১. প্রাককথন (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

১. প্রাককথন (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

ওয়ারিস্তান রাষ্ট্রের ইস্টার্ন প্রভিন্স। সেনাপ্রধান রকি চৌধুরীর আশিকানা প্রাসাদ। ৩০ সেপ্টেম্বর। রাত তিনটে।

.

‘ইন্ডিয়াকে ওড়াতে আমার তিন মিনিট সময় লাগবে। জাস্ট তিন মিনিট। ইলেকশনটা হোক, আমাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিন। আই মাইসেলফ উইল প্রেস দ্য বাটন অফ ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল।’ এক চুমুকে সিঙ্গল মল্টের গ্লাস শেষ করে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল রাজু মণ্ডল। ওয়ারিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘ডাব্লিউডিপি’র সেক্রেটারি। আগামী নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদের একনম্বর দাবিদার।

রাজুর বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। ছ’ফুটের ওপরে লম্বা, দেড়শো কেজি ওজন, একমাথা কাঁচাপাকা চুল পনিটেল করা। গাল ভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। বিশাল পাকানো গোঁফটি হেনা দিয়ে রাঙানো। মাছের মতো মদ খায়। চিমনির মতো ধোঁয়া ছাড়ে, ষাঁড়ের মতো খায়। জীবনের একমাত্র স্বপ্ন, ভারতবর্ষকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া।

‘ওইসব কথা আপনি ভোটের আগে বলুন। ভোটের পরে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আর বলবেন না। তখন মিডিয়ার সামনে হাসি মুখে শান্তিচুক্তি সই করবেন আর আড়ালে প্রক্সি ওয়ার চালাবেন। ওয়ারিস্তানের অতীত প্রধানমন্ত্রীরা এতদিন যা করে এসেছে।’ বলল নিসিম গ্রিনবার্গ।

গ্রিনবার্গ ইজরায়েলের ইহুদি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রণতরী কোম্পানি ‘ডেথ সি শিপইয়ার্ড’-এর মালিক। বয়স ষাটের আশেপাশে। বেঁটে, রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা, সবুজ চোখের মণি, গায়ের রং ফ্যাকাসে। গ্রিনবার্গ সম্প্রতি সমস্যায় আছে। কোল্ড ওয়ারের সময় জাহাজ বিক্রিতে সমস্যা হত না। দুই স্বঘোষিত নেতা, আমেরিকা আর রাশিয়া, শিপইয়ার্ড থেকে জাহাজ বেরোনোর আগেই সব কিনে নিত। সাবেক সোভিয়েতের পতনের পরে ঠান্ডা লড়াই শেষ। রণতরীর বাজার ঠান্ডা। বাধ্য হয়ে গ্রিনবার্গ নতুন বাজার তৈরিতে মন দিয়েছে। যুদ্ধ না হলে তার মালটি-ট্রিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে। গ্রিনবার্গের লক্ষ্য সাউথ ইস্ট এশিয়ার দুটি দেশ। অতীতে যাদের বলা হত তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এখন বলা হয় উন্নয়নশীল দেশ। সদা বিবাদমান এই দেশদুটি হল ওয়ারিস্তান আর ভারতবর্ষ।

ভারতের দক্ষিণে, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপদেশ ওয়ারিস্তান। প্রকৃতি রুক্ষ, নদীনালা কম, চাষআবাদের সুযোগ নেই। শিল্প বা বাণিজ্য গড়ে ওঠেনি। মূলত গাঁজা চাষ ও মাদক রফতানির ওপরে দাঁড়িয়ে এই দেশের অর্থনীতি। অতীতে ভারতের সঙ্গে ওয়ারিস্তানের সুসম্পর্ক ছিল। ব্রিটিশ বণিকের মানদণ্ড যেদিন থেকে রাজদণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, যেদিন থেকে তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিকে সফলভাবে ইমপ্লিমেন্ট করল, তবে থেকে ওয়ারিস্তান ভারতকে শত্রুদেশ মনে করে। লিবারাল বা কনজার্ভেটিভ যে পার্টিই ক্ষমতায় আসে, তাদের ভারতবর্ষের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।

ওয়ারিস্তানকে আসলে চালায় সেনাবাহিনী। নিজেরা ক্ষমতায় না এসে তারা পুতুল সরকার তৈরি করে। নির্বাচন আসে যায়। রাজা বদলায়। পুতুল প্রধানমন্ত্রী দেশশাসন করে। যেমন, এখনকার পুতুল প্রধানমন্ত্রীর নাম মায়া মল্লিক।

মায়ার পড়াশুনো অক্সফোর্ডে। ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান নিয়ে। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে শিল্প ও কৃষিহীন ওয়ারিস্তানের হাল ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মায়া প্রাো-ইন্ডিয়ান, ধর্মের দিক থেকে লিবারাল, প্রাো-গে, প্রাো-ডেমোক্র্যাসি, প্রাো-উওম্যান! এর দ্বারা দেশশাসন হয়? নিসিম গ্রিনবার্গ মায়ার ভূমিকায় খুশি নয়। সে ঝুঁকেছে প্রবলভাবে পিতৃতান্ত্রিক, গোঁয়ার, ‘ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘ডাব্লিউডিপি’-র দিকে।

ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নতুন সংগঠন। উগ্র অ্যান্টি-ইন্ডিয়া স্ট্যান্ডের জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করছে দ্রুত। অশিক্ষিত, কর্মহীন ওয়ারিস্থানি যুবকেরা দলে দলে পার্টিতে নাম লেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে থেকে মাথামোটা, পিছুটানহীন, বলশালী যুবকদের গোপন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে সুইসাইড বোম্বার বানানো হচ্ছে। অর্থ, ইনফ্রা-স্ট্রাকচার, এক্সপার্টাইজ সাপ্লাই করছে গ্রিনবার্গ।

‘আপনার কথা মানতে পারলাম না গ্রিনবার্গ। শুধু প্রক্সি ওয়ার দিয়ে আর চলবে না। ইন্ডিয়াকে ধুলোয় মেশাতেই হবে। পাশাপাশি ওই চুড়েইলকেও খতম করতে হবে।’ আর এক পেগ সিঙ্গল মল্ট শেষ করে রাজু। তার গালাগালের লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিক। সামনেই ভোট। মায়ার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা একশো শতাংশ। কিন্তু ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধান, ওয়ারিস্তানের কিং মেকার রকি চৌধুরী চাইছে রাজুর মতো প্রধানমন্ত্রী। অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান, রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক, অটোক্র্যাটিক, প্যাট্রিয়ার্কাল। ‘মেয়েদের স্থান রান্না আর শোবার ঘরে, হোমোদের স্থান কবরে!’ এই স্লোগান তুলে বিপুল জনপ্রিয়।

রাজু মণ্ডল এবং নিসিম গ্রিনবার্গ বসে রয়েছে সেনাপ্রধান রকি চৌধুরীর ‘আশিকানা’ প্রাসাদে। ওয়ারিস্তানের ইস্টার্ন প্রভিন্সে অবস্থিত আশিকানা প্রাসাদ একাধিক মিলিটারি ‘ক্যুদেতা’-র ষড়যন্ত্রের সাক্ষী। ‘ক্যুদেতা’ বা ‘ক্যু’ শব্দের অর্থ, ডিকশনারি অনুযায়ী, ‘সাডেন চেঞ্জ অব পাওয়ার, অফন উইথ ইললিগাল অর ভায়োলেন্ট মোড।’ যখনই ওয়ারিস্তানে গণতন্ত্রের বাড়াবাড়ি দেখা দিয়েছে, তখনই আশিকানায় মিলিটারি প্রধানের সঙ্গে রাজনীতির মহারথী এবং অস্ত্র লবির পাণ্ডাদের গোপন মিটিং করতে দেখা গেছে।

আজকের মিটিংও সেইরকমভাবে শুরু হয়েছে। বিশাল বড় হলঘরের মেঝেতে ভিভিডিয়াসের ম্যাট্রেস, গডফ্রে হার্স্ট কোম্পানির গালিচা পাতা। একদিকের দেওয়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছে নর্থল্যান্ডের বিশাল রেফ্রিজারেটর। লেক্সিংটনের সোফায় বসে শুরু হয়েছে কথাবার্তা। সঙ্গে এলাহি পানভোজনের ব্যবস্থা। ভেড়ার মাংস কাঠের আগুনে সেঁকে বানানো হচ্ছে তুলতুলে শিককাবাব, দুনিয়ার সবচেয়ে মহার্ঘ সিঙ্গল মল্টের ফোয়ারা বইছে। এককোণে বসে দুই গায়ক সুফিসঙ্গীত গাইছে।

গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ‘মিউজিকাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান’ সারা পৃথিবীতে ‘চাচাম-চানান’ নামে পরিচিত। হিব্রু ভাষায় চাচাম মানে ‘ওয়াইজ ওয়ান।’ চানান মানে ‘গ্রেস’। মিউজিকাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান’ পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় অনুষ্ঠান করতে পঞ্চাশ হাজার ডলার নেয়। আশিকানায় গাইতে এসেছে প্রাণের দায়ে। বিনি পয়সায়। বুল্লা শাহ-এর সুফি গানের সঙ্গে নাচছে তাতিয়ানা। আজারবাইজানের এই ‘গোরি চামড়ি’ কীভাবে যেন ওয়ারিস্থানে এসে পড়েছে। সামান্য টাকার বিনিময়ে পয়সাওয়ালা লোকেদের প্রাইভেট মেহফিলে বেলিডান্স করছিল। রকি জানতে পেয়ে আশিকানায় তুলে এনেছে। তাতিয়ানা এখন এখানেই থাকে আর সন্ধেবেলা অতিথিদের মনোরঞ্জন করে। রকি ভুরু কুঁচকে, থুতনিতে তর্জনী রেখে নাচ দেখছে।

রকির বয়স ষাট বছর। ওয়ারিস্তানের মানুষের জিনে একটা কিছু আছে। এখানকার পুরুষ ও নারীরা সুন্দর হয়। ফরসা, স্বাস্থ্যবান, লম্বা, ত্রুটিহীন ত্বকের অধিকারী ভিক্ষুক প্রতিটি রাস্তায় দেখা যায়। সেই দেশে পাঁচফুটিয়া, রোগা-পাতলা একজন মানুষ যখন দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে সেনাপ্রধান থাকে, তখন বোঝা যায় লোকটার জোরের জায়গা পেশি নয়, মস্তিষ্ক। হাতে সিঙ্গল মল্টের গ্লাস থাকলেও রকি এখনও চুমুক দেয়নি। থুতনিতে তর্জনীর টোকা দেওয়া তার মুদ্রাদোষ। টোকা দিতে দিতে সে রাজুর দিকে তাকাল।

রাজুর মধ্যে লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে। গত দু’ঘণ্টা ধরে যা আলোচনা হয়েছে, তাতে রকি বুঝতে পেরেছে, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য রাজুর যথেষ্ট লোভ। রকি দীর্ঘদিন ধরে ওয়ারিস্তানের রাজনীতিবিদদের নিয়ে দাবা খেলছে। রাজুর মতো মাথামোটা, গরম রক্তের নেতা আজ পর্যন্ত দেখেনি। তবে এসবে তার কিছু যায় আসে না। গ্রিনবার্গের আদেশ, রাজুকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে হবে। মায়ার মতো শান্তিকামী মেয়েছেলেকে কিছুতেই আর প্রধানমন্ত্রী রাখা যাবে না।

তবে তাই হোক। ওয়ারিস্তান জাহান্নামের দিকে এককদম এগোলে রকির কিছু যায় আসে না। আগামী বছর সেনাপ্রধানের পদ থেকে রিটায়ার করে সে বাহামা আইল্যান্ডে পালাবে। সেখানে কিয়ারা তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

কিয়ারা! কুড়ি বছর বয়সি ডাঁশা মেয়েটার সঙ্গে কবে যে আবার দেখা হবে…

‘আমরা এখানে ইলেকশানের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে এসেছি।’ কাশতে কাশতে বলল রাজু। আর এক পেগ সিঙ্গল মল্ট গলায় উপুড় করল। কিয়ারার চিন্তা মুলতুবি রেখে রকি খেয়াল করল, রাজু দশ পেগের আশেপাশে মদ খেয়ে আছে। এখন এর আচরণ মাতালের মতো, কথাবার্তা অসংলগ্ন, যুক্তিবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। এবার একে বাড়ি পাঠানো উচিত।

‘ইন্ডিয়াকে ওড়াতে আমার জাস্ট তিন মিনিট সময় লাগবে। আর মায়াকে ওড়াতে জাস্ট এক সেকেন্ড।’ বলে রাজু। তার চোখমুখ লাল। সে কাশছে।

‘শাটাপ!’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে গ্রিনবার্গ।

‘ইয়ু শাটাপ! উঁচ!’ হেঁচকি তুলে, বুকের বাঁদিকে হাত রাখে রাজু।

‘স্টপ ইট! ইউ আর ড্রাঙ্ক!’ ধমকায় গ্রিনবার্গ। রকি খুব মন দিয়ে রাজুকে দেখছে। সে খেয়াল করল রাজুর পা দুটো অস্বাভাবিকরকম ফোলা। দেখে মনে হয় জল জমেছে। টোকা দিলে জল ছিটকোবে।

আর এক পাত্র সিঙ্গল মল্ট গলায় ঢালল রাজু। তার মুখ বেঁকে গেছে। গালের পেশি থরথর করে কাঁপছে, ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। ‘স্টপ দিস বুলশিট।’ শান্ত কণ্ঠে বলে রকি। তার চোখেমুখে বিরক্তি। ‘বাড়ি যান রাজু। আপনার নেশা হয়ে গেছে।’ নরম গলায় বলে গ্রিনবার্গ।

‘নেশা আমার হয়নি। আমি যখন বলেছি, ভোটে জিতে ইন্ডিয়াকে উড়িয়ে দেব, তখন দেবই। আপনি বললে শুনব না।’

‘আপনাকে আমার কথাই শুনতে হবে!’ রকিকে চমকে দিয়ে পকেট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভার বার করে রাজুর রগে ঠেকায় গ্রিনবার্গ। ‘ভোটে জিতে আপনার প্রথম কাজ হবে ইন্ডিয়াকে ওড়ানো নয়। একটা কিয়েভ ক্লাস এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার কেনা।’

‘কিয়েভ… ক্লাস… এয়ারক্র্যাফট…?’ রাজু প্রশ্ন করে, ‘সেটা কী?’

‘৬৫০০০ টন ওজন বহনক্ষমতাসম্পন্ন বিমানপোত। দৈর্ঘ্য ২৮৪ মিটার, উচ্চতা ৬০ মিটার, প্রস্থ ১১ মিটার, গতি ৩০ নট।’ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পকেটে ঢুকিয়ে গ্রিনবার্গ বলে, ‘২ একর ফ্লাইং ডেকে আছে বিমান ওঠানামার জন্য রানওয়ে ও হেলিপ্যাড। আছে মিগ ২৯-এর মতো ৩০টা মাল্টি-রোল ফাইটার, কামোভ ৩১-এর মতো ৬টা হেলিকপ্টার, ৪টে চপার, ফ্লায়িং লেপার্ড লঞ্চার, ডিকয় লঞ্চার, বিমানের জন্য ত্রিমাত্রিক রাডার, জাহাজের জন্য ৪ প্যানেলযুক্ত রাডার। দাম আড়াই মিলিয়ন ইউএস ডলার।’

রাজু বলল, ‘আমার ওসব লাগবে না। আমাদের ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল আছে। ইন্ডিয়াকে ওড়াতে ওইরকম একটা নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডই যথেষ্ট।’

গ্রিনবার্গ রেগে আগুন হয়ে বলল, ‘ইডিয়েট! যুদ্ধ নয়! চাই যুদ্ধের জুজু! আপনি ”ডেথ সি কোম্পানি”-র একটা যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী কিনবেন। ওয়ারিস্তানের ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ঝুলিয়ে তার নাম দেবেন ”মওত।” ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাকেশ জৈনের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধের জুজু দেখিয়ে ও আমার কাছ থেকে আর একটা কিয়েভ ক্লাস এয়ারক্র্যাফট কেরিয়ার কিনবে। ইন্ডিয়ার ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ঝুলিয়ে নাম দেবে ‘আইএনএস স্বরাজ’। তবে না আমার মুনাফা হবে?’

গ্রিনবার্গের কথা সমর্থন করল রকি। রাজু গ্রিনবার্গের থেকে অস্ত্র কিনলে তবে রকি কাটমানি পাবে। রাজু তার ওয়ারিস্তান ছাড়ার পাসপোর্ট। রাজু তার বাহামার ভিসা। রাজু কিয়ারার কাছে পৌঁছোনোর উড়োজাহাজ। রাজুকে বোঝাতেই হবে।

স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন আবার পকেট থেকে বার করে টেবিলে রেখে গ্রিনবার্গ বলল, ‘আশা করি বুঝতে পেরেছেন।’

বুকের বাঁ-দিকে মাসাজ করতে করতে রাজু ঠান্ডা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ… মানে… আমার কেমন যেন লাগছে…’

রকি রাজুর দিকে তাকাল। মদে চুর রাজুর চোখের মণি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, শ্বাস পড়ছে ঘনঘন, স্বেদবিন্দু জমছে কপালে। রাজু কী একটা বলতে গেল। বলতে পারল না। সোফা থেকে কাটা গাছের মতো মেঝেতে পড়ে গেল।

‘মিউজিক্যাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান’ গান বন্ধ করে দিয়েছে। তাতিয়ানার নাভিনৃত্যও বন্ধ। গ্রিনবার্গ রাজুর ক্যারটিড আর্টারি টিপে বলল, ‘ওই মাই গড! হি ইজ ডেড!’

গ্রিনবার্গের কথায় পাত্তা না দিয়ে রকি বলল, ‘হি ইজ স্টিল অ্যালাইভ।’ পকেট থেকে মোবাইল বার করে ইস্টার্ন প্রভিন্সের কার্ডিয়াক কেয়ার হাসপাতালের প্রধান ডক্টর আমন মল্লিককে ফোন করল। হাতের ইশারায় হলঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারির সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড জিয়াকে ডেকে নিল। জিয়ার দ্বিতীয় পরিচয়, সে রকির স্ত্রী। হাতে একে ৪৭, আর্মি-ইউনিফর্ম পরা, বছর পঞ্চাশের জিয়ার ঘরে ঢোকার পারমিশান ছিল না। সে এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়েছিল।

‘হেলিকপটার-অ্যাম্বুল্যান্স কোথায় পাঠাতে হবে?’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন ডক্টর আমন মল্লিক। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমন জানেন, গভীর রাতে রকির ফোন কল কোনও ভালো খবর বয়ে আনবে না।

‘আশিকানার ছাদের হেলিপ্যাড।’ বলল রকি।

‘দশ মিনিটের মধ্যে চলে যাচ্ছে।’ বললেন আমন। রকি রাজুর দিকে তাকায়। রাজু সমানে হাঁফাচ্ছিল, সমানে কাশছিল। সমানে বুকের বাঁদিকে হাত বোলাচ্ছিল। পা-দুটো ফুলে ঢোল। ওর শরীরে অন্য কোনও রোগ বাসা বেঁধেছে না কি? আবার রাজুর পালসে হাত দেয় রকি। দুর্বল পালস খুব দ্রুত চলছে। যেন দুর্বল জলের পাম্প ট্যাঙ্কে যথেষ্ট জল তুলতে না পেরে বেশি পরিশ্রম করছে। এবং আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাজুর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করেছে। বাঁচার সম্ভাবনা কম।

দুজন রক্ষী রাজুকে স্ট্রেচারে শোয়াচ্ছে। গ্রিনবার্গ ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হেলিকপটার-অ্যাম্বুল্যান্সের রোটর ব্লেডের শপশপ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

.

কার্ডিয়াক কেয়ার হসপিটাল। ইস্টার্ন প্রভিন্স। ওয়ারিস্তান।

৩০ সেপ্টেম্বর। ভোর চারটে।

.

‘ডক্টর মল্লিক, হাউ ইজ দ্য পেশেন্ট?’ প্রশ্ন করল রকি।

ডক্টর আমন মল্লিক কার্ডিয়াক কেয়ার হাসপাতালের এক নম্বর কার্ডিয়োলজিস্ট। হাসপাতালের ছাদে হেলিকপটার-অ্যাম্বুল্যান্স নামার পরে গত চল্লিশ মিনিট ধরে তিনি আইসিসিইউয়ের ভিতরে ছিলেন। আশিকানায় পৌঁছেই হার্ট স্পেশালিস্ট ও সিস্টার রাজুর নাকে অক্সিজেনের নল গুঁজে দিয়েছিল। ফ্লুইড চালিয়ে জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন দিয়ে উড়িয়ে এনেছিল হসপিটালে। রাজু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল রাত তিনটেয়। আইসিসিইউতে ঢুকেছে তিনটে কুড়িতে। যমে-মানুষে টানাটানির শেষে এবার রেজাল্ট জানার পালা।

ডক্টর মল্লিক বললেন, ‘আই হ্যাভ গট আ গুড নিউজ অ্যান্ড আ ব্যাড নিউজ। কোনটা আগে শুনবেন?’

‘খারাপ খবর ডক্টর। আমরা আর্মির লোক। খারাপ খবরটাই আমাদের কাছে একমাত্র খবর।’

‘ওয়েল, রাজুর হার্টে জোড়া ব্যামো আছে। করোনারি আর্টারি ডিজিজ এবং কার্ডিয়োমায়োপ্যাথি। প্রথমটার কারণ মদ, সিগারেট, লাইফস্টাইল। রাজুর তিনটে করোনারি আর্টারিই পার্শিয়ালি ব্লকড। শুধু ব্লকেজ থাকলে তার নানা চিকিৎসা আছে। স্টেন্টিং, বেলুন সার্জারি, অ্যাঞ্জিয়োপ্ল্যাস্টি, করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফটিং। পরের রোগটা, অর্থাৎ কার্ডিয়োমায়োপ্যাথির কারণে এগুলোর একটাও করা যাবে না। আর শুধু ওষুধ খেয়ে এর চিকিৎসা হবে না। ওয়ারিস্তানের লম্বা রেসের ঘোড়া ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কারণে এখন নিয়ারলি হার্টলেস।’

‘হুম।’ মাথা নীচু করে রকি বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। ইউ ফলো রুটিন প্রসিডিয়োর। পেশেন্ট যদ্দিন বাঁচে বাঁচুক। মারা যাওয়ার পরে যা যা নিয়ম হাসপাতালকে মানতে হয়, সে সব মানুন। গুড নাইট।’

লম্বা করিডোর দিয়ে আর্মি বুটের টকটক শব্দ তুলে হেঁটে যাচ্ছে রকি। মাথা নীচু করে, কাঁধ ঝুঁকিয়ে, পরাজিতর মতো প্রস্থান। পিছন থেকে আমন বললেন, ‘আমি বলেছিলাম একটা গুড নিউজও আছে। ভালো খবরটা না শুনেই চলে যাচ্ছেন?’

রকি ঘুরে দাঁড়াল।

‘রাজু ইজ ক্লিনিক্যালি অ্যালাইভ। অল হিজ ভাইটাল সাইনস আর পারফেক্টলি নরম্যাল।’

‘ভেন্টিলেটারে থাকা পেশেন্টকে ভোটে দাঁড় করানো যায় না ডক্টর মল্লিক।’ করিডোর থেকে চেঁচিয়ে বলল, রকি, ‘হি ইজ ভেজিটেবল নাও। ও আর আমার কাজে লাগবে না। এনিওয়ে, থ্যাঙ্কস ফর দ্য গুড নিউজ।’

‘রাজু ভেন্টিলেটরে নেই।’ রকিকে থামিয়ে বলেন আমন, ‘অক্সিজেন আর ওরাল মেডিসিনের ওপরে আছে। অন্য যে-কোনও লোক এতক্ষণে মরে যেত। বাট হি ইজ ফাইটিং লাইক এ হর্স। ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে ও রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়বে। বাট হি নিডস আ হার্ট ট্রানসপ্ল্যান্ট। যে অপারেশানটা ওয়ারিস্থানে হয় না। ওকে আমেরিকা, ইউকে বা কোনও ডেভেলপড কানট্রিতে নিয়ে যান।’

‘সম্ভব নয় ডক্টর মল্লিক। ওদের কিল লিস্টে রাজু আছে। তবে অন্য একটা উপায় আছে। ইন্ডিয়াতে এক ট্রানসপ্ল্যান্ট এক্সপার্ট আছেন। শি ইজ সাউথ কোরিয়ান। নাম লুসি লাহিড়ি।’

‘লাহিড়ি ইজ অ্যান ইন্ডিয়ান টাইটল।’ অবাক হয়ে বলেন আমন।

‘আমাকে বলতে দিন। লুসি বিয়ে করেছে মেঘনাদ লাহিড়িকে। মেঘনাদ কলকাতার নামজাদা চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী। মেঘনাদ কলকাতায় থাকলেও লুসি কেরালায় থাকে। হার ‘রিসাইকল মেডিক্যাল সেন্টার’ ইজ দ্য অনলি ডেস্টিনেশান ফর রিচ অ্যান্ড ফেমাস অব হলিউড ফর এভরি কাইন্ড অব ট্রানসপ্ল্যান্ট পসিবল আন্ডার দ্য সান। কিছু বছর আগে একটা রিসার্চ প্রজেক্টের জন্য মেঘনাদের অনেক টাকার দরকার পড়েছিল। ওয়ারিস্তান গভর্নমেন্ট গোপনে ওকে ফান্ডিং করে। এখন ওকে পে-ব্যাক করতে হবে।’ কথা থামিয়ে মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে রকি।

‘রি-সাইকল হসপিটাল। দ্য অনলি ডেস্টিনেশান!’ থেমে থেমে, ওজন করে করে শব্দগুলো উচ্চারণ করছেন আমন। রকির কায়দায় ‘অনলি’ শব্দটিতে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এই হাসপাতাল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।’

‘না জানারই কথা। এনিওয়ে, আমি লুসির অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছি। উনি আগামীকাল রাত দশটায় রাজুকে দেখবেন।’

‘আগামীকাল?’ আমন অবাক।

‘আজ ৩০ সেপ্টেম্বর। এখন ভোর চারটে। আগামীকাল মানে ১ অক্টোবর। আমার হাতে বিয়াল্লিশ ঘণ্টা সময় আছে। কেরালা সাউথ ইন্ডিয়ার একটা স্টেট। ওয়ারিস্তানের কাকপক্ষীকে না জানিয়ে রাজুকে উড়িয়ে ইন্ডিয়ায় নিয়ে গিয়ে, হার্ট ট্রানসপ্ল্যান্ট করিয়ে, আবার কাকপক্ষীকে না জানিয়ে ওয়ারিস্থানে ফেরত আনতে হবে। ডক্টর মল্লিক, আপনি এইটুকু ব্যবস্থা করে দিন, যাতে রাজু প্লেন জার্নির ধকল নিতে পারে। কীভাবে, সেটা আপনি জানেন। বাকিটা আমি দেখছি।’

রকির লম্বা বয়ান থেকে কাজের কথাটুকু পিক আপ করেছেন আমন। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আপনি ডক্টর লাহিড়ির অ্যাপয়েন্টমেন্ট কীভাবে করলেন? ফোনে? শুনেছি ওয়ারিস্তানের গভর্নমেন্ট অফিসিয়ালদের ফোন কলস সিআইএ, পেন্টাগন ট্যাপ করে।’

‘ঠিকই শুনেছেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে এনক্রিপটেড মেলে। কেউ কিসসু বুঝতে পারেনি। রাজুর শারীরিক অবস্থার কথা আমি, আপনি আর লুসি লাহিড়ি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না।’

‘লুসি যদি ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সকে বলে দেয়?’

‘বলবে না। শি ইজ থরো প্রফেশনাল। এনিওয়ে, থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর!’ আমনকে জড়িয়ে ধরে রকি বলে, ‘সামনে অনেক কাজ। আমি চললাম। এখন প্রতিটি মিনিট ইম্পর্ট্যান্ট।’

.

ওয়ারিস্তানের আর্মি হেডকোয়ার্টার। সেন্ট্রাল প্রভিন্স।

৩০ সেপ্টেম্বর। সকাল দশটা।

.

‘এই নাও তোমার জিনিসপত্র।’ রকির টেবিলে একটা পাউচ আর একটা ব্যাকপ্যাক রেখে বলে জিয়া।

রকি বলে, ‘তুমি বোসো। গত ছ’ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করেছ।’

‘থ্যাঙ্কস। বলল ছ’ফুট লম্বা, অ্যাথলিটদের মতো পেশিবহুল, চোয়াড়ে চেহারার জিয়া। ওয়ারিস্থানে রকির মতো বেঁটে লোক বা জিয়ার মতো অসুন্দর মহিলা বিরল। সেই জন্যেই হয়তো জিয়ার সঙ্গে রকি নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারে। সেই জন্যেই হয়তো, জিয়ার প্রতি রকির দুর্বলতা জন্মেছিল। সেই জন্যেই হয়তো, আজ থেকে দশ বছর আগে দুজনের বিয়ে হয়।

জিয়া কি রকিকে ভালোবাসে? এই প্রশ্নের উত্তর রকি জানে না। রকির ধারণা জিয়াও জানে না। জিয়া আর্মির সেকেন্ড ইন কম্যান্ড হিসেবে বসের প্রতি যেমন কেজো অ্যাটিটিউড দেখায়, স্ত্রী হিসেবে রকির প্রতি সেইরকম নৈর্ব্যক্তিক ব্যবহার মেইনটেইন করে।

রকি কি জিয়াকে কখনও ভালোবেসেছিল? এই প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর আছে। বিয়ের প্রথম সাত বছর রকি জিয়াকে ভালোবাসত। সেই কারণেই জিয়া আর্মির সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড। সন্তানহীন দাম্পত্যে ফাটল কীভাবে ধরল, কেউ জানে না। বিবাহের সপ্তম বছরে রকির জীবনে ‘সেভেন ইয়ার্স ইচ’ হিসেবে এল কিয়ারা!

কিয়ারার সঙ্গে রকির আলাপ সুইৎজারল্যান্ডে। ওয়ারিস্তানের মিলিটারি অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত দরকারে প্রায়ই রকিকে একা জুরিখ যেতে হয়। বিদেশে গেলে পারতপক্ষে হোটেলের রুমের বাইরে বেরোয় না রকি। জুরিখেও বেরোয়নি। রুমের জানলা দিয়ে হোটেলের সামনের রাস্তায় গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট দেখে বেরিয়েছিল।

এক আমেরিকান ব্যাঙ্কারের সঙ্গী হয়ে কিয়ারা জুরিখ বেড়াতে এসেছিল। গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে লোকটা বদাম করে হোটেলের পাঁচিলে ধাক্কা মেরে স্পট ডেড। কিয়ারার মাইনর ইনজুরি হয়েছিল।

থানা-পুলিশ-হাসপাতাল এই সব করতে করতে মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় রকির। সাতান্ন বছরের বুড়ো মিলিটারি প্রধান বিচ্ছিরিভাবে নাতনির বয়সি মেয়ের প্রেমে পড়ে।

রকির এখন একটাই অবসেশান। বাহামা পালানো। ছ’মাস পরে রিটায়ারমেন্ট। চাকরি থেকে অবসরের পরে জিয়াকে মিলিটারি প্রধান বানিয়ে রকি পালাবে। অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে বাকি জীবন কাটাবে। নাসাউতে একটা বিচ হাউস কিনবে। কিনবে একটা ট্রলার আর সেসনা স্কাইমাস্টার এয়ারক্রাফট। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক বোতল বিয়ার খেয়ে ট্রলারে মাছ ধরতে বেরোবে। মাঝে মাঝে সেসনা চালিয়ে কিয়ারাকে নিয়ে অন্য আইল্যান্ডে বেড়াতে যাবে। রাতে, চাঁদের আলোয় শুয়ে রকি মহার্ঘ্য সিঙ্গল মল্টে চুমুক দেবে, আর কিয়ারা তার কোমরে মালিশ করে দেবে। একমুঠো খাবার, দু’চুমুক দারু, আর কিয়ারার আদর—জীবনের বাকি দিনগুলো এই নিয়েই কাটিয়ে দেবে রকি।

কিন্তু সেই গন্তব্যে পৌঁছোতে গেলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেতে হবে ইন্ডিয়ায়। জিয়া গত ছ’ঘণ্টা ধরে সেই ব্যবস্থাই করেছে।

পাউচের চেন খুলে জিয়া বলল, ‘এর মধ্যে তোমার প্লেনের টিকিট, পাসপোর্ট আর ইন্ডিয়ার ভিসা আছে। অ্যাজ ইন্ডিয়ান সিটিজেন। আলাদা আলাদা তিনটে সেট। মনে হয় না একটার বেশি লাগবে। যদি পরিচয় বদলাতে হয়, তাহলে প্রথম সেটটা ডেসট্রয় করে দেবে। অন্য দুটো সেট এই পাউচেই দিলাম। হ্যান্ডলাগেজ হিসেবে থাকবে। চেকিং-এর সময় সামলে রেখো। তিনটে প্রাোফাইলের জন্য, এই নাও তিনটে প্রিন্ট আউট।’ তিনটে কাগজ এগিয়ে দেয় জিয়া। প্রথম কাগজটা নিয়ে রকি দেখে, ষাট বছরের এক বুড়োর প্রাোফাইল পিকচারের পাশে লেখা, ‘অপূর্ব কুমার রায়। সংক্ষেপে, এ কে রে। দিল্লি প্রবাসী বাঙালি লেদার এক্সপোর্টার। বিপত্নীক। পুত্র ও কন্যা আমেরিকায়। স্ত্রী মারা যাবার পরে কলকাতায় শিফট করেছেন। বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি—তিনটে ভাষাই জানেন। ওয়ারিস্থানে ব্যবসার কাজে এসেছিলেন। এখন বাড়ি ফিরছেন। অন্য দুটো প্রাোফাইল হল মনোজ শর্মা আর বেঞ্জামিন ডি সুজা। সেগুলো না পড়ে রকি জিয়াকে বলল, ‘বাংলায় ”এ কে রে” মানে ”হু ইজ হি?” নাইস টাচ।’

জিয়া বলল, ‘এই নাও তোমার ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, ন্যাশনালাইজড ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স। সব তিনসেট করে আছে।’

‘ব্যাকপ্যাকে কী আছে?’

টুরিস্টদের কাছে যা থাকে। ব্রাশ, পেস্ট, শেভিং সেট, সাবান, শ্যাম্পু। সব ইন্ডিয়ান প্রাোডাক্ট। দু’সেট শার্টপ্যান্ট দিয়েছি। পোশাকে ওয়ারিস্তানের লেবেল খুলে ইন্ডিয়ান কোম্পানির লেবেল সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। যা আছে তাই দিয়ে দুদিনের বেশি চলবে না। আশা করি তার আগেই ফিরে আসবে।’

‘হোপফুলি।’ জিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে রকি, ‘ফ্লাইট কটায়?’

‘দেড়ঘণ্টা পরে। তোমার এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত। ডায়রেক্ট ফ্লাইট ফ্রম ওয়ারিস্তান টু কোচি। কোচি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট খুব বিজি। সিকিয়োরিটি ঢিলেঢালা। বেরোতে প্রবলেম হবে না। প্লাস, ওখান থেকে গাড়িতে নর্থ কেরালার ইদুক্কি জেলায় তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।’

‘যাচ্ছি কেরালায়। আমাকে বাঙালি পাসপোর্ট দিলে কেন?’

‘কেরালিয়ান নেম দিলে ম্যানেজ করতে পারতে? তুমি বাংলায় অনেক দিন ছিলে, বাংলা জানো—তাই দেওয়া হয়েছে। মনোজ শর্মা হয়ে গেলে হিন্দি বলবে। বেঞ্জামিন ডি সুজা হয়ে গেলে ইংরিজি। আর ডক্টর লুসি লাহিড়ি তোমার আসল পরিচয় জানে। ওর কাছে ”অপূর্ব কুমার রায়” সাজতে যেয়ো না।’

‘হুম।’ চিন্তিত মুখে চেয়ার থেকে ওঠে রকি, ‘মানি রেডি?’

‘মানি অ্যান্ড কার।’ লিফটের দরজা খুলে আগে রকিকে ভিতরে যেতে দিল জিয়া। লিফটের দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। ‘জি’ বাটন টিপে জিয়া বলল, ‘কোচি এয়ারপোর্টে ”ওয়েলকাম মিস্টার এ কে রে” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে তোমার জন্য দিপু নামের একটি ছেলে ওয়েট করবে। ও-ই তোমাকে গাড়িতে রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে পৌঁছে দেবে। ইউজড ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে একলাখ টাকাও দেবে। পরে যেমন লাগবে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবে।’

লিফট একতলায় এসে গেছে। বিশাল বড় লবিতে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মীরা রকি আর জিয়াকে একসঙ্গে লিফট থেকে বেরোতে দেখে লম্বা সেলাম ঠুকল।

লবির বাইরে মিলিটারির সর্বোচ্চ কর্তার জন্য বিশাল গাড়ি দাঁড়িয়ে। জিয়া বলল, ‘উঠে পড়ো। ড্রাইভারকে বলা আছে। ও এয়ারপোর্টের অনেক আগে দাঁড়িয়ে যাবে। তুমি গাড়িতে পোশাক চেঞ্জ করে নিয়ো। চেহারা বদলের উপকরণ গাড়িতে রাখা আছে। মাইনর মেকওভার করে নিয়ো। লোকাল ট্যাক্সিতে আমাদের লোক তোমার পিছনে যাচ্ছে। ”এ কে রে” হয়ে অফিশিয়াল গাড়ি থেকে নেমে, ট্যাক্সিতে এয়ারপোর্টে যেয়ো।’

আর্মির ড্রাইভার রকির লাগেজ গাড়িতে রাখছে। রকি জিয়ার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে ফিসফিস করে তার কানে কিছু বলল।

হ্যান্ডশেক থামিয়ে জিয়া অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার মাথা খারাপ নাকি? এ তো অসম্ভব ব্যাপার!’

রকি বলল, ‘গত ছ’ঘণ্টা তুমি যেমন ব্যস্ত ছিলে, আমিও ছিলাম। গ্রিনবার্গের সঙ্গে কথা বলেই এটা ঠিক হয়েছে। এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। সুতরাং যা বললাম, সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন কোরো। ইটস অ্যান অর্ডার।’

জিয়া সামান্য ভাবল, তারপর স্যালুট করে বলল, ‘জয় ওয়ারিস্তান!’

‘জয় ওয়ারিস্তান!’ গাড়িতে উঠে বসল রকি। গন্তব্য শত্রুদেশ। ইন্ডিয়া।

ভারতবর্ষ। ন্যাশনাল হাইওয়ে সিক্স। হানি দা ধাবা।

১ অক্টোবর। রাত পৌনে ন’টা থেকে পৌনে দশটা।

.

‘আববে ওয়ে! লসসি বানা!’ ধাবার খাটিয়ায় বসে হাঁক পাড়ল পাম্মি সিং। ছ’ফুট লম্বা, পঞ্চাশ বছর বয়স, ১২০ কিলো ওজন, একমুখ দাড়িগোঁফ। শিখ সম্প্রদায়ের পাঁচ নিশান কেশ, কড়া, কৃপাণ, কছেরা, কঙ্গায় সজ্জিত। পাম্মি আসাম থেকে বারো চাকার ট্যাঙ্কার নিয়ে বেরিয়েছে। গন্তব্য গুজরাটের জামনগর। রাতে খাবার সময় ছাড়া ট্যাঙ্কার দাঁড়ায় না। লম্বা জার্নিতে সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক সময়ে মাল ডেলিভারি না হলে মালিকের লস। মালিকের লস মানে পাম্মি টাকা পাবে না।

টাকার চিন্তা পরে। আগে পেটে দানাপানি দিতে হবে। খালাসি রামুকে পাম্মি জিজ্ঞাসা করে, ‘বিয়ার পিয়েগা?’

রামু আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘তিন বিয়ার পিয়েঙ্গে। স্ট্রংওয়ালা। সাথ মে মুর্গা।’

‘আববে। তেরিততো!’ বিরক্ত হয়ে পাম্মি খাটিয়া থেকে উঠে কাউন্টারের দিকে এগোয়। বঙ্গালিগুলো খুব কামচোর হয়। টেবিলে আসতে ঘণ্টাভর লাগিয়ে দেবে। পৌনে ন’টা বাজে। তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়তে হবে। ধাবার মালিক হানি সিং তার পরিচিত। যদি বলেকয়ে তাড়াতাড়ি খাবারটা ম্যানেজ করা যায়।

আজ ধাবায় বেজায় ভিড়। হানিকে স্পেশাল রিকোয়েস্ট করেও ন’টা কুড়ির আগে খাবার পাওয়া গেল না। রামুর পাল্লায় পড়ে অর্ডার বেশি দেওয়া হয়ে গেল। স্ট্রং বিয়ারের সঙ্গে চিকেন ললিপপ। রাতের খাবারে পাম্মি খেল রোটি আর কালি ডাল। রামু অর্ডার করেছে বাটার নান আর চিকেন বাটার মসালা।

ফটাফট তিনটে বিয়ার খেয়ে মাথা টলমল করছে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। পাম্মির হাত পাক্কা। রামের বড়কা বোতল উড়িয়েও স্টিয়ারিঙে বসলে পঞ্জাব দা শের হয়ে যায়।

বিল মিটিয়ে ড্রাইভারের আসনে বসে পাম্মি। কোনওরকমে উঠে এসে পাশে বসে রামু। আকণ্ঠ বিয়ার পেঁদিয়ে ল্যাতপ্যাত করছে। যেসব খাবার খেতে পারেনি সেগুলো অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে প্যাক করে নিয়েছে। এক্সট্রা দুটো বিয়ারের বোতল নিয়েছে।

ইঞ্জিন স্টার্ট করে, ক্লাচ মেরে ফার্স্ট গিয়ারে গাড়ি দেয় পাম্মি। অভ্যস্ত পায়ে ক্লাচ ছাড়ে। সামান্য স্পিড বাড়তে সেকেন্ড গিয়ারে যায়। পাশের সিটে হাফ শোওয়া হয়ে রামু নাক ডাকতে শুরু করেছে। গাড়ির স্পিড তিরিশ ছুঁলে থার্ড গিয়ারে গিয়ে, বাঁ-হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডানহাতে রামুকে খোঁচায় পাম্মি।

ঠিক এই সময় উলটো দিক থেকে একটা অ্যাম্বুল্যান্স প্যাঁ-প্যাঁ করতে করতে ট্যাঙ্কারের সামনে চলে এল। পাম্মি অভ্যস্ত হাতে স্টিয়ারিঙে মোচড় দিল। পা দিল ব্রেকে।

মুশকিল হল, বিয়ারের কারণে রিফ্লেক্স একটু হলেও ঢিলে হয়েছে। পাম্মি ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটারে পা দিল।

অ্যাম্বুল্যান্স সোজা এসে ধাক্কা মারল ট্যাঙ্কারের ড্রাইভারের কেবিনে। ট্যাঙ্কারের ড্রাইভারের কেবিন মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পাম্মি আর রামু কিছু বোঝার আগেই তাদের মাথা, ধড়, হাত, পা আলাদা-আলাদা হয়ে গেল।

দুটো গাড়িই অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে রাস্তা থেকে গড়িয়ে পাশের মাঠে পড়ে গেছে। অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভারের নাম সনাতন। সে এখনও বেঁচে। তার গায়ে আগুন লেগেছে। অ্যাম্বুল্যান্স থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। সঙ্গী ছেলেটি আগুনে পুড়ে ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে।

জ্বলন্ত পকেট থেকে মোবাইল বার করে দু’নম্বর বোতাম টেপে সনাতন। স্পিড ডায়াল দেখাচ্ছে, দু’নম্বরে স্টোর করা আছে সনাতনের মালকিন তনয়া মিত্রর নাম। নিজের জ্বলন্ত শরীর দেখতে দেখতে, মরে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে সনাতন শুনতে পায়, রিং হচ্ছে। ম্যাডাম কি ফোন তুলবেন? না তুললে জানবেন কী করে যে তাঁর কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল।

.

ইলেভেনথ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ক্রায়োনিকস।

হোটেল ফোর্ট আগুয়াড়া। গোয়া। ১ অক্টোবর।

রাত পৌনে দশটা।

.

হোটেল ফোর্ট আগুয়াড়ার ‘ফেনি ব্যাঙ্কোয়েট হল’-এ জনাপঞ্চাশ লোক রয়েছে। দশজন টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিককে বাদ দিলে বাকি সবাই অভারতীয়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইজরায়েল, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা মন দিয়ে শুনছে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে থাকা তনয়া মিত্রর বক্তৃতা। সাংবাদিকরা হাই গোপন করার চেষ্টা করছে। তনয়া একে ভারতীয়, তায় ক্রায়োনিকস সাবজেক্টের ওপরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ওপরওয়ালার হুকুম মেনে সাংবাদিকরা অনুষ্ঠান কভার করতে এসেছে। ‘ক্রায়োনিকস’ বিষয়টা দাদের মলম না ইঁদুর মারা বিষ, এই নিয়ে কোনও ধারণা নেই। আগ্রহও নেই।

তনয়ার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। সাড়ে পাঁচ ফুট হাইট। দু’ইঞ্চি হিলের সাহায্যে আর একটু লম্বা লাগছে। পরনে গাঢ় নীল রঙের বিজনেস সুট, গলায় স্কার্ফ, চোখে হালকা নীল ফ্রেমের চশমা। পোডিয়ামের ওপরে রাখা ল্যাপটপ দেখে তনয়া বক্তৃতা করছে। পিছনের দৈত্যাকার এলসিডি স্ক্রিনে, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশানের মাধ্যমে বক্তৃতার বিষয় ফুটে উঠছে।

বক্তৃতা শেষ করে তনয়া ইংরেজিতে বলল, ‘আজ কনফারেন্সের শেষ দিন। এটাই অন্তিম সেশন ছিল। আমি চাই না যে আমার বিজ্ঞানী-সহকর্মীরা আমায় কোনও প্রশ্ন করুন। অঢেল খানাপিনার আয়োজন আছে। সেইসব উপভোগ করতে করতে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেব। তবে, সাংবাদিক বন্ধুদের জন্য প্রশ্নোত্তর-পর্ব চালু আছে। আমি চাইব, আপনারা বেসিক প্রশ্ন করুন। আমি সহজ করে উত্তর দেব। ক্রায়োনিকস নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে আগ্রহ জাগাতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। আর, আপনাদের জন্যেও পানভোজনের ব্যবস্থা আছে। তাই, প্রশ্নোত্তর পর্ব চুকিয়েই অফিসের গাড়ি ধরার জন্য দৌড়োবেন না। ধন্যবাদ।’

‘ক্রায়োনিকস ব্যাপারটা কী যদি বুঝিয়ে বলেন…’ প্রথম প্রশ্ন ধেয়ে এল গোয়ার লোকাল টিভি চ্যানেল থেকে।

‘খুব ভালো প্রশ্ন। আগে জানতে হবে শব্দটার মানে কী? তারপরে বিষয়ে প্রবেশ করা যাবে। ”ক্রায়ো” শব্দটা গ্রিক। মানে ”আইস কোল্ড”। ক্রায়োনিকস একধরনের মেডিক্যাল টেকনোলজি। ক্রায়োনিকসের মাধ্যমে সাব-জিরো টেম্পারেচারে মানুষকে প্রিজার্ভ করার চেষ্টা হচ্ছে। যাতে ভবিষ্যতে আবার তাকে জাগানো যায়। এই ঘুমন্ত অবস্থাটাকে বলা হয় ”ইনডিউসড হাইবারনেশান।” বা ”সাসপেনডেড অ্যানিমেশান”।’

‘রিপ ভ্যান উইঙ্কল বা স্লিপিং বিউটির গল্প মনে পড়ছে।’ মন্তব্য করল মহারাষ্ট্র টাইমসের সাংবাদিক।

‘ঠিকঠাক রেফারেন্স দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। রিপ ভ্যান উইঙ্কল একটানা কুড়ি বছর ঘুমিয়ে ছিল। আর ঘুমন্ত রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোর ট্রিগারিং ফ্যাক্টর ছিল রাজপুত্রের চুম্বন। এই রূপকথা আমরা সবাই জানি। তবে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বিষয়টা আর রূপকথার জগতে সীমাবদ্ধ নেই। ”ন্যাশনাল এয়ারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশান” বা ”নাসা” গত কুড়ি বছর ধরে সাবজেক্টটা ডেভেলপ করার চেষ্টা করছে। অ্যাসট্রোনটদের মহাকাশে ক্রায়ো-প্রিসার্ভ করে পাঠালে দীর্ঘদিন তাদের খিদে পাবে না। অক্সিজেন কম লাগবে, বা লাগবে না। ফলে স্পেস ক্র্যাফটের ওজন কমবে। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রার সময়ে ছোট্ট জায়গায় আবদ্ধ থাকার কারণে তাদের মানসিক বিকার বা ডিপ্রেশান হবে না। এই জন্যেই সাবজেক্টটার এত কদর। আমি দীর্ঘদিন নাসার ক্রায়োনিকস ডিভিশানে চাকরি করেছি। কিন্তু ওরা ক্রায়োনিকস ডিভিশানে ফান্ড কমাতে শুরু করল। তাই সব ছেড়েছুড়ে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছি।’

‘দুষ্টু লোকে বলে, ”নাসা”-র পুরো কথাটা হল, ”নট অলওয়েজ সায়েন্টিফিক্যালি অ্যাকিউরেট।” কথাটা ভুল নয়। তা না হলে আপনার মতো বিজ্ঞানীকে কেউ ছেড়ে দেয়?’ টিপ্পনি কাটল মহারাষ্ট্র টাইমস।

‘থ্যাঙ্কস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। আর কোনও প্রশ্ন?’

‘তার মানে ক্রায়োজেনিকস আর ক্রায়োনিকস আলাদা দুটো সাবজেক্ট?’ প্রশ্ন করল কলকাতার সাংবাদিক।

‘আমি এক্সপ্লেন করছি। ফ্রিজে আমরা সাব-জিরো টেম্পারেচারে খাবার রাখি। খাবার টাটকা থাকে দীর্ঘদিন। কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখলে পরের বছর সেই আলু বিক্রি হয়। শপিং মলে ফ্রোজেন ফুডের আলাদা কাউন্টার থাকে, যেখানে কড়াইশুঁটি থেকে চিকেন, সসেজ থেকে হ্যাম, ভুট্টার দানা থেকে চিংড়ি মাছ—সব পাওয়া যায়। স্বাদ, গন্ধ, এবং খাদ্যগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। পাশাপাশি, হাই-এন্ড সায়েন্স ল্যাবে বায়োলজিক্যাল স্পেসিমেন মাইনাস দুশো সত্তর ডিগ্রি বা তারও কম তাপমাত্রায় প্রিজার্ভ করা হয়। সাব-জিরো টেম্পারেচারে পদার্থের গুণাবলীর কী বদল ঘটে, তা দেখার জন্য যে বিজ্ঞান, তার নাম ক্রায়োজেনিকস। আর মানুষকে সাব-জিরো টেম্পারেচারে ঘুম পাড়িয়ে, হার্ট বা ব্রেনের ইলেকট্রিকাল অ্যাকটিভিটি বন্ধ রেখে, আবার চালু করার যে চেষ্টা, তার নাম ক্রায়োনিকস।’

‘আপনারা সেই লক্ষ্যের থেকে কত দূরে?’ আবার মহারাষ্ট্র টাইমস।

‘পৃথিবীর কোনও প্রতিষ্ঠান সেই জায়গায় এখনও পৌঁছোতে পারেনি।’

‘ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই বিষয়ে গবেষণা করার মতো ইনফ্রা-স্ট্রাকচার, বা ফান্ডি বা সরকারি সাহায্য আছে?’ প্রশ্ন করল কলকাতার সাংবাদিক। উত্তর দেওয়া আগের সায়লেন্ট মোডে রাখা স্মার্টফোনের দিকে একপলক তাকাল তনয়া। ড্রাইভার সনাতনের ফোন ঢুকছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা কনসাইনমেন্ট নিয়ে কলকাতা যাচ্ছে সনাতন। সাংঘাতিক আরজেন্ট কিছু না হলে ফোন করবে না। অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে তনয়া বলেন, ‘এক্সকিউজ মি। আই হ্যাভ টু টেক দিস কল।’

ফোনে কী শুনল তনয়া, সাংবাদিকরা জানল না। তারা দেখল তনয়ার মুখচোখ বদলে গেছে। বড় শ্বাস নিতে নিতে সে কলকাতার সাংবাদিককে বলল, ‘আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আসুন, আমরা লবিতে বসে এই বিষয়ে আলোচনা করি।’

তাড়াহুড়ো করে প্রশ্নোত্তর-পর্ব শেষ করল তনয়া। সাংবাদিক ও বিজ্ঞানীরা যখন পানভোজনে ব্যস্ত, তখন হোটেল ফোর্ট আগুয়াড়া থেকে একটি এসইউভি তিরের মতো ছুটে যাচ্ছে এয়ারপোর্টের দিকে। গাড়িতে বসে তনয়া ই-মেল কম্পোজ করছে। ‘অ্যাক্সিডেন্ট অ্যাট এন এইচ সিক্স নিয়ার কোলাঘাট। ড্রাইভার সনাতন অ্যান্ড হিজ হেল্পার ডেড। ”ওয়ান” অ্যালাইভ। ”টু” ডেড। কাল ভোরবেলার ফ্লাইটের টিকিট পেয়েছি। আই উইল বি ইন ক্যালকাটা বাই টেন ইন দ্য মর্নিং।’

তনয়া এই মেল পাঠিয়ে দিল তার বস ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়িকে।

.

রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ির চেম্বার। হেস্টিংস, কলকাতা।

১ অক্টোবর। রাত দশটা।

.

মেঘনাদ লাহিড়ির চেম্বারটি রাজকীয়। জোনাল লাইটিঙে আলোকিত চেম্বারের এককোণে অশ্বক্ষুরাকৃতি মেহগনি কাঠের টেবিল। জার্নাল, পেপার, মনোগ্রাম, টেক্সটবুক আর রেফারেন্স বুকে টেবিল ঠাসা। বাঁদিকে ঢাউস, হাই-এন্ড কম্পিউটার। ডানদিকে একটি ল্যাপটপ। পেশেন্ট দেখার জন্য এক্সামিনেশান টেবিল ও পেশেন্টের বাড়ির লোকের বসার জন্য তিনটি চেয়ার ছাড়া এই ঘরে আর কোনও আসবাব নেই। মেঘনাদ বসে আছে হাইব্যাক চেয়ারে। ছ’ফুট লম্বা, ফরসা, খড়গনাসা, বিরলকেশ, বছর পঞ্চান্নর চিকিৎসক পরে আছে থ্রি পিস সুট। চেম্বারের তাপমাত্রা ষোলো ডিগ্রিতে রাখার জন্য দুটি এসি বিনবিন শব্দ করে চলছে। কাজের মেয়ে মলিনা চায়ের সরঞ্জাম দিয়ে গেছে। নিজের হাতে এককাপ আর্ল গ্রে চা বানিয়ে সামনে বসে থাকা সাংবাদিক যশোধরা সেনের হাতে ধরাল মেঘনাদ। নিজেও এককাপ নিল। যশোধরা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। চায়ের জন্য, এবং সাক্ষাৎকারের সময় বার করার জন্য।’

যশোধরা ‘আজ সকাল’ খবরের কাগজের সাংবাদিক। প্রতি শুক্রবার এই কাগজে বিজ্ঞান-বিষয়ক একটি ক্রোড়পত্র বেরোয়। নাম ‘বিগ-জ্ঞান’। যশোধরা তার বিভাগীয় সম্পাদক। পিয়োর সায়েন্স নিয়ে বিগ-জ্ঞান ডিল করে না। খবরের কাগজের পাঠক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান নেবে না। সায়েন্সকে সহজপাচ্য করে পরিবেশন করা হয়। যাকে চালু কথায় বলে পপুলার সায়েন্স। বিগ-জ্ঞানের পরের ইস্যুতে মেঘনাদের একটা ইন্টারভিউ বেরোবে। অনেক অনুরোধ ও ফোনাফুনির পরে নিভৃতচারী এই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর অনুমতি পাওয়া গেছে।

মেহগনি কাঠের টেবিলে নিজের মোবাইল ফোন রেখে যশোধরা অডিয়ো রেকর্ডিং চালু করে। বলে, ‘ডক্টর লাহিড়ি, আপনার কাজ সম্পর্কে অনেক কথা জানি। কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছুই জানি না। আজকের প্রথম প্রশ্ন আপনার ছোটবেলা নিয়ে। কেমন ছিল সেইসব দিন?’

মেঘনাদ জবাব দিল, ‘আমার জন্ম নদিয়া জেলার মাজদিয়া গ্রামে। বাবা শিশু-চিকিৎসক ছিলেন। সরকারি চাকরির সূত্রে ওঁর পোস্টিং ছিল মাজদিয়ায়। মা ছিলেন মাজদিয়া কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। শৈশব থেকেই দেখতাম, সরকারি কোয়ার্টারে হয় অসুস্থ শিশুদের ভিড়, নয় প্রাইভেট টিউশনি-প্রার্থী নিম্নমেধার ছাত্রছাত্রীদের। ব্যস্ত বাবা-মা আমাকে কখনও সময় দিতে পারেননি। আমি নিজেকে নিয়ে থাকতাম। পড়াশুনোতে বরাবর মেধাবী ছিলাম। ইশকুলের পরীক্ষায় আগাগোড়া ফার্স্ট হয়েছি। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম হয়েছিলাম। মেডিক্যাল এন্ট্রান্সে ফার্স্ট হয়ে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ঢুকি।’

‘আমি আপনার অ্যাকাডেমিক সাফল্যের কাহিনি শুনতে চাইনি। পাঠক জানতে চায় আপনার শৈশব কেমন কেটেছে? দুষ্টুমি করে বাবা-মায়ের বকুনি খেয়েছেন কি? বন্ধুবান্ধব কারা ছিল? ছেলেবেলার কোনও মজার স্মৃতি আছে?’

‘একনম্বর প্রশ্নের উত্তরে জানাই, আমার শৈশব কেটেছে পড়াশুনো করে। দু’নম্বর প্রশ্নের উত্তরে জানাই, আমি দুষ্টুমি করতাম না। পড়াশুনো করতাম। তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরে জানাই, আমার কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না। তখনও ছিল না, এখনও নেই। চার নম্বর প্রশ্নের উত্তরে জানাই, পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে মজা হত। আজও, যে-কোনওরকম সাফল্য আমাকে আনন্দ দেয়। পরের প্রশ্ন?’

‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পরীক্ষায় আপনি প্রথম হন। সমস্ত বিষয়ে যত মেডেল ছিল, সব আপনি পেয়েছেন। কিন্তু কলেজ লাইফ মানে শুধু পড়াশুনো নয়। ক্যান্টিন-আড্ডা-পলিটিক্স-প্রেমও কলেজের অংশ। এইসবে কতটা ইনভলভড ছিলেন?’

‘আমি লেখাপড়া ছাড়া কিছু করিনি। এমডি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে মেডিসিনে এমডি করতে গেলাম চণ্ডীগড়ের পিজিআইতে। সেখানেও ফার্স্ট হলাম। ওখানেই হিম্যাটোলজিতে ডিএম করলাম। হিম্যাটো-অঙ্কোলজি নিয়ে রিসার্চ করতে করতে কর্ড ব্লাড প্রিজার্ভেশান নিয়ে জানলাম। বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্টেম সেল নিয়ে কী গবেষণা হচ্ছে, তা জানার জন্যে চলে গেলাম সাউথ কোরিয়া। পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী হুয়াং উ সাক-এর অধীনে নাভিরজ্জুর রক্ত থেকে কীভাবে স্টেম সেল বার করতে হয় তা শিখলাম…’

‘এতক্ষণে বুঝলাম যে আপনার জীবনে গবেষণা ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু আপনি একজন সমাজসেবকও। রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি আপনি একটি অনাথ আশ্রম চালান। সেটিরও নাম রি-লাইফ। এই আশ্রম নিয়ে কিছু বলুন।’

‘রি-লাইফ অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েরা আমার সন্তানের মতো। ওদের জন্যই আমার সবকিছু। আমি চাই ওরা বড় হয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করুক। মাজদিয়ার গ্রামে জন্মে আমি যা পাইনি, ওরা তা পাক। ওরা ভালো স্কুলে পড়ুক, ভালো কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক, বিদেশে যাক, সারা পৃথিবী হোক ওদের খেলার মাঠ। এর বেশি আমার কিছু চাওয়ার নেই। তবে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা থাক। অ্যাকাডেমিক বিষয়ে কথা হোক।’

যশোধরা বাধ্য হয়ে ট্র্যাক বদলায়। বলে, ‘ঠিক আছে। তবে আমরা চেষ্টা করব আলোচনাটা সহজবোধ্য রাখতে। যাতে সাধারণ পাঠক বুঝতে পারেন।’

‘সাধারণ পাঠকের কথা ভাবলে আপনার শাহরুখ খানের কাছে যাওয়া উচিত।’ মেঘনাদ আবার আগের মুডে।

‘সাধারণ পাঠককে এত গোলা ভাববেন না, ডক্টর লাহিড়ি। তারা শাহরুখ খানকে পছন্দ করে ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞানেও তাদের আগ্রহ আছে। এটা খবরের কাগজের ইন্টারভিউ। আমরা পপুলার সায়েন্স নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করব।’

‘সে দায় আপনার আছে। আমার নেই।’

‘নাভিরজ্জুর রক্ত কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, এ নিয়ে আপনি দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নাভিরজ্জুর রক্ত কেন আমরা জমিয়ে রাখব?’

‘গর্ভস্থ ভ্রূণ নাভিরজ্জুর মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। একে ইংরিজিতে বলে আমবিলিকাল কর্ড। বাচ্চার জন্মের পরে এই কর্ডে যেটুকু রক্ত থেকে যায়, তাকে বলা হয় নাভিরজ্জুর রক্ত। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে মহৌষধ।’

‘মহৌষধ? কীভাবে?’

‘নাভিরজ্জুর রক্তে থাকে স্টেম সেল বা আদি কোষ। লিউকিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগকে ওই কর্ড ব্লাড ট্রানসফিউশানের মাধ্যমে নিরাময় করা যায়।’

‘বা:! এ তো বিরাট ব্যাপার! কিন্তু এই চিকিৎসা কি ভারতবর্ষে হয়?’

‘অবশ্যই হয়। আমার রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটেই কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক আছে।’ মেঘনাদের কথার মধ্যে তার স্মার্টফোনে একটা মেল ঢুকল। মোবাইলের পরদায় প্রেরকের নাম দেখে ভুরু কুঁচকোল মেঘনাদ। মেল পড়ে অস্ফুট গলায় বলল, ‘হায় কপাল! এ কী হল!’

পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে, ই-মেলটা সামান্য এডিট করে ফরওয়ার্ড করতে করতে যশোধরাকে বলল, ‘আপনার পরের প্রশ্ন?’

যশোধরার সাংবাদিক নাক নিউজের গন্ধ পেয়েছে। সে বলল, ‘কোনও সমস্যা?’

‘কোনও সমস্যা নেই। আপনি পরের প্রশ্ন করুন।’ লুসি লাহিড়িকে মেল পাঠিয়ে বলল মেঘনাদ।

যশোধরা বলল, ‘অ্যাকাডেমিক বিষয় নিয়েই কথা বলছি। আপনার স্ত্রী লুসি লাহিড়ির কেরিয়ার সম্পর্কে কিছু বলুন।’

‘হ্যাঁ, এইভাবে বললে উত্তর দেওয়া যায়। আমি হুয়াং উ সাক-এর অধীনে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে গবেষণা করতাম। হুয়াং দক্ষিণ কোরিয়ার নামজাদা বায়ো-টেকনোলজিস্ট। স্টেম সেল সংরক্ষণ নিয়ে ওঁর অজস্র গবেষণাপত্র আছে। হুয়াং-এর স্ত্রী কিম কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে লুসির সঙ্গে আলাপ।’

‘কীভাবে?’

‘মুন্নারে কিমের একটি হার্ট-ট্রানসপ্ল্যান্ট ইউনিট ছিল। নাম রি-সাইকল। আমি তখন সাউথ কোরিয়ায় থাকতাম। রিসার্চের কারণে কয়েকবার কেরালা এসেছিলাম। তখন লুসির সঙ্গে আলাপ হয়। ও ডাক্তারি পাশ করে, সার্জারিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে অরগ্যান ট্রানসপ্ল্যান্ট নিয়ে কাজ করছে। কাজের সূত্রেই যোগাযোগ। যোগাযোগটা বিবাহে গড়াল।’

‘আপনারা এক শহরে থাকেন না। এই লং ডিস্ট্যান্স ম্যারেজের কারণ?’

‘কারণটাও অ্যাকাডেমিক। আমার শাশুড়ি কিমের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। দুটো গাড়ির মধ্যে হেড অন কলিসন। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের ফলে ওঁর শরীরের যাবতীয় ভাইটাল অরগ্যান বন্ধ হতে থাকে। যাকে বলা হয় মালটি অরগ্যান ফেলিয়োর। ভেন্টিলেটারের সাহায্যে আমি আর লুসি ওঁকে দুশো দিন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। যে মহিলা অজস্র মানুষের হার্ট ট্রানসপ্ল্যান্ট করেছেন, তাঁর দরকারের সময় আমরা একটা কিডনি, একটা লিভার, একটা লাং, একটা হার্ট পাইনি। আমি আর লুসি শপথ করি যে অরগ্যান ডোনারের অভাবে যেন কোনও মানুষের মৃত্যু না হয়। আজ লুসি কেরালায় মায়ের প্রতিষ্ঠান চালায়। আমি কলকাতায় গবেষণা করি। কিন্তু শপথ থেকে আমরা সরে যাইনি।’

মেঘনাদের মোবাইলে ফোন ঢুকেছে। বিনয়ের সঙ্গে মেঘনাদ যশোধরাকে বলল, ‘কিছু যদি মনে না করেন, এই সাক্ষাৎকার এখানে শেষ করা যেতে পারে? আমার একটু কাজ আছে।’

‘ঠিক আছে।’ টেবিল থেকে মোবাইল তুলে আডিয়ো রেকর্ডিং বন্ধ করে, মোবাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে যশোধরা বলল, ‘গুডনাইট ডক্টর লাহিড়ি।’

মেঘনাদ বলে, ‘শুভরাত্রি যশোধরা।’ মোবাইল কানে দেয়। ওপ্রান্তে তনয়া বলছে, ‘সনাতনের কথা থেকে বুঝেছিলাম যে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে কোলাঘাটে। হানি দা ধাবা থেকে এক কিলোমিটার দূরে। সনাতন আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মারা যায়। ওর মোবাইল দীর্ঘক্ষণ অন ছিল। কন্টেনার টু উড়ে গেছে। আপনি প্লিজ, ওদিকটা সামলান।’

‘ঠিক আছে। আমি দেখছি।’ টেবিলের গায়ে লাগানো কলিং বেল টেপে মেঘনাদ। চেম্বারে ঢোকে ছ’ফুটের বেশি লম্বা, জিম করে মাসল বানানো, ক্রুকাট করে চুল কাটা, বছর পঁচিশের এক সুদর্শন যুবক। ছেলেটির চোখের তারা নীল রঙের।

মেঘনাদ বলল, ‘বালাজি, আমার কথা মন দিয়ে শোনো। সনাতন খড়গপুর থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে রি-লাইফে দুজনকে নিয়ে আসছিল। কোলাঘাটের হানি দা ধাবার এক কিলোমিটারের মধ্যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ড্রাইভার সনাতন আর তার হেল্পার স্পট ডেড। যে দুজনকে ওরা নিয়ে আসছিল, তার মধ্যে একজন মারা গেছে।’

বালাজি খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনল। সামান্য ভেবে বলল, ‘যে বেঁচে আছে, তার নাম কী?’

‘প্রথমা। এই নাও ছবি।’ টেবিলে রাখা ফাইল ঘেঁটে একটা ছবি বার করে দেয় মেঘনাদ। বালাজি বলে, ‘আমি এক্ষুনি গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি। বুনোকে ড্রাইভার হিসেবে নিচ্ছি। হাইওয়েতে জ্যাম না থাকলে কোলাঘাট পৌঁছোতে দু’ঘণ্টা লাগবে। আপনি ফোনে যোগাযোগ রাখবেন।’

‘বুনোর ভালো নাম আরণ্যক। তোমরা কেন যে ওকে বুনো বলে ডাকো…’ বলে মেঘনাদ। চায়ের ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য মলিনা চেম্বারের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে এই কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে আবার গম্ভীর হয়ে যায়।

মলিনা আর সুজাতা—এই দুজন মেয়ে ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ এজেন্সি থেকে এখানে রিক্রুট হয়েছে। রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট আর অনাথ আশ্রমে এইরকম অনেক মলিনা আর সুজাতা কাজ করে। এদের সবার বারো ঘণ্টার শিফট। একজনের কাজের সময় সকাল দশটা থেকে রাত দশটা। অন্য জনের, রাত দশটা থেকে সকাল দশটা। মেয়েগুলো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। ঘরদোর নিখুঁত পরিষ্কার রাখে।

চেয়ার থেকে উঠে, ডেস্কটপ শাটডাউন করে মেঘনাদ বলল, ‘প্রথমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। কাল সকাল দশটার মধ্যে তনয়া ফিরছে। তখন বাকি ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।’

বালাজি বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, ‘আমি আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড নিলাম। আমার আইকার্ডও নিলাম। প্রথমা আমাকে চেনে না। যদি আসতে না চায়?’

‘ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়ো।’ ল্যাপটপে গুগল আর্থ দেখতে দেখতে বলল মেঘনাদ। যা দেখল, তাতে সন্তুষ্ট হয়ে ল্যাপটপ বগলদাবা করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।

মেঘনাদ বেরিয়ে যাওয়ার পরে মলিনা ঝাড়পোঁছ শুরু করল। ডাস্টার, মপ আর ন্যাকড়া দিয়ে চেম্বারের প্রতিটি কোণ পরিষ্কার করল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল দরজার বাইরে কেউ আছে কি না। নি:শব্দে চেম্বারের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে, মেহগনি কাঠের টেবিলের তলায় হাত দিল। সেখানে রাখা আছে একটা মাইক্রো-রেকর্ডার। মলিনার আঁচলের গিঁট থেকে বেরিয়েছে একটা পুঁচকে সিডি কভার। তাতে রাখা রয়েছে ব্ল্যাঙ্ক সিডি। রেকর্ডার থেকে পুঁচকে সিডি বার করে, খালি সিডি কভারে ঢুকিয়ে আবার সেটা আঁচলে বাঁধল। ব্ল্যাঙ্ক সিডিটা মাইক্রো-রেকর্ডারে ঢুকিয়ে, রেকর্ডার অন করে দিল। শুরু হয়ে গেল পরবর্তী বারো ঘণ্টার অডিয়ো রেকর্ডিং। কাল সকাল দশটায় এসে, চেম্বার পরিষ্কার করার সময় সুজাতা এই সিডি বার করে নেবে।

.

ডক্টর লুসি লাহিড়ির চেম্বার। রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টার। মুন্নার। ১ অক্টোবর। রাত সাড়ে দশটা।

.

এই ঘরের সব কিছু সাদা। দেওয়াল সাদা, মেঝেতে সাদা মার্বেল, সিলিং সাদা রঙের। সিলিঙের এসির রং সাদা, জানলা-দরজার রং সাদা, পরদার রং সাদা, গোল টেবিল আর তাকে ঘিরে থাকা চেয়ারের রং সাদা, টেবিলে রাখা চায়ের সরঞ্জামের রং সাদা, ফুলদানিতে সাদা ফুল।

টেবিলের দুদিকে যে দুজন বসে রয়েছে, তাদের গায়ের রং বাদামি। এই হলঘরে সাদা ছাড়া অন্য রং আছে ডক্টর লুসি লাহিড়ি আর রকি চৌধুরীর চামড়ায়। আর চায়ের রঙে।

অদৃশ্য সাউন্ড সিস্টেম থেকে সংস্কৃত শ্লোক ভেসে আসছে। রকি প্রশ্ন করল, ‘এটা কী বাজছে?’

লুসি লাহিড়ি মধ্য চল্লিশের মহিলা। চেহারায় মঙ্গোলয়েড ছাপ। পরে আছে সাদা এপ্রন, সাদা পাজামা, ও সাদা চপ্পল। মাথার চুলে বয়কাট। চোখে রিমলেস চশমা। ঠোঁটে ন্যুড শেডের লিপস্টিক। সে বলল, ‘এটা একটা সংস্কৃত শ্লোক। যা পুরোনো বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্রধারণের কথা বলছে। যেমন আর তিনদিন বাদে আপনার পেশেন্ট পুরোনো হৃদয় ত্যাগ করে নতুন হৃদয় গ্রহণ করবেন।’

রকি বলল, ‘আমার সঙ্গে আপনার হাজব্যান্ডের ভাসাভাসা আলাপ থাকলেও আপনার সঙ্গে এই প্রথম সাক্ষাৎ। আমি বেশি প্রশ্ন করলে মার্জনা করবেন। জাস্ট কৌতূহল মেটাচ্ছি।’

‘আপনি দশ লাখ ডলার দিয়ে অপারেশন করাচ্ছেন। জানার অধিকার আপনার আছে। যা জানতে চান, জিজ্ঞাসা করুন।’

‘ট্রানসপ্ল্যান্ট করাতে রিচ অ্যান্ড ফেমাস আমেরিকানরা রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে ছুটে আসে কেন?’

‘আমরা সুইস ব্যাঙ্কের মতো। পৃথিবীর সেরা সার্ভিস দিই। গোপনীয়তা মেইনটেইন করি।

‘আপনার বাবা কোরিয়ার লোক। আপনার স্বামী কলকাতার লোক। আপনি কোরিয়া বা কলকাতা ছেড়ে কেরালায় সেট আপ বানালেন কেন?’

‘আমার মা এই ট্রানসপ্ল্যান্ট ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কোরিয়া ছেড়ে কেন ইন্ডিয়া বেছে নিয়েছিলেন, আমি জানি না। মা মারা যাওয়ার পরে ভেবেছিলাম পুরো এসট্যাবলিশমেন্টকে কলকাতায় রিলোকেট করব। কিন্তু আমার স্বামী বারণ করেন।’

‘অরগ্যান ট্রানসপ্ল্যান্ট অরগ্যান ডোনারের ওপরে নির্ভরশীল। আমাদের ওয়ারিস্তানে দেহদান করার প্রথা চালু নেই। অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথের পরে বেওয়ারিশ লাশের থেকে ভাইটাল অরগ্যান বার করে নেওয়া হয়। কিন্তু সাপ্লাই খুব কম। আগে থেকে পেশেন্টের নাম এনলিস্টেড থাকে। সামান্য কয়েকটা কর্নিয়ার জন্য কয়েক হাজার পেশেন্ট। যাদের নাম আগে এনলিস্টেড তারা আগে পাবে। এই সব কারণে ওখানে কর্নিয়া ট্রানসপ্ল্যান্ট ছাড়া আর কিছু হয় না।’

‘না হওয়ারই কথা। খুব ডিফিকাল্ট কাজ। ডোনার আর রেসিপিয়েন্টের ব্লাড গ্রুপ আর এইচএলএ টাইপিং মেলাতে হয়।’

‘ব্লাড গ্রুপ তো বুঝলাম। এইচএলএ টাইপিং ব্যাপারটা কী?’

‘এইচএলএ-র পুরো কথা হল হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন।’

‘রাজুর জন্য এইচএলএ টাইপিং ম্যাচ করা হার্ট আপনি পেলেন কোথা থেকে?’

‘সব জিনিস জানতে নেই মিস্টার চৌধুরী। আমি কি ওয়ারিস্তানের পলিটিক্যাল সিনারিয়ো নিয়ে প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করছি? আপনার পেশেন্ট এখানে ভরতি হওয়ার পরে আমি ওর ব্লাড গ্রুপ আর অ্যান্টিজেন স্ট্যাটাস দেখে নিয়েছি। এবং হানড্রেড পারসেন্ট ম্যাচ করে এমন একজন ডোনার খুঁজে পেয়েছি।’

রকি দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। ওয়ারিস্তান থেকে রাজুকে উড়িয়ে ইন্ডিয়ায় আনা কি মুখের কথা? ওয়ারিস্তানের মিডিয়া, পলিটিক্যাল পার্টি, অ্যাডমিনিস্ট্রেশান—কেউ রাজুর অবস্থার কথা জানে না। রাজুর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে ওয়ারিস্তানে এখন তোলপাড় চলছে। প্রধানমন্ত্রী মায়াকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়েছে রকি। ওয়ারিস্তান এয়ারলাইনসের প্লেনে রকি, রাজু, কার্ডিয়াক কেয়ার সেন্টারের এক ডাক্তার আর এক সিস্টার ছাড়া কেউ ছিল না।

কোচি এয়ারপোর্টে দিপু প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে গাড়ি ছিল। রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারের অ্যাম্বুল্যান্সও ছিল। কার্ডিয়াক কেয়ার সেন্টারের ডাক্তার আর সিস্টার মিলে অ্যাম্বুল্যান্সে করে রাজুকে এখানে নিয়ে এসেছে। দিপুর গাড়িতে এসেছে রকি। সেই ডাক্তার আর সিস্টার ফিরতি ফ্লাইটে ওয়ারিস্তান ব্যাক করেছে। রয়ে গেছে রাজু আর রকি।

লুসি জানে যে রকি ভুয়ো পাসপোর্ট আর ভিসা নিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকেছে। রাজুর পরিচয় জানে। টিভির কল্যাণে ওয়ারিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থাও জানে। কিন্তু মহিলা অদ্ভুত নিরাসক্ত। কাজের বাইরে কথা বলে না। ডোনার পাওয়া নিয়ে রকি প্রয়োজনের বাইরে কৌতূহল দেখিয়েছে বলে, ওয়ারিস্তান নিয়ে ছোট্ট একটা কমেন্ট করেছে। প্রসঙ্গ পালটাতে রকি বলে, ‘ইন্ডিয়ার এই একটা সুবিধে। অরগ্যান ডোনার সহজে পাওয়া যায়। কম পয়সায় কিডনি বেচে দেওয়া লোকেরও অভাব নেই।’

‘মানুষের কিডনি থাকে দুটো। একটা বেচে দিতেই পারে। কিন্তু লিভার, হার্ট বা প্যানক্রিয়াস থাকে একটা করে। ওটা পাওয়া ডিফিকাল্ট। আগে থেকে অরগ্যান ডোনেশানের ইচ্ছাপত্রে সই করে রেখেছে, এইরকম কেউ মারা গেলে, এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার শরীর থেকে অরগ্যান বার করে নিয়ে ক্রায়ো-প্রিজার্ভ করা গেলে, তবেই এটা সম্ভব। তা ছাড়া ব্রেন ডেড মানুষের শরীর থেকে অরগ্যান পাওয়া যায়। আপনার পেশেন্টের জন্য অরগ্যানের ব্যবস্থা করা আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।’

এই সময়ে লুসির স্মার্টফোনে মেঘনাদের মেল ঢুকল। ‘অ্যাক্সিডেন্ট অ্যাট এন এইচ সিক্স নিয়ার কোলাঘাট। ড্রাইভার সনাতন অ্যান্ড হিজ হেল্পার ডেড। ”ওয়ান” অ্যালাইভ। ”টু” ডেড।’ মেল পড়ে লুসির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।

‘শরীর খারাপ লাগছে নাকি ডক্টর?’ প্রশ্ন করল রকি, ‘কোনও খারাপ খবর? আপনাকে হঠাৎ ফ্যাকাসে লাগছে।’

কোনওরকমে নিজেকে সামলে লুসি বলল, ‘সব কিছু ঠিক আছে। আমার একটা কাজ আছে। আপনি শুতে যান। গুড নাইট।’

টলমল করতে করতে নিজের বেডরুমে ঢুকে লুসি মেঘনাদকে ফোন করে। ‘হ্যাঁগো, এবার কী হবে? অপারেশানের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে। আমার ডেটাবেসে রাজু মণ্ডলের প্রাোফাইলের সঙ্গে এইচএলএ টাইপিং ম্যাচ করার মতো আর কেউ নেই। রকি চৌধুরী সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পাঁচলাখ ডলার ওয়্যার ট্রানসফার করে দিয়েছে। অপারেশান হয়ে গেলে বাকিটা ট্রানসফার করবে। এর মধ্যে এই কাণ্ড? আমি যদি ফেইল করি, রকি আমাকে গুলি করে মারবে?’

‘মেঘনাদ বলল, আমি দেখছি। তুমি টেনশান কোরো না।’

‘আচ্ছা।’ ফোন রাখল লুসি। নিজের বিছানার দিকে এগোতে যাবে, এমন সময়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠল। আঁতকে উঠে লুসি দেখল, বিছানার পাশে রাখা রকিং চেয়ারে বসে মৃদু মৃদু দুলছে রকি। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।

‘ডক্টর লাহিড়ি, কী হয়েছে যদি না বলেন, আমি তা হলে সত্যিই আপনাকে গুলি করে মারব।’ গ্লকের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল রকি। এই গ্লক দিপু তাকে দিয়েছে। গ্লক এত সেক্সি আগ্নেয়াস্ত্র যে রকি অন্য কিছু ব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারে না।

লুসি পিস্তল দেখে ঘাবড়ে গেছে। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘যে ডোনার হার্ট দেবে, তাকে কলকাতা আনার সময় অ্যাম্বুল্যান্সে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মেয়েটা নিখোঁজ।’

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমাকে ব্যাপারটা বুঝতে দিন। এই হার্ট কোনও ক্যাডাভার বা মৃতদেহ থেকে আসছে না? বা কোনও ব্রেন ডেড মানুষের শরীর থেকে আসছে না? জ্যান্ত মানুষের শরীর থেকে আসছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেই মানুষটা, আই মিন সেই ডোনারটির হার্ট নিয়ে নেওয়ার পরে কী হবে?’

‘কিডনি আর লিভারও নেওয়া হবে। এইচএলএ আর ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করে এমন দুই পেশেন্ট এখানে ভরতি আছে। আমেরিকার রকস্টার চার্লস জ্যাকসন আর ওদের সেনেটর জন কিং।’

‘চার্লস জ্যাকসন? জন কিং?’ অবাক হয়ে বলল রকি, ‘আপনি আমাকে আর একটু ডিটেল বলুন।’

‘ডোনার মেয়েটির হার্ট পাবে আপনার পেশেন্ট। লিভার পাবে চার্লস জ্যাকসন। কিডনি পাবে জন কিং। আমার এই সেন্টারের নাম রি-সাইকল। আমি কিছু ফেলি না। মুশকিল হল, যে দাতার দানে আপনার পেশেন্ট এবং ওই দুই পেশেন্ট পুর্নজীবন পাবে, সেই মেয়েটি হঠাৎ আমাদের সাপ্লাই চেনের বাইরে চলে গেছে। ওকে খুঁজে পেলেই সব সমস্যার সমাধান।’

রকি বলল, ‘আপনি মেঘনাদ লাহিড়িকে জানিয়ে দিন যে অপূর্ব কুমার রায় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে মুন্নার থেকে কলকাতায় যাচ্ছে। ওঁর ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। আমি সময় মতো ফোন করে নেব।’

লুসি বলল, ‘মেঘনাদকে কি আপনার আসল পরিচয় বলব?’

‘ফোনে কখনওই বলবেন না। এনক্রিপ্টেড মেলে পাঠাবেন। ক্লিয়ার?’

‘এনক্রিপ্টেড মেল ছাড়া আমরা নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করি না। বাই দ্য ওয়ে, কোচিন এয়ারপোর্ট থেকে কলকাতার ফ্লাইট ভোর পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে। এখন এখান থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলে আপনি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন। ইদুক্কি থেকে এর্নাকুলামের ডিস্ট্যান্স হল…’

‘কীভাবে যাব, সেটা আমি বুঝে নিচ্ছি। আমি ঠিক সময়ে মেয়েটিকে নিয়ে চলে আসছি। আপনি অপারেশানের জন্য রেডি থাকুন।’ বরফঠান্ডা গলায় লুসিকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রকি। লুসি ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *