প্রাক্-পলাশি বাংলার রূপরেখা
অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।১ বস্তুতপক্ষে, সুবে বাংলা প্রায় দু’শো বছর ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সুবা (প্রদেশ) হিসেবে গণ্য হয়েছে। বাংলার উর্বর জমি, বিভিন্ন রকমের অপর্যাপ্ত কৃষিজ পণ্য, অসংখ্য নিপুণ তাঁতি ও অন্যান্য কারিগর, উন্নত বাণিজ্যিক ও আর্থিক সংগঠন এবং সস্তা অথচ উৎকৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা—সব মিলে সুবে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি অত্যন্ত মুল্যবান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই বাংলা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর বাংলা যেহেতু সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, বাংলায় একমাত্র সোনা-রুপো ছাড়া অন্য কিছুর বিশেষ চাহিদা ছিল না। ফলে বাংলা থেকে যারা পণ্য রফতানি করত, তাদের সবাইকে—সে ইউরোপীয় বা এশীয় বণিক যেই হোক না কেন—এ-সব পণ্য কেনার জন্য বাংলায় সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসতে হত।২
মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যখন অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে অরাজকতা, অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে বাংলা কিন্তু তখন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এখানে তখন বাংলার নবাবদের পরিচালনায় একটি সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যার ফলে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল, কোনও অস্থিরতা ছিল না, অরাজকতাও নয়। বাংলার নবাবরা এমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেন যাতে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় এবং বাংলার আর্থিক অগ্রগতি হয়। বাংলার এই উন্নতিতে নবাবদের সঙ্গে হাত মেলায় শাসক শ্রেণীর ওপরতলার একটি গোষ্ঠী।৩
আসলে ১৭০০ সালে মুর্শিদকুলি খান যখন বাংলার দেওয়ান পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন এবং পরে যখন তিনি সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন, তারপর থেকেই বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মুর্শিদকুলিব নিয়োগের ফলে বাংলায় যে এক নতুন ধরনের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু হয় শুধু তাই নয়, এর ফলে বাংলার সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোতেও বিরাট পরিবর্তন আসে। মুঘল সম্রাট ঔরংজেব একটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে মুর্শিদকুলিকে বাংলায় পাঠান—মুর্শিদকুলি এসে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধি করবেন এবং তা থেকে সম্রাটকে নিয়মিত ও যথেষ্ট রাজস্ব পাঠাবেন। সম্রাট ঔরংজেব তখন দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত— অর্থাভাবে জর্জরিত—সাম্রাজ্যের অন্য কোনও অংশ থেকে রাজস্ব বিশেষ আসছে না—এ অবস্থায় ঔরংজেবের একমাত্র ভরসা বাংলা ও মুর্শিদকুলি। মুর্শিদকুলি ঔরংজেবকে নিরাশ করেননি। বাংলার রাজস্বব্যবস্থার সংস্কার করে তিনি ঔরংজেবকে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত অর্থ পাঠিয়েছেন। একদিকে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতন্ত্রে সংস্কারের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও ভূমিব্যবস্থার কাঠামোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হয়। ছোট ছোট জমিদারির অবসান ঘটিয়ে বড় জমিদারির আবির্ভাব হয়। বড় জমিদাররা এখন নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে মুর্শিদকুলির সংস্কারের ফলে বাংলায় নতুন এক ব্যাঙ্কিং ও বাণিজ্যিক শ্রেণীর উদ্ভব হয় যারা পরে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
ঔরংজেব মুর্শিদকুলির ওপর এতই সন্তুষ্ট হন যে, তিনি তাঁকে বাংলায় নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা দেন। মুর্শিদকুলিও এ সুযোগ কাজে লাগান। তিনি সম্রাটের পৌত্র এবং বাংলার সুবাদার আজিম-উস্-শানকে অগ্রাহ্য করে ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মক্সুদাবাদে (পরে নিজের নামানুসারে মুর্শিদাবাদ নাম দেন) দেওয়ানি স্থানান্তরিত করেন। ১৭১৭ সালে তিনি বাংলায় সুবাদার পদেও নিযুক্ত হন। মুঘল রীতির ব্যতিক্রম করে এই প্রথম বাংলার ইতিহাসে সুবাদারি ও দেওয়ানি একই ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হল। এর পর থেকে বাংলার নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবেই বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। দিল্লির সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর কোনও যোগাযোগই থাকল না। বাংলা শুধু নামেমাত্র মুঘল সম্রাটের অধীনে রইল, কার্যত বাংলার ওপর সম্রাটের আধিপত্য শেষ হয়ে গেল। নবাবরা বছর বছর দিল্লিতে রাজস্ব পাঠিয়ে সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কের দায় সারতেন।
বস্তুতপক্ষে, ১৭১৩ সালের পর উত্তর ভারত থেকে বাংলায় উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও ছেদ পড়ে।৪ এরপর থেকে মুর্শিদকুলি ও তাঁর উত্তরসূরিদের আর দিল্লি থেকে পাঠানো রাজকর্মচারীদের দেশের শাসনযন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নই থাকল না। এর ফলে বাংলার নবাবদের নিজেদের ইচ্ছেমতো এবং পছন্দমতো কর্মচারী নিয়োগ করার পথে কোনও বাধা রইল না। তাঁরা বাংলায় অবস্থানকারী মুঘল মনসবদার শ্রেণী এবং নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্য থেকে পছন্দসই লোকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করতে লাগলেন। তার ফলে বাংলায় এক দৃঢ় ও শক্তিশালী নিজামতের প্রতিষ্ঠা হল এবং নবাবরা সর্বশক্তিমান হয়ে উঠলেন। উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা এখন আগের মতো আর দিল্লির দিকে না তাকিয়ে নবাবকেই একমাত্র হর্তাকর্তা হিসেবে মেনে নিল এবং নবাবের সন্তুষ্টিবিধান ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের জন্য সচেষ্ট থাকল। এতে নবাবের শক্তিবৃদ্ধি হল এবং সবাই নবাবের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠল।
রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় ক্ষমতাবিন্যাসের চেহারায়ও বেশ কিছু পরিবর্তনের সূচনা হল। নবাবি আমলের আগে বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুঘল মনসবদার শ্রেণী ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ দিল্লির সঙ্গে ছিল তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, তাদের গুরুত্ব অনেক কমে গেল কারণ দিল্লি থেকে কোনওরকম মদতের আশা তাদের ছাড়তে হল। ফলে তারা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে বাধ্য হল। স্থানীয়দের মধ্যে জমিদার এবং ব্যাঙ্কিং ও বণিক শ্রেণী, যারা আগের জমানায় বিশেষ কোনও গুরুত্ব পায়নি, তারা এখন নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের প্রেক্ষিতে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে লাগল এবং নতুন শাসকগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠল।
তবে এই নতুন সমঝোতাকে কয়েকটি বিশেষ শ্রেণীর জোটবদ্ধতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আবার এই সমঝোতাকে একটি সুদৃঢ় ও নিশ্চিদ্র জোট হিসেবে গণ্য করাও ভুল হবে। আসলে এটি কিছু স্বার্থপ্রণোদিত ব্যক্তিবিশেষের জোটবন্ধন—যারা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। নবাবও দিল্লি থেকে বিচ্ছিন্ন এইসব মুঘল মনসবদার, স্থানীয় ভূস্বামী, সওদাগর ও ব্যাঙ্কারদের বাংলার শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও আর্থিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির কাজে লাগিয়েছিলেন। তবে এখানে মনে রাখা দরকার যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (শ্রেণীভিত্তিক নয়) এই শাসক গোষ্ঠীর শক্তির উৎস ছিলেন একমাত্র নবাবই। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় ছিল নবাবের দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে। তাই নবাবকেই তারা বাংলার সর্বোচ্চ শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। ফলে এই নতুন ক্ষমতা বিন্যাসের যে কাঠামো তৈরি হয়, তাতে নবাবের স্থান ছিল সর্বোচ্চে—তার তলায় ব্যক্তিসমষ্টির জোট—যারা সম্পূর্ণভাবে নবাবের ওপর নির্ভরশীল। এতে শ্রেণীগত জোটবদ্ধতার কোনও অবকাশ ছিল না। ক্ষমতা ও সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগ করার জন্য নবাবের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর কিছু ব্যক্তিবিশেষের একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেই এই সমঝোতা হয়েছিল। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ভিত্তি বা বুনিয়াদ এই নতুন শক্তিজোটের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।
এই নতুন শক্তিজোট যে নিতান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন জগৎশেঠ পরিবার। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলেই জগৎশেঠরা সামান্য মহাজন থেকে ধীরে ধীরে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পেরেছিল। নবাবদের সঙ্গে নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে জগৎশেঠদের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান সোপান ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, পলাশি বিপ্লবের পর বাংলার নবাব যখন ইংরেজদের ক্রীড়নকে পরিণত হলেন এবং জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম দাক্ষিণ্য দেখানো আর সম্ভব হল না, তখন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জগৎশেঠরা আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ভূপাতিত হলেন। আবার এই নতুন ক্ষমতাবিন্যাসে ব্যক্তিগত সম্পর্কই যে সবচেয়ে বড় উপাদান, তার প্রমাণ হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির উত্থানের মধ্যে দেখা যায়। এই ভ্রাতৃদ্বয়ের কেউই প্রভাবশালী জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু এঁদের সঙ্গে নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, নবাব এঁদের দু’জনকেই শাসনবিভাগের উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তা ছাড়া এই নতুন শক্তিজোট কোনও অবিচ্ছেদ্য বা নিশ্ছিদ্র সংগঠনের রূপ নেয়নি—মাঝেমধ্যেই নানা টানাপোড়েনে এতে ফাটল দেখা দিয়েছে। মুর্শিদকুলি থেকে শুরু করে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বার বার এটা দেখা গেছে।৫ তবে বলা বাহুল্য, নিজামতের সঙ্গে নতুন শাসকগোষ্ঠীর জোটবদ্ধতার ভিত্তি যাই হোক না কেন, এর ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, নবাবি আমলে, বাংলায় রাজনৈতিক স্থিরতা ও শক্তিশালী নিজামতের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর (১৭২৭) তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর মূল নীতিগুলি মোটামুটি অনুসরণ করেছিলেন। ফারসি ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে (১৭২৭-৩৯) ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান’ ছিল। সিয়র-উল-মুতাখারিনে-র লেখক গোলাম হোসেন খান মন্তব্য করেছেন, সুজাউদ্দিনের সময় এতই সমৃদ্ধি দেখা গেছে যে চারদিকে প্রাচুর্য ও সুখের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল।৬ আবার ১৭৮৯ সালে ইংরেজ কোম্পানির ভূমিরাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা স্যার জন শোর (Sir John Shore) বলেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষ কয়েক বছর বাদ দিলে, মুর্শিদকুলি থেকে মীরকাশিমের সময় পর্যন্ত একমাত্র সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালেই নবাবি শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি।৭ সুজাউদ্দিনের পর তাঁর পুত্র সরফরাজ নবাব হলেন কিন্তু নিজের শক্তি সংহত করার আগেই আলিবর্দি খানের কাছে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। আলিবর্দি ১৭৪০ সালে নতুন নবাব হন। ফারসি ঐতিহাসিকরা তাঁর রাজত্বের (১৭৪০-৫৬) গৌরবোজ্জ্বল বর্ণনা দিয়েছেন। গোলাম, হোসেন খানের মতে এ সময় চারদিকেই দেশের উন্নতি হয়েছিল। ‘নবাব তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য এতই সতর্ক ছিলেন যে তাঁর সময় প্রজারা সুখস্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল।’৮ তবে আলিবর্দির রাজত্বের প্রথম দিকে প্রায় দশ বছর ধরে (১৭৪২-৫১) মারাঠারা প্রায় প্রত্যেক বছর বাংলা আক্রমণ ও লুঠ করতে অভিযান চালিয়েছে। তা ছাড়া এ সময় আফগান বিদ্রোহও হয়। আফগানদের দমন করে ও মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি (১৭৫১) করার পর আলিবর্দি ‘দেশের ও প্রজাদের উন্নতিকল্পে বিশেষ যত্নবান হন ও সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেন।’৯
ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ মুজাফ্ফরনামা থেকে আলিবর্দির রাজত্বের শেষদিকে রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরের যে বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়, তা থেকে স্পষ্ট যে নবাব আলিবর্দি মারাঠা আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে পেরেছিলেন।১০ আসলে, বাংলায় মারাঠা আক্রমণের যে নেতিবাচক প্রভাব, তার ওপর ঐতিহাসিকরা বড্ড বেশি জোর দিয়েছেন। তার মধ্যে অনেক অত্যুক্তি দেখা যায়। বলা বাহুল্য, মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলের অর্থনীতি কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু এটা ছিল সাময়িক ব্যাপার এবং কোনও কোনও বিশেষ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। বাংলার যে সামগ্রিক অর্থনীতি তার ওপর মারাঠা আক্রমণের কোনও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েনি।১১
বস্তুতপক্ষে, প্রাক্-পলাশি আমলে বাংলার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বেশ মজবুতই ছিল। নবাবি আমলে আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের পরিমাণও। বাংলার উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা এবং বাজারও সম্প্রসারিত হয়। বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ও তা থেকে প্রচুর মুনাফার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখে ভারতবর্ষের ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুধু নয়, এমনকী ইউরোপ থেকেও অসংখ্য সওদাগর ও ব্যবসায়ী বাংলায় আসে। ১৭৫৬-৫৭ সালে একজন ইউরোপীয় পর্যটক বাংলা দেখে লেখেন: ‘বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ বড় আকারেরই কারণ এখানে পারসিক, আবিসিনিয়ান, আরব, চিনা, গুজরাটি, মালাবারি, তুর্কি, ইহুদি, আর্মানি এবং এশিয়ার অন্যান্য সব প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে আসে।’১২
আসলে, সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার ঐশ্বর্য ও বাংলায় জিনিসপত্রের সস্তাগণ্ডার বাজার প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ফারসি ঐতিহাসিকরা বাংলার নামকরণ করেছিল ‘জিন্নত-উল-বিলাদ’১৩ বা ‘প্রদেশগুলির মধ্যে স্বর্গ।’ মুঘল সম্রাট ঔরংজেব বাংলাকে ‘জাতীয় স্বর্গ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সব মুঘল ফরমানেই বাংলাকে ‘ভারতবর্ষের স্বর্গ’১৪ বলে উল্লেখ করা হত। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠিয়াল জাঁ ল’ (Jean Law) বলেছেন, ‘এটা বাংলার যথার্থ অভিজ্ঞান’।১৫ ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে (Bernier) ১৬৬০-এর দশকে মন্তব্য করেছেন ‘বাংলা এতই সম্পদশালী যে প্রবাদ আছে বাংলায় ঢোকার দরজা অসংখ্য কিন্তু বেরুবার দরজা একটিও নেই।’১৬ আবার অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশকে আরেকজন পর্যটক ও ঐতিহাসিক, আলেকজ্যান্ডার ডো (Alexander Dow), লিখেছেন, ‘আন্তর্জাকিত বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা বাংলার অনুকূলেই ভারী ছিল এবং তখন বাংলাই ছিল একমাত্র পাত্র (sink) যেখানে সোনাদানা এসে শুধু জমত, তার কিছুমাত্র কখনও বেরুত না।’১৭
বলা বাহুল্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা ছিল প্রাচুর্যের দেশ। জিনিসপত্রের দাম ছিল সস্তা, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক সস্তা। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রে এ-কথা বার বার দেখা যায়। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতি (Board of Directors) ১৭৩৫ সালে লিখছে যে ‘সারা ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলাই যে সবচেয়ে সস্তাগণ্ডার দেশ শুধু তাই নয়, সারা ভারতের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচুর্যে ভরা।’১৮ প্রাক্-পলাশি আমলের কথা বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক ডো মন্তব্য করেছেন যে, ওই সময় ‘বাংলা ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও জনবহুল দেশ। এখানকার কৃষিব্যবস্থা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। একদিকে সমাজের উঁচুস্তরের লোকজন ও বণিক সম্প্রদায় প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী। অন্যদিকে সাধারণ কৃষক বা কারিগরেরাও প্রাচুর্য ও সুখশান্তিতে জীবনযাপন করছিল।’১৯ এর কারণ, ডো জানাচ্ছেন, ‘বাংলার নবাবরা দেশের নাড়িনক্ষত্র ভালভাবে জানতেন, ফলে তাঁরা শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে অত্যাচারী বা নিপীড়নকারী হয়ে ওঠেননি। তাঁরা জানতেন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তির উৎস হল প্রজারা, তাদের সমৃদ্ধি ও হিতাহিতের ওপরই নির্ভর করে আছে নবাবদের অস্তিত্ব।’২০
বাংলার উপরোক্ত প্রেক্ষাপটেই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে পরের অধ্যায়গুলিতে।
.
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline; N. K. Sinha, Economic History of Bengal. এন. কে. সিনহা এই সমৃদ্ধি সম্বন্ধে যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যদিও তিনি পরিসংখ্যানগত তেমন তথ্য দিতে পারেননি কারণ তখনকার দিনে ইউরোপে গিয়ে কোম্পানিগুলির নথিপত্র দেখা অতটা সহজ ছিল না। কিন্তু Brijen K. Gupta, (Sirajuddaullah and the East India Company), K. N. Chaudhuri, (The Trading World of Asia and the English East India Company), P. J. Marshall, (East Indian Fortunes; Bengal—the British Bridgehead) প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ছিল না। বাংলার অর্থনৈতিক অবক্ষয় প্রাক্-পলাশি ঘটনা, পলাশির পর তা শুরু হয়নি। কিন্তু আমি বিস্তারিত ও পরিসংখ্যানগত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি (From Prosperity to Decline) এটা মোটেই ঠিক নয়। নবাবি আমলে বাংলার সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
২. S. Chaudhury, ‘Asian Merchants and Companies in Bengal’s Export Trade, circa, mid-Eighteenth Century’ in S. Chaudhury and M. Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade, Europe and Asia in Early Modern Era; S. Chaudhury, ‘The Inflow of Silver to Bengal in the Global Perspective, 1650-1757’, paper presented at the XII International Economic History Congress, Madrid, August 1998, Session B-6, ‘Monetary History in Global Perspective, 1500-1800’.
৩. P. B. Calkins, ‘’The Formation of a Regionally Oriented Ruling Group in Bengal, 1700-1740′, JAS, vol. XXIX, No. 4, 1970, p. 799.
৪. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 410.
৫. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 15-16.
৬. Gholam Hossein Khan. Seir-ul-Mutaqherin, pt. I, p. 280: Gulam Husain Salim, Riyaz-us-Salatin, pp. 290-91.
৭. Minute of Sir John Shore in W. K. Firminger, ed., Fifth Report, vol. II, p. 9
৮. সিয়র থেকে উদ্ধৃত, K. K. Datta, Alivardi and His Times, p. 140.
৯. Calendar of Persian Correspondence, pt. II, quoted in K. K. Datta, Alivardi, p. 140.
১০. Quoted from Karam Ali, Muzaffarnama in K. K. Datta, Alivardi, p. 140.
১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 279-305.
১২. Grose, East Indies, p. 234
১৩. রিয়াজ, পৃ. ৪।
১৪. ঐ।
১৫. S. C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. III, p. 390; Robert Orme, Military Transactions, vol. II, p. 4.
১৬. Bernier, Travels, p. 440.
১৭. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, Ixii.
১৮. DB, vol. 106, f. 413, para 41, 31 January, 1735.
১৯. Alexander Dow, Hindostan, vol. III, Ixviii-ix.
২০. ঐ, পৃ. Ixvii.