১. বুধবার হলো মুহিবের মিথ্যাদিবস

উৎসর্গ

কন্যা লীলাবতীকে

এই উপন্যাসের নায়িকা লীলা। আমার মেয়ে লীলাবতীর নামে নাম। লীলাবতী কোনোদিন বড় হবে না। আমি কল্পনায় তাকে বড় করেছি। চেষ্টা করেছি ভালোবাসায় মাখামাখি একটি জীবন তাকে দিতে। মা লীলাবতী! নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।

———–

ভালোবাসা কী?

Theory of relativity has nothing to do with it.–আইনস্টাইন

Soft version of sexual attraction.–শোয়েডিঞ্জার (কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জনক)

ভালোবাসাই ঈশ্বর।–ম্যাথমেটিশিয়ান অ্যাবেল

————-

০১.

আজ বুধবার।

বুধবার হলো মুহিবের মিথ্যাদিবস। মিথ্যাদিসে রাত এগারোটা উনষাট মিনিট পর্যন্ত সে মিথ্যা কথা বলে। তার এই ব্যাপারটা একজন শুধু জানে। সেই একজনের নাম লীলা। লীলার বয়স একুশ। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। বিষয় ইংরেজি সাহিত্য।

লীলার সবই সুন্দর। চেহারা সুন্দর, চোখ সুন্দর, মাথার কোঁকড়ানো চুল সুন্দর। ক্লাসে তার একটা নিক নেম আছে— সমুচা। এমন রূপবতী একটা মেয়ের নাম সমুচা কেন সেটা একটা রহস্য। নাম নিয়ে লীলার কোনো সমস্যা নেই। সে বন্ধুদের টেলিফোন করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, আমি সমুচা বলছি।

মুহিবের বয়স ত্রিশ। গায়ের রঙ কালো। বেশ কালো কালো ছেলেদের ঝকঝকে সাদা দাঁত হয়। মুহিবের দাঁত ঝকঝকে সাদা। পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট কোম্পানি একবার তাকে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের জন্যে সিলেক্ট করেছিল। ডিরেক্টর সাহেব তাকে দেখে বললেন, এই ছেলের চেহারায় তো কোনো মায়া নেই। চোখ এক্সপ্রেশনলেস। একে দিয়ে হবে না।

মুহিব বলল, স্যার, আপনাদের তো মায়ার দরকার নেই। আপনাদের দরকার দাঁত। আমার দাঁত দেখুন। আমি আস্ত সুপারি দাঁত দিয়ে ভাঙতে পারি। একটা সুপারি অনুন, দাঁত দিয়ে ভেঙে দেখাচ্ছি। দশ সেকেন্ডের মামলা।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে দাঁত দিয়ে সুপারি ভাঙ। ফাজিল ছোকরা।

মুহিব বিএ পাশ করেছে আট বছর আগে। একবারে সম্ভব হয় নি। দুবার পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ডিভিশন পেয়েছে। রেজাল্ট বের হবার পর মুহিবের বাবা (আলাউদ্দিন আহমদ) ছেলেকে বললেন, বিএ-তে থার্ড ডিভিশন ফেলের চেয়েও খারাপ। কেউ রেজাল্ট জিজ্ঞেস করলে বলবি, ফেল করেছি।

মুহিব বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা।

আলাউদ্দিন বললেন, থার্ড ক্লাসের সার্টিফিকেটটা হাতে আসলে ছাগলকে কাঠালপাতার সঙ্গে খেতে দিবি। থার্ড ক্লাস সার্টিফিকেট ছাগলের খাদ্য।

মুহিব বলল, ছাগল কোথায় পাব?

আলাউদ্দিন বললেন, খুঁজে বের করবি ঢাকা শহরে ছাগলের অভাব আছে?

মুহিব বলল, জি আচ্ছা।

আলাউদ্দিন বললেন, সকালে আমার সামনে। খবরদার পড়বি না তোর মুখ দেখে দিন শুরু হওয়া মানে দিনটাই নষ্ট। নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবি। আমি ঘর থেকে বের হলে রিলিজ হবি। মনে থাকবে?

থাকবে।

এখন সামনে থেকে তার সঙ্গে কথা বলা মানে আয়ুক্ষয়।

মুহির বাবার সামনে থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। রান্নাঘরে মুহিবের। মা রাজিয়া বেগম রান্না বসিয়েছেন! এই মা মুহিবের সংসা। ভদ্রমহিলা সরুল। প্রকৃতির। মুহিবকে অসম্ভব পছন্দ করেন। তিনি বললেন, এই গাধা! কদমবুসি করেছিস?

মুহিব বলল, কদমবুসি করব কেন?

বিএ পাশ করেছিস, কদমবুসি করবি না? বিএ পাশ হওয়া সহজ কথা? কয়টা ছেলে আছে বিএ পাশ?

মুহিব মাকে কদমবুসি করল।

রাজিয়া বললেন শাড়ির আঁচলে তিন টাকা আছে]একশ টাকা নিয়ে যায় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মিষ্টি খাব। আমার হাত বন্ধ।

মুহিব শাড়ির আঁচল খুলে। তিনশ টাকার পুরোটাই নিয়ে নিল।

রাজিয়া বললেন, চুপ করে বসে থাকা বান্না শেষ করি। তারপরে হাত ধুয়ে তোর মাথায় হাত রেখে দোয়া করব। মায়ের দোয়া ছাড়া সন্তানের কিছু হয় না

মুহিব বলল, তুমি তো আমার মা না।

রাজিয়া বললেন-থাপড়ায়েত ফেলে দিব বদমাশ ছেলে। আমি মানাতো মা কে?

মুহিব ঝিম ধরে বসে রইল। মহিলা রান্না শেষ করে অজু করলেন। মুহিবের মাথায় হাত রেখে বললেন, হে আল্লাহপাক, এই ছেলেটা সত্যিকার মায়ের আদর কী জানে না। তুমি তার উপর দয়া কর।

মুহিব বিরক্তালীয় বলদ, এটা কী বললো মা!তুমি যে আদর কর এটা মিথ্যা?

মিথ্যা হবে কেন?

সত্যিকার মায়ের আদর কি তোমার আদরের চেয়ে আলাদা?

রাজিয়া বেগম চুপ করে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।

মুহিব বলল, আল্লাহপাকের সঙ্গে কথা বলছ, জেনে বুঝে বলবে না।

রাজিয়া বিব্রত গলায় বললেন, কী বলব বলে দে।

মুহিব বলল, তুমি বলো আমার এই ছেলেকে যেন কেউ দয়া না করে। উল্টা সে যেন সবাইকে দয়া করতে পারে।

রাজিয়া বেগম তোতাপাখির মতো বললেন, আমার এই ছেলেকে যেন কেউ দয়া না করে। উল্টা সে যেন সবাইকে দয়া করতে পারে।

মুহিবের চরিত্র বোঝার জন্যে তার একটা ঘটনা উল্লেখ করা জরুরি। সে বিএ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর সত্যি সত্যি ছাগলকে দিয়ে সার্টিফিকেট খাইয়েছে। কোরবানি দেবার জন্যে আলাউদ্দিন তিনহাজার চারশ টাকায় একটা ছাগল কিনেছিলেন। লবণ মাখিয়ে সার্টিফিকেটটা তার সামনে ধরতেই ছাগল খেতে শুরু করল। আলাউদ্দিন বললেন, ছাগলকে কী খাওয়াচ্ছিস?

মুহিব বলল, বিএ সার্টিফিকেটটা খাওয়াচ্ছি। আরাম করে খাচ্ছে বাবা।

আলাউদ্দিন বললেন, বিএ সার্টিফিকেটটা খাওয়াচ্ছিস মানে?

মুহিব বলল, তুমি খাওয়াতে বলেছিলে। ভুলে গেছ?

আলাউদ্দিন ছুটে এসে অর্ধেক সার্টিফিকেট ছাগলের মুখ থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি সাটিফিকেট উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হলেন না। সেটা বাধাই করে নিজের শোবার ঘরে টাঙিয়ে রাখলেন। যেদিন টাঙালেন সেদিন বাসার সবাইকে ডেকে এনে বললেন— অর্ধেক সার্টিফিকেট টাঙিয়ে রেখেছি কী জন্যে জানো? সবাইকে একটা জিনিস বোঝানোর জন্যে। সেটা হচ্ছে, সার্টিফিকেটের মতো আমার পুত্রও অর্ধমানব।

এখন মুহিবদের পরিবার সম্পর্কে বলা যাক। মুহিবের বাবা আলাউদ্দিন একটা গার্লস স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এখন নিজেই মেয়েদের একটা কোচিং সেন্টার চালান। নাম আলাউদ্দিন কোচিং। কোচিং সেন্টারের মেয়েরা তাকে ডাকে বক্ষ-স্যার। কারণ তিনি নাকি মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ান না। বুকের দিকে তাকিয়ে পড়ান। তার কোচিং সেন্টারের যথেষ্ট সুনাম আছে। তিনি নিজেও ইংরেজি খুব ভালো পড়ান।

অবসর সময়ে আলাউদ্দিন গান লেখেন। বেতার এবং টিভির তিনি একজন এনলিস্টেড গীতিকার। বাজারে তার দুটি বইও আছে— ঈশ্বর ও ধর্ম এবং কোরানের আলোকে বিজ্ঞান। কোচিং সেন্টারের ছাত্রীদের বই দুটি কেনা বাধ্যতামূলক।

আলাউদ্দিনের প্রথমপক্ষের স্ত্রীর গর্ভের সন্তান তিনজন। বড় দুই মেয়ের পর মুহিব। বড় দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। প্রথমপক্ষের স্ত্রীর নাম শেফালী। তিনি কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতস্থ। ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।

দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী রাজিয়া বেগমের একটি সন্তান, নাম অশ্রুমালা। ডাকা হয় অশ্রু। অশ্রু বাবার কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। কোচিং সেন্টারে অশ্রুর নাম হয়েছে কাউয়া। যদিও তার গায়ের রং শাদা। যথেষ্ট রূপবতী। বড় বড় চোখ। কাটা কাটা নাকমুখ।

অশ্রুর চরিত্রের বিশেষত্ব হচ্ছে, সে প্রায়ই সন্ধ্যার পর বাড়িতে ভূত দেখে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। একটা ভূতকেই সে দেখে। পুরুষ ভূত। নগ্ন থাকে। সে বিশেষ উদ্দেশ্যে অশ্রুকে জড়িয়ে ধরতে চায়।

 

বুধবার সকাল দশটা। মুহিব লীলাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

লীলাদের বাড়ির কলিংবেল তিনমাস ধরে নষ্ট। চাপ দিলেই ইলেকট্রিক শক খেতে হয়। লীলা কলিংবেলের ওপর লালকালি দিয়ে একটা নোটিশ টাঙিয়েছে।

সাবধান
কলিংবেল নষ্ট। চাপ দিলেই শক খাবেন।
দয়া করে কড়া নাড়ুন।

কলিংবেল সারানো কোনো ব্যাপার না। মোড়ের ফ্যানের দোকানের একজন মিস্ত্রি ধরে নিয়ে এলেই সে কাজটা করে দেবে। লীলার বাবার কারণে কাজটা করা হচ্ছে না। বাড়ির যাবতীয় কাজকর্মে তার নিজের পরিকল্পনা থাকে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, কলিংবেল সাৱননা কোনো বিষয় না। এর জন্যে মিস্ত্রিকে একশ টাকা দেবার কোনো মানে হয় না। কাজটা তিনি নিজেই করবেন। তিনি আজিজ মার্কেট থেকে একটা বই কিনে এনেছেন। বইয়ের নাম ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি সারাই। গত তিনমাস ধরে তিনি মন দিয়ে বইটা পড়ছেন। তার বাড়িতে কারেন্ট Two phase না-কি One phase এই নিয়ে তিনি সামান্য বিভ্রান্ত। পুরো বইটা তার একবার পড়া হয়েছে। এখন তিনি দ্বিতীয়বার পড়ছেন।

লীলার বাবার নাম শওকত চৌধুরী। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে রিটায়ার করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা মামলার গল্প করে বাকি জীবন কাটান। ইনি সেরকম না। বিচারক থাকার সময় তিনি আইনের বই ছাড়া কিছু পড়েন নি। এখন তার বাইরের বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। যে-কোনো বিষয় নিয়ে পড়তে তার ভালো লাগে। তিনি পড়েই ক্ষান্ত হন না, পাঠের বিদ্যা কাঙে লাগানোর চেষ্টা করেন। নীরোগ শরীর, সুস্থ জীবন এবং ঘরে বসে হোমিওপ্যাথ এই দুটি বই পড়ে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উৎসাহী হয়েছেন। ওষুধপত্র জোগাড় করেছেন। কালো চামড়ার ব্যাগ কিনেছেন। স্টেথিসকোপ কিনেছেন। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ওষুধ দেন। মুহিব ছাড়া তেমন কেউ তার কাছে ওষুধ নিতে আসে না। মেয়ের ছেলেবন্ধুকে কোনো বাবাই সহ্য করতে পারেন না। শওকত তার ব্যতিক্রম। তিনি মুহিবকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।

কলিংবেলের ওপর লেখা নোটিশটা মুহিব অনেকবার পড়েছে। আজও আবার পড়ল। শুধু যে পড়ল তা-না, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখল। লীলা নিজের হাতে লাল মার্কার দিয়ে লিখেছে। লেখায় তার স্পর্শ লেগে আছে। লেখাটা লীলা চিন্তা করে লিখেছে। চিন্তাটার জন্য তার মাথার ভেতরের মস্তিষ্কে। কলিংবেলে হাত রাখার অর্থ লীলার মাথার ভেতর হাত রাখা।

মুহিব কলিংবেল চাপল এবং বড় ধরনের শক খেল। সে জানে কলিংবেল চাপা মানেই শক খাওয়া। তারপরেও গত তিন মাসে সে ইচ্ছা করেই অসংখ্যবার শক খেয়েছে। ইচ্ছা করে শক খাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। মুহিব কারণটা জানে না।

শওকত দরজা খুললেন এবং আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো ইয়াং মান। ইউ আর লুকিং গ্রেট।

মুহিব বলল, চাচা, কেমন আছেন?

ভালো আছি। খুবই ভালো আছি। লীলা বাসায় নেই। ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে।

মুহিব বলল, আমি লীলার কাছে আসি নি চাচা। আপনার কাছে এসেছি। অমাির মায়ের ওষুধ দরকার। বারবার আপনাকে বিরক্ত করি। এত লজ্জা লাগে! আমার মা আবার আপনার ওষুধ ছাড়া অন্য ওষুধ খাবেন না।

শওকতের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি মুহিবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, দরজায় দাঁড়িয়ে তো ওষুধ দেয়া যায় না। ভেতরে এসে বসো। হোমিওপ্যাথি কঠিন বিদ্যা। এলোপ্যাথির মতো না যে, অসুখ হলো, কী অসুখ বলার আগেই ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিল। অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ পড়া মাত্র কী হয় জানো?

কী হয়?

আমাদের লোয়ার ইনটেশটাইনের সব উপকারী জীবাণু মরে সাফ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়া।

মুহিব বলল, উপকারী জীবাণু আছে নাকি?

শওকত বললেন, অবশ্যই আছে। They are our friends. আমরা কী করি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বন্ধুদের মেরে ফেলি। What a pity! এসো, ভেতরে এসো। সোজা আমার স্টাডি রুমে চলে যাও। আমি কেইস স্টাডির খাতাটা নিয়ে আসি। তোমার মায়ের নাম রাজিয়া বেগম। তাই না?

জি চাচা।

 

স্টাডি রুমে মুহিব এবং শওকত সাহেব। দুজনে মুখোমুখি বসা। শওকত সাহেবের হাতে পাঁচশ পাতার চামড়ায় বাঁধানো মোটা খাতা, চামড়ায় সোনালি রঙ দিয়ে লেখা

Case Study Book
S. Chowdhury

শওকত বললেন, এই যে পাওয়া গেছে। পেশেন্টের নাম রাজিয়া বেগম। বয়স পঞ্চাশ। মিডিয়াম হাইট। গাত্রবর্ণ গৌর। ঠিক আছে?

মুহিব বলল, জি চাচা।

শওকত খাতা পড়তে পড়তে বললেন, পানি পানে অনীহা। অম্ল ভোজনে আগ্রহী। নিদ্রায় সমস্যা। ঠান্ডার ধাত।

মুহিব বলল, সব ঠিক আছে চাচা।

শওকত বললেন, এক বছর আগের এন্ট্রি তে। এর মধ্যে কিছু Change হতে পারে। সেজন্যেই জিজ্ঞেস করছি। আপটুডেট থাকা দরকার। আছে কোনো চেঞ্জ?

মুহিব বলল, রাগ মনে হয় সামান্য বেড়েছে। আগে কারো সঙ্গেই রাগারাগি করতেন না। এখন বাবার সঙ্গে করেন।

শওকত বললেন, কী লিখব? খিটখিটে মেজাজ?

মুহিব বলল, খিটখিটে মেজাজ বলা ঠিক হবে না। মা খুবই শান্ত স্বভাবের। বাবার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। আগেও হয় নি। তা নিয়ে মা কিছু বলতেন না, এখন বলেন।

শওকত বললেন, সমস্যা কী বলে?

মুহিব বলল, আধকপালি মাথাব্যথী।

ডান দিক না বাঁ দিক?

ডান বামের জন্যে ওষুধ আলাদা হবে?

অবশ্যই। হোমিওপ্যাথি যে কত জটিল চিকিৎসা তোমাদের কোনো ধারণা নেই। আইনের ব্যাখ্যার চেয়েও জটিল। যাই হোক, তুমি রান্নাঘরে চলে যাও। আমাকে এককাপ চা বানিয়ে দিয়ে যাও। কাজের মেয়েটা দুদিনের ছুটি নিয়ে গেছে। আজ দশদিন। বিরাট ঝামেলায় পড়েছি।

রান্নাবান্না কে করে?

লীলা যা পারে করে। আমি নিজেও কয়েকদিন ভাত রান্না করলাম। ভেরি ডিফিকাল্ট জব। আতপ চাল রান্নার এক রেসিপি, আবার সিদ্ধচাল রান্নার অন্য রেসিপি। পুরনো চাল একভাবে ব্লাঁধতে হয়, আবার নতুন ধানের চাল অন্যভাবে। রাইস কুকার ছিল। ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়েল হারিয়ে ফেলেছি বলে সেটাও ব্যবহার করতে পারছি না।

মুহিব চা বানাতে গেল। রান্নাঘরের অবস্থা ভয়াবহ। বেসিনভর্তি আধোয়া বাসনপত্র। মেঝে নোংরা হয়ে আছে। মুহিব চা বানিয়ে দিয়ে এসে বাসনপত্র ধুয়ে পরিষ্কার করল। মেঝে মুহুল! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে সে যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছে। তার মনে হলো, বাসাবাড়িতে চাকরের কাজ নিলে তার জব স্যাটিসফেকশনের সমস্যা হতো না।

লীলার শোবার ঘর হাট করে খোলা। মুহিব সেই ঘরও ঝাট ছিল। বিছানার চাদর বদলে দিয়ে বালিশের ওপর গতরাতে লেখা চিঠি রেখে দিল। সে এ বাড়িতে এসেছিল লীলাকে চিঠিটা দিতে। মুহিব লিখেছে–

লীলা,

পরশু রাতে আমাদের বাসায় একটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা তোমাকে জানাবার জন্যেই চিঠি। ইদানীং কালে আমার এই সমস্যা হয়েছে। বাসায় যা-ই ঘটে তোমাকে জানাতে ইচ্ছা করে। আমি জানি এটা মেয়েলি স্বভাব। মেয়েরাই ঘরের কথা প্রিয়জনদের জানাতে আগ্রহ বোধ করে। ছেলেরা তেমন করে না।

যাই হোক, ঘটনাটা বলি। বাবা মার ওপর কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে রাগ করেছেন। রাগ করে তিনি মাকে অতি নোংরা কিছু বললেন। আমার বাবা এমএ পাশ একজন মানুষ। স্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার। এবং একজন গীতিকার। তোমাকে আগে বুলি নি, বাবা কিন্তু বাংলাদেশ বেতারের একজন এনলিস্টেড গীতিকার। তাঁর অসাধারণ প্রেমের গান তুমি হয়তো শুনেছ—

চাঁদবদনী সুজন সখি
নিশি রাইতের পাখি
কেন করে ডাকাডাকি?

মহান প্রেমসঙ্গীত রচয়িতা বাবা মাকে নোংরা কথা বলেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন, এক্ষুনি বাসা থেকে বের হ। এই মুহূর্তে।

মা ভেতরের বারান্দায় পেয়ারা গাছের নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তুমি তো কখনো আমাদের বাসায় আস নি। আমরা উত্তরখান বলে শহরের বাইরে থাকি। চারকাঠা জমিতে টিনের বাড়ি। নেংটির বুকপকেটের মতো বাড়িটার নাম রাজিয়া মহল। রাজিয়া আমার মায়ের নাম। আমাদের বাসাটা বেশ বড়। ভেতরের দিকের উঠানে অনেকখানি জায়গা। বড় একটা পেয়ারা গাছ এবং কাঁঠাল গাছ আছে। দুটা গাছের কোনোটাতেই কখনো ফল ধরে না।

রাত এগারোটার দিকে বাবা শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে গেলেন, তখন আমি মার কাছে গেলাম। শান্ত গলায় বললাম, মা, ঘরে চল। আমার সঙ্গে ঘুমুবে।

মা বললেন, না।

সারারাত পেয়ারা গাছের নিচে হাঁটাহাঁটি করবে?

মা জবাব দিলেন না। আমি মাকে পাজাকোলা করে তুললাম। মা বললেন, কী করিস, ফেলে দিবি তে!

আমি বললাম, ফেলব না।

রাতে মা আমার ঘরে থাকলেন। আমার ঘরের খাটটা ছোট। তাকে খাটে শুইয়ে আমি মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমালাম। গল্পটা এখানেই শেষ না। সকালবেলা বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। এবং কথা বলার সময় হেডমাস্টারের মতো গলা বের করেন।

আছিস কেমন?

জি বাবা ভালো আছি।

চাকরি খুঁজছিস?

জি।

থার্ডক্লাস বিএ-কে কে চাকরি দেবে? ড্রাইভিং শিখে ড্রাইভার হয়ে যা। বড়লোকের গাড়ি চালাবি। তেল চুরি করবি। গ্যারাজের সাথে বন্দোবস্ত করে রাখবি। ওরা তোকে কমিশন দেবে। পারবি না?

পারব।

মাঝে মধ্যে বখশিসও পাবি। বাপের ঘাড়ে বসে জীবন পার করে দেয়া তো কাজের কথা না। শরীরও হচ্ছে মহিষের মতো। কাল রাতে জানালা দিয়ে দেখলাম, তোর মাকে কোলে নিয়ে ঘরে যাচ্ছিস। তোর কোনো কাজেই আমি সন্তুষ্ট হই না। এই কাজে সন্তুষ্ট হয়েছি।

এই বলেই বাবা দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বাবার মতো হাড়কৃপণ মানুষ এক হাজার টাকা কাউকে দিবে তার প্রশ্নই ওঠে না। আমি নোট দুটা নিলাম।

লীলা, তোমার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধরি নিয়েছিলাম, সেটা শোধ দিয়ে দিলাম। খামের ভেতর এক হাজার টাকা নিশ্চয়ই পেয়েছ?

আজ এই পর্যন্ত।

মুহিব পুনশ্চ : তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ছিল। আমার মোবাইলে কোনো টাকাপয়সা নেই।

 

লীলাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই মুহিবের মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।

হ্যালো, তুমি কি সারভেন্টশ্রেণীর কেউ? কে তোমাকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছে? বাসন মজিতে বলেছে?

সরি।

তুমি ধীরে ধীরে সারভেন্ট সম্প্রদায়ের একজনে পরিণত হচ্ছ।

তা মনে হয় হচ্ছি।

আর আমি কি বলেছি এক হাজার টাকা ফেরত দাও? বলেছি?

না, বলো নি।

কবিতাটা মুখস্থ করেছ?

কোন কবিতা?

রবীন্দ্রনাথের বর্ষাযাপন কবিতাটা মুখস্থ করতে বলেছিলাম।

ভুলে গেছি। [এটা মিথ্যা কথা। অর্ধেক মুখস্থ হয়েছে। আজ বুধবার মিথ্যাদিবস। এই দিবসে মিথ্যা বলা যায়।]

Home-এর ডেফিনেশন মনে আছে?

আছে। Home is the place where if you want to go there they have to take you in.

কার কথা বলো?

রবার্ট সাহেবের।

রবার্ট সাহেবের না। রবার্ট ফ্রস্টের। কবি রবার্ট ফ্রস্ট। বলো রবার্ট ফ্রস্ট।

রবার্ট ফ্রস্ট।

লীলা বলল, তোমাকে আমি মানুষের সামনে Presentable করতে চাচ্ছি।

মুহিব বলল, কোনো লাভ হবে না। আমি যা তাই থাকব।

তুমি যা তা থাকছ না। তুমি ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছ।

মুহিব বলল, তোমাদের ড্রাইভারের নাম জলিল না?

হ্যাঁ। ড্রাইভারের নাম দিয়ে কী হবে?

মুহিব বলল, তাঁকে বলো তো আমার জন্যে একটা চাকরি দেখতে।

লীলা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, সে কী চাকরি দেখবে?

মুহিব বলল, ড্রাইভারের চাকরি। আমি ঠিক করেছি ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হব।

লীলা টেলিফোন কেটে দিল।

মহিবের নিজেকে হিমর মতো লাগছে। পকেট খালি। সে ঘটছে। তার গাঁয়ের শার্টটাও হলদ। কোনো একদিন হিমুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেলে ভালো হতো। তাকে নিয়ে জঙ্গলে জোছনা দেখতে যেত। তবে কাব্যভাব তার মধ্যে একেবারেই নেই। লীলার মধ্যে আছে। হঠাৎ তার টেলিফোন আসবে, আজ যে পূর্ণিমা জানো?

না, জানি না।

সন্ধ্যার পর বাসায় চলে এসো, চাঁদ দেখব/Jছাদেশতরঞ্চি পেতেছি।

হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই।

একজন আবৃত্তিকারকেখৱর দিয়েছি। তিনি কবিতা আবৃত্তি করবেন।

গান শোনা যায় কবিতা শোনার কিছু নেই।

প্লিজ এসো। প্লিজ।

আচ্ছা আসছি।

রাতে খেয়ে যাবে।

কী রান্না?

বাইরে থেকে খাবার আসরে। প্লেন পোলাও আর খাসির রেজালা তুমি সন্ধ্যা ছটার মধ্যে আসবে

আচ্ছা।

মুহিব যায় না লীলা তাকে যেন টেলিফোনে ধরতে না পারে তার জন্যে মোবাইল অফ করে রাখে। এই কাজটা সে করে হিমুর কুখী মনে করে। হিমু রূপার সঙ্গে এইরকম কাণ্ড করে মুখে বলে যাবে। কিন্তু যায়াল।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুহিব একটা চায়ের দোকানে অশ্রিয় নিয়েছে। পকেটে। টাকা থাকলে এককাপ চা খাওয়া যেত। হিমরা এমন অবস্থায় চা খেতে ইচ্ছা হলে। বলত—আছেন কোনো সহৃদয়ভাই যে একজন তৃষ্ণার্তকে চা খাওয়াবেন?

এধরনের কথা বলা সম্ভব হচ্ছেনা। মুহিববৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করছে।

মুহিবের মোবাইলআবার বেজোউঠেছোলীলার টেলিফোন মুহিব সেট বন্ধ করল চারপাশে একগাদা লোক নিয়ে লীলার সঙ্গে কথা বলা যায় না।

 

লীলার সঙ্গে মুহিবের পরিচয়ের গল্পটা এখন। বলা যেতে পারে। তাদের পরিচয় নর্দমায় ঘিটনাটাএেরকম—মুহির হেঁটেবাসায় ফিরছে।ধানমণ্ডি ২নম্বর রোডে মানুষজনের জটলা। মনে হচ্ছে দুবাই কিছু একটা দেখে মজা পাচ্ছে। বিনা পয়সায় মজা পাবার লোভ কেউ ছাড়েন। মুহিব এগিয়ে গেল।

মজা পাবার মতোই ঘটনা অতিরূপবতীএক তরুণী নর্দমায় পড়ে গেছে। তার সারা শরীর নর্দমার নোংরা বিষাক্ত ঘন কৃষ্ণবর্ণের তরলে মাখামাখি। মেয়েটার উচিত নর্দমা থেকে ওঠার চেষ্টা করা। তা না করে নর্দমার নোংরীয় কী যেন খুঁজছে। সে ফিতাবিহীন ম্পঞ্জের একটা স্যান্ডেল তুলল। জনতার ভেতর একজন চেঁচিয়ে উঠল, পাইছে পাইছে। জিনিস পাইছে। সবাই হেসে উঠল।

মুহিব নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, উঠে আসুন।

জনতার একজন বলল, ভাই, থাকুক না। খেলতেছে।

আবারো সম্মিলিত হাসি।

মুহিব বলল, হাত ধরুন, উঠে আসুন। মেয়েটা উঠে এসে বলল, আমার একটা বই নর্দমায় পড়ে গেছে। খুব জরুরি বই। বইটা খুঁজছিলাম।

মুহিব নর্দমায় নেমে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বই নিয়ে উঠে এল। বইটার নাম– New Enlarged Anthology of Robert Frosts Poems.

মেয়েটা বলল, আমার পা কেটে গেছে, আমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তার আগে একটা সাবান কিনে নিয়ে আসুন, আমি লেকের পানিতে গোসল করব। গা থেকে বিকট দুর্গন্ধ আসছে। আর কিছুক্ষণ এই দুর্গন্ধ থাকলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।

মহিব সাবান কিনে আনল। মেয়েটা সারা গায়ে সাবান ডলে লেকের পানিতে গোসল করল। মুহিবকে বলল, আপনি আশেপাশে থাকুন। আমি সাঁতার জানি না। পা পিছলে বেশি পানিতে পড়ে গেলে টেনে তুলবেন। আর বইটা ধুয়ে ফেলুন। বইটা আমার মা আমার পঞ্চম জন্মদিনে দিয়েছিলেন। এটা তার স্মৃতিচিহ্ন। আমি যেখানেই যাই এই বই সঙ্গে থাকে। বইটার দ্বিতীয় পাতায় আমার মায়ের লেখাটা মুছে গেছে কি-না দেখুন তো।

মুহিব পাতা উল্টাল। নর্দমার নোংরা বইটার মলাটে লেগেছে। ভেতরটা ঠিক আছে। দ্বিতীয় পাতায় লেখা–

লীলাবতী মা মণি!
বড় হয়ে এই বইটা পড়বে। ঠিক আছে মা?
চাঁদের কণা। লক্ষ্মী সোনা। ঘুটঘুট। পুটপুট।
আমার মা হুটহুট।

মুহিব বলল, আপনার নাম লীলাবতী?

লীলা গায়ে সাবান ডলতে ডলতে বলল, হুঁ।

মুহিব বলল, আপনার মা লিখেছেন— আমার মা হুটহুট। হুটহুট মানে কী?

হুটহুটের কোনো মানে নেই। এটা হলো Nonsence Rhyme.

ননসেন্স রাইমটা কী?

লীলা বলল, ননসেন্স রাইম হলো অর্থহীন ছড়া। কোনো অর্থ হবে না, কিন্তু ভালো লাগবে। অন্তমিল থাকবে, ছন্দ থাকবে।

লীলার পা ভালোই কেটেছিল। দুটা স্টিচ লাগল। ডাক্তার ধনুষ্টংকারের ইনজেকশন দিলেন। অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। মুহিব লীলাকে তার বাসায় পৌঁছে দিল। লীলা বলল, আজ আপনি বাসায় ঢুকবেন না। আগামীকাল ঠিক এই সময় আসবেন।

মুহিব বলল, আগামীকাল আসব কেন?

লীলা বলল, দরকার আছে। অবশ্যই আসবেন।

মুহিব পরদিন গেল। লীলা গাভর্তি গয়না পরে বসে আছে। তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মতো। লীলা বলল, আমার গায়ের সব গয়না হলো আমার মার। বিশেষ বিশেষ দিনে আমি আমার মায়ের গয়না পরে বসে থাকি।

মুহিব বলল, আমাকে আসতে বলেছেন কেন?

লীলা বলল, ধন্যবাদ দেবার জন্যে। গতকাল ধন্যবাদ দেয়া হয় নি। বসুন।

মুহিব বসল। লীলা বলল, বাবা বাসায় থাকলে ভালো হতো। বাবার সামনে ধন্যবাদ দিতে পারতাম। বাবার আজই একটা জরুরি কাজ পড়ে গেল।

লীলা হাতে একটা কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করল–

আমি এখনো আপনার নাম জানি না। আপনি আমার নাম জানেন। আপনি কিছুটা এগিয়ে আছেন। নর্দমায় পড়ে যাবার মতো হাস্যকর একটি ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। আপনি আমাকে টেনে তুলেছেন। এটি চোরাবালি থেকে টেনে তোলার মতো বড় কোনো উদ্ধারকর্ম না। তারপরেও যে স্বাভাবিকতার সঙ্গে কাজটি আপনি করেছেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনাকে লিখিতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

মুহিব বলল, আপনি তো বিরাট নাটক শুরু করেছেন।

লীলা বলল, নাটক এখনো শেষ হয় নি। এখন আমার মা যে কবিতার বইটা দিয়েছেন, সেখান থেকে একটা কবিতা পাঠ করে শোনানো হবে। আপনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না, কবিতা আপনার পছন্দের বিষয়। তারপরেও শুনতে হবে।

God once declared he was true
And then took the veil and withdrew,
And remember how final a hush
Then descended of old on the bush.

লীলা বলল, কিছু বুঝতে পারলেন।

মুহিব বলল, না।

লীলা বলল, বুঝতে না পারলে লজ্জিত বোধ করার কিছু নেই। এই কবিতাটা খুব সহজভাবে লেখা অত্যন্ত কঠিন একটা কবিতা। এখন বলুন, আপনার নাম কী?

মুহিব।

আপনার মোবাইল টেলিফোনের নাম্বারটা আমাকে দিন। টেলিফোনে আরো একদিন আসতে বলব, বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে।

আমার কোনো মোবাইল টেলিফোন নেই।

নেই কেন? মোবাইল ব্যবহার পছন্দ করেন না বলে নেই, না-কি টাকা নেই বলে নেই?

মুহিব বলল, টাকা নেই বলে নেই।

লীলা তার সেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, রেখে দিন, এটা আপনার। আমি আরেকটা কিনে নেব। নিতে বলছি নিন। আর শুনুন, আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। ইংরেজিতে আপনি, তুই নেই। সবাই তুমি। এখন থেকে আপনাকে আমি তুমি করে বলব। আপনিও আমাকে তুমি বলতে পারেন। তুমি বলতে অস্বস্তি বোধ করলে আপনি বলতে পারেন।

মুহিব বলল, আমি এখন উঠি?

লীলা বলল, না। তুমি দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে। আমি রান্না করেছি। আমি রাঁধতে পারি না। ডিমভাজি করেছি আর ডাল। বুয়া কৈ মাছ রান্না করেছে। আমি চাই আমার রান্না আজ খাবে। বাথরুমে যাও, হাতমুখ ধুয়ে আস। ঐদিকে বাথরুম।

মুহিব দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। বাথরুমে ঢুকে পড়ায় লীলা নামের অদ্ভুত মেয়েটা মুহিবের দুর্বলতা ধরতে পারল না।

 

বৃষ্টি এখনো পুরোপুরি কমে নি। তবে আগের মতো পড়ছে না। টিপটিপ করে পড়ছে। মুহিব বের হয়ে পড়ল। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টি আজ সারাদিনেও কমবে না। চায়ের দোকানে বন্দি হয়ে থাকার কিছু নেই।

সামান্য এগুতেই বড় বড় ছাতা হাতে কিছু লোকজনকে দেখা গেল। অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তারা ছোটাছুটি করছে। মুহিব এগিয়ে গেল। বেকার মানুষদের কৌতূহল বেশি থাকে। কৌতূহল মেটানোর অবসরও তাদের আছে।

নাটকের শুটিং হচ্ছে। সব রেডি করা আছে। বৃষ্টি পুরোপুরি থামলেই শুটিং শুরু হবে। নায়িকা প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসা। তার মাথার ওপর সী বিচের প্রকাও ছাতা ধা। সেই ছাতার রঙও লাল। ছাতা এমনভাবে ধরা যেন নায়িকার মুখ দেখা না যায়। মুহিব ছাতা হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করছে এমন একজনকে বলল, ভাই নাটকের নাম কী?

নাটকের লোকজন দর্শকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। এই লোক দিল। ভদ্রভাবে বলল, এই বসন্তে। ভ্যালেনটাইন দিবসের নাটক।

মুহিব বলল, নামটা সুন্দর। ডিরেক্টর কে?

আমিই ডিরেক্টর।

মুহিব বলল, স্যার সরি।

সরি কেন?

মুহিব বলল, আপনাকে সাধারণ কেউ ভেবেছিলাম, এইজন্যে সরি বলেছি।

আমি সাধারণ। অসাধারণ কিছু না। একটা শট দেবেন?

মুহিব বলল, বুঝতে পারলাম না কী বললেন?

আমাদের একজন আর্টিস্ট আসে নি। তার মুখে একটা সংলাপ আছে। আপনি দিতে পারবেন?

মুহিব তাকিয়ে রইল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, নাটকের নায়িকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। আপনি একজন পথচারী। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে যাবেন। এবং বলবেন, ম্যাডাম, কী হয়েছে?

মুহিব বলল, রাস্তায় কোনো অপরিচিত মেয়েকে কাঁদতে দেখলে আমরা ম্যাডাম বলি না। আমরা শুধু বলি— কী হয়েছে?

ঠিক আছে আপনি কী হয়েছে বলবেন। তখন মেয়েটি বলবে— Get lost. তারপরেও আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। তখন মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলবে— Get lost-এর মানে বোঝেন না? যান ফুটেন। আপনি চলে আসবেন। পারবেন?

জি স্যার পারব।

গুড। ক্যামেরার দিকে ভুলেও তাকাবেন না। ক্যামেরার দিকে তাকালে শট NG হয়ে যাবে।

NG টা কী?

NG হচ্ছে Not Good, অর্থাৎ শট নষ্ট। আবার নতুন করে নিতে হবে। পারবেন তো?

স্যার চেষ্টা করব।

তাহলে আসুন। বৃষ্টি থেমে গেছে। এখনি শট হবে।

মুহিব ঠিকঠাক মতো করল। নায়িকার মুখে Get lost শুনে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। নায়িকা যখন বলল, ফুটেন তখন আরো লজ্জা পেল। চলে যাবার সময় এক পলকের জন্যে দাঁড়িয়ে আরেকবার তাকালো নায়িকার দিকে।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আপনার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে যান। ছোটখাটো কোনো রোল খাকলে আপনাকে ডাকব। আপনি ক্যামেরা ফ্রি। চা খান।

শুধু চা না, তাকে চায়ের সঙ্গে দুটা সিঙ্গাড়া দেয়া হলো। সিঙ্গাড়া খাবার সময় নায়িকা এসে সামনে দাড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, আপনার অভিনয় ভালো হয়েছে। এটা প্রথম কাজ?

জি।

নাম কী?

মুহিব।

আপনার টেলিফোন নাম্বার এবং নাম একটা কাগজে লিখে আমাকে দিন। আমি চেষ্টা করব আপনাকে ভালো একটা সুযোগ দিতে।

ম্যডাম থ্যাংক য়্যু।

আপনি কি আমার নাটক বা সিনেমা দেখেছেন?

জি ম্যাডাম, অনেক দেখেছি। (পুরোপুরি মিথ্যা কথা। তাদের বাসার টিভি থাকে বাবার শোবার ঘরে। মুহিবের টিভি দেখা হয় না। নায়িকাকে সে চিনতে পারে নি। তবে আজ যেহেতু বুধবার, মিথ্যা কথা বলা যায়।)

 

মিথ্যাদিবস শেষ হবার একঘণ্টা আগে রাত এগারোটায় মুহিবের জীবনে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। দুপুরের দেখা নায়িকা তাকে টেলিফোন করলেন।

আপনি মুহিব!

জি।

আমাকে চিনেছেন তো? দুপুরে আমার সঙ্গে কাজ করলেন।

জি ম্যাডাম। স্নামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আপনার জন্যে ভালো একটা খবর আছে। একটা নাটকে আপনাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবার ব্যবস্থা করেছি।

থ্যাংক য়্যু ম্যাডাম।

ভালোমতো কাজ করবেন, আমার যেন বদনাম না হয়। আমি ডিরেক্টরকে বলেছি–আপনি একজন Born actor.

ম্যাডাম, আপনার দয়ার কথা সারাজীবন মনে থাকবে।

কান্নার শব্দ পাচ্ছি। কে কাঁদছে?

আমার ছোটবোন কাঁদছে। ভূত দেখে ভয় পেয়ে কাঁদছে। তার নাম অশ্রু। সে প্রায়ই ভূত দেখে।

আজও দেখেছে?

জি। মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল। হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেল। সে চিরুনি তুলতে নিচু হয়েই দেখে, তার খাটের নিচে ভুতটা বসে আছে। ভূতটা তার মাথার চুল খপ করে ধরে ফেলল। অশ্রু অনেক চেষ্টা করল চুল ছাড়াতে পারল না। তার মাথার একগোছা চুল ভূতটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।

এই ঘটনা কি সত্যি ঘটেছে, না আপনি বানাচ্ছেন?

সত্যি ঘটেছে ম্যাডাম।

আপনার বোন কত বড়?

এগজাক্ট বয়স বলতে পারব না। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। কোচিং সেন্টারে কোচিং করছে।

আপনার বোনের নাম কী বললেন?

অশ্রু।

আমার ধারণী অশ্রু সিজিয়োফ্রেনিক। ওর চিকিৎসা করাতে হবে। আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা দেব। তার কাছে নিয়ে যাবেন। আমি ব্যবস্থা করে দেব যেন ভিজিট না নেয়।

ম্যাডাম, থ্যাংক য়্যু।

যে নাটক করতে যাচ্ছেন তার নাম জানতে চাইলেন না?

নাম কী?

নামটা পয়েটিক–দিঘির জলে কার ছায়া গো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *