১. মাগরিবের আজান হচ্ছে

নিঃসঙ্গ নক্ষত্র – উপন্যাস – সাদাত হোসাইন

উৎসর্গ

নুসরাত
চোখের ভেতর মন দেখতে মনের আলো লাগে

এই জগতে সেই ক্ষমতা সবার থাকে না, কারো কারো থাকে
কিংবা শুধু কোনো একজনেরই।

ভূমিকা

এই ঘটনা সত্য, না মিথ্যা?

মিথ্যা।

মিথ্যা ঘটনা লিখেছেন কেন?

সরি, এটা আসলে সত্য ঘটনা।

সত্য ঘটনা এমন হয়? এমন কেন?

এই প্রশ্নে আমি চুপ করে থাকি, আমার কষ্ট হয়। আসলেই কী জীবন এমন? হয়তো এমনই, হয়তো এমন নয়। তবে আমি সবসময়ই বলি, জীবনে যেমন গল্প থাকে, তেমনি গল্পেও থাকে জীবন। সেই সব গল্পের কতটুকুই আমাদের জানা থাকে? আমরা কতজন কত কত নিঃসঙ্গ দিন-রাত্রির গল্প বুকে পুষে কাটিয়ে দেই একাকি জীবন, সেই জীবনের খবর কে রাখে? হয়তো সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ছাড়া আর কেউ-ই না।

নিঃসঙ্গ নক্ষত্র তেমনি গল্প কিংবা জীবন। এই গল্পটা কী কোথাও শুনেছি আমি? আমার ধারণা আমি শুনেছি। গল্পের মেয়েটার মুখ থেকেই শুনেছি এবং মেয়েটিকে চিনিও আমি। কিন্তু গল্পটা কী একটু অন্য রকম হয়ে গেল? না-কি আরো খানিকটা অন্যরকম হতে পারতো? অনু কী জানতে পারতো না, জীবন কেবল এমন নয়, জীবন হতে পারে আরো অন্যরকমও?

কলম অবশ্য বলে গেল, কেউ জানে না জীবন কেমন, জীবনের রকম কী! তা কেবল জীবনই জানে। তাই সে লিখে গেল জীবন। সেই জীবন সত্য না মিথ্যা, তা ধরতে পারে সাধ্য কার!

নিঃসঙ্গ নক্ষত্র সেই সত্য-মিথ্যার জীবন।

সাদাত হোসাইন
১৩ জানুয়ারি ২০১৩

*

মাগরিবের আজান হচ্ছে।

অনু দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। এই বারান্দায় সে সাধারণত আসে না। এলেই এক ধরনের গা ঘিনঘিনে বিদ্ঘুটে অনুভূতি হয় তার। এই অনুভূতির কারণ পাশের বাসার খোলা জানালাটা। জানালার সাদা ফিনফিনে পাতলা পর্দাটা মৃদু হাওয়ায় কাঁপছে। পর্দার ওপাশে একজোড়া টকটকে লাল চোখ। অন্য কোনো সময় হলে অনু এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়াতো না। কিন্তু আজ সে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে আছে, এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার ভাবনায় এসব কিছুই নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান শেষ হবে। অনু জানে, রোজকার মতো আজান শেষ হবার সাথে সাথেই আজও দুটি ঘটনা ঘটবে। প্রথমত ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাবে। তারপর, তার মা সালমা বেগম একঘেয়ে গলায় চিৎকার করে বলতে থাকবেন, এই ঘরে আয় উন্নতি হবে না। এই আমি বলে দিলাম, এই ঘরে আয় উন্নতি হবে না। আয় উন্নতি হবে কেমনে? যেই ঘরে নামাজ নাই, রোজা নাই, সন্ধ্যাবেলা কেউ ঘরে বাতি পর্যন্ত দেয় না, সেই ঘরে আয় উন্নতি হবে কেমনে? হবে না।

সন্ধ্যাবেলা ঘর অন্ধকার থাকা সালমা বেগমের পছন্দ নয়। এই নিয়ে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় চেঁচামচি করেন। সেই চেঁচামেচি অবশ্য অনু রোজ শুনতে পায় না। শুক্রবার বাদে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোয় এই সময়টাতে সে থাকে অফিসে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাড়িতে থাকে তার ছোট ভাই অয়ন আর মেজো বোন তনু। অনুরা তিন বোন, এক ভাই। অনু সবার বড়। ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোন বেনু থাকে তার শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুরে। মেজো বোন তনুর প্রথম বাচ্চা হয়েছে বলে সে আছে মায়ের বাসায়।

সবার ছোট অয়ন। অয়নের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এই সন্ধ্যাবেলাটা তাই ভাই বোনদের মধ্যে একমাত্র তনুই বাসায় থাকে। ফলে মায়ের বকুনির বেশিরভাগই শুনতে হয় তাকে একা। তনুর কোলে তার তিন মাস বয়সের মেয়ে হাফসা। এই মেয়েকে নিয়ে তার আনন্দের চেয়ে দুঃখের গল্প বেশি। সেই দুঃখের গল্পে মায়ের এই রোজ সন্ধ্যাবেলার ঝড়ঝাপ্টা যেন একটু বেশিই কাঁটা হয়ে বেঁধে।

সন্ধ্যার অন্ধকার এখনো গাঢ় হয়নি। তবে যে-কোনো সময় ঝুপ করে নেমে আসবে। অনুর উচিত এখনই ভেতরে চলে যাওয়া। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তার মোটেই ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও অনু দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আজ তার কোনো বোধবুদ্ধি কাজ করছে না। তার মনে হচ্ছে, জগতের কোনো কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না।

অনুর ঠিক সামনেই সরু গলির মাঝ বরাবর আড়াআড়ি চলে গেছে একজোড়া ইলেক্ট্রিকের তার। সেখানে মুখোমুখি দুটি কাক বসা। যেন সন্ধ্যা নামার আগে দিনের সব হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে নিতে চাইছে তারা। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে তাদের সেই হিসেব মিলছে না। অনু কি তাদের দেখছিল? সে জানে না। তবে হঠাৎ অন্য একটা কাক এসে কাক দুটোর মাঝখানে থপ শব্দে বসে পড়তেই যেন সম্বিৎ ফিরল অনুর। ইলেক্ট্রিকের তারটি প্রচণ্ড গতিতে দুলে উঠতেই ভারসাম্য হারিয়ে উড়ে গেল তিনটি কাক। অনু এতক্ষণে খেয়াল করলো, আজান শেষ হয়েছে। ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেছে। চারপাশ জুড়ে কেমন গুমোট এক অন্ধকার। এ সবই খুব সহজ সাধারণ রোজকার ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু অনুর বুকটা কেমন ভার ভার লাগতে লাল। কেমন বিষাদে ছেয়ে যাওয়া চারধার। আচ্ছা, সন্ধ্যাটা সবসময় এমন বিষণ্ণ কেন হয়?

অনু বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকলো। ঘর অন্ধকার, এখনো কেউ বাতি দেয়নি! অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার মা এখনো চিৎকার চেঁচামেচি করে কাউকে ডাকেননি। সারা বাড়ি জুড়ে গোরস্থানের নিস্তব্ধতা। অন্য কোনো দিন হলে অনু ভারি অবাক হতো। এই নিয়ে মায়ের সাথে খানিক হাসি ঠাট্টাও করতো, কিন্তু আজ কিছুই করলো না সে। অবাকও হলো না। রান্না ঘর খুঁজে মোমবাতি জ্বালালো। মেজো বোন তনুর ঘর থেকে তার মেয়ে হাফসার ঘুমভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। অনু উঁকি দিয়ে তনুর ঘরের ভেতরটা দেখলো। অন্ধকার ঘরে জায়নামাজে বসে আছে তনু। বিছানায় সদ্য ঘুমভাঙা হাফসা কাঁদছে। তনুর অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে স্থির বসে আছে জায়নামাজে। দরজায় দাঁড়িয়ে জায়নামাজে বসা তনুর আবছা অবয়বের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনু। তারপর সন্তর্পণে হাফসাকে কোলে তুলে নিলো। হাফসার কান্না অবশ্য তাতে থামলো না।

মে’র মাঝামাঝি প্রচণ্ড গরম পড়েছে। সন্ধ্যাবেলায় ইলেক্ট্রিসিটি যাওয়াটাও যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। এই সময়ে সরু বারান্দাটায় দাঁড়ালে খানিক ফুরফুরে হাওয়া পাওয়া যায়। অনু হাফসাকে কোলে নিয়ে আবারো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।

.

দূরে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় অয়নকে দেখা যাচ্ছে। অয়নের কাঁধে ব্যাগ। তার গা ঘেঁষে হেঁটে আসছে একটা কুকুর। কুকুরটাকে হাতের প্যাকেট থেকে খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে অয়ন। মজার ব্যাপার হচ্ছে খাবারের টুকরোগুলো মাটিতে পড়ার আগেই কুকুরটা শূন্যে লাফিয়ে লুফে নিচ্ছে। দৃশ্যটার ভেতরে কী যেন কী একটা আছে। অনু চোখ ফেরাতে পারছে না। সে এক দৃষ্টিতে অয়নের দিকে। তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে এমন একটা দৃশ্য সে আগে কখনো কোথাও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে, মনে করতে পারছে না। কোনো সিনেমায় কী?

অয়ন আরো খানিকটা কাছে আসতেই বারান্দায় দাঁড়ানো অনুকে দেখলো। সামান্য গলা তুলে সে বলল, ঘরে মোম আছে আপু? না-কি নিয়ে আসবো?

অনু বলল, নিয়ে আয়। সাথে কয়েলও আনিস এক প্যাকেট। যা মশা!

অয়ন ঘুরে গলির ছোট দোকানটার দিকে এগুলো। অনু দাঁড়িয়েই রইল। তার মনে হলো, অয়নকে যতটা পারে দেখে নিতে চাইছে সে। যেন প্রচণ্ড তেষ্টা পেলে যতটা সম্ভব পানি খেয়ে নেয়ার মতো ব্যাপার। অয়নের সাথে কথা বলার সময় অনুর গলাটা কি খানিক কাঁপছিল? কাঁপছিলই বোধহয়। অনু অবশ্য দুপুরের পর থেকে নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে। ভেতরে ভেতরে যা-ই হোক, অয়নের সামনে সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকই থাকবে। তাকে স্বাভাবিক থাকতেই হবে। এছাড়া আর উপায় কি? বাবার মৃত্যুর পর থেকে এই এতগুলো বছর তো সে এমন করেই স্বাভাবিক থেকেছে। নিজেকে নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখে কী অস্বাভাবিকভাবেই না সে স্বাভাবিক হয়ে থেকেছে!

অবাক ব্যাপার হলো, অয়ন ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো। অনু বারান্দা থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তার চোখ পড়েছে সরাসরি অয়নের চোখে। অয়ন ফিক করে হেসে উঠল, বিশ্বাসই তো করিস না যে আমি ম্যাজিক জানি, এখন বিশ্বাস হলো?

অনুও হাসলো, আমাকে ম্যাজিক দেখাস তুই? সব তো দেখাস কোচিংয়ের মেয়েদের!

অয়ন খানিক দমে যাওয়া গলায় বলল, এহ্! তুই কিন্তু আবার শুরু করেছিস আপু।

অনু বলল, তাহলে বল যে আজ আমাকে ম্যাজিক দেখাবি?

আজ? কীভাবে? তুই জানিস, আমার পরীক্ষা আপু।

হ্যাঁ জানি। আর এও জানি, আমাকে দেখানোর কথা এলেই তোর নানান বাহানা।

ধুর। মাঝেমধ্যে তুই কিছুই বুঝতে চাস না আপু। বাচ্চাদের মতো করিস।

অয়ন চেয়ারে বসে উবু হয়ে জুতোর ফিতে খুলছে। অনু মুগ্ধ চোখে সেইদিকে তাকিয়ে রইল। অয়ন কী খানিক শুকিয়ে গেছে? অনু এখনো ঠিকঠাক ধরতে পারছে না। তবে তার চোখের নিচে খানিক কালির আভাস। এতে অবশ্য অয়নের মুখটা আরো মায়া মায়া লাগছে। অনুর মনে হলো, অয়ন তাদের ঘরে না জন্মালে নিশ্চিত করেই কোনো রাজপুত্র হয়ে জন্মাতো। মাথাভর্তি ঘন কালো কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক। ধবধবে ফর্সা ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার নাকের নিচে গোঁফের আভাস। অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুর বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে উঠল। চোখে পানি চলে এলো তার। অদ্ভুত ব্যাপার বৈকি!

অনু চট করে ওড়নায় চোখ মুছে নিলো। খুব বেশি স্বাভাবিক আচরণ করতে গিয়ে কি সে খুব বেশি অস্বাভাবিক আচরণই করে ফেলছে?

অনু বলল, রাতে কি খাবি বল। আমি রাঁধবো।

অয়ন মাথা না তুলেই বলল, কেন? মা কই?

কেন? মা থাকলে আমি রান্না করতে পারি না?

তোর রান্না আমি খেতে পারি না আপু। রাজ্যের ঝাল দিয়ে রাখিস, খেতে। বসলে চিনির শরবত নিয়ে বসতে হয়।

অনু মিথ্যে অভিমান মাখা গলায় বলল, ও আচ্ছা, আমার রান্না এখন এতটাই বিশ্রি না? এই সেদিন অব্দিও তো মায়ের রান্না মুখে দিতে চাইতি না!

অয়ন এই কথার কোনো জবাব দিলো না। সে জুতা খোলা শেষ করে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে বের হয়েই বলল, মা কইরে আপু।

অনু বলল, নামাজে।

নামাজে? এখন কটা বাজে?

সে অনুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই মায়ের ঘরে ছুটলো। এই ঘরে তনুর সাথে মাও থাকেন। ঘরে আলো নেই। তবে আশপাশ থেকে আলো এসে ঘরের অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে আছে। অয়ন ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো। সাদা শাড়ি পরা সালমা বেগম মেঝেতে পাতা জায়নামাজে সেজদার ভঙ্গিতে বসে আছেন, আর তনু বসে আছে বিছানায়। থেকে থেকে সালমা বেগমের পিঠ কাঁপছে, তিনি কাঁদছেন! চেষ্টা করেও কান্নার শব্দ চেপে রাখতে পারছেন না তিনি। অয়ন বুঝতে পারছে না সে কী করবে! সে কি মাকে ডাকবে? না-কি চলে যাবে? মা নিশ্চয়ই নামাজে আছেন, এই সময়ে তাকে ডাকা ঠিক হবে না। কিন্তু মা এভাবে কাঁদছেন কেন?

অয়ন সামনের ঘরে এসে অনুকে বলল, মা কাঁদছে কেন রে আপু?

অনু বলল, এ আর নতুন কি? মা তো প্রায়ই নামাজে কাঁদে।

অয়ন কিছু বলতে গিয়েও আচমকা চুপ করে গেল। এই প্রথম তার মনে হলো বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। সেই কিছু একটা সে ধরতে পারছে না এবং কেউ চায়ও না সে বিষয়টা ধরতে পারুক। বরং সবাই চাইছে বিষয়টা তার থেকে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু কী এমন হয়েছে যে, সে ছাড়া আর সকলেই জানে!

.

রাতে খাবার টেবিলে সালমা বেগম আসলেন দেরি করে। অয়ন বলল, এতক্ষণ ধরে কী নামাজ মা? সেই সন্ধ্যাবেলা বসলে আর এই উঠলে?

সালমা বেগম জবাব দিলেন না। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে অয়নের পাশে এসে বসলেন। অনু খাবার বাড়ছিল। তনু তার মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। হাফসাকে ঘুম পাড়াতে নানান আহ্লাদ করতে হয়। অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দ করতে হয় মুখে, কিন্তু তারপরও হাফসা ঘুমায় না, বরং তারস্বরে কাঁদে। আজও কাঁদছে। অন্য সময় হলে অনু বা সালমা বেগম গিয়ে হাফসার ঘুম পাড়ানি উৎসবে যোগ দিত, কিন্তু আজ কেউ গেল না। যেন কেউ কিছু শুনছে না।

সালমা বেগম অয়নের কপালে হাত দিয়ে বললেন, জ্বর আর এসেছে?

অয়ন বলল, না মা, জ্বর আর আসেনি। তবে গলায় কিছুটা ব্যথা।

সালমা বেগম বললেন, গরম পড়েছে খুব। এর মধ্যে বাইরে বেশি বের হোস না। আর তোর যা ঘাম হয়, দেখা গেল বুকে ঘাম জমে গিয়েই আবার ঠান্ডা বাধাবি।

অয়ন বলল, ধুর। তুমি আজকাল উদ্ভট উদ্ভট সব কথা বলো মা। এর চেয়ে বেশি গরমে স্কুলের মাঠে রোজ ফুটবল খেলতাম আমি। কই, কখনো তো কিছু হয়নি। আর এখন তো এই রোদ এই বৃষ্টি।

অনু খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বলল, এই রোদ এই বৃষ্টি হলেই সমস্যা অয়ন। শরীরের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়।

অয়ন বলল, কিন্তু আমার পরীক্ষা সামনে। টিউশন করাতে যেতে হয়, আবার কোচিংয়ে পড়তে যেতে হয় রোজ।

অনু বলল, তোর আর টিউশন করাতে হবে না। এখন থেকে তোর হাত খরচের টাকা সব আমিই দেব।

তুই কোত্থেকে দিবি আপু? মা যে বলল, বাসা ভাড়া আবার বেড়েছে। আর আমার পরীক্ষাও তো সামনে। অনেক খরচ।

ও নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।

অয়ন খানিক হাসলো। তারপর বলল, আমাকে ভাবতে হবে আপু। আমি বড় হচ্ছি, আর এই ঘরে আমি একাই তো ছেলে। ছেলেদের অনেক দায়িত্ব নিতে হয়।

কথাটা শেষ করেই অয়ন বুঝলো কথাটা বলা তার ঠিক হয়নি। এখন সবাই মিলে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে। পরিবারে সবার ছোট হওয়ার এই এক সমস্যা। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না যে, সে বড় হয়েছে। অয়ন আতঙ্ক নিয়ে আড় চোখে মা আর বোনের দিকে তাকালো। অবাক ব্যাপার হলো অয়নের কথা শেষ হয়ে গেলেও কেউ কোনো কথা বলল না, হই হুল্লোড় করলো না। বরং সবাই যেন কেমন চুপচাপ হয়ে গেল আরো। আরো বেশি নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ।

অয়ন খানিক চুপ করে থেকে বলল, আজ তোমাদের সবার কী হয়েছে। বলো তো?

অনু বলল, কী হবে?

অয়ন বলল, কিছু একটা তো হয়েছেই। সবাই কেমন অন্যরকম।

অনু কী বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তারপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলল, আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে রে অয়ন!

অয়ন মুহূর্তের জন্য উচ্ছ্বসিত হতে গিয়েও আচমকা থমকে গেল। এই বাড়িতে অনুর বিয়ে এক রহস্যময় আতঙ্কের নাম। ভীষণ লজ্জা আর সংকোচেরও বিষয়। সেই ছোটবেলা থেকে অয়ন দেখে এসেছে, বড় আপুর বিয়ে নিয়ে নানান কথা, হাজার ঝাট। ছোট আপু বেনু, মেজো আপু তনুর অব্দি বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু বড় আপুর বিয়েটা আটকেই রইল, তার বয়সও হয়ে গেল কত! চারপাশে ফিসফাস, অনুর বুঝি আর কখনোই বিয়ে হবে না। আর যদি হয়ও, তবে তা কোনো বুড়ো ভাম পুরুষের সাথে। সতীনের সংসার করতে হবে অনুকে। এই নিয়ে রোজ রোজ কত হিসেব-নিকেশ, কেচ্ছা কাহিনি! আজকাল অবশ্য অনুর বিয়ে নিয়ে কেউ আর প্রকাশ্যে কোনো কথাও বলে না। মা বা ছোট আপুরা যে বলতে চায় না, তা নয়। কিন্তু অনুকে সবাই কম বেশি ভয় পায়। তা পাবে না কেন? এই ঘর, এই সংসার, এই তনু, বেনু, অয়ন, সব তো অনুর ওই শীর্ণ কাঁধ আর ক্রমাগত ন্যুজ হয়ে যাওয়া পিঠে ভর করেই বেড়ে উঠেছে। সেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে যে শক্তির দরকার, তনু, বেনুরা তা অর্জন করতে পারেনি।

অয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো, মা?

সালমা বেগম যেন হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি খানিক অনুর দিকে তাকালেন, খানিক অয়নের দিকে। অনুকে কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। তারপর আলতো হাতে টেবিলের উপর থেকে পানির জগটা তুলে নিয়ে গভীর মনোযোগে গ্লাসে পানি ঢালতে লাগলেন। খুব ধীরে। যেন সময়টাকে এই জগ, গ্লাস আর ঝরতে থাকা পানির মধ্যে তিনি আটকে রাখতে চাইছেন। অনু কী বুঝলো কে জানে, সে ধীর পায়ে হেঁটে এসে অয়নের কাছে দাঁড়ালো। তারপর অয়নের কাঁধে আলতো হাত রেখে বলল, আমাকে ছাড়া থাকতে তোর কষ্ট হবে অয়ন?

প্রশ্নটা খুব সহজ, সাধারণ। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সহজ সাধারণ প্রশ্নের উত্তরই হয় সবচেয়ে বেশি কঠিন। অয়নের মনে হলো, এই প্রশ্নের উত্তরটাও সেই সবচেয়ে বেশি কঠিন উত্তরের একটি। অনু আপুকে ছাড়া থাকতে কী তার কষ্ট হবে? অয়ন অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারল না। তার হয়তো বলে দেয়া উচিত যে, হ্যাঁ, তার খুব কষ্ট হবে, কিন্তু এই মুহূর্তে অয়নের কেন যেন এই অনিশ্চিত উত্তরটি দিতে ইচ্ছে করলো না।

অয়ন বলল, তুমি এখানেই থেকে যেও। বিয়ে হলেই কি সবাইকে চলে যেতে হবে?

অনু মৃদু হাসলো। তারপর দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, তাহলে তোর বিয়ে হলেও কী তোর বউটাকে আমরা তার বাবার বাড়িতেই রেখে আসবো?

অনু আপু যে এমন কিছু একটা বলবে, অয়ন শেষ মুহূর্তে এসেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ততক্ষণে যা বলার সে বলে ফেলেছে। অয়ন করুণ ভঙ্গিতে অনুর দিকে তাকালো।

অনু বলল, নুহা মেয়েটা কেমন আছে অয়ন? ওকে তো আর বাসায় নিয়ে এলি না!

অয়নের এবার সত্যি সত্যি রাগ হয়ে গেল। অনু আপু সবসময় তার সাথে যেন কেমন করে কথা বলে। তাকে পাত্তাই দিতে চায় না। তার সবকিছুকে ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দেয়। এই নিয়ে অয়নের ভারি অভিমান হয়। রাগও হয় মাঝেমধ্যে। সে খাবার ছেড়ে উঠে পড়লো। মা বার কয়েক ডাকলেন, কিন্তু অয়ন শুনলো না। সে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় চলে গেল। আবছা আলোয় বারান্দা ছাড়িয়ে উঠে যাওয়া আম গাছটার ডালপালা দেখা যাচ্ছে। সেখানে থোকায় থোকায় মুকুলও ধরেছে। এবার কি অনেক আম ধরবে গাছটায়? ধরলেও অবশ্য লাভ নেই। বাড়িওয়ালা আজিজুল মিয়ার স্ত্রী সারাক্ষণ এই আম গাছে শ্যেনদৃষ্টি রাখে।

.

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অয়নের মনে হলো তার গা একটু গরম লাগছে। আবারো জ্বর এলো না-কি! আজকাল কী যে হয়েছে, যখন তখন ঠান্ডা জ্বর লেগে যাচ্ছে তার! আজ শেষ বিকেলেও বৃষ্টি হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও সেই বৃষ্টিটা এড়াতে পারেনি অয়ন। নিজের কোচিং শেষ করে নুহার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। নুহার কোচিং তখনো শেষ হয়নি। সন্ধ্যাবেলা নুহাকে একা ফেলে চলে যেতেও মন সায় দিচ্ছিল না। অয়ন তাই নুহার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। আচমকা বৃষ্টি শুরু হতেই সে দৌড়ে গিয়ে কোচিংয়ের পাশের ঘিঞ্জি চায়ের দোকানটাতে দাঁড়ালো। কিন্তু সেখানে এত মানুষের ভিড় ছিল যে নিজেকে বৃষ্টির ছাট থেকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারেনি সে। নুহাকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়েই এসেছে অয়ন। অয়নের এই একটা জিনিস ভেবে খুব ভালো লাগে, কিছুটা সময়ের জন্য হলেও সে কারো দায়িত্ব নিতে পারে। এই যে সন্ধ্যাবেলা নুহাকে সে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসে, এই সময়টা নিজেকে খুব বড় বড় লাগে অয়নের। মনে হয় সে কারো দায়িত্ব নিতে পারছে।

নুহা আর সে একই ক্লাসে পড়ে। তারা দু’জন ভালো বন্ধু। অয়ন অবশ্য খুব যে কারো সাথে মেশে, তাও না। নুহা ছাড়া তার বন্ধু বলতে মাসুদ আর রনি। এছাড়া যাদের সাথে সে মেশে, তাদের বরং বন্ধুর চেয়ে ক্লাসমেটই বেশি বলা যায়। তবে নুহার সাথে তার সম্পর্কটা একটু বেশিই অন্যরকম। সবাই অবশ্য ভাবছে, তার আর নুহার মধ্যে আলাদা কোনো ব্যাপার আছে। কিন্তু অয়নের কখনো তা মনে হয়নি। সে নুহাকে নিয়ে আলাদা করে কখনো কিছু ভাবেওনি। তবে হ্যাঁ, নুহার সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে। একসাথে থাকা সময়টুকু কেমন আর সকল সময়ের চেয়ে অন্যরকম। তা এমন তো হতেই পারে, ভালো বন্ধু হলে এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক!

.

এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছিস? দেখছিস না-কি মশা? অনুর গলা শুনে অয়ন মাথা ঘুরিয়ে তাকালো, তবে কথা বলল না। অয়নের আরো খানিকটা কাছে এসে অনু রীতিমত আঁতকে উঠল, তুই আবারো বৃষ্টিতে ভিজছিস অয়ন? এক্ষুণি ঘরে আয়, এক্ষুণি।

অয়ন চুপচাপ ঘরে চলে এলো। অনু বারান্দা থেকে ফিরতে গিয়েও অবচেতনেই যেন জানালাটার দিকে তাকালো। অন্ধকার জানালা। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের খানিক আলো তেরছাভাবে পড়েছে জানালার গ্রিলে। অনুর মনে হলো, সেই সামান্য আলোয় জানালার পর্দা এবং ভেতরের অন্ধকার ভেদ করেও অনু সেই গা ঘিনঘিনে চোখজোড়া দেখতে পেল।

ঘরে ঢুকে একখানা গামছা এনে অয়নের মাথা মুছিয়ে দিলো অনু। তারপর অয়নের বিছানা করে দিলো, মশারি টানিয়ে দিলো। অয়ন অবাক চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল, এসব কাজ তাকে কেউ কখনো করে দেয় না। সে বরং নিজে নিজেই করে, কিন্তু আজ হঠাৎ কি হলো?

অয়নের থাকার আলাদা ঘর নেই। সে থাকে ড্রইংরুমের একপাশে পাতা ছোট্ট খাটটাতে। খাটের একপাশে টেবিল। টেবিলের সাথে আলাদা করে চেয়ার বসানোর জায়গা নেই বলে সে খাটে বসেই পড়াশোনা করে। মাঝেমধ্যে অবশ্য হেলান দিতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু খাটে বসে হেলান দেয়া যায় না। মেরুদণ্ড টানটান করে বসে থাকতে হয় সারাক্ষণ। এই কারণেই কি-না কে জানে, অয়ন হাঁটে একদম সোজা হয়ে।

রাতে ঘুমাতে গিয়ে অয়ন যেন খানিক জড়সড়ই হয়ে গেল। সে অবাক হয়ে দেখলো, তার মা সালমা বেগম একটা বালিশ নিয়ে তার সাথে ঘুমাতে চলে এসেছেন। অয়নের খাটটা অনেকটা সরু ডিভানের মতো। এখানে সে একাই ঘুমায়। সালমা বেগম ঘুমান তনুর সাথে। রাত-বিরাতে তনু একা তার মেয়েকে সামলাতে পারে না। সালমা বেগম থাকলে তার ভারি সুবিধা হয়। ফলে তিনি ঘুমান তনুর সাথেই, কিন্তু আজ হঠাৎ কী এমন হলো যে মা তার সাথে ঘুমাতে চলে এলো!

অয়নের আচমকা মনে হলো, বাড়িতে খুব খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। সবাই চেষ্টা করছে সেই খারাপ কিছু একটা তার কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে। কিন্তু পারছে না। বরং সেটি করতে গিয়ে অনু আপু, মা তার সাথে আরো বেশি বেশি অস্বাভাবিক আচরণই করে ফেলছেন। অনু আপুর বিয়ে বা তনু আপুর সংসার নিয়ে নয়, সমস্যাটা অন্য কিছু নিয়ে। কিন্তু সেই অন্য কিছুটা কী, যা সবাই তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে?

অয়ন চুপচাপ মশারির ভেতর ঢুকলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অয়নের মনে হলো সমস্যাটা আর কাউকে নিয়ে নয়, সমস্যাটা তাকে নিয়েই!

.

অনু পরপর আরো দুদিন অফিসে গেল না। ইচ্ছেমত যখন তখন অফিস কামাই দেবার মতো সৌখিন চাকরি অনুর নয়। বরং উল্টোটাই, কিন্তু তারপরও গুরুতর কারণেই অনুকে অফিস কামাই দিতে হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যা ঠিক সাতটায় সে এসেছে প্রফেসর আশফাক আহমেদের চেম্বারে। আশফাক আহমেদ হেমাটোলজির নামকরা ডাক্তার। তার এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। অনু এপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে অফিসে তার প্রজেক্টের ম্যানেজার এবং একইসাথে ব্রাঞ্চ হেড আলতাফ হোসেনের কল্যাণে। প্রফেসর আশফাক আহমেদ সময় নিয়ে রিপোর্টগুলো দেখলেন। তারপর ধীরে সুস্থে চোখ থেকে চশমাটা খুললেন। তার মাথাভর্তি চকচকে টাক। অনুর কেন যেন আশফাক আহমেদের মুখের দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছে। সে তাকিয়ে আছে তার চকচকে টাকের দিকে। আশফাক আহমেদ খানিক ঝুঁকে তার হাত দুটি লম্বালম্বি টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমার বয়স কত?

অনু আশফাক আহমেদের কাছ থেকে এই প্রশ্ন আশা করেনি। সে খানিকটা থতমত খাওয়া গলায় বলল, স্যার, রিপোর্টগুলো আমার নয়, আমার ছোট ভাইয়ের।

।আশফাক আহমেদ আবারো একইরকম গলায় বললেন, বয়স হয়েছে, আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না, ভুলে যাই। কিন্তু রিপোর্টগুলো কার, সেটা তো লেখাই আছে।

অনু মিনমিন করে বলল, এই পঁয়ত্রিশ হলো।

আশফাক আহমেদ বললেন, ওহ। তোমাকে দেখে অবশ্য আমি আরো ছোট ভেবেছিলাম। ইউ লুক মাচ ইয়াংগার দ্যান ইওর এজ।

এই আলোচনাটা অনুর ভালো লাগছিল না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। একইসাথে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাও। আশফাক আহমেদ অবশ্য এবার সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। তিনি বললেন, এখানে ছাড়াও আগে আর কোথাও টেস্ট করিয়েছিলে?

অনু বলল, জি স্যার।

আশফাক আহমেদ বললেন, সেই রিপোর্টগুলো কোথায়?

অনু রিপোর্টগুলো বের করে টেবিলে রাখলো। আশফাক আহমেদ এবার অবশ্য খুব একটা সময় নিলেন না রিপোর্টগুলো দেখতে। তিনি রিপোর্ট দেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, আমার ধারণা পেশেন্টের অবস্থাটা তুমি জানো। আগের ডাক্তার নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছেন, কিন্তু এইসব সিচ্যুয়েশনে সামান্য কনফিউশনেও থাকতে চাই না আমরা। সে জন্যই হয়তো তুমি আরো কনফার্ম হতে এখানে আবার টেস্ট করিয়েছ।

অনু দমবন্ধ করে আশফাক আহমেদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার আর তার মুখের দিকে তাকাতে ভয় করছে না অনুর। আশফাক আহমেদ সামান্য সময় নিয়ে বললেন, দিস ইজ একিউট মায়লয়েড লিউকোমিয়া। রক্তের শ্বেত কণিকায় ক্যান্সার সেল অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে। ইভেন ব্রেনেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় কেমোও কাজ করে না। বাইরে থেকে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছু বোঝা যায় না। মনে হয় সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। মাঝেমধ্যে জ্বর ঠান্ডা হবে তবে এর বেশি কিছু না।

তিনি একটু থামলেন। তারপর শান্ত, গম্ভীর গলায় বললেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেয়ার ইজ নো চান্স ফর হিজ সারভাইভাল। অ্যান্ড হি ইজ আউট অফ এনি ট্রিটমেন্টস। কোনো লাভ নেই। কেমো দিলে শুধু শুধু কষ্টটা বাড়বে। আই থিঙ্ক, পেশেন্ট ম্যাক্সিমাম তিন মাস, বা ধরো চার মাস সারভাইভ করতে পারে। ম্যাক্সিমাম। বাইরে থেকে ওই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ছাড়া আলাদা করে কিছু বোঝার উপায় নেই। বাট…।

আশফাক আহমেদ কথা শেষ করলেন না। তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন, তার সামনে বসা এই বাচ্চা চেহারার মেয়েটা এই ধকলটা নিতে পারবে কি! যদিও মেয়েটা বলেছে তার বয়স চৌত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ, কিন্তু আশফাক আহমেদ এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না। তিনি হঠাৎ কী মনে করে অনুর মাথায় হাত রাখলেন। পেশেন্টের যত খারাপ অবস্থাই হোক, এই কাজটি তিনি কখনো করেন না।

.

অনু চেম্বার থেকে বের হয়ে রিকশা নিলো। তাদের বাসা মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড। কলাবাগান থেকে তাজমহল রোড রিকশায় যেতে অনেকটা পথ। এই পুরো সময়টা অনু হুড খোলা রিকশায় আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বসে রইল। আকাশ ভর্তি অগুনতি তারা। সেই তারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুর মনে হলো তার চারপাশে আর কোনো কোলাহল নেই, গাড়ির হর্ন, রিকশার টুংটাং শব্দ কিছু নেই। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক নিঃশব্দ চরাচরে। এই নিঃশব্দ চরাচর থেকে অনু আর কখনো কোলাহলের পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায় না।

*

বিদঘুঁটে সন্ধ্যাটা চোখের সামনে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে গেল অয়নের। কোচিং শেষে আজও নুহাকে বাসায় দিয়ে আসছিল সে। স্যারের বাসা থেকে নুহার বাসা অব্দি হেঁটে যেতে ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় তিরিশ মিনিট লাগে। হাঁটার জন্য তিরিশ মিনিট লম্বা সময়। কিন্তু অয়নের মনে হয়, এই তিরিশটা মিনিট যেন এক ফু-তে উড়ে চলে যায়। রিকশায় গেলে তো সময় আরো কম। অয়ন তাই এই সময়টা হেঁটে যেতেই চায়।

নুহার কোচিং থেকে বের হবার মিনিট পাঁচেকের মাথায় বৃষ্টি শুরু হলো। অয়ন একবার ভাবলো, কোনো দোকান বা ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াবে। এই মুহূর্তে তার মনে পড়লো, মা আজ জোর করে ছাতা দিয়ে দিয়েছেন। অয়ন ব্যাগ খুলে ছাতা বের করলো। আর সাথে সাথেই নুহা বলল, এই অয়ন, ছাতাটা রাখনা। চল, আজ ভিজি।

অয়ন অসহায়ের মতো নুহার দিকে তাকালো। নুহা বলল, তুই দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস অয়ন। আগের সেই অ্যাডভেঞ্চারাস ব্যাপারটা আর তোর মধ্যে নেই।

অয়ন বলল, আমার শরীরটা আজকাল হুটহাট খারাপ হয়ে যাচ্ছেরে নুহা। যখন তখন ঠান্ডা, জ্বর।

অয়নের হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিতে নিতে নুহা বলল, লাগুক ঠান্ডা, জ্বর। আমার বড় মামা ডাক্তার। তার কাছ থেকে ফ্রি ট্রিটমেন্ট করিয়ে দেব তোকে।

অয়ন কী বলবে! সে নুহার দিকে তাকিয়ে রইল। নুহা ছাতাটা ভাঁজ করে অয়নের পিঠের ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে দিতে বলল, মা আমাকেও রোজ ছাতা দিয়ে দেয়। আমি নানান বাহানায় রেখে আসি। এই জন্য অবশ্য বকাও খেতে হয়। তবে আজ মা বাসায় নেই। বৃষ্টিতে ভেজার এমন সুযোগও আর পাব না।

অয়ন বলল, তোর বাবা কিছু বলবে না?

নুহা বলল, আরে ধুর! বাবা এসব খেয়ালই করবে না!

অয়নের শরীরটা খারাপ লাগছিল। ভয়ও হচ্ছিল খুব। কারণ এখন বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরলে এই নিয়ে তুলকালাম হবে নিশ্চিত, কিন্তু নুহা এমন করে বলল যে, সে না করতে পারল না। আজকাল রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার এখানে সেখানে খানাখন্দগুলোয় বৃষ্টির জল জমে রাস্তাগুলোও বিপদজনক হয়ে আছে। অয়ন তাই খুব দেখেশুনে সতর্ক হয়ে হাঁটছিল, কিন্তু নুহার সেসবের বালাই নেই। সে যেন ডানা মেলা প্রজাপতি। এই খানাখন্দ ভরা রাস্তায়ও নুহা যেন। উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অয়ন বার দুই তাকে সতর্কও করলো, কিন্তু নুহা দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সত্যিকারের প্রজাপতির মতোই অয়নের কাছে উড়ে এলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, তুই এত ভীতু হয়ে যাচ্ছিস কেন রে অয়ন?

অয়ন নুহার কথার জবাব দিতে গিয়েও পারল না। তার আগেই জলের নিচে ডুবে থাকা কিছুতে হোঁচট খেলো নুহা। তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার জল কাদার ভেতরই প্রায় পড়ে যাচ্ছিল সে। শেষ মুহূর্তে নুহাকে ধরে তার পড়ে যাওয়া ঠেকালো অয়ন।

নুহা অবশ্য সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। তার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। তবে তার চেয়েও বাজে ব্যাপার হচ্ছে তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উঠে গেছে। উঠে যাওয়া নখ থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। প্রচণ্ড ব্যথায় মুখ বিকৃত করে আছে সে। অয়ন এদিক-সেদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজলো, কিন্তু এই বৃষ্টিতে কোথাও কোনো খালি রিকশা নেই। অয়ন কিছুক্ষণ সেখানেই দিশেহারার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নুহাকে এক হাতে আগলে ধরে তার শরীরের ভার অনেকটাই নিজের শরীরে নিয়ে বাকি পথটুকু হেঁটে এলো সে। খানিক আগের উড়ে বেড়ানো নুহা যেন মুহূর্তেই ভেজা তুলোর মতো মিইয়ে গেল। নুহাকে যখন বাড়ির গেটে পৌঁছে দিলো, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই বলে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাটা খানিক বেশিই গাঢ়। অয়ন আর নুহা কিছুক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। অয়নের এক হাতে তখনো নুহার ভেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া। নুহা অচমকা দুষ্টুমির স্বরে বলল, তুই এখনো আমার স্যান্ডেল হাতে দাঁড়িয়ে আছিসরে গাধা!

অয়ন একবার হাতের স্যান্ডেলের দিকে তাকালো। তারপর মৃদু হেসে বলল, সবসময় তো পায়েই থাকে, আজ না হয় কিছুক্ষণ হাতে থেকে দেখুক কেমন লাগে!

নুহাও হাসলো। তারপর বলল, তখন ভুল বলেছিলাম। তুই কিন্তু মোটেই আনঅ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে যাসনি। বরং অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে গেছিস। তবে সাথে কেমন একটা সেন্সিবল ব্যাপারও চলে এসেছে। এই মানে ধর রেসপন্সিবল টাইপ।

অয়ন বলল, বাসার সবার তো উল্টো ধারণা।

নুহা বলল, বাসায় এমনই হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে মনে হয় তারা বড় হয়ে গেছে, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে মনে হয় তারা ছোট রয়ে গেছে।

অয়ন খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমি যাই নুহা। বাসায় বকবে।

নুহা ঘাড় কাঁত করে বলল, আচ্ছা।

অয়ন ভেবেছিল নুহা তাকে আরো কিছু বলবে। কিন্তু নুহা আর কিছুই বলল। অয়ন ঘুরে গেট থেকে বের হলো। আশেপাশে একটাও খালি রিকশা নেই। রাস্তায় জমে থাকা জল ছিটিয়ে দিয়ে একটা গাড়ি ঝুপ করে ছুটে গেল। অয়ন বিরক্তি নিয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক এই মুহূর্তে পেছন থেকে নুহা ডাকলো। অয়ন ঘুরে তাকাতেই সে বলল, এদিকে আয়।

অয়ন অবাক চোখে নুহার দিকে তাকিয়ে রইল। নুহা আবারো বলল, কী হলো? আয় এদিকে।

নুহার গলায় কিছু একটা ছিল। অয়ন ঘোরগ্রস্তের মতো সিঁড়ির পাশের অন্ধকার জায়গাটাতে গেল। সেখানে নুহা দাঁড়িয়ে। নুহা হঠাৎ বলল, আমি তোর সন্ধ্যাটা নষ্ট করে দিলাম তাই না অয়ন?

অয়ন একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ভেবেছিল নুহা তাকে অন্য কিছু বলবে। কিন্তু সেই অন্য কিছুটা কী, অয়ন নিজেই তা জানে না। সে অনেক ভেবেও সেই অন্য কিছুটা খুঁজে বের করতে পারেনি। নুহা এক পা সামনে এগিয়ে আলতো করে অয়নের গালে হাত রাখলো। এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে অয়নের কেমন শীত শীত লাগছে। নুহাও ঠান্ডায় কাঁপছে। কিন্তু নুহার হাতের ওইটুক স্পর্শ অয়নের কাছে কী উষ্ণ মনে হলো! কী আরামদায়ক মনে হলো? নুহা আচমকা ফিসফিস করে বলল, তুই খুব ভালো অয়ন। তুই খুব ভালো।

অয়নের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, তার গালের সাথে নুহার হাতটিকে আরো শক্ত করে চেপে ধরতে, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে তা সে পারছিল না। অয়ন যেমন ছিল, তেমনই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নুহা আরো খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে তার হাতটি বাড়িয়ে অয়নের চুলের ভেতর ডুবিয়ে দিলো। অয়নের মনে হলো সে নুহার তপ্ত নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে।

সেই তপ্ত নিঃশ্বাস আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে নুহা কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বলল, এমনই থাকিস অয়ন।

অয়ন হঠাৎ বলল, কেমন?

নুহা বলল, এই যে এমন সহজ, ভালো। এমন আর সকলের চেয়ে আলাদা।

অয়ন জানে না কেন, তার চোখে হঠাৎ জল চলে এলো, কিন্তু সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সেই জলটুকু ঝরতে না দিতে, নুহাকে দেখতে না দিতে। নুহা আবারো তার গালে হাত রাখলো। তারপর বলল, মনে থাকবে অয়ন?

অয়ন কী জবাব দেবে? নুহা আজ এমন করে বলছে কেন? এই বলার কী বিশেষ কোনো অন্য অর্থ রয়েছে?

অয়ন মুখে কিছু বলল না। কেবল শেষ মুহূর্তে সে তার মাথাটা সামান্য নিচু করে ফেলল। এই নিচু করে ফেলার অর্থ হতে পারে নুহার প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ, মনে থাকবে। হতে পারে অয়ন তার চোখ থেকে ঝরে পড়া রহস্যময় জলের ফোঁটাটুকু নুহার কাছ থেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে।

.

অয়নের সাথে শামীমের দেখা হয়ে গেল বাসার কাছের গলির মোড়ে। শামীম তনুর হাজবেন্ড। সে একটা বন্ধ দোকানের সামনে ভেজা কাপড়ে জড়সড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে মাটিতে সিলভারের বড়সর একটা চকচকে পাতিল। পাতিলের মুখ কাগজ দিয়ে আটকানো। শামীমের চোখে চশমা। খানিক পরপর সে ভেজা শার্টের খুঁটে তার চশমা মুছছে। এতে চশমার কাঁচ পরিষ্কার হবার বদলে আরো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। সে সেই ঝাপসা চোখে অয়নকে কীভাবে দেখলো কে জানে! অয়ন রিকশা থামিয়ে শামীমের সামনে। দাঁড়ালো। শামীম অত্যন্ত নরম গলায় বলল, দুঃখিত অয়ন, তোমাকে বিরক্ত করলাম।

অয়ন বলল, এটা কোনো কথা হলো ভাইয়া?

শামীম বলল, নাহ্! তুমি এতটা পথ বৃষ্টিতে ভিজে এলে, তোমাকে আবার দাঁড় করালাম।

অয়ন বলল, কিন্তু আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বাসায় যাননি?

শামীম বলল, গিয়েছিলাম। নিচের কলাপসিবল গেটের বাইরে থেকে অনেকক্ষণ ধরে কলিংবেলও চাপলাম। কিন্তু উপর থেকে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর হঠাৎ মনে হলো, আরে, কী বোকা আমি, কারেন্টই তো নেই, কেউ শুনবে কী করে! আর এই দেখো, বৃষ্টিতে পানি ঢুকে ফোনও বন্ধ হয়ে গেছে। কী দুরবস্থা বলো তো!

শামীম পকেট থেকে ফোন বের করে অয়নকে দেখালো। ফোন সত্যি সত্যিই বন্ধ হয়ে গেছে। শামীমের চোখ-মুখ জুড়ে বিব্রত হাসি। যেন ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় কোনো অপরাধ। সে অবশ্য এমনই। সবসময়ই কেমন এক দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ। চলনে-বলনে সাদাসিধে, বিনয়ী। দেখতে ছিপছিপে, ফর্সা, লম্বা। হাঁটার সময় সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে হাঁটে। দেখে মনে হয় তার চারপাশের জগত সংসারে কি ঘটছে তা নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই।

অয়ন বলল, আপনার পাশে এটা কী?

শামীম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, মাছ। জিওল মাছ।

অয়ন বলল, জিওল মাছ কী?

শামীম বলল, জীবন্ত কই আর মাগুর মাছ। আমাদের পুকুরের মাছ। পাতিলের মধ্যে পানি দিয়ে নিয়ে আসছি। এই যে সাঁতার কাটছে, শব্দ শুনতে পাচ্ছ?

অয়ন কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করলো, কিন্তু কোনো শব্দ শুনতে পেল। শামীম বলল, এই মাছ খেলে শরীরে রক্ত হয়। তনুর শরীরে এখন রক্ত দরকার। হাফসা হবার সময় অনেক রক্ত গেছে। আমি তো সেই একবার মাত্র। আসতে পারলাম। আর পারলাম না। প্রথম সন্তান, অথচ স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কী করব বলো? হুট করে চাকরিটা চলে গেল। প্রথম সন্তান হবার আগে আগে চাকরি চলে যাওয়ার চেয়ে খারাপ কিছু আর হয় না। মাথায় নানান টেনশন। নতুন ব্যবসা শুরু করেছি। সেখানেও সমস্যা, মাথা কাজ করে না।

শামীমের করুণ মুখ দেখে অয়নের মায়াই লাগল। তারা বাসার সামনের গেটে এসে দেখলো অনুও ঢুকছে। অনুকে দেখে অয়ন ভয় পেয়ে গেল। এই ভেজা চুপচুপে অবস্থায় তাকে দেখে অনু নির্ঘাত লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে। কিন্তু অয়নকে অবাক করে দিয়ে অনু কিছুই বলল না। সে শামীমকে দেখে বলল, শামীম, ভালো আছ?

অন্ধকারেও শামীম অনুর মুখের দিকে তাকালো না। সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, জি আপা ভালো আছি। আপনারা সবাই ভালো?

অনু এই কথার জবাব দিলো না। হয়তো অন্ধকারে মাথা নাড়লো বলে অনুর অভিব্যক্তিও কেউ দেখতে পেল না। সে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে গেট খুললো।

.

সেই রাতে অনুর সাথে আর কারো খুব একটা কথা হলো না। সালমা বেগম রাতে অনুর সাথে কথা বলতে এলেন। অনু তার সাথেও তেমন কিছুই বলল না। পরদিন ভোরে সে অফিসে চলে গেল। অফিসে যাওয়ার আগে অয়নকে বলে। গেল সন্ধ্যাবেলা তার অফিসে আসতে। সারাদিন অফিসে একটানা কাজ করলো অনু। তার চাকরিটা স্থায়ী কোনো চাকরি নয়, কাজের চাপও প্রচুর। একটা। এনজিও’র দুই বছর মেয়াদি প্রজেক্টের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর সে। তবে এই মেয়াদ আরো বাড়বে বলে কানঘুষা চলছে। অনুরও ধারণা প্রজেক্টের মেয়াদ বাড়বে। এই কারণেই খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করছে সে। যদিও জানে, এনজিওর চাকরিতে নিশ্চিন্ত বলে কিছু নেই।

অনু যখন অফিস থেকে বের হয়েছিল, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। অয়ন আসতে কিছুটা দেরি করলো। রিকশায় অয়নের সাথে নানান এলোমেলো, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে লাগল অনু। যেন সে জানে না, অয়নের সাথে তার কী কথা বলা উচিত। কিংবা সে এমন কিছু বলতে চায়, যেটি অয়নকে বলা উচিত নয়। এমন প্রবল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই অনু বলল, আসতে এত দেরি করলি যে?

অয়ন বলল, কোচিং শেষ করে এলাম তো!

নুহাকে পৌঁছে দিয়ে এলি?

নাহ্। ও আজ আসেনি। গতকাল হোঁচট খেয়ে পায়ের নখ উঠে গেছে।

এখন কী অবস্থা?

পা ফুলে গেছে। ব্যথা খুব।

নুহার জন্য খারাপ লাগছে অনেক? তুই ওকে খুব পছন্দ করিস, না?

অনুর আচমকা এমন প্রশ্নে অয়ন সামান্য থমকে গেল। সে জবাব দিল না। চুপ করে রইল। অনু যেন বুঝতে পারল, অন্তত এই অবস্থায় তার এমন করে বলাটা ঠিক হয়নি। বিষয়টা স্বাভাবিক করার জন্যই সে বলল, তোরা খুব ভালো বন্ধু, তাই না?

অয়ন বলল, হু। ও আমার খুব ভালো বন্ধু আপু।

অনু বলল, জীবনে ভালো বন্ধু খুব দরকার অয়ন। নিঃসঙ্গতার চেয়ে খারাপ কিছু আর নেই।

অয়ন কী ভেবে হঠাৎ বলল, বন্ধু না হলেই কী মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়? তার চারপাশে তো কত মানুষই থাকে?

অনু বলল, মানুষের অভাবে মানুষ নিঃসঙ্গ হয় না, মানুষ নিঃসঙ্গ হয় ভালো বন্ধুর অভাবে, কাছের মানুষের অভাবে।

তুই কী তাহলে নিঃসঙ্গ মানুষ?

কেন? এটা বললি কেন?

তোর তো কোনো বন্ধু নেই আপু। না, মানে কখনো দেখিনি তো।

সব কিছু কী দেখা যায়?

দেখা যায় না?

উঁহু। পৃথিবীতে বেশিরভাগ জিনিসই দেখা যায় না অয়ন। আর যেসব জিনিস দেখা যায় না, সেগুলো দেখা জিনিসের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।

অয়ন বুঝতে পারছে, আজ অনুর কিছু একটা হয়েছে। অনু কখনো তার সাথে এমন করে কথা বলে না। অয়নের সাথে যে অনুর অনেক কথা হয়, তা নয়। তবে যেটুকুই হয়, তাতে বেশিরভাগ সময়ই থাকে হাসি ঠাট্টা। এমন গম্ভীর অন্য অচেনা মানুষের মতো করে তার সাথে অনুকে কখনো কথা বলতে দেখেনি অয়ন। অয়ন কী বলবে ভেবে পেল না। অনুর সাথে এমন রিকশা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও তার তেমন একটা নেই। পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকতেও যেমন অস্বস্তি হচ্ছে অয়নের, তেমনি কথা বলতে গিয়েও সে ভেবে পাচ্ছে না কী নিয়ে কথা বলবে!

অনু বলল, ধর ভালোবাসা। এটা কখনো দেখা যায়? মায়া, স্নেহ, ঘৃণা, কষ্ট? এগুলো কিছুই কি কখনো দেখা যায়? যায় না। অথচ এগুলোই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, তাই না?

অয়ন আচমকা বলল, তোর আজ কী হয়েছে আপু?

অনু সতর্ক গলায় বলল, কী হয়েছে মানে? আমার আবার কী হবে?

কিছু একটা তো হয়েছেই।

অনু হাসার চেষ্টা করলো। বলল, কেন, দার্শনিকদের মতো কথা বলছি?

নাহ্। অচেনা মানুষের মতো কথা বলছিস। মনে হচ্ছে তোকে আমি চিনি না। অন্য কোনো মানুষের সাথে রিকশায় বসে আছি।

আচ্ছা, তাহলে বল, চেনা মানুষের মতো হতে হলে কীভাবে কথা বলতে হবে? নুহাকে নিয়ে তোকে খোঁচাতে হবে?

এই ধুর, তুই না আপু! এই বড় মানুষ হয়ে যাস্ তো আবার সাথে সাথেই বাচ্চাদের মতো করিস।

তুই নিজে কী?

আমি তো বড় হতেই চাই, কিন্তু তোদের জন্যই তো পারি না।

কত বড় হতে চাস? সামনের ওই বিল্ডিংটার সমান, না তার চেয়েও বেশি?

খুব সিরিয়াস হয়ে ওঠা পরিবেশটা খানিক হালকা করতে চাইছিল অনু। কিন্তু অয়ন হাসলো না। কথার পিঠে কোনো কথাও বলল না। সে চুপ করে গেল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, আমি একটা বড় চাকরি করার মতো বড় হতে চাই আপু।

বড় চাকরি করার মতো বড়?

হু।

কেন?

অনেক কারণ।

বল, শুনি?

এই ধর, মা সবসময় কেমন তেতে থাকে, কিছু বললেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে। রাত-বিরাতে একা একা কান্নাকাটি করে। মাকে আমি শেষ কবে হাসতে দেখেছি, ভুলেই গেছি আপু। আমার খুব ইচ্ছে জানিস, আমার বন্ধুদের মায়েদের মতো করে মাও সবসময় হেসে হেসে কথা বলবে।

তোর কী ধারণা, তোর চাকরি হচ্ছে না বলে মা এমন করছে?

অয়ন এই কথার জবাব দিল না। খানিক চুপ করে থেকে বলল, অনেক টাকা থাকলে সব কিছু অনেক সহজ হয়ে যায় আপু। সবাই অনেক আদর যত্ন করে, মান্যগণ্য করে। বন্ধুরাও আলাদা দাম দেয়। ধর হাতে একটা দামি মোবাইল ফোন থাকলেও চারপাশের মানুষের আচরণ বদলে যায়। ক্লাসে, কোচিংয়ে টিচাররা পর্যন্ত অন্যরকম করে দেখে। এমনকি…।

কিছু একটা বলতে গিয়েও অয়ন থেমে গেল। অনু বলল, কী?

কিছু না আপু।

বল?

নাহ্, কিছু না।

বললাম তো বল, আমি কিছু বলব না।

তোর মন খারাপ হবে আপু।

উঁহু, হবে না। তুই বল।

আমাদের অনেক টাকা থাকলে তোর বিয়ে নিয়েও এত সমস্যা হতো না। আপু। এখন যে সবাই একথা-সেকথা বলছে, তাও বলার সাহস পেত না। অনেক ভালো দেখে একটা বিয়ে হয়ে যেত তোর। তোর জন্য আমার খুব কষ্ট হয় আপু। দেখিস, আমার একদিন অনেক টাকা হবে। আমি আমাদের সবার সব দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারব। আর তোর অনেক রিলিফ লাগবে সেদিন, দেখিস।

অনু অয়নের দিকে তাকালো। অয়ন তাকিয়ে আছে রিকশার সামনের চাকার দিকে। অনুর খুব ইচ্ছে করছে অয়নের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতে। এই তো সেইদিনের অয়ন। এই এতটুকু একটা কাপড়ের পুটলির ভেতর পেঁচানো অয়ন। অয়ন কতটা মায়ের সন্তান? তার চেয়ে ঢের বেশি তাদের তিন বোনের। যেন একটা জীবন্ত খেলনা। অনুর বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। তার ইচ্ছে করছিল অয়নকে বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে। এত জোরে চিৎকার করে কাঁদতে, যেন সেই চিৎকারের শব্দ এই শহর, এই কোলাহল, এই পৃথিবী ছাড়িয়ে মাথার ওপরের ওই আকাশ অব্দি পৌঁছে যায়। সেখানে গিয়ে যেন কৈফিয়ত চাইতে পারে, তিনি এমন কেন করলেন?

আমরা এখন কই যাচ্ছি আপু?

কোথাও না। তোকে নিয়ে আমার হঠাৎ ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপু?

হু। কর।

আমার কী বড় ধরনের কোনো অসুখ করেছে?

অনু চট করে অয়নের দিকে তাকালো, কেন? তোর বড় কোনো অসুখ রবে কেন?

না, মানে, এই যে পরপর দুবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কত কিছু টেস্ট করিয়ে আনলি! প্রথমবার টেস্টের পরপরই মা কেমন করতে লাগল, তুইও হঠাৎ হঠাৎ কেমন করে কথা বলিস। মনে হয় আমার থেকে সবাই কিছু একটা লুকাতে চাইছিস।

অয়নের মাথায় আলতে চাটি মেরে অনু বলল, ধুর। কী যে বলিস তুই!

অয়ন অবশ্য অনুর কথা গ্রাহ্য করলো না। সে বলল, এই অসুখের ট্রিটমেন্ট করতে কি অনেক টাকা লাগে? তুই টাকা নিয়ে খুব টেনশন করছিস, তাই না? এখন বুঝেছিস তো, আমি কেন বড় চাকরি করার মতো বড় হতে চাই? এই যে কিছু একটা লাগলেই তোকে আর তাহলে এত টেনশন করতে হতো না আপু।

অনু অয়নের হাত ধরলো। তার হাতের মুঠোয় অয়নের হাতটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা। অয়ন বলল, একটা কথা বলি আপু?

হু।

ট্রিটমেন্টে কি অনেক সময় লেগে যাবে? যদি তেমন হয়, তবে ট্রিটমেন্টটা আমার পরীক্ষার পরে করাবি প্লিজ?

অনু কোনো কথা বলল না। সে মনোযোগ দিয়ে রাতের ঢাকার নিয়ন আলো দেখছে। সেই আলোয় ভেসে যাচ্ছে শহর, শহরের বিলবোর্ড, বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের হাসিমুখ তরুণ-তরুণী। হুড তোলা রিকশা, রিকশার পেইন্টিং, ঝলমলে যুগল। বাসের দরজায় ঝুলতে থাকা বাড়ি ফেরা ক্লান্ত মুখ। অনুর মনে হলো, এই শহরে দেখার মতো কত কিছুই যে রয়েছে। কিন্তু মানুষ এত বেশি নিজের জীবন দেখতে ব্যস্ত যে তার নিজেকে ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পায় না!

অয়ন বলল, তুই টাকা নিয়ে অত ভাবিস না আপু। একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। আমার এক বন্ধুর বড় ভাইয়ের কি এক অসুখ হলো, অনেক টাকা দরকার। তার বন্ধুরা সবাই মিলে চিকিৎসার ফান্ড কালেকশনে নেমে গেল ফেসবুকেও হেল্প ইভেন্ট খোলা হলো। মাত্র ক’দিনেই পুরো টাকা ম্যানেজ হয়ে গেল জানিস? এখন সে পুরোপুরি সুস্থ, তুই একদমই ভাবিস না। জাস্ট দেখিস ট্রিটমেন্টটা যেন আমার পরীক্ষার পর হয়। আর আমি তো এখন সুস্থই। কোনে সমস্যাও হচ্ছে না। পরীক্ষার পর পর্যন্ত একটু দেখিস আপু, একবার পরীক্ষ। মিস করলে আমি আরো একটা বছর পিছিয়ে যাব। আমার পিছিয়ে যেতে ইচে করে না।

ক্লাসমেটদের চেয়ে জুনিয়র হয়ে যাবি বলে?

না আপু, আমার মনে হয় আমার দ্রুত বড় হবার অনেক তাড়া।

যাতে তাড়াতাড়ি চাকরি করতে পারিস?

অয়ন মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ।

অনু হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালো, চল, আমরা আজ বাইরে কোথাও খাই।

অয়ন মাথা নিচু রেখেই বলল, আচ্ছা।

বাইরে অবশ্য তাদের খাওয়া হলো না। অনুর হাতে খুব একটা টাকা-পয়সা নেই। মাসের শেষ, তার ওপর অয়নের ডাক্তার, ওষুধ, ডায়াগনোসিসে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে গেছে। তারপরও সে অয়নকে নিয়ে ধানমন্ডির একটা রুফটপ রেস্টুরেন্টে গেল। আজকাল এই রেস্টুরেন্টগুলো খুব হচ্ছে শহরজুড়ে। বহুতল ভবনের ছাদের উপর খোলা আকাশের নিচে রেস্টুরেন্ট। অনুরা বসতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি এলো। সাথে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাত। দু’মিনিটেই যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব। ভেতরে যদিও বসার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু এত মানুষ আর কোলাহলে অয়নের আর ভালো লাগছিল না। তারা নেমে এলো তিন তলায়। সেখানে মোবাইল ফোনের দোকান। অনু অয়নকে চমকে দিয়ে একটা মোটামুটি ভালো দামের মোবাইল ফোন কিনে ফেলল। অয়ন বার কয়েক জিজ্ঞেস করলো, ফোনটা কার? অনু নাম বলল না। কেবল বলল, একজনকে উপহার দিবে। কিন্তু পছন্দটা করে দিতে হবে অয়নকে। তা অয়ন পছন্দ করেও দিলো। আবার মনে মনে অবাকও হলো। মাসের শেষে অনুর হাত যে খালি থাকে, তা অয়ন জানে। আর খালি না থাকলেও এতগুলো টাকা দিয়ে কাউকে ফোন কিনে দেয়ার মতো অবস্থা যে অনুর নেই, সেটাও তো সত্যি!

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনটা অয়নকে দিলো অনু। অয়ন অবাক গলায় বলল, কি?

অনু স্বাভাবিক গলায় বলল, এটা রাখ।

কাউকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে? কিন্তু কাল যে পারব না আপু। সারাদিন অনেকগুলো ক্লাস।

অনু মৃদু হাসলো, কাউকে দিয়ে আসতে হবে না।

তাহলে?

তোর কাছে রেখে দে।

আমার কাছে? কেন?

এটা তোর।

আমার!

অয়নের মুখ হা হয়ে গেল। তার কতবার যে ইচ্ছে হয়েছে এমন একটা ফোনের। এমন নয় যে নিজের হতে হবে, অনুর, মা’র বা তনু, যারই হতো, সে তো অন্তত খানিক গেম খেলতে পারতো। সিনেমা দেখতে পারতো। আরো কত কিছু যে করা যায় আজকাল ফোনে, কিন্তু কখনোই কাউকে বলার সাহস হয়নি অয়নের। তার বন্ধুদের অনেকেরই ফোন আছে। দামি দামি ফোন। কত কত রকমের গেম যে তাতে খেলা যায়! যদিও কলেজ থেকে ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আছে, কিন্তু তারপরও তো লুকিয়ে-চুরিয়ে সবাইই করে।

অয়ন বাকিটা সময় আর কথাই বলতে পারল না। সে চেষ্টা করছে তার উচ্ছ্বাসটা চেপে রাখতে, কিন্তু পারছে না। অনু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর বলল, তুই খুশি হয়েছিস অয়ন?

অয়ন কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে অনুর দিকে তাকালো না। দু’হাতে ফোন চেপে ধরে কিছু একটা করছে সে। তারপর হঠাৎই যেন শুনতে পেল অনুর কথা, এমন ভঙ্গিতে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক।

অনু বলল, কতটা অনেক?

অয়ন অনুর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুই যা তো আপু। পরে কথা বলছি।

অনু গেল না। সে বসেই রইল। নিস্পলক তাকিয়ে রইল অয়নের দিকে। কিন্তু অয়ন তখন ডুবে আছে অন্য কোনো জগতে। তার পুরো জগত তখন আচ্ছন্ন হয়ে আছে ওই ছোট্ট অবোধ যন্ত্রটার ভেতর। অয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুর মনে হলো, এমন একটা মুহূর্তের জন্য জীবনের অসংখ্য অপ্রাপ্তি ভুলে যাওয়া যায়। এই জগতে কাউকে আনন্দ কিনে দেয়ার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুতে নেই। আচ্ছা, এই এইটুকু প্রাপ্তির আনন্দের মুহূর্ত কী অয়নের সারাজীবনের অসংখ্য অপ্রাপ্তির কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পারছে?

অনুর ঘরের পর্দার আড়াল থেকে তখন একজোড়া চোখ অবিরাম ভিজে যাচ্ছে। সেই ভিজে যাওয়া চোখের জলের ভাষা পড়তে পারার সাধ্য কারো নেই, কারো না। সালমা বেগম তার বুকের ভেতর পৃথিবীর তীব্রতম চিৎকার চেপে রেখে নিঃশব্দ জলের যন্ত্রণাময় কান্নার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। দিচ্ছেন।

*

শামীমের কোলে হাফসা। শামীম মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ধারণা মেয়ে তার বাবাকে চিনতে পেরেছে। সে তনুকে ডেকে বলল, তোমার কাছে ভাংতি টাকা আছে?

তনু বলল, কত?

এই ধরো পাঁচশ টাকা?

পাঁচশ টাকা ভাংতি হলে আস্ত টাকা কত?

আস্ত টাকা হলো এক হাজার টাকা। আছে পাঁচশ টাকা?

পাঁচশ টাকা দিয়ে কী করবে?

মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছ? গা ভর্তি ঘামাচি উঠেছে। এই সময়ে পাউডার মাখতে হয় গায়ে।

ঘরে পাউডার আছে।

কই দেখি, কি পাউডার কিনেছ? আমার মেয়ের জন্য আজেবাজে জিনিস কিনবে না।

তনু পাউডারের কৌটা এনে দেখালো। শামীম সময় নিয়ে সেই কৌটা দেখলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল, এইসব দেশি আজেবাজে জিনিস কে এনেছে আমার মেয়ের জন্য? এই জিনিস আমার মেয়ের গায়ে মাখলে গায়ে ঘা হয়ে যাবে। তুমি এক্ষুণি টাকাটা দাও, আমি পাউডার নিয়ে আসি।

তনু বলল, বড়’পু এনেছে। তুমি ভালো করেই জানো, বড়পু হাফসার জন্য আজেবাজে জিনিস আনবে না।

আমি ভালো করে জানি বলেই তো বলছি। এই জিনিস আমার মেয়ে গায়ে মাখবে না।

না মাখলে নিজের মেয়ের জন্য নিজে কিনে আনো যাও। মেয়ে হয়েছে, একটা টাকা দিয়েছ এখন পর্যন্ত?

সব টাকার হিসেব করে রেখো, একসাথে দিয়ে দিব। এখন পাঁচশ টাকা দাও।

আমার কাছে অত টাকা নাই।

তোমার কাছে থাকবে না, তা তো জানিই। যাও তোমার বড়’পুর কাছ থেকে আনো।

আমি এখন বড়পুর কাছে টাকা চাইতে পারব না।

শামীম হাফসাকে তার কোল থেকে নামিয়ে পাশে বিছানায় রাখলো। তারপর তার চারপাশে বালিশ দিয়ে ঘেরাও করে দিলো। কিছুক্ষণ হাফসার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সামান্য ঝুঁকে আলতো করে হাফসার কপালে চুমু খেলো। তারপর নরম গলায় তনুকে ডাকলো, এই, এদিকে আসো।

তনু ভীত চোখে শামীমের দিকে তাকালো। শামীম তার জায়গা থেকে উঠল। তারপর দুই পা হেঁটে তনুর সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলল, শব্দ করো না, শব্দ করলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। সবাই জানবে, তোমার হাজবেন্ড। তোমাকে মারে, এটা তোমার জন্য গর্বের কোনো বিষয় না।

শামীম কথা শেষ করার সাথে সাথে তনুর গালে কষে চড় বসালো। তনু বিছানায় ছিটকে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। সে শামীমের দিকে তাকালো না। এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে বিছানায় বসে পড়ল। শামীম আলনা থেকে শার্ট নিয়ে গায়ে দিতে দিতে বলল, আমার চাকরি নাই। ব্যবসাপাতিও ভালো যাচ্ছে না। এই সব মুহূর্তে পুরুষের মাথার ঠিক থাকে না। তুমি কিছু মনে করো না তনু। পুরুষ মানুষের পকেট ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকে। জঘন্য ডাইনি চেহারার বউকেও মনে হয় পরি। সেই দিক থেকে তোমার চেহারা ভালো। কিন্তু পকেটে পয়সা নাই বলে তোমাকেও আমার সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোখের সামনে একটা পেতনি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শামীম লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরলো। তারপর শার্টের হাতায় চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলল, তাহলে এখন তোমার দায়িত্ব হচ্ছে তোমার নিজেকে আমার কাছে পরির মতো মনে করানো। এই জন্য দরকার আমার পকেটে পয়সা। কিছু টাকা-পয়সা হলে ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারতাম। তখন দেখতে, তোমাকে দেখলেই আমার মন ফুরফুরে হয়ে যেত। তুমি তোমার বড় বোনকে বলল, আমার লাখ দুই টাকা লাগবে।

তনুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেল শামীম। ড্রইংরুমে সালমা বেগমের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল তার। শামীম সামনের দিকে যতটা সম্ভব ঝুঁকে গিয়ে বিগলিত গলায় বলল, আম্মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগবে?

সালমা বেগম বললেন, না বাবা, কিছু লাগবে না। এই সময়ে বাইরে যাচ্ছ যে?

শামীম আরো বিগলিত গলায় বলল, তনুর হঠাৎ দাঁতে ব্যথা শুরু হয়েছে, ওর জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছি আম্মা। আপনার প্রেসার বা এসিডিটির ওষুধ আছে? না থাকলে বলেন, আমি নিয়ে আসি? কোন ওষুধ খান আপনি?

না বাবা, আমার ওষুধ লাগবে না। তুমি এই সন্ধ্যাবেলা আবার বের হবে কেন? অনুকে ফোন করে বলে দিলেই তো অনু আসার সময় নিয়ে আসতো!

কী যে বলেন না আম্মা! বড় আপু এমনিতেই অনেক ব্যস্ত থাকেন, তাকে এখন আবার এটা বলা অন্যায়। সারাদিন কী অমানুষিক খাটেন মানুষটা।

শামীমের চোখে মুখে স্পষ্ট কষ্টের ছাপ। যেন অনুর জন্য কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। সালমা বেগম বললেন, আচ্ছা যাও।

শামীম ঘর থেকে বের হয়ে গলির মোড়ে চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালো। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। মিনিট পাঁচেক পরে যে লোকটা এসে শামীমের পাশে দাঁড়ালো, শামীম তাকে আগে কখনো দেখেনি। লোকটার মাথার সামনের দিকে কোনো চুল নেই। কানের দুইপাশ থেকে মাথার পেছন অব্দি ঘন কালো চুল। লম্বায় পাঁচ ফুটের মতো। ভোতা নাকের নিচে বিছার মতো চ্যাপ্টা গোঁফ। দেখলেই কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। সে এসে শামীমকে ফোন দিলো। শামীম পকেট থেকে ফোন বের করতেই শামীমের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো। তারপর ফিসফিস করে বলল, শামীম ভাই?।

শামীম উপর নিচ মাথা নাড়ালো।

লোকটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি আজম।

শামীম লোকটার সাথে হ্যান্ডশেক করলো, এমন পাথরের মতো শক্ত হাত সে আগে কখনো ধরেনি। লোকটা অন্য হাত উঁচু করে রিকশা ডাকলো। লোকটাকে দেখে শামীমের সামান্য ভয় করছে, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঝুঁকিটা সে নেবে।

.

শামীম বাসায় ফিরল গভীর রাতে। তাকে গেট খুলে দিলো অনু। অনুরও বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছে আজ। অনুকে দেখে শামীম অপরাধীর মতো গলায় বলল, আমি খুবই দুঃখিত আপু, এত রাত পর্যন্ত আপনাকে জাগিয়ে রাখলাম।

অনু বলল, সেটা সমস্যা না। কিন্তু আমরা সবাই তোমার জন্য টেনশন করছিলাম। তোমার ফোনও বন্ধ ছিল।

শামীম কাঁচুমাচু গলায় বলল, সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকে ফোনটা যখন তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আপু। আসলে হয়েছে কি, তনুর জন্য দাঁতে ব্যথার ওষুধ কিনতে বের হয়েছি, এই মুহূর্তে আমার বন্ধুর ফোন। তার ছোট ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে, জীবন-মরণ অবস্থা। তার রক্তের গ্রুপ আর আমার গ্রুপ এক। সাথে সাথে হাসপাতালে গেলাম, অবস্থা খুবই খারাপ। অবশ্য রক্ত আমাকে দিতে হয়নি, তার আগেই আরো অনেক ডোনার চলে এসেছিল।

ওহ্, এখন কী অবস্থা?

কাল সকাল না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না আপু।

আচ্ছা। তুমি টেবিলে বসো, আমি তনুকে ডেকে দিচ্ছি।

না না আপু, এত রাতে আর তনুকে ডাকতে হবে না। ও সারাটা দিন হাফসাকে নিয়ে এত পরিশ্রম করে। এখন এত রাতে আবার ওকে কষ্ট দেয়ার দরকার নেই। আমি নিজে নিজেই খেয়ে নিতে পারব আপু।

অনু অবশ্য শামীমকে একা একা খেতে দিলো না। তনু বাথরুমে ছিল, সে আসা পর্যন্ত অনু নিজেই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে শামীমকে ভাত খাওয়ালো। ভাত খেতে খেতে শামীম বলল, আপনার চাকরির কী অবস্থা আপু?

অনু বলল, হ্যাঁ ভালো।

শামীম বলল, এখন চাকরির যা বাজার, তাতে আবার ভালো মন্দ কী? চাকরিতে চাকরিই, তাই না আপু?

অনু বলল, তা অবশ্য ঠিক।

আচ্ছা আপু, বিজনেস করলে কেমন হয় বলুন তো?

কিসের বিজনেস?

সেটাই ভাবছি। অবশ্য সবাই বলে আমাকে দিয়ে বিজনেস হবে না। কিন্তু আমার ধারণা হবে। তবে সমস্যা একটাই…।

কী সমস্যা?

সমস্যা তো আপু ক্যাপিটালের, এই জায়গাটাতেই আসলে ভয়। ক্যাপিটাল ছাড়া বিজনেস হয় না।

এই সময়ে তনু এলো, তনুর চোখ মুখ ফোলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক কেঁদেছে। অনু তার ঘরে চলে যাওয়ার আগে ড্রইং রুমে উঁকি দিলো। অয়ন মশারির ভেতর শুয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে। অনুর একবার মনে হলো, সে অয়নকে কিছু বলে। এত রাতে এই শরীরে জেগে থাকলে শরীর আরো খারাপ করবে। আর তাছাড়া এভাবে সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা কোনোভাবেই শরীর বা মনের জন্য ভালো কিছু নয়। কিন্তু সাথে সাথেই অনুর মনে হলো, সে একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের সাথে তুলনা করে অয়নের কথা ভাবছে। সে আসলে ভুলে যাচ্ছে, এই অয়ন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের কোনো মানুষ নয়। তার জীবন এখন সকল মন্দের ঊর্ধ্বে। এখানে যতটুকু ভালো, তার সবটুকুই কেবল আনন্দপ্রাপ্তির মধ্যে। বাদবাকি সকলই শূন্য, অর্থহীন। তার এই জীবনে যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায়, সেটুকুই কেবল সত্যি। সেই আনন্দের বিনিময় মূল্য যত চড়াই হোক না কেন, তা মূল্যহীন। কেবল যে কোনো মূল্যে ভালো থাকা, একটু আনন্দপ্রাপ্তিই কেবল মূল্যবান।

অনু কিছু বলল না, অন্ধকারে মশারির ভেতরে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে নিমগ্ন হয়ে থাকা অয়নের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুর আচমকা মনে হলো, আর মাত্র কয়েকটা দিন, কয়েকটা মাস, তারপর ডিভানের মতো ছোট্ট ওই বিছানাটা এখানে এমনই থাকবে। ঠিক এমনই। কেবল বিছানার ওপর ওই মানুষটা থাকবে না। বিছানাটা শূন্য পড়ে থাকবে! শূন্য পড়ে থাকবে ওই টেবিলটা। ওখানে আর কেউ বসবে না। ওই ব্যাগটা, ওই বইগুলো, ওগুলো আর কেউ কখনো পড়বে না। দরজার কাছের ওই জুতোজোড়া, আলনায় ঝুলতে থাকা ওই জামাগুলো, দেয়ালে ঝোলানো ওই র‍্যাকেট, অমনই পড়ে থাকবে। কেবল মানুষটাই আর থাকবে না। কী ভয়ংকর এক সত্য! এই ভয়ংকর সত্যটা সে কীভাবে মেনে নিচ্ছে?

মানুষ এত অসহায় কেন? বুকের ভেতর অসহনীয় প্রলয় বয়ে গেলেও অসহায় চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। সেই প্রলয় থামানোর উপায়ও মানুষের জানা নেই। অনু অন্ধকারে ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করলো তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, আচমকা ধাক্কা লেগে পড়তে পড়তেও সালমা বেগমকে ধরে সামলে নিলো সে। সেই সারাটা রাত মা আর মেয়ে পরস্পরকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে, কাল্পনিক আশ্রয় পাওয়ার ভান করতে করতে কাটিয়ে দিলো। কেউ কাঁদলো না, কথা বলল না। কেবল পরস্পরের বুকের ভেতর বয়ে গেল অব্যক্ত এক অনুভূতির তীব্র বাঅয় যন্ত্রণা।

*

আলতাফ হোসেন সদালাপী স্বভাবের মানুষ। কেউ কেউ অবশ্য আড়ালে আবডালে তাকে গায়ে পড়া স্বভাবেরও বলেন। তার বয়স পঞ্চাশ। যদিও দেখে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি মনে হয় না। অনুর প্রজেক্টের ম্যানেজার এবং একই সাথে অফিসের এই গুলশান শাখার শাখা প্রধানও তিনি। অন্যসময় সদালাপী হলেও কাজের সময় গম্ভীর, সিরিয়াস। বুধবার আলতাফ হোসেন অফিসে ঢুকলেন দুপুরের পর। বাইরে কোথাও জরুরি মিটিং ছিল। অফিসে ঢুকেই তিনি অনুকে ডাকলেন। তার টেবিলের ওপর অগোছালো কাগজের স্তূপ। চোখে ভারি চশমা। চশমার ভেতর থেকেই চিন্তিত চোখ দেখা যাচ্ছে। অনু ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, একটা বড় ঝামেলা হয়ে গেছে অনু।

অনু বলল, কী ঝামেলা ভাইয়া?

আমাদের লাস্ট সার্ভের ফিল্ড রিপোর্টের ক্রস চেকে না-কি ডাটা সংক্রান্ত ঝামেলা পাওয়া গেছে?

মানে?

মানে ক্রস চেকে ডাটা সেম আসে নাই।

এটা কীভাবে হলো?

কীভাবে হলো সেটা জানি না, বাট ইটস আ সিরিয়াস ইস্যু।

অনু মনে মনে ভয় পেয়ে গেছে। সে এই প্রজেক্টের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর, ফিল্ড সার্ভের রিপোর্টে ডাটা সংক্রান্ত কোনো ভুল থাকলে সেসবের মূল দায় বর্তায় তার কাঁধেই। সে দমে যাওয়া গলায় বলল, এখন কী হবে ভাইয়া?

কী হবে এখনো জানি না। তবে আজ হেড অফিসের মিটিংয়ে জীবনের সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি ফেস করতে হয়েছে। আমাদের বার চাকরি চলে যাওয়ার মতো অবস্থা।

অনু ঢোক গিলে বলল, সমস্যাটা কীভাবে হলো, আমি তো বুঝতে পারছি না! পুরোটা সময় আমি আমার সাধ্যমতো চেক করেছি, কিন্তু আপনি তো জানেনই, ফিল্ড সার্ভে টিমের ছেলে-মেয়েগুলো একদম নতুন। ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এই ধরনের কাজের কোনো প্রিভিয়াস এক্সপেরিয়েন্সও তাদের নাই। রিক্রুটমেন্টের সময় এটা…।

আমি জানি অনু, কিন্তু আপনিও জানেন, উনাদের কাছে এসব জাস্ট একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই না।

অনু যে এটা জানে না তা নয়, কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? এই উপায় খুঁজতে খুঁজতেই অনেক রাত অব্দি অফিসে থাকতে হলো অনুকে। অসংখ্য ডাটা রিপোর্ট মিলিয়ে দেখতে হলো, কিন্তু সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে অয়নের জন্য কেমন অস্থির রইল সে। অফিসের কাউকেই এখনো অয়নের কথা জানায়নি অনু। এসব বিষয়ে কাউকে বলতে অনুর ভালোও লাগে না। যদিও আলতাফ হোসেন খানিকটা জানেন। প্রফেসর আশফাক আহমেদের কাছে অনুকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে অয়নের বিষয়টা হয়তো তার মাথায়ই নেই। অনু অফিস থেকে বের হলো রাত এগারোটায়। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি, রিকশা, সিএনজি কিছু নেই। যা-ও কিছু বাস আছে, তাতে ওঠার মতো অবস্থা নেই। আলতাফ হোসেন বললেন, এখন যাবেন কী করে আপনি?

অনু বলল, আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া, আমি চলে যেতে পারব।

আলতাফ হোসেন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলেন। কিছুদিন ধরে তার ড্রাইভার নেই বলে নিজেকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে। অনু ছাতা মাথায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আলতাফ হোসেন অনুর পাশে এসে গাড়ি থামালেন। তারপর সামনের জানালার গ্লাস ফাঁক করে বললেন, উঠে আসেন, যাওয়ার পথে যতটা সম্ভব কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে যাই।

অনু গাড়িতে উঠল। এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে। গাড়িতে উঠে চুপচাপ বসে রইল অনু। আলতাফ হোসেন বললেন, এত টেনশন করে কি সমস্যার সমাধান হবে বলুন?

অনু বলল, নাহ্, টেনশন কিসের?

টেনশন করার মতোই বিষয়, কিন্তু এত ভাববেন না। দেখি কি করা যায়, একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতেই হবে।

আমার মাথায় কিন্তু কিছু আসছে না ভাইয়া।

এই বৃষ্টির রাতে এমন মনমরা হয়ে বসে থাকলে মাথায় কিছু আসবেও না অনু। মাথাটাকে একটু রিল্যাক্সড হতে দিন। গান শুনবেন?

অনুর এখন গান শুনতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি তার অসম্ভব পছন্দ। তার ওপর গাড়ির কাঁচের ভেতর থেকে রাতের ঢাকার এমন বৃষ্টি দেখা নিঃসন্দেহে বিশেষ এক আনন্দের অনুভূতি। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। আলতাফ হোসেন বললেন, বলুন, কার গান শুনবেন?

অনু আলতাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর বলল, আপনার যার ভালো লাগে ভাইয়া।

শ্রীকান্তের গান শুনি কি বলেন? এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব, কবে পাব, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ…।

আলতাফ হোসেন গানের সিডি খুঁজতে খুঁজতে নিজে নিজেই গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করলেন। তার এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল, আরেক হাতে তিনি অনুর সামনের গাড়ির ড্যাসবোর্ড থেকে সিডি বের করার চেষ্টা করলেন। সিডি বের করতে গিয়ে অনুর দিকে অনেকটাই ঝুঁকে আসতে হলো আলতাফ হোসেনকে। অনু কিছুটা সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তারপরও কিছুটা সময়ের জন্য আলতাফ হোসেনের শরীরের স্পর্শ এড়াতে পারল না সে। আলতাফ হোসেন একগাদা সিডি বের করতে গিয়ে সিডিগুলো একহাতে সামলাতে পারলেন না। সবগুলো সিডি একসাথে ছড়িয়ে পড়লো অনুর কোলের উপর। আলতাফ হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে বার কয়েক সরি বলতে বলতে সিডিগুলো অনুর কোলের উপর থেকে কুড়িয়ে নিলেন। কিন্তু মুহূর্তের জন্য অনুর কেমন অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো। তার মনে হলো আলতাফ হোসেনের হাত কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও ইচ্ছাকৃতভাবেই তার উরুতে চেপে বসেছে।

এই অফিসে প্রায় বছর দুই হবে অনু আছে। এই দুই বছরে আলতাফ হোসেনের কাছ থেকে কখনোই কোনো আপত্তিকর আচরণ সে পায়নি। এমন নয় যে এই সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অনুর কম। বরং অন্যান্য অনেক মেয়ের তুলনায় এই অভিজ্ঞতা তার বেশিই। তার বাস্তবতা তাকে অহরহ এমন সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। যেন সকল পুরুষেরই ধারণা, এই প্রায় মধ্য বয়সে চলে আসা, অথচ অবিবাহিতা একটি মেয়ে নিশ্চয়ই খুব সহজলভ্যই হবে।

আলতাফ হোসেন সম্পর্কে হুট করে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে অনুর খারাপই লাগছে। তারপরও ঘটনাটা অনু মাথা থেকে তাড়াতে পারল না। ভেতরে ভেতরে সে গুটিয়ে গেল। আলতাফ হোসেন বললেন, না-কি অঞ্জন দত্তের গান শুনবেন? একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে, থাকবে না সাথে কোনো ছাতা…। এখন অবশ্য বিকেল না, রাত। আচ্ছা রাতের বৃষ্টি নিয়ে কি কোনো গান নেই?

অনু জবাব দিল না। আলতাফ হোসেন নিজ থেকেই বললেন, নেই মানে? আছে তো। সেই বিখ্যাত রোমান্টিক গান, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না…। গানটা কেমন লাগে আপনার? আমার তো অসাধারণ লাগে। খেয়াল করে দেখেছেন, গানটা কিন্তু খুব সিডাকটিভ! রুনা লায়লার কণ্ঠটাও এখানে অনেক অ্যাপিলিং।

অনু হঠাৎ বলল, আমার না মাথাটা খুব ধরেছে ভাইয়া। আপনি কিছু মনে না করলে গানটা আপাতত থাকুক?

আলতাফ হোসেন বিচলিত গলায় বললেন, অবশ্যই, অবশ্যই। আমি বোধহয় গান নিয়ে খুব ছেলেমানুষি করে ফেলছিলাম, না? আসলে চারদিক থেকে এত প্রেসার, মাঝেমধ্যে মনে হয়, কিছু সময়ের জন্য হলেও সব ভুলে একটু রিল্যাক্স হই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না বুঝলেন? আচ্ছা অনু, আপনার বিয়ে টিয়ের কি হলো, কিছু ভাবছেন বিয়ে নিয়ে?

অনু ঠান্ডা গলায় বলল, এটা নিয়ে আপনার সাথে আরেকদিন কথা বলি ভাইয়া? আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আপনি এক কাজ করুন, আমাকে আসাদ গেট নামিয়ে দিন। আমি ওখান থেকে রিকশা করে চলে যেতে পারব।

আলতাফ হোসেন যেন আঁতকে উঠলেন, এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি আসাদ গেট নেমে যাবেন? পাগল নাকি?

আলতাফ হোসেন অনুকে আসাদ গেট নামিয়ে দিলেন না, তিনি অনুকে নামিয়ে দিলেন অনুদের বাসার গেটে। তবে অনুদের বাসার গেট অব্দি পৌঁছানোর পথটুকু তিনি অনর্গল কথা বলে গেলেন। তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবনের কথা। সেই জীবনে তিনি প্রচণ্ড দুঃখী একজন মানুষ। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তার স্ত্রীকে বিয়ে করা। কিন্তু মেয়ে দুটির মুখ চেয়ে তিনি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। বাইরে বাইরে সবাই তাকে দেখে ভাবে তিনি একজন অতি সদালাপী, হাসি-খুশি মানুষ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে। তার চেয়ে দুঃখী মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। মাঝেমধ্যে সুইসাইড করে মরে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওই মেয়ে দুটির মুখ চেয়েই পারেন না। তিনি খুব চান, কেউ একজন তার এই দুঃখটা বুঝুক। তাকে একটু শান্তি দিক, আশ্রয় দিক। কিন্তু এমন কেউ কী আছে?

অনু একইসাথে জড়সড় ও সতর্ক হয়ে আলতাফ হোসেনের এইসব কথা শুনলো। কারো সামনে কেউ এমন দুঃখের কথা বললে তার উচিত মানুষটাকে সান্ত্বনা দেয়া। অন্তত হা হুঁ গোছের কিছু একটা বলা। কিন্তু এই পুরোটা সময় অনু একদম চুপ করে রইল। সে কথা বলল আলতাফ হোসেন যখন তাকে তাদের বাসার গেটে নামিয়ে দিলেন তখন। কথা বলেই অনুর মনে হলো সে কথা বলে ভুল করে ফেলেছে। কথা না বলাই বরং ভালো ছিল। অনু গাড়ি থেকে নেমে সামান্য ঝুঁকে গাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, ভাইয়া, এত রাতে অনেক কষ্ট দিলাম আপনাকে।

আলতাফ হোসেন বললেন, না, না। কষ্ট কী!

অনু বলল, এক কাপ চা খেয়ে যান ভাইয়া?

অনুর ধারণা ছিল না যে, এই এতরাতে অনুর চায়ের দাওয়াত আলতাফ হোসেন গ্রহণ করবেন। সে স্রেফ সৌজন্যতাবশত বলেছে। কিন্তু অনুকে চমকে এবং একইসাথে প্রচণ্ড বিরক্ত করে দিয়ে আলতাফ হোসেন বললেন, এই ওয়েদারে এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। তবে কফি হলে সবচেয়ে ভালো হতো। বাসায় কফির ব্যবস্থা আছে?

অনু যেন সামান্য হলেও আশার আলো দেখতে পেল। সে চট করে বলল, না ভাইয়া, আমাদের বাসায় তো কফির ব্যবস্থা নেই।

আলতাফ হোসেন উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, কোনো সমস্যা নেই, চা হলেই চলবে। একটু কড়া লিকারের চিনি ছাড়া চা। খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে ভাববো, কফি খাচ্ছি, ব্ল্যাক কফি, হা হা হা।

আলতাফ হোসেনকে নিয়ে গেটের ভেতর ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে অনুর মনে হলো দোতলার সেই জানালাটা খুলে গেল। এত দূর থেকেও জানালার কাঁচের শার্সিতে একটা লোমশ কঠিন হাত যেন মুহূর্তের জন্য হলেও দেখতে পেল সে!

বাসায় ঢুকে অনুর বুকটা ধক করে উঠল। তার বড় চাচি সুফিয়া বেগম এসেছেন তাদের বাসায়। চাচাঁদের সাথে অনুদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এর পেছনে অবশ্য করুণ এক গল্প আছে। অনুর বাবারা দুই ভাই, এক বোন। অনুর বাবা মোফাজ্জল হোসেন সবার ছোট। মাঝখানে বোন। বড় ভাইয়ের তুলনায় অনুর বাবা প্রায় বার বছরের ছোট। তাদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি থানায়। কিন্তু তোফাজ্জল হোসেন তখন ছোট ভাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তাকে পড়াশোনাও করিয়েছিলেন তিনি। হয়তো ছোট ভাইকে নিয়ে নানান স্বপ্ন, পরিকল্পনাও তার ছিল। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েটে থাকতেই সালমা বেগমের সাথে তুমুল প্রেম হয়ে যায় মোফাজ্জল হোসেনের। লুকিয়ে বিয়েও করে ফেলেন তারা। এই ঘটনা মোফাজ্জল হোসেনের বড় ভাই জানতে পারেন। তিন বছর পর।

মোফাজ্জল হোসেন তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র, কিন্তু পড়াশোনাটা তার কেবল ওই নামেই ছিল, কাজকর্মে তিনি তখন ফুল টাইম টিউটর। সালমা বেগমদের টানাটানির সংসার। সালমা বেগমের বাবা দ্রুত মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে চাইছিলেন। মোফাজ্জল হোসেন উপায়ান্তর না দেখে দিন রাত টিউশন করানো শুরু করলেন।

ঘটনা জানতে পেরে মোফাজ্জল হোসেনের বড় ভাই যে খুব হৈ চৈ কিছু করেছিলেন তা নয়। তবে মোফাজ্জল হোসেনকে একটা চিঠি পাঠিয়ে তিনি লিখেছিলেন, মোফাজ্জল হোসেনের পেছনে এ পর্যন্ত তার যত টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকার পাই টু পাই হিসেব তার কাছে রয়েছে। টাকা পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত মোফাজ্জল হোসেন যেন আর কখনো তার সামনে না যায়। তাদের মধ্যে এখন থেকে আর ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক নেই। এখন থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্ক কেবল দেনাদার আর পাওনাদারের।

চিঠির সাথে তিনি টাকার বিস্তারিত হিসাবও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মোফাজ্জল হোসেনও একগুঁয়ে লোক। সেই চিঠি পেয়ে তিনিও প্রতিজ্ঞা করলেন, টাকা শোধ না করা অব্দি তিনি আর বড় ভাইয়ের সামনে যাবেন না। এই নানাবিধ জটিলতায় পড়াশোনাটাও আর শেষ হলো না মোফাজ্জল হোসেনের। সালমা বেগমও গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। অনুর জন্ম হলো। সব মিলিয়ে মোফাজ্জল হোসেনের অবস্থা তখন দিশেহারা। দিনরাত টিউশন করিয়েও কুলাতে পারেন না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও এতটুকু শিক্ষা হলো না তার। পুত্র সন্তানের আশায় আশায় আরো দুটি সন্তান নিলেন তিনি। সেই সন্তানদের নাম তনু আর বেনু।

মোফাজ্জল হোসেন অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন। উপার্জনের নানান উপায় খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু ভাগ্যের শিকে আর তার ছেড়েনি। বড় ভাইয়ের সেই টাকাও আর শোধ করতে পারেননি। অল্প বয়সেই শারীরিক মানসিকভাবে বৃদ্ধ হয়ে গেলেন মোফাজ্জল হোসেন। অনু যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, তখন স্ট্রোক করে ডান দিকটা প্যারালাইজড হয়ে গেল তার। শুরু হলো অনু, তনু আর বেনুর বিভীষিকাময় শৈশব। কিন্তু অনু তার শীর্ণ বাহু আর ছোট্ট ছায়া মেলে সেই বিভীষিকাময় সময় থেকে আগলে রাখতে চাইলো পাঁচ আর আট বছরের ছোট দুই বোন তনু আর বেনুকে।

মোফাজ্জল হোসেন কোনোমতে একটা মুদি দোকান দিলেন। যদিও তার অর্ধেক সচল শরীর নিয়ে সেই দোকান কেরোসিনের নিভে যেতে থাকা কুপির মতো জ্বলতে থাকল। অয়নের জন্ম তারও বহু পরে। একটা পুত্র সন্তানের গোপন, গভীর স্বপ্ন বা লোভ থেকে বের হতে পারেননি চিরকালের একগুঁয়ে মোফাজ্জল হোসেন। তবে সেই পুত্র সন্তানটিকেও বেশিদিন দেখার সৌভাগ্য হলো না তার। অয়নের এক বছর এক মাসের মাথায় মারা গেলেন মোফাজ্জল হোসেন। অনু তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী, তনু ক্লাস এইটে, আর বেনু ফাইভে। মোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর খবর শুনে অবশেষে তার বড় ভাই। এসেছিলেন। তবে অনুদের সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলেননি তিনি। মাঝেমধ্যে সালমা বেগমকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন বলে অনু শুনেছে, তবে তাতে তাদের পরিবারে কোনো পরিবর্তন অনুর চোখে পড়েনি।

অনুর চাচি সুফিয়া বেগম কালেভদ্রে এ বাড়িতে আসতেন। তার সেই আসায় যতটা না সম্পর্ক রক্ষার বিষয় থাকতো, তার চেয়ে বেশি থাকতো নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য জাহির আর নানা বিষয়ে খবরদারি করা। সুফিয়া বেগম এ বাড়িতে আসলেই অনুর মা সালমা বেগম তাই সারাক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত খরগোশের মতো কুঁকড়ে থাকতেন। এখনো থাকেন। অনু যে সুফিয়া বেগমকে তার মায়ের মতো ভয় পায়, বিষয়টি এমন নয়। তবে তারপরও আজ ঘরে ঢুকেই সুফিয়া বেগমকে দেখে অনুর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এই ধক করে ওঠার পেছনে সুস্পষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এতরাতে অনু বাইরে থেকে ঘরে ফিরেছে এই নিয়ে সালমা বেগমের হাড় জ্বালিয়ে খাবেন তিনি। তার ওপর অনুর সাথে অচেনা-অজানা একজন পুরুষ মানুষ! সুফিয়া বেগমের সামনে এতরাতে এভাবে মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে খারাপ ঘটনা আর হতে পারে না।

অনু অবশ্য সুফিয়া বেগমকে দেখে খুব স্বাভাবিক গলায় সালাম দিলো। তারপর বলল, কখন এসেছেন চাচি?

সুফিয়া বেগম অনুর প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আলতাফ হোসেনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আলতাফ হোসেন ঝুঁকে তাকে সালাম দিলেন। অনু বলল, উনি আমার অফিসের কলিগ চাচি।

সুফিয়া বেগম কিছু বলতে চাইছিলেন। তার আগেই অনু খানিক গলা চড়িয়ে বলল, মা, আলতাফ ভাই এখুনি বেরিয়ে যাবেন। উনার স্ত্রী, বাচ্চারা টেনশন করছেন। চট করে একটু চা করে দাও না?

অনু ইচ্ছে করেই এমন করে বলল। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো ব্যাপার। আলতাফ হোসেনকেও বুঝিয়ে দেয়া যে এখানে বেশিক্ষণ বসা যাবে না। আবার সুফিয়া বেগমকেও বুঝিয়ে দেয়া যে আলতাফ হোসেন বিবাহিত, তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, স্ত্রী সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। এই এতরাতেও তারা তার জন্য দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষায় রাত্রি জেগে আছে। যদিও অনু এও জানে যে, আদতে এতে খুব বেশি কাজও হবে না। কারণ সুফিয়া বেগমকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। অন্যরা কেঁচো খুঁড়তে সাধারণ সাপ বের হয়ে আসলে, তিনি খুঁড়লে বের হয়ে আসবে কমপক্ষে অ্যানাকোন্ডা।

আলতাফ হোসেন অবশ্য বেশিক্ষণ বসলেনও না। সুফিয়া বেগমের বিচিত্র সব প্রশ্নে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন। সুফিয়া বেগম কোমল গলায় বললেন, কি নাম তোমার বাবা?

আলতাফ হোসেন।

কি করো তুমি?

জি, অনু যেই অফিসে জব করে, আমিও সেই অফিসেই জব করি।

তোমার পোস্ট কি?

প্রজেক্ট ম্যানেজার।

প্রজেক্ট ম্যানেজার কি বড় পোস্ট?

জি, মোটামুটি।

বেতন কত তোমার?

এই তো, চলে যায় খালাম্মা।

চলে গেলে হবে? বয়স তো কম হয় নাই তোমার। মাথার চুলও পড়ে গেছে অর্ধেক। এখনো কোনোমতে চলে গেলে হবে? হবে না।

জি খালাম্মা।

বেতনের কথা যে বলো নাই, এইটা ভালো। তুমি বুদ্ধিমান পুরুষ। বুদ্ধিমান পুরুষ মানুষের এক নম্বর পরিচয় কী জানো?

জি না খালাম্মা।

বুদ্ধিমান পুরুষ মানুষ স্ত্রীর কাছে বেতনের বিষয়ে সঠিক কথা বলে না।

জি খালাম্মা।

বিয়া করছ কত বছর?

এই একুশ বছরে পড়বে।

ছেলেমেয়ে কয়জন?

দুই মেয়ে। মে

য়েরা কি করে?

এই একজন ক্লাস নাইনে পড়ে, আরেকজন এইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।

বউ কিছু করে?

জি, একটা কলেজে পড়ায়।

বাহ্! তোমার তো শিক্ষিত, সুখী পরিবার। তাইলে এত রাইতে অন্য জোয়ান মেয়ে নিয়ে ঘোরো কেন?

এই প্রশ্নে আলতাফ হোসেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, বুঝি নাই খালাম্মা।

বুঝছ ঠিকই, না বোঝার ভান ধরতেছ। শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, পুরুষ মানুষ সবসময় ভাবে নিজের ঘরে আনন্দ নাই। আনন্দ সব বাইরে বা অন্য ঘরে। এই জন্য তারা সবসময় বাইরে, অন্যের ঘরে ঘোরাঘুরি করতে চায়। কিন্তু বাইরে বা অন্যের ঘরে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে শেষে দেখে আনন্দ আসলে নিজের ঘরেই। নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও আনন্দ নাই। এই কথা মনে রাখবা? বুঝলা?

জি, খালাম্মা।

.

আলতাফ হোসেন মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত এবং হতভম্ব বোধ করছেন। এমন অদ্ভুত মানুষ তিনি তার জীবনে দেখেননি। তার ইচ্ছা করছে সুফিয়া বেগমের মুখের উপর উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে দিতে। কিন্তু সেটা শোভন হবে না বলে বলতে পারলেন না। কত আগ্রহ নিয়েই না তিনি এই বাসায় এসেছিলেন। এই বাসায় নিশ্চয়ই একটা বারান্দা আছে। ভেবেছিলেন আধো অন্ধকারে সেই বারান্দায় বসে অনুর সাথে গল্প করতে করতে বৃষ্টি দেখবেন আর চা খাবেন। একটা চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন। কিন্তু এই অদ্ভুত মহিলা সব নষ্ট করে দিলো। তিনি আচমকা উঠে দাঁড়ালেন, আমি এখন যাব খালাম্মা। রাত অনেক হয়ে গেছে। আসলে বাইরে অনেক ঝড় বৃষ্টি তো। এদিকে অফিসে জরুরি কাজ থাকায় দেরি হয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে দেখি যানবাহন কিছু নেই। অতরাতে অনু একা বিপদে পড়ে যেত। আমার সাথে গাড়ি ছিল বলে ভাবলাম পৌঁছে দিয়ে যাই।

সুফিয়া বেগম বললেন, যাও। বউ বাচ্চা ঘরে রেখে বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা ভালো না। অফিস শেষ হবার সাথে সাথে বাসায় চলে যাবে।

সুফিয়া বেগম হয়তো আরো কিছু বলতেন। কিন্তু তার আগেই অনু চলে এলো। সে এই ফাঁকে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। আলতাফ হোসেনকে রাতে খেয়ে যেতে বলা হলো। কিন্তু তিনি তাতে আর আগ্রহ দেখালেন না।

আলতাফ হোসেন চলে যেতেই সুফিয়া বেগম বললেন, অনু, তোর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

অনু ততক্ষণে ভাত খেতে বসে গেছে। সে সুফিয়া বেগমের দিকে না তাকিয়েই বলল, জি, বলেন।

তোর জন্য আমার খোঁজে ভালো একটা ছেলে আছে। ছেলে আমেরিকান সিটিজেন। বয়সটা একটু বেশি। তা পুরুষ মানুষের আবার বয়স কী? আর তোরও কী বয়স কম হয়েছে? তোর বয়সি মেয়েদের অনেকের নাতী-নাতনিও আছে।

অনু কথা বলল না। সে চুপচাপ ভাত খেয়ে যাচ্ছে। এই মহিলাকে হজম করা কঠিন। কিন্তু সে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাকে হজম করতে। আগামীকাল অফিসে গিয়ে তাকে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে অনু জানে না। এই নিয়ে তার মাথার ভেতরটা চিনচিন করছে। অয়নের সাথেও আজ এখন পর্যন্ত কথা হয়নি। সন্ধ্যার পরপর কোচিং থেকে ফিরে বৃষ্টি পেয়ে অনুর ঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অয়ন। এখনো সেখানেই ঘুমিয়ে আছে।

ছেলের আগের ঘরের দুই মেয়ে এক ছেলে আছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়েরও বিয়ে ঠিকঠাক। এই সময় ওয়াইফ মারা গেল। এখন ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে একদম নির্ঝঞ্ঝাট। শোন, এই ব্যাপারে তোর ফালতু নাক উঁচু ভাবটা বাদ দে। বাস্তব চিন্তা কর। এই যে বছরের পর বছর এত এত সম্বন্ধ আসলো, কই, কেউ শেষ পর্যন্ত আগালো? আগাবে না। কারণ ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চা হয়ে গেছে। অথচ বড় বোনের বিয়ে হয় নাই। তার বয়স পঁয়ত্রিশ। এইটা শুনলেই তো যে কেউ ভাববে এই মেয়ের সিরিয়াস কোনো সমস্যা আছে, বড়সর কোনো সমস্যা। এখন সমস্যা থাকলে তো ভালো। না থাকলেই বরং খারাপ। যদি বড়সর কোনো সমস্যা না দেখানো যায়, তখন পাত্রপক্ষ ভাবে সমস্যা এতই গুরুতর যে সেটা প্রকাশ করার মতো না। তারপর ধর, পাত্র যে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যাবে, সেই উপায়ও নাই। শ্বশুর নাই, বড় শালা সম্বন্ধি নাই, টাকা-পয়সাও নাই, শ্বশুরবাড়ির অবস্থা খারাপ। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির খরচও চালাতে হবে পাত্রের। এই ঘরে জেনে শুনে কে বিয়ে করবে আমাকে বল? শুধু তো স্বপ্ন দেখলেই হবে না। বাস্তবতাটাও তো চিন্তা করতে হবে, তাই না? আমার কথা শুনতে খারাপ লাগে। কিন্তু কী বলি একটু খেয়াল করে শুনলেই বোঝা যাবে। এর চেয়ে ভালো আর। কিছুতে নাই।

সুফিয়া বেগম এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে দম নিলেন। তারপর আবার বললেন, তার উপর তোর ছোট ভাইটাও পড়াশোনা করে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলে শুরু হবে আসল খরচ। সেই খরচ কে চালাবে? এই খরচও তো তোর জামাইকেই চালাতে হবে, না-কি? তা আমাকে বল, তুই ছেলে হলে কি এমন ফ্যামিলিতে, এমন মেয়েকে বিয়ে করতি? করতি না। তোর ভাইকেও করাতি না। কারণ সবাই নিজের ভালো চায়। এখন তুই যদি গো ধরে। থাকিস যে ফ্রেশ, আনম্যারেড ছেলে ছাড়া বিয়ে করবি না। ম্যারেড, ডিভোর্সি, বাচ্চার বাপ হলে তোর সমস্যা, তাহলে তুইই আমাকে বল, সেইটা কি সম্ভব? অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হলে তো জীবনেও সম্ভব না। কোনো ফ্যামিলিই জেনেশুনে তার ফ্রেশ ছেলেকে এমন মেয়ের সাথে এমন ফ্যামিলিতে বিয়ে দিবে? দিবে বিয়ে? দিবে না। এখন প্রেম-ট্রেম করে থাকলে আলাদা কথা। প্রেমে দুনিয়ার সবই সম্ভব। কিন্তু সেরকম কিছুও তো শুনি না। এতই যখন ফ্রেশ, আনম্যারেড ছেলের শখ, তাহলে এইসব বুড়াদের সাথে রাত বিরাতে না ঘুরে, ফ্রেশ, আনম্যারেড কোনো ছেলের সাথে ঘুরলেই তো পারিস। তোর চেহারা, ফিগার তো খারাপ না, দেখে তো বয়সও বোঝা যায় না। আনম্যারেড একটাকেও বড়শিতে গাঁথতে পারিস না?

অনুর ভাত খাওয়া শেষ হলো। তার ঘরের পর্দার আড়াল থেকে সালমা বেগম অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন। সুফিয়া বেগম যে কথাগুলো বলছেন, তার সবই বাস্তবতা। এর চেয়ে তিক্ত সত্য আর নেই। গত কয়েক বছরে এই ঘরের প্রতিটি মানুষ তার সাক্ষী। সাক্ষী আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী যে। যেখানে আছে সবাই। অনুর বিয়েটাই এখন সবার আলোচনার বিষয়, মাথাব্যথার কারণ। এই বাস্তবতা যে অনু জানে না, তা নয়। সেও জানে। কিন্তু তারপরও বিবাহিত কাউকে বিয়ে করতে তাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। আবার অবিবাহিত পাত্রের পক্ষ থেকে যে বিয়ের সম্বন্ধ একদমই আসেনি, তাও না। কিন্তু একটা দুটো যা-ই এসেছে, তাও নানান অনিবার্য কারণেই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্যও নয়।

এ বাসায় ইদানীং অনুর বিয়ে নিয়ে কেউ আর কোনো কথা বলে না। কেবল সুফিয়া বেগমই যখন বছরে দুয়েকবার আসেন, তখন এভাবে একদম নগ্নভাবেই কথাগুলো বলেন। সালমা বেগমের তখন অনুর জন্য খুব খারাপ লাগে। কিন্তু অনু বিষয়টা নিয়ে কেমন নির্বিকার হয়ে গেছে। আজও যেমন সে ভাত খাওয়া শেষে হাত ধুতে ধুতে স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি হঠাৎ কী মনে করে এলেন চাচি?

সুফিয়া বেগম থতমত খাওয়া গলায় বললেন, হঠাৎ মানে? আমি আসতে পারি না?

না মানে এমনিতে তো বছরে দুয়েকবারের বেশি কখনো আসেন না। এবার যে মাসখানেকের মধ্যেই এলেন! বিশেষ কোনো কারণ আছে? মানে আমার বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা ছাড়া?

সুফিয়া বেগম সাথে সাথেই জবাব দিলেন না। পানের বাটা থেকে পান বের করে খুব যত্ন করে একটা পান বানালেন। তারপর মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন, এই আমেরিকান পাত্রের বিষয়েই তোর মাকে ফোনে দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোন ধরার পর থেকেই শুধু কাঁদছিল। জিজ্ঞেস করলাম, বলে না। শেষে অনেকক্ষণ পর বলল, অয়নের না-কি খারাপ অসুখ হয়েছে!

শুনে সালমা বেগমের উপর কিছুটা বিরক্ত হলো অনু। সে চায় না অয়নের এই ব্যাপারটা আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী জানুক। এমনিতেই অয়ন অনেকটা আঁচ করে ফেলেছে। তার ওপর এখন যদি আশেপাশের সব মানুষও জেনে ফেলে, তখন অয়নের কাছ থেকে এটিকে আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। আজই বিষয়টা সালমা বেগমকে স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে। এমনকি সুফিয়া বেগমকেও যেন তিনি অয়নের প্রকৃত অবস্থা আর না বলেন।

অনু বলল, তার মানে আপনি অয়নকে দেখতে এসেছেন?

হ্যাঁ।

তো খারাপ অসুখ হওয়া কোনো রোগীকে দেখতে এসে সেই বাসায় এই সব কথা বলা কি মানায় চাচি?

তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? আমি তো অয়নকে দেখে আসলাম। সে কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে। গায়ে জ্বরটরও কিছু নেই। আর তোর মাকে এত জিজ্ঞেস করলাম, সেও কিছু বলল না।

সারাদিন অফিস করে এসেছি, এখন এইসব কথা বলার সময় না চাচি।

তোর তো কখনোই এইসব নিয়ে কথা বলার সময় না। গায়ের চামড়া ভাঁজ পড়ে গেলে তোর সময় হবে।

অনু আর কথা বাড়ালো না। সে তার ঘরে গিয়ে অয়নকে ডাকলো। অয়নের গা হালকা গরম। সে গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠা চোখে তাকালো, ওহ্! আমি এখানেই ঘুমিয়ে গেছিলাম?

হ্যাঁ, এখন ওঠ। কিছু খেয়ে নে।

ঘুম এখনো কাটে নাই আপু। এখন আর খাবো না। তুই আমার বিছানাটা একটু করে দিবি? আমি জাস্ট গিয়েই ঘুমিয়ে পড়বে।

যেতে হবে না। তুই এখানেই ঘুমা।

অয়ন আর কথা বলল না। সে মুহূর্তেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। সেই সারাটা রাত অনুর এক ফোঁটা ঘুম হলো না। সে সারা রাত অয়নের পাশে জেগে রইল। জেগে থাকতে থাকতে অনুর কত কী যে মনে হলো! একবার মনে হলো, অয়নের বিষয়টা সত্যি নয়। এটা একটা দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নটা দুম করে ভেঙে যাবে। সে ঘুম ভেঙে উঠে দেখবে তার সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। গলা শুকিয়ে গেছে, বুক ধরফর করছে। সে তখন টেবিল থেকে জগ নিয়ে ঢকঢক করে এক জগ পানি খেয়ে ফেলবে। আর তারপর তার কিছুটা শান্তি লাগবে। অনু হঠাৎ অদ্ভুত একটা কাজ করলো। সে তার চুলের ক্লিপ খুলে হাতের তালুতে আঁচড় কাটতে লাগল। কেটে দেখলো সে ব্যথা পাচ্ছে কি-না। বিষয়টা সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বইতে পড়েছে। সিনেমায় দেখেছে, মানুষ নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে সে বাস্তবে আছে, না স্বপ্নে! অনুর কাছে বিষয়টা খুবই হাস্যকর মনে হয়। তার বিশ্বাস হয় না যে, সত্যি সত্যি মানুষের জীবনে কখনো এমন মুহূর্ত আসে যে তাকে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে হয় সে স্বপ্নে আছে, না বাস্তবে! আজ এই নিঘুম রাতের নিঃশব্দ অন্ধকারে অনু নিজেই সেই হাস্যকর কাজটি করলো এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অনুর হঠাৎ মনে হলো। ক্লিপের এই তীক্ষ্ণ আঁচড়েও সে কোনো ব্যথা পাচ্ছে না। অনু বার কয়েক চেষ্টা করলো। কিন্তু ফলাফল একই। তার শরীর কেমন বোধহীন, অসাড়। অনু। ক্লিপের আরো ধারালো অংশ দিয়ে আরো তীব্র আঁচড় বসালো। তার হাত কেটে দরদর করে তাজা রক্ত বের হলো। কিন্তু অনুর তখনো মনে হচ্ছিল কোনো শারীরিক ব্যথা সে টের পাচ্ছে না। কী অদ্ভুত! তার বুকের ভেতরটা কেবল হুহু করে বয়ে যাওয়া শীতল বাতাসের হাহাকারের মতো কেমন এক তীব্র মাতমে তাকে নিঃস্ব করে ফেলতে লাগল। সেই মাতমে আলো ও অন্ধকার, বাস্তব ও বিভ্রম কোনো কিছুকেই যেন সে আর আলাদা করতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *