১. বিছানায় উঠে বসে

থ্রি: ফরটিসিক্স এএম
মূল : নিক পিরোগ অনুবাদ : সালমান হক

লেখকের কথা

প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাদের বইগুলো পড়ার জন্যে। গল্পগুলো লিখতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। বিশেষ করে যখন ল্যাসি, আর্চি আর মারডকের মত বিশেষ চরিত্রগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের।

যদি এই বইটা শেষ করার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় আপনাদের মনে তাহলে জানবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অমনটাই হবার কথা।

হেনরিকে নিয়ে আরো দুটো বই আসবে সামনে। থ্রি: ফিফটিথ্রি এএম আর ফোর এএম। সেখানে অনেক কিছু অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্যে। সবচেয়ে বড় চমকটার দেখা পাবেন আগামি বইয়ে।

নিক পিরোগ
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
সাউথ লেক তাহো

*

অধ্যায় ১

বিছানায় উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকালাম।

৩:০১।

শুক্রবার, ২৬শে ফেব্রুয়ারি।

তাপমাত্রা-ছাব্বিশ। ডিগ্রি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।

কিন্তু কী যেন একটা সমস্যা মনে হচ্ছে ঘড়িটায়। একটু বাঁকা হয়ে আছে, আর টেবিলের একদম কিনারার কাছে চলে এসেছে ওটা।

কয়েক সেকেন্ড লাগলো কারণটা বুঝতে।

ঘড়ির ঠিক পেছনটাতে একটা ছোট্ট সাদা থাবা দেখতে পেলাম। আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।

আর্চি।

কমলা আর সাদার মিশেলে তুষারের বলের মত লাগে ওকে। এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এরপর থাবাটা বাড়িয়ে দিল ঘড়ির দিকে।

“ফেলবি না!” চিল্লিয়ে উঠলাম।

তিন সপ্তাহ আগে আমাদের বাসায় আগমন ঘটেছে আর্চির। তখন থেকে তিনটা ওয়াইন গ্লাস, দুটো ছবির ফ্রেম, ইনগ্রিডের পছন্দের কফি মগ আর একটা স্যামসাং গ্যালাক্সি এস সিক্স ভেঙেছে ও।

কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো আর্চি, এরপর আবার থাবা বাড়িয়ে দিল সামনে।

“খবরদার, আর্চি!”

আবার তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। এরপর আরেকটা ধাক্কা।

“আরেকবার ধাক্কা দিলে কিন্তু ভালো হবে না।”

সাথে সাথে আবার ধাক্কা দিল ব্যাটা। মেঝেতে পড়ে গেল ঘড়িটা।

“ধুর, আর্চি!”

বিছানা থেকে নেমে ঘড়িটা তুললাম।

ওটার এলসিডি স্ক্রিনটা ফেঁটে গেছে।

ঘড়িটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে তিনমাস বয়সি বিড়াল ছানাটাকে না। এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে, না টেবিল থেকে উঠিয়ে নিলাম। এখনও এক হাতে ধরা যায় ওকে। ওর চোখের সবুজ রঙ হয়ত মা’র কাছ থেকে পেয়েছে কিন্তু এই চোখে যে দুষ্টুমির একটা ভাব খেলা করে সবসময় সেটা নিশ্চিতভাবেই বাবার দিক থেকে এসেছে।

“এভাবে জিনিসপত্র ভাঙা বন্ধ করতে হবে তোকে,” বললাম।

চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো ও। ছোট্ট নাকের কাছটা মৃদু কাঁপছে।

“আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই।”

ছোট্ট মুখটা ঘষতে লাগল আমার আঙলে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে, না। হেসে পারলাম না।

“এসব ভাঙছিস, ঠিক আছে,” বললাম, “কিন্তু ইনগ্রিডের আরেকটা মগ ভাঙলে তোকে রাস্তায় থাকতে হবে।”

এমনিই ভয় দেখাচ্ছি ওকে। আমার চেয়ে ইনগ্রিডের সাথে ওর সম্পর্ক আরও বেশি ভালো। এসেই ওর হৃদয় দখল করে নিয়েছে ব্যাটা। আর্চির এখানে আসার পর প্রথম সপ্তাহের পুরোটা আমাকে কাটাতে হয়েছে ওর ছবি আর ভিডিও দেখে। পুরো ষাট মিনিট! ইনগ্রিড সারাদিন ওর পেছন পেছন মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুরতে আর ছবি তুলতো পরদিন আমাকে দেখানোর জন্যে।

‘এখানে দেখো, কী সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে।‘

‘এখানে আমার চাবিটা নিয়ে খেলছে, সুন্দর না!’

‘এই দেখো আজকে তোমার কার্পেট ভিজিয়ে ফেলেছিল!’

পরের মিনিটটা ওর সাথে মেঝেতে হুটোপুটি করে কাটালাম। চার হাত পায়ে ভর করে তাড়া করে বেড়ালাম পুরো ঘরে। গুটিগুটি পায়ে বিছানার নিচে গিয়ে লুকায় আর আমি ওকে বের করে আমার বুকের ওপর বসিয়ে দেই। এরপর ছোট্ট মাথাটায় হাত বুলিয়ে দিলে আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

“ঠিক আছে চল, নিচে গিয়ে তোর বাপকে খুঁজে বের করি। তোর নামে নালিশও করতে হবে।”

আমার ছোটবেলার শোবার ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম আমরা। ছোটবেলা বললে অবশ্য ভুল হবে। সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত এখানে ছিলাম আমি।

হলওয়ের কিনারায় বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছি আমরা। সেখানে গিয়ে পেলাম না বাবাকে। তার অনুপস্থিতিতে মারডক-আমার বাবার একশ ষাট পাউন্ড ওজনের বিশাল ইংলিশ ম্যাস্টিফ কুকুর-বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। ওর বিশাল বপু বিছানার প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে। ল্যাসি আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে মারডকের পেটের ওপর। সন্দেহ নেই, ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার আগে এখানেই ছিল আর্চি।

“কিরে, উঠবি না তোরা?”

দু-জনেই নড়ে উঠলো একটু।

ল্যাসি একবার আড়মোড়া ভেঙে আবার শুয়ে পড়ল বিছানার কিনারায় গিয়ে।

মারডক আমার কোলে আর্চিকে দেখে ডেকে উঠলো মৃদু স্বরে।

“ঠিক আছে, সাবধানে,” এই বলে নিচে নামিয়ে দিলাম আর্চিকে। দ্রুত ওর মারডক আঙ্কেলের কাছে চলে গেল সে।

দু-বার ওর বিশাল জিহ্বা বের করে আর্চিকে চেটে দিল মারডক, এরপর থাবা বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো।

“আর্চি টেবিল থেকে ঘড়ি ফেলে দিয়েছে,” ল্যাসির উদ্দেশ্যে বললাম

আমি।

মিয়াও।

“কতবার ধাক্কা দিতে হয়েছে? ঠিক মনে নেই আমার, এই তিনবার।”

মিয়াও।

“ওকে আরও পরিশ্রম করতে হবে?!”

মিয়াও।

“আমি এই জন্যে রাগ করিনি যে, ওকে ঘড়িটা ফেলতে তিনবার ধাক্কা দিতে হয়েছে। আমার রাগের কারণ হল ঘড়িটা ভেঙে ফেলেছে ও!”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, স্ক্রিন ফেটে গেছে ওটার।”

মিয়াও।

“আমি জানি না ওটার দাম কত। দশ বছর আগে আমার জন্যে ঘড়িটা কিনেছিলেন বাবা। সময়ের সাথে তাপমাত্রা আর আবহাওয়ার অবস্থাও দেখা যেত ওটাতে।”

মিয়াও।

“আচ্ছা, বাবাকে জিজ্ঞেস করবো আমি।”

মিয়াও।

“এখনই তাকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে পারবো না,” ওর উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বললাম,

“শোন, তোর সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য হল এটা জানানো যে, তুই যখন ঘুমাস তখন তোর পুত্র পুরো ঘরবাড়ি মাথায় তোলে। ওকে শাসন করতে হবে তোকে।”

আমি নিজে শাসন করতে চাই না আর্চিকে। তাহলে ওর সামনে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।

ল্যাসি একবার আর্চির দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকালো।

মিয়াও।

“এক সপ্তাহের জন্যে ওর প্লে-স্টেশনে খেলা বন্ধ? আমাদের বাসায় তো কোন প্লে স্টেশনই নেই!।”

মিয়াও।

“তুই ওকে একটা প্লে-স্টেশন কিনে দিতে চাস, যাতে ওটা আবার ছিনিয়ে নিতে পারিস?” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। “তুই আসলে নিজের জন্যে একটা প্লে-স্টেশন কিনতে চাস। ক্রিসমাসে তোকে সান্তা ক্লজ প্লে-স্টেশন এনে দেয়নি বলে যা করলি!”

মিয়াও।

“না, সারা বছর মোটেও ভালো হয়ে ছিলি না তুই। বরং জ্বালিয়ে মেরেছিস গোটা সময়।”

মিয়াও।

“যেমন? একবার পাঁচটা খরগোশ নিয়ে এসেছিলি বাসায়, মনে আছে? কি করেছিস ওদের সাথে কে জানে! আর উল্টোদিকের বাসার বিড়ালটাকে উত্যক্ত করে এমন অবস্থা করেছিস যে, মামলা করতে বসেছিল ওটার মালিক।”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, বুঝলাম খুব সুন্দরি বিড়ালটা, তাই বলে ওরকম করবি? বদ কোথাকার!”

মিয়াও।

“আর কি? তুই আর মারডক মিলে দুটো ছাগলকে তাড়া করে একজনের বাসা তছনছ করেছিলি, ভুলে গেছিস? তার বিড়ালের সাথেই তো…”

আর্চির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার দিকে তাকালো ও। বুঝলাম কি চিন্তা করছে।

“হ্যাঁ, জানি আমি তুই ওসব না করলে আর্চিকে পেতাম না আমরা।”

আর্চিকে ছাড়া আমাদের জীবন এখন চিন্তাই করা যায় না। আসলে যত ইচ্ছে আমাদের জিনিসপত্র ভাঙতে পারে ও, কেউ কিছু বলবে না।

বিছানায় বসলে ল্যাসি আমার কোলের উপর এসে উঠলো। এরপর আমরা দুজন যোগ দিলাম মারডকের সাথে। সবার মনোযোগ ছোট্ট আর্চির দিকে।

কিছুক্ষণ পরপর মারডকের কান কামড়ে ধরে ঝোলে ও, এরপর আবার ছুটোছুটি করে বিছানা জুড়ে।

দারুণ মজার দৃশ্যটা!

দুই মিনিট পরে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

তিনটা আট বাজছে।

বাদবাকি বাহান্ন মিনিটে অনেক কাজ করতে হবে আমাকে।

আগামিকাল আমার বিয়ে।

.

সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক নেমে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

গতকাল পর্যন্ত যেটা আমার বাবার লিভিংরুম ছিল, এখন সেটা একটা বিয়ের মঞ্চ। সব আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিশাল টিভিটার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা বেদি। ওপরে সাদা ছাউনি ওটার। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো সাদা রঙের চেয়ার।

ভেবেছিলাম এক ঘন্টার একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন কী আর এমন কঠিন কাজ। বড় ভুল ছিল সেটা।

আমাদের হাতে সময় মাত্র ষাট মিনিট, তাই সবকিছু একদম ঠিকভাবে হতে হবে। যদি কোন অনুষ্ঠানে একটু দেরি হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে কনে-পিতার নাচের জন্যে বরাদ্দকৃত সময় কমে যাচ্ছে। ছবি তুলতে বেশি সময় লাগালে খাবার সময় পাওয়া যাবে না। কেক কাটার জন্যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিলে শ্যাম্পেইন টোস্টের সময় কমে যাবে।

মাঝে মাঝে আমি অবশ্য সাহায্য করেছি। কোন রঙের ফুল, কিংবা বিয়ের কেক কোন স্বাদের হবে। কিন্তু বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনগ্রিড আর আমার বাবা।

যাইহোক, নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। বাবা চুলোর ওপর ঝুঁকে আছেন।

“কি খবর হেনরি,” হেসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

একটা ফ্ল্যানেলের পাজামা আর লাল রঙের স্লিপার তার পরনে। চশমা। নিচে নেমে নাকের ডগায় ঝুলছে।

“ভালোই লাগছে বাবা,” লিভিংরুমের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, “সবকিছু ঠিকভাবেই এগোচ্ছে মনে হচ্ছে।”

“হ্যাঁ,” ফ্রাইপ্যানের ওপর থাকা প্যানকেক উল্টে দিতে দিতে বললেন। “সবকিছু হয়ে গেলে আরও সুন্দর লাগবে।”

“ইনগ্রিড কখন গিয়েছে?”

“সাড়ে আটটার দিকে। ওর বাবা-মা আর ও প্রায় তিনঘন্টা এখানে থেকে সাহায্য করেছে সবকিছু গোছাতে,” কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন তিনি, এরপর বললেন, “ওর মা’র অবস্থা বেশ ভালোই মনে হল।”

ইনগ্রিডের মা স্ট্রোক করেছিলেন গত জুলাইয়ে। কিছুদিন কোমায় থাকার পর জ্ঞান ফেরে তার। কিন্তু বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। গত আটমাস ধরে একজন স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে যেতে হচ্ছে তাকে। বেশ উন্নতি এই হয়েছে এতদিনে।

ইনগ্রিডের বাবা-মার সাথে আমার প্রথমবারের মত দেখা হয় তিন দিন আগে। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে আটলান্টা থেকে উড়ে এসেছেন তারা।

ইসাবেলের চমৎকার পাস্তা খাবার ফাঁকে ফাঁকে ইনগ্রিডের মা বলছিলেন, “প্রায় চ-চ-চল্লিশ বছর পর এত রা-রাত জেগে আছি আমি।”

বেশ হেসেছিলাম আমরা তার কথাগুলো শুনে।

ইনগ্রিডের বাবা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মাত্র এক ঘন্টা জেগে থাকা সত্ত্বেও কিভাবে স্টক মার্কেটে এত টাকা কামাই করি আমি। তিনি নিজেও একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার ছিলেন আগে। তবে এসব ছোটোখাটো ব্যাপার ছাড়া আমার অদ্ভুত অসুখটার প্রসঙ্গে আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি তারা।

আমি জানি ইনগ্রিড তাদের আগেই আমার অবস্থা সম্পর্কে সবকিছু খুলে বলেছিল। অবশ্য কিছুদিন আগে আমার নেয়া সিদ্ধান্তটার কথা জানিয়েছে কিনা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আট মাস আগের কথা।

মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রো-শক থেরাপির মাধ্যমে আমি স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফেরত আসতে পারতাম। যত ঘন্টা খুশি জেগে থাকতে পারতাম। কিন্তু এর জন্যে চড়া মূল্য দিতে হতো আমাকে। স্মৃতি থেকে সব কিছু মুছে যেতো চিরতরে। ইনগ্রিডের মা’র ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে অনেকটা সেরকম, তবে আমার ক্ষেত্রে জেগে ওঠার পরে বাকশক্তি, চলনশক্তি, স্মৃতিশক্তি-অতীতের সবই হারাতাম। বাচ্চাদের মত একদম শুরু থেকে শিখতে হত সবকিছু। আমার যা যা স্মৃতি আছে-বাবার কাছে অঙ্ক করতে শেখা, ল্যাসিকে খুঁজে পাওয়া, ইনগ্রিডের সাথে প্রথম দেখা হওয়া, ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া-এসব কিছুই হারিয়ে যেত অতল গহ্বরে। সদ্যোজাত শিশুর মত অবস্থা হত আমার।

অথবা, যেমন আছি তেমনই থাকতে হবে চিরকাল।

বাকি জীবন হেনরি বিনসে ভুগেই কাটাতে হবে।

এক ঘন্টার জীবন।

যদি আশি বছর বাঁচি আমি তাহলে পার্থক্যটা হবে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ঘন্টা জেগে থাকা নয়তো পনের হাজার ঘন্টা জেগে থাকা।

পনের হাজার ঘন্টাই বেছে নেই আমি।

আর সেটার জন্যে পস্তাই না একটা মুহূর্তও।

পস্তানোর মত সময়ও নেই আমার কাছে।

“অবিবাহিত জীবনের শেষ খাবার,” বাবার কথা শুনে বাস্তবে ফেরত আসলাম। আমাকে রান্নঘরের টেবিলটায় বসার ইঙ্গিত করে সেখানে এক প্লেট ভর্তি সদ্য তৈরি করা প্যানকেক নামিয়ে রাখলেন। সাথে ডিম, বেকন আর একটা লম্বা গ্লাস ভর্তি কমলার জুস।

প্যানকেকের ওপর সিরাপ ছড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “ইনগ্রিড তোমাকে ফোন করতে না বলেছে। কাল একেবারে তোমার সাথে দেখা হবে। বিয়ের আগে হবু বরের সাথে কথা বলাটা নাকি অশুভ।”

মুখের প্যানকেকটুকু গিলে বললাম, “সে বোধহয় বিয়ের আগের রাতটা ঘুমিয়ে কাটাতে চায়। যা ধকল গেছে এই কয়দিন।”

“তাই হবে হয়তো,” তিনি বললেন।

আরেক কামড় কেক মুখে দিলাম।

বাবা আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি আমার ছেলের কালকে বিয়ে।”

হেসে তার হাতের ওপর আমার হাতটা দিলাম।

আট মাস আগে জানতে পারি আমি, এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ের কথা ভেবে আবেগতাড়িত হচ্ছেন যিনি, তিনি আমার আসল বাবা নন।

আমার আসল বাবা সিডনি ওয়েন, এক খ্যাপাটে বৈজ্ঞানিক। সিআইএ’র প্রজেক্টের নামে মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোই যার কাজ। হাজার হাজার আমেরিকাকান নাগরিক তার এক্সপেরিমেন্টের শিকার হয়েছে। আমি নিজেও তাদের একজন। আমার ডিএনএ’র অর্ধেকটা হয়তো সিডনির কাছ থেকে পেয়েছি, কিন্তু আমাকে বড় করে তুলেছেন এখানে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে। তিনিই আমার বাবা।

“হ্যাঁ,” আমি বললাম জবাবে, “আমার নিজেরও বিশ্বাস হয় না।”

“ইনগ্রিডের চেয়ে ভালো কাউকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না তোমার পক্ষে। চমৎকার একটা মেয়ে।”

“আপনাকেও ভীষণ পছন্দ করে ও।”

পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম হাসছেন তিনি। এরপর বললেন, “তোমাকে কালকের শিডিউল ইমেইল করে দিয়েছি আমি।”

বিয়ের সব অনুষ্ঠানের জন্যে সময় নির্ধারণের দায়িত্ব বাবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল ইনগ্রিড। আমরা যাতে একটা নির্দিষ্ট শিডিউল অনুযায়ি সবকিছু করতে পারি এ দায়িত্বটুকুও তার।

তাকে বললাম খাওয়া শেষ করে ওটা দেখবো আমি।

“আরেকটা ব্যাপার,” তিনি বললেন, “আগামি দু-দিন তুষারপাত হতে পারে। কাল দুপুর থেকে শুরু হবার সম্ভাবনা আছে।”

“তাতে কি সমস্যা হবে নাকি?”

“না হবার সম্ভাবনাই বেশি। যারা দূর থেকে এখানে প্লেনে করে আসবে তারা এরইমধ্যে চলে এসেছে। কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে তারা। আর রবার্টের বাসাও খুব বেশি দূরে নয়।”

রবার্ট ইউলি বাবার পুরনো বন্ধু। সেই সাথে তিনি একজন ‘অর্ডেইন মিনিস্টার। আমার আর ইনগ্রিডের বিয়ে পড়াতে পারবেন তিনি।

“আর ইসাবেলের কি খবর?” জানতে চাইলাম।

“ওদের তো বড় পিকআপ ট্রাক আছে একটা। সমস্যা হবে না।”

আমরা বিয়েতে ইসাবেলের বিখ্যাত লাসানিয়া পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য ইনগ্রিডের বুদ্ধি ছিল এটা।

“ঠিক আছে তাহলে,” আরেকবার আমার পিঠে চাপড় মেরে বললেন তিনি। “আমি শুয়ে পড়ি এখন। কাল অনেক কাজ।”

আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি।

সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। গত আট মাসে হাজারবার তাকে পেছন থেকে ডাক দিয়ে অতীত নিয়ে প্রশ্ন করতে চেয়েছি আমি। জানার ইচ্ছে কেন সেনাবাহিনীর দু-জন গোয়েন্দা তার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে এসেছিল এখানে। ইসাবেলকে একটা চুলের ডিএনএ টেস্ট করার জন্যে ল্যাবে পাঠাতে বলি আমি। সেটার প্রেক্ষিতেই এখানে এসেছিলেন তারা। কিন্তু আমার জানামতে কখনো সেনাবাহিনীতে ছিলেন না বাবা।

সৌভাগ্যবশত ইসাবেল খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল তার এক চাচার চুল ওটা। যিনি অনেক আগেই মেক্সিকো ফেরত চলে গিয়েছেন। বড় একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিল ইসাবেল। ওর মিথ্যেটা সহজেই ধরে ফেলা সম্ভব। এরপর আমার সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এভাবে রিচার্ড বিনস সম্পর্কে জানতেও দেরি হতো না ওদের।

এরপরের এক দু-মাস খুব দুশ্চিন্তায় কেটেছে আমার। কিন্তু ওরকম কিছুই ঘটেনি। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ভুলে যাই আমি। হয়তো গোটা ব্যাপারটাই কোন ধরণের ভুল ছিল। আর এরপরেই বিয়ের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবার কারণে বাবাকেও কিছু জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি।

আমার ল্যাপটপটা খুলে বাবার পাঠানো ইমেইলটাইয় ক্লিক করলাম।

৩:০০-৩:০৩-স্যুট পরা/দাঁত ব্রাশ/চুল আঁচড়ানো

তিন মিনিট? যদি বাথরুমে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে আমার?

৩:০৩-৩:০৮-অতিথিদের সাথে হালকা আলাপচারিতা।

৩:০৮-৩:১৭-বিয়ের মূল পূর্ব।

৩:১৭-৩:২০-ছবি তোলা।

৩:২০-৩:২৩-শ্যাম্পেইন টোস্ট।

৩:২৩-৩:৩১-রাতের খাবার।

৩:৩১-৩:৩৪-কেক কাটা।

৩:৩৪-৩:৩৯-বর-কণে নাচ (জন লেজেন্ড/অল অফ মি)

৩:৩৯-৩:৪৪-কণে-পিতা নাচ (স্টিভ ওয়ান্ডার/লাভলী)।

৩:৪৪-৩:৫৮-সবার জন্যে উন্মুক্ত নাচ (ইনগ্রিডের প্লেলিস্ট দ্রষ্টব্য)

৩:৫৮-৪:০০-হেনরি আর ইনগ্রিডের একান্ত সময়

হেনরি আর ইনগ্রিডের একান্ত সময়? দুই মিনিট? হেসে ফেললাম। এটা বাবার সংযুক্তি নাকি ইনগ্রিডের সেটা বুঝতে পারছি না।

এরপর পরীক্ষা করে দেখলাম ওয়েবক্যামটা ঠিকঠাক আছে কিনা। আগেরদিন একটা ভিডিও রেকর্ডিং প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে রেখেছিলাম আমি। সেটা চালু করে ল্যাপটপটাকে স্লিপ মোডে দিয়ে রাখলাম।

তিনটা বেয়াল্লিশ বাজছে।

সিঁড়ির দিক থেকে হুটোপুটির আওয়াজ ভেসে আসলে সেদিকে তাকালাম।

তিন মাস্তান।

ল্যাসি, আর্চি আর মারডক।

তিনজনই টেবিলের ওপর উঠে পা ভাজ করে বসে পড়লো।

“কি চাই তোদের?” হেসে জিজ্ঞেস করলাম।

সবাই আমার দিকে তাকালো।

যেন সবার একসাথে তাকানোর ফলে ওদের কথা ফেলতে পারবো না আমি।

“ঠিক আছে।”

আমার অবিবাহিত জীবনের শেষ খাবারের অর্ধেকটা এখনও রয়ে গিয়েছে। তিনটা বাটি নিয়ে এসে ওগুলোতে ভাগ করে দিলাম ওটুকু।

তিনজনই লাফিয়ে পড়লো খাবারের ওপর।

খেয়াল করে দেখলাম ল্যাসি ওর প্লেটে ব্যাকনের ছোট্ট একটা টুকরা রেখে দিয়েছে। আর্চি মাথায় আলতো ছোঁয়া দিয়ে সেদিকে নির্দেশ করলো একবার। মুহূর্তের মধ্যে সেটুকু সাবাড় করে ফেলল আর্চি। ল্যাসি লাফিয়ে চলে আসলো আমার কোলে।

“খুব ভালো করেছিস।”

মিয়াও।

“এই যে তোর ব্যাকন থেকে আর্চির জন্যে রেখে দিলি কিছুটা।”

মিয়াও।

“তাকিয়ে ছিল? বাচ্চারা ওরকম সবকিছুর দিকেই তাকিয়ে থাকে।”

আমরা দুজনেই আর্চির দিকে তাকালাম। মারডক শুয়ে আছে আর তার লেজ দিয়ে খেলছে সে।

“ওকে কি শাস্তি দিবি ঠিক করেছিস?” ল্যাসিকে জিজ্ঞেস করলাম। “ঘড়িটা ভেঙে ফেলার জন্যে?”

মিয়াও।

“দু-দিন জাস্টিন টিম্বারলেকের গান শোনা বন্ধ ওর জন্যে? এটা আবার কেমন শাস্তি?”

মিয়াও।

“এটা তোর জন্যে সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন? নিকোলাস কেইজের সাথে একটা জাহাজে বন্দি হয়ে পড়ে থাকার চেয়েও বড় দুঃস্বপ্ন?”

মিয়াও।

“আমি জানি তুই ভলডেমর্ট হিসেবে নিকোলাস কেইজকেই কল্পনা করিস।”

মিয়াও।

“আচ্ছা বাবা, ওনার নাম মুখে নেবো না আমি।” কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে তাকালো ও।

দুই থাবা আমার বুকের ওপর রেখে চোখজোড়া কুঁচকিয়ে তাকিয়ে আছে। এতটা গম্ভীর হতে দেখিনি আগে কখনও।

মিয়াও।

“তোর মতে বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়া উচিৎ আমার?”

মিয়াও।

“হ্যাঁ, এটা ভালোভাবেই জানি, ইনগ্রিডকে বিয়ে করার পর অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাতে পারবো না আমি।”

মিয়াও।

“কারণ কখনো প্রেমে পড়িসনি তুই।”

মিয়াও।

“ব্রেন্ডা?”

মিয়াও।

“একটা গিনিপিগ? আসলেই?”

মিয়াও।

“যতবেশি দৌড়াতে পারে তত ভালো?”

মিয়াও।

“তোর বাল্যকালের প্রেমিকা?” হেসে বলে উঠলাম। “তাহলে ব্রেন্ডাকে খুঁজে পেলে বুঝতে পারবি ভালোবাসা কি জিনিস।”

আমার ফোনের অ্যালার্ম বেজে উঠলো এই সময়।

তিনটা পঞ্চাশ।

“এসব নিয়ে পরে কথা বলতে হবে আমাদের।”

ওকে নিচে নামিয়ে রেখে আমার ঘরে চলে গেলাম আমি। পরের পাঁচ মিনিট ধরে গোসল করলাম আর দাড়ি কামালাম।

আলমারি খুলে দেখলাম স্যুটটা ঠিক আছে কিনা।

তিনটা আটান্নয় বিছানায় উঠে পড়লাম।

আর্চি আর ল্যাসি দু-জনেই আমার বিছানায় উঠে দুপাশে এসে শুয়ে পড়ল।

ওরা জানে আজকের রাতটা আমার জন্যে বিশেষ কিছু।

অবিবাহিত জীবনের শেষ রাত।

*

অধ্যায় ২

গত কয়েকমাসের মধ্যে প্রথমবারের মত এক মিনিট আগে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।

দুইটা উনষাট বাজছে এখন।

এটা নিশ্চয়ই একটা শুভ লক্ষণ।

উঠে বসে জানালার বাইরে তাকালাম। দুই ইঞ্চি তুষারের আস্তরণে ঢাকা পড়েছে সবকিছু। এখনও তুষার ঝরছে অঝোর ধারায়। বাবার বাসার সামনে পাঁচ-ছয়টা গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে। বিশালাকায় ফোর্ড পিকআপটা নিশ্চয়ই ইসাবেলের স্বামীর।

হেসে উঠলাম আপনমনে।

তিন মিনিট লাগলো গায়ে স্যুট চাপিয়ে, জুতো আর বো টাই পরে ঠিক হতে।

দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে নিলাম। তেইশ ঘন্টা ঘুমোনোর পর মুখে যেরকম দুর্গন্ধ হয়, ইনগ্রিড হয়তো বিয়ের অনুষ্ঠানই বন্ধ করে দেবে।

সিঁড়ির কাছে গিয়ে নিচে তাকালাম।

বাবার লিভিংরুমটা চেনাই যাচ্ছে না এখন। ছোট ছোট উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে সবজায়গায়। এতে করে বিয়ে উপলক্ষে লাগানো ইনগ্রিডের পছন্দের বেগুনি ফুলগুলোর ঔজ্জ্বল্য বেড়ে গেছে আরও বহুগুণে। দুটো উঁচু টেবিল পাশাপাশি রাখা। একটা নানা রকম খাবারে ভর্তি আর অন্যটায় বিয়ের কেক শোভা পাচ্ছে। একটা সরু কার্পেট বারোটা চেয়ারকে পাশাপাশি আলাদা করে রেখেছে। সিঁড়ির উপরিভাগ থেকে নিচ পর্যন্ত আইভি লতা দিয়ে সাজানো। কিনারার দিকে একটা কিবোর্ড আর ট্রাইপডের ওপর একটা ভিডিও ক্যামেরা রাখা আছে।

এরপর উপস্থিত লোকজনের দিকে মনোযোগ দিলাম, বেশিরভাগের হাতেই ওয়াইনের গ্লাস। নিচে নামা শুরু করলে সবার দৃষ্টি আমার দিকে ঘুরে গেল। দুয়েকজন তালিও দিয়ে উঠলো।

বাবা ছুটে আসলেন আমার দিকে, “পাঁচ মিনিট সবার সাথে আলাপচারিতা। শুরু করে দাও,।” দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। মানে, বিশ বছরের পুরনো স্যুট পরনে একজনকে যতটা সুন্দর দেখানো যায় আর কি।

“ঠিক আছে,” মৃদু হেসে বললাম। “ইনগ্রিড কোথায়?”

“আমার ঘরে।”

“ওহ, ওর সাথে তো এখনও দেখা করা যাবে না আমার।”

মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে আমাকে ইনগ্রিডের বাবা-মা আর বোনের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি।

ওর বাবা আগে অ্যাথলেট ছিলেন, কিন্তু গত তিন যুগে চর্বি জমেছে গায়ে। মাথাভর্তি বাদামি চুল তার (বাবা এজন্যে একটু ঈর্ষান্বিত)। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তৈরি তুমি?”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, “তৈরি না হলেই বা কি, সবাই এই ভোররাতে জড়ো হয়েছে এখানে। বিয়েটা করতেই হবে।”

আমার কৌতুকটা ধরতে পারলেন তিনি। হেসে উঠলেন সশব্দে।

এরপর ইনগ্রিডের বড় বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনগ্রিডের বাবার প্রথম পক্ষের সন্তান সে। ওর চেয়ে প্রায় বারো বছরের বড়। আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে তিনি জানালেন, ইনগ্রিডের কাছে অনেক কিছু শুনেছেন। আমার সম্পর্কে। জবাবে আমিও তাই বললাম, যদিও এর আগে মাত্র একবার তার সম্পর্কে আমার সাথে কথা বলেছে ইনগ্রিড। যদি আমার এক দিন মানে এক ঘন্টা না হতো তাহলে নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে আসলেই অনেক কিছু জানতাম আমি। ইনগ্রিড আমার একঘন্টার একটা সেকেন্ডও অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে দিতে চায় না।

ইসাবেলের মা’র হাতে উল্টোপিঠে একবার চুমু খেয়ে বললাম তাকে বেগুনি ড্রেসটায় ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। এরপর অন্যদের দিকে মনোযোগ দিলাম।

ইসাবেল আর ওর স্বামী।

হিল পরা অবস্থাতেও আমার চেয়ে দুই ইঞ্চি খাটো সে। বাদামি ড্রেসটাতে দারুণ লাগছে ওকে। নিচু হয়ে ওর কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে ধন্যবাদ জানালাম সবকিছুর জন্যে, বিশেষ করে লাসানিয়ার জন্যে। ও বললো চার প্লেট লাসানিয়া নিয়ে এসেছে, তিরিশ জন মানুষের জন্যেও যা বেশি হয়ে যাবে। এরপর পাশে দাঁড়ানো গোফওয়ালা লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

জর্জ।

আমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালো সে। ক্রিসমাসে ওদের পরিবারের জন্যে বিশেষ একটা উপহারের ব্যবস্থা করেছিলাম। ডিজনিল্যান্ডে দু-দিনের ভ্রমণ। দুটো ছোট বাচ্চা আছে ওদের।

“আর্চি কোথায়?” ইসাবেল জিজ্ঞেস করলো।

আমার অদ্ভুত রুটিন আর ইনগ্রিডের কাজের চাপের ফাঁকে আর্চির সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় ইসাবেল।

আশেপাশে তাকিয়ে তিন মাস্তানকে খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। মনে হয় বাবার ঘরে ইনগ্রিডকে সঙ্গ দিচ্ছে ওরা।

হাত নেড়ে আমাকে চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিল ইসাবেল। পরের দলের দিকে এগিয়ে গেলাম।

সারি করে রাখা চেয়ারগুলোর একদম পেছনে বসে আছে একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক। দু-জনের বয়সই সত্তরের ওপর। খুব সহজেই তাদের দম্পতি বলে চালিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু আলাদা আলাদা এসেছেন তারা। ভদ্রলোক হচ্ছেন রবার্ট ইউলি, বাবার বন্ধু, ওনার সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি আমার। চুল একদম সাদা হয়ে গিয়েছে তার। পরনের কালো আলখেল্লাটার কারণে একদম অর্ডেইন মিনিস্টারের মতনই লাগছে ওনাকে। কোলে থাকা বাইবেলটার ওপর একটা ওয়াইনের গ্লাস রেখে দিয়েছেন তিনি। আর ভদ্রমহিলার নাম বনি, বাবার বাসার উল্টোদিকের বাসায় থাকেন। নিজের আকারের চেয়ে দুই সাইজ ছোট একটা ড্রেস তার পরনে। ছোট থাকতে বাবা যখন কোন কাজে শহরের বাইরে যেতেন তখন আমার খেয়াল রাখতেন তিনি। সেই এক ঘন্টায় আমার জন্যে আগে থেকেই কিছু না কিছু পরিকল্পনা করে রাখতেন বনি। বোর্ড গেম আর বেকিং সবচেয়ে বেশি পছন্দ তার। ইমেইলে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয় আমার।

তাদের সাথে আলাপ সেরে ইনগ্রিডের বয়সি তিনজন মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনজনই সোনালিচুলো আর একই ধরণের সবুজ ড্রেস পরে আছে। ইনগ্রিডের ব্রাইডসমেইড ওরা। শার্লট (মেইড অব অনর), রেবেকা আর মেগান। প্রত্যেকেই ওর হাইস্কুলের বন্ধু।

তাদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে এরকম উদ্ভট সময়ে এই অনুষ্ঠানে আসার জন্যে ধন্যবাদ জানালাম।

এরপর আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দু-জন অফিসার। তরুণ অফিসারের নাম বিলি টরেলি, ইনগ্রিডের নতুন পার্টনার। একটা জিন্সের প্যান্ট আর সবুজ পোলা শার্ট তার পরনে। দু’হাতে দুটো বিয়ার ধরা।

গত এক বছরে তার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে আমার। অমায়িক একটা ছেলে, আমার খুব পছন্দের।

“এভাবে ফর্মাল ড্রেসে আসার জন্যে ধন্যবাদ,” বললাম তাকে।

“আরে,” হেসে জবাব দিলো সে, “আমার আলমারিতে এর চেয়ে দ্র আর কিছু ছিলো না।”

“সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কাঁধ দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বললাম।

দু-জনেই হেসে উঠলাম আমরা।

বয়স্ক অফিসারের দিকে তাকালাম আমরা দুজনেই। হালকা নীল রঙের একটা স্যুট তার পরনে।

“আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি আমি,” তার বাড়িয়ে দেয়া হাত মিলিয়ে বললাম।

“আমিও,” তিনি জবাব দিলেন।

“আসার জন্যে ধন্যবাদ।“

“কোনভাবেই এটা বাদ দেয়ার কথা চিন্তা করতে পারি না আমি।”

আমি জানি জেমস মার্শাল আর ইনগ্রিড কতটা ঘনিষ্ঠ। ডিপার্টমেন্টে যোগদানের পর ওর প্রথম পার্টনার ছিলেন তিনি। সে প্রায় বারো বছর আগের কথা।

“দুঃখিত, আপনার স্ত্রী আসতে পারলেন না।”

“হ্যাঁ, লিন্ডারও মন খারাপ না আসতে পেরে। আমার ছোট ছেলেটার কাল সকালে পরীক্ষা। তাই ওকে রেখে আসা সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে, এরপর হাতের আইফোনটা দেখিইয়ে বললেন, “ও আমাকে বিশ মিনিট ধরে শিখিয়েছে কিভাবে এটাতে ভিডিও করতে হয়। কোন গড়বড় করে ফেললে বিপদে পড়তে হবে আমাকে।”

হেসে আর কিছুক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম।

এসময় মূল দরজায় কারো কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে এলে সবার দিকে ঘুরে গেলো।

আর কেউ আসবে বলে জানতাম না। বাবা দরজার দিকে গেলে কৌতূহলি দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম।

যারা ভেতরে ঢুকলেন তাদের দেখে পুরো ঘরে একটা উত্তেজনার আমেজ বয়ে গেল। এরপরেই পিন পতন নীরবতা।

প্রতিদিন তো আর আমেরিকাকার প্রেসিডেন্টকে সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয় না।

.

পেছন থেকে গুঞ্জন ভেসে এলো।

প্রেসিডেন্ট এসেছেন!

সামনাসামনি আরও সুন্দর দেখা যায় তাকে।

কত লম্বা তিনি!

হেনরি আর ইনগ্রিডের সাথে কিভাবে পরিচয় তার?

পাশের লোকটা কে?

আমি তো ভেবেছিলাম তিনি এখন ক্যাম্পেইনের কাজে ফ্লোরিডায়।

কনর সুলিভান আর রেড-প্রেসিডেন্টের সিক্রেট সার্ভিস ডিটেইলের প্রধান-দু-জনের গায়েই হালকা তুষারের আস্তরণ।

ছয় ফিট পাঁচ ইঞ্চির কনর সুলিভান ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লম্বা প্রেসিডেন্ট। রেড তার চেয়ে পাঁচ ইঞ্চি খাটো। কিন্তু তার দেহের গড়ন প্রেসিডেন্টের চেয়ে ভালো। পরনের গাঢ় নীল রঙের স্যুটটা সত্ত্বেও তাকে দেখতে একদম আদর্শ বডিগার্ডের মত লাগছে।

বাবা তাদের বড় কোটগুলো হাতে নিয়ে ভেতরে আসার অনুরোধ করলেন।

বাবার সাথে আগেও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে ওনাদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজ বাসায় প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি অন্যরকম একটা ব্যাপার। মুখে চওড়া হাসি লেগে আছে তার।

আমি নিজেও অবাক হয়ে গেছি।

আমি আর ইনগ্রিড হোয়াইট হাউজের ঠিকানায় একটা বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যেও এটা আমাদের মাথায় আসেনি যে তিনি আসলেই আসবেন। সামনেই আবার নির্বাচন। খুব গুরত্বপূর্ণ সময় তার জন্যে।

কিন্তু এসেছে তিনি।

এরকম একটা দেশ চালাতে হলে রাতের ঘুম হারাম হবেই। প্রায়ই আমাকে ফোন করতেন তিনি। আমাদের মধ্যে সর্বশেষ কথা হয়েছে তিন সপ্তাহ আগে। সুপার বোউলের দু-দিন আগে। প্যান্থারদের পক্ষে ছিলেন। তিনি আর আমি ব্রঙ্কসদের।

এক বোতল টাকিলার বাজি ধরেছিলাম আমরা।

হেরে গিয়েছিলেন তিনি।

দু-দিন পর একটা প্যাকেজ আসে আমার বাসায়।

সবচেয়ে দুর্লভ ধরণের টাকিলার একটা বোতল। স্বয়ং মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ওটা উপহার দিয়েছিলেন তাকে।

তবে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা সবসময়ই যে এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল তা নয়।

আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ দু’বছর আগে। আমার বাসার উল্টোদিকে একটা মহিলাকে খুন করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ঘটনাক্রমে আমিও সেই তদন্তে জড়িয়ে পড়ি আর ইনগ্রিডের সাথে তখনই প্রথম দেখা হয় আমার। শেষ পর্যন্ত আমি প্রমাণ করতে সক্ষম হই, প্রসিডেন্ট আসলেই নির্দোষ। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর আমাকে দেন তিনি।

দ্রুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের মাঝে। রেডকে নিয়ে আমার আর বাবার সাথে বেশ কয়েকবার পোকার খেলতেও এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সিআইএ’র একটা ব্ল্যাক সাইট আমেরিকাতে ভোলা হয়েছে শুনে সেটার অবস্থান বের করার কাজে আমাকে আর ইনগ্রিডকে ব্যবহার করেন তিনি। ফলাফল স্বরূপ ওয়াটার বোর্ডিংয়ের মত অবর্ণনীয় নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাকে। অবশ্য তার প্রায়শ্চিত্ত তিনি করেছিলেন আমার মা’র সম্পর্কে সিআইএ’র অতি গোপন একটা ফাইল দিয়ে। এরপরে আরও বড় ঘটনায় জড়িয়ে যাই আমি। মিথ্যাচার, গোপন এক্সপেরিমেন্ট, খুন-কি ছিল না সেটাতে। শেষ পর্যন্ত জানতে পারি সুলিভানের বাবার সাথে সম্পর্ক ছিল আমার মা’র। এক পর্যায়ে তো এমনটাও মনে হচ্ছিল যে, প্রেসিডেন্ট আমার সৎ ভাই। যাই হোক, প্রায় দু’মাস সময় লাগে আমার সেই ঝামেলা থেকে বের হতে, যার মধ্যে সেই বিশেষ সিদ্ধান্তটাও ছিল।

কিন্তু এখনও সুলিভানের দিকে তাকালে আমার মার কথা মনে হয়। স্যালি বিনস ওরফে এলেনা জানেভ। আমার ছয় বছর বয়স থাকাকালীন আমাকে আর বাবাকে রেখে চলে যান তিনি। তার ব্যাপারটা এখনও রহস্য আমার কাছে। এমন একটা উপন্যাস যার শেষ পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। গত আট মাস আগে এটা জানতে পারি, নিজের ওপরই এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিলেন তিনি, যখন আমি তার পেটে ছিলাম। তার কারণেই এই রাত তিনটায় বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হচ্ছে আমাকে।

তার চেয়েও খারাপ লেগেছিলো এটা জানতে পেরে যে আমার মা একজন খুনি। ষোল বছর বয়সি এক তরুণীকে খুন করেন তিনি।

লম্বা করে দু-বার শ্বাস নেবার পর মার কথা মাথা থেকে সরাতে পারলাম। আমার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছেন তিনি কিন্তু আজকের দিনের একটা সেকেন্ডও কেড়ে নিতে পারবেন না।

তাদের দুজনের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। “দেখো তো কে এসেছে!” অবাক হবার সুরে বললাম।

রেড আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আপনাকে ভালো লাগছে দেখতে।”

রেড আর প্রেসিডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। খুব কম কথা বলেন তিনি। কিন্তু মাঝে মাঝে এক লাইনের এমন সব কৌতুক বলে ওঠেন যে, সবাই হাসতে বাধ্য। তার প্রতি আলাদা একটা টানের কারণ দু’বছর আগে আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন তিনি।

“আমি ভেবেছিলাম আসতে পারবেন না আপনারা।”

হাত দিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন সুলিভান, “ক্যাম্পেইন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে একটু দূরে থাকা প্রয়োজন আমার।”

“বাচ্চাদের কপালে চুমু দিতে দিতে ক্লান্ত?”

“তেল মারতে মারতে ক্লান্ত।”

“জানতাম।” এরপর জিজ্ঞেস করলাম, “বের হতে কোন সমস্যা হয়নি তো?”

রেড আর প্রেসিডেন্ট দু-জনেই হেসে দিলেন। যদিও কোনদিন খুলে কিছু বলেননি তারা তবে এটুকু জানি যে একটা গোপন লিফট আর সুড়ঙ্গপথ ব্যবহৃত হয় এ কাজে।

“ফার্স্ট লেডি জানেন, আপনি এখানে?”

“কিমের ঘুম খুব গাঢ়। তার কিছু জানার আগেই আবার কম্বলের তলায় ঢুকে যাবো আমি।”

সবাই হেসে উঠলাম কথাটা শুনে।

“সবকিছু কেমন চলছে?” ২০১৬ সালের আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।

সুলিভান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “খুব একটা সুবিধের না।”

সেটা জানতাম আমি আগে থেকেই। বেকারত্বের হার আর বেশি ট্যাক্সের কারণে একটু চাপের মুখে আছেন তিনি। কিন্তু মনে মনে আশা করছি তিনিই জিতবেন শেষ পর্যন্ত।

“অন্তত আমার ভোট পাচ্ছেন আপনি,” হেসে বললাম আমি।

“ধন্যবাদ,” আমার ঘাড়ে একটা চাপড় দিয়ে বললেন তিনি। এরপর যোগ করলেন, “আমার পাঠানো টাকিলার বোতলটা পেয়েছিলেন তো? কিছুটা আছে নাকি এখনও? ছোট এক গ্লাস টাকিলা মন্দ হতো না এখন।”

“ওটা ধরিওনি আমি,” এই বলে পেছনের টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলাম। ওখানে বরফের ভেতর রাখা হয়েছে ওটা। “বিশেষ মুহূর্তের জন্যে বাঁচিয়ে রাখছিলাম।”

তিনজন সেদিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। ছোট তিন গ্লাস ভর্তি করে নিলাম।

“আমার লাগবে না,” রেড বললো, “ফেরার পথে খুব খারাপ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে হবে আমাকে।”

“আরে চিন্তা করো না তো তুমি,” সুলিভান তার হাতে গ্লাসটা তুলে দিয়ে বললেন। “রেঞ্জ রোভারটা তো সেজন্যেই নিয়ে এসেছি আমরা।”

গ্লাসটা নিল রেড।

“হেনরি আর ইনগ্রিডের উদ্দেশ্যে,” সুলিভান বললেন।

গ্লাসগুলো একবার উঁচু করে ধরে চুমুক দিলাম আমরা।

দারুণ স্বাদ টাকিলাটার।

কিছুক্ষণ পরে বাবা বলে উঠলেন জোরে, “অনুষ্ঠান শুরু করা যাক তাহলে।”

ইনগ্রিডের তিন বান্ধবি আর ওর বাবা উপরে বাবার ঘরের দিকে চলে গেলেন। বাকি সবাই যে যার চেয়ারে বসে পড়লেন তাড়াতাড়ি। বাবা আমাকে ইশারায় মিনিস্টার রবার্টের পাশে দাঁড়াতে বললে তার আদেশ পালন করলাম আমি। এরপর বনির দিকে ইশারা করা হলে কিবোর্ডটা ধীর লয়ে বাজাতে শুরু করলেন তিনি।

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে সিঁড়ির ওপর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি।

এর আগে কখনো কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে যাইনি আমি। কিন্তু গত মাসে ওয়েডিং ক্রাশার আর টোয়েন্টি সেভেন ড্রেসেস নামে দুটো সিনেমা দেখেছি। তাই জানি কি হতে চলেছে।

অন্তত সেটাই ধারণা ছিল আমার।

প্রথমে রেবেকা আর বিলিকে দেখা গেলো সিঁড়ির ওপরে। ওরা দুজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় সবাই দেখতে লাগলো সেদিকে। নিচে এসে আলাদা হয়ে দু-দিকে চলে আসলো তারা। বিলি এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।

হেসে আমার উদ্দেশ্যে বলল, “আরও একজন বাড়তি গ্রমস ম্যানের দরকার ছিল ওদের।”

“আমাদের দলে স্বাগতম,” হেসে জবাব দিলাম।

এরপরের পালা মেগান আর আমার আরেক গ্রুমস ম্যানের।

মারডক।

ওকেও একটা স্যুট পরানো হয়েছে।

আমি বাবার দিকে তাকালে হেসে বনির দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। কিবোর্ড বাদকের পাশাপাশি দারুণ একজন দর্জি তিনি।

সবাই হেসে উঠলো।

বেশ ভালোভাবেই মেগানের সাথে নিচে নেমে আসলো মারডক।

মেগান রেবেকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর মারডক চলে আসলো বিলির পাশে।

“ভালো দেখাচ্ছে তোকে,” বললাম আমি। খুশিতে জিহ্বা বের হয়ে গেল তার।

এরপর কে আসবে আপনারা ধরতেই পারছেন। শার্লট আর ল্যাসি।

তবে স্যুট পরিহিত অবস্থায় ল্যাসির মেজাজ মারডকের মত সুবিধের মনে হচ্ছে না। বাবাকে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে অদূর ভবিষ্যতে।

ল্যাসি যখন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, নিচু হয়ে ওর বো টাইটা ঠিক করে দিলাম আমি। “কিভাবে নিজের সাথে এমনটা হতে দিলি তুই?”

মিয়াও।

“দশটা চকলেট? আমার মনে হয় আরও বেশি চাওয়া উচিৎ ছিল তোর।”

আমার সাথে একমত পোষণ করলো ও।

এরপরে সবার আদর মিশ্রিত বিস্ময় ধ্বনি শুনে তাকালাম সিঁড়ির দিকে।

গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে আর্চি। পরনে ছোট্ট একটা সাদা কালো স্যুট।

ওর পিঠে একটা বালিশ বাঁধা আছে। যার ভেতর রাখা দুটো আঙটি।

আমাদের আঙটিবাহক ও।

আমার নিজের মুখ দিয়েও অন্যদের মতো আওয়াজ বের হয়ে গেল।

সিঁড়ির একদম নিচের ধাপে এসে বসে পড়লো ও। বড় বড় সবুজ চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। কাঁপছে অল্প অল্প।

বেশি দায়িত্ব হয়ে গিয়েছে বাচ্চা বেড়ালটার জন্যে।

বিশ সেকেন্ড ধরে সবার উৎসাহ দেবার পরেও যখন নড়লো না সে, ইসাবেল গিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। এরপর আবার নিজের সিটে গিয়ে বসলো। প্রয়োজনের সময় আঙটি খুলে দিবে।

অবশেষে সেই সময়।

বড় করে একটা শ্বাস নিলাম।

আমি তৈরি এ মুহূর্তের জন্যে।

কিন্তু তখনই ইনগ্রিডকে চোখে পড়লো আমার। সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবার বাহু ধরে।

একটু টমবয় স্বভাবের আর হোমিসাইড ডিটেক্টিভ হবার কারণে নিজের চেহারার দিকে মনোযোগ দেবার সময় পায় না ও। খুব কমই মেক-আপ দেয়া অবস্থা ওকে দেখেছি আমি। তার প্রয়োজনও নেই অবশ্য। এমনিতেই অনেক সুন্দরি ও, আমার চোখে পুরো পৃথিবীর সেরা। কিন্তু আজকে অল্পরির মতো লাগছে ওকে। বাদামি চুলগুলো খোঁপা করে রাখা হয়েছে, সেখানে দুটো সাদা ফুল গোঁজা। নিচু কাটের ড্রেসে গলা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সাদা রঙের বিয়ের পোশাকে মনে হচ্ছে স্বয়ং দেবি ভেনাস নেমে এসেছেন মতে।

হা হয়ে গেলাম আমি।

আস্তে আস্তে ওর বাবার হাত ধরে নেমে আসছে ইনগ্রিড। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সবাই।

বাবার চোখে পানি টলমল করছে। আমারো একই অবস্থা।

আমার জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। আর আমি চেষ্টা করবো আগামি বিশ সেকেন্ড যাতে চিরদিন মনে থাকে আমার। ওর প্রতিটা পদক্ষেপ আর আমার দিকে লাজুক চাহনি মাথায় গেঁথে নিলাম।

মুখে মিষ্টি একটা হাসি লেগে আছে ওর। একটু লজ্জা পাচ্ছে এরকম জাঁকজমক দেখে।

ওর বাবা কপালে একটা চুমু খেয়ে ওর মার পাশে গিয়ে বসে পড়লো।

“কি খবর?” আমার কাছে এসে মৃদু স্বরে বললো ও। আমাদের প্রতিদিনের আলাপচারিতা শুরু হয় এভাবেই।

আমি হেসে উঠলাম।

“অপূর্ব লাগছে তোমাকে,” বললাম আমি।

“জানি,” ও বললো।

সবাই হেসে উঠলো এটা শুনে।

মিনিস্টার রবার্ট এসময় শব্দ করে গলা পরিস্কার করলেন একবার। একটা শিডিউল মানতে হচ্ছে আমাদেরকে।

শক্ত করে ওর হাতটা মুঠোয় পুরলাম আমি।

আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এটা।

“আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি,” মিনিস্টার রবার্ট শুরু করলেন।

সাত মিনিট পরে আমাকে আর ইনগ্রিডকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হলো।

.

চোখ খুলেই পাশে তাকালাম আমি। উদ্দেশ্য “শুভ সকাল মিসেস বিনস” বলা।

কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না।

বিয়ের পরের দু’দিন তো ছুটি নেবার কথা ছিল ওর। কিন্তু হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কথা আগে থেকে কিছু বলা যায় না।

ফোনের দিকে তাকিয়ে কোন মেসেজ দেখতে পেলাম না।

জানালার কাছে গিয়ে পর্দা ফাঁকা করে তাকালাম। চমকে উঠলাম সাথে সাথে। এত তুষার আগে কখনো দেখিনি আমি।

প্রায় চার ফুট উঁচু তুষারের আস্তরণ। আর ঘরবাড়ির পাশে নিচু জায়গাতে প্রায় ছ’ফুট। এখনও তুষারপাত হচ্ছেই। বাবার বাসার সামনের রাস্তায় উঁচু উঁচু কতগুলো ঢিবি। অতিথিদের গাড়ি।

তারা এখনও আছেন?

এজন্যেই ইনগ্রিড নেই এখানে।

মনে হয় কাউচে ঘুমাচ্ছে সে।

সবারই কি একই অবস্থা নাকি?

বাথরুমে গিয়ে জানালার দিকে তাকালাম। তেইশ ঘন্টার ঘুমের পরেও চোখের নিচটা ফুলে আছে।

রিসেপশন অনুষ্ঠানের জন্যে বরাদ্দ ছিল চল্লিশ মিনিট। সে সময়ের মধ্যেই দু’গ্লাস শ্যাম্পেইন, এক গ্লাস রেড ওয়াইন আর বিলির সাথে এক ক্যান বিয়ার সাবাড় করেছিলাম আমি।

আর নাচ তো ছিলোই।

মাত্র বারো মিনিটের জন্যে হলেও ইনগ্রিড জনপ্রিয় সব বিয়ের গান দিয়ে প্লেলিস্টটা বানিয়েছিল। আমার পিঠের আর পায়ের পেশিগুলো এখনও ব্যথা করছে। আমি জানতামই না ওরকম জায়গায় পেশির উপস্থিতি থাকতে পারে।

বোধহয় নাচতে নাচতে ওরকম চড়কির মত ঘোরার কারণে ব্যথা করছে এখন।

ইনগ্রিড আর আমার একান্ত সময় বলতে অবশ্য কিছু ছিল না।

সেটার সুযোগই পাইনি আমরা।

কোনমতে একদম শেষ মুহূর্তে বিছানায় উঠে পড়ি আমি। তখনও মাইকেল জ্যাকসনের বিলি জিন গানের তালে তালে নাচছিলাম আমি। হাত ধরে আমাকে এখানে নিয়ে আসে ইনগ্রিড।

তাড়াতাড়ি দাঁত ব্রাশ করে নিলাম। আমি চাই না বিয়ের প্রথম দিনেই ইনগ্রিডের কাছ থেকে কথা শুনতে হোক। এরপর একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট পরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।

বাবার ঘরের কাছে গিয়ে থেমে গেলাম।

ঘরটা খালি।

.

কেউ নেই।

কোন কুকুর নেই।

কোন বিড়ালও নেই।

অদ্ভুত।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম।

লিভিংরুমটাকে কাল যেরকম দেখেছিলাম সেরকমই দেখতে পেলাম। চেয়ারগুলো ভাঁজ করে রাখা হয়েছে নাচের জায়গা করার জন্যে। কোণায় আধ খাওয়া কেক পড়ে আছে।

আমার ধারণা ছিল বাবা হয়তো এতক্ষণে সবকিছু পরিস্কার করে ফেলেছেন।

কোথায় গেল সবাই?

নিশ্চয়ই তুষার ঝড়ের কারণে এমনটা হয়েছে।

সবাই হয়তো উল্টোদিকে বনির বাসায় এখন।

আবারো নামতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে, কিন্তু থেমে গেলাম।

“এ কি” বিড়বিড় করে উঠলাম।

দু-জন পড়ে আছে মেঝেতে।

ক্যাপ্টেন জেমস মার্শাল আর রেড।

দু-জনের দেহই রক্তাক্ত। দু-জনেই মৃত।

.

মাথা খারাপের মত হয়ে গেল আমার।

“ইনগ্রিড?”

“বাবা?”

“ল্যাসি?”

“মারডক?”

কেউ নেই।

হচ্ছেটা কি?

দৌড়ে আমার ঘরে ফেরত চলে গেলাম আমরা। ইনগ্রিডের নম্বরে ফোন দিলাম। কিন্তু উত্তর আসলো না। বিলিকে ফোন দিলাম। একই অবস্থা।

সদর দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলাম।

কোমর সমান উঁচু তুষার বাইরে। কারো পায়ের ছাপও দেখতে পেলাম না। ভাবলাম দৌড়ে গিয়ে বনির বাসায় দেখে আসি। কিন্তু সামনের তুষারে এক পা এগোতেই পাঁচ মিনিট লাগবে আমার।

ইনগ্রিডের নম্বরে আবার ফোন করলাম।

এবার ভয়েস মেইলে চলে গেল কল।

“ইনগ্রিড, কি হচ্ছে এসব? তোমাদের ক্যাপ্টেন আর রেডের লাশ পড়ে আছে এখানে। কাউকে পাচ্ছি না। তাড়াতাড়ি আমাকে ফোন দা-”

এরপরেই বুঝলাম কোন লাভই হবে না এতে। দ্রুত কেটে দিলাম ফোন।

পারলে আমাকে অবশ্যই ফোন দিতো ও।

হঠাৎ আমার কানে আসলো শব্দটা।

মৃদু গোঙানি।

লন্ড্রি রুমে দৌড়ে গিয়ে আশেপাশে তাকালাম।

একটা ছোট্ট মাথা উঁকি দিল কাপড়ের জঞ্জালের ফাঁক থেকে।

আর্চি।

এখনও ছোট্ট স্যুটটা পরনে ওর।

কাঁপছে ও।

“কিছু হয়নি…সব ঠিক হয়ে যাবে,” ওকে বললাম আমি ।

তবুও গোঙানি থামলো না ওর। মনে হল, ওকে নিচে নামিয়ে রাখার অনুরোধ করছে।

সেটাই করলাম।

ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজায় আঁচড়ানো শুরু করলো ও।

বেজমেন্টের দরজা।

সেখানে দেখার কথা মাথাতে আসেনি আমার। বাবার সব জঞ্জালের কারণে অন্য কোন কিছুর জায়গা নেই ওখানে।

দরজা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। বাবার বাতিল শখের জিনিসপত্র।

এসময় গুঞ্জনের আওয়াজ কানে আসলো আমার।

বয়লার ঘর।

সেটাই!

বেজমেন্টের একদম শেষ কিনারায় চলে আসলাম। এক টানে খুলে ফেললাম বয়লারের দরজা।

একটা গুমোট গন্ধ ধাক্কা দিল আমার নাকে।

চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।

চল্লিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট জায়গায় ঠেসে ঢোকানো হয়েছে বিয়ের সব অতিথিকে। মারডক আর ল্যাসিও আছে ওখানে। ইনগ্রিডকে খুঁজে পেলাম, এখনও বিয়ের ড্রেসে ইসাবেল আর মিনিস্টার রবার্টের ওপর সে। অন্য সবার মতনই তার হাতও পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। পা-ও বেধে রাখা হয়েছে দড়ি দিয়ে। মুখে ডাক্ট টেপ।

আমার স্ত্রীর কাছে ছুটে গিয়ে দ্রুত ওর মুখ থেকে টেপ খুলে নিলাম।

লম্বা করে একটা শ্বাস নিল ও, একবার কেশে উঠলো, এরপর বললো, “তাকে নিয়ে গেছে ওরা।”

“কাকে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিন্তু উত্তরটা কি হতে যাচ্ছে সাথে সাথে বুঝে গেলাম আমি।

প্রেসিডেন্টকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *