১. প্রথম পিরামিড

প্রথম পিরামিড

‘আচ্ছা, বলো দেখি মিশরের রাজধানী কী ছিল?’

‘ছিল মানে কী? আছে তো, কায়রো।’

‘সে তো এখন, কায়রো শহরের বয়স মাত্র ১০০০ বছর।’

‘মাত্র বলছেন? আমাদের কলকাতার বয়স ৪০০ বছর, এটাকে মাত্র বলা যায়।’

‘তাহলে শুনে রাখো, ইজিপ্ট দেশটার জন্ম আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে, সেই সময় ভারতের নাম কেউ শোনেনি। তাই কায়রো ওর কাছে শিশু। যাই হোক, এবারে বলো, কায়রোর আগে কী ছিল?’

এবারে আমাদের মাথা চুলকোনোর পালা, কায়রোরও আগের রাজধানী?

ভবেশ সামন্ত এবারে বিড়িতে একটা টান মেরে বললেন,

‘মেমফিস।’

* * 

আমার নাম স্পন্দন বসু। বয়স একুশ, বাড়ি বর্ধমানে। একদম শহরের মধ্যেই। তবে এখন থাকি কলকাতায়। জয়েন্টে ৪২ র‌্যাঙ্ক করে মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়েছিলাম। এখন সেকেন্ড ইয়ার। থাকি কলেজের হোস্টেলেই।

গেল সপ্তাহে বাড়ি ফিরেই দেখলাম মামা এসেছে। মামারা দশদিন ধরে ইজিপ্ট ঘুরে এল। মোবাইলে তার ছবি দেখাচ্ছিল। পিরামিড, মমি, তুতানখামেন, নীল নদ এসব দেখে মাথা ঘুরে গেল। ইস, আমিও যদি যেতে পারতাম! কী দারুণ দারুণ গল্প বলছিল মামা। সেইসব শুনে আমার মনে হল আরিব্বাস, এগুলো নিয়ে তো আরও জানতে হবে! 

মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে থাকার একটা মস্ত বড়ো সুবিধা হল দু-পা হাঁটলেই কলেজ স্ট্রিট! এমন কোনো বই আছে নাকি যেটা ওখানে পাওয়া যায় না! গুডরিডসের ওয়েবসাইট থেকে ইজিপ্ট নিয়ে লেখা কয়েকটা বইয়ের নাম দেখে নিয়েছিলাম। সোমবার ক্লাস শেষ হতেই রুমমেট পিজি-কে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম কলেজ স্ট্রিটে। পিজির ভাল নাম প্রদীপ্ত ঘোষ, ওইটাই ছোটো হয়ে পিজি হয়ে গেছে। কলেজ স্ট্রিটে নেমে কিন্তু বেশ হতাশ হতে হল। যে বইটা খুঁজছি সেটা পাচ্ছিই না। কিন্তু সবাই একটাই কথা বলল, প্রেসিডেন্সির গেটের বাইরেই বারো নম্বর দোকান। ভবেশদার। ওখানে না পেলে নাকি আর কোথাও পাওয়ার চান্স নেই।

দোকান না বলে গুমটি বলাই ভালো। তিন চারটে পিলারের মতো করে বইয়ের স্তূপ দাঁড়িয়ে আছে, একটু ঠেলা দিলেই হুড়মুড় করে পড়বে সবকটা। কাঠের তাকগুলোতেও গিজগিজ করছে বই। কলেজ স্ট্রিটের আর পাঁচটা গুমটির সঙ্গে কোনো তফাত নেই। দোকানের একটা টুলে বসে এক ভদ্রলোক মন দিয়ে বই পড়ছেন।

‘দাদা, একটা বই খুঁজছিলাম।’

কথাটা যেন ওঁর কান অবদি পৌঁছোলই না। আবার ডাকলাম,

‘দাদা, শুনতে পাচ্ছেন?’

মাথা তুলে চাইলেন।

‘চিল্লাও কেন খামোখা, উইলবার স্মিথ-এর রিভার গড চাই তো?’

‘আপনি জানলেন কী করে?!’

এবারে ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন। ছোটোখাটো ছাপোষা চেহারা। গায়ে নীল স্ট্রাইপের পুরোনো সুতির জামা, সঙ্গে বাদামি রঙের সুতির প্যান্ট, উঠে আছে গোড়ালির একটু ওপরে। পায়ে একটা হাওয়াই চটি। মুখটাও মনে রাখার মতো নয়। রোগাটে, লম্বা, গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। চোখে একটা হাই পাওয়ারের চশমা। বয়স মনে হয় পঞ্চাশের আশেপাশে। জিজ্ঞাসা করলেন,

‘এই চত্বরে কি নয়া?’

‘না না, তবে ঘন ঘন আসা হয় না। কিন্তু, কেন বলুন তো?

‘সেই থেকে দেখছি চষে বেড়াচ্ছ। আমি ওইদিকে চা আনতে গেছিলাম, কানে গেল কথাটা। তখনই জানতুম, তোমাদেরকে এই ভবেশ সামন্তর কাছেই আসতে হবে।’

আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দুটো দেখতে দেখতেই ভবেশদা বলতে লাগলেন,

‘রিভার গড ছাড়াও উইলবারবাবুর সেভেন্থ স্ক্রোল, ওয়ারলক, হালের ডেজার্ট গড, ফারাও সব পাবে। ইজিপ্ট নিয়ে আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ফিকশন পড়ার শখ কেন?’

image25.jpg

অলংকরণ : রাজকুমার

‘মানে, ফিকশনই তো ইন্টারেস্টিং লাগে বেশি, ফ্যাক্ট বেসড লেখা অতটা ভালো লাগবে না তো।’

‘হুঁ, ইজিপ্ট নিয়ে আগে কতটা পড়েছ?’

‘ওই স্কুলের বইতে যতটুকু থাকে, তারপরে বিশ্বকোষ, কাকাবাবু, শেয়াল দেবতা রহস্য, ফারাওয়ের চুরুট, অ্যাস্টেরিক্স আর ক্লিওপেট্রা…’

‘ঠিক ঠিক, ক্লিওপেট্রা! লিজ টেলর! আমি দেখেছি।’

পিজি মাড়ি বের করে হাসতে হাসতে বলল।

লোকটা মনে হল চোখ দিয়েই পিজিকে পুড়িয়ে মারবে। তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বাহ, কাকাবাবু, টিনটিন পড়ে ইজিপ্ট চিনছ! এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে? ইজিপ্টের ইতিহাস যেকোনো থ্রিলারকে হার মানাবে, এটা কি জানো?’

‘তাই নাকি! কিন্তু বাংলায় তো তেমন কিছু নেই।’

‘হ্যাঁ, বাংলায় নেই সত্যি, দু-একটা বই ছাড়া। তবে ব্রিটিশদের লেখা গুচ্ছের বই আছে। তার এক একটা গল্প বললে তোমাদের নেশা চড়ে যাবে বলে রাখলুম।’

এবারে আমার চোখ চকচক করে উঠল,

‘আপনি মনে হচ্ছে অনেক জানেন ইজিপ্ট নিয়ে!’

‘বইয়ের দোকান দিয়েছি কি শুধু বেচবার জন্য নাকি! খনির মধ্যে বসে থাকি হে সারাদিন, না জানাটাই আশ্চর্যের নয় কি?’

বইয়ের দোকান দিলেই যে বই পড়তে হবে তার কোনো মানে নেই, তবে এই লোকটাকে দেখে বাজে বকছে বলে মনে হল না।

‘আমার নাম স্পন্দন, আর এ আমার বন্ধু প্রদীপ্ত। আমরা মেডিক্যাল কলেজে পড়ি, এই উলটোদিকের হোস্টেলেই থাকি। আপনার কাছে দারুণ দারুণ গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে যে!’

‘বিড়ি হবে?’

‘না, মানে, আমরা তো বিড়ি খাই না।’

‘ধুস! যাকগে, সাড়ে সাতটা নাগাদ দোকান বন্ধ করব। একটা বিড়ির প্যাকেট নিয়ে চলে এসো। গল্প কাকে বলে আজ বুঝবে।’

এই বলে আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজলেন ভবেশ সামন্ত। গুমটিতে একটাও লোক নেই। তাও কীসের ব্যস্ততা বুঝলাম না। বই পড়াটা লোকটার কাছে এখন বেশি জরুরি। আর কথা না বাড়িয়ে তখনকার মতো ফিরে এলাম হোস্টেলে।

পিজির একদম ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ও বেশ ছোটোখাটো মানুষ, তাই ওকে একরকম বগলদাবা করেই পাক্কা সাড়ে সাতটায় হাজির হয়ে গেলাম বারো নম্বর গুমটির সামনে। লোকটা তখন কাঠের পাল্লায় তালা লাগাচ্ছে। 

‘ভবেশবাবু।’

‘খবরদার, এসব বাবু-টাবু বলবে না, নিজেকে বেশ বুড়ো লাগে, ভবেশদা চলবে।’

‘ওহ, ওকে, ভবেশদা।’

লোকটার হেবি ঘ্যাম। নির্বিকার চিত্তে বাকি কাজ করে নিয়ে বলল,

‘বেনুর দোকানে চলো, আদা দিয়ে হেব্বি চা বানায়, খেতে খেতে গল্প জমবে। আমার প্যাকেট কই?’

পিজি বাড়িয়ে দিল জীবনে প্রথম কেনা বিড়ির প্যাকেট।

বেনুদার গুমটি সবাই চেনে, পুঁটিরামের দোকানটাকে ডান দিকে রেখে কয়েক পা হাঁটলেই ডান দিকে বেনুদার চা পাঁউরুটির দোকান। যেদিন মেসের খাবার আর মুখে তোলা যায় না সেদিন আমরা এখানে এসে ম্যাগি, ডিম পাঁউরুটি খাই। বেনুদাকে তিনটে চা বানাতে বলে আমরা গুমটির সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসলাম। ভবেশদা এবারে একটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন,

‘শুরুটা তাহলে গোড়া থেকেই করা যাক। তোমাদের বিদ্যে তো ওই লিজ টেলর লেভেলের দেখলাম।’ ভবেশদা পিজির দিকে তাকালেন বাঁকা চোখে।

মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ রাগ হল, মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্টকে বই পড়া দেখাচ্ছে। একটা অ্যানাটমির বই দিয়ে বসিয়ে দিতে হয় একে। বুঝত পড়া কাকে বলে। কিন্তু এমন একটা ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। লোকটাকে এক্ষুনি চটানো ঠিক হবে না। তাই চুপ করেই রইলাম।

‘আগে দেখি তোমরা কতদূর কী জানো। আচ্ছা, বলো দেখি মিশরের রাজধানী কী ছিল?’

image26.jpg

‘মেমফিসের নামটাও শোননি? মানে কাকাবাবুটাও দেখছি ভালো করে পড়া হয়নি। শুধু পড়ার বই গিলেছ বসে বসে।’

‘না, মানে, অনেকদিন আগে তো…’

একদম ভুলেই গেছিলাম সত্যি মেমফিসের কথা, নিজের মনেই একবার জিভ কাটলাম।

‘যাই হোক। মেমফিসে কী আছে জানো তো?’

‘হ্যাঁ এটা মনে আছে, স্টেপ পিরামিড।’

‘ঠিক। এই স্টেপ পিরামিডকেই বাকি সব পিরামিডের বাবা বা দাদু বলা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম আগাগোড়া পাথর দিয়ে বানানো সৌধ। কে বানিয়েছিল জানো?’

না, এইটা তো মনে হয় কাকাবাবুতে ছিল না। দু-জনেই এবারে মাথা নাড়লাম।

‘চলো, তাহলে আজকে সেই লোকটার গল্পটাই হয়ে যাক। এই গল্প সাড়ে চার হাজার বছর পুরোনো।’

‘ইজিপশিয়ানদের প্রধান দেবতা ‘‘রা’’। সূর্যদেব। পৃথিবী যে গোল সেটা ওরা জানত না। তাই সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত গেলে ওরা ভাবত ওদের দেবতা এবারে মাটির নীচের জগতে যাত্রা শুরু করলেন, যেখানে মৃত্যুর পরে আত্মারা যায়। সেই কারণেই মেমফিস শহরের পশ্চিম প্রান্তে তৈরি হয়েছিল একটা নেক্রোপলিস। জায়গাটার নাম সাকারা। সেখানে মৃতদের কবর দেওয়া হত। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ছিল এই কবরখানা।

image27.jpg

‘কবরে মৃতদেহ ছাড়াও রাখা থাকত জীবদ্দশায় ভোগ করে যাওয়া সব রকমের জিনিস। খাবারদাবার, পোশাক, অস্ত্র, আসবাবপত্র এমনকী বাজনা পর্যন্ত, যাতে অতিপ্রাকৃত জীবনে মানুষটার কোনো কষ্ট না হয়। কিন্তু প্রথমদিকের কবরগুলো চ্যাপটা ছিল বুঝলে, একতলা বাড়ির মতো। নীল নদের তীরের কাদামাটি পুড়িয়ে তৈরি করা ইট দিয়ে বানানো। ইজিপশিয়ানরা এখন ওকে বলে মাস্তাবা, আরবি ভাষায় যার মানে বেঞ্চ। তবে একজন ফারাও প্রথমবার অন্যরকম কিছু ভাবেন। তাঁরর নাম ছিল জোসার।’

পিজি নিজের মনে মোবাইল নিয়ে খুট খুট করছিল। টক করে আমার কাছে হোয়াটস-অ্যাপে একটা মেসেজ এল। খুলে দেখলাম পিজি লিখেছে,

‘জোসার? কেমন জুসার জুসার শুনতে লাগছে।’

ভবেশদা বেশ বিরক্ত হলেন এতে,

‘নাহ, আমি উঠি, তোমাদের মন নেই দেখছি। ফালতু সময় নষ্ট করছি।’

‘না না দাদা, খুব সরি। এই, এই মোবাইল সাইলেন্ট করে দিলাম। আপনি বলুন।’

পিজির দিকে কটমট করে তাকাতে সেও মুখটা ব্যাজার করে মোবাইলটা পকেটে পুরল এবারে।

‘তা, কোথায় যেন ছিলাম?’

‘ওই ফারাও জুস… মানে জোসার।’

‘হুম, তা জোসারের মনে হল ওর সমাধিটা বাকিদের থেকে একদম আলাদা হতে হবে। ওঁরটা ইট দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে বানানো হবে। কিন্তু অত ভারী পাথর দিয়ে একটা বাড়ি বানানো যাবে নাকি! আগে তো কেউ কখনো এমনটা ভাবেনি। জোসার তাঁরর সভায় সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকটাকে কাজটার দায়িত্ব দিলেন। নাম ইমহোটেপ।’

‘আরে, ইমহোটেপকে তো চিনি ! ‘‘মামি’’ সিনেমার ভিলেন। টাক মাথা ছিল, আনেকসুনেমুকে ভালোবাসত। হাঁ করে মুখ দিয়ে অ্যাত্তো পোকা বের করেছিল…’

পিজি এবারে মুখ হাঁ করে পোকা বের করা দেখাচ্ছিল।

‘তোমার এই বন্ধুটি তো দেখছি হলিউডেই থাকে সারাদিন। সিনেমাটা একটা দারুণ মানুষের নামটাই খারাপ করে দিয়েছে। ইমহোটেপ কীরকম ট্যালেন্টেড লোক ছিল জানো? একইসঙ্গে রাজার অ্যাডভাইসার, কবি, আর্কিটেকচার, অ্যাস্ট্রোলজার…’

‘বুঝেছি বুঝেছি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো।’

ভবেশদা চায়ের কাপে সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে বললেন,

‘ধুস, লিওনার্দো তো কালকের ছেলে। ইমহোটেপ ওকে বলে বলে দশটা গোল দিত। তা যাই হোক, রাজা তো ইমহোটেপকে ওর কবরখানা বানাতে বলে খালাস। কিন্তু সেই জিনিস বানানো যায় কী করে! পাথরের ওপরে পাথর বসিয়ে উঁচু কিছু বানাতে গেলেই যে ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এইভাবেই ছ-বার সমাধি বানাতে গিয়ে সেটা ভেঙে গেল। তখন ইমহোটেপ একটা বুদ্ধি বের করল। আচ্ছা, যদি এমনটা করা যায়, যে, মাস্তাবার ওপরে আরেকটা মাস্তাবা, তার ওপরে আরেকটা, তারও ওপরে আরেকটা। প্রতিটা ধাপই তার নীচেরটার থেকে ছোটো হবে। সেইভাবে বানিয়েও ফেলা হল কবরখানা। আর এভাবেই তৈরি হল ইজিপ্টের প্রথম পিরামিড। ধাপে ধাপে উঠেছে তাই একে স্টেপ পিরামিড বলে।’

‘তাহলে এই পিরামিডের মধ্যেই জোসারের মমি ছিল?’

image28.jpg

ইমহোটেপ

‘না, সেটা ভুল ধারণা, সাকারার স্টেপ পিরামিড কিন্তু একদম নিরেট। পিরামিডের নীচে মাটির তলায় ইমহোটেপ কবরখানা বানিয়েছিল। সেখানে মমি ছাড়াও ছিল অনেকগুলো ঘর, রাজার আসবাবপত্র রাখার জন্য। সেই ঘরগুলো আবার জোড়া ছিল সরু সরু প্যাসেজ দিয়ে। পিরামিডের চারিদিকে বিশাল বড়ো পাথরের দেওয়ালও বানিয়েছিল ইমহোটেপ। সেই দেওয়ালের গায়ে চোদ্দোখানা দরজা ছিল, যার মাত্র একটা দিয়েই পিরামিডের কাছে পৌঁছোনো যেত। বাকি সবকটা অন্ধগলিতে গিয়ে শেষ হত।’

‘ভুলভুলাইয়া!’

‘হ্যাঁ, ভুলভুলাইয়াই বটে। তবে এখন সব মাটিতে মিশে গেছে। পিরামিডটাই শুধু বেঁচে আছে, এই যা।’

‘যাই হোক, ভদ্রলোকের এলেম ছিল বলতে হবে। পাঁচ হাজার বছর আগে আর্কিটেকচারের এরকম নলেজ তো জাস্ট ভাবা যায় না!’

‘তবে ইমহোটেপের আরও বড়ো কাজ ছিল কিন্তু ডাক্তার হিসেবে।’

‘বলেন কী ! ডাক্তারও!’

‘হ্যাঁ, ইমহোটেপ দু-শোর ওপরে রোগ সারিয়েছিল। তার মধ্যে আছে গাউট, আর্থ্রাইটিস, টিবি। কিছু ছোটোখাটো অপারেশনও করত। মানুষের অ্যানাটমির ব্যাপারে ওর দারুণ জ্ঞান ছিল। ও-ই প্রথম বলে রোগ ভোগ দেবতার অভিশাপ নয়, মানুষের শরীরেরই ফল্ট। তাই চিকিৎসা করলেই সারবে। আর এই সব কিছু ঘটছিল আমাদের সুশ্রুতেরও দেড় হাজার বছর আগে।

পিজি মনে হল এতক্ষণে বেশ আগ্রহ পেয়েছে, এবারে বলল,

‘একটাই লোক ডাক্তারও আবার আর্কিটেক্টও! অবশ্য হতেই পারে, লোকটা আমার মতন, আমারও জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে…’

ভবেশদা কিন্তু বলে যেতে লাগলেন, যেন পিজির কথাটা কানেই যায়নি, 

‘ভাবো তাহলে, কী মারাত্মকরকম ট্যালেন্টেড ছিল ইমহোটেপ। ইজিপ্টের মানুষেরা ওকে ভগবানের মতো পুজো করত। কিন্তু লোকটা একদিন রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেল।’

image29.jpg
image30.jpg

‘বলেন কী? হারিয়ে গেল? এত বিখ্যাত একটা মানুষ?’

‘হ্যাঁ, কেউ আজ পর্যন্ত ইমহোটেপের কবর খুঁজে পায়নি। ওইরকম জনপ্রিয় একজন মানুষের কী হল সেটা কোত্থাও লেখা নেই। ইতিহাসের পাতা থেকেই লোকটা ভ্যানিশ হয়ে গেল। অনেকে আজও বিশ্বাস করে সাকারার মাটির নীচেই কোথাও ইমহোটেপের কবর লুকিয়ে আছে।’

‘এটাও তো বেশ মিস্ট্রির মতো। তবে ভবেশদা, এই গল্পটা শুনতে শুনতে একটা কথা মাথায় এল।’

‘বলে ফেলো।’

‘আচ্ছা, এই যে এতগুলো পিরামিড, মাস্তাবা, মমি এইসব তো ইজিপশিয়ানরা বানাত, কারণ ওরা পরলোকে বিশ্বাস করত।’

‘ঠিক পরলোক নয়, মৃত্যুর পরের আরেকটা জীবন। সেই জীবনটা যাতে নির্ঝঞ্ঝাট হয় সেইজন্যই বানানো ওগুলো। বুক অফ ডেড-এর নাম শুনেছ?’

‘শুনব না আবার!’ পিজি এবারে লাফিয়ে উঠল,

‘মামি রিটার্নসে ছিল তো, বুক অফ দ্য ডেড। দামড়া একটা বই, সোনায় মোড়া। সেইটা পড়লেই দুমদাম মরে যাওয়া মানুষ বেঁচে যায়। ওই করেই তো আনেকসুনেমুকে বাঁচাল। উফফ, আনেকসুনেমু, ভাবলেই না গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে…’

ভবেশদা এতক্ষণ মনে হয় নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিলেন। কিন্তু পিজির এই মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণ আর নিতে পারলেন না। দুম করে উঠে দাঁড়ালেন।

‘বাঁদর ছেলের দল সব। ভালো কিছু শেখার ইচ্ছা নেই। তোমাদের জন্য টিনটিনই ভালো।’

বলেই হনহন করে হাঁটা লাগালেন বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের দিকে। আমরা অনেকবার করে ডাকলেও ফিরে তাকালেন না।

হোস্টেলে ফিরেই পিজির নোটের খাতাটা জ্বালিয়ে দেব বলে ঠিক করলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *