১. মানুষই শক্তির উৎস

০১.

‘মানুষই শক্তির উৎস।…’

না, এভাবে না। ওর চিঠিটা–ওর শেষ চিঠিটা, এভাবে শুরু হয়নি। ওই কথাটা বারে বারে মনে আসছে। মনে করতে চাই বা না চাই, ওই একটি কথা যেন মন্ত্রের মতো জপে চলেছি। ইচ্ছা করি বা না করি, কথাটা আমার মনের মধ্যে বেজে চলেছে।

আসলে সমস্যা তো আমার নিজের। ভাবছিলাম, কী দিয়ে, কোথা থেকে শুরু করব। জীবনে তো কখনও ভাবিনি, কোথায় শুরু, কোথায় শেষ। না, এ কথাটা হল যেন, আমি বিশ্ব সংসারের কথা ভাবতে বসেছি। সে রকম কোনও ব্যাপক গভীর দার্শনিক ভাবনা আমার নেই। আমি নিতান্ত নিজের কথা ভাবছি, নিজের এই জীবনের কথা, মাত্র ছাব্বিশ বছর যার বয়স।

ছাব্বিশ কি? না, মাস তিনেক হয়ে গেল, সাতাশে পড়েছি। সেই হিসাবে, আমার জন্মদিনটাকে শুরু বলতে হয়। আর বেঁচে যখন আছি, তখন শেষের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু কথাটা তা না। কথা হল, জীবনে কখনও ভাবিনি, কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় শেষ করব। কী ভাবে শুরু হয়েছিল, তাও জানি না। আমাকে জানিয়েই কিছু শুরু হয়নি। কার জীবনই বা জানিয়ে শুরু হয়!

হয়, শুনেছি। অনেক মহাপুরুষের জীবন নাকি, তাঁদের জন্মের অনেক আগেই, নানা দৈববাণীতে ঘঘাষিত হয়, তিনি কবে এই ধরাধামে আসবেন, কী করবেন। আমি তো সেরকম মহাপুরুষ নই। এমনকী, এই সমাজের দিকে তাকিয়ে বলছি, আমি পুরুষও নই। আমি একটি মেয়ে, নিতান্ত একটি মেয়ে। নিতান্ত একটি মেয়ে’ কথাটার ওপর একটু বেশি জোর দিয়ে বললাম, কারণ আমি এখনও সেইখানে রয়ে গিয়েছি, সেই পর্যায়ে, যারা ভাবে এই জগৎ পুরুষশাসিত। যারা বলে, এটা আজ আর কোনও ভাবনার বিষয় না, এটা একটা পুরনো ধারণা, আমি এখনও তাদের মতো নবীনা হতে পারিনি। আমি আমার সবকিছুর মধ্যেই দেখি, অনুভব করি, পৃথিবী পুরুষশাসিত।

ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী, এখন একজন মহিলা। সেকুলার, ডেমোক্র্যাটিক ইত্যাদি যে সব নামে এই বিশাল দেশকে ভূষিত করা হয়, সে সবের সত্যতা আমার কাছে কিছু নেই–বিশেষ করে যখন ডেমোক্রাটিক বলা হয়, তখন মিথ্যাটা আরও বড় মনে হয়। অমিতদার কথা মনে পড়ছে, অমিতাভ চৌধুরী, আমাকে একদিন বলেছিলেন, ভারতবর্ষ ডেমোক্রাটিক দেশ নয়– এটা আদৌ সত্যি না। তোমরা যেখানে যে অবস্থায় খুশি এই সরকারের সমালোচনা করতে পারো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, বৈভব ইত্যাদি নিয়ে খোলা ময়দানে অভিযোগ করতে পারো এবং এই যে সব কথা বলতে পারছ, তুমি এটাকে ডেমোক্রাটিক দেশ বলে মানো না, এ সবই প্রমাণ করে, এটা ডেমোক্রাটিক দেশ। পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্রও আছে, যে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা বা তার নেতাদের সমালোচনা করলেই, তোমাকে কোতল করে দেওয়া হবে, না হয় শাস্তি পেতে হবে।

অমিতদা কী বলতে চেয়েছিলেন আমি জানি। ওঁর ইঙ্গিতটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার তাই নিয়ম। ফ্যাসিস্ট না হয়েও, সে রকম ব্যবস্থা থাকতে পারে। কেউ যদি বলে, যেখানে কোটি কোটি মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র চলছে, সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা মানেই, কোটি কোটি মানুষের স্বার্থের হানি, অতএব সমালোচনা বন্ধ। মুখে কুলুপ এঁটে রাখো। সেক্ষেত্রে সেটাকে আমি অন্যায় মনে করব কেন। কোটির জন্য মুখ বন্ধ আর গোটির জন্য মুখ বন্ধ, দুইয়ের মধ্যে অনেক তফাত আছে। যদিও এই মুখ বন্ধ কথাটার মধ্যে আমি যেন কেমন একটা পাপের গন্ধ পাই। অনেকটা আবছায়া অন্ধকারে উদ্যত ফণা তোলা সাপের মতো। সব ক্ষেত্রেই মুখ বন্ধ না করলে কি চলে না? মুখ। বন্ধ কি কোথাও শেষরক্ষা করতে পারে!

তা বলে অমিতদার কথাও মেনে নিই না। আমাদের এই ডেমোক্রাসির মানে কি কেবল কথার স্বাধীনতা! একটা চ্যাটারবকসের যে স্বাধীনতা? কথার স্বাধীনতা যে কত, সে তো রোজ খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়। কথা কথা কথা। কথার আদ্যশ্রাদ্ধ। এ যেন অনেকটা সেই রকম, ভগবান তোমাকে মুখ দিয়েছেন বলতে, বলে যাও। শুনছি কি না জানি না, যা করবার, তা করে যাচ্ছি।

আহ, আবার রাজনীতি। আবার আমি রাজনীতির কথা ভাবছি? রাজনীতি আমার সবই নিয়েছে, সবকিছু নিয়ে আমাকে এইখানে ফেলে রেখে গিয়েছে, যেখানে বসে আজ আমাকে শুরুর কথা ভাবতে হচ্ছে। আজ এই প্রথম, নিজের দিকে ফিরে তাকাবার সময় হল। নিজেকে খুঁজে দেখবার সময় হল। কিন্তু রাজনীতির কথা বোধ হয় ভোলা যায় না। রাজনীতি তো ঈশ্বরের স্থান দখল করেনি। ঈশ্বরকে ভোলা যায়। ঈশ্বরকে না-ও মানা যায়। কিন্তু মৃত্যুকে? রাজনীতি যেন রবীন্দ্রনাথের রাহুর প্রেম’-এর। মতো। ভুলে থাকতে চাইলেও, তাকে ভুলে থাকা যায় না। নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। সে অমোঘ, অপ্রতিরোধ্য। আমার সমস্ত কিছুর মধ্যে সে আছে। আমি চাই বা না চাই, কী এল গেল! অথচ চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, জীবনের জন্যই রাজনীতির প্রয়োজন। কিন্তু সে কোন রাজনীতি, যা জীবনকে প্লাবনের মতো ভরে তুলবে! আমার চোখে অন্ধকার, দৃষ্টি ঝাপসা। সেই রাজনীতি আমি দেখতে পাই না।

তবু রাজনীতি, তফাত যাক! যে কথা ভাবছিলাম। এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা, তার জন্য তাঁর মনে কি বিশেষ কোনও অহংকার আছে! থাকতে পারে হয়তো, কে জানে। কিন্তু তার জন্য ভারতবর্ষের স্ত্রীলোকদের জীবনে কী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমি কিছুই দেখতে পাই না। ভারতবর্ষ তাতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হয়ে যায়নি। পুরুষরা তেমনি পুরুষই আছে, মেয়েরা মেয়েই আছে।

মেয়েদের ছাড়া পুরুষদের চলে না। আমাদেরও তাদের ছাড়া চলে না। এই না চলাটাই তো বড় কথা। আমরা আমাদের পরস্পরের জন্য। তবু পুরুষরাই প্রধান। সেটা আমার একটুও খারাপ লাগে না, অস্বাভাবিক বলেও মনে হয় না। পুরুষদের সঙ্গে যত টেক্কা দিয়েই চলি, কখনও ভুলতে পারি না, আমি একটি মেয়ে।

আমার এমন অনেক বান্ধবী আছে, যাদের এ সব কথা মোটেই ভাল লাগে না। ওদের ধারণা, আমার মনোভাবটা ক্রীতদাসীর মতো। পুরুষদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে ওরা এত কথা বলে, এমন চেঁচায়, যেন মনে হয় পুরুষরা আমাদের শত্রু। তাই কখনও হয় নাকি! ও সব ভেবে চিন্তা করে, অনেক রকম গল্প। লেখা যায়। নারীবিদ্বেষী পুরুষ বা পুরুষবিদ্বেষী নারীর গল্প। মেয়ে বিশেষের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু ঘটতে পারে, বা পুরুষ বিশেষের। তার পিছনে নানান কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার না, সাধারণও না। অসাধারণ আর অস্বাভাবিক নিয়ে কোনও কথা চলে না।

অধীনতা? তা-ই বা মন্দ কী। সে অধীনতা তো আর শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা নয়। তার মধ্যে মান-অপমানের কোনও প্রশ্ন নেই। বিদ্রোহেরও কোনও কথা নেই। আমার তো ধারণা, অধীনতার মধ্যেও শান্তি আছে। এমনকী বোধ হয় সুখও আছে। আমি যদি অধীন হতে পারি, আমাকে যদি কেউ অধীন করতে পারে, তার চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে। সামাজিক বিচার বিশ্লেষণ, তত্ত্ব তর্কে যাই হোক, মেয়ে-পুরুষের মধ্যে যদি কোনও বিরোধ হয়, বিবাদ হয়, তা কখনও মজুর-মালিকের লড়াই না। তার মূলটা ভিন্ন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই পাই, আর রাজনৈতিক তক্তে বসেই লড়াই করি, নারী-পুরুষের মূল সম্পর্কের সমস্যা সেখানেই মিটে যায় না। সমস্যা বাইরের না, ভিতরের। আইন বা আইন সভা তার কোনও নিরসন করতে পারে না। মূল সমস্যা, নারী আর পুরুষ, তাদের দুজনের মধ্যে নিরসন করতে পারে।

সেই জন্যই বলছিলাম, এই সমাজের দিকে তাকিয়েই বলছি, আমি একটি মেয়ে। পুরুষপ্রধান সমাজে একটি মেয়ে যেমন হয়, নিতান্ত তেমনি একটি মেয়ে। আমি যা-ই বলব, আমার হাসি কান্না আবেগ, সবই এই সমাজের একটি সাধারণ মেয়ের কথা। মেয়েদের নিয়ে বড় বড় কথা বলবার কিছু নেই আমার।

ছেলেরা–মানে পুরুষেরা আমাদের নিয়ে বরাবরই একটু বাড়াবাড়ি করেছে। করেছে অবিশ্যি নিজেদের সুখের জন্য বটে, দুঃখের জন্যও বটে। এত সব বিশেষণ দিয়েছে, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। শুনলেই বোঝা যায়, কখনও আদরে গলে গিয়েছে। কখনও রাগে বারুদ হয়ে উঠেছে। কখনও বুঝতে পেরে কেবলই হাতড়ে ফিরেছে, কখনও আবার অঙ্কের মতো চুলচেরা বিচার করেছে। যা বলবার পুরুষরাই বলেছে। আমরা আর আমাদের বিষয়ে কতটুকু বলেছি! আমরা বরাবরই নীরব।

আমাদের প্রোফেসর দুষ্মন্তবাবু থাকলে, এখুনি বলে উঠতেন, উঁহু উঁহু, হল না। আয়েষার কথা ভুলে যেয়ো না, এই বন্দি আমার প্রাণেশ্বর। নারীরা মোটেই নীরব না, অনেককাল আগেই তারা মুখ খুলেছে।

সে রকম হিসাব করে বললে, আরও কিছু বলা যায় না। কিন্তু আমার ধারণায় মোট কথা, পুরুষরা মেয়েদের নিয়ে যত কথা বলেছে, আমরা তার কিছুই বলিনি। কাব্যে সাহিত্যে ধর্মগ্রন্থে, সবখানে। কিন্তু পুরুষদেরই আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, তারা কি সবসময়ে আমাদের সম্বন্ধে ঠিক কথাটি বলতে পেরেছে! বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই অসুবিধা হয়। ঠিক কথাটি সবসময়ে বলা হয়ে ওঠে না। মেয়েদের ঠিক মেয়েদের চোখে দেখলে, জটিলতা কমে। সেই হিসাবে, মেয়েরা ছেলেদের অনেক বেশি বুঝতে পারে। মেয়েরা পুরুষকে পুরুষের চোখেই দেখে। পুরুষেরা একটু নতুন কিছু না বলতে। পারলে, একটু নতুন চোখে দেখতে না পারলে, তাদের শান্তি নেই। তার মধ্যে, তাদের যেন একটি বিশেষ তৃপ্তি আছে। সেই জন্যই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রকে উদ্দেশ করে, একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লিখতে বলে, কবিতা লিখেছিলেন।

একটি নিতান্ত সাধারণ মেয়ে বলতে কী বোঝায়, সেটা আবার একটা কথা। তার মানে এই নয়, একটা সরল রেখার মতো সোজা ব্যাপার কিছু মেয়েদের স্বভাবের মধ্যেই যে সব আঁকাবাঁকা ওঠা-নামা আছে, ব্যাপারটা সেই রকমই স্বাভাবিক। একটি নিতান্ত মেয়ে, কোনও মহৎ-অমহতের কথা নেই।

কিছুকাল আগে, এক অবাঙালি লেখিকার একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পের নায়িকা এক বিবাহিতা মেয়ে। সে তার স্বামীর সঙ্গে দেহ-মিলনে মিলিত হল। স্বামীর সঙ্গে তার মিলনটা যেন অনেকটা ভিখিরিকে খাবার ছুঁড়ে দেওয়ার মতো। তারপরেই সে তার প্রেমিকের কাছে চলে গেল।

এটা একটা অদ্ভুত বা নতুন ব্যাপার কিছু না। এটা একটা নিতান্ত সাধারণ মেয়েরই গল্প। কেউ শুনলে, আমাকে না জানি কী ভাববে! পুরুষদের কথা তো বাদই দিচ্ছি, মেয়েরাও প্রতিবাদে ফেটে পড়বে। সবসময়ে তো সব বিষয় বক্তৃতা দিয়ে বোঝানো যায় না। এ কথাও বলা যায় না, কী সত্যি, কী মিথ্যা, তা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলো। কিন্তু আমি বুঝি, এটা একটা সাধারণ মেয়েরই গল্প। যে কোনও বিবাহিতা মেয়ের জীবনেই এ ঘটনা ঘটতে পারে। বলতে গেলে, এটা একটা মেয়েলি গল্প, সতোর সঙ্গে লেখা, সেন্টিমেন্টের স্পর্শ নেই। সেই জন্যই গল্পটা আমার আরও ভাল লেগেছে। পরে যখন এই গল্পটার সম্পর্কেই প্রাবন্ধিকের পণ্ডিতি বিশ্লেষণ পড়েছি, মোটেও ভাল লাগেনি। প্রবন্ধে গল্পটা হয়ে উঠেছে, যাকে বলে প্রকৃত আধুনিকতা, রিলেশনকে আবিষ্কার, বর্তমান সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনশীল যুগকে দেখা এবং বাস্তব জীবন–ইত্যাদি প্রভৃতি। বলতে ইচ্ছা করে, আ মরণ, মিনসের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আধুনিকতা আর বাস্তবতা বোঝাতে বসল।

একেবারে অবিকল এমন ঘটনা না থাকলেও, স্বামী থাকতেও অন্য পুরুষ, একি পুরাণে ইতিহাসে নেই? এ সব কি আজকাল, এ যুগেই ঘটছে নাকি। সেই যবে থেকে বিয়ে, তবে থেকেই এই গল্প। এখন। অবিশ্যি আইন এবং নীতি আছে। তারা এটাকে ব্যভিচার বলবে। বলবে, আইনের সুযোগ আছে, ডিভোর্স করো, প্রেমিকের কাছে চলে যাও। কেউ তোমার পথ আটকে রাখবে না। কিন্তু একটা লোক, কাজকর্ম করে, খায়দায়, স্ত্রী সহবাস করে, তাকে ত্যাগ করার রাস্তাই বা কোথায়। ভালবাসি না’ কথার কোনও দাম নেই। আইন আর নীতি, নারী-পুরুষের প্রকৃত অর্থের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনও কাজ করে না।

কিন্তু এত কথা ভাবছি কেন। আসলে আমি বলতে চাইছি, মনের শুচিতায় আমি বিশ্বাস করি। শরীরের স্বাস্থ্যে এবং পরিচ্ছন্নতায়। ঘৃণা করি ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে। স্বেচ্ছাচারিতাকে নিন্দা করি। কিন্তু সতীত্ব’ নাম দিয়ে, দেহের যে-শুচিতার কথা বলা হয়, তার কোনও অর্থ নেই। সব মেয়েই জানে, তাদের শরীরটা চোর চোর খেলার সামগ্রী না, ছুঁয়ে দিলেই চোর! আমি সাধারণ একটি মেয়ে, নিতান্ত একটি মেয়ে, শরীর নিয়ে স্বর্গবাসের ভাবনা ভাবি না।

যখন ছোট ছিলাম, যখন কিশোরী ছিলাম, তখন অনেক ভাবনা ছিল। যখন প্রথম জেনেছিলাম, আমার মধ্যে একটা নতুন দরজা খুলে গেল, তখন শক্ত হয়ে উঠেছিলাম। নিজের খোলা দরজার সামনে, নিজেই কঠিন প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।…তারপরে সহজ হতে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। সহজ আর স্বাভাবিক হওয়াটাই সবথেকে কঠিন।

এত কথারই বা কী দরকার। সোজা কথা সহজে বলি, সাধারণ মেয়েদের মনে শরীর নিয়ে কোনও শুচিবায়ুতা নেই। আমারও নেই। এ কথা ভাবতে গিয়ে, আমার অনেক বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এক-একজন এক-একরকম। কেউ আমার পক্ষে, কেউ আমার বিপক্ষে। আবার অন্য রকমও আছে। যেমন লীনা। ওর কোনও বাছ-বিচার নেই, ছেলে হলেই হল। অবিশ্যি এতটা বলব না, একটু বাছ-বিচার আছে। ওকেই ঠিক স্বেচ্ছাচারিণী বলা যায়, ভোলাপচুয়াস যাকে বলে।

লীনা ওর মাসিকে নিয়ে খুব গর্ব করে। ওর জীবনের চিন্তাভাবনা, সবই ওর সীতা মাসির মতো। সীতামাসি একটি রাজনৈতিক দলের নেত্ৰীস্থানীয়া। প্রত্যেক ইলেকশনেই দাঁড়ান, প্রত্যেক বারই এম-এল-এ নির্বাচিত হন। এখন বয়স হয়ে গিয়েছে। তা পঞ্চাশের কাছাকাছি তো বটেই। সীতামাসিকে আমি দেখেছি। কপালের সামনে, কানের পাশে, চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে। কিন্তু মুখের চামড়ায় তেমন ভাঁজ পড়েনি। গায়ে মেদ জমেনি। বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। স্বাস্থ্যে এখনও বেশ ধার আছে। একটিও দাঁত পড়েনি। সত্যি বলতে কী, শরীরটা দেখলে, মনে হয়, এখনও ওঁর যৌবন আছে। ভাল বক্তৃতা দিতে পারেন। ভাল বক্তৃতা বলতে আমি অ্যাজিটেশনের কথা বলছি। যাকে বলে, তাতিয়ে মাতিয়ে তোলা, সেটা খুব ভাল পারেন। তবে মূলে বড় অন্তঃসারশূন্য বলে আমার মনে হয়েছে। তৈরি করা, সাজানো-গোছানো, গরম গরম কথা বলেন, তখন ভঙ্গিটাও চমৎকার।

শুনেছি সীতামাসি নাকি ইস্কুলে পড়বার সময় থেকেই রাজনীতি করেন। কলেজে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই, ওঁর বক্তৃতার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ভক্ত জুটে যায় অগুনতি। লীনা বেশ গর্ব করে, চোখ ঘুরিয়ে বলে, সীতামাসি তাঁর কলেজে, সব ছেলেকে দলে টেনে নিয়েছিলেন। যার সঙ্গে কথা বলতেন, সেই ছেলেই কাত হয়ে যেত। বলতে গেলে, কলকাতার কলেজের ছেলেরা এক সময়ে সীতামাসির জন্যই। রাজনীতি করতে এসেছিল।

ভাবলেও অবাক লাগে। এ আবার কখনও সত্যি হতে পারে নাকি! একটি মেয়ের জন্য ছেলেরা তাঁর দলে এসে ভিড়ত? জিজ্ঞেস করলে, লীনা আরও ঝলক দিয়ে বলে, আগুন, সীতামাসি তখন ছিল। আগুন। ছেলেরা সব বাদলা পোকা। কোনও ছেলেকেই সীতামাসি বাদ দিত না। যাকে ভাল লাগত, তাকেই…।’

লীনা কথা শেষ না করে চোখের ইঙ্গিতেই সারে। বলে, দলের অনেক নেতাও সীতামাসির দিকে হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকত। সীতামাসির বর তো অন্য দলে ছিলেন। লেখাপড়ায় যেমন ভাল ছিলেন, তেমনি বড়লোকের ছেলে। তাঁকে কিছুতেই কেউ দলে আনতে পারেনি। তারপর এম এ পড়তে গিয়ে, মেসোমশাই কাত হলেন। কেবল দলেই আসেননি, সীতামাসিকে বিয়েও করেছিলেন। যাকে বলে একেবারে হজম, তাই। এখন সেই মেসোমশাই কোথায়! কোন এক ইংরেজি কাগজে বসে বসে এডিটরিয়াল লিখছেন, আর কিছুই না। সীতামাসি যা বলেন, তাই করেন। হ্যাঁ, যদি কিছু করতে হয়, সীতামাসির মতোই করা দরকার। একে বলে জীবন।’…

সীতামাসির সম্পর্কে, লীনা যা বলে, তা একেবারে মিথ্যা না। আরও কয়েকজনের মুখে শুনেছি। বিশেষ করে হরিশদার কাছে। হরিশদা, সীতামাসি সব একসময়ে একসঙ্গে রাজনীতি করতে নেমেছিলেন। দুজনেই সমবয়সি। এখন অবিশ্যি হরিশদা সীতামাসিদের দলে নেই। বরং বলা যায়, সীতামাসিদের শত্ৰুদলের লোক তিনি এখন। হরিশদা এখনও হেসে বলেন, সীতাকে দেখে আমরা সকলেই কম-বেশি মজেছিলাম।’…

হরিশদা আরও অনেক কথা বলেন, বলতে বলতে অনেক সময় রেগে যান। কিন্তু সে যাই হোক, লীনা কেন সীতামাসি হতে চায়। লীনার রূপ আছে, মানি। রাজনীতির কিছু বোঝে বলে তো মনে হয় না। যদিও গরম গরম বক্তৃতা দেয়। তবে ও বোধ হয় ভুলে গিয়েছে, সীতামাসিদের দিন আর নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে বা তার পরে পরেই, রাজনীতির যা হালচাল ছিল, সে সব একেবারেই বদলে গিয়েছে। সীতামাসিদের সময়ের কথা যা শুনি, মনে হয় তখন সব ব্যাপারটা ছিল বেশ সহজ। এখনকার মতো এত জটিল আর কুটিল হয়ে ওঠেনি। অবিশ্যি মেয়েদের রূপের দর সবসময়েই বোধ হয় সমান। লীনা তাই, সীতামাসি না হতে পারুক, একটা কিছু হতে চলেছে। ওর পিছনে পিছনেও অনেক ছেলে ঘোরে। লীনা সবসময়েই ছেলেদের নিয়ে বেড়ায়। নিজের মুখেই সব কথা বলে যায়।

লীনা হল অন্য রকম। লীনার সঙ্গে আমার কোনও দিন বনবে না। বনেওনি। লীনাকে আমি আমাদের মতো সাধারণ মেয়ে মনে করি না। ওর কথা ভাবলে, আমার গায়ের মধ্যে যেন কেমন ঘিনঘিন করে। ও ওর নিজের বিষয়ে যে সব কথা বলে, সে সব মুখ ফুটে বলা যায় না। ভারী কুৎসিত আর নোংরা মনে হয়। বেশ বুঝতে পারি, সবকিছুর মধ্যেই ওর একটা উগ্ৰ কামুকতা আছে। মেয়েপুরুষ বলতে ও একটা জিনিসই বোঝে। সেই জন্য লীনার মতো মেয়েদের কাছে শরীরের মূল্যটাও অন্য রকম। শরীরকে ওরা অন্য চোখে দেখে। লীনার কথা শুনলে অনেক সময় হাসিও পায়। ছেলেদের অদ্ভুত দুর্বলতার কথা ওর মুখে শোনা যায়।

এমন অসহায় গোবেচারা মনে হয়, তাদের আচরণের কথা শুনলে হাসি পাবেই। যদিও জানি, ব্যাপারগুলো মোটেই হাসির নয়। এক রকম দুঃখের আর কষ্টের ব্যাপার সেগুলো। কেননা, ও সব ইতর খেলা ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু আর একটা কথা অনেক সময়েই আমার মনে হয়েছে। হাসি আর যাই করি, লীনার মধ্যে অন্য মেয়েদের সর্বনাশের বীজ লুকিয়ে আছে। একটু ভালমানুষ মেয়ে, একটু অল্পবয়সের মেয়ে, যার তেমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই, সে যদি লীনার সঙ্গে মেশে, লীনার কথা শোনে, তা হলে ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। শরীরের ফাঁদ, সুখের ফাঁদ, রক্তের ফাঁদ যাকে বলে। লীনার সে ক্ষমতা আছে। যারা জানে না, লীনার কথা শুনলে, তাদের রক্তের মধ্যে…।

দরজায় খটখট শব্দ হল যেন। আমি বন্ধ দরজার দিকে এক বার ফিরে তাকালাম। প্রায় এক মিনিট কেটে গেল। আর কোনও শব্দ হচ্ছে না। বোধ হয় ভুল শুনেছি।…যাই হোক, আমি বলতে চাই, লীনারও শরীর সম্পর্কে কোনও শুচিবায়ুতা নেই, কিন্তু ওর শরীরটা হল একটা নর্দমা। একেই বোধ হয় নিমফোমানিয়াক না কী বলে, তাই। তা না হলে লীনা এ কথা বলতে পারত না, জানিস, একদিন রাত্রে আর থাকতে পারলাম না। রাত্রি দশটার সময় স্বপনের বাড়ি চলে গেলাম। গিয়ে শুনলাম, স্বপন বাড়ি নেই। তখন আমার মাথার ঠিক নেই। একজন কারোকে চাই। শঙ্করের বাড়ি গিয়ে হানা দিলাম…।

আমি আর শুনতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, তোর উচিত ছিল উন্মাদ আশ্রমে যাওয়া। সেখানে জলবিছুটি দিয়ে চাবকালেই তুই ঠিক হয়ে যেতিস, রোগ সেরে যেত।

লীনা খিলখিল করে হেসেছিল। ওর হাসিটাও আমার স্বাভাবিক মনে হয় না। আসলে লীনা অসুস্থ…খট খট খট। দরজায় শব্দ। এ বার স্পষ্ট।