১. প্রস্তাবনা : রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি
১.১ রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি
নাটকীয়ভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাব। আয়তনে পৃথিবীর ৯৫তম রাষ্ট্র—আয়তন ১,৪৩,৯৯৮ বর্গকিলোমিটার (বকি); নেপাল (১,৪৭,১৮৭ বকি) থেকে কিছুটা ছোট, তাজিকিস্তান (১,৪৩,৭০০ বকি) থেকে সামান্য বড়।[১] অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে এর স্থান অষ্টম (২০১০ সালে ১৬.৮৯ কোটি)—নাইজেরিয়ার (১৮.১ কোটি) থেকে কম, রাশিয়ার (১৪.২ কোটি) থেকে বেশি। বিশ্বের ২ শতাংশের সামান্য বেশি জনসংখ্যার বাস বাংলাদেশে। পৃথিবীর প্রতি ৫০ জন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন বাংলাদেশি। অথচ কয়েক দশক আগেও এর আবির্ভাবের কোনো আলামত দেখা যায়নি।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্থান অনন্য। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্ট্যানলি এ কোচানেকের (Stanley A. Kochanek) মতে, বাংলাদেশে একটি ‘অসাধারণ সমরূপ’ (extremely homogeneous) জনগোষ্ঠী রয়েছে। ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় যেসব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, সেসব দেশেও সাধারণত এত সমগোত্রীয় জনগোষ্ঠী দেখা যায় না। জাতিগতভাবে ৯৮.৭% বাংলাদেশি অভিন্ন। প্রায় ৯০% জনগোষ্ঠী একই ধর্মে বিশ্বাস করে। কমপক্ষে ৯৮% লোক বাংলায় কথা বলে। এসব বন্ধন সাধারণত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে। অথচ এই বাংলাদেশই আজকে পৃথিবীতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর প্রায় ২০০টি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিমাপ করে। ‘Worldwide Governance Indicators’ শীর্ষক এই বার্ষিক প্রকাশনার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল্যায়ন সম্ভব। সারণি ১.১-এ ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল্যায়ন দেখা যাবে।[৩]
সারণি-১.১
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সহিংস
সন্ত্রাসবাদ : তুলনামূলক সূচক, ১৯৯৬-২০১৪
সারণি-১ থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ রাজনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি অস্থিতিশীল ছিল। এই ১৮ বছর সময়কালে বাংলাদেশ মাত্র একবার নিচের দিক থেকে ৩০ শতাংশ দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নিচের দিক থেকে ৪.৩%। অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ দেশ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে স্থিতিশীল ছিল। ২০০৭ থেকে ২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশের অবস্থান সব সময়ই বিশ্বের ৮০ শতাংশ দেশের নিচে ছিল। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নিচের দিক থেকে ৭.৬%-এ। ২০১৪ সালে এ হার ১৮ শতাংশে উন্নীত হয়। বিশ্বব্যাংক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সূচক পরিমাপ করার জন্য গণ-আন্দোলন, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা ও সামরিক অভ্যুত্থানের মতো সহিংস ঘটনার প্রকোপ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের উপলব্ধি ব্যবহার করে। তবে অনেকে একই ধরনের সূচক নির্মাণে ভিন্ন উপাদানও ব্যবহার করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন পলিসি’ শীর্ষক একটি প্রকাশনা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করে। ১২টি উপাদানের ভিত্তিতে এ সূচক পরিমাপ করা হয়ে থাকে। উপাদানগুলো হচ্ছে[৪] (১) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, (২) শরণার্থীর সংখ্যা, (৩) গোত্রগত অসন্তোষ, (৪) মানুষের স্বদেশত্যাগ, (৫) অসম উন্নয়ন, (৬) দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অবনতি, (৭) রাষ্ট্রের বৈধতা, (৮) গণসেবা, (৯) মানবাধিকার, (১০) নিরাপত্তাব্যবস্থা, (১১) উপদলীয় কোন্দল ও (১২) বাইরের হস্তক্ষেপ। এই সূচকের ভিত্তিতে ১৭৮টি দেশের মূল্যায়ন করা হয়েছে। ২০১৪ সালের মূল্যায়নে বাংলাদেশের স্থান নিচের দিক থেকে ২৯ (সারণি-১.২ দেখুন)। এই সূচক প্রথমে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র সূচক’ হিসেবে পরিচিত ছিল। তখন একে ঠুনকো (Fragile) রাষ্ট্রের সূচক বলা হয়ে থাকে।
এই সূচক অনুসারে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ১৬.২% দেশের অন্তর্ভুক্ত। আর বিশ্বব্যাংকের সূচক অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে। অর্থাৎ দুটো সূচক অনুসারেই বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ দেশের মধ্যে রয়েছে। বস্তুত, সূচকভেদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংস পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। যেকোনো গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক সূচক ব্যবহার করা হোক না কেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সহিংস পরিস্থিতি অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
শুধু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সূচক অনুসারেই বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় নিচে নয়, অতীতের তুলনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতও বাড়ছে। বাংলাদেশে হরতালসংক্রান্ত সংখ্যাসমূহ বিশ্লেষণ করলেই এই উক্তির সত্যতা বোঝা যাবে (সারণি-১.৩)। ‘হরতাল’ শব্দটির উৎপত্তি গুজরাটি ভাষায়। মধ্যযুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে গুজরাটে শুল্ক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ রাখতেন।[৫] এই পরিস্থিতিকে হিন্দি ভাষায় বলা হতো ‘হাট-তাল’ বা হাটে তালা দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এ অসহযোগই হরতাল নামে পরিচিত হয়। ক্রমে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হোক অথবা ক্ষুদ্ৰ জনগোষ্ঠী কর্তৃক আপামর জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া অসহযোগ আন্দোলন হোক—সবই হরতাল নামে পরিচিত হয়।
সারণি-১.২
ঠুনকো রাষ্ট্রের সূচক, ২০১৪
সারণি-১.৩
বাংলাদেশে হরতাল, ১৯৪৭-২০১৫
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল সময়কালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় নিষ্পেষিত হয়েছে। এই শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধার ফলেই এ দেশে মুক্তিসংগ্রামের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। অথচ জাতির ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অসন্তোষ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক জীবন আজকের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়কালে গড়ে প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে মাত্র দুটি হরতাল পালিত হয়। যদি আঞ্চলিক ও স্থানীয় হরতালসমূহ বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে গড়ে প্রতিবছর ৩.৭৫টি হরতাল পালিত হয়। প্রতিতুলনায় ২০১১-১৫ সময়কালে প্রতিবছর গড়ে ৩৫.৫ দিন জাতীয় পর্যায়ে হরতাল পালিত হয়; আঞ্চলিক ও স্থানীয় হরতালসমূহ যোগ দিলে গড়ে হরতাল সংঘটিত হয় ৯৫.৭৫ দিন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলের তুলনায় জাতীয় পর্যায়ে ২০০৯-১৫ সময়কালে হরতালের পরিমাণ বেড়েছে ১৭৭৫ শতাংশ বা ১৭.৭৫ গুণ; আঞ্চলিক, স্থানীয়সহ সব হরতালের পরিমাণ বেড়েছে ২৫৫৩ শতাংশ বা ২৫.৫৩ গুণ। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান যুক্তি ছিল, ভিন্নরূপ জনগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হলে সমরূপ বাংলাদেশিরা বাংলাদেশে শান্তির নীড় গড়ে তুলতে সমর্থ হবে। বাস্তবে ঘটল উল্টোটি। সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তরতর করে বেড়ে গেল।
শুধু ব্যর্থতার ক্ষেত্রেই নয়, অর্জনের ক্ষেত্রেও দেখা দেয় অবাক কাণ্ড। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নেহাত অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়, তখন মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক কিসিঞ্জারের মতো অনেকেই বাংলাদেশকে ‘ভিক্ষার ঝুড়ি’ বলে নাক সিটকায়। এমনকি দুজন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশকে উন্নয়নের অগ্নিপরীক্ষা (Test case of Development) নামে আখ্যা দেন।[৬] তাঁদের বক্তব্য ছিল যে বাংলাদেশের মতো দুর্দশাগ্রস্ত দেশে যদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়, তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশেরই উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনীতিবিদদের হতাশাব্যঞ্জক ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। নিচে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো :
-নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত—জন্মলগ্নে বাংলাদেশ ছিল নিম্ন আয়ের দেশ। গত চার দশকের অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছে।
-মাথাপিছু আয়ের প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি—জনসংখ্যা হ্রাস এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
-খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাফল্য—১৯৭০ সালে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হতো। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে আবাদি জমি অনাবাদি কাজে ব্যবহারের কারণে ফসল উৎপাদনের জন্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালে মোট ৩.৪ কোটি টন খাদ্য উৎপাদিত হয়।
-দারিদ্র্যসীমার নিচে জনগোষ্ঠীর হারের উল্লেখযোগ্য হ্রাস—১৯৭০ সালে প্রায় ৭০% জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। আজ এ হার ২৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
-জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস—১৯৭০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে এক কোটি বেশি ছিল। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাসে সাফল্যের ফলে বর্তমানে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এক কোটি কম।
-মানব উন্নয়ন কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য—শিক্ষার হার বেড়েছে; শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। ১৯৭০ সালে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২। বর্তমানে এই হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ বছর।
-মানব উন্নয়ন সূচক অনুসারে সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে মধ্যম পর্যায়ে উন্নীত—জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) মানব উন্নয়নের সূচক অনুসারে সব রাষ্ট্রের সাফল্য পরিমাপ করে থাকে। বাংলাদেশ এ মূল্যায়নে সর্বনিম্ন পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন সূচকের ভিত্তিতে মধ্যম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে এমনটি ঘটার কথা নয়। গত চার দশকে বাংলাদেশে সুশাসনের ক্রম-অবনতি ঘটেছে। প্রচলিত মতবাদ অনুসারে যে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না, সেখানে টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়।
সুশাসন একটি বহুমাত্রিক বিষয়। ফলে শুধু একটি সূচকের ভিত্তিতে এর মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংক ছয়টি সূচকের ভিত্তিতে সব দেশের সুশাসন মূল্যায়ন করে। ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের সুশাসন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন সারণি-১.৪-এ দেখা যাবে।
সারণি-১.৪
বাংলাদেশে সুশাসনের মূল্যায়ন, ১৯৯৬-২০১৪
সারণি-১.৪-এ দুটো বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সময়কালে বাংলাদেশে চারটি সূচকের অবনতি ঘটেছে (বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, সরকারের কার্যকারিতা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ)। উন্নতি ঘটেছে মাত্র দুটি সূচকে (নিয়ন্ত্রণের মান ও আইনের শাসন)। সার্বিকভাবে সুশাসনের অবনতি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৬ সালে বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি ছাড়া বাকি ৫টি সূচকের মান খুবই নিচু, সব ক্ষেত্রেই সমীক্ষাকৃত দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের নিচে। শুধু গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিচের দিক থেকে ১৯৯৬ সালে ৪৭.৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। সুশাসনের অবনতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খায় না। ওপরের বিশ্লেষণ থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সুশাসন সম্পর্কিত তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও মেলে না। প্রচলিত বিশ্লেষণ অনুসারে সমরূপ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তাপ অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে সুশাসনের অভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে সুশাসনের অবনতি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিপরীত দিকে চলছে। রাজনীতি পেছনের দিকে ছুটছে আর অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সমরনায়ক উইনস্টন চার্চিলের একটি উক্তি মনে পড়ে। যুদ্ধের শুরুতে সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৯ সালের পয়লা অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, ‘I cannot forecast to you the actions of Russia. It is a riddle wrapped in a mystery inside an enigma, but perhaps there is a key. The key is Russian national interest.’
চার্চিলকে অনুকরণ করে বলতে গেলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকেও ‘রহস্যঘেরা প্রহলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি’রূপে বর্ণনা করা যায়।
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের রাজনীতির এই প্রহেলিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা। প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের সমস্যা কি সাম্প্রতিক, না এর উৎস বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে নিহিত। দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং এ প্রসঙ্গে প্রচলিত তত্ত্বসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে এ সমস্যা আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফলে এসব সমস্যা দানা বেঁধেছে। যদিও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা সমস্যার উপলব্ধির জন্য সহায়ক, তবু এসব সমস্যার সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। সমাধান খুঁজতে হলে শুধু ইতিহাস বিশ্লেষণই যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রের লক্ষ্যসমূহের আলোকে প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবর্তন ও বিচ্যুতিসমূহ ব্যাখ্যা করতে হবে। এর জন্য একটি প্রবন্ধ যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ বই। প্রবন্ধের তৃতীয় খণ্ডে প্রস্তাবিত বইয়ের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে।
১.২ অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাম্প্রতিক প্রবণতা মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অস্থিতিশীলতার শিকড় ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। অনেকের কাছেই এ তথ্য বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে লালিত ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হবে। এর কারণ, বেশির ভাগ ঐতিহাসিক বাংলাদেশের ইতিহাসকে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। এ ধারার সূচনা ঘটে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের হাতে। এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের আদৌ কোনো চর্চা হয়নি।
ব্রিটিশ শাসকেরাই প্রথম বাংলার নিয়মিত ইতিহাস রচনা করেন। ব্রিটিশ শাসকদের গর্ব ছিল যে তাঁরা ভারতে আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের ধারণা ছিল, ভারতবর্ষের ইতিহাস বড় বড় সাম্রাজ্যের ইতিহাস। তাই তাঁরা বাংলার ইতিহাসকে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসকে মৌর্য সাম্রাজ্য, কুষাণ সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য, সুলতানি শাসন, মোগল সাম্রাজ্য ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবিচ্ছেদ্য ইতিহাসরূপে গণ্য করা হয়। পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এই তত্ত্বকে নতুন উপাদানের ভিত্তিতে উপস্থাপন করেন।[৭] অথচ বাংলার ইতিহাসের সাম্রাজ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা সঠিক নয়। সাম্রাজ্য নয়, খণ্ডরাজ্য ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের নিয়তি।[৮] বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কখনো কখনো আধিপত্য স্থাপন করে। কিন্তু কখনো এ শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশের মধ্যে বারবার ছোট ছোট খণ্ডরাজ্য আত্মপ্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদানগুলো সাক্ষ্য দেয়, যেসব এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, তার মাত্র কিছু কিছু এলাকা কোনো কোনো সময় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর সাম্রাজ্যগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীন-সার্বভৌম খণ্ডরাজ্য গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাম্রাজ্যভিত্তিক ও খণ্ডরাজ্যভিত্তিক ইতিহাসের তুলনামূলক চিত্র সারণি-১.৫-এ দেখা যাবে।
সারণি-১.৫ থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে বৃহৎ সাম্রাজ্য নয়, খণ্ডরাজ্যই হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের বাস্তবতা। স্বল্পকালের জন্য বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চল বৃহৎ সাম্রাজ্যের অংশ হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রাচীনকালে রাজত্ব করেছে খড়গ রাত, নাথ, দেব, চন্দ্র, বর্মণ, হরিকেল ও পট্টিকেরা রাজবংশের মতো খণ্ডরাজ্যগুলো। কিন্তু এসব খণ্ডরাজ্য ছিল বনফুলের মতো ক্ষণস্থায়ী।
সারণি-১.৫
বাংলাদেশের ইতিহাসে এককেন্দ্রিক সাম্রাজ্যভিত্তিক (Unitary-Imperial) ও খণ্ডিত-স্থানিক (Fragmentary-Local) ব্যাখ্যার তুলনামূলক চিত্র
খ্রিষ্টাব্দ ৫০০ থেকে ১০০০ সময়কালে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে খণ্ডরাজ্যগুলোতে একটি রাজবংশ গড়ে মাত্র ৮০ বছর রাজত্ব করেছে। খ্রিষ্টাব্দ ১২০৬ থেকে ১৩৪১ সময়কালে বাংলাদেশে একজন সুলতান গড়ে ৫.৫ বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। খ্রিষ্টাব্দ ১৩৪২ থেকে ১৫৭০ সময়কালে বাংলাদেশে একজন শাসকের গড় রাজত্বকাল ছিল মাত্র ৯ বছর।[৯]
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে নৈরাজ্যও বাংলাদেশে বারবার দেখা দিয়েছে। খালিমপুর তাম্রলিপিতে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই পরিস্থিতি হলো মাছের জগতের মতো অরাজক ও নৈরাজ্যপূর্ণ।
ষোড়শ শতাব্দীতেও দেখা যায় নৈরাজ্য, হাবশি ক্রীতদাসেরা রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে দেয়। এ দেশে উত্তরাধিকারের সুস্পষ্ট কোনো আইন ছিল না। ফলে যখন- তখন ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হতো। ষোড়শ শতাব্দীর সম্রাট বাবর বাংলাদেশের এই অরাজক পরিস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ করেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের একটি অনন্য প্রথা হলো, সার্বভৌম শাসকের ক্ষেত্রে এখানে অতি স্বল্প ক্ষেত্রেই বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার অনুসরণ করা হয়। যে কেউ রাজাকে হত্যা করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করলে আমিররা, সৈনিকেরা ও কৃষকেরা তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয়—তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে এবং পূর্ববর্তী রাজার মতোই তাঁর অধিকার মেনে নেয় এবং তাঁর হুকুম তামিল করে। বাংলার লোকেরা বলে, আমরা সিংহাসনের প্রতি অনুগত, যে সিংহাসন দখল করে আমরা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকি।[১০] মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল বাংলাদেশকে ‘বুলঘকখানা’ বা অশান্ত আবাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সপ্তদশ শতকে শাহ নিয়ামত ফিরোজপুরী লিখেছেন : ১১
Bengal is a ruined doleful land
Go offer the prayers to the dead, do not delay
Neither on land nor water is there rest
It is either the tiger’s jaws or the crocodile’s gullet.
বাংলা হচ্ছে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বেদনাকুল দেশ
কালবিলম্ব না করে, যাও, মৃতদের কাছে দোয়া চাও,
মাটিতে, পানিতে কোথাও শান্তি নেই, নেই স্বস্তি
আছে শুধু বাঘের থাবা আর কুমিরের হাঁ।
বাংলাদেশে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ ঘটেছে। আবার স্থানীয় শাসকদেরও বারবার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ পর্যটক টম পিয়োরেস (Tom Piores) লিখেছেন, দূরপ্রাচ্যের লোকেরা বিশ্বাস করে বাঙালিরা বিশ্বাসঘাতক। সম্ভবত এই ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছে মেকলের বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণে। তিনি লিখেছেন, ‘What the horns are to the buffalo, what the sting is to the bee, what beauty according to the song is to woman, deceit is to the Bengalees.’ (মোষের যেমন শিং আছে, মৌমাছির আছে হুল, সংগীতে যেমন মেয়েদের সৌন্দর্য, তেমনি বাঙালিদের বিশেষত্ব প্রতারণা।)[১২] এমনকি ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালিদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল ও দলাদলি অনেক বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে অবিশ্বাসের ঐতিহ্য লালিত হয়।
ওপরের বিশ্লেষণ থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। কিন্তু এর কারণ ও সমাধান নিয়ে কোনো মতৈক্য দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে আটটি তত্ত্ব নিচে বিশ্লেষণ করা হলো।
১. ‘মাৎস্যন্যায়’ ও ‘মহাসম্মত তত্ত্ব’: প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বৃহৎ সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটেছে। তবু ভারতীয় দার্শনিকদের উদ্বেগের বিষয় ছিল নৈরাজ্য ও অরাজকতা। রামায়ণ ও মহাভারতে নৈরাজ্য সম্পর্কে গভীর শঙ্কা উচ্চারিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতে নৈরাজ্যকে ‘মাৎস্যন্যায়’ নামে অভিহিত করা হতো। মাৎস্যন্যায়ের শাব্দিক অর্থ হলো মাছের মতো অবস্থা। মাছের ভুবনে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। মাৎস্যন্যায়ের পরিস্থিতিতে সমাজে যারা শক্তিমান, তারা দুর্বলদের গ্রাস করে ও তাদের অধিকার হরণ করে। এ ধরনের পরিস্থিতি বিপজ্জনক। মাৎস্যন্যায়ের পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় হলো মহাসম্মত রাজ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। মহাসম্মত তত্ত্ব বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্রে।[১৩] বৌদ্ধদের বিশ্বাস, শাক্য বংশের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা মহাসম্মত। তিনি রাষ্ট্রের সবার সম্মতি নিয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করেছিলেন এবং সে জন্য তাঁকে মহাসম্মত বলে আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে খালিমপুর তাম্রলিপিতে মাৎস্যন্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গোপালের সিংহাসন গ্রহণ করার আগে বাংলাদেশে মাৎস্যন্যায়ের অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেশের প্রজারা গোপালকে রাজা নির্বাচন করেন এবং এই নির্বাচিত রাজবংশ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শাসন করে। এই ধরনের মতবাদ আসামেও দেখা যায়। আসামের ইতিহাসেও একটি পাল বংশ রয়েছে, সেই পাল বংশও দাবি করে, তাদের প্রথম রাজা প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে। এ ধরনের রাজা নির্বাচনের খবর দাক্ষিণাত্য ও কাশ্মীর থেকেও পাওয়া যায়। কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজাদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে রাজারা তাঁদের কর্মচারীদের দ্বারা এ কথা প্রচার করবেন যে তাঁর রাজবংশের প্রথম পুরুষ প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন। প্রাচীন ভারতের চিন্তাবিদেরা মনে করতেন যে গণসমর্থন ছাড়া কোনো রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। তাই তাঁদের অভিমত ছিল যে মাৎস্যন্যায়কে প্রতিহত করতে হলে নির্বাচিত রাজার প্রয়োজন রয়েছে। সমাধান হিসেবে এটা গ্রহণযোগ্য হলেও এই তত্ত্ব কেন বারবার মাৎস্যন্যায়ের পরিস্থিতি দেখা দেয়, তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। কাজেই এই তথ্য থেকে যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নৈরাজ্যের একটি সমাধান দেখা যায়; কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না।
২. ভৌগোলিক তত্ত্বসমূহ, বিশেষ করে সীমান্ত তত্ত্ব (Frontier Theory): অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ মানুষের ইতিহাসকে প্রভাবান্বিত করেছে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী। বিশ্বের তিনটি বড় নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বদ্বীপ অত্যন্ত অস্থিতিশীল ভূখণ্ড। প্রতিনিয়ত নদীর এক পাড় ভাঙে, আরেক পাড় গড়ে। তাই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন অস্থিতিশীল। তবে এই ধরনের অস্থিতিশীলতা বর্তমানের চেয়ে অতীতে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের তুলনায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। তাই শুধু এই তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
তবে এই প্রসঙ্গে ‘সীমান্ত তত্ত্ব’ শীর্ষক একটি বিশেষ তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা পরীক্ষা করা যেতে পারে। সীমান্ত তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ব্যাখ্যা হিসেবে প্রথম পেশ করা হয়। এটি পেশ করেন ঐতিহাসিক টার্নার।[১৪] তাঁর বক্তব্য ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে বিশাল ভূখণ্ডে রেড ইন্ডিয়ান ছাড়া অন্য কোনো জনবসতি ছিল না। পরবর্তীকালে ইউরোপিয়ানরা সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখল করে। কিন্তু তারপরও সীমান্তে অশান্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতা বিরাজ করে। মূলত যারা মূল সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারত না, তারাই এখানে আসত এবং তারা তাদের যে ঐতিহ্য ও চেতনা সেটাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করত। সীমান্ত অঞ্চলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ লালিত হয়। টার্নারের মতে, সীমান্ত অঞ্চলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রাণ। বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রচণ্ড ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রয়েছে। তাই বাংলাদেশের মানুষেরও গণতন্ত্রের প্রতি তীব্র অনুরাগ দেখা যায়। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এই উপস্থিতি সত্ত্বেও যে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে, এ পরিস্থিতিরও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
৩. মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক (Patron-client relationship) : ঐতিহাসিকদের মতে, কমপক্ষে রোমানদের সময় থেকে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। অনেক সামন্ততান্ত্রিক সমাজে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক বিরাজ করেছে। তবে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থায় মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক দুটি কারণে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। প্রথমত, হিন্দু জমিদারেরা ভূমির মুরব্বি ছিলেন অথচ মক্কেলরা ছিল মুসলমান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু জমিদারেরা মুরব্বির আসন হারান, অথচ মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের প্রভাবশালী গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সম্ভবত প্রচণ্ড ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জন্য এ অঞ্চলের মানুষ সব ব্যাপারে কোনো বিশেষ ব্যক্তির কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। এ বিষয়ে ষাটের দশকে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা সম্পর্কে ডক্টর রহিমের গবেষণা স্মরণ করা যেতে পারে।[১৫] ডক্টর রহিমের গবেষণা থেকে দেখা যায়, পূর্ব বাংলার গ্রামের লোকেরা সব বিষয়ে এক মুরব্বির পরামর্শ শোনে না, তারা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মুরব্বির পরামর্শ গ্রহণ করে। এ ধরনের সমাজে রাষ্ট্রব্যবস্থা মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্ট্যানলি এ কোচানেক বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুরব্বি মক্কেল সম্পর্ক নিয়ে একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন।[১৬] এ ধরনের সমাজে রাষ্ট্রনেতারা মুরব্বি হিসেবে বড় বড় মক্কেলদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মক্কেলদেরও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। আবার বড় মক্কেলরা ছোট মক্কেলদের মুরব্বিতে পরিণত হন এবং তাঁরা তাঁদের মক্কেলদের সুযোগ-সুবিধা দেন, বিনিময়ে মক্কেলরা মুরব্বিদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। এভাবে পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তিতে মুরব্বি-মক্কেলরা একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তবে সম্পদের অপ্রতুলতা হেতু একাধিক মুরব্বি-মক্কেল গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত দেখা দিতে পারে। এর ফলে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা জরুরি। প্রথমত, ক্ষমতার অপব্যবহার করে মক্কেলরা যাতে আইনবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা না পায়, সে লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগের ঐচ্ছিক ক্ষমতা হ্রাস করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুরব্বি-মক্কেল তথ্যের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতি শুধু মক্কেলদের জন্য করা হয় না, মুরব্বিদের ব্যক্তিস্বার্থে অনেক দুর্নীতি হয়। এর ফলে মক্কেলরা এ ধরনের দুর্নীতি সব সময় পুরোপুরি সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত, মক্কেলরা তাদের মুরব্বিদের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রাখতে পারে না। বাংলাদেশের নির্বাচনে বারবার ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি ঘটেছে।
৪. সামাজিক পুঁজির ঘাটতি : রবার্ট ডি পুটনাম সামাজিক পুঁজির নিম্নরূপ সংজ্ঞা দিয়েছেন : ‘Social capital refers to features of social organization such as trust, norms and networks that can improve the efficiency of society by facilitating coordinated action.’ (সামাজিক পুঁজি হচ্ছে পারস্পরিক আস্থার, প্রথাসিদ্ধ আচরণের ও সামাজিক সম্পর্কজালের মতো সামাজিক সংগঠনের বিশেষত্বসমূহ, যা সমন্বিত কার্যকলাপ সহজ করে সমাজের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়)।[১৭] পুটনাম তাঁর Making Democracy Work: Civic Traditions in Modern Italy গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সামাজিক পুঁজির তারতম্যের ফলে ইতালির উত্তর ও দক্ষিণে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কৃষ্টি ও সংগঠন গড়ে উঠেছে। যেখানে সামাজিক পুঁজি অপ্রতুল, সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শিকড় গাঁথতে পারে না। বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাখ্যার মূল বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের গ্রামীণ বসতিকাঠামোয় দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চল হচ্ছে ভিন্ন। পানির সহজপ্রাপ্যতা এবং বন্য আক্রমণের তীব্রতা কম হওয়ার ফলে এখানে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের প্রয়োজন কম। এর ফলে এখানে গ্রামসমূহ হচ্ছে উন্মুক্ত (Open Village)। এসব গ্রামের সংগঠনগুলো মূলত সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এদের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা সীমিত। পক্ষান্তরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে গ্রামগুলো ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংঘবদ্ধ (Corporate), যাদের অনেক বেশি প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল। এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় গ্রামীণ সংগঠনগুলো ছিল দুর্বল। তাই বাংলার ইতিহাসে এত রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।[১৮] এই তত্ত্বের সমালোচকেরা বলে থাকেন যে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা হিসেবে এ বক্তব্য সত্য ধরে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে সামাজিক ও আর্থিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক পুঁজির কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে কি না। সামাজিক পুঁজি সম্পর্কে যেসব গবেষণা হয়েছে, তাতেও বাংলাদেশে সামাজিক পুঁজির অপ্রতুলতা প্রতর্কের সমর্থন মিলছে। ১৯৮০-এর দশকে অধ্যাপিকা ইউএবি রাজিয়া আক্তার বানু দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশের পারস্পরিক আস্থা অত্যন্ত কম। তাঁর সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৪.৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী একে অপরকে বিশ্বাস করে। শহরাঞ্চলে পারস্পরিক আস্থার হার ২.৫ শতাংশ। প্রতিতুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে ৩৭ শতাংশ ও শহরাঞ্চলের ৪৪.৯ শতাংশ লোক একে অপরকে বিশ্বাস করে।
এ সম্পর্কে একটি নতুন সমীক্ষা খ্রিষ্টাব্দ ১৯৯৯-২০০১ সময়কালে পরিচালিত হয়। এ সমীক্ষার ফলাফল সারণি-১.৬-এ দেখা যাবে।
সারণি-১.৬ থেকে এ কথা স্পষ্ট, বিশ্বের ৮০টি দেশের গড় সামাজিক পুঁজির (২৭.৬) তুলনায় বাংলাদেশের সামাজিক পুঁজির (২৩.৫) পরিমাণ কম। গড়ে ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মানুষ বাঙালিদের তুলনায় একে অন্যকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে। ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য উন্নত দেশে বাংলাদেশের তুলনায় সামাজিক পুঁজি অনেক বেশি। ফ্রান্স ও বাংলাদেশে সামাজিক পুঁজি প্রায় একই পর্যায়ে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে ফ্রান্স ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছে।
সারণি-১.৬
বিভিন্ন দেশে সামাজিক পুঁজির পরিমাণ
(শতকরা কত ভাগ মানুষ অন্যদের বিশ্বাস করে)
সামাজিক পুঁজির ঘাটতি ইতিহাসের অমোঘ বিধান নয়। তবে সামাজিক পুঁজি গড়তে অনেক সময় লাগে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত, যেখানে সামাজিক পুঁজির ঘাটতি রয়েছে, সেখানে তৃণমূল সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলোর উদ্যোগে তৃণমূল সংগঠন গড়ে ওঠার ফলে এখানে সামাজিক পুঁজি ক্রমেই বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, যেখানে সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠছে, সেখানে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। এই ঘাটতি মেটানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি অত্যন্ত জরুরি।
৬. বিপ্লবের প্রভাব : নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এর আত্মপ্রকাশ। বিপ্লব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দেয় এবং নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু এ নতুন কাঠামো সবার জন্য সমভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাই নতুন ও পুরোনোর মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। সমাজের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দেয়। কখনো বিপ্লবী চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আবার কখনো প্রতিক্রিয়াশীল থারমিডরিয়ান (Thermidorian) পরিস্থিতি দেখা দেয়। এর ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এখানে ফরাসি বিপ্লবের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৭৭৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা। তবে বিপ্লবের সন্তান নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাজত্বকাল অন্তর্ভুক্ত করলে প্রথম ফরাসি বিপ্লবের অবসান হয় ১৮১৫ সালে। আবার বিপ্লবী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ১৮৩০ সালে। এর ১৮ বছর পর আবার বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৮৪৮ সালে। এরপর ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিস কমিউন প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে প্রচণ্ড ছাত্রবিক্ষোভ দেখা দেয়। বিপ্লব ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে ফরাসি দেশে বারবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। বাংলাদেশি বিপ্লবও ছিল ফরাসি বিপ্লবের মতো রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক। এই যুদ্ধের বেদনাদায়ক স্মৃতি জাতির মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করে। চার দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিপরীতমুখী শক্তির নিরন্তর সংঘর্ষ চলছে। কখনো মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকেরা জয়যুক্ত হচ্ছেন; আবার কখনো বিরোধী শক্তিরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক সমর্থকেরা মনে করেন যে এই মৌল দ্বন্দ্ব নিরসন না হওয়া পর্যন্ত এ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলবে। গত চার দশকের অভিজ্ঞতা এ অনুমানের অনেক বক্তব্য সমর্থন করে। তবু এ অনুমান বাংলাদেশের সব ধাঁধার উত্তর দিতে পারে না। বিশেষ করে যত দিন যাচ্ছে, ততই মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি জনমানস থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা। পক্ষান্তরে যত দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়ছে। বিপ্লবের প্রভাব বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের একমাত্র নিয়ামক নয়।
৭. উপদলীয় কোন্দল ও বংশভিত্তিক রাজনীতি : ঐতিহাসিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের দলাদলির পরাকাষ্ঠারূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন :[১৯]
The Bengalis and more specially the Bengalis of Calcutta, were and still, some of the finest virtuoso of factiousness. There is hardly any branch of it which they do not practice and hardly any activity, into which it has not wormed its way. The latest consequence of this factiousness, now that political power has come into the hands of these clique-ridden creatures is going to be chronic political instability. The stasis of Plato and the asabiya of Ibn Khaldum were as milk and water compared with this distilled spirnt of factionusness’ (1988, p. 401).
মধ্যযুগ থেকে বাংলার ইতিহাসে উপদলীয় কোন্দল ও দলাদলিভিত্তিক ‘কাজিয়া’র উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির নিবিড়তা অনেক বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বংশভিত্তিক রাজনীতি। বংশভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেখা যেত। তবে সম্প্রতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া কিংবা সিরিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে বংশগত রাজনীতির প্রাধান্য দেখা যায়। তবে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বংশগত রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার একজন প্রতিবেদক ভারতের প্রাদেশিক পর্যায়ের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, ভারতের মূল সমস্যা হচ্ছে, এটি বংশভিত্তিক গণতন্ত্র, এটি পরিচালনাও করে বংশসমূহ এবং এটি পরিচালিত হয় বিভিন্ন বংশের স্বার্থে। সব বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠী সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। দাবি করা হয়, প্রতিষ্ঠাতাদের এই সম্মোহনী শক্তি তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপরই বর্তায়। এই বিশ্বাসই হচ্ছে বংশগত রাজনীতির মূল ভিত্তি ম্যাক্সওয়েবার লিখেছেন যে এ ধরনের সমাজ শাশ্বত অতীতে বাস করে। কেননা, এদের জন্য বর্তমানের চেয়ে অতীত অনেক বড়। বাংলাদেশে দুটি প্রধান রাজনৈতিক বংশ রয়েছে। এদের প্রতিষ্ঠাতারা ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের জন্য এরা বিভক্ত এবং সংঘর্ষে লিপ্ত। যত দিন বাংলাদেশে বংশগত রাজনীতির প্রাধান্য থাকবে, তত দিন অস্থিতিশীলতা হ্রাস করা সম্ভব হবে না।
৮. কয়েদিদের উভয়সংকট (Prisoner’s dilemma) : অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাতকে প্রতিপক্ষের ক্রীড়াতত্ত্বের (game theory) আলোকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের সংঘাত কয়েদিদের উভয়সংকট (Prisoner’s dilemma ) ক্রীড়ার সঙ্গে তুলনীয়। এই ক্রীড়ায় যুক্তভাবে দোষী দুই আসামিকে পুলিশ কয়েদে পাঠায় I কিন্তু পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। পুলিশ আসামিদের একে অপরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে চারটি প্রস্তাব দেয় : (১) যদি তোমার সহ-আসামি দোষ কবুল করে আর তুমি কবুল না করো, তোমার পাঁচ বছরের জেল হবে আর তোমার সহ-আসামির তিন মাসের জেল হবে। (২) যদি তোমরা উভয়েই অপরাধ অস্বীকার করো, তোমাদের দুজনেরই এক বছরের জেল হবে। (৩) যদি তোমরা উভয়েই অপরাধ স্বীকার করো, তোমাদের দুজনেরই তিন বছরের কারাদণ্ড হবে। (৪) যদি তুমি অপরাধ স্বীকার করো আর তোমার সহ-অভিযুক্ত দোষ স্বীকার না করে, তবে তোমার তিন মাসের সাজা এবং সহ-অভিযুক্তের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে। এই দুই আসামিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়। কোনো সলাপরামর্শ ছাড়াই যদি তারা একে অপরের প্রতি আস্থাশীল হয়, তবে উভয়েই এক বছর করে জেল খেটে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যদি আসামিরা একে অপরকে বিশ্বাস না করে, তাহলে উভয়েই অপরাধ কবুল করবে এবং উভয়েই তিন বছর জেল খাটবে। স্বল্প মেয়াদে দেখা যায় যে এ ধরনের ক্রীড়ায় একে অপরকে অবিশ্বাস করে। ফলে উভয়েই অপরাধ কবুল করে যুক্তভাবে সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কয়েদিদের উভয়সংকটের সঙ্গে তুলনীয়। এখানে অবিশ্বাসের ফলে দুটো রাজনৈতিক দলই সংঘাতের জন্য অনেক বেশি মূল্য দিয়ে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। ১৯৮৪ সালে রবার্ট অ্যাক্সেলরড (Robert Axelrod) The Evolution of Cooperation[২০] নামের একটি বিখ্যাত গ্রন্থে এ ধরনের ক্ষেত্রে কীভাবে অবিশ্বাস কমিয়ে আনা যায়, সে সম্পর্কে কতকগুলো পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নিম্নলিখিত পরামর্শগুলো বিবেচনার যোগ্য :
(১) যদি উভয় পক্ষ ঘন ঘন এবং নিরবচ্ছিন্ন খেলা চালাতে থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের সহযোগিতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্স ও জার্মানির সেনারা যখন পরিখায় অবস্থান নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, প্রথমে তুমুল যুদ্ধ চলে। তারপর তারা আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। যদি কোনো পক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসতেন, তবে তারা তুমুল যুদ্ধ শুরু করে দিত। যখনই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চলে যেতেন, তখনই তারা যুদ্ধ বন্ধ করে দিত। কাজেই দীর্ঘদিন সংঘাত চলতে থাকলে আস্তে আস্তে তার তীব্রতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
(২) যদি প্রতিযোগিতার পুরস্কারের আকর্ষণ কমানো হয়, তবে প্রতিযোগিতার তীব্রতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগের মেয়াদ হ্রাস ও ক্ষমতা হ্রাস দ্বন্দ্বের তীব্রতা হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।
(৩) উভয় পক্ষকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এ ধরনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা দ্বন্দ্বের তীব্রতা হ্রাস করবে।
(৪) উভয় পক্ষের মধ্যে যত আদান-প্রদান বাড়বে, সংঘাতের তীব্রতা ততই কমে যাবে। উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে কয়েদিদের উভয়সংকট হ্রাসের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উভয় পক্ষের মধ্যেই দ্বন্দ্ব হ্রাসে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
উপরিউক্ত সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈপরীত্য ও আপাতবিরোধী অবস্থান নতুন কিছু নয়, এ ধরনের বৈপরীত্য ও সংঘাত বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। ভারতীয় সভ্যতার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এ ভূখণ্ডে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সব সময়ই প্রবল। সাধারণ মানুষের সম্মতি ছাড়া স্থিতিশীল রাষ্ট্রকাঠামো এখানে সম্ভব নয়। এখানে বারবার নেমে এসেছে মাৎস্যন্যায়ের বা অরাজকতার কালো ছায়া। এ অঞ্চলের সবচেয়ে স্থিতিশীল পাল সাম্রাজ্যের সূচনা হয় জনগণের নির্বাচিত শাসক দিয়ে। এখানে রাজা শুধু শাসক নন, তিনি ‘মহাসম্মত’। এখানে সামাজিক পুঁজির ঘাটতি রয়েছে। এখানে তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামীণ সংগঠন ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল। এখানে তাই ধ্রুপদি ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিপত্তি ছিল না; এখানে বেদবহির্ভূত তান্ত্রিক মতবাদ ও বহিরাগত ইসলাম ধর্ম প্রাধান্য লাভ করে। এখানে অনেক ক্ষেত্রে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বংশভিত্তিক রাজনীতি। এখানে মুক্তিযুদ্ধে বৈপ্লবিক লড়াই সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। এখানে রাজনীতিতে চলছে ‘কয়েদিদের উভয়সংকটের’ মতো একটি মারাত্মক হার-জিতের খেলা। এসব সংকটের কোনো সহজ সমাধান নেই। উপরন্তু কোনো সমাজই সব বৈপরীত্যের সমাধান করতে পারে না। তবু নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ এই সংকট হ্রাসে সহায়ক হতে পারে :
-অতীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে গণতন্ত্র কাজ করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও গণতান্ত্রিক সমাধানই সবচেয়ে কার্যকর হবে।
-বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য সামাজিক পুঁজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
-আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক যে মুরব্বি-মক্কেল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা হ্রাস করতে হবে।
-বর্তমানে যে সংঘাতময় হার-জিতের খেলা চলছে, তার প্রশমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এসব ব্যবস্থা প্রয়োজনীয় কিন্তু যথেষ্ট নয়। সব প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে হবে, নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের উপযোগী প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের সমস্যার কোনো একটি মাত্র চাবিকাঠি নেই। এর জন্য প্রয়োজন বিস্তারিত বিশ্লেষণ ও অনেক পরস্পর নির্ভরশীল সমাধান। এ কাজ একটা প্রবন্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি গ্রন্থের। প্রস্তাবিত গ্রন্থের রূপরেখা এ নিবন্ধের তৃতীয় অংশে উপস্থাপন করা হলো।
১.৩ গ্রন্থের রূপরেখা
প্রস্তাবিত বইটির শিরোনাম হলো ‘অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’। বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁকে বাঁকে রয়েছে ব্যাপক বৈপরীত্য ও আপাতবিরোধী সত্য বা প্যারাডক্স। এর ফলে মনে হবে, হেঁয়ালির বিচিত্র ছলনাজালে আবদ্ধ হয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এই সব হেঁয়ালির কোনো সুনির্দিষ্ট চাবিকাঠি নেই। এ ধরনের সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন অনেক চাবিকাঠি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রহেলিকার চাবিকাঠিসমূহের অন্বেষণের জন্য এই রাজনীতির লক্ষ্য, প্রতিষ্ঠানসমূহ, সংস্কৃতি, প্রচলিত পদ্ধতিসমূহের বিশ্লেষণ করতে হবে। এই বিশ্লেষণ ছয়টি খণ্ডে ১৫টি অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম খণ্ডে গ্রন্থের প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে। এই খণ্ডের ‘অবাক বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি অধ্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যময় হেঁয়ালিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সবশেষে প্রস্তাবিত গ্রন্থের রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলনীতিসমূহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ নিম্নরূপে বিবৃত হয়েছে : ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।’ এই খণ্ডের বিশ্লেষণের মূল লক্ষ্য হলো, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব মূলনীতি প্রতিপালনের কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং আর কী ব্যবস্থা নিতে হবে, তার বিশ্লেষণ। এই খণ্ডে চারটি অধ্যায় রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের শক্তি ও সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয় হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। এই অধ্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর এ ক্ষেত্রে যেসব নতুন চ্যালেঞ্জ উদ্ভূত হয়েছে, সে সম্পর্কেও এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয় হলো গণতন্ত্র। এ অধ্যায়ে গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শক্তি ও দুর্বলতাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তৃতীয় খণ্ডে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই খণ্ডে রয়েছে পাঁচটি অধ্যায়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নির্বাহী বিভাগের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ‘বঙ্গভবনে বাঁটকু’ শীর্ষক অধ্যায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস এবং প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠনিক ক্ষমতাবৃদ্ধির বিশ্লেষণ করা হয়েছে। উপরন্তু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ের উপজীব্য হলো জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদের ক্ষমতাবৃদ্ধি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রস্তাবও এখানে আলোচিত হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থার মৌলিক সমস্যাসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে দশম অধ্যায়ে। এই প্রসঙ্গে শাসন ব্যবস্থাকে একাধিক স্তরে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবাবলিও বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
চতুর্থ খণ্ডে আলোচনার বিষয় নির্বাচন। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের দুটো সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, সংবিধানে নির্ধারিত পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে সরকার কতটুকু প্রতিনিধিত্বশীল। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই দেশ পরিচালনা করে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত সরকার। একবার নির্বাচিত হলে সরকার পূর্ণ মেয়াদে দেশ পরিচালনা করে। জনমত যাচাই না করেই এ ধরনের সরকার সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। কাজেই নির্বাচনের সঙ্গে সরকার গঠন ও পরিচালনার সম্পর্ক বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তাই একাদশ খণ্ডে সরকার নির্বাচনের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এ ধরনের নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালে বিশেষ সরকারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। উপরন্তু সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কারের দাবি রয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
পঞ্চম খণ্ডে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুটি প্রধান ধারক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে একটি প্রাণবন্ত সিভিল সমাজ রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিভিল সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে চতুর্দশ অধ্যায়ে।
ষষ্ঠ খণ্ডের আলোচনার বিষয় হলো, এই বইয়ে বর্ণিত সমস্যাগুলো বাংলাদেশকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং চিহ্নিত সমস্যাগুলো থেকে মুক্তির পথ সন্ধান। এ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তবে এই আলোচনায় যেসব সমাধান প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সবই হয়তো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার আরও ভালো ও সহজ সমাধান সম্ভব হতে পারে। এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য সমস্যাগুলোর চূড়ান্ত সমাধান নির্দেশ করা নয়, সমাধানগুলো নিয়ে বিতর্ক শুরু হলেই এ গ্রন্থের লক্ষ্য অর্জিত হবে।
পাদটীকা
১. CIA 2016. The World Factbook. Wikipedia- আয়তনে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২।
২. Stanley A. Kochanek. 1996. Patron Client Politics and Business in Bangladesh, Dhaka: University Press Ltd. Y-39
৩. World Bank, 2016 Worldwide Governance Indicators http://www.govindicatorsa.org
৪. The Fund for Peace and Foreign Policy. 2016. Fragile State Index. http//fsi.fundforpeace.org.
৫. Irfan Habib. 1995. Essays in Indian History: New Delhi: Tulika
৬. Just Faaland and Jac k R. Parkinson. 1997. Bangladesh the Test case of Development. Dhaka: University Press Ltd.
৭. R. C. Majumdar. 1943. History of Bengal. Dhaka: Dhaka University Press.
৮. A. M. Chowdhury. 1967. Dynastic History of Bengal. Dhaka: The Asiatic Society of Pakistan
৯. Akbar Ali Khan. 1996. Discovery of Bangladesh. Dhaka: University Press Ltd. 75
১০. উদ্ধৃত : Muhammad Abdur Rahim. 1963. Social and Cultural History of Bangal. Vol. 1 Karachi: Karachi University Press. 188
১১. উদ্ধৃত : Richard M. Eaton. 1994. The Rise of Islam and Bengal Frontier, 1201-1710. Delhi: Oxford University Press. JD
১২. উদ্ধৃত : Nirad C. Chaudhuri. 1987. Thy Hand! Great Anarch. Reading, Mass: Addison, Wesley Publishing Company, SbS
১৩. A.L. Basham. 1954. The Wonder that Was India, New York: Grove Press Inc, 82
১৪. F. J. Turner. 1953. The Forntier in American History. New York: Henry Holt and Company.
১৫. S. A. Rahim. 1965. Communication and Personal Influences in East Pakistan Village. Comilla: PARD.
১৬. Stanley A. Kochanek. 1996. MEFOLL
১৭. Robert D. Putnam. 1982. Making Democrasy Work. Princeton: Princeton University Press.
১৮. Akbar Ali Khan. 1996. প্রাগুক্ত ৫৩-৬১
১৯. N. C. Chaudhuri. 1987. F, 800
২০. Robert Axelrod. 1984. The Evolution of Coperation. New York: Basic Book