১. পিপুলের জীবনটা

পিপুল – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পিপুলের জীবনটা নানা গন্ডগোলে ভরা। সেই সব গন্ডগোলের বেশির ভাগই সে নিজে পাকায়নি, কিন্তু তাকে নিয়ে গন্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে। তার মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে তার মা গলায় দড়ি দিয়ে মরে। বলাই বাহুল্য মায়ের আত্মহত্যার পিছনে প্রত্যক্ষ হাত না থাক, পরোক্ষ ইন্ধন ছিল তার মাতাল ও ফুর্তিবাজ বাবার। কিন্তু কিছু লোক থাকে, এমনিতে খুব গভীরভাবে খারাপ নয়, কিন্তু স্বভাবের চুলকুনির ফলে নানা অকাজ করে ফেলে। পিপুল যতদূর জানে, তার বাবা ভীতু ধরনের লোক, বউকে যথেষ্ট ভয় খেত এবং রোজ মদ ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করত। নিরীহ হলেও মদ খেলে লোকটা একেবারে বাঘ হয়ে উঠত, তখন হম্বিতম্বি ছিল দেখার মতো। যাই হোক, নিত্য মদ নিয়ে এবং মদজনিত অশান্তি ছাড়াও সংসারে আরও বিস্তর খটামটি ছিল। সেসব অভাবজনিত নানা আক্রোশ আর ক্ষোভের প্রকাশ। তা ছাড়া দুই পরিবারের মধ্যেও বড়ো একটা সদ্ভাব ছিল না। বিয়ের সময়ে দানসামগ্রী ইত্যাদি এবং মেয়ের বাড়ির একটা গুপ্ত কলঙ্ক নিয়ে বিস্তর ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল। ফলে পিপুলের সঙ্গে তার মামাবাড়ির সম্পর্ক ছিল না।

মা মরার পর, মামারা পুলিশ নিয়ে এসে বাড়ি ঘিরে তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। পিপুলদের লোকবল, অর্থবল বিশেষ ছিল না। তবে তার ঠাকুর্দা এবং একমাত্র কাকা উকিল টুকিল লাগাল ঘটিবাটি বেচে। তার বে-আক্কেলে বাবা ছাড়া পেয়ে দিগ্বিজয়ীর মতো হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। যার বউ সবে মরেছে তার যে হাসিখুশি হওয়া উচিত নয় এই বুদ্ধিটুকুও কেউ দেয়নি তাকে। এই সহজে রেহাই পাওয়া ইদানীং হলে হত না। ইদানীং বউ মরলে স্বামীকে দেশছাড়া হতে হয়, নইলে থানা-পুলিশ নাকাল করে মারে। তার বাবা অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়াটা কাটিয়েই কদিন খুব ফুর্তি করল। তখন পিপুল তার কাকিমার কাছে খানিকটা লাথি-ঝাঁটা খেয়েই পড়ে আছে। কাকিমার দোষ নেই, তার অনেক কটা ছেলেপুলে, অভাবের সংসার, তার ওপর মাতাল ভাশুর। পিপুল একটু দুষ্টুও ছিল বটে, কাকা দাদু বাবা সবাই তাকে প্রায় পালা করে পেটাত।

এইভাবে সে তার জীবনের গন্ডগোলগুলো টের পেতে শুরু করে।

মা-মরা ছেলেদের অনেক সমস্যা থাকে। পিপুলেরও ছিল। কিন্তু সে-সব গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছিল তার। সংসারে কারো কাছে ভালো ব্যবহার পেত না বলে ঘরের চেয়ে বাইরেটাই ছিল তার প্রিয়। সারাদিন স্কুল ছাড়া তাকে দেখা যেত রাস্তায় ঘাটে, নদীর ধারে, মাঠে জঙ্গলে।

ওদিকে বাবার অবস্থা ক্রমশ সঙ্গিন হয়ে উঠছে। টাকা-পয়সা যা রোজগার করে তা উড়িয়ে দেয় হাজারো ফুর্তিতে। যে বাপ টাকা দেয় না, তার ছেলের দুর্দশা তো সবাই জানে। কাকা কাকিমা আর দাদু মিলে তাকে রোজ বিস্তর খারাপ কথা শোনাত।

একদিন পয়সার অভাবে তার বাবা তাকে কাজে লাগানোর একটা উদ্ভট চেষ্টা করেছিল।

সেটা রবিবারই হবে। সকাল বেলায় তার বাবা তাকে ডেকে খুব হাসি-হাসি মুখে বলল, ওরে পিপুল, মামাবাড়ি যাবি?

পিপুল অবাক হয়ে বলে, মামাবাড়ি! সেখানে কে আছে?

আছে রে আছে। তাদের মেলা পয়সা হয়েছে। যাবি?

গিয়ে?

গিয়ে? গিয়ে মামা, মামি, মাসি, দাদু, দিদাদের একটু পেন্নাম করে আসবি। তোর দিদিমা খুব ভালো লোক। খুব চুপিচুপি তোর দিদিমার কানে কানে একটা কথা বলবি। বলবি, তোর মায়ের গয়নাগুলো যেন তোর কাছে দিয়ে দেয়।

গয়না! বলে হাঁ করে চেয়েছিল পিপুল।

তোর মা গলায় দড়ি দেওয়ার আগে গয়নাগুলো সব সরিয়ে ফেলেছিল। মনে হয় তোর দিদিমার কাছেই গচ্ছিত রেখে এসেছিল। ওগুলো পেলে এখন আমরা বাপ-ব্যাটায় একটু খেয়ে-পরে থাকতে পারি। তোর মামাবাড়ির অনেক পয়সা। হাত ঝাড়লেই পর্বত। ছেঁড়া জামাটামা পরে নিস, তাহলে তাদেরও একটু মায়া হবে।

পরদিন ছেঁড়া আর ময়লা জামা পরিয়ে, খালি পায়ে হাঁটিয়ে তাকে নিয়ে তার বাবা শ্বশুরবাড়ি চলল। লোকাল ট্রেনে মিনিট পনেরোর পথ। স্টেশন থেকে রিকশায় অনেকখানি। মামাবাড়ি থেকে দু ফার্লং দূরে রিকশা থেকে নেমে পড়ল তারা।

বাবা বলল, ওই সোজা রাস্তা। একটু এগিয়ে প্রথম ডানহাতি রাস্তায় ঢুকলেই দেখতে পাবি, সামনে পুকুরওলা পুরোনো বাড়ি। সোজা ঢুকে যাবি ভিতরে।

পিপুল কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, কাউকে চিনি না যে!

দুর বোকা! চেনাচেনির কী আছে? গিয়ে বলবি আমি অমুকের ছেলে। আমার নামটা বলবার দরকার নেই, মায়ের নামটাই বলিস। মা-মরা ছেলে তুই, তোকে আদর-যত্নই করবে মনে হয়। তবে আদরে কাজের কথাটা ভুলে যাস না বাবা। গয়নার কথা মনে আছে তো! খুব চুপিচুপি দিদিমাকে বলবি, আর কাউকে নয়। আমি এই যে চায়ের দোকানটা দেখছিস, এখানেই থাকব। কাজ হয়ে গেলে এখানে এসে ডেকে নিবি। আর শোন, আমি যে সঙ্গে আছি একথা খবর্দার বলিস না কাউকে!

ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নিয়ে পিপুল অনিচ্ছের সঙ্গেই পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। তার বুকটা দুরদুর করছিল। মামাবাড়ির কাউকেই সে ভালো চেনে না। কোন শিশুকালে মায়ের সঙ্গে আসত, কিছু মনেই নেই তেমন।

পুকুরওলা বাড়িটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না। পুকুরের পাশ দিয়ে একটা ইট-বাঁধানো সরু পথ। সেই পথ একটা পুরোনো পাকা বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাড়িটা বেশ বড়ো এবং দোতলা। লাল রঙের। বাগান আছে, কয়েকটা নারকেল আর সুপুরির গাছ আছে।

পিপুল খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। খিদেয় তেষ্টায় বড়ো নেতিয়ে পড়েছে সে। ও বাড়িতে গেলে খেতে দেবে কিনা সেইটেই ভাবছিল সে। আবার ভাবছিল, যদি তাড়িয়ে দেয়!

পুকুরে একজন বউ-মানুষ চান করছিল। ভরদুপুরে আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। বউ মানুষটি স্নান সেরে বাড়ির পাকা ঘাটলায় উঠে গামছা নিংড়োতে নিংড়োতে তার দিকে চেয়ে বলে, এই ছোঁড়া, তখন থেকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস ড্যাবড্যাব করে? চুরিটুরির মতলব আছে নাকি? যাঃ এখান থেকে।

পিপুল ভয় খেয়ে গেল। তারপর করুণ গলায় বলল, আমি গিরীশ রায়ের বাড়ি যাব।

কেন রে, সেখানে তোর কি?

পিপুল বলল, সেটা আমার মামাবাড়ি।

মামাবাড়ি! বলে বউটি অবাক, এটা তোর মামাবাড়ি হল কবে থেকে রে ছোঁড়া? চালাকি করছিস?

আমার দাদুর নাম গিরীশ রায়।

 বউটা এবার ধমকাল না। খুব ভালো করে তার দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বলল, শ্রীরামপুর থেকে আসছিস নাকি?

হ্যাঁ।

তোর বাবার নাম হরিশচন্দ্র?

 পিপুল অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ।

কী চাস এখানে? কে তোকে পাঠাল?

বাবার শেখানো কথা সব ভুলে গেছে পিপুল। কিন্তু বেফাঁস কথাও যে বলা চলবে না এ বুদ্ধি তার ছিল। সে বলল, আমার বড়ো জলতেষ্টা পেয়েছে। একটু জল দেবেন?

তেষ্টার কথায় সবাই নরম হয়। বউটাও হল। বলল, আয় আমার পিছু পিছু।

বাড়ির ভিতরে মস্ত ঝকঝকে উঠোন। তাতে ধান শুকোচ্ছে। বেশ কয়েকটা মাড়াই আর খড়ের গাদা। বউটা উঠোনে পা দিয়েই হঠাৎ পাড়া মাত করে চেঁচিয়ে উঠল, দেখেছ তোমরা, কে এসে উদয় হয়েছে। ওই যে খুনে হরিশচন্দ্রের ব্যাটা। নিশ্চয়ই ওই মুখপোড়াই নিয়ে এসেছে।

চেঁচামেচিতে লোকজন বেরিয়ে এল। একজন বুড়ো মানুষ, জনাতিনেক পুরুষ। সকলের চোখ তার দিকে।

পুরুষদের মধ্যে চোয়াড়ে চেহারার একজন বারান্দা থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়াল। কড়া গুল্লু গুল্লু চোখে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, কার ব্যাটা তুই?

আমার বাবার নাম শ্রীহরিশচন্দ্র ঘোষ।

 ও বাবা! বাপের নামের আগে আবার শ্রী লাগায় দেখছি। তোর মায়ের নাম কি?

আশালতা ঘোষ।

বারান্দা থেকে সেই বুড়ো লোকটি বলল, অত জিজ্ঞাসাবাদের দরকার নেই। মুখে ওর মায়ের মুখের আদল আছে।

পিপুলের ভারি ভয় আর অপমান লাগছিল। বাবা তাকে এ কোন শত্ৰুপুরীতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল।

চোয়াড়ে লোকটা বলল, কে তোকে এ বাড়িতে পাঠিয়েছে?

পিপুল কাঁদো-কাঁদো হয়ে মিথ্যে কথাটা বলে ফেলল, কেউ পাঠায়নি।

তুই নিজেই এসেছিস? একা?

পিপুল মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।

 তোর বয়সি ছেলে শ্রীরামপুর থেকে এখানে একা আসতে পারে?

পিপুল চুপ করে থাকল।

কী চাস তুই?

পিপুল মুখস্থ-করা কথাগুলো বলে গেল, আমি মা-মরা ছেলে। বাড়িতে খুব অনাদর। আমার একটু আশ্রয় হলে ভালো হয়।

কাল রাতে তার বাবা তাকে এ কথাগুলোই শিখিয়ে দিয়েছিল। মুখস্থও সে ভালোই বলেছে। কিন্তু হঠাৎ চটাস করে একটা চড় যে কেন এ সময়ে তার গালে এসে পড়ল কে জানে!

বুড়ো লোকটি বলল, আহা, মারিস কেন?

চোয়াড়ে লোকটা বলে, মারব না? কেমন যাত্রার পার্টের মতো শেখানো কথা বলছে দেখো! মা-মরা ছেলে, অনাদর, আশ্রয়–এসব মুখ থেকে কখনো বেরোয়? এই ছোঁড়া, কে তোকে এখানে এনেছে সত্যি করে বল!

মারধরে কিছু হয় না পিপুলের। নিজের বাড়িতে নিত্যই মার খায় সে। রাস্তায়-ঘাটেও ছেলেদের সঙ্গে তার নিয়মিত মারপিট হয়। স্কুলে মাস্টারমশাইরা ঠেঙিয়ে তার ছাল তুলে দেন মাঝে মাঝে। চড়টা খেয়েও তাই সে দমেনি। কিন্তু বাবার কাজটা যে হবে না সে বুঝতে পারছিল। সে চোয়াড়ে লোকটার দিকে চেয়ে সত্যি কথাই বলল, বাবা নিয়ে এসেছে আমাকে।

চোয়াড়ে লোকটা লাফিয়ে উঠে বলল, কোথায় সেই শয়তানটা? আজ ওটাকে পুকুরের কাদায় পুঁতে রাখব। লাশটাও কেউ খুঁজে পাবে না। বল ছোঁড়া, কোথায় খুনে বদমাশটা?

পিপুল মাথা বাঁচাতে বলে ফেলল, একটা চায়ের দোকানে বসে আছে। মোড় পেরিয়ে বাঁ দিকে।

চোয়াড়ে লোকটা সঙ্গেসঙ্গে দুই লম্ফে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর যা হয়েছিল তা দেখেনি পিপুল। তবে শুনেছে। তার মেজো মামা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাঁকে-ডাকে লোক জোগাড় করে চায়ের দোকান থেকে তার বাপকে টেনে বের করে হাটুরে মার মারে। হাসপাতালে দিন পনেরো পড়ে থাকতে হয়েছিল তার বাপকে। পুলিশ-কেস হয়েছিল। বিরাট গন্ডগোল।

কিন্তু ইতিমধ্যে পিপুলের যা হয়েছিল সেইটেই আসল কথা। মামা বেরিয়ে যাওয়ার পরই দাদামশাই অর্থাৎ সেই বুড়ো মানুষটি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগলেন, ওরে কি জানি কোন খুনোখুনি হয়ে যায়! ওরে তোরা দেখ, কালীপদর মাথা তো গরম, কী কান্ড করে ফেলে!

দাদামশাইয়ের চেঁচামেচিতে কয়েকজন মহিলা নানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁদের মধ্যে একজন পাকাচুলো বুড়ি। পরে জেনেছে সে-ই দিদিমা। তবে দাদু দিদিমা মাসি মামি সব কেমন হয় তা তো জানা ছিল না পিপুলের। সে হাঁ করে এঁদের দেখতে লাগল।

দিদিমা তার দিকে চেয়ে বলল, এ ছেলেটা কে?

দাদু বলল, তোমার নাতি গো, চিনতে পারছ না? আশার মুখ একেবারে বসানো!

 দিদিমা ভারি অবাক, আশার ছেলে? এর নামই তো পিপুল।

তা হবে। নাম-টাম জিজ্ঞস করা হয়নি। ওদিকে কালীপদ যে কোন সর্বনাশ করতে বেরিয়ে গেল কে জানে! এর বাপটাকে বোধ হয় ঠেঙিয়েই মেরে ফেলবে। হাতে না হাতকড়া পড়ে।

পিপুলকে কেউ ডাক-খোঁজ করল না। আর বাড়িসুষ্ঠু লোক বেরিয়ে গেল পুকুরধারে, কী কান্ড হচ্ছে তা দেখতে। পিপুলেরই শুধু দেখতে ইচ্ছে হল না সে উঠোনের কুয়োতলায় গিয়ে কপিকলে বাঁধা বালতি ফেলে জল তুলল। তারপর হাতের কোষে জল ঢেলে গলা অবধি জল খেল।

মনটা ভালো ছিল না তার। বাপের সঙ্গে যদিও তার বিশেষ আদর-আশকারার সম্পর্ক নেই, তবু ওই লোকটা ছাড়া তার কে-ই বা আছে? দাদু কাকা সবাই তাকে মারে। মারে বাবাও। তবে কিছু কম। আর সে এটা জানে যে, দুনিয়ার কোনো রহস্যময় কার্যকারণে এই বাপ লোকটার সঙ্গেই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

বারান্দায় উঠতে তার সাহস হল না। সে কুয়োতলার পাশে একটা আতা গাছের ছায়ায় বসে রইল উবু হয়ে। বাইরে কী হচ্ছে তা দেখতে গেল না। শুনতে পেল, কোনো ঘরে একটা বাচ্চা খুব চেঁচিয়ে কাঁদছে। খুব কাঁদছে। বোধহয় চৌকি বা খাট থেকে পড়ে-উড়ে গেছে।

একটু অপেক্ষা করে পিপুল ওই বিকট কান্নাটা আর সহ্য করতে পারল না। উঠে পায়ে পায়ে সে এগোল। বারান্দায় উঠে যে-ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছিল সেই ঘরে উঁকি মেরে দেখল, চার-পাঁচ মাস বয়সের একটা বাচ্চা সত্যিই খাটের নীচে মেঝেয় পড়ে আছে। ইট দিয়ে বেশি উঁচু-করা খাট। বাচ্চাটা পড়ে কপাল ফাটিয়েছে, মুখ নীল হয়ে গেছে ব্যথায়।

পিপুল গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে বিছানায় শোয়াতে যাচ্ছিল, ঠিক এ সময়ে হুড়মুড় করে একটা বউ এসে ঢুকল। তার চোখ কপালে, মুখ হাঁ-করা চুল উড়ছে। ঢুকেই বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, অ্যাই, কী করছিলি এ ঘরে? অ্যাঁ, কী করছিলি? মেরে ফেলেছিস আমার ছেলেটাকে!

পিপুল বলল, না তো। এ পড়ে গিয়েছিল।

খপ করে বাচ্চাটাকে তার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বউটা পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল, ওগো, দেখো কী সাংঘাতিক কান্ড! ঘরে ঢুকে বাচ্চাটাকে আছাড় মেরেছে…

আবার একটা চেঁচামেচি উঠল, লোকজন দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।

তারপর যে কী কান্ড হল তা ভালো করে আজ আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, সবাই মিলে তাকে এমন মারতে লাগল চারধার থেকে যে সে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে পড়ে গেল।

জ্ঞান ফিরল কুয়োর ধারে। কুয়োতলায় তাকে শুইয়ে জল ঢালা হচ্ছিল মাথায় আর গায়ে। সারা গা ভিজে সপসপে। জ্ঞান হতেই টের পেল তার মাথায় আর শরীরে ব্যথা আর জ্বলুনি। মাথার চুল বোধহয় কয়েক খাবলা উঠে গেছে। কান কেটে, কপাল ফেটে রক্ত পড়েছে। হাতে-পায়ে ঝনঝন করছে ব্যথা।

চোখ চেয়েই সে আতঙ্কের গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।

 সামনে সেই চোয়াড়ে লোকটা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখ। লোকটার পিছনে পাড়াসুদ্ধ লোক জড়ো হয়েছে।

কে একজন বলল, এ কি আপনার ভাগ্নে?

চোয়াড়ে লোকটা অর্থাৎ কালীপদ তেজের গলায় জবাব দিল, কীসের ভাগ্নে মশাই? ভাগ্নে ফাগ্নে এখন ভুলে যান। বাপ যেমন শয়তান, ছেলে তার চেয়ে কম যায় না। হরিপদর ছেলেটাকে আছাড় মেরে খুন করতে গিয়েছিল–চুরিটুরিরও মতলব ছিল বোধহয়।

সেই লোকটা বলল, সে যাই বলুন, কাজটা আপনারা ভালো করছেন না। বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এর বাপকে তো হাসপাতালে পাঠালেন। যা মার মেরেছেন তাতে ফিরলে হয়। তার ওপর এই একফোঁটা ছেলেটাকে হাটুরে মার দেওয়া হল, আপনারা তো পাষন্ড মশাই।

কালীপদ এ কথায় লাফিয়ে উঠে লোকটার দিকে তেড়ে গেল, ওঃ, খুব যে দরদ দেখছি। যখন এর বাপ আমার বোনটাকে গলা টিপে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল তখন কোথায় ছিলেন?

কালীপদ যে গুন্ডা লোক তা বোঝা গেল সেই প্রতিবাদকারী চুপ করে যাওয়ায়।

কালীপদ বলল, দরদি ঢের দেখা আছে। বেশি ফোপরদালালি করতে এলে মজা বুঝিয়ে দেব।

পিপুল আতঙ্কিত চোখে চারদিকে চেয়ে দেখছে। এরা তাকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। উঠে একটা দৌড় লাগাবে? কিন্তু শরীর এমন নেতিয়ে পড়েছে যে, উঠে দাঁড়ানোর সাধ্যই নেই!

কালীপদ তার দিকে কটমট করে এমন চেয়েছিল যে পিপুলের রক্ত জল হওয়ার উপক্রম। মারের চোটে ইতিমধ্যেই সে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছে। আর তার ভীষণ জলতেষ্টা পাচ্ছে।

কালীপদ কড়া গলায় বলল, এবার বলবি তোর মতলবখানা কী ছিল?

 পিপুল কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আর কখনো আসব না।

কিন্তু এসেছিলি কেন?

আমি আসতে চাইনি। বাবা জোর করে এনেছিল।

কালীপদর চোয়ালটা আবার শক্ত হল। বোধহয় আরও একটা চড় মারার জন্যই হাতটা তুলেছিল সে। এমন সময় বারান্দা থেকে একজন বুড়ি চেঁচিয়ে বলল, ওরে ও কালী, এরপর মানুষ-খুনের দায়ে পড়বি যে! অনেক হয়েছে। এটা গেরস্তবাড়ি, রাজ্যের লোক ঢুকে পড়েছে তামাশা দেখতে। ওসব হুড়যুদ্ধ এবার বন্ধ কর বাবা। ওই একফোঁটা ছেলেটাকে আর কত মারবি।

কালী চড়টা মারল না। তবে আরও কিছুক্ষণ তড়পাল। তারপর চাকর গোছের একটা লোককে ডেকে বলল, অ্যাই গোপলা, এটাকে নিয়ে চোরকুঠুরিতে পুরে রাখ। খবর্দার, কিছু খেতেটেতে দিবি না। জল অবধি নয়।

তার মামাবাড়ি পুরোনো আমলের। হয়তো একসময়ে অবস্থা খুবই ভালো ছিল। মাটির নীচে মেটে জলের জালা রাখার মস্ত ঘর আছে। গোপাল তাকে ধরে নিয়ে সেই অন্ধকার পাতাল ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

ভারি স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারও বটে। পিপুল শরীরে মারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানে মেঝেয় পড়ে কাঁদতে লাগল। পেটের খিদে, গলার তেষ্টা তো ছিলই। আর ছিল অপমান আর লাঞ্ছনা। নিজের বাড়িতেও তার আদর নেই বটে, কিন্তু সেখানে এই হেনস্থা তার কখনো হয়নি।

কাঁদতে কাঁদতে পিপুল অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা কত হল, দিন গিয়ে রাত এল কিনা সে জানে না, তবে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখল, তার সামনে লণ্ঠন হাতে একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে। সেই বুড়িটাই যে তাকে আর মারতে কালীপদকে নিষেধ করেছিল।

বুড়ি বলল, তুই কি পিপুল?

পিপুল ভয়-খাওয়া গলায় বলে, হ্যাঁ।

আমি তোর দিদিমা, জানিস?

দিদিমা-টিদিমা পিপুলের কাছে কোনো সুখের ব্যাপার নয়। সে বুঝে গেছে মামাবাড়ির পাট তার চুকে গেছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, আপনাদের পায়ে পড়ি।

তুই কি বাচ্চাটাকে সত্যিই আছাড় মেরেছিলি?

 পিপুল সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না, আছাড় মারব কেন? বাচ্চাটা খাট থেকে পড়ে গিয়ে ভীষণ কাঁদছিল, আমি গিয়ে কোলে নিয়েছিলাম।

দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাই হবে। তোর কপালটাই খারাপ। ছোটো বউ এমন চেঁচামেচি করল যে সকলে ধরে নিল, আছাড় মেরে ছেলেটাকে তুই মেরে ফেলতে চেয়েছিলি। এ বাড়িতে যে কী অশান্তি রে ভাই, কী আর বলব! খুব মেরেছে তোকে, না?

পিপুল এসব আদুরে কথায় আর বিশ্বাস করে না। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন, নাকে খত দিচ্ছি, আর আসব না কখনো।

ছেড়ে দেবেটা কে? কালীপদকে তো চিনিস না! কুরুক্ষেত্র করবে। এখন ও বাড়িতে নেই। ফিরতে রাত হবে। কোন মূর্তি নিয়ে ফিরবে কে জানে বাবা!

এ-কথা শুনে পিপুল ফের কাঁদতে লাগল। মনে হচ্ছিল, এই পাতালঘর থেকে আর সে কোনো দিন বেরোতে পারবে না। কাঁদতে গিয়ে দেখল তার হিক্কা উঠছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।

দিদিমা উবু হয়ে তার কাছে বসে গায়ে হাত দিয়ে বলল, শোন ভাই, এ বাড়িতে আমিও বড় সুখে নেই। দিন-রাত ভাজা-ভাজা হচ্ছি, কেন যে প্রাণটা আজও ধুকপুক করছে তা বুঝি না। সংসার তো নয়, আস্তাকুঁড়!

আমি বাড়ি যাব।

আমাদের ক্ষমতা থাকলে কি এ সংসারে এভাবে পড়ে থাকতুম!

আমি তো বাচ্চাটাকে ফেলিনি। কিছু তো চুরিও করিনি। তবে কেন আমায় আটকে রাখছেন?

তোর দোষ নেই জানি। কিন্তু তোর বাবা বড্ড খারাপ যে, ওর জন্যই তো মেয়েটা মরল। তাই তোদের ওপর সকলের রাগ। বেঁচে যখন ছিল তখনও বাপের বাড়িতে আসতে দিত না।

আমাকে কি আপনারা আরও মারবেন? আর মারলে কিন্তু আমি মরেই যাব। দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সবই ভবিতব্য রে ভাই। মারলেও কী আটকাতে পারব! আমার কথা কে শুনবে বল!

পিপুলের কান্না থামছিল না। ভয়ে বুকটা বড্ড দুরদুর করছিল। আরও মারবে? কিন্তু কেন মারবে সেটাই যে সে বুঝতে পারছে না!

দিদিমা তার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে বলল, শোন ভাই, এখন যদি তোকে ওপরে নিয়ে যাই তাহলে সবাই দেখতে পাবে। কথাটা কালীরও কানে যাবে। তুই বরং মটকা মেরে পড়ে থাক, আর একটু রাত হলে আমি চুপিচুপি আসবখন।

আমার যে বড্ড ভয় করছে!

এই লণ্ঠনটা রেখে যাচ্ছি। এখানে ভয়ের কিছু নেই। এ ঘরটা বেশ পরিষ্কার আছে। তোর কি ভূতের ভয়?

না, আমার এমনিই ভয় করছে।

 এইটুকু তো তোর বয়স, ভয় তো করবেই। তবু আর একটু কষ্ট কর দাদা। বেশিক্ষণ নয়। এ বাড়ির সবাই রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ে। শুধু ভয় কালীপদকে। তার একটু রাত হয় শুতে। তাই চুপটি করে পড়ে থাক। আর এই জলের ঘটিটা রাখ, আর দুটো বাতাসা। চুপটি করে এনেছি। ওদিকে একটা জালা আছে, ঘটিটা ওর পিছনে লুকিয়ে রাখিস।

দিদিমা চলে গেল। পিপুল তার প্রচন্ড তেষ্টা মেটাতে জল খেতে গিয়ে বিষম খেল। তারপর সবটুকু জলই প্রায় খেয়ে ফেলল। তারপর বড়ো বড়ো চারখানা বাতাসা চিবোল গোগ্রাসে। জীবনে যেন এত সুস্বাদু খাবার সে আর খায়নি।

খানিক জেগে, খানিক ঘুমিয়ে কতটা সময় পেরোল কে জানে! তবে এক সময়ে তার অপেক্ষা শেষ হল। ওপরে দরজা খোলার মৃদু শব্দ পেল সে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল, শুধু দিদিমা নয়–দাদুও।

দিদিমা বলল, কী মার মেরেছে দেখছ ছেলেটাকে!

দাদু গম্ভীর গলায় বলল, দেখেছি। কী আর করা যাবে বলো, আমাদের তো কিছু করার ছিল না।

এখন কী করবে?

কিছু করতে যে সাহস হয় না।

তা বলে চোখের সামনে দুধের ছেলেটাকে মরতে দেখব নাকি? শত হলেও নিজের নাতি। আমাদের আর ভয়টা কীসের বলো। বেঁচে থেকেও তো মরেই আছি।

দাদু চিন্তিত মুখে পিপুলের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, একেবারে মায়ের মুখের আদল, দেখেছ?

দিদিমা ঝংকার দিয়ে বলল, আমি কী ছাই চোখে ভালো দেখি! তিন বছর হল ছানি পড়ে চোখ আঁধার হয়ে আছে। সব কিছু যেন কুয়াশায় ডোবা, আবছা আবছা। ওরে ভাই, তোর নাম তো পিপুল?

পিপুল চিঁ চিঁ গলায় বলল, হ্যাঁ।

আমাদের সঙ্গে আয়, চাট্টি ভাত খাইয়ে দিই। খিদে পায়নি তোর?

পিপুলের চোখে ভাতের কথায় জল এল। মাথা নেড়ে বলে, আমার কিছু চাই না। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যাব।

দিদিমা আক্ষেপ করে বলে, ওরে, আমাদের কপাল যদি ভালো হত তাহলে বলতে পারতুম যে, এটাও তোর বাড়ির মতোই। মামাবাড়ি কী ফেলনা নাকি? কত আদর মামাবাড়িতে! তা ভাই, কপালটাই যে আমাদের ঝামা পোড়া। এখন আয় দেরি করিসনি। দেরি করলেই বিপদ। শুধু তোর নয়, আমাদেরও।

এত ভয়ের ওপর ভয়ে পিপুল সিঁটিয়ে যাচ্ছিল। ভাত খাবে কী, তার শরীর এত কাঁপছে যে মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে বুঝি। তবে এই অন্ধকার চোরকুঠুরি থেকে বেরোনোর জন্যই সে ভাত খেতে রাজি হল। দাদু আর দিদিমা চুপিসাড়ে তাকে ওপরে নিয়ে এল। বারান্দার এক প্রান্তে রান্নাঘর। বাড়ি নিঝুম। কত রাত তা জানে না পিপুল। তবে রাত বেশ গভীর বলেই মনে হল তার। উঠোনে একটা কুকুর তাকে দেখে ভেউ-ভেউ করে চেঁচিয়ে উঠল।

দাদু তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে চাপা ধমক দিল কুকুরটাকে, অ্যাই, চোপ!

 কুকুরটা লেজ নাড়তে লাগল।

রান্নাঘরে তাকে পিঁড়িতে বসিয়ে একটা থালায় ভাত বেড়ে দিল দিদিমা। বেশ তাড়াহুড়োর ভাব। বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে ভাই।

পিপুলের বিশাল খিদে মরে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এখন তার একটা বমি-বমি ভাব হচ্ছে। দু-তিন গ্রাস ভাত মুখে দিয়ে সে কেবল জল খেতে লাগল ঢকঢক করে। জল খেয়েই পেট ভরে গেল। আর কেমন শীত করতে লাগল।

কিছু একটা সন্দেহ করেই দিদিমা তার কপালে হাত দিয়ে বলল, ইস, তোর যে জ্বর এসেছে দেখছি! গা পুড়ে যাচ্ছে।

পিপুলের খুব ঘুম পাচ্ছে। আর শুধু জলতেষ্টা

দিদিমা গিয়ে দাদুকে ডেকে এনে বলল, ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, কী করবে?

দাদু চিন্তিতভাবে বলে, অনেক ক্ষত হয়েছে দেখছি। কেটেকুটে বিষিয়ে গেছে। ব্যথার তাড়সে জ্বর।

তোমার হোমিও চিকিৎসায় হবে না?

হবে না কেন? তবে চোর-কুঠুরিতে রাখলে আজ রাতেই মরে যাবে। ওকে আমাদের ঘরে নিয়ে ঢেকেঢুকে শোওয়াও। আমি চারদিকটা দেখে নিয়ে আসছি।

অনেকক্ষণ বাদে এই প্রথম পিপুল তার জ্বরঘোরেও বুঝতে পারছিল, এ পৃথিবীতে এখনও দুটি মানুষ অবশিষ্ট আছে যারা তাকে একটু-আধটু মায়া করে।

পিপুলকে ধরে তুলল দিদিমা। তারপর দাদুকে বলল, শোনো, এই ছেলে নিয়ে অনেক গন্ডগোল হবে। কালী এসে কুরুক্ষেত্র করবে। তুমি একবার গৌর মিত্রের কাছে যাও এখনই। তাকে সব বলো গিয়ে।

দাদু একটু যেন ভয় খেয়ে বলে, গৌর মিত্তির। বলো কী? গৌর রগচটা লোক, খুনোখুনি করে ফেলতে পারে! শত হলেও কালী আমাদের ছেলে!

দিদিমা খুব শান্ত গলায় বলে, ছেলে আমারও কিন্তু আমি তার মা হয়েও বলছি, গৌর মিত্তিরকে একটা জানান দিয়ে রাখো। সে ষন্ডাগুন্ডা হতে পারে, কিন্তু দশজনের উপকারও করে। আমরা বুড়োবুড়ি পেরে উঠব না, কালী এ ছেলেকে মেরে তবে ছাড়বে।

দাদু একটু দোনোমোনো করে বলল, তাই যাচ্ছি। তুমি একে ভালো করে ঢেকে শোওয়াওগে। আমি আসছি।

দিদিমা পিপুলকে দোতলার একখানা ঘরে নিয়ে এল। বেশ বড়ো ঘর। মস্ত খাট পাতা। মশারি ফেলা। সেই খাটের বিছানায় তাকে শুইয়ে একটা কাঁথা চাপা দিয়ে বলল, ঘুমো–ভয় নেই। তোর জন্যই বোধহয় আজও অবধি আমরা বেঁচে ছিলাম। আমাদের প্রাণ যতক্ষণ আছে ততক্ষণ মরবি না। ঘুমো তো ভাই।

পিপুলকে আর বলতে হল না। নরম বিছানা পেয়েই তার শরীর অবসন্ন করে এক গাঢ় ঘুম ঢেকে ফেলল তাকে।

মাথার দিককার মস্ত জানালা দিয়ে যখন ভোরের লালচে রোদ এসে বিছানা ভরে দিল তখন চোখ চাইল পিপুল। বিছানায় সে একা। তার দুধারে দাদু আর দিদিমা যে রাত্রে শুয়েছিল তা বালিশ আর বিছানা দেখেই সে টের পেল। দেখতে পেল তার শরীরে কাটা আর ফাটা জায়গাগুলোয় তুলো আর ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। তা বলে ব্যথা সে কিছু কম টের পাচ্ছিল না। জ্বরের একটা রেশ শরীরে রয়েছে এখনও। আর বড্ড তেষ্টা।

বাড়িটা নিস্তব্ধ। কোনো গোলমাল বা চেঁচামেচি নেই। তবু কান খাড়া করে রইল পিপুল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল। বিছানা ছেড়ে ধীরপায়ে গিয়ে জানলায় দাঁড়াল। এটা পুব দিক। সামনেই সেই পুকুরটা। ওপাশে কিছু বাড়িঘর। তার ওপাশে সূর্য উঠছে। কী সুন্দর দৃশ্য! পুকুরের স্থির জলে ভোর আকাশের ছায়া।

দিদিমা পিছন থেকে হঠাৎ কথা বলে উঠতেই একটু চমকে গেল পিপুল।

উঠেছিস? দেখি গা-টা দেখি, কত জ্বর।

পিপুল কপালটা এগিয়ে দিল। তারপর চাপা গলায় বলল, কালীমামা ফিরেছে?

দিদিমা একটু হাসল, ফিরেছে। তোর ভয় নেই। রাত বারোটায় ফিরেই চোরকুঠুরির চাবি চাইল। দিইনি। নেশা করে আসে, অত বুদ্ধি কাজ করে না। তবু একটু চেঁচামেচি করেছিল ঠিকই। রাত সাড়ে বারোটায় গৌর মিত্তির এল। সে আসতেই সব ঠাণ্ডা।

গৌর মিত্তির কে দিদিমা?

দিদিমা বলে ডাকলি নাকি ভাই! সোনা আমার! গোপাল আমায়! কখন থেকে কানদুটো পেতে আছি, ডাকটা শুনব বলে।

ফোকলা মুখের হাসিটি এত ভালো লাগল পিপুলের। সে বলল, বললে না?

গৌর মিত্তির তো! তার কথা কী-ই বা বলি তোকে! সে ষন্ডাগুন্ডা লোক, সবাই তাকে ভয় খায়। চন্ডালের মতো রাগ। লোকের ভালোও করে, মন্দও করে। এখানে তার খুব দাপট।

সে এসে কী করল?

তোর দাদু গিয়ে তাকে সব খুলে বলেছিল। সে দেরি করেনি। তখন-তখনই চলে এসেছিল। কালী শুতে গিয়েছিল, তাকে তুলে এনে চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে গেল। আর তোর ভয় নেই। গৌর মিত্তির যখন আশ্রয় দিয়েছে, কালী আর ভয়ে কিছু করবে না!

কালীমামা কি খুব রাগী?

 খুব। রাগ বলে নয় রে ভাই, রাগী মানুষ অনেক থাকে। সে হল বংশের কুড়ুল। অশান্তির শেষ নেই রে ছেলে।

আমি এখন কী করব দিদিমা? বাবা তো শুনেছি হাসপাতালে, কে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে?

বাড়িতে তোর তো ঠাকুর্দা আর কাকা আছে না? তারা তোকে দেখে-শোনে?

পিপুল চুপ করে রইল।

 সেখানে তোর আদর নেই, না?

না।

তবে সেখানে গিয়ে কী করবি? এখানে থাকতে পারবি না?

এখানে! বলে আতঙ্কে চোখ বড়ো করে ফেলল সে।

দিদিমা দুঃখের গলায় বলে, থাকতে তো বলছি, কিন্তু এ বাড়িতে আমাদের কী আর জোর আছে? এখন বুড়োবুড়িকে পারলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আমাদেরই ঠাঁই নেই। তবু শ্বশুরের ভিটে আঁকড়ে আর বুড়োটার মুখ চেয়ে পড়ে আছি। এখানে কী আর শান্তিতে থাকতে পারবি? যদি শতেক অত্যাচার সয়ে থাকতে পারিস তবে হয়। যতদিন আমরা আছি তোকে আগলে রাখব।

আমার বড়ো ভয় করছে যে দিদিমা।

ভয় তো আমাদেরও করে। উমাপদমামাকে মনে আছে তোর?

না, আমার কাউকে মনে নেই।

না থাকারই কথা। আমার বড়ো ছেলে হল উমাপদ। সে ততটা খারাপ নয়, তবে ভাইদের অত্যাচারে সেও তিষ্ঠোতে পারেনি। স্টেশনের কাছে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বিউটি বিচ্ছু হলেও উমাপদ কিন্তু ভালো। তার কাছে থাকবি?

পিপুল মাথা নেড়ে বলে, আমি এখানে থাকব না, বাড়ি যাব।

 বাড়িতেও তার আদর নেই বটে, কিন্তু সেখানে অবস্থা এতটা খারাপ নয়। মামাবাড়িতে এসে তার মনে হচ্ছে, তাদের চেয়েও ঢের ঢের খারাপ অবস্থায় লোকে দিব্যি আছে। বাড়ি তার চেনা জায়গা। বাড়িতে আদর না থাক, পাড়াভরতি, স্কুলভরতি তার কত বন্ধু। পালিয়ে থাকার কত জায়গা।

দিদিমা আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই যদি যাবি ভাই, তবে তাই যাস। উমাপদ গিয়ে দিয়ে আসবেখন। ওদিকে তো আর এক সর্বনাশের কথা শুনছি! জামাইকে মেরে পাটপাট করেছে, পুলিশ আসতে পারে!

বাবার সঙ্গে পিপুলের তেমন ভাবসাব নেই। তেমন টানও নেই বাবার ওপর। তবু একটু কষ্ট হচ্ছিল বাবার জন্য। মামাবাড়িটা যে ভারি বিপদের জায়গা আর কালীমামা যে সাংঘাতিক লোক এটা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

দিদিমা বাসি রুটি আর গুড় এনে দিল। সকাল বেলায় সে রাক্ষুসে খিদে টের পাচ্ছিল। পেট ভরে খেল। শরীরে হাজারো ব্যথা, ভীষণ দুর্বল। খাবারটুকু খেয়ে শরীরে যেন একটু জোর পেল।

দিদিমা সাবধান করে দিয়ে বলল, আমার ওদিকে অনেক কাজ। তোর দাদু গেছে এজমালি পুকুরে, সেখানে আজ মাছের বাঁটোয়ারা হবে। তোর ঘর থেকে বেশি বেরোনোর দরকার নেই। চুপচাপ পড়ে থাক বিছানায়। ওরা ধরে নেবে তোর এখনও অসুখ।

দিদিমা দরজা ভেজিয়ে চলে যাওয়ার পর খানিকক্ষণ সত্যিই মটকা মেরে পড়ে রইল পিপুল। কিন্তু সে নিতান্তই বালক। তার পক্ষে এভাবে অসময়ে শুয়ে থাকা তো সম্ভব নয়। সে ছটফট করছে, বারবার উঠে বসছে। পেচ্ছাপ পেয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু কোথায় সেটা করা যায় তা বুঝতে পারছে না।

দিদিমা আর এ ঘরে আসছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে আর না পেরে ভেজানো দরজা খুলে বেরিয়ে এল বিপুল। লম্বা দরদালান হাঁ-হাঁ করছে ফাঁকা। কিন্তু কোনোদিকে কোনো কলঘর নেই। পেচ্ছাপ পাওয়াটাই একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল পিপুলের কাছে। দরদালানের জানালা দিয়ে সাবধানে উঁকি দিয়ে সে দিদিমাকে খুঁজল। নীচে বড়ো উঠোন। কুয়োতলায় দু-জন ঝি বাসন মাজছে, একজন লুঙ্গিপরা লোক দাঁতন করছে পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে। পিছনদিকে গোয়ালঘরের সামনে দুটো গোরু মাটির গামলা থেকে জাবনা খাচ্ছে একমনে। দিদিমাকে কোথাও দেখা গেল না।

যে লোকটা দাঁতন করছে সে কে তা জানে না পিপুল। এ তার আর একজন মামা নয় তো! মামাদের বড়ো ভয় খাচ্ছে সে। পিপুল লক্ষ করল, কুয়োতলার ওধারে একটু জংলা জায়গা আছে। ওখানে পেচ্ছাপ করে আসা যায়। কিন্তু কে কী বলবে কে জানে! ভরসা এই, এখনও বেলা হয়নি। বাড়ির সবাই বোধহয় ঘুম থেকে ওঠেওনি। ক্ষীণ একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কালকের সেই বাচ্চাটাই কী?

পিপুল খুব সাহস করে সিঁড়ি দিয়ে খুব আস্তে আস্তে নামতে লাগল। বুক দুরদুর করছে, গলা শুকিয়ে আসছে। এরকম অদ্ভুত ভয়-ভয় এর আগে তার কখনো হয়নি। নীচের দরদালানে সিঁড়িটা যেখানে ঘুরে নেমে গেছে সেখানকার চাতালে দাঁড়িয়ে সাবধানে রেলিং এর ওপর দিয়ে দেখে নিল সে। একজন বউমতো মানুষ একেবারে ওধারে বসে কুটনো কুটছে। বউটি তাকে হয়তো দেখতে পাবে না, কিন্তু উঠোনের দাঁতনওলা লোকটা পাবে।

কিন্তু পিপুলের আর উপায় নেই। সে সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে দরজা দিয়ে বেরিয়ে উঠোনে নেমে পড়ল। দাঁতনওলা লোকটার দিকে তাকালই না পিপুল। একরকম তার নাকের ডগা দিয়েই একছুটে গিয়ে কচুবনের মধ্যে বসে পড়ল।

ওটা কে রে ঝিকু? একটা হেঁড়ে গলা হেঁকে উঠল।

 যারা বাসন মাজছিল তাদের একজন বলল, ওই তো তোমাদের বোনের ছেলে, যাকে নিয়ে কাল অত হাঙ্গামা হল!

কিন্তু এ তো দিব্যি ছুটে গেল দেখছি! শুনলুম যে সাংঘাতিক জ্বর! মা বলছিল।

তা জ্বর হতেই পারে বাপু। যা মার মেরেছ ওকে তোমরা। ওরকম মারের তাড়সে জ্বর হবে না তো কী! ওইটুকু তো ছেলে!

বেশি ফটফট করিস না। কাল আমার ঘরে ঢুকে কী করেছে জানিস?

ঝিকু নামের ঝি-টা একটু সাহসী আর মুখ-আলগা। ঝঙ্কার দিয়ে বলল, ওসব বলে কি লোকের চোখে ধূলো দেওয়া যায়? ওইটুকু ছেলে খামোখা ঘরে ঢুকে তোমার বাচ্চাকে আছড়াবে কেন? বাচ্চা গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল, ও গিয়ে তুলেছে! তোমরা বাপু দিনকে রাত করতে পার।

হেঁড়েগলা বলল, চুপ করবি না কী? আমাদের ব্যাপার আমরা বুঝব!

তোমাদের ব্যাপার আবার কী? ভাগ্নে বলে তাকে মারবে এটাই কী নিয়ম নাকি?

 পিপুলের পেচ্ছাপ হয়ে গেছে। সে ভয়ের চোটে কিছুক্ষণ বসে রইল এমনি। কিন্তু বেলাভর তো বসে থাকা যাবে না।

দাঁতনওলা লোকটা এইবার তার উদ্দেশেই একটা হাঁক মারল, এই ছোঁড়া, ওখানে কি করছিস, অ্যাঁ?

পিপুল উঠল। ঝিকুর জন্যই তার একটু সাহস হল। ঝিকুটা বোধহয় দজ্জাল। এরা বোধহয় ওকে একটু ভয় খায়।

এদিকে আয় তো! দাঁতনওলা ডাকল।

পিপুল খুব ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটা হ্যাঁক থুঃ করে মুখ থেকে খানিকটা দাঁতনের ছিবড়ে ফেলে বলল, তোর নাকি জ্বর?

হ্যাঁ। কাল রাতে খুব জ্বর এসেছিল। আজ সকালে ছেড়েছে।

ঝিকু কুয়োতলা থেকে বলল, ইস মাগো! কী মার মেরেছে দেখো! সারা গায়ে কালশিটে –তোমরা মানুষ না কী গো!

লোকটা খুব কড়া চোখে তাকে দেখছিল। মুখখানাও চোয়াড়ে। যেন জীবনে কখনো হাসেনি। বলল, লম্পট আর মাতালের ছেলে–কত আর ভালো হবি। একটা সত্যি কথা কবুল করবি? তোর মাকে তোর বাবা খুন করেনি?

না, মা তো গলায় দড়ি দিয়েছিল।

 সে তো গপ্পো। গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। বল তো সত্যি কি না?

পিপুলের চোখে জল এল। মা! মা থাকলে দুনিয়াটা কী এরকম হত? এত মারতে, অপমান করতে পারত কেউ?

সত্যি কথা তোর মুখে আসবে না জানি। এবার বল তো, তোর বাবা তোকে কেন এ বাড়িতে ঢুকিয়ে নিজে আড়ালে লুকিয়ে বসেছিল?

ঝিকু বালতিতে জল তুলতে তুলতে বলল, ওসব কথা তুলছ কেন? মশা মারতে তো কামান দেগে বসে আছ! চারদিকে তোমাদের নিয়ে কথা হচ্ছে! ছেলেটাকে মেরেছ, বাপটাকে প্রায় খুন করে ফেলেছ–কোমরে দড়ি পড়ল বলে।

তুই চুপ করবি?

ঝিকু মাঝবয়সি মজবুত চেহারার মহিলা। গায়ের রং ঘোর কালো, দাঁত উঁচু, কপালে আর সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। হঠাৎ চোখ পাকিয়ে বলল, আমাকে অত চোখ রাঙিও না। মাসকাবারে চল্লিশটা টাকা দাও বলে মাথা কিনে নাওনি!

এ কথায় লোকটা একটু মিইয়ে গেল যেন। বলল, তুই ঘরে যা। আমি আসছি। পিপুল ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ঘরে এসে খাটে বসে রইল। তার দুর্গতি যে কেন শেষ হচ্ছে না তা সে বুঝতে পারছে না।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে লোকটা হাতে এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। কাঠের চেয়ারটায় জুত করে বসে বলল, দিদিমার খুব আশকারা পাচ্ছিস, না?

পিপুল কিছু বলল না, চেয়ে রইল।

কাল অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের রাগ এখনও যায়নি।

পিপুল একটু সাহস করে হঠাৎ বলল, আমি তো কিছু করিনি।

আলবাত করেছিস। তোকে দিয়ে তোর বাপ কিছু করাতে চেয়েছিল। নইলে তার এত সাহস হয় না যে এ তল্লাটে আসবে!

সেটা আমার বাবা জানে।

তুইও জানিস। পেট থেকে কথা বার কর ভালো চাইলে।

কে জানে কেন, হঠাৎ পিপুলের একটু সাহস এল। সে হঠাৎ লোকটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আপনারা আমার বাবাকে কেন মেরেছেন? আমাকে কেন মেরেছেন? মারলেই হল!

লোকটা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। চমকে যাওয়ায় চা-ও খানিক চলকে পড়ল। খানিকক্ষণ কথা বলতে পারল না।

পিপুলের সাংঘাতিক রাগ হল এবার। লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে সে বিকট গলায় বলল, আপনারা ভীষণ খারাপ লোক। খুব খারাপ লোক।

আমরা খারাপ লোক! বলে লোকটা হাঁ করে রইল। তারপর হঠাৎ উঠবার একটা চেষ্টা করে বলল, তবে রে! তোর এত সাহস!

কী হল কে জানে, লোকটা উঠতে গিয়ে প্রথমে চেয়ারটা ফেলল দড়াম করে, তারপর চা সামলাতে গিয়ে নিজেও টাল খেয়ে একেবারে চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর। চায়ের কাপ ডিশ ভাঙল ঝনঝন করে। এই কান্ড দেখে ঠাণ্ডা হয়ে গেল পিপুল। সে কিছু করেনি।

লোকটা উঃ আঃ করে কাতর শব্দ করছিল। বিকট শব্দে নীচের তলা থেকে দুটি বউ, একজন পুরুষ কী হল, কী হল বলতে বলতে উঠে এল ওপরে। লোকটি সেই ভয়ঙ্কর কালীমামা।

লোকটি কোমর ধরে অতিকষ্টে উঠে বসে বলল, ওফ, মাজাটা গেছে।

কালীপদ চোখ পাকিয়ে বলল, এই ছোঁড়া তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বুঝি?

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, না না, ও ফেলেনি। চেয়ারটা উলটে পড়ে গেল হঠাৎ।

লোকটা দাঁড়িয়ে মাজায় হাত বোলাতে লাগল।

কালীমামা একবার বিষদৃষ্টিতে পিপুলের দিকে চেয়ে নীচে নেমে গেল। বউ দুটোও ভাঙা কাপ ডিশ কুড়িয়ে মেঝের চা ন্যাকড়ায় মুছে নিয়ে চলে যাওয়ার পর চোয়াড়ে লোকটা হঠাৎ পিপুলের দিকে চেয়ে একটু হাসল। ঝকঝকে মজবুত দাঁত, আর হাসলে চোয়াড়ে মুখটাকে বেশ ভালোই দেখায়। লোকটা চেয়ারে বসে বলল, অমন রাগিয়ে দিতে আছে।

পিপুল কথাটার জবাব খুঁজে পেল না।

লোকটা মাঝে মাঝে কাতর শব্দ করছে। তার মধ্যেই বলল, আমি তোর সেজো মামা, বুঝলি?

পিপুল ঘাড় নাড়ে–বুঝেছি।

তা এখানেই বুঝি তোর থানা গাড়ার মতলব?

 পিপুল মাথা নেড়ে বলে, না। আমি বাড়ি যাব।

হরিপদ তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে একটু চেয়ে থেকে বলে, বাড়ি যাবি? তার তত লক্ষণ দেখছি না! মা আর বাবা তো দেখছি নাতি পেয়ে হাতে চাঁদ পেয়েছে।

আমি বাড়ি যাব।

কেন, এ জায়গাটা কি খারাপ?

আমার ভালো লাগছে না।

হরিপদ এবার বেশ খুশিমনে একখানা হাসি হাসল, ওরে শোন বোকা, তেতো দিয়ে শুরু হলে খাওয়াটা শেষ অবধি ভালোই হয়। উত্তম মধ্যম খেয়ে শুরু করেছিস, তোর বউনি ভালোই হয়েছে। যতটা খারাপ ভাবছিস আমরা ততটা খারাপ নই। মেজদা একটু রাগচটা গুন্ডা লোক বটে। একটু সামলে থাকলেই হল। আমার দু-খানা ঘর আছে নীচে, আরামে থাকবি। ইস্কুলে ভরতি করে দেবখন। আমার বাচ্চাটাকে একটু রাখবি আর ফাইফরমাশ খাটবি একটু। পারবি না? বাড়ি গিয়ে কোন কচুপোড়া হবে?

পিপুল ছেলেমানুষ হলেও বোকা নয়। সে বুঝল, এ লোক ধড়িবাজ। তাকে বিনি-মাগনা চাকর রাখতে চায়। সে মাথা নেড়ে বলে, থাকলে দিদিমার কাছে থাকবে, আর কারো কাছে নয়।

আচ্ছা এখন জিরো, পরে দেখা যাবে।

এই বলে হরিপদ ক্যাকাতে ক্যাকাতে একটু নেংচে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *