একজন কমলালেবু — শাহাদুজ্জামান
বিকালের রোদে রক্তাপ্লুত ট্রাম
পুরোনো শতাব্দীর ধুলোমাখা একটা সরীসৃপের মতো কলকাতার বালিগঞ্জ ডাউন ট্রাম ঘন ঘন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দিকে। চারদিকে তখন শেষ বিকেলের রোদ। জলখাবার দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে বসে চুনীলাল দেখলেন একজন লোক হেঁটে যাচ্ছেন ওই ট্রামের দিকেই। ট্রাম এগিয়ে আসছে, সেই লোকও এগিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম লাইনের দিকে। ট্রামের ড্রাইভার জোরে জোরে ঘণ্টা বাজালেন, চিৎকার করে ডাকলেন, তবু সে লোক উঠে গেলেন ট্রাম লাইনের ওপর এবং আটকে গেলেন ট্রামের ক্যাচারে। সশব্দে ব্রেক কষল ট্রাম। চুনীলাল দৌড়ে গিয়ে ট্রামের ক্যাচারের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনলেন মানুষটাকে। লোকজনের ভিড় জমে গেল, তারা জানতে চাইল, কী নাম আপনার, কোথায় থাকেন? তারা কেউ জানে না যে এই লোক একদিন লিখেছেন :
কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে-ফুটপাত থেকে ফুটপাতে
কয়েকটি আদিম সর্পিনী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে
আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব
করে হাঁটছি আমি।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে–কেমন যেন ঠান্ডা বাতাস;
কোন দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার
তারা কোথায়?
তারা কি হারিয়ে গেছে?…
রক্তাক্ত সেই লোক বললেন, আমার নাম জীবনানন্দ দাশ, ওই ল্যান্সডাউন রোডে থাকি, ১৮৩ নম্বর বাড়ি। এইটুকু বলে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না, এলিয়ে পড়লেন রাস্তায়। লোকজন তাকে ধরাধরি করে একটা ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে গেল কাছের শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। ডাক্তাররা দেখতে পেলেন তার ডান পাটা দুমড়ে গেছে, বুকের পাঁজরের হাড়ও গেছে ভেঙে। তারা ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে দিলেন তার দুমড়ে যাওয়া পা, বুকের পাঁজর। তাঁকে স্যালাইন দেওয়া হলো, নাকে অক্সিজেন দেওয়া হলো, দেওয়া হলো নানা রকম ইনজেকশন। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের একটা রং ওঠা লোহার খাটে অচেতন শুয়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ, বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় এই মানুষ। জীবনের নানা পাকচক্র জীবনানন্দকে সবুজ ঘাস নদী জোনাকির দেশ বরিশাল থেকে টেনে এনে ফেলেছে কলকাতার বিষাক্ত এই ট্রাম লাইনের ওপর।
সেদিন ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ সাল। আরও আট দিন জীবনানন্দ ওই ওয়ার্ডে তন্দ্রাচ্ছন্ন, অচেতন শুয়ে থাকবেন। তাঁর চিকিৎসা চলবে। হাসপাতালে আসবেন তাঁর গুটিকয় চেনাজানা মানুষ, আত্মীয়জন। মাঝে মাঝে চেতনা ফিরে আসবে তার, দু-একটা কথা বলবেন তিনি। হাসপাতালের করিডরে কবিতায় পাওয়া এক মেডিকেল ছাত্র ভূমেন্দ্র গুহকে ছোটাছুটি করতে দেখা যাবে। বহুকাল পর জীবনানন্দের জীবন নিংড়েই কাটবে ভূমেন্দ্রের জীবন। তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা রাত জেগে জীবনানন্দকে পাহারা দেবেন। ডাক্তারদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন পরামর্শ করবেন তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ এসে বিষয় দাঁড়াবেন তার বিছানার পাশে। সন্ধ্যা নামলে তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। জীবনানন্দের বোন সুচরিতা দাশ অবশ্য একটা বেতের ঝুড়িতে ফল আর ফ্লাস্কে চা নিয়ে হাসপাতালের করিডরের বেঞ্চে জেগে থাকবেন রাতের পর রাত। নার্স শান্তি মুখার্জি তোয়ালে দিয়ে জীবনানন্দের কপালের ঘাম মুছে দেবেন, বিছানার পাশের টেবিলে একটা ফুলদানিতে রাখবেন ফুল।
ইমার্জেন্সি রুমটাতে তখন নানা রকম রোগীর ঠাসাঠাসি ভিড়। কেউ চেঁচাচ্ছে, কেউবা শ্বাসকষ্টে বা ব্যথায় গোঙাচ্ছে। কারও মাথা ফেটেছে বলে রক্তের ছোপ লাগা ব্যান্ডেজ মাথায় নিয়ে অসাড় পড়ে আছে। কার এক প্রস্রাবের বোতল উল্টে গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। এক জেলের আসামি রোগীকে পাহারা দিচ্ছে পাশে বসে থাকা পুলিশ। এক কোনায় একজন রোগী মারা গেছে, তার মৃতদেহ পড়ে আছে তখনো।
কয়েকটা দিন আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকবার পর ওই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের নানা রকম রোগীর গোঙানোর প্রেক্ষাপটে, ওই রং ওঠা লোহার খাটে মৃত্যুবরণ করবেন জীবনানন্দ। ট্রামের মতো এমন একটা স্লো মুভিং লকোমোটিভকে এড়িয়ে যাবার টনক মানুষের থাকার কথা। ট্রামের ক্যাচার তৈরি হয়েছিল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পশু তাড়াবার জন্য। কিন্তু জীবনানন্দ দাশই সম্ভবত ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া প্রথম এবং শেষ মানুষ। ফলে আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রামের চাকার নিচে তাঁর এই মৃত্যু নিয়ে জট থেকে যায়। প্রশ্ন জাগে :
এটা কি একটা দুর্ঘটনা?
নাকি তিনি ট্রামের চাকার নিচে আত্মহত্যা করেছেন?
অথবা এটা কি আসলে একটা হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে রয়েছে আরও অনেকের অদৃশ্য হাত?
.
ট্রাঙ্কের ভেতর তুতেনখামেনের গুপ্তধন
০১.
বরিশালের বগুড়া রোড আর গোরস্থান রোডের কোনার বাড়িটাতে সন্ধ্যা নামে। বাড়ির একদিকে কৃষ্ণচূড়াগাছ, অন্যদিকে কেয়ার ঝোঁপ, পেছনে নারকেল আর সুপারিগাছ-ঘেরা মাছের চোখের মতো ঝকঝকে একটা পুকুর। খানিকটা দূরে কয়েকটা কাঁঠাল, জামরুল আর লিচুগাছ। মাঝখানের উঠানকে ঘিরে তিনটা ঘর। তার একটাতে বিছানায় শুয়ে মিলু অপেক্ষা করে মায়ের জন্য। শুয়ে শুয়ে রান্নাঘরে হাঁড়ি-পাতিলের শব্দ শুনতে পায় সে। টের পায় মা তার শেষ কাজটুকু সারছেন। সন্ধ্যার পরপরই বাড়ির চারদিক নীরব হয়ে ওঠে। দূরে নারকেলবাগানের ভেতর থেকে শোনা যায় বাজকুড়ল পাখির ডাক। মিলুর চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসে, তবু মা না আসা পর্যন্ত প্রাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করে সে। সংসারের শেষ মানুষটার খাওয়া শেষ হলে তারপর ঘরে ফেরেন মা, মিলুর চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, তুই এখনো জেগে বাবা? ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি। বাইরের পৃথিবী তখন অন্ধকার, নিথর। মা ঘরে ফিরলেও মিলুর ভয় যায় না। ভাবে এই বুঝি কোনো পড়শি এসে বলবে, কারও বাড়ির ছেলের মারাত্মক কোনো অসুখ হয়েছে, হয়তো কোনো মহিলার বাচ্চা হবে কিংবা কোনো গরিব ঘরে কেউ মারা গেছে আর সেসব খবর শুনে সেই গভীর রাতেই মা বেরিয়ে যাবেন। হয়তো আর ফিরবেন না সারা রাত। কিন্তু যেদিন সে রকম কোনো ডাক না আসে, সেদিন মিলুর মনে গভীর প্রশান্তি। দেখে মা কুপিটার আলো একটু উসকে দিয়ে দিনের পত্রিকা নিয়ে বসেছেন। কুপির আলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকা মায়ের মুখ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে মিলু। তারপর আবার খুব ভোরে আধো ঘুম, আধো জাগরণের ভেতর বিছানায় শুয়ে সে শুনতে পায় মা গাইছেন প্রার্থনার গান :
মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে
তোমার বিশ্বসভাতে
আজি এ মঙ্গল প্রভাতে।
মায়ের এই গান শুনতে শুনতে একটা অপার্থিব আমেজে শুরু হয় মিলুর দিন। মা সেই মঙ্গলপ্রভাতের গানের মায়া শরীরে জড়িয়েই আবার ঝাঁপ দেন সংসারে। পুরো দিন রান্নাবান্না, কোটাবাছা, খুন্তি, কড়াই, গৃহস্থালি তদারকিতে অদৃশ্য থাকেন তিনি। মিলু আর তাকে কাছে পায় না। সারা দিন নিরালম্ব লাগে তার। মাকে কাছে না পাওয়ার গোপন বেদনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মিলু, শৈশবের জীবনানন্দ দাশ।
মায়ের সঙ্গে গভীর নাজুক এক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক জীবনানন্দের। মরতে বসেছিলেন তিনি শৈশবেই। জন্মের বছরই আক্রান্ত হয়েছিলেন মারাত্মক জুভেনাইল জন্ডিসে। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষে বলেছিলেন শিশু বেঁচে যেতে পারে, যদি তাকে উত্তরে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া যায়। সে সময় সেই তো এক রেওয়াজ, বাঁচবার শেষ চেষ্টায় হাওয়া বদল। উত্তর মানে তো দিল্লি, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ। বরিশাল থেকে দিল্লি যাওয়া দীর্ঘ পথ, প্রচুর টাকাপয়সার ব্যাপার। জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ ব্রজমোহন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। সামান্য বেতন, আর্থিক অনটন সংসারে। তাদের জন্য দিল্লি, আগ্রা যাওয়া রীতিমতো বিলাসিতা। কিন্তু জীবনানন্দের মা বললেন, মিলুকে নিয়ে আমি দিল্লি যাবই। এই প্রতিজ্ঞায় আঁতকে উঠলেন পরিজনেরা। তারা বললেন, এই টানাটানির সংসারে এত টাকা খরচ করে দিল্লি যাওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শিশুমৃত্যু তখন আটপৌরে ব্যাপার। পরিবারে একটা শিশু মারা যাবে, পরের বছর জন্ম হবে আরেকজনের, সেটাই রেওয়াজ তখন। কিন্তু রেওয়াজ মানবার মানুষ তো জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ নন। তিনি কবি, অমৃতের সাধক। তাঁর কবিতা প্রবাদে পরিণত;
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে;
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
মানুষ হইতে হবে–এই তার পণ।
জীবনানন্দ তাঁর প্রথম সন্তান। তাঁর নিজের এই ছেলে একদিন কথায় বড় না। হয়ে কাজে বড় হবে–এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে, সবাইকে উপেক্ষা করে, বাবা চন্দ্রনাথ দাশকে সঙ্গে নিয়ে কুসুমকুমারী উঠে পড়েছিলেন দিল্লিগামী ট্রেনে। জন্ডিসে আক্রান্ত মিলুকে নিয়ে লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, দিল্লি ঘুরে উত্তরের হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি। সেটা ১৮৯৯ সাল। এই ক্রান্তির বছরেই জন্ম জীবনানন্দের, যখন একটা পুরোনো শতাব্দী ঘাট ছাড়ছে আর এগিয়ে আসছে। নতুন এক শতাব্দী, বিংশ শতাব্দী। কোনো লুপ্ত নক্ষত্রের মতো হারিয়ে যেতেন। হয়তো জীবনানন্দ কিন্তু কুসুমকুমারী তাঁকে হাজির রাখলেন বিংশ শতাব্দীর তীব্র তীক্ষ্ণ সব বিস্ময়ের মুখোমুখি করবার জন্য।
.
০২.
বরিশাল থেকে কলকাতায় গিয়ে যখন বেথুন স্কুলে পড়ছেন কুসুমকুমারী, তখন থেকেই কবিতা লেখার শুরু তার। ছাপিয়েছেন নানা পত্রিকায়, বইও প্রকাশ করেছেন। সত্যানন্দ দাশের সঙ্গে বিয়ের পর এসে পড়লেন এক প্রকাণ্ড বিমিশ্র সংসারে। যৌথ পরিবারের দায়িত্ব নিতে হলো তাকে। কিন্তু কবিতার ঘোর ঘুচল তাঁর। সংসারের ঘোলাজলের ভেতর থেকেও লিখে গেলেন সুস্মিত শিশিরের মতো কবিতা। এমন হয়েছে–তিনি রান্না করছেন আর তখন ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সম্পাদক তাঁদের পরিবারেরই লোক মনোমোহন বাবু বললেন, কবিতা লাগবে, প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে। কুসুমকুমারী এক হাতে খাতা-কলম, অন্য হাতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে লিখে দিলেন :
অনিল চলিয়া গেল অনিলের প্রায়;
ক্ষুদ্র হাসি ক্ষুদ্র খেলা ক্ষুদ্র প্রাণ মনোভোলা
ঝরে গেল মুকুলেই না ফুটিতে হায়।
যখন কাজের চাপ কম সন্ধ্যায় কুপি জ্বালিয়ে কুসুমকুমারী বাড়ির উঠানে বসিয়েছেন কবিতাপাঠের আসর। একের পর এক আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের কবিতা। আলো-অন্ধকারে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে জীবনানন্দও। কুসুমকুমারী ছেলেকে নিজের মতো করে পড়াবেন বলে স্কুলে পাঠালেন না শুরুতে। জীবনানন্দের হাতেখড়ি হলো মায়ের কাছে। এরপর বাড়িতেই কুসুমকুমারী তাঁকে পড়ালেন বাল্যশিক্ষা, অঙ্ক। একবারে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করালেন ব্রজমোহন স্কুলে। বাবা সত্যানন্দ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। কিন্তু ছেলেকে বললেন, শুধু স্কুলে পরীক্ষা পাস করলে হবে না বাবা, চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। ভাবতে শিখতে হবে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠলে জীবনানন্দের জন্য ছোট আলাদা একটা পড়ার ঘর বানিয়ে দিলেন কুসুমকুমারী। সেই ঘরে একটা বইয়ের আলমারি, তাতে নানা রকম বই, দেয়ালে টানিয়ে দিলেন মনীষীদের ছবি। বললেন, তোর বন্ধুদের ডাক, ওদের নিয়ে সাহিত্যসভা করব। জীবনানন্দের সেই পড়ার ঘরে বসল সেসব সাহিত্যসভা, কোনো দিন কথা হলো বঙ্কিমচন্দ্র নিয়ে, কোনো দিন কালিদাস। স্কুলের সিলেবাসবন্দী পড়াশোনায় হতাশ ছিলেন কুসুমকুমারী। তাঁর ওই বিখ্যাত আদর্শ ছেলে কবিতার সূত্র ধরে তিনি এরপর লিখেছেন :
একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে
আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে
তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে?
মানুষ গড়িয়া উঠে কোন উপাদানে;
বাঙালি বোঝেনি তাহা এখনও জীবনে
পুঁথি হাতে পাঠ শেখো দুচারটে পাশ
আজিকার দিনে তাহে মিলে না আশ্বাস।
বহুকাল পর মাকে স্মরণ করে জীবনানন্দ লিখেছেন, গত শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকের তুলনামূলকভাবে একটা নির্দোষ পৃথিবীতে যখন জীবনের এত আড়ম্বর ছিল না, অহেতুক বাড়াবাড়ি ছিল না, যখন মানুষের খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না কিন্তু সবার জন্য যতদূর সম্ভব একটা মঙ্গলকামনা ছিল তখনকার তেমন একটা পৃথিবীর মানুষ আমার মা, যার কাছে গেলে একটা শান্ত উন্নত পরিমণ্ডলে যেন ঢোকা গেল এমন মনে হতো।
.
০৩.
ভোরে বিছানায় শুয়ে জীবনানন্দ একদিকে যেমন শুনতেন মায়ের প্রার্থনা গান, অন্য ঘর থেকে ভেসে আসত বাবা সত্যানন্দের উপনিষদের আবৃত্তি :
ন সন্দুশে তিষ্ঠতি রুপমস্য ন চক্ষুষ কশ্চনৈনম
হৃদা হদিস্থং ষ এনমেবং বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।
এই পরমেশ্বরের রূপ চোখে দেখা যাবে না। তাকে জানতে হবে অনুভব আর মনন দিয়ে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম ছিলেন সত্যানন্দ, ছিলেন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। সত্যানন্দের বাবা, জীবনানন্দের ঠাকুরদা সর্বানন্দ দাশ ছিলেন বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা মানুষ। নদীভাঙা মানুষ তিনি। বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে তাঁদের প্রতিপত্তি সব পদ্মার ভাঙনে ডুবে গেলে সর্বানন্দ নানা ঘোরাপথে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন বরিশালে। ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু থেকে হয়েছিলেন ব্রাহ্ম, হয়েছিলেন বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি। বরিশালের বগুড়া রোডের বাড়ি তারই নামে নামাঙ্কিত সর্বানন্দ ভবন। সত্যানন্দ, তাঁর বাবা সর্বানন্দের পথ ধরেই হয়ে উঠেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের গুরুস্থানীয় মানুষ। জীবনাচরণে ছিলেন ধার্মিক। ব্রাহ্ম ধর্ম উপনিষদ, ইসলাম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ মতের নানা মিশেলে তৈরি এক শাখা ধর্ম, হিন্দুধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে। জ্ঞানচর্চা ব্রাহ্মদের ধর্মীয় অনুষঙ্গেরই অংশ। আর্থিক টানাটানি যতই থাকুক, সত্যানন্দের জ্ঞানচর্চায় কমতি ছিল না কোনো। একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন বাড়িতে। সেই লাইব্রেরিতে ডারউইন, হাক্সলি, স্টুয়ার্ট মিলের বই। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে জীবনানন্দ আর তাঁর ছোট ভাই অশোকানন্দ, বোন সুচরিতাকে নিয়ে চলে যেতেন বইয়ের দোকানে, বই কিনে দিতেন তাদের। একবার একটু পয়সা হাতে এলে কিনে দিয়েছিলেন এনসাইক্লোপেডিয়া।
বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখেছেন, লৌকিক সফলতার চূড়ায় পৌঁছাবার একরকম আশ্চর্য ক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি একান্তই নিজের ইচ্ছায় শিক্ষাব্রতই গ্রহণ করলেন–অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে বরিশালের ব্রজমোহন ইনস্টিটিউটে। তার সম্মুখে নানা রকম অর্থকরী পথ উদ্দীপ্ত হয়েছিল। কিন্তু তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে এবং আন্তরিক প্রেরণায় স্থির করলেন যে শিক্ষকই হতে হবে।
আরও লিখেছেন, সকালবেলার রৌদ্রের সাগরের ভিতর যখন একাকী বসে থাকতেন তখন মনে হতো মহাকবির মতন তিনি নিজেকে প্রশ্ন করছেন, তুমি কি করতে এসেছ অসীম দেশ ও অসীম কালের এক প্রান্তে? এর উত্তরে মন বলে আর কিছু নয়, জীবনে এই কথাটি প্রকাশ করতে এসেছি যে দেখা হয়েছে। এই উত্তরটি সমস্ত কর্মের মধ্যে নিহিত, সমস্ত চর্চার মধ্যে আচ্ছন্ন। ক্ষণে ক্ষণে শুভ মুহূর্তে উদ্ভাসিত চৈতন্যের দীপ্তিতে এই উত্তরটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সকল দেখার অন্তরে সত্যকে দেখতে পেলাম। কোনো কিছু সংবাদ নিতে নয়, তত্ত্ব নির্ণয় করতে নয়, শুধু এই অনুভব নিয়ে স্থির হয়ে থাকতে যে দর্শন করা হলো।
.
০৪.
বৈভব নেই কিন্তু একটা প্রাণ আছে সর্বানন্দ ভবনের ভেতরের পরিবেশে। কত রকম লোকের আনাগোনা সেখানে। সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষের। বরিশালের বেশির ভাগ মানুষ তো মুসলমান আর ঐতিহাসিক কারণে তাদের অধিকাংশই তখন নিম্নবর্গের। ছেলেবেলায় তেমন সব মানুষের সাথে দিনরাত্রি ওঠাবসা মিলুর, কিশোর জীবনানন্দের।
মিলুর অসমবয়সী বন্ধু আলী মামুদ। ঋজু শরীর, লম্বা দাড়ি বার্নার্ড শয়ের মতো চেহারা। স্ত্রী-সংসার নেই তাঁর, কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। কখনো তিনি গাছি। গাছ থেকে নারকেল পেড়ে দেওয়া, সুপারি পেড়ে দেওয়া তাঁর কাজ। দড়ির ফাঁদ পায়ে বেঁধে মামুদ উঠে যান উঁচু উঁচু গাছে। সুপারিবাগানের এক গাছের মাথা থেকে অন্য গাছের মাথায় লাফ দেন অবলীলায়। শীতকালে আলী মামুদ বিক্রি করেন কমলালেবু, গরমকালে আম। বর্ষায় তার কাজ লোকের ঘর মেরামত করে দেওয়া। সর্বানন্দ ভবনের উঠানে বসে আলী মামুদ যখন কাঁচা সুপারি থেকে পাকা সুপারি বাছেন, তখন পাশে গিয়ে বসে মিলু। মামুদ তাকে গল্প শোনান গ্রামের লোকেরা কী করে এক বাঘডাশ ধরেছে। কোনো কোনো দিন মামুদের সঙ্গে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় জীবনানন্দ। দুটা নারকেল বেঁধে একটা টিউবের মতো ভাসিয়ে আলী মামুদ বাড়ির পুকুরে সাঁতার শিখিয়েছেন মিলুকে।
মিলুর বন্ধু রাজমিস্ত্রি মনিরুদ্দিনও। মনিরুদ্দিন একাধারে মসজিদ আর মন্দির দুটাই বানান। মনিরুদ্দিনের সাথে ঘর বানানো দেখতে যায় মিলু, দেখে কী করে একটা শূন্যস্থান একটু একটু করে ভরে ওঠে নতুন স্থাপত্যে। শোনে জোগালিদের আদিম ছন্দে, দুর্বোধ্য লিরিকে গাওয়া ছাদ পেটানোর গান। যখন রাজমিস্ত্রির কাজ থাকে না, মনিরুদ্দিন বন্দুক হাতে চলে যান কাশীপুরের জঙ্গলে শিকার করতে। ফিরে এলে মিলু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনে সেসব শিকারের গল্প।
সর্বানন্দ ভবনে আসতেন ফকির, বাগানে কাজ করতেন তিনি। নানা রকম গাছগাছালি মিলুকে চিনিয়েছেন তিনি। চিনিয়েছেন কোনটা দূর্বা, কোনটা মধুকুপী ঘাস। একদিন সত্যানন্দ ফকিরকে ডেকে বললেন, বর্ষায় বাড়ির পেছনের ঘাসগুলো বড় হয়ে গেছে ফকির, সাপটাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। তুমি ওগুলো কেটে ফেলো। মিলু ওই ঘাস কাটার দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলে। ফকির তখন তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, কিছু ভাববে না খোকাবাবু, এই তো আর কয়েক দিন, দেখবে আবার কেমন সুন্দর নরম কচি কচি ঘাস গজিয়ে যাবে। মিলু বড় হয়ে প্রেমিকার হৃদয়কে বলবে ঘাস। লিখবে, সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস। বড় হয়ে একবার নিজে ঘাসও হতে চাইবে সে :
…আমারও ইচ্ছ করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে চোখ ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।
সন্ধ্যায় মিলুর সঙ্গী মোতির মা, কুসুমকুমারীর গৃহস্থালি কাজের সহযোগী। তিনি মিলুকে শোনান ডাইনি আর শখমালার গল্প। মিলুর এক পূর্বপুরুষকে যে পরিরা উড়িয়ে নিয়ে যেত তাদের দেশে, তারপর তাকে পাওয়া যেত শিশিরভেজা ধানখেতের পাশে এবং তার বিছানায় ছড়িয়ে থাকত কাঁচা লবঙ্গ, এলাচি, দারুচিনি সেসব গল্প জীবনানন্দ শুনেছেন মোতির মায়ের কাছ থেকেই।
.
০৫.
কাব্য, প্রজ্ঞা, রূপকথা, ঘাস, ফুল, পাখি মিলিয়ে মূর্ত-বিমূর্ত পৃথিবীর এক মায়াবী শৈশব, কৈশোর জীবনানন্দের। যেন পৃথিবী বড় এক আনন্দের জায়গা, যেন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে সত্য আর সুন্দর। জীবনানন্দের ছেলেবেলায় জন্ম নেওয়া ওই মায়ার ভেতরেই কি বোনা আছে তাঁর জীবনের বিপদের বীজ? পৃথিবী যখন একটু একটু করে দরজা খুলেছে তার সামনে তখন বাস্তবতার কাটা মাছ। কি চারদিক থেকে বিদ্ধ করেছে তার মায়ার বেলুনকে?
সেই যে উত্তরের হাওয়ায় তার জীবন ফিরিয়ে এনেছিলেন মা, তারপর থেকে এক হাঁস ছানার মতো মায়ের পিছু পিছু থেকেছেন জীবনানন্দ সর্বক্ষণ। শৈশবে শোনা মায়ের এই যে কবিতার লাইন আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে, একে যেন জীবনানন্দ দাশ একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। কথায় বড় হওয়া তো দূরের কথা, সহজ লোকের মতো কথাই তিনি বলতে পারতেন না, বলতেন না। সারা জীবন ছিলেন ভেতর গোটানো, মুখচোরা মানুষ।
আর কাজ? মাকে দেখেছেন সবচেয়ে একাগ্রতার সাথে, সবচেয়ে ধ্যানমগ্নতায় যে কাজটা করতে, সেটা হচ্ছে লেখা। অলক্ষ্যে বুঝি তাই কাজ বলতে তিনি বুঝেছিলেন লেখাকেই। জীবনের অন্তিম সময়টায় ওই ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির একটা কামরায় একাই থাকতেন জীবনানন্দ। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকত অন্য ঘরে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ওই ঘর থেকে উদ্ধার হলো কেরোসিন কাঠের একটা টেবিল আর একটা চেয়ার, টেবিলের ওপর কয়েকটা এক্সারসাইজ খাতা, লাল, নীল কয়েকটি পেনসিল, সুলেখা কালির দোয়াত, একটা ঝরনা কলম। ঘরের কোনায় একটা পিড়ির ওপর থাক থাক করে রাখা খবরের কাগজ, নানা রকম সাহিত্য পত্রিকা, একটা তক্তপোশ, তার ওপর একটা পাতলা তোশক, চাদর, বালিশ। ওয়ারবিহীন একটা লেপ, হাতপাখা। ঘরের কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখা গোটানো একটা মাদুর। আর তক্তপোশের নিচে গোটা কয়েক কালো টিনের ট্রাঙ্ক। বিশ্বসংসারে এই ছিল জীবনানন্দের বিষয়-সম্পত্তি। এসব ফেলেই দেওয়া হতো কিন্তু হঠাৎ তুতেনখামেনের পিরামিডের গুপ্তধনের মতো ওই সব ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার হলো জীবনানন্দের লেখা অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাসের রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি।
বোন সুচরিতা আর সেই কবিতাপ্রেমিক মেডিকেল ছাত্র ভূমেন্দ্র তারপর দায়িত্ব নিলেন ওই ট্রাঙ্কগুলোর। ট্রাঙ্কগুলো বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কখনো স্টোররুমে, কখনো লফটে পড়ে থাকল। একবার ট্রামে করে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নেবার সময় হারিয়ে গেল সেসব পাণ্ডুলিপি। তারপর বহু কষ্টে তা উদ্ধার হলো ট্রাম ডিপো থেকে। নানা ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে অবশেষে সেসব পাণ্ডুলিপির জায়গা হলো কলকাতার আর্কাইভে। লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জীবনানন্দের এই অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ৬০ বছর কেবল পাতাগুলো হলুদ হয়েছে এবং ন্যাপথলিন ছাড়া কোনো কার্যকর কীটনাশক না থাকা সত্ত্বেও পোকারা তা কাটতে সাহস পায়নি।
বহুকাল পর সেসব পাণ্ডুলিপির মর্মোদ্ধারের মূল দায়িত্ব বর্তাল ভূমেন্দ্র গুহের ওপর। তার সঙ্গে কখনো যোগ দিলেন জীবনানন্দের বোন সুচরিতা, কখনো ভাই অশোকানন্দ, পরবর্তীকালে দেবেশ রায়, শঙখ ঘোষ, আফসার আহমেদ প্রমুখও। কিন্তু ভূমেন্দ্র গুহ, পরবর্তী জীবনে স্বনামধন্য চিকিৎসক, তাঁর জীবনের শেষ সময়টায় মূলত জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির ওপর ম্যাগনিফাইং গ্লাস লাগিয়েই বসে থাকলেন। আমাদের সামনে তুলে আনলেন গোপন নতুন এক জীবনানন্দকে। যদিও এখনো উদ্ধারপর্ব চলছে, তবু জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখা যোগ করলে দেখা যাচ্ছে তিনি লিখেছেন প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, গোটা বিশেক উপন্যাস, শতাধিক গল্প, পঞ্চাশটির ওপর প্রবন্ধ আর প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠার ডায়েরি, যাকে তিনি বলেছেন লিটেরারি নোটস। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর আদিম লিপির মতো সাংকেতিক ভাষায় মূলত ইংরাজিতে লেখা সেসব নোটস। লিটেরারি নোটস বললেও ওই সব ডায়েরির বিষয় পরবর্তীকালে সাহিত্য ছাড়িয়ে আরও বিবিধ বিচিত্র ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে ভরে উঠেছে। ডায়েরি কখনো হয়েছে তার বন্ধু, কখনো তার ঢাল, কখনো বা তার আত্মস্বীকারোক্তির জায়গা।
এই হচ্ছে জীবনানন্দের কাজ। লেখা তাঁর কাছে ছিল মানুষ হবার সমান্তরাল। নিজের যাবতীয় শ্রম, মেধা ঢেলে প্রকাশ্যে, গোপনে ধারাবাহিকভাবে ওই একটা কাজই করে গেছেন জীবনানন্দ। এগুলো বাতাসে গেরো দেবার কাজ। বাজিকরের মতো সে কাজের খানিকটা মাত্র দেখিয়েছেন লোকদের কিন্তু বড় অংশ লুকিয়ে রেখেছেন। লোকে না দেখুক, না জানুক, না বুঝুক, তবু লেখার কাজটা করে গেছেন অবিরাম। জগৎ-সংসারে বাকি যে কাজই করবার চেষ্টা করেছেন, তাতে নাকাল হয়েছেন বারবার।
.
বাছা কি উড়িতে পারিবি?
০১.
এক মায়ের উৎসাহে কৈশোরে স্কুলের খাতায় ছেলেমানুষি ছড়া লিখলেও কবিতার আসল সিন্দবাদ জীবনানন্দের ঘাড়ে চেপেছে আরও পরে, ধীরে ধীরে। কুসুমকুমারীই হাঁস মায়ের মতো ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসিয়ে জীবনানন্দকে চিনিয়ে দিয়েছেন কবিতার হাঙরভরা সমুদ্রের পথ।
জীবনানন্দের প্রথম কবিতা যখন ছাপা হলো, তখন তার বয়স বিশ বছর। বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে, ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেছেন তিনি সে বছর। তিনি তখন শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। সেই কবিতা তিনি লিখেছেন, ছাপিয়েছেন মায়েরই আদেশে। ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিবছরের নববর্ষের সংখ্যার বিশেষ কবিতাটা লিখতেন কুসুমকুমারী দাশ। সে বছর কুসুমকুমারী জীবনানন্দকে বললেন, মিলু, এ বছর ব্রহ্মবাদীর নববর্ষের কবিতাটা তুই লিখবি।
কবির সন্তান কবি হবে এমন কোনো গণিত নেই। রবীন্দ্রনাথের সন্তানেরা কেউ কবি নন। তিনি তাঁর সন্তানদের উৎসাহিতও করেননি। ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছেন কৃষিবিদ্যা। কিন্তু কুসুমকুমারী চেয়েছেন খুব বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই ছেলে তার অক্ষরের পর অক্ষর সাজানোর এই নিগূঢ় খেলায় নেমে পড়ুক। বস্তুত মায়ের নির্দেশেই জীবনানন্দ লিখলেন তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক কবিতা বর্ষআবাহন;
ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে
দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠল জেগে
দিব্য পরশ পেয়ে,
নাই গগনে মেঘের মায়া।
যেন স্বচ্ছ স্বৰ্গকায়া!
ভুবন ভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ হৃদয় চেয়ে।
১৯১৯ সালের ব্রহ্মবাদী পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যার প্রথম পাতায় ছাপা হলো সে কবিতা, কবিতার শেষে লেখা হলো শ্রীজীবনানন্দ দাশ বিএ। সাদামাটা, নিরীহ এক কবিতা। তবু জীবনানন্দের প্রথম ছাপা কবিতা হিসেবে এর গায়ে লেগে আছে ভিন্ন এক আভা।
কিন্তু মায়ের আদেশে ওই একটা কবিতা লিখে রহস্যজনকভাবে নীরব হয়ে গেলেন জীবনানন্দ। এক এক করে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল ব্রহ্মবাদীর ওই কবিতার পর আর একটা কবিতাও লিখলেন না তিনি। একদিন বাংলা কবিতার বাঁক বদলে ফেলবেন জীবনানন্দ কিন্তু বছরের পর বছর যায় কবিতা লিখবার কোনো তাড়া নেই তার। তাগাদা দিলেন কুসুমকুমারী। বিএ পাস করে তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি পড়ছেন। বরিশাল থেকে কলকাতায় চিঠি পাঠিয়ে লিখলেন, কী ব্যাপার মিলু, কবিতা লেখা একদম ছেড়ে দিলি? বিষয় খুঁজে পাচ্ছিস না? এক কাজ কর, আমাদের ব্রাহ্মসমাজের গুরুস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে কবিতা লেখ। কুসুমকুমারী কিছু মনীষীর নামের তালিকা পাঠালেন জীবনানন্দকে। আগেরবার মায়ের নির্দেশে কবিতা লিখে দিলেও এবার আর সাড়া দিলেন না জীবনানন্দ। নীরব রইলেন।
ইতিমধ্যে এমএ পাস করলেন জীবনানন্দ। পরীক্ষার সময় অসুস্থ হয়ে পড়াতে ফল ভালো হলো না তার। সেকেন্ড ক্লাস পেলেন। এ ফল তাকে ভোগাবে ভবিষ্যতে। ফার্ষ্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের মারপ্যাঁচে চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়বেন। তবে ওই মুহূর্তে বিশেষ সমস্যা হলো না। কলকাতায় ব্রাহ্ম এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজে জুনিয়র টিউটর পদে চাকরি একটা জুটে গেল তাঁর। বেশ মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন জীবনানন্দ। থাকতে লাগলেন সিটি কলেজের কাছে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে। মফস্বল বরিশালের ছেলে, কলকাতা মহানগরের ভিড়ে নেহাতই আগন্তুক একজন। কলকাতায় তার তেমন কোনো বন্ধু জোটেনি। নিয়মিত কলেজে যান, টিউটরিয়াল নেন, বোর্ডিংয়ে ফিরে পত্রিকা পড়েন, বই পড়েন, বেতন পেয়ে বাড়িতে মানি অর্ডারে টাকা পাঠান, এই তাঁর জীবন তখন। সে জীবনে কবিতা নেই। বছর পাঁচেক আগে ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত অকিঞ্চিৎকর সেই কবিতা ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো সম্বল নেই তাঁর।
.
০২.
কবিতাবিহীন এই সময়টায় জীবনানন্দ কী ভাবছেন, সে খোঁজ পাওয়া যায় তাঁর ডায়েরিগুলোতে দেখা যাচ্ছে জীবনানন্দ কিছু লিখছেন না তখন ঠিক, কিন্তু খুব আটঘাট বেঁধে লিখবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিংড়ে পড়ছেন বিশ্বসাহিত্য, খোঁজখবর রাখছেন বিশ্বরাজনীতির, চোখ রাখছেন বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের দিকেও। সেসব ব্যাপারে নোট রাখছেন। সেই নোটবইয়ের নাম যে দিয়েছেন লিটেরারি নোটস, তাতেই বোঝা যায়, সাহিত্য যে করবেন সেটা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন। কিন্তু একটু বুঝেশুনে নামতে চান লেখালেখিতে। মা কবিতা লেখার তাগাদা দিচ্ছেন কিন্তু ভাবছেন মায়ের আদেশ বা অনুরোধে, নেহাত সাহিত্য করার উত্তেজনায়, পত্রিকায় নাম প্রকাশের আত্মপ্রেমে কবিতা তিনি লিখবেন না। নিজেকে তৈরি করে নেবেন আগে। কবিতা নিয়ে তাঁর নিজের ভাবনা দানা বাঁধছে তখন। ডায়েরি থেকে টের পাওয়া যাচ্ছে তার মনের ভেতর তখন নানা রকম অসন্তোষ। তার আশপাশের জীবন, মানুষের রুচিবোধ, সাহিত্যবোধ নিয়ে তার মনে ক্ষোভ।
১৯২৫ সালের ডায়েরির এক পাতায় জীবনানন্দ একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন। তখন জুলাই মাস, সিটি কলেজের গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা থেকে বরিশাল ফিরছেন তিনি। স্টিমার তার বড় বড় চাকায় পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তিনি খোলা ডেকে বসে আছেন। জীবনানন্দের সঙ্গে আছেন অমূল্য নামে বরিশালের এক পরিচিত মানুষ। অমূল্য গান করেন এবং নিজেকে সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন। অমূল্য স্টিমারের ডেকে বসে জীবনানন্দকে অতুলপ্রসাদের বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখি পাতে গানটা শোনালেন এবং তারপর জীবনানন্দকে বোঝালেন অতুলপ্রসাদ কেন অত্যন্ত উঁচু দরের এক মহান কবি। জীবনানন্দ চুপচাপ তাঁর কথা শুনলেন। কিন্তু মনে মনে অমূল্যের ওপর খুব বিরক্ত হলেন। অতুলপ্রসাদ হিন্দুস্থানি গানের সঙ্গে বাংলা গানের মিশ্রণ ঘটিয়ে এ অঞ্চলের গানের একটা বৈচিত্র্য এনেছেন এবং তাঁর গানের একটা আবেদন আছে সেটা তিনি মানছেন কিন্তু তাই বলে তাকে মহান কবি ভাবার কোনো কারণ দেখেন না জীবনানন্দ। জীবনানন্দ ডায়েরিতে লিখছেন, ইংরাজিতেই লিখেছেন তিনি মূলত, On the whole, Atulprashds songs appeal. But to say that he is a great poet or even a good poet proceeds from the inherent ignorance of the unpeotical.
এরপর জীবনানন্দ তার ডায়েরিতে মহৎ কবিতার গুণ, তাৎপর্য, তার অতলস্পর্শী শক্তি নিয়ে নানা কথা লিখেছেন। সেই সূত্র ধরে তিনি বলছেন সমাজের চারদিকেই মাঝারি মানের কোনো ব্যাপারকে মহৎ ভাবার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এ নিয়ে মন-মেজাজ খারাপ করে তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, We have no taste for enjoyment. …Not have we any instinct for aesthetics. We are content with fourth hand men and materials. We have no complains if the chair is bug ridden and creaking if we can just manage to sit on it somehow. … We grind our daily rounds of topics on nothing but matter, material prospertity is the vision of our brains, matter and materialism … our nation is no better than a dead pool … We have lost the Iconoclasts spirit…
0 এই যে একটা প্রবণতা যে চেয়ারে কোনোরকম বসতে পারলেই হলো, তাতে ছারপোকা থাকুক আর তা কাঁচ কাঁচ করুক, তাতে কিছু যায়-আসে না, এই প্রবণতার ব্যাপারেই জীবনানন্দের রাগ। যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, মাঝারি মানের কোনো কিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার রুচি তার ঘুচে গেছে অনেক আগেই। তাঁর ক্ষোভ ম্যাডিওক্রাসি নিয়ে কবিতা লিখলে লিখবেন সর্বোচ্চ মানকে মাথায় রেখে, না হয় লিখবেন না, এমনই ভাবছেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি এ-ও লক্ষ করছেন যে চারদিকে লোকের আলাপ ওই একটাই ধন, সম্পত্তি, বস্তু। দেশ তখন ব্রিটিশদের অধীনে। দেশকে তখন একটা মরা পুকুরের মতো মনে হচ্ছে তার। একটা অতলান্ত অতৃপ্তির নিম্নচাপ তখন জীবনান্দের মনের ভেতর। চারদিকে মেঘ জমছে, আকাশ কালো হয়ে আসছে। সৃষ্টির জলোচ্ছ্বাসের জন্য এই নিম্নচাপ তো জরুরি।
.
০৩.
ডায়েরিতে যে বছর এসব কথা লিখেছেন, সেই ১৯২৫-এ দীর্ঘ ছয় বছরের বিরতির পর হঠাৎ জীবনানন্দ একটা নতুন কবিতা নিয়ে হাজির হলেন। তাঁর দ্বিতীয় কবিতা। এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কবিতা। এ বছর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ, যিনি দেশবন্ধু হিসেবে পরিচিত, মারা যান। তাঁকে স্মরণ করে জীবনানন্দ লিখলেন কবিতা দেশবন্ধু প্রয়াণে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা তখন চিত্তরঞ্জন দাশ। মুন্সিগঞ্জে বাড়ি তাঁর, বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করা কলকাতা হাইকোর্টের এই নামজাদা উকিল, স্বদেশি নেতা অরবিন্দ ঘোষকে বিখ্যাত আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে খালাস করিয়ে এনে সবার নজর কেড়েছেন। চিত্তরঞ্জন এরপর ওকালতি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেছেন রাজনীতি, স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজের জমানো সম্পদ দিয়ে তৈরি করেছেন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল। জোরেশোরে বলেছেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলেছেন হিন্দু-মুসলমানের যৌথ বাংলা রাষ্ট্র তৈরি করার কথা। আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি তখন চষে বেড়াচ্ছেন বাংলার নানা অঞ্চল। বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে চিত্তরঞ্জন গিয়েছিলেন দার্জিলিং এবং সেখানেই আকস্মিকভাবে মারা যান তিনি। তাঁর অকালমৃত্যু আলোড়িত করে বাংলার মানুষকে। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন : এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন কবিতা রাজভিখারী।–এই মৃত্যু জীবনানন্দকেও খুব তাড়িত করে। ডায়েরিতে দেশের যে মরা পুকুরের দশার কথা লিখেছেন, সেই স্থবির দেশকে চিত্তরঞ্জনই সুষুপ্তির ঘোর থেকে জাগিয়ে তুলবেন, এমনই মনে হয়েছিল তাঁর। জীবনানন্দ চিত্তরঞ্জনের ভেতরই দেখেছিলেন তার সেই কাঙ্ক্ষিত আইকোনোক্লাষ্টিক স্পিরিট। কবিতাটা মায়ের পছন্দের পত্রিকা ব্রহ্মবাদীর বদলে তিনি পাঠালেন রাজনৈতিকভাবে আলোচিত পত্রিকা বঙ্গবাণীতে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পথের দাবী ছাপিয়েছিল এই পত্রিকা, যা পরে বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশরা। কবিতাটা ছাপা হলো চিত্তরঞ্জনকে নিবেদিত বঙ্গবাণীর বিশেষ সংখ্যায় :
বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছে নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত সন্তান ওগো,–বিপ্লবিনী পদ্ম ছিলো তব নদী-মাতা
কালবৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইত রক্তপুঞ্জ তব
উত্তাল ঊর্মির তালে,–বক্ষে তব লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব
উদ্যত ফণার নৃত্যে আস্ফালিত ধূর্জটির কণ্ঠ-নাগ জিনি,…
ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর,
ভেঙেছিলে ধুলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃংখলের ডোর,…
প্রচুর তৎসম শব্দে ভারী এক কবিতা। প্রচলিত ধারাতেই লেখা। তবে লক্ষ রাখবার ব্যাপার যে পরবর্তী জীবনে জীবনানন্দের কপালে নির্জন কবির তকমা জুটলেও কবিতা পৃথিবীতে পাঁচ বছরের নীরবতার পর তাঁর নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল ঘোর রাজনীতির প্রশ্নেই। ছাপা হবার পর বঙ্গবাণী পত্রিকার একটা কপি জীবনানন্দ কলকাতা থেকে ডাকে পাঠিয়ে দিলেন বরিশালে তাঁর কবিতার গুরু মায়ের উদ্দেশে।
.
০৪.
জীবনানন্দের এই কবিতা পছন্দ করলেন না কুসুমকুমারী। পত্রিকা পেয়ে ফিরতি চিঠিতে কুসুমকুমারী লিখলেন, চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ ভালোই করেছ। কিন্তু রামমোহনের উপর লিখতে বলেছি তোমাকে, মহর্ষির উপরও।
কুসুমকুমারী জীবনানন্দের কাছ থেকে আশা করছিলেন তার পছন্দের মনীষীদের ভক্তি জানিয়ে লেখা শান্ত, স্তিমিত কবিতা। কুসুমকুমারী তার ছেলের কবিতার পথরেখাকে নির্দিষ্ট করে দিতে চাচ্ছিলেন। ছুটিতে কলকাতা থেকে সেবার বরিশাল গেলে এই নিয়ে কুসুমকুমারীর সঙ্গে একটা বিতর্ক বেধে যায় জীবনানন্দের। চিত্তরঞ্জনের চেয়ে রামমোহন বা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কেন অনেক মহৎ মানুষ এবং কেন তাদের সম্মান জানিয়ে কবিতা লেখা উচিত, সে কথা নতুন করে জীবনানন্দকে বলেন কুসুমকুমারী। সেই কিশোর বয়সে রাতে বিছানায় শুয়ে বাজকুড়ল পাখির ডাক শুনতে শুনতে যেভাবে মাকে কাছে চাইতেন জীবনানন্দ, তখনো তা-ই চান। কিন্তু মাকে তিনি বুঝিয়ে উঠতে পারেন না যে তার পৃথিবী আর মায়ের পৃথিবীর ভেতর ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে যোজন ফারাক। তার পক্ষে মায়ের ভোরের শিশিরের মতো নির্মল কবিতা লিখবার আর উপায় নেই। মায়ের সঙ্গে তর্ক করলেন জীবনানন্দ, বললেন, কে মহৎ আর কে মহৎ না সে বিচারের ভার আমার উপরই ছেড়ে দাও। না মা আমি ঐসব মনীষীদের নিয়ে কবিতা লিখব না।
বহু বছর পর মায়ের সঙ্গে তর্কের সেই দিনটা স্মরণ করে জীবনানন্দ লিখেছেন, তখন আমার মন বড় বড় আদর্শ পুরুষকে তাদের উঁচু পীঠস্থান থেকে নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাইত। তাদের সত্যিকারের মূল্যনিরূপণের নামে বিনাশী বুদ্ধিবলে তাদের আঘাত করে।
এমন সরব তর্কপ্রবণ মিলুকে দেখে কুসুমকুমারী অবাক হলেন। তাঁকে শুধু বললেন, ওরকম করে হয় না–আগে তাদের মহত্ত্বে বিশ্বাস কর–মনের নেতিধর্ম নষ্ট করে ফেল, শুধু মহামানুষ কেন, যে কোন মানুষ কতখানি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পাত্র অনুভব করতে শেখ।
শৈশবে বরিশালে মায়ের কাজের সঙ্গী মোতির মা জীবনানন্দকে রূপকথার সেই পাখির গল্প শুনিয়েছিলেন–
পাখী মা দেখলো, ছানারা একটু বড় হইছে। তারা ডানা ঝাপটায়।
মা কইলে–বাছারা তরা কি এখন উড়তে পারবি?
ছানারা কয়–হ পারুম।
মা কইলে–তাইলে যা, উইড়া যা। তয় সাবধানে থাকিস।
জীবনানন্দের তখন মায়ের পাখার নিচ থেকে বেরিয়ে উড়াল দেবার সময়। উড়াল তিনি দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু মায়ের ওই কথাগুলো মনে রেখেছেন। পরিণত বয়সে এসে লিখেছেন, অনেক অনুতর্ক বিতর্কের পর টের পেয়েছি মার কথাগুলো সত্যই ছিল, ওভাবে হয় না।
কিন্তু এই ধারণাও তার ইতিমধ্যে হয়েছে যে মা যে পথে চলতে চাইছেন মন পবনের মাঝি হয়ে, সে পথে হয়তো এগোনো যায় কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর পথে বিদ্বেষ, হিংসা আর সংঘর্ষের কাঁটা বিছানো। কেবল মহৎ মানুষের বন্দনায় তাতে বিশেষ কাজ হয় না। কৈশোরে জীবনানন্দ যে মায়াবী পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তা বদলে গেছে তত দিনে। জীবনের জঙ্গমতার সঙ্গে পরিচয় ঘটছে তাঁর।
.
নোঙর তুললেই নতুন দ্বীপের দেখা মেলে না
০১.
মায়ের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের পর জীবনানন্দের মনের ভেতর একটু তোলপাড় ঘটল। একটা অপরাধবোধও যেন জাগল তার। এ সময় একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ঠিক করলেন কবিতার বদলে গদ্য লিখবেন এবার। সে বছরই ব্রাহ্মসমাজের শ্রদ্ধাভাজন দুজন মানুষের মৃত্যুতে পরপর দুটা স্মৃতিচারণামূলক গদ্য লিখলেন জীবনানন্দ। লেখা দুটা ছাপালেন মায়েরই প্রিয় ব্রহ্মবাদী পত্রিকায়, যেন মায়ের সঙ্গে খানিকটা সমঝোতা করবার চেষ্টা করছেন তিনি।
একটা লেখা তিনি লিখলেন ব্রাহ্মসমাজে বড়কর্তা নামে পরিচিত কালিমোহন দাশের মৃত্যুতে, অন্যটা ব্রাহ্মসমাজের আরেক শ্রদ্ধাভাজন মানুষ বাণীপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক রসরঞ্জন সেনের মৃত্যুতে। দুজনই তাঁর পারিবারিক মানুষ, ফলে তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। লিখেছেন দুজন পরিচিত মানুষ নিয়ে কিন্তু লেখা দুটা পড়লে বোঝা যায়, এ সময় তিনি জীবন, মৃত্যু ইত্যাদি বিষয়ে বড় বড় প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনকে মিলিয়ে সেসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করছেন। কালিমোহন দাশকে নিয়ে লিখতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখলেন, দীর্ঘ পথের যাত্রা শুরু করিয়া মুসাফিরকে মাঝে মাঝে পান্থশালায় আশ্রয় লইতে হয়। যাত্রাপথটিও যেমন তার সমস্ত নয়, পান্থশালার ভিতরও তেমনি তাহার সকল অস্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হয় না। পথিক গতিশীল। কোথায় কোন দিকচক্রবালের পারে তাহার যাত্রার শেষ তাহা সে দেখিতে পায় না, মনে মনে খানিকটা সমঝাইয়া লইতে পারে শুধু। কত কত পথের বাঁক, নদীর কিনারা, হরিৎ ক্ষেত, উষর মরু তাহাকে পার হইতে হয়। কত কত সরাইখানায় তাহাকে বিশ্রাম খুঁজিতে হয়। শেষে হয়তো সে তার সুদূর নিরিখের সন্ধান পায়। পৃথিবীর প্রতি পথিকেরই এমনি করিয়া অনিবার যাত্রার সূচনা হইতেছে, অসংখ্য পথ, পরিধি অতিক্রম করিতে হইতেছে, পথিক আত্মার বেলাও তাই সে স্থিতিশীল নহে।… যে নদী মরু বালুতে বিরস হইয়া গিয়াছে সে যে ফল্পরূপে ধরণীর নিমজ্জমান স্তরকে সরস করিয়া রাখিয়াছে, যে পাপড়িগুলি ঝরিয়া পড়িয়াছে সেগুলির যে শেষ নিকাশ হইয়া যায় নাই, নব মঞ্জুরণের জন্য যে তারা তৈরী হইয়া রহিয়াছে তাহা আমরা ভুলিয়া যাই। যে অতিথি আজ আমাদের ভিতর হইতে চলিয়া গেলেন তিনি চিররাত্রির ভিতর আপনাকে নিভাইয়া, জড়াইয়া রাখেন নাই। একটা অটুট অপর্যাপ্ত প্রাণের স্পন্দনে তিনি আলোকলোকে অপরূপভাবে আপনাকে আবার ফুটাইয়া তুলিতেছেন। মরনের ভিতর কোনো বিহ্বলতা বা ভয়াল ভ্রুকুটির ব্যথা থাকিতে পারে না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাছে মৃত্যু তাই সলিল সঞ্চরমাণ আত্মার একটি নবতর লীলা-নবীন সঞ্চয়। সৃষ্টির ভিতর কোনো সুপ্তি মাত্রা নাই–আছে শুধু অন্তহীন বিকাশ।…।
জীবন যে একটা অভিযাত্রা, মানুষ যে বস্তুত একজন পথিক, মৃত্যু যে সেই প্রবহমান যাত্রারই একটা অংশ–এসব ভাবছেন জীবনানন্দ তখন। বলছেন প্রাণের মৃত্যু নেই, সে বরং নানা নতুন রূপে এই বিশ্বসংসারে আবির্ভূত হয়। জীবনানন্দ যে পরবর্তীকালে কবিতায় মানুষের বদলে শঙ্খচিল, শালিখ, বুনো হাঁস হয়ে জন্ম নিতে চাইবেন, তার বীজ যেন রোপণ হয়ে যাচ্ছে তখনই। প্রথম গদ্যটা সাধু ভাষায় লিখলেও পরের গদ্যটা লিখলেন চলতি ভাষায়। রসরঞ্জন সেনকে নিয়ে লেখা সেই রচনায় লিখলেন, সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চগ্রামে যারা বাস করেন, তাদের নিকটে মানুষের জীবনের ও ব্রহ্মাণ্ডের অবারিত সীমা ও সময় স্রোত একটা সমস্যার মত দেখা দেয়। মানুষের সভ্যতার প্রথম দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই সমস্যা সমাধান করবার নানারকম প্রয়াস চলছে। আধুনিককালের এক দ্রষ্টা আইনস্টাইন তাঁর Theory of Relativity আবিষ্কার করে সনাতন সমস্যার কোনো এক দিকের কিছু নিরসন করেছেন বটে, কিন্তু তার চরিতার্থতা আংশিক, খুবই মূল্য আছে বটে তার কিন্তু দৃষ্টি সমগ্রকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে পেরেছে বলে মনে হয় না; কোন মানুষই তা পারে না। প্রতিটি নতুন যুগ এবং যুগের বিশিষ্ট ব্যক্তিই নতুন করে নিজেকে, নিজের সমাজ ও পৃথিবীকে এবং সম্ভব হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অধ্যয়ন করে যান–যদি সম্ভব হয় কিছু নতুন আলো দিয়ে যান, কিংবা দিয়ে যেতে চেষ্টা করেন।… অধিকাংশ লোকের বেলায় দেখা যায়, পৃথিবীতে তারা জন্মগ্রহণ করে ও পরে একদিন তাদের মৃত্যু হয়, জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে এমন বিশেষ কিছুই তারা নিষ্পন্ন করে না, যার জন্য সমাজ বা ইতিহাসের অভিযান কোনো ভবিষ্যতের মঙ্গলের দিকে সামান্যভাবেও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে জীবনকে তারা যেমনভাবে পেয়েছে, তেমনিভাবে গ্রহণ করে জীবন মৃত্যুতে লয়প্রাপ্ত হয়…অনেকদিন থেকে একটা বিস্ময় অনুভব করে এসেছি এই ভেবে যে নিঃসর্গের একটা অবাধ্য প্রণালি আছে এই–অনেক অযোগ্য লোক তার নির্দেশে ইতিহাস খ্যাতি পেয়ে যায় অথচ ঢের কৃতী ব্যক্তিদের খবর সে ইতিহাসকে রাখতে দেয় না। আজ সেই উপরোক্ত আত্মার জীবন সম্পর্কেও এই কথা না ভেবে থাকতে পারা যায় না, নানা দিক দিয়েই তিনি ইতিহাসে খ্যাতি পাবার মতন উপযুক্ত মানুষ ছিলেন…।
রসরঞ্জনকে নিয়ে লিখতে গিয়ে জীবনানন্দ জীবনকে নতুন করে আবিষ্কারের কথা বলছেন, বলছেন যারা সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চগ্রামে বাস করেন, তাঁদের কাছে জীবনের সীমা এবং সময় স্রোত কেমন একটা সমস্যার মতো দেখা দেয়। এসব তাঁর নিজের জীবনের দিকে তাকিয়েই ভাবছেন যেন। নিঃসন্দেহে তাঁর মন ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চগ্রামে পৌঁছে গেছে। সময় স্রোতকে বুঝতে গিয়ে তিনি এমনকি যাচ্ছেন পদার্থবিদ্যার কাছেও, প্রশ্ন তুলছেন আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে। সেই সঙ্গে লিখছেন যে অনেক অযোগ্য লোক ইতিহাসে খ্যাতি পেয়ে যায় অথচ ঢের কৃতী ব্যক্তিদের খবর ইতিহাস রাখে না। জীবনানন্দ কি নিজের জীবনের আগাম পথরেখাটাই দেখতে পাচ্ছেন জীবনের শুরুতেই?
.
০২.
কলকাতায় তখন একটা নিঃসঙ্গ জীবনই কাটাচ্ছেন জীবনানন্দ। কলেজে ক্লাস নেওয়ার পরে কলকাতার কোলাহলে ফুটপাত থেকে ফুটপাত ধরে একা একা হেঁটে বেড়ান। চুপচাপ থাকেন, লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলবার দক্ষতা তার নেই। কলেজে মাস্টারি করছেন কিন্তু মনের ভেতর লিখবার ইচ্ছাটা প্রবল হচ্ছে। কিন্তু গদ্য না কবিতা, ঠিক কী লিখবেন, কী নিয়ে লিখবেন তখনো যেন ঠিক স্পষ্ট না তাঁর কাছে। ইতিমধ্যে দুটা কবিতা লিখেছেন আর দুটা গদ্য। সাহিত্যের এই যা সম্বল তার। এ সময় একদিন কলকাতার পথে পথে ঘুরে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে ফিরে রাতের বেলা একটা কবিতা লিখলেন জীবনানন্দ। তার আগের দুটা কবিতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আগে লিখেছেন বর্ষবরণ নিয়ে, রাজনৈতিক নেতা বা ধর্মীয় নেতার মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু এবার লিখলেন একান্ত ব্যক্তিগত একটা অনুভব নিয়ে। এর আগে তিনি তাকিয়েছেন বাইরের পৃথিবীর দিকে, এবার তাকালেন নিজের ভেতরের পৃথিবীর দিকে। কলকাতার রাস্তায় নিঃসঙ্গ ভ্রমণ শেষে এই নগরকে নিয়েই স্বগতোক্তি করলেন এই কবিতায়। কাটাকুটি করে চূড়ান্ত করবার পর নাম দিলেন নীলিমা :
রৌদ্র ঝিলমিল;
উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারেবারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!
উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,
আরক্ত কঙ্করগুলি মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
মরীচিকা-ঢাকা।
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল,
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙ্গেছে মায়াবী।
জনতার কোলাহলে একা বসে ভাবি।
কোন দূর যাদুপুর রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নিলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা
জ্বলে ওঠে আকাশে গৌরী দীপশিখা।
উসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষের এই কারাগার,
এই ধুলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার।
ডুবে যায় নীলিমায়–স্বপ্নয়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জ, শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
কলকাতা নগরকে তাঁর তখন মনে হচ্ছে একটা কারাগারের মতো। শহরজুড়ে গাঢ় ধোঁয়া। তখন কলকাতা শহরের সব বাড়িতে কয়লার চুলা, ধোয়া তাই এই শহরের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। শহরের কংক্রিটগুলো মরুভূমির বালুর মতো তপ্ত, পথে পথে যে মানুষেরা ছুটছে, তাদের যে কোথায় গন্তব্য, তার যেন নিশানা নেই, এরা যেন মুমূর্ষ। মৃতপ্রায় ধোঁয়ায় ধোয়াকার নগর নামের এই কারাগারে এক একাকী মানুষ তাকিয়ে আছে আকাশের নীলিমায়, সেখানে ভেসে বেড়ানো মেঘপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে সে হারিয়ে যাচ্ছে দূর কল্পলোকে, কবিতায় এ কথাই জানালেন তিনি।
ভাষায়, মেজাজে এই কবিতাটা তার আগের দুটা কবিতা থেকে অনেকটাই আলাদা। কবিতাটা এবার তিনি ব্রহ্মবাদী বা বঙ্গবাণী-জাতীয় পুরোনো ধাচের কোনো পত্রিকায় না পাঠিয়ে পাঠালেন কল্লোলনামের নতুন এক পত্রিকায়। সম্প্রতি পত্রিকাটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। দেখেছেন এ পত্রিকার নামের ভেতর যেমন একটা নতুনত্ব, এখানে প্রকাশিত কবিতার বিষয়, ধরনও নতুন। বাংলা কবিতার গুরু তখন রবীন্দ্রনাথ, নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বকবি খেতাব পেয়েছেন। জীবনানন্দ লক্ষ করেছেন, কল্লোল পত্রিকার লেখকেরা রবীন্দ্ৰবলয়ের বাইরে নতুন ধারার কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র–এমনি আরও নতুন সব কবি সে পত্রিকায় লিখছেন।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কল্লোল পত্রিকাতেই কাজ করতেন তখন। ডাকে। জীবনানন্দের কবিতাটা তার হাতে গিয়ে পড়ল। কবিতাটা পড়ে চমকে উঠলেন অচিন্ত্য। মনে হলো তার চেনা কলকাতা যেন নতুন করে ধরা দিয়েছে এই কবিতায়। এক নিশ্বাসে কবিতাটা পড়ে ফেললেন তিনি। খামের ওপর ঠিকানা দেখে অচিন্ত্য ছুটে গেলেন জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা করতে। অচিন্ত্যকুমার পরে স্মৃতিচারণায় লিখেছেন : হঠাৎ কল্লোলে একটা কবিতা এসে পড়ল–”নীলিমা”। ঠিক এক টুকরো নীল আকাশের সারল্যের মত। মন অপরিমিত খুশি হয়ে উঠলো। লেখক অচেনা কিন্তু ঠিকানাটা কাছেই, বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিট। বলা-কওয়া নেই, সটান একদিন গিয়ে দরজায় হানা দিলাম।
অচিন্ত্য বললেন, জীবনানন্দ বাবু, আপনার নামটা শুধু মনে মনে সম্ভাষণ করে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। একেবারে সশরীরে তাই আবির্ভূত হলাম।
কলকাতার সাহিত্য মহলে কারও সঙ্গে জীবনানন্দের কোনো পরিচয় নেই তখন। কবি হিসেবে তার তেমন কোনো পরিচিতিও নেই। অচিন্ত্য বয়সে জীবনানন্দের ছোট, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিন্তু সাহিত্য মহলে ইতিমধ্যেই বেশ আলোচিত লেখক। তাঁর কবিতা জীবনানন্দ পড়েছেন। অচিন্ত্য এভাবে তার বাড়িতে চলে এসেছেন দেখে জীবনানন্দ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। ভীরু হাসি হেসে জীবনানন্দ তাঁর হাত ধরলেন। বললেন, আসুন আসুন, ভেতরে বসুন। অচিন্ত্যকে জানালেন কল্লোল তিনি নিয়মিত পড়েন। প্রেসিডেন্সি মেসে বসে সেদিন অনেকক্ষণ কথা বললেন দুজন। যাবার আগে অচিন্ত্য বললেন, চলে আসবেন কল্লোল অফিসে, আড্ডা হবে। জীবনানন্দের কবিতাটা কল্লোল-এ পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হলো সে বছর। সেটা ১৯২৬ সাল। তাঁর নাম অবশ্য ভুল ছাপা হলো। লেখা হলো শ্রী জীবনান্দ দাশ। নাম থেকে একটা ন বাদ পড়ল। এই ভুলটা পরবর্তীকালে ইচ্ছাকৃতভাবেও অনেকে করবেন।
কল্লোল-এ এই কবিতাটা প্রকাশিত হওয়াটাকে জীবনানন্দের জীবনের একটা মোড় ফেরানো ঘটনা বলা যেতে পারে। কবিতা না গদ্য লিখবেন, কী নিয়ে লিখবেন, এসব নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল তার। কিন্তু কল্লোল-এর মতো একটা আলোচিত পত্রিকায় কবিতাটা প্রকাশিত হওয়ায়, অচিন্ত্যের এমন অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় জীবনানন্দের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। দেখা গেল, এরপর একটার পর একটা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন তিনি। তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে কবিতা লিখবেন, অক্ষর দিয়ে তৈরি করবেন একটা দ্বিতীয় জীবন। কবিতার সিন্দবাদ তখন তার ঘাড়ে ভালোমতো জেঁকে বসেছে। জীবনানন্দের প্রথম কবিতা থেকে দ্বিতীয় কবিতার দূরত্ব পাঁচ বছর হলেও নীলিমা প্রকাশের পর তাঁর কবিতা লেখার একটা জোয়ার এল যেন। একের পর এক কবিতা লিখতে লাগলেন। সব দ্বিধা কাটিয়ে সাহিত্যের হাঙরভরা সমুদ্রে সত্যি নেমে পড়লেন তিনি। সেখানে তখন জলোচ্ছাস। এই সব কবিতার মেজাজ কুসুমকুমারীর ঠিক চেনা নয় কিন্তু ছেলে অক্ষরের নেশায় পড়েছে তা দেখেই আনন্দিত তিনি।
নতুন এক একটা কবিতা লিখে দিনেশ দাশ সম্পাদিত কল্লোল ছাড়াও জীবনানন্দ পাঠাতে লাগলেন শৈলজানন্দ সম্পাদিত কালি কলম এবং ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত প্রগতিনামে নতুন ধারার আরও দুই আলোচিত পত্রিকায়। সেসব পত্রিকায় ক্রমাগত ছাপা হতে লাগল তাঁর কবিতা। কবিতায় যে অদৃশ্য ছায়ারা নাচে ঘুমে জাগরণে, সে নাচ তিনি দেখতে শুরু করেছেন তখন। শুরু হয়ে গেছে তাঁর সাহিত্যের অজানা যাত্রা। তার জানা নেই এই যাত্রার বাঁকে বাঁকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে কোন রোমহর্ষ।
.
০৩.
এসব পত্রিকায় যে নতুন কবিরা কবিতা লিখছেন তাঁরা তখন চাইছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার দ্বীপ থেকে নোঙর তুলে নতুন দ্বীপে চলে যেতে। রবীন্দ্রকাব্যের আধ্যাত্মিক আবহ থেকে কবিতাকে মাটিতে নামিয়ে আনতে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যা উপেক্ষিত সেই বিষাদ, ক্লান্তি, সংগ্রাম, ক্ষুধা, যৌনতাকে কবিতায় তুলে আনতে। পরোক্ষে, প্রত্যক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বিরোধিতা করেই এই নতুন কবিদের কাব্যযাত্রার শুরু।
জীবনানন্দ এসব নতুন পত্রিকায় কবিতা ছাপালেও ঠিক পুরোপুরি এদের দলে ভিড়লেন না। অচিন্ত্যকুমার ছাড়া আর কারও সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয়ও তখন হয়নি। কবিতা তিনি ডাকেই পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন পত্রিকায়। নতুন কবিদের সোচ্চার রবীন্দ্র-বিরোধিতায়ও তিনি শামিল হলেন না তখন। কবিতার নতুন দ্বীপ তৈরি করতে হবে, সেটা তিনি মানেন কিন্তু এ-ও টের পান যে রবীন্দ্রনাথের দ্বীপের সীমানা অনেক বিস্তৃত, তাকে অতিক্রম করা খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথের শক্তি এবং সীমাবদ্ধতাকে ভালোভাবে বুঝে নিতে চান তিনি। নতুন যুগের কবিরা একসময় কল্লোলের কবি বলে পরিচিতি পাবেন, সেই কবিদের মিছিলে পেছনের সারিতে যোগ দিলেন জীবনানন্দ। অবশ্য যোগ দিয়েও থাকলেন অনেকটা যূথভ্রষ্ট। তখন কারও জানবার কথা নয় যে একদিন রবীন্দ্র-উত্তর এসব কবিকে ছাড়িয়ে মিছিলের সবার আগে দেখা যাবে তারই মুখ। তিনি তৈরি করবেন একেবারে স্বতন্ত্র নতুন এক দ্বীপ, যে দ্বীপে পাঠক পা রেখেই বুঝবে এলাম নতুন দেশে। সেই কবিরা সবাই মিলে যে নতুন ভাষাটা খুঁজছিলেন, জীবনানন্দই পেয়ে যাবেন সেই ভাষার চাবি। তবে সেই দ্বীপ জেগে উঠতে তখনো অনেক দেরি। পলি মাটি পড়ছে কেবল। জীবনানন্দ ধীরে উচ্চবাচ্যহীনভাবে শুরু করলেন কবিতার বাঁক ফেরানোর যাত্রা। যাত্রা শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু জানিয়েই। তাঁকে বিনম্র প্রণতি জানিয়ে জীবনানন্দ তাঁর নিজের পথ ধরলেন। জীবনানন্দ একসময় এসে লিখলেন, সকল দেশের সাহিত্যেই দেখা যায় একজন শ্রেষ্ঠতম কবির কাব্যে তার যুগ এমন মানবীয় পূর্ণতায় প্রতিফলিত হয় যে, সেই যুগের, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পথে যে সব কবি নিজেদের ব্যক্ত করতে চান, ভাবে বা ভাষায়, কবিতার ইঙ্গিতে বা নিহিত অর্থে, সেই মহাকবিকে এড়িয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে। দাঁড়ায়। অবশ্য এড়িয়ে যাওয়াটাই আসল কথা নয়; অর্থহীন অসন্তোষে বা দুর্বল বিদ্রোহের অভিমানে আমি আমার পূর্ববর্তী কবিকে এড়িয়ে গেলাম অকাব্যের জঞ্জালের ভিতর–সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম আন্দোলনের কোন স্থান নেই। .. রবীন্দ্রকাব্যে রয়েছে একটি বিস্তৃত যুগের প্রাণপরিসর এবং অনেক এমন কিছু যা সময়াতীত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই সময়োত্তর কবিতাগুলোকে এবং সম্পূর্ণ বিভিন্ন কারণে তার গতিশুদ্ধ প্রখর মনের প্রবন্ধগুলোকে যদি বাদ দিই তাহলে দেখতে পাই যে প্রকৃত কাব্যালোকে সমাজ ও ইতিহাস সচেতন একটা নির্ধারিত সীমায় এসে তারপর মন্থর হয়ে গেছে…
রবীন্দ্রনাথের অপার প্রতিভাময় কবিতার ভেতরও একপর্যায়ে সমাজ ও ইতিহাস-চেতনা একটা নির্ধারিত সীমায় এসে মন্থর হয়ে গেছে, সেটা লক্ষ করলেন জীবনানন্দ। নিজের কবিতায় সেই ফাঁক ভরাট করবেন তিনি ঠিক করলেন। নজর দেবেন ওই দিকেই, সমাজ আর ইতিহাস চেতনায়।
.
পথ খোঁজা একাকী নেকড়ের মতো
০১.
এক সে সময় নতুন যে কবিতাগুলো লিখতে শুরু করলেন জীবনানন্দ, সেগুলো রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে হলেও দেখা গেল তাতে কখনো খোলামেলা, কখনো চোরাগোপ্তা রয়ে যাচ্ছে তখনকার নতুন ধারার নামজাদা অন্য কবিদের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের বাইরে নতুন ধারার কবিদের ভেতর সবচেয়ে জোরালো কণ্ঠস্বর তখন কাজী নজরুল ইসলামের। জীবনানন্দ এবং নজরুল দুজন একই বছরে, শতাব্দীর সেই ক্রান্তিকাল, ১৮৯৯ সালে জন্মেছেন। জীবনানন্দ যখন বেড়ে উঠছেন এই পূর্ব বাংলায়, সেই একই সময় পশ্চিম বাংলায় বেড়ে উঠছেন কাজী নজরুল। একই সঙ্গে বেড়ে উঠলেও বিশ শতকের বিস্ময় আর বিপদের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের দুজনের প্রতিক্রিয়া হলো বিপরীত। নজরুল হয়ে উঠলেন উদ্দাম, বিদ্রোহী, উচ্চকণ্ঠ আর জীবনানন্দ হয়ে গেলেন নির্জন, নিভৃত, নিম্নকণ্ঠ। নজরুল যখন দ্রোহের কবিতা লিখে, প্রেমের গান গেয়ে, মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে দেশ কাঁপাচ্ছেন, জীবনানন্দ তখন একাকী, স্নায়ুতাড়িত হয়ে শুধুই অক্ষরের পর অক্ষর সাজাচ্ছেন। একই বয়সী হলেও নজরুল তখন বড় মাপের তারকা কবি আর গুটিকয় মানুষ ছাড়া জীবনানন্দ দাশকে তখন চেনেনই না তেমন কেউ। আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করে কবিতায় এক নতুন আমেজ নিয়ে এসেছেন তখন নজরুল। কবিতা লিখতে এসে নজরুলের ওই প্রতাপ জীবনানন্দকেও দখল করল প্রথম দিকে। তার সে সময়ের কোনো কোনো কবিতাকে নজরুলের কবিতা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারে অনায়াসে। যেমন :
একাকী রয়েছি বসি,
নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
পাইনি যে তাহা টের!
দূর দিগন্তে চলে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
কোন সুদূরের তুরানী প্রিয়ার তরে
বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
দীর্ঘ দিবস বয়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের রোজা,
আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয়নি যে হায় দেখা,
পরানে কখনো জাগেনি রোজার ঠেকা
ঈদ, রোজা, মুসাফের ইত্যাদি শব্দের আলোড়নে নজরুলেরই দুর্বল প্রতিধ্বনি করছেন তিনি তখন। নজরুল জীবনানন্দকে তাঁর প্রথম জীবনে দখল করে রাখলেও কবিতা লেখায় কিছুদূর এগিয়েই অবশ্য তাঁর পথ হয়ে গেছে সম্পূর্ণ অচেনা, পৌঁছেছে একেবারে নতুন এক মহাদেশে, নজরুলের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। জীবনানন্দ তত দিনে নজরুলের শক্তি আর সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছেন। নজরুলকে নিয়ে তাঁর মোহভঙ্গের কথা জীবনানন্দ লিখেছেন পরবর্তীকালে। নজরুল তখন বাকশক্তিহীন। লোকে বলে পাগল হয়ে গেছেন নজরুল। পিকস ডিজিস হয়েছিল নজরুলের, যার সঙ্গে আছে নিউরোসিফিলিসের সম্পর্ক। জীবনানন্দ লিখেছেন, নজরুল ইসলাম অনেকদিন থেকে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। এর দৈহিক ওজর আমাদের জানা আছে, আত্মিক, ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে…মনের উৎসাহে তিনি লিখতে প্রলুব্ধও হয়েছিলেন, নিভে যাবার আগে বাংলার সময়পর্যায়ে তখন বিশেষভাবে আলোড়িত হয়ে উঠেছিলো বলে। এরকম পরিবেশে হয়তো শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না কিম্বা জন্মায়। কিন্তু মনন প্রতিভা ও অনুশীলন সুস্থিরতার প্রয়োজন। নজরুলের তা ছিলো না। তাই তার কবিতা চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়…কাজীর কবিতা বিশেষ একটা মাত্রার দেশে তার অতীতের ভিতর পরিসমাপ্ত। এ কবিতা পড়ে–আবৃত্তি করে সময় কেটে গেলে আধুনিক হৃদয় মনের অতলে স্পর্শিতার ক্ষোভ তৃপ্ত হতে চায় না, মন বিষয়ান্তর খোঁজে দিকনির্ণয়ী মহৎ কবিদের…বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসপ্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তার জনপ্রেম, দেশপ্রেম, পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকার দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ চিনে নেবে। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল। এ জিনিসের বিশেষ তাৎপর্যের দিকে লক্ষ রেখে বলতে পারা যায় যে, যে সময়ে ও যেখানে জনমানসে তার প্রার্থিত জিনিস পেয়েছে বলে মনে করে সেখানে বাস্তবিকই তা অদ্বিতীয়।
জীবনানন্দ জীবনের অধিকাংশ সময় বরিশালে, এই পূর্ব বাংলায় কাটিয়ে মৃত্যুর আগে গেলেন পশ্চিম বাংলায়, অন্যদিকে কাজী নজরুল প্রায় সারা জীবন পশ্চিম বাংলায় কাটালেও শেষ বয়সে তাঁকে আনা হলো এই বাংলায়, এখানেই মৃত্যু হলো তার। নজরুল হলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। এসব পাশব্দল রাজনীতির বিবেচনা। তাতে অবশ্য দুজনের ওপর অধিকার কোনো বাংলারই বাড়ে বা কমে কি? নজরুল, জীবনানন্দ সমবয়সী, একই সঙ্গে কবিতা লিখে চলেছেন তারা, দুজনের ভেতর দেখা হয়েছিল কি কখনো? কথা হয়েছিল? জীবনানন্দ কালি কলম পত্রিকা অফিসে দূর থেকে একবার দেখেছেন নজরুলকে কিন্তু কথা বলেননি। নজরুলের কাব্যের প্রভাব মেনে নিলেও নজরুলের মতো অমন বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের মানুষের কাছে ঘেঁষতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি অন্তর্মুখী জীবনানন্দ। তিনি দূর থেকেই দেখেছেন নজরুলকে। কিন্তু নজরুল কি খেয়াল করেছেন জীবনানন্দকে? তিনি কি তাঁর কবিতা পড়েছেন? কবি আবুল হোসেন একবার নজরুলকে কথায় কথায় বলেছিলেন, জীবনানন্দ দাশ তো বলেন উপমাই কবিতা। আপনার কী মত? নজরুল হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, তোমাদের এখন আর মা’তে হচ্ছে না, উপ’মা দরকার?
জীবনানন্দকে নজরুল খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
.
০২.
নজরুল ছাড়াও জীবনানন্দকে সেই সব দিনে দখল করে রেখেছিলেন আরও এক নামজাদা কবি, ছন্দের জাদুকর বলে খ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। জীবনানন্দের এসব কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথের ছায়াও স্পষ্ট :
দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ!
গান কে গাহে–গান না।
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে
অস্তচাঁদের আলো তলে।
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে–গান না।
তবে যেমন নজরুলের সীমাবদ্ধতা, তেমনি সত্যেন্দ্রনাথের দুর্বলতাও জীবনানন্দ টের পেয়ে গেছেন অচিরে। একপর্যায়ে এসে সত্যেন্দ্রনাথের ওপরও লিখেছেন প্রবন্ধ, সত্যেন্দ্রনাথ তার কবিতায় আঙ্গিকের অনুশীলনের জন্যই বিখ্যাত। তিনি (মহৎ কবির নয়, সুকবির) শব্দ ও ছন্দকে ভালোবেসে গেছেন। তার কবিতায় মননধর্মের অভাব অত্যন্ত শোকাবহকভাবে আমাদের আঘাত করে।
কবিতায় মননধর্ম, এই খুঁজছেন তখন জীবনানন্দ।
.
০৩.
তাঁর সে সময়ের কবিতায় জীবনানন্দের নিজের কণ্ঠস্বরটা ঠিক ফুটে ওঠেনি। চেনাজানা কবিদের ছায়ায় কবিতা লিখছেন তখন। তারপরও কল্লোল-এর সেসব কবিতায় মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে অদ্ভুত স্বতন্ত্র সব ইমেজ, আবহ :
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার-রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল
চুল তার শাওনের মেঘ–আর আঁখি গোধূলীর মত গোলাপী রঙ্গীন
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুম পথে-স্বপ্নে-কতদিন!
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে
তখন শকুন বধূ যেতেছিলো শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে!
কবিতার এ এক নতুন মেজাজ, কেমন রহস্যময়, ঘুম ঘুম জগৎ আর বিচিত্র রূপকল্প। একদিকে ডালিম ফুলের মতো গালের কথা বলছেন আবার সঙ্গে সঙ্গে বলছেন শ্মশানের দিকে উড়ে যাচ্ছে শকুন, শকুনও ঠিক নয় শকুনের বঁধু। শকুনের স্ত্রীর কথা বাংলা কবিতায় এর আগে কেউ বলেনি। এই কবিতারই পরের অংশে দেখা যাচ্ছে ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার, তার পরিণতি খুব করুণ :
অশ্রুর অঙ্গারে তার নিটোল ননীর গাল-নরম লালিমা
জ্বলে গেছে-নগ্ন হাত-নাই শাঁখা-হারায়েছে রুলি
এলোমেলো কালো চুলে খসে গেছে খোঁপা তার–বেণী গেছে খুলি!
সাপিনীর মতো বাঁকা আঙ্গুলে ফুটেছে তার কঙ্কালের রূপ
ভেঙ্গেছে নাকের ডাঁশা-হিম স্তন-হিম রোমকূপ।…
একটু আগেই যার গাল ছিল ডালিম ফুলের মতো লাল, সে কবিতার শেষে একেবারে ভুতুড়ে কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ, জন্ম আর মৃত্যুর ভেতর পায়চারি করছেন তিনি। বোঝা যাচ্ছে এই কবির পৃথিবীকে দেখার, জীবনকে দেখার চোখটা একেবারেই অন্য রকম, ভঙ্গিটা অন্য রকম, সেই দেখাকে শব্দে ধরার কায়দাটা অভিনব।
.
০৪.
বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা ছাপালেও কলকাতার কোনো লেখকের সঙ্গে তখন জীবনানন্দের তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। অচিন্ত্যর সঙ্গে মাঝে মাঝে বসে চা-কফি খান, গড়ের মাঠে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝে তার বোর্ডিংয়ে আসেন তখনকার আরেক আলোচিত কবি মোহিতলাল মজুমদার। জীবনানন্দের কবিতায় মোহিতলালের কবিতার ছায়া দেখা গেছে কখনো কখনো। তবে কারও সঙ্গে ঠিক ঘনিষ্ঠতা হয়নি তার। অচিন্ত্যর অনুরোধে কল্লোলঅফিসে গিয়েছেন বার কয়েক কিন্তু বসেননি বেশিক্ষণ। এর মধ্যে একদিন ঢাকা থেকে এলেন তরুণ কবি বুদ্ধদেব বসু। অচিন্ত্যকে বললেন, নীলিমার কবির সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। অচিন্ত্য বুদ্ধদেবকে নিয়ে গেলেন জীবনানন্দের ডেরা প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে। বুদ্ধদেব উচ্ছ্বসিত হয়ে জীবনানন্দকে বললেন, আমরা নতুন কবিরা যে ধরনের কবিতা লিখতে চাইছি, আমার ধারণা আপনার হাত দিয়েই তার সফল প্রকাশ ঘটবে। জীবনানন্দ খুশি হলেন এই তরুণের উচ্ছ্বাসে, ধন্যবাদ দিলেন, মৃদু হেসে সম্মতি জানালেন। বুদ্ধদেব বললেন, চলুন ইন্দোবার্মা রেস্টুরেন্টে যাই। কল্লোল অফিসের কাছের এই রেস্টুরেন্টে তখন কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। জীবনানন্দ গেলেন না। দল বেঁধে আড্ডা দেওয়াতে কখনোই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না তিনি। জীবনানন্দ অবশ্য তখনো জানেন না যে অচিরেই বুদ্ধদেব নামের এই অচেনা তরুণ জরুরি হয়ে উঠবেন তাঁর জীবনে।
এদিকে কল্লোল-এর তরুণ কবিরা মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে বা জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে যান। রবীন্দ্রবিরোধিতা করলেও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও ছিল তাদের কাম্য। এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও জীবনানন্দ কখনো রবীন্দ্রনাথের কাছে যাননি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অতিভক্তি কিংবা রবীন্দ্রনাথবিরোধী কোনো দলেই ছিলেন না তিনি। এসব দলাদলি এড়িয়ে জীবনানন্দ তখন কলকাতায় হেঁটে বেড়ান একাকী নেকড়ের মতো। নেকড়ে, কারণ ইতিমধ্যে তাঁর মনে কবিতার জন্য হিংস্র একটা ক্ষুধার জন্ম হয়েছে।
.
শিখা জ্বলে ওঠে, কাঁপে, নিভে যেতে চায়
০১.
এক এই সময় জীবনানন্দের মনে হলো পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা কবিতাগুলো নিয়ে একটা বই করা যাক। কবিতার ছায়া পৃথিবী, এর আশ্চর্য মায়া, ঘোর ইতিমধ্যে পেয়ে বসেছে তাঁকে। এ পথে আরও অগ্রসর হওয়ার আগে এযাবৎ লেখা সব কবিতাকে একত্র করে দেখতে চান, কী দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কে তাঁর বই প্রকাশ করবে? কোন প্রকাশক লগ্নি করবেন তার বইয়ে? জীবনানন্দ নেহাতই অখ্যাত লেখক এক। কিন্তু পিছপা হলেন না জীবনানন্দ। নিজের খরচেই বই প্রকাশ করবেন ঠিক করলেন। টাকাপয়সা জোগাড় হলে জীবনানন্দ অতঃপর কলকাতা থেকে প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কবিতার বই, ১৯২৭ সালে। নাম দিলেন ঝরা পালক। তার এক কবিতাতেই আছে এই শব্দবন্ধ :
আমি কবি,–সেই কবি
আকাশের পানে আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
নামটির ভেতর একধরনের পেলব অনুভূতিময়তা, খানিকটা বিষণ্ণতাও। রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা না করলেও জীবনানন্দের মনে হলো বাংলা সাহিত্যের এমন ব্যাপক সৃজনশীল মানুষটা তারই সমসময়ে বেঁচে আছেন, দারুণ হয় যদি অন্তত তার একটা মন্তব্য পাওয়া যায় এই নতুন বইটা সম্পর্কে। শুনেছেন লোকে চিঠিপত্র লিখলে, বই পাঠালে তিনি উত্তর দেন। ঝরা পালক বইটা জীবনানন্দ ডাকে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, সবিনয়ে অনুরোধ জানালেন মন্তব্যের।
রবীন্দ্রনাথ বইটা পেলেন, পড়লেন এবং চিঠির উত্তর দিলেন। কবি হিসেবে জীবনানন্দের তেমন কোনো পরিচিতি নেই তখন, কিন্তু চিঠির উত্তর দেবার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কিংবদন্তিতুল্য নিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যে চিঠিটা লিখলেন, সেটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি লিখলেন :
কল্যাণীয়েষু,
তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।
বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি। সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো।
–ইতি
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চিঠিটা কৌতূহলোদ্দীপক নানা কারণে। প্রমাণ আছে যে কেউ কবিতার বইপত্র পাঠালে, খ্যাত-অখ্যাত সবাইকেই রবীন্দ্রনাথ সে সময় মোটামুটি প্রশংসা করেই দু-চার কথা লিখে পাঠাতেন। কিন্তু জীবনানন্দকে যে চিঠিটা তিনি লিখেছেন, সেটা বেশ রূঢ়ই বলা চলে। জীবনানন্দের কবিত্ব শক্তি আছে, সেটা মেনে নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু জীবনানন্দ ভাষা নিয়ে জবরদস্তি করছেন, ওস্তাদি করছেন, তাঁর মুদ্রাদোষ আছে–এসব বলছেন। তাঁর মতো অতি ভদ্রলোক এমনভাবে কড়া ভাষায় আর কাউকে লিখেছেন বলে জানা যায় না। সত্যি বলতে জীবনানন্দের ওস্তাদির তেমন কিছু তো শুরুই হয়নি তাঁর ঝরা পালক কবিতায়।
অনেক আশা করেই বইটা জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তাঁর প্রথম বইকে নোবেল বিজয়ী কবি যেভাবে ঘাড় মটকে দিলেন, তাতে কী প্রতিক্রিয়া হলো জীবনানন্দের? জীবনানন্দ মফস্বলে বেড়ে ওঠা নামহীন গোত্রহীন নতুন কবি, পৃথিবী বিখ্যাত এক কবির কাছ থেকে এই ধরনের কড়া মন্তব্যের পর চুপসে যেতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের তিরস্কারকে চুপচাপ হজম করে নিতে পারতেন। কিন্তু না, তা ঘটেনি, বরং ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জীবনানন্দ। হতে পারেন তিনি অখ্যাত কবি এবং রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববরেণ্য কিন্তু তাই বলে তার মন্তব্যকে শিরোধার্য ভাববার কোনো কারণ দেখেননি জীবনানন্দ। রবীন্দ্রনাথের তিন লাইনের এই চিঠির এক লম্বা জবাব দিলেন জীবনানন্দ। স্তিমিত ভঙ্গিতে কিন্তু গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যকে ধসিয়ে দিলেন তিনি। সেই চিঠির ভেতর আছে জীবনানন্দের এক আশ্চর্য অহংকার, অভিমান।
.
০২.
বরিশালের আরেক কৃতী সন্তান ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী তার বাঙালনামায় বরিশালের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন যে বিশেষ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক কারণে বরিশালের মানুষের ভেতর একধরনের দুঃসাহসী, স্বাধীনচেতা ভাব আছে। বরিশালের ভাষাতেই তপন রায় লিখেছেন তাদের ভাবটা এমন যে, ক্যান ঠেকলাম কিসে আমি কারো মাহা (মাখা) তামাক খাই? রবীন্দ্রনাথকে লেখা জীবনানন্দের সেই চিঠিতে তেমন একটা ভাব যেন দেখা যায়, যেন বলতে চাচ্ছেন, ঠেকলাম কিসে? চিঠির শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে রেওয়াজমতো শ্রদ্ধাভক্তি জানিয়ে শেষে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন তার যুক্তি। জীবনানন্দ লিখেছেন :
শ্রীচরণেষু,
আপনার স্নেহাশীষ লাভ করে অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মত আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে। এত বড় দানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে যতখানি গভীর নিষ্ঠার দরকার দেবতা পূজারীকে কখনও তার থেকে বঞ্চিত করেন না। কিন্তু দানকে ধারণ করতে হলে যে শক্তির প্রয়োজন তার অভাব অনুভব করছি। অক্ষম হোলেও শক্তির পূজা করা এবং শক্তির আশীর্বাদ ভিক্ষা করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধনা। আর আমার জীবনের আকিঞ্চন সেই আরাধ্য শক্তি সেই কল্যাণময় শক্তির উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। আশা করি এর থেকে আমি বঞ্চিত হব না।
পত্রে আপনি যে কথা উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে দু-একটা প্রশ্ন মনে। আসছে। অনেক উঁচু জাতের রচনার ভেতর দুঃখ বা আনন্দের একটা তুমুল তাড়না দেখতে পাই। কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে উঠেন–পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। কিন্তু এই বিষ বা অন্ধকারের মধ্যে কিম্বা এই জ্যোতির্লোকের ভেতরেও প্রশান্তি যে খুব পরিস্ফুট হয়ে উঠছে না তা তো মনে হয় না। প্রাচীন গ্রীকরা সিরিনিটি জিনিসটার খুব পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের কাব্যের ভেতর এই সুর অনেক জায়গায় ফুটে উঠেছে। কিন্তু যে জায়গায় অন্য ধরনের সুর আছে, সে কাব্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না। দান্তের ডিভাইন কমেডির ভেতর কিম্বা শেলীর ভেতর সিরিনিটি বিশেষ নেই। কিন্তু স্থায়ী কাব্যের অভাব এদের রচনার ভেতর আছে বলে মনে হয় না। আমার মনে হয় বিভিন্ন রকম বেষ্টনীর মধ্যে এসে মানুষের মনে নানা সময়ে নানা রকম মুডস খেলা করে। সে মুডগুলোর প্রভাবে মানুষ কখনো মৃত্যুকেই বঁধু বলে সম্বোধন করে, অন্ধকারের ভেতরই মায়ের চোখের ভালোবাসা খুঁজে পায়, অপচয়ের হতাশার ভেতরই বীণার তার বাঁধবার ভরসা রাখে। যে জিনিস তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে অপরের চোখে হয়তো তা নিতান্তই নগণ্য। তবু তাতেই তার প্রাণে সুরের আগুন লাগে,–সে আগুন সবখানে ছেয়ে যায়। মুড-এর প্রক্রিয়ায় রচনার ভেতর এই যে সুরের আগুন জ্বলে ওঠে, তাতে সিরিনিটি অনেক সময়েই থাকে না–কিন্তু তাই বলেই তা সুন্দর ও স্থায়ী হয়ে উঠতে পারবে না কেন বুঝতে পারছি না।
সকল বৈচিত্র্যের মতো সুরবৈচিত্র্যও আছে সৃষ্টির ভেতর। কোন একটা বিশেষ ছন্দ বা সুর অন্য সমস্ত সুর বা ছন্দের চেয়ে বেশি করে স্থায়ী স্থান কি করে দাবি করতে পারে? আকাশের নীল রং, পৃথিবীর সবুজ রং, আলোর শ্বেত রং, কিম্বা অন্ধকারের কালো রং–সমস্ত রংগুলোরই একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ আছে। একটাকে অন্যটার চেয়ে বেশি সুন্দর ও সুচির বলা চলে বলে মনে হচ্ছে না। এই অন্ধকার, এই আলো, আকাশের নীল, পৃথিবীর শ্যামলিমা–এসবই তো সুচির-সুন্দর। সৌন্দর্য ও চিরত্বের বিচার তাই একটু অন্য ধরনের বলে মনে হয়। ঘুড়ির কাগজের সবুজ, নীল, শাদা বা কালো রং যখন পৃথিবী, আকাশ, প্রভাত বা রাত্রির বর্ণের সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বের দাবি করে বসে, তখন আর কোন প্রসঙ্গের প্রয়োজন থাকে না। আমার তাই মনে হয়, রচনার ভেতর যদি সত্যিকার সৃষ্টির মর্যাদা থাকে তা হোলে তা ভেতরকার বিশিষ্ট সুরের প্রশ্নটি হয়তো অবহেলাও করা যেতে পারে। শান্তি বা সিরিনিটি সুরে কবিতা বেঁধেও সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণার অভাব থাকলে হয়তো তাও নিষ্ফল হয়ে যায়। বিঠোফেনের কোন কোন সিম্ফনী বা সোনাটার ভেতর অশান্তি আছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজো তা টিকে আছে–চিরকালই থাকবে টিকে, তাতে সত্যিকারের সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিলো বলে।
আমার যা মনে হয়েছে তাই আপনাকে জানিয়েছি। আপনার অন্তরলোকের আলোপাতে আমার ত্রুটি অক্ষমতা মার্জিত করে নেবেন আশা করি। আপনার কুশল প্রার্থনীয়। আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন।
প্রণত
শ্রীজীবনানন্দ
সিরিনিটি বা প্রশান্তি না থাকলে ভালো কবিতা হবে না, সে কবিতার স্থায়িত্ব থাকবে না, রবীন্দ্রনাথের এই যুক্তিকে দান্তে, শেলি, বিঠোফেন দিয়ে একেবারে অকাট্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন জীবনানন্দ। রচনার ভেতর সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা এটাই দেখবার বিষয়, তার সুরটা প্রশান্তির না অশান্তির, সেটা বড় ব্যাপার নয় বলেই জীবনানন্দ মনে করেন। রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রত্যয়ী সিদ্ধান্তকে একেবারে দুমড়ে দিয়েছেন জীবনানন্দ। একটামাত্র বই বেরিয়েছে জীবনানন্দের কিন্তু তার গভীর বিশ্বাস যে কবিতাগুলো আর যা-ই হোক এর ভেতর তার একান্ত আন্তরিক সৃষ্টির প্রেরণা আছে, যা নেহাত ওস্তাদির ব্যাপার নয়। এই চিঠি বহন করছে অখ্যাত এক কবির জগৎখ্যাত এক কবিকে চ্যালেঞ্জ করবার সাহসের চিহ্ন। বাস্তবিক ওস্তাদি যদি কিছু করে থাকেন জীবনানন্দ, সেটা যথার্থ করেছেন ঝরা পালক বইটার পর। কিন্তু প্রখরদৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ কি এই বইটার ভেতরই টের পেয়েছিলেন কবিতার এমন এক গতিমুখ যা তার চেনা ভূগোলের অনেকটা বাইরে? সে জন্যই কি তার এতটা আপত্তি?
.
০৩.
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে বিস্তারিত কোনো আলোচনা না পেয়ে এবার জীবনানন্দ হাত বাড়ালেন সমসাময়িকদের দিকে। সে সময় বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ সাহিত্য সমালোচক হিসেবে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বেশ নামডাক। জীবনানন্দ তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন ঝরা পালক-এর একটা কপি, চাইলেন তার মন্তব্য। বই পেয়ে ধূর্জটিপ্রসাদ উত্তরে জীবনানন্দকে লিখলেন :
জীবানন্দ বাবু,
আপনার প্রেরিত পুস্তকখানা যথাসময়ে এসে পৌঁছেছে। বাড়ি বদল করেছি বোলে বড় গোলমালে ছিলাম। ঝরা পালক উড়তে উড়তে আমার গায়ে কি কোরে এল ভেবে পাই না। তবু আমি সেটিকে শ্রদ্ধা সহকারে গ্রহণ করেছি।…
বই খানি আসা মাত্রই পড়ে ফেলেছি। আমার মতগুলি এখনও তৈরি হয়নি–অবশ্য তৈরি হলেই যে তাদের কোন মূল্য থাকবে বলি না… যাই হোক, সময় পেলেই আপনার পুস্তিকা সম্বন্ধে কিছু মতামত জানাব-certificate হিসেবে নয়, শুধু আপনার পত্রোত্তরের আশায়। আপনাকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ইতি
বিনীত
ধূর্জটি
না, ধূর্জটিপ্রসাদ আর সময় পাননি। ঝরা পালক নিয়ে ধূর্জটি লেখেননি কোনো দিন। জীবনানন্দের নামটাও ভুল লিখেছিলেন। জীবনানন্দ টের পেলেন ধূর্জটি তাঁর বইটাকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেননি। নানা ছুতা তুলে লেখার দায়িত্বটা এড়িয়েছেন মাত্র। কিন্তু জীবনানন্দের কাছে তাঁর কবিতা তত দিনে তাঁর জীবনের মতোই মূল্যবান হয়ে উঠেছে। তাঁর অহংও তীব্র। ধূর্জটিপ্রসাদকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। তাকে বেশ হালকা চালেই লিখলেন :
ধূর্জটি বাবু,
…উড়তে উড়তে গায়ে এসে লাগলো নিশ্চয়ই চোখ বুজে ছিলেন–কিম্বা চোখ বুজে আসছিলো–এহেন সময়ে পালকের আক্রমণ। আমার মনে হচ্ছিল ঝরা পালকের পলকা ফুয়ে আপনার ঘুম জমবে ভালো। কিন্তু জানতে পারছি পালকের অত্যাচারে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়েছে। কিন্তু তবু চোখে ঘুমের ঘোর ছিলো–তাই আমাকে জীবানন্দ বাবু বলে সম্ভাষণ করেছেন। আমি কিন্তু জীবনানন্দ বাবু, বুঝলেন?…
বিনীত
জীবনানন্দ
জীবনানন্দ বেশ রেগেছেন বোঝা যায়। না, জীবনানন্দের ঝরা পালককে কবিগুরু তেমন গুরুত্ব দেননি, তরুণ প্রজন্মের সমালোচকও উপেক্ষা করছেন। বইটা নিয়ে প্রবীণ কবি কালিদাস রায়ের কাছ থেকে খানিকটা প্রশংসা পেয়েছিলেন মাত্র। তবে কথা এই যে, ঝরা পালক জীবনানন্দের দলছুট কবিতার বই। আসল জীবনানন্দ তখনো ফুটে ওঠেননি, মাঠ চাষ করছেন শুধু।
.
০৪.
ঝরা পালক বইটার বিশেষ আকর্ষণ অবশ্য এর রহস্যময় উৎসর্গপত্র। উৎসর্গের পৃষ্ঠায় জীবনানন্দ কারও নাম না নিয়ে শুধু লিখেছেন কল্যাণীয়াসুকে! কে এই কল্যাণীয়াসু? সেই রহস্য ঘুচতে আমাদের বহুদিন অপেক্ষা করতে হলো। রীতিমতো গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে ভূমেন্দ্র গুহ, তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির সেই পুনরুদ্ধারকারী, একদিন আবিষ্কার করলেন এই কল্যাণীয়াসু আসলে জীবনানন্দের কাকাতো বোন শোভনা দাশ ওরফে বেবী। এই শোভনার সঙ্গে সারা জীবন জীবনানন্দের চলবে এক আশ্চর্য প্রাণের খেলা। ঝরা পালক বইটা জীবনানন্দ শুধু রবীন্দ্রনাথ আর ধূর্জটি প্রসাদকেই নয়, একটা কপি ডাকে পাঠিয়েছিলেন শোভনাকেও। শোভনা তখন আসামে।
.
০৫.
প্রথম বই নিয়ে সব লেখকের একটা উত্তেজনা, উদ্দীপনা থাকে, জীবনানন্দেরও ছিল। কিন্তু চারদিকের নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়ায় তাঁর সেই উদ্দীপনা ক্রমে মিইয়ে এল। ঝরা পালক তাঁর মন থেকে ক্রমশ মুছে যেতে লাগল। জীবনানন্দ মনোযোগী হলেন সিটি কলেজের শিক্ষকতায়। ইতিমধ্যে জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ বরিশাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। জীবনানন্দ তখন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং ছেড়ে দিলেন। দুই ভাই মিলে বেঁচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিলেন। দুই ভাই মিলে বাজারঘাট করেন, রান্না করেন। দুজন মিলে ছুটিতে যান বরিশাল। কবিতার পৃথিবী থেকে তিনি নির্বাসিত এমনই মনে হচ্ছে তখন তাঁর। অচিন্ত্যকে লেখা এক চিঠিতে জীবনানন্দের সে সময়ের মনের অবস্থাটা বোঝা যায় :
প্রিয়বরেষু,
…স্পষ্ট হদিস পাচ্ছি আমার এই টিমটিমে কবি জীবনটি দপ করেই নিবে যাবে, যাকগে–আপসোস কিসের? আপনাদের নব নব সৃষ্টির রোশনায়ের ভেতর আলো খুঁজে পাব তো–আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে চলবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হব না তো। সেই তো সমস্ত। আমার হাতে যে বাঁশি ভেঙে যাচ্ছে-গেছে, বন্ধুর মুখে তা অনাহত বেজে চলেছে–আমার মেহেরাবে বাতি নিবে গেল, বন্ধুর অনির্বাণ প্রদীপে পথ দেখে চললুম–এর চেয়ে তৃপ্তির জিনিস আর কি থাকতে পারে।
চারিদিকে বে-দরদীর ভীড়। আমরা যে কটি সমনাধৰ্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই। আমাদের তেমন পয়সা কড়ি নেই বলে জীবনে creature comforts জিনিসটি হয়তো চিরদিনই আমাদের এড়িয়ে যাবে। কিন্তু একসঙ্গে চলার আনন্দ থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই–সে পথ যতই পর্নমলিন, আতপক্লিষ্ট বাত্যাহত হোক না কেন…।
ইতি
আপনার শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত
.
কক্ষ থেকে খসে পড়ার শুরু
০১.
প্রথম কবিতার বইয়ের ব্যর্থতার আবেশ কাটতে না কাটতেই এ সময় আরেক বড় বিপর্যয় নেমে এল জীবনানন্দের জীবনে। তাঁর সিটি কলেজের চাকরিটা চলে গেল। তাঁকে বরখাস্ত করা হলো। ঘটনাটা এই রকম; সিটি কলেজ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত কলেজ। ব্রাহ্মসমাজ মূর্তিপূজার বিরোধী ছিল বলে সিটি কলেজের হোস্টেল চত্বরে এ ধরনের কার্যকলাপ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু ১৯২০ দশকে ভারতে সরস্বতী পূজার জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। সে সময় ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবোধের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী পূজার একটা জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ঘটনাটা ১৯২৮ সালে। এর আগে সিটি কলেজের হিন্দু ছাত্ররা কলেজ চত্বরের বাইরে সব সময় সরস্বতী পূজা করত। সে বছর ছাত্ররা কলেজ চত্বরের ভেতরে পূজা করতে চাইল কিন্তু কলেজের প্রিন্সিপাল হেরম্বচন্দ্র তার অনুমতি দিলেন না। কিন্তু নিষেধ অমান্য করে হোস্টেলের ছেলেরা ভোরে তাদের চত্বরেই পূজা শুরু করল। হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট গিয়ে বাধা দিলেন কিন্তু ছাত্ররা সুপারিনটেনডেন্টের নিষেধ উপেক্ষা করেই পূজা চালিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল হেরম্বচন্দ্র কলকাতা ইউনিভার্সিটির ভিসি যদুনাথ সরকারের কাছে বললেন কোনো পদক্ষেপ নেবার জন্য। যদুনাথ সরকার ছাত্রদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্ষমা না চেয়ে বরং উল্টো পত্রিকায় বিবৃতি দিল এই বলে যে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের নিজেদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাদের জরিমানা করল কিন্তু ছাত্ররা সে জরিমানাও দিল না। এ নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় শুরু হলো বিতর্ক। দেশের গণ্যমান্য লোকেরা সে বিতর্কে যোগ দিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু জীবনানন্দ এ ঘটনায় নিলেন ছাত্রদের পক্ষ। যার যার ধর্ম পালনের অধিকার থাকা উচিত, এমনই মনে হলো তাঁর। পরিস্থিতি সামাল দিতে এরপর কলেজ আগাম ছুটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো। কলেজ খোলার পর ভর্তির মৌসুম শুরু হলে দেখা গেল, সে বছর আগের বছরের চেয়ে নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছে অর্ধেকের কম। হিন্দু ছাত্ররা ব্যাপক হারে সিটি কলেজকে বর্জন করল। বেসরকারি কলেজ, ছাত্র ভর্তি এতটা কমে যাওয়াতে পুরো কলেজের বাজেটে রীতিমতো ধস নামল। কলেজের পক্ষে সব শিক্ষকের বেতন দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল। আর্থিক এই সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে সে বছর কলেজ কর্তৃপক্ষ ১১ জন শিক্ষককে ছাঁটাই করল। ছাঁটাই করা সেই শিক্ষকদের দলে পড়লেন জীবনানন্দও। জীবনানন্দ ছিলেন ওই কলেজের সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক। উপরন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে এ খবর ছিল যে ওই গন্ডগোলের সময় জীবনানন্দ কর্তৃপক্ষের বদলে ছাত্রদের পক্ষ নিয়েছিলেন। ফলে চাকরি ছাঁটাইয়ের তালিকায় যে তাঁর নাম থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক।
কবিতাকে জীবনের আরাধ্য ভেবে নিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে পেলেন উপেক্ষা, একটা নিয়মিত জীবিকার সংস্থান ছিল, সেটাও হারালেন। এই প্রথম জীবনানন্দ বোধ করতে লাগলেন যে তিনি জীবনের মূল কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়েছেন।
.
০২.
চাকরি হারিয়ে জীবনানন্দ কলকাতা থেকে ফিরে এলেন বরিশালে। বরিশালে বসে নানা দিকে নতুন চাকরি খুঁজতে লাগলেন। ভেবেছিলেন এমএ ডিগ্রি আছে, ছয় বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা আছে, কাজ একটা কোথাও জুটেই যাবে। বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারলেন না। এমন অপ্রস্তুত, বেকায়দা অবস্থায় তিনি পড়েননি আগে। একটা সুস্থির জীবিকা, কবিতা লেখার জোয়ার মিলিয়ে জীবনটা যেন বেশ একটু গুছিয়ে উঠছিল তার। কিন্তু কবিতা বইয়ের ব্যর্থতা, বেকারত্ব সব একসাথে তাঁর জীবনে এভাবে হানা দেওয়াতে, জীবন নিয়ে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেললেন জীবনানন্দ। আত্মবিশ্বাসের পারদ নিচে নামতে লাগল তাঁর। ১৯২৯ সালের ডায়েরির একটা পাতায় লিখছেন, It looks like that: I shall survive to see me impotent and forgotten. My father had lived to see that I was wiser than him, and I have lived to see that he was wiser than me.
তাঁর তখন মনে হচ্ছে নেহাত এক নিষ্কর্মা হিসেবে সবার কাছে বিস্মৃত হয়ে যাবেন তিনি। তার বাবা ভেবেছিলেন ছেলেকে তিনি তার চেয়েও সফল দেখে যাবেন। কিন্তু জীবনানন্দ টের পাচ্ছেন, বাবার চেয়ে সফল হবার কোনো সম্ভাবনাই তার নেই। বাবা অন্ততপক্ষে একটা সংসার সামলেছেন, পাঁচজনের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছেন কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছে, সে যোগ্যতাও তাঁর নেই। তিনি আরও লিখছেন, A man, all things considered should not live in this scheme. But, why does he not die? A man like me thinks he may be misunderstood, and leave his message real unsaid by an early death. …
উড়াল দিয়ে সাগর পাড়ি দেবেন ভেবে শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়লেন। জীবন নিয়ে, কবিতা নিয়ে নিজের উদ্দীপনার কথা ভেবে নিজেকেই হাস্যকর লাগতে লাগল তার। অপমানিত লাগতে লাগল। জীবনানন্দ ভাবছেন এমন একটা অপমানের জীবন নিয়ে একজন মানুষের বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। মৃত্যুচিন্তা একটু করে উঁকি দিচ্ছে তখন তাঁর মাথায়। কিন্তু জীবন তখনো তাঁকে টানছে। তিনি ভাবছেন তার বলবার কথা রয়ে গেছে অনেক, মরবার আগে সেগুলো বলে যেতে হবে তাকে। নইলে লোকে তাকে ভুল বুঝবে।
.
নিজেকে আয়নায় ভেঙে ভেঙে
০১.
তার ওই ভেঙে পড়া সময়ে নিজের সঙ্গে নিজে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যেন মোকাবিলা শুরু করলেন জীবনানন্দ। নিজেকে প্রশ্নের মুখোমুখি করলেন। লোকে যেন তাকে ভুল না বোঝে বুঝি সে জন্যই মগ্ন চৈতন্যে নিজেকে আয়নায় ভেঙে ভেঙে দেখবার যে গোপন আয়োজন তিনি তখন করছিলেন, তাকে উপস্থিত করলেন এক অভিনব কবিতায়। তাঁর নিজের আগের কবিতা, তার পূর্বসূরি, সমসাময়িক কারও কবিতার সঙ্গে সেই কবিতার মিল নেই। বোধ নামে সেই কবিতাটা ছাপা হলো বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত প্রগতি পত্রিকায় :
আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়–শান্তি নয়–ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,–পণ্ড মনে হয়;
সব চিন্তা–প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়!
সহজ লোকের মত কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো। তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!–কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?–শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?–প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই!-ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর পরে?
স্বপ্ন নয়,–শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
পথে চলে পারে–পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধরে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারপাশে!
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে।
আমি থামি, সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে,
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজ ক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে–জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি?–তাহাদের মন
আমার মনের মত না কি?
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাটিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে? মে
ছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা-আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এইসব স্বাদ;
–এসব পেয়েছি আমি;-বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
একদিন;
এইসব স্বাদ
জানিয়াছি একদিন,–অবাধ–অগাধ;
চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা করে চলে গেছে–যখন ডেকেছি বারেবারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ।
অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র-নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা–ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়–প্রেম নয়–কোন এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে :
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন।
এই বোধ–শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ–অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের
পথ চায় না সে?–করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ–গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা–পচা চালকুমড়ার ছাঁচে
যে সব হৃদয় ফলিয়াছে।
–সেই সব।
এক বিচিত্র বোধের কথা শোনালেন জীবনানন্দ। এই বোধ তার মাথার চারপাশে ঘোরে। এই বোধ যেন একটা ভূত, সে যাকে ধরে সে আর সহজ লোকের মতো চলতে পারে না। অথচ তিনি তো সহজ লোকের মতো সবই করেছেন। বালতিতে পানি টানা থেকে শুরু করে মেয়েমানুষকে ভালোবাসা পর্যন্ত। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এই বোধের মুদ্রাদোষ তাকে পেয়ে একেবারে সবার চেয়ে আলাদা করে ছেড়েছে। শিরোনামহীন এক বোধে আক্রান্ত, একাকী অভূতপূর্ব এক মানুষের গল্প শোনালেন জীবনানন্দ এই কবিতায়।
.
০২.
তার আগের কবিতাগুলোকে অধিকাংশ লেখক, পাঠক উপেক্ষা করেছেন। দায়সারা কিছু মন্তব্য ছাপা হয়েছে তাঁর কবিতা নিয়ে। কিন্তু দেখা গেল বোধ কবিতাটার দিকে নজর পড়েছে অনেকের। এই অদ্ভুত কবিতার কী প্রতিক্রিয়া তারা দেখাবেন, এই নিয়ে যেন বেশ একটা ধন্দে পড়ে গেছেন তারা। কেউ কেউ রীতিমতো বিরক্ত, কেউ শুরু করলেন ব্যঙ্গ। কবিতা লিখে উপেক্ষার বদলে এবার শিকার হলেন বিদ্রুপের। সে সময়ের নামজাদা একজন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তিনি ঘোষণা করলেন, জীবনানন্দের এই কবিতা আসলে পাগলের প্রলাপ। তিনি লিখলেন, …আমি বোধ কবিতাটি পুনঃ পুনঃ পাঠ করেছি। কবিতা আরম্ভ :
আলো-অন্ধকারে যাই–মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়,কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়–শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
..যা কবিচিত্তে স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়, সেটি কী তা জানবার জন্য মন উন্মুখ হয়েছিল। যে বোধ কবির মাথায় ও হৃদয়ে আছে, তা পাঠকের মাথায় ও হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই অবশ্য কবির উদ্দেশ্য এবং তাইতেই কবিতাটির সার্থকতা, এই মনে করে আমি অবহিত হয়েছিলাম। বহুবার একা একা পড়ে…কবির এই বোধ আমার বোধগম্য হলো না–ইহা লজ্জার কথা হলেও সত্য কথা। সুতরাং আমাদের নিকট এ কবিতা সমগ্রভাবে অর্থহীন বলে নিরর্থক। যদিও এর প্রত্যেক কথা সহজ, সরল অনাড়ম্বর–এর ভাষা কবিতার ভাব বোঝবার পথে অন্তরায়।
এরকম হবার তিনটি কারণ হতে পারে :
১. কবি কি বলছেন তা নিজেই সম্যক জানেন না। অর্থাৎ তিনি sincere নন।
২. কবি যা বলতে চান তা প্রকাশ করবার ক্ষমতা তার মোটেই নেই। অর্থাৎ তিনি কবি নন।
৩. পাঠকের বোঝবার মত শক্তি নেই।
পরে যতীন্দ্রনাথ আরও লিখলেন, Stanzaয় Stanzaয় কবির বোধ বস্তুটি স্পষ্টতর না হয়ে ক্রমেই এমন ধোয়াটে হয়ে এসেছে যে কবিকেই মাঝে মাঝে মনে করে নিতে হয়েছে, স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, কোন এক বোধ কাজ করে। এমনি করে ভাব ঘোলাটে হতে হতে বোধ যখন একেবারে অবোধ হয়ে উঠলো তখন ভাষা প্রকৃত প্রলাপে পরিণত হয়েছে। যতীন্দ্রনাথ এভাবেই বোধ কবিতা নিয়ে তাঁর বিরক্তি, অস্বস্তি, রাগের নানা বয়ান করে গেছেন ওই লেখায়।
.
০৩.
এই কবিতাকে একেবারে তুলাধোনা করে ছাড়লেন সজনীকান্ত দাশ। শুধু বিদ্রূপ নয়, রীতিমতো আক্রমণ করলেন তিনি। সজনীকান্ত তখন সম্পাদনা করেন শনিবারের চিঠি নামের পত্রিকা। তিনি সাহিত্যে রক্ষণশীলতার পক্ষে। রবীন্দ্ৰবলয়ের বাইরের কবিদের ব্যঙ্গ করে ইতিমধ্যে বেশ আলোচিত সেই পত্রিকা। কাজী নজরুলকে প্যারোডি করে শুরু হয়েছিল সেই চর্চা। এরপর সজনীকান্ত পেয়ে গেলেন মোক্ষম এক শিকার, জীবনানন্দ দাশ। বোধ কবিতাটা প্রগতি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর সজনীকান্ত জীবনানন্দের ওপর একেবারে হামলে পড়লেন। শনিবারের চিঠি পত্রিকায় তিনি লিখলেন, …জীবনানন্দের স্বরূপ জীবনানন্দ স্বয়ং ভাদ্রের প্রগতিতে নির্দেশ করিয়াছেন :
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
মুদ্রাদোষটি কি রূপ?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে,
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজ ক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে–জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি?–তাহাদের মন
আমার মনের মত না কি?
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
মাথার মতন হৃদয়? হৃদয়ের সহিত গোবরের তুলনা এই প্রথম। কবিতা যেমনই হোক মুদ্রাদোষটি কিন্তু ভালো নয়। তারপর–
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
কবি সব করিয়াই দেখিয়াছেন শুধু বিবাহ করিয়া মেয়েমানুষেরে দেখেন নাই। দেখিলে ভালো হইত। গরিব পাঠকেরা বাঁচিত।
সজনীকান্ত পরে আরও লিখলেন, বাংলার জনগণ খবর রাখেন কিনা বলিতে পারি না, সম্প্রতি কিছুকাল হইতে পূর্ব বঙ্গ সাহিত্য নামক এক নতুন সুবৃহৎ এবং সম্পূর্ণ সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে।
জীবনানন্দের কবিতা দুর্বোধ্য, দোষ শুধু সেটা নয়; তিনি যে পূর্ব বাংলার লোক, পশ্চিম বাংলার অভিজাত লেখকের সেটাও একটা খোটা দেওয়ার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। সজনীকান্ত আরও লিখলেন, এই নব সাহিত্যের হুইটম্যান শ্ৰী জীবনানন্দ (জীবানন্দ নয়) দাশের কিছু বাণী আমাদের মর্ম স্পর্শ করিয়াছে। এই সকল বাণীর প্রচার আবশ্যক :
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ–গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
। নষ্ট শসা–পচা চালকুমড়ার ছাঁচে
যে সব হৃদয় ফলিয়াছে।
–সেই সব।
কবির হৃদয়ে মাংসে যে কুঁজ ও গলগন্ড ফলিয়াছে তাহা স্বীকার করা বাণী বৈকি। কবিতাটির নামকরণে বোধ হয় কিছুটা ভুল আছে–বোধ না হইয়া কবিতাটির নাম গোদ হইবে…।
.
০৪.
কিন্তু বোধকবিতার ভেতর দিয়ে জীবনানন্দ বস্তুত তখন পেয়ে গেছেন তাঁর একক পৃথিবীর খোঁজ। পেয়েছেন তাঁর নিজের কণ্ঠস্বর। মূল স্রোতের বাইরে পেয়ে গেছেন তার অজ্ঞাতবাসের ডেরা। এই অজ্ঞাতবাস থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যেন তিনি নতুন করে চিনতে পারছেন সব। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্বের দ্বন্দ্বকে মোকাবিলার একটা পথ যেন পেয়েছেন তিনি। সজনীকান্ত বা যতীন্দ্রনাথের জানাবার সুযোগ নেই যে তাঁদের রুচিতে এই কবিতা না ধরলেও আগামী প্রজন্মের অগণিত তরুণ, তরুণী জীবনানন্দের সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় লাইনটা মাথার ভেতর নিয়ে নির্ঘুম জেগে থাকবে। তারা টের পাবে একজন মানুষ এই কবিতা পড়ার পর আর আগের মানুষ থাকে না, বদলে যায়।
.
চরাচরে অচেনা, অভিনব হাওয়া
০১.
প্রথম সাহিত্যিক বৈরিতার অভিজ্ঞতা হলো জীবনানন্দের। মনে মনে আহত হলেন। কিন্তু সাহস জোগালেন একজন। তাঁর তরুণ সেই অনুরাগী বুদ্ধদেব বসু। তাঁকে চিঠিতে লিখলেন, যত সমালোচনাই হোক, তার যেকোনো কবিতার জন্য প্রগতি পত্রিকার দ্বার খোলা থাকবে সব সময়। জীবনানন্দ তখন তার নিজের বলবার কথাগুলো, নিজের বলবার ভাষা যেন খুঁজে পেয়েছেন। ভেতর থেকে কবিতা লিখবার তাগাদা বোধ করতে লাগলেন। বিশেষ করে, ওই বেকার বিপর্যস্ত অবস্থায় কবিতা লেখাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা হলো তাঁর। চাকরি খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে অব্যাহত রাখলেন তাঁর নতুন ধারার কবিতা লেখা। সেগুলো এক এক করে ছাপা হতে লাগল প্ৰগতিতে;
শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,–চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয়;
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়!
চারিদিকে এখন সকাল,
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল!
মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ,
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!
চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো করে,
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধরে।
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া-রোদ–ক্ষুদ–কুঁড়া-কার্তিকের ভিড়;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালিধারভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই–নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি নাই,–রূপ ঝরে পড়ে তার,
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নুতন বয়স,
মাঠে মাঠে ঝরে পড়ে কাঁচা রোদ,-ভাঁড়ারের রস!…
ফসলের স্তনের মতো বিচিত্র উপমা ব্যবহার করলেন তিনি, ব্যবহার করেন বিয়োবার মতো গ্রাম্য শব্দ, তাঁর কবিতায় উঠে এল পাচা, ইঁদুরের মতো অকাব্যিক সব পাখি, প্রাণী, অগণিত ড্যাশ, কখনো ব্রাকেট দিয়ে তিনি কবিতার ভেতর একটা নাটকীয়তা তৈরি করলেন, তাঁর কবিতায় দেখা গেল সাধু-চলিত ভাষার মিশ্রণ, একই লাইনে তাহার আবার ধরে লিখলেন তিনি। এরপর মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দ ছেড়ে লিখতে লাগলেন অক্ষরবৃত্তের কবিতা। আর তার নতুন এসব কবিতা আকারেও হতে লাগল প্রচলিত কবিতার চেয়ে অনেক লম্বা। এক একটা কবিতা দেড় শ, দুই শ লাইনের। তার এসব কবিতার ওপর আক্রমণ বাড়তে লাগল। একসময় তাঁর কবিতা ছাপালেও কালি কলম পত্রিকায় ছাপা হলো তার নতুন কবিতার বিরূপ সমালোচনা। আর্টের আটচালা; ব্যাধ ও মালাকর নামে একটা লেখায় এক সমালোচক লিখলেন, পাহাড়িয়া কবি শ্রীযুক্ত জীবনানন্দ দাশের উপদ্রপে বাঁচা দায় হয়ে উঠলো। মাসিক পত্রিকা খুললেই তার পাহাড় প্রমাণ কবিতার পাষাণ স্তূপ অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে দেখতে পাই। সেই কবিতা পাহাড়ে বিচরণ করতে গিয়ে পাঠককে ক্ষত বিক্ষত হয়ে ফিরতে হয়, ছন্দহীন নীরস কথার চড়াই উত্রাই অতিক্রম করতে পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসে।
.
০২.
চারদিকের আক্রমণের মুখে এবার জীবনানন্দের পক্ষে সরাসরি কলম ধরলেন বুদ্ধদেব বসু। বাংলা কবিতার চরাচরে যে এক নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সে কথা তাঁর প্রগতি পত্রিকায় ১৯২৯-এর এক সংখ্যায় লিখলেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। বাঙলা কবিতার ভবিষ্যৎ নামের সেই লেখায়, সুরেশ আর অনিল নামের কাল্পনিক দুই চরিত্রের সংলাপ :
অনিল : আজকাল একটা কবির লেখা পড়ে আমার আশা হচ্ছে, আর বেশী দেরী নেই, হাওয়া বদলে আসছে।
সুরেশ : কে তিনি?
অনিল : জীবনানন্দ দাশ।
সুরেশ : জীবানন্দ দাশ? কখনো নাম শুনিনি তো।
অনিল : জীবানন্দ নয়, জীবনানন্দ। নামটি অনেককেই ভুল উচ্চারণ করতে শুনি। তাঁর নাম না শোনারই কথা। কিন্তু তিনি যে একজন খাঁটি কবি তার প্রমাণস্বরূপ আমি তোমাকে তার একটি লাইন বলছি–আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে। ব্রাউনিংয়ের everlasting wash of air-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। আকাশের অন্তহীন নীলিমার দিগন্তবিস্তৃত প্রসারের ছবিকে একটি মাত্র লাইনে আঁকা হয়েছে–একেই বলে magic line। আকাশ কথাটার পুনরাবৃত্তি করবার জন্যই ছবিটি একেবারে স্পষ্ট, সজীব হয়ে উঠেছে, শব্দের মূল্যবোধের এমন পরিচয় খুব কম বাঙালী কবিই দিয়েছেন।
সুরেশ : (অনিচ্ছা সত্ত্বেও) লাইনটি ভালো বটে।
অনিল : এই কবি সেই উভচর ভাষা অবলম্বন করে আমাদের ধন্যবাদভাজন হয়েছেন। আজকালকার কবিদের মধ্যে তার ভাষা সবচেয়ে স্বাভাবিক…দ্যাখো, এতদিনে আমাদের এ কথাটা উপলব্ধি করা উচিৎ যে সংস্কৃত আর বাঙলা এক ভাষা নয়, সংস্কৃতের সঙ্গে বাঙলার নাড়ির বাধন বহুকাল ছিঁড়ে গেছে। বাঙলা এখন একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, সাবালক ভাষা–তার ব্যাকরণ, তার বিধি বিধান তার spirit সংস্কৃত থেকে আলাদা-এখন আর সংস্কৃতের সঙ্গে তার কোনই সম্পর্ক নেই। সংস্কৃতের ভাষা থেকে বাঙলা যে সব শব্দ আহরণ করেছে, সেগুলোকে বিশুদ্ধ বা chaste বাঙলা বলে স্বীকার করবার সময় হয়েছে। অথচ, আশ্চর্যের বিষয়, বাঙলা কবিতা এখন পর্যন্ত সংস্কৃত কথাগুলোর প্রতিই পক্ষপাত দেখাচ্ছে, সংস্কৃত convension গুলো এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের সুন্দরীরা এখনও বাতায়ন পাশে দাঁড়িয়ে কেশ আলুলায়িত করে দেয়, মুকুরে মুখ দেখে, চরণ অলক্ত রঞ্জিত করে, শুভ্র ও শীতল শয্যায় শোয়। আমাদের নায়িকাদের এখনো হস্তে লীলাকমলমলকে বালুকুন্দানুবিদ্ধং ইত্যাদি; যদিও ওসব ফ্যাশন দেশ থেকে বহুকাল উঠে গেছে। সংস্কৃতর দুয়ারে এই কাঙালপনা করে আর কতকাল আমার মাতৃভাষাকে ছোট করে রাখবো? আমাদের এই ভুল জীবনানন্দ বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হয়, ভাষাকে যথাসম্ভব খাঁটি বাঙলা করে তোলবার চেষ্টা তার মধ্যে দেখা যায়। তিনি সাহস করে লিখেছেন :
এই জল মেয়েদের স্তন
ঠান্ডা–শাদা–বরফের কুচির মতন।
শুনে তোমার, শুধু তোমার কেন? অনেকেরই হাসি পাবে, বলবে-ঠান্ডা–শাদা! এ আবার কী? কিন্তু এই শব্দ দুটো গদ্যে লিখতে পারি, মুখে বলতে পারি আর কবিতাতেই লিখতে পারবো না? কেন কবিতায় জানালাকে জানালা বলবো না, বিছানাকে বিছানা? আয়না আর আরশি এড়িয়ে মুকুর এবং দর্পণের উপর হোঁচট খেতে হবে কেন? ঘরের পাশে যে বাতাস আর হাওয়া বয়, তা প্রত্যাখ্যান করে সমীর-পবন-মলয়ের খোঁজে অতদূর যাবো কেন? এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়কে একখণ্ড জীর্ণ বস্ত্র লিখে আমরা দাঁত ভাঙতে যাই কেন? যত কথা আমাদের মুখের ভাষায় স্থান পেয়েছে–চেয়ার, টেবিল, টুল, ইস্কুল, দালান, কাপড়, পালা, টোকা–এবং আরো অজস্র-কাব্য ও সমাজ থেকে তাদেরকে একঘরে রেখে কেন আমরা আমাদের কবিতাকে এক বিপুল শব্দসম্ভার থেকে বঞ্চিত করবো? মৌখিক ভাষায় ইডিয়মগুলো ব্যবহার করে কবিতাকে স্বাভাবিক সহজ করে তুলবো না কেন? আমরা যখন বাঙালী তখন Sanskritisms যতদূর এড়িয়ে আমাদের খাঁটি বাংলায় লিখতে পারি, ভাষা তো ততদূর chaste হবার কথা। আমি তো বলি ক্ষণিকার ভাষা, জীবনানন্দের কবিতার ভাষা purest বাঙলা, কারণ তা বাঙলা ছাড়া আর কিছু নয়।…
.
অনেক কাকাতুয়া, কমলা রঙের রোদে এক সোনার পিতলমূর্তি
০১.
এক নিয়মিত কবিতা লিখে নিজের মনকে শান্ত রাখছেন ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছেন জীবনানন্দ। বছর ঘুরে আসছে কিন্তু কোথাও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারছেন না। মাঝে শুনলেন বাগেরহাটের পিসি কলেজে মাস কয়েকের জন্য খণ্ডকালীন এক শিক্ষক খুঁজছে তারা। হোক কয়েক মাসের তবু তিনি চলে গেলেন বাগেরহাট। ভালোই কাটল সেখানে কিন্তু মেয়াদ শেষে আবার চলে আসতে হলো বরিশাল। এ রকম একটা সময়ে জীবনানন্দের কাকা অতুলানন্দ তাঁকে ডেকে পাঠালেন আসামে, তিনি সেখানে বন বিভাগের বড় কর্মকর্তা, থাকেন আসামের ডিব্রুগড়ে। অতুলানন্দ চিঠিতে লিখলেন সেখানে কাজ বা ব্যবসার খোঁজখবর করে দেখতে পারেন জীবনানন্দ। বন বিভাগে কাঠের ব্যবসার তো নানা সুযোগ। যেকোনো একটা উপার্জনের উপায় তখন দরকার জীবনানন্দের। কাঠের ব্যবসা হলেও চলে। জীবনানন্দ রওনা দিলেন আসামে। মনে কাজের আশা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে আরেক তীব্র গোপন আশা। আসামে গেলে দেখা হবে তাঁর সেই কল্যাণীয়াসুর সঙ্গে, যাকে তিনি তাঁর প্রথম কবিতার বইটা উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অতুলানন্দ কাকার মেয়ে শোভনা দাশ, যার ডাকনাম বেবী। এর আগে অল্প সময়ের জন্য একবার গিয়েছিলেন তিনি ডিব্রুগড়ে ছুটি কাটাতে। আর সুযোগ পেলেই তাঁর কাকা শোভনাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে গেছেন বরিশালে। এই যাতায়াতের ফাঁকফোকরেই শোভনাকে ঘিরে একটা ঘোর তৈরি হয়েছে জীবনানন্দের।
জীবনানন্দের বরিশালের বাড়িতে তোলা একটা পারিবারিক ছবি আছে, যেটা প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়। সেই ছবিতে তার বাবা-মা থেকে শুরু করে সব কাকা, কাকিমা, তাঁদের ছেলেমেয়ে, অন্যান্য ভাই-বোনসহ তিন পুরুষের প্রায় সব আত্মীয়স্বজন উপস্থিত। ছবির তৃতীয় সারিতে বাম দিক থেকে তৃতীয়জন শোভনা। তখন সম্ভবত ম্যাট্রিক পাস করেছেন তিনি। একনজরেই ছবির আর সব মেয়ের তুলনায় শোভনার পার্থক্যটা চোখে পড়ে। শোভনা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। তার সাজ, বসার স্টাইলে একটা স্বাতন্ত্র আছে। সরু চশমা, চুলের মাঝখানে প্রচলিত সিথির বদলে সিঁথি করেছেন এক পাশে। সরু ঠোঁট, মিষ্টি মুখ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে ক্যামেরার দিকে সপ্রতিভভাবে তাকিয়ে আছেন। আর কোলের ওপর রাখা তাঁর নিটোল হাত। জীবনানন্দ নগ্ন নির্জন হাত নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন, সে হাত কি শোভনারই?
ডিব্রুগড়ে কাটানো সময়ের ডায়েরিতে স্পষ্ট চিহ্ন আছে জীবনানন্দ আর শোভনার ঘনিষ্ঠতার। চিহ্ন আছে শোভনার প্রতি তার তীব্র, তীক্ষ্ণ প্রেমের। এই প্রেম নিদারুণ কাবু করে রাখবে জীবনানন্দকে সারা জীবন। কাঠের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার কাকা কিন্তু জীবনানন্দ টের পেয়েছেন কাঠ ব্যবসার জন্য জন্ম হয়নি তাঁর। তিনি আসামে কাকার বাড়িতে বিছানায় শুয়ে, বসে, বই পড়ে, কবিতা লিখে আর শোভনার কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে দিন কাটিয়েছেন তখন।
জীবনানন্দের মনজুড়ে তখন নানা অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট, এ রকম এক এলোমেলো সময়ে আসামে শোভনাকে ঘিরে উন্মুখ তার মন, শরীর। শোভনা তখন হাইস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। কনভেন্ট স্কুলের বাস সকালে এসে নিয়ে যায় তাকে আর জীবনানন্দ অপেক্ষা করেন কখন তিনি ফিরবেন স্কুল থেকে। স্কুল থেকে ফিরলে ডিব্ৰুগড় বাংলোর কোনার ঘরে দরজা লাগিয়ে গল্প করতে বসেন শোভনা আর তার মিলুদা জীবনানন্দ।
জীবনানন্দ : আচ্ছা, কাকা-কাকিমা কি জানেন যে আমার উৎসর্গের পাতার কল্যাণীয়াসু আসলে তুমিই।
শোভনা : মা-বাবার তোমার কবিতার খোঁজ রাখতে বয়েই গেছে। আমি তো বইটা ডাকে পেয়ে লুকিয়ে রেখেছি আমার ঘরে, বইয়ের ফাঁকে। অবশ্য পরে জানাজানি হয়েছে সব। মা-বাবা তেমন আমলে নেননি।
শোভনা গাঢ় চোখে জানতে চেয়েছেন; মিলুদা, তুমি বইটা আমাকে উৎসর্গ করলে কেন বলো তো?
জীবনানন্দ তখন সে সময় লেখা একটা কবিতা পড়ে শুনিয়েছেন। শোভনাকে–
তুমি এই রাতের বাতাস,
বাতাসের সিন্ধু–ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর।
অন্ধকার—নিঃসাড়তার
মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে
সমুদ্রের ভাষা,
রুধিরে পিপাসা,
যেতেছ জাগায়ে,
ছেঁড়া দেহ-ব্যথিত মনে ঘায়ে
ঝরিতেছে জলের মতন,
রাতের বাতাস তুমি,-বাতাসের সিন্ধু–ঢেউ
তোমার মতন কেউ।
নাই আর।
এ সময় কাকি এসে দরজায় ধাক্কা দিয়েছেন, দরজা লাগিয়ে এত কী গল্প তোদের?
.
০২.
একদিন ডিব্রুগড়ের সবাই মিলে নৌবিহারে যাবার পরিকল্পনা হলো, জীবনানন্দ বললেন তিনি যাবেন না। শোভনাও বললেন তারও শরীর ভালো লাগছে না, তিনি যাবেন না। দুজনেরই মতলব ছিল সবাই চলে গেলে দুজনে একান্তে কিছু সময় কাটাবেন। কিন্তু কাকিমা আঁচ করলেন, তিনি জোর করেই শোভনাকে নিয়ে গেলেন নৌবিহারে। কিন্তু কাকিমা জানেন না যে তাঁর চোখ এড়িয়ে ইতিমধ্যে জীবনানন্দ আর শোভনার ভেতর ঘটেছে নানা রসায়ন। তার হদিস আছে জীবনানন্দের ডায়েরিতে। সাংকেতিক ভাষায়, ইংরাজি-বাংলায় মেশানো লেখা সেই ডায়েরিতে আছে শোভনাকে ঘিরে জীবনানন্দের আবেশের খবর। আসামে যে সময়টা ছিলেন সেই ১৯২৯ সালের শেষ এবং ১৯৩০-এর শুরুর সময়ের ডায়েরিতে লেখা কয়েকটা লাইন, A (blind) love does so much injury-। লিখছেন অন্ধ প্রেম আমাদের কী যে ক্ষতি করে! এই অন্ধ প্রেম তখন তার জেগেছে শোভনাকে ঘিরে। Tedious noon days- laying- laying laying!… Books (not a page of them) And pathetic evening, tragic deep and restless nights-। দুপুরে শুধু শুয়ে থাকছেন, হাতে বই তার, একটা পৃষ্ঠাও উল্টাচ্ছেন না এবং তারপর করুণ বিকেল, গভীর, অস্থির রাত। And that particular night (মশারি খাঁটিয়ে চলে গেল and I remained awake through) and dawn following। কোনো এক বিশেষ রাতে শোভনা এসে মশারি খাঁটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর সারা রাত আর ঘুম হয়নি তাঁর, কখন সকাল হয়ে গেছে টের পাননি।
গোঁফ কামিয়েছ : how odd; hair unfurffled; how very odd! সেভ করে গোঁফ ফেলে দিলে শোভনা নিশ্চয়ই বলেছিলেন, গোঁফ কামিয়েছ? কী বিচ্ছিরি লাগছে তোমাকে! Everyday when placing a glass of water on the table: এমন এক গ্লাস জল কেউ রেখে যেত মনে পড়ে?
প্রতি রাতে বিছানার পাশে এক গ্লাস জল রেখে দিয়ে শোভনা হয়তো ফোড়ন কেটেছিলেন এভাবে, জল রেখে যাওয়ার কথা তার মনে পড়বে কি না।
বোঝা যায়, এসব টুকটাক অন্তরঙ্গতা, অর্থহীন কথা, সময় কাটানো ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল শোভনা আর জীবনানন্দকে।
তারপর একদিন ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় লিখছেন সেই গোপন খবর, Love & kiss & everything-but all she refuses on her health ground, hot water bag and all that.
লিখছেন ভালোবাসা, চুম্বন এবং আরও সবকিছু। সেই দরজা বন্ধ করে কবিতা শোনানোর কোনো এক প্রহরে জীবনানন্দ শোভনাকে চুমু খেয়েছেন তারপর আরও অগ্রসর হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন কিন্তু শোভনা প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যাপারে। হট ওয়ার ব্যাগ ইত্যাদির কথা লিখছেন। তখন কি শোভনার পিরিয়ড চলছিল? তলপেটে ব্যথা ছিল। এসব না থাকলে ব্যাপারটা তাহলে ঘটত?
.
০৩.
কাকার বাড়িতে শুয়ে-বসে, কবিতা লিখে, কবিতা পড়ে, সে কবিতা শোভনাকে শুনিয়ে, কখনো লুকিয়ে শোভনার শরীরের ছোঁয়া নিয়ে যখন দিন কাটছে জীবনানন্দের, তখন একদিন বরিশাল থেকে জীবনানন্দের বাবা লিখলেন যে দিল্লির রামযশ কলেজে তার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছেন তিনি। ছেলের জন্য একটা চাকরির খোঁজখবর সত্যানন্দ বরাবর করে আসছিলেন। বরিশালের নামজাদা লোক অশ্বিনীকুমার দত্তের এক আত্মীয় সুকুমার দত্ত দিল্লির রামযশ কলেজে ইংরাজি বিভাগের প্রধান, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই কলেজে একটা চাকরির ব্যবস্থা করলেন তিনি এবং জীবনানন্দকে বললেন আর দেরি না করে দ্রুত সেখানে যোগ দিতে। বিপদে পড়ে ছেলেবেলায় মা জীবনানন্দকে নিয়ে একবার দিল্লি-আগ্রা ঘুরেছেন, এবার আরেক বিপদের সময় আবার তার দিল্লি যাবার পালা। বেকার মানুষ জীবনানন্দ, তাঁর আর পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ কী? আসাম থেকে বরিশাল ফিরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলেন দিল্লি। হোক নিজ বাড়ি থেকে দূরে, তবু একটা নিয়মিত চাকরি তো।
কিন্তু রামযশ কলেজে যোগ দিয়েই চুপসে গেলেন তিনি। এক ফিলাথ্রপিস্টের উদ্যোগে তৈরি দিল্লির আনন্দ পর্বত এলাকায় এই রামযশ কলেজ, যেখানে তখন কোনো শহরই গড়ে ওঠেনি। জীবনানন্দ সেই বিরান এলাকায় গিয়ে উঠলেন। তখন দিল্লিতে প্রচণ্ড শীত, শীতে কাবু হয়ে রইলেন তিনি। লোকজনও কাউকে চেনেন না, সুকুমার বাবুর সঙ্গেও আগে পরিচয় নেই। সব মিলিয়ে বেশ একটা বেকায়দা অবস্থা তখন তাঁর। শুরু থেকেই নানা রকম ঝামেলার ইঙ্গিত পেতে লাগলেন জীবনানন্দ। যোগ দেবার পর থেকেই দেখলেন চাকরি দেবার সুবাদে সুকুমার বাবু নানাভাবে তার ওপর বেশ একটা কর্তৃত্বপরায়ণ ভাব করছেন, ভাবটা এমন যে চাকরি দিয়ে তিনি জীবনানন্দকে উদ্ধার করেছেন। শুরু থেকেই সুকুমার বাবুর সঙ্গে জীবনানন্দের সম্পর্কটা একটা অস্বস্তির মোড়কে ঢাকা রইল। একদিন দিল্লির এক শিক্ষককে বলতে শুনলেন, বাঙালিগুলো তাদের দেশে ভাত পায় না এখন আমাদের উপরে এসে পড়েছে। জীবনানন্দ সতর্ক হয়ে গেলেন শিক্ষকদের সাথে মিশবার ব্যাপারে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ছাত্রদের সঙ্গে তিনি ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছিলেন না। কলেজের অন্য শিক্ষকেরা সব স্যুট-টাই পরে আসেন ক্লাস নিতে আর জীবনানন্দ পরেন ধুতি-পাঞ্জাবি। তিনি যথেষ্ট স্মার্ট নন, এমন একটা ইমেজ ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হলো। শিক্ষক হিসেবেও খুব চৌকস ছিলেন না জীবনানন্দ। সেই কলেজে স্থানীয় কিছু পান্ডা ছাত্র ছিল, জীবনানন্দ ক্লাসে গেলে ছাত্ররা নানা রকম হইহট্টগোল করত। ছাত্রদের হট্টগোলে কোনো কোনো দিন তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়েও এসেছেন। এত সব অপদস্থতার পরও জীবনানন্দ মুখ বুজে চাকরিটা করে গেছেন। চাকরি তখন তার খুব দরকার।
.
০৪.
এমনিতে একাকী মানুষ তিনি, দিল্লিতে গিয়ে আরও একাকী হয়ে পড়লেন জীবনানন্দ। কাটাতে লাগলেন নিরানন্দ দিন। তবে বরাবরের মতোই তার চারপাশ যখন বৈরী হয়ে ওঠে, কবিতা তখন হয়ে ওঠে তার স্বজন। কবিতা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। দিল্লির নিঃসঙ্গতায় আবার কবিতা লিখতে শুরু করলেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে তার কবিতা লেখা তাঁর নিজের বাস্তব জীবন নিরপেক্ষ। এ লেখার ডাক আসে ভেতর থেকে। দেখতে পাচ্ছেন দিল্লির ওই একাকী জীবনে তাকে তখন ভর করেছে প্রেম, অভিমান। কিছুদিন আগে কাটিয়ে আসা আসামের দিনগুলো তাকে তাড়া করছে তখন। তাড়া করছে শোভনার স্মৃতি। শোভনার সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতি রোমন্থনে মন ভিজে আছে তখন তার। নিঃসঙ্গ প্রবাসে শোভনাকে ঘিরে কল্পজগৎ রচনা করছেন তিনি। দিল্লি থেকে শোভনাকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছেন জীবনানন্দ। প্রেম নিবেদন করেছেন। অনেকগুলো চিঠির পর শোভনার কাছ থেকে উত্তর পেয়েছেন একটা কি দুটার। কিন্তু শোভনার সেসব চিঠি নিরুত্তাপ, সেখানে জীবনানন্দের প্রেমের প্রতি তার কোনো সাড়া নেই।
শোভনা আসামের দিনগুলোতে আরণ্যক ওই পরিবেশে, প্রাণের উচ্ছ্বাসে, প্রাকৃতিক আকর্ষণে চোরাগোপ্তা জীবনানন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সবদিক ভেবে দেখেছেন যে জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তিনি জানেন যে তাদের যে আত্মীয়তার সম্পর্ক, তাতে ধর্মীয় শাস্ত্রমতে দুজনের বিয়ে অসম্ভব। জীবনানন্দের জন্য ধর্ম অমান্য করে বিদ্রোহী হবার মতো কোনো প্রেরণা শোভনা নিজের ভেতর দেখেননি। ক্ষণিক আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন হয়তো কিন্তু তার মতো বিত্তবান বাবার রূপসী, কনভেন্টে পড়া চৌকস মেয়ে, জীবনানন্দের মতো বরিশালের লাজুক, নিম্নবিত্ত পরিবারের একজনকে জীবনা সাথি হিসেবে কল্পনা করেননি হয়তো। ফলে জীবনানন্দের মনে যত উন্মাদনাই দেখা দিক না কেন, শোভনা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
কিন্তু দিল্লির বিরান প্রবাসে বসে শোভনা জীবনানন্দকে কতটা কাবু করে রেখেছেন তার প্রমাণ আবারও মেলে তার ডায়েরিতে। ১৯৩০-এ দিল্লিতে লেখা ডায়েরির কতগুলো এন্ট্রি, What BY might be doing: her letters mystery of it all-her coolness or lovelessness: torment incarnated-…will she ever understand?
শোভনার ডাকনাম বেবী তখন সংক্ষেপে হয়ে গেছে বিওয়াই। দিল্লিতে বসে জীবনানন্দ ভাবছেন আসামে বিওয়াই কী করছে এখন? তার রহস্যময় চিঠি-তার নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া বা ভালোবাসাহীনতা। কিন্তু নিজে জীবনানন্দ তো বেদনার এক জলজ্যান্ত মূর্তি হয়ে উঠছেন…শোভনা কি কোনো দিন তা বুঝবে?
Why I love her: all her commonness and coolness. আবার ভাবছেন কী কারণেই বা নেহাত সাদামাটা, শীতল এই মেয়েটাকে ভালোবাসছি আমি?
Stale moming-Dream (BY): unique I near touch, smell flesh & soul: the wait & agony… একটা নষ্ট সকাল, বেবীকে স্বপ্ন দেখেছেন। যেন তাকে স্পর্শ করছেন, তাঁর শরীরের, আত্মার ঘ্রাণ নিচ্ছেন। এই অপেক্ষা আর তীব্র বেদনা…
শোভনার প্রতি একাধারে ভালোবাসা আর নিরাসক্ততার দোলাচলে আছেন তখন জীবনানন্দ। শোভনার শরীরের নৈকট্য পেয়েছেন জীবনানন্দ, তাকে আলিঙ্গন করেছেন, চুম্বন করেছেন। সে সুযোগ শোভনা তাকে দিয়েছেন। স্বভাবতই প্রত্যাশা বেড়েছে জীবনানন্দের, আরও নিবিড় করে পাবার আকাঙ্ক্ষা হয়েছে। শোভনার এই ঘনিষ্ঠতার অনুমোদনকে জীবনানন্দ তার প্রেমেরই স্বীকৃতি হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশ টের পেয়েছেন শোভনা তার সক্ষমতার সীমানার বাইরে।
.
০৫.
এ সময় জীবনানন্দ যে কবিতাগুলো লিখেছেন সেগুলো এমনিতেই স্বয়ম্ভু। তবু তাঁর ডায়েরির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এর ব্যক্তিগত মাত্রা এড়িয়ে যাবার উপায় থাকে না। কবিতাগুলোর পেছনে ভেসে ওঠে শোভনার মুখ। তিনি লিখেছেন :
তুমি তো জান না কিছু, না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই!–
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে!
আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
লিখেছেন :
তোমার শরীর,
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার;-তারপর,-মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন।
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে জানিনি তা,–হয়েছে মলিন
চক্ষু এই;–ছিড়ে গেছি,-ফেঁড়ে গেছি,–পৃথিবীর পথে পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন রাত্রি গেছে কেটে!
গভীর আবেগে যাঁকে কবিতা শুনিয়েছেন একদিন, তিনি আসলে সোনারূপী পিতলমূর্তিমাত্র, এমনই মনে হচ্ছে তার :
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে–একবার বেদনার পানে
অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল;
পৃথিবীর পথে পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা;-এইসব বধির নিশ্চল
সোনার পিত্তলমূর্তি : তবু, আহা, ইহাদেরি কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল;
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে–একবার বেদনার পানে।
তবু মনে পড়ছে সেসব রোদেলা দিন আর মেহগনিগাছের সেই ছায়া। একি আসামের অরণ্যেরই প্রেক্ষাপট?
অনেক কমলারঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক;
অনেক কমলারঙের রোদ ছিল,
অনেক কমলারঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।
ভালোবাসার মানুষকে যে ক্ষণকাল পেয়েছেন তারই সুখস্মৃতি তখন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনিঃ
একদিন–একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা!
একরাত–একদিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা।
একদিন–একরাত;–তারপর প্রেম গেছে চলে,
সবাই চলিয়া যায়, সকলের যেতে হয় বলে