১. ভূমিকা

ভূমিকা

১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যবর্তী সময় ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে বৈপ্লবিক বদলের যুগ। ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বদলের একটা প্রধান কারণ। এই দুশো বছরে কোম্পানি ব্রিটেনে এশিয়ায় উৎপন্ন জিনিসের ব্যাপক বাজার তৈরি করে। পণ্যের তালিকা খুবই লম্বা, তবে তিনটে আইটেম উল্লেখযোগ্য, ইন্দোনেশিয়ার গোলমরিচ, ভারতের সুতির কাপড়, ও চিনের চা। কোম্পানির বাণিজ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বাজারের মধ্যে— বিশেষ করে ইরান, ভারত, চিন ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে— যোগসাধন করে। ভারতের উপকূল অঞ্চলে কোম্পানির মাধ্যমে তিনটে বন্দর ও তাদের ঘিরে মহানগর গড়ে ওঠে। বিশ শতকের প্রথমে ভারতে যত বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি প্রতিষ্ঠান ছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেকের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই তিন শহরের কোনও একটায়। বিপুল পরিমাণ আমেরিকান রুপো কোম্পানি এশিয়ার বাজারে নিয়ে আসে। কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও সূচনা হয়।

শুধু এশিয়ায় নয়, ব্রিটেনেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দুশো বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থানীয় হয়েছিল। তার রাজনৈতিক ক্ষমতাও কম ছিল না। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের লন্ডনে ব্যবসায়ী জগতের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার সঙ্গে কোম্পানির কোনও রকম সম্বন্ধ ছিল না।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়ে বহু ইতিহাস লেখা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির ইতিহাসের কতগুলি দিক এখনও ধোঁয়াটে থেকে গেছে। সরকার-স্বীকৃত একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার নিয়ে কোম্পানির জন্ম, অথচ আগাগোড়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় থেকে বহু লোক ব্যক্তিগত ব্যাবসা চালিয়ে গেছে, তাদের অধিকাংশ আবার কোম্পানিরই মাইনে-করা কর্মচারী। ব্যাবসার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু, অথচ কোম্পানির শেষ হয় সাম্রাজ্য দিয়ে, ব্যবসায়িক স্বার্থ ও রাজ্যজয়ের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ সুস্পষ্ট নয়। যদিও কোম্পানির মালিক ও কর্মচারীরা বিদেশি, ভারতে এদেশীয় ব্যবসায়ীদের উপর তাদের এত বেশি নির্ভর করতে হয় যে ব্যাবসার নিয়মবিধি ইংরেজি ধাঁচের না ভারতীয় ধাঁচের তাই নিয়ে তর্ক সম্ভব। শুধু এদেশি ব্যবসায়ী কেন, কারবার চালানোর জন্যে দরকার দেশীয় রাজা ও দরবারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ও নানান ছোটবড় প্রয়োজনে তাদের পরামর্শ নেওয়া। কোম্পানির সাফল্যের পিছনে কূটনীতির অবদান কতটা? অর্থাৎ কোম্পানির পরিচয় একটা নয়, অনেক, যদিও শেষ পর্যন্ত অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী পরিচয়টা।

যে দুর্বোধ্য ঘটনাচক্রে একদল মশলার কারবারি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলল, সেটা বুঝতে আমাদের কিছুটা সুবিধা হবে দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে। প্রথম প্রশ্নটা কোম্পানির উদ্ভব নিয়ে। ১৫০০ সালে মাল্টিন্যাশনাল বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান খুবই বিরল। কেন এ রকম একটি সংস্থা গড়ে উঠল ইংল্যান্ডে, ভারত বা চিনের ব্যবসায়ীদের মধ্যে নয়? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পরের অংশে খুঁজব। প্রথম প্রশ্নটা যদি ঐতিহাসিক হয় তো দ্বিতীয় প্রশ্নটা তাত্ত্বিক। কোম্পানি কী ধরনের প্রতিষ্ঠান? আজকের দিনের কোম্পানির সঙ্গে তার মিল কোথায়? অমিলই বা কোথায়?

এই তাত্ত্বিক প্রশ্নটা নিয়ে গণ্ডগোল। ঐতিহাসিকরা মনে হয় একটা ব্যাপারে এক মত— ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজ্যজয় কোনও আপতিক ঘটনা ছিল না, বরং প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের সঙ্গে সংগতি রেখেই ঘটেছে। এই কথা যদি মেনে নেওয়া যায়, তা হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে আজকের যুগের কোম্পানির আকাশপাতাল তফাত করা উচিত, আজকের যুগের বহুজাতিক সংস্থারা ব্যাবসা করতে এসে লড়াইয়ে নেমে পড়ে না। অন্যদিকে কোম্পানির ব্যবসায়িক সাফল্যের দিকটাও মনে রাখা দরকার, নানারকম বাধা অতিক্রম করে, হাজার ঝুঁকি নিয়েও এত লাভজনক সংস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই সেই সাফল্যের সূত্র খুঁজতে আমাদের দেখতে হবে ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজির দিক দিয়ে এই সংস্থা কতটা দূরদর্শী, অর্থাৎ কতটা আধুনিক

ক্ষমতা এবং মুনাফা, আপাতদৃষ্টিতে এই দুটো আলাদা এমনকী পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্য জড়িয়ে গিয়ে তৈরি হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সংস্থার ইতিহাস লিখতে গেলে কেবল অর্থনীতি বা কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমিত থাকলে চলবে না। দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে হবে। কাজটা কঠিন। এবং কঠিন বলেই কোম্পানির ইতিহাস এখনও নতুন, এখনও চিত্তাকর্ষক।

উদ্ভব

১৬০০ সালের শেষ দিনে লন্ডন শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয়।

উদ্যোগীদের মধ্যে ছিল ব্যবসায়ী, জাহাজের ক্যাপ্টেন, ও কয়েক জন রাজনৈতিক নেতা। দলিলের নির্দেশ অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মূলধন ব্যবহার করে ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চিনে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে জাহাজ পাঠানো।

ভারত মহাসাগরে ব্যাবসা শুরু করার ইচ্ছা ও সেই কাজের জন্যে চাঁদা তুলে নৌবহর ভাড়া করার পরিকল্পনা অনেক দিন ধরেই দানা বাঁধছিল, অনেকটা আমেরিকায় স্প্যানিশ-পর্তুগিজ সাম্রাজ্য ও ভারত মহাসাগরে পর্তুগিজ নাবিকদের ক্ষমতাবিস্তারের প্রতিক্রিয়ায়। গত একশো বছর ধরে প্রথমে ভাস্কো ডা গামা, পরে আলভারেজ কাবরাল ও আফোন্সো দে আলবুকার্কের নেতৃত্বে আরব সাগরের তীরে ও ভারতের পশ্চিম উপকূলে একটা পর্তুগিজ শক্তির বলয় তৈরি হয়ে উঠেছিল। ডা গামা প্রথম উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পৌঁছন। এই সমুদ্রযাত্রা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। সময় লাগত এক বছরের বেশি, আর অন্তরীপের কাছে সারা বছর মারাত্মক ঝড় ও ঝোড়ো হাওয়া লেগেই আছে। আরব সাগর পর্তুগিজ নাবিকদের চেনা জায়গা ছিল না, ফলে পূর্ব আফ্রিকার বন্দর জাঞ্জিবারে পৌঁছে গুজরাটি নাবিক খুঁজতে হত পথ চেনার জন্যে।

এত বাধাবিপদ সত্ত্বেও সমুদ্রপথ ইউরোপীয় নাবিক-ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত দরকারি হয়ে উঠেছিল কারণ ভারতে পৌঁছনোর একমাত্র বিকল্প রাস্তা ছিল ভূমধ্যসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যের পাহাড়-মরুভূমি পেরিয়ে, যে রাস্তার দখল মিশরের খলিফা, অটোমান তুর্কি ও ইরানের শাহের হাতে। এদের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের বাসিন্দাদের হৃদ্যতা ছিল না। বরং ভেনিস ও জেনোয়া শহরের ব্যবসায়ীরা এই রাস্তা নিয়মিত ব্যবহার করত। তাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজ্যগুলির এতটাই সমঝোতা ছিল যে পশ্চিম ইউরোপের ব্যবসায়ীদের পক্ষে ইটালিয়ানদের বখরা না দিয়ে ব্যাবসা করা সম্ভব হত না। পর্তুগিজরা দ্রুত অনেকগুলি প্রধান বন্দর দখল বা বন্দর তৈরি করে ফেলে, গুজরাট উপকূলে দিউ, কোঙ্কনে বাসেইন, সিংহল ও গোয়ায়। আরব সাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তারে স্থানীয় রাজা ও আরব ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকরা ক্রমাগত বাধা দিয়ে চলে, তবে নৌযুদ্ধে পর্তুগিজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়া সহজ ছিল না।

পর্তুগিজ তথা পশ্চিম ইউরোপের ব্যবসায়িক স্বার্থ তখন ভারতে ততটা ছিল না যতটা ছিল আরও অনেক পুব দিকে, ইন্দোনেশিয়ার কতগুলি দুর্গম দ্বীপপুঞ্জে। এই দ্বীপগুলি থেকে ইউরোপে আসত মশলা, বিশেষ করে গোলমরিচ। সেই মরিচ বাজারে বিক্রি হত অবিশ্বাস্য রকমের চড়া দামে। কোনও রকমে সেই দ্বীপ থেকে এক জাহাজ মরিচ লিসবন বা লন্ডনে এনে ফেলতে পারলে এক হাজার পার্সেন্ট লাভ রেখে সেই মাল বিক্রি করা যেতে পারে। বলাই বাহুল্য কাজটা সহজ ছিল না। শুধু ট্রপিক্যাল সাইক্লোন ও জাহাজডুবির সম্ভাবনার কারণে নয়, মালবাহক জাহাজের উপরে জলদস্যু ও প্রতিযোগীদের আক্রমণের ভয়েও। এই মরিচ ব্যাবসা মজবুত করতে ভারতের উপকূলে বন্দর ও উপনিবেশ দরকার হয়ে পড়েছিল, এক সুরক্ষার কারণে, দুই— প্রতিযোগিতা ব্যাহত করতে। আরও একটা কারণ ছিল। ভারতে তৈরি সুতির কাপড় অনেক দিন আগে থেকেই ইন্দোনেশিয়ার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এই কাপড় সংগ্রহ করতে পারলে মরিচ কী দিয়ে কেনা হবে সে সমস্যা মিটে যায়।

এ রকম লাভজনক ব্যাবসা কত দিন জোর করে একচেটিয়া রাখা যায়? ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি, মোটামুটি প্রথম এলিজাবেথের রাজত্ব শুরু হওয়ার মুখে, ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা পূর্বসমুদ্রে পর্তুগিজ আধিপত্য কী করে মোকাবিলা করা যায় তাই নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিল। এই দুই দেশের প্রোটেস্টান্ট শাসকরা ক্যাথলিক স্পেন ও পর্তুগালকে প্ৰতিযোগী, প্রায় শত্রুস্থানীয়, মনে করত। কিন্তু ধার্মিক দ্বন্দ্ব বা বাজারি প্রতিযোগিতা, কোনওটাই পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিকাশের কারণ বুঝতে যথেষ্ট নয়।

এলিজাবেথের আমলে লন্ডন শহরে সামুদ্রিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তার পিছনে ছিল অনেকগুলি উপাদানের এক অনন্য সংযোগ। নাবিক, সেনাধ্যক্ষ, জমিদার, কারিগর, শিল্পী, সাহিত্যিক ও ব্যবসায়ী, অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরা, যারা অনেক দিক দিয়ে অসম ও আলাদা, সকলেই এশিয়া নিয়ে এক অদম্য কৌতূহল পোষণ করত। এশিয়ায় গিয়ে কী করে বাজার করা যায় এই উদ্দেশ্য নিয়ে এদের মধ্যে যোগাযোগ ও আদানপ্রদান ক্রমে বেড়ে উঠছিল। অসম স্তরের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে নানারকম দক্ষতার মধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহযোগিতা সম্ভবপর করা যে তৎকালীন ইংল্যান্ডের সমাজের একটা বিশিষ্টতা, এটা অনেক ঐতিহাসিক এখন বলে থাকেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে ওয়াল্টার রালে, মার্টিন ফ্রবিশার, জন হকিন্স ও হামফ্রে গিলবার্টের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটা দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রা সংগঠিত হয়েছে, এবং এই অভিযানের জেরে দরকারি যন্ত্রপাতি, যথা অ্যাস্ট্রোল্যাব ও কম্পাসের উন্নতিসাধন হয়েছে, ম্যাপ, মহাসাগরের স্রোত ও আবহাওয়া সম্বন্ধে জ্ঞান, অর্থাৎ ভূগোলের জ্ঞান বেড়েছে, জাহাজগুলি আয়তনে বেড়েছে। কিছুটা জোর করে কিছুটা লুকিয়ে, ইংরেজ ও ডাচরা স্প্যানিশ ও পর্তুগিজদের কাছ থেকে পূর্বসমুদ্র নিয়ে ও লম্বা সমুদ্রযাত্রার জন্যে দরকারি অনেক তথ্য জোগাড় করে ফেলেছে।

প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরাও অনেকে অ্যাডভেঞ্চারারদের দলে ঢুকে পড়েছেন। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ‘ডক্টর’ জন ডী কেমব্রিজে লেখাপড়া করা গণিতজ্ঞ, দেশ আবিষ্কারক, ও মার্টিন ফ্রবিশার সহ বেশ কয়েকটা অভিযানের পরামর্শদাতা। অনেকগুলি অভিযানেই ডী-র টাকা লগ্নি ছিল। নিজে শখের জ্যোতিষী, ফলে বেশ কয়েক জন জাহাজি ক্যাপ্টেনের কুষ্ঠি তাঁকেই বানাতে হয়। এই জাহাজি ক্যাপ্টেনদের মধ্যে কয়েক জনের পরে বিরাট নামডাক হয়, কাজেই বলতে হবে ডী কুষ্ঠিটা ভাল বুঝতেন। বলা হয়ে থাকে যে, জন ডী প্রথম ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্য’ কথাটা প্রবর্তন করেন। তাঁর সময়ে কথাটা বোঝাত উত্তর গোলার্ধে ষষ্ঠ শতাব্দীর কিংবদন্তি রাজা আর্থারের জয় করা এলাকা, যা ইংল্যান্ডের রাজা (বা রানি) বৈধভাবে দাবি করতে পারেন।

অচেনা বিপদসংকুল সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার জন্যে আত্মপ্রত্যয় দরকার, জ্ঞান দরকার, তার সঙ্গে আরও একটা অত্যন্ত জরুরি পূর্বশর্ত হল অর্থ। লন্ডন শহরের আর্থিক বাজারে ঠিক তখনই একটা বড় অদলবদল ঘটে চলেছিল। এলিজাবেথের রাজত্ব শুরু হওয়ার সময় (১৫৫৮) শহরের প্রধান ব্যবসায়ী বলতে ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার, তাদেরও অনেকে শুধু কাপড়েরই ব্যবসায়ী। চল্লিশ বছর বাদে ব্যাবসার পরিধি বেড়েছে, এবং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দরবারের নিজের আয় কখনই খুব বেশি ছিল না, আবার স্প্যানিশ বহরের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে নৌবাহিনীর পিছনে খরচও অনেক। কাজেই ব্যবসায়ীদের দেয় ট্যাক্স রানির কাছে অপরিহার্য। ১৫৯৭ সালে রানির আদেশে হানসেয়াটিক লিগ, অর্থাৎ জার্মান ব্যবসায়ীদের সংঘকে ইংল্যান্ড থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এই ঘটনার পরে লন্ডনের উঠতি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ীরা আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল। এদের মধ্যে যাদের মধ্য ইউরোপে কারবার করার অভিজ্ঞতা ছিল, ভারত ও চিনের বাজার সম্বন্ধে তাদের মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা ছিল। তারা এই দুই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়।

ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জনের পথে বাধাবিপদ বিস্তর। শুধু যাত্রাপথের নানা বিপদই নয়, স্পেন ও পর্তুগালের নাবিকদের প্রতিরোধ একটা বড় বাধা। পশ্চিমে অর্থাৎ আটলান্টিকের দিকে স্প্যানিশরা, ও পূর্ব অর্থাৎ ভারত মহাসাগরের দিকে পর্তুগিজরা, ঘাঁটি গেড়ে বসেছে একশো বছরের বেশি সময়। এই অঞ্চলে ব্যাবসা আরম্ভ করলে যুদ্ধ লাগবার সম্ভাবনা, আর নৌযুদ্ধে এদের হারানো কঠিন। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইংরেজরা উত্তর-পূর্ব সমুদ্র ঘুরে, অর্থাৎ উত্তর মেরুর কাছ দিয়ে এশিয়ায় পৌঁছনোর রাস্তা বার করা যায় কি না তাই নিয়ে কিছু জল্পনা চালায়, অভিযানেও বেরোয়। অনেকের অনেক টাকা জলে যাবার পরে এই প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়।

কিন্তু শতাব্দীর একেবারে শেষ দশ-কুড়ি বছরের কিছু ঘটনায় পর্তুগিজদের সম্বন্ধে ভয় অনেকটা দূরীভূত হল। বোঝা গেল যে অন্তত আটলান্টিকের দিকে আইবেরিয়ানদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। স্প্যানিশ-পর্তুগিজ দুই দলই সামান্য অর্থবলের উপর নির্ভর করে হাজার হাজার মাইল সমুদ্রের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ব্যাবসার ক্ষতি করেছে এবং অনেক জায়গায় প্রতিরক্ষার সুব্যবস্থাও করতে পারেনি। ব্যাবসা যথেষ্ট বাড়েনি বলে যে হারে উপনিবেশ চালানোর খরচ বেড়েছে সে হারে তাদের উপনিবেশগুলির আয় বাড়েনি। এমনকী উপনিবেশগুলির খরচ চালাতে গিয়ে স্পেনের সামরিক শক্তি দ্রুত কমে যাচ্ছে।

বিখ্যাত ‘জলদস্যু’ ফ্রান্সিস ড্রেক দেখিয়ে দিলেন যে জলযুদ্ধে স্প্যানিশরা অপরাজেয় নয়, বিশেষ করে যদি গেরিলা ধাঁচে তাদের হঠাৎ আক্রমণ করা যায়। ১৫৬০-এর দশকে ড্রেক আমেরিকা থেকে স্পেনে পাচার করা সোনা ও রুপোর জাহাজে হানা দিতে শুরু করলেন, অরক্ষিত পানামা সমুদ্রতটের কাছে। এই আক্রমণের জেরে ড্রেকের হাতে এল কয়েকটা স্প্যানিশ জাহাজ, যার সুবাদে নিজেকে তিনি বণিক হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করলেন। অচিরে ড্রেকের নেতৃত্বে একটা দল গড়ে উঠল প্রশান্ত মহাসাগরের স্প্যানিশ অঞ্চলে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে, দলের প্রধান সদস্যদের মধ্যে স্বয়ং রানিও সামিল। এই অভিযান থেকে যে সব লুঠের মাল পাওয়া গেল তার মধ্যে শুধু জাহাজ বা সোনাই নয়, আরও ছিল কয়েকটি অত্যন্ত মূল্যবান মানচিত্র। এই ম্যাপ ব্যবহার করেই ড্রেক প্রশান্ত মহাসাগর পার হলেন। ১৫৮৮ সালে ড্রেক ও অন্যান্য সেনাধ্যক্ষরা মিলে ইউরোপের দুর্ধর্ষ নৌবাহিনী স্প্যানিশ আর্মাডা-কে হারিয়ে দিলেন। ড্রেকের অব্যবহিত পরে টমাস ক্যাভেন্ডিশের নেতৃত্বে আর একটা আটলান্টিক অভিযান সংগঠিত হয়।

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের অভিযানগুলির উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক বা লুঠতরাজ চালানো, ভারত মহাসাগরের অভিযানের উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই শুধু ব্যাবসা চালানো। কিন্তু এখানেও পর্তুগিজ বিরোধের মোকাবিলা করা দরকার, কাজেই অনেক টাকারও দরকার। পশ্চিম ইউরোপের বাসিন্দারা যখন এই সমস্যার আলোচনা শুরু করল তখন অনেকেই একমত যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা তোলার জন্যে সবথেকে প্রশস্ত উপায় যৌথ মূলধনে কোম্পানি তৈরি করা।

যদিও এই সময়ে এশিয়ার তুলনায় ইউরোপের বাণিজ্য আরও বড় বা আরও বেশি উন্নত ছিল এমন বলা যাবে না, তবু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি সংগঠন, সেই সঙ্গে একচেটিয়া ব্যাবসার অনুমতিপত্র বা চার্টার এবং স্বয়ং রাজার পৃষ্ঠপোষকতা, এগুলি পশ্চিম ইউরোপীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। এশিয়ান ব্যবসায়িক ঐতিহ্যে এগুলির অনুরূপ কিছু পাওয়া যাবে না। ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যিক জগৎ বিশাল হলেও এখানে যৌথ উদ্যোগে কোম্পানি জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠান তখনও তৈরি হয়নি। এটা পুরোপুরি ইউরোপিয়ানদের প্রবর্তিত একটা সংজ্ঞা। এই সাংগঠনিক শক্তি ব্যবহার করে ইউরোপীয় কোম্পানি অনেকটা পরিমাণ মূলধন সংগ্রহ করতে পারত, ফলে সুদের হার ছিল ভারতের তুলনায় পশ্চিম ইউরোপে অনেকটা কম।

ভারতে সুদের হার ছিল সাধারণত অনেক বেশি, কিন্তু যখন ঋণদাতা ও গ্রহীতা জাতি এবং আত্মীয়তার দ্বারা সংযুক্ত, তখন হার নীচে নেমে আসত। ফলে যে সব উদ্যোগে অনেক ঝুঁকি ও অনেক মূলধন দরকার, সেসব উদ্যোগ স্বজাতির লোকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। যখন টাকা লেনদেন হচ্ছে কাকা-ভাইপোর মধ্যে, তখন টাকা মার যাওয়ার ঝুঁকি খুব কম, সে ক্ষেত্রে ডিফল্ট রিস্ক বাবদ দু’-চার পার্সেন্ট সুদের হার থেকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। ফলে সবচেয়ে বড় ট্রেডিং ও ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলোতে মালিক, পার্টনার ও দায়িত্বশীল কর্মচারীরা সাধারণত একই জাতি বা সম্প্রদায়ভুক্ত হত। পার্টনারশিপ সংস্থার মুখ্য বণিকরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই রক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সামাজিক ভালমন্দ প্ৰায় অভিন্ন ছিল।

ইউরোপের কর্পোরেট সংস্থা এই এশীয় সাংগঠনিক মডেলের বিকল্প। জাতিগত ব্যাবসার মতো সদস্যদের সাধারণ স্বার্থসাধনের উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও এগুলি জাতিগত আনুগত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। জাতিগত ব্যাবসা বা পারিবারিক ব্যাবসার সঙ্গে তুলনায় কর্পোরেট সংস্থায় ঝগড়াঝাঁটির প্রবণতা হয়তো কিছুটা বেশিই ছিল, কারণ মুখ্য সদস্য আর গৌণ অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী সদস্যদের মধ্যে খটাখটি লাগতে বাধ্য। এই ঝগড়া পরিবারের মধ্যেও আকছার লেগে থাকে, তবে ঝগড়া বাধলে মধ্যস্থতা করার লোক পরিবারের মধ্যে অনেক পাওয়া যাবে, কর্পোরেট সংস্থায় তাদের অভাব। কিন্তু পরিবার বা জাতিগত ব্যাবসার তুলনায় কর্পোরেট সংস্থার আরও

শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল। শক্তিশালী এই কারণে যে পারিবারিক-সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এরা আরও বেশি ঝুঁকি নিতে পারত, ফলে অনেক নতুন এক্সপেরিমেন্ট করা এদের পক্ষে সম্ভব ছিল- অর্থাৎ কর্পোরেটের উদ্ভাবনীশক্তি বেশি। আর স্থিতিশীল এই কারণে যে সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া একটা কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে যত সহজ, পারিবারিক-সাম্প্রদায়িক সংস্থার পক্ষে ততটা সহজ নয়। একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর এই পার্থক্য থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। কেন পশ্চিম ইউরোপের বণিকরা ভারত মহাসাগরে এসে ব্যাবসা আরম্ভ করল, ভারতীয় জাহাজিরা আগে আটলান্টিকে গেল না কেন? উত্তর, ভারতীয় জাহাজিদের টাকাপয়সা ও সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট থাকলেও তারা ছিল অনেক বেশি ঝুঁকিবিমুখ, পরিবর্তনবিমুখ।

আরও বড় কথা, কোম্পানি হওয়ার দরুন একই উদ্যোগে নানান শ্রেণির মানুষের যোগদান সম্ভবপর হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে নানারকম দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ ও আদানপ্রদান সম্ভবপর হয়। কোম্পানির মধ্যে জাহাজি ও বণিক দুই দলই যুক্ত, এবং দুয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় বোঝাপড়াও রয়েছে। এই সহযোগিতা লক্ষ করে আরও অনেক ধনী লোকজন তাদের টাকা কোম্পানিতে ঢালতে এগিয়ে এসেছিল। এ যুগের ইংরেজ বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশিষ্টতা এখানেই: বণিক-ব্যাঙ্কার-নাবিক- সৈনিকদের একই উদ্যোগের অংশীদার হয়ে উঠতে সাহায্য করা। ভারতীয় বণিকরাও নিয়মিত নাবিক ও ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে কারবার করত, কিন্তু নাবিক বা ব্যাঙ্কাররা তাদের ব্যাবসার সমান অংশীদার হত না, এবং তাদের পরামর্শ শুনে বণিকরা বিরাট ঝুঁকির প্রকল্প নিয়েছে এ রকম নজিরও পাওয়া যাবে না। বণিক-নাবিক-সৈনিকদের মধ্যে পার্টনারশিপ সক্রিয় করার ব্যাপারেই পশ্চিম ইউরোপ ১৬০০ সালে এশিয়ার থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিল, যদিও এই অগ্রগতির পরিণাম সম্বন্ধে সেইসব বণিক-নাবিক-সৈনিকদের স্পষ্ট ধারণা হয়তো ছিল না।

এ ছাড়াও যৌথ কারবার কোম্পানিকে একটা বিশেষ অর্থে আধুনিক চেহারা দিয়েছিল।

যৌথ কারবারের উৎপত্তি

যৌথ কারবারের উৎপত্তি নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তিনটে মত প্রধান, মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের পার্টনারশিপ সংস্থা, জার্মান কর্পোরেটবাদ, এবং জেনোয়া শহরে চালু এক ধরনের কোম্পানি যার মূলধন তোলা হত সাধারণের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে। জেনোয়ার প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি অনেকে আবার খুঁজে পেয়েছেন মধ্যযুগের আরব বাণিজ্যে। এইসব প্রতিষ্ঠানের তাৎপর্য অনেকটা নির্ভর করত শহর অঞ্চলের গিল্ডগুলি এদের কীভাবে ব্যবহার করত তার উপর।

মধ্যযুগের ইউরোপে গিল্ডগুলি ছিল শহর প্রশাসনের একটি অংশ। গিল্ড তার সদস্যদের বাণিজ্যিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ করত। সেই কাজ করার জন্যে গিল্ডদের প্রয়োজন ছিল সংবিধানের। সেই সংবিধানের নিয়মকানুন নিশ্চিত করবে কীভাবে শুধুমাত্র গিল্ডের সদস্যরাই ব্যাবসার সুযোগসুবিধা ভোগ করবে। অন্যভাবে বলা যায়, সংবিধান সদস্যদের একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার মেনে নিত ও যথাসাধ্য রক্ষা করার চেষ্টা করত। এখন, এই সংবিধানের নিয়মকে আইনের মর্যাদা পেতে হলে দরকার সরকারি লাইসেন্স বা চার্টার। ইংল্যান্ডে সাধারণ আইন বা কমন ল অনুযায়ী রাজার অধিকার ছিল এই ধরনের সনদ বা চার্টার প্রদান করার। সনদপ্রাপ্ত অধিকার একটা সাধারণ ‘টেম্পলেট’ অনুসরণ করে লেখা হত। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যে তৈরি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও এই ধরনের সনদের প্রচলন ছিল।

ষোড়শ শতকে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি আগে যেসব গিল্ডের মধ্যে থেকে কারবার করত তাদের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে দূরে দূরে অবস্থিত শহর- বন্দরগুলিতে চলে আসতে শুরু করেছে। যেমন, ১৫০৫ সালে তৈরি হল দি কোম্পানি অফ মার্চেন্ট অ্যাডভেঞ্চারার্স, প্রধানত বেলজিয়ামে ব্যাবসা চালানোর জন্যে। দূর দেশে ব্যাবসা চালানোর জন্যে দরকার হয়েছিল সে দেশে পাঠানো প্রতিনিধিকে কতগুলি আইন বলবৎ করার অধিকার দেওয়া; অর্থাৎ দূর দেশের ব্রাঞ্চ কিছুটা স্বশাসিত সংস্থা হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় শাখাগুলি যে কিছুটা স্বাধীন ভাবে কাজ করে এসেছে সেও এই ঐতিহ্য বহন করেই।

প্রথম দিকে এইসব কোম্পানির মালিকরা ক্ষয়ক্ষতির জন্যে দায়ী ছিল, পরে ধীরে ধীরে যৌথ কারবার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মালিকদের দায় সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে। সীমাবদ্ধ দায় চালু হতে শেয়ারের কেনাবেচা, অর্থাৎ কোম্পানির পুঁজিতে টাকার আমদানি, অনেক বেড়ে যায়। ঐতিহাসিক উইলিয়াম স্কট কর্পোরেট আইনের উপর একটি ক্ল্যাসিক লেখায় এই বিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন।

১৫৮০ থেকে ১৬১০ সালের মধ্যে রাজদরবার অনেকগুলি সংস্থাকে এ রকম সনদ দেয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সংস্থার উদ্দেশ্য বৈদেশিক বাণিজ্য। সনদের আইনকানুন মোটামুটি গিল্ডের আইনকানুন শরণ করে লিখিত, আর গিল্ডগুলির মতোই এই সব চার্টারেও ব্যাবসার অধিকার মানে একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার। অর্থাৎ এই সনদ ব্যবহার করে সংস্থার মালিকরা স্বদেশের প্রতিযোগীদের বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ পণ্যের ব্যাবসা থেকে সরিয়ে রাখতে পারত। বলাই বাহুল্য এই একচেটিয়া অনেকটা নামে মাত্র। শহরের কথা আলাদা, কিন্তু হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত সমুদ্রের উপরে তো এমন কোনও সরকারি কর্তৃত্ব নেই যে একচেটিয়া কার্যকর করবে। কাজেই বৈদেশিক ব্যবসায়ে একচেটিয়া বাস্তবে খুব একটা খাটত না।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রে একচেটিয়ার নৈতিক অধিকার নিয়ে বরাবর তীব্র সমালোচনা হয়ে এসেছে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডিং একটা ছোট দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ফলে একচেটিয়া অধিকারের ফলে যা লাভ হত তার সবটাই যেত এই দলের সদস্যদের পকেটে। এক দিকে বিশেষ আইনি অধিকার অন্যদিকে প্রচুর লাভ— এই দুয়ের সংযোগ যে বারবার আক্রমণের মুখে পড়বে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

রাজদরবার যেহেতু চার্টার প্রদানের অধিকারী তাই আক্রমণ দানা বেঁধেছিল পার্লামেন্টের অল্পবিস্তর রাজদ্রোহী দলের মধ্যে। এদের বন্ধু ছিল একদল ব্যক্তিগত বা নিজস্ব ব্যবসায়ী যারা পূর্বসমুদ্রে ব্যাবসা চালাতে চায়, কোম্পানির ভাষায় তারা হল ইন্টারলোপার। মাঝেমাঝেই প্রতিদ্বন্দ্বীরা নতুন কোম্পানি গড়ার, সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। তবে সরকারি ভাবে চার্টারের অবসান হতে হতে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে।

এত দেরি হওয়ার একটা কারণ একচেটিয়ার বিরুদ্ধ দল একজোট ছিল না। অনেকেই দেশি ব্যাবসায় একচেটিয়ার বিরুদ্ধতা করলেও বিদেশি ব্যাবসায় একচেটিয়া সমর্থন করে এসেছে। দ্বিতীয় কারণ, একচেটিয়ার বিরুদ্ধতা বহু দিন সীমাবদ্ধ ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তারা তো যাকে বলা যায় ইন্টারেস্টেড পার্টি, বা স্বার্থান্বেষী। একচেটিয়ার সর্বজনীন সমালোচনা প্রথম পাওয়া গেল অনেক পরে, ১৭৭৬ প্রকাশিত অ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অফ নেশনস’ বইতে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সমালোচনা মাঝেমাঝে তীব্র হয়ে উঠলেও কোম্পানিকে বড় বিপদে ফেলেনি। সাধারণের চোখে সমালোচনার পিছনে কাজ করেছে প্রতিযোগীদের ঈর্ষা। সমালোচকরাও অনেকে উপলব্ধি করেছে যে ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্যে একচেটিয়া অধিকার দরকার ছিল। ভারত মহাসাগরে জাহাজ পাঠানো সহজ কাজ কখনই ছিল না। বিপদ ও ঝুঁকি অনেক রকমের। ১৬০০ শতকের প্রথমে সম্ভবত দু’জন নাবিকের মধ্যে একজনের প্রাণে বেঁচে দেশে ফিরে আসার উপায় ছিল না। স্কার্ভি, জলদস্যুদের আক্রমণ ও জাহাজডুবিতে অর্ধেক লোক মরত। সুদূর ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিয়ে আসা মাল ইংল্যান্ড বা হল্যান্ডে বিলাসদ্রব্য হিসেবে বিক্রি হত, তার বাজার বড়লোকদের মধ্যে। হঠাৎ মহামারী বা মন্দায় বড়লোকদের ক্ষতি হলে কোম্পানিকে দেউলে করে দিয়ে বাজার পড়ে যেতে পারে। বিদেশে একগুচ্ছ বন্দর, কারখানা, জাহাজ, সেনাদের ছাউনির খরচ মেটানোর জন্যে চাই অঢেল পুঁজি। এত ঝুঁকি বহন করা ও পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব নয় যদি না অপর্যাপ্ত পরিমাণে লাভ করা যায়। একচেটিয়া ও যৌথ কারবার একসাথে সেই সুবিধা করে দেয়।

ষোড়শ শতাব্দীর ভারতে চার্টার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটায়। কোম্পানির ব্যাবসার জেরেই ভারতের ব্যবসায়িক জগতে একটা সম্পূর্ণ নতুন সাংগঠনিক নীতির চল শুরু হল। ইংল্যান্ডের ঢঙে কোম্পানি ভারতের রাজাদের কাছেও ব্যাবসার লাইসেন্স চায় ও সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার জন্যে তাদের সব থেকে সক্ষম অফিসারদের ভারতে পাঠায়। ভারতের ব্রাঞ্চ অফিসগুলি চালাত সবথেকে যোগ্য কর্মচারীরা, ভারতীয় ভাষায় জ্ঞান তাদের যোগ্যতার একটা বড় মাপকাঠি। সেই গুণ থাকলে অল্পবয়েসি অফিসারদের দ্রুত পদোন্নতি হত।

ব্রাঞ্চ অফিসের গুরুত্ব বাড়ায় কোম্পানির মধ্যে একটা ফাটল ধরল।

স্বার্থের সংঘাত

অনেক সময় বলা হয় যে চার্টার্ড কোম্পানি আধুনিক জয়েন্ট স্টক বা যৌথ কারবারের অগ্রদূত। সম্প্রতিকালে অ্যান কার্লোস ও স্টিফেন নিকোলাস এই তত্ত্ব প্রচার করেছেন। কথাটা ভুল নয়, কিন্তু দুয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যও ছিল। দুটি পার্থক্য প্রধান। প্রথমত, কোম্পানি যখন প্রথম তৈরি হয়, তখন পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং ও পেশাদারি ম্যানেজমেন্টের ধারণা ছিল না। কোম্পানির পরিচয় তার মালিকদের পরিচয় থেকে স্বতন্ত্র ছিল না। যখন ব্যাপকভাবে শেয়ার ব্যাবসা চালু হল, তখনও কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ন্ত্ৰণ করত বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডারদের দিয়ে তৈরি একটা গোষ্ঠী। দ্বিতীয়ত, ‘কোম্পানি’ বলতে আজকের দিনে বোঝাবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কর্মীরা শেয়ারহোল্ডারদের অধীন, আর মাথার উপর একটা কমান্ড সেন্টার সকলের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছে; ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্তু এমন একটি উদ্যোগ যার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর মাথার নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই নিয়ন্ত্রণের অভাব কিছুটা ছিল ইচ্ছাকৃত, পার্সোনেল ম্যানেজমেন্টের যে ধারাতে কোম্পানির কাজ চলত তাতে বিদেশের ব্রাঞ্চ অফিসগুলি অল্পবিস্তর স্বশাসিত হতে বাধ্য

কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে বলা যেতে পারে এক ধরনের পার্টনারশিপ। একদিকে লন্ডনের এক ধনী ও ক্ষমতাশালী ব্যাঙ্কার-বণিক গোষ্ঠী আর অন্যদিকে ভ্রাম্যমাণ নাবিক, সেনা ও খুদে ব্যবসায়ীরা। মালিকরা টাকা জোগাত, নাবিকরা জাহাজ চালাত, সৈন্যরা নিরাপত্তা সুরক্ষিত করত আর খুদে ব্যবসায়ী তথা কর্মচারীরা বিক্রির মাল সংগ্রহ করত। বণিক ও সৈনিক হল সমাজের মসৃণ ও রুক্ষ দুই দিকের লোক। এরা প্রায় দুই পৃথিবীর মানুষ। শ্রেণিভেদ এতটাই যে এদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হবে আশা করা যায় না। এই পার্টনারশিপ ফলপ্রদ হতে হলে সংস্থার লাভের বখরা কর্মীদের কিছুটা দিতে হবে, অর্থাৎ, নাবিক, সৈন্য ও খুদে ব্যবসায়ীদের নিজেদের টাকা লগ্নি করে ব্যাবসা চালানোর অনুমতি দিতে হবে। কোম্পানি এদের মাইনে দিত সামান্য, কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাবসার সুযোগ দিত।

এখন, এক সংস্থার মাইনে-করা কর্মীরা মালিকের স্বার্থে কাজ করতে করতে যদি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উপায় খুঁজতে থাকে তা হলে সংস্থার কাজকর্মে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে যেখানে মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস কম। মালিকদের মনে সবসময়েই চিন্তা থাকবে নিজেদের স্বার্থ ঠিকভাবে রক্ষা হচ্ছে কি না। বলা যায়, কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট একটা দ্বিখণ্ডিত-ব্যক্তিত্ব সমস্যার সৃষ্টি করেছিল, এবং এই দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্বের কারণেই অনেক পরের যুগে কোম্পানি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সেই জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বরাবর কোম্পানির মধ্যেই নিহিত ছিল।

কর্মচারীরা নিজেদের টাকায় বেশি কাপড় কিনে ফেললে কোম্পানির খাতে কম কাপড় উঠবে। কর্মচারীরা নিয়মিত স্থানীয় বণিক ও কারিগরদের সঙ্গে জুটে কাজ করত, তাতেও কোম্পানির স্বার্থহানি হতে পারে, কারণ এদের অনেকে ইতিমধ্যেই কোম্পানির কাছ থেকে আগাম নিয়ে বসে আছে। কর্মচারীরা স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে গন্ডগোল, কারণ রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে গেলে এদের যারা শত্রু তারা কোম্পানির উপর চটতে পারে। কোম্পানির লন্ডন ডিরেক্টররা কিছু উৎসাহদায়ক ও কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ব্যবহার করে মোটামুটি অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করত। তা হলেও মাঝেমাঝেই ব্রাঞ্চ অফিসের বিশেষ কোনও কাজ বা ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে গোলমাল লেগে যেত। যদি সেই ব্যক্তি ক্ষমতাশালী হয়, পার্লামেন্টে তার বন্ধুস্থানীয় কেউ থাকে, বা ব্যক্তিগত ব্যাবসা করে ইতিমধ্যেই তার প্রচুর পয়সা হয়ে থাকে, তা হলে শাস্তিব্যবস্থা অকেজো হয়ে যায়। আবার এর ফলে কর্মচারীরাও উঠেপড়ে লেগে যেত নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে।

রাজশক্তি পিছনে থাকলে হেড অফিস আর ব্রাঞ্চ অফিসের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। রাজার প্রদত্ত চার্টার বা সনদের একটা অর্থ কোম্পানির নিজস্ব নিয়মকানুন সমর্থন করা। আর একটা অর্থ হল সংকটকালে রাজার সৈন্যদের সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। এই রাস্তা খোলা ছিল বলেই কোম্পানির চরিত্র অন্যান্য ব্যবসায়ী সংস্থার থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়। সাহায্য নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ থেকে, যখন কোম্পানি ভারতে কয়েকটা বন্দর-শহরের মালিক, এবং ইউরোপের যুদ্ধবিগ্রহের জেরে এইসব শহরের নিরাপত্তা বিপদগ্রস্ত। যুদ্ধচালনা, আইন প্রবর্তন, পুলিশি ব্যবস্থা তৈরি করা, বা একদল লোককে নাগরিক অধিকার দেওয়া- এ সব কাজ সার্বভৌম রাজার কাজ, ব্যবসায়ী সংস্থার কাজ নয়। কিন্তু ব্রাঞ্চ অফিসগুলির উপরে এই সার্বভৌম দায়িত্ব অল্পবিস্তর বর্তায়। ভারতে অবস্থিত ব্রাঞ্চ অফিসের সৈন্যরা যুদ্ধে যোগ দিয়ে বলতে পারে রাজার হয়ে লড়ছি। ঐতিহাসিক জুলিয়া অ্যাডামস আধুনিক বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক সংস্থাগুলির এই মাত্রাটি ব্যাখ্যা করতে ‘প্যাট্রিমোনিয়াল’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। কথাটা ব্যবহার হয় এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে যেটা আমলারা চালায় না, চালায় ব্যক্তিবিশেষ বা ব্যক্তিগত কোনও সংস্থা।

উল্লেখযোগ্য কথা হল যে, রাজার পরোক্ষ সমর্থন ব্রাঞ্চ অফিসগুলিকে হেড অফিসের তুলনায় বেশি ক্ষমতাশালী করে তোলে। যতই হোক, যুদ্ধ বাধলে ব্রাঞ্চ অফিসের লোকেরাই লড়বে, লন্ডনের ডিরেক্টররা নয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্রাঞ্চ অফিস ডিরেক্টরদের বোঝাতে সক্ষম হত যে যুদ্ধে যোগ দেওয়া ব্যাবসার খাতিরে বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্থানীয় কর্মচারীরা নিজেদের বা বন্ধুদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এমনও অনেক রাজনৈতিক ঘটনায় জড়িয়ে যেত যার পিছনে লন্ডনের সঙ্গে সেই বোঝাপড়া ছিল না।

ব্রাঞ্চ অফিসের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা এসে যাওয়ায় আর একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়। ভারতীয়রাও মোটামুটি বিশ্বাস করত যে আইনকানুন প্রবর্তন, নাগরিক অধিকার রক্ষা, যুদ্ধচালনা ও শান্তিস্থাপন, এ সব বিষয়ের দায়িত্ব স্থানীয় রাজাদের হাতে। তাদের অনেকে হয়তো মোগলসম্রাটের নামে রাজ্য চালাচ্ছে, কিন্তু সম্রাট অনেক দূরের ব্যাপার, কার্যত এরা স্বাধীন রাজা। সম্রাট দূরের ব্যাপার বলেই, অর্থাৎ মাথার উপরে কেউ নেই বলেই, দরবারে দলাদলি বাধলে বা কোম্পানির ব্যাবসা নিয়ে কোনও ঝগড়া শুরু হলে যুদ্ধ প্রায় অবশ্যম্ভাবী।

মানদণ্ড থেকে রাজদণ্ড

অ্যাডাম স্মিথ একটা দামি কথা বলেছিলেন, স্পেনের আমেরিকা জয় আর ইংরেজদের ভারত জয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য হল ভারতে ইংরেজদের মোকাবিলা করতে হয় এমন সব দেশীয় রাজাদের, যাদের বন্ধুবর্গের মধ্যে রয়েছে ধনী ও ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী ও জমিদার শ্রেণির লোকেরা। এই সব লোকেরা কর সংগ্রহ করত ও আইন-কানুন-পুলিশি ব্যবস্থার তদারক করত। বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে তারাই ছিল সর্বেসর্বা। সুদূর আগ্রায় মোগল দরবার থেকে প্রাপ্ত ব্যাবসার লাইসেন্স সুরাট, পাটনা বা কাশিমবাজারে অবস্থিত হোমরাচোমরাদের ঠান্ডা রাখার জন্যে যথেষ্ট নয়। কলকাতা বা বম্বের কোম্পানি যদি নিজেকে মোটামুটি স্বাধীন শক্তি বলে মনে করে, এই সব রাজারা, এমনকী তাদের বণিক-ব্যাঙ্কার বন্ধুরাও নিজেদের স্বাধীন শক্তি বলেই মনে করে।

আরও বড় কথা, একচেটিয়া ব্যাবসার অধিকার কোম্পানির কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলেও দেশীয় রাজাদের কাছে একটা বিড়ম্বনা। রাজার কাছে কোম্পানি দরবার করছে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের দমন করার ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা বা প্রতিযোগী কোম্পানিরা দরবার করে চলেছে ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে। এসব ঝামেলায় মোগলসম্রাটের জড়াবার দরকার নেই। কিন্তু দেশীয় রাজারা ঝামেলার মধ্যে জড়িয়েই শুধু নয়, ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ার একটা প্রধান কারণ। বলাই বাহুল্য, দরবারে প্রচুর ঘুষের আদানপ্রদান হয়ে চলত। বেশিটাই ঘুষ বলে ধরা হত না, উপহার হিসেবে ধরা হত। সে টাকা মোগলসম্রাটের রাজস্বে জমা হত না। যে অর্থ ব্যাবসার কর হিসেবে কোম্পানির দেয়, তার থেকে কম অর্থ নবাবদের উপহার দিয়ে যদি সম্রাটের প্রাপ্য কর ফাঁকি দেওয়া যায় তো মন্দ কী!

এই সব আলাপ-আলোচনা পুরোপুরি লন্ডনের নির্দেশে চলত না বলাই বাহুল্য। বরং স্থানীয় কর্মচারীরা বুঝেছিল যে আলাপ-আলোচনা চালাতে গেলে সব সময়ে লন্ডনের ভৃত্যের মতো হয়ে থাকলে চলবে না। কিন্তু এরা যদি লন্ডনের ভৃত্য না হয়, তা হলে এদের কর্তা কে? দেশীয় রাজারা তো নয়। এরা কোন রাজ্যের প্রজা? কোন সংস্থার কর্মচারী? এই যে অস্পষ্টতা, যাকে আমি একটু আগে ‘দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্ব’ নামে পরিচয় দিয়েছি, তার মধ্যেই সাম্রাজ্যের সম্ভাবনা নিহিত ছিল।

অস্পষ্টতা আরও বেড়ে যায় যখন স্থানীয় কর্মীরা নিজেদের সামরিক অবস্থান সুদৃঢ় করল বম্বে-কলকাতা-মাদ্রাজ প্রতিষ্ঠা করে। গোড়ার দিকে এই উপনিবেশগুলিকে গ্রাম ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এমনকী ঠিকঠাক বন্দর ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে অনেক পরে। মাদ্রাজে দীর্ঘদিন বন্দর বলতে কিছুই ছিল না। জাহাজ দাঁড়াত অনেক দূরে। সেখান থেকে দেশি নৌকা মাল ও যাত্রীদের তীরে নিয়ে আসত। এইসব উপনিবেশের ব্যাবসার পরিধি ছিল সুরাট, মসুলিপতনম বা হুগলির পুরনো কারখানাগুলির তুলনায় অনেক কম। শত্রু ও প্রতিযোগীদের আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল সব সময়েই।

কিন্তু নড়বড়ে গোড়াপত্তন সত্ত্বেও, সতেরো শতকের শেষে কোম্পানির জমিদারিতে চলে এসেছে বেশ কয়েকটি প্রধান মোগল রাজ্য। ১৮০৩ সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ শেষ হলে সাম্রাজ্য প্রায় হাতের মুঠোয়। ব্রিটিশ রাজদরবার বা কোম্পানির ডিরেক্টররা কেউ-ই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখেনি। তা হলে সাম্রাজ্য গড়ে উঠল কী করে?

এই প্রশ্নের উত্তর দুটো অংশে দেওয়া যায়। একটা আগেই দেখেছি, স্থানীয় কর্মচারীদের অবস্থানে অস্পষ্টতা ও তাদের রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা। আর একটা ঘটনা হল দেশীয় ব্যবসায়ীদের অবস্থানে বিরাট বদল। দেশীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ইংরেজদের আঁতাত ছিল। সেই আঁতাতের জন্যেই যে সিরাজউদ্দৌলা পলাশির যুদ্ধ হেরেছিলেন সে সকলেরই জানা কথা। কিন্তু দু’-চারটে ষড়যন্ত্র দিয়ে দেশীয় ব্যবসায়ীদের অবস্থানটা ঠিক বোঝা যাবে না। ইংরেজের সঙ্গে এদের যেমন আঁতাত ছিল, তেমনি প্রচণ্ড বিরোধ, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষও ছিল। কিন্তু দুই দলের স্বার্থ অনেকাংশে এক হয়ে যায় যখন মোগল সাম্রাজ্য পতনের কালে দলে দলে দেশীয় বণিক-ব্যাঙ্কাররা দিল্লি-আগ্রা-লাহোর থেকে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে ব্যাবসা উঠিয়ে নিয়ে আসে। বলাবাহুল্য, প্রশ্নের উত্তরের এই দুটো অংশের মধ্যে সম্বন্ধ রয়েছে। কোম্পানির কর্মীদের অবস্থানের অস্পষ্টতার কারণে ইংরেজদের জমিদারি আরম্ভ হয়, আর দেশীয় ব্যবসায়ীদের অবস্থান নড়বড়ে হতে থাকলে তারা দেশীয় রাজ্য থেকে পাট উঠিয়ে ইংরেজদের জমিদারিতে চলে আসে।

এই প্রসঙ্গ নিয়ে আরও একটু বিশদ আলোচনার প্রয়োজন আছে।

ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় বণিক

ইউরোপীয় উপস্থিতির কারণে ভারতে এক হাইব্রিড বা সংকর ব্যবসায়িক দুনিয়া গড়ে ওঠে। ইউরোপীয়রা যে জগতে এসে ব্যাবসা শুরু করে সেখানে দূরপাল্লার বাণিজ্য ও ব্যাবসার নিয়মকানুন অনেক দিন থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। যেসব নিয়মে ইন্দো-ইউরোপীয় বাণিজ্য চালানো হত তার কতটা নতুন আর কতটা এই ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে পাওয়া, এবং যেগুলি নতুন দিক তার প্রভাব ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উপর কতটা পড়েছিল, সেসব প্রশ্নের মীমাংসা করা কঠিন। যৌথ উদ্যোগের ধারণাটা অবশ্যই নতুন, কিন্তু সেই ধারণাটা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিশেষ ভাবায়নি। তারা প্রথম যৌথ উদ্যোগ শুরু করে কোম্পানির আগমনের অনেক বছর পরে। তার আগে পর্যন্ত পরিবার ও স্বজাতির সাহায্যের উপরেই নির্ভর করে ছিল। তবে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসার আরও দুটো দিক ভারতীয়দের উপরে খুব প্রভাব ফেলেছে।

এক, নৌবল ব্যবহার করে, দুর্গ নির্মাণ করে, সামুদ্রিক বাণিজ্য চালনা, যে মডেল ভারত মহাসাগরে ইউরোপিয়ানদের আসার আগে বিশেষ দেখা যায়নি। আর দুই, রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বীকৃত বিধিবদ্ধ চুক্তির মাধ্যমে বিক্রিবাটার ব্যবস্থা করা। বিধিবদ্ধ চুক্তির সর্বজনীন ব্যবহার ভারতে এর আগে দেখা যায়নি। চুক্তির ব্যবহার অবশ্যই হত, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অলিখিত সামাজিক প্রথার অঙ্গ হিসেবে। বম্বে-মাদ্রাজ-কলকাতার বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই দুটো দিক— সুরক্ষা ও বাণিজ্যিক আইনের পরিকাঠামো। এই দুয়ের আকর্ষণেই বহু ভারতীয় এই শহরে চলে আসে। যদিও তাদের দেশি আইন ব্যবহার করার ব্যাপারে কোনও নিষেধ ছিল না, তবু তারা প্রথম থেকেই ইংরেজদের কোর্ট-কাছারি-আইনের ব্যবহার শুরু করে দেয়।

অন্যদিকে ভারতীয় অংশীদার বা এজেন্ট নিয়োগ করার ব্যাপারে কোম্পানি ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের লক্ষ রাখতে হত যেন জাতি-সম্প্রদায়- পরিবার ইত্যাদির প্রচলিত রীতিনীতি রক্ষিত হয়। বলাই বাহুল্য ভারতীয়দের দক্ষতা, অর্থ, নেতৃত্ব, মধ্যস্থতা—সব কিছুরই দরকার ছিল। দালাল বা এজেন্ট অত্যন্ত জরুরি ব্যক্তি, এতটাই যে তাকে প্রচুর সুযোগসুবিধা ও ক্ষমতা দেওয়া হত, আর সেই ক্ষমতা পেয়ে স্বজাতির কাছে এজেন্টের মানসম্মান অনেকটা বেড়ে যেত।

গত বিশ বছরে ঐতিহাসিকরা প্রস্তাব দিয়েছেন যে সাম্রাজ্যের সম্ভাবনা বিদেশি ও দেশি বণিকদের এই পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্যে থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য আর একটা পুরনো মতবাদের খণ্ডন করা। পুরনো বক্তব্য হল, মোগল সাম্রাজ্য পতনের সময়ে এমন অরাজকতার সৃষ্টি হয় যে ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষায় ও জনসাধারণের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কোম্পানি রাজ্য দখল করতে বাধ্য হয়। এই সাম্রাজ্যবাদী মতবাদ অর্ধসত্য, এবং প্রথম যেসব অঞ্চলে রাজ্যদখল ঘটেছে সে সব জায়গায় এই মত প্রযোজ্য নয়। পলাশির যুদ্ধের আগে বাংলা অরাজক ছিল না, রীতিমতো শক্তিশালী নবাবের শাসন চলছিল।

ক্রিস্টোফার বেইলি ও অন্যান্যদের নির্দেশিত বিকল্প মতে জোর দেওয়া হয়েছে ভারতীয় বণিক ও কোম্পানির অফিসারদের স্বার্থের সংগতির উপরে। মোগল সাম্রাজ্য পতনের একটা বড় ফলাফল হল ভারতীয় পুঁজিপতি ও কারিগররা নানান আঞ্চলিক কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ে। পাটনা, কাশী, পুণা, মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, হায়দ্রাবাদ, জয়পুর বা লখনউ যে সমৃদ্ধি পায় তা পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত লাহোর-দিল্লি-আগ্রা-মুলতানের প্রাপ্য ছিল। বিভিন্ন আঞ্চলিক স্বাধীন রাজ্যে ক্ষমতাশালী একদল বণিক-ব্যাঙ্কার শ্রেণির উদ্ভব হয়। তাদের অনেকেরই এই উপলব্ধি হয় যে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ যুদ্ধ লড়ে লড়ে দেউলে হয়ে যাওয়া রাজাদের স্বার্থের থেকে কোম্পানির স্বার্থের সঙ্গে আরও বেশি সংগত। কোম্পানি রাজনৈতিক চক্রান্তে উপযুক্ত সহযোগী খুঁজে পেল। এইভাবে, কোম্পানি-প্রতিষ্ঠিত রাজ্য মোটামুটি ভারতীয় ধারাতেই, অর্থাৎ আলাপ-আলোচনা-আঁতাতের মধ্যে দিয়ে, গড়ে ওঠে। আর একটু কম রাজনৈতিক অর্থে ঐতিহাসিক লক্ষ্মী সুব্রামানিয়ান এই আঁতাতকে ‘অ্যাংলো-বানিয়া অর্ডার’ নামে উল্লেখ করেছেন।

এটা ঠিক যে আঠারো শতকের মাঝামাঝি, যখন দেশীয় রাজ্যগুলি পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে হাত মেলানোর কথা ভেবে থাকতে পারে। এটাও ঠিক যে প্রচুর পরিমাণ ভারতীয় টাকা ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসায় বিনিয়োগ করা হয়েছিল। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যে সমঝোতা ও পারস্পরিক নির্ভরতা ছিল তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব প্রমাণ থেকে যদি আমরা ধরে নিই যে দুই দল, মানে ইউরোপীয় এবং ভারতীয় বণিকদের মধ্যে উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল, তা হলে ভুল করব। এই সম্পর্ক ছিল অসংগতিতে ভরা। এবং বন্ধুত্ব নয়, বরং এই অসংগতিই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আর একটা তত্ত্বের ইঙ্গিত বহন করে।

অ্যাংলো-বানিয়া অর্ডার আর যাই হোক না কেন পারস্পরিক আস্থা বা বন্ধুত্বের মডেল ছিল না। ইউরোপীয় আগন্তুকরা ভারতীয়দের সম্বন্ধে খুব একটা উষ্ণ মনোভাব কখনই ব্যক্ত করেনি, ভারতীয়রাও ইউরোপিয়ানদের সম্বন্ধে নয়। যদিও বণিক, কারিগর বা তাঁতিদের দক্ষতা নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা শোনা গেছে, বারবার অভিযোগ শোনা গেছে মানুষ হিসেবে এদের ধূর্ততা, শঠতা ও নষ্টামি করার প্রবণতা নিয়ে। উদারহণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় জন হেনরি গ্রোসের (১৭৭২) বা টমাস টেন্যান্টের (১৮০৪) লেখা। এই পর্যটকদের আরও আগে, ১৬৭০ সালে, ডাক্তার ও পর্যটক জন ফ্রায়ার ভারতীয় বণিকদের সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে এরা একরকম বিষাক্ত পোকাসদৃশ, রক্তচোষা, ঘোড়াজোঁক, মাছি, ইহুদিদের চেয়েও খারাপ দালাল, ভণ্ড, প্রতারক, অপরিচ্ছন্ন মানসিকতার অধিকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যরা এতটা মুখ খারাপ না করলেও ইউরোপীয় ও ভারতীয় বণিকদের মধ্যে ভদ্রতা-বন্ধুত্বের ভাব গড়ে উঠছে এমন উদাহরণ বিরল।

অস্বচ্ছন্দ সম্পর্কের পিছনে অনেক কারণ ছিল। ভারতে ব্যাবসার নিয়মনীতি ছিল জাতি এবং সম্প্রদায়ের আচারের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। কিন্তু দুই বণিকগোষ্ঠী তো এক জাতির নয়, পারস্পরিক আচারেও অভ্যস্ত নয়। তার মানে এই নয় যে এক দল আর-এক দলের তুলনায় বেশি সৎ বা বেশি আস্থাবান। সদাচরণ সম্বন্ধে এদের ধারণাটাই ভিন্ন ছিল। ঝগড়া-বিবাদ- অবিশ্বাসের সম্ভাবনা ১৬০০ শতকের প্রথমে অনেক সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ কেনাবেচা প্রধানত হত নিলামের ঢঙে। পরের দিকে চুক্তিমূলক কেনাবেচার পরিধি বহুগুণ বেড়ে যায়, ফলে চুক্তিভঙ্গের সম্ভাবনাও অনেক বাড়ে। অথচ চুক্তি ভাঙলে কোনও দেশীয় আইনও নেই কোনও দেশীয় আদালতও নেই যেখানে মামলার বিচার হতে পারে। এই অনিশ্চয়তা ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসায় কাঁটার মতো বিঁধে ছিল বরাবর। ঐতিহাসিক ওম প্রকাশ লিখেছেন যে অশোধ্য ঋণের সমস্যা ইউরোপিয়ানদের সমস্ত ব্যাবসাকে জর্জরিত করে রেখেছিল। সম্প্রতি দু’জন অর্থনীতিবিদ আনন্দ স্বামী ও রেচেল ক্র্যান্টন আফিম ও কাপড়ের ব্যাবসা নিয়ে গবেষণা করে লিখেছেন যে চুক্তির প্রয়োগ সমস্যা ব্যাপক আকার নিয়েছিল।

অর্থনৈতিক সম্পর্কে আস্থাহীনতার পাশাপাশি ছিল সামাজিক সম্পর্কে দূরত্ব।

ভারতীয়রা প্রায় কখনই ইউরোপীয় বণিকদের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে দেয়নি। ব্যাবসায় তারা নিকট সহযোগী, অথচ তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার ঘটনা ছিল লক্ষণীয়ভাবে বিরল। এই দূরত্ব বিস্ময়কর মনে হতে পারে যখন আমরা বিবেচনা করি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বণিকরা স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্কের জন্যে ভারতীয় সমাজের উপর কতটা নির্ভরশীল ছিল। কোম্পানির অধস্তন কর্মচারী আন্দাজ বছর কুড়ি বয়েসের একটি যুবক, যার জীবনের সেরা বছরগুলি কাটবে কারখানার প্রাঙ্গণে বসে বসে লেজারের খাতায় হিসেব কষে। এই পুরুষটির মহিলা সাহচর্য পাওয়ার একমাত্র উপায় ভারতীয় সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। এদের মধ্যে অনেকেই এই রাস্তায় হেঁটেছে। তবে প্রায় সব সময়েই তাদের পার্টনাররা এসেছে সমাজের নিচু স্তর থেকে। সেইসব নারীদের মধ্যেও অনেকে বাবা- মার সঙ্গে সম্বন্ধ ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে। ব্যাবসার অংশীদার ও নিকটতম সহযোগীদের, অর্থাৎ বণিক-ব্রাহ্মণ শ্রেণির বাড়ির মেয়েরা ছিল ইউরোপীয়দের কাছে সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ এলাকা।

ইউরোপীয় এবং ভারতীয়দের মধ্যে পার্টনারশিপ ছিল কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু এই পার্টনারশিপ এমনই যার পিছনে কোনও আইনি চুক্তিও নেই, সামাজিক বন্ধনও নেই, নিছক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সৃষ্ট পার্টনারশিপ। অবিমিশ্র স্বার্থপরতার উপরে যে সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে তার মধ্যে যে পারস্পরিক অবিশ্বাস জড়িয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ কি! অ্যাংলো-বানিয়া অর্ডার এমনই একটি সিনিক্যাল নৈরাজ্যবাদী অর্ডার। সেই অর্ডারে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।

লক্ষণীয় হল যে, এই ঝগড়াঝাঁটির প্রবণতাও কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি দখল করার একটা কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। যে দেশে চুক্তি বলবৎ করার পথে এত বাধা সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা হাতে নিলে ব্যাবসার সুবিধা হবে, এটা সোজা কথা। কোম্পানির ভিতরে কিছু লোক নিশ্চয়ই বুঝেছে, যে আইনি সুরক্ষা বম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজে উপলব্ধ ছিল, ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য সেই সুরক্ষা সারা ভারতেই কার্যকরী করা দরকার। অর্থাৎ, দেশি-বিদেশি বণিকদের পার্টনারশিপ ও স্বার্থের সংগতি যেমন ইংরেজদের রাজ্যজয়ের একটা তত্ত্ব হতে পারে, দুয়ের মধ্যে অসংগতি ও অনৈক্যও তেমনই বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তত্ত্ব হিসেবে পেশ করা যেতে পারে।

এই বিতর্ক চট করে শেষ হবার নয়। অবশ্যই অনেক বেসুরো পার্টনারশিপের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু সফল ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসাও গড়ে ওঠে। কয়েক জন ভারতীয় বিদেশিদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কোম্পানির বাইরে কেন, কোম্পানির ভিতরেই অনৈক্য দ্রুত বাড়তে থাকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এই অনৈক্যের প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক হলডেন ফার্বারের মত উল্লেখ করে ভূমিকা শেষ করি। কোম্পানির মধ্যে আসল বৈপরীত্য ছিল সেই দুই দলের মধ্যে যাদের এক দল সাম্রাজ্যবিস্তার থেকে লাভবান হবে বলে আশা করে আর এক দল কেবল ব্যাবসা চালিয়েই লাভবান হতে চায়। প্রথম দলে রয়েছে ইংরেজ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ, আর দ্বিতীয় দলে লন্ডনের ব্যবসায়ী, জাহাজের মালিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রমুখ। ১৭১০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই দুই দলের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলে। আর ঠিক সেই সময়েই মোগল সাম্রাজ্যের পতন প্রথম দলের সামনে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার অভাবনীয় সুযোগ এনে দেয়।

বই

এখানে যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পেশ করব তাতে একটি সুপরিচিত গল্প আবার বর্ণিত হয়েছে। তবে এবার গল্পটা বলা হবে একটু স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, যে দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক গবেষণায় এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। কোম্পানি নিয়ে অনেক ইতিহাস রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই লেখা হয়েছে ব্রিটিশ রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। এই বইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে রয়েছে ভারতকে কেন্দ্র করে যে বিশ্বায়ন দানা বাঁধে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে, সেই বিশ্বায়নের ইতিহাস। এই বইয়ের বক্তব্য, ভারতীয় ব্যাবসার ইতিহাস লিখতে হলে দেখা দরকার কী করে এই সময় ইউরোপের কারবার বদলেছে, কীভাবে যৌথ উদ্যোগের ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, প্রাচীন ও আধুনিক ব্যাবসার রীতিনীতির সমন্বয় হয়েছে। সেই ইতিহাস লিখতে হবে ব্রিটেন ও ভারত, ভারত ও চিন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, মোগলরাজ ও ব্রিটিশরাজ, এদের মধ্যে সংযোগ রেখে। ভারত মহাসাগরে ইউরোপীয় বাণিজ্য যে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সৃষ্টি করে সেটা এই বইয়ে আলোচিত হবে, একই সঙ্গে আলোচিত হবে সেই বাণিজ্যের কারণে যে নতুন রকমের বিবাদ, বিরোধ, ও প্রতিযোগিতার সূত্রপাত হয়, সেই প্রসঙ্গের।

দুটো বড় প্রশ্নের উত্তর এই বইয়ে আমরা খুঁজব। প্রথম প্রশ্ন হল, ব্যাবসা থেকে সাম্রাজ্যবাদ, কোম্পানির এই বিবর্তনের পিছনে কারণগুলি কী? এই বিবর্তন কতটা ভিতরকার, অর্থাৎ সাংগঠনিক, কতটা বাইরের, অর্থাৎ সুযোগের সদ্ব্যবহার? দু’ নম্বর প্রশ্ন, কোম্পানির ব্যাবসার কারণে ভারতের অর্থনীতিতে কী কী বদল এসেছে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর এই ভূমিকায় খোঁজা হয়েছে। এখানে উল্লিখিত তত্ত্বগুলির প্রসঙ্গ মাঝেমাঝেই ফিরে আসবে। দ্বিতীয় প্রশ্নের আলোচনা হবে বইয়ের শেষ পরিচ্ছেদে।

এই সব তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবার আগে ক্যানভাস তৈরি করা দরকার। শুরু করা যাক এলিজাবেথের আমলে লন্ডন শহরের হালচাল দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *