১. ভাগীরথী – 1742
নীলাম্বরী শাড়ি-পরা এই তরুণীটিকে দেখলে তোমরা চিনতেই পারতে না। তোমরা ওকে চেন—ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে। ইদানীং সে গৈরিকবসনা সন্ন্যাসিনী। প্রৌঢ়া উদাসিনী। যৌবনে সে এমন গৈরিকবসনা ছিল না। তার পরনে তখন ছিল ঘন নীল নীলাম্বরী, শাড়ির দুই সমান্তরাল পাড় গাঢ় সবুজ রঙের, তাতে আবার আম-জাম-কাঁঠাল-নারিকেল গাছের নকসা আঁকা। শ্রাবণ-ভাদ্রে তার শাড়ির রকমফের হত—তাও গিরিমাটির রঙ নয়, যেন গব্যঘৃত! আশ্বিন-কার্তিকে আবার তার শাড়ির পাড়ে সাদা-সাদা চুকি—শারদলক্ষ্মীর চরণে কাশফুলের উপচে-পড়া অঞ্জলি!
রূপের সঙ্গে নামটাও হারিয়ে গেছে। ছিল ভাগীরথী, হয়েছে হুগলী নদী! পাটকলের চোঙার কালিতে মায়ের সারা অঙ্গ আজ কালিঝুলি মাখা!
কে বলবে, ঐ মেয়েটিই বালিকা বয়সে বেণী দুলিয়ে মহাদেবের জটার ঘুলঘুলিয়ায় লুকোচুরি খেলেছে। পাতাঝরা পাইন আর দেওদার বনে পাথরের নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলেছে। বয়ঃসন্ধিকালে মহা-ঐরাবৎ এসেছিল ওর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে, তাকে ধরাশায়ী করে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল কিশোরী মেয়েটি। তারপর একদিন বড় হয়েছে, চিনেছে দুনিয়াকে, মহারাজ শান্তনুকে শান্ত করেছে হস্তিনাপুর-মহিষীরূপে; অষ্টবসুকে করেছে শাপমুক্ত—মহাভারতকে উপহার দিয়েছে ভীষ্মের মতো চরিত্র—আধাদেবতা- আধামানুষ।
তারপর? অচিন দেশের এক রাজপুত্র ওকে হঠাৎ মাতৃসম্বোধন করে বসল! তার আকুল আহ্বানে বিগলিত-করুণা জাহ্নবী দেবপ্রয়াগ-হরিদ্বার-হৃষীকেশ ছেড়ে ছুটল সাগর পানে—সগর রাজার অভিশপ্ত সন্তানদের উদ্ধার করতে।
মানুষের অত্যাচারে পদ্মা-মেঘনার বিকল্প পথে সে তখনও কীর্তিনাশা হয়ে ওঠেনি ভাগীরথী তখন ছিল ভিন্নপথের পথিক। পুরাণে, বিশেষ করে মৎস্য ও বায়ুপুরাণে নির্দেশ আছে যে, তখন তাম্রলিপ্তি দেশের ভিতর দিয়ে ছিল গঙ্গার প্রবাহ। এই পুরাণ অনুযায়ী গঙ্গা বা ভাগীরথী যে যে রাজ্য ধন্য করত তাদের নাম কুরু (দিল্লী), পাঞ্চাল (উত্তর প্রদেশ), কোশল (এলাহাবাদ অঞ্চল), মগধ (বিহার) অতিক্রম করে ব্রহ্মোত্তর (উত্তর-রাঢ়), বঙ্গ এবং সুক্ষ (তাম্রলিপ্তি) দিয়ে সগরমুনির আশ্রম। সপ্তদশ শতকে জাহানাবাদের কাছাকাছি গঙ্গার ধারা ছিল দ্বিধাবিভক্ত। একটি স্রোত বাঁকা-দামোদরের জলধারা আশ্রয়ী আর একটি ছিল সুহ্ম-অভিমুখী। কবি ক্ষমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যপাঠে সে রকম মনে হয়। অপরপক্ষে বিপ্রদাস পিপিলাই-য়ের মনসামঙ্গলে চাঁদ-সওদাগরের যাত্রা-পথে একে একে পড়ছে—অজয় নদ, উজানী, কাটোয়া, নদীয়া, ফুলিয়া, গুপ্তিপাড়া, মীর্জাপুর, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম, কুমারহট্ট, ডাইনে ‘হুগুলী’, বামে ভাটপাড়া—তারপর কাঁকিনাড়া, ‘মূলাজোড়া’, ভদ্রেশ্বর, ‘চাণক’, মাহেশ, খড়দহ, ‘শ্রীপাট’, ‘রিসিড়া’, ‘ঘুষুড়ি’, ‘চিত্রপুর’, কালীঘাট, পার হয়ে শেষমেশ সমুদ্র-সংগম :
“তাহার মেলান ডিঙা সংগমে প্রবেশ
তীর্থকার্য কৈল রাজা পর[ম] হরিষে।।”
ত্রিবেণী-সপ্তগ্রামে তিনটি নদীর ‘মুক্তবেণী’র কথা অনেকেই বলেছেন, বিপ্রদাস পিপিলাই (1495),কবি ক্ষমানন্দ (1640), ফান্ ডেন্ ব্রোক (1660)। তার ভিতর আজও সরস্বতীর কিছুটা হদিস মেলে—ভাগীরথীর কোল ছেড়ে কিছুক্ষণ দক্ষিণদিকে ‘ভেল-মারি কিৎ-কিৎ’ বলে একটা চক্কর দিয়ে আবার বেতড়ের কাছে নিজের কোটে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু বিপ্রদাসের পঞ্চদশ শতকের ‘অতি বিশাল যমুনা নদী’ বেমালুম না-পাত্তা!
নদীমাতৃক বঙ্গসংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র এই ভাগীরথীর দুই-কিনার। গ্রীক ঐতিহাসিক বর্ণিত ‘গংগারিডি’ যথার্থ ‘গঙ্গাহৃদি’। জননী তাঁর স্তনভাণ্ড’ রর নির্মল ধারায়, পলিমাটির আশীর্বাদে, নাব্য স্রোতধারায় এ-দেশকে দিয়েছেন পানীয়, খাদ্য, পরিবহনের সুযোগ। তাঁর দুই তীরে গড়ে উঠেছে বঙ্গ-সংস্কৃতির মূলকেন্দ্র : নবদ্বীপ, শান্তিপুর, কাটোয়া, ত্রিবেণী, ভাটপাড়া, মূলাজোড়, কালীঘাট!
রূপেন্দ্রনাথ যে সদ্যবিবাহিত সহধর্মিণীর শাঁখাপরা হাতটি ধরে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন তা এই গঙ্গাতীরের অযুতনিযুত মন্দির-প্রাঙ্গণে শুধু ‘পেন্নাম’ করতেই নয়, বঙ্গসংস্কৃতির মূল ধারাটির সঙ্গে পরিচিত হতে—‘পরশপাথর’ খুঁজতে।
আকৌশোর তিনি যে একটা স্বপ্ন দেখে আসছেন : ধর্মসংস্থাপনার্থায় ‘তাঁর’ যে আসার কথা যিনি এসে এই অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুসমাজকে ধরে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি দেবেন। তার মোহভঙ্গ করে পথের নির্দেশ দেবেন। এটাই যে ভারত সংস্কৃতির ঐতিহ্য। এককালে যেভাবে সমাজকে ধরে নাড়া দিয়েছিলেন শাক্যসিংহ, আদি শঙ্করাচার্য বা অতি সম্প্রতি চৈতন্যদেব। তিনি আসবেন, নিশ্চয় আসবেন, হয়তো তিনি লুকিয়ে আছেন এখনো, প্রকট হননি। তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে। থাকলে তিনি নিশ্চয় আছেন এই ভাগীরথী-বিধৌত কোন একটি জনপদে। শাক্যসিংহ ছিলেন রাজ-পরিবারভুক্ত—রানী ভবানী বা কৃষ্ণচন্দ্রও তো তাই। আদি শঙ্করাচার্য বা নিমাই পণ্ডিত সোনার ঝিনুকে দুগ্ধপান করেননি শৈশবে—জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, বুনো রামনাথও তা করেননি। এদের মধ্যে কে এগিয়ে এসে চেপে ধরবেন রূপেন্দ্রনাথ ভেষগাচার্যের হাতখানি—তাঁর স্বপ্ন সফল করে তুলতে?
মহাগরুড় আজ ভগ্নপক্ষ সম্পাতির মতো ধুঁকছে। কিন্তু কেন?
রূপেন্দ্রনাথের বিশ্বাস তার দুটি হেতু—
প্রথম কথা : তার পিঠে জগদ্দল পাথরের বোঝা—যা পিঠে করে সেই মুক্তপক্ষ বিহঙ্গম মহাকাশে উড্ডীন হতে অশক্ত। সে বোঝা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অবহেলিত উপেক্ষিত একদল শক্তিমান মানুষ, যারা অদ্ভুত, জল-অচল, শূদ্র।
দ্বিতীয় বাধা: বিহঙ্গমের একটি পক্ষ শাতন করেছে ঐ কূপমণ্ডূক টুলো-পণ্ডিতের দল। নারীসমাজ। তাকে অশিক্ষায়, অবজ্ঞায়, অন্ধকারে, অত্যাচারে জর্জরিত করে। তাকে ‘নরকের দ্বার’ রূপে চিহ্নিত করে। চৈতন্যদেব আচণ্ডালকে কোল দিয়েছিলেন, কিন্তু হতভাগী বিধবাদের পুড়িয়ে মারার কদর্য ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কেউ রুখে দাঁড়াননি। উনি যাচাই করে দেখতে চান, এই ভাগীরথীতীরের দুই কিনারে মহা পণ্ডিতেরা এ বিষয়ে কী ভাবেন। এঁদের মধ্যে কে এগিয়ে আসবেন এই ব্রত উৎযাপন করতে।
হায়! রূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি, সেই মহাপুরুষ তখনো অজাত। তাঁর আবির্ভাব হতে আরও তিন-দশক বাকি।
এস, তোমাদের হাত ধরে রওনা হয়ে পড়ি ঐ ‘গঙ্গাহৃদি’র দুই কিনারের মহাতীর্থের পথে। রূপেন্দ্রনাথ হয়তো সব কয়টি তীর্থে যাননি। তবে আমাদের যেতে বাধা কোথায়? রাজা রামমোহন আসন্ন—কিন্তু বঙ্গ সংস্কৃতির কোন পরিবেশে তিনি লড়াইটা শুরু করেছিলেন জানতে হলে গঙ্গাতীরের ঐ জনপদগুলির তদানীন্তন স্বরূপটুকু আমাদের চিনে নিতে হবে। সব তীর্থে হয়তো আমরাও যেতে পারব না, তবে ঐ যে কথা বলেছিল রাধা-বোষ্টমী—‘হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কিনা বুঝে নিতে কয়েকটি তণ্ডুলকণা পরীক্ষা করাই যথেষ্ট’ সেটাই আপাতত মেনে নেওয়া যাক।
সে আমলের ‘দিন আনি দিন খাই’-দের কথা, মাঠে মাঠে যারা লাঙ্গল দিত, ফসল তুলতো, কুমোরের চাকা ঘোরাতো, তাঁত চালাতো, মাছ ধরতো, নৌকা বাইতো—তাদের কথা কেউ বলেনি, কেউ লিখে যায়নি। তাদের ছায়া মাড়ানোও যে পাপ। আন্দাজে কল্পনাআশ্ৰয়ী ছবি এঁকে তোমাদের উপহার দিতে সাহস হয় না—‘সৌখিন-মজদুরি’ করতে গিয়ে যদি ভুল ছবি আঁকি? তাই হয়তো সেই হতভাগাগুলোর কথা আমারও বলা হল না।
নবদ্বীপ থেকে আমরা সাগরদ্বীপের দিকে যাব, ভাগীরথীর স্রোতরেখা ধরে। দু-পাশের জনপদগুলি দেখতে দেখতে—ঐ ‘মারহাট্টা-ডিচ্’-তক্। তার ওপারে শহর কলকাতা। সেটা পরে দেখা যাবে, সুযোগ হলে রূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে না হয় নাই হল।
নবদ্বীপ ও গোয়াড়ীকৃষ্ণনগরকে আগেই দেখা শেষ হয়েছে। আমরা বরং যাত্রা শুরু করি শান্তিপুর থেকে—