১
নৌকায় উঠার মুখে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল, শেফার চোখ থেকে চশমা খুলে পানিতে পড়ে গেল। শেফার মাইয়োপিয়া, চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখে না। সে একবার ভাবল, ‘মা আমার চশমা’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে সবার পিলে চমকে দেবে। সে তা করল না, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এল। চশমা পানিতে পড়ে যাবার ব্যাপারটা এখন কাউকে না-জানানোই ভালো। বাবা হুট করে রেগে যাবেন। সবার সামনে বকা শুরু করবেন। দেলোয়ার ভাইকে এই ঠাণ্ডার মধ্যে পানিতে নামতে হবে। কী দরকার? জায়গাটা শেফা চিনে রেখেছে। একসময় চুপিচুপি এসে পানি থেকে তুলে নিলেই হবে। চশমাটা যেখানে পড়েছে সেখানে হাঁটু পানিও হবে না। আর যদি হয় অসুবিধা হবে না। শেফা সাঁতার জানে। এই বছরই মাদার’স ক্লাব থেকে সাঁতার শিখেছে।
শেফা খুব সাবধানে পা ফেলে এগুচ্ছে। বেশি হাঁটাহাটি করা যাবে না। শেষে কোনোকিছুতে পা বেধে হুড়মুড় করে পানিতে পড়ে যাবে। চশমা ছাড়া সব কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বাবাকে দেখাচ্ছে খড়ের গাদার মতো। হলুদ কোটটা পরায় এমন লাগছে। খড়ের গাদার মাথায় লাল রঙ-করা হাঁড়ি বসানো। লাল হাঁড়িটা হচ্ছে বাবার মাথার লাল ক্যাপ।
শেফা তার বড় বোন মীরার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। এক বসায় নৌকা প্রায় কাত হয়ে গেল। মীরা তার দিকে তাকাল সরু চোখে। মীরার মাথায় নীল স্কার্ফ। শীতের জন্যে কান ঢেকে স্কার্ফ পরেছে। স্কার্ফের জন্যেই বোধ হয় তাকে দেখাচ্ছে বিদেশিনী মেয়েদের মতো। যেন ইউরোপের কোনো মেয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে। বাংলাদেশের নোংরা থেকে নিজেকে আলাদা রাখার জন্যে শরীর শক্ত করে এক কোনায় বসে আছে। মীরার হাতে একটা বই। শেফা বাজি রেখে বলতে পারে যে নৌকা ছাড়ামাত্র মীরা আপা বই পড়তে শুরু করবে এবং অবশ্যই অবশ্যই বাবার কাছে বকা খাবে। বাবার কাছ থেকে বকা না-খেয়ে আজ পর্যন্ত তারা কোনো বেড়ানো শেষ করেনি। বেশির ভাগ সময় সে বকা খায়। আজ নিশ্চিতভাবে মীরা আপার টার্ম।
শেফা খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, আপা তোর হাতে কী বই?
মীরা জবাব দিল না।
শেফা আবারো বলল, বইটার নাম কী?
মীরা বিরক্ত গলায় বলল, সবসময় ঝামেলা করিস কেন? বইয়ের নাম দিয়ে করবি কী? তুই কি কখনো বই পড়িস? আর শোন্ গায়ের উপর এসে বসছিস কেন? নৌকায় কি আর জায়গা নেই যে আমার কোলে এসে বসতে হবে?
শেফা সরে বসল।
মীরা বলল, তুই অন্য কোথাও গিয়ে বস তো। তোকে অসহ্য লাগছে।
‘কেন অসহ্য লাগছে?’
‘জানি না কেন লাগছে, প্লিজ তুই আমার পাশে বসবি না।’
শেফা উঠে দাঁড়াল। নৌকার অন্য মাথায় যাওয়া যায়। অনেকটা জায়গা হাঁটতে হবে। নৌকার ভেতরটা কেমন খোপ খোপ। নিশ্চয়ই ধাক্কা টাক্কা খাবে। শেফার বুক সামান্য ধুকধুক করছে। তার চোখে চশমা নেই বাবা ধরে ফেলবে নাতো? ধরতে না-পারার সম্ভাবনাই বেশি। বাবা হয়তো তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাবেই না। শেফার ধারণা কেউ তার মুখের দিকে ভালো করে তাকায় না। একবার তার নাকের ডগায় ফোঁড়ার মতো হল। নাক ফুলে হাতির শুঁড়ের মতো হয়ে গেল, তাও বাসার কেউ ধরতে পারল না। শুধু স্কুলের অঙ্ক মিস বলল, শেফা তোর নাকে কী হয়েছে? মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়, তোর দেখি নাক ফুলে পেপে গাছ হয়ে গেছে।
শেফার বাবা সুপ্রিম কোর্টের জাজ আজহার সাহেব মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার কাছে চলে আয়। বাবার পাশে বসতে শেফার মোটেই ইচ্ছা করছে না। বাবার পাশে বসা মানেই জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শোনা। বেড়াতে এসেও জ্ঞানীকথা শোনার কোনো মানে হয় না। কোনো উপায় নেই। শেফার মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে জ্ঞানীকথা শোনার জন্যে।
শেফা বাবার পাশে বসল। মেয়ের পিঠে হাত রেখে খুশি-খুশি গলায় বললেন, কিরে শেফা একসাইটিং লাগছে না? এ রিয়েল জার্নি বাই কান্ট্রি বোট। আগে রচনা লিখেছিস মুখস্থ করে। এখন লিখতে পারবি অভিজ্ঞতা থেকে।
শেফার মোটেই একসাইটিং লাগছে না। বাবাকে খুশি করার জন্যে বলল, দারুণ লাগছে বাবা।
আজহার সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোরা তো গ্রামে আসতেই চাস না। বলতে গেলে তোদের জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। এখন মনে হচ্ছেনা, না এলে বোকামি হত?
‘হুঁ মনে হচ্ছে। না এলে খুব বোকামি হত।’
‘গ্রামের এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা আছে? কোনো তুলনা নেই। ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড। কীরকম ফ্রেশ বাতাস দেখেছিস? ওজন ভর্তি বাতাস। ঢাকায় এ-রকম বাতাস কোথায় পাবি? ঢাকার বাতাস মানেই কাৰ্বন—মনক্সাইড। ফুসফুসের দফারফা। জখম হওয়া ফুসফুস ঠিক করার জন্যে আমাদের মাঝে মাঝে গ্রামে আসা দরকার।’
‘ঠিক বলেছ বাবা।’
ঠিক এই মুহূর্তে তার চশমাটার জন্যে শেফার খুব আফসোস হচ্ছে। এখন একটা মজার দৃশ্য হচ্ছে। চশমা না-থাকার কারণে শেফা দৃশ্যটা ভাসা-ভাসা দেখতে পাচ্ছে। ভালোমতো দেখতে পারলে খুব মজা হত। তার মা মনোয়ারা নৌকায় উঠছেন। তাঁকে সাহায্য করছেন দেলোয়ার ভাই। মনে হচ্ছে সার্কাসের কোনো খেলা হচ্ছে। দড়ির উপর হাঁটার রোমাঞ্চকর খেলা। নদীর পার থেকে নৌকার গলুই পর্যন্ত দুটা বাঁশ ফেলা আছে, বাঁশে পা দিয়ে নৌকায় উঠতে হয়। দেলোয়ার ভাই দুহাতে মার ডান হাতটা ধরে টানছেন। মনে হচ্ছে বালির বস্তা টেনে আনছেন। আর মা এমনভাবে দুলছেন যে মনে হচ্ছে তাঁর খুব ইচ্ছা নদীতে পড়ে যাওয়া। দেলোয়ার ভাই থাকতে মা একা-একা নদীতে পড়ে যাবে তা হবে না। দেলোয়ার ভাইও অতি অবশ্যই মা’র সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেবে। তাতে মজা ভালোই হবে। শুধু শেফার চশমা যেখানে পরেছে, দুজন মিলে সেখানে না-পড়লেই হল।
মনোয়ারা বেগম নৌকায় উঠে তৃপ্তির হাসি হাসছেন। তিনি আজ শাড়ি পরেননি। মীরার একটা কামিজ পরেছেন। টকটকে লাল রঙের কামিজটা আঁট হয়ে গায়ে বসে গেছে। শুরুতে তাঁর একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল এখন আর লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। শাড়ি পরে নৌকায় উঠানামা খুব ঝামেলা। তিনি বড় মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন, আদুরে গলায় বললেন, ‘বুঝলি মীরা, আরেকটু হলে পড়েই যেতাম। দেলোয়ার গাধাটা দেখছে আমার ব্যালান্সে সমস্যা হচ্ছে তার পরেও হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। মানুষ এমন গাধাও হয়।
মীরা কিছু বলল না। মনোয়ারা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, চা খাবি? ফ্লাস্কে চা নিয়ে এসেছি।
মীরা বলল, না।
‘জিজ্ঞেস কর তো তোর বাবা খাবে কি না।’
মীরা বিরক্তমুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস কর। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন?
‘তুই জিজ্ঞেস করলে অসুবিধা কী?’
‘আমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করব কেন? এমনতো না তোমার ল্যারেনজাইটিস হয়েছে, কথা বলা ডাক্তারের নিষেধ।’
মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বললেন, রেগে যাচ্ছিস কেন?
মীরা বলল, মা তুমি দয়া করে আমার পাশে বসবে না। তুমি বোধহয় জানো না যে তোমার গা থেকে কাদামাটি টাইপ একটা গন্ধ আসে, আমার মাথা ধরে যায়।
মনোয়ারা আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মীরা বলল, ঠিক আছে বসে পড়েছ যখন বোস। শুধু সারাক্ষণ ‘চা খাবি? কলা খাবি? সন্দেশ খাবি?’ এইসব করতে পারবে না। আমি কিছুই খাব না। সকাল থেকে আমার বমি আসছে। আমি যে-কোনো মুহূর্তে বমি করব। এইজন্যেই আমার পাশে বসতে নিষেধ করছি।
‘শরীর খারাপ?’
মীরা শীতল গলায় বলল, শরীর ঠিক আছে। মা শোনো, ‘শরীর খারাপ নাকি, জ্বর নাকি, কাশি হচ্ছে নাকি?’ এইসবও জিজ্ঞেস করতে পারবে না।
মনোয়ারা দুঃখিত গলায় বললেন, আচ্ছা যা তুই একা-একা বস। আমি চলে যাচ্ছি।
মুখে বললেও তিনি চলে গেলেন না। কোথাও বেড়াতে গেলে বড়মেয়ের সঙ্গে থাকতে তাঁর খুব ভালো লাগে। দুজনে মিলে গুটুর গুটুর করে কথা বলেন। মেজাজ ভালো থাকলে মীরা চমৎকার গল্প করে। আজ বোধহয় মেয়েটার মেজাজ ভালো নেই। মনোয়ারা ধরে নিলেন নৌকা ছাড়লেই মীরার মেজাজ ভালো হবে।
আজহার সাহেব বললেন, সবাই ঠিকঠাক বসেছ তো। ছাতা নেয়া হয়েছে? নদীর উপর রোদ বেশি লাগে। পানিতে রোদটা রিফ্লেক্ট করে এইজন্যে বেশি লাগে। দেলোয়ার কোথায়? দেলোয়ার?
দেলোয়ার ভীত গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, চাচাজি আমি এইখানে।
দেলোয়ার আজহার সাহেবের গ্রামের বাড়ির কেয়ার টেকার। সে তার শহরবাসী হাইকোর্টের জাজ সাহেব চাচাকে যমের মতো ভয় পায়। তার প্রধান চেষ্টা আজহার সাহেবের চোখের আড়ালে থাকা। সেটা মোটেই সম্ভব হয় না। আজহার সাহেব প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার দেলোয়ারকে খুঁজেন। অকারণেই খুঁজেন।
‘দেলোয়ার।’
‘জ্বি চাচাজি।’
‘ছাতা নিয়েছ?’
দেলোয়ারের মুখ শুকিয়ে গেল। ছাতার কথা তার একবারও মনে হয়নি।
‘কী ব্যাপার ছাতা নাওনি?’
‘জ্বি না। একদৌড় দিয়া নিয়া আসি? যাব আর আসব।’
আজহার সাহেব রাগী-রাগী গলায় বললেন, ছাতার কথা মনে করা উচিত ছিল। যাই হোক নৌকা ছাড়তে বল। ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভুল করবে না।
মনোয়ারা বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাই না। ছায়া ছায়া ভাব। তুই চা খাবি?
‘না।’
‘কচুরীপানার ফুল কত সুন্দর দেখেছিস। ফুলের মধ্যে ময়ুরের পাখার মতো ডিজাইন।’
মীরা কিছু না বলে বই খুলল। মা’র আহ্লাদী তার অসহ্য লাগছে। মীরার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা খুকি-খুকি ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠবে, ওমা কী সুন্দর একটা বক। মীরা দেখ দেখ বক দেখ। তোর বাবাকে বল্ বকটার একটা ছবি তুলতে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে বকের ছবি তোলার প্রস্তুতি নেবেন। তখন দেখা যাবে সব এসেছে ক্যামেরা আসে নি। বাবা শুরু করবেন তার বিখ্যাত চিৎকার, ক্যামেরা কেন কেনা হয়েছে? শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জন্যে? প্রয়োজনের সময় যে জিনিসটা পাওয়া যাবে না তার দরকার কী? ফেলে দিলেই হয়। বাড়িতে পৌছে প্রথম যে কাজটি করবে তা হল ক্যামেরা পুকুরে ফেলবে।
নৌকা চলতে শুরু করেছে। নদীর নাম সোহাগী। বেশ বড় নদী তবে শীতকাল বলে পানি কম। আজহারউদ্দিনের চোখেমুখে তৃপ্তির ভঙ্গি। যা দেখছেন তাতেই মুগ্ধ হচ্ছেন। তাঁর হাতে ফোকাস ফ্রি ক্যামেরা। কিছুক্ষণ পরপরই তিনি ক্যামেরা চোখের সামনে ধরছেন তবে ছবি তুলছেন না।
শেফা খুবই অস্বস্তি বোধ করছে কারণ তার বাথরুম পেয়েছে। এই কথাটা কাউকে বলা যাবে না। বাবা শোনামাত্র চেঁচিয়ে বলবেন, ঘর থেকে বেরুবার সময় বাথরুম করে বের হতে পারনি? ক্লাস টেনে উঠেছ, তুমিতো আর বাচ্চা মেয়ে না। এখন এই নদীর মধ্যে বাথরুম করবে কীভাবে। যতসব ন্যুইসেন্স।
শেফা খুবই চিন্তিত বোধ করছে। একবার বাথরুম পেয়ে গেলে খুব সমস্যা। মাথার মধ্যে শুধু বাথরুম ঘুরতে থাকে আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। নদীর পাড়ে সুন্দর একটা মাটির ঘর দেখা গেল। ঘর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে অবাক হয়ে নৌকা দেখছে। শেফার মনে হল মেয়েটা কত সুখী। সে নৌকায় নেই। ঘরে আছে। বাথরুম পেলেই বাথরুম করতে পারবে। শেফা বলল, বাবা আমরা নৌকায় কতক্ষণ থাকব?
আজহার সাহেব বললেন, অনেকক্ষণ থাকবরে মা। সাধ মিটিয়ে নৌকা ভ্রমণ। তোর ভালো লাগছে না?
শেফা শুকনো গলায় বলল, ভালো লাগছে।
‘তোরা শহরবাসী হয়ে গাছপালা ভুলে গেছিস। বল্ দেখি ঐটা কী গাছ?’
‘জানি না বাবা।’
‘মীরা তুই বলতে পারবি?’
‘না।’
‘মনোয়ারা তুমি পারবে? ‘
‘শ্যাওরা গাছ।’
‘রাইট— এটাই হল বিখ্যাত শ্যাওরা গাছ।’
শেফা বলল, বিখ্যাত কেন?
আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, বিখ্যাত কারণ গ্রামের মানুষদের ধারণা শ্যাওরা গাছে ভূত থাকে। এই গাছগুলি লোকালয়ে হয়ও না। জংলামতো জায়গা ছাড়া শ্যাওরা গাছ হয় না। গাছের পাতাগুলিও খুব ঘন। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। চাঁদের আলো যখন পড়ে তখন পাতার কারণে মনে হয় ভূত-প্রেত বসে আছে।
শেফা উঠে দাঁড়াল। বাবার জ্ঞানীকথা শুরু হয়ে গেছে। তার অসহ্য লাগছে। বাথরুমের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্ঞানীকথা শুনতে ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ নৌকায় থাকতে হবে শুনে তার বাথরুম আরো বেশি লাগছে। কিছু একটা করা দরকার। চুপিচুপি মাকে বলা যায় না। না, মাকে বললে হবে না। বলতে হবে আপাকে। আপা একটা ব্যবস্থা করবেই।
আজহারউদ্দিন বললেন, ‘শেফা যাচ্ছিস কোথায়?’
‘মা-র কাছে যাচ্ছি বাবা।’
‘মা-র কাছে যেতে হবে না। চুপ করে বস তো। চলন্ত নৌকায় হাঁটাহাঁটি করবি না। ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে যাবি।’
শেফা বসে পড়ল। আজহারউদ্দিন ডাকলেন, মীরা 1
মীরা চমকে তাকাল। বাবা ডাকছেন। ডাকার ভঙ্গি ভালো না। খুবই গম্ভীর স্বর। নিশ্চয়ই বাবা কোনো কারণে রেগেছেন। এখন রাগের প্রকাশটা হবে। খুব বিশ্রীভাবে হবে বলাই বাহুল্য।
‘কী পড়ছিস?’
‘বই।’
‘বই যে পড়ছিস সেতো দেখতেই পাচ্ছি। গল্পের বই?’
‘না, জোকস-এর একটা বই।’
‘এত ঝামেলা করে নৌকা নিয়ে বের হয়েছি কি জোকস-এর বই পড়ার জন্যে?’
‘সরি।’
‘আমি সকাল থেকে লক্ষ্য করছি তুই মুখ ভোঁতা করে বসে আছিস। কারণটা কী?
মীরা কিছু বলার আগেই মনোয়ারা শঙ্কিত গলায় বললেন, ওর শরীর ভালো না। জ্বর।
‘জ্বরটর কিছু না, ও ইচ্ছা করে এ-রকম করছে। আমি গত দুদিন ধরে ওকে লক্ষ্য করছি। এ-রকম একটা ভাব করছে যেন নির্বাসনে এসেছে। হোয়াই? বেড়াতে যেতে হলে নেপালে যেতে হবে? সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে? নিজের দেশে বেড়ানো যায় না? মীরা, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকা আমার দিকে।’
মীরা বাবার দিকে তাকাল।
‘জোকস-এর বইটা নদীতে ফেলে দে। ফেল বললাম। দ্যাটস এন অর্ডার।’
মীরা বইটা নদীতে ফেলে দিল। বই টুপ করে ডুবল না। ভেসে রইল। দেলোয়ার দুঃখিত চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে আছে। আজহারউদ্দিন গম্ভীর গলায় ডাকলেন, দেলোয়ার।
দেলোয়ার ভীত গলায় বলল, জ্বি চাচাজী।
‘নৌকা ঘুরাতে বল্। আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়িতে ফিরে যাই। মেয়েরা জোকের বই পড়ুক।’
দেলোয়ারকে কিছু বলতে হল না। মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে ফেলল। শেফা খুব খুশি। সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভালো দিক আছে। বাবা আপার ওপর রাগ করল বলেই তারা এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারছে, নয়তো দুপুর পর্যন্ত বাথরুম চেপে নদীতে নদীতে ঘুরতে হত। শেফা মনে মনে বলল, আপা থ্যাংকস। আপার জন্যে শেফার বেশ মন খারাপ লাগছে। এতগুলি মানুষের সামনে বেচারি বকা খেল।
মনোয়ারা পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে আজহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, এই তুমি চা খাবে? ফ্লাস্কে করে চা এনেছিলাম।
আজহার সাহেব বললেন, না।
মনোয়ারা মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবি? খেয়ে দেখ ঠাণ্ডার মধ্যে চা খেতে ভালো লাগবে। কাপে ঢেলে দেই?
মীরা বলল, মা তুমি একটু সরে বসো তো, আমি বমি করব।
বলতে বলতেই সে হড় হড় করে বমি করল। মনোয়ারা মেয়েকে ধরতে এগিয়ে এলেন। মীরা বলল, মা প্লিজ কাছে এসো না।
শেফার এখন বাবার জন্যে খারাপ লাগছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আপাকে বমি করতে দেখে বাবার মন খারাপ হয়েছে। অকারণে অসুস্থ মেয়েকে এতগুলি মানুষের সামনে বকা দেয়া হল। শেফার ধারণা বাবার খুব ইচ্ছা করছে বড় মেয়ের কাছে যেতে। চক্ষুলজ্জার জন্যে পারছেন না। শেফা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, আহা চক্ষুলজ্জার মতো অতি সামান্য কারণে মানুষ কত ভালো কাজ করতে পারে না। সে নিজেও পারে না। একবার স্কুল ছুটির পর শেফা গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিল। শাহবাগের মোড়ে সিগন্যালে গাড়ি থামল। বুড়ো এক ভিক্ষুক তার জানালার সামনে মাথা নিচু করে খুবই মিষ্টি গলায় বলল, সুন্দর আফা, একটা টেকা দিবেন? চা খামু। তার কথা বলার ধরন, তার হাসি, শেফার এত ভালো লাগল, কিন্তু চক্ষুলজ্জার জন্যে টাকাটা বের করতে পারল না। উল্টা কঠিন গলায় বলল, যাও মাফ কর। ‘মাফ কর’ বললে যে-কোনো ভিখিরি রাগ করে। এই বুড়ো রাগ না করে ঠিক আগের মতো মিষ্টি করে হাসল। তারপরই চলে গেল অন্য গাড়ির কাছে। শেফার খুবই ইচ্ছা করছিল ভিখিরিটাকে ডাক দিয়ে আনে। ড্রাইভার চাচাকে প্রায় বলেই ফেলছিল, ওকে ডাক দিন তো। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলা হল না। এই বুড়ার কথা শেফার মাঝে মাঝেই মনে হয়।
.
মীরা তার ঘরে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু সে জেগে আছে। যেই তাকে দেখবে সেই ভাববে সে গভীর ঘুমে। ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় মীরা খুব ভালো পারে। মনোয়ারা এসে সাবধানে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। ঘুমন্ত মানুষের গায়ে চাদর টানলে তারা হঠাৎ যেমন কিছু নড়াচড়া করে সেও তাই করল। এবং নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হল। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। ঘরে হারিকেন দেয়া হয়েছে। হারিকেনের আলোয় ঘরটা আরো অন্ধকার লাগছে। এই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আছে। পল্লী বিদ্যুত। পল্লী বিদ্যুতের নিয়ম হল রাত দশটার পর কারেন্ট আসে। বাকি রাতটা মিটিমিটি করে বাতি জ্বলে সকালবেলায় আর কারেন্ট নেই। মানুষজন এতেই খুশি। গ্রামে ইলেকট্রিসিটি আছে এই আনন্দই তাদের রাখার জায়গা নেই। দেলোয়ার তাকে বলছিল, বুঝছেন আপামণি শহর বন্দরে যেমন ঘনঘন কারেন্ট যায়, আমাদের এইখানে যায় না। দশটা-এগারোটার সময় বিদ্যুত আসে। একবার আসলে আর যাওয়া—যাওয়ি নাই। সক্কালবেলায় যাবে। তাও বেলা উঠলে
মীরা বলল, আপনাদের তো খুবই সুবিধা।
দেলোয়ার সবক’টা দাঁত বের করে বলল, বিদ্যুতের সুবিধা আমাদের আছে এইটা অস্বীকার যাবে না।
দেলোয়ার লোকটাকে মীরার পছন্দ হয়েছে। খুব হাসিখুশি। শুধু একটা সমস্যা যখন-তখন হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। মেয়েদের ঘরে যে যখন-তখন ঢোকা যায় না এই ব্যাপারটা বোধহয় জানে না। তাকে জানিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষণ আগে দেলোয়ার ঘরে ঢুকেছিল। মীরা খুব সাবধানে চোখ ফাঁক করে তাকিয়ে রইল। যাতে দেলোয়ার ধরে নেয় সে ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়ের ঘরে ঢুকে পুরুষরা বিচিত্র সব আচরণ করে। এই লোকটাও সে-রকম কিছু করে কি না তাই মীরার দেখার ইচ্ছা। হয়তো কাছে আসবে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। কিংবা খুব সাবধানে গায়ের কাপড়টা ছুঁয়ে দেখবে। অতিরিক্ত রকমের সাহসী হলে গালে হাত দেবে। দেলোয়ার অবশ্যি তেমন সাহসী না। ভয়েই মানুষটা ছোট হয়ে গেছে।
দেলোয়ার ঘরে ঢুকে অভদ্র ধরনের কিছুই করল না। মীরার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। মীরার পায়ের কাছের জানালা বন্ধ করে দিল। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে টেবিলে রাখা হারিকেনের তেল পরীক্ষা করল। তারপর যেমন হুট করে এসেছিল তেমনি হুট করে চলে গেল। যত ভালো আচরণই করুক দেলোয়ার যেন ভবিষ্যতে ঘরে না ঢোকে এই ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তার আপামণি ডাক বন্ধ করতে হবে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসী একটা মানুষ তাকে আপামণি ডাকবে কেন? মীরার বয়স মাত্র একুশ। লোকটা অশিক্ষিত মূর্খ হলে একটা কথা ছিল। তাতো না। বি. এ. পাশ। একটা গ্রাজুয়েট ছেলে চাকর স্বভাবের হয়ে গেছে কী করে? অবলীলায় ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। খালিগায়ে বালতি করে পানি নিয়ে আসছে। চোখে চোখ রেখে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। কথাও বলছে চাকরদের মতো মিনমিন করে।
মনোয়ারা মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে ট্রে। ট্রেতে দু কাপ চা। এক গ্লাস পানি। পিরিচে কয়েকটা তিলের নাড়ু। বড় মেয়ের সঙ্গে বসে চা খাওয়া মনোয়ারার খুব পছন্দের একটা ব্যাপার। মনোয়ারা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, মীরা ঘুমুচ্ছিস?
মীরা উঠে বসতে বসতে বলল, দিলে তো ঘুম ভাঙিয়ে।
‘সন্ধ্যাবেলা ঘুমুতে নেই, শরীর খারাপ করে। নে তোর জন্যে চা এনেছি। কুলি করে চা খা।’
‘কুলি ফুলি করতে পারব না। দাও চা দাও।’
‘শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে রে মা?’
‘হুঁ লাগছে।’
‘তোর বাবার উপর খুব রাগ করেছিস না?’
‘খুব না, সামান্য করেছি।’
‘তোকে বকা দিয়ে তোর বাবাও খুব মনে কষ্ট পাচ্ছে। একটু পরপর জিজ্ঞেস করছে তোর শরীর কেমন।’
‘বাবাকে বলেছ যে আমার শরীর এখন ভালো?’
‘না বলিনি। একটু কষ্ট পাক। যখন-তখন সবার সামনে বকাঝকার অভ্যাস যদি কমে।’
‘বাবার শখের নৌকাভ্রমণ নষ্ট করলাম।’
‘নষ্ট করবি কেন? নৌকাতো ঘাটেই বাঁধা আছে। কাল যাওয়া যাবে।’
‘বাবার পরিকল্পনা জানো মা? আমরা ক’দিন গ্রাম থাকব?’
‘কোর্ট তো উইন্টারের বন্ধ। ক’দিন যে থাকে।’
‘ছ’দিন থেকেই আমার অসহ্য লাগছে। বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যায় না? একটু বলে দেখ না।’
‘এখন বলা যাবে না। আরো কয়েকটা দিন থাক। তোর গ্রাম ভালো লাগে না?’
‘না মা, লাগে না। গ্রামে আসা মানেই গাদা-গাদা গরিব মানুষ দেখা। সারাক্ষণ এরা আমাদের দেখছে আর মনে মনে ভাবছে আহা এরা কত সুখী। আমার খুবই অস্বস্তি লাগে।’
‘মানুষজনের কথা বাদ দে। গ্রাম দেখতে কত সুন্দর। গাছপালা, নদী I তোদের এই বাড়িটারও কত সুন্দর। কত বড় দোতলা বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে বাঁধানো পুকুর। কত সুন্দর ফলের বাগান। ‘
‘মা চুপ করো তো। ভাঙা বাড়ি—সাপের আড্ডা। মজা এক পুকুর।’
মনোয়ারা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার কাছে খুব ভালো লাগে। আমি ঠিক করেছি তোর বাবা রিটায়ার করার পর এখানে এসে থাকব।
‘ঢাকার বাড়ি কী করবে?’
‘তোদের দু-বোনকে দিয়ে দিব। আমরা বুড়োবুড়ি থাকব গ্রামে।’
‘বলতে ভালো লাগে। বুড়োবুড়ি হও তখন দেখবে আর গ্রামে থাকতে ইচ্ছা করবে না। আর তখন গ্রামে থাকা ঠিকও হবে না। তোমাদের তখন দরকার সার্বক্ষণিক মেডিকেল কেয়ার। গ্রামে ডাক্তার কোথায়? প্র্যাকটিক্যাল হতে হবে মা। পথের পাঁচালীর গ্রাম বইএ পড়তে ভালো। থাকার জন্যে ভালো না।
মনোয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর সবসময়ই ভালো লাগে। আজ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছেন না। তাঁকে রান্নাঘরে যেতে হবে। তাঁর শাশুড়ি আজিদা বেগম ঝাল পিঠা বানাচ্ছেন। তিনি চান বৌ পিঠা বানানো দেখুক। শিখতে চাইলে শিখুক।
মীরা বলল, উঠছ কেন মা। বোস না।
‘বসতে পারব না। শাশুড়ি আম্মা পিঠা বানাচ্ছেন তাঁর কাছে বসতে হবে।’
‘শাশুড়ি আম্মা বলতে বলতে বিনয়ে ভেঙে পড়ে যাচ্ছ কেন মা। তাও যদি তোমার আপন শাশুড়ি হত। বাবার সৎ মা। তোমার সৎ শাশুড়ি।’
‘হোক সৎ শাশুড়ি। কেমন আদর সবাইকে করে সেটা দেখবি না! গ্রামের বাড়ির জন্যে তোর বাবা এত যে ব্যস্ত তার প্রধান কারণ উনি। তোর বাবা গ্রামে আসে মায়ের আদর নেবার জন্যে।
‘আদর নেবার এই ব্যাপারটাও আমার কাছে খুব হাস্যকর লাগে। বুড়ো একজন মানুষ নলা বানিয়ে মুখে ভাত তুলে দেয়া। ছিঃ দেখলেই আমার গা ঘিন ঘিন করে। সৎ দাদীকে বলো তো মা এই কাণ্ডগুলি যেন উনি আমাদের চোখের আড়ালে করেন।’
মনোয়ারা লজ্জিত গলায় বললেন, গ্রামের আদরতো এইরকমই। পুরো প্লেটের ভাত তো আর খাওয়ান না, এক-দুটা নলা মুখে তুলে নেন। নিজের ছেলেপুলে হয়নি। তোর বাবা ছিল তাঁর চোখের মণি। মীরা, তুই কি পিঠা খাবি? আনব তোর জন্যে?
‘ঝাল পিঠা আমি খাই না। তাছাড়া আমার শরীর ভালো লাগছে না। রাতে আমি কিছুই খাব না। মা শোনো, তুমি কি একটা কাজ করবে?’
‘কী কাজ।’
‘দেলোয়ার লোকটাকে বলবে সে যেন হুটহাট করে আমার ঘরে না ঢোকে। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছি, হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ল।’
‘গ্রামের ছেলে তো। এই ব্যাপারগুলি জানে না।’
‘তুমি কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন মা। তুমি তাকে বলে দেবে সে যেন আমার ঘরে এইভাবে না ঢোকে।’
‘আচ্ছা আমি বলে দেব।’
‘সে আমাকে আপামণি ডাকে। অসহ্য। তাকে বলবে যেন আপামণি না ডাকে।’
‘আচ্ছা।’
‘মা তোমার সঙ্গে আরেকটা শেষ কথা। আমি যে নৌকায় বলেছিলাম তোমার গা থেকে কাদামাটির গন্ধ আসে। আসলেই আসে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘কিন্তু এই গন্ধটা যে আমার কী ভালো লাগে তুমি জানো না। তুমি রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তোমার গায়ের গন্ধ আমাকে দিয়ে যাবে। ব্লাউজ খুলে আমি তোমার বুকে নাক ঘষব।’
মনোয়ারা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘তুই কী যে হচ্ছিস!’ তাঁর বিরক্তির অভিনয়টা তেমন ভালো হল না। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল।
বারান্দায় দেলোয়ার একটা মাটির মালশা নিয়ে আসছে। মালশা থেকে ঝুকা ঝুকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ায় দেলোয়ার চোখ মেলতে পারছে না, এমন অবস্থা। মনোয়ারা বললেন, মালশায় কী দেলোয়ার?
দেলোয়ার লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ধূপ চাচীআম্মা।’ তাকে যে-কোনো প্ৰশ্ন করলেই সে খানিকটা লজ্জা পায়।
‘ধূপ জ্বালিয়েছ কেন?’
‘মশার খুব উপদ্রব। আপামণির ঘরে ধোঁয়া দিব।’
মনোয়ারা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, মেয়েদের ঘরে ঢোকার সময় দরজা ধাক্কা দেবে, কেমন?
দেলোয়ার লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে বলল, জ্বি আচ্ছা।
‘ধোঁয়া না দিলেও হবে। এরা শহরের মেয়ে, ধোঁয়া পছন্দ করবে না।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘শীতের মধ্যে পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছ কেন? শীত লাগে না? তোমার গরম কাপড় আছে?’
‘জি।’
‘গরম কিছু পরবে। তোমাকে দেখে তো আমারই শীত লাগছে। শেফাকে দেখেছ? শেফা কোথায়?’
‘ছোট আপামণি পুকুরঘাটে।’
‘আশ্চর্য তো, রাতের বেলা সে পুকুরঘাটে কী করে? ওকে ঘরে আসতে বল।’
‘জ্বি আচ্ছা চাচীজী।’
দেলোয়ার মালশা নিয়ে অতি দ্রুত পুকুরঘাটের দিকে রওনা হল। মনোয়ারা রান্নাঘরের দিকে চললেন। তাঁর রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরঘাটের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে।
এই বাড়ির পুকুরঘাটটা মনোয়ারার খুব পছন্দ। ছোট্ট বাঁধানো ঘাট, যেন বাড়ির বৌ-ঝিদের জন্যেই করা হয়েছে। বারোয়ারি ব্যাপার না। বিশাল এক কামরাঙ্গা গাছ ঘাটের ওপর ছায়া ফেলেছে। মনোয়ারার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর গাছ কামরাঙ্গা গাছ। কী অদ্ভুত তার চিরল চিরল পাতা।
শেফা চোখমুখ শক্ত-শক্ত করে ঘাটে বসে আছে। চোখমুখ শক্ত করার কারণ একটু আগেই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ভূতের ভয়। তার মন খুব খারাপ ছিল বলে সে একা-একা ঘাটে এসে বসেছিল। বসার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গা ছমছম করতে লাগল। মনে হল সে একা না, তার আশেপাশে আরো কেউ আছে। একজন তো মনে হল ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে। সেই একজন অল্পবয়েসী একটা ঘোমটা-দেয়া বউ। তার শাড়ির শব্দ, হাতের চুরির শব্দ পর্যন্ত শেফা পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মতলব ভালো না, সে এসে শেফার পাশে বসবে। ঘোমটার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাবে এবং একসময় হাত ধরে টানতে টানতে পানিতে নিয়ে যাবে। ঠিক এ-রকম একটা গল্প সে দেব সাহিত্য কুটিরের বইএ পড়েছিল। সেই গল্পেও গ্রামের পুকুরঘাট থেকে বাচ্চা একটা ছেলেকে ঘোমটা-পরা বউ ভুলিয়ে ভালিয়ে পানিতে নিয়ে ডুবিয়ে মারে।
শেফার বুক ধকধক করছে। চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর তার প্রচণ্ড রাগও হচ্ছে। কেন সে একা-একা ঘাটে এল, কী দরকার ছিল। শেফার মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখনি মালশা হাতে দেলোয়ার চলে চল। এত শাস্তি শেফা তার জীবনে পায় নি। ও না, ভুল হয়েছে। এ-রকম শাস্তি শেফা আরেকবার তার জীবনে পেয়েছিল। সেটা খুবই গোপন ব্যাপার কাউকে বলা যাবে না।
‘ছোট আপা, চাচীজী যেতে বলেছে।’
শেফা পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুক।
দেলোয়ার বলল, একা একা বসে আছেন, ভয় লাগে না?
‘ভয় লাগবে কেন? একা একা বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে। দেলোয়ার ভাই, শুনুন। আপনাকে থ্যাংকস দেয়া হয়নি। মেনি থ্যাংকস। চশমার জন্যে।’
দেলোয়ার হাসল। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেল না। দেলোয়ারের ধারণা সে তার জীবনে এমন সরল সাদাসিধা মেয়ে দেখেনি। আজ সকালে নৌকায় উঠতে গিয়ে মেয়েটার চোখ থেকে চশমা পরে গেল। মেয়েটা তা নিয়ে একটা শব্দ করল না। বোঝা যাচ্ছে সে তার বাবার ভয়ে চুপ করেছিল।
দুপুরবেলা দেলোয়ার নদীতে নেমে চশমা উদ্ধার করে। মেয়েটাকে চশমাটা দেয়ার পর সে চশমা রেখে পরতে পরতে বলে—আচ্ছা ঠিক আছে। যেন সে জানতই দেলোয়ার চশমা নিয়ে আসবে। চশমার জন্যে ধন্যবাদটা এই মেয়ে এখন দিচ্ছে।
‘দেলোয়ার ভাই।’
‘জ্বি।’
‘দুপুরবেলা আপনি যখন আমাকে চশমাটা দিলেন তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। আপনি যে নদীতে চশমা পড়াটা লক্ষ্য করেছেন আমি বুঝতে পারি নি। আপনি বোধহয় আমার চেহারা দেখে বুঝতে পারেননি যে আমি ভয়ংকর অবাক হয়েছি। বুঝতে পেরেছিলেন?’
‘না।’
‘আমার হচ্ছে স্টোন-ফেস। আমার চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারে না, আমি অবাক হচ্ছি না-কি দুঃখিত হচ্ছি। না-কি খুশি হচ্ছি। আমার ফেস এক্সপ্রেশন লেখ।’
‘ও আচ্ছা।’
‘এক্সপ্রেশন লেখ ফেস মানুষের কখন হয় জানেন?’
‘জ্বি না।’
‘যদি চোখ ছোট হয়, ঠোঁট মোটা হয় এবং গালের চামড়া শক্ত হয় তাহলে ফেস এক্সপ্রেশন লেখ হয়ে যায়। কারণ হচ্ছে মানুষের এক্সপ্রেশন হল চোখে আর ঠোঁটে।’
‘ও।’
‘বেশিরভাগ সময় আমি মন খারাপ করে থাকি ফেস এক্সপ্রেশন লেখ বলে কেউ বুঝতে পারে না। আজ সারাদিন আমার খুবই মন খারাপ ছিল।’
‘কেন?’
‘চশমাটা নদীতে পড়ে গেল। সারাদিন চশমা ছাড়া ঘুরছি অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না। মা, বাবা, আপা কেউ একবার বুঝতেও পারল না যে আমার চশমা হারিয়েছে। অথচ আপার গালে যদি একটা মশাও কামড় দিত, সবাই বুঝতো। মা চমকে উঠে বলত—কী সর্বনাশ তোর গায়ে কি মশা কামড়েছে। বাবা বলত, মীরা মা তোমার লাল দাগ কিসের। আমার বেলা ঠিক উল্টা। আমার যদি ড্রাকুলার মতো দুটা দাঁত বড় হয়ে ঠোঁটের বাইরেও চলে আসে কেউ বুঝবে না। সবাই ভাববে জন্ম থেকেই আমার দাঁত এ-রকম।’
‘ছোট আপা চলেন ঘরে যাই, চাচীজী ডাকেন।
‘ডাকুক আমি ঘরে যাব না। আপনার কাজ থাকলে আপনি চলে যান। আপনি যদি ভাবেন একা থাকলে আমি ভয় পাব—আপনি খুবই ভুল করছেন। আর আপনি যদি আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে চান গল্প করতে পারেন।’
দেলোয়ার বসল। ভেতরে ভেতরে সামান্য উসখুস করতে লাগল। ঘরে খাওয়ার পানি আছে কি-না বুঝতে পারছে না। এই গ্রামে একটা টিউবওয়েল দিয়ে ভালো পানি আসে—মুনশিবাড়ির টিউবওয়েল। বাকি সবগুলিতে আয়রন। পানি কিছুক্ষণ রাখতেই লাল হয়ে যায়। ভাবে, আর দুই কলসি পানি এনে দিতে হবে।
‘দেলোয়ার ভাই!’
‘জ্বি।’
‘এই পুকুরে মাছ আছে?’
‘পোনা ছাড়া হয় না। তবে মাছ আছে। পুরানা পুকুর তো, বিরাট বিরাট মাছ আছে। ঘাই দেয়।’
‘ঘাই দেয় মানে কী? ‘
‘পানির মধ্যে শব্দ করে। জানান দেয়।’
‘কাল আমাকে একটা বঁড়শি এনে দেবেন আমি মাছ ধরব।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একবার বড়শি দিয়ে একটা টেংরা মাছ ধরেছিলাম। টেংরা মাছটার রঙ ছিল সবুজ আমার পরিষ্কার মনে আছে। বড় আপা কী বলে জানেন? বড় আপা বলে—মাছ ধরার এই ব্যাপারটা নাকি আমার স্বপ্নে ঘটেছে। কারণ মাছ কখনো সবুজ হয় না।’
‘টেংরা মাছের শরীরে সবুজ দাগ থাকে।’
‘আমার মাছটা পুরোটাই ছিল সবুজ।’
‘ও আচ্ছা।’
‘দেলোয়ার ভাই!’
‘জ্বি।’
‘আমার শেফা নামটা কি আপনার পছন্দ?’
‘জ্বি পছন্দ। খুব সুন্দর নাম।’
‘মোটেই সুন্দর নাম না। খুব খারাপ নাম। শেফা মানে জানেন?’
‘না।’
‘শেফা মানে হল আরোগ্য। আমাকে দেখলেই লোকজনের আরোগ্যের কথা মনে হবে। সেখান থেকে মনে হবে অসুখের কথা।’
‘আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না।’
‘ঢাকায় গেলে অনেক ক্লিনিকের নাম দেখবেন—শেফা নার্সিং হোম। শেফা ক্লিনিক। বিশ্রী ব্যাপার।
‘ছোট আপা আমি যাই, আমার পানি আনতে হবে।’
‘কাল মনে করে আমার বঁড়শি আনবেন।’
‘জ্বি আচ্ছা। কিন্তু বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরলেও এই পুকুরের মাছ খেতে পারবেন না।’
‘খেতে পারব না কেন?’
‘আপনার দাদা এই পুকুরের মাছ তাঁর বংশের কারোর খাওয়া নিষিদ্ধ করে গেছেন। অন্যরা খেতে পারবে। কিন্তু তার বংশের কেউ খেতে পারবে না।’
‘সেকি! কেন?’
‘আমি জানি না ছোট আপা।’
‘আমার বাবা কি কারণটা জানেন?’
‘জানতে পারেন। বেশিক্ষণ থাকবেন না আপা। ভয় পেতে পারেন।’
‘শুধু শুধু ভয় পাব কেন?’
শেফা ভয় পাচ্ছে। দেলোয়ার ভাই চলে যাবার পর থেকে ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। মস্ত বড় বোকামি হয়ে গেছে। তার উচিত ছিল দেলোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাওয়া। এই পুকুরের মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। নিশ্চয়ই এরও ভয়ংকর কোনো কারণ আছে। আচ্ছা ভূত-প্রেত এরা কি মাছ খায়? শেফার মাথার উপরের কামরাঙ্গা গাছের পাতা দুলছে। শেফা আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেল। বাতাস নেই, কিচ্ছু নেই, পাতা দুলছে কেন?