প্রথম অধ্যায়
বাংলায় মুসলমানদের আগমন
বাংলায় সর্বপ্রথম মুসলমানদের আগমন কখন হয়েছিল, তার সন তারিখ নির্ধারণ করা বড়োই দুঃসাধ্য কাজ। প্রাচীন ইতিহাসের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত স্তুপ থেকে তা উদ্ধার করা বড়ো কষ্টসাধ্য কাজ সন্দেহ নেই। তবুও ইতিহাসবেত্তাদের এ কাজে মনোযোগ দেয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি।
তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে বহির্জগত থেকে যেসব মুসলমান আগমন করেছিলেন, তাদেরকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক শ্রেণীর মুসমলনা ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যপদেশে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আগমন করে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেন। কতিপয় অলী দরবেশ ফকীহ শুধুমাত্র ইসলামের দাওয়াত ও তবলিগের জন্যে আগমন করেন এবং এ মহান কাজে সারা জীবন অতিবাহিত করে এখানেই দেহত্যাগ করেন।
আর এক শ্রেণীর মুসলমান এসেছিলেন –বিজয়ীর বেশে দেশজয়ের অভিযানে। তাঁদের বিজয়ের ফলে এ দেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। বলা বাহুল্য ৭১২ খৃষ্টাব্দে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সর্বপ্রথম মুহাম্মদ বিন কাসিম আগমন করেন বিজয়ীর বেশে এবং এটা ছিল ইসলামের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। তাঁর বিজয় সিন্ধুপ্রদেশ পর্যন্তই সীমিত থাকেনি। বরঞ্চ তা বিস্তার লাভ করে পাঞ্জাবের মূলাতন পর্যন্ত। আমরা যথাস্থানে তার বর্ণনা সন্নিবেশিত করব।
অপরদিকে বাংলায় মুসলমানদের আগমন দূর অতীতের কোন এক শুভক্ষণে হয়ে থাকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছিল –হিজরী ৬০০ সালে অর্থাৎ ১২০৩ খৃষ্টাব্দে। তৎকালীন ভারত সম্রাট কুতুবুদ্দীন আইবেকের সময়ে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, বলতে গেলে অলৌকিকভাবে, বাংলায় তাঁর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাব করেন। মুসলমানদের এ উভয় রাজনৈতিক বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এসবের অনে পূর্বেই যে এ দেশে ইসলামের বীজ বপন করা হয়েছিল এবং সে উপ্ত বীজ অংকুরিত হয়ে পরবর্তীকালে তা যে একটি মীরুহের আকার ধারণ করেছিল, তাও এক ধ্রুব সত্য –কিন্তু তার সময়কাল নির্ধারণটাই হলো আসল কাব যা ইতিহাসের প্রতিটি অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের জন্যে একান্ত বাঞ্ছনীয়। আসুন ঐতিহাসিক দিকচক্রবাল থেকে কোন দিগদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা তা একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরববাসী শুধু বর্বর, কলহপ্রিয় ও রক্তপিপাসু জাতিই ছিল না। বরঞ্চ তাদের মধ্যে যারা ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী, তারা জীবিকার্জনের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। মরুময় দেশে জীবন ধারণের জন্যে খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আবহমান কাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো। যে বণিক দল হযরত ইউসূফকে (আ) কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরের জনৈক অভিজাত রাজকর্মচারীর কাছে বিক্রয় করে, তারা ছিল আরববাসী। অতএব আরববাসীদের ব্যবসায় পেশা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিস্তৃত ছিল দেশ-দেশান্তর পর্যন্ত।
স্থলপথ জলপথ উভয় পথেই আরবগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে তারা বাণিজ্য-ব্যপদেশে দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতো। প্রাক ইসলামী যুগেই তারা একদিকে সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সসুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল। আরব থেকে সুদূর চীনের মাঝপথে তাদের কয়েকটি সমুদ্রতীরবর্তী একটি জেলা। ভৌগোলিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ উপদ্বীপটিকে মালাবার নামে অভিহিত করা হয়। আরব ভৌগোলিকগণের অনুলিখনে একে মালিবার (আরবী****) বলা হয়েছে।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেনঃ
“আধুনিক গ্রীকদের মলি (MALI) শব্দে বর্তমান মালাবার নামের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ ‘মালাবার’ নাম আরববাসী কর্তৃক প্রদত্ত হয় –বিশ্বকোষ সম্পাদকের এই সিদ্ধান্তটা খুবই সংগত। আমাদের মতে মালাবার, আরবী ভাষার শব্দ –মলয়+আবার= মালাবার। আরবী অনুলিখনে (আরবী***) মলয়+আবার। মলয় মূলতঃ একটি পর্বতের নাম, আবার অর্থ কুগপুঞ্জ, জলাশয়। আরবরা এদেশকে মা’বারও (আরবী*****) বলিয়া থাকেন। উহার অর্থ, অতিক্রম করিয়া যাওয়ার স্থল, পারঘাট। আজাকালকার ভূগোলে পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট। যেহেতু আরব বণিক ও নাবিকরা এই ঘাট দুইটি পার হইয়া মাদ্রাজে ও হেজাজ প্রদেশে যাতায়াত করিতেন, এবং মিশর হইতে চীনদেশে ও পথিপার্শ্বস্থ অন্যান্য নগরে বন্দরে যাতায়াত করিতেন। এই নাম দুইটি হইতে ইহাও জানা যাইতেছে, এই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয় অতি পুরাতন এবং সম্বন্ধ ছিল অতি ঘনিষ্ঠ”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, পৃঃ ৪৭-৪৮)।
নবী মুহাম্মদ মুস্তাফার (সা) দুনিয়ায় আগমনের বহুকাল পূর্বে বহুসংখ্যক আরব বণিক এদেশে (মালাবারে) আগমন করেছিলেন। তারা হরহামেশা এ পথ দিয়ে অর্থাৎ মালাবাদের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এভাবে বাংলার চট্টগ্রাম এবং তৎকালীন আসামের সিলেটও তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এর থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক ইসলামী যুগেই মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি স্থানে আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল।
খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে নভী মুস্তাফা (সা) আরবের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং চল্লিশ বৎসর বয়সে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে দ্বীন ইসলামের প্রচার কার্য শুরু করেন। তাঁর প্রচার আন্দোলন ছিল অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক। এ বিপ্লবের ঢেউ আরব বণিকদের মাধ্যমে মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট ও চীনদেশেও –যে পৌঁছেছিল, তা না বল্লেও চলে। নবী মুহাম্মদের (সা) বিপ্লবী আন্দোলনের যেমন চরম বিরোধিতা করেছে একদল, তেমনি এ আন্দোলনকে মনেপ্রাণে গ্রহণও করেছে এক দল। মালাবারের আরববাসীগণ খুব সম্ভব হিজরী সনের প্রারম্ভেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, সপ্তম শতক পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল আরব বণিকদের দ্বারাই।
মালাবারে যেসব আরব মুহাজির ইসলাম গ্রহণ করার পর স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা মোপলা নামে পরিচিত। ছোটো বড়ো নৌকার সাহায্যে মাছ ধরা এবং মাল ও যাত্রী বহন করা ছিল তাদের জীবিকার্জনের প্রধান পেশা। অনেক সময়ে তাদেরকে জীবিকার্জন ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জণ্য ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আরব দেশে যাতায়াত করতে হতো। এভাবেই তারা ইসলামের বিপ্লবী দাওয়াতের সংস্পর্শে এসেছিল।
মোপলাদের সম্পর্কে পরবর্তী কোন এক অধ্যায়ে আলোচনার বাসনা রইলো। এখানে, তাদের সম্পর্কে শুধু এতটুকু বলে রাখতে চাই যে, তারা ছিল অত্যন্ত কর্মঠ ও অধ্যাবসায়ী। সুন্দর ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল তারা। সাহসিকতায় এরা চিরপ্রসিদ্ধ। এর দাড়ি রাখে এবং মাথায় টুপি পরিধান করে, এদের মধ্যে অনেকেই ধীবর জাতীয় এবং ধীবরদের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচার করা ছিল এদের প্রধান কাজ।
মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যেও ধীরে ধীরে ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেকালে ভারতে বৌদ্ধ এবং জৈন মতাবলম্বীদের উপরে হিন্দু ব্রাক্ষণ্যবাদের নিষ্ঠুর ও অমানুষিক নির্যাতন চলছিল। এসব নির্যাতন উৎপীড়নের মুখে মুসলমান সাধুপুরুষের সাহচর্য ও সান্নিধ্য তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে।
মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের দ্রুত বিস্তার লাভের প্রধান কারণ মালাবারের স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণ। মালাবার-রাজের ইসলাম গ্রহণের চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণিত আছে।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর পূর্ব বর্ণিত গ্রন্থে বলেনঃ
“হিন্দু সমাজের প্রাচীন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে মালাবার সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। বিশ্বকোষের সম্পাদক মহাশয় তাহার অনেকগুলি উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেগুলির অধিকাংশই মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে কতকগুলি উদ্ভট উপকথা ছাড়া আর কিছুই নহে। তবে এই কোষকার নিজে মালাবারের হিন্দুরাজা সম্বন্ধে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিতেছেনঃ পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কা গমন করেন –(বিশ্বকোষ-১৪:২৩৪)।
শেখ যয়নুদ্দিন কৃত তোহফাতুল মুজাহেদীন পুস্তকেও একজন রাজার মক্কা গমন, তাঁহার হযরত রসূলে করীমের খেদমতে উপস্থিত হওয়া এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। তাহার এই বর্ণতা হইতে জানা যাইতেছে যে, মালাবারের রাজা-যে মক্কায় সফর করিয়াছিলেন এবং হযরতের খেদমতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট ইসলামের বয়আত গ্রহণ করিয়াছিলেন, স্থানীয় মুসলমানদিগের মধ্যে ইহাই মশহুর ছিল”।
মওলাতা তাঁর উক্ত গ্রন্থে আরও মন্তব্য করেনঃ
“স্থানকালাদির খুঁটিনাটি বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও এবং সেগুলিকে অবিশ্বাস্য বলিয়া গৃহীত হইলেও রাজার মক্কায় যাওয়ার, হযরতের খেদমতে উপস্থিত হওয়ার এবং কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করার পর দেশে ফিরিয়া আসার জন্য সফর করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার কোন কারণ নাই। মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে একটা দেশের সমস্ত অধিবাসী আবমান কাল হইতে যে ঐতিহ্যকে সমবেতভাবে বহন করিয়া আসিতেছে তাহাকে অনৈতিহাসিক ও ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কোনও মতে বিবেচিত হইতে পারে না। এই প্রসংগে বিশেষভাবে বিবেচ্য হইতেছে বিশ্বকোষের বিবরণটি। কোষকার বলিতেছেনঃ ‘পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরার (মালাবার) রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণাবিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন’। সুতরাং মালাবার রাজ্যের রাজার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সিংহাসন ত্যাগ করা এবং হযরতের নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আদৌ সংগত হইতে পারে না”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)
এখন শেখ যয়নুদ্দীন প্রণীত তোহফাতুল মুজাহেদীন গ্রন্থের বিবরণ, বিশ্বকোষের বিবরণ, মালাবারের মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকল অধিবাসীর আবহমান কালের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজার ইসলাম গ্রহণ ব্যাপারটি সত্য বলে গ্রহণ করতে দ্বিধাসংকোচ থাকার কথা নয়। কিন্তু তথাটি একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে রয়ে যায়। তা হচ্ছে এই যে, এত বড়ো একটি ঘটনা হাদীসের কোন গ্রন্থে বর্ণিত হয়নি কেন? অবশ্য শেখ যয়নুদ্দীন তাঁর বিবরণে কতিপয় রাবীর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীসবেত্তাদের মতে তা ‘সন্দেহমুক্ত নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসল ব্যাপারটি তাহলে কি ছিল? ঘটনাটিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলে গ্রহণ করলে হাদীসগ্রন্থে তার উল্লেখের কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এমন হওয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয় যে, মালাবারের আরব মুহাজিরগণ যেমন হিজরী প্রথম সনে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন, সম্ভবতঃ মালাবারের রাজা সিংহাসত ত্যাগ করতঃ এসব আরব মুহাজিরগণের সংগে ইসলাম গ্রহণ করেন। সিংহাসন ত্যাগের পর তাঁর পরিচয় গোপন করাটাও অসম্ভব কিছু নয় –আর এই কারণেই হয়তো তাঁর ইসলাম গ্রহণ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোন কৌতুহলের উদ্রেক করেনি। তথাটি তোহফাতুল মুজাহেদীনের গ্রন্থকার কতিপয় হাদীসের ও রাবীর উল্লেখ করেছেন।
মালাবারের আরব মুহাজিরগণের এবং স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণের পর স্থানীয় মালাবারবাসীগণও ইসলাম আকৃষ্ট হয় এবং তারা দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হয়। তারপর মালাবরে পরপর দশটি মসজিদ নির্মিত হয়। প্রথম মসজিদ পেরুমলের রাজধানী কর্ণক্রোর (কোড়ঙ্গনূর) বা ক্রাঙ্গানুরে নির্মাণ করেন মালেক ইবনে দীরান। এভাবে ত্রিবাংকোরের অন্তর্গত কুর্কবে, মঈলোর নগরে, ধর্মপত্তন নগরে, চালিয়াম নগরে, সুরুকুন্ডপুরমে, পন্থারিণীতে এবং কঞ্জরকোটে মসজিদ নির্মিত হয়।
“বিশ্বকোষ প্রণেতা বলেনঃ মসজিদ প্রতিষ্ঠার সংগে সংগেই যে এদেশে মুসলমান প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নেই। এই সকল মসজিদের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক সম্পত্তিও প্রদত্ত হইয়াছিল। ঐ সময়ে উপকূলবাসী মুসলমানগণের এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত দেশীয় অধিবাসীদিগের সংখ্যায় পরিবৃদ্ধি হইয়াছিল। ক্রমে তাহারা রাজ্য-মধ্যে প্রভাব সম্পন্ন হইয়া উঠে”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)
উপরের আলোচনায় এ সত্য প্রকট হয়ে যায় , খৃষ্টীয় সপ্তম শতকেই ভারতের মালাবার মুসলমানদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। তাদের ছিল না কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।
মালাবারের পরেই মুসলিম আরব মুহাজিরদের বাণিজ্য পথের অন্যান্য মনযিল চট্টগ্রাম ও সিলেটের কথা আসে। মালাবারে আরব মুহাজিরদের স্থায়ী বসবাসের পর তাদের অল্পবিস্তর বসতি গড়ে উছে। এটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মালাবারে যেমন প্রথম হিজরী শতকেই ইসলাম দানা বেধেঁছিল, চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার কি সমসাময়িক কালেই হয়েছিল, না তার অনেক পরে। এ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন করা সম্ভবপর নয়। তবে খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে আরবের মুসলমান বণিকদের চট্টগ্রামের সাথে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে।
ডক্টর আবদুল করিম তাঁর ‘চট্টগ্রামের সংগে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনা-গোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিককেরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্যগঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশদ্ভুত বলে দাবী করে। চট্ট্রগামী লোকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন, আলকরণ, সুলুক বহর, (সুলুক-উল-বহর), বাকালিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করেন। আগেই বলা হয়েছে যে, কো কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, আরবী শব্দ শৎ ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, চট্টগ্রাম পৃঃ-১)।
চট্টগ্রামে কয়েক শতাব্দী যাবত মুসলমান বসবাস করলেও তারা কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেননি। তাদের কাজ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচার। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলায় মুসলমান শাসন কায়েমের অনেক পরে সোনার গাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯ খৃঃ) সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করে তা মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন।