১. বড় বোনের নাম আসমানী

বড় বোনের নাম আসমানী। আসমানীর সঙ্গে মিল রেখে তার পরের জনের নাম। জামদানী। তৃতীয়জনের জন্যে মিলের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না। তার নাম পয়সা।

এত নাম থাকতে পয়সা নাম কেন–তার ইতিহাস আছে। জমির আলী তার তৃতীয় কন্যার জন্মের সময় খুবই অর্থকষ্টে পড়েছিল। সে বসে ছিল নদীর ঘাটলায়। খেয়া পারানি দেখতে দেখতে তার মনে অতি উচ্চশ্রেণীর চিন্তা-ভাবনা হচ্ছিল। যেমন–এমন কোনো ব্যবস্থা যদি থাকত যে, সন্তান জন্মের পরপর তাকে ওজন করা হবে। সরকারের কাছ থেকে ওজনের সমান সোনা সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হবে। মোটাসোটা বাচ্চা যাদের হবে তারা লাভবান, সোনা বেশি পাবে। চিকনা-চাকনাগুলি পাবে কম। মায়ের কোলে যেসব সন্তান মারা যাবে তাদের জন্যে আফসোস লাশ দাফনের খরচ ছাড়া কিছুই পাবে না।

জমির আলী মাটি কাটার কাজ করত। বর্তমানে ভিক্ষা করে। ভিক্ষা করার জন্যে সুন্দর সুন্দর জায়গা খুঁজে বের করে। খেয়াঘাট জায়গা হিসেবে ভালো। ভিক্ষা তেমন পাওয়া যায় না, তবে নৌকায় লোক পারাপার করে, দেখতে ভালো লাগে। কত কিসিমের মানুষ নামে। কেউ উদাস কেউ কুদাস। কুদাস শব্দটা জমির আলীর আবিষ্কার। কুদাস হলো উদাসের উল্টা। উদাস মানুষ দেখতে ভালো লাগে। কুদাস দেখতে ভালো লাগে না। জমির আলীর ধারণা। সে একজন উদাস মানুষ এবং ভাবের মানুষ। সে ভাবনা-চিন্তা ছাড়া থাকতেই পারে না।

ভাবনা-চিন্তার জন্যে ভিক্ষা পেশাকে তার আদর্শ পেশা বলে মনে হয়। সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা রেখে ভাবনা-চিন্তা কর। কোনো সমস্যা নাই। মাঝে মধ্যে চলমান পাবলিকের দিকে তাকিয়ে বলা একটা পয়সা দিয়া যান। একটা পয়সা হারায়ে গেলে আপনের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু একজনের জীবন রক্ষা হবে। কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলেও হয়। যার দেবার সে চাইলেও দিবে, না চাইলেও দিবে। যে দিবে না তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে এক ঘণ্টার বক্তৃতা দিলেও কিছু হবে না। খামাখা পরিশ্রম।

জমির আলী পরিশ্রম পছন্দ করে না। তার ধারণা আল্লাহপাক পরিশ্রম করার জন্যে মানুষকে তৈরি করেন নাই। পরিশ্রম করার জন্যে তিনি তৈরি করেছেন গাধা এবং মহিষকে। ফাজলামি করার জন্যে তৈরি করেছেন বানরকে। ময়লা ঘটার জন্যে তৈরি করেছেন শূকর এবং কাককে। একেক কিসিমের জন্তু একেক উদ্দেশ্যে তৈরি করা। মানুষও জন্তু। তাকেও একটা উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। উদ্দেশ্যটা কী, মাঝে-মধ্যে জমির আলী সেই নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করে। এখনো তেমন কিছু বের করতে পারে নি।

তার তৃতীয় সন্তানের জন্মের খবর যখন সে পায় তখন সে উদাস গলায় বলছিল–ভদ্রলোকের সন্তানরা, একটা পয়সা পঙ্গু মানুষটাকে দিয়া যান। (কথাটা সত্য না। সে পঙ্গু না। মাটি কাটার কাজ সে ইচ্ছা করলে এখনো করতে পারে, তবে ইচ্ছা করে না।) কন্যার জন্মের সময় পয়সা নামটা মুখে ছিল বলে। কন্যার নাম রাখা হলো পয়সা। সে তৎক্ষণাৎ মেয়ের মুখ দেখার জন্যে বাড়িতে রওনা হলো না। মেয়ের ভাগ্য কেমন দেখার জন্যে ঘণ্টা দুই খেয়াপাড়ে বসে রইল। মেয়ে ভাগ্যবতী হলে ভালো ভিক্ষা পাওয়া যাবে। দেখা গেল মেয়ের ভাগ্য খারাপ না। দুই ঘণ্টায় এগারো টাকা উঠে গেল।

মেয়ের পয়সা নামকরণের পর তার মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এলো তা হচ্ছে–পয়সা জিনিসটা দেশ থেকে উঠে গেছে। ভিক্ষা করার সময় সে অবশ্যি চায় পয়সা। মানুষ দেয় টাকা। জিনিস উঠে গেছে কিন্তু নাম থেকে গেছে। পয়সা বলে কিছু নাই, কিন্তু পয়সা নামটা আছে! এরকম জিনিস আর কী আছে যে জিনিস নাই কিন্তু নাম আছে? জমির আলী গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। একই সঙ্গে জগতে চিন্তার বিষয় অনেক আছে এটা ভেবে সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। চিন্তার বিষয় শেষ হয়ে গেলে তার জন্যে সমস্যা হতো। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকা কষ্টের ব্যাপার। হতো। মাটি কাটার চেয়েও কষ্টের হতো।

আছরের নামাজের সময় জমির আলী তার কন্যাকে দেখতে গেল। দুটাকার একটা চকচকে নোট আলাদা করা। মুখ দেখে মেয়ের হাতের মুঠোয়। ধরিয়ে দেবে। সে রাজা-বাদশা হলে মোহর দিয়ে মেয়ের মুখ দেখত। মেয়ের। হাতে এক মোহর। মেয়ের মায়ের হাতে এক মোহর। আল্লাহ তাকে ফকির বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, কাজেই দুটা গিনি সোনার মোহরের বদলে দুটাকার চকচকে নোট।

মেয়ের মুখ দেখে জমির আলী আনন্দিত গলায় বলল, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে তোমার মতোই সুন্দরী হয়েছে। মাশাল্লাহ।

মেয়ের মা আছিয়া তীব্র গলায় বলল, ঢং কইরেন না কইলাম।

ঢং এর কী দেখলা? দেখি আবুরে কোলে দাও, তার জন্যে পুরস্কার আছে।

দূরে থাকেন। দূরে থাকেন কইলাম। আপনের পুরস্কারে আমি ঝাড়ু মারি।

জমির আলী আহত গলায় বলল, নিজের সন্তানরে কোলে নিব না? আমি জন্মদাতা পিতা।

আছিয়া তীব্র গলায় বলল, দূরে থাকেন কইলাম।

জমির আলী নিজেকে সংযত করে সহজ গলায় বলল, ঠিক আছে। মা বিনা অন্য কারোর কাঁচা আবু কোলে নেওন ঠিক না। গর্দানে ব্যথা পাইতে পারে। কাঁচা আবুর গর্দান পাটখড়ির মতো নরম।

খামাখা বকর বকর কইরেন না। নাই কাজের উজির। আসল পরিচয় পথের ফকির। ছিঃ ছিঃ।

জমির আলী অপমান গায়ে মাখল না। যারা ফকিরি ব্যবসায় নামে তাদের অপমান গায়ে মাখতে হয় না। তাদের হতে হয় হাঁসের মতো। পানির মধ্যে বাস কিন্তু শরীর শুকনা। জমির আলী কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল–নয়া আবুরে মধু খাওয়াইছ? মধু না খাওয়াইলে জবান মিষ্ট হবে না। জবান হবে কাকপক্ষীর মতো কর্কশ।

আছিয়া বলল, আমারে কি আপনে মধুর চাকের উপরে বসাইয়া রাখছেন? চাক ভাইঙ্গা আবুর মুখে মধু দিব?

জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, মুখে মধু দেয়া প্রয়োজন ছিল। মেয়ে মানুষের আসল পরিচয় জবানে। যার যত মিষ্ট জবান সে তত পেয়ারা।

সামনে থাইক্যা যান কইলাম।

দুবলা শইল্যে চিল্লাফাল্লা করবা না। পেটের নাড়িতে টান পড়ব। পুয়াতি মেয়েছেলের নাড়িতে টান পড়লে বিরাট সমস্যা।

আরেব্বাসরে, আমরার কবিরাজ আইছে। সামনে থাইক্যা না গেলে আফনের খবর আছে।

জমির আলী ঘর থেকে বের হলো। সন্তানের মুখ দেখে সে খুবই আনন্দিত। গায়ের রঙ মাশাল্লা ভালো হয়েছে। চৈত্র মাসের সকালের রোদের মতো রঙ। আসমানী এবং জামদানী দুই জনের গায়ের রঙ একটু ময়লার দিকে। এই মেয়ে রঙের দিকে উড়াল দিয়েছে। জমির আলী পেছনের উঠানে গিয়ে মধুর গলায় ডাকল–আমার দুই মেয়ে কই? কই আমার আসি, কই আমার জামি?

দুই মেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো। দুই মেয়েই বাবাঅন্তঃপ্রাণ। মার ধমক খেয়ে তারা বাড়ির উত্তরে বাঁশঝাড়ে চুপচাপ বসে ছিল। দুজনেরই খুব ইচ্ছা নয়া বোনকে কোলে নেয়। কোলে নেয়া দূরের কথা, ভালোমতো দেখতেই পারে নি। আছিয়া ধমকে তাদের বাড়িছাড়া করেছে।

জমির আলী মেয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরার সবচে ছোট ভইনটার নাম আমি দিলাম পয়সা। কী, নাম কেমুন হয়েছে?

আসমানী বলল, পয়সা আবার কেমুন নাম?

খুবই সৌন্দর্য নাম। ডাক নাম পয়সা, ভালো নাম মোসাম্মত পয়সা কুমারী। এখন বলো, নাম ভালো হইছে না?

হুঁ।

এখন যাও চুলা ধরাও। খিচুড়ি রান্ধা হইব। ইসপিসাল খিচুড়ি। ঘরে চাউল ডাউলের অবস্থা কী দেখ। না থাকলে দোকানে যাইবা।

দুই বোনের চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগল। তারা তাদের বাবার হাতের খিচুড়ির ভক্ত। খিচুড়ি রান্নার প্রক্রিয়ারও ভক্ত। হাঁড়িতে জ্বাল উঠতে থাকে। হাঁড়ি ঘিরে সবাই বসে আছে। জমির আলী হাসিমুখে বলে–আরেকটা কিছু দিলে ভালো হইত। ঘরে আর কিছু আছে? না থাকলে দুই ভইন দুইটা যাও দৌড়াইতে থাকবা, চোখের সামনে সবজি বা সবজি কিসিমের যা পাইবা নিয়া আসবা। খালি কাঁঠাল পাতা আর ঘাস আনবা না। এই গুলান গরু-ছাগলের খাদ্য।

দুই মেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বের হয়ে যায়। তাদের বড়ই মজা লাগে।

 

জমির আলী খিচুড়ি রাঁধতে বসেছে। আজকের খিচুড়ি ইসপিসাল, খিচুড়িতে দুটা ডিম ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আসমানী এবং জামদানী চোখ বড় বড় করে বাবার দুপাশে বসেছে। মাঝে মাঝে হাঁড়ির ঢাকনা খোলা হয়। খিচুড়ির সুঘ্রাণ নাকে এসে লাগে–তাদের শরীর ঝিমঝিম করে। এরা দুজনই সকাল থেকে কিছু খায় নি। আছিয়া প্রসব-বেদনায় কাতর হয়ে ছটফট করছিল। দুটি ক্ষুধার্ত শিশুর কথা তার একবারও মনে হয় নি। মনে হলেও কিছু করা যেত না। ঘরে কোনো খাবার ছিল না।

জমির আলী বলল, বলো দেখি জগতের সবচে ভালো খাদ্যের নাম কী?

আসমানী এবং জামদানী এক সঙ্গে উত্তর দিল, খিচুড়ি।

জমির আলী আনন্দিত স্বরে বলল, হয়েছে। দুইজনেই পাস। ফাস ডিভিসনে পাস। এখন বলো দেখি খিচুড়ি কী জন্যে সবচে ভালো খাদ্য?

জানি না। চিন্তা-ভাবনা কইরা বলো।

তুমি বলো।

জমির আলী আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে খিচুড়ি-মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে। তার দুই কন্যা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। তারা তাদের বাবার জ্ঞান ও প্রতিভায় বিস্মিত বোধ করে।

খিচুড়ি জগতের সবচে ভালো খাদ্য, কারণ আল্লাহপাক খিচুড়ি পছন্দ করেন। জগৎ-সংসারের দিকে চাইয়া দেখ–যে-দিকে চোখ যায় সেদিকে খিচুড়ি। কালা মানুষ, ধলা মানুষ, শ্যামলা মানুষ মানুষের খিচুড়ি। গাছপালার কথা বিবেচনা কর–আম গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, তেঁতুল গাছ। গাছের খিচুড়ি। ঠিক কি-না?

হুঁ।

জগাই বিরাট এক খিচুড়ি। আল্লাহপাক কী করেছে শোন–বিরাট এক হাঁড়ি জ্বালে বসাইছে। সেই হাঁড়ির মধ্যে মানুষ, গরু, ছাগল, গাছপালা সব দিয়া খালি ঘুঁটতাছে।

জামদানী বলল, কী জন্যে?

উনার মনের কথা আমি কেমনে বলব? আমি ফকির মানুষ–আমার কি জ্ঞান বুদ্ধি আছে?

আসমানী বলল, বাপজান, তোমার বেজায় জ্ঞান বুদ্ধি।

জমির আলী মেয়ের কথায় আনন্দিত বোধ করে। সংসার তার কাছে মধুর বোধ হয়। নতুন শিশুর আগমনে অভাবের সংসার যে আরো জটিল হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। নয়া আবুর খানা খাদ্যের পিছনে বাড়তি খরচ নাই। নয়া আবুর খানা খাদ্যের ব্যবস্থা আল্লাহপাক নিজে করেন। মায়ের বুকে দুধ দিয়ে দেন। আল্লাহপাকের নাম রহমান রহিম তো খামাখা হয় নাই। আল্লাহপাক খামাখার মধ্যে নাই।

জমির আলীর ক্ষীণ সন্দেহ ছিল রাগ করে আছিয়া খিচুড়ি খাবে না। কিন্তু জমির আলীকে অবাক করে দিয়ে সে খিচুড়ি খুবই আগ্রহ করে খেল। জমির আলী বলল, টেস ভালো হইছে না?

আছিয়া জবাব দিল না।

জমির আলী বলল, চাউলের বদলে গম দিয়াও খিচুড়ি হয়। গমের খিচুড়ির টেস আরো বেশি, তয় গমের খিচুড়ির মধ্যে মাংস দেয়া লাগে। দেখি তোমরারে একদিন গমের খিচুড়ি খাওয়াব। ইনশাল্লাহ।

আছিয়া থালার খিচুড়ি শেষ করে ফেলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ক্ষুধা এখনো আছে। জমির আলী বলল, আরেক হাত খিচুড়ি দেই?

আছিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, থাকলে দেন। আরেকটা কথা মন দিয়া শুনেন–আমি আপনের সংসারে থাকব না।

জমির আলী বলল, কই যাইবা?

যেখানে ইচ্ছা যাব। সেইটা দিয়া আপনের দরকার নাই। সেইটা আমার বিবেচনা।

নয়া আবুরে নিয়া ঘুরাঘুরি করা ঠিক না।

নয়া আবুরে সাথে নিব আপনেরে কে বলেছে?

জমির আলী অবাক হয়ে বলল, তারে কই থুইয়া যাইবা?

আছিয়া বলল, আফনেরে দিয়া যাব। তারে সাথে নিয়া ভিক্ষা করবেন।

যাইবা কবে?

শইল্যে যেদিন বল পাইব সেইদিন চইল্যা যাব। আপনের গুষ্ঠী আপনে সামলাইবেন। ভাত-কাপড় দিবেন। মেয়েরা বড় হইলে বিবাহ দিবেন। আমি ঝামেলার মধ্যে নাই।

জমির আলী চিন্তিত বোধ করছে। তার চিন্তার প্রধান কারণ হলো আছিয়া সহজ মেয়ে না। জটিল মেয়ে। মুখে যা বলে তাই করে। জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, সংসারে ঝামেলা আছে কথা সত্য, তবে বউ, সংসারে মজাও আছে।

আছিয়া বলল, মজা থাকলে তো ভালোই, আপনে চাইট্যা চাইট্যা মজা খনি। আমি মজা খাইতে পারব না। অনেক খাইছি। আমার পেট ভরা। ফকির সাব শুনেন চোখের সামনে দুই মাইয়া না খাইয়া ঘুরে। পেটের ক্ষিধায় বাঁশঝাড়ে বইস্যা কান্দে। অনেক কান্দন গুনছি, আর শুনব না।

তুমি যাইবা কই?

সেটা আমার বিবেচনা। পান খাওয়াইতে পারবেন। খিচুড়ি আরাম কইরা খাইছি–একটা পান খাইতে পারলে ভালো হইত।

পান নিয়া আসতেছি। এইটা কোনো বিষয়ই না। জর্দা খয়ের দিয়া বানানি পান। কাঁচা সুপারি দিয়া আনব?

যা ইচ্ছা দিয়া আনেন। কাঁচা সুপারি দিয়া আনেন, পাকনা সুপারি দিয়া আনেন। আমার পান খাওয়া দিয়া কথা।

ঘরে পান-সুপারি ছিল না। দোকান থেকে দুই খিলি পান কিনে এনে জমির আলী দেখল আছিয়া হাঁটা চলা করছে। সামান্য খিচুড়ি খেয়েই তার শরীরে মনে হয় বল ফিরে এসেছে। নয় আবু হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে, আছিয়া সে দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আসমানী এবং জামদানী বোনের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তারা ভীত চোখে একবার মাকে দেখছে, একবার কথায় মোড় নতুন শিশুটির দিকে তাকাচ্ছে।

জমির আলীর হাত থেকে পান নিতে নিতে আছিয়া বলল–আপনের পুটল কানতাছে। পুটলা সামলান। জমির আলী বলল, মনে হয় ক্ষিধা লাগছে। বুকের দুধের জন্যে কানতেছে। আছিয়া পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, বুকে দুধ

অখনো নামে নাই। আর নামলেও লাভ নাই। আমি আর এর মধ্যে নাই।

কীসের মধ্যে নাই?

সংসারের মধ্যে নাই। অনেক সংসার করলাম। অখন অসিসালামু আলায়কুম।

তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতেছি না।

না বুঝলে নাই।

আছিয়া উঠানে চলে গেল। জলচৌকিতে বসে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। জমির আলী চিন্তিত মুখে শিশুর কান্না সামলানোর জন্যে এগিয়ে গেল। তার সঙ্গে যুক্ত হলো আসমানী ও জামদানী। বাচ্চাটাকে এখন আরো ফরসা লাগছে। হাত-পা ছুড়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কাদছে। জমির আলী মেয়ের মুখের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, এই পয়সা–এই। পয়সা কান্না থামাচ্ছে না। আসমানি বলল, বাপজান, গীত গাও। জমির আলী গীত ধরল। বানিয়ে বানিয়ে সুর করে কথা বলা। ভিক্ষুকরা এটা খুব ভালো পারে–

এই পয়সা কান্দে রে
তার ভইন রে বান্দে রে
ভইনের নাম আসমানী
হে দেশের রাজরানী।
তার ছোটটা জামদানী
ঘরে টেকার আমদানি
টেকা বলে পয়সা কই
হে আমার প্রাণের সই।

জামদানী উৎফুল্ল গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কান্দন বন্ধ হইছে। কান্দন বন্ধ হইছে। জমির আলী অবাক–আরে তাই তো, পিচকা কান্না বন্ধ করে তাকাচ্ছে।

আসমানী বলল, বাপজান, তোমারে দেখে। তোমারে দেখে।

জমির আলী বলল, কী দেখসরে বেটি? আমি কে—ক দেহি। আমি তোর পিতা জমির আলী। তোর মাতার নাম আছিয়া। দুই ভইনের একজনের নাম আসমানী, আরেকজনের নাম জামদানী। আমাদের সবেরে যে সৃষ্টি করেছেন তার নাম আল্লাহ। সাত আসমানের উপরে তার সিংহাসন।

জামদানী বলল, তোমার সব কথা শুনতাছে। মনে হয় বুঝতাছে।

জমির আলী গম্ভীর গলায় বলল, বুঝনের কথা। শিশুরা ফিরিশতার সামিল। ফিরিশতা কথা বুঝব না এইটা কেমন কথা? আমার পয়সা আম্মা সব বুঝতাছে। বুঝতাম না মা?

কী আশ্চর্য কথা, পিচকি চোখ মিটমিট করছে! পাখির পালকের মতো একটা হাত এগিয়ে দিল বাবার মুখের দিকে। আসমানী উত্তেজিত গলায় বলল, বাপজান, তোমার নাক ধরতে চায়।

জমির আলী নাক বাড়িয়ে দিয়ে হৃষ্ট গলায় বলল, ধর বেটি নাক ধর। জন্মের পরেই নাক ধইরা টানাটানি এ কেমন মাইয়া! বয়সকালে এর খবর আছে।

কন্যা নিয়ে উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সন্ধ্যা নামার পর পর সে কাঁদতে শুরু করল। দিনও খারাপ করল। ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে ঘরের চালা নড়বড় করছে। বাড়ি-ঘরের যে অবস্থা বাতাসের বেগ আরেকটু বাড়লে বাড়ি উড়ে যাবে। আছিয়া তার রোরুদ্যমান কন্যার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সে ভেতরের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছে। মনে হচ্ছে গভীর আগ্রহে সে ঝড়-বৃষ্টি দেখছে। আসমানী মায়ের কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, পয়সা কানতেছে।

আছিয়া বলল, কান্দুক। কান্দনের কপাল নিয়া আসছে, কানব না তো কী করব!

মনে হয় ক্ষিধা লাগছে।

তোর বাপরে দুধ খাওয়াইতে ক। আমি আর ঝামেলার মইদ্যে নাই।

বাচ্চার কান্নার চেয়েও যে দুশ্চিন্তা জমির আলীকে কাতর করে ফেলল সেটা দিনের অবস্থা। ভাবভঙ্গি মোটেই সুবিধার না। অনেক দূর থেকে গুম গুম শব্দ আসছে। সবাইকে নিয়ে কেরামতের পাকা দালানে চলে যাওয়া দরকার।

জামদানী ভীত গলায় বলল, ঘর-বাড়ি কাঁপতাছে বাপজান।

জমির আলী বলল, কোনো চিন্তা করিস না। আমরার সাথে ছোট শিশু আছে। ছোট শিশু ফিরিশতার সামিল। ফিরিশতার বিপদ-আপদ নাই।

আসমানী বলল, কেরামত চাচার বাড়িত যাইবা?

জমির আলী বলল, মনে হয় যাইতে হবে। তোর মারে বল।… আচ্ছা আমিই বলব। ঝড়-তুফানরে সমীহ করা লাগে। ঝড়-তুফান কারোর খালাতো ভাই মামাতো ভাই না।

আছিয়া বলল, আপনের যেইখানে ইচ্ছা সেইখানে যান। গুষ্ঠী সাথে লইয়া যান। আমি যাব না।

জমির আলী চিন্তিত মুখে বলল, ঘর-বাড়ি তো পইড়া যাইতেছে। যাউক পইড়া।

সত্যি যাইবা না?

না।

বউ তোমারে আল্লাহর দোহাই লাগে।

আফনেরে আল্লাহর দোহাই লাগে কানের কাছে ভ্যানভ্যান কইরেন না।

ঝড় প্রবল হয়েছে। বাড়ির চালার একটা অংশ উড়ে চলে গেল। আসমানী এবং জামদানী দুদিক থেকে বাবাকে জাপ্টে ধরে আছে। জমির আলী শিশু সন্তানটিকে কথায় মুড়ে বুকের কাছে দুহাতে ধরে রেখেছে। ঝড়-ঝঞার জন্যই হোক বা পরিশ্রান্ত হবার কারণেই হোক সে কাঁদছে না। জমির আলী বলল, চল রওনা দেই। দুইজন আমারে শক্ত কইরা ধর। মনে মনে নুহ নবির নাম নে। ঝড়-তুফানের সময় নুহ নবির নাম খুব কামে দেয়।

আসমানী বলল, তুমি অত কিছু জান ক্যামনে?

আছিয়া তিক্ত গলায় বলল, তোর বাপ বিরাট তালেবর বিদ্যার মটকি। হে জানব না তো কে জানব? যা বাপের সাথে যা। পথে পিছলাইয়া পইড়া পাও ভাঙ। এক আধজন লুলা হইলে সুবিধা আছে। ভিক্ষা বেশি পাওন যাইব।

ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকের আলো দেখে দেখে এগুতে হচ্ছে। এমিতে চারদিক ঘন অন্ধকার। বৃষ্টির পানি বরফ শীতল। বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। বৃষ্টির পানিতে পিছল হয়ে আছে। বুড়ো আঙুলটি টিপে টিপে খুব সাবধানে এগুতে হচ্ছে। ঝড় এমন ঝাপটা দিচ্ছে যে জমির আলীর মনে হচ্ছে, তার দুটি মেয়ের একটিকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জমির আলী বলল, শক্ত কইরা ধইরা থাক। প্রয়োজনে পাও ধইরা ঝুইলা পড়। মনে মনে বল–লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।

পথের উপর বাঁশঝাড়ের বাঁশ ভেঙে পড়েছে। ডিঙিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে কিছুদূর যাওয়া যাবে, সেটিও বিপদজনক। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে যেতে হবে। রুস্তমের ভিটার উপর দিয়ে দিনমানেও কেউ যায় না। ঝড়-বৃষ্টির নিশুতি রাতে অভিশপ্ত ভিটার ধারেকাছে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। হয়তো দেখা যাবে উঁচু ভিটার উপর সাদা থান পরা রুস্তমের দাদি বসে আছে। বহুঁ বছর আগে মৃত এই খুনখুনি বুড়িকে দেখে নাই এমন লোকের সংখ্যা এই গ্রামে খুবই কম। বুড়ি ভিটার উপর বসে পান খায়। পানের পিক ফেলে। পিকের বর্ণ টকটকে লাল। মনে হয় যেন পিক না–তাজা রক্ত।

মনের ভুলে রাতে বিরাতে কেউ যদি রুস্তমের ভিটার পাশ দিয়ে যায় তাহলেই বুড়ি মধুর গলায় ডাকবে–যায় কেডা? বদরুলের বেটা ছদরুল? কেমন আছসরে ভাইটি? আয় কাছে আয়, পান খাইয়া যা। মনের ভুলে কেউ যদি বুড়ির সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করে তাহলেই সর্বনাশ। সে বাড়ি ফিরে আসবে প্রবল জ্বর নিয়ে। খিচুনি শুরু হবে। মুখ দিয়ে গেজলা বেরুবে। ডাক্তার-কবিরাজ করার আগেই শেষ। এই গ্রামের দুইজন আর ভিনদেশী একজন এইভাবে শেষ হয়েছে।

জমির আলী ভীত গলায় বলল, আসমানী জামদানী, আমরা রুস্তম আলীর ভিটার উপর দিয়া যাব। বুড়িরে যদি দেখস ভয় খাইস না। আর বুড়ির কোনো কথার জবাব দিবি না। খবরদার কইলাম। আমি মনে মনে আয়াতুল কুরশি পড়তে থাকব। ভয়ের কিছু নাই। আয়াতুল কুরশির কাছে কেউ ভিড়তে পারে না। বড় শক্ত সূরা। জীন-ভূতের জন্যে কোরামিন ইনজেকশন।

আসমানী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আইচ্ছা।

আয়াতুল কুরশি পড়ার ব্যাপারটা জমির আলী মেয়েদের সাহস দেবার জন্যে বলেছে। আয়াতুল কুরশি সে জানে না। আল্লাহর পাক কালাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলা মহাঅপরাধ। মেয়ে দুটিকে সাহস দেবার জন্যে জমির আলী এত বড় অপরাধ করল। মেয়েরা সাহস পেল কি-না বুঝা গেল না, তবে ভয়ে জমির আলীর বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। সে নিশ্চিত রুস্তম আলীর দাদিকে দেখা যাবেই। বুড়ি পানের পিক ফেলতে ফেলতে মধুর গলায় বলবে–কে যায়? আমরার ফকির জমির আলী না? ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তিন কইন্যা লইয়া কই যাস? একটারে আমার কাছে থুইয়া যা। আদর কইরা পালব।

মেয়ে তিনটিকে কেরামতের পাকাবাড়ির বারান্দায় রেখে জমির আলী আবার বের হলো। আছিয়ার খোঁজ নেয়া দরকার। রাগ ভাঙায়ে তাকে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে কোলে করে আনতে হবে। স্ত্রী স্বামীকে কোলে নিতে পারে না, তবে স্বামী স্ত্রীকে কোলে নিতে পারে। তাতে দোষ হয় না।

আছিয়াকে পাওয়া গেল না। সে উঠানে বসে নেই। ঘরের ভেতরে নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ মানুষটা যাবে কোথায়? এমন কি হতে পারে মেয়ে তিনটার টানে সে ঘুরপথে কেরামতের পাকা দালানে উপস্থিত হয়েছে! সন্তানের টান বড় মারাত্মক টান। লোহার শিকলের টান। জমির আলী আবারো কেরামতের বাড়িতে উপস্থিত হলো।

দুই বোনই জড়সড় হয়ে উঠানে বসে আছে। আসমানীর কোলে পয়সা। সে কুঁকুঁ শব্দ করছে। দুটি মেয়েই শীতে কাঁপছে। কেরামত দরজা খুলে মেয়েগুলিকে ভিতরে ঢুকতে দেয় নি। আসমানী বলল, বাপজান, মা কই?

জমির তখন বলল, এখনো খুঁজতে যাই নাই, তরার কী অবস্থা দেখতে আসছি। অবস্থা কী?

আসমানী বলল, শীত লাগে।

ভিজা কাপড়ে শীত তো লাগবই। তোরা টাইট হইয়া বইয়া থাক। তোর মারে নিয়া আসতাছি। নয়া আবুর খবর কী?

একটু পরে পরে কান্দে।

কান্দুক, জন্মের সময় যে সব সন্তান বেশি কান্দে তারা বড় হইয়া এমন সুখে থাকে যে কান্দন কী জিনিস ভুইল্যা যায়। তোর ছোট ভইন বড়ই ভাগ্যবতী। তার ভাইগ্য দেইখা অবাক হইতেছি।

জমির আলী আবারো স্ত্রীর সন্ধানে বের হলো। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *