মহৎ জীবন
সমুদ্রগর্ভে মালোকাই দ্বীপে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত নর-নারীকে নির্বাসনে দেওয়া হতো। কেউ তাদের দেখবার ছিল না, ব্যাধি যন্ত্রণায়, দুঃখে তাদের জীবন শেষ হতো। চারিদিকে সমুদ্র, তার মাঝে আর্ত নর-নারী, বালক-বালিকা নিজেদের দুর্ভাগ্য ও আশাহীন, সান্ত্বনাহীন জীবন নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় কাল কাটায়। তারা আল্লাহকে ডাকত না, তাদের কোনো ধর্মজীবন ছিল না। তারা নিরন্তর ব্যাধি যন্ত্রণায় হা-হুঁতাশ করতো, আর অদৃষ্টকে অভিশাপ দিত। যাদের জীবনে কোনো আশা নাই, যারা আত্মীয়-পরিজন হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যাদের কোনো সমাজ নাই, যাদের কেউ শ্রদ্ধা করবার নাই, যাদের দুঃখ-ব্যাথার কথা কেউ চিন্তা করে না–তাদের জীবন কত ভয়ানক, কত দুঃখময়, কত শোচনীয়!
এই অভিশপ্ত ও নির্বাসিত নর-নারীর জন্য কার প্রাণ অস্থির হয়েছিল? তাদের দুঃখের জীবন কার প্রাণে চিন্তা সৃষ্টি করেছিল? কে এই নির্বাসিতদের মাঝে যেয়ে তাদের সেবা করবে? তাদিগকে সান্ত্বনা দেবে? তাদেরকে আল্লাহ্ ও মহৎ জীবনের কথা শোনাবে? তারা যে অভিশপ্ত! কে যাবে সেই দুঃসহ ব্যাধির সংস্পর্শে? তাদের কাছে যাওয়ার অর্থ–নিজের জীবনের সকল আশা-ভরসা জলাঞ্জলি দেওয়া এবং প্রয়োজন হলে কুষ্ঠব্যাধিকে বরণ করে নেওয়া।
দামিয়ান নামক এক যুবক বহুদিন হতে এই নির্বাসিতদের কথা চিন্তা করেছিলেন। এই সুন্দর আকাশ, এই আলো গন্ধভরা মানব-সমাজ, জীবনের সহস্র ভোগ-আকর্ষণ একদিকে, অন্যদিকে রোগপীড়িত নর-নারীর করুণ মুখ–আতুরের গগনবিদারী চিৎকার–আর সীমাহীন আঁধারে ব্যথিতের করুণ মুখেরই জয় হল। জীবনের সকল আশা কামনাকে বিসর্জন দিয়ে যুবক দামিয়ান নির্বাসিত কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তদের সেবার জন্য প্রস্তুত হলেন, বন্ধু প্রতিবেশীদের সমালোচনা, আত্মীয়-স্বজনের মিনতি তার সঙ্কল্পকে দমাতে পারলো না। দামিয়ান একদিন ফরাশি দেশের উপকূলকে শেষ নমস্কার করে একখানি বাইবেল আর একটা সাগরের মতো বিরাট আত্মা নিয়ে আর্তের সেবায় সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন। আহা! বিরাট মনুষ্যত্ব! যে জীবন সহস্র ভোগের শিক্ষা দিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা যেতো সীমাহীন সুখ দিয়ে যাকে ভরে দেওয়া যেতো, তা এখন দুস্থ নর-নারীর চিৎকার ক্রন্দনের মাঝে ব্যয়িত হতে লাগলো। দামিয়ান পিতার মতো, মায়ের মতো, বন্ধুর মতো ব্যাধিগ্রস্ত মানুষগুলিকে সেবা করতে লাগলো। তিনি যখন তাদিগকে নিয়ে সাগরকূলে বসে। আল্লাহর স্নেহের কথা বর্ণনা করতেন–যখন তিনি বলতেন, মানুষের জন্য এক অফুরন্ত আনন্দের রাজ্য আছে, আমরা সেই দিকে যাচ্ছি–ব্যাধিপীড়া দিয়ে খোদা আমাদেরকে তার অসীম স্নেহের পরিচয় দিচ্ছেন, তখন সবাই কাঁদতো, আকাশ থেকে ফেরেস্তা আশীর্বাদের অশ্রু দিয়ে তাদের সংবর্ধনা করতো, স্তব্ধ সমুদ্রের বুকের উপর দিয়ে বাতাস তাদের শোক গৌরব গেয়ে ফিরতো।
কী মহৎ এই মহাপুরুষের জীবন–কত বড় তিনি ছিলেন।
ঊনিশ বছরের সেবার পর দামিয়ান একদিন বুঝতে পারলেন–কাল ব্যাধি তাকেও ধরেছে। তিনি সেদিন সকলকে এক জায়গায় করে বললেন, আজ আমার আনন্দের সীমা নাই। আজ তোমাদেরই মতো আমি একজন হয়েছি। এতদিন তোমাদের সঙ্গে আমার ভালো করে আত্মীয়তা হয় নাই, একটু বিভেদ ছিল,–আজ খোদা সে বিভেদটুকু তুলে নিয়ে তোমাদের সঙ্গে আমায় এক করে দিয়েছেন। আজ তাঁর স্নেহের কথা স্মরণ করে
আমাদের চোখে পানি আসছে। আজ আমাদের উপাসনা বড় মধুর, বড় সুন্দর হবে।
ক্ৰমে দামিয়ানের সোনার শরীর ভেঙ্গে এল। অবশেষে এই মহাপুরুষ মানব-সমাজে তার মহৎ জীবনের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে একদিন প্রাণত্যাগ করলেন। দামিয়ান মরেন নি–মানুষ চিরকাল তাঁর স্মৃতির সম্মান করবে।
এ জগতে মানুষ নিজের সুখের জন্য কত লালায়িত, মানুষের সহানুভূতি ও বেদনাবোধ কত সুন্দর, কত মহৎ–মানুষ তা কবে বুঝবে? প্রকৃত সুখ কোথায়? পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারে সুখ আছে? আত্মার সাত্ত্বিক তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভোগ-সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ পরকে সুখ দিতে আনন্দ বোধ করবে, ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ নাই। আর্তক্ষুধিত আমার সামনে আঁখিজলে ভেসে বেড়াচ্ছে, আমি কোন প্রাণে আনন্দ-উৎসবে যোগ দেব? আর্তের দুঃখের মীমাংসা চাই, ক্ষুধিতের শান্তি চাই।
মানুষের জড়দেহের ব্যথার জন্য যে বেদনাবোধ, এ ছাড়া আর এক প্রকার বেদনাবোধ আছে। জ্ঞান ও অজ্ঞানে মানুষের আত্মার যে অবনতি ঘটে, তা দেখে মহাপ্রাণ ব্যক্তিরা যে বেদনাবোধ করেন, তাও সমান মহত্ত্বের পরিচায়ক। আত্মার দারিদ্র্য ও মানুষের শরীর-মন উভয়কেই ধ্বংস করে।
মানুষের পাপ মানব-সমাজকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যায়। তার জন্য অসীম দুঃখ সৃষ্টি করে। পাপী শুধু নিজে পাপ করে না, তার অত্যাচারের আঘাত সহ্য করতে যেয়ে মানব-সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। যে মানুষের চোখ থেকে রক্ত টেনে বের করে মানব হৃদয়ে চিতার আগুন জ্বেলে দেয়, সে জীবন্ত অভিশাপ হয়ে এ জগতে বাস করে। সে নিজের বুকে ছুরির আঘাত করে অথচ সে বুঝতে পারে না, সে কি করছে।
মানব-সমাজকে বাঁচাবার জন্যে অসীম প্রেমে, অনন্ত ব্যথা-অনুভূতিতে মহাপুরুষেরা পাগল হয়ে যান। তাদের বিরাট স্নেহের কল্যাণ আহ্বানে যারা সাড়া দেয়; তারা সৌভাগ্য লাভ করে।
আরব সমাজের পাপ–আর ব্যথিতের মর্মপীড়া মহাপুরুষ মোহাম্মদ (স)-কে কাঁদিয়েছিল–তিনি মানুষ মানুষ বলে পথে বের হয়েছিলেন।
যুবক বুদ্ধের প্রাণে মানুষের দুঃখ ও ব্যথা কী অসীম বেদনা সৃষ্টি করেছিলে–কত সুখ, কত বিলাস ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে মানুষের দুঃখ ব্যথার মীমাংসার জন্য তিনি বনে বনে ছয় বৎসর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর শরীরের উপর দিয়ে গাছ হয়ে গিয়েছিল। কী বিরাট মনুষ্যত্বের গৌরব দিয়ে খোদা তাঁকে এ জগতে পাঠিয়েছিলেন।
মানুষ যখন মহামানবতার পরিচয় দেন, তখন কেউ কেউ তাকে খোদার আসন দিয়ে থাকে। এতে মহামানুষদিগকে অপমান করা হয়। নারায়ণ হয়ে মহাপুরুষদের মোটেই তৃপ্তি। হয় না, তাঁরা চান মানব দুঃখের অবসান, অসত্য ও মিথ্যার বিরুদ্ধে মানব-সমাজের বিদ্রোহ। মহাপুরুষেরা যদি মানবসাধারণের কাছ থেকে নারায়ণ উপাধি পান, তাতে তাদের জীবনের বিশেষত্ব নষ্ট হয়।
জীবনে মহৎ হয়ে লাভ কী? কেননা আমরা মানুষ। রাজা হবার দাবি একমাত্র মানুষেরই আছে। দুঃখ, পাপ ও অজ্ঞানের আঁধারকে দুই হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে। আমাদিগকে উধ্ব হতে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। কী বিরাট আলোক, কী অফুরন্ত আনন্দের রাজ্য মানুষের সামনে, মানুষ তার গৌরব ভুলে কী করে আঁধার ও মৃত্যুর পথে হাঁটবে? মানুষকে। মহৎ করতে হবে কারণ মহৎ হবার জন্যই সে এ জগতে এসেছিল। দুঃখ-ব্যথা, মায়া প্রলোভনের ভিতর দিয়ে, সে যে কত বড়, তাই সে প্রমাণ করবে। মানুষ কত বড়, সে কী বিরাট, তার পক্ষে দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া কত বড় বোকামি, তার কতখানি অপমান হয়। সারা প্রকৃতি মানুষকে কত বড় হবার জন্যে ডাকছে, উদার আকাশ, উষা। আলো বাঁশরীর রাগিণী, মানবকণ্ঠের সঙ্গীতধ্বনি, আর্তের অশ্রু মানুষকে কেবলই মহত্ত্বের পথে ডাকছে। মিথ্যা এ জীবন, এ সুখ, এ বিষয়-বৈভব। জীবনে যে সকার্য করা যায়, তাই মানুষকে তৃপ্তি দিতে সক্ষম। দালান-কোঠা, হাতি-ঘোড়া, শত শত বিলাস উপহার কিছুরই মাঝে মানুষের তৃপ্তি নাই।
রানী ভিক্টোরিয়া একবার একখানা মৃত্যুদণ্ডের আদেশপত্রে স্বাক্ষর করতে যেয়ে সজল নয়নে ডিউক অব ওয়েলিংটনকে জিজ্ঞাসা করেন–ডিউক সত্যই কি এই ব্যক্তির প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে হবে? একে কি কিছুতেই রক্ষা করা যায় না?
ডিউক অপ্রস্তুত হয়ে বল্লেন–না মহারানী, এই ব্যক্তি তিনবার আইন অমান্য করেছে।
যার মৃত্যুর আদেশ দিতে হবে, সে ছিল একজন সৈনিক, সে তিনবার যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছিল। সৈনিকের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যাওয়া গুরুতর অপরাধ, এতে প্রাণদণ্ড হয়।
মহারানী আবার জিজ্ঞাসা করলেন–তা হলে এই ব্যক্তির সপক্ষে কিছুই আপনার বলবার নাই? ডিউক বল্লেন–লোকটি সামরিক আইন অমান্য করলেও এর স্বভাব বড় ভালো।
দয়াবতী রানী তখনই কাগজের উপর লিখলেন এর প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রত্যাহার করা গেল।
হযরত আলীর (রাঃ) সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হয়েছিল। লোকটির গায়ে অসীম শক্তি ছিল, মুসলমান সাম্রাজ্যের খলিফাও কম শক্তিশালী ছিলেন না। হযরত আলী তাকে যখন মাটির উপর ফেলে হত্যা করবেন তখন সে হঠাৎ খলিফার মুখে থুতু ফেলে দিল। খলিফা তৎক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে বল্লেন–এখন যেতে পার, তোমায় আর আমি কিছুই করব না।
লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার এই ব্যবহারের কারণ কী? হযরত আলী (রাঃ) বল্লেন-ঘৃণা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে আমি তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করি নি। তুমি দুষ্ট, মানব সমাজের সমূহ অকল্যাণ করছিলে, তাই তোমাকে শাস্তি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। যখন আমার মুখে তুমি থুতু দিয়েছিলে তখন আমার মনে ক্রোধ হয়েছিল। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আল্লাহ্র মানুষ আমি হত্যা করি নি। হযরত আলীর এই চরিত্র মহিমা মানুষের মনকে কত পবিত্র করে দেয়; আত্মবুদ্ধি কত উপরে টেনে তোলে।
গুজরাটের রাজা আহমদ শাহের জামাতা এক সময় একটা মানুষ খুন করেছিল। হত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনেরা যখন বিচারকের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করলো, তখন বিচারক ভাবলেন–জামাতার অপরাধের শাস্তি দিলে সম্রাট আমার উপর রুষ্ট হতে পারেন। এই চিন্তা তার বিবেক-বুদ্ধিকে দুর্বল করে দিল। তিনি নিজের আসনের অবমাননা করে বাদশাহের জামাতাকে বিশেষ কিছু শাস্তি দিলেন না। আহম্মদ শাহ যখন শুনলেন–তার দরিদ্র প্রজা ন্যায় বিচার পায় নি, তখন তার ভিতরকার মানুষ করুণ ঘৃণায় উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তিনি বিচারককে ডেকে বল্লেন–সাহেব, বিবেক-বুদ্ধিকে অবহেলা করে ন্যায় বিচারকে অবমাননা করে আপনি কী করে আমার নরহন্তা জামাতাকে মুক্তি দিলেন?
বিচারক লজ্জিত হয়ে বল্লেন–সম্রাট, আপনার জামাতা বলেই তাকে কিছু বলি নি, অন্য কেউ হলে তাকে কঠিন শাস্তি দিতাম।
সম্রাট বল্লেন–এর নাম কি বিচার? আমি যদি অন্যায় করতাম তা হলে আমাকেও কি –আপনি আইন অমান্য করে মুক্তি দিতে পারতেন? আপনি আপনার সুবুদ্ধিকে-ভয় করুন, আমাকে ভয় করবেন না। পাছে আমি কী মনে করি, এই ভয়েই হয়তো অপরাধীকে শাস্তি দিতে আপনি কুণ্ঠিত হয়েছেন। আমি কাপুরুষ বা অত্যাচারী রাজা নই। যার স্নেহের ধনকে আমার জামাতা হত্যা করেছে–তার অশ্রুর কি কোনো মূল্য নাই?
আহম্মদ শাহ অবিলম্বে জামাতার পুনর্বিচার করে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।
মহৎ ব্যক্তির কাছে সকলেই সমান, আপন-পর নাই। অন্যায় যে করেছে, সে আপন রক্তের কেউ হলেও তিনি তাকে শাস্তির হাত হতে রক্ষা করতে পারেন না।
তুমি অত্যাচারী বড় মানুষ আছ, তুমি গোপনে কোনো দরিদ্রের সর্বনাশ করেছ, তুমি আমার মিত্র, তোমার পত্নীর সঙ্গে আমার পত্নীর আলাপ আছে, তাই বলে কি তোমার সপক্ষে আমি কোনো কথা বলতে পারি? আমি আঁখিজলে তোমার ধ্বংসের ব্যবস্থা করবো। তুমি মিত্র বলে আমার বেশি আত্মীয় নও, মানব মাত্রেই আমার আত্মীয়। যে অত্যাচারী, যে মিথ্যার উপাসক, যে হীন দুবৃত্ত, সে আমার আত্মীয় হলেও কেউ নয়।
যে মহৎ, যে বড়, তাকে প্রশংসার লোভ না করেই বড় ও মহৎ হতে হবে। জাতির মধ্যে যখন বড় চরিত্র ও উন্নত জীবনের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তখন জাতির দুরবস্থার কথা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে হয়। কতকগুলি কাপুরুষ, মূর্খ ও হীন মানুষের জীবন জাতির দেহে শক্তি সঞ্চার করতে সক্ষম নয়। জাতির শক্তির পরিচয় পাওয়া যাবে তখন, যখন তার সন্তানগুলি মহত্ত্বকে সম্মান করতে শিখবে–যখন তারা ন্যায় ও সত্যকে সমাদর করতে জানবে।
জীবনের সব সময় ছোট বড় সকল কাজে মহত্ত্ব ও সুন্দর চরিত্রের পরিচয় দিতে হবে।
শত্রু রোমের দুয়ারে হামলা করেছে। তখনই তারা পঙ্গপালের মতো এসে রোম নগর ধ্বংস করে। আর তো সময় নাই। নদীর ব্রীজ ভেঙ্গে দিতে পারলে রক্ষা পাওয়া গেল নইলে আর কোনো উপায় নাই। যুবক হোরেশিও বল্লেন, দেশের সম্মান রক্ষা করবার জন্য কে কে প্রাণ দিবার জন্যে আমার সঙ্গে যাবে–মৃত্যু অবধারিত; কারণ পেছন থেকে ব্রীজ ভেঙ্গে দিলে আমরা আর কিছুতেই ফিরতে পারবো না। মরতে আমাদিগকে হবেই। দুজন। বীর যুবক হোরেশিওর সঙ্গে গেল ব্রীজ ভাঙ্গার জন্য আরও মানুষ তাদের সঙ্গে গেল। পেছনের লোকদিগকে হোরেশিও চিৎকার করে বললেন, আমরা সম্মুখে দাঁড়িয়ে শত্রুদের গতিরোধ করছি, তোমরা পিছন থেকে ব্রীজ ভেঙ্গে দাও। শত শত লোক মুহুর্মুহু ব্রীজের উপর আঘাত করতে লাগলো। সম্মুখের অগণিত সৈন্যের সামনে তিন বীর যুবক কুড়ুল তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। শত্রুর বজ্র-ভীষণ আক্রমণের অপেক্ষা করতে লাগলেন। পেছনের লোকগুলি প্রাণপণ শক্তিতে ব্রীজকে ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো।
শত্রুদল ব্রীজের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়ে দেখলো, ব্রীজ ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা হচ্ছে–রোম নগরে প্রবেশ করবার এই একমাত্র পথ। ব্রীজ ভেঙ্গে গেলে তাদের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে। কোনো রকমে নগরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। সেনা নায়ক হুকুম দিলেন–আর বিলম্ব নয়। হোরেশিও আর তার দুই সহযোগীর কুঠারকে ভয় করো না। ব্রীজ ভেঙ্গে গেলে আমাদের অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না।
হোরেশিওর দুঃসাহস দেখে মুহূর্তের জন্য শত্রুরা একটু হেসে নিলে, এতবড় সৈন্যবাহিনীর সামনে মাত্র তিনটি বীর। কী উন্মত্ততা!
শত্রুরা হোরেশিওকে শত শত অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলো। দুই হাত দিয়ে দীর্ঘ কুড়ুলের বাঁট ধরে হোরেশিও শক্ৰদলকে আঘাত করতে লাগলেন। সে কী ভীষণ দৃশ্য! কী অমানুষিক শক্তি-পরীক্ষা! সিংহের সামনে মেষপালের যেমন অবস্থা হয়, বিক্রম-উন্নত বীরবর হোরেশিওর সামনেও শত্রুদের তেমনি অবস্থা হতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ লড়তে পারলেই কাজ হাসিল হয়; আর পনেরো মিনিটেই ধ্বংসকার্য শেষ হবে। হোরোশিও প্রাণপণ শক্তিতে লড়তে লাগলেন, যায় প্রাণ যাবে, দেশের লক্ষ নর-নারীর স্বাধীনতা সম্মান তার হাতে। এত বড় মহত্ত্বের পরিচয় দিবার সুযোগ আর আসবে না।
পার্শ্বেই দুই ব্যক্তি অবসন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর পাঁচ মিনিট হলেই কাজ হাসিল হয়।
এইবার ব্রীজ বজ্রের শব্দে নদীর মধ্যে ভেঙ্গে পড়লো। হোরেশিও কুড়ুল দূরে নিক্ষেপ করে খরস্রোতা স্রোতোস্বিনীর মাঝে ঝাঁপ দিলেন। দশকে রক্ষা করা হয়েছে, এইবার মরণেও আনন্দ।
তীরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য নরনারী আনন্দ-চিৎকার গগন কাঁপিয়ে তুলছিল। রোমবাসীরা তীর হতে নৌকা নিয়ে অগ্রসর হল। শত্রুরা অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখতে লাগলো।
মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া মানুষের পক্ষে যদি অসম্ভবও হয়, তবু সে নীচতার পরিচয় কেন নেয়? জীবনকে পাপ ও অন্যায়ে কলঙ্কিত কেন করে? দিনে-দুপুরে মানুষের মাথায় বাড়ি দেওয়া, পত্নীর উপর অত্যাচার করা, ব্যভিচার-স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া, পত্নীর দাবিকে অগ্রাহ্য করে চরিত্রহীন হওয়া–এইগুলিকেই শুধু পাপের পূর্ণ চিত্র বলা যায় না। মানুষের শত রকমে পতন হয়, শত রকমে সে তার মানুষ্যত্বের অপমান করে। নিজেকে অপমান করবার মতো লজ্জা মানব-জীবনে আর কি আছে? আত্মসর্বস্ব হয়ে জীবন কাটানো, জ্ঞানাবদ্ধ মানুষের দুঃখ পাপকে সহ্য কর, নিজের ও জাতির মূর্খতায় কিছুমাত্র কষ্ট বোধ না করা–নিকৃষ্ট মানুষের স্বভাব।
এক সময়ে এক বালক কোনো শহরের পথে বসে কাঁদছিল। সে বাড়ি হতে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে এসেছিল, হাতে তার একটা পয়সাও ছিল না–তখন শীতকাল, শীতের কাপড়ও সঙ্গে ছিল না। এর উপর বালকের গায়ে জ্বর এসেছিল, সে সেই অপরিচিত দেশে কাকেও চিনতো না, কারো কাছ থেকে কেমন করে সাহায্য চাইতে হয় তাও সে। জানত না। পথিকেরা কয়েকবার তার কাঁদবার কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল–কিন্তু বালক উত্তরে কিছুই বলতে পারে নি।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। শীত আর শারীরিক কষ্টে বালকটি মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হল–মায়ের মুখোনি মনে করে তার চোখ দুটি পানিতে ভরে উঠেছিল। কাছে কিনারে লোকজনের বিশেষ বসতি ছিল না। খোদা সব জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন এ তোমরা বিশ্বাস। কর। মানুষের জীবনের দুঃখ দেখলে তিনিও দুঃখ বোধ করেন, তখন তিনি ব্যথা পেয়েও কিছু করেন না। মানুষ ইচ্ছা করে পাপ বরণ করে নেয়, খোদা তার গতিকে রোধ করেন না। এরূপ করলে তার সৃষ্টির আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। খোদা কতবার আঁখিজলে মানুষকে ‘আয়’ ‘আয়’ করে ডাকছেন, অবোধ মানুষ তা দেখে না। খোদা জলে, স্থলে, সারা পৃথিবীর পথে পথে মানুষের জন্যে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। মানুষ তা জানে না।
একটা রমণী কী একটা কাজে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বালকের রোদন শুনতে পেলেন। নারীর প্রাণ-স্নেহ মমতায় ভরা। রমণী বালকের নিকটে এসে স্নেহের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা তোমার কী হয়েছে? বালক মায়ের মতোই এক নারীমূর্তিকে দেখে কথা বলতে সাহস পেলো। সে বললো—মা, তোমার মতনই বাড়িতে আমার এক মা আছেন। তাঁর কথার অবাধ্য হয়ে আমি পালিয়ে এসেছিলাম, এখন বিপদের একশেষ। হয়েছে। শীতের দিনে গায়ে কাপড়-চোপড় নাই, গায়ে জ্বর এসেছে, অজানা-অচেনা দেশ, কোথায় যাই। মায়ের অবাধ্য হয়ে এখন আমাকে পথে পড়ে মরতে হল।
নারী বললেন, তোমার কেউ না থাকুক, আমি আছি। আমি তোমার মা। চল আমার সঙ্গে, বেশি দূর নয়। কাছেই আমার বাড়ি।
বালক–মা, আমার তো উঠবার সাধ্য নাই, হাত-পাগুলি হিম হয়ে ভেঙ্গে আসছে।
আচ্ছা, তা হলে আমার কোলে এসো, এই বলে রমণী বালককে কোলে তুলে নিলেন। বালককে বুকে নিয়ে নানা সান্ত্বনার কথা বলতে বলতে রমণী বাড়িতে এলেন। ঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে সেখানে বালককে শোয়ালেন। সে রাত্রিতে আর তার খাওয়া হলো না–সারা রাত্রি বালকের বিছানার পাশে বসে রইলেন। তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছিল। আহা! কার এ ব্যথার ধন। এই অজানা দেশে পথে পড়ে মরছিলো। ভাগ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এর কী অবস্থা হতো?
পরদিন রমণী নিজের খরচে ডাক্তার ডাকলেন। অনেক সেবা-শুশ্রূষায় অবশেষে। বালক বেঁচে উঠলো। রমণীটিও আনন্দে ভাবলেন আমার কষ্ট স্বীকার সার্থক হল। এখন মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যাক।
আরও কয়েকদিন পরে রমণীটি বালককে কিছু রাস্তা খরচ আর একখানা নূতন কাপড় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হলেন। প্রাণের কৃতজ্ঞতায় চোখের পানিতে রমণীর আঁচল ভিজিয়ে বালক বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
ব্যথিত বিপন্ন মানুষকে যে একটা স্নেহের কথা বলেছে, সেই মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছে। মানুষ যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে, যখন রোগযন্ত্রণায় তার শরীর ভেঙ্গে আসে, যখন সে মরণ পথের যাত্রী, তখন তার সেবাশুশ্রূষা করাতে যথার্থ মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া হয়। বিপন্ন। ব্যক্তি পরিচিতই হউক আর অপরিচিতই হউক, তাকে আপন বলে বুকে টেনে নিতে হবে। মানুষ মাত্রই মানুষের আত্মীয়–এ যে মনে করতে পারে তার ধর্ম বিশ্বাসের মূল্য খুব বেশি। সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষকে তুমি কাছে টেনে আন, এত বড় দাবির কথা বলবার সাহস আমার নাই, কিন্তু তোমার চোখের সামনে যে মরে যাচ্ছে তার দিকে তুমি ফিরে তাকাবে।? তোমার কানের কাছে যে আর্তনাদ করছে তার পানে কি তুমি একটুও অগ্রসর হবে না?
সিরাজগঞ্জে এক কাঠওয়ালার কলেরা হয়। বাজারের এক পতিতা নারীকে তার সেবা করতে দেখেছিলাম। সেই পতিতার মধ্যে দেখেছিলাম আমি–নারীর মাতৃমূর্তি, সে কী পবিত্র দৃশ্য! শ্রদ্ধাভক্তিতে আমার মাথা নত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুখ খুলে কিছুই প্রকাশ করতে পারি নি। নারী মাতৃমূর্তি কত সুন্দর! কত পবিত্র! মাতৃরূপিনী নারী জাতির যখনই আমরা অপমান দেখি, তখন মন দুঃখিত হয়ে উঠে। সে হিন্দু কি মুসলমান, সে কথা ভাববার অবসর থাকে না।
এক ব্যক্তির কথা জানি, তিনি এক সময়ে একজনের কাছ থেকে এক আনা পয়সা ধার নিয়ে কী একটা জিনিস কিনেছিলেন, কাছে তখন পয়সা ছিল না। বাড়ি এসে টাকা ভাঙ্গিয়ে সেই লোকটিকে পনেরো আনা দিয়ে নিজে মাত্র এক আনা রাখলেন; লোকটি বিস্মিত হয়ে বললেন–আপনি আমার কাছ থেকে মাত্র এক আনা নিয়েছেন, এখন পনেরো আনা দিচ্ছেন কেন? আপনার ভুল হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, বাকি পনেরো আনা তোমাকে দিলাম ওটা তোমার নিতেই হবে। লোকটি অগত্যা সে পয়সা নিতে বাধ্য হল।
এখানে এই ভদ্রলোকের চরিত্র-মাহাত্ম সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। জ্ঞান ব্যতীত মানুষের কোনো জায়গাতেই কল্যাণ নাই, কেমন করে যে উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে হয় তা সে বুঝতে পারে না। এজন্যে জ্ঞানের আসন সর্বোপরি। ভদ্রলোকের প্রাণের প্রশংসা না করে পারি না। তার নির্মল সুন্দর আত্মাটি ভক্তি পাবার যোগ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়। তার এই দান সত্যই কি মানবজাতির অনুকরণের জিনিস? আমার মন ভয়ে সঙ্কোচে উত্তর দেয়-না।
মানুষকে দান কর, কিন্তু দান করবার জন্যই কি দান করতে হবে? দেখতে হবে প্রদত্ত পয়সায় দানপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রকৃত উপকার হবে কিনা। যার আছে, তাকে আরও দিলে পয়সার অপব্যবহার করা হয় না কি? সে সেই পয়সা পেয়ে আনন্দ লাভ করতে পারে, কিন্তু সে আনন্দটুকু তার না হলেও বিশেষ ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না। এইসব টাকা দিলে জাতির কত কল্যাণ হয়, অজ্ঞান মূর্খ লোকেরা তা বোঝে না! অগণিত টাকা ব্যয় করে তার মহত্ত্বের পরিচয় দেয়। মানুষকে সবার আগে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, জ্ঞানের দ্বারা মানুষ তার জীবনের সকল কর্ম ঠিক করে নিতে পারে তাকে বলে দিতে হয় না, এই পথে তুমি চল। জ্ঞান যার নাই, সে কিছুই বোঝে না, মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
রামতনু লাহিড়ী মহাশয় একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি খুব ব্যস্ততার সঙ্গে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন, যেন কে তাকে মারতে তাড়া করছে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবার স্থির হলেন। সঙ্গের বন্ধুটি ব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন–ভাই, এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। আমি জানি তার অবস্থা বড় শোচনীয়, টাকা দেবার কোনো সঙ্গতি নাই। আমার দিকে তিনি আসছিলেন। আমি দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে সরে এসেছি। আমাকে দেখলে তার ভারি লজ্জা হত! ভদ্রলোককে কী করে লজ্জা দেব, এই ভেবেই আমি পালিয়ে এলাম। এমন করে পরের লজ্জায় ব্যথাকে অনুভব করবার ক্ষমতা কয়জনের থাকে। সাধারণত সব সময়ই মানুষ লজ্জা, ব্যথা দিতে আনন্দ বোধ করে।
জাতি বল, বংশ-মর্যাদা বল, মহত্ত্বের তুলনায় কিছুই কিছু নয়। মানুষ যেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্য দেখে সেখানেই ভক্তিতে তার মাথা নত হয়। বড়লোক বলেই কি মানুষ বেশি শ্রদ্ধা পাবার উপযোগী? বড়লোককে মানুষ লাভের আশায় শ্রদ্ধা দেখতে পারে, কিন্তু কুস্বভাব লোক কখনও মানুষের অন্তরের রাজা হতে পারে না। মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, দরিদ্র হোক, যখনই তার মধ্যে মহত্ত্ব দেখবো, তখনই তাকে আমরা শ্রদ্ধা করবো। ছোটলোক বলে সমাজে যে সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে আছে সে কি মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারে না?
আমি দেখেছি ব্যথিত মানুষের গৌরবদীপ্ত মুখ, সে মুখ কত সুন্দর! কত পবিত্র? রূপ যদি মানুষের থাকে, তবে তা মহত্ত্বের আলোকভরা মুখেই আছে। রূপবান রূপময়ী নর নারীর নীচাশয়তা তাদের রূপকে কতখানি কুৎসিত করে, তাও আমি দেখেছি।
যা বিশ্বাস করি, মানুষের ভয় অথবা লাভের আশায় তা বলতে ভয় করা কত বড় দুঃখের বিষয়! এই অবিচারটুকু জয় করবার জন্যেই মানুষ স্বাধীনতা চায়। বিশ্বাসকে যে যতখানি চেপে রাখে সে ততখানি দরিদ্র। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তিনি কিছুতেই জীবনের সত্যকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দিতে চান না। এতে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হয়।
অনেক টাকা মাইনে পাই, সেই লোভে কী করে আমি আমার কোটি টাকার আত্মাটিকে বিক্রয় করতে পারি? আমার দুর্জয় মনুষ্যত্ব আমার জীবনের উচ্চ সার্থকতা আমি কোনো জিনিসের বিনিময়েই নিরর্থক করে দিতে পারি না। অর্থ অর্জন করে শরীরকে বাঁচান হবে, অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকদের কাছে খুব প্রশংসা লাভ করা যাবে, বন্ধু-বান্ধবেরা আমার সুনাম জ্ঞান করবে; কিন্তু তাতে যদি আমার আত্মার ভাষা নীরব হয়ে যায়, আমার মনুষ্যত্ব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, তা হলে আমি আমার শরীরকে বাঁচাতে চাই না, আমি কারো প্রশংসা, কারো সুনাম পাবার লোভ করি না।
তখনও হযরত মোহাম্মদ (দঃ) তার সংস্কারের বাণী নিয়ে জগতে আসেন নি। রোম নগরে এক বাড়িতে বসে একদিন এক মহিলা সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। বাড়িতে তিনি একাকিনী ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি দরজার দিকে চাচ্ছিলেন কেউ দরজা ঠেলে ভিতরে আসে কি না।
তখন ছিল হযরত ঈছার (আঃ) যুগ। রোমের যারা মূর্তি পূজা ছেড়ে হযরত ঈছার (আঃ) সত্য ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের উপর ভারি অত্যাচার হতো। কোনো রকমে যদি শাসক সম্প্রদায়ের কেউ জানতে পারত কোনো ব্যক্তি ঈছার (আঃ) ধর্ম গ্রহণ করেছে, তখন তখনই তাকে বাঘের মুখে ফেলে দেয়া হতো। নানান নির্যাতনে তাকে মেরে ফেলা হতো। ফলে নব ধর্মাবলম্বীদিগকে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস গোপন করে রাখতে হতো। যারা তা পারত না, তাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল, এইভাবে বহু ধর্মপ্রাণ রোমবাসীকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। যে নারীর কথা বলছিলাম,–এর স্বামী কিছুদিন আগে ধর্মবিশ্বাসের জন্যে শহীদ হয়েছিলেন।
প্রাণভয়ে মানুষ নিজের বিশ্বাস ও সত্যকে অনেক সময় গোপন করে চলে, কিন্তু সামান্য লাভে বা কল্পিত সুখের জীবনের জন্যে যে নিজেকে অবনমিত করে, নিজের মনুষ্যত্ব ও বিবেক-বুদ্ধিকে বিসর্জন দেয় সে কীরূপ মানুষ!
মহিলাটির একটি ছেলে ছিল তাকে রেখে তাঁর পিতা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ছেলেটি বাড়িতে মাকে একাকিনী রেখে প্রত্যহ স্কুলে যেতো। স্বামীর একমাত্র ছেলে প্রৌঢ়ার নিঃসহায় নারী জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা। আজ বিদ্যালয় হতে ফিরে আসতে বিলম্ব করছে তাই আকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নারী জাতির সন্তানের প্রতি কত মায়া তা আমরা ধারণা করতে পারি না। মায়ের মূর্তিতে নারী কত বড়! নারী দরিদ্র হোক, পতিতা হোক, সন্তানকে বুকে করে সে রানীর আসন অধিকার করে। নারী যখন শিশুর মুখে সুধা ধারা ঢালে, তখন তাকে মা বলে সালাম করলে দোষের হয় না। নারীকে যেখানে আঁখিজল ফেলতে হয়, সেখানে খোদার অভিশাপের আগুন জ্বলে।
প্রৌঢ়ার হাতের কাজ ভুল হয়ে যাচ্ছিল। ছেলে বাড়ি আসতে দেরি করছে। বাতাস দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল, প্রৌঢ়া চমকিত হয়ে চেয়ে দেখলেন, কেউ না।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় বালক প্যানক্রিয়াস বাহির হতে ‘মা’ বলে ডাকল। হাতের কাজ ছুঁড়ে ফেলে প্রৌঢ়া দরজা খুলে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন-বাপ, আজ যে তোর এত দেরি হল? বালক বললো—”কেন ‘মা’ এত ব্যস্ত হয়েছ? আমার বয়স তো আঠার।” মা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে একখানা চেয়ারের উপর বসলেন। ছেলে মাটিতে মায়ের পায়ের কাছে বসে কোলে বাহু রেখে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন–”আজ কেন এত দেরি হল? তুই তো রোজ বেলা থাকতে আসিস। জানিস তো নিজের দেশে আমরা কতটা প্রবাসী হয়ে বাস করছি। তোর বাপকে রোমবাসীরা হত্যা করেছে–আমার সব সময় মনে ভয় হয়।”
ছেলে–মা কীসের ভয়? বিশ্বাসের জন্যে বাপ মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এর চেয়ে মহনীয় মৃত্যু কি আর আছে? আমার যদি অমনি করে মরণ হয়, তাতে আমার জীবন ধন্য হবে!
মা–বাপ, তুই অমন কথা কী করে বললি? তুই যে এখনো আমার দুধের ছেলে। আজ আমার জীবন সার্থক হল। কে তোকে এমন মধুর কথা শিখিয়েছে?
ছেলে–মা, তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছো, সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমাদিগকে যে কোনো ক্ষতি স্বীকার করতে হবে! গৌরবময় মরণের মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি আমরা পাই, তা কত সুন্দর। মহান মৃত্যু দিয়ে দুঃখময় পঙ্কিল জগতের মাঝ থেকে যদি জীবনের অভিশাপকে সরিয়ে নেওয়া যায়, তবে তা মানুষের পক্ষে কত বড় লাভ!
মা–বাপ, তুই আর ছোট ন’স, এই এখন মানুষের মতোই কথা বলতে শিখেছিস। আজ আমার নারী জীবন সার্থক হয়েছে কিন্তু তোর বাড়ি ফিরতে এত দেরি হল কেন, সে কথা তো এখনও বললি না?
প্যানক্রিয়াসের মুখ হঠাৎ কালো হয়ে গেল। অশ্রুভারে চোখ দুটি ছলছল করতে লাগলো। বললে–তুমি আর তা শুনো না মা।
মার চোখেও পানি এলো–সন্তানের এতটুকু ব্যথাও যে তিনি সইতে পারেন না। তিনি জিদ করে বললেন–না বাপ, আমার কাছে কোনো কথা গোপন করিস না। কী হয়েছিল বল।
প্যানক্রিয়াস–আজ স্কুলে একটা সভা ছিল–সভার আলোচ্য বিষয় ছিল–পণ্ডিত যিনি, সত্যের জন্য সব সময় মরতে প্রস্তুত থাকবেন। আমি এ সম্বন্ধে সভায় যখন প্রবন্ধ পড়ছিলাম, তখন সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। প্রবন্ধ শুনতে শুনতে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছিল। আমাদের শিক্ষক মহাশয়ও কেঁদেছিলেন। প্রবন্ধ পড়বার কালে মনের আবেগে হযরত ঈছার (আঃ) নাম করে ফেলেছিলাম। তাই সভা যখন শেষ হয়ে গেল, শিক্ষক মহাশয় গোপনে ডেকে বললেন–বাবা, দেশের অবস্থা খারাপ, চারদিকে শত্রুর কান খাড়া হয়ে আছে। এই কথা বলে তিনি চোখ মুছে আমার কাছ থেকে চলে গেলেন।
মা–শিক্ষক মহাশয় কি তা হলে হযরত ঈছাকে (আঃ) মানেন? তার চরিত্রবল, তার পবিত্র জীবনের প্রশংসাই এতকাল শুনেছি, তিনি যে এমন করে আত্মগোপন করে আছেন, তা তো বুঝি নি। খোদাকে ধন্যবাদ, তোমাকে উপযুক্ত শিক্ষকের হাতেই দিতে পেরেছি। তারপর?
প্যানক্রিয়াস–তারপর আমি আর ছেলেদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ালাম। নগরের হাকিমের ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। সেই ছেলেটি ভারি বদমাইস। কী কারণে জানি না, ও আমাকে বিষ চোখে দেখে। আমি ক্লাশের মাঝে সবার চোখে ভালো ছেলে, আর সে ক্লাশের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছেলে। আমার প্রশংসা শুনলে তার যেন মরণযন্ত্রণা উপস্থিত হয়। আমাকে মোটেই দেখতে পারে না। আমি যে তার কাছে কী অপরাধ করেছি। জানি নে, ভারি হিংসুক আর বদ ছেলে সে। আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে,–কিহে প্যানক্রিয়াস, তুমি আমাকে ভয় কর না? এই কথা বলে সে বিনা কারণে আমায় ধাক্কা দিলে।
আমি বললাম–এরূপ অসভ্যতার পরিচয় দিচ্ছ কেন? সে বললে–দ্যাখ প্যানক্রিয়াস, তুই নানা রকমে আমার সঙ্গে শত্রুতাচরণ করেছিস, আমার পায়ে ধরে যদি ক্ষমা চাস তা হলে তোকে ক্ষমা করবো, নইলে নয়। রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল, কিছু না বলে আমি চুপ করে রইলাম–তুমি না আমায় বলেছ, যে রাগকে জয় করতে পারে, সে-ই মানুষ,–সেই কথা আমি তখন মনে করছিলাম।
মা–তাই ঠিক বাপ।
প্যানক্রিয়াস–মা, এরপর যা ঘটেছে তা আর বলতে পাচ্ছি নে–এই কথা বলে প্যানক্রিয়াস কাঁদতে লাগল।
মা ছেলের মাথা বুকের কাছে টেনে বললেন, “বাপ, তুই আমার কাছে সব কথা বল।”
প্যানক্রিয়াস আবার বলতে শুরু করলে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সেই ছেলেটির নাম কারভিন।
কারভিন আবার বললে–প্যানক্রিয়াস, আমি কার ছেলে তা তুই জানিস? ক্লাশে লেখাপড়ায় তুই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তোর অহংকার ভরা চাউনিগুলি আমার অন্তর বিদ্ধ। করে। আচ্ছা এইবার আয়, কার গায়ে কত জোর পরীক্ষা হোক। আমাকে ভয় করতে হবে কিনা এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমি বললাম তোমার গায়ে আমার চেয়ে বেশি শক্তি আছে। আমি মারামারি করতে পারব না।
মা–এরপর কী হল?
ছেলে–আমি তাকে খুব পিটিয়ে দিতে পারতাম। কী কষ্টে যে আমি আমার রাগ দমন করতে পেরেছি, তা আর কী বলব মা। ‘কাপুরুষ’ গালটা আমার বড় লাগে। যার বাকা হৃৎপিণ্ডের রক্ত দিয়ে নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছেন–সে কাপুরুষ! প্রাণে কী জ্বালা উপস্থিত হল, তা খোদাই জানেন। ভিতরকার ক্রোধ শয়তানকে শেষকালে জয় করতে পেরেছিলাম। হেসে বললাম–ভাই কারভিন, তুমি আমাকে অন্যায় করে আঘাত করলে। তবে আমার বিশেষ লাগে নি, একটু রক্ত পড়েছে মাত্র, শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রার্থনা করি তোমার স্বভাবের এই প্রচণ্ড উগ্রতার শীঘ্রই পরিবর্তন হোক। আমাদের শত্রুতার এইখানে অবসান হোক–এরপরে যেন তোমার বন্ধু হতে পারি।
গোলমাল শুনে শিক্ষক মহাশয় সেখানে এলেন। আমি তাকে হাতে ধরে অনুনয় করে বললাম-শিক্ষক মহাশয়, কারভিনকে দয়া করে কিছু বলবেন না। ছেলেমানুষী করে এই কাজ করে ফেলেছে, ওকে ক্ষমা করুন। এজন্য আমি ওর উপর একটুও ক্রুদ্ধ হইনি।
শিক্ষক মহাশয় ভয়ানক চটে ছিলেন। আমার কথায় অগত্যা শান্ত হয়ে গেলেন। এসব কারণে বাড়ি আসতে বিলম্ব হয়েছে। মা, তোমার মনে কি ব্যথা লাগছে? মা, ব্যথার তো
কিছু নাই, দেখ দেখি আমি কেমন করে নিজেকে জয় করতে পেরেছি, এতে তোমার আনন্দ হচ্ছে না? পরকে যদি অন্যায় করে ব্যথা দিতাম, তাতেই আমার দুঃখের কারণ হতো। যে আঘাত দিয়েছে, তারই লজ্জার কারণ বেশি।
মা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন–বাপ তোর মধ্যে এত মহত্ত্ব, এত মনুষ্যত্ব জেগেছে? আমার বহু রাত্রির নয়ন-জলের প্রার্থনা তা হলে খোদা শুনেছেন। তোর বাপকে যেদিন রোমবাসীরা হত্যা করে, সেদিন তার কণ্ঠের খানিকটা লাল রক্ত আমি সংগ্রহ করেছিলাম, আমার বুকে যে মাদুলি দেখছিস এর মাঝে সেই রক্তটুকু একটু ছোট ন্যাকড়ায় ভরে রেখে দিয়েছি। আজ আঠার বছর শয়নে-স্বপনে এর রক্ত আমি টেনে বেড়াচ্ছি। তোর বাপের সেই ত্যাগ-মহিমার চিহ্ন আজ তোর গলে পরিয়ে দেবো।
এই কথা বলে প্যানক্রিয়াসের মা চোখের জলে কণ্ঠের মাদুলিটি ছেলের গলে পরিয়ে দিলেন।
এর কয়েকদিন পরে রোমবাসীরা যুবক প্যানক্রিয়াসকে ধরে নিয়ে চিতা বাঘ-দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। এ জগতে আগুন, আঁখিজল আর রক্তের ভিতর দিয়েই সত্য, কল্যাণ জয়যুক্ত হয়ে থাকে।
কত দুঃখের ভিতর দিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সঃ), হযরত ঈছার (আঃ) ধর্মের সংস্কার সাধন করেন। মানব-সমাজের যখন অধঃপতন হয়, তখন শুধু ধর্মবিশ্বাস তাদেরকে বড় করে রাখতে পারে না। হযরত ঈছার (আঃ) মহাধর্ম যখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তখনই আরব মরুভূমির মাঝে এক নতুন মহাপুরুষ মানুষের জন্য কল্যাণ-মন্ত্র নিয়ে দাঁড়ালেন।
যে কঠিন কথা বলতে পারে, সে নিজকে কত ছোট করে ফেলে। যে নীরবে অপমান। সহ্য করে শত্রুর মঙ্গল চায়–সে কত মহৎ! যিনি মহৎ। তিনি অপমানের বিরুদ্ধে সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন না, তিনি অপেক্ষা করেন। আল্লাহর কাছে তিনি শত্রুর সুবুদ্ধির প্রার্থনা করেন। তিনি কাতরভাবে বললেন–হে খোদা, এরা কিছু বোঝে না, এদিগকে ক্ষমা কর।
জাতীয় অপমান সহ্য করা মহত্ত্বের লক্ষণ নয়, বরং তা কাপুরুষতা! প্রতিশোধ নেবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি প্রতিশোধ না নেই, সেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্যের পরিচয় দেয়া হয়।
অপদার্থ ব্যক্তির অন্যায় ক্রোধের কথা শুনে চুপ করে থাকায় বিপুল মহত্ত্ব আছে। অন্যায় বা অপমানের কথা শুনে মনকে শান্ত করে রাখা সহজ কথা নয়। ক্রোধ যদি সংযত করতে পার, লোকে জানুক বা না জানুক, মহত্ত্বের পরিচয় নিয়ে যদি তুমি প্রাণে তৃপ্তি লাভ করতে পার তাহলে তোমার ভিতরে একটা দুর্জয় শক্তি জেগে উঠবে। ভিতরকার শক্তিই আমাদেরকে বড় করে তোলে–এ শক্তি লাভ হয় জ্ঞান চরিত্রবল আর পুণ্যকার্যে।
বড় মরণে যদি জীবনের বালাই হতে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত সুখের হয়। এ জগতে কামনা-বাসনার কোনো তৃপ্তি নাই। অনন্ত ক্ষুধা মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। দুঃখ-পাপের কঠিন চাপে মানুষের হৃদপিণ্ড ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ জগতে কীসের সুখ? গত জীবনে যত সুখভোগ করেছি, তার একটুও তো মনে নাই–সে কেবল একটা বিরাট স্বপ্ন আর কিছু নয়।
যতকাল বেঁচে আছি ততকাল যেন কোনো অন্যায় না করি, জীবনে যে মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবো সেই স্মৃতিটুকু মৃত্যুকালে আমার প্রাণে যথার্থ আনন্দ আনবে। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ পাপ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, যথাসাধ্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট মোচন করতে চেষ্টা করবো। তারপর মৃত্যুর দ্বারা আমাদের মুক্তি হবে। এ জগতে অনন্ত কোটি মানুষ এসেছিল, কোথায় তারা? কত যুবক-যুবতী এ জগতে কত হাসি হেসেছে–কোথায় সে সব হাসি? কেন মিছে এই স্বপ্ন-ভস্মের জন্য এত মারামারি?
অভাব ও দারিদ্র মানুষের মনুষ্যত্বকে চূর্ণ করে দেয়, কী মহত্ত্বের পরিচয় সে দেবে? প্রাণ দিয়েই যে সব সময় মানুষের কল্যাণ করতে হবে, এমন কথা হতে পারে না। দুঃখী দরিদ্রকে অর্থ দিতে হবে, দরিদ্রের জন্য ভিখারি হতে হবে। কিন্তু যার কিছু নাই, সে তো পূর্বেই ভিখারি হয়ে আছে, সে আর কী দিয়ে ভিখারি হবে? অর্থ উপার্জন কর মানুষের জন্য, এরই নাম মহত্ত্ব! নয়নে অশ্রু, হৃদয়ে প্রেম, আর হাতে অর্থ মানুষকে মহৎ করে। জীবনে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে–পরের জন্য। যে সঞ্চয় করে, পরের জন্য যিনি দরিদ্র জীবনযাপন করেন, মানব মঙ্গলে অর্থ ব্যয় করেন, তিনি নিশ্চয়ই মহৎ।
ব্রহ্মদেশে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, এক ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার চাল দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছিলেন। দরিদ্রের পক্ষে মানুষের এত কল্যাণ করা কি সম্ভব?
মহৎ যিনি, তিনি বড়। ক্ষমতা আছে, কিন্তু যে ক্ষমতার নিত্যই অপব্যবহার হয়, অর্থ আছে–কিন্তু যে অর্থ কেবল জমিদারি ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়, এরূপ ক্ষমতা ও অর্থের মালিককে বড় বলা যায় না। যারা তার কাছে লাভের আশা করে, যারা তার আত্মীয় তারাই। তার তোষামোদ ও প্রশংসা করে। জ্ঞানী ও সত্যের সেবক যারা তারা এদেরকে সম্মান করেন না।
ইচ্ছা করলে ধনীরা জীবনে কত মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারেন? মানুষের লক্ষ মণ অর্থ থাকলেও যদি সে জ্ঞান–দরিদ্র হয়, সে বোঝে না প্রকৃত ধর্মপালন কীসে হয়। প্রেমহীন মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রাণের উপাসনার যে কোনো মূল্য নাই–এ কথাও সে জানে না। সে পীড়িত নর-নারীর বুকের উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি ওজু করে মিলাদ ও ধর্মসভায় যোগ দেয়।
আমেরিকার কাছ দিয়ে সমুদ্রপথে একখানি যাত্রী জাহাজে এক ইংরেজ দম্পতি যাচ্ছিল। সঙ্গে তাদের কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বড় মেয়েটির বয়স আঠার বৎসর হবে–তার নামটি আমার ঠিক মনে নাই। হঠাৎ জাহাজের কাপ্তানের কানে দূরের একখানি জাহাজের বিপদ সংকেতের ধ্বনি এসে লাগল। কাপ্তান দূরবীন দিয়ে দেখলেন, বহুদূরে একখানি জাহাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিকদের তিনি সেদিকে জাহাজ চালাতে হুকুম দিলেন। প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পরে বিপন্ন জাহাজের নিকটবর্তী হয়ে দেখা গেল, জাহাজখানি জনমানবশূন্য। মাত্র ২-৩ জন লোক বিষণ্ণ মনে ডেকের একধারে মলিন মুখে বসে আছে। নূতন জাহাজখানি বিপন্ন জাহাজের পাশে লাগতেই তারা উঠে এল, সমস্ত যাত্রীরা তাদের কী বিপদ জানবার জন্যে সমুৎসুক হয়ে জাহাজের এক পাশে এসে দাঁড়ালেন।
কাপ্তানের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললো ভীষণ কালাজ্বরে সবাই মারা গিয়েছে, যারা এখনও মরে নি তারাও মরার মতো হয়ে কেবিনের মাঝে পড়ে আছে। কেউ তাদের দেখবার নাই। আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী ভালো আছি। কালাজ্বরের কথা শুনে যাত্রীদের ভিতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল, কারণ এই জ্বর ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে–এ জ্বর হলে রোগী মরবেই!
কাপ্তান গভীরভাবে যাত্রীদিগকে লক্ষ্য করে বল্লেন–যাত্রীদের মাঝে এমন কেউ কি নাই, যিনি এই বিপন্ন লোকগুলিকে সাহায্য করবার জন্য যেতে পারেন! এ কথাও বলছি, যিনি এদের মাঝে যাবেন, তাঁর প্রাণের আশা খুব কম। মরবার পণ করেই এদের মাঝে যেতে হবে।
কেউ কথা বলছিল না। কাপ্তান আবার বললেন, এখানে যাত্রীর সংখ্যা অল্প, কিন্তু। তবুও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবার মতো কি কেউ নাই?
একটি মেয়ে বললে–আমি এদের মাঝে যাব। সবার মুখ প্রশংসা ও শ্রদ্ধায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যে ইংরাজ দম্পতির কথা বলেছিলাম এই মেয়েটি তাদেরই!
মহৎ প্রাণ যুবতীটির মা কেঁদে বললেন, মা তুমি প্রাণ দেবার জন্য এদের মাঝে যাবে? তুমি মরো না, বেঁচে থাক।–আমার মরবার সময় হয়েছে, আমি এদের মাঝে যাবো।
মেয়ে বললে–না মা, সে কি হয়? দেখ, আমি এখন অবিবাহিতা, আমার জীবনের মূল্য নাই। আমার মৃত্যুতে জগতের বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। তুমি মরে গেলে তোমার এ ছোট শিশুটির যত্ন করবে কে? মেয়েটির পিতা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন–মা, আমি বুড়ো হয়েছি, আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমরা বাড়ি যাও, আমিই বিপন্নদের সেবা করতে যাবো।
কন্যা বল্লো–বাবা, তুমি গেলে আমার ভাই-বোনগুলি আর কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে? আর তুমি পুরুষ–তোমার কি সেবা-শুশ্রূষা করা সাজে? দয়া করে আমাকে অনুমতি দাও। সেবা দ্বারা জীবনকে ধন্য করবার সুযোগ আমাকে দাও। এর চেয়ে জীবনকে সুব্যবহার সব সময় ঘটে না।
সময় সংক্ষিপ্ত। অধিকক্ষণ অপেক্ষা করবার সময় ছিল না। পিতা স্নেহে কন্যার ললাট চুম্বন করলেন। মা, কন্যাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সজল নয়নে বললেন–মা, ধন্য তোমার জীবন, তোমাকে পেটে ধরে আমিও আজ ধন্য হলাম।
জাহাজের যাত্রীরা সবাই এসে বালিকাটির সঙ্গে করমর্দন করলেন। ছোট ভাই বোনগুলিকে একবার কোলে করে এই মহাপ্রাণা বালিকা বিপন্ন যাত্রীদের জাহাজে নেমে গেলেন।
অনেক সময় দরিদ্রের মাঝে মহত্ত্বের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যায়, শিক্ষিত ও বড়োলোকদের মাঝেও তা পাওয়া যায় না। দরিদ্র সাধারণ মানুষের মহত্ত্ব, সহৃদয়তা ও ছোট ছোট দানের নিকট জগৎ বহু পরিমাণ ঋণী। কয়েকটি হাসপাতাল বা অতিথিশালা মানুষের দুঃখের বহু পরিমাণ মীমাংসা করলেও পল্লীর সহৃদয় দীন-দুঃখী মানুষ নীরবে দুঃখ মোচন করে।
পরের অর্থ অপহরণ করে লোকে বড় মানুষ হয়েছে এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক আছে। কিন্তু পরকে মানুষ কেমন করে একেবারে নির্লোভ হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে, তার গোটা দুই দৃষ্টান্ত আমি এখানে দেবো। এই সব মানুষ জড় দেহের ভোগ অপেক্ষা আত্মার সাত্ত্বিক তুপ্তির ভিখারি। মানব সংসারে এই ভাবের মানুষের আবির্ভাব বেঁচে থাকে। ভণ্ড নরপিশাচেরা এ জগতের কেবলই অকল্যাণ করে, আর মহাপ্রাণ জাতিরা জগতের কল্যাণ, সুখ ও আনন্দ বর্ধন করেন।
কলিকাতা মদন মোহন দত্তের বাড়ির ঝি-এর ছেলে রামদুলাল, দত্তের বাড়িতে সরকারের কাজ করতো। এই যুবক এক সময় প্রভুর টাকায় এক লক্ষ টাকা লাভ করে। রামদুলাল ইচ্ছে করলে এই টাকা নিজে নিতে পারত, তাতে তার বিশেষ অন্যায় হতো না। প্রভুর টাকা প্রভুকে ফিরিয়ে দিয়ে লাভের টাকা নিজে নিলে প্রভু কিছুই জানতে পারতেন না। রামদুলালের ভিতরে যে আশ্চর্য মহত্ত্বের গৌরব ঘুমিয়ে ছিল, তা তাকে বলেছিল, দুলাল, এই টাকা তুমি তোমার প্রভুকে দিয়ে দাও। জীবনের মহত্ত্বের কাছে এই লক্ষ টাকার মূল্য খুবই কম। দুলাল প্রভুর সামনে যখন লক্ষ টাকা রেখে দিয়ে বললে–মহাশয়,
আপনাকে না জানিয়ে আপনার টাকায় লাভ করেছি–এর উপর আমার কোনো অধিকার নাই, দয়া করে গ্রহণ করলে সুখী হবো। মদনমোহন বিস্মিত হয়ে বললেন–দুলাল, তোমার মধ্যে এত মহত্ত্ব এত মনুষ্যত্ব ছিল; তা তো কখনো বুঝি নি! মানুষ এক পয়সার জন্য কতখানি নীচতার পরিচয় দেয়, আর তুমি এক লক্ষ টাকা কী করে আমাকে দিচ্ছ? আমি তো এর কিছুই জানি নে। তুমি মানুষ না দেবতা!–এ টাকা আমাকে দিতে হবে না। এ টাকা তোমারই, এর উপরে আমার কোনো অধিকার নাই।
প্রভুর আদেশে টাকা দিয়ে রামদুলাল ব্যবসা আরম্ভ করেন। উত্তরকালে তিনি বিখ্যাত ধনবান হয়েছেন। দুঃস্থ নর-নারীকে তিনি অনেক সময় গোপনে টাকা পাঠাতেন, কে যে কোথায় থেকে টাকা পাঠিয়েছে, কিছুই তারা জানতে পারতো না। মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষে তিনি লক্ষ টাকা দান করেন। কলিকাতা হিন্দু কলেজ স্থাপনের জন্য তিনি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
এইবার এক মুসলমান যুবকের মাহাত্ম বলবো–যা শুনলে আপনারা মনে করবেন এও কি সম্ভব!
বড় বাজারে এক তাঁতীর একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করবার সময় একটা জরুরি কাজে করিম বখ্শ বলে এক ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেলেন। করিম বখশ এক ঘন্টা দোকানে বসে থাকলো, কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এলো না। এদিকে ক্রেতারা জিনিসপত্রের জন্যে তাগাদা করতে লাগলো, করিম বখশের জিনিসপত্রের দাম জানা ছিল, সে কয়েকখানা কাপড় বিক্রি করলো। দুঃখের বিষয় সারাদিন চলে গেল তবুও দোকানদার ফিরে এল না। করিম অগত্যা সেদিন আর বাড়ি যেতে পারলো না, দোকানদারের অপেক্ষায় সেখানেই রাত্রি যাপন করলো। পরের দিন যথাসময়ে দোকান খুলে করিম মালিকের অপেক্ষা করতে লাগলো–কিন্তু মালিকের আর সন্ধান নাই। করিম অগত্যা নিজেই বেচাকেনা করতে লাগলো। এইভাবে ২/৩ দিন, শেষে এক মাস কেটে গেল, তাঁতী ফিরল না। করিম দোকানের ভার ফেলে যাওয়া অধর্ম মনে করে বিশ্বস্ত ভূত্যের মতো কাজ চালাতে লাগলো। তাতী যাদের কাছে ঋণী ছিল, করিম তাদের সব টাকা পরিশোধ করলো। তাতীর হয়েই সে নতুন কাপড়ের চালান এনে দোকানের আয় ঠিক রাখলো। এক বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল। করিমের আন্তরিক চেষ্টায় দোকানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছিলো, শেষে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হল। করিম সব দোকানই তাঁতীর নামে চালাতে লাগলো।
লোকে ভাবলো, করিম তাঁতীর দোকান কিনে নিয়েছে। করিমের সম্মান প্রতিপত্তি ইত্যবসরে খুব বেড়ে গেল, সে মস্ত সওদাগর হয়ে বিরাট কারবার চালাতে লাগলো।
প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। একদিন করিম দোকানের গদিতে বসে আছে, এমন সময় সে দেখলো, একটা বুড়ো লাঠি ভর করে তারই দোকানের সামনে করিম বলে একটা বালকের খোঁজ করছে। বুড়োর পরণে একখানা ময়লা কাপড়, রোগা চেহারা। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে। তাকে ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল। করিম দৌড়ে এসে বুড়োকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বললো–আমি হচ্ছি সেই করিম, এই সাত বছর আমি আপনার দোকান পাহারা দিচ্ছি–দয়া করে এখন আপনি আপনার দোকানের ভার নিন, আমি বিদায় হই।
বৃদ্ধ করিমের মহৎ প্রাণের পরিচয় পেয়ে দুই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন। বললেন–করিম, আমার আর কিছুর দরকার নাই, এসবই তোর! আমার এ সংসারে যারা আপন ছিল, সবাই ছেড়ে গেছে; এখন তুই আমার আপন। সেই সাত বছর আগের কথা, এখান হতে বেরিয়ে পথে সংবাদ পেলাম আমার পীর সাংঘাতিক পীড়া। কালবিলম্ব না করে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। যেয়ে দেখলাম পত্নীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে ছেলে দুটি মারা গেল। তারপর নানা দুর্বিপাকে আমি পড়ি। কিছুতে বাড়ি ত্যাগ করতে পারলাম না। তারপর এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমার কেউ নাই, আত্মীয় স্বজন, অর্থ, দেহের বল সব হারিয়ে এখন পথের ফকির হয়েছি। অতি দুঃখে অনেক আশা নিরাশায় মনে হল কলিকাতায় যেয়ে একবার করিমের সন্ধান করি, তাকে যদি পাই তার কাছ থেকে ২/১ টাকা ভিক্ষা নেবো। দোকান কি আর এত দিন আছে? করিম, আমি যে তোকে এমন রাজার হালে দেখবো, কখনও মনে করি নি। আর তুই যে কী, এমন করে। আমার কাছে পরিচয় দিলি, এ ভেবে আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আর কী বলবো। বল বাবা, তুই মানুষ না ফেরেস্তা!
করিম সবিস্ময়ে বললো–আপনি পিতার মতো আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। সে বিশ্বাসকে আমি রক্ষা করতে পেরেছি, এই আমার পক্ষে ঢের। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি।
তাঁতী করিমের হাত থেকে দোকানের ভার গ্রহণ করলেন না। জীবনে তার আর কোনো বন্ধন রইল না। একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে তিনি অতঃপর তীর্থে চলে গেলেন।
মানুষের জীবন যে এত সুন্দর, এত পবিত্র হয়, তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই পাপময় মানব সমাজে মহৎপ্রাণ মানুষ আছে, মানুষ এদের নাম জানুক আর না জানুক, এরা যে জগৎকে ধন্য করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নাই।
জীবনের প্রকৃত আনন্দলাভ হয়–মহত্ত্বের ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে। যে জীবন পবিত্রতা, মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের আনন্দ হতে বঞ্চিত থেকে গেল, বৃথাই সে জীবন। এই উদার আকাশতলে এই আলোগন্ধভরা পৃথিবীর বুকে একবার পাপ, নীচতা ও অন্যায় হতে ফিরে দাঁড়াও–জীবনকে মহৎ ও গরীয়ান করে তোল।
শত্রুকে আঘাত দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু তার জন্য অশ্রুপাত করা বড় কঠিন। পরাজয়ের পর হিমু (হেমচন্দ্র বন্দি হয়ে আকবরের সম্মুখে নীত হলেন, তখন তরবারি হাতে করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বৈরামকে তিনি বললেন–ওস্তাদ সাহেব, এই দুর্বল রোগজীর্ণ বন্দিকে হত্যা না করে কী ক্ষমা করা যায় না?
আকবরের প্রাণের মহত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা বৈরামের ছিল না। তিনি দুর্বল শত্রুর মাথা নিজ হস্তে ছেদন করেছিলেন। বৈরামের শক্তি ও শৌর্য দেখে মানুষ যখন ভীত শঙ্কিত হয়ে উঠছিল।–সে আজ কত দিনের কথা, মানুষ সে গরিমার কথা ভুলে গিয়েছে কিন্তু মানুষ এখনও বালক আকবরের অশ্রু সম্ভ্রমের সঙ্গে মনে করে রেখেছে।
মহাপুরুষ ডাক্তার বার্নাডো সারাজীবন গৃহহারা পথের বালক-বালিকাকে কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন। মানুষ যাদের কথা ভাবে নি; বার্নাডো তাদের জন্য অশ্রু ফেলেছেন। এ জগতে এক একটা মানুষ কত মহৎ, কত বিরাট প্রাণ নিয়ে আসেন। তাদের নয়নে শুধু অশ্রু ঝরে, হৃদয়ে অনন্ত প্রেম বয়-মহত্ত্ব ও পুণ্যের প্রতিচ্ছবি,–তাঁরা যে পথ দিয়ে যান, সে পথের ধূলিকণাগুলিও পবিত্র হয়ে উঠে। তারা নিজের জন্য বেঁচে থাকেন না।
সব সময়ই কি ঐশ্বর্য ও সুন্দরী পত্নীর জন্য লালায়িত থাকবে? ত্যাগ ও প্রাণের পূজা করতে কি তোমরা শিখবে না? দরিদ্রের করুণ মুখ, নিঃসহায় নর-নারীর দীর্ঘশ্বাসকে সম্মান জানাতে তোমাদের মন কবে আনন্দ বোধ করবে? উচ্চ অট্টালিকার আলোক-উজ্জ্বল কক্ষ, সাহানা–মল্লার মুকরিত ধনীর মর্মর সৌধ অপেক্ষা দরিদ্রের পর্ণকুটিরও সন্ধ্যার অন্ধকার সমাচ্ছন্ন বকুলগাছের পাতা-ভরা উঠানটিকে কবে বেশি শ্রদ্ধা করতে শিখবে? দেবতার জন্য সবাই পথ সাজিয়ে রেখেছে, পাপীর জন্য কবে তুমি ক্ষমা আর স্নেহ ছড়িয়ে দেবে? মধুর কথা শুনে, সদ্ব্যবহার পেয়ে আমার মন পুলকে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে–নিষ্ঠুর কথা আর মানুষের দুর্ব্যবহার পেয়েও কবে তুমি নির্বিকার ও শান্ত হয়ে থাকতে শিখবে?