পথে নানা রকম বিপদের আশঙ্কা আছে বলে সুরপতি একটি বড় বণিকদলের সঙ্গ নিয়েছিল। সুরপতির সঙ্গে তার তরুণী পত্নী সুভদ্রা আর চার বছরের শিশুপুত্র ধ্রুবকুমার।
অনেক দস্যুও বণিকের ছদ্মবেশে পথে পথে ঘোরে, সেই জন্য ভয় ছিল সুরপতির। কিন্তু এই দলটি সম্পর্কে সে-সন্দেহের অবকাশ নেই। এই দলে রয়েছে প্রায় আঠাশ-তিরিশ জন লোক এবং অনেকগুলি ঘোড়া ও খচ্চরের পিঠ-বোঝাই মালপত্র। দলটির সামনে ও পিছনে রয়েছে অস্ত্রধারী প্রহরী। অনেক অনুরোধ করে সুরপতি এই দলের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য প্রহরীদের খরচ বাবদ তাকে দিতে হয়েছে দশটি সিক্কা টাকা।
সুরপতির সঙ্গে ধন-সম্পদ বিশেষ কিছুই নেই। সে বিষণ্ণ মনে দেশ ত্যাগ করছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ভীষণ কালাজ্বরে তার পরিবারের আর সকলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার বৃদ্ধা মা, বড় ভাই তার স্ত্রী-পুত্রাদি, সুরপতির চেয়েও বয়সে ছোট এক কাকা পর পর ওই অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল এক মাসের মধ্যে। সুরপতির শোক করারও সময় পায়নি।
বিপদ শুধু এক দিক দিয়ে আসে না। এই সময়েই আবার বাজারে আগুন লাগে। দু’পুরুষ ধরে সুরপতিদের অন্নের সংস্থান হত যে বস্ত্রের দোকানটি থেকে, সেটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুন লাগার খবর পেয়ে সুরপতি বাড়িতে তিনটি মুমূর্ষ আত্মীয়কে রেখে ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু তখন বন্দরের সারি সারি দোকান দাউ দাউ করে জ্বলছে। নিয়তিতে টানা পতঙ্গের মতো সুরপতি ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিল, প্রতিবেশিরা তাকে জোর করে ধরে রাখে। তখন মাথা চাপড়ে হায় হায় করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। সকলেই বলাবলি করছিল, সপ্তগ্রাম বন্দরে অলক্ষ্মীর দৃষ্টি লেগেছে।
ভগ্নহৃদয় সুরপতি তারপর বিষয় সম্পত্তির যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সব বিক্রি করে দেশত্যাগ করেছে। বিষয়-সম্পত্তির দামও বিশেষ কিছু পায়নি, কারণ দেশজোড়া মন্দা চলছে, খরিদ্দার কেউ নেই। ভাগ্যান্বেষণে সুরপতি চলেছে দেশান্তরে।
কিন্তু সুরপতির বড় সম্পদ তার স্ত্রী। এমন রূপসী রমণী সচরাচর চোখে পড়ে না। সুভদ্রা বেশ দীর্ঘাঙ্গী, তার মাথার চুল পিঠ ছাপিয়ে নেমে আসে, বড় বড় অক্ষিপল্লব, অতি কোমল পেলব মুখ। সমস্ত শরীরখানাই যেন লাবণ্যমাখা। রাজেন্দ্রাণী হলেই তাকে মানাত, কিন্তু সে বাঁধা পড়েছে সুরপতির মতো এক ভাগ্যহীনের সঙ্গে।
সুভদ্রা শুধু রূপসীই নয়, তার মনটিও অতি কোমল। পৃথিবীতে যে কত পাপ, কত অন্যায় আছে, সে যেন তার খবরই রাখে না। সে সব কিছুই সুন্দর দেখে। সুভদ্রার জন্ম অতি গরিব বাড়িতে, অথচ সে অর্থসম্পদের কোনও মূল্যই বোঝেনি এ পর্যন্ত। সুরপতির যখন অবস্থা সচ্ছল ছিল, তখন সুভদ্রা দু’হাতে বিলিয়েছে। কোনও দীন-দুঃখী ফেরেনি তাদের বাড়ি থেকে। আবার এখন যে সুরপতি এমন দরিদ্র হয়ে গেছে, তাতেও তার কোনও রকম মালিন্য নেই। সব কিছুই সে হাসিমুখে সহ্য করতে পারে। ছেলেটিও হয়েছে ঠিক মায়ের মতো।
সুরপতির ভয় তার স্ত্রীকে নিয়ে। সুন্দরী রমণীকে নিয়ে পথচলার বিপদ অনেক। তাছাড়া সুরপতির আর একটা দুর্বলতা আছে। স্ত্রীকে সে এতই ভালবাসে যে, অপর কোনও পুরুষ তার স্ত্রীর দিকে একটু তাকালেই সে সহ্য করতে পারে না। ক্রোধে তার শরীর জ্বলে যায়। যদিও সুভদ্রা সবসময় অবগুণ্ঠনে তার মুখ ঢেকে রাখে, তবু তারও অনিন্দ্যকান্তির দিকে মানুষের চোখ যাবেই।
বণিকদলের মধ্যে একটি তরুণ সুভদ্রার পুত্রকে আদর করার ছলে প্রায়ই সুভদ্রার কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করে। দুদিন ধরেই সুরপতি লক্ষ্য করছে। যুবকটিকে তার পছন্দ হয় না। যুবকটির নাম ধনরাজ। সে খুব সুপুরুষ না হলেও স্বভাবটি অতি উচ্ছল। সে বেশি কথা বলে, বেশি হাসে। তার চোখের তারা দুটি চঞ্চল, কারুর দিকে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারে না। এই প্রকারের মানুষ সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
তবে একটি আশ্বাসের কথা এই যে, বণিকদলের দলপতি পূৰ্ণানন্দর ওপর ভরসা করা যায়। বিশাল তার চেহারা, মেজাজটিও খুব কড়া, কিন্তু মানুষটি ধার্মিক প্রকৃতির, দলের মধ্যে তিনি কঠোর শাসনের প্রবর্তন করে রেখেছেন। সুরপতির বিশ্বাস আছে যে, ধনরাজ যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে পূর্ণানন্দের কাছে নালিশ করলে সুবিচার পাওয়া যাবে।
সারা দিন ধরে পথ চলা, তারপর সন্ধ্যার পর বিশ্রাম।
এখন গ্রীষ্মকাল, তাই রাতের বাইরেই শুয়ে থাকা যায়। প্রান্তরের মধ্যে সকলেই কাছাকাছি শুয়ে থাকে, রক্ষীরা পালা করে প্রহরা দেয়। চারদিকে আগুন জ্বালা থাকে।
বণিকরা যাবে অনেক দূর। এক মাস, দেড় মাসের পথ পায়ে হেঁটে তারা চলে যায় এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। আবার কয়েক মাস পর ফেরে। সুরপতিরা কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। এর মধ্যেই তারা পার হয়ে এসেছে কয়েকটি নগর, কিন্তু সব জায়গাতেই দেখেছে কালা জ্বরের উপদ্রব। মানুষের মধ্যে হাহাকার। বঙ্গদেশে এখন সম্পূর্ণ অরাজকতা চলছে, নবাবি শাসন অতি শিখিল, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারেরা, যাদের অর্থ সম্পদ এসেছে ডাকাতি থেকে এর মধ্যে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরপার থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ টুপিওয়ালারা, যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। তার ওপর দুঃস্বপ্নের মতো যখন-তখন আসে বর্গির হাঙ্গামা, হ্রস্বতায় ঘোড়ায় চেপে দুর্ধর্ষ মারাঠারা প্রবল ঝড়ের মতো এসে এক-একটা জনপদ লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। বঙ্গের কোথাও এখন আর শান্তি নেই, অনেকেই এ রাজ্য ছেড়ে পালাচ্ছে।
সুরপতি এমন কোনও নগরে বসতি নিতে চায়, যেখানে আছে সুখ। আছে সমৃদ্ধির সম্ভাবনা। যেখানে বিদেশি নতুন মানুষও পেতে পারে কোনও রকম জীবিকা অর্জনের সুযোগ। জানে না, সে-রকম নগর কোনও দেশে আছে কি না!
এমন দিনের পর দিন পায়ে হাঁটার অভ্যেস নেই সুরপতির। তবু সে পুরুষ মানুষ। সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমার তো কখনওই হাঁটেনি। ধ্রুবকুমারকে পালা করে কোলে নিতে হয়। অবশ্য একটা সুবিধে এই, এই সার্থবাহের সকলেই ধ্রুবকুমারকে খুব ভালবেসে ফেলেছে। সকলেই তাকে নিয়ে কৌতুক করে, স্বেচ্ছায় তাকে কোলে নিয়ে যায়। সুভদ্রার কোমল পা দু’খানি নিশ্চয়ই এতখানি পথ চলায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, কিন্তু একটি বারও সেটুশব্দটি করেনা। বরং রাত্রিবেলা সে সুরপতির পায়ে তেল মালিশ করে দেয়।
একবারই মাত্র, কাল দুপুরে সুভদ্রা উঃ শব্দ করে বসে পড়েছিল পথের মাঝখানে। তার পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছে। কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে ধনরাজই আগে ছুটে গিয়েছিল। সুরপতি রুক্ষভাবে বলেছিল, আপনি সরুন! আমি দেখছি!
সুভদ্রা কিছুতেই পা দেখাবে না। স্বামীকে তার পা ছুঁতেও দেবে না নিশ্চয়ই সে অতিরিক্ত ব্যথা পেয়েছে, কারণ চোখে টল টল করছে জল। সুরপতি জেদ করতে লাগল কাটাটা দেখবার জন্য। সুভদ্রা পা ঢেকে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত ধনরাজই বাতি জ্বেলে তাতে একটা বড় আকারের চাবি নিয়ে গরম করে সুরপতিকে বলল, আপনি এটা ঠেসে ধরতে বলুন ক্ষতস্থানে।
সেই ভাবেই কাটাটা উঠল বটে কিন্তু সুরপতি খুব একটা খুশি হল না তাতে। সে ধনরাজের সাহায্য নিতে চায়নি। সেই সুযোগে পাষণ্ডটা সুভদ্রার অনেক কাছাকাছি এসেছিল এবং তার মুখ দেখার চেষ্টা করেছিল।
এই এক জ্বালা। মুখে কিছু বলা যায় না, সুরপতি ধনরাজকে কিছুতেই বলতে পাবে না, তুমি আমার পত্নীর দিকে তাকাচ্ছ কেন হে? সেটা হাস্যকর শোনাবে। অথচ ভেতবে ধিকি ধিকি করে জ্বলে রাগ। ছোঁকরাটিও অতি নির্লজ্জ, সুরপতি আকারে-ইঙ্গিতে তার অসূয়ার কথা জানায়, তবু ধনরাজ দূরে সরে যায় না। বরং বার বার গায়ে পড়ে উপকার করতে আসে।
আজ সকাল থেকে চলার গতি বৃদ্ধি করতে হয়েছে পূর্ণানন্দের আদেশে। আকাশে মেঘ জমেছে। দু’এক দিনের মধ্যেই বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টির সময় পথ চলা দায় হবে। রাত্রিবেলা আশ্রয় নিতে হবে কোনও চটিতে। তার খরচ আছে। তাছাড়া এক চটিতে এতগুলি মানুষের সংস্থান হবে কি না তা-ও একটা কথা।
দ্রুত পথ চলার আরও একটি কারণ আছে। এখানেই কুখ্যাত ডাকাত সর্দার বুধনাথের দলের খুব উপবছিল এক সময়। হিংস্র পশুর চেয়েও নৃশংস এই বুধনাথ। যদিও শোনা গেছে যে, টুপিওয়ালা সাদা চামড়ার সাহেবদের সঙ্গে নাকি বুধনাথের দলের খুব একচোট লড়াইহয়ে গেছে কিছুদিন আগে, তাতে বুধনাথের দল পর্যদস্ত হয়ে গেছে তবু তার চ্যালা-চামুণ্ডারা কেউ থাকতে পারে। দিনের বেলাতেই জায়গাটা পার হয়ে যাওয়া ভাল।
এর মধ্যেই মাঝে মাঝে দু’একটি যাত্রীদলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার মধ্যে একটি দল যে দস্যুদের, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাদের ধরন-ধারণ, তাদের চোখের চাহনি সবই বক্র। দলের মধ্যে সকলেই সমর্থ জোয়ান, একটিও শিশু বা বৃদ্ধ নেই, সেটাও স্বাভাবিক মনে হয় না। মাঝে মাঝে দু’একটি লোক হঠাৎ পথের ধার থেকে উঠে এসে এই যাত্রীদলের সঙ্গে যোগ দিতে চায়। এগুলিও সন্দেহজনক। এরা সাধারণতদস্যুদের গুপ্তচরহয়। পূর্ণানন্দকারুকেই স্থান দেননি। তিনি মানুষ চেনেন। অন্য যে দলটিকে ডাকাত বলে সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে তিনিই সকলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই দলটির মতলব নিশ্চিত ভাল ছিল না। কিন্তু এদের এত বড় দল ও সশস্ত্র রক্ষী দেখে তারা নিরীহ সেজে পাশ কাটিয়ে গেছে।
দুপুরের মধ্যে ওরা বল্লারপুরের সেই কুখ্যাত মোড়টি পার হয়ে গেল। জায়গাটা খাঁ-খাঁ করছে, এ-দিক ওদিক ছড়ানো রয়েছে কিছু শুকনো হাড়। ওগুলি ঘোড়ার হাড় বলেই মনে হয়। তাহলে এখানে নিশ্চিত কোনও যুদ্ধ হয়েছিল। টুপিওয়ালা সাদা চামড়ারা কোনও লড়াইতে চট করেহারেনা। ওরাও দল বেঁধে ব্যবসা করতে আসে, কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। টুপিওয়ালাদের দেখে সাধারণ মানুষরা ভয় পায় না, যেমন ভয় পায় নবাবের সৈন্যদের দেখে।
বল্লারপুর ছোট্ট একটি জনপদ। একটি চটি ও কিছু দোকান আছে। এখানকার মানুষজনকে দেখলে মনে হয়, তাদের মধ্যে সেরকম কোনও আতঙ্ক নেই। পথশ্রমে ক্লান্ত সুরপতির একবার মনে হল, আর বেশি দূর এগিয়ে কাজ নেই। এখানেই বসতি নিলে হয়। কাছেই একটি বেশ বড় আকারের নদী আছে। নদী-প্রান্তবর্তী জনপদের সমৃদ্ধি ক্রমেই বাড়ে।
পরামর্শের জন্য সুরপতি প্রস্তাবটা উত্থাপন করল পূর্ণানন্দের কাছে। পূৰ্ণানন্দ এককথায় উড়িয়ে দিলেন। তিনি বহুদর্শী লোক, জীবনে বহুনগর জনপদ দেখেছেন।
তিনি বললেন, সুরপতি এখানে গৃহনির্মাণ করে থাকতে পারে বটে, কিন্তু এখানে জীবিকার্জনের কোনও আশা নাই। এত ছোট জায়গায় বাইরের কোনও নতুন লোক এসে সুবিধে করতে পারে না। প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়লে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা খড়্গহস্ত হবে। তারা নবাগতকে ছলে-বলে-কৌশলে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। আবার হয়তো সুরপতির বিপণিতে আগুন লাগবে। নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে হয় কোনও বড় জায়গায়। ছোট জায়গায় সংকীর্ণতা বেশি। তাছাড়া এতটুকু জায়গায় তিনটি কালী মন্দির, অর্থাৎ এখানকার লোকেরা ঘোর শাক্ত, সুরপতির মতো বৈষ্ণব এখানে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না।
সুরপতি পূর্ণানন্দের কথাগুলো চিতা করে দেখল। এই পরামর্শ তার যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হল। ভাল করে ভেবেচিন্তেই স্থান নির্বাচন করতে হবে। বড় জায়গাতেই নতুন লোকের পক্ষে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সুবিধে। আর কিছুদূর গেলেই অন্য রাজ্য, সেখানে বৃহৎ কোনও নগর থাকতে পারে।
বল্লারপুরে আহারাদি সেরে এবং কিছু রসদ সংগ্রহ করে দলটি আবার বেরিয়ে পড়েছিল। আবার পথ চলা।
এখন সন্ধে হয়ে এসেছে। এবার কোথাও রাত্রির মতো থাকতে হবে। কাছাকাছি কোনও সুবিধাজনক স্থান পাওয়া যাচ্ছে না। আগাগোড়া রুক্ষ মাঠ। একটা কোনও জলাশয় থাকা দরকার। এত লোকের হাত-মুখ প্রক্ষালনের জন্য কম জল লাগে না।
ধনরাজ এসে সুরপতির পাশাপাশি হাঁটছে। অদুরে ছেলেকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে সুভদ্রা। সুভদ্রা হাঁটছে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিন্তু সেদিকে সুরপতির নজর পড়লেই সে আবার সামলে নিচ্ছে নিজেকে। সে কিছুতেই স্বীকার করবে না যে, তার পায়ে কাঁটা ফোঁটার ব্যথা আছে। একটু আগে সুরপতি ছেলেকে নিজের কাছে নিতে চেয়েছিল, সুভদ্রা রাজি হয়নি। সুভদ্রা একবারও ক্লান্তির কোনও চিহ্ন দেখায় না।
ধনরাজ সুরপতিকে বলল, আপনি নতুন জায়গায় বসতি নিতে চাইছেন, আপনাকে আমি একটি উপযুক্ত জায়গার সন্ধান দিতে পারি।
সুরপতি বলল, কোথায়?
ধনরাজ অতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আপনি দারুকেশ্বর চলুন। সেখানকার জল অতি মিষ্টি, দূর দূর থেকে লোকে দারুকেশরের জল পান করতে আসে। সেখানে জমি অতি উর্বরা, ফসলে কখনও কীট লাগে না। মানুষজন অতি শিষ্ট। দারুকেশ্বরে বিখ্যাত পণ্ডিতের টোল আছে, আপনার পুত্রটি সেখানে বিদ্যাশিক্ষা করতে পারবে।
দারুকেশ্বরে বাণিজ্যের হাল কীরকম?
দারুকেশ্বরে মস্ত বড় হাট বসে। গঞ্জের হাট, নৌকোয় করে সব বণিক আসে অন্য রাজ্য থেকে। দারুকেশ্বরের রেশমি কাপড়ের খুব সুনাম আছে। ইংরাজ বণিকরাও ওই কাপড় বেশি দাম দিয়ে কেনে।
কাপড়ের কথা শুনে সুরপতি একটু বেশি আগ্রহী হল। কয়েক পুরুষ ধরে তাদের কাপড়েরই ব্যবসা। সে নিজেও ওইটাই ভাল বোঝে।
সে জিজ্ঞেস করল, ওখানকার তাঁতিরা কি দাদন নিয়ে খাটে? নাকি নিজেদেরই মূলধন?
অনেক তাতি আছে, কে কীরকম ভাবে খাটে, তা আমি ঠিক বলতে পারি না।
কত দূর দারুকেশর?
আর দু’দিনের মাত্র পথ। আমার নিজের বাড়ি সেখানে। আপনি যদি গৃহ নির্মাণ করতে চান, আমি নিজে সব ব্যবস্থা করে দেব।
সুরপতি একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। দারুকেশ্বর জায়গাটার কথা শুনে তার বেশ পছন্দই হয়েগিয়েছিল। কিন্তু সেখানে এই যুবকের বাড়ি। সুরপতির আগ্রহ কমে গেল। সাহায্য করার ছুতোয় ধনরাজ সেখানে সুরপতির বাড়িতে প্রায়ই আনাগেনা করবে, আর সুভদ্রার দিকে লোভীর চোখে তাকাবে। তাঁতীদের দাদন দেবার জন্য সুরপতিকে মাঝে মাঝে যেতে হবে গ্রামান্তরে, তখন সুভদ্রা বাড়িতে একা থাকবে। সেই সুযোগ নিয়ে আসবে এই রূপচোর।
সুরপতি উদাস ভাবে বলল, দেখি।
ধনরাজ আরও সবিস্তারে দারুকেশরের গুণপনা বর্ণনা করতে লাগল। এমন জায়গা যেন দুনিয়ায় নেই। সুরপতিকে সে সেখানে নিয়ে গিয়ে বসাবেই। সুরপতি অবশ্য ইতিমধ্যেই মনেমনে ঠিক করে নিয়েছে যে, আর যেখানেই যাক দারুকেশ্বরে সে কখনওই যাবে না।
ধ্রুবকুমার তার মায়ের কোল থেকে নেমে পড়েছে। এবার ধনরাজ দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। তারপর খেলাচ্ছলে তাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল আবার। ধ্রুবকুমার খল খল করে হেসে উঠল। এর মধ্যেই ধ্রুবকুমারের সঙ্গে ধনরাজের বেশভাব জমে গেছে। সে ধনরাজের কটিবন্ধে ঝোলানো তলোয়ারটা নিজের হাতে নিতে চায়।
সন্ধে গাঢ় হয়ে এসেছে। কাছেই একটি অরণ্য। সাধারণত অরণ্যের মধ্যে এরা রাত্রিবাস করতে চায় না। কিন্তু এই অরণ্যটি তেমন ঘন নয়। দূরে দূরে গাছ, মাঝখানে পরিষ্কার তকতকেভূমি। এইসব জঙ্গলে সাধারণত হিংস্র প্রাণী থাকেনা। তার চেয়েও বড় কথা, এই জঙ্গলের মধ্যে একটি স্বচ্ছ জলের ঝরনা আছে। এই জল পান করা যায় নিশ্চিন্তে। সব দেখে শুনে পূর্ণানন্দ এখানেই রাত্রিবাসের নির্দেশ দিলেন।
সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারকে নিয়ে সুরপতি একটা বড় পিপুলগাছের নিচে আশ্রয় নিল। কাঁধের বোঝ নামিয়ে রাখল এক পাশে। ঘোড়াও খচ্চরের পিঠে বণিকদের যে মালপত্র রয়েছে তার মধ্যেও সুরপতি নিজেদের দুটি পুটলি চাপিয়ে দিয়েছে। এখন সেগুলি নিয়ে এল।
দিনেরবেলা গুরুভোজন হয়েছে, রাত্রে বিশেষ কিছু না খেলেও চলে। সঙ্গে কিছু ক্ষীরের লাড়ু আছে। তাছাড়া এক্ষুনি এক জায়গায় বেশ বড় করে আগুন জ্বালানো হবে, সেখান থেকে যে-যার ইচ্ছে মতো অন্নব্যঞ্জন তৈরি করে নিতে পারে। দলের মধ্যে আর কোনও নারীও নেই, শিশুও নেই। বণিকরা এই সময় রোজই ধ্রুবকুমারকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব আদর-যত্ন করে। বোধহয় তাদেরও বাড়িতে ছেড়ে আসা শিশুপুত্রের কথা মনে পড়ে।
সুভদ্রা ঘোমটাটা এই সময় একটু তুলল। পরিশ্রমে তার ফরসা মুখখানি এখন রক্তাভ। তবু সে সুরপতির দিকে চেয়ে হাসল।
সুরপতি বলল, আজ সপ্তম দিন পার হল। আর তো হাঁটা যায় না। এবার সামনে যেনগরী পাব, সেখানেই থেকে যাব।
সুভদ্রা বলল, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
সুরপতি ক্লান্তভাবে হেসে বলল, না। আমার কষ্টের জন্য নয়, আমি ভাবছি তোমাদের কথা। তোমার পায়ের সেই ক্ষত স্থানটা দেখি, যেখানে সেই কাটা ফুটেছিল?
সুভদ্রা তাড়াতাড়ি পা ঢেকে বলল, সেখানে আর ব্যথা বিষ নেই।
তবু আমি দেখব।
দেখার কিছু নেই। আপনার মুখ ধোওয়ার জুন্য জল এনে দেব?
সে সব পরে হবে। আগে তোমার পা দেখাও আমাকে। এখানে কাছাকাছি কেউ নেই, এখানেও কি তোমার লজ্জা?
সুভদ্রা কিছুতেই দেখাতে চায় না, কিন্তু সুরপতি দারুণ জোরজুরি করতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত সুভদ্রা তার পায়ের পাতা স্বামীকে দেখাতে বাধ্য হল। তা-ও দূর থেকে।
সে-জায়গাটা দেখে শিউরে উঠল সুরপতি। পা-টা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। খানিকটা মাংস খুবলে গেছে। এই রকম পা নিয়ে হেঁটে আসছে সুভদ্রা, অথচ একবারও মুখ ফুটে কিছু বলবে না!
সুরপতি বলল, তুমি কী সুভদ্রা? তুমি কি মানুষ?
সুভদ্রা মৃদু গলায় বল, আপনি বেশি চিন্তিত হচ্ছেন। আমার তেমন ব্যথা বোধ হয় না।
সুরপতি চিন্তিত হয়ে পড়ল। বণিকদলের মধ্যে বৈদ্য কেউ নেই। এ-রকম অবস্থা নিয়ে সুভদ্রার এক পা-ও চলা উচিত নয়। অথচ এই জঙ্গলে তারা একা একা থাকবেই-বা কী করে? থেকেও লাভ নেই, কোনও জনপদে নিয়ে গিয়ে সুভদ্রার চিকিৎসা করানোর দরকার।
কাল যে করেই হোক সুভদ্রাকে একটা অশ্বপৃষ্ঠে চাপাতে হবে। যাতে যত অর্থব্যয় হয় হোক। সুভদ্রা অশ্বপৃষ্ঠে উঠতে চাইবে না, দারুণ আপত্তি করবে–সুরপতি জানে। কিন্তু দরকার হলে তাকে জোর করেও তুলে দিতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরপতি বলল, সুভদ্রা, আমারই ভাগ্যদোষে তুমি আর ধ্রুবকুমার এত কষ্ট পাচ্ছ। হা নিয়তি, তুমি আমাদের আর কোথায় নিয়ে যাবে?
সুভদ্রা ব্যাকুল হয়ে বলল, ওকথা বলবেন না, ওকথা বলবেন না! আমাদের তো কোনও কষ্ট নেই। বরং কী সুন্দর এই পদযাত্রা! কত নতুন নতুন দেশ দেখছি! সারা জীবনে এক জায়গায় থাকা তো কূপের ব্যাঙের মতো, তার চেয়ে কত সুন্দর এই জীবন!
সুরপতি বলল, তুমি জানো না সুভদ্রা, তোমার গায়ে যদি একটি আঁচড় লাগে, তবে তা আমারও বুকে বাজে। তোমার পায়ের ওই অবস্থা, অথচ আমি তা জানতেই পারিনি। আবার আমার চিন্তা হচ্ছে ধ্রুবকুমারের জন্য। ওইটুকু শিশু, তার কি দিনের পর দিন এই ধকল সহ্য হয়! এই রকম উন্মুক্ত আকাশের নিচে ঘুমোনো! যদি তার কোনও রকম গুরুতব পীড়া হয়। সে যে আমার চোখের মণি!
সুভদ্রা স্বামীর পায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখবেন আব দু’এক দিনের মধ্যেই নিশ্চয়ই আমরা কোনও পছন্দ মতো স্থান পৌঁছে যাব।
তাই যেন হয়।
সুরপতির মনে পড়ল, আসার পথে একটু আগেই সে কয়েকটা জবাফুলের গাছ দেখেছিল। জবাগাছের পাতার রসে ক্ষতস্থানের ব্যথা কমে।
সে লাফিয়ে উঠে বলল, রও, আমি আসছি!
পরিষ্কার জ্যোৎস্না উঠেছে। অরণ্যটিকে এখন মায়াময় মনে হয়। মানুষের কলগুঞ্জন আর ভারবাহী পশুগুলির জোরালো নিশ্বাসের শব্দ মিলে একটা ঐকতান তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনও হিংস্র জন্তুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি। ভয়ের কিছু নেই।
চাঁদের আলোয় জবাগাছগুলি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না। বেশ কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে হাতের তালুতে পিষে রস করতে করতে সুরপতি আবার ফিরে আসতে লাগল।
পিপুলগাছটির কাছাকাছি এসে দেখল ধনরাজ এগিয়ে যাচ্ছে সুভদ্রার দিকে। সুভদ্রাকে একা পেয়েছে বলেই ওই তস্করটা ওই দিকে ঝুঁকেছে। ক্রোধে সুরপতির আপাদমস্তক জ্বলে গেল। কাল প্রথমেই যে নগর পাবে, সেখানেই সে এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করবে। ধনরাজকে সে আর সহ্য করতে পারছে না।
ধনরাজের কোলে শিশু ধ্রুবকুমার। সুরপতিকে দেখে সে বলল, ঘুমিয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। আমাদের কাছেও পেট ভরে খেয়ে নিয়েছে, সে-জন্য চিন্তা করবেন না।
ধনরাজ ধ্রুবকুমারকে সুরপতির কাছে না দিয়ে নামিয়ে দিল সুভদ্রার কোলে। সুভদ্রা ইতিমধ্যে ঘোমটা দিতে ভুলে গেছে। চাঁদের আলোয় মুখখানি এখন প্রস্ফুটিত কমলের মতো দেখায়। সেই মুখের দিকে ধনরাজ সতৃষ্ণ ভাবে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। তারপর আর কোনও কথা না বলে চলে গেল।
ধ্রুবকুমারকে কোলে নামিয়ে দেওয়ার ছলে পাপিষ্ঠটা নিশ্চয়ই সুভদ্রাকে ছুঁয়েছে। রাগে সুরপতি ফুঁসতে লাগল। সে এমনিতে শান্ত নিরীহ ধরনের মানুষ, লোকের সঙ্গে কলহ করতে তার প্রবৃত্তি হয় না। কিন্তু এখন ইচ্ছে হল, ছুটে গিয়ে ধনরাজের টুঁটি চেপে ধরে।
সুরপতি অতি কষ্টে রাগ দমন করল। তারপর মাটিতে বসে সুভদ্রার সমস্ত আপত্তি অগ্রাহ্য করে, প্রায় বলপ্রয়োগ করেই তার পায়ে থেঁতো করে লাগিয়ে দিল সেই জবাপাতা। তারপর একটা পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড নিয়ে বেঁধে দিল সেই পায়ে।
সুভদ্রার চোখে টল টল করছে জল। তার নির্মল মুখখানিতে ব্যথার চিহ্নমাত্র নেই। বরং চিকচিক করছে সুখ। ওই অশ্রুও সুখের।
ধ্রুবকুমারকে ভাল করে শুইয়ে দিয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রীতে খুব সংক্ষেপে আহার করে নিল। চিড়ে, ক্ষীর এবং কলা তাদের সঙ্গেই থাকে। তা দিয়ে বেশ ভালভাবেই ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর ওরা মুখোমুখি বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিজেরাও শুয়ে পড়ল পুত্রকে মাঝখানে রেখে। অদূরে যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, তার আভা এসে পড়েছে ওদের মুখে। গাছের ঘন ডালপালার ফাঁকে একটু একটু আকাশ দেখা যায় মাথার ওপরে। মেঘ সরে গিয়ে জ্যোৎস্না উঠেছে বলে সবাই নিশ্চিন্ত।
খানিকক্ষণ দু’জনে মৃদু গলায় কথা বলে তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। স্বামী ও স্ত্রী– দু’জনেরই একটা করে হাত মধ্যবর্তী সন্তানের গায়ে। দুদিক থেকে তারা ধ্রুবকুমারকে আগলে রেখেছে। মেঘভাঙা চন্দ্রালোক এসে পড়েছে তাদের মুখে।
সুরপতির ঘুম ভেঙে গেল কিছু একটা বিশ্রী শব্দে। ভারবাহী পশুগুলি হঠাৎ চ্যাঁচাতে শুরু করেছে। সে কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখল, কারা যেন ঘোড়া আর খচ্চরগুলোর দড়ি খুলে দিয়ে দম্ দম্ করে তাদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। সেগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে এ-দিক ও-দিক। তার পরই বণিকদের মধ্যে আর্তনাদ পড়ে গেল।
সত্যি যে ডাকাত এসেছে তা বুঝতে একটুখানি সময় লাগল সুরপতির। কিন্তু অস্ত্রের ঝন ঝন আর মৃত্যুকাতর চিৎকার শুনে ঘোর ভাঙতে দেরি হল না। সে জায়গা বেছে নিয়েছিল মূল বণিকদলের থেকে একটু দূরে। সে দেখল, প্রায় তিরিশ জন দস্যু সব দিক থেকে তাদের ঘিরে ধরেছে। প্রহরীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে তাদের, কিন্তু প্রহরীরা এক এক করে প্রাণ দিতে লাগল, বণিকরা চিৎকার করতে করতে পালাচ্ছে।
সুভদ্রাও জেগে উঠেছে। সুরপতি লাফিয়ে উঠে তার হাত ধরে টেনে বলল, পালাও। আমাদের এখনও দেখতে পায়নি।
মুদ্রাভরা পেটিকাটা সব সময় তার কোমরে বাঁধা থাকে, তাই সে অন্য কোনও জিনিসপত্র নেবার চেষ্টা করল না। ঘুমন্ত প্রবকুমারকে বুকে জড়িয়ে সে ছুটল।
বেশি দূর যেতে পারল না। সুভদ্রা বেশি জোর ছুটতে পারেনি। পারবেই-বা কী করে! ইতিমধ্যে তিন-চার জন দস্যু সুভদ্রাকে ঘিরে ফেলেছে। সুরপতি পেছনে তাকিয়ে শিউরে উঠে দেখল, একটি অতিকায় ভীম চেহারার দস্যু সুভদ্রার বুকের আঁচল ধরে টান দিয়েছে।
ধ্রুবকুমারকে সেইখানেই মাটিতে নামিয়ে রেখে সুরপতি আবার ফিরে এল। পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল, ছেড়ে দাও, ওর গায়ে হাত দেবে না।
নানা চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে কেউ সুরপতির কথা শুনতে পেল না ঠিক মতো।
সর্দার বুধনাথ সিং-এর চেহারা প্রায় দৈত্যের মতো। যেমন সে লম্বা, তেমনি বিরাট তার মুখ। মুখ ভরতি দাড়ি গোঁফ, সেই জঙ্গলের মধ্যে জুল জুল করে তার দুটি চোখ। অতিরিক্ত ভোগবিলাসের জন্য তার সারা গায়ে এখন চর্বি থল থল করছে। সে নিজে ধরে আছে সুভদ্রার হাত, অন্য দুজন দস্যু সুভদ্রার বসন ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। সুভদ্রা চিৎকার করছে না, শুধু ছটফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে। সে ক্ষমতা তার নেই।
শয়তান! সুরপতি ছুটে গিয়ে বুধনাথের দাড়ি চেপে ধরল এক হাতে, অন্য হাতে ওর মুখে মারল একটা ঘুষি।
ছেড়ে দে, ছেড়ে দে ওকে!
বুধনাথ একঝটকা দিয়ে সুরপতিকে ঠেলে দিতে গেল। কিন্তু সুরপতি শক্ত করে তার দাড়ি চেপে ধরে আছে। তখন এক জন দস্যু লোহার ডাণ্ডা দিয়ে সুরপতির সেই হাতের ওপর মারল। সুরপতির হাত অবশ হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ বুধনাথ সুরপতির কোমর ধরে শূন্যে তুলে খেলনার মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।
সুরপতি গিয়ে পড়ল একটা পাথরের ওপর। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, তার মাথা ফেটে গেছে। রক্ত বেরুচ্ছে গল গল করে। কিন্তু সে এখন কিছুতেই জ্ঞান হারাতে চায় না।
বুধনাথ চেঁচিয়ে উঠল, এই আওরতকে আমার চাই। এক জন বলল, সর্দার, একে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব? বুধনাথ বলল, না না, আমি এক আওরাৎকে দু’বার চাই না। তোরা সরে যা, সরে যা! আর এক জন বলল, সর্দার, তোমার হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে দিও!
বুধনাথ হা-হা করে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দ সুরপতির কানে বাজল কামান গর্জনের মতো। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল।
বুধনাথ ততক্ষণে সুভদ্রার অর্ধেক শরীর নগ্ন করে ফেলেছে। সুরপতির বিস্ফারিত চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি ফেলল সুভদ্রা। তারপর এই প্রথম সে তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বিষ দাও! আমাকে বিষ দাও। এখনই।
সুভদ্রার গলায় একটা দারুণ আর্তি ছিল। সে স্বামীর কাছে অনুরোধ করছে, কোনওক্রমে তাকে বাঁচাতে। অন্তত বিষ দিয়ে বাঁচাতে।
সুরপতি দুর্বল বা কাপুরুষ নয়। কিন্তু সে নিরস্ত্র। এমনকী বিষও সঙ্গে নেই! একবার সে ভাবল ওদের বলবে, আমার যা টাকা-পয়সা আছে, সব নিয়ে তোমবা আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দাও। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল, এ প্রস্তাব দিয়ে কোনও লাভ নেই। তাহলে তারা টাকা-পয়সা তো নেবেই, তবু সুভদ্রাকে ছাড়বেনা এবং তাকেও হত্যা করবে।
এই সময় কোথা থেকে তীরের মতো ছুঠে এল এক জন। তার হাতে খোলা তলোয়ার। সুরপতি দেখল, সেই লোকটা ধনরাজ।
ছেড়ে দে, ওকে ছেড়ে দে, কুকুর!
এই কথা বলতে বলতে সে বুধনাথের দিকে তলোয়ারের কোপ চালাল। ঠিকমতো লাগলে সেই কোপেই বুধনাথের মুও খসে পড়ত ধড় থেকে। কিন্তু কোপটা লাগল বুধনাথের বাম বাহুতে। বাহুতে কবজ আঁটা আছে বলে তার তেমন লাগল না। বুধনাথ একটা পশুর মতো গর্জন করে নিজের তলোয়ার নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ধনরাজের দিকে। শুরু হল দু’জনের যুদ্ধ। সুরপতি আশা হল ধনরাজ ঠিক জিতবে। সে-ই রক্ষা করবে সুভদ্রার সম্মান।
কিন্তু দস্যুদলের কোনও নীতিবোধ নেই। ওদের দুজনের যুদ্ধ চলার মধ্যেই আর এক জন দস্যু পেছন থেকে আক্রমণ করল ধনরাজকে। তার তলোয়ারের এক আঘাতে ধনরাজের মুণ্ডু শরীর থেকে ঝুলে পড়ল অনেকখানি। এক ঝলক রক্ত এসে লাগল সুরপতির গায়ে। তার বুকের মধ্যে হাহাকার উঠল। একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে প্রাণ দিল ধনরাজ। তার শরীরটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে গেল।
সুরপতি ধনরাজের তলোয়ারটা কুড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে দেখল, সেখানে অন্তত সাত-আট জন দস্য। সবাই সশস্ত্র। তারা সুরপতিকে লক্ষ্য করছে না, কিন্তু সুরপতি একবার রুখে দাঁড়ালেই তারা চারদিক থেকে ঘিরে তাকে কুচি কুচি করে কাটবে। সুরপতি এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। মানুষের বেঁচে থাকার টান বড় প্রবল।
বুধনাথ ততক্ষণে আবার সুভদ্রাকে জাপটে ধরে শুইয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।
বাবা! বাবা!
সুরপতি আবার চমকে উঠল। ধ্রুবকুমারের গলা। ধ্রুবকুমারকে সে একটু দুরে শুইয়ে রেখে এসেছিল। সে জেগে উঠেছে, গোলমাল শুনে এই দিকেই ছুটে আসছে।
সুরপতি সেই আহত অবস্থাতেও লাফিয়ে উঠল। সুভদ্রার দিকে আর না তাকিয়ে সে ছুটল উলটো দিকে। তার ছেলেকে বাঁচাতেই হবে। শুধু দস্যুদের হাত থেকেই নয়। ধ্রুবকুমার যেন কোন ক্রমেই তার মায়ের এই অপমানের দৃশ্য না দেখে। মাঝপথে ছেলেকে ছোঁ মেরে তুলে বুকে জড়িয়ে সুরপতি অন্ধের মতো ছুটল। মিলিয়ে গেল দূর বনের মধ্যে।