১. পা টিপে টিপে আমরা এগুই

পা টিপে টিপে আমরা এগুই।

সিনেমা হাউসের আড়াল-করা আলোর নামমাত্র আলোর আওতা ছাড়াতেই—একেবারে ঘুটঘুট্টির মধ্যে এসে পড়লাম। শুনলাম, মিনিটখানেক আগেই নাকি এধারের লাইন ফিউজ হয়ে রাস্তার সব বিদ্যুৎ-বাতি নিবে গেছে। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটুখানি ফিকে জ্যোৎস্নার আবছায়া থাকলে ভালো হতো,—এক কাস্তে চাঁদের আলো—চাঁদনির ফসল—পৃথিবীর পক্ষে নেহাত কম নয় (দুজনের পক্ষে তো খুবই বেশি!) কিন্তু এই আকস্মিক অমাবস্যায় একেবারেই মেরে দিয়েছে।

তবে এই অন্ধকারই ভালো! এমন ঘুটঘুট্টিই বা মন্দ কী? পা টিপে টিপে পাশাপাশি চলতে ভালোই লাগে। তবে পাশে নিতান্তই নিজের–কী বলে গিয়ে—ইয়ে, এই যা।

একটা খাসা ছবি–দুজনে মিলে উপভোগ করবার এই বেহালা পর্যন্ত আমাদের ঠেলে আসা! ছবিটার টানেই বিশেষ করে। নামজাদা ছবি, কিন্তু কলকাতার বড় বড় সিনেমায় যখন দেখানো হচ্ছিল, তখন ছোটখাটো নানা কাজে জড়িয়ে থেকে দেখা হয়ে ওঠেনি, তারপর আজ হঠাৎ কলকাতার উপকণ্ঠে এর পুনঃপ্রদর্শনীর ঘোষণা দেখে ভাবলুম এ-সুযোগ আর ফস্কানো না!

সুযোগই বলতে হয়! কলকাতায় বাস করে চাঁদের সঙ্গে আমাদের আড়ি। পূর্ণিমা আমাদের চোখে পড়ে না, অমাবস্যাও। চাঁদের বদলে আমরা পেয়েছি বিদ্যুতের চাঁদনি—সস্তার বাজার! হঠাৎ এই রাস্তা-জোড়া বৈদ্যুতিক বিকলতার দৌলতে, অমা-রজনীর রূপটা দেখতে পাওয়া গেল।

এইমাত্র সিনেমা ভেঙেছে, আর–আমরাও ভেঙে পড়েছি! যে অমা-রজনীর অপরূপ উপভোগ্যতা নিয়ে একটু আগেই উদ্বেল হয়ে উঠেছিলাম, এখন তার গর্ভে প্রবেশ করে তার চেহারা দেখেই চমকে উঠতে হলো।

এই সূচীভেদ্য যবনিকা ভেদ করে আজ বাড়ি পৌঁছতে পারব তো? কল্পনাকে বল্লাম : আমার হাত ধরো, নইলে হারিয়ে যাবে।

কল্পনার হাত আমার বাহুর আশ্রয় নেয়, এবং বলতে কি, নিজের ইয়ে হলেও আমার বেশ ইয়েই লাগে। আমি কল্পনাকে, মানে, কল্পনার সেই ভগ্নাংশকে বগলদাবা করে সন্তর্পণে পা বাড়াই। ফুটপাথটা কোন ধারে, ঠিক যে কোনে, পা দিয়ে হাতড়াতে থাকি।।

উঃ, কী অন্ধকার! কল্পনা দম নিয়ে বলে? বিচ্ছিরি! সিনেমার গহ্বর থেকে বার হবার তোড়ে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল—ক্ষণেকের জন্যেই। কিন্তু সেই মুহূর্তের মধ্যেই চারিধারের এই আঁধার আরো ঘোরালো আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল বুঝি। অনুভূতিটা, নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, নানা ভাবে রোমন্থন করার আগেই কনা আমার বগলে ফিরে এসেছে। ভালো করে হারাবার আগেই আবার আমরা পরস্পরের করতলগত ও কুক্ষিগত হয়ে পড়েছি।

এবং সেজন্যে তেমন দুঃখিত কি? অমাবস্যার অবশ্যম্ভাবী সুযোগে মাধুর্য-কণ্টকিত সম্ভাবনাটা নিতান্তই মাঠে মারা গেল হয়তো? পেয়ে হারাবার এবং হারিয়ে পাবার এই ফাঁকতালে, কল্পনার বদলে, আর একটি মেয়ে, (কল্পনার মতই সুন্দর আর মিষ্টি, কল্পনা করা যাক না!) অপর একটি মেয়ে হস্তগত হয়ে এলে নেহাত মন্দ ছিল না বোধ হয়।

যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলি। না, ঠিক ও-কথাটা বলি না। বলিঃ কতক্ষণ আর! এও সয়ে যাবে—সয়ে আসবে অচিরেই-কতক্ষণের দুর্যোগ।

কিন্তু ওর মধ্যেও অনুশোচনার সুর বেজে ওঠে—যোরালো একটা প্যাঁচ যেন থেকে যায়। মানে, অন্ধকারটা আস্তে আস্তে আমাদের চোখে সয়ে যাবে! সেই কথাই বলছি। অন্ধকারকে পরিষ্কার করে দিতে হয়।

এবং অন্ধকারের অরণ্য ভেদ করে আমরা দুজনে দুঃসাহসের দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়ি।

ওমা–। অকস্মাৎ আমি চেঁচিয়ে উঠি : চারধারেই জল যে। এবার যে গঙ্গা পেরুতে হয়।

অ্যাঁ? কী বলছ? গঙ্গায় এসে পড়লাম নাকি? কল্পনাও আঁৎকে ওঠে।

প্রায় তাই। জলমগ্ন পা-টাকে ফুটপাথের উপকূলে টেনে তুলি : কলকলধ্বনি শুনছ? এখন সাঁতরে পেরুতে হবে।

ইতস্ততঃ-প্রজ্জ্বলিত জোনাকি পোকার আলোয় যতদূর দৃষ্টি চলে, চারিধার জলে জলময়। এই অন্ধকারের অজুহাতে কোন এক রসিক রাস্তার ঘোলাটে জলের উৎস-মুখটা মজা করে খুলে রেখে গেছেন, (সারা কলকাতাকেই তার জলাঞ্জলি দেবার মৎলবে কিনা কে জানে!) তাইতেই এই কলোচ্ছ্বসিত জলোৎসব!

তাহলে কী হবে? কল্পনা আর পা বাড়ায় না।

কী আবার হবে! যুগে যুগে কারা গন্ধমাদন বহন করেছে? আমরাই। চলে এসো।

উহুঁ। সাদর অভ্যর্থনার বিজ্ঞাপনেও ও অবিচলিত।

তবে সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাক! সেই ভালো।

এই দ্বীপে?

দ্বীপে।

বাঃ, দ্বীপ কাকে বলে তাও জানো না?

জানি বইকি। দ্বীপ হচ্ছে, ফুটপাথের অংশবিশেষ, এমন একটি স্থলভাগ যার চারিধারে জলবেষ্টিত হয়েও–

হয়তো এটা ব-দ্বীপও হতে পারে। কল্পনা ক্রমেই নিজেকে ফাঁপিয়ে তোলে। তাও হতে পারে। আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে রাতারাতি যেসব দ্বীপ গজিয়ে ওঠে তার একটা হওয়াও বিচিত্র না! খুব অসম্ভব নয়। আমিও কল্পনার রাশ ছেড়ে দিই। রাশ ছেড়ে দেয়া খুব শক্ত ছিল না। এই সুপরিচিত শহরতলীও অন্ধকারের অপরিচয়-সূত্রে এমন অবাস্তব আর রহস্যময় হয়ে উঠেছিল যে এহেন জগতে এই মুহূর্তে সব কিছুই সম্ভব বলে বোধ হতে থাকে।

আচ্ছা, এই রকম একটা দ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হবার বাসনা তুমি মনে মনে কখনো পোষণ করোনি, ঠিক করে বলো তো?

কখনো না। কল্পনার সুদৃঢ় কণ্ঠ : আমার ভারী ঠাণ্ডা লাগছে। আমি বাড়ি যেতে চাই।

ঠাণ্ডা লাগার অপরাধ কি? সাড়ে এগারোটায় সিনেমা ভেঙেছে—এমনিতেই তো

অধেক রাত। তার ওপরে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই নির্জনতা ফাঁক পেয়ে মানুষের পাজরার ভেতরে ঢুকে হাড় কাঁপিয়ে দিতে চায়।

বাড়ি যেতে চাইবে, সে আর আশ্চর্য কি? আমি ওকে উত্তপ্ত করার প্রয়াস পাই? যারাই কিনা মকদ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হয় তারাই বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু কদিন আর? অভ্যেস হয়ে যেতে আর কদিন? প্রথম প্রথম ওইরকম একটু মন কেমন করে। তারপর কিছুদিন গেলে আর কিছুতেই তাদের সেখান থেকে সেই মরুদ্বীপের স্বর্গোদ্যান থেকে সরানো যায় না। রবিন্সন ক্রুসো পড়েছ তো?

কল্পনা বলে, তুমি একটা ক্ষ্যাপা।

কেন, এমন হতে পারে না কি?– আমি ওকে বোঝাতে চাই : অঘটন কি ঘটে না পৃথিবীতে?

বাস্তবিক, যেখানে চিরকাল এত আলোর ঝলমলানি দেখে এসেছি, চাঁদের জ্যোৎস্নাটুকুও যে-পথে কদাচ পড়তে পায়নি, যেখানে পথঘাটের কোনোদিন অন্যরূপ দেখব এমন প্রত্যাশা ছিল না, সেখানে এই বিপুল—অদ্ভুত—অপরূপ অন্ধকার, এই অপরিমেয় রহস্যঘনতা, যা ভাবতেই, আপনিই যত অসম্ভব কল্পনা মনের বলগামুক্ত হয়ে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি লাগিয়ে দ্যায়।

…মিরাকল কি ঘটে না পৃথিবীতে?… আমি বলে চলি: এইমাত্র সিনেমার এক অবাস্তব জগৎ থেকে আমরা উঠে আসছি; আবার সেই আমাদের পুরনো পরিচিত পচা একঘেয়ে জীবনে ফিরে যাবার প্রত্যাশা নিয়ে, কিন্তু এর মধ্যে কী অঘটন ঘটে গেছে, না জানি কী যাদুবলে কলকাতার মায়া কাটিয়ে কোন এক সুদূর আদিম দ্বীপের উপকূলে, আমরা উৎক্ষিপ্ত এখন—যেখানে সভ্যতা নেই, ভদ্রতা নেই, অশান্তি নেই, যুদ্ধবিগ্রহ-মারামারি কাটাকাটি কিছু নেই, নিত্য নবযুগ, নিত্য নব নব হুজুগ নেই—কেবল চারিধারে নীলাম্বুরাশি আর তালীবন, আর শুধু তুমি আছো আর আমি আছি—এমন কি হতে পারে না নাকি?

তুমি একটা ক্ষ্যাপা। কল্পনার কণ্ঠে পুরাতন ঘোষণা।

এটা কি একটা জবাব হলো?

তুমি একটা আস্ত। কথাটা সম্পূর্ণ না করেই, আমার কবল থেকে সবলে তার হাত ছাড়িয়ে নেয় : হ্যাঁ, তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি বাড়ি যেতে চাই। সে বলে।

যাবে বই কি। নিশ্চয়ই যাবে। আমি ওকে ভরসা দিই : যথাসময়েই যেতে পারে। আশ-পাশ দিয়ে একটা জাহাজ গেলে হোলো? আর জাহাজরা তো গিয়েই থাকে, কালেভদ্রে যায় বই কি! তখন আগুন জ্বেলে নিশানা দাও কি তোমার পাঞ্জাবী খুলে নিশান ওড়াও। দ্যাখো, ঐ দ্যাখো, কী একটা যাচ্ছে যেন।–

রক্তচক্ষু অতিকায় জাহাজপ্রতিম কী একটা, ভোঁসর্ভোস গর্জনে, দারুণ আওয়াজ ছেড়ে, বঙ্কিম দৃষ্টিতে আমাদের দিকে বারেক মাত্র কটাক্ষ করেই তীরবেগে অন্ধকারের মধ্যে তিরোহিত হয়ে গেল।

বাস গেল না? কল্পনা আর্তনাদ করে উঠল : বাজে বক করে বাসখানা হারালুম। থামালে কাজ দিত। থামালে না কেন?

কি করে থামাবো? আমি বিস্মিত হই : পাঞ্জাবী খুলে ওড়ানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া, সময় পেলাম কই? আর, কলকাতার পথে আগুন জ্বালালে, বুঝতেই পারছো, পেনাল কোডে পাক্কা ছমাস।

পরের বাস আসতে আবার সেই আধ ঘণ্টা। কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফ্যালে : আর আসবেই কিনা কে জানে।

নাই বা এলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দিইঃ মরুদ্বীপে সময় হু হু করে কেটে যায়। টেরই পাওয়া যায় না। আর এমন আরামে কাটে। এমন কি, সেখানে বসে এক-আধটু রোমান্সও করা যায় না যে তা নয়।

ছবিতে দেখেছি বটে। কল্পনার শুষ্ক কণ্ঠ।

দেখলেই বা, রোমান্সে কোনো দোষ নেই আমি ওকে বুঝিয়ে দিই : আব তাছাড়া রোমান্স করতে হলে মরুদ্বীপে নিক্ষিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তারও কোনো মানে নেই। রমণীয় যা, জো পেলেই জোগাড় করো-বাগে পেলেই বাগিয়ে নাও। রোমান্সের চুলের টিকি পাকড়ে আনো। অনেক বছব আগে, এমন একটা চমৎকার আঁধার রাত পেলে তুমি কী উচ্ছ্বসিতই না হতে।–

অনেক বছর আগে, তার মানে? কল্পনা প্রতিবাদ করে।

না, তত বেশি বছর আগে নয়। আমি ক্ষতিপূরণ করে দিই : কেন, তোমার গলার সুরে তো বোধ হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা। মনে হচ্ছে, সেই তুমি, সেই তরুণবয়সী তুমি, অনেক বছর—মানে, অল্প কিছুদিন আগের সেই তুমিই।

আমার গলার রেশ আমার কানে এসে লাগে। বেশ লাগে। নিজের স্ত্রীকে কেমন যেন পরস্ত্রী বলে মনে হয়।

এখনো তুমি ঢের কাঁচা, ঢের কচি। এখনো তোমাকে নিয়ে রোমান্স করা চলে।… আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলি! আমার আত্মপরভেদ লোপ পায়,—নিজের স্ত্রীর প্রতিই কেমন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করি—কেমন যেন পরস্ত্রীকাতারের মতো হয়ে পড়তে থাকি ক্রমশঃ।

…এমন চমৎকার রাত…এহেন মোহিনী অন্ধকার…তুমি আর আমি এত পাশাপাশি…

নিজের গলা শুনে নিজেই বিগলিত হই। আমার মধ্যে এত মাধুর্য আছে–তাহলে না তো! এমন মধুর কন্ঠ যে আমিও কখনো শুনিনি।

…এসো, আরো কাছে এসো। আমায় একটা চুমু দাও। এই বলে কস্তুরীকা আপনগন্ধে আপনি মাতোয়ারা হয়ে ওকে কাছে টেনে একটা চুমু খেয়ে নিই।

এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রেয়সী, আমার গালে এক চড় বসিয়ে দ্যান। বেশ মজবুত হাতের যুতসই এক চড়।

কী সাহস তোমার। কল্পনা হাঁপায় : এতদূর আস্পর্ধা।

বা রে, নিজের বৌকে যদি চুমু খেতে না পারো, আহত গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলি : তাহলে কার বৌকে চুমু খেতে যাবো, শুনি?

যা? তার ওপরে আবার একটা বউ আছে বাডিতে? বটে? কল্পনা ফোঁপাতে থাকে : আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার।

এই বলে কল্পনা, আর একটি কথাও না বলে অদ্ভুত আবহাওয়ায়, মরুদ্বীপ ত্যাগ করে জলে নেমে পড়ল এবং টলতে টলতে জলাশয় পাব হয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল।

দোর গোড়াতেই কল্পনার সঙ্গে দেখা।

উঃ, আজ খুব একটা ফাড়া গ্যাছে। কল্পনা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে? বলছি, ভেতরে চলো।

ফাড়া? য়্যা? বলল কী?

যখন ছবি দেখে আমরা বেরুলুম, তুমি বল্লে না যে, আমার হাত ধরো,তোমার মনে নেই?

আছে বইকি। আমাকে স্বীকাব করতে হয়।

আমি ধরেও ছিলাম, কিন্তু অন্ধকাবে প্রত্যেক হাতই প্রায় এক রকম। আমি তোমার হাত মনে করে আরেক জনের-লোকটা কিন্তু ভারী রোমান্টিক, ই বলো। বিয়ের আগে তুমি যেমনটা ছিলে, অনেকটা তেমনি আর কি।

বুঝেছি, অন্ধকারের সুযোগে বেহাত হয়ে আমি কঠোর ভাষায় আরেক হাত নিইঃ তুমি বেশ একটু পরস্মৈপদী ফুর্তি লুটে নিয়েছ। …ভালো করোনি। ছিঃ।

বাঃ, কী করে জানব আমি? আমি ভেবেছিলাম, তুমিই। অনেকটা তোমার মতই গলা। অবশ্যি, কেমন একটু ক্ষ্যাপা মনে হচ্ছিল, তবুও যতক্ষণ না লোকটা আমায় চুমু খেল আমি সন্দেহই করতে পারিনি। তারপরই তো আমি টের পেলুম যে তুমি নয়। তুমি কখনো চুমু খাবার কথা ভাবতেই পারে না। নিজের বউকে কি কেউ চুমু খায়—মানে, বিয়ের এই এতদিন পরে?

যাকগে, যেতে দাও, বলে কথাটা আমি উড়িয়ে দিই: যে কাজটা ফেলে রেখে গেছি মনে আছে? কাল সকালেই তার ব্যবস্থা করতে হবে। পূজো তো এসে পড়ল। কাকে কী উপহার দেওয়া যায় আজ রাত্রেই তার ফয়সলা করার দরকার।

কাল সকালে আমার সময় হবে না। আমি জানাই। এবার টাকাকড়ির যা টান-আত্মীয়তার টানাটানিটা একটু কমালে কী হয়? এবার পূজোয় ধরে কাউকে কিছু যদি না দিই?

এবারে শারদীয়ায় কাকে কী তত্ত্ব দেয়া যায়, সেই সমস্যায় পড়া গেছল। সারা বছর কেউ কারো তত্ত্ব নেব না এবং পূজোর সময় সে-সমস্তর প্রতিশোধ নেব, এই আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক প্রথা। পুজোর তত্ত্বকথা। এই দারুণ দুবৎসরে উক্ত প্রথার কোনোরূপ ইতরবিশেষ করা যায় কিনা ঠাওর করছিলাম।

উঁহু। তা হয় না। ঘাড় নাড়ল কল্পনা। পরিবারের কাছ থেকেই বাধা এল প্রথম।

তাহলে উপহার-দ্রব্য নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমি বলি : মঞ্জুকে একটা সিল্কের রুমাল, মামাকে এক কৌটো সিগ্রেট, সৌম্যকে একখানা ভালো বই, আমারই বই একখানা, আর রঞ্জনকে একটি ছড়ি—এই দেয়া যাক। এই—এই দিয়েই এবারকার হাঙ্গামা চুকিয়ে দিলে কী ক্ষতি?

ক্ষতি নেই? কল্পনা জিজ্ঞেস করে।

খতিয়ে দেখলে ক্ষতিই অবশ্যি। উপহারের ছড়াছড়ি করার আমিও পক্ষপাতী নই। কিন্তু তুমি আবার বলছো–

আমি মোটেই ওই দিতে বলছিনে। কল্পনা বাধা দিয়ে বলে? উপযুক্ত উপহার কী দেয়া যায় তাই আমি ভেবে দেখতে বলেছি।

ভেবে দেখতে আমি নারাজ নই। আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমার কেমন ভয় হচ্ছে যে ভাবতে গেলেই আরো বেশি খরচের ধাক্কায় পড়ে যাব।

উপহার তো দিতেই হবে। কিন্তু তা যাতে দেবার মতো হয় তা কি ভাবতে হবে? আহা, কে যে কী চায়, সেইটে যদি কোনো উপায়ে জানা যেত—

রক্ষে করো। আমরা বাঞ্ছাকল্পতরু হতে পারব না। আমি ককিয়ে উঠি।

কল্পতরু না হই, তাদের ইচ্ছার একটুও তো পুরণ করতে পারি। চেষ্টা করলে করা যায় না কি?

একটুখানির মধ্যে নিজেদের ইচ্ছা সীমাবদ্ধ রাখার মানু; কিনা তারা? আত্মীয়দের ভালোমতই আমার জানা আছে—চিনতে আর বাকী নেই। তাদের মনের মধ্যে হানা দিতে গিয়ে

সোজাসুজি তাদের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি না কি? আমার বাপের বাড়িতে এরকম ব্যাপারে কী করা হয়ে থাকে জানো? জিজ্ঞেস করে কল্পনা।

কল্পনার পিত্রালয়ের রহস্য আমার কল্পনাতীত। আমি ঘাড় নেড়ে আমার অজ্ঞতা জানাই। উপহারের স্থলে সেখানে প্রহার দেওয়া হয় কি না, তাই ওদের পৈতৃক পদ্ধতি কি না, জানবার আমার কৌতূহ হয়।

ইচ্ছাময়ের লীলা বলে একরকমের খেলা আমরা খেলি। পূজোর কিছুদিন আগে আত্মীয়বন্ধুদের ডেকে একটা পার্টি দিই। সেই আসরেই খেলাটা ফাদা হয়। কার কী কী জিনিস পাবার কামনা, প্রত্যেককে তার তালিকা বানাতে বলা হয়। তারপরে যে কী য় আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

দিস্তা দিস্তা কাগজ আনার দরকার পড়ে বোধ হয়? আমি অনুমান করি।–তাহলে বলো, রিমখানেক কাগজের জন্যে ভোলানাথ দত্তে অর্ডার দেয়া যাক?

বাজে বোকো না। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ও মনে হচ্ছে দুটা ইচ্ছের মধ্যেই তালিকা সম্পূর্ণ করতে বলা হোতো। আমরাও ওদের নেমন্তন্নের আসরে ডেকে এনে তাই বলবো। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। তাহলেই তো ফর্দ আর বাড়তে পাবে না।

বেশ, তারপর?

তারপরে, ইচ্ছা পুরণের জন্য একজন করে আসর থেকে উঠে পাশের ঘরে যাবে—

যেমন ধরা যাক মঞ্জুলিকা। আমি উদাহরণের পক্ষপাতী। দৃষ্টান্তের স্বরূপছাড়া কোনো বস্তু প্রত্যক্ষ করা—সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করা আমার পক্ষে সুকঠিন।

বেশ, মঙুই হলো না হয়।

তাহলে আরেকজনকেও তো যেতে হবে তার সঙ্গে। বলি আমি।

কেন? আরেকজন কেন?

বাঃ, আর কেউ না গেলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে কী করে?

এ তোমার–যতো—ইয়ের খেলা নয়। কল্পনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে: একেবারে আলাদা জিনিস।

কিন্তু মঞ্জুর মন যা চায় তাইতো যোগাতে হবে? মনে মনে সর্বদাই সে পরমুখাপেক্ষী। তার মুখ্য ইচ্ছে হলো—

চুমু খাবার? তুমিই ভালো জানো! কিন্তু সেসব এখানে চলবে না।

তাহলে সেরকম নিরামিষ ইচ্ছাপুরণে মঞ্জুর বিশেষ উৎসাহ হবে বলে মনে হয় না। আমিও জানাতে বাধ্য হই।

হলো বয়েই গেল! আমাদের তালিকা পাওয়া নিয়ে কথা। তাদের মনের ইচ্ছাটা শুধু জানার দরকার। কাগজ পেন্সিল নিয়ে না হয় দুজন করেই পাশের ঘরে যাবে—

কিন্তু জোড়া গেঁথে যদি আমরা পাশের ঘরে পাঠাই তাহলে তা, কখন ফিরবে তার কি কিছু ইয়ত্তা আছে? কোন ঘরে শেষ পর্যন্ত তাদের পাওয়া যাবে তাও বলা মুস্কিল। এমন কি,–বলতে গিয়ে আমি চেপে যাই।

মুস্কিল কিসের? ও জিজ্ঞেস করে।

মানে, আদৌ ফিরবে কিনা, কোনো ঘরেই পাওয়া যাবে কি না তাই বা কে জানে! আমার উপসংহার। আত্মীয়রা এবং আত্মীয়তা স্বভাবতই আমার কাছে রহস্যময়।

তাহলে—তাহলে না হয় এক একজন করেই ছাড়া যাবে। কল্পনা বলে : তারপরে আর কি, তালিকার ছটা আইটেমের মধ্যে যেগুলো বেশ ব্যয়সাধ্য সেগুলো হেঁটে বাদ দিলেই হবে। তখন খুব সহজেই আমাদের দেবার জিনিস আমরা বেছে নিতে পারবো।

যেমন ধরা যাক— আবার আমার উদাহরণের প্রতি টান : আমাদের মামাবাবু চান–

১। ল্যান্ড মাস্টার গাড়ি,

২। বিমানপথে ভূ-ভারত-ভ্রমণ,

৩। বালিগঞ্জে বাড়ি,

৪। বাঘ শিকার করতে,

৫। কোনো বিশেষ চিত্রতারকার সৌখ্য, এবং ৬। ভালো এক কৌটো সিগ্রেট, তাহলে তিনি খালি সিগ্রেটই উপহার পাবেন। কেমন, এই তো?

ঠিক তাই। তালিকার কোথাও না কোথাও তার মনের তাল পাওয়া যাবেই। যে তাল আমাদের মনের মানের সঙ্গে খাপ খাবে।

কনার ইচ্ছামতো, অভিলাষ-আসর জমানো গেল। তালিকাও পাওয়া গেল যথারীতি। কিন্তু পেয়ে দেখা গেল, না পেলেই ছিল ভালো! আমাদের আত্মীয়দের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও হার মানায়। মানুষকে আত্মহারা করে দেয়। মুক্তকচ্ছ করে মহাপ্রস্থানের পথে টানতে থাকে।

মঞ্জু, তার ইচ্ছা-তালিকায় চেয়েছে দেখলাম—এক, একখানা বাড়ি; সিমলাশৈলে হলেই ভালো হয়, নেহাতপক্ষে সিমলা স্ট্রিটে হলেও ক্ষতি নেই; দুই, অভিনেত্রী জীবন (বলাবাহুল্য, চিত্রনায়িকারূপে); তিন, কাশ্মীর বেড়ানো; চার, লাখখানেক টাকা (অনেক কমসম করেই); পাঁচ, নতুন ডিজাইনের ডজন খানেক শাড়ি; আর ছ নম্বরে, দেশবিখ্যাত স্বামী।

তালিকাটি আগাগোড়া চষে গেলাম—ওর কটুকষায় উপসমাপ্তি অবধি। ওর শেষ প্রার্থনাটা আমার দ্বারা পূর্ণ হবার নয়। খোঁচাটা লাগলো। কিন্তু আমার অভাবে, ওর এই অপূরণীয় ক্ষতি কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা কে জানে।

সিল্কের রুমাল। সাব্যস্ত করল কল্পনা।

সিল্কের রুমালের কথা কোথাও কিন্তু নেই ওর। আমি আপত্তি করি।

তাই চেয়েছে পাকে প্রকারে। কল্পনা গর্জে ওঠে: ওকরম চালচলনে সিল্কের রুমাল হলে মানায় না। উঁচু নজরটা দেখেছ?

আহা, তোমারই তো বোন— আমি বলতে যাই।

আমাদের আজে-বাজে স্বামী হলে চলে যায়, আর ওর চাই কি না— কল্পনা গজরাতে থাকে।

সত্যি। সন্দেশ-বিখ্যাত স্বামী চাইলেও না হয় একটা গতি করতে পারা যেত। কিন্তু ভীম নাগও এহেন নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসের আওতায় আসতে চাইবেন কি না ভাবতে গিয়ে আমায় থামতে হয়।

আমাদের মামাবাবুর চাহিদাটা একটু রাজনৈতিক। তিনি কলকাতার মেয়র হতে চেয়েছেন। মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে একজন হতেও তার অনিচ্ছা নেই। ওই দুইয়ের একটাও যদি ঘটে যায় তাহলে কলকাতায় বাড়ি পাবার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি তিন নম্বরের মধ্যে আনতেই রাজি নন; কেননা পূর্বোক্তরূপ বাড়াবাড়ি তার ভাগ্যে ঘটলে ঘরবাড়ি ইত্যাদি অবলীলাক্রমে আপনা থেকেই এসে যাবে। চতুর্থতঃ, রাজপ্রমুখ উপাধি লাভ করা। রাজত্ব থাকলে যে রাজপ্রমুখহওয়া যায় না একথা মানতে তিনি নারাজ। পঞ্চমত, বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, নিতান্ত না হতে পারলে তার বদলে—সেইটাই তাঁর শেষ ইচ্ছা—খাদ্য মন্ত্রীর দপ্তরে কোনো পদ (সেজন্য যেকোনো অপদস্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন)।

তাঁকে এক কৌটো সিগ্রেট দিলেই হবে, আমরা বিবেচনা করে দেখলুম। কেননা যন্দুর অবধি দৃষ্টি যায়, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ধোঁয়াতেই পরিসমাপ্ত হতে বাধ্য, দেখা গেল।

সৌম্য চেয়েছে (১) একটা মোটর সাইকেল, (২) কোডাকের ক্যামেরা, (৩) রাণিং শু, (৪) সাঁতার কাটবার নিজস্ব একটা পুকুর, (৫) একখানা ভালো ডিটেকটিভ বই, (৬) আস্ত একটা এরোপ্লেন।

ওর ইচ্ছামত, একখানা গোয়েন্দাকাহিনী ওকে দিতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হোলো না। ব্ল্যাক গার্লস সার্চ ফর গডবার্নার্ড শর সেই বইখানা পড়ে ছিল—দিয়ে দেয়া গেল।

রঞ্জনের অভিলাষ একটু বিচিত্র রকমের। বন্দুক, পিস্তল, রিভলবার, হাতবোমা ইত্যাদি মারাত্মক যত অস্ত্রশস্ত্রেই তার অভিরুচি।

এছাড়াও বঞ্জনের একটা পুনশ্চ ছিলো, একশো গজ লাল রঙের শালু, কেন যে তা কে জানে। তার এই লালসার মধ্যে একটু কমরেড-কমরেড-গন্ধ মিলতে লাগল। লাল নিশান উড়িয়ে কেরলের দিকে ধাওয়া করবে কি না ওই জানে। আন্দাজটা ব্যক্ত করলাম।

কিন্তু এই বাজারে একখানা রুমাল কেনা দায়, কালোবাজারে আর লালবাজারে রেষারেষি,–এর মাঝে শালু আমি পাই কোথায়?

তাও আবার একশো গজ। কল্পনা মুখ বাঁকালো।

একশো গজের কথা থাক, একটা ইঁদুরের পরবার মতো কাপড় কেনার পয়সা জোটে। আমি বল্লাম : অবশ্যি এক কাজ করলে হয়। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। আমাদের মঞ্জুর সঙ্গেই–

আর মঞ্জুকে একটা শালুর ব্লাউজ দিলেই চলে যাবে।

কল্পনাই উভয় সঙ্কটের সমাধান করে দেয়।

লাল শালুর ব্লাউজ। এক গজেই হবে তো? সায় দিই আমি? তাহলে একরকম একশ গজই দেয়া হবে। মঞ্জু আমাদের একাই একশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *