মৃত্যু
নূপুর খবরটা পায় সকালে। সারাদিন কাউকে জানায় না। কাকেই বা জানাবে! কে তার পাশে এ সময়ে দাঁড়াবে! আত্মীয়দের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিনা খবরটা শুনে বিচলিত হবে, মুষড়ে পড়বে, বা চোখের জল ফেলবে। উপদেশ হয়তো কেউ কেউ দেবে। কিন্তু যাদের কোনও কিছু যায় আসে না যমুনার-কী-হল-না-হল’য়, তাদের উপদেশ শোনার চেয়ে, নূপুর ভাবে, তার নিজের যা ভালো মনে হয় তাই করা উচিত। ভেবেও নূপুর জব্বার চৌধুরীকে ফোন করে সন্ধ্যের দিকে। জব্বার চৌধুরীর বয়স প্রায় পঁচাত্তর। খবরটা শুনে জানতে চাইলেন যমুনা আমেরিকায় থাকতো কিনা। ভারতে থাকতো শুনে তাঁর রাগ হয় খুব। বললেন, ‘ইণ্ডিয়ায় কেন থাকতে গেছে? ও কি জানে না ইণ্ডিয়া বাংলাদেশকে পানি দিচ্ছে না? ইণ্ডিয়াকে বয়কট করা উচিত ছিল যমুনার’। জব্বার কাকার কথা এরপর আর শুনতে ইচ্ছে করেনি। সুলেখাকে জানায় নূপুর। সুলেখা খালাতো বোন। যমুনার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল দেশে থাকাকালীন। খবরটি যে কোনও খবর শোনার মতোই শুনলো, বললো, ‘সবাইকেই যেতে হবে নূপুর। নিজে কী পূণ্য কামাই করলে, সেটা দেখ। সবাই ইয়া নবসি ইয়া নবসি করবে। যমুনা আজ গেছে, কাল আমরা যাবো’। আহ, সবাইকে যে যেতে হবে, যেন নূপুর এ কথা আগে জানতো না!
রাত দশটার দিকে নূপুর নাইমকে ফোন করে। এ ফোনটি করার কোনও মানে হয় না জেনেও ফোনটি করে। জানে যমুনার যদি বাধা দেওয়ার কোনও সুযোগ থাকতো, এই ফোনটি করতে সে বাধা দিতই। জেনেও সে খবরটা জানায় নাইমকে। পরিবারের লোক হিসেবে জানার অধিকার তার আছে বলেই জানায়, এ ছাড়া আর কোনও কারণ নেই। ফোনটি করার আগে নূপুর নিজেকে বার বারই কথা দেয়, সে কাঁদবে না। কারণ আর যার কাছেই হাহাকার করা মানায়, নাইমের কাছে মানায় না।
ফোন ধরেছিল নাইমই।
—দাদা, তপু ফোন করেছিল।
—তপু কে?
—বুবুর মেয়ে।
—যমুনার মেয়ে?
—তোমার তো জানার কথা যে বুবুর মেয়ের নাম তপু। তপু এখন আমেরিকায় পিএইচডি করছে। হারভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ফিজিক্সে।
—এই তপুই সেই তপু তা জানবো কী করে? তা ফোন করেছে বলে আমার হয়েছেটা কী? আমার কী করার আছে। এ বাড়ি আমার। তুই কোনও অপু তপুর হয়ে তদবির করবি না, আগেই বলে দিয়েছি। কোন বাস্টার্ড কী করলো, ফোন করলো কী করলো না, আই ডোন্ট কেয়ার।
—আমি জানি তুমি কেয়ার করো না। বুবুর ফ্ল্যাটটায় তুমি আজ প্রায়, কত বছর হল, পঁচিশ বছর, আছো। লোকে এখন ওটাকে তোমার ফ্ল্যাট বলেই জানে, এ কথা তুমিও জানো। এ নিয়ে কথা বলার জন্য আমি ফোন করিনি। তপুও আমাকে ফ্ল্যাট নিয়ে কথা বলতে ফোন করেনি। আসলে দেশের বাড়িঘর নিয়ে তপুর কোনও আগ্রহ নেই।
—তাহলে কে ফোন করেছে না করেছে তা শোনাতে গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলছিস কেন?
—ও, তুমি এই দশটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? তাহলে কাল ফোন করি। বরং কালই কথা বলি। তুমি ঘুমোও।
—কাল আমার সময় নেই। আজই বল যা বলার। ফ্যামিলির পেছনে সব এনার্জি খরচ করেছি। আর আমি পারবো না। আমার একটা লাইফ আছে, নাকি নেই?
—এনার্জি যদি খরচ করে থাকো, সে তোমার নিজের ফ্যামিলির পেছনে করেছো। আমার আর বুবুর জন্য তোমার পকেটের দু’পয়সাও খরচ হয়নি কোনোদিন। কোনও এনার্জিও খরচ হয়নি। যদি কখনও এনার্জি খরচ করে থাকো, সে আমাদের ঠকাবার ফন্দি আঁটার এনার্জি, আর কিছুর নয়।
—কী বলতে চাস তুই?
—তুমি ভালো করে জানো কী বলতে চাই।
—এত রাতে ফোন করেছিস কেন?
—খুব বেশি রাত হয়নি। রাত দশটায় তুমি ঘুমোওনা। দশটার পরে তোমার মদ খাওয়া শুরু হবে। রাত দুটো তিনটেয় ঘুমোবে তুমি।
—তাতে তোর কী! আমার পয়সায় আমি মদ খাই। তোর পয়সায় মদ তো খাই না।
—হিসেব করে দেখো, আমার আর বুবুর পয়সায় অনেক খাচ্ছো। বাবার জমিজমা টাকা পয়সা একা আত্মসাৎ না করলে, তিনজনের মধ্যে সবকিছু ভাগ করলে, তোমার ‘তোর পয়সায় বা তোদের পয়সায় মদ খাই না’ এ কথাটা বলা সাজতো।
—তোর এইসব প্যানপ্যানানি শুনতে আমি পারবো না। তোকে আমি ফাইনাল বলে দিয়েছি, বাবার সম্পত্তি নিয়ে কোনও কথা বলতে পারবি না। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ি তোকে আমি লিখে দিয়েছি।
—না, তুমি লিখে দাওনি। এ বাড়ি আমি কিনে নিয়েছি। বাজারে যা দাম, তার দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনেছি।
—তোর বাজে কথা অনেক সহ্য করেছি। বাড়ি বাজারের চেয়েও কম দামে তোকে দিয়েছি।
—তুমিও জানো তুমি মিথ্যে বলছো, এ বাড়ির দাম যখন দু’ কোটি টাকা, তুমি চার কোটি নিয়েছো।
—এই জন্যই বলি মেয়েমানুষের সঙ্গে কারবার করতে নেই। তোর কাছে বিক্রি করাই উচিত হয়নি।
—করেছো টাকার লোভে। এতগুলো টাকার লোভ কী করে সামলাবে!
—দ্বিগুণই যদি দাম নিই, তুই কিনলি কেন? তোর কোনও স্বার্থ না থাকলে তুই কিনেছিস আমার বাড়ি?
—প্রথমত এটা তোমার একার বাড়ি নয়। আমি আর বুবুও এই বাড়ির ভাগ পাই। কিন্তু যেহেতু তুমি একাই গায়ের জোরে বলছো এই বাড়ি তোমার, এই বাড়ি তোমাকে লিখে দিয়ে গেছে বাবা, যেহেতু তুমি আমাদের ভাগ আমাদের দেবে না, অগত্যা কিনেছি। দ্বিগুণ বেশি দাম দিয়ে কেনার কারণ, স্মৃতি। আর কিছু না। বাড়িটার ওপর টান আছে বলে কিনেছি।
—তোর টান আছে, আমার টান নেই? ওই বাড়িতে আমি থাকিনি? তোরাই থেকেছিস?
—থেকেছো কিন্তু টান নেই। টান থাকলে দশগুণ দাম পেলেও তুমি বিক্রি করতে না। যেমন আমি করবো না। যাকগে, এসব পুরোনো কথা। একই কথা বহুবার হয়েছে আমাদের মধ্যে। বলতে চেয়ছিলাম তপু ফোন করেছিলো।
—আশ্চর্য! ও তোকে ফোন করে, তুই ওকে ফোন করিস। এসব তোদের ব্যাপার। আমাকে জানানোর মানে কী?
—তপুর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয় আমার। তপুকে কি কোনোদিন ফোন করেছো? জানো ও দেখতে কেমন? কবে ওকে শেষ দেখেছিলে? কোনওদিন জানতে চেয়েছো ওর কথা? ও কেন তোমাকে ফোন করবে! বেচারা জানেও না ফ্যামিলি কাকে বলে। একবার শখ করে এসেছিল নিজের দেশ দেখতে, আত্মীয় স্বজনদের দেখতে, ওর নিজের মা’র ফ্ল্যাটটাতেই তো থাকতে দাওনি। কী যেন বলেছিলে? গেস্ট আছে। গেস্ট মানে তো তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক। ওরা তো সারা বছর বুবুর ফ্ল্যাটেই থাকে। তপুর জন্য জায়গা হয়না। ওকে হোটেলে উঠতে হয়েছিল।
— ফ্ল্যাট নিয়ে এত কথা বলবি না, নূপুর। সহ্যের একটা সীমা আছে আমার। আমি যদি ফ্ল্যাটটা না টেক কেয়ার করতাম, এটা এতদিনে পাড়ার গুণ্ডাপাণ্ডারা নিয়ে নিত। আমি দেখাশুনা করছি, মেইনটেইনেন্স দিচ্ছি। কম টাকা খরচা হচ্ছে আমার?
—থাকছো যখন বাড়িতে, তোমার ময়লা ফেলার খরচা, তোমাকে পাহারা দেওয়ার খরচা তো তোমাকে দিতেই হবে। বাড়িটায় ভাড়াটে থাকলেও তাই করতো।
—তুই এতকাল আমেরিকায় কাটিয়েছিস। তুই এদেশের অনেক কিছু জানিস না। আমি না থাকলে অনেক ক্ষতি হত ফ্ল্যাটের।
—তুমি না থাকলে একটা লাভ হত, বুবু ফ্ল্যাটটা বিক্রি করতে পারতো।
—বিক্রি? যমুনা ফ্ল্যাট কী করে বিক্রি করতো, শুনি? ও কি দেশে আসতে পারতো বিক্রি করতে? এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোমরে দড়ি বেধে জেলখানায় নিয়ে যেতো।
—বাজে কথা বলো না।
—আমি বাজে কথা বলি না।
—বুবুর বিরুদ্ধে কেউ মামলা করেনি। কে তাকে জেলখানায় নিত? কেন নিত?
—এলেই মামলা করতো। ভালো যে আসেনি। বাই দ্য ওয়ে, তপু কেন ওর বাবার ফ্যামিলির কাউকে দেখতে যায়নি? ওই ফ্যামিলি কেন ওকে রিসিভ করলো না? বাড়িতে রাখলো না? গুলশানে তো বিরাট বিরাট বাড়ি আছে ওর বাবার!
— এসব কেন বলো! তুমি ভালো করেই তো জানো ওরা কেউ জানে না তপুর কথা। বাবা বা বাবার ফ্যামিলি সম্পর্কে তপু নিজেও কিছু জানেও না। কোনও আগ্রহ জন্মায়নি তপুর। তপু মানুষ হয়েছে তপুর মা’র কাছে।
—সো?
—সো আবার কী? তোমাকে ইনফরমেশনটা দিলাম। তুমি জানো, তারপরও দিলাম। কনভেনশানাল জীবনের বাইরেও জীবন থাকে মানুষের। কোনোদিন কি বুঝতে চেয়েছো? শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখে গেছো।
—শোন তোর এসব কমপ্লেইন শুনলে আমার চলবে না। তোর কাজকম্ম নেই। বসে বসে আমেরিকার ডলারে ল্যাভিস লাইফ লীড করছিস। আমাকে খেটে খেতে হয়। অনেক কাজ পড়ে আছে। আমি রাখি।
নূপুর থামায় নাইমকে। ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে বলে —আমার এটা জানানো কর্তব্য বলেই জানাচ্ছি। পরে আমাকে যেন দোষ না দাও, আবার যেন না বলো যে আমি কোনও বদ উদ্দেশে খবরটা গোপন রেখেছি। শোনো, তপু জানালো বুবু মারা গেছে।
কিছুক্ষণ কোনও শব্দ নেই।
একটা স্তব্ধতা ফোনের দু’পারেই।
নূপুরের চোখে জলের ধারা। বাঁ হাতে ফোনের রিসিভার। ডান হাতে মুখ চেপে রাখা। নাইম যেন কোনো আর্তস্বর বেরিয়ে এলে না শোনে।
—ও এই কথা?
নাইম প্রথম কথা বলে।
নূপুর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে —হ্যাঁ এই কথা। এও জানালো, তপু ইণ্ডিয়ায় যাবে না, ওর মাকে ও যেমন হাসিখুশি, লাইভলি দেখেছে, ওই স্মৃতিটাই রাখতে চায়। ও বুবুর ডেডবডি দেখতে চায় না।
—চায় না তো আমাকে জানাচ্ছিস কেন!
—না, তোমাকে কোনও দায়িত্ব পালন করার জন্য জানাচ্ছি না। যা করার আমিই করবো। আমি চাইও না তুমি বুবুর কোনও কিছুতে নাক গলাও। পঁচিশ বছর তোমার কিছু যায় আসেনি বুবুর কোনো কিছু নিয়ে, এখনও সেভাবেই থাক। শুধু বুবুর বদনামটা যেমন করে গেছো এতকাল, সেটা অন্তত কোরো না কিছুদিন। আমি কলকাতা যাচ্ছি শিগগির। তোমাকে ফোন করেছিলাম শুধু এটুকু জানাতে, তোমার ছোট বোন যমুনা আর নেই। এটুকু, পরিবারের লোক হিসেবে জানানো কর্তব্য বলেই জানিয়েছি।
নূপুর নিজেই ফোন রেখে দেয়। রেখে দেয় কারণ তার হাত কাঁপছে, তার ঠোঁট কাঁপছে। ফোন রেখে তাকে বারান্দায় ছুটে যেতে হয়, লম্বা শ্বাস নিতে হয়। চিৎকার করে তাকে কাঁদতে হয় কিছুক্ষণ।
ফোন বেজে গেছে এর পর। নাইম করেছে ভেবেই ফোন সে ধরেনি। ফোন ধরেনি, কারণ সে কেঁদেছে। শুয়েছে। বারবার খাট থেকে নেমেছে। জল খেয়েছে। আবার শুয়েছে। এপাশ ওপাশ করেছে। বুকে চিনচিন ব্যথা। ফুঁপিয়েছে। শান্ত হয়েছে। সারারাত যমুনার কথাগুলো মনে বেজেছে। যমুনা বলতো, ‘আয়, নূপুর একবার আমার কাছে আয়, অনেকদিন তোকে দেখি না’। যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি নূপুরের। আর কিছুদিন বা ক’টা মাস পরই হয়তো যেত। বাড়িটা গুছিয়ে নিয়েই যেত। বাড়িটা গোছাতে গোছাতেই বছর চলে গেল। যমুনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত কী গোছানোর আছে!’ নূপুর ঠিক কী বলবে বুঝে পায়নি। আসলে যমুনার ওই দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরেই ‘কী করছিস চলে আয়’-এর আহবানকে অবজ্ঞা করতে করতে অবজ্ঞা করাটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়েছিল।
একটা ভীষণ বিষণ্ণ অসহ্য রাত্তির যায়, সকালের দিকে রাস্তায় পড়ে থাকা এতিম শিশুর মতো কুঁকড়ে শুয়ে থাকে নূপুর। প্রতিদিনের মতো চা দিয়ে যায় দুলি। চা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে থাকে। নূপুর ঘুমিয়ে পড়ে। বারোটায় নাইমের ফোনে ঘুম ভাঙে।
—কী হয়েছিল রে? কী অসুখ? বলতে চাইছি কী অসুখে মরলো? নাইম জিজ্ঞেস করে। গলাটা ভাঙা।
নূপুর দুলিকে ডেকে ওই ঠাণ্ডা চা’টাই গরম করে দিতে বলে। চা না খেলে নূপুর দিন শুরু করতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘জানি না দাদা। মনে হয় হার্ট অ্যাটাক। ব্লাড প্রেশার তো বেশি ছিল’।
—প্রেশার কবে থেকে? প্রেশার তো আমারও আছে।
—হ্যাঁ বাবার কাছ থেকে ওই প্রেশারটা পাওয়া। তুমিও পেয়েছো, বুবুও পেয়েছে।
—ওষুধ খেতো না নাকি?
—খেতো তো।
—খেলে হার্ট অ্যাটাক হবে কেন?
—প্রেশার না থাকলেও তো হার্ট অ্যাটাক হয়! কোলেস্টারোল বেশি হলে বা ব্লাডক্লট বেশি হলে। কী কারণে বুবুর এমন অ্যাটাক হল, তা জানা দরকার।
—অবশ্য বয়সও তো হয়েছিল। কিন্তু ওর মেয়ে কী বললো, কীভাবে মারা গেছে?
—না, ও কিছু বলেনি। ওকে কেউ একজন ফোনে জানিয়েছে বুবু মারা গেছে।
—কে জানিয়েছে ওকে?
—কলকাতা থেকে একজন জানিয়েছে।
—যে জানিয়েছে, সে কী যমুনার কিছু হয়? মানে কোনও রিলেটিভ? ওই সময় ছিল সে? মানে মারা যাওয়ার টাইমে ছিল? নাম কী লোকটার?
— কে খবরটা জানালো তপুকে, এটা তো কোনও ইম্পর্টেন্ট কোনও বিষয় না! রিলেটিভ বুবু কলকাতায় কোথায় পাবে? বুবু তো একাই থাকতো! কোনও বান্ধবী বা কলিগ হয়তো জানিয়েছে।
—তুই কেন জিজ্ঞেস করিসনি কে ফোন করেছিল তপুকে, কে জানিয়েছে খবরটা? যে ফোন করেছিল, তার ফোন নম্বরটা বরং নে। তার সঙ্গে সরাসরি কথা বল। কী হয়েছিল, ঘটনা কী, সবকিছু জানতে চা। হুট করে কোনও ডিসিশান নিস না। এটা উড়ো কোনো খবর কিনা যাচাই করে দেখ। কলকাতার মানুষ কিন্তু ভালো না। হয়তো যমুনার টাকা পয়সার লোভে ওকে গুম করে দিয়েছে।
—তপু বলেছে, মহিলা কী যেন নাম আরতি বানিয়তি বুঝতে পারছে না একা কী করে কী করবে। তপুকে কলকাতায় যেতে বলেছে। বলেছে লাশ আমরা মর্গে রেখে দিচ্ছি। তুমি এসে যা করার করো। এও জানিয়েছে বুবু নাকি ডেডবডি মেডিকেল কলেজে দান করে গেছে।
—কী করে গেছে?
—দান করে গেছে।
—পুরো বডিটাই?
—হুম।
—মেডিকেল কলেজ ওর বডি দিয়ে কী করবে?
—বডি কেটে কেটেই তো শেখে স্টুডেন্টরা। তাছাড়া ডেডবডি রিসার্চের কাজেও লাগে।
—বডির কি অভাব আছে নাকি আজকাল? বডি দিয়েছে ভালই করেছে। বডি বহন করার ঝামেলা গেল। বাঙালিরা বিদেশ থেকে বডি আনছে দেশে। খরচও তো সাংঘাতিক। আমি তো বলি ওদের, যেখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে, সেখানে কবর দাও, বডি দেশে আনার দরকারটা কী। ওদের জানিয়ে দে, মেডিকেলে দিয়ে দিতে।
—ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি গেলেই নাকি সব হবে।
—কবে যাবি?
—যাবো, কালই যাবো।
—বাড়ি গাড়ি আছে?
—মানে?
—মানে বাড়ি গাড়ি আছে কি না। সহায় সম্পত্তি কোথায় কী অবস্থায় আছে তা দেখতে হবে তো।
—এই সময় বিষয় আশয় নিয়ে চিন্তা করছো? মানুষটা মারা গেছে, দাদা। মানুষটা আর নেই।
—শোন, যা কিনেছে সব বিক্রি করে দিয়ে আয়। ভ্যালুয়েবল জিনিসপত্র, সোনা দানা টাকা পয়সা এসব শুধু নিয়ে আয়। অন্য কিছু আনিস না। দেখা যাবে, ওসবের যা দাম, ট্রান্সফার করতে গেলে তার চেয়ে দাম পড়েছে বেশি। কিছু অসুবিধে হলে বাংলাদেশ অ্যামবেসির সঙ্গে যোগাযোগ করিস। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে, কামাল চৌধুরী, আমি ওকে জানিয়েও রাখবো।
—ঠিক আছে।
—আসলে আমারই যাওয়া উচিত। তুই কি এত সব পারবি? তুই পারবি না। একটা পুরুষমানুষ থাকা উচিত।
—না না না, আমিই পারবো। না পারার কী আছে! বুবুর দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, ওরা নিশ্চয়ই হেল্প করবে। কী যেন নাম, মুন, আর বোধহয়, গার্গী। ওদের ঠিকানা ফোন নম্বর কিছুই অবশ্য এখন আমার কাছে নেই। ও বের করে নেওয়া যাবে। একবার তো গিয়েছিলাম কলকাতায়। ঢাকা হয়ে আমেরিকা যাওয়ার পথে থেমেছিলাম। দু’দিন ছিলাম। জয় তখন কোলে। ওদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বুবু একটা ভাড়া বাসায় থাকতো। তপু ছোট ছিল। কলকাতার ভালো একটা ইস্কুলে বুবু ওকে ভর্তি করানোর জন্য খুব চেষ্টা করছিল। বলেছিল আর ক’টা দিন থাকতে। জয় এত বিরক্ত করছিল, থাকিনি।
—শোন, কাজের কথা বলি। ওখানকার কোন ব্যাংকে কত আছে, এসব জানতে হবে। আর ইণ্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে অত সহজে টাকা ট্রান্সফার করা যায় না। পারমিশান টারমিশান নেওয়ার ব্যাপার আছে। আমার তো ভারতের ভিসা আছে, গত মাসে নিয়েছিলাম। নতুন একটা ব্যবসা শুরু করার জন্য দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। ওই ভিসায় ঘুরে আসতে পারবো। দেখি কালকের একটা টিকিট করতে পারি কি না।
— সব কিছু আমিই পারবো, দাদা। তোমার দরকার নেই যাওয়ার।
—দরকার নেই মানে?
—মানে তোমার সঙ্গে তো ভালো সম্পর্কটাও ছিল না। তুমি তো বুবুর খোঁজও নাওনি। এক আমিই যা নিয়েছি। অবশ্য আমিই বা কত খোঁজ নিয়েছি। আমারও ঝামেলা টামেলা ছিল। সব সময় যোগাযোগ করতে পারিনি। নিজের সংসার নিয়েই তো ডুবে ছিলাম। কনটাক্ট বেশিরভাগ বুবুই করতো। সবসময় তো ফোনও ধরতাম না। ডিপ্রেশনে থাকলে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। জানিনা বুবু বুঝতো কিনা। অনেক কিছুই তো ও বুঝতো। বুবুটা খুব একা ছিল। ফ্যামিলির কারো সাপোর্ট পায়নি। যদি পেতো..
নূপুরের কথা শেষ না হতেই ধমকে ওঠে নাইম।
—ফ্যামিলির সাপোর্ট কী করে আশা করে? আমরা যে ওর বিরুদ্ধে কেইস করিনি, পুলিশে খবর দিইনি, এটাই তো বেশি। আর কী চায় ও?
—না, কিছু চায় না। চাওয়ার জন্য তো আর বসে নেই! তুমি কেন সাপোর্ট করবে, তাই তো! বুবু ফিরে আসবে বলে তোমার ভয় ছিল, ফ্ল্যাটটা যদি ফেরত চায়! সেই ভয়টা এখন নিশ্চয়ই জন্মের মতো গেছে। বেশ চেঁচিয়ে কথা টথা বলছো। তোমার মনটা কী দিয়ে গড়া, বলো তো? আমরা তো একই মা’র সন্তান! কেন তুমি এত ভিন্ন মানসিকতার! মাঝে মাঝে ভাবি, তুমি মা’র পেটেই ছিলে তো! নাকি কোথাও থেকে এনে তোমাকে অ্যাডপ্ট করেছে!
— বাজে কথা রাখ। তোর বোনকে ফ্যামিলি সাপোর্ট করেনি। লজ্জা করে না বলতে? একটা মার্ডারারকে সাপোর্ট কী করে করবো আমরা? ও তোর বোন হতে পারে, কিন্তু ভুলে যাবি না ও একটা লোককে খুন করেছে। একটা খুনীর জন্য অত দরদ কেন তোর? তাহলে বলতে হবে খুনের পেছনে তুইও ছিলি। আমাদের চৌদ্দ পুরুষের কেউ কখনও খুন করেছে? আমি খারাপ, আমি অমানুষ, নাকি যমুনা খারাপ, যমুনা অমানুষ? লোকদের জিজ্ঞেস কর, কী বলে দেখ। দেখ সবাই কাকে অমানুষ বলে। খুনী মরেছে তো কী হয়েছে! খুনী মরুক, তাই তো সবাই চায়! খুনীরা জেল খাটে, খুনীদের ফাঁসি হয়, যাবজ্জীবন হয়। আর ওর তো কিছুই হয়নি। দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দিব্যি আরামে ছিল এতগুলো বছর। এখনও মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। খুনীর ভাই বলে এখনও লোকে আঙুল তুলে দেখায়।
— চিরকাল তো একই কথা বলছো। অন্তত আজকের দিনটা বন্ধ করো এসব কথা। মানুষটা ছিল, মানুষটা নেই!
—সো?
—সো একটু ভাবো ওর কথা। ও কি ভালো কিছু করেনি? শুধু খুনই করেছে? খুন তো অকারণে করেনি।
—সব খুনীই বলে যে খুন করার পেছনে কারণ ছিল।
নাইম আরও কিছুক্ষণ চেঁচায়। আরও কিছুক্ষণ যমুনাকে কুচি কুচি করে কেটে ওতে নুন আর লঙ্কা ছিটিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। গলার স্বরে তীব্র রোষ, বিদ্রূপ, ঘৃণা। নূপুর ফোন রেখে দেয়। যমুনার প্রসঙ্গ উঠলে নাইম এমন কম দিনই আছে, যেদিন যমুনাকে খুনী বলে গালি দেয়নি! আজকের দিনটা অন্তত অন্য রকম হতে পারতো। আজকের দিন অন্য দিনের মতো নয়। আজ যমুনা নেই। নূপুরের আজ কোনও মন্দ কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।
নূপুর জানে নাইম মিথ্যে কথা বলছে। নাইমকে খুনীর ভাই বলে কেউ আঙুল তুলে দেখায়, এ নূপুরের বিশ্বাস হয় না। যমুনা না জানালে হয়তো কেউ জানতোই না খুনের ঘটনাটি। আর নূপুর নাইমকে তখন না জানালে নাইমও জানতে পারতো না। নূপুরের বিয়ের উৎসব জাঁকজমক করার পেছনে নাইমের বড় একটা ভূমিকা ছিল, সে কারণেই কী না নূপুর জানে না নাইমের ওপর তার বেশ একটা বিশ্বাস জন্মেছিল। বিশ্বাস জন্মেছিল বলেই যমুনা যে কথা শুধু তাকেই বলেছিল শুধু, নূপুর সে কথা অন্যের কানে দিয়েছিল? নূপুর কি ভেবেছিল কাছের মানুষগুলোকে জানিয়ে রাখলে বিপদ আপদে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে! নাকি যমুনার ওই খুনটাকে মনে মনে সে মেনে নিতে পারেনি বলেই রাষ্ট্র করেছিল!
জীবনকে যদি পেছনে নেওয়া যেত। একটা শুধু রিমোট কন্ট্রোল থাকতো, তাহলে ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যেত। বড় অসহায় বোধ করে নূপুর। এরমধ্যে আবার ভীষণ মাথা ধরে। এই মাথা ধরা রোগটা বাড়ে যখন কারও কুৎসিত ব্যবহার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই কারণেই নূপুর চায় না নাইমকে ফোন করতে, ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্টের কথা জানাতে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে নাইম সবসময়ই বেশ দক্ষ।
যমুনা খুনী হোক আর যাই হোক, নূপুরের বোন যমুনা। দায়িত্ব তাকে এখন নিতেই হবে। কলকাতায় যার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তার নাম ফোন নম্বর সব তপুর কাছ থেকে নেয়। নির্মলা বসু। যমুনার বাড়িতে থাকছে বহু বছর। কেন থাকছে, ভাড়া থাকছে, নাকি কেয়ার টেকার, নাকি বাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য, নাকি বাড়ির খরচ শেয়ার করার জন্য একজন হাউজমেট, নূপুর আর তপুকে জিজ্ঞেস করে না। নির্মলাকে ফোন করে নূপুর জেনে নেয় কতদিন সে চেনে যমুনাকে, কী করে পরিচয়, যমুনার বাড়িটা ঠিক কোথায়, যেখানে যমুনাকে রাখা হয়েছে, সেটাই বা কতদূর বাড়ি থেকে। নূপুর যাক, এ নির্মলা চাইছে, নির্মলা জানিয়ে দেয়, কলকাতায় আর যারা আছে যমুনার চেনা পরিচিত বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী, সবাই চাইছে।
নির্মলার সঙ্গে যমুনার পরিচয় কলকাতায়। যমুনা বাড়ি খুঁজছিল কেনার জন্য। বিজ্ঞাপন দেখে অনেক বাড়িই দেখে এসেছে, পছন্দ হয়নি। যে বাড়িটি পছন্দ হল, সে বাড়ি নির্মলারই কাকার বাড়ি। নির্মলা তার বয়স হয়ে যাওয়া সন্তানহীন কাকা কাকীমার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছে। বোলপুরের গ্রামে থাকতো বাবা মা। কথা ছিল, তার কাকা কাকীমাই তাকে কলেজে পড়াকালীন সময়ে একটা পাত্র জুটিয়ে বিয়ে দেবে। পাত্রও জোটেনি, বিয়েও হয়নি। ওদিকে গ্রামে বাবা মা দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। কাকা কাকীমা একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, এত বড় বাড়িতে বাস করার কোনো মানে হয়না, তারচে’ বাড়ি বিক্রি করে শহরে অনেক ফ্ল্যাট হচ্ছে, একটি কিনে নেবেন, ফ্ল্যাটও হবে, হাতে কিছু টাকাও রইবে জমা করে রাখার জন্য। বাড়িটা কিনেছিল যমুনা। আর ওই বাড়ি কেনা বেচার কারণে ঘন ঘন দেখা হতে থাকে, ঘন ঘন কথাও হতে থাকে নির্মলা আর যমুনার। যত কথা হয় তত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। যত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তত ভালোলাগা বাড়ে, বন্ধুত্ব বাড়ে। কাকার ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে যমুনার কিছু আসবাবপত্র কেনায় আর বাড়ি ঘর সাজানোয় সাহায্য করার জন্য নির্মলা রয়ে গেল বাড়িতে। সেই যে রয়ে গেল, আর তার যাওয়া হয়নি কোথাও, না কাকার ফ্ল্যাটে, না গ্রামে, বাপের বাড়ি। নির্মলার বয়স বিয়ের বাজারের নিয়মে বেজায় বেড়ে গেছে বলে বিয়ের দুশ্চিন্তাও ততদিনে সবাই ত্যাগ করেছে। কাকার সংসারটা যতনা নিজের সংসার ছিল, তার চেয়েও যেন যমুনার সংসার নির্মলার নিজের সংসার হয়ে উঠলো। নির্মলার বিশ্বাস পুরুষ-নারীর সংসারের চেয়ে দুটো নারীর সংসার অনেক বেশি ঝুটঝামেলাহীন।
নির্মলা একটা ইস্কুলে মাস্টারি করতো, ইস্কুলের প্রিন্সিপাল নির্মলাকে এত যৌন হেনস্থা করতো যে শেষ অবদি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার। ওই বসে থাকা নির্মলাকে দেখতে দেখতেই যমুনা ভেবেছিল নির্মলা তো অন্য কোনও ইস্কুলে পড়াতে পারে, অন্যের ইস্কুলে না হলেও নিজের ইস্কুলে। সিস্টারহুড নামে প্রথমে একটা ইস্কুল শুরু করার কথা ভাবতে ভাবতে একটা সংগঠনের কথা ভাবে যমুনা। যেই ভাবা সেই কাজ। নির্মলার ওপরই দায়িত্ব বেশি পড়েছে। ঘুরে ঘুরে নির্মলাই সদস্য যোগাড় করেছে। টাকা পয়সা, নতুন চিন্তা, নতুন প্ল্যান বেশি গেছে যমুনার কাছ থেকে।
নূপুর শোনে আর ভাবে যমুনা তাকে কেন বলেনি নির্মলার কথা। এত দীর্ঘ বছর নির্মলা বাস করছে যমুনার বাড়িতে, আর যমুনা এত কথা বলেছে নূপুরকে, নির্মলার কথা কোনও কথা প্রসঙ্গেও বলেনি। নূপুর ভাবতো যমুনা বুঝি তাকে সব বলে। যমুনা কোনোদিন তো কিছু লুকোয়নি! একটু অভিমান হয় নূপুরের। পরক্ষণেই ভাবে কার ওপর আজ অভিমান করছে নূপুর! নূপুরই কি কোনওদিন যমুনার বাড়িঘরের কথা জিজ্ঞেস করেছে, ক’দিনই বা জানতে চেয়েছে যমুনা কেমন আছে, কেবল তো নিজের কথাই বলেছে, নিজের নানারকম সমস্যার কথা, আর যমুনাও খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চেয়েছে কেবল নূপুরেরই কথা। যদি হঠাৎ কখনও কিছু নূপুর জানতে চেয়েছে, সে তপু কেমন আছে, তা।
নূপুরের অনেকবার মনে হয়েছে তপুর মতো বলে দেবে, ‘তোমরা যা ইচ্ছে করার করো, আমি ওর মৃত মুখ দেখতে পারবো না। ও আমার কাছে জীবিত। আমি চাই ও জীবিতই থাকুক স্মৃতিতে’।
ভাবতে ভাবতে একবার বলেওছে নূপুর নির্মলাকে, ‘আপনারাই তো অনেক বছর ধরে যমুনাদির কাছে ছিলেন। আমরা আত্মীয় হতে পারি, কিন্তু দূরে ছিলাম, হয়তো অনেকটা বাধ্য হয়েও দূরে থাকতে হয়েছে। মাঝখানে অনেকগুলো বছরই চলে গেছে। যোগাযোগ আর কারও সঙ্গে না থাকলেও আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে..’
—আপনার কথা খুব বলতো।
নির্মলা বলে।
—বলতো বুঝি?
—হ্যাঁ, খুব বলতো।
— কী বলতো?’
—কত কিছু বলতো। ছোটবেলায় কোথায় কেমন করে আপনারা বড় হয়েছেন। দু’বোনে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এসব। গল্প শুনতে শুনতে এখন আমরা আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। আপনাকেও অনেকটা নিজের লোকই ভাবি।
‘নিজের লোক’! নূপুরের ভালো লাগে শুনতে। নিজের লোক বলতে তারই বা আছে কে এখন!
নির্মলার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে রাতের দিকে, ভারতের ভিসা, ফ্লাইট টিকিট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কথা দু’চার মিনিটে সেরে দু’জন শুরু করে চুড়ান্ত অপ্রয়োজনীয় কথা। আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে সম্বোধন প্রথম দিনেই।
—যমুনাদিকে অনেকদিন দেখিনি। পাঁচ বছর। পাঁচ বছর আগেই তো গিয়েছিল আমেরিকায়। এমএসএনে, ইয়াহুতে বা স্কাইপেতে আগে দেখতাম, কথা হত। সেও অনেকদিন আর হয় না। চুল পেকেছিল?
—অর্ধেকের বেশি চুল পেকে গিয়েছিল। আমার চোখের সামনেই পাকলো। এভাবে উৎসব করে কারও চুল পাকতে দেখিনি। গ্রে হেয়ারে কিন্তু অসাধারণ লাগতো।
—ডাই করতো?
—ডাই করবে যমুনা? পাগল হয়েছো? কয়েকদিন বলেছি চুলে কিছু রং টং লাগাও। গোদরেজের ভালো রং এসেছে। নাহ, লাগাবেই না। বয়স বেড়েছে বা বাড়ছে এ নিয়ে কোনওদিন কোনও দুশ্চিন্তা করেনি। ওরকমই ছিল যমুনা। আমাদের কিছু বন্ধু তো ওকে ওয়ার্কোহোলিক বলে। এত ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসতো!
— কী নিয়ে ব্যস্ত থাকতো ইদানিং?
— চাকরিটা তো করতোই..
— চাকরি!
—কেন, অগ্নি পাওয়ার এণ্ড ইলেকট্রনিক্সে সোলার এনার্জির চিফ ফিজিসিস্ট ছিল। নিশ্চয়ই জানো।
—ও হ্যাঁ তা তো জানি..
—এই ব্যস্ততার মধ্যেই গড়ে তুলেছে সিস্টারহুড, সেও তো বলেছি। এখন তো বেশ বড়ই হয়েছে সিস্টারহুড। প্রায় পাঁচহাজার সদস্য।
— তোমার কথা কিছু না জানালেও সিস্টারহুডের কথা বুবু জানিয়েছিল আমাকে। একদিন এও বলেছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওই সিস্টারহুডেই নাকি সময়টা দেবে। এই রিস্কি সিদ্ধান্ত বুবুই নিতে পারে। ভাগ্যিস শেষ অবদি ছাড়েনি। ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দিলে পরে কী হয় না হয় তা কে জানে। মানুষের বিপদের কথা কি বলা যায়! শুধু কি চাকরি আর সিস্টারহুড! তপুকে মানুষ করেছে।
নির্মলা হেসে বলে, তপুর পেছনে যমুনাকে মোটেই ব্যস্ত থাকতে হয়নি বললেই চলে। তপুটা এমনি এমনি বড় হয়ে গেল। যমুনা তো ওকে একেবারেই বাঙালি মায়েদের মতো বড় করেনি। ভালো ইস্কুলে পড়েছে, এই টুকুই। ঘরে মাস্টার টাস্টার রেখে দেয়নি। পড়া বুঝতে না পারলে যমুনাকে জিজ্ঞেস করতো।
—মাস্টার টাস্টার রেখে দেয়নি, এর মানে এই নয় যে তপুকে ভালোবাসতো না। ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু বাইরের কেউ সহজে বুঝতো না। আসলে যমুনা তো তপুকে নানারকম খাবার খাইয়ে বা জিনিসপত্র কিনে দিয়ে বোঝাতে চাইতো না যে সে তপুকে ভালোবাসে।
—এটা কিনে দাও ওটা চাই ওসবও করতো না তপু। আবদার করা, বায়না করা —এই ব্যপারগুলো তপু শেখেইনি। একেবারেই না। বইএর পোকা। বই কিনে দিলেই খুশি।
—আমার ছেলেটাকে বই কিনে দিতাম, ও ছুঁয়েও দেখতো না। বুবুটা খুব লাকি ছিল।
—যমুনা বলতো তুমি ওকে বুবু বলে ডাকতে। বুবু ডাকটা আমারও খুব পছন্দ।
—আসলে বুবু তো কোনও নাম নয়, বুবু হল দিদি।
নির্মলা হাসতে হাসতে বলে, জানি।
এভাবে কথা গড়াগড়ি খেতে থাকে। কী পোশাক পরতো যমুনা, শাড়ি ছাড়া আর কি কিছুই পরতো না! নীল রংটা ভালোবাসতো খুব এককালে! শেষদিকেও কি নীল রংই ছিল? বিদেশে তো বিদেশি পোশাক পরতো। কী খেতো? সব খেতো। নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষাও করতো খাবার নিয়ে। সে কী আর শুধু খাবার নিয়ে। পোকা মাকড় নিয়েও, ইট পাথর নিয়েও। সে কী আর আজ থেকে! কে রাঁধতো? কে আবার, বেশির ভাগ নির্মলাই। নির্মলাকে যমুনা কখনও আবদার বা অনুরোধ বা আদেশ করেনি ঘর সংসার আর রান্না বান্না সামলাতে, নির্মলা যা করেছে ভালোবেসেই করেছে। অবসরে কী করতো, অবসর বলে সত্যি কি কিছু ছিল? হ্যাঁ ছিল, নিশ্চয়ই ছিল। বই পড়তো। বেড়াতো। তবে বই পড়া আর বেড়ানোকে যমুনা খুব জরুরি কাজ বলেই মনে করতো। এ দুটোর কোনও একটিকেও এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে নেয়নি। যেন শিখছে এসব থেকে। বই পড়তো লাল কালিতে দাগিয়ে দাগিয়ে, মার্জিনে লিখতো নানা কিছু। আর বেড়াতে গেলেও হাতে একটা নোটবই থাকতো, নতুন জায়গায় নতুন কী দেখলো, নতুন কোনও লোকের সঙ্গে নতুন কী কথা হল, নতুন কী খেলো, নতুন কী শুনলো, এসবের অনেক কিছু লিখে রাখতো, আবার হঠাৎ হঠাৎ নিজের কিছু একটা মনে হলে, যে কোনও কিছু নিয়েই, লিখতো। নির্মলা বলতো, মাথাই তো আছে মনে রাখার, কাগজে লেখার দরকার কী! যমুনা হেসে বলতো, মাথাকে অত বিশ্বাস করতে নেই, কখন আবার সব গুলিয়ে ফেলে বা ভুলিয়ে ফেলে, বলা যায় না। কাউকে কি বিশ্বাস করতো যমুনা, মানুষ কাউকে, নূপুর প্রশ্ন করে। নির্মলা বলে, করতো, অনেককেই করতো, যেমন নির্মলাকে করতো, ভীষণ বিশ্বাস করতো। নূপুর আর জিজ্ঞেস করেনি নূপুরকে করতো কি না বিশ্বাস।
কারা বন্ধু ছিল, মুন আর গার্গী যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নূপুরের, কেমন আছে ওরা। নির্মলা ধীরে ধীরে নূপুরের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। যমুনার চেনা পরিচিতর সংখ্যা অসংখ্য। কিন্তু অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করায় খুব আগ্রহী কখনও নয়। বাড়িতে যে হৈচৈ আড্ডা হত না, তা নয়। বেশির ভাগই হত নির্মলার কারণে। নির্মলার ওপর যমুনা ভীষণ নির্ভর করতো। নির্মলা ডাকবে বন্ধুদের, আপ্যায়ণ করবে। নিজে কি যমুনা কিছুটা অন্তর্মুখী ছিল! না নির্মলার তাও মনে হয় না। তবে আড্ডা মানেই, যমুনা মনে করতো না, মন ভরে কারও নিন্দা করা অথবা কারও গুণকীর্তণ করা আর কিছুক্ষণ পরপরই কথা নেই বার্তা নেই গান গেয়ে ওঠা। নূপুর এত দেখেছে যমুনাকে, তারপরও নির্মলার চোখে আবার নতুন করে দেখে। এত চেনে সে তাকে, তারপরও নির্মলার মতো করে আবার চেনে। নূপুরের ভালো লাগে শুনতে যে যমুনা যে কোনও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওযাতে পারতো ভীষণ, সোলার সায়েনটিস্টদের সঙ্গে কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করাকে যে রকম গুরুত্ব দিত, সিস্টারহুডের অল্প শিক্ষিত মেয়েদের সঙ্গেও আলোচনা করাকে একই রকম গুরুত্ব দিত। তপুর পেছনে খরচ তেমন হয়নি বলে সিস্টারহুড চালানো সম্ভব হয়েছে। প্রথম প্রথম যমুনাকে প্রচুর টাকা ঢালতে হত, সদস্যদের চাঁদায় কুলোতো না। এখন সিস্টারহুড নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। নির্মলার ঠিক যেন এরকমই একটা সংগঠনের দরকার ছিল। আর দরকার ছিল যমুনার মতো একজন পথ প্রদর্শকের বা বন্ধুর। শুনতে শুনতে নূপুর ভাবে এ যমুনা নতুন কেউ, অচেনা কেউ, তার এতকালের চেনা দিদি নয় বা বুবু নয়।
কণ্ঠস্বর শান্ত, দুজনেরই। রাত দশটায় শুরু হয়, কথা রাত দেড়টায় শেষ হয়। দুজনই শুয়ে, দু’ দেশে। কথা হয় একজনকে নিয়ে, যে নেই। যে মৃত, সে বেঁচে থাকা মানুষকে ঘনিষ্ঠ করতে থাকে, নিজের লোক করে যেতে থাকে। যে মৃত সে-ই যেন জীবিত সত্যিকার। আর যারা তাকে ভালোবাসছে, তারাই শোকে মুহ্যমান, তারাই মৃতবৎ, তারাই মৃত।
নির্মলার কাছে যমুনার জীবন যাপনের কথা শুনতে শুনতে নূপুরের মনে হয় অনেকগুলো বছরের দূরত্বকে ভেঙে চুরে, দু ‘দেশের মাঝখানের কাঁটাতারকে ছিঁড়ে ছুঁড়ে যমুনা বাতাসের চেয়েও বেগে, আলোর চেয়েও দ্রুত, সব ছাপিয়ে, সব মাড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় বুঝি যমুনা এই বাড়িতেই আছে, এই বাড়িতে যেন দু’বোন শৈশব আর কৈশোরের সেই দুরন্ত দিনগুলো আর বছরগুলো কাটাচ্ছে। যমুনা যেমন কাছে ছিল, সারাক্ষণ কাছে ছিল, তেমনই কাছে আছে, সেই আগের মতো আছে। যেন তাকেই নূপুর শুনছে এখন, যেমন শুনতো। যমুনাময় জীবন ছিল নূপুরের। জন্ম হওয়ার পর যমুনাকে দেখেছে, যমুনার কাছেই নিজের শৈশব কৈশোর যৌবনে শিখেছে অনেককিছু, হয়তো সবকিছুই। হয়তো সব শিক্ষাই জীবনে প্রয়োগ করতে পারেনি, তাতে কী, ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় আছে, এখনও আছে, নূপুরের বিশ্বাস আছে, কেবল নাড়া পড়লেই ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়বে যুদ্ধের সৈনিকের মত। শুধু তো যমুনাই ছিল না, আত্মীয় স্বজন ছিল, কিন্তু যমুনা যেভাবে ছিল, সেভাবে নূপুরের জীবনে কেউ ছিল না। যমুনা আবিষ্কার করতো, নতুন কথা বলতো, নূপুর গ্রহণ করতো। সবসময় হয়তো গ্রহণ করতো না, তর্ক করতো কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানতে তাকে হতই যে যমুনা যা কিছুই বলে, তা-ই নূপুরকে ভাবায়। নূপুর ফেলে দেয় অনেক কথা ছুঁড়ে, কিন্তু খুব বেশিদূর ছুঁড়তে পারে না। এক সময় কুড়িয়ে আনতে হয়, কুড়িয়ে এনে নিরালায় বসে নাড়তে হয় ভাবনাগুলো।
দিনগুলো যেন হাতের মুঠোয়। সেই দিনগুলো। একসঙ্গে বড় হওয়ার দিনগুলো। যমুনা কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই সেই দিনগুলোর কথাই বলতো। দেখে মনে হত কী একটা ঘোরের মধ্যে আছে, বলতো, ‘জীবনে পারলে যে করেই হোক ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের ওই বাড়িতে আমি যাবোই। আগের মতো আবার সেই বাবা মা, আবার সেই ইনোসেণ্ট দাদা আর বোকা বোকা নূপুরকে ওই বাড়িতে আমার চাই’। নূপুর বলেছে, ‘যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে এভাবে পড়ে থেকো না। দাদাও আর ইনোসেন্ট নেই, আমিও আর বোকা নই’। যমুনা হেসে বলেছে, আসলে ‘সুখের স্মৃতি বলতে আমার ওইটুকুই। স্মৃতিগুলোকে ঝেড়ে মুছে নেড়ে চেড়ে বাঁচিয়ে রাখি’।
যমুনার কথা বলতে বলতে কেঁদেছে নির্মলা। নূপুর কাঁদেনি। অনুভব করেছে বড় একটা পাথরের তলায় চাপা পড়েছে সে। বুকের ওপর বড় একটা পাথর, চাইলেই যে পাথরকে ঠেলে সরানো যায় না।
পরদিন ঢাকায় নূপুর একটা হোটেলে উঠেছিল, নাইমের বাড়িতে ওঠেনি। নাইমকে জানায়নি যে সে ঢাকায়। ইচ্ছে করেনি জানাতে। শেষ যা কথা যা হয়েছে দুজনের, তার পর নাইমের মুখোমুখি হওয়াটা, নূপুরের মনে হয়নি, উচিত।
—শোন, আমিই যাবো। তুই অফিসিয়াল ব্যাপার গুলো পারবি না। ওর অ্যড্রেসটা বল।
—অফিসিয়াল ব্যাপার মানে?
—ডেথ সার্টিফিকেট বার করা। ব্যাংকের টাকা পয়সাগুলো ট্রান্সফার করা। বাড়ি টাড়ি যা আছে বিক্রি করা। জিনিসপত্র গুলো সর্ট আউট করা। বডি মেডিকেলে দেওয়া, নানারকম কাজ। এসব পারবি না। ওখানে লোকেরা লুটে খাবে ওর সব কিছু।
—আমি পারবো। তোমার অত চিন্তা করার দরকার নেই। ওখানে লোক আছে আমাকে হেল্প করার।
—ভাব দেখাচ্ছিস যমুনার ওপর অধিকার একার তোর। তা কিন্তু নয়। যমুনার সহায় সম্পত্তি টাকা পয়সার ভাগ আইনত আমি পাবো। আমি ভাই। ভাইরা পায়। বোনরা পায় না। ওর অ্যাড্রেস দে।
—ভুলে যেও না ওর একটা মেয়ে আছে। যা পাবে ওর মেয়ে পাবে। আর বুবু যদি উইল করে গিয়ে থাকে তাহলে আর কথাই নেই। এ দেশে উইল না চললেও ভারতে তো উইল চলে। বাবার সবকিছু নিয়েছো। বুবুর টাকা পয়সায় দয়া করে লোভ করো না। ওর মেয়েকে কিছু পেতে দাও। তোমার লোভের কারণে নিজের বাপের সম্পত্তি আমরা দুবোন পেলাম না। এখন তপুকেও বঞ্চিত করোনা। তোমরা পুরুষেরা অনেক কায়দা কানুন জানো, বুবুর যদি কিছু থাকে, জানি না আদৌ কিছু ছিল কি না, নাকি ধার করে চলতো, তুমি সব আত্মসাৎ করতে পারবে, তোমার সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু দয়া করে এবার নিস্তার দাও। লেট হার রেস্ট ইন পিস।
—ওর পিস তো আমি নষ্ট করছি না। যত ইচ্ছে পিস ও ভোগ করুক। কিন্তু আইনের তো ব্যাপার আছে। তুই লিগালি আমার বোনের হোয়ারঅ্যাবাউটস জানার আমার যে রাইটস, তা ভায়োলেট করতে পারিস না। আজকে সে ডেড। আমার এখন দায়িত্ব তার কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এটা ভাই হিসেবে আমার ডিউটি। ওর মেয়ে ইন্ডিয়ায় নেই। সুতরাং সৎকার টৎকার যা করতে হবে, আমাকেই করতে হবে।
—সরি। বুবু বলে গেছে, লিখে গেছে। বডি থেকে যে যে অরগান তুলে নেওয়ার সেগুলোও নেওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু গিয়ে বডিটা মেডিকেলে দিয়ে আসতে হবে। সেটা করার জন্যই যাবো। একবার শুধু সেই মুখটা হাতটা ছোয়াঁ।
নূপুরের কণ্ঠস্বর তখন মেঘলা হয়ে আসে।
—সেটা করতে তোর একার যেতে হবে কেন। আমি সঙ্গে যাবো। আর তুই যদি একা যাস, তোর নিশ্চয়ই অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।
—যত যাই বলো না কেন দাদা, আমি তোমাকে সঙ্গে নেবো না।
—আমার দু’মিনিট লাগবে যমুনার অ্যাড্রেস বার করতে। কলকাতা শহরে কি আমার লোক নেই ভেবেছিস? যমুনা কোথায় থাকতো কী করতো, ভেবেছিস এসব আমার কানে আসেনি? কিছুই বলিনি তোদের। সব জানি। ওখানে তার সব রকম কার্য কলাপের কাহিনী আমার জানা। দু’মিনিট লাগবে।
—ভালো কথা। দু’মিনিটে তুমি ওর ঠিকানা বার করে ওর বাড়িতে যাও। তোমার বোন মরে পড়ে রয়েছে। যাও তার ধন সম্পদ টাকা পয়সা যা আছে নিয়ে এসো। তোমার কাজে লাগবে। আমি যদি যাই আমি যাবো বুবুকে একটু চোখের দেখা দেখতে। শেষ দেখাটা দেখতে। মেডিকেলের কাটা ছেঁড়া হওয়ার আগে।
নূপুর ফোন রেখে দেয়। তার ভয় হতে থাকে। নাইম হেন কিছু নেই যে না করতে পারে। নূপুরের ইচ্ছে করে পালাতে। নাইম যে শ্বাস ফেলছে, সেই শ্বাসে আগুন, পুড়ে ছাই করে দিতে পারে। নিজেকেই বলে সে বারবার, পরিবারের লোক হলেই পরিবারেরর কারও মৃত্যুর খবর তাকে জানতে হবে, এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
নিজেকে বাঁচাতে নূপুর দেশ থেকে চুপিচুপি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাউকে জানায় না সে কবে যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে। ঢাকায় শুধু নাইমের নয়, নূপুরেরর কাকার, মামার, কাকাতো-মামাতো – খালাতো ভাই বোনদের বাড়ি। কারও বাড়িতে সে ওঠে না। কবে মারা গেছে যমুনা, কেন মারা গেছে, দেশ ছেড়েছিল কেন, বিয়ে না করেই তো বাচ্চা নিয়েছিল, বাচ্চার বাবা কে ছিল—এসব প্রশ্ন করে নূপুরের মুখের দিকে সব আত্মীয়রাই যে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে, নূপুর বেশ জানে। অনেকদিন বিদেশে বাস করেছে সে, তাই বলে দেশের কৌতূহল যে কী রকম মাত্রা ছাড়া তা এখনও ভুলে যায়নি।
নূপুরের পাসপোর্ট আমেরিকার। ভারতের ভিসা পেতে খুব দেরি হয়নি, ভিসার লম্বা লাইনে অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। একা একাই করেছে সব। কারও সাহায্য সে চায়নি। বেশ কয়েক বছর হল নূপুর কোনও কিছুতেই কারও সাহায্য আর চায় না।
যেদিন যাচ্ছে নূপুর, সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে। কপালের সামনে ক’টা পাকা চুল। দু’আঙুলে হেঁচকা টান দিয়ে পাকা চুল এক এক করে তুলতে থাকে নূপুর। নূপুরের চুল পেকেছে দেখলে যমুনার নিশ্চয়ই মনে হবে খুব বুড়ো হয়ে গেছে নূপুর। চিরকালই ছোটবোনকে সেই ছোটবেলার ছোটববোনই মনে হয়। ছোটবোনদেরও যে বয়স বেড়ে পঞ্চাশ পেরোতে থাকে, অনেকসময় ঠিক বিশ্বাস হয় না। নূপুর ভালো একটা শাড়ি পরলো, যমুনা যেরকম শাড়ি পছন্দ করে। সাজলো অনেকক্ষণ ধরে। ঠোঁটে লিপস্টিক পরলো, কপালে একটা লাল টিপ পরলো। চোখে কাজল, ভ্রু আঁকলো। মুখে মাখলো ময়ইশ্চারাজার, ফাউণ্ডেশন, পাউডার। পারফিউম মাখলো সারা শরীরে। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে যখন দেখে নিজেকে, নূপুরের চোখ দিয়ে নয়, দেখে যমুনার চোখ দিয়ে। নিশ্চয়ই নূপুরকে দেখে খুশি হবে যমুনা। নিশ্চয়ই হাসবে সেই অসাধারণ হাসি। হঠাৎ নূপুর চমকে ওঠে। এ কী ভাবছে সে। এ কেন ভাবছে সে। কী ভেবে এতক্ষণ ধরে সে সাজলো। যমুনা তো নেই! একটা আর্তচিৎকার তার কণ্ঠ চিরে বেরোতে থাকে। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে নূপুর। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
হোটেলের রুমে ফোন বাজে, নিচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বিমান বন্দরে যাওয়ার ট্যাক্সি।
যমুনা মারা যাওয়ার তিনদিন পর নূপুর বাংলাদেশ বিমানে আধ ঘণ্টার উড়ান দূরত্বে পৌঁছোলো কলকাতায়। দমদম বন্দরে দাঁড়িয়ে ছিল নির্মলা। নির্মলাকে চিনতে নূপুরের কোনও অসুবিধে হয় না।