লিঙ্গে’র ধারণাটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল ৷
উনিশ শতকে ব্রিটিশ প্রশাসন ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোর নিরিখে এবং প্রয়োজনে ভারতবর্ষীয় সমাজে এই তৃতীয় লিঙ্গের ‘হিজড়ে’ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে ৷ এক্ষেত্রে দুটি সমান্তরাল ঔপনিবেশিক বয়ানের জন্ম হয় ৷ প্রথম ক্ষেত্রে, ভারতবর্ষের অসংখ্য ছোটো-বড়ো গোষ্ঠী/উপজাতির মধ্যেই একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে ‘হিজড়ে’-দের চিহ্নিত করেন তাঁরা ৷ দ্বিতীয়ত, এই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়াকলাপ, অভ্যাস ঔপনিবেশিক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি ৷ ‘হিজড়ে’দের সম্পর্কে প্রথম বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত E.J. Kitts-এর লেখা A Compendium of Castes and Tribes found in India বইটিতে ৷ লেখকের মতে, এই জনগোষ্ঠী নিজেরাই সমাজে খানিকটা ‘প্রান্তিকায়িত’ রূপে বসবাস করে এবং এদের পেশা মূলত নাচ গান করা ৷ এদের বেশ কয়েকটি উপবিভাগও পাওয়া যায়, যেমন : ব্রিজবাসী, পেরনা, নায়ক, কলাবন্ত, দাসী—প্রভৃতি ৷ তবে এই সম্প্রদায়ের ভিতর লিঙ্গবিভাজন সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না ৷ ১৮৯১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে William Crooke ‘হিজড়ে’দের ধর্মীয় ভিত্তিতে ‘হিন্দু’ এবং ‘মুসলমান’ সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে পৃথগীকৃত করেন ৷ পাশাপাশি পুরুষ/নারী ‘হিজড়ে’র উল্লেখও পাওয়া যায় তাঁর লেখায় ৷ এমনকী এক বড়ো সংখ্যক নারী ‘হিজড়ে’ অন্নসংস্থানের জন্য পুরুষ হিজড়েদের উপর নির্ভরশীল—এরকম মন্তব্যও করেন তিনি ৷ বেশ কিছু নারী ‘হিজড়ে’ বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে—একথাও বলেছেন তিনি তাঁর রিপোর্টে ৷ এক্ষেত্রে, বোঝাই যায়, ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষ/নারীজাতীয় দ্বিকোটিক লিঙ্গবিভাজনের ছাঁচেই হিজড়ে সম্প্রদায়কে ধরতে চেয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রশাসন ৷ কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই গোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে সূত্রবদ্ধ করতে চায়নি তারা ৷ ব্রিটিশ নৃতাত্বিক ভাবনার নারী/পুরুষ—এই বিপরীত লিঙ্গবিভাজনের প্রাধান্যমূলক ধারণাই ক্রিয়াশীল থেকেছে এক্ষেত্রে ৷৬০ ঔপনিবেশিক লেখালেখি থেকে হিজড়েদের ‘ব্যক্তিগত শরীর’ কীভাবে ‘জনসমাজে বহিঃপ্রকাশ’ ঘটাত সে সম্পর্কেও জানা যায় ৷ ১৭৮০ সালের একটি লেখা থেকে জানা যায় হিজড়েরা বহিরঙ্গে মেয়েলি, অন্তরঙ্গে পুরুষালি সাজপোশাকের মাধ্যমে নিজেদের পেশ করত ৷ মেয়েদের মতোই তারা লম্বা চুল রাখত, গয়না পড়ত ৷ অনেকেই তাদের এই আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পৃথগত্বের কারণে স্বেচ্ছায় ‘হিজড়ে’ সম্প্রদায়ে যোগদান করত ৷ মুসলমান হিজড়েরা নিজেদের মেয়েলি নামে সম্ভাষণ করত—‘বড়ি বেগম’, ‘ছোটি বেগম’ ৷ এমনকী হিজড়ে সম্প্রদায়ের ভিতর আত্মীয়তার সূত্রটিও হত মেয়েলি পদ্ধতিতে, তারা একে অপরকে ‘মামী’ বা ‘ফুফি’ নামে ডাকত ৷ অর্থাৎ শারীরিকভাবে পুরোপুরি ‘নারী’ না হলেও ‘হিজড়ে’রা নিজেদের শারীরিক বহিঃপ্রকাশ ঘটাত নারী হিসেবেই ৷ হিজড়েদের ‘শরীর’কে ‘প্রাকৃতিক’/‘কৃত্রিম’ বিভাজনে ধরতে চেয়ে, তাদের ক্রমাগত ‘না-পুরুষ’, ‘উভলিঙ্গ’, ‘বন্ধ্যা/‘প্রজননশক্তিহীন’, ‘কর্তিত লিঙ্গ’ হিসেবে চিহ্নিত করার পিছনে ব্রিটিশ নৃতাত্বিকদের দ্বারা উদ্ভাবিত যৌন/লিঙ্গ পরিকাঠামোর চেনা ছাঁচটিতে ওই সম্প্রদায়কে ধরতে না পরাকেই চিহ্নিত করেছেন সাম্প্রতিক গবেষক : ‘The appropriation of the feminine cultural symbols by the hijras thus seems to have led to curiousity among the British regarding the status of the hijra body. It is apparent that the colonial anthropologists were unable to fit the hijra community into their notion of ‘intelligible gender’ which was not only binary but also clearly related to a perticular kind of body with specific cultural symbols and practices.’৬১
উল্লেখপঞ্জি
১. দ্র: Essays in self-criticism; Louis Althusser, London, 1976, p. 94-99
২. দ্র::Michel Foucault : Beyond Structuralism and Hermeneutics; H. L. Dreyfus and P. Rabinow, Chicago, 1982, p. 143-167
৩. দ্র: Discipline and Punish: The Birth of the Prison; Michel Foucault; NewYork, 1979, p. 29
৪. এই দুই ‘কেস স্টাডি’র ভিত্তিতে লেখা বই দুটি হলো : I, Pierre Riviere, having slaughtered my mother, my sister, and my borther.. A case of Parricide in the 19th Century, London, 1978 এবং Herculine Barbin : Being the Recently Discovered Memoirs of a Nineteenth Century French Hermaphrodite, New York, 1980; দুটি বই-ই উপরোক্ত দুজনের আত্মকথন, ফুকো তাদের বিস্তৃত আত্মকথা দুটি সম্পাদনা করেন ৷
৫. দ্র: The Use of Pleasure : The History of Sexuality, volume: two Michel Foucault, London, 1986, p. 32
৬. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 49
৭. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 80
৮. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 89
৯. দ্র: The Care of the Self : The History of Sexuality volume Three; London, 1988, p. 67
১০. দ্র: The Use of Pleasure; p. 98
১১. দ্র: The Care of the Self’ p. 140
১২. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 161
১৩. দ্র: পূর্বোক্ত, p.149
১৪. দ্র: Politics, Philosophy, Culture: Interviews and Other Writings (1977-1984); Michel Foucault; New York, 1990, p.49
১৫. দ্র: The History of Sexuality, Vol I; Michel Foucault, New York, 1978 p. 57-58
১৬. ফুকো বলেছিলেন ‘One of the nemerous points where I was wrong in that book was what I said about this ars erotica…the chinese ars erotica… had a techne tu biou in which the economy of pleasure played a very large role… in this ‘art of life’ the notion of exercising a perfect mastery over oneself soon became the main issue.’ দ্র: On the Genealogy of Ethics: An Overview of Work in Progress: interview with Michel Foucault; The Foucault Reader, ed. Paul Rabinow, New York 1984, pp. 347-348
১৭. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র: The Purusartha in traditional texts; K. N. Sharma; Contributions to Indian Sociology (n.s) 20/2 1986; pp. 279–287
১৮. প্রকৃতিপ্রত্যয়গতভাবে ‘আমনায়’ শব্দের অর্থ সঠিক ‘অভ্যাস’ বা ‘পুনরাবর্তন’ (proper repetition) ৷ ‘চতুর্বেদ’ থেকেই শব্দটির উৎপত্তি ৷ যেহেতু ‘বেদ’ ‘অ-পৌরুষেয়’, তাই ‘আমনায়’-এর ধারণাটিও হিন্দু ঐতিহ্যে পবিত্র পরমার্থসাধনার নামান্তর ৷ দ্রঃ K. N. Sharma, পূর্বোক্ত p. 279
১৯. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 283, এছাড়াও দ্র: On the rhetoric and semantics of purusartha; charles Malamuond, Contributions to Indian Sociology 1985, New Delhi, pp. 33-54
২০. দ্র: way of Life, king, Householder, Renouncer; Essays in Honour of Louis Dumount, ed. T. N. Madan, New Delhi, 1982, pp. 183–203
২১. দ্র: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অনুবাদ, সুকুমার সিকদার, কলকাতা, ২০০৫, পৃ. ৯-১৫
২২. দ্র: বাৎসায়নের কামসূত্র, অনুবাদ গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর, সম্পাদনা ত্রিদিবনাথ রায়, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ৪
২৩. দ্র: The Inner World: A Psycho-Analytic Study of Childhood and Society in India, Sudhir Kakar; 1999, p. 40
২৪. দ্র: Kinship in Bengali Culture, Ronald B. Inden & Ralph W. Nicholas, New Delhi, 2005, p. 51-54
২৫. দ্র: পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, K. N. Sharma, p. 284
২৬. দ্র: The Genealogy of Morals; F. Nietzche, New York, 1956, p. 220
২৭. দ্র: Soul’d out and In : Representation of body, no-body, male, female etc, in the ‘Hindu’ (?) philosophy; Debaprasad Bandyopadhyay, Margins, February 2002, p. 185
২৮. দ্র: Sudhir Kakar-এর পূর্বোক্ত বই; p. 37
২৯. দ্র: বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ , সম্পাদনা ত্রিদিবনাথ রায়, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ২৭
৩০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৭
৩১. পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮
৩২ দ্রঃ History of Indian Erotic Literature; Narendranath Bhattacharya, New Delhi; 1975, pp.90–91, লেখকের মতে:: we must say it is a pedantic and superficial production of scholasticism…he…could only devise acrobatic techniques, most of which are impossible to follow in the practical field.
৩৩. দ্র: Preface by W. G. Archer, The Koka Shastra, translated by Alex Comfort, New York, 1965, p. 13
৩৪. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 38
৩৫. দ্র: Ananga Ranga : Stages of the Bodiless one / The Hindu art of love by Kalyan Malla; translated by F. F. Arbuthnot and Richard R. Burton, New York, 1964
৩৬. দ্র: কৃষ্ণচরিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম রচনাবলী, (দ্বিতীয় খন্ড), সম্পাদনা. কাঞ্চন বসু, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৩৫৫ এবং ৪০০
৩৭. দ্র: Tales of Love, Sex and Danger, Sudhir Kakar & John. M. Ross. New Delhi, 2003, p. 9
৩৮. দ্র: কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭৭, পৃ. ৩৩৩
৩৯. বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র, সম্পাদনা অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ২৭৭
৪০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৪
৪১. দ্র: দৌলত কাজির লোরচন্দ্রানী ও সতীময়না, সম্পাদনা দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ.২৯
৪২. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭
৪৩. দ্র: ভারতচন্দ্র রচনাসমগ্র, সম্পাদনা ক্ষেত্র গুপ্ত ও বিষ্ণু বসু, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ. ২৩৬-২৩৮
৪৪. দ্র: বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমগ্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১৬
৪৫. দ্র: কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, সম্পাদনা সুকুমার সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৪০২, পৃ. ১৮৩
৪৬. বিস্তৃত তালিকার জন্য দ্র: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ২য় খণ্ড, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ৩২৫-৩২৬
৪৭. দ্র: জয়ানন্দ বিরচিত ‘চৈতন্যমঙ্গল’, সম্পাদনা বিমানবিহারী মজুমদার, সুখময় মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭১, পৃ. ৩৬
৪৮. উপনিষদ, গীতা, বেদান্ত থেকে শুরু করে তান্ত্রিক সাধনা, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথপন্থী, বাউল—সকল সাধনার ভিতরেই এই ‘উল্টা সাধন’-এর প্রক্রিয়া লক্ষণীয় ৷ এদের মধ্যে শেষোক্ত লোকায়ত সাধনাগুলিতে ‘উল্টাসাধন’-এর মুখ্য আশ্রয় ‘শরীর’ ৷ দ্র: ভারতীয় সাধনার ঐক্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, কলিকাতা, আষাঢ়, ১৩৫৮
৪৯. দ্র: শ্রীমদভাগবদগীতা, অনুবাদ রাজশেখর বসু, কলকাতা, শ্রাবণ ১৩৬৮ পৃ. ২৯, শ্লোক সংখ্যা ২ ৷:৭০, অধ্যায় সাংখ্যযোগ ৷ শ্লোকটি : ‘আপূর্যমাণমচল প্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদবৎ ৷…’
৫০. দ্র: শ্রীমদভাগবদগীতা, শ্লোক ২/৬৯; ‘যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী…’ পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯
৫১. ‘পরাবৃত্তি’—এই পারিভাষিক শব্দের বিস্তৃত, অর্থের জন্য দ্রঃ Studies in the Tantras, Prabodh Chandra Bagchi, University of Calcutta Publications, 1975, pp. 87–92
৫২. বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্র: তন্ত্রকথা, শ্রীচিন্তাহরণ চক্রবর্তী, কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৬২
৫৩. চর্যাপদে প্রকাশিত সহজযানী কায়সাধনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রঃ চর্যাগীতি পরিচয়, ড. সত্যব্রত দে, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৪২-৬৪; চর্যাগীতি পদাবলী, সুকুমার সেন, কলকাতা, ১৯৯৫ পৃ. ৩৫-৪০; চর্যাগীতি পরিক্রমা, ড. নির্মল দাশ, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ. ৫১-৫৭
৫৪. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র: নাথপন্থ, কল্যাণী মল্লিক, কলকাতা, চৈত্র ১৩৫৭; গোর্খবিজয়, সম্পাদনা ড. পঞ্চানন মণ্ডল, কলকাতা, অগ্রহায়ণ, ১৩৫৬ ৷ এই বইয়ের সুকুমার সেন লিখিত ভূমিকাটি মূল্যবান ৷
৫৫. উদ্ধৃত, ভারতীয় সাধনার ঐক্য, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০
৫৬. দ্র: প্রস্তাবনা, চৈতন্যোত্তর প্রথম চারিটি সহজিয়া পুথি, শ্রীপরিতোষ দাস, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ১-১০
৫৭. দ্র: The Post-Caitanya Sahajiya Cult of Bengal, Manindra Mohan Bose, New Delhi, 1986, p. 39
৫৮. লোচনদাস ঠাকুর বিরচিত শ্রীশ্রী চৈতন্যমঙ্গল, কলকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ১৫০
৫৯. দ্র: The evolution of third-sex constructs in ancient India: a study in ambiguity, Leonard Zwilling and Michael J. Sweet, Invented Identities : The Interplay of Gender, Religion and Politics in India, edited by Julia Leslie & Mary McGel, New Delhi, 2000 p. 99-132
৬০. দ্র: Gendered bodies: The Case of the ‘third gender’ in India, Anuja Agrawal, Contribution to Indian Sociology (n.s) 31, 2(1997)
৬১. পূর্বোক্ত, p. 287