বাড়িটা কেমন হয়ে গেছে আজ। কেমন একটা বিষণ্ণতা, চাপা অস্বস্তি ঘিরে রয়েছে সারা বাড়ি। শুধু এই বাড়িটি।
আর সব অস্বস্তিটুকু এসে যেন জমেছে সুমিতার মনে। ওরই পায়ে পায়ে অস্বস্তির ছায়া ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পড়ার ঘর থেকে শোবার ঘরে। বাবার ঘর থেকে বড়দির ঘরে। বড়দির ঘর থেকে ওর আর ওর মেজদির ঘরে। উত্তরের বারান্দা পার হয়ে খাবার এবং পাশে রান্না ঘর। সবখানে কীসের একটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে যায় সুমিতা, সেখানেই। যেন ওরই পায়ে পায়ে ফিরছে।
শুধু অস্বস্তি নয়, অশান্তিও। তার সঙ্গে কেমন একটু বুক চাপা ব্যথা ভার হয়ে চেপে আছে সর্বত্র।
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে বাগানের মধ্যে। ছোট বাগান। সামান্য কিছু ফুলগাছ। একটি কিশোরী স্বর্ণচাঁপা গাছ আছে এক কোণ ঘেঁষে। আর নিতান্ত শখ করে লাগানো কিছু শীতের আনাজ। সযত্ন হাতের ছোঁয়ায় এ সামান্যই কেমন অসামান্য হয়ে উঠেছে সবুজের সমারোহে। আজ সেখানেও সেই বিষণ্ণতা। এই শেষ শীতের দিনেও গুটি কয়েক মাঘের ফুলকপি, হাতে গোনা দুটি বাঁধাকপি। রূপ আছে যদিও, গন্ধহীন কিছু মরশুমি ফুলের গাছ। ফুটনোন্মুখ দুটি ডালিয়া আর কেমন একরকমের গাঢ় লালে হঠাৎ কালোর ছোঁয়ায় চাপা ব্যথার রং লেগেছে কিছু ফোঁটা কারনেশনে। কিছু আছে ক্রিসানথিমাম। স্বর্ণচাঁপার সুদীর্ঘ কাঁচা-সবুজ রং পাতার ঝাড়। পুবে-পশ্চিমে ছড়ানো এ ফালি বাগানের অসংখ্য উন্মুক্ত চোখের মতো পাতাগুলি। সবখানেই তার বিন্দু বিন্দু শিশিরে অশ্রু বিষণ্ণতা, জমাট হয়ে আছে নিঃশব্দ কান্না। ফাঁকে ফাঁকে মাকড়সার জালগুলিতে আলোর ছোঁয়ায় রং লাগেনি এখনও।
যেখানে যায় সুমিতা সবখানেই সেই অশান্তির ছায়া।
সামনের পুবদিকের তেতলা বাড়িটার ছাদ ডিঙিয়ে দেখা যাচ্ছে কাঁচা রোদের ইশারা। দক্ষিণের যাত্রা শেষ করে, উত্তরায়ণে বাঁক নিয়েছে সবে সূর্য। উত্তরে বাঁকা রেখা রোদ কাঁপছে তেতলার আলসের কার্নিশে। নতুন উত্তাপ তার কিরণে। সাগরপারের নতুন বাতাস আসবে পাগলা ঘূর্ণনে। সোনার মতো মাঘের রোদে তারই আভাস ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। এখানে দিগন্ত ব্যাপে রোদ ছড়াবার জায়গা নেই। জ্যামিতিক ভঙ্গিতে হঠাৎ সামনের রাস্তাটির কোথাও রোদ পড়েছে ত্রিভুজাকারে। কোনও বাড়ির দক্ষিণ দেয়াল রাঙিয়ে, পেছনের বাড়ির পুবদিকে চকিতে দিয়েছে ছুঁড়ে এক কণা রোদ। দেয়াল থেকে দেয়ালে, আলসেয়, জানালায়, হঠাৎ রোদ ঝলমল করছে ঋজুরেখায়। ফাঁকে তার কোথাও হঠাৎ এক কৃষ্ণচূড়া রাস্তার সীমানায়, কিংবা বাড়ির সীমানায় মাথা তুলেছে নারকেল নয় তো কলমের আমগাছ। শহরের এ দক্ষিণ সীমায় সবুজের দাক্ষিণ্য কিছু বেশি।
কেমন একটি সচকিত খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে এই সকালের রোদে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রামের ঘর্ঘর ধ্বনি। কখনও-সখনও তীব্র হর্নের ক্ষীণ রেশ শোনা যাচ্ছে। কেউ শেষ অবধি ঘুরিয়ে দিয়েছে রেডিয়োটার ভলুম রেগুলেটার। হঠাৎ খুশির মতো ছড়িয়ে পড়ছে গানের সুর। সামনের রাস্তায় স্বল্পজনের রকমারি পদশব্দ। পথ চলতি কিছু কথাবার্তা, হঠাৎ একটি ডাক দিল হয়তো কেউ কাউকে। সব মিলিয়ে একটি কর্মচঞ্চল খুশি খুশি ভাব দিকে দিকে।
শুধু এখানে, এই বাড়িটি স্তব্ধ ভার। একতলা বাড়িটার হলদে মাথায় পড়েছে রোদ। স্বর্ণচাঁপার আগডালে সোনার ঝিকিমিকি। তবু যেন কী এক থম ধরা।
যেন কিছু হয়নি, যেন প্রত্যহের মতোই, সকালের রোদের আশায়, ভাললাগা মনটি নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে সুমিতা। ও বেড়াচ্ছে আর ওঁরা, অর্থাৎ বাবা, বড়দি, মেজদি যেন প্রত্যহের মতোই ঘরে কিংবা বাগানে লাগিয়েছে তর্ক। অদ্ভুত সব কথা। কোনও কোনও কথা শুনতে সত্যি বড় লজ্জা করে সুমিতার। মুখ লাল হয়ে ওঠে। বোঝা-না-বোঝা ভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সকলের মুখের দিকে। ও বোঝে, সব কথা ওর শুনতে নেই, বোধ হয় বুঝতেও নেই। তখন ও সরে পড়ে, ঘুরে ফিরে বেড়ায় এখানে সেখানে।
যেন তেমনিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুমিতা। বারবার বোঝাতে চাইছে মনকে, কিছু হয়নি, কিছুই হয়নি। কিছু হয়নি, ও যেন শুধু ঘুরে ফিরে বাগানে নেমে আদরের ভঙ্গিতে হাত বাড়াতে গেল ফুলগাছের দিকে। সতেজ ডালে সবুজ পাতার পাশে শুকনো মরা পাতা ভেঙে দেবে বলে।
হাত বাড়াল, কিন্তু গাছে গিয়ে স্পর্শ করল না। আবার ফিরে তাকাল ঘরের দিকে। এখানে ওর মন নেই, মন পড়ে আছে অন্যত্র। বুকের মধ্যে খচ খচ করে উঠছে। মুচড়ে মুচড়ে উঠে কান্না পাচ্ছে কেবলি। শুধু তো অশান্তি নয়, অস্বস্তি নয়। একটি অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে আছে এ বাড়িটার হৃৎপিণ্ডে। আর সেই কাটাটি যেন আমূল বিঁধেছে ওরই বুকে। সব খোঁচাখুঁচির রক্তক্ষরা যন্ত্রণা যেন সুমিতারই। সারা বাড়িটার সমস্ত দুশ্চিন্তার কালো ছায়া তাকেই ঘিরে আছে।
বাগান থেকে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ঘরের প্রতিটি জানালা বন্ধ। কাঁচের শার্সির আড়ালে পরদাগুলি কোনটা গুটানো, কোনটা স্প্রিংয়ের গায়ে টান টান করে মেলা। কিছু দেখা যায় না ঘরের মধ্যে। সাড়া-শব্দ নেই কারুর। এক অস্বস্তিকর স্তব্ধতা বিরাজ করছে সবখানে। কেবল রান্নাঘরে বিলাসের কাজের সামান্য শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একটু আগেই সসপেনে মাখনের ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ শব্দ শুনে সুমিতা বুঝতে পেরেছে বাবার জন্য পোচ তৈরি করছে বিলাস। জন্ম থেকে দেখে আসছে সুমিতা, সকালবেলার চায়ের সঙ্গে ওইটি তার বাবার চিরকালের খাবার। আর তাদের তিন বোনের জন্য হয়তো রুটি সেঁকবে এবার কিংবা সেঁকা হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরও কিছু। আরও কিছুর পর চায়ের জল চাপবে। তারপর বাবার ঘরে ডাক পড়বে সকলের।
তখন কী হবে। একই টেবিলের এপাশে ওপাশে যখন বসবে সবাই, তখন এই নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতা হঠাৎ কেমন করে ভাঙবে। কে ভাঙবে! সে কথা ভেবে এখনই সুমিতার বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। এটুকু ওর ভয় নয়, আনন্দও নয়, এক অপার বিস্ময়ের আলো আঁধার। কিছুক্ষণ পরের সেই ভবিষ্যতের বুকে উৎকণ্ঠিত কান পেতে আছে ও।
কিন্তু আজকের স্তব্ধতা ভাঙার পরই আসল কলরব উঠবে যখন, তখনই আসল ভয়টা দেখা দেবে।
গতকাল পর্যন্তও এবাড়ির আবহাওয়া যেন অনেকখানি স্বচ্ছ ছিল। মানুষগুলির চলায় ফেরায়, কাজে কর্মে, কথায় চাউনিতে বারে বারে এ দিনটির ছায়া উঁকি দিলেও প্রত্যহের জীবনে কোথাও ব্যতিক্রম দেখা দেয়নি। তবু এ দিনটির মুখোমুখি যাতে দাঁড়াতে না হয়, সে চেষ্টা অনেক করা হয়েছে। তলে তলে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে এ দিনটিকে প্রতিরোধ করার জন্যে। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের মতো এই দিন এসেছে।
এসেছে, তবু এখনও একটি ক্ষীণ আশা রয়েছে। তাই সুমিতা উৎকর্ণ হয়ে আছে, কখন বাড়ির সামনের লোহার গেটটা বিলম্বিত সুরে উঠবে ককিয়ে। শব্দটা বেশ জোরে হয়। কোনও কোনও অন্ধকার বাতাস হুতাশন রাত্রে, উত্তরের ডেপুটির বাড়ির সোহাগি বিড়ালীটা যেমন অদ্ভুত স্বরে তাদের বাগানে এসে ডাকে টেনে টেনে, ঠিক তেমনি শব্দ হয় গেটে। প্রতিদিনের শোনা সেই শব্দ, আজকে শোনবার জন্যে কান পেতে আছে সমস্ত হৃদয়। কখন শব্দ হবে, কখন দেখা যাবে রবিদা আসছেন ঠিক তেমনি মাথাটি একটু হেলিয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশান্ত মুখে তার সেই সহৃদয় স্বাভাবিক হাসিটুকু নিশ্চয় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে শেষ মুহূর্তের কৃতকার্যতায়। মুহূর্তে সমস্ত স্তব্ধভার অন্ধকার পালাবে মুখ ঢেকে। রবিদাকে প্রথম ছুটে গিয়ে অভিনন্দিত করবে সুমিতা। যেন তারই জীবনের এক জীবন-মরণ রুদ্ধশ্বাস সমস্যার সমাধান নিয়ে আসবেন রবিদা।
কিন্তু, সে এ বাড়ির সকলের ছোট। এখনও পর্যন্ত কোনও বিষয়ে তার মতামতের দাম নেই। কোনও গুরুত্ব নেই তার কথার। কোনও গুরুতর বিষয়ে কেউ আলোচনা করে না তার সঙ্গে। বাবা তাকে আদর করে রুমনি বলে ডাকেন। বড়দি মেজদিকে বলেন উমনি আর ঝুমনি। সে ডাকেও আদর আছে। কিন্তু আরও কিছু আছে, যা দিয়ে সুমিতার মনে হয় ওরা বড়দি আর মেজদি, সুজাতা আর সুগতা। সুমিতা শুধুই রুমনি। এ বাড়ির ছোট মেয়েটি! যাকে আদর করা যায়, ধমকানো যায়, কাজে কর্মে ফাঁই ফরমায়েশ করা যায়। বিশেষ কোনও কথার সময়ে বলা যায়, রুমনি তুমি একটু ওঘরে যাও তো এখন। হঠাৎ বাইরের কোনও নতুন নোক এলে কয়েক মুহূর্ত সুমিতা কিছু প্রাধান্য পায়। তারপর যখনই পরিচয় হয়ে যায়, সে হচ্ছে এ বাড়ির রুমনি, সেই মুহূর্তেই সমস্ত প্রাধান্য যেন যায় শেষ হয়ে। আর মানুষ কী বিচিত্র! তবুও সকলের চোখ থেকে থেকে পড়ে ওর দিকে। পড়তে হয় বলেই বোধ হয় পড়ে। রাস্তায়-ঘাটে, ট্রামে বাসে, সবাই এমন তাকায় ওর দিকে। তার কারণ আর কিছুই নয়, ওর চেহারাটার জন্যে সবাই তাকায়। হয়তো আরও কিছু মনে করে, যেমন, প্রথম দর্শনে মনে করে তাদের বাড়িতে আসা নতুন লোকগুলি। যদি জানতে পারত, সে শুধুমাত্র রুমনি, তা হলে সকলের চোখের চাউনি যেত বদলে।
এ বাড়ির কোনও দুঃখের ব্যাপারে ওর দুঃখিত হতে নেই। পারিবারিক কোনও জটিল বিষয়ে ওর কিছু নেই চিন্তা করার। এমনকী, বড়দের অনেক হাসির কথায় হাসাও উচিত নয়।
এ সীমারেখাঁটি যত না টেনে দিয়েছে বাড়ির লোকেরা, তার চেয়ে হয়তো কিছু বেশি টেনেছে সুমিতা নিজে। ও যে রুমনি, সে কথাটি নিজে ভুলতে পারে না কখনও।
কিন্তু জীবনের কোন ফাঁক দিয়ে, কবে কখন ওর মনটি আড়ালে আড়ালে টপকে গেছে সেই সীমারেখা, সে খবর রাখেনি নিজেই। গৃহস্থের বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে যেমন করে ঢোকে বনলতা, ঠিক তেমনি। যখন সে ঢোকে, তখন কারুর নজরে পড়ে না। যে ঢুকেছে, সে জীবনের স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। প্রত্যহের কাজের মাঝে গৃহস্থের নজরে পড়ে না তা। তারপর আরও ঢোকে, আরও আরও। অনেকখানি ছড়িয়ে, লকলকিয়ে এপাশে ওপাশে বাড়তে থাকে। তখন নজরে পড়ে। তখন আর অন্ত থাকে না বিস্ময়ের।
ওর মনটিও তেমনি অদৃশ্যে টপকে এসেছে সেই সীমারেখা। কিন্তু সেটা নজরে পড়েনি কারুর। তাই বাড়ির আজকের অস্বস্তি ও অশান্তির মধ্যে সুমিতার কথা কারুর মনেও পড়ে না। ভাবেওনি কেউ।
কিন্তু যে দুর্ভাবনার অধিকার ওকে কেউ দেয়নি, যেটুকু আপনি এসেছে মনে, সেটুকু লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে ওকে। যত না ভয়ে, তত লজ্জায়। আজকের ঘটনা ওকেই বিচলিত করেছে সবচেয়ে বেশি। ওর বেদনা, কান্না, অস্বস্তি অশান্তি ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। যে বাতাসের ঘায়ে অকম্পিত অবিচল থাকে বড় শক্ত-পোক্ত গাছগুলি, সবচেয়ে কচি লতাটি সেই বাতাসেই যেন পড়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে।
সুমিতা সারা হচ্ছে ভেবে। কী হবে! কী হবে এর পরে!
বড় বড় দুটি ব্যাকুল উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাচ্ছে রাস্তার দিকে। এতক্ষণ সময়ের মধ্যে মাত্র তিন বার লোহার গেটটা উঠেছে ককিয়ে। বিলাস এক বার বাইরে গিয়েছিল, আবার ফিরেছে। আর ঝি এসেছে। সেই শেষ বার শব্দ হয়েছে। তারপর যেন বরফের মতো জমে গেছে গেটটা। আর কোনওদিন বুঝি শব্দ হবে না।
কিন্তু কখন আসবেন রবিদা। আজকের এই মাঘী সকালে, উনিই যে সত্যিকারের উত্তরায়ণের বাঁকে ফেরা সূর্য। ওই লোহার গেটের দিকচক্রবালে কখন উদয় হবেন। ওঁর সেই গম্ভীর কিন্তু অমায়িক হাসি দিয়ে ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেবেন সব ভয়।
কিন্তু সুমিতার নিষ্পলক চোখ জ্বালা করে জল এসে গেল, তবু না, রবিদার চিহ্নও নেই কোথাও। রাস্তায় বাড়ছে লোক চলাচল। এত লোকের আনাগোনা। কিন্তু যাকে চাই, সে আসে না। এমনিটিই হয়। তবু রবিদার আসার সময় তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।
রান্নাঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে আবার বারান্দায় উঠে এল ও। এমনি করে অনেক বার করেছে ঘর বার। আবার মন টানছে ঘরের দিকে। বড়দির ঘরের দিকে। যাকে নিয়ে আজ সারা বাড়ির চেহারা গেছে বদলে। যার জীবনের একটি অধ্যায় হয়তো একেবারে শেষ হয়ে যাবে আজ। যদি না হয়, তবে হয়তো ঝুলে থাকবে ত্রিশঙ্কুর মতো। আজ বিচারক রায় দেবেন ওর জীবনের। সত্যি সত্যি বিচারক, সত্যি সত্যি কোর্ট, কাছারি, মামলা। ভাবতে ভাবতে সুমিতার বুকের মধ্যে কনকনিয়ে উঠল।
আজকে বড়দির বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হবে। পূর্ণ হবে সন্ধ্যারাত্রি আটটার কাঁটায় কাঁটায়। তার আগেই, বেলা এগারোটা থেকে চারটের মধ্যে কোনও এক সময় হয়তো বড়দির সঙ্গে গিরীনদার বিচ্ছেদের রায় হয়ে যাবে। ভীষণ রাশভারী অথচ ভারী অমায়িক মানুষ গিরীনদা। মস্ত বড় প্রেসের মালিক। সুমিতাদের তুলনায় মস্ত বড়লোক। বিয়ের বছরখানেক আগে ওদের পরিচয় প্রেমে পরিণত হয়েছিল। আর বিয়ের এক বছর পর প্রথম শোনা গিয়েছিল ওদের বিবাদের কথা। কত কথা শোনা গেছে তখন, কত ঘটনা ঘটে গেছে এত দিনে। গত বছর এমন দিনেই বড়দি চলে এল গিরীনদার বাড়ি থেকে। স্বভাবতই বাবা নিয়েছিল বড়দির পক্ষ। মেজদিও তাই। বরং কিছু বেশি। চেষ্টা চালাতে লাগল বোঝাপড়ার। সেই ফাঁকেই যেন বিবাদের চেহারাটা হয়ে উঠতে লাগল ভয়াবহ। কথা উঠল, আলাদা হওয়া যাক উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে। সেই প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে উঠেছিল সুমিতা। সেই প্রথম নিজেরই অজান্তে রুমনির মন সকালের অলক্ষে টপকাল তার সীমারেখা। সে সীমারেখা হল ওর ব্যথা পাওয়ার অনধিকার চর্চা। আলাদা হওয়ার কথাটা কোনও সুরাহা করল না। যে দুজনকে নিয়ে ঘটনা, তলে তলে বাড়ল তাদের রেষারেষি। আগুন জ্বলল ভাল করে। ব্যাপারটা উঠল গিয়ে কোর্টে। ঘরের কথা বাইরে যেতে না যেতে হাটের আসর উঠল জমে। উভয়পক্ষেই ইন্ধন জোগাবার লোকের অভাব হল না একটুও। উপকারীর দল এলেন ছুটে। একটি কথাই বারবার শুনতে পেয়েছে সুমিতা। জুডিশিয়াল সেপারেশন। হিন্দু বিবাহ না হলে ডাইভোর্স হত।
জুডিশিয়াল সেপারেশন। আজ তার রায় পাওয়া যাবে। কী রায় পাওয়া যাবে না যাবে, সে কথা এক বারও মনে হয়নি সুমিতার। এবার কী হবে, সেই কথা ভেবে বুকে পাষাণভার।
মানুষের জীবন মনের জটিল দ্বন্দ্ব বোঝে না সে। বড়দিকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। যে কথা মুখ ফুটে কোনওদিন বলার সাহস হবে না, সে কথা হল, ওর হৃদয় মাঝের অনেক মনের একটি অস্পষ্ট মন– গিরীনদাকেও ভালবাসে। সে-ই যে ও কত বেশে কত দিন দেখেছে বড়দি আর গিরীনদাকে, কত বিচিত্র পরিবেশে, সেই ছবিগুলি আঁকা হয়ে গেছে ওর তখনকার কিশোরী বুকে। সে ছবি একটুও ম্লান হয়নি এই সবে বাড়ন্ত যৌবনের মুহূর্তে। সেই ছবিটি যেন একটি ঝকঝকে নীল আকাশ, রসসিক্ত উর্বর মাটি, একটি মসৃণ পাঁচিল, কিছু মৃদু মন্দ বাতাস। যার মাঝখান দিয়ে মনের কচি লতাটি আড়ালে আড়ালে ছড়িয়ে ছাড়িয়ে উঠেছে তর তর করে। ওদের চাউনি, হাসি, ভালবাসাবাসি, সে সবই শেষ হয়ে যাবে।
জজের বিচার কী হবে কে জানে। কিন্তু তারপরে কী করবে গিরীনদা আর বড়দি। তারপর কী হবে দুজনের, সেই কথা ভেবে ও অস্থির হয়ে উঠেছে ভয়ে ও ব্যথায়। সেই কথা ভেবেই যত বুকের কাঁপন, যত যন্ত্রণা। সে কথা বড়দি কেমন করে ভাবছে সুমিতা জানে না। মেজদির বিক্ষুব্ধ মুখে সে কথার ছায়াও দেখা যায় না। কেবল বাবাকে যখন একলা বসে থাকতে দেখে, তখন ওঁর বিশাল মুখখানিতে যেন কীসের একটি করুণ ছায়া দেখতে পায়। সে ছায়া যে কেন, কীসের জন্যে, ও তা ভেবে কূল পায় না। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে, সবাই যেন এক। কেবল একই বাড়িতে, একই পরিবেশে ওর মনটি আলাদা হয়ে গেছে সকলের কাছ থেকে।
সত্যিই আলাদা। বাবার সঙ্গে দুই দিদির যেমন সম্পর্ক, সুমিতার সঙ্গে তেমন নয়। বাবা ওকেও ভালবাসেন, অনেক কথা বলেন। কিন্তু বড়দি মেজদি আগে জন্মেছে বলে তাদের সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে অন্যরকম। সুমিতা যখন চোখ মেলে বাবাকে দেখতে শিখেছে, তখন বাবা কিছু ক্লান্ত, সৌম্য, একটু যেন করুণ। সন্তানের প্রতি একটু বেশিমাত্রায় স্নেহপরায়ণ বিপত্নীক এক ভদ্রলোক। চলায় ফেরায় কথায় ফুটে ওঠে একটু অসহায়তার আভাস। সেই মানুষটির সঙ্গেই সুমিতার ভাব, চেনাশোনা।
কিন্তু বড়দি মেজদি আর বাবা, তিনজনে মিলে আর একরকম। যাদের সবটুকু সে চেনে না, বোঝে না। আর জানে, তা বুঝতেও নেই।
কিন্তু সময় তো চলে যায়। বাইরের ঘরের পরদায় হাত দিতে গিয়ে ও থমকে দাঁড়াল। আবার তাকাল গেটের দিকে। না, রবিদার ছায়াও দেখা যায় না। শুধুই অচেনা মানুষের যাওয়া আসা।
শেষ আশা রবিদা। উনি এ বাড়ির যেমন একনিষ্ঠ বন্ধু তেমনি অন্তরঙ্গ বন্ধু গিরীনদার। গিরীনদাদের পরিবারেরও এ ব্যাপারের একমাত্র বাইরের মানুষ, প্রকৃত বন্ধুর মতো এ দুয়ের ভিতরে ছুটোছুটি করছেন শেষরক্ষার জন্যে। গতকাল রাত্রেও বাবার সঙ্গে আড়ালে কথা বলে গেছেন উনি। বলে গেছেন, আজ রাত্রে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব গিরীনের সঙ্গে কথা বলে। ওর পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত যদি কিছু করা যায়। শুনে সুমিতার ভীরু অস্থির অন্তরে মন্দ্রিত হয়ে উঠেছিল মহারব ভেরি। ইচ্ছে হয়েছিল, ছুটে গিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরে রবিদাকে।
সেই ধরার ব্যাকুল-খুশি-আশায় মনে মনে হাত বাড়িয়ে আছে। কখন আসবেন রবিদা! যেন ওঁর হাতেই আছে সেই প্রসন্নময়ের ঘুম ভাঙানো সোনার কাঠি।