পুর্ণিয়া প্যাক্ট
‘আগুন নিয়ে খেলা’র নটোরিয়াস সোম ব্যালার্ড পিয়ারে জাহাজ ভিড়লে তল্লাস করে দেখল তার নামে এসেছে একখানা তার ও তিনখানা চিঠি।
তার করেছে কুণাল-ললিতা-কল্যাণ। ‘Welcome to India and us.’ বিলেত যাওয়ার আগে সোম কুণাল-ললিতার বিয়ে দিয়ে গেছল। ইতিমধ্যে তাদের একটি ছেলে হয়েছে আর তারা সেই ছেলের নাম রেখেছে বন্ধুর নামানুসারে ‘কল্যাণ’। বন্ধুপ্রীতির এহেন নিদর্শন দুর্লভ বলে সোমের চোখ সিক্ত করলে সুখে।
একখানা চিঠি কোনো এক লাইফ ইনশিওরেন্স কোম্পানির, সোম ওখানা কোপদৃষ্টিতে ভস্ম করল। অন্য একখানা চিঠি তার তৃতীয়া প্রিয়ার, সেই যিনি বলতেন মনের মিলনই হচ্ছে স্থায়ী মিলন, দেহের মিলনে কেবল গ্লানি ও অবসাদ। তাঁর স্বভাব বদলায়নি, অভিজ্ঞতাও বাড়েনি। মণীন্দ্রলাল বসুর ‘মায়াপুরী’ থেকে চুরি করা ভাব ও চোরাই ভাষা দিয়ে তিনি পূর্ণ পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে এই কথাটি বিশদ করেছেন যে বেলা জানে তার তরুণ তার কাছে একদিন ফিরবে, লালমণি রাজপুত্র আনবে রাজকন্যা পদ্মাবতীর বাঞ্ছিত পদ্ম, রাজকন্যার কানে কানে বলবে, ‘তুমি যে পদ্ম চেয়েছিলে, রাজকন্যা, সে পদ্ম আমার বুকেই ফুটে আছে, আমি সমস্ত জগৎ ঘুরে তবে তার সন্ধান পেলুম।’
শেষ চিঠিখানা পড়ে তার ক্রোধ ও অপমানের পরিসীমা রইল না। লিখেছে তার বিধবা বোন সুমিত্রা।
‘দাদা, সুদীর্ঘ তিন বছর পরে সুদূর বিদেশ থেকে জয়ী হয়ে তুমি ফিরেছ, ভগবান তোমাকে নীরোগ ও নিরাপদ রেখে আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করেছেন। তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে এখন সেটা দিন গুণে বলা যায়, আশা করি পথে কোথাও নামবে না, সোজা এখানে চলে আসবে, সোমবার পৌঁছানো চাই।
পৌঁছে যা দেখবে তার জন্যে তোমাকে তৈরি থাকতে সাহায্য করা আমার উচিত। সেইজন্য লিখছি যে একখানা বেনামি চিঠি পেয়ে বাবা যারপরনাই লজ্জিত, বিমর্ষ ও বিরক্ত হয়ে রয়েছেন। চিঠিখানা আমাকে পড়তে দিলেন না, ছোটো মা-কেও না। গম্ভীর ভাবে বললেন, খারাপ চিঠি। আমরা তাঁকে কত বুঝিয়ে বললুম যে দাদার কোনো শত্রু তার নামে কলঙ্ক আরোপ করেছে, নইলে বেনামি লিখল কেন? বাবা বললেন, যেসব খুঁটিনাটি দিয়েছে, সেসব কখনো বানানো হতে পারে না, তার এক আনাও যদি সত্য হয় তবে অমন ছেলের মুখদর্শন করলে পাপ হবে।
চিঠিখানা তিনি তাঁর দুই একজন উকিল বন্ধুকে দেখিয়ে পরামর্শ চাইলেন। কেমন করে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে তুমি কাকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে গেছলে। এতে অন্যায়টা যে কী ঘটল আমি তো তা স্থির করতে পারলুম না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন চাল আমাদের কল্পনার বাইরে, তাই আমরা তার কদর্থ করে থাকি। ওরাও তো আমাদের বৈধব্যকে সন্দেহের দৃষ্টিতে কলুষিত দেখে, আমাদের পক্ষে যা সহজ ওদের চক্ষে তা কুটিল!
কার পরামর্শে জানিনে, বাবা তোমার জন্যে অপেক্ষা না করে কাগজে এক বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে বসেছেন। তার কাটিং তোমাকে পাঠালুম। তার উত্তরে রোজ তিন-চারখানা করে চিঠি আসছে। গোষ্ঠবাবু বলে দিনাজপুরের এক ভদ্রলোক তো সশরীরে ও সবান্ধবে এসে শহরে কোথায় বাসা নিয়ে দুবেলা বাড়িতে হাজিরা দিচ্ছেন। অধম আমিও দু-চারখানি চিঠি পেয়েছি এই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে। আমাদের থার্ড মুন্সেফের স্ত্রী সেদিন ছোটো মা-কে ও আমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে তোমার একচোট নিন্দা শুনিয়ে দিলেন ও দিব্যি সপ্রতিভভাবে প্রস্তাব করলেন যে তাঁর মেজ মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়ে দিলে চরিত্র শোধরাতে পারে।
বিজ্ঞাপনটি এই :—
Wanted A Handsome, Educated and
accomplished Kayastha bride for a graduate educated in London University, aged 25, of excellent health and very fair complexion being the eldest son of a District Judge.
For details write to :—
J.K. shome, esq.,
District Judge. Purnea.
সোম একবার পড়ল, দুবার পড়ল, তিনবার পড়ল। বাবা কি ভুলে গেছেন যে তার রংটা বেশ একটু কালো। না ধরে নিয়েছেন যে তিনবছর বিলাতবাসের পুণ্যে কালো রং কটা হয়। স্বাস্থ্য অবশ্য তার গর্ব করবার মতো, কিন্তু বরের স্বাস্থ্যের জন্য কোন মেয়ের বাপ মাথা ঘামান? আর কী ইংরাজি জ্ঞান! Being কথাটা ওখানে বসিয়ে দেওয়ার ফলে মানে দাঁড়ায় এই যে, ছেলেটির স্বাস্থ্য ভালো ও রং ধবধবে, যেহেতু সে একজন জেলা জজের প্রথম কুমার।
সোম চটবে কি হাসবে ঠিক করতে পারল না। বিয়ে করতে তার অনিচ্ছা নেই, কিন্তু বিয়ের আগে সে তার ভাবী বধূকে তার জীবনের আদি পর্ব নিরালায় শোনাতে চায়—এই তার ন্যূনতম দাবি। শুনে যদি মেয়েটি বলে, অন্যায় কিছুমাত্র হয়নি, অমন অবস্থায় পড়লে আমিও তাই করতুম, তবে সোম মেয়েটির রূপ, বিদ্যা ও গুণীত্ব নিয়ে চুল চিরবে না, মেয়েটি কায়স্থ না হয়ে কলু কিংবা কামার হলেও সোমের দিক থেকে আপত্তি থাকবে না। মোট কথা, বাবা যদি তার ন্যূনতম দাবি স্বীকার করে তাকে ওই দাবি পেশ করবার স্বাধীনতা দেন তবে সে রূপ গুণ জাতি ইত্যাদি বিবেচনা বাবার উপর ছেড়ে দেবে।
তিন বছর ইংল্যাণ্ডে কাটিয়ে প্রেম সম্বন্ধে সে এই সিদ্ধান্ত করেছিল যে ওটা অন্য দশটা ধুয়ার মতো একটা ধুয়া। Liberty, equality, world peace, disarmament, ইত্যাদির মতো ওটাও একটা তরুণ-ভুলানো বুলি। আগে ষাট মণ ঘি পুড়বে তারপর রাধা নাচবেন। প্রথমত, ব্যাংকে সুযথেষ্ট সঞ্চয়, দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যকর পল্লিতে বাড়ি না হোক বাসা, তৃতীয় মূল্যবান আসবাব ও বাসন—ন্যূনপক্ষে এতখানি ঘি পুড়লে বিবাহের যজ্ঞানল জ্বলবে। আর যে-প্রেম বিবাহান্ত নয় সে-প্রেম হয় একপ্রকার শখ, নয় একটা মনোবিকার। সাবধানী ইংরাজ ও-দুটোকে চল্লিশ হাত দূরে রেখে পথ চলে। অলসধনী ও মাথা পাগলা বোহিমিয়ান এই দুই মন্ডলীতে ওই দুই শৃঙ্গী আবদ্ধ। এ ছাড়া একটা নতুন মন্ডলীর উদ্ভব হয়েছে, তাতে প্রেম হচ্ছে শনি রবিবারের খেলাধুলার শামিল, প্রসাধনের অঙ্গ। ওকে প্রেম বললে মানে হয় না, ও হচ্ছে পরিমিত দেহচর্চা। মন্ডলীটা ব্যবসায়-ব্যস্ত নাগরিক নাগরিকার। ওদের মস্ত গুণ এই যে ওরা ধুয়া ধরে নিজেদের ভোলায় না, বুলি আওড়ে পরকে ভোলায় না। ওরা বোঝে না তত্ত্ব, বোঝে তথ্য। সোম এই মন্ডলীকে আপনার করেছিল। এরা কাজের সময় করে কাজ, উদবৃত্ত সময়ে করে পরস্পর বিনোদন। অন্তরে এরা কেউ কারুর নয়, অন্তর্মুখী হতে এরা নারাজ। এদেরই জন্যে মহাকবি ‘ক্ষণিকা’ রচনা করেছেন।
ঢিপ করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই বাবা তার মাথায় হাতে বুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তাঁর নয়নে আনন্দাশ্রু। মুখে সুগম্ভীর হাস্য। কত কী জিজ্ঞাসা করতে পারতেন, কিন্তু প্রবল আনন্দের বেলায় তুচ্ছ কথাই মুখে আসে।—‘পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
সোম বলল, ‘অসুবিধা যা হবার তার এখনও বহু বাকি। এত বড়ো দেশে একটানা রেলপথ যাত্রা শেষ হয়েও শ্রান্তির তৃষ্ণা রেখে যায়। কী গরম!’
‘ওমা, গরম কাকে বলছ, দাদা,’ সুমিত্রা প্রণাম করে বলল, ‘এখন তো শীত পড়তে আরম্ভ করেছে।’
‘বিলেতফেরতাদের,’ জাহ্নবীবাবু সবজান্তার ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রথম-প্রথম তাপবোধটা কিছু বেশি হয়ে থাকে, মা।’
বাবার অসাক্ষাতে সুমিত্রা বলল, ‘কই আমার জন্যে কী এনেছ, দেখি বাক্সের চাবি।’
তেমনি পাগলিই আছে। ওর জন্যে সোমের অন্তরে সমব্যথার অন্তঃস্রোত চক্রাকারে ঘুরছিল, মোহানা পাচ্ছিল না! ওকে খুশি করে ওর ব্যথা ভোলানোর জন্যে সোম বলল, ‘তোর জন্যে এনেছি একটা নতুন রকমের ফাউন্টেন পেন। তা দিয়ে অন্য কিছু লিখতে নেই, লিখতে হয় শুধু প্রেমপত্র।’
‘যাও,’ বলে সুমিত্রা নিজেই গেল পালিয়ে। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। এসে সোমের পায়ের কাছে একতাড়া চিঠি ঝুপ করে ফেলে দিল। তার কাছে লেখা সোমের বিয়ের প্রস্তাব। বলল, ‘দাও না, দাদা, চাবিটা। দেখি আমার বিলিতি বউদিদির ফোটো।’
এইবার সোমকে বলতে হল, ‘যা,’ কিন্তু না ভাই না বোন কেউ ওখান থেকে নড়বার নাম করল না। মাঝখান থেকে হাজির হলেন তাদের বিমাতা—কানাই-বলাইয়ের মা। তিনি এতক্ষণ ঠাকুরঘরে ছিলেন, সেখানে যে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিলেন তার চিহ্ন ছিল তাঁর কপোলে। কল্যাণ ফিরে এল কোনো অচিন্তনীয় বিদেশ থেকে, কিন্তু তাঁর কানাই আর ফিরবে না, সে গেছে বি-জগতে।
সোম তাঁকে প্রণাম করলে তিনি ‘বাবা কল্যাণ—’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
তারপর এলেন সস্ত্রীক ও ত্রিকন্যক গোষ্ঠবাবু। সোম আড়চোখে একবার মেয়ে তিনটিকে দেখে নিল। না রূপসী, না স্বাস্থ্যবতী, না সবাক, না সপ্রতিভ। ওই ভীতসন্ত্রস্ত মূঢ় মেয়ের পালকে সর্বদা তাদের মায়ের মুখপানে নিবদ্ধদৃষ্টি দেখে সোমের হাসি পেয়ে গেল। সে-হাসি আরও দুর্দম হল মা-টির স্বভাবকোপনতা গোপন করবার আয়াস দেখে। আর গোষ্ঠবাবুর চক্ষুতারকা এমন যে মানুষকে দৃষ্টিসূত্রে সুড়সুড়ি দেয় আর তাঁর কথাগুলি যেন কাতুকুতু। এঁরা এতদিন জাহ্নবীবাবুকে, তাঁর স্ত্রীকে, তাঁর কন্যাকে, তাঁর পুরাতন ভৃত্য নিধিরামকে, তৎপত্নী মোক্ষদাকে তোষামোদ করে প্রলোভন দেখিয়ে সোমের বৈলাতিক লীলারহস্য উদঘাটন করবেন বলে শাসিয়ে কিছুতেই কার্যোদ্ধার করতে পারেননি, কারণ মেয়েগুলি বিজ্ঞাপনমাফিক ‘handsome, educated and accomplished’ নয়, তাদের একমাত্র যোগ্যতা—তারা কায়স্থকন্যা।
সোম কোনোমতে হাসি চেপে বহুকষ্টে বলতে পারল, ‘দেখুন, বিজ্ঞাপন দিয়েছেন বাবা, দেশশুদ্ধ লোক জেনেছে যে তিনিই মালিক, আইনত যদিও আমি চার বছর থেকে সাবালক। আর ওদেশে আমি হয়তো রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিলুম, এদেশে আমি পুনর্মূষিক। আমার কাছে আবেদন পেশ করে আমাকে লজ্জা দেবেন না।’
গোষ্ঠবাবু তখন নাক-মুখ ঘুরিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে বললেন, ‘আ-আ-আমি স-স-সব স-অ-ব জ-জজ-আনি। আ-আ-আ—’
গোষ্ঠগৃহিণী স্বামীর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সগর্বে বললেন, ‘প্রদ্যোত আমার ভাই।’
চমক দমন করে সোম শুধাল, ‘কোন প্রদ্যোত? প্রদ্যোত সিং?’
‘সেই।’
সোমের মনে পড়ছিল পেগি ও সে যেদিন ম্যানরবিয়ের থেকে লণ্ডন প্রত্যাবর্তন করে সেদিন আয়ারল্যাণ্ড থেকে প্রদ্যোত সিং ফিরছিল। সেই যে সোমের বাবাকে বেনামি চিঠি লিখেছে ও গোষ্ঠবাবুর গোষ্ঠে গল্প করেছে সোমের এ বিষয়ে সন্দেহ রইল না। কিন্তু দু-বছর আগের ঘটনা মাস খানেক আগে জানানোর কী কারণ ঘটল? কারণটা সম্ভবত এই যে শিকারকে বন্দুকের গুলির গতিসীমার মধ্যে আনতে হলে চারিদিকে তুমুল শোরগোল করে তাকে খেদিয়ে নিয়ে আসতে হয়। সোমের প্রত্যাবর্তন প্রাক্কালে জাহ্নবীবাবুর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা উপস্থিত হলে সোমের প্রত্যাবর্তন মুহূর্তে সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে গোষ্ঠবাবু হানবেন প্রাজাপত্য বাণ, এক এক করে তিন গুলি, তার একটা-না-একটা লাগবেই। জন্তুর প্রতি কী উদারতা! তার যে গুলিটাতে খুশি সেই গুলিটাতে মরবে—তার সামনে wide choice।
জাহ্নবীবাবু কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম ধাক্কা সামলে উঠেছিলেন। বিজ্ঞাপনের সাড়া পাওয়া গেছল আসমুদ্র হিমাচল থেকে। ভারতবর্ষে যে এমন সব জায়গা আছে আর এসব জায়গায় যে বাঙালি কায়স্থ আছে, পূর্ণিয়ার জেলা জজ অত জানতেন না। কুস্তোড় কলিয়ারি, মঙ্গলদই, রেহাবাড়ী, মৌলবী বাজার, মহেঞ্জোদরো, তেজগাঁও, নওগাঁ, আকিয়াব, পোর্ট ব্লেয়ার, কোলাবা, নেলোর, ভূসাওল, খান্ডোয়া। যেসব জায়গার নাম জানতেন সেগুলিও সংখ্যায় কম নয়। কলকাতা থেকে এসেছে উনপঞ্চাশখানা দরখাস্ত। কাজেই হাজার দুর্নাম রটলেও ছেলের পাত্রীর অভাব নেই, এর জন্য তিনি নিজেকেই অভিনন্দন করলেন। কেমন লোকের ছেলে!
পাত্রী দেখতে বেরোলে ওর সঙ্গে দেশ দেখাও হয়, তীর্থ করাও হয়। কিন্তু জাহ্নবীবাবুর ছুটি ছিল না। তিনি ছেলেকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো দেশভ্রমণ ভালোবাসো বলে জানতুম। পরের দেশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করলে। এবার নিজের দেশটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নাও। চাকরির নিকট সম্ভাবনা তো নেই, ঘরে বসে বসে করবে কী!’
ততদিনে সোমেরও শ্রান্তি মোচন হয়েছিল। করবার মতো কাজও ছিল না হাতে। বলল, ‘যে আজ্ঞে।’
জাহ্নবীবাবু আলবোলার নল মুখে পুরে খানিক ভুড় ভুড় ভুড় ভুড় আওয়াজ করলেন। বললেন, ‘কুস্তোড় কলিয়ারি, মঙ্গলদই, নান্দিয়ার পাড়া, ভাওয়ালী, মাউ জংসন, কুকিচেরা, ঢেঙ্কানাল, মেমিও, তুলসীয়া—এসব না দেখলে ভারতবর্ষের দেখলে কী!’
সোম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘তা তো বটেই।’
‘ডিব্রুগড় থেকে পন্ডিচেরী পর্যন্ত একটা দৌড় দাও।’ জাহ্নবীবাবু যেন নিজে অমন একটা দৌড় দিয়ে অভিজ্ঞ হয়েছেন এইরূপ ভঙ্গিতে বললেন, ‘তারপর পন্ডিচেরী থেকে রাওলপিন্ডি।’ পিন্ডির কথায় মনে পড়ল গয়া। ‘তারপর রাওলপিন্ডি থেকে গয়া হয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো।’
সোম বলল, ‘একখানা Indian Bradshaw কেনা হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। তারপর ওইসব প্রসিদ্ধ স্থানে—কুস্তোড় কলিয়ারিতে, মাউ জংসনে, ঢেঙ্কানালে—কোন কোন হোটেলে উঠতে হবে তাদের ঠিকানা—’
‘হোটেলে উঠতে হবে না,’ জাহ্নবীবাবু আরাম কেদারায় শায়িত অবস্থা ছেড়ে ছিন্ন-গুণ ধনুকের মতো পিঠ সোজা করে বসে বললেন, ‘ওসব জায়গায় আমাদের স্বজাতীয় ভদ্রলোক রয়েছেন, তাঁদের বাড়ি আতিথ্য স্বীকার করাতে লজ্জার কিছু নেই।’
সোম ভাবল মন্দ না। রেলের পাথেয় জোটাতে পারলে বছর খানেকের মতো অন্নের ভাবনা থেকে মুক্তি।
সব আগে কোন খানে যাবে স্থির করতে না পেরে সোম দিনের পর দিন টাইমটেবল ও মানচিত্র অধ্যয়ন করে কাটাল। তার ছোটোমা একদিন তার কাছে এসে বসে সেই শীতাদ্য কালে তাকে পাখা করতে লাগলেন।
সোম বলল, ‘মা, তুমি কি কিছু বলবে?’
তিনি বললেন, ‘মানুষের জীবন। কোন দিন আছে, কোন দিন নেই। নলিনীদলগত জলের মতো তরল। কানাই—’ তিনি রুদ্ধকন্ঠে আর একবার বললেন, ‘কানাই’, তারপর কাপড়ে মুখ ঢাকলেন।
সোম সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘সাত বছর হয়ে গেল, কানাই কি এতদিন অন্য কোনো মায়ের কোলে জন্ম নেয়নি ভাবছ? ও কি তোমার কান্নার জন্যে কেয়ার করে? যারা কেয়ার করে তাদের কথা ভাবো—আমার কথা, বলাইয়ের কথা।’
‘বলাই,’ ছোটোমা চোখ মুছে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে চেয়েছিল, কলেজের কর্তারা আসতে দিল না, টেস্ট এগজামিনের আর দেরি নেই বলে।’
‘তা হোক, আমিই ওর সঙ্গে দেখা করব এখন।’ সোম বলল।
‘মানুষের জীবন,’ ছোটোমা আবার শুরু করলেন, ‘মানুষের জীবন অতিশয় চপল। তোমার বাবা তাই আমাকে বলছিলেন যে, আসছে বছর যখন তিনি পেনশন নেবেন তাঁর সময় কাটবে কেমন করে। নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলা করার বয়স হল, কিন্তু কই নাতি-নাতনি?’
সোম বুঝল। যেন বোঝেনি এমন ভাব দেখিয়ে বলল, ‘কেন? আমার দুই দিদির সাত ছেলে-মেয়ে। তাদের দুই একটিকে আনিয়ে নিতে বাধা কী?’
‘পাগল ছেলে!’ মা বললেন, ‘তা কি কখনো হয়! ওদের নিজেদের বাড়ি আছে, ওদের ঠাকুমা-ঠাকুরদাদারা ছেড়ে দেবে কেন?’
‘তা তো বটেই।’ সোম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তা তো বটেই। তাহলে আমাকেই নাতি-নাতনি তৈরি করবার ফরমাশ নিতে হয় দেখছি। এদিকে যে বাবা আমাকে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো কুস্তোড়-কলিয়ারি-ডিব্রুগড়-ফরাক্কাবাদ পাঠাচ্ছেন।’
‘তুমি বাবা আমার কথা শোনো,’ মা বললেন, ‘অত ঘুরতে হবে না। উনি কেবলই খুঁত খুঁত করছেন, কোনো পাত্রীই ওঁর বউমা হবার যোগ্য বলে ওঁর মনে হচ্ছে না, তাই ওইসব সৃষ্টিছাড়া জায়গায় পাওয়া গেলেও যেতে পারে ভাবছেন। অত বাছলে তুষের সঙ্গে সঙ্গে ধানও যাবে ফেলা। আমি বলি তুমি দুটি-কি-তিনটি মেয়ে দেখো—কাশীরটি, শ্যামবাজারেরটি আর ওই দেওঘরেরটি। ও নাকি সুন্দর বীণা বাজায়, সাক্ষাৎ বীণাপাণি।’
‘আর কাশীর মেয়েটি।’
‘কাশীরটি হল ওঁর বন্ধু দাশরথি মিত্তির মশাইয়ের ভাইঝি। উনিও ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট জজ, এখন পেনশন নিয়ে কাশীবাস করছেন। এঁরও ইচ্ছা কাশীতে বাড়ি করেন। দুই বন্ধুর দু-বেলা দেখাশোনা হবে বিশ্বনাথের মন্দিরে আর দশাশ্বমেধ ঘাটে!’
‘দাশরথিবাবুর নাম শুনেছি। শ্যামবাজারের মেয়েটি কার ভাইঝি?’
‘কার ভাইঝি জানিনে, কিন্তু ভূষণবাবুর মেয়ে, বি-এ পাস, কোন বিষয়ে নাকি ফার্স্ট হয়েছে। ভূষণবাবু তাকে এম-এ পড়াতে চান না, বলেন এম-এ পাস মেয়ের বর পাওয়া যাবে না, এক আই-সি-এস ছাড়া। আর আই-সি-এসই বা এত আসে কোত্থেকে।’
‘তা আমিও তো বি-এ-র চেয়ে বড়ো নই। আমাকে ভূষণবাবু মেয়ে দিতে যাবেন কেন?’
‘পাগল ছেলে! কীসে আর কীসে! বিলেতের বি-এ আর এদেশের বি-এ। তোমাকে পাবার জন্যে তাঁর কত আগ্রহ।’
বিলেতফেরত কৃতী পুত্রকে জাহ্নবীবাবু মনে মনে ভয় করতেন। সে যদি বেঁকে বসে সেইজন্যে সোজাসুজি তাকে আদেশ করতে পারেন না। অনুরোধ করতেও তাঁর পিতৃসম্মানে বাধে। মনোগত অভিপ্রায় সংকেতে বোঝানো ছাড়া কী উপায়। এসব বিষয়ে গৃহিণীর সাহায্য নিতেও তিনি কুন্ঠিত। পাছে কেউ ফস করে ঠাওরায় যে দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীর কথায় তিনি ওঠেন বসেন, তিনি স্ত্রৈণ, সেইজন্যে তিনি সে বেচারির সঙ্গে ভালো করে কথাই কন না। পাছে এমন অপবাদ রটে যে তিনি প্রথমার চেয়ে দ্বিতীয়াতে অধিক অনুরক্ত সেই আশঙ্কায় তিনি সে-বেচারির সঙ্গে লোকদেখানো কঠোর ব্যবহার করেন। বিধবা কন্যাকে যতসব বাহারে শাড়ি কিনে দেন, সধবা স্ত্রীকে কিনতে দেন তার সাদাসিধে সংস্করণ। সে বেচারির যদি কোনো শখ থাকে সেটা মেটে সুমিত্রার সৌজন্যে। তিনি সুমিত্রার কোনো কিছুর তারিফ করলে সুমিত্রা তখনি প্রস্তাব করে, ‘মা, তোমাকে এটা দিই?’ তিনি আপত্তি করেন, ‘না, না, তা কি হয়? আমি বুড়ো মানুষ, আমার গায়ে এটা মানাবে কেন?’ সুমিত্রা তাঁকে জোর করে পরিয়ে দিয়ে বলে, ‘চমৎকার মানিয়েছে; আজ আমরা মুনসেফ বাবুদের বাড়ি বেড়াতে যাব।’
সোম এসব জানত। তাই ছোটো মা তাকে যা বলেছেন তা যেন তার বাবার বক্তব্য নয় এই ভান করে বাবার সামনে গিয়ে পায়চারি করতে লাগল।
জাহ্নবীবাবু চোখের চশমা নাকে নামিয়ে তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন।
সোম বলল, ‘ভারি ভাবনায় পড়ে গেছি। কোনখান থেকে যাত্রারম্ভ করি স্থির করতে পারছিনে। আগে যাব পূব-মুখে লালমণির হাট, না আগে যাব পশ্চিম-মুখে লাহেরিয়া সরাই—একেই বলে উভয়সংকট।’
‘হুঁ।’ কিছুক্ষণ চিন্তার ভান করে জাহ্নবীবাবু বললেন, ‘সর্বসিদ্ধিপ্রদ কাশীধাম। সেইখান থেকে যাত্রারম্ভ হলে শুভ। দেওঘরও পুণ্য পীঠ। যিনি বিশ্বেশ্বর তিনিই বৈদ্যনাথ। কালীঘাটের কালীও জাগ্রত দেবতা। তোমরা তো প্রায়শ্চিত্ত করবে না। দেবদর্শনে প্রায়শ্চিত্ত আপনা থেকে হয় তাও করবে না?’
সোম শশব্যস্তে বলল, ‘নিশ্চয় করব। কেন করব না? তবে শুনছি দেবদর্শনের সঙ্গে আরও কী দর্শন করতে হবে।’
‘আমিও তোমাকে তাই বলব-বলব করছিলুম।’
‘আমার অনিচ্ছা নেই! তবে আমার একটি ব্রত আছে।’
‘ব্রত আছে!’
‘আজ্ঞে হাঁ। ব্রত আছে। আমার নিজের কোনো পছন্দ-অপছন্দ নেই, আপনারা যাকে পছন্দ করবেন আমি তাকেই বিয়ে করব। কিন্তু—’
জাহ্নবীবাবু কান খাড়া করে রইলেন।
‘কিন্তু বিয়ের আগে তাকে আমি গোপনে কিছু বলতে চাইব।’
‘কী বলবে?’
‘বলব আমার নিজের ইতিহাস।’
‘না, না, না, না।’ তিনি ক্রমাগত মাথা নাড়তে থাকলেন দম-দেওয়া কলের পুতুলের মতো, আর গ্রামোফোনের রেকর্ডের মতো তাঁর মুখ থেকে ছুটতে থাকল, না, না, না, না।
‘বেশ। আমি বিয়ে করব না।’
‘আহা, আমাকে বলতে দাও। তোমার স্ত্রীকে তুমি গোপনে কিছু বলবে, এতে কার কী আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বিয়ের আগে নয়, বিয়ের পরে।’
‘না, বাবা।’
‘কেন, অন্যায় কী বললুম?’
‘অন্যায় এই যে, বিয়ের পরে যদি ওকথা শোনাই তবে সে হয়তো বলবে, আগে শুনলে আমি বিয়েই করতুম না।’
‘হা-হা-হা-হা। অমন কথা কোনো হিন্দু স্ত্রী বলতে পারে? বিলেত গিয়ে তুমি ক্রিশ্চান হয়ে এসেছ দেখছি।’
‘বেশ। আমি বিয়ে করব না।’
‘‘হুঁ।’’ তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমাদেরই দোষ। ভালো চাকরির মোহে ছেলেগুলোকে বিলেত পাঠাই, চাকরিও আর হয় না, হয় শুধু শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর।’
সোমের ইচ্ছা হল বলে, আমি তো স্কলারশিপ নিয়ে গেছি, কিন্তু ওই আগুনে ইন্ধন দিয়ে কী হবে!
‘এখন বুঝতে পারছি,’ জাহ্নবীবাবু আবিষ্কার গৌরবে বললেন, ‘কেন লোকে ছেলেকে বিলেত পাঠাবার আগে বিয়ে দিয়ে রাখে। দাশরথি তাই করেছেন, দৈবকীও তাই বলেছেন। আমি আমাদের সিবিলিয়ান কবির ভাষায় ভাবলুম, ‘চাকরি না করে বিয়ে করা গোরু ভেড়ার ধর্ম’। এখন দেখছি চাকরিও হল না, ধর্মও গেল।’
সোম আর সেখানে দাঁড়াল না। শ্রোতার অভাবে জাহ্নবীবাবু অগত্যা তূষ্ণীভাব অবলম্বন করলেন।
দাদাকে জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করতে দেখে সুমিত্রা সকৌতূহলে শুধাল, ‘কোথায় আগে যাওয়া স্থির করলে?’
সোম বলল, ‘রাজপুতানায়। সেখানে এতগুলো মহারাজা মহারাণা মহারাও আছে, কেউ-না-কেউ আমাকে প্রাইভেট সেক্রেটারি রাখবে। চাকরি যার উপজীবিকা সরকারি প্রোফেসারি ছাড়া কি তার নাস্তি গতিরন্যথা?’
‘সে কী, দাদা,’ সুমিত্রা বলল, ‘আমরা যে আশা করেছিলুম তুমি বউ আনতে যাবে।’
সোম হেসে বলল, ‘আমি কি দিব্যি দিয়ে বলছি যে রাজপুতানায় বউ পেলে আনব না? কে জানে কোন রাজপুতানি আমার শৌর্য্যে মুগ্ধ হয়ে স্বয়ম্বরা হবে।’
‘বা কী মজা! রাজপুতানি বউদি আসবে। নাম তার মীরাবাঈ কি তারাবাঈ। দাদার শ্বশুরের পাকানো গোঁফ কানের কাছে চুলের সঙ্গে বাঁধা। দাড়িতে সিঁথিকাটা, দুদিকে দুই চাঁপা ফুল গোঁজা। নাম হয়তো তলোয়ার সিং। কী মজা!’
সুমিত্রা তালি দিতে দিতে ছোটোমা-র কাছে গিয়ে খবরটা দিল। তিনি ছুটলেন স্বামীর কাছে। বললেন, ‘ওগো শুনেছ? ছেলে যাচ্ছে রাজপুতানা, চাকরির খোঁজে। ওদেশে নাকি বাইজি বিয়ে করবে।’
‘কী বিয়ে করবে? কী বিয়ে করবে?’
‘বাইজি!’
‘কুষ্মান্ডটাকে বলো চাকরির জন্যে অতদূর যেতে হবে না, সরকারি চাকরির আশা আছে।’
ছোটোমা সোমের কানে ওকথা পৌঁছে দিলে সোম বলল, ‘সে চাকরি যখন হবে তখন হবে। ততদিন বসে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করতে প্রবৃত্তি হয় না।’
তিনি তখন স্বামীর কানে ওকথা তুললেন। স্বামী বললেন, ‘ওর ভাবী স্ত্রীকে ও যদি কিছু নির্জনে বলতে চায় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
সোম এর উত্তরে ছোটোমা-র মারফত বলল, ‘যাকে ওকথা নির্জনে বলব সে ভাবী স্ত্রী হতে অস্বীকৃত হতে পারে।’
ছোটোমা-র মধ্যস্থতায় বাবা বললেন, ‘মেয়ে অস্বীকৃত হলে কী আসে যায়? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। কর্তা অর্থে বরকর্তা ও কন্যাকর্তা।’
ছোটোমা-র মধ্যস্থতায় সোম এর উপর মন্তব্য করল, ‘তবে বরকর্তা কন্যাকর্তার পাণিগ্রহণ করুন। মন্ত্রপাঠপূর্বক নারীধর্ষণ আমার দ্বারা হবে না।’
এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে ছোটোমা পড়লেন হাঁপিয়ে। বাপও ছেলের মুখ দেখবে না, ছেলেও বাপের সুমুখে দাঁড়াবে না। ছোটোমা সুমিত্রাকে ডেকে বললেন, ‘আমি আর পারিনে। তুমি হও এদের টেলিফোন।’
সুমিত্রা বলল, ‘বাহবা বাহবা বেশ।’
সুমিত্রা কানে শুনল, ‘ওকে বল, ও যা বলবে তা শুনে মেয়ে যাতে বিয়ে করতে অস্বীকৃত না হয় তার ব্যবস্থা করা যাবে।’
মুখে বলল, ‘বাবা বলেছেন, তোমার কাহিনি শুনে মেয়ে রাগ করবে কি, উলটে ভাববে যার কলঙ্ক আছে সেই চাঁদ, তাকে বিয়ে না করলে কাকে বিয়ে করব, জোনাকিকে?’
সোম জেরা করল। বলল, ‘বাবা কখনো অমন কথা তোর সাক্ষাতে বলেননি। বাবার নাম করে মিথ্যা বললি?’
তখন সুমিত্রা আর কী করে, সত্য বলল।
সোম বলল, ‘মেয়ের আন্তরিক স্বীকৃতি না-পেলে শেখানো স্বীকৃতি আমার কোন কাজে লাগবে?’
সুমিত্রার দ্বারা পল্লবিত হয়ে বাবার কানে উঠল, ‘দাদা বলছে তোতাপাখির মতো যে-মেয়ে না বুঝেসুঝে ‘হাঁ’ বলবে দাদা তার অভিভাবককে বেশ বুঝেসুঝে ‘না’ বলবে।’
বাবা চটেমটে বললেন, ‘কী! বলেছে কল্যাণ ওকথা!’
তখন সুমিত্রা ডালপালা ছেঁটে মূল উক্তিটি আবৃত্তি করল।
বাবা বললেন, ‘জিজ্ঞাসা কর আন্তরিক স্বীকৃতি যদি পায় তবে বিয়ে করবে তো? না, অন্য ওজর-আপত্তির আশ্রয় নেবে?’
সুমিত্রার আর ভালো লাগছিল না টেলিফোন হতে। যাতে কল্পনার দৌড় নেই সে কি খেলা?
দাদাকে বলল, ‘কথোপকথনের এই শেষ। তিন মিনিট উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় টেলিফোন-গার্ল সতর্ক করে দিচ্ছে।’
সোম বলল, ‘আন্তরিক স্বীকৃতির পিছনে কী প্রকার মনোভাব রয়েছে সেটাও ধর্তব্য। তা যদি হয় করুণা, কিংবা সংশোধনেচ্ছা, কিংবা ব্যবসায় বুদ্ধি—অর্থাৎ আমাকে বিয়ে করলে কত সুবিধা তাই নিয়ে হিসাবিয়ানা—, কিংবা Cynicism—অর্থাৎ পুরুষমানুষের ইতিহাস ও ছাড়া আর কী হবে—, তবে আমার বিদায়।’
বাবাকে দাদার শেষ বার্তা দিয়ে সুমিত্রা বলল, ‘এবার দাও তোমার শেষ বার্তা। টেলিফোনের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।’
জাহ্নবীবাবুর ইচ্ছা করছিল বলতে, আমার মাথা আর ওর মুন্ডু। কিন্তু শেষ বার্তারূপে ওই বাক্যটির উপযোগিতা ওঁকে সন্দিগ্ধ করল। ছেলে যদি টং হয়ে রাজপুতানা চলে যায় ও বাইজিকে ঘরে আনে—কিছুই বলা যায় না, আজকালকের ছেলে—তবে নিজের ইহকাল ও পূর্বপুরুষের পরকাল দুই একসঙ্গে খাবে। অমন খানা ওর মুখরোচক হওয়া সম্ভব, কিন্তু ওর মুখে বাড়িয়ে দেওয়া কি সংগত?
চিন্তা করে বললেন, ‘পুত্রবরের নিকট আমার শেষ নিবেদন এই যে, উনি আপাতত কাশী, দেওঘর প্রভৃতি দু চার স্থলে পরীক্ষা করে দেখুন ওঁর প্রিন্সিপল, আমার পলিসির থেকে কোন অংশে কার্যকরী ও ফলপ্রদ।’
সোম ভেবে দেখল পিতা প্রকারান্তরে তার লঘিষ্ঠ দাবী মেনে নিয়েছেন, অতএব পিতার গরিষ্ঠ দাবি—কাশী, দেওঘর ইত্যাদিতে প্রিন্সিপল-এর পরীক্ষণ—অসংকোচে স্বীকার করা যায়। অল্পে সন্তুষ্ট হলে চাকরি যেকোনোদিন যেকোনোখানে জোটে, একশো টাকার হেডমাস্টারি দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু যে-মেয়ে তাকে অকুন্ঠিতচিত্তে গ্রহণ করবে তার সন্ধানে যাত্রা করা তো কঠিন অ্যাডভেঞ্চার।
রাত্রে বাবার পাশে বসে খাওয়ার সময় সোম বলল, ‘কাশী যাব স্থির করলুম।’
জাহ্নবীবাবুর মুখভাবে সুখের লক্ষণ ছিল না। তিনি বললেন, ‘যাবার আগে একটা তার করে দিও দাশরথিকে। ঠিকানা ভেলুপুরা।’
তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা জমল না। সুমিত্রার সঙ্গে যখন দেখা হল সোম বলল, ‘সুমি, রাজপুতানার জন্যে বাক্স-বিছানা বেঁধে শেষে চললুম কাশী।’
‘কেন যে ওখানে যাচ্ছ, দাদা। ওখানে তোমার হবে না।’
‘তুই কেমন করে জানলি?’
‘তোমার যেমন ভীষ্মের মতো প্রতিজ্ঞা, তুমি ভীষ্মের মতো আইবুড়ো থেকে যাবে।’
‘সেও ভালো, তবু ঠকিয়ে বিয়ে করব না।’
‘তুমি কি সত্যি অন্ধ, না অন্ধতার ভান করছ, না বিলেত যারা যায় তারা সবাই এমনি?’
‘তোর কী মনে হয়?’
‘আমার মনে হয় তুমি সত্যি অন্ধ। নইলে তুমি কখনো ধরে নিতে না যে-কোনো মেয়ে তোমার কাহিনি শুনে বাস্তবিক শক পাবে। নেহাৎ যদি অপোগন্ড না হয়।’
‘তুই আমার কাহিনির কী জানিস! আমার আসল কাহিনির প্রদ্যোত সিং-ই বা কী জানে! বাবা আমাকে যতটা খারাপ বলে জানেন আমি তার বেশি খারাপ এবং সেজন্যে অনুতাপ করিনে।’
‘বুঝেছি। কিন্তু তাতেও তোমার স্ত্রী শক পেত না, যদি বিয়ের পরে জানত।’
‘তার মানে তুই বলতে চাস যে নারীর মন স্বভাবত অসাড়। আমি কিন্তু নারীকে পাষাণী বলে ভাবতে আজও প্রস্তুত হইনি, সুমি। ওইটুকু রোমান্টিসিজম এখনও আমার চিত্তে অবশিষ্ট, মানুষের শরীরে যেমন অ্যাপেন্ডিক্স।’
‘আমি বলতে চাইনে যে আমরা পাষাণী। আমরা কাজের লোক, আমরা খুদকুঁড়ো যা পাই তাই নিই ও তাই দিয়ে রান্না চড়াই। স্বামী কুষ্ঠরোগী হলেও আমরা তাকে দোষ দিইনে, সমাজকেও দুষিনে, কাঁদি অদৃষ্টের কাছে, তাও স্বামীকে খারিজ করবার জন্যে নয়, স্বামীর কুশলের জন্য। জগতে একপক্ষকে সয়ে যেতে হয়, আমরা সেই সহিষ্ণু পক্ষ। নইলে কোনো পক্ষেই শান্তি থাকত না, একপক্ষ হত বুনো ওল আর অপর পক্ষ হত বাঘা তেঁতুল।
সোম হাসল। বলল, ‘বুনো ওলের নায়িকা বাঘা তেঁতুল। জগতে যখন আমি আছি তখন সেও আছে। সে শক পাক বা না পাক, তার মধ্যে ঝাঁজ থাকবে, প্রাণ থাকবে। নারী তো কত আছে, আমার সবর্ণা না হলে কাকে ছেড়ে কাকে বিয়ে করব? এসব কথা বাবা বুঝবেন না। তাই তার সঙ্গে করতে হল এমন একটা প্যাক্ট যে, আমার দিক থেকে রইল না কোনো প্রতিশ্রুতি অথচ তাঁর আদেশ অনুযায়ী চললুম কাশী।’
‘ও! এই তোমার মতলব?’ সুমিত্রা কৌতুক কলরোলে গৃহ মুখরিত করল। ছোটোমা ছুটে এলেন। সোম বলল, ‘এই চুপ, চুপ, চুপ।’
ছোটোমা বললেন, ‘বলো, বলো কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছিল!’
‘জান না বুঝি? দাদা কাশী যাচ্ছে একটি বাঘা তেঁতুলের খোঁজে। আমি বলি অতদূর যেতে হবে না থার্ড মুনসেফের মেয়ে নন্দরানি থাকতে।’
ছোটোমাও হাসলেন। চলে যেতে যেতে বললেন, ‘নন্দরানির মাটিও সেই জাতের।’