১. বর্তমান সময়

১. বর্তমান সময়

প্রথম দিন। গ্রিস, কারিনসের উত্তরে আর মারকিজিয়ালসের দক্ষিণে

কানে সেলফোন ধরে আছে এলিস। ওপ্রান্তের অন্তহীন রিং যেন আর শেষই হচ্ছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেহারায় ফুটে উঠল হতাশা। এতগুলো কল করার পরেও ফোন না ধরাতে এখন অসম্ভব রাগ হচ্ছে।

নো আনস্যার!!

আরো একবার ফোন কেটে যেতেই বিরক্তিতে চুকচুক শব্দ করল এলিস। বুঝতে পারছে আর কোনো আশা নেই।

আমিই বা কেন এত কষ্ট করে ফোন করছি? কিসের এত ঠেকা আমার?

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটাকে পকেটে চালান করে দিল এলিস। লং ডিসট্যান্স সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা আসলে অত সোজা না। গত বারো মাসের বেশিরভাগ সময় জুড়েই গ্রিক-আমেরিকান অ্যার্কিওলজিক্যাল মিশন অব- পিডনার হয়ে একটা আন্তর্জাতিক দলের সাথে এখানে ক্যাম্পিং করছে এলিস। মিশনের উদ্দেশ্য হল প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে গুঢ় রহস্যগুলোর একটিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। এর মূল্য হিসেবে ভাঙতে বসেছে ওর সম্পর্ক। সপ্তাহ দুই আগে অবস্থা বেশ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তখন থেকে ওর বয়ফ্রেন্ড আর একবারও কল করেনি এবং ওর ফোনও ধরেনি।

ব্লাডি ইডিয়ট। নিজে যদি ক্ষমা চাইতে না পারে অন্তত এলিসের ফোন তো ধরতে পারে যেন সবকিছু আবার জোড়া লাগাবার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। তবে যদি না…মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটাকে দূর করে দিল।

উত্তেজিত এক ছাত্রের চিৎকার শুনে গভীর চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে এল এলিস; উধশ্বাসে টানেল দিয়ে ছুটে আসছে ছেলেটা। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আড়ালে থাকা একটা সমাধি, যেটি কি-না হতে পারে শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এমন এক সমাধি যেটিকে নিয়ে গত ১৫০ বছর ধরে চলছে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। E-75 টোল রোড থেকে ৫০ কি. মি. ভেতরে থেসালোনিকিতে স্থাপিত এই টিমে গ্রিক আর আমেরিকান দুজন কো ডিরেক্টরের অধীনে প্রজেক্টের খনন কাজে সাহায্য করছে ৫০ জনেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীর কন্টিন্টে আর স্থানীয় শ্রমিকদের এক সেনাবাহিনি।

“এলিস, আমরা সমাধির প্রবেশ মুখ ভেঙে ফেলেছি!” ছেলেটার উত্তেজনা এলিসের মাঝেও সঞ্চারিত হল, “কাম অন, জলদি চলুন!” কোনোমতে শব্দগুলো উচ্চারণ করেই দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে আবার খোলা শ্যাফট দিয়ে নেমে গেল মাটির গহীনে।

উধাও হয়ে গেল বয়ফ্রেন্ডের চিন্তা। ব্যাকপ্যাক ঠিক করে ছাত্রের পিছু নিল এলিস। মনে পড়ে গেল আঠারো মাস আগে এই দলটাতে যোগ দেবার সময়কার একটা মুহূর্তের কথা।

ভাগ্যটাও এমনি যে, যখন নিমন্ত্রণটা পেল তখনই দেখা হয়েছে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। সে সময় এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছিল যা নিয়ে আর কথা বলতে চায় না ও। অবশেষে বহুকষ্টে শতবর্ষের পুরনো কোনো সিক্রেটের মতই নিজের অন্তরে মাটি চাপা দিয়েছে সেই বেদনা। এরকম এক মুহূর্তে বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সত্যিকারের সাপোর্ট পেয়ে যারপরনাই কৃতজ্ঞ এলিস। তারপর কয়েক মাস ডেট করার পরেই পেল এই খনন কাজের আমন্ত্রণ। অথচ আজ যখন প্রাচীন গ্রিসের সর্বশেষ মহারহস্যগুলোর একটির দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে তখন আর এলিসের পাশে সে নেই।

সমাধির দিকে যেতে যেতে স্মরণ করল বিলিওনিয়ার মানবদরদী কার্ট ওয়ালেসের কথা। প্রাচীন সভ্যতা আর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকার্যে উৎসর্গকত সংস্থা ওয়ালেস অ্যার্কিওলজিক্যাল ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি এই খনন কাজের ফান্ডিং করেছেন। “ফরগটেন রুটস” নামক আন্দোলনের পেছনেও আছেন এই ভদ্রলোক। এক্ষেত্রে তার লেখা পাঁচটা বইয়ের উপর ভিত্তি করেই ট্রাস্ট বিবর্তন-মতবাদের বিরুদ্ধে এই অবস্থান নিয়েছে। বইগুলোর কমন থিম হল, মানবতা তার শেকড় ভুলে গিয়ে ক্রমশ বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে নির্মিত এক ভয়ংকর থিওরির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অথচ মানবজাতির প্রকৃত উৎসবিন্দু লুকিয়ে আছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সংস্কৃতিগুলোর প্রাচীন লোকগাঁথার মাঝে।

এলিস ভদ্রলোকের কথা শুনেছে এবং তাঁর লেখাও পড়েছে। কিন্তু থিওরিগুলো নিয়ে কখনোই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। অথচ লোকটার সাথে দেখা হবার পর মুগ্ধ হয়ে গেছে তার বুদ্ধিমত্তা আর কেতাদুরস্ত পরিশীলিত আচরণ দেখে। তাছাড়া যেখানে মিটিং করেছে, সুদৃশ্য সেই রাজপ্রাসাদ তো যেন এলিসকে বশ করে ফেলেছে।

দশমিনিটের সেই মিটিংটাতে শুরুতেই কাজের কথা তুলেছিলেন ওয়ালেস। “দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের রাজত্বকাল আর তার মৃত্যু পূর্ব ও পরবর্তী সময়কাল নিয়ে তোমার দক্ষতার জন্যই এ দলে যোগদানের অনুরোধ করছি” শুরু করলেন বিলিওনিয়ার, এর আগেই অবশ্য সম্ভাষণের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নাশতার প্রস্তাবও দিয়েছেন।

শুরুতেই এমন মন্তব্য শুনে কৌতূহলী হয়ে ওঠে এলিস। একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে গবেষণা কক্ষের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ালেসের লম্বা দেহাবয়ব, সুদর্শন স্যুট পরিহিত অভিজাত ভাব, কুঞ্চিত চেহারা আর মরচে রঙা চুল।

এলিস টোপ গিলেছে বুঝতে পেরে হাসলেন ওয়ালেস, “দেখো, ট্রাস্টে আমার রিসার্চ টিম প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে মূল্যবান এক রহস্যের সূত্র পেয়েছে। আর এর সবকিছুই দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারকে ঘিরে।”

তারপর ব্যাখ্যা করে শোনালেন মিশনের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি ও দলের গঠন। শেষ করার আগেই প্রজেক্টে যোগদানের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলল এলিস।

“সাবধানে পা ফেলুন” আরো একবার তাকে গভীর চিন্তা থেকে ফিরিয়ে আনল সেই ছাত্র। এখান থেকে টানেলের ছাদ নিচু হয়ে গেছে।” শ্যাফটে নেমে টানেল ধরে পোর্টেবল ল্যাম্পের আলোর দিকে এগিয়ে চলল দুজন।

ছেলেটার হাতে ধরা টর্চ লাইটের আলোতে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে অবশেষে পৌঁছে গেল মসৃণ পাথুরে দেয়াল-অলা একটা কিউব আকৃতির চেম্বারে। চেম্বারের দু-প্রান্তে জ্বলতে থাকা দুটো পোর্টেবল এলইডি পোল লাইটসের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ছোট্ট জায়গাটা।

“থ্যাংক ইউ, মারকো।” ছেলেটা ফ্লাশলাইট অফ করতেই ওর দিকে তাকিয়ে হাসল এলিস।

চোখ পড়ল ড্যামনের দিকে। দলের আরেকজন অ্যার্কিওলজিস্ট; মাথায় কালো চুল আর বয়স মধ্য চল্লিশের কোঠায়। গত বারো মাস ধরে বিভিন্ন ঝড় ঝাঁপটা সহ্য করে খনন করা সমাধিমুখটার দিকে ইশারা করলেন।

চেম্বারে বিভিন্ন কন্টেইনারের স্তূপ দেখতে পেল এলিস। এগুলোতে ভরে বিভিন্ন আর্টিফ্যাক্ট খনি থেকে তুলে নিরাপদে পাঠিয়ে দেয়া হবে ল্যাবের উদ্দেশ্যে; যেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বসানো হবে নির্দিষ্ট তারিখ। “এখান থেকে সবকিছু বাক্সে ভরে ফেলতে হবে?” খানিকটা অবাক হয়ে গেল এলিস। কারণ স্ট্যান্ডার্ড অ্যার্কিওলজিক্যাল প্রসিডিউর অনুযায়ী সাইট থেকে সরানোর আগেই প্রতিটা আর্টিফ্যাক্টের ছবি তুলে ট্যাগ লাগিয়ে, ম্যাপ আর মেজারমেন্টের কাজ করে সম্পূর্ণ বিবরণ লিখে রাখতে হয়।

“হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার এসেছে। ডিরেক্টরেরা আমাকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যেন প্রতিটি আর্টিফ্যাক্ট নিরাপদে কুঁড়েঘরে নিয়ে জড়ো করা হয়।” উত্তর জানিয়ে কৌতূহল নিয়ে এলিসের দিকে তাকালেন ড্যামন, “আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?”

নিজের অনুভূতিকে বুঝতে না দিয়ে মাথা নাড়ল এলিস, “মনে হচ্ছে আপনি বাকিদেরকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।” শ্যাফট দিয়ে আসতে আসতে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী আর শ্রমিকদেরকে বিপরীত দিকে যেতে দেখে বুঝতে পেরেছে যে ড্যামন সমাধিতে একা ঢোকার প্ল্যান করছেন।

“ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছি কারণ…” দাঁত বের করে হাসলেন ড্যামন, “ভেবেছি আপনি আর আমিই এটার দাবিদার।” ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে মারকোর সাহায্যও পেয়েছি। লাকি গাই।” চোখ পিটপিট করে ইশারা করতেই পাল্টা দাঁত দেখাল মারকো।

“কিন্তু কোনো দরজা তো দেখা যাচ্ছে না” দ্রুভ্রু-কুঁচকে ফেলল এলিস, “অন্যান্য হেলেনিস্টিক (আলেকজান্ডার ও ক্লিওপেট্রার মধ্যবর্তি গ্রীক সভ্যতা) সমাধিগুলোতে দরজা আছে।”

কাঁধ ঝাঁকালেন ড্যামন, “চলুন তাহলে দেখি, কি বলেন?” চেহারায় ফুটে উঠল উদ্বেগ। এতটা মাসের পরিশ্রম না শেষে বৃথা যায়।

লম্বা দম নিল এলিস। এই সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত!ড্যামনের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়তেই মারকো’কে ইশারা করলেন গ্রিক অ্যার্কিওলজিস্ট। টান দিয়ে একটা পোল লাইট নিয়েই সমাধিমুখে দৌড় লাগাল ছেলেটা। এলিস আর ড্যামন ঢুকতেই দৌড়ে গেল আরেকটা ল্যাম্প আনতে, উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।

“এখানে দুটা চেম্বার আছে।” ফিসফিসিয়ে জানালেন ড্যামন। “ঠিক অন্য মেসিডোনিয়ান সমাধিগুলোর মতন গোলাকার ভল্ট। হেলিনিস্টিক যে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।”

ছোট্ট একটা অ্যান্টিচেম্বারে নিজেকে আবিষ্কার করল এলিস। দেয়াল জুড়ে রঙিন পোশাক পরিহিত এক নারীর মুরাল; সেনাবাহিনিকে নেতৃত্ব এবং পুরুষদেরকে আদেশ দিচ্ছেন। অবয়বে ফুটে উঠেছে লিভারের সমস্ত গুণ।

ড্যামনের দিকে তাকাতেই স্পষ্ট চোখে পড়ল নোকটার অন্তরের উত্তেজনা। তাদের ধারণাই সঠিক। “এটি এক রানির সমাধি!” চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফেললেন ড্যামন, “অবশেষে দুনিয়া তার শেষ আবাস দেখতে পাবে।”

অ্যান্টিচেম্বার থেকে সমাধি চেম্বারের দরজার দিকে এগোল এলিস। পিছু নিলেন ড্যামন।

কিন্তু চেম্বারে ঢুকতেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে। ভেবেছিল কোনো একটা পাথরের শবাধার, কিংবা নিদেনপক্ষে একটা মমি পাবে। অথচ যা দেখল তাতে সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল মাথার চুল।

২. আর. কে. পুরাম, নিউ দিল্লি

বাসায় ফেরার সময় সারাদিনের ঘটনাগুলো ভেবে দেখলেন ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর স্পেশাল ডিরেক্টর ইমরান কিরবাঈ।

ছয় মাস আগে জি-টুয়েন্টি দেশগুলোর উপর সন্ত্রাসী হুমকি আর মহাভারতের মাঝে লুকায়িত এক প্রাচীন রহস্য আবিষ্কারের ধুলিঝড় থামার পর, টেকনোলজি বেসড় সন্ত্রাসবাদের মনিটর আর তদন্ত করার জন্য যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠনে একমত হয়েছে ভারত আর ইউএস সরকার। মহাভারতের এক সিক্রেটের উপর ভিত্তি করে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক আধিপত্য সৃষ্টির জন্য সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল এক গোপন গ্লোবাল গ্রুপ। সেখান থেকেই এই টাস্ক ফোর্স গঠনের আইডিয়ার সূত্রপাত। পুরো পরিকল্পনাটা ভেস্তে দেয়া সম্ভব হলেও শক্ররা কিন্তু এখনো টিকে আছে। সমস্ত ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারেও এরা দ্বিধা করবে না।

তাই টাস্ক ফোর্সের ধারণাকে সানন্দে সম্ভাষণ জানিয়েছেন ইমরান। এর ফলে রাজনৈতিক স্বীকৃতি থাকায় টেকনো-টেররিজম সম্পর্কে তদন্ত করার অধিকার আর দায়িত্ব দুই-ই পাওয়া গেল। কিন্তু টাস্ক ফোর্সের লিডারদের সাথে আজই মাত্র প্রথম দেখা হল। এবং যা দেখলেন তা মোটেই পছন্দ হয়নি। জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে এখন আর টাস্ক ফোর্স থেকে পিছিয়ে আসারও উপায় নেই। পুরো অবস্থাটাই অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে এখন।

মনে পড়ে গেল ব্ল্যাকবেরিতে পাওয়া ইমেইল সতর্কবার্তার কথা। নাহ, আজ রাতে আর না। সাধারণত অফিস আওয়ারের পরের যেকোনো ইমেইলের চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানান ইমরান। যার মানে হল মাথা ঘামানোর জন্য নতুন একটা সমস্যা পাওয়া গেল। আর এ কাজে তার জুড়ি মেলা ভার। মিথুন রাশির জাতক হিসেবে এই ধরণের চ্যালেঞ্জ তার অনেক পছন্দের। এতে রুটিন ওয়ার্কের বাইরে গিয়ে নিজের প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়।

মেইল ইনবক্সে চোখ বোলালেন ইমরান। সাথে সাথে সিধে হয়ে বসলেন নিজের সিটে। ভূতুড়ে একটা ইমেইল এসেছে।

.

রানির সমাধি

দরজা দিয়ে বাইরের চেম্বারের একমাত্র ল্যাম্পের যেটুকু আলো ইনার চেম্বারে পৌঁছাচ্ছে সেই অস্পষ্টতার মাঝে চারপাশে আতঙ্কময় সব দৃশ্য দেখল এলিস আর ড্যামন।

রুমের একেবারে মাঝখানে পাথরের কেন্দ্রটা সাদাসিধে আর কারুকার্যবিহীন। এছাড়া আর কোনো কিছুই নেই। কিন্তু চেম্বারের শূন্যতা বা সাধারণ দিকটা কারো নজর কাড়েনি।

বরঞ্চ বিস্মিত হতে হবে দরজার দিকে মুখ করে থাকা চেম্বারের দেয়ালটা দেখে। সমাধির একেবারে মেঝে থেকে ফণা তুলে রেখেছে এক বিশাল পাথরের সাপ। চেম্বারের ছাদ আর দূরের দেয়াল অব্দি পৌঁছে গেছে কুণ্ডুলি পাকানো দেহ। মেঝের পাথরের উপর ঝুলে আছে তিন ফুট উঁচু পাঁচ-মাথাঅলা হূড। খোলা চোয়াল দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নগ্ন বিষদাঁত। অনাহুত অতিথিদেরকে দেখে যারপরণাই বিরক্ত।

কুণ্ডুলি পাকানো দেহটা ঠিক যেন সমাধিটাকে পাহারা দিচ্ছে। দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে এলিসের মনে হল, জীবিত অবস্থায় জীবন যেভাবে কাটিয়েছেন মৃত্যুর পরেও সেরকমই রয়েছেন এই রানি।

খাপছাড়া দৃশ্যটার সাথে আরো যোগ হয়েছে চেম্বারের বাকি দেয়ালের কারুকার্য। সর্বত্র কেবল সাপ আর সাপ। কোনোটা পাকানো, কোনোটা হিসহিস করছে। কিছু আবার চুপ করে শুয়ে আছে। আরো কয়েকটা একেবারে লম্বা করে খোদাই করা হয়েছে। ঝাপসা আলোতে মনে হচ্ছে পাথরের ছায়াগুলো দেয়াল থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্য তৈরি।

পোল লাইটস নিয়ে দৌড়ে এলেও সমাধির এই অদ্ভুত সাজসজ্জা দেখে দোরগোড়াতেই থেমে গেছে মারকো।

“ওহ গড, এসব কী!” ফিসফিসিয়ে উঠল বিস্মিত ছেলেটা।

দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ল এলিস, “কোনো সন্দেহই নেই। ইট ইজ হার টুম্ব!” আবিষ্কারের শিহরণে কাঁপছে গলার স্বর। গত বারো মাস ধরে কেবল আশাই করেছে যেন তাদের ধারণা সত্যি হয়। আর আজ তা একেবারে প্রমাণিত হয়ে গেল।

“উমম…এদিকে দেখুন” দেয়ালের কারুকাজ দেখতে দেখতে পুরো চেম্বারে হেঁটে বেড়াচ্ছে মারকো। বড় সড় চেম্বারটা কম করে হলেও পঞ্চাশ ফুট চওড়া। এবার গিয়ে দাঁড়াল মাথার উপরে টাওয়ারের মত উঁচু হয়ে থাকা বিশাল এক কুণ্ডুলি পাকানো সাপের ঠিক নিচে, প্রবেশ মুখের বিপরীত দিকের কর্ণারে।

কী পেয়েছে দেখার জন্য তাড়াহুড়া করে এগিয়ে গেল এলিস আর ড্যামন। সাপের পিছনেই দেয়ালের মাঝখানে একটা ভোলামুখ দেখা যাচ্ছে। পরস্পরের দিকে তাকাল সবাই। তৃতীয় আরেকটা চেম্বার আছে নাকি!! হেলেনিস্টিক সমাধিগুলোতত এরকমটা হবার কথা না।

মারকোকে কিছু বলতে হল না। তার আগেই হাতের বাতিটা উঁচু করে ধরে গোপন দরজাটায় আলো ধরল। ছোট্ট একটা চেম্বারে দুই সারি ভর্তি পাথরের মূর্তি আর বিভিন্ন সাইজের স্ল্যাব।

পরীক্ষা করে দেখার জন্য এগোল এলিস আর ড্যামন। “সাপ নিয়ে নিশ্চয় উনার বাড়াবাড়ি রকমের এক মুগ্ধতা ছিল।” পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এক সুন্দরী তরুণীর মূর্তি হাতে নিয়ে মন্তব্য করলেন ড্যামন। নারীদেহের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেঁচিয়ে আছে এক বিশাল সাপ।

মাথা নাড়ল এলিস, “কেন শোনেন নি? তৃতীয় আলেকজান্ডারের পিতা তো নাকি একটা সাপ। আমার ধারণা, সাপ নিয়ে উনার প্রবল আকর্ষণের গল্পগুলো আসলে সত্যি।”

“সত্যিই বিস্ময়কর।” প্রায় দশ ইঞ্চি লম্বা চারকোণা একটা ট্যাবলেটের উপর খোদাইকৃত লেখা পড়ে জানালেন ড্যামন। “দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে এখান থেকে অনেক কিছুই জানা যাবে।”

সারির পর সারি মূর্তি আর ট্যাবলেটগুলো দেখে এলিসও সম্মত হল।

ঘড়ির দিকে তাকালেন ড্যামন। “হেডকোয়ার্টারকে ইনফর্ম করতে হবে। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। নিশ্চয় এক্ষুনি এসে দেখে যেতে চাইবে সবকিছু।”

“উমম, আপনি না হয় হোটেলে গিয়েই ওদের জন্য অপেক্ষা করুন। এই ফাঁকে আমি সমাধির ছবি তুলে ফেলছি।” এর মাঝেই ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে হাতে নিয়ে নিয়েছে এলিস। “আর্টিফ্যাক্ট গুলোতে ট্যাগ লাগিয়ে কন্টেইনারে ভরে রেখে দেব।”

“থ্যাংকস। আমি মারকোকে পাঠিয়ে দেব আপনাকে সাহায্য করার জন্য।” ছেলেটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ড্যামন।

চারপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিস। অ্যার্কিওলজিস্ট হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের হাই পয়েন্ট হতে চলেছে এ সমাধি। চেম্বার আর মুরালের ছবি নিয়ে তাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

ক্যামেরার কাজ শেষ করে গোপন চেম্বারে মনোযোগ দিল। এখানেও খুব সাবধানে সবকিছুর ছবি তুলে ফেলল। তারপর প্যাডেড কন্টেইনারে ঢুকিয়ে রাখল।

“আরে, এটা আবার কী!!” একেবারে সবার শেষে হলুদ একটা কিউব নিয়ে হাতের মাঝে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে পাঁচ পাশেই খোদাইকৃত লেখা পেল। এতক্ষণ মূর্তি আর মাটির ট্যাবলেটগুলোর পেছনে লুকিয়ে ছিল। প্রথমে মনে হল প্রাচীন হাড়ের তৈরি জিনিসটার এত শত বছর পরে রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আলোর নিচে নিয়ে হাত ঘোরাতেই বুঝতে পারল একেবারে সত্যিকারের আইভরি দিয়ে বানানো হয়েছে এ কিউব। এমনকি বাতির শক্তিশালী আলোতে আইভরির তরঙ্গায়িত প্যাটার্নটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

“দুই হাজার চারশ বছর আগে মেসিডোনিয়াতে আইভরী ছিল?” আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল এলিস, “অদ্ভুত তো। ওই অংশে তোত হাতিই নেই।”

হঠাৎ এতটাই চমকে গেল যে আরেকটু হলে হাতের কিউবটাই পড়ে যেত। পিছু ঘুরতেই দেখল যে মারকো হাসছে।

“তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।” হালকা স্বরে জানাল এলিস, “প্রাচীন কোনো সমাধিতে একাকি থাকা আর কারো সাথে এমনটা করো না।” ||||||||||| “সরি,” আবার দাঁত বের করে হাসলেও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা কতটা উত্তেজিত হয়ে আছে। এরকম এক আবিষ্কারের অংশ হতে পারার মতন ঘটনা তো আর প্রতিদিন ঘটেনা। “আপনি একা একা কথা বলছিলেন দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। ড্যামন হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলেছেন। তারাও রওনা হয়ে গেছে। আরেকটা কথা, ড্যামন বলেছেন কিউবটা যেন আপনার কাছেই থাকে। ডিরেক্টরেরা দেখতে চাইবেন।” এলিসের হাতে ধরা আইভরি কিউবটার দিকে ইশারা করল।

“শিউর। শুধু এটার ছবি তুলে ট্যাগ লাগানো বাকি আছে।” কিউবটার প্রতিটা পাশের ছবি তুলে অন্যান্য আর্টিফ্যাক্টের মতই একটা কন্টেইনারে ভরে ক্যামেরাসহ ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর জানাল,

“যাক। এখানকার, কাজ শেষ। চলো এগুলো কুঁড়েঘরে নিয়ে যাই।” এবার আগে আগে এলো এলিস। দুজনে মিলে কন্টেইনারগুলোকে বয়ে এনে একেবারে মাঝখানের টেবিলের উপর রেখে দিল। এলিসের ধারণা ডিরেক্টর দুজন এক্ষুনি এসে এগুলো দেখতে চাইবেন।

“ডান।” সাদা গ্লাভস খুলে এলিসের দিকে উৎসাহী চোখে তাকাল মারকো।

এলিসও মাথা নাড়ল। “চলো।” ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। সাইটে দুজন গার্ড আছে আর লোকালয় থেকে দূরে হওয়াতে এখানে কেই বা আর চুরি করতে আসবে। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ আবিষ্কারের পর কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না।

একগাদা মরচে পড়া ছোট ছোট ভিলা মিলে তৈরি হোটেলে ফিরে নিজের রুমের পথ ধরল এলিস, আর মারকো গেল ড্যামনের খোঁজে। “পাঁচ মিনিটের মাঝেই তোমাদের সাথে দেখা করব।” ছেলেটাকে জানাল এলিস। নিজে ভালভাবেই জানে যে কী করতে চাইছে। খনন কাজের পুরো সময়টুকুতেই যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছে যেন দুই ডিরেক্টরের মুখোমুখি না হতে হয়। ড্যামনই ওদেরকে ব্রিফ করে রিপোর্ট পাঠাতেন আর প্রয়োজনের সময় নির্দেশনা চেয়ে আনতেন। কিন্তু আজ রাতে তো এড়িয়ে যাবার আর কোনো উপায় নেই। মিশনের দুজন কো-ডিরেকক্টর স্ট্যাভরস আর পিটারকে নিয়ে সমাধিতে যেতে হবে। দুজনের একজনকেও দেখতে পারে না এলিস। জানে ওদের মনোভাবও একইরকম। কিন্তু এই মিশনের লিডিং অ্যার্কিওলজিস্ট হওয়াতে ওদেরকে এড়াবারও পথ নেই। সমাধিটার নির্মাণকালের উপর একজন এক্সপার্ট হওয়াতে এও জানে যে এলিসের কাছ থেকে নিশ্চয়ই এই উদ্ভট সমাধিচিত্রের ব্যাপারে ওর নিজস্ব মতামত ওরা জানতে চাইবে।

ভাবতেই বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেল মন। আর ঠিক তখনই এক ধরনের কড়কড় বাতাসে ভরে উঠল রাতের আকাশ। মাথার উপর খুব নিচু দিয়ে উড়ে গেছে একটা হেলিকপ্টার। খানিকক্ষণ একটানা শব্দ হবার পর হঠাৎ করেই আবার থেমে গেল আওয়াজ। যেন মেশিনটা কাছেই কোথাও ল্যান্ড করেছে।

কিন্তু এলিসের মাথায় ঘুরছে একটু পরের অস্বস্তিকর কাজটার কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ আর ক্যামেরা বের করে রুমের ডেস্কের উপর রেখে দিল। এরপর কোমরের পাউচে মোবাইল ফোন আর ক্যামেরার মেমোরি স্টিক রেখে উঠে দাঁড়াল ড্যামনের ভিলার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু ভোরনবে হাত রাখতেই মনে হল বাগানের দিকে মুখ করে থাকা। জানালাতে কেউ শব্দ করছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মারকোর ভয়ার্ত চেহারা। ছেলেটার চেহারা পুরো সাদা হয়ে গেছে; যেন কেউ সবটুকু রক্ত শুষে নিয়েছে। আবারো নক করে জানালাটা খুলে দেবার জন্য ইশারা করল মারকো।

এস্তপায়ে এগিয়ে গিয়ে মারকোকে ভেতরে নিয়ে এলো এলিস। “কী…” বলার আগেই চিৎকার করে কেঁদে ফেলল আতঙ্কিত ছেলেটা।

৩. তপ্ত কড়াই থেকে বাইরে

“ওরা ড্যামনকে খুন করেছে মেঝের উপর ধপ করে বসেই হড়বড় করে বলে উঠল মারকো, “পিটার গুলি করেছে। যেন এটা কোনো ঘটনাই না।” মারকো যে কী বলছে কয়েক মিনিট ধরে এলিস তা বুঝতেই পারল না। কী বলছে এসব হাবিজাবি!! পিটার কেন ড্যামনকে খুন করবে?

ক্রন্দনরত ছেলেটার পাশে বসে কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিতে চাইল এলিস। “খুলে বলো কী হয়েছে; নিশ্চয়ই তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

“আমি নিজের চোখে দেখেছি!” ফুঁপিয়ে উঠল মারকো। “ড্যামনের দিকে তাকিয়ে সমানে চিৎকার করছিল স্ট্যাভরস; জানতে চাইছিল কেন ছবি তোলার জন্য আপনাকে একা ছেড়ে এসেছেন। আর ওদেরকে দেখানোর জন্য ড্যামনই কেন কিউবটা আনেন নি সেটা নিয়েও ঝাড়ি দিয়েছে।” ভয়ে ব্যাকুল চোখজোড়া যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।

এক বক্স টিস্যু এগিয়ে দিয়ে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে এলিস। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে যেন কোনো স্বপ্ন দেখছে। মনে মনে চাইছে এক্ষুনি এই দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাক।

শব্দ করে নাক মুছে মারকো জানালো, “এর পর পরই পিটার পিস্তল বের করেছে। তারপর ড্যামনকে বলল যে নির্দেশ না মানাতে এখন আর উনাকে ওদের দরকার নেই। খানিক চুপ করে থেকে ড্যামনের ভিলার খোলা জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যগুলো স্মরণ করে নিল। “ড্যামন ও অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আরেকটা সুযোগ দেবার জন্য পিটারকে অনেক অনুনয় করলেন। এত কাঁদছিলেন। কিন্তু পিটার কিছু শুনেনি। ঠাস করে গুলি করে দিয়েছে।” আবারো ফুঁপিয়ে উঠল মারকো।

ছেলেটার কথা শেষ হতেই এলিসের কানে এলো বেশ কয়েকজনের করিডোরে দৌড়ে আসার পদশব্দ। করিডোর দিয়ে ওর ভিলার কাছেই আসছে মনে হচ্ছে। স্ট্যাভরস আর পিটার নয়তো!! নিজের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করে মনে হল যেন শীতের মাঝে ঠাণ্ডা শাওয়ার নিচ্ছে। বুঝতে পারল কী করতে হবে।

দৌড় দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে তুলে দিল জোড়া হুড়কো। কিছুটা সময় তো অন্তত পাওয়া যাবে। যদি ড্যামনকে মেরে ফেলে তাহলে তার আর মারকোর ভবিষ্যৎও আন্দাজ করা যাচ্ছে।

‘আমাদেরকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।” তাড়াতাড়ি মারকোকে জানালো, “এক্ষুনি।”

ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তেই শুনতে পেল দরজায় কেউ এসেছে।

“তালা দেয়া!” বলে উঠল পিটার।

“ভেঙে ফেলো” জানালো স্ট্যাভরস।

দরজাতে আঘাতের শব্দও কান এড়ালো না। তবে ল্যাচটা কেঁপে উঠলেও খুলল না।

প্রথমে দরজার দিকে তারপর মারকোর দিকে তাকাল এলিস। জঙ্গলের রাস্তায় হেডলাইটের আলোতে ধরা পড়া হরিণের মতই তাকিয়ে আছে ভয়ে জমে যাওয়া ছেলেটা। বুঝতে পারছে হাতে আর বেশি সময় নেই। “মারকো!” চিৎকার করার সাহস হারিয়ে হিসহিস করে উঠল এলিস। পিটার যদি জানে যে ও সবকিছু টের পেয়ে গেছে তাহলে থামানোর জন্য যেকোনো কিছু করতে দ্বিধা করবে না। “ওখান থেকে বের হয়ে আসো, খোদার দোহাই মারকো।”

এলিসের কথা শুনে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে বাস্তবে ফিরে এল মারকো। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে এল। পিছলে ঘাসের লনে নামার সাথে সাথে ল্যাচ ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল পিটার।

“লনের দিকে গেছে!” জানালার দিকে তাকিয়েই জানিয়ে দিল সঙ্গীকে।

পেছনে কী হয়েছে দেখার জন্য না থেমেই মারকোর হাত ধরে লাফাতে লাফাতে ভিলা থেকে দূরে সরে এলো এলিস। দুজন কো-ডিরেক্টরের সাথে আর কেউ আছে কিনা না জানলেও অনুমান করছে তারা একা আসেনি।

হালকা কাশির মত শব্দ করে কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো দুটো বুলেট।

এলিসের বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না যে কেউ সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্র দিয়ে গুলি করছে।

মারকোকে পেছনে নিয়ে লনের উপর দিয়ে দৌড় লাগাল তাদের অফিসিয়াল ট্রান্সপোর্ট ল্যান্ড ক্রুজারের দিকে।

কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হল মারকে অনেক ভারী হয়ে গেছে। আরো একবার সামনে এগোতে যেতেই পাথরের মত অনড় আর নিশ্চল হয়ে পড়ে গেল ছেলেটা।

পিছু ফিরে মাটিতে পড়ে থাকা দোমড়ানো দেহটার দিকে তাকাল এলিস। পুরো মুখ আর চুলগুলো রক্তে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে যেন লাল মুখোশ পরে আছে মারকো। জায়গা মত গেথে গেছে বুলেট।

কী ঘটেছে বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলল এলিস। চলে গেল মূল্যবান কিছু মুহূর্ত। নিজের নিরাপত্তার কথা মাথায় এলেও পা দুটো যেন নড়তে চাইছে না। নির্দয়ভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে ছেলেটার জীবন। কিন্তু কেন?

আরো কয়েকটা কাশির আওয়াজ হতেই সম্বিৎ ফিরে পেল এলিস। মারকোর হাত ছেড়ে দিয়ে লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল।

চাবিটা ইগনিশনেই ঝুলছে। নির্ঘাৎ কো-ডিরেক্টরদেরকে নিয়ে সমাধি সাইটে যেতে হবে ভেবে রেখে গেছে মারকো। গুঙ্গিয়ে উঠলেও চালু হল ইঞ্জিন। এক্সিলারেটরে পা রাখতেই মাটির রাস্তায় নেমে এল গাড়ি। সমাধির দিকে ছুটল এলিস।

পেছনেই শোনা গেল চিৎকার। এখনো আশপাশ দিয়ে বাতাসে শিস কেটে যাচ্ছে বুলেট। মেঝের সাথে এক্সিলারেটর চেপে ধরতেই ল্যান্ড ক্রুজারের গায়েও লাগল একটা। যে করেই হোক ওকে সমাধিতে পৌঁছাতে হবে। ওখানে থাকা দুজন সশস্ত্র গার্ড নিশ্চয়ই ওকে এই হঠাৎ ভেঙে পড়া নরক থেকে উদ্ধার করতে পারবে।

সাইটে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কিন্তু অবাক হয়ে গেল গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা নিশ্চুপ চারপাশ দেখে। ফ্লাডলাইটস আর জেনারেটর কিছুই কাজ করছে না। সব বন্ধ।

গার্ডরা কোথায়?

লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে ছুটল এলিস। বহুবার এখানে এলেও এতটা অন্ধকারে কখনো পথ চলতে হয়নি। মাথার উপর জ্বলতে থাকা তারার আলোই ভরসা।

হঠাৎ করেই মাটির উপর পড়ে থাকা ভারী কিছুর সাথে ঠোক্কর খেয়ে পা বেধে পড়ে গেল। কোনোমতে ব্যালান্স ফিরে পেতেই মনে হল দম আটকে মরে যাবে।

জর্ডি!, দুজন গার্ডের একজন। নিচু হয়ে চেক করলেও কোন পালস পেল না। একেবারে নিথর হয়ে পড়ে আছে অসাড় দেহটা।

উদ্বিগ্ন মুখে উঠে দাঁড়াল এলিস। কী ঘটছে জানার প্রয়োজন থাকলেও মন বলছে এক্ষুনি পালাতে হবে।

নিজের সাথে যুদ্ধ করছে, এমন সময় আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধির প্রবেশ মুখের উপর নেমে এলো গভীর একটা ছায়া।

পুরোপুরি জমে গেল এলিস। এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে হেলিকপ্টার।

হাজার চিন্তার মাঝেও একটা কথা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে; ফাঁদে পড়ে গেছে ও!

৪. সাহায্য প্রার্থনা

আনোয়ার!

হা করেই ইমেইলটার দিকে তাকিয়ে আছেন ইমরান। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

পিতা-মাতাকে হারানোর পর লক্ষ্ণৌতে চাচার কাছে চলে যাবার আগ পর্যন্ত মীরাটে একসাথে বেড়ে উঠেছেন আনোয়ার আর ইমরান। বহুবছর আগের কথা হলেও এখনো অটুট আছে দুজনের সম্পর্ক। ইমরান আইপিএস এ জয়েন করেছেন আর আনোয়ার লক্ষ্ণৌতে নিজের ছোট একটা ব্যবসা শুর করলেও তেমন সুবিধে করতে পারেননি। তারপরেও টিকে আছে এ বন্ধুত্ব।

কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করেই উবাও হয়ে গেছে আনোয়ার।

আর এখন আবার এমনভাবে উদয় হয়েছে যেন অতীতের কোনো ছায়া।

পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হবার কথা ভাবতেই উদ্বেলিত হয়ে উঠল হৃদয়। অথচ ইমেইলটা খোলার সাথে সাথে মনে হল মুখে কারো ঘুষি খেয়েছেন।

মাত্র দুটো শব্দ লেখা আছে।

সাহায্য, আনোয়ার।

.

…আগুনের মধ্যে ঝাঁপ

শ্যাফট থেকে উঠে আসা ছায়াটাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পাথরের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল এলিস। লোকটার এক হাত কোমরে দেখেই বুঝতে পারল পিস্তল ধরে আছে।

কী ঘটছে খুঁজে দেখার সব চেষ্টা বাদ দিয়ে দৌড় লাগাল। গাড়ির কাছে ফিরে এসে ড্রাইভারের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে সেঁধিয়ে যেতেই পিস্তলের গর্জনে খান খান হয়ে গেল রাতের নীরবতা। এই অস্ত্রটাতে কোনো সাইলেন্সার নেই। অর্থাৎ গোপন করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।

চুরমার হয়ে গেল জানালার কাঁচ।

কানের পাশ দিয়ে গিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বিধে গেল আরেকটা বুলেট।

এতক্ষণে জীবন্ত হয়ে উঠল ল্যান্ড ক্রুজারের শক্তিশালী ইঞ্জিন। টপ স্পিডে রিভার্স করতেই নুড়ি পাথরের উপর ক্যাচকোচ শব্দ তুলল টায়ার। ফরোয়ার্ড গিয়ারে চাপ দিয়ে সমাধি থেকে বের হবার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু করল এলিস। স্টেরিও সিস্টেমের উপর গুলি লাগতেই হুইলের উপর মাথা নামিয়ে ফেলল। ভয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর মত অবস্থা। তারপরেও আতঙ্ক দমাতে গিয়ে মাথার মাঝে কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

যেমন করেই হোক পালাতে হবে।

পেছনে সচল হয়ে উঠল হেলিকপ্টার। জানে ঠিকই তাকে পিছু ধাওয়া করে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু বুঝতে পারছে না এরা কারা আর কী চায়?

ফোঁপাচ্ছে এলিস। কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি ছোটাল E-75 টোল রোড ধরে থেসালোনিকির উদ্দেশ্যে।

এদিকে হেলিকপ্টারের শব্দও কাছে চলে এসেছে। চেপে ধরল স্টিয়ারিং হুইল, যেন তাহলেই আরো জোরে ছুটবে ল্যান্ডক্রুজার।

এও জানে হেলিকপ্টারকে এড়াবার উপায় নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই তাকে ওভারটেক করবে উড়ন্ত দানব।

.

আনোয়ারের খোঁজে

“অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে চলো” ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন ইমরান, “বীকন অন্ করো!”

বাধ্য ছেলের মত ঘুরে গেল ড্রাইভার। গতি বাড়িয়ে জ্বালিয়ে দিল আলোক সংকেত। কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুবিধা এভাবে কখনো ব্যবহার করেননা ইমরান। কিন্তু এ মুহূর্তের কথা আলাদা। যে মেসেজ পেয়েছেন সেখান থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে তার বন্ধু বিপদে পড়েছে।

তাই সাহায্য করার জন্য যা কিছু সম্ভব তিনি করবেন।

ঝড়ের বেগে আইবি হেডকোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতেই ফোনে বিভিন্ন আদেশ দিয়ে দিলেন। গাড়ির উপর লাল আলো জ্বলতেই পথ ছেড়ে দিল অন্যান্য যানবাহন। কাকতালীয়ভাবে যেন সরে গেছে সব ট্রাফিক জ্যাম; মহাপ্লাবনের তোড়ে ভেসে গেছে তুষার।

অফিসে পৌঁছেই নিজের দলকে ডেকে পাঠালেন।

“তো, আমাদের হাতে কী কী আছে?” অসম্ভব শান্ত শোনাচ্ছে তার গলা। প্রচন্ড রেগে থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে শান্ত ভাব দিয়ে ঢেকে রেখেছেন নিজের উদ্বেগ; খুব বেশি দেরি হয়ে যায় নি তো! বুঝতে পারছেন বাধা পেয়ে মেসেজটাও ঠিকভাবে টাইপ করতে পারে নি অনোয়ার।

“আইপি অ্যাড্রেস ট্রেস করতে পেরেছি” রিপোর্ট করল এক অধস্তন। “দিল্লির সার্ভার। সম্ভাব্য একটা লোকেশনও জানা গেছে।” রেডমার্ক দিয়ে লোকেশন চিহ্নিত করা একটা ম্যাপের প্রিন্টআউট তুলে দিল ইমরানের হাতে, “কিন্তু এ জায়গাটার ৫০ কি. মি. রেডিয়াসের যেকোনো লোকেশনও হতে পারে।”

চোখ তুলে তাকালেন ইমরান, “আমি সঠিক লোকেশনটাই জানতে চাই। আই ওয়ান্ট দ্য ফিজিক্যাল অ্যাড্রেস।”

“স্যার, আপনি তো জানেন, সেক্ষেত্রে কোর্টের অর্ডার লাগবে। আমি অবশ্য আই এস পি’কে ফোন…”।

“কোর্ট অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করা যাবে না” লোকটাকে থামিয়ে দিলেন ইমরান। প্রতিটা মুহূর্তই অত্যন্ত দামি। আলোচনা করার মত সময় নেই, “আই এস পি’কে ব্যাখ্যা করার মতন যথেষ্ট সময়ও নেই। দিস ইজ অ্যান ইমারজেন্সি।”

হা হয়ে গেল তার এজেন্ট, “আপনি কি আইএসপি’র ডাটাবেইজ হ্যাঁক করার কথা বলছেন?”

“ঠিক তাই। আর এর সকল দায়দায়িত্ব আমার।” ইমরান ভালভাবেই জানেন যে কতটা ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কিন্তু অতশত ভেবে লাভ নেই। বিপদে পড়েছে আনোয়ার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের কখনোই এমনটা না। করলেও আজ রাতে সব নিয়ম ভেঙে ফেলবেন।

বিস্ময়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কাজে লেগে গেল পুরো টিম। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ফুস করে দম ফেললেন ইমরান। শুধু এটুকুই আশা করছেন যে, তারা সময়মতই সবকিছু খুঁজে পাবে।

৫. শিকার ধরার অভিযান

শকওয়েভ ব্লাস্টের ঠিক পরের সেকেন্ডেই এলিসের কানে এলো বিস্ফোরণের গর্জন। প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি খেলো গাড়ি। কাদামাটির রাস্তা ছেড়ে হাইওয়েতে পৌঁছাবার জন্য অ্যাসফাল্ট রোডে উঠে পড়েছে ল্যান্ডক্রুজার। অনিচ্ছাসত্ত্বেও গলা চিরে বের হল আর্তচিৎকার।

চোখের পানির ভেতর দিয়েও রিয়ার ভিউ মিররে দেখতে পেল খনন সাইটের ঊর্ধ্বাকাশে উঠে যাওয়া আগুনের বল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে তারা সমাধিটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে ও সবকিছুর ছবি তুলে রেখেছিল। ক্যামেরার মেমোরি স্টিক এখনো ওর সাথেই আছে। নিজেকে এই বলে সানা দিল যে সমাধিটা ধ্বংসের মাধ্যমে ইতিহাস আর প্রত্নতত্তের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলেও কিছুটা তো অন্তত বাঁচাতে পেরেছে।

তখনই মাথায় এল চিন্তাটা। এই লোকগুলো যারাই হোক না কেন যদি সমাধিটাকেই এভাবে উড়িয়ে দিতে পারে তাহলে এর সাথে জড়িত কোনোকিছুই আর টিকতে দেবে না।

আর সমাধিস্থানে যা পাওয়া গেছে তার একমাত্র জীবিত সাক্ষী হল এলিস। তাই ওকে মেরে না ফেলা পর্যন্ত এরা ক্ষান্ত হবে না।

হঠাৎ করেই ল্যান্ড ক্রুজারের ছাদের উপর কিছু একটা বাড়ি খেলো। হেলিকপ্টারের ধাতব শরীর দিয়ে ছাদটাকে সমানে আঘাত করছে পাইলট। নিজের সিটে লাফিয়ে উঠল এলিস। সারা সন্ধ্যার ঘটনায় সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে নার্ভ। আতঙ্কে চিৎকার করলেও বুঝতে পারছে এক্ষুনি ধরে ফেলবে ওকে।

গিয়ার শিফট করে আবারো এক্সিলেটারে চাপ বাড়াল। কপালে যাই থাকুক না কেন এত সহজে হাল ছাড়বেনা। সবশেষে হয়ত ওরাই জয়ী হবে; কিন্তু তার আগে কিছুতেই সারেন্ডার করবে না ও।

হেলিকপ্টারের পাইলটও এই নারীর জেদ টের পেয়ে হঠাৎ করেই গতি বাড়িয়ে সামনে চলে গেল। তারপর ডানদিকে খানিকটা কাৎ হয়ে সোজা ল্যান্ডক্রুজারের উপর নামতে চাইল যেন।

হেলিকপ্টারটাকে সোজা ওর দিকেই উড়ে আসতে দেখে আতঙ্কে বোবা হয়ে গেল এলিস। বুঝতে পারল পাইলটের অভিপ্রায়। রাস্তার উপর ল্যান্ড করার পাশাপাশি লোকটার প্ল্যান হল এলিসকে ভয় পাইয়ে দেয়া। যেন হেলিকপটারের অজেয় শক্তিকে সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।

বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করল এলিস। কেউ একজন তাকে এতটা অসহায় ভাবছে, তাকে নিয়ে খেলতে চাইছে ভাবতেই শক্ত হয়ে উঠল সমস্ত সত্তা।

“ওকে দোস্ত” কঠোর হয়ে উঠল গলার স্বর, “এই খেলাটা দুজনই খেলে। তুমি রুলেট চাইছো তো? তবে তাই হোক।” গিয়ার শিফট করে খানিকক্ষণের জন্য গতি ধীর করে আবারো স্পিড বাড়িয়ে সোজা হেলিকপ্টারের দিকে ধেয়ে চলল। মাটি থেকে মাত্র কয়েক মিটার উপরে ভাসছে উড়ন্ত দানব। “দেখা যাক কে আগে চোখের পাতা ফেলে।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য গর্জন করতে করতে একে অন্যের দিকে ছুটল হেলিকপ্টার আর এস ইউ ভি। এই বুঝি সংঘর্ষ ঘটে।

যাই হোক, আজগুবি খেলাটা বাদ দিয়ে রাস্তার উপর ল্যান্ড করল পাইলট। এগিয়ে যাচ্ছে ল্যান্ড ক্রুজার। মনস্তাত্ত্বিক কলাকৌশল বাদ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল হেলিকপ্টার।

রোটরের ঘূর্ণন থামতেই দেখা গেল ভেতরে একজন মাত্র লোক। এলিসও বুঝতে পারল যে পাইলটের সাথে আর কেউ নেই। জালের উপর মাছি দেখে অপেক্ষারত মাকড়সার মতই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে পাইলট; যেন জানেই যে মাছিটা তার সিল্কের ফাঁদ ছেড়ে আর কোথাও যেতে পারবে না।

হন্যে হয়ে চারপাশে তাকাল এলিস। পালানোর জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে রাস্তার উপরে এতবড় হেলিকপ্টার দেখে কিছুতেই বুকের ধুকপুকানি থামাতে পারছে না। অথচ জানে যে আতঙ্কে অন্ধ হয়ে গেলে কোনো লাভই হবে না। যদি কোনো সম্ভাবনা থেকেও থাকে, তাও হারাবে।

চোখের পানি আটকে মনযোগ দিল সামনের দিকে। যদিও ভেতর থেকে একটুও উৎসাহ পাচ্ছে না।

তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। সুযোগটা ক্ষীণ হলেও মনে খানিকটা আশা জাগল। জানে সবকিছুই ওর বিরুদ্ধে; তারপরেও বিনা চেষ্টায় হার মানবে না।

গতি কিছুটা কমিয়ে এনে মনে মনে কয়েকটা হিসাব করে নিল। ভাবনাটা কাজে দিতেও পারে।

অন্যদিকে এলিসের গাড়ি ধীর হতে দেখে পাইলট ভাবল মেয়েটা বুঝি থামতে যাচ্ছে; তাই সেও সামনে এগোল।

.

জোনগড় কেল্লা, নিউ দিল্লি থেকে ১৩০ কি. মি. দূরে, ভারত।

“এরকম উন্নতিতে আমি যে খুব খুশি হয়েছি তা কিন্তু না” অসন্তুষ্ট হয়ে বিড়বিড় করে উঠল কলিন।

বিজয়ের পারিবারিক কেল্লার ব্যালকনিতে বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে চারপাশের চমৎকার দৃশ্য। শীত এখনো তেমন জাঁকিয়ে না বসলেও রাতের বেলা বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। বিশেষ করে কৃষি জমির উপর টাওয়ারের মত উঁচু হয়ে থাকা পাহাড়ে অবস্থিত কেল্লাটাতে আর পাশের ছোট্ট গ্রামটাতে। দুৰ্গটা বিজয় পেয়েছে ওর আঙ্কেলের কাছ থেকে। বছর খানেক আগে নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়েছেন রিটায়ার্ড নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট বিক্রম সিং। খুনের সূত্র ধরেই উন্মোচিত হয়েছে দ্য গ্রেট অশোক আর মহাভারতের এক গোপন রহস্য।

কলিনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেলল বিজয়, “লোকটাকে তোমার পছন্দ হয় নি? আমার তো বেশ মজার মনে হচ্ছে।”

ভ্রু-কুঁচকে বন্ধুর দিকে তাকাল কলিন, “ঠিকই ধরেছ, ওকে আমার একটুও সহ্য হয় না। কিরবাঈ যখন জানালেন যে ইউ এস আর ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট মিলে এই জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স বানাচ্ছে, তখন তো ভেবেছিলাম আইডিয়াটা বেশ চমৎকার হবে।”

“হ্যাঁ, সেটাই তো” সম্মত হল বিজয়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ একদল সায়েন্টিস্ট আর ইঞ্জিনিয়ারদেরকে জড়ো করে টেকনোলজি বেসড টেররিজমের তদন্ত করার জন্য সহায়তা দেবে দু’দেশের সরকার। এ সময়ে এরকম একটা আইডিয়ার চেয়ে ভালো আর কিইবা হতে পারে।”

“ইয়াহ্‌; কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে জঙ্গলে হাঁটার সময় রেড রাইডিং হুডের কেমন লেগেছিল। একটা নেকড়ে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত সবকিছুই ভাল লাগে।”

মিটিমিটি হাসছে বিজয়। গত বছর তাদের অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী সি আই এ’র অপারেটর মাইকেল ব্লেকের সাথে দেখা করার জন্য দুই বন্ধুকে আজ সকালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর হেডকোয়ার্টারে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ব্লেকের সাথে ইউ এস প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নির্বাচিত জয়েন্ট টাস্ক ফোর্সের আমেরিকান হেডও এসেছিল। আর এই মিটিংয়ের জন্যই মাত্র দুদিন আগে ইউএস থেকে উড়ে এসেছে কলিন।

৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা পেশিবহুল বিল প্যাটারসনের মেধাও কম নয়। কেমিকেল আর মলিকিউলার বায়োলজীতে পি এইচ ডি আছে। প্রাক্তন আমেরিকান নেভী সিল এই আফ্রিকান-আমেরিকান বিল সবাইকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। আর নিজের অধস্তন প্রত্যেককেই সন্দেহের চোখে দেখে।

স্বাভাবিকভাবেই বিদ্রোহী স্বভাবের কলিন তাই প্রথম দেখাতেই প্যাটারসনকে অপছন্দ করে বসে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা স্বাধীনতা থাকবে সেটা নিয়ে তো দুজনের তুমুল ঝগড়াই বেঁধে গেছে। এখনো সে রাগ মাথা থেকে যায়নি। বলে উঠল, “শোনো, যদি ইউএস প্রেসিডেন্ট ভাবে যে সে খুব ভালো, ঠিক আছে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কোনো কিছু করার আগেই তার কাছে ছুটতে হবে সেটার তো কোনো মানে হয় না।” রক্তচক্ষু নিয়ে বিজয়ের দিকে তাকাল কলিন।

“আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমার মাথা আবার চিবিয়ে খেও না! আর সবকিছুর জন্যই তার পারমিশন লাগবে তা তো না। শুধু যদি কোনো সামরিক কিংবা বিশেষ ট্রেনিং সম্বলিত কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় তখন। চলল, এটুকু মেনে নেই। ৯-এর সিক্রেট নিয়ে যদি ফারুক পালিয়ে যেত তাহলে তোমার আমার কিছু করার ছিল না।” গত বছরের কথা মনে করিয়ে দিল বিজয়। “শেষ পর্যন্ত কমান্ডোরাই সবকিছু সামলেছে। এই টাস্ক ফোর্সের হয়ে আমাদের কাজ হবে বিভিন্ন ধারণাকে তদন্ত আর পরীক্ষা করে দেখা। যদি কোনো অ্যাকশনের প্রয়োজন হয় তাহলে যারা এ কাজে দক্ষ তাদের উপর ছেড়ে দেয়াই ভাল হবে।”

কথাগুলো কলিনও মেনে নিল। জানে বিজয় সত্যি কথাই বলছে; কিন্তু তারপরেও স্বীকার করতে মন চাইছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, চলো ঘরে যাই” এখনো ঘোঘোৎ করছে, “শুধু রাতের বেলা প্যাটারসন ব্যাটাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন না দেখলেই হয়।”

.

৬. সাহায্যের জন্য আকুতি

হেলিকপ্টারের পাইলট মাঝ রাস্তায় চলে আসতেই ডানদিকে গাড়ি নিয়ে জোরে এক্সিলারেটর চেপে ধরল এলিস। মনোযোগ কেবল হেলিকপ্টারের নাক আর হাইওয়ের সীমানার মাঝখানের ছোট্ট গ্যাপটার দিকে। রাস্তার কিনারে পৌঁছাতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল।

স্তম্ভিত পাইলটের পাশ দিয়ে হুশ করে পার হয়ে আসতেই এসইউভি-র পেছনে দৌড় লাগালো লোকটা। অন্যদিকে এলিস প্রাণপণে প্রার্থনা করছে যেন তার ফন্দিটা কাজে লাগে। গ্যাপটা সত্যিই এতটা চওড়া তো?

পর মুহূর্তেই ল্যান্ড ক্রুজারের দুপাশে ধাতব কিছুর ঘষা খাওয়ার শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল রাতের নীরবতা। গাড়ির একপাশে হেলিকপ্টার অন্যপাশে হাইওয়ের রেলিং।

দীর্ঘ একটা মুহূর্তের জন্য যেন থেমে গেল সময়। হেলিকপ্টার আর রেলিং এস ইউ ভি’কে চেপে ধরে গোলাগুলি থেকে বেঁচে যাওয়া অক্ষত জানালাগুলোকেও চুরমার করে দিল।

দু’চোখ বন্ধ করে ইচ্ছেশক্তির জোরে গাড়ি ছোটাল এলিস। তীক্ষ্ণ আর কর্কশ শব্দের চোটে মাথা ছিঁড়ে যাবার জোগাড়।

হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ল্যান্ডক্রুজার। মুক্ত হয়েছে দুপাশের ধাতব বাঁধন থেকে। চমকে গিয়ে তাকাতেই দেখল যে সামনে বিছিয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত হাইওয়ে।

নতুন উদ্যমে ফিরে এলো আশা। এক্সিলারেটরকে মেঝের সাথেই গেঁথে ফেলল। যেন হেলিকপ্টার থেকে যত দূরে সম্ভব সরে যাওয়া যায়।

পেছনে, এস ইউ ভি-র কাঁচবিহীন জানালা দিয়ে ভেসে আসছে পাইলটের শাপ-শাপান্ত; তাড়াতাড়ি তাই গুলির আশঙ্কায় সিটের উপর কুঁজো হয়ে বসে গেল। আর ঠিক সাথে সাথেই মাথার আশপাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। সামনের উইন্ডস্ক্রিনে দেখা গেল মাকড়সার জালের মতন রূপালি ফাটল।

কোনো মতে ড্রাইভ করলেও জানে যে এরকম অস্পষ্ট উইন্ডস্ক্রিন নিয়ে বেশি জোরে গাড়ি চালাতে পারবে না। আবারো ফিরে এলো হতাশা। গতি কিছুটা কমিয়ে মনোযোগ দিল রাস্তার দিকে।

প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যাবে। কিন্তু নাহ, একের পর এক মিনিট কেটে যাচ্ছে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে এস ইউ ভি-র কেবিনে বয়ে যাওয়া বাতাস আর ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না। গাড়ির সাথে সংঘর্ষে হেলিকপ্টারটার কোনো ক্ষতি হল, নাকি পাইলটই হাল ছেড়ে দিল কে জানে।

মাথার মধ্যে আবার ঘুরপাক খেতে লাগল গতরাতের রহস্যময় ঘটনাগুলো। প্রথমে তো ভেবেছিল হয়ত কোনো অ্যান্টিক চোরাচালানকারী মাফিয়া দল হামলা করেছে। ছবি তোলার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠার কারণও বোধহয় তাই। কেননা এতে করে কালো বাজারে দাম কমে যাবার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে সমাধিটা যখন এতটাই বিখ্যাত।

কিন্তু তাতে করে তো পুরো সমাধিটাকে উড়িয়ে দেবার রহস্যের কিনারা হচ্ছে না। কোনো যুক্তিই মাথায় আসছে না। দুই হাজার বছরের পুরনো একটা সমাধি ধ্বংস করে কার কী লাভ হল?

গাড়ি এখন লুডিয়াস নদীর উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই থেসালোনিকি পৌঁছে যাবে। তাই যা ঘটে গেছে তার চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে কী আছে সেটা নিয়েই ভাবার মনস্থির করল।

পাইলট যদি স্ট্যাভরস আর পিটারের সাথে জড়িত হয় তাহলে নিশ্চয় থেসালোনিকিতেও তাদের আরো সাগরেদ আছে। একারণেই এলিসের পিছু ধাওয়া বন্ধ করে ওদেরকেই ফোন করে তৈরি করে রাখাটা বেশি সহজ মনে করেছে। তার মানে ওর বিপদ এখনো খাড়া হয়ে ঝুলছে।

এসইউভি থামিয়ে বাইরে বের হয়ে এলে এলিস। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছে না। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। মারকো মারা গেছে। ড্যামনও। ওকে অন্তত জীবিত থাকতে হবে। রেইলের ধারে দাঁড়িয়ে সমানে ঘুষি মারতে লাগল। যেন ব্যথার সাথে ঝরে পড়বে হতাশা। মারকো আর তার অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর কথা মনে পড়ল। এত তাড়াতাড়ি কেন ছেলেটার ভাগ্যটা এমন হল?

অশ্রুমাখা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল অসংখ্য তারা। নাহ, কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না এখন।

শক্ত করে ব্রিজের রেইল আঁকড়ে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে চাইল। থেসালোনিকিতে একটা ইউ এস কনস্যুলেট আছে। ওখানে যেতে হবে। একমাত্র ওই জায়গাতেই হয়ত সত্যিকারের নিরাপত্তা পাবে। হোটেলে পাসপোর্টটা ফেলে এলেও ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে আছে। ফলে আইডেনটিটি প্রমাণ করে আশ্রয় চাইতে কোনো কষ্টই হবেনা।

মোবাইল ফোন বের করে কনস্যুলেটের ঠিকানা দেখে নিল। ৪৩ তিমিস্কি স্ট্রিট। যাক, খানিকটা সাহস পাওয়া গেল।

এবার মনে হল কাউকে ফোন করে সাহায্য চাওয়া যায়।

ওর বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু কেন যেন দ্বিধা হচ্ছে। ছেলেটা কি আদৌ তার বয়ফ্রেন্ড আছে? জানার কোনো উপায় নেই। তারপরও ও-ই ভরসা। আরো কয়েকজন বন্ধু থাকলেও বিশ্বাস করার মত কেউ নেই।

নাম্বার ডায়াল করল। বরাবরের মতই কয়েকবার রিং বেজেই ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। সময়ের দিকে খেয়াল করতেই মনে হল এখন তো স্টেটসে ভোর। দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও ফলাফল একই। কয়েকটা রিং বাজার পরেই বিজি টোন শোনা যাচ্ছে। ব্যাকুল হৃদয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখ পড়ল মেসেজ। ওকে জানাল যে নাম্বারে চেষ্টা করছে তা এখন ব্যস্ত আছে।

তার মানে ছেলেটা জেগে আছে। ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না বুঝতে পেরে দ্বিগুণ হয়ে গেল কষ্ট। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছে এরকম একটা মুহূর্তে যে কিনা ওর পাশে থাকার কথা ছিল সে-ই হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল! বুকের মাঝে উথলে উঠল কান্না। বহুকষ্টে নিজেকে সামলাল এলিস।

জয়ী হতে হলে ওকে শক্ত হতেই হবে।

আরেকটা নাম স্মরণ হতেই তাড়াতাড়ি নাম্বার ডায়াল করল। এবার কোন মোবাইল নয়, ল্যান্ডলাইন নাম্বার। কার্ট ওয়ালেসের পার্সোনাল সেল ফোনের নাম্বার পাবার মত ঘনিষ্ঠতা এখনো হয় নি।

দুটো রিংয়ের পরেই উত্তর দিল এক মহিলা কণ্ঠ।

“মিঃ ওয়ালেসের অফিস। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” ক্লারা, ওয়ালেসের অ্যাসিস্ট্যান্ট।

এত ধরনের অভিজ্ঞতা হওয়ায় কেঁপে উঠল এলিসের গলা, “আমি মিঃ ওয়ালেসের সাথে কথা বলতে চাই প্লিজ, ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট।”

“মিঃ ওয়ালেস একটা মিটিং করছেন আর তাই এখন উনাকে বিরক্ত করা। যাবে না।”

‘ব্যাপারটা সত্যিই জীবন আর মৃত্যুর সাথে জড়িত। প্লিজ, আমাকে ব্যবস্থা করে দিন।” আকুতি জানালেও ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল এলিসের অন্তর। শেষ খড়কুটোটাও হারিয়ে গেল।

“আপনার নাম আর ফোন নাম্বার বলুন, মিঃ ওয়ালেস ফ্রি হবার সাথে সাথে কল ব্যাক করবেন।”

মনে হল হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। এখন থেকে সে একেবারেই একা। আর কারো কাছ থেকে সাহায্যের আশা নেই।

.

৭. থেসালোনিকির কাছে E-75, গ্রিস

ক্লারার কথাগুলো শুনে যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল এলিস। তারপর মনে হল আচ্ছা যদি সবকিছু খুলে বলে…”।

“আমার নাম এলিস টার্নার। মিঃ ওয়ালেস গ্রিসে যে মিশন ফান্ড করেছেন সেখানে আমিও আছি। প্লিজ… প্লিজ উনাকে জানান যে সমাধিটা ধ্বংস হয়ে গেছে। দলের সদস্যদের দুজন খুন হয়েছে আর আমার পেছনেও লোক লেগেছে। আমি…আমি অনেক ভয় পাচ্ছি।” ফোঁপাতে ফোঁপাতে কোনোরকমে শেষ করল এলিস।

নরম হল ক্লারার কণ্ঠস্বর। “মিস টার্নার আপনার অবস্থার কথা শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি এক্ষুনি মিঃ ওয়ালেসকে মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে তিনি পার্সোনাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননা। তাই আমার খানিকটা সময় লাগবে। আর আপনাকে অনুরোধ করছি ইনকামিং কলের জন্য ফোনটাকে বার বার চেক করবেন।”

মাথা নেড়ে ক্লারাকে থ্যাংকস জানাল এলিস। তারপর চোখ মুছে আবার ড্রাইভারের সিটে চড়ে বসল। ও এখন সম্পূর্ণ একা। শুধু যদি ওয়ালেস ফোন করে কোনো সাহায্যের আশা দেয়!

কিন্তু তার আগ পর্যন্ত নিজের বুদ্ধিতেই পথ চলতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই। পরিষ্কার মাথা নিয়ে ভাবতে হবে পরবর্তী কর্মপন্থা।

দ্য ইউ এস কনস্যুলেট। হ্যাঁ, এখন সেটাই ওর লক্ষ্য।

ল্যান্ড ক্রুজারের জিপিএস সিস্টেমে কনস্যুলেটের কো-অর্ডিনেট সেট করে মনোযোগ দিল সামনের দিকে।

“ইন্টারেস্টিং” জিপিএস রুট দেখে আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল এলিস। খানিক আগেই পার হয়ে এসেছে E-75 এর সাথে এসে মিশে যাওয়া A2 মোটরওয়ে। আবার কিছুক্ষণ গেলেই এক্সিওস ইন্টারচেঞ্জ যা থেসালোনিকি পর্যন্ত চলে গেছে। গালিকস ব্রিজ থেকে কয়েক মাইল সামনে A2 মিশে গেছে। নিয়া ডিটিকি ইসিদোসের সাথে যা নিয়ে যাবে নাভারচো কোনটুরিওটো’র দিকে; যেখানে থেকে আবার কিছুদূর এগিয়ে বামদিকে মোড় নিলেই তিমিস্কি। জিপিএস তো তাই বলছে।

কিন্তু যেটা বেশি মনোযোগ কেড়েছে তা হল, বিকল্প দুটো রাস্তা। প্রথম রাস্তাটা নিয়া ডিটিকি ইসিদোস থেকে ২৬ অক্টোভ্রিরু পর্যন্ত গিয়ে জংশনে মিশেছে যেখান থেকে নাভারচো যাওয়া যাবে।

কিন্তু এই রাস্তাগুলো ওর কাজে লাগবে না। যতটুকু মনে হচ্ছে জংশনে ওর আশায় ওঁৎ পেতে বসে আছে সশস্ত্র লোকগুলো।

দ্বিতীয় বিকল্প রাস্তাটাকে তাই মনে ধরল। ২৬ অক্টোভিরুতে না গিয়ে এলিস যদি নেক্সট এক্সিট দিয়ে মোটরওয়ের পাতাল হয়ে ২৮ অক্টোভিরু পর্যন্ত যায় তাহলে খানিক পরেই মোনাসট্রিরিউতে টার্ন নিয়ে ইগনাশিয়া আর তারপর ডানদিকে গেলেই তিমিস্কি পৌঁছে যাবে।

হুম, তাহলে এই রাস্তাতেই যাবে বলে মনস্থির করে ফেলল। পুরোটাই একটা বাজি বলা যায়। কোনো গ্যারান্টি নেই যে অন্যেরা এ রাস্তা দেখবে না। কিন্তু ওর হাতে তো তেমন আর অপশনও নেই।

গাড়িতে উঠতেই মাথায় এলো আরেকটা নাম। যার উপর ভরসা করা যায়। অন্তত তাই মনে হচ্ছে। ওর কলেজের বয়ফ্রেন্ড। বেস্ট রিলেশনশিপগুলোর একটা। কিন্তু বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই। যদিও ছেলেটা কয়েকবার ফোন করেছে, মাঝে মাঝে ইমেইলও পাঠিয়েছে; কিন্তু এলিস উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে নি। আর কোনো আশা নেই ভেবে ক্ষান্ত দিয়েছে বেচারা।

এমনভাবে সম্পর্কটা শেষ হয়েছিল যে তাতেও খানিকটা বিরক্ত ছিল এলিস। সবসময় ভাবত সম্পর্কটা বুঝি টিকবে। বিয়ে করে দুজনে সারাজীবন একসাথে থাকবে। কিন্তু নাহ, সেরকম কিছু তো হয় নি।

আজ এরকম একটা সমস্যার মাঝে একাকী হয়ে মন চাইছে কারো সাথে কথা বলতে। প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড ছাড়া এক্ষেত্রে আর কেউ নেই। এত বছর পরে এমনটা করা উচিত হবে কিনা তাও জানে না। কেন ওর নামটাই মনে পড়ল সেটাও বুঝছে না। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দিয়েছে সেই ব্রেকআপ।

কিছুক্ষণ তাই কন্ট্রাক্ট লিস্টের আরো কয়েকটা নাম ভেবে দেখল। তারপর কী মনে হতেই দ্রুত হাতে ডায়াল করল নাম্বার। কাম অন, ফোনটা ধরো। এমন না যে এলিসের নাম্বার চিনবে না। যদি না অবশ্য ডিলিট করে দেয়। এত বছর পরে সেটার সম্ভাবনাও কম নয়।

.

৮. জোনগড় কেল্লা

নিজের রুমে বসে একদৃষ্টে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে কলিন। এগারো বছর ধরে মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ব্রেকআপের পর ওর কোনো ইমেইলের উত্তরও দেয়নি মেয়েটা। যদিও এতে তেমন অবাক হবার মত কিছু ছিল না। কারণ প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডের সাথে সে কোনো সম্পর্কই রাখতে চায়নি। অথচ আজ কিনা নিজেই কলিনকে ফোন করেছে। কী এমন ঘটল যে এত বছর পরে ওর মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেল?

নাম্বার দেখে প্রথমেই মনে হয়েছে যে ফোনটা রিসিভ করবে। কিন্তু পুরনো কথা মনে পড়ে যাওয়ায় দ্বিধায় পড়ে গেল। ভয়ও পেল। যদি মেয়েটা সত্যিই ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে চায়, অবস্থা তাহলে আরো জটিল হয়ে যাবে।

যাইহোক। যা আছে কপালে ভেবে লম্বা একটা দম নিয়ে কলটা রিসিভ করল কলিন।

.

টানেলের শেষ মাথায় আশার আলো

“এলিস?” কলিনের কণ্ঠস্বর আর কখনো এতটা মধুর লাগেনি।

‘কলিন! আমি…আসলে আর কাকে ফোন করব বুঝতে পারছিলাম না।” হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল গলা। সাথে খানিকটা স্বস্তিও পেল। কারণ জানে যে হাজার মাইল দূরে ইউএসে বসে থাকা কলিন এ মুহূর্তে তার কোনো কাজেই আসবে না।

“হেই, কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? মনে হচ্ছে কলিনও বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। এলিসের উদ্বেগ ধরতে পেরে জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছে তো?”

আতঙ্ক আর অপরাধবোধে জর্জরিত এলিস খুলে বলল গত রাতের ঘটনা। একেবারে সমাধিতে ঢোকা থেকে শুরু করে এখন হাইওয়েতে ছুটে বেড়ানো। পর্যন্ত সবকিছু।

শোনার পর কিছুক্ষণ নীবর থেকে অবশেষে কলিন বলল, “থেসালোনিকিতে মিশনের আর কেউ নেই যার কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারো?”

“কাকে যে বিশ্বাস করব আমি জানি না কলিন। যদি সত্যিই স্ট্যাভরস আর পিটারই এসবের কারণ হয় তাহলে অন্যেরা যে সাধু তা তো নিশ্চিত নই। আর আমার মনে হচ্ছে ড্যামনও এটার অংশ ছিল। “নির্দেশ পালন না করাতেই খুন হয়েছে। পিটার তো তাই বললছে।”

“ওকে। তাহলে বলব বিকল্প রাস্তা ধরে থেসালোনিকিতে ঢোকার তোমার আইডিয়াটাই ভালো। ওরা নিশ্চয় এটা আশা করছে না। সোজা কনস্যুলেটে চলে যাও। আমি এখন ভারতে আছি। তবে ইউএসএতে কয়েকটা ফোন করে দিচ্ছি। আশা করছি তোমার জন্য কিছু একটা সাহায্যের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

“তুমি ভারতে কী করছ?”

খুব বেশি ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু আঙ্কেলের কাছ থেকে বিজয়ের কেল্লা পাবার কথা জানাল কলিন। “ওহ, আচ্ছা। থ্যাংকস, কলিন, এতসব কিছু হয়ে যাবার পরে তুমি সাহায্য…”

“আরে ধুর বাদ দাও। এ কারণেই তো বন্ধুরা। সম্পর্ক থাকা না থাকা কোনো ব্যাপার না।” তারপর একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে জানতে চাইল, “বিজয়কে কিছু জানাবো?”

“উমমম…না, থাক। এখন না। ওর কেমন প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানি না।”

“টেক কেয়ার। পরে আবার কথা হবে।”

ফোন কেটে দিল।

ইঞ্জিন স্টার্ট করল এলিস। সামনে এগোল গাড়ি। কিন্তু এক কি. মি.ও যেতে পারল না। তার আগেই বেজে উঠল মোবাইল।

ছোঁ মেরে তুলেই স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ওয়ালেস নয় তো?

“এলিস?”

“মিঃ ওয়ালেস!” কত যে স্বস্তি পেল যা বলে বোঝানো যাবে না।

“শুনলাম তোমার নাকি আর্জেন্ট সাহায্য দরকার।” ওয়ালেস সত্যিই উদ্বেগে আছেন।

বুক খালি করে সব কথা বলে দিল এলিস। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গত এক ঘণ্টায় এতকিছু ঘটে গেছে।

সবকিছু শোনার পর নীরব হয়ে গেলেন ওয়ালেস। তারপর আবার যখন কথা বলা শুরু করলেন কণ্ঠে বেশ কর্তৃত্বের ভাব টের পাওয়া গেল, “তোমার কথানুযায়ী জিপিএস দেখাচ্ছে আর আধ ঘণ্টা গেলেই ইউএস কনস্যুলেট। তার মানে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় আছে হাতে।” ভদ্রলোকের গলার স্বর বেশ বিনয়ী। অন্য সময় হলে হয়ত অতি উৎসাহী মনে হত; কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে জীবিত উদ্ধারের জন্য ওয়ালেসই সবচেয়ে ভাল অপশন। “ডোন্ট ওরি, মাই ডিয়ার। কথা দিচ্ছি, তোমার আর কোনো ভয় নেই। গাড়ি চালাতে থাকো। দশ মিনিটের মাঝেই আরেকটা ফোন পাবে। কনস্যুলেটে পৌঁছেই। আমাকে ফোন দিও। এখন রাখছি।”

ওয়ালেস ফোন কেটে দিতেই বিড়বিড় করে থ্যাংকস জানাল এলিস। আজ রাতে প্রথমবারের মত খেয়াল করল যে হাইওয়েতে আর কেউ নেই। এতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো গাড়ি চোখে পড়েনি। কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল পুরো ব্যাপারটা।

ওয়ালেসের সাথে কথা বলার পর থেকে শান্ত হয়ে গেছে ভেতরটা। তাই শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরল এলিস। এস্কিওস নদী পার হতেই বেজে উঠল ফোন।

“মিস টার্নার? আমি থেসালোনিকির জেনারেল পুলিশ ডিরেক্টরেট থেকে ফোন করছি।” কানের কাছে কথা বলে উঠল এক ভারী গ্রিক কণ্ঠ।

মনে হল হার্ট না ফেইল হয়ে যায়। সত্যিই শুনছে তো? ওয়ালেস এরই মাঝে লোকাল পুলিশকেও ফোন করে দিয়েছেন! “ইয়েস” বিস্ময় চাপতে গিয়ে তোতলাতে লাগল এলিস।

লাইনের ওপাশে থাকা পুলিশ অফিসার খুব দ্রুত হড়বড় করে বলে দিল পুরো প্ল্যান। নিয়া ডিটিকি ইসিদোসের ইন্টারসেকশনে মোটর সাইকেল আরোহী তিন পুলিশ ওর সাথে দেখা করে আমেরিকান কনস্যুলেট নয়, বরঞ্চ এমন এক হোটেলে নিয়ে যাবে যেখানে রুম আর লবিতে সশস্ত্র পাহারা থাকবে। থেসালোনিকি থেকে সরাসরি ইউএসে যাবার কাগজপত্র তৈরি করে কনস্যুলেট ওর সাথে হোটেলেই যোগাযোগ করবে।

কী বলবে বুঝতে পারছে না এলিস। এতক্ষণ আতঙ্কে প্রায় অবশ হয়েছিল হাত-পা-মাথা। মনে হচ্ছে খটখটে খরার মাঝে শুরু হল বর্ষা। ফোন কাটার আগে তাই পুলিশসদস্যকে বহুবার ধন্যবাদ জানাল। আবারো গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো রাস্তায়। হাঁটু ভেঙে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তবে এবার আর ভয়ে নয় বরঞ্চ স্বস্তির জল এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সারা দেহ। জানে এখন আর কোনো চিন্তা নেই।

.

ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো হেডকোয়ার্টার, নিউ দিল্লি

ত্রস্ত্র পায়ে এক অধস্তনকে ঢুকতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন ইমরান। কী ঘটেছে জানার জন্য ভ্রু উঁচু করতেই ডেস্কের উপর একতোড়া কাগজ রেখে দিল লোকটা।

“ওকে, লেটস গো।” পেপারস পড়ে আদেশ দিলেন। দরজার দিকে যেতে যেতেই জানালেন, “কমান্ডোদেরকে অ্যালার্ট করে দাও।” এরই মাঝে একদল কমান্ডোকে স্ট্যান্ড বাই থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। মিনিটখানেকের মধ্যেই আই এস পি ডাটাবেইজ থেকে পাওয়া ঠিকানানুযায়ী ছোটার জন্য তৈরি হয়ে গেল আইবি টিম।

এমন সময়ে এক এজেন্টের ফোন বেজে উঠল; ওপাশের কথা শুনে ইমরানকে জানাল, “স্যার আমাদের টার্গেট মেডিকেল ফ্যাসিলিটিতে এইমাত্র আগুন লাগার ঘটনা রিপোর্ট করেছে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট।”

দাঁতে দাঁত ঘষে সময়মত পৌঁছে দেবার জন্য প্রার্থনা করলেন ইমরান।

.

০৯. থেসালোনিকি, গ্রিস

বিছানায় নিঃসাড় হয়ে পড়ে থেকে বাঁচার আনন্দে মুখ ডুবিয়ে দিল এলিস। কথা মতই পুলিশ এসকর্ট তাকে এ হোটেলে নিয়ে এসেছে। তারপর ভুয়া একটা নাম নিয়ে হোটেলে চেক ইন করেছে। অবস্থা সম্পর্কে ওদেরকে কী বলা হয়েছে না জানালেও এটুকু বুঝতে পারছে যে ওর সত্যিকারের পরিচয় গোপন রাখার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পুলিশ একটা কেস ফাইল করে স্ট্যাভরস আর পিটারকে ধরার জন্য তদন্তও শুরু করেছে। কিন্তু, এলিসের কেন যেন মনে হচ্ছে যে ওরা কখনো ধরা পড়বে না।

এরই মাঝে কনস্যুলেটও ফোন করে জানিয়েছে যে আগামীকাল দুপুরের আগেই এদেশ ছেড়ে যাবার সমস্ত কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাবে। নিশ্চয়তা দিয়েছে যে এখন আর কোনো ভয় নেই। এ সবকিছুই ওয়ালেসের জন্য সম্ভব

হয়েছে ভাবতেই কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে গেল মন।

কেবল একটা কাজ বাকি আছে। টিকেট বুক করতে হবে। আগামীকালও করা যাবে। কিন্তু ইউএস এ ফিরবে না। সেটা মোটেও ভালো আইডিয়া হবে

। স্ট্যাভরস আর পিটার ওর আদ্যোপান্ত সবকিছু জানে। হয়ত বাসার ঠিকানাও। এখানে এতটা নিরাপত্তা পেলেও ইউএস-এ ওকে কে বাঁচাবে? সারাক্ষণ তো আর ওয়ালেসের কাছে ছুটে যাওয়া যাবে না। এমনিতেই লোকটা যথেষ্ট করেছে।

তাহলে আর কোথায় যাবে? শাওয়ার নিতে নিতে বহুক্ষণ ভাবল। এখন চারদোনের গ্লাস হাতে নিয়ে রিল্যাক্স করলেও প্রশ্নটার কোনো উত্তর পেল না।

টিভির সুইচ অন করতেই লোকাল একটা গ্রিক চ্যানেল এল। কিন্তু হেডলাইনের সাথে সাথে ফুটে উঠা ইমেজ বোঝার জন্য ভাষাটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই। খবরে বলা হল, থেসালোনিকির হাইওয়ের দুপাশে অ্যাকসিডেন্টের খবর পাওয়াতে সমস্ত যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভুয়া একজন কলারের ফোন পেয়ে পুলিশ পৌঁছে গেলেও জড়িত কাউকেই পাওয়া যায় নি।

শোনার সাথে সাথেই শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ভয়ের একটা শীতল স্রোত।

কিসের মাঝে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে?

এটা তো কোনো সাধারণ ষড়যন্ত্র নয়। যা-ই হোকনা কেন বড় বড় রথী মহারথী জড়িত আছে। খনন সাইট থেকে কেউ যেন জীবিত বেঁচে ফিরতে না পারে সে কারণে কয়েক ঘণ্টা হাইওয়ে আটকে দেয়ার মত পাগলামো যদি করতে পারে তাহলে তাদের মূল পরিকল্পনা আরো কতটা ভয়ংকর!

কিন্তু সেটা কী? মাথা খাটাতে চাইলেও জুৎসই কোনো ব্যাখ্যা পেল না।

ফোন বেজে উঠতেই কেটে গেল চিন্তার সুতো।

“এলিস?” ভেসে এলো ওয়ালেসের মসৃণ স্বর।

“মিঃ ওয়ালেস, আপনাকে যে কিভাবে ধন্যবাদ জানাব।” কৃতজ্ঞতায় নুয়ে। পড়ল এলিস। “আমি থেসালোনিকির একটা হোটেলে উঠেছি।”

“হ্যাঁ, আমি জানি।” উত্তরে জানালেন ওয়ালেস। “বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে বোধহয় আগেও বলেছিলাম যে আমাকে কার্ট ডাকবে। যাই হোক, তুমি নিরাপদে আছো জেনে খুশি হয়েছি।”

“আমিও তাই” উত্তর দিল এলিস, “কিন্তু এখনো ভয় পাচ্ছি।” টেলিভিশনে দেখা হাইওয়ে, হাইওয়ে অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানাল। “কাল সকালে প্রথমেই আগে টিকেট বুক করব। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাই।”

“আহ, আমিও এ কারণেই ফোন করেছি। নিশ্চিত না হয়ে কিছু প্রমিজ করতে চাইনি। মনে হয়না এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রিসের কোনো কমার্শিয়াল। এয়ারলাইনে সিট পাবে। কিন্তু পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলে তোমাকে ইউএসে ফিরিয়ে আনার জন্য একটা প্রাইভেট জেট রেডি করেছি। আগামীকাল দুপুরেই রওনা হতে পারবে।”

আপনা থেকেই হা হয়ে গেল এলিসের মুখ। প্রাইভেট জেট? কার্ট ওয়ালেসের বন্ধুরা নিশ্চয় বেশ উঁচু স্তরের মানুষ। ভদ্রলোক ওকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দেবার প্ল্যান করছেন বুঝতে পেরেই নিজেকে শক্ত করে ফেলল।

“এ ব্যাপারে আসলে আমিও চিন্তা করেছি কার্ট।” হঠাৎ করেই ঠিক করে ফেলল গন্তব্য। ইউএস সম্পর্কে সন্দেহের কথা জানিয়ে খুব নম্রভাবে কিন্তু কঠোর হয়েই নাকচ করে দিল ওয়ালেসের প্রস্তাব।

“এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?” এলিসের অভিপ্রায়ের কথা শুনে অবশেষে জানতে চাইলেন ওয়ালেস।

“অবশ্যই।” অন্তত এ ব্যাপারে আর কোনো দ্বিধা নেই। “আর যদি সম্ভব হয় তো আরেকটা অনুরোধ করতে চাই।” ওয়ালেসকে আরো কিছু প্রয়োজনের কথা জানিয়ে দিল।

“ফাইন, দেন। সবকিছু রেডি হয়ে যাবে। সকাল দশটার দিকে একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করো। হ্যাভ আ সেফ ফ্লাইট আর অন্য কোনো দরকার হলেও জানিয়ে দিও।”

“আই উইল।”।

কল কাটতেই মাথার ভেতর ফেনিয়ে উঠল আরেকটা সন্দেহ। যা করছে তা ঠিক হচ্ছে তো?

জোর করেই চিন্তটাকে দূরে সরিয়ে দিল। এ শয়তানগুলোর সাথে ওকে লড়তেই হবে। বহুদিন ধরেই কেবল পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

.

১০. আর্য ল্যাবরেটরি, নিউ দিল্লি

দমকলবাহিনি আর কমান্ডোদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন ইমরান; বেদনার ভারে নুইয়ে পড়েছে দুই কাঁধ।

তিন ঘণ্টা আগে মেডিকেল স্টেন্টারে পৌঁছে দেখেন ভয়ংকর এক আগুনের সাথে যুঝছে সবাই। চারতলা ফ্যাসিলিটির উপরের তিন তলাই দাউ দাউ করে জ্বলছে।

চার ঘণ্টা ধরে পনেরোজন দমকলকর্মী অমানুষিক পরিশ্রম করে অবশেষে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ইমরান, আইবি টিম আর কমান্ডোরা অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। দমকল বাহিনি নিজেদের কাজ ভালভাবেই জানে, এখানে ওদের কিছু করার নেই।

তাই দালানে ঢোকার অনুমতি পাবার সাথে সাথে কমান্ডো, তার দল আর ফায়ারম্যানদেরকে চিৎকার করে কয়েকটা নির্দেশ দিয়েই দৌড়ে ছুটে গেলেন ইমরান। উপরের তলাগুলো ঝলসে গেলেও নিচের তলা কেমন করে যেন পুরোপুরি অক্ষত রয়ে গেছে।

“এই জায়গাটাতে কি রাখা হত?” ডেপুটি অর্জুনের কাছে জানতে চাইলেন ইমরান। “এটা একটা ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি। ওয়াশিংটনের সিয়াটলে অবস্থিত টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের হয়ে ওরা প্যাথলজিক্যাল ডিজিজ নিয়ে রিসার্চ করত।”

ভ্রু-কুঁচকে ফেললেন ইমরান, “ইউএস মাল্টিন্যাশনাল ফার্মা কোম্পানি?”

“ইয়েস। আরো তথ্য পাবার জন্য এরই মাঝে যোগাযোগও করেছি। তবে এই সেন্টারে মনে হচ্ছে ওরা নিজেদের রিসার্চ প্রোগ্রামের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিত। এর পাশাপাশি এমন কিছু মলিকিউল তৈরির চেষ্টা করছে যা কিনা মেডিসেনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অবদান সৃষ্টি করবে।”

জীবন্ত হয়ে উঠল ইমরানের ওয়াকিটকি, “স্যার, এক্ষুনি চতুর্থ তলায় একটু আসবেন প্লিজ।” জানাল এক এজেন্ট।

লাফিয়ে সিঁড়ি পার হতে গিয়েও ভয় পেয়ে গেলেন ইমরান। মধ্য চল্লিশেও নিয়মিত পরিশ্রম করা শরীর এখনো এত ফিট যে একেকবারে দুটো করে ধাপ পার হলেন।

চার তলায় পা রাখতেই জমে যাবার দশা। সম্পূর্ণ কয়লা হয়ে গেছে পুরো ফ্লোর। আর যা কিছু আগুনের হাত থেকে বেঁচে গেছে তাও দমকল বাহিনির পানি থেকে রেহাই পায় নি।

মেঝের উপর পড়ে থাকা বিভিন্ন স্তূপ বাঁচিয়ে কোনোমতে ঢুকে পড়লেন আইটি ল্যাব টাইপের একটা কামরাতে। টর্চ আর দমকল কর্মীদের মাথার ল্যাম্পে আলোকিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। নজরে পড়ল অঙ্গার হয়ে যাওয়া ফার্নিচার আর কালো কম্পিউটার টার্মিনাল।

এতক্ষণ যে ভয়টা পাচ্ছিলেন তা-ই সত্যি হল। কম্পিউটার টার্মিনালের সামনের চেয়ারে বসে আছে কৃষ্ণকালো এক মৃতদেহ।

“আনোয়ার?” কোনোমতে নামটা উচ্চারণ করলেন ইমরান।

“আয়্যাম সরি, স্যার। এই মুহূর্তে কোনো পজিটিভ আইডেন্টিটি পাওয়া সম্ভব নয়। পুরোপুরি জ্বলে গেছে।”

নিশ্চুপ হয়ে গেলেন ইমরান। তারপর বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, “অর্জুন, আমি একটা কমপ্লিট ইনভেস্টিগেশন চাই। কে এই জায়গার মালিক? তারা এখানে কী করছিল? আগুন লাগার কারণ? আর…” মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এর পরিচয়।”

কড়কড় করে উঠল ওয়াকিটকি, “স্যার, আপনি একটু গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসলে ভালো হয়। একটা জিনিস পাওয়া গেছে।”

দ্রুত আবার নিচে নেমে এলেন ইমরান। পিছনে এলো অৰ্জুন। এলিভেটর শ্যাফট চেক করতে গিয়ে একজন এজেন্ট আবিষ্কার করেছে যে লিফট গ্রাউন্ড লেভেলে থামেনি। মনে হচ্ছে আরো নিচে নেমে বেসমেন্টেও গেছে।

অদ্ভুত কিছু একটা আছে বুঝতে পেরে এজেন্ট বরুণ ঝা জোর করে এলিভেটর ওপেন করেছে। ফ্লোর বেছে নেবার প্যানেলে সাধারণ বাটনের পরিবর্তে আছে ইলেকট্রনিক টাচ প্যানেল। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে প্যানেলে বেসমেন্টের কোনো উল্লেখ নেই।

ঝা’র চোখে পড়ল আসলটার নিচে প্রায় লুকানোই বলা চলে দ্বিতীয় ছোট্ট আরেকটা প্যানেল। ব্ল্যাংক হলেও তার ধারণা কেউ যদি সঠিক অথেন্টিফিকেশন লাগানো কার্ড ঢোকায় তাহলে হয়ত নিচে যাবার জন্য আরো কয়েকটা ফ্লোর পাওয়া যাবে।

অত্যন্ত মেধাবী এজেন্ট তাই দমকল বাহিনির সাথে শেয়ার করল নিজের এক আইডিয়া। যদি দালানের নিচে কোনো গুপ্ত বেসমেন্ট থাকে তাহলে নিশ্চয় লিফটের ব্যাকআপ হিসেবে সিঁড়িও থাকবে।

ফায়ারফাইটাররা তৎক্ষণাৎ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল চারকোণা একটা ছোট্ট খালি রুম। এরপরে আর কিছু নেই। সিঁড়ির তিনদিকের দেয়াল ভেঙে ফেলার আদেশ দিল ঝ। ফলও পেল হাতেনাতে। সিঁড়ির ঠিক সামনে দেয়ালের পেছনেই খানিকটা খোলা জায়গা আছে। সাথে সাথে ইমরানকেও ফোন করে দিল।

“সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে দেয়াল ভাঙ্গা দেখলেন ইমরান। ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন ধরনের তার। এটা এখন স্পষ্ট যে কোনো এক ধরনের ইলেকট্রনিক সিস্টেম যার মাধ্যমে দেয়ালের মাঝে লুকায়িত দরজা খোলা যাবে।

কাজ শেষ হতেই দেখা গেল আরেকটা ল্যান্ডিং। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে।

কী পাবেন ভাবতে গিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন ইমরান। বেজমেন্টকে লুকানোর জন্য যদি কেউ এতটা কষ্ট করে থাকে তার মানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোপন করা হয়েছে। মনে পড়ে গেল গত বছরের এক অদৃশ্য দেয়ালের কথা। মহাভারতের আড়ালে থাকা সিক্রেট উন্মোচন করতে গিয়ে আরেকটু হলেই জানটাই খোয়াতেন।

টর্চ হাতে নিয়ে আইবি এজেন্ট আর দমকলকর্মীরা খুব সাবধানে নিচে নেমে গেল। কর্তাব্যক্তিরা যে পালিয়ে গেছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু হয়ত সাহায্যের আশায় নিচে কেউ আটকা পড়ে আছে।

কিন্তু যা পেল তাতে যারপরনাই বিস্মিত হল রেসকিউবাহিনি। বেজমেন্টেও তিনটা লেভেল আছে। নিচের দুই লেভেলে মনে হচ্ছে বসবাসের ব্যবস্থাও আছে। সংকীর্ণ করিডোরে এক সারি ঘোট ঘোট কিউবিকল। কিন্তু কোনো হোটেল কিংবা ডরমিটরি নয়। কেননা ইলেকট্রনিক তালা লাগানো প্রতিটা সেল বাইরে থেকে আটকানো।

তবে সব কজন বাসিন্দাই মৃত। যদিও কারণটা যে শ্বাসকষ্ট নয় এটা বুঝতে ফরেনসিক রিপোর্টের দরকার নেই। আগুন এখানে স্পর্শ না করলেও একজনও জীবিত নেই। বুলেট কেড়ে নিয়েছে প্রাণ।

অর্জুনের দিকে ফিরলেন ইমরান, “একটা আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল, হাহ? ওয়েল, দেখা যাক তাদের ফ্যাসিলিটিতে শ’খানেকেরও বেশি মৃতদেহ নিয়ে কী বলে। ব্যাপারটা আমি ব্যক্তিগতভাবে হ্যাঁন্ডেল করব। এই ফাঁকে তাদের সিইও আর চিফ মেডিকেল অফিসারের সাথে মিটিং করতে চাই। ভারতে তাদের অপারেশন ইতিহাস আর ট্রায়ালের সব তথ্য এনে দাও। ওই দুজনের সাথে দেখা করার আগেই আমি তাদের আগাগোড়া সবকিছু জানতে চাই।”

মাথা নাড়ল অর্জুন, “কাল বিকেলের মাঝেই রিপোর্ট করবো।”

এরপর ইমরানের ইশারা পেয়ে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে সরে এলো। “আরো দুটো কাজ করতে হবে।” ফিসফিসিয়ে জানালেন আইবি ডিরেক্টর। ধৈর্য ধরে শুনল অর্জুন।

ইমরান শেষ করতেই একেবারে অবাক হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও কিছু বলল না; শুধু জানাল, “ঠিক আছে, আমি ব্যবস্থা করছি।” দায়িত্ব পালন করতে চলে গেল অর্জুন।

চারপাশের মৃতদেহ আর সেলগুলোর দিকে তাকালেন ইমরান। গোপন বেজমেন্ট। বুলেট বিদ্ধ শরীর। এখানে আসলে কী হচ্ছিল? যার কারণে ধ্বংস করে দিল পুরো দালান। কোনো প্রমাণ কি মুছে দিতে চেয়েছে? কিসের প্রমাণ? আনোয়ারের সাথে কী ঘটেছে? ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায় এরকম একটা ফ্যাসিলিটিতেই বা ও কী করছিল?

এত্ত এত্ত প্রশ্ন। কিছু যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না। নিজের এই অনুভূতি ইমরান ভালোভাবেই চেনেন। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু একটা বলতে চাইছে। গভীর আর গূঢ় এক উদ্দেশ্যের কাভার-আপ ছিল এই বিশাল স্থাপনা।

পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতেই শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। যতদূর যেতে হোক না কেন এই রহস্যের কিনারা তিনি করেই ছাড়বেন।

.

জোনগড় কেল্লা

মাত্র গত সপ্তাহে আবিষ্কৃত রুমটার একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিবুক চুলকালো বিজয়। অত্যন্ত বিশাল এই দুর্গের পাঁচটা তলাতে পঞ্চাশটিরও বেশি কামরা আছে। আর এক বছর আগে এর উত্তরাধিকার পেলেও সবকটি কক্ষ সাথে সাথেই ঘুরে দেখার চিন্তা মাথাতেও আসেনি। এছাড়া দ্বিতীয় তলার স্টাডি আর তৃতীয় তলায় নিজের বেডরুমেই কেটে যায় বেশিরভাগ সময়। তাই কেল্লার কয়েকটা কামরা দেখলেও বাকিগুলো এখনো অদেখাই রয়ে গেছে।

গত ছয় মাস আগে ভেবে দেখল যে দুৰ্গটা ভালোভাবে চেনা দরকার। আর তা করতে গিয়ে ইন্টারেস্টিং কয়টা রুমও পেয়েছে। তবে মহাভারতের সিক্রেট লুকিয়ে রাখা কামরার মত অতটা চমৎকার নয়। এতে আরেকটা লাভ হয়েছে। জানতে পেরেছে আংকেলের পছন্দ আর অভিপ্রায়সমূহ।

যাই হোক, দুই সপ্তাহ আগে যা পেয়েছে তা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিতই বলা চলে। ছাদের ঠিক নিচেই পাঁচতলার একটা কামরা। বৈশিষ্ট্যহীন রুমটাকে দেখে প্রথমে স্টোররুমই মনে হয়েছে। বাদামি কাগজ মোড়ানো বড়সড় কিছু প্যাকেজের পাশাপাশি একগাদা কার্টন স্তূপ করে রাখা।

কৌতূহলের বশে কয়েকটা কার্টন চেক করতেই ‘থ’ বনে গেল। বিজয়ের পনের বছর বয়সে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়া ওর পিতা-মাতার ব্যবহার্য কিছু জিনিস পাওয়া গেল। আঙ্কেলের কাছে শুনেছে একেবারে সরাসরি সামনে থেকে এসে গাড়িটাকে আঘাত করেছে দ্রুত গতির এক ট্রাক। বাবা-মা দুজনেই ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। কী কারণে এতদিন পর ভুলে গেলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে বাসায় রয়ে গিয়েছিল বিজয়। ফলে বেঁচে গেছে তার জীবন।

কয়েকটা কার্টন পরীক্ষা করতেই বুঝতে পারল বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত সবকিছু প্যাক করে এই কেল্লায় এনে রেখে দিয়েছেন আঙ্কেল। তারপর থেকে এগুলো এই রুমেই আছে।

হঠাৎ করে এতদিন পর বাবার কাগজপত্র আর মায়ের জানাল দেখে বুঝতে পারল যে ওদের জন্য ভেতরে কতটা শূন্যতা রয়ে গেছে। আঙ্কেল ভ্রাতুস্পুত্রের যথেষ্ট খেয়াল রেখেছেন। হায়ার স্টাডিজের জন্য এমআইটিতে পাঠানো ছাড়াও ছেলেটাকে কখনো নিজেকে অনাথ ভাবার সুযোগ দেননি। আর বিজয়ও প্রথমে পড়াশোনায় মন দিয়েছে তারপর কাজের ভেতর ডুবে গিয়ে ভুলে গেছে সব ট্র্যাজেডি।

এবারই প্রথম পিতা-মাতার সাক্ষাৎ স্মৃতি চাক্ষুস করে মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছে; বিশেষ করে এখন যখন আঙ্কেলও আর পাশে নেই।

সে মুহূর্তেই ঠিক করে ফেলল যে কার্টনগুলোকে শিফট করে বাবা-মায়ের সমস্ত স্মৃতি সযত্নে লালন করবে। কিশোর বয়সেই দুজনকে হারিয়ে ফেলায় ভালভাবে জানার সুযোগও পায়নি। শুধু এটুকু জানে যে তাঁরা দুজনেই এ্যাকাডেমিক হিস্টোরিয়ান আর রিসার্চার ছিলেন। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে কাজ করতেন। এর বেশি কিছু আর মনে নেই। বয়ঃসন্ধিকালের ভালোবাসা আর দ্বন্দের মাঝে দিয়ে তৈরি হওয়া সে সম্পর্ককে এখন অনেক মিস করে। তাই এ রুমে থাকা জিনিসগুলো হয়ত তাকে তার পিতা-মাতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। হোক না তা তাদের মৃত্যুর পর!

তখন থেকেই প্রতিদিন এ ঘরে এক থেকে দু’ঘণ্টা করে কাটায়। কার্টন হাতড়ে বের করে পড়ে পেপারস আর জার্নাল। বুঝতে চায় বাবা-মায়ের দর্শন যা টিনএজ থাকাকালীন মোটেও পাত্তা দেয় নি।

এ উদ্দেশ্যে লাগানো ল্যাম্পের সুইচ অন করে একগাদা কাগজপত্র নিয়ে এসে বসল ডেস্কে। আজ রাতে কি এমন কিছু পাবে যা গত কয়েক রাতে পায় নি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *