প্রথম অধ্যায় – পরিপ্রেক্ষিত
প্রস্তাবনা
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আসাম প্রদেশ বা রাজ্যে বহুভাষাভাষী মানুষের বাস। এ সকল মানুষের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত স্বতন্ত্রতাও স্পষ্টতর। বিচিত্র ও বর্ণময় অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে প্রধানত অসমিয়া এবং বাঙালি জাতির ভাষা ও জাতিগতবিরোধই আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসবে। বাহ্যত, ভাষাকে কেন্দ্র করেই দু-টি জাতির মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত এবং তা থেকে সৃষ্ট জাতিবিদ্বেষ বয়ে আনে হানাহানি রক্তপাত, মৃত্যু। সংগত কারণেই সিলেটের ‘গণভোট’-ও আলোচনায় স্থান পাবে।
বাঙালি অধ্যুষিত এই জেলার গণভোটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আসাম সরকার বা দেশভাগের পূর্বমুহূর্তে ‘ধর্মে’র রাজনৈতিক ব্যবহার কতটা ক্রিয়াশীল ছিল—তা খতিয়ে দেখারও প্রয়াস থাকবে বর্তমান আলোচনায়।
আমরা লক্ষ করব, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই আসামে বসবাসকারী বাঙালি সমাজ আক্রান্ত হয়েছেন বারবার। পুড়েছে তাঁদের বাড়ি-ঘর, বিষয়-আশয়। অত্যাচারিত, ভীত-সন্ত্রস্ত, সহায় সম্বলহীন এ সব নারী-পুরুষ-শিশুর দল স্বদেশে ‘বিশেষ ধরনের’ উদবাস্তুতে পরিণত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এখানে, ওখানে বা অন্য কোনোখানে। এই মানব বিপর্যয়কারী অনালোকিত কথা-কাহিনি সর্বজনের সামনে মেলে ধরতে আক্রমণকারীর শিকার ‘মানুষ’-এর পক্ষেই আমরা সওয়াল করব, আমাদের খুঁজে ফেরার প্রয়াস থাকবে ভাষা-বিতর্কের অন্তরস্থ দিকগুলি, থাকবে বঞ্চনার বিষয়টিও।
পটভূমি
ব্রিটিশ শাসক ১৮২৬ সালে আসামে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেও অঞ্চলটিকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নিয়ন্ত্রণে রেখেই একজন কমিশনারকে পরিচালনভার দেওয়া হয়। তিনি গৌহাটি থেকে আসামের শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। ‘… ব্রিটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠার এক দশক পর, ১৮৩৬ সালে আসামের আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়। …উনিশ শতকে আসামের বিদ্যালয়গুলিতেও বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়।’১ কিন্তু অসমিয়া জাতির অগ্রণী অংশের অন্যতম বুদ্ধিজীবী গুণাভিরাম বড়ুয়া প্রমুখের প্রয়াস ও যত্নে ব্রিটিশ শাসক ১৮৭৩ সালের এপ্রিলে ‘প্রাথমিক, মধ্য ও নিম্নমধ্য বিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা ব্যবহারের আদেশজারি করা হয়… এবং এই বছর ২৫ জুলাই আইন-আদালতের ভাষারূপে অসমিয়া ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে।’২
আমরা এ কথাও জানি যে, ‘আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশনারি’রা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের স্বার্থে-অসমিয়া ভাষায় ব্যাকরণ, অভিধান লিখে, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করে ও বিদ্যালয় স্থাপন করে আধুনিক অসমিয়া জাতির গোড়াপত্তন করেন। ১৮৫৩-৫৮ সালে এ. জে. মোয়াটে মিলস ‘Report on the province of Assam’—এই প্রতিবেদন লিখে আসামে অসমিয়া ভাষা প্রচলনের স্বপক্ষে মত ব্যক্ত করেন। নেথাম ব্রাউন, ব্রাউনসন ও আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন প্রমুখদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ১৮৭৩ সালে কামরূপ, দরং, নওগাঁ, শিবসাগর ও লখিমপুর জেলারবিদ্যালয়গুলিতে অসমিয়া ভাষা সরকারি ভাষারূপে প্রতিষ্ঠালাভ করে।’৩ দীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছর আসামের আদালত তথা বিদ্যালয়গুলিতে অসমিয়া ভাষার অনুপস্থিতির জন্য অসমিয়াগণ আসামে বসবাসকারী বাঙালি জাতিকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তাঁদের অন্তরেও লালন করেন এক ধরনের ক্ষোভ-হিংসা-দ্বেষ আর ঘৃণা। অথচ বাঙালিরা এ জন্য মোটেও দায়ী ছিলেন না। সমাজ বা রাষ্ট্রে এ বিষয়ে বাঙালিদের কোনো ভূমিকা ছিল— এমন তথ্যও আমাদের হাতে নেই। বস্তুত, ইংরেজ শাসকদের ভাষানীতি বা পরিকল্পনাগত কারণেই অসমিয়া ভাষার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি।
ব্রিটিশরাজ নিজেদের স্বার্থে আসামকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক প্রদেশের মর্যাদা দিল ১৮৭৪ সালে এবং নবগঠিত প্রদেশের শাসনভার ন্যস্ত করা হয় একজন চিফ কমিশনারের ওপর। এ সময় প্রদেশের রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর জন্য চা-বাগান সমৃদ্ধ বঙ্গভুক্ত সিলেট জেলাকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গভুক্ত অপর জেলাদ্বয় কাছাড় এবং উত্তরবঙ্গের গোয়ালপাড়া জেলাকেও আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। এই যুক্তকরণের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ সেদিন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সভা-মিছিলের আয়োজন করেন, স্মারকলিপিও পাঠিয়েছিলেন শাসক বরাবর। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরও বাংলার মানুষের প্রত্যাশা ছিল ইংরেজরাজ প্রকৃত সত্য অনুধাবন করে বাংলার জেলাগুলিকে পুনরায় যথাস্থানে সংযুক্ত করবেন। কিন্তু তা হয়নি। সবগুলি জেলা আসামেই রয়ে গেল।৪ অথচ পরবর্তীতে দেখা গেল, বাংলার এই জেলাগুলোকেই পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়ার জন্য অসমিয়াসমাজ তথা আসাম শাসকবর্গের এক অন্তহীন প্রয়াস। শেষ পর্যন্ত এ কাজে তাঁরা আংশিক সফলও হয়েছিলেন, সিলেট জেলার প্রায় পুরোটাই পাকিস্তানভুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৮৭৪ সালে চিফ কমিশনার শাসিত আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর এই অঞ্চলের আদলটা কী দাঁড়াল, সে-সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায় ইতিহাসবিদ সুজিৎ চৌধুরীর একটি প্রবন্ধে। তিনি জানিয়েছেন:
মূলত চারটি স্বতন্ত্র অংশ নিয়ে এই নতুন প্রদেশের জন্ম, যার মধ্যে ছিল—
১. আহোমদের রাজ্য, যা ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সীমায়িত এবং যাকে পাঁচটি জেলায় ভাগ করা হয়েছিল, যথা—কামরূপ, দরং, শিবসাগর, লখিমপুর ও নওগাঁও। নওগাঁও জেলার দক্ষিণাংশ অবশ্য আহোম রাজ্যের অংশ ছিল না, এই অংশ ছিল ডিমাসাদের অধীন। বস্তুত যমুনা নদীর তীরবর্তী মহং ছিল আহোম রাজ্যের সীমা এবং নদীর পূর্বতীরবর্তী দিজুয়া ছিল ডিমাসা রাজ্যের সীমা। নগাঁও জেলার একটা বড় অংশ যে ডিমাসা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এ সত্য আজ সবাই প্রায় সুবিধাজনকভাবে বিস্মৃত।
২. গোয়ালপাড়া জেলা, যা ছিল মোগল আমলের বাংলা সুবার অংশ এবং ইংরেজরা দেওয়ানি লাভের সূত্রে এই জেলার উপর আধিপত্য বিস্তার করে ১৭৬৫ সালে আহোম রাজ্য ব্রিটিশ অধিকারে যাওয়ার ৬১ বছর আগে।
৩. গারো পাহাড়, খাসি-জয়ন্তিয়া পাহাড়, উত্তর কাছাড়, মিকির পাহাড়, নাগা পাহাড়সহ পার্বত্য অঞ্চলসমূহ। যার সঙ্গে পরবর্তীকালে বিজিত অন্য পার্বত্য অঞ্চলসমূহও যুক্ত হয়।
৪. শ্রীহট্ট ও কাছাড়ের সমভূমি যার তৎকালীন অভিধা ছিল সুরমা উপত্যকা। ভাষিক বিচারে প্রথম অংশটি ছিল মুখ্যত অসমিয়াভাষী, যদিও এর অভ্যন্তরেও বিস্তৃত জনজাতীয় অঞ্চল ছিল, যারা নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তখন ছিলেন, এখনও রয়েছেন। দ্বিতীয় অংশের অধিবাসীরা ছিলেন বঙ্গভাষী, যদিও পূর্বাংশের কথ্যভাষা বাংলা ও অসমিয়া এই উভয় ভাষারই লক্ষণাক্রান্ত ছিল, সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যা সাধারণ লক্ষণ। তৃতীয় অংশে ছিল পার্বত্য উপজাতীয় গোষ্ঠীসমূহের বাস, যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বর্তমান। চতুর্থ অংশের ভাষা বাংলা এবং এই অঞ্চলের ভাষিক সংখ্যালঘুদের মধ্যে রইলেন মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, ডিমাসা এবং চা-শ্রমিক বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠী—যাদের মধ্যে হিন্দিভাষীর সংখ্যাধিক্য রয়েছে। ফলে প্রদেশের নাম যদিও দেওয়া হল আসাম, কিন্তু ভাষিক বিচারে প্রদেশটি দাঁড়াল বহুভাষিক। রাজনৈতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক পটভূমি, সাংস্কৃতিক পটভূমি সমস্ত বিচারেই অঞ্চলগুলোর মধ্যে রইল বিভিন্নতা।… আসাম প্রদেশের এই বৈচিত্র্যময় ভাষিক চরিত্র তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি করেনি, বস্তুত ব্রিটিশ রাজশক্তির উদ্দেশ্যও তা ছিল না।৫
ইতিহাসবিদ কামালুদ্দীন আহমদ ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রশাসনিক পদক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে বাঙালি এবং অসমিয়াভাষীর বিষয়টি স্পষ্ট করেন। উভয় জাতির মধ্যে যে সংশয়, অবিশ্বাস ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছে— সেকথা বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। কামালুদ্দীন আহমদ জানান:
…১৮৭৪ সালে আসাম প্রদেশ গঠনের সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা সুরমা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাষা-সংস্কৃতি বা জাতিসত্তাবোধজনিত আবেগকে বিবেচনার যোগ্য উপাদান বলে মনে করেননি। এই প্রশাসনিক পদক্ষেপ নবগঠিত আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী ও অসমিয়াভাষী জনগণের সচেতন মহলে ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে একটা সংশয় ও পরস্পর অবিশ্বাসের বীজ অঙ্কুরিত করে এবং উভয়পক্ষে ধারাবাহিক স্বাতন্ত্র্য চেতনার উদ্রেক করে।৬
এসব তথ্য থেকে একথা বলার অবকাশ রয়েছে যে, একক কোনো ভাষা নয়— বহুভাষাভাষী মানুষের প্রদেশ হিসেবেই ‘আসাম’ আত্মপ্রকাশ করেছিল। কেবল বহুভাষাভাষী মানুষের বাসই নয়— চারটি স্বতন্ত্র অংশকেও একত্রিত করা হয়েছিল বসবাসকারীদের ভাষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ইতিহাস বা ভৌগোলিক অবস্থানগত দিকগুলি বিবেচনা না-করেই।
আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের প্রায়শ ‘বহিরাগত’, ‘বিদেশি’, ‘উদবাস্তু’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করা হয়। কিন্তু সত্যিই কি তাঁরা বহিরাগত? আজ সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতক থেকে বর্তমান বরাক উপত্যকায় বাঙালি অভিবাসন ধারাবাহিকভাবেই চলে আসছে। ‘বাঙালি ছাড়া অন্য যে-সমস্ত জনগোষ্ঠী এই উপত্যকায় বসবাস করছেন; তাঁরা সবাই এসেছেন এর পরবর্তীকালে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে…।’৭
এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে বাঙালি কেবল বরাক উপত্যকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; আসামের প্রায় সর্বত্রই তাঁদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ করার মতো। তাঁরা এসেছিলেন নানা কর্মসূত্রে—আসামের নিজস্ব তাগিদেও।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা যখন চা-বাগান প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেন, তখন স্থানীয়ভাবে চা-শ্রমিক না পাওয়ায় তাঁরা আসাম সরকারের মাধ্যমে চা-শিল্পে কাজ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার চা-শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন। বিহার, উড়িষ্যা (ওড়িশা), মাদ্রাজ (চেন্নাই), নাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে নিয়ে-আসা এ সব হিন্দুস্থানি চা-শ্রমিকদের বাসস্থান ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়। এ জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগও চালু করা হয়। এ সময় আসাম সরকার ‘Immigration of Labour Act’ কার্যকর করেন। এ ভাবে কয়েক লক্ষ হিন্দুস্থানি আসামে বসবাস শুরু করেন।
চা-শ্রমিকের ব্যবস্থা হলেও চা-বাগানের বিভিন্ন স্তরের পরিচালন ব্যবস্থায় যোগ্য জনশক্তি না থাকায় শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা কয়েক হাজার বাঙালিকে ওইসব পদে নিয়োগ করে চা-বাগান পরিচালন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।৮ আসামের সমতল অংশে জঙ্গলাকীর্ণ লক্ষ লক্ষ একর জমি অনাবাদি পড়ে থাকায় ওইসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বর প্রকট আকার ধারণ করে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই শ্বেতাঙ্গ চা-করগণ জঙ্গলাকীর্ণ ওইসব এলাকা চাষ-আবাদের জন্য আসাম সরকারের ওপর বার বার চাপ প্রয়োগের ফলে আসাম সরকার ‘আসাম-বাংলা’ থ্রু (Through) ট্রেনের ব্যবস্থা করে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, ত্রিপুরা, রংপুর প্রভৃতি জেলা থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি কৃষিজীবী— যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁদের Colonisation Scheme-এর আওতায় আসাম উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে বাসস্থানসহ সব ধরনের সুযোগসুবিধা প্রদান করে অনাবাদি জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষাবাদের ব্যবস্থা করেন।৯
এ সময় নওগাঁ জেলার মৈরাবাড়িও ছিল ভয়াবহ কালাজ্বর পীড়িত অঞ্চল। এই এলাকায় লোকবসতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে আসাম সরকার গৃহীত প্রকল্প আশানুরূপ সাফল্যলাভ না-করায় সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে লোক নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর এ কাজে কতৃপক্ষ ‘পূর্ববঙ্গ-আসাম রেলওয়ে কোম্পানি’র সহায়তা কামনা করেন। রেলওয়ে কোম্পানির অক্লান্ত চেষ্টার ফলেই শেষপর্যন্ত ময়মনসিংহ শহর থেকে মৈরাবাড়ি পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ‘ময়মনসিংহ-মৈরাবাড়ি’ নামফলক সংবলিত ট্রেনযোগে প্রতিদিন শত শত বাঙালি ময়মনসিংহ থেকে মৈরাবাড়ি আসা শুরু করেন। আসামের Line System বা ‘লাইন প্রথা’ এবং Colonisation Scheme-এর মাধ্যমে হাজার হাজার বাঙালি কৃষককে প্রতি বৎসর জমি প্রদান ও বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থার ফলে কেবল মৈরাবাড়ি নয়, আসাম উপত্যকার নওগাঁ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই বাঙালি বসতি গড়ে ওঠে। আসাম উপত্যকার চারটি জেলা— গোয়ালপাড়া, নওগাঁ, কামরূপ এবং দরং-এ ‘ময়মনসিংহ ব্লক’, ‘নোয়াখালি ব্লক’, ‘সুরমা ভ্যালি ব্লক’, ‘ত্রিপুরা ব্লক’, ‘বাঙালি হিন্দু ব্লক’ ইত্যাদি নামে এক-একটি বসতি এলাকা গড়ে তোলারও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আসাম সরকার।১০
চট্টগ্রাম সদর দফতর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি’ দীর্ঘকাল একই অঞ্চল (zone) হিসেবে থাকায় পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার বাঙালি নিয়মিত চাকুরে, চুক্তিভিত্তিক এবং ‘রেলওয়ে ভেণ্ডার’ (Railway Vendor) আসামে এসে বসবাস শুরু করেন। আসাম-বেঙ্গল পোস্টাল জোন-এর আওতায় বাংলা ও আসামের ডাক ও তার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করত কলকাতাস্থ Postal & Telegraphic সদর দফতর। এই সূত্রেও লক্ষাধিক বাঙালিকে আসামের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতে হয়েছে শত বৎসর জুড়েই।
কেন্দ্রীয় আয়কর বিভাগের পরিচালন ব্যবস্থা আসাম, মণিপুর এবং ত্রিপুরা একই zone-ভুক্ত হওয়ার কারণেও বাঙালিদের আসামে থেকে কাজ করতে হয়েছে।১১ অন্যদিকে আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর থেকে ভারত বিভক্তি অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭-এর আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ৭৩ বছর সিলেট জেলা ছিল আসাম প্রদেশের অন্তর্গত। সুদীর্ঘ সময়কাল জুড়ে একই প্রদেশের বাসিন্দা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সিলেট জেলার কৃষক-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েক লক্ষ সিলেটবাসী আসামে বসবাস শুরু করেন।১২
এভাবেই সমগ্র আসাম জুড়েই বাঙালি অভিবাসন চোখে পড়বে বাস্তবসম্মত কারণেই। এ বিষয়ে আরও তথ্য দিয়েছেন বিমানকুমার দে লস্কর। সমগ্র আসামে বাঙালিদের অবস্থান অবস্থিতি সম্পর্কে তিনি জানান:
আসাম প্রদেশের জনসংখ্যা প্রায় ৯২ লক্ষ। এদের মধ্যে প্রকৃত অসমিয়া ভাষাভাষী ও বড়ো (Bodo) ভাষাভাষী এক-তৃতীয়াংশের কিছু অধিক; বিভিন্ন ভাষাভাষী যেমন— খাসিয়া, গারো, লুসাই, মিকির, টিপরা, নাগা, মণিপুরি, নেপালি, শিখ, মাড়োয়ারি ও চা-বাগানের মজুর প্রভৃতি এক-তৃতীয়াংশ, বাকি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাঙালি। জাতিতে বাঙালি ন্যূনধিক ৩১ লক্ষ, কিন্তু বঙ্গভাষীর সংখ্যা আরও বেশি। কাছাড়ি, মণিপুরি, টিপরা, কুকি ও চা-বাগানের মজুরদের মধ্যে অনেকেই বাংলাতে কথা বলেন এবং স্কুল-কলেজে বাংলাকে প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিয়া থাকেন। তাহা ছাড়া এই রাজ্যের এক-এক অঞ্চলে এক-এক ভাষাভাষী লোকের সংখ্যাধিক্য। কাছাড়ের শতকরা ৯৫ জন বাংলা ভাষাভাষী, গোয়ালপাড়ার শতকরা ৫০ জন বাঙালি, বাকি ৫০ জন অসমিয়া, বড়ো ও অন্যান্য ভাষাভাষী লোক। নওগাঁ জেলায় অসমিয়া, বড়ো ও বাঙালি প্রায় সমান সমান। খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড় জেলায় খাসিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে শিলং-এ বাঙালি প্রধান। কামরূপ জেলায় অসমিয়া ও বড়ো ভাষাভাষী সংখ্যাধিক। কিন্তু গৌহাটি শহরে (পান্ডু সহ) বাঙালি বেশি। শিবসাগর ও লখিমপুর জেলায় অসমিয়া ও বড়ো সংখ্যাধিক হইলেও শহর অঞ্চলে বাঙালির সংখ্যা যথেষ্ট; সংযুক্ত মিকির হিল ও উত্তর কাছাড়ে বড়ো ভাষাভাষী সংখ্যাধিক, তবে বাঙালি কম নহে; দরং জেলায় অসমিয়া, বড়ো ভাষাভাষীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু শহর ও বাজার অঞ্চলে বাঙালি বেশি। গারো, লুসাই ও নাগা পাহাড়ে সেখানকার স্থানীয় লোকের সংখ্যা বেশি।১৩
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই অসমিয়া জাতির অগ্রণী অংশ প্রধানত দু-টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন।১৪ এক. গণতান্ত্রিক, আধুনিক জীবনবোধসম্পন্ন উদারনৈতিক ধারা— যাঁরা বাঙালি-অসমিয়াদের মধ্যে আদান-প্রদান, ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে অগ্রসর হতে চান। এই অংশ এ কথাও বুঝতেন, যে অসমিয়া জাতিসত্তা এখনও বিকাশমান—যা একটি ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পূর্ণত্বলাভ করে থাকে। এই ধারায় ছিলেন— গুণাভিরাম বড়ুয়া, বলিনারায়ণ ডেকা প্রমুখ। অপর ধারাটি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথ ধরে গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধকে তুচ্ছ করে উগ্র জাতীয়তাবাদকে আত্মস্থ করে এগিয়ে চলা এবং তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব বলে বিবেচনা করতেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আসাম প্রদেশে দ্বিতীয় ধারাটিই রাজশক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং সক্রিয় সাহায্যে মহিরুহে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এই ধারাটিই অত্যন্ত সফলভাবে সিলেট জেলাকে পাকিস্তানে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়। আর এ কাজে ইংরেজ শাসক, আসাম সরকার এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের একাংশের ভূমিকা প্রশ্নাতীত ছিল না।
আমরা জানি, জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) ভারতের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি ক্ষেত্রে জাতীয় স্তরে যেমন, তেমনই প্রদেশ বা রাজ্যস্তরেও দলটির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। অন্যদিকে সর্ববৃহৎ এই দলটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টিকেও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আর এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত কেবল জেলা বা প্রদেশ পর্যায়ে নয়— কেন্দ্রীয় পর্যায়েও তা ক্রিয়াশীল ছিল। অন্যান্য প্রদেশের মতো আসামের ক্ষেত্রেও আমরা সেটি লক্ষ করব।
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি গঠিত হয় ১৯২০ সালে। এ বছর ১৯-২০ সেপ্টেম্বর সিলেট শহরে সুরমা উপত্যকা রাষ্ট্রীয় সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই রাষ্ট্রীয় সমিতির দু-টি জেলা শাখা সিলেট এবং কাছাড়কে জেলা কংগ্রেসে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যেহেতু জাতীয় কংগ্রেস ইতিমধ্যেই ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তাই জেলাদ্বয়ের ‘…কমিটিগুলিকে সাংগঠনিক ব্যাপারে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসের আওতায় রাখা হয়।’১৫ আসাম প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে নিতে পারেননি, ফলে, বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুরমা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে। শুরু হয় ষড়যন্ত্রের জালবিস্তার। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ১৯৪৭ সালে ২-৪ সেপ্টেম্বর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভা আহ্বান করেন।১৬ সাংগঠনিক বিষয় হওয়ায় আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের ওই সভায় প্রতিনিধি পাঠানোর কোনো দায় কাছাড় জেলা কংগ্রেস কমিটির ছিল না। সভার বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হলেও সেখানে কোনো এজেণ্ডার উল্লেখ ছিল না। তারপরও কাছাড় জেলা কংগ্রেস পর্যবেক্ষক হিসেবে সহকারী সম্পাদক মহীতোষ পুরকায়স্থকে সভায় যোগদানের জন্য পাঠিয়েছিলেন। প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভা থেকে ফিরে মহীতোষ পুরকায়স্থ তাঁর রিপোর্টে বলেছিলেন:
Next day I met shri siddhinath Sharma, the General secretary of the A.P.C.C. He told me that they intended to move a resolution in the meeting of the A.P.C.C. for the inclusion of cachar District within A.P.C.C. as they had received representation from many persons of Cachar District in this respect. I replied that we had no knowledge of any such representation and if any congressmen of our District send such representation he would have sent a copy of it to us…….. i wanted to see the copy of the representation they received, but he replied that these were not in the file.১৭
সুজিৎ চৌধুরী এ সম্পর্কে জানিয়েছেন:
…এই বিতর্কের পুরো নথি দিল্লির নেহরু মিউজিয়াম ও লাইব্রেরিতে রক্ষিত রয়েছে। সেখানে সিদ্ধিনাথ শর্মা বর্ণিত সমস্ত representations দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেগুলো সবই গেছে কাছাড় কল্যাণ সমিতির নামে। আর প্যাডের মধ্যে ওই সমিতির কর্মকর্তাদের যে নাম রয়েছে, তাঁদের কেউই কোনোদিন কংগ্রেসের ত্রিসীমানায় আসেননি, আর সভাপতি হিসেবে যাঁর নাম রয়েছে, তাঁর কংগ্রেসবিরোধী ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। …ওই সমস্ত কংগ্রেসবিরোধীদের দাবির ভিত্তিতেই আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি কাছাড় জেলাকংগ্রেস নিজেদের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়। কাছাড় জেলা কংগ্রেসের সভাপতি তখন উপেন্দ্রশঙ্কর দত্ত এবং সাধারণ সম্পাদক পরেশচন্দ্র চৌধুরী। তাঁরা এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জেলা কংগ্রেস কমিটির সভা ডাকেন এবং আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে সংযুক্তিকরণের বিরোধিতা করেন। ওই প্রস্তাব সহ একাধিক স্মারকলিপি অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে তখন বল্লভভাই প্যাটেল ও তাঁর সহযোগীদের প্রাধান্য, …মধ্যবর্তী পর্যায়ে যদিও পূর্বাচল প্রদেশ কংগ্রেস বলে একটা আলাদা প্রদেশ কংগ্রেস গড়ার প্রস্তাব ওয়ার্কিং কমিটিতে দেওয়া হয়, কিন্তু সেটাকে আর টেকান যায়নি। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৃহীত পূর্বাচল প্রস্তাব ডিসেম্বর মাসে বাতিল করা হয়, আর কাছাড় জেলা কংগ্রেসকে তুলে দেওয়া হয় আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির হাতে।১৮
আসাম প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব কাছাড় জয় করেই থেমে থাকেননি। কাছাড় ভেঙে দুটি জেলা কমিটি—শিলচর এবং হাইলাকান্দি গঠন করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দেবেশ্বর শর্মা। তিনি নেতৃত্বেও আনলেন নতুন মুখ। কংগ্রেসের এই সামগ্রিক হাল-হকিকত সম্পর্কে ইতিহাসবিদ, সুজিৎ চৌধুরীর সুচিন্তিত মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— দূরসঞ্চারীও বটে। তাঁর ভাষায়:
এটা শুধু ক্ষমতার পালাবদলের ব্যাপার নয়। প্রকৃতপক্ষে এ.পি.সি.সি. বরাক উপত্যকায় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরোধী যে-শক্তিসমূহ ছিল, তাদের সংহত করে তাদের হাতেই কংগ্রেসকে তুলে দিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার দেড় বছরের মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঠেলে দেওয়া হল কংগ্রেসের বাইরে। …বরাক উপত্যকার কংগ্রেসি রাজনীতি কতিপয় ক্ষমতালিপ্সু সুবিধাবাদীদের হাতে পড়ে রাতারাতি এক ব্যাভিচারী রূপধারণ করল, সাম্প্রদায়িকতা, দালালি ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনা দেশসেবার স্থান দখল করল। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে মূলত সেই একই ধারার অনুবর্তন চলছে, আর অন্য রাজনৈতিক দলগুলির উপরও সেই অবক্ষয়ের প্রভাব পড়েছে।১৯
বস্তুত চার-এর দশক থেকেই আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের এই অংশটি রাজশক্তির সক্রিয় সহযোগিতায় ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে এবং ভারত বিভক্তির পরপরই সম্প্রসারণবাদী উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের সমর্থনে খোলাখুলিভাবেই রাষ্ট্রিক ক্ষমতা প্রয়োগে তৎপর হয়ে ওঠে। বাঙালি বা বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে সামগ্রিকভাবে আসামের মুসলিম সম্প্রদায় তথা মুসলিম লিগ (১৯০৬) দলীয় রাজনীতির প্রকৃতি বা অবস্থান কী ছিল, সে-বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কারণ আমাদের রাজনীতি তথা সমাজজীবনে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা প্রাক সাতচল্লিশকালে যেমন লক্ষণীয়, তেমনই স্বাধীনতা উত্তরকালেও ছিল স্পষ্টতর।
সিলেট এবং কাছাড় জেলাকে কেন্দ্র করে টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, বিভেদ প্রায় শতাব্দীকাল জুড়েই ছিল। এর মূলেও ছিল ব্রিটিশ শাসকদের ভেদনীতি—ভাগ করো এবং শাসন করো। দৃশ্যত এ দু-টি জেলাকে কেন্দ্র করেই আসামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের (Indian Nationalism) পরিবর্তে ক্রমশ স্থান করে নেয় দ্বিজাতি-তত্ত্ব তথা মুসলিম জাতীয়তাবোধ। এর প্রধানতম কারণ ছিল জীবন ও জীবিকারনিরাপত্তাবোধজনিত। শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা আর্থিকভাবে পিছিয়ে-পড়া অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নেতৃত্ব বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করেননি। এমনকী, তাঁরা বিভেদ সৃষ্টিতে ‘ধর্ম’কেও ব্যবহার করেছেন সর্বতোভাবেই। ফলে, খেলাফত আন্দোলনকে (১৯২১-১৯২২) কেন্দ্র করে আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষত হিন্দু-মুসলিম মিলনের যে আবহ সৃষ্টি হয়েছিল—আন্দোলনে ছেদ পড়ায় সেই স্থান দখল করে নিল সাম্প্রদায়িকতা তথা গোষ্ঠীচেতনা। এই সাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, গোষ্ঠীভাবনা মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘এলিট’ সমাজ তথা শিক্ষিত রাজনীতিবিদগণকেও স্পর্শ করে। ফলে, তাঁরাও ইংরেজসৃষ্ট ভেদনীতির ফাঁদে বাঁধা পড়লেন। আমরা তো জানি, ব্রিটিশ শাসক কখনোই চাননি হিন্দু-মুসলমানের মিলন হোক। তাঁরা ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিকে সামনে রেখেই কখনো হিন্দু সম্প্রদায় আবার কখনো বা মুসলিম সম্প্রদায়কে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ইংরেজদের এই ভেদনীতি সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সুবিচারের অধিকার’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন:
অনেক হিন্দুর বিশ্বাস, বিরোধ মিটাইয়া দেওয়া গবর্নমেন্টের আন্তরিক অভিপ্রায় নহে। পাছে কনগ্রেস প্রভৃতির চেষ্টায় হিন্দু-মুসলমানগণ ক্রমশ: ঐক্যপথে অগ্রসর হয় এইজন্য তাঁহারা উভয় সম্প্রদায়ের ধর্ম বিদ্বেষ জাগাইয়া রাখিতে চান, এবং মুসলমানের দ্বারা হিন্দুর দর্পচূর্ণ করিয়া মুসলমানকে সন্তুষ্ট ও হিন্দুকে অভিভূত করিতে ইচ্ছা করেন।২০
ইংরেজরা যে একপর্যায়ে মুসলমানদের কাছে টানার চেষ্টা করেন—সে তথ্যও পত্র-পত্রিকাতে স্পষ্ট। পত্রিকায় বলা হয়:
India does not forget an address delivered some years ago by sir Bampfylde Fuller, Governor of Bengal, in which that high official employing a significant figure of speech, represented the British Government in India as having ‘two wives’, Hindu and Moslem and the Moslem wife was the government’s favourite.২১
সিলেট জেলার অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিভাবান কংগ্রেস রাজনীতিক ছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। সিলেট জেলার বঙ্গভুক্তির বিষয়টি আসাম আইনসভায় ১৯২৬-এ উত্থাপিত হয়। তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলিম নেতা মহম্মদ সাদুল্লা এক নতুন যুক্তি উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন যে, শ্রীহট্ট যদি আসামে থাকে তবে আসামে মুসলমান জনসংখ্যা দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, যাকে বলা যায় প্রভাবশালী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী—এই জনসংখ্যা নিয়ে আসামের রাজনীতিতে মুসলমানরা সকল সময়ে একটা নিয়ন্ত্রক ভূমিকা নিতে সক্ষম হবেন। অপরদিকে বাংলা প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাধিক্য এমনিতেই রয়েছে, শ্রীহট্ট যদি বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে বাংলার মুসলিম সংখ্যাধিক্য মাত্র এক শতাংশ বাড়বে—অর্থাৎ পরিস্থিতির তেমন কোনো হেরফের হবে না, লাভের মধ্যে আসামের মুসলমানরা গুরুত্বহীন সংখ্যালঘুতে পরিণত হবেন। এই যুক্তি আবদুল মতিন চৌধুরীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।২২
এ সময় আবদুল মতিন চৌধুরী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস দলীয় সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রভাবশালী এই মুসলিম নেতা সিলেট প্রশ্নে সুরমা উপত্যকার মুসলিম সদস্যদের সংগঠিত করে একযোগে বঙ্গভুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পিছনে মতিন চৌধুরীর ভূমিকাই ছিল মুখ্য। আইনসভায় ব্রহ্মপুত্র এবং সুরমা উপত্যকার কংগ্রেস সদস্যগণ একযোগে বঙ্গভুক্তির পক্ষে ভোট দিলেও প্রস্তাবটি ২৯-১২ ভোটে পরাজিত হয়। এই পরাজয়ে মুসলিম রাজনীতিই যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরবর্তীতে এই ভেদরেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় সিলেট জেলার গণভোটকে কেন্দ্র করে।
আবদুল মতিন চৌধুরী মুসলিম লিগে যোগদান করেন ১৯৩৭-এ, যদিও আসামে মুসলিম লিগ গঠিত হয় ১৯২৭ সালে। যে-আবদুল মতিন চৌধুরী এবং তাঁর অনুসারীগণ আসামে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে সিলেট জেলার বঙ্গভুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন, সেই একই ব্যক্তি সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠানে মুসলিম লিগের শীর্ষনেতা কায়েদে আজম মহাম্মদ আলি জিন্নাহকে রাজি করিয়েছিলেন। প্রথমে কেবল সিলেট জেলা প্রশ্নে জিন্নাহ-র তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র আসাম পাকিস্তানভুক্ত হোক। কিন্তু আবদুল মতিন চৌধুরীর পীড়াপীড়িতেই নাকি এমএ জিন্নাহ সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাবটি ভাইসরয়ের কাছে পেশ করেছিলেন।২৩
১৯৩৮ সালে আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী এবং অপর পরিষদ (Assembly) সদস্য সৈয়দ আবদুর রউফ পূর্ববঙ্গাগত অভিবাসী সম্পর্কে আসাম পরিষদ-এ যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা ছিল জাতিবিদ্বেষ মানসিকতার পরিচায়ক। বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস ১৯৬০ সালের অক্টোবর-এ আসাম বিধানসভায় ‘ভাষা-বিতর্ক’ প্রসঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন:
….One Ex-Minister of Assam Shri Abdul Matin Chowdhury and another member of this House Syed Abdur Rouf made a statement on this subject in 1938 which have been published as a Govt. document. They stated, ‘The Spurious character of opposition to immigrants, on economic grounds, is evident from the persistancy with which it is urged that the East Bengal immigrants must ‘assemilate’ with the Assamese by adopting their language and culture’. The word ‘assimilation’ hardly admits of precise definition. To ask a Bengali to give up his mother tongue and inherit a culture of which he is as much proud as an Assamese of his own in exchange for a patch of land to which he is as much entitled as an Assamese— is to ask him to barter way his birth right for mere mess of pottage.২৪
মুসলিম সম্প্রদায়ের এই অবস্থানের পাশাপাশি বিপরীতধর্ম অবস্থানও ছিল লক্ষ করার মতো। আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যে মাননীয় সদস্য, তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। আর যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন, তিনিও ছিলেন পুলিশবাহিনীতে কর্মরত একজন মুসলিম সদস্য। সাড়াজাগানো ঘটনাটির উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনা ঘটেছিল সিলেট জেলার মাইজভাগ গ্রামে। এই গ্রামের মগফুর আলি আমিন ছিলেন একজন ‘খেলাফত আন্দোলন’ কর্মী। তাঁর বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে এই অভিযোগে গোলাপগঞ্জ থানার দারোগা আবদুল হামিদ আখন্দ পুলিশবাহিনী ও গুর্খাসৈন্যসহ তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়। সম্মিলিত এই সশস্ত্র বাহিনী মগফুর আলি আমিন-এর বাড়ির লোকজনদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, আসবাবপত্র ভাঙচুর, বইপত্র তছনছসহ পবিত্র কোরান শরিফটিও ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। সিলেট থেকে প্রকাশিত জনশক্তি পত্রিকায় এই ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা সম্পাদক সতীশচন্দ্র দেব এবং মুদ্রক অনাথবন্ধু দাস রাজরোষের শিকার হন। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত সম্পাদক এবং মুদ্রক উভয়কেই নিম্ন আদালতে সাজা প্রদান করা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা জজ কোর্টে আপিল করেন। শুনানির পর মাননীয় জেলা জজ বি.এন.রাও তাঁদের বেকসুর খালাস দেন। মামলাটি চলেছিল চার বছর। ১৯২৬ সালে তাঁরা মুক্তিলাভ করলেন সত্য, কিন্তু ‘মাইজভাগের ছিন্ন কোরান’ ঘটনার মূলনায়ক পুলিশকর্তা আবদুল হামিদ আখন্দ রইলেন বহাল তবিয়তেই। আর এ কারণেই সিলেট সদর থেকে নির্বাচিত আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য আবদুল হামিদ চৌধুরী (সোনা মিয়া) ১৯২৭ সালে ৫ অক্টোবর পরিষদ সভায় উপরোক্ত দারোগার বরখাস্তের দাবি জানিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কেবল বাংলায় প্রস্তাব উত্থাপনই নয়, তিনি সভায় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষাতেই সরকার এ প্রসঙ্গে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তাও জানতে চান। কিন্তু সরকার পক্ষ রইলেন নীরব। এরপরই সিলেট জেলার হবিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সদস্য গোপেন্দ্রলাল চৌধুরী এবং সিলেট সদস্য রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী একযোগে সরকার পক্ষের উত্তর দাবি করেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরকার পক্ষের জুডিশিয়াল সদস্য জানালেন, বাংলায় প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়া বিধিসম্মত নয়। এ কথা বলার পরই পরিষদে প্রচন্ড বাগবিতন্ডা শুরু হয়। সুরমা উপত্যকার সদস্যগণ দাবি করেন প্রত্যেক সদস্যেরই নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রশ্ন করার অধিকার আছে এবং সরকার পক্ষকে তার জবাব দিতে হবে। শেষপর্যন্ত বাংলা ভাষায় উত্থাপিত আবদুল হামিদ চৌধুরীর প্রস্তাব সরকার পক্ষ মেনে নেন। এভাবেই ‘১৯২৭ সালে আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদে বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।’২৫
আসামে আইনসভা গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন স্যার মহম্মদ সাদুল্লা। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র সাত মাস। ১৯৩৮ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর সাদুল্লা সরকারের পতনের পরই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন গোপীনাথ বরদলৈ। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের বিরুদ্ধেও অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। এই অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ১৯৩৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ধুবড়ি থেকে নির্বাচিত সদস্য আবদুল হামিদ খান (মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী) আইনসভায় তাঁর আলোচনার এক পর্যায়ে জানালেন:
বাঙালি ছেলেরা যে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করিতে পারিবে তাহা আসামের কংগ্রেসের নীতি নহে। বিদেশি ভাষায় শিক্ষা পাইবার জন্য তাহাদিগকে বাধ্য করা হইতেছে।২৬
বাংলা ভাষার পক্ষে আসাম আইনসভায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আপোষহীন লড়াই করার একাধিক দৃষ্টান্ত বর্তমান। আসাম আইনসভার পরবর্তী অপর এক সভাতেও মওলানা ভাসানী বাংলা ভাষার পক্ষে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করলেন। আসামের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনাথ দাস মওলানা ভাসানীর প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দিলে তিনি বাংলায় উত্তর পাবার দাবি তোলেন। মাননীয় মন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, তিনি বাঙালি নন। মওলানা ভাসানী তাঁর দাবিতে অটল থাকলে মাননীয় স্পিকার বসন্তকুমার দাস নির্দেশ দেন— ‘The Hon’ble Minister will try to answer in Bengali.’ মাননীয় মন্ত্রী তখন জানান— ‘I do not know Bengali’. মওলানা পীড়াপীড়ি করতে থাকেন— ‘আমি বাংলাতে উত্তর চাই।’ স্পিকার তখন মধ্যস্থতা করে বলেন, ‘The Hon’ble Minister may reply in English and I will translate the reply in Bengali’.২৭
এভাবেই সমস্যার সমাধান ঘটে। এ প্রসঙ্গে আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদ বা বিধানসভা সদস্য মতিউর রহমান মিয়া-র কথাও স্মরণ করা যেতে পারে।
ইমিগ্রান্ট মুসলমানদের প্রতিনিধি, পশ্চিম গোয়ালপাড়া আসন থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য মতিউর রহমান মিয়া ১৯৩৮ সালে আসাম অ্যাসেমব্লিতে বলেছিলেন:
…We are Bengalees. Our mother tongue is Bengali…..Under the circumstances if this Assamese language be imposed as a new burden on our shoulders, or on our children’s shoulders and if we are deprived of our mother tongue, then that will amount to depriving our children from opportunities of education.২৮
আসামের রাজনীতিতে আবদুল মতিন চৌধুরী, মহম্মদ সাদুল্লা প্রমুখ যেমন ছিলেন, তেমনই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। ১৯৪২ সালে ইংরেজবিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় সিলেট জেলার মোট ৩৯২ জন কারারুদ্ধ সদস্যের মধ্যে ৭৬ জনই ছিলেন ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই হিন্দ’ সংগঠনের কর্মী। এ সময় মুসলিম লিগে দলীয় সদস্যদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল ব্যাপকতর। কিন্তু তারপরও উলেমা সমর্থকদের এই বন্দিসংখ্যা আসাম তথা ভারতীয় রাজনীতিতে এক দিকচিহ্নবাহী ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া যেতেই পারে।২৯
অবিভক্ত ভারতের সমর্থনে সুরমা উপত্যকার জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃত্ব ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শিলচরে আয়োজন করেন ‘অসম ন্যাশনালিস্ট মুসলিমস কনভেনশন’-এর। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মৌলানা ইব্রাহিম। গোপীনাথ বরদলৈ মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য আবদুল মতলিব মজুমদার সম্মেলনের উদবোধন করে অখন্ড ভারতের দাবিতে সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা মৌলানা হুরমত আলি বড়লস্কর, মৌলানা মোহাম্মদ মশাহিদ, মৌলানা আবদুল জলিল, মোহাম্মদ সাজিদ রাজা মজুমদার প্রমুখ। বক্তাগণ তাঁদের ভাষণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তীব্র সমালোচনা এবং অখন্ড ভারতের দাবির প্রতি সমর্থন জানান। সম্মেলনে আগত পনেরো হাজার মুসলিম এদিন দেশভাগ বিরোধী স্লোগান দিয়ে শিলচরের বিভিন্ন রাজপথ পরিক্রমা করেন।৩০ এই পথ পরিক্রমা কেবল আসাম নয়, সমগ্র ভারতেই ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।
স্বল্প পরিসরে বর্ণিত এসব তথ্য থেকে একথা বলা যায় যে, আসামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দু-টি ধারা বেশ স্পষ্ট ছিল। এক, সুবিধাবাদী রক্ষণশীল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনালালিত এবং দুই, আধুনিক জীবনবোধসম্পন্ন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারা। ভারত ভাগের পরও আসামের রাজনীতি তথা সমাজচৈতন্যে এ দু-টি ধারার উপস্থিতি আমরা লক্ষ করব।
এ দিকে অসমিয়াগণও চুপ করে বসেছিলেন না। আসাম অন্তর্গত সিলেট এবং কাছাড় জেলা যেন তাঁদের দিন-রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এ দুটি জেলাকে আসাম থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের ডানা যে ছেঁটে ফেলা সম্ভব হবে, সেটি অসমিয়া রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীদের বুঝতে সময় লাগেনি। তাই ১৯৩৭ সালেই কংগ্রেসের প্রতি অসমিয়া জনগণের ‘…আনুগত্যের প্রশ্নে প্রথম ও প্রধান শর্তরূপে শ্রীহট্ট ও সমতল কাছাড়কে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।’৩১
১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে আসামের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ক্যাবিনেট মিশনকে জানিয়ে দেন যে, সিলেট জেলাকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে একীভূত করে দিলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এ সম্পর্কে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন :
Bardoloi let the cabinet Mission to understand in April that Assam would be quite prepared to handover Sylhet to Eastern Bengal.৩২
এরপরই কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের ক্ষমতাধর রাজনীতিক সরদার বল্লভভাই প্যাটেল-এর স্নেহধন্য গোপীনাথ বরদলৈ তাঁকে লিখলেন:
…The only alternative of this state of things is to separate the Bengali District of Sylhet and a part of Cachar from Assam and join these with Bengal.৩৩
এখানেই থেমে থাকেননি প্রধানমন্ত্রী বরদলৈ। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন উপলক্ষে বরদলৈ নেতৃত্বাধীন আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি যে-ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল সেখানে স্পষ্ট করেই জানানো হয়:
Unless the province of Assam be organised on the basis of the Assamese language and culture, the survival of the Assamese nationality and culture will become impossible. The inclusion of Bengali speaking sylhet and Cachar (plains portion) and the immigration or importation of lacs of Bengali settlers on wastelands has been threatening to destory the distinctiveness of Assam.৩৪
কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক দলের প্রাদেশিক নির্বাচনী ইস্তাহারে সুনির্দিষ্ট একটি জাতির পক্ষাবলম্বন কেবল অনভিপ্রেতই নয়, কংগ্রেস দলীয় গঠনতন্ত্রের মূলনীতিরও পরিপন্থী। কিন্তু তারপরও কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব এ সম্পর্কে নীরবতা পালন করলেন। ফলে, ইংরেজ শাসকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের শীতল অবস্থানের কারণে বরদলৈ নেতৃত্বাধীন আসাম প্রদেশ কংগ্রেস অতিসহজেই সিলেট জেলাকে গণভোটের মুখে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়।
‘ক্যাবিনেট মিশন’ ভারতে আসে ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ। ভারতে পৌঁছেই মিশন ত্রিপক্ষীয় সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যেখানে কেবল কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং মিশন উপস্থিত থাকবে। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ‘ইউনিয়নিস্ট পার্টি’র সহায়তায় পাঞ্জাবে কংগ্রেস সরকার গঠন করলেও, এই দলটিকেও আলোচনায় ডাকা হয়নি। এমনকী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি থেকেও অপর কোনো রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ক্যাবিনেট মিশন ‘মুসলিম লিগ’-কেই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করেছিল—অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নয়। ‘মিশন’-এর এই অসৎ উদ্দেশ্য বানচাল করতে কংগ্রেস কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নিল না।৩৫
কংগ্রেস অখন্ড ভারতের দাবি জানালেও লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্পষ্টত বুঝেছিলেন এটা সম্ভব নয়, ভারতকে ভাঙতেই হবে এবং সেটা হবে ধর্মের ভিত্তিতেই। এই ভাবনা থেকেই ক্যাবিনেট মিশন প্রদেশগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে। প্রথম ভাগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ, দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তৃতীয় ভাগে থাকবে বাংলা অথবা আসাম। কমিশন-পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলা এবং আসাম নিয়ে গঠিত হবে পূর্ববলয়— যা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত হবে। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার তৃতীয় ভাগ সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরে জানালেন যে, এর ফলে হিন্দু এবং মুসলিম জনসংখ্যার হারে ব্যাপক পার্থক্য ঘটবে— যা সমস্যা সৃষ্টি করবে। শেষপর্যন্ত লর্ড মাউন্টব্যাটেন মিশন পরিকল্পনা সংশোধন করে আসাম প্রদেশ যুক্ত হল প্রথম ভাগে অর্থাৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে।৩৬
ব্রিটিশ সরকার লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পিত পরিকল্পনাকে সামনে রেখে ভারত ভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ১৯৪৭ সালের ৩ জুন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে কংগ্রেস এআইসিসি-র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ জুন। সভায় লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও, আলোচনা এক পর্যায়ে তীব্র বাগবিতন্ডায় পরিণত হয়। অবিভক্ত ভারতের পক্ষে বহু সদস্য সেদিন সোচ্চার হন সত্য কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারত ভাঙার পক্ষেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।৩৭
সিলেট গণভোট
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসাম তথা সিলেট প্রসঙ্গে ঘোষণা করলেন:
Though Assam is predominantly a non-Muslim province, the district of Sylhet which is contiguous to Bengal is predominantly Muslim. There has been a demand that in the event of the partition of Bengal, Sylhet should be amalgamated with the Muslim part of Bengal. Accordingly, if it is decided that Bengal should be partitioned, a referendum will be held in sylhet under the aegis of the governor general and in consultation with the Assam provincial Government to decide whether the district of Sylhet should continue to form part of Assam province or should be amalgamated with the new province East Bengal if that province agrees. If the referendum results in favour of amalgamation with East Bengal, a Boundary Commission with terms similar to those for the Punjab and Bengal will be set-up to demarcate areas of Sylhet district and coutiguous Muslim majority areas of adjoining districts which will then be transferred of East Bengal. The rest of Assam will, in any case, continue to [remain] in India.৩৮
লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর ঘোষণা অনুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠিত হবে আসাম সরকারের সহযোগিতায়, গভর্নর জেনারেল-এর পরিচালনায় অর্থাৎ ক্ষমতার প্রকৃত অধিকারী হলেন গোপীনাথ বরদলৈ নেতৃত্বাধীন সরকার। যে গোপীনাথ বরদলৈ ইংরেজ শাসক এবং কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বকে একাধিক বার সিলেট এবং কাছাড় জেলাকে আসাম থেকে সরিয়ে পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন— সেই গোপীনাথ বরদলৈকেই কার্যত দেওয়া হল গণভোট অনুষ্ঠানের দায়িত্ব।
গণভোটকে কেন্দ্র করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্কের বাতাবরণ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে সাম্প্রদায়িক ভাবনাকেই উসকে দিল। উভয় সম্প্রদায়ের শুভবোধসম্পন্ন মানুষ চেষ্টা করেও ‘সাম্প্রদায়িক’ নামক বিষবৃক্ষের বিস্তৃতি রোধ করতে পারেননি—বরং ‘পাকিস্তান’ নামক উত্তাল ঢেউয়ের সম্মুখে তাঁরা হয়ে পড়লেন বড়োই অসহায়।
এই সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল— ‘যখন বাংলা প্রাদেশিক আইনসভার পূর্ববঙ্গের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শ্রীহট্ট জেলাকে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’৩৯ সিলেটের মানুষ গণভোটের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। সিলেট জেলার বিশিষ্ট নাগরিক আরএন চৌধুরী বল্লভভাই প্যাটেলকে চিঠিও লিখলেন। কংগ্রেস দলীয় এই প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাকে জানালেন সিলেটের মানুষ গণভোটের বিরোধিতা করছেন। চিঠিতে তিনি মুসলিম ধর্মীয় উন্মত্ততার ভয়াবহ দিকটির প্রতিও তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
এদিকে সুরমা উপত্যকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তথা বিশিষ্ট জনেরাও জনমত গঠনে এগিয়ে আসেন। শিলচরের তৎকালীন পৌরপ্রধান ও আসাম আইনসভা সদস্য সতীন্দ্রমোহন দেব উপত্যকার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য এক সভা আহ্বান করেন ৮ জুন তারিখে। সভায় সভাপতিত্ব করেন কংগ্রেস দলীয় প্রবীণ নেতা, আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ সিলেট জেলাকে ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে সমর্থন করে আবেগমথিত কন্ঠে ভাষণ দেন। সেদিন যাঁরা বক্তব্য রেখেছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন— ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ আদিত্য, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, আবদুল মতলিব মজুমদার, ললিতমোহন কর, কামিনীকুমার সেন, হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, মুজাম্মিল আলি, লাবণ্যকুমার চৌধুরী, গিরীন্দ্রনন্দন চৌধুরী, গোপেশচন্দ্র পাল প্রমুখ।৪০
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চা-শ্রমিকদের ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকা দেখে চা-শ্রমিকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কয়েক লক্ষ চা-শ্রমিক যাঁরা সিলেট জেলার চা-বাগানগুলোতে পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছিলেন, তাঁরা ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানালেন। বঞ্চনার শিকার চা-বাগান শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ালেন আসাম আইনসভা এবং এআইটিইউসি কার্য-নির্বাহক সমিতির সদস্য, সিলেট জেলার জনপ্রিয় নেতা পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৭ জুন বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা এক চিঠিতে সিলেট জেলার চা-বাগান শ্রমিকদের বাগানভিত্তিক পরিসংখ্যা উল্লেখ করে জানান যে, ‘অন্ততপক্ষে ৫০,০০০ চা-শ্রমিককে ভোটদানের অধিকার দেওয়া যেত।’ শ্রীসেনগুপ্ত তাঁর চিঠিতে ‘….লিগকর্মীদের গুণ্ডামি ও ধর্মোন্মত্ততার কথা উল্লেখ করে…উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের আসন্ন গণভোটে ভোটদান করা প্রায় অসম্ভব। তিনি প্রাদেশিক সরকারকে সব ধরনের সাহায্য প্রদানের জন্য প্যাটেলকে অনুরোধ করেন এবং তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রীহট্ট পরিদর্শনের অনুরোধ করেছিলেন।’৪১
বল্লভভাই প্যাটেল চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রাজদীপ চন্দ তাঁর নিবন্ধে জানিয়েছেন:
….পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্তকে জানিয়েছিলেন যে, ভোটার তালিকায় কোনো পরিবর্তন সম্ভবপর নয়।… সেনগুপ্তকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, গণভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা অটুট রাখার জন্য প্রাদেশিক সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাহায্যের প্রশ্নে প্যাটেল সোজাসুজি ও সুনিশ্চিত মতামত ব্যক্ত করেন যে, যদি স্থানীয় জনমত পুরোপুরি সংগঠিত থেকে থাকে তাহলে শ্রীহট্টের গণভোটের ভাগ্য সঠিক পথেই নির্ণায়িত হবে। তাই বাইরে থেকে সাহায্য ও সহযোগিতার দাবি করা নিরর্থক। এই কাজের দায়িত্ব স্থানীয় নেতৃবৃন্দকেই পালন করতে হবে। সময়ের চরম সন্ধিক্ষণে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শ্রীহট্টকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই একাই লড়তে হবে বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।৪২
অন্যদিকে গণভোট প্রসঙ্গটিকে মুসলিম লিগ নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলেন। তাঁরা দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেন যে, সিলেট গণভোট লড়াইয়ে ‘….We must win or we should perish’ ৪৩ আরও বলা হয়েছিল ‘….the first and the last battle of Pakistan will be fought in sylhet. The whole Muslim world is looking towards us…’৪৪
মুসলিম লিগ প্রধান এম.এ জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেন ঘোষণার পর পরই তিন সদস্যবিশিষ্ট গণভোট কমিটি গঠন করে দেন—যেখানে স্থান পেলেন শিল্পপতি এমএস ইস্পাহানি, বঙ্গীয় মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য মোয়াজুদ্দিন হুসেন এবং এ বাকজা। জিন্নাহ কমিটি সদস্যত্রয়কে অনুরোধ করলেন তাঁরা যেন শ্রীহট্টের মুসলমানদের একসূত্রে গেঁথে একযোগে, একলক্ষ্যে কাজ করতে সহায়তা করেন। বাংলার মন্ত্রীসভা সদস্য মোয়াজুদ্দিন হুসেনকে সিলেট গণভোটে পর্যবেক্ষকের দায়িত্বও অর্পণ করেন। জিন্নাহ লিগকর্মী সদস্যদের গণভোট কমিটি সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে কাজ করার আহ্বান জানান। আসাম প্রদেশ বাদ দিয়ে বাংলার একজন মন্ত্রীকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব অর্পণের পিছনেও ছিল মুসলিমলিগ নেতৃত্বের এক সুগভীর পরিকল্পনা।
অসম প্রদেশের বাইরে থেকে একজন পর্যবেক্ষক নিযুক্তির ব্যাপারে জিন্নাকে প্রভাবিত করেছিলেন তৎকালীন অসম প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য মইনুল হক চৌধুরী এবং তাঁর অনুরোধে সাড়া দিয়েই জিন্না এ পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। …তৎকালীন বাংলার শাসকদল ছিল মুসলিম লিগ এবং প্রয়োজনে গণভোট অভিযানকে আর্থিক আনুকূল্য জোগানোর যথেষ্ট সক্ষমতা সেই শাসকগোষ্ঠীর ছিল। তদনুসারে মইনুল হক চৌধুরী বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দিকে [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি] লিখেছিলেন যে তিনি যেন মূলধন জোগানোর উৎসগুলো খুঁজে বের করেন, যা শ্রীহট্টের গণভোটে মুসলিমলিগের অনুকূল ব্যবহারের জন্য কোনো জটিলতা ছাড়া অসম প্রাদেশিক মুসলিম লিগ কমিটির হাতে হস্তান্তরিত করা যেতে পারে।৪৫
সোহরাওয়ার্দিকে একথাও জানানো হয়েছিল যে তিনি যেন পার্শ্ববর্তী প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে মুসলমানদের দ্রুত সিলেটে আসার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
মুসলিমলিগ নেতৃত্ব প্রথমাবধি একথাও বলে আসছিলেন যে, তাঁদের প্রচারের প্রধানতম হাতিয়ার হবে ‘ধর্ম’, ইসলাম ধর্মের সর্বাত্মক ব্যবহার। তাঁদের প্রচারপত্রে, পোস্টারে, বক্তৃতায়, স্লোগানে, মিছিলে সর্বত্রই ছিল ধর্ম। …লিগ সমর্থক মুসলমানদের কাছে সিলেট হয়ে উঠেছিল জীবন ও ধর্মযুদ্ধের জ্বলন্ত প্রতীক। …মুসলিম লিগ ও মুসলমানেরা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আত্মপরিচয়। যার ভিত্তি ছিল ইসলামি আদর্শ।৪৬ লিগের প্রচারে স্পষ্টতই বলা হয়েছিল:
Our cause is noble Allah will be with us. On july 6th and 7th we are to give our verdict whether we want national liberation or perpetual slavery. Our distiny lies in our hands. I hope god will help us. Ameen.৪৭
১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই বদরপুরে মুসলিম লিগ আয়োজিত মিছিল এবং মিছিলশেষে জনসভাতেও বলা হল: ‘The choice was now between Kufristan and Islamistan.’৪৮
সুতরাং লিগের পরিকল্পনা, প্রচারে প্রথমাবধি কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তাঁরা তো বলেই ছিলেন—
Our Allah is one, Our Rasul is one, Our Quran is one, Our Qebla is one, Our political aim is one. We prefer death than slavery. We shall fight till we achieve Pakistan.৪৯
আমরা ইতিমধ্যে বলেছি যে, বল্লভভাই প্যাটেল চা-বাগান শ্রমিকদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি কোনো বিবেচনা ছাড়াই জানিয়ে দিয়েছিলেন— ‘ভোটার তালিকায় কোনো পরিবর্তন সম্ভবপর নয়।’ ফলে, বাধ্য হয়েই চা-বাগান শ্রমিকরা তাঁদের দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে আসেন। গণভোট-কে কেন্দ্র করে সিলেটে সেদিন কী ঘটেছিল? রাজনৈতিক তৎপরতার মাত্রা কতটা ছিল? আসাম সরকার তথা ইংরেজ প্রশাসনিক ভূমিকাই-বা কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গণভোটকেন্দ্রিক চালচিত্রটি সামনে আনা আবশ্যক। আবার এটাও তো সত্য যে, আসামে বাঙালি এবং বাংলা ভাষার রক্তাক্ত ইতিহাসের সুষ্পষ্ট বীজটিও কিন্তু রোপিত হয়েছিল ‘গণভোট’ নামক প্রহসনকে কেন্দ্র করেই।
১৯৪৭ সালের ২৯ জুন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৩০,০০০ চা-বাগান শ্রমিক, যাঁদের মধ্যে অসংখ্য নারীও ছিলেন— তাঁরা প্রায় ৩০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে সিলেট জেলার মৌলভি বাজারে এক সমাবেশে মিলিত হন। এই সমাবেশে তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংবাদে বলা হয়:
(i) Informing the Government of Assam and the Referendum Commissioner and the Viceroy that the demand of the tea labourer for their voting right in the ensuing referendum should be granted and if this demand is not met within 48 hours from today they would place themselves at the disposal of their union. (ii) declaring that they do not like to be united with the Pakistan Government of East Bengal and requesting the people of Sylhet specially, the cultivators to vote for retention of Sylhet in Assam and (iii) Assuring the villagers of Sylhet that the labourers would utilize their full strength in making the referendum work a success.৫০
সমাবেশে আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাসও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন:
…it was not in the hands of the Government of Assam to grant them the right of franchise. These teagarden people were not a floating population but are permanent residents of these gardens living for generations. …their demand was quite justified and they were entitled to the best consideration of the….৫১
সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীযুক্ত জীবন সান্যাল এম এল এ। মৌলভিবাজার মহকুমা শাসক মাসুদও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সমাবেশ উদ্দেশে জানান, তাঁদের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি যথাযথ কতৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। তিনি পরামর্শ দেন, শান্তিপূর্ণভাবে শহরে এসেছেন— একইভাবে তাঁরা যেন শহর ত্যাগ করেন। সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ সিলেট গণভোট কমিটির সভাপতি, কেন্দ্রের প্রাক্তন এম.এল.এ অনঙ্গমোহন দাম। তিনি বলেন:
… it is a matter of regret that garden population who are living for generations and will live as long as teagardens remain, have not been granted the right of franchise in the ensuring referendum thought they voted for the election of the provincial Assembly in 1945.৫২
এদিন অর্থাৎ ২৯ জুন চা-বাগান শ্রমিকদের এক বিশাল শোভাযাত্রা সিলেট শহরও প্রদক্ষিণ করে। তাঁরা শহর প্রদক্ষিণের পর ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের দাবিদাওয়া পেশ করেন। ‘We shall remain in Assam’ শীর্ষক সংবাদে বলা হল:
A procession of teagarden labourers paraded the streets today and met the Deputy commissioner of Sylhet. The Processionists asked for the franchise in the referendum and raised slogans such as ‘wanted franchise’ and ‘we shall remain in Assam’. …There is great resentment now in the tea labour area as a result of the denial of franchise to about 12,000 voters. The national trade union has declared the labour strike for two days. Meeting…against the Government decision are being held daily.৫৩
এদিন সিলেটে ‘মুসলিম লিগ’ এবং ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এর ফলে শহরে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। অপরদিকে ২৮ জুন শিলচর শহরে এক উত্তেজিত মুসলিম জনতা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের উপর হামলা চালায়। এ সময় তারা গণভোট প্রসঙ্গে তাঁদের দলীয় মতামত সংবলিত প্রচারপত্র—যেখানে আসামের মধ্যেই সিলেট জেলার অন্তর্ভুক্তির কথাও বলা হয়েছিল— সেগুলি বিক্রি করছিলেন। মুসলিম জনতা কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু কাগজপত্রও ছিঁড়ে ফেলে।৫৪
এদিকে আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস এবং এম.এল.এ., অক্ষয়কুমার দাস (দু-জনই গণপরিষদ সদস্য) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী Attlee-এর কাছে প্রেরিত বার্তায় চা-বাগান শ্রমিক প্রসঙ্গে জানালেন:
Reference Sylhet referendum, teagarden labourers settled in the Estates are excluded from voting. There is unrest in the Estates and the situation is explosive. The labourers are demanding repatriation to Behar. The anti-Pakistan feelings of Beharess caused Behar massacres. We demand weightage to pro-Assam votes in the proportion of two to thirty-one. There are two lakhs of teagarden labourers against the total district population of 31 lakhs. Weightage will save the situation.৫৫
গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যের বার্তার পরও ইতিবাচক কোনো ফল মেলেনি।
ক্ষুব্ধ চা-শ্রমিকরা তাঁদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় স্পষ্টত: তাঁরা জানিয়েদিলেন, যদি সিলেট পাকিস্থানে চলে যায় তাহলে তাঁরা সিলেট চা-বাগান ত্যাগ করবেন। করিমগঞ্জ থেকে ইউনাইটেড প্রেস পরিবেশিত সংবাদে বলা হল:
…Mr. Rabindranath Aditya M.L.A, in a statement says that teagarden labourers in Sylhet ‘is boiling with discontent due to denial of their franchise in the referendum and it has become extremely difficult to pacify them’. The Statement adds, “If sylhet goes to Pakistan, teagarden labourers are determined to leave sylhet gardens. It is being impressed on them by their union leaders that even if the referendum results are in favour of Pakistan, teagardens, mostly located in Hindu majority areas of the southern part of the district, would remain with Assam on demarcation by the Boundary Commission. Recommendations of the Boundary Commission are being awaited eagerly by them.
Besides Previous demonstrations on July 4, labourers of Langai circle, Karimganj, cameout of the gardens in a procession of fifteen thousand and paraded the road upto Patharkandi as a protest against inequitable denial of their franchise. European planters sympathised earlier with the demands of the labourers and assured help with garden trucks and labour volunteers in the referendum on pro-Assam issue, but on the night preceding the polling they informed the Labour Union that on the advice of the sub-divisional officer, Karimganj, they had decided to withdraw all help. This eleventh hour betrayal by European planters created fresh commotion among the labourers.৫৬
চা-বাগান শ্রমিকদের ভোটাধিকারের বিষয়টি শেষপর্যন্ত ‘সীমানা কমিশন’ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
মুখ্যত রাজনৈতিক দল ‘কংগ্রেস’, ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ এবং ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ যৌথভাবে এক লক্ষ্যে অর্থাৎ সিলেট জেলাকে আসাম প্রদেশ বা ভারতেই রাখতে হবে এই প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করে। এবং গণভোটে তাঁরাই যে বিজয়ী হবেন সে-বিষয়েও দৃঢ়মত পোষণ করেন ত্রয়ী দলের নেতৃবৃন্দ। অপরদিকে ‘মুসলিম লিগ’ দাবি করে যে, তারা সহজেই ‘walk over’ পাচ্ছেন।
জুন মাসের শেষের দিকে ‘মুসলিম লিগ’ এবং ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ শীর্ষক সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ সিলেট পৌঁছান এবং উভয় সংগঠনই স্ব স্ব দলের বক্তব্য জনসভাগুলিতে তুলে ধরেন। ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ নেতৃবর্গ গণভোটে এক শ্রেণির মানুষের গুণ্ডামি এবং গোলমাল সৃষ্টির প্রয়াসের তীব্র নিন্দা করেন। সংবাদে বলা হয়:
Maulana Mufti Muhammad Nayeem, Secretary, Maulana Abdul Hamid Siddiki and Maulana Shahid Fakiri, members of the Working Committee of the All-India Jamiet ulema in a statement ‘Condemn the hooliganism and rowdyism’ created by some people which they say ‘has made it impossible for the Nationalist Moslem workers to move freely’. They add that ‘Sylhet is sure to remain in Assam if only voters are allowed to come to the polling centres without being terrified’.৫৭
এদিকে সিলেট গণভোট কমিটির সেক্রেটারি ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডস’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে ভাইসরয় এবং আসাম গভর্নরের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তা প্রেরণ করেন। টেলিগ্রাম বার্তার কপি সিলেট গণভোট কমিশনার, কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, আচার্য কৃপালনী এবং আসাম প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈকেও পাঠানো হয়। টেলিগ্রাম বার্তায় বলা হয় :
Sylhet People view with great concern the despatch to Sylhet of non-Sylhet Muslim National Guards followed by Bengal Muslim Ministers to interfere with the referendum which concerns the district people alone. Pray prevent non-Sylhet people interfering with the free voting in the referendum.৫৮
সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়টি মুসলিম লিগ নেতৃত্বের কাছে কতটা গুরুত্ববহ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুসলিম লিগ দলীয় প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং ব্যাপকভাবে ‘মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড’ সদস্যদের সিলেট আগমণের সংবাদে। অমৃতবাজার পত্রিকা-র সিলেট প্রতিনিধি জানালেন:
Muslim National Guards are daily coming in large number from Bengal to sylhet and other parts of the district. Fifteen hundred Muslim National Guards have arrived here with the Nawab Bahadur of Dacca. The Muslim Guards have been distributed throughout the district. Mr. H.S. Suhrawardy along with Khwaja Nazimuddin also arrived here by air on Tuesday. Mr. Habibulla Bahar, Acting Secretary, Bengal Provincial Muslim League left Feni on Sunday with batches of Volunteers for Sylhet to help the local Muslims in the referendum. Some more Muslim National Guards followed him the next day.৫৯
বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস এবং ন্যাশনালিস্ট মুসলিম দল ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ একত্রে কাজ করলেও ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রথম বারের মতো কংগ্রেস-এর সঙ্গে মিলিতভাবে একই লক্ষ্যে অর্থাৎ সিলেট জেলাকে আসাম থেকে ছেঁটে ফেলার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে সংবাদপত্র জানাল:
It is gratifying to note that, that the communists for the first time, since their resignation from the parent body, are working in complete co-operation with the Congress on a common issue towards a common goal. Thousands of workers supporting Sylhet’s retention in Assam have pierced, despite threats from many Muslims League zones and are consolidating their positions.৬০
পত্রিকা আরও জানাল: ‘It is now almost certain that League will not have an easy sail.’
মুসলিম লিগ নেতৃত্ব হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে পূর্বেকার অস্পৃশ্য জাতি বলে খ্যাত ‘তপশিলি সম্প্রদায়’ তাস খেলতেও দ্বিধা করেননি। হিন্দু ভোটারে ভাঙন ধরাতে তপশিলি সম্প্রদায় প্রতিনিধি যোগেন মন্ডল সুরমা এক্সপ্রেসযোগে সিলেট পৌঁছোন ২ জুলাই’৪৭-এ। মুসলিম লিগ মনোনীত অন্তর্বর্তী সরকারের এই সদস্য বেশ কয়েকটি সভায় পাকিস্থানের পক্ষে জোর সওয়াল করেন। কিন্তু তপশিলি সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর বক্তৃতার প্রভাব তেমন না পড়লেও জমিয়ত-উল-উলেমা নেতৃত্ব যোগেন মন্ডলের এই সফরকে ‘রাজনৈতিক… উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে অ্যাখায়িত করেন।
এই তপশিলি নেতার সিলেট সফর সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হল:
…Sj. Jogen Mondal arrived at Sylhet to-day by Surma Express. He addressed several meetings at wayside stations in which, very few scheduled castes participated. The rank and file of this community are remaining firm supporting the stand for Sylhet retention in Assam.৬১
এদিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে মুসলিম লিগ প্রায় এক হাজার মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড-এর সহযোগিতায় ১ জুলাই মাধবপুর পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত ধর্মগড় বাজারের কাছে এক শোভাযাত্রা বের করে। লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিছিলকারীরা সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে ভীতি প্রদর্শন করে জানিয়ে দিল—তাঁরা অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা যদি ভোট কেন্দ্রে যায়, তাহলে তাদের ভয়াবহ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
একই দিনে অধিক রাতে মুসলিম লিগ-এর আর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় সাতিয়াজুরি বাজারে। সভাশেষে ফেরার পথে মুসলিম লিগ দলীয় বহুসংখ্যক সদস্য দত্ত পাড়ায় অবস্থিত নবকুমার দে-র বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য ছিলেন না। মুসলিম জনতা নবকুমার দে-র স্ত্রীকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। গণভোট কমিটির প্রচার সম্পাদক উদবিগ্ন হরিপদ দত্ত করিমগঞ্জ থেকে এক তারবার্তায় জানালেন:
Khaki uniformed Muslim National Guards posing as military personnel are threatening the people in the rural areas. Goondaism is rampant all around. Jamiat worker, Abdul Aziz was roughly handled the other day. Propaganda car and buses are being waylaid and pelted with stones. Mr. Satindra Deb, M.L.A. and a volunteer leader Ibrahim Ali were attacked at Churkhai.৬২
মুসলিম লিগ দলীয় সদস্যগণ প্রচারকাজে ব্যাপকভাবেই সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছিল খোলাখুলিভাবেই। ফলে, সংখ্যালঘু জনমনে উদবেগ, উৎকন্ঠা, ভীতির জন্ম দেয়, সৃষ্টি হয় ত্রাসের রাজত্ব। শিলচর থেকে অমৃতবাজার পত্রিকা প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদে বলা হল:
The Muslim League it is painful, has roused communal passions and is maintaining the same at high pitch, leaving little room for reason’s play. It is asking the Muslims to choose between worship at temple or prayer at mosque, Silchar, Sylhet and Habiganj. Railway lines are infested with League volunteers who occasionally shout Pakistan slogans. This has created panic among the peaceful passangers travelling by train. The greatest snag to referendum is hooliganism which started here with the import of national guards from outside. The situation throughout the district and also adjoining it, is daily detereorating. Far stronger measures must be taken if free voting were to be ensured.
Reports are being received from various parts of the district of assaults and illegal detention of workers engaged in referendum campaign. A propaganda van with Jamiat leaders and workers was attacked by Muslim Leaguers at Haripur Bazar, 12 miles from the town, several workers receiving injuries. Two jamiat workers were kept detained by leaguers, but later were rescued by other volunteers.৬৩
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি সিলেট পৌঁছে অতিব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিমলিগ নেতৃত্বের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী আলোচনায় সিলেট গণভোটের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা যায়। আলোচনাশেষে ২জুলাই তিনি সিলেটের গ্রামাঞ্চলে যাত্রা করেন।
এদিকে ১ জুলাই আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ প্রভুদয়াল এবং মহেন্দ্রমোহন চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট পৌঁছান এবং পরদিনই করিমগঞ্জ-এর উদ্দেশ্যে সিলেট ত্যাগ করেন। সিলেট অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। সমগ্র বিষয়টিই ছিল রহস্যময়। এ সময় আসামের মুসলিম লিগ দলীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্যার সাদুল্লাও ব্যাপকভাবে সিলেট সফর করেন।৬৪
মুসলিম লিগ সিলেট গণভোটে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে নানামুখী কৌশল অবলম্বন করেছিল। এ সম্পর্কে সুনামগঞ্জ থেকে অমৃতবাজার পত্রিকা-র বিশেষ প্রতিনিধি জানান:
The Muslim Leaguers are taking recourse to ‘boat denial’ tacties, besides mass assaults, to route their opponents in Sylhet referendum. It is reported that boats belonging to minority community are being extensively stolen to prevent them from attending the polling booths, according to a wellthoughtout plan. …United Press enquiries in official circles indicate that the Assam Government have requisitioned only twelve boats for military and a few others for the presiding officers in the referendum. They strongly contradicted the alligations that the congress Ministry had requisitioned a large number of boats ‘to deny communication facilities to League voters’.৬৫
সিলেট জেলার বিভিন্ন মহকুমায়, বিশেষত গ্রামে বসবাসকারী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মুসলিম লিগ সমর্থকরা ধারাবাহিকভাবে দোকানপাট বাড়িঘরে হামলা, লুট অব্যাহত রাখে। এ প্রসঙ্গে দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সুনামগঞ্জের দুহালিয়ায় বসবাসকারী কমপাউণ্ডার গিরিন্দ ভট্টাচার্য, মাধবনগরের ডা. ললিতমোহন রায়, জগন্নাথপুর থানার হরিপুরে চান্দিপ্রসাদ মুসলিম লিগ সদস্যদের হামলার শিকার হন। এসব অঞ্চলে দোকান বাড়িঘর লুটেরও সংবাদ পাওয়া যায়।৬৬
এ সময় আসামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষত হবিগঞ্জ এবং সিলেটের উত্তরাংশ থেকেই অধিক সংখ্যায় টেলিগ্রাম বার্তা পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। এসব টেলিগ্রাম বার্তার মূল বিষয়ই ছিল:
…intimidation and assault of members of minority community if they vote for Sylhet remaining with Assam.৬৭
গণভোট অনুষ্ঠানের দিন যতই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিল, ততই মুসলিম লিগ দলীয় সদস্য, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং তাদের সমর্থকগণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অপহরণ, লুট, জোরপূর্বক আটকে রাখা, অগ্নিসংযোগ, নিগ্রহ যেন নিত্যদিনের সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। সিলেট থেকে অমৃতবাজার পত্রিকা-র বিশেষ প্রতিনিধি ৪ জুলাই জানালেন:
The secretary, Referendum Committee, Sylhet has informed Mr. Stork, I.C.S., Referendum Commissioner that the impending referendum is going to end in fiasco in view of the large-scale lawlessness created by Muslim Leaguers. Reports of molestation, Kidnapping of workers from trains and boats, wrongful confinements, threats of killing and burning down houses are daily being received from Habiganj, Sunamganj and Sadar. The Premier and the Home Minister were duly informed, but the situation still remained the same. Urgent message have been also sent to Sardar Patel and Gandhiji.৬৮
অন্যদিকে করিমগঞ্জ গণভোট কমিটির প্রচার সম্পাদক এ সম্পর্কে জানিয়েছেন:
Notwithstanding the assurance of the viceroy and the Assam Governor to maintain peace in Sylhet during the referendum, intimidation and obstruction of free movement of jamiat workers are of daily occurrence. Congress workers sent out for propaganda purpose were reported to have been attacked at Fakirer bazar. Many were injured. Military arrangements are ridiculously inadequate. Prohibitory order under section 144 cr.p.c. has, however been promulgated. Rowdyism is reducing the referendum to a colossal mockery. Voter’s lists were supplied very late and that even uncertified and many corrections uninitiated.৬৯
আসামের গভর্নর স্যার আকবর হায়দারি ৫ জুলাই সকালে আসাম থেকে মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ এবং সিলেট সদর পরিদর্শন করেন। মূলত সিলেট জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার জন্যই তাঁর এই ঝটিকাসফর বলে জানা যায়। এদিন তিনি করিমগঞ্জও পরিদর্শন করেন। মৌলভিবাজারে গণভোট কমিটির সভাপতি আনন্দমোহন দাম সিলেটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ভোটারদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ের প্রতি গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গভর্নর জানান, গণভোট চলাকালীন সময়ে ভোটারদের নিরাপত্তা এবং তাদের রক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।৭০
করিমগঞ্জে কংগ্রেস নেতৃদ্বয় রবীন্দ্রনাথ আদিত্য এবং কামিনীকুমার সেন গভর্নরের কাছে গণভোট বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেন। ভোটারদের প্রতি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ভীতি প্রদর্শন— যাঁরা প্রধানত বাংলা থেকে বিপুল সংখ্যায় এসেছেন এবং বর্তমানে তাঁরা সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন বলে গভর্নরকে জানান। ভোট কেন্দ্রে অপর্যাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর বিষয়টিও তাঁরা গভর্নরের কাছে তুলে ধরেন। গভর্নর তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘… the military would be within the easy reach to look after the safety of the voters.’৭১
৫ জুলাই তারিখেই আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস সিলেটে ‘Associated Press of India’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গণভোটের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। গণভোটের সামগ্রিক দিক থেকেই সাক্ষাৎকারটি গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তকুমার দাস সেদিন জানিয়েছিলেন:
… the Sylhet Referendum was a special charge upon his Excellency the Viceroy. But it seemed that on behalf of the Viceroy things had been arranged in such a way as would make the referendum a farce. There was the promise given that the referendum would be conducted under military supervision with the help of the Provincial Police. The Provincial Government had already exhausted all their police and other resources and it was the inadequacy of the military deployed for the purpose that had made it impossible to conduct the referendum in a peaceful atmosphere.
…that the situation that had arisen on account of the workers of a political party having make elaborate plans for intimidation and obstructing voters from exercising their right of franchise with freedom, would be difficult to control with the military and the police that had been deployed.
Complete lawlessness was prevailing throughout the district. Nobody knew what things were going to happen during the referendum and the days after.
‘Reports are pouring in’, …‘from all parts of Sylhet district of organised goondaism. The police and the military deployed are quite inadequate to tackle the situation that will arise in most parts of the district. Out of 239 polling stations the military can be deployed in a nominal way to cover less than 100 centres and there are some polling stations where there will be no armed police at all’. ‘There are plain facts and the public must realise the gravity of the situations’…৭২
আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বসন্তকুমার দাস গণভোট প্রসঙ্গে সাংবাদিক সম্মুখে যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন, তারপর একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, ভোটের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। শ্রীদাস ভাইসরয়কেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কারণ গণভোট অনুষ্ঠানের বিশেষ দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপরেই। তিনি সমগ্র জেলায় পরিকল্পিত গুণ্ডারাজ চলছে বলে নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলতেও দ্বিধা করেননি। তিনি একথাও জানিয়েছেন, যে-সেনাসদস্য আছে তা দিয়ে মোট ২৩৯টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে নামমাত্র একশোয়েরও কম কেন্দ্রে সেনাবাহিনী দেওয়া যেতে পারে। অবশিষ্ট এমন অনেক ভোটকেন্দ্র আছে যেখানে সশস্ত্র পুলিশ পর্যন্ত থাকবে না।
সিলেট গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ৬ এবং ৭ জুলাই ১৯৪৭-এ। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৩৯টি। ভোটারের সংখ্যা ছিল মোটের ওপর ৫,৪৭০০০-এর মতো। ভোটপর্ব অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৯-৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬-০০টা পর্যন্ত।
৬ জুলাই অতিদুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই প্রথম দিনের ভোটদান পর্ব শুরু হয়। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া আর ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানির জন্য ভোটারগণ বেশ সমস্যায় পড়লেও তা ছিল সাময়িক। এদিন সিলেট গণভোট কমিশনার H.S. Stork গণভোট প্রসঙ্গে ‘Associated Press of India’-কে জানান:
… Polling was continuing peacefully… from the varies estimates twenty thousand volunteers belonging to the varies parties are at present engaged in the work throughout the district. Five medical units of R.W.A.C. have been posted in the five sub-divisional head quarters to meet any emergency.৭৩
গণভোট কমিশনার ভোটদান পর্ব শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলছে বললেও প্রকৃত অবস্থা তার বিপরীতই ছিল। এ.পি. এবং ইউ.পি. পরিবেশিত সংবাদে বলা হল:
Reports of clashes, Kidnapping of workers and arson are reaching Sylhet increasing number and giving the political parties much worry.
About precautionary arrangements political workers complained that they were entirely enadequate.৭৪
৬ জুলাই অর্থাৎ প্রথমদিনে হবিগঞ্জের গণভোট চিত্র কেমন ছিল, তার বিস্তৃত বিবরণ পাঠিয়েছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকা-র বিশেষ প্রতিনিধি। হবিগঞ্জ থেকে পাঠানো সংবাদে বলা হয়:
The voting for referendum commenced this morning and as apprehended earlier the Leaguers have started by completely blockading the entrances of polling centres by mass rally of non-voters. After two hours of voting reports have reached the Referendum office that Leaguers and Muslim National Guards are posted at all approach roads to villages and obstructing non-Muslim workers from entering villages.
Local Referendum Committee has sent the following telegram to the Referendum Commissioner: ‘Muslim Leaguers blockading entrance polling centre completely. Inadequate police force appear helpless before heavy onrush of Muslims. Threatening and intimidation going on unabated. Immediate intervention necessary, otherwise free and fair voting impossible’.৭৫
গণভোটের দ্বিতীয় দিন ৭ জুলাই তারিখেও আবহাওয়ার কোনো উন্নতি ঘটেনি, মুষলধারায় বৃষ্টি ছিলই। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ভোটারগণ ভোটদানের জন্য সাতসকালে ভোট কেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন। এদিন কর্তব্যরত সেনাবাহিনী উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে লক্ষ করে গুলি চালালে একজন নিহত ও একজন আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। ঘটনা ঘটেছিল দক্ষিণ সিলেটের আমতৈল ভোটকেন্দ্রের নিকটবর্তী স্থানে।৭৬
এদিনও বাড়ি-ঘরে লুট, হামলার একাধিক ঘটনা ঘটে। বহু ব্যক্তি আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভরতি হন। অনেক ভোটকর্মীও এদিন নিখোঁজ হন। হবিগঞ্জ, মৌলভিবাজারসহ সিলেট জেলার প্রায় সর্বত্র হামলা, কারচুপি, ভোটকেন্দ্রে মুসলিম কর্মকর্তাদের মুসলিমলিগ-কে সমর্থন, জনমনে আতঙ্কসৃষ্টিসহ যেসব ঘটনা ঘটেছিল তা ছিল ধারণাতীত। এ সম্পর্কে সমকালীন সংবাদপত্রে প্রচুর তথ্য বর্তমান। ৭ জুলাই হবিগঞ্জ থেকে পাঠান সংবাদে বলা হয় :
Reports received from different centres say that everywhere the Muslim Leaguers took to the same tactics for preventing non-Muslim voters from coming to polling stations. …..there were a number of incidents, Military arrangements were intensified. ….In the lowlying areas Muslims boatmen were not allowed to take Hindu passangers from 5th July. As a result of this, boatmen had to be hired from Tipperah. Small pockets of Hindus were kept from goingout by a strong blockade by Muslim National Guards and the League volunteers. About a 1000 Bengal National Guards came here and with the assistance of the local League volunteers undertook a terrorising campaign throughout rural areas. The League Guards and workers stopped at nothing to terroise voters and even Hindu presiding and polling officers.
Muslim presiding officers openly sided with the Muslim League if is reported by the referendum office here. A formal complain has been lodged against one E.A.C. and one centre the presiding officer and his staff resigned on account of the malpractices of the Muslim police officers and their colleagues and disturbances caused by the leaguers.
….impersonation of dead persons by the leaguers has been a common thing as reported here and one or two cases has been detected. …The Muslim Leaguers then resorted to further violence and as a result in many centres balloting had to be stopped for several hours and one presiding officer telegraphed to the S.D.O., Habiganj, that ‘free voting not possible’.
Presiding officers from many centres sent S.O.S. messages and in the Rarishal centre balloting had to be stopped for a long time. In Madhabpur area large number of Bengal National Guards with arms made their appearance and took to violent methods and actually raided the Bejura polling booths, says a message from Bejura.
In some centres Muslim presiding officers were openly siding with the leaguers and are reported to be even putting ballot papers in the Axe Box. ….
…. A passanger train on the Balla-Shaistaganj line was heldup by the League National Guards aided by the Local Leaguers armed with spears and other deadly weapons. …One Congress volunteer is reported to have been seriously stabbed at Juri.৭৭
৭ জুলাই তারিখেই মৌলভিবাজার থেকে পাঠানো অপর সংবাদে বলা হল:
Mr Pareshlal Shome, Chairman, Revenue Tribunal, has sent a telegram to the Viceroy and the Assam Governor alleging malpractics at some polling booths during voting in the Sylhet Referendum. He says : your assurance regarding peaceful vote for the Sylhet referendum has hopelessly failed here. Thousands of people blockaded both the polling centres in Maulvibazar town making it impossible for bonafide voters to reach the polling booths. I have myself failed to record my vote even after two hours. Efforts of local officers failed to clear the way for genuine voters.
Similar reports are coming from Galla, Rajnagar, Mahalala and Kazarbazar centres. Bloodshed has been reported from Jagatshi centre. Further, allegations are being made that some polling officers were giving ballot papers to voters to place in ballot boxes with a view to neutralise votes. …Pray don’t allow the referendum to be reduced to a farce and mockery by inefficiency and maladministration.৭৮
গণভোট কমিটি প্রেসিডেন্ট অনঙ্গমোহন দামও ভাইসরয়, আসাম গভর্নর, সংবাদ মাধ্যম এবং গণভোট কমিশনারের নিকট প্রায় একই অভিযোগ সংবলিত স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। এদিন আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ, মন্ত্রীদ্বয় বৈদ্যনাথ মুখার্জি এবং রামনাথ দাস মৌলভিবাজার পৌঁছালেও তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।৭৯
করিমগঞ্জের ভোটকেন্দ্রগুলিতেও ছিল একই দৃশ্য। মুসলিমলিগ এবং মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের দোর্দন্ডপ্রতাপ আর বাহুবলের কাছে অন্য আর সকলেই ছিলেন ভীত, দিকহারা, পরাজিত নাবিকসম। করিমগঞ্জ থেকে বলা হল:
…In the absence of military forces from almost half of the 44 centres of Karimganj, the acts of high handedness of Muslim Volunteers and National Guards in Khaki uniforms reached the climax during the polling hours yesterday and the assurance of adequate millitary help in the Sylhet district during the referendum proved a myth. Reports of intimidation and unserupulous means are pouring in from almost all centres.৮০
আসাম গভর্নর আকবর হায়দারি ৯ জুলাই সকালে সিলেট পৌঁছান এবং স্থানীয় সার্কিট হাউসে অবস্থান করেন। এ সময় ‘Associate Press of India’-এর বিশেষ প্রতিনিধি গভর্নর আকবর হায়দারির সঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন, যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বিশেষ প্রতিনিধি জানান:
During my discussion with Assam Governor, Lt. Col. Mahindar Singh Chopra, Commander-in-charge of the army now stationed at Sylhet, Mr. J. Dunbreck, Deputy commissioner, Sylhet, Mr. J.E. Retd. Deputy Inspector General of police, Assam, Mr. D.C. Dutta, superientendent of police, Sylhet and several party officers who had just arrived for sub-divisional headquarters were present.
Continuing the discussion the Governor added, ‘All these press reports are fantastic and entirely false. Perfect peace and order is prevailing in the district’. The Governor paid a tribute to the Army and Police for all that they had done in the last few days for the preservation of law and order and said : ‘We are all very greatful to them’. The Governor added that Mr. Basanta Kumar Das, Home Minister and Baidyanath Mukherjee, Supply Minister, who met him earlier also joined with him (Governor) in his tribute to the Army and police.
The Army officer present during the discussion said that the people of Sylhet during the referendum had generally behaved magnificently with dignity and restraint. Incidents were reported but they were negligible, he said.
The Deputy Commissioner during the discussion said that many cases of alleged lawlessness were already examined and found to be untrue.
The Governor at this stage laughingly said that he was not paying a tribute to the district authorities just now, but he would do that after the entire show was peacefully over. Regarding cases of arson the police superintendent told that the charges that the houses of a particular community were burnt were found to be entirely untrue by the investigating officer.
The Deputy Commissioner contradicted the reports published in certain section of the press that there had been evacuation in certain areas by the people of a particular community….৮১
আসাম প্রদেশ গভর্নর স্যার আকবর হায়দারি অতিসফলতার সঙ্গে সমগ্র প্রশাসনকে কীভাবে একসুরে বেঁধে ফেলেছিলেন, তারই উদাহরণ উপরোক্ত প্রতিবেদনটি। পারিষদ বেষ্টিত গভর্নর সিলেট সার্কিট হাউসে বসে জানালেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ‘অবাস্তব’ এবং ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’। তিনি আরও জানালেন, সমগ্র জেলায় ‘পূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা’ বিরাজমান। সেনাকর্তা লে. কর্নেল মহিন্দর সিং চোপরা সংঘটিত ঘটনাগুলিকে ‘নগণ্য’ বলে আখ্যায়িত করেন। ডেপুটি কমিশনার জানালেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার বা আইন অমান্যের অভিযোগ আনা হলেও পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সকল অভিযোগই অসত্য। পুলিশ সুপারও জানালেন, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অগ্নিসংযোগের যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তদন্তের পর দেখা গেছে যে, সকল অভিযোগই সম্পূর্ণ অসত্য।
ব্রিটিশসৃষ্ট আমলাদের কাছ থেকে এর বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তখনও ছিল না, এখনও নেই। আমরা এ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরব। ৯ জুলাই করিমগঞ্জ গণভোট কমিটির প্রচার সম্পাদক এক বিবৃতিতে জানালেন:
…that at a polling centre a Hindu ‘Sarpanch’ whose assistance in identification of voters was necessary, was kidnapped in a taxi occupied by some Muslims. He adds, ‘All Hindus of a village contiguous to Karimganj town are reported to have been intimidated by a local influential Muslim landlords to vote for separation or abstain and four voters are reported to be missing. in many centres presiding officers illegally refused to record tendered votes of respectable Hindu and Jamiat voters and allowed irregularities favouring Leaguers’.৮২
অপর আর এক সংবাদে বলা হল:
… S.J. Ganesh Chandra Pal M.L.A, with S.J. Ketakiranjan Bhattacharjee a worker went in a launch to rescue some hundred voters at Kanaight. Their motor launch was attacked and they had to come back unsuccessful from the polling stations. Some women Muslim volunteers had been brought from Peshawar.৮৩
গণভোটের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ৭ জুলাই সিলেট শহর থেকে দু-মাইল দূরে গোপ শহরে এক সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ৬ জনকে সিলেট সিভিল হাসপাতালে ভরতি করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস এলাকা পরিদর্শন করেন। সিলেট ডেপুটি কমিশনার এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।৮৪
সিলেট গণভোটে মুসলিম লিগ, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং তাদের দলীয় সদস্য সমর্থকদের কার্যকলাপ তথা সামগ্রিক ভূমিকা সংবলিত স্মারকলিপিসহ এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ১২ জুলাই নতুন দিল্লিতে কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের অভিযোগ তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে সংবাদপত্র জানাল:
..Mr Anil K. Chanda M.L.A. (Central), Khan Bahadur Mohamad Ali, Ex-Minister, Assam, Mr. J. Santal, Teagarden labour representative in the Assam Assembly, Mr. G. Das chowdhury, ex-president Assam legislative Council and Mr. A.M. Dam, ex-MLA (Central), represented to-day to the Congress President the grievances of the non-Muslim voters in the referendum in Sylhet.
The deligation also waited on Mahatma Gandhi to-day to acquaint him with the ‘malpractices of the Muslim presiding officers’ in the referendum.
The spokesman of the deligation Mr. Ananga Moham Dam ex-MlA (central), stated that two years backout of a population of 50,000 in Baniyachong, nearly 14,000 Muslims died in malaria epidemic. But people were allowed to vote in the names of the Muslim voters who died in that epidemic on forged personification, Mr. Dam held the Governor of Assam responsible for not making adequate arrangements to conduct ‘a fair and free referendum’. in many places, Mr. Dam added, Hindu voters ‘Were coerced by Muslim National Guards and prevented from voting’. It was further stated that nearly 13,000 labour voters were not allowed to appear before the polling stations. The deligation, it is learnt, will also meet Pandit Nehru and Sardar Patel. After seeing Mahatma Gandhi, Mr. A.K. Chanda, member of the deligation told the A.P.I. that both Acharya Kripalani and Mahatma Gandhi gave them a patient hearing.
‘Nobody can predict the result of the Sylhet referendum. But whichever party wins, i must say the referendum was not fair to the major section of the people who desire Sylhet to remain in Assam’. said Mr. Chanda.৮৫
প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কেবল ‘Patient hearing’ ছাড়া আর যে কিছুই লাভ করেননি— তা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম পরদিন সিলেট গণভোটের ফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
অবশেষে সিলেট জেলাকে কেন্দ্র করে বহু বিতর্কিত গণভোটের ফল প্রকাশিত হল। ১৩ জুলাই নতুন দিল্লি থেকে ঘোষিত বার্তায় বলা হল :
Sylhet has decided to join Pakistan, it is officially announced. A press Note issued from Viceroy’s House says: Following is the result of referendum in Sylhet district, Assam. Valid voters for joining East Bengal 2,39,619. For remaining in Assam 1,84,041. Majority 55,578. The percentage of valid votes to total electorate entitled to vote was 77.33৮৬
সিলেট গণভোটের ফল প্রকাশিত হলেও সীমানা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সমগ্র বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘোষণা প্রশাসনিকভাবে সম্ভব ছিল না। কারণ ….‘It offends the declaration of June 3, paragraph 13 providing for such transfer only after demarcation of Muslim majority areas of sylhet’. সীমানা নির্ধারণের জন্য ‘সীমানা কমিশন’ (Boundary commission) ইতিমধ্যেই গঠিত হয়েছিল। ফলে, সীমানা কমিশন-এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সকল পক্ষকে অপেক্ষা করতেই হল।
পরবর্তীতেও সিলেট গণভোট বিতর্ক কিন্তু পিছু ছাড়েনি। ১৯৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’-এর কাছে যে স্মারকলিপি প্রদান করেছিল— সেখানে সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে বড়ো রকমের অভিযোগ উত্থাপন করে বলা হল:
At the time of the Partition in 1947 it is well-known that Assam made no serious effort to win the plebiscite in Sylhet, and even allowed propagandists from the Punjab to preach in favour of Pakistan, while it harassed the men sent from Calcutta to preach in favour of its retention in the Indian Union. At the time of the plebiscite ferries were virtually closed in the Hindu areas. The Muslim Superintendent of the Government Press of Assam, where ballot papers were printed, printed false ballot papers and issued them to the members of the Muslim League, these being actually used during the plebiscite. This fact was detected several months after the plebiscite was announced, and the Muslim superintendent of the Assam Government had to be dismissed. He then joined service in Pakistan. It may be recalled that the Assam Administration did not inform the Government of India of this very serious fact far less make any attempt to have the results of the plebiscite modified. Their attitude was and it is that if a Bengali-Speaking area goes away so much the better for the Assamese-Speakers, as it will increase the relative proportion of the latter.৮৭
সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত বর্ণিত তথ্যের আলোকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভ যেমন সম্ভব—তেমনি আসাম সরকার, আসামের গভর্নর তথা প্রশাসনের সামগ্রিক তৎপরতাও চিহ্নিত করা সম্ভব। রাজনৈতিক দল হিসেবে কেবল মুসলিম লিগ-এর বিষয়টি যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে দেখব গণভোটকে কেন্দ্র করে প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় নেতা সিলেটে এসেছিলেন— যাঁদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকার নবাব বাহাদুরের নেতৃত্বে প্রথম দফাতেই ১৫০০ মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সদস্য সিলেটে আসে। বাংলার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি, খাজা নাজিমুদ্দিন, বঙ্গীয় প্রদেশ মুসলিম লিগ এর কার্যকরী সেক্রেটারি হবিবুল্লাহ বাহার প্রমুখও এসেছিলেন। তাঁদের তৎপরতাও ছিল তাৎপর্যময়। দফায় দফায় মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং মুসলিম লিগ স্বেচ্ছাসেবীদের মূলত পূর্ববাংলা থেকে আনা হলেও বহু সদস্য পাঞ্জাব, পেশোয়ার থেকেও এসেছিল— যাদের তৎপরতা আমরা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি।
অপরদিকে ‘কংগ্রেস’, ‘জমিয়ত-উল-উলেমা-ই-হিন্দ’ এবং ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ এক লক্ষ্যে কাজ করলেও কাঙ্ক্ষিত ফল কিন্তু দলগুলির অনুকূলে আসেনি। সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলীয় কোনো কেন্দ্রীয় নেতা সিলেট জেলায় পা রাখেননি স্থানীয় নেতাদের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস তথা সরকার, গভর্নর এবং ভাইসরয়-এর দিকে আঙুল তুলেছেন অনেকেই, অভিযোগও করেছেন সরাসরি। দিল্লির দরবারেও ছুটেছেন একদল প্রভাবশালী প্রতিনিধি। কিন্তু ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বরং কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রভাবশালী নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেল সিলেট গণভোটের ফলাফল মেনে নিলেন। ১৫ জুলাই ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বল্লভভাই প্যাটেল জানালেন:
I have received a telegraphic reply from Governor of Assam in regard to the Sylhet referendum. He has given full particulars. There was undoubtedly intimidation, false impersonation and incursion of Muslim National Guards from Bengal. But it sums clear from the member of People who voted and the result of voting that any irregularities that took place could never materially affect the result of the referendum.৮৮
সরদার বল্লভভাই প্যাটেল এখানেই থেমে যাননি। ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি শিলঙে এক সভায় শ্রীহট্ট বিষয়ে মন্তব্য করলেন— শ্রীহট্ট ছিল আসামের রোগগ্রস্থ অঙ্গ, যা যথার্থই কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল।৮৯
বল্লভভাই প্যাটেল-এর এই মন্তব্য যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোভাবটিও আঁচ করতে কষ্ট হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রবন্ধকার জন্মজিৎ রায়-এর মন্তব্য স্মরণ করব:
…the pre-Referendum as well as the post-Referendum gameplan was jointly prepared by the three powers : the congress leadership of Assam, the Muslim League and the British government, represented by the Cabinet Mission and the Boundary Commission, each of them acting with the common objective of crushing the strong hold in Sylhet of the rising Bengali power—economics, cultural and political…৯০
এই মন্তব্যের সঙ্গে আমরা একথাও বলব যে, কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ দায় এড়াতে পারেন না। এ সময় কেন্দ্রের অত্যন্ত ক্ষমতাবান প্রভাবশালী নেতা ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, যাঁর স্নেহধন্য ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ। সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে সরদার বল্লভভাই প্যাটেল-এর মতামত সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এক, আসাম আইনসভা সদস্য সিলেটের জনপ্রিয় নেতা পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত ১৯৪৭ সালে জুন মাসে বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বল্লভভাই প্যাটেল-এর মতামত। দুই, সিলেট গণভোটের ফলাফল মেনে নিয়ে ১৫ জুলাই ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে লেখা চিঠি। তিন, ১৯৪৮ সালে শিলঙে সিলেট গণভোট প্রসঙ্গে বল্লভভাই-এর মন্তব্য। তবে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে এ সত্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের ফলাফলই আসামে বসবাসকারী বাঙালির জীবনে নেমে আসে ঘন অন্ধকার, যে আঁধার আজও গেল না। আজও বলা হচ্ছে আসামে বাঙালিরা নাকি ‘আবর্জনার স্তূপ’ এবং তাও বলেছেন আসাম বিধানসভার মাননীয় স্পীকার প্রণব গগৈ।৯১ স্পীকারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পদে আসীন থেকে এ জাতীয় মন্তব্য কেবল অনভিপ্রেতই নয়—উদবেগজনকও বটে। আজও আসামের চার লক্ষ বাঙালি হিন্দুকে ‘ডি’-ভোটার তকমা মাথায় নিয়ে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।৯২
গণভোটের ফল প্রকাশের পরই কাছাড় জেলাবাসী উদবিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ সিলেট জেলা পাকিস্তানভুক্ত হয়েছে, এবার বুঝি কাছাড় জেলার পালা। এই ভাবনার কারণও আছে— আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ অনেক পূর্বেই কাছাড় জেলার সমতল অংশ পাকিস্তানকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কংগ্রেস হাইকমাণ্ডকে লিখিতভাবেই জানিয়েছিলেন।
উদবিগ্ন ও চিন্তিত কাছাড়ের অগ্রণী অংশ বিষয়টির প্রতি সকল স্তর ও পর্যায়ের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে একের-পর-এক জনসভার আয়োজন করেন।
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই শিলচরে এক বিশাল জনসভা আয়োজিত হয়। আয়োজক ছিল ‘কাছাড় কল্যাণ সমিতি’। সভায় সভাপতিত্ব করেন ধীরেন্দ্র গুপ্ত। সভাপতি এবং বিভিন্ন বক্তা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তার ফলাফলের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন। সর্বসম্মতিক্রমে সভায় দাবি করা হয় যে:
….Cachar must not be tagged with Pakistan. It was further resolved to retain non-Muslim areas of Sylhet in Assam on basis of June 3 declaration.৯৩
অপর আর এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯ জুলাই উধারবন্দে। এ সভারও আয়োজন করে ‘কাছাড় কল্যাণ সমিতি’। সকল সম্প্রদায়ের মিলিত এই বিশাল জনসভা সম্পর্কে বলা হল:
….Prof. Haripada Bhattacharjee gave an analysis of June 3 declaration and showed Cachar’s advantages in remaining within Assam. Sj. Mahendra Suklabaidya, ex-M.L.A, urged for united stand for retention of Cachar in Assam. Sj. Sanat Das also spoke.৯৪
২০ জুলাই সভা আয়োজিত হয় সোনাই হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীযুক্ত নগেন্দ্র চক্রবর্তী। মহেন্দ্র শুক্লাবৈদ্য, প্রফেসর হরিপদ ভট্টাচার্য ও অন্যান্য বক্তাগণ কাছাড়ের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জানান, কাছাড় জেলা অবশ্যই আসামের অন্তর্গত থাকবে। এ দিনের সভা সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হল:
…..It was resolved unanimously that a united fight must be launched against any move to Tag Cachar or any part there of with East Bengal. It was further resolved to organise National Home Guards for maintenance of peace and order in Cachar. Great enthusiasm was noticed everywhere.৯৫
কাছাড় প্রসঙ্গে পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয় লালবাজারে ২২ জুলাই। এই সভা সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হয়:
A huge meeting of people of all shades of opinion was held at Lalabazar on July 22 to discuss the present political situation of Cachar. Sj. Ramen Purkayastha repudiated Leaguer’s claim on Cachar and appealed for unity. Sj. Sarat Chandra Nath warned the Public against mischeif-mongers. prof. Haripada Bhattacharjee also address the gathering. Resolutions urging retention of Cachar in Assam was unanimously adopted.৯৬
কাছাড় প্রসঙ্গে সেদিন সাংবাদিকগণও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এ সময় শিলচর সফর করেন। তাঁরা কলকাতায় ফিরে সংবাদপত্রে এক লিখিত বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিটি দীর্ঘ হলেও অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আমরা বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরব:
It will certainly be a forcible inclusion, a distortion indeed, if some parts of Cachar which were denied the right of referendum to record their opinion are compelled to form a part of Pakistan. We strongly condem the present fanatic and corrosive move, which wants to destroy the existing natural boundary simply for a minor and solitary Muslim Pocket. The district has a one thousand feet high mountain, as its boundary on the west and where that ends, the largest river of the valley continues to form its boundary. This existing boundary line formed by the mountain and the river provides a strong defence line. We assert therefore, that the intigrity of this non-Muslim district gifted with a strong defence line must be maintained at all costs,” said Sjs. Ramendra Deshamukhya, Samarendra Bhattacharyya and Dwaresh Sharmacharyya, Calcutta journalists, hailing from Silchar, in a statement to the Press. They added: “Reasons as to why Cachar should not be included in Pakistan are given bellow:
“(a) That Cachar is predominantly a non-Muslim district having a non-Muslim population of 62.5P.C..
The only Muslim majority thana in Cachar is Hailakandi thana with Muslims forming 55.3 P.c. of the total population. “Here are the statistics according to the 1941 census:
Communal Percentage in Cachar:
“(a) But as this Hailakandi is a minor pocket separated from Sylhet by a high hill and surrounded by non-Muslim areas— it cannot be claimed as a ‘contiguous Muslim majority area of the adjoining district’.
“(b) There is no rationality in destroying the existing natural boundary for one pocket only. Besides, while taking into account the strategic requirements of the two independent states, the Boundary Commission will have to consider this Nature— made defence line which will certainly guarantee immunity from petty frictions on the border.
“(c) We are sure that Muslim Leaguers will never be so kind as to return a non-Muslim pocket from their Eastern Pakistan. It will not be out of place to mention the case of Sunamganj and Habiganj, two Muslim majority sub-divisions each of which have a predominantly non-Muslim thana within its Jurisdiction. Salla P.S. in Sunamganj has a Muslim population of 34.1 P.c. and Ajmiriganj P.S. in Habiganj has a Muslim population of 46.9 P.C. We are sure, the Leaguers will move heaven and earth to include these pockets. Why then Cachar should allow its only pocket to be separated?
“(d) Last of all, there is no justice in forcing the people of an area, not allowed to express their wishes by referendum to join with another area with which they had no previous administrative links.”৯৭
কাছাড় জেলার সর্বস্তরের মানুষ যখন একের-পর-এক জনসভার আয়োজন করে জনমত গঠনে তৎপর, সাংবাদিকগণ যখন পরিসংখ্যান, যুক্তি তুলে ধরে কেন কাছাড় জেলা আসাম অন্তর্গত থাকবে, তা প্রমাণে যত্নবান, তখনও অসমিয়াগণের তৎপরতার কোনো খামতি ছিল না। এমনকী অসমিয়া সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলের এক বড়ো অংশ উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসারে অতিসক্রিয় ছিলেন। এই অংশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ড. বাণীকান্ত বড়ুয়া [কাকতি?] এক বিদগ্ধসমাজ সভায় জানালেন:
Historically Assam is the homeland of the tribes and races. The other day Dr. B.K. Barua in course of his lecture in the Narayani Handique Historical Institute elaborately dwelt upon the fact that civilisation of Assam is Mongolian. Eternal vigilance is the price of liberty. Culturally, racially, and linguistically, every non-Assamese is a foreigner in Assam. In this connection we must bear in mind that Assam from the very ancient times never formed a part of India.৯৮
ড. বাণীকান্ত একথাও জানান যে, ১৮২৬ সালে আসাম প্রদেশ ব্রিটিশ অধিকারে যাওয়ার পর যাঁরাই নানা সূত্রে আসামে এসে বসবাস শুরু করেছেন তাঁরা সবাই বিদেশি। আসল কথা, আসাম প্রদেশ অসমিয়াদের জন্যই— অন্য কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অধিকার তারা মানতে নারাজ।
এদিকে ‘অসম সাহিত্য সভা’র প্রভাবশালী নেতা অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী এ সময় The Assam Tribune পত্রিকায় লিখলেন:
It is our definite opinion that whatever sense there has been in retaining Sylhet as a whole in Assam, there is no justification what so ever in these Cachar and Sylhet leaders trying to retain a few Hindu majority ‘thanas’ of the district within Assam. Nor can be boundary commission, in our opinion, grant this demand. There is little sense in trying to retain the junior partner of Sylhet— the Cachar plains, at any rate Hailakandi sub-division in Assam.৯৯
সিলেট প্রসঙ্গটি এখানেই থেমে থাকেনি। ‘অসম সাহিত্য সভা’ তথা আসাম সরকারের একান্ত সমর্থক The Assam Tribune মন্তব্য করল:
There seems to be no Justification in retaining a few ‘thanas’ of Sylhet district and Hailakandi Sub-division of the Cachar district within the province of Assam. Mr. A.G. Roychowdhury’s warning to the Assam Provincial congress Committee is, therefore, timely and appropriate.১০০
The Assam Tribune ২৯ জুলাই আবারও জানাল:
The case for the Assamese people is clear, they do not want to retain any part of Sylhet district. The proposal to demand a few ‘thanas’ seems quite uncalled for.১০১
অসমিয়াভাষীদের নিশানা যে কেবল বাঙালি বা বাংলাভাষীরা ছিলেন—তা নয়, পার্বত্যজাতি-দেরও তাঁরা বিবেচনায় রেখেছিলেন। দেশভাগের প্রাক্কালে অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী সংবাদপত্রে লিখলেন:
The Assam Provincial Congress committee, it is understood, has been faced with a proposal, sponsored by the Bengal Provincial Congress Committee, of amalgamation of Chittagon Hill tracts with Assam in the new Adjustment of Bengal territories between East and west. This predominantly non-Muslim area (Muslims being less than 3%) with a population of about 2,40,000 (all Tribal) can have no place in West Bengal, being an isolated place in the East, contiguous to Assam via Lushai Hills. With the greater sympathy for this area the Assamese people, I think, do not desire expension further east in quest of barren and unwieldly hills. The Assamese people most certainly live to leave out open the Lushai Hills for creation of a frontier Autonomous unit along with Tripura and Manipur.১০২
আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ ভারত ইউনিয়নভুক্ত হওয়ার জন্য বার বার আবেদন জানিয়েছিলেন, স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন আসাম সরকারের অনমনীয় অবস্থান এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শীতল মনোভাবের কারণে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ প্রায় নি:শব্দে পাকিস্তানের দখলে চলে যায়।
কেবল অসমিয়া সমাজের অগ্রণী অংশই নন, অন্যান্য স্তরের অসমিয়াগণও সিলেট জেলাকে পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে খুশি হতে পারেননি, বরং সমগ্র কাছাড় জেলা বিশেষত হাইলাকান্দি এবং ধুবড়ির বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাও পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন। এসবের মূলে যে-ভাবনা অসমিয়াদের অন্তরে ক্রিয়াশীল ছিল— তা যে আসাম থেকে বাঙালিদের বিতাড়ন, সে বিষয়টি আমরা বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করব পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে।
এই চাপান-উতরের মধ্যেই ‘সীমানা কমিশন’-এ দাবিদাওয়া সংবলিত অসংখ্য স্মারকলিপি আসামের বিভিন্ন সংগঠন, আসাম সরকার, কংগ্রেস কমিটি এবং পাকিস্থানের পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে জমা পড়ে। প্রধানত পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষে হামিদুল হক চৌধুরী, মুসলিম লিগ-এর পক্ষে ওয়াসিম এবং গোয়ালপাড়া ও কাছাড় জেলা মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এ. কে. ফজলুল হক কমিশনে সওয়াল করেন। অন্যপক্ষে সওয়াল করেন প্রধানত আইনজীবী অতুল গুপ্ত, এস কে বসু, এইচ. সি. চক্রবর্তী, এন. সি. চ্যাটার্জী প্রমুখ।
সীমানা কমিশনের সদস্য ছিলেন— বিচারপতি বি. কে. মুখার্জী, বিচারপতি সি. সি. বিশ্বাস, বিচারপতি আবুসালেহ মোহামেদ আকরাম এবং বিচারপতি এস. এ. রহমান। কমিশন চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার সাইরিল র্যাডক্লিফ (Sir cyril Radcliffe)। ১৯৪৭ সালে ৪, ৫ এবং ৬ আগস্ট কলকাতায় সীমানা কমিশনে উভয়পক্ষের মূল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এই তিন দিনই সওয়াল-জবাব শোনার জন্য কমিশন দরবার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। সীমানা কমিশন সিলেট জেলা সীমানা নির্ধারণে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল— তার মূল বয়ান ছিল এরকম:
…..The award of the Bengal Boundary commission regarding Sylhet has resulted in the whole of that district being transferred from the province of Assam to the new province of East Bengal, except for the four thanas of Patharkandi, Ratabari, Karimganj and Badarpur. No other part of the province of Assam has been transferred to East Bengal….
A line shall be drawn from the point where the boundary between the thanas of Patharkandi and Kulaura meets the frontier of Tripura state and shall run North along the boundary between those thanas, then along the boundary between the thanas of Patharkandi and Barlekha, then along the boundary between the thanas of Karimganj and Barlekha, and then along the boundary beetween the thanas of Karimganj and Beani Bazar to the point where that boundary meets the river Kusiyara. The line shall then turn to the east taking the river Kusiyara as the boundary and run to the point where that river meets the boundary between the districts of Sylhet and Cachar. The centre line of the main stream or channel shall constitute the boundary. So much of the district of Sylhet as lies to the West and North shall be detached from the province of Assam and transferred to the province of East Bengal. No other part of the province of Assam shall be transferred.১০৩
‘… ১৭ আগস্ট সিলেট চূড়ান্তভাবে বিভাজিত হল। করিমগঞ্জ মহকুমার তিনটি থানা, পাথারকান্দি (২৭৭ বর্গমাইল), রাতাবাড়ি (২৪০ বর্গমাইল), বদরপুর (১৪৭ বর্গমাইল) এবং করিমগঞ্জ থানার একটি অংশ (১৪৫ বর্গমাইল)— সব মিলিয়ে যার জনসংখ্যা ছিল ২৮,২৫,২৮২— ভারতের অন্তর্গত আসামে থেকে গেল। অন্যদিকে বিয়ানিবাজার থানা, বড়লেখা থানা এবং করিমগঞ্জ থানার অপর অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। এ ছাড়া আরও বারোটি থানা পাকিস্তানের অংশ হয়ে দাঁড়াল, যেগুলির ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি আসাম সরকার করেনি।’১০৪
সীমানা কমিশন ঘোষণার মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সিলেট জেলা সমস্যার আইনি সমাধান হলেও দু-টি সম্প্রদায়— হিন্দু এবং মুসলিম মানসে বিভাজন, তিক্ততা, অবিশ্বাস অনেকটাই স্থান করে নেয়। ফলে, সাম্প্রদায়িক সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। উদবিগ্ন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস ৭ আগস্ট তারিখে এ সম্পর্কে জানালেন:
…undoubtedly great panic had overtaken the people of the minority community and reports of sporadic acts of hooliganism in interior areas in different places of Sylhet were daily pouring in.
Mr. Das continued that there were apprehensions of communal troubles specially in areas which had been claimed for Assam. It was being thought necessary to make special arrangements to prevent any eventualities. ……The Minister urged the leaders of all communities to pool their weight to prevent any communal flare-up.১০৫
শেষপর্যন্ত আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল। সীমানা কমিশনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয় ১৭ আগস্ট। ১৯ আগস্ট থেকেই সিলেটবাসী ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ১৯ আগস্ট থেকে লাখাই এবং হবিগঞ্জ পুলিশ স্টেশন এলাকায় ব্যাপকভাবে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় এবং প্রতিদিনই তা নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে বলে সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়। ২২ আগস্ট সিলেট থেকে প্রেরিত সংবাদে বলা হল:
Mr. Benode Behari Chakravarty, Editor, janasakti, and member All-India Congress Committee, has sent wires to Mahatma Gandhi, the Bengal provincial Muslim League, Bengal Provincial Congress Committee and Premier of East Bengal stating that ‘serious communal troubles, arson and looting have brokenout under Lakhai and Habiganj police stations of Habigang sub-division since August 19 and are spreading daily. kindly take immediate steps.’ Mr. Birendra Nath Das, Secretary, Sylhet District Congress Committee and party have left for Habiganj.১০৬
বিনোদবিহারী চক্রবর্তীর পাঠানো তারবার্তা মহাত্মা গান্ধী পেয়েছিলেন এবং তিনি তার উত্তরও দিয়েছিলেন। সংবাদপত্র জানাল:
This evening I wish to devote to Sylhet. I have received frantic telegrams from Sylhet about the serious riots that have broken out there. The cause is not known. I am sorry I am unable to go just now, nor am I vain enough to think that my presence would immediately abate the mob fury. I know too that one should not without peremptory cause abandon his present duty, however humble it may be, in favour of one which may appear to be higher. To adopt the salvation army language we are all soldiers of God to fight the battle of right against wrong by means which are strictly non-violent and truthful. As his soldier ‘ours is not to reason why, ours is but to do or die’. Though therefore i am unable to respond to the urgent call of the sufferers of Sylhet I can appeal not in vain to the authorities in East Bengal in general and Sylhet in particular….১০৭
সিলেট দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে কাছাড় জেলা ও তার সংলগ্ন এলাকায় জনমনে প্রবল উত্তেজনা, ভীতি লক্ষ করা গেল। এই অবস্থায় আসাম গভর্নর ‘Assam Disturbed Areas ordinance 1947’ জারি করেন। ২৬ আগস্ট শিলং থেকে জারিকৃত ঘোষণায় বলা হয়:
The Governor of Assam in the exercise of the powers under clause 3 of the Assam disturbed Areas ordinance 1947 has declared the following areas to be disturbed area: 1. The whole of Cachar District 2. The areas within Patharkandi, Ratabari, Badarpur police stations and the portion of Karimganj police station included in Assam. ……Reports of widespread unrest and increasing lawlessness are reaching from habiganj sub-division, sylhet district, now part of Pakistan.১০৮
ঘটনা যে কতটা গুরুত্ববহ এবং উদবেগজনক ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় রাজনৈতিক নেতৃবর্গের যৌথ বিবৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে। সংবাদে বলা হল:
Congress, League and Communist leaders have already arrived and are touring the disturbed areas. Muslim National Guards and Mr. Mahmud Ali, General Secretary, Assam Provincial Muslim League and Mr. Birendra Nath Das, General Secretary, Sylhet District Congress Committee have issued the following joint statement.
While we regret very much the unhappy incidents in Lakhai and sadar thana areas, Habiganj sub-divisions, we vehemently condemn those who are responsible in these insane activities. We have no doubt that all right thinking Hindus and Muslims all over Sylhet and elsewhere would condemn the same with equal vehemence.১০৯
ইতিমধ্যে সিলেট গণভোটকে কেন্দ্র করে মুসলিম লিগ, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড এবং তাদের সমর্থকদের— বিশেষত মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের বেপরোয়া লাগামহীন সন্ত্রাস আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সিলেট জেলার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় বারংবার আক্রমণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাড়ি-ঘরে লুট, অগ্নিসংযোগ ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিতে পবিত্র ‘ইসলাম’ ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার ছিল প্রথমাবধি। উল্লেখিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে সিলেট গণভোটেরই অনিবার্য ফল তা বলাই বাহুল্য। দিশেহারা, বিপর্যস্ত বাঙালি হিন্দুদের অপরাধ ছিল— তারা আসাম প্রদেশেই থাকতে চেয়েছিলেন। প্রায় ৭৩ বছর আসামের বাসিন্দা, কিন্তু গণভোটের ফলাফলে রাতারাতি তারা পাকিস্তানি নাগরিকে পরিণত হলেন। কিন্তু সেখানেও ছিল নিরাপত্তার অভাব, আত্মসম্মান আর নারীর সম্ভ্রম হারানোর ভয়। অন্যদিকে আসামের সদাশয় সরকার, অসমিয়া সমাজ যে তাদের গ্রহণ করবেন না তা তো পূর্বেই নিশ্চিত করেছেন। দু-কুল হারানো লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু পরিবার আপন বাড়ি-ঘর, ভিটেমাটি ছেড়ে সব হারিয়ে সেই আসাম তথা ভারতের পথেই পা বাড়ালেন একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আর ভারত তো তখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
তথ্যনির্দেশ
১. জন্মজিৎ রায়, বাংলা-অসমিয়া ভাষাবিবাদ এবং তৎকালীন কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা আন্দোলন : ঐতিহাসিক পটভূমির সন্ধানে, উনিশে মে-র ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত (করিমগঞ্জ : ২০০২, ১ম প্রকাশ, লালনমঞ্চ প্রকাশনী), পৃ . ১৭৫
২. প্রাগুক্ত।
৩. সুবীর কর, বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস (শিলচর : ২০১২, ২য় প্রকাশ, সৃজন গ্রাফিক্স অ্যাণ্ড পাবলিশিং হাউস) পৃ. ৪
৪. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি (শিলচর : ২০১২, ২য় প্রকাশ, পুস্তিকা, প্রাসঙ্গিক প্রিন্টার এবং পাবলিকেশনস) পৃ. ৭
৫. সুজিৎ চৌধুরী, আসামের ভাষা সমস্যা : উৎস এবং পটভূমি, একষট্টির ভাষা সংগ্রাম ও সংগ্রামোত্তর পঞ্চাশ বছর : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কামালুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত (শিলচর : ২০১২, বরাক উপত্যকা মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি) পৃ: ২০-২১
৬. কামালুদ্দীন আহমদ, আসামের বাংলা ভাষা সংগ্রাম : একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা, একষট্টির ভাষা সংগ্রাম ও সংগ্রামোত্তর পঞ্চাশ বছর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কামালুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত (শিলচর : ২০১২, বরাক উপত্যকা মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি) পৃ . ২৯
৭. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি (করিমগঞ্জ : ২০০৭, যুগশক্তি প্রকাশন) পৃ . ১২
৮. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, শিলচর, ২৩ নভেম্বর ১৯৬০ [১৯৬০ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর হোজাই-এ অনুষ্ঠিত নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনে বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা সাংবাদিক মোহাম্মদ, হুরমত আলি বড়লস্কর-এর ভাষণ] এবং মহ. হুরমত আলি বড়লস্কর, কলোকোল (বিশেষ সংকলন), কানু আইচ সম্পাদিত, শিলচর, ২০০৪, পৃ. ৭০-৭৪
৯. প্রাগুক্ত
১০. প্রাগুক্ত
১১. প্রাগুক্ত
১২. প্রাগুক্ত
১৩. বিমানকুমার দে লস্কর, অসমিয়াভাষী ও আসামবাসী, যুগান্তর, কলকাতা, ৫ জুলাই ১৯৬০
১৪. সুজিৎ চৌধুরী, আসামের ভাষা সমস্যা : উৎস এবং পটভূমি, পৃ. ২১
১৫. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি, পৃ.৮
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ . ১৫
১৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫-১৬
১৮. প্রাগুক্ত
১৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭
২০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা প্রজা, রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খন্ড, ১৩৬৫ (পুনর্মুদ্রণ), পৃ. ৪১৮-৪১৯
২১. The Modern Review, vol.XLIII, January 1928, P.3, quoted from Sukumar Biswas, Communal Riots in Bangladesh & west Bengal 1947-1964, (Kolkata : 2012, Parul Prakashani), P. 3
২২. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি, পৃ . ৯
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ . ৯-১০
২৪. উনিশে মে’ র ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, (করিমগঞ্জ : ২০০২, লালনমঞ্চ প্রকাশনী) লালনমঞ্চ ভাষা সংগ্রামের নথি, পৃ. ৫৮-৫৯
২৫. কামালুদ্দীন আহমদ, আসামের বাংলা ভাষা সংগ্রাম : একটি ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা, একষট্টির ভাষা সংগ্রাম ও সংগ্রামোত্তর পঞ্চাশ বছর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পৃ. ৩২-৩৩
২৬. কামালুদ্দীন আহমদ, পৃ. ৩৩
২৭. প্রাগুক্ত
২৮. সুজিৎ চৌধুরী, আসামের ভাষা সমস্যা : উৎস এবং পটভূমি, পৃ . ২৪
২৯. বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি, পৃ. ১০
৩০. রাজদীপ চন্দ, ইতিহাসের আলোকে দেশভাগ ও সুরমা-বরাক উপত্যকা, নাইনথ কলাম, দেশভাগ-দেশত্যাগ : প্রসঙ্গ উত্তর-পূর্বভারত, সাময়িকী প্রসূন বর্মন সংকলিত ও সম্পাদিত, দ্বাদশ বর্ষ, ১০ম সংখ্যা (গুয়াহাটি : ডিসেম্বর ২০১২), পৃ.৭০। এ প্রসঙ্গে আরও দ্রষ্টব্য সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি, পৃ . ১০
৩১. কামালুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ.৩৪
৩২. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকা : শতবর্ষের রাজনীতি, পৃ . ১৪
৩৩. প্রাগুক্ত
৩৪. সুজিৎ চৌধুরী, বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি, (করিমগঞ্জ : ২০০৭, যুগশক্তি প্রকাশন) পৃ. ৩১
৩৫. Janmajit Roy, Notes on Sylhet Referendum, Politics of Subversion : The untold story of sylhet, edited by sujit K. Ghosh (Delhi : B.R. Publishing corporation Ltd), p.22
৩৬. প্রাগুক্ত
৩৭. রাজদীপ চন্দ, পৃ.৭১
৩৮. উদ্ধৃত নবনীপা ভট্টাচার্য, শ্রীহট্টের গণভোটের পরের কথা, নাইনথ কলাম, দেশভাগ-দেশত্যাগ : প্রসঙ্গ উত্তর-পূর্ব ভারত, পৃ: ৮৮-৮৯
৩৯. রাজদীপ চন্দ, পৃ . ৭২
৪০. রাজদীপ চন্দ, পৃ . ৭৩
৪১. রাজদীপ চন্দ, পৃ. ৭৫
৪২. রাজদীপ চন্দ, পৃ . ৭৫ – ৭৬
৪৩. বিনায়ক দত্ত, ‘সিলেট গণভোট : মুসলিমলিগ-জমিয়তি সংঘাত ও পাকিস্থানের জন্য শেষ যুদ্ধ,’ নাইনথ কলাম, দ্বাদশবর্ষ, ১০ম সংখ্যা, ২০১২ পৃ. ৫৮
৪৪. প্রাগুক্ত, পৃ . ৫৭
৪৫. রাজদীপ চন্দ, পৃ. ৭৩
৪৬. বিনায়ক দত্ত, পৃ. ৬৫
৪৭. বিনায়ক দত্ত, পৃ. ৫৮
৪৮. বিনায়ক দত্ত, পৃ. ৬৩
৪৯. বিনায়ক দত্ত, পৃ. ৫৮
৫০. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 1, 1947
৫১. প্রাগুক্ত
৫২. প্রাগুক্ত
৫৩. প্রাগুক্ত
৫৪. প্রাগুক্ত
৫৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 6, 1947
৫৬. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 13, 1947
৫৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 2, 1947
৫৮. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 3, 1947
৫৯. প্রাগুক্ত
৬০. প্রাগুক্ত
৬১. Amrita Bazar Patrika, July 3, 1947 এবং রাজদীপ চন্দ, পৃ .৭৬ দ্র.
৬২. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 4, 1947
৬৩. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 3, 1947
৬৪. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 4, 1947
৬৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 6, 1947
৬৬. প্রাগুক্ত
৬৭. প্রাগুক্ত
৬৮. প্রাগুক্ত
৬৯. প্রাগুক্ত
৭০. প্রাগুক্ত
৭১. প্রাগুক্ত
৭২. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 7, 1947
৭৩. প্রাগুক্ত
৭৪. প্রাগুক্ত
৭৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 8, 1947
৭৬. প্রাগুক্ত
৭৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 9, 1947
৭৮. প্রাগুক্ত
৭৯. প্রাগুক্ত
৮০. প্রাগুক্ত
৮১. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 11, 1947
৮২. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 12, 1947
৮৩. প্রাগুক্ত
৮৪. প্রাগুক্ত
৮৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 14, 1947
৮৬. প্রাগুক্ত
৮৭. Extracts from the Memorandum submitted to the states Re-organisation Commission by West Bengal Pradesh Congress Committee, (pp. 53-54), quoted from Sylhet Referendum Assam Government’s Press Note, February 16, 1955, Our Reply, March 1955, The Cachar States Re-organisation Committee, Silchar (Cachar), Published by shri Dhirendra Mohan Deb, for Cachar States Re-organisation Committee, Silchar (Cachar) pp. 1-16, পুস্তিকা
৮৮. রাজদীপ চন্দ, পৃ. ৮১
৮৯. রাজদীপ চন্দ, প্রাগুক্ত
৯০. Janmajit Roy, Notes on Sylhet Referendum, p. 25
৯১. বরাকের নতুন দিগন্ত (সাপ্তাহিক), মালতী দাস সম্পাদিত, শিলচর, নভেম্বর ৮-১৪, ২০১৩
৯২. প্রাগুক্ত, ডিসেম্বর ১৩ — ১৯, ২০১৩
৯৩. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 30, 1947
৯৪. প্রাগুক্ত
৯৫. প্রাগুক্ত
৯৬. প্রাগুক্ত
৯৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, July 31, 1947
৯৮. The Assam Tribune, Gauhati, July 20, 1947, উদ্ধৃত পুস্তিকা, Sylhet Referendum & Assam Government’s Press Note Dated-Feb 16, 1955, Our Reply, March, 1955, The Cachar States Re-organisation Committee, Silchar, Published by Dhirendra Mohan Deb, for Cachar States Re-organisation Committee, Silchar (Cachar), Reproduced from Appendix I of Purbachal Reconsidered, PP. 81-86
৯৯. The Assam Tribune, Gauhati, July 22, 1947, উদ্ধৃত প্রাগুক্ত
১০০. The Assam Tribune, Gauhati, July 23, 1947, উদ্ধৃত প্রাগুক্ত
১০১. The Assam Tribune, Gauhati, July 29, 1947, উদ্ধৃত প্রাগুক্ত
১০২. The Assam Tribune, Gauhati, July 24, 1947, প্রাগুক্ত
১০৩. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 18, 1947
১০৪. নবনীপা ভট্টাচার্য, ‘শ্রী হট্টের গণভোটের পরের কথা, পৃ ৮৯-৯০
১০৫. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 10, 1947
১০৬. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 25, 1947
১০৭. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 26, 1947
১০৮. Amrita Bazar Patrika, Calcutta, August 27, 1947
১০৯. প্রাগুক্ত