১. পাকিস্তান : রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল

প্রথম অধ্যায় – পাকিস্তান: রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল

  • আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে গণরোষ।
  • শেষ অধ্যায়।
  • জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখল।
  • কেন্দ্রিয় শাসকগোষ্ঠির অপশাসন-শোষণ, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিটি অঞ্চলে স্বাধিকার এবং স্বায়ত্ত্ব শাসনের আন্দোলন।
  • ৬ দফা আন্দোলন।
  • আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।
  • পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ঐক্যের ১১ দফা আন্দোলন।
  • পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূট্টোর উত্থান।
  • সারা দেশে ওয়ান ইউনিট বাতিল এবং নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের জোয়ার।
  • দেশব্যাপী আন্দোলনে অগ্রণীর ভূমিকায় ছিল জাগ্রত ছাত্র সমাজ। ‘৭০ এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপট।
  • প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়।

আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখল পাকিস্তানের জন্য অবিসংবাদিত বিপর্যয় ডেকে আনল। মার্শাল’ল জারি করার ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অবক্ষয় ঘটল। বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক ভারতে গণতন্ত্র যখন সুপ্রতিষ্ঠিত তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় বিশ্ব পরিসরে উপমহাদেশের মুসলমানদের ইমেজ বিনষ্ট হয়। সরকার রাজনীতিকদেরকে অর্ডিন্যান্স বলে অপরাধী ঘোষণা ঘোষণা করে জাতীয় রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল। মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার হরণ করে তিনি দেশের মানুষের উপর একনায়কত্ব চাপিয়ে দেন। আইয়ূবের বুনিয়াদি গণতন্ত্র দেশে দুর্নীতির প্রসার ঘটিয়েছিল। পাকিস্তানের ফেডারেল কাঠামো ভেঙ্গে কেন্দ্রকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের মূল পরিকল্পনার উপর আঘাত হানা হয়। আইয়ূব পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে একটা বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিলেন। বাঙ্গালী মুসলমানদের হিন্দু ভাবাপন্ন চির পরাধীন, সন্দেহপ্রবন বলে আখ্যায়িত করে তিনি দুই অংশের মধ্যকার সংহতি বিনষ্ট করেছিলেন। করাচী থেকে ফেডারেল ক্যাপিটাল পাঞ্জাবে স্থানান্তরিত করে করাচীর জনগণের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনেও অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। বুনিয়াদি গণতন্ত্র প্রথা প্রবর্তন করে তিনি আজীবন শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন বলে মনে করেছিলেন। এ প্রথা প্রবর্তনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের ৯জন নেতা আইয়ূব খানের এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাদের এই সাহসী পদক্ষেপ বুদ্ধিজীবি মহলে সমাদৃত হয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপ সময়োপযোগী হওয়। অপরিহার্য। এই সময়ের হেরফের একটি আন্দোলনকে বহু বছর পিছনে ঠেলে দিতে পারে। সে সময় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল আইয়ূব সরকারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির ঐক্য গড়ে তোলা। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। এ সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই জেনারেল আইয়ূব জাতির মাথায় বুনিয়াদি গণতন্ত্রের ভূত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হন।

কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সত্য হল এই যে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এক নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলে এবং সে গতি তার অমোঘ। বার বার করে ক্ষমতালোভী নেতৃত্ব এই সত্যটাকেই অস্বীকার করে থাকেন। মোনেম খানকে আইয়ূব খান বাংলাদেশে তার সবচেয়ে অনুগত এবং বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি হিসাবে বেছে নিয়ে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিয়োগ করেন। তার দ্বারা বাংলা সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালীর ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়। তার আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে দুর্নীতি প্রবেশ করে। কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতাকে তিনি ঠিকই বশীভূত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর পরিণতি মোনায়েমের জন্য সুখকর হয়নি। তার এই কূটকৌশলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল। মোনেম খাঁর ছেলে খসরু আইয়ূব বিরোধীদের খতম করার জন্য গুন্ডা বাহিনী গড়ে তুলেছিল। রাজনীতিতে ছেলে-ভাগ্নেদের প্রভাব কখনো কল্যাণকর হয়নি। অচিরেই মোনেম খাঁর অন্যায় গণবিরোধী কার্যকলাপের জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের ক্ষোভ আইয়ূব প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধুমায়িত হয়ে উঠে

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় কতগুলো অপ্রত্যাশিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে : পরবর্তী পর্যায়ে ঘটনাগুলো পাকিস্তানের রাজনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যুদ্ধ শেষে আইয়ূব খান ও লাল বাহাদুর শাস্ত্রির মধ্যে ঐতিহাসিক তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর দানের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে

তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন এবং নাটকীয়ভাবে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। একই কারণে তিনি তার মন্ত্রীত্বের পদেও ইস্তফা দেন। এরপর তিনি সরাসরিভাবে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। তিনি পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পি পি পি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জনাব ভুট্টো ও তার দল পিপিপি অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ হয়। জনাব ভুট্টো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেন তরুণ ও ছাত্র সমাজের কাছে। তার ডাকে বিশেষভাবে সাড়া দেয় পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ। নবগঠিত পিপিপি-কে জনপ্রিয় করে তুলতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনকে গতিশীল করে তুলতে তরুণ ছাত্র সমাজই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৮ সালের শেষাশেষি আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন পিপিপি-র নেতৃত্বে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে গণআন্দোলনের রূপ নেয়।

যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দেশরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয় ইউনিট এবং অস্ত্র সম্ভারের অভাবে ভারতীয় আক্রমণের মুখে ৩ দিন টিকে থাকার মত ব্যবস্থাও সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের উপর নির্ভরতার জন্য মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য অচল হয়ে যায়। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক, দেশরক্ষা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ৬ দফা দাবি পেশ করলেন। তখন তিনি অবশ্য এ কথাও বলেছিলেন যে, ৬ দফার প্রশ্নে আলোচনা করা যেতে পারে।

ছয় দফা :

(১) ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।

সংশোধিত: সরকারের চরিত্র হবে ফেডারেল এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক। জাতীয় এবং ফেডারেটিং ইউনিটসমূহতে প্রতক্ষ্য গণভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার অনুপাতে ফেডারেল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা হবে।

(২) কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে মাত্র দুইটি বিষয় থাকিবে। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয়সমূহ স্টেট বা প্রদেশসমূহের হাতে থাকিবে।

(৩) পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দুইটি পৃথক অথচ বিনিময় যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকিবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচাঁর না হইতে পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।

সংশোধিত: ফেডারেল সরকার শুধুমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং নিম্নে বর্ণিত শর্তসাপেক্ষে মুদ্রা সম্পর্কিত বিষয়াদির জন্য দায়ী থাকিবেন। বিষয়গুলো হল:-

ক) দুই উইং এর জন্য দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তনশীল মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হবে

অথবা-

সারা দেশের জন্য একটি মুদ্রা ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন প্রবর্তন করতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ ও অর্থ পাচাঁর হতে না পারে।

খ) আলাদা ব্যাংকিং রিজার্ভ সৃষ্টি করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য; আলাদাভাবে আর্থিক এবং আয়-ব্যয় এবং হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের।

দুইটি ভিন্ন কিন্তু পরিবর্তশীল মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করা প্রতিটি অংশে কিংবা অঞ্চলের জন্য অথবা একটি মুদ্রা ব্যবস্থাই চালু থাকবে তবে কেন্দ্রিয় রিজার্ভ ব্যাংকিং সিষ্টেমের ভিতর আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক সৃষ্টি করতে হবে এবং এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে যাতে এক অঞ্চলের সম্পদ কিংবা অর্থ অন্য অঞ্চলে পাচাঁর করা সম্ভব না হয়।

(৪) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ধার্য্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউর একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের মূলধন হইবে।

সংশোধিত : আর্থিক লেনদেন, আয়-ব্যয় এবং পরিকল্পনা হবে ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর। ফেডারেটিং ইউনিটগুলো কেন্দ্রিয় সরকারকে বরাদ্দকৃত অর্থের যোগান দেবে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকান্ডের জন্য। দেশের সংবিধানে নির্ধারিত বরাদ্দ আয় কেন্দ্র পাবে যথাযথভাবে নির্ধারিত অনুপাতে। সংবিধানে এমন বিধান নির্ধারন করা হবে যাতে কেন্দ্রিয় সরকার ফেডারেটিং ইউনিটগুলোর কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পায় যাতে করে ফেডারেল ইউনিটগুলোর আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নীতিগুলোর উপর ক্ষেত্রবিশেষে নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়।

(৫) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আদায়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। এইসব অর্থ আঞ্চলিক সরকারের এখতিয়ারে থাকিবে। কেন্দ্রিয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দিবে অথবা সংবিধানের নির্ধারিত হারে আদায় হইবে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি-রপ্তানীর অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকিবে

সংশোধিত: বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সব হিসাব প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিটের নিয়ন্ত্রণে পৃথক পৃথক ভাবে রাখার বিধান সংবিধানে রাখা হবে। কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিটি ফেডারেটিং ইউনিট কি অনুপাতে প্রদান করে সেটা সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত থাকবে। দেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারনের দায়িত্ব হবে কেন্দ্রিয় সরকারের। কিন্তু সেই নীতির আওতায় আঞ্চলিক সরকারগুলো বহিবাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা এবং চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে সেই বিধানও সংবিধানে থাকিতে হইবে।

(৬) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষীবাহিনী গঠন করা হইবে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মনির্ভরশীল করিতে হইবে।

সংশোধিত: জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ফেডারেটিং ইউনিটগুলো নিজস্ব মিলিশিয়া অথবা প্যারামিলিটারী ফোর্স গঠন করতে পারবে।

৬ দফা দাবি প্রণয়নের পরই মুজিবের প্রতি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার আক্রোশ বেড়ে যায়। ৬ দফার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয় পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার কথা। ঐ দাবির মধ্যে পাঞ্জাবী চক্র দেশদ্রোহিতার গন্ধ পান : তারা ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী অপপ্রয়াস বলে চিত্রিত করেন। মূলতঃ ৬ দফা ছিল পাকিস্তান ভিত্তিক বাঙ্গালীদের মুক্তি সনদ মাত্র। এই ৬ দফা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য মুজিব ও আওয়ামী লীগের উপর বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা চাপিয়ে দেয়া হয় একটার পর একটা। কোন মামলায় জামিন নিয়ে জেল থেকে বেরুনোর মুহূর্তে জেল গেট থেকে আবার মুজিব ও তার সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হত। অন্যায়ভাবে মুজিবকে এভাবে পুনঃ পুনঃ গ্রেফতার করার ফলে দেশবাসী বিশেষভাবে মুজিবের প্রতি আকৃষ্ট হয় ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে। ৬ দফার প্রতিও জনসমর্থন বাড়তে থাকে। ক্রমান্বয়ে ৬ দফা হয়ে উঠে বাঙ্গালী জনগণের মনের দাবি, সোচ্চার হয়ে উঠে তারা।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ষড়যন্ত্র চলল বাংলার সোচ্চার কণ্ঠ দাবিয়ে রাখার। হঠাৎ করে ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারী ২জন বাঙ্গালী সিএসপি অফিসার সহ মোট ২৮ জন সামরিক/বেসামরিক বাঙ্গালী অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় ‘৬৭ এর ডিসেম্বরে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার চক্রান্ত করছিল। ১৭ই জানুয়ারী রাতে হঠাৎ করে মুজিবকে মুক্তি দেয়া হল। জেল গেট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগুতেই সামরিক বাহিনীর ব্যক্তিরা তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। ১৮ই জানুয়ারী এক প্রেসনোটে বলা হয়, “মুজিব একটি ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী”। এই মামলার নাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আসামীর সংখ্যা ৩৫জন। এর মধ্যে বঙ্গবীর এমএজি ওসমানীও রয়েছেন। রাজসাক্ষী ১১ জন। ২১শে এপ্রিল গঠিত হল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। বিচার শুরু হয় কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ১৯শে জুন। ঐ মামলার ঘটনার সঙ্গে শেখ মুজিব কোনভাবেই জড়িত ছিলেন না। তবু তাকে ঐ মামলায় জড়ানো হয়েছিল তার দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানোর উদ্দেশ্যে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে চাকুরীরত বাঙ্গালী সদস্যদের প্রায় সবাই পাঞ্জাবী শাসককুলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন। তাদের বিজাতীয় শাসন-শোষণ, বঞ্চনা ও অবহেলার প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী ছিলেন তারা।

নৌ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালীদের প্রতি অবিচার ও ক্রমাগত অবহেলায় পাঞ্জাবী শাসক চক্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর কতিপয় দুঃসাহসী তরুণ সদস্য এবং কয়েকজন প্রভাবশালী বাঙ্গালী আমলার সহায়তায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা করেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও। কিন্তু শেখ মুজিব কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কথা চিন্তা করেননি। তিনি স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবি জানিয়েছিলেন মাত্র।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ধারা বিবরণী খবরের কাগজে প্রকাশিত করতে থাকে আইয়ূব-মোনেম চক্র। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মুসলমানদের ভারত বিরোধী মনোভাবকে তাদের স্বার্থে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, মানুষ যখন জানতে পারবে শেখ মুজিব ভারতের দালাল হয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কিন্তু পরিণাম হল সম্পূর্ণ উল্টোটাই। প্রকাশিত ধারা বিবরণীর মধ্যেই পরিস্ফুটিত হয়ে উঠল আইয়ূব-মোনেম চক্রের ঘৃণ্য চক্রান্ত। এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলাকে তখন বাঙ্গালীরা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেই ধরে নেয়। ফলে সারা বাংলার মানুষ আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে রুদ্র আক্রোশে ফেটে পড়ল। এখানে আবারও উল্লেখ করতে হয় যে, আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানেও মুখ্য এবং অগ্রণী ভূমিকা ছিল ছাত্র সমাজের। তারা ইতিমধ্যেই সংগ্রামকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংগ্রামে রূপ দেবার লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১১ দফার ভেতরেই বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠে। ১১ দফার ভিত্তিতেই বাংলার মাটিতে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের জোয়ার এক প্রচন্ড রূপ ধারণ করে।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি:

স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘ দিনের অনুসৃত জনস্বার্থ বিরোধী নীতির ফলেই ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর জীবনে সংকট ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে। শাসন-শোষনের নিপীড়নে অতিষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিয়াছেন। আমরা ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে নিম্নোক্ত ১১ দফা দাবিতে ব্যাপক ছাত্র গণআন্দোলনের আহ্বান জানাইতেছি :-

১। (ক) স্বচ্ছল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকরণের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকরণকৃত কলেজসমূহকে পূর্বাবস্থায় ফিরাইয়া দিতে হইবে।

(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল- কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজসমূহকে সত্ত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষার প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।

গ) প্রদেশের কলেজসমূহে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি, আইকম ও বিএ, বিএসসি, বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাশ চালু করিতে হইবে।

(ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করিতে হইবে। স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার অপরাধে স্কলারশীপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।

(ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল ও কেন্টিন খরচার ৫০ ভাগ সরকারি সাবসিডি হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।

(চ) হল ও হোস্টেলের সমস্যা সমাধান করিতে হইবে।

(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হইবে।

(জ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে।

(ঝ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে এবং অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা বন্ধ, মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করা প্রভৃতি মেডিকেল ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে। নার্স ছাত্রীদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।

(ঞ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সুব্যবস্থা, প্রকৌশল ছাত্রদের শেষ বর্ষেও ক্লাশ লইতে হইবে।

(ট) পলিটেকনিক ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের সুযোগ দিতে হইবে এবং বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করিয়া একমাত্র সেমিষ্টার পরীক্ষার ভিত্তিতেই ডিপ্লোমা দিতে হইবে।

(ঠ) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনোলজি এবং আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি অবিলম্বে মানিয়া লইতে হইবে। আইইআর ছাত্রদের ১০ দফা, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের, এমবিএ ছাত্রদের, ও আইন ছাত্রদের সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হইবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ফ্যাকাল্টি করিতে হইবে।

(ড) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানিয়া লইতে হইবে। কৃষি ডিপ্লোমা ছাত্রদের কন্ডেন্স কোর্সের দাবিসহ কৃষি ছাত্রদের সকল দাবি মানিয়া লইতে হইবে।

(ঢ) ট্রেনে, স্টীমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ কন্সেসনে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকেটেও এইরূপ সুবিধা দিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলেও বাস যাতায়াতে ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুলে ও কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের ৫০% কন্সেসন দিতে হইবে।

(ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা বিধান করিতে হইবে।

(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করিতে হইবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্ব শাসন দিতে হইবে।

(থ) শাসক গোষ্ঠির শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামান্য দলিল জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট সম্পূর্ণ বাতিল এবং ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে গণমুখী বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করিতে হবে।

(২) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হইবে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।

(৩) নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্ব শাসন দিতে হইবে।

(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ। এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।

(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরঙ্কুশ।

(গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচাঁর হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতির প্রবর্তন করিতে হইবে।

(ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর ধার্য করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকিবে।

(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করিবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকিবে।

(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মান ও নৌ বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।

৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুসহ সকল প্রদেশের স্বায়ত্ত্ব শাসন প্রদানকরতঃ সাব ফেডারেশন গঠন।

৫। ব্যাংক, বীমা, পাট ব্যবসা ও বৃহৎ ভারী শিল্প জাতীয়করণ করিতে হইবে।

৬। কৃষকদের উপর হইতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করিতে হইবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋন মওকুফ করিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মনপ্রতি ৪০ টাকা নির্ধারন ও আখের ন্যায্যমূল্য দিতে হইবে।

৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী ও বোনাস দিতে হইবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কায়দা-কানুন প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে হইবে।

৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জন সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।

৯। জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা ও আন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।

(১০) সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোট বর্হিভূত স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি কায়েম করিতে হইবে।

(১১) দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করিতে হইবে।

সংগ্রামী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্ব দেন আব্দুর রউফ (সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ), খালেদ মোহাম্মদ আলি (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ), সাইফুদ্দিন আহমদ (সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), সামসুদ্দোহা (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), মোস্তফা জামাল হায়দার (সহ-সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), দীপা দত্ত (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন), তোফায়েল আহমদ (সহ-সভাপতি, ডাকসু), নাজিম কামরান চৌধুরি (সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু)। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিন্তু সেদিন ছাত্র আন্দোলনের সাথে তাল রেখে চলতে পারেননি। সমগ্র বাংলার জনগণের কাছে সেদিন ৬ দফা আন্দোলনকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরুণ আট নেতার জনপ্রিয়তার কাছে সেদিন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভাবমুর্তি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তিকালে আগরতলা মামলা থেকে শেখ মুজিবর রহমান ছাড়া পেয়ে রেসকোর্স ময়দানে প্রথম বক্তৃতায় বলতে বাধ্য হন, “জেল থেকে বেরিয়ে এসে আমি দেখি আওয়ামী লীগের ৬ দফা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফায় বিলীন হয়ে গেছে।” যাই হোক আন্দোলন তখন দুর্বার হয়ে উঠেছে। প্রমাদ গুনলেন আইয়ূব খান। এমন সময়ই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে বন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় কুর্মিটোলায়। এর প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী গর্জে উঠলেন আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে। অতীতে তিনি প্রতিটি গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে আন্দোলনের বীজ। তিনি কিভাবে চুপ থাকতে পারেন। ভাসানী ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবেন বলে হুমকি দিলেন। তার নেতৃত্বে ঢাকার বুকে আন্দোলন উদ্দাম হয়ে উঠল। বাধঁভাঙ্গা ঢেউয়ের মত বাংলার দামাল ছেলেরা মার্শাল’ল ভঙ্গ করল। এখানেও অগ্রণীর ভূমিকায় জাগ্রত ছাত্র সমাজ। কারফিউ চলছে দিন-রাত। তার মধ্যে বর্জকণ্ঠে গর্জন উঠল মধ্যরাতে ‘জয় বাংলা’। হল থেকে হলে, তার পর বাইরে। কারফিউ আগ্রায্য করে ঢাকার রাজপথে জনতার ঢল নামল। সে রাতেই গুলি চলল। অগনিত দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী শাহাদাত বরণ করলেন সামরিক বাহিনীর গুলিতে। এতটুকু বিচলিত হলনা বাংলার দুর্জয় মানুষ। বজ্র কঠিন শপথ নিয়ে এগিয়ে চলল তারা। তাদের প্রিয় নেতাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছিনিয়ে আনবেই। বুকের রক্তের বিনিময়ে অধিকার আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়ের মুখে ধ্বসে পড়ল আইয়ূব প্রশাসন। এতে অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠে সার্বিক পরিস্থিতি।

জাতীয় রাজনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমি তখন কোয়েটায় ১৬ ডিভিশনের ৬২ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্টে পোস্টেড। আমার আবাস কিংস রোডের আর্টিলারী অফিসার্স মেসে। আমি ছাড়াও তখন কোয়েটাতে বেশ কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার বিভিন্ন রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নে পোস্টেড ছিলেন। কর্নেল দস্তগীর জিওয়ান ডিভ হেডকোয়ার্টার্স, মেজর হাফিজ ৬২ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন শহীদ ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন শরফুল ৩৩ ক্যেভারলী, ক্যাপ্টেন মহসীন বেলুচ রেজিমেন্ট, মেজর মালেক বি এম, মেজর কাদের ইঞ্জিনিয়ার্স, ক্যাপ্টেন মাওলা ইএমই ব্যাটালিয়ন, ক্যাপ্টেন আমছা আমিন ইনফ্যানট্রি স্কুল, ক্যাপ্টেন জাকের, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাফায়াত, লেফটেন্যান্ট হারুণ ২৬ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন ইফতেখার, ক্যাপ্টেন মাজহার উদ্দিন মোল্লা, লেফটেন্যান্ট কে বি ৬৩ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ক্যাপ্টেন জামাল এএমসি, ক্যাপ্টেন কাসেম এএসসি প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন বেশ কিছু সংখ্যক জেসিও, এনসিও ও জোয়ান ভাইরা স্কুল অফ ইনফ্যানট্রি এন্ড ট্যাকটিকস, ইএমই ব্যাটালিয়ন, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, ডিভ হেডকোয়ার্টার্স, ষ্টাফ কলেজ এবং ৩৩ ক্যেভারলী রেজিমেন্টে।

কোয়েটায় বাঙ্গালীদের ছোট পরিবার ছিল একটি সুখী পরিবার। আমরা সবাই মিলেমিশে হাসি আনন্দে কাটাতাম দিনগুলো। প্রায়ই আমরা সমবেত হতাম কোথাও না কোথাও। চলতো আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা, গান-বাজনা, গল্প-গুজব। জাতীয় সংকট আমাদের মাঝের ব্যবধানকে কমিয়ে আনল আরো। সবাই দেশ সম্পর্কে সচেতন, সবাই শংকিত। ভাবনায় আকুল, কি হচ্ছে? ঘটনা প্রবাহের পরিণাম কি? প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ক্ষমতা লিপ্সা কোথায় নিয়ে যাবে দেশটাকে? পাকিস্তান টিকে থাকবে কি করে? অন্যায়, অবিচার, শাসন-শোষণ শেষ হবে কবে? আইয়ূব খানের প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে সম্পূর্ণরূপে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তিনি কি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান মেনে নেবেন আলোচনার মাধ্যমে? নাকি ক্ষমতার মোহে দেশকে আরো রসাতলে টেনে নিয়ে যাবেন? গোপনে আমরা মিলিত হই বিভিন্ন জায়গায়। আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে পেতে চাই এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব। খবরা-খবরের আদান- প্রদান হয় নিজেদের মধ্যে। প্রতিটি নতুন খবর পর্যালোচনা করি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। খবর পাই দেশ থেকে আসা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। মনযোগ দিয়ে শুনি বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অফ অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি কেন্দ্রের প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি। জাতীয় রেডিও এবং টিভি মাধ্যমের প্রচারিত খবর একপেশে হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। মাঝে মধ্যে সিগন্যালস্ সেন্টারের বাঙ্গালী ভাইরা নিয়ে আসে জিএইচকিউ থেকে প্রেরিত গোপন বার্তাসমূহের সারবস্তু। এ থেকে শাসকচক্রের মন মানসিকতা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাই বা কতটুকু? পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের প্রতি মুহূর্তের ঘটনাবলী জানার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকে তীর্থের কাকের মত। দেড় হাজার মাইল দূরত্বে বসে সীমিত মাধ্যমে ঘটনা প্রবাহের যতটুকু খবরা-খবরই পাচ্ছিলাম, তার চুলচেরা বিশ্লেষন করে অবস্থার সাথে নিজেদের যতটুকু সম্ভব সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম আমরা। কিন্তু সবকিছুই করতে হচ্ছিল বিশেষ সতর্কতার সাথে। মনের দাহ ও আক্রোশ অতি কষ্টে চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম সবাই। নিজেদের সংযত রেখে ধৈর্য্য সহকারে অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে সবাইকে এ সিদ্ধান্তই গৃহিত হয় গোপন বৈঠকগুলোতে। -আশা-নিরাশার এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় কাটছিল আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত।

১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী হঠাৎ করে এক সরকারি ঘোষণায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ঐ দিন দুপুরে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে কুর্মিটোলা সেনানিবাস থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের ঝড় উঠেছে। এবারের আন্দোলন এক ইউনিট বাতিল করার আন্দোলন। সারা পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের আন্দোলনে সমন্বয় সাধন করার লক্ষ্যে ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) গঠন করলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান ডাকের প্রধান নির্বাচিত হলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গোটা দেশব্যাপী আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়েই মার্শাল আইয়ূব খান উভয় অংশের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দেশের সার্বিক সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করলেন। শেখ মুজিব, মাওলানা ভাসানী, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ বহু নেতা আমন্ত্রিত হলেন গোলটেবিল বৈঠকে

প্রেসিডেন্টের গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন প্রবাসে আমাদের মনে আশার আলো জ্বালাল। ক্ষীন আশা জাগল মনে। বৃহত্তর স্বার্থে হয়তো বা বর্তমান সংকট থেকে দেশকে বাচাঁবার জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করবার আন্তরিক প্রচেষ্টা করবেন সংশ্লিষ্ট সবাই। তবু রয়ে যায় সংশয়।

এদিকে প্রচন্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিব নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, দেখলেন ইতিমধ্যেই তিনি সারা পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে গেছেন। অথচ পূর্ব বাংলার একক নেতৃত্বের সবটুকুই কিন্তু তার একার অর্জিত সম্পদ ছিল না। বাংলাদেশের জনতা চিরদিনই চলেছে আগে আগে আর নেতারা চলেছেন পেছনে। পূর্ব পাকিস্তানের জনতার মন তখন স্বাধীনতা পাগল। তারা চঞ্চল, চরম বিষ্ফোরন ঘটানোর জন্য আকুল। কিন্তু সামনে নেই কোন উপযুক্ত নেতৃত্ব। রাজনৈতিক অঙ্গনে যার রয়েছে ভাবমুর্তি, আন্দোলন গড়ে তোলার মত অবদান সেই ভাসানী তখন বৃদ্ধ। অবদান প্রচুর, রাজনৈতিক প্রজ্ঞারও অভাব ছিল না তার। কিন্তু দেশব্যাপী সংগঠনের অভাব ছিল তার। তাই ইমেজ থাকলেও তার পক্ষে তখন আন্দোলনকে গড়ে তুলে তাকে ধরে রেখে ধাপে ধাপে চরম লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া সম্ভব ছিলনা। এদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবর রহমানকে রাতারাতি পরিনত করেছে এক কিংবদন্তী নায়কে। তাই বিষ্ফোরম্মুখ পূর্ব পাকিস্তান নেই মুহূর্তে জনগণ তাকে নেতৃত্বে বরণ করে নিতে দ্বিধাবোধ করেনি।

শেখ মুজিব আইয়ূব খানের গোলটেবিল বৈঠকের আমন্ত্রন গ্রহণ করলেন। অন্যান্য নেতাসহ প্রতিশ্রুতি দিলেন একমাত্র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতেই গোলটেবিল বৈঠকে তিনি আলোচনা করবেন।

মাওলানা ভাসানী পক্ষান্তরে এই বৈঠক বর্জন করে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষ কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অবস্থা বিশ্লেষনে তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব বাংলাকে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করা ছাড়া এ পর্যায়ে রাজনৈতিক জটিলতার অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। তাই পল্টনের এক বিশাল জনসভায় তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, “পশ্চিম পাকিস্তান আস্সালামু আলাইকুম।” ঐ জনসভায় তিনি শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান না করারও পরামর্শ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোও সে বৈঠক বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাওলানা ভাসানী ও ভুট্টোর গোলটেবিল বৈঠক বর্জন জনগণকে বৈঠকের সফলতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে। আমরাও হতাশ হয়ে পড়ি। আশার ক্ষীন আলো যা দেখতে পেয়েছিলাম হঠাৎ করেই যেন তা মিলিয়ে গেল। উৎকণ্ঠায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকলাম। পাকিস্তানের দুই অংশের দুই প্রভাবশালী নেতার অনুপস্থিতিতে ২৬শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক বসে। প্রথম বৈঠকের পর অধিবেশন মুলতবী হয়ে যায় ১০ই মার্চ পর্যন্ত। ১০ই মার্চের অধিবেশনে শেখ মুজিব তার ওয়াদার বরখেলাপ করলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার পরিবর্তে শেখ মুজিব তার ৬ দফার দাবি উত্থাপন করলেন। কথা ছিল ১১ দফাই হবে বৈঠকে ডাক এর আলোচনার ভিত্তি। কোন বিশেষ পার্টি প্রোগ্রাম বা দাবি সেখানে উত্থাপিত হবে না। কিন্তু মুজিব সমঝোতার বরখেলাপ করে ৬ দফার দাবি উত্থাপন করায় নেতাদের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হল। ডাক ভেঙ্গে গেল। বৈঠকে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হল না। ১৩ই মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ূব সভাপতির ভাষণে দুইটি প্রস্তাব মেনে নেন

১) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন এবং

২) পার্লামেন্টারী শাসন পুনঃপ্রবর্তন।

১৪ই মার্চ শেখ মুজিব ও তার ৯ সদস্য ঢাকায় ফিরে আসেন। ততক্ষণে নতুন ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়েছে।

সারা দেশব্যাপী আইয়ূব বিরোধী বিক্ষোভ তখন তুঙ্গে। আইয়ুবের ব্যক্তিগত ভাবমুর্তি ও জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ কমে আসছে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারীতে পুমনারী এমবোলিজমে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এতে করে তার কর্মক্ষমতা বিশেষভাবে হ্রাস পায়। তিনি আর আগের মত সবখানে যেতে পারছেন না। গণসংযোগ রক্ষা করতে পারছেন না প্রয়োজন মত। সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ ও ইউনিটগুলো থেকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন দিনকে দিন। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন গুটিকতক জ্বী-হুজুর টাইপ আমলার উপর। প্রতিদিনের রুটিন কাজগুলো সংক্ষিপ্ত করে সম্পাদন করতে হচ্ছিল তাকে।

এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন চক্রান্তকারী ক্ষমতা লিপ্সু জেনারেলগণ। তাদের সাথে হাত মিলান জনাব ভুট্টো এবং আইয়ূব বিরোধী বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সদস্যবৃন্দ। আইয়ূব বিরোধী এই চক্রান্তের নেতৃত্ব দেন তারই নিযুক্ত সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান যখন সেনা প্রধান হিসাবে জনাব ইস্কান্দর মির্জাকে সরিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত আটছিলেন তখন তরুণ সেনা অফিসার ইয়াহিয়া খান ছিলেন তার বিশেষ অনুগত একজন ষ্টাফ অফিসার। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের নীল নকশা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে উঠেন তিনি। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে জেনারেল মুসা খান সামরিক বাহিনী প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি নেবার পর অনেককে সুপারসিড করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সেনা প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয়। আইয়ূব খানের ধারণায় ইয়াহিয়া ছিলেন সহজ হালকা মেজাজের আরামপ্রিয় একজন সামরিক অফিসার। যার কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস নেই। ভেবেছিলেন, স্বীয় শাসন টিকিয়ে রাখতে জেনারেল ইয়াহিয়ার মাধ্যমে সেনা বাহিনীর উপর তিনি তার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন অতি সহজে। কিন্তু তার সে ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একদিকে জেনারেলদের নিয়ে ইয়াহিয়া খান তার ক্ষমতা দখলের নীল নকশা নতুন করে তৈরি করতে গোপন বৈঠকে মিলিত হতে থাকেন; অপরদিকে জেনারেল পীরজাদার মাধ্যমে ভুট্টোকে উৎসাহিত করেন আইয়ূব বিরোধী গণআন্দোলন জোরদার করে তোলার জন্য। জেনারেলদের পরোক্ষ আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই জনাব ভুট্টো সরাসরিভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন ও আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে অতি উৎসাহী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রভাবশালী বেসরকারি আমলা জনাব আজিজ আহমেদ ও তার অনুসারীরা আইয়ূব বিরোধী প্রচারণা অতি চতুরতার সাথে ছড়িয়ে দিলেন সরকারি আমলাদের মধ্যে। প্রশাসনের একটি অংশকে আইয়ূব শাহীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয় সে প্রচারণা। উপরন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে মেজর জেনারেল আকবরের নির্দেশে এমন সব তথ্য প্রেসিডেন্টকে জানানো হচ্ছিল যাতে ক্রমশঃই আইয়ূব খান হয়ে পড়ছিলেন আশাহীন ও দুর্বল। হারিয়ে ফেলছিলেন আত্মবিশ্বাস।

এহেন পরিস্থিতিতে, ১৯শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে ডেকে পাঠালেন জেনারেল মোজাফফর উদ্দিনকে। একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হল জেনারেলদের। বৈঠকে চীফ অফ জেনারেল ষ্টাফ জেনারেল গুল হাসান সবার তরফ থেকে সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে প্রস্তাব রাখলেন, “আমরা দেশের অবস্থার অবনতি আর সহ্য করব না। দেশের অখন্ডতা আজ হুমকির সম্মুখীন। আইয়ূব প্রশাসন আজ সম্পূর্ণরূপে অকেজো। এ পরিস্থিতিতে আপনার নেতৃত্বে মার্শাল’ল জারি করা ছাড়া দেশকে বাচানোর আর কোন পথ নেই। আপনি যত সত্ত্বর সম্ভব দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করুন।” বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২৫শে মার্চ দেশে সামরিক শাসন জারি করা হবে। গোপন এই বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান জেনারেল আইয়ূরকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, “আমরা পরিস্থিতির অবনতি আর দেখতে চাই না। ২৫শে মার্চের মধ্যে আপনার যা করণীয় করে ফেলুন।” আইয়ূব খান পরিস্থিতির উন্নতির জন্য শেষ চেষ্টা স্বরূপ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণর বদল করেন। কিন্তু তাতেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না।

২৪শে মার্চ জেনারেল রাও ফরমান আলী জেনারেল মোজাফ্ফর উদ্দীনের সাথে রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে জেনারেলদের মিটিং হল। অনেক ফর্মেশন কমান্ডাররা উপস্থিত ছিলেন সেই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ। মার্শাল’ল প্রস্তাব নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর তারা সবাই মিলে প্রেসিডেন্ট হাউজে গেলেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব, আলতাফ গওহর এবং ফিদা হাসান অপেক্ষা করছিলেন আলোচনার প্রথমেই প্রেসিডেন্ট দৃঢ়তার সাথে বললেন,

—এখন দেখছি মার্শাল’ল ছাড়া কোন উপায় নেই।

—আলবত। ইয়াহিয়া খান বললেন।

প্রেসিডেন্ট আইয়ূব ভেবেছিলেন তার নেতৃত্বে মার্শাল’ল জারি হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান দৃঢ়তার সাথে বললেন,

—মার্শাল’ল সামরিক বাহিনীর লোকদের নেতৃত্বে হবে। এ কথা শুনে আইয়ূব খান বললেন,

—আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে, আমি পদত্যাগ করছি। আইয়ূব- খানের বক্তৃতা রেকর্ড করা হল। ২৪শে মার্চই ইয়াহিয়া ভুট্টোর সাথে দেখা করে বললেন,

—আইয়ূব খান ব্যর্থ হয়েছেন, আমি ক্ষমতা গ্রহণ করেছি। এখন তোমার মতামত কি? অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে ভুট্টো শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন জানালেন।

২৫শে মার্চ রাতে আইয়ূবের রেকর্ডকৃত বক্তৃতা জাতির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হল। আইয়ূব পদত্যাগের কথা ঘোষণা করলেন। সামরিক শাসন জারি হল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। শাসনতন্ত্র স্থগিত করার সামরিক ফরমান জারি হল। সামরিক শাসন জারি করার যৌক্তিকতা বয়ান করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব তার বক্তৃতায় বললেন, “প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সার্বিক বিশৃঙ্খলার জন্যই সামরিক শাসন বাধ্য হয়ে জারি করা হল।”

১১ বছর আইয়ূব শাহীর শোষণ-শাসনের ফলে দেশের অবকাঠামো যখন সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে তখন প্রভাবশালী ফিল্ড মার্শাল অত্যন্ত অসহায়ের মতো বললেন, “রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেশের ধ্বংসযজ্ঞ স্বচক্ষে দেখতে চাই না বলেই আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে স্বৈরাচারের কি করুণ পরিণতি।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসন জারি ও সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্ব গ্রহণে দেশবাসী খুব একটা বিস্মিত হয়নি। এ যেন ছিল অনেকটা অবধারিত পরিণতি 1 আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবার প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যায় তখন স্বৈরাচারী একনায়কত্ব অস্ত্র শক্তির জোরে জাতির উপর একপেশে সমাধান চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর আইয়ূব খানের কাছেও সামরিক শাসন জারি করা ছাড়া আর অন্য কোন পথ ছিল না। আইয়ূব বিরোধী প্রচন্ড গণবিক্ষোভের মুখে আইয়ূব শাহীকে টিকিয়ে রেখে কিংবা আইয়ূব খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি করে অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনাও ছিল অসম্ভব। তাই আইয়ূব খানকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে মার্শাল’ল জারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জেনারেলরা। অনেককেই সে সময় বলতে শুনেছি নেহায়েত অপারগ হয়েই নাকি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক- ভারত যুদ্ধের পর থেকে ঘটনাবলী এটাই প্রমাণ করে যে আইয়ূব খানের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমবর্ধমান সার্বিক পরিস্থিতির অবনতির সাথে তাল মিলিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও ক্ষমতালিপ্পু জেনারেলরা ঠান্ডা মাথায় ক্ষমতা দখলের নীল নকশা তৈরি করে চলেছিলেন পর্দার অন্তরালে অতি গোপনে।

ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখলের উপাখ্যান কিছুটা আকস্মিক হলেও সাধারণভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেমন এতে বিস্মিতও হলেন না ঠিক তেমনি অখুশিও হলেন না। সদ্য প্রচারিত সামরিক আইনকে অভিনন্দন না জানালেও নীরবে এ পরিবর্তনকে তারা যেন মেনেই নিলেন। ক্ষমতা দখলের ২৪ ঘন্টার মধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির প্রতি প্রদত্ত ভাষণে বললেন, “আমি আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই আমার কোন রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। আমার একমাত্র প্রচেষ্টা হবে অতিসত্ত্বর একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার গঠন করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়া। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি গঠনমূলক রাজনৈতিক তৎপরতা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সুষ্ঠ, সৎ এবং পরিচ্ছন্ন কার্যকর প্রশাসন একটি পূর্ব শর্ত। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণই জাতিকে প্রদান করবেন একটি উপযুক্ত শাসনতন্ত্র এবং তাদের দায়িত্ব হবে সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সমস্যার সমাধান করা। যে সমস্ত সমস্যাবলী আজ জনমনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সেগুলোর সমাধানও তাদেরই বের করতে হবে।

ইয়াহিয়া খানের এ ভাষণের পর হঠাৎ করেই আন্দোলন, স্ট্রাইক সব বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র ও শিক্ষকগণ সব আন্দোলন পরিহার করে আপন আপন কাজে যোগদান করলেন। এভাবেই অখন্ড পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটে শেষ অধ্যায়ের সূচনা হল। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক সরকার প্রধানদের বক্তব্যের মত ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণাকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকেই দেখলেন। ইয়াহিয়ার শাসন প্রক্রিয়াকে ‘আইয়ূব ছাড়া আইয়ূবী শাসন’ বলেও অভিহিত করলেন অনেকেই। প্রথমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলরা আইয়ূবী কায়দায় দেশ শাসন করার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার যথেষ্ট অভাব ছিল। তাই তারা সার্বিক পরিস্থিতির জটিলতা এবং দীর্ঘ দিন আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে গড়ে ওঠা জনগণের চাহিদার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। তারা ভেবেছিলেন প্রশাসনিক কাঠামোতে রদবদল করে প্রশাসন যন্ত্রকে কার্যক্ষম করে তোলাটাই মূল সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকারের প্রশ্নসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দাবিগুলো নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার মাধ্যমে অতি সহজেই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বলে তারা মনে করেন।

আইয়ূব আমলে শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল মুষ্টিমেয় সামরিক ও বেসামরিক আমলার হাতে। আইয়ূবী শাসনের শেষার্ধে প্রেসিডেন্ট জেনারেলদের চেয়ে বেসামরিক আমলাদের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেন। তার পতনের জন্য এই নির্ভরশীলতাও অনেকটা দায়ী। তাই ক্ষমতায় এসেই জেনারেলরা বেসামরিক আমলাদের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন। জেনারেল এসজিএম পীরজাদা নিয়োজিত হলেন ইয়াহিয়া খানের মুখ্য স্টাফ অফিসার হিসাবে। তার অধিনে নিয়োগ করা হল বিগ্রেডিয়ার রহীম (পাঞ্জাবী) মার্শাল’ল এফেয়ার্স ইনচার্জ এবং ব্রিগেডিয়ার করিম (বাঙ্গালী) বেসামরিক বিষয়াদির ইনচার্জ। পরবর্তী পর্যায়ে দু’জনই মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তারা দু’জনই ‘সুপার সচিব’ হিসাবে সমস্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। প্রশাসনিক কোন ব্যাপারই এই তিনজনের মাধ্যম ছাড়া রাষ্ট্রপতির গোচরে আনা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এভাবেই জেনারেল পীরজাদা সমগ্র আমলাতন্ত্রকে প্রেসিডেন্টের সান্নিধ্য থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। আইয়ূব আমলে উচ্চ পর্যায়ে নিয়োজিত অভিজ্ঞ আমলাদের অনেককেই সরিয়ে দেয়া হয়। অবসর গ্রহণেও বাধ্য করা হয় অনেককে। যেমন: আলতাফ গওহর, এনএ ফারুকী, ফিদা হাসান প্রমুখ। এতে সর্বোপরিসরে বেসামরিক আমলাতন্ত্র সামরিক জান্তার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে ক্ষমতা দখলের প্রথম লগ্ন থেকেই। জেনারেল পীরজাদা ক্রমশঃ হয়ে উঠেন ইয়াহিয়ার মুখ্য পরামর্শদাতা এবং রাজনৈতিক গুরু সানডে টাইমস তাকে ‘রাজপুটিন’ হিসাবে আখ্যায়িত করে। ৩১শে মার্চ ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট বনে গেলেন। যুক্তি হিসাবে বলা হল, নতুন সরকারকে বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের স্বীকৃতি দানে কূটনৈতিক জটিলতা দূরীভূত করার জন্যই জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট হতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানরূপে বলবত থাকেন। জেনারেল আইয়ূব খান ক্ষমতা দখলের পর একটি বেসামরিক মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অসম্মত হন। ফলে ৭ই আগষ্ট তিনি যে মন্ত্রীসভা গঠন করেন তাদের সবাই ছিলেন সামরিক বাহিনীর সদস্য। জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল পীরজাদা, এয়ার মার্শাল নূর খান ও এডমিরাল আসানকে নিয়ে গঠিত হয় ক্ষমতার কেন্দ্র কাউন্সিল অফ এডমিনিস্ট্রেশন। প্রয়োজন মত মন্ত্রণালয় থেকে সচিবদের ডেকে পাঠানো হত পরামর্শের জন্য। ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলরা সবাই মনে করতেন যে সুশৃঙ্খল সেনা বাহিনী তার সাংগঠনিক শক্তি, কার্যকরী জ্ঞান, প্রাযুক্তিক বিদ্যা এবং সমসাময়িক আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের সচেতনতা দেশ ও জাতির আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বিশেষভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

ইতিমধ্যে এয়ার মার্শাল নূর খান শ্রমিক ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কতগুলো সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি তিনি যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেন। তিনি তাদের স্ট্রাইক বা ধর্মঘট করার অধিকারকে বৈধতা প্রদান করেন। আইয়ূব শাহীর শিক্ষা নীতি বাতিল করে তিনি একটি নতুন শিক্ষা নীতি প্রণয়নের পদক্ষেপও গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটিতে ছাত্রদের প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাবও তিনি উত্থাপন করেন। নূর খানের এ সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ইয়াহিয়া খান ও তার কাউন্সিল অফ এডমিনিস্ট্রেশন কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। শংকিত হয়ে উঠেন ক্ষমতাশালী কায়েমী স্বার্থবাদীর দল। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বেসরকারি আমলা গোষ্ঠি বিশেষ করে জেনারেল পীরজাদা ও জেনারেল হামিদ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বোঝানো হল এয়ার মার্শাল নূর খান তার ব্যক্তিগত ভাবমুর্তিও জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে এ সমস্ত অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছেন এবং অবাস্তব প্রস্তাবাদি কাউন্সিল অফ এডমিনিস্ট্রেশন এর বৈঠকে উত্থাপন করছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মনে সন্দেহের উদ্রেক হল। তিনি ভাবলেন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্যই নূর খান এ সমস্ত কার্যকলাপে ব্রতী হয়েছেন। এ সন্দেহ থেকে সূত্রপাত হয় ইয়াহিয়া-নূর খান দ্বন্দ্বের। তারই ফলশ্রুতিতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভেঙ্গে দেন কাউন্সিল অফ এডমিনিস্ট্রেশন। এয়ার মার্শাল নূর খান ও এডমিরাল এহসানকে চীফ অফ এয়ার ষ্টাফ এবং চীফ অফ নেভাল ষ্টাফ পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাদেরকে অবশ্য পরে যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন কেন্দ্রে কাউন্সিল অফ এডমিনিস্ট্রেশনের পরিবর্তে বেসামরিক একটি মন্ত্রীসভা তিনি গঠন করবেন। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৫জন করে মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠন করা হবে নতুন মন্ত্রীসভা।

আইয়ূব খানের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট ধারাকে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পুনর্বহাল করে প্রাদেশিক গভর্ণরদের সেই একই ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেয়া হল। এতে করে প্রাদেশিক শাসন কাঠামোতে দ্বৈততার সূত্রপাত ঘটল। কারণ, গভর্ণর নিয়োগের পরও প্রাদেশিক ও জোনাল সামরিক শাসনকর্তারা সরাসরি মুখ্য সামরিক শাসনকর্তা তথা প্রেসিডেন্টের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকেন। এ সমস্ত প্রশাসনিক কাঠামোর রদবদল জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করল। তাহলে কি ইয়াহিয়া খান তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্তভাবে দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা করছেন? গণপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে যথাশীঘ্র সম্ভব ব্যারাকে ফিরে যাবার প্রতিজ্ঞা কি তিনি আর রক্ষা করবেন না? জনাব প্রেসিডেন্ট কিন্তু সবসময় বলতে থাকলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাওয়াই তার লক্ষ্য।

ইয়াহিয়ার শাসনকাল বেসামরিক আমলা বিশেষ করে সিএসপি অফিসারদের জন্য ছিল এক কালো অধ্যায়। জেনারেল পীরজাদা এবং তার নেতৃত্বাধীন সিএমএলএ অফিসের দু’জন সুপার সেক্রেটারী জেনারেল রহিম ও জেনারেল করিমের প্ররোচণায় ৩০৩ জন সিএসপি অফিসারকে দুর্নীতির অভিযোগে চাকুরীচ্যুত করা হয়। এদের মধ্যে অনেক প্রবীণ ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ আনলেও কোন সুষ্ঠু তদম্ভ ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেয়া হয়। এমনকি চাকুরীচ্যুত অফিসাররা তাদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা বা অসত্যতা প্রমানের সুযোগ হতেও বঞ্চিত হন। চাকুরীচ্যুত অফিসারদের কয়েকজন পরবর্তিকালে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় আবার চাকুরীতে পুনর্বহাল হতে সক্ষম হন।

পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির হীন মনোভাব, বিদ্বেষ, অসম আচরণ, বঞ্চনা জনমনে সৃষ্টি করে প্রচন্ড বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের আগুনকে প্রশমিত করতে এবং বাঙ্গালীদের কিছুটা খুশি করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ৬ জন বাঙ্গালী সিএসপি অফিসারকে কেন্দ্রিয় প্রশাসনে সেক্রেটারীর পদে নিয়োগ করেন। তিনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ দেন, যখনই কোন সিনিয়র পোষ্ট খালি হবে সেখানে বাঙ্গালীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে। তার নির্দেশে বাঙ্গালীদের জন্য সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের কোটা দ্বিগুন করা হয়। বাঙ্গালীদের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য প্রেসিডেন্টের আন্তরিকতা ও সৎ প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও কালের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা প্রবাহ তখন অনেক এগিয়ে গেছে। পুরো বাঙ্গালী জাতি ১৯৬৯ সালে ভাবছে মাত্র একটি দাবির কথা স্বাধীকার অথবা স্বাধীনতা। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপগুলোকে বাঙ্গালীরা গ্রহণ করে যৎসামান্য অনুদান হিসেবে। আজ যেখানে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি চাইছে স্বাধীকার অথবা স্বাধীনতা সেখানে এ ধরণের সামান্য অনুদানে বাঙ্গালী তাদের সংগ্রাম থেকে সরে আসবেই বা কেন?

আগষ্ট মাসের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীসভা গঠন করেন। সদস্যদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন বয়সে প্রবীণ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেয়া হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, একজন প্রাক্তন চীফ জাস্টিস, তথাকথিত ২২পরিবারের একজন, জমিদারদের মধ্যে থেকে একজন এবং শিল্পপতিদের মধ্যে থেকে একজন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নেয়া হয় দু’জন প্রাক্তন সিএসপি অফিসার, একজন রাজনীতিবিদ, একজন বেসরকারি খাতের ব্যবসাদার এবং একজন শিক্ষাবিদ। ইয়াহিয়া খানের নতুন মন্ত্রীসভা জনগণের মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। যে কোন সামরিক শাসনাধীন মন্ত্রীসভার মত ইয়াহিয়ার মন্ত্রীসভার ক্ষমতাও ছিল অতি সীমিত। গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা কোন মন্ত্রীর ছিল না। সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত প্রেসিডেন্ট ও তার ‘কিচেন কেবিনেট’ এর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে। মন্ত্রীগণ আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সভা-সমিতি, ফিতা কাটার অনুষ্ঠান, নিমন্ত্রণ রক্ষা করেই খুশি ছিলেন মন্ত্রী মহোদয়গণ। তাদের মন্ত্রীত্ব বজিয়ে রাখার জন্য তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্টের অনুগ্রহের উপর। তাই প্রেসিডেন্টকে খুশি রাখাই ছিল তাদের প্রধান কর্তব্য।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতা দখল করে তখন দেশ জটিল রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত। আর্থসামাজিক অবস্থারও চরম অবনতি ঘটেছে। দেশের অখন্ডতাই শুধু নয় জাতীয় অর্থনীতিও বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সার্বিক এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা এবং সামর্থ্য কোনটাই ইয়াহিয়া সরকারের ছিল না। যে কোন সামরিক সরকারের সফলতার জন্য যেটা বিশেষ প্রয়োজন সেটা হল জনপ্রিয়তা। তাছাড়া শহরভিত্তিক বুদ্ধিজীবি, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং অন্যান্য শক্তিশালী চাপ প্রয়োগকারী সম্প্রদায়ের সহযোগিতা লাভ করাও বিশেষ প্রয়োজন। ইয়াহিয়া সরকারের উল্লেখিত জনসমর্থন এবং শহরভিত্তিক শক্তিশালী সম্প্রদায়গুলোর সহযোগিতা এ দু’টোর একটিও ছিল না। তদপুরি জান্তার মধ্যেও ছিল ক্ষমতার কোন্দল। সর্বোপরি আইয়ূব খানের মত জেনারেল ইয়াহিয়া সমগ্র সেনা বাহিনীর একচ্ছত্র অধিপতিও ছিলেন না। এসব কিছু মিলিয়ে ইয়াহিয়া সরকার ছিল মূলতঃ একটি দুর্বল অস্থায়ী সরকার।

ইতিমধ্যে জাতীয় পরিসরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষম বন্টনকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন প্রচলিত ধনতান্ত্রিক অবকাঠামোতে অর্থনৈতিক উন্নতি আর সম্ভব নয়। তারা দাবি তোলেন মানুষের বেঁচে থাকার নূন্যতম প্রয়োজনগুলো সরকারের নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য তারা সোচ্চার হয়ে উঠেন আর্থসামাজিক অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষে সময়ের এ চাহিদা পূরণ করা ছিল অসম্ভব এক প্ৰত্যাশা।

তবুও সীমিত ক্ষমতাধারী ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, “আমাদের এ অবস্থায় সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে। সামাজিক ব্যবধান অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে। গরীব ও বড়লোক শ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা, প্রতিহিংসা ও দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো যাবে না। ফলে কোন প্রকার অর্থনৈতিক অগ্রগতিই সম্ভব হবে না। সুপরিকল্পিত অর্থনীতির মানে হচ্ছে সর্বোপরিসরে সাধারণ জনগণের জীবিকার মান উন্নত করা এবং শুধুমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থের পরিবর্তে সাধারণ জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।”

বাস্তবে এ নীতি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে অবকাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সামান্য কিছু cosmetic পরিবর্তনের মাধ্যমে ফলপ্রসু করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। ইয়াহিয়া সরকার ১৯৬৯-৭০ এবং ১৯৭০-৭১ এর বাজেটে শ্রমিকদের নূন্যতম পারিশ্রমিক ধার্য্য করে দেয় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়। ইতিমধ্যে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণও কমে আসে, কমে আসে আভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার : ফলে প্ল্যানিং কমিশনকে বাজেট বরাদ্দে রদবদল করতে হয়।

১৯৬৯ এর গণআন্দোলন ও বাঙ্গালীদের পশ্চিমা বিরোধী ক্ষোভের একটি প্রধান কারণ ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য। দীর্ঘ দিনের শোষণ ও বঞ্চনার ফলে এ বৈষম্য ব্যাপক আকার ধারণ করে। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন, পাহাড় সমান এ বৈষম্য দূর করতে না পারলে পাকিস্তানকে এক রাখা যাবে না। কিন্তু পাকিস্তানকে এক রাখার জন্য অসামান্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে পশ্চিম পাকিস্তানকে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি কি তার জন্য প্রস্তুত? শাসকগোষ্ঠির এ সদিচ্ছা থাকলেও রাতারাতি এ বৈষম্য দূরীভূত করা অবাস্তব। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের এ সদিচ্ছা কতটুকুই বা বিশ্বাসযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য? এ অবস্থার মধ্যেই ইয়াহিয়ার সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয় ৪র্থ পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়নের। শেখ মুজিব প্রথমত: এর প্রতিবাদ করেন। তার যুক্তি ছিল অস্থায়ী সরকার হিসাবে ইয়াহিয়া সরকারের সুদূরপ্রসারী পাঁচশলা পরিকল্পনা প্রণয়নের কোন অধিকার নেই। কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য এবং বিদেশী সাহায্যের ধারা প্রবাহমান রাখার জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন। ফলে ১৯৭০ সালে ৩রা ফেব্রুয়ারী জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের অধিবেশন শুরু হয় রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মনোনীত মন্ত্রীদের মধ্যে ৪র্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিতর্কের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি বাধ্য হয়ে দু’টি নীতি নির্ধারক ফরমান জারি করেন। তিনি কমিটির সদস্যবৃন্দকে নির্দেশ দেন,

(১) সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

(২) আঞ্চলিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে হবে।

প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা অনুযায়ী পাঁচশলা পরিকল্পনার একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়। সেটা পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত আলাদা প্যানেলের কাছে পেশ করা হয় তাদের মতামত জানার জন্য। অর্থনীতিবিদদের মতামতসহ দু’টো প্যানেল থেকে রিপোর্ট পেশ করা হয় ন্যাশনাল ইকনোমিক কাউন্সিলে। রিপোর্ট দুইটি ছিল বিপরীতধর্মী। ১৯৭০ সালে ২রা জুন কমিশনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় পাঁচশলা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য। অধিবেশনে রিপোর্ট দুইটির উপর প্রচন্ড তর্ক-বিতর্ক হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশ আরো বেশি তীব্র হয়ে উঠে।

অনেক বাক-বিতন্ডার পর ১৯৭০ সালের জুনের শেষাশেষি চূড়ান্ত ৪র্থ পাঁচশলা পরিকল্পনা প্রণীত হয় এবং জাতীয় ইকনোমিক কাউন্সিলে সেটা গৃহিত হয়। গৃহিত পরিকল্পনায় আর্থিক বরাদ্দ ছিল নিম্নরূপ:- (কোটি রুপিতে) )

 পূর্ব পাকিস্তানপশ্চিম পাকিস্তানমোট
সরকারি খাত২৯৪০ (৬০%)১৯৬০ (৪০%)৪৯০০
বেসরকারি খাত১০০০ (৩৯%)১৬০০ (৬১%)২৬০০
মোট৩৯৪০ (৫২.৫%)৩৫৬০ (৪৭.৫%)৭৫০০

৪র্থ পাঁচশলা পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ক্রমান্বয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তনের মধ্যকার বৈষম্য ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাধাপিছু আয় বাড়িয়ে তোলা। ন্যাশনাল ইকনোমিক কাউন্সিল কর্তৃক এই চুড়ান্ত বরাদ্দের বিরোধিতা করেন ডঃ এ মালেক এবং জনাব আহসানুল হক ছাড়া মন্ত্রী পরিষদের বাকী ৩জন বাঙ্গালী মন্ত্রী। পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রীরা অভিমত প্রকাশ করলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে এ ধরণের আর্থিক বরাদ্দ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। জাতীয় ইকনোমিক কাউন্সিল ২রা জুন ১৯৭০ যে বাৎসরিক প্ল্যান ১৯৭০-৭১ চুড়ান্ত করে। তার জোর বিরোধিতা করেন মন্ত্রী পরিষদের ৩জন বাঙ্গালী জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরী, জনাব হাফিজউদ্দিন এবং জনাব শামছুল হক। তারা অভিমত প্রকাশ করেন, বাৎসরিক প্ল্যানের লক্ষ্য ৪র্থ পাঁচশলা পরিকল্পনার লক্ষ্যের সম্পূরক নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির আন্তরিকতা সেই বাৎসরিক প্ল্যানে প্রতিফলিত হয়নি বিধায় এ প্ল্যান গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালী ৩জন মন্ত্রীর যুক্তিসম্পন্ন এ প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে প্ল্যানিং কমিশনকে বাৎসরিক প্ল্যানের প্রস্তাবগুলি বাস্তবায়নের আদেশ দেন। ফলে জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরী, জনাব হাফিজ উদ্দিন এবং জনাব শামছুল হক সম্মিলিতভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে লিখিতভাবে জানান, “অতি অন্যায়ভাবে বাৎসরিক বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বৈষম্যমূলক আর্থিক বরাদ্দের প্রতিবাদে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। এ ধরণের অন্যায় মেনে নিয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তারা জানতেন যে, ইয়াহিয়া খান অতি সহজেই তাদের অব্যাহতি দিতে পারেন। তবুও তারা ভেবেছিলেন তাদের সম্মিলিত পদত্যাগের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাকী ২জন বাঙ্গালী মন্ত্রীর পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকবে না। মন্ত্রী পরিষদ থেকে সব বাঙ্গালীদের একসাথে পদত্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে রাজনৈতিক আন্দোলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে। ইয়াহিয়া খান বাধ্য হবে তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিতে। পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলি সোচ্চার হয়ে বলতে পারবে যে ইয়াহিয়া খানের দ্বারা নিযুক্ত মন্ত্রীরাও আজ তার সরকারের বাঙ্গালী বিরোধী মনোভাবে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। অন্যায় বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতায় তারা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থায় অত্যন্ত আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালেন জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরী, জনাব হাফিজউদ্দিন এবং জনাব শামছুল হক ৩জনকেই। বৈঠকে তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বললেন অতিসত্ত্বর তিনি ন্যাশনাল ইকনোমিক কাউন্সিলের জরুরী বৈঠক তলব করবেন। জরুরী বৈঠকে প্ল্যানিং কমিশনকে তিনি পরিষ্কারভাবে বললেন, “মন্ত্রীসভার বাঙ্গালী সহকর্মীরা আমায় বলেছেন- ১৯৭০-৭১ বাৎসরিক বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ অসম হয়েছে। এই বরাদ্দ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজিত আর্থিক বৈষম্য দূর করা ও আঞ্চলিক ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আমার পক্ষে এই বাজেট অনুমোদন করাও সম্ভব নয়।”

প্ল্যানিং কমিশনের কর্তা ব্যক্তিরা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও মনোভাবে হঠাৎ পরিবর্তনে হচকিত হয়ে গেলেন। কিন্তু পরিণতিতে কোন বিতর্ক ছাড়াই আমলারা বাৎসরিক বাজেটের অর্থ বরাদ্দে পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। ১৯৭০-৭১ সালের বাৎসরিক বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৫০ কোটি টাকা প্রাথমিক ভাবে বরাদ্দ করা হয়। প্রয়োজনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতে আরো অর্থ বরাদ্দ করা হবে বলে প্রেসিডেন্ট ও পরিকল্পনা কমিশন আশ্বাস প্রদান করেন। ৪র্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও ১৯৭০-৭১ সালের বাজেট প্রসঙ্গ থেকে দু’টো জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠে।

প্রথমত: ইয়াহিয়া খান ও শাসকগোষ্ঠির কয়েকজন বুঝতে পেরেছিলেন আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে না পারলে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। তাই তারা আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার চেষ্টা করেন।

দ্বিতীয়ত: যদিও বা শাসকগোষ্ঠির মুষ্টিমেয় সদস্য এবং প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আঞ্চলিক বৈষম্য থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতা দূর করে দেশের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হয়ে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তথাপি বৃহৎ পরিসরে ক্ষমতাসীন অনেকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের প্রতি হীনমন্যতা ও বিদ্বেষ তখনও বলবত থাকায় পাকিস্তানের ভাঙ্গা রোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠে।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে ষাটের দশকের শেষার্ধে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি:-

পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তান এশিয়া মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে রাশিয়া পাকিস্তানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে কম্যুনিষ্ট রাশিয়ার পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবের চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৬০ সালে। সে বছর পেশোয়ারে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি থেকে U-2 বিমান উড্ডয়নের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রুশচেভ পাকিস্তানকে রকেট আক্রমণের হুমকি দেন। পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের শাসনকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দ্বি- পাক্ষিকতাকে প্রাধান্য দেবার ফলে আমেরিকার সাথে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজিয়ে রাখার পরও গণচীন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়। ফলে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশ থেকেই পাকিস্তান প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সাহায্য লাভ করতে সক্ষম হয়।

১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলের পর আভ্যন্তরীন সার্বিক অবস্থার অবনতি বিশ্বপরিসরে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি খর্ব করে। ইয়াহিয়া সরকার ছিল মূলতঃ পররাষ্ট্র নীতিবিহীন সরকার। এ সরকারের কোন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিল না। জেনারেল পীরজাদা এবং জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য সচিব জেনারেল ওমর এই দু’জনেই ছিলেন পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারক। এই দুই জেনারেলের একজনেরও বৈদেশিক নীতি, আর্ন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কার্যক্রম ও কূটনৈতিক কার্যপ্রনালী সম্পর্কে কোন জ্ঞান কিংবা অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না। তবুও গায়ের জোরে তারা এক একজন নিজেকে হেনরী কিসিঞ্জারের মত কূটনৈতিক বিশারদ ভাবতেন। তাদের দৌরাত্ত্বে জনাব এসএম ইফসুফের মত যোগ্য ও জ্ঞানী পররাষ্ট্র সচিবকে অবসর নিতে হয়। স্বঘোষিত কূটনৈতিক বিশারদ জেনারেলদ্বয়ের সাথে মতের মিল না হওয়ার গোস্তাকীতে তিনি চাকুরিচ্যুত হন। তার স্থলে পরে জনাব সুলতান খানকে নিয়োগ করা হয়। যদিও আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পররাষ্ট্র নীতির প্রতি নজর দেবার সময় করে উঠতে পারছিলেন না তবুও সেই সময় পাকিস্তানের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলো পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিকে গতিশীল করে তোলে।

১৯৬৯ সালের আগষ্ট মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনাব নিক্সন ২২ ঘন্টার রাষ্ট্রীয় সফরে পাকিস্তানে আসেন। সফরকালে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে মার্কিন-চীন সম্পর্কের উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। পরিবর্তে জনাব নিক্সন পাকিস্তানকে বিশেষ বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে প্রয়োজনীয় সামরিক ও বেসামরিক সর্বাত্মক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ইয়াহিয়া খান সানন্দে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ও পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এতে পাকিস্তান-আমেরিকার সম্পর্ক আরো জোরদার হয়। চীনও ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রশংসা করে।

নিক্সনের পাকিস্তান সফরের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ইসলামিক সামিট কনফারেন্সে যোগদানের জন্য রাবাত যান। সেটাই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর ভারতীয় সরকার ঐ অধিবেশনে যোগদানের জন্য একজন মুসলমান মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরন করে। কিন্তু ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে রাবাত কনফারেন্সে যোগদান করতে না দেয়া হলে বাধ্য হয়ে প্রতিনিধি দলটিকে দেশে ফিরে আসতে হয়। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের ব্যর্থতায় পাকিস্তানের জনগণ খুশি হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার প্রথম বিদেশ সফর শেষে বীরের বেশে সদর্পে দেশে ফেরেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের ব্যর্থতার জন্য জনগণ ইয়াহিয়া খানকে অভিনন্দন জানায়। এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যান ইরান সফরে। প্রেসিডেন্ট নিজে ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। শুধু তাই নয় তার পূর্বসূরীরা এসেছিলেন ইরান থেকে। তাই ইরানের শাহ এর সাথে জনাব ইয়াহিয়া খান এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাদের ব্যক্তিগত নিবিড় সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কেরও বিশেষ উন্নতি ঘটে ইয়াহিয়ার আমলে। জেনারেল ইয়াহিয়ার শাসন আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অস্বাভাবিক উন্নতির ফলে ১৯৬৯-৭০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার তরফ থেকে বিরূপ চাপের সৃষ্টি হয়। আইয়ূব খানের ক্ষমতাচ্যুতিকে রাশিয়া ভালভাবে দেখেনি। ক্ষমতার রদবদল সম্পর্কে প্রাভদা মন্তব্য করে, “প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন তখন বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ছিল অনৈক্য। কিন্তু ক্রমশঃ মার্কিন ও চীনপন্থীরা একত্রিত হয়ে আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন শুরু করল।” ইজভেজিয়া লিখলো, “সামরিক শাসন জারি করার মাধ্যমে পাকিস্তানের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে আইয়ুবের ক্ষমতাচ্যুতির ঠিক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্শাল এ এ গ্রেকো পাকিস্তান সফরে আসেন। সফরকালে তিনি পাকিস্তানী জেনারেলদের জানিয়ে দেন আইয়ূব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পদক্ষেপ হবে ভুল সিদ্ধান্ত এবং তা হবে দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলকে অপছন্দ করলেও সোভিয়েত নেতৃত্বের পক্ষ থেকে কোসেজিন এবং পোদগর্নি ১১ই এপ্রিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে শুভেচ্ছা বাণী প্রেরণ করেন। এরপর মে মাসে কোসেজিন পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন। সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সরাসরি আলাপ করা। আলোচনাকালে কোসেজিন পরিষ্কারভাবে অভিমত ব্যক্ত করেন,

—একই সময়ে রাশিয়া এবং চীনের সাথে পাকিস্তান সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না।

—সোভিয়েত ইউনিয়ন কি করে একই সাথে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়? জবাবে ইয়াহিয়া খান কোসেজিনকে প্রশ্ন করেন।

—একটি সুপার পাওয়ারের পক্ষে যা করা সম্ভব পাকিস্তানের মত একটি ছোট দেশের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। উত্তরে কোসেজিন পরিষ্কার ভাষায় বলেন।

তার এ বক্তব্য থেকে পাকিস্তানের প্রতি রাশিয়ার মনোভাব পরিষ্কার হয়ে যায়। কোসেজিনের বক্তব্য চীনা নেতৃবৃন্দের হুঁশিয়ারীকেই সত্য বলে প্রতিপন্ন করে। তারা প্রেসিডেন্ট আইয়ূব এবং পরে ইয়াহিয়া খানকে পূর্বেই রাশিয়ার বন্ধুত্বের আন্তরিকতা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। কোসেজিনের সফরের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক মহা সংকটে পতিত হন। একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে চীন ও আমেরিকা। কোন দিকে যাবেন তিনি? সঠিকভাবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে ১৯৭০ সালের জুন মাসে মস্কো, অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটন এবং নভেম্বর মাসে পিকিং সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৬৯-৭০ সালে পাক-ভারত সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্রের পর থেকে পাকিস্তান সামরিক এবং বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগগুলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে সরাসরিভাবে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট এর কাছে রিপোর্ট পেশ করতে থাকে। তারা প্রেসিডেন্টকে জানায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে ভারত। প্রেসিডেন্টকে একটি বন্ধুরাষ্ট্রও একই কথা বলে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু ইয়াহিয়া এ সমস্ত অভিযোগ তেমন গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেননি। যখন তিনি এর সত্যতা অনুধাবন করতে পারলেন তখন ঘটনা গড়িয়ে গেছে অনেক দূর, প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইয়াহিয়ার মন্ত্রীসভার অনেকেও বিবৃতির মাধ্যমে পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার ভারতীয় চক্রান্তের কথা বলেছিলেন প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে দেবার জন্য। কিন্তু তাদের সে সমস্ত বক্তব্যে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি তিনি। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ ক্ষমতা গ্রহণের ২৫ ঘন্টার মধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি ব্যারাকে ফিরে যাবেন। জেনারেল আইয়ূব ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় একই ধরণের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তাদের অঙ্গীকার ও বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা তফাৎ ছিল। আইয়ূব বলেছিলেন তিনি দেশের মঙ্গলের জন্য উপযুক্ত গণতন্ত্র প্রবর্তন করবেন। ইয়াহিয়া পরিষ্কারভাবে প্রতিজ্ঞা করলেন ১০ই এপ্রিলের ভাষণে, “আমাদের লক্ষ্য দেশের গঠনমূলক একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা যাতে করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব হয়।” নির্বাচন সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখলেন, “গণভোটের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করার জন্য হবে সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা তৈরী করবেন শাসনতন্ত্র।”

এপ্রিলের ১০ তারিখ এবং জুলাই এর ২৮ তারিখের মধ্যে ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত প্ল্যান জনগণের কাছে ব্যক্ত করলেন ২৮শে জুলাই। জনাব ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেছিলেন শাসনতন্ত্র ও মন্ত্রীসভা এমনকি জাতীয় সংসদেরও অবলুপ্তি ঘোষণা করে। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেননি। তার আমলে আইয়ূবী স্টাইলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারও করা হয়নি। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করার আগে মুজিব, ভুট্টো, ভাসানী প্রমুখ নেতাদের সাথে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলাপ- আলোচনাও করেন তাই ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তেমন একটা বিস্মিত হননি। দীর্ঘ দিন আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যে গন্ডগোল ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল তার থেকে মুক্তি পাবার আশায় আপামর সাধারণ মানুষ মার্শাল’ল জারি হওয়ায় কিছুটা হাফ ছেড়েই বেঁচেছিল। আইয়ূব খানের মার্শাল’লকে যেভাবে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল ইয়াহিয়া খান তেমন অভিনন্দন না পেলেও জনগণ তার ক্ষমতা দখলকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়।

ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য আইয়ূব খানের মত গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করেননি। তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সফর করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা করতে লাগলেন। তার ব্যক্তিগত এই উদ্যোগ ও আলোচনার ধারায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খানের আন্তরিকতা সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। অতিসঙ্গত কারণেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবের সাথে তার আলাপকেই প্রাধান্য ও বিশেষ গুরুত্ব দেন।

শেখ মুজিব কিন্তু প্রথম দিকে ইয়াহিয়ার আন্তরিকতা সম্পূর্ণভাবে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেননি, কারণ ১৯৫৭ সালে তার রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে ইস্কান্দর মির্জার ক্ষমতা দখলের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক প্রশাসক ইয়াহিয়া খানকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তবে পরবর্তী পর্যায়ে তার এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে বেশ একটি সৌহার্দপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হতে সমর্থ হন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখন্ডতাকে অক্ষুন্ন রেখে রাজনৈতিক সমস্যাবলীর গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা। দেশের অখন্ডতা বজায় রাখার প্রশ্নে যে কোন পদক্ষেপ নেবার ব্যাপারে জান্তার সব জেনারেলরাই একমত ছিলেন। প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিক আলোচনার সব বিষয়বস্তুই জেনারেলদের জানাতে হত এবং এ ব্যাপারে জেনারেলদের সাথে আলোচনা না করে কোন সিদ্ধান্তই প্রেসিডেন্টের পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল’ না বিধায় তার সুচিন্তিত পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে বানচাল হয়ে যেত। এর জন্য মূলতঃ দায়ী ছিল মুজিব সম্পর্কে জান্তার অনেকের সন্দেহ। তারা কিছুতেই মুজিবের মনোভাব ও তার ৬ দফার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সব আলোচনার ক্ষেত্রে দু’টো বিষয়ই মুখ্য হয়ে দাড়ায়। মুজিব কি ৬ দফার প্রশ্নে আপোষ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখবেন? সামরিক জান্তা কি শেষঅব্দি মুজিবকে বিশ্বাস করে নির্বাচনে জয়ী হলে তার হাতে পাকিস্তানের সার্বিক ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন?

মাওলানা ভাসানীর সাথে প্রেসিডেন্টের আলোচনাকালে মাওলানা শাসনতান্ত্রিক সংকট থেকে উত্তরনের প্রসঙ্গে পরিষ্কার করে তেমন কিছু বলেননি। তিনি প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকে কোন সরকার গরীব মেহনতী মানুষের জন্য কিছুই করেনি। নিপীড়িত জনগণের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেবার জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানান। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মাওলানা ভাসানীকে বলেন,

—মাওলানা সাহেব আপনি আমার সাথে যোগদান করে নিজেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করেন না কেন?

—মজলুম জনতার দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরাই আমার কর্তব্য এবং সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলাই আমার দায়িত্ব। কোন সরকারে যোগদান করার ইচ্ছা আমার নেই। জবাবে বলেছিলেন মাওলানা।

মাওলানার সাথে আলাপ করে প্রেসিডেন্ট তার নিঃস্বার্থপরতা এবং নিপীড়িত জনগণের প্রতি আন্তরিকতায় মুগ্ধ হন। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য মধ্যপন্থী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথেও প্রেসিডেন্ট আলাপ-আলোচনা করেন। তাদের সবাই প্রেসিডেন্টকে বলেন যে, একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান বের করার মাধ্যমেই পাকিস্তানের অখন্ডতাকে অটুট রাখা সম্ভব। তাদের অনেকেই মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।

অভিজাত জমিদার গোষ্ঠির প্রতিভু জনাব ভুট্টো তখন পশ্চিম পাকিস্তানে তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে ব্যস্ত। একই সাথে অত্যন্ত চতুরতার সাথে ক্ষমতাশালী জেনারেলদের সাথেও তিনি সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। জনপ্রিয়তা বাড়াবার জন্য জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। যেমন পাঞ্জাবে তিনি বলে বেড়াচ্ছিলেন, “প্রয়োজনে আমরা হাজার বছর ধরে ভারতের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনবো।” সেই সময়ে ভুট্টোর এ ধরণের বক্তৃতা পাঞ্জাবীদের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কারণ তারা আইয়ূব খানের অক্ষমতাকে পাকিস্তানের পরাজয় বলেই মনে করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশগুলোতে তার বক্তব্য ছিল আঞ্চলিক শোষণ-বঞ্চনা দূরীকরণ এবং ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম করার মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রতিজ্ঞা প্রেসিডেন্ট এর সাথে আলোচনাকালে তিনিও ভাসানীর মতই সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলা করার জন্য কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখলেন না। মুজিবের ৬ দফা সম্পর্কেও কোন বক্তব্য বা মন্তব্য করা থেকে তিনি বিরত থাকেন। যদিও মুজিবের ৬ দফা তখন জাতীয় রাজনীতিতে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রেসিডেন্ট এর সাথে আলোচনাকালে জনাব ভুট্টো জাতীয় সমস্যাবলীর চেয়ে আর্ন্তজাতিক রাজনীতির উপর বেশি গুরুত্ব দেন। আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সংকটের মুখে যখন পাকিস্তানের অখন্ডতা হুমকির সম্মুখীন তখন তার এ ধরণের মনোভাব অনেককেই অবাক করেছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো যারা বিশেষভাবে ইসলামপ্রিয় দল বলে পরিচিত তাদের প্রতিনিধিরা রাজনৈতিকভাবে ইসলামিক আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলোচনায় প্রাধান্য দেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ, আঞ্চলিক বৈষম্যতার মত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে তারা কোন বক্তব্যই রাখেননি। দূরদর্শিতার অভাবে তারা এই বিষয়গুলির সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হন। মস্কোপন্থী ওলি খান ও মোজাফ্ফর আহমেদের ন্যাপ ও অন্যান্য চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে কোনরূপ আলোচনা করতে অসম্মতি জানায়। তারা প্রথম থেকেই সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে।

চার মাস আলাপ-আলোচনার পর ১৯৬৯ সালের ২৮শে জুলাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে তার নির্ধারিত বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, “আলোচনাকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মূল সমস্যাগুলোর উপর ভিন্ন ভিন্ন মত প্ৰকাশ করেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রকে পুনর্বহাল করার প্রশ্নে শেখ মুজিব বিরোধিতা করেছিলেন অথচ অনেক রাজনীতিবিদ মত প্রকাশ করেছেন যে আশু নির্বাচনের জন্য ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনর্বহাল করা অপরিহার্য। প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কেও বিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন সমাজভিত্তিক নির্বাচন হতে হবে যেমনটি হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে শেখ মুজিব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, নির্বাচন হতে হবে গণভোটের মাধ্যমে। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মত প্রকাশ করেছেন যে কেন্দ্রিয় শাসন কাঠামো হতে হবে দুই হাউজ ভিত্তিক। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে একত্রিত করে ১৯৫৫ সালে ওয়ান ইউনিট প্রবর্তন করা হয়েছিল এর বিরুদ্ধে মতামত রেখেছেন অনেকেই। তারা চান ওয়ান ইউনিট লুপ্ত করে আগের মত চারটি প্রদেশ সৃষ্টি করে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্ব শাসন কায়েম করতে। সবচেয়ে জটিল সমস্যা হল মুজিব যদি তার ৬ দফার প্রশ্নে আপোষ না করেন তবে কেন্দ্রিয় সরকার আদৌ কার্যকরী হবে কি? কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সম্পর্কই বা কি হবে?”

এসব কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বললেন, “অতএব আপনারা দেখতে পাচ্ছেন মূল সমস্যাগুলোর উপর বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। আমি আগেও অনেকবার বলেছি এখনও বলছি এ সমস্ত ব্যাপারে আমার চিন্তা-ভাবনা উদার এবং পরিষ্কার। সিদ্ধান্ত নিতে হবে জনগণকে। একটি ব্যাপারে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই জনগণ যে কোন ধরণের শাসনতন্ত্র এবং যে কোন ধরণের সরকার প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয় না কেন সেখানে পাকিস্তানের আদর্শ ও অখন্ডতাকে অবশ্যই বজিয়ে রাখতে হবে : আমাদের সর্বপ্রথম পাকিস্তানকে নিয়েই ভাবতে হবে : তার মানে এই নয় যে ন্যায়সঙ্গত আঞ্চলিক দাবিগুলো অবহেলিত হবে। পাকিস্তানের অখন্ডতার প্রতি হুমকি নয় এমন সব দাবিগুলো পূরণের উপায় খুঁজে পেতেই হবে।

এরপর বাঙ্গালীদের দাবি-দাওয়া ও আক্রোশ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বললেন, “জাতীয় পরিসরে বাঙ্গালীরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দায়িত্ব পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ক্ষোভ অতি স্বাভাবিক। আমি প্রতিজ্ঞা করছি এ অন্যায়ের প্রতিকার আমি করব।”

পাকিস্তানের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রপ্রধান এর আগে এত খোলাখুলিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে এত সঠিক দৃষ্টি দিয়ে দেখেননি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের রাষ্ট্র পরিসরে নীতি নির্ধারনে কোন প্রকার অংশীদারিত্ব না দেয়ার ফলে বাঙ্গালীদের মনে ক্রমান্বয়ে যে আক্রোশ দানা বেঁধে উঠে তা থেকেই সৃষ্টি হয় অবিশ্বাস, বিক্ষোভ ও প্রচন্ড গণআন্দোলন। আন্দোলনের তীব্রতায় বিপন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক অখন্ডতা। পাকিস্তানের কন্সটিটিউশন কমিশন এর প্রধান জাষ্টিস শাহাবুদ্দিন বাঙ্গালীদের মনোভাব সম্পর্কে তার রিপোর্টে বলেন, “বাঙ্গালীদের প্রতি ঔপনিবেশিক ব্যবহার করা হয়।” পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন সরকারি ডকুমেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ঔপনিবেশিক’ শব্দটা ব্যবহার করেন জাষ্টিস শাহাবুদ্দিন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের মনোভাব, আশা- আকাঙ্খার সঠিক মূল্যায়ন করার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা টিকিয়ে রাখা। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাক সেটা চায়নি। তারা চেয়েছিল তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার কায়েম করতে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ব্যর্থতাই পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ এর দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মতপ্রকাশ‍ করেন, “জাতীয় পরিসরে সমঝোতার ভিত্তিতে জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই শাসনতান্ত্রিক এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে পাবেন। যদি এই দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হন তখন বাধ্য হয়ে তাকেই জাতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে।” আগষ্টের শেষঅব্দি প্রেসিডেন্ট পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষে মূল সমস্যাবলীর কোন সমাধান সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বের করা সম্ভব নয়। তাই তিনিই অতি সংগোপনে উদ্যোগ নেন ক্ষমতা হস্ত ান্তরের পরিকল্পনা প্রণয়নের। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল হামিদ, জেনারেল পীরজাদা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই মার্শাল’ল এডমিনিষ্ট্রেটর এবং গভর্ণরদ্বয় অতি ঘন ঘন বৈঠকে মিলিত হতে লাগলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিটি ঘটনা, সে সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের মন্তব্য অতি সূক্ষভাবে বিশ্লেষন করতে লাগলেন তারা। সামরিক এবং বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগসমূহের রিপোর্ট এবং তাদের মতামত আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। তাদের এই গোপন বৈঠকগুলোতে বেসামরিক মন্ত্রীদের কোন অবস্থান ছিল না।

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক দাবিসমূহের মূল প্রবক্তা ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। তার সর্বপ্রথম দাবি ছিল সাধারণ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন ধার্য করা। তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনর্বহালের বিরোধিতা করেন। তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের নীতি সমতাভিত্তিক ভোটাভুটির পরিবর্তে গণভোটের দাবি তোলেন। তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বর্ণিত কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সম্পর্কেরও বিরোধিতা করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওয়ান ইউনিট ভাঙ্গার দাবিকে সমর্থন জানান। আওয়ামী লীগ বাদে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে কিছু রদবদল করে সেটাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। তারা শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন কায়েমের দাবি উত্থাপন করেন। তারা মুজিবের ৬ দফার বিরোধিতা করেন কিন্তু আঞ্চলিক বৈষম্যতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। তারা সবাই গণভোটের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে রায় দেন। ইসলামপ্রিয় দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো একটি শক্তিশালী কেন্দ্র এবং ইসলামিক শাসনতন্ত্র কায়েমের দাবি তোলেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের বিরোধিতা তারা করেননি। কিন্তু আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের সম্পর্কে তাদের মতামতের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবির কোন মিলই ছিল না। জনাব ভুট্টোও ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বিরোধিতা করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ওয়েষ্ট মিনিষ্টার টাইপের গণতন্ত্র পাকিস্তানের মত একটি অনুন্নত দেশে প্রযোজ্য নয়। এ ধরণের রাজনৈতিক সরকার প্রবর্তনে দেশে বিশৃঙ্খলাই যাবে বেড়ে, পরিবেশ সৃষ্টি হবে রাজনৈতিক অস্থিরতার। ফলে জাতি বা দেশের কোন উন্নতিই সম্ভব হবে না। এ ছিল তার বদ্ধমূল ধারণা। আইয়ূব খানও ঠিক একই চিন্তা করতেন। কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্ক, শাসনতন্ত্র, ইসলামিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন, ওয়ান ইউনিট ভাঙ্গা প্রভৃতি সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব ইয়াহিয়া খানের সরকারের বলেই জনাব ভুট্টো মনে করতেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেই এ সমস্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সরাসরিভাবে ওয়ান ইউনিট ভেঙ্গে ফেলার দাবি তোলেন। পাঞ্জাবের নেতৃবৃন্দ এ দাবি মেনে নিতে না চাইলেও প্রকাশ্যে তেমন জোর প্রতিবাদ তোলা বিপদজনক হবে ভেবে এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতে বাধ্য হন।

বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো আর্থ-সামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং সমাজতন্ত্র কায়েম করে জনগণের মুক্তির দাবি তোলেন। উল্লেখিত রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে তিনটি মূল বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়।

প্রথমতঃ বাঙ্গালীদের গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার দাবি।

দ্বিতীয়ত: কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোর সম্পর্ক। এটাই ছিল সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।

তৃতীয়ত: পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ান ইউনিট ভেঙ্গে প্রদেশগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা :

২৮শে নভেম্বর ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণ শুরু করেন উল্লেখিত শাসনতান্ত্রিক মূল বিষয়গুলো নিয়ে। তিনি বলেন যে দুঃখজনক হলেও দেশের রাজনীতিবিদগণ ও নেতৃবৃন্দ বিষয়গুলোর উপর ঐক্যমত সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আইয়ূব খানের মত রাজনৈতিক নেতাদের তাদের ব্যর্থতার জন্য সরাসরি দোষারোপ না করে তিনি অতি বুদ্ধিমানের মত ব্যর্থতার কারণ হিসাবে সার্বিক জটিল অবস্থাকে দায়ী করেন। এরপর তিনি বলেন বর্তমান অবস্থায় চারটি উপায়ে নির্বাচনের সমস্যা হাল করা যেতে পারে : –

(১) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা একটি কন্সস্টিটিউশনাল কনভেনশন গড়ে তোলা।

যার দায়িত্ব হবে একটি সুষ্ঠ নতুন সংবিধান তৈরি করা।

(২) ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রকে পুনরায় বহাল করা।

(৩) একটি শাসনতন্ত্র তৈরি করে সেটার উপর জাতীয় পর্যায়ে রেফারেন্ডাম গ্রহণ করা।

(৪) পুরনো শাসনতন্ত্রের ভাল-মন্দের বিশ্লেষন করে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক গঠন করে তার আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।

উল্লেখিত চারটি পন্থার দোষ-গুন বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট চতুর্থ উপায়কে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেন। তিনটি মূল সমস্যা গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচন, ওয়ান ইউনিট ভেঙ্গে দেওয়া এবং কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন গণভোটের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হবে। ওয়ান ইউনিটের অবলুপ্তি করে প্রাদেশিক নির্বাচন গণভোটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। প্রেসিডেন্ট আশা প্রকাশ করেন যে, ফেডারেল সরকারের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একটি জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করতে নিশ্চয়ই সক্ষম হবেন। ইয়াহিয়ার এ ঘোষণার বিরোধিতা

ঘোষণার বিরোধিতা করেছিলেন জান্তার মূল ক্ষমতাবলয়ের এয়ার মার্শাল নূর খান ও জেনারেল হামিদ। তারা মত প্রকাশ করেন যে, দুই হাউজ বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় পরিষদ না থাকলে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙ্গালীরা পাকিস্তান ফেডারেশনের অন্যান্য প্রদেশগুলোর উপর তাদের প্রণীত শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তাই তারা দাবি করেন শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্ত সংসদ সদস্যদের ৬০% দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। ২৫শে নভেম্বর অতি কষ্টে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার ইনার ক্যাবিনেটের সদস্যদের ৬০% এর দাবি উঠিয়ে নেবার জন্য রাজি করাতে সক্ষম হন। ২৪শে নভেম্বর তার বক্তৃতায় ৬০% সম্পর্কে কোন উল্লেখ না থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই সেদিন অবাক হয়েছিল। কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে শেখ মুজিবের অভিপ্রায় ছিল নির্বাচিত সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের এ দাবিও মেনে নেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নেতাই প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেন। তারা চেয়েছিলেন গণভোট এবং ওয়ান ইউনিট ভেঙ্গে দেওয়ার মত এ ব্যাপারেও প্রেসিডেন্টের নিজেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবি ও মেনে নেন। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার জুলাই মাসের ভাষণে আমি কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে সর্বদা বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। এ ধরণের বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অসন্তুষ্টি এবং বিক্ষোভ অতি যুক্তিসঙ্গত। এ ধরণের বঞ্চনার প্রতিকার আমাদের করতে হবে। পাকিস্তানের একাত্মতা এবং অখন্ডতা বজিয়ে রেখে পাকিস্তানের দুই অংশকে স্বায়ত্ব শাসনের পূর্ণ অধিকার দেবার মাধ্যমেই এই ক্ষোভের নিরসন করা সম্ভব। স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার শুধুমাত্র প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করলেই চলবে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে প্রদেশগুলোকে। পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক সম্পদ পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে অংশ বিশেষের জনগণ দ্বারা। কেন্দ্রিয় স্বার্থের পরিপন্থী নয় এমন সব উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তারা স্বাধীনভাবে করতে পারবেন।” প্রেসিডেন্টের ২৮শে নভেম্বরের ভাষণ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হল পাকিস্তানের সমস্যার হয়তো বা একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে চলেছে। নিউইয়র্কস টাইমস-এ শিরোনাম খবর ছাপা হয় “পাকিস্তান দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে। প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বিশ্বের অন্যান্য সব সামরিক শাসকদের জন্য এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছেন। তিনি গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাধ্যমে বেসামরিক সরকার কায়েম করার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা এবার কেন্দ্রিয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে সক্ষম হবে। জনসংখ্যা অনুপাতে এটাই তাদের ন্যায্য অধিকার।”

ক্রিশ্চিয়া সায়েন্স মনিটর লেখে, “জেনারেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণভোটের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সংসদে গৃহিত আগামী শাসনতন্ত্র বাঙ্গালীদের স্বায়ত্ব শাসনের পূর্ণ অধিকার প্রদান করবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রথমবারের মত বাঙ্গলীরা তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে জনাব সিকেস বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদাহরণ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য শুধুমাত্র দৃষ্টান্ত স্বরূপই নয় প্রশংসারও যোগ্য। তার পদক্ষেপ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।” জনাব নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ওয়াশিংটনে গ্রীক রাষ্ট্রদূতকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, “গ্রীস পাকিস্তানের উদাহরণ অনুসরন করতে পারে।” দেশে-বিদেশে সবার কাছেই প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনা পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য এক সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছিল। সামরিক শাসকগণ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না বলে যে কথিত প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে তাও খন্ডিত হয়ে যাবে ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

কিন্তু তার বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে আমাদের মনে কতগুলো প্রশ্ন দেখা দিল। সামরিক বাহিনী তথা জান্তার সবাই কি তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে একমত পোষণ করেন? শেখ মুজিব কি তাহলে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রেখে তার ৬ দফা দাবির পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছেন? নাকি তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজেকে বাঙ্গালী জনগণের একমাত্র নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় আছেন? বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি কি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে চাইবেন? পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে জনাব ভুট্টোর মনোভাব কি? প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে কার্যকরী করার জন্য তাদের যে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে তার জন্য কি তারা সত্যিই আন্তরিকভাবে প্রস্তুত? তিনটি বিষয়ের উপর ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা নির্ভরশীল:

প্রথমত: শেখ মুজিবর রহমান তার ৬ দফা দাবির প্রয়োজনীয় রদবদল করে প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে এসে পাকিস্তানের ঐক্য বাজায় রাখবেন।

দ্বিতীয়ত: পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী মহলকে প্রয়োজনীয় ত্যাগের মাধ্যমে বহুদিন ধরে বঞ্চিত বাঙ্গালীদের আশা-আকাঙ্খা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের ফলে সৃষ্ট অবিশ্বাস এবং আক্রোশ নিরসনের জন্য আম্ভরিকভাবে সচেষ্ট হতে হবে। তাহলেই শুধু সম্ভব হবে পাকিস্তানের ঐক্য বজিয়ে রাখা।

তৃতীয়ত: সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিতে হবে নির্বাচিত সরকারের হাতে।

দীর্ঘ দিনের শাসন-শোষণ, বঞ্চনা, বাঙ্গালীদের প্রতি হীন মনোভাব এবং অবজ্ঞার ফলে যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে, তার ক্ষত ১৯৬৯-৭০ সালে ক্যান্সারে পরিণত হয়। তার বিস্তৃতি ছিল বাঙ্গালীদের মনের গভীরে। ক্যান্সার আক্রান্ত দেশকে বাচানোর লক্ষ্যে ইয়াহিয়ার প্রণীত পরিকল্পনা দেশবাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও অনেকেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে। সামরিক জান্তার কিছু জেনারেল এবং জনাব ভুট্টোসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা মনে করছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালীদের খুশি করতে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করছেন। কিন্তু পক্ষান্তরে জনাব আহ্সান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর, জেনারেল ইয়াকুব জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিষ্ট্রেটর পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ জনগণের কাছে প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনার গ্রহণযোগ্যতা দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগীয় চীফ জেনারেল আকবর এবং বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগীয় চীফ জনাব রিজভী প্রেসিডেন্টকে রিপোর্ট করেন যে, জাতীয় পরিসরে জনগণ প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। কিছু সংখ্যক সংকীর্ণমনা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং আমলাতন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাদে সেনা বাহিনীর তরুণ অফিসারদের বৃহৎ অংশ এবং প্রজ্ঞাশীল জেনারেলরা যে কোন ত্যাগের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অবিশ্বাস ও ঘৃনা দূর করে পাকিস্তানের আদর্শ ও অখন্ডতা রক্ষা করার স্বপক্ষেই মত পোষণ করেন। তবুও ২৮শে নভেম্বর ১৯৬৯ এবং ৩০শে মার্চ ১৯৭০ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ভূট্টো ও কিছু সংখ্যক সংকীর্ণমনা জেনারেল এবং আমলাদের একটি অংশ থেকে ভীষণ চাপের সম্মুখীন হতে হয়। তারা দাবি তোলেন লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার-এ স্বায়ত্ব শাসনের পরিধি পরিষ্কার করে দিতে হবে প্রেসিডেন্টকে। এতে করে শেখ মুজিব রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি উত্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যেই শেখ মুজিবর রহমান গভর্ণর আসানের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, স্বায়ত্ব শাসনের পূর্ণ অধিকার এবং গণভোটের অধিকারে কোন ব্যতিক্রম হলে আলোচনার সব পথই বন্ধ হয়ে যাবে এবং শুরু হবে দেশব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। সামরিক জান্তার অনেকই মত প্ৰকাশ করেন, নির্বাচনের আগেই বল প্রয়োগ করে মুজিবের ৬ দফা ভিত্তিক দেশ বিভক্তির চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়া উচিত। নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দূরহ্ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু গভর্ণর আসান প্রেসিডেন্টকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, মুজিবের সাথে সংঘর্ষে গেলে পাকিস্তানের ঐক্য থাকবে না। প্রেসিডেন্ট জনাব আসানের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন মুজিবের মাধ্যমে ৬ দফার পরিবর্তন করেই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। ৬ দফার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে দেয়া শেখ মুজিবের প্রতিশ্রুতিই ছিল তার বিশ্বাসের ভিত্তি। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ৬ দফার দাবিতে তিনি করবেন।

ইতিমধ্যে একটি বিশেষ আশাপ্রদ ঘটনা ঘটে। জনাব শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারীতে জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরির সাথে আলোচনা করার সময় মত প্রকাশ করেন যে, এলএফও এর আওতায় প্রাদেশিক নির্বাচনও হয়ে যাওয়া উচিত। যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন, ৬ দফার দাবিতে আপোষ করে প্রাদেশিক নির্বাচনে যাওয়া তার জন্য কঠিন হবে। জনাব ভুট্টো মুজিবের অভিমত সমর্থন করেন এবং একই সাথে কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। এ থেকেও পরিষ্কার বোঝা যায় শেখ মুজিব একান্তভাবে পাকিস্তানকে হয়তোবা দ্বি-খন্ডিত করতে চাননি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরির কাছ থেকে মুজিব ও ভুট্টোর মত জানার পর কেন্দ্রিয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচন একই সাথে করার সিদ্ধান্ত নেন। গণভোটের পরিবর্তে অন্য কোন ধরণের ভোটাধিকার ভিত্তিক নির্বাচন এবং স্বায়ত্ব শাসনের অবকাঠামো, এলএফও-তে নির্ধারিত নীতি সমূহের উপর ভিত্তি না করে নির্বাচন করার ব্যাপারে তিনি তার জান্তাকে বলেন যে এ ধরণের যে কোন পদক্ষেপ বাঙ্গালী জাতির মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে ফলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। অতএব, এ ধরণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা তিনি যুক্তিসঙ্গত মনে করেন না। তার এ যুক্তি জান্তার জেনারেলরা মেনে নিতে বাধ্য হলেও জেনারেল হামিদ, জেনারেল টিক্কা, জেনারেল ওমর প্রমুখরা মনে করেন প্রেসিডেন্ট বাঙ্গালীদের প্রতি অযৌক্তিক নমনীয়তা প্রদর্শন করছেন। বিশেষ করে শেখ মুজিবের প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করতে থাকেন তারা। এদিকে জেনারেল পীরজাদা জনাব ভুট্টোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছিলেন। ৩১শে মার্চ ১৯৭০ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে যে এলএফও-এর কথা ব্যক্ত করেন তাতে পাচঁটি নীতি নির্ধারন করা হয়:-

১। ইসলামিক আদর্শই হবে পাকিস্তানের ভিত্তি।

মুজিব এর বিরোধিতা করেননি : বরং তার নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা ছিল, “আওয়ামী লীগ নির্বাচিত সংসদ দ্বারা এমন কোন সংবিধান তৈরি করতে দেবে না যার মাধ্যমে কোরআন ও সুন্নাহ্ বিরোধী কোন আইন পাশ করা যায়। জাতির কাছে আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” ইসলামী আদর্শের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অঙ্গীকার করেই শেখ মুজিব নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। কারণ তিনি ভাল করেই জানতেন ধর্মের ব্যাপারে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণই অত্যন্ত স্পর্শকাতর।

২। দেশে নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন করার সাপেক্ষে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। কেউই এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি।

৩। শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানের অখন্ডতাকে নিশ্চিত করতে হবে।

শেখ মুজিবর রহমানের মনে যাই থাক খোলাখুলিভাবে তিনি এর বিরোধিতা করেননি।

৪। পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়োজনীয় বিধিসমূহ শাসনতন্ত্রের অংশ হিসাবে পরিগনিত হবে।

এ ব্যাপারেও পূর্ব কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক নেতাই কোন উচ্চবাচ্য করতে সক্ষম হননি। জনাব শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টোও এর বিরোধিতা করেননি।

৫। কেন্দ্র-প্রাদেশিক সম্পর্ক এমন হবে যে প্রদেশগুলো পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার লাভ করবে। দেশের একতা এবং সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কেন্দ্রের অন্যান্য দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাও কেন্দ্রের হাতে থাকবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর তার ড্রাফট প্রেসিডেন্টকে দেখাতে হবে। ড্রাফটের কোন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এর ব্যাখ্যা কিংবা মন্তব্য চুড়ান্তভাবে শাসনতন্ত্রে গৃহিত হবে।

এলএফও-এর ভূমিকায় ২৭টি আর্টিক্যাল ও ২টি সিডিউল থাকায় এটাকে প্রায় একটা অস্থায়ী শাসনতন্ত্রের মতই মনে হয়। আর্টিক্যাল ২০ এর আওতায় পাঁচটি মূলনীতি বর্ণিত হয়। সংসদ কর্তৃক একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশগুলো অন্যান্য আর্টিক্যালগুলোতে বর্ণনা করা হয়।

এলএফও-তে সংযোজিত ধারা অনুযায়ী নিবাচিত সরকারকে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল এই দীর্ঘ ৯ বৎসর সময়ে দু’টি নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়। এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্য একটি নির্ধারিত সময় ধার্য করে দেয়া হয়। এতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছাও কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানে এলএফও-এর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় : অনেকেই অভিমত প্রকাশ করে যে এলএফও প্রেসিডেন্টের ২৮শে নভেম্বর বক্তব্যের পরিপন্থী। কিন্তু পর্দার আড়ালে বোঝাপড়া করতে কতটুকু বেগ পেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সে সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান ব্যক্তিগতভাবে অবহিত ছিলেন বলে তিনি এলএফও-কে মেনে নেন। এলএফও-তে বর্ণিত রাজনীতিকে অনেকে মনেপ্রানে মেনে নিতে না পারলেও যেহেতু এলএফও কোন রাজনৈতিক দলের নীতির পরিপন্থী ছিল না তাই এর বিরোধিতা করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। যদিও অনেকেই মনে করেন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শাসনতন্ত্রের অনুমোদন প্রয়োজন হবে বলে বর্ণিতধারা সংসদের অধিকার এবং সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্ন করেছে। ৪ঠা এপ্রিল ১৯৭০ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় যান। এয়ারপোর্টে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “জনগণের অধিকার এলএফও দ্বারা খর্ব করা হয়েছে বলে যে দাবি সেটা আমি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করিনা। আমার একমাত্র ইচ্ছা হচ্ছে দেশে গণতন্ত্রের প্রবর্তন করা। আমার সব পদক্ষেপই আজঅব্দি আমি আমার বক্তব্যের বাস্তবায়নের জন্যই গ্রহণ করেছি।”

১৪ই এপ্রিল ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আবার দৃঢ়তার সাথে বলেন, “ঢাকায় অবস্থানকালে সব পার্টির নেতাদের সাথে প্রণীত শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্ট এর অনুমোদন সাপেক্ষে গৃহিত হবে সে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বেশিরভাগ নেতৃবৃন্দ এলএফও-কে স্বাগতম জানিয়েছেন এবং গ্রহণ করেছেন। শাসনতন্ত্র যদি এলএফও-তে বর্ণিত নীতি অনুযায়ী প্রণীত হয় তবে শুধু প্রত্যাখান করার জন্যই আমি সেটাকে গ্রহণ করব না এটা ভাবার কোন যুক্তি নেই। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শাসনতন্ত্রের সত্যায়ন একটি প্রক্রিয়াগত লৌকিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

প্রেসিডেন্ট কি সত্যিই তার কথা রাখবেন? এ প্রসঙ্গে আলোচনাকালে তিনি জনাব জি ডাবলিউ চৌধুরিকে বলেছিলেন, “দেয়ালের লিখন পড়তে না পারার মত বোকা আমি নই। ১৯৬৮-৬৯ এ আইয়ূব বিরোধী গণআন্দোলন ছিল নিঃসন্দেহে একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম। জনগণের গণতন্ত্রের এ দাবি কোন জেনারেলের পক্ষেই আগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্রপ্রধান এবং সেনা বাহিনী প্রধান হিসাবে দেশেকে দ্বি-খন্ডিত করার কোন ষড়যন্ত্রই আমি সহ্য করব না। অবশ্য সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী যদি পরোক্ষভাবে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় না নিয়ে (মুজিবের ৬ দফার প্রতি ইঙ্গিত) সোজাসুজি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা চাইত তবে সেটা ছিল একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। তারা পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের জনগণের চেয়ে অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার ও সহযোগিতা করেছিলেন কায়েদে আযমের সাথে জাতীয় সংগ্রামে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় না করলে আজ পাকিস্তানের অখন্ডতা হুমকির সম্মুখীন হত না। এবার গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানবাসীরা শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার শুধু লাভ করবে না, তারা জাতীয় পরিসরে দেশকে শাসন করার ন্যায্য অধিকারও লাভ করবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের মতামত প্রাধান্য পাবে। আইয়ূব খানকে দেখ। আমরা দু’জনেই ব্যক্তিগত ভাবে তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজ তার কি করুন অবস্থা। নিজের দেশে তিনি আজ প্রায় নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতির জন্য তিনি নিজেই দায়ী। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আজ যে সংকট দানা বেঁধে উঠেছে তা থেকে দেশকে বাচাঁতে না পারলে আমার পরিণতিও ঠিক আইয়ূব খানের মতই শোচনীয় হবে, তুমি কি সেটাই চাও?”

ইয়াহিয়ার এ ধরণের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় তিনি আন্তরিকভাবেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংকটের মোকাবেলা করে পাকিস্তানের অখন্ডতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তা না হলে তিনি সুষ্ঠ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেন? তার মনে কোন কূটবুদ্ধি থাকলে অবশ্যই তিনি তৃতীয় বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্র প্রধানের মত ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারতেন। সামরিক জান্তার একজন একদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন, “ঘটনা প্রবাহ থেকে মনে হয় মুজিব ও তার পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো আসন থেকেই জয়লাভ করবে। তাই যদি হয় তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।’

জবাবে প্রেসিডেন্ট পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, “যদি সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্ত নিবাসী মুজিবকে পছন্দ করে এবং তার দলকে ভোট দেয় এবং মুজিব যদি রাষ্ট্র বিরোধী কোন পদক্ষেপ না নেয় তাবে তার বিরোধিতা করার আমিই বা কে আর তুমিই বা কে? তাছাড়া আমার দায়িত্ব নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, দেশকে ভাঙ্গা নয়। আমাদের সবাইকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। হতে হবে ধৈর্য্যশীল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিশ্বাস সৃষ্টি করার মাধ্যমেই পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব। শঠতা কিংবা অসৎ নির্বাচনের চিন্তা-ভাবনা করলে দেশ বাচানো যাবে না।”

ইতিমধ্যেই সব রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ জোর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দেন। এক নির্বাচনী জনসভায় শেখ মুজিবর রহমান বলেন, “পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে টিকে থাকার জন্যই। কোন শক্তিই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।”

এক পাকিস্তানের পক্ষে সব মহলের এ ধরণের মনোভাব ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেউই সে সময় ভাবতে পারেনি যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে এমন ভয়াবহ লোমহর্ষক ঘটনা ঘটতে পারে যার পরিণতিতে ভারতীয় সেনা বাহিনী বিজয়ীর বেশে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার মাটিতে পদার্পন করার সুযোগ পাবে। পরিণামে পাকিস্তানের নব্বই হাজার সদস্যের সেনা বাহিনীকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা হবে এবং দ্বি-খন্ডিত হবে পাকিস্তান।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রমের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয় এবং ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে পূর্ণমাত্রায় রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। শুরু হয় নির্বাচনী প্রচারণা। নির্বাচনী প্রচারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা ঘোলাটে হয়ে উঠে। শেখ মুজিবর রহমান বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, ৬ দফা এবং ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান এর উপর ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তানের সব জায়গায় নির্বাচনী অভিযান চালান। ১৯৭০ সালের ১৪ই আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের একটি পতাকা তৈরি করে আকাশে উড়িয়ে দেয়। ঐ মিটিংএ সভাপতিত্ব করেছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর জনাব আবু সাঈদ চৌধুরি। তাকে জোনাল মার্শাল’ল এডমিনিষ্ট্রেটর জেনারেল ইয়াকুব খান ডেকে পাঠান এবং ঘটনা সম্পর্কে কৈফিয়ত দাবি করেন। জনাব চৌধুরিকে বলা হয় ছাত্রদের এ ধরণের কাজ দেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ বিধায় আইনত দন্ডনীয়। গভর্ণর আসানের মধ্যস্থতায় জনাব চৌধুরী সে যাত্রায় রক্ষা পান। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খানের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট পেশ করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয় যে, শেখ মুজিব তার সহকর্মীদের সাথে সভাকালে বলেছেন নির্বাচনের পর তিনি এলএফও-এর তোয়াক্কা করবেন না। তিনি তার ইচ্ছা মতই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন এবং সেটাকে স্বীকৃতি দিতে প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করবেন। এ খবর পাবার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভীষণভাবে চটে যান। এদিকে অল ইন্ডিয়া রেডিও কোলকাতা থেকে খোলাখুলিভাবে ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ নামক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা শুরু করে দেয়। গোয়েন্দা বিভাগীয় রির্পোটে বলা হয়, ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ ও অস্ত্র দু’টোই পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য এবং প্রয়োজনে সেনা বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য। পাকিস্তানের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগগুলোই শুধু নয় কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্রের তরফ থেকেও একই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতাই তখন প্রেসিডেন্টকে আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আতাঁতের কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট গভর্ণর আসানের কথার উপর বিশ্বাস করে ঐসমস্ত রির্পোটকে অহেতুক সন্দেহ বলে উড়িয়ে দেন। গভর্ণর আহ্সান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শেখ মুজিব কখনও পাকিস্তানের ঐক্যের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না। গভর্ণর আহ্সান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মনেও একই বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ তখন বেশ কিছুটা ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। জনমনে আবার নতুন করে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। পরিস্থিতি যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কি সম্ভব হবে? এ অবস্থায় দু’টো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের আগষ্ট মাসে হল এক ভীষণ বন্যা, নভেম্বরে হল এক প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়। বাংলাদেশের উপর দিয়ে যখন ঘূর্নিঝড় বয়ে যায় তখন প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় সফরে গণচীনে। সেখান থেকে সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি ঢাকায় চলে এলেন। সেখানকার প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা তাকে বোঝালেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব ঠিক ততটুকু না যা খবরের কাগজগুলোতে ফলাও করে বের করা হয়েছে। অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করার কোন প্রয়োজন নেই। এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় দু’দিন থেকে ইসলামাবাদ ফিরে যান। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা ভাবলেন ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালীদের দূরাবস্থার জন্য বিশেষ চিন্তিত নন। দুর্যোগের ফলে যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় বাঙ্গালীদের তার প্রতি প্রেসিডেন্টের এরূপ হেয়ালী মনোভাবের ফলে জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। তারা তাদের এ দুর্দিনে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে আরও বেশি আন্তরিকতা ও সহানুভূতি আশা করেছিল। তাদের এ মনোভাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে শেখ মুজিবর রহমান ব্যবহার করতে ছাড়েননি তার প্রচারণায়। তিনি এ সুযোগে বলতে লাগলেন যে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠির কাছে বাঙ্গালীরা অবহেলার পাত্র মাত্র। বাঙ্গালীদের দুঃখ-কষ্টে তারা মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এক জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, দুর্যোগের মোকাবেলা করাটাই এখন জাতির প্রধান কর্তব্য। প্রশাসনকে ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ অবস্থার মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তাই সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেয়াটাই হবে যুক্তিসঙ্গত। জনাব ভুট্টো এবং মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ঘোষণা দিলেন, “ভোটের আগে ভাত চাই”। ভাসানী প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানালেন নির্বাচন পিছিয়ে দিতে। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমান হুমকি দিয়ে পরিষ্কারভাবে নির্বাচন পিছানোর বিরোধিতা করে বলেন, “নির্বাচন পিছানোর যে কোন ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োজনে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দেয়া হবে।” তার এ হুঁশিয়ারীর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য সবার মতামত উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্ট যথাসময়ে নিরপেক্ষ সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। প্রেসিডেন্ট আশা করেছিলেন তার এ সিদ্ধান্তে শেখ মুজিব খুশি হবেন। হয়েছিলও ঠিক তাই। মুজিব খুশি হলেন ইয়াহিয়ার এ সিদ্ধান্তে এবং প্রেসিডেন্টকে গোপন সূত্রে তার আগের ওয়াদার পুনরাবৃত্তি করে খবর পাঠান যে, পাকিস্তানের ঐক্য তিনি বজিয়ে রাখবেন অবশ্যই। প্রেসিডেন্ট মুজিবের ওয়াদায় পূর্ণ আস্থা স্থাপন করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *