বিশাল মাঠ। কোনও দিকে যেন তার কূলকিনারা নেই। পুব-পশ্চিম আর উত্তরে আকাশে মেশা। দক্ষিণ গ্রাম। বৈশাখ মাস। দিগদিগন্তহীন ফসলি মাঠ এখন ফাঁকা। ধু ধু, ধূসর। তেল জল না ছোঁয়ানো। কালো শরীরে খড়ি ওঠার মতো। রুক্ষু ফাটা চটা। বড় তৃষ্ণা। কিন্তু এই জগতবেড় মাঠ তৃষ্ণায় কাঁদছে না। যেন রেগে তেতাল। আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে।
গদুগদাধরের এই রকম মনে হচ্ছিল। আর হেসেছিল। কেন, এ জগতবেড় রুক্ষু ফাটা চটা মাঠ কি গদাধরের মতো গোয়ালা নাকি? লোকে বলে না। গদাধররা নিজেরাই বলে, আমরা গোয়ালারা বড়। গোঁয়ার। মিছে ঘাঁটিও না। রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। মাটি কখনও তা হয়? আর কদিন? এ মাঠ ভিজবে। জলে ডুববে। সবুজ হবে। এখন দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। আবার যখন সবুজে ঢেউ খেলবে, তখনও বিশ্বাস হবে না এ মাঠের চেহারা এমন ছিল।
গদাধর যখন হুঁকায় শেষ টান দিয়ে এ রকম ভাবছিল, তখন উত্তর-পশ্চিম কোণে আকাশ কালো হয়ে উঠেছিল। অথচ পশ্চিমের কালো মোষ-মেঘের পাশ দিয়ে তখনও শেষ বেলার রোদ মাঠের বুকে। গাছতলায় ঠাকুরদা চটের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। বুড়োর নাক ডাকছিল। অনেক পথ হেঁটে, বাথানে। এসেছে। তা পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হবে। শেষ রাত্রি থেকে হাঁটা শুরু হয়েছিল। মানুষের একলা চলা না। সঙ্গে তিনশ গোরু মোষ। চল্লিশ ভেড়া। তাদের তাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়নি। যেখানে যেখানে সামান্য সবুজের ছিটা মিলেছে, সেখানেই তিনশো চল্লিশ প্রাণী মুখ নামিয়ে থেমে গিয়েছে। যেখানেই জলাশয়, সেখানেই থামতে হয়েছে। বিশেষ করে আশিটি মোষের জন্য। জল দেখলেই যেন ওদের সারা শরীরের চামড়ায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। জলে নেমে পড়তে চায়। কিন্তু কত বার? পাঁচ ক্রোশ পথে বড়জোর এক। বার নামতে দেওয়া যায়। তারপরেই, আ ফ সোনাধার। বাবা যা। ভাল কথায় না উঠতে চাইলে, লাঠি। ঊচোতে হয়, আ তোর গতর ঠাণ্ডা করার নিকুচি করেছে।
পাঁচ ক্রোশ পথ আসতেই ঠা ঠা দুপুর। তবু তো মানুষের মতো নাদা মোতায় বসাবসি নেই। অবোলা জীব, চলতে চলতেই কাজ সারে। গাভিন গাই মোষের কথা আলাদা। তা ছাড়া ডাকের বকনা আছে। ডাকে বোঝা যায়, চোখের নজর দেখলে বোঝা যায়, চালে চলনে বোঝা যায়, জনন অঙ্গে দেখলে বোঝা যায়। গন্ধেও বোঝা যায়। মরদ চাই। বকনা আইবুড়ো মেয়েটির গর্ভধারণের সময় হয়েছে। ষাঁড় তার সঙ্গে ফেরে। বাথান চলার পথে ষাঁড় থাকেই। তা বিনে, আছে নই বাছুর, এঁড়ে ছাঁ। তিনশো চল্লিশ জীবকে তুমি তাড়া দিয়ে, দৌড় করিয়ে বাথানে সামিল করতে পার না। সময় তো লাগবেই।
বাথান-থান ঠিক করা ছিল আগেই। বাথান এতগুলো জীবের পাল বলতে পার। বাথান-ড্যারাও। বলতে পার। ঠিক ছিল, এই বিশাল জগতবেড় মাঠে বাথান হবে। পৌঁছুতে দুপুর। তারপর নিজেদের রান্না। শুকনো পাতা, কাঠকুটো, গোবরের ঘষি জ্বেলে আট মানুষের রান্না। গ্রাম থেকে জল আনা। সেই সব সেরে, ছজনা গিয়েছিল গ্রামে। ঠাকুরদা খেয়ে উঠে, কোনও রকমে হুঁকায় কয়েক টান মেরে, চট বিছিয়ে চিত্তির। গদাধর জুত করে আর এক বার কলকে সাজিয়েছিল। আশ মিটিয়ে তামাক টানতে টানতে, এই আনুরিয়ার জগতবেড় মাঠ দেখছিল। চোখের সামনে তিনশো চল্লিশ প্রাণী। সবুজের ছিটাফোঁটা নেই। ঠিক জানে, এখানে চরা চলা নেই। ওরাও কেউ কেউ শুয়ে-বসে ছিল। উত্তরের সেই আকাশে মেশা চিকচিক বিল থেকে কতগুলো বক উড়ে এসেছিল। বিশেষ শোয়া বসা গোরু মোষের কান খুসখুসি হল বকের ঠোঁট; কানের এঁটুলি, নাকের রস, চোখের পিচুটি সাফ করছিল। মাঝে মাঝে হঠাৎ হামবা ডাক শুনলেই, গদাধর চোখ তুলে দেখছিল। তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, হঁ৷ কী?
গদাধর উত্তর-পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জেগে উঠতে দেখেছিল। মেঘের পাশ থেকে, রোদ তখনও মাঠে। আনুরিয়ার মাঠ দক্ষিণ থেকে উত্তরে যেন পা টিপে টিপে নেমেছে। দেখলে চট করে বোঝা যায় না, বিলের দিকে মাঠ একটু বা ঢালে। বিলের নামও আনুরিয়া। এত্ত দূরে সেই আকাশে ঠেকানো। তবু জলে রোদের ছটায় আয়না চিকচিক রেখা। গোরু মোষগুলোর মাথার ওপারে বিল মাঠ অনেকখানি আড়ালে। শত শত মাথা আর শিঙের ওপারেও আকাশ। কিন্তু মেঘটা কি উঠবে? গদাধরের মনে আনচান উদ্বেগ। তামাকের আগুন নিভে এসেছিল। হাত দিয়ে করা ছোট গর্তে হুঁকো বসিয়ে, কলকেটা সবে উপুড় করে দিয়েছে। কালো মেঘে তখনই একটা খয়ে গোখরা ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল।
গদাধর তিনশো চল্লিশ প্রাণীর দিকে তাকিয়েছিল। ভুরু কুঁচকে, খাড়া নজরে। মেঘটা উঠছিল। উঠতে উঠতে রোদের মুখেও ঝাঁপ বন্ধ। তারপরেই প্রথম ভেড়াগুলো ডাকতে আরম্ভ করেছিল। ভেড়ার পরেই, গোরু মোষগুলোও ডাকাডাকি শুরু করেছিল। ভেরার দল এক জায়গায় গায়ে গায়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছিল। গোরু মোষগুলো নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে আরম্ভ করেছিল। গদাধর হাতের সামনে রাখা লাঠিটা নিয়ে ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়েছিল। এক বার দক্ষিণে ফিরে তাকিয়েছিল। ওই দিকে গ্রাম। ছ জন গ্রামে গিয়েছিল। না, তাদের কারোকে ফিরে আসতে দেখা যায়নি।
গদাধরের মুখ থেকে সবে রাগের ফোঁসানি বেরিয়ে এসেছিল, শালারা কি কানা? আকাশ দেখতে পাচ্ছে না?
তখনই উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে একটা ভয়ংকর গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে এসেছিল। কালো মেঘে খয়ে গোখরোর ফণা তোলা ঝিলিক হেনেছিল। লকলকিয়ে উঠেছিল চেরা জিভ। তারপরেই আনুরিয়ার মাঠ যেন বাঁই বাঁই ঘুরতে আরম্ভ করেছিল। ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুলা উড়েছিল আকাশে। ঠাকুরদা উঠে চিৎকার করে উঠেছিল, সামাল সামাল রে।
মেঘ, ঘূর্ণিঝড়ের ধুলায়, পলকেই সব অন্ধকার। তিনশো প্রাণী হঠাৎ দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, ছুটোছুটি শুরু করেছিল। ভয়ার্ত স্বরে ডাকছিল। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের গোঁ গোঁ। দৈত্য দানোর ভয়ংকর দাপাদাপি খেলা। গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে। চন্দ্ৰবোরার ভীষণ ফোঁসানির মতো শিস বেজে উঠছিল। গদাধর একলা লাঠি নিয়ে, তিনশো চল্লিশ প্রাণীর চারপাশে পাগলের মতো দৌড়োদৌড়ি করছিল, আইদিক থাক। হেই-উই শালা ওদিকে কোতায় যাচ্ছিস?’ কিন্তু ধূলিঝড়ে তার দু চোখও অন্ধকার। নাক মুখের ভিতর দিয়ে ধুলা ঢুকছিল। তার প্রচণ্ড হাঁক ধূলিঝড়ের গর্জনে আর পশুদের ভয়ার্ত ডাকে ডুবে যাচ্ছিল। বাতাসে উড়িয়ে নিচ্ছিল। তবু প্রতিটি প্রাণীকে ঘিরে সে লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করছিল। কেবল ভেড়ার দলই এক জায়গায় ঠেসাঠেসি করে চিৎকার করছিল। গোরু মোষ কোনও কোনওটা অন্ধের মতো দলছুট হয়ে এলোপাথাড়ি ছুটছিল। গদাধর তাদের পিছনে ছুটে, দলে ফিরিয়ে আনছিল।
ঠাকুরদা উঠেছিল। বাঁশ ফেড়ে, পুঁতে তার চার খোঁচায় ভাতের হাঁড়ি, কড়া ডেয়ো ঢাকনা ঝুলছিল। ঝড়ে বাঁশ উপড়ে পড়েছিল। হাঁড়িটা মাটির। ঠাকুরদা সেটা বাঁচাতে পেরেছিল। বাকিগুলোর জন্য ভাবনা ছিল না। সব লোহা আর কলাইয়ের বাসন। ঠাকুরদাও বুড়ো হাড়ে লাঠি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিল। কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছিল না। ধুলা ঢুকে কানা। তা বলে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কেবল চিৎকার করছিল, আই শালা ম্যাঘে জল নাই-আঁধ উঠেচে হে…।
এক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরেনি। সেই বিশাল মেঘের চাংড়াটাকে দলে মুচড়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে যতক্ষণ সময়। মনে হচ্ছিল, সেই সময় যেন অনন্তকাল। অথচ আধ ঘণ্টার মধ্যেই সব শান্ত। যেন সারা আকাশব্যাপী এক বিশাল ভয়ংকর ক্ষ্যাপা উন্মাদ হা হা করে ছুটে এসেছিল। দাঁড়ায়নি। ছুটতে ছুটতেই ফাটা চটা শক্ত মাঠকেই পিটিয়ে ধুলা উড়িয়ে চলে গিয়েছিল।
শরীরটা জুড়াল বটে। বিষ্টি দিলে না। ঠাকুরদা চটটা খুঁজতে খুঁজতে বেঁজে উঠছিল, বিষ্টি দিলে, চার দিনে শালা আলে ঘাস গইজে যেত। মা বাবাগুলান খেয়ে বাঁচত।’
পঁচিশ বছরের সাজোয়ান খালি গা গদাধর কোমর থেকে গামছা খুলে গা মাথা ঝাড়ছিল। কত আর ঝাড়বে। তার মাথার কালো চুলগুলো এমনিতেই সাপের মতো পাকানো। কাঁচি পড়েনি কয়েক মাস। পেঁকির থেকে লম্বা শরীর। চওড়া কাঁধ, পেশল বুক আর হাতপা। সরু কোমর। আট হাতি ধুতি, মালসাট মেরে নেংটির মতো পরেছিল। ভুরু আর চোখের পাতায় ধুলা। নাক ঝাড়ার সঙ্গে ধুলার দলা। মুখের থুথু ছিটিয়েও মাটির কিচকিচ যায়নি। গাছতলায় মালসা ঢাকা দেওয়া জলের কলসিটা আস্ত ছিল। সেই জল দিয়ে কুলকুচা করেছিল। চোখে মুখে দিয়েছিল। ঠাকুরদা তখন যাযাবর বাথান সংসারের ডেয়ো ঢাকনা, চট কাঁথার বিছানাগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করছিল। আর বৃষ্টিহীন ধূলিঝড়ের বাপ মা’র শ্রাদ্ধ করছিল।
পশ্চিমের আকাশটা তখন সিঁদুর লাল হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে দু-চারটে কালো পোঁছড়া। কিন্তু সেই লাল মেঘের ছটা মাঠে, গোরু মোষ ভেড়াদের গায়ে। তখন আর এই সিঁদুরে মেঘে প্রাণীদের চোখে ঘরপোড়া ভয় ছিল না। জানত ওই মেঘে আগুন নেই। মার যা দেবার, তা ধূলিঝড়ের ঘূর্ণি দিয়ে গিয়েছিল। ওরা সবাই শান্ত হয়ে গিয়েছিল। গাভিরা তাদের বাছুরকে ডেকে ডেকে কাছে টেনে নিচ্ছিল। সারা গা চেটে দিচ্ছিল। অন্যান্যরাও নিজেদের গা মাথা চাটাচাটি করছিল। দু-চারটে গুঁতোগুতিও। করছিল, আর অন্য দিকে সরে যাচ্ছিল। দুষ্ট ছেলেমেয়ে দু-চারটে কোন ঘরে না থাকে। বকগুলো ধূলিঝড়ে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। ঝড়ের পরেই আবার ফিরে এসেছিল। সন্ধ্যা নামার দেরি ছিল না। রকগুলোর সে খেয়াল কি ছিল না? ভেড়াগুলো গা ঝাড়া দিচ্ছিল। ওরা ঝড়ের সময় চোখ বুজে থাকে। নাক মুখ চেপে রাখে মাটিতে। বিপদের সময় ওরা এই রকম করে। হায়না শেয়াল এলেও, চোখ বুজে থাকে। আর শরীর থরথরিয়ে কাঁপে। অথচ ওরা দলে থাকলে, গোরু মোষ সবসময় ওদের পিছন নেয়। ওরা যেদিকে যাবে, গোরু মোষ সেদিকেই যাবে। কিন্তু বিপদ দেখলেই গোরু মোষ দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি আরম্ভ করে। এক জায়গায় কখনও স্থির হয়ে থাকতে পারে না।
গদাধরের জীবনে এমন ধূলিঝড় কিছু নতুন না। গোবর্ধন ঠাকুরের দয়া, এ আঁধি রাস্তায় চলার সময় বাথানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি। তা হলে তার একার পক্ষে এতগুলো প্রাণীকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আগে বার দুয়েক রাস্তায় ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। আট-দশজনে চার দিক থেকে ঘিরেও তখন সামাল দিয়ে রাখা দায়। অবোলা জীব। বোঝে না পথেঘাটে কোথাও তাদের আশ্রয় নেই। অথচ তারা আশ্রয়ের খোঁজেই অন্ধের মতো দিগবিদিক ছুটতে আরম্ভ করে।
গদাধর ঠাকুরদার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। দেখে হাসছিল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধুলা মাখামাখি। মাটি দিয়ে গড়া মানুষের মতো। লুঙির মতো করে পরা ফালি কাপড়টা কোমরে গুটিয়ে গিয়েছে। বুড়া একেবারে দিগম্বর। খেয়াল নেই। তখনও সব কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। গজগজ করে বকছিল। আঁধি ঝড়ের বাপ-মা তুলে গালাগাল দিচ্ছিল। তার মধ্যেই কয়েক বার চিৎকার করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছিল, থাকত আজ বেদ্দাবনের আখাল আজা, তা হলে ইন্দির হে, তোমার সব জারিজুরি ভেঙে দিত।
ঠাকুরদা বোঝালেও মানত না, স্বর্গের ইন্দ্রর সঙ্গে কৃষ্ণর ঝগড়াঝাটি মিটে গিয়েছিল অনেককাল। নইলে ইন্দ্রর ব্যাটা অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণর কখনও ভাব হত না। কিন্তু ঠাকুরদা ছিল সেই চিরকালের ব্রজবাসী। ইন্দ্র ব্রজবাসীদের পূজা চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ বলেছিলেন, কে ইন্দ্র? আমি ব্রজের কৃষ্ণ। ইন্দ্র এখানে কী করবে? হাঁ, এত বড় কথা। ইন্দ্র রেগেমেগে এমন ঝড় আর শিলাবৃষ্টি শুরু করে দিলেন, ব্রজবাসীরা তাদের গোরুর পাল বাঁচাতে পারে না। তা দেখে কৃষ্ণ হাসতে হাসতে কড়ে আঙুল দিয়ে পাহাড় তুলে ধরলেন। ব্রজবাসীরা তাদের গোরু বাছুর নিয়ে তার তলায় গিয়ে আশ্রয় নিল। সেই থেকে কৃষ্ণ হলেন গিরিগোবর্ধন।
গদাধরও জানত এ কথা খাঁটি সত্যি। কিন্তু ইন্দ্রর সঙ্গে পরে কৃষ্ণর যুদ্ধ হয়েছিল। ইন্দ্র হেরে গিয়েছিলেন। তখন দুজনের মিলন হয়েছিল। এ সব কথা কখনও মিথ্যা না। তবে এ কথা সত্যি, গদাধরদের কাছে চিরকাল ইন্দ্রর থেকে কৃষ্ণ বড়। আবার এ কথাও মিথ্যা না, তাঁর সঙ্গে ইন্দ্রর ভাব খাতির হয়েছিল। দুজনে বন্ধু হয়েছিলেন। কিন্তু ঠাকুরদাকে সে কথা বোঝানো যেত না। ঝড় বৃষ্টি বন্যা হলেই সে ইন্দ্রকে শাসাত। আর গিরিগোবর্ধনকে সাক্ষী মানত।
গদাধর ঠাকুরদাকে দেখে হাসতে হাসতে কোটা খুঁজেছিল। কোটা একটু দূরেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল। কলকেটা উধাও। কলকের অভাব ছিল না। গাছতলায় রাখা ঝোলার ভিতর থেকে কলকে, ঠিকরে তামাক বের করেছিল। নারকেল ছোবড়া আর গোবরের ঘষি জ্বেলে তামাক ধরিয়েছিল। হুঁকোর জল অনেকটা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। ক্ষতি কিছু ছিল না। হুঁকোয় জল না থাকলেও অনেক সময় জোর টানে শুষলেই ধোঁয়া আসে। গদাধর তামাক সেজে, হুঁকোয় বার কয়েক টান দিয়ে ঠাকুরদাকে দিয়েছিল, লাও, থিতু হয়ে বসে একটু তামাক খাও, আর বস্তুটি ঢাকা দাও।
ঠাকুরদা হাত বাড়িয়ে হুঁকো নিতে গিয়ে, মুখ নামিয়ে নিজের দিগম্বর অবস্থা দেখেছিল। আস্তে সুস্থে কোমরের ফালি কাপড় নামিয়েছিল। ধুলামাখা মুখের ভাঁজে ভাঁজে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল, শালা। বলে হুঁকোটা হাতে নিয়ে, মুখ নামাতে গিয়ে আবার বলেছিল, দাঁড়া শালা, তোর ঠাগমাকে গিয়ে বলব, লাতবউকেও লাগাব। আমাকে খিস্তি মারছ?’ গদাধর হাসতে হাসতে বস্তার ভিতর থেকে পদবন্ধন দড়িগুলো বের করেছিল। ঠাকুরদার লাতবউয়ের মুখটা চোখের সামনে এক বার ভেসে উঠেছিল। ডাগর চোখ। মাজা রং। বোঁচা নাকে নাকছাবি। এক মাথা চুল। মুখোনি তেলতেলে। হাসিখানি সরেস। রাগলে আরও সরেস। এক বিউনির কোলে ছ মাসের ছেলে। এক বার সেই মূর্তি চোখের ওপর ভেসে উঠেছিল। তারপরে চিন্তা, সন্ধেটা নামতে তখনও দেরি ছিল। আলো থাকতে থাকতেই পদবন্ধন করতে পারলে ভাল। একটা দড়ির দু ডগায় দুটো ফাঁস। দুটো গোরুর সামনের একটা করে পায়ে এই দড়ি পরিয়ে দিতে হয়। দিলে দুজনে আর একসঙ্গে ছুটতে পারে না। তবে তাড়াহুড়োর কিছু ছিল না। তিনশো প্রাণীকে একলা পদবন্ধন সম্ভব ছিল না। অন্ধকার নামলেও ক্ষতি ছিল না। ঠাকুরদার তামাক খাওয়া হয়ে গেলে, সে নিজে একটু হুঁকোয় দম নিয়ে নেবে।
ঠাকুরদা বেশি টানেনি। হুঁকোটা গদাধরের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। চট পেতে আবার শুয়ে পড়েছিল। গদাধর হুঁকো টানতে টানতে এক বার দক্ষিণের দিকে তাকিয়েছিল। না, এখনও কারোর দেখা নেই। গাঁয়েই খাবার ব্যবস্থা করে আসছে নাকি? অসম্ভব ছিল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সিঁদুরে লাল আকাশ ক্রমে বাসি রক্তের মতো হয়ে উঠেছিল। আনুরিয়ার বিল আর দেখা। যাচ্ছিল না। মোষের বড় শিংগুলোর ওপারে আকাশ। কোনও বলদের শিংও কাস্তের মতো বাঁকা। বাসি রক্ত আকাশের গায়ে যেন বিধেছিল। ঠুং ঠুং, ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে উঠছিল ওদের ঝোলানো গলা থেকে।
গদাধর মৌজ করে হুঁকো টানছিল। টানতে টানতেই ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠেছিল। নজর খাড়া হয়েছিল। পশ্চিম দিক থেকে একটা মানুষের মূর্তি যেন ছায়ার মতো বাথানের দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক দেখেছিল কি গদাধর? মুখ থেকে হুঁকোটা সরিয়ে, ঘাড় তুলে দেখেছিল। হ্যাঁ, ঠিক দেখেছিল। গদাধরের চোখে বাঘের দৃষ্টি ছিল। হায়না শেয়াল গোবাঘ বাথানে হামলা করে। বাথানে ঘোরা গোপের ছেলে সে। তার চোখও অন্ধকারে দেখতে পায়। তখন তো তবু খানিক সাঁজবেলার ঝাপসা আলো ছিল। কিন্তু লোকটা কে? বাথানে ঢুকছিল কেন? ভেড়া চুরির মতলব? না গোরু মোষ? এমনটা যখন তখন ঘটে না। কালেভদ্রে ঘটে।
তিনশো প্রাণীর মধ্যে মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল। গদাধর হুঁকোটা গর্তেয় বসিয়ে, কলকে উপুড় করে দিয়েছিল। হাতের সামনে লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝে হামবা ডাক এমনিতেই শোনা যাচ্ছিল। সেটা কিছু ব্যাপার না। গদাধর পশ্চিম দিকেই গিয়েছিল। দু-একটা ভেড়া ডেকে উঠেছিল। লোকটা কোথায়? গদাধর ভুল দেখেনি। লোকটার ছায়া দেখেই বুঝেছিল, দশাসই না হলেও, মোটামুটি চওড়া গোছের শরীর। ছোট ছেলেমেয়ে, বউ ঝি হলে অবাক হবার তেমন কিছু ছিল না। গোবর কুড়োতে ও রকম আসে। তবে সেটা অনিয়ম। যার মাঠে বাথান হবে, গোবর চোনা সব তার। অমন সার তো আর হয় না।
গদাধর পশ্চিম থেকে, গোরু মোষের গা ঘেঁষে উত্তরে গিয়েছিল। মাথা তুলে দেখবার চেষ্টা করছিল। উত্তরে গিয়ে শেষ থাকে ভেড়ার পাল। গদাধরকে দেখে, কয়েকটা ভেড়া আবার ডেকেছিল। গোরু মোষের গলায় ঘন্টা থেকে থেকেই বাজছিল। গদাধর পালের মধ্যে ঢুকেছিল। কাছেই যেন একটা প্রাণীর গলায় ঘন্টা ঘন ঘন বাজছিল। সে সেদিকে ফিরে তাকিয়েছিল। আর মুহূর্তের জন্য তার শরীরটা যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল। হে গিরিগোবর্ধন, গদাধর যা দেখেছিল, তা কি সত্যি?
ভাবতে ভাবতেই মাথায় চন করে রক্ত উঠে গিয়েছিল। এক বিয়োনি দুধেল সাদা গাইটার ওপরে একটা মানুষ। পিঠের ওপরে না। পিঠের ওপরে দু হাত দিয়ে চেপে ধরে, লোকটা সাদা গাইয়ের পিছনে। ল্যাংটা। পরনের কাপড়টা মাটিতে খসে পড়েছিল। হা, ওরে মা মেগো জানোয়ার, মানুষের মূর্তি ধরে তুই কে? লোকটার কোনও দিকে নজর ছিল না। কোনও চেতনা ছিল না। ক্ষ্যাপা জানোয়ারের মতো গাইটার পিছনে দু পা তুলে ঝাঁপাচ্ছিল। গদাধরের হাতে ধরা লাঠির মুঠি শক্ত হয়ে উঠেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল। লোকটার মাথা লক্ষ্য করে প্রথম ঘা মেরেছিল। এক ঘায়েই বেসামাল পশুটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গদাধর তখন ভয়ংকর। লোকটা কিছু বলেছিল কিনা, কানে যায়নি। তার হাতের লাঠি তখন সেই ল্যাংটাটার মাথায় ঘাড়ে সর্বাঙ্গে ঠাস ঠাস পড়ছিল। আশপাশের প্রাণীরা ঠেলাঠেলি করে সরে গিয়েছিল। গদাধর কতক্ষণ পিটিয়েছিল তার মনে নেই। যখন থেমেছিল তখন রক্তাক্ত একটা ল্যাংটা পুরুষের শরীর তার সামনে পড়ে ছিল। একেবারে অনড়, নিশ্চল। গদাধর দরদর করে ঘামছিল, হাঁপাচ্ছিল। মাত্র এক বার গলা দিয়ে রুদ্ধশ্বাস স্বর শোনা গিয়েছিল, শালা, তোকে কখনও কোন মা জন্ম দেয় নাই।
বাসি রক্ত-রং আকাশের গায়ে তখন সন্ধ্যা ঘন কালো ডানা মেলে দিয়েছে।
.
তা’ পরে?
চাপের নৌকা চলেছে চুপি গ্রামের উত্তরে। গঙ্গার এক বর্গা টানের উজান ঠেলে, লগি মেরে। চাপের নৌকা জোড়া নৌকা। দুই নৌকা একসঙ্গে জোড় বাঁধা। এক দিকে কোনও গলুই নেই। গলুই কাটা, জোড় মুখ থেকেই বাঁশের মাচা তৈরি। এই চাপের নৌকার মাথায় ছই থাকে না। গোরুর গাড়ি পারাপার করে। মোষের গাড়ি হলে সোয়া টাকা। কারণ সে গাড়ি বড়। গোরুর গাড়ি এক টাকা। গোরু মোষ সাঁতরে পার হয়।
এ পারে বর্ধমান। ও পারে নদিয়া। গঙ্গায় এখানে জোয়ার আসে না। চাপের নৌকায় গাড়ি এখন খালি ফিরছে। মাল খালাস হয়েছে পশ্চিম পারে। গাড়ির বলদ জোড়া হেঁটে চলেছে ডাঙার ওপর দিয়ে। নৌকা উজান ঠেলে, যেখান থেকে ওপারে পাড়ি দেবে, বলদ জোড়াও সেখান থেকে জলে নেমে সাঁতরে পাড়ি দেবে।
নৌকার লগি ঠেলছে শ্রীবাস। গাড়ির জোয়াল নামানো, সামনের দিকে মাচায় বসে গদাধর হুঁকো টানছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে পঞ্চানন। পঞ্চাননের বয়স বছর চৌদ্দ। গদাধরের নাতি। গদাধরের বড় ছেলে শ্রীবাস। সকলের মুখে মুখে ছিদাস। তার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। গদাধরের মতোই সাজোয়ান, এই পঁয়তাল্লিশেও। গদাধরের বয়স এখন সত্তর। গদাধর তার জীবনের সেই আনুরিয়ার মাঠের ঘটনা বলছিল মেজো নাতিকে। মেজো নাতিটি চৌদ্দ বছরের হলেও, গল্প শুনতে শুনতে বারে বারে ঢোক গিলছিল। তামাকের গন্ধে জিভে জল আসছিল। বছর খানেক হল তামাক খাওয়া ধরেছে। বাপ ঠাকুরদার সামনে খাবার রুপায় নাই। বাপ ঠাকুরদার আমলে নাকি উপায় ছিল। তখন সমাজের চালচলন ছিল নাকি আলাদা। এখন আড়াল না হলে বাপ ব্যাটায় সামনাসামনি হুঁকো বিড়ি চলে না। নিদেন নলচে আড়াল। আর, এই যে মুখের কথা, এও গঙ্গার উত্তর-পশ্চিমের পুব পারের নদিয়ার গ্রামের মানুষের। অ-তে অ নেই, র-তে থাকে অ। উত্তর-পশ্চিমের রাঢ়ের ভাষার সঙ্গে নদের এক অদ্ভুত মিশেল। নদিয়ার অভ্যন্তরে গ্রাম্য মানুষের আলেম’’গেলেলাম’ এদিকে নেই। কিন্তু ক্যানে’ আছে।
তা’ পরে? জিজ্ঞাসা পঞ্চাননের।
শ্রীবাসও লগি ঠেলতে ঠেলতে অনেক বার শোনা পুরনো কথা শুনছিল। পঞ্চাননও এই প্রথম শুনছে না। কিন্তু প্রতি বছরই যেন নতুন করে শোনা হয়। আজ কথাটা উঠেছে, আর এক ঘটনার কথায়। গদাধরের খালি গায়ে শ্রাবণের ভেজা বাতাস লাগছে। এখন আর তাকে সাজোয়ান বলা যাবে না। কিন্তু এই সত্তরেও পেশল শরীরে ভাঙন ধরেনি। মুখে বিস্তর হিজিবিজি রেখা গাঢ়তর। মাথায় চুল আর ভুরু জোড়াও ধূসর হয়েছে। চুল পাতলা হয়েছে। রোয়া বীজে ধান গাছের ফাঁকে ফাঁকে জলো মাটি কাদার মতো মাথার চাঁদি দেখা যায়। কিন্তু শরীরের আঁটুনিতে টোল-টাল শৈথিল্য নেই। ডান হাতের ডানায় দুটো তামার মাদুলি। বোধ হয় পুরনো দিনের কথা মনে পড়ায় অন্যমনস্ক চোখ গঙ্গার গেরুয়া জলের টানে। আকাশে সাদা-কালো মেঘ। রোদ নেই। মেঘের যাত্রা এখন পশ্চিমে। বাতাস বহে পুব থেকে। নদীর সময়হীন নিরন্তর স্রোতের দিকে চোখ রেখে বলল, তা’পরেতে আর কী? জেবনে সেই পেঙ্কম খুন করেছিলাম। একটাই। আর করি নাই। আনুরিয়া গাঁ থেকে আমার বাপ, আরও পাঁচজন ফিরে এল। সব্বাই এসে দেখলে, শালা রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। গাঁয়ে খবর গেল। নোক জন এল। বললে কোতয়ালিতে খবর কইত্তে হবে। শুনে আমার বাপের মেজাজ গেল বিগড়ে। পুলিশের ভয় কার না থাকে, অ্যাঁ? বাথান লিয়ে বেরয়ে কী আপদ! দু ঘা লাগিয়ে দিলে আমাকে। আমার রাগ হয়েছিল। মাথায় তো ত্যাখনো খুন চেপে ছিল।…
কলকে নিভে গিয়েছে। গদাধর খালি পাল খাটাবার মাস্তুলের গায়ে হুঁকো ঠেকিয়ে রাখল। পঞ্চাননের দিকে তাকিয়ে হাসল। মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। মাড়ির ওপর নীচের পাটিতে কয়েকটা দাঁত নেই, তা’পরে কোতয়ালিতে গেলাম। চাপাচাপির ত কিছু ছিল না। পুলিশকে সব কথা। ভেঙে বললাম। ত পুলিশ আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দিলো দিয়ে দারোগা লোকজন লিয়ে চলে গেল। বাবা অ্যাখন কাঁদতে নেগেচে। দুদিন পরে আমাকে চালান করে দিলে কেষ্টনগরে। ত্যাখন ত সায়েবদের রাজত্বি। ম্যাজিস্টরও ছিল সায়েব। আমারও উকিল ছিল। সরকারি উকিল বললে, আমি নাকি জাত। খুনি। বোঝ ঠ্যালা। কিন্তু গোলমাল ত অন্য জায়গায়। যে লোকটাকে পিটে মেরে ফেলেছিলাম তার জন্যে কেউ কাচারিতে আসে নাই। তা ম্যাজিস্টার সব বিত্তান্ত শুনে, আমার শুনতে চাইলে। আমি সব কথা বলে দিলাম। আমি ত আর ইজিরি বলতে পারি নাই। আমার সব কথা উকিল ইজিরিতে বলে দিলে। শুনে সায়েবের কী মনে হল, আমাকে জামিন দিয়ে দিলে।
তা সে নোকটা কে ছিল?’ পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল।
গদাধর নদীর দিকে তাকাল। বলল, বলেছি, ভুলে গেছিস। ও শালা ছিল আনুরিয়ারই এক কৈবত্তের ঘরের অকালকুষ্মাণ্ড। বয়েস ছিল আমার মতনই। ত্যাখনো বে’থা করে নাই। ওর বাপ মা ছিল না। ঠাগমার কাছে থাকত। গাঁয়ে ঠাগমার বেস্তর দুন্নাম ছিল। ঠাগমা এককালে নাকি কড়ে রাড়ি ছিল, ছেনালি করে বেড়াত। ওর মা শ্বশুরঘর করত না। সেও শাশুড়ির মতনই খারাপ মেয়েছেলে ছিল। নোকে বইলত ছেলেটা নাকি ওর বাপের ছেলে ছিল না। ওর নাম ছিল–
গদাধর পঞ্চাননের দিকে তাকাল। পঞ্চাননও হাসল, মনে আছে, ও শালারও নাম ছিল পঞ্চা।’
অই, অই জন্যে ত তোকে আমি পঞ্চু বলে ডাকি। গদাধর হাসল, তা সে যাগগে যাগ, আমি এখনও বিশ্বেস করি না, শালার কোন মা ছিল। মুনি দেবতাদের নাকি অনেকের মায়ের প্যাটে জমমো হয় নাই। তা সে তানাদের নীলেখেলা আলাদা। সে পঞ্চা শালার যদি যোনিতে জমমো হয়ে থাকেও সে পাপ যোনি। তা আমাকে য্যাখন কেষ্টনগরে চালান কইলে, পঞ্চার লাশ আর সেই গাইটাকেও চালান। দিলে। আমাদের উকিল বলেছিল, ও জীবটিকে আবার আনা ক্যানে? নেদেমুতে ও সব সাফ হয়ে। গেছে। তবু নাকি সে গাইকে ডাক্তারে দেখেছিল। আর ডাক্তার বলেছিল, পঞ্চাটা পাপী। বাথান নিয়ে বেরয়ে ছিলাম বোশেখে। আষাঢ়ে ঘরে ফেরবার আগেই আবার কাঁচারিতে হাজিরা দিতে গেছলাম। বাথান লিয়ে আখন আমরা ধুবুলিয়ায়। এখনকার ধুবুলিয়া লয়, ক্যাম্প ট্যাম্প হয় নাই ত্যাখন। ছ মাসের মাথায় ম্যাজিস্টর সায়েব আমাকে বেকসুর খালাস করে দেছিল। খালাস পাব এ কথা কেউ বিশ্বেস কইত্ত না। সব্বাই বলত, আমার ফাঁসি হবে। গদাধর হাসল।
পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল, তোমার ভয় হয় নাই?
না। গদাধর মাথা নাড়ল, আমার মনে ত পাপ ছিল না। পঞ্চাকে খুন করে আমার মনে কোন দুঃখু কষ্ট হয় নাই, এখনও হয় না। কোন আক্ষেপ ছিল না। কাঁচারিতে তিন মাস পরে য্যাখন ম্যাজিস্টর আমাকে জিগেস করেছিল, তুমি দোষী না নিদ্দোষী? বলেছিলাম, আমি নিদ্দোষী। তা’পরেতে আবার। একদিন জিগেস করেছিল, পঞ্চাকে মেরে তোমার পাপ হয়েছে, তা কি মানো? বলেছিলাম, না। মানি না। আমরা হলামগে যাদব। সাচা বইলব, মিছা বইলব না। আমরা হলাম যাদব, কথাটা মনে রাখবি। যাদব কখনও অমন পাপীকে ক্ষ্যামা দেবে না। ঘর কইত্তে ঘর করি, মাথা গোঁজবার ঠাঁই আছে বটে। কিন্তুন আমাদের জেবনে গো-ধন অতন হল আসল। নিজেদের ঘর থেনে আমাদের গোয়াল ঘর আসল–বাথান লিয়ে আমাদের জেবন। নিজেরা খেতে পইত্তে না পাই, দুঃখু নাই। কেষ্টর জীবদের। লিয়ে সারা জেবন দেশান্তরী হয়ে ফিরি। ক্যানে? না, আমাদের ছিটেফোঁটা জমির চাষ আবাদে তাদের। খাইয়ে থুয়ে বাঁচাতে পারি না। গিরিগোবদ্ধন আমাদের এই জেবন দেছেন–গোসেবা কর। তারাই। আমাদের অন্ন জোগান। আমরা বেন্দাবনে ছিলাম, তা’পরেতে কত পুরুষ খুইত্তে খুইত্তে এই নদেয়। এসেছি। কিন্তু অই সেই জীব চরিয়ে ফিরচি। তারা আমাদের ধন অতন, বাবা মা। তা চখের সামনে কেউ মাকে বেইজ্জত কইল্লে, তাকে আস্ত রাইখব? মনিষ্যি না আমরা? আমরা যাদব মনিষ্যি। মাথায় অক্ত উঠে গেলে আর অক্ষে নাই।
পঞ্চানন জিজ্ঞেস করল, ঠাগমা ত্যাখন তোমাকে কী বইলত?
ঠাগমা কী বইলবে?’ গদাধরের চোখ ছিল শ্রাবণের নদীর গেরুয়া স্রোতে। চোখ তুলে হেসে বলল, তোর ঠাগমার পেরানে যত ভয়, আমার বাবার পেরানেও তত ভয় ছিল। কিন্তুন ভয় ছিল না আমার মায়ের পেরানে। মা বইলত, ব্যাটা আমার পুণ্যি কইরেচে। ও কথা শুইনলে আমার বাবা ক্ষেপে উইঠত, মাকে গালিগালাজ কইত্ত–এ মাগি যত নষ্টের গোড়া। ছেলেটাকে খুনে কইরেছে। আজ বাদে কাল ফাঁসি যাবে, মাগির সে ধেয়ান নাই। মা বইলত, ফাঁসি যাবে যাগ। অই পাপ দেখে ছেলে আমার পঞ্চাকে খুন না কইলে, অমন ছেলের মুখ দেখতাম না। মা ঠিক বইলত। মায়ের আশীৰ্বাদেই না আমাকে ফাঁসি যেতে হয় নাই? তবে হাঁ, আমার ঠাকুদ্দাও মোটে ভয় পায় নাই। দশ বছর হল, ঠাকুদ্দা গত হইয়েচে সেই আনুরিয়ার মাঠেই।’
শ্রীবাসের হাতের লগি আলগা হয়ে গেল। নৌকার মুখ ঘুরে গেল। তার অন্যমনস্ক চোখ দূরের নদীতে। গদাধর ভুরু কুঁচকে মুখ ফেরাল। তারপরে হাসল, ওরে ছিবাস, ঠাকুদ্দাকে তুই মরতে দেখেছিলি। খুব কাঁদাকাটা করেছিলি। তা আমাদের জেবন ত এই রকমই। বাথান লিয়ে পথে পথে ফিরি। গোরু মোষ মরে, আমরাও মরি। এখন আর দুঃখু ক্যানে বাবা। নৌকোটা ঠ্যাল।
শ্রীবাস আবার শক্ত হাতে লগি ধরল। মন খারাপ করা মুখে, মরা চাঁদের মতো হাসি। পঞ্চানন বাবার দিকে তাকিয়ে দেখল। গদাধর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তবে হ্যাঁ, একটা কথা কী, পাপ দেখলে তুমি চণ্ডাল হবে। আবার ভাব ভালবাসা হলে তুমি সব কইরবে। পেরান যদি দিতে হয়, তাও দেবে। আর ভাব ভালবাসা হলে পাপ নাই। সেটা কেমন? তা হলে শোন, আমার মায়ের একটা কথা।
গদাধরের চোখ দূরের আকাশে। পঞ্চানন ঠাকুরদার মুখের দিকে তাকাল। গদাধরের মুখে হাসি। আপন মনেই মাথা ঝাঁকাচ্ছে। বলল, মা বলেছিল, কেষ্ট ত্যাশন দ্বারকার। তাঁর ব্যানো হইয়েছে। শুনে নারদ গেলেন তাঁকে দেইখতে। জিগেস কইরলেন, বাসুদেব ঘেঁ, কী ব্যামো তোমার হইয়েছে? বাসুদেব বইললেন, ঠাকুর, ব্যানোরও কোন হাল হদিস পাই না। ও ব্যামো সাইরবে কীসে, তা বুয়েচি। নারদ বইললেন, এ ভারী অবাক কথা বইললেন হে বাসুদেব। ব্যামোর হাল হদিস পাও না, অথচ কীসে সাইরবে, সেটি জেনে বইসে আছ। তা বেশ, বল কী সেই চিকিচ্চে? বাসুদেব বইললেন, ঠাকুর, আমাকে কারুর পা ধোয়া জল এনে দাও। অ বাবা! নারদ ঠাকুর শুনে থ মেরে গেইলেন। বাসুদেব বইললেন কারুর পা ধোয়া জল এনে দাও। ক্যানে, কী করবে পা ধোয়া জল দিয়ে। বাসুদেব বইললেন, খাব। আপনি আমাকে কারুর পা ধোয়া জল এনে দেন। বাসুদেবের কথা তো ঠাকুর ঠেইলতে পারেন না। চেঁকিতে চেপে বেরয়ে পইড়লেন। বেরয়ে সারা জগত সোমসার ঘুইরতে লাগলেন, আর সবাইকে বইলতে নাইগলেন, তোমরা কেউ বাসুদেবকে পা ধোয়া জল দাও। নইলে তাঁনার ব্যামো সারবে না। তাই কখনও কেউ দেয়? যে শোনে, সে-ই কানে আঙুল দেয়। অই না নারদ ঠাকুর, অমন পাপের কথা বইলবেন না। তিনি জগতের পিতা, তাঁনাকে কখনও পা ধোয়া জল দেওয়া যায়? অমন কথা শুইনলে পাপ। তাই ত, নারদ ঠাকুর ঘুরে বেড়ান, আর ভাবেন, বাসুদেবকে কেউ কখনও পা ধোয়া জল দেয়? তা, এই ভাইবতে ভাইবতে ঘুইরতে ঘুইরতে তিনি গেলেন বেন্দাবনে। সেখানে গে যেই মুখ খুইললেন, বাসুদেবের ব্যামো হইয়েছে, তিনি কারুর পা ধোয়া জল চান। অমনি বেন্দাবনে দাপাদাপি কাড়াকাড়ি, বাসুদেবকে কে আগে পা ধোয়া জল দেবে। বাসুদেব ব্যামোয় ভুইগছেন? অ গো, ঠাকুর আমার পা ধোয়া জল নিয়ে যাও। এই বলে আর কাঁদে। কে আগে পা ধোয়া জল দেবে, কে আগে জল দেবে। বাসুদেব যে পেরানের পেরান, তাঁনাকে সব দিতে পারি।’ গদাধরের গলা ডুবে গেল। চোখ ভরে জল। এল, খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি গালে গড়িয়ে পড়ল।
চোদ্দো বছরের বালক পঞ্চানন জানতেও পারল না, ওর দু চোখও জলে ভেসে যাচ্ছে। গদাধর হাসছে, আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শ্রীবাস লগি ঠেলছে। কিন্তু সেও নদীকে ঝাপসা দেখছে। কিন্তু পঞ্চানন জানে না, ও কেন কাঁদছে। গদাধরের কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল, আর তাকে কাঁদতে দেখে অবুঝ বালক কাঁদে।
গদাধর চোখের জল মোছে না। পুবের ভেজা বাতাসে তা আপনিই শুকিয়ে যেতে লাগল। আবার গড়াতেও লাগল। খানিকটা কেশে নিয়ে হেসে বলল, ভাব ভালবাসা হল এমনি বস্তু। সে চাইলে পরে তোমার না দেবার কিছু থাইকতে পারে না। তা, আমরা হলাম সেই বেন্দাবনের যাদব গোপ। পেরানের ঠাকুরকে পা ধোয়া জল দিতে পারি। আবার পঞ্চার মতন পাপীকে পেরানে মাইরতে পারি। এই হল গে ধম্মমা।
শ্রীবাসের খেয়াল নেই। সে তখনও লগি ঠেলছিল। বলদ দুটো ডাঙার ওপর দিয়ে চাপের নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল। তারা ঠেক চেনে। দুটিতে জলে নেমে পড়ল। যেখান থেকে সাঁতার দিলে, স্রোতের টামে দক্ষিণের ওপারে গিয়ে উঠবে, ঠিক সেখানেই জলে নেমেছে। শ্রীবাসের খেয়াল হল। তাড়াতাড়ি লগি রেখে হাল ধরল। বলদ দুটোর শরীর তেমন দেখা যায় না। মুখ আর শিং ভেসে আছে। শ্রীবাস তাদের থেকে কিছুটা দূরে থেকে নৌকার মুখ ঘোরাল। গদাধর গান ধরল। গলায় সুর নেই। যেন প্রাণের কথা শোনাবার জন্য। চিৎকার করল,
অ হে আর কি দেখা পাব গো শ্যামের
সেই রাঙা চরণে।
অ গো মলাম মলাম পেরানে মলাম
হেরে চরণ।
এ গান পঞ্চাননেরও জানা। সেও ঠাকুরদার গলার সঙ্গে গলা মেলাল,
একদিন অক্কুর এসেছিল
অথে তুলে লয়ে গেল।
অ সে কালিয়াদমন
কী মন্তন্না দিয়ে গেল।
তোমার গো ধনেরা চেয়ে রইল মেলিয়ে লয়ন।
অহে কেড়ে লিয়ে চলে গেলে আসল বেন্দাবন।
আর কি দেখা পাব গো…’
পশ্চিম-যাত্রী মেঘের আকাশ দেখে বোঝা যায় না, বেলা কোথায় গড়িয়েছে। পুবে বাতাসের টানে পিতামহ আর পৌত্রের দ্বৈত সংগীত ভেসে যায় দূরান্তরে। গেরুয়া ভৈরবী গঙ্গা ভেসে যায় সমুদ্রের টানে। সে কেবল কালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভেসে যায় না। ভূমির গড়ন বদলে দিয়ে যায়। গদাধর দক্ষিণের স্রোতের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে, আশীর্বাদ দিয়ে যাও গো, বাড়ি যাই।
ক্যানে? ও কথা বইলবে না।’ পঞ্চানন গদাধরের গলা আঁকড়ে ধরল।
গদাধর নাতির গলা জড়িয়ে ধরে হা হা শব্দে হাসল, আর কত দিন ধরে রাখবি রে ভাই। যেতে হবে না?
বাড়ি যাওয়ার আশীর্বাদ চাওয়া হল, এ জীবনের মতো শেষ যাত্রা। পঞ্চানন আবদারের স্বরে বলল, না যেতে হবে না।
সামনে ভাসে একটা মুখ। চোদ্দো বছর আগে সে তাকে ছেড়ে গিয়েছে। মানুষের কী মন। বাপ মার। কথা কেন আগে মনে পড়ে না? ছেলে নাতি সব থাকতেও, আজকাল প্রায়ই সেই মুখোনিই মনে পড়ে। সেই একেবারে প্রথম দিনের মুখ। তেরো বছর বয়স। ভাসা চোখ, বোঁচা নাকে নাকছাবি। মাজা গায়ের রং। নিমদহের মেয়ে-বর্ধমান জেলার। হাসিটি ছিল ভারী সরেস। তার থেকে বেশি সরেস রাগী। মুখোনি। দশটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছিল। পাঁচটি বেঁচেবর্তে আছে। ফি বছরে বোশেখ থেকে আষাঢ়। আবার শালি জমির আমন উঠে যাবার পরে, ছিটানে খেসারির ডগা খাইয়ে, মাঘে যাত্রা। মাঘেই ফেরা। নয় তো ফাল্গুনের মাঝামাঝি। তার মাঝখানে গো দ্বিতীয়ার পরে, কার্তিক অগ্রহায়ণে কোনও কোনও বছরে যাত্রা। বাথানের এই হল সময়। আর বন্যা হলে তো কথাই নেই। প্রাণীদের নিয়ে বাথান। তখন উঁচু ভূমির সন্ধানে ভেসে চলে। বন্যার বছরে, খেপে খেপে তিন মাস তার মুখ দেখা যেত। বন্যা না হলে, বছরে পাঁচ-ছ মাস তার সঙ্গে ঘর করা যেত।
বাথান নিয়ে ফেরা গোপজাতির এই হল জীবন। গদাধর এই সত্তর বছর বয়সেও সেই জীবন কাটিয়ে চলেছে। তার মধ্যে কত ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ঠাকুরদা থাকতে থাকতেই গদাধরের বাবা কাকারা, যার যার নিজেদের প্রাণী ভাগ করে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আবার গদাধরের বাবা বেঁচে থাকতেই, তারা তিন ভাই তিন ঠাঁই হয়েছিল। ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই মানেই, প্রাণী ভাগাভাগি। এ তো আর জমি না। জমি বাড়াতে হলে অন্য রাস্তা ধরতে হয়। তাও অনেকে ধরেছে। দিনকালের সঙ্গে সবই বদলে যায়। কিন্তু প্রাণীর যত্ন কর, সেবা কর। তারা জমির মতো না। তারা বাড়তে থাকে। বাড়াতে জানতে হয়। আবার দেখ, গদাধরের তিন ছেলেও এখন তিন ঠাঁই। একসঙ্গে থাকবার মতিগতি কারোর নেই। তার মধ্যে ছোট ছেলে গোপাল, গোপ থেকে ময়রা হয়েছে। তার ভাগের গাই গোরু মোষ ভেড়া সব বিক্রি করে। দিয়ে, দাঁইহাটে ময়রার দোকান করেছে। নিতান্ত ঘর করতে দুধের জন্য দু-তিনটি গাই রেখেছে। দোকান তার ভাল চলে। সে অনেক তাগবাগ জানে। শহর গঞ্জের মানুষের সঙ্গে তার মেলামেশা। ছেলেবেলা থেকেই বাথানে যেতে চাইত না। গদাধরই নতুন রকম চেয়েছিল। ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিল। গাঁয়ে দু-চার ঘরে সেই রেওয়াজ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শ্রীবাস আর অধরকে মেরেধরেও স্কুলে পাঠানো যায়নি। গোপাল যেত। গাঁয়ের পাঠশালায় পড়ে, পূর্বস্থলীতে বড় স্কুলেও কয়েক বছর পড়েছিল। সেই থেকেই গঙ্গার পশ্চিম পারে তার আনাগোনা। সেখানেই তার বন্ধুবান্ধব মেলামেশা। লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও, গো-সেবা, প্রাণীদের দেম্ভ করত না। সকাল হলেই কিছু খেয়ে ওপারে চলে যেত। ষোলোসতেরো বছর বয়স থেকেই তার ভাবসাব আলাদা। জামাকাপড়ের বহর অন্য রকম। কী করত কোথায় যেত, বলত না কিছুই। জিজ্ঞেস করলেও জবাব দিত না।
হ্যাঁ, এই রকম মানুষের মন। গদাধরের নজর ছিল। দেখত শুনত সবই, কিছু বলত না। ভাবত, তুই তো গোপের ব্যাটা। কী করবি, কোথায় যাবি, দেখা যাক। কিন্তু শ্রীবাস আর অধর রেগে থাকত। মাঝে মাঝে ঝগড়া বিবাদ লেগে যেত। আর গোপেদের রাগ। সে বড় চণ্ডাল। রেগে গেলে, বাপ ভাই শালা সুমুন্ধি হয়ে যায়। গোপালের চালচলনে বাবুগিরির ভাব। কোঁচা দিয়ে ধুতি পরত, গায়ে দিত বাবুদের মতো জামা। পায়ে জুতো। বিড়ি তামাক খেত না। সিগারেট টানত। কোনও কোনও দিন রাত্রেও বাড়ি ফিরত না। এ একটা ব্যাপারে গদাধরের আপত্তি ছিল। রাতে কোতায় থাকিস তুই? না, কাজের চাপে অনেক রাত হয়ে গেছিল, আর ফিরতে পারি নাই। শ্রীবাস আর অধর ও সব ওজরে খুশি ছিল না। অ্যাঁ? আমরা গোরু মোষ ভেড়া লিয়ে বাথান করছি। দুধ বেচে সোমসার চালাচ্ছি। তুই শালা কোন লাটের ব্যাটা র্যা? পাত পেতে খেতে বইসতে নজ্জা করে না?
ক্যানে লজ্জা কইরবে ক্যানে? গাই বাছুর কি তোমাদের দুজনের নাকি? ওতে আমার স্বত্ব নাই? গোরু বাছুরের দুধে আমার স্বত্ব নাই? বিনি মাগনা পাত পাতি?
ওরে শালা, আবার স্বত্ব মারাতে এসেচ? গাই গোরু থাকলেই এমনি এমনি দুধ হয়? দুধ হলে এমনি এমনি বেচা বিক্রি হয়? পদে নাই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি? ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন, বাইরে কোঁচার পত্তন। আমরা কি শালা তোর ব্যাগার খাটার নোক নাকি? অই বাবুগিরির পায়ের জুতো খুলে বাবুগিরির গাল ভেইঙে দেব।
কী, জুতো মেরে গাল ভাইঙবে? জুতো মেরে তোমাদের গাল খিচে দেব।
এত বড় কথা? আয় শালা, দেখি তোর জুতোর কত জোর। বেরিয়ে পড়ত লাঠি সোঁটা। বউ-ঝিগুলো ভয়ে কাঁটা। তখন গদাধর উঠে দাঁড়াত। ছেলেদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁক দিত, খবরদার! ঘরের সরমান লস্ট কইরচিস তোরা? আমার সামনে নড়াই করবি?’ বলতে বলতে তিন ছেলের হাত থেকে লাঠি সোটা কেড়ে নিত। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে চিৎকার করত, হারামজাদারা বেরয়ে যা আমার সামনে থেনে। লইলে এ নাটি দিয়ে তোদের মাথা আমি ফাটাব।..কিন্তু এ ভাবে চলবার কথা না। চলেওনি। গোপাল বিয়ের আগেই গদাধরকে বলেছিল, আমার গাই গোরু মোষ ভেড়া সব বেচে দেব। টাকা চাই। দোকান করব।
দোকান করবি? কীসের দোকান, কোথায়? না, দাঁইহাটে ময়রার দোকান খুলব। শুনে সকলের মাথায় হাত! এ যে জাত ছাড়া, বংশ ছাড়া কথা হে! ময়রা হলে তাকে ছানা কাটতে হবে। দুধের যে কষ্ট হয়। তাকে কখনও বিকৃত করতে নেই। গোপেরা ছানা কাটবে না। কেবল তো কষ্ট না, দুধকে কখনও নষ্ট করতে নেই। যারা করে, তারা করে। খাঁটি গোপ কখনও ছানা কাটবে না।
গোপালের কথা শুনেই শ্রীবাস আর অধর লাফিয়ে উঠেছিল। গদাধর থামিয়েছিল। হাঁ, সত্যি কথা বলতে হবে। ছোট ছেলে গোপালকে দেখে তার মনে একটু গুমোরও হত। গোপাল যখন বাবুটি সেজে বেরোত, দেখে তার ভাল লাগত। গোপাল কোর্ট কাছারির কাগজ পড়তে পারত। গাঁয়ের লোকেরা তার কাছে কাগজপত্র নিয়ে আসত। গোপাল পড়ে দিত। দরকার হলে লিখেও দিত। সে যখন ময়রা হতে চেয়েছিল, গদাধর আপত্তি করেনি। দিনকাল বদলাচ্ছিল। পুবের দেশের লোকেরা গঙ্গার এপার ওপারে ভিড় করছিল। ভিটে-মাটি ছাড়া হয়ে এসে তারা জমি জিরেত নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করছিল। বিশেষ চরের জমি নিয়ে। গঙ্গার খেয়াল। সে সমুদ্রের টানে ভেসে যায়। ভূমির গড়ন-পেটন বদলে দিয়ে যায়। কারোর জমি তিনি খেয়ে নিয়ে যান। অন্য দিকে উগরে দিয়ে যান। সেই উগরে দেওয়া চর নিয়ে লাঠালাঠি রেষারেষি। না হবে বা কেন? তাদের ভিটে ছাড়া করে নিয়ে এলে। যাবে কোথায়? বাঁচতে হবে তো। কত লোকে কত কী করছিল। নিয়মকানুন রীতিনীতি সব ভাঙচুর চলছিল। তা গোপাল যদি ময়রা হতে চায় তোক। কিন্তু গোরু মোষ ভেড়ার ভাগ দিতে মন চায়নি। গোধন অতন বলে কথা। নিতান্ত প্রাণের দায়ে না পড়লে, কেউ বিক্রি করে না। গোপালকে তার ভাগ দিলে সে সব বিক্রি করে দিত। কেনবার লোকজনও তৈরি ছিল। গদাধর বলেছিল, না, জীবের ভাগ লিয়ে বেচাবিক্রি চইলবে না। ছিবাস অধরের কাছে যত টাকা আছে, সব গোপালকে দাও। আমিও দেব, আমার যত লগদ আছে। তাইতে না কুলালে, হিসাব মতন বাকি ট্যাকা য্যাখন যেমন জুইটবে, নগদায় তা দেয়া হবে। ঘরের জীবদের বিক্রি করা চইলবে না।’
বাবার সালিশি তিন ছেলেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু নগদ আর কত থাকতে পারে? সব কিছুর সঙ্গে গোরু মোষের দামও বেড়েছিল। জমি ছিল গদাধরের ভাগে সাকুল্যে চার বিঘা। কিন্তু গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের থেকে পুব পাড়ের জমির দাম কম। তা হোক। গোধন আর জীবসেবার থেকে জমি বড় না। নিতান্ত আমনের চাষটা করতে হয়। সেই চাষের ফসলে গদাধরের গোটা পরিবারের এক মাসের খাবার হয় না। আমন উঠে গেলেই ছিটানে খেসারি চাষ হয়। যাকে বলে পায়রা চাষ। পায়রা চাষ হতে না হতেই, ছোলা মুসুর কলাই যা হোক তাড়াতাড়ি কিছু একটা চাষ করতে হয়। সবই গাই গোরু মোষদের জন্য। সেই জমিরও এক বিঘা গোপালকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শ্রীবাস, অধর আর ওদের বউরা কেবল কাঁদেনি। গদাধরের বুকের ভিতরটাও ফেটে গিয়েছিল। এক বিঘা জমি চলে যাওয়া, সে কি সহজ কথা? জীবদের মুখের খাবার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। গোপাল সেই এক বিঘা জমি বিক্রি করে দিয়েছিল।
তা সংসার তো এই রকমই। গদাধরের ঠাকুরদা যখন তার ছেলেদের সব ভাগ জোত করে দিয়েছিল, গদাধরের বাপ খুড়োরা কি সহ্য করতে পেরেছিল? পারেনি। গদাধরের বাবা যখন তার ছেলেদের জীব-জমি ভাগ করে দিয়েছিল, তখনও কি মেনে নিতে পেরেছিল? পারেনি। মন এই রকম। মনের তুষ্টি নেই। বুকের ভিতরটা কেমন জ্বলতে থাকে। অথচ সবাই মায়ের পেটের ভাই। এমনটা হয় না, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। কেন থাকতে পারে না? ভাইকে কেন শত্রু মনে হয়? ছেলেবেলায় যে-ভাইদের সঙ্গে এক থালায় বসে খেয়েছে, একসঙ্গে খেলেছে, একসঙ্গে বাথান নিয়ে বেরিয়েছে, তখন এক বারও মনে হয়নি, ভাই ভাই ঠাই ঠাঁই হবে। নারকেল পাতার লম্বা কাঠি দিয়ে যখন নতুন ঝাঁটা তৈরি হয়, তখন তার ডগা কেমন নিপাট মিলে থাকে। ঝাটাতে ঝটাতে খ্যাংরা কাঠি ক্ষয়ে ক্ষয়ে চওড়া হয়। বংশবৃদ্ধি সেই রকম। তখন তার বাড় বোঝা যায়। বংশবৃদ্ধি রোধ করা যায় না। বৃদ্ধি হলেই ভাগের কথা আসে। ভাগের কথা এলেই তখন মন প্রাণ আমার আমার করে ওঠে। মনে হয়, একটা বাছুর দিতেও। বুক ফেটে যায়। একটা জীবকেও ছাড়তে ইচ্ছা করে না। উপায় থাকলে ঠাঁই হয়েও, কেউ কারোকে একটা ভেড়ার ছানাও ছাড়বে না। কিন্তু সবই মেনে নিতে হয়। ঠাই ঠাই হয়েও আবার সবাই মিলে বাথান নিয়ে বেরোয়। একসঙ্গেই বেরোয়। তখন আর এক রকম। কেবল নিজেদের বাপ ভাই ভাইপো না। গ্রামের সব ঘরের জীবকে এক ঠাই করে বাথান চলে। সব ঘরের একজন দুজন করে থাকে। যাদের যত বেশি জীব, তাদের লোক বেশি। আট-দশজন মিলে বাথানের ডেরায় একসঙ্গে রান্নাবান্না থাকা-খাওয়া, গাই মোষ দোয়ানো, দুধ বিক্রি করে সবাই তখন মিলেমিশে থাকে। যে যার নিজের জীবদের ঠিক চেনে। ভাব ভালবাসা থাকে। সকলে মিলে দুধ বিক্রি করতে যায় না। যারা যায়, কেনা-বেচার হিসাব তাদের হাতে। অবিশ্বাস থাকে না। থাকে না এত জোর দিয়েই বা বলা যায় কেমন করে? হঠাৎ কারোর মনে সন্দেহ জাগে, হিসাব নিয়ে বিবাদ বাঁধে। কেবল এই একটা বিষয়ে না। নানা বিষয়েই হঠাৎ ঝগড়া লেগে যায়। যেন অদৃশ্য থেকে কেউ তুক করে। তখন মারপিটও লেগে যায়। দলে ছাড়াছাড়ি ঘটে। আবার দেখ, এক সময়ে সবাই মিলেমিশে যায়। এমন দেখবে না, কেবল মিল আছে। মিল অমিল দুই-ই আছে। তবু এই নিয়মেই সংসার চলছে।
তুমি ভাব, তুমি সংসার চালাও। তা নয়। সংসারের নিয়ম তোমাকে চালায়। মানুষের নিষ্কৃতি কোথায়? এত যে অবোলা জীব, তারাও দেখ, এক এক সময় কী লড়ালড়ি শুরু করে। শিং ভেঙে রক্তারক্তি। তখন লাঠি তুলে মেরে হটাতে হয়। আবার দেখ, সবাই একসঙ্গে চরে, একসঙ্গে খায়। মা সন্তান ছাড়াও এ ওর গা চেটে দেয়। সবাই নিয়মে বাঁধা। যে যেমন জীব সে তার ধর্ম মেনে চলছে। জীবের ধর্ম সংসারের নিয়ম মেনে চলা। একই সংসারে ভাব ভালবাসা হিংসা দ্বেষ মরা বাঁচা শোকতাপ হাসিকান্না একসঙ্গে বিরাজ করছে। তুমিও সংসারের সেই সবের মধ্যে বিরাজ করছ। যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি তোমাকে এই নিয়মে বেঁধে রেখেছে। তাই, একা বসে ভাবলে মনে কষ্ট লাগে। বড় অস্থির করে প্রাণ। তোমার নিষ্কৃতি নেই।
গদাধর তার ঠাকুরদার সঙ্গে বাথানে গিয়েছে ছেলেবেলা থেকে। ঠাকুরদা, বাবা, সে নিজে, আর এই তার ছেলে শ্রীবাস, শ্রীবাসের ছেলে পঞ্চানন তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। পাঁচ পুরুষ তার চোখের সামনে ভাসছে। এই পাঁচ পুরুষ যদি আলাদা না হত, এক ঠাঁই থাকত, জীব প্রাণী ভাগাভাগি না হত, তা হলে কী ঘটত? গদাধরের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কী বিশাল সেই বাথান। সমুদ্র সে চোখে দেখেনি। কিন্তু আনুরিয়ার মাঠ দেখেছে। সুজাদিয়ার মাঠ বিল দেখেছে। সমুদ্রের নাকি শেষ নেই। সেই কোন দূরের আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। আনুরিয়া সুজাদিয়ার মাঠ বিলও সেই রকম। আর এক বার চোখ ভরে দেখ, পাঁচপুরুষের জীবেরা, তাদের পায়ের ধুলা উড়িয়ে চলেছে। আনুরিয়ার মাঠ ছাড়িয়ে, সেই বিশাল গোধন বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। কালো মেঘের মতো মহিষের দল। তার সঙ্গে সাদা, শ্যামা, রাঙা গোরুর পাল। সেও যেন মেঘেরই মতো। সেই বিশাল বাথান সামাল দেবার জন্য পাঁচ পুরুষের মানুষেরা চলেছে। জীবদের গলার ঘণ্টা বাজছে, ডাকাডাকি করছে। আর দেখ, দুধের বন্যা বহে যাচ্ছে। সেই দুধের প্লাবন তোমার ঘর ধনেরত্নে ভরে তুলেছে। আ! কী সুখ হে!
গদাধরের চোখের সামনে সেই বাথানের ছবি, বুকের মধ্যে যেন কী এক দুরন্ত শক্তি আর সুখে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোনও কালে তা হয়নি। হবে না। সংসারের নিয়মে তা নেই। সেই কোন যুগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছে। কেন? হাজার কথার এক কথা। ছুঁচের ডগায় ধরে এমন মাটিও ভাই ভাইকে দেবে না। ভাই ভাইকে খুন করেছে। বুক চিরে রক্ত খেয়েছে। ভাইয়ের বউকে বেইজ্জত করেছে। জ্ঞাতি-গোষ্ঠী খুনোখুনি রক্তারক্তি করে ছারেখারে গিয়েছে। তবু কেউ ভাগ ছাড়েনি। তার মধ্যেই আবার দেখ গিয়ে কত ভাব ভালবাসা শোক তাপ। এই নিয়মে সবাই বাঁধা। সংসারের এই নিয়ম।
এই যে পঞ্চানন গদাধরের গলা জড়িয়ে ধরে আছে, সংসার থেকে ঠাকুরদাকে বিদায় দিতে চায় না। সেও একদিন ভাইয়ের সঙ্গে জীবের অংশ ভাগ নিয়ে লড়বে। তার আগেই লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে গদাধরের তিন ছেলের মধ্যে। এখনও শ্রীবাস অধর একত্র আছে। চিরকাল থাকবে না। তবে গোপালের কী দোষ? দিনকাল বদলাচ্ছে। সে ময়রা হয়েছে। দাঁইহাটে তার পসার ভাল জমেছে। পাকা বাড়ি করেছে। কিন্তু তার ছেলেরাও একদিন ভাগের লড়াইয়ে নামবে। গোটা সংসারের দিকে চেয়ে দেখ, লড়াই চলছে। কেউ কারোর ভাগ ছাড়তে চায় না। তার ঠাকুরদার যখন বাপ খুড়াদের জীব-জমি ভাগ করে দিয়েছিল, গদাধর নিজে ঠাকুরদার মাথায় ডাঙস বসাতে চেয়েছিল। ক্যানে? না সেই যে সাদা দুধেল গাইটার জন্য সে পঞ্চাকে খুন করেছিল, ঠাকুরদা সেটা এক খুড়োকে দিয়েছিল। গদাধর সেই গাইটি চেয়েছিল। ঠাকুরদা দেয়নি। তার মতে যেটা সমান ভাগ। সবাইকে তাই মেনে নিতে হবে। গাই গোরুবাছুর বলদ মোষ ভেড়া, তাদের মধ্যে সবাই এক রকম না। ভালটি সবাই চায়। নধর গাইটি, মোষটি সুন্দর পাছা, ভরাট বাট, সোহাগি বউয়ের মতো তার আচরণ। চলন দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, তাদের সব ভাগ তোমার পেতে ইচ্ছা হয়। সবল বাছুর, কলে দেবার পরে–অর্থাৎ বলদ করার পর যেন সাজোয়ান প্রাণী। তাদের সব কটিকে একলা পেতে ইচ্ছা করে। ছেউটি মেয়ের মতো সব বকনা গাইগুলোকে তোমার সাপটে নিতে ইচ্ছা করে। সরু পাছা, পেট মোটা, রোগ ভোগ করছে, কারোর বা বয়স হয়েছে, তাদের ভাগ নিতে ইচ্ছা করে না। হা, তুমি কি গোপের ব্যাটা নও হে? কেবল ভোগ করবে, দুর্বল জীবের সেবাটেবা করবে না। দুষ্টগুলোকে শাসন করে বাগে আনবে না! আদর ভালবাসা সেবা শাসন, জীবের অংশ ভাগাভাগিতে ও সবও তোমাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। যে ভাগজোত করে দেয়, তার সবদিকে নজর থাকে।
শ্রীবাস আর অধরকে এখনও গোপালের দেনা শোধ করতে হচ্ছে। পাঁচ বছর হয়ে গেল, তবু জীবের ন্যায্য দাম নগদে শোধ করতে পারেনি। পারবে। আরও দু-তিন সন লাগবে। তারপরেও শ্রীবাস অধরকে যখন জীবদের ভাগ করে দিতে হবে, গদাধর বাপ ঠাকুরদার মতোই দেবে। তখন দুই ভাইয়ের প্রাণে জ্বালা ধরবে। বিবাদ বিসম্বাদ করবে। শ্রীবাসের এই ছেলে পঞ্চাননই হয়তো গদাধরের দিকে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে, শালা বুড়োর মাথাটা দু ফাঁক কইরে ছাইড়ব।’
গদাধরেরও সেই রকম ইচ্ছা হয়েছিল। ঠাকুরদার মাথাটা বেল ফাটা করবে। সেই ঠাকুরদা যখন আনুরিয়ার মাঠে সকলের আশীর্বাদ পেল, নিজের ঘরে চলে গেল, তখন গদাধর কেঁদে বাঁচে নি। অই গ দাদা, কোতায় যাও? ঠাকুরদা জবাব দিতে পারেনি। বুড়া বলদের মতো চোখে তাকিয়েছিল। জাত জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সবাই এক রকম হয় না। ঠাকুরদার আর বাথানে যাবার দরকার ছিল না। ছেলেদের সব ভাগ জোত করে দিয়েছিল। ঘরে থেকেই তার শেষ যাত্রা করার কথা। শরীরও অশক্ত হয়ে পড়েছিল। চোখে কম দেখত। সব বুড়ো জীবেরই যেমন হয়। খড়ের জাবনা খোলচুনি কোনও কিছুতে স্বাদ পায় না। দাঁত থাকে না, চিবোতে পারে না। চোখে ছানি পড়ে। ঠাকুরদার তখন সেই রকম অবস্থা। বাথান রওনা হচ্ছে শুনেই, সে বার অগ্রহায়ণের শেষে ঠাকুরদা লাঠি হাতে দাঁড়াল। মনে হয়েছিল, এ সেই চিরকালের জোয়ান মানুষ। বলত, আট বছর বয়স থেকে আমি বাথান লিয়ে বেরয়চি। আমি বেন্দাবনের বেজবাসী আখাল। জীবদের ছেড়ে ঘরে বসে থাইকব কেমন করে।
তা বটে। কিন্তু চিরকাল তো এ রকম চলে না। তুমি বুড়ো হয়েছ। ছেলে নাতিরা রয়েছে। ঘরে ছেলের বউরা, নাতবউরা রয়েছে। ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হলেও তুমি সকলের বাপ। সবাই তোমাকে দেখাশোনা করবে। তুমি আর কেন বাথানের সঙ্গ নেবে? আ, চুপ যা দিনি। বইলচি ত, জীবদের ছেড়ে ঘরের সুখ আমার সইবে না।
সে বার অগ্রহায়ণের শেষে বাথান যাত্রায় ঠাকুরদা সঙ্গ নিল। কারোর বারণ শোনেনি। শালিধানের জমিতে তখন পায়রা চাষের খেসারির লকলকে ডগা। ঠাকুরদা আগে আগে গিয়ে সেই খেসারির মাঠে জীবদের সঙ্গে ঢুকে পড়েছিল। ওটা খাইয়ে নিলে জীবদের গায়ে গত্তি লাগে। কিন্তু খেসারি মরে না। তার চাষ ঠিক হয়। বাথান নিয়ে মাঘে ফেরা। তখন খেসারি ভোলা হয়। জমির অবস্থা ভাল থাকলে, খেসারি তুলে কলাই ছিটিয়ে দেব। খোল খেসারি কলাই পূর্ণ করলে খোলচুনি হয়। দুধেল গাভি মহিষীকে খাওয়াবে। দেখবে তাদের পালান কেমন ভরাট। মনে হবে, দুধে টসটস করছে। তেল জল মেখে পালানে হাত দিতে না দিতে, দুধের ধারা যেন গড়িয়ে পড়ে।
তা কে জানত, ঠাকুরদার সেই শেষ যাত্রা। একে তো বুড়ো হয়েছিল। পথে ধরেছিল পেটের রোগ। প্রথম প্রথম পেটে ব্যথা। তারপরে ক্ষণে ক্ষণে বেগ। যত্রতত্র কাপড় তুলে বসা। কিন্তু বসাই সার। অল্প আম বিষ্ঠার সঙ্গে রক্ত। ওদিকে ক্রমে প্রস্রাব বন্ধ। ভাতে ব্যঞ্জনে স্বাদ পেত না। দুধ মুখে রুচত বটে। হজম করতে পারত না। তারপরে আনুরিয়ার মাঠে পৌঁছে পেট ফুলতে শুরু করেছিল। যত রকমের টোটকা ওষুধ ছিল, সবই দেওয়া হয়েছিল। তবু রাখা যায়নি। বাথান নিয়ে বসে থাকবার উপায় ছিল না। আরও দক্ষিণের নারালে যাত্রার তোড়জোড় চলছিল। ওদিকে ঘাস বেশি হয়। জলের অভাব নেই। সীমানা নদিয়া জেলা। যমুনার ওপারে যাওয়া নেই। কিন্তু উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গা পেরিয়ে বর্ধমানের উঁচুতে যাওয়া আছে।
ঠাকুরদা আনুরিয়ার মাঠে মরেছিল। দক্ষিণের নাবালে যাত্রা দু দিন বন্ধ ছিল। গদাধর ঠাকুরদাকে ডাঙসের বাড়ি মারতে চেয়েছিল। সেই ঠাকুরদার বুকে পড়ে ছেলেমানুষের মতো কেঁদেছিল, আই, কোতায় যাও গ দাদা।তখন আর ঠাকুরদার মুখে কথা ছিল না। চোখ চেয়েছিল বটে। সেই চোখে আর নজর ছিল না। ঘটনা ভর দুপুরে। সকালে এক বার গদাধরকে বলেছিল, এখানে যদি মরি তবে এই আনুরিয়ার মাঠকে কোন দিন ঠ্যাকারের মাঠ ভাবিস না।’
ঠ্যাকারের মাঠ অশুভ স্থান। অমঙ্গল করে। মানুষ আর জীবদের অসুখ করে, মড়কও লাগে। আনুরিয়ার মাঠে মানুষ জীবের কখনও অসুখ বিসুখ করেনি। গদাধর ঠাকুরদার কথায় তেমন ধ্যান দেয়নি। বলেছিল, মইরবে ক্যানে? যদি তেমন বোঝ, বল। তোমাকে বাড়িতে থুইয়ে আসি।
ঠাকুরদা মাথা নেড়েছিল, না, বাড়িতে থুইয়ে আইসতে হবে না। অই বলে রাইখলাম, আনুরিয়ার মাঠ আমাদের চেরকালের মঙ্গল দিয়েছে। আমি মইরলেও এ মাঠ কোন দিন ঠ্যাকারের মাঠ হবে না।
বৃন্দাবনের ব্রজবাসী আখাল গোপ। এই ছিল ঠাকুরদার বিশ্বাস। আনুরিয়ার মাঠে বাথানের ডেরায় সে মরেছিল। মরা তো বাড়ি যাওয়া। সে বাড়িও বৃন্দাবন। গদাধর কেঁদে বাঁচেনি কেন? না, সেই সে ডাঙস নিয়ে ঠাকুরদাকে মারতে গিয়েছিল, সেই অনুতাপসেও সংসারের নিয়মের মধ্যে আছে। মন প্রাণের কত রীতি। আবার কত বিপরীত সেই রীতিতে। তাই লোকে বলে, এ সংসারের লীলা বোঝা দায়।
চাপের নৌকা দক্ষিণ-পুব মুখে পাড়ি দিচ্ছে। বলদ দুটো কয়েক হাত দূরে, বড় বড় শিং মাথা মুখ ভাসিয়ে সাঁতরাচ্ছে। দৃষ্টি দুরের ওপারে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। শ্রাবণের ভৈরবী গঙ্গার গতরে এখন ভরা যৌবন। সে এখন অনেক বড়। বেড়ে উঠে এপার-ওপারের নাবাল জমি ডুবিয়ে নিজেকে বিশাল করেছে। তবে এ যৌবনে ঢলঢল লাবণ্য নেই। আছে দুরন্ত স্রোত আর খরতা। ভাদ্রে আরও বাড়বে। গ্রামের উঁচু রাস্তার ধারে গিয়ে ঠেকবে। তখন যত বড় বেলা, গঙ্গা তত বড় ভরা। গিরিগোবর্ধন যদি কপালে দুঃখের দাগ দেন, তবে জীবেরা প্রথম সংকেত দেবে। বান আসছে।
গদাধর গেরুয়া খরস্রোতের দিকে তাকিয়ে অতীত ভাবে। ভাবে, হাঁ, এই নিজেকে দিয়ে সে এই বয়সে সংসারের লীলা বুঝতে পারে না। নাতিটা কোলের কাছে বসে। তবু, দেখ চোখের সামনে সেই মুখোনি ভাসছে। কেন? সবাই থাকতে, তার মুখ ভাসে কেন? এই কি বিপরীত রীতি, সবাই থাকতেও বুকের একটা বড় জায়গা যেন বৈশাখের আনুরিয়া মাঠের মতো খা খা করে। সেখানটা ভরতে চায় না। ঘর ভরা জীব, ছেলে বউ নাতি নাতনি। তবু মনে হয়, বড় একা। সেই ভাসা কালো চোখ। বোঁচা নাকে। নাকছাবি। মাজা গায়ের রং। পিঠ ছাপানো চুল। হাসিটি ভারী সরেস। রাগলে আরও সরেস। তেরো বছরের ছেউটি মেয়ে বা বলতে পার। তবে যে জীবের যেমন ধর্ম। নিমদের সেই মেয়েটি তখন ঋতুমতী হয়েছিল। কিন্তু বকনার মতো তার ডাক শোনা যায় নি। বকনা গাইয়ের ঋতু হওয়া চোখে দেখা। যায়। তখন তার মাতৃ অঙ্গে ধারা বহে। সে ধারার গন্ধ বাতাসে ভাসে। সে মরদকে ডাকে। কালো চোখে কেমন দিশাহারা চাহনি।
ঋতুমতী মানবীর ধর্ম আলাদা। তার ডাক শোনা যায় না। গন্ধ বাতাসে বহে, তবে তা হল ফুলেল তেলের। তার চোখে দিশাহারা চাহনি থাকে না। ঘোমটার ফাঁকে, চোখে ঝিলিক দেয়। মুখে লজ্জার ছটা লাগে। নিমদে–নিমদহের সেই মেয়ের নাম ছিল রাধারাণী। নাম ধরে কোনও দিনই ডাকা হয়নি। নাম থাকত মনে মনে। ডাকের বচন, অই গ। কোতায় গ।’ যে জাতের যেমন নিয়ম। বিয়ে করে নিয়ে এলে, নতুন ভাদ্রবউকে আগে ভাসুর কোলে তুলে নামাবে। গদাধরের বউকেও তার দাদা কোলে করে তুলে নামিয়েছিল। আর ছোট ভাই কুল গাছের কাটা ডাল নিয়ে আগে থেকেই তৈরি। বউঠানকে কুলের কাঁটা দিয়ে মারতে আসে। এক-আধটা আলতো ঝাপটা না মারে, তা নয়। গদাধরের ছোট ভাইও মেরেছিল। গদাধর তাড়াতাড়ি ভাইয়ের হাত ধরে বলেছিল, অই, মারিস নারে ভাই। তোকে শিগগির। শিগগির বে’ দেব।’
একে রঙ্গ তামাশা যা-ই বলা, ওটাও নিয়মের মধ্যে পড়ে। মন্ত্রতন্ত্র যা কিছু, পুরোহিতই বলে। গদাধররা নমো নমো করে সারে। আসল খেলা তো অন্য রকম। যত আনন্দ, সুখ সেই সবের মধ্যে। জামাই পুকুর কাটে। সেই পুকুর ঘিরে সাত পাক ঘোরা। সত্যি কি আর পুকুর? একটা গর্ত করলেই পুকুর। ওতে জল ঢাললেই কাদা। আর কনের যত সখী বোন ভাইদের কাদা মাখিয়ে দেওয়া। গুঁতো-গাঁতা ধাক্কাধাক্কিও চলে। সেই মারেও সুখ। তখন নাপিতের পো ঠাট্টা করে বলে, খড়ের সঙ্গে দড়ির বিয়ে। কে খড়, কে দড়ি, তা বোঝগা। বর বড়, না কনে বড়? কনেকে সবাই উঁচু করে তুলে ধরে। হাঁ, কনেই বড়। হতেই হবে। তারপর কনের দুচোখ পান পাতা দিয়ে ঢাকা হয়। বরের চোখে কাপড়। পান পাতা আর কাপড় সরলেই, দুজনের চোখাচোখি।
হাঁ, গদাধর নদীর স্রোতে স্পষ্ট দেখতে পায়, সেই ভাসা চোখ দুটি। তাকাতে কি পারে? চোখের পাতা যেন তার উঠতে চায় না। গদাধরেরও কেমন লজ্জা’ লেগেছিল। তবু প্যাট প্যাট করে তাকিয়েছিল। আর সেই ভাসা চোখের পাতা যখন উঠেছিল, অই! কী বইলব হে। প্রথমে মনে হয়েছিল গাভিন গাইয়ের মতো শান্ত কালো চোখ। তাকাতে না তাকাতেই যেন বাতাসের ঝাপটায় চোখের পাতা বুজে গিয়েছিল। উঁহু, হল না হল না। কনে আবার চোখ মেলল। সকলের দাবি। আবার ভাসা চোখের পাতা খুলেছিল। তখন তেরো বছরের রাধারাণীর ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে রাখতে পারেনি। আর ভাসা চোখের কালো তারায় যেন ঝিলিক হেনে গিয়েছিল। হেনেছিল একেবারে তেইশ বছরের গদাধরের বুকে। চোখে চোখ মিললেও যে বুকের রক্তে সাড়াসাড়ির বান ডাকে কে জানত।
অন্য দিকে তখন বেজায় গোলমাল। বরযাত্রীরা মাটিতে বসে, মাটিতেই খোঁদল করে, কলাপাতায় দই চিড়ে নিয়ে বসেছিল। কনের বাড়ির নিমন্ত্রিতেরা তাদের তুলে দিয়ে, নিজেরা ভোজে বসে। গিয়েছিল। ক্যানে? না, আরে তোমরা তো খেতে পাবেই। আমরা আগে খেয়ে লিই। তাই নিয়ে ধস্তাধস্তি, দই চিড়ে নিয়ে কাড়াকাড়ি। এ হল গিয়ে গোপ জাতির খাওয়া। চিড়ে দই, আখের গুড়ের পায়েস। তখন বরযাত্রীদের সামলানো দায়। ইট পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সামাল দিয়েছিল গিয়ে কনের বাপ ভাই। এমনটা না হলে, তারা নিজেদের বলে, গঙ্গাধের্যে ভূত?
তারপরে সেই একলা ঘরে। কী মাতাল কী মাতাল। নেশা ভাং কিছু না করেও, কী মাতাল কী মাতাল! তার ওপরে আবার গঙ্গাধের্যে ভূত, তেইশ বছরের রক্ত। ঘরের মধ্যে আরও এক জন ছিল। একটি গাভিন গাই। তার পেটের বাচ্চা ঘুরে গিয়েছিল। আগা-পাছা গোলমাল। গোয়ালের আর সব জীবদের থেকে তাকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল। দশটা ঘর তো নেই। দুজনকে একটা ঘর ছেড়ে দিতেই বেজায় অসুবিধা। তাই গাভিন গাইটি ছিল ঘরের এক কোণে। কিন্তু নিমদের মেয়েটি তো সত্যি আর বকনা না। একটু আদর যত্ন কর। দুটো মিঠে কথা বলো। সেও তো বকনার মতোই ডাকছিল। শুনতে পাওনিশোনা যায় না। তা বলে অমন পাগলামি করবে? অমন ষণ্ড চণ্ড হবে? নতুন শরীর বলে কথা। তাকে একটু বৃষ্টি ভেজা হতে দেবে না? লাঙ্গল চালিয়ে ফালা ফালা করলেই হল? দ্যাখ ত, কী কষ্ট দিয়েছ? উরতের শিরে টান। বস্ত্রে রক্ত। চোখে জল। মুখোনি যন্ত্রণায় কাতর। তারপরে আর আদর করলে কী হবে? ক্ষ্যামা মাগলেই বা কী হবে।
হয়, তাও হয়। নাকে খত দিতে হয় না। তার হাতে নিজেকে সমর্পণ কর। তারপরে সে নিজেকে সঁপে দেবে। সেই জন্যে গান, করণ কারণ কুম্ভ কারণ/ গৌরী পাঠ্যে ভুবন মোহন।’..হাঁ, তুমি সব নও হে। তার কাছ থেকেও পাঠ নাও। নিয়েছিল। তখন কে মত্ত কে মাতঙ্গী, বোঝ গা। বিয়ের চৌদ্দ মাস পরে, এই শ্রীবাস জন্মেছিল। তখন ও যেন চৈত্রের ছেউটি গঙ্গার মতো। তারপরে সে হয়েছিল এই রকম খরস্রোত গভীর বিশাল গঙ্গা। হাঁ, তখন এক মুখে হাসি। আর এক মুখে রাগ। এক মুখে মিষ্টি কথা। আর এক মুখে খর চোপা। তখন সে একা হাতে ছেলেমেয়ে সামলায়। ঘর আগলায়। জীবদেরও সেবা করে। ভাসুর দেবর আলাদা। একলা ঘরে সে দশভুজা। গদাধর বাথান নিয়ে দেশান্তরী। না, জীব সেবায় ফাঁকি ছিল না কোনও দিন। আজও না। তবু সেই মুখটি চোখের সামনে, আজকের মতোই চিরকাল ভাসত। এমন সময়ও গিয়েছে, গদাধর বাথানের সঙ্গে গাভিন গাই মহিষী নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এদিকে ঘরেও সে গাভিন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়নি। ঘরে জোয়ান মদ্দ পুরুষ ছিল না। কিন্তু এক বারের তরেও বলেনি, অই গো ছিবাসের বাপ, আমাকে কার কাছে রেখে যাও?
না, গোপের বেটি সে। গোপের বউ। বরং গদাধরেরই মন খচখচ করত। সে গদাধরের চোখের দিকে তাকালে, মনের কথা বুঝতে পারত। হেসে বলত, আমার দিকে তাকিয়ে অত সাতপাঁচ কী ভাইবচ? পেখম আত্তিরের কথা মনে করো। এক রত্তি মেয়েটাকে অক্তগঙ্গা করেছিলে। এখন কি আর আমি সেই মেয়ে আছি? জ্ঞাত গোষ্ঠীর শাউড়ি ভাজেরা আছে। গাঁয়ে লোকজন আছে। তুমি ঘরে থাইকলেও আমার খালাস হবে, না থাইকলেও হবে। কেউ না আসে, নিজের ধন নিজে খালাস কইরব। ও সব তাগবাগ আমাদের হাতে আছে, জান না? মনে কোন দুসকু ভাবনা রেখ না ছিবাসের বাপ। বাথান নিয়ে বেরয়ে পড়। নোকের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করো না। ঠ্যাকারের মাঠ নজর করে দেখ। জীবদের ভাল সঙ্গে নজর রে’খ। মাথার ওপরে গিরিগোবদ্ধন আছেন।
হাঁ, সে কেবল এই রকম বলত না। গদাধর সেই এক বার, বন্যায় বাথান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। সে তখন ভরপেট পোয়াতি। গদাধরের মনে শান্তি ছিল না। জীবদের বাঁচাতে বন্যার বাথান এক দিকে। অন্য দিকে ঘর দরজা কখন ভেসে যাবে, কেউ বলতে পারে না। উঠোনে বানের জল দেখে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে শুনেছিল, ঘোর বৃষ্টির রাত্রে তার অব্যর্থ ব্যথা উঠেছিল। কারোকে ডাকবার উপায় ছিল না। বানের জলে তখন ঘরের দাওয়া ভাঙছে। ওদিকে বউয়েরও পানমুচি ভেঙেছে। শ্রীবাস, অধর, অনু ঘরে তিন ছেলে মেয়ে। একখানি কাপড় ঘরের এদিকে ওদিকে খাঁটিয়ে, নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিল। ব্যথা তখন তুঙ্গে। কাপড় খাঁটিয়ে ওপাশে যেতে না যেতে, মায়ের পেট থেকে গোপাল এই সংসারে আসতে মাথা বের করে দিয়েছিল। ছেলে মেয়ে তিনটির মধ্যে অন্ন ভয় পেয়ে কেঁদেছিল। শ্রীবাসকে মা ডেকেছিল, বাবা ছিবাস, তোলা আখার আগুনে কাঠ গুঁজে দে। হাঁড়িতে গরম জল বসা। আমি আইসচি।’
বউ গোপালকে খালাস করেছিল নিজেই। না, অচেতন হয়নি। ব্যথা যন্ত্রণা দাঁতে কামড়ে ধরা ছিল। ভয় ছিল একটাই। কখন ঘরে জল ঢুকবে। মাথার ওপরে খড়ের চালা ভেঙে পড়বে। তা হলে কী করবে? লোকজন ডাকাডাকির আগেই যে সব ভেসে যাবে। কিন্তু যায়নি। নিজের হাতে চিদে কাঠি দিয়ে নাড়ি কেটেছিল। বর্ষার অন্ধকার রাত্রে ফুল পুঁততে যেতে সাহস পায়নি। মালসা ঢাকা দিয়ে। রেখেছিল। জলে উঁচু ডাঙা খুঁজতই বা কোথায়? শেয়াল কুকুরে ভেঁড়াছিড়ি করে খেত। সে যে অকল্যাণ।
ঘরটা কোনও রকমে বেঁচেছিল। গদাধর ফিরে এসে দেখেছিল, বউ নতুন ছেলে কোলে নিয়ে, তিন ছেলেমেয়েকে খাওয়াচ্ছে। গদাধরের এক বুড়ি খুড়ি পাশে বসে ছিল। বলেছিল, দ্যাখ রে গদু, বউমার। লতুন ব্যাটা হয়েছে। কাক পক্ষী টের পায় নাই, বিষ্টি উপরঝান্তি, আত্তিরে নিজে ছেলে খালাস কইরেচে।
বউ বুকের কাপড় টেনেছিল। ঘোমটা তুলে দিয়েছিল মাথায়। সামনে শাশুড়ি। ছেলেমেয়েরা সব ঘুমিয়ে পড়ার পরে, রাত্রে এক মাসের গোপালকে গদাধরের কোলে তুলে দিয়েছিল। তারপর গদাধরের কাঁধে মুখ রেখে নিঃশব্দে কেঁদেছিল। ক্যানে? না, দেখ আমি গোপের বউ। তোমার ছেলেমেয়েকে কষ্ট দিই নাই। লতুন খোকাকে তোমার কোলে তুলে দিতে পেইরেচি।
শুধু কি সেই কারণে কাঁদা? না। সেই কান্নার মধ্যে আর একটা কথা ছিল। কী কথা? বড় দুঃখের সময় তুমি কাছে ছিলে না। তোমার কথা বড় মনে পইড়াছিল। বড় ভয় পেইয়েছিলাম, তুমি কাছে নাই। এখন তুমি আমার কাছে। আমার আর কোন ভয় নাই। সেই কারণে কাঁদা।
সেই গোপালই যখন জীবের অংশ ভাগ বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল, মনে বড় কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু শক্ত মুখে বলেছিল, না, জীবের অংশ পাবে না। ধার দেনা করেও ছেলের ভাগ মেটাও। গদাধরের মন রাখবার জন্য বলেনি। ওইটি তার মনের কথা ছিল। তার প্রাণে যে বেজায় শক্তি ছিল। সেই শক্তি গদাধরের মনেও অনেক শক্তি জুগিয়েছে।
চাপের নৌকা পাড়ি দেয়। বলদ দুটো শিং মুখ ভাসিয়ে সাঁতার কেটে চলেছে। যত বড় শক্তিশালী জীবই হোক, এই টানের নদীকে ভয় তো পাবেই। তাদের চোখে তাই সংশয় ভয়। দম রাখতে নাকের ছিদ্রগুলো কাঁপছে। গদাধর ভৈরবী গঙ্গার স্রোতের সঙ্গে কথা বলছে। কথা ভেসে যাচ্ছে, স্রোতের টানে সমুদ্রের অকূলে। হাঁ, অইগো চিবাসের মা, এত শক্তি থাইকতেও কোন পেরানে আমাকে ছেইড়ে গেলে? ঘর ভরিয়ে দিয়ে গেলে গা। আমার বুকটা যে খা খা করে। একি বিপরীত রীতি, তুমি ছাড়া ক্যানে এমন একা লাগে? এই বুড়া পেরান ক্যানে কাঁদে? এ কথা যে কারুককে বইলতে পারি না।
এও সংসারের নিয়মে বাঁধা। তুমি চলে গিয়েছ। আমিও যাব। তবু এই কষ্ট মনে থাকবে, যত দিন বেঁচে আছি। কিন্তু সংসার বসে থাকে না। গদাধর সবাইকে নিয়ে সংসারের ধারায় চলেছে। বউ চলে যাবার চার বছর পরে, সে গিরিগোবর্ধনের ব্রত নিয়েছে। এক বার ব্রত নিলে বারো বছর পালন করতে হয়। পালন করছে। দশ বছর হয়েছে। আরও দু বছর বাকি। এই দু বছর তাকে বেঁচে থাকতে হবে। অনেক বৃদ্ধ গোপের মতো সে বৃন্দাবনে যেতে চায় না। ব্রাহ্মণের কাছে দীক্ষা নিয়ে, গলায় পৈতা চড়াতে চায় না। মরলে সে যেন বৃন্দাবনে যেতে পারে। জীবিতকাল পর্যন্ত সে জীবের সেবা করে যাবে। এখন এই ঘর, জীব, বাথান–এ সবই তার বৃন্দাবন। এই বৃন্দাবনের একটা জায়গা শূন্য হয়ে গিয়েছে। সেই শূন্যতার হাহাকার সংসারে কেউ জানবে না।
উঁচু গোয়াল ঘরে গাভিটি শোয়ানো। অধর গাভির সামনের পা জোড়া বাঁধছে। যদু রান্নাঘর থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে এল। আসতে আসতে মুখ না ফিরিয়ে বলল, খুড়ি, হাঁড়িতে গরম জল চাপিয়ে দাও।
ঝিঙের বার এইনেচিস?’ অধর আর এক গাছি দড়ি নিয়ে গাভিটির পিছনের পায়ের কাছে বসল।
যদু বলল, এইনেছি৷ বিচিগুলাল বার করা হয় নাই। কইরচি।
যদু শ্রীবাসের বড় ছেলে। বিশ বছরের সাজোয়ান। ঘরে মা খুড়ি, গাঁয়ের বুড়ো বুড়িরা বলে, যদু ওর ঠাকুদ্দার চারা পেইয়েচে। মুখোনি ওর মায়ের মতন হইয়েচে বটে, গড়ন পেটনে একেবারে গদাধর ঘোষ বসান।
হাঁ, যদুর দীর্ঘ সবল শরীর দেখলে যৌবনের গদাধরের চেহারা ভেসে ওঠে। চওড়া কাঁধ। কামারের নেহাইয়ের মতো শক্ত বড় বুক। সরু কোমর। মোটা শালের খুঁটির মতো উরু আর পায়ের গোছা। পেশল দু হাত, আজানুলম্বিত। চলা ফেরায় সারা শরীরের পেশিগুলো সাপের মতো খেলা করে। নাক চোখা, ভুরু জোড়া সরু। কালো চোখ দুটো ডাগর। মুখটির সঙ্গে গদাধরের মিল নেই। মুখ ওর মায়ের মতো। এখনও বালকের মতো কোমল। মাথার কালো কেউটের মতো চুলে কাঁচি পড়েনি অনেক দিন। গালে গোঁফে ক্ষুর পড়েছে দু বছর। তবে কয়েক দিনের গোঁফ দাঁড়ি এখন নতুন গজানো কচি ঘাসের। মতো দেখাচ্ছে। হাঁটুর ওপরে কাপড়। কোমরে একটা গামছা বাঁধা।
শ্রীবাস–ওর বাবাও লম্বা। গায়ের রং ফরসা। শক্তপোক্ত হলেও সে ছিপছিপে। অধর সেই তুলনায় খাটো, চওড়া, আঁটোসাটো গড়ন। মোটা নাক, বড় চোখ। তারও খালি গা। অধরের বউ রান্নাঘরে। রান্নার ফাঁকে এখন কাঠের উনোনে গরম জলের হাঁড়ি বসিয়েছে। তার পাঁচ ছেলে মেয়ে। প্রথম এক মেয়ে এক ছেলে। মাঝখানে দুটি আঁতুড়েই মারা গিয়েছে। তারপরে আবার এক মেয়ে দুই ছেলে। এখন পেটে একটি আছে। বড় মেয়ের বয়স আঠারো। চার বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে। পরের ছেলেটি ষোলো। বছরের। নাম বলরাম। তৃতীয়টি মেয়ে। তেরো বছরের মেয়েটির নাম দুর্গা। বিয়ের পাত্র খোঁজা হচ্ছে। আজ্ঞা তেমন খারাপ না। দশ আর সাত বছরের ছেলে দুটির পরে এখন আবার গর্ভধারণ করেছে। সাত বছরের মধ্যে পোয়াতি না হওয়ায়, সবাই ভেবেছিল আর হবে না। গদাধর বলত, মা ষষ্ঠী অ্যানেক দিয়েছে, আর দরকার নাই। মা ষষ্ঠীর মতলবের ওপর কথা বলতে যেয়ো না। দোগাছিয়ার মেয়েটিও ষষ্ঠী ঠাকরুনকে বলত, যে-গুলান এইসেছে, ওরা বেঁচে বত্তে থাক। আর দরকার নাই। অধরের বউয়ের শরীরটাও ভাল না। বুক জ্বালা অম্বলের কষ্ট বারো মাস। স্বাস্থ্য তেমন ভাল না। সারা শরীরের মধ্যে মুখোনি জেগে আছে। মুখোনি এক সময়ে আরও সুন্দর ছিল। এখনও ভাঙা শরীরে মুখের শ্রী ভাল। দুর্বল শরীর, অল্পেতেই সর্দিকাশি জ্বর-জ্বালা লেগে থাকে। গলায় আর বাঁ হাতে কবচ মাদুলি গণ্ডা খানেক। টোটকা চিকিৎসা লেগেই আছে। তার ওপরে পেটের ভিতর এক প্রাণী সেঁধেছে। ছ মাস। সেই এখন শোষে। তার অবস্থা এখন খোড় ব্যামো গাইয়ের মতো। যেমনটি হয়েছে গোয়ালের গাইটির।
দক্ষিণ দুয়ারি বড় ঘরটার পুবে, দু বছরের নারকেল গাছ। রোদ নেই; শ্রাবণের আকাশে মেঘ, থেমে নেই। মেঘ ধেয়ে আসছে মেঘের পিছনে তাড়া করে। আসছে পুবে ভেজা বাতাসের তাড়া খেয়ে। শ্রীবাসের বউ এ বাড়ির বড় বউ, যদুর মা। নারকেল গাছের নীচে বসে সে বড় জাঁতা পিষছে। জীবদের খাবার খোলচুনি–খেসারি আর কলাই পিষছে। কাছেই গোবর দিয়ে লেপা, মোছা-জায়গায় খোসা না ছাড়ানো কিছু মুসুর ছড়ানো রয়েছে। রোদ নেই, তবুও রেখেছে, যদি ওঠে। অধরের বউয়ের থেকে শ্রীবাসের বউ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু শরীরের বাঁধুনি শক্ত। পঁয়তিরিশেও তার রাঙা গাই রং শরীরের শক্ত বাঁধুনিতে নতুন দুধেল গাভির ঢলঢল ভাব। বাড়ির ভিতরের উঠোনে জামা গায়ে দেবার কথা নয়। নেইও। টিকোলো নাকে নাকছাবি। ডাগর কালো চোখ, সরু ভুরু। তেলতেলে মুখে, অবিন্যস্ত আঁচলের বাইরে উদাস শরীরে যেন আশ্বিনের ভরা নিবিড় নদীর খরতা। অথচ স্নিগ্ধ। দেবর অধরকে লজ্জা পাবার তেমন কারণ নেই। শ্বশুরের কথা আলাদা। শ্বশুর স্বামী আর সেজো ছেলেটি চাপের নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে সেই প্রায় রাত ভোরে। গাড়ি নিয়ে ঠাকুরদের মাল খালাস করতে গিয়েছে ওপারে। ফেরবার সময় হয়ে গেল। বাইরের পুরুষ মানুষের সাড়া শব্দ না দিয়ে ভিতরে আসার কথা না। তবু গঙ্গা জলে ধোয়া প্রায় গেরুয়া লাল পাড় শাড়ির ঘোমটা মাথার ওপরে। কাঁধের পাশ দিয়ে বুকে এসে পড়েছে। এলো চুল। দু হাতে শাঁখা আর নোয়া। গলায় রুপোর সরু শিকলি। তার এক মেয়ে চার ছেলে। মারা গিয়েছে তিনটি। মেয়েটির বয়স অধরের বড় মেয়ের মতোই। তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তিন বছর আগে।
কোনও ছেলেই বাড়ি নেই। বলরাম আর শ্রীবাসের মেজো ছেলে হীরা যাবৎ জীবদের নিয়ে গিয়েছে গঙ্গার ধারের নাবাল জমিতে। শ্রাবণ মাস বটে। কিন্তু গঙ্গার নাবিতে যে বিস্তৃত দু-আড়াই মাইল ভূমি এখনও জলে ডুবে যায়নি, সেখানে এখনও সর্বত্রই ঘাস আছে। সেই নিচু চরায় কেউ চাষ করে না। দখল সরকারের। সে দখল কেউ মানতে চায় না। জানে, বর্ষায় সে চরা ডুবে যাবেই। গঙ্গার ভরা স্রোতের টানে, চাষ বরবাদ করে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সেই কারণে কেউ চাষ করে না। গ্রামের তাবৎ গোপদের জীবেরা এখন সেই ঘাস ছাওয়া চরে চরতে যায়। বলরাম আর হীরা দু বছর ইস্কুলে। গিয়েছিল। পঞ্চাননও গিয়েছিল। সবাই এখন বাপ ঠাকুরদার সঙ্গে কাজে লেগেছে। অধরের দশ বছরের ছেলে তোপাও ওদের সঙ্গে গিয়েছে। তোপর তিন বছরের ছোট পানু, আর শ্রীবাসের ছ বছরের ছোট ছেলে ভুপা গিয়েছে পাঠশালায়। দুর্গাও বাড়ি নেই। বোধ হয় আশেপাশের কোনও বাড়িতে গিয়েছে। এ সময়ে মায়ের সঙ্গে রান্নার কাজে থাকার কথা। মেয়ের বার-টান একটু বেশি। গালাগাল কম খায় না।
হাঁ, মেয়ে ডাগর হয়ে উঠছে। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় হল। তখন তো মেয়েকে আর কাজের জন্য পাবে না। তা বলে মেয়ে এই ঘোর দুপুরে পাড়া বেড়াতে যাবে। শ্রীবাসের বউ ভামিনী জাঁতা পিষতে পিষতে ভাবছিল। মাঝে মাঝে চোখ তুলে রান্নাঘরে মেজো জা ননীবালার দিকে দেখছিল। রান্নার বাকি তেমন কিছু নেই। রান্নাঘর থেকে তার দৃষ্টি যাচ্ছিল গোয়ালে।
যদু ঝিঙের বার থেকে বিচিগুলো বের করল। শুকনো ঝিঙে। দু হাতের সামান্য চাপেই ভিতরটা ফাঁক হয়ে গেল। গাভীর পিছনের দু পা বেঁধে ফেলল অধর। গাভিটার খোঁড় ব্যামো হয়েছে। খোঁড় বললেই বোঝা যায়। ব্যামো হলে গোরু প্রথমে খোঁড়াতে আরম্ভ করে। তা সে সর্দিকাশি জ্বর পেট খারাপ, যে ব্যামোই হোক। প্রথম লক্ষণ খোঁড়ানো। যদু বিচি ছাড়ানো শুকনো ঝিঙের খোসা জ্বলন্ত কাঠের কাছে ধরল। অধর গিয়ে বসল গাই গোরুর মাথার কাছে। যদুর সেই মুহূর্তেই চোখ পড়ল উত্তর দিকে। বড় দুটো উঁচু গোয়ালের উত্তরে আরও একটা নিচু গোয়াল। সেখানে ভেড়ার পাল ছাড়াও কিছু গোরু বাছুর থাকে। তার পাশে খানিকটা খোলা জায়গায় গোটা কয়েক বাঁশের খুঁটি পোঁতা। জীবদের জাব-জাবনা দেবার খালি মাটির ম্যাচলা কয়েকটা। ওই পর্যন্ত বাড়ির সীমানা। তারপরে ফণীমনসার বেড়া। একটু ঢালুতে ছোট রাস্তা। রাস্তার উত্তরে পশ্চিমে বাঁশঝাড়।
যদু দেখল খয়েরি ডুরে শাড়ি পরা দুর্গা বাঁশঝাড়ের দিক থেকে আসছে। ওদিকে কোথায় গিয়েছিল? এক পলকের ঝিলিক জিজ্ঞাসা। ঝিঙের বারে আগুন ধরেছে। ধোঁয়া উঠছে। যদু ঝটিতি উঠে গাইটার মুখের কাছে বসল। ঝিঙের বারের ধোঁয়া দিল গাইয়ের নাকের কাছে। অধর তার আগেই গাইয়ের শিং দুটো চেপে ধরেছে। এই ধোঁয়া নাকে গেলে সহ্য হয় না। শুকনো লঙ্কা পোড়ার মতো ঝাঁজ। অনেক সময় শুকনো ঝিঙে ঘরে না থাকলে, শুকনো লঙ্কা পুড়িয়েও অসুস্থ জীবদের নাকের ভিতরে ঢোকাতে হয়। এই হল একটা চিকিৎসা। তারপরে মাথায় অল্প গরম জল দিয়ে ধুইয়ে দিতে হবে।
ঝিঙের বারের ধোঁয়া নাকে যেতেই গাই মুখ সরিয়ে নেবার জন্য মাথা নাড়া দিল। অধর শিং চেপে ধরে আছে। যদু বেশ জুত করে গাইয়ের নাকে ধোঁয়া ঢোকাচ্ছে। আওয়াজ দিল, অইনক্কী সোনা, একটু ধোঁয়া নে। রোগ ভোগ কইরচিস। খেতে পারচিসনে।
তা বললে কি আর ঝিঙের বারের ঝাঁজ কাটে। গাই চোখ লাল করে ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ছাড়তে লাগল। হাঁ, জীবের প্রাণে ভয়। সে রোগে ভোগে। চিকিৎসা বোঝে না। ধরে বেঁধে কিছু করতে গেলেই, সে বাধা দেবার চেষ্টা করে।
ননীবালা গরম জলের হাঁড়ি নিয়ে গোয়ালে ঢুকল। যদু এক পলকের জন্য উত্তরে তাকাল। দুর্গা যেন কেমন ভয় পাওয়া বাছুরের মতো নিচু গোয়ালের পিছনে গেল। আঁচল দিয়ে মুখ চাপা। কেন? খুড়ি অল্প গরম জলের হাঁড়ি বসাবার আগে, যদুর দিকে দেখল। ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল। সেও নিচু গোয়ালের দিকে তাকাল। মুখ শক্ত হল। জলের হাঁড়ি নামিয়ে গোয়াল থেকে বেরিয়ে গেল। ঝিঙের বারের ধোঁয়া তখনও রয়েছে। যদু গাইয়ের নাকের কাছে সেটা ধরে আছে। অধরের কোনও দিকে নজর নেই। চোখ তার গাইয়ের দিকে।
যদু ভাবল, দুর্গা নিচু গোয়ালের পিছনে গেল কেন? সেখান দিয়ে তো বাড়ি ঢোকবার পথ নেই। নেই বটে। তবু ফণীমনসার বেড়া ফাঁক করে ঢুকতে অসুবিধা নেই। সে মুখ ফিরিয়ে এক বার উঠোনের দিকে দেখল। নারকেল গাছের নীচে থেকে মা তাকিয়ে আছে পশ্চিমে। জাঁতার ওপরে হাত থমকে রয়েছে। তারও কোঁচকানো ভুরু জোড়ায় অবাক দৃষ্টি। খুড়িকে দেখল, রান্নাঘরের পিছনে যেতে। ওদিক দিয়ে পশ্চিমে যাবার সরু ফালি পথ আছে। এদিকে ঝিঙের বার নিভে এসেছে। যদু সেটা একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলল। উঠে গিয়ে গরম জলের হাঁড়ি নিয়ে এল। বলল, খুড়ো, শিং জোড়া ছেড়ে দাও।’
হাঁ, পায়ের বাঁধনও খুলে দিই।’অধর শিং ছেড়ে দিয়ে, গাইয়ের সামনের পায়ের দড়ি খুলে নিল।
গাই উঠে দাঁড়াবার জন্য সামনের দু পা মুড়ে, পিঠে ঝাঁকুনি দিল। যদু বলল, র র, উইঠবি।
অধর পিছনের পা দড়ি মুক্ত করতেই গাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অধর এক মুহূর্ত দেরি না করে, সামনের খুঁটির সঙ্গে ছোট দড়ি দিয়ে, গাইয়ের গলা বেঁধে দিল। যদু হাঁড়ির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে জলের উত্তাপ দেখল। হাঁড়ি তুলে আস্তে আস্তে গাইয়ের মাথায় ঢালল। গাইয়ের মাথা ঝাঁকাবার বিশেষ উপায় ছিল না। খুঁটির সঙ্গে দড়ি খুব ছোট। অধর গাইয়ের মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। গাই ডাকল, বাঁ-আঁ অ্যাঁ।
জল দিয়ে মাথা ধোয়ানো শেষ হল না। খুড়ির আর্ত চিৎকার ভেসে এল, অ’লো মুখপুড়ি হারামজাদি, এমন সব্বনাশ তুই কোতা থেনে করে এলি?
যদুর সঙ্গে অধরের চোখাচোখি হল। দুজনের চোখেই অবাক জিজ্ঞাসা। জল ঢালা তখনও শেষ হয়নি। অধর উঠোনের ওপারে ঘরের দিকে তাকাল। যদু গাইয়ের মাথায় জল ঢেলে চলেছে। অধর ডান হাত দিয়ে গাইয়ের মাথায় মুখে ঘষে দিচ্ছে। খুড়ির গলা আবার সেই রকম ভেসে এলো, বল, বল হারামজাদি শতেকখোয়ারি নষ্ট ছিল। কোথায় মরতে গেচিলি তুই।
সেই আর্ত চিৎকারের পরেই, যে শব্দ ভেসে এল, তা স্পষ্টতই মারের। ঠাস ঠাস শব্দের মধ্যেই যদু মায়ের স্বর শুনতে পেল, অইগো ন’ বউ, চুপ যা। লোকে শুইনতে পাবে। এর উপরে আর ঘুড়িকে মারিস না। আমাকে দেইখতে দে।
যদুর জল ঢালা শেষ। হাঁড়িটা নামিয়ে, কোমর থেকে গামছা খুলে, অধরের হাতে দিল, খুড়ো তুমি গাইয়ের মাথা মুখ মুচিয়ে দাও। আমি যাই, দেখি কী হইয়েছে।
অধরের অবাক চোখে নানা সংশয় জিজ্ঞাসা। যদু তার হাতে গামছাটা ধরিয়ে দিয়ে, দক্ষিণের লাগোয়া পুবের ঘরে গেল। দিনের বেলায়ও ঘরে তেমন আলো ঢোকে না। মেঘলা বেলায় আরও আবছা লাগছে। যদুদের চোখ সওয়া এই আবছা অন্ধকার। দেখল, দুর্গা মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। খুড়ি ওর চুলের মুঠি ধরে টানছে। মুখটা মাটির মেঝেয় ঠুকে দিচ্ছে। খুড়ির নিজের কাপড়চোপড়ের ঠিক নেই। বুক খোলা, চুল এলানো। মা খুড়ির দু হাত ধরেও সামলাতে পারছে না। মায়ের মাথায় ঘোমটা নেই। শাড়ির আঁচল লুটাচ্ছে। আর বলছে, ন’ বউ, অই গো শোন, পোয়াতি মানুষ তুই। আর একটা
যদু যথার্থ ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও, একটা অস্পষ্ট অনুমান করতে পারছে। দুর্গার সাদা জমি। খয়েরি ডোরা শাড়ির পাছার কাছে কয়েক জায়গায় রক্ত লেগে আছে। নিশ্চয়ই খুড়ির রক্ত না। দুর্গারই রক্ত। খুড়ি ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে পড়েছে। আর মারতে পারছে না। এখন নিজেই মাটির মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে, কপাল ঠুকছে। কাঁদছে, বলছে, অগো ভগমান, আমার ক্যানে মরণ হল না। এ পাপ ক্যানে আমাকে দেখালে গো। এ হারামজাদি ক্যানে মইরল না।
মা দুর্গাকে চিত করে দিল। দুর্গার ঠোঁটের কষে রক্ত। চোখ বোজা। যন্ত্রণা কাতর মুখে ঘাম চোখের জল আর মাটি লেগে কাদা কাদা। এক গোছা চুল কপালে গালে ছড়ানো। বুকের আঁচল খসা। গায়ের লাল জামা বগলের পাশ থেকে ছেঁড়া। এমনি ছেঁড়া না। কেউ টেনে ছিঁড়েছে। খুড়ি ছিঁড়েছে? ওর কোলের কাছে শাড়িতেও রক্তের দাগ। মা নিজের আঁচল দিয়ে দুর্গার মুখ মুছিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, মুখ খোল দুগগা। কে, নাম বল। কোতায় এ সব্বনাশ ঘইটেচে, কে দেইখেচে, সব খুলে বল।
দুর্গা যেন মড়ার মতো পড়ে আছে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওর ঠোঁট নড়ল। কথা শোনা গেল না। মা ওর শাড়ির আঁচলটা বুকে তুলে দিল। তুলে বসিয়ে দিল, বল, মুখ খোল। কে? কোতায়, বল।
জটা। দুর্গা কোনও রকমে উচ্চারণ করেই, জেঠির কোলে মুখ গুঁজল।
মায়ের চোখে দিশাহারা ভয়। দুর্গার মাথার এলো চুল টেনে টেনে গুছিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, জটা? কালী ঘোষের ছেলে জটা?’
দুর্গা মায়ের কোলে গুঁজে রাখা মুখ মাথা ঝাঁকাল, হাঁ। শিবের পোড়োয়, জঙ্গলে–
দুর্গা কথা শেষ করতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠল। যদুর মুখ শক্ত হয়ে উঠল। চোখ দপদপ জ্বলল। খুড়ি এখন নিশ্চপ, নিথর পড়ে আছে। খুড়ো এসে ঘরের দরজায় দাঁড়াল, কী হইয়েচে বউঠান?
পরে বইলব ন’ ঠারপো। তোমরা নিজেদের কাজে যাও। মা মুখ না তুলে বলল।
খুড়ি ঝটিতি বসল। খালি গা, এলানো চুল। পাগলিনীর মতো দেখাচ্ছে। তার মুখও ঘামে চোখের জলে মাটিতে কাদা কাদা। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, অগো, তোমার মেইয়ের ইজ্জত খুইয়ে এইসেচে। আমার শউড়ের বংশে কালি মাখিয়েচে। কালী ঘোষের ছেলে জটা, তোমার বকনা মেইয়েকে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতন ধইরে অক্ত গঙ্গা কইরেচে।.. যদু অধরের দিকে তাকাল। অধরের মুখ ভীষণ হয়ে উঠল। সেও যদুর দিকে তাকাল। মা বলল, চুপ যা ন’ বউ। ঘরের নাগোয়া ঘর, জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কানে গেলে আর অক্ষে থাইকবে না।
খুড়ি আবার দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। অধর লাফ দিয়ে উঠোনে নামল। গোয়ালের কাছে ছুটে গিয়ে, বাঁশের লাঠি তুলে নিল। যদুও লাফ দিয়ে উঠোনে পড়ল। ছুটে গিয়ে অধরকে দু হাতে চেপে ধরল, কোতা যাও তুমি অ্যাঁ? জটাকে মাইরেতে যাবা?
ও শালা শোরের বাচ্চার অক্ত খাব।’ ভয়ংকর গর্জে অধর চিৎকার করে উঠল। যদুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল।
যদু সবলে অধরকে চেপে ধরে, গোয়ালে উঠিয়ে নিয়ে গেল। হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে বলল, চুপ, একটা কথা বইলবা না। একেবারে গাপ খেইয়ে যাও। কাক পক্ষীকে জাইনতে দ্রেবা না। চুপ।
অধর রক্তাক্ত চোখে যদুর দিকে তাকাল। যদু অধরের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নিল। ছুঁড়ে দিল এক পাশে। গাইটিকে এর মধ্যেই যেন একটু চনমনে দেখাচ্ছে। যদু আর অধরের দিকে তার দুই চোখেও যেন সংশয়ের জিজ্ঞাসা। অধর চিৎকার করল না। নিচু স্বরে গর্জাল, কী বইলতে চাস তুই? জটাকে এমনি ছেইড়ে দেব? লিদেন সুরীন মণ্ডলের কাছে যেতে দিবি না?
না। কোন মোড়লের কাছে যেতে দেব না। যদুর শক্ত মুখ, আরক্ত চোখ, একটা কথা কারুরে বইলবা না। তোমার বাপ দাদাকেও না। যা কইরবার, আমি কইরব। আমার বোনের ইজ্জতের শোধ আমি তুইলব। গিরিগোবর্ধনের কিরা, খুড়ো, আমি তোমার ভাইপো। আমি গোপের ব্যাটা। আমি শোধ তুইলব। তুমি মা খুড়ি দুগগা আর আমি-আমরা ছাড়া এ কথা আর কেউ জাইনব না। কথা রাইখবা?
অধরের আরক্ত চোখে নানা সংশয় ও জিজ্ঞাসা, কী কইরবি তুই?
দেইখতে পাবা। চোট খাওয়া বাঘের মতো নিচু গর্জন যদুর স্বরে, শুইনতে পাবা। কিন্তু আমার কথা রাইখবা খুড়ো, কারুকে একটা কথাও বইলবা না। আমি মা-খুড়িকে বইলে আসি। তুমি গাইটাকে একটু জাব দাও, খায় কি না দেখ।
অধর যদুর দিকেই তাকিয়ে রইল। যদুর কথায় সে বশ মেনেছে, মুখ দেখলে বোঝা যায়। যদু গোয়াল থেকে বেরিয়ে গেল। অধর বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ, তোর মর্জিই থাক যদু। দেখি তুই কী করিস।
আসলে যদু কী করতে পারে, এই চিন্তা তার মনে। বাবা দাদাকেও বলতে বারণ করেছে। অধর গাইয়ের খাবার ব্যবস্থা করতে গেল। যদু পুবের ঘরে এসে ঢুকল। খুড়ি তখনও মুখে হাত চাপা দিয়ে রয়েছে। দুর্গা মুখ তুলে বসেছে। মা ওকে কোলের কাছে ধরে রেখেছে। দুর্গা যদুর দিকে তাকিয়ে মুখ। নামাল। যদু জিজ্ঞেস করল, দুগগা, শিবের পোড়োয় তোদের কেউ দেইখেচে।
দুর্গা মাথা নাড়ল। যদু আবার জিজ্ঞেস করল, তুই হাঁক-ডাক পাড়িস নাই?
দুর্গার নত মুখ। কথা নেই। যদু চাপা স্বরে গর্জে উঠল, জবাব দে।
চেঁচালে খুন কইরবে, ভয় দেখিয়েছিল। দুর্গা মুখ না তুলে বলল, জানাজানি হলে ও খুন কইরে ফেইলবে, বইলেচে।
যদুর স্বরে দূর আকাশের মেঘের ডাক, না, জানাজানি হবে না। কিন্তু সত্যি কইরে বল ত, তুই শিবের পোড়োয় গেছিলি ক্যানে?
দুর্গা চুপ। খুড়ি ঠাস করে দুর্গার গালে চড় মারল, হারামজাদি, ঘরজ্বালানি, চুপ কইরে আছিস ক্যানে? জ’ব দে।
আমি শিবের পোড়োয় যাইনাই।দুর্গার স্বর কান্না ভেজা, আমি বামুনপাড়ার অন্নর কাছে গেছিলাম। সেখান থেনে ফেরার সময়, বামুন দিঘির ধারে জটাকে দেইখেচি। ও আমাকে বইলেছিল, দুগগা তোকে আমার বোন খোঁজ কইরাছিল। শুনে আমি জটাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারিনি, ও আমার পেছু নিয়েছে। ওদের বাড়ি যেইতে, শিবের পোডোর ধার দিয়ে যেইতে হয়। তাখন…।
দুর্গা চুপ করল। যদু মায়ের দিকে তাকাল। তারপরে খুড়ির দিকে। ওর স্বরে সেই দূরের মেঘের ডাক, শোন, তোমাদের সবাইকে একটা কথা বইলে রাখচি। ঠাকুদ্দা, বাবা, বলা হীরা কারুর কানে যেন এ কথা না যায়। আমরা চার আর খুড়ো, এই পাঁচ পেরানি ছাড়া, এ কথা যেন ছ’কান না হয়। জটা। গোপের ব্যাটা, আমিও গোপের ব্যাটা। ও আমার বোনের ইজ্জত নিয়েছে, তার শোধ আমি নেব। তোমরা এখনও মুখ খুইলবা না, পরেও মুখ খুইলবা না।
কী করবি তুই?’ মায়ের চোখে ভয়ের ছায়া।
যদু বলল, এখন বইলব না। কিছুই বইলব না। যা ঘইটবে, তা সবাই জাইনবে। কিন্তু ক্যানে, কে ঘইটেছে, তা কেউ জাইনবে না। খুড়োকেও বইলে দিয়েছি, সে কারুর কাছে মুখ খুইলবে না। খুড়ো মোড়লের কাছে যেইতে চেইয়েছিল। আমি যেইতে দিই নাই। জটা বইলেচে, জানাজানি হলে দুগগাকে খুন কইরেবে। তা ওর কথাই থাইকবে, কিছু জানাজানি হবে না।
কিন্তু শোন যদু, দুগগার কথা এক বার ভাব। মা পিছনে ফিরতে যাওয়া যদুকে ডেকে ফেরাল, মেইয়েটার কষ্টের কথা বাদ দিই, কিন্তু আইবুড়ো মেইয়ের যদি পেট বাঁধে, কী হবে?
যদু এক মুহূর্ত থমকে চুপ করে রইল। তারপরে দুর্গার দিকে এক বার দেখল, তা যদি হয়, ওকে নবদ্বীপে, লয় তো কেষ্টনগরের ডাক্তারকে দেখাব। ডাক্তাররা সব পারে, আমি শুইনেছি। তবে হ্যাঁ, ট্যাকা খরচ আছে। তা দেখা যাক কী হয়। সে কথা রাত পোয়ালে ভাইবব। এখন তোমরা দুগগার কষ্ট কমাতে পার কি না দেখ। আমি ঘাটে যাচ্চি, সবাইকে চান করয়ে নিজে চান কইরে ফিরব।
সবাই বলতে চরের জীবদের। বিশেষ করে মোষদের। যদু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গোয়ালের কাছে। গিয়ে দেখল, খুড়ো গাইকে খোলচুনি দিয়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। যদুকে দেখে মুখ ফিরিয়ে তাকাল, তিন দিনের চিকিচ্চেয় কাজ দিয়েছে। আজ একটু খাইচ্ছে।
মুখ নামানো গাভী এক বার মুখ তুলে যদুর দিকে তাকাল। যদুর একটা নিশ্বাস পড়ল। গোয়ালের ওপরে উঠে, গাভির গলার কাছে একটু হাত বুলিয়ে দিল। গাভিও ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। যদু সরে এসে, গোয়ালের চালের বাতা থেকে হাত বাড়িয়ে দুটো লুড়া বের করল। আগে থেকেই জমা করে রেখেছিল। গাই গোরু মোষ খায় না, এমন ঘাসের গোড়াকে বলে লুড়া। এই লুড়া দিয়ে বিশেষ করে মোষদের গা ঘষতে হয়। যদু লুড়া নিয়ে অধরকে বলল, গামছাটা দাও।
অধর গোরুর মাথা মুখ মুছিয়ে গামছাটা নিজের কোমরে জড়িয়েছিল। খুলে দিল যদুর হাতে, তুই বইললি বটে যদু, আমার মন পেরান জ্বলে যাচ্ছে। আমি থাইকতে পারছি না।
আগুনেরও যেমন রস আছে, ঠিক তেমনি অপমানিত ক্রুদ্ধ অধরের জ্বলন্ত চোখের কোণে জলের ফোঁটা টলটলিয়ে উঠল। যদু গামছার মধ্যে লুড়া ঢুকিয়ে খুড়ার কাছে এগিয়ে গেল। বলল, খুড়ো, আমিও কি থাইকতে পারচি? আমি জানি, তোমার কী ইচ্ছে কইরচে। একটা আত–হ্যাঁ এই আজ আত্তিরটা পর্যন্ত তুমি সয়ে থাক। তুমি আমার খুড়ো, বাপের ভাই। তোমাদের অক্তে আমার জম্মো। তোমার থেনে বোনের ইজ্জতের জন্যে আমার জ্বালা কিছু কম যায় খুড়ো! তুমি জটার রক্ত খেইতে চেইয়েচ? তা যদি চাও, তাই তোমাকে দেব।’
যদুর চোখও আর শুকনো থাকল না। অধর যদুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। দেখল খানিক সময় নিয়ে। তারপরে যদুর কাঁধে একটা চাপড় মারল, না, তুই ঘাটে যা গা, ওদের চানের দেরি হইয়ে যাচ্ছে। আমি আজ ঘর থেনে বার হব না। বোবা হইয়ে যাইকব। তোর কথা রাইখব।’
যদু লুড়াসুদ্ধ গামছা ঝুলিয়ে নিয়ে গোয়ালের বাইরে এল। বাড়ির বাইরে যাবার আগে, হাঁক দিয়ে বলল, মা, আমি ঘাটে যাচ্ছি। আমার কথাগুলান মনে রেইখ তোমরা।
যদু আর এক বার অধরের দিকে দেখে, দক্ষিণের বেড়ার আগল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আগল খুলে বেরিয়ে, আবার আগল বন্ধ করল। দু পা গিয়ে পশ্চিমে ফিরতেই জ্ঞাতি জ্যাঠার সঙ্গে দেখা। বসে ছিল বাড়ির বাইরের দিকের দাওয়ায়। হুঁকো টানা দেখে বোঝা যায়, দুপুরের ভাত খাওয়া সারা। ঠাকুরদার থেকে বয়সে ছোট। দেখলে মনে হয় বড়। চোখ তুলে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, যদু?
হাঁ। যদু না থেমে বলল।
জ্যাঠা বলল, অধর কাকে বইকছিল। বউমাও রাগারাগি কইরছিল শুনলাম?
দুগগা পাড়া বেড়াতে গেচিল। যদু তখন বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছে।
জ্যাঠার ছানি পড়া চোখ থেকে যদু উধাও। বুড়ো ঘাড় ঝাঁকাল, হ্যাঁ, সব ঘরের মেইয়ে গুলানই আজকাল বারমুখো। ঘরে পদ বসে না।