নগ্ন নির্জন – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ
০১.
পুবের পাহাড়টার ওপরে দাঁড়িয়ে রাকেশ চারদিকে চাইল।
রোদ উঠে গেছে। আদিগন্ত কুয়াশার মাকড়সার জাল ছিন্নভিন্ন করে ভূলুণ্ঠিত করে নরম সোনালি আভাস বনে-পাহাড়ে, কুলথি খেতে, সরষে খেতে ছড়িয়ে গেছে। একে রোদ বলে না–এ একরকমের স্বর্গীয় ভৈরবী অভিজ্ঞতা। এরকম সকালের সামনে দাঁড়ালেই ভৈরবীর শুদ্ধ ও কোমল পর্দাগুলি চোখের সামনে একটি গাঢ় কমলা-রঙা ডালিয়ার পাপড়ির মতো এক এক করে খুলে যেতে থাকে।
সুব্বল শুধোল, এবার ফিরবে?
রাকেশ বলল, না।
ও বলল, সেটা ভালো হবে।
চতুর্দিকে শুধু সবুজ, সুপুষ্ট, প্রায়-নিচ্ছিদ্র জঙ্গল। ঘন চুলের মতো ঠাসবুনন–সুগন্ধি। শাল, শিশু, অর্জুন, কুচিলা নানারকম বাঁশ, সেগুন এবং আরও অনেক নাম-জানা ও অজানা গাছের জঙ্গল।
অনেক দূরে, নীচে কতকগুলো সেগুন গাছের আড়ালে আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা বাঘমুন্ডা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। ফরেস্ট বাংলোর সাদা দেওয়ালের পেছনের অংশটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু। এই পাহাড়ের পা ছুঁয়ে চলে গেছে কুরাপে যাওয়ার জংলি পথ। অন্য পথ গেছে পূর্ণাকোট। পূর্ণাকোটের মোড় থেকে সোজা গেলে টুকা–ডানে গেলে টিকরপাড়া-বাঁয়ে গেলে অঙ্গুল।
অফিস নেই, বাস নেই, মিছিল নেই, অন্য লোকের চিৎকার নেই, নিজের চিৎকারের ক্লান্তি নেই। এখানে শুধু ভালোলাগা আছে। পলাতক কাকে বলে রাকেশ জানে না। যদি কেউ ওকে তা বলে বলুক। কিন্তু এই পালিয়ে আসায় কোনো লজ্জা নেই। রাকেশ মাঝে মাঝেই এইরকম পালিয়ে আসে।
সুব্বল সামনের পাহাড় ও উপত্যকার মাঝামাঝি জায়গায় কতকগুলো বড়ো কালো পাথর যেখানে একটার পর একটা সাজিয়ে রাখার মতো করে সেজে আছে–সেখানের একঝাঁক। কুচিলা গাছের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ওইদিকে যেতে হবে। বলেই আগে আগে পথ দেখিয়ে পাহাড় নামতে শুরু করল। রাকেশও শুনতে পাচ্ছিল, কতগুলো বড়োকি ধনেশ, ইংরেজিতে যাকে গ্রেট ইণ্ডিয়ান হর্নবিলস বলে, ক্যাঁক ক্যাঁক হ্যাঁ হ্যাঁক করছিল। সেদিকে ওরা সাবধানে ভিজে পাথরে-জঙ্গলে পা ফেলে ফেলে নেমে চলল।
সুব্বল বলে, বড্ড কুচিলা খাঁই, আর সান কুচিলা খাঁই। শিকারে এসে এসে যতটুকু এ অঞ্চলের ভাষা না শিখলে নয়, ততটুকু শিখে ফেলেছে রাকেশ। আরও বেশি শিখতে পারলে খুশি হত–কিন্তু হয়ে ওঠেনি। বড় মানে বড়ো, সান মানে ছোটো, ইত্যাদি ইত্যাদি। যতটুকু বলতে পারে, বলে–যতটুকু না পারে হাত পা নেড়ে মুখ বিকৃত করে বুঝিয়ে দেয়। তবে, একটু ভালো করে শুনলে জঙ্গলের ওরা কী বলছে তা বুঝে নিতে পারে আজকাল। তা ছাড়া সুব্বলও মোটামুটি ভালো বাংলা বলতে পারে।
সুব্বল নাম হলে কী হয়, সুব্বল সুবল-সখা নয়। অত্যন্ত সাহসী। এখানে সামান্য জমি জমা আছে। শিকারে শখ খুব। নিজের গাদা বন্দুক দিয়ে আগে আগে অনেক শিকার করেছে। এখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কড়া-কড়িতে আর পারে না। ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো আনন্দ ফোঁটা-কার্তুজের বারুদের গন্ধে মাতাল হওয়া।
ওরা বেশ খানিকটা নেমে এসেছে। এদিকটা বেশ খাড়া। সাবধানে নামতে হচ্ছে। রাকেশের হালকা চার্চিল দো-নলা শটগানটাও যেন এখন ভারী-ভারী ঠেকছে। সামনের বড়ো কুচিলা গাছটির একেবারে মগডালে কতগুলো বড়ো বড়ো ঠোঁটওয়ালা ধনেশ কামড়াকামড়ি করছে। ঝাঁপাঝাঁপি করছে। এগুলো দেখলেই রাকেশের শহুরে জীবনের চারপাশের ভিড় করা চেনা লোকেদের কথা মনে পড়ে। অন্য পাখি মারার পর কোনো কোনো দুর্বল মুহূর্তে মনটা একটু খারাপ লাগে, কিন্তু এগুলো মেরে পৈশাচিক আনন্দ হয় রাকেশের। মারার পরও এদের পা দিয়ে লাথি মারতে ইচ্ছে করে। এদের স্বার্থপর বড়ো বড়ো ঠোঁটগুলো জুতো দিয়ে পিষে দিতে ইচ্ছে করে।
যে পাখিটিকে আকাশের পটভূমিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল–একটি পাথরে হাঁটু গেড়ে বসে প্রায় সোজা ওপরে বন্দুক তুলে তাকে গুলি করল রাকেশ। পাখিটা লদলদ করতে করতে ডালে ডালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পাথরের ওপরে আছড়ে পড়ল। সুব্বল তাকে আনতে যাবে, এমন সময় কোথা থেকে অন্য একটি পাখি এসে একেবারে তার সামনের ডালে বুক পেতে বসল। গুলির শব্দে সে গাছের সব পাখি উড়ে গেল, অথচ এ অন্য গাছ থেকে উড়ে এসে বসল।
মৃত্যু কারও স্পর্ধা সহ্য করেনি, করে না কোনোদিন। রাকেশ বন্দুক তুলেই বাঁ-দিকের ব্যারেল ফায়ার করল। এতক্ষণ যা সপ্রাণ ছিল, যা সরব ছিল, যা আওয়াজ করে ভবিষ্যময় ছিল তা নিমেষে নিভে গেল। অতীতে পর্যবসিত হয়ে গেল। ধপ আওয়াজ করে নীচে পড়ল। ঠোঁট দিয়ে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পাথরে পড়ল।
রাকেশ বন্দুকের ব্রিচটা খুলতেই ফোঁটা টোটাগুলি লাফিয়ে বেরোল। বারুদের গন্ধ নাকে এল। সুব্বল টোটাগুলি কুড়িয়ে নিল। যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক লোক হলে হয়তো এমন করত না। কিন্তু রাকেশ এগিয়ে গিয়ে গলফ-শু দিয়ে পাখিটিকে উলটে দিল। ধনেশ চোখ বুজেই ছিল। রাকেশের মুখে কেমন এক অদ্ভুত, অর্থহীন, অস্বাভাবিক হিমেল হাসি ফুটে উঠল।
এবার ওরা দুজনে পাহাড় বেয়ে নেমে বাঘমুণ্ডা গ্রামের পেছনের জঙ্গলের পায়ে-চলা সঁড়িপথ ধরে বাংলোর দিকে আসতে লাগল।
পথের ভারী লাল ধুলো শিশিরে ভিজে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বাঁশপাতা থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোচ্ছে। কতগুলি টুকলি-পাখি টাকুর-টুসি টাকুর-টুসি করে ছোটো ছোটো পিয়াশালের চারায় চারায় কী এক উৎসারিত প্রাণভরা আনন্দে ডানা ফরফরিয়ে উড়ে বেড়োচ্ছে। পথের ধুলোয় একটি বড়ো চিতার হেঁটে যাওয়ার দাগ দেখা যাচ্ছে। পথ ধরে বরাবর সেও বাংলোর দিকেই হেঁটে গেছে। খুব সম্ভব শেষরাতে। একদল ঘুঘু গিন্নি জামরঙের ওপর সাদা ফুটকি ফুটকি বালাপোশ মুড়ে কুলথিখেতের মাঝে একটি কালো কলাগাছের পাতায় সারি বেঁধে বসে-ঘুম-ভাঙানো নরম নূপুর বাজিয়ে চলেছে ঘুঘুর-ঘুঘুরর-ঘু। ঘুঘুরঘুঘুরর-ঘু।
ওরা বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল। পেছন দিক দিয়ে বাংলোটি প্রদক্ষিণ করে সামনে গেল। শ্রুতি ঘুম ভেঙে উঠে বাংলোর হাতায় পায়চারি করছিল। অর্জুনকে দেখা গেল না। রাকেশ পোঁছেই বলল, চা কোথায়? ঠাণ্ডায় জমে গেছি।
শ্রুতি বলল, একদম রেডি। পরক্ষণেই পাখিগুলোর দিকে নজর পড়তেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ওগুলো কী পাখি রাকেশদা?
সুব্বল উত্তরে বলল, কুচিলা খাঁই?
শ্রুতি বলল, কী খাঁই।
রাকেশ হেসে বলল, খাঁই–খাঁই।
শ্রুতি গলা নামিয়ে বলল, আপনার অসভ্যতা কবে যাবে বলতে পারেন?
রাকেশ বলল, জীবনে না। তারপর বলল, পাখিগুলো ধনেশ পাখি। এর তেলে অবাধ্য বাতও সারে। তোমার বাত সারাবার জন্যে নিয়ে এলাম।
শ্রুতি বলল, আমার বাত নেই।
বাত আছে। তোমার হৃৎপিন্ডে বাত আছে। হৃদয়চালনার জন্যে তোমার ধনেশের চর্বি প্রলেপের প্রয়োজন।
শ্রুতি উত্তর না দিয়ে সুব্বলকে বলল, কী করে মারলে সুব্বল?
সুব্বল বলল, সে বাবু মেরেছেন।
শ্রুতি বলল, বাবু পাখি ছাড়া আর কী মারবেন? তা তো জানি, কিন্তু মারা হল কী করে?
রাকেশ বলল, প্লিজ শ্রুতি, বাঘ-বাইসন-হাতি হয়, কী করে মারা হল বলা চলতে পারে –কিন্তু পাখি মারার গল্প ইনিয়ে-বিনিয়ে আমার কানের কাছে কেউ বলুক সে অসহ্য।
শ্রুতি এগিয়ে গিয়ে পাখিগুলো দেখল, ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখল। বলল, ইশ কী সুন্দর! কেন মারলেন?
রাকেশ উত্তর না দিয়ে ওর ঘরে ঢুকে ক্লিনিং রড বের করে বন্দুকটা পরিষ্কার করতে লাগল –শিশু-সূর্যের দিকে নলটি উঠিয়ে চোঙের মধ্যে চোখ লাগিয়ে দেখল ঝিকমিক করছে কি না।
সুব্বল পাখি দুটি নিয়ে বাবুর্চিখানার দিকে চলে গেল। শ্রুতি সুব্বলকে দিয়ে বলে পাঠাল, রাজুয়াড়কে এল, চা নিয়ে আসবে।
রাকেশ শুধোল, তুমি চা খাওনি এখনও?
না।
কেন না? তোমাকে তো প্রথমদিনই বলেছি যে, শিকারে বেরোলে ফেরার কখনো ঠিক থাকে না–তা বলে তুমি আমার জন্যে বসে থাকবে?
শ্রুতি বলল, সে আমি বুঝব, আপনি শিকারে নিয়ে এসেছেন বলে কি আমার ব্যক্তিস্বাধীনতাও নেই?
রাকেশ বন্দুকটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে গান-র্যাকে রাখতে রাখতে বলল, কী আমার ব্যক্তি রে! তারপর বাইরে এসে রোদে, হাসনুহানা ঝোঁপের পাশে বেতের চেয়ারাটা টেনে বসে, টোব্যাকোর পাউচ বের করে পাইপটা ভরতে লাগল।
তারপর শুধোল, অর্জুন কি কাল রাতেও
শ্রুতি বলল, বলবেন না ওসব কথা। আমার শুনলেই মেজাজ গরম হয়ে যায়। জীবনকে পরিমিতভাবে প্রতিদিন উপভোগ করার নামই ভালো লাগা। অথচ সেকথা কে বোঝে? খাওয়ার পর আপনি তো শুতে গেলেন–তারপর ও প্রায় একঘণ্টা বসে বসে বোতলটি শেষ করেছে। কেন, আপনি শুনতে পাননি কিছু?
রাকেশ বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, বলল, না :! আমি খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে গিয়েই শুয়ে পড়েছিলাম।
শ্রুতি বলল, তাই।
রাকেশ অর্জুনের কথা ভাবছিল। শ্রুতির মতে মেয়ে যাকে ভালোবেসে বিয়ে করল সে কেন এমন করে, সে কেন এমন হয়! ও বোধ হয় ভাবে ওর জীবন ফুরিয়ে আসছে। টাইম ইজ রানিং আউট। কিন্তু ও-ই যদি তা ভাবে, তা হলে রাকেশ কী ভাববে?
রাজুয়াড় চা নিয়ে এসে বেতের টেবিলে রাখল। শ্রুতি বলল, চা-টা একটু ভিজুক, দেখি আর একবার চেষ্টা করে ওঠাতে পারি কি না। বলে শ্রুতি উঠে নুড়ি মাড়িয়ে ঘরে গেল, ঘরে গিয়ে কী বলল, শোনা গেল না। শুধু অর্জুনের রাগ-রাগ গলা শোনা গেল-প্লিজ, আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না।
শ্রুতি ফিরে এল। রাকেশের মনে হল, ও অপ্রতিভ বোধ করছে। রাকেশ মুখ নীচু করে পাইপটি ভরতে লাগল। শ্রুতি টি-কোজিটি তুলে নিয়ে বড়ো চামচে নেড়ে নেড়ে কেতলিতে চায়ের পাতাগুলোনাড়তে লাগল। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি আমাকে দেখে মনে মনে হাসেন, না রাকেশদা?
রাকেশ চকিতে ব্যথিত মুখ তুলে বলল, কেন? তুমি কি আমাকে এতদিনে এই বুঝেছ শ্রুতি? আমার গর্ব আছে যে, তোমাকে আমার মতো করে এ জন্মে আর কেউ বোঝেনি। তোমাকে আমি দেখি, বুঝি এবং তাতে তোমার প্রতি আমার ভালো লাগাটুকুই শুধু বাড়ে। তোমাকে ভুল বুঝেছি এমন তো কখনো হয়নি।
দেশলাই জ্বেলে রাকেশ পাইপটা ধরাল। বলল, তুমি আমার কাছে কখনো শুকনো মুখে আসবে না। তোমার শুকনো মুখ দেখলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
শ্রুতি কথা না বলে পেয়ালায় চা ঢালতে লাগল। তারপর একচামচ চিনি এবং সামান্য দুধ মিশিয়ে পেয়ালাটি রাকেশের হাতে এগিয়ে দিল। রাকেশ নীচু হয়ে পেয়ালাটি নিল।
শ্রুতি বলল, রাকেশদা, ও কী? আপনার কপালের দু-পাশে যে, অনেক চুল পেকে গেছে!
রাকেশ হেসে বলল, কী করব? গেছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
শ্রুতি বলল, সেকথা নয়। তবে দেখতে ভালো লাগে না।
কিছু করার নেই। রুমনি বেঁচে থাকতে এ নিয়ে রোজ চেঁচামেচি করত–রোজ সকালে সন্না নিয়ে আমার চুলের কল্যাণে লাগত–তাতে আমার যা যন্ত্রণা হত, তার চেয়ে বার্ধক্যের যন্ত্রণা অনেক ভালো ছিল। একটা পাগলি ছিল রুমনিটা। আমার ভারি ভালো বউ।
শ্রুতি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে রাকেশের চোখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, সত্যি, রুমনিদির মতো মেয়ে আমি তো আর দেখলাম না। কী করে যে কী হয়ে গেল। দু-দিনের মেনেনজাইটিসে কেউ মারা যেতে পারে–ভাবা যায় না। আর কম বয়েসে।
রাকেশ বলল, থাক ওসব কথা শ্রুতি। সব প্রিকণ্ডিশাণ্ড, কপালে যা আছে, মানে যা ছিল, তা ঘটেছে।
শ্রুতি বলল, আপনি কপাল মানেন?
রাকেশ বলল, নিশ্চয়ই মানি। কপাল না মেনে উপায় আছে? কপাল না মানলে আমার এত দীর্ঘশ্বাস এই কপালের দোহাই দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম কী করে?
শ্রুতি নিজের পেয়ালায় চা ঢালল। রাকেশ উঠে আবার ঘরে গেল। ঘরে গিয়ে ফোর সেভেনটি ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেলটি নিয়ে এসে ফ্লানেল দিয়ে মুছতে লাগল।
শ্রুতি বলল, আমি কেবল আপনার বন্দুক রাইফেলের যত্ন দেখি আর ভাবি, আমাকে যদি কেউ এমন যত্ন করত।
ঠাট্টা নয়। সেনাবাহিনীতে একটি কথা চালু আছে, জানো? ওরা বলে–ইউ মাস্ট কিপ ইয়োর রাইফেল অ্যাজ ইউ কিপ ইয়োর ওয়াইফ।
সত্যি?
সত্যি।
ওরা চা খাচ্ছিল। চুপচাপ। এমন সময়
স্লিপিং স্যুট পরেই, গায়ে একটি কম্বল জড়িয়ে অর্জুন ঘুমকাতর-চোখে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। পাতলা ছিপছিপে চেহারা–মাজা-মাজা রং-বেশ বুদ্ধিমান মুখ–দুটি বড়ো বড়ো অভিব্যক্তিময় চোখ। বলল, বা: রাকেশদা, আমাকে ফেলেই চা খাওয়া হয়ে গেল!
রাকেশ বলল, এসো এসো, এখানে চলে এসো। সবে এককাপ খেয়েছি।
অর্জুন বাথরুম-স্লিপার পায়ে গলিয়ে কম্বল সমেত এসে চেয়ারে বসল।
শ্রুতি বলল, ও কী? কম্বল গায়ে কাটিহারের কুলির মতো ঘোরার কী মানে হয়?
আঃ কী আরাম, বলে দুষ্টুমি করে অর্জুন শ্রুতির দিকে চাইল।
এইজন্যেই রাকেশের ভালো লাগে অর্জুনকে। হুইস্কি-টুইস্কির ব্যাপারে একটু বাড়াবাড়ি করে হয়তো–তাও মনে হয় বাইরে-টাইরে এসেই করে–জানে না-নইলে ছেলেটি ভারি বুদ্ধিমান এবং সোজা টাইপের। মনে মনে একেবারে সাদামাটা। দশ বছরের ছেলের মতো সরল।
অর্জুন শুধোল, কী শিকার হল?
শ্রুতি উত্তর দিল, ধনেশ পাখি। তোমার বাতের চিকিৎসা হবে।
বড়ো বড়ো চোখ করে অর্জুন বললে, সিরিয়াসলি? তুমিই বুঝি রাকেশদাকে মারতে বলেছিলে? বাঁচালে। রাতে বাঁ-পায়ের হাঁটুটা যা কন কন করে না–কোমরটাও, বোধ হয় গেঁটেবাত হয়েছে-বলেই শ্রুতির দিকে চাইল, ওকে রাগাবার জন্যে।
শ্রুতি চোখে আগুন জ্বেলে বলল, আরও অনেক কিছু হবে। এখুনি কী!
অর্জুন তবু একটুও না রেগে বলল, দাও চা দাও।
অর্জুনকে চা ঢেলে দিয়ে শ্রুতি বলল, রাকেশদা, এলা চিঠি লিখেছে। কাল রাতে ফরেস্টরবাবু টিকরপাড়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আজ সকালে দিয়ে গেছেন।
রাকেশ রাইফেলের সেফটি ক্যাচটায় তেল দিতে দিতে বলল, কী লিখেছে পড়ো না।
শ্রুতি একদৌড়ে খাওয়ার ঘর থেকে চিঠিটা নিয়ে এল। আগের থেকে শ্রুতি সামান্য রোগা হয়েছে। পেছন থেকে আচমকা চাইলে ওকে হঠাৎ রুমনি বলে ভুল হয়।
শ্রুতি চিঠিটা এনে খাম খুলে পড়তে লাগল।
মুসৌরী
সোনা বাবা,
তুমি কী কী শিকার করলে কিচ্ছু লেখোনি। বুঝতে পাচ্ছি, তোমরা যেখানে আছ সেখান থেকে চিঠি এখানে আসতে অনেকদিন লাগে। তাই তোমার ওপর রাগ করিনি, দেরি করে চিঠি দিয়েছ বলে।
তুমি আর হরিণ-টরিন মারোনি তো? হরিণ মারলে তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না। তোমার চিঠি পড়ে বুঝতে পারছি বাঘমুন্ডা জায়গাটা কত সুন্দর। এবার গরমের ছুটিতে তোমার সঙ্গে কোনো জঙ্গলে যাব। আমার জঙ্গল পাহাড় খুব ভালো লাগে, জানো বাবা।…
অর্জুন বলল, বাপকা বেটি। রাকেশ নিঃশব্দে হাসল।
শ্রুতি একটুও হাসল না–বলল চিঠিটা শেষ করতে দাও। বলেই চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করেই হঠাৎ থেমে গেল। ওর মুখ দেখে মনে হল, ও খুব বিব্রত বোধ করছে, খুব এম্বারাসড হয়েছে।
রাকেশ বলল, কী হল? পড়ো শ্রুতি?
শ্রুতি বলল, এলাটা একটা পাগলি মেয়ে। ও আপনার জন্য খুব ভাবে, না রাকেশদা?
রাকেশ বলল, তা ভাবে। এখন ও-ই তো আমার গার্জেন।
অধৈর্য গলায় অর্জুন বলল, পড়ো না কী লিখেছে তারপর?
শ্রুতি আবার চিঠিটা তুলে নিল বিব্রত হাতে। বলল, লিখেছে–শ্রুতিমাসি তোমার সঙ্গে রয়েছে, তাই তোমার নিশ্চয়ই কোনো কষ্ট হচ্ছে না। তারপর থেমে থেমে পড়তে লাগল– শ্রুতিমাসী তোমাকে খুব ভালোবাসে, আমি জানি। তুমিও শ্রুতিমাসিকে খুব ভালোবাসো তাই না বাবা? শ্রুতিমাসিকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসলে কিন্তু তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব বাবা।
আমাদের স্কুলে সেদিন ফেট হল। আমি খুব মজা করলাম। এয়ারগানের একটা স্টল ছিল–তাতে যতগুলো প্রাইজ ছিল তার প্রায় অর্ধেক আমি পেয়েছি। একটা শেভিং সেট পেয়েছি। এল বাবা, আমার কি দাড়ি আছে? তাই তুমি এলে তোমাকে দেব বলে রেখে দিয়েছি।
আজকে থামলাম। তুমি আমার আব্বা নিয়ো। শ্রুতিমাসিকে আমার হয়ে একটা আব্বা দিয়ো। অর্জুনমেসোকে আমার কথা বোলো।
ইতি–তোমার এলাবুড়ি।
.
০২.
অর্জুন আর শ্রুতি বাংলোর হাতায় রঙিন ছাতার নীচে বসে ছিল।
আমার সঙ্গে কি একটু একলা থাকা যায় না? অর্জুন বলল।
শ্রুতি বলল, আহা, ন্যাকা, সব সময়েই তো আছি।
আছ, কিন্তু দায়সারাভাবে।
এ আবার কীরকম কথা?
যেরকম কথা, সেরকম কথা। তোমার রাকেশদা নইলে যেন একমুহূর্তও চলছে না। কেন? ও বুড়োর মধ্যে কী দেখেছ তুমি?
রাকেশদা মোটেই বুড়ো নয়।
তা তো নিশ্চয়ই। এভার ইয়াং। অন্তত তোমার চোখে।
আমার চোখে কেন, সকলেরই চোখে। কাল তো দৌড়ে পারলে না। লজ্জা করে না? সব সময় সিগারেট খাবে, কুঁজো হয়ে বসে থাকবে আর শরীরের ওপর যতরকম ভাবে পারো অত্যাচার করবে তো দম হবে কোত্থেকে।
অর্জুন সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ফু:! অর্বাচীন একেবারে অর্বাচীন। আরে, শরীরের যত্ন-ফত্ন এযুগে চলে না। যখন বাপ-দাদাদের চন্ডীমন্ডপ ছিল–অফুরন্ত অবকাশ ছিল,-গোলা-ভরা ধান, পুকুর-ভরা মাছ ছিল, মানে এককথায় যখন ভবিষ্যৎ বলে কোনো কথা মানুষের অভিধানে ছিল, তখন এসব শরীর-চর্চা-ফর্চা করা মানাত। আজকের দিতে প্রাণেরই কোনো দাম নেই। কাল যে, ওয়ার্ল্ড ওয়ার লাগবে না তুমি জানো? ভবিষ্যৎ যখন অতীব অন্ধকারাচ্ছন্ন, তখন যা যা করতে চাও প্রাণভরে করে নাও, পরে সুযোগ নাও পেতে পারো। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, যেমন আমি। সকালে ৮টার আগে উঠতে ভালো লাগে না, উঠি না। রাতে আধবোতল হুইস্কি না খেলে ভালো লাগে না, খাই। মোদ্দা কথা, যা ইচ্ছে করে তাই করি। শর্টস পরে থপ থপ করে তোমার ইয়াং রাকেশদারা সারাজীবন দৌড়ে বেড়াক, ফুসফুসের জোর বাড়াক, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই–কিন্তু এরমধ্যে আমাকে কেন?
শ্রুতি বলল, থাক, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে পারব না। অন্য কথা বল।
অর্জুন বলল, আমার অন্য কোনো কথা নেই।
তাহলে চুপ করে থাকো।
অর্জুন বলল, বেশ, রইলাম।
অনেকক্ষণ দুজনে দু-দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
শ্রুতি কিছুক্ষণ পরে বলল, ওটা কি গাছ জানো?
জানি না। তুমি কি জানো না যে, আমার বাড়ি বিডন স্ট্রিটে–সেখানেই মানুষ হয়েছি অত গাছ আমি কী করে চিনব? বাঁদর-হনুমানও নই, আর বটানিও ছিল না আমার।
শ্রুতি বলল, তোমার স্বভাবটা দিনে দিনে এমন হচ্ছে যে, বলার নয়।
অর্জুন বলল, দেখছ একটু আরাম করে রোদে বসে আছি, আমার সঙ্গে এমন ভটর-ভটর করছ কেন? তোমার রাকেশদাকে ডাকো–কোনটা কী গাছ, শুয়োরের লেজ সোজা না হয়ে বেঁকে থাকে কেন ইত্যাদি তাবৎ দুরূহ দুরূহ প্রশ্নের সমাধান পেয়ে যাবে। যে যা জানে না, তাকে সেইসব প্রশ্ন করে লজ্জা দাও কেন?
এবার শ্রুতি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল। বারান্দা পেরিয়ে বাংলোয় ঢুকল। কিছুক্ষণ এঘর ওঘর ঘুরঘুর করল। শীতের দুপুরে বাংলোর বড়ো বড়ো উঁচু ছাদওয়ালা ঘরগুলোয় ওর ভীষণ একা-একা লাগতে লাগল–শীত-শীত করতে লাগল। কুঁজো থেকে গড়িয়ে একগ্লাস জল খেল, তারপর কুয়োতলার পাশে যেখানে রাকেশ একটা অশ্বথ গাছের গায়ে টার্গেট বানিয়ে পয়েন্ট টু টু পিস্তল নিয়ে প্র্যাকটিস করছিল, পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছোল।
রাকেশ ম্যাগাজিনটি খুলে গুলি পুরছিল। মুখ ঘুরিয়ে শ্রুতিকে দেখতে পেয়ে বলল, কী ব্যাপার শ্রুতি? অর্জুন কি ঘুমিয়েছে নাকি?
ঘুমোয়নি–ওই তো রোদে বসে বই পড়ছে।
ও। বোসো, ওই কাটা গাছটার ওপরে বসো, দেখো কেমন মজা।
রাকেশ বাঁ-হাতটি পেছনে কোমরের ওপরে রেখে বেঁকে দাঁড়িয়ে ডানহাতটি সোজা সামনে তুলে পর পর পাঁচটি গুলি করল–চারটি গুলি বুলস আইতে লাগল, অন্যটি বাইরের বৃত্তে।
শ্রুতি বলল, বাঃ, আপনার হাত তো বেশ ভালো।
রাকেশ ম্যাগাজিনটা খুলতে খুলতে বলল, দুর পাগলি মেয়ে–এ কি ভালো মারা হল? যারা পিস্তলে ভালো মারে তাদের মার দেখার মতো। সেবার টোকিওতে ওয়ার্ল্ড শুটিং চ্যাম্পিয়ানশিপে একটি ইটালিয়ান ছেলে এসেছিল–ছোকরা–বেশি হলে বছর কুড়ি বয়েস হবে। চোখে সানগ্লাস–একটা লাল নাইলনের গেঞ্জি পরে বসে বসে বিয়ার খাচ্ছিল– র্যাপিড শুটিং-এ যেই ওর টার্ন এল, বিয়ারের গ্লাসটি নামিয়ে রেখে জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে তিন-চার সেকেণ্ডের মধ্যে সব কটি গুলি ছুঁড়ে আবার এসে বিয়ার খেতে লাগল। মানে কখন হাত তুলল, কখন নামাল টেরই পেলাম না।
গুলিগুলো লাগল? শ্রুতি শুধোল।
লাগল মানে? বুলস আইতে কেবল একটি মাত্র ফুটো হল। একই জায়গা দিয়ে সব কটি গুলি কার্ড ফুটো করে বেরিয়ে গেছিল। ছেলেটি ফার্স্ট হল।
সত্যি?
সত্যি।
রাকেশদা, আমাকে একবার নিয়ে যাবেন দেখাতে? আমার না এসব দেখতে খুব ভালো লাগে। মনে আছে, সেবারে আপনার সঙ্গে মোটরগাড়ির রেস দেখতে গেছিলাম–উঃ, আমার দারুণ লাগে। মাথায় একটা লাল স্কার্ফ জড়িয়ে একটি কনভার্টিবল রেসিং কারে বসে থাকব–আমার পাশে আপনি বসে চালাবেন–আমরা হাওয়ার চেয়ে জোরে চলে যাব, এক এক ল্যাপ-এ এক-একজনকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে আগে ফিনিশ করব। রাকেশদা, একবার নামুন না। আপনি আর আমি। নামবেন? বলে বড়ো বড়ো চোখের পাতা ফেলল শ্রুতি।
গুলিভরা ম্যাগাজিনটা পিস্তলের বাঁটে ভরতে ভরতে রাকেশ বলল, দুর, আজকাল আর ওসব দিন নেই। কোনো বিপজ্জনক কিছু করতে যাওয়ার আগেই এলার কথা মনে হয়। আমার যদি কিছু হয় তো এলার কী হবে? ওকে দেখার তো কেউ নেই।
শ্রুতি একটু চুপ করে থেকে বলল, কেউ নেই বলছেন কেন? আপনি ছাড়া এলার কি কেউ নেই?
রাকেশ বলল, কে আছে বল?
আপনি জানেন না কে আছে?
হঠাৎ রাকেশ যেন ভুলে-যাওয়া কিছু মনে করল। ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তুমি, হ্যাঁ শ্রুতি, তুমি তো আছই–কিন্তু তোমার নিজের ছেলে-মেয়ে হবে, তোমার স্বামী আছে–তুমি তাদের দেখাশোনা করে এলার জন্যে কি কিছু করার সময় পাবে?
শ্রুতির গলায় অভিমানের সুর লাগল। বলল, আপনি কি তাই ভাবেন নাকি? আমার অন্য কাউকে দেখতে হবে বলে আমি এলাকে দেখতে পারব না?
রাকেশ বলল, জানি, আমি তো জানিই–তুমি থাকতে আমার এলার জন্যে কোনো চিন্তা নেই–তবু তোমার ওপরে, যে দায়িত্ব তোমার নয়, সে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া আমার অনুচিত।
শ্রুতি বলল, বললেন ভালোই, দায়িত্ব যেন কারও ঘাড়ে কেউ ইচ্ছে করে চাপিয়ে দিতে পারে! দায়িত্ব কেউ স্বেচ্ছায় না নিলে কেউ কি তা দিতে পারে?
রাকেশ হাসল, বলল, সে-কথা ঠিক। তুমি যা এল সব ঠিক। সত্যি শ্রুতি, কত মেয়েই তো দেখলাম আজ পর্যন্ত–ঠিক তোমার মতো কাউকে দেখলাম না। তারপর একটু চুপ করে থেকে শ্রুতির চোখে চেয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমার না দেখা হলেই বোধ হয় ভালো হত। তোমার তো হতই–হয়তো আমারও ভালো হত।
শ্রুতি মুখ নীচু করে বলল, নিজের কথা বলুন, অন্য লোকের কী হত না হত সে ভাবনা অন্য লোককেই ভাবতে দিন।
রাকেশ এবার সময় নিয়ে ধীরে ধীরে একটি একটি করে গুলি ছুঁড়তে লাগল। গ্রামের কয়েকটি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে জড়সড় হয়ে রাকেশের পেছনে দাঁড়িয়ে বসে ওর পিস্তল ছোঁড়া দেখতে লাগল।
শ্রুতির এ সবকিছু ভীষণ ভালো লাগে। ওর অনেক কিছু ইচ্ছে ছিল–ও ছেলেদের মতো বাধাবন্ধহীন হবে–টেনিস খেলবে, রোয়িং করবে, কার-রেসে কোনো ছোট্ট খয়েরি রেসিংকারে একা একা কোনো কৃষ্ণসার হরিণীর মতো ফাস্ট হবে–কত কী স্বপ্ন দেখত শ্রুতি, কত কী স্বপ্ন দেখত! সেসব স্বপ্ন এক এক করে এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রাকেশদার মধ্যে তবু এখনও সেইসব ভেঙে যাওয়া শিশমহলের স্বপ্নগুলোর টুকরো টুকরো হারের মতো মাঝে মাঝে চমকে উঠতে দেখে। শ্রুতি বসে বসে ভাবতে লাগল, প্রত্যেকেরই মনে মনে বোধ হয় অনেক স্বপ্ন থাকে–যেসব স্বপ্ন কোনোদিন নিজের জীবনে সত্যি হয় না–কিন্তু তাদের স্বপ্ন অন্যের মধ্যে সত্যি হয়ে দেখা দেয়–জীবনের ধূলিমলিন গেরুয়া একঘেয়েমিতে হঠাৎ হঠাৎ রোদ-পড়া অভ্রর কুচির মতো সেসব স্বপ্ন ঝিকমিক করে ওঠে।
হঠাৎ রাকেশ শুধোল, ছুড়বে তুমি শ্রুতি?
শ্রুতি উঠে দাঁড়াল, বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল, পারব?
নিশ্চয়ই পারবে।
আপনি শিখিয়ে দিলে পারব।
রাকেশ প্রথমে একটি টার্গেট এনে শ্রুতিকে চেনাল। বুলস আই, ইনার, ম্যাগপাই, আউটার। সবগুলি বৃত্ত ওকে চিনিয়ে দিল। তারপর সেফটি কী করে অপারেট করতে হয় দেখিয়ে দিল। বলল, বাঁ-হাতটা পেছনে আনো, এনে এবার ডান হাত সামনে তোলো ব্যস, এইবার নিশানা করে মারো। ওয়ান-টু-থ্রি!
গুম করে গুলি হল। কিন্তু গুলি টার্গেটের কোথাও লাগল না। শ্রুতির চোখমুখ লাল হয়ে গেল–বলল, আমি পারব না রাকেশদা–আমি পারব না। আমার দ্বারা হবে না। আপনার দামি গুলি আমার জন্যে মিছিমিছি নষ্ট হবে।
রাকেশ বলল, পাগলামি কোরো না। তুমি ঠিকই পারবে। তোমার জন্যে আমার দামি জীবনটাই মিছিমিছি নষ্ট হল–না হয় কিছু গুলিই নষ্ট হবে। তারজন্যে তোমার এত কুণ্ঠা কেন? নাও, এবার ভালো করে মারো। কী হল? মারো শ্রুতি! কী হল?
কী হল শ্রুতি তা নিজেও জানে না। বলল, রাকেশদা বিশ্বাস করুন, আমি পারব না, আমার মন বলছে আমি পারব না। সবাই কি সব পারে?
রাকেশ ওর হাত থেকে পিস্তলটি নিয়ে বলল, ঠিক আছে। এখন না হলেও পরে পারবে, নিশ্চয়ই পারবে।
আমি কোনোদিনই পারব না রাকেশদা। কিছু কিছু জিনিস আছে, যা আমার মনে হয় যে, আমি কোনোদিন পারব না।
রাকেশ হাসল। বলল, জানি।
শ্রুতি হাওয়ায়-ওড়া অলক দু-হাতে সরাতে সরাতে অবাক চোখে চেয়ে বলল, জানেন? আপনি জানেন?
রাকেশ আবার হাসল, বলল, জানি।
শ্রুতি কিছু বলল না। মুখ নীচু করে রইল।
.
০৩.
রাত বোধ হয় সাতটাও বাজেনি, অথচ এখানে মনে হচ্ছে কত রাত। শ্রুতি ট্রানজিস্টারটা খুলে গান শুনছিল ঘরে বসে। অর্জুন ইজিচেয়ারে পা তুলে বসে, পাশে হুইস্কির গ্লাস রেখে জেমস বণ্ডের বই পড়ছিল। রাজুয়াড় বাবুর্চিখানায় ছিল। বাইরের বারান্দায় হ্যাঁজাকটা কাঁটার সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেটা মাঝে মাঝে আপন মনে নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলছিল।
আজ বাইরে প্রচন্ড স্তব্ধ শীত। নির্জনতা ছমছম করছে। দশ-পনেরো বর্গমাইলের মধ্যে জনমানব নেই–এক বাঘমুন্ডা গ্রামের সামান্য কয়েক ঘর ছাড়া। এইসময় পূর্ণাকোটের পথে গেলে হাতির দল দেখা যায়। রাকেশ গতরাতে ওদের নিয়ে গেছিল।
ফ্যলকন ফোর্ড গাড়ির বন্ধ কাঁচ জানলা দিয়ে হাতিদের হাঁটুগুলো শুধু দেখা যাচ্ছিল গাড়িটা থেকে; এমনভাবে ঘিরে ফেলেছিল হাতিগুলো–পাঁচ মিনিট সময় প্রায় রুদ্ধশ্বাসে কেটেছিল ওদের।
রাকেশ স্টিয়ারিংয়ে ছিল। পাশে তার ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা শোয়ানো ছিল–যদি প্রাণ বাঁচানোর জন্যে লাগে। কিন্তু হাতিরা কিছু করেনি। আস্তে আস্তে ফিরে গেছিল।
হাতিরা চলে যেতেই অর্জুন রেগে উঠে রাকেশকে বলেছিল–এরকম বাহাদুরি করার মানে হয় না।
রাকেশ মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, কীসের বাহাদুরি, অর্জুন?
এইরকম হাতির মধ্যে এনে বাহাদুরি!
মানে তোমাদের কাছে বাহাদুরি নেওয়ার জন্যে আমি তোমাদের এখানে আনলাম বলছ?
শ্রুতি তাড়াতাড়ি মাঝে পড়ে বলেছিল, তা নয় রাকেশদা–আমরাই তো আপনাকে বলেছিলাম হাতি দেখাতে!
রাকেশ বলল, হাতি তো দেখলেই।
শ্রুতি বলল, হ্যাঁ, দেখলামই তো।
অর্জুন বলল, তা দেখলাম, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারত। রাকেশ ইঞ্জিন স্টার্ট করে বলেছিল–সে দায়িত্ব আমার ওপরে নিয়েই তো আমি তোমাদের এখানে এনেছিলাম অর্জুন। বিপদ তো হয়নি।
শ্রুতি রাকেশের দিকে টেনে বলল, আসলে ও ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেছিল, তাই এখন উলটোপালটা কথা বলছে।
তখনও অর্জুন রাগ-রাগ গলায় বলল, না, আমি নার্ভাস হইনি। আমি কোনো কিছুতেই নার্ভাস হই না।
রাকেশ কথা বাড়ায়নি আর। কিন্তু শ্রুতি লজ্জিত আছে তারপর থেকে। অর্জুন আর
রাকেশদা তারপর স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা সবই বলছে–তবু যেন অর্জুনের হঠকারিতাটা শ্রুতির মনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।
হঠাৎ অর্জুন বিরক্ত গলায় বলল, কানের কাছে তোমার ট্রানজিস্টারটা থামাবে?
শ্রুতি অবাক হয়ে বলল, আমি তো আস্তে আস্তে শুনছি।
না। তবুও আমার পড়তে অসুবিধে হচ্ছে।
তুমি তো পড়ছ। আমি তাহলে কী করব?
তা আমি কী জানি? সুব্বল আর রাকেশদার সঙ্গে মাচায় বসতে গেলেই পারতে!
শ্রুতি বলল, কাল থেকে তাই যাব। এমন জায়গায় এসে ঘরে থাকার মানে হয় না।
অর্জুন বলল, বেশ তো। তুমি যাও না। আমি তো বারণ করিনি। বলে একটি সিগারেট জ্বালাল অর্জুন।
শ্রুতি রাগ করে রেডিয়ো বন্ধ করে শালটি ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় এসে ধীরে ধীরে পায়চারি করতে লাগল। হ্যাঁজাকের আলোয় বারান্দা ভরে আছে। কিন্তু বাইরের অন্ধকার তাতে যেন আরও ভারী হয়ে রয়েছে। বাইরে কতরকম ঝিঁঝি ডাকছে একটানা একটানা ঝুমঝুম, ঝুমঝুম-ঝিঁঝির ঝিঁঝির-ঝিঁঝির-ঝিঁঝির। সেখানে পায়চারি করে বেড়াতে বেড়াতে ভীষণ কান্না পেল শ্রুতির। এ কান্নার কোনো কারণ নেই। একেবারে একা থাকলে মাঝে মাঝে যেমন সকলেরই কাঁদতে ইচ্ছে করে–পুরোনো কথা ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করে, নতুন কথা ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করে–পরিণতিহীন ভবিষ্যৎ ভেবে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওকে সেই কান্নায় পেল। ওর দু-চোখ ছলছল করে উঠল।
ও ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে পায়চারি করে ওর উদগত উদাস কান্নার টুকরোগুলিকে একরাশ ঝরে-পড়া পলাশের মতো পায়ে মাড়াতে লাগল।
তারপর হঠাৎ ভয়-মেশানো কৌতূহলে ধীরে ধীরে পা বাড়াল শ্রুতি বাইরের অন্ধকারে।
বাংলোর হাতায় একটি বিরাট আমগাছ। ঝুপরি হয়ে আছে ছায়া। এক এক পা করে সাহসে ভর করে শ্রুতি গেটের কাছ অবধি পৌঁছোল। অনেক কষ্টে গেট অবধি। তার পরই ফিরে দাঁড়িয়ে আলো-ঝলমল বাংলোটির দিকে তাকাল। হ্যাঁজাকের পাশে কতগুলি পোকা ঘুরে ঘরে উড়ছে। ওপরে চাইল ও-আকাশভরা তারা, কালপুরুষ সপ্তর্ষি ধ্রুবতারা আরও কতশত তারা, নীরবে নীচের এই নিথর নিষ্কম্প জমাট-বাঁধা অন্ধকার অরণ্যের দিকে চেয়ে আছে। ওপর থেকে যে মুহূর্তে চোখ নামাল সে মুহূর্তে কী এক অজানা অনামা ভয় শ্রুতির শিরদাঁড়া বেয়ে সিরসির করে নেমে গেল। সেই মুহূর্তে শ্রুতির মনে হল, ওর পেছনের বিপুল আদিম অন্ধকাররাশি ওকে সামনের দিকের সামান্য আলোর বৃত্তের দিকে ঠেলছে, সহস্র সহস্র অদৃশ্য শীতল-কালো হাতে কারা যেন ওকে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠেলে দিচ্ছে, ঠেলে দিচ্ছে–শ্রুতির ভীষণ ভয় করতে লাগল, শ্রুতি দৌড়াতে দৌড়োতে এসে বারান্দায় উঠে পড়ল। এবং ঠিক এমন সময়–এমন সময় মনে হল সেই ডাকটা শুনল শ্রুতি।
কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। আবার শুনল, কিরি-কিরি-কিরি কিরি-কিরি–ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। সেই তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো অদ্ভুত আওয়াজে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শ্রুতির।
শ্রুতি একদৌড়ে ঘরে ঢুকেই অর্জুনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল তখন যে, অর্জুনের গা ঘেঁষে বসে–খুব ইচ্ছে করছিল তখন অর্জুন ওকে একটু আদর করুক।
কিন্তু অর্জুন বলল, আঃ কী হচ্ছে, গ্লাসটা ফেলবে যে! তারপর শ্রুতির ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয় বলল, কী হল?
শ্রুতি বলল, বাঘ্বডুম্বা।
বাঘ্বদুম্বা? সেটা আবার কী জন্তু?
জন্তু নয়, ভূত।
ননসেন্স! কোথায় শুনলে এর নাম?
রাকেশদা বলেছে।
রাকেশদা ছাড়া আর কে এমন আজগুবি ভূতের কথা বলবে!
শ্রুতি বলল, আজগুবি নয়। কালাহাণ্ডিতে, যেখানে প্রায় সব বাঘই মানুষ-খেকো, সেখানে এই ভূত আছে। যেসব মানুষ বাঘের হাতে মারা যায় তারা ভূত হয়ে যায়। ওখানের আদিবাসীরা তাদের বাঘ্বডুম্বা বলে ডাকে। তুমি একটু আগে একটা আওয়াজ শুনলে না?
লক্ষ করিনি। আমি তো পড়ছিলাম। কীরকম আওয়াজ?
কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ।
শ্রুতিকে এমন অদ্ভুত আওয়াজ করতে শুনে অর্জুন হো হো করে হেসে উঠল। নিজে একবার বলল, কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ। ফুলে ফুলে হাসতে হাসতে বলল, সত্যি, ধন্য তুমি আর ধন্য তোমার রাকেশদা। আমাকে এখান থেকে যাবার আগে তোমরা পাগল করে ছাড়বে।
শ্রুতি বলল, এতে হাসির কী আছে? তুমি জানো, আমি দাদাকে দিয়ে শোনপুরের মহারাজকে লিখিয়ে একথা যে সত্যি তা জেনেছি! শোনপুরের মহারাজা বীরপ্রতাপ সিংদেও দাদার বন্ধু।
অর্জুন বলল, তিনি কী বলেছেন? ভূত আছে?
না, তিনি তা বলেননি। বলেছেন যে, স্থানীয় আদিবাসীরা ওরকম যে বলে তা সত্যি।
তবে? আদিবাসীরা বললেই কি বাঘে-মারা মানুষ ভূত হয়ে যাবে? ও নিশ্চয়ই কোনো পেঁচাটেচার ডাক।
শ্রুতি বলল, আমি ওসব জানি না, এইমাত্র আমি ওরকম ডাক শুনলাম বাইরে। এখনও আমার বুকটা কীরকম করছে দেখো।
অর্জুন হুইস্কির গ্লাসটা হাতে তুলে বলল, দেখেছি, বলে চোখ দিয়ে কী একটা বলল শ্রুতিকে।
শ্রুতি বলল, তুমি একটি জংলি। খালি এইসবই জানো।
তারপরে আর কোনো কথা হল না।
শ্রুতি কেবল ভাবতে লাগল, এই অন্ধকারে তারা-ভরা আকাশের নীচে ঝিঁঝি-ডাকা, বাডুম্বার আওয়াজ-ভরা রাতে, মাচায় নিশ্চল হয়ে বসে থেকে বাঘ কি চিতার জন্যে অপেক্ষা করা না-জানি কেমন অভিজ্ঞতা। খুব ইচ্ছে করে শ্রুতির, একবার সেও মাচায় বসে। জীবনে এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ তো রোজ আসে না।
আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। সেই বিকেলের রমরমে রোদ থাকতে থাকতে একটি সাদা পাঁঠার গলায় দড়ি বেঁধে রাকেশ আর সুব্বল রাইফেল কাঁধে চলে গেছে কুরাপের পথের দিকে। চিতার চলাচলের পথে ওরা নাকি বসবে পাঁঠাটি বেঁধে। কখন ফিরবে ওরা কে জানে! ভাবছে শ্রুতি। বসে বসে নানান কথা ভাবছে শ্রুতি।
এমন সময় পাহাড়-কাঁপানো দূরাগত একটি রাইফেলের আওয়াজের গুমগুমানি বাংলোর ঘরের ভেজানো দরজা পেরিয়ে এসে পৌঁছোল।
শ্রুতি বলল, ওরা নিশ্চয়ই কিছু মেরেছে।
অর্জুন বলল, হবে, নতুবা মরেছে।
শ্রুতির চোখের আগুন জ্বলে উঠল। বলল, তার মানে?
মানে আবার কী? বাঘ শিকার কি চাট্টিখানি কথা–ইটস অ্যান অ্যাডভেঞ্চারাস স্পোর্ট– মারো কিংবা মরো। নইলে এত বাহাদুরি নেয় কেন তোমার রাকেশদারা?
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা অনেক লোকের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। রাকেশের উঁচু গলা শুনতে পেল। সে বলল, আমগাছের নীচে নামিয়ে রাখো-ওখানে চামড়া ছাড়াব। শ্রুতি আর অর্জুন বারান্দায় বেরিয়ে বারান্দা থেকে নেমে বাংলোর পেছনে এসে দাঁড়াল। দেখল, দুটি পাঁচ-ব্যাটারির টর্চের আলো অন্ধকার চিরে চিরে এদিক ওদিকে লাফিয়ে পড়ছে।
সুব্বল চেঁচিয়ে বলল, দিদিমণি, এতদিনে একটা হল।
শ্রুতি চেঁচিয়ে শুধোল, কী?
ওরা সমস্বরে বলল। কেউ বলল পো, কেউ বলল চিতা। প্রকান্ড চিতাটিকে এনে হ্যাঁজাকের আলোয় ওদের জন্যে পাঁচ মিনিট রাখা হল–তারপর আমগাছতলায় নিয়ে রাখল ওরা। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে সাদা পাঁঠাটাকে দেখে শ্রুতির খুব আনন্দ হল। তাহলে চিতাটা অবলা জীবটিকে মারার আগেই রাকেশদা চিতাটিকে মেরে ফেলেছে।
হ্যাজাকটা বারে বারে নিভে আসছিল। মাঝে মাঝেই সুব্বল এসে পাম্প করছিল– আলোটা আবার দপদপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। বাংলোর হাতায় প্রচুর লোক ভিড় করেছিল। এর আগে চেঁচামেচিও প্রচুর হচ্ছিল–এখন একটু চুপচাপ। কেবল মাঝে মাঝে টুকরো-টুকরো কথা, দুর্গা আর গঙ্গাধরের চিতার গায়ে ছুরি চালানোর নরম ফচফচ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
চিতাটিকে চিত করে তার বুকের মাঝবরাবর থেকে লম্বালম্বি কেটে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছিল। গোঁফগুলো প্রথমেই হাতে হাতে লোপাট হয়ে গেছে। নখের জন্য ইতিমধ্যেই চারজন প্রার্থনা জানিয়ে গেছে। চর্বি কাউকে দেওয়া হবে না, তা রাকেশ আগেই সকলকে বলে দিয়েছে। চামড়া ছাড়ানোর কাজও প্রায় শেষ। এখন তলপেটের কাজ শেষ করে মাথাটা ভালো করে ছাড়াতে হবে। মাথাটি অর্জুন মাউন্ট করবে বলেছে–মানে ট্রফিটি চেয়েছে রাকেশের কাছ থেকে। রাকেশ কথা দিয়েছে যে দেবে। বাঘ এবং চিতা সে এপর্যন্ত অনেক মেরেছে-তা ছাড়া মাথা টাঙিয়ে আহ্লাদিত হওয়ার অবস্থা সে অনেককাল আগে পেরিয়ে এসেছে।
অর্জুন সান্যাল চাপা ট্রাউজার ও কালো উরস্টেড ফ্লানেলের লংকোট পরে হাতে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে একটি বেতের চেয়ারে বসে বারান্দা থেকে স্কিনিং করা দেখছে। শ্রুতি মাঝে মাঝে বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে রাকেশের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তারপর আবার ফিরে আসছে। এক দু-বার বাবুর্চিখানায় গিয়ে তাড়া দিয়ে আসছে। রান্না ঠিকমতো হচ্ছে কি না দেখছে।
শ্রুতি ফিরে এসে বারান্দায় থামের পাশে দাঁড়াল। হ্যাঁজাকের আলোর ফালি বাঘমুন্ডার বাংলোর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নানা লোকের কাঁপা কাঁপা ছায়া আমগাছটির ডালে পাতায় লাফালাফি করছে। ঠাণ্ডাটি বেড়েছে বাইরে। লোকজনের ফিসফিসানি কি চামড়া ছাড়ানোর শব্দে কোনোরকমে বিরতি ঘটলেই বাইরের জঙ্গলের একটানা ঝিঁঝির ডাক– ঝিঁঝির-ঝি ঝিঁঝির-ঝি কানে আসছে। কেমন যেন ঘুম-ঘুম পায় একটানা ডাকে।
অর্জুন বলল, আজকের মেনু কী শ্রুতি?
কপির স্যুপ, পরোটা এবং মুরগির মাংস।
ব্য-স? বলল অর্জুন।
শ্রুতি বলল, এতেও হবে না?
তারপর শ্রুতি ওর চেয়ারের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিসে গলায় বলল, একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না?–জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছ? যে বাঘ মারল, সে তো ঠাণ্ডায় খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আর তুমি দেখছি অন্যের বাঘ-মারা সেলিব্রেট করতে বেসামাল হয়ে উঠলে। রাকেশদা কী মনে করবেন বল তো?
অর্জুন আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলল, আরে রাখো তোমার জংলি রাকেশদার কথা! তোমার রাকেশদার রক্ত গরম। তা ছাড়া কে কী মনে করবে তা নিয়ে এ. কে. সান্যাল মাথা ঘামায় না।
শ্রুতি উত্তরে কিছু বলল না। বলল, ঠিক আছে।
শ্রুতি রাকেশের কাছে চলে গেল বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে আধো-অন্ধকারে। বলল, রাকেশদা, আর কতক্ষণ লাগবে?
এই তো হয়ে গেল। আর বড়োজোর একঘণ্টা। মাথাটা আমি নিজে হাতে স্কিন করব। মাংসগুলোভালো করে স্কুপ করে বের না করতে পারলে মাউন্ট করতে অসুবিধে হবে। অর্জুনকে এল যে, একেবারে কটক থেকে সোজা ট্রেনে বুক করে দেবে চেন্নাইয়ে–দিল্লি যাওয়ার দরকার নেই, চেন্নাইয়ে ওরা ভালো করে।
আমার কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করছিলে কেন? তোমার খিদে পেয়েছে? খিদে পেলে তুমি আর অর্জুন খেয়ে নাও। আমি পরে খাব।
শ্রুতি বলল, না না। আপনি শেষ করে নিন, আমার তাড়া নেই। ওর খেতে ইচ্ছে করলে আগে খেয়ে নেবে।
সে কী? তা কি হয়? ও একা খাবে? তুমিও ওর সঙ্গে বোসো–ওকে কম্পানি দিয়ো।
শ্রুতি বলল, সে আমি যা-হয় করব। আপনি এদিকে তাড়াতাড়ি করুন। বাইরে তো রীতিমতো শীত–আপনি এই শর্টস পরে আর একটি হাতকাটা সোয়েটার পরে রয়েছেন, শীত করছে না!
রাকেশ শ্রুতির দিকে চেয়ে চাপা গলায় বলল, তুমি কাছে থাকলে আমাকে কি কোনো দিনও শীতার্ত দেখেছ?
শ্রুতি আড়চোখে স্বামীর দিকে চেয়ে নিয়ে রাকেশকে বলল, জানি না!
রাকেশ রেমিংটনের ছোরাটা থেকে রক্তমাংস কচি কলাপাতায় মুছতে মুছতে বলল, তুমি জানো। তোমার মতো ভালো করে আমিও জানি না। তারপর আরও আস্তে আস্তে বলল, তুমি কাছাকাছি কোথাও থাকলে আমার কোনোদিনই শীত করেনি।
শ্রুতি বাধা দিয়ে বলল, থাক ওসব কথা।
অর্জুন চিৎকার করে বলল, রাজুয়াড়-হুঁইস্কি। রাজুয়াড় নতুন গ্লাস দিয়ে গেল। হ্যাঁজাকের আলোতে গ্লাসের ঘোলাটে লাল তরলিমার ভেতর দিয়ে রাকেশ অর্জুনের মুখ দেখতে পাচ্ছিল। ওর মনে হল, এ এক নতুন অর্জুন। অচেনা অর্জুন।
সঙ্গে সঙ্গে শ্রুতির জন্যে এককণা অনুকম্পা মনে উঁকি মেরে গেল। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। তার পরমুহূর্তেই শ্রুতি এবং অর্জুন দুজনের ওপরই এক ঘিনঘিনে ঘৃণা ঘষে ঘষে রাকেশের সমস্ত মহৎ অনুভূতি বাতিল করে বুকে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। রাকেশ তার অনুকম্পার অক্টোপাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, রেমিংটনের ছুরিটা হাতে নিয়ে মৃত চিতাটির মাথার দিকে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে মৃত বাঘের গলায় ছুরিটি আমূল বসিয়ে সেই ঘাতক ঘৃণাটিকে স্থানান্তরিত করল।
গরম সাদা শালটি গায়ে ভালো করে জড়াল শ্রুতি। তারপর আবার বারান্দায় ফিরে এসে চেয়ারে বসল। বসে বসে উবু-হয়ে-বসা রাকেশকে একরাশ হলুদ আলোয় রক্তাক্ত লাল বাঘের পটভূমিকায় দেখতে লাগল।
সত্যি সত্যিই কেমন বুড়ো-বুড়ো হয়ে গেছে রাকেশদা। কপালের পাশে চুলে পাক ধরেছে। একটু একটু–মাথার সামনের চুল পাতলা হয়ে প্রায় টাকে দাঁড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চোখের নীচে কালি পড়েছে বলে মনে হয়। কেমন ক্লান্ত-ক্লান্ত দেখায়। ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, একদিন রাকেশদাও বুড়ো হয়ে পড়বে। রুমনিদি বেঁচে থাকতে রাকেশদা অন্যরকম ছিল।
যদিও শ্রুতির প্রতি রাকেশ রায়ের বরাবরের দুর্বলতা, কিন্তু তবু রুমনিদি বেঁচে থাকতে সে দুর্বলতা নিয়ে খেলা করা যেত। তার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে ভালো লাগত। রাকেশদা যত পাগলামি করত তখন, ও তত দূরে দূরে সরে যেত। মনে মনে বলত, ফাঁকি –সব ফাঁকি।
ওর কাছে রাকেশ ভারী গলায় কোনো আবেগময় কিছু বললে ও সঙ্গে সঙ্গে শুধোত, রুমনিদি এখন কী করছে? তাকে নিয়ে এলেন না কেন? যদি কখনো রাকেশ তার শরীরের কাছে আসার চেষ্টা করত শ্রুতি বলত, আমার হাত ধরতে পারেন-বড়োজোর হাতে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন, কিন্তু আর কিছুই নয়।
শ্রুতির মনে পড়ল, একদিন–বোধ হয় সেদিন পয়লা বৈশাখ কি পয়লা জানুয়ারি এরকম কোনো প্রথম দিন ছিল বছরের–রুমনিদির বাড়ি থেকে শ্রুতি ফিরছিল রাতে–রাকেশ ওকে পোঁছে দিতে যাচ্ছিল গাড়ি নিয়ে। যেই গাড়িটি রবীন্দ্রনগর ছাড়িয়ে জোরবাগের রাস্তায় পড়ল, অমনি রাকেশদা বলল, শ্রুতি, আজ বছরের প্রথম দিনে তোমায় আমি আদর করি? শ্রুতি একঝটকায় একেবারে জানলার পাশে ছিটকে সরে গেল–বলল, না রাকেশদা, আমার ভালো লাগে না।
রাকেশ বলল, কী ভালো লাগে না?
আমার এসব ভালো লাগে না।
কেন? তুমি কি অপবিত্র হয়ে যাবে? আমার একমাত্র অপরাধ কি এই যে, আমি তোমার রুমনিদির স্বামী? সে পরিচয় ছাড়াও কি আমার অন্য কোনো পরিচয় থাকতে নেই? আমার কোনো অন্তরঙ্গ একান্ত সত্তাও তো থাকতে পারে–যে আমি কারও নই, যে আমি একার, শুধু আমার একান্ত একার–আমার ভালো লাগার, ভালোবাসার–আমার কান্নার করুণ আমি। সেই আমি কি কেউ নই? যেহেতু আমি তোমার পরিচিত কারও স্বামী, সেইজন্যেই কি আমার সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাতিল করে ফেলতে হবে? উকিলের সঙ্গে মক্কেলের যে সম্পর্ক, ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর যে সম্পর্ক–আমার সঙ্গে তোমার সেরকম সহজ অথচ গোপন কোনো সম্পর্ক কি থাকতে পারে না শ্রুতি? সব সম্পর্কই কি মন্ত্র পড়ে কি রেজিস্ট্রি করে করতে হয়? সমাজের অনুমোদন ছাড়া কি কাউকে কিছুই দেওয়া যায় না? অন্ধকারে, চোখের জলে কেউ কি কাউকে ভালোবাসতে পারে না?
অস্বস্তিভরা গলায় শ্রুতি বলল, অত আমি জানি না রাকেশদা। আমার এসব ভালো লাগে না। হাত ধরতে পারেন। বড়োজোর হাতে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন। কিন্তু আর কিছু নয়। আর কিছুই নয়।
রাকেশ চুপ করে রইল। তারপরও হয়তো শ্রুতির হাত ধরত–হয়তো হাতে অন্যান্য দিনের মতো অবুঝ আবেগে তবুও নির্লজ্জের মতো ঠোঁট ছোঁয়াত–কিন্তু তার আগেই শর্মিলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়িয়েছিল সে পথে, হয়তো রাকেশের দুর্ভাগ্যেরই প্রতীক হয়ে। শ্রুতি বলল–একটু দাঁড়াবেন। রাকেশ দাঁড়াল। শ্রুতি শর্মিলাকে দরজা খুলে তুলে নিয়ে বলল, চল, তোকে রাকেশদা নামিয়ে দেবেন। রাকেশের সঙ্গে শর্মিলার আলাপ করিয়ে দিল শ্রুতি। তারপর জোরবেগে একসময় শ্রুতিদের বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল–শ্রুতি দরজা খুলে নামল। রাকেশকে বলল ও, আপনাকে খুব জ্বালালাম।
রাকেশ মুখে বলেছিল, ঠিক আছে। মনে মনে হয়তো বলেছিল, তুমি তো আমাকে অনুক্ষণই জ্বালাচ্ছ। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল রাকেশ শর্মিলাকে নামিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে।
নিজের ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রুতি সেদিন হেসেছিল। শীতের দুপুরে সুন্দরী বিড়ালি হতাশ হুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে যেমন ঠাট্টার হাসি হাসে, শ্রুতিও তেমনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলে ফুলে হাসতে লাগল–আয়নায় নিজের সুন্দর মুখ, সুন্দর দাঁত, সুন্দর গ্রীবা দেখতে দেখতে বলল, শখ কত, বাড়িতে স্ত্রী আছে আর উনি আমাকে প্রেম নিবেদন করছেন! চুমুই যদি খাব তো তোমাকে কেন? আমার কি সখার অভাব? কত কত ইয়াং হ্যাণ্ডসাম ছেলে ঘুরঘুর করছে–ফোন করছে–সিনেমায় নিয়ে যেতে চাইছে–আমাকে দেখে কবিতা লিখছে–ডেটিং করবার জন্যে উন্মুখ হয়ে রয়েছে–তারাই আছে আমার চারপাশে ভিড় করে। আমি কি সামান্য মেয়ে নাকি? তারা থাকতে তুমি কেন? তোমায় ভালোবাসার ভবিষ্যৎ কী? শুধু শুধু ভালোবেসে ঠকতে রাজি নয় শ্রুতি–কোনোদিন রাজি ছিল না। ভালোবাসা কেবল বর্তমানের–যা কেবল অতীতেই পৌঁছে যায় একদিন। কারও ভালোবাসারই কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। ভালোবাসার গর্ভে কোনো ভবিষ্যতেরই জন্ম হয় না–ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসাই সৃষ্টি করতে পারে। এক-একটি দুর্লভ মুহূর্ত–এক একটি সুগন্ধি ক্ষয়িষ্ণু ক্ষণ–যা আর কেঁদে কেঁদেও পরে ফিরে পাওয়া যায় না।
তখন শ্রুতি জানত না যে, সব ইয়াং হ্যাণ্ডসাম ছেলেরাই একদিন বয়স্ক হয়ে যায়, পুরোনো হয়ে যায়–একদিন বহিরঙ্গ হেরে যায় অন্তরঙ্গের কাছে। যে অন্তরের কাছে আছে, থাকে–সে চিরকাল তাই-ই থাকে। কিন্তু যাযাবর যৌবন কোথাও কোনো ঘরে বাসা বেঁধে থাকে না। একদিন ছিল, যেদিন রাকেশদাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে শ্রুতি–তার অবুঝ ভালোবাসা নিয়ে অনেক হেলাফেলা করেছে নিষ্ঠুরের মতো। সেদিন শ্রুতি বুঝতে পারেনি যে, তার ফিগার বরাবরই এমন থাকবে না, তার চাউনিতে বরাবর এত আগুন থাকবে না–তার অস্তিত্ব চিরকালই এমন করে সকলের মনে মনে উষ্ণতার উচ্ছ্বাস বয়ে আনবে না। তখন অনেক কিছু জানত না শ্রুতি। যা শেখানো হয়েছিল তাই শিখেছিল। শিখেছিল, নারী-শরীরের মতো অমোঘ এবং নিরুপদ্রব পবিত্রতা আর কিছু নেই।
কিন্তু আজকাল রাকেশদাকে দেখলে মায়া হয়। কষ্ট হয়। রুমনিদি মারা যাওয়ার পর থেকে বড়ো কান্না পায় রাকেশদার জন্যে। কেউ দেখাশোনার পর্যন্ত নেই। অফিস করেন–বাড়ি আসেন। আর বাড়ি বসে কী যে করেন তা উনিই জানেন। বন্ধু-বান্ধব বলতে কিছু নেই। শখের মধ্যে এই শিকার। তাও খুব কমই আসেন আজকাল। বনে-জঙ্গলে রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়োন। শুধোলে হাসেন। বলেন, এক সোনার হরিণীর প্রেমে পড়েছি।
যেদিন তার অনেক ছিল সেদিন তাকে সহজে হেলা করা যেত, তাকে ছেলেমানুষ আখ্যা দিয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত, তাকে পাগল বলা যেত, ইমোশনাল বলা যেত–কিন্তু আজ তার যে কিছুই নেই। শুধু তাই নয়–শ্রুতির প্রতি তার মনোভাব সেদিনও যেমন ছিল আজও তেমন আছে। একটুও বদলায়নি। এইটে ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যায় শ্রুতি। এ জগতে এ কী করে সম্ভব হল? অথচ কীই বা দিয়েছে শ্রুতি তাকে? কিছুই না, কিছুই না–শুধু তিক্ত রিক্ততা ছাড়া কিছুই না। অথচ আজ তার দেওয়ার মতো কিছু নেইও বাকি। রুমনিদি হঠাৎ মেনেনজাইটিসে মারা যাবেন তাই বা কে ভেবেছিল। তিনি অনেকদিন ধরে কোনো বড়ো অসুখে ভুগলে শ্রুতি হয়তো রাকেশদার এই অবুঝ ভালোবাসার দাম দিতেও পারত একদিন–যদি সে জানত রুমনিদি বরাবর রাকেশদার থাকবে না। তাহলে সে নিজেকে হয়তো রাকেশদার জন্যে প্রস্তুত করতে পারত। ও অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু ব্যাপারটা এমনই হল যে, কিছুই আর করার রইল না। শ্রুতির বিয়ের একবছর পর হঠাৎ মারা গেল রুমনিদি।
রাকেশদা পাগলামি করে সত্যি, অনেক পাগলামি করেছে শ্রুতির সঙ্গে, কিন্তু রুমনিদির মৃত্যুর পর আর কখনো তেমন পাগলামি করেনি। মুখেও বেশি কথা বলেনি। শুধু চোখে যতটুকু ভালোবাসা দেখানো যায়, তার সর্বস্ব দিয়ে শ্রুতির জন্যে যা করা যায় তাই করেছে।–তার বেশি এককণাও চায়নি। এর চেয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যবহার শ্রুতির অভিধানে জানা নেই। কিন্তু আজ তো শ্রুতির হাত-পা বাঁধা। ইচ্ছে করলেও তার আজ উপায় নেই কিছু দেওয়ার।
অর্জুনকে সে দেখেশুনেই বিয়ে করেছিল। শর্মিলার বার্থডে-পার্টিতে আলাপ। ওর ফাস্ট কাজিন। দিল্লির ম্যাককনোলি অ্যাণ্ড ম্যাকসেমুরে সেলস-এর নাম্বার টু অর্জুন। নিজের গাড়ি আছে, জোড়বাগে ফ্ল্যাট আছে, ভালো চাকরি আছে। তা ছাড়া অর্জুনের বয়েস অল্প–প্রায় শ্রুতিরই সমবয়েসি, সুন্দর চেহারা–দারুণ শৌখিন এবং প্রচন্ড স্মার্ট–শ্রুতির প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল, জাস্ট ইরেজিস্টেবল। তাই বিয়ে করেছিল। সুখী না হবার কোনো কারণ ছিল না। জীবনে সুখী হওয়ার মতো সমস্ত উপকরণই তার ছিল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক–হয়তো সুখী হওয়া হল না শ্রুতির এ জীবনে।
অর্জুনের জন্যে সে সব কিছু করে–আইনত, বিবেকানুগত ভাবে সে সব কিছু করতে বাধ্য–করেও–কিন্তু রাকেশদার জন্যে সে কিছুই করতে পারে না। সে জানে, তার করা উচিত নয়।
তাই আজকের এই ওড়িশার সুগভীর জঙ্গলে, বাঘমুভার বাংলোয় বসে ঝিঁঝির ঝিঁঝি রবের পটভূমিতে মৃত বাঘের মুখের সামনে উবু হয়ে বসা অসহায় বিপত্নীক দুর্দম রুক্ষ রাকেশের জন্যে দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই শ্রুতির।
হ্যাজাকের আলোয় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখ ঝাঁপসা হয়ে এল, হঠাৎ যা দেখল তা বিশ্বাস হল না শ্রুতির। ও চোখ কচলে নিল। তবুও ওর মনে হল, যে রাকেশদা বাঘের মাথার কাছে ঝুঁকে বসে আছে–তার মাথার সমস্ত চুল সাদা, দু-হাঁটুর মাঝে তার মাথা নীচু হয়ে ঝুলে পড়েছে, সে রাকেশদা যেন হাতজোড় করে শ্রুতির কাছে কী ভিক্ষা চাইছে। ভিক্ষা চাইছে-যা ও কোনোদিন তাকে দিতে পারবে না–দিতে পারেনি।
.
০৪.
কটক থেকে ফুটুদা বউদি, শেলি ও মকাকে নিয়ে এসেছিলেন টিকরপাড়ায় উইকএণ্ড কাটাতে। সঙ্গে চেনকানল থেকে পোড়া পিঠা নিয়ে এসেছিলেন অনেক। ভারী উপাদেয় বস্তু। অর্জুন আর শ্রুতি অনেকগুলো খেল।
বুঝতে পারছে রাকেশ যে অর্জুনের এই বনবাস তেমন ভালো লাগছে না। দিল্লির পার্টি করা ছেলে–আজ কারও স্ট্যাগ পার্টি, কাল বিয়ার পার্টি, পরশু ককটেল, নইলে কোথাও হই-হই করা। ওর জীবনটা একটা টপ-গিয়ারে ফেলা এঞ্জিন হয়ে গেছে। কেবল গতি চায়, একটি বিশেষ বেগের কমে চলতে গেলেই ওর মনের ইঞ্জিন কটকট-কট-কট আওয়াজ করে প্রতিবাদ জানায়।
তাতে কোনো দোষ নেই। নিজের যা ভালো লাগে তা যে অন্যেরও ভালো লাগতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যে যেমনভাবে আনন্দ পায়। এই দু-দিনের জীবনে আনন্দিত হয়ে বেঁচে থাকলেই হল।
বাঘমুন্ডার এই শান্ত নির্লিপ্ত, এখানের সবুজ শালীনতার স্নিগ্ধ আশ্চর্য জীবন, জঙ্গলের জাদু –সব মিলিয়ে রাকেশের নিজের বড়ো ভালো লাগে। এমনকী বাংলো থেকে না বেরোলেও ভালো লাগে। পুরোনো বাংলোর শার্সিভাঙা ঘরের চৌপাইয়ে শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়–কতরকম ফুলের গন্ধ নাকে আসে। বাগানের বড়ো বড়ো ডালিয়াগুলোর আড়ালে আড়ালে মৌটুসি পাখিরা দুপুরের রোদে লুকোচুরি খেলে। পাশের সেগুনজঙ্গল থেকে মোষের গলার কাঠের ঘণ্টার গম্ভীর ডুঙডুঙানি ভেসে আসে। মাঝে মাঝে কোনো প্রোষিতভর্তৃকা কাক মধ্যদুপুরে বাংলোর পেছনের পত্রহীন গাছটার ডালে বসে হাহাকার তোলা গলায় ডাকে খা-খা-কা-খা। দগদগে লাল টাগরায় মুখ হাঁ করে রোদ লাগায়। কুয়োতলা থেকে মাটির কলসিতে জল নিয়ে বাঘমুন্ডা গ্রামের মেয়েরা ফিরে আসে। এই জংলি প্রকৃতির মতোই তাদের জংলি যৌবন। যেমন টুঙি পাখির শিস শুনতে ভালো লাগে, তেমন এদের দেখতেও ভালো লাগে। শুধু দেখতে।
ফুটুদারাও বললেন, রাকেশও বলল যে, যাও তোমরা টিকরপাড়ায় বেড়িয়ে এসো। মহানদীর ওপরে চমৎকার ফরেস্ট বাংলো আছে। মহানদীর ঘননীল অথই জলে বড়ো বড়ো মহাশোল মাছ, শীতের দুপুরের হু-হুঁ-করা হিমেল হাওয়া, সবকিছু ভালো লাগবে। তাই আজ সকালে চলে গেছে অর্জুন আর শ্রুতি, ফিরবে কাল সন্ধেয় ওদের সঙ্গে। মানে, রাকেশ পূর্ণাকোটে গিয়ে ওদের নিয়ে আসবে।
শ্রুতির আদর-যত্নে এ ক-দিনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল রাকেশ। রুমনি মারা যাওয়ার পর এমন আদর তাকে কেউ করেনি। ইচ্ছে করলে আদর করার লোক জুটত না যে, তা নয়–কিন্তু ওই একরকমের খেয়ালিপনা। নিজেকে কুরে কুরে খেয়ে নিজে বেঁচে থাকাতেই ও বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে। নিজের মনের দেরাজের এক-একটি ড্রয়ার খুলেছে–আবার চাবি বন্ধ করেছে–এই মনে মনেই অনবধানে দিনগুলো কেমন করে কেটে গেছে, কেটে যাচ্ছে। মনের ঘর ছেড়ে বাইরের আঙিনায় গিয়ে ও দেখার সময় পায়নি কি দেখেনি, আর কেউ ওর জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে কি না।
রুমনির মতো করে রাকেশকে আর কেউ ভালোবাসেনি–বাসতে পারবে না কোনোদিন –এমনকী শ্রুতিও না। রুমনি রাকেশের স্ত্রী ছিল বলে নয়–স্ত্রী তো ঘরে ঘরে সব লোকেরই থাকে, সে এক আশ্চর্য সুরেলা সুগন্ধি মেয়ে ছিল বলে। রুমনির মৃত্যু তার মধ্যের একটি অন্যতম আনন্দের উৎসকে শুকিয়ে দিয়ে গেছে। সে গাছে আর ফুল ফোটে না, পাখি বসে না।
.
যে দু-জায়গায় বাঘের জন্যে মোষ বাঁধা হয়েছে, সে দু-জায়গায় মোষের জন্যে জল ও খাবার দিতে গেছে সুব্বল এবং দেখে আসতে গেছে বাঘে মোষ মেরেছে কি না।
এখন কিছু করার নেই। ব্রেকফাস্টের পর বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ চুপচাপ পাইপ খেয়েছে। তারপর জামাকাপড় পরেই কম্বলঢাকা বিছানায় শুয়ে পড়েছে রাকেশ।
শুয়ে শুয়ে-চৌপায়ায় শুয়ে শুয়ে রাকেশ ভাবছিল অনেক কথা, পুরোনো কথা–ওর বিয়ের কথা-রুমনির মৃত্যুর কথা, সব ভাবছিল।
রাকেশ ভগবান নয়। মাঝে মাঝেই এই শৈত্য, এই রাতের পর রাত নিঃসঙ্গ নির্জনতা যা কেবলমাত্র কোনো সৎ শীতল বিপত্নীকের পক্ষেই অনুভব্যতা অসহ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়, যা করতে ওর রুচি, ওর বিবেক, ওর স্মৃতি ওকে বারণ করে। যার ফলে নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কোনোদিন তেমন কিছু করা হয়ে ওঠেনি।
রাকেশের জীবনে গর্ব করার আর কিছুই নেই–কেবল এটুকু ছাড়া। সে তার স্ত্রীর স্নিগ্ধ স্মৃতিকে যথার্থ মূল্য দিয়েছে, স্বীকৃতি দিয়েছে।
শ্রুতির প্রতি রাকেশের মনোভাব রুমনির অজানা ছিল না, কিন্তু তা নিয়ে রুমনি কখনো অনুযোগ করেনি। ও হয়তো সেই মুষ্টিমেয়দের একজন, যে বিশ্বাস করত যে, কারও ভালোবাসা একজনকে দিয়েই ফুরিয়ে নাও যেতে পারে, বিশ্বাস করত যে, একসঙ্গে কারও পক্ষে দুজনকে ভালোবাসা সম্ভব। সে বিশ্বাস তার না থাকলে রুমনি রাকেশকে তার ক্ষমার ঔদার্যে কৃতজ্ঞ করে যেত না।
ভালোবাসা যে কী তা আজ অবধি রাকেশ জানল না। সে কি শরীর? কোনো শরীরকে একান্ত করে চাইবার বিমুগ্ধ বাসনার আর এক নামই কি ভালোবাসা? ভালোবাসা কি শুধুই শরীর-নির্ভর? শুধু অন্য শরীরে প্রবেশাধিকার পেলেই কি একজনের জাজ্বল্যমান শরীর ও হিমেল হৃদয়ের সব দুঃখ মেটে? ও অনেক ভেবেছে। তা বোধ হয় নয়।
শরীরটাই সব নয়। যাকে ও চায় তার শরীরটাও চায়, কিন্তু যার-তার শরীর দিয়ে বিশেষ একজনের শরীরের সান্নিধ্যের স্বাদ মেটে না। তা ছাড়া শরীর তো ঝুমঝুমির মতো; দু-দিন বাজালেই পুরোনো হয়ে যায়, ললিপপের মতো বেশি খেলেই দাঁত সিরসির করে–শরীরটা নিশ্চয়ই কিছু–কিন্তু কখনোই সবকিছু নয়। শুধু শরীর দিয়ে এই নগ্ন নির্জনতা কখনোই ভরানো যায় না।
রুমনির কথা মনে পড়ে। এইরকম উদাস একলা ভরন্ত সকালে রুমনির কথা মনে পড়ে। কনট প্লেসে ওর জন্যে রুমনি অপেক্ষা করত, রজনিগন্ধার মতো ছিপছিপে রুমনি। দূর থেকে চশমা-নাকে ওকে কেমন ভারিক্কি-ভারিক্কি দিদিমণি-দিদিমণি দেখাত। কিন্তু কাছে এলেই, ওর কাছে গেলেই রুমনি স্বর্ণলতার মতো নুয়ে পড়ত, খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তখন ওকে দেখে মনে হত রাকেশের ঋজু সত্তা আশ্রয় করে ও বেঁচে থাকবে, বেড়ে উঠবে বলেই যেন এতক্ষণ, এতদিন অপেক্ষা করছিল। আহা, সেইসব দিন! সেইসব দিন! হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্বপ্নভরা দিন! স্মৃতিও যেন আজকাল আর তেমন প্রখর নেই। রুমনির মৃত্যু প্রায় চার বছর হয়ে গেল। এলা তখন সাত বছরের। মুসৌরির স্কুলে বোর্ডিং-এ দিয়েছে রাকেশ মেয়েকে। রুমনির বড়ো সাধ ছিল যে, ওর জীবনের যা-কিছু অপূর্ণতা অপারগতা সমস্ত এলার মধ্যে সার্থকতা দিয়ে ভরে দেবে। মেয়ের মতো মেয়ে করবে এলাকে।
রাকেশ জানে না, এলা তার মৃতা মায়ের ইচ্ছানুযায়ী ভালো হবে কি না। ও চেষ্টা করবে, এইপর্যন্ত। কিন্তু রাকেশ কিছু আশা করে না আর আজকাল। সে অনেকবার আশা করেছিল -নানারকম আশা। আশা করলেই আশাভঙ্গতার দুঃখ বড়ো কঠিন হয়ে বুকে বাজে।
রুমনি আর নেই সত্যি কথা, আকাশের আশ্বাসে তাকিয়ে ভোরের বাতাসে অনেক অনেক কাঁদলেও সে আর ফিরে আসবে না এও সত্যি কথা–তবু তার ভালোবাসা আছে, বুক ভরে আছে যে ভালোবাসা, মৃত্যুর শেষদিন অবধি সে বয়ে বেড়োবে। রাকেশের মনে হয়, একবার কাউকে তেমন করে ভালোবাসলে, কারও ভালোবাসা তেমন করে পেলে, সে ভালোবাসা নিশ্চয়ই সারাজীবন থাকে। সাইকেল চড়া একবার শিখে ফেললে কেউ যেমন ইচ্ছে করেও তা ভুলে যেতে পারে না–সত্যিই তেমন করে কাউকে ভালোবেসে ফেললে শত চেষ্টা করেও তাকে আর ভোলো যায় না। যাকে ভালোবাসা যায় সে দূরে যেতে পারে, মরে যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা কেউ ভোলে না। তা সব সময় বুকের মধ্যে ঘুঘুর গানের মতো ঘুমিয়ে থাকে। কখনো কোনোদিন এমন একলা উদাস নিরুপদ্রব সকালে তাকে ডাকলেই সে পাশে আসে–যে নেই সে কাছে আসে। যে একবার কাউকে নিরুপায় ভালোবেসেছে কিংবা কারও সত্যি নিখাদ ভালোবাসা পেয়েছে, সে বরাবরের মতো, জীবনের মতো সঙ্গীই হয়ে থাকে–তাকে একাকিত্বের অসহ্য বেদনা কোনো সময় আর তেমন বিঁধতে পারে না।
এ কবছর রাকেশ তো সেই উষ্ণতা দিয়েই, সেই জানাটুকু নিয়েই নিজের মনের অন্তর্বর্তীকালীন শীতল প্রবাহগুলিকে ভরিয়ে রেখেছে।
সুব্বল ফিরে এসে বলল, মোষ দুটি বহাল তবিয়তে আছে, তবে একটি মোষের পঞ্চাশ গজের মধ্যে বাঘ হেঁটে গেছে, কিন্তু মোষকে ধরেনি।
রাকেশ বিছানা ছেড়ে উঠল, রাজুয়াড়কে বলল একটু কফি করতে, তারপর ফোর সেভেন্টি-ফাইভ ডাবল-ব্যারেলটাকে নিয়ে বাইরে রোদে এসে বসল। নতুন রাইফেল, নতুন মানে নতুন কেনা। অসমের চা-বাগানের জেরি ক্যালানের কাছ থেকে কেনা–কাস্টম বিল্ট এনগ্রেভিং করা সুন্দর রাইফেল–এ দিয়ে নাকি জেরি অনেক হাতি মেরেছে অসমে।
সুব্বল বলল, বাবু, সে গন্ধটা মারিবে নি?
এখানে আসা থেকে সুব্বল পেছনে লেগেছে বাইসনটা মারার জন্যে। বাইসনটা গুণ্ডা। পাঁচশো টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা আছে ওর মাথার ওপর। রাকেশ বলেছিল, ওটি মারতে পারলে পুরস্কারের টাকাটা সুব্বলকে দিয়ে দেবে। সে কারণে বেশ কিঞ্চিৎ উৎসাহ থাকলেও, বাইসন শিকারের শখও প্রবল ছিল সুব্বলের। কারণ সে শিকারি। সেই পরিচয়ই ওর কাছে মুখ্য।
রাকেশের অনিচ্ছা ছিল না। দিনের বেলায় পায়ে হেঁটে গুণ্ডা বাইসন মারার মধ্যে বেশ একটা শিভ্যালরি আছে। একটা ভালো-লাগা আছে। সে বাইসন তিন-তিনজন ফরেস্ট গার্ডকে গাছের সঙ্গে থেঁতলে দিয়েছে। এমনকী সেদিন পূর্ণাকোটের লোভরা বাসের পেছনেও সে নাকি শিং উঁচিয়ে তেড়ে গেছিল। কাজেই এ একটা চ্যালেঞ্জ।
শহরে বন্দরের জীবনে আজকাল আর কোনো চ্যালেঞ্জ নেই–আজকাল শিভ্যালরি দেখাবার কোনো পথ নেই। নিজের বোনকে অন্যে অসম্মান করলে বড়োজোর একটি আবেদনপত্র নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের কাছে ছুটতে হবে-পকেট থেকে পিস্তল বের করে সে শুয়োরের মাথা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। সমাজ বলবে–সেটা বর্বরতা। পিস্তল ছোঁড়াটা বর্বরতা, কিন্তু অসম্মান করাটা কী, তার বিচার হবে জ্বালা নিভে যাওয়ার পর।
যেটুকু শিভ্যালরি ওর এখনও অবশিষ্ট আছে কিংবা ও দেখাতে পারে, এই জঙ্গলে পাহাড়ে এসে রাকেশ দেখায়; নিজেও দেখে। নিজে যে একেবারে ক্লীব হয়ে যায়নি, ঘুস আর চাকরি রক্ষার বিনিময়ে সবাই যে সবসময় বুকে হেঁটে হেঁটে চলে, লাথি খেয়ে অপমান সয়ে তবুও যে সকলেই মুখ নীচু করে থাকে না–এইসব মহৎ প্রায়-বিস্মৃত বোধগুলি তার সমস্ত সত্তা ঘিরে আবার ফিরে আসে। মাথার শিরা-উপশিরায় দপদপিয়ে বেড়ায়। তাই ও রাইফেল হাতে পায়ে হেঁটে বাঘ-বাইসনের মুখোমুখি হতে ভালোবাসে। মনে মনে বাঘ-বাইসনকে অনেকের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে–কারণ ওদের মধ্যে কোন ভন্ডামি নেই। ওরা সুন্দর, সরল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। ওরা মারতে জানে এবং মরতেও জানে। মারবার সময় বাহাদুরি নেয় না কারও কাছে, মরবার সময়ও কাঁদে না কারও কাছে।
.
০৫.
গাড়িটাকে ডুঙরি পাহাড়ের নীচে একটি পলাশ গাছের ছায়ায় রেখে, লক করে, ওরা পথ ছেড়ে জঙ্গলের সঁড়িপথে ঢুকে পড়ল। সুব্বল ভালো করে দেখে নিয়েছিল এখান দিয়ে হাতি চলাচলের কোনো রাস্তা নেই–থাকলে এখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা যেত না। ওদের ফিরতে ফিরতে রাতও হয়ে যেতে পারে।
সুব্বল রাকেশের দেওয়া একটি খাকি প্যান্ট পরেছে–গায়ে একটি খাকি ফুলহাতা শার্ট –ওপরে ফুলহাতা সোয়েটার। এবারে দিল্লি থেকে আসার সময় তিব্বতি উদবাস্তুদের তৈরি মোটা একটা ছাই-রঙা ফুলহাতা সোয়েটার নিয়ে এসেছিল রাকেশ সুঝলের জন্য। সুব্বলের হাতে রাকেশের চার্চিল বন্দুক। কাঁধে একটি ঝোলা। তাতে জলের বোতল, দুটি পাঁচ ব্যাটারির টর্চ এবং রেমিংটনের ছোরাটি।
রাকেশ চাপা গরম ব্যারেথিয়ার ট্রাউজার পরেছে। পায়ে গলফ-শু। এই পরেই হাঁটতে ভালো লাগে ওর জঙ্গলে। গায়ে একটি জলপাই-সবুজ উঁচুকলারের গরম কাপড়ের ফুলশার্ট। তার ওপর চামড়ার জার্কিন-বোম সব খোলা আছে। জার্কিনের বুক-পকেটে টোব্যাকোর পাউচ এবং পাইপ দেখা যাচ্ছে। ডানদিকের পকেটে ফোর-সেভেন্টি-ফাইভ ডাবল-ব্যারেলের পাঁচ রাউণ্ড গুলি আছে। পা ফেলার সঙ্গে গুলিগুলো ঝুনুর ঝুনুর করে বাজছে।
রাকেশ দাঁড়িয়ে পড়ে ডাবল-ব্যারেল রাইফেলটা লোড করল, তারপর ডান পকেটে দুটি গুলি রেখে বাঁ পকেটে একটি রাখল। তাতে শব্দটা বন্ধ হল। টুপিটা কপালের একপাশে ঠেলে দিয়ে রাইফেলটাকে কাঁধে ফেলে সুব্বলের পেছন পেছন রাকেশ হাঁটতে লাগল।
বনে-জঙ্গলে শীতের দুপুরের একটি নিজস্ব নির্জন সৌন্দর্য আছে, যে সৌন্দর্য ভাষায় সহজে প্রকাশ করা যায় না। মিষ্টি মিহি রোদ লতাপাতায় পিছলে পিছলে এসে সমস্ত বনে বনে ছড়িয়ে গেছে। কচি শালপাতায় সে রোদ পড়েছে–তাতে এক আশ্চর্য সবুজাভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে–গ্রীষ্মের সকালে স্বচ্ছ জলে চোখ খুলে ডুবসাঁতার দিলে জলের নীচে যেমন সবুজাভা দেখা যায় তেমনি। এখানে ওখানে একটি দুটি রঙিন কাঁচপোকা কুঁই-বুবঁ-পুঁই-ই-ই-ই আওয়াজ করে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাঁশঝোঁপের নীচে নীচে ছাতারে আর বটেরের ঝাঁক খুরখুর খুরখুর করছে। পথ গেছে এঁকেবেঁকে। যেখানে পথ কিছুটা নরম মাটির ওপর দিয়ে ঝরনার ওপর দিয়ে গেছে, সেখানে নানারকম জানোয়ারের পায়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। একদল শম্বর, একটি বড়ো একরা শুয়োর এবং একদল চিতল হরিণীর খুরের দাগ আছে।
টুঙি পাখি মাঝে মাঝে পিটি-টুঙ করে লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে আলোয় ভেসে ভেসে উড়ে বেড়োচ্ছে। দূরের পাহাড়ে কুচিলা গাছে ধনেশ পাখিরা ঝাঁপাঝাঁপি করছিল তার আওয়াজ কানে আসছে।
এখন প্রায় দুটো বাজে। সুব্বল বলেছে, মাইল তিনেক হেঁটে গেলে বাইসন-চরুয়া মাঠে পৌঁছোবে ওরা।
হাঁটতে হাঁটতে রাকেশ বলল, এবার যে মোষ একেবারে চুলই না বাঘে–এ যাত্রায় বাঘ আর মারা হল না, কী বল সুব্বল?
সুব্বল মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, অধৈর্য হবার কিছু হয়নি। আপনারা এখনও পাঁচদিন আছেন। এরমধ্যে বাঘ হয়ে যাবে। বাঘটা প্রকান্ড বড়ো; কমপক্ষে দশ ফিট হবে। হেলাফেলা নয়। বড়ো বড়ো মোষ নিয়ে পাহাড়ের ওপরে চলে যায়। এ বাঘটা মারতেই হবে। নইলে বাবু দিল্লি থেকে এতদূর এলেন–আমাদের বাঘমুন্ডার অপমান হয়ে যাবে যে! এ বাঘ আপনাকে মারতেই হবে।
রাকেশ বলল, দেখা যাক। সব কপাল।
সুব্বল বলল, হবে হবে। কাল আমি গিয়ে ঠাকুরানির ঠাঁইয়ে পুজো চড়িয়ে আসব। আপনি দেখবেন, ঠিক হবে।
রাকেশ একটু পিছিয়ে পড়েছিল পাইপটা ভরতে–পাইপটা ভরে নিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে সুব্বলকে ধরে ফেলল। শুধোল, তুমি এই গুণ্ডা বাইসনটাকে দেখেছ সুব্বল?
হ্যাঁ বাবু।
খুব বড়ো?
না, খুব বড়ো না, মাঝারি। কিন্তু দেখলেই রক্ত পানি হয়ে যায়। তার চোখের এমন চাউনি। ভারি পাজি জানোয়ারটা। প্রথমে সাড়া দেয় না–আড়াল নিয়ে লুকিয়ে থাকে– তারপর মওকা বুঝে আক্রমণ করে–আর যখন তেড়ে ছোটে বাবু–তখন দেখলে মনে হয় রেলগাড়ির ইঞ্জিন পাগলা হয়ে গেছে।
রাকেশ ওর কথা শুনে হাসল। বলল, রেলগাড়ির এঞ্জিন কোথায় দেখলে?
সুব্বল বলল, কেন? ভদ্রক স্টেশনে? সেখানে আমি যে ছ-মাস কাজ করেছিলাম সে বছরের খরার সময়।
রাকেশ বলল, আমাকে আগে মারতে দেবে। মানে আমি যদি আগে দেখতে পাই। তুমি যদি দেখতে পাও আগে এবং আমাকে দেখাবার সময় পাও তো ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দেবে, যাতে আমি প্রথমে রাইফেল দিয়ে মারতে পারি, নইলে তুমিই আগে মেরে দিয়ো পরে যা করার আমি করব।
ঠিক আছে। দু-ব্যারেলেই বল পুরে নিয়েছি।
রাকেশ বলল, বেশ করেছ।
পথের বাঁ-পাশে কতকগুলো উইয়ের ঢিপি–ভাল্লুকে রাতে এসে একটা ভেঙে দিয়ে উই খেয়ে গেছে। আরও এগিয়ে যেতে পথের ওপর অনেকগুলো শজারুর কাঁটা কুড়িয়ে পেল রাকেশ। তিন-চারটি বড়ো বড়ো কাঁটা কুড়িয়ে নিয়ে টুপির ব্যাণ্ডে গুঁজে রাখল–শ্রুতি ফিরলে দেবে বলে।
এবার ওরা যেন গহন জঙ্গল ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা ঘাসের জঙ্গলে প্রবেশ করল। চারিদিকে বড়ো বড়ো পাথর-মাঝে মাঝে কেবল ছোটো বাঁশ ও সাবাই ঘাসের বন। একদল বগারি পাখি ভরর-র-র-র-র ভরর-র-র-র-র করে হাওয়ায়-ওড়া শুকনো পাতার রাশির মতো ঘাসবনের ওপরের আকাশে নেচে নেচে চোখের আড়ালের কোন দূরের ধানখেতে উড়ে গেল। রাকেশ সুব্বলের সঙ্গে সেই ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আবার ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করল। সুব্বল বলল, যদি মারা যায় তাহলে চামড়া ছাড়ানো হবে কী করে বাবু! অত ভারী জানোয়ার তো বাঘমুন্ডা বয়ে নিয়ে যেতে পঞ্চাশ-জন লোক লাগবে।
রাকেশ বলল, থামো তো তুমি, বাইসনের সঙ্গে দেখা নেই–কী করে চামড়া ছাড়ানো হবে সেই ভাবনায় মরলে।
লজ্জা পেয়ে অপ্রস্তুত হাসি হাসল সুব্বল।
এমন সময় ওদের ডানদিকে প্রায় শ-খানেক গজ দূরে একটি গভীর নালায় ভারী কোনো জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ শুনল ওরা। মনে হল কোনো ভারী জানোয়ারের পায়ের চাপে বাঁশ কিংবা শুকনো কাঠ মচমচিয়ে উঠল।
ওরা একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনল, তারপর যেহেতু নালাটি ওদের সমান্তরালে গিয়ে সামনের ঘাস ও বাঁশবনে পড়েছে, ওরা নিঃশব্দে সোজা এগিয়ে যেতে লাগল–জানোয়ার চলা সঁড়িপথটি ধরে।
কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে আর কিছুই দেখতে বা শুনতে পেল না ওরা। এদিকে ঘড়িতে দুটো বেজে গেছে অনেকক্ষণ।
জলের বোতল খুলে রাকেশ একটু জল খেল। তারপর ফিসফিস করে পরামর্শ করল। ওরা ঠিক করল আরও মাইলখানেক এগিয়ে আবার এই পথেই ফিরবে-নইলে সন্ধে হয়ে যাবে এবং সন্ধে হয়ে গেলে এই পথে ফিরতে হবে অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থায়।
সেখান থেকে প্রায় আধমাইল যাওয়ার পরই পথের মাটিতে বাইসনটির প্রকান্ড খুরের দাগ মাঝে মাঝেই দেখা যেতে লাগল। বাইসন হাতির মতো যূথবদ্ধ জানোয়ার। কিন্তু এ পথে কেবলমাত্র একটিই বেশ বড়োমাপের খুরের দাগ বার বার দেখা যেতে লাগল। কোথাও রাস্তা বরাবর–কোথাও কোনাকুনি রাস্তা পার হওয়ার। কোথাও যাওয়ার–কোথাও আসার। সন্দেহ রইল না যে, এই দাগ গুণ্ডা বাইসনটার!
এদিকে রোদের তেজ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলে পাহাড়ে কত শত পোকা-পাখি চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। ময়ূরের কেঁয়া-কেঁয়া রবে দিনান্তবেলার বাঁশি বনে বনে দিকে দিকে ছড়িয়ে যেতে লাগল। হনুমানগুলো হুপ-হাপ করে এগাছ ওগাছ লাফালাফি করে রাতের বিছানা পাতার আয়োজন করতে লাগল।
ওরা সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগল।
পথটা সামনে একটি ঝিরঝিরে ঝরনার ওপর দিয়ে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিয়েছে। সুব্বল আগে আগে যাচ্ছে। রাকেশের রাইফেলটা কাঁধেই ঝোলানো আছে স্লিং-এ। সুব্বল ঠিক যেই ঝরনাটার ওপরে গিয়ে পৌঁছেছে, এমন সময় পথের ডানদিক থেকে, যে দিকে রাকেশ কিছু দেখতে পাচ্ছিল না-সেদিক থেকে পাথরে-পাহাড়ে খুরে খুরে প্রতিধ্বনি তুলে বাইসনটাকে সুব্বলের দিকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে শুনল ও। বাইসনটা নিশ্চয়ই খুব কাছে এসে পড়েছিল এবং নিশ্চয়ই প্রচন্ড বেগে আসছিল–নইলে সুব্বলের মতো অভিজ্ঞ শিকারি থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত না।
রাকেশের মনে কী এক কু ডাক দিল। ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল– সুব্বল সঙ্গে সঙ্গে সুব্বল সংবিৎ ফিরে পেয়ে একলাফে পেছনে এসে মোটা অশোকগাছের আড়ালে চলে গেল এবং প্রায় তক্ষুনি বাইসনটিকে একটি কালো পাথরের স্তূপের মতো শেষবিকেলের আলোছায়ায় দেখা গেল। রাকেশ রাইফেল আগেই কাঁধে তুলে তৈরি ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল। ডান ব্যারেল ফায়ার করার জন্যে সামনের ট্রিগার টেনেছিল, কিন্তু গুলি হল না। কেবল কট করে আওয়াজ হল একটি। ভয়ে রাকেশের রক্ত হিম হয়ে গেল। নতুন-কেনা রাইফেল জিরোয়িং না করে এনেছে–একরাউণ্ডও গুলি ছোড়েনি আগে, খুব অন্যায় করেছে। কিন্তু কেন এমন হল বোঝার আগে বাইসনটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একবার কান দুটি নাড়াল এবং মাথা নীচু করে সোজা রাকেশের দিকে ঝড়ের মতো তেড়ে এল।
রাকেশ মস্তিষ্কচালিত হয়ে করল কি না জানে না–কারণ ওর মস্তিষ্ক যেন তখন ঠিক কাজ করছিল না–ওর দৃঢ় ধারণা হয়ে গেছিল যে, একটি গুলিও ফুটবে না–তবু কাছে আসা বাইসনটির ঘাড়ে নিশানা নিয়ে ও পেছনের ট্রিগারটিও টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বন-পাহাড় গমগমিয়ে তার ফোর-সেভেন্টি-ফাইভ গর্জে উঠল এবং যুগপৎ বাঁ-দিকের অশোকগাছের আড়াল থেকে সুব্বলও বন্দুক দিয়ে গুলি করল। ভরবেগে সামান্য এগিয়ে এসে হুড়মুড় করে একটি প্রচন্ড আওয়াজ করে বাইসনটি সামনে পা-মুড়ে পড়ে গেল। বড়ো বড়ো শিওয়ালা মাথাটা পাথরে আচড়ে পড়ল। সুব্বল পাশ থেকে বলে উঠল, আলো বাপ্পালো।
আরও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে রাকেশ বাইসনটির কাছে এগিয়ে গেল। সুন্দর সুস্থ প্রচন্ড প্রাণশক্তিময় কোনো জন্তু মারার পর প্রত্যেকের মনে যে, মুহূর্তবাহী বেদনা এসে বাসা বাঁধে সেই বেদনা রাকেশের মনে এসে বাসা বাঁধল। ঝরনার পাশের ভিজে মাটি থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোতে লাগল। একটি একলা ঝিনুকঝিঁঝি হঠাৎ ভুল করে ডেকে উঠল– ঝিঁঝির-ঝি। ঝিঁঝি।
রাকেশ রাইফেলের ব্রিচটি খুলে ডান ব্যারেলের না-ফোঁটা কার্তুজটি বের করে দেখল। স্ট্রাইকিং পিনের দাগ আছে–অথচ গুলি ফোটেনি। রাকেশের সন্দেহ হল তবে বোধ হয় ওই গুলিটিই খারাপ ছিল। সন্দেহ ভঞ্জন করার জন্যে রাকেশ ওই গুলিটা বাঁ-দিকের ব্যারেলে পুরে একটি মোটা শালগাছের ওপরের ডালে নিশানা নিয়ে গুলি করল–গমগমিয়ে উঠল আবার বন-পাহাড়। ডালটিকে করাতের মতো চিরে গেল গুলিটা। রাকেশ বুঝল, গুলির দোষ নয়। স্ট্রাইকিং পিনের দোষ। ডান ব্যারেলের স্ট্রাইকিং পিন ঠিকমতো গুলিতে স্ট্রাইক করছে না। মহা অস্বস্তির কথা। বিপদের সময় লোকে সামনের ট্রিগারই আগে টানে, আর এই রাইফেল শুধু বিপজ্জনক জানোয়ারের ওপর ব্যবহার করার সময়েই দরকার। অথচ জেরি ক্যালানের হাতের রাইফেল। এমন কেন হল বুঝল না রাকেশ।
সুব্বল এগিয়ে এসে শিংটায় হাত দিয়ে দেখল। মাথাটি রীতিমতো ম্যাসিভ। কপালের মাঝে সাদা চাঁদ–পায়ে সাদা লোমের মোজা।
রাকেশ ভাবছিল, বাঘমুন্ডায় ফিরে কিছু লোক এনে সকলে মিলে বনে আগুন জ্বেলে রাতে-রাতেই চামড়া ছাড়াতে হবে। চামড়া ছাড়াতে ছাড়তে রাত কত হবে কে জানে।
টুপিটা মাথা থেকে খুলে একটি উঁচু পাথরের ওপরে এলিয়ে বসে পা-দুটি সামনে ছড়িয়ে দিয়ে রাকেশ পাইপটা ধরাল।
সুব্বল বললে, তোমার জন্যে আমার পাঁচশো টাকা রোজগার হল বাবু। বলে সে দু-হাত একসঙ্গে করে ওরা যেমন করে প্রণাম করে তেমনি করতে গেল। রাকেশ বাধা দিয়ে বলল, আহা সুব্বল, কী হচ্ছে কী?
সন্ধের সামান্য দেরি ছিল। কিন্তু পশ্চিমদিকে উঁচু পাহাড় থাকাতে সূর্য তার আড়ালে পড়ে গেছিল। তাই ঝরনতলায় সন্ধের সায়ান্ধকার নেমে এসেছিল। পাহাড়ের ওপর দিয়ে গোলাপি আকাশ দেখা যাচ্ছিল। একসারি ছোটকি ধনেশ কিছুক্ষণ পাখা নাড়িয়ে কিছুক্ষণ ভেসে ভেসে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে রাতের আশ্রয়ে ফিরছিল।
কার দুটি অদৃশ্য ঠাণ্ডা হাত আসন্ন রাতের বার্তা বয়ে এনে রাকেশের দু-কাঁধে চেপে বসছিল। শেষবিকেলে সেই দলতাড়িত বিক্ষুব্ধ বোবা বাইসনের নিথর মৃতদেহটি থেকে একটি নিস্তব্ধ বিষণ্ণ কান্না উঠে সমস্ত বিধুর বনস্থলিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। ময়ূরের কেঁয়া রবে সেই কান্না অরণ্যে কন্দরে বারে বারে অনুরণিত হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর ওরা দুজনে গাড়ির দিকে ফিরে চলল। অনেকখানি পথ যেতে হবে। জঙ্গলের মধ্যে তখন অন্ধকার। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ এবং পথের এপাশ-ওপাশ দেখে নিতে হচ্ছিল। মাইল দুয়েক হেঁটে প্রায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা দুজনে। ততক্ষণে গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। হঠাৎ রাকেশকে ভীষণ চমকে দিয়ে রাস্তার উলটোদিকের একটা ঝাঁকড়া শিশু গাছ থেকে কিরি-কিরি-কিরি-কিরি-কিরি ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ এইরকম একটা আচমকা আওয়াজ শোনা গেল। প্রথমেই ওরা দুজনেই চমকে উঠেছিল। পরক্ষণেই সুব্বলের হাত থেকে টর্চটা প্রায় কেড়ে নিয়ে রাকেশ দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে সেই গাছটিতে আলো ফেলল। নিশ্চয়ই কোনো পাখি এমন শব্দ করে–যে শব্দকে রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘে-ভরা কালাহাণ্ডির জঙ্গলের আদিবাসীরা বাঘ্বডুম্বার ডাক বলে জানে। না:, তন্ন তন্ন করে খুঁজল গাছটিতে রাকেশ। কোনো পাখি দেখতে পেল না। হয়তো ভেতরের ডালের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। আর কিছুই শোনা গেল না। চারপাশে কেবল ঝিঁঝি ডাকতে লাগল ঝিঁঝির ঝিঁঝিঝির ঝি।
রাকেশ টর্চটা সুব্বলকে ফেরত দিয়ে গাড়ির চাবি খুলে স্টিয়ারিং-এ বসতে বসতে সুব্বলকে শুধোল–এটা কী পাখি?
ও বলল, জানি না তো?
জানি না মানে? এরকম কোনো পাখির ডাক আগে শোনোনি?
সুব্বল অনেক চিন্তা করে বলল, নাঃ, ঠিক এমনটি তো আর শুনিনি।
রাকেশ শুধোল, তবে কেমন শুনেছ? এর কাছাকাছি?
সুব্বল জিভ দিয়ে আওয়াজ করল–দুর দুর দুর দুর-দুরগুম দুরগুম।
রাকেশ বলল, দুর, সে তো পেঁচার ডাক।
এবার সুব্বল রাকেশকে উলটো প্রশ্ন করল–এটা তবে কীসের ডাক?
রাকেশ একবার অন্ধকারে সুব্বলের মুখের দিকে তাকাল, তারপর ভেবে দেখল সুব্বলকে বাঘ্বডুম্বার কথা বলাটা ঠিক হবে না। ও যদি অন্যদের গল্প করে তবে হয়তো আজ রাতে বাইসনের চামড়া ছাড়াতে আসার লোকই পাওয়া যাবে না। রাকেশ বলল, এও একরকমের পেঁচা। অন্যরকম পেঁচা।
রাকেশের মনে পড়ল, গত বছর নভেম্বর মাসে ওড়িশার কালাহাণ্ডির অরাজোর, অরাটাকরি, রামপুর, লেলিমা ইত্যাদি গভীর জঙ্গলের আদিবাসীরা রাকেশকে এই বাঘ্বডুম্বার কথা প্রথমে বলেছিল। ওরা বিশ্বাস করে, যে পুরুষ কি নারী বাঘের হাতে নিহত হয় তারা এমনি জঙ্গলে-পাহাড়ে রাতবিরেতে কিরি কিরি কিরি কিরি কিরি, ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ করে গাছ থেকে গাছে ডেকে বেড়ায়। তাদের অশান্ত আত্মা গভীর বনে বনে কেঁদে কেঁদে নিশ্বাস ফেলে।
রাকেশ জানে, ঠিকই জানে যে, এ নিশ্চয়ই কোনো অদ্ভুত নিশাচর পাখির ডাক হবে, জিম করবেটের চুরাইলের মতো, যে পাখিরা দিনের বেলায় দেখা দেয় না হয়তো, হয়তো কোনো বড়ো গাছের মগডালের কোটরে শুয়ে থাকে এরা–যেহেতু তাদের চেহারা কেউ দেখেনি রাতের অন্ধকারে বনে-পাহাড়ে, ওরা এইরকম ব্যাখ্যা করেছে এই ডাকের। কিন্তু রাকেশ আবার ভাবল, অত ভালো করে পাঁচ ব্যাটারির টৰ্চটি ফেলে দেখল–পাখিটাকে দেখতে পাওয়া উচিত ছিল। কী কারণে জানে না, এত বছর বনে-জঙ্গলে রাতের পর রাত ঘুরেছে, রাকেশের কোনোদিন এমন হয়নি, জঙ্গলের পথে গাড়ি চালিয়ে বাঘমুন্ডা যেতে যেতে ওর গা টা কেমন ছমছম করে উঠল।