অনীকের জন্য ভালোবাসা – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
১. মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ে
আমার নাম অনীক। স্কুলে আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ডাকে শুধু নিক। লন্ডনের সাউথগেট কমিউনিটি স্কুলের সেভেন্থ গ্রেডে পড়ি। আমার বয়স ষোল, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, ওজন একশ বেয়াল্লিশ পাউন্ড। গায়ের রং বাদামি, চুল কালো, চোখের রঙও কালো। আমার জন্ম বাংলাদেশের সিলেটে, এখন বৃটিশ নাগরিক। আমার মা পনেরো বছর ধরে লন্ডনে আছে, বিবিসি-তে চাকরি করে।
বাবার কথা আমার মনে পড়ে না। আমার যখন বয়স এক বছর তখন মার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভেঙে যায়। মা আমাকে নিয়ে লন্ডনে চলে আসে। এত বছর ধরে লন্ডনে থাকলেও মা নিজের দেশকে ভুলতে পারেনি। তার ঘরে তিন আলমারি বাংলা বই, কয়েকশ বাংলা গানের এল পি, অডিও ক্যাসেটের কোনো হিসেব নেই। টেলিভিশনে বাংলা ছবি দেখালে মা ওটা রেকর্ড করে রাখে, আর ছুটির দিনগুলোতে ঘুরে ফিরে দেখে। মা আমাকে ছোটবেলা থেকে বাংলা শিখিয়েছে যত্ন করে। আমার বয়সী যে কোনো বাঙালি ছেলের চেয়ে আমি ভালো বাংলা লিখতে পারি। স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আমি জার্মান নিয়েছি। বাংলা এত ভালো জানলেও বলার সময় মার মতো কিংবা দিব্যেন্দুর মতো তাড়াতাড়ি বলতে পারি না।
দিব্যেন্দু মার সঙ্গে বিবিসিতে কাজ করে। দুবছর আগে মা ওকে বিয়ে করেছে। বাইরের লোকজনের সামনে দিব্যেন্দুকে বাবা বলি, ঘরে নাম ধরে ডাকি। বয়স চল্লিশ, মার চেয়ে দুবছরের বড়। তবে স্বাস্থ্য ভালো বলে তিরিশের বেশি মনে হয় না। আমার চেয়ে দিব্যেন্দু অনেক হ্যান্ডসাম। ফর্শা তো বটেই, চেহারাও খুব শার্প, অনেকটা টম ক্রুজের মতো। দিব্যেন্দু যখন মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো তখন ওদের কমন বন্ধুরা খুব অবাক হয়েছিল। যে অর্থে মেয়েদের সুন্দরী বলা হয় মা সে অর্থে সুন্দরী নয়। গায়ের রং আমার চেয়ে সামান্য ফর্শা, চশমা পরা গম্ভীর চেহারায় মাকে তার বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক মনে হয়।
বিয়ের অনেক আগে থেকেই দিব্যেন্দু আমাদের বাড়িতে আসতো। ছোটবেলায় সে আমাকে তার নাম ধরে ডাকতে শিখিয়েছে। বলেছে আমার একজন ভালো বন্ধু সে। তার মতো চমৎকার মনের মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার যখন যা দরকার বলার আগেই কীভাবে সে টের পেতো আমি জানি না। ঠিক নিয়ে আসতো। মজার কোনো ইউনিভার্সাল ছবি রিলিজ হলে প্রথম দিনই তিনখানা টিকেট কেটে হাজির হবে । মা প্রথম প্রথম আপত্তি করতো। শেষে এটা রুটিন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।
বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার আগে দিব্যেন্দু কথা বলেছিলো আমার সঙ্গে। রোজকার মতো স্কুল থেকে ফিরে আমি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে টেলিভিশনের সামনে খেতে বসবো, এমন সময় ডোরবেল বাজলো। মা অফিসে যায় সকালে, ফেরে রাত সাতটার দিকে। আমি দরজা খুলে দিব্যেন্দুকে দেখে অবাক হলাম। কারণ মা না থাকলে সে আসে না। বললাম, মা তো অফিসে!
জানি। আমি অফিস থেকেই আসছি। দিব্যেন্দু সামান্য হেসে বললো, আজ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। কী করছো তুমি?
কিছু না। আমি বললাম, খাওয়া নিয়ে বসতে যাচ্ছিলাম।
তোমাকে নিয়ে যদি বাইরে কোথাও খাই তুমি কি আপত্তি করবে?
বাইরে খেতে আমি খুব ভালোবাসি। বললাম, আমি খুশি হবো।
দিব্যেন্দু আমাকে নিয়ে নিরিবিলি এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে এলো। আমি যা পছন্দ করি সেসব খাবারের অর্ডার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিলো। আমি বললাম, আমার সঙ্গে কী কথা বলবে দিব্যেন্দু?।
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দিব্যেন্দু বললো, আমাকে তোমার কেমন মনে হয় অনীক?
কেমন আবার মনে হবে! খুবই ভালো মনে হয়।
তুমি এখন বড় হয়েছে। কখনও কি লক্ষ্য করেছে তোমার মা কি রকম লোননি?
মাঝে মাঝে মনে হয় লোননি। তবে মা তো কাজের ভেতর ডুবে থাকতে বেশি ভালোবাসে।
অন্য কারও ভালোবাসা পায়নি বলে কাজ ভালোবাসে।
কেন পাবে না? দিব্যেন্দুর কথায় মনঃক্ষুণ্ণ হলাম–মাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
তুমি তো ছেলে। নিশ্চয় তুমি ভালোবাসবে। আরও ভালোবাসা দরকার তোমার মার।
আমি ছাড়া মাকে আর কে ভালোবাসতে যাবে?
আমি তোমার মাকে ভালোবাসি।
তা হলে আরও ভালোবাসার দরকার বলছো কেন?
আমি তোমার মাকে বিয়ে করতে চাই। শান্ত গলায় কথাগুলো বললো দিব্যেন্দু।
আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম। বিয়ে মানে মা আর আমার মাঝখানে আরেকজন আসবে। মা কি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেবে? ভাবতে গিয়ে ভয় হলো। বললাম, মাকে কি বলেছো একথা?
বলেছি।
মা কী বললো?
বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। তুমি হ্যাঁ বললে ঠিক আছে। তুমি না বললে তোমার মাও না বলবে।
বিয়ের পর তোমরা কি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবে?
কক্ষনো না। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকবো। তুমি এখন যেরকম বন্ধু আছো, আরও কাছের বন্ধু হবে।
আমাদের কি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে?
তুমি কী চাও?
আমি চাই মাকে বিয়ে করে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে।
আমার কথা শুনে দিব্যেন্দু গলা খুলে হাসলো–তুমি যা চাও তাই হবে।
দিব্যেন্দুকে আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম–তুমি কি মনে করো মা এতে সুখী হবে?
দিব্যেন্দু গম্ভীর হয়ে বললো, আমি জানি হবে।
ঠিক আছে দিব্যেন্দু। একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, মাকে তুমি বিয়ে করতে পারো। আই উইশ ইউ গুড লাক।
থ্যাঙ্ক ইউ অনীক। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে দিব্যেন্দু মৃদু হেসে বললো, আমার ভয় হচ্ছিলো–তুমি যদি রাজি না হও!
দিব্যেন্দুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললাম, মাকে আমি সুখী দেখতে চাই।
দিব্যেন্দু শান্ত গলায় বললো, আমরা সবাই সুখী হবো অনীক।
মার বিয়েতে কোনো হৈচৈ হলো না। বিবিসি থেকে মা আর দিব্যেন্দুর কজন কমন ফ্রেন্ড এসেছিলো। আমার লেবানিয় বান্ধবী শীলা এসেছিলো। মার বিয়ের কথা শুনার পর থেকে ও আসার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলো।
মা বলে দিয়েছিলো আঠারো বছরের আগে আমাকে হার্ড ডিংক্স দেয়া হবে না। মার বিয়ের রাতে দিব্যেন্দু ডিনারের পর শব্দ করে শ্যাম্পেনের বোতল খুললো। বোতলের মুখ দিয়ে সাদা ফেনার ফোয়ারা ছুটলো। সবাই শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে দিব্যেন্দুর দিকে এগিয়ে গেলো। শীলা আমার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। সবার গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিব্যেন্দু ছোট গ্লাস এনে আমার আর শীলার হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে মাকে বললো, আশা করি আজকের রাতের জন্য ওরা এক পাত্র পান করতে পারবে।
মা কোনো কথা না বলে মৃদু হাসলো। বিয়ের রাতে খুব হালকা বেগুনি রঙের একটা জামদানি পরেছিলো মা। শাড়ির ভেতর ধবধবে সাদা সুতোর নকশা। মাকে অনেক সুন্দরী মনে হচ্ছিলো। শীলাও বললো, তোমার মাকে দারুণ গ্রেসফুল লাগছে। মনেই হচ্ছে না তোমার মতো বড় একটা ছেলে আছে ওর। দিব্যেন্দুর এক বন্ধু মাকে আর আমাকে নিয়ে ওর সঙ্গে রসিকতা করলো এ্যাদ্দিন পরে বিয়ে করে তুই সবাইকে হারিয়ে দিয়েছিস। রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব শুধু নয়, রাজপুত্রের মতো একটা ছেলেও রেডিমেড পেয়ে গেলি। দিব্যেন্দুও হেসে জবাব দিলো মনে হচ্ছে হিংসায় তোদের বুক ফেটে যাচ্ছে। আই অ্যাম প্রাউড অব মাই সন। বলে দিব্যেন্দু আমার কপালে চুমো খেলো নিক শুধু আমার ছেলে নয়, আমরা দুজন চমৎকার বন্ধু।
শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দিব্যেন্দুর কথা শুনে মনে হলো আমার বয়স অনেক বেড়ে গেছে।
আমার অ্যালবামে বাবার একটা ছবি আছে। আমার বয়স তখন এক। মা বাবা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, আমি বাবার কোলে। ছবিটা সাদা কালো হলেও এত বছরেও নষ্ট হয়নি। ছবিতে মাকে যে রকম সুন্দর দেখাচ্ছিলো দিব্যেন্দুর সঙ্গে বিয়ের রাতে আরও সুন্দর মনে হচ্ছিলো। মনে হলো দিব্যেন্দু মিথ্যে বলেনি, মা সত্যি সুখী হয়েছে।
মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ের প্রথম বছরটা চমৎকার কাটলো। ওদের বিয়ে হয়েছিলো ডিসেম্বরে। এক বছর পর উইন্টার ভ্যাকেশনে আমরা ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। দিব্যেন্দুদের বাড়ি কলকাতায়।
সেবার খুব মজা হয়েছিলো কলকাতায়। আমরা দিব্যেন্দুদের বাড়িতে না উঠে গ্রেট ইস্টার্ন নামের একটা হোটেলে উঠেছিলাম। দিব্যেন্দুরা জয়েন্ট ফ্যামিলি। ওর বাবা, মা, বড় দুই ভাই, দুই কাকা আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ বড় পরিবার। সবাই ভবানীপুরের পুরোনো এক বাড়িতে একসঙ্গে থাকে। দিব্যেন্দু বলেছে ওদের পরিবার গোঁড়া। অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলো ওর বাবা। বাড়িতে ওর বাবা সবার বড়। তার কথা কেউ অমান্য করে না।
দিব্যেন্দুর মা অবশ্য বিয়ের পর ছেলেকে চিঠিতে লিখেছিলো–তোর যা ভালো। মনে হয় করবি। তুই সুখী হলে আমিও সুখী হবো। বৌমা আর দাদুভাইকে আমার আশীর্বাদ আর আদর দিস। দিব্যেন্দু ওর মার চিঠি আমাকে পড়তে দিয়েছিলো। একজন অচেনা মহিলা আমাকে দাদুভাই বলে চিঠিতে আদর পাঠিয়েছে পড়ে ভালোই লেগেছিলো। দিব্যেন্দুকে বলেছিলাম, তোমার মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। দিব্যেন্দু বলেছিলো, মা–ও বউ দেখতে চেয়েছে। আমরা সামনের উইন্টারে কলকাতা যাবো।
কলকাতা আসার আগে দিব্যেন্দুর মা লিখেছিলো–হুট করে বউ নিয়ে বাড়িতে এসে উঠিস না। তোর বাবাকে এখনও মানাতে পারিনি। তোরা বরং তোর বন্দনা মাসির বাড়িতে উঠিস। বন্দনাকে আমি বলেছি। তোরা ওর বাড়িতে উঠলে ও খুশি হবে।
প্লেনে উঠে দিব্যেন্দু বললো, মাসি-টাসি নয়, আমরা হোটেলে উঠবো।
দিব্যেন্দুর সিদ্ধান্ত জানতে পেরে মা আর আমি দুজনই খুশি হয়েছিলাম। অচেনা কারও বাড়িতে থাকতে আমি যে পছন্দ করি না একথা মা ভালোভাবেই জানে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলটাও বেশ ভালো। লন্ডনে এরকম চেহারার অনেক হোটেল দেখেছি। কলকাতা শহরটাও অনেকটা লন্ডনের মতোই। একটু বেশি পুরোনো আর নোংরা এই যা তফাত।
কলকাতায় দিব্যেন্দুর অনেক বন্ধু ছিলো। বিয়ের খবরও বন্ধুদের কাউকে জানায়নি সারপ্রাইজ দেবে বলে। হোটেলে ও একটা রিসেপশনে বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছিলো। সবাই মাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিবিসি যারা শোনে তারা মার নাম জানে। দিব্যেন্দুকে বিয়ে করার পর আমি হঠাৎ করেই যেন আবিষ্কার করলাম আমার মা দেখতে রীতিমতো সুন্দরী। বিয়ের আগে একটুও সাজতে দেখিনি মাকে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো বলে মনে হতো তেমন সুন্দরী নয়, বয়স্কও মনে হতো। বিয়ের পর মা চশমার ফ্রেম পাল্টিয়ে সরু গোল্ডেন ফ্রেম নিয়েছে, একটু মেকাপ নেয়াও শুরু করেছে–এতেই মার চেহারা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো। দিব্যেন্দুর বন্ধুর স্ত্রীরা সবাই ওকে বললো, চমৎকার বউ হয়েছে দিব্যেন্দু।
আমার সবচেয়ে মজা লেগেছিলো যখন ওরা আমাকে মার ভাই ভেবেছে। এক মহিলা বললো, এ বুঝি তোমার শালা, বোনের সঙ্গে চেহারায় অনেক মিল আছে। শুনে আমি আর দিব্যেন্দু হাসতে হাসতে বিষম খেলাম। মা তো লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলো। সবাই যখন আমার পরিচয় জানলো তখন ওদের একেক জনের চেহারা দেখার মতো হলো। এক মহিলার হাত থেকে প্লেট খসে পড়লো, আরেক জনের ড্রিংক্স আটকে গেলো গলায়, সবার চোখ গোল হলো, মুখ হা হয়ে গেলো আর আমরা হাসি চাপতেই ব্যস্ত। পরে এক মহিলা অসভ্যের মতো মার বয়স জানতে চেয়েছিলো।
কলকাতায় যাওয়ার পরদিনই দিব্যেন্দুর মা এসেছিলো হোটেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মা ওর পা ধরে সালাম করতেই ভদ্রমহিলা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর নিজের গলার হার খুলে মার গলায় পরিয়ে দিলো। মা আমাকে ইশারা করলো ওকে পা ধরে সালাম করার জন্য। এ কাজটা আমি খুবই অপছন্দ করি, তবু মার ইচ্ছায় করতে হলো। দিব্যেন্দুর মা আমার কপালে চুমো খেয়ে বললো, বেঁচে থাকো দাদুভাই।
আমাকে ওভাবে আদর করতে দেখে দিব্যেন্দু মুখ টিপে হাসছিলো। ওর মা সেই হাসি দেখতে পেয়ে বললো, আসছে বার আমি একটা ছোট্ট দাদুভাই দেখতে চাই।
মার কথা শুনে দিব্যেন্দু লজ্জা পেলো। আমি ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম।
কথাটা মার বিয়ের পর আমিও ভেবেছি। মা আর দিব্যেন্দুর যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন কি দিব্যেন্দু আমাকে এতখানি ভালোবাসতে পারবে? আমি জানি আমাকে দিব্যেন্দু এতটা ভালোবাসে বলেই মা ওকে বিয়ে করেছে। যখন দিব্যেন্দু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে তখন মা কী করবে? মাকেও তো দিব্যেন্দুর ছেলেমেয়েদেরই বেশি সময় দিতে হবে। আমি কি তখন বোর্ডিং-এ চলে যাবো? আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে বোর্ডিং-এ থাকে বটে, আমি এটা একদম পছন্দ করি না। এত বছর লন্ডনে থেকেও আমার ভেতরটা একেবারেই বাঙালিদের মতো সেকেলে রয়ে গেছে। শীলা এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঠাট্টাও করে। আমার কিছু করার নেই। আমি মার মতো এতটা বাঙালি না হলেও আমি যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই।
কলকাতা থেকে আমরা দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর আর কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলাম। খুবই মজা হয়েছিলো সেবার। বিশেষ করে হোটেলে প্রায়ই আমাকে ম্যানেজার বা রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করতে দিব্যেন্দু আমার ব্রাদার ই-ল কিনা। ইন্ডিয়ার মানুষদেরও খুব ভালো লেগেছিলো আমার। অনেকটা বাঙালিদের মতোই স্বভাব। বৃটিশদের মতো গোমড়ামুখো নয়, সব কাজ ঘড়ির কাঁটা মেপে করে না। খুবই প্রাণখোলা মানুষ, ঢিলেঢালা স্বভাবের, ঘাড়ে পড়ে আলাপ জমাতে চায়। দিল্লি থেকে ট্রেনে আগ্রা যাওয়ার পথে রাকেশ বলে একটা ছেলে আমারই বয়সের নিজে থেকে আলাপ করলো এসে। ইংরেজি বলার সময় যদিও মনে হয় হিন্দিই বুঝি বলছে, বেশ হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট, দেরাদুনে এক মিশনারি স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে। রাকেশও মাকে দেখে প্রথম ভেবেছিলো আমার বোন। আগ্রা আসার আগে ও আমার ঠিকানা রেখেছিলো, এখনও নিয়মিত চিঠি লেখে, ভিউকার্ড পাঠায়।
সেবার আমরা আঠারো দিন ছিলাম ইন্ডিয়াতে। ফিরেছি কলকাতা হয়ে। দিব্যেন্দুর মা আরও দুবার এসেছিলো আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। মা কাশ্মীর থেকে ওর জন্য খুব দামী একটা শাল কিনেছিলো। ওটা পেয়ে দিব্যেন্দুর মা খুব খুশি হয়েছিলো।
যেদিন সন্ধ্যায় আমরা লন্ডনের ফ্লাইট ধরবো সেদিন সকালে দিব্যেন্দুর মা শেষবার এসেছিলো আমাদের হোটেলে। যাওয়ার সময় দিব্যেন্দু আর মাকে জড়িয়ে কান্নাকাটিও করলো। দিব্যেন্দুকে বললো, তোর ভাইদের কারও তো ছেলে হলো না। বাড়ি ভরা গুচ্ছের মেয়ে। বৌমার একটা খোকা হলে তোর বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না। বৌমার বয়স তো আর কম হয়নি…..
দিব্যেন্দুর মার কথা বলার ধরন আমার ভালো লাগেনি। তাই চুপচাপ সরে এসেছিলাম ওদের কাছ থেকে।