১. পুরোপুরি পুলিস

১. পুরোপুরি পুলিস

এখন আমি পুরোপুরি পুলিস, আই. বি-তে (এই ডিপার্টমেন্টের প্রধান কাজ হলো যারা স্বদেশী করে তাদের উপর কড়া নজর রাখা) রীতিমতো watcher বা ডিটেকটিভ। রোজ সাড়ে দশটায় একবার আপিসে যাই (১৩ নং লর্ড সিংহ রোড)। সেখানে ডিউটি কী এবং কোথায় সব জেনে বেরিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে সিনেমা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে রবার্ট ব্লেক ও রিভলবার দেখে হতাশ হয়ে যেতো। মনের মধ্যে বেশ খানিকটা গর্বও অনুভব করতাম। আগেই বলেছি, ডিটেকটিভ উপন্যাসের আমি ছিলাম পোকা। ছেলেবেলায় বই পড়ে সম্ভব অসম্ভব কত কল্পনাই যে করেছি। আজ হাতে হাতে তার পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেয়ে আনন্দে ও গর্বে কেমন দিশেহারা হয়ে গেলাম। ভাবলাম বাংলাদেশেও যে রবার্ট ব্লেকের চেয়ে বড় ডিটেকটিভ হতে পারে, ভগবান বোধহয় আমাকে দিয়েই তা প্রমাণ করবেন।

আমাদের প্রথম ডিউটি পড়লো কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের পাশে একটি প্রসিদ্ধ খদ্দরের দোকানে। দোকানটির উপর অনেকদিন ধরেই পুলিসের নজর ছিলো। সেখানে নাকি বড় বড় সব স্বদেশী চাঁইরা এসে মিলিত হতে এবং বঙ্গমাতাকে ইংরাজের শাসনমুক্ত করার শলাপরামর্শ চলতো। আমার সঙ্গে আরও তিনজন ছিলো। দোকানের উল্টোদিকের ফুটপাথের উপর আমরা নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে পায়চারি করে দোকানে কে আসে যায় নজর রাখতাম। আর বিশেষভাবে বলা ছিলো যে, যদি পুলিসের তালিকাভুক্ত কোনো বিশেষ নেতা আসেন তাহলে তাঁকে যেভাবে হোক অনুসরণ করতে, কোনোক্রমেই যেন তিনি নজর এড়িয়ে না যেতে পারেন। তিন চারজনকে একসঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো যাতে দু’-একজনের চোখে ধুলো দিলেও সবাইকে ফাঁকি দিতে না পারে। আমাদের উপরওয়ালার নির্দেশ ছিলো যেন কোনোক্রমেই অপর পার্টি ( Suspect) বুঝতে বা চিনতে না পারে যে, আমরা পুলিসের লোক তাদের ওপর নজর রেখেছি। বলা বাহুল্য আমাদের পোশাক-আশাক সাধারণ ধুতি, সার্ট বা পাঞ্জাবি, শুধু কোমরে কাপড়ের নিচে থাকতে একটা ছ’ঘরা গুলীভর্তি রিভলবার আর মাদুলির মতো ছোট্ট একটা কৌটয় ছোট্ট একখানা কাগজ (Detective Warrant), বিশেষ বিপদে না পড়লে এর অস্তিত্ব সাধারণ পুলিসকে পর্যন্ত জানতে দেওয়া নিষেধ ছিলো। যদি কোনো লোককে অনুসরণ করতে হতো তাহলে বেশ কিছু দূরত্ব রেখেই তার পিছনে পিছনে যাওয়াই ছিলো আমাদের প্রতি নির্দেশ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি সে আমাদের কোনোক্রমে চিনতে পারে তাহলেও যাতে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করতে না পারে, অথবা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালো করে চিনে নিতে না পারে। যদি কেউ ট্রামে উঠে পড়ে, আমাদের যেতে হতো সেকেণ্ডে ক্লাশে। অর্থাৎ তার সঙ্গে এক গাড়িতে যাবার উপায় নেই। ট্যাক্সিতে গেলে ট্যাক্সি, যদি পাওয়া যায়। পাওয়া না গেলে অগত্যা ট্যাক্সির নম্বরটা টুকে নিয়ে পরদিন রিপোর্টের সঙ্গে দিয়ে দিতাম।

এ যেন এক নতুন জীবন। প্রথম প্রথম বেশ লাগতো। কাজ কিছুই নেই শুধু দাঁড়িয়ে বা বসে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেওয়া। রাত্রি আটটা সাড়ে আটটার সময় একজন উপরওয়ালা অফিসার সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে দেখে যেতেন আমরা আছি না পালিয়ে গিয়েছি। পরদিন বেলা এগারোটার সময় আপিসে গিয়ে আগের দিনের রিপোর্ট দিয়ে খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করে বেলা আড়াইটে তিনটে নাগাদ আবার ডিউটিতে বেরিয়ে যেতাম। সাধারণতঃ এক জায়গায় ডিউটি সাতদিনের বেশি দেওয়া হতো না। কেননা তাতে চিনে ফেলবার সম্ভাবনা বেশি। সেইজন্য সাতদিন অন্তর লোক বদলে দেওয়া হতো। কলেজ স্ট্রীটের ডিউটিই ছিলো খুব শক্ত। ওখানে দু’-এক ঘণ্টার মধ্যেই চিনে ফেলতো যে, আমরা আই-বি’র লোক। সেইজন্য বেছে বেছে সবচেয়ে ওস্তাদ লোককেই সেখানে পাঠানো হতো। আমি একেবারে নতুন, কাজেই ওদের সঙ্গে থাকলে কাজ শিখতে পারবো, আর বিপদ আপদের ভয়টাও একটু কম থাকবে এইজন্যেই প্রথমে ওদের সঙ্গে আমাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো।

প্রথম দু’দিন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলো না। তৃতীয়দিন বেলা প্রায় চারটা হবে। হঠাৎ দেখি আমার সঙ্গী তিনজন তিনদিকে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। হতভম্বের মতো চারদিকে চাইছি। এমন সময় দেখি ঐ খদ্দরের দোকান থেকে ২৫/২৬ বছরের পর পরা একটি লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের উপদেশ মনে পড়ে গেল। কখনো সামনা সামনি পড়বে না যাতে ভালো করে চিনে নিতে পারে বা দরকার হলে উত্তম মধ্যম দিতে পারে। কিন্তু তখন সে উপদেশ আমার কোনো কাজেই লাগলো না। লোকটা একেবারে কাছে এসে পড়েছে। তবুও ভয়ে ভয়ে এক পা দু’ পা করে পশ্চিমদিকে হটতে লাগলাম। লোকটা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে সামনের পানের দোকানে দু’ পয়সার পান দিতে বলে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো–এইসব শালা টিকটিকিগুলোর জন্য অস্থির হয়ে গেলাম। দেবো একদিন ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে…। আরও বিড় বিড় করে অনেক কথাই বললে, শুনতে পেলাম না। তখন আমি বেশ খানিকটা দূরে পিছিয়ে গিয়েছি, অন্ততঃ ইট মেরে মাথা ফাটাবার গণ্ডির বাইরে। একটু পরেই দেখি আমার সঙ্গীরা যেন ম্যাজিকের মতো এবার ওধার থেকে হাজির হলো। অন্যমনস্ক হয়ে ঐ লোকটার সামনে পড়বার জন্য প্রথমে একটু তিরস্কার বর্ষিত হলো। তারপর আমার অবস্থা দেখে পিঠ চাপড়ে বললে, এতেই ঘাবড়ে গেলে ভাই? এর চেয়েও অনেক ভীষণ ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে গিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বললো তাদের মধ্যে কবে কে ডিউটি করতে গিয়ে কতরকম বিপদে পড়েছে। এমন কি বেদম মার খেয়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছে, তারপর পুলিস এসে গাড়ি করে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও মজার কথা এই যে, ঐ মারধোর খেয়ে কোথাও নালিশ করা চলবে না। এক যদি বেমালুম হজম করে যেতে পারো ভালো, নইলে আপিসের উপরওয়ালারা শুনলে অকর্মণ্য, অপদার্থ এইসব উপাধিতে ভূষিত হয়ে সবার বিদ্রূপের খোরাক যোগাবে। এই সব সহ্য করে চাকরি করতে পারো ভালো, না হলে ছেড়ে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কী ভীষণ অবস্থা! উৎসাহ আমার অনেকটা নিবে গেল।

পরদিন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলো না, খুব সজাগভাবে দূরে দূরে থেকে সে দিনটা কাটিয়ে দিলাম। অঘটন ঘটলো পরের দিন।

আগেই বলেছি, বড় বড় স্বদেশী নেতাদের সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য কি। বেলা প্রায় পাঁচটা হবে হঠাৎ আমার একটি সঙ্গী আমার হাত ধরে একটু টান দিলে। তার দিকে তাকাতেই চোখ ইশারায় আমায় ডাকলে। বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে বললে, চিনতে পারেন কি? অমুক নেতা এইমাত্র দোকানে ঢুকেছেন, তার নাম বলতে চিনতে পারলাম। বিখ্যাত লোক। সবাই জানে। উত্তেজনায় আমার সঙ্গীর গলা কেঁপে উঠলো। বললো, জানেন ধীরাজবাবু, আজ ছ’মাস আমি এখানে ডিউটি করছি। কিন্তু কোনোদিন ওঁকে এই দোকানে ঢুকতে দেখিনি। আজ নিশ্চয়ই কোনো গোপন মিটিং আছে। আজ যেভাবেই হোক ওঁকে ‘ফলো’ করতেই হবে। বলা বাহুল্য আমার এই সঙ্গীটি সমস্ত ডিপার্টমেন্টের মধ্যে নামকরা। বহু কাজ করে বহু পুরস্কার পেয়েছে সে। তাকে এরকম উত্তেজিত হতে কোনোদিন দেখিনি। আমার সঙ্গীটি জাতিতে মুসলমান। আসল নাম বলবো না, ধরুন হানিফ। কি বলবো না বলবো ভাবছি, হানিফ হঠাৎ বললে, ধীরাজবাবু, আপনি দূরেই থাকবেন। যা করতে হয় আমরাই করব। কেননা, আজ ওঁকে মিস করলে আর রক্ষে থাকবে না।

চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখি আমার আর দু’জন সঙ্গী বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে নোটবুক বার করে কি দেখছে। বললাম, ওরা? হানিফ হেসে বললে, ওদের ভাবনা ওদের, আমি শুধু ভাবছি আপনার কথা। আমাকে বিশেষ করে রতিলালবাবু (বাবার সেই পরিচিত ব্যক্তি) বলে দিয়েছেন, যাতে আপনি কোনো বিপদে না পড়েন। লজ্জায় অপমানে হানিফের সামনে যেন এতোটুকু হয়ে গেলাম। আমার এতোদিনের ‘রহস্যলহরী’ পড়ার অভিজ্ঞতার কোনো মূল্যই রইলো না এই অশিক্ষিত হানিফের কাছে। কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। খানিক বাদে হানিফ বললে, আপনি আমার কাছ থেকে সরে যান, আজ আমরা এক সঙ্গে সবাই থাকবে না। দূরে ঐ থামটার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ওঁকে আমরা ফলো করে নিয়ে গেলে, আরও আধ ঘণ্টা, কাছাকাছি থাকবেন। যদি কোনো অফিসার আসেন, বলবেন আমরা অমুককে নিয়ে গিয়েছি। ব্যস, তারপর সোজা বাড়ি চলে যাবেন। কাল আপিসে একটু সকাল সকাল আসবেন, রিপোর্টটা সবাই এক সঙ্গে বসে লিখে তারপর জমা দিয়ে দেবো।

হ্যাঁ, না, কিছু না বলে থামটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাত তখন সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। সজাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি খদ্দরের দোকানটির ওপর। হঠাৎ দেখি, দীর্ঘাকৃতি এক বিরাট পুরুষ দোকান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে সামনের ফুটপাথে দাঁড়ালেন। তাঁকে ঘিরে দোকানের প্রায় সমস্ত লোকই দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মুখেই কেমন একটা সম্ভ্রমের ভাব। লোকটিকে ভালো করে দেখে নিলাম। লম্বায় প্রায় সাড়ে ছ’ ফুট, খুব কালো না হলেও বেশ কালো রঙ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, দাড়ি গোঁফ কামানো। মুখে একটা বিরাট গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। পরনে খদ্দরের ধুতি, গায়েও খদ্দরের পাঞ্জাবি। সত্যিই নেতা বলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। নামটা গোপন করেই গেলাম।

কলেজ স্ট্রীট ও হ্যারিসন রোডের মোড় থেকেই ট্রামটা ছেড়ে বেশ একটু জোরেই চলেছে। হঠাৎ দেখি, দীর্ঘাকৃতি নেতাটি অনায়াসে চোখের নিমেষে ট্র্যামের পাদানিতে লাফিয়ে উঠলেন। ভাববার অবসর নেই, আমিও এক লাফে ঐ ট্র্যামের সেকেণ্ড ক্লাশের পাদানির ওপর লাফিয়ে উঠলাম। তারপর কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। শুধু শুনতে পেলাম একটা হৈ হৈ চিৎকার–রোখকে–বাঁধকে…

ব্যাপারটা যখন পুরোপুরি বুঝতে পারলাম তখন আমার চার পাশে বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। ট্রামটিও থেমেছে আর অসংখ্য উৎসুক চোখের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ক্ষতবিক্ষত দেহে পথের উপর শুয়ে শুনতে পেলাম অযাচিত সমবেদনা ও তিরস্কার সমভাবে বর্ষিত হচ্ছে আমার উপর।

একজন বললে–নিছক গোঁয়ার্তুমি, চলতি ট্রামে ওঠা অভ্যেস নেই, নেই বা উঠলে বাপু?

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আর একজন বলে উঠলো–কি যা তা বলছেন মশাই। দেখেননি ট্রামের পাদানিতে কাপড়ের কোঁচাটা আটকে গিয়েছিলো বলেই বেচারা পড়ে গিয়েছে।

মাথার কাছে কে একজন গম্ভীর গলায় বললেন–দয়া করে। আপনারা একটু চুপ করুন আর পারেন তো খানিকটা বরফ এনে দিন। এই নিন পয়সা।

কৌতূহল হলো। কষ্ট হচ্ছিলো, তবুও আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। যা দেখলাম তা লিখে বোঝাতে পারবো না, শুধু মনে হচ্ছিলো–মা ধরণী, দ্বিধা হও, আর সেই ফাটলে এই অভাগাকে একটু আত্মগোপনের সুযোগ দাও।

সেই দীর্ঘাকৃতি স্বদেশী নেতা, যাকে আমি ফলো করে সবার কাছে বাহাদুরি নেবো ভেবেছিলাম, রাস্তার উপর তারই কোলে মাথা রেখে অজ্ঞান দেহে শুয়ে আছি আর তিনি সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বোধ হয় তিনি বললেন, চাকরি, চাকরি। তা সে যাই হোক। লজ্জা পাবার কিছু নেই। তবে আমি তোমার অনেক বড়। উপদেশ দেবার অধিকার আছে তাই বলছি, এ লাইন তোমার নয়। পারো তো এ চাকরি ছেড়ে দিও।

পকেট থেকে police token, রিপোর্টের খাতা খুচরো পয়সা সব ছড়িয়ে পড়েছিলো চারিদিকে। ধীরে ধীরে সেগুলো কুড়োতে কুড়োতে বললেন, তুমি আমার অনুসরণ করছিলে কেন? আমি কোথায় যাই না-যাই, কার সঙ্গে কথা কই, এই সব জেনে রিপোর্ট দেবার জন্যে? বেশ, তোমার নোট বই-এ টুকে নাও, আমি সব বলে যাই। কাল আই. বি. আপিসে রিপোর্ট দিও।

শুধু নির্বাক বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছি দেখে তিনি আবার শুরু করলেন, ভয় নেই, মিথ্যে কথা বলবো না। তুমি নির্ভয়ে রিপোর্ট দিতে পারো।

বরফ এসে গেল। সমস্ত বাঁ পা’টা ছড়ে গিয়েছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো, কে যেন ধারালো ছুরি দিয়ে ছালখানা চেঁচে নিয়েছে। খানিক বাদে বেশ একটু সুস্থ হয়েছি দেখে তিনি ভিড়ের মধ্যে একজনকে ডেকে বললেন, একখানা ট্যাক্সি।

আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে পকেট থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে আমায় দিতে গেলেন। এতক্ষণ একটা কথাও বলিনি, এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। গলা ধরে গিয়েছিলো, তবু বললুম, তার চেয়ে সবাইকে ডেকে আমার সত্যি পরিচয় জানিয়ে দিন…।

আর বলতে পারলাম না। নোটখানা পকেটে রেখে তিনি ট্যাক্সিওয়ালাকে ইশারা করলেন, ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো।

***

রতিলালবাবু ছিলেন আই. বি-র একজন দুঁদে নামকরা অফিসার। আমাদের কাজের রিপোর্ট সংগ্রহ করা এবং কার কোথায় ডিউটি সব ভার ছিল তার উপর। এদিকে তিনি আবার ছিলেন বাবার পুরাতন ছাত্র। কলেজ স্ত্রীটের ঘটনার পরদিনই বাবা তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলে সটান তাকে উপরে আমার শোবার ঘরে নিয়ে এসে বললেন, দেখো, ছেলেটার কি অবস্থা তোমরা করেছে একবার দেখো। তোমরা সবাই আছো বলেই ছেলেটাকে ওখানে ঢুকিয়েছিলাম কিন্তু এই যদি তোমাদের কাজের নমুনা হয়, দরকার নেই আমার ছেলের চাকুরির।

বাবা উত্তেজিতভাবে ঘরে পায়চারি করতে লাগলেন আর রতিলালবাবু চুপ করে আমার খাটের পাশে বসে রইলেন। আমার অবস্থা দেখে ও শুনে তিনি খুব দুঃখিত হয়েছেন বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। বাবাই আবার একটু নরম সুরে শুরু করলেন, একটা উপযুক্ত ছেলে হঠাৎ মরে গেল। এও পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কোথায় বায়োস্কোপ করতে শুরু করলো। তাই ভাবলাম, গভর্নমেন্ট সার্ভিস, লেগে থাকলে কালে হয়তো উন্নতি করতে পারবে আর আমারও কিছু সাহায্য হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর…

রতিলালবাবু আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। একটু উন্মা প্রকাশ করেই বললেন, আপনি মিছিমিছি বিচলিত হচ্ছেন স্যার। কালকের ঘটনার জন্য দায়ী ও নিজেই। আমি বার বার করে সবাইকে বলে দিয়েছি, তাছাড়া হানিফও কাল ওকে পই পই করে বারণ করে দিয়েছিলো, যেন ও ফলো না করে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করুন তো ও কেন একা চলন্ত ট্রামে সাসপেক্টকে ফলো করতে গেল? কাল আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা আপনাকে কি বলবো স্যার। একটা জরুরী মিটিং ছিলো কাল। তাতে সব বড় বড় সাসপেক্ট-এর যোগ দেবার কথা ছিলো। ও যদি কাল চুপ করে বাড়ি চলে আসতো, তাহলে আজ আমাদের আর পায় কে?

আমার কাছে বাবা শুধু একতরফাই শুনেছিলেন। রতিলালবাবুর কাছে সব শুনে খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, রতি, তাহলে ও এখনও তোমাদের মতো পাকা হয়ে ওঠেনি, দিনকতক ওকে সহজ সহজ ডিউটি দিলে ভালো হয়।

রতিলালবাবু তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন, বললেন, ওকে এখন দিনকতক টেলিফোন ডিউটি দেবো। আপিসে কাজ–দশটা পাঁচটা। কোনও ঝক্কি নেই।

অগত্যা তাই ঠিক হলো।

.

একতলার চওড়া কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেই সামনে পড়ে একটা প্রকাণ্ড বারান্দা। বারান্দার দু’দিকে কাঠের পার্টিশন দিয়ে ছোট ঘর, আর ঠিক মাঝখানে চার-পাঁচখানা চেয়ার। দক্ষিণের দেওয়ালের গা ঘেঁষে একখানা গোল টেবিল। তার উপর রেডিওর মতো প্রকাণ্ড একটা বাক্স বসানো। তাতে ইলেকটিক সুইচের মতো অসংখ্য ছোট ছোট চাবি। প্রত্যেকটিতে নম্বর দেওয়া। পাশে একটা টেলিফোনের রিসিভার আর একখানা টেলিফোন গাইড। এই হলো আমার কার্যস্থল। প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। ঐ অসংখ্য চাবি অপারেট করে কি করে ঠিকমতো কানেকশন দেবো! আমার আগে যার ডিউটি ছিলো, সে আশ্বাস দিয়ে বললে, কিছুই না, দিন দুই একটু অসুবিধা হবে, পরে দেখবেন জল। এ আবার একটা কাজ নাকি?

একখান সাদা কাগজ নিয়ে সে আমায় বোঝতে বসলো– ধরুন আপিসে তিনজন এস. এস. আছেন (Special Superintendent, S.S. 1, s.s. 2, S.S. 3,-এঁরা হলেন। আই. বি-র মাথা)। কেউ যদি টেলিফোনে এস. এস, ২কে চায় তাহলে 3 down 5 up 7 down (সুইচের মতো যে চাবিগুলো রয়েছে তাতে নম্বর দেওয়া আছে-1, 2, 3, 4, 5, 6, 7, ইত্যাদি) ব্যস, কানেকশন হয়ে গেল। তেমনি ধরুন, যদি এস. এস. ৩কে চায় তাহলে 2 down 8 up 9 down।

এই বলে সে সাদা কাগজে সব পরিষ্কার করে লিখে দিলে। আরও বলে দিলে–কথা শেষ হয়ে গেলে আর্দালি এসে বলে যাবে অথবা নিজে গিয়ে দেখে আসতে হবে কথা শেষ হয়েছে কিনা। তারপর লাইন নরম্যাল করে দিয়ে চুপ করে বসে থাকুন বা বই পড়ন, যা খুশি। মোদ্দা কথা, শুধু আপ আর ডাউনের কাজ।

তিন চারদিন সত্যই একটু অসুবিধা হলো। প্রথমতঃ এমন জড়িয়ে ইংরেজি কথা বলতো যে, বুঝতেই পারতাম না কাকে চায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। দিব্বি আরামে দশটায় খেয়েদেয়ে একখানা দীনেন্দ্র রায়ের বা ঐ ধরনের মুখরোচক নভেল সঙ্গে নিয়ে যেতাম আর পাঁচটার মধ্যে সেখান শেষ করে বুক ফুলিয়ে বাড়ি চলে আসতাম। টেলিফোন ডিউটিতে আরেকটা মস্ত সুবিধা ছিলো, কেউ জানতে পারতো না কোথায় কাজ করি। তখন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের যুগ। পুলিসে বিশেষ করে আই. বি-তে ওয়াচারের কাজ করি, শুনলে ঘেন্নায় কেউ কথা বলতো না। এমনিতেই কানাঘুষো শুনে আমার সহপাঠী অনেকেই আমার সঙ্গে আলাপ বন্ধ করে দিয়েছিলো।

আমাদের আপিসের ঠিক পাশের বাড়িটাই ছিলো এস. বি. আপিস। সেটা পুরো ক্যালকাটা পুলিসের অধীনে। সেখানে অন্যান্য সব জটিল ব্যাপারের ভিতর স্বদেশী ডাকাত ধরাতেও ওদের অধিকার আমাদের চেয়ে কম ছিলো না। ওদের বলতে এস. বি. অর্থাৎ স্পেশাল ব্রাঞ্চ। দরকার হলে ওদের সঙ্গে আমাদের ডিউটি পড়তো। দুটি আপিস আলাদা হলেও দরকার পড়লে দুই ভাই লাঠি উঠিয়ে দাঁড়াতে। এদিকে আবার রেষারেষিরও অন্ত ছিলো না। আমরা একটা ভালো শিকার পাকড়াও করেছি জানতে পারলে ওরা জ্বলে পুড়ে মরতো।

টিফিনের সময় ওদের আপিসে প্রায়ই যেতাম। সবাই ধরে বসতো, গল্প বলো। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি তখন রহস্যলহরীর কৃপায় ভর্তি। তার ভিতর থেকে বাছা বাছা গল্প বলে শোনাতাম, আর, বলতাম, ছছঃ! এসব কি একটা কাজ নাকি? ওদের দেশে পুলিস আজ কত এ্যাডভান্স, কতরকম বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে ওরা ক্রাইম ডিটেকশন করে, যদি কোনোদিন সুযোগ পাই, দেখিয়ে দেবো কি করে বড় বড় অপরাধীকে পাকড়াও করতে হয়।

সবাই হা করে কথাগুলো গিলতে, হয়তো ভাবতে–সত্যিই একটা অদ্ভুত জিনিয়াস পথভুলে ওদেশে না গিয়ে এই পরাধীন দেশের আই. বি. ডিপার্টমেন্টে ছিটকে এসে পড়েছে। এমনিভাবে দিনগুলো বেশ কাটতে লাগলো।

আগেই বলেছি, বারান্দার দুপাশে দুটো কাঠের পার্টিশন করা ঘর। প্রায়ই খালি থাকে। দু’-একজনকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর পাইনি। একদিন বুঝতে পারলাম।

স্বদেশী বড় বড় সাসপেক্ট অথবা ডেটিনিউ যাদের আটক রাখা হতো, মাঝে মাঝে তাদের আপিসে এনে ঐ ঘরে বসিয়ে রাখা হতো। তারপর বড় বড় হোমড়া-চোমড়া অফিসারের দল এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করে যেতেন। শুনতাম, কোনো কোনোদিন বেলা দশটা এগারোটায় এনে রাত্রি বারোটা একটা পর্যন্ত জেরা চলতে। এর মধ্যে খাবারও প্রচুর খাওয়ানো হতো। মূল উদ্দেশ্য হলো পার্টির ভিতরের খবর সব বের করে নেওয়া এবং প্রচুর প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভিড়িয়ে নেওয়া যাতে দলের ভিতর থেকেও সে লুকিয়ে সব খবর এদের জানাতে পারে। সোজা কথায় যাকে বলে স্পাই। লোক বুঝে মাসে মাসে দু’ শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা পর্যন্ত ব্যবস্থা ছিলো। টাকার প্রলোভনে শেষ পর্যন্ত অনেকেই টোপ গিলতো। আবার গিলতেও না এমন দু’-একটিও যে না ছিলো তা নয়। তবে দেখতাম ও শুনতাম, বেশির ভাগই টোপ গিলেছেন।

আপিসে তিনজন এস. এস-এর মধ্যে দু’জন ছিলেন খাঁটি ইংরেজ আর এস. এস-৩ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালী। নিজের অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার জোরে তিনি সাধারণ কনস্টেবল থেকে এস. এস-৩ হয়েছিলেন। এদেরও নিজস্ব স্পাই ছিলো এক একজন নামকরা পুলিস। স্বদেশী নেতা। এইসব তথাকথিত নেতারা জেল খাটতেন, খদ্দর পরতেন, বাংলা মায়ের বন্ধন দশা ঘোচাবার জন্য মিটিং-এ কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করতেন। আবার গোপনে সব সংবাদ সরবরাহ করতেন আই-বি. আপিসে। তার জন্য এদের মাসোহার বন্দোবস্ত ছিলো পাঁচ সাত শ’ টাকা। চমৎকার ব্যবস্থা! এদেরই বক্তৃতা শুনে দেখেছি হাজার হাজার নরনারী গায়ের গয়না, কাপড় অম্লান বদনে খুলে দিয়েছে। এইসব নেতারা মোটরকার চড়তেন, আড়াই শ’ তিন শ’ টাকার ভাড়ার বাড়িতে থাকতেন। অথচ কোনো চাকরি করতেন না বা দেশে জমিদারিও ছিলো না। কারা এই টাকাটা যোগাতে? দরিদ্র দেশ না বৃটিশ গভর্নমেন্ট?

এস. এস-দের নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা রেষারেষির ভাব ছিলো। কে কত জরুরী খবর সংগ্রহ করতে পারে এবং কে কত বড় বড় স্বদেশী রুই কাতলা জেলে পুরতে পারে, এই ছিলো তাদের কর্মজীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য।

একদিনের ঘটনা। টেলিফোন ডিউটিতে বসে একখানা ইংরেজি ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছিলাম। পাশের পার্টিশনের ওধার থেকে উত্তেজিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম–

-কেন মিছিমিছি নিজেও ভুগছেন আর আমাদেরও ভোগাচ্ছেন। রাজী হয়ে যান। কিছু করতে হবে না, শুধু মাঝে মাঝে মিটিং-এর স্থান কাল আমাদের জানিয়ে দেবেন। ব্যস্ মাসে মাসে মোটা টাকা পাবেন, রাজার হালে থাকবেন। আমাদের এস. এস-২কে জানেন না, অমন ভালো লোক এ ডিপার্টমেন্টে নেই… প্রশ্নকর্তা হয়তো প্রভুর আরো গুণগান করতেন, কিন্তু একটা গম্ভীর গলার চাপা হাসিতে আর বাকি কথাগুলো চাপা পড়ে গেল।

–খালি হাসেন কেন বলুন তো? আজ চার পাঁচদিন ধরে ঐ একটা কথা আপনাকে বোঝাচ্ছি, শুধু হেসেই উড়িয়ে দিতে চান?

এবার উত্তর শুনতে পেলাম। সতেজ গম্ভীর গলা; একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের হাসি তার মধ্যে লুকিয়ে আছে।

–হ্যাঁ, হেসেই উড়িয়ে দিতে চাই। যদি সম্ভব হতো, আপনাদের এই আই-বি. ডিপার্টমেন্টটাই হেসে উড়িয়ে দিতাম।

এর পর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। বই পড়া বন্ধ করে অধীর উৎকণ্ঠায় কান খাড়া করে চেয়ারে বসে আছি। আবার ভেসে এল সেই হাসি, এবার একটু জোরে

-আপনাদের তূণে যতগুলো অস্ত্র ছিলো, সবগুলোই তো এ ক’দিনে প্রয়োগ করেছেন আমার ওপর। আর কেন?

নিম্নস্বরে প্রশ্নকর্তা কি যেন বললেন, শুনতে পেলাম না। শুনতে পেলাম সেই হাসি, আরও জোরে–

-আমি কি ভাবছি জানেন? আপনাদের মতো উজবুক সব লোক নিয়ে আপনাদের হবুচন্দ্র এস. এস-২ এই ডিপার্টমেন্ট চালাচ্ছেন কি করে? তাঁকে বলে দেবেন, এক ফরমুলায় সব অঙ্ক কষা যায় না।

ঠিক এমনি সময়ে এস. এস. ৩-এর আর্দালি এসে আমাকে জানালো, সাহেব সেলাম দিয়েছেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম, পার্টিশনের পাশে গভীর নিস্তব্ধতা। বুঝলাম কেউ নেই। হয়তো ভদ্রলোককে কাল আবার নিয়ে আসবে। আবার হয়তো ঐ একই প্রশ্নের একঘেয়ে কচকচানি শুরু হবে। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। নভেলখানা খুলে পড়তে শুরু করলাম।

.

টেলিফোন ডিউটিতে বেশ আরামে আছি। দশটায় আসি। মাঝে এক ঘণ্টা এস. এস, প্রভুদের ‘লাঞ্চ’-এর ছুটি, আমারও ছুটি। তারপর পাঁচটায় সাহেবরা চলে গেলে, ব্যস্ একদম বাড়ি। টেলিফোনের অগুন্তি চাবিগুলি এখন আর ভয়ের উদ্রেক করে না। বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছে এই ক’মাসে। এখন চাবিগুলোর দিকে না চেয়েই কনেকশন দিতে পারি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু ঘটেনি। সেই নিত্যনৈমিত্তিক বাঁধাধরা রুটিন ওয়ার্ক।

পুজো প্রায় এসে গিয়েছে। দেশের বাড়িতে প্রতি বছর তিনদিন অভিনয় হয়। বলা বাহুল্য, ঐ তিনদিনই আমাকে নাম-ভূমিকায় বা বড় ভূমিকায় নামতে হয়। এবার ঠিক হয়েছে, সাজাহান, চণ্ডীদাস ও মিশরকুমারী। সময় বেশি নেই, রোজ একখানা করে নাটক সঙ্গে নিয়ে টেলিফোন ডিউটিতে বসে পাঠ মুখস্থ করি। সেদিন সাজাহানের ভূমিকা খুব মন দিয়ে তৈরি করছিলাম। যেখানটায় সাজাহান উন্মাদের মতো জাহানারাকে বলছে,–দেবো লাফ? দিই লাফ?

তন্ময় হয়ে বন্দী বৃদ্ধ সাজাহানের কথাগুলো চাপা গলায় বেশ ভাব দিয়ে আউড়ে যাচ্ছি, এমন সময়–ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই একটা অস্পষ্ট চাপা গলায় কে একজন এস. এস.-কে চাইলে। বইটির দিকে চেয়ে মুখস্থ করতে করতেই চাবিগুলো টিপে 7 down 2 up 4 down করে কনেকশন দিয়ে আবার পুরো উদ্যমে পরের সিনটা শুরু করলাম।

খেয়াল নেই, কতক্ষণ পরে দেখি তিন চারজন আর্দালি ও দু’ তিনজন বাঙালী অফিসার হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। ব্যাপার কি? ভীষণ ব্যাপার। এস. এস. আমাকে তলব করেছেন। অপরাধীর মতো ভয়ে ভয়ে এস.এস.-এর কামরায় ঢুকলাম।

সত্যিকার গোলাপখাস আম দেখেছেন? চেয়ে দেখি এস. এস-এর গালের দুটো পাশ ঠিক সেইরকম লাল হয়ে গিয়েছে। রাগে ইংরেজ-প্রভু নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলেন আর কি! আমাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে এক সঙ্গে কি যে কতকগুলো বলে গেলেন তার একবর্ণও বুঝলাম না। পাশের একজন বাঙালী অফিসার বললেন, করেছেন কি মশাই? সাহেবের একজন স্পেশাল স্পাই, যাকে মাসে মাসে বহু টাকা সাহেব গোপনে দিয়ে থাকেন, তার একটা বিশেষ দরকারী খবর আপনি এস. এস-২কে দিয়েছেন?

আমি তো অবাক। কি জবাব দেবে ভাবছি। এমন সময় রতিলালবাবু ঘরে এসে আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে বললেন, টেলিফোন ডিউটি খুব সোজা নয়! সব সময় সজাগ না থাকলে এক মুহূর্তের ভুলে অনর্থ ঘটে যেতে পারে। টেলিফোনটি ছিলো এস. এস. ১-এর আর খুব গোপনীয়। একটা গোপন মিটিং-এর খবর। যার উপর নির্ভর করে এস-এস. রাত্রে চার পাঁচজন স্বদেশী নেতাকে গ্রেপ্তার করতেন।

বুঝলাম ব্যাপার সত্যিই গুরুতর। আরো মজার কথা শুনলাম, এই ভাইটিকে নিজের স্পেশাল স্পাই করার জন্য এস. এস-২ বহুদিন ধরে চেষ্টা করছেন কিন্তু পারেননি। এবং সে যে বহুদিন আগেই এস. এস. ১-এর টোপ গিলে বসে আছে তাও জানতেন না। বুঝলাম, চাকরি এবার সত্যিই গেল।

রতিলালবাবু বললেন, বাড়ি চলে যাও, টেলিফোন ডিউটি তোমাকে আর দেওয়া হবে না এটা ঠিক। দেখি সাহেবের হাতে পায়ে ধরে অন্য ডিউটিতে দিয়ে যদি তোমার চাকরিটা কোনোরকমে রাখতে পারি।

.

রতিলালবাবুর চেষ্টায় চাকরিটা আমার রয়েই গেল, তবে ডিউটি গেল বদলে। এবার আমার ডিউটি পড়লে ভবানীপুরে। রসা রোড থেকে যে জায়গায় ট্রামটা ঘুরে বালিগঞ্জমুখো গিয়েছে সেই চৌমাথায়। শুনলাম সাসপেক্ট থাকে প্রতাপাদিত্য রোডে। বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে সে সাইকেলে বেরিয়ে পড়ে, তারপর এদিক সেদিক ঘুরে কোথায় যে সরে পড়ে কেউ তা জানে না। আজ তিন বছর ধরে ওকে ফলো করা হচ্ছে, কিন্তু অতি দুঁদে ওয়াচার পর্যন্ত হার মেনে গিয়েছে। ডিউটিতে আমরা তিনজন, তার মধ্যে একজনের সঙ্গে শুধু একখানা ভালো বাইসাইকেল। যদি কোনোদিন সাইকেলে না উঠে ট্রামে বা ট্যাক্সিতে বেরোয় এইজন্য আমরা বাড়তি দু’জন। রতিলালবাবু বিশেষ করে সঙ্গের দু’জনকে বলে দিয়েছেন যে, আমি যেন কোনো মতেই ঐ বিশেষ মূল্যবান শিকারটিকে ফলো না করি। কাজেই তিনটের সময় গিয়ে চৌমাথায় ঘাসের উপর আরামে বসে পড়ি, আর সঙ্গী দু’জনের সঙ্গে রবার্ট ব্লেক থেকে শুরু করে ওদেশের সব জাঁদরেল ডিটেকটিভের গল্প ফেঁদে বসি। সঙ্গী দু’জন আমার কথাগুলো হাঁ করে গিলতে। আমাদের শিকার বাড়ি থেকে বেরোলেই ওরা জানতে পারতো। নিমেষে তিনজনে তিনদিকে ছিটকে পড়তাম, শুধু সাইক্লিস্ট সঙ্গীটি দূরে থেকে অনুসরণ করতো। এরপর আমরা দুজন একেবারে নিশ্চিন্ত, খালি খোস গল্প আর পরনিন্দা এই করে রাত ন’টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিতাম। আমাদের শিকারটির চেহারার একটু বর্ণনা এখানে দিয়ে রাখি।

নাম ধরুন–রবি চৌধুরী, বয়েস চব্বিশ-পঁচিশ। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, কালো রঙ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, চোখ দুটি অসাধারণ তীক্ষ্ণ। চাইলে মনে হবে যেন অন্তস্তল ভেদ করতে চাইছে। পরনে খদ্দরের মোটা ধুতি, গায়ে খদ্দরের ঢিলে পাঞ্জাবি, পায়ে চটি। সাইকেল চালানোয় অসাধারণ দক্ষ।

রবি চৌধুরী সাইকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঠিক ঐ মোড়টার কাছে এসে সাইকেল আস্তে চালাতো আর চারিদিকে চাইতে চাইতে যেতে। যেন সমস্ত আই. বি. ডিপার্টমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাইতো–এসো, কে আসবে আমায় ফলো করো।

পরে বুঝেছিলাম, যত নতুন লোকই দেওয়া হোক না কেন, বাড়ি থেকে বেরিয়েই রবি বুঝতে পারতো, কারা আই-বি’র লোক। যাক, যা বলছিলাম বলি।

রাত্রি প্রায় সওয়া ন’টার সময় আমাদের তৃতীয় সঙ্গীটি গলদঘর্ম হয়ে ফিরে এল। সেই চিরপুরাতন ব্যর্থতার ইতিহাস। এ-রাস্তা ও-রাস্তা এ-গলি ও-গলি ঘুরিয়ে নাস্তানাবুদ করে আধ ঘণ্টা আগে কোথায় যে সে সরে পড়লো কেউ জানে না। মনে মনে লোকটার সম্বন্ধে একটা শ্রদ্ধা ও কৌতূহল জেগে উঠলো। শুনলাম এই বয়সে সে চার-পাঁচবার জেল খেটেছে। আমাদের আই. বি’র কর্তারা বহু চেষ্টা করেছেন তাকে টোপ গেলাবার এবং এখনো সে চেষ্টা চলেছে, কিন্তু বড় শক্ত ঠাঁই। শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

দিন পনেরো কেটে গেল। এর মধ্যে একটা নতুন উপসর্গ জুটেছে। একেই আমি ভবানীপুরের ছেলে, বহুলোকের সঙ্গে পরিচয়, তার উপর বাবা মিত্র ইনস্টিউশনের মাস্টার। কাজেই নির্বিবাদে চৌমাথায় বসে ডিউটি করা আমার ভাগ্যে সইলো না। বসে গল্প করছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে বলে উঠলো, আরে তুই এখানে বসে কি করছিস বলতো? কালও ট্রামে যেতে যেতে দেখলাম তুই এখানেই বসে আছিস…

কি জবাব দেবে বলতে পারেন? অপ্রস্তুত হয়ে একটা যা’তা বলে দিলাম। বিশ্বাস সে নিশ্চয়ই করলো না। আমার সঙ্গী দুটির দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চাইতে চাইতে সরে পড়লো। এই রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলো। একে তখন অসহযোগ আন্দোলনের যুগ, পুলিসের নাম শুনলেই লোকে ঘৃণায় ভ্রূ কুঁচকে প্রকাশ্যে গালাগালি দিতে শুরু করে, তার উপর যদি জানাজানি হয়ে যায় আমি পুলিস, শুধু পুলিস নয়, টিকটিকি পুলিস হয়ে বাঙলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানগুলোকে জেলে পুরতে সাহায্য করছি, ব্যস, আর দেখতে হবে না। আমার হয়ে গেল। মনে মনে বেশ খানিকটা দমে গেলাম।

বেলা চারটে কি সাড়ে চারটে হবে। তিনজনে আপিসের কি একটা ব্যাপার নিয়ে তর্কে মেতে আছি, হঠাৎ আমার সঙ্গী দু’জন ছিটকে কে কোথায় চলে গেল বুঝতে পারলাম না। বোকার মতো চারিদিকে চাইতে চাইতে দেখি ঠিক আমার সামনে পশ্চিমের ফুটপাথের উপর একখানা পা ঠেস দিয়ে সাইকেলে বসে রবি চৌধুরী। আঁৎকে উঠলাম। ভাটার মতো জ্বলন্ত চোখ দুটো দিয়ে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ডান হাত বাড়িয়ে আমার ডাকলে। সে ডাক অবহেলা করার মতো সাহস ও মনের বল আমার ছিলো না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক পা এক পা এগিয়ে গেলাম; কাছে যেতেই শান্ত অথচ তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম ধীরাজ না?

উত্তরে শুধু ঘাড় নাড়লাম।

তুমি ললিতবাবুর ছেলে না?

বললাম, হ্যাঁ।

তোমার বাবার কাছে আমি পড়েছি। তাকে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি। তার ছেলে হয়ে তুমি এই কাজ করছো।

কি জবাব দেবো, চুপ করে রইলাম।

রবি চৌধুরী বলে চললেন, পরাধীন দেশে জন্মে যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করছি। সেই আত্মগ্লানি খানিকটা মুছে ফেলবার জন্য দেশমায়ের সেবা করছি। ইংরেজের চোখে আমরা যাই হই, তোমাদের কাছে–আমার ছোট ভাইবোনদের কাছেও কি আমরা অপরাধী? নইলে তোমরা এই দেশের লোক হয়ে রাতদিন আমাদের পিছু পিছু ব্লাডহাউণ্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? সামান্য ক’টা টাকার জন্য এই চাকরিই স্বীকার করে নিলে। ছিঃ।

নিচে মাটির দিকে চেয়েছিলাম, মুখ তুলে দেখি রবি চৌধুরী তীরবেগে সাইকেল চালিয়ে কালীঘাট ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে গিয়েছে।

.

সে রাত্রে ভালো করে ঘুমোতে পারলাম না। পরদিন সকালে উঠে বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে পরে বললেন, নাঃ, সত্যই এরকম চাকরি তোমার করা উচিত নয়। আমি আজই রতিলালকে ডেকে সব বলি।

রতিলালবাবু সব শুনে বললেন, ছাড়বো বললেই আই. বি’র চাকরি ছাড়া যায় না স্যার। তাছাড়া ও এখন ভিতরের অনেক খবর জেনে গিয়েছে। এ অবস্থায় চাকরি ছেড়ে দিলেও গভর্নমেন্ট ওকে ছাড়বে না। ছুতোয় নাতায় একটা মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে আটক করে স্বদেশী কয়েদীদের সঙ্গে রেখে দেবে, সারাজীবনটাই খতম। তার চেয়ে দেখি কম ঝক্কির ডিউটিতে ওকে যদি দিতে পারি।

বাবা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, তার চেয়ে তুমি ওকে আপিসে কোনো ডিউটিতে দাও, নয়তো মফঃস্বলে কোনো থানায় দিয়ে দাও।

রতিলালবাবু হেসে বললেন, আপনি কেন অতো ভয় পাচ্ছেন স্যার। সব ঠিক করে দিচ্ছি। ট্রেনিং থেকে পাশ করে না এলে থানায় দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এখন আই. বি’তে বহুলোকের দরকার। দেখছেন না, স্বদেশী আন্দোলন দিন দিন কি রকম বেড়েই উঠছে? আর দিন কতক গেলে দেখবেন ও নিজেই আই. বি. ছেড়ে কোথাও যেতে চাইবে না।

বাবা অগত্যা চুপ করে গেলেন।

এইখানে একটু বলে নেওয়া দরকার আমাদের আই. বি. ডিপার্টমেন্ট ছিলো বেঙ্গল পুলিসের অধীনে আর. এস. বি. (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ছিলো ক্যালকাটা পুলিসের ভিতরে। কোনো বাড়ি তল্লাশী বা কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে আমাদের এস. বি. অথবা ক্যালকাটা পুলিশের সাহায্য নিতে হতো। যদিও আমরা আই. বি. ও এস. বি. মিলে এক সঙ্গে ডিউটি করতাম তবু আসল চাবিকাঠি ছিলো ওদের হাতে। পলিটিক্যাল ব্যাপারের জন্য কলকাতায় এই দুটি প্রতিষ্ঠান ছিলো প্রধান। সাধারণ চোর ডাকাত খুনে এদের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান সি. আই. ডি. বিভাগ। আই. বি. অথবা এস. বি’র সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। মফঃস্বলের প্রতি শহরে থানা ছাড়াও ডি. আই. বি. বা ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ ছিলো। কলকাতা আই. বি’তে কাজের চাপ পড়লেই মফঃস্বলের থানা এবং ডি. আই. বি. থেকে রিকুইজিশন করে লোক আনিয়ে নেওয়া হতো এবং কাজের চাপ কমলেই আবার তারা নিজ নিজ জেলায় ফিরে যেত।

কোনো ডিউটি তখনো আমার ঠিক হয়নি। রতিলালবাবু বলে দিলেন তাহলেও একবার করে মোজ আপিসে যেতে। রোজ যাই, ঘণ্টাখানেক থেকে গল্পগুজব করে চলে আসি। সেদিন আপিসে যেতেই দেখি কেবল নতুন মুখ, আপিস একেবারে সরগরম। ব্যাপার কি? শুনলাম ভীষণ কাজের চাপ পড়েছে। তাই মফঃস্বলের ডি. আই. বি. এবং থানা থেকে অনেক লোক আনানো হয়েছে, তার মধ্যে অফিসারও আছেন।

কি একটা কাজে উপরে গিয়েছিলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আমার পরিচিত হানিফ এবং আরো দু-একজন এস. এস, তিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে হাতে একখানা সাদা খাম। আমায় দেখে তাড়াতাড়ি সেখানা পকেটে রেখে দিলে। জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তরে তারা একটু হেসে পাশ কাটিয়ে সরে পড়লো। কৌতূহল বেড়ে গেল। অনেক চেষ্টা করে অপরের কাছ থেকে জানলাম, ওটা হলো ‘ডি-এ’ অর্থাৎ ডেঞ্জার এলাউয়েন্স। ওটা দেওয়া না দেওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করে এস-এসদের খেয়াল খুশির উপর। যার রিপোর্ট যত মূল্যবান এবং যে যত বেশি ঝক্কির ডিউটি করে ওটা মাঝে মাঝে তারা পায়। এক শ’ দু’ শ’ থেকে হাজার পর্যন্ত। প্রতি বৎসর বৃটিশ গভর্নমেন্ট ‘ডি-এ’ বাবদ বহু লক্ষ টাকা মঞ্জুর করিয়ে নেন।

আমাদের উপরে একজন অফিসার ছিলেন, গোপেনবাবু। শুনেছিলাম তিনি নিজের সহোদর ভাইকে একটা জটিল স্বদেশী মামলায় জড়িয়ে দিয়ে আই. বি’তে সাব ইনস্পেক্টরের পোস্ট, নগদ দশ হাজার টাকা ও প্রায় এক শ’ বিঘে ধানের জমি গভর্নমেন্টের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। আমরা সবাই মনে মনে তাকে ঘৃণা করলেও গোপেনবাবু ইংরেজ অফিসারদের ছিলেন খুবই প্রিয়। লেখাপড়া কিছুই জানতেন না, অতি কষ্টে আমাদের রিপোর্টগুলিতে নাম সই করে দিতেন। সবচেয়ে উপভোগ্য হতো গোপেনবাবু যখন ইংরেজিতে সাহেবদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতেন। কালো আবলুস কাঠের মতো মুখখানিতে ধবধবে সাদা দাঁতগুলো বার করে বেকুবের মতো খালি অর্থহীন হাসি হাসতেন আর প্রতি কথার মধ্যে ‘ইয়েস স্যর, ইউ ফাদার মাদার, অল রাইট স্যর’; এ ছাড়া তার তহবিলে আর ইংরেজি কথা ছিলো বলে মনে হতো না।

ঐ চেহারা আর বিদ্যে নিয়ে গোপেনবাবু তোফা সুনামের সঙ্গে চাকরি করে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে বেশ মোটা ‘ডি-এ’ ও বাদ যেত না। ভাবতাম, অদ্ভুত জায়গা এই আই. বি. ডিপার্টমেন্ট। এখানে ঢুকলে মানুষ পয়সা আর ইংরেজ প্রভুদের খুশি করবার নেশায় মেতে ওঠে। এখানে চেহারার দরকার নেই, বিদ্যেবুদ্ধির প্রয়োজন নেই, শুধু তুমি যে মানুষ আর তোমার যে বিবেক বলে একটি পদার্থ আছে সেটি ভুলে যাও, ব্যস্ আর দেখতে হবে না। দিন দিন তুমি উন্নতির চরম শিখরে উঠে যাবে।

বারান্দার কাঠের পার্টিশনটার পাশে শুনলাম মৃদু গুঞ্জন। আজকাল আর সে গুঞ্জন থামে না, রাতদিন চলে। নিচে নামছি রতিলালবাবুর সঙ্গে দেখা। বললাম, রতিদা, দিন না আমায় কোনো ডিস্ট্রিক্টের থানায় বদলি করে।

উত্তরে একটু হেসে রতিলালবাবু বললেন, পাগল, দেখছে না সব জেলা থেকেই লোক আনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যা কাজ পড়েছে, বাপস্! তাছাড়া ট্রেনিং থেকে পাশ করে না এলে কোনো জেলাই তোমাকে নেবে না। আই. বি. হচ্ছে স্পেশাল ব্যাপার। এখানে আমরা দরকার বুঝলে বিনা ট্রেনিং-এ লোক নিতে পারি কিন্তু ছেড়ে দিতে পারি না। বুঝলে?

বুঝলাম সবই, কিন্তু এখন আমি করি কী!

***

ডিউটি করে চলেছি। শেয়ালদহে, বেলেঘাটা স্টেশনে। সকালের দিকে কয়েকটা লোকাল ট্রেনে লক্ষ্য রাখতে হয়, কারণ আমাদের নির্দিষ্ট সাসপেক্ট ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। বেলা ন’টার পর খুব ঘনঘন অনেকগুলো ট্রেন আসে। আমাদের শিকারটি সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে এসে পড়তেন। তারপর পায়ে হেঁটে সারা কলকাতাটা চষে ফেলে সন্ধ্যে সাতটার পর আবার ট্রেনে ফিরে যেতেন। কোনও আপিসে চাকরি করেন না অথচ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। এটা কি? ঠিক ওই রহস্যটা ভেদ করবার জন্যই আই. বি. ডিপার্টমেন্টও কম উগ্রীব নয়। ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে সোজা হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটতে থাকেন। মাঝে মাঝে দু-একটি পানের দোকানে দাঁড়ান, এক পয়সার পান ও একটি সিগারেট নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেন। অদ্ভুত হাঁটতে পারেন ভদ্রলোক। সারাদিন এইভাবে উদ্দেশ্য বিহীনের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যার পর স্টেশনে ফিরে আসেন। একঘেয়ে রুটীন-বাঁধা কাজ। এইভাবে সারাদিন হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায় আধমরা হয়ে যাই। ভদ্রলোককে দেখে কিন্তু বুঝবার উপায় নেই, এটা যেন তার নিত্যকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

আমার সঙ্গী রহমান বললে–বুঝতে পারলেন না? লোকটা মহা ধড়িবাজ। এইভাবে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে আমাদের জব্দ করছে। বিরক্ত হয়ে যেদিন আমরা ওকে ফলো করবো না, সেই দিন ও ওদের আড্ডায় যাবে। আমাদের ও আসল ঘাঁটিটা দেখাতে চায় না।

কথাটায় যুক্তি আছে বলে মনে হলো। এইভাবে প্রায় তিন সপ্তাহের উপর কেটে গেল। আপিসেও রোজ ওই একই বাঁধা ধরা রিপোর্ট দিচ্ছি–অমুক ট্রেনে এল, তারপর এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা সাতটা কি সাড়ে সাতটার ট্রেনে বাড়ি গেল।

আমরা তখন অনেকটা বেপরোয়া। দূর থেকে পিছু নেওয়ার নিয়ম থাকলেও আমরা আর তা মেনে চলি না। স্টেশন গেটে মন্থলি টিকিট দেখিয়ে বেরলেই আমরাও সঙ্গে সঙ্গে পিছু নিই, যেন আমরা বিশেষ পরিচিত বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটু এগিয়ে-পিছিয়ে থেকে তিনজনেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।

সেদিন ছিলো শনিবার। ঘটনাটা বেশ পরিষ্কার মনে আছে। ভলোক সেদিন বেশ একটু দেরি করেই এলেন। প্রায় বারোটা। যথারীতি তিনজনে হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আজকের হাঁটায় একটু বৈচিত্র্য দেখা গেল। অন্যদিন চলতে চলতে কোনো দোকানের সামনে থেমে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে দোকানের কাঁচের জানলার জিনিসগুলো দেখতেন। মনে হতো একটু জিরিয়ে দম নিচ্ছেন। তারপর আবার হাঁটতেন। এইভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচ সাতবার থামতেন। আজ ব্যতিক্রম ঘটলো।

অভিশপ্ত ইহুদির মতো ভদ্রলোক হেঁটেই চলেছেন। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। ঘণ্টা দুই এইভাবে হাঁটার পর আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলো। আমার সঙ্গীকে বললাম–আর পারছিনে ভাই, একটু জিরিয়ে নেই।

আঁৎকে উঠে রহমান বললে,–অমন কাজও করে না ভাই! আজ ব্যাটা নির্ঘাৎ কোথাও যাবে, তাই আমাদের চোখে ধুলো দিতে চাইছে। আজ যদি একটা ভালো রিপোর্ট দিতে পারি তাহলে এ মাসে ‘ডি-এ’ মারে কে!

আমার ক্লান্ত চোখের সামনে ভেসে উঠলো আই. বি. আপিস। হাসিমুখে আমার সব সহকর্মীরা এস. এস.-এর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। হাতে একখানা করে সাদা নাম না-লেখা খাম। ক্লান্তি ঝেড়ে ফেললাম। আবার পুরো উদ্যমে হাঁটা শুরু। আরও ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটলো। দেখলাম, একই রাস্তা দু তিনবার করে ঘুরছি। এ-ফুটপাথ দিয়ে যাই, ও-ফুটপাথ দিয়ে ফিরি। দেখলাম রহমানও খানিকটা নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছে। পাকা লোক, মুখে আস্ফালন ছাড়ে না,-বুঝলে ভাই, আজ একটা হেস্তনেস্ত হবেই। আজ বাছাধনকে বুঝিয়ে দেবো।

হাতিবাগানের মোড়। পাশের একটা দোকানের ঘড়িতে সাতটা বেজে দশ। ভদ্রলোক একটা পানের দোকানে দাঁড়ালেন। আমার তখন মনে হচ্ছিলো, ফুটপাথের উপরে শুয়ে পড়ি। একটা গ্যাসপোস্ট ধরে হাঁপাতে লাগলাম। রহমান পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালো। খুব কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম। শুনলাম, ভদ্রলোক দোকানদারকে বলছেন,–বহুৎ বরফ ডালকে একঠো লিমোনেড।

মনে হলো, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। থুথু পর্যন্ত শুকিয়ে ধুলো। ঢোক গিলতে পারছি না। ক্লান্ত চোখে রহমানের দিকে তাকালাম। বোধ হয়, আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই রহমান চার পাশটা একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে মাথা নাড়লে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, ধারে কাছে কোথাও পান বা সরবতের দোকান নেই, খেতে হলে ঐ একই দোকানে খেতে হয়। অতোটা সাহস হলো না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলাম।

লোকটা এক নিঃশ্বাসে বরফ দেওয়া লেমোনেডের গ্লাশটি শেষ করে দোকানিকে বললে,–পান।

পান খাওয়া শেষ হলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার আমাদের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ চিৎকার করে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলো, এই আঁস্তাকুড়ের কুকুরগুলোর জন্যে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যেখানে যাবো ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে যাবে। আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন। আজ আমি তোদের ফলো করবো, দেখি কোথায় তোরা যাস।

এই বলে আমাদের দিকে তেড়ে এগিয়ে এল, আমরা প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। পরে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে এক পা দু পা করে পিছু হটতে শুরু করলাম। তাতেও বিপদ কাটলো না। বুঝলাম, আজ লোকটা মরীয়া। একটা অনর্থ কাণ্ড আজ ও বাধাবেই। তারপর ছুটতে শুরু করলাম। দেখি সেও ছুটতে আরম্ভ করেছে। রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম।

কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরে প্রাণের দায়ে ছুটে চলেছি, আট দশ হাত ব্যবধানে আর একটা লোক ছুটছে। কৌতূহলী পথচারীর দল থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে,–ব্যাপার কি মশাই, চোর নাকি?

হঠাৎ দেখি বাঁ দিকের একটি গলি দিয়ে রহমান অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার রীতিমতো ভড়কে গেলাম। পিছনে না চেয়ে আরো জোরে ছুটতে শুরু করে দিলাম, সময়ের হিসেব ছিলো না। তবে মনে হয়, আধ ঘণ্টা এইভাবে ছুটে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে যখন এলাম তখন আর আমার ছোটবার ক্ষমতা নেই। যা থাকে কপালে। মরীয়া হয়ে পার্কে ঢুকে পড়লাম। তারপর সটান ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম।

রাত দশটা পর্যন্ত এইভাবে শুয়ে থেকে আস্তে আস্তে উঠলাম, দেখি পা দুটো ব্যথায় টন্ টন্ করছে। দেহের ভার বইতে আর তারা চাইছে না। কোনো রকমে দু’ নম্বর বাস ধরে বাড়ি চলে এলাম। শুধু একমাত্র চিন্তা হলো–কাল থেকে ফের যদি ওখানেই ডিউটি দেয় তাহলে কি করবো!

***

পরদিন আপিসে যেতেই রহমান এক পাশে টেনে নিয়ে বললে–কালকের কথা কারো সাথে কয়েন না যেন।

তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম–পাগল হয়েছে? একি কইবার কথা ভাই? তবে দুঃখ এই, এবারে তোমার ডি-এটা মাঠে মারা গেল।

শুনতে পেলেও কোনও জবাব না দিয়ে রহমান অন্যদিকে চলে গেল।

কিসে কি হলো জানি না, আমাদের বেলেঘাটার ডিউটি বদলে গেল। এর পর সপ্তাহ দুই আর ডিউটি নেই। রোজ আপিস যাই, খানিক গল্প গুজব করি, তারপর বাড়ি চলে আসি। তখন জোর অসহযোগ আন্দোলন। বোজ মিটিং, ধরপাকড়, আই. বি. আপিস একটা নতুন উন্মাদনায় সব সময় সরগরম।

রতিলালবাবু ডেকে পাঠালেন। তার ঘরে ঢুকতেই দেখি সেখানে তিল ধারণের স্থান নেই। পরিচিত অপরিচিত লোকে ভর্তি, ওরই মধ্যে রতিলালবাবু ইশারা করে আমায় অপেক্ষা করতে বললেন। আধ ঘণ্টা বাদে সবাই চলে যেতেই রতিলালবাবু কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললেন–কি, এইভাবেই চলবে, না ভালো কাজ কর্ম করবার ইচ্ছা আছে?

কি জবাব দেবো, চুপ করেই রইলাম।

হাতের কাজ শেষ করে ড্রয়ার থেকে রতিলালবাবু একটা বড় বাম বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–ভালো করে চেয়ে দেখো।

দেখলাম, পঁচিশ ত্রিশ বছরের একটি যুবকের হাফসাইজ, বাস্ট ফটো। জীবনে অনেক রকম মুখই দেখেছি, বেশির ভাগই ভুলে গিয়েছি। কতকগুলো ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, দু-একটা এখনো মনে আছে তার মধ্যে এই ছবিটা। অসাধারণ সুপুরুষ, বলিষ্ঠ দেহ। সব চাইতে আকর্ষণীয় হলো চোখ দুটি। খুব বড় নয় অথচ তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী। স্থান কাল ভুলে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি, চমক ভাঙলো রতিলালবাবুর কথায়

–কি রকম দেখলে?

–ভালো।

রতিলালবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন–ছবিটা ভালো কি মন্দ দেখবার জন্য দিইনি। ভালো করে দেখো, মুখের মধ্যে কোনও বৈশিষ্ট্য বা কোনো রকম চিহ্ন আছে কিনা যাতে করে হাজার ভিড়ের মধ্যেও চিনে নিতে পারা যায়।

এবার সত্যিই মন দিয়ে দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনো চিহ্ন বা বৈশিষ্ট্য নজরে পড়লো না। সাহস করে বললাম–একে যেখানে যে অবস্থায় দেখবো চিনে নিতে পারবো।

রতিলালবাবু আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে আমাকে তার, পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছবিটার দিকে ঝুঁকে দেখতে লাগলাম। রতিলালবাবু ছবিটার বাঁ চোখের নিচে আঙুলটা দিয়ে বললেন–এখনো বুঝতে পারেনি? এটা কাঁচের চোখ!

ভালো করে চেয়ে দেখি, সত্যি ডান চোখ থেকে এটা যেন একটু অন্যরকম। তবে হঠাৎ কিছুতেই বোঝা যাবে না।

রতিলালবাবু ছবিটার দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন–লোকটা dangerous political suspect, এখন পলাতক। ওকে ধরবার জন্য গভর্নমেন্ট পাঁচ হাজার টাকা রিওয়ার্ড ডিক্লেয়ার করেছে। বম্বে জানে ও জাতিতে পাঞ্জাবী, দিল্লীতে ও মুসলমান, বাংলাদেশে বাঙালী। এমনি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ওর রূপ ও ভাষাও বদলে যায়। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ ও নিরুপদ্রব আন্দোলনে ও বিশ্বাস করে না, ওর ধারণা একমাত্র রক্তাক্ত বিপ্লবেই দেশের স্বাধীনতা আসবে।

কৌতূহল বেড়ে গেলো, বললাম–রতিদা, এ যে দেখছি শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সব্যসাচী।

রতিলালবাবু হাসলেন না, গম্ভীরভাবে বললেন–যতদূর মনে হয়, সব্যসাচী ছিলেন শরৎচন্দ্রের কল্পলোকের এক অসাধারণ সৃষ্টি; কিন্তু আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যতদূর জানি, এ লোকটি তাঁর কল্পনাকে বহুদূরে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে। আট-দশটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, ছদ্মবেশ ধারণে ওর জোড়া আজও আমাদের চোখে পড়েনি।

জিজ্ঞেস করলাম–কিন্তু ওর সত্যি পরিচয়টা কী?

মৃদু হেসে রতিদা বললেন, ছোট্ট একটি কথা–বাঙালী।

মনে হলো তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন গর্বও যেন লুকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম–এর নামটা কি?

রতিদা হেসেই জবাব দিলেন–জেনে কোনো লাভ হবে না, শ্রীকৃষ্ণের ছিলো শত নাম এর সহস্র। তার মধ্যে কোনটা যে আসল, আমরাও জানি না, ছবিটা রেখে দাও। যখনই সময় পাবে, একবার করে দেখে নিও। তবে খুব সাবধান; কেউ না দেখে ফেলে। আর একটা কথা, এই ছবিটার কপি হয়েছে অন্ততঃ হাজারটা। জেনে রাখো অন্ততঃ হাজার জন ওয়াচারকে ওই ছবির একটা করে কপি দেওয়া হয়েছে। তারা কলকাতার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম–সে যে কলকাতাতেই আছে, কি করে জানলেন?

রতিদা বললেন–ওসব তোমার জানবার দরকার নেই। এইটুকু শুধু জেনো, আজ থেকে পনেরো দিনের মধ্যে কলকাতায় তাকে আসতেই হবে বিপ্লবীদের একটা জরুরী মিটিং-এ যোগ দিতে।

ছবিটা পকেটে রেখে যাবে কি যাবো না ভাবছি, রতিদা বললেন–তোমার সঙ্গে যাবে রহমান ও দীনেশ। তোমরা ডিউটি দেবে আহিরীটোলা স্ত্রীট যেখানে চিৎপুরে এসে পড়েছে, সেই মোড়ে। সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত।

চারিদিকে তাকিয়ে রতিদা গলাটা একটু নামিয়ে বললেন–এটা আমার স্পেশাল ইনফরমেশান। ঐ রাস্তায় তার এক বিশেষ আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে সে একদিন আসবেই। এই জন্য রহমান আর দীনেশের সঙ্গে তোমাকে দিলাম। দেখো যদি ধরতে পারে; রিওয়ার্ড-এর টাকা তো পাবেই, তাছাড়া প্রমোশনও হবে। আজ বাড়ি গিয়ে ছবিটা খুব ভালো করে স্টাডি করো, কাল থেকে ডিউটি।

রহমান আর দীনেশ ছিলো রতিলালবাবুর অত্যন্ত প্রিয় এবং কাজও তারা সত্যিই ভালো করতো। ভাবলাম, দেখা যাক এবার কি করতে পারি। রতিলালবাবুর কাছে লোকটির যে পরিচয় পেয়েছি, তাতে খুব উৎফুল্ল হবার কথা নয়। তবুও ঔ একঘেয়ে ডিউটির চেয়ে এতে অন্তত খানিকটা বৈচিত্র্য আছে। বাড়ি চলে এলাম। রাত্রে লেপের মধ্যে হাত দুটো কপালে ঠেকিয়ে আকুলভাবে বললাম–হে মা কালী! অন্তত এ রাঘববোয়ালটা যেন আমার হাতের মুঠোয় আসে…আরও অনেক কিছুই বলেছিলাম, মনে নেই, তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম।

***

সেকালের চিৎপুর রোড। সঁতসেঁতে অপরিসর পুরনো রাস্তা। দেড় হাত চওড়া ফুটপাথ। পাশাপাশি দু’জন এক সঙ্গে যাওয়া কষ্টকর। আহিরীটোলা স্ট্রীট যেখানটায় এসে পড়েছে তার পুবদিকে একটা পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলে রাবিশগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সেইখানটায় আমরা তিন মূর্তি এসে জড়ো হলাম। শীতকাল, মোটা ব্যাপারে সবাই আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুধু নাক আর চোখ দুটো বার করে তিন জনে তিনখানা ইট নিয়ে গোল হয়ে বসলাম। রহমান প্রথমেই আমাকে সাবধান করে দিলে, যেন কোনও গল্প ফেঁদে না বসি। সব সময় চোখ কান সজাগ রেখে ডিউটি করতে হবে। তথাস্তু।

শীতের রাত গম্ভীর হতে থাকে। আমরা তিন জন অন্ধকারে তিনটি প্রেতের মধ্যে শুধু নাক আর চোখ দুটো বার করে আপাদমস্তক ব্যাপার মুড়ি দিয়ে পথ চেয়ে বসে থাকি আর মাঝে মাঝে সিগারেট ধরাই। রাত্রি এগারোটার পর যানবাহন ও লোকচলাচল ক্রমেই বিরল হয়ে আসে, শুধু জেগে আছি আমরা তিনটি প্রাণী আর স্থানীয় রাতজাগা কয়েকটি বারবিলাসিনী। মাঝে মাঝে আশেপাশের বাড়ি থেকে মদির-বিহ্বল হল্লা হঠাৎ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দিয়ে যায়। আমার জীবনে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। রহমান ও দীনেশ দেখলাম everything proof। তাদের কাছে এ একটা ছেলেখেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। হাত পা ধরে গেলে খানিক পায়চারি করে নিই, নয়তো একটু এগিয়ে গিয়ে আলোকোজ্জ্বল একটা জানলার কাছে দাঁড়াই। যা দেখি তা আমার কাছে নাটকীয় বীভৎস মনে হলেও রহমান ও দীনেশের কাছে জলভাত।

রহমান হেসে বলে,–কি দেখছেন, চলে আসুন।

লজ্জা পেয়ে ফিরে এসে ইটের উপর বসি, রাত বেড়েই চলে। বীটের কনস্টেবল এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে। রহমান উঠে গিয়ে ফিসফিস করে কি বলে। সে হেসে সেলাম করে সরে পড়ে।

এইভাবে পনেরো দিন কেটে গেল। রোমাঞ্চকর কিছু ঘটা দূরে থাক, ব্যাপারটা ক্রমেই একঘেয়ে হয়ে উঠলো। আশেপাশের রাতজাগা সুন্দরীরা আর আমাদের ইশারা করে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে না। তিনচারজনে হাসাহাসি করে, আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে কি যেন বলাবলি করে। এর মধ্যে একটা নতুন অভিজ্ঞতা লাভ হলো। আগে যাদের দেশমাতৃকার চরিত্রবান একনিষ্ঠ সন্তান বলে মনে মনে শ্রদ্ধা করতাম, দেখলাম তাদেরও কেউ কেউ গভীর রাতে গাড়ি করে আপাদমস্তক ব্যাপার বা শালে ঢেকে এখানে কয়েকটি বাড়িতে নিয়মিত পায়ের ধুলো দেন। এদের মধ্যে আছেন খদ্দরপরা বিখ্যাত দেশনায়ক, প্রফেসর, দোকানদার, কলেজ স্টুডেন্ট আর কত নাম করবে। প্রথমদিন রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিলো।

সেদিন সন্ধ্যে থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। একটা বাড়ির রোয়াকে গিয়ে দাঁড়াতেই রহমান বললে,–না, আজ হাজার ঝড় বৃষ্টি হলেও জায়গা ছেড়ে যাওয়া চলবে না।

অগত্যা সেই ইটের উপর বসে ইঁদুর-ভেজা ভিজতে লাগলাম, মাঝে রতিলালবাবু দু’বার এসে ঘুরে গিয়েছেন। ভাবলাম আজ নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটবে।

রাত তখন ন’টা সাড়ে ন’টা হবে মনে হয়। শীতের রাত, তার উপর বৃষ্টি। পথ অন্যদিনের তুলনায় জনবিরল, শুধু মাঝে মাঝে ট্রাম বাসগুলো একটানা খ্যাং খ্যাং আওয়াজ করে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ দীনেশ ও রহমান উঠে দাঁড়ালো। দৃষ্টি তাদের আবছা অন্ধকার আহিরীটোলা স্ত্রীটের উপর। প্রথমটা কিছুই দেখতে পেলাম না। পরে দেখলাম একটা মুটের মাথায় একটি বেডিং ও হাতে একটি স্যুটকেস, তার পিছনে একটি লোক। লম্বা কালো ওভারকোটে সর্বাঙ্গ ঢাকা। চোখে কালো চশমা, মাথায় কালো গুজরাটি টুপি। সমস্ত শরীর দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। লোকটি মুটেকে নিয়ে ততোক্ষণে ট্রাম-স্টপেজের কাছে এসে পড়েছে। চোখের নিমেষে দেখি রহমান ও দীনেশ তাকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। কীসে কী হলো বোঝবার আগেই দেখি সেই নির্জন রাস্তায় রীতিমত ভিড় জমে গিয়েছে। রহমান লোকটার হাত দুটো পেছন দিকে ধরে আছে আর দীনেশ চোখের চশমা খুলে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে লোকটার চোখ মুখ লাল, চারদিকে চেয়ে সে শুধু খুজছে পুলিস। দেখলাম দু-চারটে পুলিসও এসে গিয়েছে। ঠিক এমনি সময়ে রতিলালবাবু ভিড় ঠেলে এসে হাজির। এক নজর চেয়েই রহমানকে বললেন ছেড়ে দাও।

কৌতূহলী জনতা তখন লোকটিকে ঘিরে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুললো। মোট ব্যাপারটা জানা গেল–লোকটির নাম হরেন্দ্রনাথ বোস, দিল্লীতে চাকরি করেন। আদি বাড়ি আহিরীটোলা স্ট্রীটে, যাচ্ছিলেন হাওড়ায় শ্বশুরবাড়িতে। কাল সকালের ট্রেনে দিল্লী যাবেন। হঠাৎ হরেনবাবুর হুশ হলো, চিৎকার করে বললেন–আমার বেডিং, স্যুটকেস? মুটে গেলো কোথায়?

খোঁজ খোঁজ, চারদিকে মুটের খোঁজে লোক ছুটলো। আমরা ততোক্ষণে পুরনো জায়গায় সেই ইটের উপর এসে বসেছি, শুধু, তিলালবাবু দাঁড়িয়ে। দীনেশ ও রহমানকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন–এতদিনের পাকা লোক হয়ে তোমাদের এ ভুল কী করে হলো আমি বুঝতে পারি না। আজ পাঁচ দিন হলো ও আহিরীটোলা এসেছে, এ খবর তোমরা জানতে। আজ সে পালাবার চেষ্টা করবে তাও তোমাদের জানিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও এরকম ভুল কেন হলো?

সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে কেমন হেঁয়ালির মতো লাগছিলো। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো রতিলালবাবুর পরের কথা শুনে–আহাম্মকের মতো মুটেটাকে ছেড়ে দিয়ে লোকটাকে ধরতে গেলে? তিন জন তো ছিলে। তোমাদের নীরেট মাথায় এটা কি ঢুকলো না যে, ভদ্রলোক সেজে সে তোমাদের চোখে ধুলো দিতে পারবে না?

একটু পরে আমাদের পাশের রাবিশগুলোর উপরে হরেনবাবুর স্যুটকেস ও বেডিং পাওয়া গেল। কিছুই খোয়া যায়নি।

***

এই ঘটনার পর আপিসে আমাদের অবস্থা বেশ একটু খারাপ হয়ে গেল। ব্যাপারটা অল্প বিস্তর সবাই জানতে পারলো। বিশেষ করে রতিলালরাবু, রহমান ও দীনেশের অবস্থা বেশ একটু ঢিলে হয়ে গেল। আমার কথা বাদই দিলাম। কদিন ধরে দেখি আমাদের দলের সবাই বেশ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর অপর পক্ষ ছুতোয় নাতায় সেদিনকার ঘটনাটা তুলে তাতে খানিকটা নুনের ছিটে দিতে কসুর করছে না। বেশ কিছুদিন এইভাবেই কাটলো।

সেদিন আপিসে যেতেই শুনলাম আমার ডিউটি পড়েছে আউটরামঘাটে। রেঙ্গুন থেকে যে সমস্ত যাত্রীবাহী জাহাজ কলকাতায় আসে সেগুলোর উপর দৃষ্টি রাখাই হবে আমার কাজ। যদি কারোও প্রতি সন্দেহ হয়, তাকে ফলো করে কোথায় কোন ঠিকানায় ওঠে দেখে পরদিন আপিসে রিপোর্ট দিতে হবে। খুব আরামের ডিউটি। সপ্তাহে মাত্র দু’দিন রেঙ্গুন থেকে জাহাজ কলকাতায় আসে, সেই দু’দিন আউটরামঘাটে ডিউটি দিয়ে বাকি ক’দিন ছুটি। বেশ আরামে আছি। আমার সঙ্গে এবার ডিউটি পড়লো এস. বি. আপিসের একজন পাকা ওয়াচার সুবোধের। জাহাজ আসবার ঘণ্টাখানেক আগে আউটরামঘাটের দোতলায় বেঞ্চির উপর বসে দিব্যি গঙ্গার হাওয়া খাই আর সুবোধের সঙ্গে রাজ্যের গল্প করি। জাহাজ এলে রেলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়াই, দেখি অগুন্তি লোক নামছে। কিন্তু আমাদের শিকার অর্থাৎ খদ্দরপরা, চুল উষ্কখুষ্ক, স্বদেশী বা বিপ্লবী কোনও যুবককে নামতে দেখি না। সব চলে গেলে সুবোধের দিকে তাকাই, ঈষৎ হেসে সুবোধ বলে–চলুন, বাড়ি যাই।

পরদিন যথারীতি আপিসে রিপোর্ট দাখিল করি–Attended duty at Outramghat. The S. S. (Steam Ship) ‘Arankola’ came at about 2-30 P.M. No suspicious person was found.

আউটরামঘাটের ডিউটিতে আর একটা মস্ত সুবিধা ছিলো যে, পরিচিত কারো সাথে যদি দেখা হয়ে যেতো অনায়াসে বলে দিতে পারতাম–আমার আত্মীয় রেঙ্গুন থেকে আসবেন, তাই অপেক্ষা করছি।

দিন যায়, মাস যায়, এইভাবে প্রায় চার মাস কেটে গেল। হঠাৎ একদিন সুবোধ বললে–ধীরাজবাবু একটা কিছু ভালো রিপোর্ট না দিতে পারলে চাকরি বজায় রাখা কঠিন।

বললাম–তাই বলে মিছিমিছি একটা নিরীহ লোককে ধরে যা তা একটা রিপোর্ট দেওয়া ঠিক হবে কি?

আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সুবোধ দোতলার বারান্দার উপর পায়চারি করতে শুরু করে দিলো।

সেদিন জাহাজ আসবার টাইম ছিলো দুটো, বেলা দেড়টা থেকে জেটিতে অসম্ভব ভিড় হয়ে গেল। সুবোধকে কারণ জিজ্ঞেস করলাম, সে কিছুই জানে না। বেলা দুটো বেজে গেল। জাহাজের দেখা নেই, অথচ আউটরামঘাটের ওপর-নিচে লোকে লোকারণ্য। সেদিন জাহাজ দেরিতেই এল। প্রায় পৌনে তিনটে। এত ভিড় রেঙ্গুনের জাহাজে আগে কখনো দেখিনি। দূর থেকে মনে হলো দলা পাকানো অগুন্তি নরমুণ্ড একটু একটু করে জেটির দিকে এগিয়ে আসছে।

জেটি থেকে জাহাজে সিঁড়ি লাগিয়ে দেওয়ার পর শুরু হলো নামবার পালা। ইংরেজের সংখ্যাই বেশি, তারপর বাঙালী, মারোয়াড়ী, চীনে ও মাদ্রাজী কুলি একের পর এক নেমেই চলেছে আর আমরা সিঁড়ির দু’পাশে দাঁড়িয়ে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিন্তু হায়! আমাদের শিকার এর মধ্যে একটিও দেখতে পেলাম না। প্রায় আধ ঘণ্টা এইভাবেই কাটলো, তখন প্রায় সবাই নেমে গিয়েছে। হতাশ হয়ে চলে আসবো কিনা ভাবছি হঠাৎ সুবোধ আমার হাতে একটু চাপ দিলো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, চব্বিশ-পঁচিশ বছরের খদ্দর পরিহিত একটি ছেলে, হাতে একটি টিনের স্যুটকেস। মাথার চুল দীর্ঘ ও অযত্নে রুক্ষ। সন্ধি দৃষ্টিতে চারিদিকে চাইতে চাইতে একলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। আমার বুকের মধ্যে চিক্ চিব করে উঠলো। সুবোধর দিকে চেয়ে দেখি একটা নির্ঘাৎ শিকার পাকড়াবার উত্তেজনায় তার চোখ মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। ইশারায় আমায় একটু দূরে নিয়ে বললে–কাছে থাকবেন না, এর চেহারা দেখে বলে দিতে পারি এ্যানার্কিস্ট। চোখের চাউনিটা লক্ষ্য করেছেন?

আমি কিছু বলবার আগেই সুবোধ হাত ধরে টান দিলো। দেখলাম, আমাদের এ্যানার্কিস্ট শিকারটি সুটকেস হাতে ধীরে ধীরে জেটি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বলা বাহুল্য, আমরাও একটু দূরে থেকে পিছু নিলাম।

হাইকোর্টের ট্র্যাম, ডিপো থেকে বেরিয়ে স্টপেজের কাছে এসে দাঁড়ালো। দেখলাম আমাদের শিকার নির্বিকারভাবে সুটকেসটা দুই হাতে বুকের উপর চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাম যাত্রী নিয়ে গন্তব্যপথে চলে গেল কিন্তু সে তবু ঠায় দাঁড়িয়ে। যেন কোনো তাড়াই নেই যাবার।

সুবোধ কানের কাছে মুখ এনে ফিফিস্ করে বললে–একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? ঐ স্যুটকেসটা? মুটের হাতেও দিলে না, মাটিতেও নামাচ্ছে না? চোরের মতো খালি এদিক ওদিক চাইছে!

কৌতূহল ও উত্তেজনায় আমার মুখ দিয়ে বোধহয় একটু জোরেই বেরিয়ে গেল-বোমা না পিস্তল?

–আঃ আপনি দেখছি সব মাটি করবেন।

বলেই সুবোধ এমনভাবে আমার দিকে চাইলে, যেন সম্ভব হলে সে আমাকে গুলী করে মারতেও দ্বিধা করবে না। ভারি লজ্জা পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, যেখানেই ডিউটিতে যাই, একটা কাণ্ড করে বসি। আজ যদি নির্বিবাদে অন্তত এই শিকারটিকে ডাঙায় তুলতে পারি, তাহলে কিছুটা মুখ রক্ষা হবে।

দেখি তিন চারখানা ট্রাম এইভাবে ছেড়ে দিয়ে, যুবকটি ডান হাতে স্যুটকেসটি নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করেছে ডালহৌসি স্কোয়ারমুখো। আমরাও পিছু নিলাম। চৌমাথার কাছে যেখানটায় ট্রাম ঘোরে সেখানটায় এসে দাঁড়ালো। চোখে সেই শঙ্কিত চাহনি। একটার পর একটা ট্রাম এসে দাঁড়াচ্ছে, যাত্রী নিয়ে আবার ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হৃক্ষেপ নেই, দাঁড়িয়েই আছে লোকটি। বোধহয় এইভাবে আধ ঘণ্টা কেটে গেল। হঠাৎ দেখি শিয়ালদার একটি ট্রামে ও উঠে পড়েছে। সুবোধ ও আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে সেকেণ্ড ক্লাশে উঠে পড়লাম। ভাগ্যিস ওখানে ট্রাম একটু বেশিক্ষণ থামে, নইলে চলতি ট্রামে উঠতে হলেই হয়েছিলো আর কি! দেখলাম সুবোধের মুখ গম্ভীর! ফার্স্ট ক্লাশের একটি বিশেষ যাত্রীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে মহাসমাধিমগ্ন। ধর্মতলা এসে গেল, ট্রাম ভালো করে তখনও থামেনি। দেখি চোখের নিমেষে সুবোধ উঠে সেই চলতি ট্র্যাম থেকে নেমে পড়লো। মুখ বাড়িয়ে চেয়ে দেখি, আমাদের শিকারটিও হঠাৎ কখন নেমে পড়েছে। বাবা মা’র নিষেধের কথা মনে পড়লো। পা-দানির কাছে এসে দাঁড়ালাম। একটু পরে ট্র্যাম থামতেই নেমে পড়লাম।

স্যুটকেস হাতে শঙ্কা-ব্যাকুল চোখে চারদিকে চাইতে চাইতে আমাদের শিকার এসে দাঁড়ালো ট্র্যাম-স্টপেজের কাছে। আবার শুরু হলো সেই একই খেলা। ট্রামের পর ট্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওঠবার নামগন্ধ নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে টকেল হাতে চারিদিকে চাইছে।

…লোকটা পাগল নাকি? বললাম সুবোধকে।

-পাগল না হাতি! পাকা বদমাশ। ও খালি চাইছে আমাদের চোখে ধুলো দিতে।

বুঝলাম সুবোধ খুব চটেছে। আর সত্যি চটবারই কথা। এইভাবে আরও পনেরো কুড়ি মিনিট কাটলো। তারপর হঠাৎ দেখি লোকটি আবার শিয়ালদার ট্র্যামে উঠে বসেছে। সুবোধ রাগে গজগজ করে কি বললে বুঝতে পারলাম না। আমরাও সেকেণ্ড ক্লাশে উঠে এবার আর বসলাম না, সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি জানি কখন আবার হুট করে নামতে হবে। এর মধ্যে আর উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটলো না। ট্রাম শেয়ালদা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। সব যাত্রী নেমে গেল। দেখি আমাদের শিকার তখনও ঠায় বসে আছে সুটকেসটা কোলের উপর নিয়ে। কণ্ডাক্টর কি যেন বলতেই আস্তে আস্তে উঠে নেমে গেল। এদিক ওদিক দু’চারবার চেয়ে সামনের নর্থ স্টেশনে ঢুকে পড়লো। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। টিকিট কাউন্টারের সামনে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে যত রাজ্যের বিজ্ঞাপনগুলো পড়ে ফেললে, তারপর সুটকেসটা মাটিতে রেখে তার উপর বসে পড়লো।

সুবোধের দিকে তাকালাম, দেখলাম সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। বললাম,-ও যদি কোনো ট্রেনে যায়, তাহলে আমরা কি করবো?

সুবোধ বললে,–আমরাও ওর সঙ্গে যাবে!

–কিন্তু টাকাকড়ি তে বিশেষ কিছুই আনিনি।

সুবোধ হো হো করে হেসে উঠলো, বললে,–কিছুই দরকার হবে না। ডিটেকটিভ ওয়ারেন্টখানা সঙ্গে আছে তো?

সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। ছোট্ট একটি মাদুলির মতো কৌটোয়, ছোট্ট একটি কাগজ। কিন্তু অসীম তার প্রভাব, বিশেষ বিপদে পড়লে ঐটি বার করে শুধু দেখাও–ব্যস্। তোমার যেখানে খুশি যাও। কেউ বাধা দেবে না। পরে অবশ্য রেল কোম্পানি গভর্নমেন্টের কাছ থেকে রেলের মাশুল আদায় করে নেবে।

আমাদের কথা হচ্ছিলো চায়ের স্টলটার সামনে। দুকাপ চা শেষ করে সুবোধ আর আমি দুটো সিগারেট ধরালাম। সেখান থেকে আমাদের শিকার একটু দূরে হলেও বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। দেখলাম, সে সেই উদাস ফ্যালফ্যালে চোখে অগণিত যাত্রীর দিকে তাকাচ্ছে। এর যেন ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছু নেই, নেশাও নেই। ও যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাকে খুঁজছে তাকেও হয় তো ও চেনে না। চোখে সে অনুসন্ধিৎসা নেই। ঠায় টিনের সুটকেসের উপর বসে আছে। আমরাও স্টলের দু’খানা চেয়ারে বসে আছি। শুধু কারো জন্যে অপেক্ষা না করে চলে যাচ্ছে অগুন্তি কর্মব্যস্ত যাত্রীর দল আর সময়।

দু’ঘণ্টার ওপর কেটে গেল, কিন্তু পট পরিবর্তন হলো না। ও একভাবে বসে আছে, আমরাও বসে আছি। মাঝে পালা করে একটু ঘুরে আসি, সিগারেট খাই। বলা বাহুল্য, এতোক্ষণে শুধু স্টলে নয়, রেলওয়ের সমস্ত স্টাফ জেনে গিয়েছে যে, আমরা টিকটিকি পুলিসের লোক, যাকে লক্ষ্য করে বসে আছি, তাকেও চিনে ফেলেছে। আর সত্যি কথা, ওভাবে অতোক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকে হয় পাগল নয়তো সর্বহারা ভিখারী।

স্টেশনের পুলিশ কনস্টেবলটি প্রথম প্রথম দেখলাম ঝোঁপ বুঝে বেশ দু পয়সা রোজগার করছে। আমাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে যাবার পর, দেখি সে হঠাৎ সাধু হয়ে উঠেছে। ফেরিওয়ালারা দু’চার পয়সা দিতে এলে খুব দশ কথা শুনিয়ে দিচ্ছে।

স্টেশনের এই বিচিত্র পরিবেশে আরো এক ঘণ্টা কেটে গেল কখন টেরও পেলাম না। ট্র্যামের মতো ঘন ঘন না হলেও ট্রেনের পর ট্রেন আসছে যাচ্ছে। ওর কিন্তু ক্ৰক্ষেপ নেই। কোথাও যাবার তাড়া আছে বলেও মনে হয় না। সুবোধকে বললাম,–এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? ও কোথাও যাবে বলে তো মনে হয় না।

একটু চুপ করে থেকে সুবোধ বললে,-দাঁড়ান একটা কিছু সত্যিই করা দরকার।

দেখি এক পা দু পা করে সুবোধ কনস্টেবলটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর তাকে ইশারা করে একটু দূরে নিয়ে গেল। কৌতূহল বেড়ে গেল। আমিও সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সুবোধ জিজ্ঞাসা করলো,–তোমার নাম কি?

শিউশরণ সিং, হুজুর।

একটু হেসে সুবোধ বললে,–তুমি আমাদের চিনতে পেরেছে?

সেলাম করে শিউশরণ বললে,–জী, আপ তো টিকটিকি পুলিসসে আয়া!

–টিকটিকি হই আর গিরগিটি হই তুমি আমাদের ওভাবে সেলাম করে না। তাহলে সব জানাজানি হয়ে যাবে। আর আমাদের শিকারটিও পালাবে। হিন্দী বাঙলায় মিশিয়ে সুবোধ কথাগুলি বলে গেল, তারপর আঙুল দিয়ে দূরে আমাদের শিকারটিকে দেখিয়ে গলাটা একটু নিচু করে বললে,দেখে শিউশরণ! তুমি আস্তে আস্তে ঐ বাবুটির কাছে যাও। প্রথমে জিজ্ঞাসা করবে, কোথায় ও যাবে। তারপর ঐ স্যুটকেসটা খুলতে বলবে। কিন্তু খবরদার, আমাদের পরিচয় দিও না বা আমরা যে তোমায় স্যুটকেস খুলতে বলেছি, একথাও বলল না।

ব্যাপারটা রীতিমতো ঘোরালো হয়ে উঠলো। প্রকাণ্ড গোঁফ দুটো হাত দিয়ে পাকিয়ে, কোমরের বেল্টটা নেড়েচেড়ে রুলটাকে ঠিক করে নিয়ে বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চললো শিউশরণ সিং। দূরে থেকে আমরাও এক পা দু পা করে এগোতে লাগলাম।

ঠিক সেই সময় একটা ট্রেন ইন করলো। চোখের নিমেষে অগণিত যাত্রীতে প্ল্যাটফরম ভরে গেল। ততক্ষণে শিউশরণ শিকারটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সুবোধ ও আমি প্রমাদ গুণলাম। শিউশরণ কোমর থেকে রুলটা বার করে বেশ বাগিয়ে হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে–এই, তুহারা নাম কি?

ভয় পেয়ে চারদিক চাইতে চাইতে ছেলেটি জবাব দিলে– কেন? আমার নামে তোমার দরকার কি?

কৌতূহলী হুজুগপ্রিয় জনতা ততক্ষণ ভিড় করে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। শিউশরণ মোটেই দমবার পাত্র নয়; তাছাড়া বীরত্ব প্রকাশের এরকম একটা সুযোগ সে মোটেই ছাড়তে রাজী নয়। গোঁফের ডগা দুটো একটু চুমরে নিয়ে শিউশরণ জবাব দিলে–হামার দোরকার কেনো থাকবে। উধার দেখো, টিকটিকি দো-বাবু পুছতা হ্যায়।

.

বলে সে সোজা আমাদের দেখিয়ে দিলে। জনতা বিক্ষারিত দৃষ্টিতে একবার আমাদের দিকে দেখছে, আবার ছেলেটির দিকে দেখছে।

শিউশরণ বললে–খুলো সুটকেস।

–কেন? স্যটকেস খুলবো কেন? সভয়ে বললে ছেলেটি।

–আভি খুলে, নেহি তো হাম তোড় দেঙে।

এদিকে রাগে সুবোধের মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। দাতে দাঁত চেপে প্রথমে শিউশরণের মুণ্ডপাত করলে তারপর আমার দিকে ফিরে বললে–আসুন ধীরাজবাবু, আর চুপ করে থেকে লাভ নেই। যা হয় হবে।

সুবোধ ছেলেটির কাছে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে–আপনি রেঙ্গুন থেকে আসছেন?

একটু চুপ করে থেকে ছেলেটি জবাব দিলো–হ্যাঁ।

–স্যুটকেস খুলুন, আমরা দেখবো।

ছেলেটি অসহায় চোখে একবার আমার একবার সুবোধের মুখের দিকে চাইতে লাগলো। কোনো জবাব দিলে না।

এবারে সুবোধ একটু রুক্ষস্বরে বললে–ভালোয় ভালোয় খুলুন বলছি, নইলে আপনাকে এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাবে। সেই আউটরামঘাট থেকে জ্বালাচ্ছেন, আর জ্বালাবেন না।

কৌতূহলী জনতার মধ্যে থেকে দু’-একজন বলে উঠলো–খুলে দেখিয়ে দিন না মশাই।

কঁদো কাঁদো স্বরে ছেলেটি বললে–আমায় বিশ্বাস করুন, এর মধ্যে এমন কিছু নেই যার জন্যে আমায় এ্যারেস্ট করতে পারেন।

–বেশ তো, সেইটেই আমরা দেখতে চাই উঠুন।

ছেলেটি ভয়ে ভয়ে স্যুটকেসের উপর থেকে উঠে দাঁড়ালো।

সুবোধ পুরোপুরি পুলিসী সুরে বললে–এবার লক্ষ্মী ছেলেটির মতো স্যুটকেসটা খুলুন।

শেষবারের মতো একবার চারিদিকে চেয়ে আস্তে আস্তে ছেলেটি উবু হয়ে বসে সেই রহস্যময় ছোট্ট পুরোনো টিনের স্যুটকেসটি চাবি দিয়ে খুললো। কৌতূহলী জনতা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। শিউশরণ গম্ভীরভাবে সকলকে দূরে সরিয়ে দিলে।

খদ্দরের কাপড় আর তার সঙ্গে একটা ছেঁড়া ফতুয়া ভাঁজ করা রয়েছে। সুবোধ বললে–তুলুন ওগুলো।

সেগুলো ভোলা হলে দেখা গেল, তার নিচে রয়েছে দু’খানা মোটা বই। এক খানা গীতা, আরেকখানা রমেশচন্দ্রের গ্রন্থাবলী। পাশে দেখা গেল একটা আধ-পুরোনো টুথপেস্ট। একটা ব্রাশ ও একটা জিভছোলা। অন্য পাশে সূতে দিয়ে বাঁধা কতকগুলো চিঠির বাণ্ডিল। খাম ও পোটকার্ড, অশিক্ষিত মেয়েলি হাতের লেখা।

সবার নিচে কাগজমোড়া একটা ছবির মতো কি রয়েছে। সুবোধ বললে–ওটা কি খুলুন তো?

আস্তে আস্তে ছেলেটি সেটি সুটকেসের তলা থেকে তুলে বুকে চেপে ধরলো। দেখলাম, চোখ দুটো তার জলে ভরে উঠেছে। সুবোধের দিকে তাকালাম। বলতে চাইলাম, ঢের হয়েছে। অনেক রিভলভার বোমা তো পেলে, এবার ওকে রেহাই দাও। সুবোধ কিন্তু মরীয়া। মায়া, মমতা, চোখের জলে কাবু হবার দুর্বলতা সে অনেকদিন আগেই কাটিয়ে উঠেছে। তেমনি কঠোর স্বরে সুবোধ বললে–ন্যাকামি রাখুন, দেখান ওটা কি।

অতি যত্নে কাগজ দিয়ে মোড়া জিনিসটি সে ধীরে ধীরে খুলতে লাগলো। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, বহুদিনের পুরোনো একখানি ফটো, জায়গায় জায়গায় ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। একটি বিধবা মহিলা, বয়েস আন্দাজ ৫০।৫৫ হবে। হাতে হরিনামের মালা নিয়ে জপ করছেন।

এবারে ছেলেটি কেঁদে ফেলেছে। কার ছবি জিজ্ঞাসা করতেই ছেলেটি জানালো–তার বিধবা মায়ের ছবি। সংসারে ঐ এক মা ছাড়া আর কেউ নেই। সে নিজে অনেক সুপারিশ যোগাড় করে রেঙ্গুনে এক ডাক্তারখানায় কম্পাউণ্ডারের চাকরি করতো। সামান্য যা মাইনে পেতে তা থেকে প্রতি মাসে কিছু কিছু মাকে পাঠিয়ে দিতে। এইভাবে প্রায় বছর তিনেক কেটেছে। চিঠির বাণ্ডিলগুলো দেখলাম, সবই মায়ের একমাত্র ছেলেকে লেখা। সবগুলোতেই প্রায় একই কথা–সাবধানে থেকো, আমাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাবার দরকার নেই, শরীরের উপর যত্ন নিও, ইত্যাদি।

মায়ের শেষ চিঠিখানা বুক পকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিলে। দেখলাম পোস্টকার্ডে লেখা–

খোকা, এতদিনে আমার মনোবা ভগবান বোধহয় পূর্ণ করিবেন। চক্কোত্তি পাড়ার দীনু চক্কোত্তির মেয়ে টুনীর সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করিয়াছি। তুমি যে টাকা পাঠাইতে, তাহা জমাইয়া মেয়ের মোটামুটি সব গহনা গড়াইয়াছি। ওরা বড় গরীব। কিন্তু তুমি সুখী হইব। একারণে ওখানেই ঠিক করিলাম, তুমি পত্রপাঠ এক মাসের ছুটি লইয়া বাড়ি আসিবা। বৈশাখের ২৫শে ভিন্ন দিন নাই। আর আর সমস্ত সাক্ষাতে বলিব ও শুনিব। ইতি। আশীর্বাদিকা-মা।

চিঠিখানা গণেশকে ফেরত দিলাম। বলতে ভুলে গিয়েছি ছেলেটির নাম গণেশ চৌধুরী। গণেশ বলতে লাগলো–ছুটি তো পেলাম। কিন্তু রওনা হবার আগের দিন আমার ভাবী শ্বশুর দীনু চক্রবর্তীর চিঠি এল। তিনি জানিয়েছেন,–আজ সাত দিন হলো আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে, একরকম অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায়। আমি যে টাকা পাঠাতাম তা সব তিনি আমার বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখতেন, ভালো করে পেট ভরে কোনোদিন খাননি মা। গণেশ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। কি সাবনা দেবব! অপরাধীর মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুবোধের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অন্যদিকে ফিরে সে সিগারেট ধরাচ্ছে। এ ব্যাপারের এরকম পরিণতি হতে পারে এটা তারও কল্পনার বাইরে ছিলো।

একটু শান্ত হয়ে গণেশ বললে–দেশে কার কাছে যাবো বলতে পারেন? যে ভিটেয় মা নেই, সেখানে এক রাতও আমার পক্ষে কাটানো অসম্ভব। রেঙ্গুনেও আর আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কার জন্য চাকরি করবো?

আবার রুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়লো গণেশ। আমার হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললে–আপনারা দয়া করে আমায় এ্যারেস্ট করে জেলে আটকে রেখে দিতে পারেন? এভাবে আমি হয়তো পাগল হয়ে যাবে।

নীরব সান্ত্বনা দিয়ে এক পা এক পা করে স্টেশনের বাইরে চলে এলাম। চোখ দুটো কখন যে জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে জানতে পারিনি। সে আজ অনেকদিনের কথা। অনেক ঘটনা ভুলে গিয়েছি, অনেকগুলো বিস্মৃতির কুয়াশায় আবছা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও ভুলতে পারিনি গণেশকে লেখা আশীর্বাদিকা মায়ের সেই চিঠিখানির ভাষা।

চেয়ে দেখি, ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে সুবোধ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ম্লান হেসে সুবোধ বললে–চলুন, আর কেন?

কোনও জবাব দিলাম না। দু’জনে ধর্মতলার ট্র্যামে উঠে বসলাম।

.

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে আপিসে গিয়ে শুনলাম, আমাদের কয়েকজনকে সারদায় ট্রেনিং-এ পাঠানোর অর্ডার হয়ে গিয়েছে। বুঝলাম, এর মধ্যে রতিলালবাবুর প্রচ্ছন্ন হাত রয়েছে। যাই হোক, বেঁচে গেলাম। এই একঘেয়ে বিশ্রী ডিউটির হাত থেকে এতোদিনে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। ট্রেনিং শেষ করে এলে যে কোনো জেলার থানায় বদলি করে দেবে। সে অনেক ভালো। নির্দিষ্ট দিনে বাক্স বিছানা গুছিয়ে অজানা দেশে এক নূতন অভিজ্ঞতালাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *