১. বর্ষার পালা শেষ

০১.

বর্ষার পালা শেষ হয়ে আশ্বিন পড়েছিল। বৃষ্টি তবু বিদায় নেয়নি। মাঝে-মাঝেই এক-আধ পশলা জোর বৃষ্টি হচ্ছিল।

তারাপদ পর-পর দু দিন আটকে পড়ল বৃষ্টিতে। একেবারে বিকেলের শেষে এমন ঝমাঝম বৃষ্টি নেমে গেল দু দিনই যে, সে আর কিকিরার কাছে আসতেই পারল না।

আজ কোথাও কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। অফিস থেকে সোজা কিকিরার বাড়ি এসে হাজির তারাপদ।

এসে যা দেখল তাতে চমৎকৃত হল।

 কিকিরা যথারীতি তাঁর বসার ঘরেই ছিলেন। এই ঘরটিকে তারাপদরা বলে জাদুঘর। এখানে না আছে কী। দেওয়াল জুড়ে নানান জিনিস, মাটিতেও পা রাখার জায়গা নেই।

নিজের সেই সিংহাসন-মাকা চেয়ারে কিকিরা বসে ছিলেন। সামনে এক মোড়া। মোড়ার ওপর তুলোর গদি। গদির ওপর কিকিরার বাঁ পা। পায়ের সঙ্গে দড়ির ফাঁস। অবশ্য কিকিরার বাঁ পায়ের পাতা থেকে গোড়ালির অনেকটা ওপর পর্যন্ত মোটা করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়ানো। দড়ির ফাঁসটা গোড়ালির ওপর দিকে বাঁধা। আলগা করে। সেই দড়ি এক বিচিত্র কায়দায় মাথার ওপর। ঝোলানো চাকার মধ্যে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। গলিয়ে দড়ির অন্য প্রান্তটা ঝুলিয়ে একেবারে কিকিরার বাঁ হাতের সামনে। মানে, কিকিরা যখন দড়ি টানছেন, তাঁর বাঁ পা উঠে যাচ্ছে, যখন দড়ি আলগা করছেন, পা এসে মোড়ার ওপর পড়ছে।

কিকিরার ডান হাতে তাঁর পছন্দের চুরুট। দেখতে আঙুলের মতন সরু-সরু। চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধটা কিন্তু বিশ্রী।

তারাপদ যেন কতই বিমোহিত বাহবা দিয়ে বলল, “দারুণ স্যার। এ-জিনিস আপনিই পারেন।”

কিকিরা সাদামাটা গলায় বললেন, “পুলিসিস্টেম।” 

“পাঙ্খা কুলি সিস্টেম?”

“পাঙ্খা কুলি দেখেছ?”

“চোখে দেখিনি, ছবিতে দেখেছি। ইলেকট্রিসিটির যুগে পাঙ্খ-কুলি আর কোথায় দেখতে পাব!”

“জ্ঞানের রাজা! ইলেকট্রিসিটির যুগ! এ-দেশে এখনো কেরাসিন তেলের যুগ চলছে। যাও না একবার ভেতর দিকের গাঁ-গ্রামে।”

“ভুল হয়েছে স্যার।” তারাপদ যেন চট করে অপরাধ স্বীকার করে নিল।

“বাঁশবেড়ের হিরুবাবুর নাম শুনেছ? মস্ত বড় শিকারি। এক সময় হাতি ধরে বেড়াতেন। বিরাট ওস্তাদ। হিরুবাবুর কথা হল, ইলেকট্রিক মানেই সর্বনাশ। ওতে চোখ খারাপ হয়, মাথা নষ্ট হয়।”

“তাই নাকি?”

“হিরুবাবু বলেন, রেড়ির তেলের যুগটাই ছিল বেস্ট। রেড়ির যুগ গিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মতন মানুষও গিয়েছেন।

তারাপদ হাসতে-হাসতে প্রায় মাটিতেই বসে পড়ে আর কী!

কিকিরা হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বার দুই পায়ের দড়ি টানাটানির খেলা খেলে নিলেন।

হাসি থামলে তারাপদ বলল, “স্যার, আপনার লেগ কেমন?”

“পুল করতে পারছি। চাঁদু ডাক্তার কী বলে হে?”

“তিন হপ্তা নড়াচড়া চলবে না। মানে বাইরে বেরোতে পারবেন না।”

“তি-ন হপ্তা! আজ তো মাত্র দশ দিন হল তারাপদ, আরও দশ বারো দিন! আমি পারব না।”

“পারব না বললে চলবে কেন, স্যার! কে আপনাকে খানা-খন্দে পাগলাতে বলেছিল! গোড়ালির হাড় ভাঙেনি–এই যথেষ্ট। পা মচকানোর ব্যথা সারতে। সময় লাগে!”

“চাঁদু জ্বরজ্বালা, আমাশার ডাক্তার, হাড়গোড়ের সে কী বোঝে?”

তারাপদ রগড় করে বলল, “বলব চাঁদুকে। বলব, তুই বোগাস! কিস্যু জানিস না।”

কিকিরা একটু হেসে কথা পালটে বললেন, “বোসো। চা-টা খাও।” বলে চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। ধোঁয়া আসছিল না। জোরে-জোরে টান মেরে ধোঁয়া বার করলেন।

তারাপদ বসে পড়েছে ততক্ষণে। মুখ মুছে নিচ্ছিল রুমালে।

কিকিরা নিজেই বললেন, “চাঁদুকে কাল-পরশু একবার পাঠিয়ে দিয়ে। আমি তিরিশ হাজার টাকা লোকসান দিতে পারব না।”

খেয়াল করে কথাটা শোনেনি তারাপদ, তবে কানে গিয়েছিল। টাকার অঙ্কটা মাথায় থাকেনি। সে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।  

“থারটি থাউজেন্ড ইজ এনাফ।” কিকিরা আবার বললেন।

 তারাপদ বোকার মতন বলল, “তিরিশ হাজার!”

“এখন তিরিশ, পরে হাজার পঞ্চাশও হতে পারে।”

তারপদ এবার যেন ধাতে এল। রসিকতা করে বলল, “আপনার লেগ-প্রাইস…? মানে ইনসিওরেন্সের কোনো কমপেনসেশান…”

“দুঃ।” কিকিরা অদ্ভুতভাবে ‘দুঃ’ বললেন।

“লটারি পাচ্ছেন?”

“নো।”

“তা হলে ব্যাপারটা কী? তিরিশ হাজারের সঙ্গে আপনার পা মচকানোর সম্পর্কটা কোথায়?”

কিকিরা বললেন, “কাগজ-টাগজ পড়া হয় মশাইয়ের?”

“হয়। তবে পড়া না বলে চোখ বুলনো বলতে পারেন। কাগজে পাঠ্য বলতে তো মন্ত্রী-সংবাদ…!”

“বুঝেছি। তা একবার ওখানে যাও। ওই যে দেওয়ালে ঝোলানো বাস্কেট দেখছ, ওর মধ্যে তিনটে কাগজ আছে। নিয়ে এসো।”

তারাপদ উঠল।

কিকিরার এই ঘরে না আছে কী? চোরবাজারের দোকানও এমন বিচিত্র নয়। চন্দন কি সাধে বলে, ওল্ড কিউরিয়োসিটি শপ! সেকেলে গ্রামাফোন, পাদরিটুপি, দেওয়াল ঘড়ি, পায়রা-ওড়ানো বাক্স, ম্যাজিক পিস্তল, কালো আলখাল্লা, পুতুল, ভাঙা বেহালা, তরোয়াল, কাঁচের মস্ত বড় বল, আরও কত কী!

দেওয়ালে এক মাদুর কাঠির সরু টুকরি আটকানো ছিল। তারাপদ কাগজ নিয়ে ফিরে এল।

কিকিরা বললেন, “লাল পেনসিলে দাগ দেওয়া আছে। দেখো।”

তারাপদ খবরের কাগজগুলো দেখল। তিন দিনের কাগজ। তারিখ আলাদা। দু-তিন দিন বাদ-বাদ তারিখ। কাগজ একই। লাল পেনসিলের দাগ-দেওয়া জায়গাটা বার করে নিল সে।

“এটা কী স্যার?”

“পড়ো।”

“মনে-মনে, না, জোরে-জোরে?”

“জোরে-জোরে।”

তারাপদ পড়তে লাগল “আমি লোচন দত্ত, পুরা নাম ত্রিলোচন দত্ত, সাতাশের এক, যদু বড়াল লেন, কলকাতা বারোর নিবাসী, এই মর্মে জানাইতেছি যে–জনৈক প্রতারক আমার ছোট ভাই মোহন দত্ত সাজিয়া নানা জনের সঙ্গে প্রতারণা করিতেছে বলিয়া সংবাদ পাইতেছি। আমার ভাই মোহন দত্ত উনিশশো পঁচাশি সালে একুশে অগস্ট মারা গিয়াছে। আমার অন্য কোনো ভাই নাই। আমাদের উক্ত নম্বরের বসতবাটী এবং দত্ত অ্যান্ড সন্স-এর একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি ও আমার দুই নাবালক পুত্র–বিশ্বনাথ ও যোগনাথ। মোহন দত্ত আর জীবিত নাই। ওই নামে কেহ যদি কোথাও আমাদের তরফ হইতে ব্যক্তিগত, ব্যবসায়গত ও সম্পত্তিগত কোনো কাজকারবার করেন, আমরা তাহার জন্য দায়ী থাকিব না। উপরন্তু কেহ যদি প্রতারক মোহন দত্ত নামের মানুষটির বিস্তারিত খবরাখবর দেন ও তাহাকে ধরাইয়া দেন–আমাদের। পক্ষ হইতে তাঁহাকে নগদ ত্রিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে প্রতিশ্রুতি দিতেছি। যোগাযোগের ঠিকানা : সাতাশের এক, যদু বড়াল লেন, কলকাতা বারো। সময় সকাল আটটা হইতে বেলা দশটা।”

তারাপদ পড়া শেষ করেও যেন ভাল বুঝল না। মনে-মনে আবার পড়ে নিচ্ছিল।

শেষে তারাপদ বলল, “বাবা! বিরাট নোটিস। লিগ্যাল নোটিস স্যার।” কিকিরা বললেন, “লিগ্যাল নোটিস নয় বলেই মনে হচ্ছে। বয়ানটা উকিলের মতন। ব্যক্তিগত বিজ্ঞপ্তি ওটা।”

“সব দিনেই কি একই বয়ান? মানে তিন দিনের কাগজে?”

“হ্যাঁ।”

“শুধু বাংলা কাগজেই?”

“ইংরিজি আমি দেখিনি। মনে হয়, অন্য বাংলা কাগজ আর ইংরিজি কাগজেও আছে। কোন কাগজ কার চোখে পড়বে-বলা তো যায় না।”

তারাপদ বলল, “তবে এই আপনার ত্রিশ হাজার?”

“ইয়েস স্যার।”

“আপনি স্বপ্ন দেখছেন কিকিরা। টাকা অত সস্তা নয়।”

 কিকিরা বললেন, “নো সার, আমি ড্রিমিং করছি না। ড্রিলিং করছি। মানে রহস্যটা বোঝার জন্য জমি খুঁজছি। তুমি ঠিক বলেছ, অত সস্তা নয়। নয় বলেই তো ব্যাপারটা কঠিন। তুমি কি ভাবছ, লোচন দত্ত টাকার হরিলুঠ দেওয়ার জন্যে কেঁদে মরছে?”

“আমি কিছুই ভাবছি না। শুধু দেখছি, লোচন দত্ত এক আহাম্মক আর আপনিও পাগল!”

এমন সময় বগলা এল। চা আর হিঙের কচুরি, কুমড়ো-আলুর ছক্কা এসেছে।

অফিস থেকে ফিরছে তারাপদ। খিদে পেয়েছিল জোর। কচুরির ডিশটা তাড়াতাড়ি টেনে নিল। চলে গেল বগলা।

কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢোকেনি।

 “একেবারেই নয়।”

“একটা মরা লোক চার-পাঁচ বছর পরে ফিরে আসে কেমন করে?”

“আসে না। মরা লোকের ভূত আসতে পারে।”

“তা ছাড়া–এই লেখাটা পড়ে বোঝা যাচ্ছে, কোনো জাল মোহন দত্ত নানান বান্ধা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধান্ধা বৈষয়িক হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। মোহন দত্ত সম্পর্কে তার খুব যে একটা আগ্রহ রয়েছে-মনে হল না।

চা খেতে-খেতে কিকিরা বললেন, “একটা জিনিস নজর করেছ?”

“কী?”

“লোচন দত্ত এমনভাবে লিখেছে যেন সে এই মোহন দত্তকে–মানে প্রতারক জালিয়াত মোহনকে চোখে দেখেনি এখন পর্যন্ত, শুধু তার কথা শুনেছে।”

তারাপদ কচুরি খেতে-খেতে জড়ানো জিভে বলল, “হতেই পারে। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে কিকিরা! আমার নাম করেই অন্য একটা লোক যদি মানুষ ঠকিয়ে বেড়ায়–বেড়াতেই পারে–তাকে আমি চোখে না দেখতেও পারি। অন্য কেউ এসে আমায় বলতে পারে কথাটা…।”

কিকিরা বললেন, “তোমার কথা হচ্ছে না, হচ্ছে লোচন দত্ত আর মোহন দত্তের কথা। তুমি ভুলে যেয়ো না, মরা মানুষ আবার জ্যান্ত হয়ে ফিরে এসে লোক ঠকিয়ে বেড়াবে–এটা খুব ইজি কাজ নয়। কথা হল, কাদের ঠকাচ্ছে? যাদের ঠকাচ্ছে তারা যদি লোচনদের জানাশোনা লোক হয়-তবে সেই বোকা, বুন্ধুগুলো কি জানে না যে, মোহন অনেক আগেই মারা গিয়েছে?”

তারাপদ বলল, “হয়ত লোচনের অপরিচিতদের ঠকাচ্ছে!”

“যুক্তি হিসাবে সেটাই হতে পারে। কিন্তু কথা হল, কেন ঠকাবে? যে-লোক অন্যকে ঠকাচ্ছে–তার উদ্দেশ্য কী? যে ঠকছে তারই বা কী দায় পড়েছে ঠকার! ধরো, রামবাবু বলে একটা লোককে জাল মোহন ঠকাবার চেষ্টা করছে। কেন করছে? আর রামবাবু কি এতই বোকা যে, ঠকাবার আগে একবার লোচনদের খোঁজ-খবর করবে না? বাড়ি, সম্পত্তি, দোকান-সংক্রান্ত যদি কিছু হয়–তবে এইসব জিনিস এমনই যে, লোকে এই ধরনের জিনিসের সঙ্গে কোনো কারবার করতে হলে ভাল করে খোঁজ-খবর নেয়। খোঁজ নিলেই মোহন ধরা পড়ে যাবে।”

“তাই তো যাচ্ছে।”

“যাচ্ছে কি না আমি জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার কেউ এমনি-এমনি দেয় না। জাল লোক ধরতে নয়। তার জন্যে থানা-পুলিশ আছে। লোচন থানায় ডায়েরি করিয়েছে? কেন সে কাগজে সরাসরি লিগ্যাল নোটিস না দিয়ে এইরকম একটা ব্যক্তিগত বিজ্ঞপ্তি ছাপল!”

চা খাওয়া শুরু করেছিল তারাপদ। বলল, “আপনিই বলুন, কেন?” কিকিরা বললেন, “আমি ভেবে দেখেছি, দুটো কারণে হতে পারে। প্রথম কারণ, বড়াল লেনের লোচনবাবুটি মোহনচাঁদকে ধরতে চাইছে। নিজেই সে জানিয়েছে, জালিয়াত মোহনকে ধরে দিতে হবে। দ্বিতীয় কারণ, মোহন লোকটাকে সে ভয় পাচ্ছে। “

“জাল মানুষকে ভয়?”

“যদি জাল না হয়।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন আপনি! লোচন, সাল-সময় দিয়ে তার ভাইয়ের মরার খবর জানাচ্ছে, তবু বলছেন এ জাল মোহন নয়।”

কিকিরা চা খেতে-খেতে স্বাভাবিক গলায় বললেন, “তুমি জাল প্রতাপচাঁদ, ভাওয়াল মামলা–এ-সব শুনেছ? নিশ্চয় শোনোনি! শুনলে এত অবাক হতে না। দীনরাম মামলার কথাও শোনোনি। বম্বের মামলা। দীনরামকে পাক্কা আট বছর মামলা লড়তে হয়েছিল, সে আসল দীনরাম প্রমাণ করতে।”

“স্যার, ভাওয়াল মামলার কথা আমি শুনেছি। সে তো সাঙ্ঘাতিক ষড়যন্ত্র ছিল।”

কিকিরা বললেন, “লোচনও যে সাঙ্ঘাতিক ষড়যন্ত্র করেনি তুমি কেমন করে বুঝলে?”

তারাপদ চা খেতে শুরু করেছিল, বলল, “লোচনের কাছে নিশ্চয় ডেথ সার্টিফিকেটের প্রমাণ আছে…।”

“প্রমাণ থাকতে পারে, নাও পারে। আর ডেথ সার্টিফিকেট? টাকায় কী না হয়। তা ছাড়া, ছোটখাটো কোনো জায়গায় অজ গাঁ-গ্রামে মারা গেলে ডেথ। সার্টিফিকেট বড় একটা থাকে না। থানায় জানিয়ে দিলেই হয়। তা ছাড়া, কোথায় কখন কী অবস্থায় মোহন মারা গিয়েছে না জানলে কোনো কিছুই বলা যায় না। ধরো, ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে দশ-বিশটা লোক মারা গেল। তার মধ্যে অনেকের যা হাল হল–মাংসের খানিকটা তাল–মাথা নেই, হাত নেই, পা নেই–কোনোরকমেই ট্রেস করা গেল না তারা কারা। তাদেরই পুড়িয়ে ফেলা হল। শনাক্তকরণই তো হল না। কী করে তুমি তাদের যথার্থ সার্টিফিকেট পাবে! কে দেবে! থানাতেই বা কী লেখা থাকবে?”

তারপদ এসব কিছু জানে না, চুপ করে থাকল।

কিকিরা বললেন, “মোহনের মতন ঘটনা এ-দেশে কখনো-সখনো ঘটে। আমরা তার খবর পাই না। মানে, আমি বলছি মারা গেছে বলে সবাই যাকে জানে, সেই মরা-লোক আবার ফিরে এসেছে।”

তারাপদ এবার খানিকটা কৌতূহল বোধ করল। বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, মোহন মারা যায়নি?”

“না, না, এত তাড়াতাড়ি তা কেমন করে বলা যাবে?”

“তা হলে বলা যাক, মোহন মারা না যেতেও পারে!”

“হতে পারে।”

“এখন তবে কী করতে চান?”

“মোহন অনুসন্ধান। লোচন দত্তর সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হবে। ওই যে লিখেছে, যোগাযোগ–সেই যোগাযোগটা করতে হবে আগে। দেখতে হবে লোচন কার কার কাছ থেকে জেনেছে যে, এক জাল মোহন তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। দেখা করলেও কোন উদ্দেশ্য নিয়ে? লোচন নিজে মোহনকে কোথাও আচমকা দেখেছে কি না? বা মোহনই কোনোভাবে লোচনকে নিজেই জানিয়েছে কি না যে, সে হাজির হয়েছে। লোচন এর মধ্যে থানা-পুলিশ করেছে, কি করেনি!” চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন কিকিরা। হাতের পাশেই এক গোল টেবিল। পুরনো টেলিফোন থেকে টুকটাক অনেক কিছুই পড়ে আছে টেবিলে।

তারাপদ পেট ভরে কচুরি খেয়েছিল। চা খেতে-খেতে ঢেকুর তুলল। বলল, “আপনি এখন লোচনের সঙ্গে দেখা করতে চান?”

“ইয়েস স্যার।”

 “কেমন করে?”

“লেম ম্যান, লিম্পিং লিম্পিং করে…।”

তারপর হেসে ফেলল, “খোঁড়া মানুষ খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে?”

“উপায় কী?”

“চাঁদ শুনলে রাগ করবে স্যার।”

“চাঁদু ক্যান ওয়েট, তিরিশ হাজার যদি ওয়েট না করে? কে জানছে এরই মধ্যে কত লোক লোচনের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে! টাকার লোভ বড় লোভ।”

“লোচন কোনো প্রাইভেট ডিটেকটিভও তো লাগাতে পারে। কলকাতায় এখন ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস হয়েছে।”

“আমরাও তো এজেন্সি খুলেছি : কে-টি-সি–কিকিরা, তারাপদ, চন্দন। হেড অফিস আমার বাড়ি।”

তারাপদ হাসতে-হাসতে বলল, “স্যার, আমি কেটিসির নাম দিয়েছি কুটুস। দয়া করে একটা প্যাড ছাপিয়ে নিন এবার, আর শ’ খানেক ভিজিটিং কার্ড।” বলে তারাপদ চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। সিগারেটের প্যাকেট হাতড়াতে লাগল পকেটে।

কিকিরা বললেন, “হবে। শনৈঃ শনৈঃ। ধৈর্য ধরতি বালকঃ।…এবার কাজের কথা বলি।”

“বলুন”, তারাপদ সিগারেট ধরিয়ে নিল।

“আমি এর মধ্যে বাড়িতে বসে বসে দু একটা গোড়ার কাজ সেরে রেখেছি।”

“বাঃ। ফাস্ট কেলাস।”

“গলিটার খোঁজ নিতে বগলাকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছে কলকাতা কপোরেশনের স্ট্রিট ডাইরেক্টরি আছে।“

“গলিটা কোথায়?”

“বউবাজার থানার মধ্যে।”

“কেমন গলি?”

“পুরনো শহরের পুরনো গলি। লোচনদের বাড়িও পুরনো। তবে বেশ বড়। বনেদি বাড়ি ছিল বোধ হয়। এখন সামনের দিকে ভেঙেচুরে গিয়েছে।”

“লোচনকে দেখা গেল?”

“না। বগলা শুধু গলিটার খোঁজ নিয়ে বাড়ি দেখে চলে এসেছে।”

“আর কী সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, স্যার?”

“লোচনের ছেলে দুটি যমজ। তার মধ্যে একটিকে–কেউ বা কারা একবার চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। একবেলা আটকে রেখে আবার ফেরতও দিয়ে গিয়েছে। ঘটনাটা মাস-দুই আগেকার।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “সে কী! ছেলে চুরি?”

“লোচনের বাড়িতে এখন মস্ত এক পালোয়ানকে আনা হয়েছে। সে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। ওদের বাড়ির কুকুরটাও বাইরে ছাড়া থাকে। মানে, লোচন হালফিল খুব সাবধান হয়ে গিয়েছে।…তা কাল-পরশু নাগাদ চলো একবার, নিজের চোখে দেখে আসি।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। সে রাজি।