১. বেলা পড়ে এসেছিল

রিয়া উপন্যাসবুদ্ধদেব গুহ

০১.

বেলা পড়ে এসেছিল। পথের দু-পাশের গাছের ছায়াগুলি দীর্ঘতর হয়ে আসছে। শীতের কমলালেবু-রঙা রোদ হলদেটে দেখাচ্ছে এই শেষবেলাতে। শীত এখনও জাঁকিয়ে পড়েনি। এবারে শীত পড়তে দেরি হচ্ছে। পুজো শেষ হয়ে গেছে। কালীপুজোর কিছুদিন বাকি।

রিয়া আর সংজ্ঞা সাইকেলে চড়ে ফিরছিল পান্ডে স্যার-এর বাড়ি থেকে টিউশন নিয়ে। চড়াই-উতরাই-এ ভরা জঙ্গুলে পথ বেয়ে গামারিয়ার বুকের কোরক থেকে। দোকান-টোকান বি ডি ও-র অফিস সব ওইদিকেই।

সাইকেলের ঘণ্টা বাজছিল ক্রিং ক্রিং। রিয়ার পরনে সালোয়ার কামিজ। সংজ্ঞা একটি ডুরে শাড়ি পরেছে তাঁতের। গায়ে শাড়ির প্যাস্টেল রঙে রং মিলানো চাদর। সাইকেলে চলেছে। পথের দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ। অন্যান্য বাড়ির কম্পাউণ্ড; গেট। ছায়া রোদ্দুর; রোদ্দুর। ছায়া। লাল ধুলো উড়ছে। দু-পাশে ল্যানটানার গন্ধ উঠছে। উগ্র কটু গন্ধ, যা ছায়াচ্ছন্নতাকে এক ধরনের রহস্যময়তা ধার দেয়।

রিয়া বলল, কী রে? চাটুজ্যেদের বাড়িতে এবারে কারা এল?

কে জানে! প্রতিবছরই তো আসে, কোনো না কোনো চেঞ্জারের দল। সেবার সেই শ্যামবাজারের মিত্তিররা এসেছিল। মনে আছে? কী যেন নাম ছিল বকা ছেলেটার? আর ঘঘাষেদের বাড়ির সবিতা?

 রিয়া–সবিতার কথা আর বলিস না। ক্যাবলি একটা! আজকালকার দিনে অমন মূর্খামি কেউ করে?

সংজ্ঞা–এবারে ও-বাংলোতে কারা এল? আজই আসবার সময় ওদের কম্পাউণ্ডে যেন গাড়ি দেখলাম! চাটুজ্যেসাহেবরা নিজেরা কখনো আসেন না। প্রতিবছরই তো ভাড়া দেন বাড়ি।

রিয়া হেসে বলল, ড্যাঞ্চি বাবুদেরই এসেছেন কেউ। ড্যাম চিপ বলা চ্যাঞ্জারবাবুরা।

সংজ্ঞা-এখন আর কেউ ড্যাম-চিপ বলে না। শহরে আর গ্রামে জিনিসপত্রে দামের তো বিশেষ তফাত নেই আজকাল।

রিয়া–আনাজের আছে। মানে, তরি-তরকারির।

সংজ্ঞা–আর পাঁঠার মাংসরও।

 রিয়া–আসল তো জল আর হাওয়া। বিনি পয়সায় এমন জল-হাওয়া কোথায় পাবে? কলকাতার মানুষেরা তো এখন একটু নিশ্বাস নেবার মতো টাটকা বাতাসও পায় না। তোর আবার সেই কলকাতায় গিয়েই পড়বার ইচ্ছে হল। বলিহারি!

সংজ্ঞা–ইচ্ছা থাকলেই যেন সব হয়! দেখি।

সামনেই চাটুজ্যেদের বাড়ি। সেখান থেকে একটি ছোটো গাড়ি বেরুল। মারুতি।

সংজ্ঞা–গাড়ি! গাড়ি বাঁ-দিকে চাপ রিয়া। দেখিস।

রিয়া—হুঁ।

ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে সাবধান করে দিল গেট থেকে বেরিয়েই খুব জোরে-আসা গাড়িটাকে ওরা। উঁচু-নীচু পথ। যেখানে চড়াই, সাইকেল নিয়ে চড়তে হাঁফ ধরে যায়, ঠিক সেইখানেই গাড়ি! মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল রিয়া। সংজ্ঞা তখনও নামেনি। রিয়া বলল, নেমে পড় নেমে পড়। আপদ বিদেয় হোক আগে।

গাড়িটা কিন্তু এসে ওদের কাছেই থেমে গেল। সপ্রতিভ চেহারার, বুদ্ধিমান, দীর্ঘাঙ্গ অনিরুদ্ধ, গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে নেমে বলল, এক্সকিউজ মি! দরিয়াগঞ্জের বাজারটা কোন দিকে হবে বলতে পারেন?

 তারপরই, হিন্দিতে বলল, এরা বাংলা নাও বুঝতে পারে মনে করে, কিতনা দূর পড়েগি হিয়াসে? দরিয়াগঞ্জকি বাজার?

দুজনের মধ্যে রিয়াই দুষ্টুমিতে দড়। দুজনের মধ্যে বেশি সপ্রতিভও।

রিয়া বলল, বাজার সে-ই জাগে যিতনিই দূর, ই জাগে সে বাজার স্রিফ উতনাহি দূর!

দরিয়াগঞ্জ তো শুনেছি দিল্লিতে। এখানে তো কোনো দরিয়াগঞ্জ নেই।

সংজ্ঞা বলল।

 অনিরুদ্ধ– নেই?

 রিয়া–না!

অনিরুদ্ধ-তবে যে বলল মালি!

সংজ্ঞা-ভুল বলেছে। এখানে ধারিয়াগঞ্জ আছে। কিন্তু বাজার বলতে আপনারা যা বোঝেন তা তো সেখানে নেই। এখানে হাট বসে রবিবারে রবিবারে। আর এখান থেকে তিন মাইল দূর তারিয়াতেও বসে। বুধবারে।

তাই?

কী কিনতে বেরিয়েছেন?

মুরগি আর দুধ।

রিয়া বলল, ডান হাত তুলে দেখিয়ে, সোজা গিয়ে ডানদিকে মোড় নেবেন। দেখবেন, একটা মস্ত পিপ্পল গাছের তলাতে একটি খাপরার চালের ঘর। ওইখানে মৈনুদ্দিন থাকে। ওর কাছে মুরগি-মোরগা সব পাবেন। আণ্ডা-বাচ্চাও।

অনেক ধন্যবাদ। মেনি থ্যাংকস। অনিরুদ্ধ বলল। তারপরই বলল, আপনারা বাঙালি?

 রিয়া– কী মনে হচ্ছে? কাবুলি?

না। তাহলে বাঙালিই। বাঃ।

রিয়া– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু বাঃ কেন?

ওই। এমনিই বললাম। অনিরুদ্ধ বোকার মতো বলল।

তারপর আবার বলল, আপনাদের বাড়ি কোথায়? মানে, থাকেন কোন দিকে?

আপনাকে জানি না, শুনি না, বাড়ির হদিশ দিতে যাব কোন দুঃখে?

সংজ্ঞা বলল কেটে কেটে।

 অনিরুদ্ধ অপ্রতিভ হয়ে বলল, ওঃ সরি! থাক। তাহলে দেবেন না।

সোজা গিয়ে ডানদিকে। সংজ্ঞা বলল।

এবং সোজা গিয়ে বাঁ-দিকে। মানে আমাদের বাড়ি। রিয়া বলল।

কতদূর গিয়ে?

সংজ্ঞা–বেশিদূর নয়। ওদের বাড়ির নাম হ্যাপি ন্যুক। আর আমাদের বাড়ির নাম…

কী?

রিয়া বলল, ওর উচ্চারণ করতে লজ্জা করে। ওদের বাড়ির নাম ভালোবাসা।

লজ্জা পাবার কী আছে? কলকাতাতে আমাদের পাড়াতেই একটা বাড়ি আছে। ওই একই নাম। তা ছাড়া, ভালোবাসা তো লজ্জার নয়।

রিয়া–তা জানি না। এখন আমাদের যেতে হবে। একটু পরই সন্ধেও হয়ে যাবে। টর্চও আনিনি। তার ওপর একটা পাগলা শেয়াল বেরিয়েছে আবার দিনকয় হল। প্যাডেলে-রাখা পায়ের কাফ-মাসলে যদি খ্যাঁক করে দেয় দাঁত বসিয়ে? তাহলেই চিত্তির।

অনিরুদ্ধ রিয়ার কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল।

সংজ্ঞা–আরও দেরি করলে মৈনুদ্দিনকে কিন্তু আপনি নাও পেতে পারেন। তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো। নয়তো মহুয়া খেতে ভাটিখানায় চলে যাবে হয়ত একটু পর।

রিয়া-রোজই মোরগা না হলে বুঝি চলে না আপনাদের? এত প্রোটিনের কী দরকার? চেহারাটি তো দুর্বল নয় মোটেই।

দুর্বলতা ভেতরের জিনিস। বাইরের নয়। অনিরুদ্ধ বলল।

তাই? সংজ্ঞা বলল, বলেই, রিয়ার দিকে চাইল।

অনিরুদ্ধ শুধলো, আর দুধ? দুধ কোথায় পাব?

রিয়া বলল, সঙ্গে শিশু আছে বুঝি?

অনিরুদ্ধ হেসে বলল, শিশু নেই। কিন্তু আমাদের বাড়ির সকলেই দুবেলা দুধ খান। দাদু দিদা, বাবা-মা, আমি এবং আমার এক কাকা, ভজুকা।

রিয়া বলল, চারপেয়ে জানোয়ারেরাও কিন্তু একটা বয়েসে পৌঁছোবার পর দুধ ছেড়ে দেয়। মানুষদের বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত গোরুর দুধের জন্য এমন হ্যাংলামো আপনাকে অবাক করে না?

অনিরুদ্ধ প্রথমে চুপ করে থাকল একটুক্ষণ কী বলবে ভেবে না পেয়ে। পরমুহূর্তেই বলল, কথাটা ভেবে দেখার। কিন্তু দুধ কোথায় পাব তা কি বলতে পারেন?

রিয়া–এই সময়ে কোথাওই পাবেন না। তা ছাড়া আপনাদের মাদার-ডেয়ারি ফাদার ডেয়ারির মতো তো দুধের দোকান নেই এখানে, কতখানি লাগবে?

এই আড়াই কে জি মতো।

সংজ্ঞা–আমি বাড়ি গিয়েই পাঠিয়ে দেব আপনাদের বাড়ি। আমাদের বাড়িতে দুটি গোরু আছে। মুলতানি গোর।

কত দাম দিতে হবে, আপনাদের লোককে বলে দেবেন কিন্তু।

 রিয়া ফোড়ন কেটে বলল, ও তো গয়লানি নয়! দুধের ব্যাবসা তো করে না।

তাহলেও।

তাহলে কিছু নেই। এখন আমরা পালাই। পরে দেখা হবে।

সংজ্ঞা কিছু বলার আগেই রিয়া বলল।

ওদের চলে যাওয়া দেখল অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে। সাইকেল দুটো চড়াইয়ে ঠেলে ঠেলে তুলল ওরা দুজনে। চড়াইটা উঠেই পেছনে ফিরে তাকাল দু-বন্ধু। হাত তুলল অনিরুদ্ধর দিকে। বলল, চলি।

অনিরুদ্ধ বলল, বাই!

বলেই, গাড়িতে উঠে মরা আলোয় গাড়ি স্টার্ট করে এগোল।

গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ মরে যেতেই ওরাও যার যার সাইকেলে উঠে পড়ল।

 রিয়া–তুই না সুন্দর ছেলে দেখলেই তুতলে যাস। কেন বল তো?

কতদিন থাকবে এখানে তার ঠিক নেই। জানা নেই, শোনা নেই, একেবারে গয়লানি রাধা হয়ে গেলি! দুধের বিনি-পয়সার কনট্রাক্ট নেবার কী দরকার ছিল তোর? শহরের লোকেরা যত বড়োলোক, ততই কঞ্জুস। কিপটেমি না করলে কি টাকা জমে? না হয় কিছু খরচই হত!

দুধ কে খায় অত! আমাদের বাড়িতে দুধ নষ্ট হয়। সুরজের মা তো ঘি করেই রাখে। বেশি ঘি জমে গেলে গোমেজগঞ্জে বিক্রিও করে আসে কখনো কখনো। তুই তো আর খাস না।

রিয়া-না ভাই। আমি গতজন্মে কুকুর ছিলাম। ঘি খেলেই আমার চুল পড়তে থাকে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, অচেনা ইয়াং একটা ছেলেকে দুধ পাঠাবার কথা বললে মাসিমা রাগ করবেন না?

রাগ করার তো কথা নয়। তা ছাড়া, এখন তো করার আর কিছুই নেই। কথা তো দিয়েই ফেলেছি। দেখি, এখন সুরজকে বাড়িতে পাই কি না! আমি চলোম রে!

বলেই, বাঁ-দিকে হ্যাঁণ্ডেল ঘোরাল সংজ্ঞা, ওদের ভালোবাসা বাড়ির গেটে।

 গেটের ওপরের থোকা থোকা লাল ও হলুদ বুগেনভিলিয়ার ওপরে দিনের শেষ আলো পড়ে বিধুর দেখাচ্ছিল। রিয়ার ছটফটে মনটাও হঠাৎ কেমন শান্ত, বিধুর হয়ে গেল যেন। এমন শান্তি অথবা অশান্তি মনের মধ্যে কখনো বোধ করেনি রিয়া আগে। সমুদ্রের ঢেউ যখন পাকিয়ে পাকিয়ে সবচেয়ে উঁচু হয়ে ওঠে, ভেঙে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে; যখন সি-গাল ডাকে, উড়তে উড়তে সেই ঢেউয়ের ওপরে, কী যে বলে সেই ডাক, তা তো বোঝা যায় না; শুধু বোঝা যায় যে, এর পরেই ঢেউ ভাঙবে, সেই ঢেউ ভাঙার আগের মুহূর্তের নিস্তব্ধতার মতোই নিস্তব্ধতা ওর বুকের মধ্যে বাসা বাধল।

দূরে চলে যেতে যেতে সংজ্ঞা চেঁচিয়ে বলল, পরশু পান্ডে স্যারের কোচিং-ক্লাসে যাবার সময় তোকে ডেকে নিয়ে যাব রিয়া। সাড়ে তিনটেতে। ব্যাডমিন্টন খেললে তুইও ডেকে নিস আমাকে।

 রিয়া কোনো জবাব দিল না। দিতে পারল না।

কিছু একটা ঘটে গেছে রিয়ার ভেতরে। সেটা যে কী, তা ও নিজেই জানে না।

.

০২.

সুরজ বাড়িতেই ছিল। মাকে বলে সংজ্ঞা সুরজের হাতে দুধ পাঠিয়ে দিল। বলল, সুরজদাদা, চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতে যাঁরা এসেছেন তাঁদের দিয়ে এসো। ওঁদের বলা আছে।

 লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে একটু আগেই চলে গেছে সুরজ। নীহার একটু রাগ যে করেননি তা নয়! বলেছিলেন, এখন বড়ো হয়েছ, অমন অচেনা বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে গায়ে-পড়ে কথা বলার দরকার কী ছিল? চেঞ্জারেরা দু-দিনের জন্যে আসে, দু-দিন পরে চলে যায়। তাদের সব মাখামাখি, ভালো ব্যবহার রেলগাড়ির কামরায় আলাপ হওয়া সহযাত্রীদের ভাব ভালোবাসার মতোই মিলিয়ে যায় ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে ট্রেনের পেছনের লাল আলো মিলিয়ে যাবার সঙ্গেই সঙ্গেই। গত বছরের আগের বছর ঘোষেদের মেয়ে সবিতাকে কী বিপদে ফেলেই না চলে গেল সেই শ্যামবাজারের মিত্তির বাড়ির লক্কা ছেলেটা? মনে নেই? তোমাদের আমি আর কী বলব? সেই ছোঁড়াও তো এসে উঠেছিল চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতেই। তা ছাড়া তোমার বাবার এরকম অবস্থা। অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়ও নেই একজনও যিনি দাঁড়াতে পারেন আমাদের পাশে এসে। তা ছাড়া আমাদের আর্থিক অবস্থাও তো রিয়াদের মতো নয়। অনেকই ভেবেচিন্তে চলতে হয়, চলা উচিত আমাদের। আমার বড়ো ভয় করে রে তোকে নিয়ে সাগু। কবে যে বড়ো হবি তুই, চেহারাতে আর বয়েসেই শুধু বড়ো হচ্ছিস তুই, বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই হল না তোর।

এইসময় সংজ্ঞার ছোটোবোন প্রজ্ঞা হড়বড়িয়ে এসে বলল, দিদি ভাইফোঁটার পর স্কুল খুলে যাবে। আমার অঙ্কগুলো তুমি কিন্তু দেখিয়ে দিলে না এখনও।

সংজ্ঞা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে কেন? আমি নিজেকে দেখব, না তোমাকে?

সংজ্ঞা ওরকম বিরক্তির গলায় কখনোই কথা বলে না প্রজ্ঞার সঙ্গে।

 নীহার চমকে তাকালেন বড়োমেয়ের মুখের দিকে। প্রজ্ঞাও তাকাল অবাক হয়ে।

সংজ্ঞা বাথরুমে চলে গেল। চোখে-মুখে খুব করে জলের ঝাঁপটা দিল। ওর দু-কানের পেছন ঝমঝম করছে। গরম হয়ে লাল হয়ে গেছে কান। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে জল দিতে দিতে চোখদুটি জলে ভরে গেল। রিয়াকে খুব ঈর্ষা হল, রাগও হল তার প্রিয় সখীর ওপরে খুবই। ও যদি রিয়ার মতো সপ্রতিভা হত! অমন মুখেচোখে কথা যদি বলতে পারত! চমৎকার কথা বলে রিয়া।

রাত সাতটা হবে। বাইরে অন্ধকার ঘোর হয়েছে। বাইরে ঝিঁঝির ডাক। সংজ্ঞা পড়ছিল। একই ঘরে ছোটোবোন প্রজ্ঞাও খাটে শুয়ে শুয়ে পড়ছিল।

প্রজ্ঞা বলল, তোর কী হয়েছে রে দিদি?

কী আবার হবে? পাকামি না করে নিজের পড়া করো। কাল সকালে তোমার অঙ্ক নিয়ে বসব।

ঠিক আছে। বলল, অভিমানী গলায়।

প্রজ্ঞা এরকম করেই কথা বলে। অনেক সময়েই পুরো শব্দ উচারণ করে না।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতে কে এসেছে রে দিদি? তুই যে ভালোবেসে দুধ পাঠালি!

 তা দিয়ে তোর কী দরকার? বেশি ডেঁপো হয়েছিস না? প্রতিবছরই তো কত লোক আসে। আবার চলেও যায়। তা দিয়ে তোরও যেমন দরকার নেই, অন্য কারও নেই। আমার তো নেই-ই!

প্রজ্ঞা বলল, তোমার আছে। বললে তো হবে না।

প্রজ্ঞা দিদির ওপর রেগে গেলে, তুমি করে বলে।

 মানে? সংজ্ঞা বলল, বিরক্তি ও রাগের গলায়।

মানে-টানে জানি না। তবে তোর আছে।

প্রজ্ঞার দিকে ঘুরে বসে সংজ্ঞা লাল মুখে বলল, তোকে বলতেই হবে কেন তুই.। ঠিক তখুনি বাইরে একটি গাড়ির শব্দ হল এবং গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বাড়ির বাগানের সব ফুল ঝলমলিয়ে উঠল যেন। গাড়ির এঞ্জিন বন্ধ করার শব্দ হল। এবং দরজা খোলার।

কৌতূহলী প্রজ্ঞা ততক্ষণে গিয়ে জানালার পর্দার আড়াল দিয়ে আগন্তুকদের দেখতে আরম্ভ করেছে। সংজ্ঞা নিজের চেয়ারেই বসেছিল। এক চাপা উত্তেজনায় ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়েছিল।

 প্রজ্ঞা রিলে করছিল; একটা বড়ো গাড়ি। সাদা। একটা দাড়িঅলা বুড়ো। হাতে লাঠি। একজন চওড়া লাল পাড় শাড়ি পরা বুড়ি। মাথা-ভরতি সাদা চুল। সিঁথিতে দগদগে লাল সিঁদুর। সুরজদাদা। আর একজন ছেলেও।

পরক্ষণেই সংজ্ঞার দিকে ঘুরে বসে বলল, এই দিদি! সত্যিই দারুণ দেখতে রে দিদি! এর সঙ্গেই তোর দেখা হয়েছিল বুঝি? এর জন্যেই দুধ পাঠালি? বেশ করেছিস। অনেকদিন পর একটা ভালো কাজ করলি।

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বোনকে ইশারা করে সংজ্ঞা বলল, চুপ কর।

 নীহার তখন বসবার ঘরে বসে প্রজ্ঞার জন্যে সোয়েটার বুনছিলেন। গাড়ির শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে আপ্যায়ন করে ওঁদের বললেন, আসুন! আসুন! আপনারা?

অনিরুদ্ধ নীহারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আপনারা দুধ পাঠিয়েছেন, তাও মুলতানি গোরুর দুধ; আপনাদের এই লোক সুরজ তো পয়সাও নিল না। তাই দাদু-দিদা বললেন, এমন ভদ্রলোক এ যুগে প্রবাসে আছেন তাঁদের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসতেই হয়। আমি কিন্তু ওঁকে বলেছিলাম।

ওঁকে মানে?

নাম তো জানি না। মানে অনিরুদ্ধ বলল।

ও! আমার বড়োমেয়ে সংজ্ঞা। তা এইটুকু তো প্রতিবেশীর জন্যে প্রতিবেশী করেই থাকে। এ আর বেশি করা কী! আপনারা দু-দিনের জন্যে এসেছেন। আমাদের যা দেশ, আপনাদের তাই বিদেশ।

বৃদ্ধ যোগেনবাবু বললেন, না। না, মা। তা বললে তো হয় না। এইটুকু নয়; এইটুকু নয়। তা মা দুধ কি রোজই পাঠাবে। না একদিনই পাঠালে শুধু?

না, না। একদিন কেন? রোজই পাঠাব।

দুধের চেহারা দেখেই তো আমরা অজ্ঞান! এখনও মুখে দিইনি। কলকাতার লোকের পেটে সইলে হয়। আর রোজ খেতে পাব তা শুনেই তো আমি আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু দাম না নিলে রোজ নিই কী করে মা?

যোগেনবাবু বললেন।

নীহারের মুখের ভাব কঠোর হয়ে এল। ওঁর বসবার ঘরের বর্তমান দৈন্য কাউকেই বুঝতে সময় দেয় না যে, একদিন ওঁদের অবস্থা ভালো ছিল। আজ নেই। যাঁদের চোখ আছে তাঁদের চোখ খোলা-গ্যারেজে ভাঙা মিলিসেন্টে ফিয়াট গাড়িটাও এড়াবে না।

যোগেনবাবুর স্ত্রী, নীপবালা একমুহূর্ত নীহারের চোখে চেয়েই স্বামীকে বললেন, অন্য কথা বলো।

স্বামীকে একথা বলেই, নীপবালা নীহারকে দু-হাত ধরে বললেন, আমার স্বামীকে মার্জনা করবেন ভাই। ওই ওঁর দোষ। কোথায় যে কী বলতে হয়, একেবারেই জানেন না।

বৃদ্ধ যোগেনবাবু বললেন, তা ঠিক! তা ঠিক! আমার এই দোষ! সত্যিই বড়ো মারাত্মক দোষ মা!

নীহার নীপবালাকে বললেন, আমাকে আপনি করে বলবেন না। বয়সে আমি অনেকই ছোটো।

যোগেনবাবু বললেন, তা হতে পারো মা! কিন্তু জ্ঞানে-বুদ্ধিতে হয়তো নও। তোমাকে তুমি করে বলাতে কি তুমি রাগ করেছ মা আমার ওপর?

নীহার বললেন, কী যে বলেন!

নীপবালা বললেন, তা কই? মেয়েকে ডাকো। যার দৌলতে এই বিদেশ-বিভুইতে এসে দুধের সরবরাহ পাকা হয়ে গেল তাকে তো একবার ধন্যবাদ দেওয়াটা দরকার।

নীহার বললেন, আমার দুই মেয়ে।

 তাই বুঝি? তা কোনজনের সঙ্গে আমাদের অনির দেখা হয়েছিল।

বড়জনের সঙ্গে।

ডাকো মা, দুজনকেই ডাকো। আর দু-একটা দিন যাক। ভালো করে গুছিয়ে বসি, তারপর সকলে মিলে আসতে হবে কিন্তু আমাদের ওখানে। দু-দিনের মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে পারব আশা করি।

নীহার মেয়েদের ডাকলেন। প্রজ্ঞা গজগজ করছিল। ধাত! এইরকম পোশাকে কেউ বাইরের লোকের সামনে বেরোয়? তোর জন্যেই তো। দুধ বিলি করছে!

মেয়েরা এল। সাগু যোগেনবাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতে বৃদ্ধ সাগুর দুটি হাত ধরে ফেললেন. বললেন, একদ্দম না। কখখনো না। তুমি কি জানো না মা যে, এদেশে একশৃঙ্গ গণ্ডার আর প্রণম্য মানুষের সংখ্যা বড়োই কমে গেছে?

বলে, নিজেই নিজের রসিকতায় হো হো করে হেসে উঠলেন।

নীপবালা বললেন, বাঃ ভারি লক্ষ্মী মেয়ে দুটি তোমার।

প্রজ্ঞার নীচের দুধের দুটি দাঁত পড়ে মাড়ি দেখা যাচ্ছিল। এই বয়েসটা সব মেয়ের পক্ষেই এম্বুরাসিং। ওকে ডাকলেন বলে, মায়ের ওপর খুবই রাগ হচ্ছিল প্রজ্ঞার।

অনিরুদ্ধ বলল, কখন হঁদুরে নিয়ে গেল তোমার দাঁত? চলো তো দেখি, তাকে খুঁজে বের করে এক্ষুনি মারব আমি। আমার সঙ্গে বন্দুক আছে। জানো?

প্রজ্ঞা রাগ ভুলে গিয়ে বলল, তাহলে পাগলা শিয়ালটাকে মারতে পারবেন?

নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু তোমার নাম কী তা তো বললে না?

প্রজ্ঞা বলল, পাগু।

নীপবালা শুধোলেন, আর তোমার দিদির নাম?

সাগু।

অনিরুদ্ধ–সাগু? সাগু।

সাগু লজ্জায় এবং পাগুর ওপরে রাগে জ্বলে উঠল কিন্তু ওদের সামনে কিছুই বলতে পারল না।

নীপবালা বললেন, এই দোষ আমার নাতির! এত পেছনে লাগতে পারে না মানুষের! চেনা-অচেনা, আপন-পর কোনো খেয়ালই নেই।

যোগেনবাবু বললেন, আহা! পর হতে যাবে কেন? পাগু-সাগু কি আমাদের পর? ও কি কথা!

নীহার হেসে বললেন, সাগুর ভালো নাম সংজ্ঞা আর পাগুর প্রজ্ঞা।

অনিরুদ্ধ বলল, বা; ভারি সুন্দর নাম তো।

যোগেনবাবু বললেন, তা ওদের বাবা কোথায়? তাঁর সঙ্গে তো আলাপ হল না।

নীহার মুখ নীচু করে রইলেন।

সংজ্ঞা বলল, বাবার হঠাৎ-ই একটু মাথার গোলমাল মতো হয়। তাই সাইকিয়াট্রিস্টদের কথা মতো তাঁকে রাঁচির কাঁকে রোডের হাসপাতালে রাখা হয়েছে।

কতদিন মা? দুঃখের গলায় নীপবালা বললেন।

বছরখানেক হতে চলল।

বড়ো করুণ শোনাল নীহারের গলা।

একটা কথা বলব মা? ওকে হয়তো হাসপাতালে না পাঠালেও পারতে। আমার কী মনে হয় জানো? আজকালকার দিনে কমবেশি মাথার গোলমাল শতকরা নব্বই ভাগ মানুষেরই আছে। সুস্থ আছি আর আমরা ক-জন? হাসপাতালে তো উন্মাদেরাও থাকে।

যোগেনবাবু বললেন।

নীপবালা ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, আর কারও থাকুক আর না থাকুক তোমার যে মাথার গোলমাল নিশ্চয়ই বিলক্ষণই আছে তা এঁরা সকলেই এতক্ষণে বুঝে গেছেন।

অনিরুদ্ধ এই অপ্রিয় প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে বলল, না! দাদু-দিদা তোমরা যে সব বিষয়ে নিয়েই ঠাট্টা করো এটা কিন্তু ঠিক নয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত সেনসিটিভ।

নীহার তাড়াতাড়ি বললেন, না, না। তাতে কী হয়েছে বাবা।

আই অ্যাম সরি। অফুলি সরি মা। যদিও আমার বক্তব্য ছিল অন্য। কিন্তু আমার দাদুভাই ঠিকই বলেছে। বুড়ো হয়েছি তোআমার বুদ্ধিশুদ্ধি সত্যিই লোপ পেয়েছে। কোনোভাবে তোমাদের আহত করে থাকলে আমাকে নিজগুণে মার্জনা কোনো।

যোগেনবাবু অপরাধীর গলায় বললেন।

নীহার–না, না, কী যে বলেন।

অনিরুদ্ধ–প্রায়ই দেখতে যান কি আপনারা ওঁকে? রাঁচিতে?

সংজ্ঞা–না। প্রায়ই কী করে হবে? যাতায়াতেরও অনেকই অসুবিধা। শেষবার গেছিলাম বোধ হয় ঠিক মাস তিনেক আগে। না মা? এই তারিখেই। তবে, চিঠিপত্রে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। রাঁচিতে আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা থাকেন, হেভি এঞ্জিনিয়ারিং-এ কাজ করেন, তিনিও গিয়ে দেখা করেন মাঝে মাঝে।

অনিরুদ্ধ বলল, বলেন কী! তিন মাস! তার মানে বিজয়ার পরেও যেতে পারেননি?

নীহার মাথা নীচু করে বললেন, না বাবা। আমি গেলে মেয়েদের একা থাকতে হয়। এ তো কলকাতা বম্বে নয়। মেয়েদেরও তো একা পাঠানো যায় না এত ঝক্কি করে।

অনিরুদ্ধ বলল, চলুন! আমরা পরশুদিনই যাই। দাদুকেও সঙ্গে নেব। ভোরে রওয়ানা হব আর সন্ধের আগে আগেই ফিরে আসব।

যাবেন তো? ভজুকাকে আপনাদের বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে রেখে যেতে পারি।

সংজ্ঞা মুখ তুলে বলল, ভজুকা কে?

ভজুকা আমার এক কাকা। বাবার মাসতুতো ভাই। ব্যাচেলর। খুব মজার লোক। ভজুকাকে প্রত্যেকেরই পছন্দ হবে।

যোগেনবাবু বললেন, কী হল মা, যাবে তো?

নীহার একটু ভেবে বললেন, দেখি বাবা।

 নীপবালা বললেন, এতে ভাবাভাবির কিছু তো নেই মা। তোমরা যদি আগামীকালও যেতে চাও তো স্বচ্ছন্দে যেতে পারো। দাদুর আর তার দাদুভাই-এর তো এখানে আমাদের সাহায্য করার কিছু নেই। আমার ছেলে আর বউমা থাকলেই যথেষ্ট। দাদুকেও না নিয়ে গেলে চলে। ভজুই যেতে পারে অনির সঙ্গে।

আপনাকে জানাব মাসিমা। ভেবে নিয়ে একটু।

তাই ভালো। আমাদের চেনো না শোনো না পর্যন্ত! এমন হুট করে আলাপ আর এক কথাতেই অল্পবয়েসি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়াটা একটু ভাবার ব্যাপারই তো বটে। আমি হলেও ভাবতাম। তোমরা ভেবেই বোলো। কিন্তু একথাও বলব যে, তিন মাস যদি স্বামীর সঙ্গে এবং মেয়েদেরও তাদের বাবার সঙ্গে না দেখা হয়ে থাকে তবে আর দেরি না করাই ভালো।

নীপবালা বললেন।

বৃদ্ধ সৌম্য যোগেনবাবু সাদা দাড়ি নেড়ে বললেন, মা জননী! আমরা তোক কিন্তু আদৌ খারাপ নই। আমি সারাজীবন অধ্যাপনা করেছি। অনেকই ছেলে আমার হাতে যে খারাপ হয়ে গেছে একথা অস্বীকার করতে পারি না, তবে ভালোও হয়েছে অনেকে। তারাই তো আমার গর্ব। কিন্তু আমার দাদুভাই, যে তোমাদের সঙ্গে করে রাঁচি নিয়ে যাবে তার মতো ছেলেই হয় না মা। আমার নিজের নাতি বলে বলছি না বড়ো মুখ করে।

নীহার বললেন, আমি কি ও বেচারিকে একবারও খারাপ বলেছি। ছিঃছি:! এ আপনি কী বলছেন! এসব ওর পক্ষে ভারি লজ্জার কথা। দেখুন তো বেচারি লজ্জায় কেমন লাল হয়ে গেছে।

নীপবালা বললেন, সারাজীবনই তো নিজের ঢাক নিজে পেটালে। এখন কি নাতির ঢাক বাজানোর বায়না নিয়েছ?

যোগেনবাবু হেসে ফেললেন। বললেন তা কী করি! বোসবংশের একমাত্র প্রদীপ।

অনিরুদ্ধ মুখ নীচু করে বলল, সত্যি! দাদু তুমি না!

অপ্রতিভ অনিরুদ্ধর অস্বস্তি সংজ্ঞা এবং প্রজ্ঞা খুব উপভোগ করল।

.

০৩.

বাইরের বারান্দায় একটি আলো জ্বলছে। একটি দিশি কুকুর বারান্দার এককোণে চটের গদির ওপর শুয়ে আছে। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বাইরের জঙ্গলের প্রায়-অমাবস্যার জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে চেয়ে জোরে জোরে ডাকতে লাগল। ঝমঝম করে ঝিঁঝি ডাকছে। রিয়া শোয়ার ঘরের ছোট্ট পড়ার টেবলে বসে ডাইরি লিখছিল। উঠে পড়ে আলোয়ানটা জড়িয়ে নিয়ে পেছনের বারান্দার দরজা খুলে টর্চ জ্বেলে ডাকল, কালিয়া। এ কালিয়া।

জি। বাবা।

গেটে তালা দিয়েছ তো?

হ্যাঁ বাবা।

বলতে বলতে কালিয়া একটা কালো কম্বল মুড়ে নাগরা জুতো পরে নিজের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এল।

সব ঠিক হ্যায়?

 ঠিক হ্যায় বাবা।

কালিয়া বলল।

রিয়া ঘরে এসে আবার ডাইরির সামনে বসল।

 লিখল :

১.১১.৯৮
গামারিয়া

 আজ কার সঙ্গে যে দেখা হল! কেন যে হল জানি না। রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ছে ও কেন দেখা দিল রে, না দেখা ছিলো যে ভালো।

বেশ ছিলাম। আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে কোনো ঝড় ওঠেনি কখনোই। প্রথম দেখাতেই যে কাউকে এত ভালো লাগতে পারে তা গল্প-উপন্যাসে পড়েছি যদিও, কখনো বিশ্বাস করিনি। ভাবতাম, এসব ঔপন্যাসিকের কল্পনাতেই ঘটে। কারও জীবনেও যে এমন ঘটতে পারে হঠাৎ, তা ভাবারও বাইরে ছিল।

আমার মুখই আমার সর্বনাশের মূলে। এত বেশি কথা বলি আমি যে, কী বলি তা বলার সময় নিজেরই খেয়াল থাকে না। আর যা বলি, তা অনেক সময়ই যা বলতে চাই, তার ঠিক উলটোটাই। সংজ্ঞার মতো যদি কম কথা বলতে পারতাম! ওর নিশ্চয়ই সংজ্ঞাকেই ভালো লাগবে। আমার মতো বেশি কথা-বলা মেয়েকে কোনো ভালো ছেলের ভালো লাগতেই পারে না। আমি একটা থার্ড-ক্লাস।

মা-র কাছে শুনেছি। ভালো গান গায়, পড়াশুনোতেও খুব ভালো। ভদ্র, সভ্য। মা তো অনিরুদ্ধকে দেখে আর ওর কথা শুনে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছে। এই গামারিয়ার অসভ্য জংলি পুরুষদের সঙ্গে ওর কোনো মিলই নেই। সমস্ত পরিবারটিই চমৎকার। দাদু-দিদা, অনির মা-বাবা। এমনকী ভজুকাও! সবসময় এমন মজার কথা বলেন না!

আমিও তো একদিন মা হব। সব মেয়ের বুকেই একজন মা ঘুমিয়ে থাকে। তাই আমি আমর মায়ের মন ঠিকই বুঝি। মায়েরাও হয়তো বোঝেন মেয়েদের মন।

ভয় করে, মায়ের কাছে ধরা না পড়ে যাই। কিছুই যে ভালো লাগে না আমার। খেতে ইচ্ছে করে না, ঘুম আসে না, পড়াশুনো চুলোয় উঠেছে। সবসময় ওর কথাই ভাবি, মনে মনে ওর সঙ্গে কত কথা বলি। সংজ্ঞার মতো, মেপে মেপে, সত্যিকারের আমার মতো কলকল করে নয়। ওর সঙ্গে দেখা না হলে ভীষণ মন খারাপ লাগে, আবার দেখা হলে মন আরও বেশি খারাপ লাগে। ও চলে গেলে বা ওর কাছ থেকে চলে এলে মনে হয় জীবনই বৃথা হয়ে গেল। ও কাছে এলে আমার হাঁটু কাঁপে থরথর করে, গায়ে জ্বর আসে। সত্যিই কি জ্বর আসে? এই জ্বরের নাম কী কে জানে? এ তো সর্দিজ্বর নয়। আমার জানা কোনো অন্য জ্বরও নয়। একেই কি কাম-জ্বর বলে? জানি না। ইশ! আমি অত্যন্ত অসভ্য হয়ে গেছি।

বড়োই কষ্টে আছি আমি।

কুকুরটা আবারও ডেকে উঠল বার বার জোরে জোরে। রিয়া দরজা না খুলে বারান্দার দিকের জানালা একটু খুলে দেখল বাগানের বুড়ো পেয়ারা গাছটার নীচে একটা জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ ফেলতেই দেখল। তার চোখ দুটো জ্বলছে, যেন কাঠকয়লার আগুন! নিশ্চয়ই পাগলা শেয়ালটা! নাকি মালির কুকুর গুণ্ডাই দাঁড়াল গিয়ে ওখানে?

রিয়া পাগুর কাছে শুনেছিল যে, অনিরা সঙ্গে বন্দুক নিয়ে এসেছে এবং অনি পাগুকে বলেছিল যে, শেয়ালটাকে মেরে দেবে ও। কে জানে, পাগু ছোট্ট মেয়ে বলে হয়তো ওর সঙ্গে রসিকতা করেছে।

ঠিক করল, কাল নিজেই বলবে অনিকে। সবসময় আতঙ্কিত থাকতে হয়।

.

০৪.

সুরজ গোরুকে জাবনা দিয়ে ফিরে এল। সুরজের মা বারান্দার সিঁড়ির ওপরে বসেছিল। দেহাতি শাড়ি পরা। গায়ে নীহারের ব্যবহৃত একটি পুরোনো নীল-রঙা ফুলহাতা সোয়েটার তার লাল-রঙা ব্লাউজের ওপরে পরা।

সুরজ–আন্ধার হো গেল। মাইজি অবক লওটা নেহি!

সুরজের মা–ওহি তো শোচ রাহি থি বেটা। সুব্বে ছে বাজি নিকলে থে ঔর অবতক লটনেকা নামহি নেহি। রাঁচী তো দূরভি হ্যায় না কাফি হিয়াসে।

বাবুকো সাথ লে করহি আয়েগা সায়েদ।

ছোড় তু। বাবু ইস জিন্দগি মে ভালা হোনেওয়ালাই নেহি না হ্যায়।

কেইসে মালুম?

দর্দ ঔর দুখ ক্যা কমতি মিলা বাবুকো? মাইজিসি আওরত তো মুঝকো জিন্দগি মে ঔর মিলা নেহি। মর্দকো ইতনা তংক করনা, সাঁতানা, ঝাড়সে পিটনা, গালি দেনা হরবখত…নেহি, অ্যায়সি ম্যায় কভভি না দেখিন।

বাবুকি ভি কুছ কসুর তো থা। সদরমে উও রায়বাবুকি আওরতসে লটর-পটর…

আরে, কসুর কওন মর্দকি নেহি হোতা হ্যায়। ইয়ে সব ছেটিমোটি কসুর সব মর্দকিহি কুছ-না-কুছ রহতাহি। তেরা বাপ ক্যয়সা থা? কামাইমে বাহাদুর ঔর দিনরাত দারু পিকর বেহোঁস। ম্যায় তো খাট-খাটকে মর গ্যয়ি বচপনহিসে। নসিব ফিন আওরতকি যেইসি হোগি ওইসাই না মিলেগি ইস জিন্দগিমে। মগর তবভি ম্যায় কভভি ডাঁটা তেরা বাপকো? না ঝাড়সে পিটা?

হায়! তেরি হিম্মত থোড়ি থি মা!

হিম্মত কি সওয়াল মত লায়া করো বেটা। হিন্দুস্থানমে আওরাত কি হিম্মতসে ভি কুছ বড়ো চিজে হোতি হ্যায়। তুম নেহি না সমঝোগা! না ম্যায় তুকো সমঝাকে বোল না শকুংগি।

সুরজ–(কান খাড়া করে) ইক গাড়িকি আওয়াজ মিল রহি হ্যায়। মালুম হোতা আভভিতক চানোয়া-টোডিংকি উপরই হ্যায়। উরতে উরতে পাঁচ দশ মিনট লাগ হি জায়গা।

সুরজের মা স্বগতোক্তির মতো বলল, খ্যয়ের ই চিজে বহতই পসন্দ হ্যায় হামারা কি বাবুক দো লেড়কিয়া বড়ি তেজ ঔর ঠাণ্ডা মিজাজকি নিকলি। বড়ি অকলদার, বড়ি আচ্ছি হুয়ি। ইয়ে দো লেড়কিয়া নেহি রহনসে ম্যায় কব কাম ছোড় কর ভাগ জাতি থি। বড়ি পেয়ারসে বাঁতে কবতি হ্যায়, বড়ি নেক। বড়া খানদানকি লেড়কিয়াকি অ্যায়াসাহি না হৌনা চাহিয়ে। মাইজিকি খানদান ঠিক নেহী থি। ইয়ে বাত তো বার বার ম্যায় কহতি থি ঔর বরাব্বর কহেগি ভি।

 গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ জোর হতে লাগল। একবার কাছে আসে একবার দূরে, যাচ্ছে সে শব্দ, জঙ্গলের মধ্যের ফাঁক-ফোকর, বাঁক এবং চড়াই-উতরাই-এর কারণে। সুরজ আর সুরজের মা দুজনেই উঠে দাঁড়াল। এমন সময় লাল ধুলোয় ধূসরিত হয়ে বড়ো গাড়িটা ঢুকল গেটে। সকলে নামলেন একে একে। প্রত্যেকের চেহারাও ধুলি-ধূসরিত। লাল হয়ে গেছে।

ভজুকা বললেন, বাব্বাঃ। মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ! তবে একথা বলতেই হয় যে, গাড়ি তুই বেশ ভালোই চালিয়েছিস অনি। কিছু বলার নেই। উন্নতি হচ্ছে আস্তে আস্তে।

নীহার মাথার চুল থেকে ডান হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে বললেন, চলুন চলুন ভজুবাবু। ভেতরে চলুন। চা-টা খেয়ে তারপরে বাড়ি যাবেন। এসো বাবা অনি।

 অনি বলল, আজ থাক মাসিমা। এতখানি পথ, সকলেই ক্লান্ত হয়ে আছেন আপনারা। আর আমার তো চায়ের নেশাই নেই। কখনো পেলে খাই। আর ভজুকা তো সন্ধের পরে চা খায়ই না। খারাপ জিনিস খায়।

নীহার বিরক্ত মুখে বললেন, ও তাই। তাহলে আর…

অনি আবারও বলল, হ্যাঁ, ফর্মালিটি তো নেই আমাদের সঙ্গে কোনো। চলি সাগু। এবং পাগু। কাল ঠিক সকাল আটটাতে আসব। রিয়াকে তুলে নিয়ে। তোমাদের কিছু খাবার-দাবার নিতে হবে না। সেসব ভজুকার ভার। ঠিক আটটাতে। পাগু তৈরি না থাকলে কিন্তু ফেলে যাব তোমাকে। পিকনিক-এ যাওয়া হবে না।

পাণ্ড যাবে না। ওর অনেক পড়া আছে। দেওয়ালির পরেই তো পরীক্ষা। এমনিতে টেবলেই বসে না।

ঠিক আছে! বলে, অভিমান করে ভেতরে চলে গেল প্রজ্ঞা।

ভজুকা বললেন, চলি নীহারদি।

 যাওয়া নেই। আসুন।

পাণ্ড জানালা দিয়ে বলল, হাত নাড়িয়ে টা-টা। অনিদা। ভজুদা।

অনিও হাত নাড়ল। মুখে কিছুই বলল না। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। সাগুও চোখ নামিয়ে নিল অনির চোখ থেকে। তারপর চেয়ে রইল চলে যেতে-থাকা গাড়িটার দিকে।

পথে পড়ল গাড়ি। সংজ্ঞাদের গেট ছাড়িয়ে।

ভজুকা পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে বললেন, উঃ সারাটা দিনই বলতে গেলে গাড়িতে। ওঁদের খুবই ধকল গেল। কী বলিস! অনি?

হ্যাঁ। তবে খুব খুশিও হলেন সবাই। নিজের স্বামীর সঙ্গে, নিজেদের বাবার সঙ্গে এতদিন দেখা নেই। তার ওপরে মাথার গোলমাল বলে তো ছেড়ে থাকাটা আরোই কষ্টের।

কিন্তু মাথার কোনো গোলমাল গোপেনবাবুর যে আছে তা তো মনে হল না।

ভজুকা বললেন।

ওই না-মনে হওয়াটাই গোলমালের। যাই বলো, বড়ো কষ্ট লাগে দেখলে। মনের অসুখের মতো কষ্টকর আর বোধ হয় কিছুই নেই।

অনি বলল।

ভজুকা বললেন, যাই বলিস অনি, গোপেনবাবু, মানে সাগু-পাগুর বাবাকে দেখে কিন্তু মনে হয় কোনো গভীর কষ্টে ভদ্রলোক ওরকম হয়ে গেছেন। কোনো হঠাৎ শক-এ নয়। ক্যান্সারের মতো কোনো কষ্টে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছেন।

বেশ সম্ভ্রান্ত চোহারা কিন্তু সাগু-পাগুর বাবার। তাই না?

নিশ্চয়ই! তা নইলে মেয়েরা অমন সুন্দরী হয়? খুব ভালো পসার ছিল নাকি! গোমেজগঞ্জে ভিড়-ভাট্টা বলে এই নিরিবিলি গামারিয়াতে বাড়ি করেছিলেন এসে। যাতায়াতের জন্যে তাঁকে নাকি একঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হত। ফিরতেনও একঘণ্টা পরে। গোমেজগঞ্জেই বাড়ি করে থাকলে এই অসুবিধাটা সইতে হত না।

বাড়িটাতে কত গাছপালা দেখেছ?

অনি বলল।

হ্যাঁ রে! কত্বরকমের ফুল! তা ছাড়া জঙ্গল, পাহাড়ি নদী, পাহাড় সবই তো আছে এখানে। ভাবছি এখানেই একটি টিলা-ফিলা দেখে সেটল করে যাব। তোর বাবার চামচেগিরি অনেক করেছি, আর নয়। এবার নিজের কথা ভাবার সময় হয়েছে।

গাড়ির স্টিয়ারিং চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোর দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে অনি বলল, এখানে জঙ্গলই তো সব! উনি নিশ্চয়ই খুব প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন।

অনি বলল।

 ভজুকাকা অনির কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, বাঃ তাহলে বাড়ি এলাম এইবারে। হোম! সুইট হোম। গরম জলে চানটা সেরে নিয়েই জম্পেস করে এবার রাম-নামটা শুরু করতে হয়। কী বলিস! বউদি যা অবুঝ! হয়তো সাতটা থেকেই খাবার জন্যে তাড়া লাগাতে থাকবেন। আসলে অবশ্য তোর বাবারই জন্যে, ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। নয়তো যোগেন পিসে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের অবদান কতটুকু এবং কতটুকু নয় তা ফিনসে ব্যাখ্যা করতে শুরু করবেন। আর তোর বাবার কথা ছেড়েই দে। ব্যাবসা ছেড়ে সে তো আর কিছুরই খবর রাখে না। ওই সন্ধের পর যা একটু ভদ্রলোক হয়। অন্য কিছু কথাবার্তা বলা যায়। তাও দেখ, কবে এখান থেকে কোনো হঠাৎ বাহানা লাগিয়ে কুটুস করে কেটে পড়বে। এসে অবধি তো তারই তাল খুঁজছে। তোদের এই ভ্যাগাবণ্ড ভজুকা হচ্ছে গাধাবোট, বুঝলি না। তোর বাবার মহাজনি নৌকোর পেছনে বাঁধা থাকে। যেখানে যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করা চলে। ইচ্ছেমতো মাঝনদীতে খুলে রেখে নিজে হাওয়া হয়ে যাওয়া যায়। নইলে কি আর ভজুর এমনি এত কদর।

হাসতে হাসতে অনিরুদ্ধ বলল, নামো এবারে। গাড়ি গ্যারাজে ঢোকাব।

.

০৫.

রিয়াদের বাড়ির বাগানে একটি গাছতলায় কাঠের বেঞ্চে বসেছিল রিয়া। হাতে কাঁচের একটি বাটি। দুপুরবেলা। রিয়া হলুদের ওপর কালো ফুলফুল কাজ করা একটি শালোয়ার কামিজ পরেছিল। সংজ্ঞা এল পেছনের গেট খুলে। সুঁড়িপথ দিয়ে। একটি হলুদ কলো খড়কে-ডুরে শাড়ি পরেছে ও। পায়ে চটি। চুল খোলা। শাড়ির নীচে সাদা লেস-বসানো শায়া দেখা যাচ্ছে পা তোলবার সময়ে। পায়ে রুপোর পায়জোড়। ভারি সুন্দর গড়ন সংজ্ঞার হাত-পায়ের। সাধারণার্থে রিয়া অবশ্য সংজ্ঞার চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী। কিন্তু সংজ্ঞার চেহারা এবং চাল চলনের মধ্যে এক বিশেষ আভিজাত্য আছে।

সংজ্ঞা ছোটো গেট নিঃশব্দে খুলে এসে রিয়াকে বলল, কী খাচ্ছিস রে?

 বলব কেন?

পায়ের ওপর পা নাচিয়ে রিয়া বলল, জিভে ট্যাক করে শব্দ করে।

 বলই না বাবা।

না :

কেন? না কেন?

হেসে বলল সংজ্ঞা।

তুই আমাকে সব কথা বলিস?

এমন বোকা বোকা। কী খাচ্ছিস তাও বলতে বাধা?

আমি তো খাওয়ার কথাই বলছি।

সংজ্ঞা এক সেকেণ্ড গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, সব কথা কেই বা বলে অন্যকে। তা ছাড়া কীসের সব কথা? কী খাওয়া?

আমি বুঝি অন্য? পর? এমন তো ছিলাম না আগে তোর কাছে। আমিও এখন তোর কাছে সবাই?

রিয়া বলল, অনুযোগের সুরে।

তুই বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে ঝগড়া করবি তার কি করব আমি? বললে বল, নইলে ভারি বয়েই গেল।

রিয়া ডান পাটি বাঁ পা থেকে নামিয়ে দোলনার ওপর আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে বলল, খাবি তুই চালতা মাখা?

চালতা? কোথায় পেলি?

অবাক গলায় বলল সংজ্ঞা।

 কালিয়া অনেক খুঁজে-পেতে এনেছে আমার জন্যে। বলতে পারিস আনিয়েছে। গোমেজগঞ্জের মালিককে দিয়ে কলকাতা থেকে।

আমাকে সত্যি দিবি না? একটুও?

 দেব। যদি বলিস। বা তুই যা কিছুই খাস তাও আমাকে দিস একটু।

কী যে হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা বলিস! ভালো লাগে না।

কী বলব তবে? সোজা কথাকে তুই যদি বেঁকিয়ে নিস বা ন্যাকামি করে না বুঝিস তার আমি কী করব?

একটু চুপ করে থেকে সংজ্ঞা বলল, কী দিয়ে মেখেছিস? চালতা?

 কী দিয়ে? ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, একটু নুন, একটু চিনি…ট্রাক।

 জিব দিয়ে আর একবার শব্দ করল রিয়া। চোখ বড়ো বড়ো করে। তারপর বলল, এই নে। হাত দিয়ে তুলে নে একটু। পাত্র তো নেই।

মুখে দিয়ে, মুখে চোখে এক বিচিত্র ভঙ্গি করে সংজ্ঞা বলল, দারুণ!

কেমন দারুণ! অনির চুমুর মতো স্বাদ?

দেখ রিয়া, ভালো হবে না বলছি।

 সংজ্ঞা রেগে উঠে বলল।

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

বাগানে নানা পাখি ডাকছিল। দুপুরের শীতের রোদ ঝকমক করছিল সবুজ পাতায় পাতায়। হলুদ লাল পাটকিলে ও কালো কিছু ঝরাপাতা পড়েছিল গাছতলায়। পাতা ঝরার সময় এখনও আসেনি। কোনো কোনো গাছের পাতা ঝরেছিল।

সংজ্ঞা রিয়াকে একবার প্রদক্ষিণ করল। দু-একটি পাতা ওর পায়ের চাপে মুচমুচ করে ভেঙে গেল।

সংজ্ঞা বলল, স্বগতোক্তির মতো, কেন জানি না, আজকে আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে।

রিয়া বলল আসনসিঁড়ি হয়েই বাগানে দুলতে দুলতে। বাবা! তোকে সাধাসাধি করেও মদনদা বেচারা এককলি গান শুনতে পায় না আর আজকে তোর কী হল?

গাইব না! ঠিক আছে।

চালতা-মাখার চিনেমাটির হলুদ বাসনটি মাটিতে নামিয়ে রেখে রিয়া বলল, গান শুনব পরে। এখন বল, কেমন কাটল কাল বিকেলটা। কোথায় গেছিলি তোরা? ভীষণ ভালো না কাটলে কি আর গান গাইতে ইচ্ছে করছে?

সংজ্ঞা চুপ করে রইল একটুক্ষণ।

 বলবি না তাহলে?

কী বলব? আরে এমনিই। অনি বলল, লং ড্রাইভে যাবে। কলকাতার মানুষেরা বোধহয় এইরকম করেই বলে। ড্রাইভে যাওয়া শুনিনি কখনো। হাঁটতে যাওয়া, সাইকেলে যাওয়া, সাইকেল রিকশাতে যাওয়া এসবই জেনেছি এতদিন।

তারপর? রিয়া বলল, পরম ঔৎসুক্যে।

তারপর আর কী সুসানগঞ্জের জংলি পথে মাইল দশেক গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটি মাঠে গিয়ে বসলাম আমরা শতরঞ্চি বিছিয়ে, রোদে পিঠ দিয়ে। আমি বাড়ি থেকে ফ্লাস্কে করে চা, পাটিসাপটা পিঠে আর কুচো-নিমকি নিয়ে গেছিলাম। ও-ও এনেছিল কেক আর কফি। মাসিমা বাড়িতেই বানিয়েছিলেন। চ্যাটার্জিসাহেবের বাড়িতে কেক বানাবার আভেন নেই, অনির মা সুমিতা মাসিমা নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে। ভারি শৌখিন কিন্তু ওঁরা।

রাখ তো! পয়সা অঢেল থাকলে অমন শৌখিনতা অনেকেই করতে পারে। ওরা ফিলদি রিচ। কিন্তু আভেনটি কী বস্তু রে? ওভেন তো জানতাম।

উনুনের ইংরিজি তো আমরা সকলেই জানি ওভেন। Oven।

তাই তো Oven-এর সঠিক উচ্চারণ, নাকি উচ্চারণ করে আভেন। সেটাই ঠিক ইংরিজি। আমাদের ইংরিজি স্যার গঞ্জ সিং আর অত জানবে কোত্থেকে বল?

তা আমাদের ইংরিজি স্যার যা শেখাবেন আমরা তা-ই তো শিখব বল? তাও তো যা বলেন তার অর্ধেক কথাই আবার খৈনিভরা ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে আটকে থাকে।

হেসে বলল রিয়া।

 যা বলেছিস।

 সংজ্ঞা বলল, যাকগে। আমাদের অত ইংরিজি ফুটিয়ে কাজ নেই। সাহেবরা তো দেশ ছেড়ে চলে গেছে কবেই, তবে আর ওভেন না আভেন তা নিয়ে অত মাথাব্যথা কীসের? কেক খেতে পেলেই হল।

তারপর কী হল সেটা বল? তুই আসল কথাটাই এড়িয়ে যাচ্ছিস।

 রিয়া পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে এলে সংজ্ঞা বলল, আসল কথাটা আবার কী? অনি গান

শোনাল।

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গলায় উদাসীনতা এনে বলল সংজ্ঞা।

বলিস কী? দাঁড়িয়ে উঠল রিয়া বেঞ্চ ছেড়ে। দুষ্টুমি করে বলল, সে গানও গাইতে পারে নাকি? মায়ের কাছে শুনেছিলাম বটে! মাকে অবশ্য একটি রামপ্রসাদি শুনিয়ে একেবারে ফ্ল্যাট করে দিয়েছে। তোকে কী শোনাল?

আমাকে শোনানোর জন্য তো গায়নি। আমি শুনলাম ওই পর্যন্ত। গেয়েছিল পাগুরই অনুরোধে।

পাগুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

তুই একটা ইডিয়ট। ছোটোবানকে নিয়ে কেউ লাভ করতে যায়? তুই কী রে!

লাভ করতে যাওয়া আবার কী? তোর যত অদ্ভুত সব কথা।

সংজ্ঞা উষ্মার সঙ্গে বলল।

ওই হল রে হল। ক্ষতি করতে তো যাসনি? নিজের অথবা অন্যের। বেশি বেশি ন্যাকামি করিস না। যে নামেই ডাকিস লাভ ইজ লাভ। এখন বল কী গান গাইল?

একটা বাংলা গজল।

কেমন গলা?

বেশ। ভালোই। মানে, চমৎকারও বলা চলে।

তোর এই বেশ। ভালো। চমৎকার। এইসব ব্যবহারে ছিঁড়ে-যাওয়া শব্দগুলো আসলে কিছুই বোঝায় না। খুলেই বল না। গান শুনে বুক ধুকপুক করছিল? রিকিঝিকি উঠেছিল সারাশরীরে?

তুই অত্যন্ত অসভ্য! তোর সঙ্গে কথা বলা যায় না অথচ তোর মতো ভালো কথা যদি বলতে পারতাম। রিকিঝিকিটা আবার কী ব্যাপার?

রিয়া দু-বাহু নাড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, রিকিঝিকি! খুবই খারাপ অসুখ। যার হয়, সে-ই জানে।

সংজ্ঞা চুপ করেই রইল বিরক্তিতে মুখ নামিয়ে।

রিয়া বলল, শুধু অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ। আর অনিরুদ্ধ।

তার প্যায়েরভি ছাড়। আসলে বল তারপর কী হল?

হবার কী ছিল?

বলবি না তাই বল তাহলে।

 রিয়া হতাশা এবং রাগ মিশিয়ে বলল এবারে।

 যদি তাই ভাবিস, তাহলে তাই।

ঠিক আছে।

একটু চুপ করে থেকে গলার সোনার চেইনটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল সংজ্ঞা, পাগু একটা গান গেয়েছিল।

কী গান? উৎসাহিত না হয়েই বলল রিয়া।

ওই। রবীন্দ্রসংগীত। তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে তুমি ধন্য, ধন্য হে।

 আর তুই?

আমি কি তোর মতো গান গাইতে পারি যে গাইব?

ঢং করিস না আর। বীরেশদা তো তোর গান আমার চেয়ে অনেক ভালো বলেন। বলেন,  তোর স্টাইল-ই আলাদা। প্রতিটি কথার মানে বুঝে বুঝে তুই গান গাস।

সেসব তো বীরেশদার কথা। আমি আমার কথাই বললাম। বীরেশদা কত বড় বোদ্ধা!

যাকগে বীরেশদার কথা। তা কতক্ষণ ছিলি?

রিয়া গ্রীষ্ম-দুপুরের ধুলো-মাখা চড়াইয়ের মতো ছটফটিয়ে বলল।

এই আধঘণ্টা মতো, কি বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট হবে।

ও! তারপর?

 তারপর বাড়ি চলে এলাম।

 বলেই, মুখ ঘুরিয়ে বলল, ওই দেখ অনিরুদ্ধ আসছে তোরই কাছে। আমি যাই এবারে। খুশি তো! যা জেরা করার তা ওকেই কর। তোকেই আর এই দোলনাকে সমর্পণ করে গেলাম অনিকে। কোনো দাবিই না রেখে।

আড়চোখে গাছের ছায়া-ভরা পথে অনিকে তাদের বাড়ির দিকে হেঁটে আসতে দেখে, খুশি চেপে রেখে রিয়া বলল, যাবি তুই। যা তাহলে। তবে পেছনের গেট দিয়েই চলে যা। মালি একটু আগে খুলেই এসেছে। নইলে তুই থাকলে ও ফ্রি ফিল করবে না।

ঠিক আছে। পেছনের গেট দিয়েই তো এসেছিলাম। বলেই, সংজ্ঞা তাড়াতাড়ি বাগানের বড়ো বড়ো গাছের মধ্যে মিলিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু অনিরুদ্ধ ওকে দেখে ফেলেছিল। দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, এই যে সংজ্ঞা, আমার ওপরে কোনো অজানা কারণে রেগে আছ বুঝি!

সংজা থেমে পড়ে, একটি মহুয়া গাছের নীচে দাঁড়াল। মহুয়া গাছের কান্ডর খয়েরি-কালো রুক্ষ পটভূমিতে ওর সুন্দর বিব্রত ফর্সা মুখটি ফুটে উঠল। মুখে বলল, না, মানে…

ফিরে এসো। একটু পাশে পাশে থাকো।

অনি হেসে বলল।

সংজ্ঞা, রিয়ার দিকে তাকাল। দেখল, রিয়ার মুখে বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। সংজ্ঞা আরও বিব্রত হল। গভীর ইচ্ছামাখা অনিচ্ছার সঙ্গে সংজ্ঞা মুখ তুলে অনিকে বলল, বাড়িতে অনেক কাজ আছে। এখন না গেলে মা বকবেন। আমি যাই। তোমার পাশে থাকার মানুষের কি অভাব অনিদা?

রিয়াদের বাড়ির গেটের থামে হেলান দিয়ে সুরসিক অনি হাসিমুখে গেয়ে উঠল চিরকুমার সভার গান, হাত নেড়ে :

দেখব কে তোর কাছে আস
 তুই রবি একেশ্বরী একলা আমি রইব পাশে

গানের মধ্যেই আস্তে আস্তে শালীন ভঙ্গিমায় হেঁটে চলে গেল সংজ্ঞা।

অনিরুদ্ধ এগিয়ে এল রিয়ার কাছে। রিয়া মুখ গোঁজ করেই বসে রইল।

কাছে এসে অনিরুদ্ধ বলল, কী হল তোমার?

কিছু না তো!

অনিরুদ্ধকে পাত্তা না দিয়ে বলল রিয়া।

 তোমার বন্ধুকে থাকতে বলেছিলাম বলে রেগে গেলে বুঝি?

 আমার কোনো বন্ধু নেই।

আহা! তুমি বড়ো অভাগী। এত বড়ো সংসারে তোমার একজনও বন্ধু নেই।

দুবেলা মুলতানি গোরুর দুধ খেয়ে গায়ে খুব জোর হয়েছে বুঝি!

হঠাৎ বলে উঠল রিয়া। চমকে উঠে এবং সামান্য আহত হয়ে অনিরুদ্ধ বলল হঠাৎ? একথা! তোমার রাগের কারণটা কী জানতে পারি?

তোমার ওপর রাগ করতে যাব কোন দুঃখে। কে না কে পথের লোক দু-দিনের চেঞ্জার। তোমাদের ওপর শুধু রাগ কেন, ভালোবাসা, অভিমান, কোনো কিছুই নষ্ট করার মতো অহেতুক কষ্ট আর দুটি নেই। আমি বোকা নই। হয়তো আগে ছিলাম। কিন্তু এখন আর নেই।

কনগ্রাচুলেশান। বোকা লোক আমি মোটে সহ্য করতে পারি না।

বলেই, রিয়ার দিকে নিজের ডানহাতখানি বাড়িয়ে দিল। রিয়া হাত দিল না।

অনি বলল, কিছু কিছু পোকা, অ্যান্টিবায়টিক্স আর বোকাতে আমার অ্যালার্জি আছে।

তারপর একটু চুপ করে থেকেই বলল, তা কবে থেকে এই উন্নতিটি হল?

কীসের উন্নতি?

এই এই বোকা থেকে চালাক হয়ে ওঠা। সংজ্ঞার কাছে কালকে ড্রাইভে যাওয়ার কথা শোনার পরই কি?

তারসঙ্গে এর কী? রাগের গলায় বলল মুখ ফিরিয়ে রিয়া। আপনি কি ভাবেন আপনার সঙ্গ পাওয়ার জন্যে আমি লালায়িত?

কার সঙ্গে কার যে কী তা কে বলতে পারে?

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। আমি হঠাৎ একটি বড়ো গাছ দেখিয়ে বলল, এটা কী গাছ?

শিমুল। রিয়া মুখ না তুলে নৈর্ব্যক্তিক গলাতে বলল।

 ও! এই গাছেই বসন্তকালে লাল লাল ফুল ফোটে?

 আজ্ঞে হ্যাঁ।

অনিরুদ্ধ একবার আড়চোখে রিয়ার মুখে চেয়ে রাগটা কতখানি তা অনুমান করে নিল। তারপর বলল, এই গাছ থেকে তুলোও হয়। তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু তুলো তো অনেকসময় মানুষ থেকেও হয়।

সেটা কীরকম। মানুষ থেকে তুলো?

 মদনদার বন্ধুরা বলে, পেঁদিয়ে তুলো ধুনে দেব।

তা তোমার কি আমাকেও তুলো ধুনো করার ইচ্ছে হয়েছে? ইচ্ছে হলে ধুনো। তা ছাড়া যার তার হাতে তো এ অভাগার ধুনিয়ে যাবার সৌভাগ্য হবে না, হলে বলছ সাক্ষাৎ তোমার মদনদার হাতেই হবে। মন্দ কী। পেঁজা পেঁজা সাদা তুলো হয়ে নীল আকাশে ছড়িয়ে যাব। যেখানে যেখানে ছড়িয়ে পড়ব মাটিতে, সেখানে সেখানেই আমার বীজ রোপিত হয়ে যাবে। নতুন করে জন্মাব সবখানে। আঃ! ভাবলেও ভালো লাগে। তা, ঘটনাটি ঘটছে কবে? মানে ঘটাচ্ছ কবে?

এতক্ষণ পর রিয়া এইবারে হাসি হাসি তাকাল অনির দিকে। অনিরুদ্ধর রসবোধ ওর মনের রাগের মেঘ উড়িয়ে দিয়েছিল বলেই হয়তো।

রিয়া বলল যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে। ঘটলে, আমার অঙ্গুলি হেলনেই ঘটবে।

বাঃ বাঃ। বাংলার ঘরে ঘরে এমন অঘটনঘটনপটীয়সী নারীর জন্ম হোক।

তা, আমি কি একটু বসতে পারি পাশে?

পাশে বসার মানুষ তো চলে গেল একটু আগেই।

তাই? তাহলে তাই। কিন্তু আমার তো কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই যে আমি অন্য কারো পাশে একটুও বসতে পারব না।

রিয়া জবাব দিল না সে কথার।

মাসিমা কোথায়? সাড়া শব্দ নেই যে।

 মা একটু শুয়েছেন খাওয়া-দাওয়ার পর। রোজই এই সময়ে বিশ্রাম করেন।

তুমি কী করছিলে?

অনিরুদ্ধ শুধোল।

চালতামাখা খাচ্ছিলাম।

হেসে বলল রিয়া।

বাঃ। আছে নাকি?

নেই। সাগু এল। দুজনে মিলে ফুরিয়ে ফেলেছি। কাল দুপুরে এলে খাওয়াতে পারি।

কী?

চালতামাখা।

আর কিছু?

আর কী? আচার খেতে চাও তাই খাওয়াব। তেঁতুলের আচারও আছে। লেবুর আচার। আচ্ছা, কাল সকালে মাসিমার কাছে পাঠিয়েও দেব না হয় কালিয়া বা কাউকে দিয়ে। তুমিও দুখিয়া মালিকে পাঠাতে পারো।

আচার ছাড়া আরও তো কত কিছু থাকে সংসারে খাওয়ার। উপাদেয়। কী, থাকে না?

 থাকে নাকি? হয়তো হবে। আমি অত জানি না।

দুজনে তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। টুপটাপ করে পাতা ঝরছে। পাখি ডাকছে। শীতের মন্থর বাতাস বইছে ঝুরুঝুরু আওয়াজ তুলে পাতায় পাতায়, ঘাসে ঘাসে। রিয়া শালটা গায়ে টেনে নিল ভালো করে। অনি একটা ছাইরঙা ফ্ল্যানেলে ট্রাউজার আর ব্লেজার পরেছিল। ব্লেজারের বুকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমব্লেম। বুক পকেটে লালরঙা সিল্কের রুমাল গোঁজা, কলারতোলা শার্টের। কোটের কলারের নীচে শার্টের কলার উঁচিয়ে আছে, লালরঙা সিল্কের শার্ট। কিছুক্ষণ দু-দিকে মুখ করে নিজের নিজের ভাবনাতে কুঁদ হয়ে রইল ওরা।

অনিরুদ্ধ বলল, একটু হেঁটে আসি।

 আমার গায়ে বাত।

সে কী! কবে থেকে? অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে শুধোল।

অনেককে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে পারো আর আমাকে নিয়ে শুধুই হাঁটা? অবশ্য আমি এমন হ্যাংলা নই যে, গাড়ি দেখলেই ঘোড়া দেখার মতো খোঁড়া সেজে উঠে বসব তাতে।

 শোনো রিয়া, ঈর্ষা একটা পরমদূষণীয় ব্যাপার। এবং হীনম্মন্য মানুষমাত্রই ঈর্ষায় ভোগে। কিন্তু মেয়েদের বেলায় দূষণীয় নয়। ঈর্ষাটা তোমাদের বেলাতে কেমন যেন মানিয়ে যায়। ঈর্ষা জাগলে তোমাদের মুখশ্রী সুন্দরতর হয়ে যায়।

 বাবাঃ। কথা তো অনেকই শিখেছিলে। তা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো কেন? যে বা যারা অ্যাপ্রিশিয়েট করবে তাকে বা তাদের বলাটাই ভালো নয় কি?

কথা আর শিখলাম কোথায় বলো! তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে একটু শেখবার চেষ্টা করছি। খুব ভালো কথা বলো তুমি।

বললে কী হয়। কথায় কি আর চিড়ে ভেজে?

শুকনো চিঁড়ে কখনো খেয়ে দেখেছ? গুড় দিয়ে বা দই দিয়ে। চিঁড়ে মাত্রকেই যে ভেজাতে হবেই এমন কোনো কথা তো নেই।

 রিয়া দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দৈর্ঘ্যে রিয়া প্রায় অনিরুদ্ধর বুক অবধি আসে। যে কোনো মানুষইএই খুব কাছাকাছি দাঁড়ালে ওদের দুজনকে দেখে বলতেন আহা! রাজযোটক। মিল হয়েছে হে।

ভালো লাগে না।

শুধু কথা, কথা, আর কথা।

 রিয়া বলল।

 আমি জানি, তুমি…।

 বলেই, রিয়ার দু-চোখে চুমু খেল। রিয়া আনন্দে, আবেগে, অর্ধস্ফুট কামে থরথর করে কেঁপে উঠল।

মুখে বলল, অসভ্য। অস্ফুটে। এসব ভালো লাগে না। মা দেখে ফেললে! অনি সেকথার জবাব না দিয়ে গান গেয়ে উঠল।

একসময় রিয়ার মা নলিনী বাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। থামের পাশে। গান শেষ হলেই বললেন, বাঃ। ভারি চমৎকার তুমি গাইলে অনিরুদ্ধ। গান কি এখনও শেখো? সেদিনের রামপ্রসাদিটিও চমৎকার লেগেছিল। যেমন দরদ, তেমনই সুর তোমার গলাতে।

ছেলেবেলায় শিখেছিলাম। বাবা ওস্তাদ রেখেছিলেন বাড়িতে। তবে আমার দ্বারা কোনো ওস্তাদই হবার নয়। শেষপর্যন্ত Jack হলাম মাসিমা।

নলিনী বললেন, আর একদিন আমাকে এসে গান শুনিয়ে যেয়ো। একা আমাকে। গান গাইতে যেমন মনোযোগ লাগে, গান যে শোনে তারও সমান মনোযোগী হতে হয়। আমার মেয়ের এই গুণটি ছাড়া সব গুণই আছে। মনোযোগ কাকে বলে তা সে জানেই না।

অনি বলল, আমি এবার যাব মাসিমা।

কোথায় যাবে?

ভজুকাকে নিয়ে হাটে যাব। আজ যে বুধবার তারিয়াতে হাট বসে যে।

রিয়া উচ্ছল হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে যাবে অনিদা? কত্বদিন তারিয়ার হাটে যাইনি। দারুণ কাঁচের চুড়ি আর রুপোর গয়না পাওয়া যায়।

বলেই, রিয়া মাকে শুধোল, মা, আমি অনিদাদার সঙ্গে তারিয়ার হাটে যাব?

নলিনী বললেন, গেলে মুখটা একটু ঘষে মেজে যেয়ো। যা চেহারার ছিরি হয়েছে। আর একটা কথা। সাগুকে নিয়ে যেয়ো সঙ্গে।

যেতে পারবে কি ও এত শর্ট নোটিশে?

নলিনী বললেন, না যেতে পারলেও ওকে বোলো। না বলে যেয়ো না। ছেলেমানুষ! মনে দুঃখ পাবে। সাগু না গেলে রিয়াও যাবে না।

নলিনী ভেতরে চলে গেলেন।

রিয়া বলল, কখন যাবে? হাটে?

আধঘণ্টার মধ্যে।

 সংজ্ঞাকে খবর দিয়ে যাও। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

 তুমি কি সত্যিই চাও যে সংজ্ঞা সঙ্গে থাক আমাদের?

কেন? না চাওয়ার কী?

অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল। বলল, আসলে অসুবিধেটা আমারই। একসঙ্গে দুজন মেয়েকে আমি ট্যাকল করতে পারি না। ল্যাজে-গোবরে হয়ে যাই।

গবাদি পশুরা ল্যাজে-গোবরে হয়ই কোনো না কোনো সময়ে। ল্যাজ থাকলেই অমন হতে পারে। তা ছাড়া মিথ্যেবাদী ফ্লার্টদের অনেকই অসুবিধে।

না, না। ঠাট্টা নয়। আমি সত্যিই বলছি আমি তোমাকে একাই নিয়ে যেতে চাই।

তা তো চাই। সঙ্গে ভজুকাকেও নিয়ে যাচ্ছ তো সেইজন্যেই!

 কী জন্যে?

যাতে আমরা দুজন একা হতে পারি।

হেসে ফেলে অনি বলল, ভজুকা কি ব্যাড-কোম্পানি? তা ছাড়া সাগুকেও তো একা নিয়ে যাইনি। সঙ্গে তো পাগুকেও নিয়ে গেছিলাম।

রিয়া বলল, জানি। সবই জানি। কিন্তু আমি যাব না।

যাঃ বাবা :। আবার কী হল! তুমি নিজেই তো যেতে চাইলে!

কিছু হয়নি, এমনিই। সাগুকে খবর দিতে হবে। মায়ের আদেশ। ভজুকা সঙ্গে যাবে, তোমার আদেশ। এত সব কণ্ডিশন মেনে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আমি যাব না। কখনো আমাকে একা যদি কোথাও নিয়ে যেতে রাজি থাকো…আমরা সঙ্গে সাগুর তফাত আছে। আমি আমিই!

একা গিয়ে হবেটা কী? আমরা তো এই মুহূর্তেই একাই। সবসময়ই একা এই জঙ্গল পাহাড়ের পরিবেশে যেকোনো মুহূর্তেই তো একা হওয়া যায়, তারজন্যে হাটে বা লং-ড্রাইভে যাওয়ার দরকারই বা কী?

রিয়া চুপ করে রইল।

কী হল! কথা বলছ না যে!

 আমার কিছু বলার নেই। তুমি ভজুকাকে নিয়েই যাও। আমার ভালো লাগছে না যেতে।

একটু অবাক ও আহত হয়ে অনিরুদ্ধ বলল, মন থেকে বলছ তো? তুমি বড়ো খামখেয়ালি। ক্ষণে ক্ষণে মত বদলায় তোমার।

আমি এইরকমই। বলেইছি তো, আমি আমিই!

ঠিক আছে।

বলে, সামনের পাহাড়তলির দিকে চেয়ে রইল অনিরুদ্ধ।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। হেমন্তের দুপুরের রোদ ছমছম করছিল গাছে-পাতায়। কাঁচপোকা উড়ছে রোদের মধ্যে।

অনিরুদ্ধ বলল, আমি তাহলে যাই এখন?

রিয়া বলল, তোমার খুশি। আমি তো তোমাকে বেঁধে রাখিনি।

জানব কী করে? বাঁধনের তো অনেকই রকম হয়।

হয় বুঝি?

আচ্ছা আমি আজ চলি। পরে আসব আবার। কোনোদিন।

না-জানিয়ে এমন হুট-হাট করে এসো না। আমারও তো একটা সুবিধা অসুবিধা… অনির মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, সরি! আসার আগে না জানিয়ে আসাটা অন্যায় হয়েছে। আর এমন হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *