০১. ফরেস্ট অফিসারের চাকরি

কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ
প্রথম সংস্করণ: মাঘ ১৩৮৮

“I had an inheritance from my father.
It was the moon and the Sun.
I can move throughout the World now.
The spending of it is never done.”

.

টুনটুনি,

জীবনের অনেক ঋণই শোধ করা যায় না; শুধু স্বীকার করা যায় মাত্র। সেই সব অপরিশোধনীয় ঋণের স্বীকৃতিস্বরূপ আমার এই সামান্য বই তোমাকে দিলাম।

শ্ৰীমতী কৃষ্ণা গুহঠাকুরতা,
কল্যাণীয়াসু

বুদ্ধদেবদা—
৩০ এপ্রিল,
১৯৭০,
কলকাতা

.

নবীকৃত সংস্করণের ভূমিকা

উনিশশো পঁচানব্বুইতে মানে, আর দেড় মাস পরেই ‘কোয়েলের কাছে’র পঁচিশ বছর পূর্ণ হবে। সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই একটা ঘটনা। আর এই ঘটনা ঘটানোর জন্যে প্রত্যেক পাঠক-পাঠিকার কাছেই আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁদের ভালবাসাতেই আমি লেখক।

‘কোয়েলের কাছে’ লিখেছিলাম ষাটের দশকে, অত্যন্ত যত্ন করে এবং তিন বছর সময় নিয়ে। লেখাটি কলকাতাতেই লিখলেও প্রত্যেক ঋতুর বর্ণনা সেই ঋতুতেই বসে লিখেছিলাম এই ছেলেমানুষী বিশ্বাসে যে, তাতে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পালামৌকে পরিপূর্ণভাবে তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শসমেত উপস্থাপিত করতে পারব। পেরেছি কি পারিনি তার বিচারক আমি নই। হেমিংওয়ের একটি উক্তি আমাকে প্রভাবিত করেছিল: “Do not hold back anything. Give it all to your readers।”

নিজে হাতে পনেরো বার কপি করেছিলাম এই উপন্যাস এবং প্রতি বারেই কপি করতে করতে বদলেও গেছিল কমবেশি।

লেখা শেষ হয়ে যাবার পর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি আনন্দবাজার “রবিবাসরীয়”র সম্পাদক শ্রীরমাপদ চৌধুরীর ঘরের একটি আলমারির মাথার ওপরে রাখা ছিল একাধিক বছর। তখন রবিবাসরীয়তে ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হত না। আমি তখন ছোটগল্প লিখি। মজার গল্প। বন জঙ্গলের পটভূমিতে। লেখক পরিচিতিও ছিল না। আর আনন্দবাজার গোষ্ঠীর অন্য কাগজ বলতে তখন শুধুমাত্র ‘দেশ’। কিন্তু ‘দেশ’-এ আমার লেখা ছাপাই হত না। প্রথমবার ছাপা হয় উনিশশো ছিয়াত্তরে।

যুগান্তর গোষ্ঠী ষাটের দশকের মাঝামাঝি ‘অমৃত’ সাপ্তাহিক প্রকাশ করতে শুরু করেন। সম্পাদনা করতেন কম্যুনিস্ট কবি শ্রীমণীন্দ্র রায় এবং প্রধান সহকারী ছিলেন শ্রীকমল চৌধুরী। সাহিত্যিক মনোজ বসুর পুত্র ময়ূখ বসু ‘কোয়েলের কাছে’র কথা জানতেন। তা ছাড়া, ওঁরা তখন আমাদের পড়শি এবং মক্কেলও বটেন। ময়ূখই উপন্যাসখানি নিয়ে গিয়ে ‘অমৃত’তে দেন। মণীন্দ্রবাবু অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে ছাপতে শুরু করেন ধারাবাহিকভাবে। কয়েকটি কিস্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। বনফুল এবং সন্তোষকুমার ঘোষ এই অখ্যাত নবীনকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। সেই সময়ের লেখকেরা বড় মনের ছিলেন। প্রশংসা করতে বুক ফাটত না।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ শেষ হয়ে গেলে মনোজবাবুর প্রকাশনা সংস্থা ‘গ্রন্থ-প্রকাশ’ থেকে সত্তরের দশকের গোড়াতে ‘কোয়েলের কাছে’ বই হয়ে বেরোয়। তারও দশ বছর পরে উনিশশো আশিতে আনন্দ পাবলিশার্স প্রথম আনন্দ-সংস্করণ প্রকাশ করেন।

বইটিকে সুন্দর ও নয়নাভিরাম করতে গিয়ে দাম বেড়ে গেল। দাম যে বাড়ল, তার পিছনে আমার এই নবীকরণের ইচ্ছাও দায়ী। আশা করি, পাঠক-পাঠিকারা এই অপরাধ নিজগুণে মার্জনা করবেন।

বিনত
বুদ্ধদেব গুহ
পোস্ট বক্স নং ১০২৭৬
কলকাতা—৭০০ ০১৯
১৫। ১১। ১৯৯৪

এক

‘স্যান্ডারসন’ কাগজ কোম্পানির ফরেস্ট অফিসারের চাকরি নিয়ে আজই এলাম এখানে।

পাহাড়ের মাথায় খাপরার চালের পুরনো আমলের বাংলো। পাশাপাশি তিনটে ঘর। সামনে পিছনে চওড়া বারান্দা। ঘরগুলো বড় বড়। বাংলোর হাতাটাও বিরাট। চমৎকার ড্রাইভ। দু পাশে দুটো জ্যাকারান্ডা গাছ। তা ছাড়া কৃষ্ণচূড়া, ক্যাসিয়া নডুলাস, চেরি ইত্যাদি গাছে চারিদিক ভরা। বাংলোর চারপাশের সীমানায় কাঁটাতার আর কাঁটা-ঝোপ।

জায়গার নাম রুমান্ডি।

ব্ৰজেন ঘোষ (ঘোষদা) পৌঁছে দিয়ে গেলেন। বললেন, এই হল তোমার ডেরা, এইখানেই থাকবে, এইখানে বসেই বাঁশ-কাটা কাজ তদারকি করবে, এইখানেই এখন থেকে তোমার ঘরবাড়ি সব।

বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেদিকেই তাকালাম শুধু পাহাড় আর পাহাড়, বন আর বন। সত্যি কথা বলতে কী, বেশ গা-ছমছম করতে লাগল। বেশি মাইনের লোভে পড়ে এই ঘন জঙ্গলে এসে পাণ্ডব-বর্জিত পাহাড়ে বেঘোরে বাঘ-ভাল্লুক ডাকাতের হাতে প্রাণটা না যায়।

ছোটবেলা থেকে কলকাতায় মানুষ, সেখানেই পড়াশুনা শিখেছি। সেখানকার ট্রাম আর দোতলা বাসের গর্জন শুনে এবং মানুষের মেলা দেখে অভ্যস্ত আছি। কিন্তু এ এক আশ্চর্য জগতে এসে পড়লাম। এই দিনের বেলায়ও কোনও জনমানব নেই। কেবল ব্যস্ত হাওয়াটা রাশি রাশি বিচিত্র বর্ণ শুকনো পাতা তাড়িয়ে নিয়ে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। সেই পাতার নাচের শব্দ ছাড়া আছে টিয়ার ঝাঁকের কর্কশ শব্দ।

এই বিচ্ছিন্ন ও অসহনীয়ভাবে নির্জন জঙ্গলে কী করে দিন কাটবে জানি না। তার উপর এর বছরের চুক্তিতে এসেছি। কাজ করব না বললেই হল না, পালিয়ে গেলেই হল না। প্রায় কান্না পেতে লাগল।

ঘোষদা বললেন, তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। বাবুর্চি আছে ভাল। নাম—জুম্মান। পাহাড়ের নীচের হাটে গেছে বোধ হয়, তোমার খাওয়া-দাওয়ার ইন্তেজাম করতে। আর এই হচ্ছে রামধানিয়া, তোমার খিদমদগার। অত্যন্ত সাদাসিধে একটি লোক এসে লম্বা কুর্নিশ করে দাঁড়াল।

ঘোষদা বললেন, আমি এবার চলি, তুমি চানটান করে বিশ্রাম করো, জুম্মান এই এল বলে। খেয়েদেয়ে বেশ ভাল করে ঘুমিয়ে নিয়ে আজকের দিনটা রেস্ট নাও। কাল থেকে কাজ শুরু। এখানে যে রেঞ্জার আছে, যার কথা রাস্তায় বলছিলাম, সে ছেলেটি ভালই—তবে বড় সাংঘাতিক টাইপ।

চমক উঠে বললাম, মানে?

ঘোষদা হেসে বললেন, না না, তোমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। তবে ছেলেটি বড় বেপরোয়া। ওকে একটু সামলে-সুমলে চলো বাপু, নইলে বিদেশে কী বিপদ সৃষ্টি করবে কে জানে! রেঞ্জারের নাম যশোয়ন্ত।

তারপর বারান্দা থেকে নামতে নামতে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, বাইরে চলাফেরা করার সময় একটি সাবধানে কোরো। গরমের দিন। সাপের বড় উপদ্রব।

সাপ? একেবারে কুঁকড়ে গেলাম। বাঘ, ভাল্লুকে তাও দেখা যায়, বোঝা যায়, হাতে-পায়ে হেঁটে আসে। এই ঘিনঘিনে বুকে-হাঁটা পিচ্ছিল কুৎসিত সরীসৃপকে দেখলেই একটা অস্বস্তি লাগে। সারা শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। সভয়ে শুধোলাম কী সাপ আছে?

ঘোষদা বলেলেন, আছেন সকলেই। শঙ্খচূড়, কালকেউটে, পাহাড়ি গহুমন্ ইত্যাদি। কেউ কম যান না। এই গরমের সময়টাতেই বেশি ভয়। ঘাবড়াবার কিছু নেই। একটু সাবধানে থাকলেই হবে। ফরসা জায়গা দেখে পা ফেলো।

এই বলে উনি গাড়িতে উঠলেন, তারপর ওঁর জিপ লাল ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।

ঘরগুলো বেশ বড় বড়। বিরাট বিরাট জানালা ঘরের তিন দিকে। জানালায় শিক নেই কোনও। দু-পাশে দুটি ঘর। মধ্যে বসবার ঘর-কাম-খাবার ঘর। প্রত্যেক ঘরের পেছনেই সংলগ্ন বাথরুম। বাথরুমে বেশ উঁচু করে কাঠের পাটাতন। বড় বাথটাব। একটি ওয়াশ বেশিন। সব দেওয়ালে একটি করে বড় জানালা আছে।

দরজা খুলে পিছনের উঠোনে গিয়ে পড়তে হয়। পিছনের উঠোনের পর জুম্মান ও রামধানিয়ার কোয়ার্টার, বাবুর্চিখানা, কাঠ ও কয়লা রাখার ঘর ইত্যাদি। উঠোনের এক পাশে একটা বিরাট গাছ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে অনেক দিনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক ঝাঁক হলদে রঙের শালিক তাতে কিচির-মিচির করছে।

জানালার যা সাইজ, তাতে হাতির বাচ্চা পর্যন্ত অনায়াসে ঢুকে পড়ে আমার নেয়ারের খাটিয়াতে শুয়ে থাকতে পারে। একে তো এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে আছি, এই জানাটাই যথেষ্ট জানা; তার উপর যদি ঘরের মধ্যে হিংস্র জানোয়ার ঢুকে পড়ার ভয় থাকে, তবে তো অস্বস্তির একশেষ। এই সাইজের জানালা দিয়ে ঠিক কোন কোন জানোয়ার এবং কত সংখ্যায় প্রবেশ করতে পারে, তা ইচ্ছে করলেই রামধানিয়াকে শুধানো যেত। কিন্তু প্রথম দিনেই ‘কোলকাতিয়া বাবুর’ স্বরূপ উদঘাটিত যাতে না হয়, সেই চেষ্টায় আপ্রাণ সতর্ক হলাম।

দুই

জুম্মান সত্যিই রাঁধে ভাল। এরকম জায়গায় খাওয়াটাকেই হয়তো হোলটাইম অকুপেশন করতে হবে। অতএব একজন যোগ্য বাবুর্চির প্রয়োজন নিতান্তই।

খাওয়া-দাওয়ার পর আমার ইমিডিয়েট বস্—ঘোষদার কথা মতো একটু গড়িয়েই নিলাম। তারপর রোদের তেজ পড়লে, পায়চারি করলাম বেশ কিছুক্ষণ।

বাংলোর হাতা থেকে দূরে পাহাড়ের নীচে একটি শঙ্খিনী নদী চোখে পড়ে। ঘন জঙ্গলের মাঝে এঁকেবেঁকে চলে গেছে শুকনো সাদা মসৃণ বালির রেখা। এতদূর থেকে জল আছে কি নেই বোঝা যায় না।

রামধানিয়া বললে, নদীর নাম ‘সুহাগী’, আরও এগিয়ে গিয়ে নাকি কোয়েল নদীতে মিশেছে। গ্রীষ্মের জঙ্গলের লাল, হলদে ও সবুজ চঞ্চল প্রাণ-প্রাচুর্যের মাঝে ওই ছোট নদীর শান্ত সমাহিত নিরুদ্বেগ শ্বেতসত্তাটি ভারী ভাল লেগেছিল। কিন্তু এই আসন্ন সন্ধ্যায় একা-একা ওই অতটা পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে নদীতে পৌঁছই, সে সাহস আমার ছিল না।

আলো যত পড়ে আসতে লাগল, ততই যেন সমস্ত বন পাহাড় বিচিত্র শব্দে কল-কাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠল। কতরকম পাখির ডাক। অতটুকু-টুকু পাখি যে অত জোরে জোরে ডাকতে পারে, এখানে না এলে বোধ হয় জানতে পেতাম না। সব স্বর ছাপিয়ে একটি তীক্ষ্ণ স্বর কেঁয়া কেঁয়া করে একেবারে বুকের মধ্যিখান অবধি এসে পৌঁছচ্ছে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে, কী এক আর্তি যেন বনের বুক চিরে শেষ বিকেলের বিষণ্ণ আলোয় ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

রামধানিয়াকে শুধোলাম, ও কীসের ডাক? কোনও পাখির ডাক নিশ্চয়ই নয়। রামধানিয়া হেসে বললে, উ মোর হ্যায়, ঔর ক্যা বা। ‘মোর’ অথবা মেঞ্জুর, মানে ময়ূর।

রামধানিয়া বলল, মোর কাফি হ্যায় হিঁয়া সাব। ‘ঝুন্ডকে ঝুন্ড’ মানে দলে দলে; শিখলাম। ভাষাটাও একটা খুব কম বিপত্তির নয়। একসঙ্গে এতগুলো বাধা অতিক্রম করতে হলে মহাবীরের প্রয়োজন। আমার মতো পঙ্গুর অসাধ্য কাজ।

পৃথিবীতে যে এত পাখি আছে, আদিগন্ত এই বনে আসন্ন সন্ধ্যায় কান পেতে না শুনলে বোধ হয় জানতে পেতাম না।

অন্ধকার নেমে আসতে না আসতে ভয় ভয় করতে লাগল খুব।

বিজলি বাতি নেই। কবে হবে তারও ঠিক-ঠিকানা নেই। আগামী পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে হবে বলে মনেও হয় না। ঘরে ঘরে হ্যারিকেন জ্বলে উঠল। রামধানিয়া বাইরের বারান্দায়ও একটি রেখে গেল। বললাম, বাইরেরটা নিয়ে যাও।

আকাশে চাঁদ ছিল। আজই বোধ হয় পূর্ণিমা। একটি হলুদ থালার মতো চাঁদ পাহাড়ের মাথা বেয়ে পত্রবিরল শাল বনের পটভূমিতে গ্রীষ্ম-সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে আকাশ বেয়ে উঠতে লাগল। নীল, নীল, নীল আকাশে। আর সেই ঘন নীলে তার হলুদ রঙ ঝরে গিয়ে অকলঙ্ক সাদা হল। সমস্ত জঙ্গল পাহাড় হাসতে লাগল। সেই হাসিতে একটি খেয়ালি হাওয়া ঝুরু ঝুরু করে শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে নাচতে লাগল। চাঁদনী রাতে জঙ্গল পাহাড় সুহাগী নদী, প্রত্যেকে এমন এক মোহময়ী রূপ নিল যে, মনে হল এরা সেই দিনের আলোর জঙ্গল-পাহাড় কি নদী নয়। এরা নতুন কেউ।

জানি না, সকলের হয় কি না। আমার সেই প্রথম রাতে নতুন জায়গায় একটুও ঘুম এল না। যদিও পাহাড়ের উপর গরম তেমন কিছুই নেই, তবু জানালা বন্ধ করে ঘুমোনো গেল না। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর যখন শুলাম, তখন নিজেকে সত্যিই বড় অসহায় বলে মনে হতে লাগল।

সভ্যতা থেকে কতদূরে কোন নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের চুড়োয় শুয়ে আছি। জানালা বেয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরময় লুটোপুটি করছে। একটি বোগোনভেলিয়ার লতা জানালার পাশ বেয়ে ছাদে লতিয়ে উঠছে। রাতের হাওয়ার দমকে দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে লতাটা। ছায়াটা কেঁপে যাচ্ছে আমার ঘরময়। বাইরের জঙ্গলে অনেক রকম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নিশ্চয়ই নিশাচর জানোয়ারদের। কোনটা কোন জানোয়ারের আওয়াজ জানি না। সমস্ত শব্দ মিলে সেই পূর্ণিমা রাতের রুপোলি শব্দ-সমষ্টি মাথার মধ্যে ঝুম্‌ঝুম্ করছে। ঘরে শুয়ে শুয়েই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছি। অথচ বাইরের সুন্দরী প্রকৃতিতে এখন কারা চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে, তাদের সম্বন্ধে কৌতূহলও যে কম হচ্ছে, তা নয়। এ এক অভূতপূর্ব ভয়-মিশ্রিত কৌতূহল।

সারারাত এপাশ-ওপাশ করে বোধহয় শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে থাকব।

দরজায় ধাক্কা পড়তে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম, আমার ঘর শিশু-সূর্যের কোমল আলোয় ভরে গেছে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জানালা দিয়ে কোনও জানোয়ারই ঘরে প্রবেশ করেনি রাতে।

রামধানিয়া দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। দরজা খুলতেই বলল, রেঞ্জার সাহাব আয়া।

তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে পায়জামার ওপর পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে বাইরে এলাম। বাইরে এসে কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না। দেখলাম, একটি কুচকুচে কালো ঘোড়া কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আমার দিকে সপ্রতিভ চোখে তাকিয়ে আছে। ঘোড়াটার গা দিয়ে কালো সাটিনের জেল্লা বেরোচ্ছে।

এদিক-ওদিক চাইতেই দেখি, উঠোনের দিক থেকে একজন কালো, দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে সুপুরুষ এ-দেশীয় ভদ্রলোক আসছেন। তাঁর পেছনে পেছনে রামধানিয়া একটি ভাঙা ঝুড়িতে বিস্তর সাদায়-হলুদ মেশানো টোপা টোপা ফল নিয়ে আসছে।

ভদ্রলোক কাছে আসতে নিজেই হাত তুলে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, নমস্কার। প্রতিনমস্কার জানালাম।

দেখলাম, রামধানিয়া ওই ঝুড়িভর্তি ফল ঘোড়াটার মুখের সামনে ঢেলে দিল। আর ঘোড়াটা তখনই সেগুলো পরমানন্দে চিবোতে লাগল।

আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক এবার বেশ পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ওগুলো কী ফল জানেন?

নেতিবাচক ঘাড় নাড়লাম।

উনি বললেন, মহুয়া। উঠোনে যে বড় গাছটা আছে, সেটার ফল। আমি বললাম, গাছটা দেখে সেরকম অনুমান করেছিলাম বটে। আগে তো দেখিনি কোনওদিন। ফলও চিনতাম না।

ভদ্রলোক হো হো করে হাসতে লাগলেন। বললেন, স্যান্ডারসন কোম্পানির ফরেস্ট অফিসার মহুয়া চেনেন না। অজীব বাত।

কথাটায় বেশ অপ্রতিভ হলাম।

উনি বললেন, এই মহুয়াই এখানকার লোকের ধমনী বেয়ে চলে। কেন? কাল রাতে এর বাস পাননি? সারারাত হাওয়ায় যে মিষ্টি মাতাল করা গন্ধ পেয়েছেন, তা এই মহুয়ার। সারা জঙ্গল গরমের দিনে ম’ ম’ করে মহুয়ার গন্ধে। এ বড়া কিম্‌তি জিনিস। গরুকে খাওয়ান, গরু বেগে দুধ দেবে। ঘোড়াকে খাওয়ান, ঘোড়া তেড়ে ছুটবে। মহুয়ার মদ তৈরি করে মানুষকে খাওয়ান, দেখবেন ঝেড়ে ঘুমোচ্ছে। আরও গুণ আছে, ঘোড়া থেকে নামতে গিয়ে গোড়ালি মচকে গেল, তো শুখা-মহুয়া গরম করে সেঁক দিন, ব্যস সঙ্গে সঙ্গে ঠিক।

বললাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প হয় নাকি। আসুন, বসুন। উনি অবাক গলায় বললেন, একি আপনার কলকাতা নাকি মশায়, যে মিঠি-মিঠি কথা বলে চলে যাব? অনেক মাইল ঘোড়া চেপে এসেছি। সেই সূর্যোদয়ের আগে উঠেছি ঘোড়ায় এখানে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে রওনা হয়ে রাতে গিয়ে পৌঁছব।

উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, বা বা তবে তো ভালই। চমৎকার হল। ভেরি কাইন্ড অফ য়্যু।

ভেরি কাইন্ড অফ য়্যু। কথাটায় উনি আমার দিকে এমন করে কটমটিয়ে তাকালেন যে বুঝতে তিলমাত্র কষ্ট হল না যে এই জঙ্গলে ওই সব মেকি ভদ্রতা অনেক দিন আগেই তামাদি হয়ে গেছে। এখানে মানুষ মানুষকে আন্তরিকতায় আপ্যায়িত করে। তোতাপাখির মতো কতগুলো বাঁধা গৎ আউড়ে নয়।

কথা ঘুরিয়ে বললাম, যাই বলুন, বাংলাটা কিন্তু আপনি চমৎকার বলেন।

যশোয়ন্তবাবু কিঞ্চিৎ ব্যথিত এবং অত্যন্ত অবাক হয়ে বললেন, আজ্ঞে? আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। তারপর বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, আমি তো বাঙালিই হচ্ছি।

বিস্ময়ের শেষ রইল না। প্রায় ঢোঁক গিলে বললাম, তা হলে আপনি বাঙালিই হচ্ছেন? কিন্তু যশোয়ন্ত নামটা তো ঠিক…

উনি হেসে বললেন, আরে তাতে কী হল? আমরা চার পুরুষ ধরে বিহারে। হাজারিবাগের বাসিন্দা। আমার নাম যশোয়ন্ত বোস। আমার বাবার নাম নরসিং বোস। আমার মার নাম ফুলকুমারী বোস। মামাবাড়ি পূর্ণিয়া জেলায়। আমার মামারাও প্রায় তিন-চার পুরুষ হল পূর্ণিয়ায়। নাম যাই হোক আমাদের, আমরা বাঙালিই হচ্ছি।

আমি বললাম, তা তো নিশ্চয়ই। বাঙালি তো হচ্ছেনই।

যশোয়ন্তবাবু বললেন, ঘোষসাহেব আমাকে জানালেন আপনার কথা। বললেন খুব বড়া খানদানের ছেলে, অবস্থা বিপাকে বহত পড়ে-লিখে হয়েও এই জঙ্গলের কাজ নিয়ে এসেছেন, অথচ জঙ্গলের জানেন না কিছুই। তাই ভাবলাম, আপনাকে একটি তালিম দিয়ে যাই।

তারপর একটু চুপ করে থেকেই বললেন, এখানে কোনও রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। আমরা সকলে সকলের রিস্তাদার। একজন অন্যজনের জন্যে জান কবুল করতেও কখনও হটে না। আও দোস্ত, হাত্‌সে হাত মিলাও।

যশোয়ন্ত আমার হাতটি চেপে ধরলেন আন্তরিকতার সঙ্গে। যদিও একটু ঘাবড়ে গেলাম, তবুও বললাম, ভালই হল। খুব ভাল হল। একেবারে একা-একা যে কী করে এখানে দিন কাটাতাম জানি না।

যশোয়ন্তবাবুর অদ্ভুত সহজ স্বভাবের গুণে অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে এলাম। অবশ্য পাঁচ মিনিটের মধ্যে সদ্য-পরিচিত কাউকে ‘তুমি’ বলা যায়, এ একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। যদি কেউ কোনওদিন যশোয়ন্তকে দেখে থাকেন, তবে একমাত্র তিনিই এ কথা অবলীলায় বিশ্বাস করবেন।

রামধানিয়া চা নিয়ে এল, চেরি গাছের তলায়। চিড়ে ভাজা আর চা।

ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। একজোড়া বুলবুলি পাখি এসে চেরি গাছের পাতার আড়ালে বসে শিস দিচ্ছে। উপরে তাকালে দেখা যায়, শুধু নীল আর নীল। আশ্চর্য শান্তি।

পাহাড়ের নীচের গ্রামের ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। গ্রামের নামও সুহাগী; নদীর নামে নাম। ঘন জঙ্গলের আস্তরণ ভেদ করে ধোঁয়া উঠছে এঁকেবেঁকে। পেঁজা তুলোর মতো। আকাশের দিকে।

পোষা মুরগির ডাক, ছাগলের ‘ব্যা’ ‘ব্যা’ রব, মোষের গলার ঘণ্টা। কাঠ-কাটার আওয়াজ, এবং ইতস্তত নারীকণ্ঠের তর্জন ভেসে আসছে হাওয়ায়। বেশ ভাল লাগছে। আমিও একেবারে একা নই। অনেক লোকই তো আশেপাশে। বেশ সপ্রাণ, সরব জীবন্ত সকাল। বেশ ভালই লাগছে, রাতের ভয়টা কেটে গিয়ে।

যশোয়ন্ত বলল যে, আমার কাজ এমন কিছু নয়। কাগজ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার আছেন। সেই ঠিকাদারেরা লরিবোঝাই বাঁশ কেটে কেটে বিভিন্ন স্টেশনে পাঠাবেন, সেইসব বাঁশ ঠিক সাইজমতো হচ্ছে কি না, সময়মতো পাঠানো হচ্ছে কি না, এইসব কাজ তদারকি করা। যশোয়ন্ত এখানকারই ফরেস্ট রেঞ্জার, ওর কাজ, যাতে বনবিভাগের কোনও ক্ষতি না হয়, বনবিভাগের প্রাপ্য পাওনা ঠিকমতো আদায় হচ্ছে কি হচ্ছে না, ইত্যাদি দেখা। আমার কাজ কঠিনও নয়, আহামরি আরামেরও কিছু নয়। মাঝে মাঝে জিপ নিয়ে ‘কুপে’ ‘কুপে’ ঘুরে আসা। যতদিন নিজের জিপ না আসে, ততদিন একটু কষ্ট। তাও রোজ যাবার দরকার নেই।

শুধোলাম, হেঁটে হেঁটে জঙ্গলে যেতে হবে; কিন্তু জংলি জানোয়ারের ভয় নেই তো?

যশোয়ন্ত বলল, জানোয়ারের ভয় মানুষের কিছুই নেই। মানে, থাকা উচিত নয়। মানুষের ভয় মানুষেরই কাছ থেকে। তবে, প্রথম প্রথম একটু সাবধানে থাকা ভাল এবং থেকোও। তবে ভয়ের কিছু নেই। তা ছাড়া ভয় কেটে যাবে। যারা জঙ্গল, বন, পাহাড়কে জানে না, তারাই ভয় করে মরে। একবার চিনতে পারলে, ভালবাসতে পারলে, তখন আর জঙ্গল পাহাড় ছেড়ে যেতে মন চাইবে না। তা ছাড়া আমি তোমাকে শিকার করতে শিখিয়ে দেব। হাতে একটা বন্দুক নিয়ে বন-পাহাড় চষে বেড়াবে, দেখবে, দিল খুশ্ হয়ে যাবে। সাচ্ মুচ্, দিল্ বড়া খুশ্ হো যায়গা।

কী কথা বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, ওই যে নীচে সুহাগী নদী দেখা যাচ্ছে ওতে জল আছে এখন?

যশোয়ন্ত বলল, জল আছে বইকী, চিরচির করে বইছে এখন, তবে যখন গরম আরও জোর পড়বে তখন উপরে জল আর যাবে না। তখন নদী অন্তঃসলিলা হবে। খুঁড়লে পাওয়া যাবে, কিন্তু বাইরে দেখে বুঝতে পারবে না, যে জল আছে।

বললাম, কালকে রাতে চাঁদ উঠেছিল যখন, তখন নদীটাকে দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। কত নাম না-জানা পাখি ডাকছিল রাতের জঙ্গল থেকে। একটু ভয় করছিল যদিও, কিন্তু বেশ ভাল লাগছিল।

লাগবে, ভাল লাগবে বইকী। নইলে কি আর পড়ে আছি এখানে! সময়মতো প্রমোশন হলে আমি এতদিনে ডিভিশন্যাল ফরেস্ট অফিসার হয়ে যেতাম। কিন্তু আমার স্বভাব এবং আমার এই পালামৌ প্রীতি, এই দুইয়ে মিলে হয় ‘গারু’ নয় ‘লাত্’, হয় ‘চাহাল চুঙরু’ কিংবা ‘বেত্‌লা’, এইখানেই বেঁধে রেখেছে। এ শালি যাদু জানে। তারপর বলল, যাবে নাকি নদীটা দেখতে? চল ঘুরে আসি।

বাংলো থেকে পাকদণ্ডী রাস্তা বেয়ে নামতে নামতে ভাবছিলাম। যশোয়ন্ত ছেলেটার মধ্যে বেশ একটা ‘ক্রুডনেস’ আছে, যা তার চলনে-বলনে, ভাবভঙ্গিতে সব সময় ফুটে ওঠে, যা এই জঙ্গল পাহাড়ের নগ্ন পরিপ্রেক্ষিতে একটি আঙ্গিক বিশেষ বলে মনে হয়।

যশোয়ন্ত শুধাল, এটা কী গাছ, জানো? বললাম, জানি না। অর্জুন গাছ। এ জঙ্গলে ‘অর্জুন’ এবং ‘শিশু’ প্রচুর আছে। তা ছাড়া আছে শাল। সবচেয়ে বেশি। শালকে এখানকার লোকেরা বলে ‘শাকুয়া’। তা ছাড়া আরও অনেক গাছ আছে। কেঁদ, পিয়ার, আসন, পন্নান, পুঁইসার, গমহার, সাগুয়ান ইত্যাদি এবং নানা রকমের বাঁশ। সকলের নাম কি আমিই জানি? ঝোপের মধ্যে পুটুস, কুল, কেলাউন্দা এবং অন্যান্য নানা কাঁটা গাছ। ফুলের মধ্যে আছে ফুলদাওয়াই, জীরহুল, মনরঙ্গোলি, পিলাবিবি, করৌঞ্জ, সফেদিয়া এবং আরও কত কী। কত যে ফুল ফোটে, তোমাকে কী বলব; আর কী যে মিষ্টি মিষ্টি রঙ। তাদের কী যে গন্ধ। এ জঙ্গলে হরবখত্ যে হাওয়া বয়, তা হামেশা খুশবুতে ভারী হয়ে থাকে। অথচ সে খুশ্‌বু একটা বিশেষ কোনও ফুলের খুশ্‌বু নয়। অনেক ফুল, অনেক লতা, অনেক পাতার ঈত্বরদানী। কিছুদিন থাকো, তখন আপনিই হাওয়া নাকে এলে বুঝতে পারবে, কোন ফুলের বা ফলের খুশ্‌বুতে ভারী হয়ে আছে হাওয়া।

আমরা বেশ খাড়া নামছি। এঁকেবেঁকে পাথরের পর পাথরের উপর দিয়ে ঘন জঙ্গলের ছায়ানিবিড় সুবাসিত পথে আমরা নেমে চলেছি। পথের দুধারে ছোট ছোট লঙ্কার মতো কী কতগুলো গাঢ় লাল ফুল ফুটেছে। এমন লাল যে মাথার মধ্যে আঘাত করে। ঝন্ঝন্ করে স্নায়ুগুলো সব বেজে ওঠে। যশোয়ন্তকে শুধোতে বললে, এইগুলোই তো ফুলদাওয়াই। আর ওই যে, ফিকে বেগনি রঙের ফুলগুলো দেখছ, ওই ডানদিকে, ওগুলোর নাম ‘জীরহুল’। এই গরমেই ওদের ফোটা শুরু হল। গরম যত জোর পড়বে ওরা তত বেশি ফুটবে। ওদের রঙে তত চেক্‌নাই লাগবে।

ভাল করে দেখলাম বেগুনি ফুলগুলোকে। ছোট ছোট ঝোপ, ফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে, যেন গান গাইছে, যেন খুশি ভীষণ খুশি। রঙটা ঠিক বেগুনি বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না, কিশোরীর মিষ্টি স্বপ্নের মতো রং, যে স্বপ্ন আচমকা ভেঙে যায়নি।

সুহাগী নদীতে পৌঁছতে পাকদণ্ডী বেয়ে বাংলো থেকে নামতে মিনিট কুড়ি লাগে। পৌঁছেই চোখ জুড়াল।

কী সুন্দর নদী। ইউক্যালিপটাস গাছের গায়ের মতো মসৃণ, নরম, পেলব, সুন্দর বালি। মধ্যে দিয়ে পাথরে পাথরে কলকল করে কথা কইতে কইতে একটি পাঁচ বছরের শিশুর মতো ছুটে চলেছে ‘সুহাগী’। কারও কথা শুনে ঘর থেকে বেরোয়নি, কারও কথায় থামবেও না ঠিক করেছে।

জলধারা যেখানে সবচেয়ে চওড়া, এখন সেখানে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ গজ হবে। একটি প্রকাণ্ড সেগুন গাছের তলায় একটি বড় কালো পাথরের স্তৃপ। চমৎকার বসবার জায়গা। ছায়াশীতল, উঁচু, সেখান থেকে বসে নদীটিকে বাঁক নিতে দেখা যায়। দুপাশে গভীর জঙ্গল। নদী চলেছে তার মাঝ দিয়ে। পাথরের উপরে ইতস্তত শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে।…হাওয়ায় হাওয়ায় মচমচানি তুলে এপাশে-ওপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

যশোয়ন্ত বললে, এই পাথরে বসে আমি অনেক জানোয়ার শিকার করেছি।

সুহাগী থেকে ফিরে এসে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যেখানে কাজ হচ্ছে, সেখানে নিয়ে গেল যশোয়ন্ত আমাকে।

অনেকখানি বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বাঁশ কাটা হচ্ছে। ছোট ছোট বাঁশ, সরু সরুও বটে। এক ধরনের মোটা বাঁশও আছে। তবে খুবই কম। সে বাঁশ নাকি কাগজ বানাতে প্রয়োজন হয় না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খাকি-জামা পরা লোকজন মার্কা করার হাতুড়ি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন কন্ট্রাকটরের জঙ্গল আজ মার্কা হচ্ছে। কাঠের জঙ্গল।

যশোয়ন্ত নানারকম বাঁশের নাম শেখাচ্ছিল। ব্যাম্বুসা-রোবাস্টা, ব্যাম্বুসা-আরডেন্‌সিয়া, ড্যান্ড্রোক্যালামাস্-স্ট্রিকটাস্ ইত্যাদি। ড্যান্ড্রোক্যালামাস্-স্ট্রিকটাস্ই বেশি। মোটা বাঁশ এখানে খুব কম।

বাঁশ কাটার সময় ঠিকাদারের লোকজনই সব করে, তারাই তাদের নিজেদের গরজে তদারকি করে। সত্যি কথা বলতে কী তেমন কোনও কঠিন কাজই নেই। তবে যখন কোনও নতুন জঙ্গলে কাজ আরম্ভ হবে, সেই সময় আমার এবং যশোয়ন্তের প্রথম প্রথম কিছুদিন রোজ যেতে হবে; নইলে বাঁশের জঙ্গল ঠিকমতো কাটা হচ্ছে কি না, ঠিক মাপের বাঁশ, ঠিক বয়সের বাঁশঝাড় নির্ধারিত হল কি না, এসব দেখাশোনা করা যাবে না।

এখানকার সবচেয়ে বড় ঠিকাদার মালদেও তেওয়ারী। খুব নাকি ভাল লোক। সমস্ত জঙ্গলে প্রচুর লরি এবং অনেক লোক খাটছে। গরমের সময় কাজ খুব, কারণ বর্ষাকালটা কাজ বন্ধ থাকবে, জঙ্গলে রাস্তাঘাট অগম্য হয়ে উঠবে। নদীনালা ভরে যাবে। পাহাড়ি নদীর উপর বসানো কজ্ওয়েগুলোর উপর দিয়ে জল বয়ে যাবে। তখন কাজ অসম্ভব।

মালদেও বাবুর ছেলে রামদেও তেওয়ারী, এখানে সেদিন কাজ দেখতে এসেছিল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স হবে ছেলেটিরও। পায়জামা পরা, বেশ শৌখিন। করিৎকর্মা, প্র্যাক্‌টিক্যাল মানুষ। অল্পবয়সে মনে হয় কাজটা ভাল রপ্ত করেছে। কীসে দু’ পয়সা আসবে, তা জেনেছে।

জঙ্গল থেকে ফিরে সন্ধে হবার পর যশোয়ন্ত ঘোড়ায় চেপে বসল। যতবার বললাম, কী দরকার রাত করে এতটা পথ ঘোড়ায় চেপে গিয়ে? বিকেল বিকেল বেরিয়ে বেলা থাকতে পৌঁছে গেলেন না কেন? ততবারই ও বলল, মাথা খারাপ! এ গরমে কে যাবে? আর রাতেই তো মজা। চাঁদনি রাতে পাহাড় জঙ্গলে বেড়িয়ে বেড়ানোর মতো মজা আছে?

আমি বললাম, কীসের মজা! বলছেন হাতি আছে, বাইসন আছে, বাঘ আছে, জংলি মোষ আছে। যে কোনও মুহূর্তে তারা সামনে পড়তে পারে। আর আপনি বলছেন মজা আছে। এতে মজাটা কীসের?

যশোয়ন্ত বলল, মজাটা কীসের অতশত ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না, তবে এককথায় বলতে পারি, দিল খুশ হো যাতা হ্যায়।

কথা ক’টি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সেই চাঁদের আলোয় মোহময় অপার্থিবতায় সেই রহস্যময় রাতে, আলো-ছায়ায় ভরা পাহাড়ি পথে যশোয়ন্ত টগবগ টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল ওর বাংলোয়—‘নইহারে।’

তিন

সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই দরজা জানালা বন্ধ। বাইরে লু’ বইছে। ঝড়ের মতো আওয়াজ, হলুদ বনে বনে একটা অভিমানের মতো রুক্ষ, প্রচণ্ড হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্ত প্রকৃতি থেকে একটা ঝাঁজ বেরোচ্ছে। তীব্র, তীক্ষ্ণ ঝাঁজ। সুন্দরী যুবতীর সৌন্দর্যের গর্বের মতো। অসহ্য।

জুম্মানকে বর্ধমানের কোনও এক লোক নাকি কবে শিখিয়েছিলেন যে, গরমকালে কলাইয়ের ডাল, পোস্তর তরকারি এবং খেঁড়ো খেলে শরীর ভাল থাকে। তার সঙ্গে কাঁচা আম বাটা নয়তো পাতলা করে ঝোল। অতএব যত গরম পড়ছে, আমার শরীর ততই স্নিগ্ধ হচ্ছে। কিন্তু মন যেন ততই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। শুধু কলাইয়ের ডাল আর খেঁড়ো খেয়ে কতদিন কাটানো যায়?

কাজ যা সব ভোরে ভোরে। দশটার মধ্যে। খুব ভোরে উঠছি। কলকাতায় কোনও দিন ভাবতেও পারিনি যে, এত ভোরে আমি নিয়মিত উঠতে পারব। অবশ্য রাতে শুতেও বেশি দেরি হয় না। ভোরে পাখি ডাকাডাকি করার আগেই উঠি। তখনও শুকতারা দেখা যায়। দিগন্তের কাছে রুমান্ডি পাহাড়ের মাথায় সবুজ সত্তায় দপদপ করে। শুক্লপক্ষ হলে, ভোরে উঠে চাঁদটাকেও দেখা যায়। সারারাত অত বড় নীল আকাশে সাঁতার কেটে চাঁদ ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমোবে সেই আশায় স্থির হয়ে থাকে দিগন্তরেখার উপরে।

হাত-মুখ ধুয়ে বাংলোর হাতায় পায়চারি করি। কোনও কোনও দিন ইজিচেয়ারে বসে চুপ করে ভাবি।

এই সময়টা বোধহয় ভাববারই সময়। নিবিষ্ট মনে কোনও বিশিষ্ট চিন্তাকে বা কোনও বিশেষ জনকে ভাববার সময়। ভাবতে ভাবতে, পায়চারি করতে করতে সূর্যটাকে পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখি।

সমস্ত জঙ্গল পাখিদের কলকাকলিতে ভরে যায়। টিয়ার ঝাঁক ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। ময়ূর ডাকে। তিতিরগুলো র্টিঁহা র্টিঁহা টিঁহা করতে থাকে চারিদিক থেকে। তা ছাড়া কত অনামা পাখি, কত অচেনা সুর।

অনেকদিন সূর্য ওঠবার আগেই চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। সঙ্গে ‘টাবড়’ থাকে। আমার মুনশি; হেল্পার। কোম্পানিরই লোক। অনেকদিনের পুরনো ও অভিজ্ঞ। ওর বাস নীচের গ্রাম সুহাগীতে। টাবড়ের চেহারা কিছু লম্বা চওড়া নয়। বেঁটে-খাটোই। কিন্তু দেখলেই মনে হয় শক্তিতে ভরপুর। মাথার চুলগুলো পেকে সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু মুখের কি শরীরের অন্য কোনও পেশীতে একটুও টান ধরেনি। মালকোঁচা বাঁধা কাপড়, কাঁধের ওপর শুইয়ে রাখা চকচকে ধারালো টাঙ্গি।

পাকদণ্ডী পথ বেয়ে সুগন্ধি বনে বনে তিন মাইল চার মাইল হেঁটে যেতে কিছু মনেই হয় না। বুঝতেই পারি না।

যেখানে ‘কুপ’ কাটা হচ্ছে, সেখানে পৌঁছই।

ওঁরাও, খাঁরওয়ার, চেরো, সমস্ত কুলিই টাঙ্গি হাতে সেখানে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে ততক্ষণে। তাদের টাঙ্গি চালানোর ঠকাঠক শব্দ, কাজ করতে করতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলায়, সারা জঙ্গল গম-গম করত। তেওয়ারীবাবুদের কর্মচারি রমেনবাবু কাজ দেখাশোনা করতেন। আমরা দু’জন ঘুরে ঘুরে কাজ দেখতাম। টাবড় ঘুরে ঘুরে সর্দারি করত। গরম এখন খুব বেশি, তাই কাজ যা হবার তা সকালে এবং শেষ-বিকেলে হত।

ইতিমধ্যে কয়েকবার ঘোষদা আর তাঁর স্ত্রী সুমিতা বউদি এসেছিলেন, আমি কেমন আছি সেই খোঁজখবর নিতে। ঘোষদার সঙ্গে সুমিতা বউদিকে মোটেই মানায় না। বেমানানের কোনও সঙ্গত কারণ আছে বলে জানা নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, মানায় না। দু’জনের সম্পর্কের মাঝে কেমন যেন একটা অদৃশ্য বিপরীতমুখী ভাব বর্তমান; সেটা প্রমাণ করা মুশকিল, কিন্তু বোঝা আদৌ অসুবিধা নয়।

ঘোষদা খুব কৃপণ গোছের, হিসেবী, পান-খাওয়া মানুষ। একটি ভাল চাকরি আর সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে জীবনে আরও যে কিছু চাইবার আছে বা ছিল, সে-কথা বে-মালুম ভুলে গেছেন। এবং কখনও অন্য কেউ মনে করিয়ে দিলে কিংবা অন্য কোনও প্রসঙ্গে সেই বিষয় উঠলে তিনি ব্যথা পান না; বিব্রত হন না; ক্রুদ্ধ হন না। একটু ভিতু ভিতু, আমুদে; অতি সাধারণ একজন কৃতী এবং গৃহী মানুষ।

সুমিতা বউদি একেবারে উল্টো। রীতিমতো অসাধারণ। ভাল গান গাইতে পারেন, ক্ল্যাসিকাল। ছবিও আঁকেন অদ্ভুত সুন্দর। ওঁর চেহারায় এমন একটি বুদ্ধিমত্তার প্রসাধন, এমন একটি নারীসুলভ সৌকুমার্য ও অবলা ভাব যে তা গুছিয়ে বলা যায় না। মানে ওঁর কথায়, চোখের তারায়, ওঁর ব্যবহারে, এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, যে, ওঁর চেয়ে বেশি নারীত্ব আমি এর আগে আর কোনও নারীতে দেখিনি।

আমি নিজেকে শুধিয়েছি। বারবার শুধিয়েছি। জঙ্গলে পাহাড়ে আছি এবং সে কারণে ভদ্রমহিলাদের মুখ না দেখার দরুন বাঁশবনে শেয়াল-রানির মতো সুমিতা বউদিকেও বোধহয় সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বলে ভ্রম করছি। কিন্তু এ সুন্দরী-অসুন্দরীর কথা নয়। সুমিতা বউদির মতো কমনীয়ভাবে হাসতে, কথা বলতে, এমনকী ঝগড়া করতেও আমি কোনওদিন কোনও মেয়েকে দেখিনি।

ভারী ভাল লাগত। এই নিয়ে সুমিতা বৌদি আর ঘোষদা প্রায় তিনবার এলেন। রুমান্ডিতে আমার খোঁজখবর নিতে। ছুটির দিনে সকালে জিপ নিয়ে চলে আসতেন। সারাদিন কাটিয়ে যেতেন। যেদিন ওঁরা আসতেন, ভারী ভাল কাটত দিনটা আমার। আমি যে এই রুমান্ডিতে পড়ে আছি তা মনেই হত না। ভাল ভাল বাঙালি-ফর্দের রান্না হত, আনন্দ করে খাওয়া হত। তারপর প্রচুর আড্ডা। মাঝে মাঝে যশোয়ন্ত আসত। কিন্তু বুঝতাম যে, ঘোষদা যশোয়ন্তকে বিশেষ পছন্দ করেন না। ঘোষদা-বৌদি যেদিন এখানে আসেন, সেদিন যে যশোয়ন্ত এখানে আসে, উনি বিশেষ চান না।

যশোয়ন্তের নামে দিনে দিনে অবশ্য অনেক কিছু শুনছি। অনেকের কাছে। যা সব শুনি, তার সব কথা ভাল নয়, এবং কিছু কিছু তো এত বেশি খারাপ যে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয় না।

এখানকার লোকেরা বলে যশোয়ন্ত পাঁড় মাতাল। খুনিও বটে। কত যে পুরুষ আর নারী ওর শিকার হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। অবশ্য এসব কথা যাচাই করে দেখার মতো সুযোগ আমার আসেনি। হয়তো-বা ইচ্ছেও নেই। কারণ যাদের কাছে এসব কথা শুনেছি তারা কিন্তু বলেনি যে, যশোয়ন্ত লোকটা খারাপ। ওদের মুখ দেখে যা বুঝেছি তা হচ্ছে, যশোয়ন্তবাবুর পক্ষে অসাধ্য কাজ কিছুই নেই। ওর পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব।

সুমিতা বউদি যে যশোয়ন্তকে তেমন অপছন্দ করেন, তা কিন্তু মনে হয় না। তিনি ঠিক আমার সঙ্গেও যতটুকু হেসে কথা বলেন, যশোয়ন্তের সঙ্গেও তেমনই। যশোয়ন্ত যে ভয় পাবার মতো কিছু, তা ওর মুখ-চোখ দেখলে মোটেই বোঝা যায় না। বরঞ্চ উনি যশোয়ন্তের সঙ্গে যশোয়ন্তের সর্বশেষ-মারা বাঘটার দৈর্ঘ্য নিয়ে আলোচনা করেন, যশোয়ন্তের হাজারিবাগ জেলায় এবার ফসল কেমন হল না হল, এই সব নিয়ে আলোচনা করেন।

যশোয়ন্তও বউদি বলতে পাগল। বউদির জন্যে জান কবুল করতে রাজি।

ও যে কার জন্যে জান না কবুল করে জানি না।

আজকে সুমিতা বউদি আর ঘোষদা প্রায় সূর্য ওঠার আগে-আগেই এসে হাজির।

বউদি বললেন, আজকে সুহাগীর চড়ায় আমরা পিকনিক করব। যশোয়ন্তও আসবে। খুব মজা হবে।

ঘোষদা বললেন, কিন্তু যশোয়ন্ত না আসা পর্যন্ত নদীতে যাওয়া হবে না। কোনও একটা আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া এই ভাবে ‘নেচার’ করার আমি ঘোরতর বিপক্ষে।

তখন ঠিক হল তাই হবে। এখানেই চা খেয়ে নেব সকালের মতো। তারপর যশোয়ন্ত এলে সকলে মিলে নীচে গিয়ে সুহাগীর বালিতে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় বসে ‘চড়ুইভাতি’ হবে।

বাংলোয় বসে রসিয়ে-রসিয়ে চা খাওয়া হল। যখন সূর্য বেশ উপরে উঠল, তখনও যশোয়ন্তের পাত্তা নেই। তখন সাব্যস্ত হল, রামধানিয়ার কাঁধে রসদ ও বাসনপত্র দিয়ে আমরা নেমেই যাই। যশোয়ন্ত এলে পাঠিয়ে দেবে জুম্মান।

ঘোষদার জিপে করে যাওয়া হল।

সুহাগী নদী সেই পাহাড়ি পথকে পায়ে মাড়িয়ে হাসতে হাসতে নিচু কজওয়ের নীচ দিয়ে কোয়েলের দিকে চলে গেছে। জিপ থামতেই চিঁহি চিহি আওয়াজ কানে এল। তাজ্জব বনে দেখলাম, যশোয়ন্তের ঘোড়া বাঁধা আছে একটা পলাশ গাছের সঙ্গে।

নদীরেখা ধরে এগোতেই দেখি, নদীর বাঁকে ওর সেই প্রিয় বড় ছায়াশীতল পাথরের পাশে উবু হয়ে বসে বড় বড় নুড়ি দিয়ে যশোয়ন্ত উনুন বানাচ্ছে। আমাদের সাড়া পেয়েই তেড়ে-ফুঁড়ে বলল, বেশ লোক যা হোক। প্রায় একটা ঘণ্টা হল এসে বসে আছি—না দানা, না পানি।

সুমিতা বউদি কলকল করে উঠলেন, বাজে বোকো না, তোমাকে কে সোজা এখানে আসতে বলেছিল? যা উনুন বানিয়েছে, তাতে তো বাঁদরের পিণ্ডিও রান্না হবে না। সরো, সরো দেখি, উনুনটা ধরাতে পারি কি না।

ঘোষদা শশব্যস্তে বললেন, কই? যশোয়ন্ত, তোমার বন্দুক কই? এইভাবে জঙ্গলে মেয়েছেলে নিয়ে আন-আর্মড অবস্থায় কখনও আসা উচিত নয়। বাঘ আছে, ভাল্লুক আছে, হাতি তো আছেই, তার উপর বাগেচম্পা থেকে মাঝে মাঝেই বাইসনের দল চলে আসে, বলা যায় কিছু?

যশোয়ন্ত চুপ করে কী ভাবল একটুক্ষণ, তারপর হেঁটে গিয়ে ওর ঘোড়ার জিনের সঙ্গে সমান্তরালে বাঁধা একটি কী যন্ত্র বের করে আনল। কাছে এসে গাছে ঠেস দিয়ে রেখে বলল, এই হল তো? এবার বাইসন এলেও মজা বুঝবে। এ বন্দুক নয়। ফোর-ফিফটি-ফোর হান্ড্রেড ডাবল-ব্যারেল রাইফেল।

বউদি কেটলিটা উনুনে চড়াতে চড়াতে বললেন, তার মানে? একসঙ্গে সাড়ে চারশো-পাঁচশো গুলি বেরোয়?

যশোয়ন্ত হতাশ হবার ভঙ্গিতে পাথরের উপর বসে পড়ে বলল, হোপলেস। সাচমুচ বউদি। হোপলেস। তারপর হাত নেড়ে বলল, চারশো-পাঁচশো গুলি বেরোয় না, এটা রাইফেলের ক্যালিবার।

বউদি ঘাড় ফিরিয়ে হাসলেন, বললেন, ওঃ তাই বলো। তা রাইফেলের মালিকের ক্যালিবার কত?

যশোয়ন্ত এবার হেসে ফেলে বলল, তার ক্যালিবার বুঝনেওয়ালা লোক আজ পর্যন্ত এই পালামৌর জঙ্গলে দেখলাম না একজনও। তাই সে আলোচনা করা বৃথা।

জুম্মানের কাছে শুনেছি, যশোয়ন্ত অত্যন্ত রইস আদমির ছেলে। ওদের ছোটখাটো জমিদারির মতো আছে সীমারিয়া আর টুটলাওয়ার মাঝামাঝি। মুখে ও যাই বলুক, বাংলাটা খুব ভাল বললেও, ওরা আসলে বিহারী হয়ে গেছে। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। ওদের জমিদারির মাসিক আয় নাকি প্রায় হাজার দুয়েক টাকা। অথচ এই অল্প টাকার মাইনেতে এই জঙ্গলে ও পড়ে আছে আজ কত বছর। এই কাজটা বোধহয় ওর পেশা নয়, নেশা। বেহেত্‌রীন শিকারি নাকি ও। সারা বছর এইখানেই পড়ে থাকে। বছরে কোনও এক সময় যায় বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে। বেশিদিন থাকে না, পাছে ধরে বিয়ে দিয়ে দেয়। যশোয়ন্ত প্রায়ই আমাকে বলে যে, বিয়ে করা পুরুষ মানুষ আর ভরপেট মহুয়া খাওয়া মাদী শম্বর নাকি সমগোত্রীয় চলচ্ছক্তিহীন জানোয়ার।

হঠাৎ ঘোষদা বললেন, এই গরমে যে কোনও ভদ্রলোক চড়ুইভাতি করে, এই প্রথম দেখলাম।

যশোয়ন্ত বলল, তাও যা বললেন ‘ভদ্রলোক’। মাঝে মাঝে এমনি বলবেন। নইলে আমরা যে ভদ্রলোক এ কথাটা এক আমরা এবং জঙ্গলের জানোয়ারেরা ছাড়া আর কেউ তো স্বীকার করে না। মাঝে মাঝে কথাটা শুনতে ভাল লাগে।

ঘোষদা উত্তরে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

বউদি ধমকে বলেন, তোমরা এখানে কী করতে এসেছ? চড়ুইভাতি করতে, না ঝগড়া করতে?

যশোয়ন্ত উল্টো ধমক দিয়ে বলল, দু’টোই করতে।

গরম যদিও আছে প্রচণ্ড। তবু কেন জানি…এ গরমে একটুও কষ্ট হয় না। কারণ এ গরমে ঘাম হয় না মোটে। শুকনো গরম খুব বেশি হলে মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে। তবে এই গরমে বেশি হাঁটা-চলা করলে লু লেগে যাবার সম্ভাবনা এবং তা থেকে অনেক সময় পঞ্চত্বপ্রাপ্তিও ঘটে। তবু কলকাতার ভ্যাপসা-পচা গরম থেকে এ গরম অনেক ভাল। মনে হয়, মনের মধ্যেও যতটুকু ভেজা স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকে, সেটাকে সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে দেয় নিশ্চিহ্ন করে। মনটা যেন তাজা, হালকা, সজীব সুগন্ধে ভরে ওঠে।

আর্দ্রতা যত কম থাকে মনে, ততই ভাল।

সুমিতা বউদি আমায় বললেন, কী হল, এমন গোমড়ামুখো কেন?

বললাম, ভাষাটা কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারছি না।

বউদি সপ্রতিভ গলায় হেসে বললেন, এ একটা সমস্যাই নয়। আগে একটি ‘কা’ পরে একটা ‘বা। তাহলেই ফিফটি পারসেন্ট হিন্দি-নবিশ হয়ে গেলে। বাদবাকি ফিফটি পারসেন্ট থাকতে থাকতে হবে। ভাষা এমনি শেখা যায় না। ভাষা শিখতে কান চাই। তোমার চারপাশে যত লোক কথা বলছে, তাদের উচ্চারণ, তাদের বাচনভঙ্গি এবং তারা কোন জিনিসটাকে কী বলে, কোনও অনুভূতি কীভাবে ব্যক্ত করে, এইটে বুদ্ধিমানের মতো নজর করলে যে কোনও ভাষা শেখাই সহজ।

যশোয়ন্ত বলে উঠল, জব্বর বলেছেন যা হোক। এই কারণে আমি মুরগি-তিতির আর শম্বরের ভাষা আয়ত্ত করেছি।

বউদি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আর ঘোড়ফরাসী ভাষা? সেটা আয়ত্ত করোনি?

দাঁতে একটা ঘাস কাটতে কাটতে দুষ্ট যশোয়ন্ত বলল, এ জঙ্গলে ঘোড়ফরাস বেশি নেই। তাই তাদের সঙ্গে কথোপকথন হয়নি।

বউদি পুরনো কথার সুতো ধরে বললেন, তবে যা বলছিলাম, পালামৌর হিন্দি শিখতে হলে ‘কা’ আর ‘বা’। প্রথমে এই দিয়েই আরম্ভ করতে হবে।

যশোয়ন্ত আমার দিকেই ফিরে বলল, তাহলে আরম্ভ হোক। বলো দেখি ভায়া, কী সুন্দর সূর্যোদয়। হিন্দিতে কী হবে? একটা ব্রেনওয়েভ এসে গেল, বললাল, কা বঁড়িয়া সনরাইজ বা।

বউদি, ঘোষদা আর যশোয়ন্ত একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, সাবাস, সাবাস। তোমার হবে।

দেখতে দেখতে দুপুর হল। আমরা খেতে বসেছি এমন সময় নদীর পাশ থেকে কী একটা জানোয়ার আমাদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়ে ডেকে উঠল। ডাকটা অনেক অ্যালসেসিয়ান কুকুরের ডাকের মতো। ঘোষদা চমকে বললেন, কী ও।

মিথ্যা কথা বলব না, আমিও ভয় পেয়েছিলাম।

যশোয়ন্ত হাসতে লাগল, বলল, কোটরা হরিণ, ঘোষদা। আমার ধারণা ছিল না যে এইদিন জঙ্গলে থেকেও আপনি কোটরার ডাক শোনেননি।

ঘোষদা সামলে নিয়ে বললেন, শুনব না কেন? না শোনার কী আছে? তবে খেতে বসার সময় এসব বিপত্তি আমার ভাল লাগে না।

আমি শুধোলাম, কোটরা কী? যশোয়ন্ত বলল, কোটরা এক রকমের হরিণ। ছাগলের মতো দেখতে। ছাগলের চেয়ে বড়ও হয়। ইংরাজিতে বলে Barking deer| অতটুকু জানোয়ার যে অত জোরে আর অত কর্কশ স্বরে ডাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জঙ্গলের মধ্যে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা, বাঘের চলা-ফেরার বা শিকারীর পদার্পণের খবর ইত্যাদি সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জঙ্গলে এরা জানান দিয়ে দেয়।

আমি শুধোলাম, এই জঙ্গলে কী কী জানোয়ার আছে?

যশোয়ন্ত বলল, অনেক রকম জানোয়ার আছে। সে সব কি মুখে বলে শেখানো যায়; সব ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। দাঁড়াও না। তোমাকে আমার চেলা বানাব।

ঘোষদা ধমক দিয়ে বললেন, থাক। তুমি নিজে ডাকাত। দয়া করে ওকে আর চেলা বানিও না। নিজে তো গোল্লায় গেছোই, এই ছেলেটিকে আর দলে টেনো না।

একথা শুনে যশোয়ন্ত হাসি হাসি মুখে ঘোষদার দিকে তাকাল। কথা বলল না।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এল; রোদের তেজ কমে গেল। হাওয়াতে মহুয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। সুহাগী নদীর শ্বেত বালুরেখায় দু-পাশের গাছের ছায়ারা দীর্ঘতর হয়ে এল।

বেশ কাটল দিনটা। এরকম সুন্দর শান্ত দিন সব সময় আসে না। এসব দিন মনে করে রাখবার মতো। অথচ কোনও বিরাট ঘটনা ঘটেনি। কোনও চিৎকৃত সভার আয়োজন হয়নি। তবু, মনে করে রাখবার মতো।

ঘোষদা ও সুমিতা বউদি আর বাংলো অবধি এলেন না। সোজা জিপে ডালটনগঞ্জের দিকে বেরিয়ে গেলেন। যশোয়ন্ত ওর ঘোড়ায় চেপে আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে বাংলোয় ফিরল।

সময় কেটে গেল কিছুটা। যশোয়ন্ত গিয়েছে চান করতে। আমি একা।

চান করে টাটকা হয়ে যশোয়ন্ত এসে বসল ইজিচেয়ারে, তারপর হাঁক ছাড়ল, এ রামধানিয়া, ঠাণ্ডাই লাও। অমনি রামধানিয়া যথারীতি সিদ্ধি, পেস্তা, বাদাম ও ভয়সা দুধ দিয়ে বানানো ঠাণ্ডাই শ্বেতপাথরের গেলাসে করে এনে দিল। যশোয়ন্ত খুব রসিয়ে খেল।

যশোয়ন্ত বলল, লালসাহেব, আজ ঘোষদা নে মুঝে বিলকুল খরাব বানা দিয়। মগর জানতে হো মির্জা গালীব নে কেয়া কহা থা?

কেন জানি না, আমার মনে হল আজ যশোয়ন্ত মেজাজে আছে। আজকে হয়তো ও নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে ফেলবে, যা ও অন্যদিন হয়তো কোনওক্রমে বলত না।

আমি ওকে খুঁচিয়ে দিয়ে বললাম, এমনি এমনি কেউ কাউকে খারাপ বলে না নিশ্চয়ই।

যশোয়ন্ত একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, দোষ-গুণ জানি না। আমি যা, আমি তা। লুকোচুরি আমি পছন্দ করি না। আমি যা, সেই আমাকে যদি কেউ ভালবাসে, কাছে ডাকে, তাকেই আমি দোস্ত বলি, অন্যকে বলি না, অন্যের মতামতের জন্যে আমি পরোয়াও করি না। আমি মদ খাই। কিন্তু আমি মাতাল নই।

যখন ইচ্ছে হয় খাই। কেউ আমাকে কখনও রাস্তায় মদ খেয়ে মাতলামি করতে দেখেনি। মদ খাওয়া ছাড়াও আমি এমন অনেক কিছু করি, যা শুনলে তোমাদের মতো ভাল ছেলেরা আঁতকে উঠবে।

আমি বললাম, কিন্তু যশোয়ন্ত, তোমার মতো ছেলে মদ খাবে কেন?

যশোয়ন্ত আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলল, তোমার মতো ছেলে বলছ কেন? আমি কি তোমাদের মতো মাখনবাবু নাকি? মদ খাই, খেতে ভাল লাগে বলে। দিল খুশ্ হো যাতা হ্যায়। তাই খাই।

কিন্তু তোমার কী এমন দুঃখ, যার জন্যে তোমাকে এমনভাবে নষ্ট হয়ে যেতে হবে?

যশোয়ন্ত খুব একচোট হাসল। কেঁপে-কেঁপে। তারপর বলল, যে সব লোক দুঃখ ভোলার দোহাই দিয়ে মদ খায়, সেগুলো মানুষ নয়। আমি মদ খাই কোনও দুঃখ ভোলার জন্যে নয়। কারণ কোনও দুঃখ আমার নেই। মদ খাই খেতে ভাল লাগে বলে। খেয়ে নেশা হয় বলে। কোনও শালার বাবার পয়সাই খাই না। নিজের পয়সায় খাই। খেতে ভাল লাগে বলে খাই। বেশ করি।

তারপর বুঝলে লালসাহেব, যেদিন ইচ্ছা হয় ‘লালতি’র কাছে যাই। আগে রুক্‌মানিয়ার কাছেও যেতাম। সে তো মরে যাবে শিগগির। সেও এক ইতিহাস। লালতির কাছে যাই, কিন্তু বিনি পয়সায় যাই না। বিস্তর পয়সা খরচ করতে হয়।

আমি বললাম, থাক, তোমার এই বীরত্বের কাহিনী আমায় আর নাই-বা শোনালে। অসুবিধা এই যে, তুমি যা বাহাদুরি বলে বিশ্বাস করেছ, তা থেকে তোমাকে নড়ানো আমার ক্ষমতার বাইরে। মনে হয়, চেষ্টা করাও বৃথা।

যশোয়ন্ত আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, চেষ্টা করো না লালসাহেব। আমাদের বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে আমি যা, আমাকে তাই থাকতে দিয়ো। যদি কোনও দিন নিজেকে বদলাই তো এমনিই বদলাব, নিজেকে বদলানো প্রয়োজন বলে বদলাব, নিজে যতদিন মন থেকেই সেই পরিবর্তন কামনা না করব, ততদিন পৃথিবীতে এমন কোনও শক্তি নেই, যা আমাকে বদলায়। তুমি বৃথা চেষ্টা কোরো না।

আমি বললাম, রুকমানিয়া না কার কথা বললে। ঘোষদার কাছে শুনেছি, তার জীবন নাকি ইতিহাস! বলো না যশোয়ন্ত, কী সে ইতিহাস। আর কে সে রুকমানিয়া?

সেই অন্ধকারে ওর তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে যশোয়ন্ত আমাকে নিঃশব্দে চিরে চিরে দেখল কিছুক্ষণ; তারপর হায়নার মতো বুক কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বলল, একেবারে, হুবহু।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, হুবহু?

হুবহু শহুরে লোক। কৌতূহলী, বিশেষ করে কোনও নিন্দার বিষয় হলে। পরনিন্দা আর পরচর্চা, এই তো করে, কী বলো? তোমার শহুরে লোকেরা?

তারপর নিজেই বলল, রুকমানিয়ার গল্প তুমি শুনতে চাও তো শোনাব। তবে সে আজ নয়। সময় লাগবে। অন্যদিন হবে। অনেক বড় গল্প। লালসাহেব, শুধু রুকমানিয়া কেন? এই যশোয়ন্তের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি গল্প আছে। এক-একটা দিনই এক-একটা গল্প।

আরও কিছুক্ষণ পর যশোয়ন্ত উঠল। বলল, অব্ চলো ইয়ার।

বললাম, এই অমাবস্যার অন্ধকারে জঙ্গলের পথে যাবে? তা ছাড়া রাস্তা মোটে দেখা যাচ্ছে না, যাবে কী করে? থেকে যাও না আজ।

যশোয়ন্ত বলল, আরে ঠিক চলে যাব। বড় মজা লাগে এমনি অন্ধকারে যেতে। কারণ ডাইনে-বাঁয়ে কিছু নেই। ঘন অন্ধকারে লাল মাটির আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু রাস্তাটাকে মনে হয় একটি শুয়ে থাকা মেটে-অজগর সাপ। অথচ সেইটুকু দেখা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। অন্ধকারে চাইলেই চাপ-চাপ গাঢ় অন্ধকার মুখ-চোখে থাবড়া মারে। ঘোড়ার ওপর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে মহুয়ার গন্ধে মাতাল করা বনে খোয়াব দেখতে দেখতে চলে যাই; দেখি কখন ‘নিইহার’ পৌঁছে গেছি। তোমাকেও ঘোড়ায় চড়া শেখাব, দাঁড়াও না।

বললাম, হ্যাঁ, তুমি তো আমাকে সব কিছুই শেখাচ্ছ।

যশোয়ন্ত ঘোড়ায় উঠতে বললে, দেখো না ঠিক শেখাব।

তারপর হাত দিয়ে ঘোড়ার গলার কাছে একটু চাপ দিয়ে যশোয়ন্ত বলল, চলো ভয়ঙ্কর।

অবাক হয়ে বললাম, ভয়ঙ্কর কী? ঘোড়ার নাম ভয়ঙ্কর? ও বলল, এই রকম ভয়াবহ জায়গায় নিজে ভয়ঙ্কর না হলে বাঁচবে নাকি। শালা হাতিকে বড় ভয় পায়।

খট্ খট্ খটা খট্ করে যশোয়ন্তের ভয়ঙ্কর ভয়াবহ অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

চার

কাল রাত্রে বেশ ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল। সমস্ত জঙ্গলে পাহাড়ে চলেছে তাণ্ডব নৃত্য। হাওয়ার সে কী দাপাদাপি আর গর্জন! অথচ বৃষ্টির তেমন তোড় ছিল না। হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির সত্তা এমনভাবে মিশে গেছে যে হাওয়াটাই বৃষ্টি, না বৃষ্টিটাই হাওয়া বোঝা যায় না। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে রীতিমতো ঠাণ্ডা পড়ে গেছিল। রাতে দেরাজ খুলে বালাপোশ বের করে গায়ে দিতে হয়েছে। সকালে এখনও বেশ ঠাণ্ডা। হাওয়াটা মনে হচ্ছে জ্যৈষ্ঠের শেষের হাওয়া তো নয়, শরতের প্রথম হাওয়া।

আজকে আমার জিপ গাড়ি আসবে ডালটনগঞ্জে। এবং আমার নতুন বন্দুক। সেখান থেকে ঘোষদার ড্রাইভার গাড়ি, বন্দুক পৌঁছে দিয়ে যাবে।

মনে হচ্ছে, জিপটা যে এত তাড়াতাড়ি এল তার কারণ আর কিছু নয়, কোম্পানির ডিরেকটরেরা সস্ত্রীক এবং সবান্ধবে শিকারে আসছেন পরের সপ্তাহে এখানে। বাঘ শিকারে। যার আর এক নাম, জাঙ্গল ইন্‌স্‌পেকশান। সব খরচা কোম্পানির। যে খরচ কোম্পানির খাতায় লেখার নিতান্ত অসুবিধা, সে খরচ চাপবে তেওয়ারীবাবুর ঘাড়ে, কিংবা অন্য জায়গায় যে হ্যান্ডলিং কন্ট্রাকটর আছে, তাঁদের ঘাড়ে।

সভয়ে দিন গুণছি। মালিক ও তাঁর স্ত্রীর আগমনের প্রতীক্ষায়।

পথে বেরিয়ে দেখি, সারা পথে পুষ্পবৃষ্টি হয়ে রয়েছে। শুধু ফুল নয়, কত যে পাতা—রঙিন পাতা, হলদে পাতা, ফিকে হলদে পাতা, গোলাপি পাতা, লাল পাতা, সবুজ পাতা, কচি কলাপাতা রঙা-পাতা, জঙ্গলের গায়ে বিছানো রয়েছে, কী বলব। তার সঙ্গে ফুল। সমস্ত জঙ্গলে—মনে হচ্ছে যেন এক বিচিত্র বর্ণ মখমল কোমল, নয়নাভিরাম গালিচা বিছানো রয়েছে। পা ফেলতে মন কেমন। সেই চমৎকার আবহাওয়ায়, সেই সকালে সমস্ত প্রকৃতির শব্দ গ্রহণ ও শব্দ প্রেরণ করার ক্ষমতা যেন অনেক বেড়ে গেছে। দূর জঙ্গলের ময়ূরের কেঁয়া, কেঁয়া, মোরগের কঁকর কঁ, হরিয়ালের সম্মিলিত পাখার চঞ্চলতার শব্দ যেন মনে হচ্ছে কানের কাছে।

টাবড় আজ বন্দুক নিয়েছে সঙ্গে। মাঝে মাঝে ও টাঙ্গি ছেড়ে বন্দুকও নেয়। তার সেই বন্দুক দেখে মনে হয় তার জন্ম প্রাগৈতিহাসিক কালে। মুঙ্গেরী একনলা গাদা বন্দুক। তাতে কোনও টোপিওয়ালা কার্তুজ যায় না। গাদতে হয়। জানোয়ার বিশেষে সেই গাদাগাদির প্রকারভেদ হয়। ছোট জানোয়ারের জন্য কম বারুদ গাঁদতে হয়। এই গাদাগাদি কোনও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে হয় না। অংগ্‌লি ধরে হিসাব। যেমন বাঘের জন্য তিন অংগ্‌লি, হরিণের জন্য দেড় অংগ্‌লি ইত্যাদি।

আজকাল বেশ অনেক কিছু শিখে গেছি। আর সেই শহুরে বোকা ছেলেটি নেই। দেহাতী হিন্দিটাও মোটামুটি রপ্ত। সুমিতা বউদির ‘কা’ এবং ‘বা’ কিন্তু একেবারে উপেক্ষা করার নয়। রীতিমতো কাজে লেগেছে।

টাবড় একদিন মুরগি মারতে নিয়ে গেছিল।

মাঝে মাঝে গভীর জঙ্গলে গেলে দেখা যায়, শুকনো গাছের ডালে পলাশ ফুলের মতো মুরগি ফুটে আছে। টাবড়ের মতো আমি মহুয়া খাই না। মহুয়া না খেয়েই বলছি।

সকালের সোনালি আলোয় যখন কোনও মদমত্ত মোরগ কোনও বিতৃষ্ণাগত পলায়মানা মুরগির পেছনে পেছনে ছলে বলে কৌশলে কঁক্ কঁক্ কুঁক্ কুঁক্ করতে করতে ধাওয়া করে জঙ্গলময় ছুটোছুটি করে বেড়ায়, তখন-কেন জানি না আমাদের সঙ্গে এই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন কুক্কুট প্রবরদের একটা জবরদস্ত ও অবিচ্ছেদ্য মিল দেখতে পাই। সোনালি পাখনায় মোড়া, দীর্ঘগ্রীবা, সুতনুকা, কলহাস্য এবং লাস্যময়ী কুক্কুটিদের সঙ্গে, ব্যাককুম্ব্ করা সুগন্ধী স্মিতমুখী আধুনিকাদের কোনও তফাত দেখতে পাই না। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আমরা যে মোরগ-মুরগিদের থেকে কিছুমাত্র বেশি উন্নতি করেছি, তা তখন মনে হয় না।

দেখলাম টাবড় ডেকে ডেকে মুরগি মারে। কাজটা গর্হিত এবং সুখপ্রদ যে নয়, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু রকমটা আশ্চর্য।

আমরা বাংলো থেকে প্রায় আধমাইল গেছি, এমন সময় বেশ কাছেই শুঁড়িপথের ডানদিকে একটি মোরগ ডেকে উঠল। টাবড়ের মুখখানা হাসিতে ভরে গেল। রামধানিয়াকে ওইখানে বসে থাকতে বলে আমাকে বলল, আইয়ে হুজৌর।

রামধানিয়া ওইখানেই একটা পাথরের উপর বসে আমাকে আড়াল করে বিড়ি ধরাল।

আমি আর টাবড় পথ থেকে জঙ্গলে ঢুকলাম।

যেখান থেকে মোরগটা ডেকেছিল তার কাছাকাছি গিয়ে একটি ঝোপের মধ্যে আমাকে নিয়ে টাবড় বসে পড়ল। তারপর গলা দিয়ে, জিব দিয়ে, তালু দিয়ে অবিকল মুরগির ডাক ডাকতে লাগল। অঁ-ক-ক-ক্ক-ক…ক্কঁ-ক্ক, আর তার সঙ্গে মাঝে মাঝে মুরগি যেভাবে পা দিয়ে পাতা উলটে পোকা কি খাবার খোঁজে, সেই শব্দ করে আমাদের পাশের ঝরাফুল, পাতা, আঙুল দিয়ে নাড়া চাড়া করতে লাগল।

অবাক হয়ে দেখলাম, টাবড়-মুরগির ডাকে সাড়া দিয়ে দিয়ে সেই অদৃশ্য মোরগের ডাক ধীরে ধীরে আমাদের নিকটবর্তী হতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে, ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে দেখা গেল, একটি প্রকাণ্ড সোনালিতে লালে মেশানো মোরগ বীরদর্পে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তার পেছনে মুরগির হারেম।

চার চোখের মিলন হওয়ামাত্র টাবড় ‘গদাম্’ করে দেগে দিল এবং একরাশ পালক হাওয়ায় উড়িয়ে মোরগটি, আর তার সঙ্গে একটি মুরগিও ওইখানেই উল্টে পড়ল। বাদবাকিরা কঁক্কর-কঁ-কুঁক্-কুঁক্-কুঁক্ করতে করতে পড়ি-কি মরি করে পালাল।

শিকারের ফল ভাল হলেও শিকারের প্রক্রিয়াটি ভাল লাগল না। তারপর থেকে এভাবে মুরগি মারতে আমি টাবড়কে সব সময় মানা করেছি। আমার সামনে আর মারেনি সত্যি কথা, কিন্তু মনে হয় না আমার অনুরোধ-উপরোধে কোনও কাজ হয়েছে।

মুরগি দুটো রামধানিয়ার হেফাজতে দিয়ে আমরা আবার এগোলাম।

সূর্যটা এখনও ওঠেনি। হাঁটতে এত ভাল লাগছে যে কী বলব। সমস্ত বন পাহাড় কী এক সুগন্ধে ম’ ম’ করছে। একটি বাঁক নিলাম। দেখলাম, পথের পাশেই একটু ফাঁকা জায়গায় চড়ুই-রঙা একদল ছোট পাখি মাটিতে কুর্ কুর্ করছে। আমাদের দেখেই পুরো দলটি অবিশ্বাস্য বেগে ছোট ছোট পা ফেলে মিকি মাউসের বাচ্চার মতো দৌড়ে গেল ঝোপের আড়ালে।

টাবড় শুধাল, ঈ কওন চিজ আপ জানতে হ্যায় সাহাব?

বললাম, আমি আর কটা চিজ্ জানি বাবা?

টাবড় বলল, বটের। এদের নাম বটের, যারা জানে না তারা ভাববে তিতির-বাচ্চা বুঝি। হাবভাব রাহান্-সাহান্ অবিকল তিতিরের মতো।

আমি শুধোলাম, রাহান্-সাহান্ কী?

রাহান্-সাহান্ হচ্ছে চরাবরার জায়গা, আদব কায়দা ইত্যাদি।

টাবড়কে বললাম, আমাকে শিকার শেখাবে টাবড়? আমার বন্দুক আসছে কলকাতা থেকে সাহেবদের সঙ্গে।

টাবড় বলল, জরুর শিখলায়গা হুজোর। আনে দিজিয়ে বন্দুকোয়া।

‘বাগভুনুয়া’ নালায় পৌঁছে দেখি স্তুপীকৃত বাঁশ পড়ে আছে। লাদাই হচ্ছে আর লরি বোঝাই হয়ে চলে যাচ্ছে ছিপাদোহর। লরি মানে আধুনিক দানবীয় ডিজেল মার্সিডিজ লরি নয়। সেই মান্ধাতার আমলের ছোট ছোট চিৎকৃত লরি। অঢেল ধুলো, পেট্রলের মিষ্টি গন্ধ এবং গিয়ার চেঞ্জের গোঙানি ভাল লাগে।

গাছতলায় বসে বসে ছাপানো স্টেটমেন্টে দাগ দেওয়া আর নোট দেওয়া—এই তো কাজ। তা ছাড়া সেখানে আমি একজন ভীষণ রকম বড়লোক। লেখাপড়া জানি, সাড়ে চারশো টাকা মাইনে পাই, সাহেবদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা কইতে পারি, গায়ের রঙ কালো নয়, অতএব আমিও একজন সাহেব। এবং শুধু সাহেব নয়, লালসাহেব।

কোনও সত্যিকারের সাহেবকেই এ পর্যন্ত নীল কিংবা কালো বা জাফরানি হতে দেখিনি; সাহেবরা তাঁদের নিজেদের কোনও চেষ্টা ব্যতিরেকেই লাল হয়ে থাকেন। সুতরাং এ হেন পরিস্থিতিতে, আমা-হেন লোকের ‘লাল’ বা ‘সাহেব’ বলে পরিচিত হবার কথা ছিল না। নামটার রটনা যশোয়ন্তের দুষ্কর্ম।

তবে এখানে আসার বেশ কিছুদিন পরই দেখছি যে, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যারা আট আনা, এক টাকা মজুরি পায়, যাদের বিলাসিতা মানে ভাত খাওয়া, যাদের জীবন বলতে জঙ্গলের ‘কূপ’ আর কুপি-জ্বালানো একটি মাটির ঘর, যাদের খুশি বলতে চার আনার এর হাঁড়ি মহুয়ার মদ কি খেজুরের তাড়ি, তাদের কাছে আমি ছাড়া সাহেব পদবাচ্য আর কোন জীব হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *