১. মা মারা গেছেন যখন

সীমানা ছাড়িয়ে – উপন্যাস – সৈয়দ শামসুল হক

০১.

মা মারা গেছেন যখন জরিনা মাত্র সাত। শিশু–মনে লেগে থাকা কবেকার কয়েকটা মাত্র ছবি, আর অ্যালবামে কয়েকটা ফটোগ্রাফ শুধু বেঁচে আছে। যখন তার তার বয়স বারো, তখন বাবা মাঝে মাঝে দেখাতেন সেই ছবিগুলো। বলতেন তার মায়ের কথা। বলতেন, যখন নতুন মা রোকসানা ঘরে থাকতো না, কিংবা কাছাকাছি। একটাতে এক মহিলা তার বাবার পাশে বসে আছেন। পাড় গার কাঠ চেঁছে রং মাখানো চ্যাপ্টা পুতুলের মতো। পেছনের পটভূমির সঙ্গে যেন সেই মহিলার কোনো দূরত্ব নেই। আরেকটা ছবিতে শুধু সেই মহিলা। লতার মতো লীলায়িত একটা ময়ূর পাড় ঘোমটা ঘিরে রেখেছে সেই কাঠ পুতুলের মুখ। কিন্তু ঠোঁট জোড়া ভারী, একটু কালো কালো ছবিতে কালো, আসলে হয়ত গোলাপি এখুনি হয়ত হাসবেন। তারপর অ্যালবামের আরো দুটো পাতা ওলটালে বড়ো ছবি। সেই মহিলা শাল গায়ে বসে আছেন ভারী কাজ করা উঁচু নকশাপিঠ চেয়ারে। পাশে দাঁড়িয়ে এগারো বছরের চালাক চালাক ছিপছিপে এক মেয়ে নূরুন্নাহার নতুন শাড়ি পড়েছে। এমন কি এও হতে পারে ওই ছবি তোলবার দিনই প্রথম সে শাড়ি পড়ল, তাই কেমন আড়ষ্ট। আর সেই মহিলার কোলে পাঁচ বছরের আরেকটি মেয়ে। হাঁ করে বোকার মতো তাকিয়ে আছে সমুখের দিকে। ঠোঁট ঝুলে পড়েছে। অপরূপ ভঙ্গিতে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন সেই মহিলা।

কিন্তু ছবিগুলো জরিনা আর কোনোদিন দেখতে চায়নি। এখন তো একেবারেই নয়। বরং সে মনে না করতে পারলেই বাঁচে। সে স্মৃতি শুধু থেমে থাক, দৃষ্টি করলে যার প্রতিক্রিয়া হয় না, সে স্মৃতি স্মৃতিই নয়। তার মনে যে মহিলা আছেন, সেই ভালো, যে মহিলা ঝুঁকে পড়ে তার পাঁচ বছরের কোকড়ানো কালো চুলে গাঢ় নীল রিবন বেঁধে দিচ্ছেন।

.

শাহ সাদেক আলী একবার হাসলেন রোকসানার দিকে তাকিয়ে। গলাটাকে যথাসম্ভব মোলায়েম করে বললেন, তোমার ওই দোষ। নিজের মতটাকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দিতে চাও। সে বেচারার যে কিছু বলার থাকতে পারে তোমার মনেই হয় না। রোকসানা বলেছিল, নতুন বাড়িতে দোরপর্দা হবে হালকা বাদামি রঙের। কিন্তু সাদেক বলেন, সবুজ। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি, গত পরশু সেই নির্দেশ দিয়ে এসেছেন ডেকোরেটর মোহাম্মদ সোলেমানকে। কিন্তু তাতেও দোষ হতো না, যদি পরশুদিনই তিনি কথাটা বলতেন রোকসানাকে। বলেছেন সবে আজ। রোকসানার রাগ এ কারণেই আরো কিছুটা উঁচু পর্দায়। আবার সে বললো, আপনি তাহলে–।

একটু চা দিও।

সাদেক আলী কলম তুলে প্যাডে লিখতে লিখতে বললেন। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে রোকসানা এটুকু জেনেছে যে, এই কথার আড়ালে কী তিনি বলতে চান। তাই কথাটা দূরে দাঁড়ানো রোকসানার কানে গিয়ে বাজলো যেন থামো। তাকিয়ে রইলো সেই মানুষটার দিকে যে প্যাডে একটানা লিখে চলেছে দেশে খাদ্য সঙ্কটের ওপর বিবৃতি।

শাহ সাদেক আলী পছন্দ করেন না তার বিবৃতি লিখে দেবে কোনো মাইনে করা সেক্রেটারী অথবা তার পার্টির কোনো উমেদার, যারা অপেক্ষায় থাকে পার্টি কবে ক্ষমতায় আসবে, আর ক্ষমতায় এলেই যারা উঠে পড়ে লেগে যাবে, কীসে দুটো পয়সা করা যায়। এই সততাই সাদেককে অত্যন্ত সাধারণ স্তর থেকে তুলে এনেছে আজকের ঈর্ষাযোগ্য সামাজিক স্তরে, রাজনৈতিক খ্যাতির শিখরে। অবশ্য আজকের দিনে রাজনীতিতে খ্যাতি বলতে যা বোঝায় সে খ্যাতি কোনোদিনই তাঁর আসেনি, তিনিও চাননি।

জরিনার মা এসেছিলেন যখন, সাদেক তখনো ছাত্র। শ্বশুর পাঠালেন বিলেতে। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে এলেন। প্রাকটিস শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টে। সে কতকাল আগের কথা। তারপর সারা ব্রিটিশ বাংলায় জেগে উঠলো মুসলমান সমাজ। মুসলিম মধ্যবিত্তের যেন মেরুদণ্ড গড়ে উঠলো মাত্র কয়েক বৎসরে। মেরুদণ্ড পেলেন শাহ সাদেক আলী। এই সময়ে এক মামলার ব্যাপারে যেতে হয়েছিল বম্বে। আর এই যাত্রাই তার জীবনে এনে দিলো এক নতুন মোড়। বম্বেয় তার সঙ্গে দেখা হলো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর।

কলকাতায় ফিরে এসে সাদেক যোগ দিলেন রাজনীতিতে। সেদিন থেকে শুরু করে আজ আটান্ন বছর বয়স অবধি রাজনীতি তাঁর সাধনা হয়ে আছে। এর পেছনে তার প্রথমা স্ত্রী জরিনার মায়ের দানও কম নয়। কিন্তু জরিনার মা থাকতেন সকলের, এমনকি সাদেকেরও অলক্ষ্যে। তাই কোনদিনই তিনি বুঝতে পারেননি যে একজোড়া শুভ্র চোখ তাকে সারাক্ষণ উজ্জ্বল করে রেখেছে।

একদিন বড় অন্ধকার ঠেকল, যেদিন জরিনার মা মারা গেলেন। সেদিন তাঁর একটি অঙ্গচ্ছেদ হয়ে গেল যেন। সেদিন তিনি বিশেষ করে বুঝতে পারলেন কতখানি অবলম্বন তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এই রাজনৈতিক জীবনে জরিনার মায়ের কাছ থেকে। কাজ আর কাজ কাজের অবিরাম প্রবাহে হঠাৎ একটা বিষম ধাক্কা খেলেন সাদেক। কিন্তু সামলে নিতে জানেন তিনি। তাই ওপর থেকে কিছু বোঝা গেল না, সাদেক স্থিরতর হলেন, আরো নিমগ্ন–লক্ষ্য রইলো তেমনি অবিচল।

রোকসানা এসেছে তার জীবনে অনেক পরে, দীর্ঘ চার বৎসর একক জীবন যাপনের পরে। রোকসানা ইউনির্ভাসিটিতে পড়েছে। রোকসানা যে ধরনের মহিলা সেকালে তাকে বলা হতো স্বাধীন জেনানা। জরিনার মা পড়তে পারতেন কাগজের মোটা হেডিংগুলো আর লিখতেন একটা বানান তিনবার ভেবে। জরিশার মা সাদেকের সমুখেও ভালো করে ঘোমটা না টেনে স্বস্তি পেতেন না। একটা তুলনামূলক বিচারে এলে, শাহ সাদেক আলী অনেকদিন ভেবেছেন, জরিনার মা তার অন্তর্লীন একটি সত্ত্বা, আর রোকসানা তার শুধু স্ত্রী, দ্বিতীয় স্ত্রী। তাই রোকসানা যে মানুষকে পাবে বলে আশা করেছিল, সে মানুষকে কোনদিনই পায়নি। কিন্তু এ অভিযোগও সে কোনোদিন করতে পারবে না যে সাদেক তাকে ভালোবাসেননি। মনে আছে বিয়ের পরদিন রোকসানা স্বামীকে তুমি সম্বোধনে কথা বলেছিল। সাদেক তখনি কিছু বলেননি। বলেছেন খাবার টেবিলে। তুমি আমার স্ত্রী, তোমার আমার দূরত্ব থাকবে না। শুধু একটা তুমি দিয়ে যদি কাছাকাছি হতে পারি তাহলে মনে হয় বিশ্ব সংসারে অনেক সমস্যাই এরপরে আর থাকছে না।

এ কী কথা বলার ধরন! কোনো উত্তাপ নেই, নেই রুক্ষতাও বরং যে হাসি তার ঠোঁটে তখন ফুটে উঠেছিল তার চেয়ে স্নিগ্ধ কিছু সারা জীবনে রোকসানা জানে নি। অথচ গোঁড়ামির অপবাদও কেউ তাঁকে কোনদিন দিতে পারবে না। মেয়েরা তাকে তুমি বলে। বড়ো মেয়েকে বেশি দূর পড়াতে পারেননি। জরিনার বেলায় সেটা দ্বিগুণ হচ্ছে। জরিনাকে সাদেক পড়িয়েছেন ইংরেজি মাধ্যমে ইংরেজি স্কুলে। শাহ সাদেক আলীকে বার থেকে দেখে এটা অনুমান করা শক্ত। রোকসানারও একেক সময় অবাক লাগে মানুষটার এই দ্বৈত চেহারা দেখে। বিশেষ করে যখন তার মনে পড়ে, সাদেক নিজে অনেক সংস্কার মনে প্রাণে মেনেও, সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য, সে সংস্কারকে জরুরি করে তোলেননি। আসলে যা রোকসানাও বুঝতে পারেনি, প্রগতিকে অন্য অর্থে নিয়েছেন তিনি। নিজে ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারেন না। তাই বলে ভাঙ্গতে যারা পারবে তাদের তিনি বাধা দেবেন কেন?

আর এ থেকেই স্পষ্ট হয়, কী করে তিনি সবাইকে, প্রকট না করেও, নিজের আয়ত্ত্বে রেখেছেন আজীবন। তিনি যে কর্তৃত্ব করেন তা নয়, কিন্তু তাঁর কর্তৃত্ব না হলে চলে না। তার ইচ্ছেই শেষ ইচ্ছে, এ কথা তিনি কোনদিনই বলেননি, কিন্তু তাঁর ইচ্ছেই শেষ অবধি চিরকাল টিকে এসেছে অনায়াসে।

তাই কখনো কখনো তাকে পাহাড়ের মত অনড় আর ভারী মনে হয়েছে রোকসানার। মনে হয়েছে, দূর থেকেই ভালো, কাছে গেলে শিউরে উঠতে হবে তার বন্ধুরতা দেখে। অথচ আলীজাহ্‌, সাদেকেরই আপন ছোটভাই, সে কতো আপন মনে হয় তার। মনে হয়, এই একটা মানুষ যাকে শাসন করা যার, যে উদ্ধত ঋজু, কিন্তু নমনীয়। ভাইয়ে ভাইয়ে এত তফাৎ খোদা কেন যে করেছেন তা বুঝতে পারে না রোকসানা। আলীজাহ্‌কে রোকসানা দেখেছে কম। কেননা সে এ পরিবারে আসার আগে থেকেই আলীজাহ্ তার পেশার তাগিদে প্রায় ঘর ছাড়া।

আলীজাহ্‌ সাদেকের চেয়ে অন্তত কুড়ি বছর কী তারো বেশি ছোট হবে। পেশাটাও সাদেকের চেয়ে অনেক দূর পারের, একেবারেই ভিন জাতের, গোটা পরিবারের ধারা থেকে আলাদা। আলীজাহ্ চিত্রনাট্য লেখে। তার স্বপ্ন, একদিন সে চিত্রপরিচালক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজো সে একটা বড়ো রকমের সুযোগ পেল না। অন্য কেউ হলে যেখানে হাল ছেড়ে দিতো, সেখান থেকেই আলীজাহ্ যেন হালের মুঠি আরো শক্ত করে ধরেছে। আলীজাহ্ সময় পেলেই লাহোর থেকে আসে, আর আসে টাকার প্রয়োজনে সাদেকের কাছে। আর যে কদিনই সে থাকে বেশির ভাগ কাটে তার জরিনার সঙ্গে। রোকসানা এ পরিবারে আলীজাকেই সবচেয়ে দেখেছে কম। অথচ স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো একটা অভিযোগ গড়ে উঠলেই একটা মন কখন যেন নিজের অজান্তেই আলীজাহ্‌ সঙ্গে তার তুলনা করতে বসে যায়।

.

শাহ্ সাদেক আলী স্টাডিতে আরাম চেয়ারে বসে হাতলে প্যাড রেখে দ্রুত লিখে চলেছেন তার বিবৃতি। হঠাৎ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন রোকসানা ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সাদেক চোখ নাবিয়ে আনলেন প্যাডের ওপর। দুটো শব্দ লিখলেন। তারপর কলম মুড়ে, কী ভেবে বললেন, দোরপর্দার রং ইচ্ছে করলেই বদলানো যায়। কিন্তু বাড়ি একবার তৈরি হলে বদলানো অসম্ভব। বাড়িটা কিন্তু তোমার কথামতই হয়েছে।

রোকসানা হাসলো। বলল, তা হয়েছে। এখন মানে মানে ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে দিতে পারলেই বাঁচি।

রোকসানার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল নিজের একটা বাড়ি হবে। আজ সে ইচ্ছে তার পূর্ণ হতে চলেছে।

সাদেক তার হাসিমাখা মুখের দিকে সঁচালো–কৌতুক চোখ করে বললেন, তা তুমি বাঁচো বৈকি! আমিও জিরোন পাই। রোজ রোজ তোমার অনুযোগ আর আমাকে শুনতে হবে না। শেষ কথাটি সাদেকের অত্যুক্তি। অত্যুক্তি এই কারণে যে রোকসানা কোনদিন অনুযোগ করেনি তার কাছে। অভিযোগ হয়ত ছিল, জানিয়েছে, কিন্তু অনুযোগ বলতে যা বোঝায় তা কখনোই নয়। এই যেমন, বাদলার দিনে বাথরুমে যেতে গিয়ে খানিকটা বৃষ্টিতে ভিজলেন সাদেক, কেননা শোবার ঘর থেকে বাথরুমে যেতে হলে উঠোন পেরুতে হয়, ফিরে যখন এলেন, তখন হয়ত বলেছিলেন, তোয়ালে দাও তো মাথাটা মুছে ফেলি। সেই তখন রোকসানা বললেও বলে থাকতে পারে–হতো নিজের বাড়ি, শোবার ঘরের সঙ্গেই থাকতো বাথরুম। ভাড়া দেবে বলেই কি লোকে এত বিচ্ছিরি করে বাড়ি তোলে! কিংবা খিড়কি দরোজা দিয়ে বেরুতে গেলে বারান্দা দিয়ে নেমেই পড়ে ডালিম গাছের নিচু ডালটা। সাবধানে না নামলে মাথায় লাগতে পারে। হয়ত জরিনার একদিন লাগলো। সেই নিয়েও কথাটা উঠিয়ে থাকতে পারে রোকসানা। কিন্তু অনুযোগ, কখনো নয়।

বরং যা করতে সে ঠিক সাহস পায়নি সেই কথাটাই যখন স্বামীর মুখ থেকে শুনল তখন মনে মনে গর্বিত হয়ে উঠল রোকসানা। একটা বড় দায়িত্ব কৃতিত্বের সংগে পালন করার তৃপ্তিতে তার মন মুখর হয়ে উঠলো।

আরেকটা চেয়ারে, যেটা এতক্ষণ খালি ছিল এবং যেখানে একটা মাছি কয়েকবার বসবার চেষ্টা করছিল, রোকসানা বসলো। বলল, লেখা বন্ধ করতে কে বলল আপনাকে?

কই? শেষ হয়ে গেছে। বিকেলে চা খেয়ে একবার পড়ে নেবো, ব্যাস।

রোকসানা বলল, আবার কীসের প্রতিবাদ?

প্রতিবাদ নয়–প্রশ্রয়ের কৌতুক সাদেকের চোখে–বিবৃতি বলতে তোমরা শুধু প্রতিবাদই বোঝ। আর তাছাড়া মতায় থাকলে না হয় প্রতিবাদের প্রশ্ন উঠতো। ক্ষমতা নেই, গদি নেই, আমার আবার প্রতিবাদ কীসের? আমরা সবাই আবার গদি না থাকলে কথার কানাকড়ি দাম দিই না কিনা।

কিন্তু পরিহাসটুকু ধরতে পারল না রোকসানা। বুঝতে পারার মতো ক্ষমতা নেই একথা বললে ভুল হবে। আসলে আগ্রহ নেই।

একেক সময়ে সাদেকের মনে হয়েছে, যেহেতু জরিনার মা তার কর্মজীবনের জন্য অমন অবশ্যম্ভাবী ছিলেন তাই হয়ত রোকসানা বিপরীত বিন্দুতে তার নিজের স্থান বেছে নিয়েছে। আর এ ধারণার জন্যই খুব কম, প্রায় একেবারেই না, তিনি রোকসানার সঙ্গে তার কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করতেন।

রোকসানার নিস্পৃহতা চোখ এড়ালো না সাদেকের। আরো স্পষ্ট হলো রোকসানা যখন ভিন্ন প্রসঙ্গ পাড়লো।

ইস, যা বিষ্টি নেবেছিল। ভাবলাম রাত অবধি চলবে বুঝি। শীতের মুখে কিন্তু হঠাৎ অমন একদিন পাগলা বিষ্টি নাবে।

হ্যাঁ, আমারো তাই ভাবনা হচ্ছিল। ভালো কথা, আলীজাহ্ সন্ধ্যের প্লেনে আসছে।

কই, শুনিনি তো। তাই নাকি?

চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো রোকসানা।

এই তো খানিক আগে তার এলো। বলতে মনে নেই।

তা বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ যে?

হঠাৎ আবার কোথায়? ও তো ওমনিই। টাকার দরকার পড়েছে হয়ত।

তা–ই হবে। হাসলেন শাহ সাদেক আলী। ওর তো ধারণা আমার বিরাট টাকা, হাত পাতলেই হলো। তা যদ্দিন থাকে নিক না।

শেষের কথাটা ইচ্ছে করেই বললেন সাদেক। কেননা তিনি জানেন, আলীজাহ্ যে লাহোর থেকে এসে এমনি করে হাত পাতে তা রোকসানার পছন্দ নয়। কোনদিন রোকসানার মুখোমুখি আলীজাহ্ টাকা নেয়নি, সাদেক দেননি–তবু রোকসানা জানে। আর জানে বলেই তিনি তা লুকোন নি কোনদিন।

আর লুকোবেনই বা কেন? আলীজাহ্‌কে তিনি ভালোবাসেন শুধু সহোদরের মতো নয়, সন্তানের মতোও। দুজনের বয়সের দূরত্ব কুড়ি বছরের মতো হলেও মনের দিক থেকে বুঝি আলীজাহ্‌ সাদেকের সবচেয়ে কাছাকাছি।

মনে আছে কলকাতার কথা। সাদেক তখন প্র্যাকটিস করছেন, রাজনীতি করছেন আর আলীজাহ্ কলেজে নতুন উঠেছে। সাদেক চেয়েছিলেন আলীজাহ্‌ ডাক্তার হবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে যার আবদার তিনি শুনে এসেছেন উদার জনকের মতো, এ ক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?

আলীজাহ্ বললেন, আর্টস পড়ব লেখক হবো। সাদেক বললেন, বেশ তো। লেখকরাও মানুষের ডাক্তার বৈকি। আমার ইচ্ছাটা কিন্তু একদিক থেকে অপূর্ণ রইলো না।

শেষ অবধি পড়াটাও ঠিক মতো হয়নি আলীজাহ্‌। তবু সাদেক কিছু বলেননি। বি.এ. পরীক্ষার রাতে দরোজায় খিল তুলে আলীজাহ্ হ্যাঁমলেটের পাঠ রিহার্সেল করছিল–পরদিন বেতারে অভিনয় করতে হবে। আড়াল থেকে চুপ করে দেখে নিঃশব্দে সরে এসেছেন সাদেক। কেবল বুঝতে পারেননি, লেখক হবার আকাক্ষা যার সে কেন অভিনয় নিয়ে এমন করে, এমনকি এই পরীক্ষার রাতেও মাথা ঘামাবে? বরং তিনি ক্ষুণ্ণই হয়েছিলেন মনে মনে। শাহ সাদেক আলী একটি মাত্র জীবনকালে একটি লক্ষ্যেরই সমর্থক, সে লক্ষ্যে যা কিছুই হোক না কেন। কই, সুযোগ তো এসেছিল অনেক, কিন্তু তিনি দশের উন্নতি আর নিজের উন্নতি একসঙ্গে কখনোই প্রার্থনা করেননি।

আলীজাহ্‌ বি.এ পরীক্ষা দেয়া হলো না, অভিনেতা হতে পারল না, লেখক হতে পারল না। হতে পারল না নয়; কী যে হলো তার, কিছুইতে মনের স্থিরতা এলো না অনেকদিন; কোথা থেকে অকারণে যে একটা বাতাস এলো– বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো ভাবনা, আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। আকাক্ষা। এমনি করে তিন বছর। এমন কি বাসাতেও আলীজাহ্‌ নিয়মিত ফিরত না খেতে ঘুমোত না। তবু সাদেক কিছু বলেননি; আলীজাহ্‌ প্রতিভায় তার অগাধ বিশ্বাসকে কোনদিন এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতে দেননি।

অবশেষে একদিন নিতান্তই আকস্মিকভাবে আলীজাহ্‌ তার লক্ষ্য বেছে নিল চলচ্চিত্র। বলতে গেলে গোটা পরিবারে এ এমন একটা বিদ্রোহী সংকল্প যা প্রথমে সাদেককেও চিন্তাকুল করে তুলেছিল। কিন্তু মুখে তিনি কখনোই তা জানতে দেননি। বরং বম্বেতে প্রথম কাজ যখন সে পেল তখন সাদেকই খুশি হয়েছিলেন সকলের চেয়ে বেশি। আর সেই চরম খুশির প্রকাশটা ছিল, আলীজাহ্ যখন বম্বে থেকে গ্রেট পেনিনসুলারে এসে সকালে নাবলো হাওড়ায়, সাদেক নিজে তাকে গাড়ি করে আনতে গিয়েছিলেন।

তবু প্রতিষ্ঠা এলো না আলীজাহ্‌। দেশ বিভাগের পর গেল লাহোরে। সেখানেও না। অর্থের জন্য বেনামে চিত্রনাট্য লিখতে পারে আলীজাহ্ কেননা অর্থের অনেক দোষের মধ্যে একটা বড় গুণ, ওটা বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। শস্তা ছবির শিরোনামায় আলীজাহ্‌ নিজ নাম কী করে যুক্ত হতে দেবে? শিল্পমাধ্যম যদি শিল্পকেই অস্বীকার করলো, তাহলে এখানে আলীজাহ্ কেন? তাই আজ অবধি রচয়িতা–পরিচালক হবার, ভালো ছবি করার ইচ্ছে তার রয়ে গেছে অপূর্ণ।

আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, এটা সব চেয়ে ভালো করে বোঝেন শাহ সাদেক আলী। তাই তার স্নেহের উৎস আলীজাহ্‌ জন্যে আজো নির্মল, স্রোতস্বিনী।

পক্ষান্তরে এটা রোকসানার একটা গোপন মর্মপীড়া। কিন্তু কোন কালেই সাহস করে উচ্চকণ্ঠে কিছু বলা হয়নি। এবং আর দশটা কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ যে, তাতে সাদেক আহত হবেন।

সাদেক বললেন, চা দেবে না?

রোকসানা মুখে বলল, দিচ্ছি।

কিন্তু মনটা পড়ে রইলো আলীজাহ্‌ দিকে। আলীজাহ্ আসছে। এবারো সেই পুরনো ব্যর্থতার গল্প অমিত উপহাস মেশানো কণ্ঠে–দুদিন কী তিনদিন। তারপর সে চলে যাবে। না, এবার আলীজাহ্‌কে এত তাড়াতাড়ি যেতে দেবে না রোকসানা। নতুন বাড়ি হয়েছে। তাকে দেখাতে নিয়ে যাবে রোকসানা। অনেক পরামর্শ আছে সাজানো গোছানোর ব্যাপারে। জরিনার সঙ্গে হয়ত এ নিয়ে কথা বলা যেত, কিন্তু যখনি বলতে গেছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে তার, জরিনা হেসে উঠবে–যে হাসি গিয়ে বিধবে তার মর্মমূলে। মনে হয়েছে, জরিনা সংসারের এইসব খুঁটিনাটিকে উপহাস করে নিজ সত্তাকে নিশানের মত উঁচু আর ভাবনাহীন করে রাখতে পারে। না, জরিন থাক তার নিজেকে নিয়ে; আলীজাহ্‌কে তার এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আসছে, ভালোই হলো।

আর হঠাৎ মনে পড়ল রোকসানার–আলীজাহ্ কি খুশিটাই না হবে যখন সে দেখবে তার নিজের কামরা। দোতলার উত্তর–পূর্ব দিকের কামরাটা নির্দিষ্ট হয়েছে আলীজাহ্‌ জন্যে। যদিও নকশায় কামরাটা দাগ দিয়ে রেখেছে জরিনা, তবু সাজিয়ে তোলা তো তারই হাতে। আলীজাহ্‌কে এবার রোকসানা সত্যি সত্যি অবাক করে দেবে। বলবে, তুমি তো বাইরে বাইরে থাক, বউ নিয়ে এসো, সে এখানে থাকবে, তুমি তোমার মতো সিনেমা করোগে হিলি দিল্লি।

মনটা আস্তে আস্তে প্রীত হয়ে এলো রোকসানার। কেউ জানলো না এ কথা, এত একান্তে। শুধু চেয়ারের বাজুতে চোখ–বোজা বেড়ালের বাচ্চার মত বা হাত তার শীতল হয়ে পড়ে রইলো।

হঠাৎ হাতটা ছিটকে পড়লো কোলের ওপর। জরিনার কামরা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা সংগীতের আচমকা ধাক্কায় রোকসানার স্নায়ুগুলো যেন আর্তনাদ করে উঠলো।

জরিনা তার রেডিওগ্রামে আবার সেই রেকর্ড চাপিয়েছে যার শুরুতে ট্রাম্পেটের বিকট কয়েকটা খোঁচা। বেশ তো ছিল এতক্ষণ মেয়েটা ঘুমিয়ে। হঠাৎ এই বিশ্রী আওয়াজটাকে জীবন্ত করে তুলতে বলল কে তাকে? আর কী চড়া ভল্ম, যেন সব কিছু ডুবিয়ে ছাপিয়ে দিতে চায়, যেন বাড়িতে একটা ছোটখাটো রেডিওর দোকান খোলা হয়েছে।

সুর আসছে। চপল, বহুমুখী, তীব্র, ধাতব।

রোকসানা উঠে দাঁড়াল। এত জোরে না বাজালেই কি নয়?

হয়ত কানে হাত দিত রোকসানা, কিন্তু দিল না। সাদেক বললেন, কিছুটা নিরুত্তাপ কণ্ঠে, বোসো তুমি। না, বসবে কেন? আমাদের চা দিতে বলো। জরিনাও খাবে। আমি ওকে দেখছি।

.

আস্তে আস্তে জরিনা মাথা রাখলো বালিশে। দুহাত চুলের পেছনে রেখে, দুপা সমুখে ছড়িয়ে, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাড়ি উঠে এসেছে শুভ্ররক্তিম, চিতা বাঘের বুকের মত জানু অবধি। বৃষ্টি নেমেছিল দুপুরে। একটু ঠাণ্ডা করছে বৃষ্টি–শেষের বাতাসে। তা করুক।

আলীচাচা বলেন, হৃদয়কে যা স্পর্শ করে একমাত্র তা–ই সত্য।

একটু আগেই কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছিল জরিনা। একটি সুন্দর সনেট। কিন্তু হলো না। বদলে আলীচাচার মুখ ভেন্টিলেটর থেকে উপুড় হয়ে পড়া আলোর মতো তার দুচোখ জুড়ে রইলো। তার সমস্ত কবিতা যেন তার অজান্তেই একটি মাত্র পাঠকের জন্য গড়ে ওঠে; অক্ষর হয়, হয়ে এসেছে, এই এতকাল, তার পনেরো বছর বয়স থেকে, যেদিন থেকে সে কবিতা লিখতে শুরু করে–আলী চাচার জন্যে।

ঠিক এমনি মুহূর্তগুলোয় আর কাউকে তার মনে পড়ে না।

আর মাকে তার মনে পড়ে, যে–মার কথা মনে করলে কথা কয়ে ওঠেন, যে মার মুখ শুধু কাঠ পুতুলের মতো নয়, যে মা মাথার নীল রিবন বেঁধে দেন মনে করলেই সেই মাকে মনে পড়ে।

আলীচাচার নাম কবে যে পর্দায় দেখতে পাবে জরিনা! শহরের সবচেয়ে অভিজাত শো হাউস; ঠিক দুপুর রোদে কিশোরী মুখের মত সবুজ তেতে ওঠা, লম্বা কাঁচের প্যানেল আর মানুষের পোশাকের ভিড়–একটা ছবির মতো তার চোখের সমুখে ভেসে ওঠে। ভেতরে আলো নিবলো মিষ্টি ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে। আর অন্ধকার। আর সুবাস। চোখ সয়ে এলে পর মানুষ। ততক্ষণে পর্দায় ভেসে উঠেছে রচনা ও পরিচালনা–আলীজাহ্। তারপর নিবে যাওয়ার আগে, আসন্ন ছবির শুরুতে, আগুনের মতো একবার জ্বলে উঠে–সেই নাম মিলিয়ে গেল।

আলীচাচা বলেছিলেন, আমার ছবির শুরুতে, একেবারে প্রথমে, বইয়ের নামেরও আগে কবিতার একটা লাইন ভেসে উঠবে পর্দায়। কার কবিতা জানিস?

কার?

তোর।

আমার? আমার!

বিস্ময়ে প্রায় আর্তনাদের মত শুনিয়েছিল জরিনার কণ্ঠস্বর।

হ্যাঁ, তোর মানে, সেবার আমাকে কতগুলো কবিতা দিয়েছিলি ইংরেজিতে লেখা, হারে, ইংরেজিতে লিখিস কেন? বাংলায় লিখতে পারিস না? বাংলায় লিখবি।

জরিনা যেন নিবে যায়। বলে, তাই তো লিখি। শুধু কখনও ইংরেজিতে। তোমরা মনে কর আমি বুঝি বাংলায় লিখতে জানি না।

তা কেন? তোর সেই ছোটবেলায় লেখা বিচ্ছিরি রকমের অদ্ভুত চিঠিগুলোর কথা আমার মনে আছে। আমার চেয়েও ভালো বাংলা লিখিস তুই সেই তখন থেকেই।

জরিনা একটু বিব্রত হয় যেন চিঠির প্রসঙ্গে। চটপট মুখ সুঁচালো করে বলে, আমার কোন কবিতা নিয়েছ তাই বলো।

আলীজাহ্ তার সুগন্ধ সিগারেটে টান দেয়।

তোর সেই কবিতা–A Torso I am এর প্রথম দুটো লাইন।

আমার মনে নেই।

আমার আছে।

আলীচাচা তখন তর্জনী তুলে শূন্যে একটা সরল রেখা এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি টানতে টানতে বলেছিলেন,

ফেড ইন করছে–দ্যাখ–

Beneath the black sun
We shall rise in a flame

তার কণ্ঠ এত গভীর আর আবৃত্তি এত সুন্দর যে জরিনার মনে হয়েছিল এ দুটো লাইন সে কোনকালে লেখেনি। যেন পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে এক যথার্থ কবি কোন এক মঙ্গলমুহূর্তে উচ্চারণ করেছিল এই দুটো লাইন, আব তা জীবনকাল, জীবনকে অতিক্রম করে অনন্তকালের মত শুদ্ধ এবং সত্য হয়ে আছে আলীজাহ্‌ উজ্জ্বল আত্মায়।

আলীজাহ্‌ আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে জরিনার চোখে তৈলচিত্রের মতো একটা ছবির জন্ম নিয়েছিল সেদিন। বিশাল কোবাল্ট নীলের দিগন্তজোড়া ক্যানভাসে কার এক অদৃশ্য আঙ্গুল যেন দীর্ঘ অথচ সরু সোনালি তরঙ্গ এঁকে গেল। তখন তার বয়স মোল…Beneath The Black Sun.. কী সে ভেবেছিল সেই ষোল বছর বয়সে : এখন, এই মুহূর্তেও সেই ভাবনা তার ভাল লাগলো একটা ব্যথার মত… We Shall Rise… সে আর আলীচাচা…সোনালি তরঙ্গ…In A Flame… যদি তা সত্যি হতো।

আলীচাচা একদিন ছবি করবেনই।

.

কিন্তু আজ এই বৃষ্টি থামবার পর কোন কবিতা লিখতে চেয়েছিল জরিনা? কী ভাবছিল সে? না, না, না। নাম—অমর নাম পৃথিবীতে একটিও নেই– যে নাম জন্ম নিয়েছে জ্বলন্ত, দীর্ঘ, রক্তিম, আদিম অগ্নিশিখা থেকে। নেই, নেই, নেই। পনেরো বছর বয়সে পুরো হাক্সলি। জরিনা জানে, খুব ভালো করেই জানে, পনেরো বছর বয়সে সে পড়েছে অডাস হাক্সলি রূপকথার সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে শেষ করেছে এমন মেয়ে গোটা দেশে আর একটিও জন্মায়নি। আর এখন তার বিষ–ফল ভুগতে হচ্ছে। কিন্তু হাক্সলি তাকে পড়তে বলেছিল কে?

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নূরু আপার বাসায় একদিন সে একটা ইংরেজি পত্রিকা দেখেছিল। নূরু আপার স্বামী হামিদুর রহমান ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। সেই পত্রিকায় জরিনা দেখেছিল হাক্সলির ছবি। থ্রি কোয়ার্টার প্রোফাইল। চশমার একটা তেকোণা ছায়া, প্রায় দাঁড়া ছড়ানো মাকড়শার মতো, পড়েছে চোয়ালের হাড়ে। অদ্ভুত মনে হয়েছিল মানুষটাকে জরিনার। মনে হয়েছিল, কেন মনে হয়েছিল এই হাস্যকর কথাটি তা সে জানে না, লোকটা কী খেয়ে বেঁচে থাকে? কোন দর্জির দোকান থেকে কাপড় কাটিয়ে থাকে এই লেখক? আর তার বিছানার চাঁদরের রঙ?

জরিনা জানে, জরিনা অনেকদিন দেখছে, মাঝে মাঝে যাদের নিয়ে এইসব কথা মনে হয়, যা অন্তরঙ্গ, অথচ মুখে বললে শোনাবে হাস্যকর, সেই মানুষগুলো তার জীবনে কোনো না কোনো নতুন মানে যোগ করে দিয়েছে।

সেদিনই জরিনা হামিদ দুলাভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম নিয়ে এসেছিল হাক্সলির বই। বেতের গোল চেয়ারে দুপা বুকের কাছে ছড়িয়ে তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে মেতে থেকেছে এই নতুন লেখকের বই নিয়ে, যার চোয়ালের হাড়ে একটা ছবিতে ছায়া ফেলেছিল দাঁড়া ছড়ানো মাকড়শা।

সেই হাক্সলি, ঠিক মনে পড়ছে না, কোথায় যেন বলেছিলেন, আজো মনে পড়ে জরিনার আমাদের এই পৃথিবী অন্য কোনো গ্রহের নরক।

কথাটা ভালো লেগেছিল তার। যেমন করে তার ভালো লাগে আলীজাহ্‌ কথা। মনে হয়েছিল তার নিজেরই ভাবনায় এতকাল এই কথাটা জন্ম নিয়ে প্রচ্ছন্ন থেকে প্রতীক্ষা করছিল মুক্তির জন্যে। এত সহজ, এত গভীর, এত চেনা। এই পৃথিবী, এই সবুজ পৃথিবী, এই আলোয় জ্বলা আঁধারে ডোবা পৃথিবী অন্য কোনো গ্রহের নরক। তাহলে স্বর্গ কোন গ্রহ? সেখানে কি লেখক নেই একজনও?–হাক্সলির মতো?–যে এমনি চেনা গলায় বলতে পারে এই গ্রহ অন্য কোনো গ্রহের স্বর্গ?

তারপর অনেকদিন পরে, যখন তার অনেকদিন হলো পড়া হয়ে গেছে হাক্সলি, হাক্সলির ওপরে হঠাৎ বিতৃষ্ণা জন্মে জরিনার।

আলীচাচা বলেছেন—সবার চেয়ে বড় কথা, হৃদয়কে যা স্পর্শ করে একমাত্র তা–ই সত্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *