১. বিহার আর পশ্চিমবাংলার সীমান্তের কাছাকাছি কোনো অঞ্চল

কর্নেল সেন বললেন, জায়গার নামটা আমি বলব না। ধরে নাও, বিহার আর পশ্চিমবাংলার সীমান্তের কাছাকাছি কোনো অঞ্চল। সময়টা শীতকাল—নভেম্বর মাস, খুব জাঁকিয়ে শীত তখনও পড়েনি। গাড়িতে আমি একাই ছিলাম–

রঞ্জন বলল, কেন, জায়গাটার নাম বলতে আপনার আপত্তি কী? পটভূমিকা সম্পর্কে ভালো ধারণা না হলে গল্প জমে না।

কর্নেল সেন চুরুটের ছাই ঝাড়লেন, তারপর বললেন—প্রথম কথা, এটা গল্প নয়। আমি ঠিক গল্পের মতন গুছিয়ে বলতেও পারব না—যদিও অনেক সত্যি ঘটনা গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর হয়। কিন্তু লেখকেরা যেরকম কায়দাকানুন করে আগাগোড়া সাসপেন্স বজায় রাখতে পারেন, সেরকম ক্ষমতা তো আমার নেই। আমি ঠিক যেরকম দেখেছিলাম, সেইরকমভাবেই বলে যাব। তা ছাড়া, জায়গাটার নাম-ধাম আমি বলতে চাই না, কারণ যে ঘটনা আমি বলতে যাচ্ছি, তার মধ্যে এমন অনেক লোকজনের নাম থাকবে, তাঁরা অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। তাঁদের চিনিয়ে দেওয়া ঠিক রুচিসম্মত হবে না। আমি অবশ্য নাম-টাম বদলেই বলব ঘটনাটা। ঘটেছিল বছর পনেরো আগে—যেখানে এটা হয়েছিল, সেখানে কাহিনিটা এখনও প্রচলিত। ওখানকার একটি বিশিষ্ট পরিবার এর সঙ্গে জড়িত। এক হিসেবে আমিই সেই পরিবারের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। যাক গে, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক।

আমি রামগড় থেকে ঘুরতে ঘুরতে পুরুলিয়ার দিকে আসছিলাম। ধরে নাও চাস রোডেই সেই বাংলোটা। আশেপাশে কোনো শহর নেই—বাংলোটা বলতে গেলে জনশূন্য মাঠের মধ্যে। তখনও ওসব জায়গায় ইলেকট্রিক যায়নি। এখনও গেছে কিনা আমি জানি না। ডাকবাংলোটা নতুন তৈরি হয়েছে, বেশ ছিমছাম চেহারা। আমি সেখানেই সে রাতের জন্য বসতি নেব ঠিক করলুম।

আমি বললাম, কর্নেল সেন, আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন। কর্নেল সেন অবাক হয়ে বললেন, চমৎকার বাংলা বলি? এ-রকম কথা তো কেউ আমাকে আগে বলেনি। চমৎকারের কী দেখলে?

না, আপনার কথার মধ্যে বেশি ইংরেজি শব্দ থাকে না। বেশ ঝরঝরে সহজবোধ্য ভাষা।

বাঃ, বাঙালির ছেলে হয়ে এটুকু বাংলা বলতে পারব না কেন?

আপনি এতদিন আর্মিতে ছিলেন। আর্মির লোকেরা খুব সাহেব হয়। ইংরেজি ছাড়া আর কিছু বলতে চায় না। তা ছাড়া আপনি অনেক দিন বাংলা দেশের বাইরে ছিলেন—

কর্নেল সেন হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, আর্মির লোকরা খুব সাহেব হয়? তা অবশ্য অনেকটা ঠিক। নানা জায়গার লোক থাকে—তাই ইংরেজিটাই হয় সকলের সাধারণ ভাষা। কিন্তু ইংরেজিতে কথা বললেই যে সাহেবদের মতন চালচলন দেখাতে হবে তার কোনো মানে আমি বুঝতে পারি না। আর যারা মাতৃভাষা ভুলে যায়, তাদের আমি ঘৃণা করি।

যাই বলুন, আর্মির লোকজনের মধ্যে আপনি একজন ব্যতিক্রম। বার বার আর্মির লোক আর্মির লোক বলছ, তাতে মনে হতে পারে, আমি বোধহয় বন্দুক-মেশিনগান নিয়ে যুদ্ধ করেছি। তা নয়—আমি একজন ডাক্তার। কিছু দিন আর্মিতে চাকরি করেছি!

আপনি ডাক্তার? তা কিন্তু জানতাম না। রঞ্জন যখন বলেছিল, ওর মামা আসছেন, কর্নেল সেন—তখন আমি ভেবেছিলাম তিনি নিশ্চয়ই একজন ঝানু সোলজার।

না, আমি যুদ্ধ করিনি। আর্মিতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবারই র‍্যাংক থাকে। আমি অবশ্য পুরোপুরি কর্নেল নই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল। অতখানি উচ্চারণ করার অসুবিধে বলে অনেকে শুধু কর্নেল বলে। যাই হোক, আর্মির লোক বলে সবাইকে কিন্তু এক শ্রেণিতে ফেলবে না। আমি নেফা অঞ্চলে একজন সত্যিকারের আর্মি কর্নেল দেখেছিলাম, তিনি অগাধ পন্ডিত, ট্রাইবালদের ভাষা নিয়ে কত চর্চা করেছেন, যদিও বাইরে সে বিদ্যে জাহির করেন না। সেনাবাহিনীর অফিসার র‍্যাংকে সাধারণত ভালো ভালো ছাত্ররাই যায়।

রঞ্জন আমাকে ধমকে দিয়ে বলল, তুই বড় গল্পের মাঝখানে বাধা দিস। মামাবাবু, আপনি গল্পটা বলুন?

রঞ্জনের মামা কর্নেল সেন থাকেন লাদাখে। ওখানে একটি সরকারি হাসপাতাল পরিচালনা করেন। পশ্চিমবাংলার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ খুবই কম। কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন। বছর পঞ্চাশেক বয়েস, সুপুরুষ, সুঠাম স্বাস্থ্য। কথাবার্তায় অত্যন্ত ভদ্র। বিয়ে-থা করেননি, গরিব-দুঃখীদের চিকিৎসার কাজেই আত্মনিয়োগ করেছেন। কিন্তু ওঁর কথাবার্তায় সেসব কিছুই প্রকাশ পায় না। নিজের সম্পর্কে উনি খুবই কম কথা বলেন। ব্যবহারের মধ্যে বেশ মার্জিত ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে—কিন্তু তার মধ্যে কোনো কঠোরতা নেই।

রঞ্জন ওর মামাবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য আমাকে আজ রাত্তিরে খাবার নেমন্তন্ন করেছিল। আর একজন বন্ধু এবং তার স্ত্রীকেও বলেছিল, কিন্তু তারা আসতে

পারেনি। কয়েকদিন ধরেই আবহাওয়া বেশ খারাপ যাচ্ছে। আজ সারাদিনে বৃষ্টি হয়ে গেছে। কয়েকবার। রাত ন-টা থেকে বৃষ্টি নামল অসম্ভব তোড়ে। রঞ্জনের বাড়ির সামনে এক কোমর জল জমে গেল। আমার বাড়ির সামনেও নিশ্চয়ই এতক্ষণ একবুক জল। রঞ্জন বলল, তাহলে সুনীল, তোকে আজ আর বাড়ি ফিরতে হবে না। ফোন করে দে এখানেই থেকে যাবি!

রঞ্জনের মামাবাবুর সঙ্গে গল্পে এত জমে গিয়েছিলুম যে আমার বাড়ি না-ফেরায় বিশেষ আপত্তি হল না। খাওয়াদাওয়ার পর বাইরের ঘরে জমিয়ে বসলাম। মামাবাবু চুরুট ধরিয়েছেন এবং গোড়াতেই আমাদের সিগারেট খাবার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন।

মামাবাবু ঘুরেছেন অনেক দেশে। আর্মিতে ঢোকার আগে উনি ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে এসেছেন, তারপর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে চষে বেড়িয়েছেন সারা ভারতবর্ষ। আমরা অনুরোধ করলাম, মামাবাবু আপনার তো অনেক অভিজ্ঞতা—তার থেকে দারুণ একটা গল্প বলুন আমাদের। শুনতে শুনতে যদি গা ছমছম করে তাহলে বৃষ্টির দিনে বেশ জমবে।

মামাবাবু বললেন, আমি আর কী বলব! আমি তো গল্প বলতে জানি না। তোমরাই বরং বলো—পশ্চিমবাংলার খবরটবর কী। আমরা তো অতদূর থেকে খবর পাই না।

রঞ্জন বলল, পশ্চিমবাংলার খবর একঘেয়ে হয়ে গেছে। ও নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আপনি একটা গল্প বলুন!

কিন্তু আমি যে গল্প-টল্প বলতে জানি না।

আমি বললাম, গল্প মানে কী? বানিয়ে বলতে হবে না—আপনি আপনার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলুন না। আপনি জীবনে এত কিছু দেখেছেন—

মামাবাবু খানিকটা ভেবে বললেন, আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি বটে কিন্তু সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে খুব কাছাকাছি জায়গায়—বিহার আর পশ্চিমবাংলার সীমান্তেই এক জায়গায়। জায়গাটার নাম বলব না—

আমি রঞ্জনকে বললাম, তোর বউকে ডাকবি না? মাধবীকে ডাক!

রঞ্জন বলল, ও থাক। ও তো একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়বে। বেশি রাত জাগতেই পারে না–

ডাক-না, ঘুম পেলে উঠে যাবে না হয়!

মাধবী দরজার পাশ থেকে বলল, আমি এক্ষুনি আসছি। চাকরের খাবারটা দিয়েই আসছি। মামাবাবু, আমি না এলে আরম্ভ করবেন না কিন্তু!

মাধবী এসে বসার পর মামাবাবু স্মিতভাবে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর বললেন, মাধবী থাকলে আমার গল্পটা বলতে একটু অসুবিধে হবে অবশ্য। তা হলে এটা বরং থাক। আমি অন্য আর কোনো ঘটনার কথা বলা যায় কিনা ভেবে দেখি। এর মধ্যে কিছুটা মেয়েঘটিত ব্যাপার আছে—

মাধবী আদুরে গলায় বলল, মামাবাবু, আমি বাচ্চা মেয়ে নই। ওদের সামনে যা বলতে পারেন, আমার সামনে তা পারেন না?

ছেলেদের সামনে যা বলা যায় মেয়েদের সামনেও কি আর তা মামাবাবু, আপনি জানেন না, আজকাল ছেলেরা মেয়েদের সামনে আর কিছু ঢাকাঢুকি রাখে না। সব বলে দেয়। এমনকী স্বামীরা অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলেও সে-কথা বউদের কাছে লুকোয় না।

মাধবী রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে ভঙ্গি করল। কর্নেল সেন হাসতে হাসতে বললেন, তাই নাকি? বাঃ, এ তো বেশ ভালোই ব্যাপার! এতটা বদলে গেছে? কিন্তু আমার তবু একটু বাধো বাধো ঠেকবে। আমি তো একটু পুরোনো কালের লোক! আচ্ছা দেখা যাক—

রঞ্জন বাধা দিয়ে বলে উঠল, তা বলে মামাবাবু, গল্পটা কিন্তু সেনসার করে বলবেন না! একেই তো সিনেমার সেনসারের জ্বালায় আমরা অস্থির।

বয়েসে অনেক বড়ো হলেও কর্নেল সেন এসব কথা বেশ সহজভাবে নিতে পারেন। রঞ্জনের কথা শুনে আন্তরিকভাবে হেসে উঠলেন।

এবার গল্প শুরু হল। কর্নেল সেন চুরুটে অল্প ধোঁয়া ছেড়ে বলতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি দেখলে বোঝা যায়, উনি অতীতে ফিরে গেছেন। উনি বসেছেন একটা ইজিচেয়ারে, জানলার পাশে। রঞ্জন আর আমি একটা সোফায়। আর একটা সোফায় মাধবী পা গুটিয়ে বসেছে আরাম করে।

কর্নেল সেন বললেন, তখন আমার বয়েস হবে তেত্রিশ কী চৌত্রিশ। আমি তখন রামগড়ে পোস্টেড। আমার এক কাকা থাকতেন পুরুলিয়ার। তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য আসছিলাম। গাড়ি নিয়ে একা বেরিয়ে পড়েছি। অনেক পথঘাট তখন নতুন তৈরি হচ্ছে। ঠিকমতো পথের হদিশ পাওয়া যায় না। এক-একজন এক একটা ভুল রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ঘণ্টা ছয়েকের পথ, কিন্তু বেলা বারোটাতে বেরিয়েও অনেক ঘুরতে হল। রাত নটার সময়েও বিহারের সীমানা পার হতে পারিনি। রাস্তা একেবারে ফাঁকা, আলো নেই—একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আজকাল নিশ্চয়ই ওসব রাস্তায় সারারাত গাড়ি চলে।

রঞ্জন বলল, না, মামাবাবু। ট্রাক ড্রাইভাররা ছাড়া রাত্রে কেউ গাড়ি চালাতে সাহস করে ওই সব রাস্তায়। বিশেষত বর্ডারের কাছে প্রায়ই ডাকাতি হয়। কর্নেল সেন বললেন, আমার কাছে অবশ্য ডাকাতি করার মতন বিশেষ কিছু ছিল না।

তবু, গাড়িটা কেড়ে নিয়ে যদি রাস্তায় একা ছেড়ে দেয়, সেও এক ঝামেলা। হঠাৎ একটা ডাকবাংলো চোখে পড়ল। তখন ভাবলাম, ডাকবাংলোতে রাতটা কাটিয়ে ভোরে বেরোলেই হবে।

পি ডব্লু ডি-র ইনস্পেকশন বাংলো। এই সব বাংলোতে আগে থেকে রিজার্ভ করার দরকার হয় না। খালি থাকলে ঢুকে পড়া যায়। আর বাংলোটা এমন একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে যে সেখানে নিশ্চয়ই সচরাচর কেউ রাত্রিবাস করে না।

কর্নেল সেনের চুরুটটা নিভে গিয়েছিল। তিনি সেটা ধরাবার জন্য একটু থামলেন। সেই সুযোগে আমি আর রঞ্জন সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে চোখাচোখি করলাম। আমি আর রঞ্জনও বহু বাংলোতে থেকেছি, আমাদেরও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাক, রঞ্জনের মামাবাবুর অভিজ্ঞতাটা কী ধরনের।

কর্নেল সেন বললেন, গাড়িটা ঢুকিয়ে দিলাম ডাকবাংলোর কম্পাউণ্ডে। সেখানে ইলেকট্রিক নেই, বারান্দায় হ্যাজাক জ্বলছে। ঘর তালাবন্ধ। জনমনুষ্য দেখা গেল না। চৌকিদার, চৌকিদার বলে দু-বার হাঁক দিলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

বোঝাই গেল, এই সব ডাকবাংলোতে কালেভদ্রে কেউ আসে। এত রাত্রে বোধহয় কেউই আসে না। চৌকিদারটা তাই আড্ডা মারতে গেছে। কিংবা নেশা-টেশা করে হয়তো ঘুমিয়ে আছে। কারুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবলাম চলে যাব কিনা। কিন্তু সারাদিন ঘুরে তখন আমার খুবই ক্লান্তি এসেছে, তার ওপর একটু জ্বরজ্বর ভাব। এদিকে টিপটিপ করে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। শীতকালের বৃষ্টিতে জানই তো কীরকম শিরশিরে শীত করে। কপালে হাত দিয়ে মনে হল, জ্বরই এসেছে। এখন শরীর চাইছে বিছানা।

ডাকবাংলোর চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতে গেলাম। ডাকবাংলোটা দেখেই মনে হল নতুন তৈরি হয়েছে—বছরখানেকও হবে না—সব কিছুই ঝকঝক করছে। একটু দূরে একটা টালির ঘর—সাধারণত ওইরকম ঘরে চৌকিদার থাকে। সেখানে গিয়ে দেখি, সে-ঘরের দরজাটাও বন্ধ। দু-বার ঠেলা দিলাম, আবার ডাকলাম চৌকিদারকে। কোনো সাড়া নেই। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ, নিশ্চয়ই ভেতরে কেউ আছে, কিন্তু খুলছে না। বেশ কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি করলাম দরজার, তাতে কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভেঙে যাবার কথা, কিন্তু চৌকিদারটা উঠল না।

মহাবিরক্তিকর অবস্থা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ যখন, তখন ঘরের মধ্যে নিশ্চয়ই মানুষ আছে। অথচ আমার ডাকে সাড়া দিল না কেন—এ নিয়ে একটা সন্দেহ আমার মনে জাগা উচিত ছিল, কিন্তু সে-সময় আমি ও ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাইনি। শরীর ভালো ছিল না, মেজাজও ভালো ছিল না।

সেখান থেকে চলে আসছি, হঠাৎ চোখে পড়ল ডাকবাংলোর পিছনে দেওয়াল ঘেঁষে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার গায়ের রং কালো কুচকুচে, ঠিক যেন অন্ধকারে মিশে আছে। বেশ লম্বা, বলিষ্ঠ দেহ।

জিজ্ঞেস করলাম, কে ওখানে? তুমি চৌকিদার নাকি?

লোকটা কোনো সাড়া দিল না। আমি এগিয়ে গেলাম। লোকটি তখন নীচু হয়ে মাটি থেকে কী যেন খুঁজছে। আমি তার সামনে গিয়ে বললাম, এই চৌকিদার কোথায়?

লোকটি মুখ তুলে বলল, আমিই চৌকিদার!

প্রচন্ড রাগ হল! ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চৌকিদার তো এতক্ষণ সাড়া দাওনি কেন?

হুজুর, আমি কানে শুনতে পাই না।

কানে শুনতে না-পাওয়া একজন মানুষের দোষ না। কিন্তু কানে কালা লোকদের চৌকিদারের চাকরি দেওয়ারও কোনো মানে হয় না। কিন্তু তা নিয়ে তখন রাগারাগি করে লাভ নেই।

কানে শুনতে পাও না, কিন্তু আমাকে তো দেখতে পেয়েছিলে? নাকি চোখেও দেখতে পাও না?

আমি এখানে একটা জিনিস খুঁজছিলাম—তাই আপনাকে দেখতে পাইনি।

এত রাত্রে কী খুঁজছ এখানে?

আমার ক-টা পয়সা পড়ে গেছে। একটা সিকি কিছুতেই পাচ্ছি না।

 ঠিক আছে, কামরা খুলে দাও। আমি আজ রাত্তিরে এখানে থাকব।

কামরা তো রিজার্ভ আছে।

রিজার্ভ আছে? কার নামে রিজার্ভ আছে?

আছে এক সাহেবের নামে।

লোকটার ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগছিল না, বিশ্বাস হল না ওর কথা। বললাম, কোথায়, রিজার্ভেশন স্লিপ কোথায়? সেটা তো বাইরে ঝোলাবার কথা।

লোকটা বলল, এখানে ঘর খালি নেই। সাত মাইল দূরে আর একটা ডাকবাংলো আছে, আপনি সেখানে যান-না-জায়গা পেয়ে যাবেন!

আমি বললাম, কেন, সেখানে যাব কেন? এখানে তো দুটো ঘরই খালি দেখছি—বাইরে থেকে তালা ঝুলছে।

ওই দুটো কামরাই এক সাহেবের নামে রিজার্ভ আছে। সাহেব হঠাৎ এসে পড়লে আমার নোকরি চলে যাবে।

স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, লোকটা মিথ্যেকথা বলছে। যেকোনো কারণেই হোক আমাকে থাকতে দিতে চায় না। এক ধমক দিয়ে বললাম, রিজার্ভ আছে? কই, সেই চিঠি দেখাও।

লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণ আমার সব কথা সে বেশ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু এখন আবার কালা সেজে গেল। জেদ চেপে গেল আমার। আমি বললাম, দেখাও স্লিপ। কথা শুনতে পাচ্ছ না?

আমার পরনে সামরিকবাহিনীর পোশাক। সেই সময় আমি আবার মোটা গোঁফ রাখতাম। সুতরাং আমাকে হেলাফেলা করতে পারে না। বুঝতেই পারলাম, লোকটা ভয় পেয়েছে। নির্বোধ চোখে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি বললাম, যাও, চাবি নিয়ে এসো। যদি রিজার্ভ করা থাকেও, এত রাত্রে কেউ আসবে না। আমি কাল সকালেই চলে যাব। ঘর খুলে দাও।

পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে টানা বারান্দা। বৃষ্টি চেপে এসেছে। আমি দৌড়ে বারান্দায় উঠলাম। চৌকিদারটা চাবি আনতে গেছে তো গেছেই। আসার আর নাম নেই। খালি ডাকবাংলো খুলে দিতে ওর আপত্তির কারণটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। ও তো

আমার কাছে কিছু বকশিশ পাবেই। তা ছাড়া যদি খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে দেয়, তারও কিছু ভাগ পাবে।

আবার ডাকলাম চৌকিদারকে। কিন্তু সত্যিই যদি কানে কালা হয়, তাহলে শুনতে পাবে না। এই বৃষ্টির মধ্যে ওকে যদি আবার ডাকতে যেতে হয়–

বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল, চৌকিদার তখনও এল না। ও কি আমাকে এখানেই সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখতে চায়? বারান্দায় একটা চেয়ারও নেই যে বসব। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ব্যথা করে। একবার ভাবলাম, মাইল সাতেক দূরে যখন আর একটা বাংলো আছে, তখন সেটাতেই যাব কিনা। এই বিদঘুটে বাংলোর চাইতে সেটা নিশ্চয়ই ভালো হবে। কিন্তু, এই চৌকিদারটা আমাকে থাকতে না-দিতে চাইছেই-বা কেন? মনে হল চৌকিদারটা যেন দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছে—আমি চলে যাই কি না। আমি ঠিক করলাম, এখানেই থাকব। গলা চড়িয়ে ফের হাঁক দিলাম, চৌকিদার

শেষপর্যন্ত লোকটি এল চাবি নিয়ে। সেই সঙ্গে রেজিস্টার বুক। সেটা খুলে দেখলাম, মাস দেড়েক আগে একজন সার্কেল অফিসার এসেছিলেন সপরিবারে, তারপর আর কেউ আসেনি। অনেক সময় অবশ্য বাইরের লোক এলে এরা খাতায় নাম এনট্রি করে না, টাকাটা নিজেই নিয়ে নেয়। আমার বেলায় অবশ্য খাতাটা আগেই এনেছে—সম্ভবত আমার সামরিক পোশাক দেখে।

ওর আসতে এত দেরি হল কেন—একথা জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা বললে, হুজুর, চাবি খুঁজে পাচ্ছিলাম না!

যে লোক কানে শুনতে পায় না এবং সময় মতন চাবি খুঁজে পায় না—সে ডাকবাংলোর চৌকিদার হিসেবে খুবই অযোগ্য। লোকটির চেহারা দেখলে কিন্তু খুব বোকাসোকা মনে হয়। যাই হোক আমি ঠিক করলাম, আর মেজাজ গরম করব না। একটা মাত্র রাত কাটাবার তো ব্যাপার!

আমি লোকটিকে বললাম, এখানে তো বিশেষ কেউ আসেই না দেখছি। তুমি এটা রিজার্ভ আছে বলে আমাকে মিথ্যেকথা বলছিলে কেন?

না হুজুর, একটা চিঠি এসেছিল। আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

ঠিক আছে তুমি ঘর খোলো। দুটো তো ঘর রয়েছে। তা ছাড়া আমি কাল সকালেই চলে যাব।

লোকটি একটি ঘর খুলল। সেই ঘরটা অবশ্য ভালোই, আমার কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, তবু আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাশের ঘরটা কীরকম? খোললা তো।

হুজুর, ওঘরটা পরিষ্কার করা নেই।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার সঙ্গে শুধু একটা সুটকেস, মালপত্র কিছু বিশেষ নেই। বিছানাও নেই। আমার ধমক খেয়ে লোকটি কম্বল বার করে দিল।

তোমার নাম কী?

রামদাস।

ঠিক আছে, তুমি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে?

না হুজুর। খাবারের ব্যবস্থা কিছু নেই। এখানে কিছু পাওয়া যায় না।

যারা এখানে আসে, তারা খায় কী? কাছাকাছি গ্রাম নেই?

আছে, দু-মাইল দূরে। এতরাত্রে সেখানে কিছু পাওয়া যাবে না।

তুমি অন্তত একটু চা বানিয়ে দিতে পারবে?

চা, দুধ কিছু নেই।

স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, লোকটি আমার সঙ্গে কোনো সহযোগিতাই করতে চায় না। বকশিশের লোভও নেই ওর? আমার অবশ্য খিদে খুব একটা ছিল না। কিন্তু এক কাপ গরম চা পেলে ভালোই লাগত। তা ছাড়া খাবার পাওয়া যাবে না শুনলেই খিদে পেতে শুরু করে। রামদাসের ওপর রাগ আমার ক্রমশ বাড়ছিল। ওর নামে কমপ্লেন করা উচিত। খালি থাকতেও যদি ডাকবাংলোয় এসে দরকারের সময় জায়গা পাওয়া না যায় কিংবা খাবারের ব্যবস্থা না থাকে—তাহলে এগুলো তৈরি করার মানে কী? তা ছাড়া লোকটি যদি আমার সঙ্গে একটু ভালোভাবে কথা বলত তাহলেই আমি ওকে ক্ষমা করতে পারতুম।

কিন্তু লোকটা সব সময় গুম মেরে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে ভালো করে উত্তর দেয় না।

রঞ্জন হঠাৎ বলে উঠল, মামাবাবু, আপনার বোধ হয় ডাকবাংলো সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞতা নেই। নইলে ওরকম বাংলোয় আপনার থাকা উচিত হয় কি?

মাধবী বলল, আপনার ভয় করছিল না? অত ফাঁকা জায়গায়, চৌকিদারটা পাজি

কর্নেল সেন হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেন ভয় কেন? আমার সঙ্গে তো দামি জিনিসপত্র বিশেষ কিছু ছিল না। তা ছাড়া মিলিটারির লোকদেরই লোকে ভয় পায়।

রঞ্জন বলল, আমি জানি, ওইরকম বাংলোয় এমন সব ঘটনা ঘটে–

রঞ্জনকে বাধা দিয়ে আমি বললাম, তুই চুপ কর তো। ওইখানে নিশ্চয়ই সে-রকম একটা কিছু ঘটেছিল, নইলে উনি এই বাংলোর অভিজ্ঞতার কথাটাই বা বলবেন কেন?

মাধবী তাড়াতাড়ি বলে উঠল এটা ভূতের গল্প নয় তো?

কেন, ভূতের গল্প হলে তোমার আপত্তি আছে?

তা না হলে কাল সকালে শুনব! ভূতের গল্প আমার রাত্তিরে শুনতে ভালো লাগে না—

রঞ্জন তার স্ত্রীকে বলল, তাহলে খুকুমণি তুমি শুতে যাও না, কে তোমাকে আটকে রেখেছে! এটা নির্ঘাত ভূতের গল্প!

আমি রঞ্জনকে বললাম, আঃ, চুপ কর না! গল্পটা শুনতে দে—

কর্নেল সেন বললেন, আমি এ-রকম ফাঁকা জায়গায় অনেকবার একা রাত কাটিয়েছি, ভূত-টুতের দেখা পাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কখনো দেখা হয়নি। তবে ভূতের ভয় পেয়েছিলাম একবার। এক্ষুনি বলছি সেই কথা। সেদিন সেই বাংলোতে চৌকিদারের ব্যবহার আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিল। ও যেন আমাকে ওখান থেকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। ওর কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাওয়া যাবে না। বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠিক আছে, তুমি যাও! তারপর চৌকিদার চলে যাওয়ার পর আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আর আসতে চায় না। খালি পেটে সহজে ঘুম আসতে চায় না।

একবার দরজা খুলে বাইরে এলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। গাড়িটার সব দরজা লক করা আছে কি না দেখলাম। চৌকিদারের ঘরে তখন আলো জ্বলছে। কম্পাউণ্ডের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাম খানিকক্ষণ। চারদিকে অসম্ভব চুপচাপ। বড়োরাস্তা দিয়ে একটাও গাড়ি যাচ্ছে না। বাংলোর কম্পাউণ্ডের ওপাশে একটা উঁচু বাঁধের মতো। ওপরে উঠে দেখলাম, পাশেই একটা খাল। তার উলটো দিকে আট-দশটা খড় ও টিনের বাড়ি। চৌকিদারটা মিথ্যেবাদী, ও বলেছিল গ্রাম দু-মাইল দূরে। অথচ এত কাছেই তো বাড়ি রয়েছে।

ফিরে এলাম নিজের ঘরে। কেন জানি না, খুবই অস্বস্তি লাগছে, কিছুতেই শুতে ইচ্ছে করছে না। আর মনে হচ্ছিল, ঘরের মধ্যে একটা যেন ক্ষীণ গন্ধ পাচ্ছি। ঘরে ঢোকার পর থেকেই গন্ধটা নাকে আসছিল। আগে ঠিক খেয়াল করিনি। ডেটলের গন্ধের মতন। অবশ্য আমি ডাক্তার মানুষ, ডেটলের গন্ধ শোঁকা অভ্যেস বলেই বোধ হয় কল্পনা করেছিলাম সেটা। নইলে, অতরাত্রে বাংলোর মধ্যে ডেটলের গন্ধ আসবে কোথা থেকে?

আমার ঘরের তিনটে দরজা। একটা দরজা বারান্দার দিকে, উলটো দিকে আর একটা বাথরুমের—বাকি দরজাটা খুলে দেখতে হল। সেটা খুলতেই আমি চলে এলাম পাশের ঘরে। দরজাটার ছিটকিনি লাগানো ছিল না।

পাশের ঘরে এসে চৌকিদারটার ওপর আমি আরও রেগে গেলাম। ও বলেছিল, এই ঘরটা অপরিষ্কার হয়ে আছে! কিন্তু ঠিক তার উলটো, সেই ঘরটিই বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মনে হয় সে-দিন বিকেলেই সাফ করা হয়েছে। এই ঘরে ডেটলের গন্ধ আরও বেশি। এদিক-ওদিক তাকিয়েও এই গন্ধের কোনো কারণ বুঝতে পারলাম না। দুটো খাট পাশাপাশি জোড়া দিয়ে তার ওপর নিখুঁতভাবে বিছানা পাতা। ধপধপে চাদর। চৌকিদারটার মিথ্যেকথা বলার মানে কী! এঘরে কি অন্য কেউ থাকে? চৌকিদারের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে অনেক সময় বাইরের লোক ডাকবাংলোয় পাকাপাকি আস্তানা গাড়ে। হোটেলের চেয়ে অনেক সস্তা হয়। কিন্তু এখানে এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে কে থাকতে আসবে? তা ছাড়া, ঘরটায় এমন কোনো জিনিসপত্র নেই—যা থেকে বোঝা যাবে সেখানে কেউ নিয়মিত থাকে।

আমার গোঁ চাপল যে, আমি এঘরটাতেই থাকব। আমার ঘরে সিঙ্গল খাট, ওই ঘরে ডবল খাট-হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া যাবে। পাশের ঘর থেকে আমার সুটকেস ও জামাকাপড় নিয়ে এলাম। এই ঘরটায় দরজায় বাইরের থেকে তালাবন্ধ, তবু আমি ছিটকিনি দিয়ে দিলাম ভেতর থেকে। অন্য সব দরজা-টরজাও আটকালাম, হ্যাজাকটা সম্পূর্ণ না নিভিয়ে খুব কমিয়ে রেখে দিলাম টেবিলের ওপরে। সুটকেস থেকে আমার রিভলবারটা বার করে রেখে দিলাম বালিশের নীচে।

রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, আপনার সঙ্গে বুঝি সবসময় রিভলবার থাকে?

কর্নেল সেন বললেন, তখন থাকত। বিহার শরিফে একবার গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছিলাম— তারপর থেকে গান পারমিট করিয়ে নিয়েছিলাম।

মাধবী জিজ্ঞেস করলে, কী হয়েছিল বিহার শরিফে?

কর্নেল সেন বললেন, সে-গল্প শোননি? সেবার তো রঞ্জনের কাকা—অর্থাৎ তোমার খুড়শ্বশুর শৈলেনও আমার সঙ্গে ছিল। বিহার শরিফের কাছে গুণ্ডাদের পাল্লায় পড়েছিলাম। প্রাণেই মেরে ফেলত—শৈলেনের কাঁধে তো ছুরিও মেরেছিল—

আমি বললাম, সেটা অন্য গল্প। সেটা এখন থাক। এখন আগে এই ডাকবাংলোর গল্পটাই শোনা যাক।

কর্নেল সেন বললেন, ঠিক বলেছ, সে-ই ভালো। এক গল্পের মধ্যে অন্য গল্প এসে যাচ্ছিল। ডাকবাংলোর ঘটনাটাই বেশি চমকপ্রদ। সেই রাত্তিরে বেশ কিছুক্ষণ জেগে থাকার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুমটা গাঢ় হয়নি। নতুন জায়গায় গেলে মানুষের সাধারণত পাতলা ঘুমই হয়। এটা হচ্ছে এক ধরনের সহজাত ডিফেন্স ইন্সটিংক্ট। যাই হোক, ঘুমের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে একবার মনে হল, কাছাকাছি একটা গাড়ির আওয়াজ। একবার মনে হল, দূরের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছে গাড়িটা, আবার মনে হল, বাংলোর কম্পাউণ্ডেই ঢুকেছে। তাহলে কি যাদের আসবার কথা ছিল, তারা এসেছে? কিন্তু এত রাতে? একটুক্ষণ কান পেতে অপেক্ষা করার পর আর কোনো আওয়াজ পেলাম না। লোকের পায়ের আওয়াজ কিংবা বারান্দায় উঠে চৌকিদারকে ডাকাডাকি তো শুনতে পাব। তার কিছুই না। তখন বুঝতে পারলাম, আমারই মনের ভুল। রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি চলে গেছে আমি ভেবেছি বাংলোতে এসেছে। রাত্তির বেলা, বিশেষত নির্জন জায়গায়, দূরের আওয়াজও কাছের মনে হয়।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। কিন্তু সেটাও ঠিক শান্ত নিরুদবিগ্ন ঘুম নয়। কিছু একটা অস্বস্তি থেকেই গিয়েছিল। কোথায় যেন খুটখাট শব্দ শুনছি, কে যেন, কোনো একটা ভারী জিনিস ধরে টানছে, কেউ ফিসফাস করে কথা বলছে। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে ভালো করে খেয়াল করার চেষ্টা করলাম। কোথাও কিছুই নেই। সবই আমার মনের ভুল। ভূতুড়ে ডাকবাংলো নিয়ে অনেক গল্প-টল্প পড়েছি তো —মনের মধ্যে সেগুলোই বোধ হয় কাজ করছিল। বাংলার থেকে ইংরেজিতেই এসব গল্প বেশি আছে। ভূতুড়ে ডাকবাংলো সাধারণত খুব পুরোনোনা হয়। কিন্তু এই বাংলোটা প্রায় নতুন। নতুন বাড়ি ভূতদের সহ্য হয় না।

আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলামও। এবার ঘুম ভাঙল স্পষ্ট একটা অনুভূতিতে। মুখের ওপর সুড়সুড়ির মতন ভাব, কেউ যেন আমার মুখের ওপর চামর বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আশপাশে। কোথাও কিছু নেই। এটাও আমার মনের ভুল ছাড়া আর কীই-বা হবে। তাহলে হয়তো স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এ-রকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখবার মানে কী? রাত দুপুরে আমার মুখে চামর বোলাতে আসবে কে? ভূতের কী আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই? তা ছাড়া খুব ছেলেবেলায় মুশকিল আসানদের হাতে চামর দেখতাম, তারপর তো আর দেখিইনি।

এবার মনটা শান্ত করে আবার ঘুমোবার উদ্যোগ করলাম। কিন্তু চোখ বোজবার পরই মনে হল, না, মনের ভুল হতেই পারে না! আমার মন তো এতখানি কল্পনাপ্রবণ নয়। স্পষ্ট অনুভব করেছি, আমার মুখে চামরের মতন কিছু একটার ছোঁয়া লেগেছে। এটা একটা বাস্তব অনুভূতি। অর্থাৎ সত্যিই এ-রকম একটা কোনো জিনিস আছে এই ঘরের মধ্যে। কী হতে পারে? কোনো পাখি-টাখি নয় তো! চোখ খুলে তাকালাম আবার। এই ঘরের মধ্যে পাখি কী করে আসবে? ব্যাপারটার যতক্ষণ না কোনো নিষ্পত্তি করতে পারছি, ততক্ষণ আর ঘুম আসবে না।

তারপর ভাবলাম, যদি পাখি বা বাদুড়-টাদুড় কিছু হয়, তাহলে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলেই আবার তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। চোখ খোলা রেখে স্থির হয়ে শুয়ে রইলাম। ঘরের মধ্যে বা বাইরে কোথাও কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত নিস্তব্ধ রাত। হঠাৎ মনে হল, আমি খুব ক্ষীণ একটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার নিজের নয়, অন্য কারুর। একবার, দু-বার, তিনবার–

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। হ্যাজাকের মৃদু আলোয় ঘরটা আবছায়া। ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলাম আমার শিয়রের কাছে দেওয়াল ঘেঁষে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মাথায় চুল ভোলা। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলাম, সেই চুলের ঝাপটা লেগেছিল আমার মুখে।

মাধবী বিবর্ণ মুখে বলল ভূত?

রঞ্জন তার কাঁধে হাত রেখে বলল, চুপ।

কর্নেল সেন বললেন, আমারও তাই মনে হয়েছিল। এবং স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি হঠাৎ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নইলে, আমার তখন যুবক বয়েস, মাঝরাত্রে ঘরের মধ্যে একটি যুবতী মেয়েকে দেখে অন্য কিছুও তো মনে হতে পারত। আমরা যতই শিক্ষিত হই আর কুসংস্কার- মুক্ত হওয়ার বড়াই করি, এক এক সময় আমাদেরও যুক্তিবোধ নষ্ট হয়ে যায়।

মেয়েটির বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ, ভদ্রঘরের মেয়ে, মোটামুটি সুন্দরীই বলা যায়। একটা কালো রঙের শাড়ি পরে আছে, চুলগুলো সব খোলা, চোখ মুখে রীতিমতন ভয়ের চিহ্ন। মেয়েটি দু-হাত জোড় করে আছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে। পাগল হতে পারে, কিংবা বিপদে পড়ে কেউ আশ্রয় চাইতে পারে কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম কেন জান? মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে? আমি তো সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়েছি শোওয়ার আগে।

রক্তমাংসের কোনো মানুষের পক্ষে তো দেওয়াল কিংবা দরজা ভেদ করে ঢোকা সম্ভব নয়! দরজাটা খোলা, স্পষ্ট দেখছি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের মধ্যে। এটা কী করে সম্ভব? তবে কি অলৌকিক বা অশরীরী কিছু? আমার গলা শুকিয়ে গেল, হাত-পা কিছুই নড়াতে পারলাম না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটিও তাকিয়ে আছে সোজাসুজি আমার চোখে। মনে হয়, তার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম, আর যাই হোক, ভূত নয়, রক্ত মাংসেরই মেয়ে। হয়তো পাগল, কিংবা ডাইনি-জাতীয় কিছু

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে? কে আপনি?

সেই অস্পষ্ট আলোতেও মনে হল মেয়েটির ঠোট কাঁপছে। কিন্তু কিছু বলল না। আমি আবার জোরে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি?

শুনুন–

মেয়েটি কথা শেষ করল না। হঠাৎ একটা দৌড় লাগাল। দৌড় শুরু করতেই আমি ভেবেছিলাম, ও বুঝি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নখ দিয়ে আমার চোখ অন্ধ করে…। ভয়ে আমি মুখ ঢেকে ফেলেছি।

মেয়েটি কিন্তু দৌড়ে পাশের ঘরে চলে গেল মাঝখানের দরজা দিয়ে। ওই দরজাও তো আমি বন্ধ করেছিলাম।

ভয়ে আমার বুক রীতিমতন ঢিপঢিপ করছে। কিছুতেই সামলাতে পারছি না নিজেকে। একথাগুলো স্বীকার না করলে মিথ্যে বলা হত। আমি ভীতু লোক নই। কিন্তু সে-দিন ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই। মেয়ের বদলে ঘরের মধ্যে পুরুষমানুষকে দেখলে বোধ হয় ভয় পেতাম না। হঠাৎ রিভলবারটার কথা মনে পড়ল। মনে পড়তেই সাহস ফিরে এল কিছুটা।

বালিশের তলা থেকে রিভলবারটা বার করে খাট থেকে নামলাম। প্রথমে আমার পা দুটো কাঁপছিল খুব। আস্তে আস্তে সেটা কমল। একবার ইচ্ছে হল, কোনোরকমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ি। কিন্তু আবার এটাও অনুভব করলুম, মনের এই ভীরুতা না কাটাতে পারলে সারাজীবন একটা লজ্জা থেকে যাবে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দেখা দরকার। একটা রক্ত-মাংসের মেয়েই তো-তাকে এতটা ভয় পাওয়ার কী আছে? হ্যাজাকটা বাড়িয়ে দিয়ে সেটা বাঁ-হাতে নিয়ে এলাম পাশের ঘরে।

মেয়েটি সেই ঘরেই অপেক্ষা করছিল, আমি খাট থেকে নেমে দু-এক পা এগোতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। ওখানে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ করছিল আমাকে। ওঘরের দরজাও খোলাই ছিল, কেননা আমি ছিটকিনি খোলার শব্দ পাইনি। শুধু দরজার একটা পাল্লায় আওয়াজ হল দড়াম করে।

পাশের ঘরে এসে আমি চুপ করে দাঁড়ালাম। তক্ষুনি বাইরে না বেরিয়ে দেখতে লাগলাম দরজাগুলো। কোনো দরজাই ভাঙা নয়। তা হলে ছিটকিনি খুলল কী করে? আমি প্রত্যেকটা বন্ধ করেছি। না কি করিনি? অনেক সময় বেশি সাবধানি হতে গেলে আসল ব্যাপারেই ভুল হয়ে যায়। আমি যে একবার বাইরে গিয়েছিলাম—তারপর ভেতরে ঢুকে আর দরজা বন্ধ করিনি? তা প্রায় অসম্ভব বলা যায়। অথচ মেয়েটি ঢুকল কী করে ভেতরে? দরজা না-ভেঙে বা দেওয়াল ভেদ করে তো কেউ ঘরে ঢুকতে পারে না। কিংবা বাইরে থেকে ছিটকিনি খোলার কোনো উপায় আছে! এই সমস্যার সমাধান আমি আজও করতে পারিনি।

ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়েই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? কী জন্য এসেছেন? বাইরে থেকে কোনো উত্তর এল না। কোনো শব্দও নেই। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা অলৌকিক বলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। তখন আমার উচিত ছিল ভালো করে দরজা জানলা আবার বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়া। মন থেকে ব্যাপারটা একেবারে মুছে ফেলা।

কিন্তু ওই যে, একবার ধারণা হয়ে গেল, ছিটকিনি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও দরজা দিয়ে মেয়েটি ঢুকেছে, তা হলে তো আবার বন্ধ করলে আবার ঢুকতে পারে। কোনো রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে যে, বন্ধ দরজা না ভেঙে কিংবা দেওয়াল ভেদ করে আসা সম্ভব নয়, এই যুক্তিবোধটা আমার দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।

আমি বাইরের বারান্দায় চলে এলাম। সেখানেও কেউ নেই। তবু আমি চিৎকার করলাম, কে, কে ওখানে?

কোনো সাড়া নেই। তখন আমার চোখ পড়ল আমার গাড়িটার ঠিক পেছনেই আর একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট অন্ধকারে আগে সেটা আমি দেখতে পাইনি। তাহলে তো আর অলৌকিক বলে মনে করা যায় না। একটা জলজ্যান্ত জিপগাড়ি তো সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। এবং গাড়ি যখন আছে তাতে নিশ্চয়ই কেউ এসেছে।

বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে দু-এক পা নেমে গিয়ে দেখলাম জিপগাড়িটা খালি, ভেতরে কেউ নেই। যারা এসেছে, তারা গেল কোথায়? কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? ডান দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চৌকিদারের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। বেশ চেঁচিয়ে ডাকলাম, চৌকিদার, চৌকিদার!

চৌকিদার তো আগেই বলে রেখেছে যে, সে কানে শুনতে পায় না। সুতরাং তার সাড়া না দেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু চৌকিদারের ঘরে নিশ্চয়ই অন্য কেউ-না-কেউ আছে। আমি প্রথম যখন দরজা ধাক্কা দিয়েছিলাম, তখন ওর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। ওর বউ-টউ হতে পারে। কিন্তু সে তত শুনতে পারে আমার চিৎকার। সে ডেকে দিতে পারছে না? এতরাত্রে ওর ঘরে আলো জ্বলছেই-বা কেন?

জিপগাড়িটার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখবার জন্য আমি এসেছিলাম। এমন সময় মনে হল জিপগাড়িটার পেছন থেকে কিছু একটা শব্দ হল। এই প্রথম আমি অন্যভাবে সতর্ক হয়ে উঠলাম। জিপ গাড়িটার পেছনে কেউ লুকিয়ে আছে। এবং নিশ্চয়ই কোনো দুষ্টু বদমাইশ লোক। আমার ডাকে যখন সাড়াও দিচ্ছে না তখন ওদের কুমতলব থাকাই স্বাভাবিক।

আমার হাতে রিভলবার ছিল, কিন্তু ওরা জিপের পেছন থেকে খুব সহজেই আমাকে গুলি করতে পারে। আমি মাথা নীচু করে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম ঘরের মধ্যে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কে? কথা বলছেন না কেন?

এবারও কেউ সাড়া দিল না। এই সাড়া না দেওয়ার ব্যাপারই আমার কাছে সবচেয়ে অস্বাভাবিক লাগছিল। চৌকিদারকে ডেকেও সাড়া পাওয়া গেল না। মাঝরাত্রে যারা জিপে করে আসে, তারাও সাড়া দেয় না। কিন্তু ওদের যদি চুরি-ডাকাতির মতলব থেকে থাকে— তাহলে আমি যখন বাইরে বেরিয়েছিলাম, তখন ওরা আমাকে সহজেই ঘায়েল করতে পারত। একলা মেয়েটাকে প্রথম ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে আমাকে বাইরে টেনে এনেছে।

যাই হোক, এরা ডাকাত হলেও আমাকে একাই আত্মরক্ষা করতে হবে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চৌকিদারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না। খালের ওপারে কয়েকটা ঘরবাড়ি আছে বটে, কিন্তু এখান থেকে চ্যাঁচালেও তারা শুনতে পাবে না। কিংবা শুনতে পেলেও সাহায্য করতে আসবে কি না সন্দেহ। সাধারণত কেউ আসে না।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে নজর রাখলাম জিপগাড়িটার ওপর। গাড়িটার পেছনে মানুষের নড়াচড়া আর ফিসফাস কথা শোনা যাচ্ছে একটু একটু। ওরা ক-জন আছে? সেই মেয়েটাও গিয়ে ওখানে লুকিয়েছে? মেয়েটাকে দেখে আর যাই হোক, ডাকাত দলের সঙ্গিনী বলে মনে হয়নি। বরং ওর মুখে বেশ একটা ভয়ের চিহ্ন দেখেছিলাম, আমাকে কিছু একটা বলতেও চেয়েছিল। শুনুন বলেই আর শেষ করতে পারেনি, ছুটে পালিয়েছে। কী ওদের মতলব? যদি ডাকাত হয়, তাহলে আমাকে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েও ওরা ছেড়ে দিল কেন? আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেন? কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়!

দরজার ছিটকিনিটা খিল লাগিয়ে দিলাম। সে-ঘরের খাটখানা এনে ঠেকিয়ে দিলাম দরজার সঙ্গে। তারপর চলে এলাম পাশের ঘরে। মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করে টেবিলটা টেনে এনে সেখানে আটকে দিলাম। বাথরুমের দরজাটার সামনে পর পর দাঁড় করিয়ে দিলাম দুটো চেয়ার। আমার কাছে চব্বিশটা বুলেট আছে। যদি কেউ দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করে, তাহলে বেশ কিছুক্ষণ লড়াই করা যাবে। অন্তত দু-একজন ঘায়েল না হয়ে আমাকে কিছু করতে পারবে না।

ওইসব চেয়ার-টেবিল টানাটানি করার সময় আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল চৌকিদারটার ওপর। ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই ডাকাতদলের যোগসাজস আছে। কিন্তু তাহলে আবার ও আমাকে এই ডাকবাংলোয় থাকতে বারণ করেছিল কেন? এতরাত্তিরে ওর ঘরে আলোই বা জ্বলছে কেন? চৌকিদারের ব্যবহারটাই বেশি রহস্যময়। যাইহোক, তখন কিন্তু আমার আর সেরকম ভয় করছিল না। আমি রীতিমতন যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।

বাইরের দিকে দরজাটা সবচেয়ে ভালোভাবে গার্ড করা দরকার। এঘরে দুটো খাট আছে। দুটো খাটকেই টেনে এনে যদি দরজার সঙ্গে দিয়ে দেওয়া যায়—তাহলে অনেকটা দুর্গের মতো হবে।

বিছানাটা পাট করে রেখে আমি একটা খাট প্রথমে টেনে সরাতে গেলাম। একটু সরাতেই দেখলাম, তলায় একটা ডেডবডি!

মাধবী চেঁচিয়ে উঠল, কী?

কর্নেল সেন নির্লিপ্তভাবে বললেন, একটা ডেডবডি। একজন পুরুষমানুষ, বছর তিরিশেক বয়েস। পাজামা ও পাঞ্জাবি পরা, সুপুরুষ বলা যায়—মেঝেতে একটা চাদর পেতে তার মৃতদেহটি শোয়ানো, রক্ত-টক্ত কিছু নেই—সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা, লোকটির চোখ চেয়ে আছে—হঠাৎ দেখলে তাকে মৃত বলে মনে হবে না। কিন্তু আমি তো ডাক্তার মানুষ, আমি এক পলক তাকিয়েই তার মুখে মৃত্যুর চিহ্ন দেখতে পেলাম। তখন আমি বুঝতে পারলাম, কেন একটু আগে ঘরের মধ্যে ডেটলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। রক্ত-উক্ত সব ধুয়ে ডেটল দিয়ে ঘর মোছা হয়েছে। লোকটির জামা-টামা তখনও ভিজে ভিজেবুলেটের গর্তটা ঠিক বুকের মাঝখানে নয়, গলার কাছে। যে তাকে মেরেছে, সে রিভলবার চালানোয় খুব অভিজ্ঞ নয়। কিংবা হয়তো ধস্তাধস্তি হয়েছিল।

খাটটা সরিয়েই সেই মৃতদেহটা দেখতে পেয়ে আমি দু-এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

রঞ্জন বলল, ব্যাস। এখন এই পর্যন্ত!

আমি রঞ্জনের মুখের দিকে তাকালাম।

মাধবী জিজ্ঞেস করল, তার মানে?

রঞ্জন বলল, তোমার তো ঘুম পেয়ে গেছে। গল্পটা আজ এই পর্যন্ত থাক। আবার কাল শুনবে।

মাধবী সোজা হয়ে বসে চোখ বড় বড়ড়া করে বলল, আমার ঘুম পেয়েছে? তোমাকে বলেছে। এখন কেউ ঘুমোতে পারে?

রঞ্জন হাসতে হাসতে বলল, এইরকম দারুণ সাসপেন্সের জায়গায় গল্প থামিয়ে দিলে কী চমৎকার হবে বলো তো! শুয়ে শুয়ে সারারাত তারপর কী হল, তারপর কী হল ভাববে! আসল গল্পের চেয়েও নিজের মনে মনে অনেক গল্প তৈরি হবে! সেটাই ভালো না?

মাধবী ধমকে উঠল, তুমি চুপ করো তো! বড় বাজে বকো! এই পর্যন্ত শুনে বাকিটা কেউ শুনে পারে? সেই মেয়েটা কোথায় গেল?

রঞ্জন আমার দিকে ফিরে বলল, তুই কী বলিস সুনীল? আজ এই পর্যন্ত থাক? নাহলে সারারাত কেটে যাবে। মামাবাবুকে তো বিশ্রাম দেওয়া উচিত।

কর্নেল সেন চুপ করে বসে আছেন। আমি বললাম, তার চেয়ে এক কাজ করলে হয়। মাধবী বরং একটু কফি বানাক! এখন একটু গরম হলেই জমবে। নাহয় সারারাত জাগা হবে আজ! কর্নেল সেন। আপনার আপত্তি আছে?

কর্নেল সেন বললেন, কিছুমাত্র না। কফির আইডিয়াটা খুব ভালো। এখন একটু গরম কফি পেলে মন্দ হত না!

রঞ্জন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তোক তবে। মাধবী উঠে পড়ো!

মাধবী আমার দিকে তাকিয়ে ভঙ্গি করে বলল, খালি আমাকে খাটানো, এতরাত্রে রান্নাঘরে ঢুকতে আমার ভয় করছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *