১. প্রথম দিন

রাজু ও আগুনালির ভূত
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. প্রথম দিন

দুপুরবেলার দিকে রাজুর মন একটা গভীর ভাবের জন্ম হল। রাজুর বয়স তেরো এবং এই বয়সেই তার মনে নানারকম গভীর ভাবের জন্ম হয়। তখন সে দুই হাত মাথার পিছনে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই গভীর ভাব নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। এরকম সময়ে তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তার পেট ব্যথা করছে, কারণ কোনো-একটা কারণে তার দুই চোখ কুঁচকে যায় এবং মুখে কেমন জানি একটা যন্ত্রণার ভাব চলে আসে।

রাজুর মনে যখন গভীর ভাবের জন্ম হয় তখন যারা রাজুকে ভালো করে চেনে তারা তাকে ঘাটায় না। ঘাঁটিয়ে অবিশ্যি লাভও হয় না। কারণ, সে তখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তবে সাগরের কথা আলাদা, সে রাজুর ছোট ভাই, তার বয়স মাত্র সাত, কিন্তু কোনো কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য প্রায় একশো বছরের মুণিঋষিদের মতো। রাজু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিলেও সে ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করে যেতে থাকে এবং প্রায় সবসময়েই সাগর রাজুকে তার গভীর ভাবের জগৎ থেকে টেনে নিচে নামিয়ে আনতে পারে। রাজু তার জীবনের যে-তিনটি জিনিসকে সত্যি সত্যি অপছন্দ করে তার একটি হচ্ছে সাগর, অন্য দুটি হচ্ছে ঢ্যাঁড়শ ভর্তা এবং মাকড়শা। ঢ্যাঁড়শ ভর্তা এখনও কেউ তাকে খাওয়াতে পারেনি, মাকড়শা দেখামাত্র সে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে, কিন্তু সাগরকে নিয়ে সে এখনও কিছু করতে পারেনি। রাজু মোটামুটি নিশ্চিত তার বয়স আঠারো বছর হওয়ার আগেই সে কোনো একদিন সাগরকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবে। রাগের মাথায় খুন করলে নাকি ফাঁসি হয় না, কাজেই তারও মনে হয় ফাঁসি হবে না, বড়জোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে নাকি চৌদ্দ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে আসা যায়, তখন তার বয়স হবে সাতাশ, কাজেই তার পরেও মোটামুটি কিছু-একটা করে বেঁচে থাকা যাবে।

আজ দুপুরবেলাতেও সাগর না জেনেশুনে তার জীবনের উপর একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলল। রাজু তখন তুই হাত মাথার নিচে দিয়ে আকাশের একটা চিলের দিকে তাকিয়েছিল। চিলটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে এখন চিলটাকে আর দেখছে না, কারণ, তার মাথায় এখন খুব একটা জটিল চিন্তা খেলা করছে। ঠিক এই সময় সাগর রাজুর কাছে এসে বলল, “ভাইয়া, এই দেখো কী হয়েছে।”

রাজু তার কথা শুনল না। শুনলেও তার মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল না। সাগর তখন রাজুর কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই দেখো ভাইয়া।”

রাজু তখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, শুধু তার মুখের যন্ত্রণার ভাবটা আরেকটু গাঢ় হয়ে উঠল। সাগর অবিশ্যি তাতে নিরুৎসাহিত হল না, তার ডান হাতটা রাজুর নাকের সামনে ধরে বলল, “চকলেটটা মুঠো করে ধরে রেখেছিলাম, দেখো কী হয়েছে!”

রাজুকে দেখতে হল। চকলেট মুঠো করে রাখলে চকলেট গলে যায়–অনেকক্ষণ মুঠো করে রাখলে সেই গলে-যাওয়া চকলেট আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে বের করে একটা জঘন্য ব্যাপার হয়–কনুই পর্যন্ত সারা হাত আঠালো চটচটে হয়ে যায় এবং মাছিরা কোনো কারণে সেটা খেতে খুব পছন্দ করে। সাগরকে ঘিরে কিছু মাছি ভ্যান ভ্যান করছিল এবং সেটা নিয়ে সাগরের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। সে তার চটচটে হাত জিব বের করে একবার চেটে বলল, “চেটে খেলে মনে হয় আইসক্রিম। তুমি খাবে?”

রাজু অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, “না, খাব না। ভাগ এখান। থেকে।”

সাগর তবু নিরুৎসাহিত হল না, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একবার চেটে দেখো কেমন মিষ্টি মিষ্টি আবার নোনতা নোনতা লাগে।”

“নোনতা লাগে তোর হাতের ময়লার জন্যে। গাধা।”

সাগর মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি গাধা।”

“দেব একটা থাপ্পড়। ভাগ এখান থেকে।”

বয়সে বড়দের মান-সম্মান রেখে কথা বলাটা সাগর এখনও শেখেনি, মনে হয় তার শেখার কোনো ইচ্ছাও নেই। চকলেট-মাখা হাতটা উপরে তুলে বলল, “আমি দেব একটা থাপ্পড়।”

রাজু চোখ লাল করে বলল, “দিয়ে দেখ আমি তোর অবস্থা কী করি।”

রাজু কী করে সেটা দেখার জন্যেই মনে হয় সাগর একটা থাবড়া বসিয়ে দিচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে থেমে গিয়ে চকলেট-মাখা হাতটা মুখে পুরে একবার চেটে নিয়ে বলল, “তুমি পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে খারাপ ছেলে।”

রাজু কোনো কথা না বলে সাগরের দিকে চোখ লাল করে তাকাল, মানুষের চোখ দিয়ে যদি আগুন বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকত তা হলে সাগর পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

সাগর অবিশ্যি রাজুর ভয়ানক দৃষ্টিকে এতটুকু গ্রাহ্য করল না, আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “তুমি দেখতে পর্যন্ত খারাপ। তুমি যখন রাগ হও তোমাকে দেখতে আরও খারাপ লাগে। থুঃ থুঃ থুঃ!”

রাজু রেগেমেগে বলল, “ভাগ এখান থেকে। জানে মেরে ফেলব।”

“এই দেখো তোমাকে দেখতে কত খারাপ লাগছে, থুঃ!” বলে সাগর ঘরের মেঝেতে সত্যি সত্যি একদলা থুতু ফেলে দিল।

রাজু আরেকটু হলে সাগরকে মার দেওয়ার জন্যে প্রায় ধরে ফেলছিল, কিন্তু হঠাৎ তার একটা কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল। সাগর বলল, “আব্বু-আম্মু যখন ঝগড়া করে তখন তাদের দেখতে যত খারাপ লাগে তোমাকে তার থেকে বেশি খারাপ লাগে।”

রাজু কয়েক মুহূর্ত সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বলল, “কী বললি?”

সাগরের মুখটা হঠাৎ কেমন জানি কাঁদো-কাঁদো হয়ে যায়। কিছুক্ষণ মেঝেতে ফেলা তার থুতুর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ পা দিয়ে সেটা মেঝেতে লেপটে ফেলে বলল, “কিছু না।”

রাজু গলার স্বর একটু নরম করে বলল, “কী বললি?”

সাগর এবার রাজুর দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি গলার স্বর নরম করেছে না কি তাকে টিটকারি করছে বোঝার চেষ্টা করে বলল, আব্বু আর আম্মুর যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তা হলে কী হবে?”

রাজু হেসে ফেলল, বলল, “ধুর গাধা! ছাড়াছাড়ি কেন হবে?”

সাগর আশান্বিত হয়ে বলল, “ছাড়াছাড়ি হবে না?”

“না।”

“তাহলে এত ঝগড়া করে কেন?”

“পৃথিবীর সব আব্বা-আম্মা ঝগড়াঝাটি করে।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

সাগর হঠাৎ করে খুব খুশি হয়ে ওঠে। রাজু তাকে যত বড় গাধা ভেবে এসেছে সে মনে হয় তত বড় গাধা না। আব্বা-আমার ঝগড়াঝাটিটা যদিও তাদের সামনে করা হয় না, তবুও সে ঠিকই টের পেয়েছে।

সাগর চলে যাবার পর রাজু আবার তার মাথার নিচে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, এতক্ষণ সে যে-চিলের দিকে তাকিয়ে ছিল সেই চিলটা আর নেই। আকাশে এখন ছোট এক টুকরো সাদা মেঘ। সেই মেঘটা দেখতে একটা জাহাজের মতো। সেই জাহাজটা আবার আস্তে আস্তে একটা প্রাণীর মতো হয়ে যাচ্ছে সেই প্রাণীটার বড় মাথা এবং লম্বা লেজ গজাতে গজাতে হঠাৎ সেটা কয়েকটা টুকরো হয়ে ভেসে গেল। টুকরো টুকরো মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাজু আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়–তার দুই চোখ কুঁচকে আসে, মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাকে দেখে মনে হতে থাকে আবার বুঝি তার পেটব্যথা করছে।

তার অবিশ্যি পেটব্যথা করছিল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে হঠাৎ কেমন জানি ভয় ঢুকে গেছে। সাগরকে সে অবিশ্যি অনেক জোর গলায় বলেছে তার আব্বা আম্মার কখনও ছাড়াছাড়ি হবে না, কিন্তু সত্যি যদি হয়ে যায় তখন কী হবে? রাজুর হঠাৎ কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ব্যাপারটা সে চিন্তাও করতে পারে না।

রাজুর আব্বার নাম আজিজুল হক–সবাই অবিশ্যি তাঁকে ডক্টর আজিজ বলে ডাকে। আব্বা অবিশ্যি সত্যিকারের রোগী দেখার ডাক্তার না, অঙ্কে পিএইচ.ডি. করেছেন। মানুষ যখন পিএইচ.ডি. করে তখন তাকে ডক্টর বলে কেন কে জানে, অন্য একটা-কিছু বললেই হয়! মনে হয় সবাইকে একটা ধাঁকার মাঝে ফেলে দেওয়ার একটা বুদ্ধি ছাড়া ব্যাপারটা আর কিছুই না। আব্বা যখন মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে যান তখন গ্রামের যত মানুষের রোগ-শোক আছে তারা আব্বার কাছে চিকিৎসার জন্যে চলে আসে। আব্বা যতই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যে তিনি চিকিৎসা করার ডাক্তার না, তারা কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করে না। রাজু আরও একটা ব্যাপার ভালো করে বুঝতে পারে না, সেটা হচ্ছে, মানুষ অঙ্কে কেমন করে পিএইচ.ডি. করে। তখন কি এক মাইল লম্বা একটা সরল অঙ্ক করতে দেওয়া হয়, আর একজন সেটা টুকটুক করে শেষ করে, নাকি অন্যকিছু? রাজু আর আব্বাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, আব্বা শুনে হেসেই বাঁচেন না–শেষে বলেছেন, রাজু বড় হলে নাকি বুঝতে পারবে। রাজুর আব্বা ইউনিভার্সিটিতে অঙ্ক পড়ান, তাঁকে দেখতেও ঠিক অঙ্কের প্রফেসরের মতো দেখায়–চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, জুলফির কাছে চুলে পাক ধরেছে। মুখে একটা গম্ভীর ভাব, কিন্তু চোখ দুটি সবসময়েই কেমন যেন হাসিহাসি, একজন মানুষের চোখ হাসিহাসি হয়ে মুখ কেমন করে গম্ভীর হতে পারে রাজু কখনও বুঝতে পারে না।

রাজুর আম্মার নাম ফারহানা হক, শুধু আম্মার অফিসের কেউ-কেউ তাঁকে ডাকে মিসেস ফারহানা হক। অন্য সবাই তাঁকে ডাকে ঝর্না। রাজুর আব্বাও তাকে ডাকেন ঝর্না–সাগর যখন ছোট ছিল সেও ডাকত ঝর্না। রাজুর আম্মা দেখতে একেবারে অসাধারণ–তাঁকে দেখায় কলেজের একটা মেয়ের মতো, তাঁকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে তার তেরো বছরের এত বড় একটা ছেলে আছে। আম্মা যখন অফিসে যান তখন রাস্তাঘাটের সব মানুষ চোখ ট্যারা করে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকে। যারা দেখতে বাড়াবাড়ি সুন্দরী হয় তাদের মেজাজ মনে হয় একটু বেশি গরম হয়–আম্মার মেজাজও বেশ গরম। রাজু কিংবা সাগর যখন ঢ্যাঁড়শ ভর্তা কিংবা করলা ভাজা খেতে না চায় তখন আম্মা এত রেগে যান যে সেটা বলার মতো না। আব্বা মাঝে মাঝে বলেন, “থাক থাক, একদিন না খেলে কিছু হবে না–”আম্মা তখন আরও রেগে গিয়ে বলেন, “তুমি লাই দিয়ে দিয়ে ছেলেগুলির মাথা নষ্ট করেছ। মানুষজন শুধু কাঁচামরিচ আর লবণ দিয়ে ভাত খেয়ে বেঁচে আছে তুমি সেটা জান? এই দেশের কত পার্সেন্ট মানুষ ব্যালেন্সড ডায়েট খায় খবর আছে কারও?”

আম্মা গরিব-দুঃখি মেয়েদের একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। যেসব মেয়ের স্বামীরা তাদের বউদের ছেড়ে চলে যায়, কিংবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোথাও যাবার জায়গা থাকে না, তারা এখানে এসে থাকে। গরিব-দুঃখি মেয়েদের দেখে দেখে আম্মা নানারকম হিসেব শিখে গেছেন। শতকরা কতজন মানুষ বউদের পেটায়, কতজন মানুষ বউদের ছেড়ে চলে যায়, কতজন যৌতুকের টাকা দেয়নি বলে বউদের মেরে ফেলে–সব হিসেব আম্মার ঠোঁটের ডগায়। দরকার হলেই আম্মা এখন সেসব হিসেব আব্বার উপর, না হয় তাদের উপর ঝাড়তে থাকেন। রাজুর মাঝে মাঝে মনে হয়, আম্মা যদি গরিব দুঃখি মানুষজনের জন্যে কাজ না করে বড়লোকদের বাচ্চাদের কোনো স্কুলে কাজ করতেন তা হলে মন্দ হত না। আম্মা তা হলে জানতেন বড়লোকের বাচ্চাদের কত মজার মজার খেলনা থাকে, তারা কত ভালো জিনিস খায়, ছুটিছাটায় কত দেশ-বিদেশ ঘরে, গাড়ি করে কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যায়–সে তুলনায় তারা তো কিছুই করে না, কে জানে তা হলে হয়তো আম্মা এক বকাবকি করতেন না।

আব্বা আর আম্মার মাঝে সমস্যা যে, দুজনেই খুব তেজি মানুষ–কখনও কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। হয়তো খবরের কাগজে উঠেছে–একজন মানুষ বাড়ি এসে দেখেছে বউ ভাত রান্না করেনি, সে রেগে এত জোরে বউকে মেরেছে যে, বউ মরেই গেছে প্রায় প্রত্যেকদিনই এরকম খবর দু-চারটা থাকে, আর এরকম খবর আম্মার চোখে পড়লে কোনো রক্ষা নেই–সমস্ত পুরুষজাতির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়ে দেন। আব্বা তখন নিরীহ পুরুষদের পক্ষে একটা দুটো কথা বলেন আর সঙ্গে সঙ্গে আম্মার সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। একবার একটা ঝগড়া শুরু হয়ে গেলে সেটা কোনদিকে মোড় নেবে বলা খুব মুশকিল। মাঝে মাঝে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হয়ে থেমে যায়। মাঝে মাঝে সেটা অনেক দূর এগোয়, ঝগড়ার ডালপালা গজায়, কবে আব্বা আম্মাকে কী বলেছিলেন বা আম্মা আব্বাকে কী করেছিলেন সেইসব বৃত্তান্ত চলে আসে। রাজু কিংবা সাগরের সামনে দুজনেই অবিশ্যি খুব সামলে-সুমলে থাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু সবসময় যে সেটা সম্ভব হয় সেটা সত্যি নয়–একবার তো আম্মা আব্বার দিকে একটা গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন, গ্লাস ভেঙে পানি পড়ে একটা একাকার অবস্থা। ঝগড়াগুলি অবিশ্যি খুব বেশি দিন টিকে থাকে না–এক-দুইদিন পর, কোনো কোনোদিন এক-দুই ঘণ্টা পর মিটমাট হয়ে যায়। তখন আবার আম্মা আর আব্বা খুব হাসিখুশি থাকেন, তাঁদের দেখে বোঝাই যায় না যে তারা ঝগড়া করতে পারেন।

যেমন ধরা যাক আজকের ব্যাপারটা। ছুটির দিন সবাই মিলে বাসায় থাকে হৈ-চৈ করার কথা, ভালোমন্দ কিছু-একটা রান্না করার কথা, বিকালবেলা কোথাও বেড়াতে যাবার কথা–কিন্তু সেসব কিছুই হল না। সকালবেলাতেই আম্মা আর আব্বার মাঝে ঝগড়া লেগে গেল, ঝগড়ার বিষয়বস্তুটা কী সেটা রাজু ঠিক ধরতেও পারল না–আব্বা আম্মা দুজনেই একজন আরেকজনকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলেন, আব্বা তখন রেগেমেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আম্মা খানিকক্ষণ একা একা দাপাদাপি করলেন, তারপর আম্মাও ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন, যাবার আগে বলে গেলেন আর কখনও ফিরে আসবেন না। সেটা নিয়ে অবিশ্যি রাজু খুব মাথা ঘামাল না, আম্মা প্রত্যেকবারই ঘর থেকে যাবার আগে বলে যান আর কখনও ফিরে আসবেন না। আম্মা গেলে সাগরের মনে হয় একটু সুবিধেই হয়। ফ্রিজের মাঝে তুলে রাখা চকলেটগুলি বের করে খেতে শুরু করে।

.

বিকেলবেলা প্রথমে আব্বা ফিরে এলেন, তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কে জানে বাসার বাইরে গিয়ে আব্বা আর আম্মা ঝগড়াঝাটির বাকি অংশটা শেষ করে এসেছেন কি না! ঝগড়াঝাটি মনে হয় খুব পরিশ্রমের ব্যাপার, প্রত্যেকবার একটা বড় ঝগড়া করার পর আব্বা আর আম্মা দুজনকেই দেখে মনে হয় খুব বুঝি পরিশ্রম হয়েছে।

আব্বার চুলগুলি উশকো খুশকো, মুখ শুকনো। বাসায় এসে সোফায় হাঁটুর উপর হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। রাজু কয়েকবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে, মনে হয় তাকে দেখতেই পেলেন না। একসময় আব্বা উঠে গিয়ে ক্যাসেট-প্লেয়ারে একটা গান লাগিয়ে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। রাজু গানটান শোনে না, শুনতে ভালও লাগে না। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত তার দুচোখের বিষ, আর আব্বা বাসায় এসেই রবীন্দ্র-সংগীতের একটা ক্যাসেট লাগিয়ে বসে থাকেন। রাজু পাশের ঘরে বসে বসে রবীন্দ্র-সংগীত শুনতে লাগল–টেনে টেনে গাইছে শুনলেই কেমন জানি মন-খারাপ হয়ে যায়।

ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে রাজু নিজের ঘরে ফিরে এল। তার ঘরটা অবিশ্যি তার একার নয়–তার এবং সাগরের। ঘরটা ছোট, দুইপাশে দুটা ছোট ছোট বিছানা, মাঝখানে পড়াশোনা করার জন্য ছোট একটা টেবিল।

একপাশে একটা শেলফ–সেখানে গাদা করে রাখা অনেকরকম গল্পের বই। একটা বিছানায় সাগর ঘুমিয়ে আছে, অসময়ের ঘুম, বিছানায় অর্ধেক শরীর বাকি অর্ধেক মেঝেতে। একজন মানুষ যে এভাবে ঘুমাতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। রাজু খানিকক্ষণ চিন্তা করল শরীরের নিচের অংশ উপরে তুলে দেবে, নাকি উপরের অংশ নিচে নামিয়ে দেবে। অনেক ভেবেচিন্তে সে কোনেটাই করল না। হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙে যায় তা হলে সাগর হয়তো চিৎকার করেই বাসা মাথায় তুলে ফেলে বলবে, সে এইভাবেই ঘুমাতে চায়, কেন তাকে ঠিক করা হল। সাগরকে নিয়ে যা মুশকিল সেটা আর বলার মতো নয়।

রাজু তার চেয়ারে বসে মাথার নিচে হাত দিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আবার তাকে দেখে মনে হতে লাগল তার পেটব্যথা করছে।

আম্মা এলেন ঠিক সন্ধ্যেবেলায়। ততক্ষণে সাগর ঘুম থেকে উঠে গেছে। অসময়ে ঘুমিয়েছিল, তাই ঘুম থেকে উঠে সাগর খুব মেজাজ করতে লাগল। প্রথমে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদল, তারপর এক গ্লাস পানি উলটে ফেলে দুটো বই মেঝেতে ছুঁড়ে দিল। সবার শেষে একটা খেলনা লাথি মেরে ছুঁড়ে দিল দূরে, তারপর সোফায় মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। অন্যদিন হলে আম্মা আচ্ছা করে বকে দিতেন, আজকে সারাদিন বাসায় ছিলেন না বলে নিশ্চয়ই আম্মারও খুব খারাপ লেগেছে, তাই সাগরকে কিছু বললেন না। শুধু তাই না, আম্মা ক্যাসেটে একটা গান লাগিয়ে দিয়ে সাগরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ সোফায় বসে রইলেন। টেনে টেনে গাওয়া গান, এটা শুনলেও মন-খারাপ হয়ে যায়, নিশ্চয়ই এটাও রবীন্দ্রসংগীত হবে। রবীন্দ্রনাথ কেন যে এতগুলি দুঃখের গান লিখেছেন কে জানে! গান শুনেই কি না কে জানে সাগর আম্মাকে ধরে ফোপাতে লাগল, আর আম্মাও খুব মন-খারাপ করে বসে রইলেন।

রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে আব্বা খেতে এলেন না, সাগর কয়েকবার তার হাত ধরে টানাটানি করে বলল, “খেতে আসো আব্বু, খেতে আসো!”

আব্বা নরম গলায় বললেন, “তোরা খা, আমার খিদে নেই।”

“রাত্রিবেলা খেতে হয়। মনে নেই তুমি বলেছিলে না খেলে চড়ুই পাখির সমান রক্ত কমে যায়?”

আব্বা হেসে বললেন, “আমার গায়ে অনেক রক্ত, দুই-চারটা চড়ুই পাখির রক্ত কমে গেলে কিছু হবে না। তোরা খা।”

রাজু বুঝতে পারল আসলে আব্বা আর আম্মার ঝগড়া এখনও মেটেনি, দুজনে তাই একসাথে বসতে চাইছেন না। সাগর অবিশ্যি বেশি বোঝাবুঝির মাঝে গেল না, খাবার টেবিলে বসে আম্মার সাথে তর্ক করতে লাগল, “আম্মা, আব্বু ভাত খাবে না কেন?”

“খিদে নেই মনে হয়।”

“আমার যখন খিদে থাকে না তখনও তো তুমি আমাকে জোর করে খাওয়াও। খাওয়াও না?”

আম্মা উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্কর মতো বললেন, “ও!”

“কথা বল না কেন আম্মা?”

আম্মা সাগরের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, “এই তো কথা। বলছি!”

‘আব্বাকে ডাকো খাওয়ার জন্যে।”

“খেতে না চাইলে কি জোর করে খাওয়ানো যায়?”

“আমাকে তো জোর করে খাওয়াও। মনে নেই সেদিন ছোট মাছে কত কাঁটা ছিল, আমার খাওয়ার ইচ্ছা করেনি তবু তুমি বললে খেতে হবে?”

আম্মা সাগরের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে বাবা, আর বলব না।”

সত্যি সত্যি খাবার টেবিলে আম্মা কিছু বললেন না। রাজু ইচ্ছে করে যখন বাঁধাকপির ভাজাটা নিল না আম্মা সবজির উপকারিতা নিয়ে কোনো বক্তৃতা দিলেন না। ছোট মাছটা একটু খেয়ে ফেলে দেবার পরেও খাবারের অপচয় যে কত খারাপ এবং পৃথিবীতে তার বয়সী কত শিশু যে না খেয়ে আছে সেই কথাগুলি মনে করিয়ে দিলেন না। মজার ব্যাপার হল, রাজুর মনে হতে লাগল সবজির উপকারিতা কিংবা খাবারের অপচয়ের ওপরে আম্মার উঁচু গলার বক্তৃতাটাই আসলে চমৎকার ব্যাপার। আম্মার বকুনি না খেয়ে এই প্রথমবার রাজুর মন খারাপ হয়ে গেল।

রাজু আর সাগরের পরীক্ষা শেষ, পড়াশোনার ঝামেলা নেই। পরীক্ষা চলার সময় মনে হয় পরীক্ষা শেষ হলে কত কী করবে, কিন্তু সত্যি যখন পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে দেখা যায় কিছুই করার নেই। বিশেষ করে আজকের দিনটা বাড়াবাড়ি খারাপ, রাজু বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা গল্পবই পড়বে নাকি টেলিভিশন খুলে কী হচ্ছে দেখবে ঠিক করতে পারছিল না, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল–কেউ একজন এসেছে। রাজু দরজা খুলেই দেখে বাইরে আজগর মামা দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে রাজুর মনে হল নিশ্চয়ই খোদা বলে কেউ আছেন, শুধু তাই না, সেই খোদা নিশ্চয়ই ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে পছন্দ করেন, যখন দেখেন তারা খুব কষ্ট পাচ্ছে তখন একজন-দুইজন ফেরেশতাকে মানুষের মতো রূপ দিয়ে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তা না হলে আজকের দিনে এই সময়ে আজগর মামা কেমন করে এলেন! সারা পৃথিবীতে একটিমাত্র মানুষই আছে যে অসম্ভব খারাপ, দুঃখের, কষ্টের, যন্ত্রণার একটা সময়কে পুরোপুরি পালটে দিয়ে সেটাকে আনন্দের, মজার, হাসি-তামাশা, ফূর্তির একটা সময় তৈরি করে ফেলতে পারেন, আর সেই মানুষটি হচ্ছেন আজগর মামা। কী আশ্চর্য–সেই আজগর মামা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন!

আজগর মামা নিচু গলায় বলতে পারেন না–তাই দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হাঁক দিলেন, “কী হল, ভিতরে ঢুকতে দিবি, নাকি দাঁড়িয়ে থাকবি?”

রাজু উত্তর না দিয়ে চিৎকার করে এক লাফে আজগর মামার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তেরো বছরের একজন সাধারণত কারও উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না, আজগর মামা সতর্ক ছিলেন বলে কোনোমতে সামলে নিয়ে আরেকটা হাঁক দিলেন, “আরে ছাগল, ঘাড়ে উঠে পড়বি নাকি? ছাড় বলছি–ছাড়!”

রাজু আজগর মামাকে ছাড়ল না। এবং রাজুর চিৎকার শুনে সাগর ছুটে এসে সেও লাফিয়ে আজগর মামার ঘাড়ে ঝুলে পড়ল। আজগর মামা সেই অবস্থাতে দুজনকে ঝুলিয়ে নিয়ে কোনোমতে ঘরে ঢুকে দুই পাক খেয়ে তাদের সোফায় ছুঁড়ে দিলেন। সাগর চিৎকার করে ঘরে দৌড়াতে লাগল, ‘আজগর মামা এসেছে, আজগর মামা অজগর মামা

আজগর মামা ঘরের বাইরে থেকে তার জিনিসপত্র আনতে যাচ্ছিলেন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার দিলেন, “অজগর বলবি তো মাথা ভেঙে ফেলব পাজি ছেলে-”

ধমক খেয়ে সাগরের আরও আনন্দ হল, সে দুই হাত দুইদিকে প্লেনের মতো ছড়িয়ে দিয়ে”অজগর অজগর” করে চিৎকার করে ঘরে দৌড়াতে লাগল।

চিৎকার হৈচৈ শুনে আব্বা-আম্মা বের হয়ে এলেন এবং প্রথমবার তাঁদের দুজনের মুখে হাসি ফুটে উঠল, শুধু তা-ই না, তারা দুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। সারাদিন যে ঝগড়া করে মুখ গোমড়া করে বসে ছিলেন সেটা হঠাৎ করে তাঁরা কেমন করে যেন ভুলে গেলেন।

আব্বা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আরে আজগর ভাই! আপনি কোথা থেকে?” আম্মা বললেন, “দাদা, তুমি হঠাৎ করে?”

আজগর মামা তাঁর ঝোলাঝুলি নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “হঠাৎ করেই তো আসতে হয়। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আসব নাকি?”

মামার হাতে একটা পাখির খাঁচা-সেখানে অনেকগুলি পাখি, হঠাৎ ঘরে আলোর মাঝে এসে কিচিরমিচির করতে শুরু করল। রাজু অবাক হয়ে বলল, “মামা, পাখি এনেছ? পাখি?”

“হ্যাঁ, স্টেশনে দেখলাম বিক্রি করছে, কিনে আনলাম।”

আব্বা ভালো করে দেখে বললেন, “এ তো চড়ুই পাখি!”

“হ্যাঁ, যে বিক্রি করছিল সে বলে বাইগুড়ি। খুব ভালো নাকি খেতে।”

আম্মা বললেন, “এই চড়ুই পাখি তুমি খাবে?”

“ধুর! আজগর মামা হাত নেড়ে বললেন, এইটুকুন পাখিকে লোকজন জবাই করে করে খাবে শুনেই খারাপ লাগল। তাই কিনে এনেছি–সবগুলিকে ছেড়ে দেব।”

সাগর হাততালি দিয়ে বলল, “আমি ছাড়ব মামা আমি ছাড়ব!” আজগর মামা বললেন, “সবাই মিলে ছাড়” কী মজা হবে না?”

সাগর মাথা নাড়ল, রাজু মাথা নাড়ল, এমন কি আব্বা আর আম্মাও মাথা নাড়লেন। মামা পাখির খাঁচটা টেবিলের উপর রাখলেন, আম্মা বললেন, “টেবিলে রেখো না, নোংরা করে দেবে!”

আজগর মামা আম্মার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “করুক। চড়ুই পাখি কি আর মানুষ নাকি? কতই আর নোংরা করবে।”

বসার ঘর লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে আজগর মামা তার পোঁটলা-পুঁটলি খুলতে লাগলেন। মাটির হাঁড়িতে করে মোষের দুধের দই বের হল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি গোখরো সাপ বের হল, হাতে ধরলেই সেটা কিলবিল করে নড়তে থাকে। বিচিত্র রঙের মাটির পুতুল বের হল, মানুষের মস্তিষ্ক নামের ছবিওয়ালা ইংরেজি বই বের হল, নলেন গুড়ের সন্দেশ বের হল, রংচঙে শার্ট বের হল, গানের ক্যাসেট বের হল, খেলনা-পিস্তল বের হল, পেন্সিল কাটার চাকু বের হল, ছোট একটা ঢোল বের হল এবং সবার শেষে অনেকগুলি বাংলা গল্প-কবিতার বই বের হল। কে কোনটা নেবে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হল। আজগর মামাও সেই কাড়াকাড়িতে যোগ দিলেন এবং দেখা গেল শেষ পর্যন্ত তার ভাগে পড়েছে মাটির হাঁড়িতে করে আনা দুর্গন্ধযুক্ত মোষের দুধের দই। আব্বা পেয়েছেন রংচঙে শার্ট আর বই, আম্মা পেয়েছেন গানের ক্যাসেট আর সন্দেশ, বাকি সবকিছু রাজু আর সাগরের। তারা দুজনে কে কোনটা নেবে সেটা নিয়ে ঝগড়া বেধে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আজগর মামা এলে সবাই এত ভালো হয়ে যায় যে কেউ আর ঝগড়াঝাটি করল না। রাজু নিজে থেকে সাগরকে কিলবিলে সাপটা দিল, সাগরও পেন্সিল কাটার চাকুটার জন্যে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল না।

আজগর মামার জন্যে আবার টেবিলে খাবার দেওয়া হল, এবারে আব্বাও খেতে বসলেন। আম্মা দুজনকে খাবার তুলে দিতে লাগলেন আর পুরো সময়টাতে রাজু আর সাগর আজগর মামার গায়ে লেপটে দাঁড়িয়ে রইল। আজগর মামার খাওয়া একটা দেখার মতো ব্যাপার, যেটাই তাঁকে খেতে দেওয়া হয় সেটাই এত মজা করে খান যে দেখে লোভ লেগে যায়। মোরগের হাড়কে চুষে চুষে বারোটা বাজিয়ে সেটাকে চিবিয়ে একেবারে তুষ করে ফেলে দেন। মাছের মাথা কড়কড় করে চিবিয়ে সেটাকে লজেন্সের মতো করে চুষতে থাকে, ডালমাখা ভাত মুখে পুরে চোখেমুখে এমন একটা ভাব নিয়ে আসেন যেন দেখে মনে হয় পৃথিবীতে এর থেকে ভালো কোনো খাবারই নেই। রাজুর ধারণা, আজগর মামাকে যদি একটা খবরের কাগজ খেতে দেওয়া হয়, মামা সেটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে দিয়ে এমনভাবে চিবাতে থাকবেন যে দেখে মনে হবে বুঝি রসগোল্লা খাচ্ছেন।

খাওয়ার পর পাখির খাঁচা নিয়ে সবাই মিলে ছাদে উঠে এল। ছাদটা নির্জন সুনসান, আকাশে অর্ধেকটা চাঁদ, তাতেই খুব সুন্দর নরম একটা আলো। পাশে নারকেল গাছ বাতাসে ঝিরঝির করে নড়ছে, দেখে কী যে ভালো লাগছে বলার মতো নয়। মামা পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট চড়ুই পাখি বের করে এনে বললেন, “যা ব্যাটা উড়ে যা–সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকিস!”

চড়ুই পাখিটা যেন মামার কথাটা বুঝতে পারল–চিড়িক করে একটা শব্দ করে রাতের আকাশে উড়ে গেল। মামার কথা শুনে রাজু আর সাগর হি হি করে হাসতে থাকে। মামা ধমক দিয়ে বললেন, “হাসছিস কেন? একটু উপদেশ দিয়ে দেয়া ভালো না?”

সাগরও পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা চড়ুই পাখি বের করে এনে বলল, “যা পাখি উড়ে যা, মিলেমিশে থাকিস!”

তখন আম্মাও পাখির খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে একটা পাখি বের করে এনে বললেন, “যা পাখি উড়ে যা! পৃথিবীর যত মানুষ তাদের বউদের সাথে ঝগড়া করে সবার মাথায় পিচিক করে বাথরুম করে দিস!”

শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, আব্বা হাসলেন সবচেয়ে জোরে, তারপর আব্বাও একটা চড়ুই পাখি বের করে এনে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “যা পাখি উড়ে যা! পৃথিবীর যত বদমেজাজি বউ আছে তাদের নাকের ডগায় ঠোকর দিয়ে আয়!”

তখন রাজু একটা পাখি বের করে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “পৃথিবীর সব অঙ্কের মাস্টারের মাথায় বাথরুম দিস!”

তখন সাগর একটা পাখি বের করে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “যা রে পাখি উড়ে যা, আজগর মামার মাথায় বাথরুম করে দিস!”

তখন আজগর মামা খুব রেগে যাবার ভান করে সাগরকে মাথায় উপরে তুলে নিলেন যেন আছাড় মেরে ফেলে দেবেন। আর তা-ই দেখে সবাই আবার হি হি করে হাসতে লাগল।

একটা একটা করে সবগুলি পাখিকে ছেড়ে দেওয়া হল। ছাড়ার আগে সবগুলি পাখিকেই কোনো-না-কোনো উপদেশ দিয়ে ছাড়া হল। কাউকে বলা হল বানান শিখতে, কাউকে বলা হল অঙ্ক করতে, কাউকে বলা হল ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করতে। অনেকগুলি পাখি ছাড়া হল ভণ্ড পীর-ফকিরদের মাথায় বাথরুম করতে। আম্মা অনেকগুলি ছাড়লেন যারা তিন-চারটা বিয়ে করে তাদের মাথায় ঠোকর দিতে। সবচেয়ে বেশি পাখি ছাড়া হল রাজাকারদের চাঁদিতে বাথরুম করার জন্যে।

পাখিগুলি ছেড়ে দেবার পর সবাই ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের নরম আলোতে কেন জানি কেউ জোরে কথা বলে না, আজগর মামা পর্যন্ত আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলেন। খানিকক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে মামা আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেল, “ঝর্না, তুই গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস নাকি?”

আম্মা বললেন, “মোটামুটি। এত কাজের ঝামেলা–”

“সে কী।” মামা বললেন, “ছাড়িস না খবরদার! এত সুন্দর গলা তোর! গা দেখি একটা গান!”

“যাও! এইভাবে গান গাওয়া যায় নাকি?”

“এইভাবেই গাওয়া যায়–এখন তোর জন্যে শামিয়ানা টাঙিয়ে ঢাক ঢোল আনব নাকি! এইভাবেই গা!”

অন্য কেউ বললে কী হত কে জানে, কিন্তু আজগর মামা কিছু বললে কেউ সেটা ফেলে দিতে পারে না। আম্মা আব্বার গায়ে হেলান দিয়ে প্রথমে মৃদু স্বরে, তারপর আস্তে আস্তে গলা খুলে গান গেয়ে উঠলেন–আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই গান কিন্তু কী সুন্দর! রাজু অবাক হয়ে ভাবল আজ রাতে তারা যে সবাই এখানে এসেছে সেটা ঐ বুড়ো লোকটা জানল কেমন করে?

রাজু আর সাগর গিয়ে আজগর মামাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আম্মার গলার গান বাতাসে জাদুমন্ত্রের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল, আকাশ থেকে জোছনা গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে পড়তে লাগল আর নারকেল গাছের পাতা বাতাসে তিড়তিড় করে নড়তে লাগল।

হঠাৎ করে রাজুর মনে হল, বেঁচে থাকার ব্যাপারটা কী সে মনে হয় বুঝতে পেরেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *