১. পবিত্র রোমান্স ও ভালোবাসা

লাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
একটি পারিবারিক প্রেসক্রিপশন

প্রথম প্রকাশ- পয়লা ডিসেম্বর বাইতুল মোকাররম ইসলামী বই মেলা- ২০১৯

উৎসর্গ

ইচ্ছে ছিল, একটুকরো চাঁদ যেদিন আমার ঘর আলোকিত করবে, ঠিক সেদিনই আমার দ্বিতীয় কাগুঁজে সন্তানের মোড়ক উন্মোচন করে তার আগমনকে স্মরণীয় করে রাখব। কিন্তু আম্মুটার আর তর সইল না। লাভ ক্যান্ডিকে টেক্কা দিয়ে সে-ই আগে চলে আসল। আমাকে বুঝিয়ে দিল, আব্বু, ভাগ্যবতীরা সর্বদা অগ্রগামীই থাকে।

তাই আম্মুটার নাম নুসাইবা রাখলাম। নুসাইবা অর্থ ভাগ্যবতী। আর এমনকরে যে বুঝিয়ে দিতে পারে, সে কি আর যেনতেন কেউ হয়? তার অভিব্যক্তিই বলে দেয়, সে অনন্য। মেধাবী। তাই নুসাইবার সাথে যুক্ত হলো নুহা। যার অর্থ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী। নুসাইবা নুহা …

আম্মুটি! তোমার আব্বু তোমার জন্য এত্তগুলো লাভ ক্যান্ডি কিনে রেখেছে। তুমি বড় হও, তোমার ক্যান্ডি ও তোমার আব্বুর ‘লাভ ক্যান্ডি’ তোমার অপেক্ষায় আছে। আর শোনো! ‘লাভ ক্যান্ডি’র জন্য রব্বে কারীম তোমার আব্বুকে যেটুকু জাযা দেবেন তার সবটা তোমার আব্বু তোমার নামে বখশে দিচ্ছে।

উৎসর্গ- আমার আম্মুটি…

গুণিজনের মন্তব্য

এক কথায় ‘লাভ ক্যান্ডি’ একটি সাধারণ বই। অসাধারণের মহামারীর এই যুগে সাধারণ হতে পারাকেই আমি স্বার্থকতা মনে করি। সাধারণ কিছু করতে পারাকেই অমূল্য মনে করি। বইটির অংশবিশেষ পড়েই রীতিমতো বিস্মিত আমি! চতুর্থ অধ্যায়টি রিভিউ করে বেশ চমৎকৃত হয়েছি। লেখক অত্যন্ত জরুরি ও সূক্ষ্ম কিছু বিষয় এতটা সাবলীল ভাবে সাহিত্যের মোড়কে পাঠককে উপহার দিয়েছেন যে, আমি অভিভূত। ক্লিনিক্যাল দিকগুলোর প্রয়োজনীয় কারেকশন ও করে দিয়েছি। এছাড়া গল্পের গতি-প্রকৃতির দিকে হাত বাড়াইনি। গল্পের প্রয়োজনে লেখকের সাবলীল বর্ণনা যে-কাউকে মুগ্ধ করে ছাড়বে।

বইটিতে সাহিত্যের এক নতুন স্বাদ পাবেন। এখানে পাঠকের প্রতি লেখক নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। অযাচিত সুড়সুড়ি আর যৌনতা ছাড়াও রোমান্স যে এতটা স্বচ্ছ হতে পারে, সাহিত্য কতটা কোমল আর পবিত্র হতে পারে তা-ও জানতে পারবেন। বৈধ রোমান্সকে প্রোমোট করে সুখময় জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা ও জরুরি সব দিকনির্দেশনা সমৃদ্ধ অনবদ্য একটি বই ‘লাভ ক্যান্ডি’।

আমি আশাবাদী, শুধু আশাবাদী না, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, লেখকের প্রথম বই ইউটার্ন যেমন ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, লাভ ক্যান্ডিও তেমন পাঠকপ্রিয়তা পাবে। একটি পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় টার্নিং পয়েন্টগুলো উঠে এসেছে এখানে। যুবক- যুবতিদের জন্যও দিকনির্দেশনামূলক অনেক কিছু উঠে এসেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, বইটি পাঠকমহলে বাজিমাত করবে। আমি তার উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।

ডা. মো. রাকিবুর রহমান।
এম.বি.বি.এস; বি.সি.এস. (স্বাস্থ্য)
এক্স মেডিকেল অফিসার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিমেডিসিন কার্যক্রম

লেখকের কথা

‘লাভ ক্যান্ডি’ আমার দ্বিতীয় সন্তান। সন্তান বলতে কাগুঁজে সন্তান। সন্তানের প্রতি জনকের মমতা, আবেগ আর ভালোবাসা কখনও পরিমাপ করা যায় না। তবে সন্তানের আচার, অবয়ব, গতিপ্রকৃতি এসবের ভিন্নতার জন্য অনুভূতির পারদেও কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। এজন্যই দেখা যায়, একেক সন্তানের জন্য একেকরকমের অনুভূতি।

যখন আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় তার কিছুদিন পরের ঘটনা।

‘আব্বু! তোমার বইটি আমি আর পড়তে পারছি না। তুমি কেমন আছ আব্বু? কোথায় আছ এখন? দুপুরে খেয়েছো আব্বু?’

সেদিন দুপুরে অফিসে মিটিং-এ থাকাবস্থায় আব্বুর ফোন আসে। প্রথমবার রিসিভ করতে পারিনি। আব্বু সাধারণত একবার রিসিভ না করলে একটু লেট করে আবার কল দেয়। কিন্তু আজ সাথে সাথেই আবার কল দেওয়াতে ইমার্জেন্সি মনে হওয়ায় একটু সাইডে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করি।

রিসিভ করতেই একশ্বাসে কথাগুলো বলে আব্বু ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিল। ভড়কে গেলাম আমি! মুহূর্তেই বুকের ভেতরটা খিঁচে উঠল। ‘আব্বু! পড়তে পারছেন না বলতে? কী হয়েছে আপনার? এই আব্বু! এভাবে কান্না কেন? কী হলো আপনার?’

‘কিছু হয়নি আব্বু। আমি তোমার বইটি আর পড়তে পারছি না। আর একটুও পড়তে পারছি না।’

ভয় আর শঙ্কায় আমার হাত-পা কাঁপছিল। আব্বুকে আমার লাইফে হাতেগোনা মাত্র কয়েকবার কান্না করতে দেখেছি।

১৯’র বইমেলায় ‘ইউটার্ন’ প্রকাশিত হওয়ার সংবাদ শুনে সেদিন প্রথম কেঁদেছিল। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানেও ওদিন কেঁদে ফেলেছিল। তবে এভাবে ফুঁপিয়ে কান্না এই প্রথম। আমার কলিজা সুদ্ধা কাঁপতে শুরু করল।

মিটিংরুম ছেড়ে সোজা অফিসের ছাঁদে চলে গেলাম। চশমা খুলে মুখটা চেপে ধরে মিনিতি করে বললাম, ‘আব্বু প্লিজ! এভাবে বলবেন না। কী হয়েছে আপনার আগে খুলে বলুন। আপনি ঠিক আছেন তো? কোথায় আছেন এখন? কী করছেন? শারীরিক কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

মৃদু স্বরে আব্বু প্রতিত্তোর করল, ‘না আব্বু, সব ঠিক আছে। আমি অফিসে, গাড়িতে বসে আছি। তোমার বইটি পড়ছিলাম। কিন্তু এখন আমি আর পড়তে পারছি না আব্বু। আমি আর একটুও পড়তে পারছি না…।’

এই বলে এবার গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে দিল। আমার ভেতরটা যেন তখন ফেটে যেতে চাচ্ছিল। জন্মদাতা পিতার এমন কান্না কোনো সন্তানের কানে গেলে যেন কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। বোঝাতে পারব না আমি

‘আব্বু, একটু স্থির হোন প্লিজ! এভাবে বলবেন না। একটু শান্ত হোন আব্বু। একটু।’ ‘আমি ঠিক আছি। তুমি নিজের প্রতি খেয়াল রেখ। ঠিকমত খেয়ে নিও। সাবধানে থেক। আমি ঠিক আছি আব্বু। আমি ঠিক আছি।’ এই বলে আবার কান্না…

টুপ করে এবার ফোনটা কেটে দিলেন।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পর কলব্যাক করলাম। আব্বুর আসলেই কিছু হলো কি না…

ফোন রিসিভ করে আমার ভয়েস শোনা মাত্রই আবার বলতে শুরু করল, ‘আব্বু! তুমি এ-কী লিখেছো! আমি সত্যিই আর পড়তে পারছি না। আমাকে মাফ করে দিও আব্বু…। ‘

আব্বুর কান্নার আওয়াজে আমি ইমব্যালেন্সড হয়ে পড়ছিলাম।

‘আব্বু প্লিজ! একটু খুলে বলুন, কী হয়েছে? আর এভাবেই-বা বলছেন কেন?’ আব্বু আবারও বললেন, ‘আমি তোমার বইটি আর পড়তে পারছি না আব্বু! ও আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিও! আব্বু! তুমি টেনশন কোরো না। আছরের আযান হয়ে গেছে। মসজিদেও যাও। আমিও যাচ্ছি। রাখো আব্বু, ফোন রাখো। আমি ঠিক আছি। একদম ঠিক আছি।’ এবারও এই বলে ফোন রেখে দিলেন।

আব্বুর ডুকরে কাঁদার আওয়াজ সেদিন আমাকে আহত করে দিয়েছিল। এখনও মনে পড়লে পুরো শরীর মুষড়ে উঠে। কলিজাটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। বুকের ভেতরটায় তোলপাড় হতে থাকে।

জানি না, এবার ‘লাভ ক্যান্ডি’ পড়ার পর আব্বুর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। সেটা না হয় পরবর্তীতে কখনও জানাতে পারব।

আচ্ছা আপনারা ‘লাভ হসপিটাল’ নাম শুনেছেন কেউ? না কোন ফান নয়। গত ২২শে ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে দৈনিক নয়াদিগন্তে এব্যাপারে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

সেখানে লিখেছে, চীনে প্রায় ১৭ বছর আগে থেকেই ‘লাভ হসপিটাল’ নামে অসংখ্য হসপিটাল তৈরি হয়ে আসছে এবং এযাবৎ প্রায় ১০ লক্ষ পেসেন্টকে ট্রিটমেন্টও দিয়েছে তারা। এই পরিসংখ্যান ১৭ সালের। বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বেশি। এসব হসপিটালের ফলাফল নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই। আমি ভাবছি তাদের পেসেন্টদেরকে নিয়ে

সচরাচর শারিরীক ও মানসিক চিকিৎসার জন্য হসপিটাল তৈরি হয়ে থাকে। তবে এই ‘লাভ হসপিটাল’ তৈরি হয়েছে নিজের জীবনসঙ্গীর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন সহ ইত্যকার নানান সমস্যা সমাধান করার জন্য। এখানে পেসেন্টকে তারা বিভিন্ন সাজেশন ও কৌশল শিখিয়ে দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে থাকে।

অনেকেই নিজের জীবনসঙ্গীর প্রতি তুষ্ট না থেকে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি সাজানো সংসারকে বাতাসে উড়িয়ে নিজেও আকাশে উড়ার অলীক স্বপ্নে মজে পাগলামো শুরু করে দেয়।

অনেকসময় ভালোবাসার মানুষটি কারণে-অকারণে ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে, সামান্যকিছুতেই বিরক্তি প্রকাশ করে, রাতে নিয়মিত দেরি করে ফিরে, আগের মত সেই রোমান্স শত চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না, সামান্য অযুহাতে বিভিন্ন হুমকি, বকা, গায়ে হাত তোলা সহ তুলকালাম বাধিয়ে ফেলা, শশুরবাড়ির কাউকে সহ্য করতে না পারা, কিছু হলেই চলে যেতে বলা, তালাক দিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

অধিকাংশ স্ত্রীই এর আসল কারণ বের করতে অপরাগ। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে অথবা নিজের ভাগ্যের দোষ বলে তিলেতিলে মরতে থাকে। আপনার জানা উচিৎ যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণটির জন্যই অর্থাৎ অন্যের প্রতি আশক্ত হয়েই আপনার স্বামী এমন আকস্মিক পালটে যায়। তবে বলে রাখি, সবার ক্ষেত্রে কিন্তু একই কারণ না-ও হতে পারে, অনেকের স্বভাবগত কারণ এটা কিংবা ভিন্ন কারণও থাকতে পারে। তাই অহেতুক সন্দেহ করে আবার তালগোল পাকিয়ে না ফেলি যেন, সাবধান।

আসলে নিজের জীবনসঙ্গীকে নিজে ধরে রাখতে না পারলে ‘লাভ হসপিটাল’ দিয়ে ঠিক কতটুকুন কাজ হবে জানি না। তবে এক্ষেত্রে দু’টি বিষয় আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।

এক, বিভিন্ন কারণে ধীরেধীরে যখন ভালোবাসায় চির ধরে এবং এভাবে চলতে চলতে সেই চির থেকে বিশাল আকারের ফাটল ধরে ঠিক সেখান থেকেই একসময় সে বিকল্প কিছু ভাবতে থাকে।

এখানে সমাধান আপনার কাছেই আছে। নিজেকে সংশোধন করে নিন, দেখবেন তিনিও আপনাকে আগের মতই ভালোবাসবে। আর না হোক অন্তত আপনার বিকল্প কিছু চিন্তা করবে না। মনে রাখবেন, কেবল টাকা কিংবা সৌন্দর্য দিয়ে আজীবন কাউকে ধরে রাখা যায় না। এজন্য নিজের অভ্যন্তরীণ দিকটাকেও সৌন্দর্যমণ্ডিত করা জরুরি।

দুই, চারিত্রিক ত্রুটি ও ব্যক্তিত্বহীনতা। এইদিকটাতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে আপনি অন্যসব ব্যাপারে যতই ভালো থাকুন না কেন, সমাধান বড়ই অপ্রতুল।

এর সমাধান হলো, বিয়ের পূর্বেই এই বিষয়ে অবগত হয়ে নেয়া। ছেলের টাকা, বড় চাকরী আর অমাইক স্মার্টনেস, বিভিন্ন টাইটেল আর ড্রেসআপ দেখে কাত হয়ে পড়লে কিংবা মেয়ের সাদা চামড়ার চমক দেখে মাতাল হয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

বিয়ের পূর্বে চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের দিকটি খুব কম পরিবারই যাচাই করে। ফলে এর খেসারত দিতে পরবর্তীতে রাজপ্রাসাদে থেকেও অগ্নিকুণ্ডের উত্তাপ আস্বাদন করে। এখানে হয়তো ধৈর্য নয়তো নিকৃষ্টতম জায়েজ ‘তালাক’ এই দু’টির যেকোনো একটি বেছে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না।

মনে রাখবেন, বিয়ে কেবলমাত্র কোনো সামাজিক উৎসবের নাম নয়। বিয়ে দু’টি মনের স্বপ্নিল অনুভূতি আর সোনালি স্বপ্নের বাস্তবায়ন, একটি রঙিন অধ্যায়, বৈচিত্র্যময় এক পরীক্ষা এবং আখেরাতের পাথেয় অর্জনের মোক্ষম উপকরণের নাম।

কত আশা থাকে। স্বপ্ন থাকে। না বলা কত ইচ্ছে থাকে। কিন্তু অনেকেরই বিয়ের পর কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যায়। যা ভেবেছিল, সবকিছু তার উলটোদিকে ছুটে যায়। অবশেষে রুদ্ধশ্বাস এক জীবন সে দেখতে পায়। এসকল মানুষগুলোর জন্য আমাদের তো আর সেই লাভ হসপিটাল নেই, তাই সাধ্যের মধ্যে তাদের জন্য এই লাভ ক্যান্ডির আয়োজন।

১৭ সালের সেদিনের সেই প্রতিবেদনটি পড়ার পরই মূলত এই বিষয়ে কিছু করার ব্যাপারে চিন্তা শুরু করি। যার চুড়ান্ত রূপ আজকের ‘লাভ ক্যান্ডি’। যেটা প্রতিটি বিবাহিত দম্পতির জন্য প্রেসক্রিপশন আর অবিবাহিত যুবক-যুবতিদের জন্য অমূল্য সাজেশন।

কাজটি শেষ করা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। গত বইমেলার পর থেকেই পাঠকমহল থেকে প্রতিনিয়ত বেশ তাড়া আসছিল। সেইসাথে ছিল আকাশ সম প্রত্যাশা। জানি না আমার সেই পাগল পাঠকগুলোর চাহিদার ঠিক কতটুকু পূরণ করতে পারব, কিন্তু আমি আশাবাদী। সেইসাথে তাদের এই অসামান্য ভালোবাসার প্রতি ঋণীও বটে। প্রিয় পাঠক! এক আকাশ ভালোবাসা আপনাদের প্রতি…

মনে একটিই আশা, জগতের প্রতিটি নারী দাম্পত্য জীবনে সুখি হোক, প্রতিটি পুরুষ সেই সুখের রুপকার হোক আর প্রতিটি অবিবাহিত যুবক-যুবতী নিজেদের আগামীর জন্য যথাযথভাবে তৈরি হোক।

সবশেষে একটি কথা, এটা যেহুতু যা-লিকাল কিতাব নয়, তাই লা রই-বা ফি-হি বলার মতো দুঃসাহসও আমার নেই। ভালো সবটুকু আমার রবের পক্ষ থেকে, আর মন্দটুকু আমার অযোগ্যতার কারণে আমার পক্ষ থেকে। রব্বে কারীম আমাকে মাফ করুন। ‘লাভ ক্যান্ডি’ গ্রন্থটিকে কবুল করুন।

প্রিয় পাঠকের কাছে আর্জি- যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নির্ভুল রাখার, তবুও মুদ্রণ, বানান বা অন্য যেকোনোপ্রকার ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং অবগত করবেন, কৃতজ্ঞ থাকব।

আপনাদের সার্বিক পরামর্শ ও দু’আ প্রার্থী।

জাফর বিপি
লেখক, সম্পাদক ও উদ্যোক্তা

ভূমিকা

‘ভালোবাসা’ এই শব্দটিকে আমার কাছে বুলেটের মতো মনে হয়৷ নির্ভেজাল ফায়ার করতে পারলে শত্রুও বশে আসতে বাধ্য। কারণ সুপাত্রে নির্মল ভালোবাসা বিনিয়োগকারী কখনও ঠকে না।

বিনিয়োগকৃত একচিমটি ভালোবাসা প্রক্রিয়াজাত হয়ে এক সাগর ভালোবাসা হয়ে ফিরে আসে। আবার বিনিয়োগ হলে সাত সাগর হয়ে ফিরে আসে। এভাবে পুনঃপৌনিক চলতেই থাকে…

শর্ত কিন্তু দু’টি!

সুপাত্র!

নির্মল ভালোবাসা!

একবার এক লোককে তার স্ত্রী সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা তুমি কাকে বেশি ভালবাসো? তোমার মাকে? না আমাকে? অর্থাৎ কার মূল্য তোমার কাছে বেশি?’

লোকটি ক্ষনিকটা ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা তোমার জন্য কোনটা বেশি প্রয়োজন? তোমার হার্ট? না কলিজা? অর্থাৎ কোনটার মূল্য তোমার কাছে বেশি?

তার স্ত্রী থমকে গেলেন। প্রতিত্তোরে কিছু বলতে না পেরে সেটা এড়িয়ে গিয়ে পুনরায় বললেন, ‘আচ্ছা, মনেকর একটা ঝড় উঠল, আর আমরা তিনজন মাঝ নদীতে একটি নৌকায় আছি। এখন তোমার মা এবং আমি পানিতে পড়ে গেলাম, এই মূহুর্তে তুমি কার হাত ধরে নৌকায় তুলবে? আর হ্যাঁ, নৌকায় ২ জনের বেশি উঠলে কিন্তু সেটাও ডুবে যাবে।

লোকটি বেশ বিপদে পড়লেন এবার। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে স্ত্রীর হাতদু’টি বুকে টেনে, চোখে নোনা অস্রু এনে বললেন, ‘তোমাদের দু’জনকে নৌকায় তুলে, ভালোবাসি, এই কথাটি শেষবার বলে, একলা আমি, হারিয়ে যাব অথৈ জলের অতল তলে…।’

প্রিয় পাঠক! ভালোবাসা এমনই। কাকে রেখে কাকে ছাড়বেন? কার চেয়ে কে আপন? ভালোবাসার ক্ষেত্রে এসব হিসেব কষা নিতান্তই অমূলক। যারযার স্থানে তার মূল্য অপরিসীম। এখানে একজনের পরিবর্তে অন্যজনকে চিন্তা করাটাও নিছক ছেলেমানুষী। আর তাই, এমনসব প্রশ্ন করা বড়ই অমানবিক।

ভালোবাসার দাবি হলো- নিজের অস্তিত্বের বিনিময়ে হলেও মানুষটি সুখে থাকে, ভালো থাকে, পৃথিবীর নির্মল বাতাসে যুগযুগ ধরে বেঁচে থাকে, আর পরকালেও জান্নাতের বাগিচায় প্রশান্ত চিত্তে ঘুরে-ফিরে, এটাই হয় একমাত্র চাওয়া। এখানে কোনো স্বার্থ নেই। যেখানে স্বার্থ আছে সেখানে আর যা-ই থাকুক, ভালোবাসা নেই। এই দুইয়ের সম্পর্ক পরস্পর আলো-আঁধারের মতো। একসাথে উভয়ের উপস্থিতি কোনোভাবেই সম্ভব না।

সুখি হতে আসলে খুব বেশিকিছু লাগে না। আবার কোটি টাকা পেয়েও কেউ কেউ সুখি হতে পারে না। এটা রবের দান। তার কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়। অথচ মানুষ এই আসল কাজটিই বেমালুম ভুলে যায়। আবার রবের কাছে চাওয়ার পাশাপাশি নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়।

আমাদের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, আমরা চাই, পৃথিবীর সকল মানুষ তার নিজ দায়িত্বটুকু পালন করুক। তাদের প্রতি আমার যা হক আছে তা যথাযথভাবে আদায় করুক। কিন্তু আমি এসবের মধ্যে নেই। আমি হলাম তাবৎ আইনের ঊর্ধ্বে।

রব্বে কারীমের সৃষ্টির একটা সাধারণ নিজাম হলো, তিনি প্রাণীকুলকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকটিকে নারী-পুরুষ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তাদের বাহ্যিক অবয়ব, স্বভাব, চিন্তাচেতনা ও দায়িত্বগুলোও স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন। যে যার স্থান থেকে নিজের কাজটুকু করে গেলেই কিন্তু মামলা চুকে যায়। উভয়ে মিলে সুখের সাগরে অবিরত সাঁতার কাটা যায়।

ব্যবসায়ীরা লাভের আশায় অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে। চাকুরিজীবী বেতনের আশায় নিজেকেই হস্তান্তর করে। তাহলে জগতের সবচেয়ে আরাধ্য জিনিস- সুখপাখিটা কোনোকিছুর বিনিময় ছাড়া কী করে আসতে পারে?

ছাড় দিন। বাদ দিন। চুপ থাকুন। মেনে নিন। মানিয়ে নিন। চালিয়ে নিন। বলতে দিন। করতে দিন। ব্যাস, সুখ আসতে লাগবে না আর বেশিদিন।

জাস্ট ওয়েট & সি…

প্রথম অধ্যায় (পবিত্র রোমান্স ও ভালোবাসা)

রচনাসমগ্র

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সূর্যের লালিমা আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। শহর যেন খোলস বদলাচ্ছে। ব্যস্ত নগরীর যন্ত্রমানবেরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। গাড়িগুলো যেন পাল্লা দিয়ে ছুঁয়ে। পাখিরাও সব নীড়ে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার… ফাজিলটাকে কতবার ফোন করলাম! নিজে তো একটি বার করলই না, আমারটাও রিসিভ করল না। আজ আসুক…

দাঁত কিড়মিড়িয়ে বেলকনির গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে স্নেহা। বেশ রেগেছে আজ। আদিব আসলেই যেন ওকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। অনেকটা এই টাইপের। মাঝে মাঝে গ্রিল ছেড়ে দিয়ে আলতো পায়ে সামন্য পায়চারি করছে। একটু পর আবার গ্রিলে হাত রেখে বাইরের কোলাহলে দৃষ্টি ফিরাচ্ছে।

এরইমধ্যে হঠাৎ একটু দমকা হাওয়া এসে স্নেহার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। মুখটাকে ঢেকে দিল। স্নেহা মাথাটি মৃদু দুলিয়ে হাতের আলতো ছোঁয়ায় চুলগুলো কানের পিঠে গুজতে গিয়েই কেমন যেন সুড়সুড়ি পেল। হাত দিয়ে চুলগুলো ঘাড়ের সাথে চেপে ধরে একটু আড়চোখে পেছনে তাকাতেই যেন পিলে চমকে গেল!

-এ কী! আদিব তুমি!

আদিব কিছু বলল না। হাত নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। স্নেহা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘এভাবে চুপচাপ আসলে যে! ভয় পাই না বুঝি?’

‘কী করব! দরজা খুলে রেখে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকলে একটু তো ভয় দেখানোই উচিত।’

‘কী! দরজা খোলা ছিল?’

‘নাহ।’

‘তাহলে তুমি আসলে কী করে?

‘কোথায় আসলাম? এটা আমি না তো। ভুত!’

এই বলে চোখ বড় করে স্নেহার চোখের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিতে থাকল আদিব। স্নেহা এক-পা দু-পা করে পিছাচ্ছে। অমনি আদিব খপ করে স্নেহার বাজুতে ধরে ফেলল। আ…উ! করে মৃদু চিৎকার করে উঠল স্নেহা। আদিব বলল, ‘কী! এত আনমনা কেন হুম? কাছাকাছি চলে এসেছিলাম তাই ফোনটা রিসিভ করিনি।’

‘এই তুমি কে সত্যি করে বলো! সত্যি সত্যি ভু ভু ভুত-টুত না তো?’

বেচারি ভয় পেয়েছে কিছুটা। আদিব ওর কানে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘কী মনে হয় শুনি?’

‘ছেলে মানুষ দিয়ে বিশ্বাস নেই। হতেও তো পার।’ অস্ফুটে বলল স্নেহা।’চিমটি খেয়েও বিশ্বাস হচ্ছে না? আরও কিছু করতে হবে?’

‘অ্যাই! আরও কিছু মানে? আজ আমি অনেক রেগে আছি। একদম মিল দিতে আসবা না। যাও, তোমার কাজে যাও। আসতে বলেছে কে?’

‘বা রে! আমার আসার জন্য দরজাটা পর্যন্ত খুলে রেখেছ, আর বলছো আসতে বলেছে কে?’

‘দেখো! একদম ভাব জমাতে চেষ্টা করবা না বলে দিচ্ছি। আজ অনেক কষ্ট করে রাগ জমিয়েছি। সারারাত একটু একটু করে ঝাড়ব তোমাকে।’ এই বলে চোখ ফিরিয়ে নিল স্নেহা। মুখের খুন করা হাসিটুকু আড়াল করতেই কি না!

মেয়েটি ভারি অভিমানী। কিন্তু সেটা একদমই ধরে রাখতে পারে না। কারণে- অকারণে নিজেই রাগ হবে, আবার নিজেই ফিক করে হেসে দেবে। আবার সেটা যেন আমি না দেখি, সেজন্য মুখটি আড়ালে লুকাবে। আমি চাতক পাখির মতো এই হাসিটুকু দেখার অপেক্ষায় থাকি। অন্য সময়ের হাসির চেয়ে এই হাসিটি অত্যধিক রোমাঞ্চকর। এক ঝলকেই যেন ভেতরটা খুন করে ফেলে। অসার হয়ে যাই আমি। ইশ, পাগলীটা বরাবরের মতো এবারও মুখ লুকিয়ে নিল। মনটা যা চাচ্ছে না…

এই ভাবতে ভাবতেই ফিরে তাকাল স্নেহা। খোলা চুলের কিছুটা অংশ চেহারার একপাশ ঢেকে রেখেছে। একচোখেই ভ্রু নাচিয়ে বজ্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘কীহ! বলেছি না কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র চলবে না! এমনকিছু করলে আজ আর রক্ষ্যে নেই এই বলে দিলাম।’

স্নেহার রোমান্টিক ধমক খেয়ে মৃদু ভয় আর এক চিমটি দুষ্টবুদ্ধি মাথায় চেপে বসল। আদিব চুপচাপ বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কোলের ওপর কুশন রেখে একটি প্যাড ও কলম নিয়ে কিছু একটা লিখতে শুরু করল।

প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর …

ফাজিলটা সত্যি সত্যি ভয় পেল নাকি! নাহ, এটাকে আজ আস্ত ভর্তা বানাব। এই ভেবে হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখে আদিব লিখছে তো লিখছেই।

কাছে এসে প্যাডটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। অনেকটা চিলের ছোঁ মারার মতোন। আদিব ভড়কে গেল! যদিও ওর লেখা শেষ। তবুও ফর্মালিটির খাতিরে বলল, ‘আরে আরে এ কী! আর একটুখানি বাকি দাঁড়াও!’

উঁহু… কে শোনে কার কথা। প্যাডের লেখা পেইজটি একটানে ছিঁড়ে ফেলল। আদিবের ড্যাবডেবে চাহুনি দেখে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে একটা ভেংচি কেটে ছেঁড়া পেইজটি পড়তে শুরু করল স্নেহা। শুরুতেই বড় করে শিরোনাম লেখা- ‘বউ’!

শিরোনাম দেখেই মুখ তুলে কেন যেন আদিবকে একপলক দেখে নিল। এরপর এক আকাশ রাগ নিয়ে পড়তে শুরু করল।

শুরুতেই আছে ভূমিকা। সেখানে ছিল…

ভূমিকা: বউ একটি দুষ্টু মিষ্টি পাগলির নাম। পাগলের মতো এদের জটলা চুল না থাকলেও পাগল করে দেওয়ার মতো সুরভিত রেশমি চুল ঠিকই থাকে।

এটুকু পড়েই এত রাগের মাঝেও কেন যেন পেট নেচে উঠল স্নেহার। সাথে ঠোঁটও। আরেকবার দেখে নিল ফাজিলটাকে। এরপর আবার পড়তে শুরু করল…

উপকারিতা: এদের দ্বারা সাধারণত উপকার ছাড়া অপকার হয় না। কেননা এদের বক্র চাহুনিতেও হৃদয় প্রশান্ত হয়। যেটা হার্টের জন্য অনেক উপকারী।

এটুকু পড়ে চোখ বাঁকা করে তাকাল আদিবের দিকে। আদিব চোখ নামিয়ে নিল। এই সুযোগে স্নেহা একটু নিঃশ্বব্দে হেসে নিল। আদিবের ভাষায় যেটা- খুন করা হাসি। ব্যাটা মিস করল হাসিটা। এরপর আবার পড়তে লাগল।

ক্রেডিট: এদের মাঝে মোহনীয় কথা বলার যাদুকরি শক্তি বিদ্যমান। দিনশেষে ক্লান্ত বদনে ঘরে ফিরলে এদের দুষ্টু হাসি ও মিষ্টি কথার মোহে পড়ে মুহূর্তেই মনের গভীরে ভালোবাসার প্রাণোচ্ছল ঢেউ খেলে যায়।

স্নেহা এবার একটু লজ্জা পেল কি না! কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার পড়ে যাচ্ছে…

শখ: এদের কাছে চটপটি-ফুচকা, আইস্ক্রিম-আমসত্তা আর চকলেট সোনার চেয়ে দামি হলেও দিনশেষে প্রাণপ্রিয় স্বামীর একটু সান্নিধ্য হলো হীরার চেয়েও দামি।

এটুকু পড়ে কেন যেন একটু আনমনা হয়ে পড়ল স্নেহা। ক্ষানিক পর আবার পড়তে শুরু করল।

চাহিদা: প্রতিদিন না হোক, অন্তত প্রতি শুক্রবার রাতে বাসায় ফেরার সময় একটি অর্ধফুটন্ত গোলাপ এনে খোঁপায় গুঁজে দিতে হবে। আর মাঝে মাঝেই চাঁদনি রাতে পরষ্পর হেলান দিয়ে তারা গুনতে হবে।

এটুকু পড়তেই স্নেহার ঠোঁটে আবারও সেই খুন করে দেওয়া হাসি…। আদিবের প্রতি এখন কোনো খেয়াল নেই স্নেহার। সে এখন পড়ছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। এরপর…

কার্যকারিতা: সারাদিন প্রাণপ্রিয় স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় মনটা আঁকুপাঁকু করতে থাকবে আর ঠিকসময়ে ঘরে ফিরে এলেও অভিমানী কণ্ঠে ‘আজ এত দেরি করেছেন কেন?’ এই বলে একা একাই কিছুক্ষণ ঝগড়া করে গাল-নাক ফুলিয়ে কান্না জুড়ে দেবে।

এবার হাসির সাথে ফিক করে একটু শব্দ বেরিয়ে এলো। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে পরেরটুকু পড়তে লাগল…

অধিকার: স্বামী সত্যি সত্যিই একটু দেরি করে ফিরলে সেদিন রাত্রিকালীন রোজা ফরজ করে ছাড়বে। নাকের পানি ও কাজল ধোয়া চোখের পানির স্রোতে এলিয়েন সাজবে। আর এসময় যদি কোনক্রমে মোবাইল হাতে দেখে তাহলে বেচারা স্বামী যখন ওয়াশরুমে ঢুকবে তখন ফিরে এসে মোবাইলের সিম আবিষ্কার করবে ফ্রিজে রাখা তাজা ‘শিম’ এর এর মধ্যে। ব্যাটারি আবিষ্কার করবে বারান্দায় ইঁদুর মারার কলের মধ্যে। আর অবশিষ্ট কংকাল আবিষ্কার করবে বালিশের কাভারের মধ্যে। তবে এই আবিষ্কারটা হবে দুর্ঘটনার মিনিমান সপ্তাহ খানেক পর।

স্নেহা এবার মাথা তুলে আদিবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল! নাহ! মোবাইল– টোবাইল হাতে নেই। বেঁচে গেছে এবারের মতো। নেক্সট…

স্বভাব: প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় কপালে ভালোবাসার মিষ্টি ছোঁয়া এঁটে দিয়ে বলবে, মহিলা কলিগদের সাথে কথা বলবেন না। জরুরি প্রয়োজন হলে কাগজে লিখে দিবেন। তবুও কথা বলবেন না। আর তাকানোর তো প্রশ্নই আসে না।

এটুকু পড়ে মুচকি হাসির সাথে মাথা দুলিয়ে পাগলটাকে কী বলে যে একটা বকা দেবে ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না। ফাজিলটা এত্ত ভালো কেন হুম! এত্ত ভালো কেন! এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সর্বশেষ প্যারায় চোখ বুলাল…

উপসংহার: মূলত এরা বড্ড চুঁচি প্রকৃতির হয়। হ্যাঁ, একটু দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার ছুঁচি।

এটুকু পড়েই ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল স্নেহা। অজান্তেই কাগজটি বুকে চেপে ধরল। কাজল ধোয়া কয়েকটি উষ্ণ ফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়ল। গালে কিছু একটার শীতল ছোঁয়া পেয়ে স্নেহা চমকে উঠল! চোখ মেলে দেখে আদিবের হাত ওর গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। গড়িয়ে পড়া ফোঁটা আলতো ছোঁয়ায় মুছে দিচ্ছে।

আদিব অস্ফুটে বলল, ‘এই পাগলী! কান্না কেন হুম? পিট্টি দেব কিন্তু। একদম কান্না না। একদম না।’

স্নেহা আদিবের চোখের দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘এভাবে লিখতে হয় বুঝি?’

‘তো কীভাবে লিখতে হয় শুনি?’

‘দাঁড়াও। দেখাচ্ছি কীভাবে লিখতে হয়। বসো ওখানে।’ স্নেহা এই বলে আদিবের লিখিত কাগজটির অপর পিঠেই লিখতে শুরু করল। আদিব চুপচাপ বসে রইল।

প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর …

‘এই নাও। মনে মনে পড়বে। যাও, ওদিক গিয়ে পড়। আর আমাদের সোনামণিই বাদ পড়বে কেন? যাও যাও, ওদিক যাও।’

‘সোনামণি বাদ পড়বে কেন বলতে?’

‘ও তুমি বুঝবে না। যাও তো এখন ঐদিকে যাও, ঐ যে ঐদিকে!’

আঙুল উঁচিয়ে বেলকনির দিকে ইশারা করে প্যাডের নতুন একটি পাতায় আবার লিখতে শুরু করল স্নেহা।

কী করা! আদিব একটু পাশে গিয়ে স্নেহার লেখাটি পড়তে শুরু করল। শুরুতেই বড় করে একটি শিরোনাম ছিল- ‘জামাই’।

আদিব মুচকি হেসে দিয়ে মাথা দুলিয়ে অস্ফুটে বলল, পাগলী একটা…

যা হোক, এবার একটানা পুরোটা পড়ে ফেলল আদিব। পড়া শেষে আদিবের চেহারা ক্ষানিকটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। কিন্তু কেন বলুন তো? চলুন দেখে নিই। আদিবের ‘বউ’ রচনার অপর পিঠে স্নেহা লিখেছে ‘জামাই’ রচনা। ইয়া বড় এক শিরোনামের পর যা ছিল …

ভূমিকা: জামাই একটি টক-ঝাল-মিষ্টি পাগলের নাম। পাগলের মতো এদের অদ্ভুতুড়ে স্বভাব না থাকলেও টক-ঝাল-মিষ্টির অমায়িক মিশেলে নারীর স্বপ্নিল স্বপ্ন পুরুষ হয়ে অভিভূত করে দেওয়ার মতো একটি মন ঠিকই আছে।

উপকারিতা: এরা নারীর উপকারের প্রধান উৎস। এদের আলতো ছোঁয়ায় নারীর শ্বাসপ্রশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহের মাত্রাও বেড়ে যায়। যেটা দেহাভ্যন্তরীণ কোষকলার জন্য বেশ প্রয়োজনীয়।

ক্রেডিট: এদের মাঝে অভিমান ভাঙ্গানোর বাজিকরন শক্তি বিদ্যমান। ঢং দেখিয়ে হোক বা রাগ দেখিয়ে হোক কোনরকম একটু অভিমানী ভাব ধরলেই শুরু হয় একেক সময় একেক কাণ্ডকারখানা। কখনও পকেট থেকে লাভ ক্যান্ডি বের করে অনুগত বেবির মতো নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা। তখন কি আর আম্মম্মম্ম… করে চকলেটে কামড় না দিয়ে পারা যায়? তাছাড়া যখন কলমের ম্যাজিক দেখিয়ে এমনকিছু লিখে দেয়, যা পড়ে হাসি-কান্না-অভিমান-আবেগ ও ভালোবাসার সাথে এক চিমটি রাগ মেশানো ঝালমুড়ি টাইপ অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তখন আর যাই হোক, অন্য কাউকে আর সেটার ভাগ দিতে ইচ্ছে হয় না। একাই গাপুসগুপুস…

শখ: এদের কাছে পালচার আর আইফোন হট ফেভারিট হলেও অভিমানী পাগলির বাকা ঠোঁটের খুন করে দেওয়া মিষ্টি হাসি আর কাজল কালো চোখের দুষ্টু চাহুনি গোটা পৃথিবীর চেয়েও দামি।

চাহিদা: অন্তত প্রতি শুক্রবার রাতে বাসায় আসার পর যতক্ষণ মনে চায় ততক্ষণ কোলে মাথা রেখে আচ্ছামত গাল টেনে দিতে হবে। আর গুণগুণ রবে কখনও তিলাওয়াত কিংবা কখনও সুললিত সুরে কিছু একটা গেয়ে শুনাতে হবে।

কার্যকারিতা: সারাদিন পাগলিটির কথা ভাবতে ভাবতে কাজের ফাঁকেও পকেট থেকে ফোনটা বের করে আদিযুগে পাঠানো মেসেজটি বিড়বিড় করে আওড়াবে আর একা একাই পাগলের মতো হাসবে। এরপর বাসায় এসে, ‘তোমাকে একটুও ভালোবাসি না, শুধু আমার কাজকেই ভালোবাসি। এজন্য দেখো না সারাক্ষণ কাজের মধ্যেই থাকি?’ এই কথা বলে শুধু শুধুই প্রেশারটা হাই করে দেবে।

অধিকার: মাঝে মাঝেই সবজান্তা ভাব ধরে আসবে সাজিয়ে দিতে। লিপিষ্টিক দিতে গিয়ে লিপিষ্টিককে নাকিষ্টিক বানিয়ে ফেলবে। মানে সমানতালে নাকেও এঁটে দেবে। আর চোখে কাজল দিতে গিয়ে একেবারে এলিয়েন বানিয়ে ছেড়ে দেবে। আর যদি একটু শিখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলেই থ্রেট দেবে যে, আমার বউকে আমি সাজাব, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই সাজাব, তোমার কী? কী আর করা! মগের মুল্লুকের আদিবাসী বলে কথা…

স্বভাব: রাতে কখনও ঘুম ভেঙে গেলে ডাক না দিয়ে ঘুমন্ত চেহারার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। হঠাৎ ধরা খেয়ে গেলে বলবে, ‘কী! ঘুম আসছে না? দেখি ঘুম পাড়িয়ে দিই…।’ এই বলে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো আলতো করে টানতে থাকবে, এরপর পরম সুখে আবার ঘুমিয়ে পড়লে এরপর সেই ঘুমে টুটুবে চেহারটা পুনরায় শুধু দেখতেই থাকবে আর দেখতেই থাকবে।

উপসংহার: এরা মূলত রাক্ষুসে প্রকৃতির হয়। এদেরকে ভালোবাসা যতোই দেওয়া হোক তাতে মন আর ভরে না। যতই দেওয়া হয় ততোই চায়। আরও চায়, আরও চায়, আরও চায়, অনেক চায়, এত্তগুলা চায়, পাগল কোথাকার।

পড়া শেষ হলে আদিব বেচারা কী করবে ঠিক দিশা পাচ্ছে না। সাত-পাঁচ ভেবে কিছু না পেয়ে ফ্লোরে কপাল ঠেকিয়ে টুপ করে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিল! এরপর গ্রিল ধরে খিকখিক করে সত্যিকার পাগলের মতোই একটা তাল ছাড়া হাসি দিল।

ওর আজগুবি হাসির শব্দ শুনে ওদিকে স্নেহাও হিহি করে হেসে উঠে অস্ফুটে বলল, ‘এই তো আধপাগলের হাসি! পুরো পাগল হওয়ার ব্যবস্থা করছি আর একটু অপেক্ষা কর।’

আদিব কিছু বলল না। সে এখন একটি পরীকে নিয়ে চাঁদে ভ্রমণ করছে। গ্রিলের ফাঁক গলিয়ে আসা জ্যোৎস্নার পিঠে চড়ে সোজা চাঁদের কোলে… আদিব! আর একটা পরী! খুন করে দেওয়া হাসি আর কাজল চোখের অধিকারী সেই পরী! ‘বউ’ রচনার প্রত্যুত্তরে ‘জামাই’ রচনা লিখে দেওয়া সেই পরী…

কাঁধে কিছু একটার ছোঁয়া পেয়ে আঁতকে উঠল আদিব- ‘কে রে!’

‘আমি পেত্নী!’

‘আর আমি কবিরাজ! হে হে… তিড়িংবিড়িং করলে বোতলে নয়, সোজা খাঁচায় ভরব, একদম বুকের খাঁচায়! মু হু হা হা হা…!’

স্নেহা আদিবের বুকে টুপ করে কিল মেরে বসল। আদিব হাতটা বুকে চেপে ধরতেই দেখে হাতে আরও একটি কাগজ! ‘এই রে! আবার এটা কী!’ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল আদিব।

‘বলতে মানা। কিন্তু পড়তে নেই মানা।’ মৃদু মাথা নাড়িয়ে বলল স্নেহা।

আদিব ভাঁজ খুলে সেটা পড়তে লাগল। শুরুতেই দেখে বড় করে শিরোনাম লেখা- ‘বাবু’!

দেখামাত্রই চিকন স্বরে হেসে উঠল আদিব। শেষমেশ বাবুও! হা হা হা…

স্নেহা একটু লজ্জা পেল কি না! চোখ নামিয়ে নিরবতায় ডুব দিল। আদিব এবার সেটা মৃদু শব্দ করে একটানে পড়ে ফেলল। পড়ার পর… আচ্ছা আগে দেখে নিই কী ছিল স্নেহার বাবুর মধ্যে। মানে ওর ‘বাবু’ রচনার মধ্যে।

শুরুতেই…

ভূমিকা: বাবু একটি কিউট ড্রামের নাম। যার মধ্যে তেল, পানি বা চাউল না থাকলেও গোলগোলা চোখের ড্যাবড্যাবে চাহুনি আর ফোকলা দাঁতের বোকলা হাসি দিয়ে মুহূর্তেই পাথুরে মনকে মোমের মতো গলিয়ে দেওয়ার মতো ম্যাজিক্যাল পাওয়ার ঠিকই আছে। আরও আছে মাতৃত্বের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে প্রথম চমকেই ভুলিয়ে দিয়ে ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠা বক্র চেহারায় স্বর্গীয় সুখের বিভা ফুটিয়ে তোলার এক অত্যাশ্চর্য শক্তি।

উপকারিকা: এরা আব্বুদের জন্য যথেষ্ট উপকারী। আম্মুরা যখন এদের জন্য পরম মমতা মাখানো সবজি-খিচুড়ি রান্না করে তখন এই খিচুড়ি আব্বুদেরও পুষ্টি সাধনে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। চুরি বিদ্যার প্রতিফলন আরকি। তবে আম্মুদের জন্যও এরা কম উপকারী নয়। বাবু একটু বড় হলে বাবুর জন্য আনা চকলেট, আইসক্রিম আর চিপসের ওপর টমের প্রতিপক্ষ জেরির থিউরি চালাতে আম্মুরা বেশ সিদ্ধহস্ত। খিচুড়ি চুরির প্রতিশোধ আরকি।

ক্রেডিট: এরা ঝগড়া মেটানোর পরাশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত। সাংসারিক বিভিন্ন টানাপোড়েনে এদের কথা চিন্তা করে খুব সহজেই একটি মিমাংশিত অবস্থা তৈরি হয়। অতঃপর পুনরায় খিচুড়ি চুরি আর ‘জেরি’ থিউরির ব্যবহারিক পর্ব হাজির হয়।

শখ: সারাদিন আম্মুর কোলে থাকতে থাকতে দিনশেষে মনেহয় আব্বুর একটু ছোঁয়া পেতে বেশ আঁকুপাঁকু করতে থাকে। আব্বু ঘরে ফিরে এসে যেই একটু কোলে তুলে নিবে অমনি সাথে সাথে হিসসস…

চাহিদা: বাবুর নিষ্পাপ হৃদয় ব্যাংকের চেকবই চায় না, পাজারো আর পালচারের চাবি চায় না কিংবা হাজার টাকার জামা কিংবা লক্ষ টাকার গহনাপত্র ও চায় না। এরা সারাদিন আম্মুর আদরের পর দিনশেষে আব্বুরও একটু আদর চায়, দুষ্টু মিষ্টি একটু শাসন চায়, কাজ থেকে ফিরে আব্বু নিজ হাতে এক কোষ কমলা মুখে দিয়ে দেবে এটা চায়, কোলে তুলে আ……! এভাবে ডেকে ডেকে আম্মুকে নিয়ে একসাথে হাসবে, খেলবে, এটা চায়।

কার্যকারিতা: সারাদিন আম্মুর কোলে রেখে আদর করার পর যখন ঘুমিয়ে যায় তখনও বিছানায় শোয়াতে গেলে ওয়্যা… করে এক চিৎকার! নাহ, কোলেই ঘুমাবে সে। দিনে তো বেচারি আম্মুকে একটু বিশ্রাম দেবেই না, আবার রাতেও ক্ষানিক পরপর হিসসস…। আর একটু বড় হলেই শুরু হয় সারাদিন লাটিমের মতো ঘুরে ঘুরে ঘরের একেকটা জিনিষ একেক জায়গায় ফিট করা আর আম্মু কিছু বলতে গেলেই ভ্যা… আর সেইসাথে চুল টানা তো ফ্রি আছেই!

আর আব্বু বাসায় এলে যেখানেই থাকুক, পায়ে জুতো আর ময়লা যা-ই থাকুক একলাফে কোলে উঠে একটানে দাড়ি একগোছা হাতে। কী আর করা! আসলে মা- বাবার কাছে এটাই সুখ…।

অধিকার: যখন-তখন, যেখানে-সেখানেই হিসসস…! জায়নামায, নতুন ইস্ত্রি করা কাপড় পড়া অবস্থায় কোলে আর খাবার প্লেট কোনোটাকেই এরা বঞ্চিত করে না।

আর হ্যাঁ! এই ‘বাবু’ ডাকটি শোনা কেবল ওদেরই অধিকার। ওদের এই অধিকার খর্ব করে আজকালকার আপুমনিরা তাদের ইয়েদেরকে যে ‘বাবু’ ডাকে এটা কিন্তু একদমই ঠিক না।

স্বভাব: সারাদিন ওয়্যা… ওয়্যা… করে আম্মুর কলিজা ঝাঁজরা করা আর রাতে নাইট ডিউটিতে বাধ্য করা।

উপসংহার: এরা মূলত ছাগলের মতো হয়। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কলাপাতা দেখিয়ে এদের দ্বারা অনেক কিছুই করানো যায়। কিন্তু জোরাজুরি করলেই ছাগলের মতো সামনে দু’পা মেলে- এ্যা…

দ্যা ইন্ড…

শেষটুকু পড়ে হাসতে হাসতে কাশি উঠে গেল আদিবের। স্নেহাকে ধরে সোজা সোফায় বসিয়ে নিজে তার পাশে ধপাস করে পড়ে গিয়ে বলল, ‘এ্যা…!’

স্নেহা বলে, ‘কী এ্যা?’

আদিব বলে,

‘এ্যা…!’

স্নেহা বলে, ‘আরে বাবা তুমি না তো। ঐ যে বাবু, মানে বাবু আরকি।

‘এ্যা…’

‘ঐ এখন কিন্তু পানি ঢালব মাথায়!’

আদিব নাক-মুখ বাঁকিয়ে- ‘এ্যা…!’

বকুল মালা

কিছু বই একবার পড়ার জন্য নয়; বারবার পড়তে, বারবার ভাবতে এবং ব্যক্তিসত্তাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিতেই লেখা হয়।

আদিব এমনই একটি বই স্নেহার হাতে দিয়ে পড়তে বলল। কিন্তু সে এখন পড়বে না। ভালো লাগছে না। শুধুই শুয়ে শুয়ে এটা-সেটা করে সময় কাটাচ্ছে। আদিব হাসতে হাসতে আলতো করে কয়েকটি কেনু (কনুই দিয়ে গুতো দেওয়াকে কেনু বলে।) দিয়ে বলল, ‘ইইই পড়তেই হবে।

কিন্তু স্নেহা রাজি না। এখন সে পড়বেই না! দিল আম্মুকে ডাক- আম্মু! কইতরটা শুধু শুধুই সময় নষ্ট করছে। পড়ে না।

আদিব রাগ করে স্নেহাকে মাঝেমাঝে কইতর বলে ডাকে। যেটার ভদ্র রূপ হলো কবুতর। স্নেহার সাথে কবুতরের বেজায় মিল। কবুতর ঠোকর মেরে খায়, আর স্নেহা সবসময় আদিবের হাতে খায়, এ-ই পার্থক্য। না হয় ওড়াউড়ি, ছোটাছুটি, বুদ্ধিমত্তা ও কিউটনেসের দিক থেকে কবুতরকে স্নেহার ছোটবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন বললে খুব একটা অত্যুক্তি বোধহয় হবে না। এই যাহ! ভাইও তো হতে পারে! আচ্ছা সে যাকগে।

স্নেহা ওর শাশুড়ি আম্মু আসার আগেই চট করে বইটি হাতে নিয়ে গুনগুনিয়ে পড়া শুরু করে দিল। আদিবও অন্য একটি বই নিয়ে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর …

নাহ! আদিব পড়তে পারছে না। স্নেহা গুনগুনিয়ে পড়ছে। গুনগুন শব্দ কানে গেলে পড়া যায়? মনে মনে পড়তে বলল। কিন্তু হু কেয়ারস! সে শব্দ করেই পড়বে। না হয় পড়বেই না। কী মুশকিল! আদিব আম্মুকে ডেকে বলল, ‘আম্মু! কইতরটা আমাকে পড়তে দিচ্ছে না। একটু আস্তে পড়তে বলেন না!’

আম্মু বলল, ‘নালিশ করা পছন্দ করি না

আম্মুর একথা বলতে দেরি! এদিকে স্নেহা কেমন যেন ভুতুড়ে টাইপের একটা হাসি দিয়ে উঠল। কেমনটা লাগে?!

এমনসময় আদিবের ছোটভাই জিয়াদ বাজার নিয়ে হাজির। আম্মুকে ডেকে বাজারের কথা বলায় স্নেহা বইটা রেখে আড়চোখে জব্বর একখান টিপ্পনী কেটে উঠে গেল। যাব্বাবাহ…

জিয়াদ মাছ এনেছে। আরও টুকিটাকি কিছু এনেছে।

ওর এখন ছুটি চলছে। তাই সুযোগ পেলে ওকেই বাজারে পাঠায়। আদিব যায় না। ওর আম্মু আবার জিয়াদকে পাঠাতে চায় না। দাম নাকি বেশি দিয়ে আসে। আদিবের কথা হলো- এখন দুই টাকা বেশি দিয়ে আসলেও অনেককিছু শিখবে। এখন না শিখলে শিখবে কখন? আর এখন শিখে রাখলে আগামীতে চার টাকা বাঁচিয়ে আসতে পারবে। লাভ না? আদিবের আম্মু আর কিছু বলে না।

স্নেহা মাছ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ পাঙ্গাশ এনেছে। ওর যা ইচ্ছা আনতে বলেছিল। বসে বসে মাছটা ঘঁষে সাদা করে ফেলেছে। আদিব জানালা দিয়ে দেখে বলল- গুড! এভাবে পরিস্কার করে এরপর ভেজে ভুনা করলে দারুণ লাগে!

আদিবের আম্মু মেশিনে বসে টুকিটাকি সেলাই করছিল। সেলাই থামিয়ে মাথা নাড়িয়ে আদিবের কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘চাষের মাছের চেয়ে নদীর মাছে স্বাদ বেশি। কেন বলো তো! কারণ, নদীর মাছের সুখ বেশি। স্বাধীনভাবে চলতে পারে। খেতে পারে। জোয়ার-ভাটায় নাইতে পারে। কোনো জবরদস্তি নেই। আর চাষের মাছ! কোনো স্বাধীনতা নেই। যা খেতে দেবে তা-ই খেতে পাবে। জোয়ার-ভাটার ছোঁয়া নেই। না চাইতে সব পেলেও মনে কোনো সুখ নেই। সেই অসুখীর প্রভাবেই- চাষের মাছে তেমন কোনো স্বাদ নেই।

আম্মু এটা কী ব্যাখ্যা করল? বুঝতে কিছু সময় লাগবে। নির্দিষ্ট একটা বয়স লাগবে। সে যাকগে।

স্নেহা এবার মাছ কাটায় মন দিল। একটুপর পর মাছের দাম নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা এখানে মাছের দাম এত কেন! এখানেই তো ধরে, তবু এত দাম!’

আম্মু বলল, ‘এখান থেকে ধরে সব মাছ শহরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে এখানে মাছের ঘাটতি পড়ে যায়। তাই এমনিই দাম বেড়ে যায়।’

আসলে শুধু মাছের দামই না। আজকাল নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুরই এমন আকাশছোঁয়া দাম যে- কেউ তা ছুঁতে গেলে প্যারাসুট লাগবে। হাত ফসকে গেলেই কোমর ভাঙবে। এতসবের পরেও সামর্থ্যবানরা অপচয় করবে। আর বাকিরা সব না খেয়ে মরবে।

প্রকৃতপক্ষে এগুলো আমাদের জন্য রবের পক্ষ থেকে আজাব! আমাদের বদ আমলের জন্যই পৃথিবীর যাবতীয় বিশৃঙ্খলা। এসবকিছুই আমাদের দু’হাতের কামাই। আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে সৎ হয়ে যাই, ভালো ‘মানুষ’ হয়ে যাই- আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবীর পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ করে দেবেন।

তো একপর্যায়ে স্নেহা ডেকে বলল, ‘এই বলেন তো! জান্নাতে সর্বপ্রথম কী খেতে দেওয়া হবে?’

‘কী?’

‘মাছের কলিজা ভুনা!’

‘বাব্বাহ! তাই!’

‘জিহ। কিন্তু এই মাছের কলিজা তো একদম ছোট। অনেকসময় খুঁজেই পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই মাছ হবে তুলনাহীন! অকল্পনীয়!’

‘কিন্তু তুমি তো কলিজা খাও না! তাই তোমার ভাগেরটা আমার!’ বলেই আদিব হো হো করে একগাল হেসে দিল।

এরপর আদিব একটু ওয়াশরুমে গেল। বের হয়ে অযু করতে যাবে, কিন্তু তার মাছ ধোয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। একটু জায়গা দিতে বলায় আরও আটকে বসল। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? এখন অযু ছাড়া ঘরে চলে গেলে অনেক লস হয়ে যাবে।

একাধিকবার তাহকিক করে জানা গেছে- অযুর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহি ওয়ালহামদুলিল্লা’ এটা পড়ে অযু শুরু করলে যতক্ষণ এই অযু থাকবে ততক্ষণ তার আমলনামায় নেকী লেখা হতে থাকবে। কিন্তু এখন ঘরে চলে গেলে অনেকটা বঞ্চিত হয়ে যাবে।

সাহবা (রা.)রা এমন করতেন। নেকীর জন্য চালাকি করতেন। বাড়ি থেকে নামাযের জন্য মসজিদে যেতে প্রতিটি কদমে একটি করে নেকী হয় ও একটি করে গুনাহ মাফ হয়। তাই ইচ্ছে করেই ছোটছোট কদমে মসজিদে যেতেন। কী চালাকি! না?

আমরাও কম যাই না। সেদিন এত এত ডায়াল করলেই বাংলালিংক-এ ১জিবি করে ফ্রি পাওয়া যায় শুনেই হামলে পড়েছিলাম। যাক বাবা! কয়েকদিনের খোরাক মিলল। আমরা হলাম দ্বিগুণ চালাক! এটা একেবারে নগদ! ঝটপট!

কিন্তু এই দুই চালাকির মধ্যে কী বিস্তর ব্যবধান তাই না? এই ব্যবধানের জন্যই সর্বত্র তারা বিজয়ী ছিলেন। সুসংবাদ প্রাপ্ত ছিলেন। অস্ত্রহীন হলেও শত্রুর আতঙ্ক ছিলেন। আর আমরা!

এই যাহ! কোথায় চলে গেলাম। তো এরপর স্নেহার মাছ ধোয়ার অপেক্ষায় না থেকে এক মগ পানি নিয়ে একপাশে গিয়ে অযু করে ঘরে চলে এলো আদিব। তবে আসার আগে আদিবকে সাইড না দেওয়ায় এক আঁজলা পানি খুব যত্ন করে স্নেহার মুখে মেখে দিল। আহা! বেচারি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদিব এক দৌঁড়ে আম্মুর কাছে…

‘এই দিন দিন না! আরও দিন আছে..!’ এই বলে স্নেহা এক হাঁক ছাড়তেই আদিব হাসতে হাসতে পল্টি খাওয়ার যোগার।

বেচারির মাছ ধোয়া শেষ হলে তাতে লবণ দিয়ে রেখে ফ্রেস হয়ে আবার পড়তে বসল। কিন্তু শব্দ আর কমলো না। এবার আরও জোরে পড়তে লাগল। উফ…

আদিব আম্মুকে আবারও বলল, ‘এই আম্মু! কিছু বলবেন? আমাকে একটুও পড়তে দিচ্ছে না! কী হিংসুটে!’

আম্মু বলল, ‘এই স্নেহা! এবার তুমি আস্তে পড়ো।’

শুনলো না। তার মতো সে পড়তেই আছে। এবার আম্মু বলল, ‘এইটা হচ্ছে ঘাউরা বউ! আদিব তুমি ঐ রুমে গিয়ে পড়ো।’

এই কথা বলতে দেরি! অমনি পড়া বন্ধ করে হাঁক ছাড়ল- ‘কী আম্মু! আমি কী…!’

আম্মু মুড অফ। এদিকে আদিব তো হাসতে গিয়ে না আবার কারো কাঁধে চড়ে বসে! ঘাউরা বউ! হা হা হা…!

আম্মু বলল, ‘একটু আগে একবার তোমার পক্ষ নিয়েছি। ওর নালিশ শুনিনি। আর এবার ওর পক্ষ নিলাম। সমান-সমান আরকি।’

স্নেহা- ‘ভ্যা’…

আদিব- ‘ভ্যা ভ্যা! হা হা হা…!’

আসলে ‘সুখ’ কোনো বস্তুগত জিনিস নয়। এটা কেউ কাউকে দিতে পারে না। টাকা দিয়েও কিনতে পারে না। এর জন্য সু-বিশাল বাড়ি আর অঢেল অর্থবিত্তের প্রয়োজন নেই। কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স আর ক্ষমতার আস্ফালনেরও দরকার নেই। এসবের মাঝে সুখ নেই।

সুখ হলো বিচ্ছিন্ন কিছু অনুভূতির নাম। ছড়িয়ে থাকা বকুল কুড়িয়ে মালা গাঁথার নাম। সেই মালা প্রিয়জনকে নিজ হাতে পরিয়ে দেওয়ার নাম।

এর মাঝে যে ধুলিকণা থাকবে না- সেটা নয়। জীবনপ্রবাহের প্রতিটি পরতই ধূলিকণাময়। এতে বিষাক্ত সব পয়জন সুপ্ত আছে। একটু বেখেয়ালিতে এই রাজ্য ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট। একটু অসতর্কতাতেই সুখের সংসার বিষে নীল হওয়ার জন্য খুব যথেষ্ট।

উচিত হলো- বকুলগুলো কুড়িয়ে সযত্নে সংগ্রহণ করা। আর ধুলিকণাগুলো স্রেফ ঝেড়ে ফেলে বকুলের মালা গাঁথায় মন দেওয়া। আর! আর একান্তে প্রিয়জনের গলায় সেই মালা পরিয়ে দেওয়া…

গিফট বক্স

আদিব আজ স্নেহার জন্য শপিং করতে গিয়ে জ্যামে পড়ে সারপ্রাইজ দেওয়ার স্বাদ অর্ধেকটাই পেয়ে গেছে। বাকিটা দেখা যাক।

ঘণ্টাদুই পর শপিং থেকে ফিরে এসে স্নেহাকে ব্যাগগুলো দিয়ে প্রোগ্রামের প্রিপারেশনে ব্যস্ত। গেস্ট সবাই এসে গেছে। মাহিরকে নিয়ে স্নেহাও ওদিকে ব্যস্ত

হয়ে গেল। মাহিরকে একজোড়া সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরিয়ে চোখে একটি কালো সানগ্লাস লাগিয়ে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে স্নেহা। চাঁদের সবটুকু সৌন্দর্য যেন মাহিরের চেহারায় জ্বলজ্বল করছে। কী নিষ্পাপ!

অমনি রুহি হাঁক ছেড়ে বলল, ‘ভা…বী! ছেলেকে সাজালেই হবে? ভাইয়ার কথাও তো একটু ভাবা উচিৎ তাই না?’

‘ত বে রে! দাঁড়া…!’

রুহি উঠেপড়ে দৌড়! ওকে সরিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে সব বের করে মহাযজ্ঞ বাধিয়ে দিল স্নেহা। পাক্কা দেড় ঘণ্টা নানান তেলেসমাতি শেষে আয়নায় দাঁড়িয়ে স্নেহা নিজেকেই চিনতে পারছে না। আদিব বেচারা যে কীভাবে চিনবে কে জানে…

আদিবের প্রোমোশন হয়েছে। সেই খুশিতে আজকের এই প্রোগ্রাম। কাছের মানুষগুলোকে আজ মনভরে আপ্যায়ন করাবে। সেইসাথে স্নেহার জন্য আছে বিশেষ সারপ্রাইজ…

‘এই স্নেহা! এই আদিব! আরে কোথায় তোমরা! জলদি এইদিকে আসো না!

আমরা সবাই বসে আছি তো…!’

আম্মুর তাড়া করা ডাক। আম্মুর ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে আদিবের রুমে ঢুকে গেল স্নেহা। ঢুকে দেখে আদিব সোনালী রঙের পাঞ্জাবি পরে আয়নায় মুখ দেখছে। স্নেহা চাপা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমার মহারাজাকে যে আজ স্কয়ার মহারাজার মতো লাগছে!’ আদিব ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ‘স্কয়ার মহারাজা? সেটা আবার কী?

‘ও তুমি বুঝবে না।’

‘তাই! তাহলে আমার মহারানীকে তো আজ ত্রিপল মহারাণীর মতো লাগছে!’

‘ত্রিপল মহারানী! ওমাহ! এটা আবার কী?’

‘ও তুমি বুঝবে না।’

স্নেহা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। আদিব টেবিল থেকে একটি গিফট বক্স স্নেহার সামনে উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘এই! এই ত্রিপল মহারানী রাগ করে না প্লিজ! এই নাও তোমার আজকের গিফট!’

হা… করে মুখে আঙুল চেপে বড় বড় চোখ করে বক্সটির দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহা। বাহারি রঙের রঙিন কাগজে মোড়ানো বক্সটি হাতে নিয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে বাঁকা ঠোঁটের ভেঙচি কেটে সোফায় বসে বক্সটি খুলতে শুরু করল।

সে কী! ভেতরে দেখছি আরও একটি ছোট বক্স। সেটাও খুলছে। ধুর ছাই। এটার ভেতরেও আরও একটি ছোট বক্স। এবার ভ্রু কুঁচকে আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তিনটি বক্স দিয়ে মোড়াতে হয় বুঝি?’

আদিব শান্ত গলায় বলল, ‘আমার ত্রিপল মহারানী বলে কথা!’

স্নেহা এবার রাগ হয়ে খালি বক্সগুলো আদিবের দিকে ছুঁড়ে মারল। আদিব তো ক্যাঁচ ধরে হেসে কুটিকুটি…

শেষের ছোট বক্সটি খুলে দেখে ভেতরে একটি সাদা খাম। সেটার উপর লেখা- ‘Danger! Keep away!’- এটা দেখে তো স্নেহার চোখ চড়কগাছ!

–হচ্ছেটা কী? হু?

আদিব খালি বক্সগুলো দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, ‘যা লেখা আছে ফলো করে দেখে নাও হচ্ছেটা কী! ‘

স্নেহা বেশ ভয়ে ভয়ে, সন্তর্পণে খামটি খুলে ভেতরে আরও একটি সাদা কাগজ দেখল। আদিবকে একপলক দেখে নিয়ে এবার খুলছে সেটা। আদিব এবার ওয়্যারড্রবের পেছনে লুকোতে যাচ্ছে।

‘এই! কোথায় লুকোচ্ছো! দাঁড়াও বলছি!’

এই বলেই কাগজটি খুলে দেখে তাতে ব…ড় করে লেখা- I …..You!

এটা দেখা মাত্রই কেন যেন স্নেহার হার্টবিট বেড়ে গেল। আদিব ওদিকে লুকানোর ভান ধরছে। স্নেহা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘I …… You মানে কী হুম?’

‘বলব না!’

‘বলো বলছি!’

‘না বলব না!’

‘এখন কিন্তু!’

‘কী?’

‘বলো বলছি!’

‘উম হুম! বলব না… ‘

আহা ভাইয়া! বলো না! স্নেহা- ‘I Love You!’

আদিব-স্নেহা দু’জনই হা… করে তাকিয়ে দেখে জানালার পর্দার আড়ালে রুহি দাঁড়িয়ে আছে!

এই কথা শুনে স্নেহা তো লজ্জায় একদম লাল-নীল-গোলাপী হয়ে গেল।

‘তবে রে পাজি…!’ এই বলে রুহিকে দৌড়ানি দিয়ে সোজা গেস্ট রুমে চলে গেল আদিব।

এদিকে ছোট্ট সেই সাদা কাগজটি হাতে নিয়ে স্নেহা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

‘হ্যাঁ রে স্নেহা! আর কতক্ষণ!’

আম্মুর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি করে কাগজটি লুকিয়ে ফেলতে গেলে রুহি পেছন দিয়ে ঘুরে এসে খপ করে কাগজটি নিয়ে ভোঁ দৌড়!

‘রুহি! এই রুহি! আরে এই পাজি বুড়িইইই…!’

রুহি দৌড়াচ্ছে। পেছন-পেছন তার দুষ্টু ভাবিও দৌড়াচ্ছে। যে করে হোক, কাগজটা উদ্ধার করতেই হবে। নইলে ফাজিলটা অবিরত ব্লাকমেইল করেই যাবে।

তো দেখা যাক! আজ কে জিতে…

ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ

এক পড়ন্ত বিকেলে রাস্তার পাশ ঘেঁষে আদিব আর হাসান হেঁটে যাচ্ছে। বেশকিছু দিন হলো দু’জন একসাথে কিছু খাওয়া হয় না। অথচ একসময় একজনকে রেখে অন্যজন কোনোকিছু খাওয়ার চিন্তাও করত না। যা-ই খাক, লুকোচুরি করেও কেউ কারো কাছ থেকে নিস্তার পেত না। খাওয়া-দাওয়ার কথা শুনলে বা ইঙ্গিত পেলেই হলো, সেদিন আর পিছু ছাড়াছাড়ি নেই। দু’জনই একরকম। বড় মধুর ছিল সেই দিনগুলো।

অথচ আজ উভয়েরই ফ্যামিলি আছে। জব আছে। টাকা আছে। নেই শুধু সেই দিনগুলো। দু’জনই হয়ত ভাবছে এসব। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। মানুষ বড় হলে অনুভূতি আড়াল করে রাখার এক মারাত্মক প্রবণতা দেখা যায়।

বাল্যকালটা অবশ্য এর একদম বিপরীত। সেখানে যে-কেউ অকপটে তার

মনের কথাগুলো গড়গড় করে বলে দেয়। কোনো রাগ-ঢাক নেই সেখানে। কুটিলতার বালাই থেকেও মুক্ত সেই সময়টা। পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, কপট রাগ, প্রতিশোধ প্রবণতা এসব কোনোকিছুই সেই সময়টাকে কলুষিত করতে পারে না। সকালে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বিকেলেই আবার একসাথে দেখা যায়। আজ নাক ফাটিয়ে পরদিনই একসাথে গোল্লাছুট খেলতে দেখা যায়। মন্দ বিষয়গুলো ছিল খড়-কুটোর মতো। যা কিছুক্ষণ পরই ভেসে যায়। আর সম্পর্কগুলো ছিল পাথরে খোদাইকৃত নকশার মতো। যাতে ধুলো পড়লেও মুছে যেত না। মুছতে চাইলেও পারা যেত না। বাল্যকাল বুঝি এমনই হয়! না না, সবার বাল্যকাল অবশ্য এমন হয় না।

বর্তমান শিশুদের বাল্যকালটা বড় একপেশে। যান্ত্রিক। একঘরে। যেটাকে আমাদের সময় শাস্তি হিসেবে দেখা হতো। অথচ আজ সেটাকেই ক্যারিয়ার গড়ার মাধ্যম ভাবা হয়। ছোট থেকেই শিশুদেরকে বই, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, আর কোচিং-এর মধ্যে বন্দি করে ফেলা হয়। এরা সেই গোল্লাছুটের মজা বুঝবে না। বুঝবে না দুই টাকার ঝালমুড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে জামায় দাগ পড়ানো সেই ঝগড়ার স্বাদ। মায়ের বকুনির ভয়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে জামা ধুয়ে আনা সেই স্মৃতির দাগ। বুঝবে না এরা।

রুটি বেলার বেলুন, খুন্তি, ঝাড়ু, হেঙ্গার, চামচ এসব দিয়ে মায়ের শাসন পাওয়া আমাদের সেই বাল্যকাল ছিল প্রকৃত মানুষ গড়ার ভিত। সত্য করে বলছি, মায়ের সেই বৈচিত্র্য শাসন না পেলে আমাদের বাল্যকালটা নষ্ট স্মৃতিতে তলিয়ে যেত। আজকের মতো গর্বের হতো না। আর আমরাও আজকের এই আমরা হতাম না। বেশির চেয়ে বেশি দোপেয়ে কোনো জন্তু হতাম।

বর্তমানের মায়েদের শাসন হলো, অ্যাই এখন পড়তে বসো। নইলে কিন্তু ওয়াই-ফাই এর পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দেব! ব্যস, পাসওয়ার্ড হারানোর ভয়ে বাচ্চারা পড়তে বসে। পড়া শেষে এই পাসওয়ার্ডের জগতে প্রবেশ করে। তো এই পাসওয়ার্ডের যুগের বাচ্চারা বড় হলে যন্ত্র হবে না তো কী হবে? আজকাল বৃদ্ধাশ্রম তো আর এমনিতেই বানানো হয়নি তাই না? কই! আমাদের সময় তো এসব কিছু ছিল না! আমাদের বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য আমরাই যথেষ্ট ছিলাম।

এই যাহ! কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। আসলে আমাদের বাল্যকালটা এমনই যেখানে নির্ভয়ে হারিয়ে যাওয়া যায়। ইশ! সেই বাল্যকালে সত্যিই যদি আবার হারিয়ে যেতে পারতাম! তাহলে এই যন্ত্রের যুগে আর ফিরে আসতাম না।

আদিব-হাসান হাঁটতে হাঁটতে দু’জনই কেমন যেন নিরবতায় হারিয়ে গেল।

‘এই চল, আজ বজলু মামার হাতের লাল চা খাই। হেব্বি হয় মামার চা’টা।’ নিরবতা ভেঙে আদিব বলে উঠল

হাসান বলল, ‘শুধু চা খাওয়াবি?’

‘বাকিটা তুই খাওয়া। সমান সমান।’

‘আর ভালো হলি না। আচ্ছা চল। সমান সমান না, সবটাই আজ আমি খাওয়াব।

‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! আ হা হা! চল চল।’

‘মামা ভালো করে দুই কাপ চা দাও তো। আর কেক দিও দুইটা।’ দোকানিকে উদ্দেশ্য করে হাসান বলল।

বাইরে বেঞ্চে বসে পড়ল দু’জন।

আদিব বলল, ‘কী রে! তোর চোখ-মুখ কেমন শুকনা দেখাচ্ছে! কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?’

বাল্যবন্ধুদের এই একটা দোষ। চেহারা দেখেই অনেককিছু ধারণা করে ঠাস করে মুখের ওপর বলে দেয়। অনেকটা মিলেও যায়। কীভাবে সম্ভব? সে যাকগে। হাসান বলল, ‘না, তেমন কিছু হয়নি।’

‘তেমন কিছু না হলেও কিছু না কিছু হয়েছে। বলবি না সেটাই বল।’

হাসান চোখ নামিয়ে নিল।

‘বড় হয়েছিস। কথা লুকানোর সেই স্বভাবটা আজও ধরে রেখেছিস। ভাবির সাথে ঝগড়া হয়েছে?’

হাসান নিশ্চুপ।

‘মামা চা নেন।’ এই বলে দোকানি চায়ের কাপ সামনে ধরে তাকিয়ে আছে। আদিব কাপ দু’টি নিয়ে হাসানকে একটা দিল, নিজে একটা নিল। প্রথম চুমুক লাগিয়ে কাপটি হাতে রেখে বলল, ‘আচ্ছা হাসান, কিছু কথা বলি। মাইন্ড করিস না। কথাগুলো আমার দিক থেকে বলছি। তুই আবার নিজের দিকে টেনে নিস না।

আদিবের এমন কথার অর্থ হাসান ভালো করেই বুঝে। আদিব যখন হাসানকে কোনো পরামর্শ বা উপদেশ দিতে চায় ঠিক তখন ও এভাবেই শুরু করে। নিজেকেই নিজে উপদেশ দেয়। অথবা মাঝেমধ্যে অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে। সরাসরি শ্রোতার নাম ধরে কিছু বলে না। হাসান বুঝতে পেরে সম্মতি দিল।

‘হুম বল।’

‘আমি জানি, সাংসারিক দিকটা তুই আমার চেয়ে ভালো বুঝিস। কিন্তু তবুও আজ আমার কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তোর সাথে শেয়ার করতে চাই। হয়তো নিজে একটু স্বস্তি পাব। আর কিছু না। শুনবি?’

‘অবশ্যই শুনব। বল।’

আদিব বলতে শুরু করল- ‘আসলে সাংসারিক জীবনের অক্সিজেন হলো ভালোবাসা। অক্সিজেন-এর ঘাটতি হলে যেমন দম আটকে আসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ মারা যায়, তেমনি সংসারে ভালোবাসার ঘাটতি দেখা দিলে সম্পর্কে আঘাত আসে। এই অবস্থা বেশিক্ষণ চলতে থাকলে সম্পর্কের বন্ধনটি টাস করে ছিঁড়ে যায়।

‘ভালোবাসা’ শব্দটি আমার কাছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ অপার্থিব একটি শব্দ। যার সাথে পার্থিব কোন চাহিদা, আশা, লোভ, উদ্দেশ্য এসব কোনোকিছুই থাকে না। থাকে কিছু আবদার, অভিমান, খুনসুটি আর পাগলামো।

আমার কাছে…

সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ এক অকৃত্তিম অনুভূতির নাম ভালোবাসা।

মুহূর্তেই নিষ্প্রাণের মাঝে প্রাণসঞ্চার করার মতো এক অদ্ভুত শক্তির নাম

ভালোবাসা।

হৃদয়াকাশে কষ্টের ভারী মেঘের তর্জন-গর্জনকে বাতাসে মিলিয়ে দেওয়ার মতো এক প্রবল শক্তির নাম ভালোবাসা।

চৈত্রের ক্ষররৌদ্রের প্রখরতায় চৌচির হওয়া ফসলি মাঠের বৈশাখের ঝটিকা বর্ষণে প্লাবিত হওয়ার মতো চটকদার এক ম্যাজিকের নাম ভালোবাসা।

অনুর্বর জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে ‘সার’ এর মতো কার্যকরী উপাদানের নাম ভালোবাসা।

বৈদ্যুতিক যন্ত্রের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার মতো অকল্পনীয় প্রয়োজনের নাম ভালোবাসা।

জীবেনে বেঁচে থাকার স্বার্থে দেহাভ্যন্তরীণ রক্তের ‘হিমোগ্লোবিন এর ন্যায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের মতো বাধ্যতামূলক এক উপাদানের নাম ভালোবাসা।

প্রাণীকোষের প্রাণ ‘নিউক্লিয়ার্স’ এর মতো এক প্রাণোৎসের নাম ভালোবাসা।

দুষ্টদের অনিষ্টকারী শক্তিকে ম্লান করে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সম্পর্কে নতুনত্ব এনে দেওয়ার মতো এক পরাশক্তির নাম হলো ভালোবাসা।

দারিদ্রের গ্লানিকে পায়ে ঠেলে কুঁড়েঘরকে রাজপ্রাসাদে পরিণত করার মতো অব্যর্থ কংক্রিটের নাম ভালোবাসা।

ডানাবিহীন আকাশে ওড়া, চাকাবিহীন গাড়িতে চড়া, জাহাজবিহীন সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাহসের নাম ভালোবাসা।

হৃদয়াভ্যন্তরীন নিকষকালো অন্ধকার দূরীভূতকরণে আলোর ন্যায় অদ্বিতীয় মাধ্যমের নাম ভালোবাসা।

চোখাচোখির এক বর্ণহীন ভাষার নাম ভালোবাসা।

ধুরছাই, আর কত বলব? আসল কথা হলো, পাগলামোর অপর নামই ভালোবাসা।

এই বলে আদিব দম ফেলতেই হাসান হেসে ফেলল। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে! লাভ গুরু হলি কবে থেকে?’

‘হা হা হা! পাগলটা কী বলে দেখ! ওসব কিছু না। আসলে আমার অনুভব থেকে ভালোবাসার কিছু সংজ্ঞায়ন করলাম।’

‘তো এমন বিচিত্র সংজ্ঞায়নের ডেফিনেশন কেমন হবে রে?’ হাসানের বিস্ময়মাখা প্রশ্ন।

আদিব বলল, ‘তা জানি না। তবে আমি যেটুকু বুঝি, এই ভালোবাসাকে যেমন একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করে, তেমনি একেকজন একেক চোখে দেখে একেকভাবে অনুভব করে। কারও সাথে কারও মিল পাওয়া যায় না। কিছুটা পার্থক্য থাকেই থাকে।’

‘যেমন?’

‘যেমন- কিছু হতভাগী আছে, যাদেরকে ভালোবাসার নামে বিভিন্ন ভেলকিবাজিতে কুপোকাত করে কিছু ভিজাবিড়াল তাদের লালসা পূরণার্থে ওঁৎ পেতে থাকে।

সেই হতভাগীরা ওদের সেই নোংরামিতে ভালোবাসা খুঁজে পায়। ভালোবাসা আর লালসার মাঝে পার্থক্য করতে না পেরে অনেকেই নিজের বিবেক ও চরিত্রকে বিসর্জন দেয়। কিন্তু আমি…!’

‘আমি কী? থামলি কেন? বল না!’ আগ্রহভরে বলল হাসান।

আদিব বলতে শুরু করল, ‘বিছানায় মাথা রেখে পাগলীটির মুখাবয়ব পানে অপলক তাকিয়ে থাকার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পাই….

একাকি পথচলাকালীন পাশে অদৃশ্য কারও উপস্থিতি টের পেয়ে হাতটি আলতো করে বাড়িয়ে দিয়ে ওর কল্পিত আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে বাকি পথ অতিক্রম করার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পাই…

খাবারের প্রথম লোকমা ওর মুখে তুলে দিতে গিয়ে আলতো কামড়ে নিজের আঙুলটি ওর মুখে আটকে থাকার দৃশ্য দেখার মাঝে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই….

দিনশেষে ঘরে ফেরার সময় একটি চকলেট কিনে নিয়ে দু’জন ভাগাভাগি অতঃপর কাড়াকাড়ির খুনসুটির মাঝে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই…

নিভৃতে নামাজ শেষে ওর হাতটি টেনে নিয়ে ওর আঙুলেই তসবিহ গণনা করার মাঝে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই…

একান্তভাবে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে আমৃত্যু একসাথে কাটিয়ে জান্নাতেও চিরসঙ্গী করে নেওয়ার পবিত্র স্বপ্নের মাঝে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই…

কী রে আছিস? না চৌঠা আসমানে ভ্রমণে গেছিস?’

দীর্ঘক্ষণ পর আদিবের প্রশ্ন শুনে হাসান বলল, ‘চৌঠা আসমানে না। তোর দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে হারিয়ে গেছি। বল। এরপর বল। ‘

আদিব পুনরায় বলল, ‘জানিস! একবার আমি দেখলাম, এক বৃদ্ধ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি মোবাইল দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এবং একটু পরপর মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। আমি এগিয়ে গিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে বৃদ্ধ বলল, এহন আপনের চাচির লগে কথা কইলাম। পরে ফোন রাখতে যাইয়া দেহি এইখানে আপনের চাচির সেফ করা নাম ভাইসা উঠছে। সেইটা দেইখা কেন যানি খুব ভালা লাগতাছে বাজান।

আমি বৃদ্ধের এই সরলতার মাঝে আকাশের মতো বিশাল একটি হৃদয় খুঁজে পাই। আর তাতে কেবল নিখাঁদ ভালোবাসাই দেখতে পাই।’

আদিবের কথাগুলো শুনে বেশ বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাসান।

‘এই তোর চা তো শরবত হয়ে গেল। খেয়ে নে। আর এত বড়বড় চোখে তাকালে ভয় পাই তো। চা শেষ কর আগে।’ আদিবের কথা শুনে হাসান চায়ের কাপে মুখ লাগাল। কয়েকটানে শেষ করে বলল, ‘তোরটা কই?’

‘কথার ফাঁকে সেই গতকালই শেষ করেছি। হা হা হা..!’

হাসান নিশ্চুপ। নিরবতা ওর আপাদমস্তক আচ্ছন্ন করে আছে। সেইসাথে রাজ্যের চিন্তাও। আদিবের কথাগুলো কেমন যেন ভেতরটায় তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। ভালোবাসার এতরকম সংজ্ঞা হতে পারে? এর ডেফিনেশন এমন হতে পারে? মানুষের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির এতটা ব্যবধান থাকতে পারে? এই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তাতে ছেদ ফেলে আদিব বলল, ‘আমার ভালো লাগা, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা, আর ভালোবাসার অনুভূতি খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রগুলো বলি এবার। মন দিয়ে শোন।

হাসান বাধ্যগত ছেলের মতো আদিবের কথায় নিরব সম্মতি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আদিব আবারও বলতে শুরু করল- ‘ভালোবাসার মানুষটিকে মানুষ সকাল-বিকেল ও বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আর আমি তাকে নিয়ে গদ্য-পদ্য রচনায় শব্দরাজ্যে হারিয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

মানুষ বিভিন্ন প্রোগ্রামে আতশবাজি আর বেলুনের মোহনীয় পরিবেশে বাছবিচারহীন ধস্তাধস্তিতে পৈশাচিক আনন্দ পায়। আর আমি জ্যোৎস্নারাতের মাখো- মাখো চাঁদের আলোয় পাশে বসিয়ে ওর কাজল কালো হরিণী চোখ দেখতে দেখতে রাত্রি পার করার মাঝে স্বর্গীয় আনন্দ পাই।

ওরা নিজের ভালোবাসাকে বাইকের পেছনে চড়িয়ে দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়ানোর মাঝে উৎফুল্লতা খুঁজে পায়। আর আমি তার হাতে হাত রেখে ভোরের শিশির মাড়িয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ানোর মাঝে প্রফুল্লতা খুঁজে পাই।

ওরা পার্কে পরস্পর হেলান দিয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে অশ্লীল খোশালাপে টাইম পাস করে। আর আমি তার কোলে মাথা রেখে তার মিষ্টি কণ্ঠে কালামুল্লাহর তেলাওয়াত শোনার মাঝে বিভোর হয়ে থাকি।

বিশেষ দিনে ওরা রেস্টুরেন্টে হাজার টাকা বিল দিয়ে গার্লফ্রেন্ডকে খুশি করার মাঝে ক্রেডিট খুঁজে পায়। আর আমি বিশেষ দিনে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তাকে প্রস্ফুটিত গোলাপ গিফট করার মাঝে ক্রেডিট খুঁজে পাই।

ওরা গার্লফ্রেন্ডের অভিমান ভাঙাতে শপিংমলে নিয়ে যায়। আর আমি তার অভিমান ভাঙাতে আচমকা কোলে তুলে নিয়ে কপালে আলতো করে ভালোবাসার মিষ্টি ছোঁয়া এঁটে দেওয়াকেই যথেষ্ট মনে করি।

ওরা ভালোবাসি ভালোবাসি বলে বলে মুখে ফেনা তোলার মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করে। আর আমি তাকে কখনও কইতর, কখনও ভুত বলে ডাকার মাঝে ভালোবাসা প্রকাশ করি।

ওরা নিভৃতে লালসা পূরণের মাঝে ভালোবাসার প্রমাণ খুঁজে পায়। আর আমি মুনাজাতে জান্নাতেও একসাথে থাকার কামনা করার মাঝে ভালোবাসার প্রমাণ খুঁজে পাই।

ওরা পরস্পরের ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড জানার মধ্যে বিশ্বস্ততা খুঁজে পায়। আর আমি গভীর রাতে উভয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ার প্রতিজ্ঞা করার মাঝে বিশ্বস্ততার প্রমাণ পাই।

ওরা গার্লফ্রেন্ডের ‘কিউট বেবি’ হওয়ার মাঝে উত্তেজনা খুঁজে পায়। আর আমি তার স্বপ্নপুরুষ হবার অদম্য অভিপ্রায় পোষণ করার মাঝে উদ্যমতা খুঁজে পাই।

ওরা সামাজিকতা স্বরূপ কমিউনিটি সেন্টারে ভোজনোৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁজ মহলে হানিমুনের স্বপ্ন দেখে। আর আমি তাকে নিয়ে এহরামের কাপড় পরে বাইতুল্লাহ তাওয়াফের স্বপ্ন দেখি।’

এই পর্যন্ত বলেই আদিব উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘কী রে হাসান! তুই কাঁদছিস?’

আদিবের একের পর এক ভালোবাসার সব কল্পকথা শুনে হাসান কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। না কিছুর সন্ধানে গিয়েছিল? কী জানি।

যেখানেই যাক। কিন্তু চোখে পানি কেন? আদিবের জিজ্ঞাসার পর হাসান একটু নড়েচড়ে বসে বলল, ‘আদিব, আমার জন্য একটু দু’আ করিস। তোর মতো করে যেন আমিও ভাবতে পারি। আমিও তাকে নিয়ে এমন করে স্বপ্ন দেখতে পারি। স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি। দু’আ করিস খুব। করবি তো?

‘তা না হয় করলাম। কিন্তু তোর চোখে পানি দেখে তো সহ্য হচ্ছে না রে। ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর জায়গা থেকে তোর দায়িত্বটুকু তুই করে যা। ভাবির পক্ষ থেকে এরপরও কোনো ত্রুটি হয়ে গেলে ধৈর্য ধর। অপেক্ষা কর। মনে রাখিস, ভালোবাসা কোনো চুক্তির নাম নয় যে, তুমি আমার জন্য এই এই করবে, বিনিময়ে আমিও এই এই করব। তুমি করবে না, তো আমিও বাধ্য না।

ভালোবাসা একটি নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। এখানে লেনাদেনার কোনো হিসেব থাকতে নেই। পাওয়া-না পাওয়ার কোনো অংক কষতে নেই। যেখানে এসবের হিসেব হয়, প্রতিটি পদক্ষেপের অংক কষা হয়, সেখানে ভালোবাসা কীভাবে হয়!

তাই স্ত্রী, সংসার, বিয়ে এসব নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ফ্যান্টাসিতে ভোগা বেশ বিপজ্জনক।

কারণ স্বপ্নের ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো রংতুলির আঁচড় কাটা যায়, চাহিদামতো তার অবয়ব গড়া যায়, কিন্তু বাস্তবতা এত সরল নয়। আর জীবনটাও তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে আঁকা কোনো শিল্প নয়।

এখানে আশানুরূপ প্রাপ্তি না-ও হতে পারে। স্বপ্নের মতো করে কাউকে আবিষ্কারের অভিলাষ ব্যর্থও হতে পারে। অনাগত সব অলীকতায় ভোগার আগে এসব ভেবে দেখা উচিত। এরপর পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তবেই বৈবাহিক জীবনে পা বাড়ানো উচিত। এবং সাংসারিক জীবনে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ ফেলা উচিত।

চাহিদা ও স্বপ্নের পরিধি যদি সীমিত হয়, তাহলে প্রাপ্তি অল্প হলেও তৃপ্ত হওয়া যায়। অন্যথায় আলাদিনের চেরাগ হাতে পেলেও সুখী হওয়া দায়।

আর একটি বিষয় খুব স্মরণ রাখবি। তুমি সঠিক বলে আমি ভুল, ব্যাপারটি এমন নয়। কারণ, তোমার কাছে যেটা 6, আমার কাছে সেটা 9।

তাই, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা ও পরিবেশকে শান্ত রাখা উচিৎ। নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে নিজের মতটাকে শিথিল করে তারটা মেনে নেওয়া উচিত। কী! এতে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? আর হুটহাট রেগে যাবি না। কেননা রাগ হলো আগুন। যা নিয়ন্ত্রিত হলে উপকারী, বেপরোয়া হলে ধ্বংসকারী!

তাছাড়া অন্যের নিকট থেকে প্রত্যাশার মাত্রা কমিয়ে আনা চাই। দেখবি- প্রত্যাশা ছাড়াই যেটুকু মিলবে, তাতে সুখ পাবি, ভালো লাগবে। অন্যথায় অতৃপ্তি নিয়েই জীবন কাটবে।’

হাসান মন্ত্রমুগ্ধের মতো আদিবের কথাগুলো শুনছে। টু শব্দটুকুও করছে না। এর একটু পর হাসান কিছু একটা বলতে যাবে, অমনি আদিব ফের বলে উঠল, ‘আজ তোর কাছ থেকে কিছু শুনব না। আজ শুধু বলব। শুনব অন্যদিন। আজকের বলা কথাগুলো কিছুদিন অ্যাপ্লাই কর, এরপর তোর বাকি কথা সব শুনব।’

আদিব এই বলে পুনরায় বলতে শুরু করল।

‘এবার স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্যই লক্ষণীয় কিছু বিষয় বলব। কারন তুই আর আমি প্রায় কাছাকাছি সময়েই বিয়ে করেছি। অথচ আমার একটি সন্তান আছে। কিছুদিন পর ওর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাও শুরু হবে। আর তুই আজও কোনো সন্তান নেওয়ার কোনো প্লানই করিসনি। জীবনকে একটু উপভোগ করবি বলে তোর এই সিদ্ধান্ত। অথচ সেই জীবন থেকেই তুই এখন পালিয়ে বেড়াতে চাস। কেন? কেন এমনটা হলো? থাক সেই কথা। সেটা নিয়ে সরাসরি কোনো ডাক্তারের সাথে আলোচনা করব একসময়। আর সর্বশেষ যেটা বলতে চাচ্ছি, খুব মন দিয়ে শোন।

বিষয়টি হলো, স্বামী বা স্ত্রীর একে অপরের সাথে অন্যকোনো পুরুষ বা নারীকে কখনো তুলনা করা উচিত না।

মনেকর, তোর স্ত্রী দেখতে ততটা সুশ্রী না। যতবার তাকে দেখিস ততবারই কোনো না কোনো সুশ্রী নারী তোর চোখে ভেসে ওঠে। আর মনে মনে প্রলাপ বকতে থাকিস- ইশ! ঐ মেয়েটা যদি আমার স্ত্রী হতো! অথবা আমার স্ত্রী যদি ওরকম সুন্দর হতো! এটা একটা স্লো পয়জন।

স্ত্রীর মানবিক কোনো ত্রুটি নজরে আসার সাথে সাথে অন্য কোনো নারী তোর কল্পনায় চলে আসল। স্বপ্নের রানী হিসেবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা শুরু হয়ে গেল। এটি আরও একটি স্লো পয়জন।

আবার স্ত্রীদের জন্য তার স্বামী তার সার্বিক চাহিদা মিটাতে সবদিক দিয়ে পার্ফেক্ট হলেও ধরি কোনো একদিক দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে। তো যতবার তার এই দুর্বল দিকটি মনে পড়ে ততবারই এই দিকটাতে সবল কোনো পুরুষের কথা তার স্মরণ হয়ে যায়। কল্পনায় তার সাথে একপশলা বৃষ্টি বিলাসও অতিত হয়ে যায়। স্ত্রীদের জন্য এটা বড় মারাত্মক একটা স্লো পয়জন।

স্বামীর অবদানগুলো ঘুণাক্ষরেও চোখে পড়ে না। হঠাৎ কোনো মিসবিহেব দেখতে পেলে সেটাকে খামচে ধরে জটলা পাকানোটা মারাত্মক স্লো পয়জনের পাশাপাশি একপ্রকার মানষিক ব্যাধিও বটে।

এজাতীয় স্লো পয়জন সংসারের সুখগুলোকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। অশান্তি ও অহেতুক সন্দেহের বিষ ঢেলে দিয়ে জীবনকে অতিষ্ট করে দেয়।

আবার কত ভাইদের দেখি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে একদমই সন্তুষ্ট নয়। স্ত্রীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেই চেহারার দিকে আর তাকানো যায় না। অনেক বোনকে ও দেখা যায় স্বামীর ব্যাপারে যথেষ্ট বিরাগভাজন। মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটিই তার স্বামী। আমরা আসলে শোকর করতে জানি না। যেটুকু পেয়েছি এটুকুর যত্ন নিলে হয়তো এই মানুষটিই একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী হতে পারবে। কিংবা দীল জুড়ানো ও চক্ষু শীতলকারিনী স্ত্রী হতে পারবে।

মনে রাখবি- পৃথিবীতে কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের যে ত্রুটি দেখে নিজের মন অন্য কারো প্রতি ঝুঁকতে চায়, সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটিরও নিশ্চয়ই এমনকিছুতে কোনো ত্রুটি আছে, হয়তো সেইদিকটায় তার স্বামী বা স্ত্রী একেবারে সুপারস্টার! তো যে কোনোভাবে তাকে পাওয়ার পর যখন তার লুকিয়ে থাকা সেই ত্রুটিগুলো নজরে আসবে তখন আবার তৃতীয় কারো প্রতি মন ঝুঁকতে চাইবে। কারণ পৃথিবীর মানুষ কবরের মাটি ছাড়া কোনোকিছুতেই তৃপ্ত হতে পারে না।

আসলে শতভাগ ত্রুটিহীন স্বামী বা স্ত্রী পাওয়া একমাত্র জান্নাতেই সম্ভব। তাই উচিত হলো, অযথা অতৃপ্তিতে না ভুগে আল্লাহ যাকে দিয়েছেন তার ত্রুটিগুলো দাফন করে গুণগুলো নিয়ে বেঁচে থাকা, আর জান্নাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকা। সেখানে আল্লাহ প্রত্যেকটা স্বামী ও স্ত্রীকে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত করে দেবেন।

আরও একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিত, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অপরাপর নারী-পুরুষ থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখা, ভাবনার জগতকে কেবল নিজের স্বামী বা স্ত্রীর জন্যই উন্মুক্ত রাখা। তাকে ঘিরেই স্বপ্নের জগতটা চাষাবাদ করা। এতে দিনদিন সুখের রাজ্য বিস্তর হতে থাকবে। আর দুঃখরা সব লেজ গুটিয়ে পালাবে।

একটু সবর! এই তো আর ক’টা দিন…

এই মামা তোমার বিল নাও।’

শেষে এই বলে আদিব পকেট থেকে টাকা বের করতে গেলে হাসান নিষেধ করে বলল, ‘রাখ আদিব, অন্যদিন দিস।’

আদিব নাকে নাকে বলল, ‘বন্ধুকে কিছু দেওয়ার চেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে কিছু নেওয়ার মাঝে অধিক আনন্দ। ধন্যবাদ তোকে।’ এই বলে মানিব্যাগ পকেটে রেখে দিল।

হাসান বলল, ‘শোধবোধের নীতিটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না।’

‘দেখ হাসান, নিশ্চয়ই এখন আমরা আগের সেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নই! সো, আজকের চায়ের বদলে চা ছাড়া অন্যকিছু ডিমান্ড করলে কিন্তু জামায় রঙ মেখে দেব।’

‘আমি বুঝি বসে থাকব?’

‘কী করবি তুই?’

‘রঙ মাখা জামা সোজা ভাবির কাছে পাঠিয়ে দেব। সাথে চিরকুট লিখব- আজ এটা ধুয়ে না দিলে কাল নিজের স্বামীরটা সহ ধুতে হবে।’

‘তবে রে…!’

লেডি অফিসার

‘আমার কলিজাটা কোথায় রে…’

‘এই আমাকে আর কলিজা কলিজা করবা না। এটা কমন। আর কমন জিনিস আমার ভাল্লাগে না।’

‘আচ্ছা তাহলে থুক্কু। আমার পাকস্থলীটা কোথায় রে…’

‘এ্যা… কী বিচ্ছিরি ডাক! এইটা না। আনকমন ঠিক, তবে গর্জিয়াস হতে হবে।’

‘আচ্ছা আবার থুক্কু। কলিজার ইংলিশ ভার্সন- আমার লিভারটা কোথায় রে…!’

‘আরে মাবুদ! তুমি একটু রোমান্টিক আর কবে হইবা?’

‘আচ্ছা এবারও থুক্কু। আমার কিডনি দুইটা কোথায় রে…!’

অমনি খপ করে আদিবের কলার ধরে ফেলল স্নেহা। হ্যাঁচকা টানে মাথাটা কাছে এনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘দুইটা আসলো কোত্থেকে? আরেকটার নাম কী? বাড়ি কোথায়? কবে থেকে এই ভণ্ডামি? দেখি মোবাইল দেখি। নাম্বার কোনটা বলো। কিয়ামত ঘটাই দিমু আজ! সাক্ষাত কিয়ামত

এই বলে কলার ছেড়ে দিয়ে আদিবের পকেটে হাত দিল স্নেহা। আদিব গোবেচারা ভাব নিয়ে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে। আদিবের চোখেমুখে অসহায়ত্বের স্পষ্ট ছাপ। দু’হাতে স্নেহার হাতদু’টি চেপে ধরে অস্ফুটে বলল, ‘স্নেহা প্লিজ! কালই আমি রোমান্টিক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে রোমান্স শিখব। এবারের মত আমাকে ক্ষ্যামা দাও সোনা।’

‘চুপ! এক্কেবারে চুপ! কিডনি দুইটা কোথায় রে… ওলে লে লে লে! কী রোমান্টিক ডাক! আজ আরেকটা কিডনির রহস্য আমি বের করেই ছাড়ব।’

আদিবের পকেটটা ছিঁড়ে ফেলল বুঝি! তবুও ছাড়ছে না। কারণ ফোনটা ওর হাতে গেলে রহস্য উদ্ঘাটন হোক বা না হোক, ফোনটাকে উদ্ধার করতে আদিবের পনেরো গোষ্ঠী পর্যন্ত উদ্ধার হবে নির্ঘাত।

‘সোনা আমার! আমার কিডনি তো দুইটাই। বিশ্বাস না হয় হসপিটালে চলো।’

‘না! সোজা বাসায় যাব। নিজ হাতে কেটেকুটে নিজ চোখে দেখব আমি। আমাকে ঠকানোর চেষ্টা! আমার কিডনি দুইটা কোথায় রে… আ হা হা! চলো আগে বাসায়।’

আদিব কিছু না বলে চুপচাপ স্নেহার সাথে হাঁটতে লাগল। খুশিতে মাঝেমাঝে ফিক করে হেসে ফেলছে আদিব। স্নেহা কড়া গলায় বলল, ‘আমার রাগ দেখে আবার হাসি? খুব খুশি তাই না? দুইটা কিডনি নিয়ে মাস্তি করে বেজায় খুশি! হবাই তো হবা না! আমি কী আর সেই কপাল নিয়ে এসেছি…।’

গলা ধরে এলো স্নেহার। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট। ছলছল চোখ। অভিমানী মুখ।

আদিব দাঁড়িয়ে গেল। স্নেহার বাজুতে ধরে ওর চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে অপলক তাকিয়ে রইল। স্নেহা নিশ্চুপ। আদিব বলল, ‘হ্যাঁ, আমি খুশি। আমি আজ বেজায় খুশি! কারণ আমি জানি, একটি মেয়ে তার জীবন দিতে পারে। কিন্তু নিজের ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে পারে না। আর এজন্যই সে তার প্রিয় মানুষকে নিয়ে অজানা শঙ্কায় থাকে- এই বুঝি হারিয়ে গেল! জানো স্নেহা! এই মেয়েগুলো তার প্রিয় মানুষটিকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

এখন তুমিই বলো! এমন ভালোবাসা পেয়ে সেই ভাগ্যবান ছেলেটি যদি খুশিতে আত্মহারা হয়ে অজ্ঞাতেই একটু হেসে ফেলে, এটা কি অন্যায় হবে?’

স্নেহা কেন যেন কেঁদে ফেলল। চিকন ফ্রেমের চশমার ফাঁক গলিয়ে মায়াবী সে কাজল চোখের নোনতা জলে কয়েকমুহূর্তেই নেকাব ভিজে গেল। আদিব বলল, ‘এই পাগলী! বাসায় চলো। মাহির ওর দাদুর কাছে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। চলো তো, চলো চলো।’

আদিব এই বলে স্নেহার হাত ধরে গুনগুনিয়ে কালামুল্লাহর সুর ধরল। হাতদু’টি দোলাতে দোলাতে, তিলাওয়াতের মূর্ছনা ছড়াতে ছড়াতে দু’জন বাড়ির পথ ধরল।

অভিমান, সতর্কতা, শাসন এগুলো অনেকটা মরিচের মতো। একেবারে বেখবর হলে অর্থাৎ খাবারে মরিচ পরিমিত না হলে সেটা খাওয়া যায় না। পানসে লাগে। আবার অতিরিক্ত হয়ে গেলে সেটা আর খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না। ঝালে চোখমুখ লাল হয়ে আসে।

সঙ্গীর গতিপ্রকৃতির প্রতি একটু লক্ষ্য রাখা ভালো। কিন্তু এটা নিয়ে অতিরিক্ত কিছু না করা ভালো।

হার্ট যেমন মানুষের দেহ ও মনের কেন্দ্রবিন্দু, এর গতিপ্রকৃতে সামান্য হেরফের হলে স্ট্রোক করার আশঙ্কা থাকে। তেমনি সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘বিশ্বাস’। সম্পর্কে এই বিশ্বাসের সামান্য ত্রুটি থাকলে সেই সম্পর্কে পচন ধরে। আজ না হয় কাল, পচে যাবে। কোনো না কোনোভাবে কিংবা কারণে-অকারণে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। ফলাফল, নিশ্চিত বিচ্ছেদ। বাহ্যিক বিচ্ছেদ হয়তো নানান প্রতিকূলতায় বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু মনের বিচ্ছেদ ঠেকাবে কী দিয়ে?

আজ শুক্রবার। ওরা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। বাসার কাছেই চেম্বার। পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। স্নেহা অন্তঃসত্ত্বা। কিছুদিন হলো স্নেহার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। হাল্কা পেটে ব্যথা, অতিরিক্ত অস্থির লাগা, দুর্বল লাগা এইসব। তাই চেক-আপ করাতে গিয়েছিল। ইউরিন টেস্ট, ব্লাড টেস্ট, আলট্রা সহ সব রিপোর্ট আদিবের কাছে। কী হয়েছে না হয়েছে বা কন্ডিশন কী এসব কিছু স্নেহাকে জানায়নি এখনও। বলেছে সবকিছু স্বাভাবিক আছে। ধীরেধীরে কমে যাবে। স্নেহাও অতটা গুরুত্ব দেয়নি। রিপোর্টের কাগজগুলো হাতে নিয়ে দোলাতে দোলাতে আনমনা হয়ে হাঁটছে আদিব। বড় কোনো সমস্যা হয়নি তো? প্রশ্নটি আদিবের না। সে তো জানেই সবকিছু। প্রশ্নটি স্নেহার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘আচ্ছা কী হয়েছে আমার?’ জিজ্ঞেস না করে আর থাকতে পারল না স্নেহা।

‘কই কিছু না তো!’

‘না, কিছু একটা লুকাচ্ছো মনে হচ্ছে।’

‘লুকাব কেন বোকা!

‘তা জানি না, তবে লুকাচ্ছো।’

‘ওরকম কিছু না। টেনশনের কিছু নেই।’

‘যে রকমই হোক, আমাকে বললে কী হয়?’

‘না বললে কী হয়?’

স্নেহার চোখদুটো গোলগোলা হয়ে গেছে। খুব রাগ হলে ওর এরকম হয়। সেই সাথে কিছুক্ষণের জন্য চোখের পলক ফেলাও বন্ধ হয়ে যায়। আদিবের খুউব ভাল্লাগে এমন রাগান্বিত চোখ দেখতে। আদিব বলল, ‘ইশ, বাসায় যাওয়ার পরও এভাবে থাকবে কিছুক্ষণ। তোমার গোলগোলা চোখের সাথে লাল হয়ে আসা গালদুটোর কম্বিনেশন দেখতে খুউব ভাল্লাগে।’

‘কী!’

ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকানো প্রশ্ন স্নেহার। মুখোমুখি অবস্থান। কোমরে হাত। আদিব বলল, ‘এইরে, রাস্তাঘাটে মারধর কোরো না প্লিজ। বাসা পর্যন্ত যাই, এরপর বালিশ, কোলবালিশ সব হাতে ধরিয়ে দেব। যত ইচ্ছা মেরো তখন। প্লিজ!’

স্নেহা একবার আশপাশে চোখ ফিরিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কি না। নাহ, কয়েকটা পিচ্চিপাচ্চু ঝামেলা পাকালো। শেষে নিরূপায় হয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘বালিশ নেব না বাঁশ নেব সেটা বাসায় গিয়েই সিদ্ধান্ত নেব। চল আগে।’

আদিব কয়েক ঢোক বাতাস গিলে হাঁটতে শুরু করল। যাক বাবা। বাসা পর্যন্ত যাওয়া যাক আগে।

চলে এসেছে প্রায়। গার্ড গেইট খুলে দিলে স্নেহা সোজা রুমে ঢুকে গেল। আদিবও পেছন-পেছন গেল। গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে পড়ল। স্নেহা বেডরুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বেশ ক্লান্ত লাগছে। ফাজিলটা অনেকটা পথ হাঁটিয়ে এনেছে। মাইলখানেক তো হবেই। বিড়বিড় করে বলল স্নেহা। কিছুক্ষণ রেস্ট নিতেই মাহির চলে আসল।

আম্মু আম্মু! আম্মু ও আম্মু! ও আম্মু আম্মু!’ এভাবে এলোপাথাড়ি কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর স্নেহা লাফ দিয়ে উঠল।

‘জি আম্মু কী হয়েছে?’

‘আম্মু তুমি পঁচা হয়ে গেছ। আমাকে না নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে হি?’

‘আম্মু একটু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। এভাবে বলে না বাবা! এই তো আমি চলে এসেছি।’ এই বলে কোলে তুলে কয়েকটি পাপ্পা এঁটে দিল।

অমনি রিপোর্টের কথা মনে পড়ল। কী এসেছে রিপোর্টে? অস্থির হয়ে উঠল মুহূর্তেই। মাহিরকে বলল, ‘বাবা একটু খেলা করো এখানে, আমি এখনই আসছি কেমন?’

এই বলে ড্রয়িংরুমে গেল আদিবের কাছে। গিয়েই কোমরে হাত রেখে বলল- ‘অ্যাই! তুমি কি রিপোর্টে কী আসছে তা বলবা?’

আদিব কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে গিয়ে স্নেহার সামনে দাঁড়াল। অস্ফুটে বলল, ‘চোখ বন্ধ করো।’

‘সে কী! চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?’

‘করোই না! ভয় পেও না, বালিশ-বাঁশ কোনোটারই ভয় নেই। ‘

স্নেহা ফিক করে হেসে ফেলল। ‘আচ্ছা এই করলাম।’

স্নেহার ঠোঁট কাঁপছে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে। ফাজিলটা এতক্ষণ লাগাচ্ছে কেন! এই ভাবতে ভাবতেই আদিব বলল, ‘হুম, চোখ খোলো।’

স্নেহা চোখ খুলতেই দেখল, আদিব ছোট্ট একটি চিরকুট হাতে নিয়ে সামনে ধরে আছে। স্নেহা ইশারা করল, ‘এটা কী!

‘রিপোর্ট…।’

বেশ ভয়ে ভয়ে চিরকুটটি হাতে নিয়ে সেটা খুলল। তাতে লেখা- ‘আসোলামু আলাইকুম আম্মু! চিন্তা কোরো না, আমি শীঘ্রই আসছি! আর হুম, আমার আব্বুকে কিন্তু একদম মারবে না বলে দিচ্ছি।’

লেখাটা স্নেহার মাথার ঠিক দশ হাত ওপর দিয়ে গেল। ‘মানে কী? কে লিখেছে?’ বোকাবোকা স্বরে স্নেহার জিজ্ঞাসা।

আদিব স্নেহার পেটের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আমাদের নতুন লেডি অফিসার।’

জোয়ার-ভাটা

‘ব্যাটা নদীর পাড়ের মানুষ হয়েও জোয়ার-ভাটা বুঝিস না।’

‘মানে?’

‘মানে নদীতে যেমন জোয়ার নামে, আবার ভাটাও পড়ে। তাই বলে কি নদীর

সাথে আঁড়ি পাততে হবে? আর পাতলে ক্ষতি কার? প্রকৃতির নিয়মের সাথে বিদ্ৰোহ

করা সাজে না। তাহলে প্রকৃতিও বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তেমনি সাংসারিক জীবনেও

সুখের জোয়ার-ভাটা আসে। সুখের পারদ সর্বোচ্চ থেকে কখনও শূণ্যে নেমে আসে।

আবার হুট করে কখন যে উপরে উঠে যায়, এই লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। এটাই প্রকৃতি। এটাকে মেনে নিতে হয়।

আদিবের কথা শুনে হাসান আর কোনো প্রত্যুত্তর করল না। ক্ষানিক পর বলল,

‘কিন্তু তোর তো জোয়ার আর ফুরোয় না। ভাটার কপাল বুঝি একা আমারই।’

আদিব হেসে ফেলল। এটাকে অবশ্য ঠিক হাসি বলা যায় না। মুখটা নিচু করে, মাথাটা মৃদু দুলিয়ে, ঠোঁটদু’টো নাড়িয়ে কিছু একটা বলল মনে হচ্ছে।

‘কিছু বললি?’ হাসানের জিজ্ঞাসা।’নাহ। কী বলব।’

‘কী যেন বললি মনে হচ্ছে!’

‘শোন, দূর থেকে গোলাপের সৌন্দর্য দেখা যায়। এতে কাটার ঘাঁ খেতে হয় না। কিন্তু সৌরভে বিমোহিত হতে গেলে, কাছে এলে, ছুঁতে গেলে কাটা থেকে বেঁচে থাকা যায় না।

‘কী বুঝাতে চাইলি?’

‘না তেমন কিছু না। তবে এটুকু বলি, টুকিটাকি মনোমালিন্য আমাদের মাঝেও হয়। এবং কখনও কখনও সেটা বেশ সিরিয়াস রকমও হয়। কিন্তু এসব কাউকে বলি না বিধায় কেউ জানে না। যেটুকু বলি, কেবল পজিটিভটুকু। এতে করে পজিটিভিটি বাড়ে। এই যেমন তুই তো বলেই দিলি, আমার নাকি জোয়ার ফুরোয় না। আসলে যখন ফুরোয় তখন তোদেরকে জানানো হয় না। এটাই প্রকৃতি। এমন হবেই। হুজুর সা. এর স্ত্রীদের সাথেও সম্পর্কের জোয়ার-ভাটা এসেছিল। কিন্তু তারা সবসময় পজিটিভ ছিলেন। পরস্পরের পজিটিভিটি নিয়ে আলোচনা করতেন। নেগেটিভটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।’

‘তারমানে তোরাও ঝগড়াঝাটি করিস? বাহ! বাহ!’

‘শুধু কি তাই? একবার তো তোর ভাবি বলেই ফেলল, বাবার বাড়ি চলে যাবে।

বাচ্চাকে নিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়েও ফেলেছিল। কিন্তু…।’

‘কিন্তু কী?’ আদিবের রহস্য-ঘন কিন্তু’র উত্তর শুনতে হাসান উদগ্রীব হয়ে আছে। আদিব বলল, ‘কিন্তু যখন দেখলাম স্নেহা সত্যিই খুব সিরিয়াস। তখন আমি উঠে গিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলাম।’

হাসান হা করে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে।

‘এরপর?’

‘এরপর আর কী! তখম মনে হচ্ছিল যেন, দরজাটা ভেঙ্গে, সেটা দিয়ে আমাকে মেরে, আহত-টাহত করে, দাঁত দু’চারটা ফেলে এরপর বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি…!’

‘ভারি মুশকিল তো! এরপর?’

‘এরপর আর কী! কোনোরকম দাঁত-মুখ চেপে রেখে প্যাড-কলম নিয়ে বসে গেলাম।

‘এই অবস্থায় প্যাড-কলম দিয়ে কী হবে?’

‘শুধু ‘কী’ হবে না। যা হবার এই প্যাড-কলম দিয়েই হবে।’

‘মানে?’

‘মানে তখন প্যাড-কলম হাতে নিয়ে বসে কিছু একটা লিখে ফেললাম।’

‘কী সেটা?’

‘সেটা হলো অভিমান।

‘অভিমান মানে?’

‘যেটা পড়ে স্নেহা মানে তোর ভাবি বাপের বাড়ি যাবে তো দূরে থাক, আর কখনও এমন কথা মুখে আনবে না মর্মে ওয়াদা করেছিল। সেইসাথে কাজল ধোয়া চোখের পানিতে বেচারি ভুত সেজে উঠেছিল।’

আদিবের কথা শুনে হাসান ইশে পড়ে গেল। ইশে বলতে ইশে আরকি। মানে

চিপায়। মাইনকা চিপা না কী যেন বলে সেখানে আরকি। বেচারা অবাক হবে? খুশি হবে? না ব্যথিত হবে? ঠিক বুঝে উঠতে না পারার এই সিচুয়েশনটাকে কী বলবেন আপনারা? আচ্ছা যাক সে কথা।

আগ্রহ আর ধরে রাখতে না পেরে শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই বসল, সেই ‘অভিমান’ কী ছিল রে আদিব?’

আদিব কিছু না বলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে এরমধ্যে ভাঁজ করে রাখা ছোট্টি একটি কাগজ বের করল। হাসান আগ্রহভরে কাগজটির দিকে তাকিয়ে

থাকল। কিছুক্ষণ পর আদিব হাসানের হাতে কাগজটি দিয়ে বলল, ‘এই দেখ। পড়ে দেখ সেই ‘অভিমান’। নজরুলের ‘অভিশাপ’- এর মেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই জমজ বোনের নাম এই ‘অভিমান’।

হাসান কাগজটি হাতে নিয়ে একপলক চোখ বুলিয়ে আবৃত্তি করে করে পড়ছিল…

অভিমান’

নিশিত রাতে একলা যখন আমায় মনে পড়বে, খুঁজবে আমায় হন্যে হয়ে নথটি তোমার দুলবে, হুশ হারিয়ে এদেশ-ওদেশ খুঁজবে আমায় খুঁজবে- বেলা হারিয়ে বুঝবে।

বুকটি চিরে উথলে উঠবে
গুপ্ত বোবা কান্না,
দেখবে কেউ এই ভয়েতে
ফাটবে হৃদের পান্না,
খুঁজবে আমায় খুঁজবে,
শেষ বিকেলে বুঝবে।

নীলিমা যখন রাত-বিরাতে অঝোর ধারায় কাঁদবে, রুক্ষ জমিন সিক্ত হবে মরুর জীবন কাটবে, রাত-দুপুরেই কপাট খুলে খুঁজবে আমায় খুঁজবে- হারালেই তবে বুঝবে।

অনুভবে আবছা ছোঁয়া
পেয়ে আতকে উঠবে,
চমকে গিয়ে হতাশ হয়ে
ডুকরে শুধু কাঁদবে,
খুঁজবে আমায় খুঁজবে,
ঘোর কাটলে বুঝবে।

বিষণ্নতার তিক্ত বিষে উন্মাদ হয়ে ভাববে, নামটি আমার তোমার বুকে বিনবিনিয়ে বাঁজবে, ভগ্ন দেহ অসারতায় ভুগবে সদা ভুগবে- সত্যি তখন বুঝবে।

অবহেলার তীরের ঘা’তে
মূর্ছা যাবার প্রান্তে,
কলজে চিরে রক্তস্রোতে
ডুবালে মোর প্রাণকে,
খুঁজবে আমায় খুঁজবে
ভুলটা সেদিন বুঝবে।

কবিতাটি পড়া শেষ করতেই হাসানের চোখ ছলছল।

‘কী রে! তোর আবার কী হলো?’ হাসানের কাঁধে হাত রেখে আদিবের জিজ্ঞাসা।

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে হাসান বলল, ‘নাহ, আমার কিছু হয়নি। ভাবছি।’

‘কী?’

‘ভাবছি, এমন করে লিখলে ভাবি তোকে ছাড়া অন্যকিছু ভাববে কীভাবে? তোর জন্য পাগল না হয়ে থাকবে কী করে?’

‘তবুও তো মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক ডিসটার্ব দেয় রে নরে…ন। নেটওয়ার্ক আনতে উল্টেপাল্টে, থাবরে-টাবরে আরও কতভাবেই না চেষ্টা করা হয়। তবে একটি জিনিস কি জানিস?’

‘কী?’

‘মেয়েরা এই রাগ ভাঙ্গানোর ব্যাপারটি খুব ইনজয় করে। এজন্য কারণে- অকারণেই গাল ফুলিয়ে অপ্প…! এবার তার রাগ ভাঙ্গাতে নিজেকে আলাদিন বানাও। আর যেখান থেকে যেভাবে পারো প্রয়োজনে দৈত্য দিয়ে হলেও তার

অভিমান ভাঙ্গাও। এসবে অবশ্য আমিও বেশ আনন্দ পাই। সারাক্ষণ ভালোবাসা- ভালোবাসা ভাল্লাগে না। বেশি মিঠা খেলে পেটে কৃমি হয় জানিস তো? আম্মু বলতো আরকি! হা হা হা…!’

হাসানও একটু হেসে ফেলল। আদিব পুনরায় বলল, ‘এজন্য আম্মুর কথা মতো সেই ছোট্ট থেকেই টক-ঝাল-মিষ্টির কম্বিনেশন পছন্দ করি। সেই পছন্দের ছাপ আমার সাংসারিক জীবনেও। এটাই ভাল্লাগে।’

‘তুই পারিসও বটে।’ হাসান বলল।

আদিব বলল, ‘স্ত্রীর জন্য এটুকু না হয় করলামই। নিজের ইগোকে বগলদাবা করে একটু ছলাকলা না হয় করলামই। বেশরমের মতো স্ত্রীর পিছে পিছে একটু ঘুরঘুর না হয় করলামই। ক্ষতি কী? এতে বরং নেকি আছে, নেকি। বখাটেরা গার্লফ্রেন্ড-এর পেছনে ঘুরে। তার মন জয় করতে কত কিছুই না করে। আহা! আমি না হয় আমার স্ত্রীর পেছনেই ঘুরলাম! তার মনটাকে চুরি করতে একটু এদিক-ওদিক না হয় করলাম! মন্দ কী!

বিয়ে করলে তার সবকিছুর ওপর অধিকার আসে এটা ঠিক, কিন্তু তার মনটাকে আলাদা করে জয় করে নিতে হয়। বিয়ে করলেই একটি মেয়ের মন পাওয়া যায় না। এটা সাধনার বস্তু। একটু চেষ্টা করে একবার যদি স্ত্রীর মনটা কেড়ে নিতে পারিস, বেচারি আজীবনের জন্য তোর অংশ হয়ে যাবে। শারীরিক সম্পর্কের তৃপ্তি যদি দুই আনা হয়, তাহলে এই মন কেড়ে নেওয়ার তৃপ্তি হলো বাকি চৌদ্দ আনা। ভালোবাসার স্বাদ তখন পূর্ণতা পায়।

যা হোক, আজ আসি রে। বউটাকে নিয়ে আজ বাইরে বেরুনোর ডেট। মাসে একদিন বাচ্চাকে সহ ওকে নিয়ে বাইরে থেকে বেরিয়ে আসি। ফুচকা, চটপটি, চকলেট যা চায় কলিজা পর্যন্ত খাইয়ে আনি। এরপর বাসায় এসে সারামাস ওর কলিজা হয়ে থাকি। নাহ, আর বলা যাবে নাহ। যাই যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এই বলে আদিব উঠে চলে গেল। আর হাসান এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখতে লাগল। অতঃপর ‘অভিমান’ কবিতাটি পুনরায় পড়তে লাগল …

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *