শব্দবিদ্যার উপক্রমণিকা
প্রথম অধ্যায় – ১ ভাষা ও উপভাষা
ভাষা মানুষের জন্মসূত্রে পাওয়া। তাহা এতই স্বাভাবিক যে চলাফেরা বা শ্বাসক্রিয়ার মতো স্বয়ংক্রিয় বৃত্তি বলিয়া মনে হয়। কিন্তু ভাষা মানুষের জন্মলব্ধ সংস্কার অথবা শরীরচেষ্টাগত অভ্যাস মাত্র নহে। মানবশিশু অরণ্যে পশু কর্তৃক লালিত হইলে সে বাক্শক্তিহীন হয়। মানুষের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিশুর বিবিধ মানসিক ও সামাজিক ধারণার মতো ভাষাও সংসার-সমাজ সংসর্গেই অধিগত হয়। যেহেতু শিশুমনের বৃদ্ধি তাহার ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আগাইয়া যায় সেহেতু মাতৃভাষা-লাভে সে কখনই সজ্ঞান চেষ্টা অনুভব করে না।
মানুষমাত্রেই কোন না কোন সংসার-সীমানার অথবা সমাজগণ্ডীর অন্তর্গত। স্বাভাবিক অবস্থায় কোন ব্যক্তি সংসার অথবা সমাজ বিরহিত নয়। যে সংসার বা সমাজের মধ্যে মানুষ বাস করে সে সংসার ও সমাজভুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তাহার চিন্তা উদ্দেশ্য এবং কর্মর্গত সমতা কিছু না কিছু থাকিবেই। ভাষা এই সমতার প্রধান সাধন। ভাষার মধ্য দিয়া আদিম মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তির প্রথম অঙ্কুর প্রকাশ পাইয়াছিল। ভাষার মধ্য দিয়াই সেই সামাজিক প্রবৃত্তি নানাদিকে নানাভাবে প্রসারিত হইয়া আদিম নরকে পশুত্বের অন্ধজড়তা হইতে উদ্ধার করিয়া তাহাকে মননশীল করিয়াছে। প্রকৃতির দাসত্ব হইতে মুক্তি পাইয়া মানুষ প্রকৃতির প্রভুত্বের অধিকারী হইয়াছে। ভাষা চিন্তার শুধু বাহনই নয় চিন্তার প্রসূতিও। লতা যেমন মঞ্চ-অবলম্বন না পাইলে বাড়িতে পারে না চিন্তাও তেমনি ভাষা-অবলম্বন ব্যতিরেকে বিচরণ করিতে অক্ষম।
পশুর সমাজ নাই এবং তাহা থাকিবার কথাও নয়। পশু একাকী অথবা জোড় বাঁধিয়া কিংবা দল লইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কিন্তু পশুর দল পশুর “সমাজ” নয়, সে দলে একটিমাত্র পুরুষ-প্রাণী—কর্তা। সে দলকে সমাজ নয়, বরং পরিবার বলিতে পারি। পশুর জীবনধারণ শুধু বাঁচিয়া থাকা, সুতরাং তাহার পক্ষে ভাষা নিতান্ত অনাবশ্যক। তবে শারীরিক প্রয়োজনে অনেক পশু বিশেষ বিশেষ ডাক ডাকে।
এখন প্রশ্ন, ভাষা কী? চিন্তাবহ মানব-বাক্ যদি ভাষা হয়, ইঙ্গিতবহ পশুনাদও কি তাই নয়? কিন্তু মানুষের ও পশুপক্ষীর কণ্ঠোদ্গীর্ণ ধ্বনিপ্রবাহের মধ্যে মূলগত পার্থক্য আছে। যে-বুদ্ধি মুখে ভাষা যোগায় সে-বুদ্ধি ইতরপ্রাণীর ডাকের পিছনে নাই।
সুতরাং, অল্পকথায় নির্দেশ করিতে গেলে, মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা।
একজন মানুষের স্পৃহা অথবা উত্তেজনা আর একজন মানুষের কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশ করাইয়া তাহার মনে সেইরূপ স্পৃহার অথবা উত্তেজনার অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাই ভাষার প্রথম এবং প্রধান কাজ। যেমন, [রাম ও শ্যাম বেড়াইতে বাহির হইয়াছে। পথে গাছে পাকা পেয়ারা দেখিয়া শ্যাম বলিল, দাদা, ক্ষুধা পাইয়াছে, পেয়ারা খাইব। রাম গাছে উঠিয়া পেয়ারা পাড়িয়া শ্যামকে দিল।] ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করিলে এই কার্যকারণপরম্পরা পাওয়া যায়: (১) শ্যামের মুখ হইতে কতকগুলি ধ্বনি উচ্চারিত হইবার পূর্ববর্তী ঘটনা, অর্থাৎ শ্যামের কথা কহিবার উত্তেজক কারণ—শ্যামের পেয়ারা দেখা ও ক্ষুধাবোধ; (২) এই উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া,—রামের প্রতি শ্যামের বাক্য; (৩) শ্যামের কথা শুনিয়া রামের মনে অনুরূপ উত্তেজনার সঞ্চার—শ্যামের পেয়ারা দেখা ও ক্ষুধাবোধ সম্বন্ধে রামের জ্ঞান এবং প্রতিকারবাঞ্ছা; এবং (৪) রামের মনে শ্যামের বাক্যে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া—গাছে উঠিয়া ফল পাড়িয়া দেওয়া। এখন শ্যাম যদি মানুষ না হইয়া বানর হইত, তবে, ভাষার সাহায্যে সে রামের মনে তাহার উত্তেজনা সংক্রমণের প্রয়োজনই বোধ করিত না। সে নিজেই গিয়া গাছে উঠিয়া পেয়ারা লইত।
কিন্তু এক ব্যক্তির মনের ভাব বা উত্তেজনা অপর ব্যক্তির মনে সঞ্চারিত করা শুধু যে ভাষার দ্বারাই হইতে পারে এমন নয়। হাত-পা-চোখ-মুখের ইঙ্গিতের দ্বারা অথবা অন্য উপায়ে সংকেতের সাহায্যেও এক ব্যক্তির মনোভাব অপর ব্যক্তির মনে অল্পবিস্তর পরিমাণে উদ্ৰিক্ত করা যায়। ভাষায় যেমন শ্যামের কণ্ঠোদ্গীর্ণ ধ্বনিপ্রবাহ রামের কর্ণগোচর হইয়া শ্যামের মনোভাব রামকে জ্ঞাত করায়, ইঙ্গিতে তেমনি শ্যামের মুখভঙ্গি বা অঙ্গচালনা রামের দৃষ্টিগোচর হইয়া তাহার মনে সেই ভাব সঞ্চারিত করিতে পারে। কিন্তু ইঙ্গিতের দ্বারা ভাষার কাজ কিছু চলিলেও ইঙ্গিত ভাষা নয়, সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রে ভাষার বিকল্প মাত্র। তবে ইঙ্গিত কখনো কখনো ভাষার সহায়ক হইতে পারে। বক্তার ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গি বক্তব্যকে শ্রোতার কাছে আরও সহজে বোধগম্য করে। এখানে ইঙ্গিত ভাষার পরিপোষক। যেমন গানের তাল সুরের পরিপোষক।
ধ্বনিসমষ্টির মধ্য দিয়াই ভাষা বিষয়কে ব্যক্ত ও ভাবকে স্ফুট করে। বিশেষ বিশেষ অর্থবান্ ধ্বনিসমষ্টি (অর্থাৎ শব্দ) বিশেষ বিশেষ বিষয়ের ও ভাবেরই প্রতিনিধি, সেই সেই ধ্বনিগুলির নয়। অর্থাৎ, “মানুষ” বলিলে আমরা “ম্+আ+ন্+উ+ষ্” এই ধ্বনিসমষ্টি বুঝি না, বুঝি এই সমগ্র ধ্বনিসমষ্টির দ্বারা মনে উদ্বোধিত নির্দিষ্ট বিশেষ-রূপগুণসম্পন্ন প্রাণী অর্থাৎ একটি স্ফুট ও সুনির্দিষ্ট চিত্র। অতএব ধ্বন্যারূঢ় প্রতীকদ্যোতনাই ভাষার স্বরূপ লক্ষণ।
গৃহপালিত পশু পালক-চালকের ব্যক্ত শব্দ অথবা অব্যক্ত ইঙ্গিত বুঝিয়া চলে। কোন কোন ইতরপ্রাণী মুখোচ্চারিত অথবা পক্ষতাড়িত ধ্বনির সাহায্যে স্বজাতীয় অপর প্রাণীতে জৈবিক উত্তেজনার সঞ্চার করিতে পারে। গোরু ডাকিলে বাছুর ছুটিয়া আসে। তবুও এসব ইঙ্গিতই। ব্যক্ত বাক্—ভাষা—এ নয়, কেন না এখানে উচ্চারিত ধ্বনির বা ধ্বনিসমষ্টির প্রতীকদ্যোতনা নাই। গৃহপালিত পশুর শব্দবোধ সেই মননহীন অভ্যাস হইতে লব্ধ যাহাকে মনোবিজ্ঞানে বলে কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স্। ইতরপ্রাণীর ডাক স্নায়বিক উত্তেজনার অ-বোধ যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মানুষের কণ্ঠধ্বনি স-বোধ উদ্যম। বিশেষ বিশেষ অর্থদ্যোতনা করিতে মানুষ বিশেষ বিশেষ ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করে। ভাষায় বিশেষ বিশেষ ধ্বনিসমষ্টির সঙ্গে বিশেষ বিশেষ অর্থের নিত্যসম্বন্ধ আছে। ইতরপ্রাণীর ডাকে এমন ব্যাপকতা ও নমনীয়তা নাই।
ভাষা বলিতে বিশেষ করিয়া মুখের ভাষা, অর্থাৎ পরস্পর সাক্ষাৎ বাগ্ব্যবহার, বোঝায়। লেখাপড়ার ভাষা যেন মুখের ভাষার স্থায়ী প্রতিনিধি। মুখের ভাষার ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আছে। পরস্পর আলাপ তখনই সম্ভব হয় যখন বক্তা ও শ্রোতা সমকালে, সন্নিহিত থাকে। এখনকার দিনে, টেলিফোন-রেডিও ব্যবস্থায় বক্তা ও শ্রোতা সন্নিহিত না হইলেও চলে তবে সমকালবর্তী হওয়া চাই। (গ্রামোফোন ও টেপ-রেকর্ডারের বেলায় বক্তা ও শ্রোতা সমস্থানে সমকালে থাকে না, কিন্তু ভাষার কাজ—আলাপ—চলে না, শুধু একতরফা বলা অথবা শোনাই হয়। সুতরাং, গ্রামোফোন ও রেকডার মুখের ভাষা বহন করিলেও কার্যত লেখার ভাষার মধ্যেই পড়ে।) লেখার ভাষা সমস্থানক্ষণাতিশায়ী সুতরাং স্থায়ী, মুখের ভাষা ক্ষণিক। মুখের ভাষা যাহাতে স্থানকালের ব্যবধান অতিক্রম করিয়া অনুপস্থিত অজ্ঞাত অনাগত উদ্দিষ্টের কাছে পৌঁছিতে পারে তাহার জন্যই লেখার ভাষার বাহন লিপির প্রয়োজন। বাঙ্ময় ধ্বনির দৃশ্যরূপই লিপি। লিপিবদ্ধ হইলে তবেই ভাষা স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে। স্থান ও কাল ব্যবধানস্থিত বহু শ্রোতা-পাঠকের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় বলিয়া লেখার ভাষার ছাঁদ মুখের ভাষা হইতে কতকটা পৃথক্ এবং অনেকটা ধারাবাহিক আদর্শের অনুসারী। স্থান ও গোষ্ঠী বিশেষে মুখের ভাষায় কমবেশি রূপভেদ হয়। কিন্তু লেখার ভাষায় মুখের ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ রূপটিই পরিগৃহীত বলিয়া ইহাতে বৈষম্যের অবকাশ কম। সাধুভাষা হইল ধারাবাহী আদর্শ-অনুসারী মার্জিত ভাষা—লিখিবার ভাষা, যে ভাষা কোন বৃহত্তর সমাজে সর্বজন-ব্যবহার্য। তবে সাধুভাষার ব্যবহার শিক্ষাসাপেক্ষ।
ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমষ্টির কোন সুনির্দিষ্ট সর্বসাধারণ রূপ নাই। বিভিন্ন ভাষায় যে ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহৃত হয় তাহা অল্পবিস্তর বিভিন্ন। ভাষার কাজে বিশেষ একটি নির্দিষ্ট ধ্বনিসমষ্টি-ব্যবহারকারী জনমণ্ডলীকে বলে ভাষা-সম্প্রদায় (Spccch-community)। কোন একটি বিশেষ ভাষাসম্প্রদায়ের ধর্মনীতি আচারব্যবহার সমাজবিধি রাষ্ট্রশাসন জাতি ও ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে সমতা না থাকিতে পারে। আবার কোন ভাষাসম্প্রদায়ের মধ্যে সকলেই যে সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে সেই ভাষা বলে (—অর্থাৎ নির্দিষ্ট ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করে)—তাহাও না হইতে পারে। মুখের কথা ধরিয়া বিচার করিলে ভাষাসম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৃহৎ সমাজে ব্যবহৃত ভাষায় অল্পবিস্তর বৈষম্য দেখা যায়। পাশাপাশি অঞ্চলে কথিত ভাষার এমন বৈষম্য সর্বদা খুব স্পষ্ট না হইতে পারে। কিন্তু একই ভাষাসম্প্রদায়ের দুই প্রত্যন্তে এক অঞ্চলের মুখের কথা অপর অঞ্চলের লোকে সহসা সম্পূর্ণভাবে বুঝিতে না পারা অসম্ভব নয়।
প্রথমত এবং প্রধানত ধ্বনিপরিবর্তনের মধ্য দিয়াই ভাষার রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়। সেই সঙ্গে শব্দের১ রূপে এবং শব্দের প্রয়োগেও পার্থক্য দেখা যায়। ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদের উদাহরণ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের (হুগলী অঞ্চলের) এবং পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের বরিশালের) কথ্যভাষার পার্থক্য বিচার করিয়া দেখি। পশ্চিমবঙ্গের যেখানে পাই [ক, ঘ, ড়, ঢ, ধ, ভ, স, হ] (যেমন—চাকর, ঘা, বাড়ী, ঢাক, ধান, ভাই, সে, হয়) পূর্ববঙ্গে২ সেখানে দেখি যথাক্রমে [হ, গ’, র, ড’, দ’, ব’, হ’, অ] (যেমন—চাহর, গ’া, বারী, ডা’ক, দা’ন, বা’ই, হে, ‘অয়)। পশ্চিমবঙ্গে—[তার, ভাই, ছিল, পেয়েছে, দিলে]; পূর্ববঙ্গে—[হের, বা’ই, আছিল, পাইছে, দিল]। পশ্চিমবঙ্গে— [ছেলে, সঙ্গে]; পূর্ববঙ্গে— [পোলা (বা ছাওয়াল), সাথে (বা লগে)]। পশ্চিমবঙ্গে— [দোকান করা]; পূর্ববঙ্গে— [দোকান দেওয়া]।
কোন ভাষাসম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলে বিশেষ প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা (Dialect) বলে। ভাষাসম্প্রদায়ে লোকসংখ্যা নিতান্ত অল্প হইলে সে ভাষার কোন উপভাষা পরিলক্ষিত হয় না, কেন না সকলের সঙ্গে সকলের বাগ্ব্যবহারে কোন আড়াল থাকে না। তাই উপভাষায় কোন ব্যক্তিবিশেষের উচ্চারণ-দোষ অথবা ভুল প্রয়োগ টিকিতে পারে না। কিন্তু ভাষাসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা খুব বেশি হইলে উপভাষার উদ্ভব অনিবার্য। কেন না সকলের সহিত সকলের মিশিবার এবং বাগ্ব্যবহার করিবার সুযোগ থাকে না, লোকে স্বভাবতই ছোট ছোট দলে ও পৃথক্ পৃথক্ অঞ্চলে গণ্ডীবদ্ধ হইয়া পড়ে। তাহারা বিশেষ বিশেষ সামাজিক রাষ্ট্রীয় কিংবা আর্থিক অবস্থায় নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং সেইহেতু পরস্পর মেলামেশার বেশি সুযোগ পায়, তাই তাহাদের গোষ্ঠীর অথবা অঞ্চলের ভাষায় (উচ্চারণে ও শব্দপ্রয়োগে) কিছু কিছু স্বতন্ত্রতা দেখা দিতে থাকে। এইভাবে ভাষা হইতে উপভাষার উৎপত্তি হয়।
অনেক সময় কোন ব্যক্তিবিশেষের (অথবা পরিবারবিশেষের) বাগ্ব্যবভারে ধ্বনি, শব্দ অথবা শব্দপ্রয়োগ বিষয়ে অল্পস্বল্প স্বতন্ত্রতা দেখা যায়। এমন ব্যক্তিনিষ্ঠ উপভাষাকে বলিতে পারি নিভাষা (Idiolect)১।
বিশেষ বিশেষ কারণে কোন উপভাষা-সম্প্রদায় তাহার মূল যে ভাষাসম্প্রদায় তাহা হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতে পারে। তখন সেই উপভাষা—কালক্রমে এবং সুযোগ পাইলে,—লোকসংখ্যা বাড়িলে, জীবিকা ও শিক্ষা সহজলভ্য হইলে, মনীষী লেখকের আবির্ভাব ঘটিলে অথবা ধর্মবাণীর বাহনরূপে গৃহীত হইলে,—নিজের পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া কালক্রমে নূতন ভাষা বলিয়া পরিগণিত হয়। জলপ্লাবন ভূমিকম্প দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক উৎপাতের ফলে অথবা অন্য কোন কারণে ভাষাগোষ্ঠীর কোন অংশ মূল স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া পড়িতে পারে। অথবা রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে কিছু পরিবারসমষ্টি কিংবা দল স্বদেশ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র উপনিবিষ্ট হইতে পারে। এইসব অবস্থায় ভাষাসম্প্রদায় বহুধা বিচ্ছিন্ন হইবার পথ পায়। একদা সমগ্র মধ্য-ইউরোপে জার্মানিক ভাষা প্রচলিত ছিল। এই ভাষাসম্প্রদায়ের একাধিকদল খ্রীস্টীয় পঞ্চম শতাব্দের কিছু পূর্বে বিচ্ছিন্ন হইয়া আসিয়া ইংলণ্ডে উপনিবিষ্ট হইয়াছিল। জার্মানিক ভাষাসম্প্রদায়ের এই বিচ্ছিন্ন দলের একটি উপভাষা নিজের পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ ভাষা ইংরেজীতে পরিণত হইয়াছে। জার্মানিক ভাষাসম্প্রদায়ের আর কয়েকটি দল বিচ্ছিন্ন হইয়া বিভিন্ন দেশে গিয়া আইসলাণ্ডিক নরওয়েজীয় সুইডিশ দিনেমার ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার সৃষ্টি করিয়াছে। যে-দল রহিয়া গেল তাহাদের উপভাষাই আধুনিক জার্মান ভাষায় পরিণত। এখন হইতে প্রায় হাজার তিনেক বৎসর আগে উত্তর-পশ্চিম হইতে আসিয়া আর্যভাষীগণ পূর্বভারতে বসতি করে। তাহাদের উপভাষাকে ‘প্রাচ্যা’ (বা পূর্বী প্রাকৃত) বলা যায়। এই প্রাচ্যাভাষীরা অঙ্গ বঙ্গ মগধ প্রভৃতি অঞ্চলে সন্নিবিষ্ট হয়। এই উপভাষা-গোষ্ঠীর কিছু জনসমষ্টি বাঙ্গালা দেশে বিভিন্ন দলে বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি করিয়াছিল। এক দলের সঙ্গে অপর দলের যোগসূত্র একেবারে বিচ্ছিন্ন না হইলেও প্রত্যেক দল কতকটা স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই স্বতন্ত্র দলগুলির বাগ্ব্যবহারে পূর্বী প্রাকৃতের সেই বিশেষ উপভাষাটির যে বিভিন্ন স্থানীয় রূপ উদ্ভূত হইয়াছিল তাহাই আধুনিক বাঙ্গালার উপভাষা-সমূহের জড়।
অনেক সময় দেখা যায় যে, কোন ভাষার অথবা উপভাষার একটি বিশেষ শব্দ বিশেষ বিশেষ অঞ্চলেই ব্যবহৃত হইতেছে। মানচিত্রে রেখা টানিয়া সেই শব্দটি ব্যবহারের স্থানগুলি নির্দেশ করিলে তাহাকে সমশব্দ-গণ্ডীরেখা (Isogloss) বলে। আর, এইরূপে রেখা টানিয়া কোন বিশেষ ধ্বনির ব্যবহার-স্থান সীমানির্দিষ্ট করিলে তাহাকে সমধ্বনি-গণ্ডীরেখা (Isophone) বলে। তেমনি পদের প্রত্যয়-বিভক্তির বেলায় বলা হয় সমরূপ-গণ্ডীরেখা (Isomorph)।
সমশব্দ-গণ্ডীরেখার উদাহরণ
(১) চন্দ্ৰবাচক শব্দ। কাশ্মীর, গাড়োয়াল, নেপাল, আসাম। কাশ্মীর—জুন, নেপাল—জুন, গাড়োয়ালী—জুন, অসমিয়া—জোন। শব্দগুলি সব সংস্কৃত ‘জ্যোৎস্না’ হইতে আগত।
(২) সূর্যবাচক শব্দ। পাঞ্জাব ও কাশ্মীর-অংশ। ভদরবাসী—দিহরো। পশ্চিমা পাঞ্জাবী-দেহূ পূর্ব পাঞ্জাবী—(প্রাচীন প্রয়োগ) দ্যু। শব্দগুলি সব ‘দিবস’ হইতে আগত।
সমধ্বনি-গণ্ডীরেখার উদাহরণ
[চ] [ছ] ধ্বনি ধরিলে, উচ্চারণে পূর্ববঙ্গের উপভাষাগুলি ও অসমিয়া— যথাক্রমে [ৎস] ও [স]।
সমরূপ-গণ্ডীরেখার উদাহরণ
বাঙ্গালা-অসমিয়া-উড়িয়া-মৈথিল-মগহী-ভোজপুরী—এই ভাষাগুলিতে অতীতে ও ভবিষ্যৎকালে যথাক্রমে [-ল] ও [-ব] বিভক্তি যুক্ত হয়।
ভৌগোলিক রাষ্ট্রিক সামাজিক ইত্যাদি কারণে যেমন এক ভাষা হইতে একাধিক উপভাষার উদ্ভব হইতে পারে তেমনি কোন একটি উপভাষা শক্তিশালী হইয়া অপর উপভাষাগুলিকে আওতায় ফেলিয়া দিয়া অথবা লুপ্ত করিয়া ভাষারূপে একচ্ছত্র হইতে পারে। ভাষাসম্প্রদায় যদি নিতান্ত ছোট হয়, অর্থাৎ যদি তাহাতে কোন উপভাষা না থাকে, তবেই সেটিকে বিশুদ্ধ কথ্যভাষা বলা যায়। কিন্তু এমন কথ্য ভাষা অশিক্ষিত ও সঙ্কীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ ভাষাসম্প্রদায়েই দেখা যায়। যে ভাষা বহুজনভাষিত এবং যাহাতে অল্প কিছুও স্থায়ী রচনা হইয়াছে তাহা কখনই পুরাপুরি মুখের ভাষা নয়। ইহা সেই ভাষাসম্প্রদায়ের সর্বজনব্যবহার্য ভাষা হইতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত মনের অনুশীলনের বাহিরে, ঘরে ও প্রতিদিনের কাজকর্মে, হুবহু এ ভাষা ব্যবহৃত হয় না। আমরা লিখি, আর শিক্ষিত সমাজে সভা-সমিতিতে বলিয়াও থাকি—‘আমি আসিয়া দেখিলাম যে, রামবাবু বসিয়া রহিয়াছেন’ কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপে, পশ্চিমবঙ্গে বলি,—‘আমি ঘরে এসে দেখলুম (বা দেখলাম) রামবাবু বসে রয়েচেন’। আমরা সাধারণত লিখিয়া থাকি— ‘কোথায় যাইতেছ?’ বাইরে কথাবার্তা বলি—‘কোথা যাচ্ছ?’ কিন্তু ঘরে বলিয়া থাকি, পশ্চিমবঙ্গে— ‘কোজ্জাচ্ছ’। এখানে আমরা ব্যবহার করিতেছি তিনটি বাক্-রীতি, একটি লেখ্যভাষার, একটি ভদ্রভাষার, আর একটি উপভাষার। যে ভাষাসম্প্রদায়ে একাধিক উপভাষা আছে সেখানে ভাষার—অর্থাৎ শিষ্টভাষার (ভদ্রসমাজে ও লেখাপড়ায় ব্যবহৃত ভাষার)—মূলে থাকে কোন একটি বিশেষ উপভাষা। তবে তাহাতে অপর উপভাষার শব্দ ও ইডিয়ম থাকিতে কোন বাধা নাই। কিন্তু সব উপভাষা হইতে উপাদান চুনিয়া লইয়া ভাষা-তিলোত্তমা গড়া হয় না, বিশেষ একটি উপভাষাই প্রবল ও বহুব্যবহৃত হইয়া অপর উপভাষাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়া একচ্ছত্র হয়। যে-সব কারণে কোন একটি উপভাষা ভাষার মর্যাদা পাইতে পারে তাহার মধ্যে প্রধান হইল সেই উপভাষায় সাহিত্যের সৃষ্টি ও অনুশীলন। বড় কবির, বড় মনীষীর রচনা যে ভাষায় লেখা হইয়াছে, পাঠক-শ্রোতার এবং পরবর্তী কবি ও লেখকদের উপর সে ভাষার (অথবা উপভাষার) প্রভাব অনিবার্য। আর একটি বড় কারণ হইল সেই উপভাষা-সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় অথবা বাণিজ্যিক প্রাধান্য। দেশের প্রধান প্রধান শহরে সব অঞ্চলের লোক জীবিকার ও শিক্ষা ইত্যাদির জন্য আসিয়া ভিড় জমায়। তাই সেই শহরের উপভাষা ক্রমবর্ধমান হইয়া অপর উপভাষাগুলিকে ক্রমশই কোণঠেসা করিতে থাকে। সভাশোভন বলিয়াও লোকে রাজধানীর উপভাষা অনুশীলন করে, এবং রাজধানী অঞ্চলের অধিবাসী বলিয়া পরিচিত হইবার আকাঙক্ষায় লোকে—সেখানকার উপভাষাকে মাতৃভাষার আসনে বসাইতে চায়। এইভাবে রাজধানীর ও ব্যবসায়-কেন্দ্রের উপভাষা নিজের সীমানা চারিদিকে ক্রমশ প্রসারিত করিতে থাকে। এমনি করিয়াই পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় অঞ্চলের উপভাষা বাঙ্গালায় সাধুভাষা হইয়াছিল। এই সূত্রেই কলিকাতা অঞ্চলের উপভাষা আজ সমস্ত শিক্ষিত বাঙ্গালীর ভদ্র কথ্যভাষা (চলিত ভাষা) হইয়াছে। প্রাচীন বাঙ্গালার অনেক গ্রন্থকর্তা পশ্চিমবঙ্গের লোক ছিলেন, সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা (অথবা উপভাষাগুচ্ছ) স্বাভাবিক কারণে সাহিত্যে প্রাধান্য পাইয়া আসিয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দের শুরু হইতে গদ্য রচনার আরম্ভ এবং সেই সূত্রে বাঙ্গালা ভাষায় আধুনিক সাহিত্যের উদ্ভব। ঊনবিংশ শতাব্দের শক্তিশালী লেখকগণ প্রায় সকলেই কলিকাতার অথবা নিকটবর্তী স্থানের অধিবাসী কিংবা কলিকাতায় শিক্ষাপ্রাপ্ত, সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা সঙ্গত কারণেই সাধুভাষাকে প্রভাবিত করিয়াছে। কিন্তু তাই বলিয়া এ কথা বলিলে চলিবে না যে, অন্য উপভাষার ছাপ পশ্চিমবঙ্গের লেখ্য ভাষায় কিছুই পড়ে নাই। ষোড়শ শতাব্দের কয়েকজন বিশিষ্ট কবি শ্রীহট্ট ও চাটিগাঁ অঞ্চলের লোক ছিলেন। ইহাদের রচনার মধ্য দিয়া সেই সেই অঞ্চলের উপভাষার পদ বেশ কিছু আসিয়া গিয়াছে। আমরা মুখে বলি— [কর্ছি], লিখি—[করিতেছি)। [কর্ছি] পদের মূল [করিতেছি] পদ নয়। এটি পূর্ববঙ্গের উপভাষার পদ। ইহা হইতে পূর্ববঙ্গের কোন কোন আধুনিক উপভাষায় [কইর্তেছি] ও [কর্ত্যাছি] আসিয়াছে। অতএব বাঙ্গালা সাধুভাষা [করিতেছি] পদটি পূর্ববঙ্গের উপভাষা হইতে আগত।
আধুনিক সময়ে শিক্ষিত সমাজে বাঙ্গালা কথ্য ভাষার একটি বিশিষ্ট রূপ দাঁড়াইয়া গিয়াছে। ইহাকে চলিত ভাষা (Standard Colloquial) বলা হয়।১ রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথ চৌধুরী ও তাঁহাদের অনুগামী লেখকেরা তাঁহাদের রচনায় কথ্যভাষা চালাইয়াছেন। সাহিত্যের বাহন হিসাবে এই কথ্যভাষা এখন সাধুভাষাকে হটাইয়া দিতেছে। এই সাহিত্যিক কথ্যভাষার মূলে রহিয়াছে কলিকাতার উপভাষা এবং তাহারও গোড়ায় আছে দামোদর ভাগীরথী মধ্যবর্তী ভূভাগের—সেকালের মধ্য ও দক্ষিণ রাঢ়ের—বৃহত্তর উপভাষা (বা উপভাষাগুচ্ছ)। কলিকাতার প্রাচীনতর বাসিন্দাদের মধ্যে, এবং পরবর্তী কালে আগতদের মধ্যেও, মধ্য এবং দক্ষিণ রাঢ়ের অধিবাসীরাই প্রধান এবং বিশিষ্ট ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দের শেষভাগ হইতে কলিকাতা বাঙ্গালা দেশের প্রধান নগরে এবং রাষ্ট্র-সমাজ-শিক্ষা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। উনবিংশ শতাব্দের প্রথম হইতে ইহা বাঙ্গালা সংস্কৃতিরও কেন্দ্র হইয়া উঠে। সুতরাং কলিকাতার আচার-ব্যবহার ও বেশ-ভূষার মতো উপভাষার প্রভাবও কখনো একেবারে নিষ্ক্রিয় নয়। এই প্রভাবে কলিকাতার কথ্যভাষা কিছু কিছু পরিবর্তন লাভ করিতেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে অল্পবয়স্কদের মুখে [দিলে, খেলে]—এইরূপ সকর্মক ক্রিয়া [-এ]-বিভক্তিযুক্ত পদের স্থলে পূর্ববঙ্গসুলভ [দিল, খেল] ইত্যাদি [এ]-বিভক্তিহীন পদ শুনিতে পাওয়া যায়। [দিলাম, খেলাম] ইত্যাদি [-লাম]-বিভক্ত্যন্ত পদ [দিলুম, খেলুম] প্রভৃতি (-লুম]-বিভক্ত্যন্ত পদকে দ্রুত অপসারিত করিয়া দিতেছে; স্বাধীনতা লাভের পর হইতে উত্তরপূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষাসম্প্রদায়ের আরও উলটপালট আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। লক্ষ লক্ষ উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ নিবাসী এখন পশ্চিমবঙ্গে উপনিবিষ্ট। তাহার ফলে বাঙ্গালার উপভাষা-সংস্থানে বিপর্যয় অপেক্ষিত॥
২. মিশ্র-ভাষা
আধুনিক কালের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে যে, প্রয়োজনের তাগিদে দুইটি সম্পূর্ণভাবে অসম্পৃক্ত ভাষাসম্প্রদায় সাময়িক অথবা স্থায়ী ভাবে সহাবস্থিত হইবার ফলে পরস্পর মিশ্রণে কাজচালানো গোছের সরল ও সংক্ষিপ্ত বাক্রীতি উৎপন্ন করিয়াছে। এমন ভাষাকে বলা হয় মিশ্রভাষা (Jargon বা Mixed Language)। মিশ্রভাষার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই চারিটি—বীচ-লা-মার (Beach-La-Mar অথবা Beche-La-Mar), পিজিন বা পিজিন ইংরেজী (Pidgin অথবা Pidgin English), মরিশাস ক্রেওল (Mauritius Creole) এবং চিনুক (Chinook Jargon)। ইউরোপীয় (ইংরেজী অথবা ফরাসী) ভাষাকে স্থানীয় ভাষাসম্প্রদায়ের বোধগম্য ও ব্যবহারযোগ্য করিবার অশিক্ষিত চেষ্টার ফলে এই মিশ্রভাষাগুলি উদ্ভূত। এগুলির মূলস্থানীয় ভাষার শব্দের বারো আনাই ইউরোপীয়, চার আনা অথবা তাহারও কম দেশী। বাক্রীতি শিশুদের মতো, যেন-তেন-প্রকারেণ অর্থদ্যোতক। তবুও তাহাতে ব্যাকরণের একপ্রকার অপরিস্ফুট ঠাট দেখা যায়। সে ঠাটে স্থানীয় ভাষার বাক্রীতি যথাসম্ভব অনুসৃত।
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বীচ-লা-মার (Beach-La-Mar) ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এ-ভাষার শব্দসংখ্যা বেশি নয় এবং তাহা প্রায় সবই ইংরেজী, সামান্য কিছু স্পেনীয় ও পোর্তুগীস। শব্দের রূপভেদ নাই। কর্তা-কর্ম একবচন-বহুবচন স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গ—সব একপ্রকার । যেমন, ‘আমি’—me, ‘আমরা’—me two fella, me threc fella, plenty me ইত্যাদি; ‘আমার বাবা’—papa belong me; ‘সে আমার বোন’—that woman she brother belong me। ক্রিয়ার কাল-রূপ নাই, পুরুষ ও বচন ভেদ তো দূরের কথা। বিশেষ বিশেষ শব্দযোগে অতীত ও ভবিষ্যৎ কাল বোঝায়। যেমন, ‘সে খাইতেছে’—he kaikai; ‘সে সব খাইয়াছে’ he kaikai all finish; ‘আমার ক্ষুধা পাইয়াছে’—my belly no got kaikai; ইত্যাদি।
পিজিন ইংরেজী (Pidgin English) নামটির ‘পিজিন’ অংশ আসিয়াছে business শব্দের বিকৃত চীনা উচ্চারণ হইতে। সুতরাং নামটির অর্থ হইল ‘কেজো ইংরেজী’। পিজিন চীনে বহু-প্রচলিত, এবং জাপানে ও আমেরিকায় (ক্যালিফর্নিয়ায়) অপ্রচলিত নয়। অষ্টাদশ শতাব্দের মধ্যভাগের পূর্বেই এই মিশ্রভাষার সূত্রপাত হইয়াছিল। পিজিনে ইংরেজী ও চীনা ছাড়া অন্য ভাষারও শব্দ কিছু আছে। সে-সব শব্দ ইংরেজীর মারফত আসিয়াছে। চীনা ভাষায় ‘র’ নাই, তাই ‘র’ স্থানে ‘ল’। অন্যথা ভাষার ঠটি বীচ-লা মারেরই মতো। উদাহরণ, ‘আমি কালের চাকর’—My belong consoo boy; ‘তুমি ভাল আছে?’—you belong plopel?
মরিশাস ক্রেওল (Mauritius Creole) মরিশাসের শিষ্ট ভাষা ফরাসী হইতে উৎপন্ন। অনধ্যুষিতপূর্ব মরিশাস দ্বীপ প্রথমে ফরাসীরা অধিকার করে (১৭১৫) এবং মাদাগাস্কার হইতে প্রচুর নিগ্রো দাস সেখানে লইয়া যায়। সেই নিগ্রোদের সঙ্গে বাক্ব্যহারের ফলে ক্রেওলের উদ্ভব। ১৮১০ খ্রীস্টাব্দে দ্বীপটি ইংরেজের অধিকারে আসে। তাহার পর ইংরেজ ভারতবর্ষ এবং অন্যস্থান হইতে প্রচুর মজুর আমদানি করিতে থাকে। ক্রেওল ভাষা কিন্তু অপরিবর্তিত রহিয়া যায়। ক্রেওলের শব্দ প্রায় সবই ফরাসী, তবে সে-সব শব্দের বানান প্রায়ই ফরাসী ভাষায় প্রচলিত বানানের মতো নয়। ব্যাকরণ যতদূর সম্ভব সরল। পদে একবচন-বহুবচন ভেদ নাই। কারকবিভক্তি নাই। ক্রিয়ারূপও অদ্বৈত। বিশেষ বিশেষ শব্দের দ্বারা ক্রিয়ার অতীত ও ভবিষ্যৎ কাল জ্ঞাপিত হয়। অনেক সময় শব্দ ও ক্রিয়া অভিন্নরূপ। উদাহরণ, ‘আমার বাড়ি’— mo lakxé; ‘আমি খাইব’ — mo va manzé; ‘আমি খাইয়াছিলাম’— mo te manzé; ‘আমি খাইয়াছি’—mo fine manze ইত্যাদি।
চিনুক মিশ্র-ভাষা (Chinook Jargon) উত্তর আমেরিকার ওরেগনে উৎপন্ন ও ব্যবহৃত। এ ভাষা নুটকা চিনুক প্রভৃতি আদিম আমেরিকান ভাষা এবং ইংরেজী এই দুই-তরফের শব্দযোগে গঠিত। কিছু কিছু ফরাসী শব্দও আছে। ইংরেজী শব্দের অপরিচিত ধ্বনি আমেরিকান ভাষার উচ্চার্য রূপ লইয়াছে এবং আমেরিকান ভাষার অপরিচিত ধ্বনি ইউরোপীয় ভাষার উচ্চার্য রূপ লইয়াছে। যেমন, ‘তিন’—মূল আমেরিকান ভাষায় [ত্খ্লোন] চিনুক মিশ্র-ভাষায় [ক্লোন্]; ‘শুষ্ক’—ইংরেজী dry, চিনুক মিশ্র-ভাষায় [ত্লই] অথবা [দেলই]; ‘মেষ’—ফরাসী le mouton (ল মূতঁ), চিনুক মিশ্র-ভাষায় [লেমুতো] ব্যাকরণ নাই বলিলেই হয়।
আন্তর্জাতিক রাজধানীগুলিতে এবং অন্যত্র যেখানে নানা দিগ্দেশ হইতে লোকসমাগম হয় সেখানেই কেনাবেচার জন্য ছোটখাটো মিশ্র-ভাষার অস্তিত্ব হয়। কিছুকাল আগেও এমনি এক মিশ্র-ভাষা শোনা যাইত কলিকাতায় হগ্ (মিউনিসিপাল) মার্কেটে। ইংরেজী-না-জানা বাঙ্গালী দোকানদারেরা বিদেশী ক্রেতাদের গাঁথিতে যে অদ্ভুত ভাষাপাশ নিক্ষেপ করিত তাহাকে বাঙ্গালা-ইংরেজী মিশ্র-ভাষা বলা যায়। বাঙ্গালী দোকানদার বলিতে চায়—‘নাও বা না নাও, একবার দেখ তো।’ মিশ্র-ভাষার ছন্দোবন্ধে বাক্যটি দাঁড়াইল— [টেক্ টেক্ নো টেক্ নো টেক্ একবার তো সী]॥
৩. অপভাষা
এক ভাষাগোষ্ঠীর (অথবা উপভাষা সম্প্রদায়ের) ব্যক্তি যদি ভালো করিয়া না শিখিয়া অপর ভাষা (অথবা অপর উপভাষা) ব্যবহার করে তবে উচ্চারণে ও শব্দপ্রয়োগে বিকৃতি ও ভ্রমপ্রমাদ অবশ্যম্ভাবী। এমন অবস্থায় বিকৃত ও ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ বাগ্ব্যবহার অপভাষা (অথবা অপ-উপভাষা) বলা যায়। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে আগত বিদেশীরা সংস্কৃত ভাষার ধ্বনি ব্যবহারে খুব পটু ছিল না। সেইজন্য তাঁহাদের সংজ্ঞা দাঁড়াইয়াছিল ম্লেচ্ছ১ (অর্থাৎ অপভাষী)। উচ্চারণের দিক্ দিয়া বিচার করিলে ভারতবাসী আমরা ইংরেজী ভাষার সম্পর্কে অল্পবিস্তর অপভাষী অর্থাৎ ম্লেচ্ছ॥
৪. অপশব্দ
যে শব্দ উপভাষায় মূল ভাষার রূপ হইতে বিকৃত অথবা কিছু পরিবর্তিত হইয়াছে এবং যাহা সাহিত্যে অপ্রযুক্ত তাহাকে বলে অপশব্দ।১ বাঙ্গালায় অপশব্দ যেমন, [ভাইগ্গ] (মূল—ভাগ্য), [কুন্ঠে] [মূল—কোন্ স্থিতে অর্থাৎ কোথা থেকে]। সাধুভাষায় ব্যবহৃত [গাভী] ও চলিত ভাষায় ব্যবহৃত [গাই) ও [গোরু) সংস্কৃতের [গো] শব্দের দৃষ্টিতে অপশব্দ॥
৫. ইতর ও খণ্ডিত শব্দ
যে শব্দ বা পদ ভদ্রলোকের কথ্যভাষায় ও লেখ্য ভাষায় প্রয়োগ হয় না এবং যাহার উৎপত্তি কোন ব্যক্তিবিশেষের অথবা দলবিশেষের হীন ব্যবহার হইতে তাহাই ইতর শব্দ (Slang)। ইতর-শব্দ কালক্রমে ভদ্রভাষায় স্থান পাইতে পারে, লুপ্তও হইতে পারে। ইতর-শব্দের উদাহরণ,—পটল তোলা (=মরা), হাতানো (=আত্মসাৎ করা), গুল মারা (=মিথ্যা খবর দেওয়া), ইত্যাদি। খণ্ডিত-শব্দ (Clipped Word) হইল ছাঁটা, ইতর অথবা সাধারণ শব্দ। যেমন মাইক (=মাইক্রোফোন), বাইক (=বাইসাইকেল) ফোন (=টেলিফোন)॥
৬. অপার্থ-ভাষা ও সংকেত-ভাষা
গোপনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে দলের লোকের কাছে প্রকাশ্যে অন্যের অবোধ্য অথচ প্রয়োজনীয় সংলাপ স্বাভাবিকভাবে চালাইবার জন্য বিশেষ বিশেষ (এক বা একাধিক ভাষা হইতে গৃহীত) শব্দ বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এরকম বাগ্ব্যবহারকে অপার্থ-ভাষা (Cant) অথবা সংকেত-ভাষা (Code Language) বলা হয়। প্রাচীন বাঙ্গালা চর্যাগীতিতে অনেক সময় বিশেষ বিশেষ শব্দ নিজ অর্থ ছাড়াও বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইতে দেখা গিয়াছে। চর্যাগীতির প্রাচীন টীকাকার এইরকম অপার্থ-শব্দ ব্যবহারকে সন্ধাবচন বা সন্ধাভাষ বলিয়াছেন। প্রহেলিকাও এইরকম সন্ধাভাষ। দুর্বৃত্তদের সংঘে এমন বাগ্ব্যবহার অনেকদিন হইতে সবদেশেই চলিত আছে। ঠগীরা নিজেদের মধ্যে যে অপার্থ-ভাষা ব্যবহার করিত তাহার নাম ছিল রামসিয়ানা (অর্থাৎ রাম-চালাকি)। দুর্বৃত্তদের ব্যবহারে একই ভাষার অপার্থ-শব্দ একই অর্থবহ না হইতে পারে। যেমন [খোকা]—হত্যাকারী গুণ্ডাদের কাছে ‘পিস্তল’ বা ‘রিভলবার’, নেশাখোর চোরদের কাছে ‘গাঁজা’॥
৭. কৃত্রিম ভাষা
যে ভাষার শব্দ ও পদ মনগড়া সেই হইল কৃত্রিম ভাষা। কৃত্রিম ভাষা দুই রকমের। এক কোন নির্দিষ্ট দলের মধ্যেই ব্যবহৃত গোপন ভাষা, আর সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য প্রকাশ্য ভাষা। প্রথম রকমের কৃত্রিম ভাষা সংকেত-ভাষার মধ্যে পড়ে। ছোট ছেলেদের সংকেত-ভাষা—পদের ধ্বনি বিপর্যয় করিয়া অথবা পদের আদিতে বিশেষ ধ্বনি যোগ করিয়া অন্যের সমক্ষে অথচ তাহাদের অগোচরে বার্তা বিনিময়—ইহার উদাহরণ। যেমন, [মআ বিখা?] অথবা [চাম চিখাবি?] অর্থাৎ ‘আম খাবি?’
ইউরোপে শিক্ষিত লোকের ব্যবহারযোগ্য সর্বজনীন ভাষার সম্ভাবনার প্রথম স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়াছিলেন বিখ্যাত মনীষী দেকার্ত (Descartes) ১৬২৯ খ্রীস্টাব্দে। তাহার পর অনেকেই এ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা জার্মানভাষী পাদরি শ্লেয়েরে (Sehleyer) আবিষ্কৃত (উনবিংশ শতাব্দের শেষ পাদে) ভোলাপ্যুক (Volapuk)। এ ভাষার শব্দ প্রধানত ইংরেজী লাটিন ও লাটিনজাত ভাষা হইতে গৃহীত, আর ব্যাকরণ জার্মান ভাষার অনুকরণে গঠিত। ভোলাপ্যুক আবিষ্কারের বছর দশের মধ্যে উন্নততর সর্বজনীন ইউরোপীয় ভাষা গঠন করিলেন পোল্যাণ্ডের অধিবাসী ডাক্তার জামেনহফ (Zamenhof)। এ ভাষার নাম এস্পেরান্টো (Esperanto)। এ ভাষার গঠন অতি সহজ, ধ্বনিও সরল। শব্দভাণ্ডারের মূলধন হইল গ্রীক লাটিন ও লাটিন-জাত এবং জার্মানিক শাখার ভাষা হইতে গৃহীত শব্দ ও ধাতু। নিম্নের উদাহরণ হইতে এস্পেরাণ্টোর সহজবোধ্যতা বোঝা যাইবে।
La intelligenta persono lernas la interlingvon Esperanto rapide kaj facile.
ইংরেজী অনুবাদ,
The intelligent person lernas the inter- language Esperanto rapidly and easily.
শব্দগুলি ইংরেজী ফরাসী জানা ব্যক্তি সহজেই চিনিতে পারিবেন। কেবল kaj শব্দটি গ্রীক [kai]॥
৮. লিপির কথা
মুখের কথা মনের ভাব যাহাতে স্থানকালের গণ্ডী পার হইয়া স্থায়ী রূপ পায় সে চেষ্টা মানুষ বহু সহস্রাব্দ ধরিয়া করিয়া আসিয়াছিল। তাহার ফলে সভ্য সমাজে লিপির উৎপত্তি। অসভ্য সমাজে তাহা হয় নাই, কেন না অন্তরের যে প্রয়োজনে মানুষের প্রকাশবেদনা অনুভূত হয় সে প্রয়োজন তাহাদের হয় নাই। ভাষাকে স্থায়িত্ব দিবার আবশ্যকতা অসভ্য জীবনে অননুভূত।
লিপির উদ্ভবে ও উন্নতিতে কয়েকটি সুস্পষ্ট স্তর বা সোপান লক্ষ্য করা যায়। আদিম স্তরে দেখা দিয়াছিল চিত্রাঙ্কন-প্রবৃত্তি। দশ বারো হাজার বছর আগেকার মানুষ (এবং এখনকার দিনেও যে মানবগোষ্ঠী সেই প্রাগৈতিহাসিক মানসিক অবস্থায় রহিয়াছে তাহারাও) ছবি আঁকিয়া উল্লেখযোগ্য বস্তু ও ঘটনাকে প্রকাশ করিত (এবং করে)। দেশবিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্বত-গুহার গায়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের আঁকা ছবি পাওয়া গিয়াছে। সে সব ছবি মানুষের, জন্তুর ও মানুষ কর্তৃক জন্তুশিকারের। আধুনিক কালে মানুষের অনুন্নত সমাজেও এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে। উত্তর আমেরিকার আদিম অধিবাসী রেড্ ইণ্ডিয়ানদের এইরকম স্মারক আলেখ্যপদ্ধতি সুবিদিত। কোন ঘটনার বা বিষয়ের স্মারক হিসাবে চিত্রাঙ্কন ছাড়া অন্য পদ্ধতিও কোন কোন দেশে চলিত ছিল। (আমাদের এ দেশে কোন বিশেষ কর্তব্য স্মরণে রাখিবার জন্য মেয়েদের আঁচলে ও পুরুষদের কোঁচার খুঁটে গিঁট দেওয়া এখনো একেবারে অজানা নয়।) দক্ষিণ আমেরিকায় পেরু দেশের প্রাচীন অধিবাসীরা রেড ইণ্ডিয়ানদের মতো নানারঙের দড়ির গুছিতে গিঁট বাঁধিয়া বিশেষ বিষয় ও ঘটনা নথিভুক্ত করিত। এই পদ্ধতির নাম কুইপু (Quipu) অর্থাৎ গ্রন্থিলিখন।
লিপির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের প্রথম সোপানে পাই উপরে উল্লিখিত আলেখ্য ও স্মারকচিত্র পদ্ধতি। দ্বিতীয় সোপানে চিত্রলিপি (Pictogram) এবং ভাবলিপি (Ideogram)। এ স্তরে কোন বস্তু বুঝাইতে তাহার সম্পূর্ণ ছবি না দিয়া শুধু সেটির রেখাচিত্র ব্যবহৃত হইত। রেখাচিত্রের দ্বারা ভাবও বুঝানো যাইত। যেমন, পড়িয়া যাওয়া বুঝাইতে হেলানো দেওয়াল, বহন করা অর্থে মাথায়-বোঝা মানুষ, রাত্রি বুঝাইতে অর্ধবৃত্তের নীচে তারা। ভাবলিপি ও চিত্রলিপি হইতে তৃতীয় সোপান সহজেই আরূঢ় হইয়াছিল। রেখাচিত্রটি ভাবলিপি অবস্থায় যে বস্তু বা যে বিষয় বুঝাইত এখন তৃতীয় সোপানে তাহা সেই বস্তু ও বিষয় জ্ঞাপক শব্দ (অর্থাৎ ধ্বনিগুচ্ছ) নির্দেশ করিতে লাগিল। তখন রেখালিপি হইল শব্দলিপি (Phonogram)। প্রাচীন মিশরের চিত্রপ্রতীক (Hieroglyph) লিপি ও প্রাচীন চীনের লিপি এই পর্যায়ের। একটি উদাহরণ দিই। প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় [খেস্তেব] শব্দের অর্থ ছিল গাঢ় রঙের নীলা। [খেস্] শব্দের নিজস্ব অর্থ আটকানো, [তেব্] শব্দের নিজস্ব অর্থ শূকর। এই ছবি দুইটি মিলাইয়া চিত্রলিপি,—একটা লোক শূয়ারের লেজ ধরিয়া টানিতেছে—হইল [খেস্তেব্], শব্দলিপিতে।
চতুর্থ সোপানে শব্দচিত্রের রেখা সংক্ষিপ্ত ও সাঙ্কেতিক হইয়া আদলে দাঁড়াইল এবং শব্দলিপিটি সমগ্র ধ্বনিসমষ্টিকে না বুঝাইয়া শুধু আদ্যধ্বনি নির্দেশ করিতে লাগিল। এই ব্যাপারকে বলে শীর্ষনির্দেশ (Acrology)। আদ্যধ্বনি নির্দেশের ফলে শব্দলিপি পরিণামে হইল অক্ষরলিপি (Syllabic Script)। যেমন, প্রাচীন মিশরীয়ে যাহা ভাবলিপিরূপে বুঝাইত চিল [আহোম], এবং শব্দলিপিরূপে [আহোম] এই ধ্বনিসমষ্টি তাহা অক্ষরলিপিরূপে শুধু [আহোম] অক্ষরটিকে বুঝাইতে লাগিল। পঞ্চম সোপানে অক্ষরলিপির শেষ পরিণাম হইল, ধ্বনিলিপি (Alphabetic script)। যেমন প্রাচীন মিশরীয় সিংহীর [লাবোই) ছবি শব্দলিপিতে হইল [লাবোই] এই ধ্বনিসমষ্টির দ্যোতক, অক্ষরলিপিতে হইল [লা] এই আদ্য অক্ষরের (Syllable-এর) প্রতীক, এবং সব শেষে গ্রীক-রোমান ধ্বনিলিপিতে [ল্] এই একক ধ্বনি বা বর্ণ (Letter)।
গ্রীক-রোমান লিপি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বনিমূলক বর্ণমালা। ভারতীয় লিপি অংশত ধ্বনিমূলক এবং অংশত অক্ষরমূলক। যেমন [অ] ধ্বনিমূলক অক্ষর, কিন্তু [ক] (=ক্অ) অক্ষরমূলক।
প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যজগতের লিপিমালা এই চারটি সুপ্রাচীন লিপিপদ্ধতি হইতে উদ্ভূত: (১) সুমেরীয়-মিশরীয় চিত্রলিপি, (২) সম্ভাব্য ভারতীয় চিত্রলিপি, (৩) চীনীয় চিত্রলিপি, এবং (৪) মেসোপটেমীয় বাণমুখ (Cuneiform) চিত্রলিপি। শেষের পদ্ধতি খ্রীস্টপূর্ব সহস্রাব্দ শেষ হইবার পূর্বেই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
মেসোপটেমীয় লিপিচিত্র (বাঙ্গালায় অর্থসমেত)
প্রাচীন পারসীক যাণমুখ লিপি (বাঙ্গালায় লিপ্যন্তর সমেত)
সুমেরীয়-মিশরীয় লিপিচিত্র হইতে পরবর্তী কালের ইউরোপীয় বর্ণমালাগুলি এবং আরামীয় হিব্রু আরবী প্রভৃতি বিভিন্ন সেমীয় বর্ণমালাগুলি উৎপন্ন। মিশরীয় লিপিচিত্রের আদিম রূপ (Hieroglyphic) হইতে সংক্ষিপ্ত বা শিষ্ট (Hieratic) লিপি আসিয়াছিল।
মিশরীয় লিপিচিত্র
(বাঙ্গালায় লিপান্তর ও অর্থসমেত) ডানদিক হইতে পড়িতে হইবে।
সেকালের বাণিজ্যপরায়ণ ফিনিসীয়রা এই সংক্ষিপ্ত শিষ্ট মিশরীয় লিপিকে নিজেদের ভাষার উপযোগী পরিবর্তন করিয়া গ্রহণ করিয়াছিল। পরবর্তী কালে এই ফিনিসীয় লিপি হইতে একদিকে গ্রীক ও তাহা হইতে রোমান প্রভৃতি ইউরোপীয়, এবং অপরদিকে আরামীয়-হিব্রু-আরবী প্রভৃতি সেমীয় বর্ণমালা উৎপন্ন।
ফিনিসীয় লিপি
(বাঙ্গালায় লিপ্যন্তর ও অর্থসমেত। ডানদিক হইতে পড়িতে হইবে)
চীনীয় লিপিচিত্র হইতে আধুনিক চীনীয় ও জাপানী লিপি উৎপন্ন।
ভারতবর্ষের প্রাচীনতম লিপিমালা দুইটি—খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী—অশোকের অনুশাসনে প্রথম পাওয়া যাইতেছে। ব্রাহ্মী বাম হইতে ডাহিনে, খরোষ্ঠী ডাহিন হইতে বামে লিখিতে হয়। খরোষ্ঠী সেমীয় লিপি হইতে উৎপন্ন। ব্রাহ্মীর উৎপত্তি সম্বন্ধে মতভেদ আছে। ব্যুলার (Buchler) প্রভৃতি পণ্ডিতের মতে ইহাও মূলত সেমীয়। কিন্তু এই মতের বলবৎ প্রমাণ মিলে নাই। বর্তমান শতাব্দের তৃতীয় দশকের গোড়ায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক আবিষ্কৃত সুপ্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নাবশেষের মধ্যে প্রাচীন লিপিচিত্রযুক্ত সীল পাওয়া গিয়াছে। যদি কখনো দ্বিভাষিক প্রত্নলিপি আবিষ্কৃত হয় তবেই তাহার সাহায্যে এই লিপিগুলির নিঃসংশয়িত পাঠোদ্ধার হইবে এবং তখনই প্রমাণিত হইবে ব্রাহ্মী লিপির বীজ ইহাতে আছে কিনা। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর (অর্থাৎ অশোকের সময়ের) ব্রাহ্মী লিপি স্থানকালের পরিবর্তনের মধ্য দিয়া আসিয়া আধুনিক ভারতীয় এবং পূর্ব-এসীয় বিবিধ লিপিমালায় পরিণত হইয়াছে। বাঙ্গালা দেশে অশোক-লিপির সমকালের অর্থাৎ খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর একটি শিলালেখ পাওয়া গিয়াছে। একটি অশোক শিলালিপির চিত্র ও পাঠ উপরে উদ্ধৃত হইল।
ভারতবর্ষে প্রচলিত সমস্ত লিপিমালা এবং ভারতবর্ষের বাহিরে প্রচলিত কয়েকটি লিপিমালা—সিংহলী তিব্বতী বর্মী সিয়ামী যবদ্বীপী কোরীয় ব্রাহ্মী হইতে উৎপন্ন। গুপ্ত-শাসনকালে ব্রাহ্মী লিপি ভারতের পূর্বাঞ্চলে যে রূপ পাইয়াছিল তাহাকে কুটিল লিপি বলা হয়। এই কুটিল লিপি হইতে বাঙ্গালা লিপির উদ্ভব। খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দেই বাঙ্গালা বর্ণমালা নিজস্ব রূপ গ্রহণ করিয়াছিল।
অশোকের ব্রাহ্মী লিপি (বাঙ্গালা লিপ্যন্তর সমেত)
ষষ্ঠ শতাব্দের কুটিল লিপি (আধুনিক লিপ্যন্তর সমেত)
দ্বাদশতাব্দের বাঙ্গালা লিপি॥
—
১. শব্দ হইল অর্থবান ধ্বনিসমষ্টি। শব্দের সমষ্টি হইল বাক্য অর্থাৎ ভাষা।
২. [’] চিহ্ন দ্বারা কণ্ঠনালীর স্পৃষ্টধ্বনি—পূর্ববঙ্গের কথ্যভাষার হ-কারের পরিবর্তে ব্যবহৃত—দ্যোতিত হয়। উচ্চারণ যথাক্রমে চ, ছ, জ, পশ্চিমবঙ্গে অনেকটা ইংরেজী ch, chh (যেমন churchlousc), j*এর মতো, কিন্তু পূর্ববঙ্গে ts, s, dz (ৎস, স, জ) রূপে উচ্চারিত হয়।
১ ‘নিভাষা’ সংঞ্জাটি “নিজভাষা” হইতে তৈয়ারি করিলাম।
১ বাঙ্গালা সাধু ও চলিতভাষার বিস্তৃততর আলোচনা পরে দ্রষ্টব্য।
১ ম্লেচ্ছ শব্দটির মৌলিক অর্থ অবোধ্য বাগ্ব্যবহারকারী।
১ এই অর্থে পতঞ্জলি তাঁহার মহাভাষ্যে ‘অপশব্দ’ কথাটি ব্যবহার করিয়াছেন।