১. ভূমিকা

১. ভূমিকা

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সক্রিয় জীবনযাপন করা অনেক মানুষেরই অর্থনীতি বিজ্ঞানের ধারণা একেবারেই কম। তাই এটা এমন যে এমনকি ইহুদিরাও বিশ্বস্তভাবে ইহুদিবিদ্বেষীদের কাঁদুনি গেয়ে বলে— ‘ভরণপোষণের জন্য আমাদের প্রতি স্বাগতিক জাতিগুলোর ওপর আমরা নির্ভরশীল এবং স্বাগতিক এই জাতিগুলোর সমর্থন না থাকলে আমাদের অনাহারে মরতে হবে।’ এটি এমন একটি বিষয়, যা দেখায় যে কীভাবে অন্যায্য দাবি আমাদের আত্মজ্ঞানকে খাটো করে দিতে পারে; কিন্তু জাতিগুলোর আমাদের জন্য ‘স্বাগতিক’ হিসেবে কাজ করার প্রকৃত পটভূমি কী? যেখানে এটি সীমিত ফিজিওক্র্যাটিক (প্রকৃতিতান্ত্রিক) দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে না, সেখানে এটি শিশুসুলভ ত্রুটির ওপর প্রতিষ্ঠিত যে পণ্যগুলো ক্রমাগত হাত থেকে অন্য হাতে চলে যায়। এটা বোঝার জন্য আমাদের রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠার দরকার নেই যে নতুন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পৃথিবী উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বিস্ময়কর এই যুগে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এমনকি সবচেয়ে সীমিত বুদ্ধিমত্তার একজন মানুষকেও, তার অদূরদর্শী চোখ দিয়ে, তার চারপাশে নতুন পণ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো সক্ষম করে তুলেছে। উদ্যোগের চেতনাই (দ্য স্পিরিট অব এন্টারপ্রাইজ) তাদের তৈরি করেছে।

উদ্যোগ (এন্টারপ্রাইজ) ছাড়া শ্রম হলো প্রাচীনকালের নিশ্চল শ্রম; এবং এটি আদর্শের দিক থেকে কৃষকের কাজ। যে কৃষক হাজার বছর আগে যেখানে তার পূর্বপুরুষরা দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের বস্তুগত সব কল্যাণ উদ্যোগী পুরুষদের (ম্যান অব এন্টারপ্রাইজ) মাধ্যমে এসেছে। এ ধরনের গতানুগতিক মন্তব্য যোগ করতে গিয়ে আমি প্রায় লজ্জিত বোধ করছি। এমনকি যদি আমরা উদ্যোক্তা জাতি হতাম- ঠিক যেমনটা অযৌক্তিকভাবে অতিরঞ্জিত বিবরণে বলা হয়ে থাকে— তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্য জাতির প্রয়োজন হতো না। আমরা পুরোনো পণ্যের প্রচলনের ওপর নির্ভর করি না, কারণ আমরা উৎপাদন করি নতুন পণ্য।

বিশ্বে কাজের জন্য অসাধারণ ক্ষমতার দাস রয়েছে, যাদের চেহারা হস্তনির্মিত পণ্য উৎপাদনের জন্য মারাত্মক হয়েছে: এই দাসেরা হলো মেশিন। এটা সত্য যে যন্ত্রকে গতিশীল করার জন্য শ্রমিকদের প্রয়োজন; কিন্তু এর জন্য আমাদের কাছে বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়েছে, বিপুল সংখ্যায়ই রয়েছে। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশের ইহুদিদের অবস্থা সম্পর্কে যারা জানে না, তারাই কেবল এই দাবি করার সাহস দেখাবে যে ইহুদিরা হয় অযোগ্য না হয় কায়িক শ্রম করতে অনিচ্ছুক।

কিন্তু এই পুস্তিকায় আমি ইহুদিদের মুগুর দেখাতে চাই না। তাতে কাজ হবে না। তাদের সমর্থনে পুরোপুরি যুক্তিযুক্ত এবং পুরোপুরি সংবেদনশীল যা কিছু বলা যেতে পারে তার সবই ইতিমধ্যে বলা হয়ে গেছে। শ্রোতাদের একজনও যদি বুঝতে সক্ষম হয় তাহলে ওই একজনই মরুভূমিতে একজন প্রচারক। আর যদি শ্রোতাদের কেউ উদার ও উন্নত মানসিকতার হয় এবং তা ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করে থাকে তাহলে এই হিতোপদেশ বাহুল্যমাত্র। আমি মানুষের উচ্চতর আরোহণে আস্থা রাখি এবং বিশ্বাস রাখি সভ্যতার উচ্চতর স্তরে; কিন্তু আমি মনে করি এই আরোহণ অত্যন্ত ধীর হবে। আমরা কি অপেক্ষা করব যতক্ষণ না গড় মানবতা ততটা দাতব্যভাবে ঝুঁকেছে যতটা গটহোল্ড ইফ্রেইম লেসিং ঝুঁকেছিলেন ‘নাথান দ্য ওয়াইজ’ (নাটক) লেখার সময়। আমাদের অপেক্ষা করা উচিত আমাদের দিনগুলোর পরে, আমাদের সন্তানদেরও পরে, আমাদের নাতি-নাতনিদের পরে এবং আমাদের নাতি-নাতনিদের সন্তানাদির দিনগুলোরও পরে; কিন্তু বিশ্বের আত্মা অন্যভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

এই শতাব্দী প্রযুক্তিগত অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বকে বিস্ময়কর এক নবজাগরণ দিয়েছে; কিন্তু অলৌকিক এই উন্নতি মানবতার সেবার কাজে লাগেনি। দূরত্ব বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারপরও পরিসরের ঘাটতির অভিযোগ করি আমরা। আমাদের চমৎকার বাষ্পচালিত জাহাজগুলো দ্রুত ও নিশ্চিতভাবে অদেখা সমুদ্রে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রেলপথ আমাদের নিরাপদে নিয়ে যায় পার্বত্য-জগতে। ইউরোপ যখন ইহুদিদের ঘেটোতে[৭] বন্দি করে রেখেছিল তখন অজানা দেশগুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তা আমাদের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জানা হয়ে যায়। যে কারণে ইহুদিদের দুর্দশা একটা কালব্যতিক্রম ব্যাপার। এই কারণে নয় যে, শত বছর আগে আলোকায়নের একটা যুগ ছিল, বরং এই কারণে যে ওই আলোকায়ন বাস্তবে আসাটা ছিল একমাত্র নির্বাচিত উৎকৃষ্টতম চেতনা।

[৭ ঘেটো: ঘেটো বলতে ইহুদি মহল্লা বোঝায়। কোনো শহরে বা কোনো স্থানে ইহুদিরা যেখানে একসাথে বসবাস করত সেটিকে ঘেটো বলা হতো। ঘেটোতে বসবাসের বাস্তবতা মোটেও সুখকর ছিল না।]

আমি মনে করি, বৈদ্যুতিক আলো কিছু উন্নাসিক লোকের ড্রয়িং- রুমকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে উদ্ভাবিত হয়নি, বরং মানবতার কিছু অন্ধকার সমস্যার ওপর আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ইহুদি সমস্যা এবং সেটি অন্যগুলোর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আমরা শুধু নিজেদের জন্যই কাজ করছি না, অন্য অনেক ভারাক্রান্ত ও নিপীড়িত মানুষের জন্যও কাজ করছি।

ইহুদি সমস্যা এখনো বিদ্যমান। এটিকে অস্বীকার করা বোকামি হবে। এটি মধ্যযুগের একটি অবশেষ। সভ্য জাতিগুলো চেষ্টা সত্ত্বেও তা এখনো ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম বলে মনে হয় না। তারা অবশ্যই উদারতা দেখিয়েছে, যখন তারা আমাদের মুক্ত করেছে। যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি বসবাস করে সেখানেই ইহুদি সমস্যা বিদ্যমান। যেখানে এই সমস্যা সেখান থেকে সমস্যাটিকে ইহুদিরাই অভিবাসনের সময় বহন করে নিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেসব জায়গায় চলে যাই যেখানে আমরা নির্যাতিত হই না এবং যেখানে গিয়ে আমরা হাজির হই, সেখানে আমাদের উপস্থিতি নির্যাতনের তাড়না সৃষ্টি করে। প্রত্যেক দেশের ক্ষেত্রেই তা হয়, এমনকি অত্যন্ত সুসভ্য দেশেও তা হয়- যেমন ফ্রান্স। ইহুদি সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতেই থাকবে। হতভাগ্য ইহুদিরা এখন ইহুদিবিদ্বেষের বীজ ইংল্যান্ডে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে; ইতিমধ্যে তারা এই বীজ আমেরিকাতেও নিয়ে গেছে।

আমার বিশ্বাস আছে যে ইহুদিবিদ্বেষ আমি বুঝতে পারি, যা সত্যিই একটি জটিল আন্দোলন। আমি এটিকে ইহুদিদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। তধোপরি, এতে আমার কোনো ভয় বা ঘৃণা নেই। আমি বিশ্বাস করি যে এতে অশ্লীল ক্রীড়া, সাধারণ বাণিজ্য ঈর্ষা, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কুসংস্কার, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং আত্মরক্ষার ভানের কী কী উপাদান রয়েছে তা আমি দেখতে পাই। আমি মনে করি, ইহুদি সমস্যা ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে যত বড়, সামাজিক সমস্যা হিসেবে তত বড় নয়। তা সত্ত্বেও তা মাঝে মাঝে নানা ধরনের রূপ নেয়। এটি একটি জাতীয় সমস্যা, যেটিকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে নিয়ে বিশ্বের সভ্য জাতিগুলোর কাউন্সিলে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।

আমরা জনতা— একটাই জনতা।

আমরা আশপাশের সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনে নিজেদের একীভূত করতে এবং আমাদের পিতাদের বিশ্বাস রক্ষা করতে সর্বত্র সৎভাবে চেষ্টা করেছি। আমাদের তা করতে দেওয়া হয়নি। বৃথাই আমরা অনুগত দেশপ্রেমিক, কিছু জায়গায় আমাদের আনুগত্য চরম পর্যায়ে চলে যায়; বৃথাই আমরা আমাদের সহ-নাগরিকদের মতো জীবন ও সম্পত্তির ত্যাগ স্বীকার করি; আমরা বিজ্ঞান ও শিল্পে আমাদের জন্মভূমির খ্যাতি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তার সম্পদ বাড়ানোর জন্য বৃথা চেষ্টা করি।

যে দেশে আমরা বহু শতাব্দী ধরে বাস করেছি সেখানে আমরা এখনো আগন্তুকের মতো চিৎকার করি। প্রায়শই যেখানে যাদের পূর্বপুরুষরা বসবাস করেনি সেখানে ইহুদিদের পূর্বপুরুষের স্থায়ী বসবাস সত্ত্বেও ইতিমধ্যেই সেসব ভূমিতেই তারা দুর্দশার শিকার হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পারে কারা আগন্তুক; এ কারণে, প্রকৃতপক্ষে, জাতিগুলোর সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদ্ভূত যেকোনো প্রশ্নই আসলে শক্তির প্রশ্ন। আমি যখন একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজের নামে এই বিবৃতি দিচ্ছি তখন এখানে আমাদের নির্দেশক অধিকারের (প্রেসক্রিপটিভ রাইট) কোনো অংশই সমর্পণ করছি না। বিশ্বে এখন যেমন আছে এবং একটি অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্ভবত তেমনই থাকবে, অধিকার শক্তিরই অনুগামী। তাই, আমাদের অনুগত দেশপ্রেমিক হওয়ার মানে নেই, হিউগেনসরা যেমন ছিল (মধ্যযুগের ফরাসি প্রটেসস্ট্যান্টদের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী)। তাদেরও দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। আমরা যদি শান্তিতে থাকতে পারতাম…

কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না। নিপীড়ন ও নির্যাতন আমাদের নির্মূল করতে পারবে না। আমরা যে সংগ্রাম ও দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তেমন পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্বের কোনো জাতিই টিকে থাকতে পারেনি। ইহুদি-নির্যাতন (জিও-বেইটিং) আমাদের দুর্বলতাগুলোকে একেবারে খুলে নিয়েছে; আমাদের মধ্যে শক্তিশালীরা, যখন তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন শুরু হয়েছিল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি সর্বদা একনিষ্ঠ ছিল। ইহুদিদের মুক্তির পর এই মনোভাব সবচেয়ে স্পষ্ট ছিল। বৌদ্ধিকভাবে এবং সম্পদের দিক থেকে এগিয়ে থাকা ইহুদিরা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি যে একাত্মতাবোধ তা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছিল। যেখানেই আমাদের রাজনৈতিক মঙ্গল দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছে সেখানেই আমরা আমাদের পরিপার্শ্বের সঙ্গে মিশে গেছি। আমি এটাকে তেমন খারাপ কিছু মনে করি না। সুতরাং, যে রাষ্ট্রনেতা তার জাতির মধ্যে ইহুদিদের আন্তরিকতা দেখতে চান তাকে আমাদের রাজনৈতিক মঙ্গলের জন্য সময় দিতে হবে। এমনকি একজন বিসমার্কও[৮] তা করতে পারেননি।

[৮ বিসমার্ক: জার্মান সাম্রাজ্যের প্রথম চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক, জার্মানিকে একত্রীকরণের মাধ্যমে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনে তার ভূমিকা অন্যতম।]

মানুষের হৃদয়ের গভীরে আমাদের বিরুদ্ধে পুরোনো কুসংস্কার এখনো রয়ে গেছে। এর প্রমাণ যার প্রয়োজন আছে সে কেবল মানুষের কথা শুনুক, তারা অকপট ও সরলভাবে সে ব্যাপারে প্রমাণ দেবে— প্ৰবাদ ও রূপকথা উভয়ই ইহুদিবিদ্বেষী। একটি জাতি সব ক্ষেত্রেই এক মহান শিশু। এই শিশু অবশ্যই শিক্ষিত হতে পারে; কিন্তু তার শিক্ষা, এমনকি সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতেও, এত দীর্ঘ সময় নেবে যে, এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার অনেক আগেই অন্যান্য উপায়ে আমরা আমাদের নিজস্ব অসুবিধাগুলো দূর করে ফেলতে পারব, যা আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি।

আত্তীকরণ বলতে আমি কেবল পোশাক, অভ্যাস, রীতিনীতি ও ভাষার বাহ্যিক সামঞ্জস্যই বুঝি না, অনুভূতি ও আচরণেও তা প্রকাশ পায়। ইহুদিদের আত্তীকরণ প্রচেষ্টা কেবল আন্তঃবিবাহ দ্বারাই প্রভাবিত হতে পারে। তবে মিশুবিবাহের প্রয়োজনীয়তা সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুধাবন করতে হবে; এক্ষেত্রে নিছক আইনি স্বীকৃতি অবশ্যই যথেষ্ট নয়।

হাঙ্গেরীয় উদারপন্থিরা, যারা মিশ্রবিবাহকে সবেমাত্র আইনি অনুমোদন দিয়েছে, তারা একটি উল্লেখযোগ্য ভুল করেছে, যা প্ৰথম দিকের একটি ঘটনাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে; একজন বাপ্তাইজ ইহুদি একজন ইহুদিনীকে বিয়ে করেছিলেন। একই সময়ে বিবাহের বর্তমান রূপ অর্জনের সংগ্রাম ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে পার্থক্যকে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিল, এভাবে জাতিগুলোর সংমিশ্রণে সহায়তা করার পরিবর্তে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

যারা সত্যিকার অর্থে ইহুদিদের অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যেতে দেখতে চেয়েছিলেন, তারা কেবল এটা একটি উপায়েই সম্ভব হতে পারে বলে আশা করতে পারেন। ইহুদিদের আগে তাদের বিরুদ্ধে পুরোনো সামাজিক কুসংস্কার দূর করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করতে হবে। অভিজাততন্ত্র এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে কাজ করতে পারে, কারণ এই শ্রেণিতে আনুপাতিকভাবে সর্বাধিকসংখ্যক মিশ্র বিবাহ হয়ে থাকে। ইহুদি পরিবার পুরোনো অভিজাতদের তাদের অর্থ দিয়ে পুনরায় সুসজ্জিত করবে। এভাবে তারা ক্রমান্বয়ে একীভূত হবে। মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা কী রূপ নেবে, যেখানে (ইহুদিরা যেহেতু বুর্জোয়া) ইহুদি সমস্যাটি মূলত কেন্দ্রীভূত। ক্ষমতা অধিগ্রহণের আগেকার ঘটনা অর্থনৈতিক আধিপত্যের সঙ্গে সমার্থক হতে পারে, যেখানে ইহুদিদের অধিকারের বিষয়টি ভুলক্রমে তারা ঘোষণা দিয়েছে। এবং এখন তাদের অধিকারে থাকা ক্ষমতা যদি ইহুদিবিদ্বেষীদের মধ্যে ক্ষোভ ও ধিক্কারের সৃষ্টি করে তাহলে ক্ষমতার এই বৃদ্ধি কী ধরনের প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করবে? তাই শোষণের দিকে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ কখনোই নেওয়া হবে না। কারণ পদক্ষেপটি এতদিন অবজ্ঞা করা সংখ্যালঘুদের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠের বশ্যতাকে অন্তর্ভুক্ত করবে, যাদের না আছে নিজস্ব সামরিক বাহিনী, না আছে নিজস্ব প্রশাসনিক ক্ষমতা। আমি মনে করি, তাই, ইহুদিদের তাদের সমৃদ্ধির মাধ্যমে শোষণের সম্ভবনা কম। যেসব দেশ এখন ইহুদিবিদ্বেষী আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ সেখানে মিলবে। অন্য ক্ষেত্রে, যেখানে ইহুদিরা এখন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেখানে এটি সম্ভবত ভীষণভাবে বিতর্কিত হবে। আমার অপেক্ষাকৃত সুখী সহ-ধর্মবাদীরা আমাকে বিশ্বাস করবে না যতক্ষণ না ইহুদিবিদ্বেষ (জিও-বেটিং) তাদের সত্য শেখাবে; ইহুদিবিদ্বেষ যত দীর্ঘ সময়ের জন্য সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা হবে, ততই প্রচণ্ডভাবে তা ছড়িয়ে পড়বে। আপাত নিরাপদ একটি ভূমি অভিবাসী ইহুদিদের অনুপ্রবেশে আকৃষ্ট করে এবং স্থানীয় ইহুদিদের সামাজিক পর্যায়ে তাদের আরোহণ করতে দেয়, একটি বিপ্লব ঘটাতে শক্তিশালীভাবে একত্রিত করে। যৌক্তিক এই উপসংহারের চেয়ে আর সরল কিছু হয় না।

কারণ আমি সত্যের সন্ধান ছাড়া আর সমস্ত কিছুর প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতার সাথে এই উপসংহারে এসেছি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকা ইহুদিরা সম্ভবত আমার মতামতের সঙ্গে বিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব করবে। যতদূর সম্ভব শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও ভীতু মালিকদেরই যা বিপদ। তাদের নিরাপদে উপেক্ষা করা যেতে পারে। কারণ তাদের চেয়ে দরিদ্র ও নিপীড়িতদের কথা ভাবা বেশি জরুরি; কিন্তু আমি চাই শুরু থেকেই কোনো ভুল ধারণা তৈরি না হোক। বিশেষ করে আমার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যাতে বর্তমানে সম্পদের অধিকারী ইহুদিরা প্রকল্প সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে সম্পদের অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু একেবারে পুরোপুরিভাবে ব্যাখ্যা করব। যদিও আমার এই পরিকল্পনা এক টুকরো সাহিত্যের চেয়ে বেশিকিছু না হলে সবকিছু যেমন আছে তেমনই থাকবে।

এটাকে আরও যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে যে, আমি যখন বলি যে, আমরা জনতা— একটাই জনতা; তখন ইহুদিবিদ্বেষকে আরও যথার্থভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমি ইহুদিদের আত্তীকরণে বাধা দিচ্ছি যেখানে এটি সুসম্পন্ন হতে চলেছে এবং যেখানে এটি একটি নিষ্পন্ন ব্যাপার সেখানে এটিকে আমি বিপন্ন করে তুলছি। অন্তত একজন নিঃসঙ্গ লেখকের পক্ষে এককভাবে কোনোকিছুকে যতটুকু বাধা দেওয়া কিংবা বিপন্ন করা সম্ভব।

ফ্রান্সের বিরোধিতাগুলো বিশেষ করে সামনে আনা দরকার। অন্যান্য দেশেও হয়তো এই বিরোধিতা দেখা দেবে; কিন্তু আগে থেকেই আমি ফরাসি ইহুদিদের আপত্তির জবাব দিয়ে রাখব, কারণ এগুলোতে আমার বক্তব্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ থাকবে।

আমি যতই ব্যক্তিত্বের পূজা করি না কেন- রাষ্ট্রনায়ক, উদ্ভাবক, শিল্পী, দার্শনিক বা নেতাদের মধ্যে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, সেইসাথে মানবজাতির একটি ঐতিহাসিক গোষ্ঠীর সম্মিলিত ব্যক্তিত্ব, যাকে আমরা একটি জাতি বলি— যতই আমি ব্যক্তিত্বের পূজা করি না কেন, আমি এই ব্যক্তিত্বের অন্তর্ধানে শোক করি না। যার ধ্বংস হওয়ার সামর্থ্য, সম্ভাবনা এবং অবশ্যম্ভাবিতা আছে; সে ধ্বংস হোক; কিন্তু ইহুদিদের স্বাতন্ত্র্যসূচক জাতীয়তা ধ্বংস হতে পারে না, ধ্বংস হবে না, হবেই না। এটি ধ্বংস হতে পারে না, কারণ বহিরাগত শত্রুরা এটিকে সুসংহত করে। এটি ধ্বংস হবে না; দুই হাজার বছরের ভয়ানক দুর্দশায় মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। এটি ধ্বংস হবেই না এবং তা যে হবে না, হতাশ হতে অনিচ্ছুক অসংখ্য ইহুদির একজন উত্তরসূরি হিসেবে এই পুস্তিকায় আমি আবার সেটি প্রমাণের চেষ্টা করছি। ইহুদিবাদের সব শাখা শুকিয়ে ঝরে যেতে পারে; কিন্তু কাণ্ডটি থেকে যাবে।

অতঃপর, যদি সব কিংবা কোনো ফরাসি ইহুদি নিজেদের ‘আত্তীকরণের’ কারণে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, তবে আমার উত্তর সহজ, পুরো বিষয়টি তাদের মোটেই চিন্তিত করে না। তারা ফরাসি ইহুদি, তা বেশ! তাহলে এটা তো শুধু ইহুদিদের নিজস্ব ব্যাপার।

ইহুদিরা অন্যান্য রাষ্ট্রে ‘আত্তীকৃত’ হলে তাদের যতটা ক্ষতি হতো, রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্থানান্তর (কিংবা আন্দোলনের) যে প্রস্তাব আমি রাখছি, তাতে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি ফরাসি ইহুদিদের হবে না। বিপরীত দিক থেকে দেখলে এটা বরং তাদের জন্য স্পষ্টত সুবিধাই। এই জন্য যে তারা তাদের ‘ক্রোমাটিক ফাংশনের’ ক্ষেত্রে, ডারউইন যেমন বলেন, আর বিরক্তির শিকার হবে না, কিন্তু শান্তিতে আত্তীকৃত হতে পারবেন, কারণ বর্তমানের যে ইহুদিবিদ্বেষ তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। আত্তীকৃত হওয়ার কারণে যে স্বীকৃতি তাতে নিশ্চিতভাবেই তারা তাদের আত্মার গভীরে প্রশান্তি অনুভব করবে, যদি তারা যেখানে আছে সেখানেই থেকে যায় এবং যদি উচ্চতর সব প্রতিষ্ঠান নিয়ে যে নতুন ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে উঠবে, যদি তা বাস্তবে হয়।

‘আত্তীকৃতরা’ বিশ্বস্ত ইহুদিদের প্রস্থানের মাধ্যমে খ্রিস্টান নাগরিকদের চেয়েও বেশি লাভবান হবে। দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক চাপে স্থান থেকে স্থানে, এক ভূমি থেকে আরেক ভূমিতে বিতাড়িত ইহুদি সর্বহারাদের উদ্বেগজনক, অগণিত এবং অনিবার্য বিরোধিতার হাত থেকে তারা রেহাই পাবে। ভাসমান এই সর্বহারারা এক জায়গায় থিতু হয়ে যাবে। অনেক খ্রিস্টান নাগরিক, যাদের আমরা ইহুদিবিদ্বেষী বলি, তারা এখন বিদেশি ইহুদিদের অভিবাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রস্তাব দিতে পারে।

ইহুদি নাগরিকরা তা করতে পারে না, যদিও এটি তাদের অনেক বেশি সরাসরি ক্ষতি করবে। তারা প্রথমেই একই ধরনের শিল্পকারখানাগুলোতে কর্মরতদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে তীব্র প্রতিযোগিতা অনুভব করবে। যারা উপরন্তু যেখানে ইহুদিবিদ্বেষ ছিল না সেখানে তা চালু করবে এবং যেখানে তা ছিল সেখানে তা আরও জোরদার করবে। ‘আত্তীকৃতরা’ এই গোপন অসন্তোষকে ‘পরোপকারী’ উদ্যোগের অভিব্যক্তি দেয়। তারা ভাসমান ইহুদিদের জন্য অভিবাসন সমিতি গড়ে তোলে। মানুষকে নিয়ে তা মোকাবিলা না করলে এই ছবিটির বিপরীত-চিত্র দেখা যাবে, যা হবে কৌতুকপ্রদ। সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু তৈরি করা হয়েছে, নির্যাতিত ইহুদিদের জন্য নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে। এই দরিদ্র প্রাণীদের যত দ্রুত এবং যতদূর সম্ভব পাঠানোর জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছে এবং এভাবে, ইহুদিদের অনেক আপাত বন্ধুর মুখ সতর্ক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে যায়। জনহিতৈষীর ছদ্মবেশে তারা ইহুদি বংশোদ্ভূত ইহুদিবিদ্বেষী ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু উপনিবেশ স্থাপনের প্রচেষ্টা, এমনকি সত্যিকারের পরোপকারী মানুষদের দ্বারা করা হয়েছিল, যদিও আকর্ষণীয় প্রচেষ্টা ছিল, তারপরও তা ব্যর্থ হয়েছিল। আমি মনে করি না যে এই বা সেই ব্যক্তি বিষয়টিকে নিছক একটি বিনোদন হিসেবে নিয়েছিল, এমন নয় যে তারা দরিদ্র ইহুদিদের দেশত্যাগের বিষয়টিকে ঘোড়ার দৌড়ে লিপ্ত হওয়ার মতো বিষয় হিসেবে নিয়েছিল। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখাটা খুবই গুরুতর ও দুঃখজনক। তাদের এই উদ্যোগগুলো আকর্ষণীয় ছিল, কারণ তারা ছোট পরিসরে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণার ব্যবহারিক অগ্রদূতদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। তারা এমনকি দরকারি ছিল, তাদের ভুল থেকে একটি বৃহত্তর স্কেলে সফলভাবে সেই ধারণা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা যেতে পারে।

তারা অবশ্য ক্ষতিও করেছে। নতুন জেলাগুলোয় ইহুদিবিদ্বেষের পরিবহন, যা এই ধরনের কৃত্রিম অনুপ্রবেশের অনিবার্য পরিণতি, আমার কাছে তখনকার নানা ক্ষতিকর বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়। আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, অসন্তোষজনক ফল বুদ্ধিমান মানুষের ওপর সন্দেহ জাগায়। সহজ যুক্তিতে যা অবাস্তব বা অসম্ভব তা বুদ্ধিমানদের মন থেকে এই সন্দেহ দূর করবে, যা অবাস্তব কিংবা ছোট পরিসরে করা অসম্ভব, বড় পরিসরেও তা করার প্রয়োজন নেই। একই অবস্থার অধীনে একটি ছোট উদ্যোগ লোকসানি হতে পারে, আবার বড় উদ্যোগ একই অবস্থার অধীনে লাভজনক হতে পারে। ছোট নদীতে নৌকা দিয়েও চলাচল করা যায় না; কিন্তু যে নদীতে এই ছোট নদী গিয়ে মেশে সেটি আবার সরাসরি লোহার জাহাজ বহনেও সক্ষম।

কোনো মানুষই এত ধনী বা শক্তিশালী নয় যে একটি জাতিকে এক বাসস্থান থেকে অন্য বাসস্থানে সরিয়ে দিতে পারে। একটি ধারণা একাই কিন্তু তা পারে এবং রাষ্ট্রের এই ধারণার কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই ক্ষমতা থাকতে পারে। ইহুদিরা তাদের ইতিহাসের দীর্ঘ রাতজুড়ে এই রাজকীয় স্বপ্ন দেখেছে। ‘জেরুজালেমে আগামী বছর’ এটি আমাদের পুরোনো প্রবচন। স্বপ্নকে যে বাস্তবে রূপান্তর করা যায় তা দেখানোরই প্রশ্ন এখন।

এর জন্য মানুষের মন থেকে অনেক পুরোনো, অতিক্রান্ত, বিভ্রান্তিকর এবং সীমিত ধারণাগুলোকে প্রথমে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে হবে। নিস্তেজ মস্তিষ্ক, উদাহরণস্বরূপ, কল্পনা করতে পারে যে এই যাত্রা সভ্য অঞ্চল থেকে মরুভূমিতে হবে।

ব্যাপার কিন্তু তা নয়। এটি হবে সভ্যতার মাঝখানে। আমরা নিম্ন পর্যায়ে ফিরে যাব না, আমরা একটি উচ্চতর স্তরে উঠব। আমরা মাটির ঘরে বাস করব না; আমরা নতুন করে আরও সুন্দর এবং আধুনিক বাড়ি তৈরি করব এবং সেগুলো আমাদের নিরাপদ অধিকারে থাকবে। আমরা আমাদের অর্জিত সম্পত্তি হারাব না; আমরা তাদের তা বোঝাব। আমরা আরও ভালোর জন্য আমাদের অর্জিত অধিকারগুলো সমর্পণ করব। আমরা আমাদের প্রিয় প্রথাগুলো বিসর্জন দেব না; বরং আমরা সেগুলোকে আবার খুঁজে বের করব। আমাদের নতুন বাড়ি প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে যাব না।

তারাই শুধু যাবে যারা নিশ্চিত যে এর মাধ্যমে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে; যারা এখন যাওয়ার জন্য মরিয়া তারা আগে যাবে, তাদের পরে যাবে দরিদ্ররা; পরবর্তীতে যাবে যারা উন্নতি করছে তারা; এবং সব শেষে যাবে ধনীরা। যারা আগে যাবে তারা নিজেদের উচ্চতর স্তরে উন্নীত করবে, তাদের সমকক্ষ যাদের প্রতিনিধিরা শিগগিরই অনুসরণ করবে। এভাবে এই যাত্রা একই সঙ্গে শ্রেণিগত উন্নতিও।

ইহুদিদের প্রস্থানে কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয়, কোনো সংকট, কোনো নিপীড়ন হবে না; আসলে, তারা যে দেশগুলো পরিত্যাগ করবে সেগুলো সমৃদ্ধির নতুন যুগে পুনরুজ্জীবিত হবে। ইহুদিদের ছেড়ে যাওয়া স্থানে খ্রিস্টান নাগরিকদের একটি অভ্যন্তরীণ অভিবাসন হবে। বহির্মুখী স্রোত হবে ধীরগতির, কোনো ঝামেলা হবে না এবং অভিবাসনের এই প্রাথমিক আন্দোলন ইহুদিবিদ্বেষের অবসান ঘটাবে। ইহুদিরা সম্মানিত বন্ধুর মতো চলে যাবে এবং তাদের মধ্যে কেউ ফিরে এলে, তারা সভ্য দেশগুলোর দ্বারা একই অনুকূল অভ্যর্থনা এবং আচরণ পাবে, যা সমস্ত বিদেশি দর্শনার্থীদের দেওয়া হয়। তাদের বহির্গমন একটি ফ্লাইটের মতো দ্রুততর হবে না, কারণ তাদের এই সুনিয়ন্ত্রিত যাত্রা জনমতের ভিত্তিতে হবে। এই যাত্রা শুধু আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই শুরু হবে তা নয়, আগ্রহী সরকারগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতাও তাতে থাকবে, কারণ তারা এ থেকে যথেষ্ট সুবিধাও লাভ করবে।

ধারণার অখণ্ডতার নিরাপত্তা এবং এর বাস্তবায়নের শক্তি একটি সংস্থা তৈরির মাধ্যমে পাওয়া যাবে, তা হলো কর্পোরেট, বা কর্পোরেশন। এই কর্পোরেশনটিকে ‘ইহুদি সোসাইটি’ বলা হবে। এর পাশাপাশি থাকবে একটি ইহুদি কোম্পানি, অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনশীল একটি সংস্থা।

যে ব্যক্তি একা একা এই বিশাল কাজটি করার চেষ্টা করবে, সে একজন প্রতারক বা পাগল। কর্পোরেশনের সদস্যদের ব্যক্তিগত চরিত্র এটির অখণ্ডতার নিশ্চয়তা দেবে এবং কোম্পানির পর্যাপ্ত মূলধন তার স্থিতিশীলতা প্রমাণ করবে।

এই প্রারম্ভিক মন্তব্যগুলো কেবল ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ শব্দবন্ধের প্রতিটি শব্দ নিশ্চিতভাবে যে আপত্তিগুলো জাগিয়ে তুলতে পারে সেগুলোর কেবল ত্বরিৎ জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে। অতঃপর আমরা আরও আপত্তির বিষয়ে আলোচনায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যাব এবং এখন কেবল যেগুলোর ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব। এই পুস্তিকাটির স্বার্থে চেষ্টা করব যাতে এটি একটি নিষ্ক্রিয় প্রকাশনা না হয়। এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সূত্রধর্মী অধ্যায়ই সর্বোত্তম।

যদি আমি একটি পুরোনো ভবনের পরিবর্তে একটি নতুন ভবন গড়তে চাই, তবে নির্মাণ করার আগে আমাকে অবশ্যই ভাঙতে হবে। এই কারণে স্বাভাবিক এই ক্রম আমাকে বজায় রাখতে হবে। প্রথমে এবং সাধারণ অংশে আমি আমার ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করব, সমস্ত সংস্কার দূর করব, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করব এবং পরিকল্পনা তৈরি করব।

বিশেষ অংশে, যা তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত, আমি এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বর্ণনা করব। বিভাগ তিনটি হলো: ইহুদি কোম্পানি, স্থানীয় গোষ্ঠী এবং ইহুদি সোসাইটি। সোসাইটি প্রথমে তৈরি করতে হবে, কোম্পানি শেষে; কিন্তু এর বিপরীত ক্রমটি অগ্রাধিকারযোগ্য, কারণ উদ্যোগের (এন্টারপ্রাইজের) আর্থিক সাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিই প্রধানত প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং এ বিষয়ে সংশয়গুলোই প্রথমে দূর করতে হবে।

উপসংহারে, আমি সম্ভাব্য প্রতিটি আপত্তি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব। আশা করি ইহুদি পাঠকরা শেষপর্যন্ত ধৈর্য ধরে আমাকে অনুসরণ করবে। কেউ কেউ স্বভাবতই তাদের খণ্ডনের মানসিকতার জায়গা থেকে আপত্তি করেই যাবে; কিন্তু যার সন্দেহ দূরীভূত হবে তাদের উচিত এক্ষেত্রে সমর্থন দেওয়া।

যদিও আমি যুক্তির কথা বলছি, তারপরও আমি পুরোপুরি সচেতন যে কেবল যুক্তিই যথেষ্ট নয়। পুরনো বন্দিরা স্বেচ্ছায় তাদের সেল ছাড়ে না। আমরা দেখব যে যুবকরা, যাদেরকে আমাদের প্রয়োজন, তারা আমাদের নির্দেশ মানছে কি না। যুবকরা, যারা অপ্রতিরোধ্যভাবে পুরোনোদের টেনে আনে, তারা তাদের শক্তিশালী বাহুতে পুরোনোদের এগিয়ে নিয়ে যায় এবং যৌক্তিক উদ্দেশ্যগুলোকে উদ্দীপনায় রূপান্তরিত করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *