১. যুদ্ধ রথ

ওয়ারলক / মূল : উইলবার স্মিথ / অনুবাদ : শাহজাহান মানিক
অনুবাদ সহযোগী – পপি আখতার
উৎসর্গ – রাজিব ও লন্ডন প্রবাসী রিয়াদ কে

একটা দীর্ঘ সোজা সর্পের ন্যায় এক সারি যুদ্ধ রথ উপত্যকাটির বুক চিড়ে খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে চলছিল। অগ্রবর্তী রথ চালকের ঠিক পিছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পর্বতমালার দিকে চোখ তুলে তাকাল। উঁচু শৃঙ্গগুলো বৃদ্ধ মানুষের সমাধিতে পূর্ণ; আর তাদের নিরেট প্রস্তুর গহ্বরগুলো যেন সমাধিগুলোর উন্মুক্ত প্রবেশ দ্বার। প্রাচীন রোমের নির্দয় সৈন্যবাহিনী জিনদের ন্যায় কৃপাহীন দৃষ্টি নিয়ে সেই কালো গহ্বরসমূহ বুঝি তার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ে রাজপুত্র নেফার মেমনন কেঁপে উঠল এবং দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিল। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাত দিয়ে শূন্যে শয়তান তাড়ানোর পবিত্র চিহ্নটা সে আঁকল।

ঘাড় ফিরিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের সারিবদ্ধ রথগুলোর উদ্দেশ্যে সে দৃষ্টি বুলাল এবং দেখল ধুলোর মেঘের মধ্য দিয়ে ঠিক পিছনের রথে দাঁড়িয়ে টাইটা তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। বৃদ্ধ লোকটিকে ধুলোর কুন্ডলী ঘিরে আছে; তার যানের উপর পাতলা একটা ধুলোর ধূসর আস্তর পড়েছে আর যে এক ফালি সূর্য রশ্মি এই গভীর উপত্যকার গভীরে প্রবেশ করছে তাতেই ধুলোর ধূসর কণাগুলো চমকাচ্ছিল, যেন কোন দেবদূতের মতোই দীপ্যমান। অপরাধীর ন্যায় নেফার মাথা নিচু করল। বৃদ্ধ লোকটি তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়টা প্রত্যক্ষ করেছে ভেবে সে লজ্জা পেল। ট্যামোস হাউজের কোন রাজপুত্রকে এরকম দুর্বলতা দেখানো উচিত নয়, আর যৌবনের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েতো অবশ্যই আরো না। কিন্তু অন্য সবার চাইতে টাইটা তাকে খুব বেশি জানে, নেফারের শিশুকাল থেকে সে তার শিক্ষক বাবা-মা, ভাইবোনদের চেয়েও আরো বেশি কাছের। টাইটার অভিব্যক্তি কখনোই পরিবর্তিত হয় না, এমনকি এতো দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও তার প্রাচীন দৃষ্টি যেন নেফারের সত্তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। দেখেই সব বুঝে ফেলে।

নেফার ঘুরে তার পিতার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার পিতা তখন ঘোড়ার লাগাম ধরে চাবুক পিটিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটাতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে উপত্যকার মাঝে গালালা শহরের ভগ্ন-কঠিন সমতল ভূমিটা তাদের সামনে উন্মোচিত হল। প্রথম দর্শনেই এই বিখ্যাত রণক্ষেত্র নেফারকে শিহরিত করল। যৌবনে এখানে টাইটা যুদ্ধ করেছিল। তখন নরদেবতা দেবতা ট্যানোস, লর্ড হারাব অপ শক্তিকে ধ্বংস করেছিল যা কিনা তখন মিশরের জন্যে চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল। তাও তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা, কিন্তু এখনো টাইটার কাছে সব জীবন্ত, আর সে এতো সুনিপুণভাবে সেই যুদ্ধের গল্প নেফারকে শোনায় যে মনে হয় যেন সে নিজেই দুর্দশার ঐসব দিনে সেখানে ছিল।

নেফারের পিতা, প্রভু ফারাও ট্যামোস, ভগ্ন প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ঘোড়ার লাগাম টেনে রথ থামালেন। তাদের পিছনে একশ রথও ঠিক একই ভাবে থামাল এবং রথ আরোহীরা পাদানী থেকে নেমে ঘোড়াগুলোকে পানি পান করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কথা বলার জন্যে মুখ খুলতেই ফারাও-এর চিবুক থেকে ধুলোর আস্তর গড়িয়ে তার বুকের উপর ঝরে পড়ল।

মাই লর্ড! ফারাও মিশরের মহান সিংহ লর্ড নাজা, তার সেনাপতি ও প্রিয় সহচরকে সম্ভাষণ করে বললেন, সূর্য ঐ পর্বত চূড়া স্পর্শ করার পূর্বেই আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করতে চাই। আমি আশা করছি রাতের মধ্যেই আমরা এল গাবারের বালিয়াড়িটা পাড়ি দিতে পারবো।

লালচে ধুলোর আস্তর পড়া সত্ত্বেও ট্যামোসের মাথায় পরিহিত যুদ্ধের নীল মুকুটটা চকচক করছিল। সে নেফারের দিকে তাকাল, তার চোখের কোনায় অশ্রুর ফোঁটা আর ধুলোর কাদা মিলে রক্তাভ একটা পিন্ড তৈরি করেছে। তোমাকে আমি এখানে টাইটার কাছে রেখে যাচ্ছি।

যদিও জানে প্রতিবাদ করাটা বৃথা তবুও সে মুখ খুলতে চাইল। অশ্বারোহী দল শত্রুর বিরুদ্ধে চলছে। ফারাও ট্যামোসের যুদ্ধ পরিকল্পনা হচ্ছে দক্ষিণ থেকে চক্রাকারে বৃহৎ বালিয়াড়িটির মধ্য দিয়ে এবং তিক্ত ন্যাট্রন হ্রদের মাঝে একটা পথ তৈরি করে শত্রুদের অতর্কিতে তাড়িয়ে আনরাব-এর পূর্বে নীল নদের তীরে নিয়ে আসা, যেখানে মিশরীয় সৈন্যবাহিনী জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে। পুনরায় শত্রুরা সজ্জিত হওয়ার পূর্বেই ট্যামোস তখন সৈন্যদল দুটিকে একত্রিত করে তেল-আল দাবার বাইরে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে এভারিসের শত্ৰু দুৰ্গটা দখল করে নেবেন।

এটি একটি দৃঢ় এবং অসাধারণ পরিকল্পনা। যদি পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে এক ঢিলে দুই প্রজন্ম ধরে চলে আসা হিকদের সাথে লড়াইটা সহজ হয়ে যাবে। নেফার শিখেছে যুদ্ধ ও যশ হচ্ছে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়। কিন্তু, এই চৌদ্দ বছর বয়সেও তারা তাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মনে-প্রাণে সে চাচ্ছে পিতার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয় ও অমরত্বটা অর্জন করতে।

নেফার কিছু বলার পূর্বেই ফারাও তাকে থামিয়ে দিলেন। একজন যোদ্ধার প্রথম কর্তব্য কি? তিনি ছেলের কাছে জানতে চাইলেন।

নেফার চোখ নামিয়ে নরম ও বিষণ্ণ কণ্ঠে উত্তর দিল, বাধ্যবাধকতা, মহানুভব!

তাহলে কখনো তা ভুলবে না, তিনি মাথা নেড়ে ঘুরে চলে গেলেন।

নিজেকে নেফারের প্রত্যাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্ছিত মনে হল। তার চোখ জ্বলছিল এবং উপরের ঠোঁটটা কাঁপতে লাগল। কিন্তু টাইটার চাহনি তাকে শক্ত করল। চোখ কচলে চোখের জল মুছে নিজেকে সহজ করতে সে রথের পাশে ঝুলে থাকা পানির থলে থেকে এক চুমুক পানি খেল। তারপর বৃদ্ধ ম্যাগোস, যার লম্বা দোল খাওয়া কোঁকড়া চুলগুলো ভারি ধুলোয় একাকার হয়ে আছে, তার দিকে ফিরে আদেশের সুরে বলল, আমাকে সেই ভাস্কর্যটা দেখাও, টাটা।

ভগ্ন শহরটির সরু রাস্তায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ রথ, মানুষ ও এলোমেলোভাবে রাখা ঘোড়াগুলোর মধ্যকার খালি স্থানটুকু দিয়ে তারা এগিয়ে চলল। ইতোমধ্যে বিশ জন সৈন্য কাপড় খুলে খালি গায়ে প্রাচীন কূপগুলোর নিচে নেমে পড়েছে; নিচের সামান্য তিতা পানি উপরে তোলার ব্যবস্থা তারা করছিল। একদা এই কূপগুলো নীল ও লোহিত সাগরের বাণিজ্য পথে অবস্থিত একটি সমৃদ্ধশালী জনবহুল এলাকার লোকদের জল যোগান দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তারপর, বহু শতাব্দী পূর্বে, এক ভয়ংকর ভূমিকম্প পানি ধারণের স্তরগুলো উলট-পালট করে দেয়, যার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। জল তৃষ্ণায় গালালা শহর মৃত্যুবরণ করে। এখন এখানে দুশ ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ ও পানির থলেগুলো পূর্ণ করার পক্ষে খুব কমই জল অবশিষ্ট রয়েছে।

যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা পরিত্যক্ত চতুষ্কোণ স্থানটির মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছল, টাইটা নেফারকে সরু গলিটা ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তারা মন্দির ও রাজপ্রাসাদ অতিক্রম করে এগিয়ে চলল, এখন যা কেবল টিকটিকি আর বিচ্ছুদের আবাসস্থল। ঠিক মাঝ খানে দাঁড়িয়ে আছে লর্ড ট্যানোস এবং দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে তার জয়ের প্রতীক ভাস্কর্যটি, যারা কিনা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী ও ক্ষমতাধর জাতিকে প্রায় দমিত করে ফেলেছিল। ভাস্কর্যটি একসাথে জোড়া লাগানো মানুষের খুলির এক অদ্ভুত পিরামিড যা একটা লাল পাথরের পুরু বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত। পাথরে খোদাই করা স্তরগুলো যখন সে জোরে জোরে পড়ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার খুলি তার দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

আমাদের ছিন্ন মস্তকসমূহ সেই যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে যা এখানে সংগঠিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ট্যানোস লর্ড হারাব এর তলোয়ারের নিচে আমাদের মৃত্যু হয়েছিল। এ মহান লর্ডের অমর কীর্তি, যা দেবতাদের মহিমা এবং নীতিবানদের ক্ষমতা থেকে উৎসারিত–সকল প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এরূপে দেবতা ফারাও ম্যামোসের শাসনামলের চৌদ্দতম বছর স্মরণীয় হয়ে রইল।

রাজপুত্র ভাস্কর্যটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে হেঁটে দেখছিল। আর ভালোভাবে সব দেখতে প্রতিটি পদক্ষেপে সে থামছিল। টাইটা ভাস্কর্যটির ছায়ায় আসন পেতে একমনে এসব দেখছিল। যদিও টাইটার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছিল না তবে তার চোখ দুটো ছিল স্নেহপূর্ণ। বালকটির প্রতি তার বীজ বপন করা অন্য দুটি জীবনে। প্রথমজন হলেন লসট্রিস, মিশরের রাণী। টাইটা ছিল খোঁজা, কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরে তাকে খোঁজা করা হয় এবং একদা সে এক মেয়েকে ভালোবাসত। শারীরিক অক্ষমতার কারণে টাইটার ভালোবাসা ছিল পবিত্র এবং এর পুরোটাই সে বিলিয়ে দিয়েছে নেফারের দাদী, রাণী লসট্রিসকে। সে ভালোবাসা এতোই প্রবল যে আজও রাণীর মৃত্যুর বিশ বছর পর তা তার অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে বাস করছে।

অন্য জন যার জন্যে সে নেফারকে ভালোবাসে সে হচ্ছে ট্যানোস, লর্ড হারাব, যার উদ্দেশ্যে এ ভাস্কর্যটি নির্মিত। নিজের ভাইয়ের চাইতেও সে টাইটার কাছে প্রিয় ছিল। তারা দুজনেই আজ চলে গেছেন অসীমে; লসট্রিস এবং ট্যানোস, কিন্তু তাদের রক্তের শক্তিশালী ধারা এ শিশুর শিরায় শিরায় বইছে। অনেক আগে তাদের অবৈধ প্রণয় জন্ম দিয়েছিল যে শিশুটিকে সে হচ্ছে ফারাও ট্যামোস, আজ যে এই রথবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে; রাজপুত্র নেফারের পিতা।

টাটা, আমাকে সেই স্থানটি দেখাও যেখানে তুমি দুসূ দলের সর্দারটিকে কজা করেছিলে, বয়ঃসন্ধি কালের উদ্যম, উজ্জ্বলতা তার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ল। এটা কি এখানে? চতুষ্কোণের দক্ষিণ পাশে ভাঙা দেয়ালের দিকে সে ছুটে গেল। আমাকে গল্পটা আবার বল।

না, তা এখানে, এই পাশে, টাইটা দাঁড়িয়ে তার সরু পা দুটো দিয়ে লম্বা পদক্ষেপে পূর্ব পাশের দেয়ালের নিকট এগুতে এগুতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল। সে ভেঙে পড়া চূড়ারটির দিকে তাকাল। দস্যুটার নাম ছিল শূফতি। সে ছিল এক চোখা এবং প্রভু সেথ-এর ন্যায় কুৎসিত। সে এ দেয়ালের উপর উঠে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। টাইটা থামল এবং পাথরের টুকরো থেকে একখণ্ড অর্ধ শুকনো মাটির ইট তুলে নিল এবং হঠাৎ উপরের দিকে ছুঁড়ে মারল। যা উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে উড়ে গেল। কেবলমাত্র একটা পাথর ছুঁড়ে আমি তার খুলিতে আঘাত করে তাকে ধরাশয়ী করেছিলাম।

যদিও প্রথম থেকেই বৃদ্ধ লোকটির শক্তি সম্পর্কে নেফারের একটা ধারণা ছিল এবং এও জানত যে তার সহ্য ক্ষমতা লোকগাঁথা সম পর্যায়ের, তবুও তার এই লক্ষ্যভেদী নিক্ষেপে সে অবাক না হয়ে পারল না। সে পর্বতের চেয়েও বয়স্ক, আমার দাদির চাইতে বড়। কারণ সে আমাকে যেমন করে লালন-পালন করছে। দাদিকেও সেভাবেই করেছে, নেফার বিস্মিত হল। লোকে বলে সে নীল নদের দুশ বন্যা দেখেছে, পিরামিডগুলো নিজ হাতে তৈরি করেছে। নেফার উচ্চঃস্বরে জানতে চাইল, তুমি কি তার মাথাটা কেটে ঐ স্কুপের মধ্যে রেখেছিলে, টাটা? সে বীভৎস নিদর্শনটি নির্দেশ করল।

সে গল্পটা তুমি খুব ভালোই জানো, কম হলেও শতবার তোমাকে তা বলেছি, নিজ কাজের প্রশংসা নিজে না করার বিনীত ভান করল টাইটা। আমাকে তা আবার বল, নেফার আদেশ করল।

টাইটা একটা পাথরের উপর এসে বসল, আর নেফার আনন্দিত হয়ে ভালোভাবে গল্পটা শোনার জন্যে তার পায়ের কাছটায় আসন নিল, যতোক্ষণ না সৈন্যবাহিনী ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে ফিরে যাওয়ার সংকেত দিল। ঘণ্টার শব্দ প্রতিধ্বনি তুলে কালো উঁচু পাহাড় শৃঙ্গের আড়ালে হারিয়ে গেল। ফারাও আমাদের ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছেন। টাইটা বলল। সবাই দাঁড়িয়ে ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করে।

দেয়ালের বাইরে তখন সবাই ব্যস্ত, হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে; সৈন্যবাহিনী বালিয়াড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাত্রার পূর্বে পানির মশকগুলো পুনরায় ভরা হচ্ছিল এবং সৈন্যরা তাদের রথ, ঘোড়া ও অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা শেষবারের জন্যে পরখ করে নিচ্ছে।

তোরণ দিয়ে যখন তারা দুজন বের হয়ে এল, ফারাও ট্যামোস লোকজনের মাথার উপর দিয়ে তাদের দিকে তাকালেন এবং মাথা নেড়ে মৃদু ইশারায় টাইটাকে পাশে এসে দাঁড়াতে বললেন। যতো দূর পর্যন্ত সেনাধ্যক্ষরা তাদের পদধ্বনি শুনতে না পায়, ততো দূর তারা একত্রে এগিয়ে গেলেন। লর্ড নাজা তাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য এগোল। টাইটা ফারাওকে ফিসফিস্ করে একটা কিছু বলল, তারপরই ট্যামোস ঘুরে নাজাকে কঠোর কথা বলে ফেরত পাঠালেন। আহত লর্ড লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল এবং টাইটার দিকে যুদ্ধ ক্ষেত্রের শরের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

 তুমি নাজার বিরক্তের কারণ হয়েছে, একদিন হয়তো তোমাকে রক্ষা করতে আমি থাকবো না, ফারাও সর্তকবাণী উচ্চারণ করলেন।

কাউকেই আমাদের বিশ্বাস করা উচিত নয়, টাইটা আশঙ্কা প্রকাশ করল। যততক্ষণ না আমরা আপনার প্রাসাদের চারপাশের পিলারগুলোতে পেঁচিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারী সার্পসমূহের মাথা কাটতে পারছি। আর যততদিন না আপনি উত্তরের এই যাত্রা শেষ করে ফিরছেন ততোদিন আমরা দুজন ছাড়া কেউ জানবে না আমি রাজপুত্রকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু নাজা! ফারাও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসলেন! নাজা তার একজন ভাইয়ের মতো। তারা এক সাথে রেড রোড দৌড়িয়েছে।

এমনকি নাজাও। টাইটা আর কিছু বলল না। শেষ পর্যন্ত তার সন্দেহ নিশ্চিত হতে চলেছে। কিন্তু তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই যে সে ফারাওকে তা বিশ্বাস করাতে পারে।

রাজপুত্র কি জানে কেন তুমি মরুভূমির মধ্য দিয়ে এতো দ্রুত চলছো? ফারাও জিজ্ঞেস করলেন।

সে শুধু জানে আমরা তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে অজানার উদ্দেশ্যে চলেছি, তার গড বার্ড বা প্রভু পতঙ্গটা ধরতে যাচ্ছি।

বেশ, টাইটা। ফারাও মাথা নাড়লেন। সর্বদাই তুমি গোপনীয়তা পছন্দ করো, তবে তুমি সত্য। আর কিছু বলার নেই, যা বলার বলেছি। এখন যাও, হুরাস তোমার আর নেফারের উপর তার আশীর্বাদের ডানা মেলে রাখুক।

নিজের পিছন দিকটা লক্ষ্য রাখবেন, মহানুভব! কেননা শত্রু এখন কেবল আপনার সম্মুখেই শুধু নয়, পিছনেও অবস্থান করছে।

ফারাও ম্যাগোসের হাতটা টেনে নিলেন ও জোরে চাপ দিলেন। তার আঙুলের নিচের বাহুটি সরু কিন্তু একাসিয়া গাছের শুকানো ডালের ন্যায় শক্ত। তারপর তিনি নেফারের কাছে ফিরে গেলেন, সে রাজকীয় রথের চাকার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আহত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিল, এখনও আশা করছে হয়তো লর্ড তার নিষ্ঠুর আদেশ ফিরিয়ে নেবেন।

মহামান্য! আমার চাইতেও কম বয়সী অনেক লোকওতো এই সৈন্য বাহিনীতে আছে। রাজকুমার তার পিতাকে মানানোর শেষ চেষ্টা করল যে রথ বহরের সাথে তার যাওয়া উচিত। ফারাও জানেন ছেলেটি নিঃসন্দেহে ঠিকই বলছে। ম্যারন, বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ ক্ৰাতাস এর নাতি, যে তার চেয়ে তিন দিনের ছোট সেও আজ তার বাবার সাথে পিছনের কোন রথে লেন্স-বাহক হিসেবে যাচ্ছে। পিতা, কবে আপনি আমাকে আপনার সাথে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিবেন?

সম্ভবত, তুমি যখন রেড রোড দৌড়াতে পারবে। এমন কি তখন আমিও আপত্তি জানাব না।

এটা একটা অস্বাভাবিক প্রতিজ্ঞা এবং তারা দুজনেই জানে যে রেড রোড দৌড়ানন ঘোড়সওয়ার ও অস্ত্র চালনার মধ্যে সবচাইতে কষ্ট সাধ্য পরীক্ষা, যা শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়জন যোদ্ধার পক্ষে সম্ভব। এটা একটা অগ্নি পরীক্ষা যা একজন যুবককে নিঃশেষিত করে ফেলে, এমনকি কেউ কেউ মারাও যায় এবং তা অনেকটা নিজেকে বলি দেয়ার মতোই। নেফার এখনও সে দিন থেকে বহু দূরে।

এবার ফারাও এর নিষেধাজ্ঞা নরম হল এবং তার সৈন্য বাহিনীর সামনে যতোটুকু স্নেহ প্রকাশ করা যায় ততটুকু দিয়ে তিনি তার ছেলেকে বাহু বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলেন। এখন আমার আদেশ হচ্ছে তুমি টাইটার সাথে এই মরুভূমির মধ্য দিয়ে তোমার গড বার্ড ধরতে যাবে এবং প্রমাণ করবে যে রাজরক্ত ও অধিকার দুটোই তোমার দ্বৈত মুকুট ধারণের ক্ষেত্রে রয়েছে।

*

গালালার ভগ্ন দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে নেফার ও বৃদ্ধলোকটি রথের দীর্ঘ সারিকে তাদের অতিক্রম করতে দেখল। এগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং ফারাও নিজে। লাগাম কব্জিতে পেঁচিয়ে, পিছনে হেলে তিনি টান দিলেন। তার বক্ষ নগ্ন, পেশীবহুল পায়ের চারপাশে লিলেন স্কার্ট ছড়িয়ে আছে, মাথায় শোভা পাচ্ছে নীল যুদ্ধ মুকুট, সব কিছু মিলিয়ে তাকে মনে হচ্ছিল লম্বা–একজন দেবতার মতন।

তার পিছনেই লর্ড নাজা অবস্থান করছিল, তার মতই লম্বা এবং প্রায় তার মতই সুদর্শন। চেহারায় তার উদ্ধতা ও দাম্ভিকতা ঝরে পড়ছে। কাঁধে ঝুলছে বিখ্যাত সেই বাঁকানো ধনুক। নাজা মিশরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং তার নামটা তার সম্মানের প্রতীক রূপে দেওয়া হয়েছে। নাজা রাজকীয় ইউরেয়াস মুকুটধারী দলের একজন ভয়ংকর কোবরা। ফারাও ট্যামোস তাকে সেদিন এ উপাধি দিয়েছেন যেদিন তারা একত্রে রেড রোড এর অগ্নি পরীক্ষায় জয়ী হয়েছিলেন।

নাজা নেফারের দিকে কটু দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকাল। শেষ রথটা যখন নেফারকে অতিক্রম করল ততোক্ষণে ফারও-এর রথ গিরিখাতের কালো মুখে প্রবেশ করেছে। ম্যারন, তার ছেলেবেলার বন্ধু ও সাথী, অনেক দুষ্টুমির সঙ্গী, হাসি দিয়ে তার উদ্দেশ্যে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল। তারপর স্বর উঁচিয়ে নেফারকে উপহাস করে বলল, আমি অ্যাপেপির মাথাটা তোমার জন্যে খেলনা হিসেবে নিয়ে আসব। সে ওয়াদা করল, এবং তাতে নেফারের মনটা ঘৃণায় ভরে গেল। অ্যাপেপি হিকস্‌দের রাজা, আর নেফারের কোন খেলনারও দরকার নেই। সে এখন পুরুষ, কোন ছোট শিশু নয়। যদিও তার পিতা তা মানতে নারাজ।

ম্যারনের রথ অদৃশ্য হবার পর অনেকক্ষণ তারা দুজন নিঃশ্রুপ রইল। ধুলোগুলোও শান্ত হয়ে গেছে। টাইটা কিছু না বলে ঘুরে যেখানে তাদের ঘোড়াগুলো বাধা সেখানে গেল। আলখেল্লাটা এমনভাবে উঁচিয়ে সে ঘোড়ার পিঠে চড়ল যেন এখনো সে একজন তরুণ। একবার ঘোড়ার পিঠে চড়ার পর সে ঘোড়ার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। নেফারের মনে পড়ল, লোকগাঁথা অনুসারে সে-ই মিশরের প্রথম ঘোড়াসওয়ার বিদ্যার মাস্টার। এখনও সে দশ হাজার রথের খেতাব প্রাপ্ত মাস্টার যা দুই রাজ্যের ফারাওরা তাকে দিয়েছেন।

এটা ঠিক যে হাতে গুণা কয়েকজনের মধ্যে সে একজন যারা ঘোড়ার পিঠে দুপা ছড়িয়ে চড়ার সাহস দেখাতে পারে।

অধিকাংশ মিশরীয় মনে মনে এটাকে ঘৃণা করে, অশ্লীল ও অসম্মানের কাজ মনে করে, যদিও ঝুঁকির প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। তবে নেফারের এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই এবং তার প্রিয় ঘোড়া স্টারগেজের এর পিঠে চড়তেই তার মন ভালো হয়ে গেল। ভগ্ন শহরের উপরের পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবার আগেই সে তার স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ফিরে এল। দূরে উত্তরের দিগন্তে সৈন্যবাহিনীর রেখে যাওয়া ধুলোর মেঘের দিকে সে তার দৃষ্টি ফেরাল। তারপর দৃঢ়তার সাথে পিছন ফিরল।

আমরা কোথায় যাচ্ছি, টাটা? নেফার জানতে চাইল। যখন আমরা পথে ছিলাম তখন কিন্তু তুমি আমাকে একবার ওয়াদা করেছিলে যে বলবে।

টাইটা সর্বদা গুরু-গম্ভীর ও দৃঢ় প্রকৃতির। সে তাদের এই যাত্রার বিষয়ে কোন কিছু বলতে নিরুচ্ছুক। তবে সে শুধু এটুকুই বলল, গেবেল নাগার যাচ্ছি।

নেফার আগে কখনও এই নাম শোনেনি। তবে সে আস্তে করে নামটা উচ্চারণ করল। এটা ছিল রোমাঞ্চকর স্মৃতি বিজড়িত যাত্রা। উত্তেজনায় তার ঘাড়ের পিছন দিক শিরশির করে উঠল। সে সামনের মরুভূমির দিকে তাকাল। একটা খাঁজ কাটা অসীম বন্ধুর পাহাড় শ্রেণী নীল দিগন্ত পর্যন্ত বাড়ানো এবং হালকা তাপের জাল চারদিকে ছড়ানো। ছড়িয়ে থাকা পাথরের রঙে চোখ ঝলসে উঠে; কোনটি ঘন কালো মেঘের ফাঁকের বিমর্ষ নীলের মতো, কোনটা বাবুই পাখির হলদে পাখার ন্যায়, কোনটা মাংসের ক্ষতের মতো লাল, আবার কোনটা ক্রিস্টালের মতন উজ্জ্বল। তাপ দাহের ফলে যেন তারা কাঁপছে ও নাচছে।

অতীত স্মৃতি নিয়ে টাইটা এই ভয়ংকর স্থানটির দিকে তাকাল এবং নষ্টালজিক হল। এই জায়গাতেই সে তার প্রিয়তমা রাণী লসট্রিসের মৃত্যুর পর একটা আহত প্রাণীর ন্যায় চলে এসেছিল। তারপর সময়ের ব্যবধানে যখন সেই কষ্ট কিছুটা ম্লান হয়ে আসে তখন সে আবার নিজেকে হুরাসের পথে পরিচালিত করে। শারীরিক শল্য বিজ্ঞানের সকল বিষয় তারা জানা। একা এই অসীম মরুভূমিতে সে খুঁজে পেয়েছিল মনের দরজা খোলার চাবি এবং আধ্যাত্মিক এক জগৎ। সে গিয়েছিল শুধু একজন মানুষ হিসেবে কিন্তু ফিরে আসে হুরাসের সু-ভাজন রূপে এবং একজন দক্ষ যাদুকর হয়ে–যা শুধু কিছুমাত্র লোকের পক্ষেই সম্ভব।

যখন রানী লসট্রিস তার স্বপ্নে এল, তখনই শুধু টাইটা মানুষের সমাজে ফিরেছে। তখন সে গেবেল নাগারের সাধুদের গুহায় ঘুমাচ্ছিল। পনের বছরের কুমারী, সতেজ এবং আবেদনময়ী, সদ্য প্রস্ফুটিত মরু-গোলাপ যার পাপড়িতে শিশির বিন্দু দৃশ্যমান তেমন মনে হচ্ছিল তাকে। যদিও সে ঘুমাচ্ছিল তবু তার হৃদয় ভালোবাসায় ভরে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল তার বুক ফেটে তা বেরিয়ে আসবে।

প্রিয় টাইটা, লসট্রিস তার গাল স্পর্শ করে জাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি হচ্ছ সেই দুজনের মধ্যে একজন যাদের আমি ভালোবাসি। এখন ট্যানোস আমার সাথে রয়েছে, কিন্তু তোমাকে আমার কাছে আসার আগে আরো একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে যা আমি তোমাকে দিতে যাচ্ছি। আমি জানি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না, করবে কি, টাইটা?

আমি তোমার আজ্ঞাধারী, মিসট্রেস, তার কণ্ঠস্বর তার নিজের কানেই অদ্ভুত শোনাল।

থেবস্-এ, আমার শতদ্বারের শহরে, এই রাতে একটি শিশু জন্মেছে। সে আমার নিজ পুত্রের পুত্র। তার নাম হবে নেফার, যার অর্থ হচ্ছে মনে ও প্রাণে পবিত্রতা ও পূর্ণতা। আমার ইচ্ছা সে আমার আর ট্যানোসের রক্ত মিশরের উচ্চ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করুক। কিন্তু বিশাল ও নানান সমস্যা শিশুটিকে ঘিরে ধরেছে। তোমার সাহায্য ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। শুধুমাত্র তুমিই পার তাকে রক্ষা করতে ও পথ দেখাতে। এই বছরগুলো তুমি প্রকৃতির মাঝে ব্যয় করেছ। যে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করেছ তার উদ্দেশ্য এখানেই। নেফারের কাছে যাও। এখনই

যাও, তাড়াতাড়ি এবং ততোদিন তার সাথে অবস্থান করো যতোদিন তোমার দায়িত্ব শেষ না হয়। তারপর আমার কাছে ফিরে এসো, প্রিয় টাইটা। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। এবং তোমার পৌরুষত্বও তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তুমি আমারই পাশে থাকবে। হাতে হাত রেখে একমাত্র তুমিই হবে একজন যে আমার পাশে থাকবে সেদিন। আমায় নিরাশ করোনা, টাইটা।

কখনো না! টাইটা স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে ওঠে। জীবিত থাকতে আমি তোমাকে নিরাশ করেনি আর মরণে তো অবশ্যই না।

আমি জানি তুমি করবে না, লসট্রিস হাসল এবং তারপর তার অবয় মরুর সে রাতে হারিয়ে গেল। সে জেগে উঠে। তার চেহারা কান্নায় ভেজা ছিল। সে দ্রুত তার প্রয়োজনীয় জিনিসসমূহ গুছিয়ে নিল। তারপর গুহার প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে তারা দেখে সে তার চলার রাস্তা ঠিক করে নিল। সহজাত কারণেই সে দেবীর উজ্জ্বল তারাটা খুঁজল। রানীর মৃত্যুর সতের তম দিনে, যে রাতে রানীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হল, ঐ তারাটা হঠাৎ করে আকাশে দেখা দেয়, বড় লাল তারাটা সেখানে উঠল যেখানে আগে কোন তারা ছিল না। টাইটা তারাটা খুঁজে অভিবাদন জানাল। তারপর পশ্চিম মরুভূমি দিয়ে চলা শুরু করে নীলের তীরে ফিরে চলল। সেখান থেকে থেব শহর, সুন্দর শতদ্বারের থেবস্-এ।

প্রায় চৌদ্দ বছর আগের ঘটনা এটা এবং এখন সে শুধু একটা নির্জন জায়গার সন্ধানে রয়েছে সেখানে সে তার সমস্ত কিছু একত্রিত করতে পারবে যাতে লসট্রিস যে দায়িত্ব তাকে দিয়েছে তা সে পালন করতে পারে। এখন শুধুমাত্র কিছুটা শক্তি সে রাজকুমারকে দিতে পারে। কেননা সে জানে চারদিক থেকে অনেক কালো শক্তি তাকে ঘিরে রয়েছে যে ব্যাপারে লসট্রিস তাকে সর্তক করেছিল।

এসো সে বালটিকে বলল, চলো নিচে যাই এবং তোমার গড বার্ডটা ধরি।

*

গালালা ছাড়ার তৃতীয় রাতে যখন মকর রাশির নক্ষত্রপুঞ্জ উত্তর আকাশের ঠিক মাথার উপর এল, ফারাও তার সৈন্যবাহিনী থামালেন। ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজেরা রোদে শুকানো মাংস, খেজুর ও ঠাণ্ডা রুটির একটি নিরস ভোজ সারলেন। তারপর পুনরায় চলার নির্দেশ দিলেন। বাদ্যযন্ত্র বাজছে না, কোন শব্দ নেই কারণ তারা এখন এমন জায়গা দিয়ে যাচ্ছেন যেখানে হিকদের আনাগোনা রয়েছে।

ছোট দুলকি পায়ে রথ সারি এগিয়ে চলল। যতোই তারা এগোচ্ছিল চার পাশের পরিবেশ ততোই বদলে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা ঐ বিপদ-সঙ্কুল স্থান থেকে বেরিয়ে এল এবং নদীর ধারে পাহাড়ের উপর এসে পৌঁছল। শূন্যে ঘন কালো বন-বনানী এবং দূরে চন্দ্রালোকের আলো-আঁধারির মাঝে মহান মাতা নীলের গতিপথ দেখা যাচ্ছিল। তারা আবনাব এর প্রশস্ত পথ পাড়ি দিয়েছে এসেছে এবং এখন নদীর ওপারে হিকস্‌সাইনদের প্রধান সৈন্যবাহিনীর নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করছে। যদিও অ্যাপেপির বিশাল সৈন্যবাহিনীর তুলনায় তারা নগণ্য তবুও তারা হচ্ছে ট্যামোসের সব চাইতে ভালো রথী যারা শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে। তদুপরি, তারা একটি বিস্ময়কর জিনিস ধারণ করে আছে।

ফারাও যখন প্রথম এই যুদ্ধ পরিকল্পনাটা তাদের বললেন এবং জানালেন যে একাই তিনি এ অভিযান চালাবেন, তার যুদ্ধ বিষয়ক কাউন্সিলররা তখন ততোখানি জোড়ালোভাবে প্রতিবাদ করল যতোখানি শক্তি নিয়ে দেবতার বিরুদ্ধে কথা বলা যায়। এমন কি বৃদ্ধ ক্ৰাতাস যে ছিল সমগ্র মিশরীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, সেও অবাক হয়ে গেল। সেথের দোহাই এবং তার শরীরের দুর্গন্ধের কসম, আমি আপনার নোংরা কাপড় পরিবর্তন করবো না, যাতে আমি সোজা আপনাকে অ্যাপেপির ভালোবাসার বাহুবন্ধনে পাঠাতে পারি। সেই একমাত্র লোক যে দেব-সম রাজাকে এভাবে কথা বলার সাহস করতে পারে। এই কাজে যোগ্য অন্য কাউকে পাঠান। যদি আপনার তা পছন্দ না হয় তবে সবকিছু আবার ঢেলে সাজান, কিন্তু জ্বিন ও পিশাচদের খাদ্য হতে অন্তত এই মরুভূমিতে হারিয়ে যাবেন না। আপনিই মিশর। যদি অ্যাপেপি আপনাকেই নিয়ে যায় তাহলে সে আমাদের সবাইকেও নিয়ে গেল।

সমস্ত সভাসদের মধ্যে একমাত্র নাজাই তাকে সমর্থন করল, কিন্তু নাজা সবসময়ই বাধ্য ও সঠিক ছিল। তারা এখন মরুভূমি পাড়ি দিয়েছে এবং শত্রুদের পিছনে। কাল সকাল নাগাদ এমন ভাবে তাদের তারা আঘাত হানবে যার ফলে অ্যাপেপির সৈন্যবাহিনী ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যাবে। এবং আরো পাঁচটি সৈন্যদল ও এক হাজার রথ আসছে তাদের সাথে যোগ দিতে। ইতোমধ্যে সে বিজয়ের সুমধুর স্বাধ পেয়ে গেছে। পরবর্তী পূর্ণিমার পূর্বেই সে অ্যাপেপির অ্যাভারিস প্রাসাদে ভোজন করবে।

প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ মিশরের নিম্ন ও উচ্চ রাজ্য আলাদা হয়ে আছে। তখন থেকে হয় কোন জুলুমবাজ কিংবা কোন দখলবাজ উত্তরের অংশ শাসন করেছে। ট্যামোসের লক্ষ্য হচ্ছে হিকস্‌দের তাড়িয়ে দুরাজ্যকে আবারো একত্রিত করা। আর শুধুমাত্র তখনই সে ন্যায়সঙ্গত ভাবে দেবতাদের ইচ্ছায় দুই রাজ্যের হয়ে দ্বৈত-মুকুট পড়তে পারবে।

রাতের হাওয়া তার মুখে এসে ঝটকা দিল, গাল অবশ করার মতো যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তার বর্শা বাহক নিজেকে রক্ষা করতে নিচু হয়ে ঢালের আড়াল নিল। আওয়াজ বলতে একমাত্র রথের চাকার ঘূর্ণন শব্দ আর বর্শাগুলো খাপের মধ্য থেকে ঝনঝন শব্দ তুলছিল। সাবধান! গর্ত! রথ সারির পেছনের দিক থেকে একটা সর্তক বাণী উচ্চারিত হল।

হঠাৎ তার সামনে গেবেল ওয়াদুন এর প্রশস্ত পাথুরে নদী খাত উন্মোচিত হল এবং ফারাও ট্যামোস তার দলবল নিয়ে এগিয়ে চললেন। নদী খাতটি মসৃণ রাস্তা যা তাদের নদীর একটা সমতল পাললিক ভূমিতে নিয়ে গেল। ফারাও ঘোড়ার নাগাল টেনে বর্শা বাহকের দিকে তা ছুঁড়ে দিয়ে নিচে নামলেন। শক্ত হয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যথায় টনটন করছে। পিছনে না ঘুরেই শুনতে পেল নাজার রথ আসছে। হালকা শব্দে রথ থামল। ক্ষীণ কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে নাজা তার পাশে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে আমাদের বিপদ আরো শক্তিশালী হচ্ছে, নাজা বলল। ঐ দিকে দেখুন, ফারাও এর কাঁধের উপর দিয়ে সে তার লম্বা পেশীবহুল হাত দিয়ে নির্দেশ করল। নদীখাত যেখানে গিয়ে সমতলে মিশেছে তার নিচে একটা আলো দেখা গেল, তেলের বাতির হালকা হলুদ একটা আভা। ওটা আল ওয়াদুন গ্রাম। ঐখানে আমাদের গুপ্তচরেরা আমাদের অপেক্ষায় আছে। তারা আমাদের হিকস্‌দের সীমানায় নিয়ে যাবে। সব নিরাপদ কিনা দেখতে আমি এগোচ্ছি। মহামান্য, আপনি কি এখানেই অপেক্ষা করবেন এবং আমি সরাসরি এখানেই ফিরব।

আমিও তোমার সাথে যাব।

ক্ষমা চাচ্ছি। সেখানে বিশ্বাসঘাতকেরা থাকতে পারে, মেম। সে রাজার ছোটবেলার নাম ধরে বলল। আপনি মিশর এবং কোন ঝুঁকি নেওয়া পক্ষে একটু বেশিই মূল্যবান।

ফারাও তার প্রিয় বন্ধুর দিকে ঘুরে তাকালেন, সরু ও সুন্দর। হাসতেই তারার আলোয় নাজার শুভ্র দাঁতগুলো চমকালো এবং ফারাও তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলেন, বিশ্বস্ততা ও স্নেহার্দ্রতার প্রতিফলন স্বরূপ। তাড়াতাড়ি যাও এবং দ্রুত ফিরে এসো। তিনি সম্মতি দিলেন।

নাজা আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ বুকে হাত রাখল এবং রথের কাছে দৌড়ে গেল। তারপর রাজার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে রাজাকে সালাম জানাল। ট্যামোসও হাসিমুখে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন এবং দেখলেন সে নদীখাতের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। নদীর শক্ত বালি ভূমির উপর পৌঁছেই নাজা ঘোড়াগুলোর পিঠে চাবুক চালালো এবং তার রথ দ্রুত আল-ওয়াদুন গ্রামের দিকে ছুটল। নদীরখাতের প্রথম বাকের আড়ালে অদৃশ্য হওয়ার পূর্বে রথটি রূপালি বালির উপর গভীর দাগ এঁকে চলল। রথটা অদৃশ্য হতেই ফারাও অপেক্ষারত তার রথ সারির নিকট গিয়ে সৈন্যদের সাথে শান্ত স্বরে কথা বলতে লাগলেন, কারো কারো নাম ধরে ডাকলেন, হাসি-তামাশা করলেন, তাদেরকে উজ্জীবিত করলেন ও সাহস দিলেন।

তারা তাকে ভালোবাসে এবং সেখানেই তারা যেতে প্রস্তুত যেখানে সে তাদের নিয়ে যাবে।

*

নদী তটের দক্ষিণ তীর ধরে নাজা যযাদ্ধার মতো এগিয়ে চলল। প্রতি পদক্ষেপে সে পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাচ্ছিল, যতক্ষণ না সে বাঁকানো পাথরের চূড়াটার দেখা পেল যা আকাশের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা সন্তুষ্টির শব্দ তার গলা থেকে বের হল। আর একটু এগিয়ে সে এমন একটা জায়গায় পৌঁছুল যেখানটায় নদীখাতের বাঁ দিক দিয়ে একটা হালকা পায়ে হাঁটা পথ বেরিয়ে পুরাতন একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে বেঁকে চলে গেছে। বর্শা বাহককে একটা ধমক দিয়ে থামতে বলে সে রথের পাদানি থেকে নেমে দাঁড়াল এবং বাঁকানো ধনুকটা তার কাঁধে ঠিক করে নিল। তারপর রথের সাথে ঝোলানো মাটির প্রদীপটা তুলে নিয়ে চলতে লাগল। রাস্তাটা এতোই গোলক ধাঁধায় পূর্ণ যে যদি সমস্ত বাঁক ও গলি তার আগেই মুখস্থ না থাকত তবে মিনারে পৌঁছানোর আগে অন্তত ডজন খানেকবার সে রাস্তা হারাত।

অবশেষে সে ওয়াচটাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু স্থানটায় এসে পৌঁছল। এটি অনেক শতাব্দী আগে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এখন প্রায় ধ্বংস হবার উপক্রম। সে কিনারে গেল না কারণ ওপাশে পর্বতের শূন্যে খাড়া গর্ত রয়েছে। দেয়ালের ফাঁকে যেখানে সে এক আঁটি লাঠি লুকিয়ে রেখেছিল তা খুঁজে বের করল। সেগুলো দিয়ে সে দ্রুত একটা ছোট পিরামিড তৈরি করে ফেলল। তারপর মাটির প্রদীপ থেকে কাঠ কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে কিছু শুকনো ঘাস ফেলে দিল। ফলে আগুন খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল এবং সে একটা আলোর সংকেত পাঠাল। নিজেকে না লুকিয়ে সে এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যাতে নিচ থেকে কেউ আর আলোকিত চেহারাটা এবং টাওয়ারের উপরাংশ দেখতে পায়। একসময় লাকড়ি পুড়ে শেষ হয়ে আগুনের শিখা নিভে গেল। অগ্যতা নাজা অন্ধকারে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর নিচের পাথুরে পথে নুড়ি গড়ানোর আওয়াজ সে শুনল। সাথে সাথে সে একটা স্পষ্ট-তীক্ষ শীষ বাজাল। কেউ তার সংকেতের প্রতি-উত্তর দিল এবং সে উঠে দাঁড়াল। সে তার ব্রোঞ্জের তৈরি বাঁকানো তলোয়ারটা খাপ থেকে একটু বের করে রাখল এবং একটা তীর ধনুকের বানে প্রস্তুত রাখল যাতে তৎক্ষণাৎ সে তা ছুঁড়তে পারে। অল্পক্ষণ পরেই হিকস্ ভাষায় একটা কর্কশ কণ্ঠ তাকে ডাকল। সে খুব দ্রুত ও স্বাভাবিকভাবে একই ভাষায় জবাব দিল এবং কমপক্ষে দুজন লোকের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল।

এমনকি ফারাও জানেন না যে নাজার মা হিকস্ ছিল। সময়ের সাথে দখলদাররা মিশরের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। তাদের নিজেদের মাঝে স্ত্রী লোকের সংখ্যা কম থাকায় অনেক হিকস্‌ই মিশরীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছে এবং এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে রক্তের ধারা সংরক্ষিত হয়েছে।

একজন লম্বা লোক দুর্গের ভেতর প্রবেশ করল। সে মানুষের খুলি খচিত বাজু পরিধান করে আছে এবং তার দাঁড়িতে রং-বিরঙের ফিতা বাঁধা। হিকা উজ্জ্বল রঙ খুব ভালোবাসে।

লোকটি তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল, সেথের আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হোক, হে আমার চাচাত ভাই, তারপর নাজা এগিয়ে যেতেই সে তাকে জড়িয়ে ধরল।

এবং তোমার উপরও তার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক, ভাই টর্ক, কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম, নাজা তাকে সর্তক করল এবং ভোরের প্রথম আভার দিকে সে। দৃষ্টি আকর্ষণ করল যা পূর্ব দিগন্তে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

তুমি ঠিক বলেছো। হিক প্রধান তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে দাঁড়ানো তার সহযোগীর নিকট হতে লিলেন কাপড়ে মোড়ানো একটা আঁটি নিল। তারপর নাজার হাতে তা তুলে দিল আর নাজা এমনভাবে তা খুলল যেন সে কোন কামান দাগাতে যাচ্ছে। সে আগুনের শিখায় তীরের খাপটি পরীক্ষা করল। খাপটা খুব হালকা কিন্তু মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি এবং খুব সুন্দরভাবে চামড়া দিয়ে সেলাই করা। কারুকাজটা অসাধারণ। এটি কোন উচ্চপদস্থ যোদ্ধার অস্ত্র। নাজা ঢাকনা খুলে একটা তীর বের করল। সে তীরটিকে আঙ্গুলের ফাঁকে নিয়ে তার স্থায়ীত্ব ও উপযুক্তটা দেখে খুশীতে বাহবা ধ্বনি দিল।

হিকস্‌দের তীর কখনো লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয় না। তীরের শেষাংশে স্থাপিত পালক উজ্জ্বল রঙের এবং তাতে একটা বিশেষ চিহ্ন অংকিত রয়েছে। প্রাথমিক আঘাতটা মারাত্মক না হলেও যে পাথরটি তীরের আগায় বক্রাকারে স্থাপন করা আছে, তা শরীরের মাংসের মধ্যে এমনভাবে ঢুকবে যে কোন শল্যবিদ যদি তীরটা বের করে নিয়েও আসে তবুও সেই ধারালো মাথাটি ভেতরে রয়ে যাবে এবং ধীরে ধীরে তীর বিদ্ধ লোকটির যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হবে। ধারালো, সূঁচালো অংশটি ব্রোঞ্জ-এর চেয়েও শক্ত এবং হাড়ে আঘাত করার পরও এর মসৃণতা কমবে না। নাজা তীরটা খাপের মধ্যে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিল। এই ভয়ানক অস্ত্রটি সাথে নিয়ে রথে ফেরার কোন সুযোগ নেই। যদি তার বর্শা বাহক কিংবা সৈন্যদের কেউ তা দেখে ফেলে তাহলে ব্যাখ্যা করা কষ্ট সাধ্য হবে।

আমাদের এখনো আলোচনা করার অনেক কিছু রয়েছে। নাজা গোড়ালিতে ভর করে বসে পড়ল। টকও তার দেখাদেখি একইভাবে বসল। যতোক্ষণ না নাজা উঠে দাঁড়াল, দুজনে খুব নিচু ও শান্ত স্বরে প্রয়োজনীয় কথা সারল। যথেষ্ট! এখন দুজনেই আমরা জানি আমাদের অবশ্যই কি করতে হবে। অবশেষে আঘাত করার সঠিক সময় এসেছে।

ঈশ্বর আমাদের এই উদ্যোগে প্রসন্ন হোক। নাজা ও টর্ক আবার আলিঙ্গন করল। তারপর কিছু না বলে নাজা ফিরতি পথ ধরল এবং দৌড়ে টাওয়ারের নিচে চলে এল। সরু পথ ধরে পাহাড় থেকে নামতে লাগল।

নিচে ফেরার পূর্বে সে একটা গোপন জায়গায় তীরের খাপটি লুকাল। লুকানোর জন্যে তা ছিল আদর্শ স্থান। একটা কণ্টক বৃক্ষের গোড়া এবং একটা পাথর বেড়িয়ে রয়েছে। খাপটির উপর একটা পাথর চাপা দিতেই তা একটা ঘোড়ার মাথার অবয় পেল। গাছটির উপরের দিকে ডালপালাগুলো রাতের আকাশে দূর থেকেই এক অন্যরকম আড়াআড়ি চিহ্ন তৈরি করেছে। আবার জায়গাটা চিনতে তার এতোটুকু কষ্ট হবে না।

তারপর ওয়াদি অর্থাৎ নদী উপত্যকার সেখানটায় তার রথ রাখা সেই পথে সে চলল।

*

ফারাও ট্যামোস রথটাকে ফিরে আসতে দেখলেন; আর যে দ্রুততার সাথে নাজা আসছিল তাতে তার মনে হল কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটেছে। তিনি দ্রুত তার বাহিনীকে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে যে কোনো ঘটনা মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে বললেন।

নাজার রথ ঝনঝন শব্দ করে ওয়াদির নিচ থেকে পথ বেয়ে উপরে উঠল। ফারাও এর কাছে আসতেই সে লাফিয়ে নামল। কি সমস্যা? ট্যামোস জানতে চাইল। ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলতে পারেন, নাজা তাকে বলল, তার গলা কাঁপছিল, উত্তেজনাটা সে লুকিয়ে রাখতে পারল না। আমাদের শক্তির তুলনায় তারা অ্যাপেপিকে অসুরক্ষিতই রেখেছে।

তা কি করে সম্ভব?

আমার গুপ্তচরেরা আমাকে শত্রু প্রধানের ক্যাম্পের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল, আর এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি তা থেকে ওটা খুব দূরে নয়। তার তাবু পাহাড়গুলোর প্রথম সারির পিছনেই। ঐখানে। সে তার খোলা তরবারি দিয়ে পিছন দিকটা নির্দেশ করল।

তুমি কি নিশ্চিত এটা অ্যাপেপি? ট্যামোস তার উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

ক্যাম্পের আলোয় আমি তাকে পরিষ্কার দেখেছি। তার পুরো অবয়ব। তার বাঁকানো নাক ও আগুনের শিখায় চকচক করা রূপালি দাঁড়ি। এমন দৈহিক গঠন ভুল হতে পারে না। তার চারপাশে যতো লোক ছিল তাদের সবার চাইতে সে লম্বা এবং মাথায় শকুনের মুকুটটাও সে পড়ে ছিল।

তার শক্তির পরিমাণ কতটুকু? ফারাও জানতে চাইলেন।

তার স্বাভাবিক দাম্ভিকতার তুলনায় তার সাথে পঞ্চাশ জনের কম দেহরক্ষী। রয়েছে। আমি শুনেছি এবং অর্ধেকের মতো ঘুমিয়ে ছিল। তাদের বর্শাগুলো সাজানো ছিল। সে কিছুই সন্দেহ করনি এবং তার মশালগুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল। ইচ্ছে করলে একটা তড়িৎ আক্রমণ দ্বারা অন্ধকারে আমরা তাকে সহজেই ধরে ফেলতে পারি।

যেখানটায় অ্যাপেপি অবস্থান করছে সেখানে আমাকে নিয়ে চল, ফারাও নির্দেশ দিয়ে লাফ দিয়ে রথে চড়লেন।

নাজা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, এবং নদী খাতের নরম রূপালি বালি চাকার আওয়াজকে চেপে ধরল, ফলে একটা ভূতুরে নিরবতায় সৈন্যবাহিনী শেষ বাঁকটা অতিক্রম করল। বাত পেরোতেই নাজা বাহু উঁচিয়ে থামার নির্দেশ দিল। ফারাও তার পাশ থেকে সরে এসে আড়াআড়ি দাঁড়াল।

অ্যাপেপির ক্যাম্প কোথায়?

পাহাড়ের ওপাশে। আমি আমার গুপ্তচরদের ওটার উপর নজর রাখতে বলেছি, নাজা পাহাড়ের চূড়ার ওয়াচটাওয়ারে যাবার রাস্তার দিকে নির্দেশ করে বলল। ওপাশে দূরে একটা লুকায়িত মরুদ্যান রয়েছে। সেখানে একটা সুপেয় পানির কূপ এবং খেজুর গাছ রয়েছে। তারা গাছের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়েছে।

আমরা একটা ছোট অগ্রবর্তী দল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সুবিধাজনক স্থানে ক্যাম্প করবো। তারপর কিভাবে আক্রমণ করা যায় তা পরিকল্পনা করব।

নাজা আদেশ মেনে নিল এবং পাঁচজনের একটা দলকে জায়গা খোঁজার জন্য। পাঠাল। এরা প্রত্যেকে তার ঘনিষ্ঠ রক্ত সম্পর্কীয়। মনে-প্রাণে তারা তার একান্ত নিজস্ব লোক।

নিজেদের তরবারির খাপ চেপে ধর, নাজা আদেশ করল, কোন শব্দ করবে না। তারপর বাঁ হাতের ইশারা করে সে আগে বাড়ল। পিছনে ফারাও তার খুব কাছাকাছি রইল। খুব দ্রুত তারা উপরে পৌঁছে যায় এবং হাঁটতে থাকল যতোক্ষণ না নাজা সেই আড়াআড়ি কণ্টক বৃক্ষটির কালো ছায়ার নিকট উপস্থিত হল যা ভোরের আকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ সে থেমল এবং ডান হাত উঠিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। বাতাসে সে কান পাতল।

কি বিষয়? ফারাও তার খুব কাছে এসে ফিস্ ফিস্ করে জানতে চাইল।

মনে হল পাহাড়ের চূড়ায় কোন আওয়াজ শুনতে পেলাম। নাজা বলল, হিকস্‌দের ভাষায়। আপনি একটু এখানেই অপেক্ষা করুন, মহামান্য! আমি সামনের পথ পরিষ্কার করে আসছি। ফারাও এবং সৈন্য পাঁচজন ঘোড়া থেকে নেমে রাস্তার পাছে নিচু হয়ে বসে পড়ল, আর নাজা নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে একটা বড় শিলাখন্ডের আড়ালে নাজা হারিয়ে গেল। এদিকে ধীরে ধীরে সময় যততই গড়াতে লাগল ফারাও ততো অস্থির হয়ে উঠলেন। আলো ছড়িয়ে খুব দ্রুত ভোর হয়ে যাচ্ছে। হিক রাজা সহসাই সব গুছিয়ে নিয়ে তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। একটা মৃদু সংকেত পেয়ে সে তাড়াতাড়ি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। সংকেতটা হল দক্ষভাবে নাটিংগেইল পাখির ভোরের ডাকে অনুকরণ।

ফারাও তার নীল তরবারি উঁচিয়ে ধরলেন। পথ পরিষ্কার, সে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে অনুসরণ কর। তিনি উপরের দিকে চললেন এবং একটা লম্বা পাথরের সামনে এসে ফারাও উপস্থিত হলেন যা পথ রোধ করে রয়েছে। তিনি এর চারদিকে ঘুরে হঠাৎ থেমে গেলেন। লর্ড নাজা বিশ কদম দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু তারা দুজন এখানে আর বাকিরা পাথরে আড়ালে রয়ে গেছে। নাজার ধনুকে তীর লাগানো আর সেটা ফারাও এর উন্মুক্ত বক্ষ বরাবর লক্ষ্য স্থির করা। সে তা হুঁড়ার আগেই, তিনি কিসের সম্মুখীন হচ্ছেন তার পুরোপুরি অর্থ ফারাও এর বোধগম্য হল। এটাই সে জঘন্য ও ঘৃণিত জিনিস যার গন্ধ টাইটা তার অলৌকিক শক্তি দিয়ে অনুভব করেছিল।

তার শত্রুর পূর্ণ অবয়ব দেখার জন্যে ভোরের স্মিত আলোই যথেষ্ট ছিল, যাকে কিনা এতোদিন সে বন্ধু ভেবে এসেছে। খুব শক্ত করে তীরের ধনুকটা টানা, নাজার ঠোঁটে একটা ভয়ঙ্কর বক্র হাসি ফুটে উঠেছে এবং রক্তিম চোখে নিষ্ঠুর শিকারী চিতার ন্যায় সে ফারাও এর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তীরের গোড়া লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের পালকে সজ্জিত এবং ওটার মাথায় হিকদের ধাচে ধারালে ও তীক্ষ্ণ হালকা পাথর লাগানো যা শত্রুর হেলমেট ও বর্ম পর্যন্ত ভেদ করতে সক্ষম।

আপনি দীর্ঘজীবী হউন। নাজা এমনভাবে কথাটা বলল যেন অভিশাপ দিল, এবং তারপর সে তীরটা ছেড়ে দিল। একটা টুং টাং ছন্দ তুলে ধনুক থেকে ওটা রেরিয়ে এল। একটা বিষাক্ত উড়ন্ত পোকার ন্যায় ধীরে ধীরে তীরটটা এগুল। পালকগুলো তীরটাকে ঘুড়াচ্ছিল এবং এটা যখন বিশ কদম দূরত্ব অতিক্রম করল তখন যেন হঠাৎ ওটার মাঝে কিছু একটা জন্ম দিল। যদিও ফারাও এর দৃষ্টি শক্তি যথেষ্ট ভালো ছিল এবং সে কি অবস্থায় রয়েছে অন্য ইন্দ্রিয়গুলোও সে বিষয়ে পূর্ণ সচেতন ছিল তবু সে সামান্যই নড়তে পারল, যা তীরটার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। তীরটি তার ঠিক বুকের মাঝে যেখানটাতে রাজকীয় হৃদপিন্ডটা পাজরের মধ্যে রক্ষিত ছিল সে জায়গায় আঘাত হানল। এমন শব্দে তীরটা ঢুকল যেন একটা পাথর খুব উঁচু থেকে নীলের পুরু কাদার মধ্যে পতিত হল এবং অর্ধেকটা তীর তার বুকের ভেতর ঢুকে গেল। সে আঘাতের ধাক্কায় ঘুরে একটা লাল পাথরের উপর গিয়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্যে সে হাতের আঙুল দিয়ে রুক্ষ পাথরটা ধরে রইল। তীরের মাথার তীক্ষ্ণ পাথর খন্ড ভেতরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। রক্তমাখা তীরটা মাংসপেশীতে অসাধারণভাবে গেঁথে রয়েছে আর রক্তের একটা ধারা মেরুদন্ডের ডানদিক দিকে বয়ে চলল।

তার নীল তরবারি হাতের মুঠো থেকে পড়ে গেল এবং একটা মৃদু চিৎকার তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল। আওয়াজটা তার উজ্জ্বল ফুসফুসের রক্তে চাপা পড়ে গেল। সে হাঁটু ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু পাগুলো কোন শক্তি পেল না। সে পড়ে গেল এবং নখগুলো তার লাল পাথরের গায়ে আঁচড় কেটে গেল।

নাজা একটা হিংস্র চিৎকার দিয়ে সামনে লাফিয়ে গেল, ফাঁদ! সাবধান! এবং যেখানে ফারাও এর বুকে তীর লেগেছে সে স্থানটায় সে তার একটা হাত রাখল।

মৃত্যু পথযাত্রী রাজাকে সাহায্য করতে সে নিচু হল, রক্ষীরা আমি এখানে! এবং সাথে সাথে নাজার চিত্তারে সাড়া দিয়ে দুজন সৈন্য পাথরের ওপাশ থেকে উদয় হল। মুহূর্তেই তারা দেখল কিভাবে ফারাও আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে এবং পালকের উজ্জ্বল গুচ্ছ যা তীরে গোড়ায় লাগালো তা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

হিকস্‌! একজন চিৎকার করে উঠল এবং তারা ফারাওকে নাজার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে পাথরের ছায়ায় নিয়ে গেল।

ফারাওকে তার রথে নিয়ে যাও, ততক্ষণে আমি শত্রুদের দেখে আসছি। নাজা আদেশ দিল এবং চারপাশে শত্রুদের খুঁজতে বেরিয়ে গেল, খাপ থেকে অন্য একটি তীর বের করে ধনুকে লাগিয়ে সেটাকে চূড়ার দিকে শূন্যে ছেড়ে দিল। চিৎকার করে কাল্পনিক শক্রর উদ্দেশ্যে যুদ্ধের আহ্বান করল এবং নিজেই হিকদের ভাষায় তার উত্তর দিতে লাগল।

ট্যামোসের ফেলে রাখা নীল তরবারিটা কুড়িয়ে নিল ও লাফিয়ে পথে নামল এবং ছোট রথ বাহিনীতে যোগ দিতে চলল যেটি রাজাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। নিচে পুরো রথ বাহিনীকে ওয়াদিতে তাদের অপেক্ষা করছে।

এটা একটা ফাঁদ ছিল। নাজা তাদেরকে জরুরি কণ্ঠে বলল। পর্বতচূড়া শক্রতে ছেয়ে আছে। আমারা অবশ্যই ফারাওকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু সে দেখল রাজার মাথা তার কাঁধে দুর্বলভাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং সে সমস্ত সাহায্যের উর্ধ্বে চলে গেছে। নাজার বুকটা বিজয় গর্বে ফুলে উঠল। যুদ্ধের নীল মুকুট ফারাও এর মাথা থেকে খসে পড়ল এবং পথের উপর গড়াল। দ্রুত নাজা এটা কুড়িয়ে নিল এবং নিজের মাথায় পড়ার প্রবল ইচ্ছাকে সে খুব কষ্টে দমন করল।

ধৈর্য ধর। এখনো সময় আসেনি। সে নিরবে নিজেকে ধিক্কার দিল, কিন্তু ইতোমধ্যে মিশর আমার হয়ে গেছে, তার সকল মুকুট এবং যশ এবং শক্তি আমার হতে যাচ্ছে। আমিই মিশর, আমিই এর প্রতিপালক হবো। সে সাবধানে মুকুটটি তার বাহুর নিচে রাখল এবং চিৎকার করে বলল, তাড়াতাড়ি কর, শত্রুরা আমাদের পিছনে ধেয়ে আসছে। রাজাকে অবশ্যই তাদের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না।

বাহিনীটির নিচে সকলের বন্য কান্নার আওয়াজ শুনা গেল এবং তাদের বাহিনীর শল্যবিদ ফারাও-এর রথের পাশের তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে টাইটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং যদিও টাইটার মত তার যাদুর ক্ষমতা নেই তবুও সে একজন দক্ষ ডাক্তার এবং হয়তোবা এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যখন ফারাও এর বুক চিরে যে রক্তের ধারা বইছে তা বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু লর্ড নাজা আর শিকারকে মৃত্যু পথ থেকে ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নিল না। সে রূঢ়ভাবে শল্যবিদকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিল। শত্রুরা এগিয়ে আসছে। তোমার হাতুড়ে ডাক্তারীর সময় নেই। ধ্বংস হবার আগেই আমাদের অবশ্যই নিরাপদ স্থানে ফিরতে হবে।

যারা রাজাকে বহন করছিল তাদের কাছ থেকে সে রাজাকে নিয়ে আন্তরিকভাবে নিয়ে নিজের রথে শুইয়ে দিল। সে রাজার বুক থেকে তীরটা বের করে উঁচিয়ে ধরল যাতে সবাই দেখতে পায়। এই ভয়ংকর, বিভৎস হাতিয়ার আমাদের ফারাওকে পরাস্ত করেছে। আমাদের প্রভু এবং আমাদের রাজা। যে শূয়রের বাচ্চা হিস্ এটা করেছে তাকে সেথ ধ্বংস করুক এবং অনন্ত কাল আগুনে পোড়াক। তার লোকেরা যুদ্ধের মতো প্রতিধ্বনি করে সম্মতি জানাল। সতর্কতার সাথে নাজা তীরটাকে একটা লিনেনের কাপড়ে জড়িয়ে রথে পার্শ্বস্থ একটা চোঙের মধ্যে রাখল। সে এটা ফারাও এর মৃত্যু প্রমাণ হিসেবে থেবস্ এর সভা পরিষদে পেশ করবে।

এখানে এমন কেউ কি আছে সে রাজাকে ধরে রাখবে, নাজা আদেশ দিল। খুব আলতো করে।

যখন রাজার বর্শা বাহক এগিয়ে এল তখন নাজা ফারাও এর কোমর থেকে তরবারি বন্ধনীটা খুলে ফেলল এবং নীল তরবারিটা কোষবদ্ধ করে সাবধানে নিজের অস্ত্রের সাথে রেখে দিল। বর্শা-বাহক লাফ দিয়ে পাদানিতে উঠে ট্যামোসের মাথা ধরে রাখল দুহাতে। যখন রথ ঘুরে শুকনো ওয়াদির উপর দিয়ে দ্রুত চলতে লাগল তখন সতেজ লাল রক্তের একটা ধারা ফারাও এর মুখের কিনারা দিয়ে বেয়ে নেমে এল। অন্য রথগুলোকে এটার সাথে তাল রাখতে যথেষ্ট কসরত করতে হচ্ছে। যদিও তাকে তার শক্তিশালী বর্শাবাহক ধরে আছে তারপরও তার শরীরের নিমাংশ ভয়ংকরভাবে নড়াচড়া করতে লাগল।

সামনের দিকে তাকিয়ে নাজা মৃদু হাসল, যা কেউ দেখল না। তার হাসির আওয়াজ রথের চাকার আওয়াজ ও পাথরের ঘর্ষণের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল। তারা ওয়াদি পেরিয়ে বালিয়াড়ি ও ন্যাট্রোন হৃদের দিকে ছুটল।

সময়টা ছিল মধ্য সকাল এবং সূর্যটা আকাশের অর্ধাংশে পৌঁছার পূর্বে নাজা রথের সারিকে থামার নির্দেশ দিল এবং রাজাকে দেখতে শল্যবিদ আবার এগিয়ে এল। রাজার সমস্ত শক্তি, স্পৃহা যে অনেক আগেই তার শরীর ছেড়ে অসীমে যাত্রা করেছে তা বলে দেয়ার জন্য তার বিশেষ দক্ষতার দরকার নেই।

ফারাও মৃত, কব্জি পর্যন্ত ভেজা রাজ রক্ত নিয়ে শল্যবিদ উঠে দাঁড়াল এবং শান্ত স্বরে বলল। সারির মাথায় ভয়াবহ কান্নার রোল পড়ে গেল এবং তা দ্রুত শেষ মাথা অবধি ছড়িয়ে পড়ল। নাজা তাদেরকে শোক পালন করতে দিল এবং তারপর সৈন্যবাহিনীর অধিনায়কদের ডেকে পাঠাল।

সাম্রাজ্য তার প্রধানকে হারিয়েছে, সে তাদের বলল। মিশর ভয়ঙ্কর সময়ের সম্মুখীন। সবচাইতে দ্রুতগামী দশটি রথ ফারাওকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব থেবস্ নিয়ে যাবে। আমিই নিয়ে যাব। আমার মনে হয় সভাসদগণ চাইবে যেন এই রেজিমেন্টটা আমি প্রিন্স নেফারের কাছে নিয়ে যাই।

সে আর প্রথম বীজ বপন করল এবং দেখল তাদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধায় সে বীজগুলোতে শিকড় গজাতে শুরু করেছে। সে করুণ শোকাবহ কণ্ঠে তাদেরকে মোহিত করে রাখতে পারল এবং বলে গেল, আমি রাজকীয় মৃত দেহকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে শল্যবিদ অবশ্যই তা ঢেকে দিবে। কিন্তু এরমধ্যে আমাদেরকে অবশ্যই প্রিন্স নেফারকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে অবশ্যই তার বাবার মৃত্যুর সংবাদ দিতে হবে এবং তার শাসনের সময় এবার হয়েছে। এখন রাজ্যের জন্যে এটাই একমাত্র জরুরি বিষয় এবং সেই সাথে রাজ-প্রতিনিধি হিসেবে তা আমার কর্তব্যও বটে। সে সহজভাবে তার খেতাবটা বলল এবং কেউ কোন প্রশ্ন করল না–এমনি কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল না। সে একটি প্যাপিরাসের স্ক্রৌল খুলল, যা ছিল একটা মানচিত্র, থেব থেকে মেমফিস পর্যন্ত এবং তা ড্যাশবোর্ডের উপর ছড়িয়ে দিল। সে এটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

তোমাকে তোমার বাহিনীকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হবে এবং প্রিন্সের খোঁজে সীমান্তে পাঠাতে হবে। আমার বিশ্বাস যে ফারাও তাকে খোঁজাটার সাথে মরুভূমির মধ্যে মানবিক গুণাবলী শিক্ষা গ্রহণে পাঠিয়েছেন, তাই আমরা তাকে এখানে খুঁজব, গালালা হতে–যেখানে আমরা তাকে শেষ দেখেছিলাম, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে। নাজা একটা জায়গা নির্দেশিত করল এবং প্রিন্সকে খুঁজতে রথের জাল বিছিয়ে অধিনায়কদের ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল।

*

পুরোবাহিনী বাহন যোগে নাজার সাথে গালালায় ফিরে এল? তারপর লাইন ধরে এল সে বহনগুলো যা ফারাও এর মৃত দেহ বহন করছে। ন্যাট্রন হ্রদের তীরে শল্যবিদ ওয়েইফ্রা শবদেহ শুইয়ে দিল এবং রীতি অনুযায়ী দেহের বাম পাশ কর্তন করল। তারপর সে ভেতরের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো বের করে আনল। ন্যাট্রনের ভারি লবণাক্ত পানি দিয়ে পাকস্থলী ও অন্ত্রের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ধুয়ে নিল। তারপর সব অঙ্গগুলো ন্যাট্রনের পানি থেকে বাষ্পীভূত লবণ মেখে একটা মাটির মদের জারের মধ্যে রাখল। রাজার দেহাভ্যন্তর ন্যাট্রোনের লবণ দ্বারা পূর্ণ করা হল এবং লিনেনের কাপড়ে শক্ত লবণ মেখে দিয়ে রাজার দেহ মুড়িয়ে দেওয়া হল। যখন তারা থেবস্‌ পৌঁছবে তখন সে এটা রাজকীয় পুরোহিতের নিকট হস্তান্তর করবে আর তারা তখন সত্তর দিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করবে। নাজা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে চেঁচাতে লাগল। সে রাজার মৃত্যুর খবর পৌঁছনোর আগেই থেবসে পৌঁছতে চায়। এরমাঝে ভগ্ন শহরের তোরণের নিকট সেনাদলের অধিনায়কে ডেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিল, যে কিনা রাজপুত্রকে খুঁজতে যাচ্ছে।

পূর্বের সব রাস্তা তন্নতন্ন করে খুঁজবে। খোঁজাটা একটা ধূর্ত বৃদ্ধ পাখি এবং হয়তো তার চলার পথের সব নিশানা মুছে দেবে কিন্তু তার গন্ধ শুঁকে তাকে খুঁজে বের করবে, সে তাদেরকে আদেশ দিল। সাটাম ও লাকারা মরুদ্যানগুলোর মধ্যে কতক গ্রাম রয়েছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করবে, প্রয়োজনে চাবুক চালাবে এবং গরম লোহার স্যাঁক দিবে যাতে তারা কোনকিছু না লুকায়। বন-জঙ্গলের সব লুকানো জায়গা খুঁজে দেখবে। প্রিন্স ও খোঁজাটাকে খুঁজে বের কর। যতো কষ্টই হোক ব্যর্থ হওয়া চলবে না। অবশেষে যখন দলপতি পানির ব্যাগগুলো পূর্ণ করল এবং যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হল তখন সে তাদের একটা শেষ আদেশ দিল। আর তারা তার হলুদ হিংস্র চোখ ও কণ্ঠের আওয়াজ থেকে বুঝল যে এটা হল সবচাইতে ভয়ংকর আদেশ এবং এর অবাধ্যতা মানে মৃত্যু। যখন তোমরা তাকে পাবে তখন তাকে কেবল আমার হাতেই তুলে দেবে, অন্য কারো হাতে নয়।

তাদের সাথে নুবিয়ান বাহিনী ছিল, যারা হচ্ছে দক্ষিণের বন্য দ্বীপের কালোদাস। মানুষ ও জীব-জন্তু ট্রাকিং-এ তারা অসম্ভব দক্ষ। তাদের রথ যখন জনহীন প্রান্তরে বেড়িয়ে এল এবং সামনে তাদের গতি ধীর হল, লর্ড নাজা আরো কিছু মূল্যবান সময় তাদের দেখে কাটাল। তার বিজয়ানন্দটা একটা অস্বস্তিকর অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। সে জানত যে বৃদ্ধ খোঁজা, টাইটা খুব ধূর্ত প্রকৃতির এবং তার কিছু অদ্ভুত ও অতি চমৎকার অলৌকিক শক্তি রয়েছে। যদি একটাই মাত্র লোক থাকে যে আমাকে এখন হারাতে পারে ছ টাইটা। অন্যদের ওয়ারলকের কৌশলে বিরুদ্ধে না পাঠিয়ে যদি আমি নিজে ওদেরকে ধরে হত্যা করতে পারতাম, খোঁজা আর বাচ্চা ছেলেটাকে! কিন্তু আমার ঠিকানা, থেবস্ আমাকে ডাকছে এবং আমি বিলম্ব করার সাহস দেখাতে চাই না।

সে দৌড়ে রথে ফিরে গেল এবং লাগাম টেনে ধরল। চলো! সে তার দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে এগুবার নির্দেশ দিল। থেবস্-এর দিকে।

খুব দ্রুত তারা ঘোড়া ছুটাল, ফলে যখন তারা পুব পাহাড়ের ঢাল অতিক্রম করে নদীর প্রশস্ত পলিময় স্থানে পৌঁছল তখন তাদের বুকের চামড়া শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে এবং চোখ লাল ও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

আগেরবার যাবার সময় আবনাবের সামনে ক্যাম্প করার পূর্বে সৈন্যবাহিনীকে থেকে নাজা একটা পূর্ণ ফেট গার্ড বাহিনী বাছাই করে রেখে গিয়েছিল। সে তখন ফারাওকে বলেছিল যে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সে তাদের সংরক্ষিত রাখছে যারা প্রয়োজনে শূন্যস্থান পূরণ করবে এবং কোন কারণে হিকা যদি অতর্কিত হামলা চালায় তা প্রতিহত করবে। এরা সবাই তার নিজের লোক। এর অধিনায়ক তার কাছে শপথে বাঁধা ছিল। এখন তারা তার গোপন আদেশ পালন করে আবনাব থেকে ফিরে এসেছে এবং তার জন্যে মরুদ্যানে বসে অপেক্ষা করছে যা কিনা থে থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূর। প্রহরীরা রথের ধূলি সামনে এগিয়ে আসতে দেখল এবং অস্ত্র নিয়ে তৈরি হল। কর্নেল আসমর এবং তার অফিসাররা লর্ড নাজার সাথে সাক্ষাতের জন্যে পূরোপুরি সামরিক সাজে সজ্জিত ছিল। আর তাদের পেছনে সৈন্যবাহিনী অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত।

লর্ড আসমর! নাজা রথ থেকেই তার নাম ধরে অভিবাদন জানাল। থেবসের জন্যে আমি এক ভয়ংকর খবর নিয়ে এসেছি। ফারাও হিকদের হাতে নিহত হয়েছেন।

লর্ড নাজা, আমি আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।

মিশরের অবস্থা এখন পিতৃ-হারা সন্তানের ন্যায়। সৈন্যদের সারির সামনে। এসে নাজা তার রথ থামাল। এবার সে তার কণ্ঠস্বর বাড়াল যেন সৈন্যরা স্পষ্ট শুনতে পায়। প্রিন্স নেফার এখনো শিশু এবং শাসনকার্য পালনের জন্য প্রস্তুত নয়। এখন প্রয়োজনীয় দিক নিদর্শনা দেবার জন্যে মিশরের একজন শাসক অতি প্রয়োজন, নইলে হিকা আমাদের দুঃসময়ের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। সে থামল এবং আসমর দিকে গুরুত্ব সহকারে তাকাল। আসমর তার চেইনটা হালকা ভাবে উঠাল এবং সম্মতি জানাল যা নাজা তার কাছে আশা করেছিল। কেননা তার স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু তাকে পুরস্কার দেবার ওয়াদা করা হয়েছে।

নাজা এবার তার কণ্ঠ নিচুতে নামিয়ে বলল, যদি ফারাও যুদ্ধে মারা যায় তবে আর্মিদের সে অধিকার রয়েছে যে প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ ময়দানে একজন রাজ-প্রতিভূ নিয়োগ দিতে পারবে। সে শান্ত হল এবং এক হাতে মুষ্টি শক্ত করে বুকের উপর রাখল এবং অন্য হাতে বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আসমর তখন এক কদম সামনে এগিয়ে এল এবং ভারি অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। নাটকীয় ভঙ্গিমায় সে তার হেলমেটটা খুলল। তার চেহারাটা কালো এবং কঠিন। নাকের এক পাশে তার তলোয়ারে কাটা লম্বা। চিকন গাঢ় দাগ পাকানো। টেকো মাথায় ঘোড়ার চুলের বিনুনি করা পরচুলা সে পরিধান করে আছে। সে তার খোলা তরবারি আকাশের দিকে উঠাল এবং চিৎকার দিল। আর এমন কণ্ঠে চিৎকার করল যা কিনা যুদ্ধে হট্টগোলের মধ্যেও শোনার জন্য প্রশিক্ষিত। লর্ড নাজা! জয় মিশরের রাজ প্রতিভূ! জয় লর্ড নাজা।

দীর্ঘ একটা নিরবতা বয়ে গেল যততক্ষণ না সৈন্যবাহিনী একত্রে হুংকার দিয়ে উঠে তাতে সায় দিল, একটা শিকারী সিংহের ন্যায়। জয় লর্ড নাজা! জয় রাজ প্রতিভূর!

চিৎকার ও জয়োধ্বনি চলল যতক্ষণ না লর্ড নাজা তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আবার উঠালো। এবং সবাই নিরব হতেই সে স্পষ্টভাবে বলল : আপনারা আমাকে অনেক বড় সম্মান দেখিয়েছেন। আমি গ্রহণ করলাম সে দায়িত্ব যা আপনারা আজ অর্পণ করলেন।

বাক-হার! তারা চিৎকার করে উঠল এবং তরবারি এবং বর্শা দিয়ে তারা তাদের ঢলের আঘাত করতে লাগল যা দূরের পাহাড়ের ঢালে বাজের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেঙে পড়ল।

এই হট্টগোলের মধ্যে নাজা আসমরের সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তায় প্রহরী নিযুক্ত কর। আমি এ স্থান ত্যাগ করার পূর্বে এখানকার কোন কথা যেন এই জায়গা ত্যাগ না করে। একটা কথাও যেন থেবস্ এ আমার আগে না পৌঁছায়।

*

গালালা থেকে যাত্রাটা ছিল তিনদিনের কঠোর সওয়ার। ঘোড়াগুলো ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত, এমনকি নাজাও নিঃশেষিত প্রায়। তবু সে মাত্র এক ঘণ্টা বিশ্রাম নিল, গোসল করল এবং পরিচ্ছেদ বদলে নিল। তারপর তার দাড়ি কামানো চোয়াল, তৈলাক্ত চুল এবং আচড়ানো মাথা নিয়ে সে অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো রথে উপবিষ্ট হল, যা আসমর তার জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছে। রথটি তাঁবুর নিকট অপেক্ষা করছিল। স্বর্ণের পাতা দিয়ে রথের ড্যাশবোর্ড সাজানো যা সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

নাজা একটা লিনেনের সাদা আলখেল্লা পরিধান করেছে এবং বুকে স্বর্ণের প্লেট আর বাহুটা তার মূল্যবান পাথরের বাজুবন্ধে সজ্জিত। কটিতে তার ঝুলছিল সোনালি খাপের মধ্যে অসাধারণ সুন্দর নীল তলোয়ারটা, যা সে ফারাও-এর মৃত দেহ থেকে তুলে নিয়েছে। যার ফলাটা অসাধারণ এক ধাতু পিটিয়ে বানানো হয়েছে, যা ছিল ব্রোঞ্জের চাইতে ভারি, শক্ত ও ধারালো। সমগ্র মিশরে এর মত আর একটিও নেই। এক সময় এটি ট্যানোস, লর্ড হারাব-এর অধিকারে ছিল এবং পরবর্তীতে ফারাওকে তিনি এটা অর্পণ করে গেছেন। তার বেশ-ভূষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা হচ্ছে তার ডান বাহুর কুনুই-এর উপর পরিহিত বাজ পাখির মোহরাঙ্কিত স্বর্ণের মসৃণ বন্ধনি অথচ তা কিনা সবচাইতে কম দৃষ্টি নন্দনীয় অবস্থায় রয়েছে। তলোয়ারের মত এটাও সে নাজা ট্যামোসের শব দেহ থেকে নিয়ে নিয়েছে। মিশরের রাজ প্রতিভূ হিসেবে নাজা এখন থেকে এই বিশেষ ক্ষমতাধারী ব্যাজ পরার ক্ষমতা রাখে।

তার দেহরক্ষীরা তাকে ঘিরে রয়েছে আর পুরো বাহিনী তার পিছন চলছিল। প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে মিশরের নতুন রাজ প্রতিভূ থেবসের দিকে যাত্রা শুরু করল।

আসমর তার বর্শা-বাহক হিসেবে রথে উঠল। পুরো বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সে হয়তো অনভিজ্ঞ কিন্তু হিকস্‌দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ্য রূপে সে নিজেকে প্রমাণ করেছে এবং সে নাজার একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। তাছাড়া তার দেহে হিকস্‌দের রক্ত বইছে। একসময় আসমর ভাবত একটা রেজিমেন্ট নেতৃত্ব দিতে পারাটাই হবে তার সফলতার চূড়ন্ত কিন্তু এখান সে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করেছে এবং হঠাৎ করেই তার সামনে অসীম ক্ষমতার রাস্তা আজ উন্মোচিত। আর যা সে একসময় ভাবতেও ভয় পেতো সে পদমর্যাদার সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন সে পদোন্নতি প্রাপ্ত। এমন কিছু নেই যা সে আজ করতে পরবে না। আর তার পৃষ্ঠপোষক লর্ড নাজকে মিশরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করাতে এমন কোন অসংঙ্গত বা হীন কাজ নেই যা সে আজ করতে দ্বিধা করবে।

আমাদের সামনে এখন কি অবশিষ্ট, আসমর আমার পুরনো কমরেড? সঠিক সময়ে নাজা এমন ভাবে সঠিক প্রশ্নটা করল যেন সে তার চিন্তাগুলো পড়তে পারছে।

ইয়েলো ফ্লাওয়ার ট্যামোস হাউজের একজন প্রিন্স ছাড়া সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, আসমর উত্তর দিল এবং বর্শা দিয়ে পলিবাহিত ধূসর রঙের নীলের পারের পশ্চিমে পাহাড়ের দিকে নির্দেশ করল। উপত্যকার গহীন কবরে তারা শুয়ে আছে।

তিন বছর আগে হলুদ ফুলের প্লেগ বা ইয়েলো ফ্লাওয়ার দুই রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত রোগীর প্রচন্ড জ্বর সহ সারা দেহে ও মুখে হলুদ রঙের ভয়ংকর ক্ষতের সৃষ্টি হয় বলে এর উপর ভিত্তি করে এ রোগের এমন নামকরণ করা হয়েছে। এ রোগ বাছ-বেছে হয়নি। সমাজের প্রতিটি স্তর ও পর্যায়ের লোকদের এটি আক্রমণ করেছে। কাউকে ছাড় দেয়নি–না মিশরীয়, না হিক; না পুরুষ, না মহিলা; না বাচ্চা, কোন কৃষক; না কোন প্রিন্সকে। কাস্তে দিয়ে যেভাবে গাছ বাছা হয় সে ভাবে এটা সবাইকে কচুকাটা করেছে।

ট্যামাস হাউজের আটজন রাজকুমারী ও ছয়জন রাজকুমার মার যায়। ফারাও সন্তানদের মধ্যে শুধুমাত্র দুটি মেয়ে ও প্রিন্স নেফার মেমনন বেঁচে আছে। আর তা যেন ঈশ্বর স্বয়ং মিশরের সিংহাসন দখল করার জন্যে লর্ড নাজার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তোকজন বলাবলি করে যদি বৃদ্ধ যাদুকর ম্যাগোস টাইটা তার যাদু বলে তাদের রক্ষা না করতো তবে তারাও মারা যেত। তাদের বাম হাতের বাহুর উপরের দিকে সে কাটার দাগ এখনো আছে যেখান দিয়ে টাইটা তার আলৌকিক ওষুধ তাদের রক্তে প্রবেশ করিয়ে তাদের ইয়েলো ফ্লাওয়ার বিরুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছিল।

এখন নাজা তার এই অবিস্মরণীয় জয়ের মুহূর্তে বৃদ্ধ যাদুকর টাইটার আলৌকিক ক্ষমতার কথা ভাবছে। কারো অস্বীকার করার কারণ নেই সে সে জীবনের রহস্য খুঁজে পেয়েছে। তার বয়স কত হয়েছে কেউ জানে না; কেউ বলে ১০০ বছর কেউ বলে ২০০ বছর। এখানে তার হাঁটাচলা, রথ চালানো, দৌড়ানো একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের মতই। রথ দৌড়ে কেউ তার সাথে পারে না; জ্ঞানে কেউ তাকে অতিক্রম করতে পারে নি। অবশ্যই প্রভু তাকে ভালোবাসেন এবং তাকে অনন্ত জীবনের রহস্য দান করেছেন।

একদা সে ফারাও ছিল–শুধুমাত্র এ কথাটা নাজা জানে না। সে কি টাইটা ওয়ারলক এর রহস্যময় ক্ষমতাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারবে? প্রথমে তাকে অবশ্যই প্রিন্স নেফারের সাথে ধরে আনতে হবে, তবে তার কোন ক্ষতি করা যাবে না। সে খুবই মূল্যবান। যে রথগুলো নাজা পূর্বে পাঠিয়েছে সেগুলো প্রিন্স নেফারের সাথে সাথে তার জন্যে রাজ সিংহাসনও বয়ে আনবে এবং টাইটার ন্যায় অনন্ত জীবনও।

আসমর তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটাল। একমাত্র আমারই, এই রাজকীয় ফেট গার্ডরা আবনাবের দক্ষিণে যাত্রাকারী বহর। অন্যরা উত্তরে হিকস্‌দের সাথে যুদ্ধে নিয়োজিত। আর থেবকে পাহারা দিচ্ছে একদল বাচ্চা, খোঁড়া ও বৃদ্ধ লোকেরা। আপনার উদ্দেশ্য পূরণে আর কোন বাধা নেই, রাজ-প্রতিভূ।

*

শহরের প্রবেশের যে সশস্ত্র বাধার ভয় তাদের মনে ছিল তা ভিত্তিহীন প্রমাণ হল। প্রহরীরা যখনই নীল বাহিনীকে চিনতে পারল সাথে সাথে প্রধান ফটক পুরোপুরি খুলে দিল এবং অধিবাসীরা তাদের সাথে মিলিত হতে ছুটে এল। তারা নাজাকে বরণ করতে হাতে করে পদ্ম ফুলের মালা নিয়ে এসেছে, কারণ শহর জুড়ে রটে গিয়েছিল যে লর্ড নাজা অ্যাপেপি তথা হিকস্‌দের বিরুদ্ধে বিশাল জয় পেয়েছে।

কিন্তু এই অভিবাদন শীঘ্রই শোকে পরিণত হল যখন তারা রথের মেঝেতে রাজার মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখল এবং যখন শুনল সামনের রথ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ফারাও মারা গেছেন! হিকরা তাকে হত্যা করেছে। তিনি অমর হউন।

শোকাহত জনতা রথের পিছন পিছন মন্দির পর্যন্ত গেল যেখানে বাজার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হবে। তারা কেউ খেয়াল করল না যে আসমরের সৈন্যরা শহরের প্রতিটি কোনে প্রতিটি স্থানে তাদের অবস্থান দৃঢ় করছে।

যে রথটা ট্যামোসের মৃত দেহ বহন করছিল তা যেন জনতার ভিড়ে হারিয়ে গেল। পুরো শহরের লোক এখানে জড়ো হয়েছে। নাজা তার রথ বহর শহরে শীর্ণ রাস্তা দিয়ে দ্রুত নদী তীরবর্তী প্রাসাদ পানে ছুটাল। সে জানে যখন কাউন্সিলের সভ্যগণ রাজার মৃত্যুর খবর শুনবে তখন তারা দ্রুত মিটিং এ বসবে। তারা বাগানের প্রবেশ দ্বারে রথগুলো থামাল এবং আসমর ও পঞ্চাশ জন দেহ রক্ষী নাজার চার পাশ ঘিরে রাখল। তারা প্রাসাদের ভেতর আঙ্গিনা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটতে লাগল। হাইসন্থি ফুল ভর্তি ওয়াটার গার্ডেন, যার পুকুরের স্বচ্ছ পানির নিচে নদীর মাছ ঝলমল করছিল সে সব পিছন ফেলে তারা এগুতে লাগল।

এ রকম অস্ত্রধারী লোকজনের আসার ব্যাপারে কাউন্সিলের কোন ধারণা ছিল না। দরজায় কোন রক্ষী ছিল না এবং চারজন সভাসদ মাত্র জড়ো হয়েছিল। নাজা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল এবং দ্রুত তাদের উপর চোখ বুলাল। তাদের মধ্যে মেনসেট ও টালা ছিল বৃদ্ধ এবং একসময়ের দুর্দন্ত শক্তির এতোটুকুও তাদের মঝে অবশিষ্ট নেই; আর সিনকা সর্বদা দুর্বল ও দ্বিধান্বিত প্রকৃতির। একমাত্র একজন ব্যক্তিই এখানে রয়েছে যাকে তার বিবেচনা করতে হবে।

ক্ৰাতাস ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়সে বড় কিন্তু ঐ রকম একজন বৃদ্ধ ঠিক একটা আগ্নেয়গিরি যেমন। তার গায়ের জামা এলোমেলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সে তার বিছানা থেকে সরাসরি এখানে এসেছে, তবে ঘুম থেকে নয়। লোকজন বলা বলি করে এখনো সে তার দুজন যুবতী স্ত্রী ও সকল উপপত্নীদের সন্তুষ্ট রাখার সামর্থ রাখে, আর নাজারও এতে কোন সন্দেহ নেই। যুদ্ধ ও প্রণয় এই দুই ব্যাপারেই সে দক্ষ, আর সেসব লোক-গাথা পর্যায়ের। নাজা এই দূর থেকেও তার গায়ে স্ত্রী-লোকের সুগন্ধির ঘ্রাণ পাচ্ছে। বাহুর ও নগ্ন বুকের কালো গাঢ় দাগগুলো তার শত যুদ্ধ জয়ের প্রমাণ বহন করে। এই বুড়ো লোকটি কখনো কোন স্বর্ণের অলংকার পরিধান করেনি, কেননা তার ধারণা ওগুলো মানুষকে ষাঁড়ের মত ভারি করে তোলে।

মহামান্য লর্ডগণ! নাজা কাউন্সিলের সদস্যদের অভিবাদন জানাল। আমি আপনাদের জন্যে একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি। সে লম্বা পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করল এবং মেনসেট এবং টালা গুটিসুটি মেরে গেল। তারা তার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইল যেন দুটি খরগোেশ একটা কোবরার সর্পিল আগমনের দিকে চেয়ে আছে। ফারাও মৃত। তিনি যখন এল ওয়াদুন দুর্গে শক্রদের খুঁজে বেরোচ্ছিলেন তখন হিকা তাকে তীর নিক্ষেপে ধরাশায়ী করে।

ক্ৰাতাস ব্যতীত আর সবাই তার দিকে হত-বিহ্বল ভাবে চেয়ে রইল। সেই প্রথম এ দুঃসংবাদের আঘাত সামলে উঠল। তার দুঃখ ক্রোধে পরিণত হল। সে ধীরে ধীরে তার পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াল এবং নাজা ও তার দেহরক্ষীদের পানে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল, ঠিক যেভাবে কাদায় নিমজ্জিত একটা ষাঁড়ের বাচ্চা একটা অর্ধবয়স্ক সিংহের বাচ্চা দেখে অবাক হয়। কোন ধৃষ্টতায় বাজপাখির মোহর তুমি তোমার বাহুতে পরিধান করেছে? নাজা, টিমলাট এর পুত্র; যে কিনা একজন হিক এর গর্ভে জন্মেছে। আর যার তলোয়ার তুমি কোমরে ঝুলিয়েছ তার পায়ের নখের যোগ্যও তো তুমি নও। ক্রাতাসের টেকো মাথা রাগে লাল হয়ে উঠল।

মুহূর্তের জন্যে নাজা হতভম্ভ হয়ে পড়ল। আশ্চর্য! এই বৃদ্ধ দানবটা তার মায়ের গোপন ব্যাপারটা জানল কি করে! খুব গোপন ছিল বিষয়টা। টাইটা ছাড়া এই একজন ব্যক্তি আছে যে তার কাছ থেকে দ্বৈত মুকুট ছিনিয়ে নেবার যোগ্যতা রাখে।

নিজের অজান্তে সে এক পা পিছিয়ে গেল। আমি প্রিন্স নেফারের রাজ-প্রতিভূ এবং সে অধিকার বলে এই নীল বাজপাখির সীল মোহর পড়েছি। সে উত্তর দিল।

না। কাতাসের কণ্ঠে বজ্রপাত হল। তোমার সে অধিকার নেই। শুধু মাত্র মহান ও মহৎ ব্যক্তিদেরই এই নীল বাজপাখির সীল মোহর পরার অধিকার রয়েছে। ফারাও ট্যামোসের সে অধিকার ছিল, ট্যানোস, লর্ড হারাব-এরও তা ছিল এবং তাদের পূর্বোক্ত মহান রাজাদেরও। কিন্তু তুমি, ছিঁচকে চোর, অবিশ্বস্ত কুকুর, তোমার কোন অধিকার নেই।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈন্যরা আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে। আমি প্রিন্স নেফারের রাজ প্রতিভূ।

ক্ৰাতাস এবার এগিয়ে এল। তুমি কোন সৈন্য নও, তুমি হচ্ছ ঐ বেজন্মা হিকদের রক্তধারী। এমনকি তুমি কোন নাগরিক নও, কোন দার্শনিকও নও, তুমি শুধু ফারাও-এর সুদৃষ্টির কারণে একটি স্থান অর্জন করেছে। আমি ফারাওকে তোমার ব্যাপারে অন্তত ১০০ বার সাবধান করেছিলাম।

পিছু হট, বৃদ্ধ বোকা! নাজা তাকে সর্তক করল। আমি ফারাও-এর স্থানে দাঁড়িয়ে। তুমি যদি আমাকে অপদস্ত কর তবে তা মিশর ও তার মুকুটকে অপমান করার সমান হবে।

আমি তোমার কাছ থেকে সীল মোহর ও তলোয়ার কেড়ে নিচ্ছি। কাতাস নিজের অবস্থানের কথা ভুলে গেল। তারপর আমি মনের স্বাদ মিটিয়ে তোমার পিঠের ছাল চাবকে তুলে নেব।

ডান পাশে দাঁড়ানো আসমর তখন নাজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

তৎক্ষনাৎ নাজা তার সুযোগটা কাজে লাগাল। বৃদ্ধের জলন্ত চোখের দিকে সে সরাসরি তাকাল। তুমি একটা পুরোনো বাতাস ও গোবর দলা। সে তাকে চ্যালেঞ্জ করল, তোমার দিন শেষ, ক্ৰাতাস, বুড়ো হাদারাম। মিশরের রাজপ্রতিভূর দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস দেখানো ঠিক নয় তা তোমার জানা উচিত।

সে যেরূপ আশা সে করেছিল, অপমানটা ক্রাতাসের জন্যে ভারি হয়ে পড়ল। সে ছুটে তার দিকে তেড়ে এল। বয়সের তুলনায় সে আশ্চর্য রকম ক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী ছিল। সে নাজাকে ঝাঁপটে ধরে দুহাতে শূন্যে তুলে ধরল এবং বাজপাখির মোহরটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।

তুই এটার যোগ্য না।

থামাও! নিজের চার পাশে না তাকিয়ে নাজা আসমরকে বলল, যে তার পিছনে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবং চিরতরে থামিয়ে দাও!।

আসমর এক পাশে এগিয়ে এল এবং তার খোলা তরবারি দিয়ে ক্রাতাসের ঠিক কিডনি বরাবর আঘাত চালাল। তার প্রশিক্ষিত হাতে আঘাতটা ছিল শক্তিশালী। ব্রোঞ্জের ব্লেড এমনভাবে চালাল যেন একটা সূঁচ সিল্কের কাপড়ের ভিতর দিয়ে চলে গেল। তারপর আসমর তলোয়ারটাকে ঘুরিয়ে ক্ষতটা আরো বড় করল।

ক্রাতাসের দেহ কেঁপে উঠল এবং চোখগুলো বড় হয়ে এল। তার হাতের জোর কমে গেল এবং নাজাকে ছেড়ে দিতেই সে নিজের পায়ে দাঁড়াল। আসমর তলোয়ারটা বের করে নিল, অনেকটা নিরাসক্তভাবে ক্ষতের মাংস দিয়ে ওটা বেড়িয়ে এল। উজ্জ্বল ব্রোঞ্জের ব্লেডটা রক্তে লাল হয়ে গেছে এবং রক্তের একটা ধারা ক্রাতাসের সাদা আলখেল্লার মধ্যে দিয়ে বেরুতে লাগল। আসমর আবার তার তলোয়ার চালাল। এবার আরো শক্তি দিয়ে। পেট থেকে পাজরের দিকে সে ওটা টেনে তুলল। ক্ৰাতাস বিবর্ণ হয়ে গেল এবং তার সিংহের ন্যায় মাথাটা এমনভাবে নাড়াতে লাগল যেন কোন বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমিতে সে রেগে গেছে। সে ঘুরে চেম্বারের দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। আসমর দৌড়ে তার পিছনে গেল এবং পিছন দিকে আঘাত করল। কিন্তু কাতাস হাঁটতেই থাকল। আমার প্রভু, আমাকে সাহায্য করুন এবং কুকুরটাকে হত্যা করতে দিন। আসমর নাজার উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করল এবং নাজা সাথে সাথে নীল তলোয়ারটা বের করে তার সাথে যোগ দিল। নাজার আঘাতটা অন্য আঘাতের চাইতে অনেক গভীরে গিয়ে আঘাত করল। ক্ৰাতাস দরজা দিয়ে আঙ্গিনায় বেড়িয়ে গেল, সারাদেহ তার রক্তে মাখামাখি। পিছু পিছু কাউন্সিলের বাকি সদস্যরা বেড়িয়ে এল এবং চিৎকার করতে লাগল, খুন! মহান ক্রাতাসকে ছেড়ে দাও।

আসমরও তেমন করে চিৎকার করে বলল, বিশ্বাস ঘাতক। সে মিশরের রাজ প্রতিভূর উপর হাত তুলেছে। এবং সে আবার অস্ত্র তুলে ক্রাতাসের হৃদপিন্ড বরাবর নিশানা করল কিন্তু ক্ৰাতাস ততোক্ষণে মাছের পুকুরের নিকটস্থ দেয়ালটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে। যদিও সে দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছল কিন্তু নিজের রক্তে তার হাত লাল ও পিচ্ছিল হয়েছিল এবং মসৃণ পাথরের দেয়ালে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে সে পারল না। সে পানিতে পড়ে গেল এবং তলিয়ে গেল।

ঈশ্বরের দোহাই! বৃদ্ধ জারজটা কি মরবে না? আসমরের কণ্ঠ বিস্ময় ও হতাশা মিশ্রিত।

নাজা দেয়াল ধরে পানিতে কোমর সমান নামল। সে তার একটা পা ক্রাতাসের গলার উপর রেখে চাপ দিয়ে পানির নিচে তার মাথাটা চেপে ধরল। কাতাস তার পায়ের নিচে সংগ্রাম করছিল, পানি তার রক্তে লাল হয়ে গেল এবং নদীর কাদা তার সাথে মিশে গেল। নাজা তার সমস্ত ভর দিয়ে তাকে চেপে ধরে রাখল। ছোট বাচ্চার ঘোড়ায় চড়ার আনন্দের মতো মজা লাগছে! সে দম ফাটা একটা অট্ট হাসি হাসল। সাথে সাথে পাড়ে দাঁড়ানো সৈন্যরাও তাতে যোগ দিল। তারা হাসির গর্জন তুলল।

জীবনের শেষ তৃষ্ণা মিটিয়ে নে, বৃদ্ধ বোকা কাতাস।

বৃদ্ধ লোকটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ল এবং তার ফুসফুসের শেষ বাতাসটুকু কতগুলো বুদবুদ তুলে পানির উপর হারিয়ে গেল এবং অবশেষে সে স্থির হল। নাজা তখন পানি থেকে উঠে এল। ক্রাতাসের দেহটা ধীর লয়ে পানির উপরে ভেসে উঠল এবং নিচের দিকে মুখ করে তা ভেসে রইল।

একে নিয়ে যাও। নাজা আদেশ করল। একে সম্মান জনক ভাবে মমি না করে অন্যান্য দেশদ্রোহীদের সাথে ভেলি অফ দ্য জ্যাকেল এ ফেলে দাও। তার কবরের কোন চিহ্ন দেবে না। আর এভাবে ক্রাতাস স্বর্গ গমন থেকে বঞ্চিত হবে। অন্তত কাল অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে আর এটাই তার শাস্তি।

এরই মধ্যে অন্য সকল সভ্যগণ চলে এসেছে। তারা সবাই কাতাসের করুণ ভাগ্য নিজের চোখে দেখেছে। যখন নাজা তাদের সামনে নীল তরবারিটা খুলে দাঁড়াল তখন তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত এবং ভয়ে কাঁপছিল। হে আমার মহান লর্ডগণ! বিদ্রোহের পরিণাম মৃত্যু। আপনাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কারো কোন প্রশ্ন আছে? সে একে একে সবার দিকে তাকাল এবং তারা সকলে চোখ নামিয়ে নিল। ফেট গার্ডরা দেয়ালের কাছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেহেতু ক্ৰাতাস চলে গেছে সেহেতু তাদের নির্দেশনা দেবার কেউ রইল না।

হে লর্ড মেনসেট, নাজা কাউন্সিলের সভাপতিকে বলল। আপনার কি মনে হয় না যে ক্রাতাসের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।

দীর্ঘক্ষণ মেনসেট চুপ করে রইল। মনে হল যেন সে নাজার কথার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ফিস্ ফিস করে বলল। সঠিক শাস্তি হয়েছে।

কাউন্সিল কি নাজার নিয়োগ ও তাকে মিশরের রাজ-প্রতিভূ হিসেবে মেনে নিয়েছে? নাজা নরম সুরে জিজ্ঞেস করল কিন্তু তার কথা কক্ষের মধ্যে ভয়ংকর এক নিরবতা এনে দিল।

মেনসেট চোখ তুলে অন্য সদস্যদের দিকে তাকাল কিন্তু কেউ তার দৃষ্টি অনুসরণ করল না। সভাপতি ও অন্য সদস্যগণ রাজ প্রতিভূকে স্বীকার করে নিল। অবশেষে মেনসেট নাজার দৃষ্টি বরাবর সরাসরি তাকাল কিন্তু সেখানে সে একটা ভয়ংকর তিক্ত ও নিষ্ঠুর দৃষ্টি খুঁজে পেল। আগামী ভরা পূর্ণিমার আগেই নিশ্চিত তাকে তার বিছানায় মৃত দেখা যাবে। কিন্তু এখন নাজা শুধু মাথা নাড়ল।

আমি সে গুরু দায়িত্ব যা আপনারা আমার উপর ন্যস্ত করেছেন তা গ্রহণ করলাম। সে তার তরবারি খুলে সিংহাসনের দিকে তুলে ধরল। আর রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমার এখন প্রথম দায়িত্ব হল কিভাবে ফারাও ট্যামোস খুন হলেন তা কাউন্সিলের কাছে বর্ণনা করা। সে তাৎপর্য সহকারে এক মুহূর্ত থামল এবং পরবর্তী এক ঘণ্টা রাজার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণনা করে গেল। যখন আমি তাকে পাহাড়ের নিচে নিয়ে আসছিলাম তখন তার শেষ কথা যা তিনি আমাকে বলেছিলেন তা হল আমার একমাত্র পুত্রের খেয়াল রেখো। যতোদিন সে এই দ্বৈত মুকুট পড়ার যোগ্যতা অর্জন না করবে ততোদিন তুমি নেফারের দেখ-ভালো ও ওকে রক্ষা করো। আমার দুই কন্যাকে তোমার ছায়ায় রেখো এবং দেখো যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়।

তার অসীম দুঃখ লুকানোর জন্যে লর্ড নাজা একটু ভনিতা করল। তারপর আবার বলে গেল, আমি আমার প্রভু ও বন্ধু ফারাওকে হারতে দেবো না। ইতোমধ্যে প্রিন্স নেফারকে থেবসে ফিরিয়ে আনার জন্যে রথ পাঠিয়ে দিয়েছি। সে থেবসে পৌঁছা মাত্রই তাকে সিংহাসনে বসিয়ে সমস্ত দায়িত্ব আমি বুঝিয়ে দেবো।

এতোক্ষণে সভাসদগণ গুঞ্জন করলেন এবং লর্ড নাজা বলে চলল, এখন রাজ কন্যাদের আমার কাছে দ্রুত নিয়ে আসা হোক।

যখন তারা দ্বিধাগ্রস্থ ভাবে দরজা দিয়ে ঢুকল তখন বড় মেয়ে হেজারেট তার ছোট বোন মেরিকারার হাত ধরা ছিল। মেরিকারা তার বন্ধুদের সাথে খেলা করছিল। সে ক্লান্ত এবং তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে আছে। তার পাগুলো লম্বা, যেখানে মেয়েলি ভাব এখনো ফুটে উঠেনি এবং বুক এখনো বালকদের ন্যায় সমতল। সে তার কালো লম্বা চুলগুলো একপাশ করে বেঁধেছে এবং তার লিনেন স্কার্টটি এমন এলোমলা ভাবে পরিধান করা যে এর এক পাশ কোমর থেকে নিচ দিকে নেমে আছে। সে এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে সভাসদগণের সামনে লাজুক হাসি হাসল এবং নিজের হাতের উপর তার বোনের হাতের তার চাপ অনুভব করল।

হেজারেট মাত্র প্রথমবারের মত ঋতুবতী হয়েছে এবং একটা স্কার্ট ও পরচুলা পরিধান করেছে, যার ফলে তাকে একজন বিবাহ যোগ্য মহিলার ন্যায় দেখাচ্ছিল। বৃদ্ধ লোকগুলো তাকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল কেননা সে তার দাদী রাণী লসট্রিসের সৌন্দর্য ধারণ করেছে। দুধে আলতা ত্বক তার। নিতম্বটা মসৃণ ও সুঠাম গড়নের এবং তার উন্মুক্ত বুক যেন চাঁদের ন্যায়। তার অভিপ্রায় শান্ত ছিল কিন্তু তার ঠোঁটের কোণায় এক বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠেছে এবং তার বড় বড় গাঢ় নীল চোখে সন্দেহের ছায়া স্পষ্টত।

এদিকে এসো, প্রিয়তমগণ। নাজা তাদের ডাকল, আর তখনি শুধু তারা লোকটিকে চিনতে পারল যে তাদের পিতার খুব ঘনিষ্ঠ ও কাছের মানুষ ছিল। তারা হাসল ও বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে গেল। নাজা সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়াল ও তাদের সাথে মিলিত হতে নিচে নেমে এল এবং তাদের কাঁধের উপর হাত রাখল। তার কণ্ঠ ও অভিব্যক্তিতে করুণ অনুভূতি ফুটে উঠল। তোমাদের এখন শক্ত হতে হবে এবং মনে রাখবে যে তোমরা রাজকন্যা। কারণ আমি তোমাদের জন্যে একটা দুঃখের সংবাদ নিয়ে এসেছি। তোমাদের পিতা ফারাও নিহত হয়েছেন। মুহূর্তের জন্য তারা কিছু বুঝতে পারল না। তারপর হেজারেট করুণ তীক্ষ্ণ চিৎকারে ফেটে পড়ল সেই সাথে মেরিকারা।

আলতো করে নাজা তাদের জড়িয়ে ধরল এবং সিংহাসনের পায়ের কাছে বসিয়ে দিল। তারা সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

রাজকন্যাদের এই দুঃখ ও দুর্দশায় সময় সাহায্য করাটা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাজা সাদস্যদের বলল। যেভাবে আমি প্রিন্স নেফারকে আমার দায়িত্বে নিয়েছি সেভাবে এই দুরাজ কন্যা, হেজারেট ও মেরিকারাও আমার অধীনে থাকবে।

এখন পুরো রাজ-গোত্র তার হাতে। প্রিন্স নেফার কোথায় ও কত শক্তিশালী এটা কোন ব্যাপার না। টালা তার পাশের জনকে ফিস্ ফিস্ করে বলল। আমার মনে হয় সে ইতোমধ্যে মৃত্যু পথযাত্রী। আর নতুন রাজ-প্রতিভূ তার শাসন পদ্ধতির ধারণাটা পরিষ্কার সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

*

গেবেল নগরের সুউচ্চ পাহাড়ের ছায়ায় নেফার বসেছিল। যততক্ষণ না সূর্য তার প্রথম রশ্মি উপত্যকার উপর প্রসারিত করল ততক্ষণ সে নড়ল না। প্রথমে এই ভাবে স্থির হয়ে বসে থাকাটা তার স্নায়ুতন্ত্রে জ্বালা ধরিয়ে দিত এবং তার শরীরের চামড়ার মধ্যে এমন অনুভূত হতো যে যেন কোন পোকা এর উপর দিকে হেঁটে গেল। কিন্তু সে জানে যে টাইটা তাকে দেখছে তাই সে তার দেহকে জোর করে ধরে রাখল। এখন অবশেষে তার অনুভূতিগুলো চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সে পাহাড়ের গভীর থেকে উঠে আসা পানির গন্ধ অনুভব করতে পারে। এটা ধীরে উঠে এসে পাথরের বেসিনটার মধ্যে পড়ে যা তার দুই হাতের তালু একসাথে করে কাপ, আকৃতি দিলে যতোখানি হবে তার চাইতে বড় নয়। তারপর পরের বেসিনে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে, পিচ্ছিল শেওলার সবুজ লাইন ধরে। সেখান থেকে এটা নিচের দিকে বয়ে চলে উপত্যকার শুকনো বালির মধ্যে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারপরও অনেক জীবন এই পানির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। প্রজাপতি ও শুয়ো-পোকা, নাগিন ও টিকটিকি, মনোহরী গজলা-হরিণ, সহজ সাবলীলভাবে তারা নেচে বেড়ায়, ঠিক যেন তাপে কম্পিত ভূমির উপর জাফরণের গন্ধে সুরভিত ধুলির দমকা বাতাস; গায়ে ফুটকি আঁকা ওয়াইন রঙের গলকণ্ঠের পায়রাগুলো–যেগুলো পানির কাছের পর্বত শ্রেণীতে বসবাস করে সবাই এখানে এসে পানি পান করে। এই মূল্যবান জলাশয়গুলোর কাছে টাইটা তাকে নিয়ে এসেছে তার গড-বার্ড ধরার জন্যে।

গেবেল নাগার পৌঁছবার পর থেকেই তারা জাল বুনা শুরু করেছে। থেবসের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাইটা সুতা কিনে এনেছিল। সুতার দাম একটু বেশি পড়েছিল কেননা এটা পূর্বের সে সুদূর ইনডাস নদীর দেশ থেকে আনা হয়েছে যা কিনা নিয়ে আসতে এক জন লোকের কয়েক বছর লেগে যায়। সুন্দর সুতা দিয়ে কিভাবে জাল বুনতে হয় টাইটা নেফারকে শিখিয়ে দিয়েছে। লিনেনের সুতার গুচ্ছ বা চামড়ার ফালির চাইতেও জালের খোপের গিরাগুলো–গাটগুলো বেশি শক্তিশালী, কিন্তু খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না।

যখন জ্বালা বুনা শেষ হল, টাইটার ইচ্ছে ছিল নেফার নিজে ফাঁদগুলো পাতুক। এটা তোমার গডবার্ড। নিজেকেই তোমার সব করতে হবে। সে ব্যাখ্যা করল। আর ঐভাবে প্রভু হুরাসের কাছে তোমার চাওয়ার অধিকারটা বেশি গুরুত্ব পাবে।

তাই ছ্যাকা দেয়ার মতো দিনের আলোতে উপত্যকার মেঝেতে বসে টাইটা ও নেফার ঐ পার্বত্য এলাকাটা অবলোকন করছিল। যখন আঁধার নামল টাইটা পাহাড়ের পাদদেশে ছোট আগুনের কুন্ডলির পাশে এসে বসল এবং নরম সুরে তার যাদুমন্ত্র পাঠ শুরু করল। মাঝে মাঝে বিরতিতে একমুঠো করে হার্ব সে আগুনে ফেলছিল। যখন মাঝরাতের অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য আকাশে অর্ধ বাঁকা চাঁদ উঠল, নেফার পানির কাছের পাহাড়টায় চড়ার অভিযান শুরু করল, যেখানে পায়রাগুলো তাদের বাসা বেঁধেছে। সে দুটি বড় ডানা ওয়ালা পাখি ধরল, সেগুলো অন্ধকারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল এবং ডানা ঝাঁপটাচ্ছিল। তাছাড়া তাদের উপর টাইটার যাদুরও কিছুটা প্রভাব ছিল। কাঁধে ঝুলানো চামড়ার ব্যাগে করে সে ওগুলো নামিয়ে আনল।

টাইটার নির্দেশনা অনুযায়ী নেফার প্রতিটি পাখির ডানা থেকে পালক ছিঁড়ে ফেলল যাতে ওগুলো আর উড়তে না পারে। তারপর তারা পাহাড়ের পাদদেশে ও ঝর্ণার কাছাকাছি একটা জায়গা, পছন্দ করল। স্থানটা এতোটুকু ভোলামেলা যে পাখিগুলোকে উপরের আকাশ থেকে দেখা যাবে। পায়রাগুলোর পা ঘোড়ার লেজের চুলের তৈরি সুতা দিয়ে বাঁধল এবং মাটি পেতে কাঠের খুঁটির সাথে বেঁধে দিল। তারপর তাদের উপর হালকা জালটা ছড়িয়ে দিল এবং বড় বড় ঘাসের উপর তা নিয়ে রেখে এল যা সহজে গড-বার্ডগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।

জালটাকে আলতো করে বাধো, টাইটা তাকে দেখিয়ে দিল, খুব শক্ত করেও না আবার ঢিলা করেও না। এটাকে পাখিটার ঠোঁট ও পায়ের নখকে ছুঁতে হবে এবং তাকে অবশ্যই জড়াতে হবে যাতে আমরা তাকে অবমুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত ওটা ধস্তাধস্তি করে নিজেকে না জখম করে।

যখন সবকিছুতে টাইটা সম্ভষ্ট হল তখন থেকে তাদের অপেক্ষার পালা শুরু হল। শীঘ্রই পায়রাগুলো নিজেদের বন্দীদশায় অভ্যস্ত হয়ে গেল এবং নেফারের দেওয়া খাবার লোভীর ন্যায় খেতে লাগল। তারপর তারা রেশমি জালের নিচে আনন্দ চিত্তে গায়ে সূর্যের আলো ও ধুলা মাখতে লাগল। একটার পর একটা সূর্য স্নাত গরম দিন অতিবাহিত হতে লাগল এবং তারা অপেক্ষায় রইল।

বিকেলের ঠাণ্ডায় তারা পায়রাগুলোকে খাবার দিয়ে আসত। টাইটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কিনারায় বজ্রাসনে বসে সুদীর্ঘ উপত্যকা অবলোকন করত। আর নিচে নেফার ওত পেতে অপেক্ষা করত, কখনো একই স্থানে সে তা করত না। তাই খেলাটা সবসময়ই ছিল বিস্ময়কর, বিশেষ করে যখন প্রাণীগুলো ঝর্ণায় পানি খেতে আসত। টাইটা তার ধ্যান মগ্ন অবস্থায় থেকে যাদু চালনা করত যা কদাচিৎ গজলা হরিণগুলোর বেলায় ব্যর্থ হতো, আর নেফার পানি বরাবর তীর তাক করে বসে থাকতো। প্রতি সন্ধ্যায় তারা গুহার প্রবেশ মুখে বসে হরিণের মাংস আগুনে পুড়ে খেতো।

রানী লসট্রিসের মৃত্যুর পর টাইটা এ গুহায় সাধুর জীবন কাটিয়েছে। এটা তার শক্তির স্থান। যদিও নেফার একজন শিক্ষানবিস এবং বৃদ্ধ মানুষটির যাদুর শক্তি সম্পর্কে তার কোন গভীর জ্ঞান নেই, তবে এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই, কারণ প্রতিদিন ঐ ক্ষমতাগুলো তাকে বিমোহিত করছিল।

তারা যে শুধু গড বার্ড ধরতে আসে নি তা নেফারের বুঝতে বুঝতে গেবেল নাগারে তাদের অনেক দিন অতিক্রান্ত হল। নেফারের যততদূর মনে হয় এই মধ্য বিরতিটা প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনার একটা অংশ, যা টাইটা তার পিছনে ব্যয় করছে। এমনকি ফাঁদের পাশে অপেক্ষার দীর্ঘ ঘন্টাগুলোও পাঠের একটা অংশ। টাইটা তাকে তার দেহ ও সত্তার উপর নিয়ন্ত্রণ শিখাচ্ছে, মনের দরজা খোলার দীক্ষা দিচ্ছে, এমনকি গভীর ভাবে নিজেকে দেখার শিক্ষাও। নিরবতার পাঠোদ্ধার ও ফিসফিসানি শুনা শিখাচ্ছিল যা অন্যরা শুনতে পায় না।

অবশেষে একদিন সে নীরবতার ঐ স্থিরতায় পৌঁছল। এখন নেফার আরো গভীরজ্ঞান ও শিক্ষায় দীক্ষিত, যা টাইটা তাকে দিতে চায়। মরু রাতে তারা একসাথে বসে থাকত, ঘূর্ণায়মান তারার জটিল নকশার নিচে, যা অনাদি কিন্তু মহাসাগরের বাতাস ও স্রোতের ন্যায় অবর্তিত এবং তাকে সে সেই বিস্ময় বর্ণনা করত যার কোন ব্যাখ্যা নেই, যা শুধু ভোলা ও প্রসারিত মন দিয়ে অনুধাবন করা যায়। সে অনুভব করত যে সে এই অলৌকিক জ্ঞানের ছায়াময় পরিধিতে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই সাথে সে তার নিজের ভেতরে জ্ঞানের বর্ধিত ক্ষুধাও অনুভব করত।

একদিন সকালে নেফার যখন ভোরের পূর্বাহ্নে ধূসর আলোতে বাইরে গেল, দেখল ঝর্ণার অপর পাশে মরুভূমির মধ্যে এক গাদা লোক অন্ধকারে নীরবে বসে আছে। সে টাইটাকে তা জানালে বৃদ্ধটি শুধু মাথা নাড়াল। তারা সারা রাত ধরে অপেক্ষা করছে। টাইটা তার কাঁধে একটা পশমি চাদর জড়িয়ে তাদের নিকট গেল।

লোকগুলো যখন আধো আলোতে টাইটার রোগা দেহ চিনতে পারল, তখন তারা করুন অনুনয়ে ফেটে পড়ল। তারা মরুর আদিবাসী এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে নিয়ে এসেছে। বাঁচাগুলো ইয়েলো ফ্লাওয়ার-এ আক্রান্ত। আগুন জ্বর এবং সারা শরীর রোগের হলুদ ক্ষতে তাদের ঢেকে গেছে।

ঝর্ণার অপর পাশে রেখে টাইটা তাদের চিকিৎসা করল। কোন শিশুই মারা গেল না এবং দশ দিন পর আদিবাসীরা গুহার মুখে জওয়ার, লবণ ও অজিন রেখে গেল। তারপর তারা জঙ্গলে চলে গেল। ঐ ঘটনার পর যারা মানুষ ও পশু দ্বারা সৃষ্ট রোগ ও ঘা-এর ক্ষতে ভুগছিল যা তারা আসল। টাইটা তাদের সবার কাছেই গেল এবং কাউকে ফিরিয়ে দিল না। নেফার তার পাশে থেকে কাজ করল এবং যা দেখল ও শুনল তা থেকে আরো অনেক বেশি সে শিখল।

অসুস্থ বেদুইনকে সেবা-শশ্রুষা বা খাবার সংগ্রহ বা নির্দেশনা বা শিক্ষা যা তাকে দেয়া হচ্ছিল এগুলোর পরেও তারা প্রতি সকালে রেশমী জালের নিচে ফাঁদ পাততো ও তার পাশে অপেক্ষা করত।

সম্ভবত তারা টাইটার শান্ত শক্তি বলে বশীভূত হয়েছিল কেননা একদা বন্য পায়রাগুলো এখন শান্তশিষ্ট ও গৃহপালিত মুরগির বাচ্চার মতো হয়ে গেছে। আগের মতো কোন ভয়ের চিহ্ন ছাড়াই তারা নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় এবং যখন তাদের পা খোপের মধ্যে আটকে যেতো তখন জানান দিতে মৃদু কু-কু শব্দ করত ও ডানা ঝাঁপটাত।

তাদের অবস্থানের বিশতম সকালে, প্রতিদিনের মতই নেফার যখন ফাঁদের কাছে তার অবস্থান নিয়েছে তখন এমনকি সরাসরি টাইটার দিকে না তাকিয়ে নেফার গভীরভাবে তার উপস্থিতি বুঝতে পারল। বৃদ্ধলোকটির চোখ বন্ধ এবং সে পায়রাগুলোর মতই সূর্যালোকে ঝিমাচ্ছে। তার ত্বকে অসংখ্য সুন্দর আঁকা-বাঁকা বলি রেখা। প্যাপিরাসের চমৎকার পার্চমেন্টের মতো এটাকে পাঠ করা যাবে বলে মনে হল। তার চেহারায় কোন লোম নেই, ভ্রু বা দাড়ির কোন চিহ্ন নেই; শুধুমাত্র চোখের চারপাশে সুন্দর কাঁচের মত স্বচ্ছ পাপড়ি বিরাজমান। নেফার তার পিতার কাছে শুনেছে খোঁজা করার ফলে টাইটার চেহারায় দাড়ি গজায়নি আর কিছুটা সময়ের স্রোতের জন্যে। কিন্তু সে নিশ্চিত তার দীর্ঘায়ু এবং এই অনঢ় দৈহিক ও জীবনী শক্তির পেছনে আরো কোন গভীর রহস্য রয়েছে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে, একজন যুবতীর চুলের ন্যায় টাইটার চুল ঘন ও শক্ত কিন্তু রূপালি বার্ণিশ এর ন্যায় চকচকে। এটা নিয়ে টাইটা গর্বিত ও ঘাড়ের নিচে সে এটাকে পুরু বেণী করে রাখে ও নিয়মিত পরিষ্কার করে। তার শিক্ষা ও বয়স সত্ত্বেও বৃদ্ধ ম্যাগোসের মাঝে এতোটুকু অহমিকা নেই।

মানবিকতার এই একটু ছোঁয়া তার প্রতি নেফারের ভালোবাসাটা আরো বাড়িয়ে দিল যা তার বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব জাগাল। তার ইচ্ছে হল যদি সে তা কোনভাবে প্রকাশ করতে পারত। কিন্তু সে জানে টাইটা তা বুঝতে পারে কারণ টাইটা সব জানে। টাইটার বাহু সে স্পর্শ করতে যাবে এমন সময় টাইটা জেগে উঠল। নেফার জানে যে টাইটা প্রকৃতপক্ষে ঘুমাচ্ছিল না, বরং তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে গড বার্ড কে ফাঁদে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। যে বুঝতে পারল যে তার এলোমেলো চিন্তা ও চলাফেরা বৃদ্ধ লোকটির কাজে কোন না কোনভাবে সমস্যা করছে, কারণ একটা বিরক্তির ভাব টাইটার মুখে দেখা গেল যা স্পষ্টত: বিষয়টা বুঝিয়ে দিল।

টাইটা যেভাবে তাকে শিখিয়েছে সেভাবে সে লম্বা দম নিয়ে নিজের দেহ ও মনের উপর নিয়ন্ত্রণ নিল। ব্যাপারটা এমন যেন কোন গোপন রাস্তা দিয়ে শক্তির : স্তরে পৌঁছানো। কোন কিছু বোঝার আগেই সময় দ্রুত চলে যাচ্ছিল। সূর্যটা তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে গেল এবং মনে হল যেন দীর্ঘক্ষণ ওটা সেখানে অবস্থান করল। হঠাৎ করে, নেফারের মাঝে একটা অতিন্দ্রিয় ক্ষমতা ভর করল। তার মনে হল যেন সে পৃথিবীর উপর শূন্যে ঝুলে আছে এবং নিচে যা ঘটছে তার সবকিছু সে দেখতে পাচ্ছে। সে দেখল টাইটা ও সে গেবেল নাগারের একটা কূপের পাশে বসে আছে এবং তাদের পাশে মরুভূমিটা প্রসারিত হয়ে গেল। সে নদীটা দেখল যেটা মরুভূমিকে এটা বিশাল বাধের ন্যায় ধারণ করে আছে এবং যা মিশরের সীমা নির্দেশ করছে। সে শহর, রাজ্য, ভূমি যা দ্বৈত মুকুট দ্বারা বিভক্ত, সৈন্যবাহিনী, দুষ্টু মানুষের অপকর্ম এবং ন্যায় ও সৎ লোকের কষ্ট এবং আত্মত্যাগ দেখল। মুহূর্তেই সে তার গন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হল যা তাকে প্রায় আচ্ছন্ন করে ফেলল ও সাহস জোগাল। একই সাথে সে জানল যে আজ তার গড়-বার্ড আসবে। কারণ এখন অবশেষে সে তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। পাখিটা এখানে!

শব্দগুলো এতো স্পষ্ট ছিল যে মুহূর্তের জন্যে নেফারের মনে হল টাইটা কথাটা বলছে, কিন্তু সে লক্ষ্য করে দেখল তার ঠোঁট নড়ছে না, টাইটা অলৌকিকভাবে চিন্তাটা নেফারের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা যে তারই সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত, আর একটু পরেই ফাঁদের পায়রাগুলো দিয়ে তা নিশ্চিত হল।

সে যে শুনেছে এবং বুঝতে পেরেছে তার কোন কিছুই নেফার প্রকাশ করল। সে মাথা ঘুরিয়ে দেখল না কিংবা আকাশের দিকে চোখও তুলল না। সে উপরে তাকানোর সাহস দেখাল না কারণ এতে করে পাখিটা সচেতন হয়ে যেতে পারে অথবা টাইটা রাগান্বিত হতে পারে। কিন্তু সে তার অস্তিত্বের পুরোটা অনুভব করতে পারল।

রাজকীয় বাজপাখি এমন একটা দুর্লভ প্রাণী যাকে খুব কম লোকই মুক্ত ও বন্য অবস্থায় দেখতে পেয়েছে। পেছনের হাজার বছর ধরে প্রত্যেক ফারাও-এর শিকারীরা পাখিগুলোকে খুঁজেছে, ফাঁদ পেতেছে এবং রাজত্বকে পূর্ণ করার জন্যে উড়তে শেখার আগেই ছোট ছানাদের তাদের বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। এই পাখি অধিকারে থাকার অর্থ হচ্ছে, ফারাও-এর মিশরে রাজত্ব করার প্রতি প্রভু হুরাসের অনুমতি রয়েছে।

বাজ পাখি প্রভুর আরেক রূপ, বাজ পাখির মাথা দ্বারা তিনি তার প্রতিচ্ছবি প্রকাশ করেন। ফারাও নিজেই একজন প্রভু তাই সে এটা ধরতে পারেন, জয় করতে পারেন এবং শিকার করতে পারেন কিন্তু অন্য কেউ করলে নির্ঘাত মৃত্যু।

এখন পাখিটা এখানে। তার একান্ত নিজের পাখি। টাইটা এটা স্বর্গ থেকে নামিয়ে এনেছে। উত্তেজনায় নেফারের দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হল এবং ফুসফুসে বাতাসটা মনে হচ্ছে বুক ফেটে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু তবুও সে উপরে তাকানোর সাহস করল না।

সে বাজ পাখিটার আওয়াজ শুনল। এটার চিৎকার একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ মনে হল, যা আকাশ ও মরুভূমির অসীমত্বে হারিয়ে গেল। কিন্তু এটা নেফারের অন্তরে শিহরণে সৃষ্টি করল যেন প্রভু সরাসরি তার সাথে কথা বলছেন। মাথার ঠিক উপরে পাখিটা যখন দ্বিতীয় বার ডাকল এটার কণ্ঠ আরো কম্পিত ও বন্য শোনাল।

পায়রাগুলো ভয়ে বন্য হয়ে উঠল, জালের নিচে লাফালাফি করতে লাগল। এমনভাবে পাখা ঝাঁপটাতে লাগল যে তাদের থেকে পালক খসে পড়তে লাগল এবং তাদের চারপাশে বিবর্ণ ধুলার মেঘ সৃষ্টি হল।

মাথার অনেক উপরে নেফার শুনল বাজপাখিটা ফাঁদের দিকে নামতে শুরু করেছে এবং বাতাস তার ডানায় ঊর্ধ্বমুখী গান গাইতে লাগল। অবশেষে নেফার মাথা তুলল এবং নিরাপদ মনে করে ওটার দিকে তাকাল। কারণ সে জানত যে সব বাজ পাখির ধ্যান তার শিকারের দিকেই থাকে।

সে উপরের দিকে তাকাল এবং দেখল যে পাখিটা মরুর নীল আকাশ থেকে নেমে আসছে। একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য! একটা অর্ধবাহিরকৃত তলোয়ারের ন্যায় পাখিটার পাখা অর্ধ-গুটানো এবং মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। এর শক্তি ও ক্ষমতা নেফারকে জোরে আওয়াজ করতে বাধ্য করল। সে তার বাবার কাছে একটা বাজপাখি দেখেছে, তবে এটার মতন আগে কখনও দেখেনি–এটা যেমন বন্য তেমনি রাজকীয়। সে যেখানে বসে আছে সেদিকে যখন পাখিটা নেমে আসছিল তখন মনে হল যেন অলৌলিকভাবে বাজপাখিটার আকার বড় হল এবং এটার রং গাঢ় হল।

বাঁকানো ঠোঁটের চঞ্চুটা তীক্ষ্ণ ও গাঢ় হলুদ বর্ণের এবং দেখতে আগ্নেয় শিলার মত কালো। চোখগুলো হিংস্র এবং ভেতরের কোনায় কান্নার মতো সোনালি রঙের দাগ, গলাটা ক্রীম রঙের ও আরমাইনের ন্যায় ছোপ-ছোপ। ডানাগুলো কর্পিল ও কালো। প্রতিটি অংশের সমষ্টিতে প্রাণীটা এমন এক অপরূপ সৃষ্টি যে এটা যে প্রভুর প্রতিমূর্তি এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ রইল না। সে এটাকে পেতে চায়, তবে তা কি করে সম্ভব হবে তা সে বুঝতে পারছে না।

বাজপাখিটা যখন রেশমি জালের উপর এসে নামবে এবং ফাঁদে আটকা পড়বে সে সময়ের জন্য সে নিজেকে শক্ত করল। সে অনুভব করল পাশে থাকা টাইটাও একই কাজ করল। তারপর দুজনেই একসাথে সামনে দৌড়ে গেল। আর ঠিক তখন এমন কিছু একটা ঘটল যা সম্ভব হবে তা তার বিশ্বাস ছিল না। বাজপাখিটা পূর্ণবেগে নিচে নেমে এল, তার বেগ এতো ছিল যে পায়রাগুলোর নরম পালকের দেহ ছাড়া কোন কিছুই তাকে থামাতে পারত না। কিন্তু সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাজটা তার পথ পরিবর্তন করল এবং আকাশের নীলে একটা ছোট কালো বিন্দুর ন্যায় হারিয়ে গেল।

সে প্রত্যাখান করল! নেফার ফিস্ ফিস করে বলল। কেন, টাইটা কেন?

প্রভুদের মর্জি আমাদের বোঝার বাইরে। যদিও কয়েক ঘণ্টা ধরে সে স্থির হয়ে বসে ছিল। তারপর ঠিক একজন দৌড়বিদের মত শক্ত ভঙ্গিমায় টাইটা উঠে দাঁড়াল।

সে কি ফিরে আসবে না? নেফার জানতে চাইল। সে আমার পাখি। আমি তাকে আমার হৃদয়ে অনুভব করেছি। সে আমার পাখি। তাকে অবশ্যই ফিরতে হবে।

সে প্রভুর মাথার অংশ। টাইটা মৃদু স্বরে বলল। সে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের অধীন নয়।

কিন্তু সে কেন প্রত্যাখান করল? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। নেফার জোর দিল। টাইটা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। সে পায়রাগুলো মুক্ত করতে চলে গেল। এরই মধ্যে তাদের পালক আবার গজিয়েছে কিন্তু টাইটা তাদের মুক্ত করার পরও তারা উড়ে যাবার চেষ্টা করল না। একটা উড়ে এসে তার কাঁধে বসল। তারপর যখন টাইটা হাল্কাভাবে দুহাতে ধরে উড়িয়ে দিল তখনই ওটা পাহাড়ের দিকে উড়ে গেল।

সে ওটার উড়ে যাওয়া দেখল এবং তারপর ঘুরে গুহার প্রবেশ দ্বারে হেঁটে ফিরে এল। নেফার ধীরে ধীরে তাকে অনুসরণ করল। তার হৃদয় ও পা হতাশায় ভারি হয়ে গেছে। গুহার অন্ধকারে টাইটা পিছনের দেয়ালের পাথরটার উপর বসল এবং সামনের দিকে ঝুঁকে রইল যততক্ষণ না গাছের কণ্টক-ডাল ও ঘোড়ার শুকনো গোবর ধোয়া ছেড়ে আগুনে পরিণত হল। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নেফার তার বিপরীতে বসল।

দীর্ঘক্ষণ দুজন কোন কথা বলল না। বাজ পাখিটা হারানোর ব্যথা নেফারের হৃদয়ে এতোটাই গম্ভীর হয়ে বাজল যেন সে তার হাত আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে। সে জানত টাইটা তখনই কথা বলবে যখন সে প্রস্তুত হবে। অবশেষে টাইটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং মৃদুভাবে বলল, আমাকে অবশ্যই আমন রা-এর ধাঁধা অনুশীলন করতে হবে।

নেফার চমকে উঠল, সে এটা আশা করেন নি। যতোদিন ধরে তারা এক সাথে আছে এর মধ্যে নেফার তাকে দুবার তা করতে দেখেছে। সে জানত এটা একটা ক্ষুদ্র মৃত্যুর মতই যা বৃদ্ধ লোকটি জীবনী শক্তি শোষণ করে নেবে। যখন আর কোন রাস্তা খোলা না থাকে তখন সে ঐ অতি প্রাকৃতিক পন্থা অবলম্বন করে।

নেফার চুপ করে রইল এবং ভয়ের সাথে দেখল যে টাইটা ধাঁধার জন্যে প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে। প্রথমে সে ঔষধি গাছগুলোকে পাত্রে নিয়ে পিষল এবং মাটির পাত্রে পরিমাপ করল। তারপর তামার কেটলি থেকে তার মধ্যে পানি ঢালল। বাষ্পসমূহ যা মেঘের কুন্ডলীর ন্যায় ওখান হতে উদ্‌গরিত হচ্ছিল তাতে এতো ঝাঁঝ ছিলো যে নেফারের চোখে পানি এসে গেল।

মিশ্রণটা ঠাণ্ডা হতেই টাইটা গুহার পিছনের লুকানো জায়গা থেকে ধাঁধার রাখার চামড়ার থলেটা নিয়ে এল। আগুনের পাশে বসে সে আইভরি পাতগুলোকে তার এক হাতে নিল ও আঙুল দিয়ে আলতোভাবে ঘষতে লাগল এবং সুর করে আমন রা-এর মন্ত্র পাঠ করে যেতে লাগল।

মন্ত্ৰসমূহ বা ধাঁধাগুলো দশটা আইভরি পাতের সমষ্টি যা টাইটা নিজে খোদাই করে তৈরি করেছে। প্রতিটি খোদাই করা চিহ্ন দশটি ক্ষমতার প্রতীক এবং ক্ষুদ্রতম শৈল্পিক প্রয়াস। মন্ত্রগুলো পড়ার সাথে সাথে সে পাতের খোদাই করা চিহ্নগুলোকে আঙুল বুলিয়ে স্পর্শ করে গেল। প্রতিটি স্তব পাঠ করার মাঝে সে পাতগুলাতে ফুঁ দিল যাতে তারা তার জীবনি শক্তি পায়। যখন ওগুলো তার শরীরের তাপ নিয়ে নিত, তখন সেগুলো সে নেফারকে দিত। এগুলো ধরে রাখ এবং এ থেকে দম নাও। সে বলল এবং নেফার তার নির্দেশমত কাজ করে যেতে লাগল। টাইটা সুর করে তার ঐন্দ্রজালিক স্তবগুলো পড়ে যেতে লাগল এবং তার সাথে তালে তালে দুলতে লাগলো। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটোকে মনে হল বুঝি উজ্জ্বল হয়ে মনের কোন গুপ্ত জায়গা দেখল। যখন নেফার ধাঁধাগুলোকে দুই সারিতে সাজিয়ে তার সামনে রাখল, তখন সে এ পার্থিব জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন।

তারপর টাইটা যেভাবে তাকে শিখিয়েছে সেভাবে সে মাটির পাত্রে রাখা মিশ্রণের তাপমাত্রাটা আঙুল দিয়ে পরখ করে দেখল। যখন একে যথেষ্ট ঠাণ্ডা মনে হল যা মুখ পুড়িয়ে দেবে না তখন নতজানু হয়ে সে বৃদ্ধ লোকটির সামনে বসল এবং দুই হাতে ধরে তাকে তা দিল।

টাইটা এর শেষ ফোঁটা পর্যন্ত পান করল এবং আগুনের আলোতে তার চেহারা আসোয়ানের খনির চকের ন্যায় সাদা দেখাল। অনেকক্ষণ মন্ত্র পাঠ করার পর ক্রমশ তার কণ্ঠ ফিফিসানির মত শোনাল এবং একসময় চুপ হয়ে গেল। তখন শুধু তার জোরে শ্বাস টানার শব্দ শুনা গেল। সে ওষুধ ও যাদুর মন্ত্রে বিভোর হল। সে গুহার মেঝেতে পড়ে গেল এবং আগুনের পাশে একটা ঘুমন্ত, বিড়ালের ন্যায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রইল। নিজের পশমি চাদর দিয়ে নেফার তখন তাকে ঢেকে দিল এবং তার পাশে বসে রইল যতক্ষণ না সে গোঙানো শুরু করল এবং তার চেহারা বেয়ে ঘাম মাটিতে ঝরে পড়ল।

নেফার জানত বৃদ্ধ লোকটির জন্যে এখন তার আর কিছু করার নেই। সে ছায়াময় জগতের অনেক দূরে চলে গেছে, যেখানে পৌঁছানো নেফারের দ্বারা সম্ভব না এবং এই ধাঁধার ভয়ংকর জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতেও সে পারবে না যা এই বৃদ্ধ মনীষী সহ্য করছে। নিরবে সে উঠে দাঁড়াল। গুহার পিছন থেকে তীর ও ধনুক নিয়ে ঝুঁকে গুহার প্রবেশ দ্বার দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। পাহাড়ের বিপরীতে সূর্য ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে এবং দিগন্তের শেষে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। সে পশ্চিমের বালিয়াড়ির উপর উঠে এলো এবং যখন সে শীর্ষে পৌঁছে উপত্যকার দিকে তাকাল তখন পাখিটা হারানো দুঃখ তার মনে এতোটাই প্রবল হল যে সে টাইটার কথা, তার আমন রা-এর ধাঁধার কথা ভুলে গেল এবং দৌড়াতে শুরু করল। যেন পালাতে চাইছে কোন ভয়ংকর শিকারীর হাত থেকে। তার পায়ের নিচে বালি হিসহিস শব্দ তুলল। অনুভব করল তার চোখের কোণে ভয়ের অশ্রু জমেছে এবং তার গাল বেয়ে গড়িয়ে তা বাতাসে শুকাতে লাগল। সে দৌড়াতেই লাগল যতোক্ষণ না ঘামে তার শরীর ভিজে উঠল ও সূর্য পটে অস্ত গেল। অবশেষে সে গেবেল নগরের দিকে ফিরতি পথ ধরল এবং শেষ কয়েক মাইল অন্ধকারে হাঁটল।

টাইটা তখনো আগুনের পাশে চাদরের নিচে কুঁকড়িয়ে ছিল, তবে এখন অনেকটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নেফার তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল এবং শীঘ্রই ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল যা স্বপ্ন দ্বারা অস্থির এবং দুঃস্বপ্ন দ্বারা তাড়িত ছিল।

যখন সে জাগল দেখল গুহার প্রবেশ মুখে উষা ঝলমল করছে। আর টাইটা আগুনের পাশে বসে হরিণের মাংস কয়লায় ঝলসাচ্ছিল। তাকে অসুস্থ ও বিবর্ণ দেখাল কিন্তু সে তার ব্রোঞ্জের ছুরির এক পাশে এক টুকরো মাংস গেঁথে নেফারের দিকে বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ করে ক্ষিধেয় বালকটির পেট চনমন করে উঠল এবং সে দ্রুত উঠে বসে হাড্ডি থেকে মাংস খুলে খেতে লাগল। সুস্বাদু মাংসের তৃতীয় টুকরাটা যখন সে মুখে পুড়ছিল তখন সে প্রথম বারের মতো কথা বলল। তুমি কি দেখলে, টাইটা? সে জিজ্ঞেস করল।কেন গড বার্ড প্রত্যাখ্যান করল?

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। টাইটা তাকে বলল এবং নেফার জানে নিশ্চয়ই ভবিষ্যদ্বাণীটা অশুভ তাই টাইটা তাকে বলতে চাইছে না।

তারপর কিছুক্ষণ তারা নীরবে খেল, তবে নেফার আর এখন খাবারে কোন মজা পেল না এবং অবশেষে সে নরম স্বরে বলল, তুমি তো ফাঁদগুলো মুক্ত করে দিয়েছ। তো কি ভাবে আমরা কাল জাল টানাবো?

গড বার্ড গেবেল নাগারে আর আসবে না। টাইটা সহজভাবে কথাটা বলল।

তাহলে কি আর আমি আমার পিতার স্থলে কখনো ফারাও হতে পারব না? নেফার জানতে চাইল।

নেফারের কণ্ঠে গভীর কষ্ট ছিল তাই টাইটা তার উত্তরটা নরম স্বরে দিল। তোমার পাখি আমরা তার নীড় থেকে তুলে আনবো।

কিন্তু আমরা তো জানি না গড বার্ডের বাসা কোথায়। নেফার তার খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। একটা করুণ আবেদন নিয়ে সে টাইটার দিকে তাকিয়ে রইল।

বৃদ্ধ লোকটি তার মাথা হ্যাঁ সূচক করে নাড়ল। বাসাটা কোথায় আমি জানি। এটা ধাঁধা থেকে পেয়েছি। কিন্তু তোমার শক্তি ধরে রাখার জন্য তোমাকে খেতে হবে। আগামীকাল প্রথম আলো ফোঁটার আগেই আমরা এই স্থান ত্যাগ করব। সেখানে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।

বাসায় কি ছানা আছে?

হ্যাঁ, টাইটা বলল, বাজ পাখি বাচ্চা তুলেছে। বাচ্চাগুলো উড়ার জন্যে প্রায় প্রস্তুত। আমরা সেখান থেকে তোমার পাখিটা নেব। তারপর নীরবে সে নিজে নিজে বলল, অথবা প্রভু আমাদের জন্যে হয়তো অন্য আরো কোন রহস্য উন্মোচন করবেন।

*

ভোরের আগে অন্ধকার থাকতেই তারা পানির থলে ও ঘোড়ার পিঠের থলেগুলো পূর্ণ করে নিল। টাইটা রাস্তা দেখাল, তারা পাহাড়ের মুখের কিনারার দিয়ে সহজ রাস্তা বেছে নিল। এরই মধ্যে সূর্য দিগন্তের উপরে উঠে এসেছে। গেবেল নাগার তারা অনেক পিছনে ফেলে এল। যখন নেফার সামনে তাকাল সে অবাক হয়ে গেল। তাদের সামনে পাহাড়ের ক্ষীণ সীমারেখা, নীল দিগন্তের বিপরীতে আরেক নীল, এখনো এতো দূরে যে ওটাকে পৃথিবীর কোন পর্বত মনে না হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন বায়বীয় কোন বস্তু মনে হচ্ছে। নেফারের এমন অনুভূতি হল যেন সে পূর্বে এটা দেখেছে এবং সে বলল, ঐ পাহাড়টা। সে হাত তুলে নির্দেশ করল। ঐ পাহাড়ে যেখানে আমরা যাচ্ছি, তাই না টাইটা? সে এতোটাই নিশ্চিত হয়ে বলল যে টাইটা পিছন ফিরে তার দিকে তাকাল।

তুমি কিভাবে জানলে?

গতরাতে আমি এটা স্বপ্নে দেখলাম–নেফার উত্তর দিল।

টাইটা ঘুরে গেল যাতে বালকটি তার অভিব্যক্তি দেখতে না পারে। অবশেষে ভোরের আলোয় যেভাবে মরুভূমি প্রস্ফুটিত হয় সেভাবে তার মন খুলছে। কালো পর্দা যা ভবিষ্যৎকে আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখে তার মধ্য দিয়ে উঁকি মারতে সে শিখছে। প্রাপ্তির এক গভীর আত্মতৃপ্তি টাইটা অনুভব করল। একশ বার সে হুরাসের নাম নিল, তার চেষ্টা বিফল হয়নি।

অর্থাৎ আমরা কোথায় যাচ্ছি তা আমি জানি, নেফার খুব জোর দিয়ে আবার বলল।

হ্যাঁ, অবশেষে টাইটা সম্মতি জানাল। আমার বার-আম-মাসারায় যাচ্ছি।

দিনের সবচাইতে উত্তপ্ত ভাগের পূর্বেই টাইটা একাসিয়া কণ্টক গাছের গভীর একটা ঝোঁপের পাশে আস্তানা গাঢ়ল যাদের শিকড় মাটির গভীরে পানির কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে সবকিছু নামাল এবং তাদের পানি খাওয়াল, নেফার বনের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল এবং মিনিটের মধ্যে সে অন্যদের চিহ্ন আবিষ্কার করল যারা এ স্থান দিয়ে চলে গেছে। উত্তেজিতভাবে সে টাইটাকে ডাকল এবং রথের ছোট ভাগের চাকার দাগ দেখাল, গুনে দেখল দশটা যান; সেই সাথে রান্নার ছাই এবং মসৃণ ভূমির চিহ্ন–যেখানে ঘোড়াগুলোকে একাসিয়ার গুঁড়ির সাথে বেঁধে তারা ঘুমিয়েছে, সব খুঁজে পেল।

হিকস্‌? সে চিন্তিত স্বরে বলল। ঘোড়ার বিষ্ঠাগুলো এখনও তাজা, মাত্র কিছু দিনের পুরানো। এগুলোর উপরের দিক শুকিয়ে গেছে কিন্তু যখন সে একটা দলা ভাঙ্গল ভেতরটা তখনো নরম খুঁজে পেল।

আমাদের বাহিনীর-ই। টাইটা রথের চলার চিহ্নগুলো চিনতে পারল। সর্বোপরি, অনেক দশক আগে সে-ই প্রথম এই শোক দিয়ে তৈরি চাকার নক্সা তৈরি করেছিল। হঠাৎ সে থামল এবং একটা তামার ছোট্ট পাতলা ব্যাজ মাটি থেকে তুলে নিল যা ড্যাশবোর্ড থেকে পড়েছে এবং নরম মাটিতে অর্ধেক ঢুকে ছিল। আমাদের হালকা যানের ডিভিশন, সম্ভবত ফেট রেজিমেন্টের অংশ। যা লর্ড নাজার কমান্ডের অধীন।

তারা এখানে কি করছিল, নিজেদের বহর থেকে এতো দূরে? নেফার জিজ্ঞেস করল, দ্বিধান্বিত, কিন্তু টাইটা কাঁধ উঁচিয়ে ভঙ্গি করল এবং নিজের অস্বস্তি লুকানোর জন্যে ঘুরে চলে গেল।

বৃদ্ধটি বিশ্রামের জন্যে খুব অল্প সময় নিল এবং সূর্য অনেক উপরে থাকতেই যাত্রা শুরু করল। ক্রমশ বার-আম-মাসার স্পষ্ট হয়ে উঠল এবং মনে হল তাদের সামনে আকাশের অর্ধেক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা পর্বত শ্রেণীর পাদদেশের পাহাড়ের প্রথম সারির কাছে পৌঁছতেই, টাইটা তার ঘোড়াটা পরীক্ষা করল এবং পিছনে তাকাল। দূরের নড়াচড়া তার মনোযোগ আকর্ষণ করল এবং চোখের উপর হাত রেখে তা দেখার চেষ্টা করল। মরুর নিচে ধুলার বিবর্ণ একটা আস্তর তার নজরে এল। বেশ কিছু সময় নিয়ে সে ওটা পর্যবেক্ষণ করল এবং দেখল ওটা পূর্ব দিকে যাচ্ছে, রেড-সীর দিকে। এটা কোন ওরেক্স-এর পাল অথবা যুদ্ধ রথের সারি হবে। সে নেফারকে খুলে কিছু বলল না যে কিনা রাজকীয় বাজপাখি ধরার জন্যে সামনের পর্বত থেকে চোখ সরাচ্ছে না। টাইটা পা দিয়ে ঘোড়ার পেটে আঘাত করল এবং বালকটির পাশে চলে গেল। ঐ রাতে যখন তারা বার-আম-মাসার এর অর্ধেক পথ গিয়ে ক্যাম্প করল, টাইটা তখন শান্তভাবে বলল, আজ আমরা আগুন জ্বালব না।

কিন্তু খুব ঠাণ্ডা, নেফার প্রতিবাদ করল।

এবং আমরা এখানে এতো উন্মুক্ত যে মরুর দশ ক্রোশ দূর থেকে তা স্পষ্ট দেখা যাবে।

কোন শত্রু? নেফারের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল, সচকিত হয়ে আঁধার নেমে আসা চারপাশে তাকাল। দেশদ্রোহী? বেদুইনদের আক্রমণ?

সব সময়ই শত্রু বিরাজমান, টাইটা তাকে বল। মরার চাইতে ঠাণ্ডা ভালো, মাঝ রাতের পর ঠাণ্ডা বাতাস যখন নেফারকে জাগিয়ে দিল এবং তার ঘোড়া স্টারগেজার পা দাপাল ও ডেকে উঠল, সে তার ভেড়ার চামড়ার কম্বলের নিচ থেকে গড়াগড়ি দিয়ে বের হল এবং তাকে শান্ত করতে গেল। সে দেখল টাইটাও ইতোমধ্যে জেগে গেছে এবং একটু দূরে বসে আছে।

ও দিকে তাকিয়ে দেখো, সে আদেশ দিল এবং নিচু এলাকার দিকে নির্দেশ করল। দূরে আলোর একটা উজ্জ্বল দীপ্তি দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্প ফায়ার, টাইটা বলল।

মনে হয় তারা আমাদের ডিভিশনের একটা অংশ। যারা ঐ দাগগুলো রেখে গেছে যা আমরা কাল দেখেছি।

আসলে তারাই, টাইটা সম্মত হল। কিন্তু তারপরও তারা অন্য লোক হতে পারে।

চিন্তা-মগ্ন অনেক সময় পর নেফার বলল, আমি যথেষ্ট ঘুমিয়েছি। খুব ঠাণ্ডা, যাই হোক। আমাদের আবার উঠতে হবে এবং চলতে হবে। পর্বতের পাদদেশে পৌঁছার আগেই এখানে সকাল হোক তা চাই না।

ঘোড়ার উপর সব তুলে নিয়ে তারা চাঁদের আলোয় বন্য ছাগলের তৈরি একটা রুক্ষ পথ ধরে এগোতে লাগল যা তাদেরকে বার-আম-মাসারার পূর্ব দিকে নিয়ে গেল। ফলে যখন সূর্য উঠে যাবে তখন দূর ক্যাম্পের লোকেরা তাদের দেখতে পাবে না।

সূর্যের দেবতা, আমন-রা এর রথ হিংস্রভাবে পূবে ফেটে পড়ছে এবং পর্বত সোনালি আলোয় ঝলমল করছিল। গিরিখাদটা ছায়ার অন্ধকার এবং আলো আধারির পার্থক্যে আরো গম্ভীর দেখাচ্ছে এবং অনেক নিচে জঙ্গলটা আরো বৃহৎ ও ঘন মনে হল।

নেফার পিছনে তাকাল এবং আনন্দে চিৎকার করে উঠল, দেখ! এবং পর্বত চূড়ার দিকে নির্দেশ করল। টাইটা নির্দেশিত পথে তাকাল এবং দুটো কালো দাগ দেখল, যা একটা বড় বৃত্ত তৈরি করে আকাশের দিকে মুখ তুলে আছে। একটার উপর সূর্যালোক পড়ছিল ফলে ওটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা ছুটন্ত তারা।

রাজকীয় বাজ পাখি, টাইটা হাসল।এক জোড়া পাখি। তারা ঘোড়া থেকে সব নামাল এবং এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করল যেখান থেকে পাখি দুটোর উপর চোখ রাখা যায়। এতোদূর থেকেও তাদের খুব সুন্দর দেখাল যা-নেফার বর্ণনা করতে পারল না। হঠাৎ করে ছোট পুরুষ পাখিটা বাতাসের বিপরীতে উড়তে লাগল, যেন তার অলস ডানায় হিংস্রতা ভর করেছে।

সে দেখে ফেলেছে, নেফার চিৎকার করে উঠল, একজন প্রকৃত বাজ শিকারীর ন্যায়। ওটাকে এখন দেখ।

এটা যখন নামতে শুরু করল তখন এর গতি এতো দ্রুত হল যে মুহূর্তের জন্যে শিকারটা লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হবার নয়। বাজটা একটা বর্শার মতো আকাশ থেকে নেমে এল। একটা পায়রা পাহাড়ের পাদদেশে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দূর থেকেই নেফার বুঝতে পারল পাখিটা অনাগত বিপদের আভাস পেয়েছে এবং বাজটাকে এড়ানোর চেষ্টা করল। ওটা প্রায় গড়াগড়ি দিয়ে পাগলের মতো উড়ে ভয়ংকর ভাবে নিরাপদ স্থান পাথরটার নিচে যাওয়ার চেষ্টা করল। এক মুহূর্তের জন্যে তার পেটটা বেড়িয়ে ছিল। বাজটা তার থাকু ঐ স্থানটায় ঢুকিয়ে দিল এবং মনে হল বড় পাখিটা রক্তিম ও নীল ধূয়া ছড়িয়ে সব শেষ করে দিল। কবুতরের পালকগুলো সকালের বাতাসে দীর্ঘ মেঘ হয়ে ভেসে চলল এবং বাজটা তার শিকার নিয়ে গিরিখাদের দিকে উড়ে চলে গেল। নেফার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার কিছু দূরে খুনীটা তার শিকার সহ এসে বসল। তাদের পতনের আওয়াজ পর্বতের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলল এবং গিরিখাদে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

এরই মাঝে নেফার আনন্দে নাচতে লাগল এবং এমনকি টাইটাও, যে কিনা সবসময় বাজ পাখি শিকার করতে ভালোবাসে।

যখন বাজটা পায়রাটিকে মেরে ডানা মেলে নিজের বলে শব্দ করে ঘোষণা দিল তখন সে চিৎকার করে বলে উঠল বাক-হারা। স্ত্রী বাজটা নেমে এসে তার সাথীর সাথে যোগ দিল। ডানা গুটিয়ে পুরুষটা তাকে জায়গা করে দিল ভাগ নেবার জন্যে এবং তাদের ধারালো ঠোঁট দিয়ে মাংস খুবলাবার ফাঁকে ফাঁকে তারা নেফারের দিকে তাকাতে লাগল। মানুষ দুটো ও ঘোড়াগুলোর ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিল, কিন্তু যেহেতু তারা নিরাপদ দূরত্বে ছিল তাই তাদের মেনে নিল।

তারপর যখন পাথরের উপর শুধু পায়রাটার রক্তের দাগ ও কিছু পালক কেবল অবশিষ্ট রইল এবং বাজ দুটির পেট পরিপূর্ণ হল তখনই তারা আবার উড়ে চলে গেল। ডানাগুলোর কষ্ট হল তাদের উড়িয়ে নিতে, তারা পর্বতের চূড়ায় গিয়ে বসল। তাদের অনুসরণ কর, টাইটা তার ঝোলা তুলে নিল এবং রুক্ষ পর্বতের খাঁজ দিয়ে চলা শুরু করল। তাদের হারিয়ে ফেলো না।

নেফারের গতি বেশি দ্রুত এবং দীপ্ত ছিল, সে পাখিগুলোর প্রতি নজর রেখে পর্বতের শিরদাঁড়া বরাবর চলতে লাগল।

চূড়ার নিচে পাহাড়টা সুঁচের ন্যায় দুভাগে বিভক্ত, কালো তীক্ষ্ণ পাথর বেষ্টিত, যা এই নিচে থেকেও ভয়ংকর মনে হয়। তারা বাজ পাখিগুলোকে এ প্রাকৃতিক বৃহৎ পাহাড়ে উঠতে দেখল যততক্ষণ না নেফার বুজতে পারল যে তারা কোথায় গেল। যেখানটায় পাথর ঝুলে আছে, পূর্বের চূড়ার মাঝামাঝি সেখানে V-আকৃতির মত পাথর আকার নিয়েছে ওখানে একটা শুকনো ডালপালা ও খড়-কুটার দলা দেখা গেল।

নীড়!, নেফার উত্তেজিত ভাবে বলল। ঐ যে বাসা।

একই সাথে তারা দাঁড়াল মাথা পিছনে হেলে। বাজ দুটাকে প্রফুল্ল দেখাল, একটার পিছনে আরেকটা, নীড়ের কিনারে দাঁড়ানো এবং তারা মুখের ভেতর থেকে খাবার উগলে বের করছিল। পাহাড়ের বাতাসে নেফার আরেকটা ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেল, ছানাগুলো চিৎকার করে খাবার চাইছে। এই দিক থেকে সে এবং টাইটা বাজ পাখির বাচ্চাগুলোকে দেখতে পাচ্ছিল না। নেফার হতাশ হল। যদি আমরা পশ্চিম দিকের চূড়াটায় উঠতাম, ঐখানে, সে নির্দেশ করল, তাহলে আমরা পাখির নীড়টা স্পষ্ট দেখতে পেতাম।

আগে আমাকে ঘোড়াগুলো বাধতে সাহায্য কর, টাইটা আদেশ করল। তারা ঘোড়াগুলোর পা বেঁধে দিল এবং পাহাড়ের পাদদেশে দূর রেড-সী হতে ভেসে আসা বাতাসের শিশিরে ভেজা ঘাস খেতে রেখে গেল।

পর্বতের পশ্চিম চূড়ায় উঠতে তাদের সকালের বাকি সময়টা লেগে গেল। যাহোক টাইটা চূড়ার অন্য পাশে নির্ভুলভাবে সবচাইতে সহজ রাস্তাটা খুঁজে নিল। নিচের দিকে তাকিয়ে নেফারের প্রায় দম আটকে যাবার অবস্থা। অবশেষে তারা শীর্ষ চূড়ার শূন্যে একটা সরু জায়গায় এল। সেখানে তারা কিছু সময় বিশ্রাম নিল এবং দূর সাগর ও চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করল। তাদের মনে হল যে সমগ্র সৃষ্টি তাদের নিচে ছড়িয়ে আছে। আর বাতাস তাদের ঘিরে আর্তনাদ করছে, নেফারে ঝোলটাকে যা দোলাচ্ছিল এবং তার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।

নীড়টা কোথায়? সে জিজ্ঞেস করল। এমনকি এই উপরে এবং অদ্ভুত স্থানটায় দাঁড়িয়ে, পৃথিবীর অনেক উপরে থেকেও তার মনটা শুধু একটাই বস্তুর উপর স্থির হয়ে আছে।

এসো!, টাইটা উঠল এবং একটু ঘুরে তারা তাদের চলার পথটা কৌণিক বরাবর করে নিল এবং ধীরে ধীরে পর্বতের পূর্বের চূড়া দেখতে পেল। তারা উলম্ব পর্বত মুখের দিকে তাকাল যা মাত্র ১০০ কিউবিট দূরে কিন্তু তাদের থেকে এমন গভীর খাদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন যে নেফারের মাথা ঘুরে গেল।

খাদের এই পাশে তারা নীড়টা থেকে একটু উপরে রয়েছে এবং নিচে তাকাতেই তারা ওটা দেখতে পেল। মা পাখিটা কিনারে বসে ডানা মেলে বাচ্চাগুলোকে ঢেকে রেখেছে।

তারা যখন পাহাড়ের চূড়া জড়িয়ে দাঁড়াল, পাখিটা তখন মাথা উঠাল এবং এক দৃষ্টে তাদের দেখতে লাগল, যেভাবে একটা সিংহ রাগে তার কেশর ফুলায় সেভাবে পাখিটা তার ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে রাগ দেখাল। তারপর পাখিটা জোরে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার দিল এবং তাদের উপর চোখ রেখে উড়তে লাগল। পাখিটা তাদের এতো কাছে চলে এল যে এর সব পালকগুলো পরিষ্কার দেখা গেল এবং ছেড়ে আসা নীড়টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে এক জোড়া বাচ্চা খাবার খাচ্ছে এবং বন্য ছাগলের পশমের ন্যায় তাদের গায়ে পালক উঠেছে। ইতিমধ্যে তাদের প্রায় পূর্ণতা চলে এসেছে এবং লম্বায় প্রায় তাদের মায়ের সমান হয়ে গেছে। নেফার ভয়ে ও শ্রদ্ধায় তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা পাখি উঠে দাঁড়াল এবং ডানা ছড়িয়ে ভয়ংকর রকম করে ঝাঁপটাল।

খুব সুন্দর, নেফার আনমনে বলে উঠল। আমার দেখা এ পর্যন্ত সবচাইতে সুন্দর।

সে উড়ার জন্যে অনুশীলন করছে। টাইটা নরম স্বরে তাকে সতর্ক করল। দেখ ওটা কতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কয়দিনের মধ্যেই সে উড়বে।

আমি আজই তাদের ধরতে নামব। নেফার প্রতিজ্ঞা করল এবং শেষ প্রান্তে ফিরে যেতে লাগল, কিন্তু টাইটা কাঁধে হাত রেখে তাকে থামাল।

এটা কোন সহজ বা হালকা কাজ নয়। কিছু মূল্যবান সময় আমাদের পরিকল্পনা করে ব্যয় করতে হবে। এসো, আমার পাশে এসে বসো। নেফার কাঁধের উপর দিয়ে তার দিকে তাকাতেই টাইটা তাদের বিপরীতে থাকা শিলাটা ইঙ্গিতে দেখাল। নীড়টার নিচের পাথর কাঁচের ন্যায় মসৃণ। আর ৫০ কিউবিটের মধ্যে ধরার কিংবা পা রাখার মত কোন জায়গা নেই।

নেফার বাচ্চাগুলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিচে উঁকি দিল। তার পেট গুলিয়ে উঠল কিন্তু বিষয়টাকে সে কোন পাত্তা দিল না। টাইটা যেমন বলেছে আসলে তাই। তাহলে কিভাবে আমি নীড়টার কাছে যাব, টাইটা? আমি বাচ্চাগুলো চাই।

নীড়টার উপরে তাকাও! টাইটা তাড়াতাড়ি তাকে দেখাল। দেখ কিভাবে চূড়াগুলো উপরের দিকে উঠেছে, পর্বতের খুব উপরে।

নেফার মাথা নোয়াল–টাইটা যে ভয়ংকর পথটা তাকে দেখাল সে দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে কিছু বলল না।

আমরা নীড়টার উপরে উঠার একটা পথ খুঁজে বের করবোই। সাথে করে আমরা দড়ি নেব। উপর থেকে ধীরে ধীরে আমি তোমাকে নিচে নামিয়ে দেব। তুমি যদি খালি পায়ে গিঁট ধরে হাতের মুঠো নীড়ের খোলা দিকে নিতে পার তবে তুমি তাদের ধরতে পারব। আর এদিকে রশি টেনে ধরে আমি তোমাকে সোজা করে রাখব।

এখনও নেফার কিছু বলল না। টাইটার কথায় তার বমি বমি ভাব লাগছিল। কোন জীবিত ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চিত এভাবে চড়া ও টিকে থাকা অসম্ভব। টাইটা তার মনের অবস্থা বুঝল তাই কোন জবাবের জন্য জোর করল না।

আমার মনে হয়… নেফার ইতস্তত করে অস্বীকার করতে লাগল, তারপর চুপ হয়ে গেল এবং নীড়ের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে এটাই তার লক্ষ্য। সেগুলোর একটা তার গড-বার্ড এবং এটাই তার পিতার মুকুট অর্জনের একমাত্র পথ। এখন ফিরে যাওয়া মানে ঐ সব কিছুকে অস্বীকার করা যার জন্য প্রভু তাকে পছন্দ করেছেন। সে অবশ্যই যাবে।

টাইটা বালকটির এই মুহূর্তটা অনুভব করল ও যে বুঝল তারপাশে থাকা নেফার বাজটাকে গ্রহণ করল এবং অবশেষে সে সত্যিকারের পুরুষে পরিণত হতে পেরেছে। মনে মনে সে খুব খুশি হল কারণ এটাই তার লক্ষ্য।

আমি কাজটা করব, নেফার সহজভাবে বলল এবং পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চল নিচে যাই ও নিজেদের প্রস্তুত করি।

*

পরদিন সকালে তারা অস্থায়ী ক্যাম্প গুটিয়ে অন্ধকার থাকতেই পর্বতে উঠা শুরু করল। কোন রকমে পা রাখার জন্যে টাইটা একটা পথ পেয়েছিল যা নেফারের তরুণ চোখও দেখেনি। তারা প্রত্যেকে রশির ভারি গোছা বহন করছে যা লিনেন ও ঘোড়ার চুল দ্বারা তৈরি। এগুলো ঘোড়া বাধতে ব্যবহার করা হয়। তারা একটা ছোট পানির থলেও এনেছে। টাইটা সতর্ক করে দিয়েছে যে সূর্য উপরে উঠলে পর্বত চূড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।

পূর্ব পাশের চূড়ার দূরবর্তী অংশ দিয়ে উপরে যখন তারা উঠতে লাগল ততক্ষণে আলো ফুটতে শুরু করেছে এবং সে আলোয় তারা পর্বতের সম্মুখ ভাগ দেখতে পেল। এক ঘণ্টা সময় নিয়ে টাইটা উপরে উঠার একটা রাস্তা তৈরি করে নিল। অবশেষে সে সন্তুষ্ট হল। হুরাসের নামে, যিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী, চলো শুরু করি। সে বলল এবং শূন্যে প্রভুর নামে চিহ্ন আঁকল। তারপর নেফারকে সে তার পছন্দের ঐ স্থানে নিয়ে গেল যেখান থেকে বেয়ে সে উপরে উঠবে।

আমি রাস্তা দেখাব, রশির এক মাথা নিজের কোমরে বাঁধতে বাঁধতে সে বালকটিকে বলল। যখন আমি এগুতে থাকবো তখন রশি ছাড়বে। লক্ষ্য করো আমি কি করি এবং যখন আমি বলবো তখন নিজেও এটা কোমরে বাঁধবে এবং আমাকে অনুসরণ করবে। যদি পিছলে যাও আমি তোমাকে টেনে ধরবো।

প্রথমে ভয়ে ভয়ে নেফার টাইটার পথ অনুসরণ করে উঠতে লাগল। তার অভিব্যক্তি স্থবির এবং ভয়ে মুখখানা বরফের মতন সাদা হয়ে গেছে। টাইটা উপর থেকে তাকে উৎসাহ জোগাল এবং উপরে উঠতে প্রতি পদক্ষেপে বালকটির আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল। তারপর একসময় সে টাইটার পাশে চলে এল এবং দাঁত বের করে হাসল। সহজই তো।

সামনে একটু কঠিন হবে, টাইটা তাকে নিশ্চিত করল এবং পরের শিলাভাগে উঠা শুরু করল। এবার নেফার তার পিছনে বানরের ন্যায় এগিয়ে চলল, উত্তেজনায় ও আনন্দে বিচিত্র শব্দ পর্যন্ত করতে লাগল। তারা একটা পাথরের চিমনির নিচে দাঁড়াল যা একটা সরু খাজের চূড়ার দিকে সরু হয়ে শেষ হয়েছে।

এখন যেভাবে উঠব সেভাবে তোমাকে নীড়ের কাছে নামতে হবে। দেখ কিভাবে আমি হাত ও পা খাজের মধ্যে রাখি। টাইটা চিমনি থেকে বেড়িয়ে এল এবং ধীরে চলতে লাগল কিন্তু কোন বিরতি দিল না। যখন সে চূড়ার সরু প্রান্তটায় পৌঁছে থামল, তাকে নিচ থেকে মনে হচ্ছিল যেন কোন মইয়ের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে আছে। তার সরু পায়ে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।

উপর থেকে টাইটা তাকে ডাকল এবং অনেকটা নাচতে নাচতে ছন্দের তালে নেফার পাথর বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।

কেন? এটাও তো ওরকম হবে? টাইটা তার অহংকারকে নির্দিষ্ট সীমায় রাখার চেষ্টা করল। আর ধমনীতে যুদ্ধ ও মহান দৌড়বিদদের রক্ত বয়ে চলে। সে হাসল এবং তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল যেন সে আবার তরুণ হয়ে গেছে। শিক্ষা শুরু হিসেবে সে আমাকে পেয়েছে–অবশ্যই সে সব অতিক্রম করে যাবে।

যখন তারা পূর্ব পাশের পর্বত-চূড়ায় এক সাথে দাঁড়াল তখন সূর্য মাত্র অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে।

আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব! টাইটা তার কাঁধ থেকে পানির থলেটা নিল এবং বসে পড়ল।

আমি ক্লান্ত নই, টাইটা।

তবুও, আমরা বিশ্রাম নেব, টাইটা তাকে পানির থলেটা দিল এবং দেখল অন্তত ডজন বার সে পানি গিলল। নীড়ের কাছে নামাটা আরো কঠিন হবে। নেফার যখন দম নিচ্ছিল তখন সে তাকে বলল।

তোমাকে সেখানে পথ দেখানোর কেউ থাকবে না এবং একটা স্থান আছে যেখানে তুমি তোমার পা পর্যন্ত দেখতে পারবে না, যেখানে পাথর হেলে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।

আমি পারব, টাইটা।

যদি প্রভুদের ইচ্ছে হয়, টাইটাও সম্মতি জানাল এবং মাথা ঘুরিয়ে নিল যেন বালকটি ভাবে সে পর্বত, সাগর ও মরু যা তাদের শূন্যে ছড়িয়ে তাদের প্রশংসা করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার ঠোঁটের নড়া-চড়াটা সে ওকে দেখাতে চাচ্ছে না যে সে প্রার্থনা করছে। মহান হুরাস! আপনার আশীর্বাদের পাখা ছড়িয়ে দিন, কারণ এই একজন যাকে আপনি পছন্দ করেছেন। সাজিয়ে দিন তাকে, আমার মিসট্রেস লসট্রিস, যে এখন একজন দেবী, কারণ এটা আপনার গর্ভের ফল এবং আপনার রক্ত। খারাপ সেথ, তুমি তোমার হাত সরিয়ে নাও এবং তাকে ছোবে না কারণ যারা বাচ্চাটাকে রক্ষা করছে তাদের দলে তুমি নও। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং বুঝল যে অন্ধকার ও অশুভ দেবতাকে সে চ্যালেঞ্জ করেছে। একটা শংকা তাকে পেয়ে বসল। তারপর সে তাদের খুশি করতে নরম স্বরে বলল: ভালো সেথ, তাকে সফল করো এবং কথা দিচ্ছি পরবর্তীতে যখন আমি তোমার মন্দির অ্যাবিডোসের পথ দিয়ে যাবো তখন একটা ষাড় আমি তোমার উদ্দেশ্যে বলি দেবো।

সে উঠে দাঁড়াল। চল যাত্রা শুরু করা যাক।

সে চূড়ার আড়াআড়ি পথ বরাবর চলতে লাগল এবং দাঁড়িয়ে দূর নিচে ক্যাম্পের দিকে দেখল এবং ঘাস খাওয়ারত ঘোড়াগুলো দেখল। ওগুলোকে এতো ছোট দেখাল যেন মনে হচ্ছিল ইঁদুরের সদ্য জন্মানো ছানা। মা-বাজটা গিরিখাদের উপর আভিজাত্যের সাথে চক্কর দিচ্ছিল। তার আচরণ কিছুটা অন্যরকম মনে হল বিশেষ করে যখন ওটা জোড়ে চিৎকার করল এবং যতোদূর মনে পড়ে সে আগে কখনো এমন শোনেনি। আশপাশে পুরুষ পাখিটার কোন চিহ্ন নেই যদিও সে আকাশ পর্যন্ত খুঁজে দেখল।

তারপর সে নিচে দৃষ্টি নামাল এবং প্রধান চূড়ার অতল গহ্বরে দিকে তাকাল। এবং ঐ তাকটা যেটার উপর গতকাল তারা দাঁড়িয়েছিল তা দেখল। এটা তার মধ্যে শক্তি জোগাল। পাথরে শূন্যে থাকায় নীড়টা দেখা যাচ্ছে না। সে ধীরে কিনারা বরাবর চলতে লাগল যততক্ষণ না সে খাজের দেখা পেল। খাজটা নিচের দিকে নেমে পাথরের খোলা মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর বাজ পাখিটা ওখানেই তার বাসা তৈরি করেছে।

সে একটা পাথর তুলে কিনারা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। যখন এটা দেয়ালের নিচে এবং দৃশ্যের বাইরে চলে গেল তখনই তা আওয়াজ করল। সে আশা করল নীড়টা ওখানেই আছে এবং ওটার সঠিক অবস্থান বুঝতে চাইল, কিন্তু নীড়ের কোন চিহ্ন তার চোখে পড়ল না। শুধু মা-পাখিটাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ও নিঃসঙ্গভাবে চিৎকার করতে শুনল।

টাইটা নেফারকে তার কাছে ডাকল এবং দড়ির এক প্রান্ত তার কোমরে বেঁধে দিল। তারপর সতর্কতার সাথে সে বাঁধনটা পরীক্ষা করল এবং ইঞ্চি ইঞ্চি করে দড়িটা পরীক্ষা করে দেখল তাতে কোন দুর্বল জায়গা আছে কিনা। স্যাডল ব্যাগে বয়ে পাখির বাচ্চাটা আনতে পারবে। সে স্যাডল ব্যাগের গিটটা পরীক্ষা করল এবং নেফারের কাঁধে ঝুলালো যাতে চড়ার সময় এটা তার কোন সমস্যা না করে।

অস্তিরতা বন্ধ করো, টাইটা। আমার পিতা ঠিকই বলতো যে মাঝে মাধ্যে তুমি বৃদ্ধা মহিলার মত আচরণ করো।

তোমার পিতার আমাকে আরও একটু বেশি সম্মান দেখানো উচিত ছিল। আমি তাকে তার জন্মের পর থেকে লালন-পালন করেছি, যেমন এখন তোমাকে করছি। টাইটা নাক দিয়ে আওয়াজ করল এবং আবার গিটগুলো পরখ করতে লাগল ও তার কোমরের গিটটা দেখল। নেফারের মনে হচ্ছিল যেন সে তাকে তার সৌভাগ্যের দিকে যাওয়াটাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছে। তারপর নেফার কিনারা বরাবর হেঁটে গেল এবং কোন অস্বস্তি ছাড়াই ওখানে গিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াল।

সারাটা দিন আমরা এখানে নষ্ট করতে পারি না। নেফার তার বাবার একটা বিখ্যাত কথা লর্ডের ন্যায় উচ্চারণ করল।

টাইটা নিচে বসল এবং এমন একটা অবস্থায় বসল যেন সে তার গোড়ালি কোন খাজের সাথে আটকে নিতে পারে এবং পিছনে হেলে কাঁধের উপর দিকে দড়িটা ধরে রাখতে পারে। সে নেফারের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়াল এবং বালকটির মুখে হাসি দেখল। সে খাদের কিনারে নামল। আর যখন নেফার নামতে লাগল টাইটা ধীরে ধীরে দড়ি ছাড়তে লাগল।

এভাবে নেফার দেয়ালের চওড়া অংশটায় পৌঁছে গেল এবং দুই হাতে রশি ধরে ভয়ংকর রকম ঝুলতে থাকল। তার পা-গুলো নিচের কোন খাজ খুঁজতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে পায়ের পাতার নিচে একটা খাঁজ খুঁজে পেল এবং খালি পায়ে তার উপর ভর করে দাঁড়াল। তারপর কব্জি ঘুরিয়ে ভালো করে রশিটা ধরে গড়িয়ে নামতে লাগল। শেষবারের মতো একবার সে টাইটার দিকে তাকাল, হাসার চেষ্টা করল; কিন্তু হাসিটা দুর্বল মনে হল। তারপর সে ঝুলে পড়ল। আরেকটা খোল পাবার পূর্বে খাজের মধ্যে তার পাটা পিছলে গেল এবং সে দড়ির উপর আংটায় ঝুলে সে ঘুরতে লাগল। পা রাখার কোন জায়গা খুঁজে না পাওয়ায় সে শূন্যে অসহায়ভাবে ঝুলে ঘুরতে লাগল। তার সন্দেহ হল উপরের বৃদ্ধ মানুষটি তাকে উঠানোর শক্তি রাখে কিনা। সে পাগলের মত খাঁজের উপর আচড় কাটল এবং তার আঙুল আটকে গেল। অন্য হাত দিয়ে ঝুঁকে পরের খোলটা ধরল। সে স্ফিত অংশের চারপাশে ছিল। তার হৃদপিন্ড হাঁতুড়ির মতো পিটাচ্ছিল এবং তার কণ্ঠে হিস হিস আওয়াজ হচ্ছিল।

তুমি ঠিক আছ তো? সে টাইটার কণ্ঠ শুনতে পেল।

ঠিক আছি। সে চিৎকার করে উত্তর দিল। দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়ে সে নিচে তাকাল এবং নীড়ের উপরের পর্বতের খাঁজের চওড়া অংশটা দেখতে পেল। তার বাহুগুলো ক্লান্তিতে কাঁপছিল। সে তার ডান পা নিচে নামাল এবং আরেকটা খাঁজ খুঁজে পেল।

টাইটার কথাই ঠিক উপরে উঠার চাইতে নিচে নামা বেশি কঠিন। ডান হাতটা সরাতেই সে দেখল তার আঙ্গুলের গাঁটগুলি কেটে গেছে এবং পাথরের উপর তার রক্তের ছোপ লেগে আছে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে নিচে নেমে সে ঐ জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে খাজটা প্রধান খাজের দিকে উন্মুক্ত হয়েছে। আবার তাকে বাধ্য হয়ে ঘুরে কিনারায় পৌঁছতে হল এবং লুকানো খাজ খুঁজতে হল।

গতকাল সে আর টাইটা যখন খাদের অন্য পাশে বসে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছিল তখন এই কাজটি অনেক সহজ মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন খাদের কিনারে তার দুপা করুণভাবে ঝুলছে এবং অতল গহ্বরটাকে মনে হচ্ছে যেন তাকে দানবের মুখের ন্যায় গ্রাস করে নেবে। সে একটা ছোট আর্তনাদ করল এবং দুই হাতে ঝুলে পর্বতের মুখের সাথে লেগে রইল। একটা ভয় তাতে পেয়ে বসল, উদ্যমতার শেষ চিহ্নটা তার উষ্ণ বাতাসের এক ঝটকায় উবে গেল, যেন ওটা তাকে পর্বত থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিল। সে নিচের দিকে তাকাল, চোখের জল গালের ঘামের সাথে তার মিশে তার এক হল। খাদটা যেন তাকে ইশারা করছে, ভীত থাবাসহ তার দিকে এগিয়ে এল। তার সাহস দুর্বল হয়ে এল। এগুতে থাক, টাইটার গলা তার কানে এসে পৌঁছল, ক্ষীণ কিন্তু উত্তেজনায় পূর্ণ। তোমাকে অবশ্যই পৌঁছতে হবে।

অনেক কষ্টে নেফার আরেকটা ধাপ এগোনোর জন্যে নিজেকে তুলল। তার পায়ের পাতাগুলো নিচে অন্ধের মতো খাজ খুঁজল এবং একটা তাক খুঁজে পেল যা তাকে ধারণ করার মত যথেষ্ট চওড়া। ব্যথায় সে নিজেকে নামিয়ে নিল। বাহুর কাঁপুনির শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ করে তাক থেকে তার পা পিছলে গেল এবং বাহুগুলো তাকে আর ধরে রাখার জন্যে যথেষ্ট দুর্বল ছিল। সে পড়ে গেল এবং একটা করুণ আর্তনাদ করল। সে শুধুমাত্র তার দুই বাহু ধরে রাখতে পরল এবং রশিটা তার মাংসের ভেতর নিষ্ঠুরভাবে ঢেবে গেল। পাজরের নিচে তা তাকে বেঁধে রাখল এবং তার দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা হল। সে খাদের উপর ঝুলে রইল, রশিটি ও তার উপরে থাকা বৃদ্ধ লোকটি তাকে ধরে রাখল।

নেফার তুমি কি আমাকে শুনতে পারছ? তাকে ধরে রাখায় টাইটার কণ্ঠ রুক্ষ শুনাল। উত্তরে বালকটি কুকুরের বাচ্চার মতো একটা কুঁই কুঁই আওয়াজ করল। তোমাকে অবশ্যই একটা খাঁজ ধরতে হবে, এভাবে তুমি এখানে ঝুলে থাকতে পারবে না। টাইটার কণ্ঠ তাকে শান্ত করল, সে চোখ থেকে পানি মুছল এবং এক হাত দূরে থাকা পাথরটা তার দৃষ্টিগোচর হল।

আঁকড়ে ধর, টাইটা তাকে তাগাদা দিল এবং নেফার দেখল যে সে পর্বতের বিপরীতে ঝুলছে। ভোলা মুখটা যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বড়, ঢালু তাকটা এতোটা চওড়া যে যদি সে সেখানে যেতে পারে তাহলে সেখানটায় সে দাঁড়াতে পারবে। সে কম্পিত হাতটা বাড়াল এবং আঙুলের ডগা দিয়ে দেয়াল স্পর্শ করল এবং দুলতে লাগল।

মনে হচ্ছিল যেন এটা এক অসীম সংগ্রাম এবং প্রানান্ত চেষ্টা। অবশেষে সে খোলা মুখ পর্যন্ত যেতে পারল এবং তার খালি পা তাকের উপরে দাঁড়ানোর একটা জায়গা খুঁজে পেল এবং সে গুটিসুটি মেরে সেখানটায় বসল। তারপর সে শক্ত হয়ে দাঁড়াল এবং বাতাসের জন্য হা-হুঁতাশ করতে লাগল।

উপরে থাকা টাইটা তার ওজন অনুভব করল ও দড়ি ছাড়তে লাগল এবং তাকে উৎসাহ দিল। বাক-হারা, নেফার, বাক-হারা! তুমি কোথায়।

আমি নীড়ের উপর পর্বতের খাজের মধ্যে।

তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? টাইটা ছেলেটার মন অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইল যাতে সে তার পায়ের নিচের শূন্যস্থান দেখতে না পায়।

হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে চোখের ঘাম মুছে উঁকি মেরে নিচে তাকাল, আমি নীড়টির কিনারা দেখতে পারছি।

কতটা দূরে?

কাছেই।

তুমি কি ওটা ধরতে পারবে?

চেষ্টা করব।

নেফার সরু খাজের খাদের বিপরীতে পিছনে ঝুঁকে খাড়া মেঝের ঢালু দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল। নিচে সে শুধু শুকনো ডালপালা দেখল যেগুলো নীড়টির চারপাশে বেরিয়ে ছিল। আরেকটু যখন সে নিচে নামল তখন তার সামনে নীড়টি ইঞ্চি ইঞ্চি করে ক্রমশ উন্মোচিত হতে লাগল। তারপর সে চিৎকার করে উঠল। তার কণ্ঠ আরো উত্তেজিত ও শক্তিশালী শোনা গেল।

আমি পুরুষ পাখিটা দেখতে পাচ্ছি, সে এখনো বাসায়।

সে কি করছে? টাইটা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল।

শুটি সুটি মেরে আছে, মনে হয় ঘুমাচ্ছে। নেফারের কণ্ঠ দ্বিধান্বিত। আমি শুধু তার পিঠ দেখছি।

পুরুষ পাখিটা নিশ্চল, অপরিষ্কার বাসার উঁচু দিকটায় শুয়েছিল। কিন্তু এমনভাবে সে ঘুমাচ্ছে যে তার অচেতন অবস্থান সম্পর্কে নেফার বুঝতে পারল না।

বাজ পাখিটাকে এতো কাছে এবং নীড়টা স্পর্শ করার মতো সীমার মধ্যে পেয়ে উত্তেজনায় নেফার তার নিজের ভয়ের কথা ভুলে গেল।

সে আরো দ্রুত এগুল, আরো অধিক আত্মবিশ্বাস সহকারে এবং তার পায়ের নিচের খাজটা মসৃণ হল এবং দাঁড়ানোর মত একটা জায়গা সে পেল।

আমি ওটার মাথা দেখতে পাচ্ছি। তার ডানা দুটো এমনভাবে ছড়ানো যেন একটা মৃত জীব ওটা। সে পাখিটার এতো নিকটে যে হাত বাড়ালেই সে ওটাকে স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু তবুও পাখিটার মধ্যে ভয়ের লেশ মাত্র নেই–নেফার ভাবল।

হঠাৎ তার বোধোদয় হল যে ইচ্ছে করলে ঘুমন্ত পাখিটিকেই তো সে ধরতে পারে। সে কাজটি করার জন্য নিজেকে শক্ত করে আটকালো। ধীরে ধীরে সে পাখিটির দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু পরক্ষণেই তার হাত থেমে গেল। পিছনের পালকে সে হালকা রক্তের দাগ দেখতে পেল। মসৃণ রুবি পাথরের ন্যায় উজ্জ্বল, সূর্যের আলোতে তা ঝিকিমিকি করে উঠল এবং হঠাৎ করে নেফারের পেট গুলিয়ে উঠল। নেফার বুঝল পাখিটা মৃত। হারানোর একটা হাহাকার অনুভূতি তার মাঝে ছড়িয়ে পড়ল, যেন মহা মূল্যবান কোন কিছু তার থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হল। যা বাজ পাখিটার মৃত্যুর চাইতেও বেশি কিছু। রাজকীয় পাখিটা একটু বেশি কিছুর প্রতিনিধি; এটা প্রভু ও রাজার প্রতীক। যখন সে মৃত পাখিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, ওটাকে মনে হল পরিবর্তিত হয়ে স্বয়ং মৃত ফারাও-এর দেহে পরিণত হল। একটা চাপা কান্না নেফারকে শুষে নিল এবং সে হাত সরিয়ে নিল।

ঠিক সময়েই সে সরে এসেছিল, কারণ তখন সাথে সাথে সে একটা শুষ্ক, তীক্ষ্ণ ও ভয়ংকর হিসৃহিস্ আওয়াজ বাতাসে শুনতে পেল। বড় ও চকচকে একটা কালো কিছু, যেখানে কিছুক্ষণ আগে সে হাত রেখেছিল সেখানে চাবুকের মত পিটাচ্ছে এবং এমনভাবে আওয়াজ তুলল যে পুরো নীড়টা নড়তে লাগল। পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে যতোটা সম্ভব পিছনে সরে নেফার গুটিসুটি মেরে রইল এবং ভূতুড়ে জটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার চোখ তীক্ষ্ণ ও বড় হয়ে গেল এবং দুঃস্বপ্নের মতো সময় অতিবাহিত হল। সে মৃত পাখিটার পাশে বাচ্চা দুটোর মৃত দেহও দেখল যাদের দেহ পেঁচিয়ে রয়েছে একটা কালো কোবরা। সাপটা মাথা তুলল। ওটার ফনাটা কালো-সাদা দাগ কাটা।

চিকন পাতলা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে পাতলা দ্বি-খন্ডিত জিহ্বাটা একবার বের করছে আবার ভেতরে ঢুকাচ্ছে। চোখ দুটো অসীম কালো এবং প্রতিটি চোখে আলোর প্রতিফল দেখা যাচ্ছে যা দিয়ে ওটা নেফারের দিকে নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

নেফার চিৎকার করে টাইটাকে সর্তক করতে চাইল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। কোবরাটার ভয়ংকর সম্মোহিত দৃষ্টি থেকে নেফার তার চোখ সরাতে পারল না। সাপটা তার মাথা আলতো ভাবে ঘোরাতে লাগল, সেই সাথে তার ভারি দেহের ধাক্কায় নীড়টা যার মধ্যে ওটা পাকিয়ে আছে কেঁপে উঠল। কোবরার দেহটা মসৃণ অলংকারের মতো। প্রতিটি কুন্ডলী নেফারের বাহুর সমান পুরু এবং ওটা একসময় কুন্ডলীর উপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

মাথাটা পিছনে হেলে মুখ হা করল এবং নেফার তার মুখ গহ্বরের বিবর্ণ লাইন পর্যন্ত দেখতে পেল। সে স্বচ্ছ বিষ দাঁতগুলোকে ওটার দুপাশের খোল থেকে বের হতে দেখল : প্রতিটি দাঁতের আগায় বর্ণহীন বিষের ফোঁটা। সাপটার ভয়ংকর মাথা নেফারের চেহারার দিকে তেড়ে এল।

নেফার চিৎকার করে উঠল এবং এক পাশে সরে গেল, ফলে সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। যদিও টাইটা যে কোন হঠাৎ টানের জন্যে প্রস্তুত ছিল, তবুও যখন নেফারের ওজন দড়ির ওপর পড়ল তখন সে প্রায় দড়ির ওপর বুকে পড়ল। ঘোড়ার চুলের রশির একটা কুন্ডলী তার হাত থেকে মাংস ছিঁড়ে পিছলে গেল, তবুও সে শক্ত করে ধরে রাখল। নিচে বালকটির চিৎকার সে শুনতে পেল এবং অনুভব করল দড়ির অপর প্রান্তে সে দোল খাচ্ছে।

নেফার পর্বতের খাজ থেকে সোজা পাখির নীড় বরাবর দোলাতে লাগল। কোবরাটা আবার আক্রমণের জন্য ছুটে এল। এটার দৃষ্টি বালকটির উপর নির্দিষ্ট করা এবং তাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত। একই সাথে সাপটা মুখ দিয়ে হিস্ হিস্ শব্দ করছে। নেফার আবার চিৎকার করল এবং যখন কোবরাটার দিকে সে উড়ে গেল তখন সাপটাকে ভয়ংকর এক লাথি মারল সে। টাইটা তার চিৎকারের ভয়টা অনুভব করল। সে সজোরে দড়ি উপরে টানল এবং যতোক্ষণ তার বৃদ্ধ মাংসপেশিতে কুলাল সে তা টানতেই থাকল।

তার আয়ত্তের মধ্যে আসা মাত্রই কোবরাটা নেফারের চোখের বরাবর ছোবল মারল। কিন্তু ততোক্ষণে টাইটা নেফারকে রশির অন্য প্রান্ত ধরে টেনে তুলেছে। সাপটির উন্মুক্ত চোয়াল নেফারের কানের এক আঙুল দূর দিয়ে চলে গেল এবং তারপর রথের চাবুকের ন্যায় সাপটির ভারি দেহ তার কাঁধের উপরে দিয়ে এগিয়ে এল। নেফার চিৎকার দিল, জানত সে মারাত্মক কামড় খেতে যাচ্ছে।

আবার যখন সে খাদের উপর ঝুলল তখন সে তার কাঁধের উপরে যেখানে সাপটি ছোবল মেরেছে সে স্থানে এক নজর তাকাল এবং দেখল মলিন হলুদ বর্ণের বিষ তার স্যাডল ব্যাগের উপর ছড়িয়ে আছে। বিপদজনক ভাবে সে ব্যাগটা খুলে আনল এবং আবারো যখন সে যেখানে কোবরটা বিপদজনক ভাবে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে দুলে গেল তখন সে ব্যাগটাকে ঢাল রূপে ব্যবহার করল।

যে মুহূর্তে সে ওটার আয়ত্তের মধ্যে গেল কোবরাটা আবার ছোবল মারল কিন্তু নেফার এবার স্যাডল ব্যাগ দিয়ে ছোবল থেকে নিজেকে রক্ষা করল। একটা দাঁত ব্যাগের মধ্যে ঢেবে গেল। ফলে যখন নেফার পিছিয়ে এল তখন আটকে থাকা সাপটিও তার সাথে নীড় থেকে বেড়িয়ে এলো। এটা নেফারের পা জড়িয়ে ধরতে চাইল। ভারি লেজটা তাকে ধরতে গেল এবং ভয়ংকরভাবে হিসৃহিস্ শব্দ করতে লাগল। ভোলা মুখ থেকে বিষের মেঘ স্যাডেল ব্যাগ বেয়ে পড়ল। এর দেহ এতো ভারি যে এর ভারে নেফার ভয়ংকর ভাবে কাঁপতে লাগল।

প্রায় কোন কিছু না ভেবেই নেফার ব্যাগটা খাদে ছুঁড়ে মারল। ব্যাগটা শুন্ধু সাপটা এক সাথে শূন্যে পড়ে গেল। তখনও সাপটার দাঁত ব্যাগে গেঁথে ছিল আর হিসহিস্ করছিল। খাদের নিচে তা হারিয়ে যেতেই ধীরে ধীরে তার হিসৃহিস আওয়াজও ক্ষীণ হয়ে এল। মনে হল যেন এক অনন্ত পতন। অবশেষে নিচে পাথরের উপর পতনের শব্দ সে শুনল। এ পতনের আঘাতে সাপটি মরল কিনা বুঝা গেল না তবে পাথরে বাড়ি খেয়ে একটা কালো বলের ন্যায় লাফিয়ে উঠে ওটা পাথরের নিচে হারিয়ে গেল এবং নেফারের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।

মেঘের ভীত গর্জনের মতো টাইটার কণ্ঠ তার কানে পৌঁছাল। কষ্টে ও চিন্তায় তার কণ্ঠ রুক্ষ শোনাল। আমার সাথে কথা বল। আমাকে কি শুনতে পাচ্ছ?

আমি এখানে, টাইটা, নেফারের কণ্ঠ দুর্বল এবং কাঁপছিল।

আমি তোমাকে উপরে টেনে তুলছি।

ধীরে ধীরে, একটু একটু করে সে নেফারকে টেনে তুলল। এমনকি এই দুঃসময়েও নেফার বৃদ্ধ লোকটির শক্তির প্রশংসা না করে পারল না। যখন পাথর তার হাতের নাগালের মধ্যে এল, সে রশি থেকে ভর কমিয়ে দ্রুত বেয়ে উঠতে লাগল। অবশেষে সে টাইটাকে দেখতে পেল, স্বস্তি নিয়ে বৃদ্ধটি পর্বতের চূড়া থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অনেকটা জ্ঞানী, স্ফিংস-এর মতো করে।

শেষ টানে নেফার উপরে উঠে এল এবং বৃদ্ধ লোকটির বাহুতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সেখানে শুয়ে সে হুস-হুঁস করে দম নিতে লাগল। ঠিকভাবে কথা বলতে পারল না। টাইটা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। সে নিজেও আবেগে ও পরিশ্রান্তিতে কাঁপছিল। ধীরে ধীরে তারা শান্ত হল এবং পুনরায় তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। টাইটা নেফারের দিকে পানির থলে এগিয়ে ধরল। তা থেকে সে পানি নিল, গিলল এবং আবার নিল। তারপর সে টাইটার মুখের দিকে এমন করুণভাবে তাকাল যে টাইটা তাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে নিল।

এটা ভয়ংকর। নেফারের শব্দগুলো অল্পই বোঝা গেল। ওটা নীড়ের মধ্যে ছিল। ওটা বাজ পাখিগুলোকে মেরে ফেলেছে, সবগুলোকে ওহ্, ঈশ্বর! টাইটা, ওটা ভয়ানক।

ওটা কি ছিল, নেফার? টাইটা শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল।

ওটা আমার গড বার্ড মেরে ফেলেছে।

আরাম করে বসো। আরো একটু পানি খাও। সে তাকে পানির থলেটা আবার দিল।

নেফার আবার পানি খেল এবং তাড়াহুড়োয় সে ভীমড়ি খেল। তারপর কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়ে বলল। ওটা আমাকেও খুন করতে চেয়েছিল। খুব বড় ও খুব কালো।

ওটা কি ছিল, বালক? স্পষ্ট করে আমাকে বল।

একটা কোবরা, একটা বড় কোবরা, পাখির নীড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। এটা বাচ্চাগুলোকে কামড়ে হত্যা করেছে এবং সে সাথে পুরুষ পাখিটাকেও। যেই আমাকে দেখল আমাকে মারতে এল। আমি কল্পনায়ও কখনো ভাবি নি যে একটা কোবরা এতো বড় হতে পারে।

তোমাকে কি কামড় দিয়েছে? টাইটা ভয়ে জানতে চাইল এবং টেনে নেফারকে তার পায়ের উপর দাঁড় করাল পরীক্ষা করার জন্যে।

না, টাইটা, আমি ব্যাগটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছি। ওটা আমাকে ছুতে পারেনি। নেফার প্রতিবাদ করল, কিন্তু টাইটা তার স্কার্ট খুলে ফেলল এবং নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন খুঁজল। তার আঙুলের একটা গাঁট এবং উভয় হাঁটু একটু কেটে গিয়েছে। এর বাহিরে তার শক্ত তরুণ দেহে শুধুমাত্র ফারও বিশেষ চিহ্ন অঙ্কিত যা ভিতরের উরুর মধ্যে আঁকা তা দেখতে পেল। টাইটা নিজে এই নকশা এঁকেছে। এটা একটা ক্ষুদ্র শিল্পকর্ম যা চিরদিন নেফারের দ্বৈত মুকুটের দাবির প্রমাণ বহন করে।

ঐ প্রভুকে ধন্যবাদ যে তোমাকে রক্ষা করেছে। টাইটা বিড়বিড় করে বলল। এই কোবরার মাধ্যমে হুরাস তোমাকে বিপদের সংকেত পাঠিয়েছেন। তার মুখটা গম্ভীর দেখাল ও তাতে দুঃখের ছায়া স্পষ্ট। ওটা কোন সাধারণ সাপ নয়।

হ্যাঁ, টাইটা, আমি এটাকে কাছ থেকে দেখেছি। বৃহৎ কিন্তু এটা একটা সত্যিকারের সাপ।

 কিন্তু কি করে ওটা পাখির নীড়টায় পৌঁছল? কোবরা তো আর উড়তে পারে, এবং খাঁজে উঠার আর কোন রাস্তা নেই।

নেফার অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। এটা আমার গড বার্ড হত্যা করেছে। সে জোরে বলল। এবং রাজকীয় পুরুষ বাজ পাখিটাও মেরে ফেলেছে যা ফারাও এর প্রতিমূর্তি। টাইটা গম্ভীরভাবে সম্মত হল, এখন তার চোখে দুঃখের ছায়া। এখানে কোন রহস্য লুকায়িত। আমি আমার স্বপ্নে তাদের ছায়া দেখেছি। কিন্তু তোমার সাথে আজ যা ঘটল তা দ্বারা আরো নিশ্চিত হলাম। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঘটনার বাইরে।

আমাকে খুলে বলো, টাইটা। নেফার জোর করল।

টাইটা তার স্কার্ট ফিরিয়ে দিল। প্রথমে আমাদের এখান থেকে নামতে হবে এবং যে বিপদ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে তার থেকে দূরে সরে যেতে হবে।

সে এক মুহূর্ত থামল এবং আকাশের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকাল। তারপর চোখ নামিয়ে নেফারের মুখের দিকে তাকাল। তোমার জামাটা পড়ে নাও। এটুকুই শুধু সে বলল।

সে তৈরি হতেই টাইটা তাকে চুড়ার অন্য পাশে নিয়ে গেল এবং দ্রুত নামতে লাগল। এবার তাদের পথ জানা ছিল এবং টাইটা বারবার তাড়াতাড়ি নামতে তাগিদ দিল। ঘোড়াগুলো সেখানেই আছে যেখানে তারা রেখে গিয়ে ছিল। কিন্তু ঘোরায় চড়ার পূর্বে নেফার বলল, কোবরাটা যেখানে পড়েছে সে জায়টা এখান থেকে দূরে নয়। সে হাত দিয়ে পর্বতের খাজের উপরে যেখানটায় নীড়টা এখনো রয়েছে তার নিচের জায়গাটা দেখাল। চল আমরা মৃত দেহটা খুঁজে দেখি। হয়তো আমরা ওটার কোন অংশ পেতে পারি যার উপর তুমি কাজ করে ওটার ক্ষমতা ধ্বংস করতে পারবে।

তা হবে মূল্যবান সময়ের অপচয়। কোন মৃত দেহ নেই। টাইটা তার মাদি ঘোড়ার পিঠে চড়ল। চলো, নেফার। কোবরাটা ছায়াময় সেই জায়গায় ফিরে গেছে। যেখান থেকে ওটা এসেছিল।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভয়ে নেফার কেঁপে উঠল এবং দ্রুত ঘোড়ার পিঠে চড়ল।

তারা উপরের ঢাল পেরিয়ে এগিয়ে গেল এবং পূর্বের ভাঙা ছোট পাহাড়ের পাদদেশে যাবার পূর্ব পর্যন্ত কেউ কোন কথা বলল না। নেফার জানে টাইটা যখন এমন শূন্যের মুহূর্তে থাকে তখন তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা বৃথা। সে তার ঘোড়াটা টাইটার পাশে নিয়ে গেল এবং সম্মানের সাথে নির্দেশ করল। টাইটা এটা তো গেবেল নাগারে যাওয়ার রাস্তা নয়।

আমরা যেখানে ফিরে যাচ্ছি না।

কেননা?

বেদুঈনরা জানে আমরা সেখানে বসন্তে ছিলাম। তারা তাদের তা বলবে যারা আমাদের খুঁজছে। টাইটা ব্যাখ্যা করল।

নেফার হতভম্ব হয়ে গেল। কারা আমাদের খুঁজছে?

টাইটা তার মাথা ঘুরাল এবং এমন করুণ দৃষ্টিতে বালকটির দিকে চাইল যে সে চুপ হয়ে গেল। আমি তোমাকে সব বলব। আগে আমরা এই অভিশপ্ত পর্বত থেকে বেড়িয়ে একটা নিরাপদ স্থানে যাই তারপর।

টাইটা পাহাড়ের চূড়াগুলো এড়িয়ে গেল যেন দূর থেকে আকাশ সীমায় তাদের ছায়ামূর্তির কারো চোখে ধরা না পড়ে এবং উপত্যকা ও গিরিখাদের মধ্য দিকে একটা পথ ধরে এগিয়ে চলল। সে সব সময় পূর্বদিক বরাবর এগুতে থাকল, মিশর ও নীল নদ থেকে দূরে সাগরের দিকে।

তাদের লাগাম টানার আগেই সূর্য অস্ত গেল এবং সে বলল, প্রধান বহরটা ঠিক পরবর্তী পাহাড়ের সারির পরেই রয়েছে। আমাদের অবশ্যই এটা পার হতে হবে, কিন্তু শত্রুরা হয়তো সেখানে আমাদের খুঁজছে।

একটা লুকানো ওয়াদির মধ্যে তারা ঘোড়াগুলোকে বাঁধল এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘাস তাদের জন্যে রেখে গেল। তারপর তারা সাবধানে পাহাড়ের চূড়ায় উঠল এবং একটা আড়াল খুঁজে পেল যা ছিল রক্তাক্ত বর্ণের এক সারি কোমল শিলার পিছন দিক এবং সেখান থেকে নিচের রাস্তার গাড়ির বহর তারা দেখতে পারবে।

অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত আমরা এখানে থাকব, টাইটা ব্যাখ্যা করল। তারপর পার হব।

আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি করছ, টাটা। আমরা কেন পূর্ব দিকে যাচ্ছি? আমরা কেন থেবসে ফিরছি না, এবং আমার পিতার ফারাও-এর নিরাপত্তায়?

টাইটা একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং চোখ বন্ধ করল। আমি কিভাবে তাকে বলি? আমি আর বেশিক্ষণ এটা লুকিয়ে রাখতে পারব না। এখনও সে একটা বাচ্চা এবং আমাকে তাকে রক্ষা করতে হবে।

নেফার যেন তার ভাবনা পাঠ করতে পারল। সে তার হাত টাইটার বাহুতে রাখল এবং শান্তস্বরে বলল, আজ পর্বতের উপর আমি প্রমাণ দিয়েছি যে আমি একজন যুবক পুরুষ। আমাকে প্রাপ্ত বয়স্ক মনে কর।

টাইটা মাথা নাড়ল। প্রকৃতই, তুমি তা করেছ। পুনরায় কিছু বলার পূর্বে সে একবার নিচের রাস্তার দিকে আরেকবার তাকাল এবং তৎক্ষণাৎ তার মাথা নামাল, কিছু আসছে! সে সতর্ক করল।

শিলার পিছনে নেফার নিজেকে দেয়ালের সাথে সেঁটে দিল এবং দেখল ধুলার সারি দ্রুত পশ্চিম দিক থেকে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে পুরো উপত্যকায় গভীর ছায়া নেমে এসেছে এবং আকাশ সূর্যাস্তের সোনালি স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

তারা দ্রুত আসছে। মনে হচ্ছে কোন বণিক দল নয়, যুদ্ধ রথের সারি। নেফার বলল। হ্যাঁ, আমি তাদের এখন দেখতে পারছি। তার তরুণ উজ্জ্বল চোখগুলো প্রথম রথটা দেখল যার জোড়া ঘোড়াগুলো উঁচু বাহনে বসা রথীকে নিয়ে দুলকি চালে চলছে। তারা হিকস্ নয়। সে বলল। আরো কাছে এলে তা স্পষ্ট হল, এগুলো তো আমাদের। দশটা রথের একটা বহর। হ্যাঁ! প্রথম রথের পতাকা দেখো। ফেট গার্ডের একটা দল। আমরা নিরাপদ। টাইটা!

নেফার পায়ের উপর দাঁড়াল এবং দুই হাত মাথার উপর উঠিয়ে নাড়তে লাগল। এখানে! সে চেঁচাল। এখানে, নীলেরা। এখানে আমি। আমি প্রিন্স নেফার।

টাইটা তার হাড্ডিসার হাতটা উঠিয়ে ভয়ংকর ভাবে টান দিয়ে তাকে বসিয়ে দিল। বসে পড়ো, বোকা কোথাকার। তারা কোবরার দাস।

সে তীরের দিকে আর এক ঝলক তাকাল এবং দেখল যে আগের রথ ঠিকই তাদের দেখতে পেয়েছে কারণ ওটার রথ চালক জোড়া ঘোড়াগুলো পিটিয়ে তাদের দিয়ে ঘুরিয়ে দিল।

এসো! সে নেফারকে বলল। দ্রুত! তারা যেন আমাদের ধরতে না পারে।

বালকটিকে টেনে সে অপর প্রান্তে নিয়ে এল এবং ঢাল বেয়ে নিচে নামতে লাগল। প্রথম দিকে নেফার নারাজ থাকলেও, পরে সে টাইটার সাথে দ্রুত চলল। সে নিজের ইচ্ছায় দৌড়াতে শুরু করল, পাথরের পর পাথরে লাফ দিতে লাগল, তবুও বৃদ্ধ লোকটির নাগাল ধরতে পারল না। টাইটার হাড্ডিসার সরু পাগুলো যেন উড়ে চলছিল এবং তার পিছনের রূপালি চুল ঝর্ণার ন্যায় ঢেউ খেলে দুলতে লাগল। সর্বাগ্নে সে ঘোড়ার নিকট পৌঁছে এক লাফে নিজের মাদী ঘোড়াটার উপর চেপে বসল।

আমি বুঝতে পারছি না কেন আমরা আমাদের নিজেদের লোকজন থেকে দূরে ভাগছি। নেফার হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল। কি হচ্ছে, টাটা?

আগে ঘোড়ায় চাপো। এখন কথা বলার সময় নেই। আমাদের আগে এখান থেকে সরে যেতে হবে।

তারা ওয়াদির মুখ দিয়ে বেড়িয়ে যখন ভোলা স্থানে এল, নেফার তার কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে তাকাল। প্রথম রথটা পবর্তের উঁচু স্থান পেরিয়ে দ্রুত আসছে এবং চালক জোড়ে চিৎকার করছে। কিন্তু দূরত্ব ও চাকার আওয়াজে তার কণ্ঠ চাপা পড়ল।

টাইটা সামনে থেকে একটা ভাঙা আগ্নেয় পাথরের মধ্য দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল যেখান দিয়ে কোথ রথের পক্ষে এগুনো সম্ভব নয়। ঘোড়াগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লম্বা পা ফেলে দ্রুত চলতে লাগল।

যদি আমারা পাথরের মধ্যে থাকি তাহলে রাতের মধ্যেই আমরা তাদের হারাবো। দিনের আর অল্প আলোই বাকি আছে। টাইটা সূর্যের শেষ রশ্মির দিকে তাকাল যা ইতোমধ্যে পশ্চিমের পাহাড়ের পিছনে ডুব দিয়েছে।

সবসময় একজন ঘোড়া চালক একটাই রথ চালায়। নেফার বলল আত্ম বিশ্বাসের সাথে, যা সে প্রকৃতপক্ষে অনুভব করে না। কিন্তু যখন সে তার কাঁধের উপর দিয়ে আবার পিছনে তাকাল সে দেখল তা সত্যি। তারা রথগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

নেফার ও টাইটা ভগ্ন প্রান্তরটায় পৌঁছানোর পূর্বে রথগুলো এতো পিছনে পড়ে গেল নিজেদের ধুলো আর সন্ধ্যার নীলে তাদের আর ঠিকমতো দেখা গেল না।

পাথরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ঘোড়াগুলোকে তারা সতর্কতার সাথে চালাতে বাধ্য হল। কিন্তু পদক্ষেপ এতো বিপদ সংকুল এবং আলো এতো কম যে তাদের হাঁটতে হল। আলোর শেষ ঝলকে টাইটা পিছন তাকাল এবং দেখল জঘন্য রাস্তার প্রান্তে অগ্রবর্তী রথের গাঢ় মূর্তি দাঁড়িয়ে। সে চালকের কণ্ঠ চিনতে পারল। লোকটি তার উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছিল, শব্দগুলো ক্ষীণ শোনাল।

প্রিন্স নেফার, কেন পালিয়ে যাচ্ছেন? আমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। আমরা ফেট গার্ড। আপনাকে থেবস্-এ নিতে যেতে এসেছি।

নেফার তার মাথা ঘুরাল। ওটা হিলটো। আমি তার কণ্ঠ ভালো করে চিনি। সে একজন ভালো মানুষ। সে আমার নাম ধরে ডাকছে।

হিলটো একজন বিখ্যাত যোদ্ধা। সে ভেলোর এর স্বর্ণের ব্যাজ পরিধান করে। কিন্তু টাইটা নেফারকে কাঠোর ভাবে সামনে চলতে বলল, প্রতারিত হয়ো না। কাউকে বিশ্বাস করো না।

বাধ্য হয়ে নেফার ভাঙা পাথরের জঙ্গল দিয়ে চলল। তাদের পিছনের ক্ষীণ চিৎকার আরো ক্ষীণ হয়ে গেল এবং ধীরে মরুভূমির ন্যায় অসীম শান্ত হয়ে গেল। বেশি দূর যাওয়ার পূর্বেই অন্ধকার তাদের ঘোড়া থেকে নামতে বাধ্য করল এবং বন্ধুর পথটা দিয়ে তাদের হাঁটতে হল। এখানে মোড়গুলো সরু হয়ে গেছে এবং পাথরের কালো পিলারগুলো অসতর্কভাবে চলমান ঘোড়াকে পঙ্গু অথবা রথের চাকাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে পারে যদি রথগুলো তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করে! অবশেষে ঘোড়াকে বিশ্রাম ও পানি পান করাতে তাদের থামতে হল। খুব কাছাকাছি তারা বসল। ছুরি দিয়ে টাইটা রুটি ভাগ করল এবং কড়মড় করে তা চিবাতে চিবাতে নিরবে তারা কথা বলল।

তোমার উদ্দেশ্যটা আমাকে বল, টাটা। তুমি আসলে কি দেখেছো যখন তুমি আমান রা-এর ধাঁধা অনুশীলন করেছিলে।

আমি তোমাকে বলেছি। তারা বোধগম্য ছিল না।

আমি জানি তা সত্য নয়। নেফার তার মাথা নাড়ল। তুমি আমার কাছ থেকে লুকানোর জন্যে তা বলেছ। রাতের ঠাণ্ডায় এবং বিপদের অনুভূতি যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী যা সে পাখির বাসায় অনুভব করেছ তা ভেবে সে কেঁপে উঠল। তুমি ভয়ানক কিছু দেখেছ। আমি জানি তুমি কিছু একটা দেখেছে। আর ঐ কারণে আমরা এখন পালাচ্ছি। আমাকে তোমার স্বপ্ন সম্পর্কে সব বলতে হবে। আমাকে বুঝতে হবে আমাদের কি ঘটছে।

হ্যাঁ তুমি ঠিক। টাইটা শেষ পর্যন্ত রাজি হল। তোমার সময় হয়েছে জানার। সে তার একটা সরু হাত বের কল এবং নেফারকে তার চাদরের নিচে আরো কাছে টেনে নিল। বালকটি বৃদ্ধ লোকটির কংকালসার শরীরের উতায় অবাক হল। টাইটা তার সব চিন্তা একত্রিত করল এবং তারপর কথা বলল।

আমার স্বপ্নে আমি একটা বড় বৃক্ষকে চিরমাতা নীলের কিনারে বড় হতে দেখলাম। আরো দেখলাম অনেক বড় গাছ এবং তাতে নীল রঙের ফুল ফুটেছে অনেকটা সুনুল এর মতন এবং এর উপরে উচ্চ ও নিম্ন রাজ্যের দ্বৈত মুকুট ঝুলে ছিল। এর ছায়ায় মিশরের সব লোক : পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, কৃষক, যাজক ও যোদ্ধারা ছিল। বৃক্ষটি সবাইকে রক্ষা করছে এবং তারা অনেক উন্নতি করছে এবং তারা সন্তুষ্ট ছিল।

এটাতো একটা ভালো স্বপ্ন, নেফার আন্তরিকভাবে অনুবাদ করল, যেভাবে টাইটা তাকে শিক্ষা দিয়েছে। গাছটা অবশ্যই ফারাও, আমার পিতা। ট্যামোস হাউজের রং নীল এবং আমার পিতা দ্বৈত মুকুট ধারণ করেন।

এই অর্থ যা আমিও পাই।

তারপর তুমি কি দেখলে, টাটা?

নীলের ঘোলা পানিতে আমি একটা সাপ দেখলাম যা গাছটার দিকে সাঁতরে এগোচ্ছে। সাপটা আকৃতিতে অনেক বড়।

একটা কোবরা? নেফার অনুমান করল এবং তার কণ্ঠ ক্ষীণ ও ভয়ার্ত শোনাল।

হ্যাঁ, টাইটা সম্মতি সূচক উত্তর দিল, এটা খুব বড় কোবরা। ওটা পানি থেকে বেরিয়ে গাছের উপরে উঠল এবং গাছের গুঁড়ি ও শাখা-প্রশাখায় নিজেকে পেঁচিয়ে নিল যতোক্ষণ না এটাকে গাছের অংশ মনে হল। নিজেকে গাছটির সাথে মানিয়ে নিল এবং শক্তি নিল।

আমি তা বুঝলাম না, নেফার ফিফিস্ করে বলল।

তারপর কোবরাটা গাছের সবচেয়ে উপরের ডালে আসন নিল এবং ফণা তুলে সব ঢেকে দিল।

হায় হুরাস! নেফার থরথর করে কেঁপে উঠল। ওটা কি সেই সাপ যা আমাকে কামড়াতে চেয়েছিল, তোমার কি মনে হয়? সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না। দ্রুত আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কি দেখেছ, টাটা?

আমি দেখলাম গাছটা ক্রমশ শুকিয়ে গেল, পড়ে গেল এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। তারপর দেখলাম কোবরাটা এখন বিজয়ের সাথে সিংহাসনে বসে আছে। তার চোখে এখনও শয়তানি এবং সে একটা দ্বৈত মুকুট পরিধান করে আছে। মৃত গাছটা সবুজ অংকুর ছড়াল কিন্তু যখনই তারা বের হল সাপটা তাদের ছোবল মারতে লাগল। এবং তার বিষে তারা মারা গেল।

নেফার নীরব হয়ে গেল। যদিও অর্থটা পরিষ্কার ছিল কিন্তু সে তা ব্যাখ্যা করতে পারল না। গাছটির সবগুলো সবুজ অংকুরই কি ধ্বংস হয়ে গেল? সে জিজ্ঞেস করল।

শুধু একটা বাদে যেটি মাটির শূন্যে গোপনে বেড়ে উঠল যতোক্ষণ না এটা শক্তিশালী হল। তারপর ওটা দক্ষতার সাথে প্রস্ফুটিত হল এবং কোবরার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হল। যদিও কোবরাটা তার সব বিষ ও শক্তি দিয়ে আঘাত করল তবুও এটা বেঁচে রইল এবং নিজের মতো একটা জীবন পেল।

এই যুদ্ধের শেষ কি, টাটা? তাদের কে জিতল? তাদের কে দ্বৈত মুকুট অবশেষে পড়েছিল?

আমি যুদ্ধের শেষটা দেখতে পাই নি কারণ যুদ্ধের ধুয়া ও ধুলায় ওটা ঢাকা ছিল।

দীর্ঘক্ষণ নেফারকে চুপ থাকতে দেখে টাইটা ভাবল সে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু যখন বালকটি কাঁপতে লাগল বুঝল সে কাঁদছে। শেষে নেফার অনেক নিশ্চয়তা ও শেষ সীমা নিয়ে বলল। ফারাও মৃত। আমার পিতা মৃত। এটাই তোমার স্বপ্নের অর্থ। বিষে আক্রান্ত গাছটা ফারাও। পাখির নীড়টারও অর্থ কি একই নয়? মৃত পুরুষ বাজটা ফারাও। আমার পিতা মৃত, কোবরাটা তাকে হত্যা করেছে।

টাইটা তাকে কোন উত্তর দিতে পারল না। যা সে করল তা হল নেফারের কাঁধে তার হাতের জোড় বাড়াল এবং তাকে শক্তি ও শান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।

আমি কি গাছটির সবুজ অংকুর? নেফার বলে গেল। তুমি তা দেখেছ। তুমি জান যে কোবরাটা আমাকে ধ্বংস করার জন্য অপেক্ষা করছে যেমনটা সে আমার বাবাকে করেছে। তাই তুমি আমাকে সৈন্যদের সাথে থেবসে যেতে দাও নি। তুমি জান কোবরাটা আমার জন্যে সেখানে অপেক্ষা করছে।

তুমি ঠিক নেফার। আমরা ততোক্ষণ থেব ফিরতে পারব না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে রক্ষা করার মত শক্তিশালী হও। আমাদের এই মিশর থেকে চলে যেতে হবে। পূর্বে অনেক জায়গা ও ক্ষমতাবান রাজা আছে। আমার উদ্দেশ্য তাদের কাছে যাওয়া এবং তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া। তাদের সহায়তায় কোবরাটাকে ধ্বংস করতে হবে।

কিন্তু কে এই কোবরা? তুমি কি তোমার স্বপ্নে তার চেহারা দেখেছ?

আমরা জানি সে তোমার বাবার সিংহাসনের নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ স্বপ্নের মধ্যে ওটা গাছটাকে জড়িয়ে ছিল এবং তাকে সমর্থন দিচ্ছিল। সে একমুহূর্ত থামল এবং তারপর যেন সিদ্ধান্ত নিল এমনভাবে বলল। ঐ কোবরাটার নাম নাজা।

নেফার তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নাজা! সে ফিসফিসিয়ে বলল।

নাজা! এখন আমি বুঝতে পারছি কেন আমরা থেব ফিরে যাই নি। এক মুহূর্তের জন্যে সে থামল, তারপর বলল, পূর্বের রাজ্যে ঘুরে আমরা দুজন সমাজ ছাড়া, ভিক্ষুক হয়ে যাব।

স্বপ্ন দেখিয়েছে যে তুমি শক্তিশালী হবে। আমাদের অবশ্যই আমন-রা-এর ধাঁধার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।

বাবার মৃত্যু-শোকের পরও অবশেষে নেফার ঘুমাল, কিন্তু ভোর হবার আগে অন্ধকার থাকতেই টাইটা তাকে জাগাল।

তারা আবার ঘোড়ায় চড়ল এবং পূর্ব দিকে চলল যতক্ষণ না খারাপ ভূমিটা অনেক পিছনে পড়ল এবং নেফার ভোরের বাতাসে সমুদ্রের লোনা গন্ধ পেল।

জেদ এর বন্দরে আমরা একটা জাহাজ জোগাড় করে হুরিয়ান পার হব। টাইটার মনে হল তার মনের কথাটাই সে পড়ল। ব্যাবিলিয়নের ও অ্যাশিরিয়ার রাজা সারগন এবং যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস-এর মধ্যবর্তী বিশাল রাজ্যসমূহের রাজাও, তোমার পিতার প্রিয়ভাজন। সে হিকস্ ও আমাদের অন্য সব শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য প্রদানে তোমার পিতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি মনে করি সে তার ওয়াদা রাখবে কারণ সে একজন সম্মানি ব্যক্তি। আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করব যে সে আমাদের গ্রহণ করবে এবং সংযুক্ত মিশরের সিংহাসন অধিকারে সে তোমাকে সাহায্য করবে।

তাদের সম্মুখে সূর্যটা জ্বলন্ত চুল্লির ন্যায় প্রজ্জ্বলিত এবং তারা যখন পরবর্তী চূড়াটা অতিক্রম করল দেখল নিচে সমুদ্রটা সদ্য গড়া ব্রোঞ্জের যুদ্ধ ঢালের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। টাইটা দূরত্বটা পরিমাপ করল। আমরা আজ বিকেলের সূর্যাস্তের পূর্বেই উপকূলে পৌঁছে যাব। তারপর সে চোখ সরু করে পিছনের দিকে তাকাল। নাক দিকে সে একটা বিতৃষ্ণ শব্দ তুলল এবং দেখল একটা নয় চারটি হলুদ ধুলার পুচ্ছ ভূমির উপর তাদের পিছু আসছে।

হিলটো, আবার, সে বিরক্ত হল। সে ঘোড়া থেকে নামল এবং একটা উঁচু জায়গা খুঁজে নিল দেখার জন্যে, রাতে নিশ্চয়ই সে পাথুরে জায়গাটা ঘুরে এসেছে। এখন সে আমাদের চাকার দাগ খোঁজার জন্যে রথগুলোকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যে পূর্ব দিকে যাচ্ছি এটা তাকে বলে দেয়ার জন্য কোন কালো যাদুকরের দরকার নেই।

দ্রুত সে লুকানোর জন্যে চারপাশে তাকাল। যদিও পাথুরে এ জায়গাটা লুকানোর জন্য যথেষ্ট নয় তবু সে একটা স্থান খুঁজে নিল যেখানে তারা চলে আসলে লুকাতে পারে। নেমে এসো, সে নেফারকে আদেশ করল। আমাদের যতোটা সম্ভব মাথা নিচু করে রাখতে হবে এবং যাতে তারা আমাদের চিহ্নিত না করতে পারে সে জন্যে কোন ধুলা উড়ানো যাবে না। সে মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল কেন সে রাতে তাদের দাগগুলো মুছে দেবার ব্যাপারে সতর্ক ছিল না। আর তাই এখন যখন তারা লুকানোর স্থানের দিকে যাচ্ছে তখন যতোটা সম্ভব নরম মাটি এড়িয়ে যাচ্ছে এবং শক্ত পাথরের উপর দিয়ে এগোচ্ছে যাতে কোন দাগ পড়ে। তারা লুকানোর জায়গায় পৌঁছে দেখল জায়গাটা ঘোড়া লুকানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

চিন্তিত নেফার পিছনে তাকাল। তাদের পিছনে সবচাইতে কাছের রথটা মাত্র আধক্রোশ দূরে এবং খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। বাকিগুলো অর্ধ বৃত্তাকারে ছড়িয়ে আছে।

এখানে লুকানোর কোন জায়গা নেই আর পালানোর জন্যেও যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। তারা আমাদের ঘিরে ফেলেছে। টাইটা তার মাদি ঘোড়াটার পিঠ থেকে পিছলে নামল, নরম সুরে জটার সাথে কথা বলতে লাগল এবং নিচু হতে তার সামনের পাগুলো আদরে আদরে স্পর্শ করল। মাদিটা পা দাপালো এবং নাক দিয়ে আওয়াজ করল। কিন্তু টাইটা জোর করতেই ওটা অনীহা সত্ত্বেও নিচু হল এবং তার পাশে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রতিবাদে তখনো জটা নাক দিয়ে শব্দ করছিল। এরপর টাইটা নিজের স্কার্ট খুলে ওটার চোখ বেঁধে দিল যাতে জীবটা আবার উঠার চেষ্টা না করে।

তারপর সে দ্রুত নেফারের বাচ্চা ঘোড়াটার কাছে গেল এবং একই কৌশল অবলম্বন করল। যখন দুটো ঘোড়াই বসে পড়ল তখন সে নেফারকে পরিষ্কারভাবে বলল, স্টার-গেজারটার মাথার উপর বস এবং যদি ওটা উঠতে চায় তবে তাকে নিচের দিকে চেপে রাখবে।

পিতার মৃত্যুর খবর শুনার পর এই প্রথম নেফার হাসল। পশুদের সাথে টাইটার ভাব কখনো তাকে আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয় না। কি করে তুমি জীবগুলোকে বাধ্য করাও, টাইটা?

যদি তুমি তাদের কথা বলে বুঝাতে পারো তবে তুমিও তাদের যা বলবে তা-ই তারা করবে। এখন, জটার পাশে বসে এবং তাকে শান্ত রাখো।

তারা ঘোড়াগুলোর পিছনে শুয়ে পড়ল এবং সমতল ভূমির দিক থেকে বৃত্তাকারে রথের কলামকে দ্রুত ধুলো ছড়িয়ে এগিয়ে আসতে দেখল।

পাথুরের ভূমিতে তারা আমাদের চিহ্ন খুঁজে পাবে না, পাবে কি তারা? নেফার আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল।

টাইটা নাক দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করল। সে কাছের রথটির আগমন দেখছিল। মরীচিৎকার নড়াচড়ায় তাদের প্রতিবিম্বগুলোকে অলীক, কম্পমান ও ভগ্ন দেখাচ্ছে ঠিক যেমন পানির নিচে কোন কিছু দেখায়। ওটা ধীর গতিতে এগোচ্ছিল আর যখন তাদের ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন খুঁজছিল তখন রথটা এপাশ-ওপাশ দুলছিল। হঠাৎ রথটা অরো অধিক আত্মবিশ্বাস ও উদ্দেশ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে এল এবং টাইটা দেখতে পেল যে রথি তাদের নিশানা খুঁজে পেয়েছে এবং তা অনুসরণ করছে।

আরো এগুতেই তারা পাদানিতে দাঁড়ানো রথিদের পরিষ্কারভাবে চিনতে পারল। ড্যাশবোর্ডের উপর ঝুঁকে সবাই মাটির উপর তাদের চিহ্ন খুঁজছে। হঠাৎ টাইটা অস্বস্তি সহকারে বিড়বিড় করে উঠল। সেথের দুর্গন্ধময় নিঃশ্বাসের কসম, তাদের সাথে নুবিয়ানদের একটা দল রয়েছে।

বকের তৈরি মুকুট পরিধান করায় লম্বা কালো লোকটা যেন আরো বেশি লম্বা হয়ে গেছে। তারা যেখানে লুকিয়ে আছে তার থেকে ৫০০ কিউবিট দূরে নুবিয়ান লোকটি চলমান যান থেকে লাফিয়ে থামল এবং ঘোড়ার আগে দৌড়াতে লাগল। তারা এখন সেই জায়গায় আছে যেখান থেকে আমরা বাক নিয়েছিলাম। টাইটা ফিসফিস করে বলল। হে হুরাস! আমাদের প্রাণীগুলোর পায়ের চিহ্ন ঐ কালো জংলিটার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখো। বলা হয়ে থাকে যে নুবিয়ানরা বাতাসে একটা শালিকের চিহ্নও খুঁজে বের করতে পারে।

নুবিয়ান লোকটি হাত দিয়ে ইশারায় রথ থামাল। যেখানে তারা পাথুরে রাস্তায় বাঁক নিয়েছিল সেখানে সে চিহ্ন হারিয়ে ফেলেছে। একাধিকবার সে খালি মাটির উপর বৃত্তাকারে ঘুরল। এ দূরত্ব থেকে তাকে একটা শিকারী পাখির ন্যায় লাগছে যা সাপ ও ইঁদুর শিকার করতে ব্যস্ত।

তুমি কি যাদু বলে আমাদের লুকাতে পারো না, টাটা? নেফার অস্বস্তিতে ফিস্ ফিস্ করে বলল। যখন তারা গজলা হরিণ শিকার করত তখন টাইটা মাঝে মাঝে তা করত। টাইটা উত্তর দিল না কিন্তু যখন নেফার তার দিকে তাকাল সে দেখল যে বৃদ্ধ লোকটি ইতোমধ্যে তার হাতে শক্তিশালী মায়া, অসাধারণ কারুকাজ খচিত সোনালি পাঁচ কোনাওয়ালা তারা, লসট্রিসের মাছুলিটি ধরে আছে। নেফার জানত এর ভেতরে এক গোছা চুল আছে যা সে রাণী লসট্রিসের মাথা থেকে সে নিয়েছে। তার দেবীত্বে পরিণত হওয়ার আগে যখন লসট্রিস মমি করার টেবিলের উপর শুয়ে ছিল তখন সে তা সংগ্রহ কছে। টাইটা নীরবে শত্রুর চোখ থেকে লুকানোর মন্ত্র পড়তে পড়তে এটা ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করল।

বাইরে সমতলে নুবিয়ান লোকটা তার উদ্দেশ্য ঠিক করল এবং তাদের বরাবর সরাসরি তাকাল।

সে আমাদের চিহ্নের মোড় খুঁজে পেয়েছে। নেফার বলল। তারপর সে দেখল রথটা তার পিছু আসছে এবং তারা পাথুরে ভূমি দিয়ে তাদের বরাবর আসতে শুরু করল।

টাইটা নরম স্বরে বলল, আমি ঐ শয়তানকে ভালো করে জানি। তার নাম বে, এবং সে উসবাক উপজাতির একটা ভণ্ড।

যখন রথ এবং রথি সরাসরি আসতে লাগল নেফার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রথি পাদানির উপর উঁচুতে দাঁড়িয়েছিল। নিশ্চিত সে সেখানে থেকে নিচে তাদের দেখতে পাবে। কিন্তু সে তাদের দেখার কোন চিহ্ন দেখল না।

কাছে আসতেই টাইটা রথিকে চিনতে পাল, হিলটো, এমনকি তার ডান গালের নিচের যুদ্ধের সাদা দাগটাও সে দেখতে পেল।

নড়ো না। টাইটার কণ্ঠ ঠিক মৃদু বাতাস যেভাবে উজ্জ্বল সমতলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঐ রকম নরম লাগল।

বে, নুবিয়ানটা এখন এতো কাছাকাছি যে নেফার তার নগ্ন বুকে ঝুলানো নেকলেসের সব মনোরম অলংকার দেখতে পেল।

বে হঠাৎ থেমে গেল এবং তার কুৎসিত চেহারাটা কুচকে গেল। সে তার মাথা ঘুরিয়ে শিকারী কুকুরের গন্ধ শুকার মতন চারদিকে ধীরে ধীরে তাদের খুঁজল।

এখনও! টাইটা ফিস্‌ফিস্ করে বলল, সে আমাদের গন্ধ পাচ্ছে।

বে ধীর পায়ে কিছু কদম এল তারপর আবার থামল এবং তার হাত তুলল। রখটা তার পিছু পিছু এল। এদিকে ঘোড়াগুলো অশান্ত ও অস্থির হয়ে উঠল। হিলটো তার হাতের বর্ষার অগ্রভাগ দিয়ে ড্যাশবোর্ড স্পর্শ করল। একটা ছোট ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দ নিরবতার মধ্যে আরো বেশি শোনাল।

বে এখন সরাসরি নেফারের চেহারার দিকে চেয়ে আছে। নেফার অন্ধকার দিয়ে ঐ নিষ্করুণ চোখের অপলক দৃষ্টিকে ঢাকার চেষ্টা করল। কিন্তু এতে তার চোখে পানি এসে গেল। বে সামনে এগোল এবং তার নেকলেসটা তুলে ধরল। নেফার বুঝল এটা একটা মানুষ-খাদক সিংহের বুকের ভাসমান হাড়, টাইটারও এমন একটা আছে যা তার বাজুর তাবিজ ও যাদুর মাদুলির মধ্যে থাকে।

বে তার আফ্রিকান গুরুগম্ভীর করুণ সুরে মন্ত্র পড়তে লাগল। তারপর একটা খালি পা দিয়ে শক্ত মাটিতে আঘাত করল এবং নেফারের দিকে নির্দেশ করল।

সে আমার পর্দা ভেদ করছে, টাইটা সহজভাবে বলল কথাটা। হঠাৎ বে দাঁত বের করে হাসল এবং তার সিংহের মন্ত্র কবজটা দিয়ে সরাসরি তাদের দিকে নির্দেশ করল। তার পিছনে হিলটো অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। তার থেকে মাত্র ১০০ কিউবিট দূরে খোলা ভূমিতে যেখানে নেফার ও টাইটা শুয়েছিল এবং যা হঠাৎ প্রকাশিত হল সেদিকে সে তাকাল।

প্রিন্স নেফার! আমরা আপনাকে গত ত্রিশ দিন ধরে খুঁজছি। ধন্যবাদ মহান। হুরাস ও ওশিরিশকে। অবশেষে আমরা আপনাকে পেয়েছি।

নেফার দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং উঠে দাঁড়াল। হিলটো গাড়ি চালিয়ে সামনে এল ও রথ থেকে লাফ দিয়ে নামল এবং তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মাথা থেকে সে তার ব্রোঞ্জের হেলমেট খুলে ফেলল এবং যুদ্ধের ময়দানে কমান্ড করার মতন করে বলল, ফারাও ট্যামোস মৃত! ফারাও নেফার সেটির জয়। আপনি চিরঞ্জীবী হউন।

সেটি নেফারের পবিত্র নাম, পাঁচটা ক্ষমতার একটা যা তার জন্মের সময় তাকে দেয়া হয়েছিল, যা তার সিংহাসনে আরোহণের অনেক পূর্বেই ঠিক করা হয়। এই সময়ের আগে যতক্ষণ না সে ফারাও হয় তার পূর্বে এই পবিত্র নাম কারো ব্যবহার করার অনুমতি ছিল না।

ফারাও! মহান শক্তিশালী! আমরা আপনাকে পবিত্র শহরে নিয়ে যেতে এসেছি যাতে আপনি থেবস্-এ হুরাসের স্বর্গীয় প্রতীক রূপে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

আমি যদি আপনাদের সাথে যেতে রাজি না হই তবে কি হবে, কর্নেল হিলটো? নেফার জানতে চাইল।

হিলটোকে হতাশ দেখাল। সমস্ত ভালোবাসা ও আনুগত্যের সহকারে, এটা মিশরের রাজ-প্রতিভূর কঠোর আদেশ যেন আপনাকে থেব নিয়ে যাই। আমাকে ঐ আদেশ মানতে হবে এমনকি আপনি অসন্তুষ্ট হলেও।

নেফার পাশে টাইটার দিকে এক নজর তাকাল এবং মুখটা এগিয়ে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল; আমার কি করা উচিত?

আমাদের তাদের সাথে যেতেই হবে।

*

হিলটোর নেতৃত্বে ৫০টি যুদ্ধ রথের বহর যোগে তারা থেবসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। কঠিন নির্দেশ থাকার ফলে রথের কলামকে প্রথমে থেবস-এর মরুদ্যান দিয়ে যেতে হবে। দ্রুতগামী ঘোড়া সওয়ারীদের থেবস-এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হল সংবাদটা দিতে। যাতে লর্ড নাজা, মিশরের রাজ প্রতিভূ শহর থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে মরুদ্যানে এসে নতুন ফারাও নেফার সেটির সাথে সাক্ষাৎ করেন।

পঞ্চাশতম দিনে রথের বহরটি দীর্ঘ এক মাসের অধিক সময়ের ধুলোয় মাখামাখি ও বিধ্বস্ত হয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে মরুদ্যানে প্রবেশ করল। যখন তারা তাল গাছের ছায়ায় ঘেরা বনে প্রবেশ করল একটা পুরো ফেট গার্ড বাহিনী প্যারড সহকারে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। সৈন্যরা তাদের অস্ত্র খাপে ভরে রেখেছিল এবং এর পরিবর্তে তাল গাছের পাখাযুক্ত ডাল তারা হাতে ধরে ছিল। সেগুলো দোলাতে দোলাতে তারা তাদের শাসকের উদ্দেশ্যে স্তুতি ধ্বনি দিচ্ছিল।

সেটি, মহান শক্তিশালী। সত্য প্রিয়সী। স্বর্ণের হুরাস যে জীবন বাঁচিয়ে রাখে তার প্রতিনিধি। সে এরকা ও মৌমাছি। রা-এর পুত্র সেটি, সূর্যের দেবতা, চিরজীব। ও শাশ্বত।

সামনের রথে হিলটো ও টাইটার মাঝে নেফার দাঁড়িয়ে ছিল। তার কাপড় ছেঁড়া ও ধুলায় মাখা এবং ঘন চুল ধুলোয় আবৃত। সূর্যের তাপে তার চেহারা ও ত্বক পুড়িয়ে কাঠ বাদামের রং করে দিয়েছে। হিলটো রথটাকে সৈন্যেদের মাঝ দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গেল এবং নেফার উচ্চপদস্থ লোকদের যাদের সে চেনে সেদিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসল। তারাও তাকে স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহ দিল। তারা সবাই তার পিতাকে ভালোবাসত এবং এখন তাকে ভালোবাসে। উদ্যানের মাঝে কুয়ার পাশে নানান রঙের তাঁবু টানানো হয়েছে। রাজকীয় তাঁবুর বাইরে লর্ড নাজা দাঁড়িয়ে আছে আর তাকে ঘিরে রয়েছে সভাসদ, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও যাজকেরা। সবাই রাজাকে গ্রহণের প্রতীক্ষারত। নাজাকে দেখে মনে হচ্ছিল মহান শক্তিশালী কেউ ও রাজকীয় জ্যোতিতে বিরাজমান। উজ্জ্বল দামী পাথর ও স্বর্ণের অলংকার এবং সুন্দর, মিষ্টি প্রলেপন ও সুগন্ধি গায়ে মেখে সে দাঁড়িয়েছিল।

তার দুই পাশে রাজকীয় ট্যামোস হাউজের রাজকুমারী হেজারেট ও মেরিকারা দাঁড়ানো। মেক-আপ এর দরুণ তাদের মুখ মুক্তার ন্যায় সাদা এবং চোখগুলো বড় ও কালো দেখাচ্ছে। ঘোড়ার চুলের তৈরি পরচুলাটা তাদের মাথার তুলনায় বেশি বড় এবং তাদের স্কার্টটা মুক্তা ও স্বর্ণের ওজনে এতো ভারি যে বাঁকানো পুতুলের মত তারা দাঁড়িয়ে আছে। হিলটো তাদের সামনে রথটা থামাতেই লর্ড নাজা সামনে এগিয়ে এল এবং ধুলো-ময়লায় ঢাকা ছেলেটাকে নামাল। গেবেল নগর ত্যাগ করার পর থেকে সে আর গোসল করার সুযোগ পায় নি এবং তার শরীর থেকে এখন পাঠার ন্যায় গন্ধ বেরুচ্ছে।

আপনার রাজ-প্রতিভূ হিসেবে আমি আপনাকে স্যালুট জানাচ্ছি। আমি আপনার দাস এবং রাজকীয় সাথী। আপনি হাজার বছর বাঁচুন। সে বিশেষ ভাবে শব্দ করে বলল যাতে কাছে দাঁড়ানো উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিগণ প্রতিটি শব্দ শুনতে পায়। লর্ড নাজা নেফারকে কাউন্সিলের বেদীর দিকে নিয়ে গেল যা আফ্রিকা মহাদেশের গভীর বনের কালো মূল্যবান কাঠ দ্বারা তৈরি এবং আইভরি ও মুক্তা খচিত। তাকে সে তার উপর বসাল। তারপর হাঁটুগেড়ে বসে নেফারের ময়লা ও নোংরা পা কোন রকম অস্বস্তি ছাড়াই চুম্বন করল। তার পায়ের আঙুল ভাঙ্গা ও কালো ময়লার ঢেকে আছে।

সে দাঁড়াল এবং নেফারকেও দাঁড় করাল। তারপর তার ছেঁড়া স্কার্টটা এক পাশে সরাল যাতে তার উরুতে থাকা ফারাও-দের চিহ্নটা উন্মুক্ত হয়। ধীরে ধীরে সে তাতে ঘোরাল যাতে সবাই চিহ্নটা দেখতে পায়।

জয় ফারাও সেটি। প্রভু ও প্রভুদের পুত্র। সবাই চিহ্নটা দেখুন। এ চিহ্নের দিকে তাকাও পৃথিবীর সব জাতি এবং রাজার ক্ষমতায় কেঁপে ওঠো। মহান ফারাও এর সামনে সবাই নত হও। সৈন্যদের মাঝে আওয়াজ বয়ে গেল এবং দরবারে লোজন বেদীর চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। জয়, ফারাও! তার মহত্ত্ব ও মহানুভবতা নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকুন।

তারপর নাজা রাজকুমারীদের সামনে নিয়ে এল এবং হাঁটুগেড়ে বসে তারাও তাদের ভাইয়ের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল। তাদের কণ্ঠ শোনা গেল না যতোক্ষণ না ছোট রাজকুমারী মেরিকারা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল এবং লাফ দিয়ে বেদির উপর উঠল। সে দৌড়ে তার ভাইয়ের কাছে গেল। নেফার, সে চিৎকার করে উঠল, তোমাকে আমার খুব মনে পরেছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ।

নেফার ইতঃস্ততভাবে তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাল এবং ফিসফিসিয়ে বলল, তোমার গায়ে ভয়ংকর গন্ধ।

লর্ড নাজা একজন রাজ সেবিকাকে ডেকে নেফারকে ভেতরে নিয়ে যাবার জন্যে নির্দেশ দিল। তারপর মিশরের মহান লর্ড ও কাউন্সিলের সদস্যরা এক এক করে সামনে এল এবং রাজকীয় শপথ করল। সেখানে একটা মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তির সৃষ্টি হল যখন সে জড়ো হওয়া সদস্যদের জিজ্ঞেস করল তীক্ষ্ণ ও পরিষ্কার কণ্ঠে, কোথায় আমার প্রিয় ক্ৰাতাস চাচা? আমাকে অভিবাদন জানাতে সবার সাথে তারও তো আসার কথা।

টালা মিন মিন করে একটা আশ্বস্ত জনক ব্যাখ্যা দিল। লর্ড ক্ৰাতাস এখানে যোগ দিতে অসমর্থ। আপনাকে পরে এর ব্যাখ্যা করা হবে, মহামান্য। টালা বৃদ্ধ ও ক্ষীণ, এখন সে রাজ্যের কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট। সে নাজার পুতুলে পরিণত হয়ে গেছে।

যখন নাজা হাততালি দিল তখন অনুষ্ঠানটি শেষ হল। ফারাও অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছেন। শহরে রওনা দেবার পূর্বে তার বিশ্রামের প্রয়োজন। নিজের সত্ত্বাধিকারীর ন্যায় সে নেফারের হাত তুলে নিল এবং রাজকীয় কাবাকোর দিকে তাকে নিয়ে গেল, যা একটা পুরো ফেট গার্ড দ্বারা পাহারারত। সেখানে কাপড়ওয়ালা, সুগন্ধিওয়ালা ও নাপিত, রাজ-গহনার রক্ষক, ভেলভেট, নখ পরিচর্যাকারী, অঙ্গ সংবহনকারী এবং দাসীরা সবাই তাকে গোসল করানোর জন্যে অপেক্ষা করছে।

টাইটা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সে বালকটির পাশে থাকবে যাতে তাকে রক্ষা করতে পারে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল এই সব সফরসঙ্গীদের দলে ভিড়তে। কিন্তু তার লম্বা কৃশ দেহ ও রূপালি চুলে সহজেই তাকে চেনা যায়, আর তার সুনাম ও সম্মান এই দেশে এমন যে সে কখনো লুকিয়ে কোথাও যেতেও পারবে না। প্রায় সাথে সাথে একজন সার্জেন্ট অস্ত্র হাতে তার সামনে এসে দাঁড়াল। অভিবাদন, লর্ড টাইটা, প্রভু সব সময় আপনার উপর খুশি থাকুন। যদি ফারাও ট্যামোস তার মুক্তির দিনে তাকে এ সম্মান প্রদান করেছিলেন, এখন এই উপাধিতে তাকে ডাকলে টাইটার অস্বস্তি লাগে।

মিশরের রাজ-প্রতিভূ আপনাকে ডেকেছেন। সে বৃদ্ধ জ্ঞানী লোকটির ময়লা কাপড় ও ধুলো মাখা পুরানো স্যান্ডেলের দিকে তাকাল। আপনার বর্তমান অবস্থায় তার সাথে দেখা না করাই ভালো। লর্ড নাজা নোংরা পোশাক ও দুর্গন্ধ পছন্দ করেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *