১. মুছে দাও দ্বারকানাথকে

ঠাকুরবাড়ির গোপনকথা – দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ / রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : এপ্রিল ২০১৫

.
পৃথিবী-কে

.

শুরুর কথা

কেন ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস থেকে দেবেন্দ্রনাথ মুছে দিতে চাইলেন দ্বারকানাথের নাম? কেনই বা দ্বারকানাথের নথিপত্র সব পুড়িয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ? কেন ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষরা, যাঁরা পাঁচশো বছর আগে ছিলেন কুলীন-ব্রাহ্মণ, তাঁদেরই একটি শাখা ব্রাত্য হল পিরালি-ব্রাহ্মণ বদনামে?

ভৈরবনদীর পাড়ে দক্ষিণকালীর সঙ্গে ব্রাহ্ম ঠাকুরপরিবারের কীসের গূঢ় গোপন সম্পর্ক?

কে জয়রাম কুমারী? তাঁকে না জানলে কেন বোঝা যায় না দ্বারকানাথের চরিত্র?

ধনসায়রের বাগান বাড়িতে ঠাকুরবাড়ির কোন রহস্য লুকিয়ে? জোড়াসাঁকোর আটচালাকে কে রূপান্তরিত করলেন প্রাসাদে?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শ্বশুরমশাই, কাদম্বরীদেবীর বাবা শ্যাম গাঙ্গুলিকে কেন কুড়ি টাকা মাস-মাইনে দিয়ে বিদেয় করা হল ঠাকুরবাড়ি থেকে?

কেন দেবেন্দ্রনাথ পুষতেন একবাড়ি ঘরজামাই?

কেন স্ত্রী কাদম্বরীকে ছেড়ে বউঠাকরুণ জ্ঞানদানন্দিনীর

উড স্ট্রিটের বাড়িতেই থাকতে শুরু করলেন জ্যোতিরিন্দ্র?

কেন আত্মহত্যা করলেন কাদম্বরী?

কেন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথও আত্মহত্যা করতে চাইলেন?

কেন তিনি আজীবন এক নারী থেকে অন্য নারীতে ধাবমান?

কেন তিন কষ্ট পান আদরের উপবাসে?

কেনই বা তিনি নিজেই বলছেন, ‘আমি অন্তরে অসভ্য?’ আসলে কী চান সেই ‘অসভ্য’ রবীন্দ্রনাথ?

কোথায় তাঁর তৃপ্তি? তৃষ্ণার অবসান? শান্তি?

এই রকম আরও অনেক প্রশ্ন আর সংশয়ের উত্তর খুঁজতে- খুঁজতে লিখে ফেললাম ‘ঠাকুরবাড়ির গোপনকথা’।

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
২৪ মার্চ, ২০১৫
কলকাতা

.

১. মুছে দাও দ্বারকানাথকে

সাল ১৭৮৪। সে-যুগের চিৎপুরের সঙ্গে আজকের চিৎপুরের কোনও মিল নেই। পাথুরিয়াঘাটা থেকে একটু দূরে চিৎপুরের পশ্চিম প্রান্ত। নাক চাপা দিয়ে যেতে হয় সেখানে। যত রাজ্যের আবর্জনায় মজে যাওয়া নালার গন্ধে জায়গাটা দূষিত। অথচ দক্ষিণ-পুবে কিছু দূরেই একটি কাঠের সাঁকোর ওপারে টলমল পুকুর। তার পশ্চিম পাড়ে নারকেল, সুপারি আর তেঁতুল গাছের মনোরম সারি। দক্ষিণে মেছুয়াবাজারের বসতি।

ওই পুকুরে এক গ্রীষ্মের দুপুরে অবগাহনে নামলেন গোষ্ঠীপতি বৈষ্ণব শেঠ। এই সেই স্নান, যা ওই সময়ে ওই পুকুরে না ঘটলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পত্তনই হত না; ঠাকুরবাড়ির বীজটি নিহিত বৈষ্ণব শেঠের ওই ঐতিহাসিক অবগাহনে।

বৈষ্ণব শেঠ স্নান করতে-করতে তাকালেন পুকুরের অপর পাড়ের দিকে। তিনি দেখলেন সেখানে এক দীর্ঘাঙ্গ গৌরবর্ণ সুকান্ত ব্রাহ্মণ গাছের ছায়ায় গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে ভোগ দিচ্ছেন। সপরিবার তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ওই তেঁতুল গাছের তলায়।

বৈষ্ণব শেঠ ইতিমধ্যেই শুনেছেন ব্রাহ্মণের কাহিনি, তাঁর পরিচয় ও নামও জেনেছেন। বৈষ্ণব নীলমণিকে বললেন, সামনেই শান্তিরাম সিংহের বাগানের পাশে (আজ যা সিংহিবাগান নামে খ্যাত) তাঁরও একটু জমিজায়গা আছে, সেই জমির একটি অংশ তিনি নীলমণিকে দান করতে চান।

নীলমণি অব্রাহ্মণের দান গ্রহণ করতে চাইলেন না। বৈষ্ণব শেঠ তখন ওই জমি নীলমণি ঠাকুরের লক্ষ্মীজনার্দনের নামে দান করলেন।

সেই জমিতে সামান্য একটি চালাঘর করে বসবাস শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ নীলমণি ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক সাতাত্তর বছর আগে। বলা যেতে পারে, সেই শুরু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির। কিন্তু এই জন্মকাহিনি, গোড়াপত্তন, পরবর্তী ব্যাপ্তি ও বৈভবের বিশদে যাওয়ার আগে বৈষ্ণব শেঠের ঐতিহাসিক অবগাহনের পূর্ববর্তী ঘটনাবলির মধ্যে ঢুকতেই হবে। রবি ঠাকুরের হাবভাব আদবকায়দা জীবনচরিত বুঝতে ঠাকুরবাড়ির নেপথ্য গল্পটা জানা জরুরি।

ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক প্রাচীন ও পরতাশ্রয়ী। কীভাবে এবং কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই ঠাকুরবাড়ির গোড়ার গল্প।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষরা পাঁচশো বছর আগে ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ। এবং তাঁদেরই একটি শাখা পরবর্তিকালে পরিচিত নিন্দিত ব্রাত্য হলেন পিরালি- ব্রাহ্মণ নামে। রবীন্দ্রের জন্ম সমাজচ্যুত পিরালি-শাখায়।

এই শাখায় সূচনা পনেরো শতকের শেষাশেষি হিন্দু শাসকদের অধিকার থেকে চলে যাওয়া পাঠান-শাসিত গৌড়ে। বল্লাস সেন-লক্ষ্মণ সেনের যুগ ততদিনে শেষ। বক্তিয়ারউদ্দিন-লুণ্ঠিত বঙ্গ। গৌড় শাসন করছেন পাঠান সুলতান নাসির শাহ। সুলতানের খাস লোক খান জাহান আলি সেই সময়ে তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে লাগলেন পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে নতুন জনবসতি গড়ে তুলে।

মামুদ তাহির নামের এক প্রভাবশালী মুসলমান ছিলেন খান জাহান আলির ডান হাত। এই মামুদ তাহির নাকি কুলীন ব্রাহ্মণ থেকে মুসলমান হয়েছিলেন এক মুসলমান মোহিনীর প্রেমের পড়ে। মুসলমান মনোহারিণীকে তিনি পেয়েছিলেন কি না, জানা যায়নি। কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে তাঁর আর স্থান হল না হিন্দু সমাজে। সমাজচ্যুত নিঃসঙ্গ এই কুলীন আশ্রয় পেলেন খান জাহানের ছত্রচ্ছায়ায়, মামুদ তাহির পরিচয়ে। হয়ে উঠলেন কুলীন হিন্দু থেকে কট্টর মুসলমান। নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ছড়ালেন যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগনায়।

মামুদ তাহির থাকতেন চেঙ্গুটিয়ার পিরল্যা বা পিরালিয়া গ্রামে। গ্রামের লোকজন অচিরেই তাঁকে ডাকতে শুরু করল ‘পির আলি’ নামে। পিরালিয়ার সব থেকে প্রভাবশালী পুরুষের নাম তো পির আলি-ই হওয়া উচিত।

স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মতলবে পারঙ্গম জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরি বুঝলেন, ক্ষমতাবান পির আলির পাশে তাঁর নিজস্ব লোকবল নিয়ে দাঁড়ানোটাই সমীচীন হবে। হাত মেলালেন তিনি পির আলি ওরফে মামুদ তাহিরের সঙ্গে। যশোর জুড়ে চলল পির আলি আর দক্ষিণানাথের যুগ্ম কর্মযজ্ঞ।

অরণ্য কেটে তৈরি হল পথ। পথের ধারে গড়ে উঠল জনপদ। বিছিয়ে রইল আম-জাম -শিরীষের বাগান লোকালয়কে ঘিরে। সুযোগ বুঝে দক্ষিণানাথ নিজের জমিদারির ক্ষমতা, প্রভাব সবই বাড়িয়ে নিলেন ধীরে-ধীরে। দক্ষিণানাথ চৌধুরির প্রভাব-প্রতিপত্তি সব থেকে বেশি যে-জায়গাটিকে দখল করে নিল, তার নাম দক্ষিণডিহি। চেঙ্গুটিয়া পরগনার ভৈরব নদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণডিহি। এখানেই দক্ষিণানাথ গড়লেন তাঁর বিখ্যাত কালীমন্দির। এই মন্দির ঘাটের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক শুরু হবে অদূর ভবিষ্যতে। এখন জানা যাক দক্ষিণানাথের বাড়ির খবর।

দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরির সংসার কালে কালে বড় হল। অর্থে সম্পদে সংসারে তাঁর বাড়বাড়ন্ত যুগপৎ। চার ছেলে আর এক মেয়ের বাবা হলেন তিনি। বড়ো আর মেজো ছেলে, কামদেব ও জয়দেব লেখাপড়ায় বেশ ভাল। তাঁরা সংস্কৃত ও ফার্শি ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে খ্যাতিমানই হলেন না, হলেন পির আলির বিশেষ প্রিয়পাত্র। পিতৃবন্ধু পির আলি কামদেব-জয়দেব তাঁর প্রধান কর্মচারীর চাকরিতে নিযুক্ত করলেন। সেজো এবং ছোটো ভাই, রতিদেব ও শুকদেব, পণ্ডিত হয়ে পির আলির চাকরি না করে তাঁরই কৃপায় দক্ষিণডিহি গ্রামের জমিদারির তত্ত্বাবধান করতে লাগলেন।

হঠাৎ ঘনিয়ে এল বিপর্যয়। আকস্মিক মোড় নিল ঘটনা ও কামদেব-জয়দেবের জীবন। অপ্রত্যাশিত এক ভবিষ্যতের দিকে বেঁকে গেল পথ।

ঘটনাটি ঘটল রমজানের বিকেলবেলা, তখনও চলছে রোজার পবিত্র উপবাস, সান্ধ্য-নামাজের লগ্ন না-আসা পর্যন্ত। পির আলিকে রোজার ফল উপহার দিলেন এক পারিষদ। একটি নধর রসালো লেবুর ঘ্রাণ নিয়ে পির আলি বললেন, কী সুন্দর গন্ধ!

কামদেব-জয়দেব বললেন, এ কী করলেন! আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি ঘ্রাণ নিলেও অর্ধেক ভোজন। সুতরাং রোজার সান্ধ্য নমাজের আগেই যে আপনি উপবাস ভাঙলেন!

হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া মামুদ তাহির ওরফে পির আলি বেজায় অপমানিত বোধ করলেন কামদেব- জয়দেবের কথায়। মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরিও হলেন। সুযোগ এল এক বসন্ত-সন্ধ্যায় পির আলির বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার আনন্দের মধ্যে।

কামদেব-জয়দেব সেখানে আমন্ত্রিত। হঠাৎ সেখানে গো-মাংসের গন্ধ। ব্রাহ্মণরা তো নাকে চাপা দিয়ে পালালেন। পালাচ্ছিলেন কামদেব-জয়দেবও। পালাতে পারলেন না। গম্ভীর কণ্ঠে পথ আটকে দিলেন পির আলি। বললেন, পালিয়ে লাভ নেই। গরুর মাংস তো খাওয়া হয়েই গেছে আপনাদের। আপনারা হিন্দুরাই তো বলেন গন্ধ শুঁকলেই আদ্দেক খাওয়া হয়ে গেল। হিন্দু সমাজে এর পরে কি স্থান পাবেন?

এবার পির আলির লোকজন জোর করে কামদেব- জয়দেবের মুখে গুঁজে দিল গো-মাংস। মুসলমান না হয়ে তাঁদের উপায় রইল না। কামদেবের মুসলমান নাম হল কামালুউদ্দিন খাঁ চৌধুরি। আর জয়দেবের জামালুদ্দিন খাঁ চৌধুরি। শুরু হল জমিদার কুলীন ব্রাহ্মণ দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরির বংশের ইসলাম-শাখা।

এখানেই শেষ নয় এই কাহিনির। অন্য একটি শাখা দেখা দিল অচিরেই, অনিবার্যভাবে। রতিদেব-শুকদেব তখনও থাকতেন কামদেব-জয়দেবের বাড়িতে। দাদারা মুসলমান হয়ে যাওয়ায় হিন্দু সমাজ একঘরে করল ‘পির আলি’-র আনুকূল্যে আশ্রিত ‘পিরালি’ ব্রাহ্মণ অন্য দুই ভাই রতিদেব-শুকদেবকে।

এঁরাই প্রথম ‘পিরালি’ ব্রাহ্মণ। তাঁদের ধোপা-নাপিত বন্ধ হল, জীবন অসহনীয় করে দেওয়া হল, তাঁদের বোন রত্নমালা, কন্যা সুন্দরী-কে কোনও ব্রাহ্মণ বিয়ে করতে চাইল না সমাজের ভয়ে। কামদেব-জয়দেব দক্ষিণডিহি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও শুকদেব-রতিদেব ‘পিরালি’ পরিচয়ের অখ্যাতি থেকে মুক্তি পাননি। হিন্দু সমাজে তাঁরা একঘরেই রইলেন। কোনও ব্রাহ্মণ পরিবারেই রত্নমালা ও সুন্দরীর বিয়ে দেওয়া সম্ভব হল না।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য বোন রত্নমালার বিয়ে দিলেন শুকদেব, এক রাতের জন্য তাঁর বাড়িতে আশ্রিত ব্রাহ্মণ যুবক মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক রকম জোর করেই কিংবা, বলা যায়, বিশাল জমিজায়গার লোভ দেখিয়ে।

মঙ্গলানন্দ রত্নমালাকে বিয়ে করার পর আর দেশে ফিরতে পারেননি, পারেননি তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরে যেতে। রত্নমালাকে বিয়ে করার যৌতুক হিসেবে পাওয়া আড়াইশো বিঘে জমির উপর তৈরি হল মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের নতুন পিরালি-ব্রাহ্মণ বংশের আরও এক শাখা।

মুসলমান পির আলির ‘প্রভাবদুষ্টু’ পিরালি ব্রাহ্মণদের প্রসারিত শাখাপ্রশাখার সঙ্গে ক্রমেই মিশে গেল কুশারী-ব্রাহ্মণদের একটি ধারা। সে-গল্পটা এই রকম: দীন নামের এক ব্রাহ্মণ ছিলেন বর্ধমানের কুশ গ্রামের বাসিন্দা। কুশ গ্রামের বাসিন্দা বলে তিনি কুশারী ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত ছিলেন। কুলীন ব্রাহ্মণ হিসেবে কুশারীদের খ্যাতি ছিল। কুশারীরা বিচিত্র ধারায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন বঙ্গদেশের সর্বত্র। যশোর জেলার ঘাটভোগ-দমুরহুদা থেকে ঢাকার কয়কীর্তন থেকে বাঁকুড়ার সোনামুখি থেকে খুলনার পিঠাভোগ, কুশারী ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি ও প্রভাব বাড়ছিল সব জায়গাতেই। তবে সব থেকে প্রভাবশালী ও অবস্থাপন্ন ছিলেন খুলনার পিঠাভোগের কুশারীরা।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার পিঠাভোগের কুশারীদেরই একটি ধারা। যে-ধারার আদি পুরুষ পিঠাভোগের জগন্নাথ কুশারীর দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম কুশারী। এখানে একটি ঋজু সরলরেখার রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ির তেত্তিরিশ পুরুষের নাম জেনে নেওয়া যেতে পারে: ভট্টনারায়ণ, আদিবরাহ (বন্দ্য), বৈনতেয়, সুবুদ্ধি, বিবুধেশ, গাঁউ, গঙ্গাধর, পশুপতি, বিঠোক, ধরণীধর, তারপতি, গঙ্গারাম, ঊষাপতি, সুরেন্দ্র, রামরূপ, হলায়ুধ, ধর, কুমার, বিষ্ণু, হাড়ো (হরসুখ), গোবর্দ্ধন, মহাদেব, জগন্নাথ, পুরুষোত্তম (চব্বিশতম), বলরাম, হরিহর, পঞ্চানন, জয়রাম, নীলমণি, রামমণি, দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ (তেত্তিরিশতম)। জগন্নাথ কিন্তু শাণ্ডিল্যগোত্রের কুলীন ব্রাহ্মণ। তবু মুসলমান-দুষ্ট পিরালি! কীভাবে, সে-গল্পই ঠাকুরবাড়ির আদিকথা।

আগেই বলেছি ভৈরব নদীর কেয়াতলার ঘাটে দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাকালীর কথা। সেই ঘাটে এক দুর্যোগের রাতে বজরা ভিড়াতে বাধ্য হল কুলীন ব্রাহ্মণ জগন্নাথ কুশারী।

দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরির সমাজচ্যুত ছেলে শুকদেব সুযোগ বুঝে জোর করে জগন্নাথের সঙ্গে বিয়ে দিলেন তাঁর মেয়ে সুন্দরীর, ঠিক যেমন জোর করে আর এক কুলীন ব্রাহ্মণ মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বোন রত্নমালার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মঙ্গলানন্দের মতো জগন্নাথ কুশারীও সমাজচ্যুত হলেন, ‘পিরালি’ বদনাম স্থায়ী হল তাঁর বংশে, বাড়ি না ফিরে বসবাস করতে বাধ্য হলেন যৌতুক হিসেবে পাওয়া বারোপাড়া গ্রামে।

ঠাকুরবাড়িতে ঘরজামাই প্রথার চল এই সময় থেকেই। একঘরে পিরালি ব্রাহ্মণ ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বিয়ে করা মানেই তো নিজের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া। তা-ই অধিকাংশ সময়েই জামাইটি ঠাকুরবাড়িতেই আশ্রয় পেতেন।

রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটার সঙ্গে বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। তা-ই হয়তো তাঁর ‘চিরকুমার সভা’ নাটকের অক্ষয় এক অতীব দ্বিধাহীন সাবলীল আমুদে ঘরজামাই।

‘পতিত’ পিরালি ব্রাহ্মণ, শুকদেবের ঘরজামাই, পিঠাভোগের একদা জমিদার জগন্নাথ কুশারী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ। রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বতন ত্রয়োদশ পুরুষ জগন্নাথের জীবনকালে কেটেছিল ষোলো শতকের গোড়ার দিকে। পিরালি পরিবারে বিয়ে করার জন্যে তিনি একঘরে হলেন। পিঠাভোগ গ্রামে আর তাঁর পক্ষে বসবাস করা সম্ভব হল না। তিনি দক্ষিণডিহির শ্বশুরবাড়িতেই বাস করতে লাগলেন।

বলা যেতে পারে, তিনিই এক অর্থে ঠাকুরবাড়ির প্রথম ঘরজামাই। ঘরজামাইকে আদরযত্নেই রেখেছিলেন শুকদেব। সুন্দরীকে বিয়ে করার জন্যে জগন্নাথ কুশারী শ্বশুর শুকদেবের কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে পেলেন খুলনা জেলার বাড়োপাড়া নরেন্দ্রপুর গ্রামের উত্তরে উত্তরপাড়া নামের গ্রামটি।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিদিন পিতৃপুরুষের বন্দনা করতেন। যে-মন্ত্রটি উচ্চারণ করে তাঁর এই পিতৃপুরুষ বন্দনা তাঁর আদিতে আছে পুরুষোত্তমের নাম-

পুরুষোত্তমাদ্বলরামঃ বলরামদ্বারিহরঃ

হরিহরাদ্রামানন্দঃ রামানন্দান্মহেশঃ

মহেশাৎ পঞ্চাননঃ পঞ্চাননজুয়রামঃ

জয়রামন্নীলমণিঃ নীলমণেঃ রামলোচনঃ

রামলোচনাদদ্বারকানাথঃ নমঃ পিতৃপুরুষেভ্যো নমঃ

পুরুষোত্তম জগন্মাথ কুশারীর দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর জীবনকালে ষোলো শতকের মাঝামাঝি। তিনি রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পুরুষ।

পুরুষোত্তমের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ (রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বতন নবম পুরুষ) রামানন্দ কুশারীর পুত্র মহেশ্বরই প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন জীবিকার খোঁজে। রামানন্দের জীবন কাটে সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন কলকাতার পত্তন করলেন জোব চার্নক।

জোড়াসাঁকো, কয়লাঘাটা, ঠনঠনিয়া, রামবাগান ও পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির উৎস রামানন্দ-পুত্র মহেশ্বর। মহেশ্বরের ছেলে পঞ্চানন, রবীন্দ্রনাথের সাত পুরুষ আগে তাঁর ভাই শুকদেবকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন কলকাতায় উত্তরপাড়া ছেড়ে। পঞ্চানন কলকাতায় আসেন মূলত অর্থের সন্ধানে। সেই সময়ে কলকাতা ক্রমশই সমৃদ্ধির পথে। পর্তুগিজ ওলন্দাজ প্রভৃতি বিদেশি বণিক-আগমনে তখন রমরম করছে কলকাতা। এ-ছাড়া আছে শেঠ-বসাকদের সুতাবস্ত্রের হাট, যার থেকে অঞ্চলটির নাম ‘সুতানুটি’।

পঞ্চাননের পছন্দ হল কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে আদি গঙ্গার ধারে গোবিন্দপুর জায়গাটি। জেলে মালো কৈবর্তরা তখন বাস করত আদি গঙ্গার ধারে এই অঞ্চলে। পঞ্চানন শুকদেবকে নিয়ে বাসা বাঁধলেন এদের মধ্যে। পঞ্চাননের আসল উদ্দেশ্য, যে সব বিদেশি জাহাজ আসত গোবিন্দপুরে তাদের কিছু-কিছু মাল সরবরাহ করে সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসা করা।

পঞ্চানন এই ব্যবসায়ে অচিরেই বেশ অর্থ উপার্জন করলেন। গোবিন্দপুরের গঙ্গার ধারে জমি কিনে বাড়ি করলেন। এবং প্রতিষ্ঠা করলেন শিবমন্দির।

মন্দির প্রতিষ্ঠা করায় ব্রাহ্মণ পঞ্চানন ও শুকদেবের প্রতি জেলে-মালো-কৈবর্তদের ভক্তি আরও বাড়ল। তারা পঞ্চানন কুশারীকে পঞ্চানন ঠাকুর বলে ডাকতে শুরু করল।

রবীন্দ্রনাথের সাত পুরুষ আগে এইভাবে তাঁর বংশ ‘ঠাকুর’ হয়ে গেল। ইংরেজদের উচ্চারণে ‘ঠাকুর’ প্রথমে হল Taguore। পরে ক্রমশ Taguore থেকে Tagore।

ছোটোখাটো স্টিভেডর হয়ে গেলেন পঞ্চানন টেগোর বা ঠাকুর। যেই হাতে বেশ কিছু টাকা এল তাঁর, কিনে ফেললেন অনেকটা জমি, আদি গঙ্গার পাড়ে আজ যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম।

কলকাতার ঠাকুরবংশের প্রথম ঠাকুর পঞ্চানন (কুশারী) তৈরি করলেন সেখানে কলকাতার প্রথম ‘ঠাকুরবাড়ি’- গোলপাতার ঘর। ক্রমেই ধর্মতলার এই বাড়ি পঞ্চাননের দুই ছেলে জয়রাম ও সন্তাোষরামের আমলে ফুলে-ফেঁপে ধর্মতলায় ধনসায়রের বাড়ি বলে পরিচিত হল।

১৭০০ সালে আমিন হলেন জয়রাম ও সন্তাোষরাম, সেলডন সাহেবের ছাতার তলায় বাড়তে লাগল তাঁদের সম্পদ ও প্রতিপত্তি।

কে এই সেলডন? পুরো নাম, র‌্যালফ সেলডন, কলকাতার ‘কলেক্টর’। দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপিতামহ, রবীন্দ্রনাথের ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠপুরুষ, জয়রাম কুশারী সম্পর্কে আরও কিছু জানা একান্ত প্রয়োজন। এঁকে না জানলে দ্বারকানাথের শিরায় উদ্যোগী, সাহসী রক্তস্রোতের সবটুকু বোঝা যাবে না।

জয়রাম শুধু যে বাণিজ্য করে অর্থোপার্জন করতে চেয়েছিলেন তা নয় কিন্তু, তিনি ইংরেজি ও ফার্শি ভাষায় চর্চা করেছিলেন। এবং সেই জন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজ বণিকদের প্রিয় পাত্র। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি চাকরিও করতেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পে-মাস্টারের অধীনে প্রধান কর্মচারী হিসেবে। এক দিকে চাকরি, অন্য দিকে বাণিজ্য, নিরন্তর উদ্যোগী পরিশ্রম-বাঙালিদের মধ্যে এক বিরল সমন্বয়- যার ফলে জয়রাম হয়ে উঠলেন ক্রমেই এক বিপুল বিত্তবান এবং প্রভাবশালী কলকাতাবাসী।

১৭৪১ সালে যখন সুতানুটি ও গোবিন্দপুর অঞ্চলে প্রথম জরিপের কাজ শুরু হল, সেই কাজের জন্য ইংরেজের প্রয়োজন হল দুজন আমিনের। কালেক্টর র‌্যালফ সেলডন-এর অধীনে সেই জরিপেরও দুই আমিন নিযুক্ত হলেন জয়রাম ও তাঁর ভাই সন্তাোষরাম। এই আমিনি কাজের পরেই ফেঁপে উঠলেন রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ জয়রাম-সন্তাোষরাম। ততদিনে তাঁদের পিতা পঞ্চানন গত হয়েছেন।

তখন ধর্মতলার নাম ছিল ধনসায়র। সেখানে জমি কিনে জয়রাম ও সন্তাোষরাম (মতভেদ রামসন্তাোষ) বানালেন প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি। আজ যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম, সেখানেই ছিল রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের বাড়ি, বৈঠকখানা, জমিজমা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে আটতিরিশটি গ্রাম কিনে যখন জরিপের কাজ শুরু করে, তখন সেই কাজে ইংরেজকে নির্ভর করতে হয়েছিল জয়রাম-সন্তাোষরামের উপরেই। গ্রামগুলির অধিকাংশই ছিল নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে। রাজার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জয়রামের পরিচয় হল। এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান জয়রাম কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুত্বও করে ফেললেন। রাজাকে বললেন, তিনি নিজের বাড়িতে রাধাকান্ত-বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেই তো হবে না, কোথা থেকে আসবে নিয়মিত সেবার অর্থ?

ধর্মপ্রাণ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কানে কথাটা যেতেই তিনি জয়রামকে দান করলেন দেবসেবার জন্য ৩৩১ বিঘে জমি। জয়রামের বিষয়সম্পদ ও প্রভাব আরও বাড়ল। তাঁর সংসারটিও নেহাত ছোটো ছিল না। যশোরের দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এক স্ত্রী গঙ্গার দুই ছেলে, আনন্দীরাম, নীলমণি। অন্য স্ত্রী রামধনিরও দুই ছেলে, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম। আনন্দীরামকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন জয়রাম। নীলমণি ঠাকুরই ঠাকুরবংশের জোড়াসাঁকো ধারার উৎস।

আর পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরপরিবারের আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ। ত্যাজ্যপুত্র আনন্দীরাম বাসা বাঁধলেন জোড়াবাগানে।

এ-কাহিনি যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই এবার ফিরে আসছি আমরা। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন স্বয়ং নীলমণি ঠাকুর (?-১৭৯১), দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে গড়ের মাঠে, ধনসায়রের বাগানবাড়িতে।

অচিরেই তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে আমাদের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম সংস্করণ, একটি চালাঘরে।

কিছুদিন আগে ঘটে গেছে ইংরেজের ঐতিহাসিক বিপর্যয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হঠাৎ আক্রমণে ইংরেজের গজিয়ে-ওঠা বসতি বেশ বিপর্যস্ত। ইংরেজের দুর্গ তখন ছিল আজ যেখানে জিপিও-র বাড়ি, সেখানে। সেই দুর্গ দখল করে হালসিবাগানে জগৎ শেঠের বাড়িতে বিজয়-উৎসব পালন করলেন সিরাজউদ্দৌলা, কয়েকদিন কাটিয়েও গেলেন সেখানে। লড়াইয়ে হেরে ইংরেজ সাময়িকভাবে পালাল ফলতায়। পালাবার আগে ইংরেজ-কন্যারা তাদের গয়নাগাঁটি গচ্ছিত রেখে গেল জয়রামের পরিবারের কাছে।

জয়রামের পরিবার বলতে, তাঁর বিধবা স্ত্রী, তিন ছেলে নীলমণি, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম ও মেয়ে সিদ্ধেশ্বরী। ইংরেজরা কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে এল। সিরাজকে রুখতে, শেষ করতে তাদের মাথায় নতুন ছক-কলকাতার দুর্গটাকে অবিলম্বে বাড়াতে হবে, জোরদার করতে হবে, নতুন ‘ফোর্ট’ হবে গঙ্গার ধারে, ধনসায়রের পাশে। এই ছক বাস্তবে পরিণত করা অসম্ভব নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের সম্মতি ছাড়া। ইংরেজ কিনে নিতে চাইল ধনসায়রের ঠাকুরবাড়ি, সেখানেই তৈরি হবে ফোর্ট উইলিয়াম।

ইংরেজ ধনসায়রের ঠাকুরবাড়ির দাম হিসেবে দিতে চাইল অনেক টাকা। নীলমণি ও দর্পনারায়ণ সেই টাকা পেয়ে ধনসায়রের ঠাকুরবাড়ি দিয়ে দিলেন ইংরেজকে। পলাশির যুদ্ধের পরে মিরজাফরের দেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকা থেকেও নীলমণি-দর্পনারায়ণ পেলেন ১৩০০০ টাকা। এবং সেই টাকা থেকে তাঁরা বাড়ি করলেন পাথুরিয়াঘাটায়।

১৭৬৯ সালে নীলমণি ঠাকুর রামচন্দ্র কলুর কাছ থেকে জমিটা কেনেন নিজের নামে। বাড়ি করার পরেও তাঁদের হাতে যে-টাকা রইল তার থেকে কোম্পানির কাগজ কিনে রাধাকান্তের নামে দেবত্র করে দিলেন।

এবার নীলমণি ঠাকুরের কাহিনি পৃথক ধারায় প্রবাহিত। নীলমণির দুই ভাই দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম বিয়ে করলেন দক্ষিণডিহির পিরালি পরিবারের মেয়েকে। কিন্তু নীলমণি বিয়ে করলেন যশোরের মেয়ে ললিতাকে। তাঁর তিন ছেলে, রামলোচন, রামমণি, রামবল্লভ ও এক মেয়ে কমলমণি।

নীলমণি ইংরেজের অধীনে চাকরি করতেন, বাণিজ্যিক উদ্যোগে তিনি যাননি। ১৭৬৫-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উড়িষ্যা-বিহার-বাংলার দেওয়ানি লাভ করল। ক্লাইভ দেওয়ান হয়ে নতুন ভাবে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। নীলমণি ঠাকুরের ঘাড়ে ভার এল ক্লাইভের প্ল্যান ‘এক্সিকিউট’ করার কাজে সাহায্যের। তিনি সেরেস্তাদার হয়ে ওড়িশায় গেলেন।

তখন রেলপথ কোথায়? জলপথ আর হাঁটাপথে, রূপনারায়ণ হয়ে তমলুক, তারপর মহানদী পেরিয়ে কটক,-এইভাবে ওড়িশায় পৌঁছলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ, সেরেস্তাদার নীলমণি ঠাকুর।

কটকেই উপার্জন ও বসবাস শুরু করলেন তিনি। এবং নিয়মিত টাকা পাঠাতেন দর্পনারায়ণের কাছে।

দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা ছিল যে, টাকা নীলমণি পাঠাচ্ছেন, তা দর্পনারায়ণের কাছে গচ্ছিত থাকবে, দেশে ফিরলে সেই অর্থ নীলমণিকে ফেরত দেবেন দর্পনারায়ণ।

ইতিমধ্যে ছোটোভাই গোবিন্দরাম (১৭৭১) মারা গেলেন। সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রথম বড় আকারের গন্ডগোল দেখা দিল ঠাকুরবাড়িতে। ১৭৮২-তে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলেন গোবিন্দরামের বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়া।

সম্পত্তি ভাগের জন্য এই মামলার ফলে ঠাকুরবাড়ির যৌথ-সম্পদে চিড় ধরল। রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে ছটি বাড়ি নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন রামপ্রিয়া।

রামপ্রিয়ার প্রসঙ্গ ঠাকুরবাড়ির গল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে ছড়িয়ে আছে। ইনিই সেই রামপ্রিয়া যিনি ভাইপো জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়কে কলকাতার হাড়কাটা গলিতে বাড়ি করে দেন এবং দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণির সঙ্গে জগন্মোহনের বিয়েও দেন।

জগন্মোহন-শিরোমণির ছেলে শ্যামলাল রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠান কাদম্বরীর বাবা।

ওড়িশার কাজ শেষ করে ঘরে ফিরলেন নীলমণি ঠাকুর। ভাবলেন ভাই দর্পনারায়ণের কাছ থেকে গচ্ছিত সব টাকা তিনি ফেরত পাবেন। কিন্তু টাকা চাইতেই প্রচণ্ড বিবাদ বাধালেন দর্পনারায়ণ। বুঝতে পারলেন নীলমণি ক্ষমতা ও অর্থের লড়াইয়ে তিনি দর্পনারায়ণের থেকে অনেক পিছিয়ে, বিবাদে কোনও লাভ হবে না। দর্পনারায়ণের কথা মেনে নিয়েই তিনি এক লক্ষ টাকা ও লক্ষ্মীজনার্দনের বিগ্রহটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে। সঙ্গে স্ত্রী ললিতা ও ছেলেমেয়েরা। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল নীলমণির কাছে।

দীর্ঘ ফ্ল্যাশব্যাক পেরিয়ে এবার আমরা ফিরে এলাম সেই পরমলগ্নে যখন অবগাহন সেরে-ওঠা জোড়াবাগানের বৈষ্ণবচরণ শেঠের দৃষ্টি পড়ছে অপর পাড়ে গাছের তলায় লক্ষ্মীজনার্দন শিলার ভোগের আয়োজনে রত উজ্জ্বলদেহী ব্রাহ্মণ নীলমণি ঠাকুরের উপর।

মুগ্ধ বৈষ্ণবচরণের কাছ থেকে লক্ষ্মীজনার্দনের নামে নীলমণি পাচ্ছেন মেছুয়াবাজার অঞ্চলে (আজকের জোড়াসাঁকোতে) এক বিঘে জমি। সেখানে ১৭৮৪-তে তিনি তৈরি করছেন একটি আটচালার ঘর-এবং এইভাবেই রোপণ করছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি নামের বিশাল মহীরুহের প্রথম বীজটি, জায়মান ইতিহাসের দোরগোড়ায়।

বৈষ্ণবচরণ শেঠের ঐতিহাসিক অবগাহনের পরবর্তী ঘটনাবলির শুরু ১৭৮৪-তে নীলমণি ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম সংস্করণ, আটচালার ঘর থেকে। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক সাতাত্তর বছর আগে।

এই সাতাত্তর বছরের মধ্যে কী এমন ‘অঘটন’ ঘটল যার ফলে জোড়াসাঁকোর আটচালার নিবাস থেকে ঠাকুরবাড়ি উত্তীর্ণ হল এক বৈভব, মহিমা ও ‘আবদ্ধ’ নিঃসঙ্গতায়?

সেই ‘অঘটন’টির নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪- ১৮৪৬, জয়রামের প্রপৌত্র, নীলমণির পৌত্র, রামমণির পুত্র, রামলোচনের পোষ্যপুত্র, দেবেন্দ্রনাথের পিতা, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ)। ইনি না জন্মালে ‘ঠাকুরবাড়ি’ ঠাকুরবাড়ি হত না।

দুঃখের বিষয় হল এই যে, ছেলে দেবেন্দ্রনাথ, নাতি রবীন্দ্রনাথ চিরদিন কুণ্ঠিত ছিলেন দ্বারকানাথ বিষয়ে, কখনও কোনওভাবে প্রণতি জানাননি তাঁকে। মন থেকে গ্রহণ করতে পারেননি এই প্রবল পূর্বপুরুষকে, বরং দ্বারকানাথের প্রতি অনীহাই প্রকাশ করেছেন দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।

দ্বারকানাথের তৈরি জমিদারি, সম্পদ ও প্রাসাদমহিমার তাঁরা অংশীদার, তাঁর আভিজাত্যের আলো তাঁরা ত্যাগ করেননি কোনওদিন, শুধু উৎসকে অস্বীকার করেছেন। কেন দ্বারকানাথের প্রতি দেবেন্দ্র-রবীন্দ্রের শ্রদ্ধা-ভালবাসা এমন কৃপণ, সে-প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের আগে দ্বারকানাথের কথায় যাওয়া থাক। দ্বারকানাথের গল্প না জানলে ঠাকুরবাড়ির অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব এবং মানসিক চাপের কথা বোঝা যাবে না।

কিন্তু তার আগে দ্বারকানাথের ছেলে দেবেন্দ্রনাথের কথা একটু বলতেই হচ্ছে এখানে, তাঁর সঙ্গে দ্বারকানাথের চরিত্র-ব্যক্তিত্ব-মানসিকতার বিপুল পার্থক্য বোঝাতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ অধিকাংশ সময়েই ব্রহ্ম ও প্রজ্ঞার সন্ধানে ‘পলাতক’ ছিলেন হিমালয়ে, সেখান থেকে ‘রিমোট’ নিয়ন্ত্রণে বিস্তার করতেন তাঁর ধ্যান ও প্রতীতির প্রভাব, চালাতেন ঠাকুরবাড়ি, চাপে রাখতেন পুত্র-কন্যা-ঘরজামাইদের।

বাজার সরকারের মেয়ের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে, আর এক কর্মচারীর মেয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে, সবই হয়েছিল তাঁর ‘হিতৈষী’ উপদেশের ও অর্থবলের চাপে। কেউ তাঁর চাপ ও নিয়মের বিরুদ্ধে মাথা তুললে অপরাধীর উপর নেমে আসত তাঁর অমোঘ দণ্ড, অভিশাপ দিতেন মহর্ষি।

ইন্দিরা দেবী কিছু আঁচ দিয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবল প্রতাপ ও নির্মোহ নিয়ন্ত্রণের : ”যতদিন মহর্ষি ছিলেন, তাঁর অর্থবল এবং চরিত্রবলে তিনি ঘরজামাই রেখে, কুলীনের ঘর ভাঙিয়ে নিজ পরিবারে নিজ পথ সমর্থন করেছেন। যে দুটি ক্ষেত্রে তিনি থাকতেই তাঁর পরিবারে সে নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে, সেখানে তাঁর অমোঘ দণ্ড কঠিনভাবে অপরাধীর উপর পড়েছে… মজা এই যে, যেখানে কোনো বিশিষ্ট হিন্দুসমাজের বংশধরকে এঁরা স্বপরিবারভুক্ত করে সমাজচ্যুত করতেন, সেখানে তাঁদের কর্তৃপক্ষ অভিশাপ দিয়েছেন তাও যেমন শুনেছি, আবার মহর্ষির পরিবারের কেউ তাঁর নিয়মভঙ্গ করলে তিনি অভিশাপ দিয়েছেন তাও শুনেছি।”

ইন্দিরা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রবলের যে-কটি নিদর্শন দিলেন তা প্রশংসার যোগ্যই বটে: এক, তিনি অর্থবলে কুলীনের ঘর ভেঙে পাত্র এনে তাঁকে ঘরজামাই করে রাখতেন; দুই, তাঁর নিয়ম কেউ ভাঙলে তাঁর উপর নেমে আসত মহর্ষির অমোঘ দণ্ড; তিন, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করলে তিনি অভিশাপ দিতেন।

দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও দু-চার কথা এখানে না বলে দ্বারকানাথের প্রসঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না।

স্ত্রী সারদাসুন্দরী দেবীর অসুস্থতার খবর পেয়েও (১৮৭৪) তাঁকে দেখতে আসেননি দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৭৫-এ সারদার মৃত্যু হয়। ১৮৭৪-এর ৩ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথকে আবার টেলিগ্রাম করা হয় সারদার সঙ্কটের কথা জানিয়ে।

দেবেন্দ্রনাথ তখন ডালহৌসি পাহাড়ে। সেখান থেকে সরাসরি কলকাতায় না এসে তিনি চলে যান শান্তিনিকেতনে।

যদিও দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দার্শনিক’ ও ‘সাধক’, তিনি জমিদারি চালাতেন কঠোর হাতে, তাঁর শাসনকালেই প্রজাপীড়নের খবর জানা গেছে।

তাঁর বাড়ির জামাইরা যাঁদের তিনি কুলীন ব্রাহ্মণবংশ থেকে ভাঙিয়ে আনতেন, -তাঁরা বাধ্য হতেন ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করতে, এটাও ছিল তাঁর নিয়ম।

সম্পত্তির জন্য তিনি বিধবা ভ্রাতৃবধূ ত্রিপুরাসুন্দরীর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং তিনি ছিলেন স্ত্রী-স্বাধীনতার বিরোধী-সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্ত্রীকে নিয়ে বিলেত যাওয়ার পরিকল্পনা করলে দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠি লিখে বলেন, তিনি যেন পরিবারের মান মর্যাদায় হস্তক্ষেপ না করেন।

নাতনি সরলা দেবী অবিবাহিত অবস্থায় মহিশূরে চাকরি করতে যাবেন সেই খবর পেয়ে দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ”সরলা যদি অঙ্গীকার করে জীবনে কখনও বিয়ে করবে না তাহলে আমি তার তলোয়ারের সঙ্গে বিয়ে দিই যাবার আগে।”

এই সংক্ষিপ্ত দেবেন্দ্রকথার পর এবার দ্বারকানাথ ঠাকুরের গল্প।

আগেই বলেছি, নীলমণির ছেলে রামমণি, রামমণির ছেলে দ্বারকানাথ। রামমণির দুই বিয়ে। প্রথম বিয়ে থেকে রামমণির দুই ছেলে, রাধানাথ আর দ্বারকানাথ। নীলমণির দুই ছেলে। দ্বিতীয় ছেলে রামলোচনের কোনও সন্তান হয়নি। তা-ই তিনি ছোটোভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে দত্তক নিলেন।

দ্বারকানাথ বড় হতে লাগলেন রামলোচনের স্ত্রী অলকাসুন্দরীর কাছে। দ্বারকানাথের মায়ের নাম মেনকাসুন্দরী। মেনকাসুন্দরী মারা যান অলকাসুন্দরী দ্বারকানাথকে দত্তক নেওয়ার কিছুদিন পরেই। রামলোচনের মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের তেরো বছর বয়েসে। আঠারো বছর বয়েসে দ্বারকানাথ ওড়িশা ও বিরাহিমপুরের জমিদারি ও কলকাতার ভূসম্পত্তির অধিকারী হন।

দ্বারকানাথ তখন নিতান্তই শিশু, সেই শিশু দ্বারকানাথকে নিয়ে এখানে একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পরছি না। দ্বারকানাথ খেলছিলেন বাড়ির উঠোনে। এক সন্ন্যাসী এলেন ভিক্ষা চাইতে। সন্ন্যাসীর নজর পড়ে শিশু দ্বারকার উপর। তিনি শিশুটির মধ্যে রাজলক্ষণ দেখতে পান, ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে এই শিশুই একদিন বংশের মান-মর্যাদা-সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হবে, তার থেকেই শুরু হবে বংশের নতুন ইতিহাস।

সন্ন্যাসীর কথা শুনেই নাকি অলকাসুন্দরী স্বামী রামলোচনকে উৎসাহিত করেন দেওর রামমণির ‘অলৌকিক’ ছেলেটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য।

রামলোচন নিজে ছিলেন বিত্তবান, সঙ্গীতজ্ঞ, সংস্কৃতি-অনুরাগী মানুষ। সেই সঙ্গে প্রখর তাঁর বাস্তববোধ ও বৈষয়িক বুদ্ধি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দ্বারকানাথের পক্ষে ইংরেজি শেখাটি একান্ত জরুরি। তাঁকে ভরতি করলেন শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে। সেই সঙ্গে মৌলবির কাছে আরবি ও ফার্শি ভাষায় পাঠ নিলেন দ্বারকানাথ।

পরে আরও ভালভাবে ইংরেজি ভাষার চর্চা করেন দ্বারকানাথ রামমোহনের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডম, জে জি গর্ডন ও জেমস কল্ডার-এর সান্নিধ্যে এসে। গর্ডন ও কল্ডার ম্যাকিন্টশ কোম্পানির ভাগীদারও হলেন কালক্রমে। পেলেন বিলিতি সমাজের অভিজাত স্বীকৃতি।

ষোলো বছর বয়েস থেকে পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশোনা করতে লাগলেন দ্বারকানাথ। কাজটা আদৌ সহজ ছিল না। জটিলতার কারণ কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ (Permanent Settlement) প্রথা, যার সব চোরা নিয়মকানুন বুঝতে না পারার ফলে অনেক জমিদারিই নিলামে উঠে হাতবদল হত।

অনেক বাঙালি জমিদারই আইনকানুন না জানার জন্য জমিদারি হারাতেন। দ্বারকানাথ জমিদারি রক্ষার জন্য খুব ভাল করে শিখে নিলেন রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কাজ। আলস্যে-আমোদে দিন না কাটিয়ে তিনি বিভিন্ন জমিদারিতে সরেজমিনে খোঁজখবর করতে লাগলেন। পাশাপাশি ইংরেজ ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসন-এর কাছে ব্রিটিশ আইন ও আদালতের রীতিনীতি শিখে নিলেন।

দ্বারকানাথের যৌবন প্রভাবিত হয়েছিল যে-দুটি মানুষের দ্বারা তাঁদের একজন রামমোহন রায়, অন্যজন ইংরেজ-পণ্ডিত রবার্ট কাটলার ফার্গুসন।

ক্রমেই দ্বারকানাথ জমিদারি আইনব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন এবং জমিদাররা প্রায় সকলেই তাঁর কাছে উপদেশ-পরামর্শ চাইতে লাগলেন। মাত্র একুশ বছর বয়েসে দ্বারকানাথ জমিদারদের আইন-উপদেষ্টা হিসেবে উপার্জন করা শুরু করে দিলেন।

বয়েস অল্প হলে কী হবে, মেধাবী দ্বারকানাথ আরবি ফার্শি ইংরেজির সঙ্গে জমিদারি আইনটাও এতই ভাল জানতেন যে, জমিদারমহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, তাঁর উপর মানুষের বিশ্বাস বাড়তে লাগল। দ্বারকানাথ অর্থ উপার্জনের নানা কৌশলও শিখে ফেলেছিলেন নেহাত তরুণ বয়েসেই।

তিনি জমিদারির আয় থেকে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো জমাতেন। সেই যুগে ওই টাকা সত্যিই বিপুল। এ-ছাড়া আইন উপদেষ্টা হিসেবেও রোজগার তাঁর কম ছিল না।

তিনি সুদে টাকা খাটাতেন। ঋণ দিতেন সাহেবদেরও। সেই টাকার সুদ থেকেও তিনি ক্রমেই ধনী হতে শুরু করলেন।

১৮২২ সালে আটাশ বছর বয়সে তিনি উপার্জনের আরও এক পথ ধরলেন-চব্বিশ পরগনায় আবগারি বিভাগে লবণ দফতরের সেরেস্তাদারের চাকরি নিয়ে। লবণ উৎপাদন ও বণ্টনের এই কাজ থেকে তাঁর মাসিক উপার্জন ছিল দেড়শো টাকা।

১৮২৮ সালে দ্বারকানাথের উন্নতি হল, তিনি দেওয়ান হলেন। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি ছিলেন রামমোহনের সমর্থক। ফলে হিন্দু সমাজে তাঁর শত্রুর সংখ্যা কম ছিল না।

কিন্তু যুবক দ্বারকানাথ তোয়াক্কা করতেন না। চাকরির নিয়ম ও বন্ধনের মধ্যে হাঁপ ধরে গেল তাঁর। তিনি চাকরি ছেড়ে ১৮৩৪ সালে কার-টেগোর কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু তার আগেই তেজারতি ব্যবসার পাশাপাশি দ্বারকানাথ ইউরোপে নীল ও রেশম পাঠাতেও শুরু করেন।

শিলাইদহের নীলকুঠি তৈরি হয় ১৮২১-এ। দ্বারকানাথ নীল চাষ করতেন ‘রায়তি’ প্রথায়। তিনি রাম, মৌরি ও জায়ফলের ব্যবসাও করেছেন।

তাঁর ভাড়া করা জাহাজ ‘রেজোলিউশন’ এই সব পণ্য নিয়ে বুয়েনস আইরেস-এ যায় ১৮২১ সালে, যেখানে একশো বছর পরে যাবেন দ্বারকানাথের নাতি রবীন্দ্রনাথ, তেষট্টি বছর বয়সে, দেখা পাবেন তাঁর ভালবাসার বিদেশিনির। দ্বারকানাথ যৌথভাবে মালিক হন ‘ওয়াটার উইচ’ নামের আরও এক জাহাজের।

এ-ছাড়া তাঁর আরও দুটি জাহাজ, ‘এরিয়েল’ ও ‘মাভিস’ চিন দেশের সঙ্গে আফিমের কারবারে খাটত।

আফিম থেকে কয়লা, কয়লা থেকে চিনি, যে-কারবারেই টাকার গন্ধ পেয়েছেন সেখানেই ছুটে গেছেন দ্বারকানাথ।

১৮৩০ সালে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বারুইপুরে ছশো বিঘে জমি কিনে আখের চাষ শুরু করে দেন চিনির ব্যবসা করবেন বলে।

দ্বারকানাথকে বুঝতে গেলে কিন্তু একটি জরুরি কথা মনে রাখতেই হবে। তিনি এক দিকে যেমন অর্থ উপার্জনের নেশায় মেতে ছিলেন ঠিক তেমনি সমাজ-উন্নয়নের একাধিক প্রচেষ্টার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

১৮১৭-এ হিন্দু কলেজ শুরু; ১৮২৯-এ সতীদাহ নিষিদ্ধ করার আইন; ১৮৩৬-এ মেডিক্যাল কলেজ- প্রতিটি প্রচেষ্টার পিছনে ছিল দ্বারকানাথের উৎসাহন ও অবদান। ১৮২৪ সালে গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম প্রথম আইন করে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা খর্ব করলেন। প্রতিবাদ করলেন দ্বারকানাথ, গিয়েছিলেন প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত এবং বেন্টিঙ্কের শাসনকালে বেন্টিঙ্ক-এর উপর এতদূর প্রভাব বিস্তার করলেন তিনি যে, বাংলা দেশে এই আইন প্রয়োগ করা গেল না। ১৮৩৫-এ আইনটি উঠেও গেল, দ্বারকানাথেরই প্রতিবাদের ফলে।

তিনিই ছিলেন শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা কাগজ সমাচার দর্পণ-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক (১৮১৮, দ্বারকানাথ ২৪)। ভারতের প্রথম দৈনিক কাগজ ‘বেঙ্গল হরকরা’-র তিনি প্রধান ভাগীদার।

১৮২১: দ্বারকানাথ ২৭: তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সংবাদ কৌমুদী’, রামমোহন রায়কে নিযুক্ত করলেন সম্পাদক। ‘ইংলিশম্যান’ (আজকের দ্য স্টেটসম্যান) পত্রিকাও প্রকাশিত হল দ্বারকানাথেরই আর্থিক সমর্থনে।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর পিছনেও ছিল তাঁরই অর্থ।

এই সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে চলতে লাগল তাঁর নিরন্তর সম্পদসন্ধান।

১৮৩০-এ কিনলেন কালীগ্রাম পরগনা; ১৮৩৪-এ কিনলেন সাহাজাদপুর; ওই বছরেই তিনি চাকরি ছেড়ে উইলিয়াম কার নামের এক ইংরেজের সহযোগে স্থাপন করলেন কার-টেগোর কোম্পানি; কিনে নিলেন বিরাহিমপুরের কুমারখালি মৌজায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমের কুঠি; ১৮৩৭: দ্বারকানাথ ৪৩: তিনি স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন নামক কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্ট, যে-কোম্পানির মূল কাজ গঙ্গার মোহনা থেকে কলকাতার বন্দর পর্যন্ত জাহাজগুলিকে টেনে আনা; স্টিমার মেরামতের জন্য কারখানা খুললেন খিদিরপুরে এবং শুরু করলেন কয়লার বাণিজ্য স্টিমারের জ্বালানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে; উদ্যোগী হলেন ভারত-ইংল্যান্ড জাহাজ-সংযোগের ব্যাপারে, সুয়েজ খাল খননের কাজ শুরুর অনেক আগেই; দূরদৃষ্টির প্রেরণায় পার্টনার হলেন তৎকালের সব থেকে নামকরা পরিবহণ সংস্থা ‘পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল’ নামের জাহাজ কোম্পানির।

সমাজের কাজ করছেন। সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িয়ে থাকছেন। অর্থ উপার্জন করছেন বিচিত্র পথে, যার সবগুলি আইনসঙ্গত বা ন্যায়সঙ্গত নয়। তাতে বিশেষ কিছু এসে যাচ্ছে না দ্বারকানাথের, আফিম এবং চিনির ব্যবসায়ে তাঁর সমান সততা ও আগ্রহ, তিনি বুঝতে পারছেন বাণিজ্যের জন্য চাই আরও টাকা।

তা-ই ১৮২৯-এ মাত্র পঁয়তিরিশ বছর বয়েসে ষোলো লক্ষ টাকা মূলধন বিনিয়োগ করে দ্বারকানাথ নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’।

২০ আগস্ট, ১৮৪০: বিচক্ষণ দ্বারকানাথ তাঁর ছেচল্লিশ বছর বয়েসে একটি ট্রাস্ট ডিড করলেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর ছেলেরা ব্যবসাবাণিজ্য চালাতে পারবেন না, তাঁদের সেই বোধবুদ্ধি নেই।

এই ট্রাস্ট ডিডের অন্তর্ভুক্ত হল তাঁর কয়েকটি জমিদারি এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, এবং তিনি এমন ব্যবস্থা করে গেলেন যে, ব্যবসা পড়ে গেলেও এই সব সম্পত্তি তাঁর বংশধরেরা ভোগ করতে পারবেন, তাঁদের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

দ্বারকানাথ এই ব্যবস্থা না করলে তাঁর পরবর্তী তিন পুরুষ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারি ও সম্পত্তি ভোগ করতে পারতেন না, ব্যবসা পড়ে যাওয়ার ফলে সবই হারাতে হত তাঁদের।

একটি কথা মনে রাখতেই হবে, সেখানে-যেখানে ‘জমিদার’ রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভ্রাম্যমাণ, ডিহি সাহাজাদপুর, বিরাহিমপুর পরগনা, শিলাইদহে যার সদর কাছারি, কালীগ্রাম পরগনা, ওড়িশার পাণ্ডুয়া ও বালুয়া তালুক, সবই দ্বারকানাথের উইলভুক্ত সম্পত্তি, কোনও নতুন সম্পত্তি তৈরি করেননি দেবেন্দ্র- রবীন্দ্র-রথীন্দ্র।

৯ জানুয়ারি, ১৮৪২: দ্বারকানাথ ৪৮, তিনি বংশধরদের কথা ভেবে ট্রাস্ট ডিড তৈরি করেছেন দেড় বছর আগে, এবার তাঁর আর এক স্বপ্নপূরণ, বিলেত যাত্রা।

তাঁর স্ত্রী দিগম্বরী দেবী মারা গেছেন বছর তিনেক হল, তিনি বেশ ঝাড়া হাত-পা। দ্বারকানাথ বিলেত যাত্রা করলেন তাঁর নিজের জাহাজ ‘ইন্ডিয়া’-তে চেপে।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশেষ সময় সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ”তখন তাঁহার (দ্বারকানাথের) হাতে হুগলী, পাবনা, রাজসাহী, কটক, মেদিনীপুর, রঙ্গপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলার বৃহৎ বৃহৎ জমিদারী এবং নীলের কুঠি, সোরা, চিনি, চা প্রভৃতি বাণিজ্যের বিস্তৃত ব্যাপার। ইহার সঙ্গে আবার রানীগঞ্জে কয়লার খনির কাজও চলিতেছে। তখন আমাদের মধ্যাহ্ন সময়…।”

ইংল্যান্ডে দ্বারকানাথ, এই বিষয়টি নিয়েই একটি পুরো বই লেখা যায়। এখানে এইটুকু বললেই বোধহয় যথেষ্ট যে, দ্বারকানাথ বিলেতে রানি ভিক্টোরিয়া থেকে চার্লস ডিকেন্স, প্রত্যেকেরই প্রিয়তা ও বন্ধুত্ব অর্জন করেন।

রানি ভিক্টোরিয়ার নৈশভোজ থেকে ফ্রান্সে লুই ফিলিপের নৈশভোজ, সর্বত্র এক ভারতীয় ব্যবসায়ী, যাঁর নাম দ্বারকানাথ।

ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে এতদূর ঘনিষ্ঠ তিনি, যে রটে গেল রোচক প্রণয়ের গল্প। স্কটল্যান্ডের এডিনবরা মিউনিসিপ্যালিটি তাঁকে দিল স্কটল্যান্ডের নাগরিকত্ব। বিলেতে পেলেন ‘প্রিন্স’ উপাধি।

বছরখানেক বিলেতে কাটিয়ে দেশে ফিরলেন দ্বারকানাথ। পণ্ডিতেরা একজোট হয়ে বললেন, কালাপানি পেরোবার ঘোর অপরাধের জন্য তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

পণ্ডিতদের এই প্রস্তাব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দ্বারকানাথ দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু বংশধরদের কথা ভেবে ১৮৪৩-এর ১৬ অগস্ট উইল করলেন তিনি, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়েসে।

এই উইলে তিনি ‘ভদ্রাসন’-টি (৬ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন) দিনেল বড়ো ছেলে দেবেন্দ্রনাথকে আর বৈঠকখানা বাড়িটি (৫ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন, যার জন্মবৃত্তান্ত জড়িয়ে আছে দ্বারকানাথের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে এবং যে-প্রসঙ্গে পরে আসছি) দিলেন মেজো ছেলে গিরীন্দ্রনাথকে।

ছোটো ছেলে নগেন্দ্রনাথকে দিলেন ভদ্রাসন বাড়ির পশ্চিম দিকের সমস্ত জমি এবং বাড়ি তৈরির জন্য ২০,০০০ টাকা।

তাঁর অন্য দুই ছেলে মারা যান এই উইলের আগেই। দেবেন্দ্রনাথকে তিনি আরও দিয়েছিলেন:কার ঠাকুর কোম্পানিতে তাঁর অংশের পূর্ণ অধিকার এবং দরিদ্রসেবার জন্য এক লক্ষ টাকা।

৪ মার্চ, ১৮৪৫: দ্বারকানাথ আবার বিলেত গেলেন। তিনি ততদিনে রানি ভিক্টোরিয়ার ‘মাই প্রিন্স’। এবং অভিজাত ইংরেজ রমণীদের ডার্লিং ‘ডোয়ারকি’।

গত বিলেত ভ্রমণে দ্বারকানাথের পরিচয় হয় চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে। এবার তিনি ভোজসভায় ডাকলেন ‘পাঞ্চ’ পত্রিকার লেখক গোষ্ঠীকে।

সেই ভোজসভায় চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দ্বারকানাথ-মুগ্ধ উইলিয়াম থ্যাকারে।

বিলেতের প্রচণ্ড শীত থেকে রেহাই পেতে তিনি গেলেন প্যারিসে। সেখানে তাঁর পরিচয় হল ম্যাক্সমুলার-এর সঙ্গে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী জানিয়েছেন, দ্বারকানাথই প্রথম ভারতীয় যাঁর সঙ্গে ম্যাক্সমুলারের আলাপ হয়।

দ্বারকানাথ গাইতেন ইটালিয়ান বা ফরাসি গান। গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতেন ম্যাক্সমুলার। ম্যাক্সমুলারকে গজল গেয়েও শোনাতেন দ্বারকানাথ।

১৮৪৬-এর ৯ মার্চ: দ্বারকানাথ ফিরে এলেন প্যারিস থেকে লন্ডনে। শুরু হল তাঁর ক্রমাগত শরীর খারাপের পালা।

১৮৪৬-এর ৩০ জুন: এক ডাচেস-এর পার্টিতে হঠাৎ-ই অসুস্থ হয়ে পড়লেন দ্বারকানাথ। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে ব্রাইটন থেকে খানিকটা দূরে ওয়রদিং-সমুদ্র-তীরের এক স্বাস্থ্যনিলয়ে। ১৮৪৬-এর ২৭ জুলাই অজ্ঞান তিনি। তাঁকে সেই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হল সেন্ট জর্জ হোটেলে।

চারদিন পরে ৩১ জুলাই লন্ডন থেকে বেশ দূরে সারে শহরে মারা গেলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ।

১৮৪৬-এর ১ আগস্ট কেনসিল গ্রিন সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ হলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। সমাধির গায়ে এইটুকু পরিচয় :

D. N. T.

Dwarkanath Tagore

of Calcutta

OBIT 1st August, 1846

এবার দ্বারকানাথের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষভাবে স্ত্রী দিগম্বরীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা, কারণ ৫ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে তাঁর বৈঠকখানা বাড়ির নেপথ্যে অনস্বীকার্যভাবে রয়েছে তাঁর দাম্পত্যজীবনে আদরের উপবাস ও অভিমান।

১৮০৯-এ পনেরো বছরের দ্বারকানাথের সঙ্গে বিয়ে হয় যশোর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের পিরালি ব্রাহ্মণ রামতনু রায়চৌধুরী ও আনন্দময়ীর ছ বছরের খুকি দিগম্বরীর সঙ্গে (১৮০৩-২১.১.১৮৩৯)।

কালক্রমে দিগম্বরীর গর্ভে জন্মাল দ্বারকানাথের পাঁচ ছেলে, দেবেন্দ্রনাথ, নরেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ।

দিগম্বরীর ছিল ধর্ম-ধর্ম বাতিক। আর দ্বারকানাথ শিক্ষাদীক্ষায় আধুনিক, মুক্ত মানুষ। সুতরাং দেখা দিল ঘোর সঙ্কট, সংস্কারের-বিশ্বাসের-মূল্যবোধের-সম্পর্কের।

দ্বারকানাথ তখন গভীরভাবে প্রভাবিত রামমোহনের দ্বারা। ইংরেজ-মহলেও বাড়ছে তাঁর খ্যাতি-প্রতিপত্তি। বিত্তে এবং বৈদগ্ধ্যে তিনি অনন্য। সংস্কারবর্জিত আধুনিকতা নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন ঠাকুরবাড়িতে। মুসলমানের রান্না খেতেও তাঁর কোনও কুণ্ঠা নেই। তিনি শুরু করলেন নিয়মিত মাংস খাওয়া, তাঁর জন্য বারবাড়িতে মাংস রাঁধার বন্দোবস্ত হল। ইংরেজের সঙ্গে খানাপিনাও চলতে লাগল।

রামমোহনের অনুসরণে দ্বারকানাথ ‘শেরি’ সুরাও পান করতেন। দিগম্বরী পছন্দ করেননি দ্বারকানাথের এই ‘ম্লেচ্ছজীবন’, আপত্তি জানালেন প্রবলভাবে।

দ্বারকানাথ দিগম্বরীর এই ‘অন্যায়’ আবদার মেনে নিলেন না। দিগম্বরী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে মতামত চাইলেন, এমন ম্লেচ্ছ স্বামীর সঙ্গে ঘর করা উচিত কি না।

পণ্ডিতদের উপদেশ : ”স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্যকর্ত্তব্য, তবে তাহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য।”

এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী দ্বারকানাথের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। এমনকী দ্বারকানাথের সঙ্গে কোনও কারণে মুখোমুখি হলে তিনি শীতকালেও সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেন। তাঁর অকাল মৃত্যুর একটি সম্ভাব্য কারণ, ঘন ঘন গঙ্গাস্নান।

১৮২৩ সালে দ্বারকানাথ তাঁর নতুন বৈঠকখানা বাড়ি তৈরি করে সেখানে ‘আলাদা’ হয়ে যান। দ্বারকানাথের দাম্পত্যজীবনে যদি সত্যিই আদরের উপবাস ঘনিয়ে না আসত তা হলে তিনি ৫ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বৈঠকখানা বাড়ি কোনওদিনই তৈরি করতেন না।

সমাচার দর্পণে দ্বারকানাথের নতুন গৃহপ্রবেশের কথা এইভাবে লেখা হল, ”মোং কলিকাতা ১১ ডিসেম্বর ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক অনেক ভাগ্যবান সাহেব ও বিবিদিগকে নিমন্ত্রণ করাইয়া আনাইয়া চতুর্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য ভোজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করাইয়াছেন এবং ভোজনাবসানে ঐ ভবনে উত্তম গানে ও ইংগ্লন্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমোদ করিয়াছিলেন।”

এই সময় থেকেই ৬ নম্বরের ভদ্রাসন বাড়িটির সঙ্গে দ্বারকানাথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি তৈরি করেন আরও এক প্রাসাদ বা প্রমোদভবন বেলগেছিয়ায়, যেটি খ্যাত হয় বেলগাছিয়া ভিলা নামে।

দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরেই দৃশ্যটা এই রকম। দেড় বছরের মধ্যে উঠে গেল দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, ১৮৪৭-এর ২৭ ডিসেম্বর।

তার তিন সপ্তার মধ্যে ১৮৪৮-এর ১৫ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে গেল কার-ঠাকুর কোম্পানি।

দ্বারকানাথের ছেলেরা দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে একে একে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করতে লাগলেন: বিক্রি হয়ে গেল বেলগাছিয়া ভিলা, দ্বারকানাথের বহু পরিশ্রমের ফসল কলকাতার সাহেব পাড়া ও দেশি পাড়ার বহু বাড়ি-ঘর-সম্পত্তি, রানিগঞ্জের বেঙ্গল কোল-এর জায়গা, বিভিন্ন জায়গার জমিদারি, কুঠিবাড়ি প্রভৃতি।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারের বৈভব-বিস্তার-বিলাসের ইতিহাস থেকে এইভাবে ধীরে ধীরে ঝরিয়ে দেওয়া হল দ্বারকানাথকে।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নতুন পরিচয় দাঁড়াল ‘মহর্ষিভবন’। ”বাড়ির নামকরণ হল মহর্ষির নামে। এই নামকরণ কে বা কারা এবং কোন যুক্তির ভিত্তিতে করলেন-এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর আমি খুঁজে পাইনি”, লিখেছেন ‘ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা’ গ্রন্থে সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দ্বারকানাথের ব্যবসার সমস্ত প্রাথমিক প্রমাণ ও দলিলপত্র, ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ পুড়িয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ! লোপাট হয়ে গেল তাঁর বাণিজ্য প্রচেষ্টা ও সাফল্যের চিহ্নগুলি।

আজ থেকে একশো বছর আগে ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’ গ্রন্থে, ”এই কুঠীর কারবার দ্বারকানাথের জীবনের একটি সর্বপ্রধান ঘটনা, কিন্তু দুঃখের বিষয় ইহার সম্বন্ধীয় কাগজপত্র পূজ্যপাদ রবীন্দ্রনাথের কর্ত্তৃত্বে এবং তাঁহার আদেশে দগ্ধীভূত হওয়াতে এই কারবার যে কত বিস্তৃত ছিল এবং কিরূপে পরিচালিত হইত, তাহার বিবরণ উদ্ধার করিবার কোনো আশা নাই।”

ক্ষিতীন্দ্রনাথ দ্বারকানাথের এই জীবনীটি লিখেছিলেন ১৯০৮ সালে কিন্তু ঠাকুরবাড়ির প্রভাবে এ-বই তখন প্রকাশিত হয়নি। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭০-এ।

প্রশ্ন হল, দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরেই কেন এইভাবে একে একে নিভে গেল তাঁর তিলে তিলে গড়ে তোলা বাণিজ্যের দেউটি, কেন ধস নামল ঠাকুরবাড়ির আর্থিক অবস্থায়?

এই বিপর্যয়ের জন্য দ্বারকানাথকেই দায়ী করা হয়েছে, তাঁর ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দোষ, এবং এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে পুত্র দেবেন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না দ্বারকানাথকে। এবং রবীন্দ্রনাথের দ্বারকানাথ-অনীহার পিছনেও কাজ করেছে দেবেন্দ্রের প্রভাব।

বহু বছর আগে কিন্তু সত্যি কথাটা লিখে গেছেন দেবেন্দ্রের নাতি ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ”কারঠাকুর পতনের মূল কারণ… দ্বারকানাথের পুত্রগণের বৃহৎ কারবার চালাইবার অক্ষমতা। একটি বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে বুদ্ধি, যে দূরদর্শিতা এবং সর্ব্বোপরি যে সংযম আবশ্যক, সত্যের অনুরোধে বলিতে বাধ্য যে দেবেন্দ্রনাথ প্রভৃতি তিন ভ্রাতার কেহই তাহা প্রাপ্ত হন নাই। পরিশ্রম করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অর্থোপার্জ্জনের পক্ষে তাঁহারা তিন জনেই অসমর্থ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।”

দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগটি সুকৌশলে গড়ে তোলা হয়েছিল, তা হল তাঁর নিজের ঋণের বোঝা-ই ঠাকুরবাড়ির আকস্মিক আর্থিক বিপর্যয়ের কারণ। যিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ব্যাপ্তি ও বৈভবের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা, তাঁকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর বংশধরেরা নিজেদের অপারগতা ঢাকতে।

ভেতরের কথাটা অকপটে লিখেছেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ, ”দ্বারকানাথ জীবিত থাকিতে ইহার দেনা সম্বন্ধে একটি কথাও উঠে নাই। বাস্তবিক দেবেন্দ্রনাথের লেখামত যদি ধরা যায় যে কারবারের দেনা এক কোটি ছিল এবং পাওনা সত্তর লক্ষ, অসংস্থান ত্রিশ লক্ষ। একটি বিস্তৃত চলতি কারবারের পক্ষে এই অসংস্থান যে অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল তাহা তো বোধ হয় না। আরও দেখিতে হইবে যে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পূর্ব্বেই বা কি দেনা ছিল এবং তাঁহার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যেই বা কি দেনা হইল। দেবেন্দ্রনাথ গিরীন্দ্রনাথের কথায় সায় দিয়া তাঁহার হাতে কার্য্যভার সমর্পণ করিয়া ধর্ম্মবিষয়ক চিন্তায় মনোনিবেশ করিবার প্রচুর অবসর পাইয়াছিলেন, তাহাতেই আনন্দিত। এই কারবার রক্ষা করা, পৈতৃক বিষয় প্রাণপণে রক্ষা করা যে একটা বিশেষ ধর্ম্ম তাহা তাঁহার বুদ্ধিতে তখন প্রবেশ করে নাই। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহার পৈতৃক বিষয় যেন রক্ষা পাইয়া গেল-তাহা না হইলে, হাউসের দেনার দায়ে বিকিয়ে গেলে তাঁহার কি অবস্থা হইত? তিনি যে ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিলেন, তাহার কি যে অবস্থা হইত, তাহা ভাবিতে পারা যায় না…নির্ঝঞ্ঝাটে প্রয়োজন মতো টাকাকড়ি জমিদারী হইতে আসুক, তাহা হইলেই দেবেন্দ্রনাথ সুখী। …তিনি তাঁহার পিতাকে খুব অল্পই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এ অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথ তাঁহার পিতার বিশ্বতোমুখী প্রতিভাকে যে আয়ত্ত করিতে পারেন নাই, তাহা কিছু আশ্চর্য্য নহে। …দেবেন্দ্রনাথ যদি নিজে কারবারের বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারিতেন, তাহা হইলে উহার শীঘ্র পতন হইত না।”

এই চরম সত্যটুকুকে ক্রমশই দ্বারকানাথবিরোধী প্রচার মুছে দিয়েছে ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস থেকে। দেবেন্দ্রনাথ- প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথও ভুল বুঝেছিলেন বা বাধ্য হয়েছিলেন ভুল বুঝতে তাঁর ঠাকুরদাকে।

যে-বোটে তিনি মাসের পর মাস পদ্মায় ভেসে বেড়িয়েছেন, যে-জমিদারির বিদগ্ধ আলস্যে রচিত হয়েছে তাঁর যৌবনের স্বপ্ন, অসংখ্য গান-কবিতা-ছোটগল্প- উপন্যাস এবং অজস্র চিঠি, সেই বোট, সেই জমিদারি, সবই যে দ্বারকানাথের তৈরি সম্পদ, তা-ও কি ভুলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

এমনকী বিলেতে দ্বারকানাথের সমাধিটি সংস্কারের জন্যও কোনও উৎসাহ ছিল না তাঁর। ১৯০৬-এর ১৭ এপ্রিল ওই সমাধিক্ষেত্রের সুপারিনটেনডেন্ট টি-বার্জেস গগনেন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখে জানান দ্বারকানাথের সমাধিটির শোচনীয় অবস্থার কথা। গগনেন্দ্রনাথ সমাধি-সংস্কারের জন্য ৪ পাউন্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯২৭ সালে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের ছেলে নির্মলচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথকে ওই সমাধিটি অবিলম্বে সংস্কার করতে অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ ৭ পাউন্ড পাঠিয়েই তাঁর কর্তব্য শেষ করেন।

১৯৭৬-এ দ্বারকানাথের জীবনীকার এবং রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতার স্বামী কৃষ্ণ কৃপালনী সমাধিটির অবস্থা দেখে ব্যথিত হয়ে সেটির উপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

দ্বারকানাথের আদরের উপবাসের এইখানেই শেষ নয় কিন্তু। এ-কথাটা মনে রাখা একান্ত জরুরি যে, এতবার ইংল্যান্ডে যাওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন দ্বারকানাথের সমাধিক্ষেত্রে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়নি।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর দ্বারকানাথের বিখ্যাত বৈঠকখানা বাড়ি, সাংস্কৃতিক-স্মৃতি-বিজড়িত দক্ষিণের বারান্দা সব চলে গেল ‘প্রোমোটার’-এর হাতে। বিক্রি করেছিলেন রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথ।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুমিতেন্দ্রনাথ (বাদশা) ঠাকুর সে-কথা জানিয়েছেন এই ভাষায়, ”রথীদাদা আমাদের বাড়ির ছেলে, তাঁর জীবনের সঙ্গে দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়িও ওতপ্রোতভাবে জড়িত-ও বাড়ি থেকে বরবেশে তিনি বিয়ে করতে এসেছেন জুড়িগাড়ি করে এ-বাড়িতে। এই পাঁচ নম্বরের অন্দরে তাঁর বিয়ে হয়েছিল দাদামশাইয়ের (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বড় বোন বিনয়িনীর মেজ মেয়ে প্রতিমার সঙ্গে। তা সত্ত্বেও রথীদাদা ঐ ব্যবসাদারদের সঙ্গে একমত হয়ে বাড়ি ভাঙার প্রস্তাবে মত দিলেন কী করে! …দাদামশাই যেদিন শুনলেন বাড়ি ভাঙা হচ্ছে সেদিন কি রকম একটু বিচলিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু মুখে কোনো রা নেই। …লোকপরম্পরায় খবর আসে দখলের আগেই প্রথমে দক্ষিণের বাগান শেষ হয়ে গেছে মাড়োয়ারির কুঠারের ঘায়ে-নারকোলের সারি, বিরাট দেবদারু গাছ, লাইব্রেরি ঘরের গোল জাপানি গবাক্ষের ভিতর দিয়ে দেখা চাঁদনী রাতের আবছা বিরাট শিশুগাছ, সব শেষ হয়ে গেছে-কেবল দাঁড়িয়ে আছে ফটকের পাশের বৃদ্ধ নিম আর আস্তাবলের পাশে সেই ঐতিহ্যময় তেঁতুলগাছ।

তারপর একদিন খবর এল দ্বারকানাথের বৈঠকখানার গায়ে গাঁইতির ঘা পড়ছে, এক একটা চুনসুরকির গাঁথনির ইট খসে পড়ছে তিনতলা থেকে একতলায়, কাঠের কড়ি-বরগা নামছে, ধসে আচড়ে পড়ছে চাঙড়া চাঙড়া চুন-সুরকি-বালির পলেস্তারা। একটা ইতিহাসের সাক্ষীকে ধূলিসাৎ করতে উদ্যত হয়েছে আমাদেরই কয়েকজন বিবেচনাহীন ব্যক্তি। শেষ হয়ে গেল আমাদের কত আদরের জন্মস্থান, গুঁড়িয়ে গেল দ্বারকানাথের বৈঠকখানা, মিলিয়ে গেল দাদামশায়দের সেই দক্ষিণের বারান্দা-স্টুডিও-লাইব্রেরি, বিলিয়ার্ড সেলুন, কর্তাবাবা (রবীন্দ্রনাথ) দাদামশায়দের কত নাটক-যাত্রা-গান- বাজনার সাক্ষী কালো ডোরাকাটা লাল মেঝের হল।

তিন কর্তা ও তাঁদের পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের বৈঠকখানার চিহ্নকে একেবারে দ্বারকানাথের গলি থেকে লোপাট করে-শুধু দেবেন্দ্র-রবীন্দ্রপরিবারের কীর্তিকেই জগৎবাসীর কাছে জিইয়ে ও বাঁচিয়ে রাখার এই যে প্রচেষ্টা, তার পিছনে কারো কালো অদৃশ্য হাত ছিল কি?”

এই ভাবেই তাঁর নিজের বাড়ি থেকে, নিজের বংশের ইতিহাস থেকেও সত্যিই নির্বাসনে পাঠাবার চেষ্টা হয়েছিল ‘রামমোহন রায়ের দক্ষিণহস্ত’ (শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায়), প্রথম বাঙালি entrepreneur (অমলেশ ত্রিপাঠীর মূল্যায়নে) এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রাণপুরুষ, দ্বারকানাথ ঠাকুরকে।

কারণ একটাই, তাঁকে ভালচোখে দেখেননি দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।

আদরের সেই উপবাস থেকে ক্রমেই তিনি নিষ্ক্রান্ত। ‘চালাঘর’ থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে উত্তীর্ণ হওয়ার ইতিহাসে দ্বারকানাথের একক অবদানই হিরণ্ময়। তিনি অবতীর্ণ না হলে ‘চালাঘর’ চালাঘরই থাকত, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির জন্ম হত না।

কিন্তু এ-কথাও ঠিক, আদরের উপবাস জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্তরমহলের অঙ্গ। এবং উৎস সেই অন্তরমহলের একাকিত্বের, অনিশ্চয়তাবোধের, হাঁফধরানো পরিবহের, তাড়নার, পাগলামির, আত্মঘাতী প্রবণতার, প্রতিভাদীপ্ত প্রণোদনারও।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আপাত আনন্দের ঢাকনার তলায় ছিল গহন দহন, গভীর যাতনা। এবার আরও এক দহন-তাড়না-সঙ্গনিঃসঙ্গতার গল্পে ঢুকতে যাচ্ছি আমরা, যে ধারাবাহিক গল্পের একটি শেষ হচ্ছে আত্মহত্যায়; অন্যটি সঙ্গীহীন ঘরনিপণা, অভিমান ও মৃত্যুতে; এবং তৃতীয়টি অনিবার্য বিচ্ছেদ ও অনিকেত ‘ভেসে যাওয়া’-য়।

তিনটি কাহিনিরই কেন্দ্রপুরুষ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *