১. বঙ্গদেশ

১. বঙ্গদেশ

সমকালীন ভারতবর্ষ বুঝতে পারেনি তত্ত্বটা : ‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার।’ দু-তিন শ’ বছরের ব্যবধানে সুবিধাজনক মালভূমিতে দাঁড়িয়ে সেজন্য তাকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। প্রথম কথা, সমকালে, একই কালীক সমতলে দাঁড়িয়ে এ জাতীয় তত্ত্ব বোঝা যায় না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত। সক্রেটিস বা যীশুখ্রীষ্টের বিচারকও তা বুঝতে পারেনি। প্রণিধান করতে পারেননি গ্যালিলেওর সমকালীন পোপ। দ্বিতীয় কথা, আদি যুগে পশ্চিমের দ্বার দিয়ে যারা এসেছিল তারা ঐ মন্ত্রটা বিশ্বাস করত না : ‘দিবে আর নিবে’। তারা এসেছিল শুধু লুট করতে। ফলে, ভারতবর্ষের দৃষ্টিভঙ্গিটাও হয়ে উঠেছিল প্রত্যাশিতভাবে শত্রুভাবাপন্ন।

আমাদের আরও একটা স্বভাবগত দোষ ছিল : ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুসমাজ ছিল বড় বেশি সহিষ্ণু। তাই কূপমণ্ডূক টুলো পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে কোনও মার্টিন লুথার, রেজা খাঁ বা দেবী সিংহের বিরুদ্ধে কোনও অলিভার ক্রমওয়েল এখানে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। প্রতিবাদ হয়েছে, এখানে-ওখানে, গৌরবে তাকে আমরা বিদ্রোহও বলে থাকি; কিন্তু তা রাজ্যব্যাপী ব্যাপক আকার ধারণ করেনি।

সব কিছু ‘বেদ-এ আছে’ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কিছু নেই। য়ুরোপ যখন চাষবাস জানত না, কাঁচা মাংস খেত তখন আমরা নগরের পত্তন করেছি, পরমপুরুষের স্বরূপ প্রণিধানে সচেষ্ট হয়েছি—একথা যেমন সত্য, তেমনি অন্ধযুগ অতিক্রমণে য়ুরোপ যখন রেনেসাঁয় প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে তখন আমরা সতীদাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ জাতীয় কুসংস্কারে মগ্নচৈতন্য হয়ে পড়ছিলাম এ কথাও সলজ্জে স্বীকার্য।

‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’ বা বাঙলার নব জাগরণ হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। নিঃসন্দেহে তার প্রথম শঙ্খনির্ঘোষ করেছিলেন রাজা রামমোহন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্ত্য ভাষার মাধ্যমে তৌল করতে চেয়েছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে—গ্রীক, রোমক, ফরাসী সভ্যতার তত্ত্বে। তিনিই প্রথম প্রণিধান করতে পেরেছিলেন পৌত্তলিকতায়, আনুষ্ঠানিক সংস্কারে কী ভাবে রুদ্ধ হয়ে গেছে বেদ-উপনিষদের জ্ঞানচর্চা। উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি স্বচক্ষে পশ্চিমখণ্ডের সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ মূল্যায়ন করতে ছুটে গিয়েছিলেন।

কিন্তু রাজা রামকে স্বয়ম্ভূ মনে করা ভুল। তাঁর প্রাগ্বর্তী যুগেও কেউ কেউ নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন ঐ পশ্চিমের দ্বার দিয়েই আসবে জ্ঞানের আলো। তাঁদের কথা আমরা জানতে পারি না। তাঁরা ইতিহাসে হারিয়ে গেছেন। আমার কল্পনায় তাঁদের এক সম্ভাব্য প্ৰতীক : পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর। যিনি পশ্চিমের পরকলায় জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন। কুসংস্কারচ্ছন্ন ও কূপমণ্ডূক সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রয়োজনটা নিশ্চয়ই অনেকে প্রণিধান করেছেন। তাঁরা সে সুযোগ পাননি তাঁদের জীবনে

আবার বলি, আমার কল্পনায় তার আর এক প্রতীক : হটী বিদ্যালঙ্কারের পিতৃদেব। এই পশ্চিমের দরজাটা কী ভাবে ধীরে ধীরে খুলে গেল সে কথা এবার বলি। সেই ধারাবাহিকতা পৃথকভাবে বর্ণনা করব বলেই ভাগীরথী তীরের তীর্থ-পরিক্রমা কালে আমরা কয়েকটি জনপদের কথা অনুক্ত রেখেছিলাম : সপ্তগ্রাম, ব্যাণ্ডেল, হুগলী, ওলন্দাজনগর।

ভাস্কো-দা-গামা উত্তমাশা অন্তরীপ বেষ্টন করে কালিকট বন্দরে এসেছিল 1498 খ্রীষ্টাব্দে।

বলা বাহুল্য, সেই প্রথম য়ুরোপীয় নয়। স্থলপথে তার পূর্বে বহু বহু য়ুরোপীয় ভারত ভূখণ্ডে এসেছেন, সেই ম্যাসিডোনীয় সেকেন্দার শাহর আমল থেকে। জলপথেও দা-গামাই প্ৰথম আগন্তুক নয়। পূর্ববর্তী দশকে জলপথেই কালিকটে এসে পৌঁছেছিলেন আর একজন পর্তুগীজ ভাগ্যান্বেষী : পেদ্রু দা কোভিলহাস। কিন্তু ইতিহাসের ঐ রেওয়াজ—আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে পদার্পণ না করেও কলম্বাস যেমন হয়েছেন আমেরিকার আবিষ্কারক, এভারেস্টের উচ্চতা না মেপেও যেমন এভারেস্ট-সাহেব অমর, তেমনি আমাদের জানানো হয়েছে দা-গামাই এই সম্মানের অধিকারী।

দা-গামা আরব সাগরে নৃশংস লুটতরাজ করে পর্তুগীজ নৌ-বাণিজ্যের স্বরূপটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। মক্কায় তীর্থযাত্রী আরব-জাহাজ মেরী’-র যাবতীয় পণ্যসামগ্রী লুট করে কী ভাবে তিনশজন নরনারীকে হত্যা করেছিল তার বিবরণ শরদিন্দুর ‘রক্তসন্ধ্যা’। সে কাহিনী ইতিহাসের চেয়েও সত্য।

লুট আর অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়ে মালাবার উপকূলের শান্তশিষ্ট জনপদগুলিকে শ্মশানে রূপান্তরিত করে দা-গামা ফিরে গেল স্বদেশে। সঙ্গে প্রচুর পণ্য ও ধনসম্পদ এবং অসংখ্য ক্রীতদাস, ক্রীতদাসী। লোভে-লোভে সে দ্বিতীয়বারও এসেছিল।

ভারতবর্ষে তখনও বাবুর বাদশাহ এসে পৌঁছাননি। পাঠানযুগ চলছে—লোদী বংশ। সব বৃত্তান্ত শুনে মুগ্ধ হলেন পর্তুগাল রাজ। পোপকে প্রচুর উপঢোকন পাঠিয়ে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন আর ঐ সঙ্গে পূর্বদেশ-শোষণের ধর্মীয় অনুমতি। কাঞ্চনমূল্যে সব কিছুই শোধন হয়ে যায়। পোপ অনুমতি দিলেন—পর্তুগালরাজ হয়ে গেলেন “Lord of the Navigation, Conquests and Trade of Aethiopia, Arabia, Persia and India.”

তত্ত্বটা প্রণিধানযোগ্য। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে পর্তুগীজ বোম্বেটেরা যা কিছু করেছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে-কাজে কোনও পাপ ছিল না। স্বয়ং পোপ এর অনুজ্ঞাবলে তারা এই ‘হীদেন’দের প্রভু। তারা যদি সেটা না মানে তবে তাদের হত্যায় পাপ নেই।

পোপের আশীর্বাদ পেয়ে পর্তুগালরাজ এবার পাঠালেন তাঁর প্রতিনিধিকে—পর্তুগীজ ভাইসরয় : ফ্রান্সিস্কো দ্য আলমেইডা (1505)। কোচিন সমুদ্রোপকূলে থানা গাড়লেন তিনি। খুলে বসলেন দপ্তর। কাজ একটাই : সুযোগমতো আরব বণিকদের জাহাজ লুট করা।

পরবর্তী ভাইসরয় আফাসো দ্য আলবুকার্ক। এবার স্থলভাগের দিকে নজর দেওয়া হল। দুই দশকের ভিতর অধিকৃত হল গোয়া, দমন, দিউ। কোচিন থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হল গোয়ায়।

তারপর দৃষ্টি পড়ল ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে। দুটি বন্দর তাদের লক্ষ্য : সমুদ্রের কাছাকাছি চট্টগ্রাম আর সরস্বতী তীরের সপ্তগ্রাম। ক্রমে তারা এল বঙ্গদেশে।

কিন্তু তার পূর্বেও সপ্তগ্রামের ইতিহাস আছে। এবার বরং ফিরে আসি ভাগীরথী তীরের বাকি কয়টি জনপদ দেখতে : সপ্তগ্রাম, ব্যাণ্ডেল, হুগলী, চুঁচুড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *