১. প্রাক্-পরিচয় – ভারত আবিষ্কার

প্রাক্-পরিচয়

অনেকদিন পর্যন্ত ইউরোপীয়দের কাছে ভারতবর্ষ মহারাজা, সাপুড়ে আর দড়ির খেলার দেশ বলে পরিচিত ছিল। ভারতীয় বিষয়মাত্রই তাদের কাছে রোমান্টিক ও মোহময় মনে হতো। কিন্তু সম্প্রতি দু-তিন দশক ধরে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মহারাজা, সাপুড়ে ও দড়ির খেলার কুহকী অস্পষ্টতা পিছনে ফেলে ভারত এক জীবন্ত স্পন্দিত ভূখণ্ডের রূপ পরিগ্রহ করেছে। মহারাজারা আজ দ্রুত অবলুপ্তির পথে। দড়ির খেলা অলীক মায়া ছাড়া কিছু নয়। রয়ে গেছে শুধু সাপুড়েরাই— একদল অপুষ্ট, দুঃস্থ লোক, যারা পেটের দায়ে সাপ ধরে তাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলে, আর দুটো পয়সার লোভে বাঁশি বাজিয়ে সাপ খেলায়, যাতে কোনোরকমে নিজের, পরিবারের এবং সাপের ভরণপোষণ হয়।

ইউরোপের কল্পনায় ভারত চিরদিন ছিল এক অত্যাশ্চর্য দেশ, যেখানে অজানা ধনসম্পদ, অলৌকিক ঘটনাবলি আর বহু জ্ঞানীলোকেদের সমাবেশ। যেখানে নাকি পিঁপড়েরা মাটি থেকে সোনা খুঁড়ে বার করে, নগ্ন দার্শনিকরা বনে জঙ্গলে বাস করেন। প্রাচীন গ্রীকদের ভারত সম্বন্ধে ধারণা থেকেই এইসব উদ্ভব কল্পনার উৎপত্তি— যা বহু শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই ধারণা ভেঙে না দেওয়ার বদান্যতা দেখাতে যাওয়া মানে কতকগুলো অবাস্তব কিংবদন্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে জিইয়ে রাখা।

অন্য যে-কোনো প্রাচীন সভ্যতার মতোই ভারতেও ধনসম্পদ অল্প কিছু লোকের কাছে সীমাবদ্ধ ছিল। অলৌকিক ক্রিয়াকলাপেও আগ্রহ ছিল সামান্য লোকেরই, যদিও এসবে আস্থা ছিল অধিকাংশ মানুষের। অন্য সভ্যতা হলে হয়তো দড়ির ম্যাজিককে শয়তানের ক্রিয়াকলাপ বলে ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা হতো, কিন্তু ভারতে কৌতূহল ও উদার কৌতুকের মনোভাব নিয়ে তাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তিগত স্থৈর্যের মূলে রয়েছে শয়তান- সম্পর্কিত ধারণার অনুপস্থিতি।

বহু শতাব্দী ধরেই ভারত বলতে বৈভব, যাদুবিদ্যা, আর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের যে ছবি তৈরি হয়েছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তার পরিবর্তন শুরু হলো। তখন ইউরোপ আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে আর ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে অতি- আগ্রহ অনেক ক্ষেত্রেই সমপরিমাণ অনাগ্রহে পর্যবসিত হয়েছে। নতুন ইউরোপ যেসব গুণকে প্রশংসা ও শ্রদ্ধা করতে শিখল, তারা দেখল ভারতের কাছে তার কোনোটাই নেই। ভারতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও যুক্তিপূর্ণ চিন্তাকে বাহ্যত বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়া হতো না। ভারতীয় সভ্যতাকে বদ্ধ ও নিশ্চল বলে অভিহিত করে অত্যন্ত অবজ্ঞা করা হলো। যা-কিছুই ভারতীয়, সে সম্পর্কে মেকলের যে তাচ্ছিল্য, তা থেকে এই মনোভাবকে বোঝা যায়। ভারতের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলতে কেবল মহারাজা আর সুলতানদের শাসন ধরে নিয়ে তাকে প্রজাতন্ত্রবিরোধী স্বেচ্ছাচার বলে অগ্রাহ্য করা হলো। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে এ হলো প্রায় ভয়ংকরতম পাপ।

এ সত্ত্বেও অল্প কিছু কিছু ইউরোপীয় পণ্ডিতের মধ্যে এর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। প্রধানত, সংস্কৃত সাহিত্য ও প্রাচীন দর্শনের মধ্য দিয়ে তাঁরা ভারতকে আবিষ্কার করলেন। তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির অনাধুনিকতা ও উপযোগবাদের বিরোধী দিনগুলোকে বেশি করে জোর দিলেন এবং ভারতে ধর্মের তিন হাজার বছরের ধারাবাহিকতার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিক্ষেপ করলেন। তাঁদের ধারণা হলো যে ভারতীয় জীবনযাত্রা অধ্যাত্মবাদ ও দার্শনিক সূক্ষ্মতত্ত্ব দিয়ে এত বেশি প্রভাবিত যে দৈনন্দিন পার্থিব খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাবার এতে কোনো অবকাশ নেই। জার্মান রোমান্টিকতা এই দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে প্রবল সমর্থক। কিন্তু মেকলের তাচ্ছিল্যসূচক মনোভাব ভারতের যা ক্ষতি করে, এই প্রবল সমর্থন তার চেয়ে কিছু কম ক্ষতিকর নয়। অনেক ইউরোপীয়ের কাছে ভারত হয়ে উঠল এক অলৌকিক অতীন্দ্রিয় দেশ, যেখানকার অতি সাধারণ কাজকর্মকেও তাঁরা প্রতীকের আবরণে মুড়ে দেখতে লাগলেন। তথাকথিত আধ্যাত্মিক প্রাচ্যজগৎ সম্বন্ধে ধারণার শুরু এখানেই, এবং যেসব ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী নিজেদের জীবন-রীতি থেকে পলায়নের পথ খুঁজছিলেন, ভারতবর্ষ হয়ে দাঁড়াল তাঁদের মানসিক আশ্রয়স্থল। মূল্যবোধের দুটি ভাগ তৈরি হলো— ভারতীয় মূল্যবোধকে বলা হলো ‘দার্শনিক’ আর ইউরোপীয় মূল্যবোধকে অভিহিত করা হলো ‘জাগতিক’ বলে। অথচ ভারতীয় সমাজের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এইসব তথাকথিত দার্শনিক মূল্যবোধগুলোকে মিলিয়ে নেবার বিশেষ কোনো চেষ্টাই হলো না (হলে বোধহয় তার ফল কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াত)। গত একশো বছরে একশ্রেণির ভারতীয় চিন্তাবিদ্রাও এই ধারণাকেই লালন করেছেন এবং ব্রিটিশ কারিগরি উৎকর্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অক্ষমতার জন্য ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কাছে এটাই হলো সান্ত্বনা।

প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের আবিষ্কার আর ইউরোপের কাছে সেই আবিষ্কারের পরিচিতির কৃতিত্ব হলো অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে যেসব জেসুইটরা ছিলেন তাঁদের, আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইউরোপীয় কর্মচারীদের। শেষোক্তদের মধ্যে ছিলেন স্যার উইলিয়াম জোন্‌স ও চার্লস উইলকিন্‌স। প্রাচীন ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী লোকদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারততত্ত্ববিদ্যার ভাষাতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব ও অন্যান্য আরো কয়েকটি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণা হলো। বহু ইউরোপীয় পণ্ডিত ভারততত্ত্ববিদ্যায় আগ্রহ দেখালেন, আর এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন— এফ্‌ ম্যাক্সমূলার।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ব্রিটিশ শাসকবৃন্দ এবং প্রধানত এঁদের মধ্য থেকেই এসেছিলেন ভারত- ইতিহাসের প্রথম অ-ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা। সুতরাং প্রথমদিকের এইসব ইতিহাসকে বলা যায় ‘শাসকদের ইতিহাস’। রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের উত্থান- পতনের বিবরণই ছিল এইসব ইতিহাসের মূল বিষয়। রাজারাই ছিলেন ভারত- ইতিহাসের প্রধান নায়ক, আর তাঁদের ঘিরেই বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের বিবরণ। অশোক, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা আকবরের মতো রাজাদের বাদ দিলে আর- সব ভারতীয় রাজারা একটা গতানুগতিক কাঠামোর মধ্যে পড়ে গেলেন— তাঁরা স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও প্রজা-কল্যাণে উদাসীন। মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেল যে, শাসনের ব্যাপারে এই উপমহাদেশের যে-কোনো রাজার চেয়ে ব্রিটিশদের শাসন অনেক উঁচুদরের।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমে যেসব ভারতীয় ঐতিহাসিক ছিলেন তাঁদের ওপর ভারত-ইতিহাসের এই ব্যাখ্যার প্রভাব পড়ে। তাঁদের লেখা প্রামান্য ইতিহাসগুলোর মূল বিষয় হলো রাজবংশের ইতিহাস ও রাজাদের বিবরণ। কিন্তু এই ব্যাখ্যার দ্বিতীয় অংশটির একটি অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। অধিকাংশ ভারতীয় ঐতিহাসিকই হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন বা ঐ আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা বললেন, প্রাক্-ব্রিটিশ ভারতে স্বর্ণযুগ ছিল এবং প্রাচীনকালেই ছিল ভারত- ইতিহাসের প্রকৃত গৌরবময় অধ্যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতীয় জনগণের জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হিসেবেই এই অভিমতকে দেখতে হবে।

এরই সঙ্গে আর একটি আপত্তিকর ব্যাপারেরও প্রভাব পড়েছিল প্রাচীন ভারতের প্রথম ইতিহাস রচনার ওপর। যেসব ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এ সময়কার ইতিহাস লিখছিলেন, তাঁরা সকলেই গড়ে উঠেছিলেন ইউরোপের প্রাচীন আদর্শে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, প্রাচীন গ্রীক সভ্যতাই হলো মানুষের মহত্তম কীর্তি। অতএব যে-কোনো নতুন আবিষ্কৃত সভ্যতাকেই গ্রীক সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করা হতো এবং তুলনায় হীনতর মনে করা হতো। যদি বা সেসব সভ্যতার কোনো বৈশিষ্ট্যকে আলাদাভাবে প্রশংসার যোগ্য বলে মনে হতো তবে চেষ্টা করা হতো যদি কোনোমতে তাকেও গ্রীক সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে প্রতিপন্ন করা যায়। ভিনসেন্ট স্মিথ, যাঁকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বলে বহুদিন ধরে গণ্য করা হয়েছে, তিনিও এই দোষ থেকে মুক্ত ছিলেন না। এক জায়গায় তিনি অজন্তার একটি বিখ্যাত বৌদ্ধকেন্দ্রের রঙিন দেওয়াল-চিত্র সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছিলেন। সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যের এক সাসানিয়ান রাজদূতের আগমনই ঐ ছবির বিষয়। শৈল্পিক বা ঐতিহাসিক কোনো কারণেই এর সঙ্গে গ্রীসের সম্পর্ক ছিল না। তাও তিনি লিখলেন :

ছবিটি ভারত ও পারস্যের মধ্যে এক অসাধারণ রাজনৈতিক সম্পর্কের দলিল হিসেবে উল্লেখযোগ্য— কিন্তু এছাড়াও এর গুরুত্ব হলো শিল্প-ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট দিকদর্শকরূপে। অজন্তার কয়েকটি প্রধান গুহাচিত্রের অঙ্কনকাল নির্ধারণে এই চিত্রটি সাহায্য করেছে এবং এই নির্ধারিত মান অনুযায়ী অন্যান্য ছবির কাল নিরূপণ করাও সম্ভব হয়েছে। এই ছবিটি থেকে আর একটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়— অজন্তা অঙ্কনশৈলী প্ৰথমত পারস্য থেকে এবং মূলত গ্রীস থেকেই আহরিক।[১]

[১. ভি. স্মিথ, আলি হিট্টি অফ ইন্ডিয়া (১৯২৪)। পৃ. ৪৪২]

স্বভাবতই ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা এরকম বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করলেন। প্রমাণ করার চেষ্টা চলল যে, ভারত গ্রীস থেকে সংস্কৃতির কোনো অংশ গ্রহণ করেনি। অথবা, ভারতীয় সংস্কৃতি ও গ্রীক সংস্কৃতির সমান্তরাল অস্তিত্ব ছিল, ভারতীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যই গ্রীক সভ্যতায় বিদ্যমান ছিল। প্রত্যেক সভ্যতাই যে তার নিজস্ব বিস্ময়, এ-কথা তখনো পর্যন্ত ইউরোপীয় বা ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করতেন না। কোনো সভ্যতাকে তার নিজের গুণানুসারেই বিচার করার ধারা শুরু হয়েছিল আরো অনেক পরে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন প্রথম ইউরোপীয় পণ্ডিতরা ভারতবর্ষের সম্পর্কে এলেন ও তার অতীত সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন, তাঁদের তথ্য সংগ্রহের সূত্র ছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা। কেননা, এঁরাই ছিলেন প্রাচীন সংস্কৃতাশ্রয়ী ঐতিহ্যের একমাত্র স্বীকৃত অভিভাবক। তাঁদের মতে, এই ঐতিহ্য সংরক্ষিত ছিল সংস্কৃত আকর গ্রন্থগুলোর মধ্যে এবং এগুলোতে ব্যুৎপত্তি ছিল কেবল তাঁদেরই। অতএব কেবলমাত্র সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ বিভিন্ন পুঁথিপত্র বা সূত্র থেকেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা হলো। প্রাচীন বইপত্রের অনেকগুলোই মূলত ধর্মগ্রন্থ এবং স্বভাবতই ধর্মীয় উদ্দেশ্য অতীতের বিবরণকে প্রভাবিত করে। এমনকি অপেক্ষাকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রচনা, যেমন আইন-সম্বন্ধীয় বই ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’– তারও রচয়িতা ছিলেন ব্রাহ্মণরাই। সুতরাং রচয়িতাদের মন্তব্য ও ব্যাখ্যা ছিল সমাজে উচ্চপদস্থদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। ঐতিহাসিক যাথার্থ্যের উপর ততটা দৃষ্টি না দিয়ে এইসব গ্রন্থে অতীতকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল শুধু ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যেমন, জাতিভেদ প্রথাকে বর্ণনা করা হয়েছে সমাজের দৃঢ় স্ত রবিন্যাস হিসেবে। বলা হয়েছে, এই প্রথা একেবারে প্রাচীনকালেই শুরু হয়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অথচ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সমাজে জাতিভেদ প্রথা পালনের মধ্যে নানারকম অদল-বদল ঘটে। কিন্তু প্রাচীন আইনগ্রন্থ রচয়িতারা এসব কথা স্বীকার করতে চাননি।

পরবর্তী যুগে ইতিহাস রচনার সময়কালে আরো নানা জায়গা থেকে পাওয়া বিভিন্ন রকম তথ্য ব্যবহারের সুযোগ থাকায় অতীতের আরো যথাযথ বর্ণনা সম্ভব হয়েছে। এতে একদিকে যেমন ব্রাহ্মণদের রচিত তথ্যের কয়েকটি বিষয়ের যাথার্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ হয়েছে, তেমনি অন্যান্য বিষয়গুলোকে সত্য বলে প্রমাণ করারও সুযোগ মিলেছে। শিলালিপি ও মুদ্রার সাক্ষ্যের ওপর এবার থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলো। বিদেশি পর্যটকরা তাঁদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন গ্রীক, ল্যাটিন, চীনা ও আরবি ভাষায় রচিত বিভিন্ন বিবরণে। খনন-কার্যের ফলে অতীতের অনেক ধ্বংসস্তূপের আবিষ্কার শুরু হলো। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বৌদ্ধধর্মসংক্রান্ত তথ্যসম্ভার বেড়ে গেল সিংহল ও চীনে পালি অনুশাসনের আবিষ্কারের ফলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পরবর্তী ইতিহাস সম্পর্কে আরবি ও ফারসি ভাষায় লিপিবদ্ধ ভারত সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্যকে এবার উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা হলো। আগে কিন্তু এগুলোকে পশ্চিম এশিয়ার ইসলামিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই গণ্য করা হতো।

প্রথম দিককার ইতিহাস রচনায় যে কেবল রাজবংশের ইতিহাসের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হতো, তার মূলে ছিল একটি ধারণা— প্রাচ্যের দেশগুলোতে দৈনন্দিন শাসনের কাজেও রাজার ক্ষমতাই ছিল সর্বোচ্চ। অথচ আসলে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দৈনন্দিন কাজকর্মের ভার প্রায় কখনোই কেন্দ্রীভূত ছিল না। একান্তই যা ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য, সেই জাতিভেদ প্রথা রাজনৈতিক ও পেশাগত কাজকর্মেরও অঙ্গীভূত ছিল। তার ফলে যে-সমস্ত কাজকর্ম ‘প্রাচ্যদেশীয় স্বেচ্ছাচার’-এর পক্ষে স্বাভাবিক হতে পারত, তা কেন্দ্রীভূত না হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতবর্ষে শাসন ক্ষমতার গতিপ্রকৃতির হদিশ পেতে গেলে কেবল রাজবংশের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে চলবে না। বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমবায় সঙ্ঘ ও গ্রাম পঞ্চায়েতের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্লেষণও প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যক্রমে খুব অল্পদিন হলো এই গবেষণার প্রয়োজন স্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং প্রামাণ্য ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্যে এখনো দু-এক দশকের গভীর অনুসন্ধান দরকার। আপাতত রাজনৈতিক ক্ষমতা উৎপাদনের উৎসগুলো সম্পর্কে কেবল ইঙ্গিত দেওয়াই সম্ভব।

এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ না দেওয়ার আর একটি কারণ হলো একটি ধারণা যে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কখনো বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ভারতীয় সংস্কৃতি বহু শতাব্দী ধরেই অপরিবর্তিত ও জড়বৎ, এই বিশ্বাসও জন্ম নেয় এই ধারণা থেকে; এদেশের সংস্কৃতি স্থাণু, কারণ ভারতীয়রা জড়িমাগ্রস্ত এবং ভারতীয়দের জীবনদর্শন বিষাদাচ্ছন্ন ও অদৃষ্টবাদী। সন্দেহ নেই, এ সবই অতিশয়োক্তি। জাতিভেদ প্রথা, ভূমিব্যবস্থা ও বাণিজ্যিক কাজকর্মের কয়েক শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের সামান্য বিশ্লেষণ করলে এ প্রমাণ হয়ে যেত যে, ভারতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গঠন, আর যাই হোক, মোটেই স্থিতিশীল ছিল না। যদিও একথা সত্য যে কিছু কিছু স্তরে তিন হাজার বছর ধরে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বয়ে এসেছে, কিন্তু তাকে নিশ্চল বা স্রোতহীন ভাবলে ভুল হবে। হিন্দুরা গায়ত্রীমন্ত্র* জপ করে আসছে তিন হাজার বছর ধরে। কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণের প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি মোটেই অপরিবর্তিত থাকেনি। আশ্চর্য লাগে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে যেমন সেখানকার ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারা আবিষ্কারের ওপর প্রচণ্ড জোর দেওয়া হয়েছিল, এশিয়ার ইতিহাস অনুসন্ধানের সময় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি। ভারতীয় ইতিহাস যেন বিভিন্ন রাজবংশের নামাঙ্কিত কয়েকটি সময়চিহ্নের সমষ্টিমাত্র। ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও তাঁদের রচনায় একই পদ্ধতির অনুসারী হলেন! অবশ্য একথা বললে ভুল হবে যে, অন্য সমস্ত বিষয়ই উপেক্ষিত হয়েছিল। ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের উপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য সংগৃহীত হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক রচনায় এই সমস্ত তথ্য কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়েছে।

[* ঋগবেদের এই স্তোত্র রচিত হয়েছিল সূর্যদেবতা সবিতৃকে নিবেদন করে। হিন্দুশাস্ত্রে এটি হলো সবচেয়ে পবিত্র স্তোত্র।]

রাজবংশের বিবরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ায় ভারতীয় ইতিহাসকে ভাগ করা হয়েছে তিনভাগে— প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগ শুরু হয়েছে আর্য সভ্যতার আগমনের সঙ্গে (পরবর্তী কালের রচনা অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার বিবরণ থেকে শুরু)। এই যুগের শেষ হয়েছে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতে তুর্কী আক্রমণের সময়। এখান থেকে শুরু মধ্যযুগ, আর তা গিয়ে শেষ হয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশদের আগমনের সময়। যুগ-বিভাগের এই রীতিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে আবার একটা ভ্রান্ত সমীকরণ সৃষ্টি করা হয় যাতে প্রাচীন যুগকে হিন্দু ও মধ্যযুগকে মুসলমান বলে চিহ্নিত করা হলো, কেননা প্রাচীন যুগে অধিকাংশই ছিল হিন্দু রাজবংশ, আর পরের যুগের বেশির ভাগই মুসলমান রাজবংশ। দুই যুগকে আলাদা করে দেখানোর জন্যে মুসলিম সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাচীন সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত বলে জোর করে দেখানো হলো। এই বিভেদের যুক্তি হিসেবে ধর্মতত্ত্ববিদের রচনা ও মুসলিম রাজাদের সভাসদদের রচিত ধারা-বিবরণীর উল্লেখ করা হলো।

বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় এবং অভারতীয় ঐতিহাসিকেরা উভয়েই এই হিন্দু ও মুসলমান যুগবিভাগ মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিভাগ শুধু যে ভ্রান্ত তাই নয়, এর ভিত্তি সম্বন্ধেও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। দুই যুগের এরকম নামকরণ থেকে যেমন মনে হয়, ভারতবর্ষে ধর্ম কখনোই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের তেমন প্রধান কারণ ছিল না, ধর্ম ছিল নানা কারণের একটি মাত্র। ইদানীংকালে ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন যুগকে অন্যভাবে বিভক্ত করার চেষ্টা হয়েছে, যাতে বিভাগের ভিত্তি আগের মতো অযৌক্তিক না হয়। (বিভ্রান্তি এড়াবার জন্যে পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে যুগবিভাগের নামকরণ পরিহার করা হয়েছে।)

উপমহাদেশের ভৌগোলিক গঠনের প্রভাবও ভারতবর্ষে ইতিহাস-চর্চার উপর খানিকটা পড়েছে। উত্তর ভারতের সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমিতে সহজেই বড় বড় রাজ্য-স্থাপনা সম্ভব হয়েছে। উপমহাদেশের দক্ষিণাংশের উপদ্বীপ অঞ্চলটি পাহাড়, মালভূমি আর নদী উপত্যকায় খণ্ড-বিখণ্ডিত। এই বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক গঠনের জন্যে উত্তরের সকল অঞ্চলের তুলনায় এখানে রাজনৈতিক একতা কিছুটা কম। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে উত্তরের অপেক্ষাকৃত বড় বড় রাজ্যগুলো ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইতিহাসের যে সময়ে বড় বড় রাজ্য ছিল, সে সময়কে বলা হয়েছে ‘স্বর্ণযুগ’, আর যে সময়ে ছোট ছোট আঞ্চলিক রাজ্যের ছড়াছড়ি, ঐতিহাসিক সে সময়কে বলেছেন ‘অন্ধকার যুগ’। উপদ্বীপ অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে ঐতিহাসিকরা নজর দিয়েছেন কেবল বড় আয়তনের সাম্রাজ্যের সময়টুকুতেই। অমনোযোগের আর একটি কারণ হলো, উত্তরাঞ্চল ও উপদ্বীপ অঞ্চলের রাজনৈতিক কৌশল ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা একই ধরনের ছিল না। উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলোর শক্তির পরিচয় ছিল রাজ্যের সীমানা বিস্তারের মধ্যে। রাজস্ব আদায় হতো কেবল স্থলভূমি থেকেই। যে-কোনো ঐতিহাসিকের পক্ষেই এগুলো সহজবোধ্য ব্যাপার। অপরদিকে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর গঠনের ব্যাপারে তাদের নৌ-শক্তির হিসেব নেওয়াও প্রয়োজন। তার ওপর ছিল সামুদ্রিক বাণিজ্যের হিসেব-নিকেশ পুরো ব্যাপারটা উত্তরাঞ্চলের তুলনায় বেশ জটিল।

ইতিহাস রচনার পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির কথা উল্লেখ করার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আগেকার ঐতিহাসিকদের রচনার কোনো মূল্যই নেই। তাছাড়া এখানে তাঁদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কটাক্ষপাতের কোনো প্রশ্ন ওঠে না! তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির যে অসম্পূর্ণতা, তা অনেক সময়ই তাঁদের যুগেরই অসম্পূর্ণতা। কেননা, যে- কোনো ঐতিহাসিকই কিছুটা নিজের অজ্ঞাতসারেই তাঁর নিজের যুগের প্রতিনিধি। তাঁদের রচনার ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাঁরা ভারত-ইতিহাসের একটা ভিত্তি স্থাপন করতে পেরেছেন। তার সঙ্গে পাওয়া গেছে একটা নির্ভরযোগ্য কালানুক্রমিক ধারাবিবরণী। এর ওপর ভিত্তি করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস রচনা হলে ভারতীয় সভ্যতার আদর্শ ও বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে।

অতীতে ভারতবিদ্ ঐতিহাসিকদের মূলত প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ হিসেবে গণ্য করা হতো। তখনকার দিনে প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদরা এশিয়া মহাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতেন। আর অন্তত সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে তাঁদের লেখা সুদূরের রহস্যে আবৃত। ইউরোপে ও ভারতের প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কিত ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্যানধারণা এখন পাল্টে গেছে। বর্তমান জগতে ইতিহাসকে প্রাচীন সংস্কৃতির চর্চা হিসেবে না ধরে সামাজিক বিজ্ঞানের অঙ্গ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই নতুন পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভারতের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে যেসব নতুন নতুন প্রশ্ন উঠছে তা প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদদের মনে আসেনি। পার্থক্যটা হলো প্রধানত ঐতিহাসিক গুরুত্বের। রাজনৈতিক ইতিহাস ও রাজবংশগুলোর পর্যালোচনা এখনো ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। তবে এর সঙ্গে এখন মিলিয়ে দেখা হচ্ছে আরো অন্যান্য বিষয় যা একটি জাতি ও তার সংস্কৃতি গঠনের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আবার এ দুটির প্রভাব পড়েছে সামাজিক সম্পর্কের ওপর। কোনো ধর্মীয় আন্দোলনে যদি অনেক লোক অংশগ্রহণ করে, তাহলে আন্দোলনের আকর্ষণের সঙ্গে এইসব মানুষদের কোথাও একটা তাৎপর্যপূর্ণ যোগ খুঁজে পাওয়া যাবে। একটা নতুন ভাষা ও সাহিত্য তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন তা সমাজের মানুষের কোনো গভীর প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে, কারণ সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ভারত- ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের ঐতিহাসিক নায়কদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তা বিশ্লেষণ করলেই ঐতিহাসিকদের দায়িত্ব শেষ হবে না— জানা দরকার এত শতাব্দী ধরে কেন ভারতের মানুষ তাঁদের ভাবনাচিন্তাকে গ্রহণ, বর্জন বা পরিমার্জন করে এসেছেন।

এই বইতে এসব প্রশ্নগুলোকে উত্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বইটির উদ্দেশ্য হলো, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তনে যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে এবং যেসব ঘটনা এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোকে চিহ্নিত করে দেখানো। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির মূল্যায়ন করা বা নিশ্চিতভাবে এর গুণাগুণ নিয়ে মন্তব্য করার ঝোঁককে সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তেমন কোনো চেষ্টা করলে তা অর্থহীন মামুলি মন্তব্যে পর্যবসিত হতে বাধ্য। এটি মূলত কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস নয়। রাজবংশের কালানুক্রমিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে কেবল সময়ের হিসেব রাখার সুবিধার জন্যে। অর্থনৈতিক গঠন, পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি, বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব ও উন্নতি ইত্যাদি : কয়েকটি বিষয়ের ক্রমবিবর্তনের অনুসন্ধান করতে গিয়ে কয়েকটি ছক ও বিন্যাস ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হয়েছে। এই বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেই ছক ও বিন্যাসের বিবরণ এবং তার সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন ঘটনা ও তথ্য সাধ্যমতো বিশ্বাসযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে।

সম্প্রতি দুই কারণে প্রাচীন যুগের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরো তথ্যসমৃদ্ধ হয়েছে। এক, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে সমাজকে অধ্যয়নের নূতন পদ্ধতির উদ্ভব এবং দুই, প্রত্নবিদ্যালব্ধ প্রমাণ ও নিদর্শন ইতিহাস রচনায় বহুলভাবে ব্যবহার। প্রথম পদ্ধতিটির গুরুত্ব এই যে, ভারতের অতীত ইতিহাসকে বুঝতে পারার নতুন নতুন পথের সম্ভাবনা এ থেকে খুলে যাবে। তাছাড়া এভাবে যেমন নতুন প্রশ্ন উঠবে তার উত্তর অনুসন্ধানের মধ্যেই ভারত- ইতিহাসের প্রকৃত উপলব্ধি সম্ভব হয়ে উঠবে। কয়েক ধরনের গবেষণার কাজে এই পদ্ধতির সার্থক ব্যবহার ইতিমধ্যেই হয়েছে। সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অন্যান্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তুলনামূলক বিচার সম্বন্ধেও আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এটি অবশ্য পুরনো অভ্যাসমতো কোনো একটি বিশেষ সংস্কৃতির মাপকাঠিতে অন্যান্যগুলোর মান নির্ধারণের চেষ্টা নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই ইউরোপীয় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মার্ক ব্লকের (Mark Block) আলোচনা ভারতীয় ঐতিহাসিকদের কাছে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় বই হয়ে উঠতে পেয়েছে।

জরীপ, নিরীক্ষণ ও খননের সাহায্যে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব উপাদান কেবল যে পুঁথিবদ্ধ সাক্ষ্যগুলোকেই সত্য বলে সমর্থন করেছে তা নয়, ভারতের প্রাচীনতম ইতিহাসের বহু ফাঁকও পূরণ করতে সাহায্য করেছে। ভারতের প্রাক্-ইতিহাস সম্পর্কে গত পনেরো বছরে যা তথ্য পাওয়া গেছে তা পরবর্তী যুগের সংস্কৃতির বিন্যাসের ভিত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করেছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্র সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণা থাকলেও ভারতের প্রাচীন ইতিহাস বুঝতে সুবিধা হয়।

এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে, ভারতে মানুষের গতিবিধির সন্ধান মিলেছে খ্রিস্টপূর্ব চার লক্ষ থেকে দু’লক্ষ বছর আগে দ্বিতীয় হিমযুগের সময়ে। তখন প্রস্তর-হাতিয়ারের ব্যবহার হতো তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপর দীর্ঘদিন ধীরে ধীরে ক্রমবিবর্তনের পালা চলে। কিন্তু শেষদিকে বিবর্তনের গতি কিছুটা দ্রুত হয়ে চমকপ্রদ সিন্ধু-সভ্যতার জন্ম হয়। ইদানীংকালে যাকে বলা হচ্ছে হরপ্পা সভ্যতা, আনুমানিক সময় তখন ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রাগ্-হরপ্পা সভ্যতার কিছু নমুনা পাওয়া যাবে বালুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে নাল সংস্কৃতি। এবং সিন্ধুনদের অববাহিকার পশ্চিমে সকরাণ উপকূলের কুল্লি সংস্কৃতি এর উদাহরণ। আর পাওয়া যাবে, রাজস্থান ও পাঞ্জাবের নদীগুলোর তীরে তীরে কয়েকটি গ্রাম্যগোষ্ঠীর মধ্যে।

পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সমভূমি উত্তর রাজস্থান এবং পশ্চিম ভারতের কাথিয়াওয়াড় অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে হরপ্পা সভ্যতাই ছিল সবচেয়ে ব্যাপক। এটি অবশ্য একান্তভাবেই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা আর ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্র ছিল মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা শহর দুটি।* দুই শহরের বিরাট ও সুনির্মিত শস্যভাণ্ডার দেখে মনে হয়, শহরগুলোর খাদ্যের যোগান আসত দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। অর্থাগমের আর একটি সূত্র ছিল উপমহাদেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে ফলাও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশ ও মেসোপটেমিয়ার লোকেদের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগসূত্ৰ।

[* ইদানীংকালের খননকার্যের ফলে আরো কয়েকটি শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন সিন্ধুতে কোট ডিজি, রাজস্থানে কালিবঙ্গান, পাঞ্জাব রুপার এবং গুজরাটে একটি বন্দর লোথাল। কিন্তু আগেকার শহর দুটিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।]

শহরগুলোতে অত্যাধুনিক নগর-পরিকল্পনার নমুনা দেখা গেছে। প্রতি শহর বিভক্ত ছিল দুই অংশে— একটি সুরক্ষিত প্রাকারযুক্ত দুর্গের মতো অংশ যেখানে অবস্থিত ছিল নগরজীবন ও ধর্মীয় সংস্থার প্রধান কেন্দ্রগুলো; অন্য অংশে নাগরিকরা বাস করতেন।

হরপ্পা সভ্যতার নানা অবশিষ্টের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো শীলমোহরগুলো। ছোট, চ্যাপ্টা, চৌকো বা আয়তক্ষেত্রাকার এই শীলমোহরগুলোর উপর মানুষ বা পশুর মূর্তি খোদাই করা আছে। তার সঙ্গে কিছু লেখা। এই লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি। আশা করা হয়, পাঠোদ্ধার করা গেলে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য জানা যাবে। যে দুহাজার শীলমোহর পাওয়া গেছে, এগুলোকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যবহৃত নিজস্ব অভিজ্ঞান বা মুদ্রা বলে মনে করা হয়। অথবা গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে যেসব শস্যসামগ্রী আনা হতো, তার সঙ্গেও হয়তো এদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।

হরপ্পা সভ্যতা ও পরবর্তী আর্য-সভ্যতার মধ্যে যে কোনো ধারাবাহিকতা থাকতে পারল না তার কারণ হলো, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে অপেক্ষাকৃত অসভ্য জাতির লোকেদের সিন্ধু-উপত্যকায় আগমন। ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই হরপ্পা সভ্যতার দিন ফুরিয়ে এসেছিল। এরপরে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল নাগাদ ইরান থেকে ইন্দো-আর্যরা এসে পড়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সংস্কৃতিতে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্যের আমদানি করল। ভবিষ্যতেও উপমহাদেশের এই অঞ্চলটির সঙ্গে সিন্ধুনদী ও হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তর ও পশ্চিম দিকের অংশের যোগাযোগ বজায় ছিল। এই ভূখণ্ডটি অনেক সময় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়ত এবং সেখানকার সংস্কৃতির অঙ্গভূত হয়ে যেত। এইভাবেই পশ্চিম-ভারতের যোগাযোগ রইল পশ্চিমের সামুদ্রিক অঞ্চল, পারস্য উপসাগরীয় ও লোহিত সাগরীয় অঞ্চলগুলোর সঙ্গে। সিন্ধু উপত্যকার ও গাঙ্গেয় সমভূমির পরবর্তী ক্রমবিবর্তনের পার্থক্যের এই হলো কারণ।

আরো পূর্বদিকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় মানুষের ছোট ছোট বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মানুষেরা ছিল শিকার ও কৃষিকাজের মাঝামাঝি একটা স্তরে। পাথর ও তামার তৈরি নানা জিনিস আর গৈরিকবর্ণ নিম্নস্তরের মৃৎপাত্র এরা ব্যবহার করত। ইন্দো-আর্যেরা যখন গাঙ্গেয় উপত্যকায় এসে পৌঁছল, তখন তারা সম্ভবত এই মানুষগুলোরই দেখা পেয়েছিল। কেননা, ধূসর রঙ করা যেসব মৃৎপাত্রের সঙ্গে ইন্দো-আর্যদের যোগ আছে বলে আজকাল অনুমান করা হয়, সেগুলো মাটির এমন সব স্তরে পাওয়া গেছে যার নিচের স্তরে কোথাও কোথাও আগেকার গৈরিক রঙের মৃৎপাত্রেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

ধূসর রঙ করা মৃৎপাত্র খুঁজে পাওয়া গেছে গাঙ্গেয় উপত্যকার পশ্চিম অংশে। মনে হয় এগুলোর ব্যবহার ছিল ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। যেসব জায়গায় প্রাচীনতর নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার কোনো কোনো স্থানে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে লোহা। ভারতের প্রথম লোহা ব্যবহারের সময়কে এতদিন মোটামুটি ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে ধরা হতো। এই নতুন আবিষ্কারের ফলে কিন্তু সেই তারিখকে আরও প্রাচীন বলেই মনে হচ্ছে। ধূসর রঙ করা মৃৎপাত্রের অঞ্চলগুলোতে কৃষিজীবী মানুষের বাস ছিল বলে মনে হয়। তারা গবাদি পশু ও ঘোড়া পালন করত। সাধারণভাবে তামার ব্যবহারও এরা জানত। হরপ্পা সভ্যতার অঞ্চলে ঘোড়ার কিন্তু একেবারেই কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই আবার বলা হয় ধূসর রঙ করা মৃৎপাত্রের অঞ্চলগুলো সম্ভবত আর্য-সভ্যতারই অংশ। এই অঞ্চলগুলো থেকে এ যাবৎ যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তার সঙ্গে বেদ ইত্যাদি গ্রন্থে আর্য-সভ্যতা ও সংস্কৃতির যা বর্ণনা পাওয়া যায়, তার বেশ মিল লক্ষণীয়।

দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে ছোট ছোট চকমকি পাথরের তৈরি হাতিয়ারের সন্ধান পাওয়া গেছে। পরে ব্রোঞ্জ যুগে তামা, ব্রোঞ্জ ও পাথরের একত্র ব্যবহারেরও নিদর্শন আছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় অপেক্ষাকৃত উঁচুমানের কারিগরিবিদ্যার কাছে এরা হার মানে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ক্রমশ লোহার ব্যবহার থেকে।

তাছাড়া উত্তরাঞ্চলের পালিশ করা কালো মৃৎপাত্রেরও ব্যবহার এখানে দেখা যায়। এ দুটি বস্তুই গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এর থেকে বোঝা যায়, আর্যরা ক্রমশ দক্ষিণদিকে এগিয়ে আসছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকা ও দাক্ষিণাত্যের মধ্যে যোগাযোগও স্থাপিত হয়েছিল। এরপর বহু শতাব্দী ধরে উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ সাধনের যে ভূমিকা দাক্ষিণাত্য নিয়েছিল, তারই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এই সময়। দাক্ষিণাত্যে কেবল যে উত্তরের আর্য-সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল তাই নয়, ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ডেকান মালভূমির দক্ষিণদিকের কয়েকটি জায়গার সঙ্গে ভারতবর্ষের দক্ষিণতম অঞ্চলের প্রাচীন বৃহৎ প্রস্তরযুগীয় মেগালিথিক সভ্যতার যোগাযোগ ঘটেছিল।

দক্ষিণ ভারতের (মাদ্রাজ, কেবল ও মহীশূর) বৃহৎ প্রস্তরযুগীয় (মেগালিথিক ) সভ্যতার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মেগালিথিক সভ্যতার রীতিমতো মিল পাওয়া গেছে। মনে হয়, পশ্চিম এশিয়া থেকেই দক্ষিণ ভারতে এই সভ্যতার আগমন ঘটেছিল। প্রাচীন যুগের এই যোগাযোগ বজায় ছিল প্রায় আধুনিককাল পর্যন্ত।

দক্ষিণ-ভারতীয় মেগালিথ বা সমাধি স্মৃতিসৌধগুলো ছিল পাহাড় থেকে কাটা পাথরের কবর অথবা গোলাকার ঘেরা জায়গার মধ্যে আয়তাকার প্রস্ত রনির্মিত শবাধার। এইসব শবাধার কখনো কখনো মাটি দিয়েও তৈরি হতো। এর মধ্যে থাকত হাড়গোড় আর প্রথানুযায়ী কিছু জিনিসপত্র (যেমন একটি বিশেষ ধরনের লাল-কালো রঙের পাত্র)। এইসব স্মৃতিসৌধগুলো যেখানে পাওয়া গেছে, তার কাছাকাছি ছিল উর্বর ও পুকুরের জলে সেচ হওয়া জমি। ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী এই মেগালিথিক সভ্যতার পর থেকেই শুরু হয় দক্ষিণ-ভারতের ঐতিহাসিক যুগ।

এইসব বিভিন্ন সভ্যতার লোকদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য কিন্তু এক ধরনের ছিল না। জাতিবিদ্যাগত অনুসন্ধানে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধান ছয়টি জাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। সবচেয়ে প্রাচীন হলো, নেগ্রিটো। তারপর এলো প্রোটো- অস্ট্রালয়েড। এরপর মঙ্গোলয়েড ও মেডিটেরেনিয়ান। এর পরবর্তীরা আর্য- সভ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হরপ্পা অঞ্চলে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, মেডিটেরেনিয়ান, আলপাইন ও মঙ্গোলয়েড মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয়, এই সময়ে উল্লিখিত প্রথম পাঁচটি জাতি ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য ছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েড শ্রেণির লোকেদের। এদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত। এর উদাহরণ পাওয়া গেছে কয়েকটি আদিম উপজাতির মুণ্ডাভাষার মধ্যে। মেডিটেরেনিয়ান বা ভূমধ্যসাগরীয় জাতির প্রধান যোগ ছিল দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে। মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর লোকের প্রধান বাসভূমি ছিল উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর অঞ্চলগুলোতে। এদের ভাষার সঙ্গে চীন-তিব্বতীয় (Sinc-Tibetan) ভাষাগোষ্ঠীর সাদৃশ্য আছে। এদেশে সবচেয়ে শেষে যে জাতিগোষ্ঠীর আগমন, আমরা তাদের সাধারণভাবে আর্য বলে অভিহিত করি। প্রকৃতপক্ষে ‘আর্য’ শব্দটি ইন্দো- ইউরোপীয় একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম, এটি আদৌ কোনো জাতিগত বিভাগের নাম নয়। সুতরাং আর্যদের আগমনের উল্লেখ করাটা সেদিক থেকে ভ্রান্তিমূলক। অবশ্য এই ভুল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষণার ব্যাপারে এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে এখন আর্যদের ‘আর্যভাষাভাষী জাতি’ বলে অভিহিত করতে যাওয়াটা অকারণ পাণ্ডিত্য জাহির করা হয়ে যাবে। ভারতে প্রাপ্ত প্রমাণের উপর নির্ভর করে তাদের জাতিগত সত্তা নিরূপণ করা যায় না।

এই উপমহাদেশের বিভিন্ন যুগের জনসংখ্যা সম্পর্কে পরীক্ষামূলক হিসাব করা হয়েছে। তবে এই হিসেব নিতান্তই আনুমানিক। একটি হিসেব অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে উপমহাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি ১০ লক্ষ বলে ধরা হয়েছে।* উত্তর-ভারতে আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তিসংখ্যা সম্পর্কে গ্রীক বিবরণে যা বলা হয়েছে সেটাই হলো এই হিসেবের প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এও সম্ভব যে, গ্রীক লেখকেরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। কেননা, তাহলে বোঝানো যাবে, গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত অভিযান চালাতে গেলে আলেকজাণ্ডারকে কত বিরাট এক সামরিক শক্তির সম্মুখীন হতে হতো। এই ১৮ কোটি ১০ লক্ষ লোকের হিসেব কিছুটা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। এই সময়ের জনসংখ্যা ১০ কোটি বা তার কিছু কম ধরলে তা মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে লোকসংখ্যা ছিল ১০ কোটি।+ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় প্রথম লোকগণনা হয়েছিল ১৮৮১ সালে। তখন লোকসংখ্যা হয়েছিল ২৫ কোটি ৩০ লক্ষের কিছু বেশি।

ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগের এইসব জনগোষ্ঠীও সভ্যতা-সংস্কৃতির পটভূমিতে আর্য-ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটল উত্তর প্রান্তে। ভারতীয় সভ্যতায় তাদের প্রভাব পড়ল পরবর্তী যুগে।

* J. M. Datta, ‘Population of India about 320 B.C.’ Man in India, Vol. 42, No. 4, Oct- Dec. 1962.

+ W.H. Moreland, India at the Death of Akbar, (Delhi, 1962), p. 21.

1 Comment
Collapse Comments
রেজওয়ান খায়ের February 21, 2024 at 1:50 am

অশেষ ধন্যবাদ। এই বইগুলো পেয়ে যে কত উপকৃত হচ্ছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *