এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – উপন্যাস – হুমায়ূন আহমেদ
০১.
ভাদ্র মাস।
মেঘ বৃষ্টির কোনো ঠিক নেই। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। মাহফুজ বিরক্ত মুখে হাঁটছে। তার বাঁ হাতে ভারী একটা স্যুটকেস। এমন ভারী যে মনে হয় স্যুটকেসসহ হাত ছিঁড়ে পড়ে যাবে। ডানহাতে ছাতা। এখন রোদ নেই, সূর্য বড় এক খণ্ড মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সহজে বের হবে না। তারপরও ছাতাটা মাথায় ধরা। মাহফুজ মাঝেমধ্যেই চিন্তিত চোখে ডানহাতের স্যুটকেসের দিকে তাকাচ্ছে। স্যুটকেসের হাতলের অবস্থা সুবিধার না। হাত না ছিড়লেও যে-কোন মুহূর্তে হাতল ছিঁড়ে যেতে পারে। স্যুটকেস এত ভারী কেন তা মাহফুজের মাথায় ঢুকছে না। কাপড়-চোপড়ের বদলে কি সীসা ভরা হয়েছে? মেয়েদের এই সমস্যা তারা যখন স্যুটকেস গোছায় তখন স্যুটকেস ভারী হচ্ছে কিনা হালকা হচ্ছে এইসব মনে থাকে না, কারণ এই স্যুটকেস হাতে নিয়ে তাদের হাঁটতে হয় না। মাহফুজ পেছনে ফিরে সীসাভরা স্যুটকেসের মালিকের দিকে তাকাল। মালিক না– মালেকাইন, উনিশ-কুড়ি বছরের তরুণী। নাম চিত্রা।
মেয়েটা কেমন গুটগুট করে হাঁটছে। যেন হেঁটে খুব মজা পাচ্ছে। মেয়েটার চেহারা তেমন কিছু না। দশে চার দেয়া যায়। কিন্তু এখন তাকে বেশ ভাল দেখাচ্ছে। গায়ের রং আগের মতো ময়লা লাগছে না। ট্রেন থেকে নেমেই কোনো এক ফাঁকে মুখে পাউডার-ফাউডার দিয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। টিউবওয়েলে যখন মুখ ধুতে গেল তখনই মনে হয় কাজটা সেরেছে। চোখে যে কাজল দিয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। ট্রেনে আসার সময় চোখ ছিল ছোট ছোট, এখন এত বড় বড় হবে কেন? বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তো আর, বড় হয় না। আচ্ছা, শাড়িও বদলেছে না-কি? শাড়িটাও তো সুন্দর। সবুজের মধ্যে শাদা ফুল। এই মেয়ে দেখি সাজগোজে ওস্তাদ। এক ফাঁকে মুখে কোনো একটা কারুকাজ করেছে। ওমি খুঁটেকুড়ানি থেকে রাজরাণী।
একটু আগেই আকাশ মেঘলা ছিল এখন আঁ করে রোদ উঠে গেছে। যে মেঘ রোদ ঢেকে রেখেছিল সেও নেই। আকাশ ঘন নীল। ভাদ্রমাসের চিকন রোদ চামড়া ভেদ করে শরীরের রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নেশা হয়ে যায়। কেউ যদি ভাদ্রমাসের রোদে কিছুক্ষণ থাকে সে আর রোদ ছেড়ে আসতে চায় না।
মাহফুজের মাথায় ছাতা। মেয়েটা রোদের মধ্যেই হাঁটছে। ছাতার নিচে আসার জন্যে মাহফুজ তাকে ডাকছে না। আগবাড়িয়ে এত খাতির দেখাবার কিছু নেই। এই টাইপের মেয়েদের খাতির দেখালে বিপদ আছে, প্রথমে কোলে চেপে বসে, কোল থেকে ঘাড়ে, ঘাড় থেকে মাথায়। একবার মাথায় চড়লে কার সাধ্য মাথা থেকে নামায়। এদের রাখতে হয় শাসনে।
মাহফুজ ভাই!
মাহফুজ বিরক্ত মুখে পেছন ফিরল। তার বিরক্তির প্রধান কারণ মেয়েটার গলার স্বর ভাল না। খসখসা। মেয়েদের গলার স্বর হবে চিকন। চট করে কানের ভেতর ঢুকে যাবে। এই মেয়ের গলার স্বর এমন যে চট করে কানের ভেতর ঢুকবে না। কানের ফুটার কাছে কিছুক্ষণ আটকে থাকবে। তাছাড়া, ভাই ব্রাদার, ডাকার দরকার কী? এত খাতির তো হয় নি। মাহফুজ মেয়েটার উপর রাগতে গিয়েও রাগতে পারল না।
মেয়েটার হাঁটা সুন্দর। গুটুর গুটুর করে হাঁটছে। শাড়িটা পরেছে ভদ্রভাবে। মাথায় ঘোমটা দেয়ায় বউ-বউ লাগছে। এটা অবশ্যি ঠিক না। যে বউ না, সে কেন বউ সাজবে? সাজ পোশাকের মধ্যে যদি এরকম কোনো ব্যবস্থা থাকত যে সাজ দেখে ধরা যেত কে কী রকম মেয়ে তাহলে ভাল হত। কুমারী মেয়েদের একরকম পোশাক, সধবাদের একরকম পোশাক, খারাপ মেয়েদের একরকম পোশাক। আগে নিয়ম ছিল খারাপ মেয়েরা পায়ে কিছু পরতে পারবে না। তারা সাজসজ্জা সবই করবে শুধু পা থাকবে খালি। পায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে মেয়েটা কোন পদের। আজকাল বোধ হয় এইসব নিয়ম নেই।
মাহফুজ চিত্রার পায়ের দিকে তাকাল। লাল ফিতার স্যান্ডেল পরেছে। আচ্ছা পরুক। এই মেয়ে তো স্যান্ডেল পরতেই পারে। সে নিশ্চয়ই পাড়ার মেয়েদের মতো না। স্যান্ডেল জোড়া মনে হয় নতুন চকচক করছে। কালো মেয়ের পায়ে লাল স্যান্ডেল খুব মানায় তো!
তিয়াস লেগেছে। পানি খাব।
মাহফুজ বিরক্ত গলায় বলল, পথের মধ্যে পানি কই পাব? নৌকায় উঠে নেই। ঘাটলায় যাই, তারপর পানি
ঘাটলা কত দূর?
দূর নাই।
ঘাটলা দূর আছে এখনো প্রায় এক পোয়া মাইল। রিকশা পাওয়া যায়। রিকশায় যাওয়া যেত। স্টেশন থেকে নাও-ঘাটা পাঁচ টাকা ভাড়া। মাহফুজের কাছে টাকা আছে। স্কুল ফান্ডের টাকা। এই টাকা হুটহাট করে খরচ করা যায় না। তাছাড়া রিকসা নিলে দুটা রিকসা নিতে হয়। সে নিশ্চয়ই ঝপ করে এই মেয়ের সঙ্গে এক রিকসায় উঠে পড়তে পারে না।
নৌকায় কতক্ষণ লাগে?
তিন চার ঘন্টা।
এতক্ষণ লাগে?
এতক্ষণ কই দেখলে, নৌকায় পাটি পাতা আছে। শুয়ে ঘুম দিবে। ঘুম ভাঙলে দেখবে সোহাগীর ঘাটে নৌকা বাঁধা।
আপনাদের জায়গাটার নাম সোহাগী?
হু। ছাতাটা একটু ধর তো আমি সিগারেট খাব।
চিত্রা এগিয়ে এসে ছাতা ধরল। চিত্রা মেয়েটার নকল নাম। এই টাইপের মেয়েরা নকল নাম নিয়ে ঘুরেফিরে বেড়ায়। আসল নাম কেউ জানে না। আসল নাম জিজ্ঞেস করলে অন্য একটা নাম বলে সেটাও নকল।
মাহফুজ সিগারেট ধরাল। তার সিগারেট ধরানোটা উদ্দেশ্যমূলক। চিত্রা মেয়েটা রোদে কষ্ট পাচ্ছে। সিগারেট ধরাবার উছিলায় ছাতাটা তার হাতে পার করে দেয়া। মুখে বলতে হল না- নাও, ছাতা নাও। বললে মেয়েটা বলবে, জ্বি না লাগবে না। সে তখন বলবে- আহা নাও না। কথা চালাচালি হবে। কী দরকার? ছোট ট্রিকসের কারণে আপসে ছাতা তার হাতে চলে গেল। মাহফুজের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ছাতা সে ধরবে কী ভাবে? তার তো আর হনুমানের মতো লেজ নেই যে লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে ছাতা ধরে রাখবে।
চিত্রাকে নৌকায় উঠিয়ে মাহফুজ গেল চায়ের দোকানে। চায়ের তৃষ্ণা হয়েছে- এককাপ চা খাবে। মেয়েটাকে এককাপ চা পাঠাবে। মাটির কলসিতে করে ঠাণ্ডা এক কলসি পানি আর গ্লাস নিতে হবে। ভাদ্রমাসে ঘন ঘন পানির তৃষ্ণা হয়। পথে খাওয়ার জন্যেও কিছু নিতে হবে। চিড়া-মুড়ি। ভাতের ক্ষিধে চিড়া-মুড়ি দিয়ে দূর হবে না। উপায় কী? ডাল-চাল নিয়ে গেলে হয়। নৌকায় চুলা থাকে, মাঝিকে বললেই খিচুড়ি বেঁধে দেবে। তেল মশলা আর লাকড়ির দাম ধরে দিলেই হবে।
চায়ের দোকানের মালিকের নাম নিবারণ। মাহফুজের চেনা লোক। ঠাকরোকোনা এলেই নিবারণের দোকানে চা খায়। দুপুরে ভাত খায়। ভাত খাবার পর ভাতঘুমের ব্যবস্থা আছে। দোকানের পেছনে পাটি পেতে শুয়ে থাকা। মাহফুজ শুয়ে থাকে। চা দোকানের এক ছেলে তালপাখা দিয়ে বাতাস করে। মাথা বানিয়ে দেয়। যতক্ষণ ঘুম ততক্ষণ বাতাস। ফাঁকে ফাঁকে মাথা বানানো। ওস্তাদ ছেলে। একই সঙ্গে বাতাস করা এবং মাথা বানানো সহজ ব্যাপার না।
নিবারণ গ্লাসভর্তি চা মাহফুজের সামনে রাখতে রাখতে বলল, সাথের কইন্যাটা কে?
মাহফুজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, দূর সম্পর্কের বোন হয়। তার জন্যেও চা পাঠাতে হবে! চা আর একটা লাঠি-বিসকুট।
বোন শহরে থাকে?
হু।
কলেজে পড়ে?
হু।
বিবাহ হয়েছে?
না।
মেয়েটা বড়ই সৌন্দর্য।
মাহফুজ হাই তুলতে তুলতে বলল, নিবারণ কাউকে নিয়ে মাথা ধরার টেবলেট আনিয়ে দাও, মাথা ধরেছে।
মাহফুজের সত্যি সত্যি মাথা ধরেছে। পরপর এতগুলো মিথ্যা কথা বলার জন্যেই মাথা ধরেছে। মিথ্যা বলার কোনো দরকার ছিল না। সত্যি কথাটা বলে ফেললেই হত।
মিথ্যা হলো শয়তানের বিয়ের মন্ত্র। মিথ্যা বললেই শয়তানের বিয়ে হয়। বিয়ে হওয়া মানেই সন্তানসন্ততি হওয়া। একটা মিথ্যার পর আরো যে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হয় এই কারণেই। পরের মিথ্যাগুলো শয়তানের সন্তান। এইসব মাহফুজের কথা না, তার দাদীজানের কথা। মাহফুজের দাদী আতরজান সবসময় বলতেন- মিথ্যা কথা কইলে কি হয় জানস? শয়তানের বিবাহ হয়। শয়তানের স্ত্রীর গর্ভে শয়তান শিশুর জন্ম হয়। এই জন্যেই একটা মিথ্যা কথা কইলেই সাথে আরো তিনটা চাইরটা মিথ্যা বলতে হয়। সেই মিথ্যাগুলো হইল শয়তানের সন্তান। বুঝছস কিছু?
দাদীজানের গল্পের কারণে মাহফুজ ছেলেবেলায় যখনি মিথ্যা কথা বলেছে– আতংকে শিউরে উঠেছে সর্বনাশ, শয়তানের বিয়ে হয়ে গেল। এক্ষুণি তাদের ছেলেপুলে হওয়া শুরু হবে। সেই আতংকের ছায়া এখনো খানিকটা আছে। ছোটবেলায় মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সহজে বের হয় না।
মিথ্যা বললে সঙ্গে সঙ্গে কিছু কঠিন সত্য কথা বলে শয়তানের বিয়ে ভেঙে দিতে হয়। এও দাদীজানের শেখানো বুদ্ধি। মাহফুজ বিরস মুখে শয়তানের বিয়ে ভাঙার প্রস্তুতি নিল। সত্যি কথা বলতেই হবে।
নিবারণ।
জ্বে।
আমার দূর সম্পর্কের যে খালাতো বোনের কথা বললাম না– কলেজে পড়ে?
জ্বে।
আসলে কলেজে পড়ে না। বিয়ে-শাদি দিতে হবে এই জন্যে বাড়ায়ে বলা। বুঝতে পারছ?
জ্বে পারছি। না বোঝার কিছু নাই। এই সব মিথ্যা বলা যায়। এত ভগবান দোষ ধরেন না।
মেয়েটা নাটক করে। সোহাগীতে টিপু সুলতান প্লে হচ্ছে এই মেয়ে সুফিয়ার পার্ট করবে। এরা খুবই দরিদ্র। নাটক করে টাকা যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে।
ভাইজান, মেয়েটা তো খুবই সৌন্দর্য।
সৌন্দর্য কি দেখলা। গায়ের রং ময়লা।
ঠিক বলছেন- সৌন্দর্যের আসল জিনিসটা নাই– রং ময়লা। ভগবানে সব এক লগে দেন না। কিছু দেন। কিছু হাতে রেখে দেন।
মাহফুজের মাথা ধরা কমে গেছে। তারপরেও নিবারণের এনে দেয়া প্যারাসিটামল দুটা খেয়ে ফেলল। রোগ হবার আগেই অষুধ খেয়ে রাখা, যাতে দীর্ঘ যাত্রাপথে মাথা না ধরতে পারে। টুকটাক দু একটা জিনিস কেনা দরকার। টর্চের ব্যাটারি, মোমবাতি। এই দুটা জিনিস ময়মনসিংহ থেকে কিনলে সস্তা পড়ত। এত কিছু কেনা হয়েছে এই দুটা জিনিস কেন কেনা হল না কে জানে।
ভাইজান, চা আরেক কাপ দিব?
দাও।
চা খেতে ইচ্ছা করছে না, তারপরেও খাওয়া। মাহফুজের ধারণা তার জ্বর আসছে। কোনো কিছুই ভাল লাগছে না। চায়ে চুমুক দিতেই জিহ্বায় সর আটকে গেল। বমি ভাব হল। বমি ভাব হলেও খাওয়ার জিনিস নষ্ট করা যায় না।
দাদীজান বাঁশের চোঙায় খটখট করে সুপুরি হেঁচতে হেঁচতে বলতেন- মানুষ যখন খাওয়া-খাইদ্য খায় তখন তার পায়ের কাছে কে বইস্যা থাকে ক দেহি? শয়তান বইস্যা থাকে, আর কানের কাছে কুমন্ত্রণা দেয়- খাইস নারে ভাত খাইস না। পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠ্যা আয়। লক্ষীমনা পাতের ভাত সব শেষ করনের কোনো দরকার নাই। কুমন্ত্রণা শুইন্যা মানুষ পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠা যায়। তখন শয়তানের খুশির সীমা থাকে না। বাহাতুরটা দাঁত বাইর কইরা হাসে। মানুষের দাঁত বত্রিশ, শয়তানের বাহার। শয়তান দাঁত বাইর কইরা ক্যান হাসে জানস? হাসে কারণ হইল পাতের প্রত্যেকটা না খাওয়া ভাত রোজ হাশরে সঙ্কুরটা কইরা সাপ হইয়া দংশন করব। বুঝছস?
চায়ের কাপে দুই চুমুক দিয়ে রেখে দিলে কী হবে? যে চা খাওয়া হয় নাই সেই চা কি সাপ হয়ে দংশন করবে? আতরজান বেঁচে থাকলে মাহফুজ জিজ্ঞেস করত। তিনি গত বৎসর ইন্তেকাল করেছেন। শয়তানের গল্প বলার মানুষটা আর নেই। না থাকলেও সুপুরি হেঁচার শব্দটা তিনি রেখে গেছেন। মাহফুজ বাঁশের চোঙ্গায় সুপুরি হেঁচার শব্দ প্রায়ই পায়। খট খট, খট খট– কে যেন সুপুরি ভেঁচছে। এই তো শব্দটা হচ্ছে। ঠিক মাহফুজের মাথার ভেতর থেকেই শব্দ আসছে। স্পষ্ট শব্দ। আশে পাশে কেউ থাকলে তারো শোনার কথা। খট খট, খট খট, খট খট।
চা খাওয়া যাচ্ছে না। পেটের ভেতর পাক দিতে শুরু করেছে। মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, নিবারণ একটা পান আনায়ে দাও, কাঁচা সুপারি। শরীরটা জুত লাগতেছে না।
জর্দা?
না, জর্দা না।
আফনের ইস্কুলের কি অবস্থা?
এই শীতে ইনশাল্লাহ্ বিল্ডিংয়ের কাজ ধরব। রাজমিস্ত্রী বলা আছে।
একবার গিয়া দেইখ্যা আসব।
আস, দেইখ্যা যাও। এখন একবার দেখ। চাইর বছর পরে আরেকবার দেখ। কিছুই চিনবা না। গ্রামের মধ্যে পাকা সড়ক।
পাকা সড়ক?
অবশ্যই পাকা সড়ক। পুলাপানের খেলার জন্যে শিশুপার্ক। গ্রামের চাইরদিক ঘেইরা লাগাইছি রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই গাছগুলা হইল গ্রামের সীমানা। চাইর বছর পর গাছে যখন ফুল ফুটব তখন মনে হইব লাল ফিতা দিয়া গ্রাম বন্ধন করা হয়েছে।
বাহ।
অসুখবিসুখ হলে কোনে চিন্তাই নাই। গ্রামের মধ্যেই চিকিৎসালয়। পাস করা ডাক্তার।
চাইর বৎসরের মইধ্যে এইসব হইব?
অবশ্যই।
কাঁচা সুপারির পান চলে এসেছে। পান মুখে দিয়ে মাহফুজ সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়াটা ভাল লাগছে না, মাথা ঘুরাচ্ছে। জ্বর বোধ হয় এসেই পড়ল। না খেয়ে সিগারেটটা যদি ফেলে দেয় তাহলে কী হবে? রোজ হাশরে কি এই সিগারেট কাঁকড়া-বিছা হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরবে?
মাহফুজ উঠে পড়ল। দাম দিতে গিয়ে এক বিপত্তি, নিবারণ দাম নেবে না। এই ঝামেলা নিবারণ সবসময় করে। মাহফুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যবসা করতে বসেছ। দানের অফিস তো খোল নাই।
নিবারণ হাসিমুখে বলল, সবের সাথে ব্যবসা করি না। আফনের সাথে ব্যবসা নাই। আচ্ছা দেন, হাফ দাম দেন।
মাহফুজ হাফ দাম দিয়ে ঘাটলার দিকে রওয়ানা হল। রোদ এমন তেজী যে চোখ জ্বালা করছে। মাহফুজ ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না, এলোমেলো পা পড়ছে। জ্বর মনে হয় চেপে আসছে। দাদীজান মাথার ভেতর বসে ক্রমাগত পান ঘেঁচে যাচ্ছেন। বুড়ি ভাল যন্ত্রণা শুরু করেছে। আরো দুটা প্যারাসিটামল খেয়ে ফেললে হত। পানির পিপাসাও হচ্ছে। অথচ এই একটু আগেই পানি খেয়েছে।
কে, মাহফুজ না?
জ্বি।
কি হইছে তোমার এমন কইরা হাঁটছ কেন?
কিছু হয় নাই।
তোমার স্কুলের খবর কি?
ইনশাল্লাহ এই শীতে কাজ শুরু হবে।
ইটা কিননের আগে আমার সাথে যোগাযোগ করবা।
জ্বি আচ্ছা।
ইসকুল ঘরের জন্যে ইটা। একটা পাবলিক কাজ। কোন লাভ রাখব না। এক নম্বরী ইটা দিব তয় একটা কথা বাকি না। খরিদ করবা নগদ পয়সায়। এক নম্বুরী ইটা বাইশ শ হাজার।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না।
চউখতো দেখি লাল টুকটুকা।
দাড়িওয়ালা রোগা লোকটাকে মাহফুজ চিনতে পারছে না। লোকটা কে? বিড়ালের মতো চোখ। চোখে সুরমা। গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। লোকটা কথা বলছে পরিচিত ভঙ্গিতে। নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ। মাহফুজ চিনতে পারছে না কারণ এই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর দাদীজান বসে সুপুরি হেঁচছেন। মহিলা যখন এই কাণ্ডটা করেন তখন ঘোরের মতো লাগে।
মাহফুজ মনে মনে বলল, পান ছেঁচা বন্ধ কর দাদী। অনেক সুপারি খাইছ আর না।
আতরজান বললেন, কাজটা ভালো করস নাইরে আবু। কাজটা মন্দ করছস।
কোন কাজটা মন্দ করছি?
মেয়েটার নিয়া আসলি। খারাপ পাড়ার খারাপ মেয়ে।
কে বলছে খারাপ মেয়ে?
আমি জানি।
সে খারাপ হইলেও কিছু যায় আসে না। আমার তো তারে দরকার নাই। আমার দরকার তার কাজ।
তিন চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে সব সময় ঘুরে। বড় সাবধান।
শয়তান ঘুরে কেন?
যে মন্দ তার পিছে কোনো শয়তান থাকে না। হে এমেই মন্দ। তার শয়তান দরকার নাই। যে যত ভালো তার পিছনে তত শয়তান। তোর সাথে আছে চাইরটা। খুব সাবধান।
দাদীজান, পান ছেঁচা বন্ধ করবা? অসহ্য!
যে চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে ঘুরতাছে তার মধ্যে দুইটা নারী দুইটা পুরুষ। তুই একটা মিথ্যা কথা বলবি আর লগে লগে এরার বিবাহ হইব। শয়তান সংখ্যায় বাড়ব।
চুপ কর।
আমি তো চুপ কইরাই থাকতে চাই। তোর জন্যে মন কান্দে বইল্যা পারি না। তোর শইল দেখি বেজায় খারাপ।
হুঁ খারাপ। তুমি পান ছেঁচা বন্ধ কর।
মহিলা পান ছেঁচা বন্ধ করল না। প্রবল উৎসাহে বুড়ি পান ছেচছে। মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে খট খট, খট খট, খট খট।
.
নৌকা ছেড়েছে সকাল এগারোটায়।
এখন বাজছে বারোটা দশ। নৌকার ইনজিন থেকে বিকট শব্দ আসছে। ইনজিনের নৌকায় চিত্রা আরো চড়েছে, কখনো এত শব্দ হতে শুনে নি। শুধু শব্দ না, শব্দের সঙ্গে পেট্রোলের গন্ধ, ধোয়ার গন্ধ বিশ্রী অবস্থা। মাঝে মাঝে কুচকুচে কালো তেল জাতীয় কী যেন ইনজিন থেকে ছিটকে চারদিকে পড়ছে। ইনজিন চালাবার দায়িত্বে আছে নদশ বছর বয়েসী একটা ছেলে। ইনজিন থেকে তেল ছিটার ঘটনা যতবার ঘটছে ততবারই সে আনন্দে দাঁত বের করে দিচ্ছে। পর মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় বলছে– ইনজিল গরম হইছে গো। নৌকার যে হাল ধরে আছে সে বলছে, বেশি গরম? ছেলেটা আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলছে, মিডিয়াম গরম। তখন মাঝি চোখমুখ কুঁচকে ইনজিনকে কুৎসিত একটা গালি দিচ্ছে ইনজিনের মাকে সে কী করবে তা নিয়ে গালি। গালির অর্থ বুঝতে পারলে ইনজিনের খুবই রাগ করার কথা।
চিত্রা ইনজিন থেকে দূরে থাকার জন্যেই নৌকার প্রায় মাথায় বসে আছে। রোদ খুবই কড়া। চিত্রা মাথায় ছাতা ধরে আছে। মনে হচ্ছে ছাতাও রোদ আটকাতে পারছে না।
মাঝি বলল, ছাত্তিটা গাঙের পানিতে ভিজাইয়া লনগো আফা। মজা পাইবেন।
ছাতা রোদ আটকাবার জন্যে। এর মধ্যে মজা পাবার কী আছে কে জানে। চিত্রা পানিতে ছাতা ভিজিয়ে নিল। তেমন কোন মজা পাওয়া যাচ্ছে না। ভেজা ছাতা থেকে পানি গড়িয়ে শাড়িতে পড়ছে- শাড়ি নোংরা হচ্ছে এটাই রোধ হয় মজা।
চিত্রা নদীর দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো কোন দৃশ্য না। কিছু মানুষ মাছ মারছে। জাল ফেলছে, তুলছে– জালে কোন মাছ দেখা যাচ্ছে না। ক্লান্তিকর কাজটা তারা করেই যাচ্ছে।
নদীর পানিতে মহিষ নামানো হচ্ছে। গরুকে গোসল দেয়া হচ্ছে। কিছু ছেলেপুলে পানিতে ঝাপাঝাপি করছে। ঘুরেফিরে একই দৃশ্য। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ ক্লান্ত হয়। চোখ ক্লান্ত হলেই মন ক্লান্ত হয়। তখন ঘুম-ঘুম পায়। তবে নদীর দুধারেই প্রচুর কাশফুল ফুটেছে। দূর থেকে কাশফুল দেখতে ভাল লাগছে। চিত্রার সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে সে অবশ্যই কাশফুলের ছবি তুলতো। সস্তা ধরনের একটা ক্যামেরা তার আছে। সে যখন বাইরে যায়, ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে যায়। এবারই শুধু আনা হয় নি কারণ ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া যায় নি। চিত্রার ধারণা তার মা ক্যামেরাটা গোপনে বিক্রি করে দিয়েছেন। মহিলা এই ধরনের কাজ প্রায়ই করেন। ঘরের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে দেন। কাজটা নিরুপায় হয়েই তাঁকে করতে হয়। তারপরও চিত্রার ভাল লাগে না। ক্যামেরাটা তার খুব শখের ছিল। মহিলাকে যদি সে জিজ্ঞেস করে- মা ক্যামেরা বিক্রি করলে কেন? সেই মহিলা তখন খুবই ওজনদার কোন কথা বলবেন। ওজনদার কথা বলতে এই মহিলা খুব পছন্দ করেন। ওজনদার কথা বলবার সময় তিনি আবার চোখে চশমা পরে নেন। চশমা পরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলার স্বরও বদলে যায়।
চিত্রার আসল নাম- মেহের বানু। ডাক নাম বানু। তার নাটকের নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা থেকে চিত্রা। নাটকের জন্যে সুচিত্রা নাম তার মায়ের রাখা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। মফঃস্বল থেকে কেউ যখন তাকে নিতে আসে তখন তার মা চোখে চশমা পরে গম্ভীর ভঙ্গিতে পার্টির সঙ্গে কথা বলতে বসেন। পার্টির বয়স যাই হোক, তিনি কথা শুরু করেন তুমি সম্বোধনে।
বুঝছ বাপধন, আমার মেয়ের ভাল নাম সুচিত্রা। সুচিত্রা-উত্তমের সুচিত্রা। তার অভিনয় যখন দেখবা তখন বুঝবা নাম তার সার্থক। বৃক্ষরে যদি জিজ্ঞাস কর বৃক্ষ তোমার নাম কি? বৃক্ষ বলে– ফলে পরিচয়। আমার কন্যারও ফলে পরিচয়।
কয়েকটা কথা বাপধন তোমারে আগেভাগে বলি– সুচিত্রারে তোমরা দিবা এক হাজার এক টেকা। পুরা টেকা আমার হাতে বুঝাইয়া তারপর তারে নিবা। বাকির নাম ফাঁকি। টাকা আছে? আন নাই? পরে দিবা? আইচ্ছা তাইলে যাও। আল্লাহ হাফেজ।
এই বলেই তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেন। অর্থাৎ তার কথা শেষ। পার্টি যদি বলে টাকা তারা এনেছে তবে এত আনে নাই- একটু কমাতে হবে তখন তিনি আবারও চশমা পরেন আবারও কথাবার্তা শুরু হয়। আবারও এক পর্যায়ে কথা বন্ধ হয়। তিনি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলে দুঃখিত গলায় বলেন, শোন বাপধন, আমি কি মাছ বেচতে বসছি? আমি মাছের একটা দাম বললাম, তুমি বলো আরেকটা। শুরু হইল মূলামূলি। সুচিত্রারে তোমার নেওনের দরকার নাই। তুমি মাছ-হাটা থাইক্যা একটা চিতল মাছ কিইন্যা লইয়া যাও। এই দামে তুমি ভাল চিতল মাছ পাইবা। নয়া আলু আর টমেটো দিয়া চিতল মাছ বড়ই স্বাদ।
একসময় দরদাম ঠিক হয়। চিত্রার মা পার্টির হাত থেকে টাকা নিয়ে গুনতে বসেন। খুশি খুশি গলায় বলেন- ও চিত্রা ইনারারে চা দে। হুদা মুখে বইস্যা আছে। পার্টি যত আপত্তিই করুক চা না খেয়ে তারা উঠতে পারে না। চা খাবার সময় তিনি নানান ধরনের মজার মজার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজনীয় কিছু কথাও সেরে নেন- একটা কথা বলতে ভুইল্যা গেছি বাপধন। আমিও কিন্তু মেয়ের সঙ্গে যাব। আমার জোয়ান মেয়ে আমি একলা ছাড়ব না। তোমরার উপরে আমার বিশ্বাস আছে। দেইখ্যাই বুঝতেছি তোমরা ভালোমানুষের পুলাপান। আমার মেয়ের উপরে বিশ্বাস নাই। দুইটা জিনিসরে বিশ্বাস করণ নাই- জোয়ান কন্যা আর কালসর্প। আমার কথা না বই পুস্তকের কথা।
.
চিত্রার মা চিত্রাকে কখনো একা ছাড়েন নি। এখন ছাড়ছেন কারণ এখন তার মেয়ের সঙ্গে আসার উপায় নেই। তার বা পায়ে কী যেন হয়েছে- পা মাটিতে ছুঁয়াতে পারেন না। অসহ্য যন্ত্রণা। ওষুধপত্রে এই যন্ত্রণা কমে না– শুধু যখন সিগারেটের শুকা ফেলে সেখানে গাঁজা পাতা ভরে টানেন তখন ব্যথা সহনীয় পর্যায়ে আসে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মেডিকেল কলেজের ভাল ডাক্তার। তিনি বলেছেন– হাসপাতালে ভর্তি হতে। হাঁটু পর্যন্ত কেটে বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া আর কোন চিকিৎসা নেই। চিত্রার মা রাজি হন নি। তিনি রাগি গলায় চিত্রাকে বলছেন– রোজ হাশরের দিন আমি আল্লাহপাকের সামনে এক ঠ্যাং নিয়া খাড়ামু? তুই কস কি? সবেই হাসতে হাসতে দৌড় দিয়া বেহেশতে ঢুকব আর আমি ল্যাংটাইতে ল্যাংচাইতে যামু?
তুমি বেহেশতে যাইবা?
অবশ্যই।
বেহেশতে যাওনের মতো সোয়াব তুমি করছ?
না, করি নাই। আল্লাহপাক তোর-আমার মতো না। তাঁর দিল বড়। পাপী লোক তার সামনে দাঁড়াইয়া একবার যদি বলে ভুল করছি মাপ দেন। তিনি মাপ দিবেন।
.
চিত্রার মাথার উপর দিয়ে দুটা বক ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। সে চমকে উঠল বকের ডাক শুনে। কী বিকট শব্দ। এমন সুন্দর পাখি! কী সুন্দর ধবধবে শাদা রং অথচ তার গলার স্বর ভয়াবহ। বকের ডাকে শুধু যে চিত্রা চমকে উঠেছে তা না, সঙ্গের মানুষটাও চমকে উঠেছে। মানুষটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল। এখন উঠে বসেছে। অদ্ভুতভাবে চারদিকে দেখছে। মানুষটার শরীর মনে হয় খারাপ। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো হেলতে দুলতে এসে নৌকায় উঠল। চোখ টকটকে লাল। একটা চোখে পানি পড়ছে। নৌকায় উঠেই লোকটা শুয়ে পড়েছে। এতক্ষণ সে একবারও মাথা তুলে নি। বকের ডাকে এই প্রথম মাথা তুলল। লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তাকে চিনতে পারছে না। জ্বর খুব বেশি হলে এরকম হয়। চেনা মানুষকে অচেনা লাগে। আবার অচেনা মানুষকে মনে হয় খুব চেনা কেউ। চিত্রা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অসুস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে না। তার মা বিছানায় শুয়ে কাতরায়। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে সে মার ঘরে ঢুকে না। ঘরে ঢুকলেই হোসনে আরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। অভিশাপ দেন। কঠিন সব অভিশাপ। চিত্রা তাতে চিন্তিত হয় না কারণ মার অভিশাপ কখনো সন্তানের গায়ে লাগে না। দোয়া গায়ে লাগে অভিশাপ লাগে না। হাঁসের গায়ের পানির মত অভিশাপ ঝরে পড়ে যায়।
গতকাল ঘর থেকে বের হবার সময় হোসনেআরা কঠিন কিছু অভিশাপ দিলেন। চাপা গলায় বললেন, নিজের মারে এই অবস্থায় ফালাইয়া তুই রওয়ানা হইছস?
চিত্রা বলল, হুঁ। না যদি যাই উপাস থাকবা।
হোসনেআরা তখন কুৎসিত কিছু গালি দিলেন। গালির বিষয় হচ্ছে আশ্বিন মাসে মেয়েকুকুরের শরীর গরম হয়, সে তখন খুঁজে পুরুষ কুকুর। তার কন্যার শরীর সব মাসেই গরম থাকে। সে অভিনয় করার জন্যে যায় না। সে যায় শরীর ঠাণ্ডা করতে। সে আশ্বিন মাইস্যা কুকুরী না- সে বার মাইস্যা কুকুরী।
চিত্রা শান্ত মুখে গালি শুনেছে। তারপর বলেছে- মা, আমি ব্যবস্থা করে গেছি– তুমি ঠ্যাং কাটায়ে নিও।
হোসনেআরা তখন ভয়াবহ চিৎকার শুরু করলেন। চিত্রা মাকে এই অবস্থায় রেখে চলে এসেছে। সে যে-ব্যবস্থা করে এসেছে তাতে মনে হয় ঠ্যাং আজ কাটা হবে। মতি মামাকে বুঝায়ে দিয়ে এসেছে। হাতে টাকা পয়সা দিয়ে এসেছে। যে ডাক্তার ঠ্যাং কাটবেন চিত্রা তার সঙ্গেও কথা বলেছে। ডাক্তার সাহেবের কী সুন্দর চেহারা। হাসি খুশি। এই লোক মানুষের ঠ্যাং কাটে ভাবাই যায় না।
কাটা ঠ্যাং ডাক্তাররা কী করেন? ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দেন? না-কি কবর দেয়া হয়?
ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। চিত্রা মাথা ঘুরিয়ে দেখল। লোকটা পানি খাচ্ছে। প্লাস্টিকের জগভর্তি পানি উঁচু করে মুখে ধরেছে। পানি গড়িয়ে লোকটার পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। চিত্রা বলল, আপনার শরীর খারাপ? লোকটা পানির জগ মুখ থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণে জন্যে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আবার পানি খেতে শুরু করল। চিত্রার প্রশ্নের জবাব দিল না।
চিত্রা বলল, আপনার কি জ্বর এসেছে?
লোকটা বলল, হু।
চিত্রা এগিয়ে গেল। একজন অসুস্থ মানুষের কাছে এগিয়ে যাওয়া যায়। কপালে হাত রেখে তার জ্বর দেখা যায়। এতে দোষের কিছু নেই। জ্বর খুব বেশি হলে মাথায় পানি ঢালতে হবে। সেটাও কোন সমস্যা না। তারা পানির উপর দিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়ালেই পানি।
চিত্রা কপালে হাত রাখতে গেল। মাহফুজ একটু সরে গিয়ে বলল, গায়ে হাত দিও না।
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমার কি কুষ্ঠ হয়েছে যে আপনার গায়ে হাত দিতে পারব না?
মাহফুজ বলল, দরকার কী?
চিত্রা বলল, দরকার আছে।
জ্বর বেশি বললে কম বলা হয়- মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরে গ্যাসের একটু চুলা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। চুলার আগুনে চামড়ার নিচের রক্ত ফুটছে।
চিত্রা বলল, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন- আমি মাথায় পানি ঢালব।
মাহফুজ বলল, বাজে ঝামেলা করবে না। দরকার নাই।
দরকার আছে কি-না আমি দেখব। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
মাহফুজ নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলল, তোমার নাম কি?
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, নাম জিজ্ঞেস করেন কেন? নাম তো জানেন। চিত্রা।
চিত্রা তো নকল নাম। আসল নাম কি?
আসল নাম, নকল নাম– কোনটায়ই আপনার দরকার নাই। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
তুমি পড়াশুনা কতদূর করেছ?
অল্প অ-আ জানি।
কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ? এত কথা বলছেন কেন? আপনাকে-না শুয়ে থাকতে বললাম।
মাহফুজ ঘোর পাওয়া মানুষের মতো আবারও একই প্রশ্ন করল তুমি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?
ক্লাস টেন।
সায়েন্স না আর্টস?
আর্টস।
ভাল হয়েছে। তুমি আমাদের স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিতে পারবে।
আপনি শুয়ে পড়েন।
জ্বি আচ্ছা।
চিত্রা হকচকিয়ে গেল। মানুষটা জ্বি আচ্ছা বলছে কেন? জ্বর যখন খুব বাড়ে তখন শরীরের তাপ মাথার মগজে ঢুকে যায়। তখন মানুষ অদ্ভুত কথা বলে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে।
মাহফুজ শুয়ে পড়েছে। তার চোখ খোলা। অবাক হয়ে সে চারদিক দেখছে। চিত্রার ভয় ভয় লাগছে। মানুষটা মরে যাবে না তো? যদি সত্যি সত্যি মরে যায় সে কী করবে। নৌকা ঠাকরোকোনা স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর লাশ ফেলে রেখে স্টেশনের দিকে যাবে। ময়মনসিংহ যাবার ট্রেন কখন কে জানে। এটা করা কি সম্ভব?
কেন সম্ভব না। এই লোক কে? তার কেউ না। মৃত মানুষটাকে নিয়ে তার গ্রামে উপস্থিত হবার কোন মানে হয় না। সে নাটকের মেয়ে। যাচ্ছে। টিপুসুলতান নাটক করতে। নাটকের প্রধান উদ্যোক্তা মারা গেছে। নাটক অবশ্যই হবে না। সে সোহাগী গ্রামের উপস্থিত হয়ে কী করবে? তার টাকা পাওয়ার কথা, সে পেয়ে গেছে। এই টাকায় মার ঠ্যাং কাটা হচ্ছে।
চিত্রা নদীর পানিতে প্লাস্টিকের জগভর্তি করে মাহফুজের মাথায় ঢালছে। নদীর পানি গরম। রোদে পানি তেতে উঠেছে। গরম পানি মাথায় ঢাললে কি জ্বর কমে?
ইনজিনের নৌকা ভটভট করে চলছে। ছোট ছেলেটা আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। যে বুড়ো মাঝি হাল ধরে ছিল- সেও একবার উঁকি দিল। চিত্রা বলল- আপনি কি ইনাকে চিনেন?
বুড়ো মাঝি বলল, জ্বি না।
যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গাটা চেনেন তো? গ্রামের নাম সোহাগী।
জ্বে চিনি। নিমঘাটা।
নিমঘাটা না, সোহাগী।
নিমঘাটায় নাও থামব। হাঁটা পথে সোহাগী যাইবেন।
কতক্ষণ হাঁটতে হবে?
ক্যামনে কই?
ক্যামনে কই মানে? সোহাগী কখনো যান নি?
জ্বে না। নিমঘাটা গেছি। বুধবারে নিমঘাটায় হাট বসে। বড় হাট।
নিমঘাটায় ডাক্তার আছে?
জানি না।
নিমঘাটায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
ফুল ইসপিডে দিলে দেড় ঘণ্টা। যেমনে যাইতেছি– দুই আড়াই ঘণ্টা লাগব।
ফুল স্পিড দিন।
দেওন যাইব না। ইনজিন ডিসটাব আছে।
যখন সমস্যা হয় একের পর এক সমস্যা হতে থাকে। নৌকা একটা নেয়া হয়েছে ইনজিন ডিসটাব। হয়ত দেখা যাবে কিছুক্ষণ পর ইনজিন পুরোপুরি থেমে যাবে।
রোদ মরে আসছে। আকাশে চিল উড়ছে। বাচ্চা ছেলেটা বলল তুফান হইব। ছেলেটার মুখ হাসি-হাসি। যেন তুফান হওয়া ইনজিন থেকে তেল ছিটকে যাওয়ার মতোই কোন আনন্দময় ঘটনা। পুরোপুরি নৌকা ডুবলে তার আনন্দ মনে হয় আরো বেশি হবে।
চিত্রা বলল, তুফান হবে কেন? আকাশে তো মেঘ নেই।
এট্টু পরেই দেখবেন আসমান আন্ধাইর।
ঝড়ের সময় নৌকা কি নদীর উপর থাকবে? না কুলে ভিড়বে?
বুড়ো মাঝি বলল, অবস্থা বুইঝা ব্যবস্থা। যেমন অসুখ তেমন দাওয়াই।
নৌকাডুবি অসুখের দাওয়াই কী হবে? চিত্রা সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানা অসুখের কোন দাওয়াই থাকার কথা না।
আকাশের চিল নিচে নেমে আসছে। রোদের তেজ দ্রুত কমছে। তবে আকাশের কোথাও কোন মেঘ নেই। মেঘ ছাড়া রোদের তেজ কমে যাচ্ছে। কী ভাবে সেও এক রহস্য।
মানুষটা এতক্ষণ চোখ মেলে ছিল। পাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। এখন চোখ বন্ধ। জ্বর বোধ হয় একটু কমেছে। এখন ঘুমুচ্ছে। ক্রমাগত পানি ঢালার কারণে কপালে হাত দিয়ে জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে না। চিত্রা ডাকল– এই যে শুনুন। আপনি কি ঘুমুচ্ছেন?
মানুষটা জবাব দিল না। তবে বড় করে নিশ্বাস ফেলল।
আপনার শরীরটা কি এখন একটু ভাল লাগছে?
এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। চিত্রা বুঝতে পারছে না সে পানি ঢালা বন্ধ করবে না চালিয়ে যাবে।
নৌকার ছেলেটা আঙুল উঁচিয়ে বলল- এই দেখেন মেঘ।
চিত্রা মেঘ দেখল। কালো একখণ্ড মেঘ দেখা যাচ্ছে। ভীতিজনক কিছু না। কিংবা কে জানে হয়ত এই মেঘই ভয়াবহ। সাপুড় যেন সাপের হাঁচি চেনে– যারা নৌকা চালায় তারা চেনে মেঘের হাঁচি।
চিত্রা বলল, ঝড় কখন হবে?
দিরং আছে।
ছেলেটা কথাটা বলল দুঃখিত গলায়। ঝড় আসতে দেরি আছে এই দুঃখে সে মনে হয় কাতর।
চিত্রা বলল, ঝড় আসতে আসতে কি আমরা নিমঘাটায় পৌঁছব?
জানি না।
বিপদ যখন আসে একটার পর একটা আসে। বিপদরা পাঁচ ভাইবোন। এদের মধ্যে খুব মিল। এই ভাইবোনরা কখনো একা কারো কাছে যায় না। প্রথম একজন যায়, তারপর তার অন্য ভাইবোনরা উপস্থিত হয়। ঝড় যে হবে তা নিশ্চিত। এবং ঝড়ে অবশ্যই নৌকা ডুবে যাবে।
ইনজিনের ভটভট শব্দ হচ্ছে না। চিত্রা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বুড়ো মাঝি বলল, ইনজিলে ডিসটাব আছে। ঠিক করতাছি। চিন্তার কিছু নাই।
ইনজিন ঠিক করতে জানেন?
ইনজিন গরম হইছে। ঠাণ্ডা হইলে আপছে ঠিক হইব।
মাঝি নৌকা তীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘের টুকরাটা দ্রুত বড় হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটা মরে যায়নি তো?
না, মরে নি। এইতো বুক উঠানামা করছে। চিত্রা মাথায় পানি দেয়া বন্ধ করে ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
কালো মেঘ ঘন হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন মেঘের নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে আসছে। তীব্র অসহনীয় গরমটা আর নেই। বরং শীত শীত লাগছে। ঝড়ের আগে ঠাণ্ডা বাতাস বয় না-কী?
চিত্রা শোন!
চিত্রা মেঘ দেখছিল। সে চমকে তাকাল। মানুষটা দুই হাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করেছে। চিত্রা বলল, কিছু বলবেন?
মানুষটা হড়বড় করে বলল, সুলতান সাহেব আমাদের প্রধান অতিথি। উনি অনেক বড় মানুষ। তাকে বললেই তিনি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কি ব্যবস্থা?
পড়াশোনা, চাকরি।
চিত্রা তাকিয়ে আছে। মানুষটা ঘোরের মধ্যে কথা বলছে। তার সঙ্গে তর্ক বিতর্কে যাওয়া ঠিক না। চিত্রা বলল, আপনি শুয়ে পড়ুন।
মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা। বলেই আগের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝড় এসে পড়ল।
আমার পড়া অন্যতম উপন্যাস এটা।শেষটা অনেকট একবারে গল্পের মত।ধন্যবাদ ই-বাংলাকে এমন একটা উপন্যাস আপলোড দেওয়ার জন্য
very nice