১. মধুগঞ্জ মহকুমা শহর

অবিশ্বাস্য – উপন্যাস – সৈয়দ মুজতবা আলী

০১.

মধুগঞ্জ মহকুমা শহর বলে তাকে অবহেলা করা যায় না।

মধুগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য নগণ্য, মধুগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে কুড়ি মাইল দূরে, মধুগঞ্জে জলের কল, ইলেকট্রিক নেই, তবু মানুষ মধুগঞ্জে বদলি হবার জন্য সরকারের কাছে ধন্যে দিত। কারণ এসব অসুবিধাগুলো যে রকম এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে শাপ, অন্যদিক দিয়ে আবার ঠিক সেইগুলোই বর। মাছের সের দু আনা, দুধের সের ছ পয়সা, ঘিয়ের সের বারো আনা এবং সেই অনুপাতে আণ্ডা মুরগী সবই সস্তা। আর সবচেয়ে বড় কথা, কাচ্চাবাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য মধুগঞ্জ পুব-বাঙলা-আসামের অক্সফোর্ড বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না; ওয়েলশ মিশনারিদের কৃপায় মধুগঞ্জে একটি হাইস্কুল আর দুটো প্রাইমারি স্কুল যে পদ্ধতিতে চলত তা দেখে বাইরের লোক মধুগঞ্জে এসে অবাক মানত। স্কুল হস্টেলে সীটের জন্য পুব বাঙলা-আসামে একমাত্র মধুগঞ্জেই আরাই-গজী ওয়েটিং লিস্ট অফিসের দেয়ালে টাঙানো থাকত। হস্টেলের খাই-খরচা মাসে সাড়ে চার টাকা, আর সীট রেন্ট চার আনা।

মধুগঞ্জের আরেকটি সদ্গুণের উল্লেখ করতে লেখকমাত্রই ঈষৎ কুণ্ঠিত হবেন। লেখকমাত্রই সাহিত্যিক, কাজেই মধুগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের হৃদয়ে আকৃষ্ট করবে এ তো জানা কথা। কিন্তু সাহিত্যিকেরা এ তত্ত্বও বিলক্ষণ জানেন যে, এ সংসারে আর পাঁচজন শহরের দোষগুণ নির্ণয় করার সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জিনিসটাকে জমা-খরচের কোনো খাতেই ফেলার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ, এ তত্ত্ব তো অতিশয় সত্য যে, নিছক প্রকৃতির মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ চাকরিতে বদলি খোঁজে না, কিংবা ব্যবসা ফাঁদে না।

এ সত্য জানা সত্ত্বেও যে দু-একজন সাহিত্যিক বরযাত্রীরূপে কিংবা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করতে এসেছেন তারাই মধুগঞ্জের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গিয়েছেন। তাই দেখে খাস মধুগঞ্জীয় কাঁচা সাহিত্যিকরাও মধুগঞ্জের আর পাঁচটা সুখ সুবিধের সঙ্গে তার প্রাকৃতিক দৃশ্যেরও প্রশস্তি গেয়েছেন।

পশ্চিম বাঙলা যেখানে সত্যই সুন্দর সেখানেই দেখি তার উঁচু-নিচু খোয়াইডাঙা আর দূরদুরান্তের নীলা পাহাড়। উঁচু-নিচুর ঢেউ খেলানো মাঠের এখানে ওখানে কখনো বা দীর্ঘ তালগাছের সারি, আর কখনো একা দাঁড়িয়ে একটিমাত্র তালগাছ। এই তালগাছগুলো মানুষের মনে যে অন্তহীন দূরত্বের মায়া রচে দিতে পারে তা সমুদ্রও দিতে পারে না। সমুদ্রপাড়ে বসে মনে হয়, এই আধামাইল দুরেই বুঝি সমুদ্র থেমে গিয়েছে–আকাশে নেমে গিয়ে নিরেট দেয়ালের মত হয়ে সমুদ্রের অগ্রগতি বন্ধ করে দিয়েছে।

পশ্চিম বাঙলার খোয়াইডাঙা তাই তার শালতাল দিয়ে, দূর না হয়েও যে দূরত্বের মরীচিকা সৃষ্টি করে সে মায়াদিগন্ত মানুষের মনকে এক গম্ভীর মুক্তির আনন্দে ভরে দেয়। জানি, মন স্বাধীন; সে কল্পনার পক্ষিরাজ চড়ে এক মুহূর্তেই চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে সৃষ্টির ওপার পানে ধাওয়া দিতে পারে, কিন্তু সে স্বপ্ন প্রয়াণে তো আমার রক্তমাংসের শরীরকে বাদ দিয়ে চলতে হয়–আমাকে এক নিমিষে নিয়ে যায় দূর হতে দূরে যেখানকার শেষ নীল পাহাড় বলে, আরো আছে, আরো দুরের দূর আছে; সে যেন ডাক দিয়ে বলে, তুমি মুক্ত মানুষ, তুমি ওখানে বসে আছ কী করতে চলে এসো আমার দিকে।

এ মুক্তি ধারণা নিছক কবি-কল্পনা নয়। বহ্বার দেখা গিয়েছে সন্ধ্যার সময় পশ্চিমপানে তাকাতে তাকাতে সাঁওতাল ছেলে হঠাৎ দাওয়া ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে রওয়ানা দিল। তারপর সে আর ফিরল না। মড়া পাওয়া গেল পরের দিন খোয়াইয়ের মাঝখানে বাড়ি হতে অনেক দূরে। বুড়ো মাঝিরা বলে, ভূত তাকে ডেকেছিল, তারপর অন্ধকারে পথ হারিয়ে কী দেখেছে, কী ভয় পেয়ে মরেছে, কে জানে?

পুব বাঙলার সৌন্দর্য দুরত্বে নয়, পুব বাঙলার মাঠের শেষে মাঠ, মাঠের শেষে, সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে নয়, সেখানে মাঠের শেষেই ঘন সবুজ গ্রাম আর গ্রামখানির উপর পাহারা দিচ্ছে সবুজের উপর সাদা ডোরা কেটে কেটে সুদীর্ঘ সুপারি গাছ। আর সে সবুজ কত না আভা, কত না আভাস ধরতে জানে। কচি ধানের কাঁচা-সবুজ, কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার কালো সবুজ। পানার সবুজ, শ্যাওলার সবুজ, হলদে-সবুজ থেকে আরম্ভ করে আম জাম কাঠালের ঘন সবুজ, কচি বাশের সবুজ, ঘনবেতের সবুজ আর ঝরে পড়া সবুজ পাতার রস খেয়ে খেয়ে পুব বাঙলার মাটি হয়ে গেছে গাঢ় সবুজ–কৃশ্যাম। তাই তার মেয়ের গায়ের রঙে কেমন যেন সবুজের আমেজ লেগে আছে। সে শ্যামশ্রী দেশ-বিদেশে আর কে পেয়েছে, আর কে দেখেছে?

কিন্তু মধুগঞ্জের সৌন্দর্য এও নয়, ওও নয়। মধুগঞ্জ পুব বাঙলার মত ফ্ল্যাট নয়, আবার পশ্চিম বাঙলার মত ঢেউখেলানোও নয়। ভগবান যেন মধুগঞ্জে এক তিসরা খেলা খেলার জন্য নয়া এক ক্যানভাস নিয়ে বসে গেছেন। ক্যানভাসখানা বিরাট আর তাতে আছে মোটামুটি তিনটি বড় রঙের পোচ–সামনের কাজলধারা, নদীর কাকচক্ষু কালো জল, নদী পেরিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত, সর্বশেষে এক আকাশছোঁয়া বিরাট নিরেট নীল পাথরের খাড়া পাহাড়। এখানে পশ্চিম বাঙলার মত মাঠ ঢেউ খেলতে খেলতে পাহাড়ে বিলীন হয়নি-পাহাড় এখানে দাঁড়িয়ে আছে পালিশ সবুজ মাঠের শেষে সোজা খাড়া পাঁচিলের মত। তার গায়ে কিছু কিছু খাজ আছে কিন্তু এ খাজ আঁকড়ে ধরে ধরে উপরে চড়া অসম্ভব।

মধুগঞ্জের যেখানেই যাও না কেন উত্তরদিকে তাকালে দেখতে পাবে, কালো নদী, সবুজ মাঠ আর তার পর নীল পাহাড়। আর সেই পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে কত শত রূপালী ঝরনা। দূর থেকে মনে হয়, নীল ধাতুর উপর রূপোর বিদ্রী মিনার কাজ।

এ পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে না–এ পাহাড় বলে, যেখানে আছে সেইখানেই থাকো।

এ রকম পাহাড় বিলেতে প্রচুর আছে, শুধু গায়ে নেই মিনার কাজ আর সামনে নেই সবুজ মাঠ, কাজলধারার কালো জল।

তাই আইরিশম্যান ডেভিড ও-রেলি মধুগঞ্জে অ্যাসিসটেন্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ হয়ে আসামাত্রই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেল।

.

০২.

প্রেমটা কিন্তু দু তরফাই হ’ল। ছোট্ট মহকুমার শহরটি ও-রেলিকে দেখে প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেললে।

তার প্রধান কারণ বুঝতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। ও-রেলি সত্যই সুপুরুষ। ইংরেজ বাঙালীর তুলনায় অনেক বেশী ঢ্যাঙা তার উপর এদেশে বেশীদিন বাস করলে কেউ হয়ে যায় দারুণ মোটা, কেউ বড় লিকলিকে, কারো বা নাক হয়ে যায় টকটকে লাল, কারো দেখা দেয় সাদা চামড়ার তলায় বেগনি রঙের মোটা মোটা শিরা উপশিরা। তারই মাঝখানে হঠাৎ যখন স্বাস্থ্যসবল আরেক ইংরেজ এসে দেখা দেয়–ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্রেশ ফ্রম ক্রিসটিয়ান হোম্‌–তখন সে সুন্দর না হলে তাকে প্রিয়দর্শন বলে মনে হয়, রাজপুত্তুর না হলেও অন্তত কোটালপুত্তুরের খাতির পায়।

বয়স তার একুশ, জোর বাইশ। সায়েবদের ফরসা রঙ্‌ তো আছেই কিন্তু তার চুল খাঁটি বাঙালীর মতো মিশকালো আর তার সঙ্গে ঘননীল চোখ। এ জিনিসটে অসাধারণ; কারণ সায়েব-মেমদের চুল কালো হলে চোখও কালো, নিদেনপক্ষে বাদামী–আর চুল ব্লণ্ড হলে চোখ হয় নীল। আমাদের দেশেও যাদের রঙ ধবধবে ফরসা হয় তাদের চোখও সাধারণত একটুখানি কটা; তাই যখন তাদের চোখ মিশমিশে কালো হয় তখন যেন তাদের চেহারাতে একটা অদ্ভুত উজ্জ্বল্য দেখা দেয়। কালো চুল আর নীল চোখও সেই আকর্ষণী শক্তি ধরে।

মধুগঞ্জ যদিও ছোট শহর তবু ত রি বিলিতি ক্লাব এ অঞ্চলে বিখ্যাত। শহর থেকে বিশ মাইল দুরে যে স্টেশন সে পথের দুদিকে পড়ে বিস্তর চা-বাগান আর রোজ সন্ধ্যায় সে সব বাগান থেকে হেটিয়ে আসত ক্লাবের দিকে সায়েব-মেম আর তাদের আণ্ডাবাচ্চারা।

ফুটফুটে ক্লাব বাড়িটি। একদিকে লন টেনিসের কোট আর ভিতরে বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা–বিলিয়ার্ডের বল দেখে খানসামারা ক্লাবের নাম দিয়েছিল আণ্ডাঘর আর সেই থেকে এ অঞ্চলে ঐ নামই চালু হয়ে যায়।

এ সম্পর্কে মুরুব্বি রায়বাহাদুর কাশীশ্বর চক্রবর্তীরও একটা ‘অনবদ্য অবদান’ আছে। ক্লাব তখন সবেমাত্র খুলেছে। সায়েব-মেমরা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে টুকটাক করে টেনিস খেলছেন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রায়বাহাদুর ভীত নয়নে একটিবার সেদিকে তাকালেন। সে সন্ধ্যায় পাশার আড্ডায় রায়বাহাদুর গম্ভীর কণ্ঠে সবাইকে বললেন, দেখলে হে কাণ্ডখানা, সায়েবরা নিজেদের জন্য রেখেছে একখানা মোলায়েম খেলা, ধাক্কাধাকি মারামারি নেই–যে যার আপন কোটে দাঁড়িয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছে। আর তোমাদের মত কালো-আদমিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে একটা কালো ফুটবল। তার পিছনে লাগিয়েছে বাইশটা নেটিভকে–মরো গুঁতোগুঁতি করে, আপোসে মাথা ফাটাফাটি করে। আর দেখছ, সাহেবদের যদি বা কেউ তোমাদের খেলায় আসে তবে সে মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বাজায় গোরা রায়ের বাঁশি তার গায়ে আঁচড়টি লাগাবার জো নেই।

পাশা খেলোয়াড়রা একবাক্যে স্বীকার করলেন, এত বড় একটা দার্শনিক তত্ত্বের আবিষ্কার একমাত্র রায়বাহাদুরেরই সম্ভবে, তদুপরি তিনি ব্রাহ্মসন্তানও বটেন!

সেই রায়বাহাদুরের সপ্তম দর্শনের বেলুনটি ফুটো করে চুপসে দিয়ে নাম করে ফেললে বিদেশী ও-রেলি। চার্জ নেবার তিনদিন পরেই দেখা গেল, সে ইস্কুলের ছোঁড়াদের সঙ্গে ফুটবলে দমাদ্দম কিক লাগাচ্ছে আর এদেশের ভিজে মাঠে খেলার অভ্যাস নেই বলে হাসিমুখে আছাড় খেল বার তিরিশেক।

রায়বাহাদুর বললেন, ব্যাটা বদ্ধ-পাগল নয়,–মুক্ত–পাগল।

পাশা খেলোয়াড়রা কান দিলেন না। পুলিশের বড় সায়েব ছোঁড়াদের নিয়ে ধেই ধেই করলে অভিভাবকদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কিন্তু এসব পরের কেচ্ছা।

ক্লাব জয় করেছিল ও-রেলি–প্রথম দিনই টেনিস খেলায় জিতে নয়, হেরে গিয়ে। মাদামপুর চা-বাগিচায় বড় সায়েব এ অঞ্চলের টেনিস চেম্পিয়ান। পয়লা সেট ও-রেলি জিতল; কারণ সে বিলেত থেকে সঙ্গে এনেছে টেনিস খেলার এক নূতন ঢঙ-মিডকোর্ট গেম আর বড় সায়েব খেলেন সেই বেজলাইনে দাঁড়িয়ে আদ্যিকালের কুটুস-কাটুস। অথচ পরের দু সেটে ও-রেলি হেরে গেলদাবার ভাষায় বলতে গেলে অবশ্যি গজচক্র কিংবা অশ্বচক্র খেল না বটে। আনাড়ি দর্শকেরা ভাবলে বড় সায়েব প্রথম সেটে সুতো ছাড়ছিলেন; জউরীর বিলক্ষণ টের পেয়ে গেল, ও-রেলি প্রথম দিনেই ওভার চালাক, বাউণ্ডার’ হিসেবে বদনাম কিনতে চায়নি। মেমেরা তো অজ্ঞান যদিও হারলে তবু কী খেলাটাই না দেখালে, মাস্ট বি দি হীট, ইউ নো ফ্রেশ ফ্রম হোম ইত্যাদি। বড় সায়েবও খুশি। সবাইকে বলে বেড়ালেন, ছোকরা আমার চেয়ে ঢের ভালো খেলে, তবে কি না, বুঝলে তো, আমার বুড়ো হাড়, হেঁ হেঁ, অফ কোর্স!

পরদিনই দেখা গেল, ও-রেলি বুড়ো পাদ্রী সায়েব রেভরেণ্ড চার্লস ফ্রেডারিক জোনসকে পর্যন্ত বগলদাবা করে নিয়ে চলেছে আণ্ডা-ঘরের দিকে। বুড়ো পাদ্রী অতিশয় নীতিবাগীশ লোক, অবরে সবরে ক্লাবে এলে নির্দোষ বিলিয়ার্ডকে পর্যন্ত ব্যসনে শামিল করে দিয়ে এক কোণে বসে সেই অজ ওয়েলসের দেড় মাসের পুরনো খবরের কাগজ পড়তেন কিংবা বাচ্চাদের সঙ্গে কানামাছি খেলতেন। ও-রেলির পাল্লায় পড়ে ধর্মপ্রাণ পাদ্রীর পর্যন্ত চরিত্রদোষ ঘটল। দেখা গেল, পাদ্রী এখন প্রায়ই ক্লাবে এসে ও-রেলির সঙ্গে এক প্রস্ত বিলিয়ার্ড খেলে সন্ধ্যের পর তার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে শহরের বাইরে ও-রেলির বাঙলোর দিকে চলেছেন।

পাদ্রী যে ও-রেলির সঙ্গে জমে গেলেন তার অন্য কারণও আছে।

ও-রেলির থানার কাছেই পাদ্রীদের ইস্কুল। চাকরিতে ঢোকার দিন দশেক পরে ও-রেলি লক্ষ্য করল ইস্কুলে কতগুলো সায়েব-মেমের বাচ্চাও ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু দুর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না আসলে এরা ঠিক কী?

ইনসপেক্টর সোমকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, সোম?

ইয়েস স্যর।

নো; আমাকে ‘স্যর’ ‘স্যর’ করো না।

নো, স্যর।

ফের স্যর?

ইয়েস স্য—

বাচ্চাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে সায়েব শুধাল, এরা কারা।

সোম চুপ করে রইল।

ও-রেলি বলল, দেখ সোম, তুমি আমার সহকর্মী। তুমি যা জান আমাকে খোলাখুলি বললে আমি এখানে কাজ করব কী করে, আর তুমিই বা আমার সাহায্য পাবে কী করে?

আজ্ঞে, এরা ইয়োরেশিয়ন।

ভালো করে খুলে বলো।

এরা দোআঁশলা; এদের অধিকাংশ চা বাগান থেকে এসেছে। এদের বাপ—

থামলে কেন?

–চবাগানের সায়েব আর মা-এই, এই, যাদের বলে কুলী রমণী।

ও-রেলি থ মেরে সব কিছু শুনল। তারপর অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে শুধাল, তা এদের সম্বন্ধে আমাকে কেউ কিছু বলেনি কেন, এমন কি পাদ্রী সায়েব পর্যন্ত না?

সোম বললে, এদের নিয়ে খাস ইংরেজদের লজ্জার অন্ত নেই, তাই এরা তাদের ঘেন্না করে। পাদ্রী সায়েব ভালো মানুষ, তাই নিয়ে ওঁর দুঃখ হওয়ারই কথা। বোধ হয়, আপনাকে ভালো করে না চিনে কোনো কিছু বলতে চাননি।

সেদিনই থানার থেকে ফেরার সময় ও-রেলি সোজা পাদ্রীর টিলা গেল। পাত্রীকে সে কী বলেছিল জানা নেই। তবে পাদ্রী-টিলার ব্যাডমিন্টন ক্লাবের প্রথম খাস ইংরেজ সদস্য ও-রেলি–অবশ্য পাদ্রী সায়েবদের বাদ দিয়ে–সে কথাটা ক্লাবের মিনিট বুকে সগর্বে সানন্দে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

খবর শুনে এস, ডি, ও, প্লমার ও-রেলিকে বললেন, গো স্লো।

ও-রেলি তর্ক জোড়েনি, তবে এ বিষয়ে তার মনের গতি কোন দিকে সেটা জানিয়ে দিতে কসুর করেনি।

রায়বাহাদুর খবরটা শুনে বললেন, নাঃ, ছোঁড়াটাকে তো ভালো বলেই মনে হচ্ছে। তবে না আখেরে ডোবে। পাদ্রী-টিলার কোনো একটা উপকা ঠুড়িকে বিয়ে করলেই চিত্তির।

আর ইস্কুলের ছোঁড়ারা তো ওর নাম দিয়ে ছড়া বানিয়েছিল,

ও-রেলি, কোথায় গেলি?

সাহেব মনে শুধিয়ে উত্তর শুনে ড্যাম গ্রাড।

তারপর হাত-পা ছুঁড়ে আবৃত্তি করলে,

O’ Mary, go and call the cattle
Home,
Call the cattle home,
Across the sands of Dee.’

আমাকে ঐ ক্যাটলদের একটা মনে করেছ বুঝি? তাই সই, আমি না হয় তোমাদের দেবতা হোলি কাওই হলুম।

.

০৩.

এক বৎসর হয়ে গিয়েছে! ও-রেলিকে মধুগঞ্জ যে ক্রিকেট ম্যাচের মত লুফে নিয়েছিল সেই থেকে সে শহরের ছেলে-বুড়োর বুকে গোজা-ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহ্যানুযায়ী তাকে ড্রপ করা হয়নি।

ইতিমধ্যে ভর বর্ষায় মধুগঞ্জের জলে সাড়ম্বরে নৌকা বাচ হয়ে গেল। বিলেত তার নৌকা বাচ নিয়ে যতই বড়ফাট্টাই করুক না কেন পূর্ব বাঙলার নৌকাবাচের তুলনায় সে লাফালাফি বাচ্চাদের কাগজের নৌকা ভাসানোর মত। ও-রেলি উল্লাসে বে-এক্তেয়ার। নৌকবাচের আইন-কানুন সোমের কাছ থেকে তিন মিনিটে রপ্ত করে বন্দুক কাঁধে করে উঠল মোটর বোটে। সোমকে বললে, তুমি এগিয়ে যাও আমার লঞ্চ নিয়ে ওদিকের শেষ সীমানায়, সেখানে যেন কোনো বদমাইশি না হয়। আমি এদিক সামলাব–এখানেই তো জেতার গোল?

সোম বললে, সায়েব, নৌকা-বাচের ফাউল আর তারপর বৈঠে দিয়ে মাথা ফাটাফাটির ঠ্যালায় ফি বছর এ-দিনটায় ভাবি চাকরি রিজাইন দেব। আজ তুমি আমায় বাঁচালে।

সায়েব বললে, তুমি কুছ পরোয়া করো না সোম; ফাউল বাঁচাতে গিয়ে খুনজখম আমিই করব। ইউ গো রাইট অ্যাহেড।

তারপর ও-রেলি বন্দুক দেগে রেসের স্টার্ট দিলে, পিছনে পিছনে মোটর বোট হেঁকে ফাউল সামলালে, উল্লাসে চিৎকার করে ঘন ঘন গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড, ও হাউ গ্র্যাণ্ড হুঙ্কার ছাড়লে, কমজোর নৌকাগুলোকে চীয়ার আপ করলে আর সর্বশেষে প্রাইজের পাঠা, কলসী সকলের সঙ্গে হ্যাঁণ্ডশেক করে করে স্বহস্তে বিতরণ করলে। মাথা ফাটাফাটি যে হল না তার জন্য সোম আর বাইচ-ওলাদের অভিনন্দন জানালে।

সর্বশেষে সোম খুশিতে ডগমগ হয়ে বিজয়ী নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলে, আসছে বছর যে নৌকা জিতবে সে পাবে হুজুর ও-রেলির পিতার নামে দেওয়া মাইকেল শীল্ড’। পুব বাঙলায় নৌকোবাচে এই প্রথম শীড় কম কথা নয়, আপনারা ভেবে দেখুন। আর সে শীল্ড লম্বায় তিন হাত হবে, হুজুরের কাছ থেকে সেটা আমি জেনে নিয়েছি। তার মানে পুব বাঙলার যে-কোনো ফুটবল শীল্ড তার তুলনায় ছোড় আচ্ছা পোলাডা। হুজুর শীল্ড কী ধরনের হবে সেটা আমায় বলতে বারণ করেছিলেন; আমি সে আদেশ অমান্য করেছি। কাল আমার চাকরি যাবে। তা যাক! এখন আপনারা বলুন,

থ্রী চিয়ারস ফর ও-রেলি
হিপ হিপ হুররে।

সে কী হুঙ্কারে হিপ, হিপ্! গাঁয়ের লোক এ ধরনের স্কুল রসিকতা বোঝে। তার উপর তাদের আনন্দ, দু দিনের চ্যাংড়া ফুটবল খেলার পাতলা দাপাদাপিকে তারা আজ হারিয়েছে। তাদের শীলড আসছে বছর থেকে সব ফুটবল শীল্ডের কান মলে দেবে।

ক্লাবের যে দু-একটি পাঁড় ইংরেজ কালা আদমিদের রেস দেখতে আসেননি তারা পর্যন্ত হুঙ্কার শুনে আঙুল দিয়ে কান বন্ধ করে বলেছিলেন, ও-রেলি ইজ গন্ কমপ্লীটলি নেটিভ।

অসম্ভব নয়। কিন্তু সেদিন শীল্ড ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, যদি ও-রেলি গা-ঢাকা না দিত তবে পঞ্চাশখানা গায়ের লোক তাকে লিচ করত।

পাদ্রী বাঙলোর নয়মি, রুথ, ইভা, মেরি সব কটা সোমত্থ মেয়ে জাত-বেজাত ভুলে পাইকেরি দরে পড়ল ও-রেলির প্রেমে। সে হ্যাপা সামলাতে না পেরে ও-রেলিকে বাধ্য হয়ে প্রকাশ করতে হলে তার বিয়ে দেশে ঠিক হয়ে আছে, ছুটি পেলেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে।

ও-রেলি বুদ্ধিমান ছেলে। বিয়ের খবরটা সে ভেঙেছিল সোমের কাছে। সোম খবরটাকে বিয়ে বাড়িতে ফাটাবার বোমার মতই হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ আদর করার পর সেটি ফাটিয়ে দিলে হাটের মধ্যিখানে, কিন্তু তার থেকে বেরল টিয়ার গ্যাস। সে গ্যাস পৌঁছে গেল পাদ্রী-বাঙলোয় পোপের মৃত্যুসংবাদ ছড়াবার চেয়েও তেজে এবং চোখের জলের জোয়ার জাগাল নয়মি, রুথ, ইভার হৃদয় ছাপিয়ে।

হায়, এরা তো জানে না ও-রেলিকে আশা করা এদের পক্ষে বামন হয়ে চাঁদ ধরার আশা করার মত। কিংবা তাতেই বা কি, এবং এ উপমাটাও হয়ত তারা জানে যে সামান্য একটা খরগোশ যখন চাঁদের কোলে প্রতি সন্ধ্যের অশ্বিনী-ভরণীকে ঢিঢ দিয়ে বসতে পারে তখন এরাই বা এমন কি ফেলনা? বিশেষ করে নয়মি। ভারতীয় সৌন্দর্যের নুন নেমক আর ইংরেজের নিটোল স্বাস্থ্য নিয়ে গড়া এই তরুণী; এর সঙ্গে ফ্লাট করার জন্য পঁচিশটে বাগানের ইংরেজ ছোঁড়ারা ছোঁকছোঁক ঘুরঘুর করে তার চতুর্দিকে, যদিও সকলেরই জানা শেষ পর্যন্ত তারা বিয়ে করে নিয়ে আসবে বিলেত থেকে কতকগুলো খাটাশমুখো ওড মেড।

এ তত্ত্বটাও ও-রেলির জানা ছিলো বলে সে একদিন সোমকে দুঃখ করে বলেছিল, দেখো, সোম, আর যে যা-খুশি ভাবুক তুমি কিন্তু ভেবো না যে, আমি পাদ্রী-টিলার মেয়েদের নিচু বলে ধরে নিয়েছি। আমার বিয়ে ঠিক না থাকলে, আমি ওদেরই একজনকে বিয়ে করতুম। মেয়েগুলির বড় মিষ্টি স্বভাব।

সোম কানে আঙুল দিয়ে বললে, ও কথা বোল না সায়েব। জাত মানতে হয়।

ও-রেলি আশ্চর্য হয়ে বললে, ক্রিশ্চানের আবার জাত কি?

সোম বললে, জাতের আবার ক্রিশ্চান কি?

করে করে এক বছর কেটে গেল।

ও-রেলি ছুটি নিয়ে বিলেত থেকে বউ আনতে গেল।

.

০৪.

খাশপেয়ারা পোক যখন বিয়ে করে তখন তার একদল বন্ধু বউকে ভালোমন্দ বিচার না করে কাঁধে তুলে ধেই ধেই করে নাচে আবার আরেক দল তার দিকে তাকায় বড় বেশি আড় নয়নে। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হ’ল না। সোমকোম্পানি দিনের পর দিন মেমসায়েবকে ফুল পাঠাল, মিষ্টি পাঠাল, মেমের জলে শখ জেনে ছোঁড়ারা তাকে নিত্যি নিত্যি ডিঙি চড়াল, পাদ্রীর টিলায় ঘন ঘন চড়ই-ভাতে নেমতন্ন করল, ক্লাবে আর বাগিচা-বাগিচায় বেনকুয়েট ডিনার হ’ল; এ দলের খুশির অন্ত নেই।

অন্য দল বিস্তর যাচাই করার পর শুধু একটি কথা বললে, মেয়েটি ভালো, কিন্তু কেমন যেন মিশুক নয়।

কিন্তু তাদের সর্দার রায়বাহাদুর চক্রবর্তীই তাদের কানা করে দিলেন আর একটি মহামূল্যবান তত্ত্বকথা বলে বললেন, নেটিভদের সঙ্গে ধেই ধেই করা উভয় পক্ষের পক্ষেই অমঙ্গল। ওরা রাজার জাত, রাজত্ব করবে; আমরা প্রজার জাত, হুজুরদের মেনে চলব। এর ভিতর আবার দোস্তি-ইয়ার্কি কী রে বাবা? তোমরা ভেবেছ লিবার্টি পেলে তোমাদের নুতন কর্তারা তোমাদের কোলে বসিয়ে মণ্ডামেঠাই খায়াবেন? দেখে নিয়ো, আজ আমি যা বললুম।

তখনো স্বরাজের ছবি দিগদিগন্তেরও বহু পিছনে আণ্ডার ভিতরে বাচ্চার মত নিশ্চিন্দি মনে ঘুমুচ্ছেন। কাজেই রায়বাহাদুরের সঙ্গে এ বাবদে তর্ক করার উপায় ছিল না; এবং এ ধরনের মুরুবিও তখন সর্বত্রই বিস্তর মজলিস গুলজার করে এই রায়ই ঝাড়তেন। রায়বাহাদুর আবার বললেন, নেটিভ সায়েব যেন তেলে জলে। সাবধান! কিন্তু মধুগঞ্জ এ সাবধানবাণীতে কান দেবার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করল না।

রায়বাহাদুর অবশ্য মেমসায়েবকে সেলাম দিতে প্রথম দিনই কুঠিতে গিয়েছিলেন। মেমসায়েব তার গলকম্বল মানমনোহর দাড়ি দেখে একেবারে স্ট্রাক, থ! রায়বাহাদুর ভালো করেই জানতেন আজকের দিনের দাড়ি-গোঁফ কামোনো ছোঁড়ারা তার দাড়িতে উকুন অথবা ছারপোকা আছে কি না তাই নিয়ে ফিসফাস গুজগাজ করে, কিন্তু অন্তরে তার দৃঢ়তম বিশ্বাস ছিল যে, তার দাড়ি-গোঁফের কদর প্রকৃত রসিক-রসিকদের কাছে কিছুমাত্র নগণ্য নয়।

আদালতে বিস্তর সায়েবকে তিনি বহুবার বেকাবু করেছেন তার দুটি কারণ ও প্রথম, তাঁর আইনজ্ঞান এবং দ্বিতীয় তাঁর মনস্তত্ত্ববোধ। সায়েবের সাদা মুখ লাল, নীল, বেগুনী রঙের ভোল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চটপট সমঝে যেতেন সায়েব চটেছেন, খুশি হয়েছেন, হকচকিয়ে গিয়েছেন কিংবা আইনের অথই দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছেন।

প্রথম দর্শনেই তিনি বুঝে গেলেন, মেমসায়েব তাকে নেকনজরে দেখেছেন। তারই পুরা ফায়দা উঠিয়ে তিনি তাকে মেলা অভিনন্দন আর অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি যে তার সেবার জন্য সব সময়ই তৈরী সে কথা বললেন, তার স্বামী যে অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি সে কথাও উল্লেখ করলেন, এবং বলতে বলতে উৎসাহের তেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আদালত যে এদেশে শুভাগমন করেছেন বলেই তার মনে পড়ল, এ আদালত নয়। ঝুপ করে বসে পড়ে বললেন, সরি, ম্যাডাম, আই ফরগট!

মেম তো হেসেই লাল। রায়বাহাদুর ঘেমে কালো। শেষটায় মেম বললেন, ইটস ও রাইট, রে ব্যাভুর; থ্যাঙ্কুয়ু ভেরি মাচ ইনডীড।

রায়বাহাদুরের এ ভুল জীবনে এই প্রথম নয়। বুড়ো বয়সে সিনিয়ার ম্যাজিস্ট্রেটের প্রথম পুত্রসন্তান হওয়াতে তিনি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে টিফিনের পূর্বে বারের পক্ষ থেকে বলেছিলেন, আদালতের পুত্রসন্তান হওয়াতে আমরা সকলেই বড় আনন্দিত হয়েছি।

এ ভুলটাও তিনি গোপন রাখেননি। সেদিক দিয়ে তিনি সত্যিই সরল প্রকৃতির লোক। মেমসায়েবের সঙ্গে তার ভেট তিনি সবিস্তর বাখানিয়া বললেন, চাপরাসী ইন্তাজ আলীকে যে তিনি দু আনা বখশিশ দিয়েছেন সেটাও বলতে ভুললেন না।

সবশেষে খানিকক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, সায়েবের সঙ্গে তো আমার বিশেষ পরিচয় নেই, তবু কেমন যেন মনে হল একটু বদলে গিয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলুম না।

আড্ডা বললেন, আপনিও তাজ্জব বাত বললেন, রায়বাহাদুর। বিয়ে করে কোন মানুষ বদলায় না, বলুন দিকিনি? অন্তত কিছু দিনের জন্য?

সোম উপস্থিত ছিল। কেউ কেউ লক্ষ্য করল সেও কোনো আপত্তি জানাল না।

রায়বাহাদুর বললেন, কী জানি ভাই, আমার অতশত স্মরণ নেই। বিয়ে করেছিলুম কবে, সেই ঠাকুদ্দার আমলে।

জুনিয়ার তালেবুর রহমান বললে, সে কি, স্যর। বিয়ের পূর্বের কেসগুলোও তো আপনার খুঁটিনাটি সুদ্ধ মনে আছে।

উকিল মেম্বাররা সায় দিলেন।

রায়বাহাদুর গুণী লোক। মুনিঋষিরা যে রকম এককালে এক্সরে দৃষ্টি দিয়ে হাঁড়ির খবর জানতে পারতেন তিনিও হয়তো খানিকটা আসল খবর ধরতে পরেছিলেন; তবে কি না ঋষিদের তিন হাজার বছরের পুরনো লেন্স অনাদর-অবহেলায় ক্ষয়ে ঘষে গিয়েছে বলে ছবিটা আবছা আবছা হয়ে ফুটল।

ও-রেলি তাগড়া জোয়ান, তার উপর পার্টি-পরবে ভোর অবধি বেদম নাচতে পারে একটা ডান্সও মিস না করে। তাই বিয়ের পর আড্ডাঘরের ‘গ্যালা’-নাচে সবাই আশা করেছিল ও-রেলি হয় বউকে কোমরে ধরে লাফ দিয়ে টেবিলের উপর তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করবে কিংবা হলের মধ্যিখানে বউকে দুই ঠেঙে তুলে ধরে পই পই করে তার চতুর্দিকে সার্কেসি ঢঙে চক্কর খাওয়াবে। অন্ততপক্ষে টাঙ্গো নাচের সময় সে যে বউকে নিবিড় আলিঙ্গনে ধরে নিয়ে গভীর দোদুল দোলা জাগাবে সে আশা এবং বুড়ী মেমেরা সে আশঙ্কা–নিশ্চয়ই মনে মনে করেছিলেন। কারণ, বউকে, তাও আবার আনকোরা বউকে নিয়ে নাচের সময় যে ঢলাঢলি করা যায় সেটা ইংরেজ সমাজে পরকীয়াতে চলে না। ফ্রান্সে চলে, তবে নাচের মজলিসে নয়।

ও-রেলি নেচেছিল এবং তার নাচে প্রাণও ছিল, কিন্তু আয়ারল্যাণ্ডে নব বর এ রকম নাচের সময় যে কুরুক্ষেত্র জাগিয়ে তোলে এখানে সেটা হল না। কেউ কেউ কিঞ্চিৎ নিরাশ হল বটে, তবে ঝানুরা জানেন নববর (অর্থাৎ নওশাহ নূতন রাজা) পয়লা রাতে কী রকম আচরণ করবে তার ভবিষ্যদ্বাণী কেউ কখনো করতে পারে না। মদ খেলে বাঁচাল হয়ে যায় চুপ আর বোবা হয় মুখর–আর বিয়ে করা তো সব নেশার চেয়ে মোক্ষম নেশা, খোঁয়ারি ভাঙাতে গিয়েই বাদবাকী জীবনটা কেটে যায়। কিন্তু তাই বলে যে সব সময় ঠিক উলটোটাই ফলবে তারও তো কোনো স্থিরতা নেই। আবহাওয়ার জ্যোতিষীরা বললেন, বৃষ্টি হবে অতএব আপনি ছাতা না নিয়ে বেরলেন? ফলং?–ভিজে কাঁই হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ব্যত্যয়ও তো হয়।

কাজেই পালোয়ান এবং নাচিয়ে ও-রেলি আড্ডাঘরকে তার হক্কের পাকা সের থেকে এক ছটাক বঞ্চিত করাতে অল্প লোকই তাই নিয়ে মাথা চুলকালো!

গ্যালা নাচের পর পাদ্রী বাংলো দিলে পিকনিক। বাইরের বেশী লোককে নেমতন্ন করা হয় না, কিন্তু সোমের ডাক পড়েছিল কারণ পাদ্রীরা এ বাবদে বাঙালী, সায়েব কারোরই মত এত মারাত্মক নাকতোলা নয়। পাদ্রী-টিলার পিছনে যে ছোট ছোট টিলা আর বন বাদাড়ের আরম্ভ তার শেষ হয় কুড়ি মাইল দূরে রেলস্টেশনে পৌঁছে। এ বনে বুনো আম, কাঁঠাল, বৈঁইচি, কালো জাম, মিষ্টি, মধুর সন্ধ্যানে সকাল-সন্ধ্যে কাটিয়ে দেওয়া যায়। মৌসুমের সময় মাটিতে ফোটে অগুনতি লুটকি ফুল, আর গাছের গা ঝুলে ফুলে উঠে রঙ-বেরঙের অর্কিড (বাঁদরের ন্যাজ)। এ জায়গাটায় পিকনিক করতে গেলে তাস পাশা নিয়ে যেতে হয় না, গাছতলায় বসে দুটি খেয়ে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না,–এখানে একা একা কিংবা ছোট ছোট দল পাকিয়ে অনেক কিছুর অনুসন্ধানে বেরানো যায় আর লুকোচুরি খেলার অলিম্পিক যদি কোনোদিন তার সদর অপিস খুলতে চায় তবে গড়িমসি না করে এখানেই সোজা চলে আসবে।

পাদ্রী-টিলাতে আপোসে বিয়ে হলেই এখানে তার পরের দিন পিকনিক। পিকনিকওয়ালার আবার বর বধূকে নানা ছুতোয় একা একা এদিক ওদিক গুম হয়ে যেতে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে তাই নিয়ে চোখ ঠারাঠারি করে।

বর-বধু বিয়ের পর প্রথম কয়েক দিন একে অন্যকে চিনে নেয় ঘরের ভিতরে, বাইরে, বারান্দায়, নদীর পারে চাঁদের আলোতে কিংবা সমাজে আর পাঁচজনের ভিতর। এখানে নিভৃতে বনের ভিতর একে অন্যকে চিনে নেওয়ার ভিতর আরেক অভিনব মাধুর্য আছে-ওদিকে বন্ধুবান্ধব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও তারা নয়। ডাক দিলেই সাড়া মিলবে ওরা তো এসেছে ওরা তো এসেছে নব বরের নূতন শাহের খেদমত করার জন্যই।

খোয়াইডাঙার দিগ্‌দিগন্ত-মুগ্ধ কবি, পদ্মার অবিচ্ছিন্ন অবিরল স্রোতের সঙ্গে যে কবি তার জীবন ধারার মিল দেখতে পেয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, গ্রহসুর্যে-তারায় বিশ্ব-স্রোত বিশ্ব-গতি হৃদয় দিয়ে আবিষ্কার করলেন, সে কবি পর্যন্ত আপন বঁধুয়ার যে ছবিটিকে বুকের ভিতর একে নিতে চেয়েছিলেন সেটি পত্র পল্লবের অর্ধ-অচ্ছাদনে, বনানীর মাঝখানে–

পাতার আড়াল হতে বিকালের
আলোটুকু এসে
আরো কিছুখন ধরে ঝলুক তোমার
কালো কেশে ৷
হাসিয়ে মধু উচ্চহাসে
অকারণ নির্মম উল্লাসে–
বনসরসীর তীরে ভীরু কাঠ-বিড়ালিরে
সহসা চকিত কোরো ত্রাসে।

ও-রোলি বসে রইল বুড়ো পাদ্রী সায়েবের সঙ্গে বটগাছতলায় পিকনিকের হেড আপিসে। অবশ্য বউ মেব্‌ল্‌ও তার গা ঘেষে।

বুড়ো পদ্ৰী গল্প বলে যেতে লাগলেন, চল্লিশ বছরের আগেকার কথা। এসব গল্প মধুগঞ্জ বহুবার শুনেছে, কিন্তু ও-রেলির কাছে নুতন।

বুঝলে ডেভিড, তখন আমি ছোকরা পাদ্রী হয়ে এদেশে এসেছি। সোম এসব জানে, তার বাপ তখন এখানে সাবরেজিষ্ট্রর। আমাকে অনেক করে বোঝালে টিলাতে বাংলো না বানিয়ে যেন নদীপাড়ে আসন পাতি। তখনকার দিনে দুপুরবেলায় এখানে বাঘ চরাচরি করত, আমার একটা বাছুর চিতে নিয়ে গেল আমার চোখের সামনে, ব্রকফাস্টের সময়।

ও-রেলি শুধালে, টিলার মোহটা কী? আপনি তো হরিণ কিবা পাখী শিকারও করেন না।

পাদ্রী বললেন, বাঘ আর ম্যালেরিয়ার ভিতর আমি বাঘই পছন্দ করি বেশী। টিলার উপর ম্যালেরিয়া হয় কম। বন্দুক দিয়ে বাঘ শিকার করা যায়, কিন্তু মশা মারা কঠিন। কী বলো, সোম, তুমি তো রবার হলেই বন্দুক নিয়ে মত্ত। কত বার বলেছি, সোম, বরবার স্যাবিধ-শাস্তির দিন। এদিনটায় রক্তারক্তি নাই করলে।

সোম বললে, স্যার, তেত্রিশ কোটি দেবতা ছেড়ে একজন দেবতা পেয়ে আমার লাভ না ক্ষতি? তারপর ও-রেলির দিকে তাকিয়ে শুধাল, আপনি-ই বলুন, চীফ, তেত্রিশ কোটি টাকার মাইনে ছেড়ে দিয়ে এক টাকার চাকরি নেয় কোন্ লোক?

পাদ্রী বললেন, ওর যে সব কটা মেকি।

সোম বলেলেন, আমি পুলিসের লোক, স্যার, মেকি টাকা চিনতে না পারলে আমার সায়েবই কাল আমাকে ডিসমিস করবেন। মেকি খাঁটিতে তফাত আমি বেশ জানি। কিন্তু এদিককার তেত্রিশ কোটি আর ওদিককার একজন কেউ তো কখনো আমার থানায় এসে এজাহার দেননি। বাজিয়ে দেখব কী করে? মাঝে মাঝে সন্দ হয়, সব কজনই মেকি।

পাদ্রী বললেন, মাই বয়! কী বলছ?

পাদ্রীর বুড়ী বউ স্বামীকে বললেন, তোমাকে কতবার বলেছি, সোমের সঙ্গে কখনো ধর্ম নিয়ে আলোচনা কোরো না। ও যে শুধু হিন্দু তাই নয়–হিন্দুদের ভিতর অনেক সৎ লোক আছেন–ও একটা আস্ত ভণ্ড।

তারপর ও-রেলিকে শুধালেন, সোম আমাদের টিলায় এত ঘন ঘন আসে কেন?

রেলি হেসে পালটে শুধালেন, কেন, আপনাদের ঝগড়া মেটাতে?

বুড়ী রেগে বললেন, বিয়ে করেছ তো মাত্র সেদিন! ঝগড়ার তুমি কী জান হে, ছোকরা? সে কথা থাক; সোম আসে শুধুমাত্র মুগী খেতে, বাড়িতে পায় না বলে।

সোম বললে, মাশ্মি, আপনি সে ধরতে পেরেছেন, সে কথাটা এতদিন বলেননি কেন?

বুড়ী থ হয়ে বললেন, সে কী রে? তোকে এক শ বার বলেছি, তোর বাপকে পর্যন্ত লুকিয়ে রাখিনি।

সোম বললে, কই, আমার তো মনে পড়ছেনা? তা কাল থানাতে গিয়ে দেখব, কোনো পুরনো নথিতে রিপোর্ট লেখা আছে কি না?

বুড়ো পাদ্রী ও-রেলি আর মেবলের চোখের উপর কয়েকবার স্নেহের চোখ বুলিয়ে বললেন, এই যে ডেভিড সোম আসে আমাদের ঝগড়া মেটাতে, তা সে কিছু ভুল বলেনি। আজ যে রকম ডেভিড মেবল্‌বে নিয়ে এসেছে ঠিক তেমনি আমিও একদিন নিয়ে এসেছিলুম গ্রেসিকে। পনেরো বছর কেটে যাওয়ার পর একদিন আমাদের ভিতর সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়াতে হঠাৎ গ্রেসি বললে, তবে কি আমাদের হনিমুন আজ শেষ। সেই সেদিনই আমি সামলে নিলুম। তারপর দেখো, কেটে গেছে আমাদের হনিমুনেরা আরো পঁয়ত্রিশ বছর।

সোম বললে, সে কথা মধুগঞ্জের কে না জানে বলুন। কিন্তু আমার বেলা উল্টো। যাবজ্জীবন দীপান্তর মানে চোদ্দ বছরের জেল। আমার বেলা তারও বেশী। বিয়ে করেছি চোদ্দ বছর বয়সে, তারপর কেটে গেছে প্রায় আঠার বৎসর। এখনো কেউ খালাস করবার কথাটি তোলে না।

পাদ্রী সোমের পাগলামিতে কান না দিয়ে বললেন, ঠিক এই গাছতলাতেই বসেছিলুম শ্রেসিকে নিয়ে। বাঘ-ভালুকের ভয় না করে। পাশের ঝোপে কোকিল কুহু কুহু করছিল। আমাদের মনে কী আনন্দ! এমন সময় একটা হনুমান হুম হুম করে আমাদের সামনে দাঁত-মুখ খিঁচোতে লাগল। গ্রেসি কখনো বাদর দেখেনি। প্রায় ভিড়মি গিয়ে আমার কোলে মুখ গুঁজলো।

বুড়ী মেম লজ্জায় রাঙা হয়ে বললেন, ব্যস ব্যস হয়েছে। এর পরও ডেভিড মেব্‌ল্‌ উঠল না।

.

০৫.

দেখা যেত দুজনকে, রাস্তা থেকে, তাদের বাঙলোর বারান্দায় ছাতা ল্যাম্পের নীচে আরাম-চেয়ারে বসে আছে। কখনো সায়েব মেম-সায়েবের হাত-পাখাখানা এগিয়ে দিচ্ছে, কখনো মেম-সায়েব ঘরের ভিতর গিয়ে দুহাতে দুটো লাইমজুস নিয়ে আসছে। আর কখনো বা সিংহলী বাটলার জয়সু বারান্দার একপ্রান্তে গ্রামোফোন রেকর্ডের পর রেকর্ড বিলিতি বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই নির্জন বারান্দায়, কিংবা টিলার বাগানের লিচুগাছতলায় দুজন পাশাপাশি বসে সামনের কালাই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।

জ্যাৎস্না রাতে দুজনা ডিনারের পর বারান্দা থেকে নেমে লিচু বাগানের ভিতর দিয়ে নেমে আসত সদর রাস্তায়। সেখান থেকে চলে যেত নদী-পারে। নদী-পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছত গিয়ে রামশ্রী গ্রামে, সেখানে ছোট্ট কিসাই নদী বড় নদী কাজলধারার সঙ্গে মিশেছে।

কিংবা তাদের মাথায় চাপত অদ্ভুত খেয়াল । কিসাই কাজলের মোহনায় খেয়াঘাট; তারা সেই রাত দশটায় হাট-ফর্তাদের সঙ্গে বসত খেয়া-নৌকায়–বাতার উপর। তারপর দুপুর রাত অবধি খেয়া-নৌকায় বসে এপার-ওপার করে বাড়ির পথ ধরত চাঁদ যখন

মেম আসার পর সায়েব টুরে গেছে মাত্র একবার। মেমকে সঙ্গে নিয়েই গেল। ভাওয়ালি নৌকায় করে দুদিনের রাস্তা। রোজ সন্ধ্যায় সায়েব-মেম ভাওয়ালির ছাদের উপর বসে বসে মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালি গান শোনে, আর কখনো বা জয়সূর্য অল্প ভলগা-মাঝির গান গ্রামোফোনে বাজায়। মাঝি-মাল্লারা সে গীত শুনে তাজ্জব মানে, আর মাঝে মাঝে তার নকল করতে গিয়ে মেম-সায়েবের কাছে ধমক খায়। মেম বলে ভাটিয়ালিই ভালো-মাঝিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তাদের গান সায়েবদের কলে বাজানো গাওনার চেয়ে ভালো, এও কি কখনো সম্ভবে। তবে কি না সায়েব সুবোদের খেয়াল, আল্লায় মালুম, ওদের দিল ওদের দরদ কখন কোন দিকে ধাওয়া করে। একদিন তো মেমসায়েব নামের মশলা-পেষা ছোকরাটার বাঁশের বাঁশী চেয়ে নিয়ে সাবান দিয়ে ধুয়ে-পুছে ভাটিয়ালির সুর অনেকক্ষণ ধরে বাজালে।

এবারে নৌকোর বারোয়ারি ডাবাহুকোতে এনরা গুড়ুক খেলেই হয়েছে আর কি!

মাঝি-মাল্লারা কিন্তু একটা বিষয়ে নিজেদের ভিতর বিস্তর আলোচনা করল। সায়েব-মেম একে অন্যের সঙ্গে অত কম কথা কয় কেন? ভাগ্যিস ওরা জানত না যে বিয়ের আগে ও-রেলি সায়েবের বাঁচাল বলে একটুখানি বদনাম ছিল বটে।

ভাওয়ালির হালদার বুড়ো মাঝি তালেবুদ্দি বললে, খুদাতালা কত কেরামতিই দেখালে; গোরা হ’ল রাজার জাত–আমাদের ডাঙর জমিদারের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারলে উনি সেটা আল্লার মেহেরবানি সমঝে দিলখুশ হয়ে হাবেলী চলে যান। আর সেই গোরা দেখো, মেমের রুমালখানা হাত থেকে পড়ে গেলে তখ্‌খুনি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মেমকে এগিয়ে দেয়। আমি তো এ মামলা বিলকুল বুঝতে পারলাম না।

শুকুরুল্লা বললে, কইছো ঠিকই কিন্তু আমাগো সায়েব তো কখনো কাউরে চড় মারেনি। বল্কে, আমার মনে লয়, সায়েবরা হামেশাই কথা কয় কম, কাম করে বিস্তর। দেখছো না, যারা হাম্বাই-তাম্বাই করে বেশী, তারাই কাম করে কম।

মশলা-পেষা বললে, বউয়ের লগে যদি দুই-চারটা মিডা মিডা কথা না কইলা তয় বিয়া করলা ক্যান!

একই বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের মাঝি-মাল্লা চাষাভূষা অনেকক্ষণ ধরে তর্ক বিতর্ক করতে পারে না অবশ্য পুববাঙলার পটভূমি নিয়ে লেখা নভেলে তারা গোরা এবং বিনয়ের’ মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা নব্যন্যায়ের তৈলধার জ্বলিয়ে রাখতে পারে। তারা আপন আপন রায় জাহির করেই চুপ করে যায়। তর্ক করে যুক্তি দেখিয়ে একে অন্যের অভিমত বদলাবার চেষ্টা করে না। তাই বোধ করি দ্ৰসমাজে নিছক অবাস্তব তর্কাতর্কির ফলে যে রকম মন কষাকষি এবং মুখ দেখাদেখি করা হয়, চাষা-ভূযোদের ভিতর সে রকম হয় না।

তাই আলোচনার মোড় বদলে গিয়ে সভাস্থলে প্রশ্ন উত্থাপিত হল, সায়েব-মেমরা সাঁতার কাটতে ভালোবাসে, কিন্তু নদীর জল ঘোলা হলে গোসল করে না কেন?

পুব-বাঙলার লোক জানে না, সায়েবদের কাছে সাঁতার কাটা হচ্ছে স্পোর্টস-বিশেষ–স্নানের খাতিরে তারা সাঁতার কাটতে নাবে না। আমাদের কাছে স্মান যা, সাঁতার কাটাও তা।

টূর থেকে ফিরে এসে ও-রেলি পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে একা কলকাতায় চলে গেল। সোম কিন্তু সবাইকে বললে, হুজুর সরকারি কাজে কলকাতায় গেছেন জানেন তো আজকাল যা স্বদেশী-ফদেশী আরম্ভ হয়েছে।

রায়বাহাদুর বললেন, দুদিকেই বিপদ দেখতে পাচ্ছি। সায়েব যদি স্বদেশীর পিছনে লাগে, তবে তাদের দফারফা। নেটিভদের সঙ্গে দোস্তি জমিয়ে ও তাদের সব হাড়হ শিখে নিয়েছে, কড়ি চালালে আর কারো রক্ষে নেই। ওদিকে ছোকরা আবার আইরিশম্যান, ওর আপন দেশে ইংরেজের বিরুদ্ধে চলেছে জোর স্বদেশী। ও যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে, তবে তার প্রমোশনেরও তেরোটা বেজে যাবে। চাই কি কমপলসরি রেটায়ারমেন্টও হতে পারে। থাক, ও-সব কথা কইতে নেই।

জুনিয়ার তালেবুর রহমান বললে, নৌকো দিয়েছেন ভাসিয়ে মাঝগাঙে আর তারপর করেছেন নোঙরের খোঁজ। সোমের সামনে খুলে দিয়ে দিয়েছেন শুঁটকির হুঁড়ি, আর এখন বলছেন, নাক বন্ধ কর।

রায়বাহাদুর বললেন, বাবা, সুধাংশু—

সোম জিভ কেটে, দুকানে হাত দিয়ে বললে, রাম, রাম।

এবারে ও-রেলি যখন কলকাতা থেকে ফিরল,তখন সকলেরই চোখে পড়ল তার মুখের উপর পাম্ভীর্যের ছাপ।

সায়েবরা কলকাতা থেকে ফিরলে, তা সে রাত বারোটাই হোক, তখখুনি যায় ক্লাবে, সবাইকে কলকাতার তাজা খবর বিলিয়ে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য শ্বশুরবারি থেকে বাপের বাড়ি এলে মেয়ে যে রকম ধুলো-পায় সইয়ের বাড়িতে ছুট লাগায়। ক্লাবের সবচেয়ে নীরস বেরসিকও তখন কয়েকদিন ধরে আরব্য উপন্যাসের শেহেরজাদীর কদর পায়।

ও-রেলি ক্লাবে গেল ফিরে আসার তিনদিন পরে।

বুড়ো পাদ্রীর চোখের জ্যোতি কম। তার উপর এতখানি সাংসারিক বুদ্ধি নেই যে, কারো চেহারা খারাপ দেখালে তদ্দশ্যেই সে সম্বন্ধে প্রশ্ন শুধাতে নেই। ও-রেলিকে দেখামাত্রই শুধালেন, সে কি হে ডেভিড, তোমার চেহারা ও-রকম শুকিয়ে গেছে কেন?

মাদামপুরের বুড়া-সাহেব ঝানু লোক। ও-রেলি আমতা আমতা করছে দেখে বললেন, অসুখ-বিসুখ করেছিল হয়তো। কলকাতা বড় নাসটি প্লেডিসেন্ট্রি আর ডিসেন্ট্রি। কেন যে মানুষ কলকাতা যায় বুঝতে পারিনে। আমি যখন প্রথম মাদামপুর আসি

বিষ্ণুছড়া বাগিচার মেম বললেন, তা মিস্টার ও-রেলি, কলকাতার নুতন খবর কী?

মাদামপুরের বড় সায়েব তখন আশা ছাড়েননি; বললেন, কলকাতায় যেতে আঠারো দিন লাগত, আর

বিষ্ণুছড়া বাগিচার বড় মেমে আর মীরপুর বাগিচার ছোট মেমে যেন সাপে-নেউলে। একে অন্যের দেখা হলেই টুকাটুকি ঠোকাঠুকি। বললেন, মিস্টার ও-রেলি, কলকাতার সব খবরই নুতন। ফার্পোতে নেটিভরা ঢুকতে পারছে, সে-ও নূতন খবর। ময়দানে ঘাস গজাচ্ছে, সেও নূতন খবর।

বিষ্ণুছড়ার মেম ছোবল মারতেন, কিন্তু তার সায়েব শান্তভাবে মেমের হাতের উপর হাত রেখে চেপে দিয়ে বললেন, তাজা-বাসি আমরাই যাচাই করে নেব ও-রেলি। ওসব ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না।

আগে হলে ও-রেলি এতক্ষন সুবোধ ছেলের মত টু বী সীন নট টু বী হার্ড হয়ে বসে থাকতে না ততক্ষণ হয়তো প্রমাণ করে দিত। গড়ের মাঠে সত্যই কত রকম নূতন ঘাস গজাচ্ছে, তার রঙ গোলাপি, ফুল সবুজ আর সে ঘাস নেটিভ মাঠে পা ফেললেই গোখরোর মত ছোবল মারে–ডেঞ্জারেস পয়জকিবা হয়তো গম্ভীরস্বরে বয়ান করত, নেটিভরা এখনো ফার্পোতে ঢুকতে পায়নি, তবে কি না এ খবরে কিছুটা সত্য এখন ফার্পোর টেবিল-চেয়ার সরিয়ে সেখানে কার্পেটের উপর গোবর নিকনো লেপানো হয়েছে, আর তারই উপর সায়েবরা থাল পেতে হাপুর-হপুর শব্দ করে খিচুড়ির সঙ্গে মালেগাটানি সুপ মাখিয়ে খাচ্ছেন।

অবশ্য ও-রেলি একেবারে চুপ কর রসে রইল না। কিন্তু খবর বিলোতে গিয়ে দেখল এবারে কলকাতায় সে তেমন কিছুই দেখেনি। গ্রাওে বসে লাঞ্চ খেয়েছে অথচ চারিদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুমাত্র লক্ষ্য করেনি, ক্যালকাটা ক্লাবের বারে বসে অনেকক্ষণ ধরে এটা-ওটা চুকচুক করেছে কিন্তু এখন আর স্মরণ করতে পারল না, পরিচিত কার কার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছে।

বিষ্ণুছড়া বললেন, ও-রেলি গোপন সরকারী কাজে গিয়েছিলেন কলকাতায়, আর তার ফাঁকে করেছেন পার্টি পরব। দুটোয় জট পাকিয়ে গিয়েছে। বলে কী বলবেন, কী বলবেন না, ঠিক করতে পারছেন না।

ও-রেলি বুঝলে, এটা সোমের কীর্তি।

প্রকাশ্যে বললে, ঠিক তা নয়; তবে এখন কলকাতার মৌসুমটা মন্দা যাচ্ছে। বেশীর ভাগই দার্জিলিঙ কিংবা শিলঙে। আমার পরিচিত অলপ লোকের সঙ্গেই সেখানে দেখা হল।

মীরপুর বললেন, সে কি মিস্টার ও-রেলি? আপনি তো এক সেকেণ্ডে আলাপ জমিয়ে ফেলতে পারেন বদ্ধ কাল-বোবার সঙ্গে, আর আপনি করছেন পরিচয় অভাবের শোক।

মনের ভিতর চমক খেয়ে ও-রেলি দেখলে, কথাটা একেবারে খাঁটি। এই তার জীবনে প্রথম যে সে কলকাতায় কোনো নূতন পরিচয় জানতে পারেনি। তবে কি সে জমাতে চায়নি? কেন, কী হয়েছে তার?

কিছু একটা বলতে হয় যে লোক গল্পবাজ, সে কোনো কারণে চুপ মেরে গেলে সমাজে তার বড় দুরবস্থা–তাই আমতা আমতা করে বললে, না, না সেদিক দিয়ে আটকায়নি!’ বলতে বলতে মনে পড়ে গেল, ক্রিকেটার হেণ্ডারসনের হুয়াইটেওয়ের দোকানে তার দেখা হয়েছিল ও-রেলি বেঁচে গেল। শুধালে,–

ক্রিকেটার হেণ্ডারসনকে চেনেন?

বিষ্ণুছড়ার মেম বললেন, আমার দুরসম্পর্কের বোন-পো হয়?

মীরপুর মেম কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার পূর্বেই ও-রেলি ক্রিকেটের গল্প জুড়ে দিল-মীরপুর-

বিড়ার কথা। কাটাকাটিকে সে স্বদেশী বোমার চেয়েও বেশী ডরাত বললে, একটা ভালো ইংলিশ ক্রিকেট টীম নিয়ে আসছে-শীতে ইণ্ডিয়া আসতে চায়। ছেলেটার তাই নিয়ে উৎসাহের অস্তু নেই। ভারতবর্ষের সব কটা পিচ সে তার আপন হাতের তেলের চেয়েও ভালো করে চেনে। আমার তো মনে হ’ল পিচগুলোর বকরির মত চিবিয়ে খেয়েই যাচাই করে নিয়েছে, কোনটা বোলারের স্বর্গ আর কোনটা ব্যাটসম্যানের দরকার হলে কোয়ের মাটিঙও চিবুতে তৈরী।

আমি বললুম, অতশত মাথা ঘামাচ্ছ কেন হেণ্ডারসন, এদেশের ক্রিকেট বড় কাঁচা; তোমারা আনায়াসেই জিতে যাবে।

হেণ্ডারসন বললে, তার কিছু ঠিকঠিকানা নেই। বোম্বাইয়ের জ্যাম সায়েব–তোমরা নাকি নামটা অন্য ধরনে উচ্চারণ করে তিনি জ্যাম হোন আর জেলিই হোন, বিলেতে তিনি তাড় হাঁকড়ে সাবইকে ক-শো বার জেলি বানিয়ে দিয়েছেন, তার খবর তো তোমার অজানা নেই। কে বলতে পারে বলো, কালই এদেশে আরো পাঁচটা জ্যাম বেরিয়ে যাবে এবং হয়তো জ্যাম নয়, তার চেয়েও শক্ত মাল–হার্ড নাট।

আমি উত্তরে বললুম, অসম্ভব তো কিছুই নয়, তবে কি না কাল আমার ন্যাজ গজাতে পারে বলে আজ তো আমি তাই নিয়ে মাথা ঘামাইনে কিংবা ন্যাজ সাফসুতরো রাখার জন্য বুরুশও কিনিনে।

মাদামপুরের বুড়ো সাহেব লক্ষ্য করলেন, ক্রিকেটের গল্পে উত্তেজিত হয়ে ও-রেলি বললে, ভাবছি, শমশেরগঞ্জের জমিদারের কাছ থেকে কিছু টাকা বাগাব। সম্প্রতি লোকটা গুম-খুনে জড়িয়ে পড়েছিল–অথচ সোম পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রমাণ খাড়া করতে পারলে না। আমি কিন্তু জমিদারকে ভাওতা মারলুম, সব প্রমাণ তৈরি, এবারে বাছাধনকে ঝুলতে হবে। পায়ে জড়িয়ে ধরে আর কি, তখন ভবিষ্যতের জন্য তার বুকে যমদূতের ভয় জাগিয়ে দিয়ে যেন নিছক মেহেরবানি করে তাকে ছেড়ে দিয়েছি। টাকা চাইলে এখন তার ঘাড় দেবে।

সবাই কলরব তুলে নূতন করে আবার সেই গুম-খুনের পোস্টমর্টেমে লেগে গেলেন। ইংলণ্ডে হিজ ম্যাজেস্টির পরেই ক্রিকেট আলোচনা আড্ডার রাজা কিন্তু পুব বাঙলার গুম-খুন রাজারও রাজা, অর্থাৎ মন্ত্রী-অবশ্য দাবা খেলার-রাজার চেয়ে ঢের বেশী তাগদ ধরেন। কত রকম কথা-কাটাকাটিই না হ’ল, বিষ্ণুছড়ার মেম বলছেন, জমিদারের হুকুমে বড় ভাইয়ের চোখের সামনে ছোট ভাইকে জ্যান্ত পোঁতা হয়েছিল, মীরপুরের মেম বললেন, গুলতান, লোকটার বর ভাই-ই নেই, আর সে খুন হয়নি আদপেই; মীরপুরের জমিদারের টাকা খেয়ে গুম হয়ে গিয়েছে শমশেরগঞ্জকে জড়াবার জন্য।

অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলছিল। ইতিমধ্যে ও-রেলি কেটে পড়েছে।

মাদামপুরকে বাগানে ফেরার সময় বিড়বিড় করে বলতে শোনা গেল, ও-রেলিকে বোঝা ভার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *