১. বাস্তবতা কী? জাদু কী?

প্রথম অধ্যায় – বাস্তবতা কী? জাদু কী? 

বাস্তবতা হচ্ছে সেই সবকিছু, যাদের অস্তিত্ব আছে। বেশ সহজবোধ্য শোনায় কথাটি, তাই-না? আসলে বিষয়টি এত সহজবোধ্য নয়। বেশকিছু সমস্যা আছে। ডায়নোসরদের ব্যাপারটি তাহলে কী, একসময় তাদের অস্তিত্ব ছিল ঠিকই কিন্তু এখন তো আর তাদের অস্তিত্ব নেই। আর নক্ষত্রগুলো, এত দূরে যাদের অবস্থান যে, যখন তাদের আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় আর আমরা তাদের দেখতে পারি, তখন তাদের আলো হয়তো নিভে গেছে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ডায়নোসর আর নক্ষত্রদের নিয়ে আলোচনা করব, কিন্তু যাই হোক-না কেন, কিভাবে আমরা জানি যে, কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে, এমনকি এই বর্তমানেও? বেশ, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়- দৃষ্টি, ঘ্রাণ, স্পর্শ, শ্রবণ আর স্বাদ—বহু জিনিসের বাস্তব অস্তিত্ব আমাদের জন্যে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে বেশ ভালোভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করে : যেমন—কোনো পাথরের টুকরো কিংবা উট, নতুন কাটা ঘাস আর কেবলমাত্র বানানো কফি, শিরিষ কাগজ আর মখমল, জলপ্রপাত এবং দরজার ঘণ্টি, চিনি এবং লবণ, কিন্তু আমরা কি শুধুমাত্র এমনকিছুকেই ‘বাস্তব’ বলব, যদি পঞ্চইন্দ্রিয়ের যে-কোনো একটির দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে আমরা সেগুলো শনাক্ত করতে পারি? 

তাহলে বহু দূরের ছায়াপথগুলোর ক্ষেত্রে কী হবে, খালি চোখে দেখার মতো দূরত্বে যারা অবস্থান করে না? একটি ব্যাকটেরিয়ামের [বহুবচনে ব্যাকটেরিয়া] ক্ষেত্রেই-বা কী হবে, যা এতই ক্ষুদ্র যে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া যাদের দেখাই সম্ভব নয়? আমাদের তাহলে কি অবশ্যই বলতে হবে যে, তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, কারণ আমরা তাদের দেখতে পাই না? না, বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করার মাধ্যমে অবশ্যই আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়কে শক্তিশালী করতে পারি : ছায়াপথ দেখার জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্ৰ আর ব্যাকটেরিয়াদের দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র। যেহেতু আমরা জানি ও বুঝি দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র কিভাবে কাজ করে, আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারি আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সীমানা বৃদ্ধি করতে—এই ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিশক্তি এবং এই যন্ত্রগুলো যা-কিছু দেখতে আমাদের সক্ষম করে তোলে, সেটি ছায়াপথ আর ব্যাকটেরিয়াদের অস্তিত্ব আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। 

তাহলে বেতারতরঙ্গের ক্ষেত্রে কী হবে? সেগুলোর কি অস্তিত্ব আছে? আমাদের চোখ তো তাদের শনাক্ত করতে পারে না, আমাদের কানও সেটি করতে পারে না, কিন্তু আবারো বিশেষ কিছু যন্ত্র, যেমন—টেলিভিশন সেট সেগুলোকে এমন একটি সংকেতে রূপান্তরিত করে, যা আমরা দেখতে আর শুনতে পারি। সুতরাং যদিও আমরা বেতারতরঙ্গ দেখতে ও শুনতে পাই না, আমরা জানি যে, তারা বাস্তবতারই একটি অংশ। দূরবীক্ষণ এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতোই, আমরা জানি কিভাবে রেডিও আর টেলিভিশন কাজ করে। সুতরাং এগুলো যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে তার একটি চিত্র নির্মাণ করার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সহায়তা করে : বাস্তব পৃথিবী— বাস্তবতা। রেডিও-দূরবীক্ষণ যন্ত্র [এবং এক্স-রে দূরবীক্ষণ যন্ত্ৰ আমাদেরকে নক্ষত্র আর ছায়াপথ দেখার সুযোগ করে দেয়, যা মনে হতে পারে, ভিন্ন চোখ দিয়ে দেখার মাধ্যমে : বাস্তবতা সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করার অন্য আরেকটি উপায়। 

ওই ডায়নোসরদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমরা কিভাবে জানি যে তারা একসময় এই পৃথিবীতে বাস করত? আমরা তাদের কখনো দেখিনি অথবা শুনিনি বা তাদের আক্রমণ থেকে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য হইনি। দুর্ভাগ্য, কোনো টাইম-মেশিন আমাদের কাছে নেই, যা কিনা সরাসরি এই ডায়নোসরদের দেখাতে পারত। তবে এখানে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সহায়তা করার জন্য আছে ভিন্ন ধরনের একটি সহায়ক : আমাদের কাছে আছে বহু ফসিল বা জীবাশ্ম এবং সেগুলো [‘তাদের’] আমরা খালি চোখেই দেখতে পারি। জীবাশ্ম দৌড়ায় না বা লাফিয়ে বেড়ায় না ঠিকই কিন্তু যেহেতু আমরা জানি কিভাবে জীবাশ্ম তৈরি হয়, বহু মিলিয়ন বছর আগে কী ঘটেছিল সেই সম্বন্ধে সেগুলো আমাদের বেশকিছু তথ্য দিতে পারে। এখন আমরা বুঝি দ্রবীভূত নানা খনিজসহ পানি কিভাবে কাদা ও শিলার স্তরের নিচে সমাহিত কোনো জীবের মৃতদেহর মধ্যে চুইয়ে চুইয়ে প্রবেশ করে। আমরা জানি কিভাবে খনিজ পদার্থগুলো স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পানি থেকে স্ফটিক হিসেবে বের হয়ে আসে এবং মৃতদেহের খনিজ পদার্থগুলোর প্রতিটি অণুকে ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে প্রতিস্থাপিত করে, 

18 

দ্য ম্যাজিক অব রিয়েলিটি

পাথরের উপর ছাপের মতো শুধুমাত্র মূল জীবটির আকৃতি আর কাঠামোর প্রামাণিক সাক্ষ্য রেখে যায়। সুতরাং, ইন্দ্রিয় দিয়ে ডায়নোসরদের সরাসরি দেখতে না পারলেও, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর [আমরা সেই প্রাচীন জীবনের চিহ্ন দেখতে ও স্পর্শ করতে পারি] কাছে পৌঁছানো এইসব পরোক্ষ প্রমাণগুলো ব্যবহার করে আমরা ঠিকই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, তাদের অবশ্যই অস্তিত্ব ছিল। 

ভিন্ন একটি অর্থে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র এক ধরনের টাইম-মেশিন হিসেবে কাজ করতে পারে। আমরা যখন কোনোকিছুর দিকে তাকাই, আসলে আমরা যা দেখি সেটি হচ্ছে আলো, আর কোনো দূরত্ব অতিক্রম করার জন্যে আলোর খানিকটা সময় লাগে। এমনকি যখন আপনি আপনার বন্ধুর মুখের দিকে তাকান, আপনি সেই মুখটি অতীতের কোনো একটি সময়ে দেখছেন, কারণ তার মুখ থেকে ফিরে আসা আলো আপনার চোখে এসে পৌঁছাতে এক সেকেন্ডের খুব ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ পরিমাণ সময় নেয়। শব্দ দূরত্ব অতিক্রম করে আরো অনেক ধীরে, সে-কারণে শব্দ শোনার আগে আপনি আগেই লক্ষ করার মতো আকাশে আতশবাজির বিস্ফোরণ দেখতে পান। যখন দূর থেকে কাউকে গাছ কাটতে দেখেন, গাছের উপরে কুঠারের আঘাত এবং তার কারণে সৃষ্ট শব্দের মধ্যে বেমানান একটি বিলম্ব থাকে। 

আলো এত দ্রুত দূরত্ব অতিক্রম করে যে আমরা সাধারণত মনে করি আমরা যা-কিছু দেখছি সেটি ঘটছে ঠিক যে মুহূর্তে আমরা তা দেখছি, কিন্তু নক্ষত্রদের ব্যাপারটি আলাদা। এমনকি সূর্যও আট লাইট-মিনিট দূরে। যদি সূর্য কখনো বিস্ফোরিত হয়, আট মিনিট অতিক্রান্ত হবার আগে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি আমাদের বাস্তবতার অংশ হবে না এবং সেটি আমাদের জন্যেও চূড়ান্ত একটি সময়! আর যদি আমাদের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত পরবর্তী নক্ষত্রটির কথা ভাবি, ‘প্রক্সিমা সেন্টরি’, আপনি যদি এটির দিকে ২০১২ সালের কোনো একটি সময় তাকান, আপনি যা দেখবেন সেটি ঘটেছিল ২০০৮-এ। ছায়াপথগুলো হচ্ছে অসংখ্য নক্ষত্রের সম্ভার। মিল্কিওয়ে নামের একটি ছায়াপথে আমরা অবস্থান করছি। যখন আপনি মিল্কিওয়ে ছায়াপথের নিকট-প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের দিকে তাকাবেন, আপনার দূরবীক্ষণ যন্ত্র তখন টাইম-মেশিন, যা আপনাকে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে নিয়ে যাবে। পাঁচটি ছায়াপথের একটি গুচ্ছ আছে, যার নাম ‘স্টেফানস কুইন্টেট’, যাদের আমরা ‘হাবল’ দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে পারি, বিস্ময়করভাবে তারা পরস্পরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, কিন্তু আমরা তাদের পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেতে দেখছি ২৮০ মিলিয়ন বছর আগের কোনো একটি সময়ে। পরস্পরের সাথে ধাক্কা খাওয়া এই ছায়াপথগুলোর কোনো একটিতে বাস করা যদি কোনো ভিনগ্রহবাসী আমাদেরকে দেখার মতো শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখত, পৃথিবীতে তারা কী দেখত ঠিক এই মুহূর্তে, এখানে এবং এখন, ডায়নোসরদেরও আদি পূর্বসূরিদের। 

আসলেই কি মহাশূন্যে ভিনগ্রহীরা বাস করে? আমরা তাদের দেখিনি কিংবা তাদের কোনোকিছু শুনিনি। তারা কি বাস্তবতার একটি অংশ? কেউ জানে না, কিন্তু আমরা জানি, যদি তাদের অস্তিত্ব থাকে, কোন ধরনের জিনিসগুলো সেটি আমাদের বলতে পারবে। যদি কোনো একজন ভিনগ্রহবাসীর কাছে যাই, ইন্দ্রিয়গুলো সেটি সম্বন্ধে আমাদের বলতে পারবে। হয়তো কেউ একদিন এমন একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করবেন যা এখান থেকেই অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব শনাক্ত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হবে। অথবা হয়তো আমাদের রেডিও-টেলিস্কোপ এমন কোনো বার্তা শনাক্ত করতে পারবে, যার উৎস কেবলমাত্র ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমত্তাই হতে পারে। কারণ বাস্তবতা আমরা ইতোমধ্যে যা কিছু জানি শুধুমাত্র সেই সবকিছুই দিয়ে তৈরি নয়, এখানে সেই সবকিছুই আছে যাদের সম্বন্ধে আমরা এখনো কিছু জানি না বা ভবিষ্যতের কোনো সময় ছাড়া সেগুলো সম্বন্ধে আমরা জানতেও পারব না, হয়তো যখন পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে সহায়তা করার জন্যে আমরা আরো অনেক বেশি শক্তিশালী যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারব। 

পরমাণুদের অস্তিত্ব ছিল সবসময়ই, কিন্তু শুধুমাত্র খুব সাম্প্রতিক একটি সময়ে তাদের অস্তিত্বের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এবং সম্ভাবনা আনেক বেশি যে আমাদের উত্তরসূরিরা আমাদের চেয়ে আরো অনেক কিছু সম্বন্ধে জানবে, বর্তমানে এখন যা আমাদের জানা নেই। আর সেটাই হচ্ছে বিজ্ঞানের বিস্ময় আর আনন্দ : এটি চলমান একটি প্রক্রিয়া যা একের পর এক নতুন জিনিস আবিষ্কার করে চলে। এর মানে এই নয় যে, আমাদের ‘যে-কোনো’ কিছুই বিশ্বাস করা উচিত যা হয়তো কেউই কল্পনা করতে পারেন। বহু মিলিয়ন জিনিস আছে যা আমরা কল্পনা করতে পারি, কিন্তু যাদের বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, যেমন—পরী, দৈত্য- দানব, লেপরেকন [আইরিশ পুরাণে বর্ণিত এক ধরনের কাল্পনিক চরিত্র] আর হিপপোগ্রিফ [ইউরোপে পুরাণে বর্ণিত কাল্পনিক প্রাণী যার সামনের অংশ ঈগল এবং পেছনের অংশ ঘোড়া]। আমাদের সবসময়ই খোলা মনের হওয়া উচিত, কিন্তু কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে এমনকিছু বিশ্বাস করার একমাত্র ভালো কারণ হচ্ছে, যদি সত্যিকারের প্রমাণ থাকে যে এর আসলেই অস্তিত্ব আছে। 

মডেলস : আমাদের কল্পনাগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা 

কোনটি সত্য সেটি নির্ধারণে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একটি উপায়, যা সাধারণত বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন, যখন আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় সেটি সরাসরি শনাক্ত করতে পারে না; এটি হচ্ছে যা ‘হয়তো’ ঘটছে, তার একটি ‘মডেল’ ব্যবহার করা, যা পরবর্তীতে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আমরা কল্পনা করি—আপনি হয়তো বলতে পারেন অনুমান করি সেখানে কী ঘটতে বা থাকতে পারে। এটাকেই বলে মডেল। এরপর আমরা [প্রায়শই পরিমাপ করার যন্ত্র আর উপকরণ ব্যবহার করে] প্রস্তাবিত সেই মডেলটি সত্যি কিনা সেটি সমাধান করার চেষ্টা করি। তারপর মডেল যা দাবি করছে আসলেই আমরা সেটি দেখছি কিনা তা যাচাই করে দেখি। আক্ষরিকভাবে কোনো মডেল হতে পারে কাঠ কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো কোনো রেপ্লিকা বা অনুলিপি। অথবা এটি হতে পারে কাগজের উপর হিসাব-নিকাশ করা কিছু গণিত অথবা কোনো একটি কম্পিউটারে ‘সিমুলেশন’ অর্থাৎ কাল্পনিক সেই একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আমরা খুব সতর্কতার সাথে মডেলটি লক্ষ করি এবং ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করি, যদি এই প্রস্তাবিত মডেলটি সঠিক হয়, আমাদের তাহলে কী দেখা বা শোনা উচিত ইত্যাদি। তারপর আমরা দেখব সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সঠিক, নাকি ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। যদি সেগুলো সঠিক হয়, তাহলে এই বিষয়ে মডেলটি আসলেই বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করছে, আমাদের এমন আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেবে। এরপর আমরা আরো কিছু বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিকল্পনা করি, পরিবর্ধন আর পরিমার্জনার মাধ্যমে হয়তো মডেলটিকে আরো সূক্ষ্মতর করে তুলি, ফলাফলগুলোকে আবারও পরীক্ষা করে দেখি এবং সেগুলো আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করি। যদি আমাদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ভুল হয়, আমরা মডেলটি প্রত্যাখ্যান করি অথবা প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তন করি এবং তারপর আবার চেষ্টা করি। 

এখানে একটি উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক, আমরা জানি যে, জিন বংশগতির একক ডিএনএ নামক একটি জিনিস দিয়ে তৈরি। ডিএনএ সম্বন্ধে আর কিভাবে এটি কাজ করে সেই বিষয়ে আমরা এখন অনেক কিছু জানি, কিন্তু ডিএনএ আসলে দেখতে কেমন, সেটি শক্তিশালী কোনো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও আপনি বিস্তারিতভাবে দেখতে পারবেন না। ডিএনএ সম্বন্ধে আমরা যা-কিছু জানি তার প্রায় সবকিছু এসেছে পরোক্ষভাবে কল্পনায় নানা মডেল তৈরি করে ও তারপর সেগুলো পরীক্ষা করে দেখার মাধ্যমে। 

আসলেই, ডিএনএ সম্বন্ধে কেউ কোনোকিছু জানার বহুদিন আগেই, বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র মডেলে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার মাধ্যমে জিন সম্বন্ধে ইতোমধ্যেই অনেক কিছুই জানতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই সময়ে, একজন অস্ট্রীয় যাজক, যাঁর নাম ছিল গ্রেগর মেন্ডেল, তাঁর সন্ন্যাসাশ্রমের বাগানে প্রচুর পরিমাণে মটরশুঁটির চাষ করে বেশকিছু পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি একের পর এক প্রজন্মে গাছদের সংখ্যা গণনা করেন যাদের ফুলের রঙগুলো ছিল ভিন্ন অথবা যাদের [মটরশুঁটির] বীজের চামড়া ছিল কুঞ্চিত অথবা মসৃণ। মেন্ডেল কখনোই কোনো জিন দেখেননি এবং স্পর্শ করেননি। শুধু মটরশুঁটির বীজ আর ফুলগুলো তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং এই দুইটি বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন এই প্রকারগুলো গণনা করার জন্যে তিনি তাঁর ‘চোখ’ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তিনি একটি ‘মডেল’ উদ্ভাবন করেছিলেন, যার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল সেই জিনিসটি, যাকে আমরা এখন ‘জিন’ বলছি [যদিও মেন্ডেল তাদের সে নামে কখনো ডাকেননি] এবং তিনি হিসাব করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যদি তাঁর মডেলটি সঠিক হয়ে থাকে, কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রজনন পরীক্ষায়, কুঞ্চিত মটরশুঁটি বীজের চেয়ে তিনগুণ বেশি মসৃণ মটরশুঁটি বীজ পাওয়া যাবে এবং গণনা করার পর সেটাই তিনি পেয়েছিলেন। বিস্তারিত বিষয়গুলো আপাতত আলোচনার বাইরে রেখে, এখানে মূল বক্তব্যটি হচ্ছে, মেন্ডেলের ‘জিন’ ছিল তাঁর কল্পনারই একটি উদ্ভাবন : তিনি নিজের চোখে সেটি দেখেননি, এমনকি অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ ব্যবহার করেও নয়, কিন্তু তিনি মসৃণ আর কুঞ্চিত চামড়ার মটরশুঁটি বীজ দেখতে পেরেছিলেন এবং সেগুলো গণনা করার মাধ্যমেই পরোক্ষ প্রমাণ পেয়েছিলেন যে তাঁর বংশগতির ‘মডেল’ বাস্তব পৃথিবীর ‘কোনোকিছুর ভালো প্রতিনিধিত্ব করছে। পরে বিজ্ঞানীরা মেন্ডেলের পদ্ধতিটির সামান্য কিছু রদবদল করেন এবং অন্যান্য প্রাণীদের ওপরেও গবেষণা পরিচালনা করেন, যেমন—মটরশুঁটির বদলে ফ্রুট ফ্লাই [এক ধরনের মাছি], প্ৰদৰ্শন করতে যে জিনগুলো ক্রোমোজোম নামের সুতার মতো একটি অণুর উপর নির্দিষ্ট একটি সজ্জায় সজ্জিত থাকে [আমাদের, অর্থাৎ মানুষের ৪৬টি ক্রোমোজোম আছে, ফ্রুট ফ্লাইয়ের যেমন আছে ৮টি]। এমনকি এই মডেলটি পরীক্ষা করে বলা সম্ভব ছিল ঠিক কী সজ্জায় জিনগুলো ক্রোমোজোমের উপর সজ্জিত থাকে। এইসবই সম্ভব হয়েছিল জিনগুলো যে ডিএনএ দিয়ে তৈরি সেটি জানার বহু আগেই। 

এখন আমরা এই তথ্যটি সম্বন্ধে জানি এবং জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক এবং তাঁদের পরে আসা আরো বহু বিজ্ঞানীদের কল্যাণে ডিএনএ কিভাবে কাজ করে, সেটি আমরা সঠিকভাবেই জানি। ওয়াটসন আর ক্রিক তাঁদের নিজেদের চোখে ডিএনএ দেখেননি, আবারও বিভিন্ন মডেল পরিকল্পনা এবং সেগুলো পরীক্ষা করে দেখার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের আবিষ্কারটি করেছিলেন। তাদের ক্ষেত্রে, ডিএনএ কেমন দেখতে হতে পারে তা ধারণা করে আক্ষরিকার্থে তাঁরা লোহা আর কার্ডবোর্ড দিয়ে বেশকিছু মডেল তৈরি করেছিলেন এবং তাঁরা হিসাব-নিকাশ করেছিলেন, যদি সেই মডেলগুলো সঠিক হয়ে থাকে তাহলে বাস্তব ডিএনএ অণুটির সুনির্দিষ্ট কিছু পরিমাপের পরিমাণ ঠিক কী হওয়া উচিত। তাঁদের একটি মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী, তথাকথিত সেই ‘ডাবল হেলিক্স’ মডেলটির পরিমাপগুলো সঠিকভাবে মিলে গিয়েছিল রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন আর মরিস উইলকিন্সের করা পরিমাপগুলোর সাথে, যাঁরা বিশুদ্ধকৃত ডিএনএ স্ফটিকের উপর এক্স-রে রশ্মি ফেলে ছবি তোলার জন্য বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। ওয়াটসন এবং ক্রিক সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের ডিএনএ মডেল ঠিক সেই একই ধরনের ফলাফল দেবে, সন্ন্যাসাশ্রমের বাগানে গ্রেগর মেন্ডেল একসময় যা দেখেছিলেন। 

কোনটি বাস্তব সেটি আমরা জানতে পারি তিনটি উপায়ের যে-কোনো একটি ব্যবহার করে। আমরা এটি শনাক্ত করতে পারি সরাসরি আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে, অথবা পরোক্ষভাবে, বিশেষ যন্ত্রের সহায়তায় আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর শক্তি আরো সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে, যেমন দূরবীক্ষণ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র; অথবা আরো পরোক্ষভাবে, মডেল তৈরি করে যা ‘হয়তো’ বাস্তব সত্য হতে পারে এবং তারপর সেই মডেলগুলো পরীক্ষা করে দেখে যে, তারা সফলভাবে কোনোকিছু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কিনা যা আমরা দেখতে [অথবা শুনতে পারি, ইত্যাদি] পারি কোনো যন্ত্র ব্যবহার করে অথবা না করে। পরিশেষে, আসল যাচাইয়ের বিষয়টি কোনো-না-কোনো উপায়ে সবসময়ই আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর কাছেই ফিরে আসে। 

এর মানে কি তাহলে বাস্তবতা সেইসব জিনিসগুলোই শুধুমাত্র ধারণ করে, সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে যা শনাক্ত করা যেতে পারে, আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা অথবা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে? তাহলে ঈর্ষা বা আনন্দ, সুখ বা ভালোবাসা, এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কী হবে? এগুলোও তো বাস্তব, তাই নয় কি? 

হ্যাঁ, এগুলোও সব বাস্তব, কিন্তু অস্তিত্বের জন্য মস্তিষ্কের ওপর এরা নির্ভরশীল : মানব-মস্তিষ্ক, অবশ্যই এবং সম্ভবত, অন্যান্য অগ্রসর প্রাণী প্রজাতির মস্তিষ্কও, যেমন—শিম্পাঞ্জি, কুকুর এবং তিমি। পাথর বা জড় পদার্থগুলো কোনো আনন্দ অথবা ঈর্ষা অনুভব করতে পারে না, আর কোনো পর্বত ভালোবাসতে পারে না। এই আবেগগুলো তীব্রভাবে বাস্তব তাঁদের কাছে যাঁরা সেগুলো অনুভব করেন, এর অভিজ্ঞতা লাভ করেন, কিন্তু মস্তিষ্কের অস্তিত্বের আগে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটি অবশ্য সম্ভব যে এই ধরনের আবেগগুলোর এবং হয়তো অন্য আবেগগুলোর যা আমরা কল্পনা করতেও শুরু করিনি, অস্তিত্ব হয়তো থাকতে পারে অন্য কোনো গ্রহে, কিন্তু শুধুমাত্র যদি সেইসব গ্রহে মস্তিষ্কও থাকে বা মস্তিষ্কের সমতুল্য কোনোকিছু : কারণ কে জানে কী অদ্ভুত চিন্তা করার অঙ্গ অথবা অনুভব করা যন্ত্র হয়তো লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের অন্য কোথাও? 

বিজ্ঞান এবং অতিপ্রাকৃত : ব্যাখ্যা এবং তার শত্রু 

সুতরাং এটি হচ্ছে বাস্তবতা, আর এভাবেই আমরা জানতে পারি কোনোকিছু বাস্তব কি না। এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় হবে বাস্তবতার কোনো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়, যেমন—সূর্য অথবা ভূমিকম্প অথবা রংধনু অথবা বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। এবার শিরোনামে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ অন্য শব্দটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই আমি, শব্দটি হচ্ছে : ম্যাজিক বা জাদু। জাদু খুব পিচ্ছিল একটি শব্দ : এটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় তিনটি ভিন্ন উপায়ে; তবে প্রথমে শব্দটি ব্যবহার করার এই উপায়গুলোর মধ্যে পার্থক্য আমাকে অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। আমি প্রথমটির নাম দেব, ‘অতিপ্রাকৃত জাদু’, দ্বিতীয়টি ‘মঞ্চের জাদু’ এবং তৃতীয়টি [যেটার অর্থ আমার সবচেয়ে প্রিয়, আমার শিরোনামে ব্যবহৃত ‘জাদু’ শব্দটি যে উদ্দেশ্যে আমি ব্যবহার করেছি], ‘কাব্যিক জাদু’। 

‘অতিপ্রাকৃত জাদু’ হচ্ছে এক ধরনের জাদু যা আমরা খুঁজে পাই পুরাণ-কাহিনি আর রূপকথায়। [‘মিরাকলস’ বা অলৌকিক ঘটনাগুলোতেও, যদিও আমি সেই জাদুগুলোর কথা আপাতত আলোচনা করব না, এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে সেই বিষয়গুলো আবার আলোচনায় ফিরে আসবে] এটি আলাদিনের চেরাগের জাদু, জাদুকরদের জাদুমন্ত্র, গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, জে. কে. রলিংসের জাদু। এটি কাল্পনিক গল্পের সেই ডাইনির জাদু, যে মন্ত্র পড়ে কোনো রাজকুমারকে ব্যাঙে রূপান্তরিত করতে পারে, অথবা সেই পরী গডমাদারের জাদু, একটি কুমড়াকে যে কিনা ঝকমকে একটি ঘোড়াগাড়িতে রূপান্তরিত করতে পারে। শৈশব থেকেই এই গল্পগুলো আমরা সবাই এখনো সস্নেহে স্মরণ করতে পারি, এখনো আমরা অনেকেই তা উপভোগ করি যখন ক্রিসমাসের ঐতিহ্যবাহী কোনো অনুষ্ঠানে নির্বাক অভিনয় হিসেবে সেই কাহিনিগুলো উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, কিন্তু আমরা সবাই জানি, এই ধরনের জাদু হচ্ছে শুধুমাত্রই কাহিনি আর বাস্তবে এমনকিছু ঘটে না। 

মঞ্চের জাদু, এর ব্যতিক্রম, বাস্তবে আসলেই ঘটে এবং এটি দারুণ উপভোগ্যও হতে পারে। অথবা অন্ততপক্ষে, ‘কোনোকিছু’ সেখানে আসলেই ঘটে, যদিও দর্শকরা যা ঘটছে বলে মনে করেন সেটি আসলে তা নয়। মঞ্চে কোনো একজন ব্যক্তি [সাধারণত কোনো-না-কোনো এক কারণে একজন পুরুষ] ছলনার আশ্রয় নেয়, যেন আমরা ভাবি আসলেই আমরা যা মঞ্চে ঘটতে দেখছি, সেখানে ঠিক সেটাই ঘটছে—বিস্ময়কর কোনোকিছু [‘মনে’ হতে পারে ‘অতিপ্রাকৃত’ কিছু ঘটছে], যখন আসলেই সেখানে যা ঘটে, সেটি আমাদের ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। রেশমি রুমাল কিন্তু কখনো খরগোশে রূপান্তরিত হতে পারে না, যেমন-কোনো ব্যাঙ রাজপুত্রে রূপান্তরিত হতে পারে না। আমরা মঞ্চে যা দেখি সেটি শুধুমাত্রই একটি কৌশল। আমাদের চোখ আমাদের সাথে ছলনা করে অথবা বরং জাদুকরই অত্যন্ত পরিশ্রম করেন আমাদের চোখকে ফাঁকি দিতে, হয়তো বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ কোনো শব্দ ব্যবহার করে, যা আমাদের অন্যমনস্ক করে আর তাঁর হাত দিয়ে তিনি আসলেই কী করছেন আমরাও সেটি ঠিকমতো খেয়াল করতে পারি না। 

কিছু জাদুকর আছেন যাঁরা খুবই সৎ এবং আসলেই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন নিশ্চিত করতে তাঁদের দর্শকেরা যেন আগে থেকেই জানেন, তাঁরা শুধুমাত্র একটি হাতসাফাই বা কৌশল দেখাচ্ছেন। আমি সেইসব জাদুকরদের কথা ভাবছি, যেমন—জেমস ‘দ্য অ্যামেজিং’ র‍্যান্ডি অথবা পেন অ্যান্ড টেলার অথবা ড্যারেন ব্রাউন। যদিও অসাধারণ এই জাদুকরেরা দর্শকদের সাধারণত বলেন না, ঠিক কিভাবে তাঁরা তাঁদের কৌশলটি দেখাচ্ছেন—কারণ সেটি করলে তাঁদেরকে ‘ম্যাজিক সার্কেল’ [জাদুকরদের ক্লাব] থেকে বের করে দেয়া হবে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের দর্শকদের নিশ্চিত করেন, তাঁদের পরিবেশনায় ‘অতিপ্রাকৃত’ জাদুর কোনো উপস্থিতি নেই। যদিও অন্যরা সক্রিয়ভাবে দর্শকদের এমনকিছু বলেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁরা যা করছেন সেটি কৌশল মাত্র এবং এর চেয়ে বাড়তি কোনো দাবিও তাঁরা করেন না। কী করছেন সেই বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কোনো মিথ্যা কথা না বলে, এই জাদুকরেরা দর্শকদের মনে শুধুমাত্র আনন্দময় সেই অনুভূতিটি রেখে যান, এইমাত্র যেন খুব রহস্যময় কিছু একটা তাঁরা দেখলেন। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশকিছু জাদুকর আছেন তাঁরা খুব পরিকল্পিতভাবেই অসৎ এবং তাঁরা ভান করেন সত্যিকারভাবেই তাদের ‘অতিপ্রাকৃতিক’ অথবা অস্বাভাবিক কোনো ক্ষমতা আছে : যেমন–হয়তো দাবি করতে পারেন তাঁরা আসলেই লোহা বাঁকাতে পারেন বা শুধুমাত্র তাঁদের চিন্তার শক্তি ব্যবহার করে কোনো চলমান ঘড়ি বন্ধ করে দিতে পারেন। এঁদের মধ্যে কিছু অসৎ ভানকারী [‘প্রতারক’, একটা উপযুক্ত শব্দ তাদের বর্ণনা করার জন্য] খনি বা তেল কোম্পানির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করতে পারেন এমনকিছু দাবি করে যে তাঁরা তাদের ‘সাইকিক শক্তি’ ব্যবহার করে বলতে পারবেন তেলের জন্যে কোথায় ড্রিল বা খনন করা সবচেয়ে ভালো হবে। অন্য কিছু প্রতারক, মৃতদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এমন দাবি করে শোকাহত মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন, যখন এটি ঘটে, এটি আর শুধুমাত্র কৌতুক বা বিনোদনের কোনো অনুষ্ঠান থাকে না, বরং স্বার্থপর উদ্দেশ্যে মানুষের বিশ্বাসপ্রবণতা আর হতাশার সুযোগ নেয়া হয়। নিরপেক্ষভাবে বললে, এই মানুষগুলো সবাই অসৎ প্রতারক নয় এমন সম্ভাবনাও থাকতে পারে, কেউ কেউ হয়তো আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করেন যে তাঁরা কোনো মৃতের আত্মার সাথে কথা বলছেন। 

জাদুর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে সেটি, যা আমি শিরোনামে বোঝাতে চেয়েছি : ‘কাব্যিক জাদু’। কখনো সুন্দর সংগীত আমাদের আবেগে অশ্রুসিক্ত করে তুলতে পারে, আর সেই পরিবেশনাকে ‘জাদুময়’ হিসেবে আমরা বর্ণনা করি। যখন শহরের আলো থেকে দূষণমুক্ত, চাঁদহীন অন্ধকার কোনো রাতের আকাশে নক্ষত্রদের দিকে তাকাই, তখন তীব্র আনন্দ আমাদের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে, ‘বিশুদ্ধ জাদু’ হিসেবে সেই দৃশ্যটিকে আমরা বর্ণনা করি। আমরা হয়তো অসাধারণ সূর্যাস্ত অথবা পাহাড়ি ভূদৃশ্য বা আকাশে রংধনু বর্ণনা করতে একই শব্দ ব্যবহার করি, এই অর্থে জাদু, শুধুমাত্র মর্মস্পর্শী, গভীর আনন্দ উদ্রেককারী : এমনকিছু যা আমাদের শিহরিত করে, আমাদের অভ্যন্তরে পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এই বইয়ে আমি যা আপনাদের দেখাব বলে আশা করছি, সেটি হচ্ছে সেই বাস্তবতা—বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে সেই সত্যগুলো, আমরা যা অনুধাবন করেছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে, যা জাদুময়, এই তৃতীয় অর্থে, কাব্যিক অর্থে, বেঁচে থাকার আনন্দের অর্থে। 

এখন আমি সেই ‘অতিপ্রাকৃত’ ধারণাটিতে ফিরতে চাই এবং ব্যাখ্যা করতে চাই কেন এটি পৃথিবীতে ও এর চারপাশের মহাবিশ্বে যা-কিছু দেখি, সেগুলো সম্বন্ধে কখনোই সত্যিকারের কোনো ব্যাখ্যা আমাদের দিতে পারে না। আসলেই, কোনোকিছু বোঝার ক্ষেত্রে ‘অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাখ্যা দাবি করা মানে আসলেই সেটি মোটেও ব্যাখ্যা না করা, এমনকি আরো খারাপ, এটিকে কখনো যে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, সেই সম্ভাবনাটিও বাতিল করে দেয়া। কেন আমি এ কথাটি বললাম? কারণ, ‘অতিপ্রাকৃত’ যে-কোনো কিছু সংজ্ঞানুযায়ী অবশ্যই প্রাকৃতিক কোনো ব্যাখ্যার ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে। অবশ্যই এটিকে বিজ্ঞান এবং এর সুপ্রতিষ্ঠিত, বহুপরীক্ষিত এবং প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নাগালের বাইরে হতে হবে, যে পদ্ধতি গত চারশত বছর বা তারও বেশি সময় ধরে আমাদের উপভোগ করা অর্জিত জ্ঞানের অবিশ্বাস্য বিশাল অগ্রগতির জন্যে দায়ী। কিছু ‘অতিপ্রাকৃত’ কোনো উপায়ে ঘটেছে এটি বলা শুধুমাত্র এই না যে, ‘আমরা এটি বুঝি না’, বরং বলা, ‘আমরা কখনোই এটি বুঝতে পারব না, সুতরাং কোনো চেষ্টা করার দরকার নেই।’ 

বিজ্ঞান ঠিক এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিটি ধারণ করে। এখনো অবধি, বিজ্ঞান আরো বেশি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে কোনোকিছু ব্যাখ্যা না করতে পারার এর আপাত অক্ষমতায় এবং এই অক্ষমতাকেই বিজ্ঞান প্রেরণা আর উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করে আরো বেশি প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখতে, সম্ভাব্য মডেল সৃষ্টি করে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে। এর লক্ষ্য, সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে যেন আমরা আমাদের পথ খুঁজে পাই ক্রমান্বয়ে ধীরে, ধাপে ধাপে। যদি এমনকিছু ঘটে, আমাদের বাস্তবতা সম্বন্ধে যা বর্তমান বোঝাপড়ার বিরুদ্ধে যায়, বিজ্ঞানীরা সেটিকে দেখেন আমাদের বর্তমান মডেলের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে, যার কারণে বর্তমান মডেলটি বাদ অথবা কমপক্ষে পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। এই ধরনের সমন্বয় আর উপযোজন এবং পরবর্তীতে পরীক্ষা করার মাধ্যমে ক্রমশ আমরা সত্যের আরো নিকটবর্তী হতে থাকি। 

সেই গোয়েন্দা পুলিশ সম্বন্ধে আপনি কী ভাববেন, হত্যাকাণ্ড দেখে যিনি হতভম্ব, তবে এতই অলস যে সমস্যাটি সমাধান করার কোনো চেষ্টাই যিনি করেন না বরং ‘অতিপ্রাকৃত’ কোনো ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে রহস্যটি সমাধান করার চেষ্টা করেন? বিজ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে অনেক কিছুই যা একসময় অতিপ্রাকৃত শক্তির পরিণতি হিসেবে ভাবা হত—যার কারণ দেবতা [সন্তুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট উভয়েই], দানব, ডাইনি, আত্মা, অভিশাপ আর জাদুমন্ত্র আসলে সেগুলোর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা আছে : যে ব্যাখ্যাগুলো আমরা বুঝতে পারি, পরীক্ষা করে দেখতে পারি, যার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। এমনকিছু বিশ্বাস করার একেবারে কোনো কারণই নেই যে, বিজ্ঞান এখনো যেসব কিছুর কোনো প্রাকৃতিক কারণ খুঁজে পায়নি, সেগুলোর কারণ অবশ্যই অতিপ্রাকৃত; যেমন—মানুষ একসময় বিশ্বাস করত, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং নানা অসুখ কিংবা মহামারীর কারণ ক্রুদ্ধ কোনো দেবতার অভিশাপ। 1 

অবশ্যই, কোনো ব্যাঙকে রাজকুমার [নাকি কোনো রাজকুমারকে ব্যাঙে? আমি কখনোই মনে করতে পারি না] অথবা বাগানের কুমড়াকে ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তরিত করা সম্ভব হতে পারে, এমনকিছু কেউ আসলেই বিশ্বাস করেন না, কিন্তু বিষয়টি আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন এই ধরনের বিষয়গুলো ঘটা অসম্ভব? সেটি ব্যাখ্যা করার বেশকিছু উপায় আছে। আমার পছন্দের উপায়টি হচ্ছে এটি। 

ব্যাঙ এবং ঘোড়ার গাড়িগুলো বেশ জটিল জিনিস, যাদের বহু অংশ আছে, যেগুলো একটি বিশেষ উপায়ে একসাথে সমন্বয় করে যুক্ত করতে হবে, একটি বিশেষ নকশায়, শুধুমাত্র দুর্ঘটনাবশত যা ঘটতে পারে না [অথবা জাদুর কাঠি বাতাসে নাড়ানোর কারণে]। আর ‘জটিল’ বলতে আসলে সেটাকেই বোঝায়। ব্যাঙ বা ঘোড়ার গাড়ির মতো জটিল কিছু বানানো খুবই কঠিন কাজ। একটি ঘোড়ার গাড়ি বানানোর জন্য আপনাকে গাড়ির সব অংশগুলোকে সঠিকভাবে একসাথে যুক্ত করতে হবে। দক্ষ কাঠমিস্ত্রি এবং অন্য কারিগরদের সাহায্যেরও প্রয়োজন হবে আপনার। শুধুমাত্র দৈবাৎ, অথবা আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে আর ‘ছু মন্তর ছু’ বললেই ঘোড়ার গাড়ি তৈরি হয়ে যাবে না। ঘোড়ার গাড়ির একটি কাঠামো আছে, জটিলতা আর কর্মক্ষম নানা অংশ আছে : চাকা আর অক্ষদণ্ড বা অ্যাক্সল, জানালা আর দরজা, স্প্রিং আর গদির আসন। ঘোড়ার গাড়ির মতো কোনো জটিল কোনোকিছুকে সরলতর কোনোকিছুতে রূপান্তরিত করাই বরং অপেক্ষাকৃত সহজ হবে, যেমন—ছাই বা ভস্ম : সেই পরী গডমাদারের জাদুর কাঠিতে শুধুমাত্র যুক্ত থাকতে হবে একটি ব্লোটর্চ [যে যন্ত্রটি বাতাস আর গ্যাসের সংমিশ্রণে আগুনের তীব্র উত্তপ্ত শিখা সৃষ্টি করতে পারে], কিন্তু কেউই এক স্তূপ ছাই অথবা একটি কুমড়াকে একটি ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তরিত করতে পারবে না, কারণ ঘোড়ার গাড়ি খুবই জটিল একটি জিনিস। আর শুধুমাত্র জটিলই নয়, জটিল ‘উপযোগী একটি দিক বরাবর’ : এই ক্ষেত্রে মানুষের ভ্রমণ করার মতো উপযোগী ঘোড়ার গাড়ি। 

বেশ, সেই পরী গডমাদারের জন্য বিষয়টি খানিকটা সহজ করে দেয়া যাক এমন কোনোকিছু ধারণা করে—কুমড়া যোগাড় করে দিতে না বলে, তিনি সেইসব বিচ্ছিন্ন ‘অংশগুলো’ নিয়ে আসতে বললেন, একটি ঘোড়ার গাড়ি বানানোর জন্য যেগুলো দরকার। সেগুলো একটি বাক্সে এলোমেলোভাবে স্তূপাকারে সাজানো আছে : ঘোড়ার গাড়ি বানানোর জন্য এক ধরনের ‘নির্দেশ অনুসরণ করে নিজে বানাও’ কিট [আইকিয়ার সাথে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা ভাবুন আইকিয়া কিটের মতো কিছু]। একটি ঘোড়ার গাড়ি বানানোর জন্যে এ ধরনের সম্ভাব্য কিটে থাকবে শতখানেক কাঠের টুকরো, কাচের পাত, লোহার রড, গদি বানানোর সরঞ্জাম, চামড়ার টুকরো, পেরেক, স্ক্রু এবং সেইসাথে আঠার বেশকিছু পাত্র, যা তাদের একসাথে জড়ো করে ধরে রাখার জন্য দরকার। এখন কল্পনা করুন, ধাপে ধাপে নিয়মমাফিক যন্ত্রাংশগুলো কিভাবে জোড়া লাগাতে হবে সেই নির্দেশাবলি না পড়ে, পরী গডমাদার সবগুলো উপকরণ একসাথে বিশাল একটি থলের মধ্যে রেখে, বেশ জোরেই একটা ঝাঁকুনি দিলেন। যদি জানতে চাওয়া হয়, এভাবে ঝাঁকুনি দেয়ার কারণে সব অংশগুলো নিজেরাই সঠিকভাবে জড়ো হয়ে একটি কার্যকরী ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করে ফেলার ঠিক কী পরিমাণ সম্ভাবনা সেখানে আছে? এর উত্তর হচ্ছে—কার্যত শূন্য। আংশিকভাবে এর কারণ, আপনি এই এলোমেলোভাবে মেশানো বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে সংযুক্ত করতে পারেন অসংখ্য ‘সম্ভাব্য’ উপায়ে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই কার্যক্ষম ঘোড়া গাড়ি তৈরি করতে পারবে না— এমনকি এই প্রক্রিয়ায় কাজ করে এমন ‘যে-কোনো’ কিছুই নির্মাণ করা সম্ভব নয়। 

যদি আপনি বহু যন্ত্রাংশপূর্ণ থলেটিকে ঝাঁকুনি দেন যে-কোনো একভাবেই, হতে পারে কখনো হয়তো সেগুলো এমন কোনো একটি সজ্জায় সজ্জিত হতে পারে যা উপযোগী হতে পারে অথবা যা অন্যথায় আমরা হয়তো শনাক্ত করতে পারি বিশেষ কোনোকিছু হিসেবে, কিন্তু এমনকিছু ঘটার উপায়গুলোর সংখ্যা খুবই কম; আসলেই খুব কম, যদি তুলনা করা হয় সেই মিলিয়ন সংখ্যক উপায়ের সাথে : যখন সেগুলো এমন একটি সজ্জায় সজ্জিত হবে যে, তাদের জঞ্জালের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। বহু মিলিয়ন উপায় আছে নানা টুকরো যন্ত্রাংশকে অদলবদল এবং পুনঃঅদলবদল করার : সেগুলোকে আরেকটি যন্ত্রাংশের স্তূপে পরিণত করার বহু মিলিয়ন উপায় আছে। যতবারই আপনি অংশগুলো অদলবদল করবেন, প্রতিবারই অনন্য একটি জঞ্জালের স্তূপ পাবেন, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি, কিন্তু এইসব সম্ভাব্য স্তূপের মধ্যে খুব সামান্য কয়টি হয়তো উপযোগী কিছু হতে পারে [যেমন—আপনাকে কোনো বল নাচের আসরে নিয়ে যেতে পারে বহন করে] অথবা উল্লেখযোগ্য অথবা কোনো-না-কোনোভাবে স্মরণযোগ্য হতে পারে। 

কখনো কখনো আক্ষরিকভাবে আমরা গণনা করতে পারি কত সংখ্যক উপায়ে এই অংশগুলো অদলবদল করে আমরা সাজাতে পারি, যেমন— আমরা এক প্যাকেট তাসের সাথে করতে পারি, যেখানে ‘অংশগুলো’ হচ্ছে একক কার্ডগুলো। 

ধরুন, তাস খেলার সময় ডিলার বা তাস-বণ্টনকারী এক প্যাকেট তাস শাফল করে বা ফেটিয়ে চারজন খেলোয়াড়ের মধ্যে এমনভাবে বিতরণ করে দিল, যেন তাদের প্রত্যেকেই ১৩টি করে তাস হাতে পায়। দেখার জন্য আমি যখন আমাকে দেয়া তাসগুলো হাতে নেই, আমি বিস্ময়ে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে লক্ষ করি আমার হাতে ১৩টি ইশকাপনের পুরো হাত… সবগুলো ইশকাপন বা স্পেইড। সেই খেলাটি চালিয়ে যাবার জন্য আমি বেশ হতভম্ব হয়ে পড়ি; হাতের তাসগুলো আমি অন্য তিনজন খেলোয়াড়কে দেখালাম, জানতাম, তারাও আমার মতো অবাক হবে, কিন্তু তারপর প্রত্যেকেই এক এক করে তাদের হাতের তাসগুলো টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখলেন এবং সবাই বিস্ময়ে অবাক হন, প্রত্যেকেরই একটি করে ‘নিখুঁত’ হাত, একজন ১৩টি হার্ট বা হরতন, অন্যজনের ১৩টি ডায়মন্ড বা রুহিতন ও শেষজনের ১৩টি ক্লাব বা চিড়িতন। 

এটা কি ‘অতিপ্রাকৃত’ কোনো জাদুর বিষয় হবে? হয়তো তেমন কিছু ভাবতেই আমরা প্ররোচিত হতে পারি, কিন্তু গণিতবিদরা গণনা করতে পারবেন এই ধরনের বিস্ময়কর তাসের হাত একেবারে বিশুদ্ধভাবেই দৈবাৎ বা চান্সের মাধ্যমে হতে পারে। যদিও এমন সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভাব্য রকমের ক্ষুদ্র : প্রতি ৫৩, ৬৪৪, ৭৩৭, ৭৬৫, ৪৮৮, ৭৯২, ৮৩৯, ২৩৭, 880, ০০০ সংখ্যক বারে ১ বার। যদি প্রায় ১ ট্রিলিয়ন বছর ধরে আপনি তাস খেলতে থাকেন, আপনি হয়তো একবার এই ধরনের তাসের হাত পেতে পারেন, কিন্তু বিষয়টি হল, এ যাবৎ যত তাসের হাত দেখা গেছে তার চেয়ে এই তাসের দানটি কোনো অংশেই কম সম্ভাব্য নয় এবং ৫২টি তাসের কোনো হাতে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা ৫৩,৬৪৪,৭৩৭,৭৬৫, ৪৮৮, ৭৯২, ৮৩৯, ২৩৭, ৪৪০, ০০০ সংখ্যক বারে মাত্র ১ বার। কারণ বড় সংখ্যাটি তাসে সম্ভাব্য সকল হাতের সর্বমোট সংখ্যা। শুধুমাত্র আমরা কোনো বিশেষ সজ্জার তাসের হাত লক্ষ করি না এই সুবিশাল সংখ্যক দানে যা ঘটতে পারে। সুতরাং সে-কারণে সেইসব দানগুলো আমাদের বিশেষ নজরে পড়ে অসাধারণ কোনো ঘটনা হিসেবে। আমরা শুধু লক্ষ করি সেই ডিলগুলো যা কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের বিশেষ নজরে আসে। 

একজন রাজকুমারকে বহু হাজার কোটি রূপের যে-কোনো একটিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। আপনি যদি বিশেষ নিষ্ঠুর হন তার টুকরোগুলোকে হাজার কোটি সজ্জায় সাজানো যেতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সেই সজ্জাগুলো হবে জঞ্জাল, যেমন—সেই হাজার কোটি অর্থহীন, তাসের হাত যা আমরা অদলবদল করার পর ভাগে পাই। শুধুমাত্র রাজকুমার-টুকরোর সেইসব সম্ভাব্য সজ্জার খুব সামান্যতম অংশই নজরে আসবে যা শনাক্তযোগ্য বা কোনোভাবে উপযোগী হতে পারে, ব্যাঙ তো দূরের কথা। 

রাজকুমাররা ব্যাঙে রূপান্তরিত হয় না, কুমড়া ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তরিত হয় না, কারণ ব্যাঙ আর ঘোড়ারগাড়ি দুটোই জটিল জিনিস, যাদের অংশগুলো সাজানো যেতে পারে প্রায় অসীম সংখ্যক টুকরার অনুপযোগী সমাবেশে এবং তারপরও বাস্তব সত্য হিসেবে আমরা জানি, প্রতিটি জীবিত প্রাণী, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি কুমির, প্রতিটি ব্ল্যাকবার্ড, প্রতিটি গাছ, এমনকি প্রতিটি বাঁধাকপি, বিবর্তিত হয়েছে অন্য, মূলত সরলতর কোনো রূপ থেকে। তাহলে এটি ভাগ্য-নির্ভর প্রক্রিয়াই কি শুধু নয় বা এক ধরনের জাদু? না! অবশ্যই না। এটাই খুব সাধারণ ভ্রান্ত একটি ধারণা। সুতরাং আমি ব্যাখ্যা করতে চাই, কেন বাস্তব জীবনে আমরা যা কিছু দেখি-না কেন, সেগুলো ঘটনাচক্রে, ভাগ্যক্রমে বা চান্স বা আপতনের পরিণতি নয়, অথবা সামান্যতম ‘জাদুর’ কোনো অবকাশ নেই [শুধুমাত্র, অবশ্যই, সেই কঠোরভাবে কাব্যিক অর্থে এমনকিছু, যা আমাদের আনন্দ আর বিস্ময়ে পূর্ণ করে]। 

বিবর্তনের মন্থর জাদু 

জটিল কোনো জীবকে একটিমাত্র ধাপে আরেকটি জটিল কোনো জীবে রূপান্তর করার বিষয়টি—যেমন, রূপকথায় ঘটে——আসলেই বাস্তবতা- নির্ভর সকল সম্ভাবনার নাগালের বাইরে এবং তারপরও জটিল প্রাণীদের অস্তিত্ব আছে। তাহলে কিভাবে তাদের উদ্ভব হয়েছে? কিভাবে, বাস্তবে, জটিল জিনিস, যেমন—ব্যাঙ, সিংহ, বেবুন আর বটগাছ, রাজকুমার আর কুমড়া, আপনি এবং আমি অস্তিত্বশীল হয়েছি? 

ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে এটি হতবুদ্ধি করে দেয়ার মতো একটি দুর্বোধ্য প্রশ্ন ছিল, সঠিকভাবে যার উত্তর কেউই দিতে পারেননি। সে-কারণে, ব্যাখা করার চেষ্টায় মানুষ নানা ধরনের গল্প উদ্ভাবন করেছিল, কিন্তু তারপর এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন—এবং দারুণ বুদ্ধিমত্তার সাথে—ঊনবিংশ শতাব্দীতে, এযাবৎ কালের শ্রেষ্ঠতম একজন বিজ্ঞানী, চার্লস ডারউইন। আমি এই অধ্যায়ের বাকি অংশটি ব্যবহার করব তার সেই উত্তরটি ব্যাখ্যা করার জন্য, তবে ডারউইনের ব্যবহৃত শব্দগুলোর চেয়ে ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে। 

উত্তর হচ্ছে—জটিল জীবন, যেমন—মানুষ, কুমির, বাঁধাকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, হঠাৎ করেই উদ্ভব হয়নি এক ধাক্কায়, বরং ধীরে, ছোট ছোট ধাপ পার হয়ে এমনভাবে, যেন প্রতিটি ধাপের পরের পরিস্থিতি এর আগেই থেকে যা বিদ্যমান তার থেকে সামান্য একটু ভিন্ন হয়। কল্পনা করুন আপনি লম্বা পা-সহ একটি ব্যাঙ সৃষ্টি করতে চান। কাজটির শুরুতেই সবচেয়ে ভালো যে পদক্ষেপটি আপনি নিতে পারেন, সেটি হচ্ছে এমনকিছু দিয়ে কাজটি শুরু করা, ইতোমধ্যেই যাদের সে-রকম খানিকটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা কিনা আপনি অর্জন করতে চাইছেন : যেমন ধরুন ছোট পা-সহ ব্যাঙ। আপনি আপনার ছোট পা-সহ ব্যাঙগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং তাদের পায়ের মাপ নিতে হবে। আপনি সেখান থেকে কিছু পুরুষ আর স্ত্রী-ব্যাঙ বাছাই করে নেবেন যাদের পায়ের দৈর্ঘ্য গড়পড়তা অন্য সব ব্যাঙগুলোর চেয়ে লম্বা, এরপর আপনি শুধু তাদের মধ্যে প্রজননের ব্যবস্থা করে দেবেন এবং খেয়াল রাখবেন যেন তাদের ছোট পা-সহ বন্ধুরা প্রজননের কোনো সুযোগ না পায়। 

অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ পায়ের পুরুষ এবং স্ত্রী-ব্যাঙরা একসাথে ব্যাঙাচি তৈরি করবে এবং তাদের একসময় পা গজাবে এবং ব্যাঙে পরিণত হবে। এরপর আপনি নতুন প্রজন্মের ব্যাঙদের পা মেপে দেখবেন, আবারো পুরুষ আর স্ত্রী-ব্যাঙদের বাছাই করবেন যাদের পা বাকিদের চেয়ে খানিকটা বড় এবং তাদের প্রজনন করতে সুযোগ করে দেয়া হয়। 

প্রায় ১০টি প্রজন্মের সাথে এমন করার পর, আপনি হয়তো কিছু কৌতূহলোদ্দীপক পরিবর্তন লক্ষ করতে শুরু করবেন। গড় পায়ের দৈর্ঘ্য আপনার সেই বাছাই করা ব্যাঙ জনগোষ্ঠীতে এখন লক্ষ করার মতোই দীর্ঘ হবে শুরুর সেই জনগোষ্ঠীর গড় পায়ের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা। আপনি হয়তো দেখতে পারেন, দশম প্রজন্মের সব ব্যাঙের পা, প্রথম প্রজন্মের পায়ের দৈর্ঘ্যের তুলনায় বেশ লম্বা। অথবা ১০টি প্রজন্ম হয়তো যথেষ্ট নয় এমনকিছু অর্জন করার জন্য : আপনাকে হয়তো ২০ তম প্রজন্ম অথবা আরো বেশি প্রজন্ম অবধি পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু অবশেষে আপনি গর্বের সাথে বলতে পারবেন, ‘আমি একটি নতুন ধরনের ব্যাঙ তৈরি করেছি যাদের পা পুরনো ধরনের ব্যাঙের চেয়ে দীর্ঘতর’। 

কোনো জাদুর কাঠির প্রয়োজন নেই, কোনো ধরনের জাদুরই এখানে দরকার নেই। এখানে যে প্রক্রিয়াটি আমরা দেখতে পাই সেটি হচ্ছে ‘সিলেকটিভ ব্রিডিং’ বা বাছাইকৃত প্রজনন। আমি সেই বাস্তব তথ্যটি ব্যবহার করেছি শুরুতেই, ব্যাঙদের নিজেদের মধ্যে ভিন্নতা [এখানে পায়ের দৈর্ঘ্য] আছে এবং এইসব ভিন্নতা বংশগত হবার প্রবণতা আছে— তার মানে এটি পিতামাতা থেকে সন্তানে বিস্তার করে জিনের মাধ্যমে। শুধুমাত্র কোন ব্যাঙগুলো প্রজনন করতে পারবে আর কোনগুলো পারবে না, সেটি নিয়ন্ত্রণ করেই আমরা নতুন ধরনের ব্যাঙ তৈরি করতে পারব। 

খুব সহজ, তাই না? কিন্তু শুধুমাত্র পা দীর্ঘতর করা খুব বেশি চিত্তাকর্ষক বিষয় নয়। সর্বোপরি আমরা তো ব্যাঙ নিয়ে শুরু করে করেছিলাম, শুধুমাত্র তারা ছোট পায়ের ব্যাঙের একটি রূপ ছিল। ধরুন আপনি শুরু করলেন, ছোট পায়ের কোনো একপ্রকার ব্যাঙ থেকে নয় বরং এমন কিছু দিয়ে, সেগুলো আদৌ ব্যাঙ নয়। ধরুন, তারা খানিকটা দেখতে নিউটদের মতো [নিউটরা এক ধরনের উভচর প্রাণী]। যদি তুলনা করা হয়, ব্যাঙের পায়ের তুলনায় নিউটদের খুব ছোট পা থাকে [অন্তত ব্যাঙের ‘পেছনের’ পায়ের সাথে তুলনা করলে অবশ্যই] আর তারা সেটি ব্যবহার করে লাফানো নয়, বরং হাঁটার জন্য। এছাড়া নিউটদের লম্বা একটি লেজ থাকে, আর ব্যাঙের কোনো লেজ থাকে না এবং আকারে নিউটরা অধিকাংশ ব্যাঙের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সরু আর লম্বা, কিন্তু আপনি দেখতে পারবেন যে, যদি যথেষ্ট হাজার পরিমাণ প্রজন্ম সৃষ্টি হবার সময় দেয়া হয়, আপনি নিউটদের একটি জনগোষ্ঠীকে ব্যাঙের একটি জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করতে পারবেন, শুধুমাত্র ধৈর্য ধরে বাছাই করতে হবে, ওইসব বহু মিলিয়ন প্রজাতির প্রত্যেকটিতে, পুরুষ আর স্ত্রী-নিউটরা, যারা খানিকটা বেশি ব্যাঙের মতো, শুধুমাত্র তাদের প্রজনন করার সুযোগ দিয়ে এবং যাদের সাথে ব্যাঙের সদৃশ্যতা কম তাদের প্রজননে বাধা দেয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন কোনো পর্যায়ে আপনি নাটকীয় কোনো পরিবর্তন দেখবেন পাবেন না। প্রতিটি প্রজন্ম তাদের আগের প্রজন্মের মতোই প্রায় দেখতে হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও, যখন যথেষ্ট পরিমাণ প্রজন্ম অতিক্রান্ত হবে, আপনি লক্ষ করতে শুরু করবেন লেজের গড় দৈর্ঘ্য খানিকটা কম এবং পেছনের পায়ের গড় দৈর্ঘ্য খানিকটা বেশি। অনেক বড় সংখ্যার প্রজন্ম অতিক্রান্ত হলে, লম্বা-পায়ের, ছোট-লেজের সদস্যদের জন্যে হয়তো সহজ হবে লম্বা পা হামাগুড়ি দেয়ার বদলে বরং লাফ দেয়ার জন্য ব্যবহার করলে এবং এভাবে আরো কিছু পরিবর্তনও আমরা দেখব। 

অবশ্যই, আমি যে দৃশ্যকল্পটি এইমাত্র বর্ণনা করলাম, সেখানে আমি আমাদেরকে প্রজনন নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে কল্পনা করেছি, সেইসব স্ত্রী ও পুরুষ-সদস্যদের বাছাই করেছি, যাদের আমরা চেয়েছি নিজেদের মধ্যে প্রজনন করুক সেই ফলাফলটি পাওয়ার জন্য, যা আমরা নির্বাচন করেছিলাম। গবাদিপশু আর খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকরা এই একই কৌশল ব্যবহার করে আসছেন বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে, যেখানে তাঁরা নির্বাচন করেছিলেন সেই বৈশিষ্ট্যগুলো, যেমন—যে শস্যগুলোর ফলন ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ইত্যাদি। ডারউইন হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃতিতে এই প্রক্রিয়াটি কাজ করে, এমনকি যখন ‘নির্বাচন করার জন্য কোনো ব্রিডার বা কৃত্রিম প্রজননকারী [যেমন, মানুষ]’ সেখানে থাকে না। ডারউইন দেখেছিলেন যে, পুরো বিষয়টি ঘটতে পারে ‘প্রাকৃতিকভাবে’, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, শুধুমাত্র একটি সরল কারণে, প্রকৃতিতে প্রজাতির কিছু সদস্য প্রজনন করতে সক্ষম হবার মতো যথেষ্ট দীর্ঘসময় অবধি বেঁচে থাকে এবং অন্যরা বাঁচে না এবং যারা টিকে থাকে, কারণ বাকিদের চেয়ে তারা সেই কাজটি করার আরো দক্ষভাবে নানা বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত। সুতরাং যারা সফলতার সাথে টিকে থাকে তাদের সন্তানেরাও উত্তরাধিকার সূত্রে সেই জিনগুলো পায় যা তাদের পিতা অথবা মাতাকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। সেটি নিউট কিংবা ব্যাঙ হোক, সজারু অথবা কোনো আগাছা হোক, প্রতিটি প্রজাতি জনগোষ্ঠীতে সবসময়ই কিছু সদস্য থাকবে, যারা বেঁচে থাকার জন্যে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃতভাবে অধিক দক্ষ। যদি দীর্ঘ পা সেটি করতে ঘটনাচক্রে কোনো সহযোগিতা করে থাকে [ব্যাঙ অথবা ঘাসফড়িং, যারা লাফ দিয়ে বিপদ থেকে সরে যেতে পারে, অথবা গ্যাজেল, যারা চিতার আক্রমণ থেকে দ্রুত দৌড়ে পালাতে পারে], তাহলে লম্বা-পায়ের সদস্যদের মৃত্যুর সম্ভাবনা কম হবে, এর পরিণতিতে প্রজনন করতে তাদের বেশিদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেশি। এছাড়াও, প্রজনন করার জন্যে পাওয়া যাবে এমন সদস্যদেরও লম্বা পা থাকবে। সুতরাং প্রতিটি প্রজন্মে লম্বা পায়ের জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার অপেক্ষাকৃত বেশি সম্ভাবনা থাকবে এবং সময়ের সাথে আমরা দেখব কোনো একটি জনগোষ্ঠীতে ক্রমশ আরো বেশি সদস্য লম্বা পায়ের জিন বহন করবে। সুতরাং প্রভাবটি হবে ঠিক তেমন, যদি বুদ্ধিমান কোনো পরিকল্পনাকারী, যেমন—মানব কৃত্রিম-প্রজননকারী, লম্বা-পায়ের সদস্যদের প্রজনন করার জন্যে নির্বাচিত করেন—কিন্তু শুধুমাত্র ‘এ ধরনের কোনো পরিকল্পনাকারীর আসলেই কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই : এসবকিছুই ঘটছে প্রাকৃতিকভাবেই, একা একাই, সেই পরিস্থিতির স্বয়ংক্রিয় একটি পরিণতি হিসেবে—যে পরিস্থিতিতে কোনো কোনো সদস্য যথেষ্ট পরিমাণ দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে প্রজনন করার জন্যে এবং অন্য সদস্যরা সেটি করতে পারে না। এ কারণে এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’। 

যথেষ্ট পরিমাণ প্রজন্ম যদি পার করতে পারি, নিউটদের মতো দেখতে কোনো পূর্বসূরি এমন উত্তরসূরিতে পরিবর্তিত হতে পারে যাদের দেখলে ব্যাঙের মতো মনে হবে। আরো যদি প্রজন্ম পার হওয়া যায়, মাছদের মতো দেখতে কোনো পূর্বসূরি সেই উত্তরসূরিতে পরিবর্তিত হতে পারে, যারা বানরদের মতো দেখতে এবং আরো যদি প্রজন্মকে পার হবার সুযোগ দেয়া হয়, ব্যাকটেরিয়ার মতো দেখতে পূর্বসূরিরা সেই উত্তরসূরিতে পরিবর্তিত হতে পারে যারা মানুষদের মতো দেখতে এবং ঠিক এটাই ঘটেছিল। এটি হচ্ছে সেই ধরনের বিষয় যা প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের ইতিহাসে ঘটেছিল, যারা এই পৃথিবীতে কোনোদিন বেঁচে ছিল এবং এমন পরিবর্তনের জন্য যে পরিমাণ প্রজন্মসংখ্যার দরকার হয় সেটি আমার ও আপনার সম্ভাব্য সব কল্পনার চেয়েও বেশি, কিন্তু পৃথিবীর বয়স হাজার কোটি বছরের বেশি, আর আমরা জীবাশ্ম থেকে জানি জীবনের সূচনা হয়েছিল সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর [সাড়ে তিন হাজার কোটি] আগে, সুতরাং বিবর্তন হবার জন্যে যথেষ্ট সময় ছিল। 

এটাই ডারউইনের অসাধারণ ধারণাটি এবং এটিকে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন’। মানব-মনে আবির্ভূত হওয়া শ্রেষ্ঠতম ধারণাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে জীবন সম্বন্ধে আমরা যা-কিছু জানি এটি সবকিছুই ব্যাখ্যা করে। যেহেতু এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পরের অধ্যায়গুলোয় আমি আবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসব। আপাতত, বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ট যে, বিবর্তন খুব ধীর আর ক্রমান্বয়ে ঘটা একটি প্রক্রিয়া। বাস্তবিকভাবেই, এই বিবর্তনের ক্রমান্বয়ে সংঘটিত হবার বিষয়টি, এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাঙ কিংবা রাজকুমারদের মতো জটিল কিছু তৈরি করতে সহায়তা করে। জাদুর বলে কোনো ব্যাঙের রাজকুমারে রূপান্তরিত হবার ঘটনাটি কখনোই ক্রমান্বয়ে ঘটবে না, এটি ঘটবে হঠাৎ করেই। আর এটাই এইসব জিনিসকে বাস্তব জগতে অসম্ভব বলেই চিহ্নিত করেছে। বিবর্তন হচ্ছে সত্যিকারের একটি ব্যাখ্যা, যা আসলেই কাজ করে এবং এর সত্যতা প্রদর্শন করার জন্যে সত্যিকারের প্রমাণও আছে। যে-কোনো কিছু যদি এমনকিছু প্রস্তাব করে, জীবনের জটিল নানা রূপের আবির্ভাব হঠাৎ করেই, একসাথে [ধীরে ধীরে ক্রমশ বিবর্তিত হবার বদলে] হয়েছে, সেগুলো আসলেই অলস কাহিনি মাত্র। রূপকথার সেই পরী গডমাদারের জাদুর কাঠির কল্পনার চেয়ে আদৌ উত্তম কিছু নয়। 

আর কুমড়ার ঘোড়ার গাড়িতে রূপান্তরিত হবার ব্যাপারে, জাদুর মন্ত্ৰ নিশ্চিতভাবেই কিছু করে না, যেমন তারা কোনো ব্যাঙকে রাজকুমারে রূপান্তরিত করতে পারে না। ঘোড়ার গাড়ি বিবর্তিত হয় না—অন্তত প্রাকৃতিকভাবে, যেভাবে ব্যাঙ আর রাজকুমারেরা বিবর্তিত হয়। কিন্ত গাড়ি, উড়োজাহাজ আর কুড়াল, কম্পিউটার আর ফ্লিন্ট পাথর নিয়ে বানানো তীরের মাথা ইত্যাদি তৈরি করে মানুষ, যারা বিবর্তিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক আর হাত বিবর্তিত হয়েছে, নিউটদের লেজ আর ব্যাঙদের পেছনের দুটি পা ঠিক যেভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং মানব-মস্তিষ্ক, একবার যখন তা বিবর্তিত হয়েছে, তারা গাড়ি, কাঁচি কিংবা সংগীত, ওয়াশিং মেশিন এবং ঘড়ি, সবকিছু পরিকল্পনা করতে ও বানাতে সক্ষম। আরো একবার, কোনো জাদু নয়। আরো একবার চালাকির কোনো কৌশল নয়। আরো একবার, সবকিছু সুন্দর এবং সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

এই বইটির বাকি অংশে আমি আপনাদের দেখাব যে, সত্যিকারের পৃথিবী, বৈজ্ঞানিকভাবে যা বোঝা সম্ভব হয়েছে, তার নিজস্ব একটি জাদু আছে—সেই জাদুকে আমি বলি ‘কাব্যিক’ জাদু : উদ্দীপ্ত করার মতো সৌন্দর্য, যা আরো বেশি জাদুময় কারণ এটি বাস্তব এবং কারণ, কিভাবে এটি কাজ করছে আমরা সেটি বুঝতে সক্ষম। বাস্তব পৃথিবীর সত্যিকারের সৌন্দর্য এবং জাদুর সাথে অতিপ্রাকৃত মন্ত্র আর জাদুর মঞ্চের খেলা তুলনা করলে মনে হতে পারে অনেক সস্তা আর রুচিহীনভাবেই চটকদার। বাস্তবতার জাদু অতিপ্রাকৃত নয় আবার হাতসাফাইও নয়, কিন্তু খুব স্পষ্টভাবেই বিস্ময়কর। বিস্ময়কর এবং বাস্তব। বিস্ময়কর ‘কারণ’ এটি বাস্তব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *