প্রথম সূত্র
অর্চিষ্মান : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল সোয়া সাতটা
শীতের সকালগুলোয় লেকের রাস্তা ধরে হাঁটতে বেশ লাগে আর্চির। কেমন একটা ঝাপসা দৃশ্যপট। গাছের মাথায় মাথায় ক্যান্ডিফ্লসের মতো কুয়াশা। নানা রঙের টুপি, গ্লাভস আর মাফলার জড়ানো মানুষজন। মর্নিং ওয়াকার। মনে হয় যেন ঘষা কাচের ভেতর দিয়ে রঙিন কোনও ছবি দেখছে ও।
সকালে ওঠার অভ্যেস নেই আর্চির। অবশ্য অভ্যেস নেই বলাটা ঠিক নয়। কারণ আর্চি যে-কাজ করে তাতে দিনরাত, সকাল-বিকেলের পার্থক্য করলে হয় না। ক্যামেরা নিয়ে কখনও জঙ্গলে, কখনও পাহাড়ে আবার কখনও গঙ্গাসাগর বা কুম্ভমেলায় ঘুরে বেড়াতে হয় ওকে। সেখানে তো আর দিন বা রাতের পার্থক্য করলে হয় না। ছবি তুলতে গেলে সময়ের দিকে তাকালে চলে না।
একবার বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সারারাত অন্ধকারে জেগে বসে ছিল আর্চি। তন্ত্র সাধনার এমন কিছু ছবি সেদিন তোলার উদ্দেশ্য ছিল যা সাধারণ মানুষেরা কোনওদিন দেখেনি। আর একবার হিমালয়ের পাদদেশে একটা গ্রামে গিয়ে ভাম বেড়ালের মতো এক জন্তুর পেছনে সারাদিন ঘুরতে হয়েছিল ওকে। এরকম অনেক ঘটনার কথা মনে করতে পারে আর্চি। বিভিন্ন ম্যাগাজিন থেকে যেরকম ছবির অ্যাসাইনমেন্ট পায়, সেরকম ছবি তোলার জন্য ওকে ঘুরে বেড়াতে হয় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। তখন বিশ্রাম, ঘুম বা খাওয়ার কথা ঠিক মাথায় থাকে না ওর।
তবে যখন কাজকর্ম থাকে না, তখন রাজ্যের আলসেমি এসে চেপে ধরে ওকে। সারাদিন নানা রকম বিদেশি থ্রিলারের স্তূপ নিয়ে নিজেকে পেরেক দিয়ে পুঁতে রাখে বিছানার সঙ্গে। গত কুড়ি তারিখ ও কলকাতায় ফিরেছে কাশ্মীর থেকে। চেন্নাইয়ের একটা ম্যাগাজিন ওকে স্নো ফল-এর ছবি তুলে দেবার জন্য ফরমায়েশ দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইনস ডে-র জন্য ওদের ট্র্যাভেল অ্যান্ড রোম্যান্স ইস্যুতে ছাপাবে।
ছবিগুলো তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে ওকে। দেড়-দু’ফুট বরফ ভেঙে কাশ্মীরি গ্রামের ভেতর গিয়ে ছবি তোলা যেমন কষ্টের তেমন আবার উগ্রপন্থার ভয়ও আছে। ও যে-হোটেলে ছিল সেখানকার রুম সার্ভিসের ছেলে জায়েদ ওকে বলেছিল যে, এইসব ক্যামেরা, স্ট্যান্ড, ব্যাগ, লেন্সের বাক্স নিয়ে বেশি ইনটিরিয়ারে না যাওয়াই ভাল। কারণ, ‘টেররিস্ট লোগ পসন্দ নেহি করতে।’
কিন্তু সে সব শুনলে কি আর্চির কাজ হত? তাই ওকে ওর ছবি তোলার লটবহর নিয়েই যেতে হয়েছিল। হাড় ফুটো করে দেওয়া ঠান্ডায় সে এক নরক যন্ত্রণা। জায়েদ ওকে বলেছিল, “সাব, চানা চাবাতে রহিয়ে।”
“চানা? কিঁউ?” আশ্চর্য হয়েছিল আর্চি।
“নেহি তো জাবরা আটক জায়েগা।”
অ্যাঁ, ঠান্ডায় চোয়াল আটকে যাবে? তাই চানা চিবিয়ে চোয়াল সচল রাখতে হবে? বেশ অবাক হয়েছিল আর্চি। তবে কথাটা শুনেছিল ও। যে-ক’দিন ওখানে ছিল, বোধহয় দুটো ঘোড়ার খাবার একাই সাবাড় করে দিয়েছে ও।
এই চানার পরামর্শ মানলেও জায়েদের অন্য পরামর্শটা মানতে পারেনি আর্চি। জায়েদ ওকে জোব্বার তলায় কাঙ্গরি নিতে বলেছিল। কিন্তু ওসব নিয়ে কি আর ছবি তোলা যায়? তাই ওটা আর নেয়নি আর্চি। শুধু ছবি তোলবার আগে ঠান্ডায় হাত স্টেডি রাখতে ফ্লাস্কের থেকে গরম জল মেশানো ব্র্যান্ডি খেয়ে নিত একটু। তবে বিশেষ তারতম্য হত না। এটা অনেকটা বেলুন ফাটানোর গুলি দিয়ে বাঘ মারার চেষ্টার মতো হত। তবু যাই হোক, কষ্ট করে হলেও কাজটা শেষ করতে পেরেছে ও। তবে এখনও সেই সব গ্রামের দৃশ্য চিন্তা করলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আর্চির। মাইলের পর মাইল সাদা বরফ, ধূসর আকাশ আর কঙ্কালের মতো গাছে ঘেরা এক একটা গ্রাম। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ফোকাস ঠিক করার সময় মাঝে মাঝে বুক কাঁপত আর্চির। মনে হত দূরের ওইসব কঙ্কালসার গাছের জঙ্গল থেকে মুখ বাড়িয়ে কেউ কি দেখছে ওকে? কোনও বন্দুকের নল কি তাগ করে রয়েছে ওর বুকে? কোনও গুলি কি ছুটে আসবে মুহুর্তের মধ্যে? প্রতিদিন কাজ সেরে হোটেলে ফিরে আর্চি ভাবত, যাক আরেক দিন বেঁচে গেল ও।
গতকাল ছবিগুলোর প্রিন্ট নিয়ে বসেছিল ও। দেখে খুব একটা খুশি হতে পারেনি। ম্যাগাজিনটা ওকে বলেছিল যে, ছবির মুডটা যেন হলিডে আর রোম্যান্স হয়। কিন্তু ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে এই দুটো মুডের একটাকেও দেখতে পায়নি ও। ছবিগুলো খুব পেনসিভ হয়েছে। পেনসিভ আর ইরি। গা-ছমছমে একটা ভাব যেন ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত ছবি জুড়ে। বরফের সাদা রং যেন মৃত মানুষের মুখের মতো লাগছে। গাছগুলোর নগ্ন ডালপালা যেন ইংরেজি হরর ছবি থেকে নেওয়া। এই ছবি দেখে কেউ ওখানে হলিডে কাটাতে যাবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আর্চি আর কী করবে? যা উঠেছে তাই তো দিতে হবে ওকে। তারপর যদি ওরা রিজেক্ট করে তখন আরেক বার চেষ্টা করা যাবে।
ভারী ব্যাগটা এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিল ও। সামান্য রিনঠিন শব্দ হল ব্যাগের ভেতর। এতে ক্যামেরা রয়েছে। এত সকালে বাড়ি থেকে বেরোলেও ক্যামেরার ব্যাগটা নিতে ভোলেনি আর্চি। আসলে ও কখনওই এই একটা জিনিস নিতে ভোলে না। কখন কোথায় কী সাবজেক্ট পেয়ে যায় কে বলতে পারে?
ঘড়িটা একবার দেখল আর্চি। সাতটা কুড়ি বাজে। আরও মিনিট দশেক সময় রয়েছে ওর হাতে। রাওয়াত আঙ্কলের ওখানে সাড়ে সাতটা নাগাদ যেতে হবে। মেনকা সিনেমার পরেই রাওয়াত আঙ্কলের বিশাল বড় বাড়ি। রাওয়াত আঙ্কল আজ পেমেন্ট দেবেন। চার লাখ টাকা।
এইসব ঝুট-ঝামেলা একদম ভাল লাগে না আর্চির। আরে বাবা, এইসব পেমেন্ট-ফেমেন্ট আনা কি ওর কম্ম? কিন্তু বাবাকে বোঝাবে কে? তবে চেষ্টা করেছিল ও বোঝাতে, সফল হয়নি।
আর্চি ফ্রিলান্স ফোটোগ্রাফার হলেও ওদের বড় পারিবারিক ব্যাবসা আছে। একটা ট্রান্সপোর্ট-সহ সি এন্ড এফ এজেন্টের আর একটা হল অ্যাড এজেন্সির। বিদেশে মাল পাঠাবার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট এজেন্সির সঙ্গে অ্যাডভার্টাইজিং একটা অদ্ভুত কম্বিনেশন হলেও গত কুড়ি বছর ধরে বাবা খুব দক্ষতার সঙ্গে এই দুটো ভিন্ন নৌকায় পা দিয়ে দিব্যি চালাচ্ছে। এখন অবশ্য আর্চির দাদা অহনও ব্যাবসা দেখে। তবে অহন মূলত অ্যাডভার্টাইজিং নিয়েই আছে।
রাওয়াত আঙ্কল বাবার পুরনো ক্লায়েন্ট। বিভিন্ন রকম খাদ্যশস্যের এক্সপোর্ট করেন বিদেশে। বিশেষ করে বাংলাদেশে। ওঁর এই এক্সপোর্টের ক্যারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট হল বাবার কোম্পানি।
আর্চি কোনও অ্যাসাইনমেন্ট সেরে বাড়িতে ফিরলেই বাবা রে রে করে লেগে পড়ে ওর পেছনে। কী? না অনেক ক্যামেরা নিয়ে খেলাধুলো হয়েছে, এবার ওসব যন্ত্রপাতি রেখে ব্যবসায় বোসো। বাবাকে আর্চি অনেক বুঝিয়েছে যে, আম গাছে আমড়া হয় না। কিন্তু বাবা উলটে রেগে গেছে। বলেছে, “কোনটা আম আর কোনটা আমড়া তা বোঝার বয়স তোমার হয়নি।” আর্চি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে গেলেও সফল হয়নি। আসলে বাবার জীবনে একটাই যুক্তি, সেটা হল আর্চিকে ব্যবসায় বসতে হবে। তাই সুযোগ পেলেই বাবা ওকে দিয়ে ব্যবসার এটা-ওটা কাজ করিয়ে নেয়।
গতকাল রাতেই যেমন খাবার টেবিলে বলেছিল, “আর্চি, তুমি কাল সকালে মিস্টার রাওয়াতের বাড়ি গিয়ে পেমেন্ট নিয়ে আসবে।”
“আমি? কেন?” অবাক হয়েছিল আর্চি।
“কারণ আমি বলছি তাই। শোনো, ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় ওঁর বাড়ি চলে যাবে। উনি দিয়ে দেবেন।”
“সাড়ে সাতটার সময়?” সামান্য ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল আর্চির, “অত সকালে?”
“অত সকাল মানে? যখন ক্যামেরা নিয়ে ছাগল-গোরুর ছবি তোলার জন্য ভোরবেলা উঠে কুস্তি করো, তখন ‘অত সকালে!’ বলো? শোনো, মেনকা সিনেমার পাশের বড় পাঁচিল ঘেরা বাড়িটাই হল মিস্টার রাওয়াতের। দেখলেই বুঝতে পারবে। ওরকম বড় বাড়ি একটাই আছে ওখানে। ঠিক সাড়ে সাতটায় পৌঁছে যাবে। উনি চার লাখ টাকার চেক দেবেন। চেকটা নিয়ে বাড়িতে এসে ডিপোজিট বইয়ে লিখে জমা করে দেবে। হাইভ্যালু চেক, তাড়াতাড়ি ক্যাশ হয়ে যাবে। মনে থাকে যেন পরশু পঁচিশে ডিসেম্বর, ছুটির দিন, তার পরের দিন রোববার। কালকে ফার্স্ট আওয়ারে চেকটা জমা পড়া চাই।”
মেজাজ খারাপ করে কোনওমতে খেয়েদেয়ে উঠে পড়েছিল আর্চি। বাবা সবসময় ফালতু ঝামেলা বাধায়। আর রাওয়াত আঙ্কলই বা কী? ব্যাবসার টাকা অফিসে দে, না সাত সকালে বাড়িতে গিয়ে আনতে হবে। বিরক্তির একশেষ। ও ভাবল, কেউ কি রাওয়াত আঙ্কলের অফিস থেকে গিয়ে চেকটা আনতে পারত না?
আর্চির মাথা গরম হওয়ার আরেকটা কারণও ছিল। সকাল আটটায় যে ওর ইরার সঙ্গে দেখা করার কথা রাসবিহারী মোড়ে! এমনিতে গত কয়েক মাসের ঘটনায় ইরা টাইমবোম হয়ে আছে। তার মধ্যে যদি সকাল আটটায় দেখা না করে তা হলে বোমা ফাটতে সময় লাগবে না একটুও। এখন রাওয়াত আঙ্কল যদি চেক দিতে ঝোলায় তা হলে ঝঞ্জাটের আর বাকি থাকবে না।
ও তাই খাওয়ার পর অহনের ঘরে গিয়েছিল। ভেবেছিল দাদা যদি উদ্ধার করে ওকে।
অহন খাটে আধশোয়া হয়ে কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখে কিছু একটা টাইপ করছিল। আর্চি গিয়ে দাঁড়াতেই অহন মুখ তুলে তাকিয়েছিল, “কী রে ভাই, কিছু বলবি?” অহনের বয়স বছর তিরিশেক হলেও ওর গলায় আওয়াজটা কিশোর বয়সেই আটকে আছে যেন। আর অহনের স্বভাবটাও নরমসরম। যেন ডমিনেটেড হওয়ার জন্যই ওর জন্ম। আর্চির মতে অহন খানিকটা ইনকনসিসটেন্টও। হঠাৎ হঠাৎ ওর মুড শিফ্ট হয়। যদিও অহন নিজে মানে না এটা।
আর্চি বলেছিল, “দাদা, মাইরি উদ্ধার কর আমায়। এসব রাওয়াত টাওয়াতের পাল্লায় পড়লে সব গুবলেট হয়ে যাবে। ইরা এবার সত্যিই ঘাড় ধাক্কা দেবে আমায়।”
অহন সামান্য হেসে বলেছিল, “কেন, ইরার আবার কী হল?”
“আরে কাল সকাল আটটায় রাসবিহারী মোড়ে দেখা করতে বলেছে, ভীষণ আর্জেন্ট নাকি। ঠিক সময়ে পৌঁছোতে না পারলে ব্যাপক খচে যাবে। দাদা, তুই গিয়ে পেমেন্টটা নিয়ে আয় না।”
অহন হেসে বলেছিল, “দেখ, বাবা ও-সময় বাড়িতেই থাকে। আমি যেতেই পারি, কিন্তু তার পরের ঝঞ্ঝাটটা কে সামলাবে? আর দু’-পাঁচ মিনিট দেরি হলে ইরাকে ম্যানেজ করতে পারবি না?”
আর্চি বলেছিল, “ইরা ব্যাপক রেগে আছে, অন্য সময় হলে ম্যানেজ হত, কিন্তু এখন হবে না। রাওয়াত আঙ্কল যদি লেট করিয়ে দেয় তা হলেই গন্ডগোল হবে। প্লিজ, কিছু একটা কর।”
অহন ধীর গলায় বলেছিল, “একটা কাজ কর, তুই চেকটা নিয়ে রাসবিহারী মোড়ে চলে যাস। আমি অফিস যাওয়ার পথে তোর সঙ্গে ওখানে মিট করে চেকটা নিয়ে নেব। জমাটা করিয়ে দেব আমি, কেমন?”
কী আর করবে? অগত্যা রাজি হয়েছিল আর্চি।
বুক পকেটের ফোনটা টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠল। মেসেজ এসেছে। আর্চি ফোনটা বের করে মেসেজটা পড়ল— DONT FRGT, RBMORE, ৪ SHARP। ইরা পাঠিয়েছে। রিমাইন্ডার। নাঃ, আজকের অ্যাপোটা মিস করা যাবে না। প্রায় মাসখানেক দেখা নেই ইরার সঙ্গে। সেই কাশ্মীর যাওয়ার আগে দেখা হয়েছিল একবার। তাও মিনিট পনেরোর জন্য। গোটা সময়টাতেই খুব রাগারাগি করেছিল ইরা। আর্চিকে একটা কথাও বলতে দেয়নি। অবশ্য রাগারাগি করার কারণ ছিল যথেষ্ট।
কুড়ি তারিখ ফিরে বেশ কয়েক বার ইরার মোবাইলে ফোন করেছিল ও। কিন্তু প্রতি বারই ইরা কেটে দিয়েছে কল। তারপর হঠাৎ গতকাল বিকেলে ফোন করেছিল ইরা। খুব সংক্ষেপে, আজ সকাল আটটায় দেখা করার কথা বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল ও। আর্চি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি কেন এই জরুরি তলব। তবে তলব যখন, তখন তামিল করতেই হবে।
আর্চি পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে আবার হাঁটা দিল। ওই মেনকা সিনেমার পাশের বড় বাড়ির পাঁচিলটা দেখা যাচ্ছে।
আর্চি বিরাট লোহার গেটটার সামনে গিয়ে দেখল দু’জন দারোয়ান দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। আর্চিকে দেখেই দু’জনে গম্ভীর হয়ে নিজেদের কড়া ও কর্তব্যনিষ্ঠ প্রমাণ করতে ভুরু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। আর্চি ওদের নিজের নাম আর কোথা থেকে আসছে বলল। দারোয়ানদের একজন গেটের ভেতরের ছোট্ট গুমটিতে ঢুকে ফোন করল বাড়ির ভেতর। কিছুক্ষণ কথা বলে আবার ফিরে এল গেটের কাছে। গম্ভীর গলায় বলল, “আপ অন্দর যাইয়ে সাব।”
আর্চি ধন্যবাদ দিয়ে এগোতে যাবে এমন সময় দ্বিতীয় দারোয়ান নিজের অন্তরাত্মার ডাকে কর্তব্যে নেমে পড়ল। সে বলল, “ঠহরিয়ে বাবু, ই ব্যাগ মে কা হ্যায়?”
আর্চি ক্যাজুয়ালি বলল, “বম্ব..”
“হাঁ? বাম্বওয়া?” দ্বিতীয় জনের সঙ্গে প্রথম জনও লাফিয়ে উঠল এবার।
আর্চি হাত তুলে বলল, “নেহি হ্যায়। ক্যামেরা হ্যায়।”
দ্বিতীয় জন দারোয়ান তার ভীত মুখে রাগের ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে বলল, “অ্যায়সা মশকরি না করো সাব।”
আর্চি আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে হাঁটা দিল।
গেট দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকে বিরাট বড় লন। আর সেই লন ঘিরে চারটে বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর চার জন মানুষ মাঙ্কি টুপি আর সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে, হাফ প্যান্ট পরে সেই গাড়িগুলো ধোয়ামোছা করছে। এর মধ্যে একটা গাড়ি দেখে আপনা আপনি থেমে গেল আর্চি। এ বাবা, এটা কার গাড়ি? এমন ক্যাটক্যাটে গোলাপি রঙের গাড়ি চড়ে কে? তার ওপর বনেটে একটা ছোট্ট হনুমানজির মূর্তি। সম্ভবত রুপোর। অদ্ভুত দেখতে লাগছে গাড়িটাকে। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে দামি গাড়ি, কিন্তু এমন বিটকেল রং করিয়েছে কেন কে জানে? মানুষের যে কী খেয়াল!
লন থেকে একটু হেঁটে গেলেই মূল বাড়ির সিঁড়ি। বাড়িটা সাদা আর আকাশি নীল রং করা রাজপ্রাসাদ যেন। লনের থেকে থাক থাক শ্বেত পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ির মধ্যে।
আর্চিকে কিন্তু বাড়ি অবধি যেতে হল না। ও দেখল রাওয়াত আঙ্কল কালো সুট পরে বেরিয়ে আসছেন বাড়ি থেকে। পেছনে দু’জন ভৃত্য ঢাউস দুটো সুটকেস বয়ে আনছে। রাওয়াত আঙ্কলকে যতবার দেখেছে আর্চি, ততবারই মনে হয়েছে এত সুন্দর দেখতে হতে পারে মানুষ! আজ কালো সুট পরা অবস্থাতেও সেই কথাটাই মনে হল ওর। কিন্তু এত লটবহর নিয়ে কোথায় চললেন মানুষটা? ওর চেকের কী হবে?
আর্চিকে দেখে সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়ে পড়লেন রাওয়াত। তারপর ঘড়ির দিকে তাকালেন। ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে সামান্য। আর্চি কিছু বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে।
রাওয়াত চোয়াল শক্ত করে বললেন, “ইউ আর টু মিনিটস লেট। আই ডোন্ট লাইক ইট।”
আর্চি ঘড়ি দেখল, সাতটা বত্রিশ।
রাওয়াত বললেন, “আমি তো ভাবলাম তুমি আসবে না। মিস্টার রয় ফোন করেছিলেন একটু আগে। জিজ্ঞেস করছিলেন, তুমি এসেছ কি না? আমি তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম!”
“কলকাতার বাইরে?” আর্চি জিজ্ঞেস করল।
রাওয়াত বললেন, “হ্যাঁ, কলকাতার বাইরে। তবে এখন নয়। আমি সন্ধেবেলার ফ্লাইটে যাব। বাই দ্য ওয়ে ইউ আর হিয়ার ফর ইয়োর পেমেন্ট, রাইট?”
আর্চি হেসে মাথা নাড়ল।
রাওয়াত কোটের ভেতরের পকেট থেকে লম্বা মতো একটা ফোল্ডার বের করলেন, তারপর তার ভাঁজ থেকে বের করে আর্চির দিকে এগিয়ে দিলেন একটা চেক। আর্চি হাত বাড়িয়ে চেকটা নিল। রাওয়াত বললেন, “মানি রিসিপ্ট আমার অফিসে পাঠিয়ে দিয়ো, ও কে?”
আর্চি চেকটা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে মাথা নাড়ল। রাওয়াত আর দাঁড়ালেন না, এগিয়ে গেলেন ওই গোলাপি গাড়িটার দিকে। ও, তা হলে রাওয়াত আঙ্কল নিজে এই গাড়িতে চড়েন!
আর্চি শুনল রাওয়াত আঙ্কল গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন, “কিষণ, ইয়ে দো সুটকেস এয়ারপোর্ট ভেজ দিয়ো, উহা সে সুরিন্দর লে জায়েগা আপনে সাথ। অর সুরিন্দর কো কহনা কি ম্যায় সামকি ফ্লাইট সে পহচুঙ্গা।”
কিষণ মাথা নাড়ল।
আর্চি দেখল রাওয়াত আঙ্কল গোলাপি গাড়িতে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ভুরু কুঁচকে কিষণকে জিজ্ঞেস করলেন, “কালকে তোমায় টাকা দিয়েছিলাম না গাড়িতে তেল ভরতে, সেটার হিসেব কী হল?”
কিষণ পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ আর স্লিপ বের করে রাওয়াতের হাতে দিল। রাওয়াত স্লিপ দেখে টাকা মেলাতে লাগলেন। আর তারপরই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, “এক রুপিয়া কম কিউ হ্যায়? কাঁহা হ্যায় এক রুপিয়া?”
আচমকা চিৎকারে গেটের দিকে হাঁটতে থাকা আর্চি থমকে দাঁড়াল। ও শুনল রাওয়াত চিৎকার করছেন, “জানো না তুমি, পাই পয়সার হিসেব মিলিয়ে দিতে হয়? জানো না, এক একটা টাকার গুরুত্ব? কোথায় এক টাকা? এক টাকার হিসেব মিলছে না কেন? কেন মিলছে না, হারামখোর?”
আর্চি দেখল গাড়ি ধুতে থাকা মানুষগুলো থতমত খেয়ে এক টাকার জন্য চিৎকার করতে থাকা তাদের মালিককে দেখছে। রাওয়াত স্বর্গ-মর্ত-পাতাল তোলপাড় করা চিৎকার শুরু করেছেন। আর্চি ভাবল, এক টাকা বড় ভয়ংকর জিনিস। এরকম কোটি কোটি এক টাকা মিলেই না এত বড় পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, এত সুন্দর লন, এরকম কিম্ভুত রঙের গাড়ি হয়েছে। সেই এক টাকার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না?
রাওয়াতের চিৎকারে তটস্থ কিষণ পকেট থেকে এক টাকা বের করে রাওয়াতের হাতে দিল। আর্চি দেখল ফরসা রাওয়াত আঙ্কলের মুখটা ঠিক ওঁর গাড়ির মতো রঙের হয়ে গেছে। হাসি পেল আর্চির। এক টাকার জন্যও কেউ এমন চিৎকার করতে পারে ও জানল। ও জানল, এক টাকার জন্য মানুষকে ‘হারামখোর’ পর্যন্ত শুনতে হয়!
গেট দিয়ে বেরিয়ে আর্চি দেখল ঘড়ির বড় কাঁটা পৌনে আটটা পার করছে। এই রে, এখান থেকে রাসবিহারী মোড়ে হেঁটে যেতে প্রায় কুড়ি মিনিট লাগে। আজ যদি ইরাকে অপেক্ষা করতে হয়, তা হলে তো হালত খারাপ করে ছাড়বে ওর। এমনিতেই ইরা খেপে আছে ওর ওপর। আর্চি জোরে পা চালাল।
“এক্সকিউজ মি, ক’টা বাজে?”
আর্চি তাকাল। একটা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের ছেলে। কাঁধে লম্বা মতো একটা ড্রইংহোল্ডার আর হাতে একটা বড় ক্লিপবোর্ড নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে সময় জিজ্ঞেস করছে। ছেলেটা বেঁটে আর বেশ ফরসা। বিড়াল চোখ। এরকম চোখের লোক দেখলে অস্বস্তি লাগে আর্চির। কেন, তা ও জানে না, কিন্তু লাগে। আর্চি তাড়াতাড়ি সময় বলে হাঁটতে লাগল। আর্চি দেখল বিড়াল-মানুষটা ওর চেয়েও দ্রুত পায়ে চলে গেল সামনে দিয়ে।
লেকের এই রাস্তাটা ছায়া ছায়া হলেও, এস পি মুখার্জি রোডের দিকে সূর্য তার সমস্ত আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে। গত মাসখানেক কাশ্মীরে থাকার দরুন এখানে ওর তেমন ঠান্ডা লাগছে না। যদিও আজ হাওয়া দিচ্ছে, তবু এস পি মুখার্জি রোডে এসে বেশ গরম লাগল আর্চির। এখান থেকে রাসবিহারী মোড়টাও দেখা যাচ্ছে। ও ভাবল, যাক আর দেরি হবে না।
আবার মোবাইলটা বেজে উঠল পকেটে। ধ্যাত্তেরি! বিরক্ত লাগল আর্চির। এই মোবাইল জিনিসটা ওর মতে নেসেসারি ইভল্। মোটেই ভাল লাগে না ওর। কিন্তু কিছু করার নেই। এটা ছাড়া তো আর এখনকার দিনে চলার উপায় নেই।
আর্চি ফোনটা ধরল, “হ্যালো?”
“কী রে মালটা? ফিরলি কবে?”
এই রে, নানু ফোন করেছে। ঠিক খবর পেয়ে গেছে যে, ও কলকাতায় ফিরে এসেছে। ঠোঁট কামড়াল আর্চি। স্ক্রিনে নম্বরটা না দেখে ফোন ধরাটা ঠিক হয়নি একদম। এবার নানুর হাজার রকম আবদার শুরু হবে। ছেলেটা ওকে কী ভাবে কে জানে? যখনই কিছু দরকার পড়ে নানু ফোন করে আর্চিকে। সে ওর মামাতো দাদার ছেলের স্কুলে ভরতির ফর্ম থেকে, ইডেনে টেস্টের টিকিট বা শেষ মুহুর্তে ট্রেনের রিজার্ভেশন, সব কিছুতেই নানু ফোন করে ওকে। এটা ঠিক যে, কাজের সূত্রে আর্চির যোগাযোগটা খুব ভাল, প্রচুর মানুষের সঙ্গে ওর জানাশোনা, তা হলেও, সব কি আর ও পারে? তবে হ্যাঁ, চেষ্টা করে ও। ইচ্ছে বা অনিচ্ছে নিয়েই চেষ্টা করে। তবে এখন, এই মুহূর্তে আর নানুর আবদার মেটাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কী করবে, ব্যাটা তো ফোনের অন্য প্রান্তে বসে রয়েছে।
আর্চি বলল, “এই কয়েক দিন আগে ফিরলাম।”
“আমায় ফোন করিসনি কেন রে?”
আর্চি ভাবল, বলে যে, নানু কোন হরিদাস যে ওকে ফেরার খবর দিতে হবে? ও তবু নরমভাবে বলল, “করতাম আজকালের মধ্যে।”
নানু হাসল, “তা হালুয়া এনেছিস তো আমার জন্য?”
“হালুয়া? মানে?” অবাক হল আর্চি।
“তুই লাদাখ আর লে-তে গিয়েছিলি না? লে হালুয়া, শুনিসনি?” খিকখিক করে হাসল নানু।
“ব্যাড জোক। আর আমি কাশ্মীর গিয়েছিলাম, বুঝলি?”
“কাশ্মীর? আরিব্বাস, সেখান থেকে আপেল এনেছিস তো?”
“আপেল? কী আবোলতাবোল বকছিস?”
“আপেলও আনিসনি? অন্তত দু’-চারটে কাশ্মীরি মেয়ে এনেছিস নিশ্চয়ই? ওঃ, যা সব দারুণ জিনিসপত্তর আছে না ওখানে?”
আবার ধৈর্য হারাল আর্চি। বলল, “কী দরকার বল না, তখন থেকে ভাট বকছিস। এবার ফোন কেটে দেব কিন্তু।”
নানু একটু থমকাল, তারপর আবদারের গলায় বলল, “খুব দরকার তোর সঙ্গে, আজ বেলা দুটো নাগাদ আমাদের বাড়িতে আসতে পারবি?”
“বেলা দুটো নাগাদ? কেন?”
“আরে আমার পিসি আর পিসতুতো বোন আসবে। পিসতুতো বোনটার কয়েকটা ছবি তুলে দিতে হবে। বিয়ের জন্য।”
“স্টুডিয়োয় যা। আমি কি এসব ছবি তুলি নাকি?” বিরক্ত লাগল আর্চির।
নানু নাছোড় গলায় বলল, “প্লিজ ভাই, আমি বড় মুখ করে বলেছি পিসিকে। এভাবে ঝোলাস না, পুরো কেলো হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা ফ্যাসাদে ফেললি তো। তোর বড় মুখ চিরে কুমিরের মতো করে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। শালা, তোর এটা মুখ না ঝামেলার বাক্স?”
নানু বলল, “দেখ, বেশিক্ষণ তো তোর লাগবে না। ঝটাঝট মেরে দিবি। দুটোয় আসবি সোয়া দুটোর মধ্যে কাম তামাম, ব্যস।”
আর্চি চিন্তা করল। ওকে কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য দু’-চার জায়গায় দেখা করতে হবে, তারপর যাবে জনিদার কাছে। এখন জনিদা যদি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয় তা হলেও সব মিটিয়ে দুটোর মধ্যে পারবে কি না কে জানে! ও বলল, “ওটা আড়াইটে কর।”
নানু উত্তর দিল, “হবে না রে। পিসিদের চারটে নাগাদ ট্রেন আছে হাওড়া থেকে। আজ আবার মহামিছিল বেরোবে তো তিনটে নাগাদ। পুরো কলকাতা দাঁড়িয়ে যাবে। আড়াইটের মধ্যে পিসিরা বেরিয়ে যাবে। তুই ভাই দুটোতেই কর। প্লিজ।”
আর্চি দেখল, এ ভবি ভোলার নয়। ও তাই রাজি হয়ে গেল নিরুপায় হয়ে, এতে অন্তত এখনকার মতো নানুর হাত থেকে রেহাই পাবে। ও রাজি হওয়ামাত্র, ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা কেটে দিল নানু, ব্যাটা দরকারের এক সেকেন্ড বেশি কথা বলে না।
হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল আর্চি। এবার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দেখল রাসবিহারী মোড় এসে গেছে প্রায়। দূরে সালোয়ার আর জ্যাকেট পরা ইরাকে দেখতে পেল ও। ইরা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। এটা ইরা বরাবর করে। অপেক্ষা করার সময়, যে-দিক থেকে আর্চির আসার সম্ভাবনা থাকে তার বিপরীতে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে ও। এ ওর এক অদ্ভুত ছেলেমানুষি। ওর মতো করে বোঝাতে চাওয়া যে, আর্চিকে তেমন পাত্তা দেয় না ও।
আর্চির হাসি পেল। ও এগিয়ে গেল মোড়ের দিকে। রোদটা আস্তে আস্তে তার রোয়াব বাড়ালেও হাওয়া দিচ্ছে বেশ।
ও ইরার কাছে গিয়ে বলল, “এই যে আমি এসেছি।”
ইরা ঘুরল, মুখে রাগ। গম্ভীর গলায় বলল, “আমায় উদ্ধার করেছ।”
আর্চি হাসল, বলল, “ক্ষণেক দাঁড়াও বন্দিনী, খিদে পেয়েছে। দুটো বিস্কিট খাই।”
ফুটপাথের একটা ট্যারা-ব্যাঁকা চায়ের দোকানে গিয়ে দু’টাকার দুটো কয়েন দিয়ে দুটো বিস্কিট নিল আর্চি। দোকানদার ওকে এক টাকা ফেরত দিল।
বিস্কিটে কামড় দিয়ে ও ইরার দিকে তাকাল, “বলো, কী বলবে।”
ইরা যেন এই ফুলটস বলটার জন্য দু’হাজার বছর ধরে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল ক্রিজে। ও বলল, “তোমায় বলার মতো কী থাকতে পারে আমার? আর বললেও তুমি শুনবে? কী চাও তুমি? কী চাও?”
আর্চি প্রথম বিস্কিটটা শেষ করে, দ্বিতীয়টায় কামড় দিল। বিস্কিটটা বেশ ভাল।
ইরা বলল, “বাবা লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছে আমায়। বলেছে হি ইজ আপসেট উইথ ইউ। গত অক্টোবরে বাবা সময় দিল তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, তুমি মিস করলে। গত নভেম্বরে কাশ্মীর যাওয়ার দিন সকালে বাবা তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে বসে রইল, তুমি এলেই না। এর পরও ভাবো, বাবা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে? মা প্রথম থেকেই তোমার বিপক্ষে, আর এখন বাবাও আমার প্রতি তোমার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তুমি বলো, আমি কী করব? কী করব আমি?”
আর্চি দ্বিতীয় বিস্কিটটাও শেষ করল। আঃ, দারুণ খেতে। খিদের জন্যই বোধহয় আরও বেশি ভাল লাগছে। আর্চি ভাবল আরও দুটো কেনে। ইরার কথার মধ্যেই ও পেছনে ফিরে দোকানটাতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, আর তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ল ওর।
একটা শতছিন্ন চাদর জড়িয়ে পাতালরেলের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘুমোচ্ছে, ন্যাড়া মাথার একটা ভিখিরি গোছের লোক। লোকটার চোখটা সামান্য খোলা, মুখটা হাঁ। ভীষণ অসহায় ভঙ্গি। আর্চি থেমে গেল। তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে। লোকটাকে জাগানো প্রয়োজন। এর মুখটা খুব ইন্টারেস্টিং। যেন পৃথিবীর সমস্ত অসহায়তা, দুঃখ আর নিতা এসে জড়ো হয়েছে এই মুখটায়। এর ছবি তুলতেই হবে। ও হাতে ধরা এক টাকার কয়েনটা ন্যাড়া লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে, এই নিন।” ঘুম ভেঙে লোকটা চোখ মেলল। চোখে রোদ লাগছে বলেই বোধহয় চোখ কোঁচকাল। আর্চি আবার বলল, “এই যে, এই নিন।” লোকটা এবার কয়েনটা নিল।
আর্চি পিছিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল লোকটার সামনে তারপর ব্যাগের থেকে ক্যামেরা বের করে তাগ করল লোকটার দিকে। ও শুনতে পেল পেছন থেকে ইরা বলছে, “ডোন্ট ইগনোর মি লাইক দ্যাট। আমি কী জিজ্ঞেস করছি তোমায়? তুমি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ওই বেগারটাতে কনসেনট্রেট করছ কেন? কান্ট ইউ টেক এনিথিং সিরিয়াসলি? ডু ইউ কেয়ার ফর মি অর নট?”
আর্চি লেন্স ঘুরিয়ে ফোকাস করে শাটার টিপতে যাবে এমন সময় ওকে অবাক করে ন্যাড়া মানুষটা বলে উঠল, “চিজ।” এ লোকটা কে? হাসার সময় চিজ বলতে হয় লোকটা জানল কী করে? অবাক আর্চি তিন-চারটে ছবি তুলে ফেলল। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসে, গিয়ে দাঁড়াল ইরার সামনে। এতক্ষণ টানা কথা বলে যাওয়া ইরা যেন খানিকটা ক্লান্ত হয়েই চুপ করে গেছে।
আর্চি বলল, “বলো, আমি কী করব? কী করলে তোমার বাবা বিশ্বাস করবেন যে, আমি তোমার প্রতি সিরিয়াস?”
ইরা ছলছলে চোখে বলল, “মা তো এই এক মাসে পাত্র প্রায় পছন্দ করেই ফেলেছে। আমি যে কী করে ঠেকিয়ে রেখেছি, তা আমিই জানি। তুমি একটুও সিরিয়াস হবে না অর্চিষ্মান?”
আর্চি বলল, “বলল, কী করব? আমার ভুল হয়েছিল, তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে দু’বার মিস করেছি। কিন্তু আমার কাজই এরকম যে, হঠাৎ হঠাৎ এখান ওখান থেকে ডাক আসে। তুমি বলো না কী করতে হবে আমায়?”
ইরা এক মুহুর্ত থামল, তারপর বলল, “আজ বিকেল সোয়া তিনটের সময় বাবা দেখা করতে বলেছে, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কে, বাবার অফিসে। ডট সোয়া তিনটে। আমি তোমার জন্য ঠিক তিনটের সময় প্রিয়া সিনেমার সামনে ওয়েট করব। বাবা বলেছে এটাই তোমার লাস্ট চান্স। আর আমি তোমায় বলছি, যতই তোমায় আমি ভালবাসি না কেন, আজ ঠিক সময়ে না এলে আমিও তোমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না। ইটস ফাইনাল। সবসময় তুমি আমায় ইগনোর করবে তা হয় না। আজ তিনটের সময় প্রিয়ার সামনে এসো। দেখব তুমি আমার প্রতি কতটা কমিটেড। মানে আদৌ কমিটেড না জাস্ট টাইম পাস করছ আমাকে নিয়ে। তিনটের এক মিনিট পর হলে জেনো আওয়ার রিলেশনশিপ ইজ ওভার। আর এর মধ্যে কোনও ফোন করবে না আমায়। কোনও বাহানা দেবে না। আমি মোবাইল অফ করে রাখব। বুঝেছ?”
আর্চি বলল, “শোনো ইরা, প্লিজ রাগ কোরো না। শোনো…”
ইরা কঠিন গলায় বলল, “ঠিক তিনটে, প্রিয়ার সামনে।”
আর্চিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইরা চলে গেল।
শিট্, নিজের মনেই বলল আর্চি। এইজন্য সকালবেলা ডেকে পাঠিয়েছিল ইরা? আর্চির মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইরা ভীষণ একগুঁয়ে মেয়ে, যা ভাববে তাই করবে। এখন বিকেল অবধি টেনশন খাও বসে বসে। ওঃ, আজ সকাল থেকেই গন্ডগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। আর্চি ঘড়ি দেখল। সোয়া আটটা বাজে, মনটা তেতো হয়ে আছে। দাদা বলেছে আসবে। কখন আসবে? ন’টায় তো অফিসে যায় দাদা। তার আগে নিশ্চয়ই আসবে। আর্চি ফোনটা বের করল, তারপর অহনের নম্বরটা ডায়াল করে কানে লাগাল। ওই গান বাজছে— কলার টিউন।
কানে ফোনটা ধরে পাশে তাকাল আর্চি। ন্যাড়া লোকটা আর জায়গায় নেই। তবে দেওয়ালের নীচে একটা বড় পোস্টার চোখে পড়ল—‘বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে চব্বিশে ডিসেম্বর বেলা তিনটের মহামিছিলে সকলে যোগদান করুন। দক্ষিণে দেশপ্রিয় পার্ক থেকে শুরু করে ময়দান অবধি আর উত্তরে মহম্মদ আলি পার্ক থেকে শুরু করে ময়দান অবধি। এই মিছিলে শহরের সকল মানুষকে যোগদানের আহ্বান করা হচ্ছে।’
আর্চি স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল পোস্টারটার দিকে। বিকেল তিনটের সময় দেশপ্রিয় পার্ক থেকে মিছিল! দেশপ্রিয় পার্কের পাশেই তো প্রিয়া সিনেমা। সেখানেই তো অপেক্ষা করবে ইরা। আর সময়টাও তিনটে। ওকে তখনই তো পৌঁছোতে হবে ওখানে। চিনচিনে একটা টেনশন শিরদাঁড়া বেয়ে উঠতে লাগল আর্চির। ফোন বেজেই চলেছে, উত্তর দিচ্ছে না দাদা… বিকেল তিনটে… ঠিক সময়ে পৌঁছোতে পারবে তো ও? কোনও গন্ডগোল হবে না তো?
অহন : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল সোয়া আটটা
মুখ ধুতে ধুতে মোবাইলের রিং শুনতে পেল অহন। ওর ঘরের থেকে আওয়াজটা আসছে। কে ফোন করল এ-সময়? ও এক মুহূর্ত ভাবল ফোনটা গিয়ে ধরবে কি না, কিন্তু তারপরই ভাবল মুখটা তো এখনও সম্পূর্ণ ধোয়া হয়নি!
অহনের জীবনে অবসেশন বলতে হল দাঁত। ওর দাঁত যাতে পরিষ্কার থাকে সে ব্যাপারে ও সবসময় সচেতন। সেইজন্য ও কখনও সিগারেট ছোঁয়নি, পারতপক্ষে চকোলেট বা কোল্ড ড্রিঙ্কও খায় না, টক এড়িয়ে চলে। আর প্রতিবার খাওয়ার পরে খুব ভাল করে মুখ ধোয় ও। ছোটবেলায় কোথায় যেন পড়েছিল অহন যে, দাঁত মানুষের পার্সোনালিটিকে রিফ্লেক্ট করে। তাই তখন থেকেই দাঁতের প্রতি অহন ভীষণ যত্নবান। কিন্তু তাতেও কি ওর পার্সোনালিটি এল? আশেপাশের কেউই তো খুব একটা মানে না ওকে, সবাই তো তরতর করে ওর মাথায় উঠে যায়। অহন বুঝেছে যে, পার্সোনালিটি হল সেই জিনিস যা থাকলে অন্য লোকেদের মাথায় ওঠা যায়। আর এও বুঝেছে যে, দাঁতের সঙ্গে এর ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কোনও পুরুষেরই কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু অহন কী করবে? ছোটবেলা থেকেই ও নরমসরম। কিছুটা লাজুকও। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো ঠিকঠাক বলতে পারে না অন্যদের। সবাইকেই অতিরিক্ত সম্মান দিয়ে কথা বলে। ও বোঝে, এখনকার দিনে ভদ্রতাকে সবাই দুর্বলতা ভাবে। তবু নিজেকে বদলাতে পারে না কিছুতেই।
ফোনটা এখনও বেজে চলেছে। ফোন বাজলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটাকে ধরতে পারছে, ততক্ষণ অহনের মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি হয়। এই যেমন এখন হচ্ছে। মনে হচ্ছে, পাঁজরের নীচে চারটে চড়াই পাখি ছটফট করছে খুব। এদিকে মুখটা ধোয়াও একটু বাকি। কী করবে ও? অহনের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ঋ থাকলে বলত, “এই হচ্ছে ক্যালাস মানুষদের সমস্যা। বল খেলবে না ছাড়বে, ঠিক করতে করতেই উইকেট দিয়ে দেয় তারা। অহন, এত বড় হলে, তবু কনফিডেন্স, ডিসিশন এসব শব্দ তোমার ডিকশনারিতে তৈরি হল না, না? এত সংশয় কীসের তোমার? মন স্থির করে কাজ করতে পারো না? এত দ্রুত তোমার মন পালটায় কেন? সত্যি, কার পাল্লায় যে পড়েছি!”
সকালবেলাতেই ঋ-এর কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মনটা একটু তেবড়ে গেল অহনের। ঋ এখন যার পাল্লায় রয়েছে, তার ডিকশনারিতে ওইসব শব্দগুলো রয়েছে নিশ্চয়ই।
মোবাইলটা থেমে গেছে এখন। যে ফোন করছিল সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। তবে মনে মনে একটু স্বস্তি পেল অহন। যাক মুখটা অন্তত ভাল করে ধোয়া যাবে। অহন আবার মুখ ধোয়ায় মন দিল।
“কী রে, এবার তো মুখের ছাল-বাকলা উঠে যাবে। এই শীতকালে জল ঘাঁটতে ঠান্ডা লাগে না তোর?”
অহন মুখ ঘুরিয়ে দেখল মা। ও বলল, “এই তো হয়ে গেছে।”
মা বলল, “এরকম বাতিকগ্রস্ত ছেলে আমি জন্মে দেখিনি বাবা।”
অহন মুখ ধোয়া শেষ করে কলটা বন্ধ করল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল।
মা বলল, “মুখ ধোয়ার সময় কোনও কিছুই কি খেয়াল থাকে না? তোর মোবাইলটা যে অনেকক্ষণ ধরে বাজল, শুনিসনি?”
অহন আয়নায় ই করে দাঁতগুলো দেখল। নাঃ, ব্রেকফাস্টের কোনও টুকরো লেগে নেই দাঁতে। সব ক’টা দাঁত নতুন পোর্সেলিনের মতো চকচক করছে। ও বলল, “হ্যাঁ শুনেছি তো, কিন্তু মুখ ধুচ্ছিলাম বলে…”
মা ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, “যাক গে, শোন একটু পরেই তো অফিসে বেরিয়ে যাবি তার আগে তোর বাবার সঙ্গে দেখা করে যাস। তোকে ডাকছে।”
মনে মনে ঢোঁক গিলল অহন। বাবার ঘরে যাওয়া মানেই আত্মোপলব্ধি হওয়া। অহন যে আস্ত এক গবেট, ভিতু এবং ডিসিশন নিতে পারে না সেগুলো মাঝে মাঝে বাবা নিজের ঘরে ডেকে ওকে মনে করিয়ে দেয়। হয়তো এখনও সেরকম কিছুর জন্যই বাবা ডেকেছে। অবশ্য বাবা শুধু শুধু এগুলো বলে না, এর পেছনে প্রতুলকাকার কিছু অবদান থাকে।
প্রতুলকাকা আগে বাবার ট্রান্সপোর্ট আর সি এন্ড এফ এজেন্সিতে ছিলেন, কিন্তু বছর চারেক হল, মানে যবে থেকে অহন জয়েন করেছে, অ্যাডভার্টাইজিংয়ে আনা হয়েছে ওঁকে। মূলত, টাকা পয়সার দিকটাই দেখার কথা ওঁর। কিন্তু আসলে সব ব্যাপারেই উনি খবরদারি করেন। অহনকে ছোট থেকে উনি দেখেছেন বলেই বোধহয় অহনের ওপর খবরদারিটা বেশি করেন। অহনের রাগ হলেও বিশেষ কিছু ও বলতে পারে না। কারণ ওই, ওর ডিকশনারির দু’-তিনটে শব্দ মিসিং যে।
বাবা মাঝে মাঝে পার্ক স্ট্রিটে ওদের অ্যাডভার্টাইজিংয়ের অফিসে এসে একটু ঘুরে যায়। তা ছাড়া সবটা প্রায় অহনই দেখে। তার মধ্যে অবশ্য প্রতুলকাকার নাক গলানো এবং বাবার কাছে নালিশ করাটাও হয়।
অহন মায়ের কথা শুনে ঘরে গেল। নট করে রাখা টাইটা গলায় গলিয়ে নিয়ে টাইট করে নিল। ভাবল প্রতুলকাকা কি কিছু বলেছে বাবাকে? কারণ, তার একটা সম্ভাবনা আছে। একটা কাজ নিয়ে দু’দিন আগে একটু খটাখটি হয়েছে প্রতুলকাকার সঙ্গে।
অহন এবার একটা হাফ-হাতা সোয়েটার গলিয়ে মোবাইল ফোনটা তুলল। দেখা যাক কে ফোন করেছিল। আরে, আর্চি! স্ক্রিনে মিস কলে আর্চির মোবাইল নম্বরটা দেখল অহন। ও, মনে পড়ল অহনের, ওর তো রাওয়াতের চেকটা আর্চির থেকে নেওয়ার কথা। রাসবিহারী মোড়ে অপেক্ষা করছে ছেলেটা। অহন ভাবল ও তো একটু পরেই বেরোচ্ছে। এর জন্য ফোন করার দরকার ছিল না। আর্চিটা বড় অস্থির। ধৈর্য কম। কী করে যে ফোটোগ্রাফির কাজ করে! সবসময় যেন ছুটছে, যেন তাড়া করেছে কেউ ওকে। তার ওপর রেসপন্সিবিলিটির অভাব রয়েছে বেশ। কিন্তু বয়স তো কম হয়নি। অহনের চেয়ে মাত্র বছর দু’য়েকের ছোট। তবু কেমন ছটফটে একটা ভাব। যেন কিছুই কেয়ার করে না। ইরা বলে একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব আছে, কিন্তু সেখানেও বোধহয় কিছু গন্ডগোল করে রেখেছে। বাবার সঙ্গে যে ওর ঝামেলা লাগে, সেটা আশ্চর্যের নয়। হুঁ, এমন ছেলের পাশে, লোকে বলে ওর নাকি ঘনঘন মন পালটায়!
অহন আর্চির নম্বরে ডায়াল করল। রিং হতে না হতেই ফোনটা ধরল আর্চি। “হ্যালো দাদা, কী রে আমি ওয়েট করছি, আসবি কখন?”
অহন বলল, “আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরোচ্ছি। একটু ওয়েট কর।”
“তাড়াতাড়ি কর,” অধৈর্য লাগল আর্চির গলা, “কী যে করিস না! আর কতক্ষণ ওয়েট করব? আমার হয়েছে ঝামেলা।”
অহন বলল, “মাথা গরম করিস না। আমি যাচ্ছি। তুই রাসবিহারী মোড়ের ডিং ডং রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়া।”
আর্চি বিরক্ত গলায় বলল, “আজকেই সব ভুলভাল কাজ এসে জুটেছে।”
অহন কিছু বলার আগেই আর্চি কেটে দিল ফোনটা।
এই হল অহনের সমস্যা, সবাই ওকে দাবড়ায়। মাঝে মাঝে অহন ভাবে ঋ হয়তো ঠিকই বলত। ওর ডিকশনারি যে-লোকটা ছাপিয়েছে সে খুব ফাঁকিবাজের মতো কাজ করেছে।
ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চুলটা একবার দেখে নিল অহন। তারপর অভ্যেস মতো দাঁতটাও দেখল। ঠিক আছে। টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটা নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিল একবার। সামনে একটা কাজের দিন শুরু হতে যাচ্ছে, যেটা কিনা বাবার ঝাড় দিয়ে শুরু হবে। অহন বেরিয়ে বাবার ঘরে গেল এবার। এ-সময়টায় বাবা খবরকাগজ পড়ে। অফিসে বেরোতে বেরোতে বাবার এগারোটা বাজে। বাড়ির গাড়ি অহনকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসে। তারপর সময়মতো বাবাকে নিয়ে যায় অফিসে।
যা ভেবেছিল তাই, বাবা খাটের ওপর বসে কাগজ বিছিয়ে পড়ছে। প্রথম পাতাতেই বাসে চাপা পড়া শিশু মৃত্যুর খবর। এসব ভাল লাগে না অহনের। ও মুখ ঘুরিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল।
বাবা কাগজ থেকে মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করল, “আঠাশ তারিখের প্রেজেন্টেশনের কাজ কতটা এগিয়েছে?”
অহন বলল, “আজ সুগত লে-আউট দেবে। কাল আর পরশু তো ছুটি, সোমবারে বোর্ড বানিয়ে ম্যাটার সাজিয়ে ফেলব। মঙ্গলবারের আগেই হয়ে যাবে।”
বাবা এবার মুখ ফেরাল, “অ্যানিমেশন সফ্টওয়্যারের জন্য কিন্তু ইতিমধ্যে পঁচিশ হাজার বেরিয়ে গেছে। অন্যান্য ব্যাপারেও প্রায় হাজার তিরিশেক গেছে। দেখো, যেন টাকাটা নষ্ট না হয়।”
অহন ইতস্তত করে বলল, “আমি চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা? মানে?” বাবা ভুরু কুঁচকে তাকাল অহনের দিকে।
“মানে… ইয়ে…” অহন তোতলাচ্ছে।
“তোমায় কখনও পজিটিভ দেখি না কেন? সবসময় এমন ম্যাদা মেরে থাকো কেন তুমি? কেন, বলতে পারো না যে, কাজটা আমরা পাবই? পারো না?”
অহন মনে মনে ওর ডিকশনারি লেখককে আবার গালি দিল। ব্যাটা সব পজিটিভ শব্দ কাঁচি করে দিয়েছে। এমন খচ্চর ডিকশনারি লেখক ও জন্মে দেখেনি। ও মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বাবা বলল, “প্রতুলের মতের এগেনস্টে গিয়ে আমি তোমায় এই কাজটা নিয়ে প্রসিড করতে দিয়েছি। আমার নাক কেটো না। কাজটা আমার চাই। অন্তত প্রেজেন্টেশন শুড বি গুড। না হলে পরের বার থেকে প্রতুল যা বলবে সেই মতো কাজ করতে হবে তোমায়। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”
অহন খাক্রে গলা ক্লিয়ার করে মাথা নাড়ল। সোয়েটারের ভেতরে ঘাম হচ্ছে অল্প অল্প। তিরিশ বছর বয়সেও বাবার সামনে এলে ওর হাঁটু কাঁপে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল অহন। বলল, আর কবে বড় হবে তুমি? গ্রো আপ।
বাবা আবার বলল, “সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও এখন। লটস অফ থিংস আর টু বি ডান। গো।”
বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাঁপ ছাড়ল অহন। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর রাগও হল একটু। প্রতুলকাকা তো আচ্ছা ঝঞ্জাট শুরু করেছেন। ওঁর বক্তব্য ছিল যে, বড় সফট ড্রিঙ্কস্ কোম্পানির এই অ্যাডের কাজটাতে ‘অ্যাডগ্ল্যাম’ বলে কোম্পানির সঙ্গে যেন ওরা প্রতিযোগিতায় না নামে। কারণ, এক, অ্যাডগ্লাম ছোট কোম্পানি, ওরা লো কোট করে কাজটা নিয়ে নেবে। দুই, ক্যাম্পেনের তৈরির পেছনে অনেক টাকা গচ্চা যাবে। আর সেটা যদি ক্লায়েন্টের পছন্দ না হয় তা হলে গোটাটাই গিলতে হবে ওদের। যার অর্থ হেভি লস। আর তিন, ক্লায়েন্টের পেমেন্ট টার্মস ভাল নয়।
অহন বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে, এই সফট ড্রিঙ্কস্ কোম্পানিটা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। তাই এদের অ্যাড ক্যাম্পেন পাওয়া অত্যন্ত প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। ক্রেডেনশিয়াল বিরাট। এই একটা কারণই কাজটা করার জন্য যথেষ্ট। আসলে সফট ড্রিঙ্কস্ কোম্পানিটা, অ্যাডগ্ল্যাম আর বিটা অ্যাড অর্থাৎ অহনদের কোম্পানিকে বলেছে যে, একটা অনবোর্ড অ্যাড ক্যাম্পেন তৈরি করতে। যারটা পছন্দ হবে তাকেই কাজটা দেওয়া হবে। অর্থাৎ ক্যাম্পেনের পেছনে টাকা খরচ করে তার রিকভারের রিস্ক আছে। ক্লায়েন্টের পছন্দ না হলে গোটা টাকাটাই জলে। এই শেষেরটাই ছিল প্রতুলকাকার মূল আরগুমেন্ট।
প্রতুলকাকার কথার ওপর অহন জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছিল না এবং একসময়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় মেনেও নিয়েছিল ব্যাপারটা, কিন্তু তখনই এর মধ্যে ঝাপায় উর্নি।
উর্নি বছরখানেক হল জয়েন করেছে অহনদের বিটা অ্যাডে। মেয়েটা অত্যন্ত কনফিডেন্ট, সপ্রতিভ এবং কাজের। অহনের অবাক লাগে এই ভেবে যে, একটা তেইশ-চব্বিশ বছরের মেয়ে কীভাবে এরকম সাহস পায়! যে কোনও কাজ দাও, উর্নি ঝাপিয়ে পড়বে। কে জানে হয়তো অল্প বয়স বলেই ও এতটা প্যাশন নিয়ে কাজ করে। এই বছরখানেকের মধ্যেই অহন, উর্নির ওপর অনেকটা ডিপেন্ড করতে শুরু করেছে। এই সফট ড্রিঙ্কস্ কোম্পানির অ্যাড ক্যাম্পেনে প্রথম থেকেই উর্নির খুব উৎসাহ ছিল। ও বলত, “অহনদা আপনি ছাড়বেন না। আমরা যা করা দরকার, সব করব, এই প্রজেক্টটা আমাদের নিতেই হবে।”
তাই প্রতুলকাকা যখন প্রায় বানচাল করে দিচ্ছিল এই চেষ্টাটা, ঠিক তখনই উর্নি এসে বাধা দিয়েছিল। বলেছিল, “স্যার, আপনাকে আমি বলছি, এই কাজটা আমরাই পাব।”
প্রতুলকাকা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিলেন, “তুমি কী জানো এই কাজের ব্যাপারে? সব কিছু বুঝে গেছ, না? চুপ করে থাকো।”
উর্নি চুপ না করে পালটা বলেছিল, “স্যার, আমাদের ক্যাম্পেনটা দারুণ হবে। অহনদা একটা ভাল প্ল্যান করেছে।”
“প্ল্যান?” প্রতুলকাকা ভুরু তুলে তাকিয়েছিলেন অহনের দিকে।
অহন ঢোঁক গিলে নার্ভাস হাসি দিয়েছিল শুধু। কীসের প্ল্যান? উর্নি তো পুরো মিথ্যে বলছে প্রতুলকাকাকে চুপ করানোর জন্য।
প্রতুলকাকা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কীসের প্ল্যান অহন?”
অহনের হাত কাঁপছিল সামান্য। ও দেখছিল প্রতুলকাকার পেছনে দাঁড়িয়ে উর্নি অত্যন্ত কাতর চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে, যার অর্থ অহনও ওর কথার সমর্থনে কিছু একটা বলুক।
প্রতুলকাকার ভুরু সন্দেহের চাপে ক্রমশ বাঁক নিচ্ছিল। উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি আবার কী প্ল্যান ভাঁজলে?”
অহন ঠোঁট চেটে টেবিলের কাচের ওপর রাখা একটা ছোট্ট পেঙ্গুইন পেপারওয়েট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলেছিল, “সে আছে একটা।”
“আছে একটা? মানে? আমায় বলতে চাও না?”
অহন বলেছিল, “না, মানে আরও দু’-একটা ব্যাপার একটু চেক করে নিই, তারপর ঠিক বলব।”
প্রতুলকাকা সামান্য রাগের গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তা হলে এই কাজটার পেছনে তুমি টাকা ঢালবেই?”
অহন বলেছিল, “কাজটা কিন্তু আমরা পেতেও পারি।”
প্রতুলকাকা বলেছিলেন, “পাব আর পেতে পারির পার্থক্যটা বোঝো? পেলেও ওরকম পেমেন্ট টার্মস, কাজ করতে পারবে তো? যাক গে, তোমার বাবার টাকা তুমি ওড়াবে, তাতে আমার কী? যা পারো করো।”
এই কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে লাগে অহনের। মনে হয় কেউ এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছে ওকে। বাবার টাকা! আচ্ছা এই যে ছাব্বিশ বছর বয়স থেকে সব কিছু ভুলে এক ভাবে ও কাজ করে যাচ্ছে তার কি কোনও দাম নেই? সব কিছুই বাবার টাকায় হয়েছে? ওর কি কোনও কনট্রিবিউশন নেই? ঋ পর্যন্ত ওকে এই নিয়ে খোঁচা দিত। বলত, “বাবার টাকায় বেঁচে আছ, লজ্জা করে না?”
অহন দুর্বল গলায় প্রতিবাদ করত, “কিন্তু আমি তো কাজ করি। আমারও কনট্রিবিউশন আছে। শুধুই কি বাবার টাকা?”
“হ্যাঁ, তোমার বাবার টাকা। নিজের দম নেই কিছু করার? তুমি হচ্ছ। সত্যিকারের চাঁদের টুকরো ছেলে। তোমার বাবা সূর্য আর তুমি সূর্যের আলোয় আলোকিত।”
অহনের স্যাটারডে রিভিউ ছিল ঋ। ও কতটা ভুল এবং অযোগ্য তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত মেয়েটা। তবে দিত, পাস্ট টেন্স, এখন আর দেয় না। আজ মেয়েটা নেই। বিয়ে করে চলে গেছে সিডনি।
নীচে গিয়ে গাড়িতে বসল অহন। জিজুদা ওদের ড্রাইভার, রেডি হয়েই ছিল। ও বসামাত্র ছেড়ে দিল গাড়ি। গাড়ি চলামাত্র একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে ঢুকল জানলা দিয়ে। সামান্য কেঁপে উঠে দরজার মাঝামাঝি লাগানো সুইচ টিপে কাচটা তুলে দিল অহন। আজ সকাল থেকেই বেশ হাওয়া দিচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে জানলা খোলার সময়ই বুঝতে পেরেছে ও। এখন গাড়ির জানলা বন্ধ করে বেশ আরাম লাগল অহনের। ঠান্ডা ওর ভাল লাগে না।
অহন বলল, “জিজুদা রাসবিহারী মোড়ের কাছে ডিং ডং রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা একটু দাঁড় করিয়ো তো৷”
জিজুদা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সে কী, সকালেই রেস্টুরেন্টের খাবার খাবে? খেয়ে বেরোতে পারো না বাড়ির থেকে? সেই ছোট থেকে দেখছি হাবিজাবি না খেলে তোমার চলে না।”
জিজুদার এই এক সমস্যা, বেশি কথা বলে। অহনের মেজাজটা ঠিক নেই এখন। বাবা সকালেই যা ছোট ডোজ দিয়েছে একটা! ওর ইচ্ছে হল কোনও কঠিন কথা বলে জিজুদাকে। কিন্তু ওই, ওর ডিকশনারি খুঁজেও তেমন কিছু পেল না। ও নরমভাবে বলল, “আর্চি থাকবে ওখানে। ওর থেকে একটা জিনিস নেব।”
ওদের বাড়ি থেকে রাসবিহারী মোড় খুব কাছে। ডিং ডং রেস্টুরেন্টের কাছে অহন দেখল, একটা ব্যাগ কাঁধে চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্চি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বিরক্ত। জিজুদা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা আর্চির সামনে নিয়ে গিয়ে থামাল গাড়িটাকে।
আর্চি এগিয়ে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। অহন কাচ নামিয়ে হাত বাড়াল, “দে, চেকটা।”
আর্চি পকেট থেকে চেকটা বের করে এগিয়ে দিল। বলল, “নে তোদের সম্পত্তি। সক্কালবেলা পেমেন্ট আনতে হবে। কেমন ব্যাবসা করিস তোরা? আর ক্লায়েন্টগুলোও জোগাড় করেছিস বটে।”
অহন হাসল। জিজ্ঞেস করল, “বাড়ি যাবি তো এখন?”
“না, কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে, কাজের ধান্দা আছে।”
“সে কী রে, খাবি কোথায়?”
আর্চি এবার হাসল, “দাদা, এসব পেটি জিনিস নিয়ে চিন্তা করিস কেন তুই? খাবার জায়গার অভাব? তুই তোর ঘানিতে ঢোক, আমি কাটি।”
জিজুদা আবার গাড়ি ছোটাল। ঠান্ডা হাওয়া আটকাতে কাচটা আবার তুলে সিটে একটু এলিয়ে বসল অহন। জিজুদা বলল, “কেমন দাদা তুমি? ভাইকে বকে বাড়ি পাঠাতে পারলে না? ওদিকে বউদি চিন্তা করবে। তোমরা দু’ভাই-ই ছিষ্টিছাড়া।”
অহন বিরক্তিতে চোখটা বন্ধ করল। এ লোকটার নাকটা বড্ড লম্বা। ও বলল, “জিজুদা প্লিজ।”
জিজুদা বলল, “তা, যা পারো করো। আমি আর কী বলব?”
এটাই বোধহয় সবার পেটেন্ট ডায়ালগ—‘যা পারো করো’। কিন্তু করতে দেয় কই? সবাই নিজের নিজের মতামতটা ওর জীবনে ঢুকিয়ে দেয়।
অহন চেকটা বের করল। অফিসে গিয়েই ওটা জমা দিতে পাঠাতে হবে। এবার রাওয়াতের সইটা দেখল অহন। শুরুতেই একটা প্যাঁচানো ডানহাতি স্বস্তিকা। লোকটা ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাসী। গাড়ির ওরকম অদ্ভত গোলাপি রং কারও কোনওদিন দেখেনি অহন। রংটা নাকি জ্যোতিষী করতে বলেছে। গাড়ির সামনে একটা হনুমানজির মূর্তি লাগানো। কী? না, পবনপুত্র হনুমান নাকি ওঁর গাইডিং ফোর্স। তবে কিছু টাকা করেছেন বটে লোকটা! সত্যি, এরকম কনফিডেন্ট লোক ও দেখেনি। সবাইকে দাবড়ে চলেন। ও যদি এরকম হতে পারত! ঋ বলত, “তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুমি গুড ফর নাথিং।”
ঋ। অদ্ভুত সুন্দর দাঁতের একটা মেয়ে ছিল। এখন নেই। এম বি এ পড়ার সময় আলাপ হয়েছিল ওদের। পরে প্রেম। ঋ নিজেই প্রোপোজ করেছিল অহনকে। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। একটা ছোট্ট ছাউনির তলায় কোনওমতে পাঁচজনের সঙ্গে ওরা দু’জনও দাঁড়িয়েছিল। অঝোর বৃষ্টিতে অচেনা লোকজনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াতে খুব অস্বস্তি লাগছিল অহনের। বিশেষ করে ঋ-এর জন্য। লোকগুলো বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল ঋ-এর দিকে। কিন্তু ঋ-এর হুঁশ ছিল না একদম। ও নিজের মনে বকবক করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। কিন্তু অহন শুনছিল না বিশেষ। লোকগুলোর ড্যাবড্যাবে দৃষ্টির জন্য মনঃসংযোগ করতে পারছিল না। হঠাৎ ওর জামার হাত ধরে জোরে টান দিয়েছিল ঋ, বলেছিল, “কী হল উত্তর দিচ্ছ না কেন?”
“কীসের উত্তর?” একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল অহন।
“আরে তুমি শোনোনি কী বললাম?”
“না, মানে, ইয়ে…”
ঋ বলেছিল, “আমি যদি তোমার গার্লফ্রেন্ড হই কেমন হবে?”
“গার্লফ্রেন্ড? সে তো তুমিই আছ!” অহনের ধাঁধা লেগেছিল সামান্য।
“ওঃ সেই গার্লফ্রেন্ড নয়, প্রেমিকা, প্রেমিকা। কেমন হবে?”
“অ্যাঁ?” একটু ঘাবড়ানোটা নিমেষে অনেকখানি হয়ে গিয়েছিল।
“হ্যাঁ। কেমন হবে? আমার তোমাকে ভাল লাগে।”
অহন প্রথমে থতমত খেলেও পরমুহূর্তেই ওর মনে হয়েছিল আরে আশেপাশের মানুষগুলোও তো দেখছে, শুনছে। ও চোখের কোণ দিয়ে দেখছিল যে, সত্যিই মানুষগুলো ওদের কথা এমনভাবে শুনছে, যেন টিভির দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ওয়ান ডে-র শেষ ওভারের খেলা দেখছে। ও ইশারা করে ঋ-কে চুপ করতে বলছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ঋ মুদিখানার ফর্দর মতো করে অহনের দোষ আর গুণের লিস্ট তৈরি করছিল। পাশের লোকগুলো হাসছিল খুকখুক করে। ঋ তবু বলে যাচ্ছিল যে, অহন বেশ সুন্দর দেখতে, ওর মন নরম, বাবার পয়সা আছে, ওর দাঁতগুলো সুন্দর, ও সবসময় বাধ্য ছাত্রের মতো কথা শোনে, রাগ করে না ইত্যাদি ইত্যাদি। লোকজনের খুকখুকে হাসি ক্রমশ তার ডেসিবল বাড়াচ্ছিল। অহন বলেছিল, “প্লিজ এখন নয়, পরে।”
“কেন? পরে কেন?” ঋ জানতে চেয়েছিল, “সবসময় পরে কেন? না এখনই বলো, তুমি রাজি?”
বাইরের বৃষ্টিটা তখনও বেশ ভালই পড়ছিল। তবু তার মধ্যে ছাউনির তলা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল অহন। ওর আর ভাল লাগছিল না। আর ওই ছাউনির তলা থেকে ঋ চিৎকার করছিল, “ইউ স্পাইনলেস ক্রিচার, ইউ চিকেন। বাট আই স্টিল লাভ ইউ। আই লাভ চিকেন।”
এভাবে যে প্রেমের শুরু হতে পারে, বিশ্বাস করতে আজও কষ্ট হয় অহনের। কিন্তু সত্যি সেই বৃষ্টির পরের থেকেই ওদের প্রেম শুরু হয়েছিল। এবং শুরু হয়েছিল ঋ-র মুরগি ভক্ষণ।
অহন মাঝে মাঝে ভাবে সত্যিই কি ও ঋ-এর প্রেমে পড়েছিল? অমন মেয়ের প্রেমে পড়া যায়? কিন্তু ঝ সবসময় ওর সঙ্গে সেঁটে থাকত আর গালাগালি করত। একদিন তো অহন বলেই ফেলেছিল, “আমি যখন এতই অযোগ্য, তখন কেন আমার সঙ্গে ঘোরো?”
ঋ হেসেছিল, “তোমায় চিকেন থেকে লায়ন বানাবার দায়িত্ব তো আমার। আচ্ছা, তুমি এতদিন ঘুরছ আমার সঙ্গে কিন্তু কোনওদিন চুমু খাওনি তো!”
অহন কিছু উত্তর দেবার আগেই ঋ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেয়েছিল ওর ঠোঁটে। ওর ঠোঁটের ফাক দিয়ে নিজের জিভটা ঠেলে ঢোকাবার চেষ্টাও করেছিল। ভেজা ঠোঁট, জিভ, অদ্ভুত সুন্দর স্ট্রবেরির গন্ধ পাচ্ছিল অহন। কিছু সময়ের জন্য অবশ হয়ে গিয়েছিল ওর শরীর। কিন্তু তারপরই সংবিৎ ফিরেছিল ওর। খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে এসব কী করছে ওরা? ও প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল ঋ-কে।
ভবানীপুরের কাছে ঋ’দের মাসির বাড়ির সেই ছাদটার আশেপাশে ঘেঁষে পুরনো কিছু বাড়িঘরের ভিড়। আর সেখানেই, একটা বাড়ির পরের ছাদ থেকে একজন তাকিয়েছিল ওদের দিকে। সেই ছেলেটার চেহারা এখনও মনে আছে অহনের। বেঁটে ফরসা চেহারার একটা ছেলে। দূর থেকেও ছেলেটার বিড়াল-চোখটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল অহন। একরাশ কৌতূহল নিয়ে ছেলেটা তাকিয়েছিল ওদের দিকে। এরকম দৃশ্য হয়তো দেখেনি কোনওদিন।
কেন যে ওদের প্রেম হয়েছিল, আর কেনই বা তা ভেঙে গেল সেটা আজও ঠিক বুঝতে পারে না অহন। তবে শেষের ছ’মাস ঋ খুব চাপাচাপি করেছিল ওকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু অহন কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না। বাড়িতে কী বলবে ও? আর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিয়ের কথা? পাগল না পোয়েট? ও এড়িয়ে যাচ্ছিল তাই।
ছ’মাস ধরে ক্রমাগত বলতে বলতে একসময় শেষের দিনটা এল। মানে তাকে আনল ঋ নিজেই। ভিক্টোরিয়ার সামনে সেদিন দুপুরবেলা ঋ বলেছিল, “আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক এখানেই শেষ করছি। আর নয়। নিজের বাড়িতে তুমি আমায় নিয়ে গেলে না, বিয়ের কথাও বললে না। এভাবে আর সম্ভব নয়। ইউ আর নট কমিটেড। হেন্স উই শুড পার্ট আওয়ার ওয়েজ।”
“কিন্তু, আমায় আর একটু সময় দেবে না?” অহন কাতর গলায় বলেছিল।
“না। আই এনজয়েড ইয়োর কম্পানি। কিন্তু আর নয়। আই ক্যান্ট স্টে উইথ আ লুজার!”
“কিন্তু ঋ, প্লিজ শোনো…” অহন শেষ চেষ্টা করেছিল।
ঋ শোনেনি। চলে যাওয়ার আগে বলেছিল, “আমার ভালবাসা তুমি বুঝলে না। আমি যা বলেছি তা সবসময় বাধ্য কুকুরের মতো শুনেছ। কেন? ভয় পাও আমায়? রেস্টুরেন্টে গেলে সবসময় আমি যা চেয়েছি তাই খেয়েছ। চা ভাল না বাসলেও আমার জন্য কফি ছেড়ে চা খেয়েছ। কেন? এত ভয়? আমাকে ভয়, তোমার বাবাকে ভয়, এক্সকে ভয়, ওয়াইকে ভয়, পৃথিবী সুদ্ধ সবাইকে ভয়। আমার হুকুম মানতে পারো, কিন্তু আমাকে তোমার জীবনে আনার জন্য বাবার মুখোমুখি হতে পারো না। শেম অন ইউ। ইউ লিভ ইয়োর রেচেড লাইফ। আই অ্যাম আউট অব ইট।”
এর মাস কয়েক পরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ঋ’র। এখনও তারিখটা মনে আছে অহনের, থার্ড ফেব্রুয়ারি। আর ফিফ্থ ফেব্রুয়ারি রাতে হঠাৎ একটা মেসেজ এসেছিল অহনের মোবাইলে। যান্ত্রিক শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ওর। অন্ধকারের মধ্যে হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা টেবিল থেকে আলো জ্বলা মোবাইলটা তুলে দেখেছিল মেসেজটা। ঋ পাঠিয়েছে। বেশ চমকে গিয়েছিল ও। হিসেবমতো সেদিন ঋ-এর ফুলশয্যা ছিল। মেসেজটা খুলে অহন দেখেছিল ঋ লিখেছে— 2 NITE I LST MY VRGNTY. U CHICKN।
“কী গো নামবে না গাড়ি থেকে?” জিজুদার কথায় বর্তমানে ফিরে এল অহন। পার্ক স্ট্রিটে ওর অফিসের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও হাসল, তারপর গাড়ির দরজা খুলে নামল। প্রায় ন’টা বাজে। উর্নি এসেছে কি?
জিজুদা বলল, “বিকেলে গাড়ি আনতে দেরি হতে পারে কিন্তু।”
“দেরি? কেন?”
“আঃ, এটাও জানো না?” জিজুদা বিরক্ত হল, “আজ মহামিছিল আছে তো। পুরো কলকাতার প্যারালিসিস হয়ে যাবে।”
অহন বলল, “ঠিক আছে, তুমি এখন এসো।”
অফিসে ঢুকেই অহন দেখল নিজের ঘরে প্রতুলকাকা বসে রয়েছেন। কাচের মধ্যে দিয়ে ওঁর অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। অহনকে দেখে প্রতুলকাকা হাত তুললেন। ওকে দাঁড় করিয়ে উঠে এলেন চেয়ার থেকে। একটু অবাক লাগল অহনের। কী ব্যাপার? প্রতুলকাকা দাঁড়াতে বলছেন কেন?
প্রতুলকাকা দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে বললেন, “অ্যাডগ্ল্যাম থেকে ফোন করেছিল।”
“অ্যাডগ্ল্যাম থেকে? কে? শতানিক?” ভুরু কুঁচকে গেল অহনের।
“হ্যা। তোমায় খুঁজছিল।”
“আমায়? কেন?”
“কী সব অফার আছে নাকি ওর। তোমার সঙ্গে সেই নিয়ে কথা বলতে চায়।”
“আমার সঙ্গে? অফার আছে? কীসের অফার?”
“সে আমায় বলেনি। তুমি কথা বলো।”
প্রতুলকাকার মুখ দেখে অহনের মনে হল, লোকটা জানে কী অফার, কিন্তু বলছে না। একটু অস্বস্তি হল ওর। শতানিকের সঙ্গে কথা বলাটা ওর খুব একটা মনের মতো কাজ নয়। লোকটা সবসময় ঘাড়ে চড়ে কথা বলে। ও বুঝতে পারল প্রতুলকাকা ইচ্ছে করে ওকে এর মধ্যে ঠেলছেন। যেহেতু অহন কাউকে মুখের ওপর না করতে পারে না তাই ওকে বিপদে ফেলা। অহনের মনে হল, এটা নিশ্চয়ই ওই সফট্ ড্রিঙ্কস্ অ্যাডের সংক্রান্ত কোনও বিষয় হবে। শতানিক লোকটা খুব ধড়িবাজ। নিশ্চয়ই কিছু কলকবজা নাড়বে।
অহন বলল, “ঠিক আছে, আমি ফোন করব না। লেট হিম রিং মি।”
প্রতুলকাকা একটু অসন্তুষ্ট হলেন, “তুমি করবে না কেন?”
অহন হেসে বলল, “দরকারটা তো ওর, তাই মানে…”
“যা পারো করো। আমি আর কী বলব? তোমরা সব বড় হয়ে গেছ।” প্রতুলকাকা আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
অহন এবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। চেকটা ডিপোজিট স্লিপে লিখে ফেলতে হবে। কিন্তু দু’পাও এগোতে পারল না ও। দেখল করিডোরের অন্য প্রান্ত থেকে প্রায় দৌড়ে ওর দিকে আসছে উর্নি। চোখেমুখে টেনশন। মাথায় ছোট করে কাটা চুলগুলো এলোমেলো। ডান হাতে মুঠো করে ধরা চশমা। টেনশন হলেই চশমা খুলে ফেলে উর্নি।
কী হয়েছে ওর? এমন করে দৌড়ে আসছে কেন? কোনও গন্ডগোল হল কি? টেনশনে হাত ঘামতে শুরু করল অহনের। মনে হল সকালটাই বলে দিচ্ছে সামনে একটা খারাপ দিন অপেক্ষা করছে ওর।
উর্নি : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল ন’টা পাঁচ
বাঁ দিকে বেঁকে করিডোরে দিয়েই অহনকে দেখতে পেল উর্নি। দৌড়ে অহনের দিকে যেতে যেতে ও বুঝতে পারল ওকে দৌড়োতে দেখে অহন একটু ঘাবড়ে গেছে। সুন্দর দেখতে মানুষটাকে একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে যেন। উর্নি জানে অহন একটু নার্ভাস প্রকৃতির, লাজুক ধরনের। এমন মানুষকে দিয়ে ব্যাবসা হওয়া মুশকিল।
কিন্তু ব্যাপারটা এমন যে, তাতে না দৌড়ে ও পারেনি। ও, ওর সিট থেকে রাস্তায় অহনের গাড়িটাকে আসতে দেখেছিল। তাই দৌড়ে খবরটা দিতে এসেছে। কারণ ও জানে খবরটা এমন যে, এর জন্য যা যা করার এক্ষুনি না করতে পারলে ভীষণ দেরি হয়ে যাবে।
অহনের থতমত মুখের সামনে গিয়ে উর্নি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর চুলের ভেতর অভ্যেস মতো হাত চালাল একবার। অহন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এভাবে দৌড়োচ্ছ কেন? এনি প্রবলেম?”
“অহনদা, সুগত।”
“সুগত? মানে? কী হয়েছে সুগতর?”
“ও আজ আসবে না। সাত দিনের জন্য ডুয়ার্স চলে যাচ্ছে।”
“কী? আসবে না? ডুয়ার্স? কী বলছ তুমি? এর মানে কী?”
“মানে সুগত নিউ ইয়ারের আগে আসবে না।”
“আঁ? কী হবে?” উর্নি দেখল অহনের মুখের শেষ দু’-চার ফোঁটা রক্তও নিমেষে উধাও হয়ে গেল। এলোমেলো হয়ে গেল চোখের দৃষ্টিটাও।
উর্নি জানে অবস্থাটা সত্যিই জটিল। ওদের এই ফার্মে তিন জন গ্রাফিক্স আর্টিস্ট আছে। এর মধ্যে মজিদ, জুনিয়র। সুগত আর টিনাই মূলত কাজ সামলায়। টিনা এখন লিভ নিয়ে গোয়ায় গিয়ে বসে রয়েছে। আর সামনের মঙ্গলবারের প্রেজেন্টেশনটা সুগতর তৈরি করার কথা। স্টোরি বোর্ডটা রাফলি হলেও, ছবিগুলো আঁকা হয়নি বিশেষ। এরপর কম্পিউটারে ফেলে সেগুলোকে ফাইনাল চেহারা দিতে হবে। অহন, সুগতর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছিল যে, শনিবার মানে পঁচিশে ডিসেম্বর আর রবিবারও কাজ করবে ওরা। চেপে করলে মঙ্গলবারের মধ্যে ঠিক নেমে যাবে কাজটা। সুগত তখন খুব মাথা নাড়ছিল। উর্নি নিজেও তো ছিল সেখানে। ওরা পাখি পড়ানোর মতো করে সুগতকে বুঝিয়েছিল যে, কোনও মতেই যেন কামাই না করে এই ক’দিন। কারণ দুমদাম কামাই করা ওর বরাবরের অভ্যেস।
অত করে বোঝানোর পর উনি ভেবেছিল যে, সুগত বোধহয় ঠিক কাজটা উদ্ধার করে দেবে। এমনকী গতকাল সন্ধেবেলাও তো ও বুঝতে পারেনি কিছু। অফিস থেকে যাবার সময় পর্যন্ত সুগত বলেছিল, “অহনদা, কাল ক্রিসমাস ইভ। খাওয়াতে হবে কিন্তু।” আর আজ সকালের মধ্যে সব পালটে গেল!
উর্নি পৌনে ন’টার মধ্যে অফিসে চলে আসে। সারাদিনের কাজটা গুছিয়ে নেবার জন্যই একটু তাড়াতাড়ি আসে ও। আজও যখন কাগজপত্তর খুলে বসেছে ঠিক তখনই ওর মোবাইলটা বেজে উঠেছিল। উর্নি ফোনটা খুলে দেখেছিল, সুগতর বাড়ির নম্বর থেকে ফোন এসেছে। উর্নি বলেছিল, “হ্যাঁ সুগত, বল।”
সুগত খুব ক্যাজুয়ালি বলেছিল, “কয়েক দিন আসতে পারব না, বুঝলি। একটু ডুয়ার্স যাচ্ছি ঘুরতে।”
“কী বলছিস? ফালতু ইয়ারকি মারিস না।” সামান্য হেসে উত্তর দিয়েছিল ও।
“ইয়ারকি মারছি না। শোন, এক তারিখ ফিরব অ্যান্ড উইল জয়েন দ্য অফিস ফ্রম সেকেন্ড। ঠিক আছে?”
“ফালতু কথা বলিস না, সামনে মঙ্গলবার প্রেজেন্টেশন, জানিস না?”
“ডেট এক্সটেন্ড করে নে। এসে ঘ্যামাঞ্চকার কাজ নামাব। সব অ্যাডের বাপ হবে সেটা।”
“কী যা তা বলছিস! অহনদা বিপদে পড়বে।”
“দূর, বছরের শেষ, সাত দিন ছুটি নেব না? তোকে না হয় তোর বয়ফ্রেন্ড ঠুকে ছেড়ে পালিয়েছে বলে তুই লাট খেয়ে কাজ করিস। সবাই তাই করবে নাকি? অহনদাকে বলে দিস। বাই।”
বয়ফ্রেন্ডের কথাটা অবশ করে দিয়েছিল উর্নিকে। সেই সুযোগে ফোনটা কেটে দিয়েছিল সুগত। ভীষণ রাগ হচ্ছিল উর্নির, কান্নাও পাচ্ছিল। তুই জানিস টিনা নেই। এই ক্যাম্পেনটা করছিস তুই, আর সেখানেই কাজ ছেড়ে ঘুরতে গেলি? তার ওপর বয়ফ্রেন্ডের কথাটা বলতে পারলি ওভাবে? তোকে বিশ্বাস করার এই ফল? চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে বসেছিল উর্নি। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। উর্নি জানে ওদের অ্যাডের কনসেপ্টটা দারুণ হয়েছে। গোটাটাই অ্যানিমেশন নির্ভর হবে। কিন্তু অ্যানিমেশনগুলো এখন করবে কে? মজিদকে গাইড করলেও ও কাজটা করতে পারবে না। যে-পারবে সে তো ডুয়ার্সে চলে যাচ্ছে। এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতেই অহনের গাড়িটাকে রাস্তা দিয়ে আসতে দেখেছিল উর্নি। আর তাই ও ছুটে এসেছে খবর দিতে।
উর্নি বলল, “অহনদা, আপনি আপনার ঘরে চলুন, সেখানে কথা বলব।”
“ঘরে?” এলোমেলো চোখে তাকিয়ে ঘর শব্দটার মানে বোঝার চেষ্টা করল অহন। তারপর বলল, “চলো।”
অহন ঘরে ঢুকেই চেয়ারে ছেড়ে দিল শরীরটাকে। চেয়ারটা তার যথাসাধ্য আপত্তি জানাল। উর্নি এই অফিসে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, অহন সহজেই ঘাবড়ে যায়। ও সামনের চেয়ারে বসতে বসতে শুনল অহন বলছে, “এবার কী হবে? বাবা কী বলবে? এই যে মডেলদের দিয়ে ফোটো শুট করালাম, তার বড় বড় প্রিন্ট বের করালাম। সেগুলো থেকে কার্টুন আঁকিয়ে থ্রি-ডি অ্যানিমেশন করাব, এই যে যজ্ঞিবাড়ির কাজ, এসব কে করবে? উর্নি, সুগত এমন করল কেন বলো তো?”
উর্নি বলল, “অহনদা, আপনি ঘাবড়াবেন না, আমি ভাবছি এখনই একবার সুগতর বাড়িতে যাব। দেখি যদি ওকে কনভিনস্ করা যায়। যাব অহনদা?”
অহন গলার টাইটাকে আলগা করে টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলল, বলল, “ভাবতে পারছ, কী সর্বনাশটা হল? গতকাল পর্যন্ত ও এমন করল যেন সব ঠিক আছে। আর হঠাৎ আজ কী হল ওর?”
উর্নি আবার জিজ্ঞেস করল, “আমি যাব অহনদা? ওর বাড়ি হিন্দুস্তান পার্কে। আমি চিনি।”
“যাবে?” অহন মুখ তুলল, “ঠিক আছে যাও। আর যদি দেখো ওকে ফেরাতে পারলে না, তা হলে মুকুলদার কাছে চলে যাবে। রাসবিহারী মোড়ে বাড়ি। উনি ফ্রিলান্সার তো, ওঁকে ধরে নিয়ে আসবে। যেভাবেই হোক ক্যাম্পেনটা শেষ করতেই হবে।”
“মুকুলদাও না এলে?” জিজ্ঞেস করল উর্নি।
“তা হলে রূপাদির কাছে যাবে চেতলায়। সেখানেও না হলে ভবানীপুরের কাছে রাজ গুহর ওখানে যাবে। মানে, যেভাবেই হোক একজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট চাই আমার।”
অহনের ডেসপারেশনটা উর্নি বুঝল। আর সেটাই স্বাভাবিক। অহনের বাবা, মানে বড় সাহেব, নাকি এ কাজটায় একদম আগ্রহী নয়। খানিকটা স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই অহন জেদ করেছে কাজটা নিয়ে। বা বলা যায় উর্নিই অহনকে সাহস জুগিয়েছে। আর কে জানে ভেতরে ভেতরে অহনও হয়তো এই কাজটা দিয়েই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায়।
উর্নি জিজ্ঞেস করল, “রূপাদি আর রাজ গুহর ঠিকানাটা কোথায় পাব? মুকুলদারটা আমি জানি।”
অহন এবার গলার থেকে টাইটা খুলে টেবিলে জড়ো করে রেখে বলল, “প্রতুলকাকাকে বলো, উনি দিয়ে দেবেন।”
“স্যারকে বলব?” উর্নির মুখটা তেতো হয়ে গেল। এ-লোকটাকে একদম ভাল লাগে না উর্নির। পুরনো বাংলা সিনেমার ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা বিকাশ রায়ের মতো লাগে। সব কাজে বাগড়া দেবে লোকটা। এটা হবে না, ওটা ঠিক নয়, এটা করে লাভ নেই— এ ছাড়া কোনও কথা নেই লোকটার মুখে। এত নেগেটিভ মাইন্ডেড কেন কে জানে! শরীরে ইলেকট্রনের মাত্রা বোধহয় বেশি। এই ক্যাম্পেনটাতে তো প্রথম থেকেই বাগড়া দিচ্ছে লোকটা। কোথায় উৎসাহ দেবে, না, লেঙ্গি মারছে। উর্নির তো মনে হয়, এই যে বড় সাহেব এ-কাজটায় আগ্রহী নয়, এতেও ওই বুড়ো ইলেকট্রনটার আঙুল আছে। এখন এই যন্তরটার কাছে যেতে হবে ঠিকানা চাইতে!
অহন উর্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বলবে। ওঁর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো তুমি। দেখো কপালে কী আছে!”
উর্নি উঠে দাঁড়াল, বলল, “অহনদা, আপনি চিন্তা করবেন না। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে, দেখবেন। কেউ না কেউ থাকবেই।”
অহন বলল, “গাড়িটা ছেড়ে দিয়েই বিপদে পড়লাম, না হলে তোমায় দিতাম।”
উর্নি মাথা নাড়ল, “কোনও প্রবলেম নেই, ট্যাক্সি, অটো, মেট্রো সব আছে। ও ঠিক পৌঁছে যাব।”
ওর বলার ধরন দেখে অহন হাসল। বলল, “রাস্তায় বেরোবার আগে মাথার চুলগুলো ঠিক করে নিয়ো, পাগলির মতো দেখাচ্ছে।”
দেওয়ালের আয়নায় নিজেকে দেখল উর্নি। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সত্যিই পাগলির মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু রৌনক কী বলত এরকম চুল দেখে? রৌনক বলত, “ইউ লুক ড্যাম সেক্সি ইন দিস হেয়ার। আই হ্যাভ আ হার্ড অন হোয়েন ইউ লুক লাইক দিস।” রৌনক এখন কোথায় কে জানে! অবশ্য জানবেই বা কেমন করে, ফ্রি স্পিরিটদের খোঁজ রাখা কি সাধারণ মানুষদের কাজ?
অহনের চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে, নিজের টেবিলে গিয়ে ব্যাগটা খুলল উর্নি। ছোট্ট চিরুনি বের করে ঠিক করে নিল চুলটা। ওর চুল এমনিতেই ছেলেদের মতো করে ছাটা। আঁচড়াতে অসুবিধে হয় না। চিরুনিটা ব্যাগে ভরে, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিল উর্নি। এবার ও রেডি। সামনে বিস্তর কাজ পড়ে আছে। প্রথমে সুগত, না হলে মুকুলদা, তারপর রূপাদি, রাজ গুহ আরও না জানি কোথায় কোথায় যেতে হবে। ও যাবে। যেখান থেকে পারে কাজের লোক ধরে আনতেই হবে। ওর খুব দুর্দিনে অহন ওকে চাকরি দিয়েছিল এখানে। নির্ভেজাল, শান্ত মানুষটাকে সত্যিই ওর নিজের দাদার মতো লাগে। এ-লোকটার জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে উর্নির। উর্নি প্রতুলস্যারের ঘরের দিকে এগোল।
প্রতুলস্যার একটা ফাইল খুলে তার মধ্যে রাখা বিল দেখে পাশের খাতায় কী সব হিসেব করছিলেন। উর্নিকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিয়েও ওর দিকে মুখ তুলে তাকালেন না। একমনে হিসেব করতে লাগলেন। উনি দু’বার “স্যার, স্যার” বললেও উনি পাত্তা দিচ্ছেন না। উর্নির মনে হল পাশে রাখা জলের গ্লাসটা উপুড় করে দেয় লোকটার মাথায়। আচ্ছা খচ্চর লোক তো!
উর্নি আরও মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে উপায় না দেখে একটু জোরের সঙ্গেই “স্যার” বলে ডাকল।
প্রতুলস্যার মুখ তুললেন, “চেঁচাচ্ছ কেন? আমি কালা?”
উর্নি মনে মনে বলল, তোর সাতগুষ্টি কালা। মুখে বলল, “স্যার, আমায় আর্জেন্টলি বেরোতে হবে। দুটো ঠিকানা চাই। অহনদা বললেন আপনার কাছ থেকে নিয়ে নিতে।”
প্রতুলস্যার ফাইলের মধ্যে একটা পেন গুঁজে সেটাকে বন্ধ করলেন, তারপর সটান উর্নির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী, সুগত ডুবিয়েছে তো? জানতাম। আরে একাজটা হবে না, ফালতু চেষ্টা করছ। অহনটাও যেমন হয়েছে। অবশ্য তুমি তো বললে ও নাকি কী সব প্ল্যান-ট্যান করেছে। ভাল, ভাল। সে তার বাপের পয়সার শ্রাদ্ধ করলে আমার কী বলার আছে।”
উর্নি কথা ঘোরাতে বলল, “স্যার, যদি রূপা বাগচি আর রাজ গুহর অ্যাড্রেসটা একটু দেন।”
“রূপা আর রাজ!” প্রতুলস্যার তাঁর পোড়া ভুট্টাদানার মতো দাঁত দেখিয়ে হাসলেন, “ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ জয়? অহনটা খেপে গেছে একদম। তা ঠিকানা নিয়ে কী করবে? ফোন করে কথা বলো। ফালতু ট্র্যাভেলিং এক্সপেন্স বাড়িয়ে লাভ আছে?” উর্নির মাথা গরম হয়ে গেল। শালা বুড়ো, নিজে যে যখন-তখন গাড়ি দাবড়ে বেরোস, তখন? সেটা মুফতে হয়? ও বলল, “স্যার, সামনাসামনি কথা বলার ইমপ্যাক্টটাই আলাদা। প্লিজ যদি ঠিকানাগুলো দেন।”
প্রতুলস্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রয়ার টেনে একটা মোটা ডাইরি বের করলেন। তারপর তার থেকে দুটো ঠিকানা খুঁজে একটা সাদা কাগজে লিখে বাড়িয়ে দিলেন উর্নির দিকে। বললেন, “এই নাও তোমার ভাড়াটে সৈন্যদের অফিসের ঠিকানা। দেখো তারা যদি তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে রাজি হয়!”
উর্নি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।” মনে মনে বলল, ষাঁড়।
প্রতুলস্যার আবার ফাইলটা খুলে ভেতরে গুঁজে রাখা পেনটা বের করলেন। তারপর ফাইলের ওপর ঝুঁকে বললেন, “বাইরে গিয়ে আমার ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলো তো।”
উর্নি ভাবল বলে, শুধু কফি কেন? তাতে একটু তুঁতে গুলে দিলে টেস্টটা বাড়ত না? মুখে বলল “দিচ্ছি স্যার।”
করিডোরে বেরিয়ে উর্নি দেখল, গোরা বসে রয়েছে একটু দূরে। খুব মন দিয়ে একটা ইংরেজি বইয়ের ছবি দেখছে ও। বইটা দেখেই ও চিনতে পারল। একটা বিদেশি জার্নাল। উর্নি জানে ওতে বেশ কিছু ন্যুড ছবি রয়েছে। বিভিন্ন ভঙ্গিতে মেয়েরা জামাকাপড় ছাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। উর্নি দেখল গোরা বইটাকে এমন করে দেখছে যেন কালকেই ওর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা রয়েছে আর এখান থেকেই প্রশ্ন দেওয়া হবে।
গোরার বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ, অনেকটাই বড় উর্নির চেয়ে। অফিসে, অহন বাদে সবাই ওকে গোরা বলেই ডাকে। উর্নিও তাই বলে। ও বোঝে না কেন অহন ‘গোরাদা’ বলে। মাঝে মাঝে উর্নি ভাবে অহন যেন দরকারের চেয়েও বেশি ভদ্র।
উর্নি বলল, “গোরা, স্যারের ঘরে এক কাপ কফি দিয়ো।”
অনেক কষ্টে নিজেকে বইটা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে মুখ তুলল গোরা, জিজ্ঞেস করল, “কফি? এখন দিতে হবে?”
উর্নি দেখল গোরার মুখে বেজায় বিরক্তি। যেন কফি নয়, গন্ধমাদন থেকে সঞ্জীবনী খুঁজে আনতে বলা হয়েছে। এটাই পছন্দ হয় না উর্নির। লোকটা খুব কুঁড়ে। কোনও কাজ করতে বললেই বাহানা দেয়। এই যে প্রতুলস্যারের কফি নিয়ে টালবাহানা করছে, সেটা কিন্তু প্রতুলস্যারের সামনে গেলেই উবে যাবে। তখন সারা পৃথিবীর তেল ঢালবে প্রতুলস্যারের মাথায়। সেইজন্যই তো এখনও টিকে আছে এখানে। চামচাগিরি করে চাকরিটা টিকিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে উর্নি ভাবে ওর হাতে ক্ষমতা থাকলে এটাকেও ঘাড় ধাক্কা দিত। অহন আর ও জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করে বলেই এখনও ফার্মটা টিকে আছে।
উর্নি সামান্য কড়া গলায় বলল, “হ্যাঁ, এক্ষুনি দেবে। হাতের ওই বইটা রাখো। আর অহনদাকেও এক কাপ দেবে।”
“অহনদাকেও?” গোরার মুখে এখনও অনিচ্ছে।
“আপত্তি আছে?” এবার ভুরু কুঁচকে আরও কড়াভাবে জিজ্ঞেস করল উর্নি।
“না না, এই দিচ্ছি।” গোরা বইটাকে রেখে চলে গেল ওদের কফির জায়গায়। উর্নি বুঝল, শেষ কথাটা বলার সময় একটু বেশি হার্শ হয়ে গিয়েছিল। আসলে সকালেই সুগত এমন ফোনটা করল যে টেনশনে ওর মেজাজটাও খারাপ হয়ে আছে।
আর দেরি করল না উর্নি। ও বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
পার্ক স্ট্রিটের এই ফুটপাথটায় রোদ পড়ে না বিশেষ। সবসময় কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, মনমরা ভাব। শীতকালের এই সকালটায় ফুটপাথটাকে কেমন ভেজা মনে হল উর্নির। মনে হল কে যেন জল ঢেলে দিয়ে গেছে। সকাল থেকেই আজ হাওয়া দিচ্ছে একটা। বেশ ঠান্ডা একটা হাওয়া। উর্নির শরীরটা শিরশির করে উঠল, তবে কতটা ঠান্ডায় আর কতটা টেনশনে ঠিক বুঝতে পারল না। একবার আকাশের দিকে তাকাল ও। যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে ধূসর একটা জ্যামিতিক আকার দেখল উর্নি। কলকাতার মাথায় এই ধূসর রংটাই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে উর্নি। ওর খারাপ লাগত রংটা। কেননা মনমরা, দূষিত এক রং। তবে মাঝখানের দুটো বছর এই রংটাই খুব ভাল লাগতে শুরু করেছিল ওর। কারণ রৌনক। রৌনকের ঘরের রং, ওর জামাকাপড়ের রং সবটাই ওই আকাশের মতো ছিল। তখন রৌনকের সব কিছুই ভাল লাগত উর্নির। সেই দুটো বছর ওর পছন্দ অপছন্দগুলো সব কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সব থিতিয়ে গেছে। সব কিছু আগের মতো হয়ে গেছে। কারণ রৌনক আর নেই ওর জীবনে। কিন্তু উর্নি মাঝে মাঝে ভাবে, সত্যিই কি সব কিছু আগের মতো হয়েছে?
মনমরা ফুটপাথ, ধূসর আকাশ আর সকাল ন’টা কুড়ির পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগল উর্নি। একটা ট্যাক্সি ধরতে হবে। সামনে জরুরি কাজ রয়েছে।
ফ্লুরিসের সামনে দিয়ে রাস্তা পার করে অন্য দিকে গেল উর্নি। একটু দূরে, কোয়ালিটির সামনে একটা খালি ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে। ওটা ধরতে হবে। তবে মনে হল, আরেকজন ভদ্রলোক ওটা ধরবে বলে এগোচ্ছেন। উর্নি বুঝল, আর সময় নেই। আশেপাশে আর একটাও ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে না। এটা ধরতেই হবে। ও দৌড়োল। আশেপাশের দু’-এক জন একটু অবাক হয়ে তাকালেও ও পাত্তা দিল না। ওই ভদ্রলোককে অতিক্রম করে ট্যাক্সিওলাকে কোনও কিছু জিজ্ঞেস না করেই প্রায় ঝাঁপ মেরে ও ঢুকে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। তারপর অবাক হয়ে দেখল সেই ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ফুটপাথ ধরে। ইস, পুরো সিন। বোকার মতো দৌড়োল।
ও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসে দেখল ট্যাক্সিওলা জুলজুল করে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। উর্নি একটু অপ্রস্তুত মুখে জিজ্ঞেস করল, “গড়িয়াহাট জায়েগা?”
ট্যাক্সিওলাটা বলল, “বসেই যখন পড়েছেন, তখন না গিয়ে উপায় আছে? আর দেখুন, হিন্দিতে বলবেন না। আমায় দেখতে বিহারিদের মতো হলেও আমি বিহারি নই। বুঝলেন? সব উলটোপালটা লোক এসে কলকাতার ট্যাক্সি লাইনটার পোঁ… ইয়ে সব্বেনাশ করেছে। আমার তো মনে হয়…”
উর্নি বলল, “প্লিজ, গড়িয়াহাট চলুন।”
ড্রাইভারটি হতাশ হল। মুখ ফিরিয়ে মিটারের সুইচ টিপল। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “চলুন, আমার কী? সকালেই যা আজ একটু ব্যাবসা-পত্তর হবে। দুপুর হলেই তো সব মিছিল করবে। শালা বিশ্বশান্তি! একদম বো… মানে জঘন্য ব্যাপার। তোর ঘরে শান্তি আছে যে বিশ্বে আসবে? যত সব গা… ইসের মতো কারবার।”
উর্নি চশমাটা খুলে চোখের কোণ দুটো টিপল। ভুল করে রেডিয়ো স্টেশনে ঢুকে পড়েছে মনে হল। নাঃ, এ লোকটার কথায় কান দেবে না। ও সিটে হেলান দিয়ে বসল। আজ কলকাতায় ছুটির মুড যেন। চারিদিকে আধ-সেঁকা পাউরুটির মতো ভিড়, ঢিলেঢালা গাড়ি, বাইক। পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের দোকানপাট তো দারুণ ভাবে সেজেছে। স্যান্টা দাদুর আসার সময় হয়ে এল। উর্নির মা ক্রিশ্চান ছিল। এই দিনগুলোয় মা ওদের বাড়িটাকে সুন্দর ভাবে সাজাত। রিবন, বেলুন, ক্রিসমাস ট্রি, ছোট ঘণ্টা, স্টার, অ্যাঞ্জেল, লাল মোজা আরও কত কী। এখন মা নেই। ওদের বাড়িটা কঙ্কালের মতো পড়ে থাকে। শুধু ক্রিসমাস ইভের রাতে, উর্নি কাচের মধ্যে রাখা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে যিশুর পায়ের তলায়। বলে, “আমার মাকে তুমি দেখো।” ক্রিসমাস ওর কাছে খুব একটা আনন্দের সময় নয়। বছর দশেক আগে ক্রিসমাসের দিনই ওর মা মারা যায়। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না টাঙিয়ে ঝুলে পড়েছিল মা। তার বছর খানেক আগে থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিল মানুষটা। আর নিজের জন্মদিনে যিশু টেনে নিয়েছিল ওর মাকে। এই দিনটা এলেই ওর কান্না পেত খুব। কিন্তু চোখ দিয়ে জল বেরোত না। শুকনো কুয়োর মধ্যে বালতি পড়ে গেলে যেমন আওয়াজ হয়, তেমন আওয়াজ হত বুকের ভেতরে। শুধু একবার ক্রিসমাসেই কেঁদেছিল ও। রৌনকের ঘরে, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে খুব কেঁদেছিল ও।
গড়িয়াহাটে এসে ড্রাইভারটি বলল, “এসে গেছি, এবার কোথায় নামবেন?”
উর্নির সংবিৎ ফিরল। পৌনে দশটা বাজে। সুগত তো বলেছিল দশটা নাগাদ বেরিয়ে যাবে। সুগতটা এরকমই। উঠল বাই তো কটক যাই। নেহাত ছেলেটা অসাধারণ কাজ করে, তাই ওর এসব খ্যাপামো সহ্য করেও ওকে রাখা হয়েছে। কিন্তু এবার যা করল, তা ক্ষমার অযোগ্য। উর্নি জানে, অবস্থার গুরুত্ব অনুযায়ী হয়তো অহনের আসা উচিত ছিল। কিন্তু উর্নি নিজেই এসেছে। অহনকে যেরকম টেনসড দেখেছে তাতে ওর আসার প্রশ্নই ছিল না।
“কী হল? কোথায় নামবেন?” ড্রাইভারের গলায় অধৈর্য। উর্নি বলল, “আরেকটু এগিয়ে, ওই ভেতর দিয়ে গিয়ে হিন্দুস্তান পার্কে।”
“হিন্দুস্তান পার্ক? সেটা গড়িয়াহাট হল?”
“আরে একই তো।” উর্নি বোঝাবার চেষ্টা করল।
“একই?” স্টার্ট বন্ধ করে ড্রাইভারটি ঘুরে বসল, “গড়িয়াহাট আর হিন্দুস্তান পার্ক এক? রসগোল্লা আর সন্দেশ এক? হাঁস আর হাসপাতাল এক? জল আর জলযোগ এক?”
“আশ্চর্য!” চিৎকার করল উর্নি, “বলছি চলুন। কাছেই। খুব দরকার। তখন থেকে হাবিজাবি বকছেন। চলুন।”
ধমক খেয়ে ড্রাইভারটি থমকে গেল। তারপর বলল, “বকছেন কেন? যাব তো। শুধু দুটো জায়গা যে এক নয় সেটাই বোঝাচ্ছিলাম।”
উর্নি কড়া চোখে তাকাল, “চলুন বলছি, আর একটা কথা নয়।”
দশটা বাজতে পাঁচে সুগতর বাড়ির কলিংবেলটায় চাপ দিল উর্নি। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। ও কি পারবে সুগতর যাওয়া ক্যানসেল করতে?
সুগত এখানে ওর দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে থাকে। ওর দিদিই দরজা খুলে দিল। ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “আরে উর্নি? তুমিও ওদের সঙ্গে যাচ্ছ নাকি?”
উর্নি উত্তর না দিয়ে ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় ও?”
দিদি ওপরের দিকে আঙুল তুলে বলল, “ঘুলঘুলিতে।”
এই বাড়ির মেজানাইন ফ্লোরে থাকে সুগত। এটাকে ও বলে ঘুলঘুলি। উর্নি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। এ-ঘরটাকে ঘুলঘুলি বললেও ঘরটা খুব একটা ছোট নয়। তবে সিলিংটা একটু নিচু।
উর্নি দেখল একটা হ্যাভারস্যাক পেট মোটা কচ্ছপের মতো উলটে পড়ে আছে খাটে আর সুগত ছোট টুলে বসে মোজা পরছে। ওকে দেখে সুগত বলল, “কী রে এসে পড়েছিস? ওই টেবিলটায় আমার রেজিগনেশন লেটার আছে, নিয়ে যাস।”
“কী বলছিস? আমাদের এভাবে ডুবিয়ে তুই ঘুরতে যাচ্ছিস?”
“দেখ, তোকে বলেছিলাম ফিরে এসে কাজটা করে দেব। কিন্তু পাশাপাশি এটাও লিখে রেখেছি। নাউ ইটস্ ইয়োর চয়েস।”
“এমন করিস না সুগত। অহনদা ভীষণ বিপদে পড়বে।” কাতর গলায় বলল উর্নি।
সুগত এবার পায়ে স্নিকার গলিয়ে ফিতে বাঁধতে লাগল।
উর্নি আবার বলল, “প্লিজ এমন করিস না। এসব বাদ দে। মঙ্গলবার অবধি পার করে তারপর যেখানে খুশি বেড়াতে যা।”
সুগত জুতো বেঁধে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিল। তারপর বলল, “শোন, আজকাল সফট্ ড্রিঙ্কস নিয়ে কেমন বাওয়াল চলছে দেখেছিস না? তা ছাড়া এসব খেলে মানুষ মোটাও হয় খুব। ওসব বাদ দে। ওসবের অ্যাড করতে হবে না”
“তোর কী হল, কালকে অবধি তো সব ঠিক ছিল?”
“আমরা আর্টিস্টরা এরকমই। বললাম তো রেজিগনেশন লেটার টেবিলে আছে। গাড়ি করে বন্ধুদের সঙ্গে এতটা পথ যাওয়া, তার ওপর আবার শীতে জঙ্গল, বুঝতে পারছিস? শালা চাকরির মুখে লাথ।”
উর্নিকে কিছু বলতে না দিয়ে নীচে নেমে গেল সুগত। উর্নিও নামল পেছন পেছন। সুগত ওর দিদিকে বলল, “আসি রে, নিউ ইয়ারে ফিরব।”
দিদি বলল, “সাবধানে যাস।”
দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সুগত। উর্নিও বেরোল। শেষ বারের মতো চেষ্টা করল, “প্লিজ সুগত। কাম টু ইয়োর সেন্সেস।”
সামনে দাঁড়ানো একটা বড় এস ইউ ভি’র দরজা খুলে উঠে পড়ল সুগত। উর্নি দেখল ভেতরে আরও তিন জন রয়েছে। সুগত বলল, “তুইও চল না। ঝম্প হবে। আবার মাল খেলে ‘রৌনক রৌনক’ বলে বাওয়াল করবি।”
উর্নি এবার মেজাজ হারাল, আচমকা বলল, “ফাক ইউ।”
সুগত হাসল, বলল, “আই উড লাভ টু, কিন্তু সময় নেই রে।”
উর্নির মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। এস ইউ ভি বেরিয়ে গেল ওর নাকের ডগা দিয়ে।
দশটা দশ! ঘড়ি দেখল উর্নি। আর সময় নষ্ট করবে না। এবার মুকুলদাকে ধরতে হবে। সাধারণত এ-সময় রাসবিহারী মোড়ের ওঁর স্টুডিয়োতেই থাকেন উনি। অবশ্য ওটা বাড়ি কাম স্টুডিয়ো। ওখানেই ধরতে হবে ওঁকে। মুকুলদা বেরিয়ে গেলে মুশকিল।
উর্নি এদিক ওদিক তাকাল। কোনও ট্যাক্সি নেই। আর অপেক্ষাও করা যাবে না। ও প্রায় দৌড়াতে দৌড়োতে গেল বড় রাস্তায়। ওই তো অটো আসছে একটা। এটাতেই যেতে হবে। আর সময় নষ্ট করলে হবে না। উর্নি হাত তুলল। খ্যাঁচ করে ওর সামনে এসে থামল অটোটা। পেছনে দু’জন বসে রয়েছে। ও পেছনেই উঠে বসল, বলল, “রাসবিহারী মোড় যাব।” অটো চলতে শুরু করল।
ঠান্ডা হাওয়া এসে মুখে লাগছে উর্নির। সামান্য শীত শীত করছে ওর। প্রতি বছর এ-দিনটায় ওর মন খারাপ থাকে। পঁচিশে ডিসেম্বর ওর মায়ের মৃত্যুদিন, এই চিন্তাটা ওকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। কিন্তু আজ ওর মনের বোধহয় খারাপ হওয়ার মতো সময়ও নেই। হঠাৎ ওর মনে পড়ল ফেরার পথে কেক নিয়ে যেতে হবে আজ বাড়িতে। বাবা ফুট কেক ভালবাসে।
রাসবিহারী মোড়ে অটোটা থামামাত্র উর্নির মোবাইল বেজে উঠল। ও অটো থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ফোনটা ধরল। অহন। উর্নি দ্রুত বলল, “অহনদা, সরি, সুগত শুনল না। আমি এবার মুকুলদার কাছে যাচ্ছি।”
“শুনল না?” অহনের গলায় হতাশা টের পেল উর্নি।
“চিন্তা করবেন না অহনদা, আমি দেখছি কী করা যায়।” বলে উর্নি ব্যাগ থেকে দশ টাকার নোট বের করে অটোওলাকে দিয়ে মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগল।
অহন বলল, “দেখো চেষ্টা করে। আর কী বলব? ইউ ক্যারি অন।”
উর্নি বলল, “অহনদা, ডোন্ট ওরি। একটা পথ বেরোবেই।”
ফোন কাটার আগে অহনের দীর্ঘশ্বাসটা স্পষ্ট শুনল উর্নি।
“দিদি, চেঞ্জটা।”
“অ্যাঁ?” পেছনে ফিরল উর্নি। দেখল অটোওলাটা পয়সা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উর্নি বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “মানে? কীসের পয়সা?”
লোকটা ইতস্তত করে ছ’টাকা ফেরত দিল উর্নির হাতে, বলল, “দশ টাকার নোট দিয়েছিলেন, ভাড়া তো চার টাকা।”
উর্নি টাকাটা নিল। লোকটা সৎ। অবশ্য ভুলটা ওরই। এতটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল কথা বলতে বলতে যে, খেয়াল ছিল না। উর্নি হাসল, বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
অটোওলাটা মাথা নেড়ে চলে গেল। কেন জানে না, কিন্তু উর্নির মনে হল, সকাল থেকে এই প্রথম ভাল কিছু ঘটল। তবে কি ভাল ঘটনার শুরু হল? মুকুলদার কি তা হলে রাজি হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে? উর্নি দেখল অটোওলাটা অটো ঘুরিয়ে স্ট্যান্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বোম : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল দশটা কুড়ি
স্ট্যান্ডে সব অটোর পেছনে নিজের গাড়িটা রাখল বোম। তারপর বুকপকেটে হাত দিয়ে দেখল মোবাইলটা রয়েছে কি না। নাঃ আছে। এই হয়েছে এক সমস্যা। সবসময় দেখতে হয় ফোনটা পকেটে রয়েছে কি না! কেন যে রুচি এটা ওর পকেটে গুঁজে দিয়েছে! ও কি ঘুড়ি যে, লাটাইয়ের মতো করে ধরে রাখতে হবে ওকে? তবে রুচিকে কে বলবে এই কথা? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে? বোম নিজে তো বটেই, ওর বাবা-মা-ও ভয় পায় রুচিকে। সেই বিয়ের প্রথম দিন থেকেই রুচি ওদের বাড়িকে দাবড়ে চলেছে। ওদের বাড়ির পাশে থাকা নকুলজ্যাঠা তো বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় বলেছিল, “বোম, এ কাকে বিয়ে করে এনেছিস? চম্বলের মেয়ে নাকি? দস্যুদের রিলেটিভ?”
পাশেই বাঁধানো একটা গুলমোহর গাছ। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশে আশ্চর্যজনক ভাবে এখনও কিছু গাছ রয়ে গেছে। এই গুলমোহরটাও সেই গাছেদের গোত্রেরই। বোম ওই বাঁধানো গাছের গোড়ায় বসল। একটা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে সকাল থেকে। ঠান্ডা একদম ভাল লাগে না বোমের। এই সময়টায় কেমন আলস্য লাগে ওর। কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করে না। শুকনো হাওয়ার টানে পা ফেটে যায়, গায়ের চামড়া শুকিয়ে খড়ি ওঠে। সারাদিন একটা অস্বস্তি, একটা খারাপ লাগা ঘিরে থাকে ওকে। অবশ্য বোমের তো অনেক কিছুই খারাপ লাগে, তা বলে কি সেগুলো হচ্ছে না পৃথিবীতে?
পকেট থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করে তার থেকে একটা লবঙ্গ মুখে দিল বোম। লবঙ্গের গন্ধ ভাল লাগে বোমের। ও চোখ বন্ধ করল। ক’টা বাজল? সাড়ে দশটা কি? সাড়ে এগারোটা নাগাদ একবার বাড়িতে যেতে হবে ওকে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পকেটের মোবাইলটা টুং টাং শব্দে বেজে উঠল এবার। আপনা থেকেই মুখটা বেঁকে গেল বোমের। আবার ফোন! ও ফোনটা বের করে কানে ধরল, “হ্যাঁ, বলছি।”
ওপাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুচির গলা, “কোথায় তুমি? মনে আছে তো সাড়ে এগারোটার সময় সোনাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?”
বোম লম্বা শ্বাস নিল একটা, “হ্যাঁ, মনে আছে।”
“সকাল থেকে ক’টা ট্রিপ হল?”
প্রশ্নটায় একটু দমে গেল বোম। অবশ্য রুচি প্রশ্নটা করতেই পারে। অটোটা তো ওর টাকাতেই কেনা।
প্রথম প্রথম অন্য লোকের অটো, কমিশন বেসিসে চালাত বোম। কিন্তু তারপর রুচি ওকে অটো কিনে দেয়। এবং প্রতি দিনই মাঝেমধ্যে ফোন করে খবর নেয় কেমন রোজগার হচ্ছে। অবশ্য শুধু অটোই নয়, মোবাইলটাও রুচির কিনে দেওয়া। তা দিতেই পারে রুচি। এখন ওর অনেক টাকা।
বোম বলল, “এই চারটে ট্রিপ হয়েছে।”
“চারটে? এর মধ্যে তো ছ’টা হওয়ার কথা। কী করে গাড়ি চালাও? ওটা অটো না গোরুর গাড়ি? বিছানাতেও যেমন, রাস্তাতেও তেমন। তুমি ক্যালানে, ক্যালানেই রয়ে গেলে। যাক, ঠিক সময়ে চলে এসো।”
ফোনটা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল বোম। ক্যালানে! হয়তো রুচি ঠিকই বলছে। রাস্তাতেও ক্যালানে, বিছানাতেও ক্যালানে। সেইজন্যই তো রুচি কালুর সঙ্গে শুতে চেয়েছিল। এক রাতে নিঃশেষ হওয়া বোমকে বুকের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে রুচি বলেছিল, “এরই মধ্যে বেরিয়ে গেল? আমার তো গরমই হয়নি এখনও। তুমি পুরুষ মানুষ? না চেহারা, না কিছু। আমার সারাজীবন কাটবে কীভাবে বলো তো? এর চেয়ে কালুর সঙ্গে শুলে বোধহয় আরাম পেতাম।” এর কী অর্থ ও জানে। কারণ তত দিনে কালু ওকে বলে। দিয়েছিল ঘটনাটা।
“কী বোমদা, এখানে বসে কী করছ? অটো এগোবে না?”
বোম মুখ তুলে দেখল বিড়ি মুখে নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জাসু। জাসুস। মনে মনে বলল বোম। এই ব্যাটা রুচির হয়ে এখানে গোয়েন্দাগিরি করে ওর ওপর। বোম বলল, ‘নাঃ, আজ আর এ-বেলা চালাব না। তুই একটা ট্রিপ মেরে আয় না।”
জাসুর ভুরু কুঁচকে গেল, “কেন? তোমার কী হয়েছে?”
বোম শব্দ করে নাক টানল, তারপর কৃত্রিমভাবে কাশল একটু, বলল, “শরীরটা ভাল নেই রে। মাথা ধরে রয়েছে। এমন ঠান্ডা হাওয়া মেরেছে না! আর একটু পরেই তো বাড়ি যাব।”
“কেন? বাড়ি যাবে কেন?”
“সোনাইটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে রে।”
“ডাক্তারের কাছে?” ভুরু কুঁচকে গেল জাসুর, “কেন কী হয়েছে?”
ভাল করে ওর মুখটা দেখল বোম তারপর বলল, “বাদ দে।”
“না, তুমি বলো না, আমি সঙ্গে যাব?” জাসু হাতের শেষ হওয়া বিড়িটাকে মাটিতে ছুড়ে দিল। চোখেমুখে সত্যিকারের উদ্বেগ।
এই রে, প্রমাদ গুনল বোম। ও জানে সোনাইয়ের ওপর জাসুর দুর্বলতা আছে। অবশ্য যারা যারা সোনাইকে দেখে তারাই ওর ওপর দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটবেলায়, ওরা যখন খুব গরিব ছিল, সবাই ওর বাবাকে বলত, “আপনার মেয়েকে নিয়ে চিন্তা নেই, যা দেখতে, রাজপুত্র এসে নিয়ে যাবে ওকে।”
না, রাজপুত্র আসেনি সোনাইয়ের জীবনে। এসেছে কালু। এই রুটেই অটো চালায়। আজ সোনাইকে নিয়ে বোম যাবে রবীন্দ্রসদনের কাছে এক্সাইড মোড়ে। না, কোনও ডাক্তারটাক্তার নেই সেখানে। সেখানে বারোটা নাগাদ অপেক্ষা করবে কালু। আজ সোনাই আর কালু বিয়ে করবে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। বাড়ির সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বোম এই ব্যাপারে সাহায্য করবে বোনকে। অবশ্য গোপনে। আর এখন যদি এই জাসু সঙ্গে যেতে চায় তো বিপদ হবে।
বোম বলল, “তুই গিয়ে কী করবি? তার চেয়ে আমার অটো নিয়ে চক্কর মেরে দে না। রুচিও খুশি হবে।”
জাসু ঠোঁট ওলটাল, হতাশ গলায় বলল, “যখন তুমি বলছ তখন ঠিক আছে।”
বোম ওকে উৎসাহ দেবার জন্য বলল, “আর সারাজীবন কি অটোর লাইন ম্যানেজ করবি নাকি? এই যে তোকে আমি আমার অটো চালাতে দিচ্ছি, অন্য কেউ দেবে? আমি তো চাই তুই অটো চালা। নিজের পায়ে দাঁড়া। এক দিন না এক দিন তো সংসারপাতি করতে হবে, নাকি?”
“সংসারপাতি?” জাসুর মুখটা নরম হয়ে এল। বোম বুঝল ও নিশ্চয়ই মনে মনে সোনাইকেই দেখছে। বোম তো জানে, জাসু যখন ওদের বাড়ি যায় তখন শুকনো বালি যেভাবে জলের দিকে তাকায়, জাসুও তেমন ভাবে সোনাইকে দেখে। কিন্তু জাসুকে একদম সোনাইয়ের দিকে ঘেঁষতে দেয় না রুচি। কারণ রুচি নিজের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে সোনাইয়ের। কথা আছে সামনের মাঘেই বিয়ে হবে ওদের। তাই আর রিস্ক নিতে চায় না কালু, এই পৌষ মাসেই রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলতে চায়।
গত সপ্তাহে রাতের খাবারের পর যখন সোনাই চুপিচুপি বোমকে বলেছিল, “দাদা, সামনের চব্বিশে ডিসেম্বর আমরা রেজিষ্ট্রি করব ঠিক করেছি।” তখন খুব অবাক হয়েছিল বোম। ও জানত গোপনে দু’জনের ভাব রয়েছে। তা বলে বিয়ে? ও বলেছিল, “বিয়ে? মাথা খারাপ তোর? কী রোজগার করে কালু? ভাড়ার অটো চালায়, বস্তিতে থাকে, বিয়ে বললেই বিয়ে হয় নাকি? তা ছাড়া এটা পৌষ মাস না?”
সোনাই নিচু কিন্তু দৃঢ় গলায় বলেছিল, “ওসব পৌষ মাস মানি না আমরা। আর বস্তি? মনে নেই আগে কোথায় থাকতাম আমরা? দাদা, আমি চাই আমাদের রেজিষ্ট্রির দিন তুই অন্তত থাকিস। বাবা মা বা বউদি তো মানবে না। তুই থাকলে আমার ভাল লাগবে।”
সেই রাতে কিছু না বললেও বোম মেনে নিয়েছিল বোনের কথা। প্রেম কী, বোম জানে। প্রেম হারানো কী, তাও জানে। দু’দিন পরে ও সোনাইকে বলেছিল, “ঠিক আছে, তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে নিয়ে যাব।”
সোনাই বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর ওর হাত ধরে বলেছিল, “খুব ভাল হয় তা হলে। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় আর কৈফিয়ত দিতে হবে না আমায়। সত্যিই যাবি তো?”
যাবে বোম, আজ বোনটাকে নিয়ে যাবে ও। গোরাচাঁদ বলে যে-ছেলেটার সঙ্গে সোনাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে সম্পর্কে ওর শালা হলেও, তাকে একদম সহ্য করতে পারে না বোম। খুব ভড়ংবাজ, কুঁড়ে আর চালিয়াত ধরনের ছেলে। পার্ক স্ট্রিটে একটা বিজ্ঞাপন অফিসে পিয়োনের কাজ করে। কিন্তু দেখা হলেই এমন ভাব করে যেন কোম্পানিটা ওর বাবার। বলে, “বোমদা, ওসব অটো চালানোর মতো ছোটলোকি কাজকারবার ছেড়ে চলো দু’জনে ব্যবসায় নামি। দিদির থেকে টাকা নিয়ে একটা বাংলা মালের দোকান দিই। টাকার বৃষ্টি হবে। বিড়ির পোঁদ টেনে শালা গালে গর্ত হয়ে গেল, ব্যাবসা জমলে, ফরসা মেয়েছেলের আঙুলের মতো সিগারেট খাব।”
ওর কথায় কোনও উত্তর দেয় না বোম। শুধু মনে মনে বলে, আমার গাড়িই ভাল।
“ভগবান, তুমি মানুষকে বাঁচাও। সারা পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ মরে যাচ্ছে, তুমি তাদের বাঁচাও। ভগবান, মানুষের ভাল করো তুমি।”
বোম দেখল পাশের ছোট মন্দিরের সামনে হাত জোড় করে বসে নিজের মনে কথা বলে চলেছে নেড়ু পাগলা। ময়লা পাজামা আর শতছিন্ন চাদর গায়ে দেওয়া লোকটাকে দেখে কষ্ট হল বোমের। কী মানুষের কী অবস্থা!
জাসু বলল, “দেখো বোমদা, পাগলাটা শালা আজও মন্দিরের সামনে বসেছে। দেখো, এই সব ভড়ংবাজির পরে ওই বারকোশে রাখা বাতাসা নিয়ে পালাবে মালটা। বহুত হারামি পাগল, হেভি সেয়ানা।”
বোম বলল, “ধুত, অমন বলিস না। লোকটা পাগল হতে পারে, কিন্তু অনেক বড় ঘরের মানুষ।”
“মানে?” অবাক হল জাসু।
বোম বলল, “তুই তো এই ঠেকে বছর তিনেক হল এসেছিস, কিন্তু ও এই অঞ্চলে প্রায় ছ’বছর হল আছে। কেউ মেরে অজ্ঞান করে ওকে লেকে ফেলে দিয়েছিল। হয়তো মারতেই চেয়েছিল, অজ্ঞান হয়ে গেছে দেখে হয়তো ভেবেছিল মরে গেছে। পিঠে আর পেটে ছুরির ক্ষতও ছিল। মাথার ওপরটাও থেঁতলে গিয়েছিল। সে সময় ওর পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি আর জিনসের প্যান্ট ছিল। আমার এখনও মনে আছে, তখনও বিয়ে হয়নি আমার। সকালে লেকের মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম আমরা। কখনও সখনও লাশ পাওয়া গেছে শোনা যেত। সে-দিনও লাশের খবর পেয়ে আমরা খেলা থামিয়ে ছুটেছিলাম। এই নেড়ুর শরীরটা উপুড় হয়ে পড়ে ছিল জলের ধারে। আমরা যাওয়ার পরে পুলিশ আসে। তখনই বোঝা যায়, এটা লাশ নয়। মানুষটা বেঁচে রয়েছে। পুলিশ গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায় ওকে। দেখে মনে হয়েছিল, বিশাল বড় বাড়ির ছেলে এই নেড়ু পাগলা। কে জানে, সত্যিই তাই কি না! তবে পুলিশ ওকে নিয়ে যাওয়ার দু’মাস পরে ও ফিরে আসে এই অঞ্চলে। মাথা সম্পূর্ণ খারাপ, পুরনো কথা কিছু মনে নেই। পুলিশের হাসপাতাল থেকে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল না ও পালিয়ে এসেছিল, কিচ্ছু জানি না আমরা। কিন্তু তারপর থেকেই ও এখানে।”
জাসু মন্দিরের সামনে বসা নেড়ুর দিকে তাকিয়ে বলল “এ শালার পেটে পেটে এত? ছুরি খাওয়া মাল? শালা চোস্ত জিনিস তো!”
বোম বলল, “দেখ ওভাবে বলিস না। শত হলেও মানুষ তো।”
জাসু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারল না। অটোর লাইন থেকে কানাই চিৎকার করল, “ও বোমদা, তুমি মাইরি যাবে? না হলে আমি প্যাসেঞ্জার তুলি?”
বোম উত্তর দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকাল, দেখল লাইনের শেষে গাড়ি লাগাচ্ছে কালু। কালুর সঙ্গে একটু দরকারি কথা সেরে নিতে হবে ওকে। তার আগে এই জাসুকে কাটাতে হবে এখন।
বোম অটোর চাবিটা জাসুর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, “না রে কানাই, জাসু ট্রিপ দেবে। তুই ভাই পরের বার প্যাসেঞ্জার তুলিস।”
কানাই হাত দিয়ে একটা অসভ্য ইঙ্গিত করে বলল, “ওর হাতে গাড়ি দিচ্ছ তো, পুরো ইয়ে করে দেবে গাড়ির।”
জাসু রেগে গিয়ে বলল, “তোর মাকে দেব রে বাঞ্চোৎ। আমায় গাড়ি চালানো শেখাচ্ছিস?” তারপর এগিয়ে গেল বোমের অটোর দিকে।
মনে মনে নিশ্চিন্ত হল বোম। যাক গে আপদটা গেছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল পৌনে এগারোটা বাজে। এখনও হাতে একটু সময় আছে। ও আবার ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
ওদের এই স্ট্যান্ডে একমাত্র ওরই মোবাইল ফোন রয়েছে। এটার জন্য মনে মনে একটু সংকুচিত হয়ে থাকে বোম। কারণ ও জানে ওর যা ইনকাম তাতে মোবাইল ফোন রাখার সামর্থ ওর নেই। এর চেয়েও যেটা ওর গায়ে লাগে, সেটা হল এই অটো স্ট্যান্ডের সবাই এই ফোনটা নিয়ে ওকে খোঁচা দেয়। কারণ সবাই জেনে গেছে ফোনটা ওর বউয়ের, রুচি কিনে দিয়েছে ওকে।
রুচির সঙ্গে বিয়ের আগে বোমের অন্য একজনের সঙ্গে ভাব ছিল। মেয়েটার নাম ছিল রেণু। বোম ভাবত ও যেমন পাগলের মতো ভালবাসে রেণুকে, রেণুও বোধহয় তেমনই ভালবাসে ওকে। নিজের রোজগার থেকে সাধ্যমতো উপহার প্রায়ই রেণুকে কিনে দিত বোম, আর বলত, রেণুকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না ও। রেণু সব উপহারগুলো হাত পেতে নিত আর বিয়ের কথা শুনে হাসত। বোম ভাবত এটা সম্মতির হাসি।
কিন্তু হঠাৎ একদিন ও খবর পেল যে, কোনও এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে রেণুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সেদিন পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল বোমের। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ও রেণুদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। রেণুকে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমায় ভালবাসো না তুমি?”
রেণু আশ্চর্য মুখ করে বলেছিল, “না তো।”
“তা হলে আমার দেওয়া জিনিস নিতে কেন?”
“বা রে তুমি দিতে কেন? আর তার পরিবর্তে তোমাকে আমার বুক ধরতে দিইনি?”
“মানে? তুমি… তুমি..” কথা হারিয়ে ফেলছিল বোম।
রেণু তারপর এককথায় সব সমস্যার সমাধান করে দিয়ে বলেছিল, “শোনো, ট্রাকের সঙ্গে অটো কোনওদিন পারে? আর তোমার দেওয়া জিনিসের দাম যদি এখনও না ওঠে তবে আরও একবার এই দুটো ধরে নাও।” রেণু ওড়নাটা সরিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল ওর বুক।
তারপর থেকে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকত বোম। অর্ধেক দিন কাজে বেরোত না। খাটের এক কোনায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকত। বিশেষ খেত না, কথাও বলত না কারও সঙ্গে। মা জিজ্ঞেস করত, কী হয়েছে? ও বলত না। সোনাই জিজ্ঞেস করত, ও বলত না।
এইসব বেশ কিছু দিন চলার পর বাবা দুম করে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল বোমের। ওকে না জিজ্ঞেস করেই। বোমের কোনও কথা না শুনে প্রায় ঘাড় ধরে ওকে দিয়ে বিয়েটা করানো হয়েছিল। শুভদৃষ্টির সময় রুচির দিকে ভালভাবে তাকায়ওনি ও। ইচ্ছেই করছিল না ওর।
রুচিকে ও প্রথম ভাল করে দেখে ফুলশয্যায়। দু’-চারটে টুকটাক কথার পর, রুচি হঠাৎ এগিয়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরেছিল ওর। বলেছিল, “অ্যাই, তুমি ক্যাপ কিনে রেখেছ তো?”
বুঝতে পারেনি বোম, “ক্যাপ? মানে?”
“নিরোধ রে বাবা নিরোধ। আজ করবে না?”
বোমের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ও দেখেছিল শাড়ির আঁচল গায়ের থেকে নামিয়ে ব্লাউজ খুলছে রুচি। বলছে, “প্রথম দিন তো, রক্ত বেরুবে, একটা গামছা রেখেছ তো? আস্তে কোরো কিন্তু।”
ব্লাউজটা খুলে শুধু ব্রা পরে ওর দিকে এগিয়ে এসেছিল রুচি। তারপর ওর পাজামার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, “আমারটা ধরবে না?”
বোম কথা বলতে পারছিল না। ও দেখছিল এ যেন রুচি নয় রেণু। ওর দিকে যেন কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে দুটো উত্তপ্ত লোহার গোলক।
“এ মা কই গো?” রুচির আচমকা কথায় সংবিৎ ফিরেছিল বোমের।
ও দেখেছিল, রুচির হাতটা ওর পাজামার ওপর হাতড়াচ্ছে আর রুচি বলছে, “কই গো? তোমারটা কই? এ মা এ যে বিড়ির সাইজ হয়ে আছে।”
সেই রাতের পর থেকে রুচির সঙ্গে শুতেই ভয় লাগত বোমের। প্রতিটা রাত বোম কত অপদার্থ তা হাতে-মুখে পরীক্ষা করে প্রমাণ করে দিত রুচি।
বিয়ের সময় বোম ভাড়ার অটো চালাত, আর ওর বাবার একটা ছোট ধোপার দোকান ছিল। আশেপাশের মধ্যবিত্ত পাড়ার থেকে ওর মা আর সোনাই জামাকাপড় নিয়ে এসে কেচে, ইস্তিরি করে আবার বাড়িতে বাড়িতে দিয়ে আসত।
বিয়ের পর, সংসারের আয় বাড়াতে রুচি কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করল। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছিল না। টাকার অভাবে ভাল স্টক আনতে পারত না ও। তাও নিজের কথার জোরে টুকটাক বিক্রিবাটা করত রুচি। কিন্তু তারপরই বছর দু’য়েক আগে হঠাৎ কপাল খুলে যায় ওর।
একজন লটারির টিকিট বিক্রিওলা পাঁচ টাকা দিয়ে একটা পনেরো লাখ টাকার লটারির টিকিট গছিয়ে দিয়েছিল বোমকে। বোম কিনতে চায়নি। কিন্তু নাছোড়বান্দা সেই টিকিট বিক্রিওলা শেষ পর্যন্ত বোমকে বধ করে।
সে রাতে লটারির টিকিট দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিল রুচি। যা নয় তাই বলে চিৎকার করেছিল ও। বিয়ের পর থেকেই রুচির রূপ দেখে বোমের বাবা-মা একটু সমঝে চলত রুচিকে। তাই বোমের ওপর যখন রুচি চিকার করত, বাবা-মা তখন কান বন্ধ করে থাকত। সে-রাতেও বাবা-মা কান বন্ধ করেই ছিল। রুচির অকথ্য চিৎকারের বিরুদ্ধে বোম দু’-একবার দুর্বল প্রতিরোধ করেছিল, কিন্তু রুচিকে চুপ করাতে পারেনি। বরং পরিবর্তে ও নিজেই চুপ করে গিয়েছিল।
কিন্তু বোম অবাক হয়ে দেখেছিল যে, ওদের পাশের দোকান থেকে দু’দিন পর খবরকাগজ আনিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে টিকিটের নম্বর মেলাতে বসেছিল রুচি। লটারির পনেরো লাখ, অবিশ্বাস্য হলেও, জুটে গিয়েছিল ওদের। বোমের এখনও মনে আছে বাড়ির সবার সামনে রুচি উত্তেজনায় দৌড়ে এসে চুমু খেয়েছিল ওকে।
এর পর যা হবার তাই হয়েছে। রুচি সমস্ত টাকাটা নিজের নামে করে নিয়েছিল। আর সেই টাকায় ও বাড়িয়ে নিয়েছে নিজের ব্যাবসাটাকে। তবে বোমকেও অটো কিনে দিয়েছে, মোবাইল কিনে দিয়েছে আর বস্তি ছেড়ে একটা মোটামুটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছে। বোমের বাবা-মাও বুঝেছে পাল্লা কোন দিকে ঝুকেছে, ওরাও তাই রুচির দলে এখন। বোম জানে রুচিই সব। শুধু রুচির একটাই আক্ষেপ বাচ্চা হল না ওদের। রুচি তাই যৌনতা করতে গেলেই গালাগালি করে বোমকে। বলে, “কালুর সঙ্গে শুয়ে আরাম আর বাচ্চা, দুটোই নেব আমি।”
কালু ওদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। বোমের বাবা-মা ভাবত যে কালু বোমের চেয়ে ছোট হলেও বন্ধু তো, তাই গল্প করতে আসে ওদের বাড়িতে। কিন্তু রুচি ঠিক গন্ধ পেত। ও বলত, “ছেলেটা ভাল, তাগড়া, কিন্তু মনে হয় সোনাইয়ের দিকে ওর নজর রয়েছে।”
বোম মনে মনে বলত, বোধহয় নয়, রয়েছে। কারণ বোম দু’জনকে ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো অবস্থায় দেখে ফেলেছিল একদিন। কিন্তু সেটা ও রুচিকে জানায়নি। ও জানত রুচি এটা শুনলেই চুড়ান্ত অশান্তি করবে। কারণ, রুচি তখন নিজের মামাতো ভাই গোরাচাঁদের সঙ্গে সোনাইয়ের বিয়ের ছক করছে। অবশ্য শুধু এটাই নয় হয়তো আরও একটা কারণ রয়েছে।
সোনাইয়ের বিয়েটা ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। রুচি তার প্রস্তুতিও শুরু করেছে। বাবা-মা-ও যোগ্য সঙ্গত করছে তার সঙ্গে। কারণ বাবার ধোপার ব্যাবসাটা এখনও থাকলেও তা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়া মুশকিল। তাই বাবা জানে মেয়ের বিয়ে দিতে হলে রুচিই ভরসা।
আজ সকালেও বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রুচি তার শ্বশুর-শাশুড়িকে বিয়ের গয়না নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল আর বোম অবাক হয়ে দেখেছিল যে, বাবা-মা-ও প্রায় ফুল-বেলপাতা হাতে নিয়ে ঠাকুরের নাম গান শোনার মতো করে রুচির কথা শুনছে। মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছিল বোমের। ভাবছিল, নাও, যা খুশি চিন্তা করো, যেমন খুশি গয়নার ডিজাইন বানাও, সব আজ শেষ করে দেব। গোরাচাঁদকে চাঁদে পাঠাবার বন্দোবস্ত করব।
এই যে বোম রাজি হল সোনাইকে পালিয়ে বিয়ে করতে সাহায্য করায়, সেটা কি শুধু বোনের প্রতি ভালবাসার জন্য? না কি এর পেছনেও কারণ আছে? আচ্ছা, ও কি কোনওভাবে এর মধ্যে দিয়ে রুচিকে আঘাত করতে চায়? ও কি বোঝাতে চায় যে, রুচি যতই ভাবুক সব ওর কন্ট্রোলে, আসলে তা নয়? নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সোনাইয়ের বিয়ে দেবার ছকটা ভেঙে দিয়ে রুচিকে জীবনে অন্তত একবার পালটা মার দিতে চেয়েই কি ও রাজি হয়েছে সোনাইয়ের প্রস্তাবে?
“এই দেখেছ এক টাকা? তোমার এমন আছে?” প্রশ্নটা শুনে থতমত মুখ করে তাকাল বোম। দেখল নেড়ু পাগলা ওর সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। গায়ে ময়লা একটা চাদর, তাও তাতে প্রচুর ফুটো। শরীরেও খুব ময়লা লোকটার। খারাপ লাগল বোমের। মানুষের পরিণতি যে কী, কে বলতে পারে! ও বলল, “তুমি চা খেয়েছ? খাবে?”
নেড়ু মাথা নাড়ল, “কলকাতায় সব যন্ত্র হয়ে গেছে, তাই চা খেতে এখন ভাল লাগছে না।”
বোম হাসল।
নেড়ু আবার বলল, “আমায় একটা লাল-কালো জুতো কিনে দেবে? নরম বিড়ালের মতো জুতো?”
বোম বলল, “দেব একদিন।”
“একদিন নয়, গতকাল দিতে হবে, কেমন?”
বোম মাথা নাড়ল।
নেড়ু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আকাশে কী বড় গর্ত, না? যাই অনেক কাজ আছে। বাই বাই।”
নেড়ু যেতেই বোম দেখল কালু আসছে। ও জানে এতক্ষণ কালু ওর গাড়ির চাবি দিতে গিয়েছিল মালিকের বাড়ি। ভদ্রলোক কাছেই থাকেন। আজ আর কালু গাড়ি চালাবে না।
কালু আসার আগে বোম নিজেই এগিয়ে গেল ওর দিকে আর ঠিক তখনই পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল আবার। কে রে বাবা? পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল, রুচি। না, ফোনটা আর ধরল না বোম, কেটে দিল। তারপর কালুকে বলল, “যা বাড়ি থেকে রেডি হয়ে আয়। আমরা ঠিক পৌঁছে যাব।”
কালু বলল, “ঠিক সময়ে আসবে তো?”
বোম হাসল, “বলছি তো পৌঁছে যাব, এখন যা। ঝুটমুট টেনশন নিস না।”
কালুও হাসল এবার। কৃতজ্ঞ ভাবে দু’সেকেন্ড তাকিয়ে রইল বোমের দিকে তারপর হাঁটা দিল।
আবার বাজল ফোনটা। ওফ্। মাঝে মাঝে বোমের মনে হয় এটাকে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। ও ফোনটা বের করে কানে লাগিয়ে বাড়ির দিকে যাবে বলে পেছনে ঘুরল আর সঙ্গে সঙ্গে ধড়াম করে ধাক্কা খেল। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বোম। ভাগ্যিস ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়নি। ও দেখল ভীষণ সুন্দর একটা মেয়ে ঝুঁকে পড়ে তার মোবাইলটা তুলছে মাটি থেকে। ইস, ফোনটা ধরার খেয়ালে একদম লক্ষ করেনি বোম, ধাক্কা মেরে দিয়েছে।
মেয়েটা মাটি থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল বোমের দিকে, তারপর হিসহিসে গলায় বলল, “স্কাউন্ড্রেল, দেখতে পারো না?”
বোম থতমত খেয়ে বলল, “ভুল হয়ে গেছে।”
মেয়েটা হাতে ধরা মোবাইলটা দেখল একবার তারপর বলল, “ব্লাডি ইডিয়ট। জুতো দিয়ে পেটাতে হয় এইসব লোকগুলোকে।”
তারপর খটখট করে কালীঘাট মেট্রোর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
বোকার মতো তাকিয়ে রইল বোম। শুরুতেই বাধা পেল? কী জানি সব সুষ্ঠুভাবে হবে তো? বোম দেখল, মেট্রোর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার আগে সুন্দরী মেয়েটা আর একবার ওর দিকে তাকাল। চোখে এখনও আগুন জ্বলছে।
মেহের : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল এগারোটা দশ
মুখটা ঘুরিয়ে নিল মেহের। ননসেন্স। মোবাইল ফোন কানে লাগিয়ে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরছে। যেন মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে একা! আরে বাবা আশেপাশের লোকজন তো দেখবি! তা না, অন্ধের মতো কানে ফোন লাগিয়ে ঘুরছে! চেহারাটাও যেমন শ্যাবি, আচার-আচরণও তেমন। এসব লোকের হাতে মোবাইল ফোন কে দেয়? ঠিক যেন বাঁদরের হাতে বন্দুক।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাতের মোবাইলটা দেখল মেহের। স্ক্রিনটা একদম ব্ল্যাঙ্ক হয়ে আছে। কোনও ডিসপ্লে নেই। মোবাইলের মাথার অন-অফ সুইচটা কয়েক বার টিপল মেহের। নাঃ, এখনও কিছু হচ্ছে না। ওই উজবুকটা ধাক্কা মেরে মোবাইলটা ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। কী হল মোবাইলটার? মাসখানেক হল ক্যামেরা লাগানো এই মোবাইলটা কিনেছে ও। বহুদিন ধরে এর জন্য টাকা জমিয়েছে। খুব শখের জিনিস। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল ফোন নম্বর। এই মোবাইলটায় ওর সমস্ত দরকারি ফোন নম্বর সেভ করা রয়েছে। ফোনটা যদি বিগড়োয় তা হলে তো সব নম্বর লোপাট হয়ে যাবে।
মেহের দাঁতে দাঁত পিষল। মনে মনে রাস্তার ওই লোকটাকে গালাগালি দিল আবার। নেহাত ওর তাড়া আছে, না হলে আজ মোবাইলে কথা বলা জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিত লোকটার।
মেহের মোবাইলটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ঘড়ি দেখল একবার। এগারোটা চোদ্দোর মেট্রোটা পাবে কি? নানু তো বলেছে সাড়ে এগারোটা নাগাদ নন্দনের সামনে অপেক্ষা করবে। এই মেট্রোটা না পেলে পৌঁছোতে দেরি হয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল মেহের। যাঃ বাবা, এ কী রে! মেহের দেখল কাউন্টারগুলোর সামনে ইয়াব্বড় চারটে লাইন। মনে হচ্ছে, কলকাতার সমস্ত মানুষ বোধহয় এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এই লাইনে দাঁড়ালে তো এগারোটা চোদ্দো কী, তার পরের দুটো ট্রেনও মিস হয়ে যাবে ওর। নানুর সঙ্গে দেখাটাই হবে না। ঠোঁট কামড়াল মেহের। এখন কী করবে ও?
দীর্ঘ মালগাড়ির মতো লাইনটার দিকে আবার তাকাল মেহের। আজ এত ভিড় কেন মেট্রোয়? কাল অবশ্য পঁচিশে ডিসেম্বর। কলকাতার বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ এ-সময় কলকাতায় ঘুরতে আসে। আর মেট্রো রেল এখনও কলকাতার একটা দর্শনীয় বস্তু। কিন্তু সেই দর্শনের ঠেলায় তো কাজের মানুষদের প্রাণ যায়।
মেহের দেখল লাইনের সামনের দিকে দাঁড়ানো একটা ছেলে বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। এটা অবশ্য মেহেরের কাছে নতুন কিছু নয়। ও জানে যে, ও সুন্দরী। ছোট থেকেই নানা মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টি ওর গা-সওয়া হয়ে গেছে। অবশ্য শুধু মুগ্ধ দৃষ্টি নয়, কেউ কেউ তো ওর সৌন্দর্য ধরে দেখার ব্যাপারেও উৎসাহ দেখিয়েছে। অবশ্য সমস্ত মেয়ের মতো এ ব্যাপারে আত্মরক্ষার কৌশলটা মেহেরেরও জানা আছে। জানতেই হয়েছে, কারণ ছোট থেকেই ছেলেদের ব্যাপারে ওর অভিজ্ঞতা খারাপ।
ওর যখন বছর বারো বয়স তখন ওরা চেতলার কাছে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত। সুন্দর, ছিমছাম বাড়ি ছিল সেটা। কম্পাউন্ডের ভেতরে বেশ অনেকখানি জায়গা ছিল। সেখানে ওদের বাড়িওলার মেয়ে ইরাদির সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলত মেহের। ইরাদির বাবা সিমেন্টের চাতালে স্থায়ী ব্যাডমিন্টন কোর্ট কেটে দিয়েছিল ওদের জন্য। শীত-গ্রীষ্ম নিয়ে ওদের বাছবিচার ছিল না। সুযোগ পেলেই র্যাকেট আর শাটল কক্ নিয়ে নেমে পড়ত ওরা।
এভাবে ভালই চলছিল দিন, কিন্তু তারপরই মেহেরের জীবন টলে গেল একটু। ইরাদিদের বাড়িতে থাকতে এল ইরাদির জ্যাঠতুতো দাদা মোহন।
মোহনের দৃষ্টিটা প্রথম থেকেই অন্য রকম মনে হত মেহেরের। মনে হত সেই দৃষ্টি, মুগ্ধতা ছাড়াও আরও অন্য কিছু সংকেতও বহন করে আনছে। সে-সময় ওসব বেশ ভালই লাগত মেহেরের। স্কুলের বান্ধবীদের মাধ্যমে ততদিনে অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছিল ওর। পুরুষের দৃষ্টির বিভিন্ন রকম মানে তখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছিল ওর সামনে। মোহনের মুগ্ধ দৃষ্টি নিজের কাছেই ওর গুরুত্ব বাড়াত।
মোহন তখন সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। কিন্তু মেহের দেখত প্রায়ই বিকেলের আগে বাড়িতে ফিরে আসত ছেলেটা। কী ক্লাস করে ও? স্যারদের কাছে টিউশন নেয় না? ভাবত মেহের। ও দেখত যে, ইরাদি আর ওর ব্যাডমিন্টন খেলার সময় একটু দূরে ছোট সিমেন্টের বাঁধানো জায়গায় বসে ওদের খেলা দেখছে মোহন। বা আরও স্পষ্ট করে বললে, ওকে দেখছে মোহন। ভাললাগায় শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠত মেহেরের।
কিন্তু পৃথিবীর আদি নিয়ম অনুযায়ী দৃষ্টি একসময় দৃশ্য ছাড়াও আরও বেশি কিছু চায়। এক ছুটির দিনের দুপুরে ওই বড় বাড়ির পেছনের সরু গলিটায় মোহনের মুখোমুখি হয়েছিল মেহের। মোহন একটা লজেন্স বের করে এগিয়ে দিয়েছিল ওর দিকে। মেহের হাত বাড়িয়ে তা নিতে গেলে মোহন দেয়নি। বলেছিল, “হাঁ করো।” কিছু না বুঝে হাঁ করেছিল মেহের। মোহন হাত বাড়িয়ে লজেন্সটা ঠেকিয়েছিল মেহেরের ঠোঁটে তারপর আলতো করে ওর আঙুল মেহেরের ঠোঁট থেকে মুখে বুলিয়েছিল খানিকক্ষণ।
শরীরে কী যে হচ্ছিল মেহেরের তা নিজেই ঠিক বুঝতে পারছিল না। সেই নিস্তব্ধ দুপুর, নির্জন গলি, ঠোঁটে ঘুরতে থাকা আঙুল, তলপেটে যেন একটা ছোট্ট মাছ ঢুকে গিয়েছিল ওর। ওর কান গরম হয়ে উঠেছিল, চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে আসছিল। অস্ফুটে ও বলেছিল, “এমন কোরো না। মোহনদা।” মোহন আর কিছু করেনি। কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে লজেন্সটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওর মুখে।
এই কথাটা কাউকে বলেনি মেহের। ও বুঝেছিল এটা এমন ব্যাপার যে, কাউকে কিছু বলা যাবে না। তবে ভেতরে ভেতরে অনেক কিছুই পালটে গিয়েছিল মেহেরের। ও বুঝেছিল একটা ছোট্ট লজেন্স খাওয়ানো জীবনের অজানা কিছু দরজা খুলে দিতে পারে।
এর পর থেকে প্রায়ই, নানান অছিলায়, মোহন ছুঁতে চাইত মেহেরকে। শাটল কক্ বোগেনভেলিয়ার ঝোপে আটকে গেলে মোহন নিজে না পেড়ে দিয়ে, কোমর ধরে তুলে ধরত ওকে। ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট নেওয়ার নাম করে চেপে ধরত ওর হাত। কথা বলার সময়, মশা তাড়াবার অছিলায় ছুঁয়ে দিত ওর থাই। আর প্রতিবার ছোট্ট একটা মাছ খলবল করত মেহেরের তলপেটে।
এমন করতে করতেই একদিন সর্বনাশ ঘটল। সেদিন ইরাদির বাবা-মা কেউ বাড়িতে ছিল না। শীতের দুপুর বলে ইরাদিও ঘুমিয়ে পড়েছিল লেপের ওমে। নীচে, নিজের ঘরে বসে অঙ্ক করছিল মেহের। এমন সময় জানলার কাছে একটা গলা পেয়েছিল ও। গলাটা ওর চেনা। মেহের জানলার পরদা সরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী মোহনদা, ডাকছ কেন?”
মোহন চাপা, সতর্ক গলায় বলেছিল, “ওপরে আয় তো একবার, ইরা ডাকছে।”
“ইরাদি? এখন? আমায় যে বলল দুপুরে ঘুমোবে!”
“ঘুমোয়নি। আয় তাড়াতাড়ি, তোকে ডাকছে।” মোহন সরে গিয়েছিল জানলার থেকে।
ঘরের বাইরে এসে মেহের দেখেছিল মোহন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখেই বলেছিল, “চল তাড়াতাড়ি। ও তিনতলায় আছে।”
“তিনতলায়?” আশ্চর্য হয়েছিল মেহের। তিনতলায় তো মোহন থাকে। সেখানে ইরাদি কী করছে?
“হ্যাঁ, আমার ঘরে। চল।”
নিস্তব্ধ দোতলা পার করে তিনতলায় উঠে গিয়েছিল মেহের। ওর পেছনেই ছিল মোহন। ওই ঘরটায় বিশেষ যেত না মেহের। দরকার পড়ত না আর কী।
ঘরে ঢুকে একটু অবাকই হয়েছিল মেহের। ইরাদি কই? ঘরে তো কেউ নেই! শুধু টেবিলের ওপর স্তূপ করা কিছু বই আর খাটের পাশে হেলান দিয়ে রাখা একটা গিটার। মেহের জিজ্ঞেস করেছিল, “ইরাদি কই?”
মোহন কিছু না বলে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে।
“ইরাদি কই?” মেহের জিজ্ঞেস করেছিল আবার।
‘তুমি’ ডাকের সঙ্গে মোহন খুব আস্তে বলেছিল, “মেহের, আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছি। আই লাভ ইউ। তোমায় না পেলে আমি বাঁচব না।”
মোহনের চোখের দৃষ্টি পাগলাটে হচ্ছিল ক্রমশ। ভয় পেয়ে মেহের বলেছিল, “কী বলছ মোহনদা?” মোহন আর কিছু না বলেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরেছিল মেহেরের ঠোঁটে। কিছুক্ষণের জন্য সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল মেহেরের। ও বুঝতে পারছিল মোহন একটু আগে সিগারেট খেয়েছে। তামাকের তেতো গন্ধ শ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকছিল ওর। মোহন যেন ওর ঠোঁট দুটি ছিঁড়ে আনতে চাইছিল মুখের থেকে। নিজের জিভটা ঠেলে ঢোকাতে চাইল ওর মুখে।
হিন্দি ছবিতে চুম্বন দৃশ্য দেখে ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে আলোচনা করতে যে-মজাটা লাগত, বাস্তবে চুম্বনের সময় সেই মজাটা পাচ্ছিল না মেহের। বরং ভয় লাগছিল, গা ঘিনঘিন করছিল। ও বুঝতে পারছিল মোহন ওকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে বিছানার দিকে। নবলব্ধ জ্ঞান ভেতরে ভেতরে সাবধান করছিল মেহেরকে। ওকে বলছিল এখান থেকে যে-করেই হোক ওকে চলে যেতে হবে, না হলে সমূহ বিপদ। তাই শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলা মেরে ও সরিয়ে দিয়েছিল মোহনের শরীরটাকে। মোহন হাঁপাচ্ছিল তখন। পাগলাটে চোখের দৃষ্টি নিয়ে এক হাতে চেপে ধরেছিল মেহেরের হাত। তারপর নিজের পাজামার দড়ি একটানে খুলে বের করে এনেছিল নিজের উদ্ধত পৌরুষ। কাঁপা গলায় বলেছিল, “এটা একবার ধরো।” আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল মেহের। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে আত্মরক্ষার জন্য গিটারটা আনতে হাত বাড়িয়েছিল ও। কিন্তু হাতের ধাক্কায় বিকট শব্দ করে গিটারটা আছড়ে পড়েছিল মাটিতে। মোহন তখনও বলে চলেছিল, “একবার ধরো, ধরে দেখো, মেহের আমি পারছি না আর। তোমার ঠোঁট দুটো, থুতনিটা, তোমার ওই থাই… আমি… আমায়…”
আর অপেক্ষা করেনি মেহের। হাঁটু মুড়ে সটান গুঁতো দিয়েছিল মোহনের তলপেটে। মুখ দিয়ে একটা ভোঁতা শব্দ করে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল মোহন। সেই সুযোগে দরজার দিকে দৌড়েছিল মেহের। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে গোড়ালির কাছে জড়ো হওয়া পাজামা নিয়ে ওর পেছনে তাড়া করেছিল মোহন। ভেজিয়ে রাখা দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই ধাক্কা খেয়েছিল মেহের। বিভ্রান্ত চোখে ও দেখেছিল ওর সামনে ইরাদি দাঁড়িয়ে। মেহের দেখেছিল ইরাদি বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে নগ্ন মোহনের দিকে।
নীচে নিয়ে গিয়ে ইরাদি কাঁদতে থাকা মেহেরকে অনেক করে বুঝিয়েছিল যে, ও যাতে এই নিয়ে কাউকে কিছু না বলে। ইরাদি বলেছিল মোহনের ব্যবস্থা ও করবে, কিন্তু এই বিচ্ছিরি ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে মারাত্মক কেলেঙ্কারি হবে। ইরাদির বোঝানোয় মেহের আর কিছু বলেনি। যদিও ভয় হয়েছিল খুব, কষ্টও হয়েছিল, তবু অবস্থার গুরুত্ব বুঝে আর ইরাদির ওপর নির্ভর করে ও কাউকে কিচ্ছু বলেনি। তবে স্বস্তির ঘটনা এই যে, ও দেখেছিল এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই মোহন চলে গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। ইরাদি কী করেছিল, কী বলেছিল, সেসব কিচ্ছু জানতে চায়নি ও। শুধু মোহন চলে যাবার পর রাতগুলোয় ও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারত। তবে সেই ঘটনার পর থেকে মেহের বুঝেছিল যে, ছেলেদের আই লাভ ইউ-এর উৎস তাদের তলপেট।
সেই ঘটনার পর ওখানে আরও বছর দু’য়েক ছিল ওরা। চেতলার বাড়িটা ছেড়ে দেবার পর ইরাদিদের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই ওদের। সেসব ঘটনার এখন প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে। কে জানে ইরাদির বিয়ে হয়ে গেছে কি না!
মেহের দেখল ছেলেটা প্রায় কাউন্টারের কাছে চলে গেছে। আর মিনিট দু’য়েক আছে ট্রেনের। আর দেরি না করে ও কর্তব্য স্থির করে নিল মুহূর্তের মধ্যে। মেহের হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে। বলল, “আই অ্যাম ইন আ জ্যাম। ক্যান ইউ হেলপ মি আউট?” ছেলেটা থতমত খেয়ে গেল। এটা এক্সপেক্ট করেনি বোঝাই যাচ্ছে। ছেলেটা তুলে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব-বলুন না।”
“একটা রবীন্দ্রসদনের টিকিট কেটে দেবেন? এই ট্রেনটা ধরা ভীষণ জরুরি।” ছেলেটা পেছনের দিকে তাকাল। লম্বা লাইনের থেকে অনেকেই ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। একজন তো বলল, “এ কী হচ্ছে? লাইনে দাঁড়ান।”
মেহের পাত্তা না দিয়ে ছেলেটাকে বলল, “প্লিজ, খুব হেলপ হয়।” ছেলেটা এবার কাউন্টারের সামনে চলে এসেছে। ছেলেটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহের জোর করে চার টাকা গুঁজে দিল ছেলেটার হাতে। লাইনের থেকে হল্লা উঠল আবার। কিন্তু ছেলেটা সেসব শুনল না। ও টিকিটটা কেটে দিল মেহেরকে।
মেহের টিকিট নিয়ে গেটের দিকে দৌড়োতে দৌড়োতে শুনল পেছন থেকে আওয়াজ আসছে নানা রকম। মেহের জানে এটা যতটা না ওকে লক্ষ্য করে, তার চেয়ে বেশি ওই ছেলেটাকে লক্ষ্য করে। ওই যারা আওয়াজ তুলেছে, মেহের বুঝল, তাদের তলপেটের মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
প্ল্যাটফর্মে পা দেওয়ামাত্র একরাশ হাওয়া উড়িয়ে ট্রেনটা ঢুকল। কালীঘাট স্টেশনে মেট্রোর সামনের দিকে উঠলে রবীন্দ্র সদনে নেমে নন্দনে যেতে সুবিধে হয়। ট্রেনে বেশ ভিড়। তাও কোনওমতে লেডিজ সিটের সামনে হাতল ধরে দাঁড়াল মেহের। দিনকে দিন মেট্রোয় ভিড় বাড়ছে। এবার ট্রেনে বগির সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাও, ভিড় হলেও, মেট্রো হল স্বর্গ। কলকাতায় স্বর্গ, মাটির তলায়।
নানুর সঙ্গে দেখা করে ওর এক্সাইড মোড়ের বড় রেস্টুরেন্টটায় যাওয়ার কথা। ওখানে অ্যাডগ্ল্যামের শতানিক বাসু আসবে। ওর সঙ্গে দেখা করার কথা আছে মেহেরের। ওরা একটা সফট ড্রিঙ্কসের বিজ্ঞাপন করছে। শতানিক বলেছে, মেহেরকে ওর এই অ্যাসাইনমেন্টে মডেল হিসেবে প্রজেক্ট করার ইচ্ছে। যদিও বলিউডের একজন নামকরা অ্যাকট্রেস থাকবে, তবু শতানিক বলেছে যে, মেহেরকে এই অ্যাডটায় ও বিশেষভাবে প্রেজেন্ট করবে ভাবছে। অ্যাডের গোটা শুটিংটাই নাকি ক্যারাবিয়ান আইল্যান্ডসে হবে।
বাড়ির থেকে ওর মডেলিং বা অ্যাক্টিংয়ের ব্যাপারে বরাবর বাধা দেওয়া হয়েছে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল মেহের এম বি এ করে চাকরি করুক। মা-ও তাই চায়। কিন্তু মেহের মনে করে ওকে যেমন দেখতে বা ওর যা ফিগার, তাতে সামান্য চাকরি করার জন্য জন্মায়নি ও। কিন্তু এটা তো বাবা-মা বোঝে না। ওদের সেই টিপিক্যাল মধ্যবিত্তপনা। এটা ঠিক যে, এ-লাইনটা অনেকটা জুয়ার মতো। লাগলে ছক্কা না হলে অক্কা। কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে মানুষের গোটা একজিসটেন্স তো তাই— আ বিগ গ্যাম্বেল।
তবে একটা ব্যাপার, গত সাত-আট মাস চেষ্টা করে এখনও কিন্তু কোনও ওপেনিং করতে পারেনি মেহের। তবে অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। কেউ আউট রাইট না বলে দিয়েছে। কেউ কাজ দেবে বলে ঘুরিয়েছে আবার কেউ আকার-ইঙ্গিতে শোওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে যেটা ঘটনা, সেটা হল, এখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি। বাবা মাঝে মাঝেই বলে যে, এবার যেন বাবার কথা শোনে মেহের। যেন প্রস্তুতি নিয়ে ‘ক্যাট’ বা ‘ম্যাট’ দেয়। বাবার মতে পড়াশুনো করে যা পাওয়া যায়, তা সারা জীবনের জন্য। এইসব অ্যাক্টিং মডেলিং হল ক্ষণস্থায়ী, হাউইয়ের মতো। কিন্তু মেহের ভাবে, হাউই হলেও, তা উজ্জ্বল। একটা মানুষের জীবনে উজ্জ্বল মুহূর্ত ক’টা থাকে? কীসের জন্য বাঁচে মানুষ? হাউই হলেও অন্ধকার আকাশে ও যে একবার উজ্জ্বলতা ছড়াতে পেরেছিল সেটাও তো কম অ্যাচিভমেন্ট নয়।
রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে ঘড়ি দেখল মেহের। এগারোটা বাইশ। ও হাঁপ ছাড়ল, নাঃ, এবার আর চিন্তা নেই, ঠিক পৌঁছে যাবে। ওর মনে আছে, নানু বলেছিল যে ও সময়ের ব্যাপারে খুব পাকা। মেহের দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল।
নানুর সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছে সপ্তাহ দু’য়েক হল। ও একজন প্রোডিউসারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সেখানে নানুও এসেছিল। এই প্রযোজকটি একদম সাফ না বলে দিয়েছিল মেহেরকে। লোকটার রাফ ব্যবহারের ফলে মেহেরের মাথাটা বেশ গরম ছিল। ও যখন বেরোচ্ছিল অফিস থেকে তখন নানুই ওকে ডাকে। প্রথমে পাত্তা না দিলেও নানু বলে যে, ও নাকি মেহেরকে একটা সিরিয়ালে চান্স করিয়ে দিতে পারে, মানে মেহের যদি আগ্রহী হয় আর কী। মেহের আগ্রহী ছিল। ও ভেবেছিল যে, অন্তত একটা সূচনা তো হবে। ও নানুর ফোন নম্বর টুকে এনেছিল। নানু বলেছিল যোগাযোগ রাখতে।
তা যোগাযোগ রেখেওছে মেহের। যদিও ওর মন বলছিল যে, একটা উটকো লোকের ওপর এভাবে ভরসা করা ঠিক হচ্ছে না, তবু মেহের ভেবেছিল কিছু হলেও তো হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার, মেহের একটা জিনিস মাথায় রেখেছিল, এই লোকটার সঙ্গে কোনও আইসোলেটেড জায়গায় ও দেখা করবে না। কারণ বদলোকের তো অভাব নেই। কিন্তু নানু যখন নন্দনে দেখা করতে বলেছিল, তখন হাঁফ ছেড়েছিল মেহের। নানু বলেছিল, “সাড়ে দশটা মানে কিন্তু সাড়ে দশটাই, আয়াম ভেরি পাঙ্কচুআল।”
ঠিক এগারোটা বত্রিশে নন্দনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মেহের, দেখল একটা কালো গগলস চোখে অন্য দিকে তাকিয়ে জলের ধারে লাগানো রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নানু। ও আলতো করে ডাকল, “নানুবাবু, আমি এসেছি।”
“নানুবাবু?” মেহেরের ডাকে নানু ভুরু কুঁচকে তাকাল, “কল মি ওনলি নানু। নানুবাবু বললে নানুবাবুর বাজার মনে হয়।”
মেহের বলল, “ও কে। তা, এনি নিউজ?”
নানু শ্রাগ করল, “দেয়ার ইজ অলওয়েজ সাম নিউজ। বাট, আই থিঙ্ক ইট ইজ নট দ্যাট গুড।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহের। এখানেও হল না! তা সেটা ফোনেও তো জানাতে পারত লোকটা। ফালতু এখানে এল! ও বলল, “আপনি ফোনেও তো বলতে পারতেন, আমি আসতাম না। শুধু শুধু…”
মেহেরকে শেষ করতে দিল না নানু। চোখের গগলস খুলে সোয়েটারের গলার কাছে গুঁজে বলল, “কীভাবে বলব? তখনও তো জানতাম কাজটা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে সব গুবলেট হয়ে গেল। পুরো প্রজেক্টটাই ডাম্পড হয়ে গেল। তবে এখনও চান্স আছে। মানে তুমি যদি চাও।”
‘তুমি যদি চাও’— মানে? ভুরু কুঁচকে গেল মেহেরের। কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে লোকটা? ও সামান্য কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী বলতে চাইছেন আপনি?”
নানু হাসল, “তুমি মডেলিংয়ে ইনটারেস্টেড?”
এক মুহূর্ত সময় নিল না মেহের। ও বলল, “নিশ্চয়ই।”
নানু হাসল, “আমার বন্ধু ফ্যাশন ফোটোগ্রাফার। আমি বললেই তোমার হয়ে যাবে। হানড্রেড পারসেন্ট।”
মেহের বলল, “তা হলে?”
“কী তা হলে? হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি। জাস্ট কল মি অন থার্টিয়েথ। তিরিশে ডিসেম্বর তুমি আমায় ফোন কোরো, তোমায় আমি ঠিক একটা সুখবর দেব। পাক্কা।”
মেহের হাসল। লোকটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে যে, সত্যি কথাই বলছে। দেখা যাক আদৌ কিছু করতে পারে কি না!
ও বলল, “ঠিক আছে তিরিশ তারিখ না হয় ফোন করব আবার।”
নানু এবার এগিয়ে এল কাছে। চুলের মধ্যে আঙুল চালাল একবার। তারপর বলল, “হ্যাভ ফেথ। আর্চি আমার দারুণ বন্ধু। আমি ওকে যা বলি ও তাই করে। আমি যদি জানতাম যে, তুমি মডেলিংয়েও ইন্টারেস্টেড তা হলে প্রথমেই তোমাকে বলতাম।”
মেহের ঘড়ি দেখল, বারোটা পঞ্চাশ। এখান থেকে এক্সাইড মোড়ের ওই রেস্টুরেন্টে যেতে মিনিট পাঁচেক লাগবে ওর। অর্থাৎ আর সময় নেই। এখন যেতে হবে। ও বলল, “তা হলে তিরিশ তারিখ আপনাকে ফোন করছি। বাই দ্য ওয়ে আপনার ফোন নম্বরটা আর একবার দেবেন?”
“ফোন নম্বর? তোমার কাছে আছে তো, নেই?”
মেহের বলল, “আর বলবেন না, হারিয়ে ফেলেছি। মানে মোবাইলে সেভ করা ছিল। মোবাইলটা গন্ডগোল করছে, মানে বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। আবার পেতে পারি নম্বরটা?”
“অফকোর্স।” নানু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে খসখস করে লিখে দিল নম্বরটা। তারপর বলল, “এই নাও। মনে থাকে যেন, তিরিশ তারিখ। কেমন? কনসিডার ইয়োর জব ডান।”
মেহের হাসল, বলল, “আজ আসি তা হলে?”
নানুর মুখটা একটু ম্রিয়মাণ দেখাল যেন। ও বলল, “চলে যাবে? যা ওয়েদার, একটু কফি খেলে হত না?”
“সাম আদার ডে, আজ যাই, অনেক কাজ আছে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।” নানুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা দিল মেহের।
শীতের রোদ আজ বড় দুর্বল। তার ওপর হাওয়া দিচ্ছে। মেহের একবার আকাশের দিকে তাকাল। না, আকাশ দেখা যাচ্ছে না। ওর মাথার ওপর এখন ফ্লাইওভার। সারা কলকাতার শরীরে ক্রমশ ব্যান্ডেজের মতো জড়িয়ে যাচ্ছে ফ্লাইওভারগুলো। কে জানে এতে শহরের শুশ্রূষা হচ্ছে কি না! ঢাকছে কি না শহরের ক্ষতগুলো! মেহের জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চাটল একবার। ইস, চড়চড় করছে। টানছে খুব। মেহের ব্যাগের থেকে একটা ছোট্ট ক্রিমের টিউব বের করে ঠোঁটে ঘষে নিল। এটা ওকে সবসময় রাখতে হয় সঙ্গে। ওর ঠোঁট খূব টানে। ও আবার ফোনটা বের করল। আবার একবার ফোনের মাথার অন-অফ সুইচটা টিপল ও। নাঃ, সেই শূন্য স্ক্রিন। আবার সেই লোকটার প্রতি রাগটা ফিরে এল। অন্ধ সব। গোটা শহরটা অন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কারও দিকে তাকায় না, কেউ কারও কথা চিন্তা করে না। সবার মধ্যে বিছানায় উঠে মশারি গুঁজে ভাল থাকবার মতো মিডল ক্লাসনেস।
সামনের রাস্তা পার হওয়ার সিগনালটা বন্ধ। ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়াল মেহের। হাওয়ার বেগটা বাড়ল বোধহয় একটু। ঠান্ডা লাগছে ওর। জ্যাকেটের চেনটাকে আরও খানিকটা টেনে নিল। এখানের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে হবে। মা তো আজ বেরোতেই না করেছিল ওকে। কিন্তু কী করবে? কাজ আছে যে। অবশ্য মা কেন ওকে বেরোতে বারণ করেছিল সেটা ও জানে। আজ কলকাতায় মহামিছিল আছে। বিকেল তিনটে না ক’টায় জানি। তার আগে তাই বাড়ি ঢুকতে হবে ওকে। কী বিরক্তি। তোরা সারাবছর ধরে এইসব মিটিং মিছিল কর। কাউকে কাজকম্ম করতে হবে না।
সিগনালটা সবুজ হল এবার। যাক বাবা, সিগনালগুলো রং পালটাতে এত দেরি করে যে, আর পারা যায় না। রাস্তাটা পার হল মেহের। সামনেই বড় রেস্টুরেন্ট। এখানেই ওর সঙ্গে দেখা করবে বলেছিল শতানিক বাসু। লোকটার সঙ্গে কথা বলে ভাল লেগেছে ওর। শতানিক বলেছে ও নতুন হলেও ওকে বলিউডের নামকরা নায়িকার সমান ইম্পর্টেন্স দেবে। সেটা যদি সত্যি হয় তা হলে তো দারুণ ব্যাপার হবে।
রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকাল মেহের। মনে মনে বলল, হে ভগবান এইবার একটু দেখো আমায়। কাজটা যেন হয়।
“এক্সকিউজ মি” গলাটা শুনে পাশে তাকাল মেহের। একটা ফরসা, বেঁটে ছেলে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে, পিঠে একটা গোল লম্বা কেস। ছেলেটার মুখচোখ লাল। কপালে সামান্য ঘাম। বিড়ালের মতো চোখ দুটো যেন হাঁপাচ্ছে। এ কে? অসুস্থ নাকি? সাহায্য চায়? আজকাল এই টাইপের ভদ্রবেশী ভিখিরি ভীষণ বেড়ে গেছে শহরটায়। সবাই সফিসটিকেটেড ওয়েতে ভিক্ষে চায়। মেহের এসব পছন্দ করে না একদম। তার ওপর একটা দরকারি কাজে যাচ্ছে ও। খুব বিরক্ত হল মেহের। কে জানে শতানিক বাসু কী ভেবে রেখেছে ওর জন্য? বাবার মুখের ওপর জবাব দেবার মতো কিছু করতেই হবে ওকে। এখন এসব ভিখিরি টাইপের লোকদের কথা শুনলে ওর হবে? মেহের হাত নাড়িয়ে বলল, “আগে যাও।” তারপর ওই দিকে আর না তাকিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে গেল রেস্টুরেন্টে।
সাইমন : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল এগারোটা আটান্ন
“আগে যাও”! মানে? মানে কী এর? আগে যেতে বলল কেন? ও কি ভিখিরি? না কি ট্রাফিক সিগনালের কাছে গাড়ির জানলায় ঝুঁকে-পড়া সেই মানুষ যে, মদ গেলার জন্য ‘গাড়ি ভাড়া হারিয়ে গেছে’ বলে মিথ্যে কথা বলে?
একটা অসহায় রাগ এসে ধাক্কা মারছে সাইমনের মাথায়। মাথা ভেঙে বেরোতে চাইছে রাগটা। ছড়িয়ে পড়তে চাইছে সমস্ত কলকাতায়। লন্ডভন্ড করে দিতে চাইছে গোটা শহরকে।
অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। সাইমন জানে যে, রাগটা দিনে তিন-চার বার এসে ধাক্কা মারে ওর মাথায়। হয়তো মাথার ভেতর কোনও দরজা খুঁজতে চায়। কিন্তু কোনও কিছুই সে খুঁজে পায় না। আর না পেয়ে, হতোদ্যম হয়ে রাগটা একসময় নিজের গর্তের ভিতর ঢুকে পড়ে।
সাইমন কাচের দরজা ঠেলে রেস্টুরেন্টে ঢুকে যাওয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝল যে, ওর রাগের দম ফুরিয়ে এসেছে। এবার তার গর্তে ফেরার পালা। তবু, মেয়েটা অমন করে বলল কেন ওকে? আচ্ছা, দিনকে দিন কি ওকে ভিখিরির মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে? আজকাল মাঝে মাঝে আয়নায় নিজেকে দেখে ও। ফরসা চেহারায় কেমন যে রংচটা ভাব, চোখের নীচে ছায়া, গালও ভেঙে যাচ্ছে। ওর পরনের সোয়েটারটার গলার কাছটা ছিঁড়ে গেছে একটু। কিন্তু আজ তো দাড়ি কামিয়েছিল ও। বোন বলে, “দাড়ি কামালে তোকে কী বড়লোক বড়লোক লাগে রে দাদা!” সাইমন বোঝে কথাটা হাস্যকর, কিন্তু কেন জানে না, ওটা শুনতে খুব ভাল লাগে ওর। বড়লোক! শব্দটার মধ্যেই কেমন একটা সুন্দর গন্ধ আছে যেন। বিছানার সঙ্গে মিশে থাকা ওর বোন যখন বড়লোক শব্দটা বলে, সাইমন দেখে ওই রুগ্ণ শরীরের ভেতরেও কোথায় যেন আলো জ্বলে ওঠে। বোন চায় সাইমন অনেক টাকা রোজগার করুক। অনেক বড় হোক জীবনে। সাইমন জানে ও-ই হল ওর বোনের জানলা। মাসে একবার করে বাড়ি যায় সাইমন। তখন বোনের সঙ্গে বসে অনেক কথা বলে ও। গোটা মাসটা তো বোন একরকম একাই থাকে। জেঠুদের বাড়ির সবচেয়ে ছোট, অপরিষ্কার আর ড্যাম্প-ধরা ঘরে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে বোন। দুপুর আর রাতের অশ্রদ্ধার ভাত পায় একটু। বোন জানে দাদার বড়লোক হওয়া মানে ওরও হয়তো এই ছোট্ট মশারির মতো ঘর, এই নড়বড়ে চৌকির থেকে মুক্তি। সাইমন প্রতি মাসে গিয়ে ওর সাধ্যমতো টাকা দিয়ে আসে জেঠুকে। ও জানে এক মাস ফেল করলে ওরা বোনটাকে খেতে দেবে না। ওর তো আর বাবা-মা নেই যে, বোনটা সেখানে নিরাপদে থাকবে।
সাইমন মাঝে মাঝে ভাবে ওর কপালের কথা। আর্ট কলেজে থাকতে থাকতে ওর বাবা মারা গেল। মা তো সেই ছোট্ট থেকে নেই। না, মারা যায়নি মা। একজনের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। মা নাকি ভীষণ সুন্দরী ছিল। সুন্দর গায়ের রং, সবুজ চোখের মণি। যে-লোক দেখত সেই সম্মোহনে পড়ে যেত। লোকে বলে সাইমন নাকি ওর মায়ের মতো দেখতে।
‘মা’ প্রসঙ্গ এলেই ‘নাকি’ শব্দটা এসে যায় আপনা-আপনি। কারণ মায়ের মুখ স্পষ্ট মনে পড়ে না সাইমনের। বোন যখন চার মাসের তখন মা চলে গিয়েছিল। সাইমন তখন বছর তিনেকের। মায়ের কথা উঠলেই ওর চোখের সামনে আবছা মতো একটা মুখ ভেসে ওঠে। মনে হয় ঘষা কাচের উলটো পিঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনও মানুষ। কেমন আবছা, দূরবর্তী মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায় না। তাই ও আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন। নিজের মুখের মধ্যে খুঁজতে থাকে মাকে। মা, যাকে কিনা ওর মতো দেখতে!
মায়ের কথা এভাবে মনে আসাতে ও নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জনাকীর্ণ ফুটপাথে। মায়ের একটা ছবিও নেই ওর কাছে। মা চলে যাওয়ার পর বাবা সব ছবি ছিঁড়ে ফেলেছিল। একটা ছবিও রাখেনি আর। জেঠিমা বোনের ওপর রাগ হলে চিৎকার করে বলে, “বেশ্যা মাগির মেয়ে। নিজে কার না কার সঙ্গে নেচে বেড়াচ্ছে, আর আমাদের ঘাড়ে মাজা-ভাঙা মেয়েটাকে গছিয়ে দিয়েছে। এক পয়সার সুরাহা হয় না, উপরন্তু গুচ্ছের চাল ওড়াচ্ছে মাগি। শরীরের নীচের অংশটা ঠিক থাকলেও তো হত, খাটিয়ে খেতে পারতি। তোর মায়ের মতো দেখতেই হয়েছিস, কোমরটা অমন নাড়াতে শিখিসনি।”
মাঝে মাঝে বোনের মুখের দিকে তাকিয়েও মাকে খোঁজে সাইমন।
সাইমন বোঝে জেঠুদের ওই গুদাম ঘরে বোন কী কষ্ট করেই না থাকে। ইস, বোনটাকে যদি এই কলকাতায় নিয়ে আসা যেত! কিন্তু তাও তো সম্ভব নয়। ভবানীপুরের যে-চিলেকোঠায় ও থাকে, তা ওর জেঠুর বাড়ির গুদামের চেয়েও খারাপ। ঘরটার একটা নাম রেখেছে সাইমন। প্ল্যানেটোরিয়াম। চিলেকোঠার ছাদটা টালির। আর যার মধ্যে বেশ কয়েকটা ভাঙা। রাত্রে, খাটে শুয়ে ঘরের চালের দিকে তাকালে টালির ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায় স্পষ্ট। ধোঁয়ায় ঢাকা, অস্বচ্ছ কলকাতার আকাশ। ও দেখে আবছা কিছু তারা ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। যেন শ্মশান যাত্রার পথে ছড়িয়ে রাখা খই। সাইমন ভাবে কার মৃতদেহ গেছে ওই পথ দিয়ে? প্রতি রাত্রে কার মৃতদেহ যায়? ওর বাবার? না কি ওর নিজের? ও, সাইমন রুপেন মণ্ডল, কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। শিল্পী। শিল্পী না ভিখিরি?
মেয়েটা ওভাবে ওকে চলে যেতে বলল কেন? ও তো শুধু সময় জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল। অন্য কোনও উদ্দেশ্য তো ছিল না ওর! কলকাতা কি ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে? সবার কি এমনই তাড়া যে, অন্যকে দেবার মতো দু’সেকেন্ড সময়ও তাদের নেই? গালে একবার হাত বোলাল সাইমন। মসৃণভাবে কামানো গাল, নতুন ব্লেডের ধার যেন এখনও বোঝা যাচ্ছে গালে। এ গাল কি বড়লোকের গাল? হাসি পেল ওর। বুঝতে পারল রাগ আর মাথায় ধাক্কাচ্ছে না। সে তার গর্তের দিকে হাঁটা দিয়েছে।
সাইমন এবার রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে সরে এসে হাঁটতে লাগল। আজ সকাল থেকেই কনকনে হাওয়া দিচ্ছে একটা। সকালে যখন সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এ গিয়েছিল মিসেস দে-কে ছবি আঁকা শেখাতে, তখনই টের পেয়েছিল যে, পাগল হাওয়ার দিন আজ। লেকের থেকে ঠান্ডা জল-ভরা হাওয়া এসে ঝাপটা মারছিল খুব। একটা জিনিস লক্ষ করেছে সাইমন, প্রতি বছর ক্রিসমাসের দিন হঠাৎ বেশ ঠান্ডা পড়ে। ওদের গ্রামে কী অবস্থা কে জানে? বোনটা ঠান্ডায় কী করছে? বলেছিল একজোড়া গরম মোজা নিয়ে যেতে। এখনও নিয়ে যেতে পারল না। পারবে কী করে? এ মাসে এখনও তো টিউশনের টাকাই পায়নি ও। আজ একবার বলেছিল বটে মাইনেটা দিয়ে দিতে। বলেছিল, কাল ক্রিসমাস, কিছু কেনাকাটি আছে, টাকার দরকার। কিন্তু তবু দেয়নি। মিসেস দে বলেছিলেন, “না ভাই, মাস না শেষ হলে দেব কেমন করে?” তখন একবার রাগবাবাজি এসে মাথায় ‘নক’ করছিল। কিন্তু বেরোতে পারেনি। নিউ আলিপুরে যে-বাড়িতে দ্বিতীয় টিউশনটা করতে যায় সাইমন সেখানে অবশ্য আর মাইনের টাকা চায়নি। কেননা ও জানত এরাও দেবে না।
কিন্তু সময়টা জানা হল না যে। সাইমনের একটা ঘড়ি রয়েছে। ডিজিটাল। চাঁদনি থেকে চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছিল। ব্যাটারিটা সপ্তাহখানেক হল ফুরিয়েছে। এখনও ভরা হয়নি। সাইমন জানে যে, সময় দেখাটা ওর মুদ্রাদোষ। যখন হাতে ঘড়ি থাকে তখন ঘনঘন সময় দেখে ও। আর না থাকলে রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে।
সামনে থেকে একটা সুন্দর দেখতে মেয়েকে আসতে দেখল সাইমন। সামান্য চাপা গায়ের রং আর তাতেই যেন সৌন্দর্য ঝলসাচ্ছে আরও। মেয়েটার পাশে একটা লোক। রোগাটে চেহারা, মুখটায় একটু ভিতু ভাব। হাত দিয়ে মেয়েটার কনুই ধরে আছে লোকটা। মেয়েটার বাঁ হাতে একটা ঘড়ি বাঁধা। একে সময় জিজ্ঞেস করা যায়। তবে ভণিতা করবে না আর। সরাসরি জিজ্ঞেস করবে এবার।
সাইমন হাতের গোল ড্রইংহোল্ডারটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ক’টা বাজে?” লোকটা ভিতু মতো মুখটা তুলল, “অ্যাঁ?”
“ক’টা বাজে?” সাইমন আবার জিজ্ঞেস করল মেয়েটাকে লক্ষ্য করে।
মেয়েটা ঘড়ি দেখল, তারপর বলল, “বারোটা, বারোটা বাজে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।” সাইমন হাঁটা দিল। লোকটাকে পাশ কাটাতে গিয়ে শুনল লোকটা বলছে, “কী রে সোনাই, কালু তো এল না এখনও! কী হবে?”
সাইমন শুনল সুন্দরী সোনাই বলছে, “দাদা, চিন্তা করিস না, ঠিক আসবে।”
কে আসবে, না আসবে, সেসব শুনলে হবে না সাইমনের। ওকে তাড়াতাড়ি কালীঘাট ট্রামডিপোর কাছে গ্রিক চার্চের সামনে পৌঁছোতে হবে। ওর ফুটপাথের দোকান খুলতে দেরি হয়েছে যথেষ্ট।
ফুটপাথের দোকান বললেও এরও একটা নাম মনে মনে দিয়েছে সাইমন। ‘সানশাইন স্টুডিয়ো’। গ্রিক চার্চের কাছে রাস্তার পাশের একটা রেলিংয়ে নিজের আঁকা কিছু ছবি ঝুলিয়ে রাখে সাইমন। তার সামনে ছোট্ট একটা টুল আর বড় ক্লিপবোর্ড নিয়ে বসে থাকে। আগ্রহী মানুষদের পোর্ট্রের্ট এঁকে দেয় ও। তার জন্য নেয় সত্তর টাকা, আর কেউ যদি আরও তিরিশ টাকা দেয় তা হলে সেই সঙ্গে মানুষটির একটা কার্টুন এঁকে দেয়। অবশ্য এতে খুব যে লাভ কিছু হয়, তা নয়, কিন্তু কিছু তো একটা করবে ও। সারা সপ্তাহে দু’দিন করে দুটো টিউশনি করে সাইমন, আর খবর পেলে বিভিন্ন অ্যাডভার্টাইজিংয়ের ফার্মে যায় কাজের আশায়।
এই যেমন আজও গিয়েছিল। ক্যামাক স্ট্রিটে অ্যাডগ্ল্যাম বলে একটা অফিস আছে। অ্যাড ক্যাম্পেন তৈরি করে। বর্তমানে ওরা একটা সফট ড্রিঙ্কসের ক্যাম্পেনে কাজ করছে। ওদের কথা মতো তারই কিছু লে-আউট করে নিয়ে গিয়েছিল ও। কোম্পানির মালিক শতনিক বাসুর সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছিল ও। সব দেখে শুনে ভদ্রলোক পছন্দ করেছিলেন ওর লে-আউট। কিন্তু তারপরই একটা ফালতু প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
সামনে রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশন দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গ্রিক চার্চের সামনে যেতে হলে মেট্রো ধরে কালীঘাট স্টেশনে নামতে হবে ওকে। কিন্তু চার টাকা ভাড়া। টাকা বাঁচাবার জন্য ও ক্যামাক স্ট্রিটের সেই মাথা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এতটা পথ এসেছে। কিন্তু আর পারছে না। এই ভারী ড্রইংহোল্ডার আর হাতে ড্রইংবোর্ডটা ধরে এতটা হেঁটে এসে এবার বেশ ক্লান্ত লাগছে ওর। এখান থেকে কালীঘাট অবধি আর হাঁটতে পারবে না ও। বাসেও যেতে পারে, কিন্তু মেট্রোর গর্তটা ওকে টানছে খুব। খুব একটা মেট্রো রেলে চড়ে না সাইমন। দরকার হয় না। কিন্তু কখনও সখনও যখন চড়ে তখন খুব ভাল লাগে ওর। কেমন অদ্ভুত আলোর একটা সুড়ঙ্গ। পরিষ্কার, সুন্দর। এই সুড়ঙ্গে ঢুকলে কলকাতার মানুষগুলোও কেমন যেন বদলে যায়। সেই যেখানে-সেখানে পিক, থুতু, সিগারেট, গুটখার প্যাকেট ফেলা লোকগুলো হঠাৎ করে কেমন বদলে যায় যেন! সাইমনের মনে হয়, যারা শব্দ করে চায়ে চুমুক দেয় তারাও বোধহয় নিঃশব্দে চায়ের কাপ থেকে চা তুলবে মুখে।
এখান থেকে মেট্রোর মুখটা কেমন অন্ধকার লাগছে। ভেতরের টিউবটা জ্বলছে না। সাইমন মনে মনে বলল, ব্ল্যাক হোল। আর সেই কৃষ্ণগহ্বরের টানে ওর শরীর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই দিকে।
মেট্রোয় আজ বিশাল লাইন। দেখে একটু দমে গেল ও। টিকিট কাটতেই দেরি হয়ে যাবে। কখন আর গিয়ে ওর স্টুডিয়ো খুলবে ও? ধীর পায়ে একটা লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াল সাইমন। পকেটে আটত্রিশ টাকা আছে। তার থেকে দুটো দু’টাকার কয়েন হাতে নিল ও।
কালকে পঁচিশে ডিসেম্বর। ও ক্রিশ্চান হলেও এই দিনটা ওর কাছে নতুন কোনও অনুভূতি এনে দেয় না। বড় হওয়ায় দিনগুলোয় ও দেখত আকণ্ঠ বিষাদে ডুবে থাকা বাবা আর বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া বোন। প্রতিটা বড়দিন ওর কাছে আর একটা দিনের মতোই ছিল। স্যান্টাক্লজ নিয়ে কোনও ফ্যান্টাসি ছিল না ওর। ঘুমানোর আগে লাল মোজা ঝুলিয়ে রাখার কথাও মনে আসেনি কোনওদিন। তবে বোনটা খুব তাকিয়ে থাকত এই দিনটার দিকে। যখন ছোট ছিল তখন বোন ভাবত স্যান্টাক্লজ বলে রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে লোকটা এসে একদিন হাত ধরে ওকে নামিয়ে আনবে বিছানা থেকে। বোন ভাবত ও হাঁটতে পারবে, তারপর প্রজাপতির পেছনে দৌড়োতে পারবে, বাবার হাত ধরে কিনতে যাবে ক্রিসমাস ট্রি। কিন্তু স্যান্টাক্লজ আসেনি। বোনও দৌড়োতে পারেনি প্রজাপতির পেছনে। শুধু বিছানার সঙ্গে আরও, আরও মিশে গেছে ও। যেন কোনও অদৃশ্য শিকড় বোনের কোমর থেকে বেরিয়ে ওকে গেঁথে রেখেছে বিছানার সঙ্গে।
শুধু মাঝে মাঝে সাইমন একটা গান শুনত। আকণ্ঠ মদ খেয়ে জড়ানো গলায় বাবা মাঝে মাঝে গান গাইত একটা। ছোটবেলার থেকেই অদ্ভুত সুরের গানটা শুনত সাইমন, কিন্তু জড়ানো গলার জন্য কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারত না স্পষ্ট। খুব কৌতূহল হত সাইমনের। কিন্তু বিষন্ন বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ঠিক ভরসা পেত না ও। ভয় লাগত, কী জানি বাবা কী রকম রিঅ্যাক্ট করে!
তবে বড় হওয়ার পর একবার এক ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যায় গানটার শব্দগুলো স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল সাইমন।
সেদিন বোনের জ্বর ছিল খুব। বাবা, বোনের জন্য কিনে আনা ছোট্ট ফ্রকটা ওর মাথার কাছে রেখে, একটা চেয়ার টেনে বসেছিল পাশে। বোনের হুঁশ ছিল না কোনও। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, প্রায় লুকিয়ে, সাইমন শুনেছিল বোনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাবা গাইছে—
‘I saw Mommy kissing Santa Claus
Underneath the mistletoe last night.
She didn’t see me creep
down the stairs to have a peep;
She thought that I was tucked
up in my bedroom fast asleep.
Then, I saw Mommy tickle Santa Claus
Underneath his beard so snowy white;
Oh, what a laugh it would have been
If Daddy had only seen
Mommy kissing Santa Claus last night.’
একদিন জেঠিমার প্রচণ্ড গালাগালির মুখে সাইমন শুনেছিল, মা যে-মানুষটার সঙ্গে চলে গিয়েছে, তার নাকি দাড়ি ছিল মুখ-ভরতি।
টিকিট কেটে গেটের দিকে এগোল সাইমন। সেখানেও লম্বা লাইন। ছোট্ট সিকিউরিটি ব্রিজ পার হওয়ার সময় দেখল দু’জন পুলিশ ওর পিঠে ঝোলানো ড্রইংহোল্ডারটার দিকে সন্দেহজনক ভাবে তাকাচ্ছে। সাইমন ভাবল পুলিশ দুটো এটাকে রকেট লঞ্চার ভাবছে নাকি? ইচ্ছে হল ড্রইংহোল্ডারটাকে একবার পিঠ থেকে খুলে রকেট লঞ্চারের মতো তাগ করে ওদের দিকে। তা হলে দেখা যাবে ওদের ক্যাদ্দানি। সাইমন ভাবে কলকাতার মেট্রোয় যা অবস্থা তাতে যখন তখন বড়সড় কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে। ওই যে পুলিশ দুটো ওর দিকে সন্দেহজনকভাবে তাকাল, কই দেখতে তো চাইল না ওর এই লম্বাটে কেসটার মধ্যে সত্যিই কী আছে! এর মধ্যে যদি জিলেটিন স্টিক আর ডেটোনেটর থাকে? একবার পেছনের ভিড়ের দিকে তাকাল ও। ওই ভিড়ের মধ্যে কারও কাছে ওসব নেই তো?
স্টেশনে নেমে দাঁড়াল সাইমন। ঘড়িতে এখন বারোটা ষোলো। এক্ষুনি ট্রেন আছে একটা। গোল গোল থামগুলোর একটায় পিঠ রেখে দাঁড়াল সাইমন। ভালই ভিড় রয়েছে স্টেশনে। তবু তার মধ্যেও একটা দৃশ্য দেখে বেশ অস্বস্তি লাগল ওর। সামনের গোল থামটার কাছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই শীতেও মেয়েটা একটা সাদা হাতকাটা গেঞ্জি আর লো-ওয়েস্ট জিনস পরে আছে। গেঞ্জি আর প্যান্টের মধ্যে বেশ খানিকটা জায়গা উন্মুক্ত। ছেলেটা সেখানে হাত দিয়ে রেখেছে। মেয়েটাও ফিসফিস করে বলছে কিছু আর ছেলেটার গালে হাত বোলাচ্ছে আলতো করে। চারিদিকের মানুষজন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে। বিনে পয়সায় সিনেমা। সাইমন দেখল ওদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। হঠাৎ, ওর দেখা, বেশ কয়েক বছর আগেকার একটা কথা মনে পড়ে গেল। ওর প্ল্যানেটোরিয়ামের লাগোয়া একটা ছোট ছাদ রয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ও এরকমই একটা দৃশ্য দেখেছিল। একটা মেয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেয়েছিল একটা ছেলেকে। একটা ছাদের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে ছিল সাইমন, তবু যেন ওর মনে হয়েছিল সহসা চুম্বনে ছেলেটা বিব্রত। মেয়েটা সরে গেলে ছেলেটার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ও হয়েছিল সাইমনের। তখন সংবিৎ ফিরেছিল ওর। লজ্জা লেগেছিল। মনে হয়েছিল অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওভাবে দখল বসাতে নেই।
আজও মুখ ঘুরিয়ে নিল সাইমন। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। সময় হয়ে গেছে। ট্রেন আসছে কি? সাইমনের প্রশ্নের উত্তর হিসেবেই যেন প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে ঢুকল ট্রেন। ছেলেমেয়ে দু’জনও বিচ্ছিন্ন হয়ে ট্রেনের ব্যাপারে সচেতন হল। ড্যাবড্যাবে পাবলিক অসময়ে সিনেমার শো ভেঙে যাওয়ার দুঃখ নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ট্রেনের দিকে।
যতীন দাস পার্ক স্টেশনে দরজা খুলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ট্রেনটা। ফলে কালীঘাটে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় বারোটা পঁয়ত্রিশ বেজে গেল সাইমনের। বেশ খিদে পাচ্ছে ওর। সকালে বিশেষ কিছুই খাওয়া হয়নি। ওই নিউ আলিপুরের ওখানে যে-স্টুডেন্ট থাকে, তার বাড়িতে স্যান্ডউইচ আর চা দিয়েছিল, সে-সব কখন শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে! রোজ বেলা একটা নাগাদ ছাতু আর একটু আচার খায় সাইমন, আজ পেট একটু তাড়াতাড়িই হ্যাংলামো শুরু করেছে। ওই যে অতটা হেঁটেছে, সেইজন্যই বোধহয়।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে কালীঘাট ট্রাম ডিপোর দিকে হাঁটতে শুরু করল সাইমন। এখন চারিদিকে কেমন একটা ছানা-কাটা ভিড়। সাইমন জানে আজ বিশেষ কাস্টমার পাওয়া যাবে না এখন। তবে সন্ধের দিকে, চার্চে যখন মানুষ আসতে শুরু করবে, তখন কিছু মানুষ পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আজ বিকেলের পর থেকে রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন থাকবে তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। আজ তো বিশ্বশান্তির জন্য মহামিছিল আছে।
বিশ্বশান্তি একটা অদ্ভুত, হাস্যকর শব্দ। সভ্যতার একদম প্রথম অবস্থা থেকে আজ পর্যন্ত কোনওদিন শান্তি থেকেছে পৃথিবীতে? সবসময় তো যুদ্ধ, মারামারি লেগেই আছে। যা আছে, থাকবে। তার বিরুদ্ধে মিছিল করে কলকাতার গলা টিপে ধরার কী মানে কে জানে! যাই করো, মানুষের প্রবৃত্তিকে ঠেকাবে কী করে? আর এই যখন-তখন মিছিল করে সব কিছু থামিয়ে দেওয়াটাও তো অশান্তির মধ্যেই পড়ে।
ফুটপাথের পাশে লাল টালি বসানো একটা ছোট্ট মন্দিরের সামনে আজও পাগলাটাকে বসে থাকতে দেখল সাইমন। নেড়া মাথা, গায়ে ছিন্নভিন্ন একটা চাদর। লোকটা হাত জোড় করে বলছে, “ভগবান, মানুষের ভাল করো, আমার মাথার চুলকানি কমিয়ে দাও, আমায় একটা লাল-কালো জুতো দাও। ভগবান, যারা যারা সেয়ানাগিরি করছে সবার পেছনে দিয়ে দাও।”
সাইমন, দিনের মধ্যে এই প্রথম হাসল, ইউনিক প্রার্থনা। ও-ও যদি এমন করতে পারত!
নিজের জায়গায় গিয়ে কাঁধ থেকে ড্রইংহোল্ডারটা খুলে রেলিংয়ের ওপর ঝুলিয়ে দিল সাইমন। তারপর পাশের ঠেলার দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। এটা ন্যাপাদার ঠেলা। চা, বিস্কিট, পাউরুটি, ডিমভাজা, চাউমিন, চপ, নানা রকম জিনিসপত্তর বিক্রি করে ন্যাপাদা। ঠেলাটা নামে ঠেলা হলেও আকারে এমন বড় যে, তাকে সত্যিই ঠেলা দিয়ে সরানো মুশকিল। সাইমন রেলিংয়ে যে পাঁচ-ছ’টা ছবি ঝোলায়, তা, কাজ শেষ হলে প্লাস্টিকে ভাল করে মুড়ে এই ন্যাপাদার ঠেলাতেই রেখে যায়।
ন্যাপাদা সামনে দাঁড়ানো একজনের জন্য চাউমিন তৈরি করছিল। ওকে দেখে বলল, “ওই বাঁ দিকের সেলাইডিংটা খোল, তোর ছবি পেয়ে যাবি। ডান দিক থেকে আজ সরিয়ে রেখেছি এই দিকে। তা আজ এত দেরি হল?”
সাইমন ছবিগুলো বের করতে করতে বলল, “ওই ক্যামাক স্ট্রিটে গিয়েছিলাম একটা কাজে।”
চাউমিনগুলো বড় তাওয়ার একপাশে জড়ো করে একটা ডিম ভেঙে তাওয়ার মধ্যে ফেলে ঘাঁটতে ঘাঁটতে ন্যাপাদা বলল, “হয়েছে কাজটা?”
“ঠিক বুঝতে পারছি না।”
ন্যাপাদা কিছু বলার আগেই সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলে উঠল, “আরে, বললাম লঙ্কা কম দিতে। অত লঙ্কা দিচ্ছেন কেন?”
ন্যাপাদা খুন্তি দিয়ে লঙ্কা সরাতে সরাতে বলল, “তা তুই এবার বড়দিনে দেশে যাবি না?”
সাইমন থমকাল একটু, তারপর বলল, “না গো, এবার আর যাওয়া হবে না। বোনটা বলেছিল, কিন্তু জানোই তো অবস্থা। বাড়িওয়ালা কী বলেছে তোমায় তো বলেছি।”
“তোদের বাড়িওলাটা মহা হারামি। দিতে পারিস না কোনওদিন ঠুকে? যাক গে, দেখ কী করতে পারিস?”
সাইমন জানে যে, বাড়িওলা মানুষটা ভাল, শুধু একটু বোকাসোকা এই যা। না হলে এই যে, ওর চার মাসের ভাড়া বাকি পড়েছে তাতে তো ঘাড় ধরে বের করে দেয়নি ওকে। তবে এবার অবশ্য আলটিমেটাম দিয়েছে। বলেছে, “সামনের একত্রিশ তারিখের মধ্যে ঘরভাড়া মেটাতে না পারলে কিন্তু তোমায় তুলে দেব এবার। আর রাখব না।” কিন্তু সাইমন কোথায় পাবে দু’হাজার টাকা? কে দেবে, ওকে ধার? সাইমনের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। প্ল্যানেটোরিয়াম হলেও, মাথা গোঁজার ঠাঁই তো! এটা চলে গেলে কোথায় দাঁড়াবে ও? অবশ্য ও জানে এর পেছনে কার ইন্ধন আছে! সেই মোহন সেন নামে মালটার!
দেওয়ালের গায়ে এক-এক করে ছবিগুলো টাঙাল সাইমন। তারপর ছোট টিনের বোর্ডটা ইংরেজি ‘A’ অক্ষরের মতো খুলে দাঁড় করাল ফুটপাথে। এর গায়েই লেখা রয়েছে পোর্ট্রের্ট আর কার্টুন আঁকার কথা। এটা ওর সাইনবোর্ড। এটাও ন্যাপাদার ঠেলায় থাকে। ছোট্ট টুলটা নিয়ে এবার বসল সাইমন। সময় মতো বিজ্ঞাপনের লে-আউটগুলো দেখতে হবে একবার। আসলে এটা সাইমনের অভ্যাস, কাজটা হল কি হল না, সেটার ওপর গুরুত্ব না দিয়ে কাজটাকে আরও ভাল করার চেষ্টা ও শেষ পর্যন্ত করে যায়। কিন্তু এখন আগে কিছু খেতে হবে। কোলের ওপর বোর্ডটা নিয়ে বাঁ দিকে তাকাল। ছাতুওলাটা কই কে জানে! এখনও এল না তো। খিদে পাচ্ছে এত! ও জানে ন্যাপাদাকে বললেই ন্যাপাদা খাইয়ে দেবে। পয়সাও নেবে না। কিন্তু বলবে না সাইমন। ও বলে না।
চার্চের দিকে একবার তাকাল ও। কী সুন্দর ছোট ছোট বাল্ব আর রিবন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে চারিদিকে। বোনটা দেখতে পেলে কী খুশিই যে হত! ও দেশে গেলেই কলকাতার গল্প শোনার জন্য বায়না করে বোন। আর ওর প্রিয় ক্রিসমাসে যদি একবার ওকে আনা যেত এখানে। বোনটার কথা মনে পড়ায় চোখটা জ্বালা করে উঠল সাইমনের। কী অবস্থায় আছে ও? অন্য বার ক্রিসমাসে বাড়ি যায় সাইমন, কিন্তু এবার গেল না। কাল উৎসবের বাজারে যদি ছবি এঁকে কিছু রোজগার হয়। বাড়ি ভাড়াটা মেটানো খুব জরুরি। না হলে তো রাস্তায় দাঁড়াতে হবে ওকে!
“এই নে ধর।” সাইমন দেখল ন্যাপাদা একটা প্লেটে করে ওর দিকে চাউমিন বাড়িয়ে ধরেছে।
ও হাসল, “খিদে নেই ন্যাপাদা। ক্যামাক স্ট্রিটে খেয়েছি আমি।”
ন্যাপাদাও হাসল, বলল, “তবু খা। আমার মন রাখতে খা। শরীর ঠিক না। থাকলে বোনটাকে কে দেখবে? খা বলছি।”
ন্যাপাদার কথাগুলোর ভেতরে কী ছিল কে জানে? সাইমনের গলার ভেতর ছোট্ট একটা বেলুন ফুলতে লাগল। চোখের জ্বালাটা আর্দ্রতায় পরিণত হল। সাইমন হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিল এবার।
ন্যাপাদা বলল, “জানিস, সোয়া এগারোটা নাগাদ রাসবিহারী মোড়ে ব্যাপক কিচাইন হয়েছে।”
“মানে?” চাউমিন চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করল সাইমন।
“অটোওলাদের সঙ্গে একটা লোকের লেগেছিল। লোকটার পা-টা ভেঙে গেছে রে। নার্সিংহোমে যেতে হয়েছে।”
“কেন, অটোওলারা মেরেছে?”
“কে জানে? মারতেও পারে। তবে শুনলাম লোকটারই নাকি দোষ। ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিল। কেন, তুই আসার সময় কিছু দেখলি না?”
“না তো। সব ঠিক আছে দেখলাম।”
ন্যাপাদা কিছু বলার আগেই একটা প্রশ্নে সাইমন ডান দিকে তাকাল। একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাঝারি উচ্চতা। চোখমুখ ভীষণ সুন্দর। একমাথা কাঁচা-পাকা চুল। দেখে মনে হচ্ছে রেনেসাঁ যুগের কোনও ইতালীয় পুরুষ। ভদ্রলোকের গলার স্বরটাও খুব সুন্দর। ভদ্রলোককে দেখে কেমন জানি অস্বস্তি হল সাইমনের। চেনা লাগল কি?
সাইমন তাকাতেই ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, “আমার ছবি এঁকে দেবেন?”
“নিশ্চয়ই”, সামনের ছোট টুলটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সাইমন বলল, “বসুন।”
ভদ্রলোক বললেন, “আপনি খেয়ে নিন, আমি বসছি। নো প্রবলেম।”
“নো প্রবলেম?” আরে সকালে এই লোকটার সঙ্গেই তো ধাক্কা লেগেছিল ওর টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে! তখনও তো ‘নো প্রবলেম’ বলেছিলেন উনি! সাইমন দেখল ছোট টুলের ওপর বসে ভদ্রলোক সামনের গুমটি থেকে বেরোনো একটা ট্রামকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখছেন।
গোগ্রাসে চাউমিন খেতে লাগল সাইমন আর ভাবল, দু’হাজার টাকা এই ক’দিনের মধ্যে জোগাড় করতেই হবে। না হলে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে ওকে। বোনটার কী হবে তখন? কিন্তু আর মাত্র সাত দিন সময় আছে। তা হলে কি ওই মিথ্যেবাদী শতানিক বাসুর ওইসব উলটোপালটা কথা শুনেও ওকে ওঁর প্রস্তাব মেনে নিতে হবে? ওই অসম্মানজনক প্রস্তাব?
কী করবে ও? সাইমন সামনে তাকাল। ভদ্রলোক এখনও ট্রাম দেখে যাচ্ছেন।
মহেশ : ২৪ ডিসেম্বর, দুপুর একটা পাঁচ
ট্রাম দেখতে এখনও খুব ভাল লাগে মহেশের। কেমন ছোট্ট দু’কামরার যান একটা। ওপরের তারের সঙ্গে টিকি বেঁধে কেমন ভাসতে ভাসতে যায়! এই যানটি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে প্রত্যেকেরই টিকি কোথাও না কোথাও বাঁধা। সবাই কোথাও না কোথাও যেন বদ্ধ।
ট্রামটা এখন ফাঁকা, সদ্য গুমটি থেকে বেরিয়েছে, পথে লোক তুলতে তুলতে সে তার গন্তব্যের দিকে যাবে। আজ মহেশেরও গন্তব্যে পৌঁছোনোর দিন। আজ চব্বিশে ডিসেম্বর, ওর জন্মদিন, আবার আজই ওর মৃত্যুদিনও হবে।
ট্রামটা দূরে চলে যাচ্ছে। ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ। তবু মাথা ঘুরিয়ে যতক্ষণ সম্ভব সেই দিকে তাকিয়ে রইল মহেশ। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর। ও আর রৌনক দু’জনে ট্রামে করে স্কুল থেকে ফিরত। তখন কলকাতায় এত লোক ছিল না। যানবাহন বিকেলের দিকটায় একটু ফাঁকাই থাকত। ক্লাস সেভেনের মহেশের ট্রামে চড়ার ভাললাগা ছাড়া অন্য আর একটা কারণও ছিল। খোঁড়া দাদুর লজেন্স। একটা কাঠের পা নিয়ে ট্রামে উঠত লোকটা, সঙ্গে একবয়াম টক-ঝাল লজেন্স। সারাজীবনে সেই ছোটবেলার মতো টক-ঝাল লজেন্স আর কোথাও পেল না মহেশ। অবশ্য ছোটবেলার মতো কিছুই আর পাওয়া যায় না বোধহয়।
সেই যে অত বন্ধু ছিল রৌনক, তারও কি কোনও খবর আছে আর? কলেজ অবধি পৌঁছোনো ওদের গভীর বন্ধুত্বটা তো ভেঙে গেল মাত্র এক দিনের ঘটনায়। একটা দিন, কয়েকটা মুহূর্ত— এই যথেষ্ট মানুষের সম্পর্কে আর তার জীবন পালটে দেবার জন্য। মহেশকে কলেজে সবাই ‘ছদ্মবেশী রাজপুত্র’ বলে ডাকত। ছোটবেলার থেকেই সবার থেকে ওকে শুনতে হয়েছে যে, ওকে নাকি রাজপুত্রের মতো দেখতে! কে জানে রাজপুত্র কাকে বলে? ওর বাবা তো স্কুলমাস্টার ছিল।
কলেজের আগে অবধি ছোট-বড় নানান বয়সি মেয়ে ওর কাছে এলেও মহেশ কোনওদিন তাদের আমল দেয়নি, আগ্রহ বোধ করেনি। কিন্তু কলেজে ওর শেষ বছরে, ফার্স্ট ইয়ারে ভরতি হওয়া শ্রীপর্ণা ওকে মেরে ফেলেছিল একবারে। মেয়েটাকে দেখামাত্র ওর পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল নিমেষে। ওর মনে হয়েছিল এই মেয়েটা, একমাত্র এই মেয়েটার জন্যই ও অপেক্ষা করেছিল সারাজীবন।
কিন্তু শ্রীপর্ণাকে বলতে পারেনি কোনওদিন, বরং বলেছিল রৌনককে। এমন নিভৃত আনন্দের কথা বন্ধুকে ছাড়া আর কাকেই বা বলবে মানুষ? রৌনক সব শুনে খুব উৎসাহ দিয়েছিল ওকে। বলেছিল, “এগিয়ে যা তুই, কোনও ভয় পাস না।” কিন্তু শ্রীপর্ণাকে দেখলেই কী জানি হয়ে যেত ওর, সব গুলিয়ে যেত। মনে হত জিভটা কেউ চোয়ালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। ফলে কোনও দিনই এগোনো হয়নি। বরং একটা ঘটনায় পিছিয়ে এসেছিল ও।
মহেশের সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স। শ্রীপর্ণাও ফার্স্ট ইয়ারে ফিজিক্স অনার্স নিয়েই ভরতি হয়েছিল। শীতের শুরুতে একবার ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকে সব ইয়ার মিলিয়ে ওরা একটা পিকনিক আয়োজন করে। দু’দিনের পিকনিক। মহেশ হই-হট্টগোল এড়িয়ে থাকলেও এই পিকনিকটায় গিয়েছিল একমাত্র শ্রীপর্ণা যাবে বলে।
মহেশ ভাবে হয়তো ওটাই ঠিক হয়নি ওর। কারণ, না গেলে গেস্ট হাউসের ছাদে, সন্ধের অন্ধকারে ওই দৃশ্যটা দেখতে হত না ওকে। রৌনককে খুঁজতে ছাদে উঠে ও দেখেছিল ছায়াময় দুই অবয়ব পাগলের মতো খুঁড়ে চলেছে একে অপরকে। তাদের অস্ফুট গোঙানি, তাদের শরীরী ভঙ্গিমা আর শ্বাসের শব্দ নড়তে দিচ্ছিল না মহেশকে। নড়তে দিচ্ছিল না আরও একটা কারণে, ক্রমশ অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় ও বুঝতে পারছিল মানুষ দুটি কে! শ্রীপর্ণার তলপেটে মুখ গুঁজে থাকা রৌনককে চিনতে একফোঁটা অসুবিধে হয়নি ওর। সে-দিন, সেই শেষ অগ্রহায়ণের সন্ধেবেলা অদৃশ্য এক বজ্রপাত এসে মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছিল ওকে। ও ভেবেছিল, এই রৌনক আদৌ কি ওর বন্ধু? বন্ধু এরকম কাজ করতে পারে?
রৌনককে জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল, “দেখ, এটা কোনও ব্যাপার নয়। উই হ্যাভ সেক্স। দ্যাটস অল। নো স্ট্রিংস অ্যাটাচড।”
“মানে? তুই এমনি এমনি মেয়েটার সঙ্গে ওসব করলি? তুই ভালবাসিস না ওকে?”
রৌনক বলেছিল, “যতক্ষণ ওর শরীরের সঙ্গে ছিলাম ততক্ষণ তো ভালবেসেছিলাম, তারপর আর প্রয়োজন নেই।”
“মানে? কী আবোল তাবোল বকছিস?”
রৌনক হেসে বলেছিল, “আবোল তাবোল নয়, দিস ইজ মি। আ টোটাল ফ্রি স্পিরিট। আই লিভ ফর দ্য মোমেন্ট।”
মহেশ বুঝেছিল ওদের বন্ধুত্বের মুহূর্তও শেষ হল।
রৌনক যা করেছিল তা আজ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই মেনে এসেছে মহেশ। কিন্তু গত রাতে ও নিজে যা করেছে, তারপর থেকে ও নিজের মধ্যেও একজন রৌনককে দেখতে শুরু করেছে।
সামনের শিল্পী ছেলেটাকে এবার দেখল মহেশ। দ্রুত চাউমিন খাচ্ছে। একেই বলে গোগ্রাস। মায়া হল ওর। ও বুঝতে পারল মহেশকে যাতে অপেক্ষা না করতে হয় সেইজন্য দ্রুত খাবার শেষ করছে ছেলেটা। মহেশ বলল, “আপনি আস্তে খান। আমার তাড়া নেই। আমি অপেক্ষা করছি।”
সত্যিই আজ তাড়া নেই মহেশের। তাড়াহুড়ো করে মৃত্যুর কাছে যেতে চায় না ও। গত মাস চারেক হল ওর লাং ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন দেরি হয়ে গেছে বেশ। আর নাকি কয়েক মাসের মামলা। কথাটা কাউকে জানায়নি ও। অবশ্য জানাবার মতো ভাই ছাড়া আর আছেই বা কে? ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গেই থাকে মহেশ। বাবা-মা নেই। আর ও তো বিয়েই করেনি।
মাস ছয়েক হল বিয়ে হয়েছে ভাইয়ের। বাড়ির নীচের তলায় থাকে ওরা আর ওপরের তলার দুটো ঘরে মহেশ। ভাইটা খুব ভাল ওর। একটা প্রাইভেট কোম্পানির সেলস-এ আছে। মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হয়। অবশ্য বিয়ের পর বেশ কয়েক মাস ঠেকিয়ে রেখেছিল বাইরে যাওয়াটা, কিন্তু গত পরশু কোয়েম্বাটুর যেতে হয়েছে ওকে।
ভাই ওর চেয়ে প্রায় চোদ্দো বছরের ছোট। নরমসরম মানুষ, তাই ভাইটাকে আর শরীরে কর্কটের হানার ব্যাপারটা বলেনি। বললে, ও জানে, ভাই ভেঙে পড়বে।
মহেশ গত মাস কয়েক ধরে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছে ধীরে ধীরে। ও বিমা কোম্পানির চাকরি ছেড়েছে, বন্ধুবান্ধব ছেড়েছে, বই পড়াও ছেড়ে দিয়েছে। বুকের ভেতর পোষা কর্কট নিয়ে ও নিজেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে ওর চারিপাশ থেকে। বুকের ভেতর ওই পোষা প্রাণী ক্রমেই তার ব্যস্ততা বাড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে তীব্র কামড়ও বসাচ্ছে। জানান দিচ্ছে যে, সময় ফুরিয়ে আসছে ওর।
দীর্ঘ দিন ধরে মৃত্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে মহেশের চারিপাশে। ও-ও চিন্তা করছে এবার হয়তো নিজের থেকে সরে যাওয়াই ভাল হবে। এ যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না ওর। কিন্তু তবু এই পৃথিবীর মায়া কাটানোও সহজ নয়। তাই বুকের পোষা প্রাণীরা যতই দামাল হয়ে উঠুক না কেন তাকে বহন করতেই হয়েছে ওকে। তবে আজ এই প্রাণীদেরও শেষ হওয়ার দিন। ভোররাতেই মনস্থির করে নিয়েছে মহেশ। গতকাল রাতের সেই ঘটনার পর আর বেঁচে থাকার মুখ নেই ওর। বুকের কর্কট নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু মনের কর্কট আরও হিংস্র, আরও হত্যাপ্রবণ। মহেশ জানে, গত রাতে ও বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে। বিশ্বাস ভেঙেছে ও। তাই আজ, চব্বিশে ডিসেম্বর, ওর জন্মদিনে, নিজের থেকেই সরে যাবে মহেশ।
তবে সরে যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো একটু আনন্দ করে নেবে ও। এই ছবি আঁকাবে নিজের, তারপর বিরিয়ানি খাবে, টক-ঝাল লজেন্স খাবে, একটু হাঁটবে রাস্তা দিয়ে আর একসময় চলন্ত কোনও বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে।
ছেলেটা খাওয়া শেষ করে সামনের একটা বড় ঠেলার কাছে গিয়ে প্লেটটা রেখে দিল। তারপর ঠেলার ওপর রাখা জগের থেকে জল নিয়ে ধুয়ে ফেলল মুখটা। ছেলেটার তাড়া দেখে মায়া হল মহেশের। এই যে ফুটপাথে বসে ছবি আঁকে ছেলেটা, তাতে কতই বা রোজগার হয় ওর? ওর বাড়িতে কে কে আছে? কারা নির্ভরশীল ওর রং-তুলির ওপর? মহেশ ভাবল, আজ ও শেষ করতে যাচ্ছে ওর জীবন আর ওর সামনেই আরেক জন বেঁচে থাকার, ভেসে থাকার চেষ্টা করছে। এই বৈপরীত্য, এই সাদা-কালো, এই মৃত্যু আর জীবন এই সব কিছুর জন্যই তো পৃথিবী এত বর্ণময়, এত অদ্ভুত। ঠিক যেন টক-ঝাল লজেন্স।
ছেলেটা এসে বসল এবার। জিজ্ঞেস করল, “আপনার শুধু পোর্ট্রের্টই আঁকব কি?”।
মহেশ উত্তর না দিয়ে পালটা জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামটা ভাই?”
ছেলেটা থমকাল একটু। চোখেমুখে আশ্চর্য ভাব। হয়তো কেউ কোনওদিন ওকে নাম জিজ্ঞেস করেনি। ছেলেটা বলল, “সাইমন রুপেন মণ্ডল।”
হাসল মহেশ। অদ্ভুত নাম। তবে ভাল। ও বলল, “সাইমন, ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই কল ইউ সাইমন?”
“না, আপনি বলুন।”
মহেশ বলল, “আপনি আমায় দুটোই এঁকে দিন। পোর্ট্রের্ট আর কার্টুন। দেখি আমায় কার্টুনে কেমন দেখতে লাগে। সারাজীবন তো কার্টুনের মতোই কাটিয়ে দিলাম।”
সাইমন হাসল, বলল, “আচ্ছা। আপনি একটু স্থির হয়ে বসবেন, কেমন? আর মুখটা একটু পাশে ঘোরান। আর একটু, হ্যাঁ। আলোটা একটু এভাবে দরকার।”
মহেশ বাধ্য হয়ে সাইমনের নির্দেশ মতো মুখ ঘোরাল। ও দেখল ফরসা ছেলেটা কোলের ওপর রাখা ক্লিপবোর্ডে সাদা পাতা আটকাচ্ছে। এলোমেলো হাওয়ায় অবাধ্য পাতাটা উড়ছে ফরফর করে। আজ সারাদিন খুব হাওয়া দিচ্ছে কলকাতায়।
সাইমনের কথা মতো চুপচাপ বসে রইল মহেশ। সাদা পাতায় মোটা পেনসিল দিয়ে ছবি আঁকা শুরু হয়েছে। এক একটা আঁচড়ে ক্রমশ ফুটে উঠছে মহেশ। ওর ছবি স্পষ্ট হচ্ছে কলকাতায়। ওর শেষ ছবি।
ছবিটা আঁকা হলে এটা ওদের বাড়ির ঠিকানায় ক্যুরিয়ার করে দেবে মহেশ। ওর ভাইয়ের নামে পাঠাবে ছবিটা। ভাইটা খুব দুঃখ পাবে, ও জানে। কিন্তু পেলেও কিছু করার নেই। ও আর ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতে পারবে না কোনওদিন। গতকাল রাতটা যদি জীবন থেকে মুছে দিতে পারত! যা ঘটেছে, তা ঘোর অন্যায়। বিশ্বাসঘাতকতা। গতরাতে কয়েকটা মুহূর্ত ওর বুকের খাঁচায় বন্ধ থাকা কর্কটকে খুলে ছেড়ে দিয়েছে ওর মনে। একে মারার একমাত্র উপায় গোটা শরীরটাকে শেষ করে দেওয়া।
মন দিয়ে ছবি এঁকে চলেছে সাইমন। ওর কামড়ে ধরা ঠোঁট, কুঁচকে রাখা ভুরু আর দ্রুত হাতে পেনসিল চালানো দেখতে দেখতে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেল মহেশ। ওর ভাইও ভাল ছবি আঁকত একসময়। ঠিক এরকমভাবে চোখ কুঁচকে, ঠোঁট টিপে ছবি আঁর্কত ভাই। গাছ, পাহাড়, সূর্য, বাড়ি সব নিখুঁত করে এঁকে এনে দেখাত মহেশকে। বলত, “দাদা দেখ ভাল হয়েছে না?”
মহেশ গাল টিপে দিত ভাইয়ের, কোলে তুলে নিত। চোদ্দো বছরের ছোট ভাইকে যেন কতকটা নিজের সন্তানের মতোই দেখত মহেশ। আর ভাইটাও কেন যেন বিড়ালের মতো লেগে থাকত পায়ের সঙ্গে। যেখানে মহেশ সেখানেই যেত, পেছনে পেছনে ঘুরত। কেউ কিছু দিলে বাবা-মাকে না দিয়ে এক ছুটে এসে জিনিসটা ধরিয়ে দিত মহেশের হাতে। বলত, “দাদা, তুই সাবধানে রেখে দিস তো এটা।”
এবারও তো ট্যুরে যাওয়ার সময় বলেছিল, “লালিকে একটু দেখিস তো দাদা।”
মহেশ বলেছিল, “সে দেখব। কিন্তু তুই চিন্তা করছিস কেন? তোর শাশুড়িও তো রয়েছেন।”
ভাই হেসে বলেছিল, “তাও তুই দেখিস। না হলে আমার ঠিক শান্তি হয় না।”
মহেশ তো ভাইকে কথাও দিয়েছিল। বলেছিল, “চিন্তা করিস না, দেখব আমি।” কিন্তু কী যে হল, সব গন্ডগোল হয়ে গেল একদম। মহেশ ভাবল এই বিষাক্ত শরীর আর রাখবে না ও। এর আয়ু পূর্ণ হয়েছে। একে এবার বিদায় নিতে হবে।
“মুখটা একটু নামান।” সাইমনের নির্দেশে সংবিৎ ফিরল মহেশের। ও মুখটা নামাল। তারপর হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল, “আর কত দেরি ভাই?”
“এই আর মিনিট খানেক।”
মহেশ বলল, “ঠিক আছে। ডোন্ট হেস্ট। টেক ইয়োর টাইম।”
সাইমন শেষ কয়েক বার পেনসিল টেনে ছবিটা এগিয়ে দিল ওর দিকে, বলল, “এই দেখুন, হয়েছে তো?”
মহেশ হাতে নিল ছবিটা, তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, “বাঃ, একদম আমার মতো দেখতে হয়েছে, তবে এটা আমি নই।”
“আপনি নন?” সাইমন থতমত খেয়ে তাকাল ওর দিকে।
মহেশ দেখল ছেলেটা ঘাবড়ে গেছে একটু। হয়তো নিজের ওপর সংশয়ও জেগেছে ওর। মহেশ বলল, “না না আপনার আঁকা ঠিক আছে, শুধু এটা ঠিক এখনকার আমি নই। এটা চব্বিশ ঘণ্টা আগের আমি।”
সাইমন একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল।
মহেশ বলল, “আমি এখন আর এরকম নই।”
সাইমন বলল, “কিন্তু আমার তো এরকমই লাগছে। আমি যেমন দেখলাম তেমনই তো আঁকব। অবশ্য আপনার যদি পছন্দ না হয়…”
মহেশ ওকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বলল, “খুব পছন্দ হয়েছে। তা ছাড়া পুরনো নিজেকে দেখারও তো আনন্দ আছে একটা।”
এরপর কার্টুনটা আঁকতে আরও মিনিট পাঁচেক সময় নিল ছেলেটা। সেটা দেখে মহেশ বলল, “এটা একদম আমার মতো হয়েছে। রিডিকুলাস ইয়েট ট্রু।”
সাইমন এবার আর কোনও উত্তর না দিয়ে হাসল শুধু। মহেশ পকেট থেকে একশো টাকা বের করে সাইমনকে দিল। ছবি দুটোকে একটা পাতলা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে সাইমন এগিয়ে দিল মহেশের দিকে, তারপর বলল, “মেরি ক্রিসমাস।”
মহেশ প্যাকেটটা নিয়ে হাসল একবার, “ফর দ্য লাস্ট টাইম, মেরি ক্রিসমাস।”
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এবার হাজরার দিকে হাঁটতে লাগল মহেশ। একটা ক্যুরিয়ার খুঁজতে হবে। ছবিগুলো পাঠাতে হবে যে। এটাই আপাতত ওর কাজ। ভাইয়ের মুখটা হঠাৎ মনে পড়ল ওর। ভাইটাকে আর দেখতে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু সেটাই বোধহয় ভাল। ভাইয়ের হাসিমুখটা নিয়েই যেতে চায় ও। কোনও প্রিয় বস্তু ওর কাছে গচ্ছিত রেখে, নিশ্চিন্ত ভাইয়ের হাসিমুখ।
সামনেই ক্যুরিয়ার সার্ভিসের একটা দোকান দেখল মহেশ। ও ঢুকল দোকানটায়। একটা মেয়ে বসে আছে কাউন্টারে। ওকে দেখে মেয়েটা নড়েচড়ে বসল, “বলুন।”
মহেশ হাতের প্যাকেটটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ক্যুরিয়ার করতে হবে।”
মেয়েটা হাতের প্যাকেটটা নিয়ে একটা বড় খামে ঢোকাল তারপর একটা ফেল্ট পেন এগিয়ে দিল মহেশের দিকে। বলল, “ঠিকানাটা লিখে দিন একটু।”
মহেশ আলতো করে খামের ওপর নাম, ঠিকানা লিখল। বেশি জোরে চাপ দিলে ছবির ওপর দাগ পড়ে যেতে পারে। মেয়েটা খামটা নিয়ে একটা স্লিপ লিখল। তারপর বলল, “পনেরো টাকা দিন।” মহেশ টাকাটা বের করে দিল। মেয়েটা আবার বলল, “কাল পৌঁছে যাবে।”
মহেশ হাসল। কাল? তখন ও কোথায়? মহাকালোর মাঝে? কেন ক্যুরিয়ার করল ও ছবি দুটো? কেন নিজের ছবি রেখে দিতে চাইল ভাইয়ের কাছে? নিজেই জানে না ও। শুধু এটুকু জানে, এই এক জন পৃথিবীতে রয়ে গেল যে ওকে নিজের কাছে রেখে দেবে সারাজীবন।
এবার বিরিয়ানি খাবে মহেশ। সামনেই একটা দোকান। বোর্ডে লেখা দেখে ও বুঝল, এখানে বিরিয়ানি পাওয়া যায়। দোকানে ঢুকল মহেশ। শ্বেতপাথরের টেবিল, পুরনো কালচে কাঠের চেয়ার। দোকানটা একটু সাবেক ধরনের। দেখে ভাল লাগল ওর। ছোটবেলায় এরকম দোকানে বাবার সঙ্গে খেতে আসত ওরা। আজকাল তো চারিদিকে গিজগিজ করছে রেস্টুরেন্ট। তাতে রোগা রোগা চেয়ার, টেবিল, উর্দি পরা খয়াটে চেহারার বেয়ারা। দেখলেই আর খেতে ইচ্ছে করে না মহেশের।
একটা ফুল সোয়েটার পরা লোক এগিয়ে এল মহেশের কাছে, “কী খাবেন?”
মহেশ বলল, “বিরিয়ানি, মটন বিরিয়ানি আর মটন পসিন্দা। হবে?”
“দশ মিনিট বসুন।” লোকটা টেবিলে এক গ্লাস জল রাখল।
পকেটে হাত দিয়ে টাকাপয়সা বের করল মহেশ। একশো কুড়ি টাকা আছে। এখানে প্রায় নব্বই টাকার মতো লাগবে। বাকিটা কি তা হলে পকেটে থেকে যাবে? থাকুক।
লোকটার দিয়ে যাওয়া বিরিয়ানি আর মাংস খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেল মহেশ। ওর মনে হল মৃত্যুদণ্ডের আগে নিজেই যেন নিজের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে নিল। তা ছাড়া খিদেও পেয়েছিল। আজ অনেক সকালে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। কাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি তো, তাই বাড়িতে থাকতে পারছিল না ও। অপরাধবোধ ওকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
খাওয়া শেষে নব্বই টাকা দাম আর দশ টাকা টিপ দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল মহেশ। বুকে একটা হালকা ব্যথা শুরু হয়েছে। সারা সকাল চুপচাপ থেকে বুকের প্রাণীগুলো নড়াচড়া শুরু করেছে এবার। শরীরে খাবার পড়ায় শরীরও নিঝুম হয়ে আসছে। সকাল থেকে এদিক ওদিক ছন্নছাড়া ভাবে অনেক ঘুরেছে মহেশ। আর পারছে না। এবার ওর ঘুম চাই।
পাশে একটা ছোট্ট পানের দোকান। মহেশ সেখান থেকে একটা টক-ঝাল লজেন্স কিনল। আঃ, দারুণ খেতে। প্রায় ছোটবেলার মতো। ঘড়ির কাঁটা উলটো দিকে ঘুরিয়ে আবার ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করল মহেশের। মনে হল আবার শীতের রোদের মধ্যে ট্রামের জানলার ধারে বসে বাড়ি ফিরতে। নিমেষের জন্য ওর মনে হল মা তো বসে রয়েছে ওর অপেক্ষায়।
সত্যিই কি মা বসে রয়েছে কোথাও? তারার পর তারা পেরিয়ে, নক্ষত্রের পর নক্ষত্র পেরিয়ে মা তুমি কি বসে রয়েছ? আমার বড় ঘুম পাচ্ছে মা। বড় ক্লান্ত লাগছে। ঘড়ি দেখল মহেশ, দুটো বাজতে এক। নাঃ, আর না। এবার সময় হল। প্রতাপবাবু ঠিকই বলেছেন, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার কী দরকার?
রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়াল মহেশ। সাঁ-সাঁ করে বাস, ট্যাক্সি ছুটে যাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে মানুষের ভিড়। উৎসবের প্রস্তুতিতে কলকাতা জমজমাট। ও দেখল কাজটা সোজা। ওকে শুধু পায়ে পায়ে নেমে গিয়ে দাঁড়াতে হবে চলন্ত কোনও বড় বাসের সামনে। এক মুহূর্তের আলিঙ্গন। তারপর ঘুম।
মাথাটা খুব হালকা লাগছে মহেশের। বুকের কর্কটকুল চঞ্চল হয়ে উঠেছে বড়। কে যেন চোখের সামনের দৃশ্যগুলো ধীরে ধীরে মুছতে শুরু করেছে। ভাসতে ভাসতে মহেশ ফুটপাথের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে দিয়ে অবিরাম গাড়ি যাচ্ছে। বাস, ট্যাক্সি, অটো নানান সব গাড়ি। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, সামনের চলন্ত ট্যাক্সির জানলা দিয়ে একটা মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। কে মেয়েটা? চেনা চেনা লাগছে? কিন্তু এটাও মাথায় থাকল না আর। শুধু হাওয়া আর মেঘ যেন দখল নিয়ে নিয়েছে মাথার। ডান দিক দিয়ে বিশাল বড় একটা লাল বাস খ্যাপা জন্তুর মতো ছুটে আসছে। মহেশ বুঝল, এই ওর সময়। ও আবার একবার বাঁ দিকে তাকাল। মেয়েটার ট্যাক্সিটা দূরে চলে গেছে। কে মেয়েটা? চেনা লাগছে? আজ সকালে দেখা হয়েছিল না? কিন্তু কিছুই আর স্পষ্ট মনে নেই। মাথার ভেতরটা কেন অবশ হয়ে গেছে। ডান দিক থেকে বাসটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ। আর দেরি করা যাবে না। গ্যাস বেলুনের মতো মাথাটা নিয়ে ভাসতে ভাসতে রাস্তায় নামল মহেশ। তারপর বাসের দিকে এগোতে লাগল।
কলকাতায় ওলটপালট হাওয়া দিচ্ছে তখন, সূর্য বাঁক নিচ্ছে, আর পিচ দাপিয়ে ছুটে আসছে রক্তিম এক মৃত্যু।
ইরা : ২৪ ডিসেম্বর, দুপুর একটা উনষাট
ট্যাক্সির সিটে ঘুরে বসল ইরা। এতক্ষণ পেছনের কাচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল ও। ভদ্রলোক ওরকম বিপজ্জনকভাবে রাস্তায় নামছেন কেন? সকালে মামার বাড়িতে তো ভদ্রলোককে দেখল ও। এখানেও দেখে হাত নাড়ল। কিন্তু ভদ্রলোক এমনভাবে তাকালেন যে, কিছু নজরেই পড়ছে না ওঁর। কেমন অদ্ভুত স্থির দৃষ্টি। মানুষটার চোখ দুটো যেন পাথরের হয়ে গেছে।
ট্যাক্সিটা ওই ভদ্রলোককে পার করে আসার পরও ইরা পেছনের কাচ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল ওঁকে। ভাবছিল অমন বিপজ্জনকভাবে রাস্তায় নামছেন কেন উনি? অমনভাবে কেউ রাস্তা পার করে নাকি? কিন্তু এর বেশি আর দেখতে পায়নি। পেছনে একটা পাবলিক বাস এসে ঢেকে দিয়েছে পুরো দৃশ্যটা। ইরা ভাবল ভদ্রলোক কি নেশাগ্রস্ত?
সামনে রাসবিহারী মোড়ের সিগনাল। ভাগ্য ভাল সেটা সবুজ হয়ে আছে। ট্যাক্সিটা বাঁ দিকে বাঁক নিল এবার। হিন্দুস্তান পার্কে যেতে হবে ওকে নেমন্তন্ন করতে। সামনের তিরিশে ডিসেম্বর ওর বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী। আবার সেইদিন বাবার জন্মদিনও। এ-বছর মা চাইছে চেনাশুনো লোকজনদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে। কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে ইরার ওপর। ইরা তাই বেরিয়েছে আজ।
এই যে বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্ন করছে ও, তাতে সবাই ভালভাবে ব্যাপারটা নিলেও মোহনদা কিন্তু টিপ্পনি কাটছিল খুব। এই লোকটাকে দেখলেই ঘেন্না করে ইরার। এমন নোংরা মানুষ ও দেখেনি। ওকে দেখলেই বহু বছর আগের সেই দুপুরের দৃশ্যটা ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে।
ইরা তো বলেছিল মাকে যে, আর সব জায়গাতে গেলেও ওই ভবানীপুরে মোহনদার বাড়িতে ও যাবে না।
মা রাগ করেছিল, বলেছিল, “ওর সঙ্গে কী তোর? ছোট থেকে দেখছি ওকে সহ্য করতে পারিস না তুই। ও কিন্তু তোর সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। দেখ ইরু, তোর জেঠুরা কলকাতায় থাকে না। মোহন আছে। ওকে নেমন্তন্ন না করলে হয়?”
ইরা বলেছিল, “তুমি ফোনে বলে দাও ওকে।”
মা রাগ করে বলেছিল, “এবার বাড়াবাড়ি করছিস তুই। ফোনে কোনওদিন আমরা কাউকে নেমন্তন্ন করি? মোহনের ছুটি আছে আজ। তুই গিয়ে ওকে আর ওর বউকে নেমন্তন্ন করে আয়।”
ইরা তাও গাঁইগুঁই করেছিল, কিন্তু মা শোনেনি। মেজাজ খারাপ করেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ইরা। আটটা নাগাদ আর্চির সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন জায়গায় নেমন্তন্ন করতে করতে সোয়া একটা নাগাদ পৌঁছেছিল মোহনদার বাড়ি।
সকালে আর্চি ওর মাথা গরম করে দিয়েছিল, তারপর মামার বাড়িতে গিয়ে এমন একটা কথা শুনেছিল যে, রাগটা আর কয়েক ধাপ চড়ে গিয়েছিল। অবশ্য বাবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্ত হয়েছে কিছুটা। তবে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নয়। পুরোপুরিটা নির্ভর করছে আজ ঠিক সময়ে আর্চির আসার ওপর।
মোহনদার বাড়িতে ঢোকার সময় স্বভাবতই একটা টেনসড অবস্থায় ছিল ইরা। মোহনদার ফ্ল্যাটটা দোতলায়। বেল বাজতে মোহনদা নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল ওকে। তারপর বলেছিল, “আসুন রানি এলিজাবেথ। এতক্ষণে সময় হল!”
ইরা কোনও উত্তর না দিয়ে মোহনদার স্ত্রী শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “বউদি এত রোগা হয়ে গেছ কেন গো?”
শ্রেয়া কিছু উত্তর দেবার আগেই মোহনদা বলেছিল, “আমি খেতে দিই না তো, তাই।”
ইয়ারকির ছলে কথাগুলো বললেও ইরা কিন্তু ভেতরের শ্লেষটা ধরতে পেরেছিল। ইরা বুঝতে পারছিল ও যেমন সেই দুপুরটার কথা ভোলেনি মোহনদাও ভোলেনি।
সেদিন দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল ইরা। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়। কিছু পরে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যায় ওর। ইরার মনে হয়েছিল একটু ছাদে যায়। মা রোদে যে চালতার আচার রেখেছিল তা একটু টেস্ট করে দেখবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ই কিছু পড়ে যাওয়ার জোরালো শব্দ শুনেছিল ইরা। ও বুঝতে পেরেছিল যে, শব্দটা মোহনদার ঘরটা থেকে আসছে। ও দৌড়ে উঠে গিয়েছিল মোহনদার ঘরের সামনে। আর তখনই মোহনদার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসা মেহেরের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল ওর। বিস্ময় আর ভয় মেশানো দৃষ্টিতে ইরা দেখেছিল গোড়ালির কাছে পাজামা জড়ো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নগ্ন মোহনদা।
মেহেরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল ইরা। মোহনদাও হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছিল ওর অর্ধ উদ্ধত পুরুষাঙ্গ। মেহের কাঁদছিল খুব। কোনও কথা বলতে পারছিল না। ইরা ওকে ধরে নিয়ে এসেছিল দোতলায় ওর ঘরে। মেহের কেঁদেই যাচ্ছিল। ইরা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোকে কী করেছে মোহনদা? আমায় বল।”
মেহের বলেছিল, “পাজামা খুলে ওটা ধরতে বলছিল আমায়… আমার গায়ে হাত দিয়ে নিজের দিকে টানছিল…”
ফোঁপানো মেহেরের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ইরা! এ কী সর্বনাশ করতে যাচ্ছিল মোহনদা? এসব জানাজানি হলে তো বিপদ হবে খুব। ও তাকিয়ে দেখেছিল মেহের তখনও ভয়ে কাঁপছে।
ইরা মেহেরকে বলেছিল, “শোন, এই কথাটা কাউকে বলিস না কিন্তু। খুব সমস্যা হবে।”
“বলব না?” কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল মেহের, “আমায় এমন করল তবু কাউকে বলব না ইরাদি? মাকেও না?”
“শোন,” মেহেরকে পাশে বসিয়েছিল ইরা, “মোহনদাকে এই বাড়ি থেকে তাড়াবার ব্যবস্থা করছি আমি। তোকে কথা দিলাম, সাত দিনের মধ্যে যদি মোহনদা এই বাড়ি ছেড়ে না যায়, তা হলে সবাইকে তুই বলে দিস ও কী করেছিল।”
“কিন্তু ইরাদি, আমার যে ভয় করছে।” মেহেরের গলাটা খুব বিপন্ন শুনিয়েছিল।
ইরা জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, তারপর বলেছিল, “আমায় বিশ্বাস করিস তো তুই? আমি বলছি তোর কিছু হবে না। কোনও ভয় নেই তোর। মোহনদাকে এই বাড়ির থেকে সাত দিনের মধ্যে তাড়িয়ে ছাড়ব আমি। তুই চিন্তা করিস না।”
মেহেরকে নীচে ওর ঘর অবধি পৌঁছে দিয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করেনি ইরা, সোজা উঠে গিয়েছিল তিনতলায়, মোহনদার ঘরে।
খাটের ওপর দু’পায়ের মাঝে মাথা রেখে বসে ছিল মোহনদা। মেঝের ওপর পড়ে ছিল ভাঙা গিটার। যদিও ঘরটায় ঢুকতে গা ঘিনঘিন করছিল ইরার তবু ও বুঝতে পারছিল যে, এ ছাড়া ওর উপায় নেই কোনও। মোহনদাকে এ-বাড়ি থেকে তাড়াতেই হবে। ওর সেই অল্প বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়েই ইরা বুঝেছিল যে, মোহনদা একবার বিফল হয়েছে, কিন্তু যৌনতা এমন জিনিস যে, মানুষকে পশু করে দেয়। মোহনদা আবার সুযোগ বুঝে মেহেরকে ধরবে। এত দিন যাবৎ পিডোফিল শব্দটা শুনেছিল ইরা, এবার নিজের জ্যাঠতুতো দাদার মধ্যে সেই মানসিক রুগিটাকে আবিষ্কার করেছিল ও।
ইরাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তড়িঘড়ি খাট থেকে নামার চেষ্টা করেছিল মোহনদা। ইরা হাত তুলে বাধা দিয়েছিল। বিপন্ন মুখে মোহনদাই প্রথম কথা শুরু করেছিল। ও বলেছিল, “ইরা, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর, আমি সজ্ঞানে করিনি কিছু। আমার মাথায় ভূত ঢুকেছিল। আমি ভীষণ অন্যায় করেছি। তুই কাউকে বলিস না প্লিজ। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে। মেহেরের কাছে গিয়েও আমি আলাদাভাবে ক্ষমা চেয়ে নেব।”
ইরা ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল মোহনদার দিকে। ওর চোখের সামনে ভাসছিল অর্ধ উদ্ধত সেই পুরুষাঙ্গটা। গা গুলোচ্ছিল ইরার। তবু মোহনদাকে কথা বলার সময় দিয়েছিল ও। কিন্তু যেই মোহনদা মেহেরের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছিল, তখন আর ও ঠিক থাকতে পারেনি। হাত তুলে ও থামিয়ে দিয়েছিল মোহনদাকে। তারপর কঠিন গলায় বলেছিল, “একদম মেহেরের আশেপাশে ঘেঁষবে না তুমি। আর শোনো, আমি চাই না তোমার মতো নোংরা ছেলে আমাদের বাড়িতে থাকে। সাত দিনের মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তুমি।”
“সাত দিন? কিন্তু কোথায় যাব?” মোহনদার গলায় অসহায়তা টের পেয়েছিল ইরা। ও বলেছিল, “জাহান্নামে যাও, আমার জানার দরকার নেই। শোনো, আমি মেহেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। ও সাত দিন কাউকে কিছু বলবে না। কিন্তু তারপর যদি ও তোমায় এ বাড়িতে দেখে তা হলে কিন্তু সবাইকে বলে দেবে ও। আর আমি ওকে সেকন্ড করব। তখন বুঝতে পারছ তো কী হবে? জানো তো সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের জন্য আজকাল জল কত দূর গড়ায়। যদি ভাল চাও, তা হলে সাত দিনের মধ্যে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর খবরদার মেহেরের আশেপাশে ঘেঁষবে না একদম।”
মোহনদা বলেছিল, “কাকু-কাকিমা মানবে আমার চলে যাওয়া? ওদের কী বলে বোঝাব আমি?”
ইরার হাত-পা জ্বালা করছিল খুব। মনে হচ্ছিল, ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় জানোয়ারটার গালে। ও চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, “বাবা-মা যদি জানে যে, একটা ছোট মেয়ের পেছনে তুমি ন্যাংটো হয়ে দৌড়োচ্ছ তা হলে সেটা কি মেনে নেবে ওরা? দেখো, ভাল চাও তো কেটে পড়ো। বাবা-মাকে কীভাবে তুমি কনভিন্স করবে সেটা তোমার ব্যাপার। মোট কথা, সাত দিন পর এ-বাড়িতে থাকলে তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে, বুঝেছ?”
মোহনদা সেদিন আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু ইরা শোনেনি। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল মোহনদা। তারপর মেহেররা যত দিন ওদের বাড়িতে ছিল তত দিন আর ওদের বাড়িমুখো হয়নি। মা অবশ্য এক রাতে বলেছিল, “কেন যে মোহনটা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, বুঝলাম না! বন্ধুদের সঙ্গে রুম শেয়ার করে কি এখানের চেয়ে আরামে থাকবে? এত ভাল ছিল ছেলেটা!”
ইরার খুব ইচ্ছে করছিল ভাল ছেলের স্বরূপটা ফাঁস করে দিতে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছিল ও। শুধু বলেছিল, “যে চলে গেছে যাক না। তুমি অত ভাবছ কেন?”
সেই মোহনদা এখন বড় চাকরি করে এক নামকরা মাল্টিন্যাশনালে। ওর বউ শ্রেয়া খুব ভাল মেয়ে। ভবানীপুরের এই ফ্ল্যাটটার ভাড়া দেয় ওর অফিস। মোহনদা অফিস থেকে গাড়িও পায়। কিন্তু এখনও ইরা আর মোহনদার মধ্যে অদৃশ্য মেহের ঘোরাফেরা করে। ঘোরাফেরা করে সেই তিনতলার ঘর, সেই নির্জন দুপুর আর শীতকাল। আর ওদের মধ্যে পড়ে থাকে তার-ছেঁড়া ভাঙা একটা গিটার। ইরা কিছুতেই সহজভাবে কথা বলতে পারে না মোহনদার সঙ্গে। মোহনদাও কেমন যেন একটা বাঁকা সুরে কথা বলে সবসময়।
দুপুরে মোহনদার ফ্ল্যাটে গিয়ে তিরিশ তারিখ ইরাদের বাড়িতে যাবার জন্য নেমন্তন্ন করার পরই যেমন মোহনদা বলেছিল, “হঠাৎ এই বয়সে কাকু-কাকিমার বিবাহবার্ষিকীর মতিভ্রম হল? লোকে হাসবে তো।”
“যাঃ, কী বলছ!” শ্রেয়া বাধা দিয়েছিল।
মোহনদা তবু বলছিল, “তা টোপর-মুকুট পরিয়ে বসাবি তো? না কি একদম সাদামাটা?”
ইরা চুপ করে শুনছিল। শ্রেয়া উত্তর দিয়েছিল, “আরে শুধু কি বিবাহবার্ষিকী নাকি? শুনলে না সেদিন কাকুরও জন্মদিন!”
খিকখিক করে গা-জ্বালানো হাসি দিচ্ছিল মোহনদা। বলেছিল, “কাকুর জন্মদিন? এই বয়সে? কী রে মাথায় রঙিন টুপি পরিয়ে, গলায় বিব্ বেঁধে কেক কাটাবি নাকি? সত্যিই যা খেল দেখাচ্ছিস না তোরা!”
আর চুপ করে থাকতে পারেনি ইরা। দুম করে বলে দিয়েছিল, “কে কেমন খেল দেখায় জানা আছে। আমি যদি খেল দেখানো আর মতিভ্রমের কথা তুলি অনেকের পাজামা খুলে যাবে।”
জোঁকের মুখে নুন পড়েছিল যেন। একদম চুপ করে গিয়েছিল মোহনদা। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরে চলেও গিয়েছিল ভেতরের ঘরে।
শ্রেয়া কিন্তু তা বলে উঠে যায়নি। মেয়েটা এতটা সরল যে, এর ভেতরে যে একটা গন্ডগোল আছে সেটাও বুঝতে পারেনি। ও জোর করে বসিয়ে রেখেছিল ইরাকে। অনেক গল্প করেছিল। ইরার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ডিমের অমলেট করেও খাইয়েছে। খুব ধরেছিল দুপুরে ভাত খেয়ে যাবার জন্য, কিন্তু ইরা এটা আর মানেনি। কারণ এখান থেকে বেরিয়ে ওকে যেতে হবে রিনিদির কাছে। রিনিদি বলে রেখেছে, আজ দুপুরে যেন ওর ওখানেই খায় ইরা।
ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় ইরা আবার বলেছিল তিরিশ তারিখ যেতে। তারপর শ্রেয়ার কান বাঁচিয়ে চাপা গলায় মোহনদাকে বলেছিল, “ভদ্রভাবে আসতে পারলে আসবে। না হলে এসো না।”
“দিদি, কোন গলিতে বাঁক নেব?” ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথায় সংবিৎ ফিরল ইরার। ও বলল, “সামনের থেকে বাঁ দিকে।”
গাড়িটা বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে এগোনোমাত্র ইরা আবার নির্দেশ দিল, “ওই ডান দিকের হলুদ বাড়িটার সামনে দাঁড়ান।”
গাড়ি থামলে, ও দেখল তেতাল্লিশ টাকা উঠেছে। টাকাটা দিয়ে গাড়ি থেকে নামল ও। এখানে একটা-দেড়টা নাগাদ আসবে বলেছিল ইরা। এখন প্রায় সোয়া দুটো বাজে। রিনিদি নিশ্চয়ই রাগ করেছে। তাই একবারও ফোন করে খোঁজ নেয়নি। ইরা ব্যাগের থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল।
আরে স্ক্রিন সাদা কেন? এই রে চার্জ চলে গেছে বোধহয়। তাই কি রিনিদি ফোন করেও পায়নি! ও ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খুঁজল, এমনই কপাল চার্জারটাও আনেনি সঙ্গে করে। এখন কী হবে? যাক গে, রিনিদির কাছে যদি চার্জার থাকে তা হলে চার্জ দিয়ে দেবে ফোনটা। ও এগিয়ে গিয়ে কলিং বেল টিপল।
দরজা খুলেই হইহই করে উঠল রিনিদি, “আরে কোথায় ছিলি তুই? কখন থেকে তোকে ফোন করছি। লাইন পাচ্ছিলাম না। সুইচ অফ করে রেখেছিলি নাকি? ক’টা বাজে দেখেছিস? খিদে পায়নি তোর? এত দেরি হল কেন? কোনও সমস্যা হয়েছিল?”
ইরা ঘরে ঢুকে ব্যাগটাকে সামনের টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, “এত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়? তার চেয়ে তাড়াতাড়ি খেতে দাও রিনিদি, তাড়া আছে।”
“তাড়া? কেন? ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছিস?”
“না গো তিনটের সময় কাজ আছে একটু। ভীষণ দরকারি। প্লিজ খেতে দিয়ে দাও এবার। আর, ভাল কথা, তোমার কাছে মোবাইলের চার্জার আছে। আমার মোবাইলের ব্যাটারিটা গেছে।”
“চার্জার?” রিনিদি এ-দিক ও-দিক তাকাল। তারপর বলল, “তুই হাতটা ধুয়ে বস আমি আনছি।”
ইরা বাড়ির সবটা চেনে। মাঝে মাঝেই এখানে আসে ও। রিনিদি ওর নিজের দিদি নয়। রবীন্দ্রসংগীত শেখার সময় আলাপ হয়েছিল। তাও অনেক বছর হল। ইরা ভাবে নিজের দিদি থাকলেও বোধহয় তার সঙ্গে এত ভাল সম্পর্ক হত না ওর।
হাত ধুয়ে, মুখে জল দিয়ে ঘরে এসে ইরা দেখল রিনিদি চার্জার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও হাত বাড়িয়ে চার্জারটা নিয়ে বলল, “এ মা এতে তো হবে না। তোমাদের এই চার্জারটা তো ফিট করবে না আমার মোবাইলে।”
“এই রে কী হবে তা হলে?” চার্জারটা ফেরত নিয়ে জিজ্ঞেস করল রিনিদি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরা। এখনই এটা হতে হল? ও বলল, “যাক গে, খেতে দিয়ে দাও।”
খাওয়ার টেবিলে গিয়ে অবাক হয়ে গেল ইরা। ও বলল, “এত কিছু কে খাবে? আরও কেউ আসছে নাকি?”
রিনিদি বলল, “এত কিছু কোথায়? মোটে তো চারটে পদ। চুপ করে বসে খা তো, পাকামো করতে হবে না। এই যে পি এইচ ডি করবি বলে লাফাচ্ছিস, ভাল করে না খাওয়া-দাওয়া করলে পড়াশুনো করার শক্তি পাবি গায়ে? বস।
রিনিদি কাঁধ ধরে জোর করে বসিয়ে দিল ওকে। তারপর ওর সামনে রাখা চৌকো কাচের প্লেটটা সোজা করে তাতে ফ্রায়েড রাইস বাড়তে লাগল। ঘটনাটা সত্যিই। ইরা পি এইচ ডি করবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে বটে, কিন্তু এখনও কাজ শুরু করে উঠতে পারেনি। তবে তার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারল না ও।
ইরা বুঝল শ্রেয়ার খাওয়ানো অমলেটটা ওর খিদেটাকে মেরে দিয়েছে। এখানে খাওয়ার নেমন্তন্ন আছে বলেই তো খেতে চায়নি ও। কিন্তু মেয়েটা এমন জোর করল! ও জানে রিনিদি দারুণ রান্না করে। কিন্তু কী করবে? খিদেটা তেমন নেই যে। অবশ্য এজন্য শুধু অমলেটকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওর ভেতরে যে-টেনশনটা পাক মারছে সেটাও কিছু খেতে দিচ্ছে না ওকে।
ফ্রায়েড রাইসের ভেতরে আঙুল চালাতে চালাতে ইরা ভাবল আজ ঠিক সময়ে এসে পৌঁছোবে তো আর্চি? দু’-দু’বার বাবার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করেছে ও। আজকেই শেষ সুযোগ। ওর ইচ্ছে হল রিনিদির মোবাইল থেকে একটা ফোন করে আর্চিকে। একবার খোঁজ নিয়ে দেখে কোথায় আছে ও। একবার জিজ্ঞেস করে, ঠিক সময়ে আসছে তো? কিন্তু নিজেকে সামলাল ও। কেন প্রতিবার ও যাবে নিজের থেকে? আর্চির কোনও দায়িত্ব নেই? কোনও কমিটমেন্ট নেই ওর তরফ থেকে? সব কি একতরফা ইরাকেই করে যেতে হবে? যদি আজ আর্চি ঠিক সময়ে না আসে তা হলে ও সত্যি সত্যিই আর কোনও যোগাযোগ রাখবে না ওর সঙ্গে। তাতে মা তিরিশ তারিখ সবার সামনে যা খুশি বলুক, ও মেনে নেবে।
“কী রে কিছুই খাচ্ছিস না যে? খারাপ হয়েছে?” ইরা দেখল খাওয়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে রিনিদি। ও বলল, “না না ভালই হয়েছে।”
“তা হলে? মন খারাপ? কাকিমা আবার বিয়ে নিয়ে ঝঞ্ঝাট করছে নাকি?”
ইরার মনে পড়ে গেল আজ মামার বাড়ি থেকে বেরোবার পর ওর সঙ্গে বাবার কথোপকথন।
ও বলল, “না গো, বোধহয় অম্বল হয়ে গেছে। তাই ভাল লাগছে না। গা গুলোচ্ছে।”
রিনিদি হাসল, “বিয়ের আগেই গা গুলোচ্ছে?”
ইরাও হাসল এবার, “ধ্যাত, খালি বাজে কথা, না? তা নিখিলদা কই?”
“কোথায় আর, অফিসে। বললাম তুই আসবি, ছুটি নাও। বলে কিনা অফিসে বিদেশিরা আসছে। ওকে যেতেই হবে।”
ইরা জানে নিখিলদা খুব বড় চাকরি করে। রিনিদির সঙ্গে বিয়ের দিনও নাকি অফিস করেছিল নিখিলদা। লোকটা কাজপাগল। ও জিজ্ঞেস করল, “আর সুগত? ও কোথায়? অফিসে?”
“আর অফিস!” রিনিদি বাঁ হাত দিয়ে ওর পাতে মাংস দিয়ে বলল, “সে আজ সকালবেলা বন্ধুদের সঙ্গে ডুয়ার্স গেছে। পুরো রাস্তাটা গাড়িতে যাবে। কেমন ছেলে জানিস? আজ খুব ভোরে আমায় ঘুম ভাঙিয়ে বলছে ওকে নাকি সকাল দশটায় বেরোতে হবে। অফিসের থেকে তো উর্নি এসে হাজির। মেয়েটা কাজ করে ওদের সঙ্গে। শুনলাম অফিসেও নাকি কী সব দরকারি কাজকর্ম ফেলে এসেছে ও। এই সুগতকে নিয়ে হয়েছে আমার জ্বালা। ওকে বললে বলে আর্টিস্টরা নাকি এরকমই হয়। তোর নিখিলদা তো বলে, ‘তোমার ভাইয়ের কিচ্ছু হবে না। যার ডিসিপ্লিন নেই তার কিছু নেই।’ আমি কী করি বল তো?”
ইরা এক টুকরো মাংস মুখে দিয়ে ভাবল বাবাও এরকম কথা বলেছিল একবার। আর্চির সত্যিই কোনও ডিসিপ্লিন নেই। ভীষণ অগোছালো ছেলে। এই যে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তিনটে অবধি আর্চি না এসে পৌঁছেলে আর্চির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না ও, সেটা কি খেয়াল আছে আর্চির? গা-টা আবার গুলিয়ে উঠল। একবার ওয়াক তুলল ইরা।
“কী রে সত্যি শরীর খারাপ লাগছে? আর খেতে হবে না, ওঠ, ওঠ।” রিনিদি চেয়ার থেকে উঠে বাঁ হাত দিয়ে ইরাকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে। বলল, “নে, হাত ধুয়ে নে। একটা ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে নিস। ঠিক হয়ে যাবি।”
ইরা উঠে পড়ল। মনে মনে ধন্যবাদ দিল রিনিদিকে। সত্যিই আর খেতে, পারছিল না ও। কষ্ট হচ্ছিল। পেটের ভেতরে যেন এক পাহাড় প্রজাপতি উড়ছে। আর্চি ঠিক আসবে তো?
ইরা বাইরের ঘরে এসে চেয়ারে বসল। দুটো চল্লিশ বাজে। রিনিদি ছোট্ট কাপে করে একটা ওষুধ এনে বলল, “খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। ভাল লাগবে।” কাপটা নিয়ে গলায় ঢালামাত্র গলা জ্বলে গেল ওর। ওরে বাবা, এ ওষুধ না অ্যাসিড? ইরা মুখ বিকৃত করে বলল, “ভাল করে খেলাম না বলে শেষ পর্যন্ত বিষ দিলে?”
“মারব এক থাপ্পড়, ইয়ারকি হচ্ছে?” রিনিদি হেসে সামনে বসল।
ইরা টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, “এবার আসল কথায় আসি। শোনো, তিরিশ তারিখ সন্ধেবেলা তুমি আর নিখিলদা আমাদের বাড়ি আসবে। বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকীর সঙ্গে সে-দিন বাবার জন্মদিনও।” ইরা তৃতীয় ঘটনাটা আর বলল না। ওটা হলে ভাল হবে না মোটেই। তবে তৃতীয় ঘটনাটা ঘটবে কি না সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আজ আর্চির ওপর।
ইরা উঠল এবার। ঘড়ির কাঁটা পৌনে তিনটে পার হচ্ছে। এখান থেকে অটো করে প্রিয়া সিনেমার সামনে চলে যাবে ও। ইরা বলল, “আজ আসি গো রিনিদি। একটু তাড়া আছে।”
“কোথায়, যাবি কোথায়?”
“একটু প্রিয়া সিনেমার সামনে যাব।”
“মানে দেশপ্রিয় পার্ক? আরে সেখানে তো আজ মিছিল না কী সব আছে। সাবধানে যাস। জানিসই তো আজকাল মিছিল-টিছিলে কেমন গন্ডগোল হয়।”
তাই তো, আজ মিছিল আছে। এটা তো মনে ছিল না ওর। এই রে আর্চি আসতে পারবে তো তা হলে? ইরা নার্ভাস হয়ে রিনিদির দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর “ঠিক সময়ে চলে যেয়ো কিন্তু” বলে বেরিয়ে গেল বাইরে।
হিন্দুস্তান পার্কের এই রাস্তাটা খুব নির্জন। দু’দিকে শুধু বড় বড় বাড়ি আর তাদের দেওয়ালের ওপর দিয়ে উঁকি দেওয়া নানা রকম ফুলগাছ। ইরা একবার আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর রঙের প্লাস্টিক কে যেন টাঙিয়ে দিয়েছে কলকাতার মাথায়। আজ হাওয়া দিচ্ছে খুব। সকাল থেকেই দিচ্ছিল, কিন্তু এখন যেন বেড়েছে হাওয়ার বেগটা। জ্যাকেটের চেনটা গলা অবধি টেনে দিল ইরা।
বড় রাস্তা দিয়ে ফাঁকা অটো যাচ্ছিল একটা। ইরা হাত তুলে থামাল সেটাকে। অটোর চালক বলল, “দিদি, প্রিয়া সিনেমা অবধি গাড়ি যাচ্ছে, তারপর আর যেতে দিচ্ছে না।”
ইরা উঠে বসল অটোয়, বলল, “আমি প্রিয়া অবধিই যাব, চলুন।”
তিনটে বাজতে পাঁচে প্রিয়ার উলটো দিকের ফুটপাথে নামল ইরা। তারপর রাস্তা পার হয়ে গিয়ে দাঁড়াল প্রিয়ার সামনে।
এখানে খুব ভিড় এখন। সিনেমার শো শুরু হওয়ার সময় বলেই বোধহয়। একটা কোনা করে দাঁড়াল ইরা। চারিদিকে নানান রঙের মানুষ। সামনের দেশপ্রিয় পার্কের ভেতরের কিছুটাও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সেখানে প্রচুর লোক জমা হয়েছে। মাইক নিয়ে চিৎকার করে কিছু বলা হচ্ছে। তবে বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট। কিছু মাতব্বর গোছের লোক সামনের মেন রোডে লাঠি হাতে ঘুরছে। এরাই যানবাহন আটকাচ্ছে। ঘড়ি দেখল ইরা, তিনটে বাজতে দু’মিনিট বাকি। আর্চি কই? যদি গড়িয়াহাটের দিক থেকে আসে তা হলে কোনও ব্যাপার নেই। কিন্তু যদি রাসবিহারী মোড়ের দিক থেকে আসে? তা হলে? তা হলেই তো বিপত্তি। ইরা মনে মনে বলল, তবু আর্চিকে প্রমাণ করতে হবে ওর সিনসিয়ারিটি।
পাশে খচমচ শব্দ হওয়ায় ইরা দেখল ওর থেকে হাত পাঁচেক দূরে, ফুটপাথে, একটা নেড়া মাথার লোক বসে রয়েছে। লোকটার গায়ে শতছিন্ন একটা চাদর। লোকটা খুব গম্ভীরভাবে একটা পুরনো খবরের কাগজের পাতা উল্টোচ্ছে। আরে, এই লোকটার ছবিই সকালবেলায় তুলছিল না আর্চি? ভাল করে দেখল ইরা। হ্যাঁ, তাই তো, এই তো লোকটা।
ইরা এবার অন্য দিকে তাকাল। দেশপ্রিয় পার্কের ভেতরে লোক বেড়েছে আরও। আর সবাই মিলে বড় লাইন করে প্ল্যাকার্ড তুলে এগোচ্ছে পার্কের গেটের দিকে। মিছিল শুরু হল। মাইকে স্লোগান ফেটে পড়ছে ঘনঘন। কিন্তু আর্চি কই? এ-দিক ও-দিক তাকাল ইরা। একটু দূরে অদ্ভুত গোলাপি রঙের একটা বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্য সময় হলে হয়তো অদ্ভুত রঙের গাড়িটা দেখে ওর প্রতিক্রিয়া হত। কিন্তু এখন যেন আমলই দিল না ও।
ঘড়ি দেখল ইরা। ঠিক তিনটে বাজে। আর্চি তুমি কই? তবে কি মা-ই ঠিক? তবে কি তুমি ইরেসপন্সিবল? প্রেমের দাম নেই তোমার কাছে? এ-দিক ও-দিক তাকাল ইরা। কী করবে ও? আর্চি কি আজও আসবে না? তবে কি আর্চি সত্যি ওকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছিল? ইরা দেখল মিছিলটা প্রায় পৌঁছে গেছে পার্কের গেটে। আর্চি এল না তা হলে?
প্রথম সূত্র সমাপ্ত