১. ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে

অন্তরে – (উপন্যাস) ইমদাদুল হক মিলন
প্রথম প্রকাশ – একুশের বইমেলা ২০০১

উৎসর্গ
প্রিয়দর্শন গায়ক শুভ্রদেবকে
গভীর ভালবাসায়

ব্যাপারটা শুরু হলো পা থেকে।

রাত দুপুরে সুমির মনে হলো তার ডানপায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছে। মৃদু মোলায়েম সুরসুরি। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে আলতো ভঙ্গিতে তেলাপোকা হেঁটে গেলে যে অনুভূতি হয় ব্যাপারটা তেমন।

সুমির ঘুম পাতলা। ফলে মুহূর্তেই ভেঙে গেল। কিন্তু ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা উধাও। সুমি ঠিক বুঝতে পারল না আসলেই কি অনুভূতিটা হচ্ছিল নাকি ঘুমঘোরে এমন মনে হয়েছে। নাকি সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল। অনুভূতিটা হচ্ছিল স্বপ্নে। নাকি সত্যি সত্যি তেলাপোকা হেঁটে গেছে পায়ের ওপর দিয়ে।

কিন্তু সুমির বিছানায় মশারি টাঙানো। এ বাড়িতে মশার উপদ্রব তেমন নেই। মা বাবা এবং ভাইয়া মশারি না টাঙিয়েই ঘুমোয়। শুধু সুমি, মশারি না টাঙিয়ে কিছুতেই বিছানায় যাবে না সে। মশা নয়, তেলাপোকার কারণে এই ব্যবস্থা। |||||||||| সুমির তেলাপোকা ভীতি ভয়াবহ। গায়ে তেলাপোকা উঠলে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে সে। তেলাপোকার কারণে মশারি তো সে টাঙাবেই, টাঙিয়ে অতি যত্নে, অতি নিখুঁত ভঙ্গিতে বিছানার চারপাশে এমন করে গুজবে মশারি, তেলাপোকার বাবারও সাধ্য নেই এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর গলে ভেতরে প্রবেশ করার। তার ওপর প্রতি পনের দিনে একবার নকরোচ এনে নিজ হাতে ছড়িয়ে রাখবে আনাচে কানাচে, যে সমস্ত জায়গায় তেলাপোকাঁদের থাকার সম্ভাবনা সে সমস্ত জায়গায়। হাতের কাছে সব সময় আছে এরোসল। ধারী তেলাপোকা তো দূরের কথা, নকরোচের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ছানাপোনাও যদি দুএকটা চেখে পড়ে, তক্ষুণি তাদের ওপর ফুস করে স্প্রে করবে এরোসল। অর্থাৎ তেলাপোকার বংশ ধ্বংস।

সুমির এই অত্যাচারের ফলে বাড়িটা একেবারেই তেলাপোকা শূন্য। তাহলে সুমির পায়ে এই অনুভূতিটা হলো কী করে? কে সুরসুরি দিল পায়ে।

দরজা বন্ধ করে ঘুমোনোর অভ্যেস সুমির। সুতরাং কেউ যে তার রুমে ঢুকে পায়ে সুরসুরি দেবে সে উপায় নেই। তাছাড়া মধ্যরাতে তাকে না ডেকে কে ঢুকবে তার রুমে?

সুমিদের বাড়িতে তারা চারজন মানুষ। মা বাবা ভাইয়া আর সুমি। দুজন। কাজের লোক আছে। নূরজাহান বুয়া আর তার তেরো চোদ্দ বছরের ছেলে মতি। মা বাবা কিংবা ভাইয়া রাত দুপুরে সুমির ঘরে ঢুকে নিশ্চয় তার পায়ে সুরসুরি দেবে না। নূরজাহান বুয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। দিনভর কাজ করে। রাতভর মরার মতো ঘুমোয়। সম্ভব শুধু মতির পক্ষে। কারণ ছোঁকড়াটা দুষ্ট প্রকৃতির। কিন্তু সুমিকে সে যমের মতো ভয় পায়। এমন সাহস মতির কখনই হবে না, সুমি ঘুমিয়ে আছে আর তার রুমে ঢুকে তার পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে! সবচে’ বড় কথা হলো রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লোক ঢুকবে কী করে!

তারপরই সুমির মনে হলো ঘুমোবার আগে দরজাটা কি আজ সে বন্ধ করেছিল!

হয়তো বন্ধ করেনি। দরজা খোলা দেখে বাবা হয়তো তার রুমে ঢুকে সুমির সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করছে। এই ধরনের দুষ্টুমির স্বভাব বাবার আছে। বিশেষ করে সুমির সঙ্গে। আচমকা এমন করতেও পারেন তিনি।

বাবার কথা ভেবে ভাল লাগল সুমির। সত্যি সত্যি বাবা যদি এসে থাকেন, সত্যি সত্যি যদি সুমির পায়ে সুরসুরি দিয়ে থাকেন তাহলে বেশ মজা হবে।

বাবার কথা ভেবে প্রথমে মাথার কাছের আলোটা জ্বালল সুমি। তারপর বিছানায় উঠে বসল।

রুমে কেউ নেই। ওই তো ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ দরজা। তাহলে পায়ে সুরসুরিটা সুমির দিল কে? সুমি একটু চিন্তিত হলো। তাহলে কি তেলাপোকা ঢুকেছে মশারির ভেতর!

সুমি তারপর পাগলের মতো তেলাপোকা খুঁজতে লাগল। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা পেল না। আর যেভাবে মশারি গোঁজা, তেলাপোকা ঢোকা সম্ভবই না।

মশারি গোঁজার আগেই যদি ঢুকে বসে থাকত তাহলেও যেভাবে সুমি খুঁজেছে, না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তোলাপোকা কেন পিঁপড়ে হলেও চোখে পড়ত।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল কী? সুমির পায়ে আসলে কেউ সুরসুরি দেয়নি। তেলাপোকা, না মানুষ। সে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে। সুরসুরির অনুভূতিটা হয়েছে স্বপ্নে।

লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল সুমি।

সুমির ঘুম পাতলা তার ওপর একবার ভাঙলে সহজে আর আসতে চায় না। ঘুম ভাঙার পর আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত সময়টা খুবই যন্ত্রণার। কী যে অসহায় লাগে! সবচে’ বড় কথা কত কথা যে মনে পড়ে!

এখনও পড়ল।

কিন্তু যে মানুষটার কথা মনে পড়ল তার কথা সুমি ভাবতে চায় না। একেবারেই ভাবতে চায় না। সেই মানুষটার কারণে জীবন অন্যরকম হয়ে গেছে তার। এলোমেলো হয়ে গেছে। মনের ভেতর দেখা দিয়েছে নানারকমের জটিলতা। হাজার চেষ্টায়ও জটিলতাগুলো কাটাতে পারছে না সে।

কিন্তু এই যে রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে মানুষটার কথা সুমির মনে পড়ছে, মন থেকে এখন সে তাকে মোছে কী করে?

ভাবনাটা সে তাড়ায় কী করে?

এইসব মুহূর্তে আজকাল খুব আল্লাহকে ডাকে সুমি। আল্লাহকে বলে, ইয়া হে আল্লাহ, তোমার রহমতের দরজা আমার জন্য খুলে দাও। আমার মন থেকে ওর চিন্তা মুছে দাও। আমার মনে শান্তি দাও।

আজও এভাবেই বলল। বলতে বলতে মন এলোমেলো করে দেয়া মানুষটার কথা ভুলতে পারল এবং এক সময় তন্দ্রামতো এলো সুমির।

এই অবস্থায় আবার সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো। সেই সুরসুরির অনুভূতি।

কিন্তু এবার আর পায়ে নয়। তলপেটের সামান্য ওপরে, নাভির কাছাকাছি। সুমির মনে হলো তলপেটের সামান্য নিচে নেমে আছে তার সালোয়ার এবং নাভির সামান্য উপরে ওঠে গেছে কামিজ। ফলে যে জায়গাটুকু উন্মুক্ত হয়েছে। সেখানে মৃদু মোলায়েম হাতে সুরসুরি দিচ্ছে কেউ।

সুরসুরি দিচ্ছে নাকি হাত বুলাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে গলার কাছে, গালের কাছেও একই অনুভূতি। কিন্তু এখানে ঠিক সুরসুরি নয়, যেন কেউ মুখ ঘষছে। খুবই নরম, আদুরে ভঙ্গিতে মুখ ঘষছে। তার শ্বাস প্রশ্বাসও যেন টের পেল সুমি। সঙ্গে বেশ পুরুষালি একটা পারফিউমের গন্ধ।

এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল সুমি। ধরফর করে উঠে বসতে গিয়ে পারফিউমের গন্ধটা চিনতে পারল। খুবই পরিচিত, কমন পারফিউম, ওয়ান ম্যান শো।

কিন্তু এতরাতে বন্ধঘরে এই পারফিউম মেখে কে এসে নাভিমূলে সুরসুরি দিচ্ছে সুমির?

গলার কাছে, গালের কাছেই বা মুখ ঘষছে কে?

সুমি বেডসুইচ টিপল। কিন্তু আলো জ্বলল না।

এবার বুকটা ধ্বক করে উঠল সুমির। হাত পা কাঁপতে লাগল। ঢোক গিলতে গিয়ে টের পেল গলা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। দমটাও কী রকম বন্ধ হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে।

ব্যাপারটা কী? কী হচ্ছে এসব? প্রথমে পায়ে সুরসুরি, তারপর নাভিমূল এবং গালে মুখে। সঙ্গে পারফিউমের গন্ধ, গালে গলায় কার মুখের স্পর্শ! এখন সুইচ টিপে দেখছে আলো জ্বলছে না।

কিন্তু ভূতের ভয়ে সুমির একদমই নেই। কোনওদিনও ছিল না। স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে একা ঘরে শোয়। ভয় টয় কোনওদিনও তেমন পায়নি। এমন কি দুঃস্বপ্নও সে তেমন দেখে না। ঘুম আগে আর একটু গভীর ছিল। গত কয়েক মাসে হালকা হয়ে গেছে। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে প্রায়ই। অর্থাৎ আগের সুমির সঙ্গে আজকের সুমির অনেক ব্যবধান। গত কয়েক মাসে সুমি অনেক বদলে গেছে।

কিন্তু ভূতের ভয় তার তৈরি হয়নি।

তবু সুমি এখন ভয় পাচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ ঘরে কে এসে ঢুকবে, কে এমন করবে সুমির সঙ্গে!

নাকি আসলে এসব ঘটেনি, সুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছে অথবা অবচেতনে এই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।

কিন্তু আলো জ্বলছে না কেন? এটা তো ভৌতিক কাণ্ড!

ঠিক তখুনি গ্রীবার কাছে অতি মৃদু ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলল কেউ, সঙ্গে সেই পারফিউমের গন্ধ।

সঙ্গে সঙ্গে সুমি একেবারে লাফিয়ে উঠল। কে? কে এখানে? কে? এ্যা, কে?

নিজের অজান্তে অন্ধের ভঙ্গিতে এদিক ওদিক শূন্যে হাতাতে লাগল সে। কে? কে এখানে? কে?

কিন্তু কাউকে ছুঁতে পারল না সুমি। কারও স্পর্শ কিংবা অস্তিত্ব টের পেল না। শুধু নিরেট বিছানা, নেটের মশারি, বেডসুইচ, পড়ার টেবিল চেয়ারে হাত লাগছে, বইপত্রে হাত লাগছে।

লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো সুমি। নিরেট অন্ধকারে হাতাতে হাতাতে দরজার কাছে এল। ছিটকিনি খুলে পাগলের মতো ছুটে এল মা বাবার বেডরুমের দরজায়। দুহাতে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে মাকে ডাকতে লাগল, বাবাকে ডাকতে লাগল। ওমা, মা। বাবা, বাবা দরজা খোল, তাড়াতাড়ি দরজা খোল। তাড়াতাড়ি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে আলো জ্বলল। মূসা সাহেব দরজা খুললেন। তাঁর পেছনে রুনু। রুনুই আগে কথা বললেন, কী রে, কী হয়েছে?

সুমির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখে আতঙ্ক। প্রথমে কথাই বলতে পারল না সে।

মূসা সাহেব দেখতে পেলেন মেয়েটি তাঁর থরথর করে কাঁপছে। দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। কী হয়েছে মা? কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?

তখনও কথা বলতে পারছে না সুমি। বাবার বুকে থরথর করে কাঁপছে। কোন ফাঁকে রুনু ধরেছিলেন মেয়ের হাত। তিনিও ততোক্ষণে দিশেহারা। অস্থির গলায় বললেন, কী রে, কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?

সুমি কথা বলবার আগেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এল সাদি। হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙে গেছে তার। মা বাবা এবং সুমিকে দেখে সে এসে দাঁড়াল তিনজন মানুষের সামনে। ঘুম ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?

রুনু বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। পাগলের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছিল। এখন কোনও কথা বলছে না।

মূসা সাহেব এসব কথা গ্রাহ্য করলেন না। সুমিকে বুকে জড়িয়ে তার মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছেন। কী হয়েছে মা? বল আমাকে। ভয় পেয়েছিস? বল। না বললে বুঝব কী করে?

সাদিও বলল কথাটা। বল কী হয়েছে? না বললে সমস্যাটা আমরা বুঝব কী করে?

তততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলেছে সুমি। কোনও রকমে বলল, আমার রুমে যেন কে ঢুকেছিল।

এ কথা শুনে তিনজন মানুষ একসঙ্গে চমকাল।

মূসা সাহেব বললেন, কী?

সুমি মাথা নাড়ল। হ্যাঁ বাবা। কে যেন ঢুকেছিল আমার রুমে।

রুনু বললেন, কে? কে ঢুকেছিল?

তা বলতে পারি না!

সাদি বলল, তোর রুমের দরজা বন্ধ ছিল না?

ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।

মূসা সাহেব বললেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকলে সেই রুমে কেউ ঢোকে কেমন করে?

রুনু বললেন, কী আশ্চর্য কথা! তাছাড়া ওর রুমে মাঝরাতে কে ঢুকতে যাবে? এই বাড়িতে আছে কে? বুয়া আর মতি থাকে নীচতলায়। তাছাড়া এরকম রাত দুপুরে…।

সাদি বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

মূসা সাহেব বললেন, বাড়িতে চোর টোর ঢোকেনি তো?

রুনু আইনজ্ঞ। জজকোর্টে প্রাকটিস করেন অনেকদিন ধরে। বাড়ির নীচতলায় তাঁর চেম্বার। নারী এবং শিশু বিষয়ক কেস বেশি ডিল করেন। পেশার ক্ষেত্রে মোটামুটি নামডাক আছে তার। রোজগার ভালই।

কিন্তু আইনজ্ঞ হওয়ার ফলে যে কোনও বিষয়ে জেরা করার একটা স্বভাব নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গেছে তাঁর। যুক্তিবাদি মানুষ তিনি। অযৌক্তিক কথাবার্তা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। স্বামীর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাঁর দিকে তাকালেন। এরকম বাড়িতে চোর ঢোকে কী করে? নীচের মেইনগেট বন্ধ করলে বাড়িটা দূর্গ। মেইনগেটের পর গাড়ি বারান্দা। তারপর ভেতরে ঢোকার আরেকটা কোলাপসিবল গেট। ইয়া বড় একটা তালা সেই গেটে লাগিয়ে দেয় মতি। দোতলায় ওঠার পরও ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে কাঠের দরজা। আজ সেই দরজাটা আমি নিজ হাতে লক করেছি। এরকম তিনটে দরজা টপকে চোর ঢোকে কী করে? তার ওপর সুমির নিজের রুমও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

অকাট্য যুক্তি।

তবু আমতা আমতা করে মূসা সাহেব বললেন, হয়তো দিনের বেলায় কোনও ফাঁকে চোর ঢুকে ঘাপটি মেরেছিল।

রুনু বললেন, তাও সম্ভব নয়। কারণ সুমির রুমে তেমন কোনও ফার্নিচার নেই। বাথরুম ছাড়া ঘাপটি মেরে থাকার জায়গা নেই। তবে আমি সিওর বাথরুমে ওভাবে ঘাপটি মেরে কেউ ছিল না। কারণ ঘুমোবার আগে সুমি নিশ্চয় বাথরুমে ঢুকেছিল। কেউ থাকলে তখুনি দেখে ফেলত।

সাদি অস্থির গলায় বলল, বুঝলাম কিন্তু ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল কী?

রুনু বললেন, সুমিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করা উচিত। নয়তো বোঝা যাবে না কী ঘটেছে।

তারপর সুমির দিকে তাকালেন তিনি। তুই যে বললি তোর রুমে কেউ ঢুকেছিল, বুঝলি কী করে? মানে তুই দেখেছিস কী না?

মা বাবা এবং ভাইয়ার কথা শুনতে শুনতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে সুমি। বাবা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বাবার দুহাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করল সে। না আমি কাউকে দেখতে পাইনি।

তাহলে বুঝলি কী করে যে কেউ ঢুকেছে?

আমার পায়ে সুরসুরি দিয়েছে।

রুনু কথা বলবার আগেই মূসা সাহেব বললেন, মানে?

আমার পায়ে কে যেন সুরসুরি দিচ্ছিল।

সাদি হেসে ফেলল। পায়ে সুরসুরি দিচ্ছিল?

রুনুও হাসলেন। এমন কথা বাপের জন্মেও শুনিনি। চোর ঘরে ঢুকে চুরি না করে কারও পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে, শুনলে লোকে খানিক বুঝতেই পারবে না তার হাসা উচিত না কাঁদা।

সুমি বলল, আমি কি তোমাকে বলেছি যে ঘরে চোর ঢুকেছিল?

মূসা সাহেব বললেন, না না আমি বলেছি। তোদের যুক্তিতর্কে বুঝলাম চোর ঢোকেনি। ব্যাপারটা অন্য কিছু।

সাদি বলল, অন্যকিছু মানে?

রুনু বললেন, তেলাপোকা টোকা পায়ে উঠেছিল।

সুমি বলল, না, তেলাপোকা না। বেশ কয়েকবার সুরসুরি দেয়ার পর আমার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সুরসুরিটা বন্ধ হয়ে যায়। তবু আমি উঠে লাইট জ্বেলেছি। দেখি, না কোথাও কেউ নেই। মশারির ভেতর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তেলাপোকা কিংবা ওরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি।

মূসা সাহেব বললেন, তাহলে সুরসুরি তোর পায়ের কেউ দেয়নি। তুই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিস তোর পায়ে কেউ সুরসুরি দিচ্ছে।

প্রথমবার আমিও তাই ভেবেছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার…।

কথাটা শেষ করল না সুমি।

রুনু বললেন, আবার কী হল? আবার সেই পায়ে সুরসুরি?

না।

তাহলে?

নাভিমূলের ব্যাপারটা বাবা এবং ভাইয়ার সামনে বলতে লজ্জা করছিল সুমির। ওইটুকু চেপে বাকিটুকু বলল সে, তবে বলল একটু ঘুরিয়ে। পরের বার গলার কাছটায় সুরসুরি দিচ্ছিল। ঘুম ভাঙার পর সুরসুরিটা বন্ধ হলো ঠিকই কিন্তু একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।

রুনু ভ্রু কোঁচকালেন। গন্ধ মানে? কিসের গন্ধ?

পারফিউমের।

পারফিউমের? পুরুষালি পারফিউম না মেয়েলি?

পুরুষালি শব্দটাই শুধু নয় পারফিউমের নামটাও প্রায় মুখে এসে যাচ্ছিল সুমির, কিন্তু কী যেন কী কারণে বলতে লজ্জা করল তার। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি মিথ্যে কথা বলল, তা খেয়াল করিনি।

মূসা সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন তিনি তার আগেই রুনু বলল, তারপর কী করলি তুই? ভয় পেয়ে গেলি? ছুটে এসে আমাদের দরজা ধাক্কাতে লাগলি?

না। বেডসুইচ টিপেছি, দেখি জ্বলছে না। তখুনি পিঠের কাছে কে যেন শ্বাস ফেলল। আবার সেই পারফিউমের গন্ধটা পেলাম। কে কে করে চিৎকার করলাম। তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলে…।

মূসা সাহেব রুনুর দিকে তাকালেন। এসবের মানে কী?

রুনু বেশ চিন্তিত। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

সাদি বলল, বুঝতে না পারার কিছু নেই। সুরসুরি বা শ্বাস ফেলার ব্যাপারটি ঘটেছে স্বপ্নে। আর পারফিউমের গন্ধটা ওর নিজের পারফিউমেরই গন্ধ। হয়তো ঘরের কোথাও পারফিউমের শিশি আগেই ছিটকে পড়ে ভেঙে টেঙে ছিল, ওই থেকে গন্ধ আসছিল।

সুমি বলল, তাহলে প্রথমবার গন্ধটা পাইনি কেন?

হয়তো গন্ধটা তখনও ছিল। তুই খেয়াল করিসনি।

কিন্তু সুইচ টেপার পর আলোটা পরেরবার জ্বলল না কেন?

কী করে জ্বলবে? তখন তো ইলেকট্রিসিটি ছিল না।

মূসা সাহেব বললেন, তুই বুঝলি কী করে যে ইলেকট্রিসিটি ছিল না?

তোমাদের কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে আসবার কিছুক্ষণ আগে টয়লেটে গিয়েছিলাম আমি। তখন আমার বাথরুমের আলো জ্বলেনি। ব্যাপারটা হয়েছে এই রকম, সুমি এসে তোমাদের দরজায় ধাক্কা দিয়েছে ঠিক তখুনি আলো এসেছে। এইজন্য তোমরা সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলেছে।

রুনু বললেন, ঠিকই বলেছিস। এরকমই ঘটেছে।

সুমি বলল, না। নিশ্চয় এর মধ্যে অন্যকোনও ব্যাপার আছে। সুরসুরিটা আমি পরিষ্কার টের পেয়েছি। শ্বাস ফেলাটা টের পেয়েছি। যে ধরনের পারফিউমের গন্ধ ছিল ওই ধরনের পারফিউম আমার কালেকশানে নেই।

মূসা সাহেব বললেন, তুই কি তাহলে বলতে চাচ্ছিস যে ব্যাপারটা ভুতুড়ে?

কিন্তু ভূতের ভয় আমার নেই। বিশ্বাসও নেই।

তাহলে এত ভয় পেয়েছিস কেন?

ভয় পাওয়ার কারণ, ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে।

এবার সাদি একটা হাই তুলল। ধুৎ কিছু না এসব। যা শুয়ে পড় গিয়ে। আমি গেলাম। সকালে অফিস আছে।

সুমি বলল, কিন্তু একটা ব্যাপার তোমাদের প্রমাণ করা উচিত।

কী?

ওই যে তুমি বললে হয়তো আমার রুমে কোনও পারফিউমের শিশি ভোলা আছে কিংবা ভেঙেছে, ওটা তো এখুনি তোমরা প্রমাণ করতে পার।

রুনু বললেন, ঠিক।

মূসা সাহেব বললেন, চল সবাই মিলে তাহলে ওর রুমে যাই। খুঁজে পেতে দেখি।

সাদির খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। তবু সবার সঙ্গে সুমির রুমে এসে ঢুকল।

রুমে ঢুকে প্রথমেই সুইচ টিপলেন রুনু। উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল রুম।

সুমি কী রকম একটা হাপ ছাড়ল। ভয়টা এখন অনেকটাই কমেছে। তবু বুকের ভেতর কী রকম থম ধরে আছে।

মূসা সাহেব রুনু এবং সাদি তখন রুমের চারদিকে তাকিয়ে ভাঙা কিংবা মুখ ভোলা পারফিউমের শিশি খুঁজছে। সুমি নিজেও তার ড্রেসিংটেবিলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল, ও রকম কোনও পারফিউমের শিশি পাওয়া যায় কী না।

না পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে সাদি বলল, সুমি, এসব আসলে তোর মনের গণ্ডগোল। এই রুমের কোথাও কিছু নেই, কিছু হয়নি। যেসব অনুভূতির কথা তুই বললি ওসব হয়েছে স্বপ্নে অথবা তোর অবচেতন মনে। হয়তো এই ধরনের কিছু তুই ভেবেছিস কিংবা কল্পনা করেছিস। ঘুমটা গম্ভীর হয়নি বলে ঘুমে জাগরণে মিলেমিশে ওসব তোর মনে হয়েছে। কিছু না, কিছু না। শুয়ে পড়। দরকার হলে একটা রিলাকজিন খা। ফ্রেস ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেল সুমি। না না এই রুমে একা আমি আর পোব না। কিছুতেই না।

তাহলে কোথায় শুবি?

মূসা সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মেয়েটা যখন ভয় পাচ্ছে, তুমি না হয় ওর সঙ্গে থাক।

রুনু একটু বিরক্ত হলেন। ওর বিছানায় আমার ঘুম হবে? তুমি তো জানো নিজের বিছানা ছাড়া একদম ঘুমোতে পারি না আমি। সকালে কোর্টে দৌড়াতে হবে। জরুরী একটা কেস আছে। ঘুমটা ভাল না হলে…। তারচে’ বরং একটা কাজ করি নীচতলা থেকে নূরজাহান আর মতিকে ডাকি। নূরজাহান শোবে সুমির রুমের মেঝেতে আর মতি সামনের বারান্দায়।

শুনে মূসা সাহেব একটু গম্ভীর হলেন। এতকিছুর দরকার নেই। সুমি, তুই গিয়ে তোর মার সঙ্গে আমাদের রুমে শো। আমি থাকছি তোর রুমে।

সাদি বলল, আমি তাহলে গেলাম বাবা।

যা।

কিন্তু মায়ের পাশে শুয়েও বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারল না সুমি। সারারাত মনের ভেতরটা আকুলি বিকুলি করল তার। বুকটা ভার হয়ে রইল। মনে মনে প্রায় সারারাত আল্লাহকে ডাকল সুমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *