১. বোম্বে থেকে

প্রথম প্রবাস উপন্যাসবুদ্ধদেব গুহ

০১.

বোম্বে থেকে লুফতহানসার উড়ান কাল খুব সকালে। একটানা। না থেমে ফ্রাঙ্কফার্ট।

বোম্বেতে ইতিপূর্বে কাজে এসেছি অনেকবার। এবার অকাজে। কলকাতা থেকে বোম্বে ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনসের উড়ান মাত্র ঘণ্টা তিনেক লেট ছিল। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করলাম। শহরে অনুপস্থিত এক বন্ধুর গাড়ি ও তার সেক্রেটারি-ছিপছিপে সুন্দরী একটি পারশি মেয়ে, নাম জারীন, নিতে এসেছিলেন সান্টা-ক্রুজে। তখন শেষ বিকেল। সেপ্টেম্বর মাস। ভ্যাপসা গরম।

 জারীন আমাকে তাজ হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কাল শেষরাতে গাড়ি আসবে বলে গেলেন।

চান-টান করে হোটেলের ঘরের পর্দা সরিয়ে কাঁচের মধ্যে দিয়ে বোম্বের রাতের আলো দেখছিলাম।

মনটা খারাপ লাগছিল। বেশ বেশি খারাপ। অথচ সে মুহূর্তে আনন্দিত হওয়ারই কথা ছিল। দু-মাসের জন্য বিদেশ যাচ্ছি, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। কত দেশে পা রাখব, কত লোকের সঙ্গে মিশব, চোখ খুলে পৃথিবীর শরীর দেখব, কান খুলে হৃৎস্পন্দন শুনব– নিজের বুকের মধ্যে, চেতনার মধ্যে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে সমস্ত পৃথিবীর শব্দ, স্পর্শ, রূপকে রুপোলি নূপুরের মতো ঝুমঝুমির মতো বাজাব ভেবেছিলাম।

কিন্তু তবুও দুঃখ হচ্ছিল।

চিরকেলে মধ্যবিত্ত বাঙালি বোধহয় কখনো শক্ত হতে জানেনি। শক্ত করতে পারেনি নিজেকে। বাইরের মুখোশটা শক্ত করতে পারলেও ভেতরটা শামুকের অভ্যন্তরের মতো চিরদিন তার তুলতুলই রয়ে যায়। বাঙালি বোধহয় চিরকালই বাঙালিই থেকে যায়। একটুতেই তার মন খারাপ হয়। যখন খুব আনন্দিত হবার কথা ঠিক তখনই কলকাতার ফেলে-আসা বাড়ি, বয়স্ক বাবা, ভগ্নস্বাস্থ্য মা, বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন বাড়ির বিভিন্ন ঘরে বসে-শুয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা অনেককে বারবার মনে পড়ে। যাদের ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার পেয়েছি, পাই প্রতিনিয়ত; যাদের প্রত্যেকের সঙ্গে অনেক সময়েই খারাপ ব্যবহার করি এবং করেই পরমুহূর্তে নিজেই কষ্ট পাই এমন প্রত্যেককেই মনে পড়ে–বারবার। নিরুচ্চারে মন বলে–ভালো থেকো তোমরা সব। তোমরা সকলে খুব ভালো থেকো।

এই মন খারাপটা আসলে অমূলক। কারণ, দূরত্ব মনে করলেই তা দূরত্ব। যাত্রার সময়ের হিসেবে কখনো কখনো শিয়ালদা থেকে ট্রেনে বহরমপুর (একশো তিরিশ মাইল) যেতে যে সময় লাগে সেই সময়ে দমদম থেকে ফ্রাঙ্কফার্টে গিয়ে পৌঁছোনো যায়। বহুহাজার মাইল দূর না ভেবে মাত্র বারো ঘণ্টা দূর ভাবলেই মন খারাপের আর হেতু থাকে না। তা ছাড়া, একথাটা প্রায়ই সত্যি যে, বাংলার অন্য প্রান্তে বোনের বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে যত-না দেখা হয়, যে বোনের বিয়ে সুদূরে নিউইয়র্কে তার সঙ্গে দেখা হয় তার চেয়ে বেশি। কোনো বিপদ-আপদে বা দোল-দুর্গোৎসবে বাংলার বোন গরুর গাড়ি, সাইকেলরিকশা, ট্রেন এবং ট্যাক্সির মাধ্যমে বাড়ি এসে পৌঁছতে যে সময় নেয়, নিউইয়র্কের বা টোকিওর বোন তার চেয়ে আগে এসে পৌঁছে যায়। তবু, সব জানা সত্ত্বেও মন খারাপ লাগে দূরে যেতে–অল্প কিছুদিনের জন্যে হলেও।

অন্ধকার থাকতে তৈরি হয়ে নিয়ে শেষরাতে হোটেলের লবিতে এসে দাঁড়ালাম। আমি যে লিফটে নাবলাম সে লিফটেই লুফতহানসা কোম্পানির দুজন এয়ারহোস্টেস–হলুদ আর নীল ইউনিফর্ম পরে নামল। তখন পর্যন্ত তাদের সুন্দর চেহারাই চোখে পড়েছে–গুণাবলি চোখে পড়ল অনেক পরে-প্লেনের মধ্যে।

 ভোরের মিষ্টি সামুদ্রিক হাওয়া অন্ধকারের আড়াল থেকে ছুটে আসছিল চোখে-মুখে, গাড়ির মধ্যে। সান্টা-ক্রুজে পৌঁছিয়ে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করলাম আগে। তারপর কাউন্টারে বসা একজন মোটাসোটা হাসিখুশি পারশি ভদ্ৰমিহলা আমাকে ছাপ্পান্নটি টাকার বিনিময়ে তেলচিটে আটটি ডলার দিলেন। এবং তিনি নিজে যতই হাসিখুশি থাকুন না কেন, আমাকে বিলক্ষণ অখুশি করলেন। এই আটটি ডলার সম্বল করে আমায় পাড়ি দিতে হবে ফ্রাঙ্কফার্ট— সেখান থেকে লানডান।

যেহেতু আমি একজন সাধারণ নাগরিক, যেহেতু আমি পাট বা চা বা নরকঙ্কাল বা অন্যকিছু রপ্তানি করে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারি না, অথবা যেহেতু আমি সরকারি কেউ-কেটা নই কোনো, সেইহেতু আমার বরাদ্দ এই করুণ এবং হাস্যোদ্দীপক ছাপ্পান্ন টাকার সমতুল বিদেশি মুদ্রা।

ইমিগ্রেশনের পর কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়ে ব্যক্তিগত হাতব্যাগ ইত্যাদি পরীক্ষা-টরীক্ষার পর এমবার্কমেন্ট লবিতে গিয়ে বসলাম।

 ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। পুজোর আগের সোনালি রোদে ছেয়ে গেছে টারম্যাক। তবে এখানের রোদকে কলকাতার রোদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। বিশেষ করে এই সময়ের রোদ। বাংলায় এখন শরৎ আলোর কমলবনে বাহির হয়ে বিরাজ করে, যে ছিল মোর মনে মনে।

একটু পরই উড়ান ঘোষিত হল। টারম্যাকের ওপর বাস গড়িয়ে চলল। তারপর ডি-সি~ টেন প্লেনে উঠে পড়লাম।

ডাকোটা, অ্যাভো, ফকার–ফ্রেণ্ডশিপ, স্কাইমাস্টার, ক্যারাভিল, বোয়িং ৭০৭ ইত্যাদি সমস্ত প্লেনে চড়া এক; আর ডি-সি-টেন-এ চড়া আর এক। ঢুকতেই মনে হল, গান শুনতে বুঝি কোনো হলে এসে পৌঁছোলাম।

এই ফাঁকে বলে নিই লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে যে, পাঠক যদি খুব তালেবর হন তাহলে অধমকে ক্ষমা করবেন। কারণ লেখক একজন সামান্য লোক। বিদেশ যাত্রা তার এই প্রথম। এমনকী স্বদেশেও জাম্বো জেটে কখনোই চড়ার সৌভাগ্য হয়নি তার এর আগে।

একথাও উপক্রমণিকায় বলে রাখা ভালো যে, যাঁরা আকছার বিদেশ যান বা সেখানেই যাঁদের মৌরসিপাট্টা–এ লেখা তাঁদের জন্যে একেবারেই নয়। বরং যাঁরা কখনো যাননি এবং ভবিষ্যতেও যাঁদের যাওয়ার আশা ক্ষীণ বা একটুও নেই–তাঁদের কথা মনে করেই এই পাতা ভরানো। যাঁরা বিদেশে যাননি এবং যাবেন না, তাঁরা যদি এ লেখা পড়েন তাহলেই নগণ্য লেখক বিশেষ পুরস্কৃত হবে। তালেবরদের জন্যে বা বিদেশ সম্বন্ধে পন্ডিতমন্য পাঠকদের জন্যে অনেক পন্ডিত ও বিদগ্ধ লেখক আছেন। তাঁদের জন্যে এই মূর্খ লেখকের নামচা নয়।

প্রথমেই ফার্স্ট ক্লাসের ডেক। পিছনে ইকনমি ক্লাস। তাও পরপর তিনটি ভাগ আছে। যখন সিনেমা দেখানো হয় তখন একইসঙ্গে তিনটি জায়গায় দেখানো হয়। ষোলো মিলিমিটারের প্রজেক্টর বোধ হয় ওই বিরাট প্লেনের পুরো দৈর্ঘ্য সামলাতে পারে না, তাই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া, কোট ইত্যাদি রাখবার ওয়াড্রোব তো আছেই। তাদেরই গায়ে পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখানো হয়।

 সব প্যাসেঞ্জারের সিট দেখে বসতে বসতে, কোট খুলে রাখতে, আরও সব বড়ো বড়ো টুকিটাকি প্রস্তুতিপর্ব সমাধা হতে হতে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগল। অত লোক একপ্লেনে গেলে ওই সময় লাগাই স্বাভাবিক। সবাই চেপে চুপে, টায়-টায় বসে পড়ার পর রৌদ্রালোকিত টারম্যাকে ট্যাকসিইং করে জটায়ুর মতো প্লেনটা প্রধান রানওয়ের দিকে এগিয়ে চলল। প্রধান রানওয়েতে পড়ে, গতি বাড়িয়ে দেখতে দেখতে বোম্বের মাটি ছেড়ে একটা চক্কর মেরে আরব সাগরের নীল জলের ওপরে উড়ে এল। তারপরই জেটপ্লেনসুলভ অবলীলায় সোজা মেঘ ফুড়ে নীচের পৃথিবীকে চোখ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায় ক্রমাগত ওপরে উঠতে লাগল। দেখতে দেখতে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার ফিট ওপরে উঠে সমান্তরাল রেখায় চলতে লাগল। কিন্তু সেদিন পেঁজা কাঁপাস তুলোর মতো কয়েক-খন্ড নরম হালকা মেঘ ছাড়া আকাশ একেবারে পরিষ্কার ছিল। তাই কিছুক্ষণ পরই শুধু মাথার ওপরের এবং পাশের চারদিকে মহাশূন্যতা জনিত নীল এবং আরব সাগরের গভীরতার জলজ-নীলে মিলে এক আদিগন্ত নীলিমা শুধু উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিমই নয়, ঈশান, নৈঋতও সম্পূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তার মধ্যে একটি রুপোলি পাখির মতো উড়ে চলতে লাগল ডি-সি– টেন প্লেনখানি।

এতক্ষণ পর ভেতরে চাইবার অবকাশ হল। ভেবে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে সত্যি সত্যি আম্মো যাচ্ছি। কিন্তু চারপাশের সহযাত্রীদের দেখে ও দ্রুতসঞ্চারিণী নীলচক্ষু ব্লণ্ড ও ব্রুনেট কেশশালিনী এয়ারহোস্টেসদের দেখে অবিশ্বাস করারও উপায় ছিল না।

আমার পাশেই এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বসেছিলেন। সিডনি থেকে আসছেন। তাঁর সঙ্গে খুব আলাপ জমে গেল। ভদ্রলোক পিস্তল-শুটিং-এ অস্ট্রেলীয় চ্যাম্পিয়ান। নানাবিধ পিস্তল, ব্যালিস্টিকস এবং শুটিং কম্পিটিশন সম্বন্ধে নানা গল্প জুড়ে দিলেন তিনি।

ইতিমধ্যে খাওয়ানোর অত্যাচারও শুরু হয়ে গেল। আন্তজার্তিক ফ্লাইটে এত এত খাবার দেওয়া হয় যে নেহাত হ্যাংলা বা রাক্ষস ছাড়া কারও পক্ষেই সে খাবারের যথার্থ সম্মান করা সম্ভব নয়। তবু চোখ চেয়ে দেখলাম সবাই-ই খেয়ে চলেছেন। কিছুই করবার নেই, তাই-ই বোধহয় সকলেই খাওয়াতে মনোনিবেশ করেছেন।

ব্রেকফাস্টের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান মাখন, ড্যানিশ চিজ, জার্মান সসেজ, গরম গরম এবং মাখনের চেয়েও নরম ব্রেকফাস্ট রোলস। গরম ডিম ভাজা, ফিঙ্গার চিপস, নানারকম ফল এবং চা অথবা কফি।

ব্রেকফাস্টের পর কফির পেয়ালা শূন্য করে অত্যন্ত পুলকিত হওয়া গেল একথা জেনে যে, এখানে পাইপ খাওয়া চলতে পরে। ভারতবর্ষের মধ্যে কোনো উড়ানেই পাইপ খেতে দেওয়া হয় না। কেন দেওয়া হয় না জানি না। এখানে কেন দেওয়া হয় তাও জানি না। কিন্তু ভাগ্যিস হয়।

এই পাইপ-খাওয়া ব্যাপারটা স্বদেশে এখনও চালিয়াতি ও দম্ভ ও উচ্চমন্যতার শরিক বলে গণ্য হয়। পাইপ এখনও সমাজতন্ত্রে শামিল হয়নি। কেন যে হয়নি একথা ভেবে অনেক বিনিদ্র রাত কাটিয়ে বার বার আমার এই কথাই মনে হয়েছে যে, এ জন্যে বাংলা ছায়াছবি দায়ী মুখ্যত। দ্বিতীয়ত দায়ী, পাইপ খাওয়ার সর্বপ্রকার গুণাবলি সম্বন্ধে সাধারণের অপার অজ্ঞতা। ছায়াছবির কথা এই কারণে মনে পড়ে, কারণ সেই প্রমথেশ বড়ুয়ার আমল থেকে জমিদারের কুঁড়ে, দুশ্চরিত্র, বাপের পয়সায় বসে বসে-খাওয়া হাঁদা ছেলেরাই, যাদের একমাত্র কাজ ছিল বিলিয়ার্ড খেলা, হুইস্কি খাওয়া এবং স্নানরতা গ্রামের মেয়েদের শালীনতা নষ্ট করা; তারাই শুধু পাইপ খেয়ে এসেছে। এবং তাদের প্রত্যেককে পাইপ খেতে দেখে পাইপ খেকোদের সম্বন্ধে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গবাসীদের মনে যে, তাদের মানুষ খেকোদের চেয়েও বেশি ঘৃণা করা হয়েছে।

 দ্বিতীয় কারণ সম্বন্ধে বলি যে, পাইপ খাওয়া ব্যাপারটা যে, যে-কোনো ব্র্যাণ্ডের সিগারেট খাওয়ার চেয়েও অনেক সস্তা ও স্বাস্থ্যকর একথা অনেকেই জানেন না। তা ছাড়া যাঁরা বিবাহিত লোক, তাঁদের পক্ষে পাইপ শান্তিরক্ষার জন্যে প্রায় অপরিহার্য বলেই মনে হয়। স্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধটা দাঙ্গার পর্যায়ে যাতে না পৌঁছোয় সে জন্যে মতবিরোধের সঙ্গে সঙ্গেই পাইপ-খেকোরা পাইপ-খোঁচাখুঁচি ভরাভরি নিয়ে পড়তে পারেন। তাতে মানও বাঁচে, কুলও থাকে।

পরিশেষে এও বলি যে, পাইপ-খেকোদের মস্ত সুবিধে যে পাইপ কাউকে অফার করতে হয় না, অতএব ট্যাঁকের পয়সা ও অন্যের স্বাস্থ্যরক্ষাও হয় তাতে, নিজের হিতের সঙ্গে সঙ্গে।

 গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়ার পর জমিয়ে পাইপ ধরিয়ে বসেছি, এমন সময়ে ইয়ারফোন নিয়ে এল এয়ার হোস্টেসরা। ভাড়া দু-ডলার। ইয়ারফোনে কান লাগিয়ে ফোর-চ্যানেলড মিউজিক শোনা যাবে এবং সিনেমা যখন দেখানো হবে, তখন ইংরিজি, ফরাসি, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় সিনেমার কথা অনূদিত হয়ে কানে আসবে।

কিন্তু দু-ডলার তো অনেক টাকা। তা ছাড়া পকেটে মাত্র আটটি ডলার আছে। ডলার কটি সেন্ট-মাখানো কাগজে মুড়িয়ে অতিসযতনে পার্সের ভেতরের ভরে রেখেছি। কোনো সুন্দরীর চিঠিকেও এর আগে এত যত্নে রাখিনি আমি। কিন্তু নিরুপায়। এই দুর্মূল্য আট ডলারের একটি ডলারও খরচ করার সাহস এখন আমার নেই। এই যথাসর্বস্ব খরচ করে ফেললে যে মাসতুতো ভাই আমার লানডানে থাকে এবং যে আমাকে সেখানে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যাচ্ছে, সে যদি দৈবাৎ হিথ্রো এয়ারপার্টে না আসে তাহলে ট্যাক্সি করে যে তার বাড়ি পৌঁছোব সে সংস্থানও রইবে না।

পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে, সে না এলে ওই টাকায় তার বাড়ি থেকে মাইল দশেক আগে গিয়ে ফুটপাথে স্যুটকেস হাতে নেমে পড়তে হত। তারপর কী করতে হত এখনকার মতো সে প্রসঙ্গের অবতারণা না করাই ভালো।

 যাই হোক, ঠিক করলাম, আপাতত চলচ্চিত্রের বোবা-যুগেই বাস করা যাক। বিনিপয়সায় যতটুকু দেখা যায় তাই-ই দেখব; পয়সা ছাড়া শোনা যখন যাবেই না। অনেকে বিনিপয়সায় পেলে দাদের মলমও খান–তাঁদের কথা স্মরণ করে বোবা-যুগের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব না বলেই মনস্থ করলাম।

ব্রেকফাস্টের পরই, ট্রলিতে করে চলমান ডিউটি-ফ্রি শপ নিয়ে এয়ারহোস্টেসরা পাশ দিয়ে ঘুরে গেল। পাইপের টোব্যাকো, সিগারেট, হুইস্কি, পারফিউম ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখ খুলে একবার দেখে আবার নিলাম।

দোকান বন্ধ হওয়ার পরই আরম্ভ হল ছবি দেখানো। পশ্চিম জার্মানির একটি ছবি। কিশোর প্রেমের। তবে আমরা কিশোর প্রেম বলতে যা বুঝি এ তেমন নয়। আমাদের কিশোর প্রেম মানে বাছুরপ্রেম। কিশোরীর ফ্রকের কোনা উড়ে গেল হাওয়ায়–একঝলক ফর্সা হাঁটু চোখে পড়ল–কিশোরের বুকের মধ্যে দিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেস চলে গেল ধ্বকঋকিয়ে। বাড়ি গিয়ে ধপাস করে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়ল সে, নইলে নেহাত কবিপ্রকৃতির ছেলে হলে, খাতা-কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসে গেল।

কিন্তু এ-ছবি সেরকম নয়।

একটি উর্দু শায়ের শুনেছিলাম, নাজিম মিয়ার কাছে, কৈশোরের বর্ণনার।

আভি লড়প্পন ভি হ্যায়,
শাবাব ভি হ্যায়,
হায়া কি পরদেমে ও সৌখবে।
 নকাব ভি হ্যায়।

অর্থাৎ এখন মেয়েটির ছেলেমানুষি চপলতাও আছে, আবার যুবতীসুলভ লজ্জাও ছেয়ে এসেছে। শৈশব ও যৌবন যেন দুটি ঘর। দু-ঘরের মধ্যে একটি পর্দা টাঙানা। হাওয়া এসে পর্দায় দোল দিচ্ছে। একবার এঘর, একবার ওঘর। তারই নাম কৈশোর।

কিন্তু জার্মান ছবির কিশোর নায়কের বয়েস তেরো কি চোদ্দ এবং কিশোরীরও তাই-ই। নিভৃতে তারা দুজনে দুজনকে চোখের নিমেষে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলে তারপর বাৎসায়নের বইতে যা যা করণীয় বলে লেখা আছে, তার সবকিছুই এমন পটুতার সঙ্গে করে ফেলল যে এ-ব্যাপারে এই বালখিল্যদের পান্ডিত্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য বলে মনে হল। বোঝাই গেল যে, সিনেমার কিশোর নায়কের দুগুণ বয়েস হওয়া সত্ত্বেও এ-অধমের এ-বাবদে জ্ঞানগম্যি বড়োই কম। তড়িৎ-ঘড়িৎ পাইপ ভরলাম আবার। ছবি দেখে রীতিমতো আপসেট।

কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই দাগ কাটল না এখানের অন্য কারও মনেই। প্লেনে কম করে পনেরো-কুড়িজন শিশু ছিল। শিশু বলতে যাদের বয়েস দশ থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। তারাও অম্লান বদনে কেউ মায়ের কোলে বসে আঙুল চুষতে চুষতে, কেউ লাল প্লাস্টিকের বল কোলে নিয়ে অত্যন্ত তন্ময় হয়ে এ-ছবি দেখে গেল। যেন বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছে।

ছবি শেষ হতে না হতেই প্রি-লাঞ্চ ড্রিঙ্কস সার্ভ করার আয়োজন শুরু হল। বিনিপয়সায় নানারকম ফুট-জুস, কোকো-কোলা, অ্যাপলসাইডার ইত্যাদি পাওয়া যায়। পয়সা দিলে নানারকম কন্টিনেন্টাল রেড ও হোয়াইট ওয়াইন, নানারকম বিয়ার ও এল জার্মানির লাগার বিয়ার–অরাঞ্জাবুম। এবং অন্যান্য যে-কোনো পানীয়।

বিনিপয়সায় বলেই হয়তো টোম্যাটো-জুস ভালো লাগল।

ইতিমধ্যে এয়ার-হোস্টেসদের এবং আমাদের সেকশনে যে ফ্লাইটপার্সার ছেলেটি ছিল তাদের কর্মদক্ষতা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেছিলাম। কী তড়িৎ গতিতে, হাসিমুখে ও কী সুষ্ঠুভাবে যে তারা তাদের কাজ করছিল, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। প্রায় তিনশোজন লোকের দেখা-শোনা, মাত্র চারজন মেয়ে ও দুজন ফ্লাইট-পার্সার যে আন্তরিকতার সঙ্গে ও যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে করছিল, তাতে পুরো জার্মান জাতটার ওপরে শ্রদ্ধা না জন্মিয়ে উপায় ছিল না। তাদের পটভূমিতে আমাদের ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনসের (এয়ার ইণ্ডিয়ার নয়), এয়ারহোস্টেসদের কথা মনে আসছিল। এ নয় যে, তাঁরা কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন, কিন্তু তাঁরা যেন কলের পুতুল অথবা বহুদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা রোগিণী। তাঁরা হাসেন অতীব কষ্ট করে। ঘাড় বেঁকিয়ে অন্যদিকে ফিরে হাতজোড় করে যেমন তাঁরা নমস্তে বলেন তা দেখে, প্যাসেঞ্জারদেরই হাসি আসে। অথচ তাঁরা নিজেরা হাসতে জানেন না। এত টাকা মাইনে দিয়ে, এমন সুন্দর সাজপোশাক পরিয়ে এমন রাম গড়রের ছানাদের কেন ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনসে রাখা হয় তা সাধারণ বুদ্ধির বাইরে। হয়তো অসাধারণ বুদ্ধিরও বাইরে।

মনে হয় এর একমাত্র প্রতিকার প্রতিযোগিতায়। একচেটিয়া উদ্যোগের কুফল সম্বন্ধে আমাদের জাতীয় সরকার যদি সচেতন হতেন–আনন্দের কথা হত। কিন্তু মাঝে মাঝে সরকারের উচিত নিজের আঙিনায় চেয়ে দেখা। একচেটিয়া উদ্যোগের কুফলগুলি সরকারি উদ্যোগসমূহে প্রায়শই বড়োই নগ্ন ও প্রতিকারহীন ভাবে প্রকট। যে-কেউই দেশকে ভালোবাসে, তার চোখে এটা খারাপ ঠেকে।

কিছুক্ষণ পর মাইক্রোফোনে ক্যাপ্টেন বললেন যে, আমরা এখুনি ইরান ও টার্কি পেরিয়ে এলাম।

ভাবতে ভালোই লাগছিল যে, সত্যি সত্যিই একঘণ্টায় এতদূরে চলে এসেছি। ক্যাপ্টেন আরও বললেন যে, কয়েক ঘণ্টা পরে ইউরোপের ভূখন্ড দেখা যাবে–আলপস-এর বরফাবৃত চুড়োও দেখা যাবে।

 এই আজ সকালেই বোম্বেতে ছিলাম। ব্রেকফাস্ট খেলাম, বোবাছবি দেখলাম, লাঞ্চ খেতে না-খেতে কোথায় এসে পড়লাম। পৃথিবীটা সত্যিই বড়ো ছোটো হয়ে গেছে। হাতের মুঠোয়। এই বিজ্ঞানের দিনে। এতে সুখী হওয়া উচিত কি দুঃখী হওয়া উচিত তা চট করে বলা মুশকিল।

লাঞ্চ খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই চা। তারপর আবার প্রি-ডিনার ড্রিঙ্কস। বাইরে তখন খটখটে রোদ।

প্লেনে উঠেই ঠিক করেছিলাম যে, যতবারই খেতে দিক না কেন, আমার নিজের ঘড়ি দেখে সেই সময়মতোই খাব। আমার ঘড়িতে খাবার সময় না হলে খাবই না। তাই ডিনার দিলেও, ডিনার এলেও খেলাম না।

দেখতে দেখতে বারো-তেরো ঘণ্টা সময় কেটে গেল। প্লেন ক্রমশ নীচে নামতে লাগল। এয়ার-হোস্টেস আর ফ্লাইট-পার্সাররা নানা-রঙা ছোটো ছোটো তোয়ালে জীবাণুমুক্ত করে সিদ্ধ করে গরম অবস্থায় প্রত্যেককে স্টেইনলেস স্টিলের সাঁড়াশি করে তুলে দিয়ে গেল। ওই দিয়ে মুখ হাত, গলা-ঘাড়, সব মুছে নেওয়ায়, মনে হল, ক্লান্তি দূর হল। সত্যি সত্যিই হল কি না জানি না। এই ন্যাপকিন দেওয়ার উদ্দেশ্য ক্লান্তি দূর করানো–তাই-ই মনে হল যে ক্লান্তি দূর হল।

দেখতে দেখতে প্লেন ফ্রাঙ্কফার্ট এয়ারপার্টের ওপরে উড়ে এল। দূরে দেখা গেল সারি সারি গাছের মধ্যে মধ্যে অটোবান দিয়ে সাঁই-সাঁই করে বিচিত্রবর্ণ সব গাড়ি ছুটে চলেছে।

ফ্রাঙ্কফার্টে ল্যাণ্ড করে প্লেন এসে লুফতহানসা এয়ারওয়েজের টার্মিনালের সামনে দাঁড়াল।

আমারই মতো যাঁরা কখনো দেশের বাইরে যাননি, তাঁদের প্রথমে খুবই অবাক লাগে দেখে যে, বেশিরভাগ বিদেশি এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয় না। প্লেন থামলে, ট্র্যাকটর বা ছোটো অথচ শক্তিশালী কোনো গাড়ি প্লেনকে টেনে নিয়ে এমনভাবে দাঁড় করায় যে, প্লেনের দরজা একটি সেন্ট্রালি হিটেড অথবা দেশভেদে এয়ার-কনডিশানড প্যাসেজওয়ের মুখে এসে একেবারে সেঁটে যায়।

প্লেন থেকে বেরিয়ে তাই একটুও ঠাণ্ডা লাগল না। সেই প্যাসেজওয়ে দিয়ে হেঁটে এসে টার্মিনালের ভেতরে পৌঁছোলাম।

তখন ফ্রাঙ্কফার্টে দুপুর বারোটা। যদিও আমার ঘড়িতে প্রায় বিকেল চারটে বাজে।

লুফতহানসার টার্মিনাল থেকে একইসঙ্গে প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা প্লেন ছাড়ার বন্দোবস্ত আছে। টার্মিনালের মধ্যেই এস্কালেটর রয়েছে অনেক। উঠছে, নামছে। বিভিন্ন পথ। প্রত্যেকটি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত–ঝকঝকে, তকতকে। এত পথ যে, মনে হয় পথ হারিয়ে যাব। তা ছাড়া এই প্রথম বিদেশের মাটিতে পা দেওয়ায় অপরিচিতিজনিত ভয়মিশ্রিত অস্বস্তিও যে ছিল না, তা নয়।

কাউন্টারে শুধোতেই জার্মান মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, তুমি এ-১৫ নম্বর গেটে চলে যাও, সেখান থেকে তোমার লানডানের প্লেন ছাড়বে।

 এ-১৫ খুঁজে বের করতে তো প্রায় কাঁদো-কাঁদো অবস্থা–যেহেতু লানডানের প্লেনটা আর কুড়ি মিনিট পরেই ছেড়ে যাবে, তাই উৎকণ্ঠারও হেতু ছিল।

সবচেয়ে বড়ো হেতু, পকেটের বিশল্যকরণী–আট ডলার।

জীবনে প্রথম এস্কালেটরে পা দিয়েই মনে হল এই পা পিছলে আলুর দম হলাম বুঝি! কেবলই মনে হচ্ছিল যে, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই বুঝি এই বাঙালের দিকেই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আমি যে নিতান্তই একজন আকাট তা বুঝি আমার গায়ের গন্ধেই টের পাচ্ছে সকলে। যাই-ই হোক অনেকবার এস্কালেটরে উঠে নেমে, অনেক পথ স্যুটকেস হাতে হেঁটে-দৌড়ে শেষপর্যন্ত এ-১৫ গেট খুঁজে পেলাম।

চেক-ইন করে গিয়ে প্লেনে উঠলাম–বোয়িং। কলকাতা-দিল্লি ম্যাড্রাস-বোম্বতে যে প্লেন চলাচল করে। ডি সি টেন-এর পরে এই প্লেনকে এত ছোটো বলে মনে হচ্ছিল যে, সে বলার নয়।

প্লেনে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্চ দিল খেতে। আমার ঘড়িতে তখনও ডিনারের সময় হয়নি, তবুও প্রায় আটঘণ্টা আগে আগের প্লেনে লাঞ্চ খাওয়াতে এই প্লেনের লাঞ্চকে ডিনার মনে করে খেয়েই ফেললাম।

 পশ্চিম জার্মানির সীমানা ছাড়িয়ে অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের ওপর দিয়ে প্লেনটা উড়তে লাগল। নীচে সবুজ খেত, কারখানা, বাড়ি-ঘর। অন্য রঙের, অন্য ধাঁচের। আমাদের দেশে জানলায় বসে নীচের দৃশ্য একরকম লাগে আর এখানে অন্যরকম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেনটা ইংলিশ চ্যানেলের ওপরে উড়ে এল বিভিন্ন ইয়োরোপিয়ান দেশের ওপর দিয়ে। নীচে ইংলিশ চ্যানেলের নীল জলের মধ্যে অগণ্য জাহাজ দেখা যাচ্ছিল।

নীচে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এই চ্যানেল পেরিয়েই জার্মানি আক্রমণ করেছিল অ্যালায়েড ফোর্সেস একদিন। তারও আগে ড্রেক, হকিন্স, আরও কতজনের দৌরাত্ম্যর স্থান ছিল এই জলভূমি। কতবার এখানে ইংল্যাণ্ডের ভাগ্য নির্ণয় হয়েছে। ছবি দেখেছি দ্য ব্যাটল অব ব্রিটেন, উইনস্টন চার্চিলের মেমোয়ার্স-এর দ্য ফাইনেস্ট আওয়ার! সব একইসঙ্গে মাথার মধ্যে ঝিলিক মারছিল।

Never in the history of mankind, so many had owed, so much, to so few  রয়্যাল এয়ারফোর্সের পাইলটদের উদ্দেশে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে চার্চিল তাঁর দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একথা বলেছিলেন।

ছোটোবেলা থেকে বহু বই পড়েছি, বহু ছবি দেখেছি এ পর্যন্ত এই ইংলিশ চ্যানেল সম্বন্ধে, কিন্তু সশরীরে সেই ঐতিহাসিক নীল জলরাশির ওপর দিয়ে চলেছি মনে করেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল।

ইংরেজরা যে নিয়মবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তী জাত তা আকাশ থেকে দেখলেও বোঝা যায়। যেই ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে প্লেনটা ইংল্যাণ্ডের ওপর এল, অমনি সমস্ত বাড়ি-ঘর কলকারখানা সবকিছুরই মধ্যে একটা দারুণ শৃঙ্খলা চোখে পড়ল। কোনোকিছুই অগোছালো দেখাচ্ছিল না ওপর থেকেও।

 হঠাৎ ঘোর ভাঙতেই দেখি, প্লেনটা নীচে নামছে।

মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই লানডানের হিথ্রো এয়ারপোর্টের ওপর একচক্কর লাগিয়েই বোয়িং প্লেনটা নেমে এল টারম্যাকে।

সত্যি-সত্যিই লানডানে এসে পৌঁছোলাম। ঐতিহাসিক লানডান। কুইন মেরির–দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের–উইনস্টন চার্চিলের–হিপিদের-হরেকৃষ্ণ-হরেরামের লানডান।

একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছিল। হিথ্রো এয়ারপোর্টের টারম্যাকের পাশে রানওয়ের মাঝে-মাঝে সেপ্টেম্বর মাসের সবুজ সতেজ ঘাস গজিয়ে আছে। একঝাঁক নরম সী-গাল সেই সবুজ তৃণভূমি ও কালো টারম্যাকের সীমানায় বসে আছে। কেউ ডানা নাড়ছে, কেউ একদৃষ্টে দেখছে সামনে, কেউ ঠোঁট দিয়ে চিকন ও মসৃণ, সাদা, ভিজে ডানা পরিষ্কার করছে।

প্লেনটা গড়িয়ে গিয়ে ঠিক পাখিগুলোর পাশেই এসে থামল।

আজকের লানডানেও যতটুকু শৃঙ্খলা বর্তমান, তা অন্যত্র আছে কি না সন্দেহ। টার্মিনাল বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়তেই দেখলাম, তাবৎ পৃথিবীর যাবৎ কোণ থেকে আসা শয়ে শয়ে সাদা-কালো-হলুদ-বাদামি-লাল মানুষে ভেতরটা গিজগিজ করছে। কত প্লেন যে উড়ছে নামছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিমিনিটেই নাকি ওঠা-নামা এখানে।

লম্বা লাইন পড়েছে। ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি নেই। আমাদের দেশে, লাইনে না-দাঁড়ানোকেই আমরা এখনও বাহাদুরি বলে মনে করি। জীবনের যে-কোনো ক্ষেত্রেই মামা-কাকা, চেনা শোনা খোঁজ করে যাতে সকলের সঙ্গে একীভূত না হতে হয় এই চেষ্টাতেই আমরা সচেষ্ট থাকি। আগেই বলেছি, আকাশ থেকেই হোক, কি মাটিতে নেমেই হোক প্রথমেই ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের যে-দিকটা চোখ পড়ে, তা হল নিয়মানুবর্তিতার দিক।

হলুদ অক্ষরে লেখা জ্বলছে–ব্রিটিশ পাসপোর্টস, কমনওয়েলথ পাসপোর্টস, আদার পাসপোর্টস। তিনটি ভিন্ন লাইন।

কমনওয়েলথ পাসপোর্টসের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাকি শামিল হলাম বলব? শামিল হওয়া বলাটাই বোধহয় সপ্রতিভতার লক্ষণ।

কাস্টমস অফিসারদের সুন্দর করে ব্রাশ-করা নেভি-রু ও কালো ব্লেজার। পিতলের বোতামে বোবাধহয় রোজই ব্রাসো লাগিয়ে পালিশ করেন এঁরা। একেবারে ঝকঝক করছে। কালো চামড়ার জুতো–তাতেও মুখ দেখা যায় এমন পালিশ।

 এত লোক একইসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে, এত অফিসার ডেস্কে ডেস্কে কাজ করছে কিন্তু কোনো চেঁচামেচি নেই। সকলেই ফিসফিস করে কথা বলছে। একমাত্র পশ্চিমি লোকেরাই ফিসফিস করে, মুখের অভিব্যক্তি একটুও না বদলে অন্যকে চরম গালাগালি বা অপমান করতে পারে। ওদের এই অভিব্যক্তিহীনতা দেখে, মাঝে মাঝে মনে হয়, ওদের মধ্যে আন্তরিকতা কম। কেউ মরে গেলেও ওদের মুখ যেরকম অভিব্যক্তি, কেউ জন্মালেও সেরকম। আমরা পুবের লোকেরা গলার গ্রামের সঙ্গে আন্তরিকতার মাত্রা বুঝি বেঁধে রেখেছি। আন্তরিকতা যতই খাঁটি, গলার স্বর ততই উদারা মুদারা তারার প্রতি দ্রুতধাবমানা।

এ-ব্যাপারটা আমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না–তবে কোনো আমেরিকানের মগজে এই ভাবনাটা কোনোক্রমে ঢুকিয়ে দিতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে ইউনিভার্সিটি বা ফোর্ড ফাউণ্ডেশান থেকে গ্রান্ট নিয়ে তিনি একটি পোর্টেবল টাইপরাইটার, প্রচুর কাগজ ও বলপয়েন্ট পেন সঙ্গী করে প্লেনে প্লেনে এবং বড়ো বড়ো হোটেলে হোটেলে ঘুরে ঘুরে প্রাচ্য দেশের সব জায়গা ঘুরে হয়তো গ্রাফ-সহযোগে আন্তরিকতা ও স্বরগ্রামের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক সম্বন্ধে বিস্তারিত পেপার সাবমিট করে ডক্টরেট হবেন।

একজন ইয়া-ইয়া পাকানো গোঁফওয়ালা ডাকসাইটে কাস্টমস অফিসার কমনওয়েলথ পাসপোর্টস-এর লাইনের মাথায় দাঁড়িয়ে প্রত্যেককে এক-একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের ডেস্কে পাঠাচ্ছিলেন–যেমন যেমন ডেস্ক খালি হচ্ছিল। ভদ্রলোকের চেহারা দেখেই আমার মনে হল ইনি নিশ্চয়ই হাইল্যাণ্ডার্স দলে ফুটবল খেলতেন। বাবা যখন মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন, আমার জন্মের আগে, তখন এরাই বোধহয় বুট-সমেত পদাঘাত করে বাবার হাঁটুর মালাইচাকি ফাটিয়ে দিয়েছিলেন, যার পর তাঁর খেলাই ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

ভদ্রলোকের জবরদস্ত চেহারা, লালমুখ ও পুরুষ্টু গোঁফের দিকে আমি কটমটিয়ে তাকিয়েছিলাম, এমন সময়ে উনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মিনমিনে গলায় আমাকে আঙ্গুল দিয়ে একটি ফাঁকা কাউন্টারের দিকে যেতে নির্দেশ দিলেন।

বোঁচকা-কুঁচকি নিয়ে করাউন্টারে উপস্থিত হতেই দেখি, একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ইয়াংম্যান মেয়েদের মতো লম্বা বাবরি চুল ও থুতনিসমান জুলপি নিয়ে টুলে বসে আছেন। মুখে ভাবান্তর নেই। হাতে বায়রোবল-পয়েন্ট পেন।

আমার কাগজপত্র দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে হুমম হুমম করছিলেন। কোথায় থাকব? কতদিন থাকব? কেন মরতে এখানে এলাম? এখান থেকে কোন চুলোয় যাব ইত্যাদি তাবৎ বিরক্তিকর প্রশ্ন একের পর এক গুলতির পাথরের মতো আমার দিকে ছুড়ছিলেন।

আলি সাহেবের ভাষায় যাকে বলে গাঁক-গাঁক করে ইংরেজি বলা, তেমনি ইংরেজিতে আমি ক্রমান্বয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম।

ইন্টারভিউতে বসতে হবে এই ডিস্টার্বিং ভাবনার ভয়ে জীবনে যখন কারও চাকরিই করলাম না, তখন এদের দেশ দেখতে এসে এত কৈফিয়ত দিতে বিরক্তি লাগছিল। স্পনসরশিপ সার্টিফিকেট দেখালাম, বললাম, ভায়ার আমার নিজের ফ্ল্যাট আছে, মানে বহুদিন হল সে রয়েছে এ-পোড়া দেশে। সেই-ই নেমন্তন্ন করে আমাকে এনেছে, তাবৎ খরচ-খরচা সব তার।

এত কিছু সত্ত্বেও বুকের মধ্যে একটু যে দুর-দুর করছিল না এমন নয়, কারণ কিছুদিন আগেই আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক লানডানে বেড়াতে আসবার জন্যে দমদম থেকে এয়ার-ইণ্ডিয়ার উড়ানে এসেছিলেন। দমদমে তাঁর পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের সকলে বিস্তর ফুলটুল এবং একগাদা টলটলে চোখের জল ফেলে বিদায় দিয়েছিলেন।

চোখের জল আকছার ফেলেন বলেই বোধহয় বাঙালি মেয়েদের চোখ এমন উজ্জ্বল।

যাই-ই হোক সে ভদ্রলোক লানডানে নেমেই আবার পত্রপাঠ পরের প্লেনে কলকাতা ফিরেছিলেন কারণ তাঁকে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট লানডানের মাটিতে পা দিতে দেয়নি।

 বিপদটা হয়েছিল, ফিরে গিয়ে কী বলবেন সেই কারণে।

অতএব তিনি কাউকে কিছু না বলে দমদমে নেমেই সটান ট্যাক্সি নিয়ে মধ্যমগ্রামে তাঁর এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে পনেরো দিন প্রচুর মশার কামড় ও বাগানের আম খেয়ে কাটিয়ে একদিন ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর শালি তাঁকে দেখামাত্রই বলেছিল, জামাইবাবুকে একেবারে সাহেবের মতো দেখাচ্ছে।

 দেখাবেই।

 কারণ বাগানের রোদে হাওয়ায় তাঁর ফ্যাকাশে কৃষ্ণবর্ণ এক স্বাস্থ্যোজ্বল বেগুনের গাঢ় বেগুনিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।

 আমিও কোনো ঝুঁকি নিইনি। আমার ফেরার টিকিট বোম্বাই-এর ছিল। জারীনকে বলে এসেছিলাম যে, আমি কোনো কারণে হঠাৎ ফিরে এলে বন্ধুর ফ্ল্যাটে বেশ ক-দিন থাকতে পারি বন্ধু থাকুক আর নাই থাকুক একথা যেন সে বন্ধুকে বলে রাখে।

যাই-ই হোক, অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদের পর, উইশ উ্য আ নাইস টাইম ইন লানডান বলে ছেলেটি ভাবলেশহীন মুখে এক চিলতে ক্যাস্টর-অয়েল গেলা হাসি ফুটিয়ে আমাকে ছুটি দিলেন।

এবার কাস্টমস। তার আগে মাল নেওয়া। সমস্ত ইনকামিং ফ্লাইটের মাল একইসঙ্গে লুকোনো কনভেয়র বেল্টে করে এসে একটা সদা-ঘুরন্ত চাকতির মধ্যে পড়ছে। যখন যে ফ্লাইটের মাল আসছে তখন সে ফ্লাইটের নম্বর ভেসে উঠছে টেলিভিশনে।

ইতিমধ্যে ইতি-উতি তাকিয়ে দেখে নিয়েছিলাম যে, প্রত্যেকেই একটা করে ট্রলি টেনে নিয়ে আসছেন কোনা থেকে। দু-একজনকে দেখলাম ওই ট্রলিতে মাল বোঝাই করে মাল নিয়ে কাস্টমস ব্যারিয়ারের দিকে এগোলেন। ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আমিও একটা ট্রলি নিয়ে এলাম এবং এমনভাবে পাইপমুখে স্যুটকেস ভরা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কাস্টমস ব্যারিয়ারে এলাম যে আমার নিজেরই মনে হতে লাগল যে বাল্যাবস্থা থেকেই আমি হিথ্রো এয়ারপোর্টে যাওয়া-আসা করে থাকি।

কাস্টমসের লোকেরা কিছুই দেখলেন না। ফ্রাঙ্কফার্ট থেকে ওড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ফর্ম দিয়েছিল ভরতি করার জন্যে, সেটা ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে জমা করতে হয়েছিল। কাস্টমস-এ শুধু জিজ্ঞেস করল, কোনো পারফিউম বা হুইস্কি-টুইস্কি আছে?

নেই, শুনেই ছেড়ে দিল।

একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের পক্ষে এ বড়ো কম আশ্চর্যের কথা নয়। সরকারি কর্মচারিরা, সে কাস্টমসেরই হোক, পুলিশেরই হোক বা ইনকামট্যাক্সেরই হোক, সকলেই প্রত্যেক নাগরিককে ভদ্রলোক বলে মানে, তাদের সহজাত সততায় বিশ্বাস করে, তাদের সঙ্গে ভদ্র ও ন্যায্য ব্যবহার করে, কথায় কথায় হাতে মাথা কাটে না, একথা হঠাৎ দেশ ছেড়ে বাইরে এলে বিশ্বাস করতেও আনন্দ হয়।

কাস্টমসের ব্যারিয়ার পেরিয়ে বাইরে এসে দেখি লোকে লোকে লোকারণ্য। এ-ওর সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছে, কেউ বা কাউকে চুমু খাচ্ছে, অনেকদিন পরে দেখা-হওয়া বন্ধু-বান্ধবী, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের হাতে হাত রেখে, গায়ে গায়ে লেপটে শীতার্ত পৃথিবীকে অন্যের কাছ থেকে নেওয়া উষ্ণতায় ভরে দিচ্ছে একে অন্যকে।

কিন্তু ভায়া কোথায়?

চতুর্দিকে চেয়েও আমার ভায়ার দর্শন মিলল না। তখন আমার প্রায় কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। শেষে কি তীরে এসে তরী ডুববে? চিঠি লিখেছি–ট্রাঙ্ক-কল করেছি, তবুও ভায়া এল না কেন? দিশি ভাইকে কি কাটাতে চায়?

আসবার আগে তিনমাস ধরে প্রচন্ড পাঁয়তারা করতে হয়েছিল। অফিসের কাজকর্ম গোছানো, পুজো সংখ্যার লেখা শেষ করা। এমনকী দেশ-এর বিনোদন সংখ্যার জন্যে একটি উপন্যাসের কপি আসার আগের রাতে শেষ করে দমদম এয়ারপোর্টে হস্তান্তরিত করেছি। গত একমাসে চারঘণ্টার বেশি ঘুমুতে পারিনি–এত কাজ ছিল।

তারপরও কি এই হেনস্থা?

লবির এককোনায় স্যুটকেস ও বোঁচকাকুঁচকি রেখে, নতুন করে পাইপটাতে তামাক ভরে বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করছি, এমন সময়ে টাক-পড়া, ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়িওয়ালা চশমা নাকে সুলেখা একজিকিউটিভ ব্ল্যাক রঙের এক ভদ্রলোক আমার দিকে করমর্দনের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন।

চেনা সম্ভব ছিল না আমার মাসতুতো ভাইকে। এমনকী কিস-তুতো বা শিষ-তুতো ভাই হলেও চেনার কথা ছিল না। তার চেহারার যে এত পরিবর্তন হয়েছে এ কবছরে তা না। দেখলে বিশ্বাস হত না।

টবী বলল, সরি রুদ্রদা, গাড়ি পার্ক করতে দেরি হয়ে গেল।

আমি তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। ঠিক লোকের সঙ্গে করমর্দন করছি কি না সে বিষয়ে তখনও সন্দেহ হচ্ছিল।

হঠাৎ ও বলল, খী খারবার? আমাকে চিনছ না নাকি?

আমি হেসে ফেলে বললাম, সন্দ সন্দ লাগছিল।

 কী কারবার কথাটা টবী খী খারবার-এর মতো করে বলে।

শুনে খুব মজা লাগছিল।

 টবী আমার হাত থেকে ট্রলিটা কেড়ে নিয়ে আমাকে নিয়ে চলল পাশের পার্কিং লটে।

ব্যাপার দেখে বুঝলাম যে, গাড়ি পার্ক করতে দেরি হওয়াটা কিছুই বিচিত্র নয়। একটা চারতলা বিরাট বাড়ি–সারি সারি শয়ে শয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। পার্কিং ফি আছে। কলকাতার কুড়ি পয়সা পার্কিং ফি দিতেই আমাদের অবস্থা কাহিল হয়, এখানের পার্কিং ফি সাংঘাতিক। তবে এদের রোজগারও আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। এরা পাউণ্ডকে টাকা বলে এবং টাকার সমান মূল্য মনে করেই খরচ করে অথচ পাউণ্ডের মূল্য আমাদের টাকার চেয়ে ষোলোগুণ বেশি।

চারতলায় পৌঁছে ট্রলি থেকে স্যুটকেস ইত্যাদি গাড়ির বুটে তুলে নিয়ে ট্রলিটা ওখানেই ফেলে রাখল টবী।

আমি শুধোলাম, এটা পৌঁছে দিতে হবে না?

ও বলল, না। এয়ারপোর্টের লোক এসে মাঝে মাঝেই নিয়ে গিয়ে আবার ভেতরে জড়ো করে রাখবে।

পার্কিং লট থেকে বেরিয়েই এমন জোরে গাড়ি ছুটোল টবী যে, সে বলার নয়। আমার রীতিমতো ভয় করতে লাগল। ওর গাড়িটা কালচে-নীল-রঙা একটা ফোর্ড কার্টিনা। আজকালকার সব বিদেশি গাড়িরই পিক-আপ এত ভাল যে, গাড়িতে বসামাত্রই সাঁ করে স্পিড় তোলা যায়–আবার যে-কোনো সময়ে পঞ্চাশ-ষাট মাইল স্পিডেও ভ্যাকুয়াম ব্রেক থাকাতে একমুহূর্তে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। গাড়িগুলো আমাদের দিশি গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি ভারীও বটে।

 আমি বললাম, কী করছিস। আস্তে চালা, ভয় করছে।

টবী হাসল, বলল, খী খারবার। আস্তেই তো চালাচ্ছি। মোটে ষাট মাইলে যাচ্ছি। বেশি আস্তে চললে আবার পুলিশ ধরবে।

ওকে কিছুতেই নিবৃত্ত করতে না পেরে বললাম, আসবার আগেই আমার বুকে একটা ব্যথা হয়েছিল, প্লিজ আস্তে চালা।

ও আবার বলল, সে কী! জানতাম না তো! খী খারবার, এই বয়সেই এসব কী? বলেই, গাড়ি আস্তে করল, মানে পঞ্চাশ মাইলে নামাল স্পিডোমিটারের কাঁটা।

গাড়িতে হিটার চলছে, কাঁচ বন্ধ। এত হাজার মাইল, এত সমুদ্র, এত পাহাড়, এত নদী, জঙ্গল পেরিয়ে এলাম কিন্তু এ পর্যন্ত স্বাভাবিক হাওয়া ও আবহাওয়ার একটুও স্বাদ পেলাম না। বাঁ-দিকের কাঁচটা নামাতেই হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া আসতে লাগল। হাওয়ায় কোনো আদ্রতা নেই, শুকনো মচমচে ঠাণ্ডা। বড়ো ভালো লাগল।

টবী বলল, এতখানি উড়ে এসেছ, তাই শরীর গরম হয়ে গেছে। তা বলে কাঁচটা খুলে রেখো না, ঠাণ্ডা লেগে যাবে রুদ্রদা।

কাঁচটা তুলে দিতে দিতে বললাম, মহাঝামেলায় পড়লাম দেখছি, উড়ে এসে।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর আমরা এসে টবীর ফ্ল্যাটে পৌঁছোলাম। স্মিতা এসে দরজা খুলল। ছোট্ট সাজানো-গুছোনো ফ্ল্যাট। ওদের বাড়তি ঘর নেই, তাই আমি খাওয়ার ঘরে শোব। খাওয়ার টেবিলের পাশে একটু নীচু ডিভান তার ওপর সুন্দর প্যাস্টেল-রঙা কম্বল পাতা।

যদিও ওদের ঘড়িতে তখন বাজে পাঁচটা–আমার ঘড়িতে গভীর রাত।

একটু পরেই সন্ধে নেমে এল। সন্ধে নামতেই পর্দা সরিয়ে দেখলাম, দিকে দিকে হলুদ হয়ে গেছে আকাশ যেন। সোডিয়াম-ভেপার ল্যাম্পগুলোর আলো ভারি নরম, স্বপ্নময়। কুয়াশার পক্ষে ভালো বলে এরা রাস্তার সব আলোই বদলে ফেলে সোডিয়াম-ভেপার ল্যাম্প লাগিয়েছে। তাই রাতের লানডানকে ফিসফিসে-কথা-বলা একটা মিষ্টি হলুদ-বসন্ত পাখি বলে মনে হয়।

.

০২.

ভোরবেলা ধূমায়িত কফির পোয়ালা নিয়ে স্মিতা ঘরে এল। বলল, আর ঘুমোয় না, এবার উঠে পড়ো রুদ্রদা।

উঠতেই এক বিপত্তি।

ডিভানের পাশেই খাওয়ার টেবিলের ওপরে নীচু করে ঝোলানো বাতির শেডটা একেবারে টং করে ব্রহ্মতালুতে লেগে গেল। বাল্যাবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে মুখস্থ করা সংস্কৃত ব্যাকরণের বয়ান বহুকাল পর মস্তিষ্কের কোষে কোষে নড়ে-চড়ে উঠল।

এর জন্যেই পন্ডিতজন বলেন ম্লেচ্ছদের দেশে যেতে নেই।

কফির পেয়ালা হাতে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে শাল জড়িয়ে খাবার ঘরে ঢুকতেই আরও বিপত্তি।

দেখি টবী একটা চকরা-বকরা ড্রেসিং-গাউন পরে, কোলের ওপর কাগজ পেনসিল নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখামাত্রই বলল, করেছ কী! এ তো রীতিমতো কবি-কবি পোশাক। মায়ের চিঠিতে পড়ি তুমি নাকি ইদানীং প্রেমের গল্প-টল্প লিখছ? তা লেখো, কিন্তু এ পোশাক এখানে বেশিদিন চালাতে পারবে না।

তারপর বলল, যাই-ই হোক, আগে কাজের কথা বলি, তোমাকে কতগুলো প্রশ্ন করছি। চটপট উত্তর দাও।

একে ঘুম রয়েছে চোখে তার ওপর টনক তখনও টোকা খেয়ে টনটন করছে। থতমত খেয়ে শুধোলাম, কী প্রশ্ন?

টবী বলল, তোমার নিশ্চয়ই এদের সঙ্গে দেখা করতে হবে?

কাদের সঙ্গে?

আরও অবাক হয়ে শুধোলাম আমি।

টবী বলল, তোমার মেজোপিসিমার সেজোছেলের বড়ো শালা; যে এখানে ডাক্তার। তোমার বড়োদিদির সেজোভাসুরের ছোটোমেয়ে–যার এখানের এক এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তোমার প্রতিবেশীর ছোটোবেনের বড়োদেওর যে এখানে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়তে এসে-পরীক্ষা না দিয়ে কোনো জুইশ ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি করছে।

আমি বললাম থাম থাম। ঠিক ঠিক না বললেও, প্রায় কাছাকাছি গেছিস। পার্সে একটা লিস্ট সত্যিই আছে। সবসুদ্ধ পনেরোজনের ঠিকানা ও ফোন নম্বর।

তারপর একটু চুপ করে থেকেই বললাম, কী করা যায় বল তো?

 টবী উলটে ধমক দিয়ে বলল, তোমার ইচ্ছেটা কী? ঝেড়ে কাশো?

আমি বললাম, ইচ্ছেটা কারো সঙ্গেই দেখা না করা। আমি তো এখানে পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসিনি–পায়ে হেঁটে, বাসে-টিউবে ঘুরে-ঘারে জায়গাটা কেমন, এদেশের লোকগুলো কেমন তাই একটু জানতে-শুনতে এসেছি। এদের সঙ্গে দেখা করতে হলে তো আমার অন্য কিছুই করা হবে না।

মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টবী আমাকে বলল, বুঝেছি। আই লাইক ঊ্য। আগেও করতাম। যাক তোমার বুদ্ধি যে ভোঁতা হয়নি এ ক-বছরে, তা জেনে ভালো লাগল। এবার কফি খেতে খেতে আরও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফেলো তো তাড়াতাড়ি রুদ্রদা।

ততক্ষণে আমি রীতিমতো উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছি। কিন্তু টবী আমাকে মুখ খোলার সুযোগই দিল না।

বলল, বল; বলে ফেলো।

 একনম্বর প্রশ্ন–কলকাতায় কই মাছের কেজি এখন কত করে?

দু-নম্বর প্রশ্ন–দক্ষিণ কলকাতায় ভালো শাড়ির দোকান ও চুল-বাঁধার দোকান এখন কী কী?

তিননম্বর প্রশ্ন–নকশাল আন্দোলন এখনও চলছে কি?

চারনম্বর প্রশ্ন–ধনেপাতার চালান ঠিক আছে কি নেই? বড়ো পাবদা মাছ কি গড়িয়াহাট বাজারে উঠেছে?

পাঁচনম্বর প্রশ্ন–এবার শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসবে কেমন ভিড় হয়েছিল?

ছ-নম্বর প্রশ্ন–সত্যজিৎবাবুর নতুন ছবি কী?

নম্বর প্রশ্ন–তোমার দিদিমার গলব্লাডারের ব্যথা কেমন আছে?

আটনম্বর প্রশ্ন–দেশে বর্তমানে মাসে পাঁচহাজার টাকা মাইনের, সপ্তাহে পাঁচদিন কাজের, সামান্য ট্যাক্স-কাটা চাকরি কি গড়াগড়ি যাচ্ছে?

ন-নম্বর প্রশ্ন–কিশোরকুমারের নবতম বাংলা রেকর্ড কী? সত্যিই কি দেবব্রত বিশ্বাসের আর রেকর্ড হবে না?

এই অবধি বলে, টবী চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইল।

 আমি বললাম, দেখ, একে বিদেশবিভুই জায়গা, এই প্রথম সকাল, তুই কী যে সব উলটোপালটা প্রশ্ন করছিস, কিছু বুঝতে পারছি না।

 টবী হাত নেড়ে বলল, সবই তোমার ভালোর জন্যে। তুমি চটপট উত্তরগুলো দিয়ে যাও —-আমি অফিস থেকে গোটা পঞ্চাশেক ফোটোকপি করিয়ে আনব জেরক্স মেশিনে।

নাও, এখুনি তোমার পার্স থেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের লিস্টটা দাও–তাদের সবাইকেই এক সন্ধ্যায় আমার এখানে একইসঙ্গে নেমন্তন্ন করে দেব–তুমি একইসঙ্গে মাত্র একটা সন্ধ্যা নষ্ট করে পাপ-পুণ্য যা করার করে নেবে। তারা তোমাকে যা যা প্রশ্ন করবে তা আমার হুবহু জানা। যেই কেউ প্রশ্ন করবে–তুমি অমনি একটি করে ফোটোকপি করা কাগজ ধরিয়ে দেবে তাদের হাতে। তোমার গলা-ব্যথাও হবে না, বিরক্তিও হবে না এবং সেই সঙ্গে তাদেরও উত্তর পাওয়া হবে। নাও, সময় নষ্ট না করে পটাপট উত্তরগুলো বলে ফেলো।

আমাকে নিরুত্তর দেখে, টবী কী বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে স্মিতা ওকে বলল, তোমার স্যাণ্ডউইচ প্যাক করে দিয়েছি–এবার বেরিয়ে পড়ো জামাকাপড় ছেড়ে, অফিসের দেরি হয়ে যাবে।

 টবী, উঠতে উঠতে বলল, কিছু মনে কোরো না রুদ্রদা, বাঙালি হয়েও বাঙালিদের এই অহেতুক বাঙালি-প্রীতি ও কলকাতা-সিকনেস আমার আর সহ্য হয় না।

স্মিতা জোরে হেসে উঠল।

বলল, ব্যাসস আবার শুরু করলে?

 টবী উত্তর না দিয়ে বসবার ঘর ছেড়ে শোবার ঘরে গেল।

স্মিতা বলল, জানেন রুদ্রদা, আমি তো একা থাকি–এই পাগলের সঙ্গে ঘর করি। আমার সঙ্গে একটু কিছু মতের অমিল হলেই দু-হাতে মুঠি পাকিয়ে হাত মাথার ওপর তুলে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমাকে বলবে, বাঙালির কিছু হবে না; এ জন্যেই বাঙালির কিসসু হল না।

তারপরই বলল, আপনার কি মত? এই যে বাঙালিরা যেখানেই যায়, যেখানেই থাকে, সেখানেই নিজেদের সমাজ তৈরি করে নিয়ে থাকে–লানডানে বসেও ধনেপাতা দিয়ে ডিপ ফ্রিজে রাখা দু-বছরের পুরোনো কই মাছ বেঁধে খায়–কলকাতায় জন্যে হায়-হায় করে, এটা কি ভালো না খারাপ?

আমাকে কিছু বলতে দেবার আগেই স্মিতা আবার বলল, অবশ্য একটা ব্যাপারে টবীর সঙ্গে আমি একমত যে, পাঁচজন বাঙালি এই দূরদেশে এসেও মিলে-মিশে থাকতে পারে না। পরনিন্দা, পরচর্চা, দলাদলি, ঈষা, এই-ই-সব। এসব দেখে মনে হয় ও যা বলে তার অনেকখানিই হয়তো ঠিক। জানেন তো ওর এখানে কোনো বাঙালি বন্ধু নেই-ই বলতে গেলে। জার্মানিতেই বেশি দিন ছিল–তাই বেশির ভাগ বন্ধুবান্ধব জার্মান–বাকিরা ইংলিশ। ভারতীয়দের মধ্যে কিছু মারাঠি ও পাঞ্জাবি বন্ধু আছে। কেন জানি না, বাঙালিদের ওপর ওর এত রাগ-বাঙালি হয়েও।

আমি বললাম, জানি না। হয়তো ও বাঙালিদের অনেকের চেয়ে বেশি ভালোবাসে বলেই। হয়তো নিজ প্রদেশীয়দের দোষগুলো ওর চোখে বেশি করে লাগে–ও হয়তো মনে-প্রাণে চায় যে আমরা এ দোষগুলো কাটিয়ে উঠি–যেগুলোকে ও দোষ বলে মনে করে।

আমাদের আলোচনা আর বেশি দূর এগোবার আগেই টবী হাত তুলে বলল, চললাম রুদ্রদা। সাতটায় ফিরব। ফিরেই ডিনার খেয়ে তোমায় নিয়ে বেরোব।

বললাম, বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাতে?

টবী হাসল, বলল, সে যাই-ই এল।

স্মিতা চাকরি করে। টবী চাকরি করে না। নিজের ডিজাইন এঞ্জিনিয়ার্সের ফার্ম আছে। আমার জন্যে স্মিতা দু-দিন ছুটি নিয়েছে–আমাকে টিউব-বাস চিনিয়ে-চিনিয়ে চালাক করে দেবে–যাতে বড়োবাজারি ষাঁড়ের মতো আমি একাই লানডানের হাটে-বাজারে চরে খেতে পারি।

টবীর পক্ষে ছুটি নেওয়া সম্ভব হয়নি। ছুটি নেয়নি ভালোই করেছে। নিলে আমারই অপরাধী লাগত নিজেকে।

চান-টান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ফ্ল্যাট বন্ধ করে, পাম্প বন্ধ করে, স্মিতা আমাকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ল। এই ফ্ল্যাটে হিটিং সিস্টেম আলাদা আলাদা। প্রতিফ্ল্যাটে একটি করে পাম্প আছে। গরম জল প্রতিঘরের দেওয়ালের চারপাশে লাগানো পাইপের মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়–তাতেই ঘর গরম হয়ে যায়। এই সিস্টেম এখন পুরোনো ও তামাদি হয়ে গেছে।

বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিল। জলজ্যান্ত লম্বা চওড়া পুরুষমানুষ হয়ে শেষে কিনা একজন মহিলার হাত ধরে লালিপপ খেতে খেতে লানডানের পথে ঘুরে বেড়াব?

আপাতত নিরুপায়।

লানডানে তখন সামার সবে শেষ হয়েছে। তখনও লানডানারদের হিসেবে ঠাণ্ডা তেমন পড়েনি। কিন্তু আমার হিসেবে তখনই বিলক্ষণ ঠাণ্ডা।

আকাশে পরিষ্কার রোদ আছে : রোদের সঙ্গে একটা হু-হু হাওয়াও আছে। স্মিতা আমাকে নিয়ে এসে বাস-স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াল–টিউব স্টেশানে যাবে বলে।

এ জায়গাটা লানডানের উপকণ্ঠে মিডলসেক্সে, ওরা হেঁটে-কেটে বলে মিডেকস।

 বাস আসতে বেশ দেরি হচ্ছিল–দেরি নাকি হয় বিশেষ করে অফিস টাইমের পর। তবে বাস-স্টপেজে যে পঞ্চাশজন লোক হা-পিত্যেশ করে দাঁড়িয়েছিলেন তখন এমন নয়। এমনকী অফিস-কাছারির সময়েও কলকাতায় যেমন ভিড় তার পাঁচ শতাংশও হয় না। এই মুহূর্তে স্মিতা, আমি; একটি ফুটফুটে বসরাই গোলাপের মতো গোলাপি মেয়ে, একজন রিটায়ার্ড বৃদ্ধ –ব্যসস এই ক-জন।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, চলো হাঁটা যাক। চমৎকার আবহাওয়া। তোমার নর্থওল্ট টিউব স্টেশান কতদূর?

স্মিতা বলল, তা মাইল খানেকের ওপর হবে।

আমি বললাম, তোমার কষ্ট হবে না তো?

ও বলল, না না। আমি হাঁটতে ভালোবাসি। চলুন।

 ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোনরক বা ফতেপুর-সিক্রীর গাইডের মতো স্মিতা আমাকে হাত নেড়ে নেড়ে শহর চেনাতে চেনাতে এগোতে লাগল। এ রকম গেঁয়ো লোক পেলে সচরাচর শহুরে মেয়েরা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে তাদের ভেজাল পান্ডিত্য নির্ভেজালভাবে জাহির করে।

কিন্তু স্মিতার বাকসংযম আছে।

একটা জায়গায় এসে রাস্তা পেরোতে হবে। সেখানে ট্রাফিক-লাইট ছিল না–কিন্তু পথে জেব্রাক্রসিং-এর দাগ ছিল। স্মিতা আর আমি ফুটপাথের প্রান্তে দাঁড়িয়েছি গিয়ে, এমন সময়ে আমাদের দেখে দু-পাশে প্রায় পর পর এক-একদিকে পাঁচ-ছটি করে দ্রুতধাবমানা গাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ভ্যাকুয়াম ব্রেক দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা হাত তুলে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তা পেরোতেই সঙ্গে সঙ্গে আবার গাড়িগুলো চলতে শুরু করল।

 দেখে ভারি অবাক লাগল। একজন মানুষের কত দাম এখানে–মানুষ হয়ে জন্মালে কত সম্মান। মনুষ্যজীবনের মূল্য এরা অনেক ধরেছে। আর আমার দেশে ফুটপাথে, হাইওয়েতে মৃতদেহ পড়ে থাকে, যেখানে মানুষের মৃতদেহ খাবলে খাবলে কাক চিল, পথের কুকুরে কামড়াকামড়ি করে খায় এবং অন্য মানুষ তা দেখে নাকে রুমাল চেপে রুজির ধান্দায় চলে যায়–যেতেই হয়–কারণ না গেলে তার অবস্থাও তথৈবচ হয়। যে দেশে মানুষ গিনিপিগের মতো জন্মায় এবং বিনা চিকিৎসা, বিনা-খবরদারিতে তেমন অবলীলায় মরে–সেই দেশের লোক হয়ে প্রথম প্রথম এসব দেখে মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি দেখলে আদিখ্যেতা বলেই মনে হয়। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সবই চোখ সয়ে যায়। একটা আশ্চর্য বিশ্বাস জন্মে যায় যে, মানুষ তো এইরকম সম্মানেরই যোগ্য।

যোগ্য না কি?

দেখতে দেখতে নর্থওল্ট টিউব স্টেশানে এসে পৌঁছোলাম আমরা। টিকিট কাউন্টারে দেখি, একজন ভারতীয় বসে আছেন।

আমি তাকে দেখে পুলকিত হতেই স্মিতা বলল, খবদার হিন্দি বা কোনো ভারতীয় ভাষায় কথা বলবে না–এ ব্রিটিশের চাকরি করে সুতরাং কাজের সময়ে ভুলেও একে দিশি ভাষা বলতে শুনবে না। আমি একবার বলতে গিয়ে লজ্জা পেয়েছিলাম।

শুনে অবাক হলাম। দেশে এরকম বি এন জি এস (বিলেত-না-গিয়ে সাহেব) অনেক আছেন যাঁরা এখনও দেশ স্বাধীন হবার এত বছর পরেও বাংলায় কথা বলেন না, কিন্তু বি জি-এসদের (বিলেত গিয়ে সাহেব) কাছ থেকে অন্যরকম কিছু আশা করেছিলাম।

স্মিতাই ইংরেজিতে বলল, আমাকে একটা ট্রাভেল-অ্যাজ-ইউ-প্লিজ টিকিট দিন।

টবী বলে রেখেছিল এই টিকিট কাটতে। সাতদিনের জন্যে টিউব এবং বাস-ট্রামে ভাড়া লাগবে না। তদুপরি একটু বিনিপয়সার সাইটসিইং ট্যুরও আছে। দাম নিল তিন পাউণ্ড সেন্ট–অর্থাৎ প্রায় সাতান্ন টাকার মতন।

টিউবের ভাড়া কম নয়। এখানে বাসের ভাড়াও কলকাতার তুলনায় বেশ বেশি।

 টিউব স্টেশানটা মাটির ওপরে। টিউব ট্রেন যে সবসময়েই পাতাল দিয়ে চলে তা নয়। অনেক জায়গায় মাটির ওপর দিয়েও গেছে। এ স্টেশানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে প্ল্যাটফর্মে নামলাম। বেশির ভাগ স্টেশানেই এস্কালেটর আছে। অনেক স্টেশান তো এত নীচুতে যে একাধিক এস্কালেটরে অনেক নীচে নামতে হয়। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেই স্মিতা প্রথমেই আমাকে নিয়ে একটা রঙিন ম্যাপের সামনে দাঁড় করিয়ে টিউব চড়ার আদবকায়দা বোঝাতে লাগল।

ও ভাগলপুরের মেয়ে, ও কী করে জানবে যে বেনারসের গলি ও বড়োবাজারের গুলি যার দেখা আছে সে হারিয়ে যাবে এমন অলিগলি আকাশপাতাল কোথাওই নেই। যাই হোক, হাতে একটা কাগজের ম্যাপ নিয়ে দেওয়ালের ম্যাপের দিকে দেখে গুঁড়ি-গুডি ছাত্রর মতো ব্যাপারটা বুঝে নিলাম।

দিদিমণি বললেন, আমি নাকি খুব বুদ্ধিমান। আসলে ব্যাপারটা এত সোজা যে, যে-কোনো খুব-নির্বুদ্ধি লোকেরও পাঁচমিনিটের বেশি লাগবে না বুঝতে।

প্ল্যাটফর্মের দু-পাশেই অনেক স্ত্রী-পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক একটি চোদ্দ-পনেরো বছরের সবে কুঁড়ি-ফোঁটা মেনি-মেনি মেয়েকে মাথার সিঁথি থেকে শুরু করে হাঁটুর মালাইচাকি অবধি সমানে এবং সবেগে চুমু খেয়ে যাচ্ছেন। অথচ আশ্চর্য! আমি ছাড়া আর কেউই দেখলাম সেদিকে তাকাচ্ছে না। তাদের একেবারে গায়ে-লেগে দাঁড়িয়েই অনেকে মনোনিবেশ সহকারে খবরের কাগজে হিথ ও উইলসনের প্রাক-নির্বাচন বাক-যুদ্ধের খবর পড়ছে, কেউ বা লাইনের অন্য পারে ফুটে-থাকা জংলি ফুলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। ভাবটা পাচ্ছ, তাই খাচ্ছ, না থাকলে কোথায় পেতে? কী করেই বা খেতে?

আসলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাটা এরা এমন পর্যায়ে এনে ফেলেছে যে, সে বলবার নয়। এরা শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই কামনা করেনি, এ-সমস্ত স্বাধীনতার যে শেষ এবং চরম গন্তব্য–ব্যক্তিগত স্বাধীনতা তারই শীর্ষে এসে পৌঁছেছে এরা। দেখে ভারি ভালো লাগল।

ছোটোবেলা থেকে মাইণ্ড ইওর ওওন বিজনেস বা দিস ইজ নান অফ ইওর বিজনেস বাক্য দুটি শুনে আসছি। এতদিনে বাক্য দুটির তাৎপর্য বুঝলাম।

এরা সত্যিই পরের চরকায় তেল দেয় না। দেয় না বললে মিথ্যে বলা হবে। লোকচক্ষুর অন্তরালে হয়তো দেয়; সামনাসামনি কখনোই দেয় না?

উইমেনস লিব যে পর্যায়েই উপনীত হোক না কেন, মহিলারা হয়তো অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন, কিন্তু অফুরান ফুসফুস গুজগুজ সর্বকালের সর্বদেশের মহিলাদের জারক রস। এ নইলে এঁদের খাবার হজম হয় না, কখনো হবে না। কিন্তু লোকের সামনে এমনই কুডনট কেয়ারলেস মুখভঙ্গি করে অনেকানেক মহিলারা এইক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন যে, মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ট্রেনটার আশু এবং নির্বিঘ্ন আগমন কামনা ছাড়া অন্য কোনো কামনাই তাঁদের মনে নেই। যেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধকে তাঁরা দেখেনইনি।

ট্রেনটা এসে গেল। আসাতেই ইলেকট্রিকালি দরজাগুলো খুলে গেল। প্রথম যাঁরা নামবার নেমে গেলেন, তারপর যাঁরা ওঠার, উঠে পড়লেন। তিরিশ সেকেণ্ড মতো থামে এক-এক স্টেশানে ট্রেনগুলো ভেতরে উঠতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল।

অফিস-কাছারির ভিড় এখন নেই। এখানে সাড়ে দশটার সময়ে কোনো অফিসযাত্রীই ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে রেলিশ করে ভাত খেয়ে, দুটি অ-খয়েরি গুণ্ডি মোহিনী পান মুখে দিয়ে দার্শনিকের মতো ট্রামের জানলার পাশের সিটে বসে অফিস যান না। যাঁরা অফিস যাবার সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে প্রত্যেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। হাজিরা প্রায় সব জায়গায়ই সকাল নটায়। তাই এখন প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে কিছু ছাত্র, ছাত্রী আমার মতো ট্যুরিস্ট ও অন্য নানাবিধ লোকেরা। বেশির ভাগই মহিলা–বাজার-টাজার করতে বা অন্য কাজে বেরিয়েছেন।

সুন্দর গদি আটা বসার সিট–বসার সিট ভরে গেলে লোকে রডের সঙ্গে ঝোলানো নরম হাতল ধরে দাঁড়ান। মেয়েদের জন্য কোনো সংরক্ষিত আসন নেই। ট্রেনগুলি হিটেড। ঠাণ্ডা লাগে না। চাকরি-খালির বিজ্ঞাপনে চরিদিক ভরা। টিউবের গার্ডের চাকরি, টেলিফোনের চাকরি, অন্যান্য নানারকম চাকরি।

এখানের অনেক মেয়েরা তো প্রায় সপ্তাহে সপ্তাহে চাকরি ছাড়ে আর নতুন চাকরি নেয় সুযোগ-সুবিধামতো। বেকার বিমা, অসুখ-বিসুখের খরচ, পেনশন বা অবসরকালীন অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আছে। মাইনের ওপর ইনকাম ট্যাক্সও দেয় এরা এবং আমাদের দেশের চেয়ে অনেক কম হারে। ট্যাক্সের বদলে ওরা অনেকই পায়। এদেশে যে বেশি ট্যাক্স দেয় তাকে লোকে ন্যায্য কারণে সম্মান-এর চোখে দেখে।

আশ্চর্য নয় যে ভারতীয় ও অন্যান্য দেশীয় লোকেরা এখানে মাছি-পড়ার মতো ভিড় করে আসছে বহুবছর ধরে। সেই জন্যেই ইদানীং ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে এত কড়াকড়ি এরা করেছে। না করে উপায়ই বা কী? চাচা আপন প্রাণ বাঁচায় বিশ্বাস করা দোষণীয় নয়। তা ছাড়া বর্তমানে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে যা লগ্নি তার একটা ভাগ চলে গেছে অ্যামেরিকান ও তৈলাক্ত দেশগুলোর হাতে। আবুদাবি আর দুবাইয়ের শেখরা রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে এই দেশে জাপানি ও অ্যামেরিকানদের সঙ্গে। এঁদের অর্থনীতিতে ভারি একটা শঙ্কার ছায়া পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন যে পুরো দেশটাই কিনে ফেলবে শেখরা অ্যামেরিকানরা আর জাপানিরা মিলে। এদের ভয়টা সম্পূর্ণ অমূলকও নয়।

টিউব স্টেশানের নামগুলো বেশ। কিছু কিছু নাম আছে বিখ্যাত সব ব্যাবসাকেন্দ্র বা কেনাকাটা-কেন্দ্রের নামে। স্টেশনাগুলো একেবারে সেইসব জায়গার পায়ের নীচে। যেমন পিকাডিলি সার্কাস। একটা স্টেশানের নাম শেফার্ডস বুশ। নামটায় এমন একটা পুরোনো দিনের গুঁফো-রাখাল আর ঝোঁপ-ঝাড়ের গন্ধ আছে যে, এই নাম ভর করেই একটা গায়ে-কাঁটা দেওয়া শার্লক-হোমস-মার্কা গোয়েন্দা-গল্প লেখা যায়।

পিকাডিলি সার্কাসে গিয়ে নামলাম আমরা।

পাতাল থেকে মাটিতে পৌঁছেই তাজ্জব বনে গেলাম। হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামা ইস্তক, মিডেকসের অপেক্ষাকৃত জনবিরল এলাকায় হেঁটে আসার পর, এই প্রথম ঐতিহাসিক লানডানের গায়ের গন্ধ নাকে এসে পৌঁছোল। মেঘলা দুপুরের সী-গাল-ওড়া সমুদ্রের স্বগতোক্তির মতো জবরদস্ত জলরাশির এক চাপা গুম-গুমানি কানে এল।

হাজার হাজার ট্যুরিস্ট চলেছে পথ বেয়ে। সমস্ত পৃথিবীর লোক যেন জমা হয়েছে এসে এই তারুণ্যের তীর্থসঙ্গমে। বৃদ্ধরাও এখানে বৃদ্ধ নন, বৃদ্ধারা তরুণী। কতরকম তাঁদের চেহারা, কতরকম তাঁদের বেশবাস। অবশ্য বেশবাসের বৈচিত্র্য আজকাল কমে এসেছে। জিনসের দৌলতে। অ্যামেরিকানদের পররাষ্ট্রনীতি দুনিয়ার সর্বত্র মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হলেও, ভারতে যেমন মাদ্রাজি দোসার, পৃথিবীতে তেমন অ্যামেরিকান জিনসের আধিপত্য নিঃসংশয়ে স্বীকৃত হয়েছে।

প্যারিসের পটভূমিতে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বিখ্যাত উপন্যাস আছে –দ্য মুভেবল ফিসট। চোখের সামনেই এই সাবলীল স্বচ্ছতোয়া, ঘনসন্নিবিষ্ট ও যৌবনমদে উচ্ছল সৌন্দর্য দেখে ওই নামটি মনে পড়ে গেল। সামনের চলমান বিপুল উৎফুল্ল, উৎসুক, উদ্বেল জনরাশির দিকে তাকিয়ে প্রথমেই যা আমাকে নিবিড়ভাবে বিস্মিত করেছিল তা এদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বলতা এবং সাচ্ছল্য।

হাজার হাজার পাউণ্ডের শপিং করছে এক-একজন, এক-একদিনে। হি-হি-হা-হা করে হাসছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে; হুল্লোড় করছে। মনে হচ্ছে সারাপৃথিবী বুঝি এক অনিঃশেষ মজায় মেতেছে, মনে হচ্ছে, এরা সকলেই ইউলিসিসের মতো মনস্থির করেছে যে, I will drink Life to the Lees.

এখানের এই হরজাই চোখ-ঝলসানো বাজারে আমার জেঠিমা, কি মিনা, কি রিনি বউদি এবং আমার অনেক চেনা ও অল্প-চেনা ভদ্রলোক-ভদ্রমহোদয়রা এসে পড়লে যে কী আদিখ্যেতা করতেন তাই ভাবছি।

আশ্চর্য! এখনও ফোরেন জিনিস দেখলে অনেক ভারতীয়রই মাথার ঠিক থাকে না। মনে হয় এ বহুবছরের বিদেশি শাসন ও স্বদেশি উদাসীনতাজনিত অবচেতনের গভীরে শিকড় গেড়ে-বসা এক হিলহিলে হীনমন্যতার ফল। এর মূল অনেক গভীরে। ভাবলে অবাক লাগে যে স্বাধীনতা পাওয়ার পর এত বছর কেটে গেল অথচ আমরা এই হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠা তো দূরের কথা, তাকে যেন আরও অনেক প্রবলই করলাম।

ভোগ্যপণ্য ও বিলাসদ্রব্য ইত্যাদি, এমনকী দৈনন্দিন ব্যবহারের সাধারণ জিনিসপত্র দেখেও অবাক হতে হয় না যে, তা বলব না। যাদের রুচি সুন্দর, যাদের শখ আছে, তাদের অনেক জিনিসই বিদেশে চোখে পড়ে ভালো লাগার মতো; কিন্তু যা-কিছু ফোরেন তার সব কিছুই স্বদেশীয় থেকে ভালো যে, একথা বিশ্বাস করা লজ্জার।

 যাই হোক, বাঙাল লেখক একটি জুতোর দোকানে ভ্রাতৃবধূর হাত ধরে গিয়ে ঢুকল। সেকালে অন্দরমহলে আসতে গেলে ভাসুরঠাকুরকে বিস্তর খড়মবাজি গলাবাজি করে তাঁর আগমন বার্তা দিকে দিকে প্রচার করে ভ্রাতৃবধূকে ঘোমটা টানার সম্পূর্ণ অবকাশ দিয়ে তারপর অন্দরে আসতে হত। আর আজ ভাদ্রবউ ট্যাং-ট্যাং করে ভাসুরঠাকুরকে নিয়ে জুতো কিনতে চলেছে ম্লেচ্ছদের পাড়ায়–যখন-তখন বরাহ খাচ্ছে-গোমাংস ভক্ষণ করছে। আমার ঠাকুমা জানতে পেলে বলতেন, কী খিটক্যাল কী খিটক্যাল।

 সারাপৃথিবীকে জুতো-মেরে যারা চামড়া ও জুতো এক্সপোর্ট করছে সেদেশের লোক হয়েও লানডানে জুতো কিনতে ঢোকাটা আমার পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আমার মতামতের দাম কী? সঙ্গে বিলিতি ভাদ্রবউ–দিশি দাদার আপত্তি শুনছে কে?

লানডানে যে জুতোর দাম বিস্তর হবে একথা জানা ছিল, কিন্তু স্মিতা বলল সারাপৃথিবী ঘুরবে, মোটে একজোড়া চামড়ার জুতো এনেছ! অসুবিধে হবে। চলো তোমাকে একটা হাঁটাহাঁটি করার জন্যে জুতসই জুতো কিনে দিই।

সব জুতোই হাঁটাহাঁটি করার জন্যেই বানানো হয় বলেই ধারণা ছিল–কিন্তু ইদানীং বসা বসি শোওয়া-শুয়ির জন্যেই বোধহয় জুতো বেশি ব্যবহার হয়। বিজ্ঞাপনের ছবিতে আকছার দেখছি–সম্পূর্ণ নগ্না রমণী পায়ে কালো কুচকুচে হাঁটু সমান রাইডিং বুট পরে মেনিবেড়ালের মতো সাদা বিছানায় আধো-শুয়ে গাঢ় লাল-রঙা উলের লাছি নিয়ে সোয়েটার বুনছে। উলের বিজ্ঞাপন।

বিরাট দোকান। থাক থাক সারি সারি জুতো সাজানো র‍্যাকে র‍্যাকে। মেঝেতে কার্পেট পাতা। নীচু গ্রামে স্টিরিও সিস্টেমে বাজনা বাজছে। কিন্তু বিক্রেতা কোথাওই দেখা গেল না।

ব্যাবসাটা ভূতুড়ে বলে মনে হল। স্মি

তা বলল, তোমার পা কত বড়ো?

আমি পা দেখিয়ে বললাম, যত বড়ো দেখছ তত বড়ো।

ও বিরক্ত হয়ে বলল, কী যে করো রুদ্রদা, সাইজ কত? কত নম্বর?

আমি বললাম, তা জানি না, আমার মালকিন বলতে পারবেন। জুতো জামা সব উনিই কেনেন।

স্মিতা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল আট হবে বোধহয়।

 সাইজ জেনেই বা কী করবে? দু-দুজন জলজ্যান্ত খরিদ্দার এসে দোকানে দাঁড়িয়েছি– সাক্ষাৎ লক্ষ্মী আমরা, তবু কারোরই পাত্তা নেই। আমাদের কলকাতা হলে এতক্ষণে চারজন সুন্দর সুবেশ যুবক একটা তেকোনা চিত্তিরের ওপর আমার ছি-চরণ ফেলে পা বুকের ওপর নিয়ে পা ধরে কত টানাটানি সাধাসাধি আর এদের কিনা এমনই হিমশীতল ব্যবহার!

যাই-ই হোক বাইরে দুটি বিরাট বিরাট গামলায় বিভিন্নরকমের ও বিভিন্ন মাপের জুতোর একপাটি করে রাখা আছে। পছন্দ করতে বিস্তর সময় ব্যয় হল। পছন্দসই জুতো পাচ্ছিলাম না বলে নয়; দামগুলো বড়োই অপছন্দসই হচ্ছিল। কলকাতার ফুটপাথে যে অকৃত্রিম স্বদেশীয় টায়ার-সোলের পেরেকমারা চমৎকার ট্যাঁকসই জুতো জলের দামে বিক্রি হয় সেই পদের জুতোর দামও দেখি বিস্তর।

আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, দেখো স্মিতা, আমার একজোড়া জুতোতেই চলে যাবে আমি লিভিংস্টোন নই বা জন হান্টার নই যে হেঁটে হেঁটে দেশ আবিষ্কার করব বা গুচ্ছের হাতি মারব–তুমি জুতো-টুতো কিনো না আমার জন্যে।

স্মিতা নিজের গালে নিজের তর্জনী দিয়ে একটি টুসকি মেরে বলল, ওমা! ন-টাকা তো দাম মোটে।

বললাম, বল কী? ন-টাকা?

ও বলল বিশ্বাস হচ্ছে না, দেখো, বলেই লেবেলটা দেখাল। আমি দেখলাম ন পাউণ্ড দশ সেন্ট–সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটর হয়ে গিয়ে কুড়ি দিয়ে গুণ করেই আঁৎকে উঠলাম। বললাম, তোমাদের টাকা আমাদের টাকায় তফাত আছে। এসব জুতো আমার ছি চরণের যুগ্যি নয়।

স্মিতা কিছুতেই শুনল না। একটা মোটা রাবার সোলের সোয়েডের-গা ভেতরে ফ্ল্যানেলের লাইনিং-দেওয়া ফিকে খয়েরি জুতোকে ফিতে সরি, লেজ ধরে মরা ধেড়ে ইঁদুরের মতো দোলাতে দোলাতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে দোকানের গভীরে ঢুকল।

অনেকখানি গিয়ে দেখি একটি বেলডাঙার কুমড়োর মতো গোলাকৃতি মেয়ে মিনি স্কার্ট পরে বসে চকোলেট খাচ্ছে আর কাউন্টারের রোগা টিং-টিং ঝুলোফো ভেঙে-যাওয়া-ডান হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছেলেটির সঙ্গে বসে নেকু-নেকু গল্প করছে।

আমাদের দেখেই ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়েস স্যার।

আমি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম।

বলেন কী গো!

সাক্ষাৎ লাল টকটকে সায়েব এমন আমার মতো লোককে স্যার বলে? বন্ধু-বান্ধবদের বাবা-ঠাকুরদাকে দেখেছি ধুতির ওপর জিনের কোট পরে, ট্যাঁক-ঘড়ি খুঁজে পানের ডিবে হাতে নিয়ে বিদেশি কোম্পানির বড়োবাবুর চাকরি করেছেন আর সারাদিন স্যার স্যার করেছেন। বাড়ি এসে গিন্নিদের কাছে রাতের বেলা সায়েবের গল্প করেছেন। সায়েবরা তো ভগবান। সায়েবরাও আবার কাউকে স্যার বলে নাকি?

যাকগে, লানডানের বুকে সেই প্রথম শ্বেতাঙ্গ আমার প্রবাসের প্রথমদিনে আমাকে স্যার সম্মান দিয়ে এমনই পুলকিত ও চমকিত করে দিলে যে আমার মনে হল এই স্যারে ও নাইটহুডে কোনোই ফাঁক নেই।

স্মিতার হাত থেকে সেই একপাটি জুতোটা বাঁ-হাতে নিয়ে কাউন্টারের পাশেই একটা ছোটো চারকোনা পেতলের বাক্সে ফেলেই ছেলেটা একটা সুইচ টিপে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাক্সটা সাঁ করে ওপরে উঠে গেল। বুঝলাম, এটি একটি লিফট। তার পরক্ষণেই বাক্সটি আবার ওপর থেকে সাঁ করে নেমে এল। দেখলাম, সেই একপাটি জুতো, সঙ্গে একটি পলিথিনের ব্যাগে মোড়া সেইরকমই একজোড়া নতুন জুতো।

ছেলেটি সেই একপাটি স্যাম্পল জুতোটি নিয়ে কাউন্টারের পাশে একটি কনভেয়র বেল্টে ফেলে দিল। বেল্টে করে জুতোটি সেই গামলায় গিয়ে পড়ল, যেখান থেকে স্মিতা সেটাকে তুলে এনেছিল।

 জুতো এসে পৌঁছেলে ছেলেটি বাঁ-হাতে স্মিতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে ক্যাশ রেজিস্টারের চাবি টেপাটেপি করে চেঞ্জ ফেরত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ঊ্য স্যার, থ্যাঙ্ক ঊ্য ম্যাম।

জুতোর প্যাকেট বগলে নিয়ে আমি গট গট করে স্মিতার সঙ্গে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। জীবনে প্রথমবার সায়েবের মুখে স্যার শোনার যে কী উন্মাদনা যাঁরা না শুনেছেন তাঁরা কখনোই বুঝবেন না।

সেই মুহূর্তে, মনে মনে ব্যাটাদের নীল চাষের অপরাধ, শোষণের অপরাধ, ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়ার অপরাধ, স্বাধীনোত্তর ব্যাবসাদারির আণ্ডার-ইন-ভয়েসিং-এর সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে হল।

স্মিতা বলল, এরপর তোমার একটা ওভারকোট কিনতে হবে।

ওভারকোট যে আমার ছিল না, তা নয়। মানে, আমার নয়, বাবার ছিল। কালো কম্বলের ওভারকোট। ওজন মন দেড়েক হবে। বাবার সাড়ে ছ-ফুট চেহারার আপাদমস্তক যাতে ঢাকা পড়ে সেইমতো করে এবং ডিসেম্বরের জঙ্গলের শীত যেন কোনোমতেই ঢুকে পড়তে না পারে তার সমস্ত বন্দোবস্তই তাতে ছিল। সেই ওভারকোটের সাইজ এমনই ছিল যে, তার বাঁ-পকেটে আমাদের ফক্স-টেরিয়ার কুকুর ম্যাডাকে আকণ্ঠ ঢুকিয়ে ডান পকেটে টিফিন ক্যারিয়ার ভরতি লুচি, কষা মাংস এবং কাঁচাগোল্লা নিয়ে কাঁধে বত্রিশ ইঞ্চি ডাবল ব্যারেল গ্রীনার বন্দুক ফেলে বাবা শীতকালের ভোরে শুয়োর শিকারে বেরোতেন। একবার ক্যারাম বোর্ডের গুটি হারিয়ে যাওয়ায় সেই আপাদমস্তক ওভারকোটের একডজন বোম কেটে ফেলে আমরা কাজ চালিয়েছিলাম। পরে অবশ্য সেই গুটি ফুটে উঠেছিল পিঠে।

অনেক কারণে সে ওভারকোট নিয়ে এতখানি পথ আসা যেত না। বিশ কেজি ওজনের প্রায় সবটহি ওভারকোটই খেত। সবচেয়ে বড়ো কথা, ইমিগ্রেশনেই আটকে যেতাম। ওরা আমাকে নিঃসন্দেহে হিমালয়ের ভালুক বলে ভাবত। মানুষ বলে মানত না।

স্মিতা কোনো ওজর-আপত্তি না শুনে আমাকে নিয়ে একটি বড়ড়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকল। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বলতে ছোটোবেলায় কলকাতার হল অ্যাণ্ড অ্যাণ্ডারসন, কমলালয় স্টোর্স এবং ইদানীংকার নতুন দিল্লির সুপার মার্কেটকেই জানতাম।

ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মানে যে একজন আঙ্গা-পাঙ্গা মানুষকে এপাশ দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য পাশ দিয়ে তাকে পৃথিবীর তাবৎ স্থাবর সম্পত্তির মালিক করে বের করে দেওয়া যায় এ ধারণা ছিল না।

এক এক তলায় এক একরকম জিনিস। কতরকমের কত বিচিত্র যে জিনিস তা বলার নয়। সাইজ লেখা, দাম লেখা, যার যেটা খুশি তুলে নিচ্ছে, নিয়ে গিয়ে কাউন্টারে দাম দিচ্ছে।

 ক্রমেই এসব দেখে যা মনে হয় তা হচ্ছে আমাদের দেশ হলে তো দিনে কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস চুরি যেত! এত জিনিস অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো লোক নেই, দারোয়ান নেই–আশ্চর্য!

 স্মিতা বলল, ওপরের কোনো এক ঘরে অনেকগুলো টেলিভিশনের সামনে একজন লোক বসে আছে। প্রতিতলার ছবি ফুটে উঠছে তার সামনে। এদেশে অভাবের জন্যে লোকে চুরি কমই করে। কিন্তু ক্লিপটোম্যানিয়াক লোক আছে। কোনো সন্দেহজনক লোককে কোনো তলায় দেখা গেলেই ইন্টারকমে সেই তলার কাউন্টারে বা কোনো বিশেষ লোককে সেই আগন্তুকের চেহারা ও পোশাকের বর্ণনা দিয়ে দেয় টেলিভিশনের সামনে বসা মনিটার।

তবুও বলব যে, এসব দেশে যে চুরি হয় না, বাইরে দুধের বোতল পড়ে থাকে, কাগজের স্টলে কাগজ পড়ে থাকে দাম লেখা–এসবে এরা যে জাত হিসেবে আমাদের চেয়ে বিশেষ ভালো একথা মোটেই প্রমাণিত হয় না। আসলে অর্থনৈতিক দিকটা এদের এতই ভালো যে খুব গরিব লোকও তেমন গরিব নয়–আমরা গরিব বলতে যা বুঝি। তা ছাড়া অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক কারণ আছে। লোকসংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক কম বলে এদের প্রশাসনটা চালানোও অনেক সোজা ও সহজ। আমাদের দেশের সাধারণ লোকদের যে অবস্থা তা এদের দেশের লোকদের হলে চুরি হত কি হত না সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

স্মিতা আমাকে নিয়ে ওভারকোটের ডিপার্টমেন্টে ঢুকল। কতরকম যে ওভারকোট চামড়ার, ফারের, শিপস্কিনের, ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ের–লংকোট, হাফকোট, গলাবন্ধ, গলা খোলা, তার ইয়ত্তা নেই। দেখে চর্মচক্ষু সার্থক করা গেল। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা হালকা নীলচে-ছাই রং, গলায় ফার দেওয়া ওভারকোট পছন্দ করা গেল–দামও পছন্দসই। ভাদ্রবউ বড়োলোক হলেও তাকে লজ্জাকরভাবে খরচ করানোতে আমার আপত্তি ছিল।

 ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলি সবই সেন্ট্রালি-হিটেড। বাইরে বেরিয়ে টাটকা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক লাগে মুখে। ঝকঝকে রোদ ছিল আকাশে। ঝকঝকে বলব না–লক্ষ লক্ষ গাড়ি ও বাসের পেট্রল-ডিজেলের ধোঁয়ার লানডানের আকাশ কখনও ঝকঝকে বলতে যা বোঝায় তা থাকে না। তবু রোদটা মিষ্টি লাগছিল।

স্মিতা বলল, সকাল থেকে তোমাকে অনেক দৌড় করিয়েছি, লাঞ্চের সময়ও হয়ে গেছে, চলো কোথাও খেয়ে নেওয়া যাক।

পিকাডিলিতেই একটা দোকানের সামনে ফুটপাথে চেয়ার-টেবিল পাতা ছিল–রোদে বসে খাওয়ার জন্যে। সেখানেই গিয়ে বসলাম। শুধু রোদে বসার জন্যেই নয়–সামনের যে অবিশ্রান্ত কাকলিমুখর জনস্রোত তা চোখ চেয়ে দেখার মতো। এখনই যদি এই ভিড়, তো বসন্তে (মানে ওদের গ্রীষ্মে না জানি কী ভিড় ছিল)।

স্মিতা বলল, লানডানের ভিড়ের কখনোই কমতি নেই।

স্কচ বিফ-রোস্টেড স্যাণ্ডউইচ আর কফি খেলাম। স্যাণ্ডউইচের মধ্যে মাখন সর্ষে লেটুস আর সেলারি পাতা ভরা।

কতরকম ভাষা যে এই জনস্রোতের! টুকরো-টুকরো ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, জাপানিজ সব ঝরাপাতার মতো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। হাওয়াটারও যেন নেশা লেগেছে–এই নেশা-রঙিন পরিবেশে।

ইচ্ছে করছিল সারাদিনই এখানে বসে থাকি, আর চোখের মণির লেন্সে ছায়া-ফেলা এই মুখগুলি চিরদিনের মতো মস্তিষ্কের কোষে-কোষে ডেভেলাপ করে রেখে দিই। যেন এই সাতসাগরের পারের ছেলে-মেয়েরা, তাদের হাসি, তাদের গান, তাদের মুখের অভিব্যক্তিসমেত চিরদিনই মনের মধ্যে থেকে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *